❏ ফিরআউন ও তার বাহিনী ধ্বংসের বিবরণ
বাদশাহ ফিরআউনের আনুগত্য স্বীকার এবং আল্লাহর নবী ও তাঁর রাসূল মূসা ইবনে ইমরান (عليه السلام)-এর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়ে মিসরের কিবতীদের যখন তাদের কুফরী, অবাধ্যতা ও সত্য বিমুখতায় অবস্থান দীর্ঘায়িত হতে লাগল; আল্লাহ তা’আলা তখন মিসরবাসীর নিকট বিস্ময়কর ও সুস্পষ্ট প্রমাণাদি পেশ করেন এবং তাদেরকে এমন সব অলৌকিক ঘটনা দেখান যাতে চোখ ঝলসে যায় এবং মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এতদসত্ত্বেও তাদের কিছু সংখ্যক ব্যতীত কেউ বিশ্বাস স্থাপন করেনি; অন্যায় থেকে প্রত্যাবর্তন করেনি; জোর-জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত থাকেনি এবং কেউ কেউ বলেন, তাদের মধ্যে মাত্র তিন ব্যক্তি ঈমান এনেছিলেন। একজন হচ্ছেন ফিরআউনের স্ত্রী, কিতাবীরা তার সম্বন্ধে মোটেও অবহিত নয়। দ্বিতীয়জন হচ্ছেন ফিরআউনের সম্প্রদায়ের মুমিন ব্যক্তিটি যার নসীহত প্রদান, পরামর্শ দান ও তাদের বিরুদ্ধে দলীলাদি পেশ করার বিষয়টি ইতিপূর্বেই সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয়জন হচ্ছেন উপদেশ প্রদানকারী ব্যক্তিটি যিনি শহরের দূর প্রান্ত থেকে ছুটে এসে মূসা (عليه السلام)-কে তাঁর বিরুদ্ধে সাজানো ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে অবহিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, “হে মূসা (عليه السلام)! ফিরআউনের পারিষদবর্গ আপনাকে হত্যা করার জন্য সলাপরামর্শ করছে। সুতরাং আপনি বের হয়ে পড়েন। আমি আপনার একজন মঙ্গলকামী বৈ নই। এটি আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর অভিমত। যা ইবন আবু হাতিম (رحمة الله)ও বর্ণনা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর অভিমত হল, এঁরা তিনজন হচ্ছেন জাদুকরদের অতিরিক্ত। কেননা জাদুকরগণও কিবতীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

আবার কেউ কেউ বলেন, ফিরআউনের সম্প্রদায় কিবতীদের মধ্য হতে একটি দল ঈমান এনেছিল। জাদুকরদের সকলে এবং বনী ইসরাঈলদের সকল গোত্রই ঈমান এনেছিল। কুরআন মজীদে নিম্নোক্ত আয়াতে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়ঃ

فَمَاۤ ءَامَنَ لِمُوسَىٰۤ إِلَّا ذُرِّیَّةࣱ مِّن قَوۡمِهِۦ عَلَىٰ خَوۡفࣲ مِّن فِرۡعَوۡنَ وَمَلَإِی۟هِمۡ أَن یَفۡتِنَهُمۡۚ وَإِنَّ فِرۡعَوۡنَ لَعَالࣲ فِی ٱلۡأَرۡضِ وَإِنَّهُۥ لَمِنَ ٱلۡمُسۡرِفِینَ[Surat Yunus ৮৩]

অর্থাৎ-“ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গ নির্যাতন করবে এ আশংকায় তার সম্প্রদায়ের একদল ব্যতীত আর কেউই তার প্রতি ঈমান আনেনি। যমীনে তো ফিরআউন পরাক্রমশালী ছিল এবং সে অবশ্যই সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা ইউনুসঃ ৮৩)।

আয়াতাংশ قومه-তে ة সর্বনামটিতে ফিরআউনকেই নির্দেশ করা হয়েছে। কেননা, বাক্যের পূর্বাপর দৃষ্টে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। আবার কেউ কেউ নিকটতম শব্দ মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি নির্দেশ করে বলে বলেছেন। তবে প্রথম অভিমতটিই বেশি স্পষ্ট। তাফসীরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর তারা ঈমান এনেছিল গোপনে। কেননা, তারা ফিরআউন ও তার প্রতিপত্তি এবং তার সম্প্রদায়ের অত্যাচার, অবিচার ও নিষ্ঠুরতাকে ভয় করত। তারা আরো ভয় করত যে, যদি ফিরআউনের লোকেরা তাদের ঈমানের কথা জানতে পারে তাহলে তারা তাদেরকে ধর্মচ্যুত করে ফেলবে। ফিরআউনের ঘটনা আল্লাহ বর্ণনা করেছেন আর আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَإِنَّ فِرۡعَوۡنَ لَعَالࣲ فِی ٱلۡأَرۡضِ وَإِنَّهُۥ لَمِنَ ٱلۡمُسۡرِفِینَ)

অর্থাৎ- “নিশ্চয়ই দেশে তো ফিরআউন পরাক্রমশালী ছিল। সে ছিল স্বৈরাচারী, হঠকারী ও অন্যায়ভাবে দাম্ভিক।” আবার সে তার প্রতিটি কাজে, আচরণে ও ব্যবহারে ছিল সীমালংঘনকারী। বস্তুত সে ছিল এমন একটি মারাত্মক জীবাণু যার ধ্বংস ছিল অত্যাসন্ন; সে এমন একটি নিকৃষ্ট ফল যার কাটার সময় ছিল অত্যাসন্ন, এমন অভিশপ্ত অগ্নিশিখা যার নির্বাপন ছিল সুনিশ্চিত।

তখন মূসা (عليه السلام) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেনঃ

(وَقَالَ مُوسَىٰ یَـٰقَوۡمِ إِن كُنتُمۡ ءَامَنتُم بِٱللَّهِ فَعَلَیۡهِ تَوَكَّلُوۤا۟ إِن كُنتُم مُّسۡلِمِینَ ۝ فَقَالُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ تَوَكَّلۡنَا رَبَّنَا لَا تَجۡعَلۡنَا فِتۡنَةࣰ لِّلۡقَوۡمِ ٱلظَّـٰلِمِینَ ۝ وَنَجِّنَا بِرَحۡمَتِكَ مِنَ ٱلۡقَوۡمِ ٱلۡكَـٰفِرِینَ)

[Surat Yunus ৮৪ - ৮৬]

‘হে আমার সম্প্রদায়! যদি তোমরা আল্লাহতে ঈমান এনে থাক, যদি তোমরা আত্মসমর্পণকারী হও তবে তোমরা তাঁরই উপর নির্ভর কর। তারপর তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপর নির্ভর করলাম। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে জালিম সম্প্রদায়ের উৎপীড়নের পাত্র করো না এবং আমাদেরকে তোমার অনুগ্রহে কাফির সম্প্রদায় হতে রক্ষা কর। (সূরা ইউনুসঃ ৮৪-৮৬)।

অর্থাৎ মূসা (عليه السلام) তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা, আল্লাহ তা’আলার কাছে সাহায্য প্রার্থনা এবং আল্লাহ তা’আলার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করার জন্যে হুকুম দিলেন। তাঁরা তা মান্য করলেন। তাই আল্লাহ তাআলাও তাদেরকে তাদের বিপদাপদ থেকে উদ্ধার করলেন।

আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেনঃ

(وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ مُوسَىٰ وَأَخِیهِ أَن تَبَوَّءَا لِقَوۡمِكُمَا بِمِصۡرَ بُیُوتࣰا وَٱجۡعَلُوا۟ بُیُوتَكُمۡ قِبۡلَةࣰ وَأَقِیمُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ)[Surat Yunus ৮৭]

অর্থাৎ-“আমি মূসা (عليه السلام) ও তার ভাইয়ের নিকট প্রত্যাদেশ করলাম, মিসরে তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য গৃহ স্থাপন কর, তোমাদের গৃহগুলোকে ইবাদত গৃহ কর, সালাত কায়েম কর এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ দাও।” (সূরা ইউনুসঃ ৮৭)

অন্য কথায় আল্লাহ তা’আলা মূসা (عليه السلام) ও তাঁর ভ্রাতা হারূন (عليه السلام)-কে ওহী মারফত নির্দেশ দিলেন যেন তারা তাদের সম্প্রদায়ের জন্যে কিবতীদের থেকে আলাদা ধরনের গৃহ নির্মাণ করেন যাতে তারা নির্দেশ পাওয়া মাত্রই ভ্রমণের জন্যে তৈরি হতে পারে এবং একে অন্যের ঘর সহজে চিনতে পারে ও প্রয়োজনে বের হয়ে পড়ার জন্যে সংবাদ দিতে পারে।

আয়াতে উল্লেখিত আয়াতাংশ ( وَٱجۡعَلُوا۟ بُیُوتَكُمۡ قِبۡلَةࣰ ) এর অর্থ হচ্ছে, তোমাদের গৃহগুলোকে ইবাদত গৃহ কর। কেউ কেউ বলেন, এটার অর্থ হচ্ছে গৃহগুলোতে বেশি বেশি সালাত আদায় করবে।‘ মুজাহিদ (رحمة الله), আবূ মালিক (رحمة الله), ইবরাহীম আন-নাওয়ী (رحمة الله), আর রাবী (رحمة الله), যাহযাক (رحمة الله), যায়িদ ইবন আসলাম (رحمة الله), তাঁর পুত্র আবদুর রহমান (رحمة الله) ও অন্যান্য তাফসীরকার এ অভিমত পোষণ করেন। এ অভিমত অনুযায়ী আয়াতাংশের অর্থ হবেঃ তারা যেসব অসুবিধা, ক্লেশ, কষ্ট ও সংকীর্ণতায় ভুগছে তা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে অধিক হারে সালাত আদায় করে আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।

যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেনঃ

واستعينوا بالصبر والصلوة .

অর্থাৎ- “ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর।” (সূরা বাকারাঃ ৪৫)

হাদীসে বর্ণিত রয়েছে, রাসূল (ﷺ) যখন কোন কঠিন বিষয়ের সম্মুখীন হতেন, তখন তিনি সালাত আদায় করতেন।

আবার কেউ কেউ বলেন, এটার অর্থ হচ্ছে—ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের অত্যাচারের ভয়ে মসজিদ বা মজলিসে প্রকাশ্য ইবাদত কষ্টসাধ্য হওয়ায় গৃহের নির্দিষ্ট স্থানে তাদেরকে সালাত আদায়ের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। প্রথম অর্থটি অধিক গ্রহণযোগ্য। তবে দ্বিতীয় অর্থটিও অগ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহই অধিক জ্ঞাত।

সাঈদ ইব্‌ন জুবাইর (رحمة الله) আয়াতাংশ ( وَٱجۡعَلُوا۟ بُیُوتَكُمۡ قِبۡلَةࣰ ) এর তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটার অর্থ হচ্ছে, তোমরা তোমাদের বাড়িগুলোকে মুখোমুখি করে তৈরি কর।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

(وَقَالَ مُوسَىٰ رَبَّنَاۤ إِنَّكَ ءَاتَیۡتَ فِرۡعَوۡنَ وَمَلَأَهُۥ زِینَةࣰ وَأَمۡوَ ٰ⁠لࣰا فِی ٱلۡحَیَوٰةِ ٱلدُّنۡیَا رَبَّنَا لِیُضِلُّوا۟ عَن سَبِیلِكَۖ رَبَّنَا ٱطۡمِسۡ عَلَىٰۤ أَمۡوَ ٰ⁠لِهِمۡ وَٱشۡدُدۡ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ فَلَا یُؤۡمِنُوا۟ حَتَّىٰ یَرَوُا۟ ٱلۡعَذَابَ ٱلۡأَلِیمَ ۝ قَالَ قَدۡ أُجِیبَت دَّعۡوَتُكُمَا فَٱسۡتَقِیمَا وَلَا تَتَّبِعَاۤنِّ سَبِیلَ ٱلَّذِینَ لَا یَعۡلَمُونَ)[Surat Yunus ৮৮ - ৮৯]

অর্থাৎ মূসা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গকে পার্থিব জীবনে শোভা ও সম্পদ দান করেছ যা দিয়ে হে আমাদের প্রতিপালক! তারা মানুষকে তোমার পথ থেকে ভ্রষ্ট করে। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের সম্পদ বিনষ্ট কর, তাদের হৃদয় কঠিন করে দাও। তারা তো মর্মন্তুদ শাস্তি প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত ঈমান আনবে না।’ তিনি প্রতি উত্তরে বললেন, ‘তোমাদের দুজনের প্রার্থনা গৃহীত হল। সুতরাং তোমরা দৃঢ় থাক এবং তোমরা কখনও অজ্ঞদের পথ অনুসরণ করবে না।’ (সূরা ইউনুসঃ ৮৮-৮৯)

উপরোক্ত আয়াতে একটি বিরাট অভিশাপের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার শত্রু ফিরআউনের বিপক্ষে মূসা (عليه السلام) আল্লাহ তা’আলার আযাব-গযব অবতীর্ণ হবার জন্যে বদদুআ করলেন। কেননা, সে সত্যের অনুসরণ ও আল্লাহ তাআলার সহজ সরল পথ থেকে বিমুখ ও বিচ্যুত ছিল। আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত সৎ, সহজ-সরল পথের বিরোধিতা করত, অসত্যকে আঁকড়ে ধরেছিল, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রমাণ এবং যুক্তিগ্রাহ্য দলীলাদি দ্বারা সুপ্রমাণিত বাস্তবতাকে সে অস্বীকার, অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করত। মূসা (عليه السلام) আরয করলেন, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি ফিরআউন, তার সম্প্রদায় কিবতী ও তার অনুসারী এবং তার ধর্মকর্মের অনুগামীদেরকে পার্থিব জীবনে শোভা ও সম্পদ প্রদান করেছ, তারা পার্থিব সম্পদকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং তারা অজ্ঞ তাই তাদের এসব সম্পদ, শোভা যথা দামী দামী কাপড়-চোপড়, আরামপ্রদ সুন্দর সুন্দর যানবাহন, সুউচ্চ প্রাসাদ ও প্রশস্ত ঘরবাড়ি, দেশী-বিদেশী সুপ্রসিদ্ধ খাবার-দাবার, শোভাময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জনপ্রিয় রাজত্ব, প্রতিপত্তি ও পার্থিব হাঁকডাক ইত্যাদি থাকাকে বিরাট কিছু মনে করে।

আয়াতে উল্লিখিত (رَبَّنَا ٱطۡمِسۡ عَلَىٰۤ أَمۡوَ ٰ⁠لِهِمۡ ) আয়াতাংশের অর্থ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) ও মুজাহিদ (رحمة الله) বলেন, আয়াতাংশে উল্লেখিত اطمس এর অর্থ ধ্বংস করে দাও।

আবুল আলীয়া (رحمة الله), আর রাবী ইবন আনাস (رحمة الله) ও যাহহাক (رحمة الله) বলেন, এটার অর্থ হচ্ছে—এগুলোকে, এদের আকৃতি যেভাবে রয়েছে ঠিক সেভাবে নকশা খচিত পাথরে পরিণত করে দাও।‘

কাতাদা (رحمة الله) বলেন, এটার অর্থ সম্পর্কে আমাদের কাছে যে বর্ণনা পৌঁছেছে তা হচ্ছে-‘তাদের ক্ষেত-খামার সব কিছুই পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। মুহাম্মদ ইবন কা’ব (رحمة الله) বলেন, এটার অর্থ হচ্ছে তাদের চিনি জাতীয় দ্রব্যাদি পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরো বলেন, এটার অর্থ এও হতে পারে যে, তাদের সমুদয় সম্পদ পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এ সম্পর্কে উমর ইবন আবদুল আযীয (رحمة الله)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন তিনি তাঁর একটি দাসকে বললেন, ‘আমার কাছে একটি থলে নিয়ে এস। নির্দেশানুযায়ী সে একটি থলে নিয়ে আসলে দেখা গেল থলের মধ্যকার ছোলা ও ডিমগুলো পাথরে পরিণত হয়ে রয়েছে।‘ বর্ণনাটি ইবন আবু হাতিম (رحمة الله)-এর।

আয়াতাংশ (وَٱشۡدُدۡ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ فَلَا یُؤۡمِنُوا۟ حَتَّىٰ یَرَوُا۟ ٱلۡعَذَابَ ٱلۡأَلِیمَ) এর তাফসীর প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, এটার অর্থ হচ্ছে, তাদের অন্তরে মোহর করে দাও। আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত ধর্ম ও নিদর্শনাদিকে ফিরআউন ও তার সম্প্রদায় কর্তৃক অমান্য করার দরুন মূসা (عليه السلام) তাদের প্রতি আল্লাহ, তাঁর দীন ও তাঁর নিদর্শনাদির পক্ষে ক্রুদ্ধ হয়ে যখন বদদু’আ করলেন, অমনি আল্লাহ তা’আলা তা কবুল করেন এবং আযাব-গযব অবতীর্ণ করেন।

যেমন—নূহ (عليه السلام)-এর বদদুআ তার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলা করেছিলেন। যখন তিনি বলেছিলেনঃ

وَقَالَ نُوحࣱ رَّبِّ لَا تَذَرۡ عَلَى ٱلۡأَرۡضِ مِنَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ دَیَّارًا ۝ إِنَّكَ إِن تَذَرۡهُمۡ یُضِلُّوا۟ عِبَادَكَ وَلَا یَلِدُوۤا۟ إِلَّا فَاجِرࣰا كَفَّارࣰا[Surat Nuh ২৬ - ২৭]

“হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরদের মধ্য হতে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিও না। তুমি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে তারা তোমার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে কেবল দুষ্কৃতকারী ও কাফির।“

যখন মূসা (عليه السلام) ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের প্রতি অভিশাপ দিয়েছিলেন, তার ভাই হারূন (عليه السلام) তার দু’আর সমর্থনে ‘আমীন’ বলেছিলেন এবং হারূন (عليه السلام)ও দু’আ করেছেন বলে গণ্য করা হয়েছিল, তাই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

(قَالَ قَدۡ أُجِیبَت دَّعۡوَتُكُمَا فَٱسۡتَقِیمَا وَلَا تَتَّبِعَاۤنِّ سَبِیلَ ٱلَّذِینَ لَا یَعۡلَمُونَ)

[Surat Yunus ৮৯]

অর্থাৎ—“তোমাদের দুজনের দু’আ কবুল হল। সুতরাং তোমরা দৃঢ় থাক এবং তোমরা কখনও অজ্ঞদের পথ অনুসরণ করবে না।” (সূরা ইউনুস ও ৮৯)

তাফসীরকারগণ এবং আহলি কিতাবের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বনী ইসরাঈল তাদের ঈদের উৎসব পালনের উদ্দেশ্যে শহরের বাইরে যাবার জন্যে ফিরআউনের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করলে ফিরআউন অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদেরকে অনুমতি প্রদান করল। তারা বের হবার জন্যে প্রস্তুতি নিতে লাগল এবং পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের সাথে বনী ইসরাঈলের একটি চালাকি মাত্র, যাতে তারা ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের অত্যাচার-অবিচার থেকে মুক্তি পেতে পারে।

কিবাতীরা আরো উল্লেখ করেছে যে, আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে কিবতীদের থেকে স্বর্ণালংকার কর্জ নেয়ার জন্যে হুকুম দিয়েছিলেন; তাই তারা কিবতীদের থেকে বহু অলংকারপত্র কর্জ নিয়েছিল এবং রাতের অন্ধকারে তারা বের হয়ে পড়ল ও বিরামহীনভাবে অতি দ্রুত পথ অতিক্রম করতে লাগল – যাতে তারা অনতিবিলম্বে সিরিয়ার অঞ্চলে পৌঁছতে পারে। ফিরআউন যখন তাদের মিসর ত্যাগের কথা জানতে পারল, সে তখন তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হল এবং তাদের বিরুদ্ধে তার রাগ চরম আকার ধারণ করল। সে তার সেনাবাহিনীকে প্ররোচিত করল এবং বনী ইসরাঈলকে পাকড়াও করার ও তাদের সমূলে ধ্বংস করার জন্যে তাদের সমবেত করল।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

۞ وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ مُوسَىٰۤ أَنۡ أَسۡرِ بِعِبَادِیۤ إِنَّكُم مُّتَّبَعُونَ ۝ فَأَرۡسَلَ فِرۡعَوۡنُ فِی ٱلۡمَدَاۤىِٕنِ حَـٰشِرِینَ ۝ إِنَّ هَـٰۤؤُلَاۤءِ لَشِرۡذِمَةࣱ قَلِیلُونَ ۝ وَإِنَّهُمۡ لَنَا لَغَاۤىِٕظُونَ ۝ وَإِنَّا لَجَمِیعٌ حَـٰذِرُونَ ۝ فَأَخۡرَجۡنَـٰهُم مِّن جَنَّـٰتࣲ وَعُیُونࣲ ۝ وَكُنُوزࣲ وَمَقَامࣲ كَرِیمࣲ ۝ كَذَ ٰ⁠لِكَۖ وَأَوۡرَثۡنَـٰهَا بَنِیۤ إِسۡرَ ٰ⁠ۤءِیلَ ۝ فَأَتۡبَعُوهُم مُّشۡرِقِینَ ۝ فَلَمَّا تَرَ ٰ⁠ۤءَا ٱلۡجَمۡعَانِ قَالَ أَصۡحَـٰبُ مُوسَىٰۤ إِنَّا لَمُدۡرَكُونَ ۝ قَالَ كَلَّاۤۖ إِنَّ مَعِیَ رَبِّی سَیَهۡدِینِ ۝ فَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ مُوسَىٰۤ أَنِ ٱضۡرِب بِّعَصَاكَ ٱلۡبَحۡرَۖ فَٱنفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرۡقࣲ كَٱلطَّوۡدِ ٱلۡعَظِیمِ ۝ وَأَزۡلَفۡنَا ثَمَّ ٱلۡـَٔاخَرِینَ ۝ وَأَنجَیۡنَا مُوسَىٰ وَمَن مَّعَهُۥۤ أَجۡمَعِینَ ۝ ثُمَّ أَغۡرَقۡنَا ٱلۡـَٔاخَرِینَ ۝ إِنَّ فِی ذَ ٰ⁠لِكَ لَـَٔایَةࣰۖ وَمَا كَانَ أَكۡثَرُهُم مُّؤۡمِنِینَ ۝ وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ ٱلۡعَزِیزُ ٱلرَّحِیمُ

[Surat Ash-Shu'ara ৫২ - ৬৮]

অর্থাৎ, আমি মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি ওহী অবতীর্ণ করেছিলাম এই মর্মে ও আমার বান্দাদেরকে নিয়ে রাতের বেলা বের হয়ে পড়; তোমাদের তো পশ্চাদ্ধাবন করা হবে। তারপর ফিরআউন শহরে শহরে লোক সহকারী পাঠাল এই বলে যে, এরা তো ক্ষুদ্র একটি দল; ওরা তো আমাদের ক্রোধ উদ্রেক করেছে এবং আমরা তো সকলেই সদা সতর্ক। পরিণামে আমি ফিরআউন গোষ্ঠীকে বহিষ্কৃত করলাম ওদের উদ্যানরাজি ও প্রস্রবণ থেকে এবং ধনভাণ্ডার ও সুরম্য সৌধমালা থেকে। এরূপই ঘটেছিল এবং বনী ইসরাঈলকে এসবের অধিকারী করেছিলাম। ওরা সূর্যোদয়কালে তাদের পশ্চাতে এসে পড়ল। অতঃপর যখন দু’দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসার সঙ্গীরা বলল, “আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম।‘ মূসা বলল, ‘কখনই নয়! আমার সঙ্গে আছেন আমার প্রতিপালক; সত্বর তিনি আমাকে পথ-নির্দেশ করবেন।’ তারপর মূসার প্রতি ওহী করলাম, ‘তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রে আঘাত কর,’ ফলে এটা বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতের মত হয়ে গেল। আমি সেখানে উপনীত করলাম অপর দলটিকে এবং আমি উদ্ধার করলাম মূসা ও তাঁর সঙ্গী সকলকে। তৎপর নিমজ্জিত করলাম অপর দলটিকে। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে কিন্তু তাদের অধিকাংশই মু’মিন নয়। তোমার প্রতিপালক— তিনি তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (সূরা শুআরাঃ ৫২-৬৮)

তাফসীরকারগণ বলেন, ফিরআউন যখন বনী ইসরাঈলকে পিছু ধাওয়ার জন্যে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বের হল তখন তার সাথে ছিল একটি বিরাট সৈন্যদল। ঐ সৈন্যদলের ব্যবহৃত ঘোড়ার মধ্যে ছিল একলাখ উন্নতমানের কালো ঘোড়া এবং সৈন্য সংখ্যা ছিল ষোল লাখের ঊর্ধ্বে।

প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলাই সম্যক জ্ঞাত।

কেউ কেউ বলেন, শিশুদের সংখ্যা বাদ দিয়ে বনী ইসরাঈলের মধ্যেই ছিল প্রায় ছয় লাখ যোদ্ধা। মূসা (عليه السلام)-এর সাথে বনী ইসরাঈলের মিসর ত্যাগ ও তাদের আদি পিতা ইয়াকুব (عليه السلام) বা ইসরাঈলের সাথে মিসর প্রবেশের মধ্যে ছিল চারশ ছাব্বিশ সৌর বছরের ব্যবধান।

মোদ্দা কথা, ফিরআউন সৈন্যসামন্ত নিয়ে বনী ইসরাঈলকে ধরার জন্যে অগ্রসর হল এবং সূর্যোদয়ের সময়ে তারা পরস্পরের দেখা পেল। তখন সামনাসামনি যুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। এ সময়ই মূসা (عليه السلام)-এর অনুসারিগণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলতে লাগল, ‘আমরা তাহলে ধরা পড়ে গেলাম।’ তাদের ভীত হবার কারণ হল, তাদের সম্মুখে ছিল উত্তাল সাগর। সাগরে ঝাপিয়ে পড়া ছাড়া তাদের আর কোন পথ বা গতি ছিল না। আর সাগর পাড়ি দেয়ার শক্তিও ছিল না। তাদের বাম পাশে ও ডান পাশে ছিল সুউচ্চ খাড়া পাহাড়। ফিরআউন তাদেরকে একেবারে আটকে ফেলেছিল। মূসা (عليه السلام)-এর অনুসারীরা ফিরআউনকে তার দলবল ও বিশাল সৈন্যসামন্ত সহকারে অবলোকন করছিল। তারা ফিরআউনের ভয়ে আতংকিত হয়ে পড়ছিল। কেননা, তারা ফিরআউনের রাজ্যে ফিরআউন কর্তৃক লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছিল। সুতরাং তারা আল্লাহর নবী মূসা (عليه السلام)-এর কাছে তাদের অবস্থা সম্পর্কে অনুযোগ করল।

তখন আল্লাহর নবী মূসা (عليه السلام) তাদেরকে অভয় দিয়ে বললেনঃ ( كَلَّاۤۖ إِنَّ مَعِیَ رَبِّی ) অর্থাৎ—কখনও না; নিশ্চয়ই আমার সাথে আমার প্রতিপালক রয়েছেন, তিনি আমাকে পরিত্রাণের সঠিক পথ-নির্দেশ করবেন।‘ মূসা (عليه السلام) তাঁর অনুসারীদের পশ্চাৎভাগে ছিলেন। তিনি অগ্রসর হয়ে সকলের সম্মুখে গেলেন এবং সাগরের দিকে তাকালেন। সাগরে তখন উত্তাল তরঙ্গ ছিল। তখন তিনি বলছিলেনঃ আমাকে এখানেই আসার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার সাথে ছিলেন তাঁর ভাই হারূন (عليه السلام) এবং ইউশা ইবন নূন যিনি বনী ইসরাঈলের বিশিষ্ট নেতা, আলিম ও আবিদ। মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام)-এর পরে আল্লাহ তা’আলা তাঁর কাছে ওহী প্রেরণ করেন ও তাকে নবুওত দান করেন। পরবর্তীতে তার সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা আসবে। মূসা (عليه السلام) ও তার দলবলের সাথে ফিরআউন সম্প্রদায়ের মু’মিন বান্দাটিও ছিলেন। তারা থমকে দাঁড়িয়েছিলেন আর গোটা বনী ইসরাঈল গোত্র তাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। কথিত আছে, ফিরআউন সম্প্রদায়ের মুমিন বান্দাটি ঘোড়া নিয়ে কয়েকবার সাগরে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করেন কিন্তু তার পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠল না। তাই তিনি মূসা (عليه السلام)-কে জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আল্লাহর নবী (عليه السلام)! আমাদেরকে কি এখানেই আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে?’ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘হ্যাঁ’। যখন ব্যাপারটি তুঙ্গে উঠল, অবস্থা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াল, ব্যাপারটি ভয়াবহ আকার ধারণ করল; ফিরআউন ও তার গোষ্ঠী সশস্ত্র সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ক্রোধভরে অতি সন্নিকটে এসে পৌঁছাল; অবস্থা বেগতিক হয়ে দাঁড়াল; চক্ষু স্থির হয়ে গেল এবং প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠল, তখন ধৈর্যশীল মহান শক্তিমান, আরশের মহান অধিপতি, প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলা মূসা কালিমুল্লাহ (عليه السلام)-এর কাছে ওহী প্রেরণ করলেন। ( أَنِ ٱضۡرِب بِّعَصَاكَ )

অর্থাৎ নিজ লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত কর। যখন তিনি সাগরে আঘাত করলেন, কর্থিত আঁছে তিনি সাগরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর হুকুমে বিভক্ত হয়ে যাও।’ যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

(فَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ مُوسَىٰۤ أَنِ ٱضۡرِب بِّعَصَاكَ ٱلۡبَحۡرَۖ فَٱنفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرۡقࣲ كَٱلطَّوۡدِ ٱلۡعَظِیمِ)

[Surat Ash-Shu'ara ৬৩]

অর্থাৎ-আমি মূসার প্রতি ওহী করলাম, আপন লাঠি দ্বারা সমুদ্রে আঘাত কর, ফলে তা বিভক্ত’হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতের মত হয়ে গেল। (সূরা শুআরাঃ ৬৩)।

কথিত আছে, সমুদ্রটি বারটি খণ্ডে বা রাস্তায় বিভক্ত হয়েছিল। প্রতিটি গোত্রের জন্যে একটি করে রাস্তা হয়ে গেল, যাতে তারা নিজ নিজ নির্ধারিত রাস্তায় সহজে পথ চলতে পারে। এ রাস্তাগুলোর মধ্যে জানালা ছিল বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেন, যাতে তারা একদল অন্যদলকে অনায়াসে রাস্তা চলার সময় দেখতে পায়। কিন্তু এই অভিমতটি শুদ্ধ নয়। কেননা, পানি যেহেতু স্বচ্ছ পদার্থ তাই তার পিছনে আলো থাকলে দৃষ্টি বাধাপ্রাপ্ত হয় না। সুতরাং একদল অন্যদলকে দেখার জন্যে জানালা থাকার প্রয়োজন হয় না। যেই সত্ত্বা কোন বস্তুকে সৃষ্টি করতে হয়ে যাও বললে সাথে সাথে তা হয়ে যায়, সেই সত্তার মহান কুদরতের কারণেই সমুদ্রের পানি ছিল পর্বতের মত দণ্ডায়মান। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা সমুদ্রে বিশেষ ধরনের বায়ু প্রেরণ করেন যার ধাক্কায় পানি সরে রাস্তাগুলো শুকিয়ে যায়, যাতে ঘোড়া ও অন্যান্য প্রাণীর খুর না আটকিয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

(وَلَقَدۡ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ مُوسَىٰۤ أَنۡ أَسۡرِ بِعِبَادِی فَٱضۡرِبۡ لَهُمۡ طَرِیقࣰا فِی ٱلۡبَحۡرِ یَبَسࣰا لَّا تَخَـٰفُ دَرَكࣰا وَلَا تَخۡشَىٰ ۝ فَأَتۡبَعَهُمۡ فِرۡعَوۡنُ بِجُنُودِهِۦ فَغَشِیَهُم مِّنَ ٱلۡیَمِّ مَا غَشِیَهُمۡ ۝ وَأَضَلَّ فِرۡعَوۡنُ قَوۡمَهُۥ وَمَا هَدَىٰ)[Surat Ta-Ha ৭৭ - ৭৯]

অর্থাৎ-“আমি অবশ্যই মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি প্রত্যাদেশ করেছিলাম এ মর্মে, আমার বান্দাদেরকে নিয়ে রাতের বেলা বেরিয়ে পড় এবং তাদের জন্যে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে এক শুকনো পথ নির্মাণ কর। পশ্চাৎ হতে এসে তোমাকে ধরে ফেলা হবে এরূপ আশংকা করো না এবং ভয়ও করো না। অতঃপর ফিরআউন তার সৈন্য-সামন্তসহ তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল, তারপর সমুদ্র তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করল আর ফিরআউন তার সম্প্রদায়কে পথভ্রষ্ট করেছিল এবং সৎপথ দেখায়নি।” (সূরা তা-হাঃ ৭৭-৭৯)

বস্তুত পরম পরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা প্রতিপালকের আদেশে যখন সমুদ্রের অবস্থা এরূপ দাঁড়াল বনী ইসরাঈলকে নিয়ে সমুদ্র পার হবার জন্যে মূসা (عليه السلام)-কে নির্দেশ দেয়া হল, তখন তারা সকলে আনন্দচিত্তে অতি দ্রুত সমুদ্রে অবতরণ করেন। তারা অবশ্য দৃষ্টি নিক্ষেপকারীদের দৃষ্টি ঝলসিয়ে দেয় ও তাদের অবাক করে দেয়। আর এরূপ দৃশ্য মু’মিনদের অন্তরসমূহকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়। যখন তারা এরূপে সমুদ্র পার হবার জন্যে সমুদ্রে অবতরণ করেন, নির্বিঘ্নে তারা সমুদ্র পার হলেন এবং তাদের শেষ সদস্যও সমুদ্র পার হলেন। আর যখন তারা সমুদ্র পার হলেন, ঠিক তখনই ফিরআউনের সৈন্য-সামন্তের প্রথমাংশ ও অগ্রগামীদল সমুদ্রের কিনারায় পৌঁছাল। তখন মূসা (عليه السلام) ইচ্ছে করেছিলেন যে, পুনরায় সমুদ্রে লাঠি দিয়ে আঘাত করবেন যাতে সমুদ্রের অবস্থা পূর্ববৎ হয়ে যায় এবং ফিরআউনের দল তাদেরকে ধরতে না পারে ও তাদের পৌঁছার কোন বাহনই না থাকে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা সমুদ্রকে এ অবস্থায় ছেড়ে দিতে মূসা (عليه السلام)-কে নির্দেশ দিলেন। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

(۞ وَلَقَدۡ فَتَنَّا قَبۡلَهُمۡ قَوۡمَ فِرۡعَوۡنَ وَجَاۤءَهُمۡ رَسُولࣱ كَرِیمٌ ۝ أَنۡ أَدُّوۤا۟ إِلَیَّ عِبَادَ ٱللَّهِۖ إِنِّی لَكُمۡ رَسُولٌ أَمِینࣱ ۝ وَأَن لَّا تَعۡلُوا۟ عَلَى ٱللَّهِۖ إِنِّیۤ ءَاتِیكُم بِسُلۡطَـٰنࣲ مُّبِینࣲ ۝ وَإِنِّی عُذۡتُ بِرَبِّی وَرَبِّكُمۡ أَن تَرۡجُمُونِ ۝ وَإِن لَّمۡ تُؤۡمِنُوا۟ لِی فَٱعۡتَزِلُونِ ۝ فَدَعَا رَبَّهُۥۤ أَنَّ هَـٰۤؤُلَاۤءِ قَوۡمࣱ مُّجۡرِمُونَ ۝ فَأَسۡرِ بِعِبَادِی لَیۡلًا إِنَّكُم مُّتَّبَعُونَ ۝ وَٱتۡرُكِ ٱلۡبَحۡرَ رَهۡوًاۖ إِنَّهُمۡ جُندࣱ مُّغۡرَقُونَ ۝ كَمۡ تَرَكُوا۟ مِن جَنَّـٰتࣲ وَعُیُونࣲ ۝ وَزُرُوعࣲ وَمَقَامࣲ كَرِیمࣲ ۝ وَنَعۡمَةࣲ كَانُوا۟ فِیهَا فَـٰكِهِینَ ۝ كَذَ ٰ⁠لِكَۖ وَأَوۡرَثۡنَـٰهَا قَوۡمًا ءَاخَرِینَ ۝ فَمَا بَكَتۡ عَلَیۡهِمُ ٱلسَّمَاۤءُ وَٱلۡأَرۡضُ وَمَا كَانُوا۟ مُنظَرِینَ ۝ وَلَقَدۡ نَجَّیۡنَا بَنِیۤ إِسۡرَ ٰ⁠ۤءِیلَ مِنَ ٱلۡعَذَابِ ٱلۡمُهِینِ ۝ مِن فِرۡعَوۡنَۚ إِنَّهُۥ كَانَ عَالِیࣰا مِّنَ ٱلۡمُسۡرِفِینَ ۝ وَلَقَدِ ٱخۡتَرۡنَـٰهُمۡ عَلَىٰ عِلۡمٍ عَلَى ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ وَءَاتَیۡنَـٰهُم مِّنَ ٱلۡـَٔایَـٰتِ مَا فِیهِ بَلَـٰۤؤࣱا۟ مُّبِینٌ)[Surat Ad-Dukhan ১৭ - ৩৩]

অর্থাৎ তাদের পূর্বে আমি তো ফিরআউন সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছিলাম এবং তাদের নিকটও এসেছিল এক সম্মানিত রাসূল। সে বলল, “আল্লাহর বান্দাদেরকে আমার নিকট প্রত্যর্পণ কর। আমি তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল এবং তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করো না। আমি তোমাদের নিকট উপস্থিত করছি স্পষ্ট প্রমাণ। তোমরা যাতে আমাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করতে না পার, সে জন্য আমি আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালকের শরণ নিচ্ছি। যদি তোমরা আমার কথায় বিশ্বাস স্থাপন না কর, তবে তোমরা আমার নিকট থেকে দূরে থাক।

তারপর মূসা তাঁর প্রতিপালকের নিকট নিবেদন করল, ‘এরা তো এক অপরাধী সম্প্রদায়।‘’ আমি বলেছিলাম, ‘তুমি আমার বান্দাদেরকে নিয়ে রাতের বেলা বের হয়ে পড়; তোমাদের পশ্চাদ্ধাবন করা হবে। সমুদ্রকে স্থির থাকতে দাও, ওরা এমন এক বাহিনী যা নিমজ্জিত হবে। ওরা পশ্চাতে রেখে গিয়েছিল কত উদ্যান ও প্রস্রবণ, কত শস্যক্ষেত্র ও সুরম্য প্রাসাদ, কত বিলাস-উপকরণ, ওতে তারা আনন্দ পেতো।’ এরূপই ঘটেছিল এবং আমি এ সমুদয়ের উত্তরাধিকারী করেছিলাম ভিন্ন সম্প্রদায়কে। আকাশ এবং পৃথিবী কেউই ওদের জন্যে অশ্রুপাত করেনি এবং ওদেরকে অবকাশও দেয়া হয়নি। আমি তো উদ্ধার করেছিলাম বনী ইসরাঈলকে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি হতে ফিরআউনের; সে তো ছিল পরাক্রান্ত সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। আমি জেনে-শুনেই ওদেরকে বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম এবং ওদেরকে দিয়েছিলাম নিদর্শনাবলী—যাতে ছিল সুস্পষ্ট পরীক্ষা। (সূরা দুখানঃ ১৭-৩৩)

আয়াতাংশ (وَٱتۡرُكِ ٱلۡبَحۡرَ رَهۡوًاۖ ) এর অর্থ হচ্ছে সমুদ্রকে তার অবস্থায় স্থির থাকতে দাও, তার ব্যত্যয় ঘটায়ো না। এ মতটি আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), মুজাহিদ (رحمة الله), ইকরিমা (رحمة الله), রাবী (رحمة الله), যাহহাক (رحمة الله), কাতাদা (رحمة الله), কাব আল-আহবার (رضي الله عنه), সেমাক ইবন হারব (رحمة الله) এবং আবদুর রহমান ইবন যায়দ ইবন আসলাম (رحمة الله) প্রমুখের।

সমুদ্রের সেই স্থিতাবস্থায়ই ফিরআউন সমুদ্রের তীরে পৌঁছলো, সবকিছু দেখল এবং সমুদ্রের আশ্চর্যজনক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করল। আর পুরোপুরি বুঝতে পারল যেমন পূর্বেও বুঝত যে, এটা মহাসম্মানিত আরশের মহান মালিক প্রতিপালকেরই কুদরতের লীলাখেলা। সে থমকে দাঁড়াল, সম্মুখে অগ্রসর হলো না এবং বনী ইসরাঈল ও মূসা (عليه السلام)-কে পিছু ধাওয়া করার জন্যে মনে মনে অনুতপ্ত হল, তবে এ অবস্থায় অনুতাপ যে তার কোন উপকারে আসবে না, সে তা ভাল করে বুঝতে পারল। তা সত্ত্বেও সে তার সেনাবাহিনীর নিকট তার অটুট মনোবলের কথা ও আক্রমণাত্মক ভাব প্রকাশ করল। যে সম্প্রদায়কে সে হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল, ফলে তারা তার আনুগত্য স্বীকার করেছিল, যারা তাকে বাতিলের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও তার অনুসরণ করেছিল নিজ কুফরীতে লিপ্ত ফাসিক ও ফাজির নাফসের প্ররোচনায় তাদেরকে উদ্দেশ করে সে বলল, ‘তোমরা একটু লক্ষ্য করে দেখ, সমুদ্র আমার জন্যে সরে গিয়ে কিরূপে পথ করে দিয়েছে—যাতে আমি আমার ঐসব পলাতক দাসদেরকে ধরতে পারি——যারা আমার আনুগত্য স্বীকার না করে আমার রাজত্ব থেকে বের হয়ে যাবার চেষ্টা করছে।’ মুখে এরূপ উচ্চবাচ্য করলেও অন্তরে সে দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল যে, সে কি তাদের পিছু ধাওয়া করবে, নাকি আত্মরক্ষার্থে পিছু হটে যাবে? হায়! তার হটে যাবার কোন উপায় ছিল না, সে এক কদম সামনে অগ্রসর হলে কয়েক কদম পিছু হটবার চেষ্টা করছিল।

তাফসীরকারগণ উল্লেখ করেন, এরূপ অবস্থায় জিবরাঈল (عليه السلام) একটি আকর্ষণীয় ঘোটকীর উপর সওয়ার হয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন এবং ফিরআউন যে ঘোড়ার উপর সওয়ার ছিল তার সম্মুখ দিয়ে সমুদ্রের দিকে ঘোটকীটি অগ্রসর হল। তার ঘোড়াটি ঘোটকীর প্রতি আকৃষ্ট হল এবং ঘোড়াটি ঘোটকীর পিছু পিছু ছুটতে লাগল। জিবরাঈল (عليه السلام) দ্রুত তার সামনে গেলেন এবং সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন। ঘোড়া ও মাদী ঘোড়াটি ছুটতে লাগল। ঘোড়াটি সামনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে লাগল। ঘোড়ার উপর ফিরআউনের আর নিয়ন্ত্রণ রইল না। ফিরআউন তার ভাল-মন্দ কিছুই চিন্তা করতে সক্ষম ছিল না। সেনাবাহিনী যখন ফিরআউনকে দ্রুত সামনের দিকে অগ্রসর হতে দেখল, তারাও অতি দ্রুত তার পিছনে সমুদ্রে ঝাঁপ দিল। যখন তারা সকলেই পরিপূর্ণভাবে সমুদ্রে ঢুকে গেল এবং সেনাবাহিনীর প্রথম ভাগ সমুদ্র থেকে বের হবার উপক্রম হল আল্লাহ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-কে আদেশ করলেন; তিনি যেন তাঁর লাঠি দিয়ে পুনরায় সমুদ্রে আঘাত করেন। তিনি সুমদ্রে আঘাত করলেন। তখন সমুদ্র পূর্বের আকার ধারণ করে ফিরআউন ও তার সেনাবাহিনীর মাথার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলো। ফলে তাদের কেউই আর রক্ষা পেল না, সকলেই ডুবে মরল। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

(وَأَنجَیۡنَا مُوسَىٰ وَمَن مَّعَهُۥۤ أَجۡمَعِینَ ۝ ثُمَّ أَغۡرَقۡنَا ٱلۡـَٔاخَرِینَ ۝ إِنَّ فِی ذَ ٰ⁠لِكَ لَـَٔایَةࣰۖ وَمَا كَانَ أَكۡثَرُهُم مُّؤۡمِنِینَ ۝ وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ ٱلۡعَزِیزُ ٱلرَّحِیمُ)[Surat Ash-Shu'ara ৬৫ - ৬৮]

অর্থাৎ- এবং আমি উদ্ধার করলাম মূসা ও তার সঙ্গী সকলকে। তারপর নিমজ্জিত করলাম অপর দলটিকে। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে কিন্তু তাদের অধিকাংশই মু’মিন নয়। তোমার প্রতিপালক— তিনি তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (সূরা শুআরাঃ ৬৫-৬৮)।

অর্থাৎ তিনি তার পছন্দনীয় মু’মিন বান্দাদের উদ্ধারের ব্যাপারে পরাক্রমশালী। তাই তাদের একজনও ডুবে মারা যাননি। পক্ষান্তরে তার দুশমনদেরকে ডুবিয়ে মারার ব্যাপারেও তিনি পরাক্রমশালী। তাই তাদের কেউই রক্ষা পায়নি। এতে রয়েছে আল্লাহ তা’আলার অসীম কুদরতের একটি মহা নিদর্শন ও প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আবার অন্যদিকে রাসূল (ﷺ) যে মহান শরীয়ত ও সরল-সঠিক তরীকা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন, তার সত্যতার জ্বলন্ত প্রমাণও বটে।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

( وَجَـٰوَزۡنَا بِبَنِیۤ إِسۡرَ ٰ⁠ۤءِیلَ ٱلۡبَحۡرَ فَأَتۡبَعَهُمۡ فِرۡعَوۡنُ وَجُنُودُهُۥ بَغۡیࣰا وَعَدۡوًاۖ حَتَّىٰۤ إِذَاۤ أَدۡرَكَهُ ٱلۡغَرَقُ قَالَ ءَامَنتُ أَنَّهُۥ لَاۤ إِلَـٰهَ إِلَّا ٱلَّذِیۤ ءَامَنَتۡ بِهِۦ بَنُوۤا۟ إِسۡرَ ٰ⁠ۤءِیلَ وَأَنَا۠ مِنَ ٱلۡمُسۡلِمِینَ ۝ ءَاۤلۡـَٔـٰنَ وَقَدۡ عَصَیۡتَ قَبۡلُ وَكُنتَ مِنَ ٱلۡمُفۡسِدِینَ ۝ فَٱلۡیَوۡمَ نُنَجِّیكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنۡ خَلۡفَكَ ءَایَةࣰۚ وَإِنَّ كَثِیرࣰا مِّنَ ٱلنَّاسِ عَنۡ ءَایَـٰتِنَا لَغَـٰفِلُونَ)[Surat Yunus ৯০ - ৯২]

অর্থাৎ—আমি বনী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করলাম; এবং ফিরআউন ও তার সৈন্যবাহিনী ঔদ্ধত্যসহকারে সীমালংঘন করে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। পরিশেষে যখন সে নিমজ্জমান হল তখন বলল, ‘অমি বিশ্বাস করলাম বনী ইসরাঈল যাতে বিশ্বাস করে। নিশ্চয়ই তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ এখন! ইতিপূর্বে তো তুমি অমান্য করেছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। অবশ্যই মানুষের মধ্যে অনেকে আমার নিদর্শন সম্বন্ধে গাফিল। (সূরা ইউনুসঃ ৯০-৯২)।

অন্য কথায়, অত্র আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা কিবতী কাফিরদের প্রধান ফিরআউনের ডুবে মরার বিবরণ দেন। উত্তাল তরঙ্গ যখন তাকে একবার উপরের দিকে উঠাচ্ছিল এবং অন্যবার নিচের দিকে নামাচ্ছিল এবং ফিরআউন ও তার সেনাবাহিনী কিরূপ মহাসংকট ও দুর্ভেদ্য মুসীবতে পতিত হয়েছিল তা বনী ইসরাঈলরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করছিল যা তাদের চোখ জুড়াচ্ছিল ও হৃদয়ের জ্বালা প্রশমিত করছিল। ফিরাউন যখন নিজের ধ্বংস প্রত্যক্ষ করল; সে কোণঠাসা হয়ে পড়ল এবং তার মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল তখন সে বিনম্র হল; তওবা করল এবং এমন সময় ঈমান আনয়ন করল, যখন তার ঈমান কারো উপকারে আসে না।

যেমন আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

(إِنَّ ٱلَّذِینَ حَقَّتۡ عَلَیۡهِمۡ كَلِمَتُ رَبِّكَ لَا یُؤۡمِنُونَ ۝ وَلَوۡ جَاۤءَتۡهُمۡ كُلُّ ءَایَةٍ حَتَّىٰ یَرَوُا۟ ٱلۡعَذَابَ ٱلۡأَلِیمَ)[Surat Yunus ৯৬ - ৯৭]

অর্থাৎ—যাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিপালকের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছে তারা ঈমান আনবে না যদি তাদের নিকট প্রত্যেকটি নিদর্শন আসে—যতক্ষণ না তারা মর্মন্তুদ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। (সূরা ইউনুসঃ ৯৬-৯৭)

আল্লাহ্ তা’আলা এ প্রসঙ্গে আরো ইরশাদ করেছেনঃ

(فَلَمَّا رَأَوۡا۟ بَأۡسَنَا قَالُوۤا۟ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَحۡدَهُۥ وَكَفَرۡنَا بِمَا كُنَّا بِهِۦ مُشۡرِكِینَ ۝ فَلَمۡ یَكُ یَنفَعُهُمۡ إِیمَـٰنُهُمۡ لَمَّا رَأَوۡا۟ بَأۡسَنَاۖ سُنَّتَ ٱللَّهِ ٱلَّتِی قَدۡ خَلَتۡ فِی عِبَادِهِۦۖ وَخَسِرَ هُنَالِكَ ٱلۡكَـٰفِرُونَ)

[Surat Ghafir ৮৪ - ৮৫]

অর্থাৎ—তারপর তারা যখন আমার শাস্তি প্রত্যক্ষ করল তখন বলল, আমরা এক আল্লাহতে ঈমান আনলাম এবং আমরা তাঁর সাথে যাদেরকে শরীক করতাম তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলাম। ওরা যখন আমার শাস্তি প্রত্যক্ষ করল, তখন ওদের ঈমান ওদের কোন উপকারে আসল না। আল্লাহর এই বিধান পূর্ব থেকেই তাঁর বান্দাদের মধ্যে চলে আসছে এবং এ ক্ষেত্রে কাফিররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (সূরা মুমিনঃ ৮৪-৮৫)।

অনুরূপ মূসা (عليه السلام) ফিরাউন ও তার গোষ্ঠীর ব্যাপারে বদ দুআ করেছিলেন, যাতে আল্লাহ্ তাআলা তাদের সম্পদ ধ্বংস করে দেন এবং তাদের অন্তরে আল্লাহ্ তা’আলা মোহর মেরে দেন, যাতে তারা মর্মন্তুদ শাস্তি প্রত্যক্ষ করার পূর্বে ঈমান না আনতে পারে। অর্থাৎ তখন তাদের ঈমান তাদের কোন কাজে আসবে না আর এটা হবে তাদের জন্যে আক্ষেপের কারণ। মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام) যখন এরূপ বদ দু’আ করছিলেন, তখন আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করলেনঃ ( قَدۡ أُجِیبَت دَّعۡوَتُكُمَا )

অর্থাৎ—‘তোমাদের দু’জনের দু’আ কবূল হল।‘ এ প্রসঙ্গে নিম্নে বর্ণিত হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য। ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন ফিরআউনের উক্তিঃ

(ءَامَنتُ أَنَّهُۥ لَاۤ إِلَـٰهَ إِلَّا ٱلَّذِیۤ ءَامَنَتۡ بِهِۦ بَنُوۤا۟ إِسۡرَ ٰ⁠ءِیلَ )

[Surat Yunus ৯০]

“আমি বিশ্বাস করলাম বনী ইসরাঈল যাতে বিশ্বাস করে, নিশ্চয়ই তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই।” (সূরা ইউনুসঃ ৯০)

এ প্রসঙ্গে জিবরাঈল আমাকে বললেন, (হে রাসূল!) ঐ সময়ের অবস্থা যদি আপনি দেখতেন! সমুদ্রের তলদেশ থেকে কাদা নিয়ে তার মুখে পুরে দিলাম, পাছে সে আল্লাহ্ তা’আলার রহমত না পেয়ে যায়। এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) ইবন জারীর (رحمة الله) ও ইবন আবূ হাতিম (رحمة الله) প্রমুখ এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান পর্যায়ের বলে মত প্রকাশ করেছেন। আবু দাউদ তাবলিসী (رحمة الله)ও অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবন আবু হাতিম (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন।

আল্লাহ তা’আলা যখন ফিরআউনকে ডুবিয়ে দিলেন, তখন সে তার আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করল এবং উচ্চৈঃস্বরে বললঃ

( ءَامَنتُ أَنَّهُۥ لَاۤ إِلَـٰهَ إِلَّا ٱلَّذِیۤ ءَامَنَتۡ بِهِۦ بَنُوۤا۟ إِسۡرَ ٰ⁠ءِیلَ )

রাসূল (ﷺ) বলেন, জিবরাঈল (عليه السلام) তখন আশঙ্কা করছিলেন যে, আল্লাহ্ তা’আলার রহমত আল্লাহ তাআলার গযবের উপর প্রাধান্য না পেয়ে যায়। তিনি তখন তাঁর পাখা দ্বারা কাল মাটি তুলে ফিরআউনের মুখে ছুঁড়ে মারল যাতে করে তার মুখ ঢাকা পড়ে যায়।

ইবন জারীর (رحمة الله) অন্য এক সূত্রে আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে এ মর্মের হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবরাহীম তায়মী (رحمة الله), কাতাদা (رحمة الله), মাইমুন ইব্‌ন মিহরান (رحمة الله) প্রমুখ হাদীসটি মুরসালরূপে বর্ণনা করেছেন।

কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে, জিবরাঈল (عليه السلام) বলেছেন, ‘আমি ফিরআউনের মত অন্য কাউকে এত বেশি ঘৃণা করি নাই যখন সে বলেছিল

(فَقَالَ أَنَا۠ رَبُّكُمُ ٱلۡأَعۡلَىٰ)

[Surat An-Nazi'at ২৪]

অর্থাৎ ‘আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠতম প্রতিপালক।’

(ءَاۤلۡـَٔـٰنَ وَقَدۡ عَصَیۡتَ قَبۡلُ وَكُنتَ مِنَ ٱلۡمُفۡسِدِینَ)

[Surat Yunus ৯১]

আয়াতাংশে উল্লেখিত প্রশ্নটি অস্বীকৃতি বোঝাবার জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে। আর আল্লাহ তা’আলা যে তার ঈমান কবূল করেননি এটি তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। কেননা, আল্লাহ্ তা’আলা জানতেন যে, যদি তাকে পুনরায় দুনিয়ায় ফেরত পাঠানো হত তাহলে সে পুনরায় পূর্বের ন্যায় আচরণ করত। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্যান্য কাফিরের সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে, যখন তারা জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করবে তখন বলে উঠবেঃ

(وَلَوۡ تَرَىٰۤ إِذۡ وُقِفُوا۟ عَلَى ٱلنَّارِ فَقَالُوا۟ یَـٰلَیۡتَنَا نُرَدُّ وَلَا نُكَذِّبَ بِـَٔایَـٰتِ رَبِّنَا وَنَكُونَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ)

[Surat Al-An'am ২৭]

“তুমি যদি দেখতে পেতে যখন তাদেরকে আগুনের পার্শ্বে দাঁড় করানো হবে এবং তারা বলবে, হায়! যদি আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটত তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনকে অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।” (সূরা আনআমঃ ২৭)

জবাবে আল্লাহ্ তা’আলা বলবেনঃ

(بَلۡ بَدَا لَهُم مَّا كَانُوا۟ یُخۡفُونَ مِن قَبۡلُۖ وَلَوۡ رُدُّوا۟ لَعَادُوا۟ لِمَا نُهُوا۟ عَنۡهُ وَإِنَّهُمۡ لَكَـٰذِبُونَ)

[Surat Al-An'am ২৮]

“না, পূর্বে তারা যা গোপন করত তা এখন তাদের নিকট প্রকাশ পেয়েছে এবং তারা প্রত্যাবর্তিত হলেও যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল পুনরায় তারা তা-ই করত এবং নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।” (সূরা আন্‌আমঃ ২৮)

আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) প্রমুখ মুফাসসির বর্ণনা করেছেন যে, বনী ইসরাঈলের কেউ কেউ ফিরআউনের মৃত্যুর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছিল এবং তারা বলেছিল, ফিরআউন কখনও মরবে না; এ জন্য আল্লাহ তাআলা সমুদ্রকে নির্দেশ দেন, যাতে ফিরআউনকে কোন একটি উঁচু জায়গায় নিক্ষেপ করে। কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ পানির উপরে। আবার কেউ কেউ বলেন, মাটির একটি ঢিবির উপরে। তার গায়ে ছিল তার কর্ম যা ছিল সপরিচিত যাতে ফিরআউনের লাশ বলে বনী ইসরাঈল সহজে শনাক্ত করতে পারে, আল্লাহ্ তা’আলার কুদরতের পরিচয় পেতে পারে।

এজন্যই আল্লাহ্ বলেনঃ

(فَٱلۡیَوۡمَ نُنَجِّیكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنۡ خَلۡفَكَ ءَایَةࣰۚ )

[Surat Yunus ৯২]

অর্থাৎ——“আজ আমি তোমার দেহটা রক্ষা করব যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্যে নিদর্শন হয়ে থাক। তোমার পরিচিত বর্মসহ তোমাকে রক্ষা করব যাতে তুমি বনী ইসরাঈলের কাছে শক্তিমান আল্লাহ তাআলার কুদরতের একটি নিদর্শন হয়ে থাক।‘ এ জন্যই কেউ কেউ আয়াতাংশটিকে নিম্নরূপ পাঠ করেছেন। ( لِتَكُونَ لِمَنۡ خَلۡفَكَ ءَایَةࣰۚ )

অর্থাৎ——যাতে তুমি তোমার সৃষ্টিকর্তার একটি নিদর্শন হয়ে থাক।’ আয়াতাংশের অর্থ নিম্নরূপও হতে পারে। ‘তোমাকে রক্ষা করেছি তোমার বর্মসহ যাতে তোমার বর্ম তোমার পরবর্তী বনী ইসরাঈলের জন্যে তোমাকে চেনার ব্যাপারে এবং তোমার ধ্বংসের ব্যাপারে একটি প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়।‘ কোন্ অর্থটি সঠিক, আল্লাহই অধিক জ্ঞাত। ফিরআউন ও তার সৈন্যবাহিনী আশুরার দিন ধ্বংস হয়েছিল।

ইমাম বুখারী (رحمة الله) তাঁর কিতাব সহীহ বুখারী শরীফে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা শরীফ আগমন করলে, দেখলেন ইহুদীরা আশুরার দিন সিয়াম পালন করে থাকে। (কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে) তারা বলল, এটা এমন একটি দিন যেদিনে ফিরআউনের বিরুদ্ধে মূসা (عليه السلام)-এর বিজয় সূচিত হয়েছিল।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ انتم احق بموسى منهم فصوموا

অর্থাৎ মূসা (عليه السلام) সম্পর্কে বনী ইসরাঈল থেকে তোমরা (মুসলমানরা) বেশি হকদার। কাজেই তোমরা ঐ দিন সিয়াম পালন কর। বুখারী ও মুসলিম শরীফ ব্যতীত অন্যান্য হাদীস গ্রন্থেও এ মর্মের হাদীসটি পাওয়া যায়।
Top