❏ হযরত ইউসুফ (عليه السلام) এর ঘটনা
(إِذۡ قَالَ یُوسُفُ لِأَبِیهِ یَـٰۤأَبَتِ إِنِّی رَأَیۡتُ أَحَدَ عَشَرَ كَوۡكَبࣰا وَٱلشَّمۡسَ وَٱلۡقَمَرَ رَأَیۡتُهُمۡ لِی سَـٰجِدِینَ قَالَ یَـٰبُنَیَّ لَا تَقۡصُصۡ رُءۡیَاكَ عَلَىٰۤ إِخۡوَتِكَ فَیَكِیدُوا۟ لَكَ كَیۡدًاۖ إِنَّ ٱلشَّیۡطَـٰنَ لِلۡإِنسَـٰنِ عَدُوࣱّ مُّبِینࣱ وَكَذَ ٰلِكَ یَجۡتَبِیكَ رَبُّكَ وَیُعَلِّمُكَ مِن تَأۡوِیلِ ٱلۡأَحَادِیثِ وَیُتِمُّ نِعۡمَتَهُۥ عَلَیۡكَ وَعَلَىٰۤ ءَالِ یَعۡقُوبَ كَمَاۤ أَتَمَّهَا عَلَىٰۤ أَبَوَیۡكَ مِن قَبۡلُ إِبۡرَ ٰهِیمَ وَإِسۡحَـٰقَۚ إِنَّ رَبَّكَ عَلِیمٌ حَكِیمࣱ)[Surat Yusuf ৪ - ৬]
অর্থাৎ, স্মরণ কর, ইউসুফ তার পিতাকে বলেছিল, হে আমার পিতা! আমি এগারটি নক্ষত্র, সূর্য ও চন্দ্রকে দেখেছি—দেখেছি তাদেরকে আমার প্রতি সিজদাবনত অবস্থায়। সে বলল, আমার পুত্র! তোমার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত তোমার ভাইদের নিকট বর্ণনা করো না; করলে তারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে। শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। এভাবে তোমার প্রতিপালক তোমাকে মনোনীত করবেন এবং তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেবেন এবং তোমার প্রতি, ইয়াকূবের পরিবার-পরিজনের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করবেন, যেভাবে তিনি এর পূর্বে পূর্ণ করেছিলেন তোমার পিতৃ-পুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের প্রতি। তোমার প্রতিপালক সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।। (১২: ৪-৬)
ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, হযরত ইয়াকূব (عليه السلام)-এর বারজন পুত্র সন্তান ছিলেন। তাদের নামও আমরা উল্লেখ করেছি। বনী ইসরাঈলের সকলেই তার সাথে সম্পৃক্ত। এই বার ভাইয়ের মধ্যে গুণ-গরিমায় ইউসুফ (عليه السلام) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। উলামাদের এক দলের মতে, বার ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র ইউসুফ (عليه السلام) ছিলেন নবী। অবশিষ্টদের মধ্যে কেউই নবী ছিলেন না। ইউসুফ (عليه السلام)-এর ঘটনায় তার ভাইদের যে সব কর্মকাণ্ড ও উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তা থেকে এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে কতিপয় আলিমের মতে, অন্য ভাইরাও নবী ছিলেন। নিম্নোক্ত আয়াত থেকে তারা দলীল গ্রহণ করেন। যথাঃ
(قُلۡ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَمَاۤ أُنزِلَ عَلَیۡنَا وَمَاۤ أُنزِلَ عَلَىٰۤ إِبۡرَ ٰهِیمَ وَإِسۡمَـٰعِیلَ وَإِسۡحَـٰقَ وَیَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطِ وَمَاۤ أُوتِیَ مُوسَىٰ وَعِیسَىٰ وَٱلنَّبِیُّونَ مِن رَّبِّهِمۡ لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ أَحَدࣲ مِّنۡهُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ)
[Surat Aal-E-Imran ৮৪]
অর্থাৎ, বল, আমরা আল্লাহতে এবং আমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তার বংশধরদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল তাতে ঈমান এনেছি। (৩: ৮৪)
এই আলিমগণ মনে করেন যে, اسباط বা বংশধর বলতে ইয়াকূব (عليه السلام)-এর বাকি এগার পুত্রকে বুঝান হয়েছে। কিন্তু তাঁদের এই দলীল মোটেই শক্তিশালী নয়। কেননা اسباط শব্দ দ্বারা বনী ইসরাঈলের বংশকে বুঝানো হয়েছে এবং তাদের মধ্যে যারা নবী ছিলেন যাঁদের প্রতি আসমান থেকে ওহী এসেছে, তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে।
ভ্রাতাদের মধ্যে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-ই যে কেবল নবী ছিলেন ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণিত ইবন উমর (رضي الله عنه)-এর রেওয়ায়ত থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেছেনঃ
ان الكريم ابن الكريم ابن الكريم ابن الكريم يوسف بن يعقوب اسحاق بن ابراهیم
অর্থাৎ, ‘তিনি ছিলেন এক সম্মানিত পুরুষ যিনি আর এক সম্মানিত পুরুষের পুত্র। তিনিও আর এক সম্মানিত পুরুষের পুত্র, আবার তিনি আর এক সম্মানিত পুরুষের পুত্র—ইনি হলেন ইউসুফ (عليه السلام), যিনি ইয়াকূব নবীর পুত্র। আর তিনি ইসহাকের পুত্র এবং তিনি হযরত ইবরাহীমের পুত্র।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) আবদুল ওয়ারিছের সূত্রে এককভাবে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবরাহীম (عليه السلام)-এর কাহিনী আলোচনায় আমরা এ হাদীসের বিভিন্ন সূত্র উল্লেখ করেছি। এখানে তার পুনরুল্লেখ প্রয়োজন নেই। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই। মুফাসসিরিনে কিরাম ও আলিমগণ বলেন, ইউসুফ (عليه السلام) যখন অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক মাত্র, তখন একদা স্বপ্নে দেখেন যেন এগারটি নক্ষত্র (احد عشر كوكبا) যার দ্বারা ইংগিত করা হয়েছে তাঁর এগার ভাইয়ের প্রতি এবং সূর্য ও চন্দ্র (والشمس والقمر) অর্থাৎ তার পিতা-মাতা তাঁকে সিজদা করছেন। স্বপ্ন দেখে তিনি শংকিত হন। ঘুম থেকে জেগে ওঠে পিতার কাছে স্বপ্নটি বর্ণনা করেন। পিতা বুঝতে পারলেন যে, অচিরেই তিনি উচ্চমর্যাদায় আসীন হবেন, দুনিয়া ও আখিরাতের উচ্চ মর্যাদায় ভূষিত হবেন; আর তাঁর পিতা-মাতা এবং ভাইগণ তার অনুগত হবেন। পিতা তাঁকে এ স্বপ্নের কথা গোপন রাখতে বলেন এবং তা ভাইদের কাছে বর্ণনা করতে নিষেধ করেন। যাতে তারা হিংসা না করে এবং ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে না পারে। ইয়াকূব (عليه السلام)-এর এই আশংকা আমাদের উপরের বক্তব্যকে সমর্থন করে। এ জন্যে কোন কোন বর্ণনায় আছেঃ
استعينوا على قضاء حوائجكم بكتمانها فان كل ذي نعمة محسود.
অর্থাৎ‘তোমরা তোমাদের প্রয়োজন পূরণে গোপনীয়তার সাহায্য গ্রহণ কর, কেননা প্রত্যেক নিয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিই হিংসার শিকার হয়ে থাকে। আহলি কিতাবদের মতে, হযরত ইউসুফ (عليه السلام) স্বপ্নের বৃত্তান্ত পিতা ও ভাইদের সাক্ষাতে একত্রে ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু তাদের এ মত ভুল।
(وَكَذَ ٰلِكَ یَجۡتَبِیكَ رَبُّكَ)
[Surat Yusuf ৬]
(এভাবেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে মনোনীত করবেন।) অর্থাৎ যেভাবে তোমাকে এই তাৎপর্যবহ স্বপ্ন দেখানো হয়েছে যখন তুমি একে গোপন করে রাখবে তখন তোমার প্রতিপালক তোমাকে এর জন্যে মনোনীত করবেন। (یَجۡتَبِیكَ رَبُّكَ) অর্থাৎ বিভিন্ন রকম অনুগ্রহ ও রহমত তোমাকে বিশেষভাবে দান করবেন। وَیُعَلِّمُكَ مِن تَأۡوِیلِ) ٱلۡأَحَادِیثِ) (আর তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিবেন। অর্থাৎ কথার গুঢ়তত্ত্ব ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা বোঝবার শক্তি দান করবেন—যা অন্য লোকের পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে না। (وَیُتِمُّ نِعۡمَتَهُۥ عَلَیۡكَ) তাঁর নিয়ামত তোমার উপর পূর্ণ করে দিবেন। অর্থাৎ ওহীরূপ নিয়ামত তোমাকে দান করবেন। (وَعَلَىٰۤ ءَالِ یَعۡقُوبَ) (আর ইয়াকূবের পরিবারবর্গের উপর) অর্থাৎ তোমার ওসীলায় ইয়াকূবের পরিবারবর্গ দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণপ্রাপ্ত হবে। (كَمَاۤ أَتَمَّهَا عَلَىٰۤ أَبَوَیۡكَ مِن قَبۡلُ إِبۡرَ ٰهِیمَ وَإِسۡحَـٰقَۚ) (যেমনিভাবে এর পূর্বে তোমার পিতৃ-পুরুষ ও ইবরাহীম ও ইসহাকের উপর তা পূর্ণ করেছিলেন) অর্থাৎ আল্লাহ তোমাকে নিয়ামতে পূর্ণ করবেন ও নবুওত দান করবেন। যেভাবে তা দান করেছেন তোমার পিতা ইয়াকূবকে, পিতামহ ইসহাককে ও প্রপিতামহ ইবরাহীম খলীলুল্লাহকে (إِنَّ رَبَّكَ عَلِیمٌ حَكِیمࣱ) (নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়)। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন,
(ٱللَّهُ أَعۡلَمُ حَیۡثُ یَجۡعَلُ رِسَالَتَهُۥۗ)
[Surat Al-An’am ১২৪]
(আল্লাহই ভাল জানেন যে, রিসালাতের দায়িত্ব তিনি কাকে অর্পণ করবেন।)
এ কারণে রসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে যখন জিজ্ঞেস করা হয় কোন ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা সম্মানিত? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ইউসুফ—যিনি নিজে আল্লাহর নবী, আর এক আল্লাহর নবীর পুত্র। তিনিও আল্লাহর নবীর পুত্র এবং তিনি আল্লাহর খলীলের পুত্র। ইবন জারীর ও ইবন আবী হাতিম (رحمة الله) তাদের তাফসীরে এবং আবূ ইয়ালা ও বাযযার তাঁদের মুসনাদে জাবির (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট একবার এক ইহুদী আগমন করে-তাকে বুসতানাতুল ইহুদী বলে অভিহিত করা হতো। সে বলল, হে মুহাম্মদ! সেই নক্ষত্রগুলোর নাম কি, যেগুলোকে ইউসুফ (عليه السلام) সিজদাবনত দেখেছিলেন? রসূলুল্লাহ (ﷺ) কোন প্রকার উত্তর না দিয়ে নীরব থাকলেন। কিছুক্ষণ পর জিবরাঈল (عليه السلام) ঐ নামগুলোসহ অবতরণ করেন। রসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন লোকটিকে ডেকে আনেন ও জিজ্ঞেস করেন। আমি যদি ঐ নামগুলো তোমাকে বলতে পারি তাহলে কি তুমি ঈমান আনবে? সে বলল, হ্যাঁ। রসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, এগুলোর নাম হল জিরয়ান, তারিক, দিয়াল, যুল কাতিফান, কাবিস, উছাব, উমরদান, ফায়লাক, মুসবিহ, দারূহ, যুল-ফারা’, দিয়া ও নূর। ইহুদী লোকটি বলল, আল্লাহর কসম, এগুলোই সেই নক্ষত্রসমূহের নাম। এ বর্ণনায় একজন রাবী হাকাম ইবন যুহায়রকে মুহাদ্দিসগণ যঈফ বলে অভিহিত করেছেন।
আবূ ইয়ালার বর্ণনায় আছে যে, ইউসুফ (عليه السلام) যখন তাঁর স্বপ্নের কথা পিতাকে শোনান তখন পিতা বলেছিলেন, এ বিষয়টি বিক্ষিপ্ত, আল্লাহ একে সমন্বিত করে বাস্তবে রূপ দান করবেন।’ রাবী বলেন, সূর্য বলতে এখানে তাঁর পিতাকে এবং চন্দ্র বলতে তাঁর মাতাকে বুঝানো হয়েছে।
(۞ لَّقَدۡ كَانَ فِی یُوسُفَ وَإِخۡوَتِهِۦۤ ءَایَـٰتࣱ لِّلسَّاۤىِٕلِینَ إِذۡ قَالُوا۟ لَیُوسُفُ وَأَخُوهُ أَحَبُّ إِلَىٰۤ أَبِینَا مِنَّا وَنَحۡنُ عُصۡبَةٌ إِنَّ أَبَانَا لَفِی ضَلَـٰلࣲ مُّبِینٍ ٱقۡتُلُوا۟ یُوسُفَ أَوِ ٱطۡرَحُوهُ أَرۡضࣰا یَخۡلُ لَكُمۡ وَجۡهُ أَبِیكُمۡ وَتَكُونُوا۟ مِنۢ بَعۡدِهِۦ قَوۡمࣰا صَـٰلِحِینَ قَالَ قَاۤىِٕلࣱ مِّنۡهُمۡ لَا تَقۡتُلُوا۟ یُوسُفَ وَأَلۡقُوهُ فِی غَیَـٰبَتِ ٱلۡجُبِّ یَلۡتَقِطۡهُ بَعۡضُ ٱلسَّیَّارَةِ إِن كُنتُمۡ فَـٰعِلِینَ)[Surat Yusuf ৭ - ১০]
অর্থাৎ, ইউসুফ এবং তার ভাইদের ঘটনায় জিজ্ঞাসুদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। স্মরণ কর, তারা বলেছিল, ইউসুফ ও তার ভাই আমাদের পিতার নিকট আমাদের অপেক্ষা অধিক প্রিয়। অথচ আমরা একটি সুসংহত দল; আমাদের পিতা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই আছেন। ইউসুফকে হত্যা কর অথবা তাকে কোন স্থানে ফেলে আস। ফলে তোমাদের পিতার দৃষ্টি শুধু তোমাদের প্রতিই নিবিষ্ট থাকবে। এরপর তোমরা ভাল লোক হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে একজন বলল, ইউসুফকে হত্যা করো না এবং তোমরা যদি কিছু করতেই চাও তাকে কোন গভীর কূপে নিক্ষেপ কর। যাত্রীদলের কেউ তাকে তুলে নিয়ে যাবে। (১২: ৭-১০)
এ কাহিনীতে যেসব নির্দশন, হিকমত, ইশারা-ইংগিত, উপদেশ ও স্পষ্ট দলিল-প্রমাণ রয়েছে আল্লাহ তা অবহিত করেছেন। এরপর ইউসুফ ও তাঁর সহোদর ভাই বিন-য়ামীনের প্রতি পিতার স্নেহ-মমতার ব্যাপারে অন্য ভাইদের হিংসার কথা উল্লেখ করেছেন। এ হিংসার কারণ ছিল তারা একটি সংহত দল হওয়া সত্ত্বেও পিতা ইউসুফ ও বিন-য়ামীনকে অধিক ভালবাসেন। তাদের দাবি এই যে, আমরা একটি সংহত দল হিসাবে ঐ দু’জনের চেয়ে আমরাই অধিক ভালবাসা পাওয়ার হকদার। ( إِنَّ أَبَانَا لَفِی ضَلَـٰلࣲ مُّبِینٍ)
[Surat Yusuf ৮] (আমাদের পিতা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছেন।) তিনি আমাদের থেকে ঐ দু’জনকে বেশি ভালবাসেন। অতঃপর তারা পরামর্শ করল, ইউসুফকে হত্যা করবে নাকি দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসবে, যেখান থেকে আর কোন দিন সে ফিরে আসতে পারবে না। এতে পিতার পূর্ণ স্নেহ-মমতা কেবল তাদের প্রতিই নিবদ্ধ থাকবে। অবশ্য পরবর্তীতে তারা তওবা করে নেয়ারও গোপন ইচ্ছা পোষণ করেছিল। এই সিদ্ধান্তের উপর যখন তারা ঐক্যবদ্ধ হল তখন
(قَالَ قَاۤىِٕلࣱ مِّنۡهُمۡ)
[Surat Yusuf ১০]
তাদের মধ্যে একজন বলল, মুজাহিদের মতে সেই ব্যক্তির নাম শামউন; সুদ্দীর মতে য়াহূযা এবং কাতাদা ও ইবন ইসহাকের মতে রাবীল—যে ছিল তাদের মধ্যে বয়সে বড়।
لَا تَقۡتُلُوا۟ یُوسُفَ وَأَلۡقُوهُ فِی غَیَـٰبَتِ ٱلۡجُبِّ یَلۡتَقِطۡهُ بَعۡضُ ٱلسَّیَّارَةِ (ইউসুফকে হত্যা কর না বরং কোন গভীর কূপে নিক্ষেপ কর। হয়ত কোন পথিক তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে) إِن كُنتُمۡ فَـٰعِلِینَ (যদি তোমরা কিছু করতেই চাও) অর্থাৎ তোমরা যা বলছ তা যদি একান্তই করতে চাও তবে আমার দেয়া প্রস্তাব গ্রহণ কর। তাকে হত্যা করা বা দূরে ফেলে আসার চাইতে এটা করাই উত্তম। ফলে তারা সবাই এ প্রস্তাবে একমত হয়।
(قَالُوا۟ یَـٰۤأَبَانَا مَا لَكَ لَا تَأۡمَ۬نَّا عَلَىٰ یُوسُفَ وَإِنَّا لَهُۥ لَنَـٰصِحُونَ أَرۡسِلۡهُ مَعَنَا غَدࣰا یَرۡتَعۡ وَیَلۡعَبۡ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَـٰفِظُونَ قَالَ إِنِّی لَیَحۡزُنُنِیۤ أَن تَذۡهَبُوا۟ بِهِۦ وَأَخَافُ أَن یَأۡكُلَهُ ٱلذِّئۡبُ وَأَنتُمۡ عَنۡهُ غَـٰفِلُونَ قَالُوا۟ لَىِٕنۡ أَكَلَهُ ٱلذِّئۡبُ وَنَحۡنُ عُصۡبَةٌ إِنَّاۤ إِذࣰا لَّخَـٰسِرُونَ)[Surat Yusuf ১১ - ১৪]
অর্থাৎ, অতঃপর তারা বলল, হে আমাদের পিতা! ইউসুফের ব্যাপারে তুমি আমাদেরকে বিশ্বাস করছ না কেন? যদিও আমরা তার শুভাকাঙ্ক্ষী? আগামীকাল তুমি তাকে আমাদের সঙ্গে প্রেরণ কর, সে ফল-মূল খাবে ও খেলাধুলা করবে। আমরা তার রক্ষণাবেক্ষণ করব। সে বলল, এটা আমাকে কষ্ট দিবে যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে এবং আমি আশংকা করি, তোমরা তার প্রতি অমনোযোগী হলে তাকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলবে। তারা বলল, আমরা একটি সংহত দল হওয়া সত্ত্বেও যদি নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলে, তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তই হব। (১২: ১১-১৪)
পুত্ররা পিতার কাছে আবদার করল যে, তিনি যেন তাদের সাথে ভাই ইউসুফকে যেতে দেন। তাদের উদ্দেশ্য জানাল যে, সে তাদের সাথে পশু চরাবে, খেলাধুলা ও আনন্দ-ফুর্তি করবে। তারা অন্তরে এমন কথা গোপন করে রাখল, যে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত ছিলেন। বৃদ্ধ পিতা তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তর দিলেন, হে পুত্রগণ! আমার কাছ থেকে সামান্য সময়ের জন্যেও তার বিচ্ছিন্ন হওয়া আমাকে বড়ই পীড়া দেয়। এছাড়া আমার আরও আশংকা হয় যে, তোমরা খেলাধুলায় মত্ত হয়ে পড়লে সেই সুযোগে নেকড়ে বাঘ এসে তাকে খেয়ে যাবে। আর তোমরা তা প্রতিহত করতে পারবে না অসতর্ক থাকার কারণে এবং সেও পারবে না অল্প বয়স্ক হওয়ার কারণে।
قَالُوا۟ لَىِٕنۡ أَكَلَهُ ٱلذِّئۡبُ وَنَحۡنُ عُصۡبَةٌ إِنَّاۤ إِذࣰا لَّخَـٰسِرُونَ)
(তারা বলল, যদি নেকড়ে বাঘে তাকে খেয়ে ফেলে, অথচ আমরা একটা সংহত দল, তাহলে তো আমরা বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হব।) অর্থাৎ বাঘ যদি তার উপর আক্রমণ করে ও আমাদের মাঝ থেকে নিয়ে খেয়ে ফেলে কিংবা আমাদের অসতর্ক থাকার কারণে এরূপ ঘটনা ঘটে যায়, অথচ আমরা একটি সংহত দল তথায় বিদ্যমান, তা হলে তা আমরা অক্ষম ও দুর্ভাগা বলে পরিগণিত হব।
আহলি কিতাবদের মতে, হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) পুত্র ইউসুফকে তার ভাইদের পেছনে পেছনে প্রেরণ করেন। কিন্তু ইউসুফ পথ হারিয়ে ফেলেন। পরে অন্য এক ব্যক্তি তাঁকে তাঁর ভাইদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। কিন্তু এটি তাদের একটি ভ্রান্তি বিশেষ। কেননা, ইয়াকূব (عليه السلام) ইউসুফকে এতই বেশি ভালবাসতেন যে, তিনি তাঁকে তাদের সাথে পাঠাতেই চাচ্ছিলেন না, সুতরাং তিনি তাকে একা পাঠাবেন কি করে?
(فَلَمَّا ذَهَبُوا۟ بِهِۦ وَأَجۡمَعُوۤا۟ أَن یَجۡعَلُوهُ فِی غَیَـٰبَتِ ٱلۡجُبِّۚ وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَیۡهِ لَتُنَبِّئَنَّهُم بِأَمۡرِهِمۡ هَـٰذَا وَهُمۡ لَا یَشۡعُرُونَ وَجَاۤءُوۤ أَبَاهُمۡ عِشَاۤءࣰ یَبۡكُونَ قَالُوا۟ یَـٰۤأَبَانَاۤ إِنَّا ذَهَبۡنَا نَسۡتَبِقُ وَتَرَكۡنَا یُوسُفَ عِندَ مَتَـٰعِنَا فَأَكَلَهُ ٱلذِّئۡبُۖ وَمَاۤ أَنتَ بِمُؤۡمِنࣲ لَّنَا وَلَوۡ كُنَّا صَـٰدِقِینَ وَجَاۤءُو عَلَىٰ قَمِیصِهِۦ بِدَمࣲ كَذِبࣲۚ قَالَ بَلۡ سَوَّلَتۡ لَكُمۡ أَنفُسُكُمۡ أَمۡرࣰاۖ فَصَبۡرࣱ جَمِیلࣱۖ وَٱللَّهُ ٱلۡمُسۡتَعَانُ عَلَىٰ مَا تَصِفُونَ)
[Surat Yusuf ১৫ - ১৮]
অর্থাৎ, অতঃপর ওরা যখন তাকে নিয়ে গেল এবং তাকে গভীর কূপে নিক্ষেপ করতে একমত হল, এমতাবস্থায় আমি তাকে জানিয়ে দিলাম, তুমি ওদেরকে ওদের এই কর্মের কথা অবশ্যই বলে দিবে যখন ওরা তোমাকে চিনবে না। ওরা রাতে কাঁদতে কাঁদতে পিতার নিকট আসল। তারা বলল, হে আমাদের পিতা! আমরা দৌড়ে প্রতিযোগিতা করছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের মালপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম, অতঃপর নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলেছে; কিন্তু তুমি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবে না, যদিও আমরা সত্যবাদী। ওরা তার জামায় মিথ্যা রক্ত লেপন করে এনেছিল। সে বলল, না, তোমাদের মন তোমাদের জন্যে একটি কাহিনী সাজিয়ে দিয়েছে। সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল। (সূরা ইউসুফঃ ১৫-১৮)।
ইউসুফের ভাইয়েরা পিতাকে পীড়াপীড়ি করতে থাকলে তিনি ইউসুফ (عليه السلام)-কে তাদের সাথে পাঠিয়ে দেন। পিতার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলে তারা ইউসুফকে মুখে গালাগালি করতে থাকে এবং হাতের দ্বারা লাঞ্ছনা-গঞ্জনা দিতে থাকে। অবশেষে এক গভীর কূপে নিক্ষেপ করার ব্যাপারে একমত হয় এবং কূপের মুখে যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে পানি তোলা হয় সেই পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে তারা ইউসুফ (عليه السلام)-কে কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করে দেয়। তখন আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দেয় যে, তোমাকে এ দুরবস্থা থেকে অবশ্যই উদ্ধার করা হবে এবং তাদের এই দুষ্কর্মের কথা এমন এক অবস্থায় তাদেরকে তুমি জানাবার সুযোগ পাবে, যখন তুমি হবে ক্ষমতাশালী আর তারা হবে তোমার মুখাপেক্ষী এবং ভীত-সন্ত্রস্ত। কিন্তু তারা টেরও পাবে না।
মুজাহিদ ও কাতাদা (رحمة الله)-এর মতে, لَا یَشۡعُرُونَ (তারা জানবে না) অর্থাৎ আল্লাহ ইউসুফ (عليه السلام)-কে ওহীর মাধ্যমে এ বিষয়ে যা বলবেন তা তার ভাইয়েরা জানবে না। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর মতে لَا یَشۡعُرُونَ অর্থ হল, তুমি তাদেরকে এমন এক সময়ে তাদের এ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানাবে যখন তারা তোমাকে চিনবে না। ইবন জারীর (رحمة الله) এটা বর্ণনা করেছেন। ইউসুফ (عليه السلام)-কে কূপে নিক্ষেপ করে তারা তার জামায় কিছু রক্ত মেখে রাত্রিকালে কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে ফিরে এল। এ জন্যে কোন কোন প্রাচীন বিজ্ঞজন বলেছেন, অত্যাচারের অভিযোগকারীর কান্নাকাটিতে প্রতারিত হয়ো না। কেননা, বহু অত্যাচারীও এমন আছে যারা প্রতারণাপূর্ণ কান্নাকাটি করে থাকে। এ প্রসঙ্গে তারা ইউসুফ (عليه السلام)-এর ভাইদের কান্নাকাটির কথা উল্লেখ করেন। ইউসুফ (عليه السلام)-এর ভাইয়েরা রাত্রিকালে অন্ধকারের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে হাযির হয়। অন্ধকার রাত্রে আসার উদ্দেশ্য ছিল তাদের বিশ্বাস ঘাতকতাকে আড়ালে রেখে প্রতারণার চেষ্টা করা, ওজর প্রকাশ করা নয়।।
قَالُوا۟ یَـٰۤأَبَانَاۤ إِنَّا ذَهَبۡنَا نَسۡتَبِقُ وَتَرَكۡنَا یُوسُفَ عِندَ مَتَـٰعِنَا
(তারা আরজ করল, হে পিতা! আমরা দৌড়ে প্রতিযোগিতা করছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের মালামাল অর্থাৎ কাপড়-চোপড়ের কাছে রেখে গিয়েছিলাম) فَأَكَلَهُ ٱلذِّئۡبُۖ (তখন তাকে নেকড়ে বাঘে খেয়ে ফেলে) অর্থাৎ দৌড় প্রতিযোগিতার সময় যখন আমরা তার থেকে দূরে চলে যাই তখন তাকে বাঘে খেয়ে ফেলে। وَمَاۤ أَنتَ بِمُؤۡمِنࣲ لَّنَا وَلَوۡ كُنَّا صَـٰدِقِینَ (কিন্তু আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না। যদিও আমরা সত্য কথাই বলছি) অর্থাৎ ইউসুফ (عليه السلام)-কে বাঘে খেয়েছে আমাদের এ সংবাদ আপনি বিশ্বাস করবেন না। আপনার কাছে ইতিপূর্বে আমরা কোন বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হইনি, তবে এ ব্যাপারে আমাদেরকে কিভাবে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিযুক্ত করবেন। কারণ বাঘে খাওয়ার ব্যাপারে আপনি আশংকা প্রকাশ করেছিলেন। আর আমরা তাঁকে নিজেদের দায়িত্বে গ্রহণ করেছিলাম যে, আমরা থাকতে তাঁকে বাঘে খেতে পারবে না। কেননা, আমরা সংখ্যায় অধিক। সুতরাং আমরা সত্যবাদী হিসেবে আপনার কাছে প্রমাণিত হতে পারিনি। সে কারণে আমাদেরকে সত্যবাদী না ভাবাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আসল ঘটনা তো এরূপই। وَجَاۤءُو عَلَىٰ قَمِیصِهِۦ (তারা ইউসুফের জামায় মিথ্যা রক্ত মাখিয়ে আসল) তারা একটি বকরীর বাচ্চা যবেহ করে জামায় রক্ত মাখিয়ে আনে। যাতে এই ধারণা দিতে পারে যে, তাকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। তারা রক্ত মাখিয়েছিল বটে কিন্তু জামা ছিড়তে ভুলে গিয়েছিল। বস্তুত মিথ্যার সমস্যাই হল ভুলে যাওয়া (افة الكذب النسيان) তাদের উপর সন্দেহের লক্ষণাদি যখন স্পষ্ট হয়ে উঠল, তখন তাদের এ কাজ পিতাকে আর প্রতারিত করতে পারেনি। কেননা, ইউসুফের মধ্যে শিশুকালেই যেসব মহৎ গুণাবলী ও নবীসুলভ লক্ষণাদি ফুটে উঠেছিল এবং যার দরুন পিতা তাকে অন্যদের তুলনায় অধিক ভালবাসতেন, এ কারণে ইউসুফের প্রতি অন্য ভাইদের হিংসা ও শত্রুতার ব্যাপারে তিনি অবহিত ছিলেন। পিতার কাছ থেকে ফুসলিয়ে নিয়ে তাঁর চোখের আড়ালে নিয়ে তারা ইউসুফকে গায়েব করে দেয় এবং আসল ঘটনা ঢাকা দেওয়ার জন্য তারা কান্নার ভান করে পিতার কাছে আসলে পিতা বললেনঃ
بَلۡ سَوَّلَتۡ لَكُمۡ أَنفُسُكُمۡ أَمۡرࣰاۖ فَصَبۡرࣱ جَمِیلࣱۖ وَٱللَّهُ ٱلۡمُسۡتَعَانُ عَلَىٰ مَا تَصِفُونَ
অর্থাৎ, বরং তোমরা নিজেরাই একটা বিষয় সাজিয়ে নিয়েছ সুতরাং আমি পূর্ণ ধৈর্য ধারণ করছি। তোমরা যা কিছু বলছ সে বিষয়ে আল্লাহর কাছেই আমি সাহায্য প্রার্থনা করছি।
আহলি কিতাবদের মতে, রুবীল পরামর্শ দিয়েছিল যে, ইউসুফকে কূপের মধ্যে রাখা হোক। তার উদ্দেশ্য ছিল যে, অন্য ভাইদের অজান্তে তাকে পিতার কাছে ফিরিয়ে দিবে। কিন্তু ভাইয়েরা রুবীলকে ফাঁকি দিয়ে কাফেলার নিকট তাঁকে বিক্রি করে দেয়। দিনের শেষে যখন রুবীল ইউসুফ (عليه السلام)-কে উঠিয়ে আনতে যান, তখন তাকে কূপের মধ্যে পেলেন না। তখন তিনি চিৎকার করে উঠেন এবং নিজের জামা ছিড়ে ফেলেন। আর অন্য ভাইয়েরা একটা বকরী যবেহ্ করে ইউসুফ (عليه السلام)-এর জামায় রক্ত মাখিয়ে আনে। হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) ইউসুফের খবর শুনে নিজের কাপড় ছিড়ে ফেলেন ও কাল লুঙ্গি পরে নিলেন এবং দীর্ঘ দিন যাবত পুত্র-শোকে বিহবল থাকেন। তাদের এ ব্যাখ্যা ত্রুটিপূর্ণ এবং এ চিত্রায়ন ভ্রান্তি-প্রসূত।
অতঃপর আল্লাহ বলেনঃ
(وَجَاۤءَتۡ سَیَّارَةࣱ فَأَرۡسَلُوا۟ وَارِدَهُمۡ فَأَدۡلَىٰ دَلۡوَهُۥۖ قَالَ یَـٰبُشۡرَىٰ هَـٰذَا غُلَـٰمࣱۚ وَأَسَرُّوهُ بِضَـٰعَةࣰۚ وَٱللَّهُ عَلِیمُۢ بِمَا یَعۡمَلُونَ وَشَرَوۡهُ بِثَمَنِۭ بَخۡسࣲ دَرَ ٰهِمَ مَعۡدُودَةࣲ وَكَانُوا۟ فِیهِ مِنَ ٱلزَّ ٰهِدِینَ وَقَالَ ٱلَّذِی ٱشۡتَرَىٰهُ مِن مِّصۡرَ لِٱمۡرَأَتِهِۦۤ أَكۡرِمِی مَثۡوَىٰهُ عَسَىٰۤ أَن یَنفَعَنَاۤ أَوۡ نَتَّخِذَهُۥ وَلَدࣰاۚ وَكَذَ ٰلِكَ مَكَّنَّا لِیُوسُفَ فِی ٱلۡأَرۡضِ وَلِنُعَلِّمَهُۥ مِن تَأۡوِیلِ ٱلۡأَحَادِیثِۚ وَٱللَّهُ غَالِبٌ عَلَىٰۤ أَمۡرِهِۦ وَلَـٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا یَعۡلَمُونَ وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُۥۤ ءَاتَیۡنَـٰهُ حُكۡمࣰا وَعِلۡمࣰاۚ وَكَذَ ٰلِكَ نَجۡزِی ٱلۡمُحۡسِنِینَ)[Surat Yusuf ১৯ - ২২]
অর্থাৎ, এক যাত্রীদল আসল, তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে প্রেরণ করল; সে তার পানির ডোল নামিয়ে দিল। সে বলে উঠল, কী সুখবর! এ যে এক কিশোর! ওরা তাকে পণ্যরূপে লুকিয়ে রাখল; ওরা যা করছিল সে বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত ছিলেন। ওরা তাকে বিক্রি করল স্বল্পমূল্যে মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে। মিসরের যে ব্যক্তি তাকে ক্রয় করেছিল, সে তার স্ত্রীকে বলল, ‘সম্মানজনকভাবে এর থাকার ব্যবস্থা কর, সম্ভবত সে আমাদের উপকারে আসবে অথবা আমরা ওকে পুত্ররূপেও গ্রহণ করতে পারি।’ এবং এভাবে আমি ইসুফকে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম তাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেয়ার জন্যে। আল্লাহ তার কার্য সম্পাদনে অপ্রতিহত; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা অবগত নয়। সে যখন পূর্ণ যৌবনে উপনীত হল, তখন আমি তাকে ‘হিকমত ও জ্ঞান দান করলাম। এবং এভাবেই আমি সৎকর্ম পরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করি। (১২: ১৯-২২)
এখানে আল্লাহ তাআলা ইউসুফ (عليه السلام)-কে যখন কূপে ফেলা হয় তখনকার ঘটনা বর্ণনা করছেন যে, তিনি আল্লাহর তরফ থেকে বিপদমুক্তি ও তার করুণার প্রতীক্ষা করছিলেন। তখন একটি যাত্রীদল এসে উপস্থিত হলো।
আহলি কিতাবগণ বলেন, গমনকারী ঐ কাফেলার সাথে মালামাল ছিল পেস্তা, খেজুর ও তারপিন। তারা সিরিয়া থেকে মিসরে যাচ্ছিল। ঐ স্থানে এসে তারা একজনকে উক্ত কূয়া থেকে পানি আনার জন্যে পাঠায়। সে কুয়ার মধ্যে বালতি ফেললে ইউসুফ তা আঁকড়ে ধরেন। লোকটি তাঁকে দেখেই বলে উঠল یَـٰبُشۡرَىٰ (কী আনন্দের ব্যাপার!) هَـٰذَا غُلَـٰمࣱۚ (এতো একটি কিশোর) وَأَسَرُّوهُ بِضَـٰعَةࣰۚ (এবং তারা তাকে পণ্যদ্রব্য হিসেবে লুকিয়ে রাখল)। অর্থাৎ তাদের অনান্য ব্যবসায়িক পণ্যের সাথে একেও একটি পণ্য বলে দেখালো। وَٱللَّهُ عَلِیمُۢ بِمَا یَعۡمَلُونَ (তারা যা কিছু করছিল আল্লাহ তা ভালরূপেই জানেন) অর্থাৎ ইউসুফের সাথে তার ভাইদের আচরণ এবং কাফেলা কর্তৃক পণ্যের মাল হিসেবে লুকিয়ে রাখা সবই আল্লাহ দেখছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এর পরিবর্তন করছিলেন না। কেননা এর মধ্যেই নিহিত ছিল বিরাট তাৎপর্য এবং এটা ছিল পূর্ব নির্ধারিত। আর মিসরীয়দের জন্যে এই কিশোর ছিলেন রহমতস্বরূপ, যে কিশোর আজ সেখানে প্রবেশ করছেন বন্দী কৃতদাস রূপে, পরবর্তীতে ঐ কিশোরই হবে সে দেশের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। এই কিশোরের সাহায্যেই তারা দুনিয়ায় ও আখিরাতে সীমা-সংখ্যাহীন কল্যাণ লাভ করবে। ইউসুফ (عليه السلام)-এর ভাইয়েরা যখন জানল যে, একটি কাফেলা ইউসুফ (عليه السلام)-কে কূয়া থেকে তুলে নিয়েছে, তখন তারা কাফেলার সাথে সাক্ষাৎ করল এবং বলল, এ ছেলেটি আমাদের গোলাম, পালিয়ে এসেছে। তখন তারা ইউসুফ (عليه السلام)-কে ভাইদের কাছ থেকে কিনে নিল। بِثَمَنِۭ بَخۡسࣲ (স্বল্প মূল্যে) স্বল্পমূল্যে মানে। কম মূল্য, কেউ কেউ এর অর্থ মেকী মুদ্রা বলেছেন।
دَرَ ٰهِمَ مَعۡدُودَةࣲ وَكَانُوا۟ فِیهِ مِنَ ٱلزَّ ٰهِدِینَ (মাত্র কয়েকটি দিরহামের বিনিময়ে এবং এ ব্যাপারে তারা ছিল নির্লোভ) ইবন মাসউদ, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) নাওফুল বাকালী, সুদ্দী, কাতাদা ও আতিয়্যাতুল আওফী (رحمة الله) বলেন, তারা বিশ দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে। ইউসুফ (عليه السلام)-এর প্রত্যেক ভাই ভাগে দুই দুই দিরহাম করে পায়। মুজাহিদের মতে, তারা বাইশ দিরহামে এবং ইকরামা ও মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের মতে চল্লিশ দিরহামে বিক্রি করে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
وَقَالَ ٱلَّذِی ٱشۡتَرَىٰهُ مِن مِّصۡرَ لِٱمۡرَأَتِهِۦۤ أَكۡرِمِی مَثۡوَىٰهُ (মিসরের যে লোকটি তাকে ক্রয় করেছিল সে তার স্ত্রীকে বলেছিল, একে উত্তম ভাবে থাকার ব্যবস্থা কর।) অর্থাৎ যত্ন সহকারে রাখ। عَسَىٰۤ أَن یَنفَعَنَاۤ أَوۡ نَتَّخِذَهُۥ وَلَدࣰاۚ (সম্ভবত এ আমাদের কল্যাণে আসবে কিংবা আমরা একে পুত্র বানিয়ে রাখব।) এটা ছিল আল্লাহর বিশেষ রহমত, করুণা ও অনুগ্রহ—যে ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি তাঁকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ দান করতে চেয়েছিলেন।
আহলি কিতাবরা বলে, মিসরের যে ব্যক্তি ইউসুফ (عليه السلام)-কে খরীদ করেছিলেন তিনি ছিলেন মিসরের ‘আযিয’ অর্থাৎ অর্থমন্ত্রী। ইবন ইসহাকের মতে, তাঁর নাম আতফীর ইবন রূহায়ব। ঐ সময় মিসরের বাদশাহ ছিলেন রায়্যান ইবন ওলীদ, তিনি ছিলেন আমালিক বংশোদ্ভূত। ইবন ইসহাকের মতে, আযীযের স্ত্রীর নাম রাঈল বিনত রা‘আঈল (راعيل بنت رعاييل) অন্যদের মতে যুলায়খা। বলাবাহুল্য, যুলায়খা তার উপাধি ছিল। ছা’লাবী আবু হিশাম রিফাই (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আযীযের স্ত্রীর নাম ফাকা বিনত য়ানূস। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি ইউসুফ (عليه السلام)-কে মিসরে নিয়ে বিক্রি করেছিল তার নাম মালিক ইবন যা’আর ইবন নুওয়ায়ব ইবন আফাকা ইবন মাদয়ান ইবন ইবরাহীম। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
ইবন ইসহাক (رحمة الله) ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ মানব জাতির মধ্যে তিনজন লোক সব চাইতে দূরদর্শীঃ (১) মিসরের আযীয যখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন একে সযত্নে রাখ; (২) সেই বালিকা যে তার পিতাকে মূসা (عليه السلام) সম্পর্কে বলেছিল; (হে পিতা! তাকে কাজে নিযুক্ত করুন। কারণ, আপনার মজুর হিসেবে সে ব্যক্তিই উত্তম হবে যে হবে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত। (২৮ কাসাসঃ ২৬) (৩) হযরত আবু বকর (رضي الله عنه), যখন তিনি হযরত উমর (رضي الله عنه)-কে খলীফা নিযুক্ত করেন।
কথিত আছে, ‘আযীয’ ইউসুফ (عليه السلام)-কে বিশ দীনারের বিনিময়ে ক্রয় করেছিলেন। কিন্তু কেউ কেউ বলেছেন, তাঁর সম ওজনের মিশক, সম ওজনের রেশম ও সম ওজনের রৌপ্যের বিনিময়ে ক্রয় করেছিলেন। আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত।
আল্লাহর বাণীঃ وَكَذَ ٰلِكَ مَكَّنَّا لِیُوسُفَ فِی ٱلۡأَرۡضِ (এভাবে আমি ইউসুফকে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম) যেমন এই আযীয ও তাঁর স্ত্রীকে ইউসুফ (عليه السلام)-এর সেবাযত্নে ও সাহায্য-সহযোগিতার জন্য নির্ধারণ করার মাধ্যমে মিসরের বুকে তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। وَلِنُعَلِّمَهُۥ مِن تَأۡوِیلِ ٱلۡأَحَادِیثِۚ (এবং তাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিলাম) অর্থাৎ স্বপ্নের তত্ত্বজ্ঞান ও তার ব্যাখ্যা وَٱللَّهُ غَالِبٌ عَلَىٰۤ أَمۡرِهِۦ (আল্লাহ তাঁর কার্য-সম্পাদনে অপ্রতিহত) অর্থাৎ আল্লাহ যখন কোন সিদ্ধান্ত নেন, তখন তা বাস্তবায়িত হয়েই থাকে। কেননা, তিনি তা বাস্তবায়নের জন্যে এমন উপায় নির্ধারণ করে দেন, যা মানুষের কল্পনার বাইরে। এ কারণেই আল্লাহ বলেছেনঃ وَلَـٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا یَعۡلَمُونَ (কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা অবগত নয়) وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُۥۤ ءَاتَیۡنَـٰهُ حُكۡمࣰا وَعِلۡمࣰاۚ وَكَذَ ٰلِكَ نَجۡزِی) সে যখন পূর্ণ যৌবনে উপনীত হল তখন আমি তাকে হিকমত ও জ্ঞান দান করলাম এবং এভাবেই আমি সৎকর্ম পরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি।)
এ কথা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইতিপূর্বের সমস্ত ঘটনা হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর পূর্ণ যৌবন প্রাপ্তির পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল। অর্থাৎ ৪০ বছর বয়সের পূর্বে। কেননা, চল্লিশ বছর বয়সকালে নবীদের প্রতি ওহী প্রেরিত হয়।
কত বছর বয়সে পূর্ণ যৌবন প্রাপ্তি ঘটে, সে ব্যাপারে আলেমগণের মধ্যে মতভেদ আছে। ইমাম মালিক, রাবীআ, যায়দ ইবন আসলাম ও শা’বী বলেন, পূর্ণ যৌবন প্রাপ্তি বলতে বালেগ হওয়া বুঝায়। সাঈদ ইবন জুবায়রের মতে, তা আঠার বছর। দাহ্হাকের মতে বিশ বছর; ইকরিমার মতে পঁচিশ বছর; সুদ্দীর মতে ত্রিশ বছর; ইবন আব্বাস, মুজাহিদ ও কাতাদা (رضي الله عنه)-এর মতে তেত্রিশ বছর এবং হাসান বসরী (رحمة الله)-এর মতে চল্লিশ বছর। কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত হাসান বসরী (رحمة الله)-এর মতকে সমর্থন করে। (حَتَّىٰۤ إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُۥ وَبَلَغَ أَرۡبَعِینَ سَنَةࣰ)
[Surat Al-Ahqaf ১৫]
(যখন সে যৌবন প্রাপ্ত হল এবং চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হল)। আল্লাহ বলেনঃ
(وَرَ ٰوَدَتۡهُ ٱلَّتِی هُوَ فِی بَیۡتِهَا عَن نَّفۡسِهِۦ وَغَلَّقَتِ ٱلۡأَبۡوَ ٰبَ وَقَالَتۡ هَیۡتَ لَكَۚ قَالَ مَعَاذَ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ رَبِّیۤ أَحۡسَنَ مَثۡوَایَۖ إِنَّهُۥ لَا یُفۡلِحُ ٱلظَّـٰلِمُونَ وَلَقَدۡ هَمَّتۡ بِهِۦۖ وَهَمَّ بِهَا لَوۡلَاۤ أَن رَّءَا بُرۡهَـٰنَ رَبِّهِۦۚ كَذَ ٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ ٱلسُّوۤءَ وَٱلۡفَحۡشَاۤءَۚ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُخۡلَصِینَ وَٱسۡتَبَقَا ٱلۡبَابَ وَقَدَّتۡ قَمِیصَهُۥ مِن دُبُرࣲ وَأَلۡفَیَا سَیِّدَهَا لَدَا ٱلۡبَابِۚ قَالَتۡ مَا جَزَاۤءُ مَنۡ أَرَادَ بِأَهۡلِكَ سُوۤءًا إِلَّاۤ أَن یُسۡجَنَ أَوۡ عَذَابٌ أَلِیمࣱ قَالَ هِیَ رَ ٰوَدَتۡنِی عَن نَّفۡسِیۚ وَشَهِدَ شَاهِدࣱ مِّنۡ أَهۡلِهَاۤ إِن كَانَ قَمِیصُهُۥ قُدَّ مِن قُبُلࣲ فَصَدَقَتۡ وَهُوَ مِنَ ٱلۡكَـٰذِبِینَ وَإِن كَانَ قَمِیصُهُۥ قُدَّ مِن دُبُرࣲ فَكَذَبَتۡ وَهُوَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ فَلَمَّا رَءَا قَمِیصَهُۥ قُدَّ مِن دُبُرࣲ قَالَ إِنَّهُۥ مِن كَیۡدِكُنَّۖ إِنَّ كَیۡدَكُنَّ عَظِیمࣱ یُوسُفُ أَعۡرِضۡ عَنۡ هَـٰذَاۚ وَٱسۡتَغۡفِرِی لِذَنۢبِكِۖ إِنَّكِ كُنتِ مِنَ ٱلۡخَاطِـِٔینَ) [Surat Yusuf ২৩ - ২৯]
অর্থাৎ, সে যে স্ত্রীলোকের ঘরে ছিল সে তার থেকে অসৎকর্ম কামনা করল এবং দরজাগুলো বন্ধ করে দিল ও বলল, ‘এসো। সে বলল, আমি আল্লাহর শরণ নিচ্ছি। তিনি আমার প্রভু; তিনি আমাকে সম্মানজনকভাবে থাকতে দিয়েছিল, সীমালংঘনকারীরা সফলকাম হয় না। সে রমণী তো তার প্রতি আসক্ত হয়েছিল এবং সেও ওর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত যদি না সে তার প্রতিপালকের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করত। তাকে মন্দ কর্ম ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখার জন্যে এভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। সে তো ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। ওরা উভয়ে দৌড়ে দরজার দিকে গেল এবং স্ত্রীলোকটি পেছন থেকে তার জামা ছিড়ে ফেলল। তারা স্ত্রীলোকটির স্বামীকে দরজার কাছে পেল। স্ত্রীলোকটি বলল, যে তোমার পরিবারের সাথে কুকর্ম কামনা করে তাকে কারাগারে প্রেরণ অথবা অন্য কোন মর্মন্তুদ শাস্তি ব্যতীত আর কি দণ্ড হতে পারে?’ ইউসুফ (عليه السلام) বলল, ‘সেই আমা থেকে অসৎকর্ম কামনা করেছিল।’ স্ত্রীলোকটির পরিবারের একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিল, যদি ওর জামার সম্মুখ দিক ছিন্ন করা হয়ে থাকে, তবে স্ত্রীলোকটি সত্য কথা বলেছে এবং পুরুষটি মিথ্যাবাদী। কিন্তু ওর জামা যদি পেছন দিক হতে ছিন্ন করা হয়ে থাকে, তবে স্ত্রী লোকটি মিথ্যা বলেছে এবং পুরুষটি সত্যবাদী। গৃহস্বামী যখন দেখল যে, তার জামা পেছন দিক হতে ছিন্ন করা হয়েছে, তখন সে বলল, এটি তোমাদের নারীদের ছলনা, ভীষণ তোমাদের ছলনা! হে ইউসুফ! তুমি এটি উপেক্ষা কর এবং হে নারী! তোমার অপরাধের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তুমি অপরাধী। (১২: ২৩-২৯)
আযীযের স্ত্রী হযরত ইউসুফের প্রতি আসক্ত হয়ে নিজ কামনা চরিতার্থ করার জন্যে কিভাবে যে ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছিল এখানে আল্লাহ তা উল্লেখ করেছেন। আযীযের স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত রূপসী, ঐশ্বর্যশালী, উচ্চ সামাজিক মর্যাদার এবং ভরা যৌবনের অধিকারিণী। তিনি মূল্যবান জলুসপূর্ণ পোশাক পরিধান ও অঙ্গ-সজ্জা করে ইউসুফ (عليه السلام)-কে আপন কক্ষে রেখে ভবনের সমস্ত দরজা বন্ধ করে তাকে আহ্বান জানান। সর্বোপরি তিনি ছিলেন মন্ত্রীর স্ত্রী। ইবন ইসহাকের মতে, এই মহিলাটি ছিলেন মিসরের বাদশাহ রায়্যান ইবনুল ওলীদের ভাগ্নী। অপরদিকে হযরত ইউসুফ (عليه السلام) ছিলেন অত্যধিক রূপ-সৌন্দর্যে দীপ্তিমান নওজোয়ান। কিন্তু তিনি ছিলেন নবী বংশোদ্ভূত একজন নবী। তাই আল্লাহ তাঁকে এই অশ্লীল কাজ থেকে হেফাজত করেন এবং নারীদের ছলনা থেকে রক্ষা করেন। এর ফলে তিনি সহীহায়নের হাদীসে বর্ণিত সর্বাপেক্ষা মুত্তাকী সাত শ্রেণীর লোকের অন্যতম সর্দার বলে প্রতিপন্ন হন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, যে দিন আল্লাহর (আরশের) ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না, সে দিন সাত শ্রেণীর লোককে আল্লাহ তার ছায়া দান করবেনঃ
(১) ন্যায়পরায়ণ শাসক (২) যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে অশ্রু ঝরায় (৩) যে ব্যক্তি সালাত শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসার পর পুনরায় মসজিদে না যাওয়া পর্যন্ত তার অন্তর মসজিদের সাথে বাঁধা থাকে (৪) সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরে মহব্বত করে। আল্লাহর উদ্দেশেই তারা একত্র হয় এবং আল্লাহর উদ্দেশেই তারা বিচ্ছিন্ন হয় (৫) যে ব্যক্তি এমন গোপনীয়তার সাথে সাদকা করে যে, তার ডান হাত কি দিল বাম হাত তার খবর রাখে না (৬) ঐ যুবক যে তার উঠতি বয়স আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে কাটায়। (৭) ঐ পুরুষ যাকে কোন সুন্দরী ও সম্ভ্রান্ত মহিলা কু-কর্মের প্রতি আহ্বান করে কিন্তু সে বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি। (বুখারী ও মুসলিম)
মোটকথা, আযীযের স্ত্রী ইউসুফ (عليه السلام)-এর প্রতি আসক্ত হয়ে ও অত্যধিক লোভাতুর হয়ে আপন কামনা চরিতার্থ করার জন্যে আহ্বান জানায়। ইউসুফ (عليه السلام) বললেনঃ مَعَاذَ ٱللَّهِۖ (আল্লাহর পানাহ চাই) إِنَّهُۥ رَبِّیۤ (তিনি তো আমার মনিব) অর্থাৎ মহিলার স্বামী—এ বাড়ির মালিক আমার মনিব। أَحۡسَنَ مَثۡوَایَۖ অর্থাৎ তিনি আমার প্রতি সদয় ব্যবহার করেছেন ও আমাকে মর্যাদার সাথে তার কাছে থাকার বন্দোবস্ত করেছেন। إِنَّهُۥ لَا یُفۡلِحُ ٱلظَّـٰلِمُونَ (জালিমরা কখনও সফলকাম হয় না) وَلَقَدۡ هَمَّتۡ بِهِۦۖ وَهَمَّ بِهَا لَوۡلَاۤ أَن رَّءَا بُرۡهَـٰنَ رَبِّهِۦۚ (মহিলাটি ইউসুফের প্রতি আসক্ত হয়েছিল এবং সেও তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তো যদি না সে আপন প্রতিপালকের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করত।) তাফসীরে আমরা এ আয়াত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেছি।
মুফাসসিরগণ এ স্থলে যত কথা বলেছেন, তার অধিকাংশই আহলি কিতাবদের গ্রন্থাদি থেকে গৃহীত। সুতরাং সেগুলো উপেক্ষা করাই শ্রেয়। এখানে যে কথাটি বিশ্বাস করা প্রয়োজন তা এই যে, আল্লাহ হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-কে এ অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে হিফাজত করেন ও পবিত্র রাখেন এবং ঐ মহিলার কবল থেকে তাকে রক্ষা করুন।
তাই তিনি বলেছেনঃ
كَذَ ٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ ٱلسُّوۤءَ وَٱلۡفَحۡشَاۤءَۚ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُخۡلَصِینَ
‘তাকে মন্দকর্ম ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখার জন্য এভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম সে তো ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।’ وَٱسۡتَبَقَا ٱلۡبَابَ (তারা উভয়ে দৌড়ে দরজার দিকে গেল) অর্থাৎ হযরত ইউসুফ (عليه السلام) মহিলার কবল থেকে বাঁচার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে দরজার দিকে ছুটে গেলেন এবং মহিলা তার পেছনে পেছনে গেল وَأَلۡفَیَا سَیِّدَهَا لَدَا ٱلۡبَابِۚ (তারা উভয়ে মহিলার স্বামীকে দরজার কাছে পেল) তখন চট করে মহিলাটি কথা বলতে আরম্ভ করল এবং তাকে ইউসুফের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করলঃ قَالَتۡ مَا جَزَاۤءُ مَنۡ أَرَادَ بِأَهۡلِكَ سُوۤءًا إِلَّاۤ أَن یُسۡجَنَ أَوۡ عَذَابٌ أَلِیمࣱ (মহিলাটি বলল, যে তোমার পরিবারের সাথে কুকর্ম কামনা করে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ কিংবা কোন কঠিন শাস্তি ব্যতীত আর কি দণ্ড হতে পারে?’)
মহিলা নিজেই অপরাধী অথচ সে অভিযুক্ত করছে ইউসুফ (عليه السلام)-কে এবং নিজের পূতচরিত্র ও কলুষমুক্ত হওয়ার কথা বলছে। এ কারণে ইউসুফ বললেনঃ هِیَ رَ ٰوَدَتۡنِی عَن نَّفۡسِیۚ (এ মহিলাই আমাকে ফুসলাতে চেষ্টা করেছে) প্রয়োজনের মুহূর্তে তিনি সত্য কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। وَشَهِدَ شَاهِدࣱ مِّنۡ أَهۡلِهَاۤ (মহিলার পরিবারের জনৈক সাক্ষী সাক্ষ্য দিল)।
ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, যে সাক্ষ্য দিয়েছিল সে ছিল একান্তই দোলনার এক শিশু। আবু হুরায়রা (رضي الله عنه), হিলাল ইবন আসাফ, হাসান বসরী, সাঈদ ইবন জুবায়র ও যাহহাক থেকে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। ইবন জারীরও এ মতই গ্রহণ করেছেন। হযরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে এ ব্যাপারে মারফু হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং অন্যরা তা মওকুফরূপে বর্ণনা করেছেন।
কেউ কেউ বলেছেন, সাক্ষ্যদাতা ছিল মহিলার স্বামীর নিকটআত্মীয় একজন পুরুষ। আবার কেউ বলেছেন, সে ছিল মহিলার নিকটাত্মীয় একজন পুরুষ। সাক্ষ্যদাতা পুরুষ বলে অভিমত পোষণকারীদের মধ্যে রয়েছেন ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), ইকরিমা, মুজাহিদ হাসান, কাতাদা, সুদ্দী, মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ও যায়দ ইবন আসলাম (رحمة الله)। যে সাক্ষ্য দিল إِن كَانَ قَمِیصُهُۥ قُدَّ مِن قُبُلࣲ فَصَدَقَتۡ وَهُوَ مِنَ ٱلۡكَـٰذِبِینَ
(যদি ওর জামার সম্মুখ দিকে ছেঁড়া হয়ে থাকে তবে মহিলাটি সত্য কথা বলেছে এবং পুরুষটি মিথ্যাবাদী)। কারণ, তখন বোঝা যাবে ইউসুফ (عليه السلام) মহিলাকে ধরতে গিয়েছেন; আর মহিলা প্রতিরোধ করেছে। যার ফলে জামার সম্মুখ দিকে ছিড়ে গেছে। وَإِن كَانَ قَمِیصُهُۥ قُدَّ مِن دُبُرࣲ فَكَذَبَتۡ وَهُوَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ (আর যদি তার জামা পিছন দিক থেকে ছেড়া হয়ে থাকে তবে মহিলাটি মিথ্যা বলেছে এবং পুরুষটি সত্যবাদী)। কারণ, তখন প্রমাণিত হবে যে, ইউসুফ (عليه السلام) মহিলার কবল থেকে পালাতে চেয়েছেন এবং মহিলা তাঁকে ধরার জন্যে পেছনে পেছনে ছুটেছে ও তার জামা টেনে ধরার কারণে পেছন দিকে ছিড়ে গেছে। আর বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। তাই আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ
فَلَمَّا رَءَا قَمِیصَهُۥ قُدَّ مِن دُبُرࣲ قَالَ إِنَّهُۥ مِن كَیۡدِكُنَّۖ إِنَّ كَیۡدَكُنَّ عَظِیمࣱ ) ‘গৃহস্বামী যখন দেখল যে, তার জামা পেছন দিক থেকে ছেঁড়া রয়েছে। তখন সে বলল, এ হল তোমাদের নারীদের ছলনা। বস্তুত ভীষণ তোমাদের ছলনা।’) অর্থাৎ এ যা কিছু ঘটেছে তা তোমাদের নারীদের কূট-কৌশল— তুমিই তাকে ফুসলিয়েছ এবং অন্যায়ভাবে তার ওপর দোষারোপ করছ।
এরপর মহিলার স্বামী এ ব্যাপারটির নিষ্পত্তিকল্পে বলেনঃ یُوسُفُ أَعۡرِضۡ عَنۡ هَـٰذَاۚ
(ইউসুফ! এ বিষয়টিকে তুমি উপেক্ষা কর) অর্থাৎ কারও নিকট এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করো না। কারণ, এ জাতীয় বিষয় গোপন করাই বাঞ্ছনীয় ও উত্তম। অপর দিকে তিনি মহিলাকে তার অপরাধের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করার নির্দেশ দেন। কেননা, বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তওবা করে তখন আল্লাহ তার তওবা কবূল করেন। ঐ সময় মিসরবাসী যদিও মূর্তিপূজা করত, কিন্তু তারা বিশ্বাস করত যে, যে সত্তা পাপ মোচন করেন। এবং পাপের শাস্তি দেন তিনি এক ও লা-শরীক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নন। এ জন্যে স্ত্রী লোকটিকে তার স্বামী ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেন; তবে কিছু কিছু কারণে তিনি মহিলার অসহায়ত্ব ও অক্ষমতা উপলব্ধি করেন। কেননা, মহিলা এমন কিছু প্রত্যক্ষ করেছিল যা দেখে মনকে দাবিয়ে রাখা খুবই কঠিন (অর্থাৎ ইউসুফ (عليه السلام)-এর রূপ)। তবে ইউসুফ (عليه السلام) ছিলেন পাক-পবিত্র ও নির্মল নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী।
وَٱسۡتَغۡفِرِی لِذَنۢبِكِۖ إِنَّكِ كُنتِ مِنَ ٱلۡخَاطِـِٔینَ (তুমি তোমার অপরাধের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর। কারণ নিশ্চিতভাবে তুমিই অপরাধী।)
(۞ وَقَالَ نِسۡوَةࣱ فِی ٱلۡمَدِینَةِ ٱمۡرَأَتُ ٱلۡعَزِیزِ تُرَ ٰوِدُ فَتَىٰهَا عَن نَّفۡسِهِۦۖ قَدۡ شَغَفَهَا حُبًّاۖ إِنَّا لَنَرَىٰهَا فِی ضَلَـٰلࣲ مُّبِینࣲ فَلَمَّا سَمِعَتۡ بِمَكۡرِهِنَّ أَرۡسَلَتۡ إِلَیۡهِنَّ وَأَعۡتَدَتۡ لَهُنَّ مُتَّكَـࣰٔا وَءَاتَتۡ كُلَّ وَ ٰحِدَةࣲ مِّنۡهُنَّ سِكِّینࣰا وَقَالَتِ ٱخۡرُجۡ عَلَیۡهِنَّۖ فَلَمَّا رَأَیۡنَهُۥۤ أَكۡبَرۡنَهُۥ وَقَطَّعۡنَ أَیۡدِیَهُنَّ وَقُلۡنَ حَـٰشَ لِلَّهِ مَا هَـٰذَا بَشَرًا إِنۡ هَـٰذَاۤ إِلَّا مَلَكࣱ كَرِیمࣱ قَالَتۡ فَذَ ٰلِكُنَّ ٱلَّذِی لُمۡتُنَّنِی فِیهِۖ وَلَقَدۡ رَ ٰوَدتُّهُۥ عَن نَّفۡسِهِۦ فَٱسۡتَعۡصَمَۖ وَلَىِٕن لَّمۡ یَفۡعَلۡ مَاۤ ءَامُرُهُۥ لَیُسۡجَنَنَّ وَلَیَكُونࣰا مِّنَ ٱلصَّـٰغِرِینَ قَالَ رَبِّ ٱلسِّجۡنُ أَحَبُّ إِلَیَّ مِمَّا یَدۡعُونَنِیۤ إِلَیۡهِۖ وَإِلَّا تَصۡرِفۡ عَنِّی كَیۡدَهُنَّ أَصۡبُ إِلَیۡهِنَّ وَأَكُن مِّنَ ٱلۡجَـٰهِلِینَ فَٱسۡتَجَابَ لَهُۥ رَبُّهُۥ فَصَرَفَ عَنۡهُ كَیۡدَهُنَّۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِیعُ ٱلۡعَلِیمُ)[Surat Yusuf ৩০ - ৩৪]
অর্থাৎ, নগরের কতিপয় নারী বলল, আযীযের স্ত্রী তার যুবক দাস থেকে অসৎকর্ম কামনা করছে; প্রেম তাকে উন্মত্ত করেছে, আমরা তো তাকে দেখছি স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে। স্ত্রীলোকটি যখন ওদের ষড়যন্ত্রের কথা শুনল, তখন সে ওদেরকে ডেকে পাঠাল, ওদের জন্যে আসন প্রস্তুত করল, ওদের প্রত্যেককে একটি করে ছুরি দিল এবং ইউসুফ (عليه السلام)-কে বলল, ওদের সম্মুখে বের হও। তারপর ওরা যখন তাকে দেখল তখন তারা ওর গরিমায় অভিভূত হল এবং নিজেদের হাত কেটে ফেলল। ওরা বলল, ‘অদ্ভুত আল্লাহর মাহাত্ম্য! এতো মানুষ নয়, এতো এক মহিমান্বিত ফেরেশতা।
সে বলল, ‘এ-ই সে যার সম্বন্ধে তোমরা আমার নিন্দা করেছ; আমি তো তা থেকে অসৎকর্ম কামনা করেছি; কিন্তু সে নিজেকে পবিত্র রেখেছে, আমি তাকে যা আদেশ করেছি সে যদি তা না করে, তবে সে কারারুদ্ধ হবেই এবং হীনদের অন্তর্ভুক্ত হবে। ইউসুফ বলল, হে আমার প্রতিপালক! এই নারীগণ আমাকে যার প্রতি আহ্বান করছে তা অপেক্ষা কারাগার আমার কাছে অধিক প্রিয়। আপনি যদি ওদের ছলনা থেকে আমাকে রক্ষা না করেন তবে আমি ওদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ তারপর তার প্রতিপালক তার আহ্বানে সাড়া দিলেন এবং তাকে ওদের ছলনা থেকে রক্ষা করলেন। তিনি তো সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (১২: ৩০-৩৪)।
এখানে আল্লাহ উল্লেখ করছেন সে সব কথা, যা শহরের মহিলা সমাজ তথা আমীর, ওমরাহ ও অভিজাত লোকদের স্ত্রী-কন্যাগণ আযীযের স্ত্রী সম্পর্কে নিন্দাবাদ করছিল। নিজের ক্রীতদাসের প্রতি প্রেমে উন্মত্ত হয়ে প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ছলনা করার জন্য তারা তাকে ভৎসনা করছিল। দাসের প্রতি এরূপ আসক্ত হওয়া তার মত অভিজাত মহিলার পক্ষে মোটেই শোভনীয় ছিল না। তাই তারা বলছিলঃ (إِنَّا لَنَرَىٰهَا فِی ضَلَـٰلࣲ مُّبِینࣲ ) (আমরা তাকে স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে দেখছি) অর্থাৎ সে অপাত্রে প্রের্ম নিবেদন করছে। فَلَمَّا سَمِعَتۡ بِمَكۡرِهِنَّ (আযীযের স্ত্রী যখন তাদের চক্রান্তের কথা শুনল) অর্থাৎ তার প্রতি শহরের মহিলাদের ভৎসনার কথা শুনল এবং দাসের প্রতি প্রেম নিবেদন করার কারণে তাকে নিন্দাবাদ করার কথা জানল। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে আযীযের স্ত্রী এ ব্যাপারে ছিল অক্ষম। তাই সে ইচ্ছে করল তার ওযর ঐ মহিলাদের সামনে প্রকাশ করতে। তখন তারা বুঝবে যে, এই যুবক দাস তেমন নয় যেমন তারা ধারণা করেছে এবং এ সেসব দাসের মত নয়, যেসব দাস তাদের কাছে আছে। সুতরাং সে শহরের মহিলাদের নিমন্ত্রণ করল এবং সকলকে বাড়িতে ডেকে আনল। সে একটি ভোজ সভার আয়োজন করল। ভোজসভায় যে সব খাদ্য-দ্রব্য পরিবেশন করা হয়। মধ্যে এমন কিছু দ্রব্য ছিল যা ছুরি দিয়ে কেটে খেতে হয়, যেমন লেবু ইত্যাদি। উপস্থিত প্রত্যেককে একটি করে ছুরি দেয়া হল। আযীযের স্ত্রী পূর্বেই ইউসুফ (عليه السلام)-কে উৎকৃষ্ট পোশাক পরিয়ে প্রস্তুত রেখেছিল। তখন তিনি ছিলেন পূর্ণ যৌবনে দীপ্তিমান। এ অবস্থায় মহিলাটি ইউসুফ (عليه السلام)-কে তাদের সম্মুখে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দিলে তিনি বের হয়ে আসেন। ইউসুফ (عليه السلام)-কে তখন পূর্ণিমার চাঁদের চাইতেও অধিকতর সুন্দর দেখাচ্ছিল। فَلَمَّا رَأَیۡنَهُۥۤ أَكۡبَرۡنَهُۥ (যখন তারা তাকে দেখল তখন ওরা তাঁর গরিমায় অভিভূত হলো) অর্থাৎ তারা ইউসুফ (عليه السلام)-এর সৌন্দর্য-দর্শনে বিস্মিত হয়ে ভাবল, কোন আদম সন্তান তো এ রকম রূপ-লাবন্যের অধিকারী হতে পারে না। ইউসুফ (عليه السلام)-এর সৌন্দর্যের দীপ্তিতে অভিভূত হয়ে তারা চেতনা হারিয়ে ফেলে। এমনকি আপন আপন হাতে রক্ষিত ছুরি দ্বারা নিজেদের হাত কেটে ফেলে। অথচ যখমের কোন অনুভূতিই তাদের ছিল না। وَقُلۡنَ حَـٰشَ لِلَّهِ مَا هَـٰذَا بَشَرًا إِنۡ هَـٰذَاۤ إِلَّا مَلَكࣱ كَرِیمࣱ (মহিলারা বলল, অদ্ভুত আল্লাহর মাহাত্ম্য! এতো মানুষ নয়, এ তো মহিমান্বিত ফেরেশতা!) মিরাজ সংক্রান্ত হাদীসে এসেছে, ‘আমি ইউসুফের কাছ দিয়ে গেলাম, দেখলাম সৌন্দর্যের অর্ধেকই তাকে দেওয়া হয়েছে।
সুহায়লী (رحمة الله) ও অন্যান্য ইমাম বলেছেন, হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-কে অর্ধেক সৌন্দর্য দেয়া হয়েছিল-এ কথার অর্থ হল আদম (عليه السلام)-এর যে সৌন্দর্য ছিল তার অর্ধেক ইউসুফ (عليه السلام)-কে দেয়া হয়েছিল। কারণ আল্লাহ নিজ হাতে আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন। সুতরাং তিনিই ছিলেন সবার চাইতে বেশি সুন্দর। এ জন্যে জান্নাতবাসী আদম (عليه السلام)-এর দৈহিক মাপ ও সৌন্দর্য নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর ইউসুফ (عليه السلام)-এর সৌন্দর্য ছিল আদম (عليه السلام)-এর সৌন্দর্যের অর্ধেক। এ দু’জনের মাঝখানে আর কোন সৌন্দর্যবান ব্যক্তি হবে না। যেমন হযরত হাওয়া (عليه السلام)-এর পরে হযরত ইবরাহীম খলীল (عليه السلام)-এর স্ত্রী সারাহ্ ভিন্ন আর কেউ হাওয়ার সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর চেহারায় বিদ্যুতের ন্যায় উজ্জ্বল দ্যুতি ছিল। যখন কোন মহিলা কোন কাজে তার কাছে আসত তখন তিনি নিজের চেহারা ঢেকে রাখতেন। অন্যরা বলেছেন, লোকজন যাতে চেহারা দেখতে না পায়, সে জন্যে হযরত ইউসুফ (عليه السلام) বোরকা পরিহিত থাকতেন। এ কারণেই যখন আযীযের স্ত্রী ইউসুফ (عليه السلام)-এর প্রেমে আসক্ত হয় এবং অন্যান্য মহিলা তার রূপ-দর্শনে আংগুল কাটার ন্যায় ঘটনা ঘটায় ও হতভম্ব হয়ে যায়, তখন আযীযের স্ত্রী বলেছিলঃ قَالَتۡ فَذَ ٰلِكُنَّ ٱلَّذِی لُمۡتُنَّنِی فِیهِۖ (এই হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার জন্যে তোমরা আমাকে তিরস্কার করছ।) অতঃপর মহিলাটি হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর পূত-চরিত্র হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেঃ وَلَقَدۡ رَ ٰوَدتُّهُۥ عَن نَّفۡسِهِۦ فَٱسۡتَعۡصَمَۖ
(আমি তার থেকে অসৎকর্ম কামনা করেছি কিন্তু সে নিজেকে পবিত্র রেখেছে অর্থাৎ রক্ষা করেছে) وَلَىِٕن لَّمۡ یَفۡعَلۡ مَاۤ ءَامُرُهُۥ لَیُسۡجَنَنَّ وَلَیَكُونࣰا مِّنَ ٱلصَّـٰغِرِینَ (এ যদি আমার কথা না শুনে তবে তাকে কয়েদ করা হবে এবং লাঞ্ছিত করা হবে।) এ সময় অন্যান্য মহিলা ইউসুফ (عليه السلام)-কে তাঁর মনিব-পত্নীর প্রস্তাব মেনে নিতে উৎসাহ যোগায়; কিন্তু তিনি তা কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, তাঁর দেহে নবুওতের ধমনী প্রবাহিত ছিল। তিনি রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রার্থনা করেনঃ
رَبِّ ٱلسِّجۡنُ أَحَبُّ إِلَیَّ مِمَّا یَدۡعُونَنِیۤ إِلَیۡهِۖ وَإِلَّا تَصۡرِفۡ عَنِّی كَیۡدَهُنَّ أَصۡبُ إِلَیۡهِنَّ وَأَكُن مِّنَ ٱلۡجَـٰهِلِینَ (‘হে আমার রব! তারা আমাকে যে কাজের দিকে আহ্বান জানায় তার চাইতে কারাগারই বরং আমার কাছে অধিক প্রিয়। আপনি যদি ওদের ছলনা থেকে আমাকে রক্ষা না করেন, তবে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং তখন তো আমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব।)
অর্থাৎ আপনি যদি আমার উপর দায়িত্ব ছেড়ে দেন, তাহলে আমি অক্ষম দুর্বল। নিজের কল্যাণ-অকল্যাণ কোনটির উপরই আমার কোন হাত নেই- আল্লাহ যা চান তাই হয়। আমি দুর্বল, তবে আপনি যতটুকু শক্তি-সামর্থ্য দেন এবং আপনার পক্ষ থেকে যতটুকু হিফাজত দান করেন তাই আমি পেয়ে থাকি। এ জন্যেই আল্লাহ বলেনঃ
فَٱسۡتَجَابَ لَهُۥ رَبُّهُۥ فَصَرَفَ عَنۡهُ كَیۡدَهُنَّۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِیعُ ٱلۡعَلِیمُ
অর্থাৎ, আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করলেন। তার উপর থেকে মহিলাদের চক্রান্ত প্রতিহত করলেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (১২: ৩৪)
(ثُمَّ بَدَا لَهُم مِّنۢ بَعۡدِ مَا رَأَوُا۟ ٱلۡـَٔایَـٰتِ لَیَسۡجُنُنَّهُۥ حَتَّىٰ حِینࣲ وَدَخَلَ مَعَهُ ٱلسِّجۡنَ فَتَیَانِۖ قَالَ أَحَدُهُمَاۤ إِنِّیۤ أَرَىٰنِیۤ أَعۡصِرُ خَمۡرࣰاۖ وَقَالَ ٱلۡـَٔاخَرُ إِنِّیۤ أَرَىٰنِیۤ أَحۡمِلُ فَوۡقَ رَأۡسِی خُبۡزࣰا تَأۡكُلُ ٱلطَّیۡرُ مِنۡهُۖ نَبِّئۡنَا بِتَأۡوِیلِهِۦۤۖ إِنَّا نَرَىٰكَ مِنَ ٱلۡمُحۡسِنِینَ قَالَ لَا یَأۡتِیكُمَا طَعَامࣱ تُرۡزَقَانِهِۦۤ إِلَّا نَبَّأۡتُكُمَا بِتَأۡوِیلِهِۦ قَبۡلَ أَن یَأۡتِیَكُمَاۚ ذَ ٰلِكُمَا مِمَّا عَلَّمَنِی رَبِّیۤۚ إِنِّی تَرَكۡتُ مِلَّةَ قَوۡمࣲ لَّا یُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَهُم بِٱلۡـَٔاخِرَةِ هُمۡ كَـٰفِرُونَ وَٱتَّبَعۡتُ مِلَّةَ ءَابَاۤءِیۤ إِبۡرَ ٰهِیمَ وَإِسۡحَـٰقَ وَیَعۡقُوبَۚ مَا كَانَ لَنَاۤ أَن نُّشۡرِكَ بِٱللَّهِ مِن شَیۡءࣲۚ ذَ ٰلِكَ مِن فَضۡلِ ٱللَّهِ عَلَیۡنَا وَعَلَى ٱلنَّاسِ وَلَـٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا یَشۡكُرُونَ یَـٰصَـٰحِبَیِ ٱلسِّجۡنِ ءَأَرۡبَابࣱ مُّتَفَرِّقُونَ خَیۡرٌ أَمِ ٱللَّهُ ٱلۡوَ ٰحِدُ ٱلۡقَهَّارُ مَا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِهِۦۤ إِلَّاۤ أَسۡمَاۤءࣰ سَمَّیۡتُمُوهَاۤ أَنتُمۡ وَءَابَاۤؤُكُم مَّاۤ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَـٰنٍۚ إِنِ ٱلۡحُكۡمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعۡبُدُوۤا۟ إِلَّاۤ إِیَّاهُۚ ذَ ٰلِكَ ٱلدِّینُ ٱلۡقَیِّمُ وَلَـٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا یَعۡلَمُونَ یَـٰصَـٰحِبَیِ ٱلسِّجۡنِ أَمَّاۤ أَحَدُكُمَا فَیَسۡقِی رَبَّهُۥ خَمۡرࣰاۖ وَأَمَّا ٱلۡـَٔاخَرُ فَیُصۡلَبُ فَتَأۡكُلُ ٱلطَّیۡرُ مِن رَّأۡسِهِۦۚ قُضِیَ ٱلۡأَمۡرُ ٱلَّذِی فِیهِ تَسۡتَفۡتِیَانِ)[Surat Yusuf ৩৫ - ৪১]
অর্থাৎ, নিদর্শনাবলী দেখার পর তাদের মনে হল যে, তাকে কিছুকালের জন্যে কারারুদ্ধ করতে হবে। তার সাথে দু’জন যুবক কারাগারে প্রবেশ করল। ওদের একজন বলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমি আংগুর নিংড়িয়ে রস বের করছি এবং অপরজন বলল, “আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমি আমার মাথার উপর রুটি বহন করছি এবং পাখি তা থেকে খাচ্ছে। আমাদেরকে তুমি এর তাৎপর্য জানিয়ে দাও, আমরা তোমাকে সকর্মপরায়ণ দেখেছি।’
ইউসুফ বলল, তোমাদেরকে যে খাদ্য দেয়া হয় তা আসার পূর্বে আমি তোমাদেরকে স্বপ্নের তাৎপর্য জানিয়ে দেব। আমি যা তোমাদেরকে বলব তা আমার প্রতিপালক আমাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তা হতে বলব। যে সম্প্রদায় আল্লাহে বিশ্বাস করে না ও পরলোকে অবিশ্বাসী আমি তাদের মতবাদ বর্জন করেছি; আমি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক এবং ইয়াকুবের মতবাদ অনুসরণ করি। আল্লাহর সাথে কোন বস্তুকে শরীক করা আমাদের কাজ নয়। এটা আমাদের ও সমস্ত মানুষের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ; কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।
‘হে কারাসঙ্গীরা! ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক শ্রেয়, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ? তাকে ছেড়ে তোমরা কেবল কতকগুলো নামের ইবাদত করছ, যে নাম তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা রেখেছ; এগুলোর কোন প্রমাণ আল্লাহ্ পাঠাননি। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহর। তিনি আদেশ দিয়েছেন অন্য কারও ইবাদত না করতে, কেবল তার ব্যতীত; এটাই সরল দীন কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা অবগত নয়।
‘হে কারাসঙ্গী দ্বয়! তোমাদের একজন সম্বন্ধে কথা এই যে, সে তার মনিবকে মদ্য পান করাবে এবং অপরজন সম্বন্ধে কথা এই যে, সে শূলবিদ্ধ হবে; তারপর তার মাথা থেকে পাখি আহার করবে। যে বিষয়ে তোমরা জানতে চেয়েছ তার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে! (সূরা ইউসুফঃ ৩৫-৪১)
আযীয ও তার স্ত্রী সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ইউসুফের পবিত্রতা প্রকাশ পাওয়ার পর কিছুদিনের জন্যে তাকে জেলে রাখা তাদের কাছে সংগত বলে মনে হল। কারণ, এতে ঐ ব্যাপারে লোকজনের চর্চা কমে যাবে এবং এটাও বোঝা যাবে যে, ইউসুফ (عليه السلام)-ই অপরাধী যার কারণে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এভাবে অন্যায়ভাবে তাকে জেলখানায় পাঠানো হল। অবশ্য ইউসুফ (عليه السلام)-এর জন্যে আল্লাহ্ এটাই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। এর দ্বারা আল্লাহ্ তাকে রক্ষা করলেন। কেননা, জেলে থাকায় তিনি তাদের সংসর্গ ও সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার সুযোগ পান।
ইমাম শাফিঈর বর্ণনা মতে, সূফী সম্প্রদায়ের কেউ কেউ এ ঘটনা থেকে দলীল গ্রহণ করে বলেছেনঃ না পাওয়াটাই এক প্রকার হিফাজত।
আল্লাহর বাণীঃ ( وَدَخَلَ مَعَهُ ٱلسِّجۡنَ فَتَیَانِۖ (তার সাথে আরও দুই যুবক জেলখানায় প্রবেশ করল।) এদের মধ্যে একজন ছিল বাদশার দরবারের সাকী, তার নাম বানূ বলে কথিত আছে। অপরজন বাদশার রুটি প্রস্তুতকারী অর্থাৎ খাদ্যের দায়িত্বশীল—তুর্কী ভাষায় যাকে বলে আলজাশেনকীর। কথিত আছে তার নাম ছিল মাজলাছ। বাদশাহ এ দু’জনকে কোন এক ব্যাপারে অভিযুক্ত করে কারাগারে আবদ্ধ করেন। জেলখানায় ইউসুফ (عليه السلام)-এর আচার-আচরণ, স্বভাবচরিত্র, সাধুতা, নীতি-আদর্শ, ইবাদত বন্দেগী ও সৃষ্টির প্রতি করুণা দেখে তারা দু’জনেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যায়। এ দুই কারাবন্দী যুবক তাদের নিজ নিজ অবস্থান অনুযায়ী স্বপ্ন দেখে। মুফাস্সিরগণ বলেছেন, তারা একই রাত্রে এ স্বপ্ন দেখেছিল। সাকী দেখে, পাকা আংগুরে ভর্তি তিনটি গোছা, সেখান থেকে সে আংগুর ছিড়ে রস নিংড়িয়ে পেয়ালা ভরে বাদশাহকে পরিবেশন করছে। অপর দিকে রুটি প্রস্তুতকারী দেখে, তার মাথার উপর রুটি ভরা তিনটি ঝুড়ি রয়েছে। আর পাখিরা এসে উপরের ঝুড়ি থেকে রুটি ঠুকরিয়ে খাচ্ছে। স্বপ্ন দেখার পর দু’জনেই নিজ নিজ স্বপ্নের বৃত্তান্ত ইউসুফ (عليه السلام)-এর কাছে ব্যক্ত করে তারা এর ব্যাখ্যা জানতে চাইল এবং বললঃ إِنَّا نَرَىٰكَ مِنَ ٱلۡمُحۡسِنِینَ (আমরা আপনাকে সৎকর্মপরায়ণ দেখছি।) ইউসুফ তাদেরকে জানালেন যে, স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে তিনি সম্যক অবহিত ও অভিজ্ঞ।
قَالَ لَا یَأۡتِیكُمَا طَعَامࣱ تُرۡزَقَانِهِۦۤ إِلَّا نَبَّأۡتُكُمَا بِتَأۡوِیلِهِۦ (ইউসুফ বলল, তোমরা প্রত্যহ নিয়মিত যে খাদ্য খাও তা আসার পূর্বেই আমি তোমাদেরকে এর তাৎপর্য জানিয়ে দেব।) এ আয়াতের অর্থ কেউ এভাবে করেছেন যে, তোমরা দু’জনে যখনই কোন স্বপ্ন দেখবে, তা বাস্তবে পরিণত হবার পূর্বেই আমি তার ব্যাখ্যা বলে দেব। এবং যেভাবে আমি ব্যাখ্যা দেব সেভাবেই তা বাস্তবায়িত হবে। আবার কেউ এর অর্থ বলেছেন যে, তোমাদেরকে যে খাদ্য দেয়া হয় তা পরিবেশন হওয়ার আগেই আমি বলে দেব কি খাদ্য আসছে, তা মিষ্টি না টক।
যেমন হযরত ঈসা (عليه السلام) বলেছিলেনঃ
(আমি তোমাদেরকে বলে দেব কি খাদ্য তোমরা খেয়েছ এবং বাড়িতে কি রেখে এসেছ) হযরত ইউসুফ (عليه السلام) তাদেরকে জানালেন যে, এ জ্ঞান আল্লাহ্ আমাকে দান করেছেন। কেননা, আমি তাকে এক আল্লাহ্ বলে বিশ্বাস করি ও আমার পূর্ব পুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করিঃ مَا كَانَ لَنَاۤ أَن نُّشۡرِكَ بِٱللَّهِ مِن شَیۡءࣲۚ (আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা আমাদের কাজ নয়)। ذَ ٰلِكَ مِن فَضۡلِ ٱللَّهِ عَلَیۡنَا (এটা আমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ) কেননা তিনিই আমাদেরকে এ পথ প্রদর্শন করেছেন। وَعَلَى ٱلنَّاسِ (এবং মানুষের উপরও) কেননা, আল্লাহ্ আমাদেরকে আদেশ করেছেন, মানুষকে এদিকে আহ্বান করার। তাদেরকে সত্য পথে আনার চেষ্টা করার ও সত্য পথ প্রদর্শন করার। আর এ সত্য সৃষ্টিগতভাবে তাদের মধ্যে বিদ্যমান এবং তাদের স্বভাবজাত। وَلَـٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا یَشۡكُرُونَ (কিন্তু অধিকাংশ লোকই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না)। এরপর হযরত ইউসুফ (عليه السلام) তাদেরকে আল্লাহর একত্বের প্রতি ঈমান আনার জন্যে তাদেরকে দাওয়াত দেন, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদতের নিন্দা করেন। মূর্তির অসারতা, অক্ষমতা ও হেয় হওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
یَـٰصَـٰحِبَیِ ٱلسِّجۡنِ ءَأَرۡبَابࣱ مُّتَفَرِّقُونَ خَیۡرٌ أَمِ ٱللَّهُ ٱلۡوَ ٰحِدُ ٱلۡقَهَّارُ مَا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِهِۦۤ إِلَّاۤ أَسۡمَاۤءࣰ سَمَّیۡتُمُوهَاۤ أَنتُمۡ وَءَابَاۤؤُكُم مَّاۤ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَـٰنٍۚ إِنِ ٱلۡحُكۡمُ إِلَّا لِلَّهِ
(হে আমার কারাসঙ্গী দ্বয়! ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক শ্রেয়, নাকি পরাক্রমশালী এক আল্লাহ্? তাকে ছেড়ে তোমরা কেবল কতকগুলো নামের ইবাদত করছ—যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃ-পুরুষ রেখেছ। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ কোন প্রমাণ নাজিল করেননি। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই।)
অর্থাৎ তিনি তাঁর সৃষ্টিকুলের মধ্যে যেরূপ ইচ্ছা করেন সেরূপই বাস্তবায়িত করেন। যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন। যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন। أَمَرَ أَلَّا تَعۡبُدُوۤا۟ إِلَّاۤ إِیَّاهُۚ (তিনি হুকুম করেছেন ও তাঁকে ব্যতীত কারও ইবাদত কর না) তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। ذَ ٰلِكَ ٱلدِّینُ ٱلۡقَیِّمُ (এটাই সরল দীন অর্থাৎ সরল ও সঠিক পথ।) وَلَـٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا یَعۡلَمُونَ (কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা অবগত নয়।)।
অর্থাৎ সঠিক পথ তাদের সম্মুখে প্রকাশিত ও স্পষ্ট হওয়ার পরও তারা সে পথে চলতে পারে। কারাগারের এ দুই যুবককে এমন একটি পরিবেশে দাওয়াত দান হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর পূর্ণ কৃতিত্বেরই পরিচায়ক। কেননা, তাদের অন্তরে ইউসুফ (عليه السلام)-এর প্রভাব ও মহত্ত্ব আসন গেড়ে বসেছিল। যা তিনি বলবেন, তা গ্রহণ করার জন্যে তারা ছিল উদগ্রীব। সুতরাং তারা যে বিষয়ে জানতে চেয়েছে তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অধিক কল্যাণকর বিষয়ের প্রতি আহ্বান জানানোই তিনি সঙ্গত মনে করেছেন। তাঁর প্রতি আরোপিত সে গুরুদায়িত্ব পালনের পর তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করে বলেনঃ
یَـٰصَـٰحِبَیِ ٱلسِّجۡنِ أَمَّاۤ أَحَدُكُمَا فَیَسۡقِی رَبَّهُۥ خَمۡرࣰاۖ (হে আমার জেলখানার সাথীরা। তোমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা হলঃ তোমাদের দু’জনের মধ্যে একজন আপন মনিবকে মদ্য পান করাবে) সে লোকটি ছিল সাকী।
وَأَمَّا ٱلۡـَٔاخَرُ فَیُصۡلَبُ فَتَأۡكُلُ ٱلطَّیۡرُ مِن رَّأۡسِهِۦۚ (আর দ্বিতীয়জনকে শূলে চড়ান হবে, এবং পাখিরা তার মাথা থেকে আহার করবে।) সে ব্যক্তিটি ছিল রুটি প্রস্তুতকারী। قُضِیَ ٱلۡأَمۡرُ ٱلَّذِی فِیهِ تَسۡتَفۡتِیَانِ (যে বিষয়ে তোমরা জানতে চেয়েছিলে তার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে) অর্থাৎ যা বলে দেয়া হল তা অবশ্যম্ভাবীরূপে কার্যকর হবে এবং যেভাবে বলা হল সেভাবেই হবে। এ জন্যে হাদীসে এসেছে, স্বপ্নের ব্যাখ্যা যতক্ষণ করা না হবে ততক্ষণ তা ঝুলন্ত থাকে। যখন ব্যাখ্যা করা হয় তখন তা বাস্তবায়িত হয়।
الرؤيا علير جل طائر مالم تعبر فاذا عبرت وقعت
ইবন মাসউদ, মুজাহিদ ও আবদুর রহমান ইবন যায়দ ইবন আসলাম (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিতঃ কয়েদী দু’জন স্বপ্নের কথা বলার পরেও ইউসুফ (عليه السلام)-এর ব্যাখ্যা দানের পরে বলেছিল, আসলে আমরা কোন স্বপ্নই দেখি নাই। তখন হযরত ইউসুফ (عليه السلام) বলেছিলেন (قُضِیَ ٱلۡأَمۡرُ ٱلَّذِی فِیهِ تَسۡتَفۡتِیَانِ) (যে বিষয়ে তোমরা জিজ্ঞাসা করেছ সে বিষয়ের ফয়সালা চূড়ান্ত হয়ে গেছে।)
وَقَالَ لِلَّذِی ظَنَّ أَنَّهُۥ نَاجࣲ مِّنۡهُمَا ٱذۡكُرۡنِی عِندَ رَبِّكَ فَأَنسَىٰهُ ٱلشَّیۡطَـٰنُ ذِكۡرَ رَبِّهِۦ فَلَبِثَ فِی ٱلسِّجۡنِ بِضۡعَ سِنِینَ[Surat Yusuf ৪২]
(যে ব্যক্তি সম্পর্কে ইউসুফের ধারণা ছিল যে, সে মুক্তি পাবে। তাকে সে বলে দিলঃ তোমার প্রভুর কাছে আমার কথা বলবে। কিন্তু শয়তান তাকে প্রভুর কাছে তার বিষয় বলার কথা ভুলিয়ে দিল। ফলে ইউসুফ কয়েক বছর কারাগারে রইল। (১২: ৪২)
আল্লাহ জানান যে, যে ব্যক্তির প্রতি ইউসুফ (عليه السلام)-এর ধারণা হয়েছিল যে, সে মুক্তিলাভ করবে— সে ব্যক্তি ছিল সাকী ٱذۡكُرۡنِی عِندَ رَبِّكَ (তোমার মনিবের নিকট আমার কথা বলবে।)
অর্থাৎ আমি যে বিনা অপরাধে জেলখানায় আছি এ বিষয়ে বাদশাহর কাছে আলোচনা করিও। এ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, উপায় অবলম্বনের চেষ্টা করা বৈধ এবং তা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়।
আল্লাহ বাণীঃ
فَأَنسَىٰهُ ٱلشَّیۡطَـٰنُ ذِكۡرَ رَبِّهِۦ
(শয়তান তাকে তার প্রভুর নিকট তার কথা বলার বিষয় ভুলিয়ে দিল) অর্থাৎ যে মুক্তি লাভ করল তাকে ইউসুফ যে অনুরোধ করেছিলেন তা বাদশাহর কাছে আলোচনা করতে শয়তান তাকে ভুলিয়ে দিল। মুজাহিদ, মুহাম্মদ ইবন ইসহাক প্রমুখ আলিম এ কথাই বলেছেন। এটাই সঠিক এবং এটাই আহলি কিতাবগণের বক্তব্য।
فَلَبِثَ فِی ٱلسِّجۡنِ بِضۡعَ سِنِینَ
(ফলে ইউসুফ কয়েক বছর কারাগারে রইল) بضع শব্দটি তিন থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যার জন্যে ব্যবহৃত হয়; কারও মতে সাত পর্যন্ত, কারও মতে পাঁচ পর্যন্ত। কারও মতে দশের নিচে যে কোন সংখ্যার জন্যে এর ব্যবহার হয়। ছালাবী এসব মতামত বর্ণনা করেছেন। বলা হয়ে থাকে نسوة এবং بضعة رجال ব্যাকরণবিদ ফাররার মতে, দশের নিচের সংখ্যার জন্যে - এর ব্যবহার বৈধ নয় বরং তার জন্যে نيف শব্দ ব্যবহার করা হয়।
আল্লাহ বলেনঃ فَلَبِثَ فِی ٱلسِّجۡنِ بِضۡعَ سِنِینَ) সে কারাগারে কয়েক বছর রইল।) আল্লাহর বাণীঃ
(فِی بِضۡعِ سِنِینَۗ لِلَّهِ ٱلۡأَمۡرُ)
[Surat Ar-Rum ৪]
উক্ত দু’খানা আয়াত দ্বারা ফাররার মতামত রদ হয়ে যায়। ফাররার মতে بضع-এর ব্যবহার হবে এভাবে যথাঃ بضعة عشر بضعة عشرون থেকে এ পর্যন্ত। কিন্তু بضع ومائة এবং بضع والف বলা যাবে না। জওহারী বলেন, عشر (দশ)-এর উর্ধ্বের ক্ষেত্রে بضع-এর ব্যবহার হবে না। সুতরাং بضع عشر এ বলা যাবে কিন্তু بضعة وتسعون بضعة وعشرون বলা যাবে না। জওহারীর এ মতও সঠিক নয়। কেননা হাদীসে এসেছেঃ
الايمان بضع وستون وفي رواية وسبعون شعبة اعلاها قول لا اله الا الله وأدناها إماطة الأذى عن الطريق
ঈমানের ষাটের উপরে, ভিন্ন রেওয়ায়তে সত্তরের উপরে শাখা আছে; তন্মধ্যে সর্ব উপরের শাখা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা এবং সর্বনিম্নের শাখা পথের উপর থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া। (সহীহ বুখারী) কেউ কেউ বলেছেন (فَأَنسَىٰهُ ٱلشَّیۡطَـٰنُ ذِكۡرَ رَبِّهِۦ) এর صغير(সর্বনাম) ইউসুফ নির্দেশ করেছে। কিন্তু তাদের এ মত অত্যন্ত দুর্বল। যদিও এ মত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) ও ইকরিমার বলে বর্ণনা করা হউক না কেন। ইবন জারীর এ প্রসঙ্গে যে হাদীসের উল্লেখ করেছেন তা সম্পূর্ণরূপে দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। ইবরাহীম ইবন ইয়াযীদ আল-খাওযী আল-মাক্কী (رحمة الله) এ হাদীসের সনদে একক বর্ণনাকারী। অথচ তার বর্ণনা অগ্রহণযোগ্য। অপর দিকে হাসান ও কাতাদা (رحمة الله)-এর মুরসাল বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। আর এ স্থলে তো তা আরও বেশি অগ্রহণযোগ্য। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
সহীহ ইবন হিব্বানে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর কারাগারে অধিককাল পর্যন্ত আবদ্ধ থাকার কারণ সম্পর্কে এক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটি আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ্ ইউসুফের প্রতি রহম করুন, তিনি যদি ٱذۡكُرۡنِی عِندَ رَبِّكَ “তোমার প্রভুর কাছে আমার কথা বলবে” কথাটি না বলতেন, তবে তাকে অতদিন কারাগারে থাকতে হত না। আল্লাহ তাআলা হযরত লূত (عليه السلام)-এর প্রতিও রহম করুন; কারণ তিনি তার কওমকে বলেছিলেন- ( لَوۡ أَنَّ لِی بِكُمۡ قُوَّةً أَوۡ ءَاوِیۤ إِلَىٰ رُكۡنࣲ شَدِیدࣲ)[Surat Hud ৮০] তোমাদের মুকাবিলায় আমার যদি আজ শক্তি থাকত কিংবা কোন শক্ত অবলম্বনের আশ্রয় পেতাম। এরপর আল্লাহ যত নবী প্রেরণ করেছেন তাদেরকে বিপুল সংখ্যক লোক বিশিষ্ট গোত্রেই প্রেরণ করেছেন।
কিন্তু এ হাদীস এই সনদে মুনকার। তাছাড়া মুহাম্মদ ইবন আমর ইবন আলকামা সমালোচিত রাবী। তাঁর বেশ কিছু একক বর্ণনায় বিভিন্ন রকম দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষত এ শব্দগুলো একান্তই মুনকার। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের হাদীসও উক্ত হাদীসকে ভুল প্রতিপন্ন করে।
(وَقَالَ ٱلۡمَلِكُ إِنِّیۤ أَرَىٰ سَبۡعَ بَقَرَ ٰتࣲ سِمَانࣲ یَأۡكُلُهُنَّ سَبۡعٌ عِجَافࣱ وَسَبۡعَ سُنۢبُلَـٰتٍ خُضۡرࣲ وَأُخَرَ یَابِسَـٰتࣲۖ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡمَلَأُ أَفۡتُونِی فِی رُءۡیَـٰیَ إِن كُنتُمۡ لِلرُّءۡیَا تَعۡبُرُونَ قَالُوۤا۟ أَضۡغَـٰثُ أَحۡلَـٰمࣲۖ وَمَا نَحۡنُ بِتَأۡوِیلِ ٱلۡأَحۡلَـٰمِ بِعَـٰلِمِینَ وَقَالَ ٱلَّذِی نَجَا مِنۡهُمَا وَٱدَّكَرَ بَعۡدَ أُمَّةٍ أَنَا۠ أُنَبِّئُكُم بِتَأۡوِیلِهِۦ فَأَرۡسِلُونِ یُوسُفُ أَیُّهَا ٱلصِّدِّیقُ أَفۡتِنَا فِی سَبۡعِ بَقَرَ ٰتࣲ سِمَانࣲ یَأۡكُلُهُنَّ سَبۡعٌ عِجَافࣱ وَسَبۡعِ سُنۢبُلَـٰتٍ خُضۡرࣲ وَأُخَرَ یَابِسَـٰتࣲ لَّعَلِّیۤ أَرۡجِعُ إِلَى ٱلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ یَعۡلَمُونَ قَالَ تَزۡرَعُونَ سَبۡعَ سِنِینَ دَأَبࣰا فَمَا حَصَدتُّمۡ فَذَرُوهُ فِی سُنۢبُلِهِۦۤ إِلَّا قَلِیلࣰا مِّمَّا تَأۡكُلُونَ ثُمَّ یَأۡتِی مِنۢ بَعۡدِ ذَ ٰلِكَ سَبۡعࣱ شِدَادࣱ یَأۡكُلۡنَ مَا قَدَّمۡتُمۡ لَهُنَّ إِلَّا قَلِیلࣰا مِّمَّا تُحۡصِنُونَ ثُمَّ یَأۡتِی مِنۢ بَعۡدِ ذَ ٰلِكَ عَامࣱ فِیهِ یُغَاثُ ٱلنَّاسُ وَفِیهِ یَعۡصِرُونَ)
[Surat Yusuf ৪৩ - ৪৯]
অর্থাৎ, রাজা বলল, “আমি স্বপ্নে দেখলাম, সাতটি স্থূলকায় গাভী ওদেরকে সাতটি শীর্ণকায় গাভী ভক্ষণ করছে এবং দেখলাম সাতটি সবুজ শীষ ও অপর সাতটি শুষ্ক। হে প্রধানগণ! যদি তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে পার তবে আমার স্বপ্ন সম্বন্ধে অভিমত দাও। ওরা বলল, এটা অর্থহীন স্বপ্ন এবং আমরা এরূপ স্বপ্ন-ব্যাখ্যায় অভিজ্ঞ নই।’ দু’জন কারাবন্দীর মধ্যে যে মুক্তি পেয়েছিল এবং দীর্ঘকাল পরে যার স্মরণ হল, সে বলল, আমি এর তাৎপর্য তোমাদেরকে জানিয়ে দেব। সুতরাং তোমরা আমাকে পাঠাও। সে বলল, হে ইউসুফ! হে সত্যবাদী! সাতটি স্থূলকায় গাভী, তাদেরকে সাতটি শীর্ণকায় গাভী ভক্ষণ করছে এবং সাতটি সবুজ শীষ ও অপর সাতটি শুষ্ক শীষ সম্বন্ধে তুমি আমাদেরকে ব্যাখ্যা দাও। যাতে আমি তাদের কাছে ফিরে যেতে পারি ও যাতে তারা অবগত হতে পারে। ইউসুফ বলল, তোমরা সাত বছর একাদিক্রমে চাষ করবে। তারপর তোমরা যে শস্য সংগ্রহ করবে তার মধ্যে যে সামান্য পরিমাণ তোমরা ভক্ষণ করবে, তা ব্যতীত সমস্ত শীষ সমেত রেখে দিবে, এবং এরপর আসবে সাতটি কঠিন বছর, এ সাত বছর যা পূর্বে সঞ্চয় করে রাখবে লোকে তা খাবে, কেবল সামান্য কিছু যা তোমরা সংরক্ষণ করবে তা ব্যতীত। এবং এরপর আসবে এক বছর, সে বছর মানুষের জন্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে এবং সে বছর মানুষ প্রচুর ফলের রস নিংড়াবে। (১২: ৪৩-৪৯)
এখানে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর কারাগার থেকে সসম্মানে বের হওয়ার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। তা এভাবে যে, মিসরের বাদশাহ রায়্যান ইবন নূহ উপরোক্ত স্বপ্নটি দেখেন। তার বংশ লতিকা হচ্ছেঃ রায়্যান ইবনুল ওলীদ ইবন ছারওয়ান ইব্ন আরাশাহ ইবন ফারান ইবন আমর ইবন আমলাক ইবন লাউয ইবন সাম। আহলি কিতাবগণ বলেনঃ বাদশাহ স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি এক নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ সেখান থেকে সাতটি মোটাতাজা গাভী উঠে এসে নদী তীরের সবুজ বাগিচায় চরতে শুরু করে। অতঃপর ঐ নদী থেকে আরও সাতটি দুর্বল ও শীর্ণকায় গাভী উঠে এসে পূর্বের গাভীদের সাথে চরতে থাকে। এরপর এ দুর্বল গাভীগুলো মোটাতাজা গাভীদের কাছে গিয়ে সেগুলোকে খেয়ে ফেলে। এ সময় ভয়ে বাদশাহর ঘুম ভেঙে যায়। কিছুক্ষণ পর বাদশাহ পুনরায় ঘুমিয়ে পড়েন। এবার আবার স্বপ্নে দেখেন, একটি ধান গাছে সাতটি সবুজ শীষ। আর অপর দিকে আছে সাতটি শুকনো ও শীর্ণ শীষ। শুকনো শীষগুলো সবুজ সতেজ শীষগুলোকে খেয়ে ফেলছে। বাদশাহ এবারও ভয়ে ভীত হয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠেন। পরে বাদশাহ পারিষদ ও সভাসদবর্গের কাছে স্বপ্নের বর্ণনা দিয়ে এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু তারা কেউই স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী ছিল না। বরং ( قَالُوۤا۟ أَضۡغَـٰثُ أَحۡلَـٰمࣲۖ) (তারা বলল, এটা তো অর্থহীন স্বপ্ন) অর্থাৎ এটা হয়ত রাত্রিকালের স্বপ্ন বিভ্রাট। এর কোন ব্যাখ্যা নেই। এছাড়া স্বপ্নের ব্যাখ্যা দানে আমরা পারদর্শীও নই। তাই তারা বললঃ وَمَا نَحۡنُ بِتَأۡوِیلِ ٱلۡأَحۡلَـٰمِ بِعَـٰلِمِینَ (আর আমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা দানে অভিজ্ঞ নই।) এ সময় সেই কয়েদিটির ইউসুফ (عليه السلام)-এর কথা স্মরণে পড়ল যে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেছিল এবং যাকে হযরত ইউসুফ (عليه السلام) অনুরোধ করেছিলেন তার মনিবের নিকট ইউসুফ (عليه السلام)-এর কথা আলোচনা করতে। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত সে ঐ কথা ভুলে রয়েছিল। মূলত এটা ছিল আল্লাহ নির্ধারিত তকদীর এবং এর মধ্যে আল্লাহর নিগূঢ় রহস্য নিহিত ছিল। ঐ মুক্ত কয়েদী যখন বাদশাহর স্বপ্নের কথা শুনল ও এর ব্যাখ্যা প্রদানে সকলের অক্ষমতা দেখল, তখন ইউসুফ (عليه السلام)-এর কথা ও তার অনুরোধের কথা স্মরণ পড়ল। আল্লাহ তাই বলেছেনঃ وَقَالَ ٱلَّذِی نَجَا مِنۡهُمَا وَٱدَّكَرَ بَعۡدَ أُمَّةٍ (দু’জন কারাবন্দীর মধ্য থেকে যে ব্যক্তি মুক্তি লাভ করেছিল এবং দীর্ঘকাল পরে যার স্মরণ হয়েছিল, সে বলল, بعد امة অর্থ প্রচুর সময়ের পর অর্থাৎ কয়েক বছর পর। ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) ইকরিমা (رضي الله عنه) ও দাহহাক (رحمة الله)-এর কিরাআত অনুযায়ী وادجر بعد امة এর অর্থ بعد النسيان ভুলে যাওয়ার পর স্মরণ হল, মুজাহিদের কিরাআত بعد امة মীমের উপর সাকিন; এর অর্থও ভুলে যাওয়া (الرجل) অর্থ লোকটি ভুলে গেছে। কবি বলেছেনঃ
امهت وكنت لا انسي حديثا- كذلك هر يزى بالعقول
অর্থাৎ আমি ইদানীং অনেক কথা ভুলে যাই। অথচ ভুলে যাওয়ার দোষ আমার মধ্যে ছিল না। এভাবেই যুগের বিবর্তন জ্ঞানকে কলংকিত করে দেয়। পারিষদবর্গ ও বাদশাহকে উদ্দেশ করে সে বলল, أَنَا۠ أُنَبِّئُكُم بِتَأۡوِیلِهِۦ فَأَرۡسِلُونِ (আমি আপনাদেরকে এ স্বপ্নের তাৎপর্য জানাতে পারব। সুতরাং আমাকে পাঠিয়ে দিন) অর্থাৎ ইউসুফ (عليه السلام)-এর কাছে। তারপর ইউসুফ (عليه السلام)-এর কাছে গিয়ে সে বললঃ
یُوسُفُ أَیُّهَا ٱلصِّدِّیقُ أَفۡتِنَا فِی سَبۡعِ بَقَرَ ٰتࣲ سِمَانࣲ یَأۡكُلُهُنَّ سَبۡعٌ عِجَافࣱ وَسَبۡعِ سُنۢبُلَـٰتٍ خُضۡرࣲ وَأُخَرَ یَابِسَـٰتࣲ لَّعَلِّیۤ أَرۡجِعُ إِلَى ٱلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ یَعۡلَمُونَ
‘হে ইউসুফ! হে সত্যবাদী! সাতটি মোটাতাজা গাভী, তাদেরকে সাতটি শীর্ণকায় গাভী ভক্ষণ করছে এবং সাতটি সবুজ শীষকে অপর সাতটি শুষ্ক শীষ খেয়ে ফেলছে—এ স্বপ্নের আপনি ব্যাখ্যা বলে দিন। যাতে আমি লোকদের কাছে ফিরে গিয়ে বলতে পারি এবং তারাও জানতে পারে।’ (১২: ৪৬)
আহলি কিতাবদের মতে, বাদশাহর কাছে সাকী ইউসুফ (عليه السلام)-এর আলোচনা করে। বাদশাহ ইউসুফ (عليه السلام)-কে দরবারে ডেকে এনে স্বপ্নের বৃত্তান্ত তাঁকে জানান এবং ইউসুফ (عليه السلام) তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে শুনান। এটা ভুল। আহলি কিতাবদের পণ্ডিত ও রাব্বানীদের মনগড়া কথা। সঠিক সেটাই যা আল্লাহ কুরআনে বলেছেন। যা হোক, সাকীর কথার উত্তরে ইউসুফ (عليه السلام) কোন শর্ত ছাড়াই এবং আশু মুক্তি দাবি না করেই তাৎক্ষণিকভাবে বাদশাহর স্বপ্নের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে শুনালেন এবং বলে দিলেন, প্রথম সাত বছর স্বচ্ছন্দময় হবে এবং তারপরের সাত বছর দুর্ভিক্ষ থাকবে।
ثُمَّ یَأۡتِی مِنۢ بَعۡدِ ذَ ٰلِكَ عَامࣱ فِیهِ یُغَاثُ ٱلنَّاسُ (এরপর আসবে এক বছর। সে বছরে মানুষের জন্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে) ফলে প্রচুর ফসল ফলবে ও মানুষ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে। وَفِیهِ یَعۡصِرُونَ (সে বছরে তারা প্রচুর রস নিংড়াবে) অর্থাৎ আখ, আঙ্গুর, যয়তুন, তিল ইত্যাদির রস বের করবে তাদের অভ্যাস অনুযায়ী। স্বপ্নের ব্যাখ্যার সাথে হযরত ইউসুফ (عليه السلام) সচ্ছলতার সময় ও দুর্ভিক্ষকালে তাদের করণীয় সম্পর্কে পথনির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন, প্রথম সাত বছরের ফসলের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশ শীষসহ সঞ্চয় করে রাখবে। পরের সাত বছরে সঞ্চিত ফসল অল্প অল্প করে খরচ করবে। কেননা এরপরে ফসলের জন্যে বীজ পাওয়া দুষ্কর হতে পারে। এ থেকে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়।
وَقَالَ ٱلۡمَلِكُ ٱئۡتُونِی بِهِۦۖ فَلَمَّا جَاۤءَهُ ٱلرَّسُولُ قَالَ ٱرۡجِعۡ إِلَىٰ رَبِّكَ فَسۡـَٔلۡهُ مَا بَالُ ٱلنِّسۡوَةِ ٱلَّـٰتِی قَطَّعۡنَ أَیۡدِیَهُنَّۚ إِنَّ رَبِّی بِكَیۡدِهِنَّ عَلِیمࣱ قَالَ مَا خَطۡبُكُنَّ إِذۡ رَ ٰوَدتُّنَّ یُوسُفَ عَن نَّفۡسِهِۦۚ قُلۡنَ حَـٰشَ لِلَّهِ مَا عَلِمۡنَا عَلَیۡهِ مِن سُوۤءࣲۚ قَالَتِ ٱمۡرَأَتُ ٱلۡعَزِیزِ ٱلۡـَٔـٰنَ حَصۡحَصَ ٱلۡحَقُّ أَنَا۠ رَ ٰوَدتُّهُۥ عَن نَّفۡسِهِۦ وَإِنَّهُۥ لَمِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ ذَ ٰلِكَ لِیَعۡلَمَ أَنِّی لَمۡ أَخُنۡهُ بِٱلۡغَیۡبِ وَأَنَّ ٱللَّهَ لَا یَهۡدِی كَیۡدَ ٱلۡخَاۤىِٕنِینَ ۞ وَمَاۤ أُبَرِّئُ نَفۡسِیۤۚ إِنَّ ٱلنَّفۡسَ لَأَمَّارَةُۢ بِٱلسُّوۤءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّیۤۚ إِنَّ رَبِّی غَفُورࣱ رَّحِیمࣱ
[Surat Yusuf ৫০ - ৫৩]
অর্থাৎ, রাজা বলল, তোমরা ইউসুফকে আমার নিকট নিয়ে এস। দূত যখন তাঁর নিকট উপস্থিত হল তখন সে বলল, তুমি তোমার প্রভুর নিকট ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস কর, এবং যে নারীগণ হাত কেটে ফেলেছিল তাদের অবস্থা কী? আমার প্রতিপালক তাদের ছলনা সম্পর্কে সম্যক অবগত। রাজা নারীগণকে বলল, “যখন তোমরা ইউসুফ থেকে অসৎ কর্ম কামনা করেছিলে, তখন তোমাদের কী হয়েছিল। তারা বলল, অদ্ভুত আল্লাহর মাহাত্ম্য! আমরা ওর মধ্যে কোন দোষ দেখিনি। আযীযের স্ত্রী বলল, এক্ষণে সত্য প্রকাশ হল। আমিই তার থেকে অসৎ কর্ম কামনা করেছিলাম সে তো সত্যবাদী। সে বলল, আমি এটা বলেছিলাম, যাতে সে জানতে পারে যে, তার অনুপস্থিতিতে আমি তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি এবং আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্র সফল করেন না। সে বলল, আমি আমাকে নির্দোষ মনে করি না। মানুষের মন অবশ্যই মন্দকর্মপ্রবণ। কিন্তু সে নয়, যার প্রতি আমার প্রতিপালক দয়া করেন। আমার প্রতিপালক অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (১২: ৫০-৫৩)
বাদশাহ যখন হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, সঠিক সিদ্ধান্ত ও অনুধাবন ক্ষমতার সম্যক পরিচয় পেলেন, তখন তাকে তার দরবারে উপস্থিত করার আদেশ দেন। যাতে করে তিনি তাঁকে কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত করতে পারেন। দূত যখন ইউসুফ (عليه السلام)-এর কাছে আসে তখন হযরত ইউসুফ (عليه السلام) সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি জেলখানা থেকে ততক্ষণ পর্যন্ত বের হবেন না, যতক্ষণ না প্রত্যেক ব্যক্তি জানতে পারে যে, তাকে অন্যায়ভাবে ও শত্রুতাবশত কারাগারে আবদ্ধ করা হয়েছিল এবং মহিলারা তাঁর প্রতি যে দোষ আরোপ করেছে তা সম্পূর্ণ অমূলক অপবাদ, তিনি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তাই তিনি বললেনঃ ( ٱرۡجِعۡ إِلَىٰ رَبِّكَ) (তুমি তোমার প্রভুর কাছে চলে যাও) অর্থাৎ বাদশাহর কাছে।
فَسۡـَٔلۡهُ مَا بَالُ ٱلنِّسۡوَةِ ٱلَّـٰتِی قَطَّعۡنَ أَیۡدِیَهُنَّۚ إِنَّ رَبِّی بِكَیۡدِهِنَّ عَلِیمࣱ (এবং তাকে জিজ্ঞেস কর, যেসব মহিলা নিজেদের হাত কেটে ফেলেছিল তাদের অবস্থা কী? আমার প্রতিপালক তো তাদের ছলনা সম্পর্কে সম্যক অবগত।) কেউ কেউ এখানে ان ربي এর অর্থ মনিব ও প্রভু বলেছেন। অর্থাৎ আমার মনিব আযীয আমার পবিত্রতা এবং আমার প্রতি আরোপিত অপবাদ সম্পর্কে ভাল করেই জানেন। সুতরাং বাদশাহকে গিয়ে বল, তিনি ঐ মহিলাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন যে, তারা যখন আমাকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিল, তখন আমি কত দৃঢ়ভাবে আত্মরক্ষা করেছিলাম। মহিলাদের কাছে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বুঝবে যে, প্রকৃত ঘটনা কি ছিল এবং আমিই-বা কী ভাল কাজ করেছিলাম? قُلۡنَ حَـٰشَ لِلَّهِ مَا عَلِمۡنَا عَلَیۡهِ مِن سُوۤءࣲۚ (তারা বলল, অদ্ভুত আল্লাহর মহিমা! আমরা ইউসুফের মধ্যে কোন দোষ দেখিনি) قَالَتِ ٱمۡرَأَتُ ٱلۡعَزِیزِ (আযীযের স্ত্রী বলল) তিনি ছিলেন যুলায়খা। ٱلۡـَٔـٰنَ حَصۡحَصَ ٱلۡحَقُّ (এক্ষণে সত্য প্রকাশিত হল) অর্থাৎ যেটা বাস্তব ও সত্য তা প্রকাশিত ও সুস্পষ্ট হয়ে গেল। আর সত্যই অনুসরণযোগ্য। أَنَا۠ رَ ٰوَدتُّهُۥ عَن نَّفۡسِهِۦ وَإِنَّهُۥ لَمِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ (আমিই তার থেকে অসৎকর্ম কামনা করেছিলাম। বস্তুত সে-ই সত্যবাদী।) অর্থাৎ সে দোষমুক্ত। সে আমার কাছে অসৎকর্ম কামনা করেনি এবং তাকে মিথ্যা, জুলুম, অন্যায় ও অপবাদ দিয়ে কারাবন্দী করা হয়েছে।
ذَ ٰلِكَ لِیَعۡلَمَ أَنِّی لَمۡ أَخُنۡهُ بِٱلۡغَیۡبِ وَأَنَّ ٱللَّهَ لَا یَهۡدِی كَیۡدَ ٱلۡخَاۤىِٕنِینَ (আমি এটি বলছিলাম যাতে সে জানতে পারে যে, তার অগোচরে আমি তার বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আর আল্লাহ্ বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্র সফল করেন না।)
কারো কারো মতে, এটা হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর কথা। তখন অর্থ হবেঃ আমি এ বিষয়টি যাচাই করতে চাই এ উদ্দেশ্যে, যাতে আযীয জানতে পারে যে, তার অনুপস্থিতিতে আমি তার সাথে কোন বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আবার কারো কারো মতে, এটা যুলায়খার উক্তি। তখন অর্থ হবে এই যে, আমি একথা স্বীকার করছি এ উদ্দেশ্যে, যাতে আমার স্বামী জানতে পারে যে, আমি মূলত তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার কোন কাজ করিনি। এটা অবশ্য তার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু আমার সাথে কোন অশ্লীল কাজ সংঘটিত হয়নি। পরবর্তীকালের অনেক ইমামই এই মতকে সমর্থন করেন। ইব্ন জারির ও ইবন আবী হাতিম (رحمة الله) প্রথম মত ব্যতীত অন্য কিছু বর্ণনাই করেননি।
وَمَاۤ أُبَرِّئُ نَفۡسِیۤۚ إِنَّ ٱلنَّفۡسَ لَأَمَّارَةُۢ بِٱلسُّوۤءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّیۤۚ إِنَّ رَبِّی غَفُورࣱ رَّحِیمࣱ (আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করি না। মানুষের মন অবশ্যই মন্দকর্মপ্রবণ। কিন্তু সে নয় যার প্রতি আমার প্রতিপালক দয়া করেন। নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।)
কেউ বলেছেন, এটা ইউসুফ (عليه السلام)-এর উক্তি, আবার কেউ বলেছেন যুলায়খার উক্তি। পূর্বের আয়াতের দুই ধরনের মতামত থাকায় এ আয়াতেও দুই প্রকার মতের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এটা যুলায়খার বক্তব্য হওয়াটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও সঙ্গত।
আল্লাহর বাণীঃ
(وَقَالَ ٱلۡمَلِكُ ٱئۡتُونِی بِهِۦۤ أَسۡتَخۡلِصۡهُ لِنَفۡسِیۖ فَلَمَّا كَلَّمَهُۥ قَالَ إِنَّكَ ٱلۡیَوۡمَ لَدَیۡنَا مَكِینٌ أَمِینࣱ قَالَ ٱجۡعَلۡنِی عَلَىٰ خَزَاۤىِٕنِ ٱلۡأَرۡضِۖ إِنِّی حَفِیظٌ عَلِیمࣱ وَكَذَ ٰلِكَ مَكَّنَّا لِیُوسُفَ فِی ٱلۡأَرۡضِ یَتَبَوَّأُ مِنۡهَا حَیۡثُ یَشَاۤءُۚ نُصِیبُ بِرَحۡمَتِنَا مَن نَّشَاۤءُۖ وَلَا نُضِیعُ أَجۡرَ ٱلۡمُحۡسِنِینَ وَلَأَجۡرُ ٱلۡـَٔاخِرَةِ خَیۡرࣱ لِّلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ وَكَانُوا۟ یَتَّقُونَ)[Surat Yusuf ৫৪ - ৫৭]
অর্থাৎ, রাজা বলল, ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে আমার একান্ত সহচর নিযুক্ত করব। তারপর রাজা যখন তার সাথে কথা বলল, তখন রাজা বলল, আজ তুমি আমাদের কাছে মর্যাদাশালী ও বিশ্বাসভাজন হলে। ইউসুফ বলল, আমাকে দেশের ধন-সম্পদের উপর কর্তৃত্ব প্রদান করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও সুবিজ্ঞ।’ এভাবে ইউসুফ (عليه السلام)-কে আমি সে দেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম। সে সেদেশে যেখানে ইচ্ছা অবস্থান করতে পারত।
আমি যাকে ইচ্ছা তার প্রতি দয়া করি; আমি সৎকর্মপরায়ণদের শ্রমফল নষ্ট করি না। যারা মুমিন এবং মুত্তাকী তাদের পরলোকের পুরস্কারই উত্তম। (১২: ৫৪-৫৭)।
ইউসুফ (عليه السلام)-এর উপর যে অপবাদ দেয়া হয়েছিল তা থেকে যখন তাঁর মুক্ত ও পবিত্র থাকার কথা বাদশাহর কাছে সুস্পষ্ট হল তখন তিনি বললেনঃ ( ٱئۡتُونِی بِهِۦۤ أَسۡتَخۡلِصۡهُ لِنَفۡسِیۖ (ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে এসো, আমি তাকে আমার একান্ত সহচর করে রাখব) অর্থাৎ আমি তাকে আমার বিশেষ পারিষদ ও রাষ্ট্রীয় উচ্চমর্যাদা দিয়ে আমার পারিষদভুক্ত করে রাখব। তারপর বাদশাহ যখন ইউসুফ (عليه السلام)-এর সাথে কথা বললেন, এবং তাঁর কথাবার্তা শুনে তাঁর অবস্থাদি সম্যক জানলেন, তখন বললেনঃ إِنَّكَ ٱلۡیَوۡمَ لَدَیۡنَا مَكِینٌ أَمِینࣱ (আজ তুমি আমাদের কাছে মর্যাদাশীল ও বিশ্বাসভাজন হলে)
قَالَ ٱجۡعَلۡنِی عَلَىٰ خَزَاۤىِٕنِ ٱلۡأَرۡضِۖ إِنِّی حَفِیظٌ عَلِیمࣱ ) (ইউসুফ বললঃ আমাকে রাজ্যের ধন-সম্পদের উপর কর্তৃত্ব প্রদান করুন; আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও সুবিজ্ঞ।) হযরত ইউসুফ (عليه السلام) বাদশাহর কাছে ধন-ভাণ্ডারের উপর তদারকির দায়িত্বভার চাইলেন। কারণ, প্রথম সাত বছর পর দুর্ভিক্ষের কালে সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশংকা ছিল। সুতরাং সে সময় আল্লাহর পছন্দ অনুযায়ী মানুষের কল্যাণ সাধন ও তাদের প্রতি সদয় আচরণ করার ব্যাপারে যাতে ত্রুটি না হয়, সে লক্ষ্যে তিনি এই পদ কামনা করেন। বাদশাহকে তিনি আশ্বস্ত করেন যে, তাঁর দায়িত্বে যা দেয়া হবে তা তিনি বিশ্বস্ততার সাথে সংরক্ষণ করবেন এবং রাজস্ব বিষয়ে উন্নতি ও উৎকর্ষ বিধানে তিনি বিশেষ অভিজ্ঞতার পরিচয় দেবেন। এতেই প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি নিজের আমানতদারী ও দায়িত্ব পালনের প্রতি দৃঢ় আস্থাশীল, সে তার যোগ্য পদের জন্য আবেদন করতে পারে।
আহলি কিতাবদের মতে, ফিরআউন (মিসরের বাদশাহ) ইউসুফ (عليه السلام)-কে পরম মর্যাদা দান করেন এবং সমগ্র মিসর দেশের কর্তৃত্ব তাঁর হাতে তুলে দেন। নিজের বিশেষ আংটি ও রেশমী পোশাক তিনি তাকে পরিয়ে দেন, তাঁকে স্বর্ণের হারে ভূষিত করে এবং মসনদের দ্বিতীয় আসনে তাঁকে আসীন করেন। তারপর বাদশাহর সম্মুখেই ঘোষণা করা হলোঃ আজ থেকে আপনিই দেশের প্রকৃত শাসক। কেবল নিয়মতান্ত্রিক প্রধানরূপে রাজ সিংহাসনের অধিকারী হওয়া ছাড়া অন্য কোন দিক দিয়েই আমি আপনার চেয়ে অধিক ক্ষমতাশালী নই। তারা বলেন, ইউসুফ (عليه السلام)-এর বয়স তখন ত্রিশ বছর এবং এক অভিজাত বংশীয়া মহিলা ছিলেন তাঁর স্ত্রী।
বিখ্যাত তাফসীরবিদ ছালাবী বলেছেন, মিসরের বাদশাহ আযীযে মিসর কিতফীরকে পদচ্যুত করে ইউসুফ (عليه السلام)-কে সেই পদে বসান। কথিত আছে, কিতফীরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী যুলায়খাকে বাদশাহ ইউসুফের সাথে বিবাহ দেন। ইউসুফ (عليه السلام) যুলায়খাকে কুমারী অবস্থায় পান। কেননা, যুলায়খার স্বামী স্ত্রী সংসর্গে যেতেন না। যুলায়খার গর্ভে ইউসুফ (عليه السلام)-এর দুই পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তাদের নাম আফরাইম ও মানশা। এভাবে ইউসুফ (عليه السلام) মিসরের কর্তৃত্ব লাভ করে সে দেশে ন্যায়বিচার কায়েম করেন এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের কাছেই বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
কথিত আছে, ইউসুফ (عليه السلام) যখন কারাগার থেকে বের হয়ে বাদশাহর সম্মুখে আসেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ত্রিশ বছর। বাদশাহ সত্ত্বরটি ভাষায় তাঁর সাথে কথা বলেন। যখন যে ভাষায় তিনি কথা বলেন, ইউসুফ (عليه السلام) তখন সেই ভাষায়ই তার উত্তর দিতে থাকেন। অল্প বয়স হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এ অসাধারণ যোগ্যতা দেখে বাদশাহ বিস্মিত হন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আল্লাহর বাণীঃ وَكَذَ ٰلِكَ مَكَّنَّا لِیُوسُفَ فِی ٱلۡأَرۡضِ (এভাবে আমি ইউসুফকে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত করি।) অর্থাৎ কারাগারের সংকীর্ণ বন্দী জীবন শেষে তাকে মুক্ত করে মিসরের সর্বত্র স্বাধীনভাবে চলাচলের ব্যবস্থা করে দিই। یَتَبَوَّأُ مِنۡهَا حَیۡثُ یَشَاۤءُۚ نُصِیبُ بِرَحۡمَتِنَا مَن نَّشَاۤءُۖ (সে তথায় যেখানে ইচ্ছা নিজের জন্যে স্থান করে নিতে পারত) অর্থাৎ মিসরের যে কোন জায়গায় স্থায়িভাবে থাকার ইচ্ছা করলে সম্মান ও মর্যাদার সাথে তা করার সুযোগ ছিল।) نُصِیبُ بِرَحۡمَتِنَا مَن نَّشَاۤءُۖوَلَا نُضِیعُ أَجۡرَ ٱلۡمُحۡسِنِینَ (আমি যাকে ইচ্ছা তাকে আমার রহমত দান করি এবং সৎ কর্মশীলদের বিনিময় আমি বিনষ্ট করি না।) অর্থাৎ এই যা কিছু করা হল তা একজন মুমিনের প্রতি আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ বিশেষ। এ ছাড়াও মুমিনের জন্যে রয়েছে পরকালীন প্রভূত কল্যাণ ও উত্তম প্রতিদান।
এ কারণেই আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ وَلَأَجۡرُ ٱلۡـَٔاخِرَةِ خَیۡرࣱ لِّلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ وَكَانُوا۟ یَتَّقُونَ (যারা মু’মিন এবং মুত্তাকী তাদের আখিরাতের পুরস্কারই উত্তম ) কথিত আছে, যুলায়খার স্বামী ইতফীরের মৃত্যুর পর বাদশাহ ইউসুফ (عليه السلام)-কে তার পদে নিযুক্ত করেন এবং তার স্ত্রী যুলায়খাকে ইউসুফ (عليه السلام)-এর সাথে বিয়ে দেন। ইউসুফ (عليه السلام) নিজেকে একজন সত্যবাদী ও ন্যায়নিষ্ঠ উযীর হিসেবে প্রমাণিত করেন।
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) বলেন, মিসরের বাদশাহ ওলীদ ইবন রায়ান ইউসুফ (عليه السلام)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
জনৈক কবি বলেছেনঃ
وراء مضيق الخوف متسع الامن - واول مفروح به غاية الحزن فلا تيأسن فالله ملك يوسفا - خزائنه بعد الخلاص من السجن
অর্থঃ ভয়-ভীতির সংকীর্ণতার পরে থাকে নিরাপত্তার প্রশস্ততা আর আনন্দ স্কুর্তির পূর্বে থাকে চূড়ান্ত পেরেশানী ও চিন্তা। অতএব, তুমি নিরাশ হয়ো না। কেননা আল্লাহ হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-কে অন্ধ কারাগার থেকে মুক্ত করে তার ধন-ভাণ্ডারের মালিক করে দিয়েছিলেন।
মহান আল্লাহ বলেন।
(وَجَاۤءَ إِخۡوَةُ یُوسُفَ فَدَخَلُوا۟ عَلَیۡهِ فَعَرَفَهُمۡ وَهُمۡ لَهُۥ مُنكِرُونَ وَلَمَّا جَهَّزَهُم بِجَهَازِهِمۡ قَالَ ٱئۡتُونِی بِأَخࣲ لَّكُم مِّنۡ أَبِیكُمۡۚ أَلَا تَرَوۡنَ أَنِّیۤ أُوفِی ٱلۡكَیۡلَ وَأَنَا۠ خَیۡرُ ٱلۡمُنزِلِینَ فَإِن لَّمۡ تَأۡتُونِی بِهِۦ فَلَا كَیۡلَ لَكُمۡ عِندِی وَلَا تَقۡرَبُونِ قَالُوا۟ سَنُرَ ٰوِدُ عَنۡهُ أَبَاهُ وَإِنَّا لَفَـٰعِلُونَ وَقَالَ لِفِتۡیَـٰنِهِ ٱجۡعَلُوا۟ بِضَـٰعَتَهُمۡ فِی رِحَالِهِمۡ لَعَلَّهُمۡ یَعۡرِفُونَهَاۤ إِذَا ٱنقَلَبُوۤا۟ إِلَىٰۤ أَهۡلِهِمۡ لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُونَ )
[Surat Yusuf ৫৮ - ৬২]
অর্থাৎ, ইউসুফের ভাইয়েরা আসল এবং তার কাছে উপস্থিত হল। সে ওদেরকে চিনল; কিন্তু ওরা তাকে চিনতে পারল না এবং সে যখন ওদের সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিল, তখন সে বলল, ‘তোমরা আমার কাছে তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইকে নিয়ে এসো। তোমরা কি দেখছ না যে, আমি মাপে পূর্ণ মাত্রায় দেই? আমি উত্তম মেযবান? কিন্তু তোমরা যদি তাকে আমার কাছে নিয়ে না আস তবে আমার কাছে তোমাদের জন্যে কোন বরাদ্দ থাকবে না এবং তোমরা আমার নিকটবর্তী হবে না। তারা বলল, ‘তার বিষয়ে আমরা তার পিতাকে সম্মত করার চেষ্টা করব এবং আমরা নিশ্চয়ই এটা করব।’ ইউসুফ তার ভৃত্যদেরকে বলল, ‘ওরা যে পণ্যমূল্য দিয়েছে তা তাদের মালপত্রের মধ্যে রেখে দাও-যাতে স্বজনদের কাছে প্রত্যাবর্তনের পর তারা বুঝতে পারে যে, এটা প্রত্যপর্ণ করা হয়েছে; তাহলে তারা পুনরায় আসতে পারে।’ (সূরা ইউসুফঃ ৫৮-৬২)
এখানে আল্লাহ হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর ভাইদের মিসরে আগমনের বিষয়ে জানাচ্ছেন যে, দুর্ভিক্ষের বছরগুলোতে যখন সমগ্র দেশ ও জাতি তার করাল গ্রাসে পতিত হয়, তখন খাদ্য সংগ্রহের জন্যে তারা মিসরে আগমন করে। ইউসুফ (عليه السلام) ঐ সময় মিসরের দীনী ও দুনিয়াবী সার্বিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ভাইয়েরা ইউসুফ (عليه السلام)-এর কাছে উপস্থিত হলে তিনি তাদের চিনে ফেলেন কিন্তু তারা তাকে চিনতে পারল না। কারণ ইউসুফ (عليه السلام) এত বড় উচ্চ পদ-মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন এটা তাদের কল্পনারও অতীত ছিল। তাই তিনি তাদেরকে চিনলেও তারা তাকে চিনতে পারেনি।
আহলি কিতাবদের মতে, ইউসুফ (عليه السلام)-এর ভাইয়েরা তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে সিজদা করে। এ সময় ইউসুফ (عليه السلام) তাদেরকে চিনে ফেলেন। তবে তিনি চাচ্ছিলেন, তারা যেন তাঁকে চিনতে না পারে। সুতরাং তিনি তাদের প্রতি কঠোর ভাষা ব্যবহার করেন এবং বলেন, তোমরা গোয়েন্দা বাহিনীর লোক আমার দেশের গোপন তথ্য নেয়ার জন্যে তোমরা এখানে এসেছ। তারা বলল, আল্লাহর কাছে পানাহ চাই! আমরা তো ক্ষুধা ও অভাবের তাড়নায় পরিবারবর্গের জন্যে খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছি। আমরা একই পিতার সন্তান। বাড়ি কিনআন। আমরা মোট বার ভাই। একজন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, সর্ব কনিষ্ঠজন পিতার কাছেই আছে। এ কথা শুনে ইউসুফ (عليه السلام) বললেন, আমি তোমাদের বিষয়টি অবশ্যই তদন্ত করে দেখব। আহলি কিতাবরা আরও বলে যে, ইউসুফ (عليه السلام) ভাইদেরকে তিনদিন পর্যন্ত বন্দী করে রাখেন। তিনদিন পর তাদেরকে মুক্তি দেন, তবে শামউন নামক এক ভাইকে আটক করে রাখেন। যাতে তারা অপর ভাইটিকে পরবর্তীতে নিয়ে আসে। আহলি কিতাবদের এ বর্ণনার কোন কোন দিক আপত্তিকর। আল্লাহর বাণীঃ (وَلَمَّا جَهَّزَهُم بِجَهَازِهِمۡ) (ইউসুফ যখন তাদের রসদের ব্যবস্থা করে দিলেন। অর্থাৎ তিনি কাউকে এক উট বোঝাইর বেশি খাদ্য রসদ প্রদান করতেন না। সে নিয়ম অনুযায়ী তাদের প্রত্যেককে এক উট বোঝাই রসদ প্রদান করলেন। قَالَ ٱئۡتُونِی بِأَخࣲ لَّكُم مِّنۡ أَبِیكُمۡۚ (তোমরা তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইটিকে আমার কাছে নিয়ে এসো) ইউসুফ (عليه السلام) তাদেরকে তাদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তারা বলেছিল, আমরা বার ভাই ছিলাম। আমাদের মধ্যকার একজন চলে গেছে। তার সহোদরটি পিতার কাছে রয়েছে।
ইউসুফ (عليه السلام) বললেন, আগামী বছর যখন তোমরা আসবে তখন তাকে সাথে নিয়ে এসো। أَلَا تَرَوۡنَ أَنِّیۤ أُوفِی ٱلۡكَیۡلَ وَأَنَا۠ خَیۡرُ ٱلۡمُنزِلِینَ (তোমরা কি দেখছ না, আমি মাপে পূর্ণ মাত্রায় দেই এবং মেহমানদেরকে সমাদর করি?) অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে উত্তমভাবে মেহমানদারী করেছি, তোমাদের থাকার ভাল ব্যবস্থা করেছি। এ কথা দ্বারা তিনি অপর ভাইকে আনার জন্যে তাদেরকে উৎসাহিত করেন। যদি তারা তাকে না আনে তবে তাদেরকে তার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেনঃ
فَإِن لَّمۡ تَأۡتُونِی بِهِۦ فَلَا كَیۡلَ لَكُمۡ عِندِی وَلَا تَقۡرَبُونِ অর্থাৎ, যদি তাকে আমার কাছে নিয়ে না আস, তাহলে আমার কাছে তোমাদের কোন বরাদ্দ থাকবে না এবং তোমরা আমার নিকটবর্তী হবে না। অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে রসদও দেব না। আমার কাছে ঘেঁষতেও দেব না। তাদেরকে প্রথমে যেভাবে বলেছিলেন এটা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতরাং উৎসাহ ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তাকে হাযির করার জন্য তিনি এ ব্যবস্থা করেন। قَالُوا۟ سَنُرَ ٰوِدُ عَنۡهُ أَبَاهُ (তারা বললঃ আমরা তার সম্পর্কে তার পিতাকে সম্মত করার চেষ্টা করব।) অর্থাৎ আমাদের সাথে তাকে আনার জন্যে এবং আপনার কাছে হাযির করার জন্যে সম্ভাব্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব وَإِنَّا لَفَـٰعِلُونَ (এবং আমরা তা অবশ্যই করব) অর্থাৎ তাকে আনতে আমরা অবশ্যই সক্ষম হব। তারপর হযরত ইউসুফ (عليه السلام) তাদের প্রদত্ত পণ্যমূল্য এমনভাবে তাদের মালামালের মধ্যে রেখে দেয়ার জন্যে ভৃত্যদেরকে নির্দেশ দেন যাতে তারা তা টের না পায়।
لَعَلَّهُمۡ یَعۡرِفُونَهَاۤ إِذَا ٱنقَلَبُوۤا۟ إِلَىٰۤ أَهۡلِهِمۡ لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُونَ
যাতে স্বজনদের কাছে প্রত্যাবর্তনের পর তারা বুঝতে পারে যে তা প্রত্যর্পণ করা হয়েছে। তাহলে তারা পুনরায় আসতে পারে। মূল্য ফেরত দেওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কেউ বলেছেন, হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর ইচ্ছা ছিল, যখন তারা দেশে গিয়ে তা লক্ষ্য করবে তখন তা ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। অন্য কেউ বলেছেন, হযরত ইউসুফ (عليه السلام) আশংকা করছিলেন যে, দ্বিতীয়বার আসার মত অর্থ হয়তো থাকবে না। কারও মতে, ভাইদের নিকট থেকে খাদ্য দ্রব্যের বিনিময় গ্রহণ করা তাঁর কাছে নিন্দনীয় বলে মনে হচ্ছিল।
তাদের পণ্যমূল্য কি জিনিস ছিল সে ব্যাপারে মুফাসসিরদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। পরে সে সম্পর্কে আলোচনা আসছে। আহলি কিতাবদের মতে তা ছিল রৌপ্য ভর্তি থলে। এ মতই যথার্থ মনে হয়।
(فَلَمَّا رَجَعُوۤا۟ إِلَىٰۤ أَبِیهِمۡ قَالُوا۟ یَـٰۤأَبَانَا مُنِعَ مِنَّا ٱلۡكَیۡلُ فَأَرۡسِلۡ مَعَنَاۤ أَخَانَا نَكۡتَلۡ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَـٰفِظُونَ قَالَ هَلۡ ءَامَنُكُمۡ عَلَیۡهِ إِلَّا كَمَاۤ أَمِنتُكُمۡ عَلَىٰۤ أَخِیهِ مِن قَبۡلُ فَٱللَّهُ خَیۡرٌ حَـٰفِظࣰاۖ وَهُوَ أَرۡحَمُ ٱلرَّ ٰحِمِینَ وَلَمَّا فَتَحُوا۟ مَتَـٰعَهُمۡ وَجَدُوا۟ بِضَـٰعَتَهُمۡ رُدَّتۡ إِلَیۡهِمۡۖ قَالُوا۟ یَـٰۤأَبَانَا مَا نَبۡغِیۖ هَـٰذِهِۦ بِضَـٰعَتُنَا رُدَّتۡ إِلَیۡنَاۖ وَنَمِیرُ أَهۡلَنَا وَنَحۡفَظُ أَخَانَا وَنَزۡدَادُ كَیۡلَ بَعِیرࣲۖ ذَ ٰلِكَ كَیۡلࣱ یَسِیرࣱ قَالَ لَنۡ أُرۡسِلَهُۥ مَعَكُمۡ حَتَّىٰ تُؤۡتُونِ مَوۡثِقࣰا مِّنَ ٱللَّهِ لَتَأۡتُنَّنِی بِهِۦۤ إِلَّاۤ أَن یُحَاطَ بِكُمۡۖ فَلَمَّاۤ ءَاتَوۡهُ مَوۡثِقَهُمۡ قَالَ ٱللَّهُ عَلَىٰ مَا نَقُولُ وَكِیلࣱ وَقَالَ یَـٰبَنِیَّ لَا تَدۡخُلُوا۟ مِنۢ بَابࣲ وَ ٰحِدࣲ وَٱدۡخُلُوا۟ مِنۡ أَبۡوَ ٰبࣲ مُّتَفَرِّقَةࣲۖ وَمَاۤ أُغۡنِی عَنكُم مِّنَ ٱللَّهِ مِن شَیۡءٍۖ إِنِ ٱلۡحُكۡمُ إِلَّا لِلَّهِۖ عَلَیۡهِ تَوَكَّلۡتُۖ وَعَلَیۡهِ فَلۡیَتَوَكَّلِ ٱلۡمُتَوَكِّلُونَ وَلَمَّا دَخَلُوا۟ مِنۡ حَیۡثُ أَمَرَهُمۡ أَبُوهُم مَّا كَانَ یُغۡنِی عَنۡهُم مِّنَ ٱللَّهِ مِن شَیۡءٍ إِلَّا حَاجَةࣰ فِی نَفۡسِ یَعۡقُوبَ قَضَىٰهَاۚ وَإِنَّهُۥ لَذُو عِلۡمࣲ لِّمَا عَلَّمۡنَـٰهُ وَلَـٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا یَعۡلَمُونَ)[Surat Yusuf ৬৩ - ৬৮]
অর্থাৎ, তারপর তারা যখন তাদের পিতার কাছে ফিরে আসল তখন তারা বলল, হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্যে বরাদ্দ নিষিদ্ধ করা হয়েছে; সুতরাং আমাদের ভাইকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন যাতে আমরা রসদ পেতে পারি। আমরা অবশ্যই তার রক্ষণাবেক্ষণ করব।’ সে বলল, “আমি কি তোমাদেরকে তার সম্বন্ধে সেরূপ বিশ্বাস করব, যেরূপ বিশ্বাস পূর্বে তোমাদেরকে করেছিলাম তার ভাই সম্বন্ধে? আল্লাহ্ই রক্ষণাবেক্ষণে শ্রেষ্ঠ এবং তিনি দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু। যখন ওরা ওদের মালপত্র খুলল তখন ওরা দেখতে পেল ওদের পণ্যমূল্য ওদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।
ওরা বলল, হে আমাদের পিতা! আমরা আর কি প্রত্যাশা করতে পারি? এতো আমাদের প্রদত্ত পণ্যমূল্য, আমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে; পুনরায় আমরা আমাদের পরিবারবর্গকে খাদ্য-সামগ্রী এনে দেব এবং আমরা আমাদের ভ্রাতার রক্ষণাবেক্ষণ করব এবং আমরা অতিরিক্ত আর এক উট বোঝাই পণ্য আনব; যা এনেছি তা পরিমাণে অল্প। পিতা বলল, আমি ওকে কখনই তোমাদের সাথে পাঠাব না, যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর নামে অঙ্গীকার কর যে, তোমরা ওকে আমার কাছে নিয়ে আসবেই, অবশ্য যদি তোমরা একান্ত অসহায় হয়ে না পড়।’ তারপর যখন ওরা তার কাছে প্রতিজ্ঞা করল, তখন সে বলল, আমরা যে বিষয়ে কথা বলছি, আল্লাহ তার বিধায়ক। সে বলল, হে আমার পুত্রগণ! তোমরা এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না। ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে আমি তোমাদের জন্য কিছু করতে পারি না। বিধান আল্লাহরই। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি এবং যারা নির্ভর করতে চায় তারা আল্লাহরই উপর নির্ভর করুক এবং যখন তারা তাদের পিতা তাদেরকে যেভাবে আদেশ করেছিল। সেভাবেই প্রবেশ করল, তখন আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে তা তাদের কোন কাজে আসল না; ইয়াকূব কেবল তার মনের একটি অভিপ্রায় পূর্ণ করেছিল এবং সে অবশ্যই জ্ঞানী ছিল। কারণ আমি তাকে শিক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এটি অবগত নয়। (১২: ৬৩-৬৮)
মিসর থেকে তাদের পিতার কাছে ফিরে আসার পরের ঘটনা আল্লাহ তা’আলা এখানে বর্ণনা করছেনঃ পিতাকে তারা বলেঃ (مُنِعَ مِنَّا ٱلۡكَیۡلُ) (আমাদের জন্যে বরাদ্দ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ এ বছরের পরে আপনি যদি আমাদের ভাইকে আমাদের সাথে না পাঠান তবে আমাদের বরাদ্দ দেওয়া হবে না। আর যদি আমাদের সাথে পাঠান তাহলে বরাদ্দ বন্ধ করা হবে না।
وَلَمَّا فَتَحُوا۟ مَتَـٰعَهُمۡ وَجَدُوا۟ بِضَـٰعَتَهُمۡ رُدَّتۡ إِلَیۡهِمۡۖ قَالُوا۟ یَـٰۤأَبَانَا مَا نَبۡغِیۖ (যখন তারা তাদের মালপত্র খুলল, তখন দেখতে পেল তাদের পণ্যমূল্য ফেরত দেয়া হয়েছে। তারা বলল, পিতা! আমরা আর কি চাইতে পারি?) অর্থাৎ আমাদের পণ্যমূল্যটাও ফেরত দেওয়া হয়েছে। এরপর আমরা আর কি আশা করতে পারি? وَنَمِیرُ أَهۡلَنَا আমরা আমাদের পরিবারবর্গের জন্যে খাদ্য-সামগ্রী এনে দেবো যাতে তাদের বছরের ও বাড়ি ঘরের সংস্থান হতে পারে) وَنَحۡفَظُ أَخَانَا وَنَزۡدَادُ (আমরা আমাদের ভাইকে রক্ষণাবেক্ষণ করব এবং অতিরিক্ত আনতে পারব) তার কারণে كَیۡلَ بَعِیرࣲۖ (আর এক উট বোঝাই পণ্য।)
আল্লাহ্ বলেনঃ ذَ ٰلِكَ كَیۡلࣱ یَسِیرࣱ (যা এনেছি তা পরিমাণে অল্প) অর্থাৎ অন্য সন্তানটি গেলে যা পাওয়া যেতো তার তুলনায় যা আনা হয়েছে তা অল্প। হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) আপন পুত্র বিনয়ামীনের ব্যাপারে অত্যন্ত কুণ্ঠিত ছিলেন। কারণ তার মাঝে তিনি তার ভাই ইউসুফ (عليه السلام)-এর ঘ্রাণ পেতেন, সান্ত্বনা লাভ করতেন এবং তিনি থাকায় ইউসুফকে কিছুটা ভুলে থাকতেন। তাই তিনি বললেনঃ
لَنۡ أُرۡسِلَهُۥ مَعَكُمۡ حَتَّىٰ تُؤۡتُونِ مَوۡثِقࣰا مِّنَ ٱللَّهِ لَتَأۡتُنَّنِی بِهِۦۤ إِلَّاۤ أَن یُحَاطَ بِكُمۡۖ (পিতা বললঃ আমি তাকে কখনই তোমাদের সাথে পাঠাব না। যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর নামে অঙ্গীকার কর যে, তোমরা তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবেই। অবশ্য যদি তোমরা বিপদে পরিবেষ্টিত হয়ে একান্ত অসহায় হয়ে না পড়।) অর্থাৎ তোমরা সকলেই যদি তাকে আনতে অক্ষম হয়ে পড়, তবে ভিন্ন কথা।
فَلَمَّاۤ ءَاتَوۡهُ مَوۡثِقَهُمۡ قَالَ ٱللَّهُ عَلَىٰ مَا نَقُولُ وَكِیلࣱ (অতঃপর যখন তারা তাঁর কাছে প্রতিজ্ঞা করল তখন তিনি বললেনঃ আমরা যে বিষয়ে কথা বলছি আল্লাহ্ তার বিধায়ক)। পিতা ইয়াকূব (عليه السلام) পুত্রদের থেকে অঙ্গীকারনামা পাকাপোক্ত করে নেন। তাদের থেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আদায় করেন এবং পুত্রের ব্যাপারে সম্ভাব্য সাবধানতা অবলম্বন করেন। কিন্তু কোন সতর্কতাই তাদেরকে ঠেকাতে পারল না। হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) তাঁর নিজের ও তাঁর পরিবার-পরিজনের খাদ্য-সামগ্রীর প্রয়োজন না হলে কখনও তাঁর প্রিয় পুত্রকে পাঠাতেন না। কিন্তু তকদীরেরও কিছু বিধান রয়েছে। আল্লাহ্ যা চান তাই নির্ধারণ করেন, যা ইচ্ছা তাই গ্রহণ করেন। যে রকম ইচ্ছা সে রকম আদেশ দেন। তিনি প্রজ্ঞাময়, সুবিজ্ঞ। অতঃপর পিতা আপন পুত্রদেরকে শহরে প্রবেশের সময় এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন বরং বিভিন্ন প্রবেশদ্বার দিয়ে যেতে বলেন। এর কারণ হিসেবে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), মুজাহিদ ইবন কা’ব, কাতাদা ও সুদ্দী (رحمة الله) বলেন, যাতে তাদের উপর কারও কুদৃষ্টি না পড়ে, সে জন্যে তিনি এরূপ নির্দেশ দিয়েছিলেন, কেননা তাদের অবয়ব ও চেহারা ছিল অত্যধিক আকর্ষণীয় ও সুশ্রী। ইব্রাহীম নাখঈ (رحمة الله) বলেছেন, এরূপ নির্দেশ দেওয়ার কারণ হল, তিনি তাদেরকে বিক্ষিপ্ত করে দিতে চেয়েছিলেন এ উদ্দেশ্যে যে, হয়ত তারা কোথাও ইউসুফ (عليه السلام)-এর সংবাদ পেয়ে যেতে পারে কিংবা এভাবে তারা বেশি সংখ্যক লোকের কাছে ইউসুফ (عليه السلام)-এর সন্ধান জিজ্ঞেস করতে পারে। কিন্তু প্রথম মতই প্রসিদ্ধ। এ কারণেই তিনি বললেন, وَمَاۤ أُغۡنِی عَنكُم مِّنَ ٱللَّهِ مِن شَیۡءٍۖ (আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে আমি তোমাদের জন্যে কিছুই করতে পারি না।)
আল্লাহর বাণীঃ
وَلَمَّا دَخَلُوا۟ مِنۡ حَیۡثُ أَمَرَهُمۡ أَبُوهُم مَّا كَانَ یُغۡنِی عَنۡهُم مِّنَ ٱللَّهِ مِن شَیۡءٍ إِلَّا حَاجَةࣰ فِی نَفۡسِ یَعۡقُوبَ قَضَىٰهَاۚ وَإِنَّهُۥ لَذُو عِلۡمࣲ لِّمَا عَلَّمۡنَـٰهُ وَلَـٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا یَعۡلَمُونَ
অর্থাৎ, যখন তারা তাদের পিতা যেভাবে আদেশ দিয়েছিলেন সেভাবেই প্রবেশ করল, তখন আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে তা তাদের কোনই কাজে আসল না। ইয়াকূব কেবল তার মনের একটি অভিপ্রায় পূর্ণ করেছিল এবং সে অবশ্যই জ্ঞানী ছিল। কারণ, আমি তাকে শিক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়ে অবগত নয়। (সূরা ইউসুফঃ ৬৮)
আহলি কিতাবদের মতে, হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) পুত্রদের কাছে আযীযের উদ্দেশে হাদিয়াস্বরূপ পেস্তা, বাদাম, আখরোট, তারপিন তেল, মধু ইত্যাদি প্রেরণ করেন। এছাড়া প্রথম বারের ফেরত পাওয়া দিরহাম ও আরও অর্থ সংগ্রহ করে তারা মিসরের উদ্দেশে যাত্রা করে।
(وَلَمَّا دَخَلُوا۟ عَلَىٰ یُوسُفَ ءَاوَىٰۤ إِلَیۡهِ أَخَاهُۖ قَالَ إِنِّیۤ أَنَا۠ أَخُوكَ فَلَا تَبۡتَىِٕسۡ بِمَا كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ فَلَمَّا جَهَّزَهُم بِجَهَازِهِمۡ جَعَلَ ٱلسِّقَایَةَ فِی رَحۡلِ أَخِیهِ ثُمَّ أَذَّنَ مُؤَذِّنٌ أَیَّتُهَا ٱلۡعِیرُ إِنَّكُمۡ لَسَـٰرِقُونَ قَالُوا۟ وَأَقۡبَلُوا۟ عَلَیۡهِم مَّاذَا تَفۡقِدُونَ قَالُوا۟ نَفۡقِدُ صُوَاعَ ٱلۡمَلِكِ وَلِمَن جَاۤءَ بِهِۦ حِمۡلُ بَعِیرࣲ وَأَنَا۠ بِهِۦ زَعِیمࣱ قَالُوا۟ تَٱللَّهِ لَقَدۡ عَلِمۡتُم مَّا جِئۡنَا لِنُفۡسِدَ فِی ٱلۡأَرۡضِ وَمَا كُنَّا سَـٰرِقِینَ قَالُوا۟ فَمَا جَزَ ٰۤؤُهُۥۤ إِن كُنتُمۡ كَـٰذِبِینَ قَالُوا۟ جَزَ ٰۤؤُهُۥ مَن وُجِدَ فِی رَحۡلِهِۦ فَهُوَ جَزَ ٰۤؤُهُۥۚ كَذَ ٰلِكَ نَجۡزِی ٱلظَّـٰلِمِینَ فَبَدَأَ بِأَوۡعِیَتِهِمۡ قَبۡلَ وِعَاۤءِ أَخِیهِ ثُمَّ ٱسۡتَخۡرَجَهَا مِن وِعَاۤءِ أَخِیهِۚ كَذَ ٰلِكَ كِدۡنَا لِیُوسُفَۖ مَا كَانَ لِیَأۡخُذَ أَخَاهُ فِی دِینِ ٱلۡمَلِكِ إِلَّاۤ أَن یَشَاۤءَ ٱللَّهُۚ نَرۡفَعُ دَرَجَـٰتࣲ مَّن نَّشَاۤءُۗ وَفَوۡقَ كُلِّ ذِی عِلۡمٍ عَلِیمࣱ ۞ قَالُوۤا۟ إِن یَسۡرِقۡ فَقَدۡ سَرَقَ أَخࣱ لَّهُۥ مِن قَبۡلُۚ فَأَسَرَّهَا یُوسُفُ فِی نَفۡسِهِۦ وَلَمۡ یُبۡدِهَا لَهُمۡۚ قَالَ أَنتُمۡ شَرࣱّ مَّكَانࣰاۖ وَٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِمَا تَصِفُونَ قَالُوا۟ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡعَزِیزُ إِنَّ لَهُۥۤ أَبࣰا شَیۡخࣰا كَبِیرࣰا فَخُذۡ أَحَدَنَا مَكَانَهُۥۤۖ إِنَّا نَرَىٰكَ مِنَ ٱلۡمُحۡسِنِینَ قَالَ مَعَاذَ ٱللَّهِ أَن نَّأۡخُذَ إِلَّا مَن وَجَدۡنَا مَتَـٰعَنَا عِندَهُۥۤ إِنَّاۤ إِذࣰا لَّظَـٰلِمُونَ)
[Surat Yusuf ৬৯ - ৭৯]
অর্থাৎ, ওরা যখন ইউসুফের সম্মুখে উপস্থিত হল, তখন ইউসুফ তার সহোদরকে নিজের কাছে রাখল এবং বলল, আমিই তোমার সহোদর, সুতরাং তারা যা করত তার জন্যে দুঃখ করো না।
তারপর সে যখন ওদের সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিল, তখন সে তার সহোদরের মালপত্রের মধ্যে পানপাত্র রেখে দিল। তারপর এক আহ্বায়ক চিৎকার করে বলল, “হে যাত্রীদল! তোমরা নিশ্চয়ই চোর। তারা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা কী হারিয়েছ?’ তারা বলল, ‘আমরা রাজার পানপাত্র হারিয়েছি; যে ওটা এনে দেবে সে এক উট বোঝাই মাল পাবে এবং আমি এর জামিন। তারা বলল, “আল্লাহর শপথ! তোমরা তো জান, আমরা এ দেশে দুষ্কৃতি করতে আসিনি এবং আমরা চোরও নই। তারা বলল, “যদি তোমরা মিথ্যাবাদী হও তবে তার শাস্তি কী?’ তারা বলল, এর শাস্তি যার মালপত্রের মধ্যে পাত্রটি পাওয়া যাবে, সে-ই তার বিনিময়।’ এভাবে আমরা সীমালংঘনকারীদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।
তারপর সে তার সহোদরের মালপত্র তল্লাশির পূর্বে তাদের মালপত্র তল্লাশি করতে লাগল, পরে তার সহোদরের মালপত্রের মধ্য হতে পাত্রটি বের করল। এভাবে আমি ইউসুফের জন্যে কৌশল করেছিলাম। রাজার আইনে তার সহোদরকে সে আটক করতে পারত না, আল্লাহ ইচ্ছা না করলে। আমি যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় উন্নীত করি। প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তির উপর আছে সর্বজ্ঞানী। তারা বলল, সে যদি চুরি করে থাকে তার সহোদরও তো পূর্বে চুরি করেছিল। কিন্তু ইউসুফ প্রকৃত ব্যাপার নিজের মনে গোপন রাখল এবং তাদের কাছে প্রকাশ করল না; সে মনে মনে বলল, তোমাদের অবস্থা তো হীনতর এবং তোমরা যা বলছ সে সম্বন্ধে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত। ওরা বলল, “হে আযীয! এর পিতা আছেন— অতিশয় বৃদ্ধ; সুতরাং এর স্থলে আপনি আমাদের একজনকে রাখুন। আমরা তো আপনাকে দেখছি মহানুভব ব্যক্তিদের একজন। সে বলল, যার কাছে আমরা আমাদের মাল পেয়েছি তাকে ছাড়া অন্যকে রাখার অপরাধ হতে আমরা আল্লাহর শরণ নিচ্ছি। এরূপ করলে আমরা অবশ্যই সীমালংঘনকারী হব।’ (১২: ৬৯-৭৯)
এখানে আল্লাহ্ উল্লেখ করছেন সে সব অবস্থার কথা যখন ইউসুফ (عليه السلام)-এর ভাইয়েরা তার সহোদর বিনয়ামীনকে নিয়ে মিসরে তার কাছে উপস্থিত হয়েছিল। ইউসুফ (عليه السلام) তাঁকে একান্তে কাছে নিয়ে জানান যে, তিনি তাঁর আপন সহোদর ভাই। তাকে তিনি এ কথা গোপন রাখতে বলেন এবং ভাইদের দুর্ব্যবহারের ব্যাপারে সান্ত্বনা দেন এবং অন্য ভাইদের বাদ দিয়ে কেবল বিনয়ামীনকে কাছে রাখার জন্যে ইউসুফ (عليه السلام) বাহানা অবলম্বন করেন। সুতরাং তিনি নিজের পানপাত্র বিনয়ামীনের মালপত্রের মধ্যে গোপনে রেখে দেয়ার জন্যে ভৃত্যদেরকে আদেশ দেন। উক্ত পানপাত্রটি পানি পান এবং লোকজনকে তাদের খাদ্যদ্রব্য মেপে দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হত। এরপর তাদের মধ্যে ঘোষণা দেয়া হয় যে, তারা বাদশাহর পানপাত্র চুরি করেছে, যে ব্যক্তি তা ফিরিয়ে দেবে তার জন্যে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘোষণাকারী তার জন্যে যিম্মাদার হল। কিন্তু তারা ঘোষণাকারীর দিকে তাকিয়ে এ কথা বলে তাদের প্রতি আরোপিত দোষ প্রত্যাখ্যান করল যে, (قَالُوا۟ تَٱللَّهِ لَقَدۡ عَلِمۡتُم مَّا جِئۡنَا لِنُفۡسِدَ فِی ٱلۡأَرۡضِ وَمَا كُنَّا سَـٰرِقِینَ) (আল্লাহর কসম, তোমরা তো জানো, আমরা এদেশে দুষ্কৃতি করতে আসিনি এবং আমরা চোরও নই।) অর্থাৎ আপনারা যে আমাদেরকে চুরির দোষে অভিযুক্ত করেছেন, আমরা যে সেরূপ নই তা আপনারা খুব ভাল করেই জানেন।
قَالُوا۟ فَمَا جَزَ ٰۤؤُهُۥۤ إِن كُنتُمۡ كَـٰذِبِینَ قَالُوا۟ جَزَ ٰۤؤُهُۥ مَن وُجِدَ فِی رَحۡلِهِۦ فَهُوَ جَزَ ٰۤؤُهُۥۚ كَذَ ٰلِكَ نَجۡزِی ٱلظَّـٰلِمِینَ (‘তারা বলল, তোমরা যদি মিথ্যাবাদী হও তা হলে এর কি শাস্তি হবে? তারা বলল, এর শাস্তি- যার মালপত্রের মধ্যে পাত্রটি পাওয়া যাবে সে-ই তার বিনিময়। আমরা এভাবেই সীমালংঘনকারীদের শাস্তি দিয়ে থাকি।
এটা ছিল তাদের শরীয়তের বিধান যে, যার মাল চুরি করবে, তার কাছেই চোরকে অর্পণ করা হবে। অর্থ (এভাবেই আমরা সীমালংঘনকারীদের শাস্তি দিয়ে থাকি।) আল্লাহ বলেনঃ
فَبَدَأَ بِأَوۡعِیَتِهِمۡ قَبۡلَ وِعَاۤءِ أَخِیهِ ثُمَّ ٱسۡتَخۡرَجَهَا مِن وِعَاۤءِ أَخِیهِۚ (অতঃপর সে তার সহোদরের মালপত্র তল্লাশির পূর্বে ওদের মালপত্র তল্লাশি করতে লাগল। পরে তার সহোদরের মালপত্রের মধ্য হতে পাত্রটি বের করল) এরূপ করার কারণ হল, অপবাদ থেকে বাঁচা এবং সন্দেহমুক্ত কৌশল অবলম্বন করা। আল্লাহ বলেনঃ
كَذَ ٰلِكَ كِدۡنَا لِیُوسُفَۖ مَا كَانَ لِیَأۡخُذَ أَخَاهُ فِی دِینِ ٱلۡمَلِكِ
(এ ভাবে আমি ইউসুফের জন্যে কৌশল করিয়ে দিয়েছিলাম। অন্যথায় বাদশাহর আইনে তার সহোদরকে সে আটক করতে পারত না।) অর্থাৎ তারা যদি নিজেরা এ কথা স্বীকার না করত যে, যার মালপত্রের মধ্যে পাওয়া যাবে, সে-ই তার বিনিময় হবে; তবে মিসরের বাদশাহর প্রচলিত আইনে তাকে ইউসুফ (عليه السلام) আটকে রাখতে পারতেন না।
إِلَّاۤ أَن یَشَاۤءَ ٱللَّهُۚ نَرۡفَعُ دَرَجَـٰتࣲ مَّن نَّشَاۤءُۗ (তবে যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন তাহলে ভিন্ন কথা। আমি যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় উন্নীত করি) অর্থাৎ জ্ঞানের ক্ষেত্রে। وَفَوۡقَ كُلِّ ذِی عِلۡمٍ عَلِیمࣱ (প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তির উপরে রয়েছেন সর্বজ্ঞানী।) কেননা ইউসুফ (عليه السلام) ছিলেন তাদের চেয়ে অধিক জ্ঞানী। মতামত দান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতায় তিনি ছিলেন অধিক পারঙ্গম। আর এ ব্যাপারে তিনি যা কিছু করেছেন তা আল্লাহর নির্দেশক্রমেই করেছেন। কারণ, এর উপর ভিত্তি করেই সৃষ্ট পরিবেশে পরবর্তীতে তার পিতা ও পরিবারবর্গ এবং প্রতিনিধি দলের সেদেশে আগমনের সুযোগ হয়। যা হোক, ভাইয়েরা যখন বিনয়ামীনের মালপত্রের মধ্য থেকে পানপাত্র বের করা প্রত্যক্ষ করল তখন তারা বললঃ إِن یَسۡرِقۡ فَقَدۡ سَرَقَ أَخࣱ لَّهُۥ مِن قَبۡلُۚ (সে যদি চুরি করে থাকে তবে তার সহোদরও তো ইতিপূর্বে চুরি করেছিল।) সহোদর বলতে তারা ইউসুফ (عليه السلام)-কেই বুঝাচ্ছিল। কথিত আছে যে, হযরত ইউসুফ (عليه السلام) একবার তাঁর নানার একটি মূর্তি চুরি করে এনে ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, ইউসুফ (عليه السلام)-এর প্রতি অধিক স্নেহ ভালবাসার টানে তার ফুফু তার ছোটবেলায় নিজের কাছে রেখে লালন-পালন করার জন্যে কৌশল হিসেবে ইসহাকের একটি কোমরবন্দ গোপনে ইউসুফ (عليه السلام)-এর কাপড়ের মধ্যে বেঁধে রাখেন। ইউসুফ (عليه السلام) তা টের পাননি। পরে কোমরবন্দটির সন্ধান করা হলে ইউসুফের কাপড়ের মধ্যে তা পাওয়া যায়। তাদের কথায় এ দিকেই ইংগিত ছিল। কেউ কেউ বলেছেনঃ ইউসুফ ঘর থেকে খাদ্য নিয়ে গোপনে ভিক্ষুকদেরকে আহার করাতেন। এছাড়া এ প্রসঙ্গে আরও বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্নজনে বলেছেন। এজন্যেইঃ (তারা বলল, সে যদি চুরি করে থাকে, তবে ইতিপূর্বে তার সহোদরও তো চুরি করেছিল।
কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার ইউসুফ নিজের মনের মধ্যে গোপন করে রাখল।) সেই গোপন কথাটি এই। أَنتُمۡ شَرࣱّ مَّكَانࣰاۖ وَٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِمَا تَصِفُونَ
(তোমাদের অবস্থা তো হীনতর এবং আল্লাহ ঐ বিষয়ে খুবই অবহিত যা তোমরা ব্যক্ত করছ।) ইউসুফ (عليه السلام) এ কথা মনে মনে বললেন, প্রকাশ করলেন না। তিনি সহনশীলতার সাথে তাদেরকে ক্ষমা ও উপেক্ষা করেন এবং সেই সুযোগে তারা দয়া ও করুণা লাভের উদ্দেশ্যে বললঃ
یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡعَزِیزُ إِنَّ لَهُۥۤ أَبࣰا شَیۡخࣰا كَبِیرࣰا فَخُذۡ أَحَدَنَا مَكَانَهُۥۤۖ إِنَّا نَرَىٰكَ مِنَ ٱلۡمُحۡسِنِینَ قَالَ مَعَاذَ ٱللَّهِ أَن نَّأۡخُذَ إِلَّا مَن وَجَدۡنَا مَتَـٰعَنَا عِندَهُۥۤ إِنَّاۤ إِذࣰا لَّظَـٰلِمُونَ)
(তারা বলল, হে আযীয! এর পিতা আছেন অতিশয় বৃদ্ধ। সুতরাং এর স্থলে আপনি আমাদের একজনকে রাখুন। আমরা আপনাকে একজন মহানুভব ব্যক্তি হিসেবে দেখছি। সে বললঃ যার কাছে আমাদের মাল পেয়েছি তাকে ছাড়া অন্যকে রাখার অপরাধ হতে আমরা আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। এরূপ করলে আমরা অবশ্যই জালিমে পরিণত হব। (১২: ৭৮-৭৯)
অর্থাৎ আমরা যদি অপরাধীকে ছেড়ে দেই এবং নিরপরাধকে আটক রাখি তাহলে সেটা হবে সীমালংঘন। এটা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বরং মাল যার কাছে পাওয়া গেছে তাকেই আমরা আটকে রাখব। আহলি কিতাবদের মতে, এই সময়ই ইউসুফ (عليه السلام) তাদের কাছে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু এটা তাদের মারাত্মক ভুল, প্রকৃত ব্যাপার তারা মোটেই বুঝেনি। আল্লাহ্ বলেনঃ
فَلَمَّا ٱسۡتَیۡـَٔسُوا۟ مِنۡهُ خَلَصُوا۟ نَجِیࣰّاۖ قَالَ كَبِیرُهُمۡ أَلَمۡ تَعۡلَمُوۤا۟ أَنَّ أَبَاكُمۡ قَدۡ أَخَذَ عَلَیۡكُم مَّوۡثِقࣰا مِّنَ ٱللَّهِ وَمِن قَبۡلُ مَا فَرَّطتُمۡ فِی یُوسُفَۖ فَلَنۡ أَبۡرَحَ ٱلۡأَرۡضَ حَتَّىٰ یَأۡذَنَ لِیۤ أَبِیۤ أَوۡ یَحۡكُمَ ٱللَّهُ لِیۖ وَهُوَ خَیۡرُ ٱلۡحَـٰكِمِینَ ٱرۡجِعُوۤا۟ إِلَىٰۤ أَبِیكُمۡ فَقُولُوا۟ یَـٰۤأَبَانَاۤ إِنَّ ٱبۡنَكَ سَرَقَ وَمَا شَهِدۡنَاۤ إِلَّا بِمَا عَلِمۡنَا وَمَا كُنَّا لِلۡغَیۡبِ حَـٰفِظِینَ وَسۡـَٔلِ ٱلۡقَرۡیَةَ ٱلَّتِی كُنَّا فِیهَا وَٱلۡعِیرَ ٱلَّتِیۤ أَقۡبَلۡنَا فِیهَاۖ وَإِنَّا لَصَـٰدِقُونَ قَالَ بَلۡ سَوَّلَتۡ لَكُمۡ أَنفُسُكُمۡ أَمۡرࣰاۖ فَصَبۡرࣱ جَمِیلٌۖ عَسَى ٱللَّهُ أَن یَأۡتِیَنِی بِهِمۡ جَمِیعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡعَلِیمُ ٱلۡحَكِیمُ وَتَوَلَّىٰ عَنۡهُمۡ وَقَالَ یَـٰۤأَسَفَىٰ عَلَىٰ یُوسُفَ وَٱبۡیَضَّتۡ عَیۡنَاهُ مِنَ ٱلۡحُزۡنِ فَهُوَ كَظِیمࣱ قَالُوا۟ تَٱللَّهِ تَفۡتَؤُا۟ تَذۡكُرُ یُوسُفَ حَتَّىٰ تَكُونَ حَرَضًا أَوۡ تَكُونَ مِنَ ٱلۡهَـٰلِكِینَ قَالَ إِنَّمَاۤ أَشۡكُوا۟ بَثِّی وَحُزۡنِیۤ إِلَى ٱللَّهِ وَأَعۡلَمُ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ یَـٰبَنِیَّ ٱذۡهَبُوا۟ فَتَحَسَّسُوا۟ مِن یُوسُفَ وَأَخِیهِ وَلَا تَا۟یۡـَٔسُوا۟ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ لَا یَا۟یۡـَٔسُ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡقَوۡمُ ٱلۡكَـٰفِرُونَ[Surat Yusuf ৮০ - ৮৭]
অর্থাৎ, তারপর যখন তারা তার নিকট হতে সম্পূর্ণ নিরাশ হল, তখন তারা নির্জনে গিয়ে পরামর্শ করতে লাগল। ওদের মধ্যে যে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিল, সে বলল, তোমরা কি জান না যে, তোমাদের পিতা তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার নিয়েছেন এবং পূর্বেও তোমরা ইউসুফের ব্যাপারে ত্রুটি করেছিলে। সুতরাং আমি কিছুতেই এ দেশ ত্যাগ করব না, যতক্ষণ না আমার পিতা আমাকে অনুমতি দেন অথবা আল্লাহ আমার জন্যে কোন ব্যবস্থা করেন এবং তিনিই বিচারকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তোমরা তোমাদের পিতার কাছে ফিরে যাও এবং বলবে, হে আমাদের পিতা! আপনার পুত্র চুরি করেছে এবং আমরা যা জানি তারই প্রত্যক্ষ বিবরণ দিলাম। অদৃশ্যের ব্যাপারে আমরা অবহিত ছিলাম না। যে জনপদে আমরা ছিলাম তার অধিবাসীদের জিজ্ঞাসা করুন এবং যে যাত্রীদলের সাথে আমরা এসেছি তাদেরকেও। আমরা অবশ্যই সত্য বলছি।
ইয়াকূব বলল, না, তোমাদের মন তোমাদের জন্যে একটি কাহিনী সাজিয়ে দিয়েছে। সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়; হয়তো আল্লাহ তাদেরকে এক সঙ্গে আমার কাছে এনে দিবেন। তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ সে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল এবং বলল, ‘আফসোস ইউসুফ এর জন্যে।’ শোকে তার চক্ষুদ্বয় সাদা হয়ে গেল এবং সে ছিল অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট। তারা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আপনি তো ইউসুফ এর কথা ভুলবেন না যতক্ষণ না আপনি মুমূর্ষ হবেন, অথবা মৃত্যুবরণ করবেন।’ সে বলল, 'আমি আমার অসহনীয় বেদনা, আমার দুঃখ শুধু আল্লাহর কাছে নিবেদন করছি এবং আমি আল্লাহর কাছ থেকে জানি যা তোমরা জান না। “হে আমার পুত্রগণ, তোমরা যাও, ইউসুফ ও তার সহোদরের অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহর আশিস থেকে তোমরা নিরাশ হয়ো না। কারণ আল্লাহর আশিস হতে কেউই নিরাশ হয় না, কাফিরগণ ব্যতীত। (১২: ৮০-৮৭)
আল্লাহ ইউসুফ (عليه السلام)-এর ভাইদের সম্পর্কে জানাচ্ছেন যে, যখন তারা বিনয়ামীনকে ইউসুফ (عليه السلام)-এর হাত থেকে ছাড়িয়ে আনার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেল, তখন পারস্পরিক পরামর্শের জন্যে একটু দূরে সরে গিয়ে মিলিত হল। তখন তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ রূবীল বললঃ
أَلَمۡ تَعۡلَمُوۤا۟ أَنَّ أَبَاكُمۡ قَدۡ أَخَذَ عَلَیۡكُم مَّوۡثِقࣰا مِّنَ ٱللَّهِ وَمِن قَبۡلُ مَا فَرَّطتُمۡ فِی یُوسُفَۖ (তোমরা কি জান না যে, তোমাদের পিতা তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার নিয়েছেন এবং পূর্বেও তোমরা ইউসুফের ব্যাপারে ত্রুটি করেছিলে) অর্থাৎ অবশ্য কিন্তু তোমরা সে অঙ্গীকার রক্ষা কর নাই। বরং তাতে ত্রুটি করেছ। যেমন তোমরা ইতিপূর্বে তার ভাই ইউসুফের ব্যাপারেও ত্রুটি করেছিলে। এখন আমার সামনে এমন কোন উপায় নেই যা নিয়ে পিতার সামনে দাঁড়াব। فَلَنۡ أَبۡرَحَ ٱلۡأَرۡضَ (সুতরাং আমি কিছুতেই এ দেশ ত্যাগ করব না) অর্থাৎ আমি এ দেশেই স্থায়িভাবে থেকে যাব حَتَّىٰ یَأۡذَنَ لِیۤ أَبِیۤ (যতক্ষণ না আমার পিতা আমাকে অনুমতি দেন।) অর্থাৎ তার কাছে যাওয়ার। أَوۡ یَحۡكُمَ ٱللَّهُ لِیۖ (অথবা আল্লাহ আমার জন্যে কোন ব্যবস্থা করেন। যেমন পিতার কাছে ভাইকে ফিরিয়ে নেয়ার কোন উপায় যদি বের করে দেন। وَهُوَ خَیۡرُ ٱلۡحَـٰكِمِینَ (তিনিই শ্রেষ্ঠ ফয়সালাদানকারী)। ٱرۡجِعُوۤا۟ إِلَىٰۤ أَبِیكُمۡ فَقُولُوا۟ یَـٰۤأَبَانَاۤ (তোমরা তোমাদের পিতার কাছে ফিরে যাও এবং বল, হে পিতা! আপনার পুত্র চুরি করেছে। অর্থাৎ তোমরা যা প্রত্যক্ষ করেছ তাই পিতার কাছে গিয়ে বল। وَمَا شَهِدۡنَاۤ إِلَّا بِمَا عَلِمۡنَا وَمَا كُنَّا لِلۡغَیۡبِ حَـٰفِظِینَ (আমরা যা জানি তারই প্রত্যক্ষ বিবরণ দিলাম। অদৃশ্যের ব্যাপারে আমরা অবহিত ছিলাম না।) وَسۡـَٔلِ ٱلۡقَرۡیَةَ ٱلَّتِی كُنَّا فِیهَا وَٱلۡعِیرَ ٱلَّتِیۤ أَقۡبَلۡنَا فِیهَاۖ (যে জনপদে আমরা ছিলাম, তার অধিবাসীদের আপনি জিজ্ঞেস করুন এবং যে যাত্রীদলের সাথে আমরা এসেছি তাদেরকেও) অর্থাৎ আমরা আপনাকে এই সংবাদ দিলাম যে, আমাদের ভাই চুরি করে ধরা পড়েছে এটা মিসরে সর্বত্র রটে গেছে এবং যে কাফেলার সাথে আমরা এসেছি তাদের এ ঘটনাটি জানা আছে। কেননা, তখন তারা সেখানে আমাদের সাথেই ছিল। وَإِنَّا لَصَـٰدِقُونَ (আমরা অবশ্যই সত্য বলছি।) قَالَ بَلۡ سَوَّلَتۡ لَكُمۡ أَنفُسُكُمۡ أَمۡرࣰاۖ فَصَبۡرࣱ جَمِیلٌۖ (ইয়াকূব বলল, না তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটি কাহিনী সাজিয়ে দিয়েছে। সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়।) অর্থাৎ তোমরা যা বলছ আসল ঘটনা তা নয়। সে চুরি করেনি। কেননা, তার স্বভাব-চরিত্র এ রকম নয়। বরং এটা তোমাদেরই একটা সাজান গল্প। অতএব, ধৈর্য অবলম্বনই শ্রেয়।
ইবন ইসহাক (رحمة الله) প্রমুখ বলেছেন, ইউসুফ (عليه السلام)-এর ব্যাপারে সীমালংঘনের পরে তার ভাইয়েরা যখন বিনয়ামীনের সাথেও অসদ-ব্যবহার করতে শুরু করে তখন পিতা ইয়াকূব (عليه السلام) উপরোক্ত কথা বলেন। প্রাচীনকালের কোন কোন পণ্ডিতের উক্তি, ‘মন্দের পরবর্তী প্রতিফল মন্দই হয়ে থাকে। অতঃপর হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) বলেনঃ عَسَى ٱللَّهُ أَن یَأۡتِیَنِی بِهِمۡ جَمِیعًاۚ (হয়তো আল্লাহ তাদেরকে এক সঙ্গে আমার কাছে এনে দেবেন।) অর্থাৎ ইউসুফ, বিনয়ামীন ও রুবীলকে। إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡعَلِیمُ (নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ।) অর্থাৎ প্রিয়জনদের বিরহে আমি যে অবস্থায় পতিত হয়েছি তা তিনি সম্যক অবগত ٱلۡحَكِیمُ (প্রজ্ঞাময়) অর্থাৎ তিনি যা ফয়সালা ও বাস্তবায়ন করবেন তা অত্যন্ত প্রজ্ঞার সাথে করবেন। চূড়ান্ত কৌশল ও অলংঘনীয় দলীলের অধিকারী একমাত্র তিনিই। وَتَوَلَّىٰ عَنۡهُمۡ (এবং সে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।) অর্থাৎ ইয়াকূব (عليه السلام) পুত্রদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেনঃ وَقَالَ یَـٰۤأَسَفَىٰ عَلَىٰ یُوسُفَ (হায়! আফসোস ইউসুফের জন্যে।) পূর্বের দুঃখের সাথে নতুন দুঃখের উল্লেখ করছেন এবং যে ব্যথাটি সুপ্ত ছিল তা পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। জনৈক কবি বলেছেনঃ
نقل فؤادك حيث شئت من الهوى- وما الحب الا للحبيب الا ول
‘তুমি কামনার বশে তোমার হৃদয়কে যেথায় ইচ্ছা ফিরাতে পারো। কিন্তু প্রেমের বেলায় প্রথম প্রেমিকই আসল।’
অন্য এক কবি বলেছেনঃ
لقد لامني عند القبور علي البكا - رفيقي لتذراف الدموع السوافك
فقال اتبكی كل قبر رأيته - القبر ثوى بين اللوى فالدكادك
فقلت له ان الاسى ببعث الاسی - فدعني فهذا كله قبر مالك
অর্থাৎ, গোরস্তানের কবরসমূহের কাছে গিয়ে আমার ক্রন্দন ও অশ্রুপাত দেখে আমার বন্ধু আমাকে তিরস্কার করল। সে বললঃ লিওয়া (বালির ঢিবি) ও দাকাদিকের (শক্তভূমির) মধ্যবর্তী যত কবর আছে তার মধ্যে যে কবরই নজরে পড়বে, সে কবরের পাশেই কি তুমি এভাবে কাঁদতে থাকবে? আমি তাকে বললাম, দুঃখই দুঃখীজনকে পরিচালিত করে। আমাকে আমার কাজের উপর ছেড়ে দাও। এখানে যত কবর আছে সবই আমার প্রেমাস্পদ মালিকের কবর।
আল্লাহর বাণীঃ وَٱبۡیَضَّتۡ عَیۡنَاهُ مِنَ ٱلۡحُزۡنِ (শোকে তার চোখ দু’টি সাদা হয়ে যায়। অর্থাৎ অতিরিক্ত কান্নাকাটির ফলে। فَهُوَ كَظِیمࣱ (এবং সে ছিল অসহনীয় মনস্তাপে কাতর।) অর্থাৎ ইউসুফ (عليه السلام)-এর জন্য অতিশয় শোক, তাপ ও অধীর আগ্রহে তিনি মুহ্যমান হয়ে পড়েন। পুত্রগণ যখন পিতাকে সন্তান হারাবার শোকে কাতর অবস্থায় দেখল তখন قَالُوا۟ (তারা বলল) অর্থাৎ পিতার প্রতি করুণাবশে ও মমতাবোধে বললঃ تَٱللَّهِ تَفۡتَؤُا۟ تَذۡكُرُ یُوسُفَ حَتَّىٰ تَكُونَ حَرَضًا أَوۡ تَكُونَ مِنَ ٱلۡهَـٰلِكِینَ
‘আপনি তো ইউসুফকে ভুলবেন না, যতক্ষণ না মুমূর্ষ হবেন কিংবা মৃত্যুবরণ করবেন।) অর্থাৎ তারা বলছে, আপনি সর্বক্ষণ ইউসুফ (عليه السلام)-কে স্মরণ করছেন ও শোক প্রকাশ করছেন। ফলে দিন দিন আপনার শরীর শিথিল হয়ে যাচ্ছে ও শক্তি ক্ষয়ে যাচ্ছে। এর চাইতে বরং নিজের প্রতি কিছুটা লক্ষ্য রাখলেই আপনার জন্য ভাল হতো।
قَالَ إِنَّمَاۤ أَشۡكُوا۟ بَثِّی وَحُزۡنِیۤ إِلَى ٱللَّهِ وَأَعۡلَمُ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ (ইয়াকূব বলল, আমি আমার অসহনীয় বেদনা ও আমার দুঃখ শুধু আল্লাহর নিকট নিবেদন করছি এবং আমি আল্লাহর নিকট থেকে এমন কিছু জানি যা তোমরা জান না।’) অর্থাৎ পিতা তার পুত্রদেরকে বলছেনঃ আমি যে দুঃখ-যাতনার মধ্যে আছি তার অনুযোগ না তোমাদের কাছে করছি, না অন্য কারও কাছে বরং আমার অনুযোগ আল্লাহর কাছেই ব্যক্ত করছি আর আমি জানি যে, আল্লাহ আমাকে এ অবস্থা থেকে মুক্তি দেবেন ও উদ্ধার করবেন। আমি আরও জানি যে, ইউসুফ (عليه السلام)-এর স্বপ্ন অবশ্যই বাস্তবে পরিণত হবে এবং স্বপ্ন অনুযায়ী আমি ও তোমরা তার উদ্দেশে সিজদাবনত হবো। তাই তিনি বলেনঃ (আমি আল্লাহর কাছ থেকে জানি যা তোমরা জান না।) তারপর তিনি পুত্রগণকে ইউসুফ (عليه السلام) ও তার ভাইকে সন্ধান করার জন্যেও জনসমাজে তাঁদের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্যে উৎসাহিত করেনঃ
یَـٰبَنِیَّ ٱذۡهَبُوا۟ فَتَحَسَّسُوا۟ مِن یُوسُفَ وَأَخِیهِ وَلَا تَا۟یۡـَٔسُوا۟ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ لَا یَا۟یۡـَٔسُ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡقَوۡمُ ٱلۡكَـٰفِرُونَ (হে পুত্রগণ! তোমরা যাও, ইউসুফ ও তার সহোদরের অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। কেননা আল্লাহর রহমত থেকে কাফির ব্যতীত কেউ নিরাশ হয় না।)
অর্থাৎ কঠিন অবস্থার পর মুক্তি পাওয়ার আশা থেকে নিরাশ হয়ো না। কেননা, বিপদ ও সংকটের পর তা থেকে আল্লাহর রহমতে উদ্ধার পাওয়ার ব্যাপারে কেবলমাত্র কাফিররাই নিরাশ হতে পারে।
فَلَمَّا دَخَلُوا۟ عَلَیۡهِ قَالُوا۟ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡعَزِیزُ مَسَّنَا وَأَهۡلَنَا ٱلضُّرُّ وَجِئۡنَا بِبِضَـٰعَةࣲ مُّزۡجَىٰةࣲ فَأَوۡفِ لَنَا ٱلۡكَیۡلَ وَتَصَدَّقۡ عَلَیۡنَاۤۖ إِنَّ ٱللَّهَ یَجۡزِی ٱلۡمُتَصَدِّقِینَ قَالَ هَلۡ عَلِمۡتُم مَّا فَعَلۡتُم بِیُوسُفَ وَأَخِیهِ إِذۡ أَنتُمۡ جَـٰهِلُونَ قَالُوۤا۟ أَءِنَّكَ لَأَنتَ یُوسُفُۖ قَالَ أَنَا۠ یُوسُفُ وَهَـٰذَاۤ أَخِیۖ قَدۡ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَیۡنَاۤۖ إِنَّهُۥ مَن یَتَّقِ وَیَصۡبِرۡ فَإِنَّ ٱللَّهَ لَا یُضِیعُ أَجۡرَ ٱلۡمُحۡسِنِینَ قَالُوا۟ تَٱللَّهِ لَقَدۡ ءَاثَرَكَ ٱللَّهُ عَلَیۡنَا وَإِن كُنَّا لَخَـٰطِـِٔینَ قَالَ لَا تَثۡرِیبَ عَلَیۡكُمُ ٱلۡیَوۡمَۖ یَغۡفِرُ ٱللَّهُ لَكُمۡۖ وَهُوَ أَرۡحَمُ ٱلرَّ ٰحِمِینَ ٱذۡهَبُوا۟ بِقَمِیصِی هَـٰذَا فَأَلۡقُوهُ عَلَىٰ وَجۡهِ أَبِی یَأۡتِ بَصِیرࣰا وَأۡتُونِی بِأَهۡلِكُمۡ أَجۡمَعِینَ[Surat Yusuf ৮৮ - ৯৩]
অর্থাৎ, যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হল তখন বলল, হে আযীয! আমরা ও আমাদের পরিবার-পরিজন বিপন্ন হয়ে পড়েছি এবং আমরা তুচ্ছ পণ্য নিয়ে এসেছি। আপনি আমাদের রসদ পূর্ণমাত্রায় দিন এবং আমাদেরকে দান করুন; আল্লাহ দাতাগণকে পুরস্কৃত করে থাকেন। সে বলল, তোমরা কি জান, তোমরা ইউসুফ ও তার সহোদরের প্রতি কিরূপ আচরণ করেছিলে? যখন তোমরা ছিলে অজ্ঞ? ওরা বলল, তবে কি তুমিই ইউসুফ? সে বলল, আমিই ইউসুফ এবং এ আমার সহোদর: আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। যে ব্যক্তি মুত্তাকী এবং ধৈর্যশীল, আল্লাহ সেরূপ সৎকর্ম পরায়ণদের শ্রমফল নষ্ট করেন না। ওরা বলল, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ নিশ্চয় তোমাকে আমাদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন এবং আমরা নিশ্চয়ই অপরাধী ছিলাম। সে বলল, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তিনি দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু। তোমরা আমার এ জামাটি নিয়ে যাও এবং এটি আমার পিতার মুখমণ্ডলের উপর রাখবে। তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আর তোমাদের পরিবারবর্গের সবাইকে আমার কাছে নিয়ে এস।’ (১২: ৮৮-৯৩)
এখানে আল্লাহ ইউসুফ (عليه السلام)-এর ভাইদের পুনরায় ইউসুফ (عليه السلام)-এর কাছে গমন এবং খাদ্যের বরাদ্দ ও অনুদান পাওয়ার আবেদন ও সেই সাথে বিনয়ামীনকে তাদের কাছে প্রত্যর্পণর অনুরোধ সম্পর্কে আলোচনা করছেন।
فَلَمَّا دَخَلُوا۟ عَلَیۡهِ قَالُوا۟ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡعَزِیزُ مَسَّنَا وَأَهۡلَنَا ٱلضُّرُّ
(যখন তারা ইউসুফের কাছে উপস্থিত হল তখন বলল, হে আযীয! আমরা ও আমাদের পরিবার-পরিজন বিপন্ন হয়ে পড়েছি।) বিপন্ন হওয়ার কারণ দুর্ভিক্ষ, দুরবস্থা ও সন্তানাদির সংখ্যাধিক্য। وَجِئۡنَا بِبِضَـٰعَةࣲ مُّزۡجَىٰةࣲ (এবং আমরা সামান্য কিছু পণ্য নিয়ে এসেছি।) অর্থাৎ অতি নগণ্য পণ্যমূল্য—যা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি ছাড়া আমাদের থেকে গ্রহণ করার মত নয়। নগণ্যের ব্যাখ্যায় কেউ বলেছেন, রদ্দী মুদ্রা; কেউ বলেছেন, কম পরিমাণ মুদ্রা আবার কেউ বলেছেন, বাদাম, কফি বীজ ইত্যাদি। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তা ছিল কয়েকটি খড়ের বস্তা ও রশি এবং এ রকম আরও কিছু।
فَأَوۡفِ لَنَا ٱلۡكَیۡلَ وَتَصَدَّقۡ عَلَیۡنَاۤۖ إِنَّ ٱللَّهَ یَجۡزِی ٱلۡمُتَصَدِّقِینَ (আপনি আমাদের বরাদ্দ পূর্ণমাত্রায় দিন এবং আমাদেরকে দান করুন। আল্লাহ দাতাদেরকে পুরস্কৃত করে থাকেন।)
সুদ্দী বলেছেন, এখানে দান বলতে তাদের নগণ্য পণ্যমূল্য গ্রহণ করা বুঝানো হয়েছে। ইবন জুরায়জ বলেন, এখানে দান করুন বলতে বুঝানো হয়েছে, আমাদের ভাইকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন। সুফয়ান ইবন উওয়ায়না বলেন, আমাদের নবীর জন্যে সাদকা গ্রহণ যে হারাম করা হয়েছে, তার দলীল নেয়া হয়েছে এই আয়াত থেকে। ইবন জারীর (رضي الله عنه) এটি বর্ণনা করেছেন। শেষে হযরত ইউসুফ (عليه السلام) যখন দেখলেন, তাদের অবস্থা এই; যা কিছু তারা নিয়ে এসেছে তা ছাড়া আর কিছুই তাদের কাছে নেই, তখন তিনি নিজের পরিচয় দিলেন, তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করলেন এবং তাদের ও নিজের প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করেন। এ সময় হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর কপালের একদিকে যে তিল ছিল তা অনাবৃত করে দেখালেন, যাতে তারা তাঁকে শনাক্ত করতে পারে। তিনি বললেনঃ
هَلۡ عَلِمۡتُم مَّا فَعَلۡتُم بِیُوسُفَ وَأَخِیهِ إِذۡ أَنتُمۡ جَـٰهِلُونَ (তোমরা কি জান, তোমরা ইউসুফ ও তার সহোদরের প্রতি কিরূপ আচরণ করেছিলে? যখন তোমরা ছিলে অজ্ঞ। তারা বলল;) এ কথা শুনে তারা অতি আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল এবং বারবার ইউসুফের প্রতি তাকাতে থাকে। কিন্তু তারা বুঝে উঠতে পারছিল না যে, এ ব্যক্তিই সে। أَءِنَّكَ لَأَنتَ یُوسُفُۖ قَالَ أَنَا۠ یُوسُفُ وَهَـٰذَاۤ أَخِیۖ (তবে কি তুমিই ইউসুফ? সে বলল, আমিই ইউসুফ এবং এই আমার সহোদর ভাই।) অর্থাৎ আমি সেই ইউসুফ যার সাথে তোমরা ঐ আচরণ করেছিলে এবং পূর্বে যার প্রতি অত্যাচার করেছিলে। (এই আমার ভাই) কথাটি পূর্বের কথাকে জোরালো করার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে এবং এদের দুই ভাইয়ের প্রতি তাদের মনে যে হিংসা লুক্কায়িত ছিল আর যেসব ষড়যন্ত্র অপকৌশল তাদের বিরুদ্ধে পাকিয়েছিল সে দিকে এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাই তিনি বলেছেনঃ
قَدۡ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَیۡنَاۤۖ (আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। অর্থাৎ আমাদের প্রতি আল্লাহর কৃপা, দান, অনুকম্পা বর্ষিত হয়েছে। আমাদেরকে তিনি সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর এটা আমাদেরকে দিয়েছেন তার প্রতি আমাদের আনুগত্য, তোমাদের নিপীড়নে ধৈর্য ধারণ, পিতার সাথে সদাচরণ ও আমাদের প্রতি পিতার মহব্বত ও স্নেহের বদৌলতে।
إِنَّهُۥ مَن یَتَّقِ وَیَصۡبِرۡ فَإِنَّ ٱللَّهَ لَا یُضِیعُ أَجۡرَ ٱلۡمُحۡسِنِینَ قَالُوا۟ تَٱللَّهِ لَقَدۡ ءَاثَرَكَ ٱللَّهُ عَلَیۡنَا
(যে ব্যক্তি মুত্তাকী ও ধৈর্যশীল। আল্লাহ সেরূপ সৎকর্ম পরায়ণদের কর্মফল নষ্ট করেন না। তারা বলল, আল্লাহর শপথ, আল্লাহ তোমাকে আমাদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন।)
অর্থাৎ আল্লাহ তোমাকে মর্যাদা দান করেছেন, অনুগ্রহ করেছেন যা আমাদের প্রতি করেন নি। وَإِن كُنَّا لَخَـٰطِـِٔینَ (আমরা নিশ্চয়ই অপরাধী ছিলাম!) অর্থাৎ পূর্বে তোমার সাথে যা করেছি তাতে আমরাই ছিলাম অপরাধী। আর এখন তো তোমার সম্মুখেই আমরা আসামীর কাঠগড়ায় হাযির। قَالَ لَا تَثۡرِیبَ عَلَیۡكُمُ ٱلۡیَوۡمَۖ (সে বলল, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই।) অর্থাৎ তোমরা যা কিছু করেছ তার কোন প্রতিশোধ আমি নেব না। এরপর আরও বাড়িয়ে বললেনঃ یَغۡفِرُ ٱللَّهُ لَكُمۡۖ وَهُوَ أَرۡحَمُ ٱلرَّ ٰحِمِینَ (আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তিনি দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু)। কারও কারও মতে لَا تَثۡرِیبَ عَلَیۡكُمُ ٱلۡیَوۡمَۖ এর উপর ওয়াকফ (অর্থাৎ তোমাদের উপর কোন অভিযোগ নেই) এবং ٱلۡیَوۡمَ یَغۡفِرُ ٱللَّهُ لَكُمۡۖ আলাদা বাক্য (অর্থাৎ আল্লাহ আজ তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন); কিন্তু এ মত দুর্বল। প্রথম মতই সঠিক।
তখন হযরত ইউসুফ (عليه السلام) নিজের গায়ের জামা তাদের কাছে দিয়ে বললেন, এটা অন্ধ পিতার চোখের ওপর রেখে দিও। এতে আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসবে। এ ছিল প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম, নবুওতের আলামত ও বিরাট এক মু’জিযা। শেষে তিনি ভাইদেরকে তাদের পরিবার-পরিজনসহ সসম্মানে মিসরে চলে আসার জন্যে বলে দেন।
(وَلَمَّا فَصَلَتِ ٱلۡعِیرُ قَالَ أَبُوهُمۡ إِنِّی لَأَجِدُ رِیحَ یُوسُفَۖ لَوۡلَاۤ أَن تُفَنِّدُونِ قَالُوا۟ تَٱللَّهِ إِنَّكَ لَفِی ضَلَـٰلِكَ ٱلۡقَدِیمِ فَلَمَّاۤ أَن جَاۤءَ ٱلۡبَشِیرُ أَلۡقَىٰهُ عَلَىٰ وَجۡهِهِۦ فَٱرۡتَدَّ بَصِیرࣰاۖ قَالَ أَلَمۡ أَقُل لَّكُمۡ إِنِّیۤ أَعۡلَمُ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ قَالُوا۟ یَـٰۤأَبَانَا ٱسۡتَغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوبَنَاۤ إِنَّا كُنَّا خَـٰطِـِٔینَ قَالَ سَوۡفَ أَسۡتَغۡفِرُ لَكُمۡ رَبِّیۤۖ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِیمُ)[Surat Yusuf ৯৪ - ৯৮]
অর্থাৎ, তারপর যাত্রীদল যখন বের হয়ে পড়ল তখন তাদের পিতা বলল, তোমরা যদি আমাকে অপ্রকৃতিস্থ মনে না কর তবে বলি, আমি ইউসুফের ঘ্রাণ পাচ্ছি। তারা বলল, আল্লাহর শপথ! আপনি তো আপনার পূর্ব বিভ্রান্তিতেই রয়েছেন। তারপর যখন সুসংবাদবাহক উপস্থিত হল এবং তার মুখমণ্ডলের উপর জামাটি রাখল তখন সে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে পেল। সে বলল, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আল্লাহর কাছ থেকে জানি, যা তোমরা জান না? ওরা বলল, ‘হে আমাদের পিতা! আমাদের পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আমরা তো অপরাধী।' সে বলল, 'আমি আমার প্রতিপালকের কাছে তোমাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করব। তিনি তো অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (১২: ৯৪-৯৮)
আবদুর রাজ্জাক (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি (وَلَمَّا فَصَلَتِ ٱلۡعِیرُ) -এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, কাফেলা যখন মিসর থেকে যাত্রা করে তখন একটি প্রবল বায়ুপ্রবাহ ইউসুফ (عليه السلام)-এর জামার ঘ্রাণ ইয়াকূব (عليه السلام)-এর কাছে নিয়ে পৌঁছায়।
قَالَ أَبُوهُمۡ إِنِّی لَأَجِدُ رِیحَ یُوسُفَۖ لَوۡلَاۤ أَن تُفَنِّدُونِ (সে বলল, আমি অবশ্যই ইউসুফের ঘ্রাণ পাচ্ছি -যদি তোমরা আমাকে অপ্রকৃতিস্থ মনে না কর।’)
ছাওরী, শুবা (رحمة الله) প্রমুখ বলেছেন, আট দিনের পথের দূরত্ব থেকেই তিনি এই ঘ্রাণ পান। হাসান বসরী (رحمة الله) ও ইবন জুরায়জ মক্কী (رحمة الله) বলেছেন, ইয়াকূব (عليه السلام) ও কাফেলার মধ্যকার দূরত্ব ছিল আশি ফারসাখের৮৪ (ফারসা বলতে প্রায় আট কিলোমিটার বোঝায়।) এবং ইউসুফ (عليه السلام)-এর নিখোঁজকাল থেকে ঘ্রাণ পাওয়া পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান আশি বছর। আয়াতের অর্থ তোমরা যদি বল যে, অতি বৃদ্ধ হওয়ার ফলে আমি প্রলাপোক্তি করছি। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), আতা, মুজাহিদ, সাঈদ ইবন জুবায়র ও কাতাদা (رحمة الله) বলেছেনঃ تفندون অর্থাৎ نسفهن তোমরা আমাকে নির্বোধ সাব্যস্ত করো। মুজাহিদ ও হাসান (رحمة الله) বলেছেনঃ تفندون অর্থ تهدمون তোমরা যদি আমাকে অতিশয় বৃদ্ধ সাব্যস্ত করো।
قَالُوا۟ تَٱللَّهِ إِنَّكَ لَفِی ضَلَـٰلِكَ ٱلۡقَدِیمِ তারা বলল, 'আল্লাহর শপথ! আপনি তো আপনার পুরনো বিভ্রান্তির মধ্যেই রয়েছেন। কাতাদা ও সুদ্দী (رحمة الله) বলেন, তারা এ কথা দ্বারা একটি শক্ত কথাই বলেছে। আল্লাহ বলেনঃ
فَلَمَّاۤ أَن جَاۤءَ ٱلۡبَشِیرُ أَلۡقَىٰهُ عَلَىٰ وَجۡهِهِۦ فَٱرۡتَدَّ بَصِیرࣰاۖ (তারপর যখন সুসংবাদবাহক উপস্থিত হল এবং তার মুখমণ্ডলের উপর জামাটি রাখল তখন তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন।) অর্থাৎ অতি স্বাভাবিকভাবেই কেবল মুখমণ্ডলের উপর ইউসুফ (عليه السلام)-এর জামাটি রাখার সাথেই দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসে। অথচ তিনি তখন ছিলেন অন্ধ। ঐ সময় তিনি তাদেরকে বললেনঃ قَالَ أَلَمۡ أَقُل لَّكُمۡ إِنِّیۤ أَعۡلَمُ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ (আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কিছু জানি, যা তোমরা জান না।) অর্থাৎ আমি জানি যে, আল্লাহ ইউসুফকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন, আমার চক্ষু তার দ্বারা ভাল হয়ে যাবে এবং প্রশান্তি দান করবেন।
قَالُوا۟ یَـٰۤأَبَانَا ٱسۡتَغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوبَنَاۤ إِنَّا كُنَّا خَـٰطِـِٔینَ (তারা বলল, হে পিতা! আমাদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। কেননা অবশ্যই আমরা ছিলাম অপরাধী।) তারা অপরাধমূলক যেসব কাজ ইতিপূর্বে করেছে এবং পিতা ও তাঁর পুত্র ইউসুফ (عليه السلام)-এর কাছ থেকে তার মুকাবিলায় যে ব্যবহার পেয়েছে এবং ইউসুফ (عليه السلام)-কে তারা যা করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেসব ব্যাপারে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে তারা পিতার কাছে আবেদন জানায়। তাদের নিয়ত যখন তওবা করা অথচ তখনো তা কার্যকর হয়নি তখন আল্লাহ তাদেরকে তওবা করার তাওফীক দান করেন এবং পিতা তাদের আবেদনে সাড়া দেন এবং বলেনঃ قَالَ سَوۡفَ أَسۡتَغۡفِرُ لَكُمۡ رَبِّیۤۖ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِیمُ (আমি আমার প্রতিপালকের কাছে তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।)
ইবন মাসউদ (رضي الله عنه), ইবরাহীম আততায়মী, আমর ইবন কায়স, ইবন জুরায়জ (رحمة الله) প্রমুখ বলেছেন—হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) পুত্রদের পক্ষে ইসতিগফার করার জন্যে শেষ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। ইবন জারীর মুহারিব ইবন দীছার (رحمة الله) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ হযরত উমর (رضي الله عنه) মসজিদে নববীতে এসে জনৈক ব্যক্তিকে বলতে শুনেনঃ
اللهم دعوتى فاجبت وامرتنى فاطعت وهذا السحر فاغفرلى
‘হে আল্লাহ্! আপনি আমাকে আহ্বান করেছেন, আমি সাড়া দিয়েছি; আপনি আমাকে হুকুম করেছেন, আমি তা মেনে নিয়েছি। এখন রাতের শেষ প্রহর; অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।’ হযরত উমর (رضي الله عنه) গভীরভাবে উক্ত শব্দের প্রতি লক্ষ্য করে বুঝতে পারলেন যে, আওয়াজটি আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (رضي الله عنه)-এর ঘর থেকে আসছে। তিনি আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (رضي الله عنه)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। আবদুল্লাহ বলেনঃ হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) পুত্রদের পক্ষে প্রার্থনা করার জন্যে শেষ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন তিনি বলেছিলেনঃ (قَالَ سَوۡفَ أَسۡتَغۡفِرُ لَكُمۡ رَبِّیۤۖ (আমি অচিরেই তোমাদের জন্যে আমার প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব।) অপর আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ ( وَٱلۡمُسۡتَغۡفِرِینَ بِٱلۡأَسۡحَارِ)
[Surat Aal-E-Imran ১৭] (যারা শেষ রাতে ক্ষমা প্রার্থনা করে।)
সহীহ হাদীসে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আমাদের প্রতিপালক প্রতিরাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন—– কে আছে তওবাকারী? আমি তার তওবা কবুল করব। কোন প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে দান করব। আছে কোন প্রার্থনাকারী? আমি তার প্রার্থনা মঞ্জুর করব।
এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) তাঁর পুত্রদের পক্ষে ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে জুমআর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। ইবন জারীর (رضي الله عنه) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ এটি আমার ভাই ইয়াকূব (عليه السلام)-এর তার ছেলেদের উদ্দেশে বলেছিলেন। سوف استغفر لكم ربى দ্বারা অর্থ – حتى نأتى ليلة الجمعة যতক্ষণ না জুমআর রাত আসে। উক্ত সনদে এ হাদীসটি খুবই অপরিচিত। হাদীসটি মারফু হওয়ার ব্যাপারেও বিতর্ক রয়েছে। বরং এটা ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর মওকুফ হাদীস বা নিজস্ব উক্তি হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক।
(فَلَمَّا دَخَلُوا۟ عَلَىٰ یُوسُفَ ءَاوَىٰۤ إِلَیۡهِ أَبَوَیۡهِ وَقَالَ ٱدۡخُلُوا۟ مِصۡرَ إِن شَاۤءَ ٱللَّهُ ءَامِنِینَ وَرَفَعَ أَبَوَیۡهِ عَلَى ٱلۡعَرۡشِ وَخَرُّوا۟ لَهُۥ سُجَّدࣰاۖ وَقَالَ یَـٰۤأَبَتِ هَـٰذَا تَأۡوِیلُ رُءۡیَـٰیَ مِن قَبۡلُ قَدۡ جَعَلَهَا رَبِّی حَقࣰّاۖ وَقَدۡ أَحۡسَنَ بِیۤ إِذۡ أَخۡرَجَنِی مِنَ ٱلسِّجۡنِ وَجَاۤءَ بِكُم مِّنَ ٱلۡبَدۡوِ مِنۢ بَعۡدِ أَن نَّزَغَ ٱلشَّیۡطَـٰنُ بَیۡنِی وَبَیۡنَ إِخۡوَتِیۤۚ إِنَّ رَبِّی لَطِیفࣱ لِّمَا یَشَاۤءُۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡعَلِیمُ ٱلۡحَكِیمُ ۞ رَبِّ قَدۡ ءَاتَیۡتَنِی مِنَ ٱلۡمُلۡكِ وَعَلَّمۡتَنِی مِن تَأۡوِیلِ ٱلۡأَحَادِیثِۚ فَاطِرَ ٱلسَّمَـٰوَ ٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ أَنتَ وَلِیِّۦ فِی ٱلدُّنۡیَا وَٱلۡـَٔاخِرَةِۖ تَوَفَّنِی مُسۡلِمࣰا وَأَلۡحِقۡنِی بِٱلصَّـٰلِحِینَ)[Surat Yusuf ৯৯ - ১০১]
অর্থাৎ, তারপর তারা যখন ইউসুফের নিকট উপস্থিত হল, তখন সে তার পিতা-মাতাকে আলিঙ্গন করল এবং বলল, আপনারা আল্লাহর ইচ্ছায় নিরাপদে মিসরে প্রবেশ করুন। এবং ইউসুফ তার পিতা-মাতাকে উচ্চাসনে বসাল এবং তারা সকলে তার সম্মানে সিজদায় লুটিয়ে পড়ল। সে বলল, হে আমার পিতা! এ হচ্ছে আমার পূর্বেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা; আমার প্রতিপালক একে সত্যে পরিণত করেছেন এবং তিনি আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেন এবং শয়তান আমার ও আমার ভাইদের সম্পর্ক নষ্ট করবার পরও আপনাদেরকে মরু অঞ্চল থেকে এখানে এনে দিয়ে আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা তা নিপুণতার সাথে করেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে রাজ্য দান করেছ এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছ। হে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা! তুমিই ইহলোক ও পরলোকে আমার অভিভাবক। তুমি আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দাও এবং আমাকে সৎকর্ম পরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত কর। (১২: ৯৯-১০১)
এখানে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর প্রিয়জনদের সাথে পুনঃমিলনের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। বিচ্ছেদের সময়সীমা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত আছে। কারও মতে, আশি বছর। কারও মতে, তিরাশি বছর। এ দুটি মতের কথা হাসান (رحمة الله) থেকে বর্ণিত হয়েছে। কাতাদা (رحمة الله)-এর মতে, পঁয়ত্রিশ বছর। কিন্তু মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের মতে, বিচ্ছেদের কাল মাত্র আঠার বছর। আহলি কিতাবদের মতে, এই সময় ছিল চল্লিশ বছর। তবে ঘটনার উপর দৃষ্টিপাত করলে বিচ্ছেদকাল খুব বেশি বলে মনে হয় না। কেননা, মহিলাটি যখন ইউসুফকে ছলনা দিয়েছিল তখন অনেকের মতে তিনি মাত্র সতের বছরের যুবক। তিনি আত্মরক্ষা করলেন। ফলে কয়েক বছর জেলখানায় থাকেন। ইকরিমা প্রমুখের মতে, জেলখানায় থাকার সময়সীমা সাত বছর। এরপর প্রাচুর্যের সাত বছর অতিক্রান্ত হয়। তারপর মানুষ দুর্ভিক্ষের সাত বছরে পতিত হয়। এর প্রথম বছরে ইউসুফ (عليه السلام)-এর ভাইয়েরা খাদ্যের জন্য মিসরে আসে। দ্বিতীয় বছরে তারা বিনয়ামীনকে নিয়ে আসে। আর তৃতীয় বছরে ইউসুফ (عليه السلام) নিজের পরিচয় দেন এবং পরিবার-পরিজনকে নিয়ে আসতে বলেন। ফলে সে বছরেই ইউসুফ (عليه السلام)-এর গোটা পরিবার মিসরে তাঁর কাছে চলে আছে। এ হিসেবে মিলনকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ১৭+৭+৭+৩=৩৪ বছর। (فَلَمَّا دَخَلُوا۟ عَلَىٰ یُوسُفَ ءَاوَىٰۤ إِلَیۡهِ أَبَوَیۡهِ) (তারপর যখন তারা ইউসুফের কাছে উপস্থিত হল তখন সে তার পিতা-মাতাকে আলিঙ্গন করল।) অর্থাৎ ভাইদের থেকে আলাদা হয়ে ইউসুফ (عليه السلام) কেবল তার পিতা-মাতার সাথে একান্তে মিলিত হন। وَقَالَ ٱدۡخُلُوا۟ مِصۡرَ إِن شَاۤءَ ٱللَّهُ ءَامِنِینَ (এবং বললঃ আপনারা আল্লাহর ইচ্ছায় নিরাপদে মিসরে প্রবেশ করুন।) কারো কারো মতে, এখানে বর্ণনা ঘটনানুক্রমিক নয়। ঘটনা ছিল, প্রথমে তিনি তাদেরকে মিসরে প্রবেশের জন্য স্বাগত সম্ভাষণ জানান, তারপর তাদেরকে আলিঙ্গন করেন। ইবন জারীর (رضي الله عنه) এ ব্যাখ্যাকে দুর্বল বলেছেন। তাঁর এ মন্তব্যকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ইমাম সুদ্দী (رحمة الله) বলেছেন, যে, ইউসুফ (عليه السلام) নিজে অগ্রসর হয়ে পিতা-মাতার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং পথে যেখানে তারা অবতরণ করেছিলেন সেখানে তাদের তাঁবুতে গিয়ে তাদের আলিঙ্গন করেন। তারপর সেখান থেকে যাত্রা করে মিসরের প্রবেশ দ্বারের সন্নিকটে পৌছলে ইউসুফ (عليه السلام) বললেন, (আল্লাহর ইচ্ছায় আপনারা নিরাপদে মিসরে প্রবেশ করুন।) তবে বলা যেতে পারে যে, এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উক্তরূপ কথা সংযোজন না করেও পারা যায় এবং এর কোন প্রয়োজনও নেই। যেমন ادخلوا مصر অর্থ اسكنوا مصر অর্থাৎ আপনারা মিসরে বসবাস করুন কিংবা মিসরে অবস্থান করুন। (আল্লাহ চাহেন তো নিরাপদ অবস্থায় থাকবেন।) এ ব্যাখ্যা খুবই সঠিক ও সুন্দর।
আহলি কিতাবদের মতে, হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) যখন বিলবীস এলাকায় জাশির নামক স্থানে পৌছেন, তখন হযরত ইউসুফ (عليه السلام) তার সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে আসেন। ইয়াকূব (عليه السلام) নিজের আগমনবার্তা পৌঁছানোর জন্যে য়াহুযাকে আগেই পাঠিয়ে দেন। তারা আরও বলেছেন, মিসরের বাদশাহ ইয়াকূব (عليه السلام)-এর পরিবারকে অবস্থান গ্রহণ এবং তাদের গৃহপালিত সমস্ত পশু ও মালপত্র নিয়ে থাকার জন্যে সম্পূর্ণ জাশির এলাকা তাদেরকে ছেড়ে দেন। একদল মুফাসসির উল্লেখ করেছেন যে, হযরত ইউসুফ (عليه السلام) যখন হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) তথা ইসরাঈল-এর অন্যান্য সংবাদ শুনলেন, তখন তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে দ্রুত বের হয়ে আসেন। সেই সাথে ইউসুফ (عليه السلام)-এর সহযোগিতা ও আল্লাহর নবী ইসরাঈলের সম্মানার্থে বাদশাহ ও তার সৈন্যরা এগিয়ে আসে। ইসরাঈল বাদশাহর জন্যে দুআ করেন। নবী ইয়াকুব (عليه السلام)-এর আগমনের বরকতে আল্লাহ মিসরবাসীর উপর থেকে অবশিষ্ট বছরগুলোর দুর্ভিক্ষ তুলে নেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
ইয়াকুব নবীর সাথে তাঁর পুত্রগণ ও পুত্রদের সন্তান ও পরিজনসহ মোট কত লোক মিসরে এসেছিলেন সে ব্যাপারে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। আবু ইসহাক সাবিঈ (رحمة الله) ইবন মাসউদ (رضي الله عنه)-এর বরাতে বলেন, এদের সংখ্যা ছিল তেষট্টি। মূসা ইবন উবায়দা (رضي الله عنه) আবদুল্লাহ ইবন শাদ্দার বরাতে বলেছেন, তিরাশিজন। আবু ইসহাক মাসরুক (رضي الله عنه) সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, এরা যখন মিসরে প্রবেশ করেন তখন এদের সংখ্যা ছিল তিনশ’ নব্বই। কিন্তু এঁরা যখন মূসা (عليه السلام)-এর নেতৃত্বে মিসর থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন তাদের যুদ্ধক্ষম যুবকের সংখ্যাই ছিল ছয় লক্ষের উপরে। আহলি কিতাবদের মতে, তারা সংখ্যায় ছিল সত্তরজন। তারা এদের নামও উল্লেখ করেছে। আল্লাহর বাণীঃ وَرَفَعَ أَبَوَیۡهِ عَلَى ٱلۡعَرۡشِ (এবং ইউসুফ তার পিতা-মাতাকে উচ্চাসনে বসাল।) কেউ কেউ বলেছেন, ইউসুফের মা ঐ সময় জীবিত ছিলেন না। তাওরাতের পণ্ডিতগণের মতও তাই। কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, ঐ সময় আল্লাহ তাকে জীবিত করে দেন। অপর এক দলের মতে, ইউসুফ (عليه السلام)-এর খালার নাম ছিল লাইলী। খালাকে মায়ের স্থানে গণ্য করা হয়েছে। ইবন জারীর (رحمة الله) ও অন্যরা বলেছেন, কুরআনের সুস্পষ্ট দাবি হল, ঐ সময় তাঁর মা জীবিত ছিলেন। সুতরাং এর বিরুদ্ধে আহলি কিতাবদের মতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে ভিন্ন ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটাই শক্তিশালী মত। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। পিতা-মাতাকে উচ্চাসনে উঠানোর অর্থ তাদেরকে নিজের কাছে সিংহাসনে বসান। وَخَرُّوا۟ لَهُۥ سُجَّدࣰاۖ (এবং তারা সকলে তার সম্মানে সিজদায় লুটিয়ে পড়ল)। অর্থাৎ তার পিতা-মাতা ও এগার ভাই ইউসুফ (عليه السلام)-এর সম্মানার্থে সিজদা করেন। এ রকম সিজদা করা তাদের শরীয়তে ও পরবর্তী নবীদের শরীয়তে বৈধ ছিল: কিন্তু আমাদের শরীয়তে এটা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। هَـٰذَا تَأۡوِیلُ رُءۡیَـٰیَ مِن قَبۡلُ (সে বলল, হে আমার পিতা! এটাই আমার পূর্বেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা।) অর্থাৎ এটা সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা যা পূর্বে আমি আপনাকে শুনিয়েছিলাম যে, এগারটি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্র আমাকে সিজদা করছে। আপনি আমাকে এ স্বপ্ন গোপন রাখার জন্যে বলেছিলেন এবং তখন আমাকে কিছু প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন।
قَدۡ جَعَلَهَا رَبِّی حَقࣰّاۖ وَقَدۡ أَحۡسَنَ بِیۤ إِذۡ أَخۡرَجَنِی مِنَ ٱلسِّجۡنِ (‘আমার প্রতিপালক তা সত্যে পরিণত করেছেন এবং আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। কেননা, তিনি আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছেন।’)
অর্থাৎ দুঃখ-কষ্ট ও সংকীর্ণতার পরে আমাকে শাসক বানিয়েছেন। মিসরের যেখানে ইচ্ছা সেখানেই আদেশ কার্যকরী করার ক্ষমতা দান করেছেন। وَجَاۤءَ بِكُم مِّنَ ٱلۡبَدۡوِ (আপনাদেরকে মরু অঞ্চল থেকে এখানে এনে দিয়েছেন।)
অর্থাৎ গ্রাম থেকে তারা ইবরাহীম খলীলুল্লাহর দেশের আরাবাত নামক এক নিভৃত মরু পল্লীতে বসবাস করতেন। مِنۢ بَعۡدِ أَن نَّزَغَ ٱلشَّیۡطَـٰنُ بَیۡنِی وَبَیۡنَ إِخۡوَتِیۤۚ (শয়তান আমার ও ভাইদের মাঝে সম্পর্ক নষ্ট করার পর।) অর্থাৎ তারা যেসব নির্যাতনমূলক আচরণ করেছিল— যার বর্ণনা পূর্বে দেয়া হয়েছে তারপর। إِنَّ رَبِّی لَطِیفࣱ لِّمَا یَشَاۤءُۚ (নিশ্চয় আমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন, তা নিপুণতার সাথেই সম্পন্ন করেন।) অর্থাৎ তিনি যখন কোন কিছু করার ইচ্ছা করেন তখন তা বাস্তবায়নের উপায় বের করেন ও এমন সহজ-সরল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করেন যা মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বরং তিনি নিজেই তা নির্ধারণ করেন এবং তাঁর নিজ কুদরতে সূক্ষ্মভাবে সম্পন্ন করেন। إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡعَلِیمُ ٱلۡحَكِیمُ (তিনিই তো সর্বজ্ঞ।) সকল বিষয়ে অবগত (প্রজ্ঞাময়)। অর্থাৎ পরিকল্পনা গ্রহণে, পদ্ধতি নির্ধারণে ও বাস্তবায়নে তিনি প্রজ্ঞাশীল।
আহলি কিতাবদের মতে, হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর কর্তৃত্বে যত খাদ্য রসদ ছিল তা তিনি মিসরবাসী ও অন্যদের কাছে সকল প্রকার জিনিসের বিনিময়ে বিক্রি করেন। যেমন স্বর্ণ, রৌপ্য, যমীন, আসবাবপত্র ইত্যাদি; এমনকি তাদের জীবনের বিনিময়েও বিক্রি করেছেন। ফলে তারা সবাই ক্রীতদাসে পরিণত হয়। এরপর তিনি তাদের ব্যবহারের জন্যে তাদের জমি-জিরাত ছেড়ে দেন এবং তাদেরকে এই শর্তে মুক্তি দেন যে, তারা যে সব ফসল ও ফল উৎপন্ন করবে তার এক-পঞ্চমাংশ রাজস্ব দেবে। এটাই পরবর্তীকালে মিসরের স্থায়ী প্রথায় পরিণত হয়।
সা’লাবী (رحمة الله) বলেছেন, দুর্ভিক্ষের সময়ে হযরত ইউসুফ (عليه السلام) ক্ষুধার্তদের কথা ভুলতে পারতেন না। দুর্ভিক্ষকালে তিনি কখনও পেট ভরে খেতেন না। প্রত্যহ দুপুরে তিনি মাত্র এক লুকমা খাবার খেতেন। তার দেখাদেখি ঐ সময়ে অন্যান্য দেশের রাজরাজড়ারা-ও এই নীতি অনুসরণ করেন। আমি বলি, আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (رضي الله عنه)-ও তার আমলে দুর্ভিক্ষের বছরে পেট ভরে আহার করেন নি। দুর্ভিক্ষের পর সচ্ছলতা ফিরে আসা পর্যন্ত তিনি এ নিয়ম পালন করেছেন। ইমাম শাফিঈ (رحمة الله) বলেন, দুর্ভিক্ষ কেটে যাওয়ার পর জনৈক বেদুঈন হযরত উমর (رضي الله عنه)-কে জানায় যে, দুর্ভিক্ষ দূর হয়েছে। আপনি এখন মুক্ত স্বাধীন।
এরপর হযরত ইউসুফ (عليه السلام) যখন দেখলেন যে, তাঁর প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ পরিপূর্ণ হয়েছে, তার আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়ে গেছে, তখন উপলব্ধি করলেন যে, এই পৃথিবীর কোনই স্থায়িত্ব নেই। এর উপরে যা কিছু আছে সবই ধ্বংস হবে। আর পূর্ণতার পরেই আসে ক্ষয়ের পালা তখন তিনি আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করলেন। আল্লাহর অনেক অনুগ্রহ ও করুণার কথা স্বীকার করলেন এবং মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দান এবং সৎলোকদের অন্তর্ভুক্ত রাখার জন্য দু’আ করেন। তার এ দু’আ ছিল এমন পর্যায়ের, যেমন অন্যান্য সময় দু’আর মধ্যে বলা হয় اللهم احينا مسلمين وتوفنا مسامين (হে আল্লাহ! আমাদেরকে মুসলিমরূপে জীবিত রাখুন এবং মুসলিমরূপে মৃত্যু দান করুন।) অর্থাৎ যখন আপনি আমাদেরকে মৃত্যু দিবেন, তখন যেন আমরা মুসলমান থাকি। এমনও বলা যায় যে, তিনি এ দুআ করেছিলেন মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায়। যেমনিভাবে রসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর মৃত্যু-শয্যায় থেকে প্রার্থনা করেছিলেন। তাঁর রূহকে ঊর্ধ জগতে উঠিয়ে নিতে ও নবী-রাসূল ও সালিহীনদের অন্তর্ভুক্ত করতে। রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেনঃ اللهم في الرفيق الاعلى এ দু’আ তিনবার বলার পর তিনি ইনতিকাল করেন।
এমনও হতে পারে, হযরত ইউসুফ (عليه السلام) শরীর ও দেহের সুস্থ থাকা অবস্থার উপর ইসলামের সাথে মৃত্যু কামনা করেছিলেন। আর এটা তাদের শরীয়তে বৈধ ছিল। হযরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিতঃ ما تمني نبي قط الموت قبل يوسف অর্থাৎ হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর পূর্বে কোন নবী মৃত্যু কামনা করেননি। কিন্তু আমাদের শরীয়তে মৃত্যু কামনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে, ফিৎনা-ফাসাদের সময় তা জায়েয আছে। যেমন ইমাম আহমদ (رحمة الله) হযরত মু’আয (رضي الله عنه)-এর দু’আ সম্বলিত হাদীস বর্ণনা করেছেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি যখন কোন সম্প্রদায়কে পরীক্ষায় ফেলতে চান তখন ঐ পরীক্ষায় আমাকে না ফেলেই আপনার কাছে উঠিয়ে নিন। فاذا اردت بقوم فتنة فتو فنا اليك غير مفتو نين অন্য এক হাদীসে আছেঃ হে আদম সন্তান! ফিতনায় জড়িয়ে পড়ার চেয়ে মৃত্যুই তোমার জন্যে শ্রেয়।
হযরত মারয়াম (عليه السلام) বলেছিলেনঃ (یَـٰلَیۡتَنِی مِتُّ قَبۡلَ هَـٰذَا وَكُنتُ نَسۡیࣰا مَّنسِیࣰّا)
[Surat Maryam ২৩] (হায়, আমি যদি এর পূর্বে মরে যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম। (সূরা মারয়ামঃ ২৩) হযরত আলী (رضي الله عنه) ইবন আবি তালিবও মৃত্যু কামনা করেছিলেন তখন, যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে ওঠে, ফিৎনা-ফাসাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, হত্যা-সন্ত্রাস বিস্তার লাভ করে এবং সর্বত্র সমালোচনার চর্চা হতে থাকে। সহীহ্ বুখারী সংকলক ইমাম আবু আবদুল্লাহ বুখারী (رحمة الله)-ও মৃত্যু কামনা করেছিলেন, যখন তার বিরোধীরা সর্বত্র বিরোধিতার বিভীষিকা ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং তিনি অত্যধিক মানসিক যাতনায় ভুগছিলেন।
স্বাভাবিক অবস্থায় মৃত্যু কামনা সম্পর্কে ইমাম বুখারী (رحمة الله) ও ইমাম মুসলিম (رحمة الله) তাদের সহীহ গ্রন্থদ্বয়ে হযরত আনাস ইবন মালিক (رضي الله عنه)-এর হাদীস বর্ণনা করেছেন, যাতে আছে— রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
لا يتمني احدكم الموت لضر نزل به اما محسنا فيزداد واما مسيئا فلعله يستعتب ولكم ليقل اللهم أحيني ما كانت الحيوة خيرا لي وتوفني اذا كانت الوفاة خيرالی.
অর্থাৎ, বিপদে ও দুঃখে পড়ে তোমরা মৃত্যু কামনা করো না। কেননা বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি যদি নেককার হয়, তাহলে তার নেকী বেড়ে যাবে। আর যদি সে পাপিষ্ঠ হয় তাহলে তার পাপ কমে যাবে। বরং এ রকম বলা উচিত যে, হে আল্লাহ! যতদিন বেঁচে থাকা আমার জন্যে কল্যাণকর হয় ততদিন আমাকে জীবিত রাখুন! আর মৃত্যু যখন আমার জন্যে মঙ্গলময় হয় তখন আমাকে মৃত্যু দান করুন।
এখানে ضر বলতে মানুষের দেহের রোগ বা অনুরূপ অবস্থা বোঝান হয়েছে, দীন সম্পর্কীয় নয়। এটা স্পষ্ট যে, হযরত ইউসুফ (عليه السلام) মৃত্যু কামনা করেছিলেন তখন, যখন তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত কিংবা তার নিকটবর্তী হয়েছিলেন। ইবন ইসহাক (رحمة الله) আহলি কিতাবদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) মিসরে পুত্র ইউসুফ (عليه السلام)-এর কাছে সতের বছর থাকার পর ইনতিকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি ইউসুফ (عليه السلام)-এর কাছে ওসীয়ত করে যান যে, তাকে যেন তাঁর পিতৃ-পুরুষ ইবরাহীম (عليه السلام) ও ইসহাক (عليه السلام)-এর পাশে দাফন করা হয়। সুদ্দী (رحمة الله) লিখেন যে, হযরত ইউসুফ (عليه السلام) ধৈর্যের সাথে এ ওসীয়ত পালন করেন। পিতার মৃতদেহ তিনি সিরিয়ায় পাঠিয়ে দেন এবং পিতা ইসহাক (عليه السلام) ও পিতামহ ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (عليه السلام)-র কবরের পাশে একই গুহায় তাকে দাফন করা হয়।
আহলি কিতাবদের মতে, হযরত ইয়াকুব (عليه السلام) যখন মিসরে যান তখন তাঁর বয়স ছিল একশ’ ত্রিশ বছর। তাদের মতে, তিনি মিসরে সতের বছর জীবিত থাকেন। (১৩০+১৭= ১৪৭ বছর)। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তারা হযরত ইয়াকূব (عليه السلام)-এর বয়স লিখেছে সর্বমোট একশ’ চল্লিশ বছর। এ কথা তাদের কিতাবে লিখিত আছে। নিঃসন্দেহে এটা তাদের ভুল। এটা হয় লিপিগত ভুল কিংবা তাদের হিসেবের ভুল অথবা তারা চল্লিশের উপরের খুচরা বছরগুলোকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু এ রকম করা তাদের নীতি নয়। কেননা, অনেক স্থানে তারা খুচরা সংখ্যাসহ উল্লেখ করেছে। এখানে কিভাবে এর ব্যতিক্রম করল তা বোধগম্য নয়।
আল্লাহ কুরআনে বলেনঃ
(أَمۡ كُنتُمۡ شُهَدَاۤءَ إِذۡ حَضَرَ یَعۡقُوبَ ٱلۡمَوۡتُ إِذۡ قَالَ لِبَنِیهِ مَا تَعۡبُدُونَ مِنۢ بَعۡدِیۖ قَالُوا۟ نَعۡبُدُ إِلَـٰهَكَ وَإِلَـٰهَ ءَابَاۤىِٕكَ إِبۡرَ ٰهِـۧمَ وَإِسۡمَـٰعِیلَ وَإِسۡحَـٰقَ إِلَـٰهࣰا وَ ٰحِدࣰا وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ)
[Surat Al-Baqarah ১৩৩]
অর্থাৎ, তবে কি তোমরা উপস্থিত ছিলে যখন ইয়াকুবের মৃত্যু নিকটবর্তী হয়? যখন সে সন্তানদের বললঃ আমার পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা বললঃ আমরা আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের উপাস্যের ইবাদত করব। তিনি একক উপাস্য। আর আমরা সবাই তাঁর কাছে আত্মসমর্পণকারী। (সূরা বাকারাঃ ১৩৩)
হযরত ইয়াকুব (عليه السلام) আপন সন্তানদেরকে যে খালিস দীনের প্রতি ওসীয়ত করেন, তা হল দীন ইসলাম। যে দীনসহ সমস্ত নবীকে তিনি প্রেরণ করেছেন। আহলি কিতাবরা উল্লেখ করে, হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) তাঁর পুত্রদেরকে একজন একজন করে ওসীয়ত করেন এবং তাদের অবস্থা ভবিষ্যতে কেমন হবে সে সম্পর্কে অবহিত করেন। পুত্র ইয়াহুযাকে তিনি তাঁর বংশ থেকে এক মহান নবীর আগমনের সু-সংবাদ দেন। বংশের সবাই তার আনুগত্য করবে। তিনি হলেন সায়্যিদিনা ঈসা ইবন মারয়াম (عليه السلام)। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আহলি কিতাবদের বর্ণনা মতে, হযরত ইয়াকূব (عليه السلام)-এর মৃত্যুতে মিসরবাসী সত্তর দিন পর্যন্ত শোক পালন করে। হযরত ইউসুফ (عليه السلام) চিকিৎসাবিদদেরকে উৎকৃষ্ট সুগন্ধি দ্বারা পিতার মরদেহকে অক্ষুন্ন রাখতে আদেশ দিলে তারা তাই করে। এভাবে চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়। অতঃপর হযরত ইউসুফ (عليه السلام) মিসরের বাদশাহর কাছে এই মর্মে মিসরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি চান যে, তিনি পিতাকে পিতৃ-পুরুষদের পাশে দাফন করবেন। বাদশাহ অনুমতি দিলেন। ইউসুফ (عليه السلام)-এর সাথে মিসরের গণ্যমান্য ও প্রভাবশালী লোকদের এক বিরাট দল গমন করে। হিবরূন (হেব্রন) নামক স্থানে পৌঁছে পিতাকে সেই গুহায় দাফন করেন, যে গুহাটি হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) ইফরূন ইবন সাখার-এর কাছ থেকে খরীদ করে নিয়েছিলেন। সাতদিন তথায় অবস্থান করার পর সকলেই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পিতার মৃত্যুতে ইউসুফ (عليه السلام)-এর ভাইগণ ইউসুফ (عليه السلام)-কে অত্যধিক সান্ত্বনা দেন ও সম্মান দেখান। ইউসুফ (عليه السلام)-ও তাদেরকে সম্মানিত করেন এবং প্রত্যাবর্তনের পর উত্তমভাবে তাদেরকে মিসরে থাকার ব্যবস্থা করেন। এরপর আসে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর অন্তিমকাল। মৃত্যুকালে তিনি স্ব-বংশীয়দেরকে ওসীয়ত করে যান যে, তারা যখন মিসর থেকে বের হয়ে যাবেন তখন যেন তার লাশও মিসর থেকে সাথে করে নিয়ে যান এবং বাপ-দাদার কবরের পাশে তাঁকেও যেন দাফন করা হয়। ফলে মৃত্যুর পরে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর লাশ সুগন্ধি দ্বারা আবৃত করে একটি সিন্দুকে পুরে মিসরে রেখে দেওয়া হয়। হযরত মূসা (عليه السلام) যখন বনী ইসরাঈলকে নিয়ে মিসর থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন ঐ সিন্দুকও নিয়ে আসেন এবং তার পিতৃ-পুরুষদের পাশে দাফন করেন। পরে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। আহলি কিতাবদের মতে, মৃত্যুকালে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এর বয়স হয়েছিল একশ’ দশ বছর। আহলি কিতাবদের এই লেখাটি আমি দেখেছি এবং ইবন জারীর (رحمة الله)ও তা নকল করেছেন। মুবারক ইবন ফুযালা হাসান সূত্রে বর্ণনা করেছেনঃ ইউসুফ (عليه السلام)-কে যখন কুয়ায় নিক্ষেপ করা হয়, তখন তার বয়স ছিল সতের বছর। পিতার কাছ থেকে অনুপস্থিত ছিলেন আশি বছর এবং পিতার সাথে মিলনের পরে জীবিত ছিলেন তেইশ বছর। সুতরাং মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল (১৭+৮০+২৩) একশ’ বিশ বছর। অন্যদের মতে, মৃত্যুকালে তিনি তার ভাই ইয়াহুযাকে ওসীয়ত করে যান।