মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-এর কীর্তিমান জীবন ও অবদান

মুফতি মাহমুদ হাসান

 

জন্মবৃত্তান্তঃ

 

▶হজরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) ৬০৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছেন। রাসুল (ﷺ)-এর হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর। তাঁর বংশ পঞ্চম পুরুষে এসে রাসুল (ﷺ)-এর বংশের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবিবা (رضي الله عنه)-এর সহোদর ভাই ছিলেন। তিনি মক্কা বিজয়ের সময় রাসুল (ﷺ)- এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে ইসলাম প্রকাশ করলেও মূলত হিজরতের আগেই তিনি গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ জন্যই তিনি বদর, ওহুদ, খন্দকসহ কোনো যুদ্ধেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসেননি- (উস্দুল গাবাহ ৫/২১০)। 


মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) আল্লাহপ্রদত্ত অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। রাসুল (ﷺ)-এর কাছে তিনি এতই নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন যে তিনি তাঁকে ওহি লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ফকিহ সাহাবিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। রাসুল (ﷺ) থেকে তাঁর সূত্রে ১৬৩টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সর্বপ্রথম তিনিই ইসলামের ইতিহাস রচনা করেছেন।

 

রাসুল (ﷺ)-এর দৃষ্টিতে হজরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)


▶হজরত উম্মে হারাম (رضي الله عنه) বলেন, 'আমি রাসুল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, আমার উম্মতের সর্বপ্রথম সামুদ্রিক অভিযানে অংশগ্রহণকারী বাহিনীর জন্য জান্নাত অবধারিত'- (সহিহ বোখারি, হা. ২৯২৪) ।


▶এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাল্লাব (রহ.) বলেন, 'হাদিসটিতে হজরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-এর ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। কেননা হজরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-ই ছিলেন ওই বাহিনীর সিপাহসালার।'- (ফাতহুল বারী : ৬/১০২)।


▶হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবি উমায়রা (رضي الله عنه) বলেন, 'রাসুল (ﷺ) মুয়াবিয়ার জন্য এ দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ! মুয়াবিয়াকে সঠিক পথে পরিচালনা করুন ও তাঁকে পথপ্রদর্শক হিসেবে কবুল করুন।" (তিরমিজি, হা. ৩৮৪২) ।


▶একবার মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) রাসুল (ﷺ)-এর অজুতে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন, তখন রাসুল (ﷺ) তাঁকে বললেন, 'হে মুয়াবিয়া, যদি তোমাকে আমির নিযুক্ত করা হয়, তাহলে আল্লাহকে ভয় করবে এবং ইনসাফ করবে। ' মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) বলেন, 'সেদিন থেকেই আমার বিশ্বাস জন্মেছিল যে, এ কঠিন দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়বে।'- (মুসনাদে আহমাদ হা. ১৬৯৩৩)।


▶হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণিত, একদিন জিবরাঈল (আ.) রাসুল (ﷺ)-এর কাছে এসে বললেন, 'হে মুহাম্মদ (ﷺ), মুয়াবিয়াকে সদুপদেশ দিন, কেননা সে আল্লাহর কিতাবের আমানতদার ও উত্তম আমানতদার।'- (আল মুজামুল আওসাত, হা. ৩৯০২) ।


খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন


▶অসাধারণ নৈপুণ্যের কারণে হজরত ওমর (رضي الله عنه) তাঁর খেলাফতকালে তাঁকে দামেস্কের আমির নিযুক্ত করেছিলেন। হজরত ওসমান (رضي الله عنه) তাঁকে পুরো শামের (সিরিয়ার) আমির নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁদের খেলাফতকালে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) ইসলামের বহু যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে অনেক দেশ জয় করেছিলেন।


খেলাফত আমলের কীর্তি


▶হজরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) চরম সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সব ফিতনা দমন করে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনেন। পরিস্থিতি এমন হয় যে, মহিলারা রাতে তাদের ঘরের দরজা খুলে ঘুমাতেও ভয় করত না, কোনো ব্যক্তি পথে পড়ে থাকা কারো জিনিস ছুঁয়ে দেখার সাহস পেত না। তাঁর শাসনামলে সারা পৃথিবীতে কোনো মুসলমান ভিক্ষুক ছিল না। রাজ্যের অমুসলিম নাগরিকদেরও শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম যোগাযোগের জন্য ডাক বিভাগ চালু করেন এবং সরকারি দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণের জন্য পৃথক বিভাগ চালু করেন। তিনি মুসলিম বাহিনীকে সুশৃঙ্খল রূপ দেন ও ইসলামের দাওয়াত বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন- (তারিখে ত্বাবারি, মু'জামুল বুলদান ৪/৩২৩, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৩/১৫৭)। 


পর্তুগাল থেকে চীন পর্যন্ত এবং আফ্রিকা থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ৬৫ লাখ বর্গমাইল বিস্তৃত অঞ্চল তাঁর শাসনামলে ইসলামের পতাকাতলে চলে আসে। তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর খেলাফতের গুরুদায়িত্ব পালন করেন ।


ইয়াজিদকে খলিফা বানানোর কারণ


▶হজরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) যখন জীবন সায়াহ্নে পৌঁছলেন, বিশিষ্ট সাহাবি হজরত মুগিরা ইবনে শু'বা (رضي الله عنه) যিনি বাইআতে রিদ্ওয়ানে রাসুল (ﷺ)-এর সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন, তিনি মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-কে পরামর্শ দিলেন যে, হজরত ওসমান (رضي الله عنه)-এর শাহাদাতের পর মুসলমানদের যে করুণ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে, তা আপনার সামনেই রয়েছে। তাই আমার পরামর্শ হলো, সব প্রাদেশিক গভর্নরকে ডেকে আপনার জীবদ্দশায়ই ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত নিয়ে উম্মতকে রক্তক্ষয়ী হাঙ্গামা থেকে রক্ষা করুন। এ পরামর্শ আনুযায়ী হজরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) সব গভর্নরের কাছে এ মর্মে চিঠি প্রেরণ করলেন যে, আমি জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে গেছি, তাই চাচ্ছি যে, মুসলমানদের কল্যাণে আমার জীবদ্দশায়ই একজন খলিফা নিযুক্ত করে যাব। অতএব তোমরা নিজ নিজ পরামর্শ ও তোমাদের পরামর্শদাতাদের মধ্যে যোগ্য ব্যক্তিদের পরামর্শও লিখে পাঠাও।


এতে বেশির ভাগ আমিরই ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার পক্ষে রায় দিলেন। কুফা, বসরা, শাম ও মিসরের লোকেরা ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে নিল। বাকি মক্কা-মদিনার গুরুত্ব বিবেচনা করে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) স্বয়ং হিজাযে উপস্থিত হয়ে সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। এতে মক্কা-মদিনার জনসাধারণও ইয়াজিদের বাইয়াত গ্রহণ করে নিলেন। আর হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه), আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (رضي الله عنه), হুসাইন ইবনে আলী (رضي الله عنه). ও আব্দুর রহমান ইবনে আবী বকর (رضي الله عنه)- এ পাঁচজনের ব্যাপারে খেলাফত মেনে না নেওয়ার শঙ্কা থাকায় মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) পৃথক পৃথক প্রত্যেকের সঙ্গে মিলিত হয়ে পরামর্শ করেন। এতে প্রথমোক্ত চারজন এ বলে মেনে নিলেন যে, সব লোক স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। শুধু হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবী বকর (رضي الله عنه) এতে দ্বিমত পোষণ করলেন। এভাবে বেশির ভাগ উম্মতের রায় মতে ইয়াজিদের খেলাফত নিশ্চিত হলো। তাই মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-এর ইন্তেকালের পর ইয়াজিদ থেকে যেসব অন্যায় কাজ সংঘটিত হয়েছিল, তার দায়ভার মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-এর ওপর বর্তাবে না, বরং ইয়াজিদের অন্যায়ের জন্য তিনি নিজেই দায়ী- (তারিখে ইবনুল আসীর ৩/৯৭-১০০) ।


হযরত আলী ও মুয়াবিয়া (রাঃ) মতানৈক্য ইজতিহাদী

মুফতী সৈয়্যদ মুহাম্মদ অসিয়র রহমান


ইসলামের ইতিহাসে মাওলা আলী শের-ই খোদা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ছিলেন একাধারে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র জামাতা,খোলাফা-ই রাশিদীনের অন্যতম,বিশিষ্ট সাহাবী,বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ,সুদক্ষ শাসক এবং সুনিপুণ রণকৌশলী ।


আর হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুও ছিলেন অহী লিখক এবং দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ বিশিষ্ট সাহাবী।ব্যক্তিত্ব ও কর্মদক্ষতার বলে তিনি প্রায় ৪০ বছর যাবৎ একাধিক পদে ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।হযরত মাওলা আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর ওফাতের ৬মাস পর তিনি মুসলিম জগতের একচ্ছত্র অধিপতি ও প্রথম সুলতান হিসেবে শাসনভার পরিচালনা করেন । উল্লেখ্য, এ ছ’মাস হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর স্থলাভিষিক্ত হন।এরপর তিনি হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র অনুকূলে খিলাফতের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন । তখনকার জীবিত সাহাবী ও তাবে’ঈনের মধ্যে কেউ তাঁর শাসনের বিরোধিতা করেননি । কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য যে,চৌদ্দশ’ বছর পর শিয়া,রাফেজী,শিয়া সম্প্রদায়ের দোসরগণ এবং আবুল আ’লা মওদুদী ইত্যাদি ভ্রান্ত মতবাদের অনুসারী ও স্বার্থান্বেষী মহল হযরত মাওলা আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু ও আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা’র মধ্য যে ইজতিহাদী মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়,তার যথাযথ ও সঠিক বিশ্লেষণ না করে সত্যের মাপকাঠি সাহাবা-ই কিরামের সমালোচনায় উঠেপড়ে লেগে যায় । ক্ষেত্র বিশেষে তারা এমন সব আষাঢ়ে গল্পের অবতারণা করে,যা বিবেকবান মানুষকেও নাড়া দেয়। ইতিহাসের বর্নিল পাতায় হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ও আমীর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর মধ্যে মতানৈক্য এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যার সঠিক সমাধান অনুসন্ধান করা ও জানা প্রত্যেকের জন্য জরুরি। প্রথমে সম্মানিত সাহাবা-ই কেরামের শান-মান ও মর্যাদা সর্ম্পকে কিছুটা আলোকপাত করা যাক ।


কোরআনের আলোকে সাহাবা-ই কেরামের মর্যাদা:মহান আল্লাহ পাক প্রিয় নবী রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রিয় সহচর সাহাবা-ই কেরামকে যে মযার্দার আসনে আসীন করেছেন,পৃথিবীর ইতিহাসে তা সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।  বহু আয়াত ও হাদীস শরীফ দ্বারা তাঁদের মযার্দা প্রকাশ পায় । নিম্নে কতিপয় আয়াত উপস্থাপনের প্রয়াস পাচ্ছি ।


▶মহান মহান আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন –


 لَا يَسْتَوِي مِنكُم مَّنْ أَنفَقَ مِن قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُوْلَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِّنَ الَّذِينَ أَنفَقُوا مِن بَعْدُ وَقَاتَلُوا وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى


অর্থাৎ,তোমাদের মধ্যে সমান নয় ঐসব লোক যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় ও জিহাদ করেছে, তারা মর্যাদায় ঐসব লোক অপেক্ষা বড়, যারা মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় ও জিহাদ করেছে এবং তাদের সবার সাথে আল্লাহ জান্নাতের ওয়াদা করেছেন ।  [সূরা হাদীদঃ আয়াত ১০]


وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُوا كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاءُ ۗ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَٰكِنْ لَا يَعْلَمُونَ


▶অর্থাৎ, যখন তাদেরকে বলা হয়, ঈমান আন,যেমন অপরাপর লোকেরা ঈমান এনেছে’, তখন তারা বলে আমরা কি নির্বোধদের মত ঈমান আনব? শুনছো ! তারাই হলো নির্বোধ, কিন্তু তারা জানেনা । [সূরা বাকারাঃ আয়াত ১৩]


এ আয়াতে এটাই বলা হয়েছে যে, যার ঈমান সাহাবা-ই কেরামের ঈমানের মত নয়, সে মুনাফিক এবং বড় বোকা । এ আয়াতসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কোন সাহাবী ফাসিক বা কাফির হতে পারেন না এবং সকল সাহাবীর জন্য আল্লাহ তা’আলা জান্নাতের ওয়াদা করেছেন । এটাও প্রমাণিত হল যে, নেক্‌কার বান্দাদের মন্দ বলা মুনাফিকদের কুপ্রথা । যেমন-রাফেযী (শিয়া) সম্প্রদায় সাহাবা-ই কেরামকে খারেজীগণ ‘আহলে বায়তকে, গা্য়রে মুক্বাল্লিদগণ ইমাম আবু হানিফাকে এবং ওহাবীগণ আল্লাহর প্রিয় ওলীদেরকে মন্দ বলে।


হাদীসের আলোকে সাহাবা-ই কেরামের মর্যাদা 


সাহাবা-ই কেরামের ফযিলত সম্পর্কে অনেক হাদীস শরীফ বর্ণিত আছে । তন্মধ্যে কয়েকটি এখানে উদ্ধৃত হল –


عن ابی سعید الخدری رضی اللہ تعالی عنہ قال قال رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلم ولا تسبوا اصحابی فلو انّ احدکم انفق مثل احد ذھبا ما بلغ مدّ احدھم ولا نصفہ-


▶অর্থাৎ, হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু  তা’আলা আনহুর থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন -“আমার কোন সাহাবীকে মন্দ বলনা । তোমাদের কেউ যদি উহুদ পর্বততূল্য স্বর্ণও খয়রাত করে,তবুও তাঁদের সোয়া সের যব সদ্‌কা করার সমানও হতে পারেনা;বরং এর অর্ধেকেরও বরাবর হতে পারেনা ।” 

[বুখারীঃ১ম খন্ড-৫১৮ পৃষ্ঠা, তিরমিযীঃ২য় খন্ড-২২৫ পৃষ্ঠা]


عن عبد اللہ بن المغفل رضی اللہ عنہ قال قال رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلم فی اصحابی لا تتخذو انتم عرضا من بعدی فمن احبھم فبحبی احبھم ومن ابغضھم فببغضی ابغضھم –


▶অর্থাৎ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন , হুজুর আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন – “আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর , তাঁদেরকে ভৎর্সনা ও বিদ্রূপের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত কর না। যে আমার সাহাবীকে মহব্বত করল,সে আমার মুহাব্বতে তাঁদেরকে মুহাব্বত করল এবং যে তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল, সে আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণের কারনে তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল”। 

[তিরমিযি শরীফ, ২য়-২২৫]


عن ابن عمر رضی اللہ تعالی عنہ قال قال رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلّم اذا را‏‏یتم الذین یسبّون اصحابی فقولوا لعنۃ اللہ علی شرّکم-


▶অর্থাৎ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু  তা’আলা আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “যখন তোমরা এ ধরনের লোক দেখবে, যারা আমার সাহাবীকে মন্দ বলে, তখন তাদের উদ্দেশে বলে দাও, তোমাদের অনিষ্টের উপর আল্লাহর অভিশাপ হোক”।  [তিরমিযী ২য় খন্ড-২২৫ পৃঃ]


হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু  তা’আলা আনহু:নাম ‘আলী’, উপনাম- ‘আবুল হাসান’, উপাধি-‘আসাদুল্লাহ’। পিতা – ‘আবু তালেব’। বাল্যকাল থেকে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র তত্ত্বাবধানে বড় হন। সম্পর্কের দিক থেকে তিনি প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র চাচাতো ভাই এবং হুজুরের কন্যা হযরত ফাতিমা যাহরা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা’র স্বামী ছিলেন। তিনিই কিশোরদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাবুক অভিযান ব্যতীত সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি বীরত্ত্বের পরিচয় দেন। ৩৫ হিজরী সনের ২৪ যিলহজ্ব তিনি ইসলামের ৪র্থ খলীফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাগর, জ্ঞান শহরের প্রধান ফটক এবং বেলায়েতের সম্রাট হিসেবে খ্যাত। আহলে বায়তের অন্যতম সদস্য হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-


إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيراً


▶অর্থাৎ, “হে নবীর পরিবারবর্গ! আল্লাহ তো এটাই চান যে, তোমাদের থেকে প্রত্যেক অপবিত্রতা দূরীভূত করে দেবেন এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে খুব পরিচ্ছন্ন করে দেবেন”। [সূরা আহযাব-৩৩]


এ প্রসঙ্গে স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন –


لا یحبّ علیاً منافق، و لا یبغضه مومن


▶অর্থাৎ, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু  তা’আলা আনহুকে মুনাফিক্ব ভালবাসবে না এবং কোন মু’মিন আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে ঘৃণা করতে পারেনা। [মুসনাদে আহমদ]


গদীরে খুম-এ ,রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাওলা আলীর হাত তুলে ধরে ইরশাদ করেন –


من کنت مولاہ فعلی مولاہ


▶অর্থাৎ, “আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা”। [তিরমিযী শরীফ ২১৩-২১৪ পৃঃ]


উল্লেখ্য, শিয়াগণ এ হাদীসের অপব্যাখ্যা করেও নানা বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। তারা এর অপব্যাখ্যার ভিত্তিতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক্ব , হযরত ওমর ও হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম’র খিলাফতকে অস্বীকার করে। তারা ‘মাওলা’ মানে বলে আমীর, ইমাম বা খলীফা।কিন্তু এটা তাদের মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জঘন্য ভুল ব্যাখ্যা। এখানে ‘মাওলা’ মানে ‘প্রিয়’, ‘সাহায্যকারী’। [সাওয়াইক্বে মুহরিক্বাহ্ ও আসাহহুস সিয়ার ইত্যাদি]


বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে “ঐতিহাসিক গদীর-ই খুম’র ঘটনা” নামক পুস্তিকায়, লিখেছেন মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান।


▶হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু  তা’আলা আনহু’র মর্যাদা: তাঁর নাম ‘মুয়াবিয়া’ উপনাম ‘আবু আব্দুর রহমান’। পিতা-হযরত আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু । মাতা-হযরত হিন্দা রাদিয়াল্লাহু  তায়ালা আনহা। পিতা মাতা উভয়ের দিক থেকে তাঁর বংশধারা পঞ্চম পুরুষে হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বংশের সাথে মিলে যায়। ঐতিহাসিকগণের নির্ভরযোগ্য সূত্রানুসারে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হযরত আবু সুফিয়ানসহ পরিবারের অন্য সদস্যবৃন্দের সাথে অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম ধর্ম কবুল করেছেন।অপর বর্ণনা মতে, হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় ইসলাম কবুল করেছেন, তবে প্রকাশ করেছেন ৮ম হিজরী মক্কা বিজয়ের সময়। ইসলাম গ্রহনের পর থেকে হযরত আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু  তায়ালা আনহু, হিন্দা রাদিয়াল্লাহু  তায়ালা আনহা ও হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু  তা’আলা আনহুকে কখনো স্বয়ং রসূলে মাক্ববূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী বা মুমিনদের মর্যাদা থেকে খারিজ করেননি এবং কোন সাহাবীই তাঁদের শানে কটুক্তিও করেননি, বরং হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহী লেখকগণের মধ্যে গণ্য করে এক বিরাট সৌভাগ্যের অধিকারী করেছেন।

[মাদারিজুন্নুবুয়ত কৃত শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি]


▶ইমাম আহমদ রাদিয়াল্লাহু  তা’আলা আনহু ‘মুসনাদে আহমদ’-এ বর্ণনা করেছেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু  তা’আলা আনহু’র জন্য এভাবে পরম করুণাময়ের দরবারে ফরিয়াদ করেছেন-


اللھم علم معاویۃ الکتاب والحساب


অর্থাৎ, “হে আল্লাহ! মু’য়াবিয়াকে পবিত্র কুরআন ও অঙ্কশাস্ত্রের জ্ঞান দান কর।"

[মুসনাদে আহমদ  আন্নাহিয়া আন্ তা’নিল আমীর মুয়াবিয়া, কৃত: আল্লামা আব্দুল আযীয-১৪ পৃঃ]


▶তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হাদীসে হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু  তা’আলা আনহু’র জন্য এভাবে দোয়া করেছেন


اللھم اجعلہ ھادیا مھدیّا واھد بہ الناس


অর্থাৎ, “হে আল্লাহ! তুমি মুয়াবিয়াকে হাদী এবং মাহদী বানিয়ে দাও এবং তাঁর মাধ্যমে মানুষকে হিদায়াত দান কর।"


এতদসত্ত্বেও তাঁর শানে ‘তাঁকে সাহাবী ও একজন মু’মিনের মর্যাদাও দেয়া যায়না’ মর্মে শিয়া-রাফেজী অনুসারিদের কটুক্তি করা সাহাবা-ই রাসুলরে প্রতি জঘন্যতম বেআদবীর শামিল।সুত্রঃরওশন দলীল।(চলবে)

Top