ইমাম আহমদ রেযা (رحمة الله)’র আরবী কবিতা 

মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন 


পৃথিবীর সকল জীবন্ত ভাষা ও সাহিত্যের অতীব ও গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হলো ‘কবিতা’। কবিতার মাধ্যমেই সাবলীল ও ছান্দিক আকারে ফুটে উঠে মানুষের সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্নার বাস্তব চিত্র। ফলে কবিতার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ স্বভাবজাত। বিশেষত আরবী- সাহিত্যে ‘কবিতা’ বিশেষ স্থান দখল করে আছে আবহমানকাল থেকেই। ইসলাম প্রচারের উৎস ও লালন ক্ষেত্র যেমন আরব ভূমি, ইসলামের নবী ও ধর্মীয়গ্রন্থ কুরআন-হাদীসের ভাষাও আরবী, সেহেতু অনেক অনারব ভাষাভাষী লোকেরাও আরবী সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। এ ধারাবাহিকতায় হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীতে এ উপমহাদেশে যে-সব মহান মনীষী আরবী সাহিত্যের চর্চা করেছেন তাঁদের মধ্যে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (১৮৫৬-১৯২১) অন্যতম। তিনি তাঁর সমকালের অন্যতম মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, মুফতি, দার্শনিক ও বিচিত্র বিষয়ে বহু গ্রন্থ প্রণেতা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন আরবী, ফার্সী ও উর্দু কাব্যসাহিত্যের এক প্রবাদ পুরুষ। বিশেষত একজন অনারব বংশজাত হয়েও আরবী গদ্য ও পদ্য সাহিত্যে তাঁর রচনাবলী খোদ আরব সাহিত্যিকদেরকেও চমকে দিয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের আল্লাহ্ প্রদত্ত অদৃশ্যজ্ঞান (ইলমে গায়ব) বিষয়ক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আদ্ দাওলাতুল মাক্কিয়্যাহ্ ফিল মাদ্দাতিল গায়বিয়্যা’ আরবী গদ্য রচনারীতিতে ক্লাসিক আরবী মাকামাতসমূহের সমপর্যায়ের শুধু নয় বরং কতেক বৈশিষ্ট্যে অতুলনীয়ও বটে। ক্লাসিক আরবী গদ্য সাহিত্যের পাশাপাশি আরবী পদ্য বা কবিতায় ছিলো তাঁর সমান পদচারণা। যে সব উপাদান নিয়ে আরবী কাব্য সাহিত্যের সৌধ গড়ে উঠেছে, তার সব উপাদানেই ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র আরবী কবিতার মধ্যে পাওয়া যায়। আরব সাহিত্যিকগণ আরবী কাব্যের যে-সব উপাদান নির্ণয় করেছে তা’ নয়ভাগে বিভক্ত। যেমন:

১. গৌরব (فخر), ২. বীরত্ব (حماسه ), ৩. প্রশংসা (مدح), ৪. ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ (هجاء), ৫. ভর্ৎসনা (عتاب), ৬. শোকগাথা (مرثية), ৭. প্রেম-প্রীতি (غزل), ৮. বর্ণনা (وصف), ৯. জ্ঞানগর্ব নীতিবাক্য (حكمة)।

আমরা যখন ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর আরবী কবিতাগুলো পর্যালোচনা করি, তখন তাঁর কবিতায় উপরিউক্ত সব উপাদান পূর্ণমাত্রায় দেখতে পাই। যেমান:-

১. প্রশংসা (مدح): এটা হলো কোন সম্ভ্রান্ত গোত্র বা মর্যাদাবান ব্যক্তি বা প্রেমাস্পদের উত্তম গুণসমূহের উল্লেখ করে কবিতা রচনা করা। প্রশংসামূলক কবিতা আরবী কাব্যের বিরাট একটি স্থান দখল করে আছে। প্রতিযুগে কবিদের একটি দল এমন ছিলো যে, তাঁরা বিভিন্ন রাজা-বাদশা ও নবাবদের দরবারে গিয়ে তাঁদের প্রশংসায় কবিতা রচনা করতেন। রাজা-বাশাগণও তাঁদের কবিতায় সন্তুষ্ট হয়ে কবিকে পুরস্কৃত করতেন। কখনো বা মোটা অংকের এককালীন সম্মানি এবং বাৎসরিক ভাতাও দিতেন। কিন্তু ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এ প্রকৃতি ও স্বভাবের কবি ছিলেন না। দুনিয়ার কোন রাজা-বাদশা ও নবাবের প্রশংসায় তিনি কবিতা রচনা করেননি বরং তাঁর জনৈক ভক্ত নানপারার নবাবের প্রশংসায় কবিতা লিখতে অনুরোধ করলে তিনি তখনই প্রিয় নবীর প্রশংসায় একটি দীর্ঘ না’ত (রসূল প্রশস্তি) রচনা করলেন, যার একটি চরণে ভর্ৎসনার সূরে লিখছেন যে-

ميں گدا هوں اپےর كريم كا

ميرا دين پاره نان نهيں


অর্থাৎ : ‘আমি তো আপন দাতারই ভিখারী, আর আমার দ্বীন তো রুটির টুকরো নয়।’


মূলতঃ তাঁর সকল কবিতা মহান আল্লাহর প্রশংসা ও প্রিয় রসূলের প্রশস্তিকে কেন্দ্র করেই রচিত এবং শরয়ী উৎকর্ষ ও আধ্যাত্মিকতার সুরে অনুরণিত। জাগতিক কোন স্বার্থে কারো প্রশংসা করে তিনি কাব্য রচনা করেন নি। যেমন:

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন:


اَلْحَمْدُ لله رَبِّ الكَوْنِ وَالْبَشَرِ

حَمْدًا يَّدُوْمُ دَوَامًا غَيْرَ مُنْحَصَرِ

وَافْضَلُ الصَّلواتِ الزَّاكياتِ على

خير البَرِبَّهِ مُنْجِى النَّاسِ مِنْ سَقَرِ

بِكَ العياذ ألَهِىْ اِنْ أَشأحَكَمًا

سِوَاكَ ياربَّنَا يَامُنْزِلَ النَّذَرِ

اَلَا تَعالَ أِلى المُخْتَارِ من مُّضرٍ

صلى اله على المختار من مضر


১. সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার, যিনি সৃষ্টিজগত ও মানুষের রব। তাঁর অসীম, অশেষ ও সর্বদা প্রশংসা করছি।

২. উত্তম ও পুতঃপবিত্র দরূদ (বর্ষিত হোক) সর্বোত্তম সৃষ্টি প্রিয়নবীর উপর, যিনি লোকদেরকে দোযখ থেকে মুক্তিদাতা।

৩. হে রব! আপনি ব্যতীত অন্য কাউকে বিচারক হিসেবে মান্য করা থেকে তোমার আশ্রয় চাচ্ছি, হে দয়া অবতীর্ণকারী।

৪. (ওহে শ্রোতা) আহমদ মুখতার সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের দিকে ফিরে আস, এবং স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর প্রতি রহমত বর্ষণ করেন।

আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের না‘ত (প্রশস্তি) বর্ণনা করতে গিয়ে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর অন্য একটি কবিতায় লিখেছেন যে-


الحمد للمتوحَّدِ

بجلاله المتفرد


وصلاة مولنا على

خير الانام محمد


والالِ وَالاصحاب


هم مأواى عندشدائد

شدائد

فالى العظيم توسلى

بكتابه وباحمد


لَاهُمَّ قدهجم العدٰى

العدى من كل عادٍ معتد


هاوين زلة مثبت

باغين ذلة مهتد


لكن عبدك امنٌ

أِذ من دَعَاك يؤيدِ


لااختشى من بأسهم يدُ ناصرى اقْوى يد

يا ربِّ ربَّاه يا

كنزالفقير الفاقد


بك التجى بك ادفع

فى نحر كل مهدّدِ


انت القوى فقوِّنى

انت القديرُ فأيّدِ


وأدم صلاتك والسلا


والسلا م م على الحبيب الاجود


واجعل بها احمد رضا

رضا عبدا بحرز السيّد


১. একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর জন্য প্রশংসা, যিনি স্বীয় মহত্ব ও মর্যাদায় একক ও অদ্বিতীয়।

২. আল্লাহ্র পরিপূর্ণ রহমত বর্ষিত হোক আমার মালিক সর্বোত্তম সৃষ্টি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র উপর।

৩.তাঁর পবিত্র বংশধর এবং সাহাবীদের প্রতি রহমত বর্ষিত হোক, যাঁরা কঠিন বিপদকালে আমাদের আশ্রয়স্থল।

৪. আল্লাহ্ তা’আলার সমীপে তাঁর পবিত্র কিতাব (কুরআন) এবং আহমদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার ওসীলা কামনা করছি।

৫. ইয়া আল্লাহ্! শত্রুগণ আমার উপর আক্রমণ করে বসেছে।

৬. এবং প্রত্যেক সীমালংঘনকারী অত্যাচারীগণ যে দৃঢ় পথে আবস্থানকারী তার পদস্খলন কামনা করে, সৎপথ প্রাপ্তদের ত্রুটি হাওয়াকে কামনা করে।

৭. কিন্তু আপনার গোলাম নির্ভয়, কেননা যে আপনাকে আহ্বান করে তাকে সাহায্য করা হয়।

৮. আমি তার (শত্রুর) শক্তি ও ক্ষমতায় ভীতু নই, কারণ আমার সাহায্যকারীর হাত অত্যন্ত মজবুত।

৯. আর আপনার রহমত ও শান্তি অতি দানশীল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর বর্ষণ করুন।

১০. এবং সালাত ও সালামের উসীলায় আহমদ রেযাকে মুনিবের নিরাপদময় গোলাম বানিয়ে দিন।


আল্লাহ্ তা’আলার কাছে সাহায্য প্রার্থনা ও আশ্রয় চেয়ে তিনি এক স্থানে লিখেছেন:


عدت العادُونَ وجَاروا

ورجوتُ اللهَ مجيرا


وكفى بالله وليّا

وكفى بالله نصير


১. (আমার) বিরুদ্ধবাদীরা জুলুম ও কঠিন অত্যাচার করেছে, আমি আল্লাহর ভরসা করেছি, (তিনি প্রকৃত মুক্তিদাতা)

২. আল্লাহ্ (আমার) মালিক হিসেবে যথেষ্ট আর আল্লাহই সাহায্যকারী হিসেবে যথেষ্ট।


ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র রচনাবলীর মূল উপজীব্য ছিলো ইশ্কে রাসূল (নবীপ্রেম)। ইশকে রাসূলই হচ্ছে প্রত্যেক মু’মিন মুসলমানের ঈমানের সঞ্জীবনী শক্তি। তাই তিনি জীবনভর বিশ্ববাসীকে ইশকে রাসূলের গীত শুনিয়েছেন। যেমন হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন:


وكل خير من عطاء المصطفى


صلى عليه الله مع من يُصطفى


الله يُعطى والحبيب قاسم


صلى عليه القادة الاكارم


مانال خيرا مِّنْ سواه نائلٌ


كلا ولا يُرجى لغير نائلٌ


منه الرجا منه العطا منه المدد


فى الدين والدنيا والاخرى للابد


১. প্রত্যেক প্রকারের নিয়ামত ও কল্যাণ (সৃষ্টিজগত) মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পক্ষ থেকে পেয়ে থাকে। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর প্রতি এবং অন্যান্য মনোনীত প্রিয় বান্দাদের সাথে রহমত অবতীর্ণ করুন।

২. আল্লাহ্ দাতা আর তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বন্টনকারী। সম্প্রদায়ের সম্মানিত সরদারগণ তাঁর প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ করেন।

৩. কোন প্রাপকই তিনি ব্যতীত কারো থেকে মামুলি নিয়ামতও পায়নি। এটা নিশ্চিত যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত কারো থেকে দানের আশা করা যায় না।

৪. তিনিই (আমাদের) আশা-ভরসা, তাঁরই পক্ষ থেকে দ্বীন ও দুনিয়ার এবং অশেষ পরকালীন জীবনের সাহায্য রয়েছে।


তেমনিভাবে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র কাছে সাহায্য চেয়ে লিখেছেন-


رسول الله انت بُعثتَ فينا


كريمًا رحمةً حصنًا حصينًا


تَخَوِّ فنى العدى كيدا متينا


اجرنى يا امان الخائفين


১. ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি আমাদের মাঝে দয়ালু, করুণাময় এবং সুরক্ষিত দুর্গ হিসেবে প্রেরিত।

২. (আল্লাহর শাস্তির) ভয়ে ভীতুদের হে নিরাপত্তাদাতা। শত্রু স্বীয় প্রতারণা ও ধোকায় আমাকে সর্বদা ভয়ের মধ্যে রেখেছে, আপনি আমাকে আশ্রয় প্রদান করুন এবং রক্ষা করুন।

প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি ছিলো ইমাম আহমদ রেযার পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস। তাই তিনি পরিপূর্ণ আস্থা সহকারে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে লিখেছেন:


رسول الله انت المستجارُ


فلا اخشى الأعادى كيف جاروا


بفضلك ارتجى اَنْ عن قريب


تمزق كيدهم والقوم بَارُوْا


১. ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার থেকেই সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। তাই আমি শত্রুদেরকে কিছুমাত্র ভয় করিনা, সে যতই আমার প্রতি অত্যাচার-অবিচার করুক না কেন?

২. আপনার প্রতি আমার পূর্ণ ভরসা আছে যে, আপনি অতিসত্ত্বর শত্রুদের সকল প্রতারণার জাল ছিন্ন করে দেবেন আর শত্রু দল ধ্বংসে নিপাত হবে।


ইমাম আহমদ রেযা তাঁর ‘কসিদায়ে নূনিয়ায়’ প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি দরূদ-সালাম’র হাদিয়া পেশ করতে গিয়ে লিখেছেন-


وصلاة ربى دائما وعلى


خير البرية سيد الاكوان


صلى المجيد على الرسول واله


ومحبه ومطيعه بحنان


صلى عليك الله يا ملك الورى


ماغرد القمرى فى الافنان


صلى عليك الله يافرد العلى


مااطرب الورقاء بالالحان


صلى عليك الله يامولاى ما


رنّ الحمام على شجون البان


১. আমার রবের অবিরত রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক ওই সত্তার উপর যিনি সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বোত্তম এবং বিশ্বকুল সরদার।

২. মহা সম্মানিত রবের রহমত হোক প্রিয় রসূল ও তাঁর পরিবার-পরিজন, তাঁর প্রেমিক-আশেক ও অনুগতদের উপর।

৩. হে সৃষ্টিকুলের বাদশা! আল্লাহ্ আপনার প্রতি তাঁর স্বীয় রহমত বর্ষণ করুন, যতক্ষণ গানের পাখি গাছের ডালে গান করতে থাকবে।

৪. হে উচ্চ মর্যাদার একক অধিকারী! রব্বে-কায়েনাত আপনার উপর দরূদ (রহমত) অবতীর্ণ করতে থাকুক, যতক্ষণ পর্যন্ত কবুতর মধুর সূরে গাইতে থাকবে।

৫. হে আমার আকা! আপনার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষণ হতে থাকুক, যযক্ষণ পর্যন্ত কবুতর বান গাছে বাকবাকুম করতে থাকবে।

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো লিখেছেন-


ااذكر حاجتى ام قدكفانى


حيائك إنَّ شيمتك الحياء


إذا اثنى عليك المرء يوما


كفاه من توضّئك الثناء


رسول الله فضلك ليس يحصى


وليس لجودك السامى انتهاء


فان اكرمتنا د نيا واخرى


فليس البحر ينقصه الدلاء


১. (ইয়া রাসূলাল্লাহ্!) আমি কি আমার অভাব-অভিযোগ পেশ করব, না আপনার লজ্জাশীলতায় আমার জন্য যথেষ্ট – যা আপনার অলংকার।

২. যখন কোন দিন কেউ আপনার প্রশংসা করেছে তখন আপনার প্রশংসায় আলোকিত হওয়ায় ছিল তার জন্য যথেষ্ট।

৩. তিনি এমন দানশীল ও দয়ালু যে সকাল-সন্ধ্যা সৃষ্টিজগতকে দান করতে থাকেন। তাতে কোন ধরনের পরিবর্তন হয় না।

৪. ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার দয়া ও দান গণনা করে শেষ করা যাবে না। আপনার বদন্যতার পরিসমাপ্তি নেই।

৫. আপনি যদি আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের সব কিছুই দান করেন তারপরও আপনার দয়ার সমুদ্র সেচন করে শেষ করা যাবে না।


২. ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ (هجاء): কোন লোকের বা বংশের দোষ বর্ণনা বা কীর্তি তুলে ধরে যে কবিতা রচনা করা হয় তাই হলো ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা। এ প্রকারের কবিতা তরবারীর আঘাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর। স্বয়ং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত হাস্সান বিন সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে কুরাইশদের ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ ও কুৎসার উপযুক্ত জবাব দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, (لهذا اشد عليه من وقع النبل) ‘নিশ্চয় তা’ তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপের চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে।’ ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হিও একস্থানে নজদী ওহাবীদের ব্যঙ্গ করে বলেন:


ولا ادرى وسوف إخال أدْرى


اقوم ال نجدِ ام نساءُ


فمن فى كفهِ منهم خضاب


كمن فى كفه منهم لواءُ


تَظُنُّ بداهة فيهم رشيدًا


واِنْ تُمْعِنْ فَرُشْدُهم هَبَاءُ


فما فيهم رشيد الصدق الا


رضيع او تبيع او غذاءُ


فمامعنى تحاورُهم ولكن


عسى الخنانُ يهدى من يشاءُ


১. এক্ষুণি আমার জান নেই, অবশ্য আশা করি কিছুক্ষণ পর আমার কাছে প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পাবে যে, আমার বিরুদ্ধবাদী নজদীরা পুরুষ, না মহিলা।

২. লোকদের মাঝে যাদের হাতে মেহেদী লেগে আছে তারা কি ওই সব লোকের সমকক্ষ হতে পারে যাদের হাতে জিহাদের ঝাণ্ডা রয়েছে।

৩. তুমি (আমার শত্রুদের মাঝে) সত্য ও ন্যায় আছে বলে ধারণা করেছ, বরং যদি তুমি চিন্তা করে দেখো তবে দেখবে তাদের সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতা ওই ধুলাবালির মতো যা সূর্যের কিরণে শুধু দেখতে পাওয়া যায়।

৪. তাদের মধ্যে কোন সত্যবাদি ও ন্যায়পরায়ণ নেই বরং আছে অসভ্য বা অনুগামী।

৫. তিনি সৎপথ বিচ্যুত লোকদের সাথে সব বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তবে হিদায়ত আল্লাহর ইচ্ছাধীন, তিনি মহা দয়াবান, যাকে চান সৎপথ প্রদর্শন করেন।


শোকগাথা (مرثيه): শোক ও সমবেদনা আপ্লুত এ কবিতায় মৃতের গুণাগুণ বর্ণিত হয়ে থাকে। ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হিও এ ধারার অনেক আরবী কবিতা রচনা করেছেন। বিশেষত তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষী মহলের অনেকের মুত্যুতে আরবী ছন্দে তাঁদের শোকগাথা রচনা করেছেন। যেমন তাঁর প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ ইসমাঈল কাদেরী নকশবন্দী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ইন্তিকালে যে শোকগাথা রচনা করেছেন তা আরবী সাহিত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তিনি লিখেছেন:


بلى ليل ذِى همَّ طويلٍ وسيَّما


هموم على اعلى مهام ئم جلَّتِ


اُلا كلُّ رُزءٍ فى دَنَاك مُنْتَهٍ


وكل مُحاقٍ مُسْفِرٌ عن اَهِلَّةٍ


شمال عبد الله جلَّت جليلة


وشَمْليل اِسمعيل بالتِّلْو صلَّتِ


قضى الله فى جناته جَمْعَ شَمْلِنَا


وبوّانا فى روضةٍ مُخْضَئِلّةِ


حَبَا الله أسمعيل فضلا ورحمةً


واكرم مثواه بمنزل خُلةِ


الهى أليك بالحبيب توسُّلى


بهِ فاغفر اللهم ذنْبنى وزلَّتِىْ


১. আমার শুভার্থীর ইন্তেকালে আমার দুঃখের রাত দীর্ঘ হয়ে গেছে তা আশ্চর্যের কিছু নয়, কারণ, কঠিন দুঃখে জর্জরিত ব্যক্তির রাত এমনিই দীর্ঘ হয়ে থাকে। বিশেষ করে নির্জন উপত্যকা ও মরূদ্যানে বসবাসকারীদের দুঃখ-দুর্দশা দীর্ঘ হয়ে থাকে।

২. হে বন্ধু! আপনার ব্যক্তি সত্তা এমনই ছিলো যে, আপনার সান্নিধ্যে গেলে আমার সকল দুঃখ-বেদনা দুর হয়ে যেতো। মাসের শেষ তিন দিন চাঁদ দেখা যায় না কিন্তু ওই চাঁদ প্রথম তারিখে নতুন চাঁদ হয়ে উদিত হয় এবং ক্রমান্বয়ে পূর্ণতা লাভ করে। তেমনি আপনার সান্নিধ্যে কোন দুঃখীজন গেলে সে খুশী হয়ে ফিরে আসতো।

৩. ওবাইদুল্লাহ্র বাম হাত ছিলো মহান মর্যাদাময়, (ডান হাতের তো তুলনাই নেই) অর্থাৎ ইলম, আমল হিদায়ত, উপদেশ ইত্যাদিতে উচ্চ মর্যাদাশীল আর মরহুম ইসমাঈল’র বাম হাত ওবাইদুল্লাহর পরে দ্বিতীয় নম্বর ছিলো। অর্থাৎ তিনিও মান-মর্যাদায় ওবাইদুল্লাহর অতি নিকটবর্তী ছিলেন।

৪. মহান আল্লাহ্ ফায়সালা করে দিয়েছেন যে, আমরা সৎপন্থীদের দলকে জান্নাতে একত্রিত করবেন এবং সবুজ-শ্যামল বাগানে আমাদের আশ্রয়স্থল করবেন।

৫. আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় দয়া ও রহমতে মরহুম ইসমাঈলকে তাঁর বন্ধুত্বের উচ্চ মকাম দান করুন।

৬. হে আল্লাহ্! আপনার দরবারে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে নিজের ওসীলা ও সুপারিশকারী বানিয়ে প্রার্থনা করছি যে, আমার গুনাহ্ ও অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি মার্জনা করুন।


দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, মানুষের আসল গন্তব্যস্থল হলো আখিরাত। দুনিয়ার ভালবাসা ও আসক্তি মানুষকে সমূহ বিপদের প্রতি ধাবিত করে। তাই ইসলামী ভাবধারার কবিগণ দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ব্যক্ত করে অনেক কবিতা রচনা করেছেন। দ্বীন পরিত্যাগ করে দুনিয়াকে আকঁড়ে ধরার অশুভ পরিণতি বর্ণনা করে এবং সৃষ্টিজগতের সর্বোত্তম আদর্শ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াল্লাম-এর জীবনাদর্শকে অনুসরণ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন:


هى الدنيا تبيدُ ولاتفيدُ


فأفِّ لمن يُّرِيْدُ ومن يَّرودُ


نفوس الجهل تائقة إليها


فملتمس وَّ اخرمستزيدُ


ولم أر مثل طالبها غبيًّا


ولا كبشا لمذ بحه أقود


يُبارى جهده وإن استطاعا


تفلَّت وهو عن كَلئى شرودُ


وذا المسكين يقعدُوْ نحو موتهِ


بأرجلهِ ويحقد من يُّحيدُ


اَلَمْ تراَنَّ مُؤْتَفِكَاتِ قوم


هَوَتْ لِهوًى فأهواها السمود


أمسلم عذ بوجه الله منهم


فاِنَّ معاذه الركن الشديد


ولذ برسولهِ فَلِياذهُ الحق


وعَاهَدَه من الله العهودُ


على المولى من اﻷ علىٰ صلاةٌ


تفيض فتستفيض بها العبيدُ


على الوالى من العالى سلامٌ


يجودُ فيَجْتَدِىْ منه العبود


صلاة لَّاتُحدُّ ولَا تُعدُّ


ولاتفنى وإن فِنَيْتْ اُبُوْدُ


سلام لايُمَنُّ ولايُمَانى


وَلايبلى متى بَلِيَتْ عهودُ


رسول الله انت لنا الرجاءُ


وفضلُكَ واسع وجداك الجُوْدُ


حبيب الله مَنْ تَقْرَبْهُ حفظًا


فكل كريهةٍ عنه بعيدُ


১. এ দুনিয়া, যা ধ্বংসকারী, উপকারী নয়, তাই ওই লোকের জন্য দুঃখ যে দুনিয়াকে পেতে চাই এবং উহা লাভ করার ইচ্ছা পোষণ করেন।

২. মূর্খ লোকেরাই দুনিয়াকে অর্জন করতে কামনা-বাসনা করেন। তাই কেউ দুনিয়ার পেছনে দৌড়াচ্ছে, আর কেউ পার্থিব সম্পদ, যশ-খ্যাতি ইত্যাদি বৃদ্ধি করতে সদা মগ্ন।

৩. আমি দুনিয়ার লোভী ব্যক্তির চেয়ে কোন অজ্ঞ দেখেনি, এমনকি ওই বে-আক্কল ছাগলকেও না, যাকে যবেহ্ করার জন্য টেনে নেওয়া হয়।

৪. ওই ছাগল যথাসম্ভব যবেহের স্থানে যেতে জিদ করে থাকে। এবং সুযোগ পেলে এমনভাবে পলায়ন করে, তাকে ঘাস দেখালেও কাছে আসে না।

৫. আর (এ দুনিয়া লোভী) বেচারা, অজ্ঞ স্বয়ং নিজ পায়ে মুত্যুর দিকে দৌঁড়ায় আর যে লোক তার মঙ্গল কামনায় তাকে বাধা দেয়, সে তার শত্রু বনে যায়।

৬. তুমি কি দেখো নি, এক সম্প্রদায়ের বস্তিকে উল্টিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেননা তারা মন্দ প্রবৃত্তির প্রতি ধাবিত হয়েছিলো আর অনর্থক খেলা-ধুলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

৭. হে মুসলিম! মন্দ লোকের মন্দ থেকে আল্লাহর আশ্রয়ে এসো, কারণ তাঁর আশ্রয় অত্যন্ত মজবুত।

৮. আর আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র আশ্রয় কামনা কর! কারণ তাঁর আশ্রয় সত্য ও সঠিক আর তাঁর আশ্রয়ের ব্যাপারে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অত্যন্ত মজবুত।

৯. আমাদের আকা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর মহান রবের এমন করুণা রয়েছে যে, আমরা তাঁর উম্মতগণও যাতে করুণাসিক্ত হতে পারি।

১০. আমাদের মালিক ও হাকিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর আল্লাহ্ তা’আলা শান্তি অবতীর্ণ করেছেন, যাতে আমরা তাঁর উম্মতগণ তা হতে শান্তি লাভ করতে পারি।

১১. তাঁর প্রতি আল্লাহর এমন রহমত অবতীর্ণ হোক, যা অসীম ও অগণিত, যা কখনো নিঃশেষ হবে না, যদিও এ দীর্ঘ যুগ একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে।

১২. তাঁর প্রতি অশেষ ও অফুরন্ত আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক, যুগ পুরাতন হয়ে গেলো তা যেন পুরানা না হয়।

১৩. ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি আমাদের ভরসাস্থল। আর আপনার দয়া ও করুণা অত্যন্ত প্রশস্ত। আর আপনার দানই প্রকৃত দান।

১৪. যে লোকের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর সন্নিকটে হয়েছে, তবে তার থেকে সকল মুসিবত দুরীভূত হয়েছে এবং সে নিরাপত্তা লাভ করেছে।


এভাবে উর্দু ও ফার্সী কবিতা ছাড়াও ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর আরবী কবিতার সংখ্যাও প্রচুর। এ প্রবন্ধে নমুনা হিসেবে কিছু আরবী কবিতা পেশ করেছি। মিসর আল্-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কুল্লিয়াতুল লুগাত ওয়াত তারজামা’ বিভাগের প্রফেসর ড. হাসেম মুহাম্মদ আহমদ আবদুর রহীম ‘বাসাতিনুল গুফরান’ নামে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর আরবী কবিতাগুলোর এক বিরাট সংকলন মিসর থেকে প্রকাশ করেছেন। তিনি উক্ত গ্রন্থে কবিতাগুলোর সংক্ষিপ্ত তাহকীক এবং রচনার প্রেক্ষাপটও বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া আল্লামা ফযুলে রসূল বদায়ুনী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর ইলমে খিদমত ও রদ্দে-ওয়াহাবিয়া’য় তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হির কাসীদাতান রা’ই‘আতানি (قصيدتان رائعتان) নামে ৩১৩ বদরী সাহাবীর সংখ্যা অনুপাতে এক দীর্ঘ আরবী কবিতা রচনা করেন। ইরাকের সাদ্দাম ইসলামী ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. রশীদ আবদুর রহমান ওবাইদী ব্যাখ্যা সহকারে ইরাক ও ভারত থেকে উক্ত কাসিদা প্রকাশ করেছেন। ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর উর্দু ও ফার্সী কবিতার মতো তাঁর আরবী কবিতাগুলোতে সূফীতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, দর্শন, ভাষা অলংকার, নৃতত্ত্ব, প্রবাদ-প্রবচন এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি কাব্যগুণে সমুন্নত। ফলে আরব বিশ্বের অনেক গবেষক তাঁর আরবী কবিতার উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করেছেন এবং তাঁঁর কবিতাগুলোকে আরবী সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ বলে মন্তব্য করেছেন।

আল্লাহ্ তা’আলা এ মহান মনীষীর জ্ঞান সমুদ্র থেকে উপকৃত হওয়ার আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

আ-মী-ন।

Top