❏ প্রিয় রাসূল (ﷺ) জানাযার পর দোয়া নির্দেশ দিয়েছেন
আল্লাহর হাবীব রাসূলে আকরাম (ﷺ) জানাযার নামাজের পর পর দোয়া করা নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন এ বিষয়ে অপর হাদিসে আছে, ইমাম ইবনু মাজাহ, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম ইবনু হিব্বান, ইমাম বায়হাক্বী, ইমাম তাবারানী (رحمة الله عليه) প্রমূখ বর্ণনা করেছেন,
حَدَّثَنَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ يَحْيَى الْحَرَّانِيُّ، حَدَّثَنِي مُحَمَّدٌ يَعْنِي ابْنَ سَلَمَةَ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِبْرَاهِيمَ، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَقُولُ: إِذَا صَلَّيْتُمْ عَلَى الْمَيِّتِ فَأَخْلِصُوا لَهُ الدُّعَاءَ
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, রাসূলে করিম (ﷺ) বলেছেন: যখন মৃত ব্যক্তির জানাযা আদায় করবে এরপরেই তার জন্যে দোয়া করবে।”
(সুনানে ইবনে মাজাহ, ১০৯ পৃঃ হাদিস নং ১৪৯৭; আবু দাউদ শরীফ, ২য় জি: ৪৫৬ পৃঃ হাদিস নং ৩১৯৯; সহীহ্ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৩০৭৬; মেসকাত শরীফ, ১৪৬ পৃঃ; ইমাম বায়হাকী তার সুনানে কুবরায়, ৪র্থ খন্ড, ২১০ পৃঃ হাদিস নং ৬৯৬৪; ইমাম তাবারানী: আদ-দোয়া, হাদিস নং ১২০৫; ইমাম বায়হাক্বী: মারেফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হাদিস নং ৭৬২২; মেরকাত শরহে মেসকাত; ইমাম সুয়ূতী: জামেউছ ছাগীর, ১ম জি: ৫১ পৃঃ;)
এই হাদিসের সনদ প্রসঙ্গে আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله عليه) তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন: قَالَ ابْنُ حَجَرٍ: وَصَحَّحَهُ ابْنُ حِبَّانَ. -“হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله عليه) বলেন: ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله عليه) এই হাদিসকে সহীহ্ বলেছেন।”
(ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত;)
এই হাদিস সম্পর্কে আল্লামা মুহাম্মদ ইবনু ইসমাঈল ইবনে ছিলাহ (র:) ওফাত ১১৮২ হিজরী তদীয় কিতাবে صح সহীহ্ বলেছেন।(আত তানভীর শরহে জামেউছ ছাগীর, ৭৭৪ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;)
আল্লামা মানাভী (رحمة الله عليه) বলেন: وَإِسْنَاده حسن -“এর সনদ হাছান।” (ইমাম মানাভী: আত তাইছির শরহে জামেইছ ছাগীর, ১ম খন্ড, ১১২ পৃঃ;)
সুনানু আবী দাউদ ও সুনানু ইবনু মাজাহ এর তাহকিকে নাছিরুদ্দিন আলবানী হাদিসটিকে حسن হাছান বলেছেন।
এই হাদিসে জানাযার পর মায়্যেতের জন্যে দোয়া করার জন্যে আল্লাহর নবী (ﷺ) নির্দেশ দিয়েছেন। তাই নবী পাক (ﷺ)’র নির্দেশ যারা মানেনা তারা সঠিক পথের পথিক হতে পারেনা। কারণ আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বলেন:
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا-
“রাসূল (ﷺ) তোমাদেরকে যা নির্দেশ দিয়েছেন তোমরা তা গ্রহণ করো এবং যা থেকে নিষেধ করেন তা বর্জন করো।” (সূরা হাশর: ৭ নং আয়াত)
এই হাদিস উল্লেখ করে আল্লামা মুহাম্মদ ইবনু ইসমাঈল ইবনে ছিলাহ (র:) ওফাত ১১৮২ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন,
(فأخلصوا له الدعاء) أو إذا دعوتم له في صلاة أو غيرها
-“মৃত ব্যক্তির জন্য খালেছভাবে দোয়া করো’ অর্থাৎ তোমরা যখন জানাযার নামাজে অথবা অন্য সময় তার জন্য দোয়া কর খালেছভাবে দোয়া করো।”(আত তানভীর শরহে জামেউছ ছাগীর, ৭৭৪ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;)
উক্ত হাদিসের দোয়াটি যে জানাযার পরের দোয়া, সে বিষয়টি নি¤েœ উল্লেখিত হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়। ইমাম বুখারী (র:) তদীয় তারিখে সহীহ্ সনদে বর্ণনা করেন,
قَالَ مُحَمد بْنُ حُميد: حدَّثنا حَكَّامُ بْنُ سَلم الرّازِيّ، سَمِعَ عِيسَى بْنَ يَزِيدَ أَبَا مُعاذ، عَنْ خَالِدِ بْنِ كَيسان، عَنِ الرُّبَيِّعِ بِنتِ مُعَوِّذٍ، أَنَّ النَّبيَّ صَلى اللَّهُ عَلَيه وسَلم قَالَ: إِذا صَلَّوا عَلى جنَازَةٍ، وأَثنَوا خَيرًا، يَقول الرَّبُّ، عَزَّ وجَلَّ: أَجَزتُ شَهادَتَهُم فيمَا يَعلَمُونَ، وأَغفِرُ لَهُم مَا لاَ يَعلَمُونَ
-“রুবাঈ’ বিনতে মুওয়াবিয (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: তোমরা যখন কোন জানাযা পড়বে তারপরেই ভাল প্রসংশা করবে। বলবে: ওগো রব তা’আলা! আমি তাদের জন্য উত্তম সাক্ষ্য দিচ্ছি যা তারা আমল করেছে। আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন যা তারা আমল করতে পারেনি।”
(ইমাম বুখারী: তারিখুল কবীর, রাবী নং ৫৭৪ এর ব্যাখ্যায়; আত তানভীর শরহে জামেউছ ছাগীর, ৭৭৪ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়; ইমাম মানাভী: আত তাইছির বি’শারজি জামেইছ ছাগীর, ১ম খন্ড, ১১১ পৃঃ; ইমাম মানাভী: ফায়জুল কাদির, হাদিস নং ৬৬৪; ফাতহুল কবীর, হাদিস নং ১২২৬; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৪২২৮৩; ইমাম সুয়ূতী: জামেউল আহাদিছ, হাদিস নং ২১৯৯; জামেউছ ছাগীর, হাদিস নং ৬৬৪;)
লক্ষ্য করুন, এই হাদিসে মৃত ব্যক্তির জন্য প্রসংশা ও তার জন্য এরূপ দোয়া মূলত জানাযার পরেই বুঝাচ্ছে। জানাযার ভিতরে কেউ মৃত ব্যক্তির জন্য প্রসংশা করেনা। সুতরাং فَأَخْلِصُوا لَهُ الدُّعَاءَ এই হাদিসের দোয়া মূলত জানাযার পরেই বুঝানো হয়েছে। অনেক ওহাবী ও নজদীরা এই হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা করেন। তারা বলেন:
فَأَخْلِصُوا لَهُ الدُّعَاءَ (ফাখলিছু লাহুদ দোয়া) এই নির্দেশ নামাজের ভিতরেই হবে, আলাদা দোয়া নয়। তাদের এই ব্যাখ্যা ভুল ও যথার্থ নয়। কারণ এখানে উল্লেখ আছে, إِذَا صَلَّيْتُمْ عَلَى الْمَيِّتِ فَأَخْلِصُوا لَهُ الدُّعَاءَ (ইজা ছাল্লায়তুম আলাল মায়্যেত ফাখলিছু লাহুদ দোয়া)। এই বাক্যের মাঝে (فَ) ‘ফা’ হরফে আত্ফ তা’কিবের জন্যে রয়েছে। আর সকলেই জানেন যে, হরফে আত্ফ থাকলে ‘মাতুফ’ ও ‘মাতুফ আলায়হে’ একই সময় সংগঠিত হয়না। এই ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে একটি আয়াত উল্লেখ করা যেতে পারে: فَإِذا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوا -“যখন তোমরা খাবার শেষ করবে এরপরেই জমীনে ছড়িয়ে পরবে।” (সূরা আহযাব: ৫৩)।
এখানে (فَ) ‘ফা’ হরফ দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রথম কাজ (খাওয়া-দাওয়া) শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় কাজ (জমীনে ছড়িয়ে পরা) করতে হবে। নাকি খাবারের ভিতরেই জমীনে ছড়িয়ে পরবেন? অবশ্যই না, বরং খাবার শেষ হওয়ার পরেই জমীনে ছড়িয়ে পরতে হবে। এটাই এই আয়াতের فَ (ফা) অক্ষর দ্বারা প্রমাণিত হয়। অনরূপ অন্য আয়াতে আছে:- فَإِذا قُضِيَتِ الصَّلاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ
-“যখন নামাজ থেকে বের হবে এরপরেই জমীনে ছড়িয়ে পর।” (সূরা জুময়া: ১০)
এই আয়াতেও (فَ) ‘ফা’ দ্বারা বুঝা যায়, নামাজ শেষ হওয়ার পর জমীনে ছড়িয়ে পরতে হবে। অতএব (فَ) ‘ফা’ হরফ দ্বারা একটি কাজ শেষ হওয়ার পর পর অন্য কাজ সম্পাদিত বুঝায়, দু’টি কাজ একসাথে নয়। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা’লা আরো বলেন: إِذا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ... (ইজা কুমতুম ইলাছ ছালাত ফাগছিলু ওজুহাকুম....) -“যখন নামাজের ইচ্ছা করবে পরপরই তোমাদের চেহারা ও হাত ধৌত কর।” (সূরা মায়েদা: ৬ নং আয়াত)
এই আয়াতেও বলা হয়েছে নামাজের ইচ্ছা করার পর ওজু করতে হবে। অতএব, (فَ) ‘ফা’ হরফটি একটি কাজ শেষ হওয়া পরে অন্য কাজ করা বুঝায়। এখন এই (فَ) ‘ফা’ হরফের ব্যাপারে নাহুর কিতাবে রয়েছে:-
“(فَ) ‘ফা’ হরফটি যুক্ত হওয়া ও পিছনে হওয়া অর্থে ব্যবহার হয়। যেমন:-قَامَ زَيْدُ فَعَمْرُو -“জায়েদ দাঁড়ালেন অত:পর আমর দাঁড়ালেন।” বাক্যটি তখন বলা হয় যখন বিরামহীন ভাবে ‘জায়েদ’ পূর্বে ও ‘আমর’ পরে দাঁড়াবে। সুতরাং (فَ) ‘ফা’ কিছু সময় হলেও ব্যবধান বুঝায় তা যত কমই হোক।” (হেদায়াতুন্নাহু)।
এ বিষয়ে অন্য কিতাবে আছে.
“(فَ) ‘ফা’ হরফটি যুক্ত হওয়া ও পেছনে হওয়া অর্থে ব্যবহার হয়। অর্থাৎ معتوف (মা’তুফ) বিন্দুমাত্র বিলম্ব ব্যতীত معتوف عليه (মা’তুফ আলায়হি) এর সাথে যুক্ত ভাবে এর পর বুঝানোর জন্যে (فَ) ‘ফা’ ব্যবহার হয়। সুতরাং معتوف (মা’তুফ) কিছু সময় ব্যবধানে ইহা যত কমই হোকনা কেন معتوف عليه (মা’তুফ আলায়হি) এর পরে হবে।” (নূরুল আনওয়ার, বহছে হুরুফে আত্ফ)।
আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি নক্সবন্দী হানাফী (র:) বলেছেন,
بالفاء الموضوع للتعقيب بلاتراخ -“(فَ) ‘ফা’ অভ্যয়টি কোন সময় না নিয়ে অনতিবিলম্বে কোন কাজের পরে অন্য কাজ সম্পাদন করার অর্থে ব্যবহার হয়।”(তাফছিরে মাজহারী, ৮ম খন্ড, ৮৩ পৃঃ;)
সুতরাং প্রমাণ হয়ে গেল, (فَ) ‘ফা’ হরফে আত্ফ থাকার কারণে
إِذَا صَلَّيْتُمْ عَلَى الْمَيِّتِ فَأَخْلِصُوا لَهُ الدُّعَاءَ
(ইজা ছাল্লায়তুম আলাল মায়্যেতি ফাখলিছু লাহুদ দোয়া) এই হাদিসের অর্থ হবে ‘সালাত শেষ হওয়ার পরপরই মায়্যেতের জন্যে খালেছ ভাবে দোয়া করতে হবে’। সালাত ও দোয়া এক সময় নয় বরং সালাত শেষ হওয়ার পর দোয়া করতে হবে। এটাই আরবী গ্রামারের নিয়ম। এছাড়াও إِذَا صَلَّيْتُمْ عَلَى الْمَيِّتِ (ইজা ছাল্লায়তুম আলাল মায়্যেত) হলো شرط ‘শর্ত’ এবং فَأَخْلِصُوا لَهُ الدُّعَاءَ (ফাখলিছু লাহুদ দোয়া) হলো ‘জাযা’। আর আরবী ব্যকরণ অনুযায়ী শর্ত ও জযা একই সময়ে সম্পাদন হয়না। তার আরেকটি কারণ হলো صَلَّيْتُمْ (ছাল্লায়তুম) হলো مَاضِي (মাজি) বা ‘অতীত কাল বাচক’ এবং فَأَخْلِصُوا (ফাখলিছু) হলো امر (আমর) বা আদেশ। সুতরাং সালাত অতীত হওয়ার পর দোয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। তাই হাদিসের সঠিক অর্থ হলো “যখন মায়্যেতের জানাযার নামাজ আদায় করবে এর পরেই তার জন্যে খালেছভাবে দোয়া করবে”।