কিতাবঃ ফাদাক বাগান

মূল: মওলানা মুহাম্মদ আবদুস্ সাত্তা’র তানসউয়ী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


[Bengali translation of ‘Fadak Garden’ by Mawlana Muhammad Abdus-Satta’r Tonswiy; translator: Kazi Saifuddin Hossain]


সূচিপত্র


ভূমিকা;


সাফল্যের সূত্র;


সাহাবা কেরাম (رضي الله عنه);


ফাদাক বাগান;


আম্বিয়া (عليه السلام)’এর উত্তরাধিকার:


প্রথম প্রমাণ;

দ্বিতীয় প্রমাণ;

তৃতীয় প্রমাণ;

চতুর্থ প্রমাণ;

পঞ্চম প্রমাণ;

ষষ্ঠ প্রমাণ;


হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه) হতে অনুরোধের বিবরণ;


হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه)’এর উত্থাপিত প্রশ্নের উদ্দেশ্য ও হেকমত;


উত্তরাধিকারের পক্ষে পেশকৃত শিয়া-বর্গের প্রামাণ্য দলিল:


প্রথম প্রমাণ;

জবাব;


দ্বিতীয় প্রমাণ;

জবাব


তৃতীয় প্রমাণ;

জবাব;


প্রশ্ন;

জবাব;


ফাদাক উপহারস্বরূপ দানের ইঙ্গিত-সম্বলিত বর্ণনাসমূহ;


হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه)’এর অসন্তুষ্টির ধারণাজ্ঞাপক বর্ণনাসমূহ;


হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه) পরিতুষ্ট ছিলেন;


হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه)’এর জানাযা।


بسم الله الرحمن الرحيم


 মহান আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।


ভূমিকা


সমগ্র জগতের প্রভু আল্লাহরই প্রতি যাবতীয় প্রশংসা বিহিত। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক সাইয়্যেদুল মুরসালীন (আম্বিয়াকুল শিরোমণি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), তাঁর পরিবার-সদস্যবৃন্দ (رضي الله عنه), পবিত্র স্ত্রীমণ্ডলী (رضي الله عنه) ও সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)’এর প্রতি।


মুসলমান সম্প্রদায়ের মাঝে প্রভাষণ দিতে আমি যেখানে সফরে গিয়েছি, সেখানেই ফাদাক বাগানের ঘটনা সম্পর্কে আমাকে প্রশ্নবানে আক্রান্ত হতে হয়েছে [ফাদাক হচ্ছে উত্তর আরবে অবস্থিত খায়বার এলাকার নিকটবর্তী একটি পল্লী, যা মদীনা হতে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দূরে]। তবে এখানে লক্ষণীয় যে, খোদ ঘটনাটি ইসলাম ধর্মের মৌলিক এমন কোনো বিষয় নয় যে কারো ঈমানদারি সংরক্ষণে সে সম্পর্কে জানতেই হবে।


উদাহরণস্বরূপ, কেউ ইসলাম ধর্মের মৌলিক আক্বীদা-বিশ্বাস পোষণ করলে এবং ফাদাকের ঘটনা-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য না জানলে, কিংবা ঘটনাটি সম্পর্কে একেবারে বে-খবর হলেও তাঁর বিশ্বাস মজবুত-ই থাকবে। এটা স্রেফ একটা ঐতিহাসিক ঘটনা মাত্র।


আমার আক্বীদা-বিশ্বাস হলো, আনসার ও মুহাজিরীন, বনূ হাশিম ও বনূ ক্বুরাইশ গোত্রগুলোর মাঝে সার্বিকভাবে বিরাজ করছিলো ঐকমত্য; আর সুনির্দিষ্টভাবে তা বিরাজ করছিলো সর্ব-হযরত আবূ বকর, উমর, উসমান, আলী, আব্বাস, হাসান, হুসাইন, সাইয়্যেদাহ ফাতিমাহ আল-যাহরা ও সাইয়্যেদাহ আয়েশাহ আল-সিদ্দীক্বা (رضي اللّٰه عنهم)’এর মাঝে। অধিকন্তু, আমার আক্বীদা-বিশ্বাস হলো, তাঁরা ছিলেন মূর্ত প্রকাশ নিম্নের ক্বুরআনী আয়াতসমূহের:


رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ


অর্থ: (তাঁরা) পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। [আল-ক্বুরআন, ৪৮:২৯; নূরুল ইরফান]


এবং


وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّٰهِ جَمِيْعًا


অর্থ: আর আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো সবাই মিলে। [আল-ক্বুরআন, ৩:১০৩; নূরুল ইরফান]


এ ছাড়া, আল-ক্বুরআনের বিভিন্ন আজ্ঞার উদ্দীপ্ত অনুসারী হিসেবে আমি এই পুস্তিকাটি সংকলনে অনুপ্রাণিত হয়েছি।


আমরা বর্তমানে এমন এক যুগে বসবাস করছি যখন নানা অঙ্গন থেকে ইসলামী ঐক্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা চলছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর সময়কাল হতে আজ অবধি মুসলমান সম্প্রদায়ের মাঝে কীল বসিয়ে তাঁদেরকে দল-উপদলে বিভক্ত করার প্রাণান্ত চেষ্টা করা হয়েছে। উপরন্তু, এমন আরো কিছু লোক আছে যারা ইসলামের সে সকল মহান নেতৃবৃন্দকে মিথ্যে অভিযোগ দ্বারা অসম্মান/অপদস্থ করতে চায়, যাঁদের পুণ্যাত্মাকে স্বয়ং রাসূলে পাক (ﷺ) হৃষ্টপুষ্ট করেছিলেন। ওই লোকেরা প্রিয়নবী (ﷺ)’এর মহান সাহাবায়ে কেরাম (رضي اللّٰه عنهم)’কে একে অপরের আত্মমগ্ন শত্রু, পার্থিব লোভ-লালসাসম্পন্ন ও গরিব-অভাবী মানুষের প্রতি অযত্নবান হওয়ার দোষারোপ করে থাকে। তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হলেন উম্মতের পথপ্রদর্শনকারী তারকারাজিসম সর্ব-হযরত আবূ বকর, উমর, উসমান, আলী ও সাইয়্যেদাহ ফাতিমা (رضي اللّٰه عنهم)। (আমরা অমন ভুলভ্রান্তি হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি)


ওপরে উল্লেখিত বিষয়াদির কারণে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমি কিছু কথা লেখার জন্যে কলম হাতে তুলে নিয়েছি।


আশা করা যায়, এই লেখনীর মাধ্যমে ইসলামী পতাকা উড্ডীনকারী নেতৃবৃন্দ ও তাঁদের নির্মল চরিত্র মহান সাহাবা-মণ্ডলীর প্রতি হানা অন্যায় আক্রমণ হতে অমলিন থাকবে। এটা যেনো উম্মতের ঐক্য অটুট রাখারও মাধ্যম হয়। আর আল্লাহর দয়া ছাড়া পুণ্যদায়ক কর্ম সাধনের ক্ষমতা কারোরই নেই।


ফাদাক বাগানের ঘটনার গভীরে ডুব দেবার আগে একবার নিচের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবুন: একজন ন্যায়বান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ভালোভাবেই জানেন যে অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতেও কোনো ধর্মীয় আন্দোলনের গোড়াপত্তনের সময়ে সেটার উত্থান ও সাফল্যের চাবিকাঠি হচ্ছেন সে সকল ব্যক্তি, যাঁরা ভিত্তিমূল স্থাপনে নিজেদের সমস্ত কিছু ত্যাগ ও উৎসর্গ করেন। তাঁরা এই লক্ষ্য অর্জনে তাঁদের ধনসম্পদ, পরিবার ও জীবন বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত থাকেন। তবু এ ত্যাগ-তিতিক্ষা তখনই সহনীয় হয়, যখন আন্দোলনের নেতার প্রতি তাঁদের পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা থাকে। এটা কেবল তখনই গ্রহণযোগ্য হয়, যখন তাঁরা পূর্ণ সচেতন হন এ মর্মে যে তাঁদের নেতা স্বার্থপর নন; কিংবা মানুষের সম্পদের প্রতি তাঁর কুদৃষ্টি নেই; বরঞ্চ তিনি বৃহত্তর স্বার্থকে নিজের ও নিজের প্রিয়জনদের চেয়েও অগ্রাধিকার দেন।


সাফল্যের রহস্য নিহিত রয়েছে সেই আন্তরিক নেতার নিঃস্বার্থ ত্যাগে, যিনি উদ্দেশ্য ও আদর্শের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করেন। ওই ধরনের নেতার অধীনেই উল্লেখিত অনুসারীবৃন্দ তাঁর হুকুম তামিল করে থাকেন।


সাফল্যের সূত্র 


এই ফর্মূলা/সূত্রটি পছন্দনীয় ও পরীক্ষিতভাবে সাফল্যমণ্ডিত হওয়ার কারণ এই যে, এটা খাঁটি ও ত্রুটিহীন শিক্ষাগুলোর মধ্য হতে একটি, আর এর সাথে সংযুক্ত রয়েছে আম্বিয়া (عليهم السلام)’এর পবিত্র ও আশীর্বাদধন্য জীবন (-সমূহের শিক্ষাও)। 


রাজা-বাদশাহ যেখানে ক্ষমতায় আরোহণ করেন সম্পদের পাহাড় গড়তে, বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে, আর নিজেদের প্রতিটি খোশখেয়াল ও জৈবিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার ক্ষেত্রে থাকেন মোহাবিষ্ট; যেখানে তাঁদের দিন-রাত অতিবাহিত হয় এক মনে এক ধ্যানে দুনিয়া অর্জনের একমাত্র ধান্ধায়, সেখানে এক শ্বাসভর্তি দূষণমুক্ত বায়ুস্বরূপ আমরা পয়গাম্বর (عليهم السلام)’বৃন্দ ও তাঁদের প্রতিনিধি (رضي اللّٰه عنهم)’মণ্ডলীকে রাজা-বাদশাহর একদম বিপরীত অবস্থানে দেখতে পাই। তাঁদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ হতে যোজন যোজন দূরে। আল্লাহতা’লাকে সন্তষ্ট করাই তাঁদের অন্তরের সাধনা। তাঁদের বেদনা ও আবেগ হলো নিজেদের ধনসম্পদ, দেহ ও আত্মা, নিকটজন, আরাম-আয়েশ সবই আল্লাহতা’লার পথে ও রেযামন্দিতে উৎসর্গ করা। এই হচ্ছে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নগুলোর উৎসমূল এবং এটাই প্রকৃত সাফল্য। 


এই পুণ্যাত্মাবৃন্দ ওই (ঐশী) পথে চলাকালে যতো নির্যাতন-নিপীড়ন ও বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছেন, তা তাঁদের জন্যে কেবল সহনীয়-ই হয় নি, বরং তাঁরা তাতে লাভ করেছেন ঐশী পরমানন্দ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। তাঁদের মক্বাম/মর্যাদাপূর্ণ স্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে আল্লাহতা’লার চূড়ান্ত গোলামি ও তাঁরই খাতিরে সমস্ত কর্ম সম্পাদন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত-ব্যয়, প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, সমস্ত দুশ্চিন্তা-ভাবনা একমাত্র আল্লাহরই জন্যে হওয়া উচিৎ। প্রত্যেকের বচন, শ্রবণ, দান, দণ্ডায়মান, উপবেশন, শয়ন ও চূড়ান্তভাবে জীবন যাপন ও মরণ সবই হওয়া চাই একমাত্র আল্লাহর খাতিরে। এই শিক্ষাই পয়গাম্বর (عليهم السلام)’মণ্ডলী দিয়ে গিয়েছেন এবং তাঁদের খলীফা/প্রতিনিধি (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দও তা গ্রহণ করেছেন।


রোমের সিজার (রাজা) ও পারস্যের খসরু (বাদশাহ)’বর্গের উত্তরাধিকারের শিক্ষা হিসেবে তাঁদের পরে আগত রাজা-বাদশাহ পেয়েছিলেন ধনসম্পদ ও বস্তুগত মালিকানা, যার সাথে যোগ হয়েছিলো ক্ষমতা ও অহঙ্কার। পক্ষান্তরে, পয়গাম্বর (عليهم السلام)’বৃন্দ উত্তরাধিকারস্বরূপ রেখে যান ন্যায়-নিষ্ঠা, দৃষ্টান্তমূলক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, নুবুওয়্যতের জ্ঞান-প্রজ্ঞা, আর আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গের আবেগ। এ পথ-চলার সময় তাঁদের প্রাপ্ত অর্থ-বিত্ত তাঁরা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছিলেন আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়ের ও গরিব-দুঃস্থদের দানের উদ্দেশ্যে।


মহানবী (ﷺ)’এর ক্ষেত্রে ক্বুরআন মজীদ একেবারে উচ্চকণ্ঠ ও সুস্পষ্ট; এরশাদ হয়েছে:


 قُلْ إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلْعَالَمِينَ 


অর্থ: আপনি বলুন, ‘নিঃসন্দেহে আমার নামায, আমার ক্বুরবানীগুলো, আমার জীবন ও আমার মরণ - সবই আল্লাহর জন্যে, যিনি রব্ব সমগ্র জাহানের।’ [সূরা আন‘আম, ১৬২ আয়াত, নূরুল এরফান]


অন্যত্র ঘোষিত হয়েছে:


 قُلْ مَآ أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِلاَّ مَن شَآءَ أَن يَتَّخِذَ إِلَىٰ رَبِّهِ سَبِيلاً


অর্থ: আপনি বলুন, ‘আমি এর জন্যে তোমাদের কাছ থেকে কোনো বিনিময় চাই না, কিন্তু যে ইচ্ছা করে সে তার রব্বের পথ অবলম্বন করুক!’ [সূরা ফুরক্বান, ৫৭ আয়াত, প্রাগুক্ত নূরুল এরফান]


প্রিয়নবী (ﷺ) একটি হাদীসে উল্লেখ করেন: 


ما لي وللدنيا


অর্থ: দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক? (মানে সম্পর্ক নেই) [মুসনাদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله): #২৬৪১]


এ কারণেই রাসূলে করীম (ﷺ) দিন-রাত মগ্ন ছিলেন পরকাল-ভোলা, অজ্ঞতায় নিমজ্জিত, দুনিয়া-আসক্ত, নিজেদের কামনা-বাসনার শেকলাবদ্ধ ব্যক্তিদের মুক্তির চিন্তায়। তাঁর ভাবনা ছিলো আল্লাহর সাথে আত্মিক যোগাযোগ-বিচ্ছিন্নতা হতে তাদেরকে রক্ষা করা; ঐশী জ্যোতি অর্জন করে আল্লাহকে জানার রাস্তাটি তাদের জন্যে আলোকিত করা; আর এর পাশাপাশি তাদেরকে আপন ধনসম্পদ, জীবন, পরিবার ও বন্ধুবান্ধব, সংক্ষেপে সব কিছু আল্লাহর দরবারে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত করা।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে তেইশ বছরের (নবুওয়্যতের) সময়কালে অক্লান্ত ও আকুলভাবে আল্লাহর দিকে (মানুষকে) আহ্বানের সাধনারত হন, আর পূর্ণ আন্তরিকতা ও ভক্তিসহ ইসলামের বাণী প্রচার-প্রসারে শিক্ষা ও উপদেশ দান করেন। এই আশীর্বাদপূর্ণ প্রচারের ফলাফল বিস্ময়কর। মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে আরম্ভ করেন, যেমনটি ক্বুরআন মজীদে নির্দেশিত হয়েছে: 


وَرَأَيْتَ ٱلنَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ ٱللَّهِ أَفْوَاجاً


অর্থ: এবং আপনি মানুষদেরকে দেখবেন, আল্লাহর দ্বীনে দলে দলে প্রবেশ করছে। [সূরা নাসর, ২ নং আয়াত, নূরুল এরফান]


ওপরের আয়াতটি সেসব মানুষকে উদ্দেশ্য করেছে, যাঁরা নজিরবিহীন সংখ্যায় ইসলাম ধর্মে ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছেন। তাঁদের সম্পর্কে ক্বুরআন মজীদ ঘোষণা করে:


 يَتْلُواْ عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُّبِينٍ


অর্থ: যিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের প্রতি তাঁর (আল্লাহর) আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন, আর তাদেরকে কিতাব (ক্বুরআন) ও হিকমত (ঐশী জ্ঞান-প্রজ্ঞা) শিক্ষা দান করেন এবং নিশ্চয় তারা এর আগে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিলো। [সূরা আলে ইমরান, ১৬৪ আয়াত, নূরুল এরফান]


সাহাবা কেরাম (رضي اللّٰه عنهم)’কে এই শিক্ষাদান ও তাঁদের পবিত্রকরণের ফলশ্রুতিতে তাঁরা সমস্ত পাপ ও অপকর্ম পরিত্যাগ করেন এমনই এক পর্যায়ে যে, আল্লাহতা’লা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে তাঁদের সম্পর্কে বারংবার বলেন তাঁরা আচার-ব্যবহারে সবচেয়ে মহৎ; (বস্তুতঃ) এ কথার দ্বারা তিনি বুঝিয়েছেন তাঁদের ঈমানদারি, হেদায়াত-প্রাপ্তি, আস্থাশীলতা, আন্তরিকতা এবং সর্বোপরি তাঁরই রেযামন্দি/সন্তুষ্টি অর্জনকে।


হুদায়বিয়া’র সন্ধিকালে ১৪০০ সাহসী সাহাবা (رضي الله عنه) কুফফার-বর্গকে যুদ্ধে মোকাবিলায় নিজেদের জীবন শাহাদাতে উৎসর্গ করার শপথ প্রিয়নবী (ﷺ)’এর আশীর্বাদধন্য হাতে গ্রহণ করেন। 


সাহাবা-এ-কেরাম (رضي اللّٰه عنهم)’এর ধর্মের প্রতি এ অমর এশক্ব-মহব্বত এবং এতদুদ্দেশ্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার (অনন্য) নজির ’হায়া’তুল ক্বুলূব’ পুস্তকে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই বইটিকে শিয়া গোষ্ঠী নিজেরাও বিশ্বস্ত হিসেবে বিবেচনা করে।


হযরত উরওয়াহ ইবনে মাসউদ (رضي اللّٰه عنه) নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর নির্দেশাবলীকে সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দ শ্রদ্ধা করতেন এবং মেনে চলতেন। তিনি তাঁদেরকে আদেশ দিলে তৎক্ষণাৎ তাঁরা তা পালন করতেন; তিনি অযূ করলে অবশিষ্ট পানি যাতে মাটিতে না পড়ে সে জন্যে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করতেন; আর তিনি কথা বল্লে তাঁরা নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করতেন এবং শ্রদ্ধাবনত হয়ে এক নাগাড়ে তাঁর পবিত্র চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতেন না।”


হযরত উরওয়াহ (رضي اللّٰه عنه) আরো বলেন: “আমি এমন কোনো রাজাকে দেখিনি, যাঁর প্রতি আপন সভাসদবর্গ ওই রকম সম্মান প্রদর্শন করেছেন, যেমনটি করেছেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর প্রতি তাঁরই সাহাবা-এ-কেরাম (رضي اللّٰه عنهم)।” [হায়া’তুল্ ক্বুলূব, ২য় খণ্ড, ৪০৫ পৃষ্ঠা]


এই শপথ গ্রহণের ঘটনাটি ‘বায়’আত আল-রিদওয়ান’ নামে পরিচিত [লেখকের নোট: হুদায়বিয়াহ’র সন্ধির সময় প্রিয়নবী (দ:)’এর হাতে একটি গাছের নিচে ওই আনুগত্য প্রকাশের ঘটনাটি ঘটে; এটা হযরত উসমান (رضي اللّٰه عنه)’এর নিহত হওয়ার গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিশোধ গ্রহণের শপথ ছিলো]। আল্লাহতা’লা এ সম্পর্কে বলেন:


 إِنَّ ٱلَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ ٱللَّهَ يَدُ ٱللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ           


 অর্থ: ওই সব মানুষ যারা আপনার কাছে বায়’আত গ্রহণ করছে, তারা তো আল্লাহরই কাছে বায়’আত গ্রহণ করছে। তাদের হাতগুলোর ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে। [সূরা ফাতহ্, ১০ আয়াত, নূরুল এরফান]


শপথটির ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আল্লাহতা’লা ফরমান:


لَّقَدْ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنِ ٱلْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ ٱلشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأنزَلَ ٱلسَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحاً قَرِيباً


অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহতা’লা সন্তুষ্ট হয়েছেন ঈমানদারদের প্রতি যখন তারা ওই বৃক্ষের নিচে আপনার কাছে বায়’আত গ্রহণ করছিলো। সুতরাং আল্লাহ জেনেছেন যা তাদের অন্তরগুলোতে রয়েছে। অতঃপর তাদের ওপর প্রশান্তি অবতীর্ণ করেছেন এবং তাদেরকে শিগগির আগমনকারী বিজয়ের পুরস্কার দিয়েছেন। [সূরা ফাতহ্, ১৮ আয়াত, নূরুল এরফান]


একই সূরায় এই ১৪০০ অনুগত ও আশীর্বাদধন্য পুণ্যাত্মা যাঁরা নিজেদের জান ক্বুরবান করার জন্যে ছিলেন প্রস্তুত, তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ আরো ফরমান:


 إِذْ جَعَلَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ ٱلْجَاهِلِيَّةِ فَأَنزَلَ ٱللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ وَعَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ وَأَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ ٱلتَّقْوَىٰ وَكَانُوۤاْ أَحَقَّ بِهَا وَأَهْلَهَا وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيماً


অর্থ: যখন কাফির-বর্গ তাদের হৃদয়ে পোষণ করে রেখেছে অন্ধকার যুগের গোত্রীয় অহমিকার মতো অহমিকা, তখন আল্লাহ আপন প্রশান্তি আপন রাসূল ও ঈমানদারদের ওপর অবতীর্ণ করেছেন এবং খোদাভীরুতার বাণী তাদের প্রতি অপরিহার্য করেছেন; এবং তারা এরই অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত ছিলো। এবং আল্লাহ সব কিছু জানেন। [সূরা ফাতহ্, ২৬ আয়াত, নূরুল এরফান]


সূরাটির শেষে আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন:


 مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ ٱللَّهِ وَٱلَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلْكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعاً سُجَّداً يَبْتَغُونَ فَضْلاً مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضْوَاناً سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِّنْ أَثَرِ ٱلسُّجُودِ ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي ٱلتَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي ٱلإِنجِيلِ


অর্থ: মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল; এবং তাঁর সাথে যারা আছে, কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং পরস্পরের মধ্যে সহানুভূতিশীল, আপনি তাদেরকে দেখবেন রুকু’কারী, সেজদা-রত, আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদের চিহ্ন তাদের চেহারায় রয়েছে সেজদার চিহ্ন থেকে, তাদের এ বৈশিষ্ট্য তাওরীতের মধ্যে রয়েছে এবং তাদের (অনুরূপ) বৈশিষ্ট্য রয়েছে ইনজীলে। [সূরা ফাতহ্, ২৯ আয়াত, নূরুল এরফান]


সংক্ষেপে, সূরাহ আল-ফাতহ্ উল্লেখ করে হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (رضي اللّٰه عنهم) সম্পর্কে; তাঁদের পরিপূর্ণ আক্বীদাহ-বিশ্বাস, আস্থাশীলতা, আন্তরিকতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে আবেগ-উৎসাহ সম্পর্কে। ওপরে উল্লেখিত গুণাবলী-ই বাস্তবিক পক্ষে বদর যুদ্ধে ও বায়’আত আল-রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবা (رضي الله عنه)’বৃন্দকে পরবর্তীকালের মুসলমানদের দ্বারা তালাশ করার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো; আর (এ উপায়ে) তাঁদেরই মাধ্যমে মুসলমানদের মোকাবিলাকৃত (নতুন নতুন) চ্যালেঞ্জ ও কুফফারদের বিরোধিতার সমাধানসমূহ অন্বেষিত হতো। মুসলমান সর্বসাধারণ তাঁদেরই বরকত-আশীর্বাদ, দুআ’ ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতার মধ্যস্থতা লাভের জন্যে তাঁদের কাছে দলে দলে ছুটে যেতেন।


আল্লাহতা’লা পবিত্র গ্রন্থে সাহাবা কেরাম (رضي اللّٰه عنهم) সম্পর্কে উল্লেখ করেন:


 وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ ٱلإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ ٱلْكُفْرَ وَٱلْفُسُوقَ وَٱلْعِصْيَانَ أُوْلَـٰئِكَ هُمُ ٱلرَّاشِدُونَ


অর্থ: কিন্তু আল্লাহ তোমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করে দিয়েছেন এবং সেটাকে তোমাদের অন্তরে সুশোভিত করে দিয়েছেন আর কুফর ও নির্দেশ অমান্য করা এবং অবাধ্যতাকে তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় করে দিয়েছেন। এমন লোকেরাই সৎপথে রয়েছে। [আল-ক্বুরআন, ৪৯:৭; নূরুল এরফান]


এক মুহূর্তের জন্যে ভাবুন, সাহাবা কেরাম (رضي اللّٰه عنهم)’মণ্ডলীর ঈমান-আক্বীদাহ কতোখানি সুদৃঢ় ছিলো এবং বে-ঈমানী, পাপ এবং আল্লাহতা’লা ও তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)’এর নির্দেশ অমান্য করার প্রতি তাঁদের ঘৃণার ব্যাপকতা ছিলো কতোখানি।


ক্বুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহতা’লা মুহাজিরীন (হিজরতকারী) ও আনসার (সাহায্যকারী) সাহাবা (رضي الله عنه)’বৃন্দের প্রশংসা করেন:


 لِلْفُقَرَآءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُواْ مِن دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلاً مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضْوَاناً وَيَنصُرُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ أُوْلَـٰئِكَ هُمُ ٱلصَّادِقُونَ


অর্থ: ওই দরিদ্র হিজরতকারীদের জন্যে (এ সম্পদ), যাদেরকে আপন ঘরবাড়ি ও সম্পদ থেকে উৎখাত করা হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর সন্তুষ্টি চায় এবং আল্লাহ ও রাসূলের সাহায্য করে। তারাই সত্যবাদী। [আল-ক্বুরআন, ৫৯:৮]


 وَٱلَّذِينَ تَبَوَّءُوا ٱلدَّارَ وَٱلإِيمَانَ مِن قَبْلِهِمْ


অর্থ: এবং যারা এ শহরে (মানে মদীনায়) প্রথম থেকে গৃহ নির্মাণ করেছে এবং ঈমান গ্রহণ করেছে তাদের (মানে অন্যদের) আগে। [আল-ক্বুরআন, ৫৯:৯]


 ٱلَّذِينَ أُخْرِجُواْ مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلاَّ أَن يَقُولُواْ رَبُّنَا ٱللَّهُ


অর্থ: ওই সব লোক, যাদেরকে আপন ঘর-বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধু এতোটুকু কথার ওপর যে তারা বলেছিলো, ‘আমাদের রব্ব আল্লাহ।’ [আল-ক্বুরআন, ২২:৪০]


وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلَّذِينَ ءَاوَواْ وَّنَصَرُوۤاْ أُولَـٰئِكَ هُمُ ٱلْمُؤْمِنُونَ حَقّاً لَّهُمْ مَّغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ


অর্থ: এবং ওই সব লোক, যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছে আর যারা আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে তারাই প্রকৃত ঈমানদার। তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানের জীবিকা। [আল-ক্বুরআন, ৮:৭৪]


 وَٱلسَّابِقُونَ ٱلأَوَّلُونَ مِنَ ٱلْمُهَاجِرِينَ وَٱلأَنْصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا ٱلأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَآ أَبَداً ذٰلِكَ ٱلْفَوْزُ ٱلْعَظِيمُ


অর্থ: এবং সবার মধ্যে অগ্রগামী প্রথম মুহাজির ও আনসার আর যারা সৎকর্মের সাথে তাদের অনুসারী হয়েছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট; আর তাদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন বাগানসমূহ (জান্নাতসমূহ), যেগুলোর নিম্নদেশে নহরসমূহ প্রবহমান। তারা সদাসর্বদা সেগুলোর মধ্যে অবস্থান করবে। এটাই হচ্ছে মহা সাফল্য। [আল-ক্বুরআন, ৯:১০০]


আল্লাহতা’লা তাঁর পবিত্র গ্রন্থের বিভিন্ন অংশেও সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দের আধ্যাত্মিক অর্জনসমূহের ভূয়সী প্রশংসা করেন এই মর্মে যে, মূলতঃ মুসলমানদের ঈমানের মাপকাঠি-ই হচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের অনুপম আত্মার গভীরে প্রোথিত আক্বীদা-বিশ্বাস ও তাক্বওয়া/খোদাভীরুতা এবং আস্বাদিত আল্লাহতা’লার নৈকট্য তাঁদের জান্নাতে প্রবেশের পথকে সুগম করে দিয়েছে। ক্বুরআন মজীদের ঘোষণা এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট; কেউ আল্লাহতা’লার মর্জি মোতাবেক সঠিক পথপ্রাপ্ত হতে চাইলে তাঁকে একমাত্র সাহাবা-এ-কেরাম (رضي اللّٰه عنهم)’এরই পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। এরশাদ হয়েছে:


فَإِنْ آمَنُواْ بِمِثْلِ مَآ آمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ ٱهْتَدَواْ


অর্থ: অতঃপর তারাও যদি এভাবে ঈমান আনতো, যেমন তোমরা এনেছো, তবেই তো তারা হিদায়ত পেয়ে যেতো। [আল-ক্বুরআন, ২:১৩৭]


وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُواْ كَمَآ آمَنَ ٱلنَّاسُ


অর্থ: এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘ঈমান আনো যেমন অপরাপর লোকেরা (মানে সাহাবাবৃন্দ) ঈমান এনেছে।’ [আল-ক্বুরআন, ২:১৩]


সাহাবা কেরাম (رضي الله عنه)     


সাহাবামণ্ডলী (رضي اللّٰه عنهم) এমন এক দল যাঁদের সম্পর্কে ক্বুরআন মজীদ ঘোষণা করেছে - وَرَأَيْتَ ٱلنَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ ٱللَّهِ أَفْوَاجاً - “এবং আপনি (হে রাসূল) মানুষদেরকে দেখবেন, আল্লাহর দ্বীনে দলে দলে প্রবেশ করছে” [সূরা নাসর, ২ নং আয়াত, নূরুল এরফান]; তাঁরা এমন এক জাতি যাঁরা তাক্বওয়া/খোদাভীরুতা ও পুতঃপবিত্রতায় উদ্বেল; তাঁরা এমন ব্যক্তিত্ববৃন্দ যাঁরা আল্লাহর চিরস্থায়ী রেযামন্দি/সন্তুষ্টি ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি অর্জন করেছেন; তাঁরা এমন মহামানব-বৃন্দ যাঁদের কাছে ঈমানকে করা হয়েছে প্রিয় আর পক্ষান্তরে কুফর/অবিশ্বাস তো দূরে পাপকেও করা হয়েছে ঘৃণিত; তাঁরা এমন এক জাতি যাঁদের সম্পর্কে আল-ক্বুরআন সাক্ষ্য বহন করছে।


এটা সত্যি অবোধগম্য যে এ সকল সাহসী ব্যক্তিত্বের সামনে জান্নাতের মহারানী, প্রিয়নবী (ﷺ)’এর নন্দিনী হযরতে ফাতিমাতুয্ যাহরা (رضي اللّٰه عنها) নিপীড়িত হয়েছিলেন আর তাঁরা হাত গুটিয়ে বসেছিলেন এবং ফিরেও তাকাননি। ওই ধরনের গভীর ও মজবুত ঈমানের অধিকারী আনসার, মুহাজিরীন, বনূ হাশিম ও বনূ আবদে মানাফ বাহিনী ওই ভয়ভীতি প্রদর্শন প্রত্যক্ষ করে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন - এমনটি বিশ্বাস করা একেবারেই বাতুলতা।


যুক্তিতর্কের খাতিরে যদি কেউ এতে বিশ্বাস করেন, তাহলে ফলস্বরূপ আল-ক্বুরআনের সাক্ষ্য এর দরুন মিথ্যে প্রমাণিত হবে, আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর ২৩ বছরের সমস্ত প্রচেষ্টাও হবে ব্যর্থ। উপরন্তু, ওই ধরনের ধ্যানধারণা (অন্তরে) লালন করার দরুন আল-ক্বুরআন এবং হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (رضي اللّٰه عنهم) হতে আমাদের কাছে উপনীত সমস্ত আক্বীদা-বিশ্বাসই অনির্ভরযোগ্য বলে সাব্যস্ত হবে। আল্লাহতা’লা আমাদেরকে এ জাতীয় মিথ্যে হতে রক্ষা করুন (আমীন)!


ফাদাক বাগানের ঘটনাটি এবং ধারণাকৃত মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها)’এর বঞ্চনা স্রেফ ইতিহাসের একখানা উপাখ্যান, যার কোনো উল্লেখ ক্বুরআন মজীদে যেমন নেই, তেমনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর গ্রহণযোগ্য হাদীসেও নেই। এতে যদি নিহিত থাকে এমন উপাদান যা সাহাবা কেরাম (رضي اللّٰه عنهم) ও তাঁদের ইসলামী বিশুদ্ধতার সম্মানহানি করে এবং এর পাশাপাশি ক্বুরআন ও হাদীসের সত্যবাদিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। ওই ধরনের ঘটনাবলীর বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই ও বিচারের মাপকাঠি ক্বুরআন ও সুন্নাহ’র পরিধির আওতাভুক্ত, যা অর্জনে ব্যর্থ হলে তেমন এক ব্যাখ্যা অন্বেষণ করতে হবে যা ঈমানী তত্ত্বের বিরোধী হবে না। নীতিগতভাবে ক্বুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের পরিপন্থী কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিকে গ্রহণ করা এবং এর পাশাপাশি সেটাকে অখণ্ড ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তির ভিত্তি বানানো স্রেফ অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতা ছাড়া কিছু নয়।


ফাদাক বাগানের ঘটনার সত্যনিষ্ঠ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে অগ্রাহ্য ও প্রথম ইসলামী খলীফা হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতি অন্ধভাবে বলপ্রয়োগের দোষারোপ এবং সাহাবা কেরাম (رضي اللّٰه عنهم) এতে নীরব ছিলেন মর্মে ধারণা পোষণ, আর সর্বোপরি তাঁদেরকে এতে সহযোগী বলে অভিযোগ উত্থাপন ক্বুরআন-হাদীসকে মিথ্যে বলে প্রতিপন্ন করারই সামিল। হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه), যিনি প্রসঙ্গক্রমে ‘আসাদুল্লাহ’ (আল্লাহ সিংহ) উপাধি ধারণকারী ছিলেন, তিনি এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর চাচা হযরত আব্বাস (رضي اللّٰه عنه) তাঁদেরই আপন ঘনিষ্ঠজনের প্রতি বঞ্চনা ও নিপীড়ন সংঘটিত হওয়ার সময় নীরব ছিলেন, এ কথা সত্যি অকল্পনীয়। অতএব, যদি এ ঐতিহাসিক ঘটনার ক্বুরআন-সুন্নাহসম্মত সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিষয়ে কারোর কোনো জ্ঞান না থাকে, তাহলে তাঁর জন্যে এদিকে কোনো রকম মনোযোগ না দেয়াই উত্তম হবে। এটাই হবে সবার জন্যে নিরাপদ ও মঙ্গলজনক সমাধান। 


এক্ষণে আমরা এ সব মৌলিক বিষয় আলোচনা করার পরে আল্লাহতা’লার সাহায্য কামনা করে ফাদাক বাগানের ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপৃত হবো।


ফাদাক বাগান

         

ফাদাক বাগানের বিষয়টি বুঝতে হলে নিম্নোক্ত ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে:


প্রথমতঃ ফাদাক ছিলো একটি পল্লী যা মদীনা মোনাওয়ারা হতে আনুমানিক তিন-রাত্রব্যাপী যাত্রার দূরত্বে ছিলো; এতে কিছু ঝর্না ও খেজুর গাছ ছিলো। এটা বিনা বাধায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর অধিকারে চলে আসে এবং গনীমতের মালামালে অন্তর্ভুক্ত হয়। মুসলমান, অ-মুসলমান, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ও শিয়া ইতিহাসবিদ সবাই সর্বসম্মত এ মর্মে যে, ফাদাক - فاء - তথা শান্তিপূর্ণ পন্থায় আহরিত সম্পদ হতে নিঃসৃত ছিলো। ‘শরহে নাহজ আল-বালাগাহ’ শীর্ষক শিয়াদের পুস্তক, যা সাইয়্যেদ আলী আল-নক্বী লিখেছেন, তাতে এই তথ্যের (সমর্থনে) উল্লেখ করা হয়েছে:

 

“একটি সূত্র অনুযায়ী ফাদাক এলাকার লোকেরা সেটার অর্ধেকটুকু অর্পণ করেছিলো; অপর সূত্র অনুসারে গোটা জনপদই শান্তিপূর্ণভাবে প্রিয়নবী (ﷺ)’এর প্রতি কোনো রকম বিরোধিতা প্রদর্শন না করে সেটা অর্পণ করেছিলো।” [শরহে নাহজুল বালাগাহ, ৯৫৯ পৃষ্ঠা]


আল-ক্বুরআন শান্তিপূর্ণভাবে অর্জিত সম্পদ-সম্পত্তিকে ‘ফায়’ বলে চিহ্নিত করে।


দ্বিতীয়তঃ ফাদাক হোক বা অন্য কোনো সম্পদ হোক, ’ফায়ে’র সম্পদ-সম্পত্তি আল-ক্বুরআন কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে নিম্নে: 


 مَّآ أَفَآءَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ ٱلْقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي ٱلْقُرْبَىٰ وَٱلْيَتَامَىٰ وَٱلْمَسَاكِينِ وَٱبْنِ ٱلسَّبِيلِ كَيْ لاَ يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ ٱلأَغْنِيَآءِ مِنكُمْ


অর্থ: আল্লাহ আপন রাসূলকে নগরবাসীদের কাছ থেকে যে গনীমত প্রদান করিয়েছেন, তা আল্লাহ ও রাসূলের এবং নিকটাত্মীয়দের আর এতিম, মিসকীন ও মুসাফিরদের, যাতে তা তোমাদের ধনীদের সম্পদ না হয়ে যায়। [আল-ক্বুরআন, ৫৯:৭; নূরুল এরফান]


উল্লেখিত আয়াত অনুযায়ী, এই সম্পদ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর সুবিবেচনার অধীনে রাখার কারণ ছিলো গরিব-দুঃস্থদেরকে সহায়তা দান এবং ধনীদেরকে প্রশ্রয় না দেয়া। এই আয়াতটি অর্থ জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে একদম সুস্পষ্ট এবং এতে কোনো দ্ব্যর্থবোধক কিছুই নেই। ‘ফায়ে’র গ্রহীতা কারা সে কথা এটা সহজভাবে চিহ্নিত করেছে, যা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর পাশাপাশি সর্ব-হযরত আবূ বকর, উমর, আলী ও ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنهم) সম্যক অবগত ছিলেন। অনুরূপভাবে, এই আয়াতের ও বৃহত্তর পরিমণ্ডলে অন্যান্য সব আয়াতের আজ্ঞাসমূহ মুসলমানবৃন্দের কাছে স্পষ্ট; কোনো রকম অস্পষ্টতা দ্বারা সেগুলো আচ্ছাদিত নয়।


এই আয়াতটির শিয়াপন্থী এক তাফসীরে উল্লেখিত হয়:


هي لله وللرسول عليه السلام و لمن قام مقامه بعده


অর্থ: ‘ফায়ে’ আল্লাহ, তাঁর রাসূল (ﷺ) ও তাঁর পরে তাঁরই প্রতিনিধিত্বকারীদের অধিকার। [তাফসীর আল-সাফী, ২১০ পৃষ্ঠা]


অতএব, এটা স্পষ্ট যে ‘ফায়ে’ এমন সম্পত্তি নয় যা মালিকানাধীন হবে বা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হওয়া যাবে।


তৃতীয়তঃ ফাদাক ও তার অবস্থা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর সময় হতে ইমামে আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর খেলাফত আমল অবধি, এমন কী ইমাম হাসান (رضي اللّٰه عنه)’এর যুগ পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিলো। এই সত্যটি আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা’আত এবং শিয়া উভয় সম্প্রদায়েরই বইপত্রে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে, যা আমরা শিয়া গোষ্ঠীর বইপত্র হতে উদ্ধৃত করে দেখাবো। সত্য-সঠিক পথপ্রাপ্ত চার খলীফা সর্ব-হযরত আবূ বকর, উমর, উসমান ও আলী (رضي اللّٰه عنهم)’এর শাসনামলে ফাদাক বাগানের অবস্থার ন্যূনতম পরিবর্তনও হয়নি। ফাদাক বাগানের ভূ-সীমা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর মনোনীত পন্থায় বজায় রাখা হয়, যে পন্থাটি ছিলো ক্বুরআন-নির্দেশিত। স্বীকার করতে হয় যে, মারওয়ানের শাসনামলে এ ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধন করা হয়েছিলো; তবে খলীফা উমর বিন আবদিল আযীয (رحمة اللّٰه عليه) খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হলে তা আবারো পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হয়।


আমাদের যদি ফাদাকের বিষয়টিতে সর্ব-হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব ও উমর ফারূক্ব (رضي اللّٰه عنهما)’এর কর্মকে কপটতাপূর্ণ ও নিপীড়নমূলক আখ্যায়িত করতেই হয়, তাহলে তাঁদের আগে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং তাঁদের পরবর্তীকালে (খেলাফতে) আগত সর্ব-হযরত উসমান, আলী ও হাসান (رضي اللّٰه عنهم)’এর ক্ষেত্রেও তা-ই আখ্যায়িত করতে হবে - তা এতদ্দর্শনে যে তাঁদের (নিজ নিজ) শাসনামলে বিষয়টির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কোনো রকম পার্থক্যই ছিলো না। আল্লাহ আমাদেরকে এই নির্বুদ্ধিতা থেকে রক্ষা করুন (আমীন)।


অধিকন্তু, খোদ খলীফা হযরত উমর (رضي اللّٰه عنه)-ই ‘ফায়ে’র ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলেন সর্ব-হযরত আব্বাস ও আলী (رضي اللّٰه عنهما)’এর কাছে। তাঁরা ‘ফায়ে’র অন্যান্য জমি সম্পত্তির সাথে বনী নাযীর গোত্রের জমি-জিরাত ও বাগানগুলোর ব্যবস্থাপনা করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেমন সেগুলোর উৎপন্ন ফসল ও আয় দেখাশুনা করতেন, ঠিক একইভাবে তাঁরাও দেখাশুনা করতেন।


চতুর্থতঃ এ কথাও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ও শিয়া উভয় দলের নির্ভরযোগ্য বইপত্রে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) ’ফায়ে’ বিষয়ে আপন (নীতিগত) অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর কাজ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এরই কাজের প্রতিফলনে সত্যনিষ্ঠ ছিলো; ভূমি ব্যবস্থাপনায় ও প্রশাসনে কোনো রকম পরিবর্তন সাধন তিনি করেন নি। তবে হযরত মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها)’এর প্রতি খলীফার মহব্বত ও শ্রদ্ধা তখনই প্রকাশ পায়, যখন তিনি মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها)’কে তাঁর আপন সম্পদ হতে পছন্দ মাফিক সব কিছু গ্রহণ করার জন্যে প্রস্তাব করেন। 


এরই ফলশ্রুতিতে শিয়া গোষ্ঠীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ‘হাক্কুল এয়াক্বীন’ পুস্তকে হযরত মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها)’এর গুণাবলী সম্পর্কে খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর বক্তব্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে এভাবে: 


“আমি আমার ব্যক্তিগত সম্পদ আপনার কাছ থেকে আটকে রাখবো না। আপনার অন্তর যা চায় গ্রহণ করুন। আপনি আপনার পিতার উম্মতের মহারানী, আর এর পাশাপাশি আপনার সন্তানদের এক আশীর্বাদপূর্ণ ও খাঁটি বংশপরম্পরার ধারক-বাহক। আপনার গুণগত শ্রেষ্ঠত্ব কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না। আমার সমস্ত সম্পদই আপনার সেবায় (উৎসর্গিত), কোনো রকম সংকোচ ছাড়াই গ্রহণ করুন। তবে মুসলমানদের সম্পদের ব্যাপারে আমি আপনার প্রিয়ভাজন পিতা (ﷺ)’এর করা বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারবো না।” [হাক্কুল এয়াক্বীন, ২৩১ পৃষ্ঠা]


অনুরূপভাবে, সহীহ বুখারীতেও মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها)’এর প্রতি খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর বাণী লিপিবদ্ধ হয়েছে এভাবে:


قرابة رسول الله صلى عليه وسلم أحب إلي من قرابتي


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর পরিবার-সদস্যবৃন্দ আমার কাছে আপন পরিবার-সদস্যদের চেয়েও ঘনিষ্ঠ। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৫০৮]


সহীহ বুখারী হাদীসগ্রন্থে খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي اللّٰه عنه)’এর বক্তব্যের আরেকটি বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে এভাবে:


لست تاركا شيئا كان رسول الله ﷺ يعمل به إلا عملت به ، وإني لأخشى إن تركت شيئا من أمره أن أزيغ


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা করতেন, তা করা আমি পরিত্যাগ করতে পারি না। আমি স্রেফ তা-ই করবো, যা তাঁর (অনুশীলন) সম্পর্কে আমি জানি। নতুবা, আমি আমার ক্ষেত্রে পথভ্রষ্টতার আশঙ্কা করি। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩০৯৩]


ওপরের এ বিষয়টি প্রতীয়মান করে যে, খলীফা হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) যদিও মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها)’এর জন্যে নিজস্ব সম্পদ ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন, তবুও তিনি কোনোক্রমেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর আদেশ ও অনুশীলনের বিরোধিতা করার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না।


পঞ্চমতঃ এবং সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো অহরহ উচ্চারিত ওই (কথিত) ঘটনাটি, যা’তে ফাদাক বাগানের জমি-জিরাত হতে বঞ্চিত হওয়ার কারণে খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতি মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها) মৌখিক ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন। এই (কথিত) বাদানুবাদ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের কোনো নির্ভরযোগ্য উৎস দ্বারা সমর্থিত নয়, হতে পারে না। তিনি খলীফাকে তাঁর কাছ থেকে ফাদাক কেড়ে নেয়ার দায়ে নিপীড়ক হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন বলে নিরূপণ করাটা একেবারেই অসম্ভব। একইভাবে, এটাও কোনো বিশ্বস্ত সূত্র হতে প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে তিনি খলীফার সাথে কথা না বলার শপথ বা অঙ্গীকার করে তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার (মওলানা আবদুস্ সাত্তার তানসউয়ী’র) তরফ থেকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করুন, খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতি মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها) নিজ অসন্তুষ্টি উচ্চারণ করেছিলেন মর্মে এমন যুক্তি আখেরাত পর্যন্ত কেউই প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন না।


ক্রোধ অন্যান্য আবেগের মতোই প্রমাণ করা যায় না, যদি না তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ নিজেরাই প্রকাশ করেন। অবশ্যই অনুমান একমাত্র উপায় হয়ে যায়, যখন কেউ তথ্য-প্রমাণ ও সূত্রের ক্ষেত্রে দেউলিয়া হয়। কিন্তু কোনো ব্যক্তির কর্ম তো দূরে, তাঁর আবেগ প্রমাণ করার জন্যে এটা যথেষ্ট হবে কি? কারো মানসিক অবস্থার দিকে ইশারা করে এমন সূত্র বিদ্যমান থাকলেও (এক্ষণে) প্রশ্ন দাঁড়ায়, ওই ধরনের ইঙ্গিত ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ভুল করার অবকাশ আছে কি? নাকি নেই? সত্যি, কোনো বিষয়ের বাস্তবতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছাড়া এমন কী অভ্রান্ত সত্তাও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেন না। পয়গাম্বর মূসা (عليه السلام) ও হযরত খিযির (رحمة اللّٰه عليه)’এর ঘটনাটি এ ব্যাপারে একটি স্পষ্ট প্রমাণ। হযরত খিযির (رحمة اللّٰه عليه) যখন জাহাজের কিছু ক্ষতিসাধন করেন, তখন অভ্রান্ত পয়গাম্বর মূসা (عليه السلام) তাঁর অনুমান-নির্ভর মতামত ব্যক্ত করেন; জাহাজে আরোহণকারী সবাইকে পানিতে ডুবিয়ে দেয়ার অভিপ্রায় হযরত খিযির (رحمة اللّٰه عليه)‘এর ছিলো মর্মে ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি তাঁকে এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভর্ৎসনা করেন। অথচ আমরা (বৃত্তান্ত হতে) জানি, তা সত্য ছিলো না। অতএব, এ থেকে পরিষ্কার হয় যে কারো কর্মের ব্যাপারে কেউ স্রেফ ব্যক্তিগত মত পোষণ করলেই তা সত্য হয়ে যায় না।


স্রেফ জল্পনার ওপর ভিত্তি করে সর্ব-হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) ও সাইয়্যেদাহ ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها)’এর মাঝে বিভেদ দেখা দিয়েছিলো মর্মে এমন একটি অভিমত পোষণ করা ভ্রান্তি; এমন কী যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেয়া হয় যে ওই মত পোষণকারী একজন অভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব। নিঃসন্দেহে এই ধারণাটি অমূলক, যদি না বা যতোক্ষণ না হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) নিজেই বিষয়টি ওই রূপ বলে বর্ণনা করেন। এই (বিভেদ) তত্ত্বটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নির্ভরযোগ্য বইপত্রে সমর্থিত হয় নি।


শিয়া গোষ্ঠীর নির্ভরযোগ্য বইপত্রের দিকে তাকালে অবশ্য আমরা দেখতে পাই যে, ফাদাক বাগানের বিষয়টি নিয়ে সর্ব-হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) ও আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর মাঝে এক প্রকাশ্য বাক-বিতণ্ডার কথা উল্লেখিত হয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর খেলাফত আমলে তিনি ফাদাক বাগানের ব্যবস্থাপনায় কোনো রকম পরিবর্তন/সংস্কার সাধন করেন নি; তিনি তাঁর পূর্বসূরী খলীফা সর্ব-হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) ও উমর (رضي اللّٰه عنه)’এর পদাঙ্ক অনুসরণের পন্থাই অবলম্বন করেন, আর তাঁর পূর্বসূরী খলীফাবৃন্দ এ ব্যাপারে রাসূলে কারীম (ﷺ)’এর অনুসৃত নীতি গ্রহণ করেছিলেন।


শিয়া সূত্রগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর প্রতি হযরত মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها)’এর রাগ সত্ত্বেও তাঁরা হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه)’কে নির্ভুল বলে ভক্তি করেন এবং তাঁকে মনোনীত ও সত্য-সঠিক ইমাম হিসেবে সম্বোধন করেন। অথচ খলীফা হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতি তাঁরা বলপ্রয়োগ ও জুলুম-অত্যাচারের অভিযোগ এনে তাঁকে গালমন্দ করেন, যদিও তাঁর বিরুদ্ধে এ রকম মতবিরোধের কোনো প্রামাণ্য দলিল-ই নেই। 


এ-ই কি ন্যায়বিচার? এটাই কি সততা? 


ফাদাক বাগানের বিষয়টি উপলব্ধি করতে হলে পরবর্তী বিবেচ্য, শিয়া মতানুসারে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর সাতটি বাগানের মালিকানা বজায় রেখেছিলেন, যেগুলো হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর মালিকানাধীন বাগান, জমি ও সম্পদ হতে আলাদা সম্পত্তি ছিলো। শিয়াদের বিভিন্ন বর্ণনায় মহানবী (ﷺ)’এর চাচা হযরত আব্বাস (رضي اللّٰه عنه)’এর কথা উঠে এসেছে, যিনি মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর কাছে ওই সাতটি বাগানের মালিকানা চান; এরই পরিপ্রেক্ষিতে মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها) ওই সব জমি-জিরাতের কোনো উত্তরাধিকার নেই মর্মে উত্তর দেন এবং তিনি হযরত আব্বাস (رضي اللّٰه عنه)’কে তা হতে কিছুই দেননি।


অতএব, ‘ফুরূ’ আল-কা’ফী’ পুস্তকের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি ব্যক্ত করে:


عن أحمد بن محمد عن ابي الحسن الثاني عليه السلام قال سألته عن الحيطان السبعة التي كانت ميراث رسول الله ﷺ لفاطمة عليها السلام فقال لا انما كانت وقفا كان رسول الله ﷺ يأخذ إليه منها ما ينفق علي اضيافه فلما قبض ﷺ جاء العباس يخاصم فاطمة فيها فشهد علي عليه السلام وغيره إنما وقف على فاطمة عليها السلام وهي الدلال والعفاف والحسنى والصيافة ومالام ابراهيم والمبيت والبرقة.


অর্থ: আহমদ ইবনে মুহাম্মদ বর্ণনা করেন ইমাম মূসা কা’যিম (رحمة اللّٰه عليه) হতে এ মর্মে, আমি (আহমদ) হযরত মূসা কা’যিম (رحمة اللّٰه عليه)’কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর প্রতি উত্তরাধিকারস্বরূপ দানকৃত সাতটি বাগান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। হযরত ইমাম (رحمة الله) উত্তর দেন এগুলো আসলে ওয়াক্বফ [حُبوس সম্পত্তি], উত্তরাধিকার নয়, যেখান থেকে ফলন নিয়ে প্রিয়নবী (ﷺ) নিজ মেহমানদের জন্যে তদনুযায়ী খরচ করতেন। কিন্তু তাঁর বেসাল-প্রাপ্তির পরে হযরত আব্বাস (رضي اللّٰه عنه) ওই সাতটি বাগান মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর কাছে চাইতে আসেন, যেগুলোর ওয়াক্বফ হওয়ার ব্যাপারে হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه) ও অন্যান্যরা সাক্ষ্য বহন করেছিলেন। সাতটি বাগানের নাম ‘আল-দালা’ল,’ ‘আল-ইফা’ফ,’ ‘আল-হুসনা,’ আল-সিয়্যাফাহ,’ ’মা’লা’ম,’ ‘ইবরাহীম,’ ’আল-মাবীত’ ও ‘আল-বারাক্বাত।’ [ফুরূ’ আল-কা’ফী, ৩য় খণ্ড, ২৭ পৃষ্ঠা]


এক্ষণে চিন্তার খোরাক এই যে, মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর মালিকানাধীন সাতটি বাগান ও হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর নিজস্ব জমি-সম্পত্তি বিদ্যমান থাকার বিষয়টি জেনে ফাদাক বাগানের মালিকানাও মহানবী (ﷺ) হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’কে দান করেছিলেন ধারণা করাটা দুষ্কর। বস্তুতঃ এ চিন্তা তাঁর নুবুওয়্যতের মর্যাদা ও মহত্ত্বের প্রতি এক আক্রমণ, বিশেষ করে যখনই বিবেচনা করা হয় শিয়া সূত্রমতে ওই জমির ফলন সহস্র সহস্র স্বর্ণমুদ্রা। মোল্লা বা’ক্বির আল-মাজলিসী তাঁর ‘হায়াত আল-ক্বুলূব’ পুস্তকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও ফাদাক এলাকাবাসীর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিবলে বাৎসরিক আয় আনুমানিক চব্বিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ছিলো মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেন।


অতএব, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাতটি বাগান ছাড়াও অতিরিক্ত ফাদাক বাগানের আয় মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’কে মঞ্জুর করেছিলেন এমনটি কল্পনা করা সরাসরি ক্বুরআন মজীদের পরিপন্থী এবং তা নুবুয়্যতের মাহাত্ম্য সম্পর্কেও মন্দ একটি চিত্র অঙ্কন করে। এটা যদি সত্যি হতো, তাহলে এর মানে দাঁড়াতো প্রিয়নবী (ﷺ) আল্লাহতা’লার স্পষ্ট নির্দেশের বিরোধিতাকারী; যেমন এরশাদ হয়েছে:


كَيْ لاَ يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ ٱلأَغْنِيَآءِ مِنكُمْ 


অর্থ: যাতে তা তোমাদের ধনীদের সম্পদ না হয়ে যায়। [আল-ক্বুরআন, ৫৯:৭; নূরুল ইরফান]


অধিকন্তু, এর (তথা ফাদাক বাগানের মালিকানা আপন কন্যাকে দানের) মানে দাঁড়াতো রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজস্ব স্বার্থ অন্বেষণকারী; আর এতে তাঁর পরিবারসদস্যদের প্রতি অসঙ্গত পক্ষপাতিত্ব প্রদান করা হতো। আল্লাহতা’লা আমাদেরকে এ ধরনের অযৌক্তিক চিন্তা হতে হেফাযত করুন (আমীন)। উপরন্তু, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’কে যে আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘মনুষ্যজাতির প্রতি (খোদায়ী) করুণা’ (رَحْمَةٌ لِّلْعَالَمِينَ) গুণগত বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছিলো, এটা তারও পরিপন্থী হতো। তাঁর কাছে এই পীড়ন কীভাবে সহনীয় হতো, যখন আহলে সুফফাহ ও অন্যান্য গরিব মুহাজিরীন ও আনসার সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم) আর্থিক সঙ্কটাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় অন্ন ও বস্ত্রের সংস্থান করতে পারছিলেন না, আর এর পাশাপাশি সামরিক অভিযানগুলোর জন্যে সম্পদের যোগানের ভীষণ চাহিদা দেখা দিয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর চূড়ান্ত সামরিক অভিযান - তাবুকের যুদ্ধ, যা কষ্টকর অভিযান নামেও খ্যাত, তা ছিলো ত্যাগ-তিতিক্ষা ও স্বল্প রসদের সারসংক্ষেপ। সাহাবা কেরাম (رضي اللّٰه عنهم)’মণ্ডলীর প্রত্যেককে দিনে একটি করে খেজুর বরাদ্দ করা হতো। যখন তাও কমে যায়, তখন তাঁরা সময়ে সময়ে একটি খেজুরের মধ্যকার গর্তটুকু চুষতেন এবং একটি খেজুর কয়েকজনের মাঝে ভাগাভাগি করতেন, সুপেয় জলও একইভাবে ভাগাভাগি করতেন। ওই অভিযানের বাহনের বিবরণ ক্বুরআন মজীদে বিধৃত হয়েছে এভাবে:


وَلاَ عَلَى ٱلَّذِينَ إِذَا مَآ أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لاَ أَجِدُ مَآ أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَّأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ ٱلدَّمْعِ حَزَناً أَلاَّ يَجِدُواْ مَا يُنْفِقُونَ 


অর্থ: এবং না তাদের ওপর, যারা আপনার দরবারে উপস্থিত হয় যেনো আপনি তাদেরকে বাহন দান করেন, আপনার কাছে এ জবাব পেয়েছে যে, ‘আমার কাছে কোনো কিছু মওজূদ নেই, যার ওপর তোমাদেরকে আরোহণ করাবো।’ ফলে তারা এভাবে ফিরে যায় যে, তাদের চোখসমূহ থেকে অশ্রু বিগলিত হতে থাকে এ দুঃখে যে তারা (আল্লাহর রাস্তায়) অর্থব্যয়ের সামর্থ্য পায় নি। [আল-ক্বুরআন, ৯:৯২; নুরুল ইরফান]


অতএব, এ কথা অচিন্তনীয় যে প্রিয়নবী (ﷺ) গরিব-দুঃস্থ ও এতিম-অনাথ, মুহাজিরীন ও আনসার সাহাবা এবং মুসলমান সাধারণের প্রয়োজন উপেক্ষা করে এতো বড় একটি সম্পত্তির মালিকানা নিজ কন্যার বরাবর হস্তান্তর করতে পারেন। নতুবা এর (হস্তান্তরের) মানে দাঁড়াতো তিনি ক্বুরআনী বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। এই ধারণাটি আরো অসম্ভাব্য প্রতীয়মান হয় সেই ঘটনায়, যেখানে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) নিজ পিতার কাছে সাহায্যস্বরূপ এক দাসীকে চেয়েছিলেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে প্রতি ওয়াক্তের নামায-শেষে তেত্রিশবার করে সোবহানাল্লাহ, আল-হামদু লিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর পাঠ করার ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন; এরই ফলশ্রুতিতে খোদায়ী সাহায্যপ্রাপ্তি ঘটে, যা নিঃসন্দেহে কোনো দাসীর কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার চেয়েও অধিকতর কার্যকর। একইভাবে, যখন মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها) ফাদাক বাগান সম্পর্কে নিজ পিতার কাছে জানতে চান, তখন প্রিয়নবী (ﷺ) বনূ হাশিম, গরিব ও অভাবীদের প্রয়োজনকে আপন পরিবারের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে তা মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর কাছে হস্তান্তর না করার পন্থাটি বেছে নেন। তাঁর সারা যাহেরী/প্রকা্শ্য জিন্দেগী-ব্যাপী মহানতম পয়গাম্বর (ﷺ) অভাবী মানুষের মাঝে এবং ইসলামী (রাষ্ট্রের) অর্থনৈতিক খাতে ওই সম্পদ ব্যয় অব্যাহত রাখেন, যার বিবরণ ‘মিশকাতুল মাসাবীহ’ ও ‘সুনানে আবী দাউদ’ গ্রন্থগুলোর মতো নির্ভরযোগ্য ইসলামী বইপত্রে পাওয়া যায়। এটা ক্বুরআন মজীদের নিম্নবর্ণিত আদেশ হতেও ভালোভাবে বোঝা যায়। এরশাদ হয়েছে:


يٰأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لأَزْوَاجِكَ إِن كُنتُنَّ تُرِدْنَ ٱلْحَيَاةَ ٱلدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحاً جَمِيلاً ـ وَإِن كُنتُنَّ تُرِدْنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ وَٱلدَّارَ ٱلآخِرَةَ فَإِنَّ ٱللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَاتِ مِنكُنَّ أَجْراً عَظِيماً


অর্থ: হে অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবী)! আপনার স্ত্রীবৃন্দকে বলে দিন, ‘যদি তোমরা পার্থিব জীবন ও সেটার ভূষণ কামনা করো, তবে এসো, আমি তোমাদেরকে সম্পদ দেই এবং সৌজন্যের সাথে ছেড়ে দেই। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং পরকালের ঘর চাও, তবে নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের মধ্যকার সৎকর্মপরায়ণা নারীদের জন্যে মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন। [আল-ক্বুরআন, ৩৩:২৮-২৯; নূরুল এরফান]


আল্লাহতা’লা আরো উল্লেখ করেন: 


إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُـمُ ٱلرِّجْسَ أَهْلَ ٱلْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيـراً


অর্থ: (হে নবীর পরিবারবর্গ) আল্লাহ তো এটাই চান যে, তোমাদের থেকে প্রত্যেক অপবিত্রতা দূরীভূত করে দেবেন এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে অতীব পরিচ্ছন্ন করে দেবেন। [আল-ক্বুরআন, ৩৩:৩৩; নূরুল এরফান]


একটু থেমে ক্ষণিকের জন্যে ভাবুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর মহান স্ত্রী (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দের জন্যে তিনি যা অপছন্দ করেছেন, তা তিনি তাঁরই স্নেহাস্পদ কন্যার জন্যে চাইবেন এমনটি হওয়া কি আদৌ সম্ভব? পার্থিব বস্তুবাদের আবর্জনা হতে তিনি আপন কন্যাকে দূরে সরিয়ে রাখবেন, যেমনটি তিনি রেখেছিলেন ঈমানদারবৃন্দের মায়েদের, মানে তাঁর স্ত্রীদের, একমাত্র সেটাই অর্থপূর্ণ হতে পারে। তাঁর ওপর চাপ ছিলো ওই সম্পদ অভাবী ও উপযুক্তদের মাঝে বণ্টন করার; স্রেফ নিজ পরিবারসদস্যদের এই দুনিয়ার সম্পদ দ্বারা সমৃদ্ধ করা নয়। মহান পরিবারসদস্যদের এই পৃথিবীর ময়লা-আবর্জনা হতে পরিশুদ্ধ করা ছিলো ক্বুরআনী নির্দেশ, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক পরিপূর্ণভাবে পালিত হয়।


এ সব আল-ক্বুরআনের আয়াত ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর হাদীস স্পষ্ট প্রতীয়মান করে যে, ফাদাক বাগান মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’কে দান করা হয়েছিলো মর্মে দাবি উত্থাপনকারীরা আসলে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন। ওই ধরনের ভাষ্য নুবুওয়্যতের চরিত্র বৈশিষ্ট্যকে খাটো করে এবং তা বানোয়াট কাহিনী ছাড়া কিছু নয়।


বাগানটি উপহার ছিলো মর্মে দাবিটিকে যদি ক্ষণিকের জন্যে গ্রহণও করা হয়, তাহলেও প্রশ্ন দাঁড়াবে শিয়াদের অভিযোগ অনুসারে খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর কাছে কেন হযরত মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها) সেটা উত্তরাধিকারস্বরূপ পেতে চেয়েছিলেন? এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যাই নেই - আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন নেই, তেমনি শিয়াদের দৃষ্টিকোণ থেকেও নেই।


আম্বিয়া (عليهم السلام)’এর উত্তরাধিকার


উত্তরাধিকারের দাবিটি বুঝতে হলে জেনে রাখুন, ইতিপূর্বে উল্লেখিত হযরত আব্বাস (رضي اللّٰه عنه) কর্তৃক মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর কাছে এসে সাতটি বাগানের মালিকানা চাওয়ার ঘটনায় তাঁকে বোঝানো হয়েছিলো যে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওয়াক্বফ হিসেবে দান করেছিলেন; আর ওয়াক্বফ সম্পত্তিতে কোনো উত্তরাধিকার নেই, এ কথা সবারই জানা। যেহেতু ক্বুরআন মজীদে ফাদাক বাগানকে ‘ফায়’ (فاء) তথা ওয়াক্বফ ঘোষণা করা হয়েছে, সেহেতু এখানে উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি কীভাবে উত্থাপন করা সম্ভব? সাতটি বাগান ও ফাদাক সম্পর্কে উত্তরাধিকারের দাবি উত্থাপন যেমন অর্থহীন, ঠিক একইভাবে প্রিয়নবী (ﷺ) কর্তৃক রেখে যাওয়া অন্যান্য সম্পদের ক্ষেত্রেও উত্তরাধিকারের প্রশ্ন তোলা প্রযোজ্য হবে না।


আম্বিয়া (عليهم السلام) কোনো পার্থিব উত্তরাধিকার যে রেখে যান না, সেই প্রশ্নে আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা’আত ও শিয়া উভয়েই একমত; তাঁরা স্রেফ যা উত্তরাধিকারস্বরূপ রেখে যান তা হলো ঐশী জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও নির্মল/খাঁটি চরিত্র বৈশিষ্ট্য তথা গুণাবলী।       


প্রথম প্রমাণ


শিয়া গোষ্ঠীর পুস্তক ‘উসূলুল্ কা’ফী’ হতে ইমাম জা’ফর আল-সা’দিক্ব (رحمة اللّٰه عليه)’এর বর্ণনা নিচে দেয়া হলো:


إن العلماء ورثة الأنبياء إن الأنبياء لم يورثوا دينارا ولا درهما ولكن أورثوا العلم فمن أخذ منه أخذ بحظ وافر.


অর্থ: উলামা (-এ-হক্কানী/রব্বানী) হলেন উত্তরাধিকারী আম্বিয়া (عليهم السلام)’বৃন্দের, যাঁরা কোনো দীনা’র বা দিরহাম উত্তরাধিকারস্বরূপ রেখে যান না, বরং স্রেফ (ঐশী) জ্ঞান-প্রজ্ঞা রেখে যান। অতঃপর যে ব্যক্তি তা অর্জন করেন, তিনি নিশ্চয় আধিক্যপূর্ণ একটি অংশই প্রাপ্ত হন। [উসুলূল কা’ফী, ১৮ পৃষ্ঠা]


দ্বিতীয় প্রমাণ


হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه) নিজ পুত্র মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়্যাহ (رضي اللّٰه عنه)’কে বিদায় বেলায় যে উপদেশ দেন, তা শিয়াদের ‘মান লা এয়াহদুরুহু আল-ফক্বীহ’ শীর্ষক পুস্তকটি বিবৃত করে নিচে:


تفقه في الدين فإن الفقهاء ورثة الأنبياء إن الأنبياء لم يورثوا دينارا ولا درهما ولكنهم ورثوا العلم فمن أخذ منه أخذ بحظ وافر.


অর্থ: দ্বীনী বিষয়াদির গভীর সমঝদারি অর্জন করো; নিশ্চয় (এতদসংক্রান্ত) জ্ঞান-বিশারদবৃন্দই উত্তরাধিকারী আম্বিয়া (عليهم السلام)’মণ্ডলীর, যাঁরা কোনো দীনা’র বা দিরহাম উত্তরাধিকারস্বরূপ রেখে যান না, বরং স্রেফ (ঐশী) জ্ঞান-প্রজ্ঞা রেখে যান। অতঃপর যে ব্যক্তি তা অর্জন করেন, তিনি নিশ্চয় আধিক্যপূর্ণ একটি অংশই প্রাপ্ত হন। [‘মান লা এয়াহদুরুহু আল-ফক্বীহ’, ২য় খণ্ড, ৩৪৬ পৃষ্ঠা]


তৃতীয় প্রমাণ


ইমাম জা’ফর আস্ সা’দিক্ব (رحمة اللّٰه عليه) বলেন:


إن العلماء ورثة الأنبياء وذاك أن الانبياء لم يورثوا درهما ولا دينارا وإنما ورثوا احاديث من احاديثهم فمن أخذ بشيء منها فقد أخذ حظا وافرا.


অর্থ: উলামা (-এ-হক্কানী/রব্বানী)’বৃন্দ হলেন আম্বিয়া (عليهم السلام)’মণ্ডলীর ওয়ারিস্/উত্তরাধিকারী, কেননা পয়গাম্বর (عليهم السلام)’বৃন্দ কোনো দীনা’র অথবা দিরহাম রেখে যান না, বরং স্রেফ তাঁদের আহাদীস তথা দ্বীনী জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও বিধান রেখে যান। অতঃপর যে ব্যক্তি তার কোনো অংশ অর্জন করেন, তিনি বাস্তবিকপক্ষে আধিক্যপূর্ণ একটি অংশই অর্জন করেন। [‘উসূলুল কা’ফী,’ ১৭ পৃষ্ঠা]


ওপরের তিনটি বর্ণনা স্পষ্ট বিবৃত করে এ মর্মে যে, পয়গাম্বর (عليهم السلام)’মণ্ডলী কোনো নির্দিষ্ট বস্তুগত সম্পদ উত্তরাধিকারস্বরূপ রেখে যান না। তাঁদের (যাহেরী) অবর্তমানে রেখে যাওয়া তাঁদেরই পরিশীলিত খাঁটি/নির্মল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য/গুণাবলী ও ঐশী জ্ঞান-প্রজ্ঞা হতে ফায়দা লাভ করেন তাঁদের উত্তরাধিকারীবৃন্দ। সর্ব-হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه) ও জা’ফর আস্ সা’দিক্ব (رحمة اللّٰه عليه) মহানবী (ﷺ) হতে এসব বিবরণ এনেছেন বিষয়টি ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে। তৃতীয় বিবরণটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা এতে মর্মার্থ সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে, মানে তাঁরা (ঐশী) জ্ঞান-প্রজ্ঞা ছাড়া অন্য কিছু উত্তরাধিকারস্বরূপ রেখে যান না।


চতুর্থ প্রমাণ


ইমাম জা’ফর সা’দিক্ব (رحمة اللّٰه عليه) বলেন:


ورث سليمان داؤد وورث محمد ﷺ سليمان.


অর্থ: পয়গাম্বর সোলায়মান (عليه السلام) ছিলেন হযরত দাউদ (عليه السلام)’এর উত্তরাধিকারী; অনুরূপভাবে, মহানবী (ﷺ) উত্তরাধিকার পান সোলায়মান (عليه السلام) হতে। [’উসুলূল কা’ফী,’ ১৩৭ পৃষ্ঠা]


ইমাম জা’ফর সা’দিক্ব (رحمة اللّٰه عليه)’এর এই কথা নিয়ে একটু ভাবুন। অবশ্যঅবশ্য এতে উল্লেখিত উত্তরাধিকার হতে পারে একমাত্র নুবূওয়্যতের, (ঐশী) জ্ঞান-প্রজ্ঞার ও (খোদাপ্রদত্ত) পুতঃপবিত্র চরিত্র/গুণাবলীর। পার্থিব বস্তুগত উত্তরাধিকারের কথা ধারণা করা এখানে একদম অসম্ভব। ভাষ্যটিতে এমন এক আধ্যাত্মিকতার উল্লেখ রয়েছে যা এক পয়গাম্বর হতে আরেক পয়গাম্বরের কাছে (উত্তরাধিকারস্বরূপ) হস্তান্তরিত হয়।


পঞ্চম প্রমাণ


শিয়াপন্থীদের কাছে নির্ভরযোগ্য ইবনে বা’বাওয়াইহ রচিত ‘আল-খিসা’ল’ কিতাব, যা’তে গ্রন্থকার লেখেন:


أتت فاطمة بنت رسول الله ﷺ في شكواه الذي توفي فيه فقالت يا رسول الله هاذان ابنان فورثهما شيأ قال أما الحسن فإن له هيبتي وأما الحسين فان له جراتي.


অর্থ: মহানবী (ﷺ)’এর শেষ অসুখের সময় হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) তাঁর কাছে আসেন এবং অনুরোধ করেন: “এই দু জন আমার সন্তান; আপনার কাছ থেকে উত্তরাধিকারস্বরূপ পাবার জন্যে তাদের প্রতি কোনো কিছু মঞ্জুর করুন।” তিনি উত্তরে বলেন, “হাসানের ক্ষেত্রে সে আমার প্রতিপত্তি উত্তরাধিকারস্বরূপ পেয়েছে; আর হুসাইন পেয়েছে আমার শৌর্য-বীর্য।” [ইবনে বা’বাওয়াই কৃত ‘আল-খিসা’ল’, ৩৯ পৃষ্ঠা]


এই বিবরণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁরই প্রিয় দুই নাতি সর্ব-ইমাম হাসান ও হুসাইন (رضي اللّٰه عنهما)’কে (উত্তরাধিকারস্বরূপ) দান করেন। এখানে আর্থিক উত্তরাধিকারের কোনো উল্লেখ নেই। এই বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘শরহে নাহজ আল-বালাগাহ’ (২য় খণ্ড, ২৬১ পৃষ্ঠা) গ্রন্থের পাশাপাশি ‘আল-মানা’ক্বিবুল ফা’খিরাতি লিল-’ইতরাতিত্ তা’হিরাহ’ (১৮৯ পৃষ্ঠা) পুস্তকেও।


ষষ্ঠ প্রমাণ


عن الفضيل بن يسار قال سمعت أبا جعفر عليه السلام يقول لا والله ما ورث رسول الله العباس ولا على ولا ورثته إلا فاطمة عليها السلام.


অর্থ: হযরত ফুযায়ল ইবনে এয়াসা’র (رحمة اللّٰه عليه) বর্ণনা করেন যে তিনি হযরত আবূ জা’ফর তথা ইমাম বা’ক্বের (رحمة اللّٰه عليه)’কে বলতে শুনেছেন এ কথা: “আমি আল্লাহর নামে শপথ করছি, হযরত আব্বাস (رضي اللّٰه عنه) বা হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর কেউই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে উত্তরাধিকার পান নি। স্রেফ হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) পেয়েছিলেন।” [’মান লা এয়াহদুরুহু আল-ফক্বীহ’, ২য় খণ্ড, ২১৭ পৃষ্ঠা]


’মান লা এয়াহদুরুহু আল-ফক্বীহ’ শীর্ষক গ্রন্থটির উক্ত বিবরণ অনুসারে, প্রিয়নবী (ﷺ)’এর উত্তরাধিকার কেবল মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) একার জন্যেই সুনির্দিষ্ট করা হয়েছিলো। সর্ব-হযরত আব্বাস (رضي اللّٰه عنه), আলী (كرم اللّٰه وجهه), রাসূল (ﷺ)’এর পবিত্র স্ত্রী-মণ্ডলী ও অন্যান্য পরিবারসদস্যবৃন্দ (رضي اللّٰه عنهم) কেউই তা পান নি।


আল-ক্বুরআনে নির্দেশিত উত্তরাধিকারের বিধান অনুসারে একজন কন্যা পান অর্ধেক এবং স্ত্রী-মণ্ডলী সমষ্টিগতভাবে পান এক-অষ্টমাংশ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যদি অ-বিশেষজ্ঞ হিসেবে উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত (ঐশী) বিধানটির পালনকারী হতেন, তাহলে শিয়া গোষ্ঠীর অবাক হওয়া উচিৎ ছিলো কেন ইমাম বাক্বের (رحمة اللّٰه عليه) ওপরোক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন।


এতদসংক্রান্ত সমস্ত ভাষ্য বিবেচনায় নিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় যে, ইমাম-মণ্ডলী এ মর্মে অভিমত পোষণ করেন যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তরাধিকারের বিধানে আমাদের মতো দায়-দায়িত্ব দ্বারা আবদ্ধ নন। প্রিয়নবী (ﷺ)’এর সম্পত্তি/সম্পদ (উত্তরাধিকারস্বরূপ) বণ্টন (পদ্ধতি) সাধারণ মুসলমানদের চেয়ে বহুলাংশে আলাদা ছিলো। আইনের ক্ষেত্রে যেমন নানা ছাড় থাকে, তেমনি এ বিধানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর বেলায়ও ছাড় দেয়া হয়েছে। 


বস্তুতঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আক্বীদাহ-বিশ্বাস এ ব্যাপারে একই।


সহীহ আল-বুখারী গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে:


لاَ نُورَثُ مَا تَرَكْنَا صَدَقَةٌ.


অর্থ: আমরা (আম্বিয়া-বৃন্দ عليهم السلام) উত্তরাধিকারস্বরূপ কিছু রেখে যাই না; যা রেখে যাই তা সাদাক্বাহ (দানস্বরূপ)। [আল-বুখারী, হাদীস নং ৬৩৪৬]


সহীহ আল-বুখারী গ্রন্থের এ বিবরণ হতে ওই ছাড়ের বিষয়টি সুস্পষ্ট।


হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه) হতে অনুরোধের বিবরণ


শিয়া গোষ্ঠী ও তাঁদের নেতৃবর্গ সহীহ বুখারীর উদ্ধৃতি দিয়ে বেশ জোরালোভাবে মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) কর্তৃক হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর খেলাফত আমলে তাঁর কাছে উত্তরাধিকার চাওয়ার কাহিনীটি বর্ণনা করে থাকেন, যেটা খলীফা তাঁকে দিতে অস্বীকার করেছিলেন; এবং যে কারণে তিনি খালি হাতে ফিরে এসেছিলেন এবং এরই ফলশ্রুতিতে রাগান্বিত হয়েছিলেন। আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল জামাআতের কিছু মানুষও হাদীসশাস্ত্রের অন্যান্য বইপত্র অধ্যয়নে ব্যাপৃত না হওয়ায় বা স্রেফ সহীহ বুখারী ভালোভাবে পাঠ না করায় নিজেদের জ্ঞানের স্বল্পতাহেতু একই ভ্রান্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে থাকেন। তাঁদের ভুল ধারণা হলো, হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর কাছে গিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে তাঁরই (প্রাপ্য) উত্তরাধিকার চাইতে।


এই চিন্তাধারাটি সঠিক নয়। বস্তুতঃ সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম হতে যা সাবেত বা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা উপলব্ধি করি যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় তো দূরে, হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) এমন কী ব্যক্তিগতভাবে খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর দরবারে মোটেও যান নি। প্রতিষ্ঠিত বিবরণগুলোতে বরঞ্চ পরিদৃষ্ট হয় তিনি আপন উত্তরাধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে খলীফার কাছে একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিলেন।


عن عائشة أن فاطمة بنت النبي ﷺ أرسلت إلى أبي بكر تسأله ميراثها من رسول الله ﷺ مما أفاء الله عليه.


অর্থ: হযরত মা আয়েশাহ (رضي اللّٰه عنها) হতে বর্ণিত যে, হযরত ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) জনৈক প্রতিনিধিকে খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর কাছে প্রেরণ করেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর প্রতি আল্লাহতা’লার দানকৃত (সম্পদের) অংশ হতে তাঁর উত্তরাধিকার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে। [সহীহ বুখারী, ৩৯৯৮ নং হাদীস]


এই রওয়ায়াত/বর্ণনা হতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) বাস্তবিক পক্ষে জনৈক প্রতিনিধিকে খলীফার দরবারে পাঠিয়েছিলেন এবং নিজে (সেখানে) যান নি। যে সব বিবরণে তাঁর প্রতিনিধি প্রেরণের অংশটুকু বাদ পড়েছে, সেগুলোকে আক্ষরিক মূল্যে গ্রহণ করা যায় না, কেননা সেগুলোর সবই এই একক ঘটনাটির বিবরণ দেয়।


এই ধরনের ভাষা (তথা অভিব্যক্তি) সর্বত্র পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যখন বলে, এই খালটি রাজা খনন করেছেন, বাস্তবে তো রাজা কোনো শ্রম দেন নি, স্রেফ তা অনুমোদন (তথা চালু) করেছেন। তবে ওই খাল খননের কীর্তি তাঁরই প্রতি আরোপিত হয়। একইভাবে প্রশ্ন করার কাজটি মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর প্রতি আরোপিত হয়েছে, যদিও তিনি নিজে কোনো আলোচনাতেই জড়িত হন নি।


হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه)’এর উত্থাপিত প্রশ্নের উদ্দেশ্য ও হেকমত


কেউ হয়তো এ কথা ভেবে অবাক হতে পারেন যে, আল-ক্বুরআন তো ‘ফায়’ (فاء)-সংক্রান্ত বিধানের ব্যাপারে স্পষ্ট, আর এটাও সবারই জানা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোনো উত্তরাধিকার রেখে যাবেন না, তাহলে মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) অনুমানমূলকভাবে কেন উত্তরাধিকার চেয়েছিলেন? আল-ক্বুরআনে নির্দেশিত ’ফায়’-এর হক্বদার হলেন আল্লাহতা’লা (মানে লিল্লাহ দান-সদকাহ), তাঁর রাসূল (ﷺ), রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর নিকটাত্মীয়, এতিম-অনাথ এবং আটকে পড়া মুসাফির। উপরন্তু, ক্বুরআন মজীদ যথাযথভাবে এর কোনো অংশ ধনীদেরকে দেয়ার ব্যাপারে অনুৎসাহিত করেছে। তাহলে আবারো প্রশ্নটি করতে হয়, মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) কর্তৃক আপাতদৃষ্টিতে তাঁর (উত্তরাধিকারের) অংশটি চাওয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী ছিলো?


মৌলভী আনওয়ার শাহ কাশমিরী (দেওবন্দী ঘরানার আলেম) ‘আল-জামেউত্ তিরমিযী’ গ্রন্থের ওপর নিজের লেখা শরাহ’তে (ব্যাখ্যায়) ইমাম সৈয়দ সামহুদী (رحمة اللّٰه عليه)’এর সূত্রে একটি যথাবিহিত জবাবের দিকে ইঙ্গিত করেছেন এভাবে:


হযরত ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) আপন পারিবারিক বন্ধনের কারণে ‘ফায়’-ভিত্তিক জমি-জিরাতের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। এই প্রস্তাব কোনোক্রমেই মালিকানার প্রশ্নে ছিলো না। খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) অতঃপর যে উত্তর প্রেরণ করেন, তা ছিলো প্রিয়নবী (ﷺ)’এর একটা হাদীস, যেটা সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করে তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী-ই মালিকানা বা ব্যবস্থাপনাসূত্রে (’ফায়’ সম্পত্তিতে) কোনো রকম উত্তরাধিকার পাবেন না। সর্ব-হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه), আব্বাস (رضي اللّٰه عنه), আবদুর রহমান বিন আউফ (رضي اللّٰه عنه) ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দ খলীফার এই সিদ্ধান্তের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন। [আল-উরফুল শাযী, ৪৮৫ পৃষ্ঠা]


এই সমাধানের পরে মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) আর কখনোই বিষয়টি উত্থাপন করেন নি। খলীফা হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) যে হাদীসটি মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর খেদমতে উপস্থাপন করেছিলেন, তা সহীহ বুখারী শরীফ হাদীসের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে: 


إن رسول الله ﷺ قال لا نورث ما تركنا صدقة إنما يأكل آل محمد ﷺ في هذا المال وإني والله لا أغير شيئا من صدقة رسول الله ﷺ عن حالها التي كان عليها في عهد رسول الله ﷺ ولأعملن فيها بما عمل به رسول الله ﷺ.


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “আমাদের (মানে আম্বিয়া’বৃন্দের) কোনো উত্তরাধিকারী নেই; আমরা যা রেখে যাই, তার সবই দান-সদকাহ।” (হযরত আবূ বকর - رضي اللّٰه عنه - বলেন), প্রিয়নবী (ﷺ)’এর পরিবারসদস্যবৃন্দ এসব সম্পত্তির আয়ে জীবন নির্বাহ করবেন, কিন্তু আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, মহানবী (ﷺ)’এর সময়কাল হতে তিনি যে দান-সদক্বাহ (পদ্ধতি) বজায় রেখেছিলেন, আমি তাতে (বিন্দুমাত্র) পরিবর্তনও সাধন করবো না। বরঞ্চ তিনি যেভাবে (বণ্টন) করতেন, আমিও তা-ই করবো। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৯৯৮]


খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর সামনে নিজের সমাধানটি পেশ করেন এই বলে যে, তিনি এমন কোনো পরিবর্তন অনুমোদন করবেন না যা (সরাসরি) প্রিয়নবী (ﷺ)’এর আচরিত রীতির খেলাফ বা পরিপন্থী হয়। তবে তিনি তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে, পুতঃপবিত্র ও মহান পরিবারসদস্যবৃন্দের ব্যয়ও একই উৎস হতে আসবে। মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها) এতদশ্রবণে খলীফার এই সমাধানে ও তাঁর অটল সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট ও আশ্বস্ত হন। 


শিয়া গোষ্ঠী উপরোক্ত একই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন, যা তাঁদের বইপত্রে লিপিবদ্ধ হয়েছে; মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) খলীফার উত্তর প্রাপ্ত হয়ে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর জীবিকা ও ব্যয়ভার ফাদাক বাগানের পাশাপাশি ‘ফায়’-এর অন্যান্য জমিসম্পত্তি হতে সংকুলান করা হয়েছিলো।


ولك على الله أن اصنع بها كما كان يصنع فرضيث بذلك واخذت العهد عليه به وكان يأخذ غلتها فيدفع اليهم منها ما يكفيهم


অর্থ: (খলীফা বলেন), “আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, আমি হুবহু তা-ই করবো, যা প্রিয়নবী (ﷺ) অনুশীলন করতেন।” খলীফার এ কথায় মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها) সন্তুষ্ট হন এবং তাঁর কাছ থেকে এ কথার অঙ্গীকার নেন। খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) উক্ত সম্পত্তির ফসল তুলে আহলে বায়ত (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ তাঁদের কাছে হস্তান্তর করতেন। [’শরহে নাহজুল বালাগাহ,’ ৩৩২ পৃষ্ঠা] 


হযরত মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها) কর্তৃক (ফাদাক-সংক্রান্ত) প্রশ্নটি করার পেছনে কারণ ছিলো স্রেফ জমি-জিরাতগুলোর ব্যবস্থাপনাটুকু তাঁর ও অন্যান্য ঘনিষ্ঠ পরিবারসদস্যদের কাছে হস্তান্তরকরণ। তবে এক দীর্ঘস্থায়ী আশঙ্কা ছিলো এ মর্মে যে, সাধারণ মানুষ এটাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর উত্তরাধিকার বণ্টনকৃত হয়েছে বলে ভুল ব্যাখ্যা করতে পারে, যেটা হয়তো ভবিষ্যতে ভূমি-সম্পদ অপব্যবহারের সূত্রপাত করতে পারে, তাই খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) সেটাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার ফায়সালাকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই একই আশঙ্কার কারণে (খলীফা থাকাকালে) হযরত উমর (رضي اللّٰه عنه) সর্ব-হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه) ও আব্বাস (رضي اللّٰه عنه)’এর তত্ত্বাবধানে থাকা ‘ফায়’-এর জমি-জিরাত বিভক্ত করার প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছিলেন।


হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) কর্তৃক খলীফার দরবারে জনসমক্ষে এ বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষ্য দাবি করে প্রতিনিধি প্রেরণের মানে হতে পারে এই কারণটি যে, তিনি উম্মতকে (শরঈ বিধানের) জ্ঞান শিক্ষাদান করতে চেয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর মিরাস্ সম্পর্কে মানুষকে জ্ঞানদান করা একটি আধ্যাত্মিক কর্ম। এই উত্তরধিকারের ভিত্তিস্তম্ভ হলো মহৎ চরিত্র ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান। এমতাবস্থায় দিবাকরের মতো স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে যে, মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها)’এর নিজের বা তাঁর সন্তানদের জন্যে উত্তরাধিকারস্বরূপ কোনো বস্তুগত মালিকানা রাখা হয়নি এবং কখনো রাখাও হবে না। প্রিয়নবী (ﷺ)’এর পবিত্র জীবনের মতো তাঁর সম্পদও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় হবার জন্যে নসীবকৃত ছিলো।


এই প্রশ্নটি খলীফার দরবারে জনসমক্ষে উত্থাপন না করা হলে অনেক মানুষের মনেই এই সন্দেহের অবকাশ থাকতো যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর উত্তরাধিকার বুঝি আল-ক্বুরআনে বর্ণিত ঐশী বিধানেরই অধীন।


অধিকন্তু, মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) প্রিয়নবী (ﷺ)’এর সম্পদ হতে আলাদা থাকার শিক্ষাটি নিজ সন্তানদেরকে দেয়ার চেষ্টারত ছিলেন। 


হয়তো বা নবী-নন্দিনী (رضي اللّٰه عنها)’এর উদ্দেশ্য ছিলো খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’কে পরীক্ষা করা এ মর্মে যে, তিনি গরিব-দুঃস্থ, এতিম-অনাথ, বনূ হাশিম গোত্র ও অন্যান্য হক্বদার প্রাপকের প্রতি ওই সম্পদ ব্যয় করে মহানবী (ﷺ)’এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন কি-না। নাকি (চাপে পড়ে) নতুন পথ বেছে নেন (মানে মালিকানা নবী-বংশের বরাবর হস্তান্তর করেন)। খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর বিশ্বস্ত উত্তরসূরী হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই পরীক্ষাটির ফলাফল অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। (এতে প্রমাণিত হয়) তিনি তাঁর পূর্বসূরীর শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন এবং (নবী পাকের) খান্দান প্রশ্নে বা তাঁদের প্রতি ভক্তিপ্রেমের ভিত্তিতে তা হতে সরে আসেন নি।


উত্তরাধিকারের পক্ষে পেশকৃত শিয়া-বর্গের প্রামাণ্য দলিল


প্রথম প্রমাণ


 يُوصِيكُمُ ٱللَّهُ فِيۤ أَوْلَٰدِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ ٱلأُنْثَيَيْنِ


অর্থ: আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে; পুত্রের অংশ দুজন কন্যার সমান। [আল-ক্বুরআন, ৪:১১]


এই আয়াতটি অর্থের দিক থেকে সার্বিক। এতে সাধারণ মানুষ যেমন দায়বদ্ধ, তেমনি দায়বদ্ধ রাসূলে খোদা (ﷺ)-ও। তাঁর সম্পদের ওপরে হক্ব (অধিকার) রয়েছে তাঁরই কন্যার। খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) এই আয়াতটির বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং হযরত ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’কে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন নিম্নের এ হাদীসটি নিজ দাবির পক্ষে পেশ করে:


لاَ نُورَثُ مَا تَرَكْنَا صَدَقَةٌ.


অর্থ: আমরা (আম্বিয়া-বৃন্দ عليهم السلام) উত্তরাধিকারস্বরূপ কিছু রেখে যাই না; যা রেখে যাই তা সাদাক্বাহ (দানস্বরূপ)। [আল-বুখারী, হাদীস নং ৬৩৪৬]


জবাব


শিয়া গোষ্ঠীর উপস্থাপিত আয়াতে করীমাটি সুনির্দিষ্টভাবে উম্মতকেই উদ্দেশ্য করে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’কে করে না। আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা’আত ও শিয়া উভয়েই এ সিদ্ধান্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, আম্বিয়া (عليهم السلام)’বৃন্দ অর্থসম্পদের উত্তরাধিকার রেখে যান না। আমরা এর সমর্থনে ইতিপূর্বে শিয়াদের নির্ভরযোগ্য বইপত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি। হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه) ও ইমাম জা’ফর সাদিক্ব (رحمة اللّٰه عليه) উভয়েই যে এই একই দৃষ্টিভঙ্গি রাখতেন, তাও আমরা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছি। অনুরূপভাবে, আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা’আতের বিবরণগুলোও একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলন করে। একমাত্র খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)-ই এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন মর্মে  শিয়াদের দাবিটি ভিত্তিহীন। তাছাড়া, তা যদি সত্যও হতো, তাতেও রওয়ায়াত/বিবরণটির সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হতো না। কেননা ‘মুতাওয়াতির’ (বিপুল সংখ্যক বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস, যার ব্যাপারে সামষ্টিকভাবে তাঁদের মিথ্যে হিসেবে একমত হওয়া অসম্ভব) থেকে ‘খবরে ওয়াহিদ’ (মুতাওয়াতির নয় এমন হাদীস) পর্যন্ত হাদীসের শ্রেণিকরণ কেবল তাদেরই জন্যে (নির্দিষ্ট), যাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে সরাসরি হাদীস শোনেন নি। কিন্তু সাহাবা-এ-কেরাম (رضي اللّٰه عنهم) যাঁরা সরাসরি তাঁর কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কোনো রকম সন্দেহের অবকাশই নেই। তাঁদের ধর্মবিশ্বাসে ক্বুরআন মজীদ যেমন এক বাস্তবতা, তেমনি ওই সমস্ত আহাদীস-ও আরেক বাস্তবতা।


ওপরে প্রদত্ত ব্যাখ্যাটি অবশ্য এখানে অপ্রয়োজনীয়, কেননা এ হাদীসটি খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর পাশাপাশি আরো অনেক সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم) বর্ণনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সর্ব-হযরত উমর ফারূক্ব, উসমান বিন আফফান, আলী ইবনে আবী তালিব, আবদুর রহমান বিন আউফ, আব্বাস, হুযায়ফা ইবনে এয়ামান, যুবায়র ইবনে আওয়াম, সা’আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস, আবূদ্ দার্দা, আবূ হুরায়রাহ ও প্রিয়নবী (ﷺ)’এর পবিত্র বিবি সাহেবাবৃন্দ (رضي اللّٰه عنهم)। এছাড়াও অন্যান্য সাহাবা (رضي اللّٰه عنهم) রয়েছেন।


অতএব, এ হাদীসটি সূরা নিসার উক্ত ১১ নং আয়াতের সাথে মিলে না, বরং এটা আয়াতে উল্লেখিত সমস্ত বিধান হতে প্রিয়নবী (ﷺ)’কে ছাড় দেয়। কিন্তু এটা তো কোনো বিরল দৃষ্টান্ত নয়। নিচের আয়াতটির দিকে নজর দিলে আমরা একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করি:


فَٱنكِحُواْ مَا طَابَ لَكُمْ مِّنَ ٱلنِّسَآءِ مَثْنَىٰ وَثُلَٰثَ وَرُبَٰعَ


অর্থ: তবে বিবাহ করে নাও যেসব নারী তোমাদের ভালো লাগে - দুই দুই, তিন তিন এবং চার চার। [সূরা নিসা, ৩ নং আয়াত, নূরুল এরফান]


এই আয়াতটি সামগ্রিকভাবে উম্মতের জন্যে বিধানকৃত; কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এটার বাধ্যবাধকতা হতে মুক্ত, যেহেতু তাঁকে চারের অধিক বিবাহ করার অধিকার দেয়া হয়েছে।


কোনো আয়াতের ব্যাখ্যা দানকালে একটি হাদীসের অর্থ বিস্তৃত বা সংকীর্ণকরণ অবশ্যম্ভাবীরূপে আয়াতটির বিরুদ্ধাচরণ নয়। শিয়া গোষ্ঠীও আলোচ্য আয়াতটিতে (৪:১১) মুসলমান পিতার সন্তানবর্গ অবিশ্বাসী হলে, বা সন্তানবর্গ পিতাকে খুন করলে, অথবা তাদেরকে গোলাম বানানো হলে (ঐশী) বিধি-বিধানগত বাধ্যবাধকতা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। অনুরূপভাবে, তাঁরা এর অর্থকে বিস্তৃত করেছেন সেসব সন্তানকে বাদ দিতে, যাদের জন্ম হয়েছে ‘লি’আন’-এর পরে [লি’আন হচ্ছে কারো স্ত্রীর অবৈধ যৌনাচারের ব্যাপারে শপথকৃত সাক্ষ্য, যার ফলে বিচারের রায়ে স্ত্রী তালাক্ব/ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়]।


দ্বিতীয় প্রমাণ


 وَوَرِثَ سُلَيْمَانُ دَاوُودَ


অর্থ: এবং সুলায়মান দাউদের স্থলাভিষিক্ত হলো। [আল-ক্বুরআন, ২৭:১৬; নূরুল এরফান]


জবাব


আয়াতোল্লিখিত ‘ওয়ারিসী/উত্তরাধিকার’ উদ্দেশ্য করেছে নুবূওয়্যত, রাজত্ব ও (ঐশী) জ্ঞানকে। এই আয়াতের শানে নুজূলের দিকে তাকালে (মহানবী ﷺ -এর বিষয়ের) অনুরূপই ব্যক্ত হয়। কেননা পয়গাম্বর দাউদ (عليه السلام)’এর ঊনিশ জন সন্তান ছিলেন; এই আয়াতটি যদি আর্থিক/বস্তুগত উত্তরাধিকারকে উদ্দেশ্য করতো, তাহলে এতে অন্যান্য সন্তানদেরকে বঞ্চিত করা বোঝাতো।


শিয়া গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিধি-বিধানগত ‘উসূলুল কা’ফী’ পুস্তকে উদ্ধৃত রওয়ায়াত/বিবরণ আমাদের ওপরোক্ত জবাবকে আরো মজবুত বা শক্তিশালী করেছে। ওতে বিবৃত হয়: 


قال ابو عبد الله عليه السلام ان سليمان ورث داؤد وان محمدا ورث سليمان.


অর্থ: পয়গাম্বর সুলাইমান (عليه السلام) পয়গাম্বর দাউদ (عليه السلام)’এর উত্তরাধিকার লাভ করেন; আর প্রিয়নবী (ﷺ) ওয়ারিসী লাভ করেন পয়গাম্বর সুলায়মান (عليه السلام)’এর।


উদ্ধৃত আয়াতটিতে নিশ্চিতভাবে উদ্দেশ্য করা হয়েছে নুবূওয়্যতের উত্তরাধিকারকে, যেমনিভাবে এখানে বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (ﷺ)’এর পক্ষে কোনোক্রমেই পয়গাম্বর সুলায়মান (عليه السلام)’এর (অর্থগত) সম্পদ-সম্পত্তি উত্তরাধিকারস্বরূপ লাভ করা সম্ভবপর ছিলো না।


তৃতীয় প্রমাণ


পয়গাম্বর যাকারিয়্যা (عليه السلام) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এই বলে:


 وَإِنِّي خِفْتُ ٱلْمَوَالِيَ مِن وَرَآءِى وَكَانَتِ ٱمْرَأَتِي عَاقِراً فَهَبْ لِي مِن لَّدُنْكَ وَلِيّاً


অর্থ: এবং আমার মনে আমার আপন স্বজনদের সম্পর্কে আশঙ্কা রয়েছে; আর আমার স্ত্রী বন্ধ্যা; সুতরাং আমাকে আপনার কাছ থেকে এমন কাউকে দান করুন, যে আমার কাজ সম্পাদন করবে। [আল-ক্বুরআন, ১৯:৫; নূরুল এরফান]


 يَرِثُنِي وَيَرِثُ مِنْ آلِ يَعْقُوبَ وَٱجْعَلْهُ رَبِّ رَضِيّاً


অর্থ: সে আমার উত্তরাধিকারী হবে এবং এয়াক্বূবের বংশধরদের উত্তরাধিকারী হবে; এবং হে আমার রব্ব! তাকে পছন্দনীয় করুন। [প্রাগুক্ত ১৯:৬; নূরুল এরফান]


এ সব আয়াতে করীমা হতে তাঁরা (ফক্বীহ-মণ্ডলী) সিদ্ধান্ত নেন যে, আম্বিয়া (عليهم السلام)’বৃন্দের ওয়ারিস্ আছেন, যাঁরা তাঁদের অর্থসম্পদের উত্তরাধিকার পান।


জবাব


এখানেও আমাদের উত্তর একই, যদিও তা আমাদের প্রমাণাদি ছাড়া নয়। এ সব আয়াতে উত্তরাধিকার বলতে বোঝানো হয়েছে (ঐশী) জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও নুবূওয়্যতকে। অন্য কোনো কিছু ধরে নেয়া একেবারেই অযৌক্তিক হবে। প্রথমতঃ পয়গাম্বর যাকারিয়্যা (عليه السلام)’এর যুগে পয়গাম্বর এয়াক্বূব (عليه السلام)’এর সহস্র সহস্র বংশধর বর্তমান ছিলেন। তাহলে পয়গাম্বর যাকারিয়্যা (عليه السلام)’এর প্রার্থনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা কি তাঁর উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হতেন না? 


দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর কোনো পয়গাম্বর (عليه السلام)’এর পক্ষে এ ধরনের দুনিয়াবী ফায়দা/সুবিধার জন্যে এমন দুআ’ করা, যা অন্যান্য হক্বদার প্রাপককে তাঁদের হক্ব থেকে বঞ্চিত করবে, তা ধারণা করাও অযৌক্তিক। এটা নবুওয়্যতের মৌলিক কাঠামোকে খর্ব করে, যেটা দাবি করে অন্তরের পুতঃপবিত্রতা, আর লোভ ও ভোজনবিলাস হতে মুক্ত মন-মানসিকতা।


ক্বুরআন মজীদে নিরন্তর তালাশ করার পরও কেউ পয়গাম্বর (عليهم السلام)’বৃন্দের বস্তুগত/আর্থিক উত্তরাধিকার প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন না। তাঁরা নিজেরা যেমন উত্তরাধিকার পান নি, তেমনি তাঁদের পোষ্যরাও তাঁদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে উত্তরাধিকার লাভ করেন নি।


ওহে শিয়া-বর্গ! সর্ব-হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه) ও ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) কি এসব বাস্তবতা সম্পর্কে অনবধান ছিলেন যে আপনারা তাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণা করছেন এবং উক্ত  আয়াতগুলো থেকে ভ্রান্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন?


হযরত আব্বাস (رضي اللّٰه عنه) যখন ‘ফায়’ (فاء) জমি-জিরাতের যৌথ তত্ত্বাবধান ছেড়ে দেন, তখন তা হযরত ইমামে আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর একক তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত হয়। উত্তরাধিকারের (ঐশী) বিধান যদি এক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হতো, তাহলে হযরত আব্বাস (رضي اللّٰه عنه)’এর ধারণাকৃত অধিকার হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর দ্বারা গ্রহণ করা কীভাবে সম্ভব হতো? অধিকন্তু, এসব জমি-জিরাত হযরত আলী (كرم اللّٰه وجهه)’এর (বেসালের) পরে সর্ব-ইমাম হাসান ও হুসাইন (رضي اللّٰه عنهما) তত্ত্বাবধান করতেন। এটা যদি সত্যিসত্যি উত্তরাধিকার হতো, যেমনটি কারো কারো বিশ্বাস বিদ্যমান, তাহলে তাঁদের দু জনের প্রত্যেকেই এসব জমি হতে নিজ নিজ অংশ তাঁরা (ভাগাভাগি) করে নিতেন। সর্ব-হযরত আব্বাস (رضي اللّٰه عنه) ও আলী (كرم اللّٰه وجهه) তাঁদের মধ্যকার অংশও ভাগাভাগি করতেন প্রিয়নবী (ﷺ)’এর সম্মানিতা বিবি সাহেবা (رضي اللّٰه عنهنّ)’বৃন্দের ভাগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে। এই ভাগটি এরপর সর্ব-ইমাম হাসান ও হুসাইন (رضي اللّٰه عنهما) ও তাদের বোনদের মাঝে বণ্টন করা হতো। কিন্তু তা তো অবশেষে হয় নি।


মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها)’এর প্রতি অন্যায় করা হয়েছে মর্মে প্রবক্তারা কি (কখনো) এ ব্যাপারটি বিবেচনা করেছেন যে, উত্তরাধিকার বণ্টন না করা জোরজবরদস্তি হয়ে থাকলে ফলশ্রুতিতে তা প্রিয়নবী (ﷺ)’এর সম্মানিতা বিবি সাহেবা (رضي اللّٰه عنهنّ)’বৃন্দের প্রতিও অন্যায় সাব্যস্ত হবে। এই অন্যায়ের হাত হতে হযরত আব্বাস (رضي اللّٰه عنه) ও খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর কন্যা হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ (رضي اللّٰه عنها)-ও রেহাই পেতেন না।


আহলে বায়ত (رضي اللّٰه عنهم)’এর প্রিয় আওলাদ হযরত যায়দ আল-শহীদ (رحمة اللّٰه عليه) হতে এ মর্মে বর্ণিত যে, তিনি বলেন:


اما انا لو كنت مكان أبي بكر حكمت كما حكم به أبو بكر في فدك.


অর্থ: আমি যদি খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর স্থানে থাকতাম, তাহলে তাঁর ফাদাক (বাগান)-সংক্রান্ত একই আদেশ আমিও জারি করতাম। [আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া, ৫ম খণ্ড, ২৮৯ পৃষ্ঠা]


ফাদাক বাগান বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর পদাঙ্ক অনুসরণ করার জন্যে যদি খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) অন্যায়কারী হন, তাহলে (একই শাসন নীতি) সম্প্রসারণের দায়ে সর্ব-হযরত আলী, হাসান, হুসাইন ও যায়দ আল-শহীদ (رضي اللّٰه عنهم) সবাই অন্যায়কারী সাব্যস্ত হবেন। আল্লাহতা’লা আমাদেরকে এই মূর্খতা হতে রক্ষা করুন (আমীন)।


প্রশ্ন


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর পবিত্র বিবি সাহেবা (رضي اللّٰه عنهنّ)’বৃন্দের প্রত্যেককে কেন একটি করে ঘর দেয়া হয়েছিলো, যদি সম্পত্তির বণ্টন না-ই থাকতো? 


জবাব


প্রিয়নবী (ﷺ)’এর যাহেরী জিন্দেগীতে সর্ব-হযরত ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) ও উসামাহ (رضي اللّٰه عنه)’কে যেমন গৃহ দেয়া হয়েছিলো, অনুরূপভাবে তাঁর প্রত্যেক সহধর্মিণীকেও একক মালিকানাধীন একটি করে গৃহের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছিলো। 


ক্বুরআন মজীদে রাসূলে পাক (ﷺ)’এর সম্মানিতা স্ত্রীবৃন্দের (رضي اللّٰه عنهنّ) এসব ঘরের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়:


وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ


অর্থ: আর নিজেদের গৃহসমূহে অবস্থান করো। [আল-ক্বুরআন, ৩৩:৩৩; নূরুল এরফান]


এতে প্রমাণিত হয় যে সম্মানিতা স্ত্রী সাহেবা (رضي اللّٰه عنهنّ)’মণ্ডলীর ঘরগুলো তাঁদেরই মালিকানাধীন ছিলো এবং সেগুলো তাঁদেরকে উত্তরাধিকার হিসেবে দেয়া হয় নি।


আমরা যদি ধরেও নেই যে এসব গৃহ প্রিয়নবী (ﷺ)’এর মালিকানাধীন ছিলো, তাতেও কোনো আপত্তি নেই। কোনো স্বামী যখন পরলোক গমন করেন, তখন তাঁর বিধবাকে তাঁরই ঘরে ‘ইদ্দাহ’ মেয়াদ পর্যন্ত অবস্থানের অধিকার দেয়া হয়; কেননা এই সময় তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেন না (‘ইদ্দাহ’ মানে কোনো স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর ইন্তেকাল-পরবর্তী সময়কাল যখন তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেন না)।


প্রিয়নবী (ﷺ)’এর স্ত্রী সাহেবাবৃন্দ (رضي اللّٰه عنهنّ)’এর প্রতি পুনর্বিবাহ হারাম করা হয়েছে। অতএব, তাঁদেরকে এসব গৃহে অনির্দিষ্টকালের জন্যে বসবাসের অধিকার দেয়া হয়েছিলো।


ফাদাক উপহারস্বরূপ দানের ইঙ্গিত-সম্বলিত বর্ণনাসমূহ


ফাদাকের উত্তরাধিকার এবং একে ঘিরে বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কিত রওয়ায়াত/বিবরণসমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত; তাই এটা হেবা তথা উপহারস্বরূপ দেয়া হয়েছে মর্মে বিবেচনা করার কোনো অবকাশই নেই। তবে আমরা এ মর্মে উল্লেখসম্বলিত কিছু কিছু রওয়ায়াত পেয়ে থাকি। এগুলো শিয়াদের কৃত বানোয়াট পুনর্সংকলন, যা সেই মতবাদের অনুসারী বর্ণনাকারীদের দ্বারা মাপকাঠি হিসেবে ধরা হতে পারে। এর বিপরীতে আমরা পাই আহলুস্ সুন্নাতে ওয়াল-জামা’আতের নির্ভরযোগ্য বইপত্রে খেলাফতে আসীন হওয়ার কালে খলীফা উমর বিন আবদিল আযীয (২য় উমর)’এর নিম্নের ভাষ্যটি:


حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ الْجَرَّاحِ، حَدَّثَنَا جَرِيرٌ، عَنِ الْمُغِيرَةِ، قَالَ جَمَعَ عُمَرُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ بَنِي مَرْوَانَ حِينَ اسْتُخْلِفَ فَقَالَ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ كَانَتْ لَهُ فَدَكُ فَكَانَ يُنْفِقُ مِنْهَا وَيَعُودُ مِنْهَا عَلَى صَغِيرِ بَنِي هَاشِمٍ وَيُزَوِّجُ مِنْهَا أَيِّمَهُمْ وَإِنَّ فَاطِمَةَ سَأَلَتْهُ أَنْ يَجْعَلَهَا لَهَا فَأَبَى فَكَانَتْ كَذَلِكَ فِي حَيَاةِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ حَتَّى مَضَى لِسَبِيلِهِ فَلَمَّا أَنْ وَلِيَ أَبُو بَكْرٍ رضى الله عنه عَمِلَ فِيهَا بِمَا عَمِلَ النَّبِيُّ ﷺ فِي حَيَاتِهِ حَتَّى مَضَى لِسَبِيلِهِ فَلَمَّا أَنْ وَلِيَ عُمَرُ عَمِلَ فِيهَا بِمِثْلِ مَا عَمِلاَ حَتَّى مَضَى لِسَبِيلِهِ ثُمَّ أَقْطَعَهَا مَرْوَانُ ثُمَّ صَارَتْ لِعُمَرَ بْنِ عَبْدِ الْعَزِيزِ قَالَ ء يَعْنِي عُمَرَ بْنَ عَبْدِ الْعَزِيزِ ء فَرَأَيْتُ أَمْرًا مَنَعَهُ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ فَاطِمَةَ عَلَيْهَا السَّلاَمُ لَيْسَ لِي بِحَقٍّ وَأَنَا أُشْهِدُكُمْ أَنِّي قَدْ رَدَدْتُهَا عَلَى مَا كَانَتْ يَعْنِي عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ ‏.‏ قَالَ أَبُو دَاوُدَ وَلِيَ عُمَرُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ الْخِلاَفَةَ وَغَلَّتُهُ أَرْبَعُونَ أَلْفَ دِينَارٍ وَتُوُفِّيَ وَغَلَّتُهُ أَرْبَعُمِائَةِ دِينَارٍ وَلَوْ بَقِيَ لَكَانَ أَقَلَّ ‏.‏


অর্থ: প্রিয়নবী (ﷺ)’এর মালিকানাধীন ছিলো ফাদাক বাগান; আর তিনি তা হতে দান-সদক্বাহ করতেন বনূ হাশিম গোত্রের গরিব-দুঃস্থদের প্রতি, বারংবার অনুগ্রহ প্রদর্শনস্বরূপ; আর অবিবাহিতদের বিয়ের ব্যয়ভারও বহনের মাধ্যমে। হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) এই বাগানটির মালিকানা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর কাছে চান, কিন্তু তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানান। মহানবী (ﷺ)’এর যাহেরী জিন্দেগীতে এভাবেই বিষয়টি জারি থাকে। অতঃপর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي اللّٰه عنه) খলীফা পদে আসীন হলে তিনি প্রিয়নবী (ﷺ) যেভাবে ফাদাকের ব্যবস্থাপনা জারি রেখেছিলেন, সেভাবেই তা আজীবন জারি রাখেন। অতঃপর হযরত উমর ফারূক্ব (رضي اللّٰه عنه) খলীফার দায়িত্ব গ্রহণ করলে তিনিও আজীবন একই পদ্ধতিতে ওই ব্যবস্থাপনা জারি রাখেন। এরপর ফাদাক বাগানটি মারওয়ানের হাতে ন্যস্ত হয়, যিনি তা বণ্টন করেন; আর এরপর এটা উমর বিন আবদীল আযীয়ের (رحمة الله) ব্যবস্থাপনায় আসে।


(খলীফা উমর বিন আবদীল আযীয বলেন), মহানবী (ﷺ) যা হযরত ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’কে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, আমি বিশ্বাস করি তাতে আমার কোনো অধিকারই নেই; আর (তাই) আমি আপনাদেরকে সাক্ষ্য বহন করতে আহ্বান জানাই এতে যে, আমি এটাকে (মানে ফাদাক বাগানকে) আগের অবস্থায় পুনঃসংরক্ষণ করেছি; মানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর সময়কালের অবস্থায় (ফিরিয়ে নিয়েছি)। [সুনানে আবী দাউদ, ২৯৭২, বই নং ২০, হাদীস নং ৪৫]


হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه)’এর অসন্তুষ্টির ধারণাজ্ঞাপক বর্ণনাসমূহ   


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর উত্তরাধিকারের প্রশ্নে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’কে প্রশ্ন করলে খলীফা প্রত্যুত্তরে একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দেন:


نحن معاشر الانبياء لا نورث ما تركنا فهو صدقة.


অর্থ: আমরা পয়গাম্বর (عليهم السلام)-ভ্রাতৃকুল কোনো উত্তরাধিকার রেখে যাই না; যা রেখে যাই তা দান-সদক্বাহ। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৩৪৬]


কিছু কিছু রওয়ায়াত তথা বিবরণে এই উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেন বলে বিবৃত হয় এবং তিনি চিরতরে খলীফার সাথে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান বলেও অভিমত প্রকাশ করা হয়। এই পর্যায়ে ওই বিবরণের বাস্তবতা বা প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অনুধাবন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।


যে রওয়ায়াত/বিবরণটি এ বইতে ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছিলো, তাতে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যান এবং কখনোই এই প্রশ্নটি আর উত্থাপন করেন নি মর্মে বিবৃত হয়েছিলো। তাতে তাঁর রাগান্বিত হওয়ার কোনো উল্লেখই ছিলো না। তাছাড়া, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর কোনো হাদীস উল্লেখ করলে উম্মতের কারোরই পক্ষে উষ্মা প্রকাশ করা অসম্ভব ব্যাপার, তাঁর প্রিয়ভাজন কন্যার কথা তো বহু দূরে! তবে এখানে প্রশ্ন রয়ে যায়, এই বর্ণনাটিতে তাহলে - ”غضبت“ - মানে “তিনি রাগান্বিত হন” বাক্যটি কেন এসেছে?


প্রথমতঃ ফাদাক বাগানের হাদীস সংকলনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই পাঁচজন সাহাবা (رضي الله عنه) এই হাদীসটি বর্ণনা করেন; তাঁরা হলেন সর্ব-হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা (رضي اللّٰه عنها), আবূ হুরায়রাহ (رضي اللّٰه عنه), আবূ আল-তোফায়ল (رضي اللّٰه عنه), আমির ইবনে ওয়াসিলাহ (رضي اللّٰه عنه) এবং উম্মে হানী (رضي اللّٰه عنها)। শেষ চার জনের বর্ণনায় হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর অসন্তুষ্টি প্রকাশের কোনো উল্লেখই নেই। হযরত মা আয়েশাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর বিবরণের দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাই ইমাম যুহরী (رحمة اللّٰه عليه)’এর সূত্রে তাঁর কতিপয় শিষ্য এই অংশটুকু বর্ণনা করেন। [লেখকের নোট: এই রওয়ায়াতটির সর্বমোট ৩৬টি এসনাদ তথা বর্ণনাকারীদের পরম্পরা বিদ্যমান। এগারোটি সর্ব-হযরত আবূ হুরায়রাহ (رضي اللّٰه عنه), আবূ আল-তোফায়ল (رضي اللّٰه عنه) আমির ইবনে ওয়াসিলাহ (رضي اللّٰه عنه) এবং উম্মে হানী (رضي اللّٰه عنها)’এর সূত্রে, যেখানে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর রাগান্বিত হওয়ার কোনো উল্লেখ নেই। অবশিষ্ট ২৫টি এসনাদ এসেছে মা আয়েশাহ (رضي اللّٰه عنها) হতে আল-যুহরী (رحمة اللّٰه عليه) নামের বর্ণনাকারীর মাধ্যমে। এর মধ্যে ৯টিতে মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর উষ্মা প্রকাশের কোনো উল্লেখ নেই। অতএব, ৩৬টির মধ্যে ২০টি বিবরণেই অসন্তুষ্টির কথা নেই। কেবল ১৬টি বর্ণনায় তাঁর রাগান্বিত হওয়ার বাক্যটি আমরা দেখতে পাই, যার সবই আল-যুহরী (رحمة اللّٰه عليه)’এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এই ১৬টি বর্ণনার মধ্যে ৭টি স্পষ্ট ব্যক্ত করে এ কথাগুলো আল-যুহরী (رحمة اللّٰه عليه)’এর নিজস্ব, যা হযরত মা আয়েশাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর পরিবর্তে ‘তিনি (আল-যুহরী) বলেন’ কথাগুলোর পরে দৃশ্যমান; এবং আরেকটি রওয়ায়াতে আলোচ্য হাদীসটির শেষে বিবৃত হয় ‘তিনি (মা আয়েশাহ) বলেন’, যার দরুন ইশারা হয় যে (রওয়ায়াতের) বাক্যের মধ্যে বাধা/ছেদ পড়েছিলো। এতে ৩৬টির মধ্যে ৮টি বিবরণই কেবল অবশিষ্ট থাকে, যেখানে আল-যুহরী (رحمة اللّٰه عليه)’এর শিষ্যবৃন্দ তাঁর (আল-যুহরীর) কথা এবং মা আয়েশাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর আসল/মূল বিবরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন নি। সুতরাং খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর বিরুদ্ধে গোটা অভিযোগটা-ই আল-যুহরী (رحمة اللّٰه عليه)’এর ধারণার ওপর ভিত্তিশীল, হযরত মা আয়েশাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর বিবরণের ওপর ভিত্তিশীল নয়। এটা আল-যুহরী (رحمة اللّٰه عليه)’এর তরফ হতে বিচার-বিবেচনার ক্ষেত্রে একটি ভ্রান্তি ছিলো।]           


হযরত মা আয়েশাহ (رضي اللّٰه عنها) হতে অবশিষ্ট বর্ণনাকারীবৃন্দের পাশাপাশি ইমাম আল-যুহরী (رحمة اللّٰه عليه) হতে বর্ণনাকারীমণ্ডলীও এই সংযোজন সঙ্গত কারণে বর্জন করেন। যেখানেই উষ্মা প্রকাশের বিবরণ বিধৃত হয়েছে, তা খোদ হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) হতে সাবেত/প্রমাণিত নয়; বরঞ্চ তা ওই পরিস্থিতিতে মানবীয় আবেগ-অনুভূতি কেমন হতে পারে, তার ওপরই স্রেফ জল্পনাকল্পনা-মূলক একটি অনুমান।


এ রকম বাহ্যিক দৃষ্টিগত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বিভ্রান্তিকর হতে পারে, যেমনটি আমরা দেখতে পাই পয়গাম্বর মূসা (عليه السلام)’এর ক্ষেত্রে। তিনি তূর পাহাড় হতে ফিরে ইসরাঈলীদেরকে বিদ্রোহ করতে দেখতে পান; যার ফলশ্রুতিতে তিনি রাগান্বিত হয়ে তাঁর ভাই পয়গাম্বর হারূন (عليه السلام)’এর চুল ও দাড়ি মোবারক (শক্তভাবে) ধরেন এই ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, তিনি পাহাড়ে গমনের আগে যে আদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন তা বুঝি তাঁর ভাই মান্য করেন নি। এই বাহ্যতঃ দৃশ্যমান পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে নেয়া সিদ্ধান্তটি পয়গাম্বর মূসা (عليه السلام)’এর তরফ থেকে সঠিক বিবেচনা ছিলো না। 


হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর অসন্তুষ্টি প্রকাশের বিবরণটির বেলায় বাহ্যিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নি, বরং আবেগ-অনুভূতি কেমন হতে পারে তার ওপর অনুমান-নির্ভর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কোনো আবেগের প্রতিক্রিয়া নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার, যখনই ওই আবেগের ঘটনাটি আ্ন্দাজের ওপর ভিত্তিশীল হয়।


দ্বিতীয়তঃ কোনো বর্ণনাকারী কখনো কখনো সদৃশ দৃষ্টান্তগত বিষয়ে অনুমানভিত্তিক কোনো কিছু রওয়ায়াতে তথা বর্ণনায় যোগ করতে পারেন, যা হয়তো সঠিক হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। রাসূলে পাক (ﷺ)’এর সেই ঘটনার কথাই ধরুন, যেখানে তিনি কিছু দিনের জন্যে আপন (পবিত্র) বিবি সাহেবা (رضي اللّٰه عنهنّ)’বৃন্দের কাছ থেকে দূরে সরে ছিলেন। তিনি ওই সময় ওপরের তলায় বসবাস করে নিজেকে নিঃসঙ্গ রেখেছিলেন। কিন্তু শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো যে তিনি তাঁর স্ত্রী (رضي اللّٰه عنهنّ)’বৃন্দকে তালাক্ব দিয়েছেন। হযরত উমর ফারূক্ব (رضي اللّٰه عنه) এই বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাইতে প্রিয়নবী (ﷺ)’এর কাছে আসেন এবং তাঁকে তখন জানানো হয় মহানবী (ﷺ) তাঁর স্ত্রী (رضي اللّٰه عنهنّ)’বৃন্দকে তালাক্ব দেন নি। 


রাসূলে খোদা (ﷺ) যখন নির্জন বাস গ্রহণ করে কিছু দিনের জন্যে তাঁর স্ত্রী (رضي اللّٰه عنهنّ)’বৃন্দের কাছে আসা বন্ধ করেন, তখনই মানুষেরা সদৃশ দৃষ্টান্তভিত্তিক অনুমানের দ্বারা ধরে নেন তিনি বুঝি তাঁর বিবি সাহেবা (رضي اللّٰه عنهنّ)’বৃন্দকে তালাক্ব দিয়েছেন, যা সর্বসাধারণ মানুষের পক্ষে একটি দুর্ভাগ্যজনক ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো।


অনুরূপভাবে, ফাদাক বাগান-সংক্রান্ত রওয়ায়াতটিতে বর্ণনাকারীবৃন্দ দেখতে পান এই বাক্যটি - ” لم تتكلم “ - মানে “মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) আর কখনোই খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর সাথে কথা বলেন নি।” কতিপয় বর্ণনাকারী ধরে নেন এটা তাঁর অসন্তুষ্টির কারণেই হয়েছে, আর তাই তাঁরা রওয়ায়াতটিতে সুবিধামতো যোগ করেন - ”غضبت“ - মানে “তিনি রাগান্বিত হন,” যা এরপর এসনাদের/পরম্পরার অন্যান্য (পরবর্তীকালের) বর্ণনাকারীর কাছে চলে আসে।


আরবী এবারত তথা উদ্ধৃতিতে - ” لم تتكلم “ - বাক্যটির প্রকৃত অর্থ হলো, মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) উক্ত বিষয়টি আর কখনোই খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর দরবারে উত্থাপন করেন নি, কেননা তিনি খলীফার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট ছিলেন!


হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং তাই এরপর থেকে তাঁর সাথে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন মর্মে ধারণা করাটা সদৃশ দৃষ্টান্তভিত্তিক অনুমান হতে সৃষ্ট এক ভ্রান্তি, যদিও এতে বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততা ও আস্থাশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না; অথবা তাঁর যোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয় না।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাওয়ার পরে যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো যে তিনি তাঁর পবিত্র বিবি সাহেবা (رضي اللّٰه عنهنّ)’বৃন্দকে তালাক্ব দেন নি, ঠিক অনুরূপভাবে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) যে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন সেটাও কেউ সাবেত/প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম নন, যতোক্ষণ না খোদ মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) নিজস্ব ভাষ্য দ্বারা এটা নির্ধারণ করেন। তিনি রাসূলে পাক (ﷺ)’এর একখানা হাদীস শরীফ শোনার পরে রাগান্বিত হয়েছিলেন মর্মে ধারণা করার দুঃসাহস কীভাবে কেউ করতে পারে? “মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) আর কখনোই খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর সাথে কথা বলেন নি।” - এই বাক্যটি শুনে বর্ণনাকারী (রাবী) ঘটনাটি আলগাভাবে বর্ণনা করেছিলেন, হুবহু বর্ণনা করেন নি; আর এরই ফলশ্রুতিতে সদৃশ দৃষ্টান্তভিত্তিক অনুমানের ওপর ভিত্তি করে “তিনি রাগান্বিত হন” বাক্যটি বর্ণনাকারী অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।


আমাদের এই (দৃষ্টিভঙ্গিগত) অবস্থানটি আরো মজবুত হয়, যখনই কেউ ইমাম যুহরী (رحمة اللّٰه عليه)’এর অন্যান্য শিষ্যদের দিকে তাকান, যাঁরা এই অংশটি সম্পূর্ণ বাদ দিয়েছিলেন। বস্তুতঃ তাঁরা রওয়ায়াতটি হুবহু বর্ণনা করেন।


ওপরের হাদীসটি যেহেতু সহীহ আল-বুখারী হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, সেহেতু এই কিতাবটির সত্যতা সম্পর্কে কারো কারো মনে বিভ্রান্তি থাকতে পারে। সবাইকে বুঝতে হবে যে, এই সংকলনটি নির্ভরযোগ্য হওয়ার মানে হচ্ছে এর রাবী বা বর্ণনাকারীবৃন্দ সকলেই নির্ভরযোগ্য, আস্থাভাজন ও ন্যায়পরায়ণ। এতে কোনো মিথ্যুক বা জালিয়াত নেই। যদি কোনো বর্ণনাকারীকে আলগাভাবে একটি হাদীস বর্ণনা করতে দেখা যায়, যা বিবেচনাগত ভ্রান্তির কারণে হুবহু বর্ণনা নয়, তাহলে সেটা তাঁর নির্ভরযোগ্যতা বা বিশ্বস্ততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না; আর সেটা বুখারী শরীফের সত্যতা বা প্রামাণিকতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে না।


যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া হয় ফাদাকের ঘটনায় মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) রাগান্বিত হয়েছিলেন, তাহলে এটা ওই সময়কার আলোচনার বিষয়বস্তু হতো এবং সর্বশ্রদ্ধেয় আহলে বায়ত, তাবেঈন ও মদীনাবাসী (رضي اللّٰه عنهم أجمعين)’বৃন্দের মাঝে ব্যাপক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াতো। যেহেতু এ বিতর্কের উৎস হচ্ছেন কেবল ইমাম যুহরী (رحمة اللّٰه عليه)’এর সামান্য কয়েকজন শিষ্য, সেহেতু এর কোনো ওজন (মানে গুরুত্ব) নেই, ঠিক যেমনটি নেই এতে কোনো সত্যের লেশচিহ্নও।


বুদ্ধিবৃত্তি ও ন্যায় আমাদের কাছে এটা দাবি করে যে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর (এতদসংক্রান্ত) সিদ্ধান্ত ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর হাদীসটির প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। যিনি ‘বাতূল’ (পুতঃপবিত্র) উপাধিপ্রাপ্তা, বৈষয়িক লোভ-লালসার ব্যাধি হতে মুক্ত তথা নির্মল এবং জান্নাতের রানী হবার মহাসম্মানে ভূষিতা, তাঁর কাছ থেকে এর ব্যতিক্রম অন্য কিছু একদম অসম্ভব একটা ব্যাপার।


হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه) পরিতুষ্ট ছিলেন


ফাদাক বাগান বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’কে অনুসরণকল্পে গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর সন্তুষ্টি আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামাআত ও শিয়া উভয় সম্প্রদায়ের রওয়ায়াত/বিবরণগুলো বিবৃত করে। আহলে সুন্নাতের বইপত্রের দিকে কেউ তাকালে দেখতে পাবেন আল-বায়হাক্বী (رحمة اللّٰه عليه)’এর রওয়ায়াতগুলো; সহীহ আল-বুখারীগ্রন্থের শরাহ/ব্যাখ্যাগুলো; মিশকাতুল মাসাবীহ পুস্তকের ব্যাখ্যাগুলো; শরহুল আক্বায়েদ কিতাবের ব্যাখ্যামূলক বই ‘নিবরাস’ (৫৫০ পৃষ্ঠা); আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়াহ, তাবাক্বাত-এ-ইবনে-সা’আদ ও অন্যান্য কিতাব।


প্রিয়নবী (ﷺ)’এর বেসাল শরীফের পরে খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي اللّٰه عنه) হযরতে ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه)’এর উপস্থিতিতে মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’কে সম্বোধন করে বলেন:


والله ما تركت الدار والمال، والأهل والعشيرة، إلا إبتغاء مرضاة الله، ومرضاة رسوله، ومرضاتكم أهل البيت، ثم ترضاها حتى رضيت. قال ابن كثير: وهذا إسناد جيد قوي.


অর্থ: “আল্লাহর শপথ! আমি আমার ঘর, সম্পদ, পরিবার ও বংশকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)’এর রেযামন্দি/সন্তুষ্টির ওয়াস্তে এবং আপনাদের তথা আহলে বায়ত (رضي اللّٰه عنهم)’এর সন্তুষ্টির খাতিরে উৎসর্গ করেছি।” বর্ণনাকারী বলেন, খলীফা (رحمة الله) এমন ভাষণ দেন যার দরুন মা ফাতিমা (رضي اللّٰه عنها) খুশি হন। হাফেয ইবনে কাসীর এই বিবরণ সম্পর্কে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বলেন: এর এসনাদ/বর্ণনাকারীদের পরম্পরা মজবুত। [আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়াহ, ৫ম খণ্ড, ২৮৯ পৃষ্ঠা]


শিয়া গোষ্ঠী কর্তৃক সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচিত ইবনে আল-মায়সাম আল-বাহরানী বিরচিত ‘নাহজুল বালাগাহ’ (৫৪৩:৩৫), ইবনে আবী আল-হাদীদ প্রণীত উক্ত কিতাবের ’শরাহ’/ব্যাখ্যা (২৯৬:১৬) এবং ‘দুর্রাহু নাজাফিয়্যাহ’ (৩৩২ পৃষ্ঠা) ইত্যাদি বইপত্রে লিপিবদ্ধ আছে:


كان رسول الله ﷺ يأخذ من فدك قوثهم ويقسم الباقي ويحمل منه في سبيل الله و لك على الله أن اصنع بها كما كان يصنع فرضيت بذلك وأخذت العهد عليه به وكان يأخذ غلتها فيدفع إليهم منها ما يكفيهم ثم فعلت الخلفاء بعده كذلك إلى أن ولى معاوية. 


অর্থ: খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي اللّٰه عنه) হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’কে সম্বোধন করে বলেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফাদাক (বাগান) হতে আপনাদের রসদ (আলাদা করে) রেখে বাকি অংশ বিতরণ করতেন। তিনি এর রাজস্ব থেকে (সামরিক) অভিযানের অর্থায়নও করতেন। আমি আল্লাহর নামে ক্বসম করছি, আমি হুবহু তা-ই করবো, যেভাবে প্রিয়নবী (ﷺ) পরিচালনা করেছেন।” এতদশ্রবণে মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) খুশি হন এবং খলীফার (رضي الله عنه)’এর কথার অঙ্গীকার নেন। খলীফা (رحمة الله) ওই সম্পত্তির ফসল তুলে আহলে বায়ত (رضي اللّٰه عنهم)’বৃন্দকে সেখান থেকে এমন পরিমাণ (রাজস্ব) হস্তান্তর করতেন যা তাঁদের জন্যে পর্যাপ্ত হতো। তাঁর উত্তরসূরী খলীফামণ্ডলীও একই পদ্ধতিতে বণ্টন করতেন, যতোক্ষণ না আমীরে মু’আবিয়া (رضي اللّٰه عنه) খলীফা পদে আসীন হন।


শিয়া সম্প্রদায়ের উপরোল্লিখিত তিনটি কিতাব নিম্নবর্ণিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে স্পষ্ট বক্তব্য দেয়:


১) ফাদাক বাগানের ফসল (তথা রাজস্ব) আহলে বায়ত (رضي اللّٰه عنهم) ও গরিব-দুঃস্থদের খাতে ব্যয় হতো। এর পাশাপাশি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় অর্থায়নও এ থেকে আসতো। এই সম্পত্তি কখনোই সর্ব-হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها), আলী (كرّم اللّٰه وجهه), কিংবা তাঁদের সন্তান সর্ব-ইমাম হাসান ও হুসাইন (رضي اللّٰه عنهما)’এর প্রতি হেবা/উপহৃত হয় নি। 


২) হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) খলীফা হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর কাছে এ অঙ্গীকার নেন যে ফাদাক বাগানের উৎপন্ন সম্পদ ঠিক সেভাবেই ব্যয় করা হবে, যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ব্যয় করতেন। খলীফা (رضي الله عنه) এতে সম্মত হন, যার ভিত্তিতে মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) সন্তুষ্ট হন।


৩) খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي اللّٰه عنه) ফাদাক বাগানের রাজস্ব হতে হযরত ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها), সর্ব-ইমাম হাসান ও হুসাইন (رضي اللّٰه عنهما)’এর সমস্ত চাহিদা দেখাশুনা করতেন।


৪) বণ্টনের এই পদ্ধতিটি খুলাফা-এ-রাশেদীন সর্ব-হযরত আবূ বকর, উমর, উসমান ও আলী (رضي اللّٰه عنهم)’এর (প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগীতে একই রকম ছিলো। ইমাম হাসান (رضي اللّٰه عنه)’এর খেলাফত আমলেও এতে কোনো পরিবর্তন সাধিত হয় নি, যতোক্ষণ না হযরত মু’আবিয়া (رضي اللّٰه عنه) খলীফা পদে আসীন হন। তাঁর শাসনামলের আগে কোনো পরিবর্তনই সাধন করা হয় নি, কেননা খলীফাবৃন্দ (رضي الله عنه) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)’এর আদেশ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। এ-ই যখন অবস্থা, তখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)’এর আজ্ঞার প্রতি হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর অসন্তুষ্টি প্রকাশের (ধারণাকৃত) বিষয়টি বোধগম্য হওয়াটা একেবারেই অসম্ভব। তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন মর্মে কেউ যদি নিজ দাবিতে অনমনীয় থাকেন, তাহলে তাঁর প্রতি প্রশ্ন হলো: হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) ফাদাক বাগানের উৎপন্ন ফসল গ্রহণ করেছিলেন কেন? এর একমাত্র যৌক্তিক ব্যাখ্যা হচ্ছে রাবী তথা বর্ণনাকারীদের এসনাদে অবস্থিত কোনো বর্ণনাকারী কর্তৃক (বিবরণটিকে) ভুল বোঝা, যা (পরম্পরার) পরবর্তী বর্ণনাকারীদের মাঝে চলে এসেছে।


৫) (শিয়াদের) এ সব বইয়ে লিপিবদ্ধ বক্তব্যসমূহে কিছু মানুষের মধ্যে বিরাজমান ভ্রান্ত ধারণারও অপনোদন রয়েছে, যে ভুল ধারণায় ব্যক্ত হয় খলীফা উসমান (رضي اللّٰه عنه) তাঁর শাসনামলে ফাদাক বাগানের জমি মারওয়ানের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। খলীফা (رضي الله عنه) যে তাঁর পূর্বসূরীদের মতোই সম্পত্তিটির ব্যবস্থাপনা করেছিলেন, সেই বিষয়টি দৃঢ়ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। 


অনুরূপভাবে, সাইয়্যেদ আলী নক্বী তাঁর লিখিত ‘শরহে নাহজ আল-বালাগাহ’ গ্রন্থে লেখেন:


ابو بکرغله وسودآن را گرفته بقدر کفایت با اهل بیت عليه السلام مي داد وخلافاء بعد از وبرآن اسلوب رفتار نمودند تا زمان معاويه


অর্থ: খলীফা হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) ফাদাক বাগানের রাজস্ব আহলে বায়ত (رضي اللّٰه عنهم)’এর কাছে এমন পরিমাণ হস্তান্তর করতেন, যা তাঁদের জন্যে পর্যাপ্ত হতো। (পরবর্তী) খলীফাবৃন্দ (رضي اللّٰه عنهم)-ও এই ঐতিহ্য জারি রাখেন হযরত মু’আবিয়া (رضي اللّٰه عنه)’এর আগমনের আগ পর্যন্ত। [আলী নক্বী কৃত শরহে নাহজ আল-বালাগাহ, ৯৬০ পৃষ্ঠা]


এতেও প্রমাণিত হয় যে, হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) তাঁর ব্যয় নির্বাহে এই রাজস্ব গ্রহণে খুশি ছিলেন, যা তাঁর সন্তুষ্টি-ই প্রতিফলন করে। এছাড়া, শিয়া সূত্রগুলোর বর্ণনা হতে এ-ও স্পষ্ট যে, খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي اللّٰه عنه)’এর পবিত্র বিবি সাহেবা (رضي الله عنه) নিরবচ্ছিন্নভাবে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর খেদমত/সেবা করতেন। তাঁর অসুস্থতার দিনগুলোতেও খলীফা (رضي الله عنه)’এর স্ত্রী হযরত আসমা বিনতে উমাইস (رضي اللّٰه عنها) নবী-নন্দিনী (رضي الله عنه)’এর প্রয়োজনীয় সেবাশুশ্রূষা করতেন। এই ক্ষণস্থায়ী জগতের আবাসস্থল ত্যাগের সময় মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর সামনে উপস্থিত হলে তাঁর দাফন-কাফনের মুখ্য দায়িত্বও হযরত আসমা বিনতে উমাইস (رضي اللّٰه عنها)’এর কাঁধে ন্যস্ত হয়। 


’জিলাউল উয়ূন’ শীর্ষক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে:


امیر المومنين و اسمآء بنت عميس فطمة را غسل دادند


অর্থ: হযরতে ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه) ও হযরত আসমা বিনতে উমাইস (رضي اللّٰه عنها) হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর গোসল দেন। [জিলাউল উয়ূন, ৭৩ পৃষ্ঠা]


নবী-নন্দিনী (رضي اللّٰه عنها)’এর শেষ অসুখের সময় হযরত আসমা বিনতে উমাইস (رضي اللّٰه عنها) একটি অস্থায়ী পর্দাবৃত তাঁবু প্রস্তুত করে তা হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর খেদমতে পেশ করেন। তিনি এটা দেখে অসীয়ত/উইল করেন তাঁর দাফন-কাফন প্রক্রিয়া যেনো এই তাঁবু দ্বারা আবৃত হয়। তাঁর নির্দেশনা মান্য করা হয়।


হযরত আলী (كرّم اللّٰه وجهه) কর্তৃক খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর হাতে আনুগত্যের অঙ্গীকার ও তাঁরই ইমামতিতে নামায আদায়ের ঘটনাটির বিবরণ শিয়া গোষ্ঠীর বইপত্রেও বিদ্যমান। শিয়া পণ্ডিত আল-তাবারসী রচিত ‘আল-এহতেজাজ’ পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে:


ثم تناول يد أبي بكر فبايعه.


অর্থ: অতঃপর ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه) খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي اللّٰه عنه)’এর হাত মোবারক ধরেন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন। [আল-এহতেজাজ, ৫২ পৃষ্ঠা]


একই বইয়ে হযরত আলী (كرّم اللّٰه وجهه) সম্পর্কে আরো বলা হয়:


ثم قام وتهيأ للصلاة وحضر المسجد وصلى خلف أبي بكر.


অর্থ: অতঃপর ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه) উঠে দাঁড়ান, নামাযের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর ইমামতিতে নামায পড়েন। [প্রাগুক্ত আল-এহতেজাজ, ৬০ পৃষ্ঠা]


এই একই লিপি পাওয়া যায় ‘তাফসীর আল-ক্বুম্মী,’ ‘মিরআত আল-উক্বূল শারহ আল-উসূল ওয়াল-ফুরূ’ ইত্যাদি শিয়া গ্রন্থাবলীতেও।


হযরতে মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) যদি সত্যিসত্যি অসন্তুষ্ট হতেন, তাহলে হযরতে ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه) কেন খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর কাছে আনুগত্যের অঙ্গীকার করতে গেলেন এবং তাঁরই ইমামতিতে নামায পড়লেন? এক্ষণে চৌদ্দ শ বছর পরে কোনো ‘পণ্ডিত’ (?) আবির্ভূত হয়ে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর রাগান্বিত হওয়ার কল্পিত কাহিনী শুনে ‘ফতোয়া’ ঝাড়ছেন যে খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) হতে দূরত্ব বজায় রাখাই ঈমানের দাবি! যদিও আল্লাহর সিংহ (আসাদউল্লাহ) হযরতে ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه) যে খলীফার (رضي اللّٰه عنه) হাতে বাইয়া’ত তথা আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন, তা অস্বীকার করা হচ্ছে। এই অসন্তুষ্টির দাবি উত্থাপনকারীদের দাবির মধ্যে কোনো সত্যতা থাকলে ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه) খলীফা (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন কেন?


ওপরের সমস্ত বিবরণ এই বাস্তবতাকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করে যে, সর্ব-হযরত আলী (كرّم اللّٰه وجهه) ও মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) খলীফা (رضي الله عنه)’এর সাথে সুসম্পর্ক রাখতেন এবং তাঁর প্রতি খুশি ছিলেন। তাঁদের মতো এতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অন্তরে শত্রুতাভাব বজায় রেখে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। সত্যিসত্যি রাগান্বিত হলে পয়গাম্বর মূসা (عليه السلام) কর্তৃক পয়গাম্বর হারূন (عليه السلام)’এর প্রতি ব্যক্ত ইতিপূর্বে উল্লেখিত ঘটনার মতো প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো। তিনি তাঁর ভাইয়ের দাড়ি ও চুল মোবারক শক্তভাবে ধরেছিলেন এই ভেবে যে তিনি বুঝি ভুল করেছেন। অথবা, নবী-নন্দিনী (رضي اللّٰه عنها)’এর রৌপ্য পরিধান দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশের মতো কিছু একটা হতো, যেমনিভাবে এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে শিয়া সম্প্রদায়ের বইপত্রে।


শিয়া পণ্ডিত আব্বাস আলী ক্বুম্মী নিজ ‘মুনতাহা আল-আমল’ পুস্তকে লেখেন:


হযরত ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) ফাদাক বাগান বিষয়ে হযরতে ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه)’এর প্রতি রাগান্বিত হন এবং তাঁকে বলেন - اشتملت شملة الجنين وقعدت حجرة الظنّين - অর্থাৎ, আপনি ভ্রূণের মতো পাকিয়েছেন এবং অসহায়ের মতো বসে আছেন। [মুনতাহা আল-আমল, ৯৭ পৃষ্ঠা]


শিয়া ‘আল-এহতেজাজ’ কিতাবের উদ্ধৃতি, যা বা’ক্বির আল-মজলিসী অনুবাদ করেছেন তাঁর ‘হাক্কুল এয়াক্বীন’ গ্রন্থে, তাতে লেখা হয়:


خطا بهای شجاعانه درشت با سید وصیا نمود که مانند جنین در رهم پرده نشین شده ومثل خا نان در خانه گر یخته


অর্থ: (মা ফাতিমাহ رضي اللّٰه عنها বলেন) আপনি কেন লুকিয়ে বসে আছেন এবং আমার সাহায্যে এগিয়ে আসছেন না? [হাক্কুল এয়াক্বীন, ১ম খণ্ড, ১৬১ পৃষ্ঠা]


একইভাবে, শিয়া ‘জিলাউল-উয়ূন’ কিতাবে আমরা দেখতে পাই লিপিবদ্ধ আছে:


হযরত ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) হযরতে ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه)’এর প্রতি রাগান্বিত হন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর গৃহের উদ্দেশ্যে ঘর ত্যাগ করেন।


ওই বইয়ের আরো কিছু দূর পড়লে আমরা দেখতে পাই:


তিনি হযরতে ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه)’এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে (সেখানে) যান। [জিলাউল উয়ূন, ৬১ ও ৭১ পৃষ্ঠা]


সর্ব-পয়গাম্বর মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام), প্রিয়নবী (ﷺ) ও তাঁর কন্যা হযরত ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) এবং হযরতে ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه) প্রমুখের মধ্যকার এ সব ঘটনা যদি তাঁদের ঈমানদারির প্রতি আঙ্গুল ওঠানোর মতো না হয় অথবা তাঁদের প্রতি মানহানিকর না হয় (শিয়া দৃষ্টিকোণ থেকে), তাহলে খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর প্রতি হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর রাগের ধারণাকৃত/কল্পিত ঘটনাটির ক্ষেত্রে পরিপন্থী বা উল্টো দৃষ্টিভঙ্গি নেয়াটা চরম পর্যায়ের অন্যায় নয় কি?


হযরত ফাতিমা (رضي الله عنه)’এর জানাযা


সর্ব-হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) ও মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর মধ্যকার ধারণাকৃত/কল্পিত টানাপোড়েনের কারণে খলীফা (رضي الله عنه) তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করেন নি কিংবা তাঁকে জানাযা সম্পর্কে জানানো হয়নি বলাটা সত্যেরই অপলাপ মাত্র। খলীফা (رضي الله عنه)’এর জন্যে তৃতীয় কোনো পক্ষের দ্বারা জানানোর কোনো প্রয়োজনই ছিলো না, কেননা তাঁরই স্ত্রী হযরত আসমা বিনতে উমাইস (رضي اللّٰه عنها) নবী-নন্দিনী (رضي الله عنه)’এর শেষ দিনগুলোতে তাঁর সেবাশুশ্রূষা করছিলেন। খলীফা (رضي الله عنه)’এর বিবি সাহেবা (رضي الله عنه)-ই দাফন-কাফন ও পর্দাবৃত তাঁবুর তত্ত্বাবধান করেছিলেন। অধিকন্তু, খলীফা (رضي الله عنه) নবী-নন্দিনী (رضي الله عنه)’এর জানাযার নামাযে ইমামতি করেন নি মর্মে কোনো রওয়ায়াত নেই; বরঞ্চ কিছু রওয়ায়াত এর সত্যতাই প্রতিষ্ঠা করে:


عن جعفر ابن محمد عن أبيه قال ماتت فاطمة بنت النبي صلى الله عليه و سلم فجاء أبو بكر وعمر ليصلوا فقال أبو بكر لعلي بن أبي طالب ثقدم فقال ما كنت لاتقدم وأنت خليفة رسول الله ﷺ فتقدم أبو بكر فصلى عليها.


অর্থ: হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها) বেসালপ্রাপ্ত হন; অতঃপর সর্ব-হযরত আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) ও উমর (رضي اللّٰه عنه) জানাযায় আসেন। খলীফা (رضي الله عنه) হযরতে ইমামে আলী (كرّم اللّٰه وجهه)’কে জানাযায় ইমামতি করার অনুরোধ জানান। তিনি তা জ্যেষ্ঠতার কারণ দেখিয়ে ফিরিয়ে দেন। তিনি বলেন, “আপনার তথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর খলীফার উপস্থিতিতে আমি কীভাবে জানাযাতে ইমামতি করি?” এমতাবস্থায় খলীফা (رضي الله عنه) এগিয়ে যেয়ে জানাযার নামায পড়ান। [কানযুল উম্মাল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩১৮ পৃষ্ঠা]


عن حماد عن إبراهيم قال صلى أبو بكر الصديق على فاطمة بنت رسول الله صلى الله عليه و سلم فكبر عليها أربعا.


অর্থ: খলীফা (رضي الله عنه) নবী-নন্দিনী (رضي الله عنه)’এর জানাযার নামায পড়ান এবং চার বার তাকবীর পাঠ করেন। [তাবাক্বাত ইবনে সা’আদ, ৮ম খণ্ড, ২৯ পৃষ্ঠা]


এই বর্ণনাটি ’সীরাতে হালাবিয়্যাহ’ গ্রন্থে হুবহু লিপিবদ্ধ আছে। [সীরাতে হালাবিয়্যাহ, ৩য় খণ্ড, ৩৯১ পৃষ্ঠা]


আহলে সুন্নাত ওয়াল্ জামাআত ও শিয়া সম্প্রদায় উভয়েরই ইতিহাসবিদবৃন্দ উল্লেখ করেন যে, ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) তাঁর বড় ভাই ইমাম হাসান (رضي اللّٰه عنه)’এর জানাযা পড়াবার সম্মান মদীনা নগরীর তদানীন্তন রাজ্যপাল সাঈদ ইবনে আল-’আস-কে প্রদান করেন। ইমাম হুসাইন (رضي اللّٰه عنه) বলেন:


لو لا أنه سنة ما قدمته.


অর্থ: (নেতা কর্তৃক নামাযে ইমামতি করার) রীতি/প্রথাটি না হলে আমি তাকে অনুমতি দিতাম না।


এই ঘটনাও এ বাস্তবতাকে সমর্থন যোগায় যে হযরত মা ফাতিমাহ (رضي اللّٰه عنها)’এর জানাযার নামাযে খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه) ছাড়া অন্য কেউই ইমামতি করেন নি। এ সব নামাযে রীতিগতভাবে শাসকই ইমামতি করতেন। আর আল্লাহতা’লা-ই সবচেয়ে ভালো জানেন।


হাদীস-শাস্ত্রের উসূল তথা নীতিমালা অনুযায়ী লক্ষণীয় যে, কোনো বিষয়কে সাবেত/প্রতিষ্ঠাকারী রওয়ায়াত তথা বিবরণ তা নাকচকারী অপর কোনো বিবরণের ওপরে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। 


এই নীতির আলোকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভাবনীয় যে, সর্ব-হযরত আলী (كرّم اللّٰه وجهه) কিংবা আব্বাস (رضي اللّٰه عنه) কর্তৃক যে সমস্ত বিবরণে জানাযা পড়ার উল্লেখ রয়েছে, সেগুলোতে নামাযে ইমামতি করাকে উদ্দেশ্য করা হয় নি। আর আল্লাহতা’লা-ই জানেন সবচেয়ে ভালো; তাঁর জ্ঞানই সর্বোৎকৃষ্ট।


পক্ষপাতহীন চিন্তাধারা অনুযায়ী প্রত্যেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’কে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণকারী ব্যক্তিত্ব (رضي اللّٰه عنه) যিনি নিজের খরচ বাবদ ফাদাক বাগান থেকে এক কানাকড়িও নেন নি, যিনি অসীয়ত/উইল করে গিয়েছিলেন যেনো (খলীফা হিসেবে) তাঁর নেয়া সমস্ত বেতনই রাজকোষে ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং যিনি কাফনের নতুন কাপড়ের পরিবর্তে পুরোনো কাপড়ের টুকরো পছন্দ করেছিলেন, তাঁর তরফ থেকে অন্যায় আচরণ করা একেবারেই অসম্ভব ছিলো। আল্লাহ পাক তাঁকে মহা পুরস্কার মঞ্জুর করুন, আমীন।


খলীফা আবূ বকর (رضي اللّٰه عنه)’এর পরম সততা ও ন্যায়পরায়ণতা-ই মুহাজিরীন, আনসার, বনূ হাশিম ও ক্বুরাইশ গোত্রগুলোকে তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো। প্রিয়নবী (ﷺ)’এর প্রথম খলীফা (প্রতিনিধি) ছিলেন সাইয়্যেদুনা আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي اللّٰه عنه)। এই ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্য ও পারস্পরিক ভালোবাসার মাধ্যমেই সাহাবা কেরাম (رضي اللّٰه عنهم أجمعين) ইহ ও পারলৌকিক দুই জাহানে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করেন।


প্রত্যেক ব্যক্তি, সমাজ ও অনাগত যুগের সাফল্যের মাপকাঠি হচ্ছেন সাহাবা কেরাম (رضي اللّٰه عنهم أجمعين) ও তাঁদের স্বর্ণযুগ।


মুসলমান সমাজ যদি আত্মশুদ্ধি ও নিজেদের ঈমানের হেফাযত এবং দুনিয়াবী/পার্থিব সাফল্য ও চিরস্থায়ী (পারলৌকিক) মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা করেন, তাহলে একমাত্র মুক্তির পথ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর পদাঙ্ক অনুসরণ, যা সর্ব-হযরত আবূ বকর, উমর, উসমান, আলী, আহলে বায়ত ও সাহাবা কেরাম (رضي اللّٰه عنهم أجمعين) কর্তৃক ন্যূনতম বিচ্যুতি ব্যতিরেকে অনুসৃত হয়েছিলো। মহান স্রষ্টা আল্লাহতা’লা, তাঁর রাসূল (ﷺ) এবং সৃষ্টিকুলকে এই খাঁটি ও নির্মল পুণ্যাত্মাবৃন্দই সন্তুষ্ট করেছিলেন। জগতের জন্যে অনুসরণীয় এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত তাঁরা রেখে গিয়েছেন।


আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণের তৌফীক্ব তথা সামর্থ্য দান করুন, আমীন।


و ما توفيقي الا بالله


আল্লাহতা’লা ছাড়া আমি (একেবারে) অসহায়।


*সমাপ্ত*    


 

*ফাদাক বাগান*


মূল: মওলানা মুহাম্মদ আবদুস্ সাত্তা’র তনসউয়ী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


[Bengali translation of ‘Fadak Garden’ by Mawlana Muhammad Abdus-Satta’r Tonswi; translator: Kazi Saifuddin Hossain; final post]


 


Top