❏ মূসা (عليه السلام) ও খিযির (عليه السلام)-এর ঘটনা
আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(وَإِذۡ قَالَ مُوسَىٰ لِفَتَىٰهُ لَاۤ أَبۡرَحُ حَتَّىٰۤ أَبۡلُغَ مَجۡمَعَ ٱلۡبَحۡرَیۡنِ أَوۡ أَمۡضِیَ حُقُبࣰا فَلَمَّا بَلَغَا مَجۡمَعَ بَیۡنِهِمَا نَسِیَا حُوتَهُمَا فَٱتَّخَذَ سَبِیلَهُۥ فِی ٱلۡبَحۡرِ سَرَبࣰا فَلَمَّا جَاوَزَا قَالَ لِفَتَىٰهُ ءَاتِنَا غَدَاۤءَنَا لَقَدۡ لَقِینَا مِن سَفَرِنَا هَـٰذَا نَصَبࣰا قَالَ أَرَءَیۡتَ إِذۡ أَوَیۡنَاۤ إِلَى ٱلصَّخۡرَةِ فَإِنِّی نَسِیتُ ٱلۡحُوتَ وَمَاۤ أَنسَىٰنِیهُ إِلَّا ٱلشَّیۡطَـٰنُ أَنۡ أَذۡكُرَهُۥۚ وَٱتَّخَذَ سَبِیلَهُۥ فِی ٱلۡبَحۡرِ عَجَبࣰا قَالَ ذَ ٰلِكَ مَا كُنَّا نَبۡغِۚ فَٱرۡتَدَّا عَلَىٰۤ ءَاثَارِهِمَا قَصَصࣰا فَوَجَدَا عَبۡدࣰا مِّنۡ عِبَادِنَاۤ ءَاتَیۡنَـٰهُ رَحۡمَةࣰ مِّنۡ عِندِنَا وَعَلَّمۡنَـٰهُ مِن لَّدُنَّا عِلۡمࣰا قَالَ لَهُۥ مُوسَىٰ هَلۡ أَتَّبِعُكَ عَلَىٰۤ أَن تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمۡتَ رُشۡدࣰا قَالَ إِنَّكَ لَن تَسۡتَطِیعَ مَعِیَ صَبۡرࣰا وَكَیۡفَ تَصۡبِرُ عَلَىٰ مَا لَمۡ تُحِطۡ بِهِۦ خُبۡرࣰا قَالَ سَتَجِدُنِیۤ إِن شَاۤءَ ٱللَّهُ صَابِرࣰا وَلَاۤ أَعۡصِی لَكَ أَمۡرࣰا قَالَ فَإِنِ ٱتَّبَعۡتَنِی فَلَا تَسۡـَٔلۡنِی عَن شَیۡءٍ حَتَّىٰۤ أُحۡدِثَ لَكَ مِنۡهُ ذِكۡرࣰا فَٱنطَلَقَا حَتَّىٰۤ إِذَا رَكِبَا فِی ٱلسَّفِینَةِ خَرَقَهَاۖ قَالَ أَخَرَقۡتَهَا لِتُغۡرِقَ أَهۡلَهَا لَقَدۡ جِئۡتَ شَیۡـًٔا إِمۡرࣰا قَالَ أَلَمۡ أَقُلۡ إِنَّكَ لَن تَسۡتَطِیعَ مَعِیَ صَبۡرࣰا قَالَ لَا تُؤَاخِذۡنِی بِمَا نَسِیتُ وَلَا تُرۡهِقۡنِی مِنۡ أَمۡرِی عُسۡرࣰا فَٱنطَلَقَا حَتَّىٰۤ إِذَا لَقِیَا غُلَـٰمࣰا فَقَتَلَهُۥ قَالَ أَقَتَلۡتَ نَفۡسࣰا زَكِیَّةَۢ بِغَیۡرِ نَفۡسࣲ لَّقَدۡ جِئۡتَ شَیۡـࣰٔا نُّكۡرࣰا۞ قَالَ أَلَمۡ أَقُل لَّكَ إِنَّكَ لَن تَسۡتَطِیعَ مَعِیَ صَبۡرࣰا قَالَ إِن سَأَلۡتُكَ عَن شَیۡءِۭ بَعۡدَهَا فَلَا تُصَـٰحِبۡنِیۖ قَدۡ بَلَغۡتَ مِن لَّدُنِّی عُذۡرࣰا فَٱنطَلَقَا حَتَّىٰۤ إِذَاۤ أَتَیَاۤ أَهۡلَ قَرۡیَةٍ ٱسۡتَطۡعَمَاۤ أَهۡلَهَا فَأَبَوۡا۟ أَن یُضَیِّفُوهُمَا فَوَجَدَا فِیهَا جِدَارࣰا یُرِیدُ أَن یَنقَضَّ فَأَقَامَهُۥۖ قَالَ لَوۡ شِئۡتَ لَتَّخَذۡتَ عَلَیۡهِ أَجۡرࣰا قَالَ هَـٰذَا فِرَاقُ بَیۡنِی وَبَیۡنِكَۚ سَأُنَبِّئُكَ بِتَأۡوِیلِ مَا لَمۡ تَسۡتَطِع عَّلَیۡهِ صَبۡرًا أَمَّا ٱلسَّفِینَةُ فَكَانَتۡ لِمَسَـٰكِینَ یَعۡمَلُونَ فِی ٱلۡبَحۡرِ فَأَرَدتُّ أَنۡ أَعِیبَهَا وَكَانَ وَرَاۤءَهُم مَّلِكࣱ یَأۡخُذُ كُلَّ سَفِینَةٍ غَصۡبࣰا وَأَمَّا ٱلۡغُلَـٰمُ فَكَانَ أَبَوَاهُ مُؤۡمِنَیۡنِ فَخَشِینَاۤ أَن یُرۡهِقَهُمَا طُغۡیَـٰنࣰا وَكُفۡرࣰا فَأَرَدۡنَاۤ أَن یُبۡدِلَهُمَا رَبُّهُمَا خَیۡرࣰا مِّنۡهُ زَكَوٰةࣰ وَأَقۡرَبَ رُحۡمࣰا وَأَمَّا ٱلۡجِدَارُ فَكَانَ لِغُلَـٰمَیۡنِ یَتِیمَیۡنِ فِی ٱلۡمَدِینَةِ وَكَانَ تَحۡتَهُۥ كَنزࣱ لَّهُمَا وَكَانَ أَبُوهُمَا صَـٰلِحࣰا فَأَرَادَ رَبُّكَ أَن یَبۡلُغَاۤ أَشُدَّهُمَا وَیَسۡتَخۡرِجَا كَنزَهُمَا رَحۡمَةࣰ مِّن رَّبِّكَۚ وَمَا فَعَلۡتُهُۥ عَنۡ أَمۡرِیۚ ذَ ٰلِكَ تَأۡوِیلُ مَا لَمۡ تَسۡطِع عَّلَیۡهِ صَبۡرࣰا)
[Surat Al-Kahf ৬০ - ৮২]
অর্থাৎ, ‘স্মরণ কর, যখন মূসা তার সঙ্গীকে বলেছিল, দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে না পৌঁছে আমি থামব না অথবা আমি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকব। তারা উভয়েই যখন দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে পৌঁছল তারা নিজেদের মাছের কথা ভুলে গেল, এটা সুড়ংগের মত পথ করে সমুদ্রে নেমে গেল। যখন তারা আরো অগ্রসর হলো, মূসা তার সঙ্গীকে বলল, “আমাদের সকালের নাশতা নিয়ে এসো, আমরা তো আমাদের এ সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’ সঙ্গী বলল, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আমরা যখন শিলাখণ্ডে বিশ্রাম করছিলাম তখন আমি মাছের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। শয়তানই এটার কথা বলতে আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। মাছটি আশ্চর্যজনকভাবে নিজের পথ করে সমুদ্রে নেমে গেল। মূসা বলল, আমরা তো সেই স্থানটিরই অনুসন্ধান করছিলাম। তারপর তারা নিজেদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চলল। তারপর তারা সাক্ষাৎ পেল, আমার বান্দাদের মধ্যে একজনের, যাকে আমি আমার কাছ থেকে অনুগ্রহ দান করেছিলাম ও আমার কাছ থেকে শিক্ষা দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান।
মূসা তাকে বলল, সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে তা হতে আমাকে শিক্ষা দেবেন, এই শর্তে আমি আপনার অনুসরণ করব কি? সে বলল, আপনি কিছুতেই আমার সঙ্গে ধৈর্য ধারণ করে থাকতে পারবেন না, যে বিষয়ে আপনার জ্ঞানায়ত্ত নয় সে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করবেন কেমন করে? মূসা বলল, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। এবং আপনার কোন আদেশ আমি অমান্য করব না। সে বলল, “আচ্ছা আপনি যদি আমার অনুসরণ করবেনই তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না যতক্ষণ না আমি সে সম্বন্ধে আপনাকে কিছু বলি। তারপর উভয়ে চলতে লাগল, পরে তারা যখন নৌকায় আরোহণ করল, তখন সে ওটা বিদীর্ণ করে দিল। মূসা বলল, আপনি কি আরোহীদের নিমজ্জিত করে দেবার জন্যে এটা বিদীর্ণ করলেন? আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন।’ সে বলল, 'আমি বলিনি যে, আপনি আমার সঙ্গে কিছুতেই ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না?’ মূসা বলল, আমার ভুলের জন্য আমাকে অপরাধী করবেন না এবং আমার ব্যাপারে অত্যধিক কঠোরতা অবলম্বন করবেন না।
তারপর উভয়ে চলতে লাগল। চলতে চলতে ওদের সাথে এক বালকের সাক্ষাত হলে সে তাকে হত্যা করল। তখন মূসা বলল, আপনি কি এক নিস্পাপ জীবন নাশ করলেন, হত্যার অপরাধ ছাড়াই? আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন।’ সে বলল, আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সঙ্গে কিছুতেই ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না?’ মূসা বলল, এটার পর যদি আমি আপনাকে কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করি তবে আপনি আমাকে সঙ্গে রাখবেন না, আমার ওযর আপত্তির চুড়ান্ত হয়েছে। তারপর উভয়ে চলতে লাগল, চলতে চলতে তারা এক জনপদের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছে তাদের কাছে খাদ্য চাইল, কিন্তু তারা তাদের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করলো। তারপর তারা এক পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেল এবং সে এটাকে সুদৃঢ় করে দিল। মূসা বলল, আপনি তো ইচ্ছে করলে এটার জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন।’ সে বলল, এখানেই আপনার এবং আমার মধ্যে সম্পর্কছেদ হল; যে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করতে পারেন নি আমি তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছি।’
নৌকাটির ব্যাপার—এটা ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির, ওরা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত; আমি ইচ্ছা করলাম নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করতে। কারণ, তাদের সম্মুখে ছিল এক রাজা যে বলপ্রয়োগে সকল নৌকা ছিনিয়ে নিত। আর কিশোরটি—তার পিতামাতা ছিল মু’মিন। আমি আশঙ্কা করলাম যে, সে বিদ্রোহাচরণ ও কুফরীর দ্বারা তাদেরকে বিব্ৰত করবে। তারপরে আমি চাইলাম যে, ওদের প্রতিপালক যেন ওদেরকে তার পরিবর্তে এক সন্তান দান করেন, যে হবে পবিত্রতায় মহত্তর ও ভক্তি-ভালবাসায় ঘনিষ্ঠতর। আর ঐ প্রাচীরটি—এটা ছিল নগরবাসী দুই পিতৃহীন কিশোরের, এর নিম্নদেশে আছে ওদের গুপ্তধন এবং ওদের পিতা ছিল সকর্মপরায়ণ। সুতরাং আপনার প্রতিপালক দয়াপরবশ হয়ে ইচ্ছা করলেন যে, ওরা বয়ঃপ্রাপ্ত হউক এবং ওরা ওদের ধনভাণ্ডার উদ্ধার করুক। আমি নিজ থেকে কিছু করিনি, আপনি যে বিষয়ে ধৈর্যধারণে অপারক হয়েছিলেন, এটাই তার ব্যাখ্যা। (সূরা কাহাফঃ ৬০-৮২)
কোন কোন কিতাবী বলে যে, খিযির (عليه السلام)-এর কাছে যে মূসা (عليه السلام) গমন করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন মূসা (عليه السلام) ইবন মীশা ইবন ইউসুফ (عليه السلام) ইবন ইয়াকুব (عليه السلام) ইবন ইসহাক (عليه السلام) ইবন ইব্রাহীম আল খলীল (عليه السلام)। এ সব কিতাবীর অভিমতের সমর্থন করে যারা তাদের কিতাব ও বই-পুস্তক থেকে তথ্যাদি উদ্ধৃত করে থাকে, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন নূপ ইবন ফুআলা আল হেমইয়ারী আশ-শামী, আল বুকালী। কথিত আছে যে, তিনি ছিলেন দামিশকের অধিবাসী। তাঁর মাতা হচ্ছেন কাব আহবারের স্ত্রী। বাহ্যত কুরআনের পূর্বাপর বর্ণনা ও সর্বজন গৃহীত বিশুদ্ধ হাদীসের স্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মূসা (عليه السلام) ইবন ইমরানই হচ্ছেন বনী ইসরাঈলের কাছে প্রেরিত মূসা (عليه السلام)।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বলেন, সাঈদ ইবন জুবায়র (رضي الله عنه) বলেছেন—একদিন আমি ইবন আব্বাস। (رضي الله عنه)-কে বললাম যে, নূফ আল বুকালীর ধারণা যে, খিযির (عليه السلام)-এর সাথে যে মূসা (عليه السلام) সাক্ষাত করেছিলেন তিনি বনী ইসরাঈলের মূসা (عليه السلام) নন। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, “আল্লাহর দুশমন মিথ্যা বলেছে।” উবাই ইবন কাব (رضي الله عنه) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছেন যে, একদিন মূসা (عليه السلام) ইসরাঈলীদের কাছে বক্তব্য রাখছিলেন। এমন সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হল যে, মানব জাতির মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী কে? তিনি বললেন ‘আমি’। যেহেতু জ্ঞানকে তিনি আল্লাহ তাআলার দিকে সম্পর্কিত করেন নি তাই আল্লাহ তা’আলা তাঁকে ভৎসনা করলেন। তাঁর কাছে আল্লাহ্ তা’আলা এ মর্মে ওহী প্রেরণ করেন যে, দুই সমুদ্রের সংগমস্থলে আমার এক বান্দা রয়েছে যিনি তোমার চাইতে অধিক জ্ঞানী। মূসা (عليه السلام) বললেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমি কেমন করে তার কাছে পৌঁছতে পারব?” আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, একটি মাছ সাথে নিয়ে তা থলেতে পুরে নাও। যেখানেই মাছটি হারিয়ে যাবে, সেখানেই তাকে পাওয়া যাবে। তিনি একটি মাছ নিয়ে তা একটি থলে পুরে নিলেন। তারপর তিনি চলতে লাগলেন। তাঁর সাথে তার খাদিম ইউশা ইবন নূনও ছিলেন। যখন তারা শৈলশীলার কাছে পৌঁছলেন, তখন তারা তাতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। মাছটি লাফ দিয়ে থলে থেকে বের হয়ে গেল এবং সুড়ঙ্গের পথ করে সাগরে নেমে গেল।
আল্লাহ তা’আলা মাছের যাত্রাপথের পানি ঠেকিয়ে রাখলেন, যাতে সুড়ঙ্গের মত হয়ে গেল। মূসা যখন জাগলেন, তখন খাদিম মাছটি সম্বন্ধে তাকে অবহিত করতে ভুলে গেলেন এবং তারা বাকি দিন ও রাত পথ চলতে লাগলেন। পরদিন সকালে মূসা (عليه السلام) তার খাদিমকে বলেন, ‘আমাদের প্রাতঃরাশ আন, আমরা তো আমাদের এ সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। যে স্থানে পৌঁছার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-কে হুকুম দিয়েছিলেন সে স্থান অতিক্রম করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কোন ক্লান্তি বোধ করেননি। খাদিম মূসা (عليه السلام)-কে বললেন, “আপনি কি লক্ষ্য করেছেন আমরা যখন শিলাখণ্ডে বিশ্রাম করছিলাম তখন আমি মাছের কথা ভুলে গিয়েছিলাম? শয়তানই এটার কথা বলতে আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। মাছটি আশ্চর্যজনকভাবে নিজের পথ করে সাগরে নেমে যায়।” অর্থাৎ মাছটি পথ করে সমুদ্রে নেমে যাওয়ায় দু’জনই আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলেন। মূসা (عليه السلام) বললেন, “আমরা তো সেই স্থানটিরই অন্বেষণ করছিলাম।’
তারপর তাঁরা নিজেদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চললেন এবং পাথরটির কাছে গিয়ে পৌঁছলেন। তারা সেখানে একজন বস্ত্রাবৃত লোককে দেখতে পান। মূসা (عليه السلام) তাঁকে সালাম দিলেন, তখন ঐ ব্যক্তি অর্থাৎ খিযির (عليه السلام) বললেন, আপনার এ জনপদে সালাম আসল কোত্থেকে? মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘আমি মূসা।’ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘বনী ইসরাঈলের মূসা (عليه السلام)?’ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই। সত্যের যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে তা থেকে আমাকে শিক্ষা দেবেন এজন্য আমি আপনার কাছে এসেছি।’ খিযির (عليه السلام) বললেন, “হে মূসা (عليه السلام)! আল্লাহ্ তা’আলা তার জ্ঞান থেকে আমাকে একটি বিশেষ জ্ঞান প্রদান করেছেন, যা আপনার অজ্ঞাত। অনুরূপভাবে আপনাকে এমন একটি জ্ঞান দান করেছেন যা আমার অজ্ঞাত। তাই আপনি কিছুতেই আমার সঙ্গে ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারবেন না।”
হযরত মূসা (عليه السلام) খিযির (عليه السلام)-কে বললেন, “আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আপনার কোন আদেশ আমি অমান্য করব না।” খিযির (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-কে বললেন, ‘যদি আপনি আমার অনুকরণ করেনই, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না যতক্ষণ না আমি সে সম্বন্ধে আপনাকে কিছু বলি।’ তারপর উভয়ে সাগরের তীর ধরে চলতে লাগলেন এবং একটি নৌকার দেখা পেলেন। নৌকার মালিকদের সাথে পারাপারের ব্যাপারে আলোচনা করলেন। নৌকার মালিকগণ খিযির (عليه السلام)-কে চিনতে পারলেন এবং ভাড়া না নিয়েই তাদেরকে পার করে দিলেন। যখন তারা উভয়ে নৌকায় আরোহণ করলেন, খিযির (عليه السلام) কিছুক্ষণের মধ্যে কুঠার দ্বারা নৌকার একটি কাঠ খুলে ফেললেন। তখন মূসা (عليه السلام) তাঁকে বললেন, ‘এরা বিনাভাড়ায় আমাদেরকে পার করে দিলেন আর আপনি আরোহীদেরকে নিমজ্জিত করার জন্যে নৌকাটিকে বিদীর্ণ করে দিলেন! আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন!” তিনি মূসা (عليه السلام)-কে বললেন, “আমি কি আপনাকে বলিনি যে, আপনি আমার সাথে কিছুতেই ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না?” মূসা (عليه السلام) বললেন, “আমার ভুলের জন্য আমাকে অপরাধী ঠাওরাবেন না এবং আমার ব্যাপারে অত্যধিক কঠোরতা অবলম্বন করবেন না।”
রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেন, “প্রথম বারের প্রশ্নটি মূসা (عليه السلام) হতে ভুলক্রমে সংঘটিত হয়েছিল।” রসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেন, এমন সময় একটি চড়ুই পাখি এসে নৌকার এক পাশে বসল তারপর ঠোঁট দিয়ে পানি উঠাল। তখন খিযির (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-কে লক্ষ্য করে বললেন, “আল্লাহ্ তা’আলার জ্ঞানের তুলনায় আমার ও আপনার জ্ঞানের পরিমাণ হচ্ছে সাগর থেকে নেয়া চড়ুই পাখির এক বিন্দু পানির মত।” তারা উভয়ে নৌকা থেকে অবতরণের পর সাগরের কূল ঘেঁষে চলতে লাগলেন। অতঃপর খিযির (عليه السلام) এক বালককে দেখতে পেলেন। সে অন্যান্য বালকের সাথে খেলাধুলা করছিল। খিযির (عليه السلام) কিশোরটির মাথা ধরে টেনে ছিড়ে ফেললেন। এভাবে তাকে তিনি হত্যা করলেন। মূসা (عليه السلام) তখন তাঁকে বললেন, “আপনি কি এক নিস্পাপ জীবন নাশ করলেন, হত্যার অপরাধ ছাড়াই? আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন!” তিনি বললেন, “আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সঙ্গে কিছুতেই ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না?”
রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘এবারের প্রশ্নটি উত্থাপন ছিল পূর্বের বারের চেয়ে গুরুতর। তাই মূসা (عليه السلام) বললেন, এটার পর যদি আমি আপনাকে কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি তবে আপনি আমাকে সঙ্গে রাখবেন না। আমার ওযর আপত্তির চূড়ান্ত হয়েছে। অতঃপর উভয়ে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে তারা এক জনপদের আধিবাসীদের নিকট পৌঁছে তাদের কাছে খাদ্য চাইলেন। কিন্তু তারা এঁদের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। অতঃপর তারা তথায় এক পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেলেন, তখন খিযির (عليه السلام) তা সুদৃঢ় করে দিলেন। তখন মূসা (عليه السلام) বললেন, “তারা এমন একটি সম্প্রদায় যাদের কাছে আমরা আগমন করলাম, তারা আমাদেরকে না দিল খাদ্য, না করল মেহমানদারী, আপনি তো ইচ্ছে করলে এটার জন্যে পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন। খিযির (عليه السلام) বললেন, “এখানেই আপনার এবং আমার মধ্যে সম্পর্কছেদ হল। যে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করতে পারেন নি আমি তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছি।’
রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেন, “আমাদের এটা পছন্দনীয় ছিল যে, মূসা (عليه السلام) যদি ধৈর্যধারণ করতেন, তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাদের সম্বন্ধে আমাদেরকে আরও অনেক ঘটনা শুনাতেন। সাঈদ ইবন জুবায়র (رحمة الله) বলেন, উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখিত আয়াতাংশ (أوَكَانَ وَرَاۤءَهُم مَّلِكࣱ یَأۡخُذُ كُلَّ سَفِینَةٍ غَصۡبࣰا) [Surat Al-Kahf ৭৯] -এর স্থলে আব্দুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) পাঠ سفينة শব্দটির সাথে صالحة বিশেষণ সহকারে পাঠ করতেন। পুনরায় আয়াতাংশ (وَأَمَّا ٱلۡغُلَـٰمُ فَكَانَ ) -এর সাথে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) পড়তেন। (وَأَمَّا ٱلۡغُلَـٰمُ فَكَانَ أَبَوَاهُ مُؤۡمِنَیۡنِ ) শব্দটি যোগ করে পড়তেন। হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে যে, সে ছিল কাফির। বুখারী শরীফে সুফয়ান ইবন উয়ায়না (رضي الله عنه)-এর সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে। তবে এতে অতিরিক্ত রয়েছে, মূসা (عليه السلام) সফরে বের হয়ে পড়লেন। তার সাথে ছিলেন ইউশা ইবন নূন এবং তাদের সাথে ছিল একটি মাছ। অতঃপর তারা উভয়ে একটি পাথরের কাছে পৌঁছলেন এবং দুজনেই পাথরের নিকট অবতরণ করলেন। বর্ণনাকারী বলেন, ‘মূসা (عليه السلام) পাথরের উপর তার মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। পাথরের উপর ছিল একটি প্রস্রবণ, যাকে الحيلة বলা হত। কোন কিছুর মধ্যে ঐ প্রস্রবণের পানি পড়লে ঐ বস্তুটি জীবিত হয়ে যেত। ভুনা মাছটির উপরও উক্ত প্রস্রবণ থেকে পানি পড়েছিল। তাই মাছটি নড়ে উঠল, থলে থেকে বের হয়ে সমুদ্রে পড়ে গেল। অতঃপর যখন মূসা (عليه السلام) জেগে উঠলেন, তখন খাদিমকে বললেন, আমাদের নাশতা নিয়ে এস। আমরা তো আমাদের এ সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তারপর হাদীসটির বাকি অংশ বর্ননা করা হয়েছে। উক্ত হাদীসে আরো আছে, তিনি বলেন, নৌকার একপাশে একটি চড়ুই পাখি এসে বসল; সমুদ্রে তার ঠোঁট ডুবাল। তখন খিযির (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-কে বললেন, “আমার, আপনার এবং সমস্ত সৃষ্টিকুলের জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় এই চড়ুই পাখির সমুদ্রে ডুবানো ঠোঁটের মাধ্যমে সংগৃহীত এক বিন্দু পানির ন্যায় নগণ্য। আতঃপর পূর্ণ হাদীসটি বর্ণনা করেন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) অন্য একটি সূত্রেও সাঈদ ইবন জুবায়র (رضي الله عنه) হতে এ হাদীসটি বর্ণনা করেন। সাঈদ ইবন জুবায়র (رضي الله عنه) বলেন, একদিন আমরা আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর ঘরে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন তিনি বললেন, “তোমরা আমাকে যে কোন প্রশ্ন করতে পার।” আমি বললাম, হে আবু আব্বাস (رضي الله عنه)! আল্লাহ তা’আলা আপনার জন্যে আমাকে উৎসর্গ করে দিন, কূফাতে একজন বক্তা আছে, তাকে বলা হয় নূফ। তার ধারণা যে, খিযির (عليه السلام)-এর সাথে যার ঘটনা ঘটেছে তিনি বনী ইসরাঈলের মূসা (عليه السلام) নন। বর্ননাকারী আমরের মতে, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, “আল্লাহর দুশমন মিথ্যা বলেছে।” বর্ণনাকারী ইয়ালা (رحمة الله)-এর মতে, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, ‘আমাকে উবাই ইবন কা’ব (رضي الله عنه) বলেছেন যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আল্লাহর রাসূল মূসা (عليه السلام) একদিন জনগণকে নসীহত করছিলেন, তাতে চোখে পানি এসে গিয়েছিল এবং অন্তরসমূহ বিগলিত হয়ে গিয়েছিল। মূসা (عليه السلام) যখন স্থান ত্যাগ করছিলেন অমনি এক ব্যক্তি তাকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, “হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর যমীনে কি কেউ আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী রয়েছেন?” তিনি প্রতি উত্তরে বললেন “না”। জ্ঞানকে আল্লাহ তা’আলার প্রতি সম্পর্কিত না করায় আল্লাহ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-কে ভৎসনা করেন। মূসা (عليه السلام)-কে বলা হল, “হ্যাঁ রয়েছে।” মূসা (عليه السلام) বললেন, “হে আমার প্রতিপালক! তিনি কোথায় আছেন?” আল্লাহ তা’আলা বললেন, “দুই সমুদ্রের সংগমস্থানে।” মূসা (عليه السلام) বললেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি চিহ্ন নির্দেশ করুন যা দিয়ে আমি তাকে চিনে নিতে পারব।” তিনি বললেন, “যেখানে মাছটি তোমার নিকট থেকে পৃথক হয়ে যাবে।”
ইয়ালা (رحمة الله) বলেন, আল্লাহ তা’আলা বললেন, ‘একটি ভুনা মাছ সাথে নিয়ে নাও। যেখানেই তাতে প্রাণ সঞ্চার করা হবে সেখানেই তুমি খিযির (عليه السلام)-কে পাবে। মূসা (عليه السلام) একটি মাছ নিয়ে একটি থলে রাখলেন। অতঃপর আবার খাদেমকে বললেন, “আমি তোমাকে অন্য কোন দায়িত্ব দিয়ে কষ্ট দেব না, তুমি শুধু যেখানে মাছটি আমাদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে সে জায়গাটি সম্বন্ধে আমাকে অবহিত করবে।” খাদেম ইউশা (عليه السلام) বললেন, এটাতো আর তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, (وَإِذۡ قَالَ مُوسَىٰ لِفَتَىٰهُ)
‘স্মরণ কর, যখন মূসা (عليه السلام) আপন খাদেম ইউশা ইবন নূন-কে বললেন।’ সাঈদ (رضي الله عنه) ব্যতীত অন্য বর্ণনাকারী বর্ণনা করেন, ইউশা (عليه السلام) একটি পরিষ্কার জায়গায় পাথরের ছায়ায় অবস্থান করছিলেন এবং মূসা (عليه السلام) নিদ্রিত ছিলেন। মাছটি নড়ে উঠল, ইউশা (عليه السلام) মনে মনে বললেন, নিজে না জেগে ওঠা পর্যন্ত আমি মূসা (عليه السلام)-কে জাগাব না বরং জেগে উঠলে তার কাছে মাছের ঘটনাটি বলব। কিন্তু পরে তিনি তা বলতে ভুলে গেলেন। এদিকে মাছটি নড়াচড়া করতে করতে সাগরে নেমে গেল। আল্লাহর হুকুমে মাছের নির্গমন জায়গায় পানির চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। পাথরের মধ্যেও মাছের কিছু চিহ্ন রয়ে যায়। বর্ণনাকারী আমর সেই চিহ্নের প্রতি ইঙ্গিত করতে গিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তার পাশের দুইটি আঙ্গুলের দ্বারা বৃত্ত তৈরি করে দেখালেন।
অতঃপর মূসা (عليه السلام) বললেনঃ ( لَقَدۡ لَقِینَا مِن سَفَرِنَا هَـٰذَا نَصَبࣰا) [Surat Al-Kahf ৬২]
‘আমরা এ সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’ এ পর্যন্ত তোমার থেকে আল্লাহ তা’আলা ভ্রমণের কষ্ট দূর করে রেখেছিলেন। উভয়ে ফিরে চললেন এবং খিযির (عليه السلام)-কে পেয়ে গেলেন। উসমান ইবন আবু সুলাইমান (رحمة الله) বলেন, খিযির (عليه السلام) সমুদ্রের বুকে একটি সবুজ রংয়ের চাটাইয়ের উপর ছিলেন। সাঈদ (رضي الله عنه) বলেন, তিনি তার কাপড়ে আবৃত অবস্থায় ছিলেন। কাপড়ের একপ্রান্ত ছিল তাঁর দুই পায়ের নিচে এবং অপরপ্রান্ত ছিল তাঁর মাথার নিচে। মূসা (عليه السلام) তাঁকে সালাম করলেন। তখন তিনি চেহারা থেকে কাপড় সরালেন এবং বললেন, “এ অঞ্চলে কি সালামের প্রথা আছে? আপনি কে?” মূসা (عليه السلام) বললেন, “আমি মূসা।” তিনি বললেন, ‘বনী ইসরাঈলের মূসা?’ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ খিযির (عليه السلام) বললেন, “ব্যাপার কী? আপনি কেন এসেছেন?” মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘আপনি যে জ্ঞান শিক্ষা লাভ করেছেন তার থেকে আপনি আমাকে কিছু শিখাবেন এজন্যই আমি এখানে এসেছি।’ ‘আপনার হাতে তৌরাত রয়েছে তা কি যথেষ্ট নয়? হে মূসা (عليه السلام)! আপনার কাছে তো আল্লাহর ওহী আসে। আমার কাছে এক প্রকার জ্ঞান রয়েছে যা শিক্ষা করা আপনার পক্ষে সমীচীন নয়। অন্যদিকে আপনার কাছে এমন জ্ঞান রয়েছে যা আমাকে মানায় না।’
এমন সময় একটি পাখি তার ঠোঁট দ্বারা সমুদ্র থেকে এক বিন্দু পানি উঠাল। খিযির (عليه السلام) বললেন, “আল্লাহর শপথ, আল্লাহ্ তা’আলার জ্ঞানের তুলনায় আমার ও আপনার জ্ঞানের পরিমাণ হচ্ছে সমুদ্র থেকে উঠানো পাখির ঠোঁটের এ পানির বিন্দুর মত। যখন তারা উভয়ে নৌকায় আরোহণ করলেন তখন তারা দেখলেন, ছোট ছোট ফেরী নৌকা রয়েছে, যেগুলো লোকদেরকে নদী পারাপার করে। তারা খিযির (عليه السلام)-কে চিনতে পেরে বলে উঠলঃ “ইনি তো আল্লাহর পুণ্যবান বান্দা।” বর্ণনাকারী বলেন, আমরা সাঈদ (رضي الله عنه)-কে জিজ্ঞাসা করলামঃ ‘তিনি কি খিযির (عليه السلام)?’ তিনি বললেন ‘হ্যাঁ।’ তারা আরো বলল, ‘তাঁর কাছ থেকে আমরা ভাড়া গ্রহণ করব না।’ খিযির (عليه السلام) নৌকাটিকে ফুটো করে দিলেন এবং এতে একটি পেরেক ঠুকে দিলেন। মূসা (عليه السلام) বললেন, “আপনি কি আরোহীদেরকে ডুবিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে ফুটো করে দিলেন? আপনি তো একটা গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন।”
মুজাহিদ (رحمة الله) বলেন, امرا আয়াতে উল্লেখিত শব্দটির অর্থ হচ্ছে منكر অর্থাৎ অন্যায় কাজ। খিযির (عليه السلام) বললেন, “আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সঙ্গে কিছুতেই ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারবেন না?” প্রথম প্রশ্নটি ছিল ভুলক্রমে, দ্বিতীয়টি ছিল শর্ত হিসেবে আর তৃতীয়টি ছিল ইচ্ছাকৃত। মূসা (عليه السلام) বললেন, “আমার ভুলের জন্যে আমাকে অপরাধী ঠাওরাবেন না ও আমার ব্যাপারে অত্যধিক কঠোরতা অবলম্বন করবেন না। তারপর উভয়ে চলতে লাগলেন, চলতে চলতে তাঁদের সাথে এক বালকের সাক্ষাত হলে তিনি তাকে হত্যা করলেন। বর্ণনাকারী ইয়ালা (رحمة الله) বলেন, সাঈদ (رضي الله عنه) বলেছেন, ‘তিনি অনেকগুলো ছেলেকে খেলারত অবস্থায় পেলেন, তাদের মধ্য থেকে তিনি একটি চটপটে কাফির বালককে শোয়ালেন এবং ছুরি দ্বারা যবেহ করে ফেললেন। মূসা (عليه السلام) বললেন, “আপনি একটি নিস্পাপ জীবন নাশ করলেন, যে এখনও কোন নোংরা কাজ করেনি।” ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) আয়াতে উল্লেখিত نفسا ذاكية কে نفسا ذاكية مسلمة পাঠ করেছেন অর্থাৎ নিস্পাপ ও মুসলিম পবিত্ৰাত্মা বালক। অতঃপর উভয়ে চলতে লাগলেন এবং তাঁরা একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেলেন। তিনি এটাকে সুদৃঢ় করে দিলেন। বর্ণনাকারী হাত উঠিয়ে বলেন, খিযির (عليه السلام) এভাবে হাত উঠালেন এবং এতে প্রাচীরটি ঠিক হয়ে গেল। বর্ণনাকারী ইয়ালা (رحمة الله) বলেন, আমার ধারণা সাঈদ (رحمة الله) বলেছেন, “খিযির (عليه السلام) প্রাচীরটিকে আপন হাত দ্বারা স্পর্শ করলেন। অমনিতেই এটা সুদৃঢ় হয়ে গেল।” মূসা (عليه السلام) বললেন, আপনি তো ইচ্ছা করলে এটার জন্যে পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন, যা আমরা খেতে পারতাম।’ আয়াতে উল্লেখিতঃ وكان وراءهم (তাদের পেছনে) কে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) امامهم (তাদের সামনে) পড়েছেন। সাঈদ (رحمة الله) ব্যতীত অন্য মুফাসসিরগণ বলেন, উল্লেখিত বাদশার নাম ছিল ( هددبن بدد) (হাদাদ ইবন বাদাদ)। আর নিহত কিশোরটির নাম ছিল জায়সূর।
বাদশা’র সামনে দিয়ে যখন কোন খুঁত বিশিষ্ট নৌকা অতিক্রম করত তখন সে এটাকে খুঁতের কারণে ছেড়ে দিত এবং তারপর এ স্থান অতিক্রম করার পর মালিকের খুঁত সারিয়ে নিয়ে নৌকাকে কাজে লাগাত। তাফসীরকারদের কেউ কেউ বলেন, নৌকার ছিদ্রটি বন্ধ করা হয়েছিল কাঁচের দ্বারা। আবার কেউ কেউ বলেন, আলকাতরা দিয়ে। কিশোরটির পিতামাতা ছিলেন মু’মিন বান্দা কিন্তু কিশোরটি নিজে ছিল কাফির। খিযির (عليه السلام) বলেন, তাই আমি আশঙ্কা করেছিলাম যে, তার প্রতি বাৎসল্যের কারণে পিতামাতা তার ধর্মের অনুসারী হয়ে পড়বেন। এজন্যেই আমি চেয়েছিলাম যে, তাদেরকে প্রতিপালক যেন ওর পরিবর্তে এমন এক সন্তান দান করেন, যে হবে পবিত্রতায় মহত্তর ও ভক্তি-ভালবাসায় ঘনিষ্ঠতর। সাঈদ ইবন জুবায়র (رحمة الله)-এর ধারণা, সন্তানটি ছিল বালক, মেয়ে নয়।’ দাউদ ইবন আবু আসিম (رحمة الله) অসংখ্য তাফসীরকারের থেকে বর্ণনা করেন যে, সন্তানটি ছিল বালিকা।
আবদুর রাজ্জাক (رحمة الله) আব্দুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে এবং মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) উবাই ইবন কাব সূত্রে অন্যরূপ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
ইমাম যুহরী (رحمة الله) আব্দল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন। একদিন তিনি ও হুর ইবন কায়স ইবন হাসন ফারাবী মূসা (عليه السلام)-এর সঙ্গী সম্পর্কে বিতর্কে রত ছিলেন। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, তিনি ছিলেন খিযির (عليه السلام)।’ এমন সময় উবাই ইবন কাব (رضي الله عنه) তাদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) তাঁকে ডাকলেন এবং বললেন, আমি ও আমার এই সঙ্গী মূসা (عليه السلام)-এর সঙ্গী সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছি, যার সাথে সাক্ষাত করার জন্যে মূসা (عليه السلام) আল্লাহ্ তা’আলার নিকট পথের সন্ধান চেয়েছিলেন। আপনি কি এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কিছু শুনেছেন? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। এরপর হাদীসের বাকি অংশটুকু বর্ণনা করেন। হাদীসের বিস্তারিত বর্ণনা বিভিন্ন সনদ সহকারে সূরায়ে কাহাফের তাফসীরে আমি বর্ণনা করেছি। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।
আয়াতাংশ
فَلَمَّا جَاوَزَا قَالَ لِفَتَىٰهُ ءَاتِنَا غَدَاۤءَنَا لَقَدۡ لَقِینَا مِن سَفَرِنَا هَـٰذَا نَصَبࣰا
[Surat Al-Kahf ৬২]
এ উল্লেখিত ইয়াতীমদের সম্পর্কে সুহায়লী (رحمة الله) বলেন, তারা ছিল কাশিহ-এর দুই ছেলে আসরাম ও সুরাইম। আয়াতে উল্লেখিত কানয (كنز) ছিল অর্থ স্বর্ণ। এটা ইকরিমা (رحمة الله)-এর অভিমত। আবার আব্দুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, (كنز)-এর অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। অধিক গ্রহণীয় অভিমত অনুসারে এটার অর্থ হচ্ছে, জ্ঞানের বাণী সম্বলিত একটি স্বর্ণের পাত। বাযযার (رحمة الله) আয়ূর (رضي الله عنه)-এর সূত্রে একটি মারফু হাদীস বর্ণনা করেন এবং বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর কিতাবে যে (كنز)-এর কথা উল্লেখ করেছেন তা ছিল একটি নিরেট সোনার পাত।
তাতে লিখা ছিলঃ
عجبت لمن أيقن بالقدر كيف نصب و عجبت لمن ذكر النار لما ضحك وعجبت لمن ذكر الموت كيف غفل لا اله الا الله.
অর্থাৎ—“তকদীরে বিশ্বাসী লোক কী করে ব্যতিব্যস্ত হয়, সে জন্যে বিস্মিত হই, দোযখের কথা মনে রেখেও যে ব্যক্তি হাসতে পারে তার জন্যে আমি বিস্ময় বোধ করি; যে ব্যক্তি মৃত্যুর কথা স্মরণে রেখেও লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ থেকে গাফিল থাকে, তার জন্য বিস্মিত রোধ করি।”
অনুরূপভাবে হাসান বসরী (رحمة الله) ও জাফর সাদেক (رحمة الله) থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
আয়াতে উল্লেখিত ابو هما বলতে কারো কারো সপ্তম পূর্ব-পুরুষের, আবার কারো কারো মতে দশম পূর্ব-পুরুষের কথা বলা হয়েছে। যাই হোক, এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ পুণ্যবান লোকের বংশধরদের হেফাজত করে থাকেন।
আয়াতাংশ رحمة من ربك-এর দ্বারা বোঝা যায় যে, খিযির (عليه السلام) নবী ছিলেন। তিনি নিজের থেকে কিছুই করেননি। বরং যা করেছেন তাঁর প্রতিপালকের নির্দেশেই করেছেন। সুতরাং তিনি নবী ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি একজন রাসূল ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, ‘তিনি একজন ওলী ছিলেন। একটি বিরল মতে, তিনি একজন ফেরেশতা ছিলেন। এর চাইতে আশ্চর্যজনক কথা হচ্ছে যে, কেউ কেউ বলেন, তিনি ফিরআউনের পুত্র ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন যাহহাকের পুত্র যিনি হাজার বছর ধরে গোটা পৃথিবীতে রাজত্ব করে গেছেন।
ইবন জারীর তাবারী (رحمة الله) বলেন, “কিতাবীদের অধিকাংশের অভিমত হচ্ছে, তিনি ছিলেন আফরীদুনের যুগের লোক। আরো কথিত আছে যে, তিনি ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ যুল-কারনায়নের অগ্রগামী বাহিনীর সেনাপতি। আর এ যুলকুরনায়নকেই কেউ কেউ আফরীদুন ও যুল ফারাস বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ছিলেন, ইবরাহীম খলীল (عليه السلام)-এর যুগের লোক।’ কিতাবীরা আরো মনে করেন যে, “তিনি আবে-হায়াত’ পান করে অমর হয়ে গেছেন এবং আজও তিনি জীবিত আছেন।” কেউ কেউ বলেন, “ইবরাহীম (عليه السلام)-এর প্রতি যারা ঈমান আনয়ন করেছিলেন এবং বাবেল শহর থেকে ইবরাহীম (عليه السلام)-এর সাথে হিজরত করেছিলেন, তিনি তাদের কারোর সন্তান ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, তাঁর নাম ছিল মালকান। কেউ কেউ বলেন, তাঁর নাম ছিল, আরমিয়া ইবন খালকিয়া। কেউ কেউ বলেন, ‘লাহরাসিবের পুত্র সাবাসিবের আমলে তিনি একজন নবী ছিলেন। ইবন জারীর (رحمة الله) বলেন, আফরীদূন ও সাবাসিবের মধ্যে যুগ-যুগান্তরের ফারাক ছিল যা সম্পর্কে বংশ বৃত্তান্তের পারদর্শীদের কেউ অনবহিত থাকতে পারে না।
ইবন জারীর (رحمة الله) বলেন, বিশুদ্ধ অভিমত হল যে, তিনি আফরীদূনের যুগের লোক, যিনি মূসা (عليه السلام)-এর যুগ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। মূসা (عليه السلام)-এর নবুওতের কাল ছিল মনুচেহেরের আমল। আর মনুচেহের ছিলেন পারস্য সম্রাট আফরীদূনের পৌত্র এবং আবরাজের পুত্র। পিতামহ আফরীদূনের পর যুবরাজ মনুচেহের সম্রাট হন। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ। তিনিই প্রথম পরিখা খনন করেছিলেন এবং তিনিই প্রথম প্রত্যেক গ্রামে সর্দার নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকাল প্রায় ১৫০ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কথিত আছে যে, তিনি ছিলেন ইসহাক ইবন ইবরাহীমের অধঃস্তন বংশধর। তাঁর বহু বাগ্মিতাপূর্ণ সুন্দর সুন্দর বক্তৃতা ও উক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়, যা শ্রোতৃবর্গকে বিস্ময়াভিভূত করে। আর এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি ইবরাহীম খলীল (عليه السلام)-এর অধঃস্তন বংশধর ছিলেন। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
وَإِذۡ أَخَذَ ٱللَّهُ مِیثَـٰقَ ٱلنَّبِیِّـۧنَ لَمَاۤ ءَاتَیۡتُكُم مِّن كِتَـٰبࣲ وَحِكۡمَةࣲ ثُمَّ جَاۤءَكُمۡ رَسُولࣱ مُّصَدِّقࣱ لِّمَا مَعَكُمۡ لَتُؤۡمِنُنَّ بِهِۦ وَلَتَنصُرُنَّهُۥۚ قَالَ ءَأَقۡرَرۡتُمۡ وَأَخَذۡتُمۡ عَلَىٰ ذَ ٰلِكُمۡ إِصۡرِیۖ قَالُوۤا۟ أَقۡرَرۡنَاۚ قَالَ فَٱشۡهَدُوا۟ وَأَنَا۠ مَعَكُم مِّنَ ٱلشَّـٰهِدِینَ
[Surat Aal-E-Imran ৮১]
‘স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তা’আলা নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি আর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে, যখন একজন রাসূল আসবে তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি স্বীকার করলে? (সূরা আল ইমরানঃ ৮১)
অন্য কথায়, আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যেক নবী থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, তিনি তাঁর পরে আগত নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবেন ও তাঁকে সাহায্য করবেন। যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যমানায় খিযির (عليه السلام) জীবিত থাকতেন, তাহলে রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্য স্বীকার, তার সাথে মিলিত হওয়া ও তার সাহায্য করা ব্যতীত খিযির (عليه السلام)-এর কোন গত্যন্তর থাকত না। তিনি অবশ্যই ঐসব লোকের অন্তর্ভুক্ত হতেন যারা বদরের দিন রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পতাকাতলে সমবেত হয়েছিলেন। যেমনটি জিবরাঈল (عليه السلام) ও ফেরেশতাদের সর্দারগণ হয়েছিলেন। কিংবা তিনি রাসূল ছিলেন—যা কেউ কেউ বলেছেন; অথবা তিনি ফেরেশতা ছিলেন—যেমনি কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। খিযির (عليه السلام) নবী ছিলেন এবং এটিই সঠিক অভিমত। তিনি যাই হয়ে থাকুন না কেন, জিবরাঈল (عليه السلام) হচ্ছেন ফেরেশতাদের সর্দার এবং মূসা (عليه السلام) মর্যাদায় খিযির (عليه السلام)-এর তুলনায় শ্রেষ্ঠ। রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যমানায় যদি মূসা (عليه السلام) জীবিত থাকতেন, তবে রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর সাহায্য করা তার জন্যেও অপরিহার্য হত।
এমতাবস্থায় খিযির (عليه السلام) যদি ওলীই হয়ে থাকেন যেমনি অনেকেই মনে করে থাকেন। তবে তাঁর উম্মতভুক্ত হওয়াটা অধিকতর যুক্তিযুক্ত হতো। কিন্তু কোন হাসান পর্যায়ের কিংবা নির্ভরযোগ্য দুর্বল হাদীসেও পাওয়া যায় না যে, তিনি একদিনও রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে হাযির হয়েছিলেন কিংবা তার সাথে মিলিত হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে হাকীম (رحمة الله) কর্তৃক যে শোকবাণী সংক্রান্ত হাদীস বর্ণিত রয়েছে, তার সূত্র খুবই দুর্বল। পরবর্তীতে খিযির (عليه السلام) সম্বন্ধে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা হবে।
মূসা (عليه السلام)-এর কাহিনী সম্বলিত পরীক্ষার হাদীস
ইমাম আবু আবদুর রহমান নাসাঈ (رحمة الله) তাঁর ‘সুনানের’ কিতাবুত তাফসীরে কুরআন। মজীদের সূরায়ে তা-হার ৪০ নং আয়াতের তাফসীরে বা পরীক্ষার হাদীস বর্ণনা করেন।
আয়াতটি হচ্ছেঃ
( وَقَتَلۡتَ نَفۡسࣰا فَنَجَّیۡنَـٰكَ مِنَ ٱلۡغَمِّ وَفَتَنَّـٰكَ فُتُونࣰاۚ )
[Surat Ta-Ha ৪০]
“আর তুমি এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে; অতঃপর আমি তোমাকে দুশ্চিন্তা হতে মুক্তি দেই, আমি তোমাকে বহু পরীক্ষা করেছি।’ আর সে হাদীসটি হচ্ছে নিম্নরূপঃ
আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ (رحمة الله) হতে বর্ণিত। তিনি সাঈদ ইবন জুবায়র (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি একদিন وَفَتَنَّـٰكَ فُتُونࣰاۚ আয়াতাংশ এর তাফসীর প্রসঙ্গে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-কে প্রশ্ন করলেন, ‘ফুতুন কি? আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বললেন, “হে ইবন জুবায়র! দিন ফুরিয়ে আসছে فتون সম্বন্ধে একটি সুদীর্ঘ হাদীস রয়েছে। বর্ণনাকারী বললেন, পরদিন সকালে সে প্রতিশ্রুত ফুতুন সংক্রান্ত হাদীসটি শোনার জন্যে আমি আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর কাছে গেলাম। তিনি বললেনঃ ইবরাহীম (عليه السلام)-এর বংশে আল্লাহ তা’আলা যে নবীগণ ও রাজ-রাজড়ার উদ্ভব ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে ফিরআউন ও তার পরামর্শদাতারা আলোচনায় বসে। তাদের কেউ কেউ বলল, বনী ইসরাঈলরা এটা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ পোষণ করে না। তাই তারা এটার জন্যে অপেক্ষা করছে। তারা ধারণা করেছিল যে, ইউসুফ ইবন ইয়াকূব (عليه السلام) সেই প্রতিশ্রুত নবী। কিন্তু যখন তিনি ইনতিকাল করলেন, তখন তারা বলল, ইবরাহীম (عليه السلام)-কে এরূপ ওয়াদা দেয়া হয়নি।
ফিরআউন বলল, তোমাদের অভিমত কি? অতঃপর তারা পরামর্শ করল এবং এ কথার উপর একমত হল যে, ফিরআউন কিছু সংখ্যক লোককে বড় বড় ছুরিসহ পাঠাবে। তারা বনী ইসরাঈলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে যখনই কোন ছেলে সন্তান পাবে, তখনই তাকে হত্যা করবে। তারা কিছুদিন যাবত এরূপ করল। অতঃপর যখন তারা দেখল যে, বনী ইসরাঈলের বৃদ্ধরা মৃত্যুর কারণে এবং ছোটরা হত্যার কারণে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা বলাবলি করতে লাগল যে, এভাবে বনী ইসরাঈলরা ধ্বংস হয়ে গেলে যে সব দৈহিক শ্রম ও সেবার কাজ তারা করত তা ভবিষ্যতে কিবতীদেরকে করতে হবে, তাই তারা পুনরায় স্থির করল যে, এক বছর প্রতিটি ছেলে সন্তান হত্যা করা হবে এবং পরের বছর তাদের কাউকে হত্যা করা হবে না। নবজাতকগুলো বড় হয়ে বৃদ্ধদের মধ্যে যারা মারা যাবে তাদের স্থান পূরণ করবে। আর বৃদ্ধরা সংখ্যায় যাদের জীবিত রাখা হচ্ছে, তাদের চেয়ে অধিক হবে না। মোটকথা, প্রয়োজনীয় কর্মীদের সংখ্যা পূর্বের মত থাকবে, তাতে হত্যার দ্বারা কোন প্রকার অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে না। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে তারা একমত হল। যে বছর নবজাতকদের হত্যা করা হবে না, সে বছরই মূসা (عليه السلام)-এর মা হারূন (عليه السلام)-কে নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা হন এবং তিনি নিবিঘ্নে নবজাতক হারূন (عليه السلام)-কে জন্ম দেন। পরবর্তী বছর তিনি মূসা (عليه السلام)-কে গর্ভে ধারণ করেন। তাই তাঁর অন্তরে ভীতি ও দুশ্চিন্তার উদ্রেক হল। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, হে ইবন জুবায়র! এটা ছিল ‘ফুতুন বা পরীক্ষাসমূহের একটি। মাতৃগর্ভে থাকতেই আল্লাহর ইচ্ছায় মূসা (عليه السلام)-কে এই পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়।
আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-এর মায়ের কাছে ইলহাম করলেন যে, তুমি ভীত হবে না ও চিন্তাগ্রস্ত হবে না, আমি তাকে আবার তোমার কাছে ফেরত পাঠাব এবং তাকে রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত করব। আল্লাহ্ তা’আলা তখন তাকে নির্দেশ দিলেন যে, যখন তুমি তাকে প্রসব করবে তখন তাকে একটি সিন্দুকে পুরে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। যখন তিনি মূসা (عليه السلام)-কে প্রসব করেন তখন সে মতে কাজ করেন। সন্তান যখন মার কাছ থেকে দূরে সরে গেল, তখন তার কাছে শয়তান আগমন করল। মা মনে মনে বলতে লাগলেন, হায়! আমার ছেলেকে আমি কী করলাম। যদি আমার সামনে ছেলেকে যবেহ করা হত, আমি তাকে দাফন-কাফন করতে পারতাম। তাহলে ছেলেটিকে সাগরের প্রাণী ও মাছের খাদ্য হিসেবে নদীতে ফেলে দেয়া থেকে আমার কাছে অধিকতর প্রিয় হতো। পানির স্রোত সিন্দুকটিকে প্রায় নদীমুখে নিয়ে গেল, যেখান থেকে ফিরআউনের স্ত্রীর বাদীরা পানি উঠিয়ে নিয়ে যেতো। যখন তারা সিন্দুকটি দেখতে পেল, তখন এটা তারা উঠিয়ে নিল এবং খুলতে চাইল। তাদের একজন বলল, এটার ভেতরে যদি কোন সম্পদ থাকে আর আমরা এটা খুলি তাহলে এটাতে আমরা যা পাব ফিরআউনের স্ত্রী তা বিশ্বাস নাও করতে পারেন।’ সুতরাং তারা যেরূপ পেলো হুবহু সে অবস্থায় এটাকে ফিরআউনের স্ত্রীর কাছে নিয়ে হাযির করল। ফিরআউনের স্ত্রী যখন সিন্দুকটি খুললেন তাতে একটি নবজাতক শিশুকে দেখতে পেলেন এবং তার অন্তরে শিশুটির প্রতি এক অভূতপূর্ব স্নেহের উদ্রেক হল। অন্যদিকে মূসা (عليه السلام)-এর মা অস্থির হয়ে পড়লেন এবং তার মনে শুধু মূসা (عليه السلام)-এর স্মৃতিই ভাসতে লাগল। জল্লাদেরা যখন এ নবজাতকটির কথা শুনতে পেল তখন তারা তাকে যবেহ করার জন্যে ফিরআউনের স্ত্রীর কাছে ছুরি নিয়ে ছুটে আসল। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বললেন, হে ইবন জুবায়র! এটাও ছিল সে ফুতুন বা পরীক্ষাসমূহের অন্যতম।
ফিরআউনের স্ত্রী জল্লাদদের বললেন, ফিরআউন না আসা পর্যন্ত একে ছেড়ে দাও। এই একটি ছেলের জন্যে বনী ইসরাঈল সংখ্যায় বেড়ে যাবে না। তিনি আসলে আমি তার কাছ থেকে তাকে চেয়ে নেবো, যদি তিনি তা মঞ্জুর করেন, তাহলে এটা হবে তোমাদের একটা চমৎকার কাজ, আর যদি তিনি তাকে হত্যার নির্দেশ দেন, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ থাকবে না। তিনি তখন ফিরআউনের কাছে গেলেন এবং বললেন, এই শিশুটি আমার ও আপনার চোখ জুড়াবে। ফিরআউন বলল, তোমার জন্যে তা হতে পারে, কিন্তু আমার জন্যে নয়, আমার এটার কোন প্রয়োজন নেই। রসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, সে পবিত্র সত্তার শপথ! যার শপথ গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যদি ফিরআউন মূসা নবজাতককে নয়ন প্রীতিকর রূপে গ্রহণ করে নিত, যেমন তার স্ত্রী সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন, তাহলে তাকে আল্লাহ তা’আলা সুপথ প্রদর্শন করতেন যেমন তার স্ত্রীকে করেছিলেন কিন্তু সে তা থেকে বঞ্চিত থাকে। সুতরাং ফিরআউনের স্ত্রী তার আশে-পাশের প্রতিটি মহিলার কাছে লোক প্রেরণ করে একজন ধাত্রী তালাশ করতে লাগলেন। কিন্তু যে মহিলাই তাকে দুধ পান করাতে আসে কারো স্তন নবজাতক মূসা গ্রহণ করলেন না। তাতে ফিরআউনের স্ত্রী আশংকা করতে লাগলেন যে, হয়তো এই শিশুটি দুধ না খেয়ে মারাই যাবে। তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন।
অতঃপর তিনি এ আশায় তাকে বাজারে ও লোকালয়ে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন যে, হয়তো এই ধরনের কোন ধাত্রী পাওয়াও যাবে, যার স্তন শিশুটি গ্রহণ করবে। কিন্তু শিশুটি কারো স্তনই গ্রহণ করলেন না। অন্যদিকে মূসা জননী ব্যাকুল হয়ে মূসার বোনকে বললেন, তার পিছনে পিছনে যাও এবং খোঁজ নাও যে, তার কোন সংবাদ পাওয়া যায় কিনা, সে জীবিত আছে নাকি কোন জীব-জন্তু তাকে খেয়ে ফেলেছে। আর এসময় তিনি তাঁর সন্তান সম্পর্কে তাঁর প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতির কথাটি ভুলেই বসেছিলেন। দূর থেকে মূসা (عليه السلام)-এর বোন তার দিকে লক্ষ্য রাখছিলেন, কিন্তু লোকজন টের পায়নি। মূসার বোন দেখলেন, কোন ধাত্রীই মূসা (عليه السلام)-কে দুধ পান করাতে পারছে না। তখন তিনি অত্যন্ত খুশী হয়ে ধাত্রী অন্বেষণকারীদের বলতে লাগলেন, আমি তোমাদের এমন একটি পরিবারের সন্ধান দিতে পারি, যারা তাকে স্নেহ-মমতা দিয়ে সুচারুরূপে লালন-পালন করার দায়িত্ব নিতে পারে। তারা সব সময়ই তার হিতাকাঙ্খী হবে। তারা বলতে লাগল, তুমি কেমন করে জানতে পারলে যে, তারা তার হিতাকাঙ্খী হবে, তারা কি তাকে চিনে? এ ব্যাপারে তারা সন্দেহ করতে লাগল। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, হে ইবনে জুবায়র! এটাও ছিল সে পরীক্ষাসমূহের একটা।
মূসার বোন বললেন, তারা তার হিতাকাঙ্খী ও তার প্রতি সদয়। কেননা, তারা সম্রাটের শ্বশুর পক্ষের সন্তুষ্টি বিধান ও সম্রাটের কাছ থেকে উপকার লাভের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। তার কথায় তারা মুগ্ধ হয়ে মূসার বোনকে তার মায়ের কাছে প্রেরণ করল। তিনি মায়ের কাছে গিয়ে এ সংবাদ দিলেন। তখন তাঁর মা আসলেন। যখন তিনি তাঁকে আপন কোলে তুলে নিলেন, তখন তিনি মায়ের স্তন চুষতে আরম্ভ করেন ও তৃপ্তিসহকারে দুধ পান করেন। তখন একজন সংবাদদাতা ফিরআউনের স্ত্রীর কাছে গিয়ে এ সুসংবাদ দিলেন যে, আমরা আপনার ছেলের জন্যে ধাত্রী পেয়েছি। ফিরআউনের স্ত্রী মা ও শিশুকে ডেকে পাঠান। তারা তার কাছে গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি যখন তার প্রতি শিশুটির আকর্ষণ লক্ষ্য করলেন, তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি এখানে থেকে যাও এবং আমার এই সন্তানকে দুধ পান করাও। কেননা, সে আমার কাছে অতি প্রিয়। মা বললেন, আমার সন্তানাদি ও বাড়িঘর ছেড়ে আমি এখানে থাকতে পারি না, তাতে আমার সব কিছু বিনাশ হয়ে যাবে। যদি আপনি ভাল মনে করেন, তাহলে তাকে আমার কাছে সমর্পণ করতে পারেন, আমি তাকে নিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারি। সে আমার সাথে থাকবে। তার কল্যাণ সাধনে আমার কোন প্রকার ত্রুটি হবে না। আমি আমার ঘরবাড়ি ও সন্তানাদি ছেড়ে কোথাও থাকতে পারব না। মূসার মা ঐ মুহূর্তে আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি স্মরণ করে ফিরআউনের স্ত্রীর নিকট অনড় রইলেন এবং নিশ্চিত থাকলেন যে, আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন।
তারপর মূসার মা আপন সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। তখন থেকে আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-কে তাঁর মায়ের তত্ত্বাবধানে অতি উত্তম রূপে লালন-পালন করতে লাগলেন এবং তাঁকে ভাগ্য-নির্ধারিত পন্থায় তাকে হিফাজত করলেন। ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈল যেরূপ উপহাস ও জুলুমের শিকার হচ্ছিল তা কিছুটা লাঘব হল এবং তারা শহরের এক প্রান্তে বসবাস করতে লাগল। মূসা (عليه السلام) যখন আরো বেড়ে উঠলেন, তখন একদিন ফিরআউনের স্ত্রী মুসার মাকে বললেন, “একদিন আমাকে তুমি আমার ছেলেটি দেখাবে।” মূসার মা ছেলেকে দেখাবার জন্যে একটি দিন নির্ধারণ করেন। এদিকে ফিরআউনের স্ত্রী খাজাঞ্চী ধাত্রী ও আমলাদেরকে নির্দেশ দিলেন প্রত্যেকে যেন উপহারসহ তাঁর পুত্র মূসা (عليه السلام)-কে সংবর্ধনা জানায়। তিনি অন্য একজন বিশ্বস্ত কর্মচারীকে পাঠালেন, যাতে তাদের মধ্যে কে কি উপহার দেয় তার হিসাব রাখে।
মূসা (عليه السلام) মায়ের বাড়ি থেকে বের হবার পর হতে ফিরআউনের স্ত্রীর কাছে পর্যন্ত আসার পথে অসংখ্য উপহার ও উপটৌকন লাভ করেন। ফিরআউনের স্ত্রীর কাছে এসে পৌঁছলে তিনিও তাকে উপঢৌকনাদি প্রদান করলেন এবং অত্যন্ত খুশি হলেন। মূসা (عليه السلام)-এর মাকেও তার উত্তম সেবার জন্যে বহু টাকা-পয়সা প্রদান করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি মূসা (عليه السلام)-কে নিয়ে ফিরআউনের কাছে যাবো, যাতে করে তিনিও তাকে উপঢৌকন প্রদান করেন ও তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। যখন ফিরআউনের স্ত্রী মূসা (عليه السلام)-কে নিয়ে তার কোলে তুলে দিলেন, তখন মূসা ফিরআউনের দাড়ি ও মাটির দিকে আকর্ষণ করলেন। তখন ফিরআউনকে আল্লাহর শত্রু পথভ্রষ্ট পারিষদরা বলল, আপনার কি স্মরণ নেই যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবী ইবরাহীম (عليه السلام)-কে কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন? তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ইবরাহীমের একজন অধঃস্তন বংশধর আপনার উত্তরাধিকারী হবেন। তিনি আপনার উপর জয়লাভ করবেন ও আপনাকে পরাজিত করবেন। সুতরাং আপনি কসাই জল্লাদের নিকট কাউকে প্রেরণ করেন যাতে তারা এসে তাকে হত্যা করে ফেলে। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, হে ইবন জুবায়র! এটাও ছিল একটা পরীক্ষা।
ফিরআউনের স্ত্রী একথা শুনে ফিরআউনের কাছে দৌড়ে আসলেন এবং বললেন যে, শিশুটি আপনি আমাকে দান করেছেন, এর ব্যাপারে আপনার কী হয়েছে? ফিরআউন বলল, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না যে, এই শিশুটির ধারণা সে আমাকে পরাস্ত করবে ও আমার উপর বিজয়ী হবে। ফিরআউনের স্ত্রী বললেন, আপনি বরং তাকে পরীক্ষা করুন। চলুন আমরা এমন একটি কাজ করি যা থেকে সঠিক তথ্য বের হয়ে আসবে। দু’টি জ্বলন্ত অঙ্গার ও দুটি মুক্তা তার সামনে রেখে দিন যদি সে মুক্তা দু’টি ধরে এবং জ্বলন্ত অঙ্গার না ধরে, তাহলে বুঝতে হবে যে তার বোধশক্তি আছে। আর যদি জ্বলন্ত অঙ্গার দুটি ধরে এবং মুক্তা না ধরে, তাহলে বুঝতে হবে তার এখনও বোধোদয় হয়নি। কেননা বোধশক্তি সম্পন্ন কেউ মুক্তার উপর অঙ্গারকে অগ্রাধিকার দিতে পারে না। সে মতে দু’টি জ্বলন্ত অঙ্গার ও দুটি মুক্তা তার সামনে রাখা হল। তিনি জ্বলন্ত অঙ্গার ধরলেন। ফিরআউন তার হাত পুড়ে যাবে এ ভয়ে তার হাত থেকে অঙ্গারগুলো সরিয়ে নিল। ফিরআউনের স্ত্রী বললেন, আপনি কি লক্ষ্য করছেন না?
শিশু মূসা মুক্তা ধরার জন্যে ইচ্ছে করেছিলেন কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তা থেকে তাকে ফিরিয়ে রাখলেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর সিদ্ধান্ত কার্যকরী করেই থাকেন। মূসা (عليه السلام) যখন যৌবনে পদার্পণ করলেন, তখন ফিরআউন সম্প্রদায়ের কারো পক্ষে বনী ইসরাঈলের প্রতি কোনরূপ জুলুম বা কটাক্ষ করার উপায় ছিল না। এখন বনী ইসরাঈল পুরোপুরি বিরত থাকে। একদিন মূসা (عليه السلام) শহরের এক প্রান্ত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, অমনি দেখলেন যে, দুইটি লোক একে অপরের সাথে ঝগড়া করছে। এদের একজন কিবতী ও অন্য একজন ইসরাঈলী। মূসা (عليه السلام)-কে দেখে ইসরাঈলীটি তার কাছে কিবতীর বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করল। তাতে মূসা (عليه السلام) অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। কেননা, কিবতীটি ইসরাঈলীদের মধ্যে মূসা (عليه السلام)-এর অবস্থান এবং তিনি ইসরাঈলীদের হিফাজত করে থাকেন তা জানতো। যদিও অন্য কারো তা জানা ছিল না। তখন মূসা (عليه السلام) কিবতীটিকে একটি ঘুষি দিলেন। ফলে সে মারা গেল। ইসরাঈলী ও আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ এই হত্যার ব্যাপারটি দেখতে পায়নি। যখন লোকটি মারা গেল, তখন মূসা (عليه السلام) বললেন,
( هَـٰذَا مِنۡ عَمَلِ ٱلشَّیۡطَـٰنِۖ إِنَّهُۥ عَدُوࣱّ مُّضِلࣱّ مُّبِینࣱ)
[Surat Al-Qasas ১৫]
অর্থাৎ—এটা শয়তানের কাণ্ড! সে তো প্রকাশ্য শত্রু ও বিভ্রান্তকারী। (কাসাসঃ ১৫)
অতঃপর তিনি বলেনঃ
قَالَ رَبِّ إِنِّی ظَلَمۡتُ نَفۡسِی فَٱغۡفِرۡ لِی فَغَفَرَ لَهُۥۤۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِیمُ قَالَ رَبِّ بِمَاۤ أَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ فَلَنۡ أَكُونَ ظَهِیرࣰا لِّلۡمُجۡرِمِینَ فَأَصۡبَحَ فِی ٱلۡمَدِینَةِ خَاۤىِٕفࣰا یَتَرَقَّبُ فَإِذَا ٱلَّذِی ٱسۡتَنصَرَهُۥ بِٱلۡأَمۡسِ یَسۡتَصۡرِخُهُۥۚ قَالَ لَهُۥ مُوسَىٰۤ إِنَّكَ لَغَوِیࣱّ مُّبِینࣱ[Surat Al-Qasas ১৬ – ১৮]
অর্থাৎ, সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো আমার নিজের প্রতি জুলুম করেছি। সুতরাং আমাকে ক্ষমা কর। অতঃপর তাকে ক্ষমা করলেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সে আরো বলল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি যেহেতু আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছ, আমি কখনও অপরাধীদের সাহায্যকারী হবো না। অতঃপর ভীত সতর্ক অবস্থায় সেই নগরীতে তার প্রভাত হল। (সূরা কাসাসঃ ১৬-১৮)
ফিরআউনের কাছে তার সম্প্রদায় সংবাদ পৌঁছাল যে, বনী ইসরাঈলরা ফিরআউন সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। হে ফিরআউন! আমাদের জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ করুন, আমরা তাদেরকে ক্ষমা করব না। ফিরআউন বলল, হত্যাকারীকে তোমরা খুঁজে বের করে দাও, সাক্ষী উপস্থিত করো। কেননা, সম্রাট তার সম্প্রদায়কে ভালবাসলেও বিনা সাক্ষ্য-প্রমাণে তাদের জন্যে কাউকে হত্যা করা তার পক্ষে সমুচিত হবে না। সুতরাং তাকে খোঁজ করে বের কর; আমি এর প্রতিশোধ নেব। তারা খুঁজতে লাগল কিন্তু তারা কোন প্রমাণ খুঁজে পেল না। পরের দিন মূসা (عليه السلام) উক্ত ইসরাঈলীকে দেখতে পেলেন, সে অন্য একজন কিবতীর সাথে ঝগড়া করছে। মূসা (عليه السلام)-কে দেখে সে পূর্বের দিনের মত কিবতীটির বিরুদ্ধে মূসা (عليه السلام)-এর কাছে ফরিয়াদ করল। মূসা (عليه السلام) অগ্রসর হলেন। কিন্তু আগের দিন যেই ঘটনা ঘটে গেছে তার জন্য খুবই লজ্জিত ছিলেন এবং আজকের দৃশ্যও অপছন্দ করতে লাগলেন। এদিকে ইসরাঈলীটি খুবই রাগান্বিত হয়ে কিবতীকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল। গতদিনের ও আজকের কাজের জন্য মূসা (عليه السلام) ইসরাঈলীকে লক্ষ্য করে বললেনঃ انك لغوي منين অর্থাৎ তুমি তো স্পষ্টই একজন বিভ্রান্ত ব্যক্তি।
ইসরাঈলীটি মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি তাকাল। মূসা (عليه السلام)-এর কথা শুনে এবং আগের দিনের ন্যায় রাগান্বিত অবস্থায় দেখে সে ঘাবড়ে গেলো এবং ভয় করতে লাগলো যে, তাকে স্পষ্টই একজন বিভ্রান্ত ব্যক্তি বলার পর হয়ত মূসা (عليه السلام) তাকেই আক্রমণ করতে পারেন। অথচ তিনি কিবতীকে আক্রমণ করতেই উদ্যত ছিলেন। ইসরাঈলীটি মূসা (عليه السلام)-কে লক্ষ্য করে বললঃ হে মূসা। গতকাল তুমি যেমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছ, সেভাবে আমাকেও কি হত্যা করতে চাও? তাকে হত্যা করার জন্যে মূসা (عليه السلام) আক্রমণ করছেন ভেবেই সে এ কথাটি বলল। ততক্ষণে তারা দু’জন ঝগড়া থেকে ক্ষান্ত হল। কিন্তু কিবতীটি তার সম্প্রদায়ের কাছে ইসরাঈলীর মুখে শোনা হত্যা তথ্যটি জানিয়ে দিল। এই কথা শুনে ফিরআউন জল্লাদদের মূসা (عليه السلام)-কে হত্যার জন্যে প্রেরণ করল। ফিরআউন প্রেরিত জল্লাদরা রাজপথ ধরে ধীর গতিতে মূসা (عليه السلام)-এর দিকে অগ্রসর হতে লাগল। মূসা (عليه السلام) তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল এরূপ কোন আশংকা তাদের ছিল না। অতঃপর মূসা (عليه السلام)-এর দলের একজন লোক শহরের প্রান্ত থেকে সংক্ষিপ্ত পথ ধরে তাদের পূর্বেই মূসা (عليه السلام)-এর কাছে পৌঁছে এ সংবাদটি দিল। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, হে ইবন জুবায়র (رضي الله عنه)! মূসা (عليه السلام)-এর জন্য এটাও ছিল একটি পরীক্ষা।
মূসা (عليه السلام) তখন মাদায়ান শহরের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ইতিপূর্বে মূসা (عليه السلام) এ ধরনের কোন পরীক্ষার শিকার হননি এবং এ রাস্তায় চলাচল করেন নি। কাজেই এই রাস্তা ছিল তার অপরিচিত। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার ওপর ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও অটল ভরসা। তিনি বলেছিলেন
( عَسَىٰ رَبِّیۤ أَن یَهۡدِیَنِی سَوَاۤءَ ٱلسَّبِیلِ)
[Surat Al-Qasas ২২]
আশা করি আমার প্রতিপালক আমাকে সরল পথ প্রদর্শন করবেন।
এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছেঃ
(وَلَمَّا وَرَدَ مَاۤءَ مَدۡیَنَ وَجَدَ عَلَیۡهِ أُمَّةࣰ مِّنَ ٱلنَّاسِ یَسۡقُونَ وَوَجَدَ مِن دُونِهِمُ ٱمۡرَأَتَیۡنِ تَذُودَانِۖ )
[Surat Al-Qasas ২৩]
অর্থাৎ—যখন সে মাদায়ানের কূপের নিকট পৌঁছল, দেখল একদল লোক তাদের পশুগুলোকে পানি পান করাচ্ছে এবং ওদের দুটি স্ত্রীলোক তাদের পশুগুলোকে আগলাচ্ছে অর্থাৎ ছাগলগুলোকে।
মূসা (عليه السلام) তাদের দুজনকে বললেন, তোমাদের কী ব্যাপার? তোমরা পৃথক হয়ে বসে আছ, লোকজনের সাথে পশুগুলোকে পানি পান করাচ্ছ না? তারা দু’জন বললেন, ‘জনতার ভিড় ঠেলার শক্তি আমাদের নেই। আমরা তাদের পান করাবার পর উচ্ছিষ্ট পানির অপেক্ষা করছি।’ মূসা (عليه السلام) তাদের দুজনের বকরীগুলোকে পানি পান করালেন। তিনি বালতি দিয়ে এত বেশি পানি উঠাতে সক্ষম হলেন যে, তিনিই রাখালদের অগ্রবর্তী হয়ে গেলেন। এরপর দু’জন মহিলা তাদের বকরীগুলো নিয়ে তাদের বৃদ্ধ পিতার কাছে পৌঁছলেন। অন্যদিকে মূসা (عليه السلام) গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিলেন এবং বলতে লাগলেনঃ
( رَبِّ إِنِّی لِمَاۤ أَنزَلۡتَ إِلَیَّ مِنۡ خَیۡرࣲ فَقِیرࣱ)
[Surat Al-Qasas ২৪]
অর্থাৎ—“হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবে আমি তার কাঙ্গাল।” আজ বকরীগুলোকে নিয়ে দেরি না করে দ্রুত পৌঁছায় তাদের পিতার কাছে কেমন কেমন ঠেকছিল। তাই বললেনঃ আজকে তোমাদের ব্যাপার কী? তখন তারা দু’জনেই মূসা (عليه السلام) সম্বন্ধে তাদের পিতাকে অবহিত করল। তাকে ডেকে আনার জন্যে পিতা একজনকে মূসা (عليه السلام)-এর কাছে পাঠালেন। তাদের একজন মূসা (عليه السلام)-এর কাছে গিয়ে তাঁকে ডেকে আনলেন। মূসা (عليه السلام) যখন মহিলাদের পিতার সাথে আলোচনা করলেন, তখন তিনি মূসা (عليه السلام)-কে অভয় দিয়ে বললেনঃ
(ف نَجَوۡتَ مِنَ ٱلۡقَوۡمِ ٱلظَّـٰلِمِینَ)
[Surat Al-Qasas ২৫]
অর্থাৎ—তুমি জালিম সম্প্রদায়ের কবল হতে বেঁচে গিয়েছ। আমাদের এখানে ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের কোন কর্তৃত্ব নেই। আমরা তার রাজত্বে বাস করি না।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(قَالَتۡ إِحۡدَىٰهُمَا یَـٰۤأَبَتِ ٱسۡتَـٔۡجِرۡهُۖ إِنَّ خَیۡرَ مَنِ ٱسۡتَـٔۡجَرۡتَ ٱلۡقَوِیُّ ٱلۡأَمِینُ)
[Surat Al-Qasas ২৬]
অর্থাৎ—“তাদের একজন বলল, হে পিতা! তুমি তাকে মজুর নিযুক্ত কর। কারণ, তোমার মজুর হিসাবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী—বিশ্বস্ত।” পিতাকে তার মর্যাদাবোধ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য করল যে, তুমি কেমন করে জানলে যে, সে শক্তিশালী এবং আমানতদার? মেয়েটি বলল, তাঁর শক্তির বিষয়ে প্রমাণ এই যে, পানি পান করানোর ক্ষেত্রে বালতি টানার ব্যাপারে এর চেয়ে অধিক শক্তিশালী আমি কাউকে দেখিনি। আমানতদারীর বিষয়ে প্রমাণ এই যে, আমি যখন তাঁর কাছে গিয়ে পরিচয় দিলাম, তখন তিনি একবার আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। যখন তিনি আঁচ করতে পারলেন আমি একজন মহিলা, তখন তিনি তাঁর মাথা নীচু করলেন। আপনার সংবাদ তাঁর কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি আর মাথা উঠিয়ে তাকাননি। অতঃপর আমাকে বললেন, তুমি আমার পেছনে চলবে এবং রাস্তার নির্দেশনা দেবে। তাঁর এ কাজের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তিনি আমানতদার। পিতার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল, মেয়ের কথার সত্যতাও প্রমাণিত হল এবং মেয়ের বক্তব্য অনুযায়ী মূসা (عليه السلام) সম্বন্ধে তিনি তাঁর অভিমত নির্ধারণ করলেন। তিনি তখন মূসা (عليه السلام)-কে উদ্দেশ করে বললেনঃ
قَالَ إِنِّیۤ أُرِیدُ أَنۡ أُنكِحَكَ إِحۡدَى ٱبۡنَتَیَّ هَـٰتَیۡنِ عَلَىٰۤ أَن تَأۡجُرَنِی ثَمَـٰنِیَ حِجَجࣲۖ فَإِنۡ أَتۡمَمۡتَ عَشۡرࣰا فَمِنۡ عِندِكَۖ وَمَاۤ أُرِیدُ أَنۡ أَشُقَّ عَلَیۡكَۚ سَتَجِدُنِیۤ إِن شَاۤءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّـٰلِحِینَ[Surat Al-Qasas ২৭]
‘আমি আমার এই কন্যা দু’টির একটি তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করবে। যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, সে তোমার ইচ্ছে। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাহেতো তুমি আমাকে সদাচারী পাবে।’ (সূরা কাসাসঃ ২৭)
তিনি এ প্রস্তাবে রাযী হলেন। আট বছর কাজ করা ছিল মূসা (عليه السلام)-এর উপর অপরিহার্য। আর দুই বছর ছিল তার পক্ষ থেকে অঙ্গীকার। আল্লাহ্ তা’আলা তাকে পূর্ণ দশ বছরের মেয়াদ পালনের তাওফীক দেন। সাঈদ ইবন জুবায়র (رضي الله عنه) বলেন, একদিন এক খৃস্টান পণ্ডিত আমার সাথে সাক্ষাৎ করে বললেন, তুমি কি জান, মূসা (عليه السلام) কোন্ মেয়াদটি পূর্ণ করেছিলেন?’ তখন আমি জানতাম না, তাই বললাম, ‘না, আমি জানি না।’ এরপর আমি আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং এ সম্পর্কে আমি তার সাথে আলোচনা করলাম। তিনি বললেন, ‘তুমি কি জান না যে, আট বছর পূর্ণ করা আল্লাহর নবীর উপর ওয়াজিব ছিল। তিনি কোনক্রমেই তার থেকে কম করতে পারতেন না। তুমি জেনে রেখ, আল্লাহ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-এর দ্বারা ওয়াদা মুতাবিক দশ বছরের মেয়াদ পূরণ করান।’ অতঃপর আমি উক্ত খৃস্টানের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে সংবাদটি দিলাম, তখন সে বলল, ‘তোমাকে এ ব্যাপারে যে সংবাদ দিয়েছে সে কি তোমার থেকে বেশি জ্ঞানী?’ উত্তরে আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, তিনি শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগণ্য।’
মূসা (عليه السلام) যখন তাঁর পরিবার নিয়ে রওয়ানা হলেন, তখন আগুন, লাঠি ও হাতের মু’জিযা প্রকাশিত হল— যা আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনুল করীমে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর মূসা (عليه السلام) নিহত ব্যক্তি ও মুখের জড়তা সম্পর্কে ফিরআউন সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যে আশঙ্কা পোষণ করতেন, সে সম্বন্ধে তিনি আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে ফরিয়াদ করেন। মুখের জড়তা অনর্গল কথাবার্তা বলার ব্যাপারে কিছুটা অন্তরায় সৃষ্টি করত। তাই তিনি তাঁর প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করলেন যেন আল্লাহ তা’আলা তার ভাই হারূনের মাধ্যমে তাঁর সাহায্য করেন। তাঁর পক্ষ থেকে হারূন (عليه السلام) প্রাঞ্জল ভাষায় জনগণের সাথে কথা বলেন, যেখানে মূসা (عليه السلام) তাদের সাথে অনর্গল কথা বলতে অপারক। আল্লাহ্ তা’আলা তার দরখাস্ত মঞ্জুর করলেন। তার মুখের জড়তা দূর করে দিলেন, হারূন (عليه السلام)-এর কাছে ওহী প্রেরণ করলেন ও তাকে হুকুম দিলেন যেন তিনি তার ভাই মূসা (عليه السلام)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। মূসা (عليه السلام) আপন লাঠিসহ ফিরে আসলেন। শেষ পর্যন্ত হারূন (عليه السلام)-এর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়।
অতঃপর দু’জন একত্রে ফিরআউনের কাছে গমন করলেন এবং তার ফটকে বহুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করলেন কিন্তু তাদেরকে অনুমতি দেয়া হল না। কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করে তাদেরকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হল। তারা বললেন, আমরা তোমার প্রতিপালকের দূত। ফিরআউন বলল, ‘তোমাদের প্রতিপালক কে?’ তাঁরা তার উত্তর প্রদান করেন, ‘যার বর্ণনা কুরআনুল করীমে রয়েছে।’ ফিরআউন বলল, ‘তোমরা কী চাও?’ প্রসঙ্গক্রমে সে ইত্যবসরে হত্যার কথাও উল্লেখ করল। হত্যার ব্যাপারে ওযর পেশ করে মূসা (عليه السلام) বলেন, ‘আমি চাই যে, তুমি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং বনী ইসরাঈলকে আমার সাথে যেতে দেবে।’ ফিরআউন তা অস্বীকার করল এবং বলল, ‘যদি তুমি সত্যবাদী হও তাহলে কোন মু’জিযা প্রদর্শন কর।’ তখন তিনি তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলেন। অমনি তা একটি বিরাট অজগরে পরিণত হল, যা বিরাট হা মেলে ফিরআউনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়। ফিরআউন যখন দেখল অজগরটি তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সে ভয় পেয়ে গেল এবং সিংহাসন থেকে লাফিয়ে পড়ল। মূসা (عليه السلام)-এর কাছে এটাকে ফিরিয়ে রাখার জন্যে ফরিয়াদ করতে লাগল। তখন মূসা (عليه السلام) তা-ই করলেন। অতঃপর মূসা (عليه السلام) তার হাত বগলের নীচ থেকে বের করলেন। ফিরআউন এটাকে শুভ্ৰসমুজ্জ্বল নির্দোষ ও শ্বেত রোগে আক্রান্ত নয় দেখতে পেল। তিনি আবার হাত ভিতরে নিয়ে নিলেন। এটা অমনি পূর্বের রঙ ধারণ করল। ফিরআউন যা দেখল তা নিয়ে তার পারিষদবর্গের সাথে সলাপরামর্শ করল। তখন তারা বললঃ
( هَـٰذَ ٰنِ لَسَـٰحِرَ ٰنِ یُرِیدَانِ أَن یُخۡرِجَاكُم مِّنۡ أَرۡضِكُم بِسِحۡرِهِمَا وَیَذۡهَبَا بِطَرِیقَتِكُمُ ٱلۡمُثۡلَىٰ)
[Surat Ta-Ha ৬৩]
‘এ দু’জন অবশ্যই জাদুকর, তারা চায় তাদের জাদু দ্বারা তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বের করে দিতে এবং তোমাদের উৎকৃষ্ট জীবন ব্যবস্থা ধ্বংস করতে।’
অর্থাৎ তোমাদের রাজত্ব এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে তোমাদেরকে বিতাড়িত করতে। এভাবে মূসা (عليه السلام) যা চেয়েছিলেন ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গ তার কিছুই দিতে রাযী হল না। পারিষদরা ফিরআউনকে পরামর্শ দিল, “আপনার রাজত্বে জাদুকরের অভাব নেই, কাজেই সকল জাদুকর একত্রিত হবার জন্যে আপনি নির্দেশ দেন, যাতে তারা তাদের দুজনের উপস্থাপিত জাদুকে পরাজিত করতে পারে।” অতঃপর ফিরআউন বিভিন্ন শহরে জাদুকর সহকারী পাঠাল, যাতে তারা উঁচুমানের জাদুকরদের ডেকে আনে। যখন তারা ফিরআউনের কাছে আসল তখন বলতে লাগল, ‘কি দিয়ে তিনি জাদু দেখান?’ পারিষদবর্গ বলল, ‘সাপ দিয়ে।’ তখন তারা বলল, ‘আল্লাহর শপথ, তাহলে তারা উভয়ে আমাদের উপর জয়লাভ করতে পারবে না। কেননা, পৃথিবীতে এমন কোন ব্যক্তি নেই, যে আমাদের ন্যায় সাপ, রশি ও লাঠি দিয়ে আমাদের চাইতে উত্তম জাদু দেখাতে পারে। তবে যদি আমরা তাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারি, তাহলে আমাদের পুরস্কার কী হবে?’ ফিরআউন তাদেরকে বলল, ‘তাহলে তোমরা আমার নৈকট্য লাভকারী ও বিশিষ্ট সভাষদবর্গের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর তোমরা যা চাইবে তা-ই আমি তোমাদেরকে দেবো।’ এভাবে তারা ফিরআউন থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করল ও উৎসবের দিন নির্ধারিত করল, যে দিন পূর্বাহে জনগণকে সমবেত করা হবে।
সাঈদ ইবন জুবায়র (رضي الله عنه) বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) আমার কাছে বর্ণনা করেন, উৎসবের দিনেই আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-কে ফিরআউন ও তার জাদুকরদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করেছিলেন। আর সেই দিনটি ছিল আশুরার দিন। যখন তারা একটি মাঠে সমবেত হলো, তখন লোকজন বলাবলি করতে লাগল—‘চল, আজ আমরা তাদের এই প্রতিযোগিতা দেখার জন্যে উপস্থিত হই এবং উপহাস ছলে বলতে লাগল, যদি নতুন জাদুকররা (মূসা ও হারূন) জয়লাভ করে তাহলে আমরা তাদের অনুসরণ করবো।’ জাদুকরগণ বলল, ‘হে মূসা! হয় তুমি প্রথমে নিক্ষেপ কর, নতুবা আমরাই প্রথমে নিক্ষেপ করি।’ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘বরং তোমরাই নিক্ষেপ কর।’ তখন তারা তাদের দড়ি ও লাঠি নিক্ষেপ করল ও বলতে লাগল, ‘ফিরআউনের ইযযতের শপথ, আমরাই জয়ী হব।’ মূসা (عليه السلام) তাদের জাদু প্রত্যক্ষ করলেন ও তাতে তিনি তাঁর অন্তরে কিছু ভীতি অনুভব করলেন। তাঁর কাছে আল্লাহ্ তা’আলা ওহী পাঠালেন, ‘হে মূসা! তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর।’ যখন তিনি তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলেন, তখন তা একটি বিরাট অজগরে পরিণত হল, যা হা করে থাকে। সে লাঠি ও দড়িগুলোকে একত্র মিশিয়ে সবগুলোকে তার মুখে পুরতে লাগল। এমনকি কোন লাঠি বা দড়িই অবশিষ্ট রইল না। জাদুকররা যখন ঘটনার যথার্থতা বুঝতে পারল, তখন তারা বলতে লাগল, ‘মূসা (عليه السلام)-এর ব্যাপারটি যদি জাদু হত তাহলে আমাদের জাদুকে এটা কখনও গ্রাস করতে পারত না। এটা নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে। কাজেই আমরা আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি ও মূসা (عليه السلام) যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করলাম, আমরা পূর্বে যা কিছু পাপ করেছি তার থেকে তওবা করলাম।’ এভাবে আল্লাহ তা’আলা উক্ত জনপদে ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের শক্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন।
সত্য প্রতিষ্ঠিত হল এবং তাদের সমস্ত কার্যকলাপ মিথ্যা প্রতিপন্ন হল। তারা পরাভূত হল ও অপদস্থ হল। অন্যদিকে ফিরআউনের স্ত্রী ছিন্ন বসন পরিহিতা অবস্থায় বের হলেন এবং ফিরআউন ও ফিরআউনীদের বিরুদ্ধে মূসা (عليه السلام)-এর সাহায্যের জন্যে আল্লাহর কাছে দুআ করতে লাগলেন। ফিরআউনের গোত্রের যারা তাকে দেখল তারা মনে করতে লাগল যে, তিনি ফিরআউন ও ফিরআউনীদের জন্যে সহানুভূতি প্রদর্শনার্থে ছিন্ন বসন পরেছেন। আসলে তার সমস্ত চিন্তা-ভাবনা ছিল মূসা (عليه السلام)-এর জন্যেই। মূসা (عليه السلام)-এর সাথে কৃত ফিরআউনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বিষয়টি দীর্ঘায়িত হতে লাগল। বনী ইসরাঈলকে মূসা (عليه السلام)-এর কাছে প্রত্যর্পণ করার জন্যে যখনই ফিরআউন কোন নিদর্শন প্রদর্শন করার শর্ত আরোপ করতো এবং মূসা (عليه السلام)-এর দু’আয় আল্লাহর পক্ষ থেকে নিদর্শন প্রকাশিত হতো, তখনই ফিরআউন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বলতো, “হে মূসা! তোমার প্রতিপালক কি এটা ব্যতীত অন্য একটি নিদর্শন আমাদের জন্যে প্রদর্শন করার ক্ষমতা রাখেন?
এরূপ বার বার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার কারণে আল্লাহ্ তা’আলা ফিরআউনের সম্প্রদায়ের প্রতি স্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে পর্যায়ক্রমে তুফান, পঙ্গপাল, উঁকুন, ভেক ও রক্ত আযাবরূপে পাঠান। প্রত্যেকটি মুসীবত অবতীর্ণ হলে ফিরআউন মূসা (عليه السلام)-এর কাছে ফরিয়াদ করত এবং তা দূর করার জন্যে মূসা (عليه السلام)-কে অনুরোধ করত যে, মুসীবত দূর হয়ে গেলে সে বনী ইসরাঈলকে মূসা (عليه السلام)-এর কাছে প্রত্যর্পণ করবে। আবার যখনই মুসীবত দূর হয়ে যেত, তারপর দিনই সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করত। শেষ পর্যন্ত আপন সম্প্রদায়সহ উক্ত জনপদ ত্যাগ করার জন্যে মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ আসল। মূসা (عليه السلام) তাদেরকে নিয়ে রাতের বেলা রওয়ানা হয়ে পড়লেন। প্রত্যুষে ফিরআউন টের পেল যে, বনী ইসরাঈলরা চলে গেছে। তখন সে বিভিন্ন শহরে লোক পাঠাল এবং বিরাট এক সৈন্যদল নিয়ে তাঁদের পিছু ধাওয়া করল। এদিকে আল্লাহ্ তা’আলা সমুদ্রকে হুকুম দিলেন, আমার বান্দা মূসা (عليه السلام) তোমাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করবে, তখন তুমি বারটি খণ্ডে খণ্ডিত হয়ে যাবে, যাতে মূসা ও তার সাথীরা নির্বিঘ্নে পার হয়ে যেতে পারে। অতঃপর তুমি ফিরআউন ও তার সাথীদেরকে গ্রাস করে ফেলবে।
লাঠি দিয়ে সমুদ্রকে আঘাত করতে মূসা (عليه السلام) ভুলে গেলেন ও সমুদ্রের পাড়ে পৌঁছে গেলেন। মূসা (عليه السلام) তাঁর লাঠি দ্বারা আঘাত করবেন আর সে গাফিল থাকবে, যার কারণে সে হবে আল্লাহ তা’আলার কাছে নাফরমান—এই ভয়ে সাগর উত্তাল ছিল। যখন উভয় দল। পরস্পরকে দেখল ও নিকটবর্তী হল, মূসা (عليه السلام)-এর সাথিগণ তাঁকে বলল, আল্লাহ্ আপনার প্রতিপালক, আল্লাহ্ তা’আলা যা হুকুম করেন তাই করুন, নচেৎ আমরা ধরা পড়ে যাব। তিনি মিথ্যা বলেননি এবং আপনিও আমাদেরকে মিথ্যা বলেননি। মূসা (عليه السلام) বলেন, আমার প্রতিপালক আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আমি যখন সমুদ্রের কিনারায় আসব, তখন তা বার ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে যাতে আমি নির্বিঘ্নে সমুদ্র পার হয়ে যেতে পারি। অতঃপর লাঠির কথা স্মরণে আসল, তখন তিনি আপন লাঠি দ্বারা সমুদ্রে আঘাত করলেন। এরপর যখন ফিরআউনের সেনাবাহিনীর অগ্রভাগ মূসা (عليه السلام)-এর সেনাবাহিনীর পশ্চাদ্ভাগের নিকটবর্তী হলো, সমুদ্র তার প্রতিপালকের নির্দেশ অনুযায়ী ও মূসা (عليه السلام)-এর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বিভক্ত হয়ে গেল। যখন মূসা (عليه السلام) ও তাঁর সাথিগণ সকলেই সমুদ্র পার হলেন এবং ফিরআউন ও তার সাথীরা সমুদ্রে প্রবেশ করল, নির্দেশ মোতাবেক সমুদ্র দু’দিক থেকে মিশে গিয়ে তাদের ডুবিয়ে দিল। আবার মূসা (عليه السلام) যখন পার হয়ে গেলেন, তখন তাঁর সাথিগণ বলতে লাগল, আমাদের আশংকা হচ্ছে ফিরআউন হয়তো ডুবেনি। আমরা তার ধ্বংসের ব্যাপারে সুনিশ্চিত নই।
মূসা (عليه السلام) তাঁর প্রতিপালকের কাছে এ ব্যাপারে দু’আ করলেন। ফলে আল্লাহ তা’আলা ফিরআউনের শরীর সমুদ্র থেকে বের করে দিলেন যাতে তারা ফিরআউনের ধ্বংসের ব্যাপারে নিশ্চিত হল। অতঃপর বনী ইসরাঈলরা এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে আগমন করলেন যাদের ইবাদতের জন্যে প্রতিমা রয়েছে, তখন তারা মূসা (عليه السلام)-কে বলতে লাগলঃ
قَالُوا۟ یَـٰمُوسَى ٱجۡعَل لَّنَاۤ إِلَـٰهࣰا كَمَا لَهُمۡ ءَالِهَةࣱۚ قَالَ إِنَّكُمۡ قَوۡمࣱ تَجۡهَلُونَ إِنَّ هَـٰۤؤُلَاۤءِ مُتَبَّرࣱ مَّا هُمۡ فِیهِ وَبَـٰطِلࣱ مَّا كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ[Surat Al-A'raf ১৩৮ - ১৩৯]
তারা বলল, “হে মূসা! তাদের দেবতার ন্যায় আমাদের জন্যেও এক দেবতা গড়ে দাও।” তিনি বললেন, তোমরা তো এক মূর্খ সম্প্রদায়, এসব লোক যাতে লিপ্ত রয়েছে তা তো বিধ্বস্ত হবে এবং তারা যা করছে তাও অমূলক।” (সূরা আ’রাফঃ ১৩৮)
অর্থাৎ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তো সমুদ্র পার হওয়ার ব্যাপারটি নিজ চক্ষে প্রত্যক্ষ করলে এবং নিজ কানেও শুনলে, যা তোমাদের পক্ষে আল্লাহর কুদরত অনুধাবন করার জন্যে যথেষ্ট।
অতঃপর মূসা (عليه السلام) পথ চলতে লাগলেন এবং তাদেরকে নিয়ে অবতরণ করলেন ও বলতে লাগলেন, তোমরা হারুন (عليه السلام)-এর আনুগত্য করবে। কেননা, আল্লাহ তা’আলা তাকে আমার প্রতিনিধি মনোনীত করেছেন। আমি আমার প্রতিপালকের সমীপে যাচ্ছি এবং ত্রিশ দিন পর আমি তোমাদের কাছে ফিরে আসব। মূসা (عليه السلام) যখন তাঁর প্রতিপালকের সাথে ত্রিশ দিনের মধ্যে কথাবার্তা বলার ইচ্ছে করলেন ও ত্রিশ দিন-রাত রোযা রাখলেন, তখন তিনি রোযাদারের মুখের গন্ধের ন্যায় গন্ধ অনুভব করলেন এবং আপন প্রতিপালকের সাথে এ গন্ধ নিয়ে কথাবার্তা বলা অপছন্দনীয় মনে করলেন। তাই মূসা (عليه السلام) একটি গাছের ডাল নিয়ে চিবালেন যাতে মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যায়। মূসা (عليه السلام) যখন আল্লাহর সমীপে পৌঁছলেন, তখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে বললেন, ‘তুমি রোযা কেন ভঙ্গ করলে?’ অথচ কেন তিনি এরূপ করেছিলেন এ ব্যাপারে তিনিই অধিক জ্ঞাত ছিলেন। মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! সুগন্ধিযুক্ত মুখ নিয়ে ছাড়া আপনার সাথে কথাবার্তা বলা আমার অপছন্দনীয় ছিল।’ আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, “হে মূসা! তুমি কি জান না, রোযাদারের মুখের গন্ধ মিশকের গন্ধের চেয়ে শ্রেয়? কাজেই তুমি ফেরত যাও, আরো দশটি রোযা রাখ এবং তারপর আস।’ প্রতিপালক যা নির্দেশ দিলেন মূসা (عليه السلام) তা-ই করলেন।
এদিকে মূসা (عليه السلام)-এর সম্প্রদায় যখন দেখতে পেল যে, মূসা (عليه السلام) নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ ত্রিশদিনের মধ্যে ফেরত আসছেন না, এটা তাদের কাছে খুবই খারাপ লাগল। হারূন (عليه السلام) বনী ইসরাঈলদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা মিসর থেকে বের হয়ে এসেছ অথচ তোমাদের কাছে ফিরআউন সম্প্রদায়ের দেয়া ও আমানতের প্রচুর বস্তু রয়েছে। অনুরূপভাবে তোমাদেরও প্রচুর বস্তু তাদের কাছে রয়েছে। আমার মতামত হচ্ছে, তাদের কাছে তোমাদের যে পরিমাণ বস্তু রয়েছে, সে পরিমাণ তোমরা হিসাব করে রেখে দিতে পার, তবে তাদের ধার দেয়া বস্তু তোমাদের কাছে তাদের আমানতী বস্তু, আমি তোমাদের জন্য হালাল মনে করি না। আর আমরা তাদের কোন বস্তু তাদের কাছে ফেরত পাঠাতে পারছি না। অন্যদিকে আমরা তাদের কোন বস্তু নিজেরাও ভোগ করতে পারছি না। হারূন (عليه السلام) একটি গর্ত খুঁড়তে হুকুম দিলেন যখন একটি বিরাট গর্ত খোঁড়া হল, তখন তিনি সম্প্রদায়ের সকলকে তাদের কাছে মজুদ জিনিসপত্র ও অলংকারাদি গর্তে নিক্ষেপ করতে আদেশ করলেন। অতঃপর তাতে আগুন ধরিয়ে তা পুড়িয়ে দেয়া হল। হারূন (عليه السلام) বললেন, এ সম্পদ আমাদেরও নয় এবং তাদেরও নয়।
সামিরী ছিল বনী ইসরাঈলের পড়শী এমন এক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যারা গরু পূজা করত। সে বনী ইসরাঈলের লোক ছিল না। মূসা (عليه السلام) ও বনী ইসরাঈলের সাথে সমুদ্র পাড়ি দেবার সময় সে জিবরাঈলের ঘোটকীর পায়ের ধুলা দেখতে পেয়ে এক মুষ্টি তুলে নিয়েছিল। এখন সে হারূন (عليه السلام)-এর কাছে গেল। হারূন (عليه السلام) তাকে লক্ষ্য করে বললেনঃ “হে সামিরী! তোমার মুষ্ঠির মধ্যে যা রয়েছে তুমি কি তা অগ্নিতে নিক্ষেপ করবে না?’ সে সকলের অলক্ষ্যে সেই ধুলা মুঠোয় ধরে রেখেছিল। সে বলল, এটাতো সেই দূতের ঘোটকীর পায়ের ধুলা, যে আপনাদেরকে সমুদ্র পার করিয়েছেন, তবে আমি এটাকে কিছুতেই নিক্ষেপ করব না, যতক্ষণ না আপনি আল্লাহ্ তা’আলার কাছে দু’আ করেন যে, আমি যে কাজের জন্য এটাকে নিক্ষেপ করব সে কাজই যেন হয়ে যায়। সে মতে তিনি দু’আ করলেন এবং সে তা নিক্ষেপ করে বলল, আমি চাই এগুলো যেন বাছুরে পরিণত হয়ে যায়। ফলে গর্তের মধ্যে যত সোনা-দানা, সহায়-সম্পদ অলংকারাদি তামা-লোহা ইত্যাদি ছিল, একত্রিত হয়ে একটি বাছুরের আকার ধারণ করল। যার মধ্যখানটা ছিল ফাঁকা, তার মধ্যে প্রাণ ছিল না, ছিল শুধু গরুর ডাক।
আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহর কসম, বাছুরটির কোন শব্দ ছিল না, বাতাস তার পেছনের দিক দিয়ে ঢুকত এবং সামনের দিক দিয়ে বের হয়ে যেত। এজন্য এক প্রকারের শব্দ হত, বাছুরের নিজস্ব কোন শব্দ ছিল না। এই ঘটনার পর বনী ইসরাঈল তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। একদল বলল, হে সামিরী! এটা কি? তুমিই তো এটা সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। সামিরী বলল, এটা তোমাদের প্রতিপালক। তবে মূসা (عليه السلام) পথ হারিয়ে ফেলেছেন। অন্য একদল বলল, যতক্ষণ না মূসা (عليه السلام) আমাদের কাছে ফিরে আসেন, আমরা এটাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করব না। এমনও তো হতে পারে যে, এটাই আমাদের প্রতিপালক! তাই এটাকে আমরা বিনষ্ট করলাম না আর এটা সম্বন্ধে আমরা বিপাকেও পড়লাম না। তাই আমরা এটাকে দেখে-শুনে রাখব। আর যদি এটা আমাদের প্রতিপালক বলে প্রমাণিত না হয়, তাহলে এ সম্পর্কে আমরা মূসা (عليه السلام)-এর নির্দেশই মান্য করব। অন্য একদল বলল, এটা শয়তানের কাজ, এটা আমাদের প্রতিপালক নয়, এটাতে আমরা বিশ্বাস স্থাপন করি না, এটাকে আমরা সত্য বলে গ্রহণও করি না। বাছুরটি সম্বন্ধে সামিরী যা বলেছিল, তাকে তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তার। মিথ্যা দাবিকে তারা মিথ্যা বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করল। হারুন (عليه السلام) তাদেরকে বললেনঃ
(یَـٰقَوۡمِ إِنَّمَا فُتِنتُم بِهِۦۖ وَإِنَّ رَبَّكُمُ ٱلرَّحۡمَـٰنُ)
[Surat Ta-Ha ৯০]
“হে আমার সম্প্রদায়! এটা দ্বারা তো কেবল তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে। তোমাদের প্রতিপালক দয়াময়।” এটা তোমাদের প্রতিপালক নয়। তারা হারূন (عليه السلام)-কে প্রশ্ন করল, মূসা (عليه السلام)-এর খবর কি? আমাদের সাথে ত্রিশদিনের ওয়াদা করে গিয়েছেন, তিনি তো আমাদের সাথে কৃত ওয়াদা পূরণ করলেন না! চল্লিশ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। তাদের মধ্যে যারা নির্বোধ, তারা বলল, মূসা (عليه السلام) তাঁর প্রতিপালককে পাননি, তাই তিনি তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-এর সাথে কথা বলার সময় তিনি তাকে বনী ইসরাঈলের মধ্যে সংঘটিত ব্যাপারসমূহ অবগত করেন। তাতে মূসা (عليه السلام) অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসেন। এরপর তিনি তাদেরকে যা বললেন, তা কুরআনুল করীমে উল্লেখিত হয়েছে।
মূসা (عليه السلام) তাঁর সহোদর হারূন (عليه السلام)-এর কেশ ধরে আকর্ষণ করতে লাগলেন এবং রাগের কারণে ফলকগুলো ফেলে দেন। তারপর তিনি তাঁর সহোদরের ওযর গ্রহণ করে নিলেন এবং তাঁর জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। অতঃপর তিনি সামিরীর দিকে মনোযোগ দিলেন এবং তাকে লক্ষ্য করে বললেন, “তুমি এমনটি কেন করলে?’ সামিরী বলল, “আমি জিবরাঈলের ঘোটকীর পায়ের এক মুঠো ধুলা সংগ্রহ করেছিলাম, আমি এটার অলৌকিক ক্ষমতা অনুধাবন করেছিলাম এবং আপনাদের কাছে ছিল এটা অজানা বস্তু। এরপর এটাকে নিক্ষেপ করলাম এবং আমার মন এরূপ করাই আমার জন্য শোভন করেছিল।’ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘দূর হ’, তোর জীবদ্দশায় তোর জন্যে এটাই রইল যে, তুই বলবি, ‘আমাকে কেউ ছুঁয়ো না’ এবং তোর জন্য রইল একটি নির্দিষ্ট কাল, তোর বেলায় যার ব্যতিক্রম হবে না; তুই তোর সেই ইলাহের প্রতি লক্ষ্য কর যার পূজায় তুই রত ছিলে, আমরা এটাকে জ্বালিয়ে দেবই; অতঃপর এটাকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে নিক্ষেপ করবই।”
বলাবাহুল্য, এটা যদি উপাস্যই হত তাহলে এটাকে এরূপ কেউ করতে পারত না। এজন্যই বনী ইসরাঈল এটাকে নিশ্চিতভাবে পরীক্ষা হিসেবে গণ্য করে। আর যাদের মতামত হারূন (عليه السلام)-এর মতামতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল তারা মহাখুশী হলো এবং নিজেদের সম্প্রদায়ের উপকারার্থে মূসা (عليه السلام)-কে লক্ষ্য করে তারা আরো বলল, “হে মূসা (عليه السلام)! আপনি আল্লাহ্ তা’আলার কাছে প্রার্থনা করুন, যেন তিনি আমাদের জন্যে তওবা করার নিমিত্তে একটি বিধি ব্যবস্থা করেন, যা আমরা আঞ্জাম দিলে, আমাদের কৃত পাপরাশির কাফফারা হয়ে যায়।” অতঃপর মূসা (عليه السلام) তাঁর সম্প্রদায় থেকে সত্তরজন এমন লোককে এ কাজের জন্যে মনোনীত করলেন, যারা ভাল কাজ সম্পাদনে ত্রুটি করে না এবং আল্লাহ তা’আলার সাথে কাউকে শরীক করে না, তাদের নিয়ে মূসা (عليه السلام) তওবার জন্যে চললেন। অতঃপর ভূমিকম্প দেখা দিল। আর এতে আল্লাহ নবী, তাঁর সম্প্রদায় ও মনোনীত লোকদের কাছে লজ্জিত হলেন এবং বলতে লাগলেন, “হে আল্লাহ্ তা’আলা! ইচ্ছে করলে তুমি তাদেরকে ও আমাকে এর পূর্বেই ধ্বংস করে দিতে পারতে। আমাদের মধ্যে যারা নির্বোধ, তাদের কৃতকর্মের জন্যে কি আমাদেরকে তুমি ধ্বংস করবে?” উত্তর আসল, ‘তাদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যাদের অন্তরে বাছুরপ্রীতি রয়েছে। ও এটার প্রতি তারা বিশ্বাস রাখে; তাই তাদেরকে নিয়ে ভূমি কেঁপে উঠেছিল।’
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
وَرَحۡمَتِی وَسِعَتۡ كُلَّ شَیۡءࣲۚ فَسَأَكۡتُبُهَا لِلَّذِینَ یَتَّقُونَ وَیُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱلَّذِینَ هُم بِـَٔایَـٰتِنَا یُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِینَ یَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِیَّ ٱلۡأُمِّیَّ ٱلَّذِی یَجِدُونَهُۥ مَكۡتُوبًا عِندَهُمۡ فِی ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِیلِ
[Surat Al-A'raf ১৫৬ - ১৫৭]
“আমার দয়া—তা তো প্রত্যেক বস্তুতে ব্যাপ্ত। সুতরাং আমি এটা তাদের জন্যে নির্ধারিত করব যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় ও আমার নিদর্শনে বিশ্বাস করে, যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর, যার উল্লেখ তাওরাত ও ইঞ্জীল, যা তাদের কাছে আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়।” (সূরা আরাফঃ ১৫৬-১৫৭)
মূসা (عليه السلام) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায়ের জন্য আমি তোমার কাছে তওবা কবুলের দু’আ করছি, আর তুমি আমাকে বলছ, নিশ্চয়ই আমার রহমত এমন একটি সম্প্রদায়ের জন্যে লিপিবদ্ধ করেছি যা তোমার সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন। হায়! যদি তুমি আমার জন্মকে আরো বিলম্ব করতে এবং আমাকে সেই রহমতপ্রাপ্ত ব্যক্তির উম্মতের অন্তর্ভুক্ত করতে, কতই না ভাল হত! আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-কে বললেন, তাদের তওবা হচ্ছে তাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি যার সাথে সাক্ষাৎ করবে, তার পিতা বা সন্তান হোক না কেন সে তাকে তরবারি দ্বারা হত্যা করবে। কে নিহত হলো, এ ব্যাপারে কোন পরোয়া করবে না। যাদের গুনাহ মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام)-এর কাছে অজ্ঞাত থাকলেও আল্লাহ তা’আলা তাদের পাপ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। তারা নিজ নিজ পাপের কথা স্বীকার করলো ও তাদেরকে যা করতে বলা হয়েছে তা করলো। তখন আল্লাহ্ তা’আলা হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়কে মাফ করে দিলেন।
অতঃপর মূসা (عليه السلام) বনী ইসরাঈলদেরকে নিয়ে পবিত্র ভূমির দিকে অগ্রসর হলেন। রাগ থেমে যাবার পর তিনি ফলকগুলো কুড়িয়ে নিলেন এবং ফলকে লিখিত বিভিন্ন করণীয় কাজ সম্পর্কে উম্মতদেরকে নির্দেশ দিলেন। এগুলো তাদের কাছে কঠিন মনে হতে লাগল এবং এগুলোকে পুরোপুরি স্বীকার করে নিতে তারা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন আল্লাহ তা’আলা তূর পাহাড় তাদের মাথার উপর চাঁদোয়ার মত উত্তোলিত করলেন। পাহাড় তাদের নিকটবর্তী হতে লাগল, এমনকি তারা ভয় করতে লাগল যে, তা তাদের মাথার উপর না পড়ে যায়। তারা একদিকে তাদের ডান হাতে কিতাবখানা ধরে রেখেছিল, অন্যদিকে গভীর মনোযোগ সহকারে পাহাড়ের প্রতি দৃষ্টি রেখেছিল। তারা ছিল পাহাড়ের পেছনে। ভয় করছিল, না জানি কখন তাদের উপর তা পড়ে যায়।
অতঃপর তারা চলতে চলতে পবিত্র ভূমিতে পৌঁছে গেল এবং সেখানে তারা একটি শহর পেল, যাতে রয়েছে একটি দুর্ধর্ষ জাতি। তারা ছিল নিকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী। তাদের ফল-ফলাদি অত্যন্ত বৃহৎ আকারের ছিল বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বনী ইসরাঈলরা বলল, “হে মূসা! এখানে রয়েছে একটি দুর্দান্ত জাতি যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত এরা শহরে অবস্থান করবে আমরা তাতে প্রবেশ করব না। যদি তারা বের হয়ে যায় তাহলেই কেবল আমরা সেখানে প্রবেশ করব। দুর্দান্ত সম্প্রদায়টির মধ্য থেকে দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় করত; বললেন, আমরা মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি ঈমান এনেছি এবং আমরা আমাদের সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে এসেছি। তারা আরো বললেন, আমরা আমাদের সম্প্রদায়ের শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত। তোমরা তাদের বিরাট শরীর ও সংখ্যার আধিক্য দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। আসলে তাদের তেমন শক্তি-সামর্থ্য নেই। তোমরা তাদের ফটক দিয়ে প্রবেশ করার চেষ্টা কর। তোমরা তাতে প্রবেশ করতে পারলেই তাদের উপর জয়ী হবে। কেউ কেউ বলেন, যাদের উক্তি উপরে উল্লেখ করা হল, তারা হলেন মুসা (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের লোক। অর্থাৎ বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা ভয় করছিল। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(قَالُوا۟ یَـٰمُوسَىٰۤ إِنَّا لَن نَّدۡخُلَهَاۤ أَبَدࣰا مَّا دَامُوا۟ فِیهَا فَٱذۡهَبۡ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَـٰتِلَاۤ إِنَّا هَـٰهُنَا قَـٰعِدُونَ)
[Surat Al-Ma'idah ২৪]
“তারা বলল, হে মূসা! তারা যতদিন সেখানে থাকবে, ততদিন আমরা সেখানে প্রবেশ করবই না। সুতরাং তুমি আর তোমার প্রতিপালক যাও এবং যুদ্ধ কর। আমরা এখানেই বসে থাকব। (৫ মায়িদাঃ ২৪)
এরূপ বলে তারা মূসা (عليه السلام)-এর ক্রোধের উদ্রেক করল। তিনি তাদের জন্য বদদু’আ করলেন, তাদেরকে ফাসিক’ বলে আখ্যায়িত করলেন। এর আগে তিনি তাদের বিরুদ্ধে আর বদদু’আ করেননি। কেননা, এখন তিনি তাদের মধ্যে পাপ এবং অবাধ্যতা দেখতে পেলেন, আর আল্লাহ্ তা’আলা তার বদদু’আ কবুল করলেন এবং আল্লাহ্ তা’আলাও তাদেরকে ফাসিক বলে আখ্যায়িত করলেন—যেমনটি মূসা (عليه السلام) করেছিলেন। চল্লিশ বছরের জন্যে পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ তাদের জন্যে নিষিদ্ধ করে দিলেন। যাতে তারা পৃথিবীতে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে। সারাদিন ধরে তারা চলতেই থাকবে। তাদের কোন স্বস্তি নসীব হবে না। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা সদয় হয়ে তাদের উপর তীহের ময়দানে মেঘের ছায়া দান করেন; তাদের জন্যে মান্না ও সালওয়া অবতীর্ণ করেন। তাদেরকে এমন পোশাক দান করেন যা না ছিড়ে, না ময়লা হয়। তাদেরকে এমন একটি বর্গাকৃতির পাথর দান করলেন এবং এটাকে লাঠি দ্বারা আঘাত করার জন্য মূসা (عليه السلام)-কে নির্দেশ দিলেন। ফলে পাথর থেকে বারটি প্রস্রবণ প্রবাহিত হল। প্রতি দিকে তিনটি করে প্রস্রবণ অবস্থিত ছিল, তাদের প্রতিটি গোত্র নিজ নিজ প্রস্রবণের পরিচয় পেয়ে গেল। তারা নিজ নিজ প্রস্রবণ থেকে পানি পান করতো। আবার তারা যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেত, সেখানেই এই পাথরটিকে পূর্বদিনের অবস্থানে পেত।
উপরোক্ত হাদীসটি মারফু বলে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) উল্লেখ করেছেন। আমার মতে এটাই যথার্থ। কেননা, একদা মুআবিয়া (رضي الله عنه) ইবন আব্বাস (عليه السلام) থেকে শোনার পর মূসা (عليه السلام) কর্তৃক নিহত ব্যক্তিটি সম্বন্ধে ফিরআউনীকে তথ্য প্রকাশকারী হিসেবে মানতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ফিরআউন বংশীয় লোকটির জানার কোন উপায়ই ছিল না। জানতো কেবল ইসরাঈলীটি, যে সেখানে উপস্থিত ছিল। তাহলে ফিরআউনী ব্যক্তিটি কেমন করে এ তথ্য প্রকাশ করতে পারে? তাঁর এই উক্তি শুনে আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) রাগান্বিত হলেন এবং মুআবিয়া (رضي الله عنه)-এর হাত ধরলেন ও তাঁকে নিয়ে সা’দ ইবন মালিক যুহরী (رضي الله عنه)-এর কাছে গেলেনএবং তাঁকে বললেন, হে আবু ইসহাক! আপনার কি ঐ দিনটির কথা মনে পড়ে? যেদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মূসা (عليه السلام) কর্তৃক নিহত ফিরআউন সম্প্রদায়ের লোকটি সম্বন্ধে বর্ণনা করেছিলেন? তথ্যটি ইসরাঈলীটি প্রকাশ করেছিল, না-কি ফিরআউনী? জবাবে তিনি বলেছিলেন, এই তথ্যটি প্রকাশ করেছিল ফিরআউনী। তবে সে এটা শুনেছিল ইসরাঈলী থেকে, যে এ ঘটনার সাক্ষ্য দিয়েছিল ও এটা উল্লেখ করেছিল।
ইমাম নাসাঈ (رحمة الله)-ও অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেন। ইবন জারীর তাবারী (رحمة الله) ও ইবন আবু হাতিম (رحمة الله) তাঁদের তাফসীরে এরূপ হাদীসের উল্লেখ করেছেন। তবে এ হাদীসটি মরযূ না হয়ে মওকূফ হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। এ বর্ণনার অধিকাংশই ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে গৃহীত। এতে কিছু কিছু অংশ এমনও রয়েছে যা সন্দেহমুক্ত নয়। আমি আমার উস্তাদ হাফিজ আবুল হাজ্জাজ মযী (رحمة الله) থেকে শুনেছি। তিনি বলেন, এটা ইহুদী আলিমদের বর্ণনা হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।