❏ হযরত আইয়ূব (عليه السلام)-এর ঘটনা
ইবন ইসহাক (رحمة الله) বলেন, হযরত আইয়ুব (عليه السلام) ছিলেন রোমের বাসিন্দা। তাঁর বংশপঞ্জি নিম্নরূপঃ আইয়ুব ইব্ন মূস, ইবন যারাহ ইবনুল ঈস ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম আল-খলীল (عليه السلام)। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁর বংশ তালিকা এভাবেঃ আইয়ুব ইবন মূস ইবন রাবীল ইবনুল ঈস ইবন ইসহাক ইবন ইয়াকূব (عليه السلام)। কোন কোন ঐতিহাসিক অন্যরূপ লিখেছেন। ইবন আসাকির (رحمة الله) লিখেছেন, আইয়ুব নবীর মা ছিলেন হযরত লূত (عليه السلام)-এর কন্যা। কেউ কেউ বলেছেন, হযরত আইয়ুব (عليه السلام)-এর পিতা সেই ঈমানদারদের একজন যারা হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপের দিন ঈমান এনেছিলেন। কিন্তু প্রথম মতটাই অধিক প্রসিদ্ধ। কেননা, তিনি ছিলেন ইবরাহীম (عليه السلام)-এর অধঃস্তন বংশধর। এ বিষয়ে আমরা নিম্নোক্ত আয়াতের তাফসীরে বিস্তারিত লিখেছি। যথাঃ
وَمِن ذُرِّیَّتِهِۦ دَاوُۥدَ وَسُلَیۡمَـٰنَ وَأَیُّوبَ وَیُوسُفَ وَمُوسَىٰ وَهَـٰرُونَۚ
[Surat Al-An'am ৮৪]
(আর তার (ইবরাহীমের) বংশধরদের মধ্যে রয়েছে দাঊদ, সুলায়মান, আইয়ূব, ইউসুফ, মূসা ও হারূন।) (৬: ৮৪)
সঠিক মত এই যে এ ذريته বলতে ইবরাহীম (عليه السلام)-এর বংশধরদের বোঝানো হয়েছে; নূহ (عليه السلام)-এর বংশধর নয়। হযরত আইয়ুব (عليه السلام) সেসব নবীর অন্যতম যাদের নিকট ওহী পাঠানো হয়েছে বলে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমনঃ
( إِنَّاۤ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَیۡكَ كَمَاۤ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ نُوحࣲ وَٱلنَّبِیِّـۧنَ مِنۢ بَعۡدِهِۦۚ وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰۤ إِبۡرَ ٰهِیمَ وَإِسۡمَـٰعِیلَ وَإِسۡحَـٰقَ وَیَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطِ وَعِیسَىٰ وَأَیُّوبَ وَیُونُسَ وَهَـٰرُونَ وَسُلَیۡمَـٰنَۚ وَءَاتَیۡنَا دَاوُۥدَ زَبُورࣰا)
[Surat An-Nisa' ১৬৩]
অর্থাৎ, ‘তোমার কাছে ওহী' প্রেরণ করেছি যেমন নূহ ও তার পরবর্তী নবীগণের কাছে প্রেরণ করেছিলাম। ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণ, ‘ঈসা, আইয়ুব, হারূন। এবং সুলায়মানের কাছে ওহী প্রেরণ করেছিলাম। (৪: ১৬৩)
অতএব, বিশুদ্ধ মত এই যে, হযরত আইয়ুব (عليه السلام) ছিলেন ‘ঈসা ইবন ইসহাক (عليه السلام)-এর বংশধর। তার স্ত্রীর নামের ব্যাপারেও বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। কারও মতে, লায়্যা বিনত ইয়াকূব। কারও মতে, রুহমাহ বা রাহিমাহ বিনত আফরাইম। কারও মতে, মানশা বিনত ইউসুফ ইবন ইয়াকূব। শেষোক্ত মতই বেশি প্রসিদ্ধ। এই কারণে আমরা এখানে এই মতেরই উল্লেখ করেছি। হযরত আইয়ুব (عليه السلام)-এর ঘটনা বলার পর আমরা বনী ইসরাঈলের অন্যান্য নবী সম্পর্কে আলোচনা করব ইনশাল্লাহ। আল্লাহর বাণীঃ
( وَأَیُّوبَ إِذۡ نَادَىٰ رَبَّهُۥۤ أَنِّی مَسَّنِیَ ٱلضُّرُّ وَأَنتَ أَرۡحَمُ ٱلرَّ ٰحِمِینَ فَٱسۡتَجَبۡنَا لَهُۥ فَكَشَفۡنَا مَا بِهِۦ مِن ضُرࣲّۖ وَءَاتَیۡنَـٰهُ أَهۡلَهُۥ وَمِثۡلَهُم مَّعَهُمۡ رَحۡمَةࣰ مِّنۡ عِندِنَا وَذِكۡرَىٰ لِلۡعَـٰبِدِینَ)
[Surat Al-Anbiya' ৮৩ - ৮৪]
অর্থাৎ, এবং স্মরণ কর, আইয়ুবের কথা, যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল, আমি দুঃখ-কষ্টে পড়েছি। তুমি তো দয়ালুদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম। তার দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করে দিলাম, তাকে তার পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সঙ্গে তাদের মত আরো দিয়েছিলাম আমার বিশেষ রহমতরূপে এবং ইবাদতকারীদের জন্যে উপদেশস্বরূপ। (২১: ৮৩-৮৪)।
সূরা সাদে আল্লাহ বলেনঃ
(وَٱذۡكُرۡ عَبۡدَنَاۤ أَیُّوبَ إِذۡ نَادَىٰ رَبَّهُۥۤ أَنِّی مَسَّنِیَ ٱلشَّیۡطَـٰنُ بِنُصۡبࣲ وَعَذَابٍ ٱرۡكُضۡ بِرِجۡلِكَۖ هَـٰذَا مُغۡتَسَلُۢ بَارِدࣱ وَشَرَابࣱ وَوَهَبۡنَا لَهُۥۤ أَهۡلَهُۥ وَمِثۡلَهُم مَّعَهُمۡ رَحۡمَةࣰ مِّنَّا وَذِكۡرَىٰ لِأُو۟لِی ٱلۡأَلۡبَـٰبِ وَخُذۡ بِیَدِكَ ضِغۡثࣰا فَٱضۡرِب بِّهِۦ وَلَا تَحۡنَثۡۗ إِنَّا وَجَدۡنَـٰهُ صَابِرࣰاۚ نِّعۡمَ ٱلۡعَبۡدُ إِنَّهُۥۤ أَوَّابࣱ)
[Surat Sad ৪১ - ৪৪]
অর্থাৎ, স্মরণ কর, আমার বান্দা আইয়ুবকে, যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল, শয়তান তো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলেছে। আমি তাকে বললাম, তুমি তোমার পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত কর, এই তো গোসলের সুশীতল পানি আর পানীয়। আমি তাকে দিলাম তার পরিজনবর্গ ও তাদের মত আরও আমার অনুগ্রহস্বরূপ ও বোধশক্তিসম্পন্ন লোকদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ। আমি তাকে আদেশ করলাম, এক মুঠো তৃণ লও ও তা দিয়ে আঘাত কর এবং শপথ ভঙ্গ করো না। আমি তাকে পেলাম ধৈর্যশীল। কত উত্তম বান্দা সে! সে ছিল আমার অভিমুখী। (৩৮: ৪১-৪৪)
ইবন আসাকির (رحمة الله) কালবী (رحمة الله) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, সর্বপ্রথম প্রেরিত নবী হযরত ইদরীস (عليه السلام)। তারপরে নূহ, তারপর ইবরাহীম (عليه السلام)। তারপর ইসমাঈল, তারপর ইসহাক, তারপর ইয়াকূব, তারপর ইউসুফ (عليه السلام)। তারপর লূত, তারপর হূদ, তারপর সালিহ, তারপর শু’আয়ব, তারপর মূসা ও হারূন, তারপর ইলয়াস, তারপর আল-য়াসা, তারপর উরফী ইবন সুওয়ায়লিখ আফরাইম ইবন ইউসুফ ইবন ইয়াকূব (عليه السلام)। তারপর ইউনুস (عليه السلام) ইবন মাত্তা— ইয়াকূবের বংশধর। তারপর আইয়ূব ইবন যারাহ ইবন আমূস ইবন লায়ফারাম ইবনুল ঈস ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম (عليه السلام)। উক্ত ক্রমধারায় কোন কোন নামের ক্ষেত্রে আপত্তি আছে। কেননা হূদ ও সালিহ (عليه السلام) সম্পর্কে প্রসিদ্ধ মত এই যে, তাঁদের আগমন নূহ (عليه السلام)-এর পরে ও ইবরাহীম (عليه السلام)-এর পূর্বে হয়েছিল।
ঐতিহাসিক ও তাফসীরকারগণ বলেছেন, হযরত আইয়ুব (عليه السلام) ছিলেন সে কালের একজন বড় ধনাঢ্য ব্যক্তি। সকল প্রকার সম্পদের অধিকারী ছিলেন তিনি। যথা চতুষ্পদ ও গৃহপালিত পশু। দাস-দাসী এবং হাওরান অঞ্চলের বুছায়না এলাকার বিশাল জমির মালিকানা ছিল তার হস্তগত।
ইবন আসাকির (رحمة الله) বর্ণনা করেন, হযরত আইয়ুব (عليه السلام)-এর ঐ সব সম্পদ ছাড়াও আরও ছিল প্রচুর সন্তান ও পরিবার-পরিজন। পরে এ সব কিছু তার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নানা প্রকার দৈহিক ব্যাধি দ্বারা তাকে পরীক্ষায় ফেলা হয়। শরীরের সর্ব অংগে রোগ ছিল এত ব্যাপক যে, জিহবা ও হৃৎপিণ্ড ব্যতীত কোন একটি স্থানও অক্ষত ছিল না। এ দুই অংগ দ্বারা তিনি আল্লাহর যিকির করতেন। এতসব মুসীবত সত্ত্বেও তিনি ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখান। রাত-দিন সকাল-সন্ধ্যা সর্বক্ষণ আল্লাহর যিকিরে রত থাকেন। রোগ দীর্ঘ স্থায়ী হওয়ায় বন্ধু-বান্ধব, আপনজন তার কাছ থেকে সরে যেতে থাকে। অবশেষে তাঁকে শহরের বাইরে এক আবর্জনাময় স্থানে ফেলে রাখা হয়। একে একে সবাই তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একমাত্র স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ তার খোঁজ-খবর রাখত না। স্বামীর অধিকার, তার পূর্বের ভালবাসা ও অনুগ্রহের কথা মনে রেখে স্ত্রী তার সেবায় নিয়োজিত থাকেন। স্ত্রী তাঁর অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। পেশাব-পায়খানায় সাহায্য করতেন এবং অন্যান্য খিদমতে আঞ্জাম দিতেন। স্ত্রীও ক্রমশ দুর্বল হতে থাকেন। অর্থের দৈন্য দেখা দেয়। ফলে মানুষের বাড়িতে কাজ করে সেই পারিশ্রমিক দ্বারা স্বামীর আহার্য ও ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হন। তবুও তিনি অসীম ধৈর্যের পরিচয় দেন। সম্পদ ও সন্তানাদি হারান। স্বামীর করুণ অবস্থা, অর্থের অভাব ও মানুষের সাহায্য-সহানুভূতির অনুপস্থিতি— এ সব প্রতিকূল অবস্থাকে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে মুকাবিলা করেন। অথচ সম্পদ-ঐশ্বর্য, বন্ধু-বান্ধব ইতিপূর্বে সবই তাঁদের করায়ত্ত ছিল। সহীহ হাদীসে আছে— রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
اشد الناس بلاء الانبياء ثم الصالحون. ثم الأمثل فالأمثل يبتلى الرجل على حسب دينه فان كان دينه صلابة زيد في بلائه.
অর্থাৎ, সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হয় নবীগণের। তারপর সত্যপন্থী লোকদের, এরপর দীনদাদীর স্তর ভেদে পর্যায়ক্রমে এ পরীক্ষা চলে। যদি সে দৃঢ়তার সঙ্গে দীনের আনুগত্য করতে থাকে তবে তার পরীক্ষাও কঠোরতর হয়। উল্লেখিত বিপদ-আপদ হযরত আইয়ূব (عليه السلام)-এর ক্ষেত্রে যতই বৃদ্ধি পেয়েছে ততই তার ধৈর্য, সহনশীলতা, আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি তাঁর ধৈর্য ও মুসীবত পরবর্তীকালে প্রবাদে পরিণত হয়ে যায়। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ ও অন্য অনেকে ইসরাঈলী উলামাদের বরাতে হযরত আইয়ুব (عليه السلام)-এর সম্পদ ও সন্তানাদি নিঃশেষিত হওয়া ও দেহের রোগ সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা দান করেছেন। আল্লাহ এগুলোর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।
মুজাহিদ (رحمة الله) বলেছেন, পৃথিবীতে হযরত আইয়ুব (عليه السلام)-এরই সর্বপ্রথম বসন্ত রোগ হয়। ঐতিহাসিকগণ হযরত আইয়ুব (عليه السلام)-এর পরীক্ষাকালের স্থায়িত্ব সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। ওহাবের মতে, তার পরীক্ষাকাল ছিল তিন বছর এর কমও নয়, বেশিও নয়। আনাস (رضي الله عنه) বলেন, সাত বছর কয়েক মাস পর্যন্ত তার পরীক্ষা চলে। এই সময়ে তাঁকে বনী ইসরাঈলের একটি আবর্জনাময় স্থানে ফেলে রাখা হয়। বিভিন্ন রকম কীট তার দেহের উপর দিয়ে চলাচল করত। অতঃপর আল্লাহ তাঁকে এ মুসীবত থেকে উদ্ধার করেন। বিপুলভাবে তাকে পুরস্কৃত করেন এবং তার প্রশংসাও করেন।
হুমায়দ (رحمة الله) বলেছেন, হযরত আইয়ুব (عليه السلام) আঠার বছর যাবত মুসীবতে আবদ্ধ ছিলেন। সুদ্দী (رحمة الله) বলেছেন, আইয়ুব (عليه السلام)-এর দেহ থেকে মাংস খসে পড়ে এমনকি তার হাড় ও শিরা ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তার স্ত্রী তার দেহের নিচে ছাই বিছিয়ে দিতেন। এ অবস্থা যখন দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকে, তখন একদা স্ত্রী বললেন, হে আইয়ুব! আপনি যদি আপনার প্রতিপালকের কাছে দু’আ করতেন তাহলে তিনি এ বিপদ থেকে আপনাকে উদ্ধার করতেন। তদুত্তরে আইয়ুব (عليه السلام) বললেন, আমি সত্তর বছর সুস্থ দেহে জীবন যাপন করেছি, এখন তার জন্যে সত্তর বছর সবর করলেও তা নগণ্যই হবে। স্বামীর মুখে এ কথা শুনে স্ত্রী ঘাবড়ে যান। তখন থেকে তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মানুষের কাজকর্ম করে আইয়ুব (عليه السلام)-এর আহার্যের বন্দোবস্ত করতেন।
কিছুদিন পর লোকজন যখন জানল যে, এই মহিলাটি আইয়ুব (عليه السلام)-এর স্ত্রী। তখন আর তারা তাকে কাজে নিতো না। তাদের ভয় হল যে, এরূপ মেলামেশার দ্বারা আইয়ুবের রোগ হয়ত তাদের মধ্যে সংক্রামিত হতে পারে। একদা স্ত্রী কোথাও কাজ খুঁজে না পেয়ে অবশেষে জনৈক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কন্যার কাছে খুব উন্নতমানের খাদ্যের বিনিময়ে নিজের চুলের দুইটি বেনীর একটি বিক্রি করে দেন। উক্ত খাদ্য নিয়ে তিনি আইয়ুব (عليه السلام)-এর কাছে উপস্থিত হন। আইয়ুব (عليه السلام) এমন খাদ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ খাদ্য কোথায় পেয়েছ? স্ত্রী জানালেন, অন্যের কাজ করে এ খাদ্য সংগ্রহ করেছি। পরের দিনও স্ত্রী কোথাও কাজ না পেয়ে অবশিষ্ট বেনীটিও খাদ্যের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। উক্ত খাদ্য আইয়ুব (عليه السلام)-এর কাছে নিয়ে আসলে এবারও তিনি অসন্তুষ্ট হন এবং কসম করেন যে, কোথা থেকে কিভাবে এ খাদ্য তিনি পেলেন, না বলা পর্যন্ত তিনি তা খাবেন না। তখন স্ত্রী নিজ মাথা থেকে ওড়না তুলে দেখান। আইয়ূব (عليه السلام) স্ত্রীর মাথা মুণ্ডিত দেখে আল্লাহর কাছে দু’আ করেনঃ
أَنِّی مَسَّنِیَ ٱلضُّرُّ وَأَنتَ أَرۡحَمُ ٱلرَّ ٰحِمِینَ
[Surat Al-Anbiya' ৮৩]
অর্থাৎ, হে আমার প্রতিপালক! আমি দুঃখে-কষ্টে পতিত হয়েছি, আর আপনি তো সকল দয়ালুদের শ্রেষ্ঠ দয়ালু। (সূরা আম্বিয়াঃ ৮৩)
ইবন আবী হাতিম (رحمة الله) আবদুল্লাহ ইবন উবায়দ ইবন উমায়র (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত আইয়ূব (عليه السلام)-এর দুই ভাই ছিল। একদা তারা তাদের ভাইকে দেখতে আসে। কিন্তু আইয়ুব (عليه السلام)-এর দেহের দুর্গন্ধের কারণে তারা তার কাছে যেতে সক্ষম হলো না। দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন একজন অপর জনকে বললঃ আইয়ুবের মধ্যে কোন কল্যাণ আছে বলে যদি আল্লাহ জানতেন, তাহলে তিনি এভাবে তাকে এরূপ কঠিন পরীক্ষায় ফেলতেন না। তাদের এ কথায় তিনি এতই মর্মাহত হন যে, এমনটি আর কখনও হননি। অতঃপর তিনি আল্লাহর কাছে দু’আ করলেন, হে আল্লাহ! আপনি যদি জানেন যে, এমন একটি রাতও যায়নি, যে রাত্রে আমি পেট ভরে খানা খেয়েছি অথচ আমার জানা মতে, কোন ব্যক্তি ক্ষুধার্ত অবস্থায় থেকেছে, তা হলে আমার সত্যতা প্রকাশ করুন। তখন আকাশ থেকে তাঁর কথার সত্যতা ঘোষণা করা হয় এবং ঐ দুই ভাই তা শ্রবণও করে। অতঃপর তিনি পুনরায় বললেন, হে আল্লাহ! আপনি যদি জানেন যে, বস্ত্রহীন লোকের খবর পাওয়ায় আমি কখনও দুটি জামা গ্রহণ করিনি তাহলে আমার সত্যতা প্রকাশ করুন। তখন আকাশ থেকে তার সত্যতা ঘোষণা করা হয় যা ঐ দুই ভাই শ্রবণ করেছিল। অতঃপর তিনি বলেন, হে আল্লাহ! আপনার ইযযতের কসম, এরপর সিজদায় পড়ে যান এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনার ইযযতের কসম, আমার মুসীবত দূর না করা পর্যন্ত আমি মাথা উঠাব না।’ সত্যই বিপদমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি আর মাথা উঠাননি।
ইবন আবী হাতিম (رحمة الله) ও ইবন জারীর (رحمة الله) উভয়ে আনাস ইবন মালিক (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহর নবী আইয়ূব (عليه السلام)-এর রোগ আঠার বছর যাবত স্থায়ী ছিল। কাছের ও দূরের সকল লোক তাঁকে পরিত্যাগ করে যায়। কিন্তু দুই ব্যক্তি পরিত্যাগ করেনি। তারা ছিল তাঁর দুই ভাই। এ দুই ভাই ছিল তাঁর খুবই আদরের পাত্র। সকালে ও বিকেলে তারা আইয়ুব (عليه السلام)-এর কাছে আসত। একদিন এক ভাই অপরজনকে বলে, দেখ— আল্লাহ জানেন যে, আইয়ূব এমন কোন পাপ করেছে যা অন্য কোন লোক কখনও করেনি। অপরজন বলল, কি সে পাপ? সে বলল, আজ আঠারটি বছর সে রোগে ভুগছে। আল্লাহ তাকে রহমত করেননি। রোগ থেকে মুক্তি দেননি। বিকেলে যখন তারা আসল, তখন দ্বিতীয় ভাইটি আর ধৈর্য ধরতে পারল না। আইয়ূব (عليه السلام)-এর কাছে তা বলে দিল। হযরত আইয়ুব (عليه السلام) বললেন, ‘তুমি কি বলছ, তা আমি বুঝি না। তবে আল্লাহ জানেন, একদা আমি দুই ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম যারা পরস্পর ঝগড়া করছিল এবং আল্লাহর যিকির করছিল। আমি বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করলাম এবং তারা যে অনুপযুক্ত পরিবেশে আল্লাহর যিকির করেছে সে জন্যে তাদের পক্ষ থেকে আমি কাফফারা আদায় করি।’
হযরত আইয়ুব (عليه السلام) প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাইরে যেতেন। প্রয়োজন শেষ হলে স্ত্রী তার হাত ধরে আনতেন ও স্ব-স্থানে রাখতেন। একদা স্বামীর কাছে আসতে স্ত্রীর দেরি হয়। এ সময়ে আল্লাহ আইয়ুব (عليه السلام)-এর কাছে ওহী পাঠালেনঃ
ٱرۡكُضۡ بِرِجۡلِكَۖ هَـٰذَا مُغۡتَسَلُۢ بَارِدࣱ وَشَرَابࣱ
[Surat Sad ৪২] (হে আইয়ূব! তোমার পা দ্বারা মাটিতে আঘাত কর। এই তো গোসলের ও পান করার ঠাণ্ডা পানি) বেশ কিছু সময় দেরি করে স্ত্রী আজ আইয়ূব (عليه السلام)-এর কাছে আসলেন ও তাঁকে দেখতে লাগলেন। হযরত আইয়ূব (عليه السلام) পূর্বের চেয়েও অধিক সুন্দর ও সুস্বাস্থ্যবান হয়েছেন। তিনি এ অবস্থায় স্ত্রীর সম্মুখে আসলেন। স্ত্রী তাকে চিনতে না পেরে বললেন, ‘আল্লাহ তোমাকে বরকতময় করুন। এখানে আল্লাহর নবী রোগগ্রস্ত অবস্থায় অবস্থান করছিলেন তাঁকে কি তুমি দেখেছ? আল্লাহর কসম, ঐ নবী রোগে পড়ার পূর্বে যখন সুস্থ ছিলেন, তখন তাঁর যে চেহারা ছিল সে চেহারার সাথে তোমার চেহারার ন্যায় অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ চেহারার লোক আমি আর কাউকে দেখিনি।’ হযরত আইয়ুব (عليه السلام) বললেন, ‘আমিই সেই লোক।’ হযরত আইয়ুব (عليه السلام)-এর বাড়িতে দু’টি উঠান ছিল। একটি গম মাড়ানোর এবং আরেকটি যবের। আল্লাহ দুই খণ্ড মেঘ পাঠিয়ে দেন। একটি খণ্ড গমের উঠানের উপর এসে স্বর্ণ বর্ষণ করে। পর্যাপ্ত বর্ষণের ফলে তা পরিপূর্ণ হয়ে গড়িয়ে যেতে থাকে। অপর খণ্ডটি যবের ঊঠানের উপর রৌপ্য বর্ষণ করে—যা পরিপূর্ণ হয়ে গড়িয়ে যেতে থাকে। উপরোক্ত সকল বর্ণনা ইবন জারীর (رحمة الله)-এর। ইবন হিব্বান (رحمة الله) ও তাঁর সহীহ গ্রন্থে উপরোক্ত সমুদয় ঘটনা ইবন ওহাব সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের মারফু বর্ণনা একান্তই গরীব’ পর্যায়ের। এটা মওকূফ হওয়াই সঠিক। ইবন আবী হাতিম (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন, আল্লাহ হযরত আইয়ুব (عليه السلام)-কে জান্নাতের পোশাক পরিধান করান। আইয়ুব (عليه السلام) জান্নাতী পোশাক পরে একটু দূরে গিয়ে পথের পাশে বসে থাকেন। তারপর তার স্ত্রী যখন সেখানে আসেন, তখন তিনি তাঁকে চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দা! এখানে রোগগ্রস্ত যে লোকটি ছিল তাঁকে সম্ভবত কুকুরে বা বাঘে নিয়ে গেছে।’ এভাবে লোকটির সাথে কিছু সময় ধরে স্ত্রী কথা বলতে থাকেন। লোকটি বলল, ‘সম্ভবত আমিই সেই আইয়ুব।’ স্ত্রী বললেন, ‘হে আল্লাহর বান্দা! আপনি কি আমার সাথে উপহাস করছেন?’ তখন তিনি বলে উঠলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে রহম করুন। আমিই তো আইয়ুব। আল্লাহ আমার সুস্বাস্থ্য ফিরিয়ে দিয়েছেন।’
ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহ হযরত আইয়ুব (عليه السلام)-কে পূর্বের সম্পদ ও সন্তান অবিকল ফিরিয়ে দেন এবং সেই সাথে সমপরিমাণ অতিরিক্ত দান করেন। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ (رحمة الله) বলেন, আল্লাহ তাকে ওহীর মাধ্যমে জানানঃ আমি তোমার সন্তানাদি ও ধন-সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছি এবং আরও সমপরিমাণ দান করেছি, এখন এই পানি দ্বারা তুমি গোসল কর। কারণ এর দ্বারা তুমি আরোগ্য লাভ করবে। তোমার আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে কুরবানী দাও এবং তাদের জন্যে ক্ষমা চাও। কেননা, তোমার ব্যাপারে তারা আমার অবাধ্যতা করেছে। ইবন আবী হাতিম (رحمة الله) এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবন আবী হাতিম (رحمة الله) আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে আরো বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ আইয়ুব (عليه السلام)-কে রোগ থেকে মুক্তি দেয়ার পর তাঁর প্রতি স্বর্ণ বর্ষণ করেন। আইয়ুব (عليه السلام) তা অঞ্জলি ভরে উঠিয়ে কাপড় ভর্তি করতে থাকেন। তখন অদৃশ্যলোক থেকে তাঁকে বলা হল, ‘হে আইয়ূব! তুমি কি তৃপ্ত হওনি?’ আইয়ূব (عليه السلام) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! কে এমন আছে, যে আপনার রহমতে তৃপ্ত হয়ে কে তা চাওয়া বন্ধ করতে পারে? অনুরূপ বর্ণনা করেছেন ইমাম। আহমদ আবু দাউদ তায়ালিসী (رحمة الله) সূত্রে, আবদুস সামাদ (رحمة الله) কাতাদা (رحمة الله) থেকে এবং ইবন হিব্বান (رحمة الله) আবদুস সামাদ (رحمة الله) থেকে। এ হাদীস সহীহ-এর শর্তে উত্তীর্ণ। অবশ্য, ‘সিহাহ সিত্তার কোন গ্রন্থে এটা বর্ণিত হয়নি। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবু হুরায়রা (رضي الله عنه)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, জনৈক লোকের মাধ্যমে আইয়ুব (عليه السلام)-এর কাছে কতগুলো স্বর্ণ-পাত্র পাঠান হয়। তিনি সেগুলো নিজের কাপড়ে ভরে রাখতে থাকেন। তখন আওয়াজ হল, ‘হে আইয়ুব! যা তোমাকে দেয়া হয়েছে তা কি তোমার জন্যে যথেষ্ট নয়?’ আইয়ুব বললেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! আপনার অনুগ্রহ থেকে কে হাত গুটাতে পারে?’ হাদীসটি উক্ত সূত্রে মওকূফ। তবে অন্য সূত্রে আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে এটা মারফু রূপেও বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ একদা আইয়ুব (عليه السلام) বিবস্ত্র অবস্থায় গোসল করছিলেন। এমন সময় তাঁর সামনে এক ঝাঁক স্বর্ণের পঙ্গপাল পতিত হল। তিনি সেগুলো হাতে ধরে কাপড়ে রাখতে লাগলেন। তখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে ডেকে বললেন, হে আইয়ুব! তুমি যা দেখতে পাচ্ছো তা থেকে আমি কি তোমাকে অমুখাপেক্ষী করে দেইনি? তিনি উত্তর দিলেন, অবশ্যই আমার প্রতিপালক কিন্তু আমি আপনার বরকতের অমুখাপেক্ষী নই। বুখারী (رحمة الله) আবদুর রাযযাক (رحمة الله) সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহর বাণীঃ (ٱرۡكُضۡ بِرِجۡلِكَۖ) (তুমি তোমার পা দ্বারা আঘাত কর।) আইয়ূব (عليه السلام) নির্দেশ মোতাবেক আপন পা দ্বারা মাটিতে আঘাত করলেন। আল্লাহ সেখান থেকে একটি ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করেন। যার পানি ছিল সুশীতল। আল্লাহ তাঁকে এই পানি দ্বারা গোসল করতে ও তা পান করতে হুকুম দেন। আইয়ুব (عليه السلام) তাই করলেন। ফলে তার সমস্ত ব্যথা বেদনা ও তাঁর দেহের প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সকল রোগ-শোক ও ক্ষত দূর হয়ে গেল। আল্লাহ তাকে সু-স্বাস্থ্য দান করেন, তার চেহারাকে সুদর্শন চেহারায় পরিবর্তন করে দেন। এ ছাড়া তাঁকে প্রচুর ধন-সম্পদও দান করেন। এমনকি স্বর্ণের পঙ্গপালও বর্ষণ করেন। তাঁকে আল্লাহ সন্তান-সন্ততিও প্রদান করেন। আল্লাহ বলেনঃ ( وَءَاتَیۡنَـٰهُ أَهۡلَهُۥ وَمِثۡلَهُم مَّعَهُمۡ) (তাকে তার পরিবারবর্গ ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সমপরিমাণও দিলাম)। কারও কারও মতে, আল্লাহ আইয়ূব (عليه السلام)-এর পূর্বের সন্তানদেরকে জীবিত করে দেন। আর কারও মতে, পূর্বের সন্তানদের বিনিময়ে আল্লাহ আইয়ুব (عليه السلام)-কে সওয়াব দান করেন এবং তাদের স্থলে সমসংখ্যক সন্তান দুনিয়ায় দান করেন। আর এ সকলকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার সাথে একত্র করবেন। رَحۡمَةࣰ مِّنۡ عِندِنَا (আমার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ) অর্থাৎ আমি তাঁর যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিলাম। ( فَكَشَفۡنَا مَا بِهِۦ مِن ضُرࣲّۖ) (এবং তার উপর যে মুসীবত চেপে ছিল তা থেকে তাকে মুক্ত করলাম।) অর্থাৎ এটা ছিল তাঁর প্রতি আমার রহমত, কৃপা ও অনুগ্রহ। وَذِكۡرَىٰ لِلۡعَـٰبِدِینَ (এবং ইবাদতকারীদের জন্যে উপদেশস্বরূপ) অর্থাৎ এটা ঐ ব্যক্তির জন্যে উপদেশস্বরূপ যে তার দেহ, সম্পদ কিংবা সন্তানের ব্যাপারে পরীক্ষায় পতিত হবে। তার জন্যে আল্লাহর নবী আইয়ুব (عليه السلام) আদর্শ হয়ে থাকবেন। কেননা, আল্লাহ আইয়ুব (عليه السلام)-কে তার চাইতেও অনেক বড় পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। কিন্তু তিনি ধৈর্যধারণ করেন এবং বিনিময়ে পুরস্কার আশা করেন। ফলে আল্লাহ তাকে মুক্তি দেন। উপরোক্ত আয়াত رحمة منا থেকে যারা এ অর্থ নিয়েছেন যে, এটা তার স্ত্রীর নাম (رحمة)- তাদের এরূপ দলীল গ্রহণ সম্পূর্ণ বাতিল ও ভ্রান্তিপূর্ণ। যাহ্হাক (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ আইয়ুব (عليه السلام)-এর স্ত্রীকে যৌবন ফিরিয়ে দেন এবং স্ত্রীকে পূর্বাপেক্ষা অধিক সুশ্রী করে দেন; এমনকি আরও ছাব্বিশজন পুত্র সন্তানও তাঁর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। রোগ থেকে মুক্তি লাভের পর আইয়ুব (عليه السلام) সত্তর বছর জীবিত ছিলেন। তিনি রোম দেশে বসবাস করতেন এবং দীনে হানীফ তথা সত্য ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এরপর পরবর্তী লোকজন ইবরাহীম (عليه السلام)-এর দীনের মধ্যে বিকৃতি ঘটায়। আল্লাহর বাণীঃ
(وَخُذۡ بِیَدِكَ ضِغۡثࣰا فَٱضۡرِب بِّهِۦ وَلَا تَحۡنَثۡۗ إِنَّا وَجَدۡنَـٰهُ صَابِرࣰاۚ نِّعۡمَ ٱلۡعَبۡدُ إِنَّهُۥۤ أَوَّابࣱ)
[Surat Sad ৪৪]
অর্থাৎ, হে আইয়ূব! তুমি স্ব-হস্তে তৃণশলা ধারণ কর এবং তা দ্বারা স্ত্রীকে প্রহার কর। তবুও কসম ভঙ্গ করো না। আমরা আইয়ুবকে ধৈর্যশীল পেয়েছি। কতই না উত্তম বান্দা সে! নিঃসন্দেহ সে ছিল আমার অভিমুখী। (সূরা সাদ : ৪৪)
অর্থাৎ এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে আইয়ুব (عليه السلام)-এর প্রতি বিশেষ রেয়াত। তিনি স্ত্রীকে একশ’ কোড়া মারার শপথ করেছিলেন। এর কারণ হিসেবে কেউ বলেছেন, স্ত্রী চুল বিক্রি করায় তিনি এই শপথটি করেছিলেন। কেউ বলেছেন যে, একদা শয়তান নবীর স্ত্রীর কাছে চিকিৎসকের বেশ ধরে গিয়ে আইয়ুব (عليه السلام)-এর ব্যাধির নির্দিষ্ট ঔষধের বর্ণনা দিয়েছিল। স্ত্রী তাঁর কাছে এসে উক্ত ঔষধের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এটা শয়তানের কাজ। তখন তিনি কসম করেন যে, স্ত্রীকে একশ’ কোড়া মারবেন। রোগ মুক্তির পর আল্লাহ তাঁকে জানালেন যে, শস্যের গোছার মত এক গোছা তৃণ একত্রে বেঁধে একবার স্ত্রীকে মার। এতে একশ’ কোড়া মারা হয়েছে বলে গণ্য হবে। এতেই কসমের কাফফারা হয়ে যাবে। কসম ভাঙ্গার গুনাহ হবে না। এটা হল মুক্তির সহজ ব্যবস্থা এবং এমন ব্যক্তির কসম থেকে নিষ্কৃতি লাভের উপায়, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর আনুগত্য করে। বিশেষ করে একজন ধৈর্যশীল সতী-সাধ্বী, সত্যপন্থী নেককার স্ত্রী লোকের ক্ষেত্রে। এজন্যে আল্লাহ এই সুযোগ দেয়ার কারণ হিসেবে সাথে সাথেই উল্লেখ করেছেনঃ ( إِنَّا وَجَدۡنَـٰهُ صَابِرࣰاۚ نِّعۡمَ ٱلۡعَبۡدُ) (আমি তাকে সবরকারীরূপে পেয়েছি। কত ভাল বান্দা সে! নিশ্চয়ই সে আল্লাহর ইবাদতকারী)। বহু সংখ্যক ফিকাহবিদ এই রেয়াতকে আয়মান ও নুযুর (শপথ ও মানত) অধ্যায়ে দলীলরূপে প্রয়োগ করেছেন। কিছু সংখ্যক ফকীহ এর ব্যাপ্তি আরও বাড়িয়ে দিয়ে শপথ থেকে বাঁচার উপায় ও বাহানা অধ্যায় সংযোজন করেছেন (كتاب الحيل في الخلاص من الايمان) তাঁরা দলীল হিসেবে এ আয়াতকেই পেশ করেছেন এবং রকমারি মাসআলা বের করেছেন। আমরা তার কিছু অংশ ‘কিতাবুল আহকামে’ যখন পৌছব ইনশাল্লাহ তখন আলোচনা করব।
ইবন জারীর (رحمة الله) প্রমুখ ইতিহাসবেত্তা লিখেছেন যে, হযরত আইয়ুব (عليه السلام) তিরানব্বই বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। কারও মতে, তিনি এর চেয়ে বেশিদিন জীবিত ছিলেন। মুজাহিদ (رحمة الله) সূত্রে লায়ছ বর্ণনা করেন যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ দলীল হিসেবে ধনীদের বিরুদ্ধে সুলায়মান (عليه السلام)-কে, দাস-দাসীদের বিরুদ্ধে ইউসুফ (عليه السلام)-কে এবং মুসীবত ও বিপদগ্রস্তদের মুকাবিলায় আইয়ুব (عليه السلام)-কে পেশ করবেন। ইবন আসাকির (رحمة الله)ও সমঅর্থবোধক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। মৃত্যুকালে হযরত আইয়ূব (عليه السلام) তাঁর পুত্র হাওমালকে ওসীয়ত করে যান। তার পরে বিশর ইবন আইয়ূব তার স্থলাভিষিক্ত হন। অনেকের ধারণা মতে, এই বিশরই কুরআনে বর্ণিত যুল-কিফল। এদের ধারণা হিসেবে তিনি নবী এবং পঁচাত্তর বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন। কিছু লোক। যখন আইয়ুব (عليه السلام)-এর পুত্র বিশরকে যুল-কিফুল বলেছেন, তখন আমরা যুল-কিফল-এর কাহিনীই এখন আলোচনা করব।