❏ হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর সন্তান-সন্তুতি প্রসঙ্গ
হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর প্রথম সন্তান ইসমাঈল (عليه السلام)। যিনি মিসরের কিবতী বংশীয়া হাজেরার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর স্ত্রী তার চাচাত বোন সারাহর গর্ভের দ্বিতীয় পুত্র ইসহাক (عليه السلام) জন্মগ্রহণ করেন। তারপর হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) কিনআনের কানতুরা বিনত ইয়াকতানকে বিবাহ করেন। তাঁর গর্ভে ছয়টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তারা হলেন (১) মাদয়ান (২) যামরান (৩) সারাজ (৪) য়াকশান (৫) নাশুক (৬) এ নামটি অজ্ঞাত। এরপর হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) হাজুন বিনত আমীনকে বিবাহ করেন। এই পক্ষে পাঁচটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেনঃ (১) কায়সান (২) সুরাজ (৩) উমায়স (৪) লূতান (৫) লাফিস। আবুল কাসিম সহায়লী তার ‘আত-তারীফ ওয়াল আ’লাম’ গ্রন্থে এরূপ উল্লেখ করেছেন।

হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর জীবদ্দশায় যে সব বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তন্মধ্যে লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের ঘটনা ও তাদের উপর আল্লাহর আযাবের ঘটনা অন্যতম। ঘটনাটি নিম্নরূপঃ হযরত লূত (عليه السلام) ছিলেন হারান ইব্‌ন তারাহ-এর পুত্র। এই তারাহকেই আযরও বলা হত। যা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। হযরত লূত ছিলেন ইবরাহীম খলীল (عليه السلام)-এর ভাতিজা। ইবরাহীম, হারান ও নাজুর এরা ছিলেন তিন ভাই যা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। হারানের বংশধরকে বনূ হারান বলা হয়। কিন্তু আহলে কিতাবদের ইতিহাস এ মত সমর্থন করে না। হযরত লূত (عليه السلام) চাচা ইবরাহীম খলীল (عليه السلام)-এর নির্দেশক্রমে গওর যাগার অঞ্চলে সাদ্দুম শহরে চলে যান। এটা ছিল ঐ অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র। অনেক গ্রাম, মহল্লা ও ক্ষেত-খামার এবং ব্যবসায়কেন্দ্র এ শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ছিল। এখানকার অধিবাসীরা ছিল দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট, পাপাসক্ত, দুশ্চরিত্র, সংকীর্ণমনা ও জঘন্য কাফির। তারা দস্যুবৃত্তি করতো। প্রকাশ্য মজলিসে অশ্লীল ও বেহায়াপনা প্রদর্শন করত। কোন পাপের কাজ থেকেই তারা বিরত থাকত না। অতিশয় জঘন্য ছিল তাদের কাজ-কারবার। তারা এমন একটি অশ্লীল কাজের জন্ম দেয় যা ইতিপূর্বে কোন আদম সন্তান করেনি। তাহলো, নারীদেরকে ত্যাগ করে তারা সমকামিতায় লিপ্ত হয়। হযরত লূত (عليه السلام) তাদেরকে এক ও লা-শরীক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানান এবং এসব ঘৃণিত অভ্যাস, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বর্জন করতে বলেন। কিন্তু তারা তাদের ভ্রান্তি, বিদ্রোহ, পাপ ও কুফরের প্রতি অবিচল থাকে। ফলে, আল্লাহ তাদের উপর এমন কঠিন আযাব নাযিল করলেন যা ফেরাবার সাধ্য কারোরই নেই, এ ছিল তাদের ধারণাতীত ও কল্পনাতীত শাস্তি। আল্লাহ তাদেরকে সমূলে বিনাশ করে দিলেন। বিশ্বের বিবেকবানদের জন্যে তা একটি শিক্ষাপ্রদ ঘটনা হয়ে থাকল। এ কারণেই আল্লাহ তার মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সূরা আ’রাফে আল্লাহ বলেনঃ

(وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِنَ الْعَالَمِينَ * إِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ شَهْوَةً مِنْ دُونِ النِّسَاءِ ۚ بَلْ أَنْتُمْ قَوْمٌ مُسْرِفُونَ * وَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَنْ قَالُوا أَخْرِجُوهُمْ مِنْ قَرْيَتِكُمْ ۖ إِنَّهُمْ أُنَاسٌ يَتَطَهَّرُونَ * فَأَنْجَيْنَاهُ وَأَهْلَهُ إِلَّا امْرَأَتَهُ كَانَتْ مِنَ الْغَابِرِينَ * وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ مَطَرًا ۖ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُجْرِمِينَ) [Surat Al-A'raf]

অর্থাৎ, এবং লূতকে পাঠিয়েছিলাম। সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, “তোমরা এমন কুকর্ম করছ, যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে কেউ করেনি; তোমরা তো কাম-তৃপ্তির জন্যে নারী ছেড়ে পুরুষের কাছে গমন কর, তোমরা তো সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু বলল, এদেরকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা তো এমন লোক যারা অতি পবিত্র হতে চায়। তারপর তাকে ও তার স্ত্রী ব্যতীত তার পরিজনবর্গকে উদ্ধার করেছিলাম, তার স্ত্রী ছিল পেছনে রয়ে থাকা লোকদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম। সুতরাং অপরাধীদের পরিণাম কি হয়েছিল তা লক্ষ্য কর! (৭ঃ ৮০-৮৪)

সূরা হূদে আল্লাহ বলেনঃ

(وَلَقَدْ جَاءَتْ رُسُلُنَا إِبْرَاهِيمَ بِالْبُشْرَىٰ قَالُوا سَلَامًا ۖ قَالَ سَلَامٌ ۖ فَمَا لَبِثَ أَنْ جَاءَ بِعِجْلٍ حَنِيذٍ * فَلَمَّا رَأَىٰ أَيْدِيَهُمْ لَا تَصِلُ إِلَيْهِ نَكِرَهُمْ وَأَوْجَسَ مِنْهُمْ خِيفَةً ۚ قَالُوا لَا تَخَفْ إِنَّا أُرْسِلْنَا إِلَىٰ قَوْمِ لُوطٍ * وَامْرَأَتُهُ قَائِمَةٌ فَضَحِكَتْ فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِنْ وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ * قَالَتْ يَا وَيْلَتَىٰ أَأَلِدُ وَأَنَا عَجُوزٌ وَهَٰذَا بَعْلِي شَيْخًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عَجِيبٌ * قَالُوا أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ ۖ رَحْمَتُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ ۚ إِنَّهُ حَمِيدٌ مَجِيدٌ * فَلَمَّا ذَهَبَ عَنْ إِبْرَاهِيمَ الرَّوْعُ وَجَاءَتْهُ الْبُشْرَىٰ يُجَادِلُنَا فِي قَوْمِ لُوطٍ * إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَحَلِيمٌ أَوَّاهٌ مُنِيبٌ * يَا إِبْرَاهِيمُ أَعْرِضْ عَنْ هَٰذَا ۖ إِنَّهُ قَدْ جَاءَ أَمْرُ رَبِّكَ ۖ وَإِنَّهُمْ آتِيهِمْ عَذَابٌ غَيْرُ مَرْدُودٍ * وَلَمَّا جَاءَتْ رُسُلُنَا لُوطًا سِيءَ بِهِمْ وَضَاقَ بِهِمْ ذَرْعًا وَقَالَ هَٰذَا يَوْمٌ عَصِيبٌ * وَجَاءَهُ قَوْمُهُ يُهْرَعُونَ إِلَيْهِ وَمِنْ قَبْلُ كَانُوا يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ ۚ قَالَ يَا قَوْمِ هَٰؤُلَاءِ بَنَاتِي هُنَّ أَطْهَرُ لَكُمْ ۖ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَلَا تُخْزُونِ فِي ضَيْفِي ۖ أَلَيْسَ مِنْكُمْ رَجُلٌ رَشِيدٌ * قَالُوا لَقَدْ عَلِمْتَ مَا لَنَا فِي بَنَاتِكَ مِنْ حَقٍّ وَإِنَّكَ لَتَعْلَمُ مَا نُرِيدُ * قَالَ لَوْ أَنَّ لِي بِكُمْ قُوَّةً أَوْ آوِي إِلَىٰ رُكْنٍ شَدِيدٍ * قَالُوا يَا لُوطُ إِنَّا رُسُلُ رَبِّكَ لَنْ يَصِلُوا إِلَيْكَ ۖ فَأَسْرِ بِأَهْلِكَ بِقِطْعٍ مِنَ اللَّيْلِ وَلَا يَلْتَفِتْ مِنْكُمْ أَحَدٌ إِلَّا امْرَأَتَكَ ۖ إِنَّهُ مُصِيبُهَا مَا أَصَابَهُمْ ۚ إِنَّ مَوْعِدَهُمُ الصُّبْحُ ۚ أَلَيْسَ الصُّبْحُ بِقَرِيبٍ فَلَمَّا جَاءَ أَمْرُنَا جَعَلْنَا عَالِيَهَا سَافِلَهَا وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهَا حِجَارَةً مِنْ سِجِّيلٍ مَنْضُودٍ * مُسَوَّمَةً عِنْدَ رَبِّكَ ۖ وَمَا هِيَ مِنَ الظَّالِمِينَ بِبَعِيدٍ) [Surat Hud]

অর্থাৎ, আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ সুসংবাদসহ ইবরাহীমের
নিকট আসল। তারা বলল, ‘সালাম’। সেও বলল, ‘সালাম’, সে অবিলম্বে এক কাবাব করা বাছুর আনল। সে যখন দেখল, তাদের হাত ঐটির দিকে প্রসারিত হচ্ছে না। তখন তাদেরকে অবাঞ্ছিত মনে করল এবং তাদের সম্বন্ধে তার মনে ভীতি সঞ্চার হল। তারা বলল, ‘ভয় করো না, আমরা লূতের সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছি।’ তখন তার স্ত্রী দাঁড়িয়েছিল এবং সে হাসল। তারপর আমি তাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম। সে বলল, ‘কি আশ্চর্য! সন্তানের মা হব আমি যখন আমি বৃদ্ধা এবং এই আমার স্বামী বৃদ্ধ! এটা অবশ্যই এক অদ্ভুত ব্যাপার।’ তারা বলল, ‘আল্লাহর কাজে তুমি বিস্ময় বোধ করছ? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ। তিনি প্রশংসাৰ্থ ও সম্মানাহ্।’

তারপর যখন ইবরাহীমের ভীতি দূরীভূত হল এবং তার নিকট সুসংবাদ আসল তখন সে লূতের সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে আমার সাথে বাদানুবাদ করতে লাগল। ইবরাহীম তো অবশ্যই সহনশীল। কোমল-হৃদয়, সতত আল্লাহ অভিমুখী। হে ইবরাহীম! এ থেকে বিরত হও। তোমার প্রতিপালকের বিধান এসে পড়েছে। ওদের প্রতি তো আসবে শাস্তি যা অনিবার্য এবং যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ লূতের নিকট আসল তখন তাদের আগমনে সে বিষন্ন হল এবং নিজেকে তাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করল এবং বলল, ‘এটি নিদারুণ দিন’! তার সম্প্রদায় তার নিকট উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে আসল এবং পূর্ব থেকে তারা কু-কর্মে লিপ্ত ছিল।

সে বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! এরা আমার কন্যা, তোমাদের জন্যে এরা পবিত্র। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার মেহমানদের প্রতি অন্যায় আচরণ করে আমাকে হেয় করো না। তোমাদের মধ্যে কি কোন ভাল মানুষ নেই?’ তারা বলল, ‘তুমি তো জান, তোমার কন্যাদেরকে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই; আমরা কি চাই তা তো তুমি জানই।’ সে বলল, তোমাদের উপর যদি আমার শক্তি থাকত অথবা যদি আমি নিতে পারতাম কোন শক্তিশালী আশ্রয়! তারা বলল, হে লূত! আমরা তোমার প্রতিপালক প্রেরিত ফেরেশতা। ওরা কখনই তোমার নিকট পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং তুমি রাতের কোন এক সময়ে তোমার পরিবারবর্গসহ বের হয়ে পড় এবং তোমাদের মধ্যে কেউ পেছন দিকে তাকাবে না, তোমার স্ত্রী ব্যতীত। ওদের যা ঘটবে তারও তাই ঘটবে। প্রভাত ওদের জন্যে নির্ধারিত কাল। প্রভাত কি নিকটবর্তী নয়?

তারপর যখন আমার আদেশ আসল তখন আমি জনপদকে উল্টিয়ে দিলাম এবং তাদের উপর ক্রমাগত বর্ষণ করলাম পাথর-কংকর যা তোমার প্রতিপালকের কাছে চিহ্নিত ছিল। এটি জালিমদের থেকে দূরে নয়। (১১ঃ ৬৯-৮৩)

সূরা হিজরে আল্লাহ বলেনঃ

(وَنَبِّئْهُمْ عَنْ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ * إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلَامًا قَالَ إِنَّا مِنْكُمْ وَجِلُونَ * قَالُوا لَا تَوْجَلْ إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ * قَالَ أَبَشَّرْتُمُونِي عَلَىٰ أَنْ مَسَّنِيَ الْكِبَرُ فَبِمَ تُبَشِّرُونَ * قَالُوا بَشَّرْنَاكَ بِالْحَقِّ فَلَا تَكُنْ مِنَ الْقَانِطِينَ * قَالَ وَمَنْ يَقْنَطُ مِنْ رَحْمَةِ رَبِّهِ إِلَّا الضَّالُّونَ * قَالَ فَمَا خَطْبُكُمْ أَيُّهَا الْمُرْسَلُونَ * قَالُوا إِنَّا أُرْسِلْنَا إِلَىٰ قَوْمٍ مُجْرِمِينَ * إِلَّا آلَ لُوطٍ إِنَّا لَمُنَجُّوهُمْ أَجْمَعِينَ * إِلَّا امْرَأَتَهُ قَدَّرْنَا ۙ إِنَّهَا لَمِنَ الْغَابِرِينَ * فَلَمَّا جَاءَ آلَ لُوطٍ الْمُرْسَلُونَ * قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ مُنْكَرُونَ * قَالُوا بَلْ جِئْنَاكَ بِمَا كَانُوا فِيهِ يَمْتَرُونَ * وَأَتَيْنَاكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّا لَصَادِقُونَ * فَأَسْرِ بِأَهْلِكَ بِقِطْعٍ مِنَ اللَّيْلِ وَاتَّبِعْ أَدْبَارَهُمْ وَلَا يَلْتَفِتْ مِنْكُمْ أَحَدٌ وَامْضُوا حَيْثُ تُؤْمَرُونَ * وَقَضَيْنَا إِلَيْهِ ذَٰلِكَ الْأَمْرَ أَنَّ دَابِرَ هَٰؤُلَاءِ مَقْطُوعٌ مُصْبِحِينَ * وَجَاءَ أَهْلُ الْمَدِينَةِ يَسْتَبْشِرُونَ * قَالَ إِنَّ هَٰؤُلَاءِ ضَيْفِي فَلَا تَفْضَحُونِ * وَاتَّقُوا اللَّهَ وَلَا تُخْزُونِ * قَالُوا أَوَلَمْ نَنْهَكَ عَنِ الْعَالَمِينَ *قَالَ هَٰؤُلَاءِ بَنَاتِي إِنْ كُنْتُمْ فَاعِلِينَ * لَعَمْرُكَ إِنَّهُمْ لَفِي سَكْرَتِهِمْ يَعْمَهُونَ * فَأَخَذَتْهُمُ الصَّيْحَةُ مُشْرِقِينَ * فَجَعَلْنَا عَالِيَهَا سَافِلَهَا وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ حِجَارَةً مِنْ سِجِّيلٍ * إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِلْمُتَوَسِّمِينَ * وَإِنَّهَا لَبِسَبِيلٍ مُقِيمٍ * إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِلْمُؤْمِنِينَ) [Surat Al-Hijr]

অর্থাৎ, এবং ওদেরকে বল, ইবরাহীমের অতিথিদের কথা, যখন ওরা তার কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘সালাম’, তখন সে বলেছিল, আমরা তোমাদের আগমনে আতংকিত। ওরা বলল, ‘ভয় করো না, আমরা তোমাকে এক জ্ঞানী পুত্রের শুভ সংবাদ দিচ্ছি।’ সে বলল, তোমরা কি আমাকে শুভ সংবাদ দিচ্ছ আমি বার্ধক্যগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও? তোমরা কী বিষয়ে শুভ সংবাদ দিচ্ছ? ওরা বলল, ‘আমরা সত্য সংবাদ দিচ্ছি, সুতরাং তুমি হতাশ হয়ো না।’ সে বলল, যারা পথভ্রষ্ট তারা ব্যতীত আর কে তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ হতে হতাশ হয়? সে বলল, ‘হে প্রেরিতগণ! তোমাদের আর বিশেষ কি কাজ আছে?’ ওরা বলল, ‘আমাদেরকে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়েছে তবে লূতের পরিবারবর্গের বিরুদ্ধে নয়, আমরা অবশ্যই ওদের সকলকে রক্ষা করব। কিন্তু তার স্ত্রীকে নয়। আমরা স্থির করেছি যে, সে অবশ্যই পেছনে রয়ে যাওয়া লোকদের অন্তর্ভুক্ত।

ফেরেশতাগণ যখন লূত পরিবারের কাছে আসল, তখন লূত বলল, তোমরা তো অপরিচিত লোক। তারা বলল, না ওরা সে বিষয়ে সন্দিগ্ধ ছিল, আমরা তোমার নিকট তাই নিয়ে এসেছি; ‘আমরা তোমার কাছে সত্য সংবাদ নিয়ে এসেছি এবং অবশ্যই আমরা সত্যবাদী, সুতরাং তুমি রাতের কোন এক সময়ে তোমার পরিবারবর্গসহ বের হয়ে পড় এবং তুমি তাদের পশ্চাদানুসরণ কর এবং তোমাদের মধ্যে কেউ যেন পেছন দিকে না তাকায়; তোমাদেরকে যেখানে যেতে বলা হচ্ছে তোমরা সেখানে চলে যাও। আমি তাকে এ বিষয়ে প্রত্যাদেশ দিলাম যে, প্রত্যুষে ওদেরকে সমূলে বিনাশ করা হবে। ’

নগরবাসিগণ উল্লসিত হয়ে উপস্থিত হল। সে বলল, ‘ওরা আমার অতিথি; সুতরাং তোমরা আমাকে বে-ইজ্জত করো না। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর ও আমাকে হেয় করো না।’ তারা বলল, ‘আমরা কি দুনিয়াশুদ্ধ লোককে আশ্রয় দিতে তোমাকে নিষেধ করিনি?’ লূত বলল, ‘একান্তই যদি তোমরা কিছু করতে চাও তবে আমার এই কন্যাগণ রয়েছে। তোমার জীবনের শপথ, ওরা তো মত্ততায় বিমূঢ় হয়েছে। তারপর সূর্যোদয়ের সময়ে মহানাদ তাদেরকে আঘাত করল; এবং আমি জনপদকে উল্টিয়ে উপর নিচ করে দিলাম এবং ওদের উপর প্রস্তর-কংকর বর্ষণ করলাম। অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে পর্যবেক্ষণ শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যে। তা লোক চলাচলের পথের পাশে এখনও বিদ্যমান। অবশ্যই এতে মুমিনদের জন্যে রয়েছে নিদর্শন। (১৫ঃ ৫১-৭৭)

সূরা শুআরায়, আল্লাহ বলেনঃ

(كَذَّبَتْ قَوْمُ لُوطٍ الْمُرْسَلِينَ * إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ لُوطٌ أَلَا تَتَّقُونَ * إِنِّي لَكُمْ رَسُولٌ أَمِينٌ * فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ * وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ ۖ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَىٰ رَبِّ الْعَالَمِينَ * أَتَأْتُونَ الذُّكْرَانَ مِنَ الْعَالَمِينَ * وَتَذَرُونَ مَا خَلَقَ لَكُمْ رَبُّكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ ۚ بَلْ أَنْتُمْ قَوْمٌ عَادُونَ * قَالُوا لَئِنْ لَمْ تَنْتَهِ يَا لُوطُ لَتَكُونَنَّ مِنَ الْمُخْرَجِينَ * قَالَ إِنِّي لِعَمَلِكُمْ مِنَ الْقَالِينَ * رَبِّ نَجِّنِي وَأَهْلِي مِمَّا يَعْمَلُونَ * فَنَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ أَجْمَعِينَ * إِلَّا عَجُوزًا فِي الْغَابِرِينَ * ثُمَّ دَمَّرْنَا الْآخَرِينَ * وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ مَطَرًا ۖ فَسَاءَ مَطَرُ الْمُنْذَرِينَ * إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً ۖ وَمَا كَانَ أَكْثَرُهُمْ مُؤْمِنِينَ * وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ) [Surat Ash-Shu'ara ১৬০ - ১৭৫] অর্থাৎ, লূতের সম্প্রদায় রাসূলগণকে অস্বীকার করেছিল, যখন ওদের ভাই লূত ওদেরকে বলল, তোমরা কি সাবধান হবে না? আমি তো তোমাদের জন্যে এক বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি এর জন্যে তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না, আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের কাছেই আছে। সৃষ্টির মধ্যে তোমরা তো কেবল পুরুষের সাথেই উপগত হও এবং তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে যে স্ত্রীলোক সৃষ্টি করেছেন তাদেরকে তোমরা বর্জন করে থাক। তোমরা তো সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। ওরা বলল, ‘হে নূত! তুমি যদি নিবৃত্ত না হও, তবে অবশ্যই তুমি নির্বাসিত হবে।’

লূত বলল, ‘আমি তোমাদের এ কাজকে ঘৃণা করি। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এবং আমার পরিবার-পরিজনকে, ওরা যা করে তা থেকে রক্ষা কর।’ অতঃপর আমি তাকে এবং তার পরিবার-পরিজন সকলকে রক্ষা করলাম। এক বৃদ্ধা ব্যতীত, যে ছিল পেছনে রয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত। তারপর অপর সকলকে ধ্বংস করলাম। তাদের উপর শাস্তিমূলক বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম, তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল, তাদের জন্যে এই বৃষ্টি ছিল কত নিকৃষ্ট! এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু ওদের অধিকাংশই মুমিন নয়। তোমার প্রতিপালক, তিনি তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (২৬ঃ ১৬০-১৭৫)

সূরা নামলে আল্লাহ বলেনঃ

(وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ وَأَنْتُمْ تُبْصِرُونَ * أَئِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ شَهْوَةً مِنْ دُونِ النِّسَاءِ ۚ بَلْ أَنْتُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ * فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَنْ قَالُوا أَخْرِجُوا آلَ لُوطٍ مِنْ قَرْيَتِكُمْ ۖ إِنَّهُمْ أُنَاسٌ يَتَطَهَّرُونَ * فَأَنْجَيْنَاهُ وَأَهْلَهُ إِلَّا امْرَأَتَهُ قَدَّرْنَاهَا مِنَ الْغَابِرِينَ * وَأَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ مَطَرًا ۖ فَسَاءَ مَطَرُ الْمُنْذَرِينَ) [Surat An-Naml ৫৪ - ৫৮]

অর্থাৎ, স্মরণ কর, লূতের কথা, সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমরা জেনেশুনে কেন অশ্লীল কাজ করছ? তোমরা কি কাম-তৃপ্তির জন্যে নারীকে ছেড়ে পুরুষে উপগত হবে? তোমরা তো এক অজ্ঞ সম্প্রদায়। উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু বলল, লূত পরিবারকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা তো এমন লোক যারা পবিত্র সাজতে চায়। তারপর তাকে ও তার পরিবারবর্গকে উদ্ধার করলাম, তার স্ত্রী ব্যতীত; তাকে করেছিলাম ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের উপর ভয়ংকর বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম; যাদের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল তাদের জন্য এই বর্ষণ ছিল কত মারাত্মক! (২৭ঃ ৫৪-৫৮)

সূরা আনকাবূতে আল্লাহ বলেনঃ

(وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ إِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِنَ الْعَالَمِينَ * أَئِنَّكُمْ لَتَأْتُونَ الرِّجَالَ وَتَقْطَعُونَ السَّبِيلَ وَتَأْتُونَ فِي نَادِيكُمُ الْمُنْكَرَ ۖ فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَنْ قَالُوا ائْتِنَا بِعَذَابِ اللَّهِ إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ * قَالَ رَبِّ انْصُرْنِي عَلَى الْقَوْمِ الْمُفْسِدِينَ * وَلَمَّا جَاءَتْ رُسُلُنَا إِبْرَاهِيمَ بِالْبُشْرَىٰ قَالُوا إِنَّا مُهْلِكُو أَهْلِ هَٰذِهِ الْقَرْيَةِ ۖ إِنَّ أَهْلَهَا كَانُوا ظَالِمِينَ * قَالَ إِنَّ فِيهَا لُوطًا ۚ قَالُوا نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَنْ فِيهَا ۖ لَنُنَجِّيَنَّهُ وَأَهْلَهُ إِلَّا امْرَأَتَهُ كَانَتْ مِنَ الْغَابِرِينَ * وَلَمَّا أَنْ جَاءَتْ رُسُلُنَا لُوطًا سِيءَ بِهِمْ وَضَاقَ بِهِمْ ذَرْعًا وَقَالُوا لَا تَخَفْ وَلَا تَحْزَنْ ۖ إِنَّا مُنَجُّوكَ وَأَهْلَكَ إِلَّا امْرَأَتَكَ كَانَتْ مِنَ الْغَابِرِينَ * إِنَّا مُنْزِلُونَ عَلَىٰ أَهْلِ هَٰذِهِ الْقَرْيَةِ رِجْزًا مِنَ السَّمَاءِ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ * وَلَقَدْ تَرَكْنَا مِنْهَا آيَةً بَيِّنَةً لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ) [Surat Al-Ankabut ২৮ - ৩৫]

অর্থাৎ, স্মরণ কর লুতের কথা, সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমরা তো এমন অশ্লীল কাজ করছ; যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে কেউ করেনি। তোমরাই তো পুরুষে উপগত হচ্ছ। তোমরাই তো রাহাজানি করে থাক এবং তোমরাই তো নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে ঘৃণ্য কাজ করে থাক।’ উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু এই বলল, ‘আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি নিয়ে এসো যদি তুমি সত্যবাদী হও।’ সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য কর। যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ সুসংবাদসহ ইবরাহীমের কাছে আসল, তারা বলেছিল, আমরা এই জনপদের অধিবাসীদেরকে ধ্বংস করব। এর অধিবাসীরা তো জালিম। ইবরাহীম বলল, এই জনপদে তো লূত রয়েছে। তারা বলল, ‘সেখানে কারা আছে তা আমরা ভাল জানি; আমরা তো লূতকে ও তার পরিবার-পরিজনবর্গকে রক্ষা করবই; তার স্ত্রী ব্যতীত; সে তো পেছনে রয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত।’

এবং যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ লূতের কাছে আসল, তখন তাদের জন্যে সে বিষন্ন হয়ে পড়ল এবং নিজকে তাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করল। তারা বলল, ভয় করো না, দুঃখও করো না। আমরা তোমাকে ও তোমার পরিজনবর্গকে রক্ষা করব, তোমার স্ত্রী ব্যতীত; সে তো পেছনে রয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত। আমরা এই জনপদবাসীদের উপর আকাশ থেকে শাস্তি নাযিল করব, কারণ তারা পাপাচার করেছিল। আমি বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্যে এতে একটি স্পষ্ট নিদর্শন রেখেছি। (২৯ঃ ২৮-৩৫)

সূরা সাফফাতে আল্লাহ বলেনঃ

(وَإِنَّ لُوطًا لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ * إِذْ نَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ أَجْمَعِينَ * إِلَّا عَجُوزًا فِي الْغَابِرِينَ * ثُمَّ دَمَّرْنَا الْآخَرِينَ * وَإِنَّكُمْ لَتَمُرُّونَ عَلَيْهِمْ مُصْبِحِينَ * وَبِاللَّيْلِ ۗ أَفَلَا تَعْقِلُونَ)

[Surat As-Saaffat ১৩৩ - ১৩৮]

অর্থাৎ, লূতও ছিল রাসূলগণের একজন। আমি তাকে ও তার পরিবারের সকলকে উদ্ধার করেছিলাম-এক বৃদ্ধা ব্যতীত, সে ছিল পেছনে রয়ে যাওয়া লোকদের অন্তর্ভুক্ত। তারপর অবশিষ্টদেরকে আমি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছিলাম। তোমরা তো ওদের ধ্বংসাবশেষগুলো অতিক্রম করে থাক সকালে ও সন্ধ্যায়, তবুও কি তোমরা অনুধাবন করবে না? (৩৭ঃ ১৩৩-১৩৮)

সূরা যারিয়াতে হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর মেহমান ও পুত্রের সুসংবাদের ঘটনা উল্লেখ করার পর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

(قَالَ فَمَا خَطْبُكُمْ أَيُّهَا الْمُرْسَلُونَ * قَالُوا إِنَّا أُرْسِلْنَا إِلَىٰ قَوْمٍ مُجْرِمِينَ * لِنُرْسِلَ عَلَيْهِمْ حِجَارَةً مِنْ طِينٍ * مُسَوَّمَةً عِنْدَ رَبِّكَ لِلْمُسْرِفِينَ * فَأَخْرَجْنَا مَنْ كَانَ فِيهَا مِنَ الْمُؤْمِنِينَ * فَمَا وَجَدْنَا فِيهَا غَيْرَ بَيْتٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ * وَتَرَكْنَا فِيهَا آيَةً لِلَّذِينَ يَخَافُونَ الْعَذَابَ الْأَلِيمَ)

[Surat Adh-Dhariyat ৩১ - ৩৭]

অর্থাৎ, ইবরাহীম বলল, ‘হে ফেরেশতাগণ! তোমাদের বিশেষ কাজ কী?’ ওরা বলল, ‘আমাদেরকে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে।’ ওদের উপর নিক্ষেপ করার জন্যে মাটির শক্ত ঢেলা, যা সীমালংঘনকারীদের জন্যে চিহ্নিত, তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে। সেখানে যে সব মুমিন ছিল আমি তাদেরকে উদ্ধার করেছিলাম এবং সেখানে একটি পরিবার ব্যতীত কোন আত্মসমর্পণকারী আমি পাইনি। যারা মর্মন্তুদ শাস্তিকে ভয় করে, আমি তাদের জন্যে তাতে একটি নিদর্শন রেখেছি। (৫১ঃ ৩১-৩৭)

সূরা কামার আল্লাহ বলেনঃ

(كَذَّبَتْ قَوْمُ لُوطٍ بِالنُّذُرِ * إِنَّا أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ حَاصِبًا إِلَّا آلَ لُوطٍ ۖ نَجَّيْنَاهُمْ بِسَحَرٍ * نِعْمَةً مِنْ عِنْدِنَا ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي مَنْ شَكَرَ * وَلَقَدْ أَنْذَرَهُمْ بَطْشَتَنَا فَتَمَارَوْا بِالنُّذُرِ * وَلَقَدْ رَاوَدُوهُ عَنْ ضَيْفِهِ فَطَمَسْنَا أَعْيُنَهُمْ فَذُوقُوا عَذَابِي وَنُذُرِ * وَلَقَدْ صَبَّحَهُمْ بُكْرَةً عَذَابٌ مُسْتَقِرٌّ * فَذُوقُوا عَذَابِي وَنُذُرِ * وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ) [Surat Al-Qamar ৩৩ - ৪০]

অর্থাৎ, লূত সম্প্রদায় প্রত্যাখ্যান করেছিল সতর্ককারীদেরকে, আমি ওদের উপর পাঠিয়েছিলাম পাথরবাহী প্রচণ্ড ঝড়। কিন্তু লূত পরিবারের উপর নয়। তাদেরকে আমি উদ্ধার করেছিলাম রাতের শেষাংশে আমার বিশেষ অনুগ্ৰহস্বরূপ; যারা কৃতজ্ঞ আমি তাদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। লূত ওদেরকে সতর্ক করেছিল আমার কঠোর শাস্তি সম্পর্কে; কিন্তু ওরা সতর্কবাণী সম্বন্ধে বিতণ্ডা শুরু করল। ওরা লুতের কাছ থেকে তার মেহমানদেরকে দাবি করল, তখন আমি ওদের দৃষ্টিশক্তি লোপ করে দিলাম এবং আমি বললাম, ‘আস্বাদন কর, আমার শাস্তি এবং সতর্কবাণীর পরিণাম। ভোরে বিরামহীন শাস্তি তাদেরকে আঘাত করল এবং আমি বললাম, আস্বাদন কর, আমার শাস্তি এবং সতর্কবাণীর পরিণাম। আমি কুরআন সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্যে; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? (৫৪ঃ ৩৩-৪০)

তাফসীর গ্রন্থে এ সব সূরার যথাস্থানে আমরা এই ঘটনার বিশদ আলোচনা করেছি। আল্লাহ হযরত লূত (عليه السلام) ও তাঁর সম্প্রদায় সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। আমরা ইতিপূর্বে কওমে নূহ, কওমে আদ ও কওমে ছামূদ-এর আলোচনায় সেসব উল্লেখ করেছি।

এখন আমরা সে সব কথার সার-সংক্ষেপ বর্ণনা করব, যা তাদের কর্মনীতি ও পরিণতি সম্পর্কে কুরআন, হাদীস ও ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহর সাহায্য কামনা করি। তাহলো, হযরত লূত (عليه السلام) তাঁর সম্প্রদায়কে এক ও লা-শরীক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানান। সেইসব অশ্লীল কাজ করতে নিষেধ করেন যার উল্লেখ স্বয়ং আল্লাহ তাআলা করেছেন। কিন্তু একজন লোকও তার আহ্বানে সাড়া দেয়নি এবং তার উপর ঈমান আনেনি। নিষেধকৃত কর্ম থেকে কেউ বিরত থাকেনি। বরং তারা তাদের অবস্থার উপর অটল অবিচল হয়ে থাকে এবং নিজেদের ভ্রষ্টতা ও মূর্খতা থেকে বিরত থাকেনি। এমনকি তারা তাদের রাসূলকে তাদের সমাজ থেকে বহিষ্কার করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।

রাসূল যখন তাদেরকে উদ্দেশ করে উপদেশ দেন, তখন তারা বিবেক না খাটিয়ে এই এক উত্তরই দিতে থাকে যে, লূত পরিবারকে তোমরা তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। কেননা, তারা এমন মানুষ যারা পাক-পবিত্র সাজতে চায়। এ কথার মধ্য দিয়ে তারা লূত পরিবারের নিন্দা করতে গিয়ে তাদের চরম প্রশংসাই করেছে। আবার এটাকেই তারা বহিষ্কারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। চরম শত্রুতা ও ঘৃণা থাকার কারণেই তারা লূতকে এ কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু আল্লাহ হযরত লূত (عليه السلام)-কে ও তার পরিবারবর্গকে পবিত্র রাখলেন এবং সম্মানের সঙ্গে সেখান থেকে তাদেরকে বের করে আনলেন, তবে তার স্ত্রীকে নয়। আর তার সম্প্রদায়ের সবাইকে আপন বাসভূমিতে চিরস্থায়ীভাবে থাকতে দিলেন। তবে সে থাকা ছিল দুর্গন্ধময় সমুদ্র তরঙ্গের আঘাতে লীন হয়ে। যা ছিল প্রকৃতপক্ষে উত্তপ্ত আগুন ও তাপ প্রবাহ এবং তার পানি তিক্ত ও লবণাক্ত।

তারা নবীকে এরূপ উত্তর তখনই দিয়েছে, যখন তিনি তাদেরকে জঘন্য পাপ ও চরম অশ্লীলতা যা ইতিপূর্বে বিশ্বের কোন লোক করেনি, তা থেকে নিবৃত্ত থাকতে বলেছেন। এ কারণেই তারা বিশ্ববাসীর জন্যে উদাহরণ ও শিক্ষাপ্রদ হয়ে রয়ে গিয়েছে। এ পাপকর্ম ছাড়াও তারা ছিনতাই, রাহাজানি করত, পথের সাথীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করত। প্রকাশ্য মজলিসে বিভিন্ন রকম নির্লজ্জ কথা বলতো এবং লজ্জাজনক কাজে লিপ্ত হতো। যেমন সশব্দে বায়ু ত্যাগ করত। এতে কোন লজ্জা বোধ করত না। অনেক সময় বড় বড় জঘন্য কাজও করত। কোন উপদেশদানকারীর উপদেশ ও জ্ঞানী লোকের পরামর্শের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করতো না। এ জাতীয় কাজের মাধ্যমে তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত বরং তার চাইতেও অধম ও বিভ্রান্ত বলে পরিচয় দিত। তারা তাদের বর্তমান কাজ থেকে বিরত থাকেনি, বিগত পাপ থেকে অনুশোচনা করেনি এবং ভবিষ্যতে আত্মসংশোধনের ইচ্ছাও করেনি। অতএব, আল্লাহ তাদেরকে শক্ত হাতে পাকড়াও করলেন। তারা হযরত লূত (عليه السلام)-কে বলেছিলঃ

ائتنا بعذاب الله إن گفت من الصادقين

(তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকলে আল্লাহর আযাব আমাদের জন্যে নিয়ে এস) অর্থাৎ নবী তাদের যে কঠিন আযাবের ভয় দেখাচ্ছিলেন তারা সেই আযাব কামনা করছিল এবং ভয়াবহ শাস্তির আবেদন জানাচ্ছিল। এই সময় দয়ালু নবী তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানান। তিনি বিশ্ব প্রভু ও রাসূলগণের ইলাহ্-এর নিকট অনাচারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য প্রার্থনা করেন। ফলে নবীর মর্যাদা হানিতে আল্লাহর ক্রোধের উদ্রেক হয়, নবীর ক্রোধের জন্যে আল্লাহ ক্রোধান্বিত হন। নবীর প্রার্থনা কবুল করেন এবং তাঁর প্রার্থিত বস্তু দান করেন। আপন দূত ও ফেরেশতাগণকে প্রেরণ করেন। তারা আল্লাহর খলীল ইবরাহীম (عليه السلام)-এর কাছে আগমন করেন। তাকে এক জ্ঞানী পুত্রের সুসংবাদ দেন এবং তারা যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে এসেছেন সে বিষয়টিও তাঁকে জানান।

(قَالَ فَمَا خَطْبُكُمْ أَيُّهَا الْمُرْسَلُونَ * قَالُوا إِنَّا أُرْسِلْنَا إِلَىٰ قَوْمٍ مُجْرِمِينَ * لِنُرْسِلَ عَلَيْهِمْ حِجَارَةً مِنْ طِينٍ * مُسَوَّمَةً عِنْدَ رَبِّكَ لِلْمُسْرِفِينَ) [Surat Adh-Dhariyat ৩১ - ৩৪]

অর্থাৎ, ইবরাহীম বলল, হে ফেরেশতাগণ! আপনাদের আগমনের উদ্দেশ্য কী? তারা বলল, আমরা এক অপরাধী সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। যাতে তাদের উপর শক্ত ঢেলা নিক্ষেপ করি, যা সীমালংঘনকারীদের শাস্তি দেয়ার জন্যে আপনার প্রতিপালকের কাছে চিহ্নিত রয়েছে।

আল্লাহ বলেনঃ

(وَلَمَّا جَاءَتْ رُسُلُنَا إِبْرَاهِيمَ بِالْبُشْرَىٰ قَالُوا إِنَّا مُهْلِكُو أَهْلِ هَٰذِهِ الْقَرْيَةِ ۖ إِنَّ أَهْلَهَا كَانُوا ظَالِمِينَ * قَالَ إِنَّ فِيهَا لُوطًا ۚ قَالُوا نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَنْ فِيهَا ۖ لَنُنَجِّيَنَّهُ وَأَهْلَهُ إِلَّا امْرَأَتَهُ كَانَتْ مِنَ الْغَابِرِينَ)

[Surat Al-Ankabut ৩১ - ৩২]

অর্থাৎ, আর যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ ইবরাহীমের কাছে সুসংবাদ নিয়ে আসল, তখন তারা বলেছিল, আমরা এই জনপদের অধিবাসীদের ধ্বংস করব। কারণ এর অধিবাসীরা জালিম। ইবরাহীম বলল, এই জনপদে তো লূতও আছে। তারা বলল, ওখানে কারা আছে সে সম্পর্কে আমরা ভালভাবে অবগত আছি। আমরা তাকে ও তার পরিবারবর্গকে অবশ্যই রক্ষা করব, তবে তার স্ত্রীকে নয়। সে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। (২৯ঃ ৩১-৩২)

আল্লাহ্ বলেনঃ

(إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَحَلِيمٌ أَوَّاهٌ مُنِيبٌ * يَا إِبْرَاهِيمُ أَعْرِضْ عَنْ هَٰذَا ۖ إِنَّهُ قَدْ جَاءَ أَمْرُ رَبِّكَ ۖ وَإِنَّهُمْ آتِيهِمْ عَذَابٌ غَيْرُ مَرْدُودٍ) [Surat Hud ৭৫ - ৭৬]

(যখন ইবরাহীমের ভীতি দূর হল ও সুসংবাদ জানান হল, তখন সে দূতের প্রসঙ্গ নিয়ে আমার সাথে বিতর্ক করা আরম্ভ করল) কেননা, ইবরাহীম (عليه السلام) আশা করেছিলেন যে, তারা খারাপ পথ পরিহার করে ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে।

তাই আল্লাহ্ বলেনঃ

(فَلَمَّا ذَهَبَ عَنْ إِبْرَاهِيمَ الرَّوْعُ وَجَاءَتْهُ الْبُشْرَىٰ يُجَادِلُنَا فِي قَوْمِ لُوطٍ)

[Surat Hud ৭৪]

(নিশ্চয়ই ইবরাহীম বড়ই ধৈর্যশীল, কোমল হৃদয় ও একনিষ্ঠ ইবাদতকারী। হে ইবরাহীম! এ জাতীয় কথাবার্তা থেকে বিরত থাক। তোমার পালনকর্তার নির্দেশ এসে গেছে এবং তাদের উপর সে আযাব অবশ্যই পতিত হবে)। অর্থাৎ এ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে কথা বল। কেননা, তাদের ধ্বংস ও নির্মূল করার আদেশ চূড়ান্ত হয়ে গেছে। তোমার পালনকর্তার নির্দেশ এসে গেছে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়ে গেছে। তাঁর এ নির্দেশ ও শাস্তি ফেরাবার ও প্রতিহত করার সাধ্য কারও নেই। এ নির্দেশ অপ্রতিরোধ্যভাবে আসবেই। (সূরা হূদঃ ৭৪-৭৫)

সাঈদ ইবন জুবায়র, সুদ্দী, কাতাদা ও মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন যে, হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) ফেরেশতাদেরকে বলেছিলেনঃ আপনারা কি এমন কোন জনপদ ধ্বংস করবেন যেখানে তিনশ’ মুমিন রয়েছে? তারা বললেন, না। তিনি বললেন, যদি দুশ’ থাকে? তারা বললেন না। ইবরাহীম বললেন, যদি চল্লিশ জন মুমিন থাকে? তারা বললেন, না। তিনি বললেন, যদি চৌদ্দজন মুমিন থাকে? তারা বললেন তবুও না। ইবন ইসহাক লিখেছেনঃ ইবরাহীম (عليه السلام) এ কথাও বলেছিলেন যে, যদি একজন মাত্র মুমিন থাকে তবে সেই জনপদ ধ্বংস করার ব্যাপারে আপনাদের মত কি? জবাবে তারা বললেনঃ তবুও ধ্বংস করা হবে না। তখন তিনি বললেন, সেখানে তো লূত রয়েছে। তারা বলল, ‘সেখানে কে আছে তা আমাদের ভালভাবেই জানা আছে।’

আহলি কিতাবদের বর্ণনায় এসেছে যে, ইবরাহীম (عليه السلام) বলেছিলেন, হে আল্লাহ! লূত সম্প্রদায়ের মধ্যে পঞ্চাশজন সৎকর্মশীল লোক থাকলেও কি আপনি তাদেরকে ধ্বংস করবেন? এভাবে উভয়ের কথোপকথন দশজন পর্যন্ত নেমে আসে। আল্লাহ বলেন, তাদের মধ্যে দশজন সৎকর্মশীল লোক থাকলেও আমি তাদেরকে ধ্বংস করব না।

আল্লাহর বাণীঃ

(وَلَمَّا جَاءَتْ رُسُلُنَا لُوطًا سِيءَ بِهِمْ وَضَاقَ بِهِمْ ذَرْعًا وَقَالَ هَٰذَا يَوْمٌ عَصِيبٌ)

[Surat Hud ৭৭]

অর্থাৎ, আর যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ লূতের কাছে আগমন করল তখন তাদের আগমনে সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হল এবং বলতে লাগল, আজ অত্যন্ত কঠিন দিন। (সূরা হুদঃ ৭৭)

মুফাসসিরগণ বলেছেনঃ এই ফেরেশতাগণ ছিলেন হযরত জিবরাঈল (عليه السلام), মীকাঈল (عليه السلام) ও ইসরাফীল (عليه السلام)। তারা ইবরাহীম (عليه السلام)-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন এবং সাদ্দুম শহরে এসে উপস্থিত হন। লুত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের পরীক্ষাস্বরূপ এবং তাদের শাস্তিযোগ্য হওয়ার চূড়ান্ত প্রমাণস্বরূপ তারা সুদর্শন তরুণ বেশে হাযির হন। হযরত লূত (عليه السلام)-এর বাড়িতে তারা অতিথি হিসাবে ওঠেন। তখন ছিল সূর্য ডোবার সময়। হযরত লূত (عليه السلام) তাদের দেখে ভীত হলেন। মনে মনে ভাবলেন, যদি তিনি আতিথ্য প্রদান না করেন, তবে অন্য কেউ তা করবে। তিনি তাদেরকে মানুষই ভাবলেন। দুশ্চিন্তা তাঁকে ঘিরে ধরল। তিনি বললেন, আজ একটা বড় কঠিন দিন।

ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে মুজাহিদ, কাতাদা ও মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) হযরত লুত (عليه السلام)-এর এ কঠিন পরীক্ষার বর্ণনা দিয়েছেন। হযরত লুত (عليه السلام) অন্যান্য সময়ে তাঁর সম্প্রদায়কে নিজের মেহমানদের কাছে ঘেঁষতে নিষেধ করতেন। এ কারণে তারা লূত (عليه السلام)-এর উপর শর্ত আরোপ করেছিল যে, তিনি নিজের বাড়িতে কাউকে মেহমান হিসেবে রাখবেন না। কিন্তু সেদিন তিনি এমন লোকদেরকেই মেহমানরূপে দেখতে পেলেন যাদেরকে সরিয়ে দেয়ার উপায়ও ছিল না।

কাতাদা (رحمة الله) বলেন, হযরত লূত (عليه السلام) নিজের ক্ষেতে কাজ করছিলেন, এমন সময় মেহমানগণ তাঁর কাছে উপস্থিত হন এবং তাঁর বাড়িতে মেহমান হওয়ার আবেদন জানান। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করতে লজ্জাবোধ করেন এবং সেখান থেকে তাদেরকে সাথে নিয়ে রওয়ানা হন এবং তাদের আগে আগে হাঁটতে থাকেন। তাদের সাথে তিনি এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলতে থাকেন, যাতে তারা এ জনপদ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। হযরত লূত (عليه السلام) তাদেরকে বললেন, হে ভাইয়েরা! এই জনপদের লোকের চেয়ে নিকৃষ্ট ও দুশ্চরিত্র লোক ধরাপৃষ্ঠে আর আছে কিনা আমার জানা নেই। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তিনি আবার এ কথা উল্লেখ করেন। এভাবে চারবার তাদেরকে কথাটি বলেন। কাতাদা (رحمة الله) বলেন, ফেরেশতাগণ এ ব্যাপারে আদিষ্ট ছিলেন যে, যতক্ষণ নবী তাঁর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা যেন তাদেরকে ধ্বংস না করেন।

সুদ্দী (رحمة الله) বলেন, ফেরেশতাগণ ইবরাহীম (عليه السلام)-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লূতের সম্প্রদায়ের উদ্দেশে রওয়ানা হন। দুপুর বেলা তারা সেখানে পৌঁছেন। সাদ্দূম নদীর তীরে উপস্থিত হলে হযরত লূত (عليه السلام)-এর এক মেয়ের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। বাড়িতে পানি নেয়ার জন্যে সে এখানে এসেছিল। লূত (عليه السلام)-এর ছিলেন দুই কন্যা। বড়জনের নাম রায়ছা এবং ছোট জনের নাম যারাতা। মেয়েটিকে তারা বললেনঃ ওহে! এখানে মেহমান হওয়া যায় এমন কারও বাড়ি আছে কি? মেয়েটি বললেন, আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত জনপদে প্রবেশ করবেন না। নিজের সম্প্রদায়ের ব্যাপারে মেয়েটির অন্তরে লোকগুলোর প্রতি করুণার উদ্রেক হয়। বাড়ি এসে মেয়েটি পিতাকে সম্বোধন করে বললেনঃ পিতা নগর তোরণে কয়েকজন তরুণ আপনার অপেক্ষায় আছেন। তাদের মত সুদর্শন লোক আমি কখনও দেখিনি। আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদেরকে না লাঞ্ছিত করে! ইতিপূর্বে সম্প্রদায়ের লোকজন হযরত লূত (عليه السلام)-কে কোন পুরুষ লোককে মেহমান রাখতে নিষেধ করে দিয়েছিল। যা হোক, হযরত লূত (عليه السلام) তাদেরকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং নিজের পরিবারবর্গের লোকজন ছাড়া আর কেউ বিষয়টি জানতে পারেনি। কিন্তু লূতের স্ত্রী বাড়ি থেকে বের হয়ে জনপদের লোকদের কাছে খবরটি পৌঁছিয়ে দেয়। সে জানিয়ে দেয় যে, লূতের বাড়িতে এমন কতিপয় সুশ্রী তরুণ এসেছে যাদের ন্যায় সুন্দর লোক আর হয় না। তখন লোকজন খুশীতে লূত (عليه السلام)-এর বাড়ির দিকে ছুটে আসে।

আল্লাহর বাণীঃ

وَمِن قَبۡلُ كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ ٱلسَّیِّـَٔاتِۚ

[Surat Hud ৭৮]

(ইতিপূর্বে তারা বিভিন্ন রকম পাপকর্মে লিপ্ত ছিল) অর্থাৎ বহু বড় বড় গুনাহর সাথে এই জঘন্য পাপ কাজও তারা চালিয়ে যেতো।

قَالَ یَـٰقَوۡمِ هَـٰۤؤُلَاۤءِ بَنَاتِی هُنَّ أَطۡهَرُ لَكُمۡۖ

[Surat Hud ৭৮]

লূত বলল, হে আমার সম্প্রদায়! এই যে আমার কন্যারা আছে যারা তোমাদের জন্যে পবিত্রতম।

এ কথা দ্বারা হযরত লূত (عليه السلام) তাঁর ধর্মীয় ও দীনী কন্যাদের অর্থাৎ তাদের স্ত্রীদের প্রতি ইংগিত করেছেন। কেননা, নবীগণ তাদের উম্মতের জন্যে পিতৃতুল্য। হাদীস ও কুরআনে এরূপই বলা হয়েছে।

আল্লাহ বলেনঃ

وَجَاۤءَهُۥ قَوۡمُهُۥ یُهۡرَعُونَ إِلَیۡهِ وَمِن قَبۡلُ كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ ٱلسَّیِّـَٔاتِۚ قَالَ یَـٰقَوۡمِ هَـٰۤؤُلَاۤءِ بَنَاتِی هُنَّ أَطۡهَرُ لَكُمۡۖ فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَلَا تُخۡزُونِ فِی ضَیۡفِیۤۖ أَلَیۡسَ مِنكُمۡ رَجُلࣱ رَّشِیدࣱ[Surat Hud ৭৮]

নবী মুমিনদের জন্যে তাদের নিজেদের চাইতেও ঘনিষ্ঠতর আর তাঁর স্ত্রীগণ মুমিনদের মা। (৩৩: ৬)। কোন কোন সাহাবা ও প্রাচীন আলিমগণের মতে নবী মু’মিনদের পিতা।

উপরোক্ত আয়াতের অনুরূপ আর একটি আয়াত এইঃ

أَتَأۡتُونَ ٱلذُّكۡرَانَ مِنَ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ وَتَذَرُونَ مَا خَلَقَ لَكُمۡ رَبُّكُم مِّنۡ أَزۡوَ ٰ⁠جِكُمۚ بَلۡ أَنتُمۡ قَوۡمٌ عَادُونَ[Surat Ash-Shu’ara ১৬৫ – ১৬৬]

অর্থাৎ, তোমরা বিশ্বের পুরুষদের কাছে গমন করছ। আর তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে যে স্ত্রীকুল সৃষ্টি করেছেন তাদেরকে পরিত্যাগ করছ; বরং তোমরা এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। (২৬: ১৬৫)

মুজাহিদ, সাঈদ ইবন জুবায়র, রাবী ইবন আনাস, কাতাদা, সুদ্দী ও মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) আয়াতের উক্তরূপ ব্যাখ্যা করেছেন এবং এ ব্যাখ্যাই সঠিক। দ্বিতীয় মতটি অর্থাৎ তাঁর নিজের কন্যাগণ হওয়া ভুল। এটা আহলি কিতাবদের থেকে গৃহীত এবং তাদের কিতাবে অনেক বিকৃতি ঘটেছে। তাদের আর একটি ভুল উক্তি এই যে, ফেরেশতারা সংখ্যায় ছিলেন দুইজন এবং রাত্রে তারা লুত (عليه السلام)-এর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করেন। এছাড়া আহলি কিতাবগণ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক অদ্ভুত মিথ্যা উপাখ্যান সৃষ্টি করেছে।

আল্লাহর বাণীঃ

فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَلَا تُخۡزُونِ فِی ضَیۡفِیۤۖ أَلَیۡسَ مِنكُمۡ رَجُلࣱ رَّشِیدࣱ

[Surat Hud ৭৮]

অতএব, আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার মেহমানদের প্রতি অন্যায় আচরণ করে আমাকে হেয় কর না। তোমাদের মধ্যে কি কোন ভাল মানুষ নেই? (১১: ৭৮)

এ আয়াতে হযরত লুত (عليه السلام) নিজ জাতিকে অশ্লীল কাজ থেকে বারণ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি এ কথারও সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তাদের সমাজের একজন লোকও সুস্থ রুচির বা ভাল স্বভাবের ছিল না; বরং সমাজের সমস্ত লোকই ছিল নির্বোধ, জঘন্য পাপাসক্ত ও নিরেট কাফির। ফেরেশতাগণও এটাই চাচ্ছিলেন যে, সম্প্রদায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পূর্বেই নবীর কাছ থেকে তাদের সম্পর্কে তারা কিছু শুনবেন। কিন্তু সম্প্রদায়ের অভিশপ্ত লোকেরা নবীর উত্তম কথার উত্তরে বললঃ

قَالُوا۟ لَقَدۡ عَلِمۡتَ مَا لَنَا فِی بَنَاتِكَ مِنۡ حَقࣲّ وَإِنَّكَ لَتَعۡلَمُ مَا نُرِیدُ

[Surat Hud ৭৯]

অর্থাৎ, আপনি ভাল করেই জানেন, আপনার কন্যাদের দিয়ে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আপনি এও জানেন যে, আমরা কি চাচ্ছি। (১১: ৭৯)

তারা বলছে, হে লূত! আপনি অবগত আছেন যে, স্ত্রীদের প্রতি আমাদের কোন আকর্ষণ নেই। আমাদের উদ্দেশ্য কি, তা আপনি ভাল করেই জানেন। নবীকে উদ্দেশ করে তারা এরূপ কুৎসিৎ ভাষা ব্যবহার করতে আল্লাহকে একটুও ভয় পায়নি। যিনি কঠিন শাস্তিদাতা। এ কারণে হযরত লূত (عليه السلام) বলেছিলেনঃ

قَالَ لَوۡ أَنَّ لِی بِكُمۡ قُوَّةً أَوۡ ءَاوِیۤ إِلَىٰ رُكۡنࣲ شَدِیدࣲ

[Surat Hud ৮০]

অর্থাৎ, হায়, তোমাদের উপর যদি আমার শক্তি থাকত অথবা যদি আমি নিতে পারতাম কোন শক্তিশালী আশ্রয়। (১১: ৮০)

অর্থাৎ তিনি কামনা করেছিলেন সম্প্রদায়কে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা যদি হযরত লুতের থাকত, অথবা তাকে সাহায্যকারী ধনবল বা জনবল যদি থাকত তা হলে তাদের অন্যায় দাবির উপযুক্ত শাস্তি তিনি দিতে পারতেন।

যুহরী (رحمة الله) আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে মারফুরূপে হাদীস বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ সন্দেহ প্রকাশের ব্যাপারে আমরা ইবরাহীম (عليه السلام)-এর চাইতে বেশি হকদার। আল্লাহ লুত (عليه السلام)-এর উপর রহম করুন। কেননা, তিনি শক্তিশালী অবলম্বনের আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। আমি যদি সেই দীর্ঘকাল জেলখানায় অবস্থান করতাম যেমনি ইউসুফ (عليه السلام) করেছিলেন তবে আমি অবশ্যই আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিতাম। এ হাদীস আবুয যিনাদ ভিন্ন সূত্রেও বর্ণনা করেছেন এবং মুহাম্মদ ইবন আমর (رحمة الله) আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন, আল্লাহ নূত (عليه السلام)-এর উপর রহমত বর্ষণ করুন। কেননা, তিনি শক্তিশালী অবলম্বন অর্থাৎ আল্লাহর নিকট আশ্রয় কামনা করেছিলেন। এরপর থেকে আল্লাহ যত নবী প্রেরণ করেছেন তাদেরকে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী করে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর বাণীঃ

وَجَاۤءَ أَهۡلُ ٱلۡمَدِینَةِ یَسۡتَبۡشِرُونَ ۝ قَالَ إِنَّ هَـٰۤؤُلَاۤءِ ضَیۡفِی فَلَا تَفۡضَحُونِ ۝ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَلَا تُخۡزُونِ ۝ قَالُوۤا۟ أَوَلَمۡ نَنۡهَكَ عَنِ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ قَالَ هَـٰۤؤُلَاۤءِ بَنَاتِیۤ إِن كُنتُمۡ فَـٰعِلِینَ

[Surat Al-Hijr ৬৭ - ৭১]

অর্থাৎ, নগরবাসীরা উল্লসিত হয়ে উপস্থিত হলো। সে বলল, ওরা আমার মেহমান, সুতরাং তোমরা আমাকে বে-ইজ্জত করো না। আল্লাহকে ভয় কর এবং আমাকে হেয় করো না। তারা বলল, হে লূত! আমরা কি তোমাকে দুনিয়া শুদ্ধ লোককে আশ্রয় দিতে নিষেধ করিনি? লূত বলল, তোমাদের একান্তই যদি কিছু করতে হয় তাহলে আমার এই কন্যাগণ রয়েছে। (১৫: ৬৭)

হযরত লুত (عليه السلام) সম্প্রদায়ের লোকজনকে তাদের স্ত্রীদের কাছে যেতে আদেশ দেন এবং তাদের কু-অভ্যাসের উপর অবিচল থাকার মন্দ পরিণতির কথা জানিয়ে দেন যা অচিরেই তাদের উপর পতিত হবে। কিন্তু কোন কিছুতেই তারা নিবৃত্ত হল না। বরং নবী যতই তাদেরকে উপদেশ দেন, তারা ততই উত্তেজিত হয়ে মেহমানদের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করে। কিন্তু রাতের শেষে তকদীর তাদেরকে কোথায় পৌঁছিয়ে দেবে তা তাদের আদৌ জানা ছিল না। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনের কসম করে বলেনঃ

لَعَمۡرُكَ إِنَّهُمۡ لَفِی سَكۡرَتِهِمۡ یَعۡمَهُونَ

[Surat Al-Hijr ৭২]

অর্থাৎ, তোমার জীবনের শপথ! ওরা তো মত্ততায় বিমূঢ় হয়েছে। (১৫: ৭২)

আল্লাহর বাণীঃ

وَلَقَدۡ أَنذَرَهُم بَطۡشَتَنَا فَتَمَارَوۡا۟ بِٱلنُّذُرِ ۝ وَلَقَدۡ رَ ٰ⁠وَدُوهُ عَن ضَیۡفِهِۦ فَطَمَسۡنَاۤ أَعۡیُنَهُمۡ فَذُوقُوا۟ عَذَابِی وَنُذُرِ ۝ وَلَقَدۡ صَبَّحَهُم بُكۡرَةً عَذَابࣱ مُّسۡتَقِرࣱّ[Surat Al-Qamar ৩৬ – ৩৮]

লূত ওদেরকে আমার কঠোর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছিল। কিন্তু ওরা সতর্কবাণী সম্বন্ধে বিতণ্ডা শুরু করল। তারা লুতের কাছ থেকে তার মেহমানদেরকে দাবি করল। তখন আমি ওদের দৃষ্টিশক্তি লোপ করে দিলাম এবং আমি বললাম, আস্বাদন কর আমার শাস্তি ও সতর্কবাণীর পরিণাম। প্রত্যুষে বিরামহীন শাস্তি তাদেরকে আঘাত করল। (৫৪: ৩৬-৩৮)

মুফাসসির ও অন্যান্য আলিম বলেছেন, হযরত লূত (عليه السلام) তাঁর সম্প্রদায়কে তার ঘরে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন এবং তাদেরকে বাধা দেন। ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। তারা তা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতে উদ্যত হলো। আর হযরত লূত (عليه السلام) দরজার বাইরে থেকে তাদেরকে উপদেশ দিতে এবং ভিতরে যেতে বারণ করতে থাকেন। উভয় পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ চলতে থাকে। অবস্থা যখন সঙ্গীন হয়ে আসল এবং ঘটনা লুত (عليه السلام)-এর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার উপক্রম হল; তখন তিনি বললেন, তোমাদের প্রতিহত করার শক্তি যদি আমার থাকত অথবা কোন শক্তিশালী অবলম্বনের আশ্রয় নিতে পারতাম তবে তোমাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করতাম। এ সময় ফেরেশতাগণ বললেনঃ

یَـٰلُوطُ إِنَّا رُسُلُ رَبِّكَ لَن یَصِلُوۤا۟ إِلَیۡكَ

[Surat Hud ৮১]

“হে লূত! আমরা তোমার প্রতিপালক প্রেরিত ফেরেশতা। ওরা কখনই তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না।” (১১: ৮১)

মুফাসসিরগণ উল্লেখ করেন, জিবরাঈল (عليه السلام) ঘর থেকে বেরিয়ে তাদের সম্মুখে আসেন এবং নিজ ডানার এক প্রান্ত দ্বারা হালকাভাবে তাদের চেহারায় আঘাত করেন। ফলে তাদের দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়ে যায়। কেউ কেউ বলেছেন, তাদের চোখ সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। এমনকি চেহারায় চোখের কোন চিহ্নই অবশিষ্ট রইলো না। তারপর তারা দেয়াল হাতড়িয়ে কোন মতে সেখান থেকে ফিরে যায়। আল্লাহর নবী লুত (عليه السلام)-কে ধমক দিতে দিতে বলতে থাকেন— কাল সকালে আমাদের ও তার মধ্যে বোঝাপড়া হবে।

আল্লাহ বলেনঃ

وَلَقَدۡ رَ ٰ⁠وَدُوهُ عَن ضَیۡفِهِۦ فَطَمَسۡنَاۤ أَعۡیُنَهُمۡ فَذُوقُوا۟ عَذَابِی وَنُذُرِ ۝ وَلَقَدۡ صَبَّحَهُم بُكۡرَةً عَذَابࣱ مُّسۡتَقِرࣱّ[Surat Al-Qamar ৩৭ – ৩৮]

অর্থাৎ, ওরা লূতের কাছ থেকে তার মেহমানদেরকে দাবি করল। তখন আমি তাদের দৃষ্টিশক্তি লোপ করে দিলাম এবং আমি বললামঃ এখন আমার শাস্তি ও সতর্ক বাণীর পরিণাম আস্বাদন কর। প্রত্যুষে বিরামহীন শাস্তি ও তাদের উপর আঘাত হানল। (৫৪: ৩৭-৩৮)

ফেরেশতাগণ হযরত লূত (عليه السلام)-এর কাছে দু’টি প্রস্তাব পেশ করেন (১) পরিবার-পরিজন নিয়ে রাতের শেষে রওয়ানা হয়ে যাবেন (২) কেউ পেছনের দিকে ফিরে তাকাবেন না। অর্থাৎ সম্প্রদায়ের উপর যখন আযাব পতিত হবে এবং আযাবের শব্দ শোনা যাবে তখন কেউ যেন পশ্চাতে ফিরে না তাকায়। ফেরেশতাগণ আরও জানান যে, তিনি যেন সকলের পেছনে থেকে সবাইকে পরিচালনা করেন। الا امرءتك এই বাক্যাংশের দু’টি অর্থ হতে পারে (১) যাওয়ার সময় তোমার স্ত্রীকে সাথে নেবে না। এ অবস্থায় امراءة এর উপর যবর দিয়ে পড়তে হবে এবং فاسو باهلك থেকে সে ব্যতিক্রম হবে। (২) যাওয়ার পথে দলের কেউ পেছনের দিকে তাকাবে না কিন্তু কেবল তোমার স্ত্রীই এ নির্দেশ অমান্য করে পেছনের দিকে তাকাবে; ফলে সম্প্রদায়ের উপর যে আযাব আসবে ঐ আযাবে সেও গ্রেফতার হবে। এ অবস্থায় امراءة ولا يلتفت احد থেকে মুস্তাসনা (ব্যতিক্রম) হবে। পেশ যুক্ত পাঠ (امرأتك) এ অর্থকে সমর্থন করে। কিন্তু প্রথম অর্থই অধিকতর স্পষ্ট।

সুহায়লী বলেন, লুত (عليه السلام)-এর স্ত্রীর নাম ওয়ালিহা এবং নূহ (عليه السلام)-এর স্ত্রীর নাম ওয়ালিগা। আগন্তুক ফেরেশতাগণ ঐসব বিদ্রোহী পাপিষ্ঠ, সীমালংঘনকারী নির্বোধ অভিশপ্ত সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হবে এ সুসংবাদ লুত (عليه السلام)-কে শোনান, যারা পরবর্তী যুগের লোকদের জন্যে দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।

আল্লাহর বাণীঃ

إِنَّ مَوۡعِدَهُمُ ٱلصُّبۡحُۚ أَلَیۡسَ ٱلصُّبۡحُ بِقَرِیبࣲ

[Surat Hud ৮১]

অর্থাৎ, তাদের প্রতিশ্রুত সময় প্রভাত কাল। আর প্রভাত কাল খুব নিকটে নয় কি?

হযরত লূত (عليه السلام) নিজ পরিবারবর্গ নিয়ে বের হয়ে আসেন। পরিবারবর্গ বলতে তার দু’টি কন্যাই মাত্র ছিল। সম্প্রদায়ের অন্য কোন একটি লোকও তার সাথে আসেনি। কেউ কেউ বলেছেন, তার স্ত্রীও একই সাথে বের হয়েছিল। কিন্তু সঠিক খবর আল্লাহই ভাল জানেন। তাঁরা যখন সে এলাকা অতিক্রম করে চলে আসেন এবং সূর্য উদিত হয়, তখন আল্লাহর অলংঘনীয় নির্দেশ ও অপ্রতিরোধ্য আযাব তাদের উপর নেমে আসে। আহলি কিতাবদের মতে, ফেরেশতাগণ হযরত লূত (عليه السلام)-কে তথায় অবস্থিত একটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে বলেন। কিন্তু হযরত লূত (عليه السلام)-এর নিকট তা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ঠেকে। তাই তিনি নিকটবর্তী কোন গ্রামে চলে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। ফেরেশতাগণ বললেন, তাই করুন। গ্রামে পৌঁছে সেখানে স্থিত হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করবো এবং তারপরই আমরা আযাব অবতীর্ণ করব। আহলি কিতাবগণ বলেন, সে মতে হযরত লুত (عليه السلام) গওরযাগর নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে চলে যান এবং সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তাদের উপর আল্লাহর আযাব নেমে আসে।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

فَلَمَّا جَاۤءَ أَمۡرُنَا جَعَلۡنَا عَـٰلِیَهَا سَافِلَهَا وَأَمۡطَرۡنَا عَلَیۡهَا حِجَارَةࣰ مِّن سِجِّیلࣲ مَّنضُودࣲ ۝ مُّسَوَّمَةً عِندَ رَبِّكَۖ وَمَا هِیَ مِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ بِبَعِیدࣲ[Surat Hud ৮২ – ৮৩]

অর্থাৎ, তারপর যখন আমার আদেশ আসল তখন আমি জনপদকে উল্টিয়ে দিলাম এবং ওদের উপর ক্রমাগত বর্ষণ করলাম পাথর, কংকর যা তোমার প্রতিপালকের কাছে চিহ্নিত ছিল। এটি জালিমদের থেকে দূরে নয়। (১১: ৮২)

মুফাসসিরগণ বলেন, হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) আপন ডানার এক প্রান্ত দিয়ে লূত সম্প্রদায়ের আবাসভূমি গভীর নিচু থেকে উপড়িয়ে নেন। মোট সাতটি নগরে তারা বসবাস করত। কারও মতে তাদের সংখ্যা চারশ’, কারও মতে চার হাজার। সে এলাকার সমস্ত মানুষ, জীব-জন্তু, ঘরবাড়ি ও ধন-সম্পদ যা কিছু ছিল সবকিছুসহ উঠিয়ে নেয়া হয়। উপরে আকাশের সীমানা পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়। আসমানের এত কাছে নিয়ে যাওয়া হয় যে, সেখানকার ফেরেশতাগণ মোরগের ডাক ও কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ পর্যন্ত শুনতে পান। তারপর সেখান থেকে উল্টিয়ে নিচে নিক্ষেপ করা হয়। মুজাহিদ (رحمة الله) বলেন, সর্বপ্রথম যা নিচে এসে পতিত হয় তা হল তাদের উঁচু অট্টালিকাসমূহ।

وَأَمۡطَرۡنَا عَلَیۡهِمۡ حِجَارَةࣰ مِّن سِجِّیلٍ

[Surat Al-Hijr ৭৪]

(তাদের উপর পাথর কঙ্কর বর্ষণ করলাম)

سجيل ফার্সী শব্দ, একে আরবীকরণ করা হয়েছে। অর্থ ও অত্যধিক শক্ত ও কঠিন। منضود অর্থ ক্রমাগত। অর্থাৎ আকাশ থেকে একের পর এক যা তাদের উপর আসতে থাকে। مسومة অর্থ চিহ্নিত। প্রতিটি পাথরের গায়ে সেই ব্যক্তির নাম লেখা ছিল যার উপর তা পতিত হবার জন্যে নির্ধারিত ছিল। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ

مُّسَوَّمَةً عِندَ رَبِّكَ لِلۡمُسۡرِفِینَ

[Surat Adh-Dhariyat ৩৪]

(তোমার প্রতিপালকের নিকট চিহ্নিত যা সীমালংঘনকারীদের জন্যে নির্ধারিত।)।

আল্লাহর বাণীঃ

وَأَمۡطَرۡنَا عَلَیۡهِم مَّطَرࣰاۖ فَسَاۤءَ مَطَرُ ٱلۡمُنذَرِینَ

[Surat Ash-Shu’ara ১৭৩]

অর্থাৎ, তাদের উপর শাস্তিমূলক বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম। যাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল তাদের জন্যে এ বৃষ্টি কতই না নিকৃষ্ট! (২৬: ১৭৩)

আল্লাহর বাণীঃ

وَٱلۡمُؤۡتَفِكَةَ أَهۡوَىٰ ۝ فَغَشَّىٰهَا مَا غَشَّىٰ

[Surat An-Najm ৫৩ – ৫৪]

অর্থাৎ, উৎপাটিত আবাসভূমিকে উল্টিয়ে নিক্ষেপ করেছিলেন। তারপর তা আচ্ছন্ন করে ফেলল কী। সর্বগ্রাসী শাস্তি! (৫৩: ৫৩)

অর্থাৎ আল্লাহ সেই জনপদের ভূখণ্ডকে উপরে তুলে নিচের অংশকে উপরে ও উপরের অংশকে নিচে করে উল্টিয়ে দেন। তারপর শক্ত পাথর-কংকর বর্ষণ করেন অবিরামভাবে যা তাদের সবাইকে ছেয়ে ফেলে। প্রতিটি পাথরের উপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম লেখা ছিল। এ পাথরগুলো ঐ জনপদে উপস্থিত সকলের উপর পতিত হয়। অনুরূপ যারা তখন সেখানে অনুপস্থিত ছিল অর্থাৎ মুসাফির, পথিক ও দূরে অবস্থানকারী সকলের উপরই তা পতিত হয়। কথিত আছে যে, হযরত লূত (عليه السلام)-এর স্ত্রী তার সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে থেকে যায়। অপর মতে বলা হয়েছে যে, সে তার স্বামী ও দুই কন্যার সাথে বেরিয়ে যায়। কিন্তু যখন সে আযাব ও শহর ধ্বংস হওয়ার শব্দ শুনতে পায়, তখন সে পেছনে সম্প্রদায়ের দিকে ফিরে তাকায় এবং আগের পরের আল্লাহর সকল নির্দেশ অমান্য করে। ‘হায় আমার সম্প্রদায়! বলে সে বিলাপ করতে থাকে। তখন উপর থেকে একটি পাথর এসে তার মাথায় পড়ে এবং তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে। এভাবে সে নিজ সম্প্রদায়ের ভাগ্যের সাথে একীভূত হয়ে যায়। কারণ, সে ছিল তার সম্প্রদায়ের ধর্মে বিশ্বাসী। তাদের সংবাদ সরবরাহকারিণী; হযরত লূত (عليه السلام)-এর বাড়িতে মেহমান আসলে সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে সে সংবাদ পৌঁছিয়ে দিত। আল্লাহ বলেনঃ

ضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلࣰا لِّلَّذِینَ كَفَرُوا۟ ٱمۡرَأَتَ نُوحࣲ وَٱمۡرَأَتَ لُوطࣲۖ كَانَتَا تَحۡتَ عَبۡدَیۡنِ مِنۡ عِبَادِنَا صَـٰلِحَیۡنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمۡ یُغۡنِیَا عَنۡهُمَا مِنَ ٱللَّهِ شَیۡـࣰٔا وَقِیلَ ٱدۡخُلَا ٱلنَّارَ مَعَ ٱلدَّ ٰ⁠خِلِینَ

[Surat At-Tahrim ১০]

অর্থাৎ, আল্লাহ কাফিরদের জন্যে নূহ ও লূতের স্ত্রীকে দৃষ্টান্ত উপস্থিত করেছেন। ওরা ছিল আমার বান্দাগণের মধ্যে দুজন সৎকর্মপরায়ণ বান্দার অধীন। কিন্তু ওরা তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ফলে, নূহ ও লূত তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে কিছুমাত্র রক্ষা করতে পারল না। তাই ওদেরকে বলা হল, জাহান্নামে প্রবেশকারীদের সাথে তোমরাও ওতে প্রবেশ কর। (৬৬: ১০)

অর্থাৎ তারা নবীদের সাথে দীনের ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, নবীর দীন গ্রহণ করেনি এখানে এ অর্থ কিছুতেই নেয়া যাবে না যে, তারা প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য কোনভাবে অশ্লীল কাজে জড়িত ছিল। কেননা, আল্লাহ কোন ব্যভিচারিণীকে কোন নবীর স্ত্রী হিসেবে নির্ধারণ করেননি। হযরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-সহ অন্যান্য প্রাচীন ও পরবর্তীকালের ইমাম ও মুফাসিরগণ এ কথাই বলেছেন। তারা বলেছেন, কোন নবীর কোন স্ত্রী কখনও ব্যভিচার করেননি। যারা এর বিপরীত মত ব্যক্ত করেছেন, তারা বিরাট ভুল করেছেন। 'ইফকের’ ঘটনায় কতিপয় ব্যক্তি হযরত আয়েশা (رضي الله عنه)-এর প্রতি অপবাদ দিলে আল্লাহ্ তা’আলা আয়েশা (رضي الله عنه)-এর পবিত্রতা ঘোষণা করে যে আয়াত নাযিল করেন, তাতে ঐসব মু’মিন লোকদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করেন। আল্লাহর বাণীঃ

إِذۡ تَلَقَّوۡنَهُۥ بِأَلۡسِنَتِكُمۡ وَتَقُولُونَ بِأَفۡوَاهِكُم مَّا لَیۡسَ لَكُم بِهِۦ عِلۡمࣱ وَتَحۡسَبُونَهُۥ هَیِّنࣰا وَهُوَ عِندَ ٱللَّهِ عَظِیمࣱ ۝ وَلَوۡلَاۤ إِذۡ سَمِعۡتُمُوهُ قُلۡتُم مَّا یَكُونُ لَنَاۤ أَن نَّتَكَلَّمَ بِهَـٰذَا سُبۡحَـٰنَكَ هَـٰذَا بُهۡتَـٰنٌ عَظِیمࣱ

[Surat An-Nur ১৫ - ১৬]

অর্থাৎ, যখন তোমরা মুখে মুখে এ কথা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং তোমরা একে তুচ্ছজ্ঞান করছিলে। যদিও আল্লাহর কাছে এটা ছিল গুরুতর এবং তোমরা যখন এ কথা শুনলে তখন কেন বললে না— এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদের উচিত নয়। আল্লাহ পবিত্র মহান। এতে এক গুরুতর অপবাদ। (২৪: ১৫-১৬)

অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনার নবীর স্ত্রী এ দোষে জড়িত হবে এ থেকে আপনি পবিত্র।

আল্লাহ বাণীঃ

وَمَا هِیَ مِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ بِبَعِیدࣲ

[Surat Hud ৮৩]

(আর এটা জালিমদের থেকে বেশি দূরে নয়) অর্থাৎ এই শাস্তি বেশি দূরে নয় সেইসব লোকদের থেকে যারা লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের ন্যায় কুকর্মে লিপ্ত হবে। এই কারণে কোন কোন আলিম বলেছেন, পুরুষের সাথে সমকামিতায় লিপ্ত ব্যক্তিকে ‘রজম’ বা পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হবে, চাই সে বিবাহিত হোক কিংবা অবিবাহিত। ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমদ, ইবন হাম্বল (رحمة الله) প্রমুখ ইমাম এই মত পোষণ করেন। তাঁরা বর্ণিত সেই হাদীস থেকেও দলীল গ্রহণ করেছেন যা ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) কর্তৃক মুসনাদে আহমদে ও সুনান গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, এমন কোন লোক যদি তোমরা পাও, যে লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের অনুরূপ পাপ কাজে লিপ্ত, তখন সংশ্লিষ্ট উভয় ব্যক্তিকেই হত্যা কর। ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) বলেন, পুরুষের সাথে সমকামীকে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে ফেলে দিয়ে তার উপর পাথর নিক্ষেপ করতে হবে; যেভাবে লুতের সম্প্রদায়ের সাথে করা হয়েছিল। তিনি দলীলরূপে নিমোক্ত আয়াত পেশ করেছেন।

وَمَا هِیَ مِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ بِبَعِیدࣲ

[Surat Hud ৮৩]

(এটা জালিমদের থেকে বেশি দূরে নয়) আল্লাহ তা’আলা লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের গোটা এলাকাকে একটি দুর্গন্ধময় সমুদ্রে পরিণত করেন। ঐ সমুদ্রের পানি ও সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। এভাবে স্মরণীয় বিধ্বস্ত এলাকাটি পরবর্তীকালের সেইসব মানুষের জন্যে শিক্ষণীয় ও উপদেশ গ্রহণের বস্তুতে পরিণত হয়েছে, যারা আল্লাহর অবাধ্য হয়, রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, প্রবৃত্তির অনুসরণ করে ও আপন মনিবের নাফরমানী করে। এ ঘটনা সে বিষয়েও প্রমাণ বহন করে যে, আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন এবং তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে আসেন। আল্লাহর বাণীঃ

إِنَّ فِی ذَ ٰ⁠لِكَ لَـَٔایَةࣰۖ وَمَا كَانَ أَكۡثَرُهُم مُّؤۡمِنِینَ ۝ وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ ٱلۡعَزِیزُ ٱلرَّحِیمُ

[Surat Ash-Shu’ara ৮ – ৯]

অর্থাৎ, নিশ্চয় তাতে আছে নিদর্শন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই মুমিন নয়। তোমার প্রতিপালক তিনি তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (২৬: ৮-৯)

আল্লাহর বাণীঃ

فَأَخَذَتۡهُمُ ٱلصَّیۡحَةُ مُشۡرِقِینَ ۝ فَجَعَلۡنَا عَـٰلِیَهَا سَافِلَهَا وَأَمۡطَرۡنَا عَلَیۡهِمۡ حِجَارَةࣰ مِّن سِجِّیلٍ ۝ إِنَّ فِی ذَ ٰ⁠لِكَ لَـَٔایَـٰتࣲ لِّلۡمُتَوَسِّمِینَ ۝ وَإِنَّهَا لَبِسَبِیلࣲ مُّقِیمٍ ۝ إِنَّ فِی ذَ ٰ⁠لِكَ لَـَٔایَةࣰ لِّلۡمُؤۡمِنِینَ

[Surat Al-Hijr ৭৩ – ৭৭]

অর্থাৎ, তারপর সূর্যোদয়ের সময়ে এক মহানাদ তাদেরকে আঘাত করল এবং আমি জনপদকে উল্টিয়ে উপর-নীচ করে দিলাম এবং তাদের উপর পাথর-কংকর বর্ষণ করলাম। অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে পর্যবেক্ষণ শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের জন্যে। লোক চলাচলের পথের পাশে তা এখনও বিদ্যমান। এতে অবশ্যই রয়েছে মু’মিনদের জন্যে নির্দশন। (১৫: ৭৩-৭৭)

متو سمين বলা হয় সেসব লোকদেরকে যারা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে থাকে। এখানে দূরদৃষ্টির অর্থ হল এই বিষয়ে চিন্তা করা যে, এ জনপদটি ও তার বাসিন্দারা আবাদ হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে আল্লাহ্ তা ধ্বংস ও বিধ্বস্ত করে দিলেন। তিরমিযী ইত্যাদি কিতাবে মারফু হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) বলেছেনঃ

اتقوا فراسة المؤمن فانه ينظر بنور الله

মু’মিনের দূরদৃষ্টিকে তোমরা সমীহ করবে, কেননা সে আল্লাহপ্রদত্ত নূরের সাহায্যে দেখতে পায়। একথা বলে রাসূল (ﷺ) নিম্নোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেনঃ

إِنَّ فِی ذَ ٰ⁠لِكَ لَـَٔایَـٰتࣲ لِّلۡمُتَوَسِّمِینَ

[Surat Al-Hijr ৭৫]

(দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মু’মিনদের জন্যে এতে নিদর্শন রয়েছে)। আল্লাহর বাণীঃ

وَإِنَّهَا لَبِسَبِیلࣲ مُّقِیمٍ

[Surat Al-Hijr ৭৬]

(পথের পাশে তা এখনও বিদ্যমান) অর্থাৎ যাতায়াতের চালু পথে ঐ জনপদের ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান রয়েছে। যেমন অপর আয়াতে বলা হয়েছেঃ

وَإِنَّكُمۡ لَتَمُرُّونَ عَلَیۡهِم مُّصۡبِحِینَ ۝ وَبِٱلَّیۡلِۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ

[Surat As-Saaffat ১৩৭ – ১৩৮]

(তোমরা তো তাদের ধ্বংসাবশেষগুলো সকাল-সন্ধ্যায় অতিক্রম করে থাক। তবুও কি তোমরা অনুধাবন করবে না? (৩৭: ১৩৭-১৩৮) অপর আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ

وَلَقَد تَّرَكۡنَا مِنۡهَاۤ ءَایَةَۢ بَیِّنَةࣰ لِّقَوۡمࣲ یَعۡقِلُونَ

[Surat Al-Ankabut ৩৫]

অর্থাৎ, বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্যে আমি এতে একটি স্পষ্ট নিদর্শন রেখেছি। (২৯: ৩৫)

আল্লাহর বাণীঃ

فَأَخۡرَجۡنَا مَن كَانَ فِیهَا مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ ۝ فَمَا وَجَدۡنَا فِیهَا غَیۡرَ بَیۡتࣲ مِّنَ ٱلۡمُسۡلِمِینَ ۝ وَتَرَكۡنَا فِیهَاۤ ءَایَةࣰ لِّلَّذِینَ یَخَافُونَ ٱلۡعَذَابَ ٱلۡأَلِیمَ[Surat Adh-Dhariyat ৩৫ – ৩৭]

অর্থাৎ, সেখানে যেসব মুমিন ছিল আমি তাদেরকে উদ্ধার করেছিলাম এবং সেখানে একটি পরিবার ব্যতীত আর কোন মুসলিম গৃহ আমি পাইনি। যারা মর্মন্তুদ শাস্তিকে ভয় করে আমি তাদের জন্যে এর মধ্যে একটি নির্দশন রেখেছি। (৫১: ৩৫-৩৭)

অর্থাৎ লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের জনপদটিকে আমি শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণের জন্যে রেখে দিয়েছি সেইসব লোকের জন্যে যারা আখিরাতের আযাবকে ভয় করে। না দেখেই আল্লাহকে ভয় করে, মহান প্রতিপালকের সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়ার ব্যাপারে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে, প্রবৃত্তি পরায়ণতা থেকে বিরত থাকে, আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিস থেকে দূরে থাকে। তাঁর নাফরমানী থেকে বেঁচে থাকে এবং লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের মত হওয়ার ব্যাপারে অন্তরে ভয় রাখে (ومن تشبه بقوم فهو منهم) যে ব্যক্তি কোন জাতির সাথে সাদৃশ্য রাখে সে তাদের দলভুক্ত। সকল ব্যাপারে পূর্ণ সাদৃশ্য হতে হবে এমন কোন কথা নেই; বরং কোন কোন ব্যাপারে সাদৃশ্য থাকলেই হয়। যেমন কেউ কেউ বলেছেন, তোমরা যদি সম্পূর্ণরূপে কওমে লূত হয়ে থাক, তবে কওমে লূত তোমাদের থেকে খুব বেশি পৃথক নয়। অতএব, যে লোক জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও আল্লাহ-ভীরু, সে আল্লাহর যাবতীয় নির্দেশ মেনে চলবে এবং রাসূলের আদর্শকে অনুসরণ করবে, সে অবশ্যই হালাল স্ত্রী ও যুদ্ধবন্দী দাসী ভোগ করবে। শয়তানের পথে চলতে সে ভয় পাবে। অন্যথায় সে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য হবে এবং নিমোক্ত আয়াতের আওতায় এসে যাবে

وَمَا هِیَ مِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ بِبَعِیدࣲ

[Surat Hud ৮৩]

(জালিমদের থেকে তা বেশি দূরে নয়।)
Top