❏ ইসহাক ইবন ইবরাহীম (عليه السلام)
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)-এর একশ’ বছর বয়সকালে এবং ইসমাঈল (عليه السلام)-এর জন্মের চৌদ্দ বছর পর ইসহাক (عليه السلام)-এর জন্ম হয়। তাঁর মাতা সারাহকে যখন পুত্র হওয়ার সুসংবাদ দেওয়া হয় তখন তাঁর বয়স ছিল নব্বই বছর। আল্লাহ্ বলেনঃ

(وَبَشَّرۡنَـٰهُ بِإِسۡحَـٰقَ نَبِیࣰّا مِّنَ ٱلصَّـٰلِحِینَ ۝ وَبَـٰرَكۡنَا عَلَیۡهِ وَعَلَىٰۤ إِسۡحَـٰقَۚ وَمِن ذُرِّیَّتِهِمَا مُحۡسِنࣱ وَظَالِمࣱ لِّنَفۡسِهِۦ مُبِینࣱ)[Surat As-Saaffat ১১২ - ১১৩]

অর্থাৎ, আমি ইব্রাহীমকে ইসহাকের সু-সংবাদ দিয়েছিলাম সে ছিল একজন নবী ও সৎকর্ম পরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত। আমি ইবরাহীমের প্রতি ও ইসহাকের প্রতি বরকত দান করেছিলাম। তাদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মশীল এবং কতক নিজেদের প্রতি স্পষ্ট অত্যাচারী। (৬৭:১১২-১১৩)

আল্লাহ্ কুরআনের অনেক আয়াতে ইসহাক (عليه السلام)-এর প্রশংসা করেছেন। আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণিত এ মর্মের হাদীসে পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ একজন সম্মানিত ব্যক্তি, যার পিতাও ছিলেন সম্মানিত, তার পিতাও ছিলেন সম্মানিত এবং তাঁর পিতাও ছিলেন সম্মানিত। তিনি হলেন ইউসুফ ইবন ইয়াকূব ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম। আহলি কিতাবগণ বলেন, ইসহাক (عليه السلام) তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে পিতার জীবদ্দশায় রুফাকা বিনত বাৎওয়াইলকে বিবাহ করেন। রুফাকা ছিলেন বন্ধ্যা। তাই ইসহাক (عليه السلام) সন্তানের জন্যে আল্লাহর কাছে দু’আ করেন। এরপর স্ত্রী সন্তান-সম্ভবা হন এবং তিনি জময দুই পুত্র সন্তান প্রসব করেন। তাদের প্রথমজনের নাম রাখা হয় ‘ঈসূ’ যাকে আরবরা ‘ঈস’ বলে ডাকে। এই ঈস হচ্ছেন রূমের পিতা। দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার সময় থেকে তার ভাইয়ের পায়ের গোড়ালি আঁকড়ে থাকতে দেখা যায়। এই কারণে তার নাম রাখা হয় ইয়াকূব। কেননা এ শব্দটির মূল ধাতু (عقب) অর্থ গোড়ালি বা পশ্চাতে আগমনকারী। তাঁর অপর নাম ইসরাঈল, যার নামে বনী-ইসরাঈল বংশের নামকরণ করা হয়েছে।

কিতাবীগণ বলেন, হযরত ইসহাক (عليه السلام) ইয়াকুবের তুলনায় ঈসূকে অধিকতর ভালবাসতেন; কারণ তিনি ছিলেন প্রথম সন্তান। পক্ষান্তরে তাদের মা রুফাকা ইয়াকূবকে বেশি ভালবাসতেন; কেননা, তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ। ইসহাক (عليه السلام) যখন বয়োবৃদ্ধ হন এবং তার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়, তখন তিনি পুত্র ঈসের নিকট একটি উত্তম আহার্য চান। তিনি একটি পশু শিকার করে রান্না করে আনার জন্যে দলকে নির্দেশ দেন। যা আহার করে তিনি তার জন্যে বরকত ও কল্যাণের দুআ করবেন। ঈস শিকার কাজে পারদর্শী ছিলেন। তাই তিনি শিকারে বেরিয়ে পড়লেন। এদিকে রুফাকা তার প্রিয় পুত্র ইয়াকূবকে পিতার দু’আ লাভের জন্যে পিতার চাহিদা অনুযায়ী দুটি উৎকৃষ্ট ছাগল ছানা যবেহ করে খাদ্য প্রস্তুত করে ভাইয়ের পূর্বেই পিতার সম্মুখে পেশ করার আদেশ দেন। খাদ্য তৈরি হবার পর মা রুফাকা ইয়াকুবকে ঈসের পোশাক পরিয়ে দেন এবং উভয় হাতে ও কাঁধের উপরে ছাগলের চামড়া জড়িয়ে দেন। কারণ ঈসের শরীরে বেশি পরিমাণ লোম ছিল, ইয়াকূবের শরীরে সেরূপ লোম ছিল না। তারপর যখন খাদ্য নিয়ে ইয়াকূব পিতার কাছে হাযির হলেন তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কে? উত্তরে তিনি বললেনঃ আপনার ছেলে। তখন পিতা তাকে কাছে টেনে নেন ও আলিঙ্গন করেন। তবে তিনি মুখে ব্যক্ত করলেন যে, কণ্ঠস্বর তো ইয়াকুবের মত কিন্তু শরীর ও পোশাক ঈসের বলে মনে হয়। আহার শেষে তিনি দুআ করলেন যে, ভাইদের মধ্যে তিনি যেন অধিকতর ভাগ্যবান হন, ভাইদের উপরে ও পরবর্তী বংশধরদের উপরে যেন তাঁর নির্দেশ ও প্রভাব কার্যকরী হয় এবং তিনি অধিক পরিমাণ জীবিকা ও সন্তানের অধিকারী হন।

পিতার নিকট থেকে ইয়াকূব চলে আসার পর তাঁর ভাই ঈস সেই খাদ্য নিয়ে পিতার কাছে হাযির হন যা খাওয়ানোর জন্যে তিনি তাকে আদেশ করেছিলেন। পিতা জিজ্ঞেস করলেন, বৎস! এ আবার তুমি কি নিয়ে এসেছ? ঈস বললেনঃ এতো সেই খাদ্য যা আপনি খেতে চেয়েছিলেন। পিতা বললেন, এই কিছুক্ষণ পূর্বে কি তুমি খাদ্য নিয়ে আসনি এবং তা আহার করে কি তোমার জন্যে আমি দুআ করিনি? ঈস বললেনঃ আল্লাহর কসম, আমি আসিনি। তিনি তখন বুঝতে পারলেন যে, ইয়াকূবই আমার আগে এসে এ কাজ করে গেছে। তিনি ইয়াকূবের উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন। কিতাবীদের বর্ণনা মতে, এমনকি পিতার মৃত্যুর পর তাকে হত্যা করার হুমকিও দেন। তারপর পিতার নিকট দু’আ চাইলে পিতা তার জন্যে ভিন্ন দুআ করেন। তিনি দু’আ করলেন যেন ঈসের সন্তানরা শক্ত যমীনের অধিকারী হয়, তাদের জীবিকা ও ফল-ফলাদি যেন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ইয়াকূব (عليه السلام)-এর প্রতি ঈসের হুমকির কথা তাদের মা’র শ্রুতিগোচর হলে তিনি ইয়াকুব (عليه السلام)-কে তার ভাই অর্থাৎ ইয়াকুবের মামা লাবানের কাছে চলে যেতে নির্দেশ দেন। লাবান হারানে বসবাস করতেন। ঈসের ক্রোধ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করার জন্যে তিনি তাকে পরামর্শ দেন। এ ছাড়া তিনি লাবানের কন্যাকে বিয়ে করতেও তাকে বলে দেন। এরপর তিনি তাঁর স্বামী ইসহাক (عليه السلام)-কে এ ব্যাপারে অনুমতি ও প্রয়োজনীয় উপদেশ দান এবং তার জন্য দু’আ করতে বলেন। হযরত ইসহাক তাই করলেন। ইয়াকূব (عليه السلام) ঐ দিন বিকেলেই তাদের কাছ থেকে বিদায় নেন। তারপর যেখানে পৌঁছলে সন্ধ্যা হয় সেখানে একটি পাথর মাথার নিচে রেখে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখেন, যমীন থেকে আসমান পর্যন্ত একটি সিঁড়ি স্থাপিত রয়েছে। ফেরেশতাগণ সেই সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করছেন। আর আল্লাহ তাকে ডেকে বলছেনঃ আমি তোমাকে বরকতে পরিপূর্ণ করব, তোমার সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি করব, তোমাকে ও তোমার বংশধরদেরকে এই যমীনের অধিকারী বানাব। ঘুম থেকে জেগে এরূপ একটি স্বপ্নের জন্যে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং মানত করেন যে, আল্লাহ যদি আমাকে নিরাপদে পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেন তাহলে এই স্থানে আল্লাহর উদ্দেশে একটি ইবাদতখানা নির্মাণ করব; যা কিছু রিযিক পাব তার এক-দশমাংশ আল্লাহর রাহে দান করব। তারপর সেই পাথরটি চেনার সুবিধার্থে তার উপর কিছু তেল ঢেলে দেন। তিনি এই স্থানের নাম রাখেন বায়তুল অর্থাৎ বায়তুল্লাহ। এটাই বর্তমান কালের বায়তুল মুকাদ্দাস যা হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) পরবর্তীকালে নির্মাণ করেছিলেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পরে আসবে।

আহলি কিতাবগণ আরো বলেন যে, হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) হারানে পৌঁছে মামার কাছে উপস্থিত হন। মামা লাবানের ছিল দুই কন্যা। বড়জনের নাম লায়্যা এবং ছোটজনের নাম রাহীল। রূপ-লাবণ্যে ছোটজনই শ্রেষ্ঠ। তাই ইয়াকূব মামার কাছে ছোটজনকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন। মামা এই শর্তে বিবাহ দিতে রাযী হন যে, সাত বছর পর্যন্ত তাঁর মেষ পালের দেখাশোনা করতে হবে। সাত বছর অতীত হবার পর লাবান বিবাহের আয়োজন করেন। লোকজনকে দাওয়াত দেন এবং আপ্যায়িত করেন এবং রাতে জ্যেষ্ঠ কন্যা লায়্যাকে ইয়াকুবের নিকট বাসরঘরে প্রেরণ করেন। লায়্যা দেখতে কুৎসিত ও ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি-সম্পন্না ছিলেন। সকাল বেলা ইয়াকূব তাঁর কাছে লায়্যাকে দেখতে পেয়ে মামার নিকট অভিযোগ করলেন যে, আপনি কেন আমার সাথে প্রতারণা করলেন? আমি তো আপনার কাছে রাহীলের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। উত্তরে মামা বললেন, এটা আমাদের সামাজিক রীতি নয় যে, জ্যেষ্ঠা কন্যাকে রেখে কনিষ্ঠা কন্যাকে বিয়ে দেব। এখন যদি তুমি এর বোনকে বিয়ে করতে চাও তবে আরও সাত বছর কাজ কর, তাহলে তাকেও তোমার সাথে বিয়ে দেব। সুতরাং ইয়াকূব (عليه السلام) আরও সাত বছর কাজ করলেন। তারপর তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যার সাথে কনিষ্ঠ কন্যাকেও ইয়াকুব (عليه السلام)-এর কাছে বিয়ে দেন। এরূপ দুই কন্যাকে একই ব্যক্তির সাথে বিবাহ দেওয়া তাদের শরীআতে বৈধ ছিল। পরবর্তীকালে তাওরাতের মাধ্যমে এ বিধান রহিত হয়ে যায়। এই একটি দলীলই রহিত হবার জন্যে যথেষ্ট। কেননা, হযরত ইয়াকূব (عليه السلام)-এর কর্মই এটা বৈধ ও মুবাহ হওয়ার প্রমাণবহ। কারণ, তিনি ছিলেন মাসূম বা নিস্পাপ। লাবান তাঁর উভয় কন্যার সাথে একটি করে দাসী দিয়েছিলেন। লায়্যার দাসীর নাম ছিল যুলফা এবং রাহীলের দাসীর নাম ছিল বালহা। লায়্যার যে ঘাটতি ছিল আল্লাহ তাকে কয়েকটি সন্তান দান করে সে ঘাটতি পূরণ করেন। সুতরাং লায়্যার গর্ভে ইয়াকূব (عليه السلام)-এর প্রথম সন্তান রূবীল দ্বিতীয় সন্তান শাউন, তৃতীয় সন্তান লাবী এবং চতুর্থ সন্তান য়াহুযা। রাহীলের কোন সন্তান হত না, তাই তিনি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লেন এবং নিজের দাসী বালহাকে ইয়াকূব (عليه السلام)-এর কাছে সমর্পণ করলেন। ইয়াকূব (عليه السلام) দাসীর সাথে মিলিত হলে এক পুত্র সন্তান জন্ম হয়। নাম রাখা হয় দান। বালহা দ্বিতীয়বার গর্ভ ধারণ করে এবং দ্বিতীয়বারও পুত্র সন্তান জন্ম হয়। এর নাম রাখা হয় নায়ফতালী। এবার লায়্যাও তাঁর দাসী যুলফাকে ইয়াকূব (عليه السلام)-এর কাছে সমর্পণ করেন। যুলফার গর্ভেও দুই পুত্র সন্তানের জন্ম হয়; একজনের নাম হাদ এবং অপরজনের নাম আশীর। তারপর লায়্যা নিজেও সন্তান-সম্ভবা হন এবং পঞ্চম পুত্রের মা হন। এ পুত্রের নাম রাখা হয় আয়সাখার। পুনরায় লায়্যা গর্ভবতী হলে ষষ্ঠ পুত্রের জন্ম হয় যার নাম রাখা হয় যাবিলূন। এরপর তিনি সপ্তম সন্তানরূপে এক কন্যা সন্তান প্রসব করেন যার নাম রাখা হয় দিনা। এভাবে লায়্যার গর্ভে ইয়াকূব (عليه السلام)-এর সাত সন্তানের জন্ম হয়। তারপর স্ত্রী রাহীল একটি পুত্র সন্তানের জন্যে আল্লাহর কাছে দু’আ করেন। আল্লাহ্ তাঁর প্রার্থনা কবুল করেন। ফলে আল্লাহর নবী ইয়াকূব (عليه السلام)-এর ঔরসে তার গর্ভে এক সুন্দর সুশ্রী মহান পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেন যার নাম রাখা হয় ইউসুফ।

এ পরিবারের সকলেই হারানে বসবাস করতে থাকেন। ইয়াকূব (عليه السلام) মামার উভয় কন্যাকে বিবাহ করার পর আরও ছয় বছর পর্যন্ত তাঁর মেষ চরান। অর্থাৎ সর্বমোট বিশ বছর তিনি মামার কাছে অবস্থান করেন। তখন হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) নিজ পরিবারবর্গের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্যে মামার কাছে অনুমতি চান। মামা তাঁকে বললেন, তোমার কারণে আমার ধন-সম্পদে অনেক বরকত হয়েছে। অতএব, আমার সম্পদের যে পরিমাণ ইচ্ছে, তুমি আমার কাছে চেয়ে নাও। ইয়াকূব (عليه السلام) বললেন, তাহলে এই বছরে আপনার বকরীর যতগুলো বাচ্চা হবে তা থেকে যেগুলোর রং হবে সাদা-কালো ফোঁটা বিশিষ্ট, সাদা-কালো মিশ্রিত, কালো অংশ বেশি ও সাদা অংশ কম কিংবা মাথার দু’দিকে টাকপড়া সাদা এ জাতীয় বাচ্চাগুলো আমাকে দিন। মামা তার দাবি মেনে নেন। সে মতে মামার ছেলেরা পিতার মেষ-পাল থেকে এ জাতীয় বকরীগুলো বেছে বেছে আলাদা করে নিলেন এবং সেগুলোকে পিতার মেষপাল থেকে তিন দিনের দূরত্বে নিয়ে যান। যাতে করে ঐ জাতীয় বাচ্চা জন্ম হতে না পারে। এ দেখে ইয়াকূব (عليه السلام) সাদা রং-এর তাজা বাদাম ও দালাব নামক ঘাস সংগ্রহ করলেন এবং সেগুলো ছিড়ে ঐসব বকরীর খাওয়ার পানিতে ফেললেন। উদ্দেশ্য এই যে, বকরী ঐ দিকে তাকালে ভীত হবে এবং পেটের মধ্যের বাচ্চা নড়াচড়া করবে। ফলে সে সব বাচ্চা উপরোক্ত রং-বিশিষ্ট হয়ে জন্মাবে। বস্তুত এটা ছিল একটি অলৌকিক ব্যাপার এবং ইয়াকুব নবীর অন্যতম মুজিযা। এভাবে নবী ইয়াকূব (عليه السلام) প্রচুর সংখ্যক বকরী, পশু ও দাস-দাসীর মালিক হন এবং এ কারণে তার মামার ও মামার ছেলেদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়, যেন ইয়াকূব (عليه السلام)-এর কারণে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।

আল্লাহ্ ওহীযোগে ইয়াকূব (عليه السلام)-কে নির্দেশ দেন যে, তুমি তোমার জন্মভূমিতে নিজ জাতির কাছে চলে যাও। এ সময় আল্লাহ্ তাকে সাহায্যের আশ্বাস প্রদান করেন। অতঃপর ইয়াকূর্ব (عليه السلام) নিজ স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের কাছে বিষয়টি পেশ করেন। তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর আনুগত্যের পক্ষে সাড়া দেন। সুতরাং ইয়াকূব (عليه السلام) তার পরিবারবর্গ ও ধন-সম্পদ সাথে নিয়ে রওয়ানা হয়ে পড়েন। আসার সময় স্ত্রী রাহীল তার পিতার মূর্তিসমূহ লুকিয়ে নিয়ে আসেন। তারা যখন ঐ এলাকা অতিক্রম করেন তখন লাবান (রাহীলের পিতা) ও তাঁর সম্প্রদায় তাদের কাছে এসে উপস্থিত হন। লাবানকে না জানিয়ে আসার জন্যে তিনি ইয়াকূব (عليه السلام)-কে মৃদু ভর্ৎসনা করে বললেন, আমাকে জানিয়ে আসলে ধুমধামের সাথে কন্যাদের ও তাদের সন্তানদের বিদায় সম্বর্ধনা জানাতে পারতাম। ঢোল-তবলা ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আমোদ-ফুর্তি করে বিদায় দিতাম। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমার মূর্তি কেন নিয়ে এসেছ? মূর্তির ব্যাপারে ইয়াকুব (عليه السلام) কিছুই জানতেন না। তাই তিনি অস্বীকার করে বললেন, আমরা তো মূর্তি আনিনি। লাবান তাঁর কন্যা ও দাসীদের অবস্থান স্থল ও জিনিসপত্র তল্লাশি করলেন কিন্তু কিছুই পেলেন না। রাহীল ঐ মূর্তিটি নিজ বাহনের পৃষ্ঠদেশে বসার স্থানে গদির নীচে রেখে দিয়েছিলেন। তিনি সে স্থান থেকে উঠলেন না এবং ওযর পেশ করে জানালেন যে, তিনি ঋতুবতী। সুতরাং তিনি তা উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলেন।

অবশেষে শ্বশুর-জামাতা উভয়ে তথায় অবস্থিত জালআদ নামক একটি টিলার কাছে পরস্পরে এ মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন যে, ইয়াকূব (عليه السلام) সাবানের কন্যাদেরকে ত্যাগ করবেন না এবং তাদের বর্তমানে অন্য কাউকে বিয়ে করবেন না এবং এই টিলা অতিক্রম করে লাবান ও ইয়াকূব কেউই অন্যের দেশে যাবেন না। অতঃপর খাবার পাক হল। উভয় পক্ষ একত্রে আহার করলেন এবং একে অপরকে বিদায় জানিয়ে প্রত্যেকে স্ব-স্ব দেশের পানে যাত্রা করলেন। ইয়াকুব (عليه السلام) সাঈর এলাকা পর্যন্ত পৌঁছলে ফেরেশতাগণ এসে তাকে অভ্যর্থনা জানান। ইয়াকূব (عليه السلام) সেখান থেকে একজন দূতকে তার ভাই ঈসের নিকট প্রেরণ করেন, যাতে ভাই তাঁর প্রতি সদয় হন এবং কোমল আচরণ করেন। দূত ফিরে এসে ইয়াকূব (عليه السلام)-কে এই সংবাদ দিল যে, ঈস চারশ’ পদাতিক সৈন্যসহ আপনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ সংবাদ পেয়ে ইয়াকুব (عليه السلام) ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। আল্লাহর কাছে দুআ করেন, সালাত আদায় করেন, কাকুতি-মিনতি জানান এবং ইতিপূর্বে প্রদত্ত সাহায্যের প্রতিশ্রুতির উল্লেখ করেন এবং ঈসের অনিষ্ট থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এছাড়া তিনি তার ভাইকে দেয়ার জন্যে বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন তৈরি রাখলেন। উপঢৌকনের মধ্যে ছিল দু’শ ছাগী, বিশটা ছাগল, দু’শ’ ভেড়ী, বিশটা ভেড়া, ত্রিশটা দুধেল উটনী, চল্লিশটা গাই, দশটি ষাঁড়, বিশটি গাধী ও দশটা গাধা। তারপর তিনি এ পশুগুলোর প্রত্যেক শ্রেণীকে আলাদা আলাদাভাবে হাঁকিয়ে নেওয়ার জন্যে রাখালদেরকে নির্দেশ দেন এবং এর এক-একটি শ্রেণী থেকে আর একটি শ্রেণীর মাঝে দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেন। এরপর তাদেরকে বলে দেন যে, ঈসের সাথে প্রথমে যার সাক্ষাৎ হবে এবং ঈস বলবেন, তুমি কার লোক এবং এ পশুগুলো কার? তখন উত্তর দিবে, আপনার দাস ইয়াকুবের। মনিব-ঈসের জন্যে তিনি এগুলো হাদিয়াস্বরূপ পাঠিয়েছেন। এরপর যার সাথে দেখা হবে এবং তার পরে যার সাথে সাক্ষাৎ হবে সবাই ঐ একই উত্তর দিবে। আর তোমরা প্রত্যেকেই এ কথা বলবে যে, তিনি আমাদের পেছনে আসছেন।

সবাইকে বিদায় করার দুইদিন পর ইয়াকূব (عليه السلام)-সহ তার দুই স্ত্রী, দুই দাসী এবং এগারো পুত্র যাত্রা শুরু করেন। তিনি রাত্রিকালে পথ চলতেন এবং দিনের বেলা বিশ্রাম নিতেন। যাত্রার দ্বিতীয় দিন প্রভাতকালে ইয়াকূব (عليه السلام)-এর সম্মুখে জনৈক ফেরেশতা মানুষের আকৃতিতে দেখা দেন। ইয়াকূব (عليه السلام) তাঁকে একজন পুরুষ মানুষ বলে ধারণা করেন। ইয়াকূব (عليه السلام) তাঁকে পরাস্ত করার জন্যে অগ্রসর হন এবং ধস্তাধস্তির মাধ্যমে বাহ্যিক দৃষ্টিতে ইয়াকূব (عليه السلام) জয়ী হন। তবে ফেরেশতার দ্বারা ইয়াকূব (عليه السلام) তাঁর উরুতে আঘাত প্রাপ্ত হন। তখন তিনি খোঁড়াতে থাকেন। প্রভাতের আলো ফুটে উঠলে ফেরেশতা ইয়াকূব (عليه السلام)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম কি? উত্তরে তিনি বললেন, আমার নাম ইয়াকূব (عليه السلام)। ফেরেশতা বললেন, এখন থেকে আপনার নাম হবে ইসরাঈল। ইয়াকূব (عليه السلام) জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পরিচয় কি এবং আপনার নাম কি? প্রশ্ন করার সাথেই ফেরেশতা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তখন ইয়াকূব (عليه السلام) বুঝতে পারলেন যে, ইনি ফেরেশতা। পায়ে আঘাত পেয়ে ইয়াকূব (عليه السلام) খোঁড়া হয়ে আছেন। বনী-ইসরাঈলগণ এ কারণে উরু-হাঁটুর মাংসপেশী খান না।

তারপর ইয়াকূব (عليه السلام) দেখতে পান যে, তাঁর ভাই ঈস চারশ’ লোকের এক বাহিনী নিয়ে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। তিনি পরিবারবর্গকে পেছনে রেখে সম্মুখে যান। ঈস সম্মুখে উপস্থিত হলে তাকে দেখেই ইয়াকূব (عليه السلام) সাতবার তাঁকে সিজদা করেন। এই সিজদা ছিল সে যুগে সাক্ষাৎকালের সালাম বা অভিবাদন (সম্মান সূচক) এবং তাঁদের শরীআতে এ সিজদা বৈধ ছিল। যেমন ফেরেশতারা হযরত আদম (عليه السلام)-কে সম্মানসূচক সিজদা করেছিলেন এবং হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-কে তাঁর পিতা-মাতা ও ভাইয়েরা সিজদা করেছিলেন। এ সম্পর্কে আলোচনা সামনে আসবে। ইয়াকূব (عليه السلام)-এর এ আচরণ দেখে ঈস তার কাছে গেলেন এবং তাঁকে আলিঙ্গন করে চুমো খেলেন এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তারপর চোখ তুলে তাকাতেই নারী ও বালকদেরকে দেখে ঈস ইয়াকূব (عليه السلام)-কে লক্ষ্য করে বললেন, এদেরকে তুমি কোথায় পেলে? ইয়াকূব (عليه السلام) বললেন, আল্লাহই আপনার দাসকে এসব দান করেছেন। এ সময় দাসীদ্বয় ও তাদের সন্তানরা ঈসকে সিজদা করল। এরপর লায়্যা ও তার সন্তানরা সিজদা করে এবং শেষে রাহীল ও তার পুত্র ইউসুফ এসে ঈসকে সিজদা করেন। এরপর ইয়াকুব (عليه السلام) তার ভাইকে দেয়া হাদিয়াগুলো গ্রহণ করার জন্য বারবার অনুরোধ জানালে ঈস তা গ্রহণ করেন। এরপর ঈস সেখান থেকে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন, তখন তিনি আগে-আগে ছিলেন এবং ইয়াকূব ও তার পরিবার-পরিজন, দাস-দাসী ও পশু সম্পদসহ তার পিছে পিছে সাঈর পর্বতের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।

সাহুর নামক স্থান অতিক্রমকালে তিনি সেখানে একটি ঘর নির্মাণ করেন এবং পশুগুলোর জন্যে ছাউনি তৈরি করেন। এরপর শাখীম এলাকার উর-শালীম (اورشليم) নামক গ্রামের সন্নিকটে অবতরণ করেন এবং শাখীম ইবুন জামূর-এর এক খণ্ড জমি একশ’ ভেড়ার বিনিময়ে ক্রয় করেন। সেই জমিতে তিনি তাঁবু স্থাপন করেন এবং একটি কুরবানীগাহ্ তৈরি করেন। তিনি এর নাম রাখেন ‘ঈল-ইলাহে ইসরাঈল।’ এই কুরবানীগাহটি আল্লাহ্ তার মাহাত্ম্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করার আদেশ দিয়েছিলেন। এটাই বর্তমান কালের বায়তুল মুকাদ্দাস। পরবর্তীকালে সুলায়মান ইবন দাউদ (عليه السلام) এ ঘরের সংস্কার করেন। এটাই সেই চিহ্নিত পাথরের জায়গা যার উপর তিনি ইতিপূর্বে তেল রেখেছিলেন—যার আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে।

আহলি কিতাবগণ এখানে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন, যা ইয়াকূব (عليه السلام)-এর স্ত্রী লায়্যার পক্ষের কন্যা দীনা সম্পর্কিত। ঘটনা এই যে, শাখীম ইবন জামূর দীনাকে জোরপূর্বক তার বাড়িতে ধরে নিয়ে যায়। তারপর দীনার পিতা ও ভাইদের কাছে তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। দীনার ভাইয়েরা জানাল যে, তোমরা যদি সকলে খাতনা করাও তাহলে আমাদের সাথে তোমাদের বৈবাহিক সম্পর্ক হতে পারে। কেননা, খাৎনাবিহীন লোকদের সাথে আমরা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করি না। শাখীমের সম্প্রদায়ের সবাই সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে খাতনা করাল। খাতনা করার পর তৃতীয় দিবসে তাদের ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হয়। এই সুযোগে ইয়াকূব (عليه السلام)-এর সন্তানগণ তাদের উপর হামলা করে। শাখীম ও তার পিতা জামূরসহ সকলকে হত্যা করে ফেলে। হত্যার কারণ ছিল তাদের অসদাচরণ, তদুপরি তারা ছিল মূর্তিপূজারী, কাফির। এ কারণে ইয়াকুব (عليه السلام)-এর সন্তানরা তাদেরকে হত্যা করে এবং তাদের ধন-সম্পদ গনীমত হিসেবে নিয়ে নেয়।

এরপর ইয়াকূব (عليه السلام)-এর কনিষ্ঠ স্ত্রী রাহীল পুনরায় সন্তান-সম্ভবা হন এবং পুত্র বিন-য়ামীন জন্মগ্রহণ করেন। রাহীল বিন-য়ামীন প্রসব করতে গিয়ে খুবই কষ্ট পান। ফলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার অব্যবহিত পরে রাহীলের ইনতিকাল হয়। ইয়াকূব (عليه السلام) আফরাছ অর্থাৎ বায়তু-লাহমে (বেথেলহামে) তাকে দাফন করেন। তিনিই তার কবরের উপর একটি পাথর রেখে দিয়েছিলেন যা আজও বিদ্যমান আছে। হযরত ইয়াকূব (عليه السلام)-এর সন্তানের মধ্যে বারজন পুত্র। এদের মধ্যে লায়্যার গর্ভে যাঁদের জন্ম হয় তারা হচ্ছেন (১) রূবীল, (২) শামউন, (৩) লাবী, (৪) য়াহুযা, (৫) আয়াখার ও (৬) যায়িলুন। রাহীলের গর্ভে জন্ম হয় (৭) ইউসুফ ও (৮) বিন-য়ামীনের। রাহীলের দাসীর গর্ভে জন্ম হয় (৯) দান ও (১০) নায়ফতালী-এর। লায়্যা দাসীর গর্ভে জন্ম হয় (১১) হাদ ও (১২) আশীর-এর। অতঃপর হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) কানআনের হিবরূন গ্রামে চলে আসেন এবং তথায় পিতার সান্নিধ্যে থাকেন। হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-ও এখানেই বসবাস করতেন। রোগাক্রান্ত হয়ে হযরত ইসহাক (عليه السلام) একশ’ আশি বছর বয়সে ইতিকাল করেন। তাঁর পুত্রদ্বয় ঈস ও ইয়াকূব (عليه السلام) তাকে তার পিতার পূর্বোল্লেখিত তাদের কেনা জমিতে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)-এর কবরের পাশে সমাহিত করেন।
Top