❏ জানাযার পরে দোয়া করার কিছু কারণ
জানাযার পরে দোয়া করার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে তখন অনেক লোকেরা উপস্থিতি থাকে। আর বহু লোক একত্রিত হয়ে আল্লাহর কাছে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করলে ঐ দোয়া কবুল হওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে। যেমন নিচের দলিল গুলো লক্ষ্য করুন, ইমাম আহমদ, ইমাম মুসলীম (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبَّاسٍ... فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَا مِنْ رَجُلٍ مُسْلِمٍ يَمُوتُ فَيَقُومُ عَلَى جَنَازَتِهِ أَرْبَعُونَ رَجُلًا، لَا يُشْرِكُونَ بِاللَّهِ شَيْئًا، إِلَّا شَفَّعَهُمُ اللَّهُ فِيهِ
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)’র গোলাম কুরাইব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমি রাসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছি: যদি কেউ মারা যায় ও তার জানাযায় ৪০ জন মুত্তাকী লোক হাজির হয় যারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেননি। তারা যদি তার জন্যে সুপারিশ করেন তাহলে কবুল করা হবে।”
(সহীহ্ মুসলীম, হাদিস নং ৯৪৮; মেসকাত শরীফ, ১৪৫ পৃঃ; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৪র্থ খন্ড, ১২৯ পৃঃ; সুনানে ইবনে মাজাহ; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২৫০৯; আশিয়াতুল লুময়াত;)
এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েতে আছে,
وَعَنْ عَائِشَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَا مِنْ مَيِّتٍ تُصَلِّي عَلَيْهِ أُمَّةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يَبْلُغُونَ مِائَةً كُلُّهُمْ يَشْفَعُونَ لَهُ إِلَّا شُفِّعُوا فِيهِ
-“হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নবী করিম (ﷺ) বলেছেন: যদি কোন ব্যক্তি মারা যায় ও তার জানাযায় ১০০ জন লোক হাজির হয় এবং দোয়া করেন তাহলে অবশ্যই দোয়া কবুল করা হবে।”
(সহীহ্ বুখারী, সহীহ্ মুসলীম, হাদিস নং ৯৪৭; মেসকাত শরীফ, ১৪৫ পৃঃ; মোল্লা আলী ক্বারী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৪র্থ খন্ড, ১৩০ পৃঃ; মুসনাদে আহমদ;)
এই হাদিস দুটি দ্বারা প্রমাণিত হয়, জানাযার নামাজে ৪০/১০০ জন লোক উপস্থিত হয়ে মায়্যেতের জন্যে দোয়া করলে তাদের দোয়া কবুল করা হবে। তাই জানাযার নামাজে ৪০ কিংবা ১০০ জন লোক হাজির হলে মায়্যেতের জন্যে অধিক আগ্রহের সাথে দোয়া করা উচিৎ, যেহেতু তখন দোয়া কবুলিয়াতের গ্যারান্টি আছে। দলবদ্ধভাবে এক জামাত লোক দোয়া বা মুনাজাত করার বিষয়ে একধিক সহীহ্ হাদিসে আছে, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলীম, ইমাম আহমদ (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন,
حَدَّثَنَا يَعْقُوبُ بْنُ مُجَاهِدٍ الْبَصْرِيُّ، ثنا الْمُنْذِرُ بْنُ الْوَلِيدِ الْجَارُودِيُّ، ثنا أَبِي، ثنا شَدَّادٌ أَبُو طَلْحَةَ الرَّاسِبِيُّ، عَنِ الْجُرَيْرِيِّ، عَنْ أَبِي عُثْمَانَ، عَنْ سَلْمَانَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا رَفَعَ قَوْمٌ أَكُفَّهُمْ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ يَسْأَلُونَهُ شَيْئًا، إِلَّا كَانَ حَقًّا عَلَى اللهِ أَنْ يَضَعَ فِي أَيْدِيهِمُ الَّذِي سَأَلُوا
-“হযরত সালমান ফারছী (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: যখন কোন সম্প্রদায় তাদের হাঁতের অগ্রভাগ আল্লাহর দরবারে কোন কিছু প্রার্থনার জন্য উচু করে, তখন আল্লাহর জন্য আবশ্যক হয়ে যায় যে, যা প্রার্থনা করে তা দেওয়া।”
(ইমাম তাবারানী: মুজামুল কবীরে, হাদিস নং ৬১৪২; ইমাম ইবনে শাহিন: আত্তারগীব ফি ফাদ্বাইলিল আমাল, হাদিস নং ১৪৪; ইমাম সুয়ূতী: জামেউছ ছাগির, হাদিস নং ১১৮৫৪; ইমাম সুয়ূতী: জামেউল আহাদিস, হাদিস নং ২০০৮০; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৩১৪৫; আল্লামা মানাভী: আত্ তায়ছির শরহে জামেউছ ছাগির, ২য় খন্ড, ৩৫০ পৃঃ; মুখলেছিয়্যাত, হাদিস নং ২৮১৫; ইমাম হায়ছামী: মজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ১৭৩৪১; আত্ তানভির শরহে জামেউছ ছাগির, ৯ম খন্ড, ৩৯৬ পৃঃ;)
এই হাদিস সম্পর্কে হাফিজুল হাদিস ইমাম হায়ছামী (رحمة الله عليه) বলেছেন,
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ، وَرِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيحِ. -
“ইমাম তাবারানী (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন এবং ইহার সকল বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত।” (ইমাম হায়ছামী: মজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ১৭৩৪১;)
এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম আব্দুর রউফ মানাভী (رحمة الله عليه) বলেন:
عَن سلمَان الْفَارِسِي وَرِجَاله رجال الصَّحِيح -
“হযরত ছালমান ফারছী (رضي الله عنه) হতে, এর সকল বর্ণনাকারীগণ বিশুদ্ধ।” (আল্লামা মানাভী: আত্ তায়ছির শরহে জামেউছ ছাগির, ২য় খন্ড, ৩৫০ পৃঃ;)
এই হাদিস সম্পর্কে স্বয়ং নাছিরুদ্দিন আলবানী বলেন:
قلت: وهذا إسناد رجاله ثقات رجال (الصحيح)
-“আমি (আলবানী) বলি: এই হাদিসের সকল বর্ণনাকারীগণ বিশুদ্ধ।”(আলবানী: ছিলছিলায়ে জয়ীফা, হাদিস নং ৫৯৪৮;)
يَعْقُوبُ بْنُ مُجَاهِدٍ الْبَصْرِيُّ ‘
ইয়াকুব ইবনে মুজাহিদ বাছরী’ ছাড়াও ভিন্ন আরেকটি সনদে আরেকটি সূত্রে হাদিসটি ইমাম আবুল হাফছ উমর ইবনে আহমদ ইবনে উছমান (رحمة الله عليه) (ওফাত ৩৮৫ হিজরী) যিনি ইমাম ইবনে শাহিন (رحمة الله عليه) নামে প্রসিদ্ধ তিনি তার কিতাবে এভাবে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন:-
حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ صَاعِدٍ، ثنا الْمُنْذِرُ بْنُ الْوَلِيدِ الْجَارُودِيُّ، ثنا أَبِي، ثنا أَبُو طَلْحَةَ الرَّاسِبِيُّ، شَدَّادُ بْنُ سَعِيدٍ، عَنِ الْجُرَيْرِيِّ، عَنْ أَبِي عُثْمَانَ، عَنْ سَلْمَانَ، صَاحِبِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،
-“ইয়াহইয়া ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সাঈদ হাদিস বর্ণনা করেছেন মুনজির ইবনে ওয়ালিদ জারুদী থেকে- তিনি তার পিতা থেকে- তিনি আবু তালহা রাছিউ থেকে- তিনি সাদ্দাদ ইবনে সাঈীদ থেকে- তিনি জুরাইরী থেকে- তিনি আবী উছমান থেকে- তিনি সালমান ফারছী (رضي الله عنه) থেকে..।”
(ইমাম ইবনে শাহিন: আত্তারগীব ফি ফাদ্বাইলিল আমাল, হাদিস নং ১৪৪;)
এই সনদের সকল রাবীগণ বিশ্বস্ত ও প্রসিদ্ধ। তাই জানাযার পরে এক জামাত লোক একত্রিত হয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করলে সেই দোয়া কবুল হওয়ার গ্যারান্টি রয়েছে। যেমন:
হাদিস শরীফে আরো উল্লেখ আছে, ইমাম তিরমিজি ও ইমাম নাসাঈ (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন,
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ يَحْيَى الثَّقَفِيُّ الْمَرْوَزِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا حَفْصُ بْنُ غِيَاثٍ، عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَابِطٍ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ رضى الله عنه، قَالَ: قِيلَ يَا رَسُولَ اللهِ: أَيُّ الدُّعَاءِ أَسْمَعُ؟ قَالَ: جَوْفَ اللَّيْلِ الآخِرِ، وَدُبُرَ الصَّلَوَاتِ الْمَكْتُوبَاتِ.
-“হযরত আবু উমামা বাহেলী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলে পাক (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, কোন দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হয়? প্রিয় নবীজি (ﷺ) বললেন: নিশির শেষ ভাগে এবং প্রত্যেক ফরজ নামাজের পরে দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হয়।”
(তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ৩৪৯৯; ইমাম নাসাঈ: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ৯৮৫৬; মেসকাত শরীফ, ৮৯ পৃঃ; মেরকাত শরহে মেসকাত, ৩য় খন্ড, ৪৩ পৃঃ; মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ৪র্থ খন্ড, ১৫৬ পৃঃ; আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, হাদিস নং ২৫৫০; ইমাম মুগলতাঈ: শরহে ইবনে মাজাহ, জামেউল উলুম ওয়াল হিকাম, ২য় খন্ড, ১৪৩ পৃঃ; ইবনে রজব: ফাতহুল বারী, ১১তম খন্ড, ১৩৪ পৃঃ; ইমাম নববী: আল-আজকার, হাদিস নং ১৮০; রিয়াদুস ছালেহীন, হাদিস নং ১৫০০; ইবনে তাইমিয়া: ফাতওয়ায়ে কুবরা, ২য় খন্ড, ২০৫ পৃঃ; ইবনে তাইমিয়া: মজমুয়ায়ে ফাতওয়া, ২২তম খন্ড, ৪৯২ পৃঃ; মুবারকপুরী: তুহফাতুল আহওয়াজী, ৩০০ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়; শাওকানী: নাইলুল আওতার, হাদিস নং ৮০৯; সহীহ্ হাদিস।)
এই হাদিস সম্পর্কে হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله عليه) ও আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله عليه) বলেন, أَنَّهُ صَحِيحٌ لِغَيْرِهِ. -
“নিশ্চয় এই হাদিস সহীহ্ লি’গাইরিহী।”(ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৩য় খন্ড, ৪৩ পৃঃ;)
এই হাদিস উল্লেখ করে ইমাম তিরমিজি (رحمة الله عليه) বলেন, هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ
-“এই হাদিস হাছান।” (তিরমিজি, হাদিস নং ৩৪৯৯;)
নাছিরুদ্দিন আলবানী হাদিসটিকে صحيح لغيره (সহীহ্ লি’গারিহী) বলেছেন।”(সহীহ্ তারগীব ওয়া তারহীব, হাদিস নং ১৬৪৮;)
এই হাদিসে الصَّلَوَاتِ الْمَكْتُوبَاتِ (আছ ছালাতিল মাকতুবাত) শব্দদ্বয় বহুবচনের আনা হয়েছে। এখানে الصَّلَوَاتِ হল সকল ফরজ সালাত, যেহেতু শব্দটি বহুবচন। সুতরাং প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর দোয়া কবুল হওয়ার গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা রয়েছে। বলুন! যে সময় দোয়া করলে দোয়া কবুল হওয়া নিশ্চয়তা আছে সে সময় দোয়া করা উচিৎ নয় কি? অতএব, এই হাদিস প্রমাণ করে, যেকোন ফরজ নামাজের পর দোয়া করলে আল্লাহ পাক কবুল করেন। আমরা সবাই জানি জানাযার নামাজ ফরজের অন্তর্ভূক্ত তথা ‘ফরজে কেফায়া’। তাই এই হাদিসের আলোকে ফরজে কেফায়া জানাযার নামাজের পরেও আল্লাহ পাক বান্দাহ্’র দোয়া কবুল করেন। সুতরাং জানাযার পরে দোয়া করা উচিৎ।
এ বিষয়ে আরেক হাদিসে আছে, ইমাম ইবনু হিব্বান, ইমাম বায়হাক্বী, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিজি (رحمة الله عليه) প্রমূখ বর্ণনা করেছেন,
وَعَن سَلْمَانَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ رَبَّكُمْ حَيِيٌّ كَرِيمٌ يَسْتَحْيِي مِنْ عَبْدِهِ إِذَا رَفَعَ يَدَيْهِ إِلَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا
-“হযরত ছালমান (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: তোমাদের প্রভূ লজ্জাশীল ও দাতা; তাঁর কোন বান্দা তাঁর কাছে দুই হাঁত উঠালে তা খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।”
(সহীহ্ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৮৭৬; ইমাম বায়হাক্বী: দাওয়াতুল কবীর; মেসকাত শরীফ, ১৯৫ পৃঃ; মেরকাত শরহে মেসকাত, ৫ম খন্ড, ১২৭ পৃঃ; সুনানে আবী দাউদ, হাদিস নং ১৪৮৮; তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ৩৫৫৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, ২৭৫ পৃঃ হাদিস নং ৩৮৬৫; ইবনে হাজার: ফাতহুল বারী শরহে বুখারী, ১১তম খন্ড, ১৫৬ পৃঃ; সনদ বিশুদ্ধ।)
মহান আল্লাহ পাক যদি হাঁত উঠিয়ে দোয়া করলে আমাদেরকে দিতে চান, তাহলে আমরা তাঁর কাছে চাইতে রাজী নয় কেন? তাই মহান আল্লাহর দয়ার আশা করে জানাযার পর মায়্যেতের জন্যে দু’হাঁত উঠিয়ে দোয়া করা আমাদের জন্যে উচিৎ।