❏ কওমে শু‘আয়ব বা মাদয়ানবাসীর ঘটনা
আল্লাহ্ তা’আলা সূরা আরাফে কওমে লূতের কাহিনী শেষ করার পর বলেনঃ
وَإِلَىٰ مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا ۗ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۖ قَدْ جَاءَتْكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ ۖ فَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ * وَلَا تَقْعُدُوا بِكُلِّ صِرَاطٍ تُوعِدُونَ وَتَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِهِ وَتَبْغُونَهَا عِوَجًا ۚ وَاذْكُرُوا إِذْ كُنْتُمْ قَلِيلًا فَكَثَّرَكُمْ ۖ وَانْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ * وَإِنْ كَانَ طَائِفَةٌ مِنْكُمْ آمَنُوا بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ وَطَائِفَةٌ لَمْ يُؤْمِنُوا فَاصْبِرُوا حَتَّىٰ يَحْكُمَ اللَّهُ بَيْنَنَا ۚ وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِينَ *(قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لَنُخْرِجَنَّكَ يَا شُعَيْبُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَكَ مِنْ قَرْيَتِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا ۚ قَالَ أَوَلَوْ كُنَّا كَارِهِينَ * قَدِ افْتَرَيْنَا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا إِنْ عُدْنَا فِي مِلَّتِكُمْ بَعْدَ إِذْ نَجَّانَا اللَّهُ مِنْهَا ۚ وَمَا يَكُونُ لَنَا أَنْ نَعُودَ فِيهَا إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّنَا ۚ وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا ۚ عَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْنَا ۚ رَبَّنَا افْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمِنَا بِالْحَقِّ وَأَنْتَ خَيْرُ الْفَاتِحِينَ * وَقَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لَئِنِ اتَّبَعْتُمْ شُعَيْبًا إِنَّكُمْ إِذًا لَخَاسِرُونَ * فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوا فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ * الَّذِينَ كَذَّبُوا شُعَيْبًا كَأَنْ لَمْ يَغْنَوْا فِيهَا ۚ الَّذِينَ كَذَّبُوا شُعَيْبًا كَانُوا هُمُ الْخَاسِرِينَ * فَتَوَلَّىٰ عَنْهُمْ وَقَالَ يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَنَصَحْتُ لَكُمْ ۖ فَكَيْفَ آسَىٰ عَلَىٰ قَوْمٍ كَافِرِينَ[Surat Al-A’raf ৮৫ – ৯৩]
অর্থাৎ, মাদয়ানবাসীদের কাছে তাদের স্বগোত্রীয় শু‘আয়বকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, “হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ্ নেই। তোমাদের প্রতিপালক হতে তোমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ এসেছে। সুতরাং তোমরা মাপ ও ওজন ঠিকভাবে দেবে; লোকদেরকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দেবে না এবং দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর বিপর্যয় ঘটাবে না; তোমরা মু’মিন হলে তোমাদের জন্যে এটা কল্যাণকর। তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ভয় প্রদর্শনের জন্যে কোন পথে বসে থাকবে না, আল্লাহর পথে তাদেরকে বাধা দেবে না এবং তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করবে না। স্মরণ কর, তোমরা যখন সংখ্যায় কম ছিলে আল্লাহ তখন তোমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কিরূপ ছিল, তা লক্ষ্য কর। আমি যাসহ প্রেরিত হয়েছি তাতে যদি তোমাদের কোন দল বিশ্বাস করে এবং কোন দল বিশ্বাস না করে তবে ধৈর্যধারণ কর, যতক্ষণ না আল্লাহ্ আমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন। আর তিনিই শ্রেষ্ঠ মীমাংসাকারী। তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক প্রধানগণ বলল, হে শু‘আয়ব! তোমাকে ও তোমার সাথে যারা বিশ্বাস করেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বের করবই অথবা তোমাদেরকে আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে আসতে হবে।’ সে বলল, কী! আমরা তা ঘৃণা করলেও?’ তোমাদের ধর্মাদর্শ হতে আল্লাহ আমাদেরকে উদ্ধার করার পর যদি আমরা তাতে ফিরে যাই, তবে তো আমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করব, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ্ ইচ্ছা না করলে আর তাতে ফিরে যাওয়া আমাদের কাজ নয়; সবকিছুই আমাদের প্রতিপালকের জ্ঞানায়ত্ত। আমরা আল্লাহর প্রতি নির্ভর করি; হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ন্যায্যাভাবে মীমাংসা করে দাও; এবং তুমিই মীমাংসাকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’ তার সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসী প্রধানগণ বলল, তোমরা যদি শুআয়বকে অনুসরণ কর তবে তোমরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতঃপর তারা ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হল, ফলে তাদের প্রভাত হল নিজ ঘরে উপুড় হয়ে পতিত অবস্থায়। মনে হল, শু‘আয়বকে যারা প্রত্যাখ্যান করেছিল তারা যেন কখনও সেখানে বসবাস করেই নি। শু‘আয়বকে যারা প্রত্যাখ্যান করেছিল, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে তাদের থেকে মুখ ফিরাল এবং বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমার প্রতিপালকের বাণী আমি তো তোমাদেরকে পৌঁছে দিয়েছি এবং তোমাদেরকে উপদেশ দিয়েছি; সুতরাং আমি কাফির সম্প্রদায়ের জন্যে কি করে আক্ষেপ করি!’ (৭: ৮৫-৯৩)
সূরা হূদের মধ্যেও লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের ঘটনা বলার পর আল্লাহ বলেনঃ
(۞ وَإِلَىٰ مَدۡیَنَ أَخَاهُمۡ شُعَیۡبࣰاۚ قَالَ یَـٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَـٰهٍ غَیۡرُهُۥۖ وَلَا تَنقُصُوا۟ ٱلۡمِكۡیَالَ وَٱلۡمِیزَانَۖ إِنِّیۤ أَرَىٰكُم بِخَیۡرࣲ وَإِنِّیۤ أَخَافُ عَلَیۡكُمۡ عَذَابَ یَوۡمࣲ مُّحِیطࣲ وَیَـٰقَوۡمِ أَوۡفُوا۟ ٱلۡمِكۡیَالَ وَٱلۡمِیزَانَ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَلَا تَبۡخَسُوا۟ ٱلنَّاسَ أَشۡیَاۤءَهُمۡ وَلَا تَعۡثَوۡا۟ فِی ٱلۡأَرۡضِ مُفۡسِدِینَ بَقِیَّتُ ٱللَّهِ خَیۡرࣱ لَّكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِینَۚ وَمَاۤ أَنَا۠ عَلَیۡكُم بِحَفِیظࣲ قَالُوا۟ یَـٰشُعَیۡبُ أَصَلَوٰتُكَ تَأۡمُرُكَ أَن نَّتۡرُكَ مَا یَعۡبُدُ ءَابَاۤؤُنَاۤ أَوۡ أَن نَّفۡعَلَ فِیۤ أَمۡوَ ٰلِنَا مَا نَشَـٰۤؤُا۟ۖ إِنَّكَ لَأَنتَ ٱلۡحَلِیمُ ٱلرَّشِیدُ قَالَ یَـٰقَوۡمِ أَرَءَیۡتُمۡ إِن كُنتُ عَلَىٰ بَیِّنَةࣲ مِّن رَّبِّی وَرَزَقَنِی مِنۡهُ رِزۡقًا حَسَنࣰاۚ وَمَاۤ أُرِیدُ أَنۡ أُخَالِفَكُمۡ إِلَىٰ مَاۤ أَنۡهَىٰكُمۡ عَنۡهُۚ إِنۡ أُرِیدُ إِلَّا ٱلۡإِصۡلَـٰحَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُۚ وَمَا تَوۡفِیقِیۤ إِلَّا بِٱللَّهِۚ عَلَیۡهِ تَوَكَّلۡتُ وَإِلَیۡهِ أُنِیبُ وَیَـٰقَوۡمِ لَا یَجۡرِمَنَّكُمۡ شِقَاقِیۤ أَن یُصِیبَكُم مِّثۡلُ مَاۤ أَصَابَ قَوۡمَ نُوحٍ أَوۡ قَوۡمَ هُودٍ أَوۡ قَوۡمَ صَـٰلِحࣲۚ وَمَا قَوۡمُ لُوطࣲ مِّنكُم بِبَعِیدࣲ وَٱسۡتَغۡفِرُوا۟ رَبَّكُمۡ ثُمَّ تُوبُوۤا۟ إِلَیۡهِۚ إِنَّ رَبِّی رَحِیمࣱ وَدُودࣱ قَالُوا۟ یَـٰشُعَیۡبُ مَا نَفۡقَهُ كَثِیرࣰا مِّمَّا تَقُولُ وَإِنَّا لَنَرَىٰكَ فِینَا ضَعِیفࣰاۖ وَلَوۡلَا رَهۡطُكَ لَرَجَمۡنَـٰكَۖ وَمَاۤ أَنتَ عَلَیۡنَا بِعَزِیزࣲ قَالَ یَـٰقَوۡمِ أَرَهۡطِیۤ أَعَزُّ عَلَیۡكُم مِّنَ ٱللَّهِ وَٱتَّخَذۡتُمُوهُ وَرَاۤءَكُمۡ ظِهۡرِیًّاۖ إِنَّ رَبِّی بِمَا تَعۡمَلُونَ مُحِیطࣱ وَیَـٰقَوۡمِ ٱعۡمَلُوا۟ عَلَىٰ مَكَانَتِكُمۡ إِنِّی عَـٰمِلࣱۖ سَوۡفَ تَعۡلَمُونَ مَن یَأۡتِیهِ عَذَابࣱ یُخۡزِیهِ وَمَنۡ هُوَ كَـٰذِبࣱۖ وَٱرۡتَقِبُوۤا۟ إِنِّی مَعَكُمۡ رَقِیبࣱ وَلَمَّا جَاۤءَ أَمۡرُنَا نَجَّیۡنَا شُعَیۡبࣰا وَٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ مَعَهُۥ بِرَحۡمَةࣲ مِّنَّا وَأَخَذَتِ ٱلَّذِینَ ظَلَمُوا۟ ٱلصَّیۡحَةُ فَأَصۡبَحُوا۟ فِی دِیَـٰرِهِمۡ جَـٰثِمِینَ كَأَن لَّمۡ یَغۡنَوۡا۟ فِیهَاۤۗ أَلَا بُعۡدࣰا لِّمَدۡیَنَ كَمَا بَعِدَتۡ ثَمُودُ)
[Surat Hud ৮৪ - ৯৫]
অর্থাৎ, মাদয়ানবাসীদের নিকট তাদের স্ব-গোত্রীয় শু‘আয়বকে পাঠিয়েছিলাম; সে বলেছিল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ্ নেই। মাপে ও ওজনে কম করো না। আমি তোমাদেরকে সমৃদ্ধিশালী দেখছি, কিন্তু আমি তোমাদের জন্যে আশংকা করছি এক সর্বগ্রাসী দিনের শাস্তি। হে আমার সম্প্রদায়! ন্যায়সংগতভাবে মাপবে ও ওজন করবে। লোকদেরকে তাদের প্রাপ্যবস্তু কম দেবে না এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটাবে না, যদি তোমরা মুমিন হও তবে আল্লাহ অনুমোদিত যা বাকি থাকবে তোমাদের জন্যে তা উত্তম; আমি তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক নই।’ ওরা বলল, “হে শু‘আয়ব! তোমার সালাত কি তোমাকে নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পিতৃ-পুরুষেরা যার ইবাদত করত, আমাদেরকে তা বর্জন করতে হবে এবং আমরা ধন-সম্পদ সম্পর্কে যা করি তাও না? তুমি তো অবশ্যই সহিষ্ণু, সদাচারী।’
সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আমি যদি আমার প্রতিপালক-প্রেরিত স্পষ্ট প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি এবং তিনি যদি তাঁর কাছ থেকে আমাকে উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করে থাকেন, তবে কি করে আমি আমার কর্তব্য হতে বিরত থাকব? আমি তোমাদেরকে যা নিষেধ করি, আমি নিজে তা করতে ইচ্ছা করি না। আমি আমার সাধ্যমত সংস্কার করতে চাই। আমার কার্য-সাধন তো আল্লাহরই সাহায্যে; আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি এবং আমি তাঁরই অভিমুখী। হে আমার সম্প্রদায়! আমার সাথে বিরোধ যেন কিছুতেই তোমাদেরকে এমন অপরাধ না করায় যাতে তোমাদের উপর তার অনুরূপ বিপদ আপতিত হবে যা আপতিত হয়েছিল নূহের সম্প্রদায়ের উপর, হূদের সম্প্রদায়ের উপর কিংবা সালিহর সম্প্রদায়ের উপর, আর লূতের সম্প্রদায় তো তোমাদের থেকে দূরে নয়। তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন কর; আমার প্রতিপালক পরম দয়ালু, প্রেমময়।’ তারা বলল, হে শু‘আয়ব! তুমি যা বল তার অনেক কথা। আমরা বুঝি না এবং আমরা তো তোমাকে আমাদের মধ্যে দুর্বলই দেখছি। তোমার স্বজনবর্গ না থাকলে আমরা তোমাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলতাম, আমাদের উপর তুমি শক্তিশালী নও।’ সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে কি আমার স্বজনবর্গ আল্লাহর চাইতে অধিক শক্তিশালী? তোমরা তাকে সম্পূর্ণ পেছনে ফেলে রেখেছ। তোমরা যা কর আমার প্রতিপালক তা পরিবেষ্টন করে আছেন।
‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা নিজ নিজ অবস্থায় কাজ করতে থাক, আমিও আমার কাজ করছি; তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে কার উপর আসবে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি এবং কে মিথ্যাবাদী? সুতরাং তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি। যখন আমার নির্দেশ আসল তখন আমি শু‘আয়ব ও তার সঙ্গে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করেছিলাম, তারপর যারা সীমালংঘন করেছিল মহানাদ তাদেরকে আঘাত করল, ফলে তারা নিজ নিজ ঘরে নতজানু অবস্থায় শেষ হয়ে গেল; যেন তারা সেখানে কখনও বসবাস করেনি। জেনে রেখ, ধ্বংসই ছিল মাদয়ানবাসীদের পরিণাম; যেভাবে ধ্বংস হয়েছিল ছামূদ সম্প্রদায়। (১১: ৮৪-৯৫)
সূরা আল-হিজরে লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের ঘটনা বর্ণনার পর বলা হয়েছেঃ
(وَإِن كَانَ أَصۡحَـٰبُ ٱلۡأَیۡكَةِ لَظَـٰلِمِینَ فَٱنتَقَمۡنَا مِنۡهُمۡ وَإِنَّهُمَا لَبِإِمَامࣲ مُّبِینࣲ)
[Surat Al-Hijr ৭৮ - ৭৯]
অর্থাৎ, আর ‘আয়কাবাসীরাও৮২(আয়কা অর্থ গভীর অরণ্য। শু’আয়ব (عليه السلام)-এর সম্প্রদায় অরণ্যের অধিবাসী ছিল। আয়কা মাদায়নের পার্শ্বের অঞ্চল। উভয় অঞ্চলের জন্য তিনি নবী ছিলেন।) তো ছিল সীমালংঘনকারী। সুতরাং আমি ওদেরকে শাস্তি দিয়েছি, এরা উভয়ই৮৩(উভয় শব্দ দ্বারা লূত (عليه السلام) ও শু’আয়ব (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের বসতির ধ্বংস্তূপ বুঝানো হয়েছে।) তো প্রকাশ্য পথের পাশে অবস্থিত। (১৫: ৭৮-৭৯)
সূরা শু‘আরায় উক্ত ঘটনার পর আল্লাহ্ বলেনঃ
(كَذَّبَ أَصۡحَـٰبُ لۡـَٔیۡكَةِ ٱلۡمُرۡسَلِینَ إِذۡ قَالَ لَهُمۡ شُعَیۡبٌ أَلَا تَتَّقُونَ إِنِّی لَكُمۡ رَسُولٌ أَمِینࣱ فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِیعُونِ وَمَاۤ أَسۡـَٔلُكُمۡ عَلَیۡهِ مِنۡ أَجۡرٍۖ إِنۡ أَجۡرِیَ إِلَّا عَلَىٰ رَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۞ أَوۡفُوا۟ ٱلۡكَیۡلَ وَلَا تَكُونُوا۟ مِنَ ٱلۡمُخۡسِرِینَ وَزِنُوا۟ بِٱلۡقِسۡطَاسِ ٱلۡمُسۡتَقِیمِ وَلَا تَبۡخَسُوا۟ ٱلنَّاسَ أَشۡیَاۤءَهُمۡ وَلَا تَعۡثَوۡا۟ فِی ٱلۡأَرۡضِ مُفۡسِدِینَ وَٱتَّقُوا۟ ٱلَّذِی خَلَقَكُمۡ وَٱلۡجِبِلَّةَ ٱلۡأَوَّلِینَ قَالُوۤا۟ إِنَّمَاۤ أَنتَ مِنَ ٱلۡمُسَحَّرِینَ وَمَاۤ أَنتَ إِلَّا بَشَرࣱ مِّثۡلُنَا وَإِن نَّظُنُّكَ لَمِنَ ٱلۡكَـٰذِبِینَ فَأَسۡقِطۡ عَلَیۡنَا كِسَفࣰا مِّنَ ٱلسَّمَاۤءِ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ قَالَ رَبِّیۤ أَعۡلَمُ بِمَا تَعۡمَلُونَ فَكَذَّبُوهُ فَأَخَذَهُمۡ عَذَابُ یَوۡمِ ٱلظُّلَّةِۚ إِنَّهُۥ كَانَ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیمٍ إِنَّ فِی ذَ ٰلِكَ لَـَٔایَةࣰۖ وَمَا كَانَ أَكۡثَرُهُم مُّؤۡمِنِینَ وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ ٱلۡعَزِیزُ ٱلرَّحِیمُ)[Surat Ash-Shu'ara ১৭৬ - ১৯১]
অর্থাৎ, আয়কাবাসীরা রাসূলগণকে অস্বীকার করেছিল যখন শুআয়ব ওদেরকে বলেছিল, তোমরা কি সাবধান হবে না? আমি তোমাদের জন্যে এক বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর ও আমার আনুগত্য কর। এর জন্যে আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না। আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের কাছেই আছে। মাপে পূর্ণমাত্রায় দেবে; যারা মাপে ঘাটতি করে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না এবং ওজন করবে সঠিক দাঁড়িপাল্লায়। লোকদেরকে তাদের প্রাপ্ত বস্তু কম দিবে না এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটাবে না। এবং ভয় কর তাঁকে, যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তারা বলল, তুমি তো জাদুগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত; আমাদের মত একজন মানুষ। আমরা মনে করি, তুমি মিথ্যাবাদীদের অন্যতম। তুমি যদি সত্যবাদী হও, তবে আকাশের এক খণ্ড আমাদের উপর ফেলে দাও। সে বলল, আমার প্রতিপালক ভাল জানেন তোমরা যা কর। তারপর ওরা তাকে প্রত্যাখ্যান করল, পরে ওদেরকে মেঘাচ্ছন্ন দিনের শাস্তি গ্রাস করল। এতে ছিল এক ভীষণ দিনের শাস্তি। এতে অবশ্যই রয়েছে নিদর্শন, কিন্তু ওদের অধিকাংশই মুমিন নয়। এবং তোমার প্রতিপালক, তিনি তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (২৬: ১৭৬-১৯১)
মায়ানবাসীরা ছিল আরব জাতির অন্তর্ভুক্ত। মাদয়ান শহরে তারা বসবাস করত। মাদয়ান সিরিয়ার নিকটবর্তী মা’আন এলাকার একটি গ্রামের নাম। এর অবস্থান হিজাযের পার্শ্বে ও লুত সম্প্রদায়ের হ্রদের সন্নিকটে। লূতের সম্প্রদায়ের পরেই এই সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। মায়ানবাসীরা ছিল মাদয়ান ইবন মাদয়ানে ইবন ইবরাহীম খলিলুল্লাহর সন্তান। শু‘আয়ব ইবন মীকীল ইবন য়াশজান তাদের নবী। ইবন ইসহাক উপরোক্ত মত বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, শু‘আয়ব (عليه السلام)-কে সুরিয়ানী ভাষায় বলা হয় বিনযূন। কিন্তু এ মত গ্রহণযোগ্য নয়। শু’আয়ব (عليه السلام)-এর নসবনামায় বিভিন্ন মত দেখতে পাওয়া যায়। কেউ বলেন, শুআয়ব ইবন য়াশখার ইবন লাবায় ইবন ইয়াকূব। কেউ বলেছেন, শুআয়ব ইবন নুওয়ায়ব ইবন আয়ফা ইবন মাদয়ান ইবন ইবরাহীম। কারও মতে, শুআয়ব ইবন দায়ফূর ইবন আয়ফা ইবন ছাবিত ইবন মাদয়ান ইবন ইবরাহীম। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন মত রয়েছে।
ইবন আসাকির (رحمة الله) বলেন, হযরত লূত (عليه السلام)-এর কন্যা ছিলেন হযরত শু‘আয়বের মা; মতান্তরে, তিনি ছিলেন তাঁর নানী। যে কয়জন লোক ইবরাহীম (عليه السلام)-এর প্রতি ঈমান এনেছিল শু‘আয়ব (عليه السلام) ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর সাথে হিজরত করেন ও তার সাথে দামেশকে যান। ওহব ইবন মুনাব্বিহ্ বলেন, শু’আয়ব ও মালগাম দু’জনে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপের দিন তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। উভয়ে তার সাথে সিরিয়ায় হিজরতও করেন। সেখানে তিনি লুত (عليه السلام)-এর দুই কন্যাকে তাঁদের দুজনের সাথে বিবাহ দেন। ইবন কুতায়বা এভাবেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু উপরোক্ত কোন মতই সন্দেহমুক্ত নয়।
আবু উমর ইবন আবদুর বার (رحمة الله) ‘ইসতি আব’ গ্রন্থে সালামা ইবন সা’দ আল আনাযী প্রসঙ্গে লিখেন যে, তিনি রসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর কাছে আগমন করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর আনাযা পর্যন্ত তিনি তার বংশ পঞ্জিকাও উল্লেখ করেন। রাসূল (ﷺ) বললেন, কতই না উত্তম এ আনাযা গোত্র, তারা ছিল নির্যাতিত এবং এরাই সেই সাহায্যপ্রাপ্ত শুআয়বের অনুসারী এবং মূসা (عليه السلام)-এর শ্বশুর গোষ্ঠী। এ বর্ণনা সঠিক হলে প্রমাণিত হয় যে, হযরত শু‘আয়ব মূসা (عليه السلام)-এর সমগোত্রীয় এবং তিনি আদি আরবদের অন্তর্ভুক্ত এবং তার কবীলার নাম আনাযা। তবে এরা আনাযা ইবন আসাদ ইবন রাবীআ ইবন নাযার ইবন মা’দ ইবন আদনান গোত্র নয়। কেননা, এই আনাযা উপরোক্ত আনাযার দীর্ঘকাল পরে এসেছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
সহীহ ইবন হিব্বান গ্রন্থে আম্বিয়া ও রসূলগণের বিবরণ অধ্যায়ে হযরত আবু যর (رضي الله عنه)-এর বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ নবীদের মধ্যে চারজন নবী আরবের যথা—হৃদ, সালিহ, শুআয়ব ও তোমাদের নবী, হে আবু যর! কোন কোন প্রাচীন বিজ্ঞ আলিম হযরত শু‘আয়ব (عليه السلام)-কে ‘খতীবুল আম্বিয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা, তিনি তার সম্প্রদায়কে ঈমান গ্রহণের জন্যে যে দাওয়াত পেশ করেন তার শব্দ ও ভাষা ছিল অতি উচ্চাঙ্গের এবং বক্তব্য ও উপস্থাপনা ছিল অতি প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী। ইবন ইসহাক (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, রসূল (ﷺ) যখনই হযরত শুআয়ব (عليه السلام)-এর উল্লেখ করতেন তখনই তিনি বলতেনঃ তিনি ছিলেন খতীবুল আম্বিয়া (নবীগণের খতীব)। মাদয়ানবাসীরা ছিল কাফির, ডাকাতি ও রাহাজানি করত, পথচারীদেরকে ভয়-ভীতি দেখাত এবং আয়কার উপাসনা করত। আয়কা ছিল পার্শ্ববর্তী অরণ্যের একটি ঘন শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট গাছের নাম। তাদের লেন-দেনের ক্ষেত্রে তারা ছিল অত্যন্ত জঘন্য। ওজনে এবং মাপে তারা খুবই কম দিত। পক্ষান্তরে কারও থেকে নেওয়ার সময় বেশি বেশি নিত। আল্লাহ্ তাদেরই মধ্য থেকে শুআয়ব (عليه السلام)-কে তাদের রসূলরূপে প্রেরণ করেন। তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানান। মাপে ও ওজনে কম দেয়া এবং পথিকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন প্রভৃতি দুষ্কর্ম থেকে নিষেধ করেন। কিছু লোক তাঁর প্রতি ঈমান আনল, কিন্তু অধিকাংশই কুফরীর উপর অটল থাকল। ফলে আল্লাহ তাদের উপর কঠিন আযাব নাযিল করেন।
আল্লাহর বাণীঃ
(وَإِلَىٰ مَدۡیَنَ أَخَاهُمۡ شُعَیۡبࣰاۚ قَالَ یَـٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَـٰهٍ غَیۡرُهُۥۖ قَدۡ جَاۤءَتۡكُم بَیِّنَةࣱ مِّن رَّبِّكُمۡۖ)[Surat Al-A’raf ৮৫]
অর্থাৎ, মায়ানবাসীদের কাছে তাদের স্ব-গোত্রীয় শুআয়বকে প্রেরণ করেছি। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল কর। তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন ইলাহ্ নেই। তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট দলীল এসে গেছে। (৭: ৮৫)
অর্থাৎ আমি তোমাদের নিকট যা কিছু বিধি-বিধান নিয়ে এসেছি তার সত্যতার উপর সুস্পষ্ট দলীল ও অকাট্য প্রমাণ এসে গেছে। আর তিনি যে আমাকে রসূল করে পাঠিয়েছেন তার প্রমাণও এসে গেছে। এই দলীল ও প্রমাণ হল সেই সব মু’জিযা যা হযরত শু‘আয়ব (عليه السلام)-এর হাতে আল্লাহ্ প্রকাশ করেন। সেই মু’জিযাসমূহের বিস্তারিত বিবরণ আমাদের কাছে না পৌঁছলেও আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ (بينة) থেকে মোটামুটি এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
فَأَوۡفُوا۟ ٱلۡكَیۡلَ وَٱلۡمِیزَانَ وَلَا تَبۡخَسُوا۟ ٱلنَّاسَ أَشۡیَاۤءَهُمۡ وَلَا تُفۡسِدُوا۟ فِی ٱلۡأَرۡضِ بَعۡدَ إِصۡلَـٰحِهَاۚ
অর্থাৎ, মাপে ও ওজনে পুরোপুরি দাও। মানুষের প্রাপ্য বস্তু কম দিও না এবং সমাজকে সংস্কারের পর ফিৎনা ফাসাদ সৃষ্টি করো না। (৭: ৮৫)
এ আয়াতে আল্লাহ্ তাদেরকে জুলুমের পথ পরিহার করে ইনসাফের পথে চলার নির্দেশ দেন। অন্যথায় তাদেরকে কঠোর শাস্তির ভয় প্রদর্শন করেন। অতঃপর বলেনঃ
ذَ ٰلِكُمۡ خَیۡرࣱ لَّكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِینَ وَلَا تَقۡعُدُوا۟ بِكُلِّ صِرَ ٰطࣲ تُوعِدُونَ
[Surat Al-A’raf ৮৫-৮৬]
অর্থাৎ, ‘তোমরা মু’মিন হলে এটাই তোমাদের জন্যে কল্যাণকর এবং ভয় দেখাবার উদ্দেশ্যে প্রতিটি রাস্তায় বসে থেকো না।’ অর্থাৎ পথের উপর বসে পথিকদেরকে ভয় দেখিয়ে তাদের সম্পদ ও শুল্ক আদায় করো না। উপরোক্ত আয়াত (وَلَا تَقۡعُدُوا۟ بِكُلِّ صِرَ ٰطࣲ تُوعِدُونَ) এর ব্যাখ্যায় সাহাবীদের বরাত দিয়ে সুদ্দী (رحمة الله) বলেছেন যে, তারা পথিকদের থেকে তাদের পণ্য দ্রব্যের এক-দশমাংশ টোল আদায় করত। ইসহাক ইন বিশর.... ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেছেন, শু‘আয়ব (عليه السلام)-এর সম্প্রদায় ছিল সীমালংঘনকারী, বিদ্রোহী— তারা রাস্তার উপরে বসে থাকত। يبخسون الناس অর্থাৎ তারা মানুষের নিকট থেকে তাদের এক-দশমাংশ উসূল করত। এ প্রথা তারাই সর্বপ্রথম চালু করে।
( وَتَصُدُّونَ عَن سَبِیلِ ٱللَّهِ مَنۡ ءَامَنَ بِهِۦ وَتَبۡغُونَهَا عِوَجࣰاۚ)
[Surat Al-A’raf ৮৬]
অর্থাৎ, ‘আল্লাহর প্রতি যারা ঈমান পোষণ করে তাদেরকে আল্লাহর পথে চলতে বাধা দিও না আর আল্লাহর পথের মধ্যে বক্রতা তালাশ করো না। আল্লাহ্ তাদেরকে দুনিয়ার ডাকাতি ও দীনের ডাকাতি উভয়টা থেকে নিষেধ করে দেন।
( وَٱذۡكُرُوۤا۟ إِذۡ كُنتُمۡ قَلِیلࣰا فَكَثَّرَكُمۡۖ وَٱنظُرُوا۟ كَیۡفَ كَانَ عَـٰقِبَةُ ٱلۡمُفۡسِدِینَ)
[Surat Al-A’raf ৮৬]
অর্থাৎ, ‘স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন তোমরা সংখ্যায় কম ছিলে। অতঃপর আল্লাহ্ তোমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে দেন, আর তোমরা লক্ষ্য করে দেখ, ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের পরিণতি কেমন হয়!’ (৭: ৮৬)
প্রথমে তারা সংখ্যায় কম ছিল, পরে আল্লাহ্ তা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন— এই নিয়ামতের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এরপর যদি তারা আল্লাহর প্রদর্শিত পথের বিরুদ্ধে যায় তাহলে সে জন্যে যে শাস্তি আসবে তার হুমকি দেয়া হয়। অন্য এক ঘটনায় তাদের উদ্দেশে বলা হয়েছেঃ
( وَلَا تَنقُصُوا۟ ٱلۡمِكۡیَالَ وَٱلۡمِیزَانَۖ إِنِّیۤ أَرَىٰكُم بِخَیۡرࣲ وَإِنِّیۤ أَخَافُ عَلَیۡكُمۡ عَذَابَ یَوۡمࣲ مُّحِیطࣲ)
[Surat Hud ৮৪]
অর্থাৎ, মাপে ও ওজনে কম দিও না, আমি তো তোমাদেরকে সচ্ছল অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। আমি তোমাদের উপর এক সামগ্রিক আযাব আসার আশংকা করছি।’ অর্থাৎ তোমরা যে অপরাধে অভ্যস্ত হয়ে গেছ তার উপর অবিচল থেকো না, অন্যথায় তোমাদের ধন-সম্পদের বরকত আল্লাহ্ তা’আলা উঠিয়ে নেবেন, তোমাদেরকে অভাবগ্রস্ত করে দেবেন। উপরন্তু থাকবে পরকালের আযাব। আর যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই রকম উভয় শাস্তি একত্রিত হবে, সে ব্যক্তি মহা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এই কারণে আল্লাহ তাদেরকে প্রথমে হালকাভাবে ঐসব কাজ থেকে নিষেধ করেছেন এবং দুনিয়ায় আল্লাহর নিয়ামত উঠিয়ে নেয়ার ভয় দেখিয়েছেন ও আখিরাতের শাস্তি থেকে হুঁশিয়ার করেছেন এবং কঠোরভাবে সাবধান করে দিয়েছেন।
অতঃপর আল্লাহ্ নির্দেশের সুরে বলেনঃ
(وَیَـٰقَوۡمِ أَوۡفُوا۟ ٱلۡمِكۡیَالَ وَٱلۡمِیزَانَ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَلَا تَبۡخَسُوا۟ ٱلنَّاسَ أَشۡیَاۤءَهُمۡ وَلَا تَعۡثَوۡا۟ فِی ٱلۡأَرۡضِ مُفۡسِدِینَ بَقِیَّتُ ٱللَّهِ خَیۡرࣱ لَّكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِینَۚ وَمَاۤ أَنَا۠ عَلَیۡكُم بِحَفِیظࣲ)
[Surat Hud ৮৫ - ৮৬]
অর্থাৎ, হে আমার সম্প্রদায়! ন্যায়সঙ্গতভাবে মাপবে ও ওজন করবে। লোকদেরকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দেবে না এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটাবে না। যদি তোমরা মুমিন হও, তবে আল্লাহ্ অনুমোদিত যা বাকি থাকবে তোমাদের জন্যে তাই উত্তম। আমি তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক নই। (১১: ৮৫-৮৬)
ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) ও হাসান বসরী (رحمة الله) بقيت الله خيرلكم -এর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ
অর্থাৎ—‘আল্লাহ্ যা কিছু রিযিক তোমাদেরকে দান করেন তা ঐসব সম্পদের তুলনায় অনেক ভাল যা তোমরা মানুষের থেকে জোরপূর্বক আদায় কর।’
ইবন জারীর (رحمة الله) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন; ওজনে কম দিয়ে মানুষের সম্পদ নেয়ার চাইতে মাপ ও ওজন সঠিকভাবে পুরোপুরি দেওয়ার পর যা কিছু মুনাফা অবশিষ্ট থাকে, তা-ই তোমাদের জন্যে বহুগুণে উত্তম। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে এরূপ ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। হাসান বসরী (رحمة الله) যে ব্যাখ্যা করেছেন নিম্নের আয়াত তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণঃ
(قُل لَّا یَسۡتَوِی ٱلۡخَبِیثُ وَٱلطَّیِّبُ وَلَوۡ أَعۡجَبَكَ كَثۡرَةُ ٱلۡخَبِیثِۚ)
[Surat Al-Ma'idah ১০০]
অর্থাৎ, ‘বল, পবিত্র বস্তু ও অপবিত্র বস্তু সমান হয় না, যদিও অপবিত্র বস্তুর আধিক্য তোমার কাছে আকর্ষণীয় হোক না কেন।’ অর্থাৎ হালাল জিনিস যদি কমও হয় তবুও তা তোমাদের জন্যে ভাল হারাম জিনিস থেকে, যদিও তা বেশি হয়। কেননা, হালাল জিনিস কম হলেও তা বরকতময়; পক্ষান্তরে হারাম জিনিস বেশি হলেও তা বরকত শূন্য।
আল্লাহ্ বলেছেনঃ
(یَمۡحَقُ ٱللَّهُ ٱلرِّبَوٰا۟ وَیُرۡبِی ٱلصَّدَقَـٰتِۗ)
[Surat Al-Baqarah ২৭৬]
অর্থাৎ—“আল্লাহ্ সূদকে বিলুপ্ত করেন এবং দান-সাদকাকে বৃদ্ধি করেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ সূদের মাল যতই বেশি হোক না কেন, ক্রমান্বয়ে তা ফুরিয়ে যায়। ইমাম আহমদ (رحمة الله) তার মুসনাদে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। রসূল (ﷺ) আরও বলেছেন, ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতার জন্যে গ্রহণ ও বর্জনের ইখতিয়ার থাকে যতক্ষণ তারা আলাদা হয়ে না যায়। যদি তারা সততার সাথে বেচা-কেনা করে এবং পণ্যের দোষ-গুণ প্রকাশ করে দেয় তাহলে এ ব্যবসায়ে উভয়কে বরকত দান করা হয়। আর যদি তারা পণ্যের দোষ-গুণ গোপন রাখে এবং মিথ্যার আশ্রয় নেয়, তাহলে উভয়ের থেকে এ বেচা-কেনায় বরকত উঠিয়ে নেয়া হয়। মোটকথা, হালাল মুনাফা কম হলেও তাতে বরকত হয়, কিন্তু হারাম মুনাফা বেশি হলেও তাতে বরকত থাকে না। এ কারণেই নবী শুআয়ব (عليه السلام) বলেছিলেনঃ
(بَقِیَّتُ ٱللَّهِ خَیۡرࣱ لَّكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِینَۚ)
[Surat Hud ৮৬]
আল্লাহর অনুমোদিত যা-ই বাকি থাকে তা-ই তোমাদের জন্যে উত্তম, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। আল্লাহর বাণীঃ
وَمَاۤ أَنَا۠ عَلَیۡكُم بِحَفِیظࣲ)
[Surat Hud ৮৬]
‘আমি তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক নই’ অর্থাৎ তোমাদেরকে আমি যা করার নির্দেশ দিয়েছি তোমরা তা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে কর, আমাকে বা অন্যকে দেখাবার জন্যে নয়।
আল্লাহর বাণীঃ
(قَالُوا۟ یَـٰشُعَیۡبُ أَصَلَوٰتُكَ تَأۡمُرُكَ أَن نَّتۡرُكَ مَا یَعۡبُدُ ءَابَاۤؤُنَاۤ أَوۡ أَن نَّفۡعَلَ فِیۤ أَمۡوَ ٰلِنَا مَا نَشَـٰۤؤُا۟ۖ إِنَّكَ لَأَنتَ ٱلۡحَلِیمُ ٱلرَّشِیدُ)[Surat Hud ৮৭]
অর্থাৎ, তারা বলল, হে শু‘আয়ব! তোমার সালাত কি তোমাকে নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পিতৃ-পুরুষরা যার ইবাদত করতো আমাদেরকে তা বর্জন করতে হবে এবং আমরা ধন-সম্পদ সম্পর্কে যা করি তাও না? তুমি তো অবশ্যই সহিষ্ণু, সদাচারী। (১১: ৮৭)
শুআয়ব (عليه السلام)-এর সম্প্রদায় এ কথাটি ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও উপহাসস্বরূপ বলেছে। তারা বলেছে, এই যে সালাত তুমি পড়ছ তা কি তোমাকে আমাদের বিরোধিতা করতে বলে যে, আমরা কেবল তোমার আল্লাহরই ইবাদত করব এবং আমাদের পূর্ব-পুরুষগণ যাদের ইবাদত করত তাদেরকে ত্যাগ করে দেব? কিংবা তুমি যেভাবে চাও সেভাবে আমরা আমাদের লেনদেন করব আর যেভাবে চাও না সেভাবে আমাদের পছন্দনীয় লেনদেন করা ছেড়ে দেব? إِنَّكَ لَأَنتَ ٱلۡحَلِیمُ ٱلرَّشِیدُ (নিশ্চয় তুমি একজন ধৈর্যশীল, সত্যপন্থী) এ প্রসঙ্গে হযরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), মায়মূন ইবন মিহরান, ইবন জুরায়জ, যায়দ ইবন আসলাম (رضي الله عنه) এবং ইবন জারীর (رحمة الله) বলেন, এ উক্তি তারা ঠাট্টা ও বিদ্রুপাত্মকভাবে করেছে।
(قَالَ یَـٰقَوۡمِ أَرَءَیۡتُمۡ إِن كُنتُ عَلَىٰ بَیِّنَةࣲ مِّن رَّبِّی وَرَزَقَنِی مِنۡهُ رِزۡقًا حَسَنࣰاۚ وَمَاۤ أُرِیدُ أَنۡ أُخَالِفَكُمۡ إِلَىٰ مَاۤ أَنۡهَىٰكُمۡ عَنۡهُۚ إِنۡ أُرِیدُ إِلَّا ٱلۡإِصۡلَـٰحَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُۚ وَمَا تَوۡفِیقِیۤ إِلَّا بِٱللَّهِۚ عَلَیۡهِ تَوَكَّلۡتُ وَإِلَیۡهِ أُنِیبُ)
[Surat Hud ৮৮]
অর্থাৎ, শু‘আয়ব বলল, হে আমার সম্প্রদায়। এ ব্যাপারে তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আমি যদি আমার পালনকর্তার সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকি, আর তিনি যদি আমাকে তার কাছ থেকে উত্তম রিযিক দান করেন, তবে কি করে আমি আমার কর্তব্য থেকে বিরত থাকবো? আমি তোমাদেরকে যা নিষেধ করি, আমি নিজে তা করতে ইচ্ছা করি না। আমি আমার সাধ্যমত সংস্কার করতে চাই। আমার কার্য-সাধন তো আল্লাহরই সাহায্যে। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি এবং আমি তারই অভিমুখী। (১১: ৮৮)
এখানে হযরত শুআয়ব (عليه السلام) কোমল ভাষায় কিন্তু সুস্পষ্ট ইংগিতে তাঁর সম্প্রদায়কে সত্যের দিকে দাওয়াত দিচ্ছেন। তিনি বলছেন—তোমরা কি একটু চিন্তা করে দেখেছ, হে মিথ্যাবাদীর দল! إِن كُنتُ عَلَىٰ بَیِّنَةࣲ مِّن رَّبِّی ‘আমি যদি আমার রবের প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকি।’ অর্থাৎ আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশের উপর যে, তিনি আমাকে তোমাদের নিকট রসূলরূপে প্রেরণ করেছেন। وَرَزَقَنِی مِنۡهُ رِزۡقًا حَسَنࣰا এবং তাঁর কাছ থেকে আমাকে উত্তম রিযিক দান করেছেন উত্তম রিযিক অর্থ নবুওত ও রিসালাত। অর্থাৎ তোমরা যদি তা বুঝতে না পার, তবে তোমাদের ব্যাপারে আমার আর কি করার আছে? এ কথাটি ঠিক তদ্রুপ যা নূহ (عليه السلام) তাঁর জাতিকে বলেছিলেনঃ وَمَاۤ أُرِیدُ أَنۡ أُخَالِفَكُمۡ إِلَىٰ مَاۤ أَنۡهَىٰكُمۡ عَنۡهُۚ
‘যে কাজ করতে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করি আমি সে কাজ নিজে করতে ইচ্ছা করি না।’ অর্থাৎ তোমাদেরকে যে কাজ করতে আদেশ করি সে কাজ সর্বপ্রথম আমিই করি; আর যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করি তা থেকে সর্বপ্রথম আমি-ই বিরত থাকি। বস্তৃত পক্ষে এটা একটা উৎকৃষ্ট ও মহান গুণ। এর বিপরীত আচরণ অত্যন্ত জঘন্য ও নিকৃষ্ট। বনী ইসরাঈলের শেষ দিকের আলিম ও ধর্মোপদেশদাতাগণ এই দোষে দুষ্ট ছিলেন। আল্লাহ্ বলেনঃ
(۞ أَتَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبِرِّ وَتَنسَوۡنَ أَنفُسَكُمۡ وَأَنتُمۡ تَتۡلُونَ ٱلۡكِتَـٰبَۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ)
[Surat Al-Baqarah ৪৪]
অর্থাৎ, ‘তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের আদেশ দাও এবং নিজেদেরকে বিস্মৃত হও? অথচ তোমরাই তো কিতাব অধ্যয়ন কর। তবে কি তোমরা বুঝ না?’ (২: ৪৪)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। তার পেট থেকে নাড়িভুড়ি বের হয়ে যাবে এবং তা নিয়ে সে ঘুরপাক খেতে থাকবে, যেমনটি গাধা আটা পেষার চাক্কি নিয়ে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। দোযখবাসীরা তার কাছে এসে জড়ো হয়ে জিজ্ঞেস করবে, হে অমুক! তোমার একি দশা, তুমি না সৎ কাজের আদেশ দিতে ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে? সে বলবে, হ্যাঁ, আমি সৎ কাজের আদেশ করতাম কিন্তু নিজে তা করতাম না এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতাম কিন্তু আমি নিজেই তা করতাম। এ আচরণ নবীদের নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী—পাপিষ্ঠ ও দুবৃত্তদের নীতি। পক্ষান্তরে জ্ঞানী-গুণী উলামা যারা না দেখেই আল্লাহকে ভয় করে চলে তাদের অবস্থা হয় সেই রকম, যেমন নবী শুআয়ব (عليه السلام) বলেছেনঃ
( وَمَاۤ أُرِیدُ أَنۡ أُخَالِفَكُمۡ إِلَىٰ مَاۤ أَنۡهَىٰكُمۡ عَنۡهُۚ إِنۡ أُرِیدُ إِلَّا ٱلۡإِصۡلَـٰحَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُۚ)
[Surat Hud ৮৮]
অর্থাৎ—আমার যাবতীয় কর্মতৎপরতার উদ্দেশ্য হল, সাধ্য অনুযায়ী কথা ও কাজের সংশোধন ও সংস্কার করা।
وَمَا تَوۡفِیقِیۤ إِلَّا بِٱللَّهِۚ عَلَیۡهِ تَوَكَّلۡتُ وَإِلَیۡهِ أُنِیبُ
অর্থাৎ—‘সর্বাবস্থায় আল্লাহই আমাকে সাহায্য ও ক্ষমতা দান করবেন। সকল বিষয়ে তাঁর উপরই আমি ভরসা রাখি এবং সকল ব্যাপারে তাঁর দিকেই আমি প্রত্যাবর্তন করি।’ এ হল তারগীব বা উৎসাহ প্রদান। এরপর হযরত শু‘আয়ব (عليه السلام) কিছুটা তারহীব বা ধমকের সুরে বলেনঃ
(وَیَـٰقَوۡمِ لَا یَجۡرِمَنَّكُمۡ شِقَاقِیۤ أَن یُصِیبَكُم مِّثۡلُ مَاۤ أَصَابَ قَوۡمَ نُوحٍ أَوۡ قَوۡمَ هُودٍ أَوۡ قَوۡمَ صَـٰلِحࣲۚ وَمَا قَوۡمُ لُوطࣲ مِّنكُم بِبَعِیدࣲ)[Surat Hud ৮৯]
অর্থাৎ, হে আমার সম্প্রদায়! আমার বিরোধিতা যেন কিছুতেই তোমাদেরকে এমন অপরাধ না করায় যাতে তোমাদের উপর তার অনুরূপ বিপদ আসবে, যেরূপ বিপদ আপতিত হয়েছিল। কওমে নূহ, কওমে হূদ কিংবা কওমে সালিহর উপর আর কওমে লূত তো তোমাদের থেকে খুব দূরে নয়। (১১: ৮৯)
অর্থাৎ আমার সাথে তোমাদের শত্রুতা এবং আমি যে দীন নিয়ে এসেছি তার সাথে বিদ্বেষ ভাব যেন তোমাদেরকে গুমরাহী, মূর্খতা ও শত্রুতার উপর অবিচল থাকতে বাধ্য না করে। এরূপ হলে তোমাদের উপর সেই ধরনের আযাব ও শাস্তি আসবে, যে ধরনের আযাব ও শাস্তি এসেছিল কওমে নূহ, কওমে হৃদ ও কওমে সালিহ-এর মিথ্যাচারী বিরুদ্ধাচারীদের উপর।
وَمَا قَوۡمُ لُوطࣲ مِّنكُم بِبَعِیدࣲ)) (কওমে লূত তো তোমাদের থেকে দূরে নয়) ‘দূরে নয়’ এই কথাটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে; (১) সময়ের দিক থেকে, অর্থাৎ কুফর ও জুলুমের কারণে কওমে লূতের উপর যে শাস্তি এসেছিল সে ঘটনা বেশি দিনের নয়। তাদের সব বর্ণনাই তোমাদের কাছে পৌঁছেছে। (২) স্থান ও অবস্থানের দিক দিয়ে। অর্থাৎ কওমে লূতের বিধ্বস্ত এলাকা তোমাদের বাসস্থান থেকে দূরে নয়।
(৩) নীতি ও কর্মের দিক থেকে। অর্থাৎ কওমে লুত যেমন ডাকাতি-রাহাজানি করত, মানুষের ধন-সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নিত এবং বিভিন্ন রকম গোপন ফাঁদ আঁটত, তোমরাও তাই করছ। অবশ্য উপরোক্ত তিনটি মতকে এখানে একত্রেও বলা যেতে পারে, যেমন কওমে লুত সময়ের দিক থেকে, অবস্থানের দিক থেকে এবং কর্মনীতির দিক থেকে দূরে নয়। অতঃপর ভয় ও আগ্রহ সৃষ্টি সমন্বিত আহ্বানস্বরূপ বলেনঃ
(وَٱسۡتَغۡفِرُوا۟ رَبَّكُمۡ ثُمَّ تُوبُوۤا۟ إِلَیۡهِۚ إِنَّ رَبِّی رَحِیمࣱ وَدُودࣱ)
[Surat Hud ৯০]
অর্থাৎ, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তাঁর কাছে তওবা কর। আমার প্রতিপালক নিশ্চয় দয়ালু প্রেমময়। (১১: ৯০)
অর্থাৎ তোমরা যেসব অপরাধে জড়িত আছ, তা বর্জন কর এবং দয়াময় প্রেমময় প্রতিপালকের নিকট তওবা কর। কেননা, যে ব্যক্তি তার কাছে তওবা করে, তিনি তার তওবা কবূল করেন। কারণ সন্তানের প্রতি মাতার স্নেহের চেয়ে বান্দাহর প্রতি আল্লাহর দয়া অধিকতর।
(قَالُوا۟ یَـٰشُعَیۡبُ مَا نَفۡقَهُ كَثِیرࣰا مِّمَّا تَقُولُ وَإِنَّا لَنَرَىٰكَ فِینَا ضَعِیفࣰاۖ)
[Surat Hud ৯১]
অর্থাৎ, তারা বলল, হে শু‘আয়ব! তুমি যা বল তার অধিকাংশই আমরা বুঝি না, আমরা তো তোমাকে আমাদের মধ্যে দুর্বল—শক্তিহীন দেখতে পাচ্ছি। (১১: ৯১)
ইবন আব্বাস, সাঈদ ইবন জুবায়র ও ছাওরী (رضي الله عنه) বলেছেন, হযরত শু’আয়ব (عليه السلام)-এর চোখে দৃষ্টিশক্তি ছিল না। মারফু হাদীসে বর্ণিত, আল্লাহর মহব্বতে নবী শুআয়ব (عليه السلام) এতো অধিক পরিমাণ কান্নাকাটি করেন যে, তিনি অন্ধ হয়ে যান। আল্লাহ্ তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। আল্লাহ্ জিজ্ঞেস করলেন, হে শুআয়ব! তোমার কান্নাকাটি কি জাহান্নামের ভয়ে, নাকি জান্নাতের লোভে? শু‘আয়ব (عليه السلام) বলেন, বরং আপনার মহব্বতেই কাঁদি। আমি যখন আপনাকে দেখব, তখন আমার প্রতি কি করা হবে তার পরোয়া আমি করি না। আল্লাহ তখন ওহীর মাধ্যমে জানালেন, হে শু’আয়ব! আমার সাথে তোমার সাক্ষাৎ খুবই আনন্দময় হবে। এ জন্যে আমি ইমরানের পুত্র মূসা কালীমুল্লাহকে তোমার খিদমতে নিয়োগ করেছি। এ হাদীস ওয়াহিদী ... শাদ্দাদ ইবন আমীন (رضي الله عنه) সূত্রে রসূল (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন। কিন্তু এটা অত্যন্ত গরীব’ হাদীস। খাতীব বাগদাদী (رحمة الله) একে যয়ীফ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
وَلَوۡلَا رَهۡطُكَ لَرَجَمۡنَـٰكَۖ وَمَاۤ أَنتَ عَلَیۡنَا بِعَزِیزࣲ
অর্থাৎ, তোমার আত্মীয়বর্গ না থাকলে আমরা তোমাকে পাথর মেরে হত্যা করতাম। তুমি আমাদের উপর শক্তিশালী নও। (১১: ৯১)
এটি ছিল তাদের কট্টর কুফরী ও জঘন্য শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ। এ কারণেই তারা বলেছেঃ
ما نفقه كثيرا مما تقول
(তুমি যা বল তার অধিকাংশই আমরা বুঝি না।) অর্থাৎ আমরা তা উপলব্ধি করি না। কেননা ওসব আমরা পছন্দ করি না, চাইও না। ওর প্রতি আমাদের কোন আগ্রহ নেই, আকর্ষণও নেই। ওদের এ কথাটি ঠিক কুরায়শ কাফিরদের সেই কথার সাথে মিলে যায়, যা তারা রসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে উদ্দেশ করে বলেছিলঃ
(وَقَالُوا۟ قُلُوبُنَا فِیۤ أَكِنَّةࣲ مِّمَّا تَدۡعُونَاۤ إِلَیۡهِ وَفِیۤ ءَاذَانِنَا وَقۡرࣱ وَمِنۢ بَیۡنِنَا وَبَیۡنِكَ حِجَابࣱ فَٱعۡمَلۡ إِنَّنَا عَـٰمِلُونَ)[Surat Fussilat ৫]
অর্থাৎ, ওরা বলে, তুমি যার প্রতি আমাদেরকে আহ্বান করছো সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণ-আচ্ছাদিত। আমাদের কানে আছে বধিরতা এবং আমাদের ও তোমার মাঝে রয়েছে অন্তরাল। সুতরাং তুমি তোমার কাজ কর, আমরা আমাদের কাজ করি। (৪১: ৫)
(وَإِنَّا لَنَرَىٰكَ فِینَا ضَعِیفࣰاۖ)
[Surat Hud ৯১]
(আমরা আমাদের মধ্যে তোমাকে দুর্বল দেখতে পাচ্ছি)। অর্থাৎ নিঃসঙ্গ ও পরিত্যাজ্য وَلَوۡلَا رَهۡطُكَ অর্থাৎ আমাদের মধ্যে যদি তোমার গোত্র ও আত্মীয়বর্গ না থাকত। لَرَجَمۡنَـٰكَۖ وَمَاۤ أَنتَ عَلَیۡنَا بِعَزِیزࣲ (তবে আমরা অবশ্যই তোমাকে পাথর মেরে হত্যা করতাম। তুমি আমাদের উপর শক্তিশালী নও।)
(قَالَ یَـٰقَوۡمِ أَرَهۡطِیۤ أَعَزُّ عَلَیۡكُم مِّنَ ٱللَّهِ)
[Surat Hud ৯২]
(হে আমার সম্প্রদায়! আমার আত্মীয়-স্বজন কি আল্লাহর চাইতেও তোমাদের উপর অধিক শক্তিশালী?) অর্থাৎ তোমরা আমার গোত্র ও স্বজনদেরকে ভয় কর এবং তাদের কারণে আমাকে খাতির করছ, অথচ আল্লাহর পাকড়াওকে ভয় করছ না এবং আল্লাহর রসূল হওয়ার কারণে আমাকে খাতির করছ না। ফলে প্রমাণিত হচ্ছে যে, আমার গোত্র ও আত্মীয়-স্বজনই তোমাদের উপর আল্লাহর চাইতে অধিক শক্তিশালী।
وَٱتَّخَذۡتُمُوهُ وَرَاۤءَكُمۡ ظِهۡرِیًّاۖ
(আর আল্লাহকে তোমরা পশ্চাতে ফেলে রেখেছ) অর্থাৎ আল্লাহর দিকে তোমরা পিঠ দিয়ে রেখেছে।
إِنَّ رَبِّی بِمَا تَعۡمَلُونَ مُحِیطࣱ
(তোমরা যা-ই কর, আমার প্রতিপালক তা পরিবেষ্টন করে আছেন।) অর্থাৎ তোমরা যা কিছু কাজ-কর্ম কর না কেন সে সব বিষয়ে আল্লাহ্ পূর্ণভাবে অবগত আছেন। যখন তাঁর কাছে ফিরে যাবে, তখন তিনি এর প্রতিফল দান করবেন।
(وَیَـٰقَوۡمِ ٱعۡمَلُوا۟ عَلَىٰ مَكَانَتِكُمۡ إِنِّی عَـٰمِلࣱۖ سَوۡفَ تَعۡلَمُونَ مَن یَأۡتِیهِ عَذَابࣱ یُخۡزِیهِ وَمَنۡ هُوَ كَـٰذِبࣱۖ وَٱرۡتَقِبُوۤا۟ إِنِّی مَعَكُمۡ رَقِیبࣱ)[Surat Hud ৯৩]
অর্থাৎ, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের অবস্থানের উপর থেকে কাজ কর, আমি আমার কাজ করতে থাকি। অচিরেই জানতে পারবে যে, আযাব কার উপর আসে, যা তাকে লাঞ্ছিত করে ছাড়বে? এবং আরও জানতে পারবে যে, মিথ্যাবাদী কে? তোমরা অপেক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষায় থাকলাম। (সূরা হূদঃ ৯৩)
এটা স্বাভাবিক আদেশ নয় যে, তাদেরকে তাদের রীতি-নীতি ও অভ্যাস পদ্ধতির উপরে থাকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে বরং এটা ধমকের সুরে কঠোর হুঁশিয়ারি বাণী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। শীঘ্রই জানতে পারবে যে, পরকালের শুভ পরিণতি কার ভাগ্যে জুটে এবং ধ্বংস ও বিনাশ কাকে গ্রাস করে। مَن یَأۡتِیهِ عَذَابࣱ یُخۡزِیهِ (কার উপর লাঞ্ছনাকর আযাব আসে) এ আযাব দুনিয়ায় তাদের উপর পতিত আযাবকে বুঝান হয়েছে। ( وَیَحِلُّ عَلَیۡهِ عَذَابࣱ مُّقِیمٌ) (এবং তাদের উপর স্থায়ী আযাব চেপে বসবে)-এ আযাব হল আখিরাতের আযাব। وَمَنۡ هُوَ كَـٰذِبࣱۖ (আর কে মিথ্যাবাদী) অর্থাৎ যে বিষয়ে সংবাদ দেয়া হচ্ছে। সুসংবাদ ও সতর্কবাণী শুনানো হচ্ছে সে বিষয়ে তোমাদের ও আমার মধ্যে কে মিথ্যাবাদী তা অতি শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। وَٱرۡتَقِبُوۤا۟ إِنِّی مَعَكُمۡ رَقِیبࣱ ‘তোমরাও অপেক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করতে থাকি। নিম্নের আয়াতে এ আয়াতের সাদৃশ্য আছে, যাতে বলা হয়েছেঃ
(وَإِن كَانَ طَاۤىِٕفَةࣱ مِّنكُمۡ ءَامَنُوا۟ بِٱلَّذِیۤ أُرۡسِلۡتُ بِهِۦ وَطَاۤىِٕفَةࣱ لَّمۡ یُؤۡمِنُوا۟ فَٱصۡبِرُوا۟ حَتَّىٰ یَحۡكُمَ ٱللَّهُ بَیۡنَنَاۚ وَهُوَ خَیۡرُ ٱلۡحَـٰكِمِینَ ۞ قَالَ ٱلۡمَلَأُ ٱلَّذِینَ ٱسۡتَكۡبَرُوا۟ مِن قَوۡمِهِۦ لَنُخۡرِجَنَّكَ یَـٰشُعَیۡبُ وَٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ مَعَكَ مِن قَرۡیَتِنَاۤ أَوۡ لَتَعُودُنَّ فِی مِلَّتِنَاۚ قَالَ أَوَلَوۡ كُنَّا كَـٰرِهِینَ قَدِ ٱفۡتَرَیۡنَا عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا إِنۡ عُدۡنَا فِی مِلَّتِكُم بَعۡدَ إِذۡ نَجَّىٰنَا ٱللَّهُ مِنۡهَاۚ وَمَا یَكُونُ لَنَاۤ أَن نَّعُودَ فِیهَاۤ إِلَّاۤ أَن یَشَاۤءَ ٱللَّهُ رَبُّنَاۚ وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَیۡءٍ عِلۡمًاۚ عَلَى ٱللَّهِ تَوَكَّلۡنَاۚ رَبَّنَا ٱفۡتَحۡ بَیۡنَنَا وَبَیۡنَ قَوۡمِنَا بِٱلۡحَقِّ وَأَنتَ خَیۡرُ ٱلۡفَـٰتِحِینَ)
[Surat Al-A'raf ৮৭ - ৮৯]
অর্থাৎ, আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি তাতে যদি তোমাদের কোন দল বিশ্বাস করে এবং কোন দল বিশ্বাস না করে, তবে ধৈর্যধারণ কর, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন। আর তিনিই শ্রেষ্ঠ মীমাংসাকারী। তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক প্রধানগণ বলল, হে শুআয়ব! তোমাকে ও তোমার সাথে যারা বিশ্বাস করেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেবই। অথবা তোমাদেরকে আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে আসতে হবে।’ সে বলল, কী আমরা তা ঘৃণা করলেও? তোমাদের ধর্মাদর্শ থেকে আল্লাহ আমাদেরকে উদ্ধার করার পর যদি আমরা তাতে ফিরে যাই তবে তো আমরা আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করব। আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ ইচ্ছা না করলে আর ওতে ফিরে যাওয়া আমাদের কাজ নয়। সব কিছুই আমাদের প্রতিপালকের জ্ঞানায়। আমরা আল্লাহর প্রতি নির্ভর করি; হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দিন এবং আপনিই মীমাংসাকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। (৭: ৮৭-৮৯)
শু‘আয়ব (عليه السلام)-এর সম্প্রদায় তাদের ধারণা মতে ঈমান গ্রহণকারীদেরকে পূর্ব-ধর্মে ফিরিয়ে নেয়ার কামনা করেছিল। নবী শু‘আয়ব (عليه السلام) তাদের এ আশা প্রত্যাখ্যান করে বলেনঃ
أَوَلَوۡ كُنَّا كَـٰرِهِینَ (আমরা যদি অপছন্দ করি তবুও কি?) অর্থাৎ এরা স্বেচ্ছায় তোমাদের ধর্মে ফিরে আসবে না। যদি ফিরে আসে তবে বুঝতে হবে শক্তি প্রয়োগের ফলে অসন্তুষ্টি ও অনিচ্ছায় ফিরে এসেছে। কেননা, আন্তরিক আগ্রহ নিয়ে যে ব্যক্তি ঈমান আনে তার সে ঈমান কেউ কেড়ে নিতে পারে না, কেউ তাকে তা থেকে ফিরাতে পারে না, কারও পক্ষে তা সম্ভবও নয়। এ জন্যেই বলেছেনঃ
(قَدِ ٱفۡتَرَیۡنَا عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا إِنۡ عُدۡنَا فِی مِلَّتِكُم بَعۡدَ إِذۡ نَجَّىٰنَا ٱللَّهُ مِنۡهَاۚ وَمَا یَكُونُ لَنَاۤ أَن نَّعُودَ فِیهَاۤ إِلَّاۤ أَن یَشَاۤءَ ٱللَّهُ رَبُّنَاۚ وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَیۡءٍ عِلۡمًاۚ عَلَى ٱللَّهِ تَوَكَّلۡنَاۚ)[Surat Al-A'raf ৮৯]
অর্থাৎ, ‘আমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদকারী হয়ে যাব যদি আমরা তোমাদের ধর্মে ফিরে যাই। অথচ তিনি আমাদেরকে এ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আমাদের কাজ নয় ঐ ধর্মে ফিরে যাওয়া কিন্তু আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যদি চান। আমাদের প্রতিপালক প্রত্যেক বস্তুকে জ্ঞান দ্বারা বেষ্টন করে আছেন। আল্লাহর প্রতিই আমরা ভরসা করছি।’ অর্থাৎ আমাদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। তিনিই আমাদের রক্ষাকারী। সকল বিষয়ে তিনিই আমাদের আশ্রয় স্থল। অতপর হযরত শু‘আয়ব (عليه السلام) সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন এবং তারা যে শাস্তির যোগ্য তার সত্বর আগমন কামনা করেন। তিনি বলেনঃ
(رَبَّنَا ٱفۡتَحۡ بَیۡنَنَا وَبَیۡنَ قَوۡمِنَا بِٱلۡحَقِّ وَأَنتَ خَیۡرُ ٱلۡفَـٰتِحِینَ)
[Surat Al-A’raf ৮৯]
অর্থাৎ, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের মধ্যে ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ফয়সালা করে দিন যথার্থ ফয়সালা। আপনিই শ্রেষ্ঠ ফয়সালা দানকারী।’ (৭: ৮৯)
এভাবে হযরত শু‘আয়ব (عليه السلام) তাঁর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন। আর আল্লাহর রাসূলদের যারা অস্বীকার করে, অবাধ্য হয় ও বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের বিরুদ্ধে রসূলদের প্রার্থনা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সম্প্রদায়ের লোক যে নীতির উপর ছিল তার উপরই তারা অটল অবিচল হয়ে রইল।
(وَقَالَ ٱلۡمَلَأُ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ مِن قَوۡمِهِۦ لَىِٕنِ ٱتَّبَعۡتُمۡ شُعَیۡبًا إِنَّكُمۡ إِذࣰا لَّخَـٰسِرُونَ)
[Surat Al-A’raf ৯০]
অর্থাৎ, তার সম্প্রদায়ের কাফির সর্দাররা বললঃ যদি তোমরা শু’আয়বের অনুসরণ কর, তবে নিশ্চিতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আল্লাহর বাণীঃ
(فَأَخَذَتۡهُمُ ٱلرَّجۡفَةُ فَأَصۡبَحُوا۟ فِی دَارِهِمۡ جَـٰثِمِینَ)
[Surat Al-A’raf ৯১]
অর্থাৎ, ‘অনন্তর তাদেরকে ভূমিকম্প পাকড়াও করল। ফলে তারা সকাল বেলায় ঘরের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (৭: ৯০-৯১)
সূরা আরাফে বলা হয়েছে, ভূমিকম্প তাদেরকে পাকড়াও করেছিল। অর্থাৎ এক মহা কম্পন তাদের গোটা আবাসভূমিকে সজোরে আঘাত করে। ফলে তাদের দেহ থেকে তাদের রূহ উধাও হয়ে যায়। গোটা এলাকার জীব-জন্তু জড়-বস্তুর ন্যায় নিশ্চল হয়ে পড়ে। তাদের শবদেহগুলো নিথর হয়ে যত্রতত্র পড়ে থাকে। উক্ত জনগোষ্ঠীর উপর আল্লাহ বিভিন্ন প্রকার আযাব ও শাস্তি নাযিল করেন। যখন তারা বিভিন্ন প্রকার অন্যায় ও জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত হলো, তখন আল্লাহ তাদের উপর মহাকম্পন পাঠালেন। যার ফলে সকল চলাচল মুহুর্তে বন্ধ হয়ে যায়। বিকট আওয়াজ পাঠান যার ফলে অপর সকল আওয়াজ নীরব হয়ে যায়। আগুনের মেঘ পাঠান, যার লেলিহান শিখা চতুর্দিক থেকে তাদেরকে বেষ্টন করে ফেলে। কিন্তু বিভিন্ন সূরায় আলোচনার পূর্বাপরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যেখানে যেমন প্রয়োজন আল্লাহ্ সেখানে ততটুকুই উল্লেখ করেছেন। সূরা আ’রাফের বক্তব্যে কাফির সর্দাররা আল্লাহর নবী ও তাঁর সাথীদেরকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। এলাকা থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেয় অথবা তাদেরকে তাদের পূর্বের কুফরী ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। এই পটভূমিতে আল্লাহ বলেনঃ
(فَأَخَذَتۡهُمُ ٱلرَّجۡفَةُ فَأَصۡبَحُوا۟ فِی دَارِهِمۡ جَـٰثِمِینَ)
[Surat Al-A’raf ৯১]
অর্থাৎ, ‘অতঃপর ভূমিকম্প তাদেরকে আঘাত করল। ফলে তারা তাদের ঘরের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।
এখানে তাদের বহিষ্কারের হুমকি ও ধমকের মোকাবিলায় ভূমিকম্পের কথা এবং ভীতি প্রদর্শনের মোকাবিলায় ভয়ের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং পূর্বাপর আলোচনার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়েছে। অপর দিকে সূরা হূদে বলা হয়েছে এক বিকট শব্দ তাদেরকে আঘাত করে।
ফলে তারা নিজেদের ঘর-বাড়িতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। এর কারণ ঐ সূরায় বর্ণিত হয়েছে যে, তারা নবীকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও উপহাস করে বলতোঃ
( أَصَلَوٰتُكَ تَأۡمُرُكَ أَن نَّتۡرُكَ مَا یَعۡبُدُ ءَابَاۤؤُنَاۤ أَوۡ أَن نَّفۡعَلَ فِیۤ أَمۡوَ ٰلِنَا مَا نَشَـٰۤؤُا۟ۖ إِنَّكَ لَأَنتَ ٱلۡحَلِیمُ ٱلرَّشِیدُ)[Surat Hud ৮৭]
অর্থাৎ, ‘তোমার সালাত কি তোমাকে নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা যেগুলোর ইবাদত করত আমরা তা বর্জন করি? কিংবা আমাদের ধনসম্পদ আমাদের ইচ্ছামত ব্যবহার না করি? তুমি তো অবশ্যই সহিষ্ণু, সদাচারী। (১১: ৮৭)
সুতরাং আল্লাহর রসূলকে এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলার কারণে এখানে এই ভয়ানক বিকট শব্দের উল্লেখ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। সূরা শু‘আরায় বলা হয়েছে যে, এক মেঘাচ্ছন্ন দিবসের আযাব তাদেরকে গ্রাস করেছিল। এর কারণ হল, তারা এ জাতীয় আযাব নিয়ে আসার জন্য তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। সুতরাং তাদের আগ্রহ অনুযায়ী সেই আযাবের কথা বলাই সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। কেননা তারা বলেছিলঃ
(قَالُوۤا۟ إِنَّمَاۤ أَنتَ مِنَ ٱلۡمُسَحَّرِینَ وَمَاۤ أَنتَ إِلَّا بَشَرࣱ مِّثۡلُنَا وَإِن نَّظُنُّكَ لَمِنَ ٱلۡكَـٰذِبِینَ فَأَسۡقِطۡ عَلَیۡنَا كِسَفࣰا مِّنَ ٱلسَّمَاۤءِ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ قَالَ رَبِّیۤ أَعۡلَمُ بِمَا تَعۡمَلُونَ)
[Surat Ash-Shu'ara ১৮৫ - ১৮৮]
অর্থাৎ, ‘তুমি তো জাদুগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। তুমি আমাদেরই মত একজন মানুষ বৈ তো নও। আমাদের ধারণা, তুমি মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত। অতএব যদি সত্যবাদী হও, তবে আকাশের এক খণ্ড আমাদের উপর ফেলে দাও। সে বলল, তোমরা যা কর, আমার পালনকর্তা সে সম্পর্কে ভাল জানেন।’ (২৬: ১৮৫-১৮৮)
আল্লাহ বলেনঃ
(فَكَذَّبُوهُ فَأَخَذَهُمۡ عَذَابُ یَوۡمِ ٱلظُّلَّةِۚ إِنَّهُۥ كَانَ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیمٍ)
[Surat Ash-Shu’ara ১৮৯]
অতঃপর তারা তাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করলো ফলে তাদেরকে মেঘাচ্ছন্ন দিবসের আযাব পাকড়াও করল। নিশ্চয়ই সেটা ছিল এক ভীষণ দিবসের আযাব। (২৬: ১৯০)
কাতাদা (رحمة الله) সহ কতিপয় মুফাসসিরের মতে, আয়কাবাসী ও মাদয়ানবাসী অভিন্ন সম্প্রদায় নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন দুইটি সম্প্রদায়। কিন্তু তাদের এ মত দুর্বল। এ মতের পক্ষে দুইটি যুক্তি পেশ করা হয়;
(১) আল্লাহর বাণীঃ
كَذَّبَ أَصۡحَـٰبُ لۡـَٔیۡكَةِ ٱلۡمُرۡسَلِینَ إِذۡ قَالَ لَهُمۡ شُعَیۡبٌ أَلَا تَتَّقُونَ
[Surat Ash-Shu’ara ১৭৬ – ১৭৭]
(আয়কাবাসীরা রসূলগণকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছে। যখন শু’আয়ব তাদেরকে বলল....) এখানে ‘তাদের স্বগোত্রীর শু‘আয়ব’ বলা হয়নি কিন্তু মাদয়ানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছেঃ (وَإِلَىٰ مَدۡیَنَ أَخَاهُمۡ شُعَیۡبࣰاۚ)
অর্থাৎ মাদয়ানবাসীদের কাছে তাদের স্বগোত্রীয় শু’আয়বকে রসূলরূপে পাঠালাম; (২) আয়কাবাসীদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ও ‘মেঘাচ্ছন্ন দিবসের’ (يوم الطلةআযাব তাদেরকে গ্রাস করে। আর মাদয়ানবাসীদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে যে, ভূমিকম্প ও মহানাদ (الرجفة والصيحة) তাদেরকে আঘাত হানে। প্রথম প্রশ্নের উত্তর এই যে,
(كَذَّبَ أَصۡحَـٰبُ لۡـَٔیۡكَةِ ٱلۡمُرۡسَلِینَ)
[Surat Ash-Shu'ara ১৭৬]
এর পরে না বলে বলা হয়েছে (اذ قال لهم اخوهم شعيب ) কেননা, এখানে কথা বলা হয়েছে আয়কার অধিবাসীদের সম্বোধন করে, সুতরাং এ ক্ষেত্রে তাদের স্বগোত্রীয় বলা সংগতিপূর্ণ নয়। কিন্তু যেখানে গোত্রকে সম্বোধন (مدين)- করা হয়েছে, সেখানে তাদের ‘স্বগোত্রীয়’ বলাই যুক্তিসংগত। প্রকৃত পক্ষে এ একটি সূক্ষ্ম ও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর এইঃ يوم الظلة বা ‘মেঘাচ্ছন্ন দিবসের শাস্তি’ এই একটি স্বতন্ত্র শাস্তির উল্লেখ দেখেই যদি বলা হয় যে, এরা ভিন্ন সম্প্রদায়, তা হলে رجغة বা ভূমিকম্প এবং صيحة বা নাদ এ দু’টি স্বতন্ত্র শাস্তির থেকেও দলীল নেয়া যেতে পারে যে, এরাও দু’টি ভিন্ন সম্প্রদায়—যাদের এক দলের উপর ভূমিকম্প ও অপর দলের উপর নাদ-রূপে আযাব এসেছিল। কিন্তু এমন কথা কেউই বলেননি। তবে হাফিজ ইবন আসাকির (رحمة الله) হযরত শু‘আয়ব নবীর আলোচনা প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইবন উছমান (رحمة الله) আবদুল্লাহ ইবন আমর (رضي الله عنه) বর্ণিত একটি মারফূ’ হাদীসের উল্লেখ করেছেনঃ
أن مدين واصحاب الأيكة امتان بعث الله اليهما شعيبا عليه السلام .
অর্থাৎ মাদয়ানবাসী ও আয়কাবাসী দু’টি সম্প্রদায়। উভয়ের কাছে আল্লাহ হযরত শু‘আয়ব (عليه السلام)-কে নবীরূপে প্রেরণ করেন। কিন্তু এ হাদীসটি গরীব পর্যায়ের। এর সনদে বিতর্কিত ব্যক্তিও রয়েছেন। সম্ভবত এটা হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর (رضي الله عنه)-এর নিজস্ব উক্তি যা তিনি ইয়ারমুকের যুদ্ধের সময় বনী ইসরাঈলের কাহিনী সম্পর্কে প্রাপ্ত দুই উট বোঝাই পাণ্ডুলিপি থেকে নিয়ে থাকবেন।
এছাড়া লক্ষণীয় যে, আল্লাহ তাআলা আয়কাবাসীদের সেই সব দোষ-ত্রুটির উল্লেখ করেছেন, যেগুলো মাদয়ানবাসীদের মধ্যেও ছিল। যেমনঃ ওজনে ও মাপে কম দেওয়া ইত্যাদি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উভয়ে একই সম্প্রদায়ভুক্ত। বিভিন্ন প্রকার শাস্তি তাদের উপর পতিত হয়। অবশ্য বিভিন্ন সূরায় আলোচনার পরিবেশ অনুযায়ী বিভিন্ন রকম সম্বোধন করা হয়েছে।
আল্লাহর বাণীঃ
(فَكَذَّبُوهُ فَأَخَذَهُمۡ عَذَابُ یَوۡمِ ٱلظُّلَّةِۚ إِنَّهُۥ كَانَ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیمٍ)
[Surat Ash-Shu’ara ১৮৯]
‘মেঘাচ্ছন্ন দিবসের আযাব তাদেরকে গ্রাস করে নিল। এটা ছিল ভয়াবহ দিবসের শাস্তি। (সূরা শুআরাঃ ১৮৯)
মুফাসসিরগণ বলেছেনঃ শু‘আয়বের সম্প্রদায় প্রচণ্ড গরমে আক্রান্ত হয়। আল্লাহ সাত দিন পর্যন্ত তাদের উপর বায়ু প্রবাহ বন্ধ রাখেন। ফলে পানি, ছায়া ও ঝর্ণাধারা তাদের কোন কাজেই আসেনি। তখন তারা ঘর-বাড়ি ছেড়ে উন্মুক্ত প্রান্তরে চলে যায়। এক টুকরা মেঘ এসে তাদেরকে ছায়াদান করে। সম্প্রদায়ের সবাই ঐ মেঘের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণের উদ্দেশ্যে সমবেত হয়। সকলে যখন সমবেত হল তখন আল্লাহ তাদের উপর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও জ্বলন্ত অঙ্গার নিক্ষেপ করেন। গোটা এলাকাব্যাপী প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয় এবং আকাশ থেকে এক ভয়াবহ নাদ আসে। ফলে সকলের প্রাণ বায়ু উড়ে যায়, ঘরবাড়ি উজাড় হয় এবং নিজ নিজ ঘরের মধ্যে তারা উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। যারা শুআয়ব (عليه السلام)-কে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছিল, তারা এরূপ নিশ্চিহ্ন হলো যে, এখানে যেন তারা কোন দিনই বসবাস করেনি। যারাই শু’আয়ব (عليه السلام)-কে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হল। পক্ষান্তরে, আল্লাহ শু‘আয়ব (عليه السلام)-কে ও তার সাথের মুমিনদেরকে আযাব থেকে রক্ষা করেন।
আল্লাহ বলেনঃ
(وَلَمَّا جَاۤءَ أَمۡرُنَا نَجَّیۡنَا شُعَیۡبࣰا وَٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ مَعَهُۥ بِرَحۡمَةࣲ مِّنَّا وَأَخَذَتِ ٱلَّذِینَ ظَلَمُوا۟ ٱلصَّیۡحَةُ فَأَصۡبَحُوا۟ فِی دِیَـٰرِهِمۡ جَـٰثِمِینَ كَأَن لَّمۡ یَغۡنَوۡا۟ فِیهَاۤۗ أَلَا بُعۡدࣰا لِّمَدۡیَنَ كَمَا بَعِدَتۡ ثَمُودُ)
[Surat Hud ৯৪ - ৯৫]
অর্থাৎ, যখন আমার নির্দেশ এল, তখন আমি শু‘আয়ব ও তার সঙ্গী ঈমানদারগণকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করেছিলাম, তারপর যারা সীমালংঘন করেছিল, মহানাদ তাদেরকে আঘাত হানলো। ফলে তারা নিজ নিজ ঘরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল। যেন তারা সেখানে কখনও বসবাসই করেনি। জেনে রেখো, ধ্বংস ছিল মায়ানবাসীদের পরিণাম যেভাবে ধ্বংস হয়েছিল। ছামূদ সম্প্রদায়। (১১: ৯৪-৯৬)
আল্লাহ আরও বলেনঃ
(وَقَالَ ٱلۡمَلَأُ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ مِن قَوۡمِهِۦ لَىِٕنِ ٱتَّبَعۡتُمۡ شُعَیۡبًا إِنَّكُمۡ إِذࣰا لَّخَـٰسِرُونَ فَأَخَذَتۡهُمُ ٱلرَّجۡفَةُ فَأَصۡبَحُوا۟ فِی دَارِهِمۡ جَـٰثِمِینَ ٱلَّذِینَ كَذَّبُوا۟ شُعَیۡبࣰا كَأَن لَّمۡ یَغۡنَوۡا۟ فِیهَاۚ ٱلَّذِینَ كَذَّبُوا۟ شُعَیۡبࣰا كَانُوا۟ هُمُ ٱلۡخَـٰسِرِینَ)[Surat Al-A'raf ৯০ - ৯২]
অর্থাৎ, তার সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসী প্রধানগণ বলল, তোমরা যদি শু‘আয়বের অনুসরণ কর তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারপর এক ভূমিকম্প তাদেরকে আঘাত করল। ফলে তারা ঘরের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে রইল, যারা শুআয়বকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছিল। মনে হবে যেন এখানে তারা কখনও বসবাস করেনি। শু‘আয়বকে যারা মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করছিল, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। (৭: ৯০-৯২)
এ কথাটি তাদেরই কথার পাল্টা হিসাবে বলা হয়েছে। কারণ তারা বলেছিলঃ
لَىِٕنِ ٱتَّبَعۡتُمۡ شُعَیۡبًا إِنَّكُمۡ إِذࣰا لَّخَـٰسِرُونَ
(যদি তোমরা শুআয়বের অনুগামী হও তবে অবশ্যই তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (৭: ৯০)।
সম্প্রদায়ের ধ্বংসের পরে নবী শুআয়ব (عليه السلام) দুঃখ করে যে কথা বলেছিলেন সে প্রসংগে আল্লাহর বাণীঃ
( یَـٰقَوۡمِ لَقَدۡ أَبۡلَغۡتُكُمۡ رِسَـٰلَـٰتِ رَبِّی وَنَصَحۡتُ لَكُمۡۖ فَكَیۡفَ ءَاسَىٰ عَلَىٰ قَوۡمࣲ كَـٰفِرِینَ)
[Surat Al-A'raf ৯৩]
অর্থাৎ, “হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে আমার প্রতিপালকের পয়গাম পৌঁছিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদের উপদেশ দিয়েছি। এখন আমি কাফির সম্প্রদায়ের জন্যে কী করে আক্ষেপ করি। (৭: ৯৩)
অর্থাৎ তাদের ধ্বংসের পরে তিনি তাদের এলাকা থেকে এই কথা বলে চলে আসেন যে,
(یَـٰقَوۡمِ لَقَدۡ أَبۡلَغۡتُكُمۡ رِسَـٰلَـٰتِ رَبِّی وَنَصَحۡتُ لَكُمۡۖ)
[Surat Al-A’raf ৯৩]
(হে আমার সম্প্রদায়! আমি আমার প্রতিপালকের পয়গাম পৌঁছিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদেরকে উপদেশ দান করেছি) অর্থাৎ পৌঁছিয়ে দেয়ার ও উপদেশ দেয়ার যে দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করা হয়েছিল তা আমি পূর্ণরূপে আদায় করেছি এবং তোমাদের হিদায়াতের জন্যে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার এসব প্রচেষ্টা তোমাদের কোন উপকারে আসেনি। কেননা যে ব্যক্তি ভ্রান্ত পথে চলে আল্লাহ তাকে হিদায়াত করেন না, আর তার কোন সাহায্যকারীও থাকে না। অতএব, এরপর আমি তোমাদের ব্যাপারে আক্ষেপ করব না। কেননা তোমরা উপদেশ গ্রহণ করনি, লাঞ্ছিত হবার দিনকে ভয় করনি। এ জন্যেই তিনি বলেছেন, কিভাবে আমি কাফির সম্প্রদায়ের জন্যে আক্ষেপ ও দুঃখ প্রকাশ করব! অর্থাৎ যা সত্য তা তোমরা মানছ না, সেদিকে প্রত্যাবর্তন করছ না এবং সেদিকে দৃষ্টিপাতও করতে প্রস্তুত নও। ফলে তাদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন আঘাত আসল, যা না যায় ফিরান আর না যায় প্রতিরোধ করা, আর না স্থগিত করা সম্ভব। কারও উপর পতিত হলে না সে এর থেকে রক্ষা পেতে পারে, না পলায়ন করে বাঁচতে পারে।
হাফিজ ইবন আসাকির (رحمة الله) তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে হযরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর উক্তি উল্লেখ করেছেন যে, হযরত শু’আয়ব (عليه السلام) হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর পরবর্তী কালের লোক। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ (رحمة الله) থেকে বর্ণিত, হযরত শুআয়ব (عليه السلام) ও তাঁর সঙ্গী মুমিনগণ সকলেই মক্কা শরীফে ইনতিকাল করেন এবং তাঁদের কবর কা’বা গৃহের পশ্চিম পাশে দারুন-নাদওয়া ও দারে বনী-সাহমের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত।