ইমাম আহমদ রেযা (رحمة الله)’র অনন্য কাব্য প্রতিভা
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল নোমান
হিজরি চতুর্দশ শতাব্দির মুজাদ্দিদ আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁ বেরেলভী (رحمة الله) বহুমুখী প্রতিভার এক বিষ্ময়কর নাম। ইলমে ফিক্হের মধ্যে যিনি ছিলেন যুগের ইমাম আবু হানিফা, ইলমে হাদিসের মধ্যে ইমাম বুখারী, দর্শনে রাযী, এভাবে কাব্যে না‘তে রাসূল (দ:)’র ভুবনেও তিনি ছিলেন যুগের হাস্সান বিন ছাবিত। আ‘লা হযরতের কাব্য প্রতিভা এবং না‘তিয়া কালামের বিষয়টি বিষ্ময়কর।
কাব্যের বিবিধ সংজ্ঞা হতে একটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা হলো: “মানব মনের ভাবনা যখন অনুভূতি রঞ্জিত যথাবিহীন শব্দসম্ভারে বাস্তব সুষমমন্ডিত চিত্তাকর্ষক ও ছন্দোময় রূপ লাভ করে তখনই এর নাম কবিতা।” এ সংজ্ঞাকে সামনে রেখে আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (رحمة الله)’র সাহিত্য কর্মের যদি বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবেÑ এগুলো শুধু কবিতাই নয়; বরং সার্থক কবিত্যের এক অনুপম রূপায়ন।
কুরআন ও হাদিসে প্রিয় নবী (ﷺ) ’র যে প্রশংসা গীত হয়েছে, আ‘লা হযরতের কলমে তা ছন্দে প্রস্ফুটিত হয়ে অমর কাব্যে রূপ নিয়েছে। মূলতঃ না‘তে রাসূল লিখা ও বলা তলোয়ারের ধারে চলার মত। যদি অতিরঞ্জন হয়, তবে মহান রবের ঐশী মর্যাদায় আঘাত লাগে, আবার যদি কম হয়, তবে শানে রিসালাতের মানহানি হয়। [আল্লামা কাউসার নিয়াজী কৃত ইমাম আহমদ রেযা (رحمة الله) এক হামাহ্ যিহাত শাখসিয়্যাত] আ‘লা হযরত শানে তাওহীদ ও শানে রিসালতকে স্ব-স্ব মর্যাদায় সংরক্ষিত রেখে না‘তিয়া কালাম রচনা করেছেন অপূর্ব দক্ষতায়। কাব্য ও না‘তিয়া কালামে উপাদান সংগ্রহে কুরআন-হাদিস ও শরীয়তের গন্ডি হতে এক চুলও নড়েননি আ‘লা হযরত। ঈমান আক্বিদার মাপকাঠিতে অবস্থান করেও যারা কাব্য উপাদান ব্যবহারে অপিরিমেয় সৃজনী প্রতিভার জোরে বিশ্ব দরবারে সমুজ্জ্বল, আ‘লা হযরত তাঁদের অন্যতম। আ‘লা হযরত তাঁর কাব্য ধারার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে নিজেই বলেছেন:
قرآن سے میں نے نعت گوئی سیکھی، یعنی رہے احکام شریعت ملحوظ
অর্থাৎ- আমি কুরআন থেকে না‘ত শিখেছি, যাতে শরয়ী বিধি-বিধান অটুট থাকে (হাদায়েকে বখশিশ)।
তাঁর কাব্য মূলতঃ রাসূল প্রশস্তিকে কেন্দ্র করে রচিত। নবীপ্রেমানলের টানে তাঁর হৃদয় সর্বদা জাগরিত থাকত। আপাদমস্তক নবী প্রেম নিবেদিত ইমাম আহমদ রেযা (رحمة الله)’র কথায়, কাজে, লিখনি, চিন্তা-চেতনা, ভাব দ্যোতনা, রচনাশৈলী সবকিছুতে তা প্রস্ফুটিত। তাঁর যবানিতে ফুটে উঠেছে যে,
دہن میں زباں تمہارے لئے بدن میں ہے جاں تمہارے لئے
ہم آئے یہاں تمہارے لئے اٹھیں بھی وہاں تمہارے لئے
অর্থাৎ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মুখের বচন আপনারই জন্য, আমার দেহের প্রাণ আপনারই জন্য, দুনিয়াতে আমাদের আগমন আপনারই জন্য এবং কবর হতে উত্থান হবে আপনারই জন্য। (হাদায়েকে বখশিশ)
রাসূল প্রেমে বিগলিত হয়ে বিদগ্ধ মনকে শান্তনা দিতে না‘তে রাসূলের হিল্লোল বয়ে যেত ইমাম আহমদ রেযার যবান ও কলমে। প্রেমাত্মার মহিমা তাঁর এ উক্তি হতে সহজেই অনুমেয় যে,
القلب شج والهم شجوں دل زار چناں جاں زیر چنوں
پت اپنی بپت میں کا سے کہوں مراکون ہے ترے سواجانا
অন্তর আমার ব্যথিত ক্ষতবিক্ষত, দুঃখ জ্বালা অবিরত,
অন্তর সদা ফরিয়াদরত, প্রাণ নিতান্ত অসহায়, ওহে প্রাণের রাসূল আমার প্রাণের যাতনা কাকে বলবো, আপনি ছাড়া আর কে আছে?
যিনি আমার ব্যথার কথা শুনবে, প্রেমিকচিত্তের হৃদয়গ্রাহী আকুতি। (হাদায়েক বখশিশ)
الروح فداک فزد حرقا یک شعلہ دگر برزن عشقا
مورا تن من دھن سب پھونک دیا یہ جان بھی پیارے جلا جانا
অন্তরাত্মা আপনার প্রতি উৎসর্গিত, প্রেমানল আরো বাড়িয়ে দিন, অনুরূপ প্রেমশিখা হৃদয়ে জ্বালিয়ে দিন, ইয়া রাসূলাল্লাহ !
আমার দেহ, মন, ধন-সম্পদ সবইতো আপনার তরে সপে দিয়েছি, ওহে রাসূল, আমার এ প্রাণটুকুও আপনার প্রেমের আগুনে ভস্মিভূত করে দিন। (হাদায়েকে বখশিশ)
আ‘লা হযরত তাঁর না‘তে রাসূল ’র পুষ্পাঞ্জলি সাজাতে এমন সব শরয়ী কুসুম চয়ন করেছেন, যাতে প্রেমিকচিত্ত উদ্বেলিত না হয়ে পারে না। তাঁর রচিত অমর কীর্তি হাদায়েকে বখশিশ এর কবিতার ছত্রে ছত্রে নবীপ্রেমের যে অনন্য সুর অনুরণিত হয়েছে তা তাঁর অকৃত্রিম আনুগত্য ও মুহব্বতের অক্ষয় প্রতিধ্বনি। বিশেষতঃ সহজ শব্দের আবরণে সূক্ষ্ম তত্ত্বের উপস্থাপনা আ‘লা হযরতের রচনার এক অভিনব আঙ্গিক। ছন্দ, কৌশল, উপমা প্রয়োগ ও অলঙ্কারের দুর্লভ সমন্বয়ে তাঁর না‘তিয়া কালামসমূহ এক অনন্য রূপ লাবণ্যে ঐশ্বর্যমন্ডিত। আবার তাঁর কাব্যের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও ভাবগত আবেদন একজন পাঠককে মোহিত ও আকৃষ্ট করে রাখে।
চমৎকারিত্বের ব্যাপার হচ্ছে, আ‘লা হযরত তাঁর কাব্যব্যঞ্জনাকে একটি ভাষাতেই পল্লবিত করেননি; বরং উর্দূ, ফার্সি ও আরবি ভাষাতেও তিনি লিখেছেন দীর্ঘ না‘ত, গজল, মরসিয়াসহ নানা আঙ্গিকের প্রচুর লেখা। একই সাথে চার ভাষায় ব্যতিক্রমধর্মী না‘তে রাসূল রচনা করে তিনি যে অনতিক্রম্য উচ্চাসনে আসীন হয়েছেন তা রীতিমত বিষ্ময়কর। যার প্রথম চরণটি হলোÑ
لم يات نَظيرك في نظر مثل تونه شد پیدا جانا
جگ راج کو تاج تورے سرسو ہے تجھ کو شہ دوسرا جانا
প্রিয় নবী কোন কালে কোন দৃষ্টিতে আপনার সমতুল্য কেউ কখনো দেখেনি।
ওহে প্রিয় হাবীব! আপনার সমকক্ষ কিছু সৃষ্টিই হয়নি।
জগতের রাজত্যের রাজমুকুট আপনার শিরেই শোভা পায়।
এজন্যই আমি আপনাকে উভয় জগতের রাজাধিরাজ স্বীকার করলাম।
তাছাড়া তিনি স্বতন্ত্র আরবি ভাষায়ও চমৎকার কাব্যমালা রচনা করেন। একবার তাঁর (আ‘লা হযরতের) অন্যতম খলিফা আল্লামা যিয়াউদ্দীন আহমদ মাদানী (رحمة الله) মিশরের অধিবাসী আলেমগণের সম্মুখে ইমাম আহমদ রেযা বিরচিত হামদ (মহান প্রভুর প্রশংসা সম্বলিত কবিতা) শুনালে মিশরের আলেমগণ তাৎক্ষণিক বলে উঠলেন, এই কবিতাগুলো কোন বিশুদ্ধভাষী আরব্য কবিরই হবে। ঐ হামদে বারী তা‘আলার কয়েকটি পংক্তি হলোÑ
الحمد للمتوحد
بجلالة المتفرد
وصلوته دوما علي
خير الانام محمد
والأل والاصحاب هم
ماواي عند شدائد
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি একক। মহিয়ান শ্রেষ্ঠত্বে, একক অদ্বিতীয়।
সর্বদা তাঁর করুণাধারা বর্ষিত হোক, সৃষ্টি কূলের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির উপর, যাঁর নাম মুহাম্মদ ।
নবীজির পবিত্র বংশধরগণ, তাঁর সম্মানিত সাহাবাগণের উপর, কঠিন ক্রান্তিকালে যাঁরা আমার আশ্রয় স্থল।
ব্যাকুলতা, আবেগ ও তাঁর কাব্যের অন্তর্নিহিত ভাব গভীরতা এমন যে, তা শ্রোতাকূলকে অন্য জগতে নিয়ে যায় এবং অন্তরাত্মায় নবী প্রেমের হিল্লোল বয়ে দেয়। গাউছে জমান, মুর্শিদে বরহক, রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীকত আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (رحمة الله) আ‘লা হযরতের না‘তিয়া কালামগুলোর মৌলিকত্ব ও প্রেমানুভূতি যথার্থই অনুধাবন করে বলেন,
انکی شعروں میں اتنی تاثیر، خدا جانے انکی دل کی کیا حالت ہے
তাঁর (আ‘লা হযরত) না‘তিয়া কালামগুলোতে নবী প্রেমের এতই প্রভাব, খোদা তা‘লাই অবগত আছেন, তাঁর অন্তরাত্মায় নবীপ্রেমের কী অবস্থা।
এভাবে তাঁর বিপুল কাব্যমালার ছত্রে ছত্রে ফুঁটে আছে যেন প্রেমজাত বেহেস্তি কাননের অজ¯্র পুষ্পরাজি, যা একজন ঈমানদারের হৃদয়কে ইশকে রাসূলের আলোয় উদ্ভাসিত করে। এককথায় আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (رحمة الله)’র না‘তিয়া কালামগুলো নবীপ্রেমিকদের জন্য প্রেরণার উৎস ও সঞ্জিবনী শক্তি।
তথ্যপঞ্জী
১. আল-হাকায়েক ফিল হাদায়েক (শরহে হাদায়েকে বখশিশ) : আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়াইসী (رحمة الله), ২য় খন্ড।
০২. সুখনে রেযা : মাওলানা সূফী আউয়াল কাদেরী রেজভী;
০৩. মা‘রেফে রেযা (উর্দূ) : নভেম্বর, ২০১৫ সংখ্যা।
০৪. কালামে রেয: হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জামান।
০৫. আল মুখতার : আ‘লা হযরত কনফারেন্স, ২০১০ স্মারক;
০৬. আল মুখতার, আ‘লা হযরত কনফারেন্স, ২০১৪ স্মারক।