❏ প্রিয় রাসূল (ﷺ) নিজেই জানাযার পর দোয়া করেছেন


হাদিস শরীফ থেকে জানা যায়, আল্লাহর হাবীব হযরত রাসূলে পাক (ﷺ) জানাযার নামাজের পরে দোয়া করেছেন। এমনকি দোয়া করার পরেও মৃত ব্যক্তির জন্য বেশী বেশী ইস্তেগফার করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। যেমন:


হাদিস শরীফে আছে, ইমাম ওয়াকেদী, ইমাম ইবনু সা’দ, ইমাম বায়হাক্বী, ইমাম আবু নুয়াইম (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন, 

أَخْرَجَهُ الْوَاقِدِيُّ فِي "كِتَابِ الْمَغَازِي"، فَقَالَ: حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ صَالِحٍ عَنْ عَاصِمِ بْنِ عُمَرَ بْنِ قَتَادَةَ حَدَّثَنِي عَبْدُ الْجَبَّارِ بْنُ عُمَارَةَ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي بَكْرٍ قَالَ: لَمَّا الْتَقَى النَّاسُ بِمُؤْتَةَ جَلَسَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى الْمِنْبَرِ، وَكُشِفَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الشَّامِ فَهُوَ يَنْظُرُ إِلَى مَعْرَكَتِهِمْ فَقَالَ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ: أَخَذَ الرَّايَةَ زَيْدُ بْنُ حَارِثَةَ فَمَضَى حَتَّى اسْتُشْهِدَ، وَصَلَّى عَلَيْهِ وَدَعَا لَهُ، وَقَالَ: اسْتَغْفِرُوا لَهُ، دَخَلَ الْجَنَّةَ وَهُوَ يَسْعَى، ثُمَّ أَخَذَ الرَّايَةَ جَعْفَرُ بْنُ أَبِي طَالِبٍ فَمَضَى حَتَّى اسْتُشْهِدَ فَصَلَّى عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَدَعَا لَهُ ، وَقَالَ: اسْتَغْفرُوا لَهُ

-“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর (رضي الله عنه) বলেন: যখন মুসলমানগণ মুতার যুদ্ধে লিপ্ত, তখন নবী পাক (ﷺ) মিম্বরে বসলেন। ফলে প্রিয় নবীজি (ﷺ) ও শাম দেশের মাঝে দৃশ্যমান করে দেওয়া হল ফলে তিনি স্বচক্ষে যুদ্ধ ক্ষেত্র দেখতে লাগলেন। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন: যায়েদ ইবনে হারেছা পতাকা হাতে নিয়েছেন অত:পর শহীদ হয়েছেন। আল্লাহর নবী (ﷺ) তাঁর জানাযার নামাজ আদায় করলেন ও দোয়া করলেন এবং বললেন: তোমরা তাঁর জন্যে মাগফেরাত কামনা করো। কারণ সে জান্নাতে প্রবেশ করে ছুটাছুটি করছে। অত:পর হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব (رضي الله عنه) পতাকা হাঁতে নিয়েছেন অত:পর সেও শহীদ হয়েছেন। প্রিয় নবীজি (ﷺ) তাঁর জানাযা আদায় করলেন ও দোয়া করলেন এবং বললেন: তোমরা তাঁর জন্যে মাগফেরাত কামনা করো.....।”

(ওয়াকেদী তাঁর ‘কিতাবুল মাগাজী’ গ্রন্থে, ২য় খন্ড, ৭৬১ পৃঃ; ইমাম ইবনে সা’দ: তাব্কাতুল কুবরা, ৪র্থ খন্ড, ২৮ পৃঃ দারুল কুতুব ইলমিয়া; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়্যাত, ৪র্থ খন্ড, ২৮২ পৃঃ; ইমাম আইনী: উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী, ৮ম খন্ড, ২২ পৃঃ; ইবনুল হুমাম: ফাতহুল কাদীর, ২য় খন্ড, ১২১ পৃঃ; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ২য় খন্ড, ৩৫৫ পৃঃ; ইমাম যায়লায়ী: নাছবুর রায়া, ২য় খন্ড, ২৮৪ পৃঃ; ইমাম ইস্পাহানী: দালায়েলুন নবুয়াত, ১ম খন্ড, ৫২৯ পৃঃ;) 


হাদিসের সনদের মান নূন্যতম দ্বায়িফ অথবা হাছান। উল্লেখ্য যে, হাদিসটি ইমাম ওয়াকেদী (رحمة الله عليه) ছাড়াও ইমাম বুখারীর উস্তাদ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সা’দ (رحمة الله عليه)(ইমাম ইবনে সা’দ: তাব্কাতুল কুবরা, ৪র্থ খন্ড, ২৮ পৃঃ দারুল কুতুব ইলমিয়া;) ওফাত ২৩০ হিজরী এবং ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী (رحمة الله عليه)

(ইমাম ইস্পাহানী: দালায়েলুন নবুয়াত, ১ম খন্ড, ৫২৯ পৃঃ;) ওফাত ৪৩০ হিজরী নিজ নিজ সনদে বর্ণনা করেছেন। ইমাম বায়হাক্বী (র:) ওফাত ৪৫৮ হিজরী তদীয় কিতাবে হাদিসটি এভাবে বর্ণনা করেছেন,

قَالَ الْوَاقِدِيُّ: حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ صَالِحٍ، عَنْ عَاصِمِ بْنِ عُمَرَ بْنِ قَتَادَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَمَّا قُتِلَ زَيْدٌ، أَخَذَ الرَّايَةَ جَعْفَرُ بْنُ أَبِي طَالِبٍৃ ثُمَّ مَضَى قُدُمًا حَتَّى اسْتُشْهِدَ  فَصَلَّى عَلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَدَعَا لَهُ وَقَالَ: اسْتَغْفِرُوا لِأَخِيكُمْ،

-“আছেম ইবনে উমর ইবনে কাতাদা (رضي الله عنه) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেছেন: যখন জ্রয়দ (رضي الله عنه) শহিদ হয়ে গেল তখন মুতার যুদ্ধে পতাকা হাতে নিল হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব (رضي الله عنه)।..... অত:পর সে শহিদ হল এমনকি তিনি তা স্বচক্ষে অবলোকন করলেন অত:পর রাসূল (ﷺ) তার জানাযা আদায় করলেন এবং তার জন্য দোয়া করলেন এবং বললেন: তোমরা তোমাদের ভাই এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।” (ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন নবুয়াত, ৪র্থ খন্ড, ৩৬৯ পৃঃ;)


ইমাম মুহাম্মদ ইবনু সা’দ (رحمة الله عليه) এর সনদটি হচ্ছে নিম্নরূপ,

أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عُمَرَ قَالَ: حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ صَالِحٍ عَنْ عَاصِمِ بْنِ عُمَرَ بْنِ قَتَادَةَ قَالَ: وَحَدَّثَنِي عَبْدُ الْجَبَّارِ بْنُ عُمَارَةَ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي بَكْرِ بْنِ محمد بن عمرو بن حزم.

এই হাদিসের সনদে কোন মারাত্বক আপত্তিকর রাবী নেই। তবে বর্ণনাকারী عَبْدُ الجَبَّارِ بنُ عمَارَةَ ‘আব্দুল জাব্বার ইবনু আম্বারা’ সম্পর্কে ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله عليه) তাকে مجهول বললেও وذكره ابن حبان في الثقات ইমাম ইবনু হিব্বান (رحمة الله عليه) তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন।(মুজামুছ ছাগীর লি’ইবনে জারির তাবারী, রাবী নং ২০০৯; ইবনু হিব্বান: কিতাবুস সিক্বাত, রাবী নং ১৪১৭৭; ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ১৫৪৪;) 


ইহার আরেকজন বর্ণনাকারী مُحَمَّد بن صالح بن دينار মুহাম্মদ ইবনু ছালেহ ইবনে দিনার সম্পর্কে ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله عليه) ليس بالقوي শক্তিশালী নয় বলেছেন কিন্তু ইমাম আহমদ ইবনে ছালেহ, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম ইবনু হিব্বান, ইমাম ইবনু সা’দ, ইমাম ইজলী (رحمة الله عليه)ثقة  বিশ্বস্ত বলেছেন।(ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৩৫৬;) 


ইমাম আহমদ (رحمة الله عليه) তাকেثقة  বিশ্বস্ত বলেছেন।(ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৫২৯৩;) 


হাফিজুল হাদিস ইমাম ওয়াকেদী (র:) সম্পর্কে এক জামাত ইমাম দুর্বল ও পরিত্যাজ্য আখ্যা দিয়েছেন এবং ইমাম নাসাঈ, ইমাম ইসহাক্বসহ কতিপয় ইমাম তাকে কিযবের অভিযোগ দিয়েছেন। তবে এক জামাত ইমাম তার উপর নির্ভর করেছেন ও তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন। যেমন 

ইমাম দারওয়ারদী (র:) তাঁকে أمير المؤمنين في الحديث (আমিরুল মু’মীনিন ফিল হাদিস) বলেছেন।(ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৬০৬;) 


ইমাম ইয়াকুব ইবনু শায়বাহ ও কতিপয় মুহাদ্দিছগণ তাকে ثقة বিশ্বস্ত বলেছেন।

(ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৬০৬;) ইমাম আবু উবাইদ কাশেম ইবনু সালাম (র:) তাকে ثقة বিশ্বস্ত বলেছেন।(ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৬০৬; ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৩৩৪; ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৫৫০১;) 


ইমাম মুছআব ইবনু আব্দিল্লাহ (র:) বলেছেন: واللَّه ما رأينا مثل الواقدي قطّ. 

-“আল্লাহর কসম! ইমাম ওয়াকেদীর মত আমরা আর কাউকে দেখিনি।”(ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৩৩৪;) 


ইমাম মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক্ব ছাগানী (র:) বলেছেন ثقة مأمون. -“সে বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য।”  (ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৩৩৪;) 


ইমাম ইয়াজিদ ইবনু হারুন (র:) বলেছেনثقة  সে বিশ্বস্ত।”(ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৩৩৪;) 


ইমাম আবু ইয়াহইয়া আযহারী (র:) তাকে ثقة مأمون. -“সে বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য।”(ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৫৫০১;) 


ইমাম আসকালানী (র:) উল্লেখ করেছেন,

وقال النووي في شرح المهذب في كتاب الغسل منه الواقدي ضعيف باتفاقهم

-“ইমাম নববী (র:) তদীয় ‘শারহু মুহাজ্জাব’ গ্রন্থে গোসলের অধ্যায়ে ইমাম ওয়াকেদী (র:) বলেছেন, সকল ইমামগণের ঐক্যমতে সে দুর্বল বর্ণনাকারী।”(ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৬০৬;) 


অনুরূপ ইমাম যাহাবী (র:) তদীয় ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’র মধ্যেও বলেছেন। অতএব, ইমাম ওয়াকেদী (র:)’র বর্ণিত রেওয়ায়েত নূন্যতম দ্বায়িফ হবে। এছাড়া বাকী রাবীগণ সকলেই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী। অতএব, সামগ্রীক বিচারে হাদিসটি গ্রহণযোগ্য।

সুতরাং, এই হাদিস দ্বারা সরাসরি প্রমাণিত হয়ে যায়, স্বয়ং আল্লাহর নবী (ﷺ) সাহাবীদের জানাযার নামাজের পরে দোয়া করেছেন। যে আমল প্রিয় নবীজি (ﷺ) করেছেন, সে আমলকে বেদয়াত বলা গোমরাহী ও মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। হাদিসের ভাষ্যটি হলো:-

فَصَلَّى عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ অর্থাৎ, প্রিয় নবীজি (ﷺ) তাঁর জানাযা আদায় করলেন।وَدَعَا لَهُ  (ওয়া দায়া লাহু) -“অত:পর তাঁর জন্যে দোয়া করলেন। এখানে সালাত ও দোয়ার মাঝে (و) ‘ওয়া’ হরফে আত্ফ বিদ্যমান রয়েছে। আর সকলেই অবগত আছেন যে, আরবী গ্রামার মোতাবেক ‘মাতুফ’ ও ‘মাতুফ আলায়হি’ কোন সময় এক জাতের হয় না এবং এক সময় সংগঠিত হয়না, বরং একটি কাজ শেষ হওয়া পরে অন্য কাজ সম্পাদিত হয় বুঝায়। সুতরাং  فَصَلَّى عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَدَعَا لَهُ(ফাছাল্লা আলায়হি রাসূলুল্লাহি ওয়া দায়া লাহু) এর (و) দ্বারা প্রমাণিত হয়, الصَّلَاةَ (ছালাত) এবং دُعَاءِ (দোয়া) একই সময় সংগঠিত হবেনা। বরং সালাত সংগঠিত হওয়ার পরে দোয়া সংগঠিত হবে বুঝাবে। তাই  دُعَاءِদ্বারা নামাজ বুঝানো অজ্ঞতা। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) জানাযার সালাত আদায়ের পরেই সাহাবীর জন্য দোয়া করেছেন অত:পর তার জন্য মাগফেরাত কামনা করেছেন। উল্লেখ যে, 


প্রিয় নবীজি (ﷺ) সাহাবী হযরত জাফর (رضي الله عنه) এর জন্য দেখে দেখেই দোয়া করেছেন। যেমন ঐ হাদিসেই উল্লেখ আছে,

وَكُشِفَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الشَّامِ فَهُوَ يَنْظُرُ إِلَى مَعْرَكَتِهِمْ

-“ফলে প্রিয় নবীজি (ﷺ) ও শাম দেশের মাঝে দৃশ্যমান করে দেওয়া হল ফলে তিনি স্বচক্ষে যুদ্ধ ক্ষেত্র দেখতে লাগলেন।” সুতরাং রাসূলে আকরাম (ﷺ) দেখে দেখেই দোয়া করেছেন। 

জানাযার পর আল্লাহর রাসূল (ﷺ) দোয়া করেছেন এই মর্মে আরেকটি সহীহ্ হাদিস উল্লেখ করা যায়, 


ইমাম মুসলীম (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন,

وحَدَّثَنِي هَارُونُ بْنُ سَعِيدٍ الْأَيْلِيُّ، أَخْبَرَنَا ابْنُ وَهْبٍ، أَخْبَرَنِي مُعَاوِيَةُ بْنُ صَالِحٍ، عَنْ حَبِيبِ بْنِ عُبَيْدٍ، عَنْ جُبَيْرِ بْنِ نُفَيْرٍ، سَمِعَهُ يَقُولُ: سَمِعْتُ عَوْفَ بْنَ مَالِكٍ، يَقُولُ: صَلَّى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى جَنَازَةٍ، فَحَفِظْتُ مِنْ دُعَائِهِ وَهُوَ يَقُولُ: اللهُمَّ، اغْفِرْ لَهُ وَارْحَمْهُ وَعَافِهِ وَاعْفُ عَنْهُ، وَأَكْرِمْ نُزُلَهُ

-“যুবাইর ইবনে নুফাইর (رحمة الله عليه) বলেন, আমি হযরত আউফ ইবনে মালেক (رضي الله عنه) কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এক জানাযা আদায় করলেন। অত:পর আল্লাহর রাসূল (ﷺ) থেকে তার দোয়া শিখলাম, আ তিনি বলেছিলেন: আল্লাহুম্মাগফির লাহু ওয়ারহামহু ওয়া আফিহি ওয়াফু আনহু ওয়া আকরিম নুজুলাহু।”(সহীহ্ মুসলীম, ১ম খন্ড, ৩১১ পৃঃ হাদিস নং ২২৭৬;)


এই হাদিসের প্রিয় নবীজি (رحمة الله عليه) থেকে যে দোয়া আউফ ইবনে মালেক (رضي الله عنه) শিখেছেন তা ছিল জানাযার নামাজের পরে। যেমন মুসলীম শরীফের শরাহ্তে ইমাম নববী (رحمة الله عليه) উল্লেখ করেছেন,

أن قوله حفظت من دعائه أي علمنيه بعد الصلاة فحفظته. -“আমি তাঁর দোয়া শিখলাম’ অর্থাৎ জানাযার পর রাসূল (ﷺ) আমাকে দোয়া শিক্ষা দিলেন ফলে ইহা শিখলাম।” (ইমাম নববী: শরহে মুসলীম, ৮ম খন্ড, ৭৫ পৃঃ;) 


সুতরাং রাসূলে পাক (ﷺ)’র সুন্নাহ মোতাবেক জানাযার পর দোয়া করা অবশ্যই জায়েয। কেননা প্রিয় নবীজি (ﷺ) জানাযার পরে তালিমান উচ্চস্বরে এই দোয়া পাঠ করেছেন ও সাহাবীদের শিক্ষা দিয়েছেন। 


এ বিষয়ে অপর হাদিসে আছে, ইমাম আহমদ, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম ইবনে মাজাহ, ইমাম বাজ্জার, ইমাম নাসাঈ, ইবনে ইবনু খুজাইমা (رحمة الله عليه) প্রমূখ বর্ণনা করেছেন,

حَدَّثَنَا خَلَفُ بْنُ الْوَلِيدِ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَيُّوبُ بْنُ عُتْبَةَ، عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا صَلَّى عَلَى الْجِنَازَةِ، فَقَالَ: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا، وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا، وَصَغِيرِنَا وَكَبِيرِنَا، وَذَكَرِنَا وَأُنْثَانَا، اللَّهُمَّ مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَأَحْيِهِ عَلَى الْإِسْلَامِ، وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الْإِيمَانِ 

-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন: যখন রাসূল (ﷺ) জানাযার নামাজ আদায় করতেন, তারপর (নামাজের পর) বললেন: আল্লাহুম্মাগ ফিরলী হায়্যেনা ওয়া মায়্যেতেনা ওয়া ছাগিরীনা ....।” 

(মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৮৮০৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৪৯৮; আবু দাউদ শরীফ, ২য় জি: ৪৫৬ পৃঃ হাদিস নং ৩২০১; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস নং ৮৫৫৬; ইমাম নাসাঈ: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ১০৮৫২; সহীহ্ ইবনে খুজাইমা, হাদিস নং ৩০৭০; তাবারানী: আদ-দোয়া, হাদিস নং ১১৭৩; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস নং ১৩২৬; ইমাম বায়হাক্বী: দাওয়াতুল কবীর, হাদিস নং ৬২৮; মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদিস নং ৬০০৯; ইমাম বায়হাক্বী: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ৬৯৭১;)


ইমাম হাকেম (رحمة الله عليه) বলেন: هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ عَلَى شَرْطِ الشَّيْخَيْنِ -“এই হাদিস বুখারী-মুসলীমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ্।”(মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস নং ১৩২৬;) 


আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله عليه) বলেন: حَسَنٌ صَحِيحٌ، -“এই হাদিস হাছান সহীহ।”(মেরকাত শরহে মেসকাত;) 


এই হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, রাসূলে পাক (ﷺ) জানাযার নামাজের পরে দোয়া করতেন। এখানে فَقَالَ (ফাক্বালা) অর্থ হলো এরপরে বা নামাজের পর বললেন। কারণ (فَ) ‘ফা’ হরফে আত্ফ, যা একটি কাজ শেষ হওয়ার পর আরেকটি কাজ করা বুঝায়। এ ব্যাপারে পূর্বে আমরা গ্রামারের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তবে এই দোয়া জানাযার ভিতরেও প্রিয় নবীজি (ﷺ) পড়েছেন। 


এ সম্পর্কে আরেকটি রেওয়ায়েতে আছে, ইমাম ইবনে মাজাহ, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম বায়হাক্বী, ইমাম ইবনু হিব্বান (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন,

 حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ إِبْرَاهِيمَ الدِّمَشْقِيُّ قَالَ: حَدَّثَنَا الْوَلِيدُ بْنُ مُسْلِمٍ قَالَ: حَدَّثَنَا مَرْوَانُ بْنُ جَنَاحٍ قَالَ: حَدَّثَنِي يُونُسُ بْنُ مَيْسَرَةَ بْنِ حَلْبَسٍ، عَنْ وَاثِلَةَ بْنِ الْأَسْقَعِ، قَالَ: صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى رَجُلٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ: اللَّهُمَّ إِنَّ فُلَانَ بْنَ فُلَانٍ فِي ذِمَّتِكَ، فَقِهِ فِتْنَةَ الْقَبْرِ 

-“হযরত অছিলাতা ইবনে আছকা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে নিয়ে এক মুসলমানের জানাযা আদায় করেন। অত:পর (নামাজের পরে) তাঁকে বলতে শুনলাম: হে আল্লাহ অমুকের পুত্র অমুত তোমার জিম্মায়....।”(সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ, ১০৯ পৃঃ হাদিস নং ১৪৯৯; সুনানে আবী দাউদ, হাদিস নং ৩২০২; সহীহ্ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৩০৭৪; ইমাম বায়হাক্বী: দাওয়াতুল কবীর, হাদিস নং ৬৩১;) 


এই হাদিস সম্পর্কে আল্লামা ইবনে মুলাক্কিন মিছরী (رحمة الله عليه) বলেন:

رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَابْن مَاجَه وَصَححهُ ابْن حبَان -“ইমাম আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله عليه) একে সহীহ্ বলেছেন।”(তুহফাতুল মুহতাজ ইলা আদিল্লাতিল মিনহাজ, ১ম খন্ড, ৫৯৭ পৃঃ;) 


এখানে فَسَمِعْتُهُ এর ফা (فَ) দ্বারা প্রমাণিত হয় নামাজ আদায়ের পরপরই এই দোয়া করেছিলেন ফলে সাহাবীরা ঐ দোয়াটি শুনেছেন। এ ব্যাপারে পূর্বে আমরা গ্রামারের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

এই হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত হয়, আল্লাহর নবী (ﷺ) জানাযা আদায় করে মায়্যেতের জন্যে উচ্চ আওয়াজে দোয়া করতেন ফলে সাহাবীরা ঐ দোয়া গুলো শুনতেন। নিচু আওয়াজে দোয়া করলে সাহাবীরা শুনতেন না। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, জানাযার নামাজের ভিতরের দোয়া উচু আওয়াজে পড়া হয়না ফলে কেউ ঐ দোয়া গুলো পিছন থেকে মুছল্লীরা শুনেনা। নামাজের বাহিরের দোয়া উচু আওয়াজে পড়তেন তাই সাহাবীগণ শুনেছেন, এখানে فَسَمِعْتُهُ অর্থ অত:পর আমি শুনলাম। (فَ) ‘ফা’ হরফে আত্ফ এর অন্তর্ভূক্ত। 


এ বিষয়ে আরেক হাদিসে রয়েছে, ইমাম ইবনু মাজাহ, ইমাম আবু দাউদ ত্বয়ালিছী (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন,

حَدَّثَنَا أَبُو دَاوُدَ قَالَ: حَدَّثَنَا الْفَرَجُ بْنُ فَضَالَةَ، عَنْ أَبِي بَكْرِ بْنِ أَبِي مَرْيَمَ، عَنْ حَبِيبِ بْنِ عُبَيْدٍ، عَنْ عَوْفِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: شَهِدْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَّى عَلَى جِنَازَةِ رَجُلٍ مِنَ الْأَنْصَارِ فَسَمِعْتُهُ يَقُولُ: اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَيْهِ وَاغْفِرْ لَهُ وَارْحَمْهُ 

-“হযরত আওফ ইবনে মালেক (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, রাসূলে পাক (ﷺ) আমাদেরকে নিয়ে এক আনছারী ব্যক্তির জানাযা আদায় করেন। অত:পর (নামাজের পর) তাঁকে বলতে শুনলাম “আল্লাহুম্মা ছাল্লি ওয়াগফিরলাহু ওয়ার হামুহু....।”(সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ, ১১০ পৃঃ হাদিস নং ১৫০০; মুসনাদে আবী দাউদ ত্বায়ালিছী, হাদিস নং ১০৯২;) 


এই হাদিসের সনদে فرج بن فضالة بن النعمان (ফারাজ ইবনে ফুদ্বালা ইবনে নুমান) সম্পর্কে ইমামগণ অনেকে সমালোচনা করলেরও ইমাম আহমদ (رحمة الله عليه), ইবনে মাঈন (رحمة الله عليه) তার উপর নির্ভর করেছেন ও ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله عليه) তাকে সত্যবাদী বলেছেন। যেমন:-

 قال معاوية بْن صالح، عن أحمد بْن حنبل: ثقة. -

“মুয়াবিয়া ইবনে ছালেহ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه) হতে বর্ণনা করেন, সে বিশ্বস্ত।”(ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৪৭১৪;)

 

وَقَال عثمان بْن سَعِيد الدارمي ، عَن يحيى بْن مَعِين: ليس به بأس.

-“উছমান ইবনে সাঈদ দারেমী ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (رحمة الله عليه) হতে বর্ণনা করেন, তার ব্যাপারে অসুবিধা নেই।”(ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৪৭১৪;) 


وَقَال أبو حاتم: صدوق، يكتب حديثه، ولا يحتج به، -

“ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله عليه) বলেন: সে সত্যবাদী, তার হাদিস লিখি কিন্তু তার উপর নির্ভর করিনা।”(ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৪৭১৪;) 


ইমাম ইবনু মাদিনী (র:) বলেছেন: هو وسط وليس بالقوي -“সে মধ্যম ও শক্তিশালী নয়।”(ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৪৮৬;) 


তাই অন্যান্য রেওয়ায়েত দ্বারা সমর্থন পাওয়ায় হাদিসটি অবশ্যই হাছান হিসেবে স্বীকৃতি পাবেনা। এই হাদিসও প্রমাণ করে আল্লাহর হাবীব (ﷺ) জানাযার পর দোয়া করেছেন, এবং সাহাবীগণ পেছন থেকে সেই দোয়া শুনেছেন, এ জন্যেই বলা হয়েছে فَسَمِعْتُهُ (ফাছামি’তুহু)। এখানেও (فَ) ‘ফা’ হরফে আত্ফ রয়েছে, যার ব্যাপারে পূর্বে গ্রামারের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। 


এ বিষয়ে অপর রেওয়ায়েতে আছে, ইমাম আহমদ, ইমাম বায়হাক্বী, ইমাম নাসাঈ, ইমাম তাবারানী, ইমাম আবু দাউদ (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন,

حَدَّثَنَا عَبْدُ الصَّمَدِ، حَدَّثَنِي أَبِي، حَدَّثَنِي أَبُو الْجُلَاسِ عُقْبَةُ بْنُ سَيَّارٍ، قَالَ: حَدَّثَنِي عَلِيُّ بْنُ شَمَّاخٍ، قَالَ: شَهِدْتُ مَرْوَانَ سَأَلَ أَبَا هُرَيْرَةَ، كَيْفَ سَمِعْتَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي عَلَى الْجِنَازَةِ؟ فَقَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ: اللهُمَّ أَنْتَ رَبُّهَا، وَأَنْتَ خَلَقْتَهَا، وَأَنْتَ هَدَيْتَهَا لِلْإِسْلَامِ، وَأَنْتَ قَبَضْتَ رُوحَهَا، وَأَنْتَ أَعْلَمُ بِسِرِّهَا، وَعَلَانِيَتِهَا، جِئْنَا شُفَعَاءَ فَاغْفِرْ لَهَا

-“আলী ইবনু সাম্মাখ বলেন, আমি মারওয়ানের কাছে উপস্থিত ছিলাম সে হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) প্রশ্ন করল, রাসূলে পাক (ﷺ) কে জানাযায় কিভাবে পাঠ করতে শুনতেন? তখন হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বললেন: ‘আল্লাহুম্মা আন্তা রাব্বুহা ওয়া আন্তা খালাক্বতুহা ওয়া আন্তা হাদায়তুহা লিল ইসলাম....।”

(ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, ৮ম খন্ড, ৮৫ পৃঃ ৪২৩০১ ও ৪২৩০২; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৮৫৪৫; ইমাম বায়হাক্বী: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ৬৯৭৬; ইমাম নাসাঈ: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ১০৮৫০; ইমাম তাবারানী: আদ দোয়া, হাদিস নং ১১৮৬; সুনানে আবী দাউদ, হাদিস নং ৩২০০;) 


সুতরাং জানাযার ভিতরে কোন দোয়া উচ্চস্বরে পাঠ করা হয়না। সুতরাং এই দোয়া জানাযার পরেই প্রিয় রাসূল (ﷺ) উচ্চস্বরে পাঠ করেছেন এবং হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) শুনেছেন ও মুখস্থ করেছেন। অতএব, জানাযার নামাজের পর খোদা তা’লার নিকট মায়্যেতের জন্য দোয়া করা রাসূলে পাক (ﷺ)’র সুন্নাত। 

Top