❏ ইসরাঈলের জীবনে সংঘটিত আশ্চর্য ঘটনাবলী

ইসরাঈলের জীবনে যে সব আশ্চর্য ঘটনা সংঘটিত হয় তন্মধ্যে ইউসুফ ইবন রাহীলের ঘটনা অন্যতম। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ্ কুরআনে একটি স্বতন্ত্র সূরা নাযিল করেছেন, যাতে মানুষ এর থেকে গবেষণা করে উপদেশ, শিষ্টাচার ও সূক্ষ্ম তত্ত্ব লাভ করতে পারে।

(بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ الۤرۚ تِلۡكَ ءَایَـٰتُ ٱلۡكِتَـٰبِ ٱلۡمُبِینِ ۝ إِنَّاۤ أَنزَلۡنَـٰهُ قُرۡءَ ٰ⁠ نًا عَرَبِیࣰّا لَّعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ۝ نَحۡنُ نَقُصُّ عَلَیۡكَ أَحۡسَنَ ٱلۡقَصَصِ بِمَاۤ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَیۡكَ هَـٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ وَإِن كُنتَ مِن قَبۡلِهِۦ لَمِنَ ٱلۡغَـٰفِلِینَ)[Surat Yusuf ১ - ৩]

অর্থাৎ, আলিফ-লাম-রাঃ এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত। আমি এটি অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় কুরআন যাতে তোমরা বুঝতে পার। আমি তোমার নিকট উত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি, ওহীর মাধ্যমে তোমার নিকট কুরআন প্রেরণ করে; যদিও এর পূর্বে তুমি ছিলে অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত। (১২ সূরা ইউসুফঃ ১-৩)

হরূফে মুকাততাআত সম্পর্কে আমরা সূরা বাকারার তাফসীরের শুরুতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ বিষয়ে কেউ জানতে চাইলে সেখানে দেখে নিতে পারেন। তারপর এ সূরা সম্পর্কে তাফসীরের মধ্যে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করেছি। তার কিছুটা আমরা এখানে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করব।

তার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাঁর বান্দা ও রাসূলের উপর উচ্চাংগ আরবী ভাষায় যে মহান কিতাব নাযিল করেছেন তার প্রশংসা করছেন। এর পাঠ ও বক্তব্য এতই সুস্পষ্ট, যে কোন বুদ্ধিমান ধী-শক্তিসম্পন্ন লোক সহজেই তা অনুধাবন করতে পারে। সুতরাং আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে এ কিতাবই শ্রেষ্ঠ। ফেরেশতাকুলের শ্রেষ্ঠ ফেরেশতা। এটি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানবের উপর সর্বোত্তম সময়ে ও সর্বোৎকৃষ্ট স্থানে নাযিল করেছেন।

وهو اشرف كتاب نزل من السماء انزله اشرف الملئكة على اشرف الخلق فى اشف زمان ومجان

যে ভাষায় তা নাযিল হয়েছে তা অতি প্রাঞ্জল এবং তার বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আহসানুল কাসাস বা উত্তম বর্ণনার সম্পর্ক যদি অতীত কিংবা ভবিষ্যতের ঘটনার সাথে হয়, তবে তার অর্থ হবে মানুষ সে বিষয়ে যে মতভেদ করছে তন্মধ্যে সঠিক পন্থা কি স্পষ্টভাবে বলে দেয়া এবং ভুল ও বাতিল মতের খণ্ডন করা। আর যদি তার সম্পর্ক আদেশ ও নিষেধের সাথে হয় তাহলে তার অর্থ হবে ভারসাম্যপূর্ণ শরীআত ও বিধান, উত্তম পদ্ধতি এবং স্পষ্ট ও ন্যায়ানুগ ফয়সালা। অন্য আয়াতে এর দৃষ্টান্ত নিম্নরূপঃ

(وَتَمَّتۡ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدۡقࣰا وَعَدۡلࣰاۚ لَّا مُبَدِّلَ لِكَلِمَـٰتِهِۦۚ وَهُوَ ٱلسَّمِیعُ ٱلۡعَلِیمُ)

[Surat Al-An’am ১১৫]

অর্থাৎ, সত্য ও ন্যায়ের দিক থেকে তোমার প্রতিপালকের বাণী সম্পূর্ণ। (৬: ১১৫)

অর্থাৎ সংবাদ ও তথ্য দানের ক্ষেত্রে এটা সত্য আর আদেশ ও নিষেধের ক্ষেত্রে এটা ন্যায়নিষ্ঠ। এ কারণেই আল্লাহ্ বলেছেনঃ

(نَحۡنُ نَقُصُّ عَلَیۡكَ أَحۡسَنَ ٱلۡقَصَصِ بِمَاۤ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَیۡكَ هَـٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ وَإِن كُنتَ مِن قَبۡلِهِۦ لَمِنَ ٱلۡغَـٰفِلِینَ)[Surat Yusuf ৩]

অর্থাৎ, " আমি তোমার কাছে উত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি। ওহীর মাধ্যমে তোমার কাছে এ কুরআন প্রেরণ করেছি। যদিও এর আগে তুমি ছিলে অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত। (১২: ৩)

অর্থাৎ যে বিষয়ে তোমার কাছে ওহী প্রেরিত হচ্ছে সে বিষয়ে অনবহিত ছিলে।

অনুরূপভাবে আল্লাহ্ অন্যত্র বলেছেনঃ

(وَكَذَ ٰ⁠لِكَ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَیۡكَ رُوحࣰا مِّنۡ أَمۡرِنَاۚ مَا كُنتَ تَدۡرِی مَا ٱلۡكِتَـٰبُ وَلَا ٱلۡإِیمَـٰنُ وَلَـٰكِن جَعَلۡنَـٰهُ نُورࣰا نَّهۡدِی بِهِۦ مَن نَّشَاۤءُ مِنۡ عِبَادِنَاۚ وَإِنَّكَ لَتَهۡدِیۤ إِلَىٰ صِرَ ٰ⁠طࣲ مُّسۡتَقِیمࣲ ۝ صِرَ ٰ⁠طِ ٱللَّهِ ٱلَّذِی لَهُۥ مَا فِی ٱلسَّمَـٰوَ ٰ⁠تِ وَمَا فِی ٱلۡأَرۡضِۗ أَلَاۤ إِلَى ٱللَّهِ تَصِیرُ ٱلۡأُمُورُ)[Surat Ash-Shura ৫২ - ৫৩]

অর্থাৎ, এ ভাবে আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রূহ তথা আমার নির্দেশ। তুমি তো জানতে কিতাব কি এবং ঈমান কি? বরং আমি একে করেছি আলো—যা দিয়ে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করি। তুমি তো প্রদর্শন কর কেবল সরল পথ। সে আল্লাহর পথ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার মালিক। জেনে রেখ, সকল বিষয়ের পরিণাম আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তন করে। (৪২: ৫২-৫৩)

আল্লাহ্ বলেনঃ

(كَذَ ٰ⁠لِكَ نَقُصُّ عَلَیۡكَ مِنۡ أَنۢبَاۤءِ مَا قَدۡ سَبَقَۚ وَقَدۡ ءَاتَیۡنَـٰكَ مِن لَّدُنَّا ذِكۡرࣰا ۝ مَّنۡ أَعۡرَضَ عَنۡهُ فَإِنَّهُۥ یَحۡمِلُ یَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ وِزۡرًا ۝ خَـٰلِدِینَ فِیهِۖ وَسَاۤءَ لَهُمۡ یَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ حِمۡلࣰا)

[Surat Ta-Ha ৯৯ - ১০১]

অর্থাৎ, এ ভাবেই আমি তোমার কাছে সেই সব ঘটনার সংবাদ দেই যা পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল। আর আমি তোমাকে আমার কাছ থেকে উপদেশ দান করেছি। যে এর থেকে বিমুখ হবে সে কিয়ামতের দিন মহাভার বহন করবে। সেখানে তারা স্থায়ী হয়ে থাকবে। কিয়ামতের দিন এই বোঝ তাদের জন্যে কতই না মন্দ! (২০: ৯৯-১০১)

অর্থাৎ এই কুরআন বাদ দিয়ে যে ব্যক্তি অন্য কিতাবের অনুসরণ করবে, সে ব্যক্তিই এ সতর্কবাণীর যোগ্য হবে। মুসনাদে আহমদ ও তিরমিযী শরীফে হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে মারফূ ও মওকূফ উভয়ভাবে বর্ণিত হাদীসে এ কথাই বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি কুরআন বাদে অন্য কিছুতে হিদায়ত অন্বেষণ করবে তাকে আল্লাহ্ পথভ্রষ্ট করবেন। ইমাম আহমদ (رحمة الله) জাবির (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন, একদা হযরত উমর (رضي الله عنه) আহলি কিতাবদের থেকে প্রাপ্ত একখানি কিতাব নিয়ে রাসূল (ﷺ)-এর কাছে আসেন এবং তা তাঁকে পড়ে শোনান। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে বললেন, “ওহে ইবনুল-খাত্তাব! কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই কি তোমরা এতে নিমগ্ন হয়ে পড়েছ? সেই সত্তার কসম করে বলছি, যার হাতের মুঠোয় আমার জীবন। আমি তোমাদের কাছে এক উজ্জ্বল আলোকদীপ্ত পরিচ্ছন্ন দীন নিয়ে এসেছি। আহলি কিতাবদের কাছে যদি কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস কর এবং তারা কোন কিছুকে হক বলে তবে তোমরা তা মিথ্যা জানবে কিংবা তারা যদি কোন কিছুকে বাতিল বলে, তবে তোমরা তা সত্য বলে জানবে। সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন, যদি মূসা (عليه السلام) জীবিত থাকতেন, তাহলে আমার আনুগত্য না করে তারও উপায় থাকতো না।’

এ হাদীছ বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমদ (رحمة الله) ভিন্ন এক সূত্রে এ হাদীসটি হযরত উমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ

والذي نفسي بيده لو اصبح فيكم موسى ثم اتبعتموه وتركتمونی الضللتم - انكم حظى من الأمم وانا حظكم من النبين

যে সত্তার হাতে আমার জীবন, সেই সত্তার কসম, তোমাদের মাঝে যদি নবী মূসা বর্তমানে থাকতেন আর আমাকে বাদ দিয়ে তোমরা তাঁর অনুসরণ করতে, তবে অবশ্যই পথভ্রষ্ট হতে। তোমরা আমারই উম্মত আর আমিই তোমাদের নবী।

এই হাদীসের সনদ ও মতন সূরা ইউসুফের তাফসীরে বর্ণনা করা হয়েছে। হাদীসটির কোন কোন বর্ণনায় এরূপ এসেছে যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) একদা জনসমক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে বললেন, হে জনমণ্ডলী! আমাকে সংক্ষিপ্ত বাক্যে ব্যাপক কথা বলার শক্তি দান করা হয়েছে, চূড়ান্ত কথা বলার শক্তি দেওয়া হয়েছে, অতি সংক্ষেপ করার ক্ষমতা আমাকে প্রদান করা হয়েছে। একটি সুস্পষ্ট উজ্জ্বল জীবন ব্যবস্থা আমাকে দেওয়া হয়েছে। অতএব, না বুঝে-শুনে নির্বোধের ন্যায় অন্য কিছুতে প্রবিষ্ট হয়ো না। নির্বোধ লোকদের কর্মকাণ্ড যেন তোমাদেরকে ধোকায় না ফেলে। অতঃপর তিনি সেই লিপিটি আনতে বলেন এবং একটি একটি করে এর প্রতিটি অক্ষর মুছে ফেলা হয়।
Top