এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণীঃ
(وَبَشَّرْنَاهُ بِإِسْحَاقَ نَبِيًّا مِنَ الصَّالِحِينَ * وَبَارَكْنَا عَلَيْهِ وَعَلَىٰ إِسْحَاقَ ۚ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِمَا مُحْسِنٌ وَظَالِمٌ لِنَفْسِهِ مُبِينٌ) [Surat As-Saaffat ১১২ - ১১৩]
অর্থাৎ, আমি তাকে সুসংবাদ দিয়েছিলাম ইসহাকের, সে ছিল এক নবী, সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। আমি তাঁকে বরকত দান করেছিলাম এবং ইসহাককেও। তাদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মপরায়ণ এবং কতক নিজেদের প্রতি স্পষ্ট অত্যাচারী। (সূরা সাফফাতঃ ১১২-১১৩)
মাদায়েন অঞ্চলের অধিবাসী লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের কুফরী ও পাপাচারের শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে আল্লাহর ফেরেশতাগণ সেখানে যাওয়ার পথে হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) ও সারাহকে এ সুসংবাদ শুনিয়ে যান।
আল্লাহ বলেনঃ
(وَلَقَدْ جَاءَتْ رُسُلُنَا إِبْرَاهِيمَ بِالْبُشْرَىٰ قَالُوا سَلَامًا ۖ قَالَ سَلَامٌ ۖ فَمَا لَبِثَ أَنْ جَاءَ بِعِجْلٍ حَنِيذٍ * فَلَمَّا رَأَىٰ أَيْدِيَهُمْ لَا تَصِلُ إِلَيْهِ نَكِرَهُمْ وَأَوْجَسَ مِنْهُمْ خِيفَةً ۚ قَالُوا لَا تَخَفْ إِنَّا أُرْسِلْنَا إِلَىٰ قَوْمِ لُوطٍ * وَامْرَأَتُهُ قَائِمَةٌ فَضَحِكَتْ فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِنْ وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ * قَالَتْ يَا وَيْلَتَىٰ أَأَلِدُ وَأَنَا عَجُوزٌ وَهَٰذَا بَعْلِي شَيْخًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عَجِيبٌ * قَالُوا أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ ۖ رَحْمَتُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ ۚ إِنَّهُ حَمِيدٌ مَجِيدٌ * فَلَمَّا ذَهَبَ عَنْ إِبْرَاهِيمَ الرَّوْعُ وَجَاءَتْهُ الْبُشْرَىٰ يُجَادِلُنَا فِي قَوْمِ لُوطٍ) [Surat Hud ৬৯ - ৭৪]
অর্থাৎ, আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ ইবরাহীমের কাছে সুসংবাদ নিয়ে এসেছিল। তারা বলল, ‘সালাম’। সেও বলল, ‘সালাম’। সে অবিলম্বে এক কাবাব করা বাছুর নিয়ে আসল। সে যখন দেখল, তাদের হাত সেটার দিকে প্রসারিত হচ্ছে না, তখন তাদেরকে অবাঞ্ছিত মনে করল এবং তাদের সম্বন্ধে তার মনে ভীতি সঞ্চার হলো। তারা বলল, ভয় করো না, আমরা লূতের সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। তখন তার স্ত্রী দাঁড়িয়েছিল এবং সে হাসল। তারপর আমি তাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকূবের সুসংবাদ দিলাম। সে বলল, কি আশ্চর্য! সন্তানের জননী হব আমি, যখন আমি বৃদ্ধা এবং এই আমার স্বামী বৃদ্ধ। এটি অবশ্যই এক অদ্ভুত ব্যাপার! তারা বলল, আল্লাহর কাজে তুমি বিস্ময় বোধ করছ? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ। তিনি প্রশংসাৰ্থ ও সম্মানাহ্। (সূরা হুদঃ ৬৯-৭৪)
আল্লাহর বাণীঃ
(وَنَبِّئْهُمْ عَنْ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ * إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلَامًا قَالَ إِنَّا مِنْكُمْ وَجِلُونَ * قَالُوا لَا تَوْجَلْ إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ * قَالَ أَبَشَّرْتُمُونِي عَلَىٰ أَنْ مَسَّنِيَ الْكِبَرُ فَبِمَ تُبَشِّرُونَ * قَالُوا بَشَّرْنَاكَ بِالْحَقِّ فَلَا تَكُنْ مِنَ الْقَانِطِينَ * قَالَ وَمَنْ يَقْنَطُ مِنْ رَحْمَةِ رَبِّهِ إِلَّا الضَّالُّونَ)
[Surat Al-Hijr ৫১ - ৫৬]
অর্থাৎ, এবং ওদেরকে বল, ইবরাহীমের অতিথিদের কথা, যখন ওরা তার নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, ‘সালাম’। তখন সে বলেছিল, ‘আমরা তোমাদের আগমনে আতংকিত।’ তারা বলল, ‘ভয় করিও না, আমরা তোমাকে এক জ্ঞানী পুত্রের শুভ সংবাদ দিচ্ছি।’ সে বলল, ‘তোমরা কি আমাকে শুভ সংবাদ দিচ্ছ আমি বার্ধক্যগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও? তোমরা কি বিষয়ে শুভ সংবাদ দিচ্ছ?’ ওরা বলল, ‘আমরা সত্য সংবাদ দিচ্ছি; সুতরাং তুমি হতাশ হইও না।’ সে বলল, ‘যারা পথভ্রষ্ট তারা ব্যতীত আর কে তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ হতে হতাশ হয়?’ (সূরা হিজরঃ ৫১-৫৬)
আল্লাহর বাণীঃ
(هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ * إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلَامًا ۖ قَالَ سَلَامٌ قَوْمٌ مُنْكَرُونَ * فَرَاغَ إِلَىٰ أَهْلِهِ فَجَاءَ بِعِجْلٍ سَمِينٍ * فَقَرَّبَهُ إِلَيْهِمْ قَالَ أَلَا تَأْكُلُونَ * فَأَوْجَسَ مِنْهُمْ خِيفَةً ۖ قَالُوا لَا تَخَفْ ۖ وَبَشَّرُوهُ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ * فَأَقْبَلَتِ امْرَأَتُهُ فِي صَرَّةٍ فَصَكَّتْ وَجْهَهَا وَقَالَتْ عَجُوزٌ عَقِيمٌ * قَالُوا كَذَٰلِكِ قَالَ رَبُّكِ ۖ إِنَّهُ هُوَ الْحَكِيمُ الْعَلِيمُ)
[Surat Adh-Dhariyat ২৪ - ৩০]
অর্থাৎ, ‘তোমার নিকট ইবরাহীমের সম্মানিত মেহমানদের বৃত্তান্ত এসেছে কি? যখন ওরা তার কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘সালাম’। উত্তরে সে বলল, ‘সালাম’। এরা তো অপরিচিত লোক। তারপর ইবরাহীম তার স্ত্রীর নিকট গেল এবং একটি মাংসল গরুর বাছুর ভাজা অবস্থায় নিয়ে আসল ও তাদের সামনে রাখল এবং বলল, ‘তোমরা খাচ্ছ না কেন?’ এতে ওদের সম্পর্কে তার মনে ভীতির সঞ্চার হল। ওরা বলল, ভীত হয়ো না। তারপর ওরা তাকে এক জ্ঞানী পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিল। তখন তার স্ত্রী চিৎকার করতে করতে আসল এবং গাল চাপড়িয়ে বলল, এই বৃদ্ধা বন্ধ্যার সন্তান হবে? তারা বলল, তোমার প্রতিপালক এরূপই বলেছেন, তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। (সূরা যারিয়াতঃ ২৪-৩০)
এখানে মেহমান অর্থ ফেরেশতা— যারা মানুষের আকৃতি ধারণ করে এসেছিলেন, এরা সংখ্যায় ছিলেন তিনজনঃ জিবরাঈল (عليه السلام), মীকাঈল (عليه السلام) ও ইসরাফীল (عليه السلام)। হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর বাড়িতে এলে তিনি মেহমানরূপে গণ্য করেন এবং মেহমানদের সাথে যে রকম আচরণ করা হয় সে রকম আচরণ করেন। সুতরাং তিনি তার গোয়ালের সবচাইতে হৃষ্টপুষ্ট একটি বাছুর ভুনা করে তাদের সামনে পেশ করেন। কিন্তু তিনি আহারের প্রতি তাদের কোনই আগ্রহ দেখতে পেলেন না। কেননা, ফেরেশতাদের আহারের কোন প্রয়োজন হয় না। ইবরাহীম তাদেরকে অপরিচিত লোক মনে করলেন।
( وَأَوْجَسَ مِنْهُمْ خِيفَةً ۚ قَالُوا لَا تَخَفْ إِنَّا أُرْسِلْنَا إِلَىٰ قَوْمِ لُوطٍ)
[Surat Hud ৭০]
তাদের সম্বন্ধে তার মনে ভীতির সঞ্চার হল। তারা বলল, 'ভীত হয়ো না, আমরা লূতের সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। অর্থাৎ তাদেরকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। এ সময় স্ত্রী সারাহ্ আল্লাহর ক্রোধে লূতের সম্প্রদায়ের শাস্তির কথা শুনে আনন্দিত হন। সারাহ্ মেহমানদের সামনেই দণ্ডায়মান ছিলেন— যেমনি আরব ও অনারবদের মধ্যে নিয়ম প্রচলিত আছে। সারাহ যখন ঐ সংবাদ শুনে হেসে দেন তখন আল্লাহ তাকে সুসংবাদ দেনঃ
( فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِنْ وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ)
[Surat Hud ৭১]
(তারপর আমি তাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম) অর্থাৎ ফেরেশতারা তাকে এ বিষয়ে সুসংবাদ দেন।
(فَأَقْبَلَتِ امْرَأَتُهُ فِي صَرَّةٍ )
[Surat Adh-Dhariyat ২৯]
(তখন তার স্ত্রী চিৎকার করতে করতে সম্মুখে আসল।)
( فَصَكَّتْ وَجْهَهَا وَقَالَتٌْ)
[Surat Adh-Dhariyat ২৯]
(এবং নিজের গাল চাপড়িয়ে বলতে লাগল) অর্থাৎ যেভাবে মেয়ে লোকেরা অবাক হলে করে থাকে।
(قَالَتْ يَا وَيْلَتَىٰ أَأَلِدُ وَأَنَا عَجُوزٌ وَهَٰذَا بَعْلِي شَيْخًا )
[Surat Hud ৭২]
(কী আশ্চর্য! আমি জননী হব, অথচ এখন আমি বৃদ্ধা এবং এই আমার স্বামী বৃদ্ধ) অর্থাৎ আমার মত একজন বৃদ্ধা ও বন্ধ্যা মহিলা কী করে সন্তান জন্ম দিতে পারে। আর আমার স্বামীও এই বৃদ্ধ! এ অবস্থায় সন্তান হওয়ার সংবাদে তিনি আশ্চর্যবোধ করেন। তাই তিনি বলেনঃ
( إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عَجِيبٌ)
[Surat Hud ৭২]
(এটা অবশ্যই এক অদ্ভুত ব্যাপার।)
(قَالُوا أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ ۖ رَحْمَتُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ ۚ إِنَّهُ حَمِيدٌ مَجِيدٌ)
[Surat Hud ৭৩]
(ওরা বলল, আল্লাহর কাজে আপনি বিস্ময়বোধ করছেন? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ। তিনি প্রশংসার অধিকারী ও সম্মানের অধিকারী।)
ইবরাহীম (عليه السلام)-ও এ সুসংবাদ পেয়ে ও স্ত্রীর খুশীর সাথে শরীক হয়ে এবং স্ত্রীর মনে দৃঢ়তা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নিজেও আশ্চর্যবোধ করেন।
(قَالَ أَبَشَّرْتُمُونِي عَلَىٰ أَنْ مَسَّنِيَ الْكِبَرُ فَبِمَ تُبَشِّرُونَ * قَالُوا بَشَّرْنَاكَ بِالْحَقِّ فَلَا تَكُنْ مِنَ الْقَانِطِينَ)
[Surat Al-Hijr ৫৪ - ৫৫]
অর্থাৎ, ইবরাহীম বলল, তোমরা কি আমাকে শুভ সংবাদ দিচ্ছ আমি বার্ধক্যগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও? তোমরা কি বিষয়ে শুভ সংবাদ দিচ্ছ? তারা বলল, আমরা সত্য সংবাদ দিচ্ছি। সুতরাং আপনি হতাশ হবেন না।
এই বাক্য দ্বারা সুসংবাদকে দৃঢ়তর করা হয়েছে। তারপর ফেরেশতাগণ ইবরাহীম (عليه السلام) ও সারাহকে এক জ্ঞানী পুত্র সন্তানের (بغلام عليم) সুসংবাদ দিলেন। অর্থাৎ ইসহাক (عليه السلام) ও তার ভাইয়ের কথা। ইসমাঈল (عليه السلام)-কে আল্লাহ বিভিন্ন গুণের ও মর্যাদার অধিকারী বলে কুরআনে উল্লেখ করেছেন যেমন حليم বা ধৈর্যশীল—যা তাঁর অবস্থার সাথে খুবই সামজস্যপূর্ণ। তাছাড়া ওয়াদা পালনকারী এবং সহনশীল বলেও তাঁর উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ
( فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِنْ وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ)
[Surat Hud ৭১]
(আমি তাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পর ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম।) এ আয়াত দ্বারাই মুহাম্মদ ইবন কা’ব আল কুরাজী (رحمة الله) প্রমুখ দলীল পেশ করেছেন যে, যাকে যবেহ-এর হুকুম করা হয়েছিল তিনি হলেন ইসমাঈল (عليه السلام)-ইসহাক (عليه السلام) নন। কেননা ইসহাক (عليه السلام)-কে যবেহ করার হুকুম দেয়া যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। যেহেতু সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, তিনি বেঁচে থাকবেন এবং তাঁর ইয়াকুব নামক একজন সন্তানও জন্মগ্রহণ করবে। কিন্তু ইসহাক يعقوب শব্দটি عقب শব্দ থেকে নির্গত যার অর্থ পরে হওয়া বা পরে আসা।
আহলি কিতাবদের মতে, ফেরেশতাদের সম্মুখে ভুনা করা বাছুরের সাথে রুটি, তিনটা মশক, ঘি ও দুধ আনা হয় এবং ফেরেশতাগণ তা খেয়েও ছিলেন। কিন্তু ফেরেশতাদের খাওয়ার মতটি এক চরম ভ্রান্তি বৈ কিছু নয়। কারও কারও মতে, ফেরেশতাগণ আহার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু খাদ্যদ্রব্য তখন বাতাসে মিশে যায়। আহলি কিতাবদের মতে, আল্লাহ ইবরাহীম (عليه السلام)-কে বলেনঃ তোমার স্ত্রীকে সারা(سارا) বলে ডেকো না, বরং সে হচ্ছে সারাহ্(سارة)। আমি তাকে বরকত দান করব এবং তাকে পুত্র সন্তান দান করব। সে পুত্রকেও বরকতময় করব। তার বংশ থেকে অনেক গোত্র হবে এবং সে বংশে অনেক রাজা-বাদশাহর জন্ম হবে। একথা শুনে ইবরাহীম (عليه السلام) শুকরিয়া আদায়ের জন্যে সিজদায় পড়ে যান। তিনি মনে মনে চিন্তা করে হাসেন এবং বলেন, আমার বয়স যখন একশ’র উপরে এবং সারাহর বয়স নব্বই—এখন আমাদের সন্তান হবে! ইবরাহীম (عليه السلام) প্রার্থনা করেন, হে আল্লাহ! ইবরাহীম যদি আপনার সম্মুখে লালিত-পালিত হত! আল্লাহ বলেনঃ হে ইবরাহীম! আমি আমার নিজের কসম করে বলছি, তোমার স্ত্রী সারাহ্, অবশ্যই পুত্র সন্তান প্রসব করবে। তার নাম হবে ইসহাক। সে দীর্ঘজীবী হবে এবং আমার আশিস ধন্য হবে সে এবং তার পরবর্তী বংশধররা। ইসমাঈলের ব্যাপারে তোমার প্রার্থনা কবুল করেছি। তাকে বরকত দান করেছি। আমি তাকে বড় করেছি ও যথেষ্ট সমৃদ্ধি দিয়েছি। তার বংশে বারজন বাদশাহর জন্ম হবে। তাকে আমি এক বিশাল বংশের প্রধান বানাব। এ বিষয়ে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। আল্লাহর বাণীঃ
( فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِنْ وَرَاءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ)
[Surat Hud ৭১]
(আমি তাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম।) এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিবি সারাহ্ নিজ পুত্র ইসহাক ও ইসহাকের পুত্র ইয়াকূব (নাতি)-এর দ্বারা আনন্দ লাভ করবেন। অর্থাৎ ইবরাহীম (عليه السلام) ও সারাহর জীবদ্দশায় ইয়াকূবের জন্ম হবে এবং তাকে দেখে উভয়ের চোখ জুড়াবে। যেমন জুড়াবে পুত্র ইসহাককে পেয়ে।
এই অর্থ যদি গ্রহণ করা না হয় তাহলে ইসহাকের সাথে তাঁর বংশের সবাইকে বাদ দিয়ে কেবল ইয়াকূবের উল্লেখ করার কোন অর্থ হয় না। যখনই নির্দিষ্টভাবে ইয়াকূবের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তখনই নিশ্চিতভাবে বুঝতে হবে যে, ইবরাহীম (عليه السلام) ও সারাহ্ ইয়াকূবকে পেয়ে সেরূপ খুশী হবেন ও আনন্দ উপভোগ করবেন, যেরূপ খুশী ও আনন্দ উপভোগ করবেন তার পিতা ইসহাকের জন্মের দরুন। আল্লাহর বাণীঃ
(وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ ۚ كُلًّا هَدَيْنَا )
[Surat Al-An’am ৮৪]
অর্থাৎ, আমি তাকে দান করেছি ইসহাক ও ইয়াকূব। প্রত্যেককেই আমি পথ প্রদর্শন করেছি। (সূরা আনআমঃ ৮৪) আল্লাহর বাণীঃ
(فَلَمَّا اعْتَزَلَهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ)
[Surat Maryam ৪৯]
অর্থাৎ, অতঃপর ইবরাহীম যখন তাদেরকে এবং আল্লাহ ব্যতীত তারা আর যাদের পূজা করত—তাদের সবাইকে পরিত্যাগ করল। তখন আমি তাকে দান করলাম ইসহাক ও ইয়াকূব। (সূরা মারয়ামঃ ৪৯)
এ আয়াতটি উল্লেখিত অভিমতকে আরও শক্তিশালী করেছে। বুখারী ও মুসলিমের একটি হাদীসও এই মতকে সমর্থন করে। আবূ যর (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি একদা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সর্বপ্রথম নির্মিত মসজিদ কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদুল হারম। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদুল আকসা। আমি বললাম, এ দু’ মসজিদের নির্মাণের মধ্যে ব্যবধান কত? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। আমি বললাম, এর পরবর্তী মর্যাদাসম্পন্ন মসজিদ কোনটি? তিনি বললেন, এর পরে সব জায়গা সমান। যেখানেই সালাতের সময় হয় সেখানেই পড়ে নাও; কেননা সকল জায়গাই সালাত আদায়ের উপযুক্ত।
আহলি কিতাবদের মতে, হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) মসজিদে আকসা নির্মাণ করেন। এর অপর নাম মসজিদে ঈলিয়া— বায়তুল মুকাদ্দাস। এটাও উল্লেখিত হাদীসের বর্ণনার সত্যতার প্রমাণবহ। এ হিসাবে ইবরাহীম (عليه السلام) ও ইসমাঈল (عليه السلام) কর্তৃক মসজিদুল হারম নির্মাণের চল্লিশ বছর পর ইয়াকূব (যার অপর নাম ইসরাঈল) (عليه السلام) কর্তৃক মসজিদে আকসা নির্মাণের তথ্য পাওয়া যায়। এই সাথে আরও প্রমাণিত হয় যে, ইবরাহীম (عليه السلام) ও ইসমাঈল (عليه السلام) যখন মসজিদুল হারম নির্মাণ করেন তখন ইসহাক (عليه السلام) বর্তমান ছিলেন। কেননা ইবরাহীম (عليه السلام) যখন দু’আ করেছিলেন তখন বলেছিলেন—আল্লাহর বাণীঃ
(وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَٰذَا الْبَلَدَ آمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ * رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ ۖ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي ۖ وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ * رَبَّنَا إِنِّي أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِنَ النَّاسِ تَهْوِي إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُمْ مِنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ * رَبَّنَا إِنَّكَ تَعْلَمُ مَا نُخْفِي وَمَا نُعْلِنُ ۗ وَمَا يَخْفَىٰ عَلَى اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ * الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ ۚ إِنَّ رَبِّي لَسَمِيعُ الدُّعَاءِ * رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي ۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ * رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ)
[Surat Ibrahim ৩৫ - ৪১]
অর্থাৎ, স্মরণ কর, ইবরাহীম বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! এই নগরীকে নিরাপদ করো এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে প্রতিমা পূজা থেকে দূরে রেখ। হে আমার প্রতিপালক! এ প্রতিমাগুলো বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সেই আমার দলভুক্ত, কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদের কতককে বসবাস করালাম অনুর্বর উপত্যকায় তোমার পবিত্র ঘরের নিকট, হে আমাদের প্রতিপালক! এজন্যে যে, ওরা যেন সালাত কায়েম করে। অতএব, তুমি কিছু লোকের অন্তর ওদের প্রতি অনুরাগী করে দাও এবং ফলাদি দ্বারা ওদের রিযকের ব্যবস্থা করিও, যাতে ওরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো জান, যা আমরা গোপন করি ও যা আমরা প্রকাশ করি, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কিছুই আল্লাহর নিকট গোপন থাকে না। প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য, যিনি আমাকে আমার বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। আমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রার্থনা শুনে থাকেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সালাত কায়েমকারী কর এবং আমার বংশধরদের মধ্য হতেও। হে আমাদের প্রতিপালক! আমার প্রার্থনা কবুল কর। হে আমাদের প্রতিপালক! যেদিন হিসাব হবে সেদিন আমাকে আমার পিতামাতাকে এবং মুমিনগণকে ক্ষমা করো!’ (১৪ঃ ৩৫-৪১)
সুলায়মান ইবন দাঊদ (عليه السلام) সম্পর্কে হাদীসে যা বর্ণিত হয়েছে অর্থাৎ তিনি যখন বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেন তখন আল্লাহর নিকট তিনটি জিনিস চেয়েছিলেন। নিম্নের আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছিঃ
(قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكًا لَا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدِي )
[Surat Sad ৩৫]
অর্থাৎ, সুলায়মান বলল, হে আমার রব! আমাকে মাফ করুন এবং আমাকে এমন সাম্রাজ্য দান করুন, যার অধিকারী আমি ছাড়া আর কেউ না হয়। (সূরা সাদঃ ৩৫)
সুলায়মান (عليه السلام)-এর আলোচনায়ও আমরা এ বিষয়ে উল্লেখ করব। এর অর্থ— তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসকে পুনঃনির্মাণ করেন। কেননা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, উভয় মসজিদের নির্মাণের মধ্যে চল্লিশ বছরের ব্যবধান। কিন্তু সুলায়মান (عليه السلام) ও ইবরাহীম (عليه السلام)-এর মধ্যে চল্লিশ বছরের ব্যবধানের কথা কেউ বলেন নি। কেবলমাত্র ইবন হিব্বান (رحمة الله) তার ‘তাকাসীম ও আনওয়া’ গ্রন্থে এর উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তার আগে বা পরে অন্য কেউ এ মত পোষণ করেন নি।