❏ মূসা (عليه السلام)-এর সাথে কারূনের ঘটনা
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(۞ إِنَّ قَـٰرُونَ كَانَ مِن قَوۡمِ مُوسَىٰ فَبَغَىٰ عَلَیۡهِمۡۖ وَءَاتَیۡنَـٰهُ مِنَ ٱلۡكُنُوزِ مَاۤ إِنَّ مَفَاتِحَهُۥ لَتَنُوۤأُ بِٱلۡعُصۡبَةِ أُو۟لِی ٱلۡقُوَّةِ إِذۡ قَالَ لَهُۥ قَوۡمُهُۥ لَا تَفۡرَحۡۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا یُحِبُّ ٱلۡفَرِحِینَ وَٱبۡتَغِ فِیمَاۤ ءَاتَىٰكَ ٱللَّهُ ٱلدَّارَ ٱلۡـَٔاخِرَةَۖ وَلَا تَنسَ نَصِیبَكَ مِنَ ٱلدُّنۡیَاۖ وَأَحۡسِن كَمَاۤ أَحۡسَنَ ٱللَّهُ إِلَیۡكَۖ وَلَا تَبۡغِ ٱلۡفَسَادَ فِی ٱلۡأَرۡضِۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا یُحِبُّ ٱلۡمُفۡسِدِینَ قَالَ إِنَّمَاۤ أُوتِیتُهُۥ عَلَىٰ عِلۡمٍ عِندِیۤۚ أَوَلَمۡ یَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ قَدۡ أَهۡلَكَ مِن قَبۡلِهِۦ مِنَ ٱلۡقُرُونِ مَنۡ هُوَ أَشَدُّ مِنۡهُ قُوَّةࣰ وَأَكۡثَرُ جَمۡعࣰاۚ وَلَا یُسۡـَٔلُ عَن ذُنُوبِهِمُ ٱلۡمُجۡرِمُونَ فَخَرَجَ عَلَىٰ قَوۡمِهِۦ فِی زِینَتِهِۦۖ قَالَ ٱلَّذِینَ یُرِیدُونَ ٱلۡحَیَوٰةَ ٱلدُّنۡیَا یَـٰلَیۡتَ لَنَا مِثۡلَ مَاۤ أُوتِیَ قَـٰرُونُ إِنَّهُۥ لَذُو حَظٍّ عَظِیمࣲ وَقَالَ ٱلَّذِینَ أُوتُوا۟ ٱلۡعِلۡمَ وَیۡلَكُمۡ ثَوَابُ ٱللَّهِ خَیۡرࣱ لِّمَنۡ ءَامَنَ وَعَمِلَ صَـٰلِحࣰاۚ وَلَا یُلَقَّىٰهَاۤ إِلَّا ٱلصَّـٰبِرُونَ فَخَسَفۡنَا بِهِۦ وَبِدَارِهِ ٱلۡأَرۡضَ فَمَا كَانَ لَهُۥ مِن فِئَةࣲ یَنصُرُونَهُۥ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَمَا كَانَ مِنَ ٱلۡمُنتَصِرِینَ وَأَصۡبَحَ ٱلَّذِینَ تَمَنَّوۡا۟ مَكَانَهُۥ بِٱلۡأَمۡسِ یَقُولُونَ وَیۡكَأَنَّ ٱللَّهَ یَبۡسُطُ ٱلرِّزۡقَ لِمَن یَشَاۤءُ مِنۡ عِبَادِهِۦ وَیَقۡدِرُۖ لَوۡلَاۤ أَن مَّنَّ ٱللَّهُ عَلَیۡنَا لَخَسَفَ بِنَاۖ وَیۡكَأَنَّهُۥ لَا یُفۡلِحُ ٱلۡكَـٰفِرُونَ تِلۡكَ ٱلدَّارُ ٱلۡـَٔاخِرَةُ نَجۡعَلُهَا لِلَّذِینَ لَا یُرِیدُونَ عُلُوࣰّا فِی ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فَسَادࣰاۚ وَٱلۡعَـٰقِبَةُ لِلۡمُتَّقِینَ)[Surat Al-Qasas ৭৬ - ৮৩]
অর্থাৎ, কারূন ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত, কিন্তু সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল। আমি তাকে দান করেছিলাম এমন ধনভাণ্ডার যার চাবিগুলো বহন করা একদল বলবান লোকের পক্ষেও কষ্টসাধ্য ছিল। স্মরণ কর, তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করবে না, নিশ্চয় আল্লাহ্ দাম্ভিকদেরকে পছন্দ করেন না। আল্লাহ্ যা তোমাকে দিয়েছেন তা দিয়ে আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান কর এবং দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলবে না। তুমি অনুগ্রহ কর যেমনটি আল্লাহ্তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেয়ো না। আল্লাহ্ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালবাসেন না। সে বলল, ‘এ সম্পদ আমি আমার জ্ঞানবলে প্রাপ্ত হয়েছি।’ সে কি জানত না আল্লাহ্ তার পূর্বে ধ্বংস করেছেন বহু মানবগোষ্ঠীকে, যারা তার চাইতে শক্তিতে ছিল প্রবল, জনসংখায় ছিল অধিক। অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না। কারণ, তার সম্প্রদায়ের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছিল জাঁকজমক সহকারে। যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা বলল, আহা! কারূনকে যেরূপ দেয়া হয়েছে আমাদেরকেও যদি তা দেয়া হত! প্রকৃতই সে মহাভাগ্যবান। এবং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্য আল্লাহর পুরস্কারই শ্রেষ্ঠ এবং ধৈর্যশীল ব্যতীত এটা কেউ পাবে না। তারপর আমি কারূনকে তার প্রাসাদসহ ভূগর্ভে প্রোথিত করলাম। তার স্বপক্ষে এমন কোন দল ছিল না, যে আল্লাহর শাস্তি থেকে তাকে সাহায্য করতে পারত এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না। আগের দিন যারা তার মত হবার কামনা করেছিল তারা বলতে লাগল, দেখলে তো আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছে, তার রিযিক বর্ধিত করেন এবং যার জন্য ইচ্ছে হ্রাস করেন। যদি আল্লাহ আমাদের প্রতি সদয় না হতেন তবে আমদেরকেও তিনি ভূগর্ভে প্রোথিত করতেন। দেখলে তো কাফিররা সফলকাম হয় না। এটা আখিরাতের সেই আবাস যা আমি নির্ধারিত করি তাদের জন্য, যারা এই পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য। (সূরা কাসাসঃ ৭৬-৮৩)
আ’মাশ (رحمة الله) আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, কারূন ছিল মূসা (عليه السلام)-এর চাচাতো ভাই। অনুরূপভাবে ইবরাহীম নাখয়ী আবদুল্লাহ ইবন হারিস ইবন নওফল (رحمة الله) সিমক ইবন হরব (رحمة الله) কাতাদা (رحمة الله) মালিক ইবন দীনার (رحمة الله) ও ইবন জুরাইজ (رحمة الله) বলেছেন, তবে তাঁরা মূসা (عليه السلام) ও কারূনের বংশপরম্পরা নিম্নরূপ বর্ণনা করেন। কারূন ইবন ইয়াসহারর ইবন কাহিস; মূসা (عليه السلام) ইবন ইমরান ইবন হাফিছ। ইবন জুরাইজ ও অধিকাংশ উলামায়ে কিরামের মতে কারূন ছিল মূসা (عليه السلام)-এর চাচাতো ভাই।
ইবন ইসহাক (رحمة الله) তাকে মুসা (عليه السلام)-এর চাচা বলে মনে করেন, কিন্তু জুরাইজ (رحمة الله) তা প্রত্যাখ্যান করেন। কাতাদা (رحمة الله) বলেছেন, সুমধুর কণ্ঠে তাওরাত পাঠের জন্যে তাকে নূর বলে আখ্যায়িত করা হতো। কিন্তু আল্লাহ শত্রু মুনাফিক হয়ে গিয়েছিল, যেমনি সামিরী হয়েছিল। অতঃপর তার ধন-দৌলতের কারণে তার দাম্ভিকতা তাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। শাহর ইবন হাওশাব (رحمة الله) বলেন, নিজ সম্প্রদায়ের উপর গর্ব করার উদ্দেশ্যে কারূন তার পরিধেয় কাপড়ের দৈর্ঘ এক বিঘত লম্বা করে দিয়েছিল।
আল্লাহ্ তা’আলা কারূনের প্রচুর সম্পদের কথা কুরআনুল করীমে উল্লেখ করেছেন। তার চাবিগুলো শক্তিশালী লোকদের একটি দলের জন্যে কষ্টকর বোঝা হয়ে যেতো। কেউ কেউ বলেন, এ চাবিগুলো ছিল চামড়ার তৈরি আর এগুলো বহন করতে ষাটটি খচ্চরের প্রয়োজন হতো। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলাই সমধিক জ্ঞাত। তার সম্প্রদায়ের উপদেশ দাতাগণ তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন। তারা তাকে বলেছিলেন, তোমাকে যা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে গর্ব করো না এবং অন্যের উপর দর্প করো না। কেননা, আল্লাহ তা’আলা দাম্ভিক লোকদের পছন্দ করেন না। আল্লাহ্ যা তোমাকে দিয়েছেন, তা দিয়ে আখিরাতের আবাস অন্বেষণ কর। অর্থাৎ তারা বলেছিলেন, হে কারূন! আখিরাতে আল্লাহ্ তা’আলা থেকে যাবতীয় ছওয়াব অর্জন করার প্রচেষ্টা তোমার অব্যাহত থাকা প্রয়োজন। কেননা, এটা তোমার জন্যে উত্তম ও অধিকতর স্থায়ী। এতদসত্ত্বেও তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলবে না অর্থাৎ বৈধভাবে অর্জন ও ব্যয় করবে এবং হালাল পবিত্র বস্তুসমূহ উপভোগ করবে। তবে আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহ করবে, যেমনটি তাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তা’আলা তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহর যমীনে ফিতনা-ফাসাদ করবে না। আমার নির্দেশ লঙ্ঘন করে তাদের সাথে দুর্ব্যবহার ও ঝগড়াঝাটি করবে না। অন্যথায় তোমাকে শাস্তি দেয়া হবে এবং তোমাকে যা দেয়া হয়েছে তা কেড়ে নেয়া হবে। কেননা, আল্লাহ্ তা’আলা ফিতনা সৃষ্টিকারীকে ভালবাসেন না।
তার সম্প্রদায়ের এরূপ স্পষ্ট নসীহতের জবাবে তার একমাত্র উত্তর ছিল, আমার জ্ঞানের জন্যে আমাকে এসব দেয়া হয়েছে। তোমরা আমাকে যেসব নসীহত করলে এগুলো মান্য করার আমার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা, এগুলো আল্লাহ তা’আলা আমায় দান করেছেন এ জন্য যে, তিনি আমাকে এসব বস্তুর উপযুক্ত বলে মনে করেছেন। যদি আমি তাঁর অন্তরঙ্গ না হতাম কিংবা তাঁর কাছে আমার কোন প্রাপ্য না থাকত তাহলে কখনও তিনি আমাকে যা দিয়েছেন তা দিতেন না। তাঁর এ বক্তব্য খণ্ডন করে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
أَوَلَمۡ یَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ قَدۡ أَهۡلَكَ مِن قَبۡلِهِۦ مِنَ ٱلۡقُرُونِ مَنۡ هُوَ أَشَدُّ مِنۡهُ قُوَّةࣰ وَأَكۡثَرُ جَمۡعࣰاۚ وَلَا یُسۡـَٔلُ عَن ذُنُوبِهِمُ ٱلۡمُجۡرِمُون[Surat Al-Qasas ৭৮]
“সে কি জানত না, আল্লাহ্ তার পূর্বে ধ্বংস করেছেন বহু মানব গোষ্ঠীকে, যারা তার চাইতে শক্তিতে ছিল প্রবল, জনসংখ্যায় ছিল অধিক। অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না।” (সূরা কাসাসঃ ৭৮)
অর্থাৎ তার পূর্বে বহু উম্মতকে তাদের পাপ ও অপরাধের জন্যে ধ্বংস করে দিয়েছি, যারা কারূন অপেক্ষা শক্তিতে অধিক প্রবল ছিল, ধনবলে, জনবলে তার চাইতে অগ্রগামী ছিল। যদি কারূনের বক্তব্য যথার্থ হত তাহলে তার চাইতে অধিক শক্তিশালী ও সম্পদশালী কাউকে শাস্তি দিতাম না। সুতরাং তার সম্পদ আমার প্রিয়পাত্র বা অনুগ্রহভাজন হওয়ার প্রমাণ নয়। যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(وَمَاۤ أَمۡوَ ٰلُكُمۡ وَلَاۤ أَوۡلَـٰدُكُم بِٱلَّتِی تُقَرِّبُكُمۡ عِندَنَا زُلۡفَىٰۤ إِلَّا مَنۡ ءَامَنَ وَعَمِلَ صَـٰلِحࣰا )
[Surat Saba' ৩৭]
“তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এমন কিছু নয় যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে দেবে। তবে তারা ব্যতীত যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। (সূরা সাবাঃ ৩৭)
অন্যত্র আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
(أَیَحۡسَبُونَ أَنَّمَا نُمِدُّهُم بِهِۦ مِن مَّالࣲ وَبَنِینَ نُسَارِعُ لَهُمۡ فِی ٱلۡخَیۡرَ ٰتِۚ بَل لَّا یَشۡعُرُونَ)
[Surat Al-Mu'minun ৫৫ – ৫৬]
“তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সাহায্য স্বরূপ যে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করি তা দিয়ে তাদের জন্য সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করেছি? না, বরং তারা বুঝে না।’ (সূরা মুমিনূনঃ ৫৫-৫৬)
উপরোক্ত প্রতিউত্তর দ্বারা বোঝা যায় যে, আয়াতাংশ ( إِنَّمَاۤ أُوتِیتُهُۥ عَلَىٰ عِلۡمٍ عِندِیۤ) -এর অর্থ আমরা যা বুঝেছি তা যথার্থ। আর যারা মনে করেন কারূন যে জ্ঞানের গর্ব করতো তা কি রসায়নশাস্ত্রে তার পারদর্শিতা কিংবা তা ছিল তার ইসমে আজমের জ্ঞান, যা প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ করত, তাদের ধারণা সঠিক নয়। কেননা রসায়নশাস্ত্র এমন একটি শিল্প যা বস্তুর মৌলিক কোন পরিবর্তন সাধন করে না এবং এটা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নয়। ইসমে আজম-এর মাধ্যমে কাফিরের দু’আ উর্ধজগতে উত্থিত হয় না। আর কারূন ছিল অন্তরে কাফির এবং দৃশ্যত মুনাফিক। এ ছাড়াও এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে তার উত্তরটি সঠিক হয় না। অধিকন্তু দুটি বাক্যের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কও বিরাজমান থাকে না। এই সম্পর্কে তাফসীর গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।
অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, (فَخَرَجَ عَلَىٰ قَوۡمِهِۦ فِی زِینَتِهِۦۖ এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কারূন তার সম্প্রদায়ের সামনে উপস্থিত হয়েছিল জাঁকজমক সহকারে। (সূরা কাসাসঃ ৭৯)
বহু তাফসীরকার উল্লেখ করেছেন যে, একদিন কারূন মূল্যবান পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে গাড়ি, ঘোড়া, বহু সংখ্যক লস্কর ও পরিচর্যাকারী নিয়ে শহরে বের হল। যারা পার্থিব সম্পদকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে, কারূনকে এরূপ শান-শওকতে দেখে তারা কামনা করতে লাগল যদি তাদেরও এরূপ ধন-সম্পদ থাকত! তারা তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হলো। তখনকর বুদ্ধিমান পণ্ডিত ও সাধকগণ তাদের কথা শুনে তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ
( وَیۡلَكُمۡ ثَوَابُ ٱللَّهِ خَیۡرࣱ لِّمَنۡ ءَامَنَ وَعَمِلَ صَـٰلِحࣰاۚ )
অর্থাৎ——‘ধিক তোমাদেরকে! আখিরাতের জীবনে আল্লাহ প্রদত্ত পুরস্কারই শ্রেষ্ঠ, অধিকতর স্থায়ী ও উন্নতর।’ আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ ( إِلَّا ٱلصَّـٰبِرُونَ) অর্থাৎ—এ পৃথিবীর চাকচিকোর দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আখিরাতের মহাকল্যাণ লাভের জন্য যে উপরোক্ত নসীহতকে গ্রহণ করতে পারে একমাত্র ঐ ব্যক্তি যার অন্তরে আল্লাহ্ তা’আলা হিদায়ত প্রদান করেছেন, তাকে দৃঢ়চিত্ত করেছেন, তার বুদ্ধি-বিবেক পোক্ত করেছেন এবং তাঁর গন্তব্যস্থলে পৌঁছার তাকে তাওফীক দান করেছেন। কোন কোন বুযুগানে দীন কতই না উত্তম কথা বলেছেন, সন্দেহের স্থলে দূরদৃষ্টি এবং ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ বুদ্ধিমত্তা আল্লাহ্ তা’আলার কাছে প্রিয়।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(فَخَسَفۡنَا بِهِۦ وَبِدَارِهِ ٱلۡأَرۡضَ فَمَا كَانَ لَهُۥ مِن فِئَةࣲ یَنصُرُونَهُۥ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَمَا كَانَ مِنَ ٱلۡمُنتَصِرِینَ)
[Surat Al-Qasas ৮১]
অর্থাৎ—‘আল্লাহ্ তা’আলা যখন কারূনের জাঁকজমক ও দাম্ভিকতাসহ স্বীয় সম্প্রদায়ের উপর গর্ব সহকারে তার শহর প্রদক্ষিণের কথা বর্ণনা করে তার পরিণতি সম্পর্কে বলেন, তাকে তার বাড়িঘরসহ আমি ভূগর্ভে প্রোথিত করলাম।’ (সূরা কাসাসঃ৮১)
ইমাম বুখারী (رحمة الله) আবূ সালিম (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এক ব্যক্তিকে রাসূল (ﷺ) দেখতে পেলেন, সে তার পরিধেয় বস্ত্র হেঁচড়িয়ে চলছে। সে ভূগর্ভে চলে যাচ্ছে। কিয়ামতের দিন পর্যন্ত সে এভাবে ভূগর্ভে তলিয়ে যেতেই থাকবে।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকেও অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেন। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) ও ইমাম সুদ্দী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন, একদিন কারূন একজন ব্যভিচারী মহিলাকে এ শর্তে কিছু অর্থ দিল যে, সে জনতার সামনে প্রকাশ্যে বলবে, হে মূসা ! তুমি আমার সাথে ব্যভিচার করেছ। কথিত আছে যে, মহিলাটি জনসমক্ষে মূসা (عليه السلام)-কে এরূপ বলেছিল। মূসা (عليه السلام) আঁৎকে উঠলেন এবং দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। অতঃপর মহিলাটির দিকে অগ্রসর হয়ে শপথ সহকারে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাকে এরূপ মিথ্যা অপবাদে কে প্ররোচিত করেছে?’ মহিলাটি তখন উল্লেখ করল যে, কারূনই তাকে এ কাজে প্ররোচিত করেছে। সে আল্লাহ্ তা’আলার কাছে ক্ষমা চাইল এবং তওবা করল। তখন মূসা (عليه السلام) সিজদাবনত হলেন এবং কারূনের বিরুদ্ধে বদ্ দু’আ করলেন। আল্লাহ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-এর কাছে এ মর্মে ওহী প্রেরণ করলেন যে, ভূমিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এ ব্যাপারে সে তোমার যাবতীয় নির্দেশ মান্য করবে। তখন মূসা (عليه السلام) কারূন ও তার ঘরবাড়ি গ্রাস করার জন্যে ভূমিকে নির্দেশ দিলেন। ফলে তা-ই হয়। আল্লাহ্ তা’আলাই সর্বজ্ঞ।
এরূপও কথিত আছে যে, একদিন কারূন সাজসজ্জা করে সৈন্য-সামন্ত, ঘোড়া, খচ্চর ও মূল্যবান পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে তার সম্প্রদায়কে নিজ ক্ষমতা প্রদর্শনার্থে মূসা (عليه السلام)-এর মাহফিলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। মূসা (عليه السلام) তখন তাঁর সম্প্রদায়কে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবহুল দিনগুলো সম্বন্ধে নসীহত করছেন। জনতা যখন কারূনকে দেখল, তখন মজলিসের অনেকেই তার দিকে ফিরে তাকাল। মূসা (عليه السلام) তাকে ডাকলেন এবং তার এরূপ করার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কারূন বলল, ‘হে মূসা! যদিও তুমি নবুওত প্রাপ্ত হয়ে আমার উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছ, কিন্তু মনে রেখো, আমিও বিত্ত-সম্পদের দিক থেকে তোমার উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছি। যদি ইচ্ছে কর, তাহলে তুমি ঘরের বের হয়ে আমার বিরুদ্ধে আল্লাহ কাছে বদদু’আ করতে পার এবং আমিও তোমার বিরুদ্ধে বদ দু’আ করব।’
তখন তারা উভয়েই জনতার সামনে হাযির হলেন। মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘তুমি দু’আ করবে, না কি আমি দু’আ করব?’ অতঃপর কারূন দু’আ করল কিন্তু মূসা (عليه السلام)-এর বিরুদ্ধে তার দু’আ কবুল হলো না। মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘এবার আমি দু’আ করব কি?’ কারূন বলল, ‘হ্যাঁ’। মূসা (عليه السلام) বললেন, اللهم مرالارض فلتطعن وليوم “হে আল্লাহ্! ভূমিকে নির্দেশ দাও, যাতে সে আজ আমার নির্দেশ মান্য করে।’ অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (عليه السلام)-কে ওহীর মাধ্যমে জানালেন, “আমি ভূমিকে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি।’ তখন মূসা (عليه السلام) বললেন, হে ভূমি! তাদেরকে পাকড়াও কর!’ ভূমি তাদেরকে তাদের পা পর্যন্ত গ্রাস করল। এরপর মূসা (عليه السلام) বললেন, “হে ভূমি তাদেরকে আরো পাকড়াও কর।’ ভূমি তাদেরকে হাঁটু পর্যন্ত গ্রাস করল। তারপর কাঁধ পর্যন্ত। পুনরায় মূসা (عليه السلام) বললেন, তাদের পুঞ্জীভূত ধন-দৌলতের দিকে অগ্রসর হও। ভূমি এগুলোর দিকে অগ্রসর হল এবং তারা সে দিকে তাকাল। মূসা (عليه السلام) আপন হাতে ইংগিত করলেন এবং বললেন, ‘বনু লাওয়ী নিপাত যাও!’ সাথে সাথে ভূমি তাদেরকে গ্রাস করে ফেলল।
কাতাদা (رحمة الله) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কারূন ও তার সম্প্রদায় কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিদিন একটি মানব দেহের পরিমাণ তলিয়ে যেতে থাকবে। আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সপ্ত যমীন পর্যন্ত ভূমি তাদেরকে ভূগর্ভস্থ করেছিল। এই প্রসঙ্গে বহু তাফসীরকার বহু ইসরাঈলী বর্ণনা পেশ করেছেন, আমি ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলো পরিহার করেছি। আয়াতাংশ فما كان له من فنة এর অর্থ হচ্ছে ( یَنصُرُونَهُۥ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَمَا كَانَ مِنَ ٱلۡمُنتَصِرِینَ) তার জন্যে নিজের থেকে কিংবা অপর থেকে কোন সাহায্যকারী ছিল না।
যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ فماله من قوة ولا ناصر অর্থাৎ তার শক্তিও নেই কিংবা তার সাহায্যকারীও নেই। যখন কারূন ভূগর্ভে চলে গেল তার বাড়িঘর, জান-মাল, পরিবার-পরিজন, জমি-জমা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কারূনের ন্যায় যারা সম্পদ কামনা করেছিল তারা লজ্জিত হল এবং আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের জন্যে উত্তম ব্যবস্থাপনা করে থাকেন। এ জন্যেই তারা বললঃ
( لَوۡلَاۤ أَن مَّنَّ ٱللَّهُ عَلَیۡنَا لَخَسَفَ بِنَاۖ وَیۡكَأَنَّهُۥ لَا یُفۡلِحُ ٱلۡكَـٰفِرُونَ)
[Surat Al-Qasas ৮২]
“যদি আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের প্রতি সদয় না হতেন, তবে আমাদেরকেও তিনি ভূগর্ভে প্রোথিত করতেন। দেখলে তো, কাফিররা সফলকাম হয় না। (সূরা কাসাসঃ ৮২)
আয়াতে উল্লেখিত ويلك শব্দটি সম্পর্কে তাফসীরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। কাতাদা (رحمة الله) বলেছেনঃ ويكان এর অর্থ হচ্ছে الم تران অর্থাৎ তুমি কি দেখনি? ও অর্থের দিক দিয়ে এটি একটি চমৎকার উক্তি। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা জানিয়ে দেনঃ
(وَإِنَّ ٱلۡـَٔاخِرَةَ هِیَ دَارُ ٱلۡقَرَارِ)
[Surat Ghafir ৩৯]
‘আখিরাতের আবাস অর্থাৎ স্থায়ী আবাস। এটা এমন একটি আবাস যাকে দেয়া হয় সে ঈর্ষার পাত্র হয়। আর যাকে বঞ্চিত করা হয় সে করুণার পাত্র হয়। এরূপ আবাসস্থল এমন লোকদের জন্যে তৈরি করে রাখা হয়েছে, যারা পৃথিবীতে উদ্ধত হতে চায় না কিংবা কোন প্রকার বিপর্যয়ও সৃষ্টি করতে চায় না। আয়াতে উল্লেখিত علو কথাটির অর্থ হচ্ছে ঔদ্ধত্য অহংকার ও গর্ব فساد বা বিপর্যয়ের অর্থ হচ্ছে পাপের কাজ যা পাপী ব্যক্তির নিজের মধ্যে হোক বা অন্যের সাথে সম্পৃক্ত হোক। যেমন লোকের সম্পদ আত্মসাৎ করা ও তাদের জীবিকা অর্জনের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা, তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার করা এবং তাদের অকল্যাণ কামনা করা। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ “শুভ পরিণতি তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্যে।” কারূনের ঘটনাটি হয়ত বা তাদের মিসর থেকে বের হবার পূর্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
কেননা, আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ
(فَخَسَفۡنَا بِهِۦ وَبِدَارِهِ ٱلۡأَرۡضَ )
[Surat Al-Qasas ৮১]
‘তাকে ও তার প্রাসাদ ভূগর্ভে প্রোথিত করলাম।’ دار এর প্রকাশ্য অর্থ প্রাসাদই হয়ে থাকে। আবার এটা হয়ত বা তীহের ময়দানেই হয়েছিল। তাহলে এখানে دار এর অর্থ হবে এমন একটি স্থান যেখানে। তাঁবু নির্মাণ করা হয়ে থাকে। যেমন প্রসিদ্ধ কবি আনতারাহ্ বলেছেনঃ
يادار عبلة بالجواء تكلمي – وعمي صباحا دار عبلة واسلمی
এখানে دار শব্দটি স্থান অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা কারূনের অপকীর্তির কথা একাধিক আয়াতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ
(وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا مُوسَىٰ بِـَٔایَـٰتِنَا وَسُلۡطَـٰنࣲ مُّبِینٍ إِلَىٰ فِرۡعَوۡنَ وَهَـٰمَـٰنَ وَقَـٰرُونَ فَقَالُوا۟ سَـٰحِرࣱ كَذَّابࣱ)
[Surat Ghafir ২৩ - ২৪]
“আমি আমার নিদর্শন ও স্পষ্ট প্রমাণসহ মূসাকে প্রেরণ করেছিলাম ফিরআউন, হামান ও কারূনের নিকট, কিন্তু তারা বলেছিল এ তো এক জাদুকর, চরম মিথ্যাবাদী। (সূরা মু’মিনঃ ২৩–২৪)
আল্লাহ্ তা’আলা সূরায়ে আনকাবুতে ‘আদ, ছামূদ, কারূন, ফিরআউন ও হামানের কথা উল্লেখের পর বলেনঃ
وَلَقَدۡ جَاۤءَهُم مُّوسَىٰ بِٱلۡبَیِّنَـٰتِ فَٱسۡتَكۡبَرُوا۟ فِی ٱلۡأَرۡضِ وَمَا كَانُوا۟ سَـٰبِقِینَ فَكُلًّا أَخَذۡنَا بِذَنۢبِهِۦۖ فَمِنۡهُم مَّنۡ أَرۡسَلۡنَا عَلَیۡهِ حَاصِبࣰا وَمِنۡهُم مَّنۡ أَخَذَتۡهُ ٱلصَّیۡحَةُ وَمِنۡهُم مَّنۡ خَسَفۡنَا بِهِ ٱلۡأَرۡضَ وَمِنۡهُم مَّنۡ أَغۡرَقۡنَاۚ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِیَظۡلِمَهُمۡ وَلَـٰكِن كَانُوۤا۟ أَنفُسَهُمۡ یَظۡلِمُونَ[Surat Al-Ankabut ৩৯ - ৪০]
“মূসা তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ এসেছিল। তখন তারা দেশে দম্ভ করত, কিন্তু তারা আমার শাস্তি এড়াতে পারেনি। তাদের প্রত্যেককেই আমি তার অপরাধের জন্যে শাস্তি দিয়েছিলাম। তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড ঝড়। তাদের কাউকে আঘাত করেছিল মহানাদ, কাউকে আমি প্রোথিত করেছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ্ তাদের প্রতি কোন জুলুম করেননি। তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। (সূরা আনকাবুতঃ ৩৯-৪০)
যাকে ভূগর্ভে প্রোথিত করা হয়েছিল সে ছিল কারূন, যার কথা পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। যাদেরকে নিমজ্জিত করা হয়েছিল, তারা ছিল ফিরআউন, হামান ও তাদের সৈন্য-সামন্ত। তারা ছিল অপরাধী।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবদুল্লাহ ইবন আমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) সালাত সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ ‘যে ব্যক্তি সালাত নিয়মিত আদায় করে, কিয়ামতের দিন এই সালাত তার জন্যে হবে নূর, দলীল ও পরিত্রাণের উপকরণ আর যে ব্যক্তি সালাত নিয়মিত আদায় করবে না তার জন্যে কোন নূর, দলীল ও নাজাত হবে না এবং কিয়ামতের দিন সে কারূন, ফিরআউন, হামান ও উবাই ইবন খালফের সঙ্গী হবে।’ এটি ইমাম আহমদ-এর একক বর্ণনা।