❏ ফরজ নামাজের পর দোয়া


মুসলীম জীবনে ফরজ নামাজের পর দোয়া বা মুনাজাত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসূলে পাক (ﷺ)’র সুন্নাতী আমল। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের মধ্যে অসংখ্য দলিল বিদ্যমান রয়েছে। আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সকল উলামা, ফোজালা, ছোলাফা ও ফোকাহাগণ একমত যে, ফরজ নামাজের পর দোয়া করা অত্যান্ত সওয়াব বা নেকীর কাজ এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র সুন্নাহ নির্ভর একটি আমল। অজ্ঞ ও অলস ব্যক্তিরাই এই আমল অস্বীকার করে থাকে। অথচ প্রিয় নবীজি রাসূলে করিম (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণ ফরজ নামাজের সালাম ফিরানোর পর দোয়া করেছেন বলে একাধিক রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি পবিত্র কুরআনেও ফরজ নামাজের পরে দোয়ার কথা বিদ্যমান রয়েছে। এ বিষয়ে নিচের দলিল-আদিল্লাহসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হল।


❏ পবিত্র কুরআনের আলোকে ফরজ নামাজের পর দোয়া


পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তা’আলা ফরজ নামাজের পর দোয়ার কথা বলেছেন। যেমন মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, 

فَإِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبْ وَإِلَى رَبِّكَ فَارْغَبْ -

“যখন তোমরা ফরজ নামাজ থেকে বের হও তখন রবের প্রতি মনোনিবেশ কর।” (সূরা ইনশিরাহ: ৭-৮ নং আয়াত)


উক্ত আয়াতদ্বয়ে মহান আল্লাহ তা’আলা ফরজ নামাজের পরে দোয়ার কথাই বলেছেন।(এই আয়াতের আরো একাধিক তাফছির রয়েছে। যেমন জেহাদ থেকে অবসর হয়ে দোয়া ও এবাদতে মশগুল হওয়া ইহ্যাদি। তবে ফরজ নামাজের পর দোয়ার বিষয়টি সর্বাধিক বর্ণিত ও রইছুল মুফাচ্ছেরীন হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিঃ) সমর্থিত।) এই মর্মে মুফাচ্ছিরীনে কেরামের এক জামাত এরূপ তাফছির পেশ করেছেন। যেমন পবিত্র কুরআনের এই আয়াতদ্বয়ের তাফছিরের দিকে লক্ষ্য করুন। 


ইমাম জালালুদ্দিন মুহাল্লী  (رحمة الله عليه) ও আল্লামা আহমদ ছাবী (رحمة الله عليه) স্ব স্ব তাফছিরের কিতাবে উল্লেখ করেন, 

إِذَا فَرَغْت مِنْ الصَّلَاة {فَانْصَبْ} اِتْعَبْ فِي الدعاء -

“যখন নামাজ থেকে বের হবে দোয়ার প্রতি মনোনিবেশ কর।”(তাফছিরে জালালাইন শরীফ, ৫০২ পৃঃ; তাফছিরে ছাবী, ৪র্থ খন্ড, ৫২৫ পৃঃ;) 


প্রিয় নবীজি (ﷺ)’র আপন চাচাত ভাই ও র’ইছুল মুফাচ্ছেরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)’র অভিমত,

قال ابن عباس: إذا فرغت من الصّلاة المكتوبة، فانصب إلى ربك في الدعاء، 

-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন: যখন ফরজ নামাজ থেকে বের হবে, তখন রবের প্রতি দোয়া দ্বারা মনোনিবেশ কর।”(তাফছিরে রুহুল মায়ানী, ৩০তম জি: ৪৯৬ পৃঃ; তাফছিরে খাজিন শরীফ, ৪র্থ খন্ড, ৪৪৩ পৃঃ; তাফছিরে তাবারী শরীফ, ৩০তম জি: ২৫৭ পৃঃ; তাফছিরে নাসাফী, ৪র্থ জি: ৪৪৭ পৃঃ; তাফছিরে ইবনে কাছির, ৪র্থ খন্ড, ৬৪৪ পৃঃ;) 


হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও কয়েকজন বিশিষ্ট তাবেঈগণের তাফছির লক্ষ্য করুন,

قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ، وَقَتَادَةُ، وَالضَّحَّاكُ، وَمُقَاتِلٌ، وَالْكَلْبِيُّ: فَإِذَا فَرَغْتَ مِنَ الصَّلَاةِ الْمَكْتُوبَةِ فَانْصَبْ إِلَى رَبِّكَ فِي الدُّعَاءِ

-“ফকিহ্ সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه), তাবেঈ কাতাদা, দ্বাহ্হাক, মুকাতিল ও কালবী (رضي الله عنه) বলেন: যখন ফরজ নামাজ থেকে বের হবেন তখন দোয়া দ্বারা প্রভূর প্রতি মনোনিবেশ কর।”(তাফছিরে মায়ালেমুত্তানজিল, ৫ম খন্ড, ৩৭৩ পৃঃ; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ১০ম খন্ড, ৫৪২ পৃঃ; তাফছিরে মাজহারী, ১০ম খন্ড, ২৭১ পৃঃ; তাফছিরে কবীর, ৩২তম জি: ৮ পৃঃ; তাফছিরে কুরতবী শরীফ, ২০তম জি: ৮৩ পৃঃ;) 


এ বিষয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তাফছির হচ্ছে,

فإذَا فرغتَ من صلاتِك فاجتهدْ في الدُّعاءِ -

“যখন নামাজ থেকে বের হবেন তখন দোয়ার দ্বারা চেষ্টা করুন।”(তাফছিরে আবু সাউদ, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৫৫৬ পৃঃ;) 


হাফিজুল হাদিস, ইমাম আবু জাফর ইবনু জারির আত-তাবারী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৩১০ হি.} উল্লেখ করেন,

فَإِذَا فَرَغْتَ مِنْ صَلَاتِكَ، فَانْصَبْ إِلَى رَبِّكَ فِي الدُّعَاءِ، وَسَلْهُ حَاجَاتِكَ

-“এর অর্থ হল: যখন তোমার নামাজ থেকে বের হবে তখন প্রভূর প্রতি দোয়া দ্বারা মনোনিবেশ কর ও তোমার হাজতের কথা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো।”(তাফছিরে তাবারী শরীফ, ৩০তম জি: ২৫৭ পৃঃ;) 


এ আয়াতের তাফছিরে আল্লামা কাজী নাছিরুদ্দিন বায়জাবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৮৫ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন, فَإِذا فَرَغْتَ من الصلاة فانصب بالدعاء (ফা ইজা ফারাগতা মিন ছালাতি ফানছাব বিদ দোয়া) -“যখন নামাজ থেকে বের হবে তখন দোয়ায় মনোনিবেশ কর।”(তাফছিরে বায়দ্বাবী, ২য় জি: ৬৯৭ পৃঃ;) 


এই আয়াতের তাফছিরে হাফিজুল হাদিস, ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৯১১ হিজরী} তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন,

عَن قَتَادَة فَإِذا فرغت فانصب قَالَ: إِذا فرغت من صَلَاتك فانصب فِي الدُّعَاء

-“হযরত কাতাদা (رحمة الله عليه) বলেন: যখন নামাজ হতে বের হবে তখন দোয়ার প্রতি মনোনিবেশ কর।”(তাফছিরে দূর্রে মানছুর, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৬৫৯ পৃঃ;) 


সুতরাং পবিত্র কুরআনের এই আয়াতের নির্ভরযোগ্য তাফছিরসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয়, ফরজ নামাজের পর দোয়া করা বা দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা স্বয়ং আল্লাহ পাকের নির্দেশ। বিশিষ্ট সাহাবী র’ইছুল মুফাচ্ছেরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)সহ হযরত কাতাদা, মুকাতিল, দ্বাহ্হাক, কালবী (رضي الله عنه) প্রমূখ তাবেঈগণ ফরজ নামাজের পর দোয়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন। তাই সাধারণ নিম মোল্লাদের কথা বাদ দিয়ে সাহাবী ও তাবেঈগণের পথে চলাই মু’মীন লোকের কাজ। অতএব, ফরজ নামাজের পর দোয়া অস্বীকার করার কোন রাস্তা নেই, যেহেতু বিষয়টি পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত।

Top