কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া
(ইসলামের ইতিহাসঃ আদি-অন্ত)
প্রথম খণ্ড
মূলঃ আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)
মূল কিতাব পরিমার্জন ও সম্পাদনায়ঃ
ড. আহমদ আবু মুলহিম
ড. আলী নজীব আতাবী
প্রফেসর ফুয়াদ সাইয়েদ
প্রফেসর মাহদী নাসির উদ্দীন
প্রফেসর আলী আবদুস সাতির
অনুবাদঃ
মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ এমদাদ উদ্দীন
মাওলানা মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন
মাওলানা বোরহান উদ্দীন
মাওলানা মোঃ আবু তাহের
সম্পাদনা পরিষদঃ
অধ্যাপক মাওলানা আবদুল মান্নান (সভাপতি)
মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী (সদস্য)
পরিচালক, অনুবাদ ও সংকলন বিভাগ (সদস্য সচিব)
গ্রন্থস্বত্বঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
প্রথম প্রকাশঃ জুন ২০০০
❏ মহাপরিচালকের কথা
“আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া” প্রখ্যাত মুফাসসির ও ইতিহাসবেত্তা আল্লামা ইবনে কাসীর (র) প্রণীত একটি সুবৃহৎ ইতিহাস গ্রন্থ। এই গ্রহে সৃষ্টির শুরু তথা আরশ, কুরসী, নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল প্রভৃতি এবং সৃষ্টির শেষ তথা হাশর-নশর, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম প্রভৃতি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
এই বৃহৎ গ্রন্থটি ১৪টি খণ্ডে সমাপ্ত হয়েছে। আল্লামা ইবনে কাসীর (র) তার এই গ্রন্থকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগে আরশ, কুরসী, ভূমণ্ডল, নভোমণ্ডল এতদুভয়ের অন্তর্বর্তী সব কিছু তথা ফেরেশতা, জিন, শয়তান, আদম (আ)-এর সৃষ্টি, যুগে যুগে আবির্ভূত নবী-রাসূলগণের ঘটনা, বনী ইসরাঈল, ইসলাম-পূর্ব যুগের ঘটনাবলী এবং মুহাম্মদ (ﷺ)-এর জীবন-চরিত আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতকাল থেকে ৭৬৮ হিজরী সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ কালের বিভিন্ন ঘটনা এবং মনীষীদের জীবনী আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় ভাগে রয়েছে ফিৎনা-ফাসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কিয়ামতের আলামত, হাশর-নশর, জান্নাত-জাহান্নামের বিবরণ ইত্যাদি।
লেখক তার এই গ্রন্থের প্রতিটি আলোচনা কুরআন, হাদীস, সাহাবাগণের বর্ণনা, তাবেঈন ও অন্যান্য মনীষীর উক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। ইবন হাজার আসকালানী (র), ইনুল ইমাদ আল-হাম্বলী (র) প্রমুখ ইতিহাসবিদ এই গ্রন্থের প্রশংসা করেছেন। বদরুদ্দীন আইনী (র) এবং ইবন হাজার আসকালানী (র) গ্রন্থটির সার-সংক্ষেপ রচনা করেছেন। বিজ্ঞজনদের মতে, এ গ্রন্থের লেখক ইবনে কাসীর (র) ইমাম তাবারী, ইবনুল আসীর, মাসউদী ও ইবন খালদুনের ন্যায় উচ্চস্তরের ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও ইতিহাসবেত্তা ছিলেন।
বিখ্যাত এ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রথম খণ্ড পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে আমরা আল্লাহ তা’আলার শুকরিয়া আদায় করছি। আমরা গ্রন্থখানির অনুবাদক ও সম্পাদকমণ্ডলীকে আন্তরিক মুবারকবাদ জানাচ্ছি। গ্রন্থটির প্রকাশনার ক্ষেত্রে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন তাদের সবাইকে মুবারকবাদ জানাচ্ছি।
পরম করুণাময় আল্লাহ তা’আলা আমাদের এ শ্রম কবুল করুন। আমীন!
মোঃ ফজলুর রহমান
মহাপরিচালক
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
❏ প্রকাশকের কথা
প্রথম মানব-মানবী হযরত আদম ও হাওয়া (আ) থেকে মানব সভ্যতার শুভ সূচনা হয়েছে। হযরত আদম (আ) ছিলেন মানব জাতির আদি পিতা এবং সর্বপ্রথম নবী। আল্লাহ তা’আলা মানুষ সৃষ্টির পর তাঁর বিধি-বিধান আম্বিয়া-ই-কিরামের মাধ্যমেই মানব জাতির কাছে পৌঁছিয়েছেন। নবী-রাসূলগণ সহীফা অথবা কিতাব নিয়ে এসেছেন। মানব ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা, আম্বিয়া-ই-কিরামের আগমন ও তাঁদের কর্মবহুল জীবন সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাই ইসলামের নির্ভুল ইতিহাস জানার জন্য কুরআন ও হাদীসই হলো মৌলিক উপাদান। আজ বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগেও কুরআন-হাদীসের তত্ত্ব ও তথ্য প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত।
আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর (র) কর্তৃক আরবী ভাষায় রচিত “আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া” গ্রন্থে আল্লাহ তা’আলার বিশাল সৃষ্টিজগতসমূহের সৃষ্টিতত্ত্ব ও রহস্য, মানব সৃষ্টিতত্ত্ব এবং আম্বিয়া-ই-কিরামের সুবিস্তৃত ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। ১৪ খণ্ডে সমাপ্ত এই বৃহৎ গ্রন্থটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় একটি ইতিহাস গ্রন্থ। লেখক গ্রন্থটি তিন ভাগে বিভক্ত করে রচনা করেছেন।
গ্রন্থের প্রথম ভাগে সৃষ্টিজগতের তত্ত্ব-রহস্যাবলী, আদম (আ) থেকে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) পর্যন্ত আম্বিয়া-ই-কিরামের ধারাবাহিক আলোচনা, বনী ইসরাঈল ও আইয়ামে জাহেলিয়াতের ঘটনাবলীর বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে নবী করীম (ﷺ)-এর ওফাতের পর থেকে ৭৬৮ হিজরী পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য খলীফা, রাজা-বাদশাহগণের উত্থান-পতনের ঘটনা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক বিষয়াবলীর সবিস্তার আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় ভাগে রয়েছে মুসলিম উম্মাহর অশান্তি ও বিপর্যয়ের কারণ, কিয়ামতের আলামতসমূহ, হাশর-নশর, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদির বিশদ বিবরণ। তাই ইসলামের ইতিহাস চর্চাকারীদের জন্য গ্রন্থটি দিক-নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
গ্রন্থটির গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সবগুলো খণ্ড অনুবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে গ্রন্থটির ৯ খণ্ডের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের সুবিধার্থে ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’র বাংলা নামকরণ করা হয়েছে “ইসলামের ইতিহাসঃ আদি-অন্ত”। গ্রন্থটির অনুবাদ ও সম্পাদনার সাথে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের সবাইর প্রতি রইলো আমাদের আন্তরিক মোবারকবাদ।
গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড ২০০০ সালে অনুবাদ ও সংকলন বিভাগ থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এর সকল কপি ফুরিয়ে যায়। ব্যাপক পাঠকচাহিদার প্রেক্ষিতে বর্তমানে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হলো।
আমরা আশা করি বইটি পূর্বের মতোই পাঠক মহলে সমাদৃত হবে। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টা কবুল করুন!
মোহাম্মদ আবদুর রব
পরিচালক, প্রকাশনা বিভাগ
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
❏ ক. রাজনৈতিক অবস্থা
ভূমিকা
হিজরী ৭ম শতাব্দীতে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অনেক বিপ্লবাত্মক ঘটনা সংঘটিত হয়। ৬৫৬ হিজরী/১২৫৮ খৃঃ সনে তাতারীরা বাগদাদ আক্রমণ করে এবং প্রায় বিশ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে।১ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ২১৫।] তাতার রাজবংশের উর্ধতন পুরুষ হালাকু খান।২[ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, পৃঃ ২৬২।] ২ লাখ যোদ্ধা নিয়ে হালাকু খান এই অভিযান পরিচালনা করে। শহরের পর শহর ও জনপদ ধ্বংস করে সে সদলবলে বাগদাদে এসে পৌঁছে। তাদেরকে প্রতিরোধ করার জন্যে বাগদাদে তখন মাত্র দশ হাজারের অধিক অশ্বারোহী সৈনিক ছিল না। অন্যান্য সৈনিক নিজ নিজ এলাকা ত্যাগ করে চলে যাবার পর এরাই কেবল অবশিষ্ট রয়েছিল। তাদের অনেকেই নিজ নিজ এলাকা থেকে উৎখাত হওয়ার পর তাদের অবস্থা এতই করুণ হয়ে দাঁড়ায় যে, বাজারে ও মসজিদের দরজায় দরজায় ভিক্ষাপ্রার্থী হয়। তাদেরকে লোকজনের করুণা ভিক্ষা করতে দেখা যায়।৩ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ২১৩।] উযীর ইবন আলকামী মুহাম্মদ ইবন আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন আলী ইবন আবী তালিবকে কেন্দ্র করে সন্দেহ আবর্তিত হয়ে থাকে। ইবন আলকামী ছিল খলীফা মুসতাসিম বিল্লাহর উযীর।৪ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ২২৫] তাতারদের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা ও হালাকু খাঁর সাথে তার ঘনিষ্ঠতাই এ সন্দেহের কারণ।
(১) খিলাফত
তাতাররা বাগদাদের শেষ আব্বাসী খলীফা মুসতাসিমকে হত্যা করে বাগদাদে আব্বাসী খিলাফতের অবসান ঘটায়।৫ [আল মুসতাসিম বিল্লাহঃ আবু আহমদ আবদুল্লাহ্ ইবন আল-মুসতানসির বিল্লাহ। জন্ম ৬০৯ হিজরীতে, খিলাফতের বায়আত ৬৪০ হিজরীতে। নিহত ৬৫৬ হিজরীতে। তখন তার বয়স হয়েছিল ৪৭ বছর। খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন ১৫ বছর।] তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে সক্ষম সকল নারী-পুরুষ, শিশু-যুবক ও বৃদ্ধকে তারা হত্যা করে। বাগদাদে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় বিশ লাখ।৬ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ২১৬।] কতক বিধর্মী, একদল ব্যবসায়ী এবং ইবন আলকামীর গৃহে আশ্রয় গ্রহণকারী লোকজন ও অল্প কিছু লোক ব্যতীত বাগদাদের কেউই রক্ষা পায়নি। একাদিক্রমে ৪০ দিন এই হত্যাযজ্ঞ চলে।
খলীফা মুসতাসিমের সাথে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আবুল আব্বাস আহমদ এবং মেজো পুত্র আবুল ফযল আবদুর রহমান নিহত হন। তিন বোনসহ তার ছোট ছেলে মুবারক বন্দী হন। রাজধানী থেকে প্রায় এক হাজার কুমারী মেয়েকে বন্দী করা হয়। নির্যাতনের ভয়াবহতা এত করুণ ছিল যে, রাজধানী থেকে এক একজন আব্বাসী লোককে ধরে আনা হত অতঃপর তার ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী-পরিজনসহ সবাইকে খিলাল কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হত। অতঃপর তাদের সম্মুখে বকরী জবাই করার মত তাকে জবাই করে দেয়া হত। তার কন্যা ও দাসীদের মধ্য থেকে যাদেরকে পছন্দ হত বন্দী করে নিয়ে যেত। এ পর্যায়ে তিন বছর পর্যন্ত খিলাফতের মসনদ খলীফা-শূন্য ছিল।
অবশেষে আবুল কাসিম আহমদ ইবন যাহিরের আবির্ভাব ঘটে। আবুল কাসিম ছিলেন খলীফা মুসতানসির বিল্লাহ-এর ভাই এবং বাগদাদের শেষ খলীফা মুসতাসিম বিল্লাহর চাচা। তিনি বাগদাদে বন্দী ছিলেন। পরে মুক্তি পেয়েছিলেন। এরপর তিনি মিসর, সিরিয়া ও আরব উপদ্বীপের কর্তৃত্বের অধিকারী যাহিরের নিকট যান।৭ [যাহির হল রুকনুদ্দীন বায়বার্স আল বুন্দুকদারী। সুলতান মালিক মুযাফফর কুতুযকে হত্যার পর লোকজন তাকে আল-মালিকু যাহির উপাধি প্রদান করে। ৬৫৮ হিঃ সনে তিনি মিসর গমন করেন এবং সিংহাসনে আরোহণ করেন। এক বছরের মধ্যে সিরিয়ার শাসন ক্ষমতা একে একে নাসির উদ্দীন ইবন আযীয তারপর হালাকু এবং তারপর মুযাফফর কুতুযের হাত বদল হওয়ার পর যাহির বায়বার্সের হাতে এসে স্থির হয়। অবশ্য আল মুজাহিদ নাম নিয়ে সানজার তার সাথে প্রথমে অংশীদারিত্ব নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যাহির-ই একচ্ছত্র সুলতানাতের অধিকারী হন।] সেখানকার কাজী সর্বপ্রথম তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তারপর যাহির, তার উযীরবর্গ ও অন্যান্য প্রশাসক তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মুসতানসিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা তার ভাই মুসতানসির বিল্লাহ-এর নাম অনুসারে তাকে মুসতানসির বিল্লাহ্ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এটি ৬৫৯ হিজরীর ঘটনা। তখন তিনি মালিকুয যাহিরকে ‘সুলতান’ মনোনীত করেন। তাঁকে কালো জুব্বার খেলাত গলায় মালা এবং তার পায়ে স্বর্ণের মল পরিয়ে দেয়া হয়। সচিব (রঈসুল কুত্তাব) খলীফার পক্ষ থেকে ‘সুলতান’ মনোনয়নের ঘোষণাপত্র পাঠ করে শুনালেন।৮ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়া নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ২৪৫।] এরপর খলীফা বাগদাদে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। সুলতান তাকে দশ লাখ স্বর্ণমুদ্রা উপঢৌকন স্বরূপ প্রদান করেন।৯ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়া নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ২৪৫।]
৬৬০ হিজরী সনের ৩রা মুহাররাম তাতারদের হাতে খলীফা নিহত হন। মালিকু যাহিরের সেনাবাহিনী পরাজিত হয় এবং এক বছর যাবত খলীফার পদ শূন্য থাকে। অবশেষে ৬৬১ হিজরী সনের১০ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়া নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ২৫০।] ২রা মুহাররাম হাকিম বি-আমরিল্লাহ আবুল আব্বাস আহমদ ইবন আবী আলী আল কাবী ইবন আলী ইবন আবী বকর ইবন মুসতারশিদ বিল্লাহ-এর বংশ পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তার হাতে বাইয়াত সম্পন্ন হয়। ৪০ বছর তিনি খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। ৭০১ হিজরীতে তিনি ইনতিকাল করেন। অতঃপর তার পুত্র মুসতাকফী বিল্লাহ খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি রীতিমত খিলাফতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ৭৩৭ হিজরী সনে সুলতান নাসির মুহাম্মদ ইবন কালাউন তাকে বন্দী করে এবং জনসাধারণের সাথে তার মেলামেশা নিষিদ্ধ করে দেয়। নজরবন্দী অবস্থায় ৭৪০ হিজরী সনে তার মৃত্যু হয়।
এরপর মুতাযিদ বিল্লাহ খিলাফতের মসনদে আসীন হন। ৭৬৩ হিজরী পর্যন্ত তাঁর খিলাফত অব্যাহত থাকে। তারপর মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ খলীফা নিযুক্ত হন। খলীফার দুর্বলতা ও শক্তিহীনতার বর্ণনা স্বরূপ আমরা উল্লেখ করছি যে, খলীফা মুসতাকফী বিল্লাহ্ তাঁর পরবর্তী খলীফারূপে তাঁর পুত্র আহমদ আবী রাবীকে মনোনীত করে যান। কিন্তু সুলতান নাসির তাতে বাদ সাধেন। বরং আবী রাবী-এর ভ্রাতুস্পুত্র আবু ইসহাক ইবরাহীমকে তিনি খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। তিনি খলীফাকে 'আল ওয়াছিক’ উপাধি প্রদান করেন। কায়রোতে এক জুমু’আর নামাযে তিনি খলীফার পক্ষে খুতবা দেন। অতঃপর মনসূর এসে ইবরাহীমকে বরখাস্ত করেন এবং আবুল কাসিমকে খলীফা নিযুক্ত করেন। মনসূর তাঁকে মুসতানসির বিল্লাহ্ উপাধি দেন।
যাহোক, কায়রোতে অবস্থানকালে আব্বাসী খলীফাগণ বাগদাদে অবস্থানের তুলনায় ভালই ছিলেন। চরম দুরবস্থার দিনেও সুলতানগণ কায়রোর খলীফাদেরকে দেশান্তরিত করতেন কিংবা বরখাস্ত করতেন মাত্র। কিন্তু অঙ্গ কর্তন কিংবা হত্যা করা পর্যন্ত তা গড়াতো না। ঘটনা পরম্পরায় এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, প্রথম দু’জন খলীফা তাদের নেতৃত্বে তাতারদের হাত থেকে বাগদাদ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য খলীফা এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেননি বিধায় এবং সুলতানগণ কর্তৃক মনোনয়ন ব্যতীত তাদের নিজস্ব কোন মান-মর্যাদা না থাকায় তাদের কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। এ সময়ে খিলাফতের পদবীটি একটি প্রতীকী ও ক্ষমতাহীন পদরূপে চিহ্নিত হয়ে থাকে। অবশেষে ১৫১৭ খৃঃ সুলতান সালীম উছমানী কায়রো আগমন করেন এবং খিলাফতের পদ অধিকার করেন। তিনি দাবি করেন যে, শেষ খলীফা তার সমর্থনে ঐ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।
❏ (২) সুলতানী শাসন
৬৭৬ হিজরী থেকে ৭৭৬ হিজরী পর্যন্ত মিসর, সিরিয়া ও মক্কা-মদীনায় ২১ জনের অধিক সুলতান রাজত্ব করেছেন। এ থেকেই সুলতান পদবীটির অস্থিরতা ও দুর্বলতার দিকটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত সুলতানগণ উচ্চপদস্থ আমীর-উমারা ও তুর্কী সেনাধ্যক্ষদের হাতের পুতুলে পরিণত হন। সুলতান পদবীটিও খলীফা পদের ন্যায় নামসর্বস্ব হয়ে পড়ে। উভয় পদই তখন নেহাৎ প্রতীকী রূপ ধারণ করে। প্রকৃত ক্ষমতা চলে যায় আমীর-উমারা ও নায়েবদের হাতে। সুলতানগণ তাদের ক্রীড়ানকে পরিণত হন। তারা যাকে ইচ্ছা ক্ষমতায় বসাত আর যাকে ইচ্ছা অপসারিত করত। অনেককেই নিতান্ত অল্প বয়সে সুলতান পদে বসানো হয়েছে। সুলতান মনসুর সালাহউদ্দীন মুহাম্মদ ইবন মুযাফফর হাজী সুলতান পদে আসীন হয়েছিলেন মাত্র ১২ বছর বয়সে।১১ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ-১৪, পৃঃ ২১৯।] শা’বান ইবন হুসায়ন যখন সুলতান হন তখন তার বয়স ১০ বছরের বেশি ছিল না।১২ [ ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ- ৩১৯।] আশরাফ নিহত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, নাসির মুহাম্মদকে সুলতান পদে বসানো হবে। তখন তিনি ৮ বছরের বালক মাত্র।১৩ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ৩৫৪।] এমনও দেখা যেত যে, কোন কোন আমীর রাতে গৃহবন্দী হয়ে ঘুমোতেন আর ভোরে তিনি সুলতান পদে আসীন হতেন। আবার রাতে ঘুমোতেন নতুনভাবে গৃহবন্দী হয়ে। যেমন ঘটেছিল হুসায়ন নাসিরের ক্ষেত্রে। সেনাবাহিনীর একটি অংশ তাঁকে মিসরের সুলতান পদে অধিষ্ঠিত করে। এরপর তাদের নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এবং তারা পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হয়। ফলে শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং হুসায়নকে ঐ প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি ইতিপূর্বে বন্দী ছিলেন।১৪ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২১৯।] পরিস্থিতি এমন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যে, এখন গায়ে উকুন ভর্তি ও নোংরাদেহী কোন ক্রীতদাসও যদি সুলতান পদে আসীন হওয়ার স্বপ্ন দেখতো তাহলে অনায়াসেই তাও বাস্তবায়িত হতো, যেমন ঘটেছিল সুলতান কুতুযের ক্ষেত্রে।১৫ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ২৩৫।]
❏ (৩) প্রধান প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা
প্রথম ঘটনাঃ তাতারদের ধ্বংসলীলা মধ্যপ্রাচ্যের জন্যে ফিরিঙ্গীদের (ইউরোপীয় খৃস্টানদের) সাথে গোপন আলোচনার পথ খুলে দেয় এবং অবশিষ্ট আব্বাসী খিলাফত ও স্বাধীনতা রক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। বাগদাদ ও দামেশকে সংঘটিত মহা ধ্বংসযজ্ঞের পর বিজয়ীদের জন্যে অন্ধকারের সূচনা হয়। তাতার রাজারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং সুন্নত অনুসারে জীবন যাপনে প্রয়াসী হয়। তাদের রাজন্যবর্গও এতদঞ্চলের রাজাদের ন্যায় হয়ে যায়। তারা আলোচনা সভা অনুষ্ঠান করতেন। তারা কখনো রোমানদের সাথে যুদ্ধ করতেন আবার কখনো রাজত্বের খাতিরে সন্ধি ও করতেন। অতঃপর উপহার-উপঢৌকন বিনিময় করতেন।
দ্বিতীয় ঘটনাঃ জনপদসমূহকে ক্রুসেড আক্রমণের প্রভাবমুক্ত করা। এ সূত্রে রাজা যাহির বায়বার্স কায়সারিয়্যাহ্, আরসূর্ণ, ইয়াফা, শাকীফ, এন্টিয়ক, তাবারিয়্যা, কাসীর, কুর্দীদের দুর্গ, আক্কা দুর্গ, গারীন ও সাফীতা দুর্গ উদ্ধার করেন। মারকাব, বানিয়াস, এন্টারতোস অঞ্চল আধাআধি ভাগে ভাগ করে নেন। যেমনটি সাইফুদ্দীন কালাউস ত্রিপোলী শহর এবং আশরাফ খলীল ইবন কালাউন আক্কা অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেছিলেন। সূর ও সায়দা অঞ্চল দু’টির কর্তৃত্ব আশরাফের হাতে সোপর্দ করে। অতঃপর তিনি আক্রমণ চালিয়ে ফিরিঙ্গীদের কবল থেকে উপকূলবর্তী অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন।
তৃতীয় ঘটনাঃ ৭৩৬ হিজরীতে তাতারদের পতন। তাতার রাজা আবু সাঈদ খয়বান্দা ইবন আরগুন ইবন আগা ইবন হালাকু ইবন তূল ইবন চেঙ্গীস খান-এর মৃত্যুর সাথে সাথে তাতারদের পতন ঘটে। তার সম্পর্কে ইবন কাছীর (র) মন্তব্য করেছেন, “তিনি ছিলেন তাতার রাজদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক, সর্বোত্তম পন্থার অনুসারী এবং সুন্নত অনুসরণে সর্বাধিক দৃঢ়। তার শাসনামলে আহলুস্ সুন্নাহ সম্প্রদায়ের উন্নতি হয় এবং রাফেযীগণ লাঞ্ছিত হয়। তাঁর পিতার শাসনামলে এর বিপরীত ঘটেছিল। তার পরে তাতারী শাসন অক্ষুন্ন রাখার জন্যে কেউ মাথা তোলেনি। বরং তারা নিজেরা পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।১৬ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৮২।] ইবন কাসীর (র) অন্যত্র বলেছেন, “রাজা আবু সাঈদ তাঁর পিতা খরবান্দার পরে শাসনভার গ্রহণ করেন। ১১ বছর বয়সে তিনি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি ন্যায়বিচার ও সুন্নত প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দেন। ফলে সকল প্রকারের বিশৃংখলা, অনাচার ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত স্তিমিত হয়ে পড়ে।১৭ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৭৯।] অবশ্য কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোকে আমরা উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে গণ্য করি না। এতদ্বারা আমরা সে সকল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বুঝাচ্ছি যা বিভিন্ন গোত্র ও ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ ও ফিরিঙ্গীদের মধ্যে স্থাপিত হয়। এর একটি হল দামেশক অধিপতি সালিহ ইসমাঈল কর্তৃক সায়দা ফিরিঙ্গীর নিকট সাকীফ আরনূন দুর্গ অর্পণ করা। খতীব শায়খ ‘ইযযুদ্দীন ইবন আবদুস সালাম ও মালেকী সম্প্রদায়ের শায়খ আবু আমর ইবন হাজেব। সুলতানের এই সন্ধি ও হস্তান্তর প্রক্রিয়ার তীব্র বিরোধিতা করেন। ফলে সুলতান এদের দু’জনকে কারারুদ্ধ করেন এবং পরবর্তীতে ছেড়ে দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখেন।১৮ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ১৬৬।]
এ বিষয়ে অপর একটি ঘটনা হচ্ছে দুই মিত্র শক্তির উত্থান। এক পক্ষে ছিল ফিরিঙ্গীরা, দামেশক অধিপতি সালিহ, কুর্ক অধিপতি নাসির দাউদ এবং হিমস অধিপতি মনসুর। অন্য পক্ষে ছিল খারিযিমিয়্যাহ ও মিসর অধিপতি সালিহ আইয়ুব।১৯ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ১৭৫ - ১৭৬।] ফিরিঙ্গী ও তাদের মুসলিম মিত্রদের মধ্যে অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়।
পরবর্তী সময়ে মৈত্রী সম্পর্কের অবনতি ঘটে। প্রথম পক্ষে আসে ফিরিঙ্গীরা ও মিসরীয় সৈন্যগণ আর দ্বিতীয় পক্ষে থাকেন সিরিয়া অধিপতি ও বাগদাদের আব্বাসী খলীফা। খলীফা তখন মিসরের সুলতান ও সিরিয়ার সুলতানের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার জন্যে শায়খ নাজমুদ্দীন বাদরাঈকে প্রেরণ করেন। তখন উভয় পক্ষের সৈন্যগণ প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তিনি উভয় পক্ষের মাঝে বিরোধ মীমাংসা করে সন্ধি স্থাপন করে দিলেন। মিসরীয় সৈনিকগণ তখন ফিরিঙ্গীদের (ইউরোপীয় খৃস্টানদের) দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এবং যুদ্ধে ফিরিঙ্গীদের সাহায্য কামনা করেছিল। তারা ফিরিঙ্গীদের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় যে, ফিরিঙ্গীরা যদি তাদেরকে সিরিয়ার বিরুদ্ধে সাহায্য করে তবে বায়তুল মুকাদ্দাস তাদের হাতে সোপর্দ করা হবে।২০ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ১৯৬।]
অন্যান্য আরও কতক গোত্র ফিরিঙ্গীদের প্রতি আসক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। যেমন ঘটেছিল সুলতান আশরাফ খলীলের ক্ষেত্রে। পূর্ব থেকেই ফিরিঙ্গীদের সাথে তাদের সম্পর্ক থাকার কারণে তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাসরাওয়ান পর্বত ও জুরাদের দিকে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
তার সেনাবাহিনীর সেনাপতিত্বে ছিলেন বুনদার। আর তার সহযোগিতায় ছিল শানকার আল-আশকার।২১ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, পৃঃ ৩৪৬, ৩৪৭।] মুসলিম রাষ্ট্রের শাসকগণ ফিরিঙ্গীদের সাথে উপহার-উপঢৌকন বিনিময় করতেন। ফিরিঙ্গী রাজার দূত যখন আশরাফের সাথে সাক্ষাত করতে এসেছিল, তখন তার সাথে ছিল সাদা পশম বিশিষ্ট একটি বিরল প্রজাতির ভল্লুক, যার লোম ছিল সিংহের লোমের ন্যায়।২২ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৩, ১৫১।] ফিরিঙ্গীদের ও কতক শাসকের মধ্যকার এই সুসম্পর্কপূর্ণ মৈত্রী ও উপঢৌকন বিনিময় ছিল অনেকটা বিরল ঘটনা। তার তুলনায় তাদের বিরুদ্ধে জিহাদী তৎপরতা ছিল অনেক বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী। প্রকাশ থাকে যে, এসব সম্পর্ক স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজত্ব দখলের লড়াইয়ে আপন ভাইয়ের বিরুদ্ধে বহিঃশত্রুর সাহায্য গ্রহণ ও শক্তি সঞ্চয় করা। সুতরাং এসব মৈত্রী চুক্তি ছিল একান্তই আত্মরক্ষার প্রয়োজনে।
❏ (৪) অশান্তি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা
সে যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল ভয় ও ত্রাস। সে ভীতি ও ত্রাসের উৎস ছিল তাতাররা। বছরের পর বছর ধরে উত্তাল তরঙ্গের মত তারা হানা দিতে থাকে।
ইবন কাছীর (র) মানুষের এই সন্ত্রস্ত ভাবকে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “সংবাদ প্রচারিত হল যে, তাতাররা সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং তারা মিসরেও হানা দেবে। ফলে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠে এবং তারা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায়। তারা পালাতে থাকে মিসরের ছোট ছোট শহর, কুরক, শূবাক ও সংরক্ষিত দুর্গগুলোর দিকে। উট বিক্রি হতে লাগল হাজার দিরহামে, গাধা পাঁচশ’ দিরহামে এবং গৃহের আসবাবপত্র ও খাদ্য-সামগ্রী পানির দরে বিক্রি হতে লাগল। শহরে ঘোষণা দেয়া হল—কেউ যেন পরিচয়পত্র ছাড়া পথে বের না হয়। পরে সংবাদ এল যে, মিসরের সুলতান শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে সিরিয়া অভিমুখে বের হওয়ার পর পুনরায় মিসর ফিরে এসেছেন। এতে ভীতি আরো বহুগুণ বেড়ে গেল এবং অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ল। এদিকে খাদ্যাভাব, অতি বর্ষণ, প্রচণ্ড শীত, ক্ষুধা ও আকালের কারণে পশুপাল দুর্বল ও ক্ষীণ হয়ে পড়ে।"২৩ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৫, ১৬।]
তাতারদের ত্রাস এই ভীতিকে আরও তীব্রতর করে তোলে। তারা লাখ লাখ লোককে জবাই করে। বাড়িঘর ও প্রাসাদ-অট্টালিকা ধ্বংস করে, ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে এবং গাছপালা নির্মূল করে। তাতারদের ‘কাতীআ’ অঞ্চলে উপস্থিতি ইবন কাসীর (র) এভাবে বর্ণনা। করেছেনঃ “তাতাররা যখন দামেশকের নিকটবর্তী ‘কাতীআ’ অঞ্চলে পৌঁছে, তখন কাতীআ ও তার আশে-পাশে কোন লোক ছিল না। শহর ও দুর্গসমূহ লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। বাড়িঘর ও পথে-ঘাটে ভিড় জমে গেল। শহরে তখন কোন শাসক ছিল না, চোর-ডাকাতরা শহরে ও বাগ-বাগিচায় ঢুকে পড়ে। তারা সবকিছু ভেঙ্গে-চুরে দুমড়ে-মুচড়ে বিধ্বস্ত করে দেয় এবং যতটুকু পারল লুটপাট করে নিয়ে গেল। খুবানী, গম ও সকল শাক-সবজি সময়ের পূর্বেই কেটে তুলে নিয়ে যায়।"২৪ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২৪।]
এ ভীতি তাতারদের সৃষ্ট সন্ত্রাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তাতাররা এবং ফিরিঙ্গীরা উভয় দলই এই ধ্বংসযজ্ঞে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশগ্রহণ করে। তাতাররা যা করেনি ফিরিঙ্গীরা তা ষোলকলায় পূর্ণ করে। তারা ৭৬৭ হিজরীতে আলেকজান্দ্রিয়ায় অভিযান পরিচালনা করে এবং ৪০০০ লোককে বন্দী করে এবং সাধ্যমত ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে সমুদ্রপথে নিয়ে যায়। চারদিকে তখন শুধু ক্রন্দন, আর্তনাদ, হাহাকার, আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ ও আশ্রয় প্রার্থনা, হৃদয়বিদারক আহাজারী যা দেখে চোখ অশ্রুসজল হয় আর কান বধির হয়ে যায়।২৫ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৩২৮।] ভয় শুধু বহিরাগত শত্রুদের পক্ষ থেকে ছিল না, অভ্যন্তরীণ অশান্তি ও বিপর্যয়ের ভয়ও ছিল। উদাহরণ স্বরূপ হাম্বলী সম্প্রদায় ও শাফিঈ সম্প্রদায়ের মধ্যে আকীদা সম্পর্কিত বিষয়ে সংঘটিত দাঙ্গাহাঙ্গামার উল্লেখ করা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি দামেশকে পর্যন্ত গড়ায় এবং উভয় পক্ষ নায়েবে সুলতান ‘টাংকর’-এর দপ্তরে উপস্থিত হয়। তিনি তাদের মধ্যে আপস রফা করে দেন।২৬ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৭৭।]
নিরীহ মানুষদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখার ক্ষেত্রে উগ্রপন্থী দলগুলোর প্রভাব ছিল। এসকল দলের বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করার ব্যাপারে গভর্নরদের কোন গরজ ছিল না। তবে শাংকল মাংকল একবার দুরান অঞ্চলে ওদের একটি দলের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তিনি তাদেরকে পরাজিত করেছিলেন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসাবে তাদের খণ্ডিত শিরগুলো বুসরার প্রাচীরের ওপর ঝুলিয়ে রেখেছিলেন।২৭ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২৭৭, ২৭৮।]
এ সময়ে শুধু অশান্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও গুপ্তঘাতকদের ভীতি ছিল তা নয় বরং তখন একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ঘটেছিল। কখনো কখনো দলে দলে পঙ্গপাল উড়ে এসে ক্ষেত-খামার ও ফলমূল, বৃক্ষের পাতা খেয়ে নিঃশেষ করে দিত। তখন পত্র-পল্লবহীন গাছগুলো লাঠির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকত। মানুষের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল আর মৃত্যু চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সাথে সাথে ভূমিকম্পে মানুষের বাড়িঘর ও যানবাহন ধ্বংস এবং অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হচ্ছিল। এর সাথে প্রলয়ঙ্করী বন্যা ও প্লাবন দেখা দেয় ফলে শহর ও নগর ধ্বংস হয় এবং প্রচুর প্রাণহানি ঘটে। নীলনদ থেকে বাঁধভাঙ্গা জোয়ার উঠে পানিতে শহর-নগর ডুবে যায় এবং বহু লোকজন মারা যায়। প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এটি সংক্রামিত হতে থাকে শহর থেকে শহরে, নগর থেকে নগরে। ফলে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং এতে মানুষের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে।
❏ খ. অর্থনৈতিক অবস্থা
দ্রব্যমূল্য, আমদানী-রপ্তানী ও রাষ্ট্রীয় কর
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম অস্থিরতা চলছিল। বহির্বাণিজ্য পাশ্চাত্যবাসীদের হাতে চলে যায়। কারণ, তখন ইউরোপীয়রা সিরিয়ার সাথে যুদ্ধ করে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল নিজেদের করায়ত্ত করে নেয়। দুই যুগের অধিককাল ধরে তারা এটি নিজেদের করতলগত রাখতে সমর্থ হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিয়মিতভাবে নদী খনন না করা এবং পানি সেচ ও ভূমি উন্নয়নের ব্যবস্থা না করার কারণে কৃষিপণ্যের ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও বিশৃংখলার কারণে গ্রাম ও জনপদগুলো বিরান হয়ে যাচ্ছিল। সাথে সাথে যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে এবং আমির-উমারাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্যে অর্থ সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানী বৃদ্ধি করতে হয়েছিল। কিন্তু সে তুলনায় আমদানী ছিল কম।
বিপ্লবোত্তর যুগে পালিয়ে যাওয়া আমীর-উমারা, বরখাস্তকৃত নায়েবরা এবং সচিব ও আমলারা ফিরে আসে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা জনসাধারণ থেকে সম্পদ দাবি করে।২৮ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৬৯, ১৭৭।] সুলতানের নায়েবগণ কোন কোন ক্ষেত্রে গত তিন বছরের বকেয়া কর কিংবা ৪ মাসের খাজনা অগ্রিম দাবি করে বসে।২৯ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৫।]
রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসায়-বাণিজ্যের মন্দাভাব এবং কৃষিপণ্যের উৎপাদনহীনতা দেশকে দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতির দিকে ঠেলে দেয়। তখন একজোড়া ভেড়ার বাচ্চা বিক্রি হত। ৫০০ দিরহামে।৩০ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৭।] একটি গারারার (এক বস্তা খাদ্যবস্তুর) দাম পৌঁছেছিল ২২০ দিরহামে। অনেক সময় রুটির অভাব দেখা দিত। ফলে কাঠের গুঁড়ি মিশ্রিত ভেজাল যবের রুটিও বিক্রি হতো। এক রতল (এক রতল হচ্ছে প্রায় এক পাউণ্ড বা আধা কেজি।) পরিমাণ যায়তুনের তেল বিক্রি হত ৪.৫০ দিরহামে। সাবান ও চাউলের মূল্যও অনুরূপ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কোন কিছুই জনগণের ক্রয়ক্ষমতার আওতার মধ্যে ছিল না। তবে গোশত বিক্রি হত ২.২৫ দিরহামে। এক সের মিহি ময়দা বিক্রি হত ৪ দিরহামে। আঙ্গুর রসের দাম ছিল এক কিনতার (কিনতার=১০০ রতল যা ১মণের অধিক।) ২০০ দিরহামের উপরে। চাউলের দাম ছিল আরো বেশি।৩১ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১১৭, ১৮৩, ২১৯, ২২০, ২২৩।] তবে সুলতান নাসিরের শাসনামলে কিছুটা সচ্ছলতা ও উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। ৭২৪ হিজরী সনে সুলতান নাসির খাদ্য শস্যের কর রহিত করে দেন। তখন সমগ্র খাদ্যশস্য সিরিয়ায় সংরক্ষিত ছিল। ফলে সুলতানের কল্যাণের জন্যে অনেকেই দু’আ করেন।৩২ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১১৫।]
সুলতানের নায়েবও তখন বহু কর রহিত করে দেন। তার মধ্যে রয়েছে গো-খাদ্যের কর, দুধ-কর এবং চামড়ার উপর কর। বাজার পরিদর্শকদের থেকে অর্ধ দিরহামের অতিরিক্ত যে কর নেয়া হত তা তিনি বাতিল করে দেন। লাশ দাফন-কাফনে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আয় থেকে যে কর নেয়া হত তাও তিনি বাতিল করে দেন। অপরিপক্ক খেজুর বিক্রয়ের বিধি-নিষেধ তিনি প্রত্যাহার করেন। ফলে জিনিসপত্র অনেকটা সস্তা হয়ে যায়। এমনকি তখন বলা হত যে, এক কিনতার* খাদ্যশস্য বিক্রি হত ১০ দিরহামে।৩৩ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৯০।]
পরবর্তীতে লবণ-কর এবং প্রাসাদ-করও রহিত করলেন।৩৪ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২৯৩।] অনুরূপভাবে ছাগল-ভেড়ার করের অর্ধেক প্রত্যাহার করে নেন, যেমন করেছিলেন স্থানীয় ও বিদেশী সুতার করের ক্ষেত্রে। ফলে জনগণ আনন্দিত হয়।৩৫ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৩২৭।] ঐ আমলটি রাজকীয় বিলাস-ব্যসনের জন্য চিহ্নিত হয়ে আছে অবশ্য, যদিও তখন জনগণ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় আর্ত-চীৎকার করছিল। তখন ৭৩২ হিজরী সনে সুলতান মালিক নাসিরের পুত্র আনুক মুহাম্মদের সাথে আমীর সাইফুদ্দীন বাজামার আস-সাকীএর কন্যার বিবাহ হয়। ঐ বিবাহে যৌতুক ছিল দশ লাখ দীনার। এই বিবাহ ভোজে বকরী, মুরগী ও ঘোড়া-গরু মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার প্রাণী যবেহ করা হয়েছিল। ১৮ হাজার কিনতার মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়েছিল। আলোকসজ্জায় তিন হাজার কিনতার তৈলাদি পোড়ানো হয়েছিল।৩৬ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৬৫।]
❏ গ. শিক্ষা ব্যবস্থা
ঐ যুগে যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিদ্যা চর্চার ব্যাপক প্রচলন ছিল, তখনই ‘জাহিয’ শিক্ষক শ্রেণীর সমালোচনা করেন এবং তাদের দোষ-ক্রটি বর্ণনা করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্লথ গতি ও মন্দাভাবের আমলে অবস্থা যে কত শোচনীয় ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
সে যুগের শিক্ষকদের দুরবস্থা সম্পর্কে অবগতির জন্যে আমরা ইবন কাসীরের বক্তব্যটুকু উদ্ধৃত করছি, যা তিনি শায়খ মুহাম্মদ ইবন জা’ফর ইবন ফিরআউনের জীবনী বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রায় চল্লিশ বছর পর্যন্ত শায়খ মুহম্মদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। আমি তার নিকট একাধিক বিষয়ে পড়াশুনা করেছি। ছোট ছোট ছেলেদেরকে তিনি কঠিন কঠিন বর্ণগুলো শিক্ষা দিতেন। যেমন ‘রা’ ইত্যাদি। তার কোন সঞ্চয় ছিল না। ছিল না কোন বাসগৃহ বা ধনসম্পদ। খাবারের দোকান থেকে কিনে খেতেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়েই রাত্রি যাপন করতেন।৩৭ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১১৮।]
শিক্ষকদের দুরবস্থার কথাটা আরও পরিষ্কার হয় যখন আমরা অবগত হই যে, সেযুগে মাদ্রাসার একজন ছাত্রের মাসিক বৃত্তি ছিল ১০ দিরহাম। উচ্চতর শ্রেণীর ছাত্রদের বৃত্তি ছিল ২০ দিরহাম এবং একজন শিক্ষকের বেতন ছিল ৮০ দিরহাম।৩৮ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৩৩৬।] এটি সে সময়ে যখন একটি ছাগল-ভেড়ার বাচ্চার দাম ছিল ২৫০ দিরহাম।৩৯ [ ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৩২৫।] অন্য কথায়, এর মূল্য ছিল একজন শিক্ষকের মাসিক বেতনের তিনগুণ। সম্ভবত এটিই ছিল অধঃপতনের যুগে শিক্ষার মন্দা বাজার কথিত সোনালি বাণীর বাস্তব উদাহরণ।
❏ যুগের বৈশিষ্ট্যাবলী
(১) এ যুগের শিক্ষা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন
জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রসমূহঃ শিক্ষা কেন্দ্রসমূহ বাগদাদ, বসরা, কূফা ও মদীনা থেকে দামেশক, কায়রো, কুদস, আলেকজান্দ্রিয়া, হামাত, হালাব, আলেপ্পো, হিমস, উসুয়ূত ও ফায়্যুম নগরীসমূহে স্থানান্তরিত হয়। ফলে জ্ঞানার্জনকারীদের উপাধির বহর বেড়ে যায়। যথা——দিমাশকী, হালাবী, কাহেরী, ফায়ুমী, ইস্কান্দরী, মাকদেসী, হামাবী, সুয়ুতী ও হিমসী ইত্যাদি। এই যুগে কায়রো সেই ভূমিকা পালন করছে, যা ইতিপূর্বে বাগদাদ পালন করতো। ফলে আলিম-উলামা ও কবি-সাহিত্যিকগণ কায়রোতে ভিড় জমান।
(২) সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে শাসকবর্গের মনোযোগ প্রত্যাহৃত হল। লেখককে তার গ্রন্থের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে পুরস্কৃত করার সেই যুগটি গত হয়ে যায়। খুব অল্প সংখ্যক সুলতান, আমীর, উযীর ও খলীফাই জ্ঞানার্জনের প্রতি, আলিম লোকদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রতি অথবা কবিতা শ্রবণে তৃপ্তিলাভের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। তাঁরা আরবী সাহিত্যের স্বাদ কী করে আস্বাদন করবেন—যেখানে আরবী ভাষায় তাদের কোন ব্যুৎপত্তিই ছিল না। অবশ্য তাদের কেউ কেউ ইতিহাস শাস্ত্রের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। ফলে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় কতক ইতিহাস গ্রন্থ ও বিশ্বকোষ রচিত হয়েছিল।
(৩) ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানের উৎকর্ষ
ইবন খালদূনের 'মুকাদ্দমা’ গ্রন্থটি এ শাস্ত্রের শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থ। ইতিহাস দর্শনের গুরুত্ব ইবন খালদুন যথার্থরূপে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন কোন বিশেষ শাস্ত্রের তত্ত্বানুসন্ধানীর জন্যে তার ঘটনা প্রবাহ লেখাই মুখ্য কাজ নয় বরং তার কাজ হল শাস্ত্রের স্থান ও তার প্রকারভেদ নির্ণয় করা। পরবর্তী লেখকগণ সে অনুসারে ক্রমান্বয়ে ঘটনাবলী ও তথ্যাদি সন্নিবেশিত করবেন, যাতে এক সময় এই শাস্ত্র পূর্ণতা লাভ করতে পারে। তখন অবশ্য রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামরিক জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও প্রসার লাভ করে।
(৪) গ্রন্থাগার ও ঘরবাড়ি ধ্বংস
বড় বড় গ্রন্থাগারের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল। কারণ বাগদাদ লুণ্ঠনের সময় মোগল ও তাতাররা গ্রন্থাগারগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিল এবং নদীবক্ষে নিক্ষেপ করেছিল। তদ্রপ স্পেন অধিকার করার পর সেখানকার অধিবাসীরা সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছে। ইসলামী উপদলগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলশ্রুতিতেও বহু মূল্যবান গ্রন্থ বিনষ্ট হয়েছিল। যেমন মাহমুদ গযনবী, মুতাযিলাদের কিতাবগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে সবচাইতে প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়েছিল তাতারদের হাতে। তারা নরহত্যায় মেতে উঠেছিল, ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছিল, বইপত্র পুড়িয়ে দিয়েছিল এবং যেগুলো তারা লুট করে নিতে পারেনি, সেগুলো নষ্ট করে দিয়েছিল।
(৫) সঙ্কটকালে মানুষ ধর্মের আশ্রয় খোঁজে
আরবগণ পশ্চিমাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেনবাসীরা আন্দালুস পুনঃ অধিকার করে নিল। মোগলরা শহরের পর শহর ধ্বংস করে দিল এবং মোগল, তুর্কী ও বর্বররা শহরগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিল। অবশ্য কতক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য আরব সুলতানদের হাতে রয়ে যায়। যেমন ঘটেছে ইয়ামানে ও মাগরিবে।(মরক্কো-তিউনিসিয়া অঞ্চল।) তখন মুক্তির আশায় মানুষ ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ পর্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পশ্চাৎমুখিতা দেখা দিল এবং কতক লোক বাজে বিষয়াদি ও কিসসা কাহিনীর প্রতি ঝুঁকে পড়ল। যেমন ঘটেছিল মহাকাশ বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র ও রসায়ন শাস্ত্রের ক্ষেত্রে।
(৬) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা
মামলুক সুলতানদের আমলে মিসর ও সিরিয়ায় বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সে সময়ের কথা যখন মামলুক সুলতানগণ ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত মোগল আধিপত্যের প্রভাবাধীন ছিল।
আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থের ১৪তম খণ্ডে প্রায় ৮০টির অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর প্রধানগুলো ও সিংহভাগই ছিল সিরিয়াতে আর অবশিষ্টগুলো কুদস, হালাব, বাআ’লবাক, হিমস, হামাতু ও কায়রোতে ছিল।
ইবন কাসীর (র) কায়রোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা উল্লেখে তেমন কোন গুরুত্ব দেননি। এ কারণে যে, এ গ্রন্থটি হল ইবন আসাকির (র)-এর লিখিত 'তারীখে দামেশক’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট গ্রন্থ। তদুপরি জীবনের বিভিন্ন শাখায় অধঃপতনের প্রেক্ষিতে অধঃপতিত যুগ হিসেবে চিহ্নিত এ যুগের সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আধিক্যের তথ্যটি সামঞ্জস্যশীল মনে হয় না। তবে মোগলদের ধ্বংসযজ্ঞের মুখে বহু বড় বড় আলিম-উলামা সিরিয়া ও মিসরে পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে এতদঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাধিক্যের তথ্যটি সত্য প্রতীয়মান হয়। তদুপরি নুরুদ্দীন জঙ্গীর শাসনামল থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যে প্রচুর সম্পত্তি ওয়াকফ করার বিষয়টিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাধিক্যের সত্যতার প্রমাণ করে। তৃতীয়ত, এ সময়ে শাফিঈ, হানাফী, হাম্বলী ও মালেকী মাযহাব অনুসারীদের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। এই তিনটি কারণে সে যুগে প্রচুর সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল কুরআন ও হাদীস শিক্ষা দেয়া। চিকিৎসা শাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব ও অন্যান্য শাস্ত্রের প্রতি তখন গুরুত্ব কম ছিল।
(৭) জ্ঞান চর্চা শিক্ষকদেরকে উচ্চ পদের যোগ্য করে তোলে
বহু শিক্ষক, উযীর, নায়েব ইত্যাদি বড় বড় প্রশাসনিক পদের তুলনায় কাযী, মুফতী, খতীব, শায়খ, ইমাম, বায়তুল মালের কার্যনির্বাহী, ভাণ্ডার পরিদর্শক, রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণাগার পরিদর্শক, দফতরাদি পরিদর্শক, হিসাবরক্ষক, ইয়াতীমদের পরিদর্শক, গ্রন্থাগার পরিদর্শক, ওয়াকফ স্টেট পরিদর্শক ও কারামুক্তি প্রার্থী দফতরের পরিচালক পদে অধিকসংখ্যক নিয়োগ লাভ করেন।
❏ ইবন কাসীর (র)-এর জীবনী
(ক) ব্যক্তি পরিচয়
তার নাম ইসমাঈল ইবন উমর ইবন কাসীর ইবন দূ ইবন কাসীর ইবন দিরা আলকুরায়শী। তাঁর খান্দানটি কুরায়শের বনী হাসালা শাখা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। সম্ভ্রান্ত গোত্ররূপে এ গোত্রটির খ্যাতি রয়েছে। তাদের বংশ লতিকা সংরক্ষিত রয়েছে।
আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক আল মিযযী এ বংশ লতিকার কিছু অংশ সম্পর্কে অবগতি লাভ করেছেন— যদ্দরুন তিনি আনন্দিত হন ও অনেকটা বিস্ময়বোধ করেন। এ জন্যে তিনি আমার বংশ তালিকায় ‘আল কুরায়শী’ উপাধি লেখা শুরু করেন।৪০ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৩২।]
আমার নিকট এটি ইবন কাসীর (র)-এর বিশুদ্ধতম বংশ তালিকা। কারণ, ইবন কাসীর (র) তার ইতিহাস গ্রন্থ 'আল-বিদায়া ওয়ান্ নিহায়া’তে নিজে এটি উদ্ধৃত করেছেন। এজন্যে তার নাম ও বংশ পরিচয়ে যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে সে সম্পর্কে আমরা আলোকপাত করবো না।৪১ [ইবন হাজর, আদদুররুল কামিনা, খঃ ১, পৃঃ ২৯৯, ৩৭৭। দাউদী, তাবাকাতুল মুফাসসিরীন, খঃ ১, পৃঃ ১১০। যাহাবীঃ তাবাকাতুল হুফফাজ পৃঃ ৫৭, যিরকানী আল-আলম, খঃ ১, পৃঃ ৩২০।] কারণ যার সম্পর্কে এসব বিবৃতি তার সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিপরীতে অন্য সব তথ্য একেবারে গুরুত্বহীন।
জন্মঃ ৭০১ হিজরী সনে ইবন কাছীর (র) জন্মগ্রহণ করেন। যেমনটি ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’তে তিনি উল্লেখ করেছেন।৪২ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২২।] এ থেকে তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে যে মতপার্থক্য ছিল তার নিরসন হল।৪৩ [ইবন কাসীর, উমদাতুত্ তাফসীর (আল মুকাদ্দামা) খঃ ১১, পৃঃ ২২। যারকানী, আল ইলাম, খঃ ১: পৃঃ ৩৭।] তাঁর জন্মস্থান ছিল 'বুসরা’(বর্তমানে উযা হুরান নামে পরিচিত।)-এর অন্তর্গত ‘মিজদাল’ নামক জনপদে। ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে তাঁর জন্মস্থান ‘মুজায়দিল’ বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।৪৪ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ১৪, পৃঃ ৩২।] যতদূর মনে হয় ভুলক্রমেই এমনটি লিখিত হয়েছে।
তাঁর পিতাঃ তার পিতা হলেন খতীব শিহাবউদ্দীন আবু হাফস উমর ইবন কাসীর। তিনি বসবাস করতেন বুসরা নগরীর পশ্চিমে অবস্থিত ‘শারকাবীন’ গ্রামে। বসরা ও শারকাবীনের দূরত্ব খুবই সামান্য। খতীব শিহাবউদ্দীন ৬৪০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতুল গোত্র বনু উকবায় তিনি বিদ্যার্জনে ব্রতী হন। তিনি চমৎকার কবিতা লিখতেন। বুসরার আন্নাকা অঞ্চলের বিদ্যালয়সমূহে তিনি লেখাপড়া করেন। তারপর বুসরার পূর্বদিকে অবস্থিত খিতাবা জনপদে চলে যান। তিনি শাফিঈ মাযহাব অবলম্বন করেন এবং ইমাম নওয়াবী ও ইমাম গাযারীর নিকট বিদ্যা শিক্ষা করেন। তিনি সেখানে প্রায় ১২ বছর অবস্থান করেন। এরপর ফিরে আসেন ‘মিজদাল’-এ। এখানে তার বিবাহ হয়। আবদুল ওহহাব, আবদুল আযীয ও ইসমাঈল নামক তিন পুত্রের জন্মের পর তার কয়েকজন কন্যা সন্তানও জন্মগ্রহণ করে। এছাড়া ইউনুস ও ইদ্রীস নামক দুই পুত্রও জন্মগ্রহণ করে। ইবন কাসীরের পিতার একটি প্রসিদ্ধ জীবনালেখ্য 'আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।৪৫ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ১৪, পৃঃ ৩৩।] ৭০৩ হিজরীতে মুজায়দিলে ইবন কাছীরের পিতার ইতিকাল হয়। তখন ইসমাঈল-এর বয়স প্রায় তিন বছর।
❏ (২) শৈশব ও যৌবন
ইবন কাসীর (র)-এর সহোদর আবদুল ওহহাব ৭০৭ হিজরীতে সপরিবারে দামেশকে চলে যান। তাঁর সম্পর্কে ইবন কাসীরের মন্তব্য, “তিনি আমাদের সহোদর এবং আমাদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহবৎসল ছিলেন।”৪৬ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ১৪, পৃঃ ৪৮।] ইবন কাসীর (র) হিজরী ৮ম শতাব্দীতে মামলুক সুলতানদের শাসনামলে তার যৌবনকাল অতিবাহিত করেন। তাতারীদের আক্রমণ, একাধিক দুর্ভিক্ষ, হৃদয়বিদারক দুর্যোগগুলো তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। তখন দুর্ভিক্ষে লক্ষ-লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটে। তিনি ফিরিঙ্গীদের সাথে সংঘটিত ক্রুসেড যুদ্ধগুলোও দেখেছেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, শাসকদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদি তাঁর সম্মুখেই সংঘটিত হয়। এতদসত্ত্বেও এ যুগে শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষ সাধনের প্রবল উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। আমীর-উমারাদের আগ্রহ এবং বিজ্ঞজন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে অকাতরে দান করার কারণে প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বহুসংখ্যক গ্রন্থ রচিত ও সংকলিত হয়।
মৃত্যুঃ ৭৭৪ হিজরী সনে ২৬শে শা’বান বৃহস্পতিবার তার ইনতিকাল হয়। তার জানাযায় বহুসংখ্যক লোকের সমাগম ঘটে। তার ওসীয়ত অনুসারে তার সর্বশেষ আবাসস্থল সূফীদের গোরস্থানে শায়খুল ইসলাম তকী উদ্দীন ইবন তাইমিয়্যা (র)-এর কাছে তাকে দাফন করা হয়। যা দামেশকের বাব আন-নাসর-এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত।
❏ (৩) তার শিক্ষকবৃন্দ
ইবন কাসীর (র) প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন। দশ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তিনি কুরআন মজীদ কণ্ঠস্থ করে নিয়েছিলেন। শায়খ নূরুদ্দীন আলী ইবন ইবনুহীজা কুরকী শাওবাকী দিমাশকী শাফিঈ (মৃত্যুঃ ৭৩০ হিঃ)-এর ওফাত উপলক্ষে ইবন কাছীর (র) লিখেছেন, “কুরআন হিফজ ও কিতাব অধ্যয়নে তিনি আমাদের সহপাঠী ছিলেন। আমি ৭১১ হিজরীতে কুরআন খতম করি।’৪৭ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃ ১৫৬, ৩২৬।]
শত শত শায়খের নিকট তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে তিনি যাদের দ্বারা প্রভাবিত হন এবং যাদের তিনি অনুসরণ করেন তাদের সংখ্যা খুবই অল্প ছিল। এদের মধ্যে শায়খ তকী উদ্দীন ইবন তাইমিয়া সর্বাগ্রগণ্য। কারণ তাঁর সাথে ইবন কাছীর (র)-এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ইবন কাসীর তার অভিমত অনুসরণ করতেন এবং তালাকের মাসআলায় তার মতানুযায়ী ফতোয়া দিতেন। এ ব্যাপারে তিনি বিপদেও পড়েছিলেন এবং কষ্টও ভোগ করেছেন। আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে ইবন কাসীর (র)-এর লিখিত তথ্য সূত্রে আমরা তা জানতে পারি। হিজরী ৮ম শতাব্দীর প্রথমার্ধের বড় বড় ঘটনার বর্ণনায় এ তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ইতিহাস শাস্ত্রে তিনি সিরিয়ার ইতিহাসবিদ কাসিম ইবন মুহাম্মদ বিরলী (মৃত্যু ৭৩৯ হিঃ) দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কাসিম ইবন মুহাম্মদ (র)-এর ইতিহাস গ্রন্থ যা মূলত শায়খ শিহাবুদ্দীন আবু শামা মাকদেসী-এর ইতিহাস গ্রন্থের পরিশিষ্ট। ইবন কাসীরের ইতিহাস গ্রন্থে উপরোল্লেখিত গ্রন্থের সবিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
হাদীস শাস্ত্রে তার উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন শায়খ মিযযী ইউসুফ ইবন আবদুর রহমান জামালুদ্দীন (মৃত্যু ৭৪৪ হিঃ)। তিনি সে যুগে গোটা মিসরে স্বীকৃত ও প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন। 'তাহযীবুল কামাল’ গ্রন্থটি তাঁর রচিত। ইবন কাছীর (র) শায়খ 'মিযযী’-এর অধিকাংশ গ্রন্থ তাঁর কাছে অধ্যয়ন করেন। ইবন কাসীর (র) উক্ত শায়খের এতই ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য অর্জন করেছিলেন যে, শায়খের কন্যা ‘যায়নাব’কে তিনি বিবাহ করেন। তিনি হাদীসশাস্ত্র ও রাবীদের জীবনী সম্পর্কে শায়খ মিযযী থেকে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন।৪৮ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২০৩, ২০৪। ইবন হাজর, আদদুরারুল কামিনা, খঃ ৪, পৃঃ ৪৫৭।] তিনি অংক শাস্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ করেন উস্তাদ ‘হাযরী’ থেকে।৪৯ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৫৬।]
ইবন কাসীর (র)-এর আরো কতিপয় শিক্ষক
(১) জনাব ইজুদ্দীন আবু ইয়া’লা, হামযা ইবন মুআইয়িদুদ্দীন আবুল মা’আলী, আস’আদ ইবন ইজ্জুদ্দীন আবু গালিব মুযাফফর ইবনুল ওযীর আত তামীমী দামেশকী ইবনুল কালানসী (মৃঃ ৭২৯ হিঃ)। ইনি মুহাদ্দিস ছিলেন। নেতৃত্বের গুণাবলীও তাঁর মধ্যে ছিল। ৭১০ হিজরী সনে তিনি মন্ত্রীত্ব লাভ করেছিলেন।৫০ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৫৩।]
(২) ইব্রাহীম ইবন আবদুর রহমান গাযারী। ইবন কাসীর (র) তাঁর নিকট শাফিঈ মাযহাবের দীক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ তাঁর কাছে অধ্যয়ন করেন।৫১ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃষ্ঠা ১৫২।]
(৩) নাজমুদ্দীন ইবনুল আসকালানী (র)। ৯টি মজলিসে ইবন কাসীর (র) তাঁর নিকট সহীহ মুসলিম অধ্যয়ন করেন।
(৪) শিহাবুদ্দীন আলহিজার ওরফে ইবন শাহনা। আশরাফিয়া দারুল হাদীসে তিনি হাদীসের প্রায় ৫০০টি পুস্তিকা(جزء) অধ্যয়ন করেন। ৭৩০ হিজরীতে তাঁর ইনতিকাল হয়। তার নাম ছিল আহমদ ইবন আবু তালিব।
(৫) কামালুদ্দীন ইবন কাযী শাহবাহ্, তাঁর নিকট ইবন হাজিব রচিত উসূল বিষয়ক গ্রন্থ ‘মুখতাসার’ পাঠ করেন।
(৬) শায়খ নাজমুদ্দীন মূসা ইবন আলী ইবন মুহাম্মদ জীলী দামেশকী। ইনি বিদগ্ধ জ্ঞানীজন এবং লেখক ছিলেন। ইবনুল বাসীস নামে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। লিপি বিদ্যায় উস্তাদ এবং স্থানীয় বিশেষজ্ঞ বলে তিনি বিবেচিত হতেন। ৭১৬ হিজরী সনে তাঁর মৃত্যু হয়।
(৭) শায়খ হাফিজ ও ইতিহাসবিদ শামসুদ্দীন যাহাবী মুহাম্মদ ইবন আহমদ কায়মায- তাঁর নিকটও তিনি শিক্ষা লাভ করেন। ৭৪৮ হিজরী সনে তাঁর মৃত্যু হয়।
(৮) নাজমুদ্দীন মূসা ইবন আলী ইবন মুহাম্মদ, তিনি একাধারে শায়খ এবং উচ্চমানের কবি ছিলেন। ৭১৬ হিজরীতে তিনি ইনতিকাল করেন।
(৯) কাসিম ইবন আসাকির, ইবন শীরাযী, ইসহাক আসাদী মিসর থেকে তাঁকে অনুমতি দিয়েছেন আবু মূসা কুরাফী এবং আবুল ফাতাহ্ দারূসী।
❏ তাঁর জ্ঞান গরিমার স্বীকৃতি
এমন একজন মানুষ যিনি তাঁর সমসাময়িক যুগের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ, হাদীসবিশারদ, তাফসীরকারগণ এবং অংক শাস্ত্রবিদগণের কাছে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছেন, এ ধরনের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষ খুব কমই দেখা যায়।
দাউদী তাঁর প্রশংসা করেছেন এভাবে- “আমরা যাদেরকে পেয়েছি তাদের মধ্যে ইবন কাসীর (র) হাদীসের মূল পাঠ কণ্ঠস্থকারীদের মধ্যে অগ্রগামী ছিলেন এবং হাদীসের উৎস, পরিচিতি, রিজাল পরিচিতি এবং শুদ্ধাশুদ্ধ বিচারে বিজ্ঞতম ব্যক্তি। তাঁর সমকালীন বিদগ্ধজন ও তার শায়খগণ তাঁর স্বীকৃতি দিতেন। ফিকাহ ও ইতিহাস শাস্ত্রের বহু কিছু তার নখদর্পণে ছিল। তিনি যা শুনতেন তা খুব কমই ভুলতেন। তিনি গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী উত্তম ফিকাহবিদ ছিলেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। আরবী ভাষার আলোচনায় তিনি সার্থকভাবে অংশ নিতেন। কবিতা রচনা করতেন। আমি বহুবারই তাঁর কাছে গিয়েছি কিন্তু কোন বার কিছু না শিখে এসেছি বলে আমার মনে পড়ে না।”৫২ [দাউদী, তাবাকাতুল মুফাসসিরীন, খঃ ১৪, পৃঃ ১১১।]
ইবন কাসীর (র)-এর প্রশংসা বর্ণনায় হাফিজ যাহাবী (র) বলেনঃ “তিনি হাদীসসমূহের উৎস নির্ণয় করেছেন, সেগুলো যাচাই-বাছাই করেছেন, গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাফসীর গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং এসব ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।”৫৩ [যাহাবী, তাবাকাতুল হুফফায, খঃ ৪, পৃঃ ২৯।] ‘আল মু’জামুল মুখতাস’ গ্রন্থে বলেছেন, “তিনি ফতোয়াবিশারদ ইমাম, প্রাজ্ঞ ও প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ, বিজ্ঞ ফকীহ এবং হাদীসের বরাত সমৃদ্ধ তাফসীরে সিদ্ধহস্ত।”
আবুল মুহসিন হুসাইনী (র) বলেছেন, “তিনি একই সাথে ফতোয়া দিয়েছেন, শিক্ষকতা করেছেন, তর্কযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, ফিকাহ, তাফসীর ও ব্যাকরণ শাস্ত্রে নতুন রচনাশৈলী উদ্ভাবন করেছেন এবং হাদীস বর্ণনাকারী ও হাদীসের সত্যাসত্য বিচারের ক্ষেত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।৫৪ [আবুল মাহাসিন আল হুসায়নি, যায়লু তাযকিরাতুল হুফফায, পৃঃ ৫৮।]
আল্লামা সুয়ূতী (র) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “তাঁর তাফসীর গ্রন্থটি অভূতপূর্ব, তাঁর পদ্ধতিতে আর কোন তাফসীর গ্রন্থ সংকলিত হয়নি।”৫৫ [সুয়ূতী, যায়লু তাবাকাতিল হুফফাজ, পৃঃ ২২।]
গবেষণামূলক বিষয়াদিতে যেমন, ইতিহাসবিদ, তাফসীরকার এবং হাদীস বিশারদরূপে তিনি সামাজিক জীবনে এবং চিন্তার জগতে রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। আল্লামা যাহাবী (র)-এর পর তিনি উম্মুস্সা’ওয়াত তানাককুরিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।৫৬ [আলহাসানী, যায়লু তাযকিরাতিল হুফফাজ পৃঃ ৫৮। ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৮২, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৭৫।] তিনি ‘নুজায়বিয়ায়’ শিক্ষকতা করেন এবং ৭৪৮ হিজরী সনে ফাওকানী বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন।
দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তিনি সিরিয়ার নায়েবে সুলতানের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন এবং সাইপ্রাসবাসীদের ভীতি প্রদর্শন ও শাস্তির ঘোষণা প্রদানসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।৫৭ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ৩২৯।] অন্যত্র তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তিনি খলীফার সাথে সাক্ষাত করেছিলেন এবং খলীফা তাঁকে বিনয়ী, বিচক্ষণ ও মিষ্টভাষী বলে প্রশংসা করেছিলেন।৫৮ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২৫৭।]
❏ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
অধঃপতনের যুগে রাজনৈতিক বিষয়াদিতে উলামা-মাশায়েখদের পরস্পর বিরোধী ভূমিকার কারণে দলীল-প্রমাণের প্রতি জনসাধারণের বীতশ্রদ্ধ ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। তাই ফতোয়া প্রার্থী সংশ্লিষ্ট ফতোয়ার সাহায্যে সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা আন্দোলন সংগঠিত করবে এমন আশংকায় তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতোয়া দানে বিরত থাকেন। যেমন কাযীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দানে তিনি বিরত থাকতেন। কারণ ফতোয়া দ্বারা প্রশাসনকে বিব্রত করা হয়।৫৯ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ২১৬।]
অস্থিরতার এই যুগে রাজনৈতিক বিষয়ে নিজের রায় ঘোষণার ব্যাপারে তিনি যতটুকু রক্ষণশীল ছিলেন, অন্যদের সাথে মিলেমিশে কাজ করার ব্যাপারে তিনি ততটুকু উদার ও অকুণ্ঠ ছিলেন। হারীরিয়্যা তরীকার সাথে সংশ্লিষ্ট ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনকারী আবদুল্লাহ আল মুলাতী থেকে হাদীস বর্ণনা করাকে তিনি স্বভাবগতভাবে এবং শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে অপছন্দ করতেন।৬০ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃষ্ঠা ৩২৭।]
❏ খ. রচনাবলী
ইবন কাসীর (র) বিশেষত ইতিহাস, তাফসীর এবং হাদীস বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত ও পাণ্ডুলিপি আকারে বহু গ্রন্থ রয়েছে।
(১) প্রকাশিত গ্রন্থরাজি
(১) আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াঃ এটির জন্যেই আমরা এই ভূমিকা লিখছি। এটি ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ। ১৪ খণ্ডে সমাপ্ত। শেষ দুখণ্ড শেষ যুগের ফিতনা-ফাসাদ ও যুদ্ধবিগ্রহ বিষয়ক। ইবন কাসীর (র) তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, “শায়খ শিহাবুদ্দীন আবু শামা মাকদেসীর ইতিহাস গ্রন্থের পরিশিষ্ট স্বরূপ আমাদের শায়খ হাফিজ ইলমুদ্দীন বিরযালী যে ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন এটি তার পরিশিষ্ট। তার ইতিহাস গ্রন্থের পরিশিষ্ট স্বরূপ এযুগ পর্যন্ত ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ আমি এ গ্রন্থে সংযোজিত করেছি। তার ইতিহাস গ্রন্থ থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্যগুলো চয়ন করার কাজ আমি শেষ করেছি ৭৫১ হিজরী সনে। হযরত আদম (আ) থেকে আমাদের এ যুগ পর্যন্ত তিনি যা লিখেছেন তা এখানে এসে শেষ হয়েছে।৬১ [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৯৪।]
কিন্তু ৭৩৮ হিজরীর পর থেকে ৭৫১ হিজরী পর্যন্ত সময়কালে বিরযালীর সংগহীত কোন তথ্য সম্পর্কে আমি অবগত হইনি।৬২ [আমাদের সম্মুখে উপস্থিত গ্রন্থে আমরা এই বর্ণনাভঙ্গি লক্ষ্য করি।
(ক) ইবন আসাকিরের (মৃত্যু ৫৭১) দামেশকের ইতিহাস (تا ريخ دمشق)
(খ) আবু শামা (মৃত্যু ৬৬৫) রচিত দামেশকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (اختصار تاريخ دمشق)
(গ) বিরজালী (মৃত্যু ৭৩৯) রচিত দামেশকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের পরিশিষ্ট (ذيل اختصا تاريخ دمشق)।
(ঘ) ইবন কাসীর (মৃত্যু ৭৭৪) রচিত, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (البداية والنهاية )
(ঙ) শিহাবুদ্দীন ইবন হাজী (মৃঃ ৮১৬) রচিত, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-এর পরিশিষ্ট (ذيل البداية والنهاية) আমার ধারণা, এটিই তাঁর পূর্বতন আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থ।) ইবন কাসীর তার ইতিহাস গ্রন্থের অনুসরণ করে ৭৬৮ হিজরী সন পর্যন্ত পৌঁছান অর্থাৎ তার মৃত্যুর ৬ বছর পূর্ব পর্যন্ত ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে, 'আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থটি শায়খ শিহাবুদ্দীন আবু শামা মাকদেসীর (মৃঃ ৬৬৫ হিঃ) ইতিহাস গ্রন্থের পরিশিষ্টের পরিশিষ্ট।৬৩ [ইনি হলেন শিহাবুদ্দীন আবদুর রহমান ইবন ইসমাঈল ইবন ইবরাহীম ইবন উছমান ইবন আবু বকর ইবন আব্বাস, আবু মুহাম্মদ আল মাকদেসী। তিনি ছিলেন একাধারে ইমাম, আলিম, হাফিজ, মুহাদ্দিস, ফকীহ ও ইতিহাসবিদ। তিনি আবু শামা নামে প্রসিদ্ধ। তিনি দারুল হাদীস আল আশরাফিয়া-এর শায়খ এবং রুকনিয়াহ মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ হল বহু খণ্ডে সমাপ্ত ইখতিসার তারিখে দামিশক [বিরযালী (র) এ গ্রন্থেরই পরিশিষ্ট রচনা করেছেন], শরহুশ শাতিবিয়্যাহ, আররাদ্দু ইলাল আমীরিল আউয়াল, আল মাবআছ, আল ইসরা, আররাওদাতায়ন ফীদ দাউলাতায়ন আসসালাহিয়্যাহ্ ওয়ান নূরিয়্যাহ। ৫৯৯ হিজরীতে তার জন্য 'আররাওদাতায়ন’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট রূপে তিনি আরও কিছু তথ্য সংযোজন করেছেন। তিনি হাদীস এবং ফিকাহ্ অধ্যয়ন করেছেন ফখর ইবন আসাকির ও ইবন আবদুস সালাম (র) থেকে। তিনি মুজতাহিদের স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন। কবিতাও রচনা করেছেন। অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে তার মৃত্যু হয়। ৬৬৫ হিজরী সনে তার বাসগৃহে তাকে দাফন করা হয়।]
সুতরাং এই কিতাবের বুনিয়াদ ও ভিত্তি হল শায়খ আবু শামা মাকদেসীর ইতিহাস গ্রন্থ, এটিতে রয়েছে ৬৬৫ হিজরী পর্যন্ত সময়কালের তথ্য। তার পরবর্তী অংশের ভিত্তি হল বিরযালীর ইতিহাস গ্রন্থ।৬৪ [বিরযালী হলেন, ইলমুদ্দীন আবু মুহাম্মদ আল কাসিম ইবন মুহাম্মদ ইবন বিরযালী। সিরিয়ার ইতিহাসবিদ। শাফিঈ মাযহাবের অনুসারী। ৬৬৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। অর্থাৎ যে বছর শায়খ আবু শামা মাকদেসী ইনতিকাল। করেন সে বছর বিরযালীর জন্ম হয়। ৭৩৯ হিজরীতে তিনি ইনতিকাল করেন। তখন তিনি ইহরাম বাঁধা অবস্থায় ছিলেন। অতঃপর তাকে গোসল দেওয়া হয় এবং কাফন পরানো হয়। এক হাজারেরও অধিক শায়খ ও আলিম তার লাশ বহন করে নিয়ে যান। আন নূরিয়া মাদ্রাসায় তিনি শায়খুল হাদীস ছিলেন। তাঁর কিতাবগুলো এই প্রতিষ্ঠানের জন্যে তিনি ওয়াকফ করে দেন। [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃঃ ১৯৬-৯৭] এটি হল ৭৩৮ হিজরী সন পর্যন্ত, অর্থাৎ তার মৃত্যুর এক বছর পূর্ব পর্যন্ত। তারপর তথ্য সন্নিবেশিত করলেন ইবন কাসীর (র) ৭৬৮ হিজরী সন পর্যন্ত। অবশ্য ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থটি হুবহু আবু শামার গ্রন্থ নয়। কারণ, ইবন কাসীর (র) ছিলেন আবু শামা-এর ইতিহাস গ্রন্থ এবং বিরযালীর ইতিহাস গ্রন্থের পরিশোধন ও পরিমার্জনকারী। ইবন কাসীর (র) বলেন, “তার ইতিহাস-গ্রন্থ থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্যগুলো চয়ন করার কাজ শেষ করি ৭৫১ হিজরী সনের জুমাদাল উখরার ২০ তারিখ বুধবারে।”৬৫[ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ১৪, পৃষ্ঠা ১৯৪, তাঁর সংকলন 'আলমুকতাফা লি তারীখে আবীশামা’ এটিকে তিনি আবু শামা রচিত ইতিহাস গ্রন্থ “আর রাওপাতায়ন’-এর সাথে সংযোজন করেছেন। জুরজী যায়দান তার তারীখে আদাবিল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে এরূপ উল্লেখ করেছেন। তাতে ৭২০ হিজরী পর্যন্ত কালের ঘটনাবলী তিনি বিবৃত করেছেন। ‘কুপরিলীতে’ এর একটি কপি রয়েছে। কায়রোর আন্তর্জাতিক আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাণ্ডুলিপি বিভাগে এর একটি ফটো কপি রয়েছে। তার শিষ্য তকীউদ্দীন ইবন রাফি সালামী (মৃত্যু ৭৭৪ হিঃ) 'আল ওফিয়াতে’ এর একটি পরিশিষ্ট লিখেছেন। 'দারুল কুতুব আলমিসরিয়াতে’ এর একটি কপি রয়েছে।]
তিনি তাঁর এই গ্রন্থটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেনঃ
(১) প্রথম অংশে রয়েছে আরশ-কুরসী, আসমান-যমীন ও এগুলোর মধ্যে যা আছে তা সৃষ্টির ইতিহাস এবং আসমান-যমীনের মধ্যবর্তী যা আছে সেগুলো সৃষ্টির ইতিহাস। অর্থাৎ ফেরেশতাকুল, জিন, শয়তান ইত্যাদির বর্ণনা। আরও রয়েছে হযরত আদম (আ)-এর সৃষ্টি, আম্বিয়া-ই কেরামের ঘটনাবলী, ইসরাঈলীদের বিবরণ এবং আইয়ামে জাহিলিয়াতের ঘটনাবলীসহ হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এর নবুওত লাভ পর্যন্ত কালের ঘটনাবলী।
(২) দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে নবী করীম (ﷺ)-এর ওফাতের পর থেকে ৭৬৮ হিজরী পর্যন্ত।
(৩) তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য অশান্তি, বিপর্যয়, কিয়ামতের আলামতসমূহ, পুনরুত্থান, হাশর-নশর, কিয়ামত দিবসের ভয়াবহ অবস্থা ও জান্নাত-জাহান্নামের বিবরণ।
ইতিহাস গ্রন্থ সংকলনে তিনি তাঁর পূর্বে সংকলিত ইতিহাস গ্রন্থগুলোর তথা তারীখে তাবারী, তারীখে মাসউদী ও তারীখে ইবনিল আছীর ইত্যাদি গ্রন্থের রীতি অনুসরণ করেছেন। ঘটনাবলী তিনি বছরওয়ারী বর্ণনা করেছেন। এগুলো বর্ণনায় তিনি বিভিন্ন শিরোনাম ব্যবহার করেছেন। প্রথমে তিনি বছরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী বর্ণনা করেছেন। তারপর ঐ বছর যারা ইনতিকাল করেছেন তাঁদের জীবনী আলোচনা করেছেন। কবিতার উদ্ধৃতি আছে প্রায় সব পৃষ্ঠাতেই। অনেক সময় তাঁর স্বরচিত কবিতা কিংবা প্রাসঙ্গিক কুরআনুল করীমের আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন।
এই গ্রন্থটি বহুবার মুদ্রিত হয়েছে। আমার মনে হয় এর প্রাচীনতম মুদ্রণ হল ১৩৪৮ হিজরীর মুদ্রণটি। বাদশাহ আবদুল আযীয ইবন আবদুর রহমান আল সউদ এটি মুদ্রণ ও প্রকাশে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছিলেন। আসতানাতে অবস্থিত ওলীউদ্দীন লাইব্রেরীতে রক্ষিত কপি থেকে কুর্দিস্তান আল আলামিয়া প্রেসে এটি মুদ্রিত হয়েছিল।
দ্বিতীয়বার মুদ্রিত হয়েছিল কায়রোর আসসা’আদাহ ছাপাখানায় ১৩৫১ হিজরীতে। তারপর দুই খণ্ডে আলাদা-আলাদা ছাপা হয় মিসরে। অনুরূপভাবে শায়খ ইসমাঈল আনসারী কর্তৃক পরিমার্জিত রূপে রিয়াদে ছাপা হয় ১৩৮৮ হিজরী সনে, তবে এ সকল মুদ্রণে বিভিন্ন ত্রুটি ছিল। এ জন্যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিশোধন করে বর্তমান মুদ্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ প্রসংগে আমরা উল্লেখ করতে পারি যে, শিহাবুদ্দীন ইবন হুযযী (ওফাত ৮১৬ হিঃ) “আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ৭৪১ হিজরী থেকে ৭৬৯ হিজরী সন পর্যন্ত সময়কালের ঐতিহাসিক তথ্যাদি সন্নিবেশিত করে। বার্লিনে তার একটি কপি রয়েছে।
আমরা এ বিষয়ে ঐতিহাসিক জুরজী যায়দানের একটি অভিমতের বিরোধিতা করি। তিনি বলেছেন যে, ‘বিরযালী’ রচিত ‘আল মুকতাফা লি তারীখে আবী শামাহ’ গ্রন্থটি ইবন আসাকির রচিত 'ইখতিসারু তারীখ-ই-দামিশক’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট। জুরজী যায়দান উল্লেখ করেছেন যে, আররাওদাতাইন ফী আখবারে দাওলাতাইন আসসিলাহিয়্যাহ ওয়ান নুরিয়্যাহ্’ গ্রন্থের সাথে ‘আল মুকতাফা লি তারীখে আবী শামাহ্’-এর সম্পর্ক রয়েছে তা সঠিক নয়।
যেহেতু ইবন আসাকীর-এর ইতিহাস গ্রন্থটি হল এ সিরিজের মূল ভিত্তি যা সর্বমহলে সুপরিচিত। 'আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’-ই যেহেতু এই ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত, তাই ইবন আসাকির সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার— যদিও এখানে তার আলোচনা খুব একটা প্রাসংগিক নয়।
তিনি, ইবন আসাকির, হাফিজ আবুল কাসেম আলী ইবন আবু মুহাম্মদ হাসান ইবন হিবাতুল্লাহ ওরফে ইবন আসাকির দিমাশকী। তার উপাধি ছিল সেকাতুদ্দীন। তিনি সিরিয়ার মুহাদ্দিছ, শাফিঈ মাযহাবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফকীহ্। কোন কোন সফরে তিনি সামআনীর সফরসঙ্গী ছিলেন। দামেশকের নূরিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপক পদে নিয়োগ লাভ করেছিলেন। তার রচিত 'তারীখে দিমাশক’ গ্রন্থের জন্যে তিনি সমধিক খ্যাতি লাভ করেন। খতীব আবু বকরের ‘তারীখ-ই বাগদাদ’ গ্রন্থের রচনা-রীতি অনুসরণে ইবনে আসাকির ৮০ খণ্ডে সমাপ্ত এই গ্রন্থটি সংকলন করেছেন। তাতে তিনি ইসলামের প্রারম্ভিক যুগ থেকে তাঁর সমসাময়িক কাল পর্যন্ত দামেশকে বসবাসকারী এবং দামেশকে আগত গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, রাবীগণ, মুহাদ্দিসগণ, হাফিজগণ, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের জীবনী আলোচনা করেছেন। দামেশকের “মাজমা আল ইলমী আল-আরবী”-এর অর্থানুকল্যে এ গ্রন্থের কতক অংশ প্রকাশিত হয়েছিল আর কতক অংশ প্রকাশিত হয়েছিল দামেশকের 'রাওদাতুশ শাম" প্রকাশনালয়ের সহায়তায়।
এই গ্রন্থের কয়েকটি পরিশিষ্ট গ্রন্থ রয়েছে তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলঃ
মূল রচয়িতা ইবন আসাকির (র)-এর পুত্র আলকাসিম রচিত পরিশিষ্ট।
সদরুদ্দীন বাকরী-এর রচিত পরিশিষ্ট।
উমর ইবন হাজিব রচিত পরিশিষ্ট।
আলোচ্য গ্রন্থের কয়েকটি সার-সংক্ষেপ গ্রন্থ রয়েছে, তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলঃ
ইখতিসারে আবী শামা, এটির পরিশিষ্ট লিখেছেন বিরযালী এবং পরবর্তী অংশ ইবন কাসীর (র)।
‘লিসানুল আরব’ গ্রন্থ প্রণেতা জামালউদ্দীন ইবন মানযূর রচিত সংক্ষিপ্তসার। ইসমাঈল আজলূযী আল-জার্রাহ্ কৃত সংক্ষিপ্তসার।
ইখতিসার-ই শায়খ আবুল ফাতহ আল খাতীব (ওফাত ১৩১৫ হিঃ)।
❏ ইবন কাসীর (র)-এর অন্যান্য রচনা
(২) তাফসীরুল কুরআনিল কারীম (তাফসীরে ইবন কাসীর)
এটি প্রথমে ছাপা হয় বুলাকে, কানূজীর ‘ফাতহুল বয়ানের’ পার্শ্বটীকা রূপে এটি প্রকাশিত , হয়েছিল ১০ খণ্ডে। পুনরায় ছাপা হয় ১৩০০ হিজরীতে সাইয়িদ আবু তায়্যিব সিদ্দীক ইবন হাসান খান রচিত 'মাজমাউল বয়ান ফী মাকাসিদিল কুরআন’ গ্রন্থের পার্শ্বটীকা স্বরূপ। ১৩৪৩ হিজরীতে এটি নাজদ ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের ইমাম সুলতান আবদুল আযীয ইবন আবদুর রহমান আল ফায়সাল-এর নির্দেশে মিসরের আল মানার ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়। এটির পার্শ্বটীকায় ছিল ইমাম বগভী (র) রচিত তাফসীর। পরে সংক্ষিপ্ত আকারে “উমদাতুত্ তাফসীর আনিল হাফিজ ইবন কাছীর” নামে ১৯৫৬ খৃস্টাব্দ/১৩৭৫ হিজরীতে পুনঃপ্রকাশিত হয়। এটি ৫টি খণ্ডে মুদ্রিত হয়। তাফসীর নং ১৬৮ ক্রমিক নম্বরে ৭ খণ্ডে সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখিত মাকতাবাতুল আযহারিয়ায় রক্ষিত পান্ডুলিপি থেকে এটি মুদ্রিত হয় ৮২৫ হিজরীতে। মুহাম্মদ আলী সূফী এটির কপি করে দিয়েছিলেন। আমার জানা মতে এটি উৎকৃষ্টতম ছাপা।
ইবন কাসীর (র) কুরআন করীমের তাফসীর কুরআনের আয়াত দ্বারা, অতঃপর হাদীস দ্বারা এই নীতির অনুসরণ করেছেন। ইসরাঈলীদের মনগড়া বর্ণনাগুলোর তিনি সমালোচনা করেছেন। এগুলোর প্রতি তার কোন আস্থা ছিল না। তবে শরীয়ত যেগুলো সমর্থন করে, সেগুলো ব্যতিক্রম। তিনি তাফসীর গ্রন্থের সাথে 'ফাযায়েলুল কুরআন’ও সংযুক্ত করে দিয়েছেন। যা ১৩৪৮ হিজরীতে স্বতন্ত্রভাবে মিসরে ছাপা হয়েছিল। অতঃপর তার তাফসীরের সাথে পুনরায় ছাপা হয়।
(৩) আল ইজতিহাদ ফী তামাবিল জিহাদ
দারুল কুতুব আলমিসুরিয়্যাতে এর একটি অশুদ্ধ কপি সংরক্ষিত আছে। 'আলমাখতূতাত ইন্সটিটিউটে’ এর ফটোকপি মজুদ আছে। এ কিতাবটি অতি সাধারণভাবে কোন প্রকারের পরিশোধন পরিমার্জন ব্যতীত প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ছিল বহু ভুল ও বিকৃতি। ১৩৪৭ হিজরী সনে ‘আবুল হাওল’ প্রেসে এটি মুদ্রিত হয়। তবে পরিশোধিত ও পরিমার্জিত প্রকাশনা হল ১৪০১ হিজরী মুতাবিক ১৯৮১ খৃস্টাব্দে বৈরুতে প্রকাশিত মুদ্রণটি। আবদুল্লাহ আবদুর রহীম উসায়লীন এই মুদ্রণের তত্ত্বাবধান করেন।
সিরিয়ার নায়েবে সুলতান আমীর মুনজাক ইবন আবদুল্লাহ্ সায়ফুদ্দীন আল ইউসুফীর (ওফাত-৭৭৬ হিঃ) আগ্রহ পূরণার্থে ইবন কাসীর (র) এ গ্রন্থটি সংকলন করেছিলেন। এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত রয়েছে হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুসলিম ও ক্রুসেডারদের যুদ্ধ বিগ্রহের বর্ণনা। সেই যুগের বর্ণনা যে যুগে ইবন কাসীর (র) জীবন যাপন করেছিলেন। ইতিহাস শাস্ত্রে এটি একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থরূপে বিবেচিত হয়। কারণ, সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী এই গ্রন্থে সত্যতা ও বিশ্বস্ততার সাথে বর্ণিত হয়েছে। তিনি তার এ গ্রন্থটি একটি ভূমিকা দ্বারা শুরু করেন। এতে তিনি জিহাদে উদ্বুদ্ধকারী কুরআনের আয়াতসমূহ এবং এরপর এ বিষয়ক হাদীসসমূহ উল্লেখ করেছেন। মোট ১৩টি হাদীস তিনি এখানে সন্নিবেশিত করেছেন। তারপর ক্রুসেডার ও মুসলমানদের মধ্যকার যুদ্ধ-বিগ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন। এরপর আলেকজান্দ্রিয়া সীমান্তে ফিরিঙ্গীদের আগ্রাসী আক্রমণ এবং মুসলমানদের প্রতিরোধের কথা বর্ণনা করেছেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর যুগ থেকে শুরু করে খিলাফতে রাশেদা ও তার পরবর্তী যুগের সিরিয়ায় মুসলমানদের ‘জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্’-এর জন্যে অবিরাম প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন। ফিরিঙ্গীদের বায়তুল মুকাদ্দাস দখল এবং সালাহউদ্দীন আয়ুবী কর্তৃক তা পুনরুদ্ধারের ইতিহাস এবং গাযা, নাবলুস, আজলূন, কুর্ক, গাওর, শাওবাক ও সাফাদ অঞ্চল পুনরাধিকারের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন।
(৪) ইখতিসার-ই-উলুমিল হাদীস
এটি হাদীসের পরিভাষা বিষয়ক একটি পুস্তিকা। “আল-বাইছুল হাছীছ ইলা মা’রিফাতি উলুমিল হাদীস” শিরোনামে আহমদ মুহাম্মদ শাকির এটির ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন। এটা হচ্ছে ইবন কাসীর (র) কৃত ইবন সালাহ-এর মুকদ্দিমা’ গ্রন্থটির সংক্ষিপ্ত সার। এ গ্রন্থের কয়েকটি মুদ্রণ হয়।
(ক) ১৩৫৩ হিজরী সনে শায়খ মুহাম্মদ আবদুর রাযযাক হামযার পরিশোধন সহকারে এর মক্কা সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
(খ) ১৩৫৫ হিজরী সনে এর মিসরীয় সংস্করণ ছাপা হয়। আহমদ শাকির এটি সংশোধন করেছেন।
(গ) কিছু অতিরিক্ত ব্যাখ্যা ও মন্তব্য সহকারে আহমদ শাকির ১৩৭০ হিজরী সনে এটা কায়রো থেকে পুনঃ প্রকাশ করেন।
(৫) শামাইলুর রাসূল ওয়া দালাইলু নুবুওয়াতিহী ওয়া ফযায়েলিহী ও খাসাইসিহী
এটি ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। ১৩৮৬ হিঃ/১৯৬৭ খ্রীঃ কায়রো থেকে প্রকাশিত এ গ্রন্থটি মুস্তাফা আবদুল ওয়াহিদ কর্তৃক পরিশোধিত ও পরিমার্জিত।
পরিশোধনে তিনি নিম্নে উল্লেখিত কপিগুলোর সাহায্য নিয়েছেন।
(ক) ওলীউদ্দীন কৃত ফটোকপি, এটি ইতিহাস গ্রন্থ ক্রমিক নং ১১১০ রূপে 'দারুল কুতুব আল মিসরিয়্যা’ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে।
(খ) মাকতাবা-ই-তায়মুরিয়্যা সংরক্ষিত ইতিহাস গ্রন্থ নং ২৪৪৩।
(গ) আলেপ্পোর মাকতাবা-ই-আহমদিয়া পান্ডুলিপি থেকে সংরক্ষিত কপি অনুসারে ১৩৫১ হিঃ সনে দারুস সাআদা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কপি।
(৬) ইখতিসারু আস সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ
এটিও ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ থেকে সংকলিত গ্রন্থ। এতে ইবন কাসীর (র)-এর জাহেলী যুগের আরব ইতিহাস এবং সীরাতুন্নবী (ﷺ) বিষয়ক আলোচনা স্থান পেয়েছে। 'আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’-এর ২য় খণ্ডের শেষ থেকে ৫ম, খণ্ডের শেষ পর্যন্ত প্রায় তিন খণ্ডের আলোচনা এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। অর্থাৎ এই অংশটি ৪ ভাগে বিভক্ত। গ্রন্থটি বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। যেমনঃ
(ক) মিসরীয় মুদ্রণঃ ১৩৫৮ হিঃ/১৯৫৭ খ্রীঃ আরিফ লাইব্রেরীতে রক্ষিত কপি অনুসারে “আল ফুসূল ফী ইখতিসারে সীরাতে রাসূল (ﷺ)” শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
(খ) বৈরুত ও দামেশকের ‘মুআসসাসাতু উলুমিল কুরআন ওয়া দারুল কলম’ প্রকাশনালয়ের প্রকাশনা। ১৩৯৯-১৪০০ হিজরীর মধ্যে ডঃ মুহাম্মদ ঈদ আল-খারাবী ও প্রফেসর মুহিউদ্দীন মস্তূ এই সংস্করণটি সম্পাদনা করেন।
(৭) আহাদীসুত তাওহীদ ওয়ার রাদদু আলাশ শিরক
ব্রুকলম্যান তার আরবী সাহিত্যের ইতিহাস تا ريخ الادب العربي গ্রন্থের (২/৪৮) পরিশিষ্টে এ তথ্য উল্লেখ করেছেন এবং তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ১২৯৭ হিজরী সনে এটি দিল্লীতে মুদ্রিত হয়েছে।
উপরোল্লেখিত গ্রন্থগুলোই হচ্ছে ইবন কাসীর (র) রচিত প্রকাশিত গ্রন্থ। তাঁর অপ্রকাশিত রচনাবলীর সংখ্যা অনেক। সেগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধগুলোর তালিকা নিম্নে দেয়া হচ্ছেঃ
❏ তাঁর অপ্রকাশিত রচনাবলী
(৮) জামিউল মাসানীদ
এ গ্রন্থটি ৮ খণ্ডে সমাপ্ত। শায়খ মুহাম্মদ আবদুর রাযযাক হামযা এটির নামকরণ করেছেন “আল-হাদসূ ওয়াস্ সুনান ফী আহাদীসিল মাসানীদ ওয়াস্ সুনান”। এটিতে তিনি ইমাম আহমদ আল-বাযযায-এর মুসনাদ, আবূ ইয়া’লা-এর মুসনাদ, ইবন আবী শায়বার মুসনাদ এবং ৬টি প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। দারুল কুতুব আল-মিসরিয়াতে এর একটি কপি মওজুদ আছে যা সাত খণ্ডে বাঁধাইকৃত।
৭ম খণ্ডে আবু হুরায়রা (رضي الله عنه)-এর মুসনাদ-এর সিংহভাগ স্থান পেয়েছে।
(৯) তাবাকাতুশ শাফিঈয়া
দাউদী তার গ্রন্থে (১ম খঃ পৃঃ ১১০-১১১)-এর উল্লেখ করেছেন। কায়রোর আল মাখতূতাত ইন্সটিটিউটে ৭৮৯ ক্রমিক নম্বরে এ পুস্তকটির একটি ফটোকপি মওজুদ আছে যা ত্রুটিপূর্ণ। রাবাতের কাতানীর কপি থেকে এটি ফটো কপি করা হয়েছে। সেখানে শুস্তারবামিত এর অপর একটি পান্ডুলিপি রয়েছে যার ক্রমিক নং হচ্ছে ৩৩৯০।
❏ ইবন কাসীর (র)-এর বিলুপ্ত রচনাবলী
ইবন কাসীর (র)-এর যে সকল রচনা আমরা পাইনি কিন্তু তাঁর গ্রন্থাদিতে কিংবা পূর্ববর্তী যুগের লেখকদের গ্রন্থে সেগুলোর নাম পাওয়া যায় তার কতকগুলোর কথা আমরা নিম্নে উল্লেখ করছিঃ
(১০) আত তাকমীল ফী মারিফাতিস সিকাতি ওয়াদ দুআ’ফা ওয়াল মাজাহীল
হাদীসের বর্ণনাকারিগণ সংক্রান্ত ৫ খণ্ডে সমাপ্ত এ-গ্রন্থটিতে তিনি তাঁর শায়খ ‘মিযযী’-এর ‘তাহযীবুল কামাল’ এবং আল্লামা যাহাবী-এর মীযানুল ইতিদাল’ গ্রন্থদ্বয় একত্র করেছেন। তিনি নিজে হাদীস বর্ণনাকারীদের যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত অতিরিক্ত কিছু তথ্যও এতে সংযোজন করেছেন।
নিম্নে বর্ণিত গ্রন্থসমূহে আলোচ্য গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছেঃ
(ক) হাজী খলীফা রচিত কাশফুযযুনূন, খঃ ১, পৃঃ ৪৭১
(খ) দাউদী রচিত তাবাকাতুল মুফাসসেরীন, খঃ ১, পৃঃ ১১০
(গ) আল্লামা সুয়ূতী রচিত যায়লু তাযকিরাতিল হুফফাজ, পৃঃ ৫৮।
(১১) আল কাওয়াকিবুদ দারারী ফীত তারীখ
এটি জীবন চরিত বিষয়ক গ্রন্থ। 'আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ থেকে এটি সংকলিত। হাজী খলীফা তাঁর 'কাশফুজ জুনুন’ গ্রন্থে আলোচ্য গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের ১৫২১ পৃষ্ঠায় এর উল্লেখ করেছেন।
(১২) সীরাতুশ শায়খায়ন
এ গ্রন্থে তিনি হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-এর খিলাফত প্রাপ্তি, তার মর্যাদা ও আচার-আচরণের বিষয় উল্লেখ করেছেন। এরপর উল্লেখ করেছেন হযরত উমর ফারুক (رضي الله عنه)-এর জীবন, কর্ম ও অন্যান্য বিষয়। তারা দুজনে নবী করীম (ﷺ) থেকে যে সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন, সেগুলোও তিনি এ গ্রন্থে সংকলিত করেছেন। ফলে গ্রন্থটি হয়েছে তিনখণ্ড বিশিষ্ট।
নিম্নে বর্ণিত গ্রন্থগুলোতে আলোচ্য গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ
(ক) আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া খঃ ৭, পৃঃ ১৮।
(খ) আল্লামা সুয়ূতী রচিত যায়লু তাযকিরাতিল হুফফাজ, পৃঃ ৩৬১।
(১৩) আল ওয়াদিহুন নাফীস ফী মানাকিবিল ইমাম মুহাম্মদ ইবন ইদরীস
এ গ্রন্থটি মানাকিবিশ শাফি’ঈ’ নামে প্রসিদ্ধ।
নিম্নে বর্ণিত গ্রন্থগুলোতে এর উল্লেখ রয়েছেঃ
(ক) হাজী খলীফা রচিত কাশফুজ জুনুন, খঃ ২, পৃঃ ১৮৪০।
(খ) আদ দাউদী রচিত ‘তাবাকাতুল মুফাসসিরীন’ খঃ ১, পৃঃ ১১১।
(১৪) কিতাবুল আহকাম
এটি একটি বিরাট গ্রন্থ। তিনি এটি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। হজ্জ অধ্যায় পর্যন্ত রচনা করেছিলেন। “আল-আহকামুস সুগরা ফীল হাদীস” নামেও এটির উল্লেখ পাওয়া পায়। হাজী খলীফা রচিত 'কাশফুজ জুনুন’ গ্রন্থের ১ম খণ্ডে ৫৫০ পৃষ্ঠায় এ গ্রন্থটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
(১৫) আল আহকামুল কবীরা
নিম্নলিখিত গ্রন্থাদিতে এ গ্রন্থের আলোচনা রয়েছেঃ
(ক) ইবন কাসীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ৩, পৃঃ ২৫৩।
(খ) আদ দাউদী তাবাকাতুল মুফাসসিরীন, খঃ ১, পৃঃ ১১০, ১১১।
(১৬) তাখরীজু আহাদীসি আদিল্লাতিৎ তানবীহ ফী ফুরুইশ শাফি’ঈয়্যা
নিম্নোক্ত গ্রন্থাদিতে এ গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ
(ক) ইবন কাসীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খঃ ২, পৃঃ ১২৫।
(খ) আল বাগদাদী, হিদায়াতুল আরেফীন, খঃ ১, পৃঃ ২১৫।
(১৭) ইখতিসারু কিতাবি আল মাদখাল ইলা কিতাবিস সুনান লিল বায়হাকী
এর সারসংক্ষেপ। ইবন কাসীর (র) রচিত “ইখতিসার উলুমিল হাদীস" গ্রন্থের ৪র্থ পৃষ্ঠায় উল্লেখ পাওয়া যায়।
(১৮) শারহু সহীহ আল-বুখারী
তিনি এটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। নিম্নে বর্ণিত গ্রন্থগুলোতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ
(ক) ইবন কাসীর (র) রচিত 'আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’, খঃ ৩, পৃঃ ৩। (খ) প্রাগুক্ত খঃ ১১, পৃঃ ৩৬।
(গ) হাজী খলীফা রচিত 'কাশফুজ জুনুন’ খঃ ১, পৃঃ ৫৫০।
(ঘ) আদ দাউদী, তাবাকাতুল মুফাসৃসিরীন, খঃ ১, পৃঃ ১১০-১১১।
(১৯) আস-সিমাত
হাজী খলীফা রচিত কাশফুজ জুনুন গ্রন্থের ২য় খণ্ডে ১০০২ পৃষ্ঠায় এর উল্লেখ রয়েছে। উপরোল্লেখিত পরিশিষ্ট, ভাষ্য গ্রন্থ, সারসংক্ষেপ এবং সংকলনগুলোর পাশাপাশি ইবন কাসীর (র)-এর একটি কাব্য গ্রন্থেরও সন্ধান পাওয়া যায়, যা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। এটি সংকলন ও ব্যাখ্যা করা জরুরী। অদূর ভবিষ্যতে একাজ সম্পন্ন করার হিম্মত ও তাওফীক যেন আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে দান করেন।
তার কবিতার নমুনাঃ
تمر بنا الايام تتري وانما - نساق الي الاجال والعين تنظر
দিন যাচ্ছে অবিরাম আর আমরা আহা
নীত হচ্ছি মৃত্যুর দিকে চক্ষু দেখিছে তাহা।
فلا عائد ذاك الشباب الذي مضى - ولا زائل هذا المشيب المكدر
অতীত যৌবন আসবে না ফিরে কভু এ জীবনে
জরাজীর্ণ এই বার্ধক্য যাবে না সরে কোনক্ষণে।
❏ জ্ঞাতব্য
(১) তার রচনাশৈলীঃ আল্লামা ইবন কাসীর (র) ও তাঁর রচনাবলী সম্পর্কে আলোচনার উপসংহারে তাঁর রচনাশৈলী সম্পর্কে কিছু কথা বলা জরুরী। ইবন কাসীর (র) ছন্দ ও বাক্যের সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিতেন। তবে তিনি কতগুলো স্থানীয় শব্দ ব্যবহার করেছেন, যেগুলো ঐতিহাসিক তাবারী, মাসউদী ও ইবনুল আসীরের ভাষাগত উৎকর্ষের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। ইবন খালদূন তার মুকাদ্দমা ও ইতিহাস গ্রন্থে যে পর্যায়ের ভাষাগত অলংকার ব্যবহার করেছেন ইবন কাসীর (র)-এর ব্যবহৃত ভাষা তার তুলনায় দুর্বল। আমরা এ কথা বলতে পারি। যে, ইবন কাসীর (র) তার ইতিহাস গ্রন্থ রচনার প্রতি যত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, শব্দ ও ভাষার প্রতি তত গুরুত্ব দেননি। কারণ তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে ততটা পারদর্শী ছিলেন না। তাঁর কবিতার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
তার ভাষার মধ্যে আমরা প্রচুর ভুল-ভ্রান্তি লক্ষ্য করি। যেমন তিনি বলেছেনঃ
ووطنوا اراضی کشیرة من صنع بلادهم
অনুরূপভাবে তাঁর যুগের তুর্কী ও মামলুকদের ব্যবহৃত কতকগুলো শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। যথোচিত শব্দ চয়নেও কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁর ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়।
যেমন সালাহ উদ্দীনের ব্যাপারে তাঁর পুত্রদের শোক ও আহাজারীর বর্ণনায় তিনি লিখেছেন – يتبا كون عليه (তারা কৃত্রিমভাবে তার জন্যে কাঁদছে।) যেন পিতা-পুত্রের মাঝে কোন আন্তরিক ও আত্মিক সম্পর্ক ছিল না, ফলে তারা কান্নার ভান করেছে।
(২) বর্ণনা পদ্ধতিঃ এতো ছিল ভাষাগত দিক। বর্ণনা পদ্ধতির ক্ষেত্রে ইবন কাসীরের রচনা পাঠে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে।
(ক) কুরআনুল দ্বারা কুরআনের তাফসীর করার পদ্ধতি বিষয়ের সাথে সংগতি রেখে তিনি কুরআন করীমের প্রচুর আয়াত সন্নিবেশিত করেছেন। অতঃপর আয়াতের সাথে সম্পর্কিত হাদীসসমূহ উল্লেখ করেছেন।
(খ) তার ইতিহাস গ্রন্থে বিশ্বকোষ সুলভ বর্ণনা পদ্ধতি লক্ষণীয়। তিনি বর্ণনাকারীদের সূত্র ও ভাষ্যসমূহ দ্বারা তার ইতিহাস গ্রন্থকে সমৃদ্ধ করেছেন।
(৩) ইসরাঈলী বর্ণনাগুলো সম্পর্কে তিনি সন্দেহ পোষণ করতেন। তিনি বলেছেন, এটি এবং এটির ন্যায় অন্যান্য বর্ণনা আমার মতে মিথ্যাচারী ও ধর্মত্যাগী লোকদের স্বকপোলকল্পিত রচনা। এ সবের দ্বারা তারা তাদের দীনের ব্যাপারে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে। অন্যত্র তিনি বলেছেন, এই তাফসীরে আমি যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছি তা হল ইসরাঈলী বর্ণনা বর্জন। কারণ এগুলোর উল্লেখ করা শুধু সময়ের অপচয়। এগুলোতে রয়েছে তাদের মধ্যে প্রচলিত মিথ্যাচারের বর্ণনা।
(৪) একজন হাদীসবিশারদ ইমামের মতই তিনি রেওয়ায়েত বা বর্ণনা সূত্রসহ তথ্য উল্লেখে গুরুত্ব দিয়েছেন। ইজতিহাদ ও আপন অভিমত সংযোজনকে তিনি অপছন্দ করতেন।
(৫) সংশ্লিষ্ট গ্রন্থগুলোর একত্রীকরণ। কোন তথ্য কিংবা বর্ণনাতে রং চড়াতে গিয়ে তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন করতেন না। বরং প্রতিটি দলীল ও বর্ণনাকে তিনি হুবহু উদ্ধৃত করতেন।
(৬) অলংকরণ, বিন্যাস, সৌন্দর্য বিধান, ব্যাখ্যাকরণ ও হেতু বর্ণনা তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল। বরং তার প্রধান ও সার্বিক লক্ষ্য ছিল তথ্যসমূহ একত্র করা। ফলে কখনো কখনো তথ্য ও বর্ণনার পুনরাবৃত্তি পরিলক্ষিত হয়। আবার কখনো কোন তথ্যের প্রাসংগিক বিষয়াদি একাধিক স্থানে সন্নিবেশিত হয়েছে।
❏ তথ্য সূত্র
আমরা শুধু গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান তথ্য সূত্রসমূহ উল্লেখ করছি, যাতে বিস্তারিত জানার জন্যে ভাষ্যগ্রন্থসমূহের সাহায্য নেয়া যায়ঃ
(১) ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৪ খণ্ড, ৭ ভলিউমে।
(২) ইবন কাসীর, উমদাতুত তাফসীর আনিল হাফিজ ইবন কাসীর
সংক্ষেপায়ন ও সম্পাদনা- আহমদ মুহাম্মদ শাকির, দারুল মাআরিফ, মিসর। প্রথম প্রকাশ, ১৩৭৬ হি/১৯৫৬ খৃঃ।
(৩) ইবন কাসীর, আল-ইজতিহাদ ফী তালাবিল জিহাদ, সম্পাদনা, আবদুল্লাহ, আবদুর রহীম উসায়লান, বৈরুত, ১৪০১ হিঃ/১৯৮১ খৃঃ।
(৪) ইবন কাসীর, ইখতিসার উলুমিল হাদীস, সম্পাদনা—আহমদ শাকির, ভূমিকা, আবদুর রাযযাক হামযা, কায়রো, ১৩৭০ হিঃ।
(৫) ইবন কাসীর, শামাইলুর রাসূলু ওয়া দালাইলু নুবুওয়াতিহী, ওয়া ফাযাইলিহী ওয়া খাসাইসিহী, সম্পাদনা— মুস্তফা আবদুল ওয়াহিদ, ঈসা আল বাবী আল হালাবী এণ্ড কোম্পানী মুদ্রণালয়, কায়রো, ১৩৮৬হিঃ/১৯৬৭ খৃঃ।
(৬) ইবন কাসীর, ইখতিসারু আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, সম্পাদনা—মুহাম্মদ ঈদ আল খাতরাবী ও মুহিউদ্দীন মস্তুও, উলুমুল কুরআন ওয়া দারুল কলম ফাউন্ডেশন দামেশক, বৈরুত, ১৩৯৯-১৪০০ হিঃ।
(৭) ইবন কাসীর, আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, সম্পাদনা—মুস্তাফা আবদুল ওয়াহিদ, দারুল মা’রিফাহ্ লিত তাবাআ ওয়ান নাশূর, বৈরুত, ১৩৯৯ হিঃ/১৯৭৯ খৃঃ।
(৮) ইবন কাসীর, তাফসীর ইবন কাসীর ওয়াল বাগাবী, মাতবা’আতুল মানার মুদ্রিত, মুহাম্মদ রশীদ রেযার উপস্থাপনা, মুদ্রণ নির্দেশ দিয়েছেন সুলতান আবদুল আযীয আল-সাউদ, নজদ ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ইমাম, মিসর, ১৩৪৩ হিজরী।
(৯) খায়রুদ্দীন আযিরিকলী, আল-আ’লাম, কামূস ও তারাজিম, দারুল ইলম লিল মালাঈন, বৈরুত রোড নং-৫, ১৯৮০ খৃস্টাব্দ।
(১০) জুরজী যয়দান, তারীখু আদাবিল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ, উপস্থাপনা, শাওকী দায়ফ, দারুল হিলাল মুদ্রিত, কায়রো।
(১১) শামসুদ্দীন আযহাবী, তাকিরাতুল হুফফাজ, হায়দ্রাবাদে মুদ্রিত, ১৩৩৪ হিজরী।
(১২) ইবন হাজর আল আসকালানী, আদদুরারুল কামিনা ফী আ’ইয়ান আল মিআতিস সামিনা, হায়দ্রাবাদে মুদ্রিত, ১৩৪৮ হিজরী।