❏ মূসা (عليه السلام)-এর ফযীলত, স্বভাব, গুণাবলী ও ওফাত

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

وَٱذۡكُرۡ فِی ٱلۡكِتَـٰبِ مُوسَىٰۤۚ إِنَّهُۥ كَانَ مُخۡلَصࣰا وَكَانَ رَسُولࣰا نَّبِیࣰّا ۝ وَنَـٰدَیۡنَـٰهُ مِن جَانِبِ ٱلطُّورِ ٱلۡأَیۡمَنِ وَقَرَّبۡنَـٰهُ نَجِیࣰّا ۝ وَوَهَبۡنَا لَهُۥ مِن رَّحۡمَتِنَاۤ أَخَاهُ هَـٰرُونَ نَبِیࣰّا[Surat Maryam ৫১ - ৫৩]

“স্মরণ কর, এই কিতাবে উল্লেখিত মূসার কথা, সে ছিল বিশুদ্ধচিত্ত এবং সে ছিল রাসূল, নবী। তাকে আমি আহবান করেছিলাম তূর পর্বতের দক্ষিণ দিক থেকে এবং আমি অন্তরঙ্গ আলাপে তাকে নিকটবর্তী করেছিলাম। আমি নিজ অনুগ্রহে তাকে দিলাম তার ভাই হারূনকে নবীরূপে।” (সূরা মারয়ামঃ ৫১–৫৩)

আল্লাহ্ তা’আলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেনঃ

(قَالَ یَـٰمُوسَىٰۤ إِنِّی ٱصۡطَفَیۡتُكَ عَلَى ٱلنَّاسِ بِرِسَـٰلَـٰتِی وَبِكَلَـٰمِی فَخُذۡ مَاۤ ءَاتَیۡتُكَ وَكُن مِّنَ ٱلشَّـٰكِرِینَ)

[Surat Al-A'raf ১৪৪]

‘আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, হে মূসা! আমি তোমাকে আমার রিসালাত ও বাক্যালাপ দ্বারা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। (সূরা আরাফঃ ১৪৪)

সহীহ বুখারী ও মুসলিমের বরাতে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেনঃ আমাকে তোমরা মূসা (عليه السلام)-এর উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করবে না। কেননা, কিয়ামতের দিন যখন মানব জাতি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়বে, তখন আমিই প্রথম ব্যক্তি, যে সংজ্ঞা ফিরে পাবো। তখন আমি মূসা (عليه السلام)-কে আল্লাহ্ তা’আলার আরশের একটি স্তম্ভ ধরে রয়েছে দেখতে পাব। আমি জানি না, তিনি কি অচেতন হয়েছিলেন? অতঃপর আমার পূর্বে তিনি চেতনা ফিরে পেলেন, নাকি তূরে অচেতন হওয়ার প্রতিদানে তিনি আদৌ অচেতনই হননি। একথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, এ ধরনের উক্তি ছিল রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর বিনম্রতা ও বিনয়ের প্রকাশ স্বরূপ। কেননা, তিনি ছিলেন সর্বশেষ নবী, তিনি ছিলেন দুনিয়া ও আখিরাতে নিঃসন্দেহে আদম সন্তানের সর্দার। এর বিপরীত হওয়ার কোন অবকাশ নেই।

আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

۞ إِنَّاۤ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَیۡكَ كَمَاۤ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ نُوحࣲ وَٱلنَّبِیِّـۧنَ مِنۢ بَعۡدِهِۦۚ وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰۤ إِبۡرَ ٰ⁠هِیمَ وَإِسۡمَـٰعِیلَ وَإِسۡحَـٰقَ وَیَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطِ وَعِیسَىٰ وَأَیُّوبَ وَیُونُسَ وَهَـٰرُونَ وَسُلَیۡمَـٰنَۚ وَءَاتَیۡنَا دَاوُۥدَ زَبُورࣰا ۝ وَرُسُلࣰا قَدۡ قَصَصۡنَـٰهُمۡ عَلَیۡكَ مِن قَبۡلُ وَرُسُلࣰا لَّمۡ نَقۡصُصۡهُمۡ عَلَیۡكَۚ وَكَلَّمَ ٱللَّهُ مُوسَىٰ تَكۡلِیمࣰا

[Surat An-Nisa' ১৬৩ - ১৬৪]

“আমি তো তোমার কাছে ওহী প্রেরণ করেছি, যেমন নূহ ও তার পরবর্তী নবীদের কাছে প্রেরণ করেছিলাম, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাঁর বংশধরগণ ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারূন ও সুলায়মান-এর নিকটও ওহী প্রেরণ করেছিলাম এবং দাউদকে যাবূর দিয়েছিলাম। অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের কথা পূর্বে আমি তোমাকে বলেছি এবং অনেক রাসূল, যাদের কথা তোমাকে বলিনি এবং মূসার সাথে আল্লাহ্ সাক্ষাত বাক্যালাপ করেছিলেন। (সূরা নিসাঃ ১৬৩ – ১৬৪)

আল্লাহ্ তা’আলা আরও ইরশাদ করেনঃ

(یَـٰۤأَیُّهَا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ لَا تَكُونُوا۟ كَٱلَّذِینَ ءَاذَوۡا۟ مُوسَىٰ فَبَرَّأَهُ ٱللَّهُ مِمَّا قَالُوا۟ۚ وَكَانَ عِندَ ٱللَّهِ وَجِیهࣰا)

[Surat Al-Ahzab ৬৯]

“হে মুমিনগণ! মূসাকে যারা ক্লেশ দিয়েছে, তোমরা তাদের মত হয়ো না। ওরা যা রটনা করেছিল, আল্লাহ তা থেকে তাকে নির্দোষ প্রমাণিত করেন এবং আল্লাহর নিকট সে মর্যাদাবান। (সূরা আহযাবঃ ৬৯)

ইমাম বুখারী (رحمة الله) আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন; মূসা (عليه السلام) ছিলেন এক লজ্জাশীল ও পর্দা রক্ষাকারী ব্যক্তি। শালীনতার কারণে তার দেহের কোন অংশই দেখা যেতো না। তাই বনী ইসরাঈলের কিছু সংখ্যক লোক তাকে অপবাদ দিল ও বলতে লাগল, কোন রোগের কারণে তিনি নিজের পায়ের চামড়া কাউকে দেখতে দেন না। তিনি শ্বেত রোগ কিংবা একশিরা অথবা অন্য কোন রোগে আক্রান্ত রয়েছেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে সে সব দোষ থেকে মুক্ত বলে প্রতিপন্ন করতে ইচ্ছে করলেন। একদিন মূসা (عليه السلام) এক নির্জন স্থানে গোসল করছিলেন ও পাথরের উপর কাপড় রেখেছিলেন। যখন তিনি গোসল সেরে কাপড় পরার জন্যে কাপড় ধরতে গেলেন, অমনি পাথর কাপড় নিয়ে দৌড়াতে লাগল। মূসা (عليه السلام) হাতে লাঠি ধারণ করলেন ও পাথরের পেছনে ছুটলেন এবং বলতে লাগলেন, ‘হে পাথর! আমার কাপড়, হে পাথর! আমার কাপড়।’ এমনিভাবে তিনি দৌড়াতে দৌড়াতে বনী ইসরাঈলের গণ্যমান্য লোকদের সামনে হাযির হয়ে গেলেন। তখন তারা তাঁকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখে নিল যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। এভাবে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের অপবাদ থেকে তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করেন। পাথরটি থেমে গেল, মূসা (عليه السلام) আপন কাপড় তুলে নিয়ে পরে নিলেন আর পাথরকে তিনি লাঠি দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন। তিনটি, চারটি কিংবা পাঁচটি আঘাতের কারণে পাথরের উপর অংশ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। এই তথ্যের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে নিম্নের আয়াতেঃ

(یَـٰۤأَیُّهَا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ لَا تَكُونُوا۟ كَٱلَّذِینَ ءَاذَوۡا۟ مُوسَىٰ فَبَرَّأَهُ ٱللَّهُ مِمَّا قَالُوا۟ۚ وَكَانَ عِندَ ٱللَّهِ وَجِیهࣰا)

‘হে মু’মিনগণ! তোমরা ওদের মত হয়ো না, যারা মূসাকে ক্লেশ দিয়েছিল। ওরা যা রটনা করেছিল, আল্লাহ্ তা থেকে তাকে নির্দোষ প্রমাণিত করেন এবং আল্লাহর নিকট সে মর্যাদাবান।’ (সূরা আহযাবঃ ৬৯)

ইমাম আহমদ (رحمة الله), ইমাম বুখারী (رحمة الله) ও মুসলিম (رحمة الله) বিভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। প্রাচীন কালের আলিমগণের কেউ কেউ বলেন, মূসা (عليه السلام)-এর মাহাত্মের একটি ছিল—তিনি আল্লাহ তা’আলার সমীপে আপন ভাই-এর ব্যাপারে সুপারিশ করেছিলেন এবং তাঁকে তার সাহায্যকারী হিসেবে পাওয়ার জন্যে দরখাস্ত করেছিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর দরখাস্ত কবূল করেছিলেন এবং তাঁর ভাইকে নবীও করে দিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

(وَوَهَبۡنَا لَهُۥ مِن رَّحۡمَتِنَاۤ أَخَاهُ هَـٰرُونَ نَبِیࣰّا)

[Surat Maryam ৫৩]

‘আমি নিজ অনুগ্রহে তাকে দিলাম তার ভাই হারূনকে নবীরূপে।’ (সূরা মারয়ামঃ ৫৩)

ইমাম বুখারী (رحمة الله) আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদিন রাসূল (ﷺ) কিছু সম্পদ সাহাবীদের মধ্যে বণ্টন করেন। তখন এক ব্যক্তি বলল, এই বণ্টনের দ্বারা আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য রাখা হয়নি। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে এসে তাঁকে তা জানালাম। তখন আমি তার চেহারায় ক্রোধের ভাব লক্ষ্য করলাম। তখন তিনি ইরশাদ করেন, মূসা (عليه السلام)-এর উপর আল্লাহ্ তা’আলার রহমত বর্ষিত হোক। তাকে এর চাইতেও বেশি ক্লেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি ধৈর্যধারণ করেছিলেন। ইমাম মুসলিম (رحمة الله)-ও অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ (رحمة الله)-ও আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ তাঁর সাহাবীগণকে সম্বোধন করে বলেন, তোমাদের মধ্য হতে কেউ যেন কারোর দোষ সম্বন্ধে আমাকে অবহিত না করে। কেননা আমি চাই, যেন তোমাদের মধ্যে পরিষ্কার মন নিয়ে চলাফেরা করি। অর্থাৎ আমার মনে যেন তোমাদের কারো ব্যাপারে বিরূপ ধারণা না থাকে। বর্ণনাকারী বর্ণনা করেন, ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর কাছে কিছু সম্পদ এসে পৌঁছল। তখন তিনি এগুলো বিতরণ করলেন। আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, আমি দুই ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন একজন অন্যজনকে বলছিল, আল্লাহর শপথ, এই বিরতণে মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর সন্তুষ্টি কিংবা আখিরাত কামনা করেন নি। তখন আমি সেখানে দাঁড়ালাম ও তাদের কথোপকথন শুনলাম। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর কাছে আগমন করলাম এবং বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বলেছেন যে, আমার সাহাবীদের মধ্য হতে কেউ যেন আমার কাছে কারোর দুর্ণাম না করে। কিন্তু আমি অমুক ও অমুকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম আর তারা এরূপ এরূপ বলছিল। এতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারা রক্তিম হয়ে গেল। তিনি এতে খুবই দুঃখ পেলেন এবং বললেন, “এসব বাদ দাও, মূসা (عليه السلام)-কে এর চাইতেও অধিক দুঃখ-কষ্ট দেয়া হয়েছিল। তবুও তিনি ধৈর্যধারণ করেছিলেন।”

আবু দাউদ ও তিরমিযী (رحمة الله) ভিন্ন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মিরাজের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মূসা (عليه السلام)-এর কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম কালে দেখেন, তিনি তাঁর কবরে সালাত আদায় করছেন।

সহীহায়নের অন্য হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, মিরাজের রাতে ষষ্ঠ আসমানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মূসা (عليه السلام)-এর সাথে সাক্ষাত করেন। জিবরাঈল (عليه السلام) বললেন, ‘ইনিই মূসা, একে সালাম করুন।’ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেন, আমি তাকে সালাম করলাম। উত্তরে তিনি বললেন, ‘পুণ্যবান নবী ও পুণ্যবান ভাইকে স্বাগতম।’ রাসূল (ﷺ) বলেন, যখন আমি তাঁকে অতিক্রম করি তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, “আপনি কাঁদছেন কেন?” তিনি বললেন, “আমার পরে একজন যুবককে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে, যার বেহেশতে প্রবেশকারী উম্মতের সংখ্যা আমার উম্মতের চাইতে বেশি হবে।’ পক্ষান্তরে ইবরাহীম (عليه السلام) সপ্তম আসমানে অবস্থান করছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় ইবরাহীম (عليه السلام) ষষ্ঠ আসমানে এবং ঈসা (عليه السلام) সপ্তম আসমানে অবস্থান করছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু পূর্বোক্ত বর্ণনা বিশুদ্ধতর।

বিশিষ্ট মুহাদ্দিসগণের মতে, মূসা (عليه السلام) ষষ্ঠ আসমান এবং ইবরাহীম (عليه السلام) সপ্তম আসমানে বায়তুল মামুরের প্রতি পিঠ দিয়ে হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন। বায়তুল মামুরে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা যিয়ারত করেন এবং তারা আর কোনদিন সেখানে আসেন না। তবে এ ব্যাপারে সমস্ত বর্ণনাকারীই একমত যে, আল্লাহ তা’আলা যখন মুহাম্মদ (ﷺ) ও তাঁর উম্মতের প্রতি দিনে-রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করেন তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মূসা (عليه السلام)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মূসা (عليه السلام) বললেন, আপনি আপনার প্রতিপালকের কাছে ফেরত যান এবং তাঁর কাছে আবেদন করুন, যেন তিনি আপনার উম্মতের জন্যে তা লাঘব করে দেন। কেননা, আমি আপনার পূর্বে বনী ইসরাঈলের আচরণে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। অথচ আপনার উম্মত চোখ, কান ও অন্তরের দিক থেকে বনী ইসরাঈল থেকে দুর্বলতর।

মূসা (عليه السلام)-এর পরামর্শে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে গিয়ে প্রতিবার হ্রাস করাতে করাতে শেষ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্তে পৌঁছলেন। এবার আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, এই নাও পাঁচ ওয়াক্ত কিন্তু সওয়াবের দিক থেকে তা হবে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সমান। আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ও মূসা (عليه السلام) উভয়কে আমাদের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দিন।

ইমাম বুখারী (رحمة الله) আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) আমাদের কাছে তাশরীফ আনেন এবং বলেন, “আমার সম্মুখে সকল উম্মতকে পেশ করা হয়। তখন আমি একটি বিরাট দল দেখতে পেলাম যা দিগন্ত জুড়ে রয়েছে। ঘোষণা করা হল যে, এই হচ্ছে মূসা (عليه السلام) ও তাঁর উম্মত। ইমাম বুখারী (رحمة الله) সংক্ষিপ্ত আকারে এবং ইমাম আহমদ (رحمة الله) বিস্তারিতভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “একদিন হুসায়ন ইবন আবদুর রহমান সাঈদ ইবন জুবায়র (رضي الله عنه)-এর কাছে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে ঐ তারকাটি দেখেছ, যা গত রাতে বিধ্বস্ত হয়েছে?” হুসায়ন (رضي الله عنه) বলেন, ‘আমি দেখেছি।’ এরপর তিনি আবার বলেন, ‘আমি নামাযে ছিলাম না। কেননা আমাকে বিচ্ছু বা সাপ দংশন করেছিল।’ তিনি বললেন, ‘তখন তুমি কী করলে? তখন আমি বললাম, আমি ঝাড়-ফুঁক করাই।’ তিনি বললেন, ‘তুমি কেন তা করতে গেলে?’ তখন আমি বললাম, ‘বুরাইদাহ আসলামী (رحمة الله) থেকে বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে।’ তিনি বলেন, ঝাড়-ফুঁক করা হয় অন্যের কুদৃষ্টি অথবা দংশন থেকে রক্ষা পাবার জন্যে।

সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র বলেনঃ শ্রুত হাদীসের উপর যিনি হুবহু আমল করে থাকেন, তিনি উত্তম কাজই করে থাকেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি ইরশাদ করেছেনঃ সকল উম্মতকে আমার সামনে পেশ করা হলে আমি কোন নবীকে দেখলাম, তার সাথে একটি ক্ষুদ্র দল রয়েছে, আবার কোন নবীকে দেখলাম তার সাথে কেবল একজন কি দুইজন। আবার এমন নবীকেও দেখলাম যার সাথে একজন লোকও নেই। অতঃপর আমার কাছে একটি বিরাট জামাতকে উপস্থিত করা হলো। আমি বললাম, এরাই বুঝি আমার উম্মত। তখন বলা হল, এ হচ্ছে মূসা (عليه السلام) ও তাঁর সম্প্রদায়। আমাকে বলা হল, এবার দিগন্ত রেখার দিকে তাকান। দেখতে পেলাম, একটি বিশাল দল। অতঃপর বলা হল, ‘এদিকে একটু লক্ষ্য করুন!’ দেখলাম, এ দিকেও একটি বিশাল দল। তখন বলা হল, এরাই হচ্ছে আপনার উম্মত। তাদের সাথে রয়েছে এমন সত্তর হাজার ব্যক্তি যারা বিনাহিসাবে এবং শাস্তি ভোগ ব্যতীতই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’

অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) উঠে দাঁড়ালেন এবং ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন সকলে এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলেন। তখন তারা বলাবলি করতে লাগলেন, এরা কারা হতে পারে, যারা বিনা হিসাবে ও আযাব ভোগ ব্যতীতই জান্নাতে প্রবেশ করবেন? কেউ কেউ বললেন, সম্ভবত তারা হচ্ছেন নবী করীম (ﷺ)-এর সাহাবীগণ। আবার কেউ কেউ বললেন, সম্ভবত তারা হচ্ছেন ঐ সব ব্যক্তি যারা ইসলামের যুগে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং আল্লাহ তা’আলার সাথে কখনো কাউকে শরীক করেন নি। এ ধরনের অনেক কিছুই তারা উল্লেখ করলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অতঃপর তাদের দিকে বেরিয়ে আসলেন এবং বললেন, তোমরা কাদের ব্যাপারে বলাবলি করছ? তখন তারা তাদের কথোপকথন সম্বন্ধে তাকে অবহিত করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, “তারা হচ্ছে ঐ সব ব্যক্তি যারা কপটতা করে না, যারা ঝাড়ফুঁকের আশ্রয় নেয় না। যারা অশুভ নিয়ে কু-সংস্কারের আশ্রয় নেয় না এবং তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি ভরসা রাখে।’

এই হাদীস শুনে উক্কাশা ইবন মুহায়সিন আল আসাদী (رضي الله عنه) বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাদের একজন।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তাদের একজন।’ অতঃপর অন্য এক ব্যক্তি দাঁড়িয় বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমিও তাদের একজন।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘উক্কাশা এ ব্যাপারে তোমার চাইতে অগ্রগামী হয়ে গেছে।’ এই হাদীসটি বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। আমরাও কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা বর্ণনাকালে আবার এটার উল্লেখ করব। আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (عليه السلام) সম্পর্কে কুরআনের বহু জায়গায় উল্লেখ করেছেন ও তাঁর প্রশংসা করেছেন এবং তাঁর কালামে মজীদে মূসা (عليه السلام)-এর কাহিনী কোথাও বিস্তারিত আবার কোথাও সংক্ষিপ্ত আকারে বহুবার উল্লেখ করেছেন। কুরআনের বহু স্থানে মুহাম্মদ (ﷺ) ও তাঁর প্রতি প্রেরিত কিতাবের পাশাপাশি মূসা (عليه السلام) ও তাঁর প্রতি প্রদত্ত কিতাব তাওরাত সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন। যেমন সূরা বাকারায় রয়েছেঃ

وَلَمَّا جَاۤءَهُمۡ رَسُولࣱ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّقࣱ لِّمَا مَعَهُمۡ نَبَذَ فَرِیقࣱ مِّنَ ٱلَّذِینَ أُوتُوا۟ ٱلۡكِتَـٰبَ كِتَـٰبَ ٱللَّهِ وَرَاۤءَ ظُهُورِهِمۡ كَأَنَّهُمۡ لَا یَعۡلَمُونَ[Surat Al-Baqarah ১০১]

অর্থাৎ—যখন আল্লাহর পক্ষ হতে তাদের নিকট রাসূল আসল, যে তাদের নিকট যা রয়েছে তার সমর্থক, তখন যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের একদল আল্লাহর কিতাবটিকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করল, যেন তারা জানে না। (সূরা বাকারাঃ ১০১)

অন্যত্র আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ الۤمۤ ۝ ٱللَّهُ لَاۤ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡحَیُّ ٱلۡقَیُّومُ ۝ نَزَّلَ عَلَیۡكَ ٱلۡكِتَـٰبَ بِٱلۡحَقِّ مُصَدِّقࣰا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡهِ وَأَنزَلَ ٱلتَّوۡرَىٰةَ وَٱلۡإِنجِیلَ ۝ مِن قَبۡلُ هُدࣰى لِّلنَّاسِ وَأَنزَلَ ٱلۡفُرۡقَانَۗ إِنَّ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ بِـَٔایَـٰتِ ٱللَّهِ لَهُمۡ عَذَابࣱ شَدِیدࣱۗ وَٱللَّهُ عَزِیزࣱ ذُو ٱنتِقَامٍ[Surat Aal-E-Imran ১ - ৪]

অথাৎ-আলিফ লাম মীম, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও সর্বসত্তার ধারক। তিনি সত্যসহ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যা তার পূর্বের কিতাবের সমর্থক। আর তিনি অবতীর্ণ করেছিলেন তাওরাত ও ইঞ্জীল ইতিপূর্বে; মানব জাতির সৎপথ প্রদর্শনের জন্য আর তিনি ফুরকানও অবতীর্ণ করেছেন। যারা আল্লাহর নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে, তাদের জন্য কঠোর শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ্ মহাপরাক্রমশালী দণ্ডদাতা। (সূরা আল ইমরান ১ – ৪)

সূরায়ে আনয়ামে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

وَمَا قَدَرُوا۟ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦۤ إِذۡ قَالُوا۟ مَاۤ أَنزَلَ ٱللَّهُ عَلَىٰ بَشَرࣲ مِّن شَیۡءࣲۗ قُلۡ مَنۡ أَنزَلَ ٱلۡكِتَـٰبَ ٱلَّذِی جَاۤءَ بِهِۦ مُوسَىٰ نُورࣰا وَهُدࣰى لِّلنَّاسِۖ تَجۡعَلُونَهُۥ قَرَاطِیسَ تُبۡدُونَهَا وَتُخۡفُونَ كَثِیرࣰاۖ وَعُلِّمۡتُم مَّا لَمۡ تَعۡلَمُوۤا۟ أَنتُمۡ وَلَاۤ ءَابَاۤؤُكُمۡۖ قُلِ ٱللَّهُۖ ثُمَّ ذَرۡهُمۡ فِی خَوۡضِهِمۡ یَلۡعَبُونَ ۝ وَهَـٰذَا كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ مُبَارَكࣱ مُّصَدِّقُ ٱلَّذِی بَیۡنَ یَدَیۡهِ وَلِتُنذِرَ أُمَّ ٱلۡقُرَىٰ وَمَنۡ حَوۡلَهَاۚ وَٱلَّذِینَ یُؤۡمِنُونَ بِٱلۡـَٔاخِرَةِ یُؤۡمِنُونَ بِهِۦۖ وَهُمۡ عَلَىٰ صَلَاتِهِمۡ یُحَافِظُونَ

[Surat Al-An'am ৯১ - ৯২]

‘তারা আল্লাহ্ তা’আলার যথার্থ মর্যাদা উপলব্ধি করেনি; যখন তারা বলে, আল্লাহ্ মানুষের নিকট কিছুই নাযিল করেন নি। বল, কে নাযিল করেছেন মূসার আনীত কিতাব যা মানুষের জন্য আলো ও পথনির্দেশ ছিল তা তোমরা বিভিন্ন পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করে কিছু প্রকাশ কর ও যার অনেকাংশ গোপন রাখ এবং যা তোমাদের পিতৃ-পুরুষগণ ও তোমরা জানতে না তাও শিক্ষা দেয়া হয়েছিল? বল, আল্লাহই; তারপর তাদেরকে নিরর্থক আলোচনারূপ খেলায় মগ্ন হতে দাও। আমি এ কল্যাণময় কিতাব নাযিল করেছি, যা এর পূর্বেকার কিতাবের সমর্থক এবং যা দ্বারা তুমি মক্কা ও এর চতুর্পার্শ্বের লোকদেরকে সতর্ক কর, যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে তারা তাতে বিশ্বাস করে এবং তারা তাদের সালাতের হেফাজত করে। (সূরা আন’আমঃ ৯১-৯২)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা তাওরাতের প্রশংসা করেছেন। অতঃপর কুরআনুল করীমের ততোধিক প্রশংসা করেছেন।

এরপর আল্লাহ্ তা’আলা অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ

ثُمَّ ءَاتَیۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَـٰبَ تَمَامًا عَلَى ٱلَّذِیۤ أَحۡسَنَ وَتَفۡصِیلࣰا لِّكُلِّ شَیۡءࣲ وَهُدࣰى وَرَحۡمَةࣰ لَّعَلَّهُم بِلِقَاۤءِ رَبِّهِمۡ یُؤۡمِنُونَ ۝ وَهَـٰذَا كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ مُبَارَكࣱ فَٱتَّبِعُوهُ وَٱتَّقُوا۟ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ

[Surat Al-An'am ১৫৪ - ১৫৫]

‘তারপর আমি মূসাকে দিয়েছিলাম কিতাব যা সৎকর্মপরায়ণের জন্য সম্পূর্ণ, যা সমস্ত কিছুর বিশদ বিবরণ, পথ-নির্দেশ এবং দয়াস্বরূপ, যাতে তারা তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাত সম্বন্ধে বিশ্বাস করে। এই কিতাব আমি নাযিল করেছি যা কল্যাণময়। সুতরাং এটার অনুসরণ কর এবং সাবধান হও, হয়তো তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে। (সূরা আন’আমঃ ১৫৪-১৫৫)

আল্লাহ্ তা’আলা সূরা মায়িদায় ইরশাদ করেনঃ

إِنَّاۤ أَنزَلۡنَا ٱلتَّوۡرَىٰةَ فِیهَا هُدࣰى وَنُورࣱۚ یَحۡكُمُ بِهَا ٱلنَّبِیُّونَ ٱلَّذِینَ أَسۡلَمُوا۟ لِلَّذِینَ هَادُوا۟ وَٱلرَّبَّـٰنِیُّونَ وَٱلۡأَحۡبَارُ بِمَا ٱسۡتُحۡفِظُوا۟ مِن كِتَـٰبِ ٱللَّهِ وَكَانُوا۟ عَلَیۡهِ شُهَدَاۤءَۚ فَلَا تَخۡشَوُا۟ ٱلنَّاسَ وَٱخۡشَوۡنِ وَلَا تَشۡتَرُوا۟ بِـَٔایَـٰتِی ثَمَنࣰا قَلِیلࣰاۚ وَمَن لَّمۡ یَحۡكُم بِمَاۤ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰۤىِٕكَ هُمُ ٱلۡكَـٰفِرُونَ[Surat Al-Ma'idah ৪৪]

وَلۡیَحۡكُمۡ أَهۡلُ ٱلۡإِنجِیلِ بِمَاۤ أَنزَلَ ٱللَّهُ فِیهِۚ وَمَن لَّمۡ یَحۡكُم بِمَاۤ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰۤىِٕكَ هُمُ ٱلۡفَـٰسِقُونَ ۝ وَأَنزَلۡنَاۤ إِلَیۡكَ ٱلۡكِتَـٰبَ بِٱلۡحَقِّ مُصَدِّقࣰا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡهِ مِنَ ٱلۡكِتَـٰبِ وَمُهَیۡمِنًا عَلَیۡهِۖ فَٱحۡكُم بَیۡنَهُم بِمَاۤ أَنزَلَ ٱللَّهُۖ وَلَا تَتَّبِعۡ أَهۡوَاۤءَهُمۡ عَمَّا جَاۤءَكَ مِنَ ٱلۡحَقِّۚ لِكُلࣲّ جَعَلۡنَا مِنكُمۡ شِرۡعَةࣰ وَمِنۡهَاجࣰاۚ وَلَوۡ شَاۤءَ ٱللَّهُ لَجَعَلَكُمۡ أُمَّةࣰ وَ ٰ⁠حِدَةࣰ وَلَـٰكِن لِّیَبۡلُوَكُمۡ فِی مَاۤ ءَاتَىٰكُمۡۖ فَٱسۡتَبِقُوا۟ ٱلۡخَیۡرَ ٰ⁠تِۚ إِلَى ٱللَّهِ مَرۡجِعُكُمۡ جَمِیعࣰا فَیُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ فِیهِ تَخۡتَلِفُونَ

[Surat Al-Ma’idah ৪৭ – ৪৮]

‘নিশ্চয়ই আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলাম; তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো; নবীগণ যারা আল্লাহর অনুগত ছিল তারা ইহুদীদের সে অনুসারে বিধান দিত, আরো বিধান দিত রাব্বানীগণ এবং বিদ্বানগণ, কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল এবং তারা ছিল তার সাক্ষী। সুতরাং মানুষকে ভয় করবে না, আমাকেই ভয় করবে এবং আমার আয়াতসমূহ তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করবে না। আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারাই কাফির।

ইনজীল অনুসারীগণ যেন আল্লাহ তাতে যা অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুসারে বিধান দেয়। আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই ফাসিক। আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি এর পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সমর্থক ও সংরক্ষক রূপে। (সূরা মায়িদাঃ ৪৪, ৪৭ ও ৪৮)

উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনুল করীমকে অন্যান্য কিতাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী, এগুলোর সমর্থক অন্যান্য কিতাবে যা কিছু বিকৃতি ও পরিবর্তন করা হয়েছে তার প্রকাশকারীরূপে গণ্য করেছেন। কিতাবীদেরকে তাদের কিতাবসমূহের রক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু তারা এগুলোর হিফাজত করতে পারেনি। এগুলো সংরক্ষণ ও এগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করতে সমর্থ হয়নি। এ জন্যই তাদের নির্বদ্ধিতা, জ্ঞানের স্বল্পতা, তাদের উপাস্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদির কারণে ঐ সব কিতাবে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আর তাদের প্রতিও কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’আলার লা’নত। এ জন্যেই তাদের কিতাবগুলোতে আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর রাসূল সম্পর্কে এমন সব স্পষ্ট ভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়, যেগুলোর কদর্যতা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

সূরায়ে আম্বিয়ায় আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

وَلَقَدۡ ءَاتَیۡنَا مُوسَىٰ وَهَـٰرُونَ ٱلۡفُرۡقَانَ وَضِیَاۤءࣰ وَذِكۡرࣰا لِّلۡمُتَّقِینَ ۝ ٱلَّذِینَ یَخۡشَوۡنَ رَبَّهُم بِٱلۡغَیۡبِ وَهُم مِّنَ ٱلسَّاعَةِ مُشۡفِقُونَ ۝ وَهَـٰذَا ذِكۡرࣱ مُّبَارَكٌ أَنزَلۡنَـٰهُۚ أَفَأَنتُمۡ لَهُۥ مُنكِرُونَ[Surat Al-Anbiya' ৪৮ - ৫০]

‘আমি তো মূসা ও হারূনকে দিয়েছিলাম ফুরকান, জ্যোতি ও উপদেশ, মুত্তাকীদের জন্যে যারা না দেখেও তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এবং তারা কিয়ামত সম্বন্ধে ভীত-সন্ত্রস্ত। এটা কল্যাণময় উপদেশ, আমি এটা অবতীর্ণ করেছি। তবুও কি তোমরা এটাকে অস্বীকার কর? (সূরা আম্বিয়াঃ ৪৮ – ৫০)

সূরায়ে কাসাসে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

فَلَمَّا جَاۤءَهُمُ ٱلۡحَقُّ مِنۡ عِندِنَا قَالُوا۟ لَوۡلَاۤ أُوتِیَ مِثۡلَ مَاۤ أُوتِیَ مُوسَىٰۤۚ أَوَلَمۡ یَكۡفُرُوا۟ بِمَاۤ أُوتِیَ مُوسَىٰ مِن قَبۡلُۖ قَالُوا۟ سِحۡرَانِ تَظَـٰهَرَا وَقَالُوۤا۟ إِنَّا بِكُلࣲّ كَـٰفِرُونَ ۝ قُلۡ فَأۡتُوا۟ بِكِتَـٰبࣲ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ هُوَ أَهۡدَىٰ مِنۡهُمَاۤ أَتَّبِعۡهُ إِن كُنتُمۡ صَـٰدِقِینَ[Surat Al-Qasas ৪৮ - ৪৯]

‘তারপর যখন আমার নিকট থেকে তাদের নিকট সত্য আসল, তারা বলতে লাগল, মূসাকে যেরূপ দেয়া হয়েছিল, তাকে সেরূপ দেয়া হলো না কেন? কিন্তু পূর্বে মূসাকে যা দেয়া হয়েছিল তা কি তারা অস্বীকার করেনি? ওরা বলেছিল, দুটিই জাদু, একে অপরকে সমর্থন করে। এবং ওরা বলেছিল, ‘আমরা সকলকে প্রত্যাখ্যান করি।’ বল, তোমরা সত্যবাদী হলে আল্লাহর নিকট হতে এক কিতাব আনয়ন কর, যা পথনির্দেশে এ দুটি থেকে উৎকৃষ্টতর হবে, আমি সেই কিতাব অনুসরণ করব। (সূরা কাসাসঃ ৪৮ – ৪৯)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা উভয় কিতাব ও উভয় রাসূলের প্রশংসা করেছেন।

রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর দরবার হতে ফিরে গিয়ে জিনরা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, আমরা এমন একটি কিতাবের বাণী শুনেছি, যা মূসা (عليه السلام)-এর পরে অবতীর্ণ হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর প্রতি প্রথম ওহী নাযিল হয় নিম্নরূপঃ

بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِی خَلَقَ ۝ خَلَقَ ٱلۡإِنسَـٰنَ مِنۡ عَلَقٍ ۝ ٱقۡرَأۡ وَرَبُّكَ ٱلۡأَكۡرَمُ ۝ ٱلَّذِی عَلَّمَ بِٱلۡقَلَمِ ۝ عَلَّمَ ٱلۡإِنسَـٰنَ مَا لَمۡ یَعۡلَمۡ ۝ كَلَّاۤ إِنَّ ٱلۡإِنسَـٰنَ لَیَطۡغَىٰۤ ۝ أَن رَّءَاهُ ٱسۡتَغۡنَىٰۤ

[Surat Al-Alaq ১ - ৭]

অর্থাৎ, পাঠ কর, তোমার প্রতি পালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত হতে। পাঠ কর, আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না। (সূরা আলাকঃ ১-৫)

এই প্রথম ওহী নাযিল হবার প্রেক্ষিতে যে ঘটনা ঘটেছিল তা শোনার পর ওয়ারকা ইবন নওফল বলেছিল, পবিত্র, পবিত্র, ইনিই সেই জিবরীল (নামূস) যিনি মূসা ইবন ইমরানের নিকট ওহী নিয়ে এসেছিলেন। মোটকথা, মূসা (عليه السلام)-এর শরীয়ত ছিল মহান, তাঁর উম্মতের সংখ্যা ছিল প্রচুর, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বহু নবী, আলিম-ইবাদতগোযার বান্দা, সাধুসন্তু, বুদ্ধিজীবী, বাদশাহ, আমীর-সর্দার ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। কিন্তু তাঁরা যখন বিদায় নিলেন, তখন সে উম্মতের মধ্যেও পরিবর্তন দেখা দিল। যেমন তাদের এবং তাদের শরীয়তেও বিকৃতি ঘটলো। তারা নিজ নিজ কর্মদোষে বানর ও শূকরে পরিণত হলো। একের পর এক বিধান রহিত হতে লাগল এবং তাদের উপর বিপদাপদ নেমে আসতে লাগল। তাদের এই ঘটনাসমূহ খুবই দীর্ঘ ও আলোচনা-সাপেক্ষ। তাই অতি সংক্ষেপে অবহিত হতে ইচ্ছুকদের জন্যে তার কিঞ্চিত বর্ণনা করা হবে।

মূসা (عليه السلام)-এর বায়তুল্লাহয় হজ্জ পালন

ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘আল আযরাক’ উপত্যকায় গমন করেন এবং প্রশ্ন করেন, ‘এটা কোন্ উপত্যকা?’ উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘আল আযরাক উপত্যকা।’ তখন তিনি ইরশাদ করলেন, ‘আমি যেন মূসা (عليه السلام)-কে দেখতে পাচ্ছি, তিনি যেন রাস্তার মোড় থেকে অবতরণ করছেন এবং তালবিয়া সহকারে আল্লাহ্ তা’আলাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকছেন।’ এরপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) হারশা মোড়ে পৌঁছলেন এবং প্রশ্ন করলেন, ‘এটা কোন মোড়?’ উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম বললেন, “এটা হারশা মোড়।’ তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেন, ‘আমি যেন ইউনুস ইবন মাত্তা (عليه السلام)-কে দেখতে পাচ্ছি। তিনি একটি লাল রঙের উটের উপর সওয়ার রয়েছেন, তাঁর পরনে পশমের একটি জুব্বা এবং তাঁর উটের নাকের দড়ি ছিল খেজুর গাছের ছালের। তিনি তালবিয়া পড়ছেন।’ এই হাদীসটি মুসলিমও বর্ণনা করেছেন।

তাবারানী (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে মারফূ রূপে হাদীস বর্ণনা করেন যে, মূসা (عليه السلام) একটি লাল রঙের ষাঁড়ে সওয়ার হয়ে হজ্জ করেছিলেন। এ হাদীসটি অত্যন্ত গরীব পর্যায়ের।

ইমাম আহমদ (رحمة الله) মুজাহিদ (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা একদিন আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর নিকটে ছিলাম। সকলে দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগলেন। কেউ একজন বললেন, দাজ্জালের কপালে দুই চক্ষুর মাঝে ك-ف-ر লিখা থাকবে। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) মুজাহিদকে বলেন, ‘তারা কি বলাবলি করছে?’ মুজাহিদ (رحمة الله) বললেন, ‘তারা বলছেন, দাজ্জালের দুই চোখের মাঝখানে ك-ف-ر লিখা থাকবে। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে আমি এরূপ কথা বলতে শুনিনি। তবে এই কথা বলতে শুনেছি, ইবরাহীম (عليه السلام) সম্বন্ধে জানতে হলে তোমাদের সাথীর দিকে অর্থাৎ আমার দিকে লক্ষ্য কর। আর মূসা (عليه السلام) ছিলেন ধূসর রংয়ের ব্যক্তি, তাঁর ছিল কোঁকড়ানো চুল। তিনি লাল রঙের উটের উপর সওয়ার ছিলেন। উটের নাকের দড়ি ছিল খেজুর গাছের ছালের। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আমি যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছি। আর তিনি উপত্যকা থেকে তালবীয়া পড়ায় রত অবস্থায় নেমে আসছেন।

ইমাম আহমদ (رحمة الله) অন্য এক সূত্রে আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন, ‘(মিরাজের রাতে) ঈসা ইবন মারয়াম, মূসা (عليه السلام) ও ইবরাহীম (عليه السلام)-কে দেখেছি। তবে ঈসা (عليه السلام)-এর রঙ সাদা। তিনি ছিলেন কোকড়ানো চুল ও চওড়া বুকধারী। মূসা (عليه السلام) ছিলেন ধূসর রঙের এবং বিশালদেহী।’ সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ইবরাহীম (عليه السلام) কেমন ছিলেন? তিনি বললেন, তোমাদের সাথী অর্থাৎ আমার দিকে তাকাও।

ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আল্লাহর নবী বলেছেন, মিরাজের রাতে আমি মূসা (عليه السلام) ইবন ইমরানকে দেখেছি একজন দীর্ঘদেহী ও কোঁকড়ানো চুলধারী ব্যক্তি হিসেবে, মনে হয় যেন তিনি শানুয়া গোত্রের লোক। ঈসা ইব্‌ন মারয়াম (عليه السلام)-কে দেখেছি মাঝারি গড়ন, লাল-সাদা মিশ্রিত রং ও লম্বাটে মাথার অধিকারী।

ইমাম আহমদ (رحمة الله) অন্য এক সূত্রে আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন, ‘মিরাজের রাতে আমি মূসা (عليه السلام)-এর সাথে সাক্ষাত করেছি।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁর শারীরিক গঠন বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘তিনি ছিলেন ঢেউ খেলানো চুলের অধিকারী, যেন তিনি শানুয়া গোত্রের একজন।’ এরপর আমি ঈসা (عليه السلام)-এর সাথে সাক্ষাত করলাম। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ঈসা (عليه السلام)-এর শারীরিক গঠন বর্ণনা করেন এবং বলেন, ‘তিনি ছিলেন মাঝারি গড়নের ও গৌরবর্ণের অধিকারী। মনে হয় তিনি যেন এইমাত্র গোসলখানা থেকে বেরিয়ে এসেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমি ইবরাহীম (عليه السلام)-কে দেখেছি। তাঁর বংশধরের মধ্যে তাঁর সাথে আমার অত্যধিক সামঞ্জস্য রয়েছে।’ ইবরাহীম (عليه السلام)-এর আলোচনায় এই ধরনের অধিকাংশ হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।

মূসা (عليه السلام)-এর ইন্তিকাল

ইমাম বুখারী (رحمة الله) তাঁর ‘সহীহ বুখারী’তে ‘মূসা (عليه السلام)-এর ইন্তিকাল’ শিরোনামে আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদিন মৃত্যুর ফেরেশতা (আযরাঈল)-কে মূসা (عليه السلام)-এর কাছে প্রেরণ করা হয়। যখন তিনি মূসা (عليه السلام)-এর কাছে আসলেন, তখন তিনি তাঁকে চপেটাঘাত করলেন। ফেরেশতা আল্লাহ তা’আলার দরবারে ফিরে গিয়ে আরয করলেন, “আপনি আমাকে এমন এক বান্দার কাছে প্রেরণ করেছেন যিনি মৃত্যু চান না। আল্লাহ তা’আলা বললেন, তার কাছে পুনরায় যাও ও তাঁকে একটি ষাঁড়ের পিঠে হাত রাখতে বল এবং এ কথাটিও বল যে, তার হাতের নিচে যতগুলো চুল পড়বে তাঁকে তত বছরের আয়ু দেয়া হবে।’ মূসা (عليه السلام) বললেন, “হে আমার প্রতিপালক! তারপর কি হবে? আল্লাহ্ বললেন, ‘তারপর মৃত্যু।’ তখন তিনি বললেন, ‘তাহলে এখনই তা হয়ে যাক।’

বর্ণনাকারী বলেন, তখন তিনি আল্লাহ তা’আলার দরবারে আরয করলেন যেন তাকে একটি ঢিল নিক্ষেপের দূরত্বে পবিত্র ভূমি বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকটবর্তী করা হয়। আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেন, “যদি আমি সেখানে এখন থাকতাম, তাহলে ঐ স্থানটিতে তাঁর কবরটি তোমাদেরকে চিহ্নিত করে দেখাতাম। এটা রাস্তার পার্শ্বে ‘লাল ঢিবির নিকটে অবিস্থত।” ভিন্ন সূত্রেও অনুরূপ বর্ণিত রয়েছে। ইমাম মুসলিম (رحمة الله) ও ইমাম আহমদ (رحمة الله) অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে আহমদ (رحمة الله)-ও আবু হুরায়রা (رضي الله عنه)-এর উক্তিরূপে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, মৃত্যুর ফেরেশতা মূসা (عليه السلام)-এর নিকট আগমন করে বললেন, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিন।’ তিনি তখন মৃত্যুর ফেরেশতাকে চপেটাঘাত করে তার একটি চোখ নষ্ট করে দেন। ফেরেশতা তখন আল্লাহ্ তা’আলার কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপনি আমাকে আপনার এমন এক বান্দার কাছে প্রেরণ করেছেন, যিনি মৃত্যু চান না। তিনি আমার চোখ নষ্ট করে দিয়েছেন।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘তখন আল্লাহ্ তা’আলা তার চোখ নিরাময় করে দিলেন এবং বললেন, তুমি আমার বান্দার কাছে ফিরে যাও এবং তাকে বল, আপনি কি দীর্ঘায়ু চান? যদি আপনি দীর্ঘায়ু চান, তাহলে আপনি একটি ষাঁড়ের পিঠের উপর আপনার হাত রাখুন এবং আপনার হাতের নিচে যতগুলো লোম পড়বে তত বছরের আয়ু আপনাকে প্রদান করা হবে।’ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘তারপর কি হবে?’ আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, ‘তারপর মৃত্যু!’ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাহলে অচিরেই মৃত্যু দেয়া হোক।’ এ বর্ণনাটি শুধু ইমাম আহমদ (رحمة الله)-এরই।

ইবন হিব্বান (رحمة الله)-ও উপরোক্ত হাদীসটি আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করে এ হাদীসে কিছু জটিলতা রয়েছে বলে ইঙ্গিত করে এগুলোর যে উত্তর প্রদান করেছেন তার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপঃ

মৃত্যুর ফেরেশতা যখন মূসা (عليه السلام)-কে মৃত্যুর কথা বললেন, তখন তিনি তাঁকে চিনতে পারেননি। কেননা, তিনি মূসা (عليه السلام)-এর কাছে অপরিচিত অবয়বে আগমন করেছিলেন। যেমন একবার জিবরাঈল (عليه السلام) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকটে এক বেদুঈনের অবয়বে আগমন করেছিলেন। ইবরাহীম (عليه السلام) ও লুত (عليه السلام)-এর নিকট ফেরেশতাগণ যুবকের অবয়বে এসেছিলেন। তাই তাঁরা তাঁদেরকে প্রথমে চিনতে পারেননি। অনুরূপভাবে মূসা (عليه السلام)-ও তাঁকে সম্ভবত চিনতে পারেননি, তাই তাঁকে চপেটাঘাত করে তাঁর চোখ নষ্ট করে দিয়েছিলেন। কেননা, তিনি বিনা অনুমতিতে মূসা (عليه السلام)-এর ঘরে প্রবেশ করেছিলেন। এই ব্যাখ্যাটি আমাদের শরীয়তসম্মত। কেননা, যদি কেউ কারো ঘরের মধ্যে বিনা অনুমতিতে তাকায় তাহলে এভাবে তার চোখ ফুটো করে দেয়ার বৈধতা রয়েছে। অতঃপর তিনি হাদীসটি আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেন, একদা মূসা (عليه السلام)-এর রূহ কবয করার জন্যে মৃত্যুর ফেরেশতা মূসা (عليه السلام)-এর কাছে আগমন করে তাঁকে বলেন, ‘আপনার প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিন!’ তখন মূসা (عليه السلام) মৃত্যুর ফেরেশতাকে চপেটাঘাত করলেন। তাতে তাঁর চোখ বিনষ্ট হয়ে যায়। এরপর তিনি সম্পূর্ণ হাদীসটি বর্ণনা করেন, যেমন ইমাম বুখারী (رحمة الله)-ও এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

অতঃপর তিনি তার ব্যাখ্যায় বলেন, ‘যখন মূসা (عليه السلام) মৃত্যুর ফেরেশতাকে চপেটাঘাত করার জন্যে হাত উঠালেন, তখন ফেরেশতা তাকে বললেনঃ অর্থাৎ “আপনার প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিন।” তাঁর এ ধরনের ব্যাখ্যা যথার্থ বলে মেনে নেয়া যায় না, কেননা মূল পাঠে তাকে চপেটাঘাত করার বিষয়টি প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিন’ বলার পরের ঘটনা বলে উল্লেখিত হয়েছে। তবে প্রথম ব্যাখ্যাটি মূল পাঠের সাথে সামঞ্জস্যশীল। কেননা, মূসা (عليه السلام) মৃত্যুর ফেরেশতাকে চিনতে পারেন নি। ঐ নির্দিষ্ট সময়টিতে ফেরেশতা রূহ কবয করার জন্যে আসবেন এরূপ ধারণা করাও হয়নি। কেননা, মূসা (عليه السلام) অনেক কিছু করার আশা পোষণ করেছিলেন আর সেই সব কাজ বাকি রয়ে গিয়েছিল। যেমন মূসা (عليه السلام) ময়দানে তীহ থেকে বের হয়ে পবিত্র ভূমি বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন যে, তিনি হারূন (عليه السلام)-এর পর ‘তীহ’ প্রান্তরে ইনতিকাল করবেন। অচিরেই এ সম্পর্কে বর্ণনা পেশ করা হবে।

কোন কোন তাফসীরকার মনে করেন, মূসা (عليه السلام) বনী ইসরাঈলকে নিয়ে তীহ ময়দান থেকে বের হয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেছিলেন। এই অভিমতটি কিতাবীদের ও জমহুর উলামার অভিমতের পরিপন্থী। আর এটা মূসা (عليه السلام)-এর সেই দু’আর সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ। যাতে তিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি ঢিল নিক্ষেপের তফাতে বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকটবর্তী করুন।’ যদি তিনি তথায় প্রবেশই করে ফেলতেন, তাহলে তিনি এরূপ দু’আ করতেন না। কিন্তু তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের সাথে তীহ প্রান্তরে ছিলেন। যখন তাঁর মৃত্যু সন্নিকট হল, তখন তিনি যেই পবিত্র ভূমিতে হিজরত করার জন্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই ভূমির নিকটবর্তী হবার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করলেন এবং নিজের সম্প্রদায়কে এই কাজে অনুপ্রাণিত করলেন, কিন্তু তাদের ও তাদের আকাঙ্ক্ষিত পবিত্র ভূমির মাঝে ভাগ্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এই জন্যই সারা দুনিয়ার জন্যে প্রেরিত রাসূল ও মানব-কুল শিরোমনি মুহাম্মদ (ﷺ) ইরশাদ করেন, ‘যদি আমি সেখানে যেতাম, তাহলে তোমাদেরকে লাল ঢিবির কাছে মূসা (عليه السلام)-এর কবর দেখাতাম।’

ইমাম বুখারী (رحمة الله) আনাস ইবন মালিক (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, ‘মি’রাজের রাতে যখন আমি মূসা (عليه السلام)-এর কাছে গমন করলাম তখন আমি তাকে লাল ঢিবির নিকট তাঁর কবরে সালাত আদায় করতে দেখলাম।’

ইমাম মুসলিম (رحمة الله)-ও অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেন। সুদ্দী (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন। তারা বলেন, অতঃপর আল্লাহ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-এর কাছে ওহী প্রেরণ করলেন, আমি হারূন (عليه السلام)-কে মৃত্যু দান করব। তাই তাঁকে অমুক পাহাড়ে নিয়ে আস। নির্দেশ মুতাবিক মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام) নির্দেশিত পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হলেন। পথে তারা এমন একটি গাছ দেখতে পেলেন, যেরূপ গাছ কেউ কোনদিন দেখেনি। এরপর তাঁরা একটি পাকা ঘর দেখতে পেলেন, সেখানে একটি খাট রয়েছে এবং খাটে সুসজ্জিত বিছানাও রয়েছে। আর ঘরে তখন সুবাতাস খেলছে।

হারূন (عليه السلام) যখন পাহাড় ও ঘরের দিকে তাকালেন তখন এগুলো তার কাছে খুবই ভাল লাগল। তাই তিনি বললেনঃ “হে মূসা! আমি এই খাটে ঘুমাতে চাই।’ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘আপনার ভাল লাগলে আপনি এখানে ঘুমিয়ে পড়ুন।’ হারূন (عليه السلام) বললেন, ‘তবে আমার ভয় হচ্ছে, ঘরের মালিক যদি এসে আমার উপর রাগান্বিত হন।’ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘এ ব্যাপারে আপনি কোন ভয় করবেন না, ঘরের মালিকের ব্যাপারটি আমিই দেখব। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।’ তিনি বললেন, “হে মূসা! তুমিও আমার সাথে ঘুমিয়ে পড়। যদি ঘরের মালিক আসেন তাহলে তিনি আমাদের দু’জনের প্রতিই রাগান্বিত হবেন।’ যখন তারা দু’জনই ঘুমিয়ে পড়লেন, হারূন (عليه السلام)-কে মৃত্যু স্পর্শ করল। যখন তিনি ব্যাপারটি টের পেলেন, তখন বললেন, “হে মূসা! তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়েছ।” হারূন (عليه السلام) যখন ইন্তিকাল করলেন, ঘর, গাছ ও খাট আসমানে উঠিয়ে নেয়া হল। অতঃপর মূসা (عليه السلام) যখন তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসলেন, অথচ হারূন (عليه السلام)-ও তার সাথে নেই, তখন বনী ইসরাঈলরা বলতে লাগল, “নিশ্চয়ই মূসা হারূনকে হত্যা করেছেন।’ বনী ইসরাঈলরা হারূন (عليه السلام)-কে যেহেতু অধিকতর ভালবাসে, সে জন্য মূসা হিংসা করে হারূন (عليه السلام)-কে হত্যা করেছেন। বস্তুত মূসা (عليه السلام) থেকে বনী ইসরাঈলের কাছে হারূন (عليه السلام) ছিলেন অধিকতর নমনীয়। পক্ষান্তরে মূসা (عليه السلام)-এর মধ্যে ছিল কিছুটা কঠোরতা।মূসা (عليه السلام) একথা শুনে তাদেরকে বললেন, “তোমাদের জন্য আমাদের আফসোস, তোমরা কি জান না, তিনি ছিলেন আমার সহোদর। তোমরা কি করে ভাবলে যে, আমি তাঁকে হত্যা করতে পারি?’ যখন তারা এ বিষয় নিয়ে মূসা (عليه السلام)-কে অধিক জ্বালাতন করতে লাগল, তখন তিনি দাঁড়িয়ে দু’রাকাত সালাত আদায় করলেন ও আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রার্থনা করলেন। তখন খাটটি উপর থেকে নিচে নেমে আসল এবং তারা সকলে আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী জায়গায় হারূন (عليه السلام)-এর লাশটি দেখতে পেল।

অতঃপর মূসা (عليه السلام) ও তাঁর খাদেম ইউশা (عليه السلام) একদিন পায়চারী করছিলেন। এমনি সময় একটি কাল বাতাস বইতে লাগল। ইউশা (عليه السلام) সেদিকে তাকালেন এবং এটাকে কিয়ামতের আলামত বলে ধারণা করলেন। তখন তিনি মূসা (عليه السلام)-কে জড়িয়ে ধরলেন এবং বলতে লাগলেন, ‘কিয়ামত সমাগত আর আমি আল্লাহর নবী মূসা (عليه السلام)-কে জড়িয়ে ধরে আছি।’ মূসা (عليه السلام) তখন জামার ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়লেন এবং ইউশা (عليه السلام)-এর হাতে জামা রয়ে গেল। ইউশা (عليه السلام) জামা নিয়ে যখন বনী ইসরাঈলের কাছে আসলেন, তখন তারা তাঁকে অভিযুক্ত করে বলতে লাগল, “তুমি আল্লাহর নবীকে হত্যা করেছ।” তিনি বললেন, ‘না, আল্লাহর শপথ, আমি তাকে হত্যা করিনি। বরং তিনি আমার হাত থেকে ছুটে চলে গেছেন।’ তারা তার কথা বিশ্বাস করল না এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হল। ইউশা (عليه السلام) বললেন, “যেহেতু তোমরা আমাকে বিশ্বাস করছ না, সেহেতু আমাকে তিন দিনের অবকাশ দাও।” অতঃপর তিনি আল্লাহ তা’আলার নিকট প্রার্থনা করেন। ফলে যত জন ইউশা (عليه السلام)-কে পাহারা দিত সকলকে স্বপ্নে দেখানো হল যে, ইউশা (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-কে হত্যা করেন নি বরং তাকে আল্লাহ তা’আলা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। ফলে তারা ছেড়ে দিল। অন্যদিকে মূসা (عليه السلام)-এর সাথে যারা দুর্ধর্ষ লোকদের কবলিত পবিত্র শহর বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করতে অস্বীকার করেছিল তাদের কেউই এ শহরের বিজয়ের সময় অবশিষ্ট ছিল না। সকলেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল। তবে উপরোক্ত বর্ণনার সূত্রে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আল্লাহই অধিকতর জ্ঞাত। পূর্বে আমরা বর্ণনা করেছি যে, মূসা (عليه السلام)-এর সাথে যারা ছিলেন, তাঁদের মধ্য হতে ইউশা ইবন নূন (عليه السلام) ও কালিব ইবন ইউকাল্লা (عليه السلام) ব্যতীত অন্য কেউ তীহ প্রান্তর থেকে বের হতে পারেনি। কালিব ছিলেন মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام)-এর বোন মারয়ামের স্বামী। তারা উল্লেখিত দুই ব্যক্তি ইসরাঈলদেরকে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন।

ওহাব ইবন মুনাব্বিহ্ (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন যে, একদিন মূসা (عليه السلام) একদল ফেরেশতার নিকট আগমন করলেন। তারা তখন একটি কবর খুঁড়ছিলেন। এই কবর থেকে উত্তম, সুন্দর ও মনোরম কবর কখনও দেখা যায়নি। তিনি ফেরেশতাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনারা কার জন্যে এই কবরটি খুঁড়ছেন? তারা বললেন, “এটা আল্লাহ্ তা’আলার এক বান্দার জন্যে যিনি খুবই সম্মানিত। যদি আপনি এরূপ সম্মানিত বান্দা হতে চান তাহলে এ কবরে প্রবেশ করুন। বহুক্ষণ এখানে সটান শুয়ে পড়ুন এবং আপনার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ করুন এবং আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস নিতে থাকুন। তিনি তাই করলেন ও ইন্তিকাল করলেন। ফেরেশতাগণ তাঁর জানাযার নামায আদায় করেন এবং তাঁকে দাফন করেন।

কিতাবীরা ও অন্যান্য উলামায়ে কিরাম উল্লেখ করেন যে, মূসা (عليه السلام) যখন ইনতিকাল করেন তখন তাঁর বয়স ছিল একশ বিশ বছর। ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে মারফু হাদীস বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন; পূর্বে মৃত্যুর ফেরেশতা জনগণের কাছে প্রকাশ্যে আগমন করতেন। তাই একদিন মূসা (عليه السلام)-এর কাছেও প্রকাশ্যে আগমন করলেন। অমনি মূসা (عليه السلام) তাঁকে চপেটাঘাত করে তাঁর চোখ নষ্ট করে দেন। ফেরেশতা প্রতিপালকের কাছে আগমন করলেন ও বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনার বান্দা মূসা (عليه السلام) আমার চোখ বিনষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি যদি আপনার কাছে সম্মানিত না হতেন তাহলে আমি তাঁর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতাম।’

আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, “হে ফেরেশতা! তুমি আমার বান্দার কাছে ফিরে যাও এবং তাকে বল যে, সে যেন একটি ষাঁড়ের পিঠের উপর তার হাত রাখে। তাতে তার হাতের নিচে যতটি লোম পড়বে তাকে তত বছরের আয়ু দেয়া হবে।’ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘তারপর কী হবে?’ তিনি বললেন, “তারপর মৃত্যু।” মূসা (عليه السلام) বললেন, “তাহলে তা এখনই হোক।” বর্ণনাকারী বলেন, মৃত্যুর ফেরেশতা তাঁকে একটি বস্তুর ঘ্রাণ নিতে দিলেন এবং এভাবে তাঁর রূহ কবয করলেন। বর্ণনাকারী বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা মৃত্যুর ফেরেশতার চোখ নিরাময় করে দিলেন। এরপর থেকে মৃত্যুর ফেরেশতা লোকজনের কাছে গোপনে আসেন। ইবন জারীর তাবারী (رحمة الله)-ও অনুরূপ হাদীস মারভাবে বর্ণনা করেন।

ইউশা (عليه السلام)-এর নবুওত লাভ এবং বনী ইসরাঈলের দায়িত্ব গ্রহণ

তিনি হলেন ইউশা ইবন নূন ইবন আফরাসীম ইবন ইউসুফ (عليه السلام) ইব্‌ন ইয়াকূব (عليه السلام) ইবন ইসহাক (عليه السلام) ইবন ইবরাহীম খলীল (عليه السلام)। কিতাবীরা বলেন, “ইউশা হলেন হুদ (عليه السلام)-এর চাচাতো ভাই। আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন শরীফে খিযির (عليه السلام)-এর ঘটনা প্রসঙ্গে ইউশা (عليه السلام)-এর নাম উল্লেখ না করে তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ “স্মরণ কর, যখন মূসা তার খাদেমকে বলেছিল।’ বুখারী শরীফেও উবায় ইবন কা’ব (رضي الله عنه) থেকে নাম ধরে তার বর্ণনা এসেছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন যে, তিনি হলেন ইউশা ইবন নূন (عليه السلام)। কিতাবীদের মধ্যে তাঁর নবুওত সম্পর্কে ঐকমত্য রয়েছে। তাদের একটি দল যারা সামিরাহ বলে বিখ্যাত, তারা মূসা (عليه السلام)-এর পর ইউশা ইবন নূন (عليه السلام) ব্যতীত কারো নবুওত স্বীকার করে না। তাওরাতে ইউশা (عليه السلام)-এর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই তারা ইউশা (عليه السلام) ব্যতীত অন্যের নবুওতকে অস্বীকার করে। অথচ অন্যদের নবুওত প্রতিপালকের তরফ থেকে সত্য ও যথার্থ। তাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’আলার লা’নত বর্ষিত হতে থাকবে।

ইবন জারীর প্রমুখ তাফসীরকার, মুহাম্মদ ইবন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন; মূসা (عليه السلام)-এর শেষ জীবনে মূসা (عليه السلام) হতে ইউশা (عليه السلام)-এর দিকে নবুওত স্থানান্তরিত হয়। মূসা (عليه السلام) ইউশা (عليه السلام)-এর সাথে সাক্ষাত করে প্রশ্ন করতেন যে, কি কি নতুন আদেশ-নিষেধ অবতীর্ণ হয়েছে। একদিন ইউশা (عليه السلام) বলেন, “হে কালীমুল্লাহ্! আমি আপনাকে কোন দিনও প্রশ্ন করিনি যে, আপনার কাছে আল্লাহ্ তা’আলা কী ওহী প্রেরণ করেছেন, আপনিই বরং প্রয়োজনে আমাকে নিজের পক্ষ থেকে ওহী সম্পর্কে ব্যক্ত করতেন।’ তখন মূসা (عليه السلام) বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করলেন এবং মৃত্যুকেই শ্রেয় বিবেচনা করলেন। উপরোক্ত বর্ণনায় সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কেননা মূসা (عليه السلام)-এর কাছে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সর্বদাই আল্লাহর আদেশ, ওহী, শরয়ী নির্দেশ ও কথাবার্তা অবতীর্ণ হত এবং তিনি আল্লাহ তা’আলার নিকট আজীবন সম্মানিত, যোগ্য, মর্যাদাবান ও দক্ষতাসম্পন্ন নবী রূপেই ছিলেন। বুখারী শরীফে মূসা (عليه السلام) কর্তৃক মৃত্যুর ফেরেশতার চোখ বিনষ্ট করা সম্পর্কিত হাদীসটি ইতিপূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে।

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক (رحمة الله)-এর উপরোক্ত বর্ণনাটি যদি তিনি আহলি কিতাবদের কিতাব থেকে বর্ণনা করে থাকেন তাহলে জেনে রাখা দরকার যে, তাদের তাওরাত নামী কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, মূসা (عليه السلام)-এর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বনী ইসরাঈলের প্রয়োজন মুতাবিক আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি আদেশ-নিষেধ সংক্রান্ত ওহী অবতীর্ণ করেছেন। তাঁবু আকৃতির গম্বুজে স্থাপিত সাক্ষ্যদানে তাঁবূত সম্বন্ধে তাদের কিতাবে উল্লেখিত তথ্যাদি পর্যালোচনা করলে তা সহজেই প্রতীয়মান হয়। বনী ইসরাঈলের তৃতীয় যাত্রা পুস্তকে উল্লেখ রয়েছে যে, বনী ইসরাঈলকে ১২টি গোত্রে বিভক্ত করার জন্যে আল্লাহ তা’আলা মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আবার প্রতিটি গোত্রের একজন আমীর নির্ধারণ করার জন্যে হুকুম দিয়েছিলেন। আমীরকে বলা হতো নকীব। তীহ ময়দান থেকে বের হবার পর দুর্ধর্ষ জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি হিসেবে তাদেরকে এরূপ বিভক্ত করার হুকুম দেয়া হয়েছিল। আর এ নির্দেশটি ছিল চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হবার শেষের দিকে। এ জন্যই কেউ কেউ বলেছেন, মূসা (عليه السلام) মৃত্যুর ফেরেশতার চোখ বিনষ্ট করে দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি তাঁকে তাঁর ঐ সময়ের অবয়বে চেনেননি। অধিকন্তু আল্লাহ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-কে এমন একটি কাজের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর যমানায় যেটা সংঘটিত হবার তিনি আশা পোষণ করছিলেন কিন্তু তার আমলে এটা সংঘটিত হওয়া তকদীরের ফয়সালা ছিল না। বরং এটা তাঁর খাদেম ইউশা ইবন নূনের ভাগ্যেই নির্ধারিত ছিল।

যেমন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) সিরিয়ার রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইচ্ছে করেছিলেন এবং এজন্য নবম হিজরীতে তিনি তাবুকে পৌঁছেও ছিলেন। কিন্তু ঐ বছর তিনি যুদ্ধ না করে ফিরে আসেন। অতঃপর দশম হিজরীতে তিনি হজ আদায় করেন ও মদীনায় ফিরে এসে উসামা (رضي الله عنه)-কে আমীর নিযুক্ত করেন। তাঁর জীবদ্দশায় সিরিয়ার উদ্দেশে একটি সেনাদল প্রেরণের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন এবং নিম্ন বর্ণিত আয়াতের মর্মানুযায়ী স্বয়ং যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নেন।

যাতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

قَـٰتِلُوا۟ ٱلَّذِینَ لَا یُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَلَا بِٱلۡیَوۡمِ ٱلۡـَٔاخِرِ وَلَا یُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَلَا یَدِینُونَ دِینَ ٱلۡحَقِّ مِنَ ٱلَّذِینَ أُوتُوا۟ ٱلۡكِتَـٰبَ حَتَّىٰ یُعۡطُوا۟ ٱلۡجِزۡیَةَ عَن یَدࣲ وَهُمۡ صَـٰغِرُونَ[Surat At-Tawbah ২৯]

অর্থাৎ, যাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহে ঈমান আনে না, শেষ দিনেও নয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন, তা হারাম গণ্য করে না এবং সত্য দীন অনুসরণ করেনা, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে স্বহস্তে জিযিয়া দেয়। (সূরা তওবাঃ ২৯)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উসামা বাহিনী প্রস্তুত করার সাথে সাথেই ইনতিকাল করেন। তখন উসামা জুরাফ নামক স্থানে স্থাপিত তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইনতিকালের পর তাঁর খলীফা আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) উসামা বাহিনী প্রেরণের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করেন। অতঃপর যখন আরব উপদ্বীপের অবস্থা স্বাভাবিক হয় ও নিজেদের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের অবসান ঘটে এবং সত্য তার নিজস্ব পথে অগ্রসর হয়, পূর্ব-পশ্চিমে ইরাক-সিরিয়ায় এবং পারস্য সম্রাট কিসরার সাথী-সংগীও রোম সম্রাট কায়সরের বাহিনীর বিরুদ্ধে ইসলামী বাহিনী প্রেরণ করা হয় এবং আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে বিজয় দান করেন এবং শত্রু পক্ষের জানমালের অধিকারী করে দেন। এ সম্বন্ধে ইনশাআল্লাহ যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। অনুরূপ আল্লাহ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-কে বনী ইসরাঈল থেকে সৈন্য সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে নকীব নির্ধারণ করতে হুকুম দিয়েছিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

( وَلَقَدۡ أَخَذَ ٱللَّهُ مِیثَـٰقَ بَنِیۤ إِسۡرَ ٰ⁠ۤءِیلَ وَبَعَثۡنَا مِنۡهُمُ ٱثۡنَیۡ عَشَرَ نَقِیبࣰاۖ )

[Surat Al-Ma'idah ১২]

অর্থাৎ, আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাঈলের অংগীকার গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের মধ্য হতে বারজন নেতা নিযুক্ত করেছিলেন। (সূরা মায়েদাঃ ১২)

۞ وَلَقَدۡ أَخَذَ ٱللَّهُ مِیثَـٰقَ بَنِیۤ إِسۡرَ ٰ⁠ۤءِیلَ وَبَعَثۡنَا مِنۡهُمُ ٱثۡنَیۡ عَشَرَ نَقِیبࣰاۖ وَقَالَ ٱللَّهُ إِنِّی مَعَكُمۡۖ لَىِٕنۡ أَقَمۡتُمُ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَیۡتُمُ ٱلزَّكَوٰةَ وَءَامَنتُم بِرُسُلِی وَعَزَّرۡتُمُوهُمۡ وَأَقۡرَضۡتُمُ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنࣰا لَّأُكَفِّرَنَّ عَنكُمۡ سَیِّـَٔاتِكُمۡ وَلَأُدۡخِلَنَّكُمۡ جَنَّـٰتࣲ تَجۡرِی مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَـٰرُۚ فَمَن كَفَرَ بَعۡدَ ذَ ٰ⁠لِكَ مِنكُمۡ فَقَدۡ ضَلَّ سَوَاۤءَ ٱلسَّبِیلِ

[Surat Al-Ma'idah ১২]

অর্থাৎ, আর আল্লাহ বলেছিলেন, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি; তোমরা যদি সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও, আমার রাসূলগণে ঈমান আন ও তাদেরকে সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করব এবং নিশ্চয় তোমাদেরকে দাখিল করব জান্নাতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; এর পরও কেউ কুফরী করলে সে সরল পথ হারাবে। (সূরা মায়েদাঃ ১২)

অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে উদ্দেশ করে বলেন, তোমাদের প্রতি আমি যা বাধ্যতামূলক করেছি তা যদি তোমরা যথাযথ পালন কর এবং যুদ্ধ থেকে বিরত না থাক—যেমন পূর্বে বিরত ছিলে তাহলে এটার সওয়াবকে আমি তোমাদের উপর পতিত গযব ও শাস্তির কাফফারা রূপে গণ্য করব। এ প্রসঙ্গে হুদায়বিয়ার যুদ্ধে যে সব বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে পিছু হটে রয়েছিল তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

قُل لِّلۡمُخَلَّفِینَ مِنَ ٱلۡأَعۡرَابِ سَتُدۡعَوۡنَ إِلَىٰ قَوۡمٍ أُو۟لِی بَأۡسࣲ شَدِیدࣲ تُقَـٰتِلُونَهُمۡ أَوۡ یُسۡلِمُونَۖ فَإِن تُطِیعُوا۟ یُؤۡتِكُمُ ٱللَّهُ أَجۡرًا حَسَنࣰاۖ وَإِن تَتَوَلَّوۡا۟ كَمَا تَوَلَّیۡتُم مِّن قَبۡلُ یُعَذِّبۡكُمۡ عَذَابًا أَلِیمࣰا[Surat Al-Fath ১৬]

অর্থাৎ, যে সব আরব মরুবাসী পশ্চাতে রয়ে গিয়েছিল তাদেরকে বল, তোমরা আহূত হবে এক প্রবল পরাক্রান্ত জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে; তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আত্মসমর্পণ করে। তোমরা এ নির্দেশ পালন করলে আল্লাহ তোমাদেরকে উত্তম পুরস্কার দান করবেন। আর তোমরা যদি পূর্বের মত পৃষ্ঠপ্রদর্শন কর, তিনি তোমাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি দেবেন। (সূরা ফাতহঃ ১৬)

অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা’আলা বনী ইসরাঈলের ক্ষেত্রেও বলেছেনঃ

( فَمَن كَفَرَ بَعۡدَ ذَ ٰ⁠لِكَ مِنكُمۡ فَقَدۡ ضَلَّ سَوَاۤءَ ٱلسَّبِیلِ)

[Surat Al-Ma'idah ১২]

অর্থাৎ, ‘এরপরও তোমাদের কেউ কুফরী করলে সে সরল পথ হারাবে।’ অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তাদের দুষ্কর্মের ও ওয়াদাভঙ্গের জন্য তিরস্কার করেন। যেমন তাদের পর খৃস্টানদের ধর্মীয় ব্যাপারে মতবিরোধের জন্য আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে তিরস্কার করেন। এ সম্পর্কে তাফসীরের কিতাবে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।

বস্তুত আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-কে বনী ইসরাঈলের ঐসব যোদ্ধার নাম লিপিবদ্ধ করার জন্যে নির্দেশ দেন যারা অস্ত্রধারণ করতে পারে, যুদ্ধ করতে পারে এবং বিশ বছর কিংবা তার অধিক বয়সে পৌঁছেছে আর তাদের প্রতিটি দলের জন্যে একজন নকীব তথা নেতা নির্ধারণেরও তিনি হুকুম দেন।

প্রথম গোত্রটি ছিল রূবীল-এর গোত্র। রূবীল ছিলেন ইয়াকূব (عليه السلام)-এর প্রথম সন্তান। এ গোত্রে যোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৪৬ হাজার ৫শ’। তাদের নেতা ছিলেন আল ইয়াসূর ইবন শাদ ইয়াসূরা।

দ্বিতীয় গোত্রটি ছিল শামউন-এর গোত্র। তাদের সংখ্যা ছিল ৫৯ হাজার ৩শ’। তাদের নেতা ছিলেন শালো মীঈল ইবন হুরইয়া শুদাই।

তৃতীয়টি ছিল ইয়াহুদা-এর গোত্র। তাদের সংখ্যা ছিল ৭৪ হাজার ৬শ’। তাদের নেতা ছিলেন নাহশূন ইবন ওমায়না দাব।

চতুর্থ ছিল ঈশাখার-এর গোত্র। তাদের সংখ্যা ছিল ৫৪ হাজার ৪শ’। তাদের নেতা ছিলেন নাশাঈল ইবন সাওগার।

পঞ্চম গোত্রটি ছিল ইউসুফ (عليه السلام)-এর। তাদের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার ৫শ’। তাদের নেতা ছিলেন ইউশা ইবন নূন (عليه السلام)।

ষষ্ঠ ছিল মীশা-এর গোত্র। তাদের সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ২শ’। তাদের নেতা ছিলেন জামলীঈল ইবন ফাদাহ সূর।

সপ্তম গোত্রটি ছিল বিন ইয়ামীন-এর গোত্র। তাদের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার ৪শ’। তাদের নেতা ছিলেন আবীদান ইবন জাদউন।

অষ্টম গোত্রটি ছিল হাদ-এর গোত্র। তাদের সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজার ৬শ’ ৫০ জন। তাদের নেতা ছিলেন আল ইয়াসাফ ইবন রাউঈল।

নবমটি ছিল আশীর-এর। তাদের সংখ্যা ছিল ৪১ হাজার ৫শ’। তাদের নেতা ছিলেন ফাজ-ঈল ইবন আকরান।

দশম গোত্রটি ছিল দান-এর। তাদের সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার ৭শ’ নেতা ছিলেন আখী আযার ইবন আম শুদাই।

একাদশতম গোত্রটি ছিল নাফতালী-এর গোত্র। তাদের সংখ্যা ছিল ৫৩ হাজার ৪শ’। তাদের নেতা ছিলেন আখীরা ইব্‌ন আইন।

দ্বাদশতম গোত্রটি ছিল যাবূলূন-এর গোত্র। তাদের সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার ৪শ’। তাদের নেতা ছিলেন আলবাব ইবন হাইলূন। উপরোক্ত বর্ণনাটি ইহুদীদের কিতাবে উল্লেখিত রয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলাই অধিক পরিজ্ঞাত।

বনু লাওয়ী উপরোক্ত বনী ইসরাঈলের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে বনী ইসরাঈলের সাথে যোদ্ধা হিসাবে গণ্য করতে নিষেধ করেছেন। কেননা, তারা ছিল তাঁবু গম্বুজের বহন, খাটানো ও গুটানোর দায়িত্বে নিয়োজিত। তারা ছিল মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام)-এর গোত্র। তাদের সংখ্যা ছিল ২২ হাজার। এ সংখ্যার মধ্যে ১ মাস বা তদূর্ধ বয়সের শিশুদেরকেও ধরা হয়েছে। তারা আবার নিজেরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি ছোট ছোট গোত্র, তাঁবু গম্বুজের বিভিন্ন কাজের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল। একদল এটাকে পাহারা দিত, অন্য একদল এটার যাবতীয় মেরামতের কাজে নিয়োজিত থাকত। যখন বনী ইসরাঈলরা অন্যত্র গমন করত, তখন একটি দল তাঁবু পরিবহন ও খাটানোর কাজে নিয়োজিত থাকত। তারা সকলেই তাঁবু গম্বুজের আশেপাশে, সামনে, পেছনে, ডানে ও বামে হেফাজতে নিয়োজিত থাকত।

বনু লাওয়ী ব্যতীত বনী ইসরাঈলের যোদ্ধাদের মোট সংখ্যা যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তা হচ্ছে ৫ লাখ ৭১ হাজার ৬শ’ ৫৬; কিন্তু তারা বলে ২০ বছর বয়স্ক ও তদূর্ধর অস্ত্র ধারণকারী বনী ইসরাঈলের যোদ্ধাদের সংখ্যা হচ্ছে (তা অবশ্য বনু লাওয়ীকে বাদ দিয়ে) ৬ লাখ ৩ হাজার ৫শ’ ৫৫ জন। এরূপ বর্ণনায় সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কেননা, তাদের কিতাবে উল্লেখিত উপরোক্ত সৈন্যদের মোট সংখ্যার সাথে তাদের উল্লেখিত সৈন্য সংখ্যার মিল নেই। আল্লাহ্ তাআলাই অধিক পরিজ্ঞাত।

চলার সময় তাঁবু-গম্বুজের হেফাজতে নিযুক্ত বনু লাওয়ীরা বনী ইসরাঈলের মধ্যভাগে অবস্থান করতেন। আর ডানপাশের শীর্ষে থাকতেন বনু রুবীল ও বাম পার্শ্বের শীর্ষে থাকতেন বনুবান। বনু নাফতালী হতেন পশ্চাৎবর্তী দলে অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশে মূসা (عليه السلام) বনু হারূন (عليه السلام)-কে ইমাম নির্ধারণ করলেন। তাদের পূর্বে তাদের পিতারাও এরূপ ইমাম ছিলেন। তারা ছিলেন নাদাব; হুবকারাহ, আবীহু, আল আযির ও ইয়াসমার।

বস্তুত বনী ইসরাঈলের যারা মূসা (عليه السلام)-কে বলেছিল, তুমি ও তোমার প্রতিপালক শত্রুর সাথে গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানেই বসে রইলাম। অর্থাৎ যারা দুর্দান্ত লোকজন অধ্যুষিত শহর বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিল, তাদের একজনও তখন জীবিত ছিল না।

এটা সাওরী (رحمة الله)-এর অভিমত। তিনি ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে এরূপ বর্ণনা করেন। অনুরূপভাবে কাতাদা (رحمة الله), ইকরিমা (رحمة الله) ও সুদ্দী (رحمة الله), ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه), ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণনা করেন। আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه)-সহ পূর্ব ও পরের উলামায়ে কিরাম বলছেন, হারূন (عليه السلام) ও মূসা (عليه السلام) উভয়েই ইতোপূর্বে তীহের প্রান্তরে ইনতিকাল করেছিলেন। তবে ইবন ইসহাক (رحمة الله) মনে করেন যে, যিনি বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেছেন, তিনি হচ্ছেন মূসা (عليه السلام) আর ইউশা (عليه السلام) ছিলেন তাঁর অগ্রগামী দলের প্রধান। তিনি আবার এ প্রসঙ্গে বালআম ইব্‌ন বাঊর-এর ঘটনাও বর্ণনা করেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَٱتۡلُ عَلَیۡهِمۡ نَبَأَ ٱلَّذِیۤ ءَاتَیۡنَـٰهُ ءَایَـٰتِنَا فَٱنسَلَخَ مِنۡهَا فَأَتۡبَعَهُ ٱلشَّیۡطَـٰنُ فَكَانَ مِنَ ٱلۡغَاوِینَ ۝ وَلَوۡ شِئۡنَا لَرَفَعۡنَـٰهُ بِهَا وَلَـٰكِنَّهُۥۤ أَخۡلَدَ إِلَى ٱلۡأَرۡضِ وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُۚ فَمَثَلُهُۥ كَمَثَلِ ٱلۡكَلۡبِ إِن تَحۡمِلۡ عَلَیۡهِ یَلۡهَثۡ أَوۡ تَتۡرُكۡهُ یَلۡهَثۚ ذَّ ٰ⁠لِكَ مَثَلُ ٱلۡقَوۡمِ ٱلَّذِینَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَاۚ فَٱقۡصُصِ ٱلۡقَصَصَ لَعَلَّهُمۡ یَتَفَكَّرُونَ ۝ سَاۤءَ مَثَلًا ٱلۡقَوۡمُ ٱلَّذِینَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَا وَأَنفُسَهُمۡ كَانُوا۟ یَظۡلِمُونَ[Surat Al-A'raf ১৭৫ - ১৭৭]

অর্থাৎ, তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শুনাও যাকে আমি দিয়েছিলাম নিদর্শন, অতঃপর সে ওটা বর্জন করে ও শয়তান তার পেছনে লাগে, আর সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। আমি ইচ্ছে করলে এটার দ্বারা তাকে উচ্চমর্যাদা দান করতাম কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে ও তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। তার অবস্থা কুকুরের মত, যার ওপর তুমি বোঝা চাপালে সে হাঁপাতে থাকে এবং তুমি বোঝা না চাপালেও হাঁপায়। যে সম্প্রদায় আমার নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের অবস্থাও এরূপ; তুমি বৃত্তান্ত বিবৃত কর যাতে তারা চিন্তা করে। যে সম্প্রদায় আমার নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে ও নিজেদের প্রতি জুলুম করে তাদের অবস্থা কত মন্দ! (সূরা আ’রাফঃ ১৭৫-১৭৭)

বালয়াম ইবন বাওর-এর ঘটনা তাফসীরে উল্লেখ রয়েছে। ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه) প্রমুখ উল্লেখ করেছেন যে, সে ইসমে আযম জানত। তার সম্প্রদায় তাকে মূসা (عليه السلام) ও তাঁর সম্প্রদায়ের উপর অভিশাপ দিতে অনুরোধ করেছিল। প্রথমত সে বিরত ছিল কিন্তু যখন তারা তাকে পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করল, তখন সে তার একটি গাধার উপর আরোহণ করল। এরপর বনী ইসরাঈলের শিবিরের দিকে অগ্রসর হল। যখন সে তাদের নিকটবর্তী হল, তখন গাধাটি তাকে নিয়ে বসে পড়ল। সে গাধাটিকে মারধর করতে লাগল। গাধাটি দাঁড়িয়ে কিছু দূর চলার পর আবার বসে পড়ল। তখন সে গাধাটিকে আগের চাইতে অধিক মার দিল। গাধাটি দাঁড়াল, পরে আবার বসে পড়ল। তখন সে আবার গাধাটিকে অধিক জোরে পিটাতে লাগল। তখন গাধাটির মুখে ভাষা ফুটল। সে বালয়ামকে বলতে লাগল, ‘হে বালয়াম! তুমি কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি ফেরেশতাদের দেখছ না-তাঁরা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে তীব্রভাবে বাধা দিচ্ছেন? তুমি কি আল্লাহর নবী ও মুমিনদের অভিশাপ দেওয়ার জন্য যাচ্ছ?’ তবু সে বিরত রইল না, সে আবার গাধাটিকে মার দিল।

গাধাটি অগ্রসর হল এবং হাসবান পাহাড়ের চূড়ার নিকটবর্তী হল। বালয়াম মূসা (عليه السلام)-এর শিবির ও বনী ইসরাঈলের দিকে তাকালো এবং তাদেরকে অভিশাপ দিতে লাগল। তবে তার জিহবা তার এখতিয়ারে ছিল না। সে মূসা (عليه السلام) ও তাঁর সম্প্রদায়ের জন্যে আশীর্বাদ করতে লাগল এবং তার নিজের সম্প্রদায়ের উপর অভিশাপ দিতে লাগল। তার সম্প্রদায় তাকে এ জন্য তিরস্কার করতে লাগল। তখন সে তার সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং বলল যে, সে তার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার জিহবা ক্রমেই ঝুলে পড়ছিল এবং তা শেষ পর্যন্ত বুকের উপর গিয়ে পড়ল। সে তার সম্প্রদায়কে বলতে লাগল, ‘আমার দুনিয়া ও আখিরাত বরবাদ হয়ে গেল। প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি ব্যতীত আমার জন্যে আর কোন পথই বাকি রইলো না।’ তারপর সে তার সম্প্রদায়কে নির্দেশ দিল তারা যেন তাদের নারীদেরকে বিশেষ সাজে সজ্জিত করে পণ্য বিক্রয়ের ছলে মূসা (عليه السلام)-এর সৈন্যদের কাছে পাঠায়। তারা তাদের কাছে মালপত্র বিক্রয় করবে ও নিজেদেরকে তাদের কাছে সমর্পণ করবে যাতে তারা তাদের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। কেননা, তাদের মধ্য হতে যদি একজনও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তাহলে এটা তাদের সকলের ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। তারা এরূপ করল। তাদের নারীদের বিশেষভাবে সজ্জিত করল এবং তাদেরকে বনী ইসরাঈল শিবিরে পাঠাল। তাদের মধ্যকার কুস্তি নাম্নী একজন নারী বনী ইসরাঈলের একজন সরদারের কাছে গেল। তার নাম ছিল যামরী ইবন শালুম। কথিত আছে যে, সে ছিল বনু শামাউন ইবন ইয়াকূব (عليه السلام)-এর গোত্রের সরদার। সে তখনই এই নারীটিকে নিয়ে তার তাঁবুতে প্রবেশ করল ও তার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হল। আল্লাহ্ তা‘আলা বনী ইসরাইলের প্রতি প্লেগ রোগ পাঠালেন। এ রোগ তাদের মধ্যে ছড়াতে লাগল। এই সংবাদ যখন ফিনহাস ইবন আযার ইবন হারূন-এর কাছে পৌঁছল, তখন তিনি তার লোহার বর্শা হাতে ঐ তাঁবুতে ঢুকে তাদের দুইজনকেই বিদ্ধ করলেন। অতঃপর তাদেরকে নিয়ে ঘরের বের হয়ে জনসমক্ষে আসলেন। তখন তার হাতে ঐ হাতিয়ারটিও ছিল। পুরুষ ও মহিলা উভয়ের লাশ তিনি ঘরের বাইরে নিয়ে আসেন এবং আকাশের দিকে লাশ দু’টি তুলে ধরে বললেন, ‘হে আল্লাহ্! আপনার অবাধ্যের সাথে আপনি এরূপ আচরণই করে থাকেন।’ এরপর প্লেগের প্রকোপ প্রশমিত হয়ে যায়। ঐ প্লেগ মহামারীতে সত্তর হাজার লোক মারা গিয়েছিল। যারা এ সংখ্যা কম করে বলেন, তারাও বিশ হাজার লোক মারা গিয়েছিল বলে থাকেন।

ফিনহাস ছিলেন তাঁর পিতার প্রথম সন্তান। তার পিতা আল আযার ছিলেন হারূন (عليه السلام)-এর পুত্র। এ জন্য বনী ইসরাঈলরা কুরবানীর পশুর নিতম্ব, বাহু ও চোয়াল ফিনহাস বংশীয়দের প্রাপ্য বলে মনে করত। অনুরূপভাবে তাদের সবকিছুর প্রথমটি তাদের প্রাপ্য বলে মনে করত। বালয়ামের উপরোক্ত ঘটনাটি ইবন ইসহাক (رحمة الله) বর্ণনা করেন। আর তা যথার্থই বলে বুযুর্গানে দীনের অনেকেই মন্তব্য করেছেন। তবে হয়ত মিসর থেকে প্রথমবার বায়তুল মুকাদ্দাস প্রবেশের জন্যে মূসা (عليه السلام) যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি তা বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু কোন কোন বর্ণনাকারী তা অনুধাবনে সক্ষম হননি। ইতিপূর্বেও এ সম্বন্ধে কিছু বর্ণনা তাওরাতের বরাতে উদ্ধৃত করা হয়েছে। আল্লাহই অধিক পরিজ্ঞাত। আবার এ ঘটনাটি তীহ ময়দানে ভ্রমণকালে সংঘটিত একটি ভিন্ন ঘটনাও হতে পারে। কেননা, এ ঘটনার বর্ণনায় হাসবান পাহাড়ের উল্লেখ রয়েছে। তা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে বহু দূরে অবস্থিত। অথবা এ ঘটনা ছিল মূসা (عليه السلام)-এর বাহিনীর যারা ইউশা ইবন নূন (عليه السلام)-এর নেতৃত্বে বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশে তীহ ময়দান থেকে বের হয়ে এসেছিল তাদের—যেমন সুদ্দী (رحمة الله) বলেছেন।

উপরোক্ত বিভিন্ন মতামতের প্রেক্ষিতে জমহুর উলামায়ে কিরাম এ ব্যাপারে একমত যে, হারুন (عليه السلام) তাঁর ভাই মূসা (عليه السلام)-এর প্রায় দু’বছর পূর্বে তীহ প্রান্তরে ইনতিকাল করেন। তারপর মূসা (عليه السلام)ও সেখানেই ইনতিকাল করেন। একথা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, মূসা (عليه السلام) তাঁর প্রতিপালকের কাছে বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকটবর্তী স্থানে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুআ করেছিলেন এবং তা কবুলও হয়েছিল।

বনী ইসরাঈল যার সাথে তীহ ময়দান থেকে বের হয়েছিল এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল, তিনি ছিলেন ইউশা ইবুন নূন (عليه السلام)। কিতাবীরা ও অন্যান্য ইতিহাসবেত্তা উল্লেখ করেন যে, ইউশা ইবন নুন (عليه السلام) বনী ইসরাঈলকে নিয়ে জর্দান নদী অতিক্রম করে উরায়হায় পৌঁছলেন। উরায়হা ছিল ময়দানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মজবুত প্রাচীরঘেরা দুর্গ, সুউচ্চ অট্টালিকাপূর্ণ জনবহুল শহর। তিনি এ শহরটিকে ছয় মাস অবরোধ করে রাখেন। অতঃপর একদিন ইউশা (عليه السلام)-এর সৈন্যরা শহরটি আক্রমণ করলেন এবং যুদ্ধের শিংগায় ফুঁক এবং সমস্বরে তাকবীর দিতে লাগলেন, শহরের প্রাচীরগুলোতে ফাটল সৃষ্টি হল এবং প্রাচীরের একটি বিধ্বস্ত অংশ দিয়ে ইউশা (عليه السلام)-এর সৈন্য দুর্গে ঢুকে গেলেন। তারা প্রচুর গণিমত লাভ করলেন এবং বার হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করলেন। এভাবে তারা বহু রাজরাজড়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন।

এরূপও কথিত আছে যে, ইউশা (عليه السلام) সিরিয়ার একত্রিশজন রাজার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন আবার এরূপও বর্ণিত রয়েছে যে, উপরোক্ত শহরটির অবরোধ জুম’আর দিন আসরের পর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। যখন সূর্য অস্ত যায় কিংবা অস্ত্র যাওয়ার উপক্রম হয় ও তাদের জন্য তাদের শরীয়তে নিষিদ্ধ শনিবার প্রায় আগত, তখন ইউশা (عليه السلام) সূর্যকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তুমি অস্ত যাবার জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত, আর আমিও এই শহরকে জয় করার জন্য নির্দেশ প্রাপ্ত। হে আল্লাহ! সূর্যকে আমার জন্যে ঠেকিয়ে রাখুন।’ শহরটি জয়লাভ করা পর্যন্ত আল্লাহ্ তা‘আলা সূর্যকে ইউশা (عليه السلام)-এর জন্য ঠেকিয়ে রাখলেন। অন্যদিকে আল্লাহ্ তা‘আলা চাঁদকে হুকুম দিলেন—যেন উদয় হতে বিলম্ব করে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত রাতটি ছিল পূর্ণিমার রাত। সূর্যের ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর হাদীসে উল্লেখিত রয়েছে। যা একটু পরেই আমরা আলোচনা করছি। তবে চাঁদের ব্যাপারটি কিতাবীদের দ্বারা বর্ণিত এবং তা হাদীসের পরিপন্থী নয়; বরং এটা অতিরিক্ত। এ বর্ধিত অংশকে সত্য বা মিথ্যা বলা যায় না। তারা আরো উল্লেখ করেন যে, এ ঘটনাটি ঘটেছিল উরায়হা বিজয়কালে। তবে এতে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা অধিক পরিজ্ঞাত। অধিকতর গ্রহণযোগ্য মতামত হচ্ছে—এ ঘটনাটি ঘটেছিল বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়কালে। মূল লক্ষ্য ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় আর উরায়হা বিজয় ছিল তার উপায় মাত্র।

ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন—ইউশা (عليه السلام) ব্যতীত অন্য কারোর জন্যে সূর্যকে নিশ্চল করে রাখা হয়নি। এ বর্ণনাটি শুধু ইমাম আহমদ (رحمة الله) থেকেই বর্ণিত। তবে এটা ইমাম বুখারী (رحمة الله)-এর শর্ত অনুযায়ী সূত্রে বর্ণিত। এ হাদীসের দ্বারা বোঝা যায়, বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মিত হয় ইউশা ইবন নূন (عليه السلام)-এর হাতে, মূসা (عليه السلام)-এর হাতে নয়। আর সূর্যের নিশ্চলতা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়কালে, উরায়হা বিজয় করার সময় নয়। এ কথা আমরা পূর্বেই বর্ণনা করেছি। আবার এটাও বোঝা যায় যে, সূর্যকে নিশ্চল করে রাখা ছিল ইউশা (عليه السلام)-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বর্ণনার দ্বারা নিম্নোক্ত হাদীসের দুর্বলতাও বোঝা যায়, যাতে বলা হয়েছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলী (رضي الله عنه)-এর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলেন। সে জন্য আলী (رضي الله عنه) আসরের নামায আদায় করতে পারেননি। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আবেদন করলেন, যেন সূর্যকে তার জন্য ফিরিয়ে দেয়া হয় যাতে তিনি আসরের নামায আদায় করতে পারেন। তখন সূর্যকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। উপরোক্ত হাদীস আলী ইবন সালেহ আল মিসরী (رحمة الله) বিশুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এটা মুনকার হাদীস যার মধ্যে বিশুদ্ধতার লেশমাত্র নেই। এমনকি এটাকে হাসান পর্যায়ের হাদীসও বলা যায় না। এ ঘটনাটি বহু সংখ্যক বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক অথচ এক পর্যায়ে আহলে বায়তের কোন একজন মাত্র অপরিচিত মহিলা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন একজন নবী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তখন তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বলেন, যে ব্যক্তি নব বিবাহিত, এখনও বাসর রাত যাপন করেনি, সে যেন আমার সৈন্যদলের অন্তর্ভুক্ত না হয়, আর এমন ব্যক্তিও যেন অন্তর্ভুক্ত না হয়—যে ঘরের ভিত্তি পত্তন করেছে কিন্তু এখনও তার ছাদ দিতে পারেনি। আবার এমন ব্যক্তিও যেন অন্তর্ভুক্ত না হয়, যে বকরী কিংবা মেষ খরিদ করেছে ও শাবক জন্মের অপেক্ষায় রয়েছে। অতঃপর তিনি যুদ্ধ করতে করতে এমন সময় শহরের নিকটবর্তী হলেন, যখন আসরের সালাত আদায় করা হয় কিংবা তিনি বলেন, আসরের ওয়াক্তের নিকটবর্তী হন। তখন তিনি সূর্যকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তুমি যেমন নির্দেশপ্রাপ্ত তেমনি আমিও নির্দেশপ্রাপ্ত। হে আল্লাহ! এটাকে ক্ষণকাল আমার জন্যে নিশ্চল করে রাখুন!’ অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা বিজয় দান পর্যন্ত সূর্যকে নিশ্চল করে রাখেন। নবীর সৈন্যগণ গনীমতের মাল এক স্থানে জড়ো করলেন এবং আগুন এগুলোকে গ্রাস করার জন্যে আসল কিন্তু গ্রাস করতে অস্বীকার করল। তখন তিনি বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা কেউ এ গনীমতের মাল হতে কিছু মালে খিয়ানত করেছ, কাজেই তোমাদের প্রতি গোত্র থেকে একজন করে আমার কাছে বায়আত কর।’ তারা বায়আত করলো। একজনের হাত নবীর হাতের সাথে আটকে গেল। তখন তিনি বললেন, ‘তোমাদের গোত্রের লোকই গনীমতের মাল আত্মসাৎ করেছে। কাজেই তোমাদের গোত্রের লোকজনকে বল, আমার বায়আত গ্রহণ করতে।’ গোত্রের সকলে তাঁর হাতে বায়আত হল, কিন্তু দুই বা তিনজনের হাত নবীর হাতের সাথে আটকিয়ে গেল। তখন নবী বললেন, ‘তোমাদের কাছে চুরির মাল রয়েছে। তোমরাই আত্মসাৎকারী।’ তখন তারা একটি গরুর মাথা পরিমাণ স্বর্ণ বের করে দিল। বর্ণনাকারী বলেন, তারা তা গনীমতের মালের সাথে রেখে দিল। মাল ময়দানে রাখা ছিল। এরপর আগুন অগ্রসর হয়ে আসল এবং মালগুলোকে গ্রাস করে নিল। আমাদের উম্মতের পূর্বে কারোর জন্য গনীমতের মাল বৈধ ছিল না। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের দুর্বলতা ও অক্ষমতার দিকে লক্ষ্য করে গনীমতের মাল আমাদের জন্য বৈধ করে দিলেন। উপরোক্ত সূত্রে শুধু ইমাম মুসলিম (رحمة الله)-ই এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

বাযযায (رحمة الله)ও অন্য সূত্রে আবু হুরায়রা (رضي الله عنه)-এর বরাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। মোদ্দাকথা, যখন ইউশা (عليه السلام) বনী ইসরাঈলকে নিয়ে শহরের দরজায় পৌঁছেন তখন তাদেরকে বিনীতভাবে শহরে প্রবেশের নির্দেশ দেওয়া হয়। অর্থাৎ যেহেতু আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতিশ্রুতি মতে মহান বিজয় দান করে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, সেজন্য তাদেরকে অনুনয়-বিনয়ের সাথে শোকর গোযার হয়ে ও রুকূ অবস্থায় প্রবেশ করতে হুকুম দেয়া হল। তাদেরকে আরো হুকুম দেয়া হল, যেন তারা প্রবেশ করার সময় মুখে উচ্চারণ করেحطة অর্থাৎ পূর্বে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করতে অস্বীকার করে আমরা ও আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যে ভুল করেছিলাম সেই ভুল ক্ষমা কর। আর এজন্যই মক্কা বিজয়ের সময় যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন তিনি উটের উপর আরোহণ করে অত্যন্ত বিনীতভাবে আল্লাহর শোকর গোযার ও প্রশংসাকারী রূপে প্রবেশ করেন। তিনি মাথা এতই নিচু করেছিলেন যে, তাঁর পবিত্র দাড়ি জিনের গদি স্পর্শ করছিল। আর তার সাথে ছিল এমন সৈন্য-সামন্ত যাদের মাথানত থাকার কারণে শুধু চোখের কাল অংশই দেখা যাচ্ছিল। বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে সবুজ বাহিনীতে অবস্থান করছিলেন তাদের অবস্থা এরূপ ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কায় পৌঁছে গোসল করেন ও আট রাকাত সালাত আদায় করেন। এই সালাত সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের দুইটি মতামত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এটা ছিল শোকরানা সালাত। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে মহা বিজয় দান করেছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন,এটা ছিল চাশতের সালাত। কেননা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চাশতের ওয়াক্তে এই সালাতটি আদায় করেন। বনী ইসরাঈল কথায় ও কাজে আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশের বিরোধিতা করেছিল এবং নিতম্বের ওপর ভর করে দ্বারে প্রবেশ করেছিল ও বলতে ছিল حبةفى شعرة অর্থাৎ বীজ তার খোসায়। অন্য বর্ণনা মতে, তারা বলেছিলঃ حنطة فى شعرة অর্থাৎ গম তার খোসায়। মোটকথা, তাদেরকে যা নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তারা তা পাল্টে দিয়েছিল ও এ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছিল। মক্কী সূরা আল আ’রাফের উক্ত ঘটনার বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَإِذۡ قِیلَ لَهُمُ ٱسۡكُنُوا۟ هَـٰذِهِ ٱلۡقَرۡیَةَ وَكُلُوا۟ مِنۡهَا حَیۡثُ شِئۡتُمۡ وَقُولُوا۟ حِطَّةࣱ وَٱدۡخُلُوا۟ ٱلۡبَابَ سُجَّدࣰا نَّغۡفِرۡ لَكُمۡ خَطِیۤـَٔـٰتِكُمۡۚ سَنَزِیدُ ٱلۡمُحۡسِنِینَ ۝ فَبَدَّلَ ٱلَّذِینَ ظَلَمُوا۟ مِنۡهُمۡ قَوۡلًا غَیۡرَ ٱلَّذِی قِیلَ لَهُمۡ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَیۡهِمۡ رِجۡزࣰا مِّنَ ٱلسَّمَاۤءِ بِمَا كَانُوا۟ یَظۡلِمُونَ[Surat Al-A'raf ১৬১ - ১৬২]

অর্থাৎ, স্মরণ কর, তাদেরকে বলা হয়েছিল, এ জনপদে বাস কর এবং যেখানে ইচ্ছা আহার কর এবং বল, ক্ষমা চাই এবং নতশিরে দরজায় প্রবেশ কর। আমি তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করব। আমি সকর্মপরায়ণদেরকে আরও অধিক দান করব। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা জালিম ছিল তাদেরকে যা বলা হয়েছিল, তার পরিবর্তে তারা অন্য কথা বলল। সুতরাং আমি আকাশ থেকে তাদের প্রতি শাস্তি প্রেরণ করলাম যেহেতু তারা সীমালংঘন করেছিল। (সূরা আরাফঃ ১৬১-১৬২)

মাদানী সূরা আলবাকারায় ইরশাদ হয়েছেঃ

وَإِذۡ قُلۡنَا ٱدۡخُلُوا۟ هَـٰذِهِ ٱلۡقَرۡیَةَ فَكُلُوا۟ مِنۡهَا حَیۡثُ شِئۡتُمۡ رَغَدࣰا وَٱدۡخُلُوا۟ ٱلۡبَابَ سُجَّدࣰا وَقُولُوا۟ حِطَّةࣱ نَّغۡفِرۡ لَكُمۡ خَطَـٰیَـٰكُمۡۚ وَسَنَزِیدُ ٱلۡمُحۡسِنِینَ ۝ فَبَدَّلَ ٱلَّذِینَ ظَلَمُوا۟ قَوۡلًا غَیۡرَ ٱلَّذِی قِیلَ لَهُمۡ فَأَنزَلۡنَا عَلَى ٱلَّذِینَ ظَلَمُوا۟ رِجۡزࣰا مِّنَ ٱلسَّمَاۤءِ بِمَا كَانُوا۟ یَفۡسُقُونَ[Surat Al-Baqarah ৫৮ - ৫৯]

অর্থাৎ, স্মরণ কর, যখন আমি বললাম, এ জনপদে প্রবেশ কর, যা ইচ্ছা এবং যেখানে ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে আহার কর, নতশিরে প্রবেশ কর দরজা দিয়ে এবং বল, ক্ষমা চাই। আমি তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করব এবং সৎকর্মপরায়ণ লোকদের প্রতি আমার দান বৃদ্ধি করব। কিন্তু যারা অন্যায় করেছিল তারা তাদেরকে যা বলা হয়েছিল তার পরিবর্তে অন্য কথা বলল। সুতরাং অনাচারীদের প্রতি আমি আকাশ থেকে শাস্তি প্রেরণ করলাম, কারণ তারা সত্য ত্যাগ করেছিল। (সূরা বাকারাঃ ৫৮-৫৯)

সাওরীর (رحمة الله) ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে আয়াতংশ وادجلوا الباب سجدا -এর তাফসীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, তিনি বলেছেন—এটার অর্থ হচ্ছে ছোট দরজা দিয়ে নতশিরে প্রবেশ কর। হাকিম (رحمة الله), ইবন জারীর (رحمة الله), ইবন আবূ হাতিম (رحمة الله) এবং আওফী (رحمة الله) ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। সাওরী (رحمة الله) থেকে ভিন্ন সূত্রেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে। মুজাহিদ, সুদ্দী ও যাহহাক (رحمة الله) বলেন, উপরোক্ত দরজাটি ছিল বায়তুল মুকাদ্দাসের বায়তে ঈলিয়ার বাবে হিত্তা।

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, তারা নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের মাথা উঁচিয়ে প্রবেশ করে। তবে এটি ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর মতের পরিপন্থী নয়। ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেছেন যে, তারা তাদের নিতম্বের উপর ভর দিয়ে প্রবেশ করেছিল। তারা মাথা উঁচিয়ে নিতম্বের ওপর ভর দিয়ে প্রবেশ করেছিল বলে একটি হাদীস পরবর্তীতে আসছে।

আয়াতাংশে উল্লেখিত وقولوا حطة এ ‘ওয়াও’ অক্ষরটি অবস্থা জ্ঞাপক حايه সংযোজক অব্যয় (عاطفة) নয়। অর্থাৎ—তোমরা (حطة) বলতে বলতে নতশিরে প্রবেশ কর। ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه), আতা, হাসান বসরী, কাতাদা, রাবী (رحمة الله) বলেন, তাদেরকে ক্ষমা চাওয়ার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

ইমাম বুখারী (رحمة الله) আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ বনী ইসরাঈলকে বলা হয়েছিলো, নতশিরে দরজায় প্রবেশ কর, حطة বল কিন্তু তারা তাদের নিতম্বের ওপর ভর করে প্রবেশ করেছিল। এভাবে তারা حطة এর পরিবর্তে বলেছিল حبةفى شعرة অর্থাৎ চুলের মধ্যে বীজ রয়েছে। অনুরূপভাবে নাসাঈ (رحمة الله) মওকুফ রূপে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

আবদুর রাজ্জাক (رحمة الله) আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলা বনী ইসরাঈলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তোমরা নতশিরে বায়তুল মুকাদ্দাসের দ্বারে প্রবেশ কর এবং বল حطة অর্থাৎ ক্ষমা চাই, তাহলে তোমাদের তাবৎ পাপ মাফ করে দেব। কিন্তু তারা আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশ পরিবর্তন করে নিতম্বের ওপর ভর করে حنطة فى شعرة বলতে বলতে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করে। ইমাম বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযী (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেন। তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটিকে হাসান ও সহীহ পর্যায়ের বলে মন্তব্য করেছেন।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) আবু হুরায়রা ও ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে সে বর্ণনায় حبة فى شعرة এর স্থলে তারা حنطة فى شعيرة বলেছিল বলে উল্লেখ আছে। যার অর্থ হচ্ছে যবের মধ্যে গম।

মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করে আসবাত (رحمة الله) আয়াতাংশঃ

(فَبَدَّلَ ٱلَّذِینَ ظَلَمُوا۟ قَوۡلًا غَیۡرَ ٱلَّذِی قِیلَ لَهُمۡ ) -এর তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, নিজ ভাষায় বনী ইসরাঈল বলেছিলঃ هطي سقاثا ازمة مزبا আরবী অর্থ হচ্ছেঃ

حبة حنطة حمراء مثقوبة فبها شعرة سوداء

অর্থাৎ ‘লাল গমের বীজ যার মধ্যে খচিত ছিল কাল দানা।’

আল্লাহ তাআলা কুরআনুল করীমে উল্লেখ করেছেন যে, তাদের ঐ বিরোধিতার জন্যে তিনি আযাব নাযিল করেছিলেন। আর এই আযাব হচ্ছে প্লেগ, যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে উল্লেখ রয়েছে। উসামা ইবন যায়িদ (رحمة الله) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন—এই ব্যথা কিংবা রোগ (প্লেগ) একটি আযাব, তোমাদের পূর্বে কোন কোন সম্প্রদায়কে এর মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়েছিল।

ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) ও ইবন আবূ হাতিম (رحمة الله) সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস (رضي الله عنه) উসামা ইবন যায়দ ও খুযায়ম (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, প্লেগ রোগটি একটি আযাব, তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে এর মাধ্যমে আযাব দেয়া হয়েছিল। পাঠটি ইবন আবূ হাতিমের। যাহহাক (رحمة الله) ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, رجز শব্দটির অর্থ হচ্ছে আযাব।

অনুরূপভাবে মুজাহিদ, আবু মালিক, সুদ্দী, হাসান বসরী (رحمة الله) ও কাতাদা (رحمة الله) বলেছেনঃ

আবুল আলীয়া (رحمة الله) বলেন رجز -এর অর্থ গযব। শাবী বলেন, رجز শব্দটির অর্থ প্লেগ। কিংবা তুষারপাত। সাঈদ ইবন জুবায়র (رضي الله عنه) বলেন, তা হচ্ছে প্লেগ।

যখন বনী ইসরাঈল বায়তুল মুকাদ্দাসে আধিপত্য বিস্তার করে, তখন থেকেই তারা সেখানে বসবাস করতে থাকে। আর তাদের মধ্যে ছিলেন আল্লাহর নবী ইউশা (عليه السلام)। আল্লাহর কিতাব তাওরাতের নির্দেশ মুতাবিক তিনি তাদের প্রশাসন কার্য পরিচালনা করতেন। অতঃপর তিনি একশ’ সাতাশ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তিনি মূসা (عليه السلام)-এর ইন্তিকালের পর সাতাশ বছরকাল জীবিত ছিলেন।
Top