❏ তবুক যুদ্ধের সময় ছামূদ জাতির আবাসভূমি হিজর উপত্যকা দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গমন
ইমাম আহমদ, ইবন উমর (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন, তাবুক অভিযানকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সদলবলে হিজর উপত্যকায় অবতরণ করেন। যেখানে ছামূদ জাতি বসবাস করত। ছামূদ সম্প্রদায় যেসব কূপের পানি পান করত, লোকজন সেসব কূপের পানি ব্যবহার করে। এ পানি দিয়ে আটার খামীর তৈরি করে এবং যথারীতি ডেকচি উনুনে চড়ান। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ আসায় তারা ডেকচির খাদ্য ফেলে দিয়ে খামীর উটকে খেতে দেন। তারপর তিনি সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে যে কূপ থেকে আল্লাহর উটনী পানি পান করত সে কূপের নিকট অবতরণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লোকজনকে সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির বাসস্থানে যেতে নিষেধ করেন। তিনি বললেন, ‘আমার আশংকা হয় তোমাদের উপর না তাদের মত আযাব আপতিত হয়। সুতরাং তোমরা তাদের ঐ স্থানে প্রবেশ করো না।’ ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবদুল্লাহ ইবন উমর (رضي الله عنه) থেকে অন্য এক বর্ণনায় বলেন, হিজরে অবস্থানকালে রাসূল (ﷺ) বলেছিলেনঃ তোমরা আল্লাহর গযবে ধ্বংস প্রাপ্তদের ঐসব বাসস্থানে কান্নারত অবস্থায় ছাড়া যেয়ো না, যদি একান্তই কান্না না আসে তাহলে সেখানে আদৌ যেয়ো না। যে আযাব তাদের উপর এসেছিল, সেরূপ আযাব তোমাদের উপরও না পতিত হয়ে যায়। বুখারী ও মুসলিমে একাধিক সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় এভাবে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন ছামূদ জাতির এলাকা অতিক্রম করেন তখন মাথা ঢেকে রাখেন, বাহনকে দ্রুত চালান এবং কান্নারত অবস্থায় ব্যতীত কাউকে তাদের বাসস্থানে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। অন্য বর্ণনায় এতটুকু বেশি আছে যে, যদি একান্তই কান্না না আসে তবে কান্নার ভঙ্গী অবলম্বন কর এই ভয়ে যে, তাদের উপর যে আযাব এসেছিল, অনুরূপ আযাব তোমাদের উপরও না এসে পড়ে।'
ইমাম আহমদ (رحمة الله) আমের ইবন সা'দ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেনঃ তাবুক যুদ্ধে গমনকালে লোকজন দ্রুত অগ্রসর হয়ে হিজরবাসীর বাসস্থানে প্রবেশ করতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি লোকজনের মধ্যে ঘোষণা করে দেন الصلواة خامعة অর্থাৎ সালাত আদায় করা হবে। আমের (رضي الله عنه) বলেন, এ সময় আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হই। তিনি তখন নিজের বাহন উট থামাচ্ছিলেন এবং বলছিলেনঃ তোমরা কেন ঐসব লোকের বাসস্থানে প্রবেশ করছ, যাদের উপর আল্লাহ গযব নাযিল করেছেন। এক ব্যক্তি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আশ্চর্যজনক বস্তু হিসেবে এগুলো দেখছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আমি কি এর চেয়ে অধিক আশ্চর্যের কথা তোমাদেরকে বলবো না? তা হল এই যে, তোমাদের মধ্যেই এক ব্যক্তি তোমাদেরকে সেসব ঘটনা বলে দেয় যা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়ে গেছে এবং সেসব ঘটনার কথাও বলে যা ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে। অতএব, তোমরা সত্যের উপর অটল-অবিচল হয়ে থাক। তা না হলে আল্লাহ তোমাদেরকে শাস্তি দিতে বিন্দুমাত্র পরোয়া করবেন না। শীঘ্রই এমন এক জাতির আবির্ভাব হবে যারা তাদের উপর আগত শাস্তি থেকে নিজেদেরকে বিন্দুমাত্র রক্ষা করতে পারবে না। এ হাদীসের সনদ হাসান পর্যায়ের কিন্তু অন্য হাদীস গ্রন্থকারগণ এ হাদীসটি বর্ণনা করেননি। কথিত আছে যে, সালিহ (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের লোকজন দীর্ঘায়ু হতো। মাটির ঘর বানিয়ে তারা বাস করত। কিন্তু কারোর মৃত্যুর পূর্বেই তার ঘর বিনষ্ট হয়ে যেত। এ কারণে তারা পাহাড় কেটে প্রাসাদ নির্মাণ করত।
ইতিহাসবেত্তাগণ লিখেছেন, হযরত সালিহ (عليه السلام)-এর নিকট নিদর্শন দাবি করলে, আল্লাহ ঐ কওমের জন্যে উটনী প্রেরণ করেন। একটি পাথর থেকে উটনীটি বের হয়ে আসে। এই উটনী ও তার পেটের বাচ্চার সাথে দুর্ব্যবহার করতে তাদেরকে তিনি নিষেধ করেন। দুর্ব্যবহার করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি আসবে বলেও তিনি জানিয়ে দেন। তিনি আরও জানিয়ে দেন যে, শীঘ্রই এরা উটনীটিকে হত্যা করবে এবং এর কারণেই তারা ধ্বংস হবে। যে ব্যক্তি উটনীটিকে হত্যা করবে তিনি তার পরিচয়ও তুলে ধরেন। তার গায়ের রঙ হবে গৌর, চোখের রঙ নীল এবং তার চুল হবে পিঙ্গল বর্ণের। সম্প্রদায়ের লোকজন এই বৈশিষ্ট্যের কোন শিশু জন্মগ্রহণ করলে সাথে সাথে তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে গোটা জনপদে ধাত্রীদের নিয়োজিত করে। এই অনুসন্ধান দীর্ঘকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ ভাবে এক প্রজন্মের পর অন্য প্রজন্মের অবসান ঘটে।
তারপর এক সময়ে উক্ত সম্প্রদায়ের এক সর্দার ব্যক্তির পুত্রের সাথে আর এক সর্দার ব্যক্তির কন্যার বিবাহের প্রস্তাব দেয়। সেমতে বিবাহও হয়। এই দম্পতির ঘরেই উটনীর হত্যাকারীর জন্ম হয়। শিশুটির নাম রাখা হয় কিদার ইবন সালিফ। সন্তানের পিতা-মাতা ও বাপ-দাদা সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী হওয়ার কারণে ধাত্রীদের পক্ষে তাকে হত্যা করা সম্ভব হলো না। শিশুটি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্য শিশুরা এক মাসে যতটুকু বড় হয় সে এক সপ্তাহে ততটুকু বড় হয়ে যায়। এভাবে সে সম্প্রদায়ের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। সবাই তাকে নেতা হিসেবে মেনে চলে। এক পর্যায়ে তার মনের মধ্যে উটনী হত্যা করার বাসনার উদ্রেক হয়। সম্প্রদায়ের আরও আট ব্যক্তি এ ব্যাপারে তাকে অনুসরণ করে। এই নয়জন লোকই হযরত সালিহ (عليه السلام)-কেও হত্যা করার পরিকল্পনা করে। এরপর যখন উটনী হত্যার ঘটনা সংঘটিত হলো এবং সালিহ (عليه السلام)-এর নিকট এ সংবাদ পৌঁছাল, তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে সম্প্রদায়ের লোকদের নিকট যান। সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় লোকেরা নবীর কাছে এই কথা বলে ওজর পেশ করল যে, আমাদের নেতৃস্থানীয় কারো দ্বারা এ ঘটনা ঘটেনি। ঐ কয়েকজন অল্প বয়সী যুবক এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
কথিত আছে যে, তখন সালিহ (عليه السلام)-এর প্রতিকার হিসাবে উটনীটির বাচ্চাটিকে নিয়ে এসে তার সাথে উত্তম ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। লোকজন বাচ্চাকে ধরে আনার জন্যে অগ্রসর হলে বাচ্চাটি পাহাড়ে উঠে যায়। লোকজনও পিছে পিছে পাহাড়ে উঠল। কিন্তু বাচ্চা আরও উপরে উঠে পাহাড়ের শীর্ষে চলে যায়, যেখানে তারা পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। বাচ্চা সেখানে গিয়ে চোখের পানি ফেলে কাঁদতে থাকে। তারপর সে হযরত সালিহ (عليه السلام)-এর দিকে মুখ ফিরিয়ে তিনবার ডাক দেয়। তখন সালিহ (عليه السلام) সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা তিনদিন পর্যন্ত বাড়িতে বসে জীবন উপভোগ কর-এ এমন এক ওয়াদা যা মিথ্যা হবার নয়। নবী তাদেরকে আরও জানালেন, আগামীকাল তোমাদের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাবে, পরের দিন রক্তিম এবং তৃতীয় দিন কালো রঙ ধারণ করবে। চতুর্থ দিনে এক বিকট শব্দ এসে তাদেরকে আঘাত হানে। ফলে তা নিজ নিজ ঘরে মরে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। এ বর্ণনার সাথে কোন কোন দিক সম্পর্কে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে এবং কুরআনের সুস্পষ্ট বর্ণনায় সংঘর্ষশীল, যা ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করে এসেছি। সঠিক ত আল্লাহই জানেন।