❏ মূসা কালীমুল্লাহ্ (عليه السلام)-এর বিবরণ
তিনি হচ্ছেন মূসা ইব্ন ইমরান ইব্ন কাহিছ ইব্ন আযির ইব্ন লাওয়ী ইব্ন ইয়াকূব ইব্ন ইসহাক ইব্ন ইবরাহীম (عليه السلام)। আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনুল করীমের বিভিন্ন জায়গায় সংক্ষেপে ও বিস্তারিতভাবে মূসা (عليه السلام)-এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর বর্ণনাকালে তাফসীরের কিতাবে আমি তা বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। এখানে মূসা (عليه السلام)-এর ঘটনার আদ্যোপান্ত কিতাব ও সুন্নতের আলোকে আমি বর্ণনা করতে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। ইসরাঈলী বর্ণনাসমূহ থেকে এ সম্পর্কে যে সব বর্ণনা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এবং আমাদের পূর্ববর্তী উলামায়ে কিরামও এগুলো বর্ণনা করেছেন তা এখানে পেশ করব।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
(وَٱذۡكُرۡ فِی ٱلۡكِتَـٰبِ مُوسَىٰۤۚ إِنَّهُۥ كَانَ مُخۡلَصࣰا وَكَانَ رَسُولࣰا نَّبِیࣰّا وَنَـٰدَیۡنَـٰهُ مِن جَانِبِ ٱلطُّورِ ٱلۡأَیۡمَنِ وَقَرَّبۡنَـٰهُ نَجِیࣰّا وَوَهَبۡنَا لَهُۥ مِن رَّحۡمَتِنَاۤ أَخَاهُ هَـٰرُونَ نَبِیࣰّا) [Surat Maryam ৫১ – ৫৩]
অর্থাৎ–স্মরণ কর, এ কিতাবে উল্লেখিত মূসার কথা, সে ছিল বিশুদ্ধচিত্ত এবং সে ছিল রাসূল ও নবী। তাকে আমি অহ্বান করেছিলাম তুর পর্বতের দক্ষিণ দিক হতে এবং আমি অন্তরংগ আলাপে তাকে নৈকট্যদান করেছিলাম। আমি নিজ অনুগ্রহে তাকে দিলাম তার ভাই হারূনকে নবীরূপে। (সূরা মরিয়মঃ ৫১-৫৩) আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
طٰسٓمّٓ ﴿۱﴾ تِلۡکَ اٰیٰتُ الۡکِتٰبِ الۡمُبِیۡنِ ﴿۲﴾ نَتۡلُوۡا عَلَیۡکَ مِنۡ نَّبَاِ مُوۡسٰی وَ فِرۡعَوۡنَ بِالۡحَقِّ لِقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ ﴿۳﴾ اِنَّ فِرۡعَوۡنَ عَلَا فِی الۡاَرۡضِ وَ جَعَلَ اَہۡلَہَا شِیَعًا یَّسۡتَضۡعِفُ طَآئِفَۃً مِّنۡہُمۡ یُذَبِّحُ اَبۡنَآءَہُمۡ وَ یَسۡتَحۡیٖ نِسَآءَہُمۡ ؕ اِنَّہٗ کَانَ مِنَ الۡمُفۡسِدِیۡنَ ﴿۴﴾ وَ نُرِیۡدُ اَنۡ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیۡنَ اسۡتُضۡعِفُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ نَجۡعَلَہُمۡ اَئِمَّۃً وَّ نَجۡعَلَہُمُ الۡوٰرِثِیۡنَ ۙ﴿۵﴾ وَ نُمَکِّنَ لَہُمۡ فِی الۡاَرۡضِ وَ نُرِیَ فِرۡعَوۡنَ وَ ہَامٰنَ وَ جُنُوۡدَہُمَا مِنۡہُمۡ مَّا کَانُوۡا یَحۡذَرُوۡنَ ﴿۶﴾
অর্থাৎ–ত্বাসীন মীম; এই আয়াতগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি তোমার নিকট মূসা ও ফিরআউনের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে বিবৃত করছি মুমিন সম্প্রদায়ের উদ্দেশে। ফিরআউন দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সেখানকার অধিবাসীবৃন্দকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণীকে সে হীনবল করেছিল। ওদের পুত্রদেরকে সে হত্যা করত এবং নারীদেরকে জীবিত থাকতে দিত। সে তো ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্বদান করতে ও উত্তরাধিকারী করতে এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে। ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা ওদের নিকট তারা আশঙ্কা করতো। (সূরা কাসাসঃ ১-৬)
সুরায়ে মরিয়মে মূসা (عليه السلام)-এর ঘটনা সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করে সূরায়ে কাসাসে কিছুটা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। এখানে মূসা (عليه السلام) ও ফিরআউনের ঘটনা যথাযথভাবে বর্ণনা করেছেন যেন এর শ্রোতা ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী। ফিরআউন দেশে (মিসরে) পরাক্রমশালী হয়েছিল; স্বৈরাচারী হয়েছিল এবং নাফরমান ও বিদ্রোহী হয়েছিল, পার্থিব জগতকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল; মহা পরাক্রমশালী প্রতিপালক আল্লাহ্ তা‘আলার ইবাদত ও আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিল। আবার তাদের মধ্য থেকে একশ্রেণী (বনী ইসরাঈল)-কে হীনবল করেছিল; তারা ছিলেন বনী ইসরাঈলের একটি দল এবং এঁরা ছিলেন আল্লাহর নবী ইয়াকূব ইব্ন ইসহাক ইব্ন ইবরাহীম খলীলুল্লাহ্ (عليه السلام)-এর বংশধর। সেই যামানায় তারাই ছিলেন পৃথিবীর সর্বোত্তম অধিবাসী। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর এমন এক বাদশাহকে আধিপত্য দান করেছিলেন যে ছিল জালিম, অত্যাচারী, কাফির ও দুশ্চরিত্র। সে তাদেরকে তার দাসত্ব ও সেবায় নিয়োজিত রাখতো এবং তাদেরকে নিকৃষ্টতম কাজকর্ম ও পেশায় নিয়োজিত থাকতে বাধ্য করত। উপরন্তু সে তাদের পুত্রদেরকে হত্যা করত এবং নারীদেরকে জীবিত রাখত। সে ছিল একজন বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। তার এই অমানবিক কর্মকাণ্ডের পটভূমি হচ্ছে নিম্নরূপঃ
বনী ইসরাঈলগণ ইবরাহীম (عليه السلام) হতে প্রাপ্ত ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন। যে বংশধর থেকে এমন এক যুবকের আবির্ভাব ঘটবে যার হাতে মিসরের বাদশাহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আর এটা এজন্য যে, মিসরের তৎকালীন বাদশাহ্ হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর স্ত্রী হযরত সারাহ্-এর সম্ভ্রম নষ্ট করতে মনস্থ করেছিল কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সম্ভ্রম রক্ষা করেন। আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত। এ সুসংবাদটি বনী ইসরাঈলের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কিবতীরা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত। ধীরে ধীরে তা ফিরআউনের কানে যায়। সুতরাং তার কোন পরামর্শদাতা কিংবা পারিষদ রাত্রিকালীন গল্পচ্ছলে এ প্রসঙ্গটি তুলে। তখন বাদশাহ বনী ইসরাঈলের পুত্রগণকে হত্যার নির্দেশ দিল। কিন্তু ভাগ্যের লিখন কে খণ্ডাতে পারে?
সুদ্দী (رحمة الله) ইব্ন আব্বাস, ইব্ন মাসউদ (رضي الله عنه) ও প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণনা করেন, একদিন ফিরআউন স্বপ্নে দেখল, যেন একটি অগ্নিশিখা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে এসে মিসরের বাড়ি-ঘর ও কিবতীদের সকলকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিল, কিন্তু মিসরে বসবাসরত বনী ইসরাঈলের কোন ক্ষতি করল না। ফিরআউন জেগে উঠে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। জ্যোতিষী ও জাদুকরদেরকে সমবেত করল এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইল। তারা তখন বলল, এই যুবক বনী ইসরাঈল বংশে জন্মগ্রহণ করবে এবং তারই হাতে মিসরবাসী ধ্বংস হবে। এ কারণেই ফিরআউন বনী ইসরাঈলের পুত্রগণকে হত্যা করতে এবং নারীদের জীবিত রাখতে নির্দেশ দিল। এই জন্যেই আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন, আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে; তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও দেশের অধিকারী করতে; এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে, যা এদের নিকট তারা আশঙ্কা করত। অর্থাৎ বনী ইসরাঈলকে হীনবল করা হয়েছিল। আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতিশ্রুতি হচ্ছে যে, তিনি শিগগিরই হীনবলকে শক্তিশালী করবেন, পরাভূতকে বিজয়ী করবেন এবং অবনমিতকে শক্তিমান করবেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সবকিছুই বনী ইসরাঈলের ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ اَوۡرَثۡنَا الۡقَوۡمَ الَّذِیۡنَ کَانُوۡا یُسۡتَضۡعَفُوۡنَ مَشَارِقَ الۡاَرۡضِ وَ مَغَارِبَہَا الَّتِیۡ بٰرَکۡنَا فِیۡہَا ؕ وَ تَمَّتۡ کَلِمَتُ رَبِّکَ الۡحُسۡنٰی عَلٰی بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ۬ۙ بِمَا صَبَرُوۡا ؕ وَ دَمَّرۡنَا مَا کَانَ یَصۡنَعُ فِرۡعَوۡنُ وَ قَوۡمُہٗ وَ مَا کَانُوۡا یَعۡرِشُوۡنَ ﴿۱۳۷﴾
অর্থাৎ–যে সম্প্রদায়কে দুর্বল গণ্য করা হত তাদেরকে আমি আমার কল্যাণপ্রাপ্ত রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের উত্তরাধিকারী করি; এবং বনী ইসরাঈল সমন্ধে তোমার প্রতিপালকের শুভ বাণী সত্যে পরিণত হল যেহেতু তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। (সূরা আরাফঃ ১৩৭)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ
وَّ زُرُوۡعٍ وَّ مَقَامٍ کَرِیۡمٍ ﴿ۙ۲۶﴾ وَّ نَعۡمَۃٍ کَانُوۡا فِیۡہَا فٰکِہِیۡنَ ﴿ۙ۲۷﴾ کَذٰلِکَ وَ اَوۡرَثۡنٰہَا قَوۡمًا اٰخَرِیۡنَ ﴿۲۸﴾
অর্থাৎ–তারা পশ্চাতে রেখে গিয়েছিল কত উদ্যান ও প্রস্রবণ, কত শস্যক্ষেত্র ও সুরম্য প্রাসাদ, কত বিলাস উপকরণ, যা তাদের আনন্দ দিত এরূপই ঘটেছিল এবং আমি এই সমুদয়ের উত্তরাধিকারী করেছিলাম ভিন্ন সম্প্রদায়কে। (সূরা দুখানঃ ২৫-২৮) অর্থাৎ বনী ইসরাঈলকে। এ সম্বন্ধে অন্যত্র আরো বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্। মোটকথা, ফিরআউন সম্ভাব্য সবরকম সতর্কতা অবলম্বন করল যাতে মূসা (عليه السلام) দুনিয়াতে না আসতে পারে। সে এমন কিছু সংখ্যক পুরুষ ও স্ত্রীকে নিযুক্ত করল যাতে তারা রাজ্যে ঘুরে ঘুরে গর্ভবতী নারীদের সন্ধান করে ও তাদের প্রসবের নির্ধারিত সময় সম্বন্ধে অবগত হয়। আর যখনই কোন গর্ভবতী নারী পুত্র সন্তান প্রসব করত, তখনই এসব হত্যাকারী তাদেরকে হত্যা করে ফেলত।
কিতাবীদের ভাষ্য হচ্ছে এই যে, ফিরআউন পুত্র-সন্তানদেরকে এ উদ্দেশ্যে হত্যা করার হুকুম দিত যাতে বনী ইসরাঈলের শান-শওকত হ্রাস পেয়ে যায়।
সুতরাং কিবতীরা যখন তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে প্রয়াস পাবে কিংবা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে তখন তারা তা প্রতিরোধ করতে সমর্থ হবে না।
এ ভাষ্যটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, তাদের পুত্র-সন্তানদের এরূপ হত্যা করার হুকুম দেয়া হয়েছিল মূসা (عليه السلام)-এর নবুওতপ্রাপ্তির পর, জন্মলগ্নে নয়।
যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ
(فَلَمَّا جَاۤءَهُم بِٱلۡحَقِّ مِنۡ عِندِنَا قَالُوا۟ ٱقۡتُلُوۤا۟ أَبۡنَاۤءَ ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ مَعَهُۥ وَٱسۡتَحۡیُوا۟ نِسَاۤءَهُمۡۚ )
[Surat Momin ২৫]
অর্থাৎ–তারপর মূসা আমার নিকট হতে সত্য নিয়ে তাদের নিকট উপস্থিত হলে তারা বলল, মূসার প্রতি যারা ঈমান এনেছে তাদের পুত্র-সন্তানদেরকে হত্যা কর এবং তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখ। (সূরা মুমিনঃ ২৫) আর এজন্যেই বনী ইসরাঈল মূসা (عليه السلام)-কে বলেছিলঃ
قَالُوۡۤا اُوۡذِیۡنَا مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ تَاۡتِیَنَا وَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جِئۡتَنَا
অর্থাৎ—আমাদের নিকট তোমার আসার পূর্বে আমরা নির্যাতিত হয়েছি এবং তোমার আসার পরেও। (সূরা আরাফঃ ১২৯)
সুতরাং বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে এই যে, মূসা (عليه السلام) -এর দুনিয়ায় আগমন ঠেকাবার জন্যেই ফিরআউন বনী ইসরাঈলের পুত্র-সন্তানদের প্রথমে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল। তাকদীর যেন বলছিল, হে বিপুল সেনাবাহিনীর অধিকারী। পরম ক্ষমতা ও রাজত্বের অধিপতি বিধায় অহংকারী পরাক্রমশালী সম্রাট! ঐ অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অপ্রতিহত এবং অবিচল মহাশক্তির অধিকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, যেই সন্তানটি থেকে পরিত্রাণের আশায়, অগণিত, অসংখ্য নিস্পাপ পুত্র-সন্তান তুমি হত্যা করছ সেই সন্তান তোমার ঘরেই প্রতিপালিত হবে, তোমার ঘরেই সে লালিত-পালিত হবে, তোমার ঘরেই তোমার খাদ্য খেয়ে ও পানীয় পান করে বড় হয়ে উঠবে, তুমিই তাকে পালক-পুত্র হিসেবে গ্রহণ করবে ও তাকে লালন করবে অথচ তুমি এ রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হবে না। অবশেষে তার হাতেই তোমার দুনিয়া ও আখিরাত সর্বস্ব বিনাশ হয়ে যাবে। কারণ সে যা কিছু প্রকাশ্য সত্য নিয়ে আসবে তুমি তার বিরোধিতা করবে, এবং তার কাছে যে ওহী নাযিল হবে, তুমি তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে- এটা এজন্য যাতে তুমি এবং গোটা জগদ্বাসী জানতে পারে যে, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের প্রতিপালক যা ইচ্ছা তা আঞ্জাম দিয়ে থাকেন, তিনিই মহাপরাক্রমশালী একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ও তাঁর শক্তি ও ইচ্ছাকে কেউ প্রতিহত করতে পারে না।
একাধিক তাফসীরকার এরূপ বর্ণনা করেছেন- কিবতীরা ফিরআউনের কাছে এমর্মে অভিযোগ করে যে, বনী ইসরাঈলের পুত্র-সন্তান হত্যা করার কারণে তাদের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে এবং তারা আশঙ্কা করতে বাধ্য হচ্ছে যে, ছোটদেরকে হত্যা করার কারণে বড়দের সংখ্যাও ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকবে। ফলে কিবতীদেরকে ঐ সব নিকৃষ্ট কাজ করতে হবে যেগুলো বনী ইসরাঈল করতে বাধ্য ছিল। এরূপ অভিযোগ ফিরআউনের কাছে পৌঁছার পর ফিরআউন এক বছর পর পর পুত্র-সন্তানদের হত্যা করতে নির্দেশ দিল। তাফসীরকারগণ উল্লেখ করেন, যে বছর পুত্র-সন্তানদের হত্যা না করার কথা সেই বছর হারূন (عليه السلام) জন্মগ্রহণ করেন। অন্যদিকে যে বছরে পুত্র-সন্তানদের হত্যা করার কথা সে বছরে মূসা (عليه السلام) জন্মগ্রহণ করেন।
সুতরাং মূসা (عليه السلام)-এর আম্মা মূসা (عليه السلام)-কে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাই তিনি গর্ভবতী হওয়ার প্রথম দিন থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে লাগলেন এবং গর্ভের কথা প্রকাশ হতে দিলেন না। যখন তিনি সন্তান প্রসব করলেন, একটি সিন্দুক তৈরি করার জন্যে তাঁকে সংগোপনে নির্দেশ প্রদান করা হল। তিনি সিন্দুকটিকে একটি রশি দিয়ে বেঁধে রাখলেন। তাঁর বাড়ি ছিল নীলনদের তীরে। তিনি তাঁর সন্তানকে দুধ পান করাতেন এবং যখনই কারো আগমনের আশঙ্কা করতেন তাকে সিন্দুকে রেখে সিন্দুক সমেত তাকে নদীতে ভাসিয়ে দিতেন। আর রশির এক প্রান্ত তিনি নিজে ধরে রাখতেন। যখন শত্রুরা চলে যেত তখন তিনি তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসতেন। আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ
وَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰۤی اُمِّ مُوۡسٰۤی اَنۡ اَرۡضِعِیۡہِ ۚ فَاِذَا خِفۡتِ عَلَیۡہِ فَاَلۡقِیۡہِ فِی الۡیَمِّ وَ لَا تَخَافِیۡ وَ لَا تَحۡزَنِیۡ ۚ اِنَّا رَآدُّوۡہُ اِلَیۡکِ وَ جَاعِلُوۡہُ مِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۷﴾ فَالۡتَقَطَہٗۤ اٰلُ فِرۡعَوۡنَ لِیَکُوۡنَ لَہُمۡ عَدُوًّا وَّ حَزَنًا ؕ اِنَّ فِرۡعَوۡنَ وَ ہَامٰنَ وَ جُنُوۡدَہُمَا کَانُوۡا خٰطِئِیۡنَ ﴿۸﴾ وَ قَالَتِ امۡرَاَتُ فِرۡعَوۡنَ قُرَّتُ عَیۡنٍ لِّیۡ وَ لَکَ ؕ لَا تَقۡتُلُوۡہُ ٭ۖ عَسٰۤی اَنۡ یَّنۡفَعَنَاۤ اَوۡ نَتَّخِذَہٗ وَلَدًا وَّ ہُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۹﴾
অর্থাৎ–মূসার মায়ের অন্তরে আমি ইংগিতে নির্দেশ করলাম, “শিশুটিকে বুকের দুধ পান করাতে থাক।” যখন তুমি তার সম্পর্কে কোন আশঙ্কা করবে, তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করবে এবং ভয় করবে না, দুঃখও করবে না। আমি তাকে তোমার নিকট ফিরিয়ে দেব এবং তাকে রাসূলদের একজন করব। অবশেষে ফিরআউনের লোকজন তাকে উঠিয়ে নিল। এর পরিণাম তো এই ছিল যে, সে তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হবে। ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনী ছিল অপরাধী। ফিরআউনের স্ত্রী বলল, এই শিশু আমার ও তোমার নয়ন প্রীতিকর। একে হত্যা করবে না, সে আমাদের উপকারে আসতে পারে। আমরা তাকে সন্তান হিসেবেও গ্রহণ করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে তারা এর পরিণাম বুঝতে পারেনি। (সূরা কাসাসঃ ৭-৯)
মূসার মায়ের কাছে যে ওহী পাঠানো হয়েছিল, তা ছিল ইলহাম ও নির্দেশনা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ اَوۡحٰی رَبُّکَ اِلَی النَّحۡلِ اَنِ اتَّخِذِیۡ مِنَ الۡجِبَالِ بُیُوۡتًا وَّ مِنَ الشَّجَرِ وَ مِمَّا یَعۡرِشُوۡنَ ﴿ۙ۶۸﴾ ثُمَّ کُلِیۡ مِنۡ کُلِّ الثَّمَرٰتِ فَاسۡلُکِیۡ سُبُلَ رَبِّکِ ذُلُلًا
অর্থাৎ–তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে তার অন্তরে ইংগিতে নির্দেশ দিয়েছেন, ঘর তৈরি কর পাহাড়ে, গাছপালায় ও মানুষ যে ঘর তৈরি করে তাতে। এরপর প্রত্যেক ফল থেকে কিছু কিছু আহার কর এবং তোমার প্রতিপালকের সহজপথ অনুসরণ কর। (সূরা নাহলঃ ৬৮)
এ ওহী নবুওতের ওহী নয়। ইব্ন হাযম (رحمة الله) ও ইল্ম আকাইদ বিশারদগণের অনেকেই এটাকে মনে করেন, কিন্তু বিশুদ্ধ অভিমত হল প্রথম অভিমতটিই। আর এটিই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মত বলে আবুল হাসান আল আশ‘আরী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন। সুহায়লী বলেছেন, মূসা (عليه السلام)-এর মায়ের নাম ছিল আয়ারেখা। আবার কেউ কেউ বলেন, তার নাম ছিল আয়াযাখ্ত। মোদ্দাকথা হল, উপরোক্ত কাজের দিকনির্দেশনা তাঁর অন্তরে দেয়া হয়েছিল। তাঁর অন্তরে ইলহাম করা হয়েছিল যে, তুমি ভয় করো না এবং দুঃখিত হয়ো না। কেননা, যদিও সন্তানটি তার হাতছাড়া হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা তা শিগগিরই ফেরত দেবেন। আর আল্লাহ তাঁকে অচিরেই রাসূল হিসেবে মনোনীত করবেন। তিনি আল্লাহ তা‘আলার কিতাবকে দুনিয়া এবং আখিরাতে সমুন্নত করবেন। অতএব, মূসা (عليه السلام)-এর মা তাই করলেন যেভাবে তিনি আদিষ্ট হয়েছিলেন। একদিন তিনি তাকে ছেড়ে ছিলেন কিন্তু রশির প্রান্ত নিজের কাছে আটকে রাখতে ভুলে গেলেন। মূসা (عليه السلام) নীলনদের স্রোতে ভেসে গেলেন। তারপর ফিরআউনের বাড়ির ঘাটে গিয়ে পৌঁছলেন। ফিরআউনের লোকজন তাকে উঠিয়ে নিল। এটার পরিণাম তো এই ছিল যে, তিনি তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হবেন।
কেউ কেউ বলেন, ليكون এর মধ্যে لام অক্ষরটি পরিণাম জ্ঞাপক। এটি আয়াতাংশের فالتقطه এর সাথে সম্পৃক্ত হলে এ অর্থই স্পষ্ট। কিন্তু যদি বাক্যের মর্মার্থের সাথে তা সংযুক্ত হয়ে থাকে তাহলে لام -কে অন্যান্য لام -এর ন্যায় কারণ নির্দেশক বলে মনে করতে হবে। তাতে বাক্যের মর্ম দাঁড়াবে ফিরআউনের লোকজন তাকে উঠিয়ে নেবার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যাতে সে তাদের শত্রু কিংবা দুঃখের কারণ হবে। এ সম্ভাবনাটির সমর্থন মিলছে আয়াতে উল্লেখিত—
( إِنَّ فِرۡعَوۡنَ وَهَـٰمَـٰنَ وَجُنُودَهُمَا كَانُوا۟ خَـٰطِـِٔینَ)
[Surat Al-Qasas ৮]
আয়াতাংশ থেকে।
অর্থাৎ–ফিরআউন তার দুষ্ট উযীর হামান এবং তাদের অনুচররা ভ্রান্তির মধ্যে ছিল, তাই তারা এই শাস্তি ও হতাশার যোগ্য হয়ে পড়ে। তাফসীরকারগণ আরো উল্লেখ করেন যে, দাসীরা তাকে একটি বন্ধ সিন্দুকে দরিয়া থেকে উদ্ধার করে কিন্তু তারা তা খুলতে সাহস পায়নি। তারা ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়া (رضي الله عنه) বিনতে মুযাহিস ইব্ন আসাদ ইব্ন আর-রাইয়ান ইবনুল ওলীদ-এর সামনে বন্ধ সিন্দুকটি রাখল।
এই ওলীদই ছিল ইউসুফ (عليه السلام)-এর যুগে মিসরের ফিরআউন। তৎকালীন মিসরের অধিপতিদের উপাধি ছিল ফিরআউন। আবার কেউ কেউ বলেন, আসিয়া ছিলেন বনী ইসরাঈল বংশীয় এবং মূসা (عليه السلام)-এর গোত্রের মহিলা। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন মূসা (عليه السلام)-এর ফুফু। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক সুহায়লীও এরূপ বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলাই অধিক জ্ঞাত।
মারয়াম (رضي الله عنه) বিনতে ইমরানের ঘটনায় আসিয়া (رضي الله عنه)-এর গুণাবলী ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। কিয়ামতের দিন বেহেশতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্ত্রীদের সাথে তারা দুইজনও অন্তর্ভুক্ত হলেন।
আসিয়া যখন সিন্দুকটির দরজা খুললেন ও পর্দা হটালেন তখন দেখলেন মূসা (عليه السلام)-এর চেহারা নবুওতের উজ্জ্বল নূরে ঝলমল করছে। মূসা (عليه السلام)-কে দেখামাত্র আসিয়ার হৃদয়মন তার প্রতি স্নেহমমতায় ভরে উঠল। ফিরআউন আসার পর জিজ্ঞাসা করল, ‘ছেলেটি কে?’ এবং সে তাকে যবেহ করার নির্দেশ দিল। কিন্তু আসিয়া ফিরআউনের কাছ থেকে তাঁকে চেয়ে নিলেন এবং এভাবে তাঁকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করলেন। আসিয়া বললেনঃ
অর্থাৎ এই শিশুটি তোমার ও আমার চোখ জুড়াবে। ফিরআউন বলল, এটা তোমার জন্যে হতে পারে, কিন্তু আমার জন্যে নয়। একে দিয়ে আমার কোনই প্রয়োজন নেই। কথা বাড়ালে বিপত্তিই বাড়ে। আসিয়া বলেছিলেনঃ অর্থাৎ-“সে আমাদের উপকারে আসতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সে আশা পূর্ণ করেছিলেন। দুনিয়ায় আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে মূসা (عليه السلام)-এর দ্বারা হিদায়াত দান করেছেন এবং আখিরাতে তাকে মূসা (عليه السلام)-এর কারণে স্বীয় জান্নাতে স্থান দেবেন। আবার তিনি বলেছিলেনঃ অর্থাৎ—“আমরা তাকে সন্তান হিসেবেও গ্রহণ করতে পারি।” তারা তাঁকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন; কেননা তাদের কোন সন্তান ছিল না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, অর্থাৎ তারা জানে না যে, তাকে সিন্দুক থেকে উঠিয়ে নেওয়ার জন্যে ফিরআউন পরিবারকে নিযুক্ত করে আল্লাহ্ তা‘আলা ফিরআউন ও তার সৈন্যদের প্রতি কিরূপ মহা আযাব অবতীর্ণ করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তী আয়াতে ঘটনার পরবর্তী অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ اَصۡبَحَ فُؤَادُ اُمِّ مُوۡسٰی فٰرِغًا ؕ اِنۡ کَادَتۡ لَتُبۡدِیۡ بِہٖ لَوۡ لَاۤ اَنۡ رَّبَطۡنَا عَلٰی قَلۡبِہَا لِتَکُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۰﴾ وَ قَالَتۡ لِاُخۡتِہٖ قُصِّیۡہِ ۫ فَبَصُرَتۡ بِہٖ عَنۡ جُنُبٍ وَّ ہُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿ۙ۱۱﴾ وَ حَرَّمۡنَا عَلَیۡہِ الۡمَرَاضِعَ مِنۡ قَبۡلُ فَقَالَتۡ ہَلۡ اَدُلُّکُمۡ عَلٰۤی اَہۡلِ بَیۡتٍ یَّکۡفُلُوۡنَہٗ لَکُمۡ وَ ہُمۡ لَہٗ نٰصِحُوۡنَ ﴿۱۲﴾ فَرَدَدۡنٰہُ اِلٰۤی اُمِّہٖ کَیۡ تَقَرَّ عَیۡنُہَا وَ لَا تَحۡزَنَ وَ لِتَعۡلَمَ اَنَّ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ وَّ لٰکِنَّ اَکۡثَرَہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿٪۱۳﴾
অর্থাৎ–মূসার মায়ের হৃদয় অস্থির হয়ে পড়েছিল, যাতে সে আস্থাশীল হয় তজ্জন্য আমি তার হৃদয়কে দৃঢ় করে না দিলে সে তার পরিচয় তো প্রকাশ করেই দিত। সে মূসার বোনকে বলল, এর পিছনে পিছনে যাও। সে তাদের অজ্ঞাতসারে দূর হতে তাকে দেখছিল। পূর্ব থেকেই আমি ধাত্রীর দুধপানে তাকে বিরত রেখেছিলাম। মুসার বোন বলল, “তোমাদের কি আমি এমন এক পরিবারের সন্ধান দেব, যারা তোমাদের হয়ে তাকে লালন-পালন করবে এবং তার মঙ্গলকামী হবে।” তারপর আমি তাকে ফেরত পাঠালাম তার মায়ের নিকট যাতে তার চোখ জুড়ায়, সে দুঃখ না করে এবং বুঝতে পারে যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না। (সূরা কাসাসঃ ১০-১৩)
আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه), মুজাহিদ (رحمة الله), ইকরামা (رحمة الله), সায়ীদ ইব্ন জুবাইর (رضي الله عنه) প্রমুখ বলেন, “মূসা (عليه السلام)-এর মায়ের অন্তর দুনিয়ার অন্যান্য চিন্তা ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র মূসা (عليه السلام)-কে নিয়ে চিন্তায় অস্থির ছিল। আল্লাহ্ তা‘আলা যদি তাকে ধৈর্য দান না করতেন ও তার হৃদয়ে দৃঢ়তা দান না করতেন তাহলে ব্যাপারটি তিনি প্রকাশ করে দিতেন এবং অন্যের কাছে প্রকাশ্যে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে ফেলতেন। তিনি তার বড় মেয়ে, মূসা (عليه السلام)-এর বোনকে তার পেছনে পেছনে গিয়ে খবরাখবর নেয়ার জন্যে পাঠালেন। মুজাহিদ (رحمة الله) বলেন, সে দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করছিল। আর কাতাদা (رحمة الله) বলেন, তিনি এমনভাবে তার প্রতি লক্ষ্য করছিলেন যেন এ ব্যাপারে তাঁর কোন আগ্রহ নেই। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা তা বুঝতে পারছিল না। ঘটনা হল এই, যখন ফিরআউনের ঘরে মূসা (عليه السلام)-এর থাকা সাব্যস্ত হলো তখন ফিরআউনের লোকজন তাকে দুধ পান করাবার চেষ্টা করল কিন্তু তিনি কারো বুকের দুধ গ্রহণ করলেন না বা অন্য কোন খাদ্যও গ্রহণ করলেন না। তারা তার ব্যাপারে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল এবং তাঁকে যে প্রকারেই হোক না কেন তারা যে কোন খাদ্য খাওয়াতে চেষ্টা করল কিন্তু তারা তাতে ব্যর্থ হল। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ “পূর্ব থেকেই আমি অন্যের বুকের দুধ গ্রহণ থেকে তাকে বিরত রেখেছিলাম।” তারা তাঁকে ধাত্রী ও অন্যান্য নারীসমেত বাজারে পাঠালো যাতে তারা এমন লোক খুঁজে বের করতে পারে, যে তাকে দুধ পান করাতে সক্ষম হয়। তারা তাকে নিয়ে ছিল ব্যস্ত এবং বাজারের লোকজনও তাদের দিকে লক্ষ্য করে রয়েছে- এমন সময় মূসা (عليه السلام)-এর বোন মূসা (عليه السلام)-এর দিকে তাকালেন কিন্তু তিনি তাকে চিনেন বলে পরিচয় প্রকাশ করলেন না, বরং বললেনঃ
(۞ هَلۡ أَدُلُّكُمۡ عَلَىٰۤ أَهۡلِ بَیۡتࣲ یَكۡفُلُونَهُۥ لَكُمۡ وَهُمۡ لَهُۥ نَـٰصِحُونَ)
[Surat Al-Qasas ১২]
অর্থাৎ–তোমাদের কি আমি এমন এক পরিবারের সন্ধান দেব, যারা তোমাদের হয়ে তাকে লালন-পালন করবে এবং তার মঙ্গলকামী হবে?
আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, “মূসা (عليه السلام)-এর বোন যখন তাদেরকে এরূপ বললেন তখন তারা তাকে বলল, তুমি কেমন করে জান যে, তারা তার মঙ্গলকামী ও তার প্রতি মেহেরবান হবে? তিনি বললেনঃ বাদশাহর বেগমের ছেলের উপকার সাধনে সকলেই আগ্রহী। তখন তারা তাকে ছেড়ে দিল এবং তার সাথে তারা তাদের বাড়িতে গেল। তখন মূসা (عليه السلام)-এর মা মূসা (عليه السلام)-কে কোলে তুলে নিলেন ও তাকে নিজ বুকের দুধ খেতে দিলেন। মূসা (عليه السلام) মায়ের স্তন মুখে নিলেন, চুষতে আরম্ভ করলেন এবং দুধ পান করতে লাগলেন। এতে তারা সকলে অতীব খুশি হল। এক ব্যক্তি এ সুসংবাদ আসিয়াকে গিয়ে জানাল। তিনি মূসা (عليه السلام)-এর মাকে তাঁর নিজ মহলে ডেকে পাঠালেন এবং সেখানে অবস্থান করে তাকে উপকৃত করতে আসিয়া (رضي الله عنه) আহ্বান জানালেন। কিন্তু মূসা (عليه السلام)-এর মা তাতে রাযী হলেন না বরং বললেন, আমার স্বামী ও ছেলে-মেয়ে রয়েছে তাই আমি তাদেরকে ছেড়ে মহলে থাকতে পারি না, তবে আপনি যদি তাকে আমার নিকট পাঠিয়ে দেন তাহলে আমি তাকে দুধ পান করাতে পারি। তখন আসিয়া মূসা (عليه السلام)-কে তার মায়ের সাথে যেতে দিলেন। তিনি তার জন্যে বহু মূল্যবান উপঢৌকন দিলেন ও তাঁর খোরপোশের জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দিলেন। মূসার মা মূসা (عليه السلام)-কে নিয়ে নিজ ঘরে ফিরে গেলেন এবং এভাবে আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় মা-ছেলের মিলন ঘটালেন। আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেনঃ
(فَرَدَدۡنَـٰهُ إِلَىٰۤ أُمِّهِۦ كَیۡ تَقَرَّ عَیۡنُهَا وَلَا تَحۡزَنَ وَلِتَعۡلَمَ أَنَّ وَعۡدَ ٱللَّهِ حَقࣱّ )
[Surat Al-Qasas ১৩]
আমি তাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলাম। যাতে তার চোখ জুড়ায়, সে দুঃখ না করে এবং বুঝতে পারে যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। মূসা-জননীর কাছে মূসা (عليه السلام)-কে ফেরত প্রদানের মাধ্যমে একটি প্রতিশ্রুতি এভাবে পূর্ণ হল। আর এটাই নবুওতের সুসংবাদের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে বিবেচ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ অর্থাৎ তাদের অধিকাংশই এটা জানে না। যেই রাতে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)- এর সাথে কথোপকথন করেন সেই রাতেও এরূপ ইহসান প্রদর্শনের কথা আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেনঃ
وَ لَقَدۡ مَنَنَّا عَلَیۡکَ مَرَّۃً اُخۡرٰۤی ﴿ۙ۳۷﴾اِذۡ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰۤی اُمِّکَ مَا یُوۡحٰۤی ﴿ۙ۳۸﴾ اَنِ اقۡذِفِیۡہِ فِی التَّابُوۡتِ فَاقۡذِفِیۡہِ فِی الۡیَمِّ فَلۡیُلۡقِہِ الۡیَمُّ بِالسَّاحِلِ یَاۡخُذۡہُ عَدُوٌّ لِّیۡ وَ عَدُوٌّ لَّہٗ ؕ وَ اَلۡقَیۡتُ عَلَیۡکَ مَحَبَّۃً مِّنِّیۡ ۬ۚ وَ لِتُصۡنَعَ عَلٰی عَیۡنِیۡ ﴿ۘ۳۹﴾
অর্থাৎ– এবং আমি তো তোমার প্রতি আরো একবার অনুগ্রহ করেছিলাম, যখন আমি তোমার মাকে জানিয়েছিলাম যা ছিল জানাবার এই মর্মে যে, তুমি তাকে সিন্দুকের মধ্যে রাখ তারপর এটাকে দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও যাতে দরিয়া এটাকে তীরে ঠেলে দেয়, এটাকে আমার শত্রু ও তার শত্রু নিয়ে যাবে। আমি আমার নিকট হতে তোমার উপর ভালবাসা ঢেলে দিয়েছিলাম যাতে তুমি আমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হও। (সূরা তা-হাঃ ৩৭-৩৯)
শেষোক্ত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় কাতাদা (رحمة الله) প্রমুখ তাফসীরকার বলেন, যাতে আমার সামনে তুমি ভাল ভাল খাবার খেতে পার ও অতি উত্তম পোশাক পরতে পার। আর এগুলো সব আমার হেফাজত ও সংরক্ষণের দ্বারা সম্ভব হয়েছে, অন্য কারো এরূপ করার শক্তি, সামর্থ্য নেই। আল্লাহ তা‘আলা আরও ইরশাদ করেনঃ
اِذۡ تَمۡشِیۡۤ اُخۡتُکَ فَتَقُوۡلُ ہَلۡ اَدُلُّکُمۡ عَلٰی مَنۡ یَّکۡفُلُہٗ ؕ فَرَجَعۡنٰکَ اِلٰۤی اُمِّکَ کَیۡ تَقَرَّ عَیۡنُہَا وَ لَا تَحۡزَنَ ۬ؕ وَ قَتَلۡتَ نَفۡسًا فَنَجَّیۡنٰکَ مِنَ الۡغَمِّ وَ فَتَنّٰکَ فُتُوۡنًا ۬
অর্থাৎ–যখন তোমার বোন এসে বলল, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব কে এই শিশুর ভার নেবে? তখন আমি তোমাকে তোমার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিলাম যাতে তার চোখ জুড়ায় এবং সে দুঃখ না পায়; এবং তুমি এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে; অতঃপর আমি তোমাকে মনঃপীড়া হতে মুক্তি দেই। আমি তোমাকে বহু পরীক্ষা করেছি। (সূরা তা-হাঃ ৪০) পরীক্ষার ঘটনাসমূহ যথাস্থানে ইনশাআল্লাহ্ তুলে ধরা হবে। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ لَمَّا بَلَغَ اَشُدَّہٗ وَ اسۡتَوٰۤی اٰتَیۡنٰہُ حُکۡمًا وَّ عِلۡمًا ؕ وَ کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۱۴﴾ وَ دَخَلَ الۡمَدِیۡنَۃَ عَلٰی حِیۡنِ غَفۡلَۃٍ مِّنۡ اَہۡلِہَا فَوَجَدَ فِیۡہَا رَجُلَیۡنِ یَقۡتَتِلٰنِ ٭۫ ہٰذَا مِنۡ شِیۡعَتِہٖ وَ ہٰذَا مِنۡ عَدُوِّہٖ ۚ فَاسۡتَغَاثَہُ الَّذِیۡ مِنۡ شِیۡعَتِہٖ عَلَی الَّذِیۡ مِنۡ عَدُوِّہٖ ۙ فَوَکَزَہٗ مُوۡسٰی فَقَضٰی عَلَیۡہِ ٭۫ قَالَ ہٰذَا مِنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّہٗ عَدُوٌّ مُّضِلٌّ مُّبِیۡنٌ ﴿۱۵﴾ قَالَ رَبِّ اِنِّیۡ ظَلَمۡتُ نَفۡسِیۡ فَاغۡفِرۡ لِیۡ فَغَفَرَ لَہٗ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ ﴿۱۶﴾ قَالَ رَبِّ بِمَاۤ اَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ فَلَنۡ اَکُوۡنَ ظَہِیۡرًا لِّلۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۱۷﴾
অর্থাৎ–যখন মূসা (عليه السلام) পূর্ণ যৌবনে উপনীত ও পরিণত বয়স্ক হল তখন আমি তাকে হিকমত ও জ্ঞান দান করলাম; এইভাবে আমি সৎ কর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কার প্রদান করে থাকি। সে নগরীতে প্রবেশ করল, যখন এর অধিবাসীরা ছিল অসতর্ক। সেখানে সে দু’টি লোককে সংঘর্ষে লিপ্ত দেখল- একজন তার নিজ দলের এবং অপরজন তার শত্রুদলের। মূসা (عليه السلام)-এর দলের লোকটি তার শত্রু দলের লোকটির বিরুদ্ধে মূসা (عليه السلام)-এর সাহায্য প্রার্থনা করল, তখন মূসা (عليه السلام) তাকে ঘুষি মারল; এভাবে সে তাকে হত্যা করে বসল। মূসা (عليه السلام) বললেন, এটা শয়তানের কাণ্ড। সেতো প্রকাশ্য শত্রু ও বিভ্রান্তকারী। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো আমার নিজের প্রতি জুলুম করেছি। সুতরাং আমাকে ক্ষমা কর। তারপর তিনি তাকে ক্ষমা করলেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সে আরো বলল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি যেহেতু আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছ আমি কখনও অপরাধীদের সাহায্যকারী হব না। (সূরা কাসাসঃ ১৪-১৭)
যখন আল্লাহ্ তা‘আলা উল্লেখ করেন, তিনি তার মায়ের কাছে তাকে ফেরত দিয়ে তার প্রতি অনুগ্রহ ও দয়া করেছেন তারপর তিনি উল্লেখ করতে শুরু করলেন যে, যখন তিনি পূর্ণ যৌবন লাভ করেন এবং শারীরিক গঠন ও চরিত্রে উৎকর্ষ মণ্ডিত হল এবং অধিকাংশ উলামার মতে, যখন ৪০ বছর বয়সে উপনীত হন, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে হিকমত ও নবুওতের জ্ঞান দান করেন। যে বিষয়ে তাঁর মাতাকে পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
( إِنَّا رَاۤدُّوهُ إِلَیۡكِ وَجَاعِلُوهُ مِنَ ٱلۡمُرۡسَلِینَ)
[Surat Al-Qasas ৭]
অর্থাৎ–“আমি তাকে তোমার নিকট ফেরত দেব এবং তাকে রাসূলদের একজন করব।” তারপর আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-এর মিসর থেকে বের হয়ে মাদায়ান শহরে গমন এবং সেখানে নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত অবস্থানের কারণ বর্ণনা শুরু করেন এবং মূসা (عليه السلام) ও আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে যে সব কথোপকথন হয়েছে এবং আল্লাহ তা‘আলা তাকে যেরূপ মর্যাদা দান করেছেন তার প্রতিও ইংগিত করেছেন। যার আলোচনা একটু পরেই আসছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ (وَدَخَلَ ٱلۡمَدِینَةَ عَلَىٰ حِینِ غَفۡلَةࣲ مِّنۡ أَهۡلِهَا অর্থাৎ -“সে নগরীতে প্রবেশ করল যখন তার অধিবাসীবৃন্দ ছিল অসতর্ক।” আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه), সাঈদ ইব্ন জুবাইর (رضي الله عنه), ইকরিমা (رحمة الله), কাতাদা ও সুদ্দী (رحمة الله) বলেন, তখন ছিল দুপুর বেলা। অন্য এক সূত্রে বর্ণিত; আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেছেন, এটা ছিল মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়। সেখানে তিনি দু’জনকে সংঘর্ষে লিপ্ত পেলেন- একজন ছিল ইসরাঈলী এবং অন্যজন ছিল কিবতী। আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه), কাতাদা (رحمة الله), সুদ্দী (رحمة الله), মুহম্মদ ইব্ন ইসহাক (رحمة الله) এ মত পোষণ করেন। মূসা (عليه السلام)-এর দলের লোকটি শত্রু দলের লোকটির বিরুদ্ধে মূসা (عليه السلام)-এর সাহায্য প্রার্থনা করল। বস্তুত ফিরআউনের পালক-পুত্র হবার কারণে মিসরে মূসা (عليه السلام)-এর প্রতিপত্তি ছিল। মূসা (عليه السلام) ফিরআউনের পালক-পুত্র হওয়ায় এবং তার ঘরে লালিত-পালিত হওয়ায় বনী ইসরাঈলদেরও সম্মান বৃদ্ধি পায়। কেননা, তারা মূসা (عليه السلام)-কে দুধ পান করিয়েছিল-এ হিসাবে তারা ছিল মূসা (عليه السلام)-এর মামা গোত্রীয়। যখন ইসরাঈল বংশীয় লোকটি মূসা (عليه السلام)-এর সাহায্য প্রার্থনা করল তখন তিনি তার সাহায্যে এগিয়ে আসলেন। মুজাহিদ (رحمة الله) فوكزاه শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন, এর অর্থ তিনি তাকে ঘুষি দিলেন। কাতাদা (رحمة الله) বলেন, তিনি তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন। ফলে কিবতীটি মারা যায়। আর এই কিবতীটি ছিল কাফির ও মুশরিক। মূসা (عليه السلام) তাকে প্রাণে বধ করতে চাননি, বরং তিনি তাকে সাবধান ও নিরস্ত্র করতে চেয়েছিলেন। এতদসত্ত্বেও মূসা (عليه السلام) বললেনঃ
قَالَ ہٰذَا مِنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّہٗ عَدُوٌّ مُّضِلٌّ مُّبِیۡنٌ ﴿۱۵﴾ قَالَ رَبِّ اِنِّیۡ ظَلَمۡتُ نَفۡسِیۡ فَاغۡفِرۡ لِیۡ فَغَفَرَ لَہٗ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ ﴿۱۶﴾ قَالَ رَبِّ بِمَاۤ اَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ فَلَنۡ اَکُوۡنَ ظَہِیۡرًا لِّلۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۱۷﴾ فَاَصۡبَحَ فِی الۡمَدِیۡنَۃِ خَآئِفًا یَّتَرَقَّبُ فَاِذَا الَّذِی اسۡتَنۡصَرَہٗ بِالۡاَمۡسِ یَسۡتَصۡرِخُہٗ ؕ قَالَ لَہٗ مُوۡسٰۤی اِنَّکَ لَغَوِیٌّ مُّبِیۡنٌ ﴿۱۸﴾ فَلَمَّاۤ اَنۡ اَرَادَ اَنۡ یَّبۡطِشَ بِالَّذِیۡ ہُوَ عَدُوٌّ لَّہُمَا ۙ قَالَ یٰمُوۡسٰۤی اَتُرِیۡدُ اَنۡ تَقۡتُلَنِیۡ کَمَا قَتَلۡتَ نَفۡسًۢا بِالۡاَمۡسِ ٭ۖ اِنۡ تُرِیۡدُ اِلَّاۤ اَنۡ تَکُوۡنَ جَبَّارًا فِی الۡاَرۡضِ وَ مَا تُرِیۡدُ اَنۡ تَکُوۡنَ مِنَ الۡمُصۡلِحِیۡنَ ﴿۱۹﴾ وَ جَآءَ رَجُلٌ مِّنۡ اَقۡصَا الۡمَدِیۡنَۃِ یَسۡعٰی ۫ قَالَ یٰمُوۡسٰۤی اِنَّ الۡمَلَاَ یَاۡتَمِرُوۡنَ بِکَ لِیَقۡتُلُوۡکَ فَاخۡرُجۡ اِنِّیۡ لَکَ مِنَ النّٰصِحِیۡنَ ﴿۲۰﴾ فَخَرَجَ مِنۡہَا خَآئِفًا یَّتَرَقَّبُ ۫ قَالَ رَبِّ نَجِّنِیۡ مِنَ الۡقَوۡمِ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿٪۲۱﴾
অর্থাৎ–মূসা বলল, “এটা শয়তানের কাণ্ড। সেতো প্রকাশ্য শত্রু ও বিভ্রান্তিকারী। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো আমার নিজের প্রতি জুলুম করেছি, সুতরাং আমাকে ক্ষমা কর। তারপর তিনি তাকে ক্ষমা করলেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সে আরো বলল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি যেহেতু আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছ, (অর্থাৎ মর্যাদা ও প্রতিপত্তি দিয়েছ) আমি কখনও অপরাধীদের সাহায্যকারী হব না। তারপর ভীত-সতর্ক অবস্থায় সেই নগরীতে তার প্রভাত হল। হঠাৎ সে শুনতে পেল, পূর্বদিন যে ব্যক্তি তার সাহায্য চেয়েছিল, সে তার সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। মূসা তাকে বলল, তুমি তো স্পষ্টই একজন বিভ্রান্ত ব্যক্তি। তারপর মূসা যখন উভয়ের শত্রুকে ধরতে উদ্যত হল, তখন সে ব্যক্তি বলে উঠল, হে মূসা! গতকাল তুমি যেমন একজনকে হত্যা করেছ সেভাবে আমাকেও কি হত্যা করতে চাচ্ছ! তুমি তো পৃথিবীতে স্বেচ্ছাচারী হতে চাচ্ছ, শান্তি স্থাপনকারী হতে চাও না? নগরীর দূর প্রান্ত হতে এক ব্যক্তি ছুটে আসল ও বলল, হে মূসা! পারিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করবার পরামর্শ করছে! সুতরাং তুমি বাইরে চলে যাও, আমি তো তোমার মঙ্গলকামী। ভীত-সতর্ক অবস্থায় সে সেখান থেকে বের হয়ে পড়ল এবং বলল, “হে আমার প্রতিপালক! তুমি জালিম সম্প্রদায় হতে আমাকে রক্ষা কর।” (কাসাসঃ ১৫-২১)
বস্তুত আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, মূসা (عليه السلام) মিসর শহরে ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের ব্যাপারে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। পাছে তারা জেনে ফেলে যে, নিহত ব্যক্তির যে মামলাটি তাদের কাছে উত্থাপন করা হয়েছে তাকে বনী ইসরাঈলের এক ব্যক্তির সাহায্যার্থে মূসা (عليه السلام)-ই হত্যা করেছেন। তা হলে তাদের ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যাবে যে, মূসা (عليه السلام) বনী ইসরাঈলেরই একজন। এতে পরবর্তীতে বিরাট অনর্থ ঘটে যেতে পারে। এজন্যই তিনি ঐদিন ভোরে এদিক ওদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলাফেরা করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন, আগের দিন যে ইসরাঈলীটির তিনি সাহায্য করেছিলেন ঐ ব্যক্তি আজও অন্য একজনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে মূসা (عليه السلام)-কে সাহায্যের জন্য আহ্বান করছে। মূসা (عليه السلام) তাকে তার ঝগড়াটে স্বভাবের জন্য ভর্ৎসনা করলেন এবং বললেন, তুমি তো স্পষ্টই একজন বিভ্রান্ত ব্যক্তি। তারপর তিনি মূসা (عليه السلام) ও ইসরাঈলী ব্যক্তিটির শত্রু কিবতীটিকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন যাতে তিনি কিবতীটিকে প্রতিহত করতে পারেন এবং ইসরাঈলীকে তার কবল থেকে রক্ষা করতে পারেন। তারপর তাকে তিনি আক্রমণের জন্য উদ্যত হলেন ও কিবতীটির দিকে অগ্রসর হলেন। তখন লোকটি বলে উঠল।
( یَـٰمُوسَىٰۤ أَتُرِیدُ أَن تَقۡتُلَنِی كَمَا قَتَلۡتَ نَفۡسَۢا بِٱلۡأَمۡسِۖ إِن تُرِیدُ إِلَّاۤ أَن تَكُونَ جَبَّارࣰا فِی ٱلۡأَرۡضِ وَمَا تُرِیدُ أَن تَكُونَ مِنَ ٱلۡمُصۡلِحِینَ)[Surat Al-Qasas ১৯]
অর্থাৎ, হে মূসা! গতকাল তুমি যেমন একব্যক্তিকে হত্যা করেছ, সেভাবে আমাকেও কি হত্যা করতে চাচ্ছ! তুমি তো পৃথিবীতে স্বেচ্ছাচারী হতে চাচ্ছ, শান্তি স্থাপনকারী হতে চাও না। কেউ কেউ বলেন, এ উক্তিটি ইসরাঈলীয়—যে মূসা (عليه السلام)-এর পূর্বদিনের ঘটনাটি সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল, সে যখন মূসা (عليه السلام)-কে কিবতীটির দিকে অগ্রসর হতে দেখল, তখন সে ধারণা করল, তিনি তার দিকেও আসবেন—কেননা, তিনি তাকে প্রথমেই এই বলে ভর্ৎসনা করেছেন যে, তুমি তো একজন বিভ্রান্ত লোক। এজন্যেই সে মূসা (عليه السلام)-কে এ কথাটি বলে এবং পূর্বের দিন যে ঘটনা ঘটেছিল সে তা প্রকাশ করে দিল। তখন কিবতী মূসা (عليه السلام)-কে ফিরআউনের দরবারে তলব করানোর উদ্দেশ্যে চলে যায়। তবে এ অভিমতটি শুধু এ উক্তিকারীরই। অন্য কেউ তা উল্লেখ করেননি। এ উক্তিটি কিবতীটিরও হতে পারে। কেননা, সে যখন মূসা (عليه السلام)-কে তার দিকে অগ্রসর হতে দেখল, তাঁকে ভয় করতে লাগল এবং মূসা (عليه السلام)-এর মেযাজ থেকে ইসরাঈলী পক্ষে চরম প্রতিশোধের আশঙ্কা করে নিজ দূরদর্শিতার আলোকে সে উপরোক্ত উক্তিটি করেছিল। যেন সে বুঝতে পেরেছিল যে, সম্ভবত এ ব্যক্তিটিই গতকালের নিহত ব্যক্তিটির হত্যাকারী। অথবা সে ইসরাঈলীটির মূসা (عليه السلام)-এর কাছে সাহায্যের প্রার্থনা করা থেকেই সে ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরেছিল এবং উপরোক্ত বাক্যটি বলেছিল। আল্লাহই মহা জ্ঞানী।
মূলত ফিরআউনের কাছে এই সংবাদ পৌঁছেছিল যে, মূসা (عليه السلام)-ই গতকালের খুনের জন্য দায়ী। তাই ফিরআউন মূসা (عليه السلام)-কে গ্রেফতার করার জন্যে লোক পাঠাল, কিন্তু তারা মূসা (عليه السلام)-এর নিকট পৌঁছার পূর্বেই শহরের দূরবর্তী প্রান্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর রাস্তা দিয়ে একজন হিতাকাঙ্ক্ষী মূসা (عليه السلام)-এর নিকট পৌঁছে দরদমাখা সুরে বললেন, হে মূসা (عليه السلام)! ফিরআউনের পারিষদবর্গ আপনাকে হত্যা করার সলাপরামর্শ করছে। কাজেই আপনি এখনই এই শহর থেকে বের হয়ে পড়ুন। আমি আপনার একজন হিতাকাঙ্ক্ষী অর্থাৎ আমি যা বলছি, সে ব্যাপারে। মূসা (عليه السلام) তাৎক্ষণিকভাবে মিসর থেকে বের হয়ে পড়েন কিন্তু তিনি রাস্তাঘাট চিনতেন না তাই বলতে থাকেন—
( رَبِّ نَجِّنِی مِنَ ٱلۡقَوۡمِ ٱلظَّـٰلِمِینَ)
[Surat Al-Qasas ২১]
অর্থাৎ, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জালিম সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করুন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
وَ لَمَّا تَوَجَّہَ تِلۡقَآءَ مَدۡیَنَ قَالَ عَسٰی رَبِّیۡۤ اَنۡ یَّہۡدِیَنِیۡ سَوَآءَ السَّبِیۡلِ ﴿۲۲﴾ وَ لَمَّا وَرَدَ مَآءَ مَدۡیَنَ وَجَدَ عَلَیۡہِ اُمَّۃً مِّنَ النَّاسِ یَسۡقُوۡنَ ۬۫ وَ وَجَدَ مِنۡ دُوۡنِہِمُ امۡرَاَتَیۡنِ تَذُوۡدٰنِ ۚ قَالَ مَا خَطۡبُکُمَا ؕ قَالَتَا لَا نَسۡقِیۡ حَتّٰی یُصۡدِرَ الرِّعَآءُ ٜ وَ اَبُوۡنَا شَیۡخٌ کَبِیۡرٌ ﴿۲۳﴾ فَسَقٰی لَہُمَا ثُمَّ تَوَلّٰۤی اِلَی الظِّلِّ فَقَالَ رَبِّ اِنِّیۡ لِمَاۤ اَنۡزَلۡتَ اِلَیَّ مِنۡ خَیۡرٍ فَقِیۡرٌ ﴿۲۴﴾
অর্থাৎ—যখন মূসা মাদায়ান অভিমুখে যাত্রা করল তখন বলল, আশা করি আমার প্রতিপালক আমাকে সরলপথ প্রদর্শন করবেন। যখন সে মাদায়ানের কূপের নিকট পৌঁছল, দেখল একদল লোক তাদের পশুগুলোকে পানি পান করাচ্ছে এবং তাদের পিছনে দু’জন নারী তাদের পশুগুলোকে আগলাচ্ছে। মূসা (عليه السلام) বলল, তোমাদের কি ব্যাপার?’ তারা বললেন, ‘আমরা আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করাতে পারি না, যতক্ষণ রাখালরা তাদের পশুগুলোকে নিয়ে সরে না যায়। আমাদের পিতা অতি বৃদ্ধ।’ মূসা (عليه السلام) তখন তাদের পশুগুলোকে পানি পান করাল, তারপর তিনি ছায়ার নিচে আশ্রয় গ্রহণ করে বলল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবে আমি তার কাঙ্গাল। (সূরা কাসাসঃ ২২-২৪)
উল্লেখিত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা আপন বান্দা, রাসূল ও কালীম মূসা (عليه السلام)-এর মিসর থেকে বের হয়ে যাবার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ফিরআউনের সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি তাকে দেখে ফেলে নাকি, এই ভয়ে চতুর্দিকে তাকাতে তাকাতে মূসা (عليه السلام) শহর থেকে বের হয়ে পড়লেন, কিন্তু কোথায় যাবেন বা কোন দিকে যাবেন তিনি কিছুই জানেন না। তিনি ইতিপূর্বে মিসর থেকে আর কোনদিন বের হননি। যখন তিনি মাদায়ানে যাবার পথ ধরতে পারলেন তখন তিনি বলে উঠলেন, আমি আশা করি আমার প্রতিপালক আমাকে সোজা রাস্তা প্রদর্শন করবেন। অর্থাৎ সম্ভবত আমি এবার মনযিলে মকসুদে পৌঁছতে পারব। এভাবে বাস্তবে ঘটেছিলও তাই। এ পথই তাকে মনযিলে মকসুদে পৌঁছায়। কি সে মনযিলে মকসুদটি? মাদায়ানে একটি কূয়া ছিল যার পানি সকলে পান করত। মাদায়ান হলো সেই শহর যেখানে আল্লাহ তআলা ‘আইকাহ’ বাসীদের ধ্বংস করেছিলেন আর তারা ছিল শুয়ায়ব (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়।
উলামায়ে কিরামের একটি মত অনুযায়ী মূসা (عليه السلام)-এর যুগের পূর্বে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যখন মূসা (عليه السلام) মাদায়ানের পানির কুপে পৌঁছলেন, সেখানে একদল লোক পেলেন যারা তাদের পশুগুলোকে পানি পান করাচ্ছে এবং তাদের পেছনে দু’জন নারীকে পেলেন যারা তাদের ছাগলগুলোকে আগলাচ্ছে, যাতে এগুলো সম্প্রদায়ের ছাগলগুলোর সাথে মিশে না যায়।
কিতাবীদের মতে, সেখানে সাতজন নারী ছিল। এটাও তাদের ভ্রান্ত ধারণা। তারা সাতজন হতে পারে তবে তাদের মধ্য হতে দু’জন পানি পান করাতে এসেছিল। তাদের বর্ণনা বিশুদ্ধ হলেই কেবল এ ধরনের সামঞ্জস্যসূচক উত্তর গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এটা স্পষ্ট যে, শুয়ায়ব (عليه السلام)-এর কেবল দুটি কন্যাই ছিল। মূসা (عليه السلام)-এর প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বললেন, আমরা আমাদের দুর্বলতার জন্যে রাখালদের পানি পান করার পূর্বে আমরা আমাদের পানির কাছে পৌঁছতে পারি না। আর এসব পশু নিয়ে আমাদের আসার কারণ হচ্ছে- আমাদের পিতার বৃদ্ধাবস্থা ও দুর্বলতা। তখন মূসা (عليه السلام) তাদের পশুগুলোকে পানি পান করালেন।
তাফসীরকারগণ বলেন, রাখালরা যখন তাদের জানোয়ারগুলোর পানি পান করানো শেষ করত, তখন তারা কূয়ার মুখে একটি বড় ও ভারী পাথর রেখে দিত। তারপর এই দুই নারী আসতেন এবং লোকজনের পশুগুলোর পানি পান করার পর যা উচ্ছিষ্ট থাকত তা হতে আপন বকরীগুলোকে পানি পান করাতেন। কিন্তু আজ মূসা (عليه السلام) আসলেন এবং একাই পাথরটি উঠালেন। তারপর তিনি তাদেরকে ও তাদের বকরীগুলোকে পানি পান করালেন এবং পাথরটি পূর্বের জায়গায় রেখে দিলেন।
আমীরুল মুমিনীন উমর (رضي الله عنه) বলেন, পাথরটি দশজনে উঠাতে পারত। তিনি একবালতি পানি উঠালেন এবং তাতে দু’জনের প্রয়োজন মিটে যায়। পুনরায় তিনি গাছের ছায়ায় ফিরে গেলেন। তাফসীরকারগণ বলেন, এটা সামার গাছের ছায়া। ইব্ন জারীর তাবারী (رحمة الله) ইব্ন মাসউদ (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি এই গাছটিকে সবুজ ও ছায়াদার দেখেছেন। মূসা (عليه السلام) বলেন, “হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহই অবতীর্ণ করবেন আমি তার কাঙ্গাল।”
আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, মূসা (عليه السلام) মিসর থেকে মাদায়ান ভ্রমণকালে শাক সবজি ও গাছের পাতা ব্যতীত অন্য কিছু খেতে পাননি। তার পায়ে তখন জুতা ছিল না। জুতা না থাকায় দুই পায়ের তলায় যখম হয়ে গিয়েছিল। তিনি গাছের ছায়ায় বসলেন। তিনি ছিলেন সৃষ্টিকুলের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার মনোনীত ব্যক্তি। অথচ ক্ষুধার কারণে তাঁর পেট পিঠের সাথে লেগে গিয়েছিল এবং তার দেহে এর প্রভাব দৃশ্যমান ছিল। আর তখন তিনি এক টুকরো খেজুরের পর্যন্ত মুখাপেক্ষী ছিলেন। এ আয়াত প্রসঙ্গে আতা ইব্ন সাইব (رحمة الله) বলেন। তিনি নারীদেরকে শুনিয়ে এ দু’আটি করেছিলেন।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
فَجَآءَتۡہُ اِحۡدٰىہُمَا تَمۡشِیۡ عَلَی اسۡتِحۡیَآءٍ ۫ قَالَتۡ اِنَّ اَبِیۡ یَدۡعُوۡکَ لِیَجۡزِیَکَ اَجۡرَ مَا سَقَیۡتَ لَنَا ؕ فَلَمَّا جَآءَہٗ وَ قَصَّ عَلَیۡہِ الۡقَصَصَ ۙ قَالَ لَا تَخَفۡ ٝ نَجَوۡتَ مِنَ الۡقَوۡمِ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۲۵﴾ قَالَتۡ اِحۡدٰىہُمَا یٰۤاَبَتِ اسۡتَاۡجِرۡہُ ۫ اِنَّ خَیۡرَ مَنِ اسۡتَاۡجَرۡتَ الۡقَوِیُّ الۡاَمِیۡنُ ﴿۲۶﴾ قَالَ اِنِّیۡۤ اُرِیۡدُ اَنۡ اُنۡکِحَکَ اِحۡدَی ابۡنَتَیَّ ہٰتَیۡنِ عَلٰۤی اَنۡ تَاۡجُرَنِیۡ ثَمٰنِیَ حِجَجٍ ۚ فَاِنۡ اَتۡمَمۡتَ عَشۡرًا فَمِنۡ عِنۡدِکَ ۚ وَ مَاۤ اُرِیۡدُ اَنۡ اَشُقَّ عَلَیۡکَ ؕ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰہُ مِنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۲۷﴾ قَالَ ذٰلِکَ بَیۡنِیۡ وَ بَیۡنَکَ ؕ اَیَّمَا الۡاَجَلَیۡنِ قَضَیۡتُ فَلَا عُدۡوَانَ عَلَیَّ ؕ وَ اللّٰہُ عَلٰی مَا نَقُوۡلُ وَکِیۡلٌ ﴿٪۲۸﴾
অর্থাৎ–নারী দ্বয়ের একজন শরমজনিত পায়ে তার নিকট আসল এবং বলল, “আমার পিতা আপনাকে আমন্ত্রণ করেছেন, আমাদের জানোয়ারগুলোকে পানি পান করানোর পারিশ্রমিক দেয়ার জন্য, তারপর মূসা (عليه السلام) তাঁর নিকট এসে সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করলে সে বলল, ভয় করো না তুমি জালিম সম্প্রদায়ের কবল থেকে বেঁচে গিয়েছ। তাদের একজন বলল, হে পিতা! তুমি একে মজুর নিযুক্ত কর, কারণ তোমার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।” সে মূসা (عليه السلام)-কে বলল, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই এ শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করবে- যদি তুমি দশবছর পূর্ণ কর, সে তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তুমি আমাকে সদাচারী পাবে। মূসা (عليه السلام) বলল, “আমার ও আপনার মধ্যে এ চুক্তিই রইল।’ এ দুটি মেয়াদের কোন একটি আমি পূর্ণ করলে আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না। আমরা যে বিষয়ে কথা বলছি আল্লাহ তার সাক্ষী। (২৮ কাসাসঃ ২৫-২৮)
মূসা (عليه السلام) গাছের ছায়ায় বসে যখন বললেনঃ
رب اني لما انزلت الي من خير فقير
তখন নারীদ্বয় তা শুনতে পান এবং তারা দু’জন তাদের পিতার কাছে গেলেন। কথিত আছে, তাঁদের এরূপ ত্বরান্বিত প্রত্যাবর্তনে শুয়ায়ব (عليه السلام) তার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তারা যখন তাঁকে মূসা (عليه السلام)-এর ঘটনা সম্পর্কে জানালেন, তখন শুয়ায়ব (عليه السلام) তাদের একজনকে মূসা (عليه السلام)-কে ডেকে আনতে পাঠালেন। তাদের একজন আযাদ নারীসুলভ শরম জড়িত পায়ে তাঁর নিকট আসলেন এবং বললেন, আমার পিতা পানি পান করানোর পারিশ্রমিক দেয়ার জন্যে আপনাকে ডাকছেন। তিনি কথাটি স্পষ্ট করে বললেন, যাতে মূসা (عليه السلام) তার কথায় কোনরূপ সন্দেহ না করেন। এটা ছিল তার লজ্জা ও পবিত্রতার পূর্ণতার প্রমাণ। যখন মূসা (عليه السلام) শুয়ায়ব (عليه السلام)-এর কাছে আগমন করলেন এবং তাঁর মিসর ও ফিরআউন থেকে তার পলায়ন করে আসার যাবতীয় ঘটনা শুয়ায়ব (عليه السلام)-এর কাছে বর্ণনা করলেন তখন তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি ভয় করো না, তুমি জালিম সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব থেকে বের হয়ে এসেছ, এখন আর তুমি তাদের রাজ্যে নও।’
এই বৃদ্ধ কে? এ নিয়ে উলামায়ে কিরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, “তিনি হচ্ছেন শুয়ায়ব (عليه السلام)।” এটাই অধিকাংশ ব্যাখ্যাকারীর কাছে সুপ্রসিদ্ধ অভিমত। হাসান বসরী (رحمة الله) ও মালিক ইব্ন আনাস (رحمة الله) এ মত পোষণ করেন। এ ব্যাপারে একটি হাদীসেও সুস্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। তবে এর সনদে কিছু সন্দেহ রয়েছে। অন্য একজন প্রকাশ্যভাবে বলেছেন যে, শুয়ায়ব (عليه السلام) তার সম্প্রদায় ধ্বংস হবার পরও অনেকদিন জীবিত ছিলেন। অতঃপর মূসা (عليه السلام) তাঁর যুগ পান এবং তাঁর কন্যাকে বিবাহ করেন।
ইব্ন আবু হাতিম (رحمة الله) প্রমুখ হাসান বসরী (رحمة الله) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, মূসা (عليه السلام)-এর ঘটনা সংশ্লিষ্ট এ ব্যক্তির নাম শুয়ায়ব, তিনি মাদায়ানে কূয়ার মালিক ছিলেন কিন্তু তিনি মাদায়ানের নবী শুয়ায়ব নন। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি হচ্ছেন শুয়ায়ব (عليه السلام)-এর ভাতিজা। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি হচ্ছেন শুয়ায়ব (عليه السلام)-এর চাচাতো ভাই। কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন শুয়ায়বের সম্প্রদায়ের একজন মুমিন বান্দা। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি হচ্ছেন একজন লোক যার নাম ইয়াসরূন। কিতাবীদের গ্রন্থাদিতে এরূপ বিবরণ রয়েছে। তাদের ভাষ্য মতে, ইয়াসরূন ছিলেন একজন বড় ও জ্ঞানী জ্যোতিষী। আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) ও আবু উবায়দা ইব্ন আবদুল্লাহ (رحمة الله) তাঁর নাম ইয়াসরূন বলে উল্লেখ করেছেন। আবু উবায়দা আরো বলেন, তিনি ছিলেন শুয়ায়ব (عليه السلام)-এর ভাতিজা। আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) এ বর্ণনায় বাড়িয়ে বলেন, তিনি ছিলেন মাদায়ানের লোক।
মোটকথা, যখন শুয়ায়ব (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-কে আতিথ্য ও আশ্রয় দান করলেন, তখন তিনি তাঁর সমস্ত কাহিনী শুয়ায়ব (عليه السلام)-এর কাছে বর্ণনা করলেন। তখন শুয়ায়ব (عليه السلام) তাকে সুসংবাদ দিলেন যে, তিনি জালিমদের কবল থেকে পরিত্রাণ লাভ করেছেন। তখন দুই কন্যার একজন তাঁর পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা! তাকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তোমার বকরী চরাবার জন্যে নিযুক্ত কর। তারপর সে তার প্রশংসা করে বলল যে, মূসা (عليه السلام) শক্তিশালী এবং আমানতদারও বটে। উমর (رضي الله عنه), আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه), কাযী শুরায়হ (رحمة الله), আবু মালিক (رحمة الله), কাতাদা (رحمة الله), মুহম্মদ ইব্ন ইসহাক (رحمة الله) প্রমুখ বলেন, “শুয়ায়ব (عليه السلام)-এর কন্যা যখন মূসা (عليه السلام) সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য করলেন, তখন তাঁর পিতা তাঁকে বললেন, তুমি তা কেমন করে জানলে?” জবাবে তিনি বললেন, তিনি এমন একটি পাথর উত্তোলন করেছেন যা উত্তোলন করতে দশজন লোকের প্রয়োজন। আবার আমি যখন তার সাথে বাড়ি আসছিলাম, আমি তার সামনে পথ চলছিলাম, এক পর্যায়ে তিনি বললেন, “তুমি আমার পেছনে পেছনে চল, আর যখন বিভিন্ন রাস্তার মাথা দেখা দেবে তখন তুমি কঙ্কর নিক্ষেপের মাধ্যমে আমাকে পথ নির্দেশ করবে।”
আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, তিন ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা অতি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন—
(১) ইউসুফ (عليه السلام)-এর ক্রেতা–যখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, “সম্মান জনকভাবে তার থাকবার ব্যবস্থা কর।”
(২) মূসা (عليه السلام)-এর সঙ্গিনী—যখন তিনি বলেছিলেন, “হে আমার পিতা! তুমি তাকে মজুর নিযুক্ত কর, কারণ তোমার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।”
(৩) আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) যখন তিনি উমর (رضي الله عنه) ইব্ন আল খাত্তাবকে খলীফা মনোনীত করেন। অতঃপর শুয়ায়ব (عليه السلام) বলেনঃ
قَالَ إِنِّیۤ أُرِیدُ أَنۡ أُنكِحَكَ إِحۡدَى ٱبۡنَتَیَّ هَـٰتَیۡنِ عَلَىٰۤ أَن تَأۡجُرَنِی ثَمَـٰنِیَ حِجَجࣲۖ فَإِنۡ أَتۡمَمۡتَ عَشۡرࣰا فَمِنۡ عِندِكَۖ وَمَاۤ أُرِیدُ أَنۡ أَشُقَّ عَلَیۡكَۚ سَتَجِدُنِیۤ إِن شَاۤءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّـٰلِحِینَ[Surat Al-Qasas ২৭]
অর্থাৎ– সে বলল, “আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করবে, যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, সে তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাহে তো তুমি আমাকে সদাচারী রূপে পাবে।”
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আবু হানীফা (رحمة الله)-এর কিছু সংখ্যক অনুসারী দলীল পেশ করেন যে, যদি কেউ বলে, আমি দুটি দাসের মধ্যে একটি, কিংবা কাপড় দু’টির একটি, অনুরূপভাবে অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রেও দুটির একটি বিক্রি করব তাহলে এরূপ বলা শুদ্ধ হবে। কেননা, শুয়ায়ব (عليه السلام) বলেছিলেন, অর্থাৎ- আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে। আসলে এ যুক্তি যথার্থ নয়; কেননা, বিয়ের ক্ষেত্রটি হচ্ছে পরস্পর সম্মতির ব্যাপার, ব্যবসায়ের মত লেনদেনের ব্যাপার নয়। আল্লাহ তা‘আলাই সম্যক জ্ঞাত।
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা ইমাম আহমদ (رحمة الله)-এর অনুসারিগণ প্রচলিত প্রথা অনুসারে আহার ও বাসস্থানের বিনিময়ে মজুর নিযুক্তির বৈধতার প্রমাণ বলে পেশ করেন। ইব্ন মাজাহ্ (رحمة الله) তার ‘সুনান গ্রন্থে باب استجار الاجير অর্থাৎ শ্রমিক নিয়োগ শিরোনামে পেটেভাতে মজুর নিযুক্তির বৈধতা প্রমাণার্থে যে হাদীস বর্ণনা করেছেন-এ হাদীসটিও প্রসঙ্গক্রমে তারা উল্লেখ করেছেন। উতবা ইব্ন নুদ্র (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম। রাসূল (ﷺ) সূরা কাসাস পাঠ করলেন। তিনি যখন মূসা (عليه السلام)-এর ঘটনায় পৌঁছলেন তখন তিনি বললেন, নিশ্চয়ই মূসা (عليه السلام) আট বছর কিংবা দশ বছর পেটেভাতে এবং চরিত্রের পবিত্রতা অক্ষুন্ন রাখার জন্যে কায়িক শ্রম করেছেন। তবে হাদীসটি দুর্বল বিধায় এর দ্বারা দলীল পেশ করা যায় না। অন্য এক সূত্রে ইব্ন আবু হাতিম (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
(قَالَ ذَلِكَ بَیۡنِی وَبَیۡنَكَۖ أَیَّمَا ٱلۡأَجَلَیۡنِ قَضَیۡتُ فَلَا عُدۡوَنَ عَلَیَّۖ وَٱللَّهُ عَلَىٰ مَا نَقُولُ وَكِیلࣱ)
[Surat Al-Qasas ২৮]
অর্থাৎ–মূসা (عليه السلام) তাঁর ভাবী শ্বশুরকে বলেন, আপনি যে চুক্তির কথা বলেছেন তাই স্থির হল, তবে দুই মেয়াদের মধ্যে যে কোনটাই আমি পূর্ণ করব, আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না। আমরা যে বিষয়ে কথা বলছি আল্লাহ তার সাক্ষী। এতদসত্ত্বেও মূসা (عليه السلام) দু’টির মধ্যে দীর্ঘতমটি পূর্ণ করেন অর্থাৎ পূর্ণ ১০ বছর তিনি মজুরি করেন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) সাঈদ ইব্ন জুবায়র (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ননা করেন, তিনি বলেন, হীরার অধিবাসী একজন ইহুদী আমাকে প্রশ্ন করল, اى الا جلين قضى موسى অর্থাৎ মূসা (عليه السلام) কোন্ মেয়াদটি পূরণ করেছিলেন? বললাম, আমি জানি না, তবে আরবের মহান শিক্ষিত লোকটির কাছে জিজ্ঞাসা করব। অতঃপর আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর নিকট এসে তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, দু’টির মধ্যে যেটা অধিক ও বেশি পছন্দনীয় সেটাই তিনি পূরণ করেছিলেন। কেননা, আল্লাহর নবী যা বলেন তা অবশ্যই করেন।
ইমাম নাসাঈ (رحمة الله)ও অন্য এক সূত্রে সাঈদ ইব্ন জুবায়র (رضي الله عنه) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেন।
ইব্ন জারীর তাবারী (رحمة الله)ও অন্য এক সূত্রে আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, “একদিন আমি জিবরাঈল (عليه السلام)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, “মূসা (عليه السلام) কোন্ মেয়াদটি পূর্ণ করেছিলেন? তখন তিনি বলেন, যেটা বেশি পরিপূর্ণ সেটাই তিনি পূরণ করেছিলেন।” ইমাম আল বাযযার (رحمة الله) অন্য এক সূত্রে আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) হতে অনুরূপ বর্ণনা পেশ করেছেন।
ইমাম সানীদ (رحمة الله) মুজাহিদ (رحمة الله) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) একদিন এ ব্যাপারে জিবরাঈল (عليه السلام)-কে জিজ্ঞাসা করলেন। পুনরায় জিবরাঈল (عليه السلام) এ সম্বন্ধে ইসরাফীল (عليه السلام)-কে জিজ্ঞাসা করলেন। ইসরাফীল (عليه السلام) মহান প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলাকে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, যেটি অধিক পরিপূর্ণ ও অধিক কল্যাণকর।
ইব্ন জারীর তাবারী (رحمة الله)-ও অন্য এক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, মূসা (عليه السلام) কোন্ মেয়াদটি পূরণ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, যেটা অধিক পরিপূর্ণ সেটাই তিনি পূরণ করেছিলেন। ইমাম আল বাযযার (رحمة الله) ও ইব্ন আবু হাতিম (رحمة الله) আবু যর (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে একদিন প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, মূসা (عليه السلام) কোন্ মেয়াদটি পূরণ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, যেটা অধিক পরিপূর্ণ ও অধিক কল্যাণকর। তিনি বলেন, “যদি তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, কোন কন্যাটিকে মূসা (عليه السلام) বিয়ে করেছিলেন, তখন বলে দাও, ছোট কন্যাটিকে।”
ইমাম আল বায্যার (رحمة الله) ও ইব্ন আবূ হাতিম (رحمة الله) অন্য এক সূত্রে উতবা ইব্ন নুদর (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, মূসা (عليه السلام) জীবিকা নির্বাহ ও চরিত্রের হেফাজতের জন্যে মজুরি করেছেন। এরপর তিনি যখন মেয়াদ পূরণ করেন তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল কোন্ মেয়াদটি ইয়া রাসূলাল্লাহ! তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রতি উত্তরে বলেন, যেটি অধিক পরিপূর্ণ ও অধিক কল্যাণকর।
যখন মূসা (عليه السلام) শুয়ায়ব (عليه السلام) হতে বিদায় গ্রহণের ইচ্ছা করেন, তখন তিনি তার স্ত্রীকে বলেন, তাঁর পিতার নিকট থেকে কিছু বকরী চেয়ে নিতে যাতে তারা এগুলো দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। তাই এ বছর যতগুলো বকরী মায়ের রংয়ের ভিন্ন রং-এ জন্ম নিয়েছে সেগুলি তাকে দান করলেন। তাঁর বকরীগুলো ছিলো কালো ও সুন্দর। মূসা (عليه السلام) লাঠি নিয়ে গেলেন এবং একদিক থেকে এগুলোকে পৃথক করলেন। অতঃপর এগুলোকে পানির চৌবাচ্চার কাছে নিয়ে গেলেন এবং পানি পান করালেন। মূসা (عليه السلام) চৌবাচ্চার পাশে দাঁড়ালেন। কিন্তু একটি বকরীও পানি পান শেষ করে নিজ ইচ্ছায় ছুটে আসল না। যতক্ষণ না তিনি একটি একটি করে মৃদু প্রহার করেন। বর্ণনাকারী বলেন, দুই-একটি ব্যতীত বকরীগুলো প্রতিটি যমজ, বকনা এবং মায়ের রংয়ের অন্য রং-এর বাচ্চা জন্ম দেয়। এগুলোর মধ্যে চওড়া বুক, লম্বা বাঁট, সংকীর্ণ বুক, একেবারে ছোট বাট এবং হাতে ধরা যায় না এরূপ বাটের অধিকারী বকরী ছিল না। অর্থাৎ সবগুলোই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যদি তোমরা সিরিয়া পৌঁছতে পারতে তাহলে তোমরা এখনও ঐ জাতের বকরী দেখতে পেতে। এসব বকরী হচ্ছে সামেরীয়। এ হাদীসটি মরফূ’ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
ইব্ন জারীর তাবারী (رحمة الله) আনাস ইবনে মালিক (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যখন আল্লাহর নবী মূসা (عليه السلام) তার নিয়োগকর্তাকে মেয়াদপূর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, তখন তিনি বললেন, প্রতিটি বকরীই তোমার, যা তার মায়ের রং-এ জন্ম নেবে। মূসা (عليه السلام) মানুষের একটি আকৃতি পানিতে দাঁড় করিয়ে রাখলেন যখন বকরীগুলো মানুষের আকৃতি দেখল, ভয় পেয়ে গেল এবং ছুটাছুটি করতে লাগল। একটি ব্যতীত সবগুলোই চিত্রা বাচ্চা জন্ম দিল। মূসা (عليه السلام) ঐ বছরের সব বাচ্চা নিয়ে নিলেন। এ বর্ণনাটির রাবীগণ বিশ্বস্ত। অনুরূপ ঘটনা হযরত ইয়াকূব (عليه السلام) সম্পর্কেও পূর্বে বর্ণিত আছে। আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত। আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ
فَلَمَّا قَضٰی مُوۡسَی الۡاَجَلَ وَ سَارَ بِاَہۡلِہٖۤ اٰنَسَ مِنۡ جَانِبِ الطُّوۡرِ نَارًا ۚ قَالَ لِاَہۡلِہِ امۡکُثُوۡۤا اِنِّیۡۤ اٰنَسۡتُ نَارًا لَّعَلِّیۡۤ اٰتِیۡکُمۡ مِّنۡہَا بِخَبَرٍ اَوۡ جَذۡوَۃٍ مِّنَ النَّارِ لَعَلَّکُمۡ تَصۡطَلُوۡنَ ﴿۲۹﴾ فَلَمَّاۤ اَتٰىہَا نُوۡدِیَ مِنۡ شَاطِیَٴ الۡوَادِ الۡاَیۡمَنِ فِی الۡبُقۡعَۃِ الۡمُبٰرَکَۃِ مِنَ الشَّجَرَۃِ اَنۡ یّٰمُوۡسٰۤی اِنِّیۡۤ اَنَا اللّٰہُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ۳۰﴾ وَ اَنۡ اَلۡقِ عَصَاکَ ؕ فَلَمَّا رَاٰہَا تَہۡتَزُّ کَاَنَّہَا جَآنٌّ وَّلّٰی مُدۡبِرًا وَّ لَمۡ یُعَقِّبۡ ؕ یٰمُوۡسٰۤی اَقۡبِلۡ وَ لَا تَخَفۡ اِنَّکَ مِنَ الۡاٰمِنِیۡنَ ﴿۳۱﴾ اُسۡلُکۡ یَدَکَ فِیۡ جَیۡبِکَ تَخۡرُجۡ بَیۡضَآءَ مِنۡ غَیۡرِ سُوۡٓءٍ ۫ وَّ اضۡمُمۡ اِلَیۡکَ جَنَاحَکَ مِنَ الرَّہۡبِ فَذٰنِکَ بُرۡہَانٰنِ مِنۡ رَّبِّکَ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ وَ مَلَا۠ئِہٖ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا قَوۡمًا فٰسِقِیۡنَ ﴿۳۲﴾
মূসা (عليه السلام) যখন তাঁর মেয়াদ পূর্ণ করবার পর সপরিবারে যাত্রা করল, তখন সে তুর পর্বতের দিকে আগুন দেখতে পেল। সে তার পরিবারবর্গকে বলল, তোমরা অপেক্ষা কর, আমি আগুন দেখেছি। সম্ভবত আমি সেখান থেকে তোমাদের জন্য খাবার আনতে পারি অথবা এক খণ্ড জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড আনতে পারি, যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পার। যখন মূসা (عليه السلام) আগুনের নিকট পৌঁছল, তখন উপত্যকার দক্ষিণ পার্শ্বে পবিত্র ভূমিস্থিত এক বৃক্ষের দিক হতে তাকে আহ্বান করে বলা হল, হে মূসা! আমিই আল্লাহ, জগতসমূহের প্রতিপালক। আরও বলা হল, তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর,’ তারপর যখন সে এটাকে সাপের মত ছুটোছুটি করতে দেখল, তখন পেছনের দিকে ছুটতে লাগল এবং ফিরে তাকাল না। তাকে বলা হল, হে মূসা! সম্মুখে আস, ভয় করো না, তুমি তো নিরাপদ। তোমার হাত তোমার বগলে রাখ, এটা বের হয়ে আসবে শুভ্র সমুজ্জ্বল নির্দোষ হয়ে। ভয় দূর করবার জন্য তোমার হাত দুটি নিজের দিকে চেপে ধর। এ দুটি তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত প্রমাণ, ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের জন্য। ওরা তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়। (সূরা কাসাসঃ ২৯-৩২)
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মূসা (عليه السلام) পূর্ণতর মেয়াদ অর্থাৎ দশ বছর পূরণ করেছেন। মুজাহিদ (رحمة الله) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রথম তিনি ১০ বছর পূরা করেন, পরে আরো দশ বছর। আয়াতে উল্লেখিত—এর অর্থ হচ্ছে, মূসা (عليه السلام) তাঁর শ্বশুরের নিকট থেকে সপরিবারে রওয়ানা হলেন। একাধিক মুফাসসির ও অন্যান্য উলামা বর্ণনা করেন যে, মূসা (عليه السلام) তাঁর আত্মীয়-স্বজনের সাথে মুলাকাতের জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তাই তিনি গোপনে মিসরে গিয়ে তাঁদের সাথে দেখা করতে মনস্থ করলেন। যখন তিনি সপরিবারে রওয়ানা হলেন তখন তাঁর সাথে ছিল ছেলে-মেয়ে ও বকরীর পাল। যা তিনি তার অবস্থানকালে অর্জন করেছিলেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন, ঘটনাচক্রে তার যাত্রার রাতটি ছিল অন্ধকার ও ঠাণ্ডা। তারা পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন, পরিচিত রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করেও তারা আগুন জ্বালাতে ব্যর্থ হন। অন্ধকার ও ঠাণ্ডা তীব্র আকার ধারণ করল। এ অবস্থায় হঠাৎ তিনি দূরে অগ্নিশিখা দেখতে পেলেন যা তূর পর্বতের এক অংশে প্রজ্বলিত ছিল। এটা ছিল তূর পর্বতের পশ্চিমাংশ যা ছিল তার ডান দিকে। তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে বললেন, ‘তোমরা এখানে অপেক্ষা কর, আমি আগুন দেখতে পেয়েছি।’ আল্লাহই ভাল জানেন।
সম্ভবত এ আগুন শুধু তিনিই দেখেছেন অন্য কেউ দেখেননি; কেননা, এই আগুন প্রকৃত পক্ষে নূর ছিল, যা সকলের দৃষ্টিগোচর হয় না। তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে বললেন, আমি হয়ত সেখান থেকে সঠিক রাস্তার সন্ধান পেতে পারব। কিংবা আগুনের কাষ্ঠখণ্ড নিয়ে আসবো যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পার। সূরায়ে তা-হার আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, তারা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন। যেখানে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ ہَلۡ اَتٰىکَ حَدِیۡثُ مُوۡسٰی ۘ﴿۹﴾ اِذۡ رَاٰ نَارًا فَقَالَ لِاَہۡلِہِ امۡکُثُوۡۤا اِنِّیۡۤ اٰنَسۡتُ نَارًا لَّعَلِّیۡۤ اٰتِیۡکُمۡ مِّنۡہَا بِقَبَسٍ اَوۡ اَجِدُ عَلَی النَّارِ ہُدًی ﴿۱۰﴾
অর্থাৎ–মূসার বৃত্তান্ত তোমার নিকট পৌঁছেছে কি? সে যখন আগুন দেখল তখন তার পরিবারবর্গকে বলল, তোমরা এখানে থাক, আমি আগুন দেখেছি। সম্ভবত আমি তোমাদের জন্য তা হতে কিছু জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে আসতে পারব অথবা আমি তার নিকট কোন পথনির্দেশ পাব। (সূরা তা-হাঃ ৯-১০)
এতে প্রমাণিত হয় যে, সেখানে অন্ধকার ছিল এবং তারা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
اِذۡ قَالَ مُوۡسٰی لِاَہۡلِہٖۤ اِنِّیۡۤ اٰنَسۡتُ نَارًا ؕ سَاٰتِیۡکُمۡ مِّنۡہَا بِخَبَرٍ اَوۡ اٰتِیۡکُمۡ بِشِہَابٍ قَبَسٍ لَّعَلَّکُمۡ تَصۡطَلُوۡنَ ﴿۷﴾
অর্থাৎ–স্মরণ কর, সে সময়ের কথা যখন মূসা (عليه السلام) তার পরিবারবর্গকে বলেছিল- আমি আগুন দেখেছি, সত্বর আমি সেখান থেকে তোমাদের জন্য কোন খবর আনব অথবা তোমাদের জন্য আনব জ্বলন্ত অঙ্গার যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পার। (সূরা নামলঃ ৭)
বাস্তবিকই তিনি তাদের নিকট সেখান থেকে সুসংবাদ নিয়ে এসেছিলেন, সে কী সুসংবাদ। তিনি সেখানে উত্তম পথনির্দেশ পেয়েছিলেন, কী উত্তম পথনির্দেশ! তিনি সেখান থেকে নূর নিয়ে এসেছিলেন, কী চমৎকার সে নূর! অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
فَلَمَّاۤ اَتٰىہَا نُوۡدِیَ مِنۡ شَاطِیَٴ الۡوَادِ الۡاَیۡمَنِ فِی الۡبُقۡعَۃِ الۡمُبٰرَکَۃِ مِنَ الشَّجَرَۃِ اَنۡ یّٰمُوۡسٰۤی اِنِّیۡۤ اَنَا اللّٰہُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ۳۰﴾
অর্থাৎ–যখন মূসা (عليه السلام) আগুনের নিকট পৌঁছল, তখন উপত্যকার দক্ষিণ পার্শ্বে পবিত্র ভূমিস্থিত এক বৃক্ষ হতে তাকে আহ্বান করে বলা হল, হে মূসা! আমিই আল্লাহ, জগতসমূহের প্রতিপালক। (সূরা কাসাসঃ ৩০)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
فَلَمَّا جَآءَہَا نُوۡدِیَ اَنۡۢ بُوۡرِکَ مَنۡ فِی النَّارِ وَ مَنۡ حَوۡلَہَا ؕ وَ سُبۡحٰنَ اللّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۸﴾
অর্থাৎ–অতঃপর সে যখন তাঁর নিকট আসল তখন ঘোষিত হল, ধন্য যারা রয়েছে এ আলোর মধ্যে এবং যারা রয়েছে তার চতুষ্পার্শ্বে, জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ পবিত্র ও মহিমান্বিত। (সূরা নামলঃ ৮)
অর্থাৎ যিনি যা ইচ্ছা তা করেন এবং যা ইচ্ছা নির্দেশ করেন। এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন হে মূসা! আমি তো আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
সূরা তা-হায় আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
فَلَمَّاۤ اَتٰىہَا نُوۡدِیَ یٰمُوۡسٰی ﴿ؕ۱۱﴾ اِنِّیۡۤ اَنَا رَبُّکَ فَاخۡلَعۡ نَعۡلَیۡکَ ۚ اِنَّکَ بِالۡوَادِ الۡمُقَدَّسِ طُوًی ﴿ؕ۱۲﴾وَ اَنَا اخۡتَرۡتُکَ فَاسۡتَمِعۡ لِمَا یُوۡحٰی ﴿۱۳﴾ اِنَّنِیۡۤ اَنَا اللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعۡبُدۡنِیۡ ۙ وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ لِذِکۡرِیۡ ﴿۱۴﴾ اِنَّ السَّاعَۃَ اٰتِیَۃٌ اَکَادُ اُخۡفِیۡہَا لِتُجۡزٰی کُلُّ نَفۡسٍۭ بِمَا تَسۡعٰی ﴿۱۵﴾ فَلَا یَصُدَّنَّکَ عَنۡہَا مَنۡ لَّا یُؤۡمِنُ بِہَا وَ اتَّبَعَ ہَوٰىہُ فَتَرۡدٰی ﴿۱۶﴾
অতঃপর যখন সে আগুনের নিকট আসল তখন আহ্বান করে বলা হল, ‘হে মূসা! আমিই তোমার প্রতিপালক। অতএব তোমার পাদুকা খুলে ফেল, কারণ তুমি পবিত্র তুওয়া উপত্যকায় রয়েছ। এবং আমি তোমাকে মনোনীত করেছি। অতএব, যা ওহী প্রেরণ করা হচ্ছে তুমি তা মনোযোগের সাথে শুন! আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। অতএব, আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর। কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী, আমি এটা গোপন রাখতে চাই যাতে প্রত্যেকেই নিজ কর্মানুযায়ী ফল লাভ করতে পারে। সুতরাং, যে ব্যক্তি কিয়ামতে বিশ্বাস করে না ও নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে এটাতে বিশ্বাস স্থাপনে নিবৃত্ত না করে, নিবৃত্ত হলে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে। (সূরা তা-হাঃ ১১-১৬)
প্রাচীন যুগের ও পরবর্তীকালের একাধিক মুফাসসির বলেন, মূসা (عليه السلام) যে আগুন দেখলেন তার কাছে পৌঁছতে তিনি মনস্থ করলেন। সেখানে পৌঁছে সবুজ কাটা গাছে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পেলেন। এ আগুনের মধ্যকার সবকিছু দাউ দাউ করে জ্বলছে অথচ গাছের শ্যামলিমা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। অবাক হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। আর এই গাছটি ছিল পশ্চিমদিকের পাহাড়ে তাঁর ডানদিকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ مَا کُنۡتَ بِجَانِبِ الۡغَرۡبِیِّ اِذۡ قَضَیۡنَاۤ اِلٰی مُوۡسَی الۡاَمۡرَ وَ مَا کُنۡتَ مِنَ الشّٰہِدِیۡنَ ﴿ۙ۴۴﴾
মূসাকে যখন আমি বিধান দিয়েছিলাম তখন তুমি পশ্চিম প্রান্তে উপস্থিত ছিলে না এবং তুমি প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলে না। (সূরা কাসাসঃ ৪৪)
মূসা (عليه السلام) যে উপত্যকায় ছিলেন তার নাম হচ্ছে তূওয়া। মূসা (عليه السلام) কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলেন। আর এই গাছটি ছিল পশ্চিম পার্শ্বে তাঁর ডানদিকে। সেখানে অবস্থিত তুওয়া নামক পবিত্র উপত্যকায় তার প্রতিপালক তাকে আহ্বান করলেন। প্রথমত তিনি তাকে ঐ পবিত্র স্থানটির সম্মানার্থে পাদুকা খুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন এবং বিশেষ করে ঐ পবিত্র রাতের সম্মানার্থে।
কিতাবীদের মতে, মূসা (عليه السلام) এই নূরের তীব্রতার কারণে দৃষ্টিশক্তি লোপ পাওয়ার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নিজের চেহারার উপর হাত রাখলেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে সম্বোধন করে বলেন, “নিশ্চয়ই আমিই আল্লাহ, জগতসমূহের প্রতিপালক।
ইরশাদ হচ্ছেঃ
اني انا الله لا إله إلا أنا فاغبانی. وأقم الصلوة لذكري.
অর্থাৎ–‘আমি জগতসমূহের প্রতিপালক, যিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। শুধু তাঁর জন্যেই ইবাদত ও সালাত নির্ধারিত, অন্য কেউ এর যোগ্য নয়। আর আমার স্মরণে সালাত কায়েম কর। অতঃপর তিনি সংবাদ দেন যে, এই পৃথিবী স্থায়ী বাসস্থান নয় বরং স্থায়ী বাসস্থান হচ্ছে কিয়ামত দিবসের পরের বাসস্থান যার অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব অবশ্যম্ভাবী, যাতে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমল অনুসারে ভাল ও মন্দ কর্মফল ভোগ করতে পারে। এই আয়াতের মাধ্যমে উক্ত বাসস্থান লাভের জন্য আমল করার এবং মাওলার নাফরমান ও প্রবৃত্তির পূজারী এবং অবিশ্বাসী বান্দাদের থেকে দূরে থাকার জন্যে মূসা (عليه السلام)-কে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। অতঃপর তাকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি কোন বস্তুর সৃষ্টির পূর্বে নির্দেশ দেন হয়ে যাও তখন তা হয়ে যায়।
অন্য আয়াতে আল্লাহ্ ইরশাদ করেনঃ
وَمَا تِلۡكَ بِیَمِینِكَ یَـٰمُوسَىٰ قَالَ هِیَ عَصَایَ أَتَوَكَّؤُا۟ عَلَیۡهَا وَأَهُشُّ بِهَا عَلَىٰ غَنَمِی وَلِیَ فِیهَا مَـَٔارِبُ أُخۡرَىٰ قَالَ أَلۡقِهَا یَـٰمُوسَىٰ فَأَلۡقَىٰهَا فَإِذَا هِیَ حَیَّةࣱ تَسۡعَىٰ[Surat Ta-Ha ১৭ - ২০]
অর্থাৎ—“হে মূসা! তোমার ডান হাতে এটা কী? অর্থাৎ এটা কি তোমার লাঠি নয়, ‘তোমার কাছে আসার পর থেকে যা তোমার পরিচিত?’ তিনি বললেন, এটা আমার লাঠি যা আমি সম্যক চিনি, এটাতে আমি ভর দেই এবং এটা দ্বারা আঘাত করে আমি আমার মেষপালের জন্য গাছের পাতা ঝরিয়ে থাকি। আর এটা আমার অন্যান্য কাজেও লাগে। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, “হে মূসা! তুমি এটা নিক্ষেপ কর। অতঃপর তিনি এটা নিক্ষেপ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে এটা সাপ হয়ে ছুটতে লাগল।”
এটা একটি বিরাট অলৌকিক ব্যাপার এবং একটি অকাট্য প্রমাণ যে, যিনি মূসা (عليه السلام)-এর সাথে কথা বলেছেন, তিনি যখন কোন বস্তু সৃষ্টির পূর্বে বলেন كن (হয়ে যাও) তখন তা হয়ে যায়। তিনি তার ইচ্ছা মুতাবিক কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকেন।
কিতাবীদের মতে, মিসরীয়দের মূসা (عليه السلام)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার আশঙ্কা থাকায় তাঁর সত্যতা প্রমাণের জন্যে মূসা (عليه السلام) আপন প্রতিপালকের কাছে কোন প্রমাণ প্রার্থনা করেন। তখন মহান প্রতিপালক তাঁকে বললেন - তোমার হাতে এটা কী? তিনি বললেন, এটা আমার লাঠি। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, এটাকে ভূমিতে নিক্ষেপ কর। অতঃপর তিনি এটাকে নিক্ষেপ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে এটা সাপ হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগল। মূসা (عليه السلام) এটার সম্মুখ থেকে পলায়ন করেন। তখন মহান প্রতিপালক তাকে হাত বাড়াতে এবং এটার লেজে ধরতে নির্দেশ দিলেন। যখন তিনি এটাকে মযবুত করে ধরলেন তার হাতে সেটা পূর্বের মত লাঠি হয়ে গেল।
সূরা কাসাসের (৩১) আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ اَنۡ اَلۡقِ عَصَاکَ ؕ فَلَمَّا رَاٰہَا تَہۡتَزُّ کَاَنَّہَا جَآنٌّ وَّلّٰی مُدۡبِرًا وَّ لَمۡ یُعَقِّبۡ ؕ یٰمُوۡسٰۤی اَقۡبِلۡ وَ لَا تَخَفۡ اِنَّکَ مِنَ الۡاٰمِنِیۡنَ ﴿۳۱﴾
অর্থাৎ–আরও বলা হল, তুমি তোমার লাঠিটি নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন সে এটাকে সাপের মত ছুটাছুটি করতে দেখল তখন সে পিছনের দিকে ছুটতে লাগল এবং ফিরে তাকাল না।’ অর্থাৎ লাঠিটি একটি বড় ভয়ংকর দাঁত বিশিষ্ট অজগরে পরিণত হল। আবার এটা সাপের মত দ্রুত ছুটাছুটি করতে লাগল, আয়াতে উল্লেখিত جان শব্দটি جنان রূপেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটা খুবই সূক্ষ্ম কিন্তু অতি চঞ্চল ও দ্রুতগতিসম্পন্ন। কাজেই এটার মধ্যে স্থূলতা ও তীব্র গতি লক্ষ্য করে মূসা (عليه السلام) পিছনে ছুটতে লাগলেন। কেননা, মানবিক প্রকৃতিতে তিনি প্রকৃতস্থ এবং মানবিক প্রকৃতিও তা-ই চায়। তিনি আর কোন দিকে দেখলেন না। তখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে আহ্বান করলেন, হে মূসা! সামনে অগ্রসর হও, তুমি ভয় করবে না, তুমি নিরাপদ। যখন মূসা (عليه السلام) ফিরে আসলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সাপটি ধরার জন্যে নির্দেশ দিলেন। বললেন, এটাকে ধর, ভয় করো না, এটাকে আমি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেব।’ কথিত আছে, মূসা (عليه السلام) অত্যন্ত ভয় পেয়েছিলেন তাই তিনি পশমের কাপড়ের আস্তিনে নিজের হাত রাখলেন। অতঃপর নিজের হাত সাপের মুখে রাখলেন। কিতাবীদের মতে, সাপের লেজে হাত রেখেছিলেন, যখন তিনি এটাকে মজবুত করে ধরলেন, তখন এটা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসল এবং দুই শাখাবিশিষ্ট পূর্বেকার লাঠিতে পরিণত হল। সুতরাং মহাশক্তিশালী এবং দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের নিয়ন্তা পাক পবিত্র। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর হাত তার বগলে রাখার নির্দেশ দিলেন। এর পর তা বের করতে হুকুম দিলেন। অকস্মাৎ তা চাঁদের মত শুভ্র-সমুজ্জ্বল হয়ে চক্ চক্ করতে লাগল। অথচ এটা কোন রোগের কারণ নয়, এটা শ্বেত রোগের কারণে নয় বা অন্য কোন চর্মরোগের কারণেও নয়।
এজন্য আল্লাহ তা‘আলা এর পরের আয়াতে ইরশাদ করেনঃ
اُسۡلُکۡ یَدَکَ فِیۡ جَیۡبِکَ تَخۡرُجۡ بَیۡضَآءَ مِنۡ غَیۡرِ سُوۡٓءٍ ۫ وَّ اضۡمُمۡ اِلَیۡکَ جَنَاحَکَ مِنَ الرَّہۡبِ ﴿۳۲﴾
অর্থাৎ—তোমার হাত তোমার বগলে রাখ, এটা বের হয়ে আসবে শুভ্র-সমুজ্জ্বল নির্দোষ হয়ে। ভয় দূর করার জন্যে তোমার হাত দুটি নিজের দিকে চেপে ধর। (সূরা কাসাসঃ ৩২)
কেউ কেউ বলেন, এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যখন তোমার ভয় করবে তোমার হাত তোমার হৃৎপিণ্ডের উপর রাখবে, তাহলে প্রশান্তি লাভ করবে। এ আমলটা যদিও বিশেষভাবে তার জন্যেই ছিল কিন্তু এটার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে তাতে যে বরকত হবে তা যথার্থ। কেননা, যে ব্যক্তি নবীদের অনুসরণের নিয়তে এটা আমল করবে সে উপকার পাবে।
আল্লাহ তা‘আলা সূরায়ে নামলে ইরশাদ করেনঃ
وَ اَدۡخِلۡ یَدَکَ فِیۡ جَیۡبِکَ تَخۡرُجۡ بَیۡضَآءَ مِنۡ غَیۡرِ سُوۡٓءٍ فِیۡ تِسۡعِ اٰیٰتٍ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ وَ قَوۡمِہٖ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا قَوۡمًا فٰسِقِیۡنَ ﴿۱۲﴾
অর্থাৎ–এবং তোমার হাত তোমার বগলে রাখ। এটা বের হয়ে আসবে শুভ্র নির্মল অবস্থায়। এটা ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের নিকট আনীত নয়টি নিদর্শনের অন্তর্গত। তারা তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়। (সূরা নাম্লঃ ১২)
অন্য কথায় লাঠি ও হাত দুটো নিদর্শন যেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা সূরায়ে কাসাসে ইরশাদ করেনঃ
فَذٰنِکَ بُرۡہَانٰنِ مِنۡ رَّبِّکَ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ وَ مَلَا۠ئِہٖ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا قَوۡمًا فٰسِقِیۡنَ ﴿۳۲﴾
অর্থাৎ—“এই দু’টি তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত প্রমাণ, ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের জন্যে। ওরা তো ছিল সত্যত্যাগী সম্প্রদায়।” (২৮ঃ ৩২) এ দু’টির সাথে রয়েছে আরো সাতটি। তাহলে মোট হবে নয়টি নিদর্শন।
সূরায়ে বনী ইসরাঈলের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا مُوۡسٰی تِسۡعَ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ فَسۡئَلۡ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ اِذۡ جَآءَہُمۡ فَقَالَ لَہٗ فِرۡعَوۡنُ اِنِّیۡ لَاَظُنُّکَ یٰمُوۡسٰی مَسۡحُوۡرًا ﴿۱۰۱﴾ قَالَ لَقَدۡ عَلِمۡتَ مَاۤ اَنۡزَلَ ہٰۤؤُلَآءِ اِلَّا رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ بَصَآئِرَ ۚ وَ اِنِّیۡ لَاَظُنُّکَ یٰفِرۡعَوۡنُ مَثۡبُوۡرًا ﴿۱۰۲﴾
অর্থাৎ—তুমি বনী ইসরাঈলকে জিজ্ঞাসা করে দেখ, আমি মূসাকে নয়টি স্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছিলাম। যখন সে তাদের নিকট এসেছিল, ফিরআউন তাকে বলেছিল, হে মূসা! আমি মনে করি, তুমি তো জাদুগ্রস্ত। মূসা বলেছিল, “তুমি অবশ্যই অবগত আছ যে, এই সমস্ত স্পষ্ট নিদর্শন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালকই অবতীর্ণ করেছেন প্রত্যক্ষ প্রমাণস্বরূপ। হে ফিরআউন! আমি তো দেখছি তোমার ধ্বংস আসন্ন। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১০১-১০২)
এই ঘটনা সূরায়ে আরাফের আয়াতে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ لَقَدۡ اَخَذۡنَاۤ اٰلَ فِرۡعَوۡنَ بِالسِّنِیۡنَ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الثَّمَرٰتِ لَعَلَّہُمۡ یَذَّکَّرُوۡنَ ﴿۱۳۰﴾ فَاِذَا جَآءَتۡہُمُ الۡحَسَنَۃُ قَالُوۡا لَنَا ہٰذِہٖ ۚ وَ اِنۡ تُصِبۡہُمۡ سَیِّئَۃٌ یَّطَّیَّرُوۡا بِمُوۡسٰی وَ مَنۡ مَّعَہٗ ؕ اَلَاۤ اِنَّمَا طٰٓئِرُہُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۳۱﴾ وَ قَالُوۡا مَہۡمَا تَاۡتِنَا بِہٖ مِنۡ اٰیَۃٍ لِّتَسۡحَرَنَا بِہَا ۙ فَمَا نَحۡنُ لَکَ بِمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۳۲﴾ فَاَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمُ الطُّوۡفَانَ وَ الۡجَرَادَ وَ الۡقُمَّلَ وَ الضَّفَادِعَ وَ الدَّمَ اٰیٰتٍ مُّفَصَّلٰتٍ فَاسۡتَکۡبَرُوۡا وَ کَانُوۡا قَوۡمًا مُّجۡرِمِیۡنَ ﴿۱۳۳﴾
অর্থাৎ– আমি তো ফিরআউনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষ ও ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা আক্রান্ত করেছি যাতে তারা অনুধাবন করে। যখন তাদের কোন কল্যাণ হত তারা বলত, এটা আমাদের প্রাপ্য আর যখন তাদের কোন অকল্যাণ হত তখন তারা মূসা ও তার সঙ্গীদেরকে অলক্ষুণে গণ্য করত; শোন, তাদের অকল্যাণ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন, কিন্তু তাদের অধিকাংশ এটা জানে না। তারা বলল, আমাদেরকে জাদু করবার জন্য তুমি যে কোন নিদর্শন আমাদের নিকট পেশ কর না কেন, আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না। অতঃপর আমি তাদেরকে প্লাবন, পঙ্গপাল, উকুন ও রক্ত দ্বারা ক্লিষ্ট করি। এগুলো স্পষ্ট নিদর্শন কিন্তু তারা দাম্ভিকই রয়ে গেল, আর তারা ছিল এক অপরাধী সম্প্রদায়।’ (সূরা আরাফঃ ১৩০-১৩৩)
এ সম্বন্ধে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এ নয়টি হল এমন নিদর্শন বা অন্য দশটি নিদর্শনের থেকে ভিন্ন। এ নয়টি নিদর্শন হল আল্লাহ তা‘আলার কুদরত সম্পর্কীয় আর অন্য দশটি নিদর্শন আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়ত বিষয়ক তাঁর বাণী সম্পর্কীয়। এ সম্বন্ধে এখানে এজন্য উল্লেখ করে দেয়া হল। কেননা, অনেক বর্ণনাকারীই এ ব্যাপারে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। তারা ধারণা করে থাকেন যে, এ নয়টিই হয়ত উক্ত দশটির অন্তর্ভুক্ত। সূরায়ে বনী ইসরাঈলের শেষাংশের তাফসীরে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত আল্লাহ তা‘আলা যখন মূসা (عليه السلام)-কে ফিরআউনের কাছে যাবার জন্যে নির্দেশ দিলেন।
যেমন সূরায়ে কাসাসের আয়াতে ইরশাদ হচ্ছেঃ
قَالَ رَبِّ اِنِّیۡ قَتَلۡتُ مِنۡہُمۡ نَفۡسًا فَاَخَافُ اَنۡ یَّقۡتُلُوۡنِ ﴿۳۳﴾ وَ اَخِیۡ ہٰرُوۡنُ ہُوَ اَفۡصَحُ مِنِّیۡ لِسَانًا فَاَرۡسِلۡہُ مَعِیَ رِدۡاً یُّصَدِّقُنِیۡۤ ۫ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اَنۡ یُّکَذِّبُوۡنِ ﴿۳۴﴾ قَالَ سَنَشُدُّ عَضُدَکَ بِاَخِیۡکَ وَ نَجۡعَلُ لَکُمَا سُلۡطٰنًا فَلَا یَصِلُوۡنَ اِلَیۡکُمَا ۚۛ بِاٰیٰتِنَاۤ ۚۛ اَنۡتُمَا وَ مَنِ اتَّبَعَکُمَا الۡغٰلِبُوۡنَ ﴿۳۵﴾
অর্থাৎ– “মূসা (عليه السلام) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো তাদের একজনকে হত্যা করেছি। ফলে আমি আশংকা করছি, তারা আমাকে হত্যা করবে। আমার ভাই হারুন আমার চাইতে অধিকতর বাগ্মী। অতএব, তাকে আমার সাহায্যকারীরূপে প্রেরণ কর, সে আমাকে সমর্থন করবে। আমি আশংকা করছি, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী ঠাওরাবে। আল্লাহ বললেন, আমি তোমার ভাইয়ের দ্বারা তোমার বাহু শক্তিশালী করব এবং তোমাদের উভয়কে প্রাধান্য দান করব। তারা তোমাদের নিকট পৌঁছতে পারবে না। তোমরা এবং তোমাদের অনুসারীরা আমার নিদর্শন বলে তাদের উপর প্রবল হবে।” (সূরা কাসাসঃ ৩৩-৩৫)
অন্য কথায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দা, রাসূল, প্রত্যক্ষ সম্বোধনকৃত মূসা (عليه السلام) সম্পর্কে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, মূসা (عليه السلام) আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের জুলুম ও অত্যাচার হতে পরিত্রাণ পাবার জন্যে মিসর ত্যাগ করেছিলেন। কেননা, তিনি অনিচ্ছাকৃত ভুলক্রমে এক কিবতীকে হত্যা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা যখন মূসা (عليه السلام)-কে ফিরআউনের কাছে যেতে হুকুম দিলেন—তখন মূসা (عليه السلام) উত্তরে বলেনঃ
قَالَ رَبِّ إِنِّی قَتَلۡتُ مِنۡهُمۡ نَفۡسࣰا فَأَخَافُ أَن یَقۡتُلُونِ وَأَخِی هَـٰرُونُ هُوَ أَفۡصَحُ مِنِّی لِسَانࣰا فَأَرۡسِلۡهُ مَعِیَ رِدۡءࣰا یُصَدِّقُنِیۤۖ إِنِّیۤ أَخَافُ أَن یُكَذِّبُونِ
[Surat Al-Qasas ৩৩ – ৩৪]
অর্থাৎ–“হে আল্লাহ! আমার ভাইকে আমার সাহায্যকারী, সমর্থনকারী ও উযীররূপে নিযুক্ত করুন যাতে সে আমাকে তোমার রিসালাত পরিপূর্ণভাবে তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারে; কেননা, সে আমার অপেক্ষা বাগ্মী এবং বর্ণনার ক্ষেত্রে আমার থেকে অধিকতর সমর্থ।
তার আবেদনের প্রতি উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
( سَنَشُدُّ عَضُدَكَ بِأَخِیكَ وَنَجۡعَلُ لَكُمَا سُلۡطَـٰنࣰا فَلَا یَصِلُونَ إِلَیۡكُمَا بِـَٔایَـٰتِنَاۤۚ أَنتُمَا وَمَنِ ٱتَّبَعَكُمَا ٱلۡغَـٰلِبُونَ)
[Surat Al-Qasas ৩৫]
অর্থাৎ–“আমার নিদর্শনসমূহ তোমাদের নিকট থাকার দরুন তারা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কেউ কেউ বলেন, অর্থাৎ আমার নিদর্শনগুলোর বরকতে তারা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, তোমরা এবং তোমাদের অনুসারিগণ আমার নিদর্শন বলে তাদের উপর প্রবল হবে।
সূরায়ে তা-হার আয়াতে ইরশাদ হচ্ছেঃ
اِذۡہَبۡ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ اِنَّہٗ طَغٰی ﴿٪۲۴﴾ قَالَ رَبِّ اشۡرَحۡ لِیۡ صَدۡرِیۡ ﴿ۙ۲۵﴾ وَ یَسِّرۡ لِیۡۤ اَمۡرِیۡ ﴿ۙ۲۶﴾ وَ احۡلُلۡ عُقۡدَۃً مِّنۡ لِّسَانِیۡ ﴿ۙ۲۷﴾ یَفۡقَہُوۡا قَوۡلِیۡ ﴿۪۲۸﴾
অর্থাৎ–“ফিরআউনের নিকট যাবে, সে সীমালংঘন করেছে। মূসা (عليه السلام) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দাও এবং আমার কর্ম সহজ করে দাও। আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।” (সূরা তা-হাঃ ২৪-২৮)
কথিত আছে, মূসা (عليه السلام) বাল্যকালে ফিরআউনের দাড়ি ধরেছিলেন। তাই ফিরআউন তাঁকে হত্যা করতে মনস্থ করেছিল। এতে আসিয়া (رضي الله عنه) ভীত হয়ে পড়লেন এবং ফিরআউনকে বললেন, মূসা শিশুমাত্র। ফিরআউন মূসা (عليه السلام)-এর সামনে খেজুর ও কাঠের অঙ্গার রেখে মূসা (عليه السلام)-এর জ্ঞান-বুদ্ধি পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। মূসা (عليه السلام) খেজুর ধরতে উদ্যত হন, তখন ফেরেশতা এসে তার হাত অঙ্গারের দিকে ফিরিয়ে দিলেন। তখন তিনি অঙ্গার মুখে পুরে দিলেন। অমনি তার জিহ্বার কিছু অংশ পুড়ে যায় ও তার জিহ্বায় জড়তার সৃষ্টি হয়। অতঃপর মূসা (عليه السلام) আল্লাহ তা‘আলার কাছে এতটুকু জড়তা দূর করতে আবেদন করলেন যাতে লোকজন তার কথা বুঝতে পারে; তিনি পুরোপুরি জড়তা দূর করার জন্যে দরখাস্ত করেননি।
হাসান বসরী (رحمة الله) বলেন, ‘নবীগণ আল্লাহ তা‘আলার দরবারে প্রয়োজন মাফিক দরখাস্ত করে থাকেন। এ জন্য তাঁর জিহ্বায় তার কিছুটা প্রভাব রয়েই যায়। এজন্যে ফিরআউন বলত যে, এটা মূসা (عليه السلام)-এর একটি বড় দোষ এবং এ জন্য মূসা (عليه السلام) নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করে বলতে পারে না; তার মনের কথা উত্তমরূপে বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করতে পারে না।
অতঃপর মূসা (عليه السلام) বললেনঃ
وَ اجۡعَلۡ لِّیۡ وَزِیۡرًا مِّنۡ اَہۡلِیۡ ﴿ۙ۲۹﴾ ہٰرُوۡنَ اَخِی ﴿ۙ۳۰﴾ اشۡدُدۡ بِہٖۤ اَزۡرِیۡ ﴿ۙ۳۱﴾ وَ اَشۡرِکۡہُ فِیۡۤ اَمۡرِیۡ ﴿ۙ۳۲﴾ کَیۡ نُسَبِّحَکَ کَثِیۡرًا ﴿ۙ۳۳﴾ وَّ نَذۡکُرَکَ کَثِیۡرًا ﴿ؕ۳۴﴾ اِنَّکَ کُنۡتَ بِنَا بَصِیۡرًا ﴿۳۵﴾ قَالَ قَدۡ اُوۡتِیۡتَ سُؤۡلَکَ یٰمُوۡسٰی ﴿۳۶﴾
অর্থাৎ—“আমার জন্যে করে দাও একজন সাহায্যকারী আমার স্বজনবর্গের মধ্য থেকে; আমার ভাই হারূনকে; তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় কর ও তাকে আমার কার্যে অংশী কর। যাতে আমরা তোমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে পারি প্রচুর এবং তোমাকে স্মরণ করতে পারি- অধিক। তুমি তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা। তিনি বললেনঃ হে মূসা! তুমি যা চেয়েছ তোমাকে তা দেয়া হল।” (সূরা তা-হাঃ ২৯-৩৬)
অন্য কথায় তুমি যা কিছুর আবেদন করেছ, আমি তা মঞ্জুর করেছি এবং তুমি যা কিছু চেয়েছ তা তোমাকে দান করেছি। আর এটা হয়েছে আপন প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তার বিশিষ্ট মর্যাদার কারণে। তিনি তাঁর ভাইয়ের প্রতি ওহী প্রেরণের জন্যে সুপারিশ করায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি ওহী প্রেরণ করেন। এটা একটা বড় মর্যাদা।
যেমন সূরায়ে আহযাবে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ کَانَ عِنۡدَ اللّٰہِ وَجِیۡہًا ﴿ؕ۶۹﴾
অর্থাৎ–“আল্লাহর নিকট সে মর্যাদাবান।” (সূরা আহযাবঃ ৬৯)
সূরা মারয়ামের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ وَہَبۡنَا لَہٗ مِنۡ رَّحۡمَتِنَاۤ اَخَاہُ ہٰرُوۡنَ نَبِیًّا ﴿۵۳﴾
অর্থাৎ– “আমি নিজ অনুগ্রহে তাকে দিলাম তার ভাই হারূনকে নবীরূপে।” (সূরা মারয়ামঃ ৫৩)
একদা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এক ব্যক্তিকে তার সম্প্রদায়ের লোকদের প্রশ্ন করা শুনতে পেলেন। আর তারা সকলে হজের জন্যে ভ্রমণরত ছিলেন। প্রশ্নটি হলো, কোন ভাই তার নিজের ভাইয়ের প্রতি সর্বাধিক ইহসান করেছেন? সম্প্রদায়ের লোকেরা নীরব রইল, তখন আয়েশা (رضي الله عنه) তাঁর হাওদার পাশের লোকদের বললেন, তিনি ছিলেন মূসা (عليه السلام) ইব্ন ইমরান। তিনি যখন আপন ভাইয়ের নবুওত প্রাপ্তির সুপারিশ করেন, তখন তা আল্লাহ তা‘আলার দরবারে মঞ্জুর হয় এবং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি ওহী নাযিল করেন।
তাই আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَہَبۡنَا لَہٗ مِنۡ رَّحۡمَتِنَاۤ اَخَاہُ ہٰرُوۡنَ نَبِیًّاو
আবার আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা শু‘আরায় ইরশাদ করেনঃ
وَ اِذۡ نَادٰی رَبُّکَ مُوۡسٰۤی اَنِ ائۡتِ الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿ۙ۱۰﴾ قَوۡمَ فِرۡعَوۡنَ ؕ اَلَا یَتَّقُوۡنَ ﴿۱۱﴾ قَالَ رَبِّ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اَنۡ یُّکَذِّبُوۡنِ ﴿ؕ۱۲﴾ وَ یَضِیۡقُ صَدۡرِیۡ وَ لَا یَنۡطَلِقُ لِسَانِیۡ فَاَرۡسِلۡ اِلٰی ہٰرُوۡنَ ﴿۱۳﴾ وَ لَہُمۡ عَلَیَّ ذَنۡۢبٌ فَاَخَافُ اَنۡ یَّقۡتُلُوۡنِ ﴿ۚ۱۴﴾ قَالَ کَلَّا ۚ فَاذۡہَبَا بِاٰیٰتِنَاۤ اِنَّا مَعَکُمۡ مُّسۡتَمِعُوۡنَ ﴿۱۵﴾ فَاۡتِیَا فِرۡعَوۡنَ فَقُوۡلَاۤ اِنَّا رَسُوۡلُ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ۱۶﴾ اَنۡ اَرۡسِلۡ مَعَنَا بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ﴿ؕ۱۷﴾ قَالَ اَلَمۡ نُرَبِّکَ فِیۡنَا وَلِیۡدًا وَّ لَبِثۡتَ فِیۡنَا مِنۡ عُمُرِکَ سِنِیۡنَ ﴿ۙ۱۸﴾ وَ فَعَلۡتَ فَعۡلَتَکَ الَّتِیۡ فَعَلۡتَ وَ اَنۡتَ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۱۹﴾
অর্থাৎ– “স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক মূসাকে ডেকে বললেন, তুমি জালিম সম্প্রদায়ের নিকট যাও- ফিরআউন সম্প্রদায়ের নিকট; ওরা কি ভয় করে না? তখন সে বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আশংকা করি যে, ওরা আমাকে অস্বীকার করবে এবং আমার হৃদয় সংকুচিত হয়ে পড়বে, আর জিহ্বা তো সচল নয়। সুতরাং হারূনের প্রতিও প্রত্যাদেশ পাঠান! আমার বিরুদ্ধে তো ওদের একটি অভিযোগ রয়েছে, আমি আশংকা করি তারা আমাকে হত্যা করবে। আল্লাহ বললেন, না, কখনই নয়; অতএব, তোমরা উভয়ে আমার নিদর্শনসহ যাও, আমি তো তোমাদের সাথে রয়েছি শ্রবণকারী। অতএব, তোমরা উভয়ে ফিরআউনের নিকট যাও এবং বল, আমরা তো জগতসমূহের প্রতিপালকের রাসূল, আর আমাদের সাথে যেতে দাও বনী ইসরাঈলকে। ফিরআউন বলল, আমরা কি তোমাকে শৈশবে আমাদের মধ্যে লালন-পালন করিনি? তুমি তো তোমার জীবনের বহু বছর আমাদের মধ্যে কাটিয়েছ। তুমি তোমার কর্ম যা করবার তা করেছ; তুমি অকৃতজ্ঞ।” (সূরা শু‘আরাঃ ১০-১৯)
মোদ্দাকথা, তারা দুইজন ফিরআউনের নিকট গমন করলেন এবং তাকে উপরোক্ত কথা বললেন। আর তাদেরকে যা কিছু সহকারে প্রেরণ করা হয়েছিল তার কাছে তাঁরা তা পেশ করলেন। তারা তাকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান করলেন। তাঁরা তাকে বনী ইসরাঈলদের তার কর্তৃত্ব ও নির্যাতন থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানান। যাতে তারা যেখানেই ইচ্ছে গিয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে, নিরংকুশভাবে আল্লাহ তা‘আলার একত্ব স্বীকার করতে, আল্লাহ তা‘আলাকে একাগ্রচিত্তে ডাকতে এবং আপন প্রতিপালকের কাছে অনুনয় বিনয় করে নিজেদের ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু এতে ফিরআউন দাম্ভিকতার আশ্রয় নিল এবং জুলুম ও সীমালংঘন করল; সে মূসা (عليه السلام)-এর দিকে তাচ্ছিল্যের নজরে তাকাল এবং বলতে লাগল, তুমি কি আমাদের মাঝে বাল্যকালে লালিত-পালিত হওনি? আমরা কি তোমাকে আমাদের ঘরে পুত্রের মত লালন-পালন করিনি? তোমার প্রতি ইহসান করিনি? এবং একটি নির্দিষ্ট মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার প্রতি অনুগ্রহ করিনি?’ ফিরআউনের এই কথার দ্বারা বোঝা যায়, যে ফিরআউনের কাছে মূসা (عليه السلام)-কে নবীরূপে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং যে ফিরআউন থেকে মূসা (عليه السلام) পলায়ন করেছিলেন, সে অভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু কিতাবীরা মনে করে, যে ফিরআউনের নিকট থেকে মূসা (عليه السلام) পলায়ন করেছিলেন তিনি মাদায়ানে অবস্থান কালেই সে মারা গিয়েছিল। আর যে ফিরআউনের কাছে মূসা (عليه السلام)-কে নবীরূপে প্রেরণ করা হয়েছিল, সে ছিল অন্য লোক। আয়াতাংশ— (وَفَعَلۡتَ فَعۡلَتَكَ ٱلَّتِی فَعَلۡتَ وَأَنتَ مِنَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ)
[Surat Ash-Shu’ara ১৯]এর অর্থ হচ্ছে - তুমি কিবতী লোকটিকে হত্যা করেছ; আমাদের থেকে পলায়ন করেছ এবং আমাদের অনুগ্রহের প্রতি অস্বীকৃতি জানিয়েছ।
মূসা (عليه السلام) প্রতি উত্তরে বলেনঃ
قَالَ فَعَلۡتُہَاۤ اِذًا وَّ اَنَا مِنَ الضَّآلِّیۡنَ ﴿ؕ۲۰﴾ فَفَرَرۡتُ مِنۡکُمۡ لَمَّا خِفۡتُکُمۡ فَوَہَبَ لِیۡ رَبِّیۡ حُکۡمًا وَّ جَعَلَنِیۡ مِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۲۱﴾
অর্থাৎ– মূসা বললেন, আমি তো এটা করেছিলাম তখন যখন আমি ছিলাম অজ্ঞ।’ অন্য কথায়, আমার কাছে ওহী অবতীর্ণ হবার পূর্বে আমি এটা করেছিলাম। অতঃপর আমি যখন তোমাদের ভয়ে ভীত ছিলাম, তখন আমি তোমাদের নিকট হতে পলায়ন করলাম। তারপর আমার প্রতিপালক আমাকে জ্ঞানদান করেছেন এবং আমাকে রাসূলরূপে মনোনীত করেছেন। (২৬ঃ ১৯-২১) মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি ফিরআউনের লালন-পালন ও অনুগ্রহ করার উল্লেখের জবাবে—মূসা (عليه السلام) বলেনঃ
وَ تِلۡکَ نِعۡمَۃٌ تَمُنُّہَا عَلَیَّ اَنۡ عَبَّدۡتَّ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ﴿ؕ۲۲﴾ قَالَ فِرۡعَوۡنُ وَ مَا رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ؕ۲۳﴾ قَالَ رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ؕ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّوۡقِنِیۡنَ ﴿۲۴﴾ قَالَ لِمَنۡ حَوۡلَہٗۤ اَلَا تَسۡتَمِعُوۡنَ ﴿۲۵﴾ قَالَ رَبُّکُمۡ وَ رَبُّ اٰبَآئِکُمُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۲۶﴾ قَالَ اِنَّ رَسُوۡلَکُمُ الَّذِیۡۤ اُرۡسِلَ اِلَیۡکُمۡ لَمَجۡنُوۡنٌ ﴿۲۷﴾ قَالَ رَبُّ الۡمَشۡرِقِ وَ الۡمَغۡرِبِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ؕ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۲۸﴾
অর্থাৎ– আমার প্রতি তোমার যে অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করছ তা তো এই যে, তুমি বনী ইসরাঈলকে দাসে পরিণত করেছ। তুমি যে উল্লেখ করেছ, তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছ অথচ আমি বনী ইসরাঈলের একজন; আর এর পরিবর্তে তুমি একটা গোটা সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণরূপে আপন কাজে নিযুক্ত রেখেছ এবং তাদেরকে তোমার খেদমত করার কাজে দাসে পরিণত করে রেখেছ। ফিরআউন বলল, “জগতসমূহের প্রতিপালক আবার কী?’ মূসা বলল, ‘তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর প্রতিপালক, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। ফিরআউন তার পারিষদবর্গকে লক্ষ্য করে বলল, তোমরা শুনছ তো?’ মূসা বলল, তিনি তোমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষগণেরও প্রতিপালক। ফিরআউন বলল, তোমাদের প্রতি প্রেরিত তোমাদের রাসূলটি তো নিশ্চয়ই পাগল। মূসা বলল, তিনি পূর্ব-পশ্চিমের এবং এদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর প্রতিপালক যদি তোমরা বুঝতে। (সূরা শু‘আরাঃ ২২-২৮)
ফিরআউন ও মূসা (عليه السلام)-এর মধ্যে যে সব কথোপকথন, যুক্তিতর্কের অবতারণা ও বাদ-প্রতিবাদ হয়েছিল এবং মূসা (عليه السلام) দুশ্চরিত্র ফিরআউনের বিরুদ্ধে যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক ও দৃষ্টিগ্রাহ্য যুক্তি-প্রমাণের অবতারণা করছিলেন; আল্লাহ তা‘আলা তার উল্লেখ করেছেন এভাবে যে, ফিরআউন মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার করেছিল এবং দাবি করেছিল যে, সে নিজেই মাবুদ ও উপাস্য। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
فَحَشَرَ فَنَادٰی ﴿۫ۖ۲۳﴾ فَقَالَ اَنَا رَبُّکُمُ الۡاَعۡلٰی ﴿۫ۖ۲۴﴾
অর্থাৎ–সে সকলকে সমবেত করল এবং উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করল, আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক।’ (সূরা নাযিআতঃ ২৩-২৪)
অন্যত্র ইরশাদ করেছেনঃ
وَ قَالَ فِرۡعَوۡنُ یٰۤاَیُّہَا الۡمَلَاُ مَا عَلِمۡتُ لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰہٍ غَیۡرِیۡ
অর্থাৎ–“ফিরআউন বলল, হে পারিষদবর্গ! আমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ আছে বলে আমি জানি না।” (সূরা কাসাসঃ ৩৮) উপরোক্ত বক্তব্য উচ্চারণকালে সে জেনে-শুনেই গোয়ার্তুমি করেছে, কেননা সে সম্যক জানতো যে, সে নেহাত একটি দাস, আর আল্লাহই হচ্ছেন সৃজনকর্তা, উদ্ভাবন কর্তা, রূপদাতা, প্রকৃত উপাস্য।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ جَحَدُوۡا بِہَا وَ اسۡتَیۡقَنَتۡہَاۤ اَنۡفُسُہُمۡ ظُلۡمًا وَّ عُلُوًّا ؕ فَانۡظُرۡ کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الۡمُفۡسِدِیۡنَ ﴿۱۴﴾
অর্থাৎ—“তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলো প্রত্যাখ্যান করল যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিল। দেখ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কি হয়েছিল?” (সূরা নাম্লঃ ১৪)
এজন্যেই সে মূসা (عليه السلام)-এর রিসালাতকে অস্বীকার করতে গিয়ে এবং একথা প্রকাশ করতে গিয়ে মূসা (عليه السلام)-কে যে রিসালাত প্রদানকারী কোন প্রতিপালকই নেই—সে বলেছিল, অর্থাৎ জগতসমূহের প্রতিপালক আবার কে? কেননা, তাঁরা দু’জন [মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام)] তাকে বলেছিলেন, اِنَّا رَسُوۡلُ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡن অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আমরা জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রেরিত রাসূল।’ (সূরা শু‘আরাঃ ১৬) যেন তাদের দুজনকে বলছিল, তোমরা ধারণা করছ যে, জগতসমূহের প্রতিপালক তোমাদেরকে প্রেরণ করেছেন—এরূপ প্রতিপালক আবার কে? জবাবে মূসা (عليه السلام) বলেছিলেন। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেনঃ
رب السموت والأرض وما بينهما إن كنتم موقنين-
অর্থাৎ—জগতসমূহের প্রতিপালক এসব দৃশ্যমান আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর এবং এগুলোর মধ্যে যেসব সৃষ্টি বিদ্যমান রয়েছে যেমন মেঘ, বাতাস, বৃষ্টি, তৃণলতা, জীব-জন্তু ইত্যাদির সৃজন কর্তা। প্রতিটি বিশ্বাসী লোক জানে যে, এগুলি নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি, এদের একজন সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আছেন আর তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলা; তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই; তিনিই জগতসমূহের প্রতিপালক। ফিরআউন তার আশে-পাশে উপবিষ্ট উজির-নাজির ও আমীর-উমারাকে মূসা (عليه السلام)-এর সুপ্রমাণিত রিসালাত অবমাননা এবং খোদ মূসা (عليه السلام)-কে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করার লক্ষ্যে বলল, তোমরা কি মূসার অযৌক্তিক কথাবার্তা শুনছ? মূসা (عليه السلام) তখন তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, অর্থাৎ তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের পূর্বে তোমাদের বাবা, দাদা ও অতীতের সমস্ত সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করেছেন; কেননা প্রত্যেকেই জানে যে, সে নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি; তার পিতামাতা কেউই নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি। অন্য কথায়, সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কোন কিছুই সৃষ্টি হয়নি এবং প্রত্যেককেই জগতসমূহের প্রতিপালক সৃষ্টি করেছেন। এই দুটি বিষয়েরই নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
سَنُرِیۡہِمۡ اٰیٰتِنَا فِی الۡاٰفَاقِ وَ فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَہُمۡ اَنَّہُ الۡحَقُّ
অর্থাৎ–আমি ওদের জন্যে আমার নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করব বিশ্বজগতে এবং ওদের নিজেদের মধ্যে; ফলে ওদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এটাই সত্য।’ (সূরা ফুসসিলাতঃ ৫৩) এসব নিদর্শন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠা সত্ত্বেও ফিরাউন তার গাফিলতির নিদ্রা থেকে জাগ্রত হল না এবং নিজেকে পথভ্রষ্টতা থেকে বের করল না বরং সে তার স্বেচ্ছাচারিতা, অবাধ্যতা ও পথভ্রষ্টতায় অটল রইল। আর মন্তব্য করলঃ
اِنَّ رَسُوۡلَکُمُ الَّذِیۡۤ اُرۡسِلَ اِلَیۡکُمۡ لَمَجۡنُوۡن
অর্থাৎ—“নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে প্রেরিত রাসূলটি পাগল।
قَالَ رَبُّ الۡمَشۡرِقِ وَ الۡمَغۡرِبِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ؕ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۲۸﴾
সে বলল, তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের এবং এগুলোর মধ্যবর্তী সব কিছুর প্রতিপালক যদি তোমরা বুঝতে। (সূরা শু‘আরাঃ ২৭-২৮)
তিনিই এসব উজ্জ্বল নক্ষত্রকে অনুগত করেছেন এবং ঘূর্ণায়মান কক্ষপথে এগুলোকে আবর্তিত করছেন। তিনিই অন্ধকার ও আলোর সৃষ্টিকর্তা, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক, সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, উপগ্রহ, চলমান ও স্থির তারকারাজির সৃজনকর্তা; রাতকে অন্ধকার সমেত এবং দিনকে আলো সমেত সৃষ্টিকারী; সবকিছু তাঁরই অধীনে, নিয়ন্ত্রণে ও ইখতিয়ারে চলমান এবং নিজ নিজ কক্ষপথে সন্তরণরত। সব সময়ই একে অন্যকে অনুসরণ করছে এবং নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরে চলেছে। সুতরাং তিনিই মহান সৃষ্টিকর্তা, মালিক, নিজ ইচ্ছেমাফিক আপন মাখলুকের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপকারী। যখন ফিরআউনের বিরুদ্ধে দলীল-প্রমাণাদি পেশ করা হল, তার সন্দেহ দূরীভূত হল এবং হঠকারিতা ছাড়া তার কোন যুক্তিই অবশিষ্ট রইল না। তখন সে জোর-জবরদস্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগের কৌশল গ্রহণ করল। যেমন আয়াতে উক্ত হয়েছেঃ
قَالَ لَئِنِ اتَّخَذۡتَ اِلٰـہًا غَیۡرِیۡ لَاَجۡعَلَنَّکَ مِنَ الۡمَسۡجُوۡنِیۡنَ ﴿۲۹﴾
অর্থাৎ—‘ফিরআউন বলল, তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর আমি তোমাকে অবশ্যই কারারুদ্ধ করে রাখব।’ মূসা (عليه السلام) প্রতি উত্তরে বলেন, اَوَ لَوۡ جِئۡتُکَ بِشَیۡءٍ مُّبِیۡنٍ অর্থাৎ আমি তোমার নিকট স্পষ্ট কোন নিদর্শন নিয়ে আসলেও?’ ফিরআউন বলল, فَاۡتِ بِہٖۤ اِنۡ کُنۡتَ مِنَ الصّٰدِقِیۡن অর্থাৎ তুমি যদি সত্যবাদী হও তবে তা উপস্থিত কর।”
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
فَاَلۡقٰی عَصَاہُ فَاِذَا ہِیَ ثُعۡبَانٌ مُّبِیۡنٌ ﴿ۚۖ۳۲﴾ وَّ نَزَعَ یَدَہٗ فَاِذَا ہِیَ بَیۡضَآءُ لِلنّٰظِرِیۡنَ ﴿٪۳۳﴾
অর্থাৎ–“অতঃপর মূসা তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলে তৎক্ষণাৎ তা এক সাক্ষাৎ অজগর হয়ে গেল এবং মূসা হাত বের করল আর তৎক্ষণাৎ তা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র উজ্জ্বল প্রতিভাত হল।” (সূরা শু‘আরাঃ ২৮-৩৩)
এ দুটো স্পষ্ট নিদর্শন যদ্বারা আল্লাহ্ তা‘আলা মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام)-কে শক্তিশালী করেছিলেন। আর এ দুটো নিদর্শন হচ্ছে লাঠি ও হাত। এগুলো দ্বারা আল্লাহ্ তা‘আলা বিরাট অলৌকিক নিদর্শন প্রদর্শন করলেন যাতে সকল মানবীয় জ্ঞান ও দৃষ্টি মু‘জিযা দু’টোর কাছে হার মেনে গেল। যখন তিনি হাত থেকে লাঠি নিক্ষেপ করলেন, তখন এটা বিরাট আকারের অত্যাশ্চর্য মোটা ভয়ংকর ও বিস্ময়কর সাপে পরিণত হল। এমনকি কথিত আছে যে, ফিরআউন এটাকে দেখার পর এতই ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল যে, তৎক্ষণাৎ তার দাস্ত হতে লাগল; একদিনেই তার চল্লিশ বার দাস্ত হল অথচ এর পূর্বে সে চল্লিশ দিনে একবার পায়খানায় যেত। এখন অবস্থা বিপরীতে দাঁড়াল। অনুরূপভাবে যখন মূসা (عليه السلام) তাঁর নিজ হাত নিজ বগলে রাখলেন এবং বের করলেন তখন তা চাঁদের একটি টুকরার ন্যায় সমুজ্জ্বল হয়ে বের হয়ে আসল। আর এমন আলো বিচ্ছুরিত করতে লাগল যা চোখকে একেবারে ঝলসিয়ে দেয়। পুনরায় যখন হাত বগলের মধ্যে স্থাপন করলেন, তখন তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসল। এসব নিদর্শন দেখার পরও ফিরআউন এর থেকে কোনভাবেই উপকৃত হলো না। বরং সে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায়ই রয়ে গেল। সে প্রকাশ করতে লাগল যে, এসব জাদু ব্যতীত অন্য কিছু নয়। তাই সে জাদুকরদের দ্বারা মূসা (عليه السلام)-এর মুকাবিলা করতে ইচ্ছা পোষণ করল। সুতরাং সে তার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার সমস্ত জাদুকরের মাধ্যমে মূসা (عليه السلام)-কে মুকাবিলা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করল। অতঃপর সে লোক পাঠাল যারা সমগ্র রাজ্যের, তার প্রজাবর্গের, তার নিয়ন্ত্রণাধীন জাদুকরদের সমবেত করবে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা নির্ধারিত জায়গায় পেশ করা হবে। এতে ফিরআউন, তার পারিষদবর্গ, আমীর-উমারা ও অনুসারীদের কাছে আল্লাহ্ তা‘আলার অসীম কুদরত, ক্ষমতা ও নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছিল।
আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা তা-হায় ইরশাদ করেনঃ
فَلَبِثۡتَ سِنِیۡنَ فِیۡۤ اَہۡلِ مَدۡیَنَ ۬ۙ ثُمَّ جِئۡتَ عَلٰی قَدَرٍ یّٰمُوۡسٰی ﴿۴۰﴾ وَ اصۡطَنَعۡتُکَ لِنَفۡسِیۡ ﴿ۚ۴۱﴾ اِذۡہَبۡ اَنۡتَ وَ اَخُوۡکَ بِاٰیٰتِیۡ وَ لَا تَنِیَا فِیۡ ذِکۡرِیۡ ﴿ۚ۴۲﴾ اِذۡہَبَاۤ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ اِنَّہٗ طَغٰی ﴿ۚۖ۴۳﴾ فَقُوۡلَا لَہٗ قَوۡلًا لَّیِّنًا لَّعَلَّہٗ یَتَذَکَّرُ اَوۡ یَخۡشٰی ﴿۴۴﴾ قَالَا رَبَّنَاۤ اِنَّنَا نَخَافُ اَنۡ یَّفۡرُطَ عَلَیۡنَاۤ اَوۡ اَنۡ یَّطۡغٰی ﴿۴۵﴾ قَالَ لَا تَخَافَاۤ اِنَّنِیۡ مَعَکُمَاۤ اَسۡمَعُ وَ اَرٰی ﴿۴۶﴾
অর্থাৎ–অতঃপর তুমি কয়েক বছর মাদায়ানবাসীদের মধ্যে ছিলে, হে মূসা! এর পরে তুমি নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলে এবং আমি তোমাকে আমার নিজের জন্য প্রস্তুত করিয়ে নিয়েছি। তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনসহ যাত্রা কর এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করবে না। তোমরা দুজন ফিরআউনের নিকট যাও, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে, তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে। তারা বলল, “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আশঙ্কা করি সে আমাদের উপর বাড়াবাড়ি করবে অথবা অন্যায় আচরণে সীমালঙ্ঘন করবে।” তিনি বললেন, “তোমরা ভয় করবে না, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি, আমি শুনি ও আমি দেখি।” (সূরা তা-হাঃ ৪০-৪৬)
আল্লাহ্ তা‘আলা যে রাতে মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি ওহী নাযিল করেন, তাকে নবুওত দান করেন, নিজের কাছে ডেকে নিয়ে তাঁর সাথে একান্তে কথা বলেন, সে রাতে মূসা (عليه السلام)-কে সম্বোধন করে বলেন, “আমি তোমাকে প্রত্যক্ষ করছিলাম যখন তুমি ফিরআউনের ঘরে ছিলে, তুমি আমার হিফাযতে ও যত্নে ছিলে। তারপর আমি তোমাকে মিসর ভূখণ্ড থেকে বের করে আমার ইচ্ছা, কুদরত ও কৌশল মাফিক তোমাকে মাদায়ানে নিয়ে আসলাম। সেখানে তুমি কয়েক বছর অবস্থান করলে। তারপর তুমি নবুওতের নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলে অর্থাৎ আমার নির্ধারিত তাকদীর অনুযায়ী। তোমাকে আমার কালাম ও রিসালাতের জন্যে আমি মনোনীত করলাম। সুতরাং তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনসহ যাত্রা কর আর যখন তোমরা আমাকে স্মরণ করবে কিংবা তোমাদের আহ্বান করা হবে তোমরা আমার স্মরণে শৈথিল্য প্রদর্শন করবে না; কেননা, ফিরআউনেকে সম্বোধন করার সময়, তার প্রতি উত্তর প্রদানের সময়, তার প্রতি উপদেশ দানের সময় এবং তার সম্মুখে দলীল পেশ করার সময় আমার স্মরণ তোমাদের বিজয় দানে সাহায্য করবে। আবার কোন কোন হাদীসে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমার ঐ বান্দাই পরিপূর্ণ বান্দা যে তার প্রতিপক্ষের সাথে মুকাবিলার সময়ও আমাকে স্মরণ করে।
যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا لَقِیۡتُمۡ فِئَۃً فَاثۡبُتُوۡا وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿ۚ۴۵﴾
অর্থাৎ—“হে মুমিনগণ! তোমরা যখন কোন দলের মুকাবিলা করবে তখন অবিচলিত থাকবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (সূরা আনফালঃ ৪৫)
তারপর আল্লাহ্ তা‘আলা নির্দেশ দিয়ে বলেন, “তোমরা দুইজনে ফিরআউনের কাছে যাত্রা কর সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে, তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।” (সূরা তা-হাঃ ৪৩)
ফিরআউনের কুফরী, জুলুম ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারটি আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও তার সাথে নম্র কথা বলার নির্দেশ, মাখলুকের প্রতি আল্লাহ্ তা‘আলার পরম রহমত, বরকত, মেহেরবানী, নম্রতা ও ধৈর্যশীলতার পরিচায়ক। ফিরআউন ছিল তখনকার যুগে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকৃষ্টতম সৃষ্টি অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ যমানার শ্রেষ্ঠতম মনোনীত ব্যক্তিত্বকে তার হিদায়াতের জন্যে তার কাছে প্রেরণ করেন। এতদসত্ত্বেও তিনি মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام)-কে নম্র ভাষায় তাকে আল্লাহর পথে আহ্বান করার জন্যে নির্দেশ দেন। আবার তাদের দুইজনকে তার সাথে এমন ব্যবহার করার জন্যে নির্দেশ দেন, যেমনটি যার উপদেশ গ্রহণ কিংবা ভয় করার সম্ভাবনা আছে তার সাথে করা হয়ে থাকে।
আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রাসূল মুহাম্মদ (ﷺ)-কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেনঃ
اُدۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّکَ بِالۡحِکۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ الۡحَسَنَۃِ وَ جَادِلۡہُمۡ بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ ؕ اِنَّ رَبَّکَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَنۡ ضَلَّ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُہۡتَدِیۡنَ ﴿۱۲۵﴾
অর্থাৎ–‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (সূরা নাহ্লঃ ১২৫)
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ لَا تُجَادِلُوۡۤا اَہۡلَ الۡکِتٰبِ اِلَّا بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ ٭ۖ اِلَّا الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا مِنۡہُم
তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী। (সূরা আনকাবুতঃ ৪৬)
হাসান বসরী (رحمة الله) বলেনঃ আয়াতাংশের মাধ্যমে তার প্রতি রেয়াত প্রদর্শনার্থে বলা হয়েছে তোমরা দু’জনে তাকে বলবে, তোমার রয়েছেন একজন প্রতিপালক, তোমার জন্যে রয়েছে মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান এবং তোমার সামনে রয়েছে বেহেশত-দোযখ। ওহাব ইব্ন মুনাব্বিহ্ (رحمة الله) বলেছেন, এর অর্থ হচ্ছে তোমরা দু’জন তাকে বলে দাও, শাস্তি ও রোষের তুলনায় আমি আল্লাহর ক্ষমা ও দয়ার অধিকতর নিকটবর্তী। য়াযিদ আর রাক্কাশী (رحمة الله) এই আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেন, শত্রুর সাথে যিনি এরূপ বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের উপদেশ দিচ্ছেন বন্ধুর সাথে কিরূপ ব্যবহার এবং তাকে কিরূপ আহ্বানের উপদেশ দেবেন তা সহজেই অনুমেয়। আল্লাহর বাণীঃ
قَالَا رَبَّنَاۤ اِنَّنَا نَخَافُ اَنۡ یَّفۡرُطَ عَلَیۡنَاۤ اَوۡ اَنۡ یَّطۡغٰی ﴿۴۵﴾
তারা বললঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আশঙ্কা করি সে আমাদের উপর বাড়াবাড়ি করবে অথবা অন্যায় আচরণে সীমালঙ্ঘন করবে।” (সূরা তা-হাঃ ৪৫)
এটা এজন্যে যে ফিরআউন ছিল অত্যাচারী, অনমনীয়, শয়তান ও সীমালঙ্ঘনকারী; মিসরে তার শক্তি ছিল দুর্দম, সে ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং বিরাট ক্ষমতা ও সৈন্য-সামন্তের অধিকর্তা। তাই মানবীয় চরিত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে তারা দুজনই তার ব্যাপারে ভীত হলেন এবং প্রকাশ্যত তাদের উপর সে হামলা করতে পারে এরূপ আশঙ্কা করছিলেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দৃঢ় থাকতে অনুপ্রাণিত করেন। তিনিই সুউচ্চ, সুমহান। তিনি বলেন, “তোমরা ভয় করবে না, আমি তোমাদের সাথে রয়েছি; আমি শুনি ও আমি দেখি।” অন্য এক আয়াতেও বলেন, “আমি তোমাদের সাথে শ্রবণকারী।”
ইরশাদ হচ্ছেঃ
فَاۡتِیٰہُ فَقُوۡلَاۤ اِنَّا رَسُوۡلَا رَبِّکَ فَاَرۡسِلۡ مَعَنَا بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ۬ۙ وَ لَا تُعَذِّبۡہُمۡ ؕ قَدۡ جِئۡنٰکَ بِاٰیَۃٍ مِّنۡ رَّبِّکَ ؕ وَ السَّلٰمُ عَلٰی مَنِ اتَّبَعَ الۡہُدٰی ﴿۴۷﴾ اِنَّا قَدۡ اُوۡحِیَ اِلَیۡنَاۤ اَنَّ الۡعَذَابَ عَلٰی مَنۡ کَذَّبَ وَ تَوَلّٰی ﴿۴۸﴾
সুতরাং তোমরা তার নিকট যাও এবং বল, আমরা তোমার প্রতিপালকের রাসূল। সুতরাং আমাদের সাথে বনী ইসরাঈলকে যেতে দাও এবং তাদেরকে কষ্ট দিও না, আমরা তো তোমার নিকট এনেছি তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে নিদর্শন এবং শান্তি তাদের প্রতি যারা অনুসরণ করে সৎপথ। আমাদের প্রতি ওহী প্রেরণ করা হয়েছে যে, শাস্তি তার জন্যে যে মিথ্যা আরোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। (সূরা তা-হাঃ ৪৭-৪৮)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন যে, তিনি তাদের দু’জনকে নির্দেশ দিলেন যাতে তারা ফিরআউনের নিকট যায় এবং তাকে এক অদ্বিতীয় আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের দিকে আহ্বান করেন। আর বনী ইসরাঈলকে যেন সে তার কয়েদ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি দেয়। এবং তাদেরকে যেন সে আর কষ্ট না দেয়। তাদের সাথে যেতে যেন অনুমতি দেয় এবং তাদেরকে তারা আরো বলেন, “আমরা তোমার কাছে তোমার প্রতিপালকের তরফ থেকে মহা নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আর তা হচ্ছে লাঠি ও হাতের মু‘জিযা। শান্তি একমাত্র তাদেরই প্রতি যারা অনুসরণ করে সৎপথ।” সৎপথ অনুসারীদের সাথে শান্তিকে সম্পৃক্ত করার বর্ণনাটি খুবই চিত্তাকর্ষক ও তাৎপর্যপূর্ণ। তারপর তারা তাকে অস্বীকৃতির মন্দ পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, আমাদের কাছে ওহী এসেছে যে, শাস্তি ঐ ব্যক্তির জন্যে যে সত্যকে অন্তর দিয়ে অবিশ্বাস করে এবং কার্যত তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
সুদ্দী (رحمة الله) প্রমুখ আলিম উল্লেখ করেছেন যে, মূসা (عليه السلام) যখন মাদায়ান থেকে প্রত্যাবর্তন করে আপন মাতা ও ভাই হারুনের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন তারা রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। খাবারের মধ্যে ছিল শালগম। তিনি তাঁদের সাথে তা খেলেন। তারপর তিনি বললেন, “হে হারূন! আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে ও তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমরা ফিরআউনকে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের দিকে আহ্বান করি। সুতরাং তুমি আমার সাথে চল।” তখন তারা দু’জনেই ফিরআউনের মহলের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। তাঁরা দরজা বন্ধ পেলেন। মূসা (عليه السلام) দারোয়ানদের বললেন, তোমরা ফিরআউনের কাছে সংবাদ নিয়ে যাও যে, আল্লাহর রাসূল তার দরজায় উপস্থিত। দারোয়ানরা মূসা (عليه السلام)-কে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগল।
কেউ কেউ বলেছেন, ‘ফিরআউন তাদেরকে দীর্ঘক্ষণ পর প্রবেশ করার অনুমতি দিয়েছিল। মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক (رحمة الله) বলেন, ‘দু’বছর পর তাদেরকে ফিরআউন অনুমতি দিয়েছিল। কেননা, কেউ অনুমতি আনার জন্যে যেতে সাহস পায়নি।’ আল্লাহই সম্যক অবগত। এরূপও কথিত আছে যে, মূসা (عليه السلام) দরজার দিকে অগ্রসর হয়ে লাঠি দ্বারা দরজায় আঘাত করেন। এতে ফিরআউন ভীষণ বিব্রত বোধ করল এবং তাদেরকে উপস্থিত করার জন্যে নির্দেশ দিল। তারা দু’জনেই তার সম্মুখে দাঁড়ালেন এবং তাকে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ মুতাবিক তার মহান সত্তার ইবাদতের প্রতি আহ্বান করলেন।
কিতাবীদের মতে, আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-কে বলেছিলেন, “লাওয়ী ইব্ন ইয়াকূব (عليه السلام) -এর বংশধর হারূন (عليه السلام) অতি শিগগির আত্মপ্রকাশ করবেন এবং তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবেন। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তিনি নিজের সাথে বনী ইসরাঈলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে নিয়ে ফিরআউনের কাছে যান এবং আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে যা কিছু নিদর্শন প্রদান করেছেন ফিরআউনের কাছে তা যেন প্রকাশ করেন। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-কে বলেন, “শিগগিরই আমি তার অন্তর কঠিন করে দেব তাতে সে বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়কে যেতে দেবে না। আমার অধিকাংশ নিদর্শন ও অত্যাশ্চর্য বস্তুসমূহ মিসরে অবস্থিত।” আল্লাহ তা‘আলা হারূন (عليه السلام)-এর প্রতি ওহী পাঠালেন তিনি যেন তার ভাইয়ের দিকে অগ্রসর হন এবং হোরাইব পর্বতের নিকটবর্তী প্রান্তরে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। যখন তিনি সাক্ষাৎ করেন তখন মূসা (عليه السلام) তাকে তার প্রতিপালকের নির্দেশের কথা অবহিত করলেন। যখন তারা দুজন মিসরে প্রবেশ করলেন, তখন তারা বনী ইসরাঈলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে সমবেত করলেন এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে ফিরআউনের কাছে গেলেন। ফিরআউনের কাছে আল্লাহ তা‘আলার রিসালতের বাণী পৌঁছালে ফিরআউন বলল, ‘আল্লাহ কে? আমি তাকে চিনি না এবং আমি বনী ইসরাঈলকে যেতে দেব না।’
আল্লাহ তা‘আলা ফিরআউন সম্পর্কে ইরশাদ করেনঃ
قَالَ فَمَنۡ رَّبُّکُمَا یٰمُوۡسٰی ﴿۴۹﴾ قَالَ رَبُّنَا الَّذِیۡۤ اَعۡطٰی کُلَّ شَیۡءٍ خَلۡقَہٗ ثُمَّ ہَدٰی ﴿۵۰﴾ قَالَ فَمَا بَالُ الۡقُرُوۡنِ الۡاُوۡلٰی ﴿۵۱﴾ قَالَ عِلۡمُہَا عِنۡدَ رَبِّیۡ فِیۡ کِتٰبٍ ۚ لَا یَضِلُّ رَبِّیۡ وَ لَا یَنۡسَی ﴿۫۵۲﴾ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ مَہۡدًا وَّ سَلَکَ لَکُمۡ فِیۡہَا سُبُلًا وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً ؕ فَاَخۡرَجۡنَا بِہٖۤ اَزۡوَاجًا مِّنۡ نَّبَاتٍ شَتّٰی ﴿۵۳﴾ کُلُوۡا وَ ارۡعَوۡا اَنۡعَامَکُمۡ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی النُّہٰی ﴿٪۵۴﴾ مِنۡہَا خَلَقۡنٰکُمۡ وَ فِیۡہَا نُعِیۡدُکُمۡ وَ مِنۡہَا نُخۡرِجُکُمۡ تَارَۃً اُخۡرٰی ﴿۵۵﴾
অর্থাৎ–ফিরআউন বলল, হে মূসা! কে তোমাদের প্রতিপালক? মূসা বলল, আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথনির্দেশ করেছেন। ফিরআউন বলল, তাহলে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কী?’ মূসা বলল, এটার জ্ঞান আমার প্রতিপালকের নিকট কিতাবে রয়েছে; আমার প্রতিপালক ভুল করেন না এবং বিস্মৃতও হন না। যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বিছানা এবং এতে করে দিয়েছেন তোমাদের চলবার পথ, তিনি আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন এবং আমি তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি। তোমরা আহার কর ও তোমাদের গবাদি পশু চরাও; অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য। আমি মাটি থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেব এবং তা থেকে আবার তোমাদেরকে বের করব।” (সূরা তা-হাঃ ৪৯-৫৫)
আল্লাহ তা‘আলা ফিরআউন সম্পর্কে সংবাদ দিচ্ছেন। ফিরআউন মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে বলে, “হে মূসা! তোমার প্রতিপালকটি কে?” মূসা (عليه السلام) প্রতিউত্তরে বলেন, আমাদের প্রতিপালক সমগ্র মাখলুক সৃষ্টি করেছেন, তাদের আমল, রিযিক ও মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করেছেন। আর এগুলো তাঁর নিকট সংরক্ষিত কিতাবে বা লাওহে মাহফুযে লিখে রেখেছেন। অতঃপর প্রতিটি সৃষ্টিকে তার জন্যে নির্ধারিত বিষয় বস্তুর প্রতি পথনির্দেশ করেছেন। প্রত্যেক মাখলুকের আমল আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ ইলম, কুদরত ও তকদীর অনুযায়ী ঘটে থাকে।
অন্য আয়াতে অনুরূপ ইরশাদ হচ্ছেঃ
سَبِّحِ اسۡمَ رَبِّکَ الۡاَعۡلَی ۙ﴿۱﴾ الَّذِیۡ خَلَقَ فَسَوّٰی ۪ۙ﴿۲﴾ وَ الَّذِیۡ قَدَّرَ فَہَدٰی ۪ۙ﴿۳﴾
অর্থাৎ–তুমি তোমার সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। যিনি সৃষ্টি করেন ও সুঠাম করেন এবং যিনি পরিমিত বিকাশ সাধন করেন ও (মাখলুককে) সেদিকে পথনির্দেশ করেন। (সূরা আলাঃ ১-৩)
ফিরআউন মূসা (عليه السلام)-কে বলেছিল, “যদি তোমার প্রতিপালক সৃজনকর্তা, পরিমিত বিকাশকারী, মাখলুককে তাঁর নির্ধারিত পথে পথ-প্রদর্শনকারী হয়ে থাকেন এবং তিনি ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য না হয়ে থাকেন, তবে পূর্বেকার যুগের লোকেরা কেন তাকে ছেড়ে অন্যদের ইবাদত করল? তুমি তো জান, পূর্বেকার যুগের লোকেরা তারকারাজি ও দেব-দেবীকে আল্লাহর সাথে শরীক করত, তাহলে পূর্বেকার গোত্রগুলোকে কেন তিনি তোমার উল্লিখিত সঠিক পথে পরিচালনা করলেন না?” মূসা (عليه السلام) বললেন, তারা যদিও আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা করেছে এটা তোমার পক্ষের বা আমার বিপক্ষের কোন দলীল হতে পারে না। কেননা, তারা তোমার ন্যায় মূর্খতার শিকার হয়ে যে সব অপকর্ম করেছে, কিতাবসমূহে তাদের ছোট বড় সব আমলের কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। এবং আমার মহান প্রতিপালক তাদের শাস্তিদান করবেন। এক অণুপরিমাণ কারো উপর তিনি জুলুম করবেন না। কেননা, বান্দাদের সব আমলই তার নিকট একটি লিপিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে, কিছুই বাদ পড়বে না এবং আমার প্রতিপালক কিছুই বিস্মৃত হবেন না। এরপর মূসা (عليه السلام) ফিরআউনের কাছে আল্লাহ তা‘আলার শ্রেষ্ঠত্ব, বস্তুসমূহ সৃষ্টির শক্তি, ভূমিকে বিছানারূপ, আকাশকে ছাদরূপে সৃষ্টি করার শক্তি রয়েছে—এর উল্লেখ করেন। বান্দা ও জীব-জানোয়ারের রিযিকের জন্যে বাদল ও বৃষ্টিকে যে তিনি নিয়ন্ত্রণাধীনে রেখেছেন এটাও তিনি উল্লেখ করেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ
كلو وارعوا انعامكم ان في ذلك لايت لاولي النهى
তোমরা আহার কর ও গবাদি পশু চারণ কর অবশ্যই তাতে নিদর্শন রয়েছে সহজ-সরল বিশুদ্ধ বিবেক ও সুস্থ প্রকৃতিসম্পন্ন লোকদের জন্যে। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ও তোমাদের পূর্ব পুরুষদের সৃষ্টিকর্তা।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اعۡبُدُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ وَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ﴿ۙ۲۱﴾ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّ السَّمَآءَ بِنَآءً ۪ وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخۡرَجَ بِہٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزۡقًا لَّکُمۡ ۚ فَلَا تَجۡعَلُوۡا لِلّٰہِ اَنۡدَادًا وَّ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۲﴾
অর্থাৎ–“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদত কর, যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার, যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তা দিয়ে তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেন। সুতরাং তোমরা জেনেশুনে কাউকেও আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করিয়ো না।” (সূরা বাকারাঃ ২১-২২)
এ আয়াতে বৃষ্টির মাধ্যমে ভূমিকে সজীব করা ও উদ্ভিদ জন্মানোর মাধ্যমে পৃথিবীকে সুশোভিত করা দ্বারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এই প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, “মাটি থেকে আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি তাতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেব এবং তা হতে পুনর্বার তোমাদেরকে বের করব।”
অনুরূপ সূরায়ে আরাফের ২৯ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে کَمَا بَدَاَکُمۡ تَعُوۡدُوۡنَ অর্থাৎ—‘তিনি যেভাবে প্রথমে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তোমরা সেভাবে ফিরে আসবে।’
অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছেঃ
وَ ہُوَ الَّذِیۡ یَبۡدَؤُا الۡخَلۡقَ ثُمَّ یُعِیۡدُہٗ وَ ہُوَ اَہۡوَنُ عَلَیۡہِ ؕ وَ لَہُ الۡمَثَلُ الۡاَعۡلٰی فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿٪۲۷﴾
অর্থাৎ—তিনি সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনয়ন করেন, তারপর তিনি এটাকে সৃষ্টি করবেন পুনর্বার; এটা তার জন্য অতি সহজ। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তারই; এবং তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা রূমঃ ২৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ لَقَدۡ اَرَیۡنٰہُ اٰیٰتِنَا کُلَّہَا فَکَذَّبَ وَ اَبٰی ﴿۵۶﴾ قَالَ اَجِئۡتَنَا لِتُخۡرِجَنَا مِنۡ اَرۡضِنَا بِسِحۡرِکَ یٰمُوۡسٰی ﴿۵۷﴾ فَلَنَاۡتِیَنَّکَ بِسِحۡرٍ مِّثۡلِہٖ فَاجۡعَلۡ بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَکَ مَوۡعِدًا لَّا نُخۡلِفُہٗ نَحۡنُ وَ لَاۤ اَنۡتَ مَکَانًا سُوًی ﴿۵۸﴾ قَالَ مَوۡعِدُکُمۡ یَوۡمُ الزِّیۡنَۃِ وَ اَنۡ یُّحۡشَرَ النَّاسُ ضُحًی ﴿۵۹﴾
আমি তো তাকে আমার সমস্ত নিদর্শন দেখিয়েছিলাম কিন্তু সে মিথ্যা আরোপ করেছে ও অমান্য করেছে। সে বলল, হে মূসা! তুমি কি আমাদের নিকট এসেছ তোমার জাদু দ্বারা আমাদেরকে আমাদের দেশ হতে বের করে দেবার জন্যে? আমরাও অবশ্যই তোমার নিকট উপস্থিত করব এটার অনুরূপ জাদু, সুতরাং আমাদের ও তোমার মধ্যে নির্ধারণ কর এক নির্দিষ্ট সময় ও এক মধ্যবর্তী স্থান, যার ব্যতিক্রম আমরাও করব না এবং তুমিও করবে না। মূসা বললেন, “তোমাদের নির্ধারিত সময় উৎসবের দিন এবং যেদিন পূর্বাহ্ণে জনগণকে সমবেত করা হবে।’ (সূরা- তা-হাঃ ৫৬-৫৯)
আল্লাহ্ তা‘আলা ফিরআউনের দুর্ভাগ্য এবং আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন ও অমান্য করে সে যে পাপিষ্ঠতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে এর উল্লেখ করছেন। ফিরআউন মূসা (عليه السلام)-কে বলেছিল যে, মূসা (عليه السلام) যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার সবটাই জাদু।
কাজেই সেও এরূপ জাদু দ্বারা মূসা (عليه السلام)-এর মুকাবিলা করবে। অতঃপর মুকাবিলার জন্যে মূসা (عليه السلام)-কে সে একটি নির্দিষ্ট সময় ও স্থান নির্ধারণ করতে বলল। আর মূসা (عليه السلام)-এরও উদ্দেশ্য ছিল যাতে তিনি জনতার সামনে আল্লাহ তা’আলার প্রদত্ত নিদর্শন, দলীল ও প্রমাণাদি প্রকাশ করতে পারেন। তাই তিনি বললেন, ‘তোমাদের নির্ধারিত সময় হচ্ছে তোমাদের উৎসবের দিন, যেদিন তারা সাধারণত সমবেত হতো।’ সেদিন দিনের প্রথমভাগে সূর্যের আলো প্রখর হবার সময় জনগণকে সমবেত করা হবে, যাতে সত্য সুস্পষ্টভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরা যায়। এই মুকাবিলা রাতের বেলায় হবার জন্যে মূসা (عليه السلام) বলেননি, যাতে তাদের মধ্যে কোন সন্দেহ উদয় না হয় এবং তাদের জন্যে সত্য ও অসত্য বোঝা অসম্ভব না হয়ে পড়ে। বরং তিনি চেয়েছেন যাতে এই মুকাবিলা প্রকাশ্য দিবালোকে অনুষ্ঠিত হয়। কেননা, তিনি তাঁর প্রতিপালক প্রদত্ত অন্তদৃষ্টি দ্বারা সুনিশ্চিত ছিলেন যে, এই মুকাবিলায় আল্লাহ তা’আলা নিজের নিদর্শন ও দীনকে বিজয় মণ্ডিত করবেন—যদিও কিবতীরা তা কোনমতেই মেনে নিতে পারবে না।
আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেনঃ
فَتَوَلَّىٰ فِرۡعَوۡنُ فَجَمَعَ كَیۡدَهُۥ ثُمَّ أَتَىٰ قَالَ لَهُم مُّوسَىٰ وَیۡلَكُمۡ لَا تَفۡتَرُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبࣰا فَیُسۡحِتَكُم بِعَذَابࣲۖ وَقَدۡ خَابَ مَنِ ٱفۡتَرَىٰ فَتَنَـٰزَعُوۤا۟ أَمۡرَهُم بَیۡنَهُمۡ وَأَسَرُّوا۟ ٱلنَّجۡوَىٰ قَالُوۤا۟ إِنۡ هَـٰذَ ٰنِ لَسَـٰحِرَ ٰنِ یُرِیدَانِ أَن یُخۡرِجَاكُم مِّنۡ أَرۡضِكُم بِسِحۡرِهِمَا وَیَذۡهَبَا بِطَرِیقَتِكُمُ ٱلۡمُثۡلَىٰ فَأَجۡمِعُوا۟ كَیۡدَكُمۡ ثُمَّ ٱئۡتُوا۟ صَفࣰّاۚ وَقَدۡ أَفۡلَحَ ٱلۡیَوۡمَ مَنِ ٱسۡتَعۡلَىٰ [Surat Ta-Ha ৬০ – ৬৪]
অর্থাৎ——“অতঃপর ফিরআউন উঠে গেল এবং পরে তার কৌশলসমূহ একত্র করল ও তারপর আসল। মূসা (عليه السلام) তাদেরকে বলল, ‘দুর্ভোগ তোমাদের। তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে না। করলে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দ্বারা সমূলে ধ্বংস করবেন।’ যে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে সেই ব্যর্থ হয়েছে। ওরা নিজেদের মধ্যে নিজেদের কর্ম সম্বন্ধে বিতর্ক করল এবং ওরা গোপনে পরামর্শ করল। ওরা বলল, ‘এ দু’জন অবশ্যই জাদুকর, তারা চায় তাদের জাদু দ্বারা তোমাদেরকে তোমাদের দেশ হতে বহিষ্কার করতে এবং তোমাদের উৎকৃষ্ট জীবন ব্যবস্থা ধ্বংস করতে।’ অতএব, তোমরা তোমাদের জাদু ক্রিয়া সংহত কর। অতঃপর সারিবদ্ধ হয়ে উপস্থিত হও এবং যে আজ জয়ী হবে সে সফল হবে। (সূরা তা-হাঃ ৬০-৬৪)
আল্লাহ তা’আলা ফিরআউনের সত্যের বিরুদ্ধে মুকাবিলা করার প্রস্তুতি সম্বন্ধে বলেন যে, ফিরআউন চলে গেল এবং তার রাজ্যের সমস্ত জাদুকরকে একত্র করল। ঐ সময় মিসর দেশটি জাদুকরে ভরপুর ছিল। আর এ জাদুকররা ছিল তাদের পেশায় খুবই পটু। প্রতিটি শহর ও প্রতিটি স্থান থেকে সংগ্রহ করে জাদুকরদেরকে সমবেত করা হল। বস্তুত তাদের একটি বিরাট দল সমবেত হল। কেউ কেউ বলেন, যথা মুহাম্মদ ইবন কা’ব (رحمة الله) বলেন, “তারা ছিল সংখ্যায় আশি হাজার।” কাসিম ইবন আবু বুরদা (رحمة الله) বলেন, “তারা ছিল সংখ্যায় সত্তর হাজার।” সুদ্দী (رحمة الله) বলেন, “তাদের সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার থেকে চল্লিশ হাজারের মধ্যে।” আবু উমামা (رحمة الله) বলেন, “তারা ছিল উনিশ হাজার।” মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) বলেন, “তারা ছিল পনের হাজার।” কা’ব আহবারের মতে, তারা ছিল বার হাজার। ইব্ন আবু হাতিম (رحمة الله) আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “তারা ছিল সংখ্যায় সত্তরজন।” অন্য সূত্রে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “তারা ছিল বনী ইসরাঈল বংশীয় চল্লিশজন ক্রীতদাস। এদেরকে ফিরআউন তাদের গণকদের কাছে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল এবং সেখানে জাদু শিক্ষা করার জন্যে হুকুম দিয়েছিল। এই জন্যই তারা আত্মসমর্পণের সময় বলেছিল, ‘তুমি আমাদেরকে জাদু শিখতে বাধ্য করেছিলে।‘ এই অভিমতটি সন্দেহযুক্ত।
ফিরআউন, তার আমীর-উমারা, পারিষদবর্গ, সরকারী কর্মচারীবৃন্দ এবং নির্বিশেষে দেশের সকলেই মাঠে হাযির হল। কেননা, ফিরআউন তাদের মধ্যে ঘোষণা করেছিল তারা সকলে যেন এই বিরাট মেলায় হাযির হয়। তারা বের হয়ে পড়ল এবং বলাবলি করতে লাগল, জাদুকররা যদি জিতে যায় তাহলে আমরা তাদেরই অনুসরণ করব। মূসা (عليه السلام) জাদুকরদের দিকে অগ্রসর হয়ে তাদেরকে উপদেশ দিলেন এবং আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন ও দলীলাদির বিরুদ্ধে ভ্রান্ত জাদু নিয়ে মুকাবিলায় অবতরণের জন্যে তাদেরকে তিরস্কারও করেন। তিনি তাদেরকে বললেন, “দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে না। করলে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দ্বারা সমূলে ধ্বংস করে দেবেন। যে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে সেই ব্যর্থ হয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে নিজেদের কর্ম সম্বন্ধে বিতর্ক করল।” কেউ কেউ বলেন, তাদের বিতর্কের অর্থ হচ্ছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে, এটা নবীর কথা, জাদু নয়। আবার কেউ কেউ বলে, বরং সে-ই জাদুকর। আল্লাহ তাআলাই সম্যক জ্ঞাত।
এ বিষয়ে এবং অন্যান্য বিষয় সম্বন্ধে তারা গোপনে সলাপরামর্শ করল এবং বলতে লাগল, মূসা (عليه السلام) ও তাঁর ভাই হারূন (عليه السلام) দুজনই বিজ্ঞ ও দক্ষ জাদুকর; তারা তাদের জাদুবিদ্যায় অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে যেন লোকজন সমবেত হয়, তারা বাদশাহ ও তার পারিষদবর্গের উপর চড়াও হতে পারে, তোমাদের সামগ্রিকভাবে নির্মূল করে দিতে পারে। আর এ জাদুবিদ্যা দিয়ে যেন তারা তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করতে পারে। তারা বলতে লাগল, “তোমরা তোমাদের জাদু ক্রিয়া সংহত কর, অতঃপর সারিবদ্ধ হয়ে উপস্থিত হও এবং যে আজ জয়ী হবে সে সফল হবে। প্রথম কথাটি তারা এজন্য বলল, যাতে তারা তাদের কাছে প্রাপ্ত যাবতীয় ধরনের চেষ্টা, তদবীর, ছলচাতুরী, অন্যের প্রতি অপবাদ, জাদু ও ধোঁকাবাজির আশ্রয় নেয়। আফসোস, আল্লাহর কসম, তাদের সমস্ত ধ্যান-ধারণা ও যুক্তি-তর্ক ছিল মিথ্যা ও ভ্রান্ত। অপবাদ, জাদু ও ভিত্তিহীন যুক্তি-তর্ক কেমন করে এমন সব মু’জিযার মুকাবিলা করতে পারে, যেগুলো মহান আল্লাহ আপন বান্দা ও রাসূল মূসা (عليه السلام)-এর মাধ্যমে প্রদর্শন করেছেন। রাসূলকে এমন দলীল দ্বারা শক্তিশালী ও পুষ্ট করা হয়েছে, যার সামনে দৃষ্টি স্তিমিত হয়ে যায় এবং লোক হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। ফিরআউন বলতে লাগল, “তোমাদের কাছে যা কিছু তদবীর জানা রয়েছে সব কিছু নিয়ে মাঠে নেমে পড় এবং একতাবদ্ধ হয়ে মুকাবিলা কর।’
অতঃপর তারা পরস্পরকে মুকাবিলার জন্যে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করতে লাগল। কেননা, ফিরআউন তাদেরকে পদমর্যাদা ও উপঢৌকনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অবশ্যই শয়তানের প্রতিশ্রুতি প্রতারণামূলক।
আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
قَالُوا۟ یَـٰمُوسَىٰۤ إِمَّاۤ أَن تُلۡقِیَ وَإِمَّاۤ أَن نَّكُونَ أَوَّلَ مَنۡ أَلۡقَىٰ قَالَ بَلۡ أَلۡقُوا۟ۖ فَإِذَا حِبَالُهُمۡ وَعِصِیُّهُمۡ یُخَیَّلُ إِلَیۡهِ مِن سِحۡرِهِمۡ أَنَّهَا تَسۡعَىٰ فَأَوۡجَسَ فِی نَفۡسِهِۦ خِیفَةࣰ مُّوسَىٰ قُلۡنَا لَا تَخَفۡ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡأَعۡلَىٰ وَأَلۡقِ مَا فِی یَمِینِكَ تَلۡقَفۡ مَا صَنَعُوۤا۟ۖ إِنَّمَا صَنَعُوا۟ كَیۡدُ سَـٰحِرࣲۖ وَلَا یُفۡلِحُ ٱلسَّاحِرُ حَیۡثُ أَتَىٰ
[Surat Ta-Ha ৬৫ – ৬৯]
অর্থাৎ—তারা বলল, ‘হে মূসা! হয় তুমি নিক্ষেপ কর অথবা প্রথমে আমরাই নিক্ষেপ করি।‘ মূসা (عليه السلام) বলল, “বরং তোমরাই নিক্ষেপ কর।‘ তাদের জাদু প্রভাবে অকস্মাৎ মূসা (عليه السلام)-এর মনে হল তাদের দড়ি ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে। মূসা (عليه السلام) তার অন্তরে কিছু ভীতি অনুভব করল। আমি বললাম, ‘ভয় করবে না, তুমিই হচ্ছো প্রবল। তোমার ডান হাতে যা রয়েছে তা নিক্ষেপ কর; এটা ওরা যা করেছে তা গ্রাস করে ফেলবে। ওরা যা করেছে তা তো কেবল জাদুকরের কৌশল। জাদুকর যেখানেই আসুক, সফল হবে না।‘ (সূরা তা-হাঃ ৬৫-৬৯)
জাদুকররা যখন সারিবদ্ধ হল, মূসা (عليه السلام) তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারা তখন মূসা (عليه السلام)-কে বলল, হয় তুমি আমাদের আগে নিক্ষেপ কর, অথবা আমরা আগে নিক্ষেপ করি।‘ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘বরং তোমরাই প্রথম নিক্ষেপ কর।’ অতঃপর তারা দড়ি ও লাঠিগুলো নিক্ষেপ করার ঘোষণা দিল এবং পারদ ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এগুলোতে স্থাপন করল। আর এ জন্যে দড়ি ও লাঠিগুলো দর্শকের চোখে মনে হচ্ছিল যেন নিজ ইচ্ছে মাফিক ছুটাছুটি করছে অথচ এগুলো যন্ত্রের জন্যেই নড়াচড়া করছিল। এভাবে তারা মানুষের চোখকে জাদু করেছিল এবং তাদের মনের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছিল। তারা তাদের দড়ি ও লাঠিগুলো নিক্ষেপ করার সময় বলেছিল, ‘ফিরআউনের মহা মর্যাদার শপথ! আমরা বিজয়ী হবই।’
আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(قَالَ أَلۡقُوا۟ۖ فَلَمَّاۤ أَلۡقَوۡا۟ سَحَرُوۤا۟ أَعۡیُنَ ٱلنَّاسِ وَٱسۡتَرۡهَبُوهُمۡ وَجَاۤءُو بِسِحۡرٍ عَظِیمࣲ)
[Surat Al-A’raf ১১৬]
‘যখন তারা নিক্ষেপ করল তখন তারা লোকের চোখে জাদু করল, তাদেরকে আতংকিত করল এবং তারা এক বড় রকমের জাদু দেখাল।‘ মূসা (عليه السلام) জনগণের জন্যে একটু ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি আশংকা করতে লাগলেন যে, ওহী প্রাপ্তির পূর্বে তিনি তার হাতের লাঠি ছাড়তে পারছেন না, তাই লাঠি ছাড়ার পূর্বেই যদি জনগণ তাদের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে প্রতারিত হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা’আলা নির্দিষ্ট মুহূর্তে লাঠি নিক্ষেপ করার জন্যে মূসা (عليه السلام)-এর কাছে ওহী নাযিল করেন। মূসা (عليه السلام) তখন হাতের লাঠি নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন।
যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেনঃ
فَلَمَّاۤ أَلۡقَوۡا۟ قَالَ مُوسَىٰ مَا جِئۡتُم بِهِ ٱلسِّحۡرُۖ إِنَّ ٱللَّهَ سَیُبۡطِلُهُۥۤ إِنَّ ٱللَّهَ لَا یُصۡلِحُ عَمَلَ ٱلۡمُفۡسِدِینَ وَیُحِقُّ ٱللَّهُ ٱلۡحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡمُجۡرِمُونَ[Surat Yunus ৮১ – ৮২]
অর্থাৎ—“তোমরা যা এনেছ তা জাদু, আল্লাহ্ তা’আলা এটাকে শীঘ্রই অসার করে দেবেন। আল্লাহ্ তা’আলা অশান্তি সৃষ্টিকারীদের কর্ম সার্থক করেন না। অপরাধীরা অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ্ তা’আলা তার বাণী অনুযায়ী সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।” (সূরা ইউনুসঃ ৮১-৮২)
আল্লাহু তা’আলা অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ
وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ مُوسَىٰۤ أَنۡ أَلۡقِ عَصَاكَۖ فَإِذَا هِیَ تَلۡقَفُ مَا یَأۡفِكُونَ فَوَقَعَ ٱلۡحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ فَغُلِبُوا۟ هُنَالِكَ وَٱنقَلَبُوا۟ صَـٰغِرِینَ وَأُلۡقِیَ ٱلسَّحَرَةُ سَـٰجِدِینَ قَالُوۤا۟ ءَامَنَّا بِرَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ رَبِّ مُوسَىٰ وَهَـٰرُونَ[Surat Al-A’raf ১১৭ – ১২২]
অর্থাৎ-মূসার প্রতি আমি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমিও তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর,’ সহসা এটা তাদের অলীক সৃষ্টিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল। ফলে সত্য প্রতিষ্ঠিত হল এবং তারা যা করছিল তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হল, সেখানে তারা পরাভূত হল ও লাঞ্ছিত হল এবং জাদুকররা সিজদাবনত হল। তারা বলল, আমরা ঈমান আনলাম জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রতি যিনি মূসা ও হারূন এরও প্রতিপালক। (সূরা আরাফঃ ১১৭-১২২)
একাধিক পূর্বসূরি আলিম উল্লেখ করেন যে, মূসা (عليه السلام) যখন আপন লাঠি নিক্ষেপ করলেন, তখন তা পা, বড় গর্দান এবং ভয়ংকর ও ভীতিপ্রদ অবয়ববিশিষ্ট একটি বিরাট অজগরে পরিণত হল। জনতা এটাকে দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত ও বিহ্বল হয়ে পড়ল এবং ছুটে পালাতে লাগল। জনতা অজগর দেখে যখন পিছনে সরে গেল, অজগর সম্মুখ পানে অগ্রসর হল এবং জাদুকরদের দড়ি ও লাঠি দিয়ে তৈরি অলীক সৃষ্টিগুলোকে একে একে অতি দ্রুত গ্রাস করতে লাগল। জনতা অজগরের প্রতি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অন্যদিকে জাদুকররা মূসা (عليه السلام)-এর লাঠির কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেল এবং এমন একটি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করল যা তাদের ধারণার বাইরে ছিল, যা তাদের বিদ্যার ও পেশার আওতার বাইরে ছিল। এখন তারা স্পষ্টভাবে বুঝতে ও জানতে পারল যে, মূসা (عليه السلام)-এর কর্মকাণ্ড ভিত্তিহীন জাদু নয়, অবাস্তব নয়, মায়া নয়, নিছক ধারণা নয়, মিথ্যা নয়, অপবাদ নয়, পথভ্রষ্টতাও নয় বরং এটাই সত্য বা যথার্থ। সত্য দ্বারা পুষ্ট রাসূল ব্যতীত অন্য কোন ধারক ও বাহকের এরূপ অত্যাশ্চর্য প্রদর্শন করা আর কারো পক্ষেই সম্ভব না। এভাবে আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তর থেকে অজ্ঞতার পর্দা দূর করে দিলেন এবং তাদের অন্তরকে হিদায়াতের নূর দ্বারা আলোকিত করে দিলেন। তাকে কাঠিন্য মুক্ত করে দিলেন। ফলে তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে ঝুঁকে পড়ল এবং তার সন্তুষ্টির জন্যই সিজদায় নত হল। তারা উপস্থিত জনতার পক্ষ থেকে কোন প্রকার শাস্তি বা নির্যাতনের আশংকা না করে প্রকাশ্যভাবে উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে বলতে লাগল, “আমরা মূসা ও হারূন-এর প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম।”
আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
فَأُلۡقِیَ ٱلسَّحَرَةُ سُجَّدࣰا قَالُوۤا۟ ءَامَنَّا بِرَبِّ هَـٰرُونَ وَمُوسَىٰ قَالَ ءَامَنتُمۡ لَهُۥ قَبۡلَ أَنۡ ءَاذَنَ لَكُمۡۖ إِنَّهُۥ لَكَبِیرُكُمُ ٱلَّذِی عَلَّمَكُمُ ٱلسِّحۡرَۖ فَلَأُقَطِّعَنَّ أَیۡدِیَكُمۡ وَأَرۡجُلَكُم مِّنۡ خِلَـٰفࣲ وَلَأُصَلِّبَنَّكُمۡ فِی جُذُوعِ ٱلنَّخۡلِ وَلَتَعۡلَمُنَّ أَیُّنَاۤ أَشَدُّ عَذَابࣰا وَأَبۡقَىٰ قَالُوا۟ لَن نُّؤۡثِرَكَ عَلَىٰ مَا جَاۤءَنَا مِنَ ٱلۡبَیِّنَـٰتِ وَٱلَّذِی فَطَرَنَاۖ فَٱقۡضِ مَاۤ أَنتَ قَاضٍۖ إِنَّمَا تَقۡضِی هَـٰذِهِ ٱلۡحَیَوٰةَ ٱلدُّنۡیَاۤ إِنَّاۤ ءَامَنَّا بِرَبِّنَا لِیَغۡفِرَ لَنَا خَطَـٰیَـٰنَا وَمَاۤ أَكۡرَهۡتَنَا عَلَیۡهِ مِنَ ٱلسِّحۡرِۗ وَٱللَّهُ خَیۡرࣱ وَأَبۡقَىٰۤ إِنَّهُۥ مَن یَأۡتِ رَبَّهُۥ مُجۡرِمࣰا فَإِنَّ لَهُۥ جَهَنَّمَ لَا یَمُوتُ فِیهَا وَلَا یَحۡیَىٰ وَمَن یَأۡتِهِۦ مُؤۡمِنࣰا قَدۡ عَمِلَ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فَأُو۟لَـٰۤىِٕكَ لَهُمُ ٱلدَّرَجَـٰتُ ٱلۡعُلَىٰ جَنَّـٰتُ عَدۡنࣲ تَجۡرِی مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَـٰرُ خَـٰلِدِینَ فِیهَاۚ وَذَ ٰلِكَ جَزَاۤءُ مَن تَزَكَّىٰ[Surat Ta-Ha ৭০ – ৭৬]
অর্থাৎ– “তারপর জাদুকররা সিজদাবনত হল ও বলল, “আমরা হারূন ও মূসার প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলাম।’ ফিরআউন বললঃ ‘কী, আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা মূসাতে বিশ্বাস স্থাপন করলে! দেখছি, সে তো তোমাদের প্রধান, সে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে। সুতরাং আমি অবশ্যই তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং আমি তোমাদেরকে খেজুর গাছের কাণ্ডে শূলবিদ্ধ করবই এবং তোমরা অবশ্যই জানতে পারবে—আমাদের মধ্যে কার শাস্তি কঠোরতর ও অধিক স্থায়ী।’ তারা বলল, ‘আমাদের নিকট যে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে তার উপর এবং যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তার উপর তোমাকে আমরা কিছুতেই প্রাধান্য দেব না; সুতরাং তুমি যা করতে চাও তা করতে পার। তুমি তো কেবল এই পার্থিব জীবনের উপর কর্তৃত্ব করতে পার। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছি, যাতে তিনি ক্ষমা করেন আমাদের অপরাধ এবং তুমি আমাদেরকে যে জাদু করতে বাধ্য করেছ তাও।’ আর আল্লাহ শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী, যে তার প্রতিপালকের নিকট অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য তো রয়েছে জাহান্নাম, সেথায় সে মরবেও না, বাঁচবেও না। যারা তাঁর নিকট উপস্থিত হবে মু’মিন অবস্থায় সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের জন্যে রয়েছে সমুচ্চ মর্যাদা- স্থায়ী জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেথায় তারা স্থায়ী হবে এবং এই পুরস্কার তাদেরই, যারা পবিত্র। (সূরা তা-হাঃ ৭০-৭৬)
সাঈদ ইবন জুবাইর (رضي الله عنه), ইকরিমা, কাসিম ইবন আবু বুরদা, আওযায়ী (رحمة الله) প্রমুখ বলেন, ‘যখন জাদুকররা মূসা (عليه السلام)-এর মুজিযা প্রত্যক্ষ করে সিজদায় অবনত হলেন তখন তারা জান্নাতে তাদের বসবাসের জন্য তৈরি ও তাদের অভ্যর্থনার জন্যে সুসজ্জিত ও দালানকোঠা অবলোকন করলেন আর এজন্যই তারা ফিরআউনের ভয়ভীতি, শাস্তি ও হুমকির প্রতি ভ্রুক্ষেপমাত্র করলেন না। ফিরআউন যখন দেখতে পেল, জাদুকররা মুসলমান হয়ে গেছে এবং তারা মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام)-এর প্রচারিত বাণী লোকসমাজে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে, সে ভীত হয়ে পড়ল এবং ভবিষ্যত আশংকায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। এতে সে হতবিহ্বল হয়ে আপন অন্তদৃষ্টি ও দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলল। তার মধ্যে ছিল শঠতা, ধোঁকাবাজী, প্রতারণা, পথভ্রষ্টতা ও জনগণকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখার সুনিপুণ কৌশল। এজন্যই সে জনতার উপস্থিতিতে জাদুকরদের বলল, ‘কী আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা মূসাতে বিশ্বাস স্থাপন করলে!’ অর্থাৎ আমার প্রজাদের সামনে এরূপ জঘন্য কাজটি করার পূর্বে কেন আমার সাথে পরামর্শ করলে না। অতঃপর সে তাদেরকে ধমকি দিল, শাস্তির ভয় দেখাল এবং মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বলতে লাগল, নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রধান; সে-ই তোমাদেরকে জাদুশিক্ষা দিয়েছে।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ
قَالَ فِرۡعَوۡنُ ءَامَنتُم بِهِۦ قَبۡلَ أَنۡ ءَاذَنَ لَكُمۡۖ إِنَّ هَـٰذَا لَمَكۡرࣱ مَّكَرۡتُمُوهُ فِی ٱلۡمَدِینَةِ لِتُخۡرِجُوا۟ مِنۡهَاۤ أَهۡلَهَاۖ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَ[Surat Al-A’raf ১২৩]
অর্থাৎ—“ফিরআউন বলল, কী! আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বে তোমরা এটাতে বিশ্বাস করলে? এ তো এক চক্রান্ত; তোমরা সজ্ঞানে এই চক্রান্ত করেছ নগরবাসীদেরকে এটা হতে বহিষ্কারের জন্যে। আচ্ছা, তোমরা শীঘ্রই এটার পরিণাম জানবে।” (সূরা আরাফঃ ১২৩)
ফিরআউনের এ উক্তিটি একটি ভিত্তিহীন অপবাদ ব্যতীত কিছু নয়। প্রত্যেকটি বোধ শক্তিসম্পন্ন লোকই জানে যে, এটা ফিরআউনের কুফরী, মিথ্যাচারিতা ও প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয় বরং এরূপ কথা ছেলেমেয়েদের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তার অমাত্যবর্গ ও অন্য সকলেরই জানা ছিল যে, মূসা (عليه السلام)-কে জাদুকররা কোনদিনও দেখেননি, তিনি কেমন করে তাদের প্রধান হতে পারেন? যিনি তাদেরকে জাদুশিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া তিনি তাদেরকে একত্র করেননি এবং তাদের একত্রিত হবার বিষয়টিও তার কাছে জানা ছিল না, বরং ফিরআউন তাদেরকে ডেকেছে এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, গ্রাম-গঞ্জ, শহর-নগর, মিসরের শহরতলি ও বিভিন্ন জায়গা থেকে বাছাই করে তাদেরকে সে মূসা (عليه السلام)-এর সামনে উপস্থাপন করেছে।
সূরা আ’রাফে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
ثُمَّ بَعَثۡنَا مِنۢ بَعۡدِهِم مُّوسَىٰ بِـَٔایَـٰتِنَاۤ إِلَىٰ فِرۡعَوۡنَ وَمَلَإِی۟هِۦ فَظَلَمُوا۟ بِهَاۖ فَٱنظُرۡ كَیۡفَ كَانَ عَـٰقِبَةُ ٱلۡمُفۡسِدِینَ وَقَالَ مُوسَىٰ یَـٰفِرۡعَوۡنُ إِنِّی رَسُولࣱ مِّن رَّبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ حَقِیقٌ عَلَىٰۤ أَن لَّاۤ أَقُولَ عَلَى ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡحَقَّۚ قَدۡ جِئۡتُكُم بِبَیِّنَةࣲ مِّن رَّبِّكُمۡ فَأَرۡسِلۡ مَعِیَ بَنِیۤ إِسۡرَ ٰۤءِیلَ قَالَ إِن كُنتَ جِئۡتَ بِـَٔایَةࣲ فَأۡتِ بِهَاۤ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ فَأَلۡقَىٰ عَصَاهُ فَإِذَا هِیَ ثُعۡبَانࣱ مُّبِینࣱ وَنَزَعَ یَدَهُۥ فَإِذَا هِیَ بَیۡضَاۤءُ لِلنَّـٰظِرِینَ قَالَ ٱلۡمَلَأُ مِن قَوۡمِ فِرۡعَوۡنَ إِنَّ هَـٰذَا لَسَـٰحِرٌ عَلِیمࣱ یُرِیدُ أَن یُخۡرِجَكُم مِّنۡ أَرۡضِكُمۡۖ فَمَاذَا تَأۡمُرُونَ قَالُوۤا۟ أَرۡجِهۡ وَأَخَاهُ وَأَرۡسِلۡ فِی ٱلۡمَدَاۤىِٕنِ حَـٰشِرِینَ یَأۡتُوكَ بِكُلِّ سَـٰحِرٍ عَلِیمࣲ وَجَاۤءَ ٱلسَّحَرَةُ فِرۡعَوۡنَ قَالُوۤا۟ إِنَّ لَنَا لَأَجۡرًا إِن كُنَّا نَحۡنُ ٱلۡغَـٰلِبِینَ قَالَ نَعَمۡ وَإِنَّكُمۡ لَمِنَ ٱلۡمُقَرَّبِینَ قَالُوا۟ یَـٰمُوسَىٰۤ إِمَّاۤ أَن تُلۡقِیَ وَإِمَّاۤ أَن نَّكُونَ نَحۡنُ ٱلۡمُلۡقِینَ قَالَ أَلۡقُوا۟ۖ فَلَمَّاۤ أَلۡقَوۡا۟ سَحَرُوۤا۟ أَعۡیُنَ ٱلنَّاسِ وَٱسۡتَرۡهَبُوهُمۡ وَجَاۤءُو بِسِحۡرٍ عَظِیمࣲ ۞ وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ مُوسَىٰۤ أَنۡ أَلۡقِ عَصَاكَۖ فَإِذَا هِیَ تَلۡقَفُ مَا یَأۡفِكُونَ فَوَقَعَ ٱلۡحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ فَغُلِبُوا۟ هُنَالِكَ وَٱنقَلَبُوا۟ صَـٰغِرِینَ وَأُلۡقِیَ ٱلسَّحَرَةُ سَـٰجِدِینَ(قَالُوۤا۟ ءَامَنَّا بِرَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ رَبِّ مُوسَىٰ وَهَـٰرُونَ قَالَ فِرۡعَوۡنُ ءَامَنتُم بِهِۦ قَبۡلَ أَنۡ ءَاذَنَ لَكُمۡۖ إِنَّ هَـٰذَا لَمَكۡرࣱ مَّكَرۡتُمُوهُ فِی ٱلۡمَدِینَةِ لِتُخۡرِجُوا۟ مِنۡهَاۤ أَهۡلَهَاۖ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَ لَأُقَطِّعَنَّ أَیۡدِیَكُمۡ وَأَرۡجُلَكُم مِّنۡ خِلَـٰفࣲ ثُمَّ لَأُصَلِّبَنَّكُمۡ أَجۡمَعِینَ قَالُوۤا۟ إِنَّاۤ إِلَىٰ رَبِّنَا مُنقَلِبُونَ وَمَا تَنقِمُ مِنَّاۤ إِلَّاۤ أَنۡ ءَامَنَّا بِـَٔایَـٰتِ رَبِّنَا لَمَّا جَاۤءَتۡنَاۚ رَبَّنَاۤ أَفۡرِغۡ عَلَیۡنَا صَبۡرࣰا وَتَوَفَّنَا مُسۡلِمِینَ[Surat Al-A’raf ১০৩ – ১২৬]
অর্থাৎ তাদের পর মূসাকে আমার নিদর্শনসহ ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের নিকট পাঠাই; কিন্তু তারা এটা অস্বীকার করে। বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কি হয়েছিল তা লক্ষ্য কর। মূসা বলল, ‘হে ফিরআউন! আমি তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট থেকে প্রেরিত। এটা স্থির নিশ্চিত যে, আমি আল্লাহ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলব না; তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে স্পষ্ট প্রমাণ আমি তোমাদের নিকট এনেছি সুতরাং বনী ইসরাঈলকে আমার সাথে যেতে দাও।’ ফিরআউন বলল, ‘যদি তুমি কোন নিদর্শন এনে থাক তবে তুমি সত্যবাদী হলে তা পেশ কর।’ তারপর মূসা তার লাঠি নিক্ষেপ করল এবং তৎক্ষণাৎ এটা এক সাক্ষাৎ অজগর হল। সে তার হাত বের করল আর তৎক্ষণাৎ এটা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র উজ্জ্বল প্রতিভাত হল। ফিরআউন সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলল, ‘এতো একজন সুদক্ষ জাদুকর, এ তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে চায়। এখন তোমরা কী পরামর্শ দাও?’
তারা বলল, ‘তাকে ও তার ভাইকে কিঞ্চিৎ অবকাশ দাও এবং নগরে নগরে সংগ্রাহকদেরকে পাঠাও, যেন তারা তোমার নিকট প্রতিটি সুদক্ষ জাদুকরকে উপস্থিত করে।’ জাদুকররা ফিরআউনের নিকট এসে বলল, “আমরা যদি বিজয়ী হই তবে আমাদের জন্য পুরস্কার থাকবে তো?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ, এবং তোমরা আমার সান্নিধ্য প্রাপ্তদেরও অন্তর্ভুক্ত হবে।’ তারা বলল, “হে মূসা! তুমিই কি নিক্ষেপ করবে, না আমরাই নিক্ষেপ করব?’ সে বলল, তোমরাই নিক্ষেপ কর, যখন তারা নিক্ষেপ করল তখন তারা লোকের চোখে জাদু করল; তাদেরকে আতংকিত করল এবং তারা এক বড় রকমের জাদু দেখাল। আমি মূসার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমিও তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর, সহসা এটা তাদের অলীক সৃষ্টিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল। ফলে সত্য প্রতিষ্ঠিত হল এবং তারা যা করছিল তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হল। সেখানে তারা পরাভূত হল ও লাঞ্ছিত হল এবং জাদুকররা সিজদাবনত হল। তারা বলল, ‘আমরা ঈমান আনলাম জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রতি – যিনি মূসা ও হারূন-এরও প্রতিপালক।’
ফিরআউন বলল, ‘কী! আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বে তোমরা এটাতে বিশ্বাস করলে? এটা তো এক চক্রান্ত। তোমরা সজ্ঞানে এ চক্রান্ত করেছ নগরবাসীদের নগর থেকে বহিষ্কারের জন্যে। আচ্ছা, তোমরা শীঘ্রই এটার পরিণাম জানবে। আমি তো তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কর্তন করবই, তারপর তোমাদের সকলেরই শূলবিদ্ধও করব।’ তারা বলল আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরে যাব। তুমি তো আমাদেরকে শাস্তি দান করছ শুধু এজন্য যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনে ঈমান এনেছি। যখন এটা আমাদের নিকট এসেছে। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্যদান কর এবং মুসলমানরূপে আমাদের মৃত্যু ঘটাও। (সূরা আ’রাফ ১০৩-১২৬)
আল্লাহ্ তা’আলা সূরা ইউনুসে ইরশাদ করেনঃ
ثُمَّ بَعَثۡنَا مِنۢ بَعۡدِهِم مُّوسَىٰ وَهَـٰرُونَ إِلَىٰ فِرۡعَوۡنَ وَمَلَإِی۟هِۦ بِـَٔایَـٰتِنَا فَٱسۡتَكۡبَرُوا۟ وَكَانُوا۟ قَوۡمࣰا مُّجۡرِمِینَ فَلَمَّا جَاۤءَهُمُ ٱلۡحَقُّ مِنۡ عِندِنَا قَالُوۤا۟ إِنَّ هَـٰذَا لَسِحۡرࣱ مُّبِینࣱ قَالَ مُوسَىٰۤ أَتَقُولُونَ لِلۡحَقِّ لَمَّا جَاۤءَكُمۡۖ أَسِحۡرٌ هَـٰذَا وَلَا یُفۡلِحُ ٱلسَّـٰحِرُونَ قَالُوۤا۟ أَجِئۡتَنَا لِتَلۡفِتَنَا عَمَّا وَجَدۡنَا عَلَیۡهِ ءَابَاۤءَنَا وَتَكُونَ لَكُمَا ٱلۡكِبۡرِیَاۤءُ فِی ٱلۡأَرۡضِ وَمَا نَحۡنُ لَكُمَا بِمُؤۡمِنِینَ وَقَالَ فِرۡعَوۡنُ ٱئۡتُونِی بِكُلِّ سَـٰحِرٍ عَلِیمࣲ فَلَمَّا جَاۤءَ ٱلسَّحَرَةُ قَالَ لَهُم مُّوسَىٰۤ أَلۡقُوا۟ مَاۤ أَنتُم مُّلۡقُونَ فَلَمَّاۤ أَلۡقَوۡا۟ قَالَ مُوسَىٰ مَا جِئۡتُم بِهِ ٱلسِّحۡرُۖ إِنَّ ٱللَّهَ سَیُبۡطِلُهُۥۤ إِنَّ ٱللَّهَ لَا یُصۡلِحُ عَمَلَ ٱلۡمُفۡسِدِینَ وَیُحِقُّ ٱللَّهُ ٱلۡحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡمُجۡرِمُونَ
[Surat Yunus ৭৫ – ৮২]
অর্থাৎ- “পরে আমার নিদর্শনসহ মূসা ও হারূনকে ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের নিকট প্রেরণ করি। কিন্তু ওরা অহংকার করে এবং ওরা ছিল অপরাধী সম্প্রদায়। তারপর যখন ওদের কাছে আমার নিকট হতে সত্য এল তখন ওরা বলল, এটা তো নিশ্চয়ই স্পষ্ট জাদু।‘ মূসা বলল, ‘সত্য যখন তোমাদের নিকট আসল, তখন সে সম্পর্কে তোমরা এরূপ বলছ? এটা কি জাদু? জাদুকররা তো সফলকাম হয় না।’ ওরা বলল, “আমরা আমাদের পিতৃপুরুষগণকে যাতে পেয়েছি তুমি কি তা থেকে আমাদেরকে বিচ্যুত করবার জন্যে আমাদের নিকট এসেছ এবং যাতে দেশে তোমাদের দুজনের প্রতিপত্তি হয় এজন্য? আমরা তোমাদের প্রতি বিশ্বাসী নই।
ফিরআউন বলল, ‘তোমরা আমার নিকট সকল সুদক্ষ জাদুকরকে নিয়ে এস। তারপর যখন জাদুকররা এল তখন তাদেরকে মূসা বলল, ‘তোমাদের যা নিক্ষেপ করার তা নিক্ষেপ কর।’ যখন তারা নিক্ষেপ করল, তখন মূসা বলল, “তোমরা যা কিছু এনেছ তা জাদু, আল্লাহ জাদুকে অসার করে দেবেন। আল্লাহ অশান্তি সৃষ্টিকারীদের কর্ম সার্থক করেন না। অপরাধীরা অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর বাণী অনুযায়ী সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। (সূরা ইউনূসঃ ৭৫-৮২)
আল্লাহ তা’আলা সূরা শূআরায় মূসা (عليه السلام) ও ফিরআউন সম্পর্কিত ঘটনা বর্ণনার্থে ইরশাদ করেনঃ
قَالَ لَىِٕنِ ٱتَّخَذۡتَ إِلَـٰهًا غَیۡرِی لَأَجۡعَلَنَّكَ مِنَ ٱلۡمَسۡجُونِینَ قَالَ أَوَلَوۡ جِئۡتُكَ بِشَیۡءࣲ مُّبِینࣲ قَالَ فَأۡتِ بِهِۦۤ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ فَأَلۡقَىٰ عَصَاهُ فَإِذَا هِیَ ثُعۡبَانࣱ مُّبِینࣱ وَنَزَعَ یَدَهُۥ فَإِذَا هِیَ بَیۡضَاۤءُ لِلنَّـٰظِرِینَ قَالَ لِلۡمَلَإِ حَوۡلَهُۥۤ إِنَّ هَـٰذَا لَسَـٰحِرٌ عَلِیمࣱ یُرِیدُ أَن یُخۡرِجَكُم مِّنۡ أَرۡضِكُم بِسِحۡرِهِۦ فَمَاذَا تَأۡمُرُونَ قَالُوۤا۟ أَرۡجِهۡ وَأَخَاهُ وَٱبۡعَثۡ فِی ٱلۡمَدَاۤىِٕنِ حَـٰشِرِینَ یَأۡتُوكَ بِكُلِّ سَحَّارٍ عَلِیمࣲ فَجُمِعَ ٱلسَّحَرَةُ لِمِیقَـٰتِ یَوۡمࣲ مَّعۡلُومࣲ وَقِیلَ لِلنَّاسِ هَلۡ أَنتُم مُّجۡتَمِعُونَ لَعَلَّنَا نَتَّبِعُ ٱلسَّحَرَةَ إِن كَانُوا۟ هُمُ ٱلۡغَـٰلِبِینَ فَلَمَّا جَاۤءَ ٱلسَّحَرَةُ قَالُوا۟ لِفِرۡعَوۡنَ أَىِٕنَّ لَنَا لَأَجۡرًا إِن كُنَّا نَحۡنُ ٱلۡغَـٰلِبِینَ قَالَ نَعَمۡ وَإِنَّكُمۡ إِذࣰا لَّمِنَ ٱلۡمُقَرَّبِینَ قَالَ لَهُم مُّوسَىٰۤ أَلۡقُوا۟ مَاۤ أَنتُم مُّلۡقُونَ فَأَلۡقَوۡا۟ حِبَالَهُمۡ وَعِصِیَّهُمۡ وَقَالُوا۟ بِعِزَّةِ فِرۡعَوۡنَ إِنَّا لَنَحۡنُ ٱلۡغَـٰلِبُونَ فَأَلۡقَىٰ مُوسَىٰ عَصَاهُ فَإِذَا هِیَ تَلۡقَفُ مَا یَأۡفِكُونَ فَأُلۡقِیَ ٱلسَّحَرَةُ سَـٰجِدِینَ قَالُوۤا۟ ءَامَنَّا بِرَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ رَبِّ مُوسَىٰ وَهَـٰرُونَ قَالَ ءَامَنتُمۡ لَهُۥ قَبۡلَ أَنۡ ءَاذَنَ لَكُمۡۖ إِنَّهُۥ لَكَبِیرُكُمُ ٱلَّذِی عَلَّمَكُمُ ٱلسِّحۡرَ فَلَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَۚ لَأُقَطِّعَنَّ أَیۡدِیَكُمۡ وَأَرۡجُلَكُم مِّنۡ خِلَـٰفࣲ وَلَأُصَلِّبَنَّكُمۡ أَجۡمَعِینَ قَالُوا۟ لَا ضَیۡرَۖ إِنَّاۤ إِلَىٰ رَبِّنَا مُنقَلِبُونَ إِنَّا نَطۡمَعُ أَن یَغۡفِرَ لَنَا رَبُّنَا خَطَـٰیَـٰنَاۤ أَن كُنَّاۤ أَوَّلَ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ
[Surat Ash-Shu’ara ২৯ – ৫১]
অর্থাৎ- ফিরআউন বলল, ‘তুমি (হে মূসা) যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর আমি তোমাকে অবশ্যই কারারুদ্ধ করব।’ মূসা বলল, ‘আমি তোমার নিকট স্পষ্ট কোন নিদর্শন আনয়ন করলেও?’ ফিরআউন বলল, ‘তুমি যদি সত্যবাদী হও, তবে তা উপস্থিত কর।‘ তারপর মূসা (عليه السلام) তার লাঠি নিক্ষেপ করলে তৎক্ষণাৎ তা এক সাক্ষাৎ অজগর হল এবং মূসা হাত বের করল আর তৎক্ষণাৎ তা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র ও উজ্জ্বল প্রতিভাত হল। ফিরআউন তার পারিষদবর্গকে বলল, “এতো এক সুদক্ষ জাদুকর। এ তোমাদেরকে তোমাদের দেশ হতে তার জাদুবলে বহিষ্কার করতে চায়। এখন তোমরা কি করতে বল?’ ওরা বলল, ‘তাকে ও তার ভাইকে কিছুটা অবকাশ দাও এবং নগরে নগরে সংগ্রাহকদেরকে পাঠাও যেন তারা তোমার নিকট প্রতিটি সুদক্ষ জাদুকর উপস্থিত করে।’ তারপর এক নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট সময়ে জাদুকরদেরকে একত্র করা হল- এবং লোকদেরকে বলা হল,‘ তোমরাও সমবেত হচ্ছ কি?’ যেন আমরা জাদুকরদের অনুসরণ করতে পারি, যদি ওরা বিজয়ী হয়। তারপর জাদুকররা এসে ফিরআউনকে বলল, ‘আমরা যদি বিজয়ী হই আমাদের জন্য পুরস্কার থাকবে তো?’ ফিরআউন বলল, ‘হ্যাঁ, তখন তোমরা অবশ্যই আমার ঘনিষ্ঠদের শামিল হবে।‘ মুসা তাদেরকে বলল, ‘তোমাদের যা নিক্ষেপ করার তা নিক্ষেপ কর। তারপর তারা তাদের রশি ও লাঠি নিক্ষেপ করল এবং ওরা বলল, ‘ফিরআউনের ইযযতের শপথ! আমরাই বিজয়ী হব।‘ তারপর মূসা তার লাঠি নিক্ষেপ করল; সহসা এটা তাদের অলীক সৃষ্টিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল। তখন জাদুকররা সিজদাবনত হয়ে পড়ল এবং বলল, “আমরা ঈমান আনয়ন করলাম জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রতি; যিনি মূসা ও হারূন-এরও প্রতিপালক।‘ ফিরআউন বলল, “কী! আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা এটাতে বিশ্বাস করলে? সে-ই তো তোমাদের প্রধান, যে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে। শীঘ্রই তোমরা এটার পরিণাম জানবে। আমি অবশ্যই তোমাদের হাত এবং তোমাদের পা বিপরীত দিক হতে কর্তন করব এবং তোমাদের সকলকে শূলবিদ্ধ করবই।‘ ওরা বলল, ‘কোন ক্ষতি নেই, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করব। আমরা আশা করি যে, আমাদের প্রতিপালক আমাদের অপরাধ মার্জনা করবেন; কারণ আমরা মু’মিনদের মধ্যে অগ্রণী।’ (সূরা শুআরাঃ ২৯-৫১)
মোদ্দাকথা হল এই যে, ফিরআউন নিশ্চয়ই জাদুকরদেরকে এ কথা বলে যে, মূসা (عليه السلام) ছিলেন তাদের প্রধান যিনি তাদের জাদু শিক্ষা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ফিরআউন মিথ্যা বলেছে, অপবাদ দিয়েছে এবং চরম পর্যায়ের কুফরী করেছে। ফিরআউনের মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি অপবাদ সর্বজনবিদিত। নিম্নে বর্ণিত আয়াতাংশসমূহের মাধ্যমে বিজ্ঞমহলের নিকট ফিরআউনের ধৃষ্টতা ও মূর্খতা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। যেমন আয়াতাংশ—
قَالَ فِرۡعَوۡنُ ءَامَنتُم بِهِۦ قَبۡلَ أَنۡ ءَاذَنَ لَكُمۡۖ إِنَّ هَـٰذَا لَمَكۡرࣱ مَّكَرۡتُمُوهُ فِی ٱلۡمَدِینَةِ لِتُخۡرِجُوا۟ مِنۡهَاۤ أَهۡلَهَاۖ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَ[Surat Al-A’raf ১২৩]
“এটা একটা চক্রান্ত, এই চক্রান্তের মাধ্যমে তোমরা নগরবাসীদেরকে তাদের ভিটামাটি থেকে উৎখাতের চেষ্টা করছ; অচিরেই তোমরা জানতে পারবে। এবং তার উক্তিঃ আমি তোমাদের ডান হাত ও বাম পা কিংবা বাম হাত ও ডান পা কর্তন করে দেব। আর তোমাদের সকলকে শূলবিদ্ধ করব যাতে তোমরা অন্যদের জন্যে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। রাজ্যের অন্য কোন ব্যক্তি ভবিষ্যতে এরূপ করার যেন আর সাহস না পায়। এ জন্যেই ফিরআউন বলেছিল, তোমাদেরকে খেজুর গাছের কাণ্ডে শূলবিদ্ধ করব। কেননা তা সবচাইতে উঁচু এবং সবচাইতে বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য।’ সে আরও বলেছিল, “তোমরা বুঝতে পারবে যে, আমাদের মধ্যে দুনিয়াতে কে বেশি কঠোর স্থায়ী শাস্তিদাতা।’ মু’মিন জাদুকরগণ বলেছিলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব নিদর্শন ও অকাট্য প্রমাণাদি এসেছে ও আমাদের অন্তরে স্থান নিয়েছে এগুলোকে ছেড়ে আমরা কোনদিনও তোমার আনুগত্য করব না।’
আয়াতাংশ والذي فطرنا -এর ‘ওয়াও’ সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন, এটা পূর্ববর্তী বাক্যের সাথে সংযুক্তকারী অব্যয়। আবার কেউ কেউ বলেন, এখানে এই অক্ষরটি ‘শপথ’ অর্থবোধক।
মুমিন জাদুকরগণ ফিরআউনকে আরো বললেন, ‘তুমি যা পার তা কর; তোমার আদেশ তো শুধুমাত্র এই পার্থিব জীবনেই চলতে পারে। তবে যখন আমরা এই নশ্বর জগত ছেড়ে আখিরাতে চলে যাব তখন ঐ সত্তার আদেশ বলবৎ থাকবে যার প্রতি আমরা বিশ্বাস স্থাপন করছি এবং আমরা যার প্রেরিত রাসূলগণের অনুসরণ করছি।
তারা আরো বললেনঃ
(إِنَّاۤ ءَامَنَّا بِرَبِّنَا لِیَغۡفِرَ لَنَا خَطَـٰیَـٰنَا وَمَاۤ أَكۡرَهۡتَنَا عَلَیۡهِ مِنَ ٱلسِّحۡرِۗ وَٱللَّهُ خَیۡرࣱ وَأَبۡقَىٰۤ)
[Surat Ta-Ha ৭৩]
অর্থাৎ- ‘আমরা আমাদের প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি যাতে তিনি আমাদের যাবতীয় অন্যায়-অপরাধ ও তুমি যে আমাদেরকে জোর-জবরদস্তি করে জাদু করতে বাধ্য করেছ সেই অন্যায় ক্ষমা করে দেন।’ কেননা, আল্লাহ তাআলা কল্যাণময় এবং তুমি আমাদেরকে সান্নিধ্য প্রদানের (পার্থিব জগতে) যে ওয়াদা অঙ্গীকার করেছ তার চেয়ে আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত সওয়াব অধিকতর কল্যাণকর ও অধিকতর স্থায়ী।‘ অন্য আয়াতাংশে বলা হয়েছেঃ মুমিন জাদুকরগণ বলেছিলেন, “আমাদের কোন ক্ষতি নেই, কেননা আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরে যাব। আমরা আশা রাখি যে, আমাদের প্রতিপালক আমাদের কৃত পাপরাশি ও অনাচারসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আমরা কিবতীদের পূর্বেই মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام)-এর প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি বলে আমরা ঘোষিত হব।
তারা তাকে আরো বললেনঃ
(وَمَا تَنقِمُ مِنَّاۤ إِلَّاۤ أَنۡ ءَامَنَّا بِـَٔایَـٰتِ رَبِّنَا لَمَّا جَاۤءَتۡنَاۚ رَبَّنَاۤ أَفۡرِغۡ عَلَیۡنَا صَبۡرࣰا وَتَوَفَّنَا مُسۡلِمِینَ)
[Surat Al-A’raf ১২৬]
অর্থাৎ—তুমি তো আমাদেরকে শাস্তিদান করছো শুধু এ জন্য যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করেছি যখন এগুলো আমাদের কাছে এসেছে। এছাড়া আমাদের অন্য কোন অপরাধ নেই। হে আমাদের প্রতিপালক! পরাক্রমশালী অত্যাচারী হিংস্র শাসক, তাগূত ও শয়তান আমাদেরকে যে অসহনীয় শাস্তি প্রদান করছে তা সহ্য করার আমাদেরকে ধৈর্য দাও এবং আমাদেরকে আত্মসমর্পণকারীরূপে মৃত্যু দান কর।‘
অতঃপর তারা তাকে উপদেশস্বরূপ মহান প্রতিপালকের শাস্তির প্রতি ভীতি প্রদর্শন করে বললেনঃ
(إِنَّهُۥ مَن یَأۡتِ رَبَّهُۥ مُجۡرِمࣰا فَإِنَّ لَهُۥ جَهَنَّمَ لَا یَمُوتُ فِیهَا وَلَا یَحۡیَىٰ)
[Surat Ta-Ha ৭৪]
অর্থাৎ—যে তার প্রতিপালকের নিকট অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য তো রয়েছে জাহান্নাম, সেখানে সে মরবেও না, বাঁচবেও না। তাঁরা বললেন, ‘সুতরাং সাবধান তুমি যেন এসব অপরাধীর অন্তর্ভুক্ত না হও।‘ কিন্তু ফিরআউন তাদের উপদেশ অমান্য করে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।
তারা তাকে আরো বললেনঃ
وَمَن یَأۡتِهِۦ مُؤۡمِنࣰا قَدۡ عَمِلَ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فَأُو۟لَـٰۤىِٕكَ لَهُمُ ٱلدَّرَجَـٰتُ ٱلۡعُلَىٰ جَنَّـٰتُ عَدۡنࣲ تَجۡرِی مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَـٰرُ خَـٰلِدِینَ فِیهَاۚ وَذَ ٰلِكَ جَزَاۤءُ مَن تَزَكَّىٰ[Surat Ta-Ha ৭৫ – ৭৬]
অর্থাৎ- যারা তাঁর নিকট উপস্থিত হবে মু’মিন অবস্থায় সৎকর্ম সম্পাদন করে তাদের জন্যে রয়েছে সমুচ্চ মর্যাদা স্থায়ী জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এই পুরস্কার তাদেরই যারা পবিত্র।‘ (সূরা তা-হাঃ ৭৫-৭৬)
সুতরাং তুমি এ দলের অন্তর্ভুক্ত হও। কিন্তু ফিরআউন ও তার আমলের মধ্যে ভাগ্যলিপি অন্তরায় হল- যা ছিল অখণ্ডনীয় ও অপরিবর্তনীয়। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলা তার দুষ্কর্মের জন্য আদেশ দিলেন যে, “অভিশপ্ত ফিরআউন জাহান্নামী, সে মর্মন্তুদ শাস্তি ভোগ করবে, তার মাথার উপর গরম পানি ঢালা হবে এবং তাকে অপমানিত, লাঞ্ছিত ও তিরস্কৃত করার উদ্দেশ্যে বলা হবে -জাহান্নামের আযাব আস্বাদন কর, তুমি তো ছিলে সম্মানিত অভিজাত।” (সূরা দুখানঃ ৪৯)।
উপরোক্ত আয়াতসমূহের পূর্বাপর দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ফিরআউন মু’মিন জাদুকরদের শূলবিদ্ধ করেছিল ও তাদের মর্মন্তুদ শাস্তি দিয়েছিল। আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস ও উবায়দ ইবন উমায়র (رضي الله عنه) বলেন, তারা দিনের প্রথম অংশে ছিলেন জাদুকর। আর দিনের শেষাংশে পুণ্যবান শহীদ হিসেবে পরিগণিত হলেন। উপরোক্ত উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে মুমিন জাদুকরদের নিম্নোক্ত মুনাজাতে।
( رَبَّنَاۤ أَفۡرِغۡ عَلَیۡنَا صَبۡرࣰا وَتَوَفَّنَا مُسۡلِمِینَ)
অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্যদান কর এবং মুসলিমরূপে আমাদের মৃত্যু ঘটাও!’
❏ পরিচ্ছেদ
এ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি যখন ঘটে গেল— কিবতীরা যখন এই তুমুল প্রতিযোগিতায় পরাজয়বরণ করল; জাদুকরগণ মূসা (عليه السلام)-এর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন ও নিজেদের প্রতিপালকের সাহায্যপ্রার্থী হলেন; তখন কিবতীদের কুফরী, হঠকারিতা ও সত্য বিমুখতাই কেবল বৃদ্ধি পেল।
আল্লাহ তা’আলা সূরায়ে আ’রাফে তাদের কথা বর্ণনা করে ইরশাদ করেনঃ
وَقَالَ ٱلۡمَلَأُ مِن قَوۡمِ فِرۡعَوۡنَ أَتَذَرُ مُوسَىٰ وَقَوۡمَهُۥ لِیُفۡسِدُوا۟ فِی ٱلۡأَرۡضِ وَیَذَرَكَ وَءَالِهَتَكَۚ قَالَ سَنُقَتِّلُ أَبۡنَاۤءَهُمۡ وَنَسۡتَحۡیِۦ نِسَاۤءَهُمۡ وَإِنَّا فَوۡقَهُمۡ قَـٰهِرُونَ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِ ٱسۡتَعِینُوا۟ بِٱللَّهِ وَٱصۡبِرُوۤا۟ۖ إِنَّ ٱلۡأَرۡضَ لِلَّهِ یُورِثُهَا مَن یَشَاۤءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۖ وَٱلۡعَـٰقِبَةُ لِلۡمُتَّقِینَ قَالُوۤا۟ أُوذِینَا مِن قَبۡلِ أَن تَأۡتِیَنَا وَمِنۢ بَعۡدِ مَا جِئۡتَنَاۚ قَالَ عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن یُهۡلِكَ عَدُوَّكُمۡ وَیَسۡتَخۡلِفَكُمۡ فِی ٱلۡأَرۡضِ فَیَنظُرَ كَیۡفَ تَعۡمَلُونَ[Surat Al-A'raf ১২৭ - ১২৯]
অর্থাৎ—-ফিরআউনের সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলল, “আপনি কি মূসাকে ও তার সম্প্রদায়কে রাজ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে এবং আপনাকে ও আপনার দেবতাগণকে বর্জন করতে দেবেন?’ সে বলল, ‘আমরা তাদের পুত্রদেরকে হত্যা করব এবং তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখব; আর আমরা তো তাদের উপর প্রবল।’ মূসা তাঁর সম্প্রদায়কে বলল, ‘আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর এবং ধৈর্য ধারণ কর। যমীন তো আল্লাহরই; তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছে এটার উত্তরাধিকারী করেন এবং শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্য।’ তারা বলল, ‘আমাদের নিকট তোমার আসার পূর্বে আমরা নির্যাতিত হয়েছি এবং তোমার আসার পরেও।‘ সে বলল, ‘শীঘ্রই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্রু ধ্বংস করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে যমীনে তাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন; তারপর তোমরা কি কর তা তিনি লক্ষ্য করবেন।’ (সূরা আরাফঃ ১২৭-১২৯)।
এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ফিরআউনের সম্প্রদায় সম্পর্কে জানাচ্ছেন যে, তারা ছিল ফিরআউনের পারিষদবর্গ ও গোত্রপ্রধান। তারা তাদের বাদশাহ ফিরআউনকে আল্লাহর নবী মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি অত্যাচার, অবিচার ও জুলুম করার এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে প্ররোচিত করেছিল। তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করার পরিবর্তে তারা তাকে প্রত্যাখ্যান, নির্যাতন এবং অগ্রাহ্য করছিল।
তারা বললঃ
( أَتَذَرُ مُوسَىٰ وَقَوۡمَهُۥ لِیُفۡسِدُوا۟ فِی ٱلۡأَرۡضِ وَیَذَرَكَ وَءَالِهَتَكَۚ )
[Surat Al-A'raf ১২৭]
অর্থাৎ, আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে রাজ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে এবং আপনাকে ও আপনার দেবতাগণকে বর্জন করতে দেবেন?’ (আ’রাফঃ ১২৭) একক লা-শরীক আল্লাহ তা’আলার ইবাদতের প্রতি আহ্বান করা এবং আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্যের ইবাদত থেকে নিষেধ করাকে তারা বিপর্যয় সৃষ্টি বলে আখ্যায়িত করেছে। আবার কেউ কেউ বলেন, ‘আয়াতাংশের অর্থ হচ্ছে, আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে রাজ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে এবং আপনাকে ও আপনার ইবাদতকে বর্জন করতে দেবেন?’ দু’টি অর্থেরই এখানে সম্ভাবনা রয়েছে। তার একটি হচ্ছে, সে আপনার ধর্মকে বর্জন করে চলে আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সে আপনার ইবাদত বর্জন করে। শেষোক্ত সম্ভাবনাটির কথা এজন্যই বলা হয়ে থাকে যে, তারা তাকে উপাস্য বলেও ধারণা করত। তার প্রতি আল্লাহর লানত।
সে (ফিরআউন) বলল, ‘আমরা তাদের পুত্রদের হত্যা করব এবং নারীদেরকে জীবিত রাখব’ অর্থাৎ যাতে তাদের মধ্যে যোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে না পারে। আমরা তাদের উপর সর্বদা প্রভাবশালী থাকব।‘ অর্থাৎ বিজয়ীরূপে থাকব। তখন মূসা (عليه السلام) তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, আল্লাহ তাআলার নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর এবং ধৈর্যধারণ কর।‘ অর্থাৎ যখন তারা তোমাদেরকে দুঃখ-কষ্ট দিতে উদ্যত, তখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে সাহায্যের প্রার্থনা কর এবং তোমাদের দুঃখ-কষ্টে তোমরা ধৈর্যধারণ কর। জেনে রেখো, এই পৃথিবীর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা’আলা, তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্য হতে যাকে চান এই পৃথিবীর উত্তরাধিকারী করেন। তবে শেষ শুভ পরিণতি মুত্তাকীদের জন্যেই। সুতরাং তোমরা মুত্তাকী হতে সচেষ্ট হও যাতে তোমাদের পরিণাম শুভ হয়।
যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেনঃ
(وَقَالَ مُوسَىٰ یَـٰقَوۡمِ إِن كُنتُمۡ ءَامَنتُم بِٱللَّهِ فَعَلَیۡهِ تَوَكَّلُوۤا۟ إِن كُنتُم مُّسۡلِمِینَ فَقَالُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ تَوَكَّلۡنَا رَبَّنَا لَا تَجۡعَلۡنَا فِتۡنَةࣰ لِّلۡقَوۡمِ ٱلظَّـٰلِمِینَ وَنَجِّنَا بِرَحۡمَتِكَ مِنَ ٱلۡقَوۡمِ ٱلۡكَـٰفِرِینَ)
[Surat Yunus ৮৪ - ৮৬]
অর্থাৎ, মূসা (عليه السلام) বলেছিল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! যদি তোমরা আল্লাহতে ঈমান এনে থাক, যদি তোমরা আত্মসমর্পণকারী হও তবে তোমরা তাঁরই উপর নির্ভর কর।’ তারপর তারা বলল, ‘আমরা আল্লাহর উপর নির্ভর করলাম। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে জালিম সম্প্রদায়ের উৎপীড়নের পাত্র করো না এবং আমাদেরকে তোমার অনুগ্রহে কাফির সম্প্রদায় হতে রক্ষা কর!’ (সূরা ইউনুসঃ ৮৪-৮৬)
আয়াতাংশ (قَالُوۤا۟ أُوذِینَا مِن قَبۡلِ أَن تَأۡتِیَنَا وَمِنۢ بَعۡدِ مَا جِئۡتَنَاۚ ) -এর অর্থ হচ্ছে, হে মূসা! তোমার আগমনের পূর্বে আমাদের পুত্র-সন্তানদের হত্যা করা হতো এবং তোমার আগমনের পরেও আমাদের পুত্র-সন্তানদের হত্যা করা হচ্ছে। মূসা (عليه السلام) তাদেরকে বললেন, ‘অতি শীঘ্রই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্রুকে ধ্বংস করে দেবেন এবং তোমাদেরকে যমীনে তাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন।’
আল্লাহ তা’আলা সূরা মু’মিনে ইরশাদ করেনঃ
وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا مُوسَىٰ بِـَٔایَـٰتِنَا وَسُلۡطَـٰنࣲ مُّبِینٍ إِلَىٰ فِرۡعَوۡنَ وَهَـٰمَـٰنَ وَقَـٰرُونَ فَقَالُوا۟ سَـٰحِرࣱ كَذَّابࣱ[Surat Ghafir ২৩ - ২৪]
অর্থাৎ—আমি আমার নিদর্শন ও স্পষ্ট প্রমাণসহ মূসা (عليه السلام)-কে প্রেরণ করেছিলাম ফিরআউন, হামান ও কারুণের নিকট কিন্তু তারা বলেছিল, এতো এক জাদুকর, চরম মিথ্যাবাদী।‘ (সূরা মুমিনঃ ২৩-২৪)
ফিরআউন ছিল রাজা, হামান ছিল তার মন্ত্রী এবং কারুণ ছিল মূসা (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের একজন ইহুদী কিন্তু সে ছিল ফিরআউন ও তার অমাত্যদের ধর্মের অনুসারী, সে ছিল প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক। তার ঘটনা পরে সবিস্তারে বর্ণনা করা হবে।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা উল্লেখ করেনঃ
فَلَمَّا جَاۤءَهُم بِٱلۡحَقِّ مِنۡ عِندِنَا قَالُوا۟ ٱقۡتُلُوۤا۟ أَبۡنَاۤءَ ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ مَعَهُۥ وَٱسۡتَحۡیُوا۟ نِسَاۤءَهُمۡۚ وَمَا كَیۡدُ ٱلۡكَـٰفِرِینَ إِلَّا فِی ضَلَـٰلࣲ[Surat Ghafir ২৫]
অর্থাৎ—অতঃপর মূসা আমার নিকট থেকে সত্য নিয়ে তাদের নিকট উপস্থিত হলে তারা বলল, মূসার সাথে যারা ঈমান আনয়ন করেছে, তাদের পুত্রদের হত্যা কর এবং তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখ। কিন্তু কাফিরদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবেই। (সূরা মুমিনঃ ২৫)
মূসা (عليه السلام)-এর নবুওত প্রাপ্তির পর পুরুষদের হত্যার উদ্দেশ্য ছিল, বনী ইসরাঈলকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা এবং তাদের কর্মক্ষমদের সংখ্যা হ্রাস করা যাতে তাদের শান-শওকত লোপ পেয়ে যায় এবং তাদের কোন প্রতিপত্তিই অবশিষ্ট না থাকে। আর তারা যেন কিবতীদের বিরুদ্ধে কোন সময় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে এবং কিবতীদেরকে তারা প্রতিহত না করতে পারে। অন্যদিকে কিবতীরা অবশ্য তাদেরকে যমের মত ভয় করত। তবে এতে তাদের কোন লাভ হয়নি এবং তাদের ভাগ্যলিপি যা আল্লাহ তা’আলার মহাহুকুম كن এর মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে তা তারা রদ করতে পারেনি।
ফিরআউন বলতে লাগলঃ
(وَقَالَ فِرۡعَوۡنُ ذَرُونِیۤ أَقۡتُلۡ مُوسَىٰ وَلۡیَدۡعُ رَبَّهُۥۤۖ إِنِّیۤ أَخَافُ أَن یُبَدِّلَ دِینَكُمۡ أَوۡ أَن یُظۡهِرَ فِی ٱلۡأَرۡضِ ٱلۡفَسَادَ)[Surat Ghafir ২৬]
অর্থাৎ—“আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মূসাকে হত্যা করি এবং সে তার প্রতিপালকের শরণাপন্ন হউক। আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের দীনের পরিবর্তন ঘটাবে অথবা সে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।” (সূরা মুমিনঃ ২৬)
এ জন্যই জনগণ ঠাট্টার ছলে বলত, ‘ফিরআউন নির্দেশদাতা হয়ে গেছে।‘ কেননা ফিরআউন তার ধারণায় জনগণকে ভয় দেখাত যেন মূসা (عليه السلام) তাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে না পারে। আল্লাহ বলেনঃ
(وَقَالَ مُوسَىٰۤ إِنِّی عُذۡتُ بِرَبِّی وَرَبِّكُم مِّن كُلِّ مُتَكَبِّرࣲ لَّا یُؤۡمِنُ بِیَوۡمِ ٱلۡحِسَابِ)
[Surat Ghafir ২৭]
অর্থাৎ—মূসা বলল, যারা বিচার দিবসে বিশ্বাস করে না, সেই সকল উদ্ধত ব্যক্তি থেকে আমি আমার ও তোমাদের প্রতিপালকের শরণাপন্ন হয়েছি। (সূরা মুমিনঃ ২৭)
অর্থাৎ আমি আল্লাহ তা’আলার শাহী দরবারের শরণাপন্ন হচ্ছি যাতে ফিরআউন ও অন্যরা আমার প্রতি অনিষ্টের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করতে না পারে, তারা এতই উদ্ধত যে, তারা আমার প্রতি কোনরূপ ভ্রুক্ষেপই করে না এবং আল্লাহ তা’আলার আযাব ও গযবকে ভয় করে না; কেননা তারা আখিরাতে ও হিসাব-নিকাশে বিশ্বাস রাখে না।
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(وَقَالَ رَجُلࣱ مُّؤۡمِنࣱ مِّنۡ ءَالِ فِرۡعَوۡنَ یَكۡتُمُ إِیمَـٰنَهُۥۤ أَتَقۡتُلُونَ رَجُلًا أَن یَقُولَ رَبِّیَ ٱللَّهُ وَقَدۡ جَاۤءَكُم بِٱلۡبَیِّنَـٰتِ مِن رَّبِّكُمۡۖ وَإِن یَكُ كَـٰذِبࣰا فَعَلَیۡهِ كَذِبُهُۥۖ وَإِن یَكُ صَادِقࣰا یُصِبۡكُم بَعۡضُ ٱلَّذِی یَعِدُكُمۡۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا یَهۡدِی مَنۡ هُوَ مُسۡرِفࣱ كَذَّابࣱ یَـٰقَوۡمِ لَكُمُ ٱلۡمُلۡكُ ٱلۡیَوۡمَ ظَـٰهِرِینَ فِی ٱلۡأَرۡضِ فَمَن یَنصُرُنَا مِنۢ بَأۡسِ ٱللَّهِ إِن جَاۤءَنَاۚ قَالَ فِرۡعَوۡنُ مَاۤ أُرِیكُمۡ إِلَّا مَاۤ أَرَىٰ وَمَاۤ أَهۡدِیكُمۡ إِلَّا سَبِیلَ ٱلرَّشَادِ)
[Surat Ghafir ২৮ - ২৯]
অর্থাৎ——ফিরআউন বংশের এক ব্যক্তি যে মু’মিন ছিল এবং নিজ ঈমান গোপন রাখত; বললেন, তোমরা কি এক ব্যক্তিকে এ জন্য হত্যা করবে যে, সে বলে, ‘আমার প্রতিপালক আল্লাহ, অথচ সে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ তোমাদের নিকট এসেছে? সে মিথ্যাবাদী হলে তার মিথ্যাবাদিতার জন্যে সে দায়ী হবে আর যদি সে সত্যবাদী হয়, সে তোমাদেরকে যে শাস্তির কথা বলে, তার কিছু তো তোমাদের উপর আপতিত হবেই। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সৎপথে পরিচালিত করেন না। হে আমার সম্প্রদায়! আজ কর্তৃত্ব তোমাদের দেশে তোমরাই প্রবল; কিন্তু আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি এসে পড়লে কে আমাদেরকে সাহায্য করবে?’ ফিরআউন বলল, “আমি যা বুঝি আমি তোমাদের তাই বলছি। আমি তোমাদের কেবল সৎপথই দেখিয়ে থাকি।‘ (সূরা মুমিন ২৮-২৯)
উপরোক্ত ব্যক্তিটি ফিরআউনের চাচাতো ভাই ছিল। সে তার সম্প্রদায়ের কাছে ঈমান গোপন রাখত। কেননা, সে তাদের তরফ থেকে তার জীবন নাশের ভয় করত। কেউ কেউ বলেন, এ লোকটি ছিল ইসরাঈলী। এই অভিমতটি শুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ এবং পূর্বাপরের সাথে শব্দ ও অর্থের দিক দিয়ে তার কোন মিল নেই। আল্লাহ তা’আলাই অধিক জ্ঞাত।
ইবন জুরায়জ (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর বরাতে বলেন, এই লোকটি এবং যে লোকটি শহরের শেষ প্রান্ত থেকে এসেছিলেন তিনি এবং ফিরআউনের স্ত্রী ব্যতীত কিবতীদের মধ্যকার অন্য কেউ মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন করেনি। বর্ণনাটি ইবন হাতিমের। দারাকুতনী (رحمة الله) বলেছেন, শাম আন নামে ফিরআউন বংশের উক্ত মুমিন ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো কথা জানা যায় না। সুহাইলী এরূপ বর্ণনা করেছেন। তাবারানী (رحمة الله) তার ইতিহাস গ্রন্থে তার নাম খাইর বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলাই অধিকতর জ্ঞাত। মূলত এই ব্যক্তিটি তার ঈমান গোপন রেখেছিলেন। যখন ফিরআউন মূসা (عليه السلام)-কে হত্যা করার ইচ্ছে করল এবং এই ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প হল, তখন সে তার আমীরদের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করল। মুমিন বান্দাটি মূসা (عليه السلام)-এর ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তাই তিনি ফিরআউনকে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভয়ভীতিপূর্ণ কথাবার্তা দ্বারা সুকৌশলে এ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলেন। তিনি তাকে সৎপরামর্শ স্বরূপ এবং যাতে সেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এ জন্য তার সাথে কথা বললেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে হাদীস বর্ণিত রয়েছে। তিনি বলেছেনঃ
افضل الجهاد كلمة عدل عند سلطان جائر.
অর্থাৎ—‘অত্যাচারী শাসকের সম্মুখে ন্যায় কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ।‘ আর এখানে এটার মর্যাদা আরো অধিক। কেননা, ফিরআউন ছিল সর্বাধিক অত্যাচারী। আর মুমিন বান্দার বক্তব্য ছিল অত্যধিক ন্যায়ভিত্তিক। কেননা, এর উদ্দেশ্য ছিল নবীকে নিরাপদ রাখা। আবার এটাও সম্ভাবনা রয়েছে যে, তিনি তাদের কাছে নিজের গোপন ঈমানকে প্রকাশ করতেই চেয়েছিলেন। তবে প্রথম সম্ভাবনাই অধিকতর স্পষ্ট। আল্লাহ তাআলাই সম্যক জ্ঞাত। তিনি বললেন, “হে ফিরআউন! আপনি কি এমন একটি লোককে হত্যা করতে যাচ্ছেন যে বলে যে, তার প্রতিপালক আল্লাহ তাআলা! এ ধরনের কথা বা দাবির প্রতিশোধ অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা হয় না। এ ধরনের কথা যারা বলেন বা স্বীকার করেন তাদের সম্মান ও ইজ্জত করতে হয়; তাদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করতে হয়। তাদের কোন কাজের প্রতিশোধ নিতে হয় না। কেননা, তিনি আপনাদের কাছে আপন প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট নিদর্শন তথা মুজিযা নিয়ে এসেছেন; যা তার সত্যতা প্রমাণ করে। কাজেই যদি আপনারা তাকে তার কাজ চালিয়ে যেতে দেন তাহলে আপনারা নিরাপদ থাকবেন। কেননা, যদি তিনি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকেন, তাহলে এই মিথ্যার দায়দায়িত্ব তার উপরেই বর্তাবে; এতে আপনাদের কোন ক্ষতি হবার আশংকা একেবারেই নেই। আর যদি তিনি সত্যবাদী হয়ে থাকেন (আর আসলেও তাই) এবং আপনারা তাঁর বিরোধিতা করেন, তাহলে আপনাদের উপর ঐসব মুসীবতের কিয়দংশ অবতীর্ণ হবে যেগুলো আপনাদের উপর অবতীর্ণ হবে বলে তিনি সতর্ক করছেন। আপনারা ঐসব আযাবের কিয়দংশ অবতীর্ণ হওয়ার আশংকায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। আর যদি ঐসব শাস্তির সবগুলো অবতীর্ণ হয় তাহলে আপনাদের অবস্থা কিরূপ হবে? সেই অবস্থায় ফিরআউনের প্রতি মুমিন বান্দার এরূপ উপদেশ প্রদান তার উচ্চমার্গের বুদ্ধিমত্তা, কর্মকুশলতা ও সতর্কতার পরিচায়ক।
অতঃপর তাঁর উক্তিঃ یَـٰقَوۡمِ لَكُمُ ٱلۡمُلۡكُ ٱلۡیَوۡمَ ظَـٰهِرِینَ فِی ٱلۡأَرۡضِ দ্বারা তিনি তার সম্প্রদায়ের লোকজনদের সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, তাদের এই প্রাণপ্রিয় রাজ্য শীঘ্রই হরণ করে নেয়া হবে। কেননা, যে কোন বাদশাহ বা রাজা যদি ধর্মের বিরোধিতা করে তাহলে তাদের রাজ্য হরণ করে নেয়া হয় এবং তাদেরকে সম্মান প্রদানের পর লাঞ্ছিত করা হয় যা ফিরআউনের সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে ঘটেছে।
অতঃপর মূসা (عليه السلام) যা কিছু নিয়ে এসেছিলেন এ সম্পর্কে ফিরআউনের অনুসারীরা সন্দেহ পোষণ, বিরোধিতা ও বৈরীভাব পোষণ করায় তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা তাদের ঘরবাড়ি, সহায় সম্পদ, বিত্তবৈভব, রাজত্ব ও সৌভাগ্য থেকে বহিষ্কার করলেন এবং লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে তাদেরকে সাগরের দিকে ঠেলে দেয়া হলো; আর তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দানের পর তাদের কর্মফলের দরুন তাদের রূহসমূহকে হীনতাগ্রস্তদের হীনতম পর্যায়ে অধঃপতিত করা হয়। এ জন্যই প্রাজ্ঞ, আপন সম্প্রদায়ের পরম শুভাকাক্ষী সত্যের অনুসারী, সত্যবাদী, পুণ্যবান ও হিদায়াত প্রাপ্ত মুমিন বান্দাটি বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! আজ কর্তৃত্ব তোমাদের, জনগণের মধ্যে তোমরা অধিক মর্যাদাসম্পন্ন এবং তাদের উপর তোমরা শাসন চালিয়ে যাচ্ছ, তোমরা সংখ্যায়, সামর্থ্যে, শক্তিতে ও দৃঢ়তায় যদি বর্তমানের চেয়ে অধিক গুণে প্রতিপত্তি অর্জন করতে পার তাহলেও এটা আমাদের কোন উপকারে আসবে না এবং আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ তাআলার আযাবকে আমাদের থেকে প্রতিহত করতে পারবে না।‘ জবাবে ফিরআউন বলল, ‘আমি যা বুঝি, আমি তাই তোমাদের বলছি; আমি তোমাদের কেবল সৎপথই প্রদর্শন করে থাকি।’ উপরোক্ত দুটি বাক্যেই ফিরআউন ছিল মিথ্যাবাদী। কেননা, অন্তরের অন্তস্থল থেকে সে উপলব্ধি করত যে, মূসা (عليه السلام)-এর আনীত বিষয়াদি নিশ্চিতভাবে আল্লাহ তাআলার তরফ থেকেই। তবে সে হঠকারিতা, শত্রুতা, সীমালংঘন ও কুফরীর কারণে মুখে এর বিপরীত প্রকাশ করত।
আল্লাহ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-এর উক্তির বিবরণ দিয়ে ইরশাদ করেনঃ
(قَالَ لَقَدۡ عَلِمۡتَ مَاۤ أَنزَلَ هَـٰۤؤُلَاۤءِ إِلَّا رَبُّ ٱلسَّمَـٰوَ ٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ بَصَاۤىِٕرَ وَإِنِّی لَأَظُنُّكَ یَـٰفِرۡعَوۡنُ مَثۡبُورࣰا فَأَرَادَ أَن یَسۡتَفِزَّهُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ فَأَغۡرَقۡنَـٰهُ وَمَن مَّعَهُۥ جَمِیعࣰا وَقُلۡنَا مِنۢ بَعۡدِهِۦ لِبَنِیۤ إِسۡرَ ٰۤءِیلَ ٱسۡكُنُوا۟ ٱلۡأَرۡضَ فَإِذَا جَاۤءَ وَعۡدُ ٱلۡـَٔاخِرَةِ جِئۡنَا بِكُمۡ لَفِیفࣰا وَبِٱلۡحَقِّ أَنزَلۡنَـٰهُ وَبِٱلۡحَقِّ نَزَلَۗ وَمَاۤ أَرۡسَلۡنَـٰكَ إِلَّا مُبَشِّرࣰا وَنَذِیرࣰا)[Surat Al-Isra' ১০২ - ১০৫]
অর্থাৎ-“তুমি অবশ্যই অবগত আছ যে, এ সমস্ত স্পষ্ট নিদর্শন, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালকই অবতীর্ণ করেছেন প্রত্যক্ষ প্রমাণস্বরূপ। হে ফিরআউন! আমি তো দেখছি তোমার ধ্বংস আসন্ন। তারপর ফিরআউন তাদেরকে দেশ হতে উচ্ছেদ করার সংকল্প করল, তখন আমি ফিরআউন ও তার সঙ্গীদের সকলকে ডুবিয়ে দিলাম। এরপর আমি বনী ইসরাঈলকে বললাম, তোমরা যমীনে বসবাস কর এবং যখন কিয়ামতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে তখন তোমাদের সকলকে আমি একত্র করে উপস্থিত করব।” (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১০২-১০৪)
অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(فَلَمَّا جَاۤءَتۡهُمۡ ءَایَـٰتُنَا مُبۡصِرَةࣰ قَالُوا۟ هَـٰذَا سِحۡرࣱ مُّبِینࣱ وَجَحَدُوا۟ بِهَا وَٱسۡتَیۡقَنَتۡهَاۤ أَنفُسُهُمۡ ظُلۡمࣰا وَعُلُوࣰّاۚ فَٱنظُرۡ كَیۡفَ كَانَ عَـٰقِبَةُ ٱلۡمُفۡسِدِینَ)[Surat An-Naml ১৩ - ১৪]
অর্থাৎ, তারপর যখন তাদের নিকট আমার স্পষ্ট নিদর্শন আসল তারা বলল, ‘এটা স্পষ্ট জাদু।’ তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করল যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিল। দেখ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছিল। (সূরা নামলঃ ১৩-১৪)
আয়াতাংশে বর্ণিত ফিরআউনের উক্তি ( وَمَاۤ أَهۡدِیكُمۡ إِلَّا سَبِیلَ ٱلرَّشَادِ) অর্থাৎ—“আমি তোমাদেরকে কেবল সৎপথই প্রদর্শন করে থাকি।” এতেও সে মিথ্যা কথা বলেছে। কেননা, সে সঠিক রাস্তায় ছিল না, সে ছিল পথভ্রষ্টতা, নির্বুদ্ধিতা ও সন্ত্রাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। সে প্রথমত নিজে দেবদেবী ও মূর্তিদের পূজা করে। অতঃপর তার মূর্খ ও পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়কে তার অনুকরণ ও অনুসরণ করতে এবং সে যে নিজেকে রব’ বলে দাবি করেছিল এ ব্যাপারে তাকে সত্য বলে স্বীকার করার জন্যে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(وَنَادَىٰ فِرۡعَوۡنُ فِی قَوۡمِهِۦ قَالَ یَـٰقَوۡمِ أَلَیۡسَ لِی مُلۡكُ مِصۡرَ وَهَـٰذِهِ ٱلۡأَنۡهَـٰرُ تَجۡرِی مِن تَحۡتِیۤۚ أَفَلَا تُبۡصِرُونَ أَمۡ أَنَا۠ خَیۡرࣱ مِّنۡ هَـٰذَا ٱلَّذِی هُوَ مَهِینࣱ وَلَا یَكَادُ یُبِینُ فَلَوۡلَاۤ أُلۡقِیَ عَلَیۡهِ أَسۡوِرَةࣱ مِّن ذَهَبٍ أَوۡ جَاۤءَ مَعَهُ ٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةُ مُقۡتَرِنِینَ فَٱسۡتَخَفَّ قَوۡمَهُۥ فَأَطَاعُوهُۚ إِنَّهُمۡ كَانُوا۟ قَوۡمࣰا فَـٰسِقِینَ فَلَمَّاۤ ءَاسَفُونَا ٱنتَقَمۡنَا مِنۡهُمۡ فَأَغۡرَقۡنَـٰهُمۡ أَجۡمَعِینَ فَجَعَلۡنَـٰهُمۡ سَلَفࣰا وَمَثَلࣰا لِّلۡـَٔاخِرِینَ)
[Surat Az-Zukhruf ৫১ - ৫৬]
অর্থাৎ—ফিরআউন তার সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বলে ঘোষণা করল, ‘হে আমার সম্প্রদায় মিসর রাজ্য কি আমার নয়? এ নদীগুলো আমার পাদদেশে প্রবাহিত, তোমরা এটা দেখ না? আমি তো শ্রেষ্ঠ এই ব্যক্তি থেকে, যে হীন এবং স্পষ্ট কথা বলতেও অক্ষম। মূসাকে কেন দেয়া হল না স্বর্ণবলয় অথবা তার সাথে কেন আসল না ফেরেশতাগণ দলবদ্ধভাবে?’ এভাবে সে তার সম্প্রদায়কে হতবুদ্ধি করে দিল, ফলে ওরা তার কথা মেনে নিল। ওরা তো ছিল এক সত্যত্যাগী সম্প্রদায়। যখন ওরা আমাকে ক্রোধান্বিত করল আমি তাদেরকে শাস্তি দিলাম এবং নিমজ্জিত করলাম ওদের সকলকে। তৎপর পরবর্তীদের জন্যে আমি ওদেরকে করে রাখলাম অতীত ইতিহাস ও দৃষ্টান্ত। (৪৩ যুখরুফঃ ৫১-৫৬)
আল্লাহ তা’আলা আরও ইরশাদ করেনঃ
(فَأَرَىٰهُ ٱلۡـَٔایَةَ ٱلۡكُبۡرَىٰ فَكَذَّبَ وَعَصَىٰ ثُمَّ أَدۡبَرَ یَسۡعَىٰ فَحَشَرَ فَنَادَىٰ فَقَالَ أَنَا۠ رَبُّكُمُ ٱلۡأَعۡلَىٰ فَأَخَذَهُ ٱللَّهُ نَكَالَ ٱلۡـَٔاخِرَةِ وَٱلۡأُولَىٰۤ إِنَّ فِی ذَ ٰلِكَ لَعِبۡرَةࣰ لِّمَن یَخۡشَىٰۤ)
[Surat An-Nazi'at ২০ - ২৬]
অর্থাৎ—অতঃপর মূসা ওকে (ফিরআউনকে) মহা নিদর্শন দেখাল। কিন্তু সে অস্বীকার করল এবং অবাধ্য হল। তারপর সে পেছন ফিরে প্রতিবিধানে সচেষ্ট হল। সে সকলকে সমবেত করল এবং উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করল আর বলল, ‘আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক।‘ তারপর আল্লাহ তাকে আখিরাতে ও দুনিয়ায় কঠিন শাস্তিতে পাকড়াও করলেন। যে ভয় করে তার জন্য অবশ্যই এটাতে শিক্ষা রয়েছে। (সূরা নাযিআতঃ ২০-২৬)
আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেনঃ
(وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا مُوسَىٰ بِـَٔایَـٰتِنَا وَسُلۡطَـٰنࣲ مُّبِینٍ إِلَىٰ فِرۡعَوۡنَ وَمَلَإِی۟هِۦ فَٱتَّبَعُوۤا۟ أَمۡرَ فِرۡعَوۡنَۖ وَمَاۤ أَمۡرُ فِرۡعَوۡنَ بِرَشِیدࣲ یَقۡدُمُ قَوۡمَهُۥ یَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ فَأَوۡرَدَهُمُ ٱلنَّارَۖ وَبِئۡسَ ٱلۡوِرۡدُ ٱلۡمَوۡرُودُ وَأُتۡبِعُوا۟ فِی هَـٰذِهِۦ لَعۡنَةࣰ وَیَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِۚ بِئۡسَ ٱلرِّفۡدُ ٱلۡمَرۡفُودُ)[Surat Hud ৯৬ - ৯৯]
অর্থাৎ—আমি তো মূসাকে আমার নিদর্শনাবলী ও স্পষ্ট প্রমাণসহ পাঠিয়ে ছিলাম ফিরআউন ও তার প্রধানদের নিকট। কিন্তু তারা ফিরআউনের কার্যকলাপের অনুরূপ করত এবং ফিরআউনের কার্যকলাপ ভাল ছিল না। সে কিয়ামতের দিনে তার সম্প্রদায়ের অগ্রভাগে থাকবে এবং সে তাদেরকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করবে। যেখানে প্রবেশ করানো হবে তা কত নিকৃষ্ট স্থান! এ দুনিয়ায় তাদেরকে করা হয়েছিল অভিশাপগ্রস্ত এবং অভিশাপগ্রস্ত হবে তারা কিয়ামতের দিনেও। কত নিকৃষ্ট সে পুরস্কার—যা ওদেরকে দেওয়া হবে। (সূরা হূদঃ ৯৬-৯৯)
ফিরআউনের উক্তি দুটি যে মিথ্যা তার বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(یَـٰقَوۡمِ لَكُمُ ٱلۡمُلۡكُ ٱلۡیَوۡمَ ظَـٰهِرِینَ فِی ٱلۡأَرۡضِ فَمَن یَنصُرُنَا مِنۢ بَأۡسِ ٱللَّهِ إِن جَاۤءَنَاۚ قَالَ فِرۡعَوۡنُ مَاۤ أُرِیكُمۡ إِلَّا مَاۤ أَرَىٰ وَمَاۤ أَهۡدِیكُمۡ إِلَّا سَبِیلَ ٱلرَّشَادِ وَقَالَ ٱلَّذِیۤ ءَامَنَ یَـٰقَوۡمِ إِنِّیۤ أَخَافُ عَلَیۡكُم مِّثۡلَ یَوۡمِ ٱلۡأَحۡزَابِ مِثۡلَ دَأۡبِ قَوۡمِ نُوحࣲ وَعَادࣲ وَثَمُودَ وَٱلَّذِینَ مِنۢ بَعۡدِهِمۡۚ وَمَا ٱللَّهُ یُرِیدُ ظُلۡمࣰا لِّلۡعِبَادِ وَیَـٰقَوۡمِ إِنِّیۤ أَخَافُ عَلَیۡكُمۡ یَوۡمَ ٱلتَّنَادِ یَوۡمَ تُوَلُّونَ مُدۡبِرِینَ مَا لَكُم مِّنَ ٱللَّهِ مِنۡ عَاصِمࣲۗ وَمَن یُضۡلِلِ ٱللَّهُ فَمَا لَهُۥ مِنۡ هَادࣲ وَلَقَدۡ جَاۤءَكُمۡ یُوسُفُ مِن قَبۡلُ بِٱلۡبَیِّنَـٰتِ فَمَا زِلۡتُمۡ فِی شَكࣲّ مِّمَّا جَاۤءَكُم بِهِۦۖ حَتَّىٰۤ إِذَا هَلَكَ قُلۡتُمۡ لَن یَبۡعَثَ ٱللَّهُ مِنۢ بَعۡدِهِۦ رَسُولࣰاۚ كَذَ ٰلِكَ یُضِلُّ ٱللَّهُ مَنۡ هُوَ مُسۡرِفࣱ مُّرۡتَابٌ ٱلَّذِینَ یُجَـٰدِلُونَ فِیۤ ءَایَـٰتِ ٱللَّهِ بِغَیۡرِ سُلۡطَـٰنٍ أَتَىٰهُمۡۖ كَبُرَ مَقۡتًا عِندَ ٱللَّهِ وَعِندَ ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ۚ كَذَ ٰلِكَ یَطۡبَعُ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ قَلۡبِ مُتَكَبِّرࣲ جَبَّارࣲ)[Surat Ghafir ২৯ - ৩৫]
অর্থাৎ—ফিরাউন বলল, আমি যা বুঝি, আমি তোমাদের তাই বলছি। আমি তোমাদের কেবল সৎপথই দেখিয়ে থাকি। মুমিন ব্যক্তিটি বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্য পূর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহের শাস্তির দিনের অনুরূপ দুর্দিনের আশংকা করি। যেমন ঘটেছিল নূহ, আদ, ছামূদ ও তাদের পূর্ববর্তীদের ব্যাপারে। আল্লাহ তো বান্দাদের প্রতি কোন জুলুম করতে চান না। হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্য আশংকা করি আর্তনাদ দিবসের। যেদিন তোমরা পশ্চাৎ ফিরে পলায়ন করতে চাইবে, আল্লাহর শাস্তি থেকে তোমাদের রক্ষা করার কেউ থাকবে না। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্যে কোন পথপ্রদর্শক নেই। পূর্বেও তোমাদের নিকট ইউসুফ এসেছিল স্পষ্ট নিদর্শনসহ; কিন্তু সে তোমাদের নিকট যা নিয়ে এসেছিল তোমরা তাতে বার বার সন্দেহ পোষণ করতে। পরিশেষে যখন ইউসুফের মৃত্যু হল তখন তোমরা বলেছিলে তার পরে আল্লাহ আর কোন রাসূল প্রেরণ করবেন না। এভাবে আল্লাহ বিভ্রান্ত করেন সীমালংঘনকারী ও সংশয়বাদীদেরকে। যারা নিজেদের নিকট কোন দলীল-প্রমাণ না থাকলেও আল্লাহর নিদর্শন সম্পর্কে বিতণ্ডায় লিপ্ত হয়, তাদের এই কর্ম আল্লাহ এবং মুমিনদের দৃষ্টিতে অতিশয় ঘৃণার্থ। এভাবে আল্লাহ প্রত্যেক উদ্ধত ও স্বৈরাচারী ব্যক্তির হৃদয়ে মোহর মেরে দেন। (সূরা মুমিনঃ ২৯-৩৫)
এমনিভাবে আল্লাহ তাআলার এ ওলী মুমিন বান্দাটি তাদেরকে সতর্ক করে দেন যে, যদি তারা আল্লাহর রাসূল মূসা (عليه السلام)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তাহলে তাদের প্রতি আল্লাহ তা’আলার আযাব ও গযব অবতীর্ণ হবে, যেমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল। তাদের পূর্ববর্তী উম্মত যেমন নূহ (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়, আদ, ছামূদ ও তাদের পরবর্তী যুগের উম্মতদের প্রতি আল্লাহ তাআলার গযব অবতীর্ণ হবার বিষয়টি বিশ্ববাসীর কাছে দলীলাদির দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ছিল। আরও প্রমাণিত ছিল যে, আম্বিয়ায়ে কিরাম যা কিছু নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন তা অস্বীকার করার কারণে তাদের শত্রুদের প্রতি আল্লাহ তা’আলার আযাব ও গযব অবতীর্ণ হয়েছিল এবং তাঁদের অনুসরণ করার কারণে তাঁদের অনুসারীদেরকে আল্লাহ তাআলা নাজাত দিয়েছেন। তিনি তাদেরকে কিয়ামত সম্পর্কে সতর্ক করেন। উক্ত আয়াতে কিয়ামতের দিবসকে يوم التناد বা আহ্বানের দিবস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। উক্ত দিবসে যখন লোকজন ছুটাছুটি করতে থাকবে, তখন তারা যদি সমর্থ হয় তবে একে অন্যকে আহ্বান করবে অথচ এরূপ সুযোগ তাদের হয়ে উঠবে না।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(یَقُولُ ٱلۡإِنسَـٰنُ یَوۡمَىِٕذٍ أَیۡنَ ٱلۡمَفَرُّ كَلَّا لَا وَزَرَ إِلَىٰ رَبِّكَ یَوۡمَىِٕذٍ ٱلۡمُسۡتَقَرُّ)
[Surat Al-Qiyamah ১০ - ১২]
অর্থাৎ—“সেদিন মানুষ বলবে, আজ পালাবার স্থান কোথায়? না, কোন আশ্রয়স্থল নেই। সেদিন ঠাঁই হবে তোমার প্রতিপালকেরই নিকট।” (সূরা কিয়ামাঃ ১০-১২)
পুনরায় আল্লাহ তা’আলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেনঃ
(یَـٰمَعۡشَرَ ٱلۡجِنِّ وَٱلۡإِنسِ إِنِ ٱسۡتَطَعۡتُمۡ أَن تَنفُذُوا۟ مِنۡ أَقۡطَارِ ٱلسَّمَـٰوَ ٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ فَٱنفُذُوا۟ۚ لَا تَنفُذُونَ إِلَّا بِسُلۡطَـٰنࣲ فَبِأَیِّ ءَالَاۤءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ یُرۡسَلُ عَلَیۡكُمَا شُوَاظࣱ مِّن نَّارࣲ وَنُحَاسࣱ فَلَا تَنتَصِرَانِ فَبِأَیِّ ءَالَاۤءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ)[Surat Ar-Rahman ৩৩ - ৩৬]
অর্থাৎ “হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সীমা তোমরা যদি অতিক্রম করতে পার, অতিক্রম কর, কিন্তু তোমরা অতিক্রম করতে পারবে না সনদ ব্যতিরেকে। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? তোমাদের প্রতি প্রেরিত হবে অগ্নিশিখা ও ধূম্রপুঞ্জ, তখন তোমরা প্রতিরোধ করতে পারবে না। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? (সূরা আর-রহমানঃ ৩৩-৩৬)
আয়াতে উল্লিখিত يوم التناد কে কেউ কেউ দালে তাশদীদ দিয়ে পাঠ করেন তখন তার অর্থ يوم الفرار বা পলায়নের দিন। এটা কিয়ামতের দিনও হতে পারে আবার এটার দ্বারা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আযাব-গযব অবতীর্ণ করার দিনও হতে পারে, যেদিন তারা। মুক্তির জন্যে পলায়ন করতে চাইবে, কিন্তু পবিত্রাণের কোনই উপায় থাকবে না। (সাদঃ ৩)
আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ
(فَلَمَّاۤ أَحَسُّوا۟ بَأۡسَنَاۤ إِذَا هُم مِّنۡهَا یَرۡكُضُونَ لَا تَرۡكُضُوا۟ وَٱرۡجِعُوۤا۟ إِلَىٰ مَاۤ أُتۡرِفۡتُمۡ فِیهِ وَمَسَـٰكِنِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تُسۡـَٔلُونَ)[Surat Al-Anbiya' ১২ - ১৩]
অর্থাৎ—অতঃপর যখন ওরা আমার শাস্তি প্রত্যক্ষ করল, তখনই ওরা জনপদ থেকে পলায়ন করতে লাগল। তাদেরকে বলা হয়েছিল পলায়ন কর না এবং ফিরে এস তোমাদের ভোগ সম্ভারের নিকট ও তোমাদের আবাসগৃহে, হয়ত এ বিষয়ে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। (সূরা আম্বিয়াঃ ১২-১৩)
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে মিসর দেশে ইউসুফ (عليه السلام)-এর নবুওত সম্পর্কে সংবাদ দেন। ইউসুফ (عليه السلام)-এর নবুওত জনগণের কাছে তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের জন্যে একটি নিয়ামত ও আল্লাহর অনুগ্রহ ছিল মূসা (عليه السلام) ছিলেন তাঁরই অধঃস্তন বংশধর। তিনি জনগণকে আল্লাহ তা’আলার একত্ববাদ ও ইবাদতের প্রতি আহ্বান করেছিলেন এবং মাখলুকের মধ্য হতে কাউকেও আল্লাহ তা’আলার অংশীদার ধারণা করতে বিরত রাখেন। আল্লাহ তা’আলা ঐ সময়কার মিসরবাসীদের সত্যকে মিথ্যা এবং নবী-রাসূলগণের বিরোধিতা সম্পর্কে সংবাদ দিতে গিয়ে বলেনঃ
(فَمَا زِلۡتُمۡ فِی شَكࣲّ مِّمَّا جَاۤءَكُم بِهِۦۖ حَتَّىٰۤ إِذَا هَلَكَ قُلۡتُمۡ لَن یَبۡعَثَ ٱللَّهُ مِنۢ بَعۡدِهِۦ رَسُولࣰاۚ )
[Surat Ghafir ৩৪]
অর্থাৎ তারা রাসূলকে অস্বীকার করেছিল এ জন্যই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
( كَذَ ٰلِكَ یُضِلُّ ٱللَّهُ مَنۡ هُوَ مُسۡرِفࣱ مُّرۡتَابٌ ٱلَّذِینَ یُجَـٰدِلُونَ فِیۤ ءَایَـٰتِ ٱللَّهِ بِغَیۡرِ سُلۡطَـٰنٍ أَتَىٰهُمۡۖ )[Surat Ghafir ৩৪ – ৩৫]
অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলার তরফ থেকে তাদের কাছে আগত কোন প্রকার দলীল ও প্রমাণ ব্যতীতই তারা আল্লাহ তা’আলার প্রদত্ত খোদায়ী অস্তিত্ব ও একত্ববাদের জন্যে দলীলাদি ও প্রমাণাদি সম্পর্কে বাক-বিতণ্ডা করে। আর জনগণ থেকে এ কাজে যারা লিপ্ত হবে তাদের প্রতি আল্লাহ তা’আলা চরম অসন্তুষ্ট হন।
এ জন্যই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
( كَذَ ٰلِكَ یَطۡبَعُ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ قَلۡبِ مُتَكَبِّرࣲ جَبَّارࣲ)
[Surat Ghafir ৩৫]
অর্থাৎ- এভাবে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক উদ্ধত ও স্বৈরাচারী ব্যক্তির হৃদয়ে মোহর মেরে দেন। অত্র আয়াতাংশে উল্লিখিত مُتَكَبِّرࣲ جَبَّارࣲ এ শব্দ দুটি বিশেষ্য বিশেষণরূপে বা সম্বন্ধ পদ দু ভাবেই পড়া হয়ে থাকে এবং ঐ দুটির অর্থই এমন যে, একটি অপরটির জন্যে অবশ্যম্ভাবী। যদি কোন সময় জনগণের হৃদয়সমূহ সত্যের বিরোধিতা করে তাহলে তা প্রমাণ ব্যতিরেকেই করে থাকে। এ জন্যই আল্লাহ তা’আলা এসব হৃদয়ে মোহর মেরে দেন।
ফিরআউনের ঔদ্ধত্য বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(وَقَالَ فِرۡعَوۡنُ یَـٰهَـٰمَـٰنُ ٱبۡنِ لِی صَرۡحࣰا لَّعَلِّیۤ أَبۡلُغُ ٱلۡأَسۡبَـٰبَ أَسۡبَـٰبَ ٱلسَّمَـٰوَ ٰتِ فَأَطَّلِعَ إِلَىٰۤ إِلَـٰهِ مُوسَىٰ وَإِنِّی لَأَظُنُّهُۥ كَـٰذِبࣰاۚ وَكَذَ ٰلِكَ زُیِّنَ لِفِرۡعَوۡنَ سُوۤءُ عَمَلِهِۦ وَصُدَّ عَنِ ٱلسَّبِیلِۚ وَمَا كَیۡدُ فِرۡعَوۡنَ إِلَّا فِی تَبَابࣲ)[Surat Ghafir ৩৬ - ৩৭]
অর্থাৎ—“ফিরআউন বলল, হে আমান! আমার জন্য তুমি নির্মাণ কর এক সুউচ্চ প্রাসাদ যাতে আমি পাই অবলম্বন—অবলম্বন আসমানে আরোহণের, যেন দেখতে পাই মূসার ইলাহকে; তবে আমি তো ওকে মিথ্যাবাদীই মনে করি। এভাবেই ফিরআউনের নিকট শোভনীয় করা হয়েছিল তার মন্দ কর্ম এবং তাকে নিবৃত্ত করা হয়েছিল সরল পথ থেকে এবং ফিরআউনের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল সম্পূর্ণরূপে।” (সূরা মুমিনঃ ৩৬-৩৭)
অন্য কথায়, মূসা (عليه السلام) দাবি করেছিলেন যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে প্রেরণ করেছেন আর ফিরআউন তাঁকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছিল এবং তার সম্প্রদায়কে সে বলেছিলঃ
( یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡمَلَأُ مَا عَلِمۡتُ لَكُم مِّنۡ إِلَـٰهٍ غَیۡرِی فَأَوۡقِدۡ لِی یَـٰهَـٰمَـٰنُ عَلَى ٱلطِّینِ فَٱجۡعَل لِّی صَرۡحࣰا لَّعَلِّیۤ أَطَّلِعُ إِلَىٰۤ إِلَـٰهِ مُوسَىٰ وَإِنِّی لَأَظُنُّهُۥ مِنَ ٱلۡكَـٰذِبِینَ)[Surat Al-Qasas ৩৮]
“হে পারিষদবর্গ! আমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ আছে বলে আমি জানি না। হে হামান! তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও এবং একটি সুউচ্চ প্রাসাদ তৈরী কর; হয়ত আমি এটাতে উঠে মূসার ইলাহকে দেখতে পাব। তবে, আমি অবশ্য মনে করি, সে মিথ্যাবাদী।” (কাসাসঃ ৩৮)।
সূরায়ে মুমিনের ৩৬ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে, ফিরআউন বলেছিলঃ ( لَّعَلِّیۤ أَبۡلُغُ ٱلۡأَسۡبَـٰبَ أَسۡبَـٰبَ ٱلسَّمَـٰوَ ٰتِ ) অর্থাৎ—যাতে আমি পাই অবলম্বন—অবলম্বন আসমানে আরোহণের অর্থাৎ আসমানে আরোহণের রাস্তা।
অতঃপর ফিরআউন বলেঃ
( فَأَطَّلِعَ إِلَىٰۤ إِلَـٰهِ مُوسَىٰ وَإِنِّی لَأَظُنُّهُۥ كَـٰذِبࣰاۚ )
[Surat Ghafir ৩৭]
অর্থাৎ—“হয়ত এটাতে উঠে আমি মূসার ইলাহকে দেখতে পাব। তবে আমি অবশ্য মনে করি সে মিথ্যাবাদী।” শেষোক্ত আয়াতাংশের দুটি সম্ভাব্য অর্থ রয়েছে একটি হল—ফিরআউন বলল, মূসা যে বলেছে ফিরআউন ব্যতীত জগতের জন্যে অন্য কোন প্রতিপালক আছে, এই কথায় আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি। দ্বিতীয়টি হল—ফিরআউন বলল, মূসা যে বলেছে তাকে আল্লাহ তাআলা রসূলরূপে প্রেরণ করেছেন এই দাবিতে আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি। প্রথম অর্থটি ফিরআউনের অবস্থার প্রেক্ষিতে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়। কেননা, সে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিল। দ্বিতীয় অর্থটি শব্দগতভাবে সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেননা সে বলেছে অর্থাৎ- আমি মূসার ইলাহর কাছে পৌঁছব এবং তাকে জিজ্ঞাসা করবে তিনি মূসাকে নবীরূপে প্রেরণ করেছেন কিনা।
অধিকন্তু তার কথা وإنى لا ظنه كاذبين এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য ছিল লোকজনকে মূসা (عليه السلام) থেকে বিরত রাখা—তারা যেন মূসা (عليه السلام)-কে বিশ্বাস না করে তাই তাকে মিথ্যাবাদী ধারণা করার জন্য ফিরআউন জনগণকে উৎসাহিত করেছিল।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(وَكَذَ ٰلِكَ زُیِّنَ لِفِرۡعَوۡنَ سُوۤءُ عَمَلِهِۦ وَصُدَّ عَنِ ٱلسَّبِیلِۚ )
[Surat Ghafir ৩৭]
আবার صد عن السبيل কে صد عن السبيل রূপেও পড়া হয়ে থাকে। আয়াতাংশ وَمَا كَیۡدُ فِرۡعَوۡنَ إِلَّا فِی تَبَابࣲ এর তাফসীর প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) ও মুজাহিদ (رحمة الله) বলেনঃ الافي تباب-এর অর্থ হচ্ছে الافي خسار অর্থাৎ সে ব্যর্থ হয়েছে এতে তার কোন উদ্দেশ্যই হাসিল হয়নি। কেননা, মানবজাতির জন্য এটা সম্ভব নয় যে, তাদের শক্তি দ্বারা তারা দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে উঠতে পারে, তাহলে তারা কেমন করে উধ্বতর আসমানে কিংবা তারও ঊর্ধ্বের সুউচ্চ আসমানে উঠতে পারবে যার সম্বন্ধে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ জ্ঞাত নন। একাধিক তাফসীরকার উল্লেখ করেছেন যে, এই সুউচ্চ প্রাসাদটি ফিরআউনের মন্ত্রী হামান ফিরআউনের জন্যে নির্মাণ করেছিল। এর চাইতে উচ্চতর প্রাসাদ আর দ্বিতীয়টি দেখতে পাওয়া যায়নি। আর এটা ছিল পোড়ানো ইটের তৈরী। এ জন্যেই ফিরআউন হামানকে বলেছিল, “হে হামান! আমার জন্যে তুমি ইট পোড়াও তারপর এর দ্বারা আমার জন্যে একটি সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ কর।“
কিতাবীদের মতে, বনী ইসরাঈলকে ইট বানাবার কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল এবং তারা ফিরআউনের অনুসারিগণ কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন ধরনের ক্লেশজনক কাজকর্ম আঞ্জাম দিতে বাধ্য হত। তাদেরকে ফিরআউনের জন্য যে সব কাজ করতে বাধ্য করা হত তাতে তাদেরকে কেউ সাহায্য করত না বরং তারা নিজেরাই ফিরআউনের জন্যে মাটি, ভূষি ও পানি সংগ্রহ করত এবং ফিরআউন প্রত্যহ তাদের থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কাজ করিয়ে নিত। তারা যদি তা না করত তাহলে তাদেরকে প্রহার করা হত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হত এবং তাদেরকে চরম কষ্ট দেয়া হত।
এ জন্যই তারা মূসা (عليه السلام)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলঃ
(قَالُوۤا۟ أُوذِینَا مِن قَبۡلِ أَن تَأۡتِیَنَا وَمِنۢ بَعۡدِ مَا جِئۡتَنَاۚ قَالَ عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن یُهۡلِكَ عَدُوَّكُمۡ وَیَسۡتَخۡلِفَكُمۡ فِی ٱلۡأَرۡضِ فَیَنظُرَ كَیۡفَ تَعۡمَلُونَ)[Surat Al-A'raf ১২৯]
অর্থাৎ—“আমাদের নিকট তোমার আসার পূর্বে আমরা নির্যাতিত হয়েছি এবং তোমার আসার পরেও।’ তিনি বললেন, ‘শীঘ্রই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্রুকে ধ্বংস করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে রাজ্যে তাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। অতঃপর তোমরা কি কর তা তিনি লক্ষ্য করবেন।”
এমনি করে মূসা (عليه السلام) তার সম্প্রদায় বনী ইসরাঈলকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, কিবতীদের বিরুদ্ধে পরিণামে তাদেরই জয় হবে। আর কালে এরূপই সংঘটিত হয়েছিল। এটা ছিল নবুওতের সত্যতার একটি প্রমাণ। এখন আমরা আবার মুমিন বান্দার উপদেশ, নসীহত ও যুক্তি-প্রমাণের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(وَقَالَ ٱلَّذِیۤ ءَامَنَ یَـٰقَوۡمِ ٱتَّبِعُونِ أَهۡدِكُمۡ سَبِیلَ ٱلرَّشَادِ یَـٰقَوۡمِ إِنَّمَا هَـٰذِهِ ٱلۡحَیَوٰةُ ٱلدُّنۡیَا مَتَـٰعࣱ وَإِنَّ ٱلۡـَٔاخِرَةَ هِیَ دَارُ ٱلۡقَرَارِ مَنۡ عَمِلَ سَیِّئَةࣰ فَلَا یُجۡزَىٰۤ إِلَّا مِثۡلَهَاۖ وَمَنۡ عَمِلَ صَـٰلِحࣰا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنࣱ فَأُو۟لَـٰۤىِٕكَ یَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ یُرۡزَقُونَ فِیهَا بِغَیۡرِ حِسَابࣲ)
[Surat Ghafir ৩৮ - ৪০]
“মুমিন ব্যক্তিটি বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করব। হে আমার সম্প্রদায়! এই পার্থিব জীবন তো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু এবং আখিরাতই হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস। কেউ মন্দ কাজ করলে সে কেবল তার কর্মের অনুরূপ শাস্তি পাবে এবং পুরুষ কিংবা নারীর মধ্যে যারা মুমিন হয়ে সৎকর্ম করবে তারা দাখিল হবে জান্নাতে, সেখানে তাদেরকে দেয়া হবে অপরিমিত জীবনোপকরণ। (সূরা মুমিনঃ ৩৮-৪০)।
অর্থাৎ মুমিন বান্দাটি তাদেরকে সঠিক ও সত্য পথের দিকে আহ্বান করছেন। আর তা হচ্ছে আল্লাহর নবী মূসা (عليه السلام)-এর অনুসরণ করা এবং তিনি আপন প্রতিপালকের কাছ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সত্য বলে স্বীকার করা। অতঃপর তিনি তাদেরকে নশ্বর ও নিকৃষ্ট দুনিয়ার মোহ হতে বিরত থাকার উপদেশ দিচ্ছেন যা নিঃসন্দেহে ধ্বংস ও শেষ হয়ে যাবে এবং তিনি তাদেরকে আল্লাহ তা’আলার কাছে সওয়ার অন্বেষণের জন্যে অনুপ্রাণিত করছেন, যিনি কোন আমলকারীর আমলকে বিনষ্ট করেন না। তিনি এমনই শক্তিশালী যার কাছে প্রতিটি বস্তুর কর্তৃত্ব রয়েছে, যিনি কম আমলের জন্যে বেশি সওয়াব প্রদান করেন, এবং মন্দ কর্মের প্রতিদান তার বেশি প্রদান করেন না। মুমিন বান্দাটি তাদেরকে আরো সংবাদ দিচ্ছেন যে, আখিরাতই হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস, যারা আখিরাতের প্রতি অটল ঈমান রেখে সৎকাজ করে যায়, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের সুউচ্চ ও নিরাপদ প্রাসাদমালা, অসংখ্য কল্যাণ এর চিরস্থায়ী অক্ষয় রিযিক ও ক্রমবর্ধমান কল্যাণসমূহ।
অতঃপর তারা যে মতবাদে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে তার অসারতা এবং যেখানে প্রত্যাবর্তন করবে তা সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করে তিনি বলেনঃ
(۞ وَیَـٰقَوۡمِ مَا لِیۤ أَدۡعُوكُمۡ إِلَى ٱلنَّجَوٰةِ وَتَدۡعُونَنِیۤ إِلَى ٱلنَّارِ تَدۡعُونَنِی لِأَكۡفُرَ بِٱللَّهِ وَأُشۡرِكَ بِهِۦ مَا لَیۡسَ لِی بِهِۦ عِلۡمࣱ وَأَنَا۠ أَدۡعُوكُمۡ إِلَى ٱلۡعَزِیزِ ٱلۡغَفَّـٰرِ لَا جَرَمَ أَنَّمَا تَدۡعُونَنِیۤ إِلَیۡهِ لَیۡسَ لَهُۥ دَعۡوَةࣱ فِی ٱلدُّنۡیَا وَلَا فِی ٱلۡـَٔاخِرَةِ وَأَنَّ مَرَدَّنَاۤ إِلَى ٱللَّهِ وَأَنَّ ٱلۡمُسۡرِفِینَ هُمۡ أَصۡحَـٰبُ ٱلنَّارِ فَسَتَذۡكُرُونَ مَاۤ أَقُولُ لَكُمۡۚ وَأُفَوِّضُ أَمۡرِیۤ إِلَى ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ بَصِیرُۢ بِٱلۡعِبَادِ فَوَقَىٰهُ ٱللَّهُ سَیِّـَٔاتِ مَا مَكَرُوا۟ۖ وَحَاقَ بِـَٔالِ فِرۡعَوۡنَ سُوۤءُ ٱلۡعَذَابِ ٱلنَّارُ یُعۡرَضُونَ عَلَیۡهَا غُدُوࣰّا وَعَشِیࣰّاۚ وَیَوۡمَ تَقُومُ ٱلسَّاعَةُ أَدۡخِلُوۤا۟ ءَالَ فِرۡعَوۡنَ أَشَدَّ ٱلۡعَذَابِ)[Surat Ghafir ৪১ - ৪৬]
অর্থাৎ—“হে আমার সম্প্রদায়! কি আশ্চর্য আমি তোমাদেরকে আহ্বান করছি মুক্তির দিকে, আর তোমরা আমাকে ডাকছ আগুনের দিকে। তোমরা আমাকে বলছ আল্লাহকে অস্বীকার করতে এবং তার সমকক্ষ দাঁড় করাতে, যার সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞান নেই। পক্ষান্তরে আমি তোমাদেরকে আহ্বান করছি পরাক্রমশালী ক্ষমাশীল আল্লাহর দিকে। নিঃসন্দেহে তোমরা আমাকে আহ্বান করছে এমন একজনের দিকে যে দুনিয়া ও আখিরাতের কোথাও আহ্বানযোগ্য নয়। বস্তৃত আমাদের প্রত্যাবর্তন তো আল্লাহর নিকট এবং সীমালংঘনকারীরাই জাহান্নামের অধিবাসী। আমি তোমাদেরকে যা বলছি তোমরা তা অচিরেই স্মরণ করবে এবং আমি আমার ব্যাপার আল্লাহতে অর্পণ করছি। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখেন। তারপর আল্লাহ তাকে তাদের ষড়যন্ত্রের অনিষ্ট হতে রক্ষা করলেন, এবং কঠিন শাস্তি পরিবেষ্টন করল ফিরআউন সম্প্রদায়কে। তাদেরকে উপস্থিত করা হয় আগুনের সম্মুখে সকাল ও সন্ধ্যায় এবং যেদিন কিয়ামত ঘটবে সেদিন বলা হবে ফিরআউন সম্প্রদায়কে নিক্ষেপ কর কঠিন শাস্তিতে।‘ (সূরা মুমিনঃ ৪১-৪৬)।
অন্য কথায় মুমিন বান্দাটি ফিরআউনের সম্প্রদায়কে পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলীর এমন প্রতিপালকের ইবাদতের প্রতি আহ্বান করছিলেন যিনি কোন বস্তুকে সৃষ্টি করতে হলে বলে থাকেন كن অর্থাৎ ‘হয়ে যাও’ তখন হয়ে যায়। অন্যদিকে তারা তাকে পথভ্রষ্ট মূর্খ ও অভিশপ্ত ফিরআউনের ইবাদতের প্রতি আহ্বান করছিল, এজন্যই তিনি তাদেরকে তাদের অনুসরণ না করার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেনঃ
(۞ وَیَـٰقَوۡمِ مَا لِیۤ أَدۡعُوكُمۡ إِلَى ٱلنَّجَوٰةِ وَتَدۡعُونَنِیۤ إِلَى ٱلنَّارِ تَدۡعُونَنِی لِأَكۡفُرَ بِٱللَّهِ وَأُشۡرِكَ بِهِۦ مَا لَیۡسَ لِی بِهِۦ عِلۡمࣱ وَأَنَا۠ أَدۡعُوكُمۡ إِلَى ٱلۡعَزِیزِ ٱلۡغَفَّـٰرِ)[Surat Ghafir ৪১ - ৪২]
অতঃপর তিনি তাদের কাছে তাদের অবস্থান তুলে ধরলেন যে, তারা আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত এমন দেব-দেবীর ও মূর্তির পূজা-অর্চনা করছে, যারা তাদের কোন প্রকার উপকার বা ক্ষতিসাধন করতে পারে না।
এ জন্যই তিনি বলেনঃ
(لَا جَرَمَ أَنَّمَا تَدۡعُونَنِیۤ إِلَیۡهِ لَیۡسَ لَهُۥ دَعۡوَةࣱ فِی ٱلدُّنۡیَا وَلَا فِی ٱلۡـَٔاخِرَةِ وَأَنَّ مَرَدَّنَاۤ إِلَى ٱللَّهِ وَأَنَّ ٱلۡمُسۡرِفِینَ هُمۡ أَصۡحَـٰبُ ٱلنَّارِ)[Surat Ghafir ৪৩]
অর্থাৎ দেব-দেবীগুলো এ দুনিয়ায় কোন প্রকার ক্ষমতা প্রয়োগ বা কর্তৃত্বের অধিকারী নয় বলে প্রমাণিত, তাহলে চিরস্থায়ী আবাসস্থলে তারা কেমন করে এসবের অধিকারী হবে? তবে আল্লাহ্ তা’আলা পরাক্রমশালী, সৃষ্টিকর্তা এবং নেককার ও বদকার সকলের রিযিকদাতা, তিনি বান্দাদের জীবিত করেন, মৃত্যুদান করেন এবং তাদের মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত করবেন। অতঃপর তাদের মধ্যে যারা নেককার, তাদেরকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করাবেন। এবং অবাধ্যদেরকে জাহান্নামে প্রবিষ্ট করাবেন।
অতঃপর তারা যখন তাদের অবাধ্যতায় অটল থাকে, তখন তিনি তাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “আমি তোমাদেকে যা বলছি তা অচিরেই তোমরা স্মরণ করবে এবং আমি আমার ব্যাপারে আল্লাহতে অর্পণ করছি, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সর্বশেষ দৃষ্টি রাখেন।”
অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(فَوَقَىٰهُ ٱللَّهُ سَیِّـَٔاتِ مَا مَكَرُوا)
[Surat Ghafir ৪৫]
অর্থাৎ—মুমিন বান্দাটি ফিরআউন সম্প্রদায়ের অনুসরণকে অস্বীকার করায় তাদের কুফরীর দরুন তাদের উপর আল্লাহ তা’আলা যে কঠিন আযাব-গযব অবতীর্ণ করেন তা থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন। আর তারা তার বিরুদ্ধে ও আল্লাহ তাআলার সরল পথ থেকে জনগণকে বিপথে রাখার জন্যে বিভিন্ন মনগড়া ধ্যান-ধারণা প্রচার করে তারা মুমিন বান্দা ও বনী ইসরাঈলের অন্যান্য সদস্যের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছিল তা থেকে তিনি তাঁকে নিরাপদে রাখলেন। অন্যদিকে তাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার আযাব-গযব বেষ্টন করলো।
আল্লাহ তা’আলা এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেনঃ “ফিরআউন সম্প্রদায়কে কঠিন শাস্তি পরিবেষ্টন করল।” কবরে তাদের রূহসমূহকে সকাল-সন্ধ্যায় আগুনের সামনে উপস্থিত করা হয় আর যেদিন কিয়ামত ঘটবে সেদিন বলা হবে, “ফিরআউন সম্প্রদায়কে কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ কর।” এই আয়াত্তের মাধ্যমে প্রমাণিত কবর আযাব সম্বন্ধে তাফসীরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই।
মোদ্দা কথা হল, আল্লাহ তাআলা যেমন কোন সম্প্রদায়কে দলীল পূর্ণ করণ ও রাসূল প্রেরণ ব্যতীত ধ্বংস করেন না, তদ্রপ ফিরআউন সম্প্রদায়ের কাছে দলীল-প্রমাণাদি ও রাসূল প্রেরণ করে আল্লাহ তাআলার প্রমাণাদির ব্যাপারে তাদের সন্দেহ নিরসন করে এবং কখনও ভয়ভীতি প্রদর্শন ও কখনো অনুপ্রেরণা দানের মাধ্যমে তাদের প্রতি রাসূল প্রেরণের পর তারা অমান্য করাতে তিনি তাদেরকে ধ্বংস করেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
(وَلَقَدۡ أَخَذۡنَاۤ ءَالَ فِرۡعَوۡنَ بِٱلسِّنِینَ وَنَقۡصࣲ مِّنَ ٱلثَّمَرَ ٰتِ لَعَلَّهُمۡ یَذَّكَّرُونَ فَإِذَا جَاۤءَتۡهُمُ ٱلۡحَسَنَةُ قَالُوا۟ لَنَا هَـٰذِهِۦۖ وَإِن تُصِبۡهُمۡ سَیِّئَةࣱ یَطَّیَّرُوا۟ بِمُوسَىٰ وَمَن مَّعَهُۥۤۗ أَلَاۤ إِنَّمَا طَـٰۤىِٕرُهُمۡ عِندَ ٱللَّهِ وَلَـٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا یَعۡلَمُونَ وَقَالُوا۟ مَهۡمَا تَأۡتِنَا بِهِۦ مِنۡ ءَایَةࣲ لِّتَسۡحَرَنَا بِهَا فَمَا نَحۡنُ لَكَ بِمُؤۡمِنِینَ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَیۡهِمُ ٱلطُّوفَانَ وَٱلۡجَرَادَ وَٱلۡقُمَّلَ وَٱلضَّفَادِعَ وَٱلدَّمَ ءَایَـٰتࣲ مُّفَصَّلَـٰتࣲ فَٱسۡتَكۡبَرُوا۟ وَكَانُوا۟ قَوۡمࣰا مُّجۡرِمِینَ)
[Surat Al-A'raf ১৩০ - ১৩৩]
অর্থাৎ, আমি তো ফিরআউনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষ ও ফল-ফসলের ক্ষতির দ্বারা আক্রান্ত করেছি যাতে তারা অনুধাবন করে। যখন তাদের কোন কল্যাণ হত, তারা বলত; এটাতো আমাদের প্রাপ্য। আর যখন কোন অকল্যাণ হতো তখন তারা মূসা ও তার সঙ্গীদেরকে অলক্ষুণে গণ্য করত; তাদের অকল্যাণ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন; কিন্তু তাদের অধিকাংশ এটা জানে না। তারা বলল, আমাদেরকে জাদু করার জন্যে তুমি যে কোন নিদর্শন আমাদের নিকট পেশ করনা কেন, আমরা তোমাতে বিশ্বাস করবো না। তারপর আমি তাদেরকে প্লাবন, পঙ্গপাল, উকুন, ভেক ও রক্ত দ্বারা ক্লিষ্ট করি। এগুলি স্পষ্ট নিদর্শন, কিন্তু তারা দাম্ভিকই রয়ে গেল। আর তারা ছিল এক অপরাধী সম্প্রদায়। (সূরা আ’রাফঃ ১৩০-১৩৩)
এখানে আল্লাহ্ তা’আলা জানাচ্ছেন যে, তিনি ফিরআউনের সম্প্রদায়কে দুর্ভিক্ষ দ্বারা ক্লিষ্ট করেছেন। ফিরআউনের সম্প্রদায় হচ্ছে কিবতীগণ سنينا বা ‘দুর্ভিক্ষের বছরগুলো বলতে এমন সব বছরকে বুঝানো হয়, যে গুলোয় ফসল হয় না এবং গবাদি পশুর দুধ দ্বারাও মানুষ উপকৃত হতে পারে না। আয়াতে উল্লেখিত وَنَقۡصࣲ مِّنَ ٱلثَّمَرَ ٰتِ -এর অর্থ হচ্ছে গাছের ফলফলাদি ও কম হওয়া। আয়াতাংশঃ لَعَلَّهُمۡ یَذَّكَّرُونَ -এর দ্বারা ইংগিত করা হয়েছে যে, তারা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও তারা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেনি বরং তারা আরো অবাধ্য হয়ে উঠে ও কুফরী হঠকারিতার মধ্যে অবিচল থাকে। যখন তাদের কোন কল্যাণ হত, অর্থাৎ প্রচুর ফসলাদি হত তখন তারা বলত আমাদেরই, অর্থাৎ এটা আমাদের ন্যায্য পাওনা এবং আমরাই এর উপযুক্ত। আর যখন কোন অকল্যাণ হত তখন তারা বলত, এটা মূসা ও তার সঙ্গীরা অলক্ষুণে হওয়ার কারণে আমাদের উপর আরোপিত হয়েছে। অথচ তারা কল্যাণের সময় বলত না যে এটা মূসা ও তার সঙ্গীদের বরকতে কিংবা তাদের শুভ অবস্থানের দরুন হয়েছে। তাদের অন্তরসমূহ দাম্ভিক ও অস্বীকারকারী এবং সত্য থেকে বিমুখ। যখন তাদের প্রতি কোন অকল্যাণ আপতিত হয়, তখন তারা এটি মূসা (عليه السلام) ও তাঁর সঙ্গীদের প্রতি আরোপ করে আর যখন তারা কোন প্রকার কল্যাণ দেখতে পেতো, তখন তারা এটাকে নিজেদের কৃতিত্ব বলে দাবি করতো।
এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ أَلَاۤ إِنَّمَا طَـٰۤىِٕرُهُمۡ عِندَ ٱللَّهِ তাদের অকল্যাণ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থাৎ আল্লাহ্ তাদেরকে একথার জন্যে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবেন। তারা বলেঃ
مَهۡمَا تَأۡتِنَا بِهِۦ مِنۡ ءَایَةࣲ لِّتَسۡحَرَنَا بِهَا فَمَا نَحۡنُ لَكَ بِمُؤۡمِنِینَ
অর্থাৎ—তারা বলল, আমাদেরকে জাদু করার জন্যে তুমি আমাদের কাছে যে কোন নিদর্শন বা মু’জিযা পেশ কর না কেন, আমরা তোমাতে বিশ্বাস করব না, এবং তোমার আনুগত্য করব না।
অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা’আলা অন্য আয়াতে তাদের সম্পর্কে ইরশাদ করেনঃ
(إِنَّ ٱلَّذِینَ حَقَّتۡ عَلَیۡهِمۡ كَلِمَتُ رَبِّكَ لَا یُؤۡمِنُونَ وَلَوۡ جَاۤءَتۡهُمۡ كُلُّ ءَایَةٍ حَتَّىٰ یَرَوُا۟ ٱلۡعَذَابَ ٱلۡأَلِیمَ)[Surat Yunus ৯৬ - ৯৭]
অর্থাৎ—নিশ্চয়ই যাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিপালকের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছে তারা ঈমান আনবে না যদিও তাদের নিকট প্রত্যেকটি নিদর্শন আসে, যতক্ষণ না তারা মর্মন্তুদ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। (সূরা ইউনুসঃ ৯৬-৯৭)
তাদের শাস্তি সম্পর্কে অন্য আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(فَأَرۡسَلۡنَا عَلَیۡهِمُ ٱلطُّوفَانَ وَٱلۡجَرَادَ وَٱلۡقُمَّلَ وَٱلضَّفَادِعَ وَٱلدَّمَ ءَایَـٰتࣲ مُّفَصَّلَـٰتࣲ فَٱسۡتَكۡبَرُوا۟ وَكَانُوا۟ قَوۡمࣰا مُّجۡرِمِینَ)[Surat Al-A'raf ১৩৩]
“অতঃপর আমি তাদেরকে প্লাবন, পঙ্গপাল, উকুন, ভেক ও রক্ত দ্বারা ক্লিষ্ট করি। এগুলো স্পষ্ট নিদর্শন; কিন্তু তারা দাম্ভিকই রয়ে গেল আর তারা ছিল এক অপরাধী সম্প্রদায়।”
আয়াতে উল্লেখিত الطوفان শব্দটির অর্থ নিয়ে তাফসীরকারদের মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। এ الطوفان-এর অর্থ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত রয়েছে। তিনি বলেন, অত্যধিক বৃষ্টিপাত যাতে ফসলাদি ও ফলমূল বিনষ্ট হয়। সাঈদ ইবন জুবাইর, কাতাদা, সুদ্দী এবং যাহহাক (رحمة الله)ও এ মত পোষণ করেন। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) ও আতা (رحمة الله) থেকে অন্য একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, তুফানের অর্থ ‘বিপুল হারে মৃত্যুবরণ’। মুজাহিদ বলেন, ‘তুফান’-এর অর্থ সর্বাবস্থায়ই প্লাবন এবং প্লেগ। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে অন্য একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, তুফানের অর্থ হচ্ছে প্রতিটি মুসীবত যা জনগণকে বেষ্টন করে ফেলে। ইবন জারীর ও ইবন মারইয়াহ (رحمة الله) হতে বর্ণিত। তাঁরা আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, ‘তুফানের অর্থ মুত্যু’। এই হাদীসটি গরীব পর্যায়ের।
আয়াতে উল্লেখিত الجراد শব্দটির অর্থ যে পঙ্গপাল তা সুবিদিত। সালমান ফারসী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তা’আলার বাহিনীসমূহের মধ্যে এগুলোর সংখ্যাই সর্বাধিক, এগুলো আমি খাই না এবং এগুলো খাওয়াকে হারামও বলি না। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর রুচি বিরুদ্ধ হওয়ার জন্যেই তিনি পঙ্গপাল খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন। যেমন তিনি গুইসাপ খাওয়া থেকে বিরত ছিলেন এবং পিয়াজ ও রসুন খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন। বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে আব্দুল্লাহ ইবন আবু আওফা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে যোগদান করেছি। সে সময় আমরা পঙ্গপাল খেতাম। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসসমূহ নিয়ে তাফসীরে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সার কথা হচ্ছে এই যে, আল্লাহু তা’আলা তাদের শস্য-শ্যামল মাঠ ধ্বংস করে দিলেন। তাদের ফল-ফসলাদি ও গবাদি পশু কিছুই বাকি রইলো না, সবই ধ্বংস হয়ে গেল।
আয়াতে উল্লেখিত القمل-এর অর্থ নিয়ে মতানৈক্য দেখা যায়। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (رحمة الله) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, قمل হচ্ছে এমন একটি পোকা যা গমের মধ্য থেকে বের হয়ে আসে। এই বর্ণনাকারী থেকে অন্য একটি বর্ণনা বর্ণিত রয়েছে। তিনি বলেন, قمل-এর অর্থ হচ্ছে এমন ছোট পঙ্গপাল যার পাখা নেই। মুজাহিদ, ইকরিমা ও কাতাদা (رحمة الله)ও একমত পোষণ করেন। সাঈদ ইবন জুবাইর (رضي الله عنه) ও হাসান বসরী (رحمة الله) বলেন قمل হচ্ছে এমন একটি জীব যা কাল ও ছোট। আবদুর রহমান ইবন যায়দ ইবন আসলাম (رحمة الله) বলেন قمل হচ্ছে পক্ষবিহীন মাছিসমূহ। ইবন জারীর (رحمة الله) আরবী ভাষাভাষীদের বরাতে বর্ণনা করেছেন যে, قمل -এর অর্থ হচ্ছে উকুন বা পরজীবী কীট বিশেষ। উকুন দলে দলে তাদের ঘরে ও বিছানায় প্রবেশ করে এবং তাদের প্রতি অশান্তি ঘটায়। ফলে তাদের পক্ষে ঘুমানোও সম্ভব হতো না এবং জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আতা ইবন সাইব (رحمة الله)قمل কে সাধারণ উকুন বলে ব্যাখ্যা করেছেন। হাসান বসরী (رحمة الله) এ قمل কে ميم এর তাশদীদ ব্যতিরেকে ‘কুমাল’ রূপে পাঠ করেছেন। ব্যাঙ একটি বহুল পরিচিত প্রাণী। এগুলো তাদের খাবারে ও বাসনপত্রে লাফিয়ে পড়ত। এমন কি তাদের কেউ যদি খাওয়ার বা পান করার জন্যে মুখ খুলত অমনি ওগুলো মুখে ঢুকে পড়ত। রক্তের ব্যাপারটিও ছিল অনুরূপ। যখন তারা পানি পান করতে যেত তখনই পানিকে রক্ত মিশ্রিত পেত। যখনি তারা নীল নদে পানি পান করতে নামত, অমনি তার পানি রক্ত মিশ্রিত পেত। এমনিভাবে কোন নদী-নালা বা কূয়া ছিল না যার পানি ব্যবহারের সময় রক্ত মিশ্রিত মনে না হত। বনী ইসরাঈল বংশীয়রা এসব উপদ্রব থেকে মুক্ত ছিল। এগুলো ছিল পরিপূর্ণ অলৌকিক ঘটনা ও অকাট্য প্রমাণাদি যা মূসা (عليه السلام)-এর কাজের মাধ্যমে তাদের জন্যে প্রকাশ পেয়েছিল। বনী ইসরাঈলের আবাল বৃদ্ধবনিতা সকলেই এভাবে লাভবান হয়েছিল। এসব ব্যাপার ছিল তাদের জন্য উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ও প্রমাণ। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) বলেন, জাদুকররা যখন প্রতিযোগিতায় পরাস্ত ও ব্যর্থকাম হয়ে ঈমান আনয়ন করল তখনও আল্লাহর শত্রু ফিরআউন তার কুফরী ও দুষ্কর্মে অবিচল রইল। তখন আল্লাহ একে একে তার সম্মুখে নিদর্শনাদি প্রকাশ করেন। প্রথমে দুর্ভিক্ষ এবং তারপর তুফান অবতীর্ণ করেন। এরপর পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত স্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে পর পর প্রেরণ করেন। প্লাবনের ফলে তারা ঘর থেকে বের হতে পারতো না এবং কোন প্রকার কাজ-কর্মও করতে পারতো না। ফলে তারা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়।
এরূপে তারা যখন দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হল তখন তারা মূসা (عليه السلام)-কে বলতে লাগল।
(یَـٰمُوسَى ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ بِمَا عَهِدَ عِندَكَۖ لَىِٕن كَشَفۡتَ عَنَّا ٱلرِّجۡزَ لَنُؤۡمِنَنَّ لَكَ وَلَنُرۡسِلَنَّ مَعَكَ بَنِیۤ إِسۡرَ ٰءِیلَ)[Surat Al-A'raf ১৩৪]
অর্থাৎ—হে মূসা! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট আমাদের জন্যে প্রার্থনা কর, তোমার সাথে তিনি যে অঙ্গীকার করেছেন সে মতে; যদি তুমি আমাদের ওপর থেকে শাস্তি অপসারিত কর তবে আমরা তো তোমাতে ঈমান আনবই এবং বনী ইসরাঈলকেও তোমার সাথে অবশ্যই যেতে দেব। (সূরা আ’রাফঃ ১৩৪)
তখন মূসা (عليه السلام) তার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করেন এবং আল্লাহ্ তা’আলা তাদের ওপর থেকে তার প্রেরিত শাস্তি অপসারিত করেন। কিন্তু তারা তখন তাদের অঙ্গীকার পূরণ করল না। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি পঙ্গপাল অবতীর্ণ করেন। পঙ্গপাল তাদের গাছপালা সব নিঃশেষ করে ফেলে এমনকি তাদের ঘরের দরজাসমূহের লোহার পেরেকগুলো পর্যন্ত খেতে থাকে। ফলে তাদের ঘরবাড়িগুলো পড়ে যেতে থাকে। তখন তারা পূর্বের মত মূসা (عليه السلام)-কে আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে প্রার্থনা করার জন্য অনুরোধ জানায়। মূসা (عليه السلام) তাঁর প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করায় তাদের উপর থেকে আযাব রহিত হয়ে যায়। কিন্তু তারা তাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করল না। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাদের প্রতি উকুন প্রেরণ করেন। বর্ণনাকারী বলেন যে, মূসা (عليه السلام)-কে একটি বালুর ঢিবির কাছে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আরো আদেশ দেয়া হয়েছির তিনি যেন তাঁর লাঠি দ্বারা তাতে আঘাত করেন। তারপর মূসা (عليه السلام) একটি বড় ঢিবির দিকে গিয়ে তাতে আপন লাঠি দ্বারা আঘাত করলেন তাতে তাদের উপর উকুন ছড়িয়ে পড়ল। এমনকি উকুন ঘরবাড়ি ও খাদ্য-সম্ভারের উপর ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তাদের নিদ্রা ও শান্তি বিঘ্নিত হতে লাগল। যখন তারা এই মুসীবতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল, তখন তারা মূসা (عليه السلام)-কে পূর্বের মত আল্লাহর দরবারে দু’আর জন্য অনুরোধ জানাতে লাগল। অতঃপর মূসা (عليه السلام) তাঁর প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করলেন এবং আল্লাহ্ তা’আলা তাদের উপর থেকে আযাব হটিয়ে দিলেন কিন্তু তারা তাদের অঙ্গীকার কিছুই পূরণ করল না। তাতে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের উপর ব্যাঙ প্রেরণ করেন। তাদের ঘরবাড়ি, খানাপিনা, ও হাঁড়ি-পাতিল ব্যাঙে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তাদের কেউ যখন কোন কাপড় কিংবা খাবারের ঢাকনা উঠাত, অমনি তারা দেখতে পেত যে, সেগুলো ব্যাঙ দখল করে রেখেছে। এই মুসীবতে যখন তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল, তখন তারা আগের মত মূসা (عليه السلام)-এর কাছে দুআর জন্য অনুরোধ জানাতে লাগল। মূসা (عليه السلام) তাঁর প্রতিপালককে ডাকলেন এবং তিনি তাদের উপর থেকে আযাব বিদূরিত করলেন। কিন্তু তারা তাদের প্রতিশ্রুতি মোটেও রক্ষা করল না। তাই আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি রক্তের শাস্তি প্রেরণ করেন। ফিরআউন সম্প্রদায়ের পানির উৎসগুলো রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তারা যখনই কোন কয়া, নদীনালা ও পাত্র থেকে পানি পান করতে ইচ্ছে করত এগুলো রক্তে পরিণত হয়ে যেত। যায়দ ইবন আসলাম বলেন, আয়াতাংশে উল্লেখিত دم শব্দটির অর্থ رعاف বা নাক থেকে ঝরা রক্ত। বর্ণনাটি ইবন আবী হাতিমের।
অন্যত্র আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(وَلَمَّا وَقَعَ عَلَیۡهِمُ ٱلرِّجۡزُ قَالُوا۟ یَـٰمُوسَى ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ بِمَا عَهِدَ عِندَكَۖ لَىِٕن كَشَفۡتَ عَنَّا ٱلرِّجۡزَ لَنُؤۡمِنَنَّ لَكَ وَلَنُرۡسِلَنَّ مَعَكَ بَنِیۤ إِسۡرَ ٰۤءِیلَ فَلَمَّا كَشَفۡنَا عَنۡهُمُ ٱلرِّجۡزَ إِلَىٰۤ أَجَلٍ هُم بَـٰلِغُوهُ إِذَا هُمۡ یَنكُثُونَ فَٱنتَقَمۡنَا مِنۡهُمۡ فَأَغۡرَقۡنَـٰهُمۡ فِی ٱلۡیَمِّ بِأَنَّهُمۡ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَا وَكَانُوا۟ عَنۡهَا غَـٰفِلِینَ)
[Surat Al-A'raf ১৩৪ - ১৩৬]
অর্থাৎ—এবং যখন তাদের উপর শাস্তি আসত তারা বলত, ‘হে মূসা! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট আমাদের জন্য প্রার্থনা কর, তোমার সাথে তিনি যে অঙ্গীকার করেছেন সে অনুযায়ী। যদি তুমি আমাদের উপর থেকে শাস্তি অপসারিত কর, তবে আমরা তো তোমাতে ঈমান আনবই এবং বনী ইসরাঈলকেও তোমার সাথে অবশ্যই যেতে দেব।’ আমি যখনই তাদের উপর থেকে শাস্তি অপসারিত করতাম এক নির্দিষ্ট কালের জন্যে যা তাদের উপর নির্ধারিত ছিল, তারা তখনই তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করত। সুতরাং আমি তাদেরকে শাস্তি দিয়েছি।
এবং তাদেরকে অতল সমুদ্রে নিমজ্জিত করেছি। কারণ তারা আমার নিদর্শনকে অস্বীকার করত এবং এই সম্বন্ধে তারা ছিল গাফিল। (সূরা আ’রাফ ১৩৪-১৩৬)।
আল্লাহ তা’আলা এখানে ফিরআউনের ও তার সম্প্রদায়ের কুফরী, জোর-জুলুম, পথভ্রষ্টতা ও মূর্খতায় লিপ্ত থাকা এবং আল্লাহ তা’আলার নিদর্শনাদির অনুসরণ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন থেকে বিমুখতা ইত্যাদি সম্বন্ধে বর্ণনা করছেন। অথচ আল্লাহর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়টি বিভিন্ন প্রকার অলৌকিক নিদর্শনাদি ও অকাট্য প্রমাণাদি দ্বারা প্রমাণিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে নিদর্শনাদি প্রদর্শন করেছেন এবং এগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে দলীল ও প্রমাণ সাব্যস্ত করেছেন। যখনই তারা আল্লাহর কোন নিদর্শন প্রত্যক্ষ করত এবং মুসীবতের শিকার হত তখনই তারা মূসা (عليه السلام)-এর কাছে শপথ করে ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় যে, যদি তাদের উপর থেকে এসব মুসীবত দূরীভূত হয়ে যায় তাহলে ফিরআউন মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং মূসা (عليه السلام)-এর দলের লোকদেরকে মূসা (عليه السلام)-এর সাথে যেতে দেবে। অথচ যখনি তাদের উপর থেকে এরূপ আযাব-গযব উঠিয়ে নেয়া হত, তখনি তারা দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ত এবং প্রেরিত সত্যকে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করত। আর মুসা (عليه السلام) এর দিকে ফিরেও তাকাত না। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাদের প্রতি অন্য একটি নিদর্শন বা মুসীবত অবতীর্ণ করতেন যা পূর্বের প্রেরিত নিদর্শন ও মুসীবত থেকে অধিকতর কষ্টদায়ক হত। তখন তারা মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মৌখিক অঙ্গীকার করত। কিন্তু পরে তারা মিথ্যাচারে লিপ্ত হত। এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হত কিন্তু তা পূরণ করত না।
ফিরআউন ও তার সম্প্রদায় বলত, ‘হে মূসা! যদি তুমি আমাদের উপর থেকে এই মুসীবত দূরীভূত কর, আমরা তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব এবং তোমার সাথে বনী ইসরাঈলকে যেতে দেব। তখন তাদের উপর থেকে এই কঠিন আযাব ও শাস্তি দূর করা হত কিন্তু পুনরায় তারা তাদের নিরেট মূর্খতা ও বোকামিতে ফিরে যেত। মহা পরাক্রমশালী, ধৈর্যশীল আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে অবকাশ দিতেন এবং তড়িঘড়ি করে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করতেন না, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সংশোধনের সুযোগ দিতেন এবং আযাব-গযবের ব্যাপারে সতর্ক করতেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণাদি পূর্ণ করার পর তাদেরকে কঠোরভাবে পাকড়াও করলেন। যাতে এটা পরবর্তীদের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকে এবং তাদের মত অন্যান্য কাফিরের জন্য এটা নজীর স্বরূপ এবং মুমিন বান্দাদের মধ্য থেকে যারা নসীহত গ্রহণ করে তাদের জন্যে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
যেমন আল্লাহ্ তা’আলা সূরা যুখরুফে ইরশাদ করেনঃ
(وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا مُوسَىٰ بِـَٔایَـٰتِنَاۤ إِلَىٰ فِرۡعَوۡنَ وَمَلَإِی۟هِۦ فَقَالَ إِنِّی رَسُولُ رَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ فَلَمَّا جَاۤءَهُم بِـَٔایَـٰتِنَاۤ إِذَا هُم مِّنۡهَا یَضۡحَكُونَ وَمَا نُرِیهِم مِّنۡ ءَایَةٍ إِلَّا هِیَ أَكۡبَرُ مِنۡ أُخۡتِهَاۖ وَأَخَذۡنَـٰهُم بِٱلۡعَذَابِ لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُونَ وَقَالُوا۟ یَـٰۤأَیُّهَ ٱلسَّاحِرُ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ بِمَا عَهِدَ عِندَكَ إِنَّنَا لَمُهۡتَدُونَ فَلَمَّا كَشَفۡنَا عَنۡهُمُ ٱلۡعَذَابَ إِذَا هُمۡ یَنكُثُونَ وَنَادَىٰ فِرۡعَوۡنُ فِی قَوۡمِهِۦ قَالَ یَـٰقَوۡمِ أَلَیۡسَ لِی مُلۡكُ مِصۡرَ وَهَـٰذِهِ ٱلۡأَنۡهَـٰرُ تَجۡرِی مِن تَحۡتِیۤۚ أَفَلَا تُبۡصِرُونَ أَمۡ أَنَا۠ خَیۡرࣱ مِّنۡ هَـٰذَا ٱلَّذِی هُوَ مَهِینࣱ وَلَا یَكَادُ یُبِینُ فَلَوۡلَاۤ أُلۡقِیَ عَلَیۡهِ أَسۡوِرَةࣱ مِّن ذَهَبٍ أَوۡ جَاۤءَ مَعَهُ ٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةُ مُقۡتَرِنِینَ فَٱسۡتَخَفَّ قَوۡمَهُۥ فَأَطَاعُوهُۚ إِنَّهُمۡ كَانُوا۟ قَوۡمࣰا فَـٰسِقِینَ فَلَمَّاۤ ءَاسَفُونَا ٱنتَقَمۡنَا مِنۡهُمۡ فَأَغۡرَقۡنَـٰهُمۡ أَجۡمَعِینَ فَجَعَلۡنَـٰهُمۡ سَلَفࣰا وَمَثَلࣰا لِّلۡـَٔاخِرِینَ)[Surat Az-Zukhruf ৪৬ - ৫৬]
অর্থাৎ, মূসাকে তো আমি আমার নিদর্শনসহ ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের নিকট পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, আমি তো জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রেরিত। সে ওদের নিকট আমার নিদর্শনসহ আসা মাত্র তারা তা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে লাগল। আমি তাদেরকে এমন কোন নিদর্শন দেখাইনি যা এটার অনুরূপ নিদর্শন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নয়। আমি তাদেরকে শাস্তি দিলাম যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে। তারা বলেছিল, ‘হে জাদুকর! তোমার প্রতিপালকের নিকট তুমি আমাদের জন্য তা প্রার্থনা কর যা তিনি তোমার সাথে অঙ্গীকার করেছেন; তা হলে আমরা অবশ্যই সৎপথ অবলম্বন করব।’ তারপর যখন আমি তাদের উপর থেকে শাস্তি বিদূরিত করলাম, তখনই তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে বসল। ফিরআউন তার সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বলে ঘোষণা করল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! মিসর রাজ্য কি আমার নয়? আর এ নদীগুলো আমার পাদদেশে প্রবাহিত, তোমরা এটা দেখ না? আমি তো শ্রেষ্ঠ এই ব্যক্তি হতে, যে হীন এবং স্পষ্ট কথা বলতেও অক্ষম। মূসাকে কেন দেয়া হল না স্বর্ণবলয় অথবা তার সংগে কেন আসল না ফেরেশতাগণ দলবদ্ধভাবে?’ এভাবে সে তার সম্প্রদায়কে হতবুদ্ধি করে দিল, ফলে ওরা তার কথা মেনে নিল। ওরা তো ছিল এক সত্যত্যাগী সম্প্রদায়! যখন ওরা আমাকে ক্রোধান্বিত করল আমি তাদেরকে শাস্তি দিলাম এবং নিমজ্জিত করলাম তাদের সকলকে। তারপর পরবর্তীদের জন্য আমি তাদেরকে করে রাখলাম অতীত ইতিহাস ও দৃষ্টান্ত। (সূরা যুখরুফঃ ৪৬-৫৬)
নীচাশয় ও দুরাচার ফিরআউনের নিকট আপন সম্মানিত বান্দা ও রাসূলকে প্রেরণের ঘটনা আল্লাহ্ তা’আলা উপরোক্ত আয়াতসমূহে ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর রাসূলকে এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাদিসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তারা জনগণের সম্মান ও আস্থা অর্জনে সমর্থ হন। এবং তারা কুফর ও শিরক পরিত্যাগ করে সত্য ও সরল পথের প্রতি প্রত্যাবর্তন করে। অথচ তারা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন না করে ঐ সব নিদর্শন নিয়ে ঠাট্টা ও হাসি-তামাশায় লিপ্ত হয়। এবং আল্লাহ প্রেরিত সত্যপথ থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারপর আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি পরপর নিদর্শনাদি প্রেরণ করেন। যার প্রতিটিই তার পূর্ববর্তীটির তুলনায় অধিকতর গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(وَأَخَذۡنَـٰهُم بِٱلۡعَذَابِ لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُونَ وَقَالُوا۟ یَـٰۤأَیُّهَ ٱلسَّاحِرُ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ بِمَا عَهِدَ عِندَكَ إِنَّنَا لَمُهۡتَدُونَ)[Surat Az-Zukhruf ৪৮ - ৪৯]
অর্থাৎ, আমি তাদেরকে শাস্তি দিলাম যাতে তারা ফিরে আসে। তারা বলেছিল, ‘হে জাদুকর! তোমার প্রতিপালকের নিকট তুমি আমাদের জন্য তা প্রার্থনা কর, যা তিনি তোমার সাথে অঙ্গীকার করেছেন, তাহলে আমরা অবশ্যই সৎপথ অবলম্বন করব।” (সূরা যুখরুফঃ ৪৮-৪৯)
তাদের সময়ে জাদুকর সম্বোধন সে যুগে দূষণীয় বলে বিবেচিত হতো না। কেননা, তাদের আলিমদেরকে ঐ যুগে জাদুকর বলে আখ্যায়িত করা হতো। এজন্যই তারা প্রয়োজনের সময় মূসা (عليه السلام)-কে জাদুকর বলে সম্বোধন করে এবং তাঁর কাছে অনুনয়-বিনয় করে তাদের আর্জি পেশ করে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(فَلَمَّا كَشَفۡنَا عَنۡهُمُ ٱلۡعَذَابَ إِذَا هُمۡ یَنكُثُونَ)
[Surat Az-Zukhruf ৫০]
“যখন আমি তাদের থেকে শাস্তি বিদূরিত করলাম তখনই তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে বসল।”
তারপর আল্লাহ তা’আলা ফিরআউনের দাম্ভিকতার বর্ণনা দেন। ফিরআউনও তার রাজ্যের বিশালতা, সৌন্দর্য এবং বহমান নদী-নালা নিয়ে গর্ববোধ করত। নীল নদের সাথে সংযুক্ত করায় এসব বাড়তি খাল, নালা দেশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়। অতঃপর ফিরআউন তার নিজের দৈহিক সৌন্দর্য নিয়েও গর্ব করে এবং আল্লাহর রাসূল মূসা (عليه السلام)-এর দোষত্রুটি বর্ণনা করতে শুরু করে। স্পষ্ট কথাবার্তা বলতে মূসা (عليه السلام)-এর অক্ষমতাকেও সে ত্রুটিরূপে চিহ্নিত করে। বাল্যকালে তার জিহ্বায় কিছুটা জড়তা দেখা দেয়, যা তার জন্যে ছিল পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য ও সম্মানের ব্যাপার যা তার সাথে আল্লাহ তা’আলার কথোপকথন, তাঁর নিকট ওহী প্রেরণ; এর পর তাঁর কাছে তৌরাত অবতীর্ণ করার ক্ষেত্রে এটা কোন প্রকার অন্তরায় হয়নি। অথচ ফিরআউন এটাকে উপলক্ষ করে মূসা (عليه السلام)-এর ত্রুটি নির্দেশ করেছিল। ফিরআউন মূসা (عليه السلام)-এর স্বর্ণবলয় ও শরীরে সাজসজ্জা না থাকাকেও ত্রুটি বলে আখ্যায়িত করে অথচ এটা হল নারীদের ভূষণ, পুরুষের ব্যক্তিত্বের সাথে এটা সম্পৃক্ত নয়। তাই নবীদের ব্যক্তিত্বের সাথে তা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, কেননা নবীগণ পুরুষদের মধ্যে জ্ঞান-বুদ্ধি, মারেফাত, সাহস, পরহেজগারী ও জ্ঞানের দিক দিয়ে অধিকতর পরিপূর্ণ। তাঁরা দুনিয়ায় অধিকতর সাবধানতা অবলম্বনকারী এবং আখিরাতে আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক তাঁর ওলীদের জন্যে যে সব নিয়ামতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, সে সম্বন্ধে অধিকতর জ্ঞাত।
আয়াতে উল্লেখিত مقترنين আয়াতাংশ দ্বারা দুটি অর্থ নেয়া যায়। প্রথমত, যদি ফিরআউনের উদ্দেশ্য হয় যে, ফেরেশতাগণ কেন মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন না।
তাহলে তার এই আপত্তি যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা, মূসা (عليه السلام)-এর চাইতে কম মর্যাদাসম্পন্ন লোকেরও ফেরেশতাগণ অনেক সময় সম্মান করে থাকেন। কাজেই ফেরেশতা দলবদ্ধভাবে মূসা (عليه السلام)-এর সাথে আগমন করা নবুওতের মর্যাদার জন্য শর্ত নয়। যেমন হাদীস শরীফে রয়েছে-রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, যখন শিক্ষার্থীগণ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনে ইলম শিক্ষার জন্যে ঘরের বের হয় তখন তাদের সম্মানার্থে ফেরেশতাগণ তাদের চলার পথে তাদের পাখা বিস্তার করে দেন। সুতরাং মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি ফেরেশতাগণের সম্মান, বিনয় প্রদর্শন যে কী পর্যায়ের ছিল তা সহজেই অনুমেয়। আর যদি এই কথার দ্বারা ফিরআউনের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে যে মূসা (عليه السلام)-এর নবুওতের পক্ষে ফেরেশতাগণ সাক্ষীরূপে উপস্থিত হন না কেন, তাহলে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা মূসা (عليه السلام)-এর রিসালতকে এমন সব মু’জিযা ও মজবুত দলীলাদি দ্বারা শক্তিশালী করেছেন যা জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ এবং সত্য সন্ধানীদের কাছে সুপ্রমাণিত হিসেবে বিবেচ্য। তবে এসব মুজিযা ও মজবুত দলীলাদির ব্যাপারে ঐসব ব্যক্তি অন্ধ, যারা সারবস্তু ছেড়ে কেবল ছাল-বাকল নিয়েই ব্যস্ত থাকে। যাদের অন্তরে আল্লাহ্ তা’আলা মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তাদের অন্তর সংশয় সন্দেহের দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন যেমনটি কিবতী বংশীয় ক্ষমতার মোহে অন্ধ ও মিথ্যাচারী ফিরআউনের ক্ষেত্রে ঘটেছিল।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
فَٱسۡتَخَفَّ قَوۡمَهُۥ فَأَطَاعُوهُۚ
[Surat Az-Zukhruf ৫৪]
অর্থাৎ—এভাবে সে তার সম্প্রদায়কে হতবুদ্ধি করে দিল, তখন তারা তাকে মেনে নিল এবং তার প্রভুত্বকেও স্বীকার করে নিল। যেহেতু তারা ছিল একটি সত্যত্যাগী সম্প্রদায়।
অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(فَلَمَّاۤ ءَاسَفُونَا ٱنتَقَمۡنَا مِنۡهُمۡ )
[Surat Az-Zukhruf ৫৫]
অর্থাৎ—যখন তারা আমাকে ক্রোধান্বিত করল, আমি তাদেরকে শাস্তি দিলাম অর্থাৎ নিমজ্জিত করলাম অবমাননা, লাঞ্ছনা-গঞ্জনায়, নিয়ামত দানের পর আযাবে নিপতিত করে, সুখের পর দুঃখ দিয়ে, আনন্দের পর বিষাদগ্রস্ত করে এবং সুখের জীবনের পর দোযখের কঠিন আযাব দিয়ে। অতঃপর আমি তাদেরকে তাদের অনুসারীদের জন্যে অতীত ইতিহাস এবং তাদের থেকে যারা শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় ও আযাবকে ভয় করতে চায় তাদের জন্যে দৃষ্টান্তে পরিণত করলাম।
তাদের পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
فَلَمَّا جَاۤءَهُم مُّوسَىٰ بِـَٔایَـٰتِنَا بَیِّنَـٰتࣲ قَالُوا۟ مَا هَـٰذَاۤ إِلَّا سِحۡرࣱ مُّفۡتَرࣰى وَمَا سَمِعۡنَا بِهَـٰذَا فِیۤ ءَابَاۤىِٕنَا ٱلۡأَوَّلِینَ وَقَالَ مُوسَىٰ رَبِّیۤ أَعۡلَمُ بِمَن جَاۤءَ بِٱلۡهُدَىٰ مِنۡ عِندِهِۦ وَمَن تَكُونُ لَهُۥ عَـٰقِبَةُ ٱلدَّارِۚ إِنَّهُۥ لَا یُفۡلِحُ ٱلظَّـٰلِمُونَ وَقَالَ فِرۡعَوۡنُ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡمَلَأُ مَا عَلِمۡتُ لَكُم مِّنۡ إِلَـٰهٍ غَیۡرِی فَأَوۡقِدۡ لِی یَـٰهَـٰمَـٰنُ عَلَى ٱلطِّینِ فَٱجۡعَل لِّی صَرۡحࣰا لَّعَلِّیۤ أَطَّلِعُ إِلَىٰۤ إِلَـٰهِ مُوسَىٰ وَإِنِّی لَأَظُنُّهُۥ مِنَ ٱلۡكَـٰذِبِینَ وَٱسۡتَكۡبَرَ هُوَ وَجُنُودُهُۥ فِی ٱلۡأَرۡضِ بِغَیۡرِ ٱلۡحَقِّ وَظَنُّوۤا۟ أَنَّهُمۡ إِلَیۡنَا لَا یُرۡجَعُونَ فَأَخَذۡنَـٰهُ وَجُنُودَهُۥ فَنَبَذۡنَـٰهُمۡ فِی ٱلۡیَمِّۖ فَٱنظُرۡ كَیۡفَ كَانَ عَـٰقِبَةُ ٱلظَّـٰلِمِینَ وَجَعَلۡنَـٰهُمۡ أَىِٕمَّةࣰ یَدۡعُونَ إِلَى ٱلنَّارِۖ وَیَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ لَا یُنصَرُونَ وَأَتۡبَعۡنَـٰهُمۡ فِی هَـٰذِهِ ٱلدُّنۡیَا لَعۡنَةࣰۖ وَیَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ هُم مِّنَ ٱلۡمَقۡبُوحِینَ
[Surat Al-Qasas ৩৬ - ৪২]
অর্থাৎ—মূসা (عليه السلام) যখন ওদের নিকটে আমার সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলো নিয়ে আসল—ওরা বলল, এটাতো অলীক ইন্দ্রজাল মাত্র। আমাদের পূর্ব-পুরুষগণের কালে কখনও এরূপ কথা শুনিনি। মূসা বলল, আমার প্রতিপালক সম্যক অবগত, কে তাঁর নিকট থেকে পথ-নির্দেশ এনেছে এবং আখিরাতে কার পরিণাম শুভ হবে। জালিমরা কখনও সফলকাম হবে না।
ফিরআউন বলল, ‘হে পারিষদবর্গ! আমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ রয়েছে বলে আমি জানি না। হে হামান! তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও এবং একটি সুউচ্চ প্রাসাদ তৈরি কর, হয়ত আমি এতে উঠে মূসার ইলাহকে দেখতে পাব। তবে আমি অবশ্য মনে করি, সে মিথ্যাবাদী।’ ফিরআউন ও তার বাহিনী অন্যায়ভাবে পৃথিবীতে অহংকার করেছিল এবং ওরা মনে করেছিল যে, ওরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না। অতএব, আমি তাকে ও তার বাহিনীকে ধরলাম এবং তাদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। দেখ, জালিমদের পরিণাম কী হয়ে থাকে। ওদেরকে আমি নেতা করেছিলাম। ওরা লোকদেরকে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত; কিয়ামতের দিন ওদেরকে সাহায্য করা হবে না। এ পৃথিবীতে আমি ওদের পশ্চাতে লাগিয়ে দিয়েছি অভিসম্পাত এবং কিয়ামতের দিন ওরা হবে ঘৃণিত। (সূরা কাসাসঃ ৩৬-৪২)
আল্লাহ তা’আলা এ আয়াতের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, যখন ফিরআউন ও তার দলের লোকেরা সত্যের অনুসরণ থেকে অহংকারভরে মুখ ফিরিয়ে নিল এবং তাদের বাদশাহ মিথ্যা দাবি করল, তারা তাকে মেনে নিল ও তার আনুগত্য করল। তখন মহাশক্তিশালী, মহাপরাক্রমশালী প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলার ক্রোধ তীব্র আকার ধারণ করল যার বিরুদ্ধে কেউ জয়লাভ করতে পারে না এবং যাকে কেউ প্রতিহত করতে পারে না। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিলেন, ফিরআউন ও তার সৈন্য-সামন্তকে একদিন প্রত্যুষে ডুবিয়ে দিলেন, ফলে তাদের মধ্যকার কোন ব্যক্তি বা তাদের বাসস্থানের কোন অস্তিত্ব বাকি রইল না। তারা সকলে ডুবে গেল ও দোযখবাসী হল। এই পৃথিবীতে বিশ্ববাসীর মাঝে তারা অভিসম্পাতের শিকার হল এবং কিয়ামতের দিনেও। কিয়ামতের দিনে তাদের পুরস্কার কতই না নিকৃষ্ট হবে এবং তারা হবে ঘৃণিতদের অন্তর্ভুক্ত।