আল মাওয়ারিদুল হানিয়াহ ফি মাওলিদি খাইরিল বারিয়াহ-এর বাংলা অনুবাদ [মীলাদে সামহুদী]

الموارد الهنية في مولد خير البرية ﷺ


মূলঃ 

মদীনার ঐতিহাসিক ইমাম নূরুদ্দীন আলী ইবনে আহমদ সামহূদী (رحمة الله) (ওফাতঃ ৯১১ হিজরী)


অনুবাদ, তাখরীজ ও তা'লীকঃ

মুহাম্মাদ হাসিব হাসেমী


টেক্সট রেডীঃ 

ডা. মাসুম বিল্লাহ সানি



প্রকাশনায়ঃ

মাকতাবাতুল ওয়াজীহ


الموارد الهنية

 في

 مولد خير البرية ﷺ 

(مخطوط)



مصنف: 

مؤرخ المدينة نور الدين أبو الحسن علي بن عبد الله بن أحمد السمهودي الشافعي

المتوفي- ৯১১ هـ


ترجمة ـ تخريج ـ تعليق

محمد حسيب الهاشمي


 

خطبة الكتاب

 الحمد لله الذي أطلع في أفق الجلال نور الوجود، وأبرز في حلل الجمال والكمال من أشرف العناصر أشرف مولودی، ورقاه في مدارج المعارف إلى حضرات الإنس والشهود، واختصه بخصائص ودّه وحبّه فهو مودود ربه الودود، وجعل شهر ربيع بمولده نور النور وأزهر النور لظهور فيه رحمة بهذا الوجود فهو موسم الخيرات و معدن المسرات عند كل مسعود وفضل محتده ومثواه فما شابهه أحد في حلاه وعلاه على ما خصه به المعبود، وأشهد أن لا إله الله وحده لا شريك له شهادة أعدّها اللواء الموعود، وأشهد أن سيدنا محمدا عبده ورسوله صاحب الحوض المورود والمعقود، صلى الله عليه وعلى آله وأنصاره وأصحابه وأحبابه وأصهاره صلاة مستمرة دائمة الورود، موجبة لقائلها أعلى الدرجات من دار الخلود مع المقربين الشهود الرُّكع السجود، من فضل مولاه الرحيم الودود.


 

অনুবাদকের কথাঃ

আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত এর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া এবং হুযুর রাহমাতুল্লিল আলামীন, রাসূলে আমীন (ﷺ) এঁর বারগাহে রিসালাতে দুরুদ পাক নিবেদন করছি অত্র কিতাবের অনুবাদ সম্পন্ন করে। রাসূলে আকরাম নূরে মুজাসসাম (ﷺ) এর মীলাদের ওপর যুগে যুগে অনেক মুহাদ্দীস, মুফাসসির ও ফকীহ কিতাব লিখেছেন। ইমাম আল্লামা নূরুদ্দীন সামহূদী (رحمة الله) (ওফাত- ৯১১হিঃ) তাদের মধ্যে অন্যতম। যুগের ইমাম, মুহাদ্দীস ও ঐতিহাসিক আল্লামা সামহুদীর এই কিতাবটি এখনও আরবীতে ছাপা হয়নি। কিতাবটির মাখতুতাহ বা হাতে লিখা কপিটি থেকে উর্দ‚ অনুবাদ হয়েছে যা অনুবাদ করেছেন "মুফতী আবু মুহাম্মাদ ইজায আহমদ সাহেব" এবং প্রকাশ করেছে "যাভিয়া পাবলিকেশন, দরবার মার্কেট, লাহোর"। মূল লেখাটিও আমার সংগ্রহে আছে। উর্দ‚ অনুবাদটির প্রয়োজনীয় সংশোধন করে মূল লেখাটি সামনে নিয়ে আমি এই অনুবাদটি সম্পন্ন করেছি। সাথে তাখরীজের কাজও সম্পন্ন করেছি। আল্লাহ তায়ালা আমার এই কাজকে কবুল করুন। 

-আরয গুযার

মুহাম্মাদ হাসিব হাসেমী








الموارد الهنية في مولد خير البرية ﷺ

আল মাওয়ারিদুল হানিয়াহ ফি মাওলিদি খাইরিল বারিয়াহ-এর বাংলা অনুবাদ (মীলাদে সামহুদী)



কুরআন মাজীদ এবং শানে রাসূল (ﷺ) 


হামদ ও সালাতের পর-

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সত্যের (দ্বীন ইসলামের) স্বাদ প্রদান করেছেন এবং (তাঁর প্রিয়তম হাবীব) মুস্তাফা (ﷺ) এঁর আনুগত্য আমাদের নসীব করেছেন। 


❏ আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে তাঁর নবী (মুহাম্মাদ মুস্তফা (ﷺ)) এঁর শান এবং সিফাত বর্ণনা করে ইরশাদ করেনঃ-

 الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ

অনুবাদঃ ওই সব লোক যারা দাসত্ব করবে এ পড়াবিহীন অদৃশ্যের সংবাদদাতা রাসূলের, যাঁকে লিপিবদ্ধ পাবে নিজেদের নিকট তাওরীত ও ইনজীলের মধ্যে।  ১

1➠সুরা আ'রাফঃ ১৫৭


❏ আর আল্লাহ তায়ালা তাঁর (ﷺ) মহান চরিত্র বর্ণনা করেছেন। এবং মাহাত্ম ও সম্মানের জন্য তাকিদ (জোরসূচক) শব্দ বৃদ্ধি করে বলেছেন-

وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ

অনুবাদঃ নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।  ২

2➠সুরা ক্বলমঃ ৪


আলমে মালাকূতে শানে আহমদীর প্রকাশ


❏ ইমাম মুসলিম তাঁর 'সহীহ'-তে হযরত সাইয়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেন- 

اِنَّ اللهَ تعالى كَتَبَ مَقَادِيرَ الْخَلْقِ، قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ، (قالَ) وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ

অনুবাদঃ আল্লাহ তায়ালা যমীন ও আসমান সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর পূর্বে সমগ্র সৃষ্টির তাকদীর লিখে দিয়েছেন এবং ঐ সময় আল্লাহর আরশ পানির ওপর ছিল।  ৩

3➠

১) সহীহ মুসলিম, কিতাবুল কদর, হাদীসঃ ২৬৫৩

২) সুনানে তিরমিযী, আবওয়াবুল কদর, হাদীসঃ ২১৫৬

৩) মুসনাদে বাযযার, ৬/৪২৬, হাদীসঃ ২৪৫৬


আর যা কিছু উম্মুল কিতাব অর্থাৎ লাওহে মাহফুযে লিখা হয়েছিল তার মধ্যে এটাও ছিল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) হলেন খাতামুন্নাবীয়্যিন বা শেষ নবী। 


❏ ইমাম হাকেম হযরত সাইয়্যিদুনা উমর ইবনুল খাত্তাব (رضي الله عنه) থেকে সহীহ সনদে বর্ণনা করেন, হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ

لَمَّا اقْتَرَفَ آدَمُ الْخَطِيئَةَ قَالَ: يَا رَبِّ أَسْأَلُكَ بِحَقِّ مُحَمَّدٍ لَمَا غَفَرْتَ لِي، فَقَالَ اللَّهُ: يَا آدَمُ، وَكَيْفَ عَرَفْتَ مُحَمَّدًا وَلَمْ أَخْلُقْهُ؟ قَالَ: يَا رَبِّ، لِأَنَّكَ لَمَّا خَلَقْتَنِي بِيَدِكَ وَنَفَخْتَ فِيَّ مِنْ رُوحِكَ رَفَعْتُ رَأْسِي فَرَأَيْتُ عَلَىَ قَوَائِمِ الْعَرْشِ مَكْتُوبًا لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ فَعَلِمْتُ أَنَّكَ لَمْ تُضِفْ إِلَى اسْمِكَ إِلَّا أَحَبَّ الْخَلْقِ إِلَيْكَ، فَقَالَ اللَّهُ: صَدَقْتَ يَا آدَمُ، إِنَّهُ لَأُحِبُّ الْخَلْقِ إِلَيَّ ادْعُنِي بِحَقِّهِ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكَ وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُكَ

অনুবাদঃ যখন হযরত সাইয়্যিদুনা আদম (عليه السلام) এঁর দ্বারা ভুল হল, তখন তিনি আল্লাহর দরবারে আরয করলেন, হে আমার রব! মুহাম্মদ (ﷺ) -এঁর ওসিলায় তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আল্লাহ তাআলা বললেন, হে আদম! তুমি মুহাম্মদ (ﷺ) কে কিভাবে চিনেছ? তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি যখন আমাকে তোমার কুদরতের হাতে বানিয়ে আমার মধ্যে রূহ নিক্ষেপ করেছো, তখন আমি আমার মস্তক উত্তোলন করলে দেখতে পেলাম, আরশের চৌকাঠে "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ" কালেমাটি লিপিবদ্ধ। সেদিন আমি জানতে পারলাম যে, তোমার নামের সাথে এমন একজন সত্ত্বার নাম মিলিত হয়েছে, যিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতের মধ্যে তোমার কাছে সব চাইতে প্রিয়। আল্লাহ পাক বললেন, হে আদম! তুমি ঠিকই বলেছ, তিনি তো আমার কাছে সমগ্র সৃষ্টি জগতের চেয়ে অত্যধিক প্রিয়। তুমি আমার কাছে তাঁর ওসিলায় ক্ষমা প্রার্থনা করেছ, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম, যদি মুহাম্মদ (ﷺ) না হতেন তাহলে তোমাকে সৃষ্টি করতাম না। ৪

4➠

১) মুসতাদরাক লিল হাকেম, ২/৬৭২, হাদীসঃ ৪২২৮

২) বায়হাকী, দালায়েলুন নবুয়াত, ৫/৪৮৯

৩) তাবরানী, মু'জামুস সগীর, ২/১৮২, হাদীসঃ ৯৯২

৪) তাবরানী, মু'জামুস সগীর, ২/১৮২, হাদীসঃ ৯৯২


❏ ইমাম তাবরানীর বর্ণনায় (অতিরিক্ত) আরো আছে-

وهوَ آخِرُ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّتِكَ

অনুবাদঃ তিনি তোমার বংশধরদের মধ্যে সর্বশেষ নবী হবেন। ৫

5➠ তাবরানী, মু'জামুস সগীর, ২/১৮২, হাদীসঃ ৯৯২


صلى الله عليه وسلم كلما ذكره الذاكرون وكلما سهى عن ذكره الغافلون


❏ ইমাম ইবনে আবি হাতেম নিজ তাফসীরে এবং ইমাম আবু নুয়াইম নিজ কিতাব- "দালায়েলুন নবুয়াত" -এ হযরত সাইয়্যিদুনা আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন- রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ 

كُنْتُ أَوَّلَ النَّبِيِّينَ فِي الْخَلْقِ واَخِرَهُمْ فِي الْبَعْثِ

অনুবাদঃ আমি সৃষ্টির দিক দিয়ে সর্বপ্রথম নবী এবং প্রেরণের দিক দিয়ে সর্বশেষ নবী।   ৬

6➠

১) আবু নুয়াইম, দালায়েলুন নবুয়াত, ১ম পরিচ্ছেদ, পৃ➠ ৪২, হাদীসঃ ৩

২) আবুল কাসেম আল-বাজালী, আল-ফাওয়াইদ, ২/১৫, হাদীসঃ ১০০৩

৩) তাবরানী, মুসনাদুশ শামিয়্যিন, ৪/৩৪, হাদীসঃ ২৬৬২


নবী করীম (ﷺ) এঁর বংশধারার মর্যাদা ও পবিত্রতা


❏ ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ-তে সাইয়্যিদুনা ওয়াসালাহ ইবনে আসকা' (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ 

إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى مِنْ وُلْدِ إِبْرَاهِيمَ إِسْمَاعِيلَ , وَاصْطَفَى مِنْ وُلْدِ إِسْمَاعِيلَ بَنِي كِنَانَةَ , وَاصْطَفَى مِنْ بَنِي كِنَانَةَ قُرَيْشًا , وَاصْطَفَى مِنْ قُرَيْشٍ بَنِي هَاشِمٍ , وَاصْطَفَانِي مِنْ بَنِي هَاشِمٍ فَاَنَا خِيَارٌ مِنْ خِيَارٍ مِنْ خِيَارٍ

অনুবাদঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীম (عليه السلام) এঁর বংশ থেকে ইসমাঈল (عليه السلام) কে নির্বাচন করেছেন। অতঃপর ইসমাঈল (عليه السلام) এঁর বংশ থেকে কিনানাহ্ কে নির্বাচন করেছেন। অতঃপর কিনানাহর বংশ থেকে কুরাইশ কে নির্বাচন করেছেন। অতঃপর কুরাইশ থেকে বনু হাশেমকে এবং বনু হাশেম থেকে আমাকে নির্বাচন করেছেন। আমি উত্তম থেকে অতি উত্তম (বংশ) থেকে (এসেছি)। 


❏ ইমাম আবু নুয়াইম "দালায়েলুন নবুয়ত" -এ হযরত সাইয়্যেদাহ আয়শা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেন, জীবরাঈল (عليه السلام) বলেন-

قَلَّبْتُ مَشَارِقَ الْأَرْضِ، وَمَغَارِبَهَا، فَلَمْ أَرَ رَجُلًا أَفْضَلَ مِنْ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَلَمْ أَرَ أَبٍ أَفْضَلَ مِنْ بَنِي هَاشِمٍ

অনুবাদঃ আমি পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত খুঁজলাম। কিন্তু মুহাম্মাদ (ﷺ) থেকে উত্তম কাউকে দেখিনি। আর কোন পিতার সন্তানকে বনু হাশিমের থেকে উত্তম দেখিনি।  ৭

7➠

১) তাবরানী, মু'জামুল আওসাত, ৬/২৩৭, হাদীসঃ ৬২৮৫

২) লালকায়ী, শরহু উসুলি ই'তিকাদি আহলিস সুন্নাহ, ৪/৮২৯, হাদীসঃ ১৪০২

৩) কাযী আয়ায, আশ-শিফা বি-তা'রিফে হুকুকিল মুস্তফা, পৃ➠ ৫১৬

৪) কাস্তালানী, মাওয়াহিব, ১/৫৮

৫) সালেহী শামী, সুবুলুল হুদা, ১/২৩৬


হুযুর আকরাম (ﷺ) সকল সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম এবং সকল পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান। সৃষ্টিগত দিক থেকে তিনি সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের মধ্যে প্রথম এবং প্রেরণের থেকে তিনি সর্বশেষ। আল্লাহ তাআলা তারই উপর নবুয়ত ও রিসালাতের ধারাবাহিকতা শেষ করেছেন। 

صلى الله عليه و عليهم اجمعين


সর্বপ্রথম সৃষ্টি


(ইমাম সামহুদী (رحمة الله) বলেনঃ)

خَلَقَهُ اللهُ اَوَّلَ خَلْقِهِ نُوْرَاهُ نَاظِرًا اِلَى الْحَقِّ

আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সর্বপ্রথম তাঁরই নূর সৃষ্টি করেছেন এবং তা (নূরে মোহাম্মদী) আল্লাহ তাআলার দিদার করতে থাকে। আল্লাহ তাআলা প্রসংশা করতে থাকেন এরপর এই নূর মহৎ ও উত্তম বাবা ও দাদাদের পৃষ্ঠ থেকে পবিত্র মায়েদের রেহেমের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে। তাদের ওপর উৎকৃষ্ট দুরুদ ও পাক-পবিত্র সালাম হোক। 


❏ হযরত সাইয়্যেদুনা (আবদুল্লাহ) ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত নবী কারীম (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ

لَمَّا خَلَقَ اللَّهُ آدَمَ أَهْبَطَنِي فِي صُلْبِهِ إِلَى الْأَرْضِ فَجَعَلَني فِي صُلْبِ نُوحٍ فِي السَّفِينَةِ، وَقَذَفَ بِي فِي النَّارِ فِي صُلْبِ إِبْرَاهِيمَ، ثُمَّ لَمْ يَزَلِ اللهُ يَنْقُلُنِي مِنَ الأَصْلَابِ الْكرِيْمَةِ إِلَى الْأَرْحَامِ، حَتَّى أَخْرَجَنِي مِنْ بَيْنِ أَبَوَيَّ، وَلَمْ يَلْتَقَيَا عَلَى سِفَاحٍ قَطُّ فَأَنَا خَيْرُكُمْ نَفْسًا وَخَيْرُكُمْ اَبًا

যখন আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (عليه السلام) কে সৃষ্টি করলেন তখন ঐ নূরকে তাঁর পেশানিতে রেখে জমিনে নামালেন। (এরপর) নূহ (عليه السلام) এঁর পৃষ্ঠদেশে রাখলেন। এরপর ইবরাহীম (عليه السلام) এঁর পৃষ্ঠদেশে রাখলেন। আল্লাহ তায়ালা আমাকে পবিত্র পৃষ্ঠসমূহ থেকে পবিত্র রেহেমসমূহে স্থানান্তর করতে থাকেন। যখন দুইটি গোত্র হয়েছে তখন আমাকে তাদের মধ্যে উত্তম গোত্রে রেখেছেন যতক্ষন না আমি আমার পিতা-মাতার মাধ্যমে দুনিয়াতে এসেছি। যারা কখনো কোন অপবিত্র কাজে লিপ্ত হন নি। তাই আমি তোমাদের মধ্যে নিজ ব্যক্তিসত্ত্বা ও বংশ দুই দিক থেকেই সর্বোত্তম।  ৮

8➠

১) ইবনে হাজার, আল মাতালিবুল আলিয়াহ, ১৭/১৯৫, হাদীসঃ ৪২০৯

২) সুয়ূতী, দুররুল মানছুর, ৭/৬০৭

৩) ইবনে কাছীর, আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া, ৩/৩৭০


❏ ইমাম ইবনে সা'দ; হযরত হিশাম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনুস সায়িব কালবী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-

كَتَبْتُ  لِلنَّبِيِّ   صَلَّى  اللهُ  عَلَيْهِ  وَسَلَّمَ  خَمْسَ  مِائَةِ  اُمٍّ فَمْا وَجَدْتُ فِيْهِنَّ سِفَاحًا وَلاَ شَيْئًا مِمِّا كَانَ مِنْ اَمْرِ الجَاهِلِيَّة

আমি নবী করিম (ﷺ) -এঁর বংশধারার পূর্ববর্তী পাঁচশত  মায়ের তালিকা প্রস্তুত   করেছি।  তাঁদের মধ্যে  আমি চরিত্রহীনতা এবং জাহেলিয়াতের কিছুই পাইনি। ৯

9➠

১) ইবনে সা'দ, তাবাকাত, ১/৪২

২) ইবনে কাছীর, আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া, ৩/৩৬৪

৩) কাসতালানী, আল মাওয়াহিবু লাদুন্নিয়াহ, ১/৮৬

 

নবী করীম (ﷺ) এমনভাবেই পবিত্র পৃষ্ঠ থেকে পবিত্র রেহেমের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়ে দুনিয়াতে আসেন। এই স্থানান্তরের ধারাবাহিকতা হুযুর (ﷺ) এঁর মহান দাদা আবদুল মুত্তালিব বিন হিশাম বিন আবদে মানাফ বিন কুসাই ইবনে কিলাব বিন মুররা বিন কা'ব বিন লুয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর বিন মালিক বিন নাছর বিন কিনানা বিন খুযায়মা বিন মুদরিকাহ বিন ইলিয়াস বিন মুদার বিন নাযার বিন মা'দ বিন আদদান এসে পৌছে।

এই পর্যন্ত (অর্থাৎ আদনান পর্যন্ত) সকল আহলে শান (উলামায়ে কেরাম) একমত। আর এই ব্যাপারে কোন ইখতিলাফ নেই যে, হযরত আদনান মূলত আল্লাহর নবী হযরত ইসমাঈল বিন খালীলুল্লাহ ইবরাহীম (عليه السلام) এঁর বংশধর। ইখতিলাফ শুধু এই ব্যাপারে আছে যে, হযরত আদনান এবং হযরত ইসমাঈল (عليه السلام) এঁর মাঝখানে কতজন রয়েছেন?


হযরত আবদুল মুত্তালিবের ললাটে নূরে মুহাম্মাদী (ﷺ) 


যখন এই নূরে মোহাম্মাদী হযরত সাইয়্যিদুনা আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) পর্যন্ত পৌছালো তখন ঐ নূর তাঁর পেশানীকে আলোকিত করে দিল। যার বদৌলতে তাঁর শান্তি ও স্বচ্ছলতা আসলো। হযরত আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) সংকল্প করলেন যেন এই নূর তাঁর থেকে কখনো আলাদা না হয়। 


এমনকি তাকে স্বপ্নে বলা হলোঃ হে আবদুল মুত্তালিব! ফাতেমা বিনতে আমর বিন আয়য কে বিবাহ করো। এরপর তিনি বিবাহ করলে ওই নুরের স্থানান্তর হওয়ার সময় আসে। এবং যখন তাঁর পেশানীর থেকে ওই নূর স্থানান্তরিত হওয়ার সময় আসে তখন হযরত সাইয়েদুনা আব্দুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) তার অভ্যাস মোতাবেক শিকার করার জন্য বের হন। কিছু সময় পরে শিকার থেকে যখন ফিরে আসেন তখন তার প্রচন্ড পিপাসা লাগে। তিনি তখন জমজম কুপের নিকটে গেলেন এবং পানি পান করলেন। এরপর তার স্ত্রী ফাতেমার নিকটে গেলেন। তখন সাইয়্যেদুনা আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) তাঁর গর্ভে আসেন। যিনি জন্ম হতে যাওয়া সকল মানুষের মধ্যে সবচেয়ে মহান (মোহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) এঁর ভবিষ্যৎ পিতা। এভাবে পূর্বপুরুষদের মধ্য দিয়ে আসতে থাকা এই নূর তাঁর স্ত্রীর (গর্ভের) মধ্যে স্থানান্তরিত হয়ে গেল। যখন সাইয়্যেদুনা আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) জন্ম নিলেন তখন এই নূর তার ললাটে চমকিত হলো এবং যে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করত সেই ইচ্ছা করত যেন ওই নূর সে লাভ করে। 


সাইয়্যেদুনা ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়া (عليه السلام) নিহত হওয়ার সময় পরিহিত জামা


শাম দেশে অবস্থানরত ইয়াহুদী আলেমগণ এটা জেনে গিয়েছিল যে, খাতামুন্নাবীয়্যিন (ﷺ) এঁর পিতার জন্ম হয়ে গেছে। কারণ তাদের নিকট হযরত সাইয়্যেদুনা ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়া (عليه السلام) এর রক্ত-রঞ্জিত একটি সাদা জুব্বা ছিল। আর এটা সেই জুব্বা ছিল যা (পরিহিত অবস্থায়) তিনি (عليه السلام) শহীদ হয়েছিলেন। ওই ইয়াহুদী আলেমগণ তাদের কিতাবে পড়েছিল যে, যখন এই জুব্বা থেকে রক্ত উঠে (আগের মত) সাদা হয়ে যাবে তখন বুঝে যাবে যে, আখেরী নবী মুহাম্মদ (ﷺ) এঁর পিতার জন্ম হয়ে গেছে।


ঐ ইয়াহুদীরা মক্কা মুকাররামাতে যাওয়ার ইচ্ছা করল যাতে হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) এঁর বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করতে পারে। একদিন তারা হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) -কে একাকী পেয়ে গেল। তারা তাঁকে হত্যা করার চিন্তা করল (এবং হত্যা করার জন্য সামনে আগালো)। তখন তারা একটি ঘোড়া দেখতে পেলো যা দুনিয়ার কোন ঘোড়ার মত নয় বরং ঐ ঘোড়া তাদের ওপর আক্রমন করল এবং তাদেরকে (হত্যা করতে) বাধা দিল। 


যমযম কূপ


হযরত সাইয়্যেদুনা আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) কুরাইশদের সরদার, হারামের বুযুর্গ এবং বনু ইসমাঈলের গোত্রসমূহের মধ্যে সম্মানিত ছিলেন। একবার তিনি স্বপ্নে দেখলেন- কেউ একজন এলো এবং তাঁকে যমযম কূপ খনন করতে বলল। এবং ঐ জায়গাও চিহ্নিত করে দিল (যেখানে যমযম কূপ অবস্থিত)। এই যমযম কূপ তাঁর দাদা সাইয়্যেদুনা ইসমাঈল (عليه السلام) এঁর পানির (প্রবাহের) স্থান এবং হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) এঁর খননকৃত গর্ত। এটা জুরহাম (গোত্রের) অধিবাসীরা বন্ধ করে দিয়েছিল। এবং পাঁচশত বছ যাবৎ তার কোন চিহ্নও অবশিষ্ট ছিল না। 

যখন খুযা'আহ গোত্রের নিকট বায়তুল হারামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব আসে তখন হযরত সাইয়্যিদুনা আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) তাঁর পুত্রকে সাথে নিলেন এবং জমজম কূপ খনন করা শুরু করলেন। ওই সময়ে অন্য কোন শরিক ছিল না। তারা তিন দিন পর্যন্ত খনন করলেন। এক সময় জমজমের কিনারা দেখতে পেলেন। তাঁরা তাদের রব আল্লাহ তায়ালার তাকবীর দিলেন এবং বললেনঃ এটা ইসমাইল (عليه السلام) এর প্রাচীর। কুরাইশগণ বললঃ আমাদেরও এই কাজে অংশীদার করে নাও। তখন তিনি বললেনঃ আমি এই কাজ নিজে করছি না। এই সৌভাগ্য তো মানুষের মধ্যে থেকে নির্বাচিত করে নেওয়া হয়েছে। এজন্য মানুষ হযরত আব্দুল মুত্তালিব এবং জমজম কূপের মাঝখানে বাধা হয়ে দাড়ালো। তখন তিনি এই কূপ দ্বিতীয় বার খনন করা শুরু করলেন এবং তার মধ্য থেকে খানায়ে কাবার জিনিসপত্র বের করে নিলেন।


সাইয়্যেদুনা আব্দুল মুত্তালিবের মান্নত 


যখন হযরত আব্দুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) যমযম কূপ খনন করার সময় কোন সঙ্গী পাচ্ছিলেন না ওই সময়ে তিনি মান্নত করেছিলেন যে, যদি তার দশটি পুত্র সন্তান হয় তাহলে তার মধ্য থেকে একজনকে কুরবানী করে দিবেন। দশ জনের সংখ্যা হযরত সাইয়্যেদুনা আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) দ্বারা পূর্ণ হয়। তখন তিনি তার মানত পূর্ণ করার ইচ্ছা করলেন যে, তিনি ওই ১০ জনের মধ্য থেকে একজনকে কুরবানী করবেন। তখন তিনি বাইতুল হারামের প্রাঙ্গণে সকল পুত্রের নামের (লটারি করার জন্য) গুটি ফেললেন। সেখানে নবী আকরাম নবী করীম (ﷺ) এঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) এঁর নামও ছিল। হযরত আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) চাচ্ছিলেন যেন আবদুল্লাহর (رضي الله عنه) নামের গুটি না ওঠে। কারণ তিনি তাকে খুব মহব্বত করতেন। কিন্তু গুটিতে তারই নাম উঠলো। তিনি তাঁকে ওই সময়ই কুরবানী করার ইচ্ছা করলেন। কিন্তু কুরাইশগণ তাকে নিষেধ করলেন এবং বললেন- যদি আপনি এটা করেন তাহলে আরবগনও ভবিষ্যতে আপনার অনুসরণ করবে (অর্থাৎ সকলেই তাদের সন্তানকে হত্যা করবে)। এজন্য আপনি প্রত্যেক গুটির বদলে দশটি উট যুক্ত করুন। তখন হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) এঁর দিয়তের (রক্তপনের) পরিমান ঊট দ্বারা দেয়া হয়। ঐ সময় দিয়তের পরিমান দশ ঊট ছিল। এরপর যদি দ্বিতীয় বারও (লটারিতে) তাঁর নামই ওঠে তাহলে আরও দশটি ঊট যুক্ত হবে। এভাবে করতে করতে যদি গুটি ঊটের নামে গিয়ে পরে তাহলে বুঝবেন, এই ফিদিয়া কবুল হয়েছে। 

সাইয়্যেদুনা আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) তাই করলেন। এবং বার বার (লটারির) গুটি ফেলতে থাকেন এবং একেক বারে দশটি করে ঊট হতে থাকে। কারণ, প্রতি বার হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) এঁর নামই উঠছিল। কিন্তু যখন একশ ঊট হয়ে গেল তখন ঊটের নাম উঠল। হযরত সাইয়্যিদুনা আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) (শুধু একবারেই সন্তুষ্ট হলেন না। বরং) আরও তিনবার গুটি ফেললেন। তখনও প্রতি বার ঊটের নামই আসে। তখন তিনি হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) এঁর পক্ষ থেকে ঊট জবেহ করলেন এবং হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) এঁর পেশানিতে আল্লাহ তায়ালার হাবীব ও খলিল (ﷺ) এঁর ঐ নূর চমকিত রাখলেন। 


কুরাইশদের নারীগণ এবং নূরে মোহাম্মাদী


কুরাইশদের নারীগণ ঐ নূরকে দেখতেন এবং তা পাওয়ার আকাক্সক্ষা করতেন। হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) ফেরেশতাদেরকে দেখতেন যারা তাঁকে মোবারকবাদ দিতেন। যখন হযরত সাইয়্যেদুনা আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) তাঁর বিবাহ দেয়ার ইচ্ছা করলেন ঐ সময়ে ওয়ারাক্বাহ ইবনে নওফেলের বোন রুকইয়াহ তাঁর (হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন রুকইয়াহ বলতে লাগল- "আমার নিকট এসো। আমি তোমাকে তত ঊট দেব, যা তোমার জন্য যবেহ করা হয়েছিল।" হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) বললেনঃ

أَمَّا الْحَرَامُ فَالْمَمَاتُ دُونَهْ ... وَالْحِلُّ لَا حَلَّ فَأَسْتَبِينَهْ

فَكَيْفَ لِي الْأَمْرُ الَّذِي تَبْغِينَهْ ... يُحْمِي الْكَرِيْمُ عِرْضَهُ وَدِيْنَهُ

অনুবাদঃ হারাম কাজ করার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো আর হালালের তো অস্তিত্বই নেই। সুতরাং, তুমি আমার কাছে যা চাও (তা কখনোই হবে না। শুনে নাও) একজন নেক ব্যক্তি তাঁর ধর্ম ও সম্মান বজায় রাখে। ১০

10➠  সিরাতে ইবনে হিশাম, ১/১০৪


এরপর তিনি তাঁর পিতার সাথে ওহব ইবনে আবদে মান্নাফের নিকট যান যিনি ছিলেন নেক ও পবিত্র হযরত আমিনা (رضي الله عنه) এঁর পিতা। এবং তিনি শামের ঐ ইয়াহূদীদের সাথে ষড়যন্ত্র দেখেছিলেন যারা হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) কে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। তিনি ঐ ঘোড়াসমূহকেও দেখেছিলেন যেগুলো তাদেরকে (হত্যা করা থেকে) বাধা দিয়েছিল। 

 

তা'লীকঃ


হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) কে প্রস্তাব প্রদানকারীনি রমনী ছিল "কায়লা" কিন্তু তাকে রুকইয়া বিনতে নওফেল নামে ডাকা হত। সে ছিল বনু আসাদ ইবনে আবদুল উযযা গোত্রের। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ সেই প্রস্তাবে রাজী হননি। বস্তুত সকলেই হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) এঁর কপালে থাকা নূরে মোহাম্মাদীর আকাঙ্ক্ষী ছিল। সকলেই চাইত যেন সেই নূর তারা লাভ করতে পারে। কিন্তু হযরত আবদুল মুত্তালিব তাঁর সবচেয়ে আদরের সন্তান হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) এঁর বিবাহ হযরত সাইয়্যেদাহ আমিনা বিনতে ওহব এঁর সাথে দেন। 

━━━━━━━━━━━━━━━━


সাইয়্যেদুনা আবদুল্লাহ ও সাইয়্যেদা আমিনার বিবাহ


ওহব ইবনে আবদে মান্নাফেরও ইচ্ছে হলো (নিজের কন্যা) আমিনার বিবাহ তাঁর (আবদুল্লাহর) সাথে দেয়ার। হযরত সাইয়্যিদাহ আমিনা (رضي الله عنه) ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে উত্তম কন্যা। তাই, তিনি তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। এরপর হযরত আমিনার বিবাহ করিয়ে দেন এবং ঐ বিবাহ বরকত প্রকাশের একটি মাধ্যম হয়ে গেল। 

 

তা'লীকঃ 


হযরত আমিনা (رضي الله عنه) এঁর বংশীয় নসবনামা হল- (آمِنَةُ بِنْتُ وَهْبِ بْنِ عَبْدِ مَنَافِ بْنِ زُهْرَةَ بْنِ كِلَابِ) আমিনা বিনতে ওহব ইবনে আবদে মান্নাফ ইবনে যুহরাহ ইবনে কিলাব। উলে­খ্য যে, মদিনার বনী আদি বংশের জাহরা গোত্রে আব্দুল মোত্তালেবও বিবাহ করেছিলেন এবং সেই ঘরে আবু তালেব, হযরত হামজা, হযরত আব্বাছ ও নবী করিম [ﷺ]-এঁর  পিতা হযরত আব্দুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। সেই গোত্রেরই কন্যা ছিলেন বিবি আমেনা  (رضي الله عنه)।  সুতরাং হযরত আব্দুল্লাহ ও নবী করিম [ﷺ] উভয়েরই মাতুলালয় ছিল মদিনা। আবদে মান্নাফে গিয়ে হুযুর আকরাম (ﷺ) এঁর সম্মানিত পিতা ও মাতা উভয়ের বংশ (অর্থাৎ দাদা ও নানার বংশ) এক হয়ে গেছে। ইমাম কাস্তালানী মাওয়াহিবে লিখেন- (وهى يومئذ أفضل امرأة فى قريش نسبا وموضعا) অর্থাৎ হযরত আমিনা (رضي الله عنه) বংশ ও মর্যাদার দিক দিয়ে কুরাইশ নারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন।  ১১

11➠  আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ, ১/৭১


সুতরাং হুযুর আকরাম (ﷺ) এঁর সম্মানিত পিতা ও মাতা উভয়ই উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তাঁরা কখনোই জাহিলিয়াতের কাজে পতিত হননি। 

━━━━━━━━━━━━━━━━


❏ যখন হযরত আমিনার মধ্যে নূরে হাবীব (ﷺ) স্থানান্তর হওয়ার সময় আসলো তখন আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের প্রহরী রিদওয়ানকে হুকুম দেন জান্নাতুল ফিরদৌসের দরজা খুলে দিতে এবং আসমান ও জমিনে ঘোষণা করে দিতে যে, ঐ নূর যার কারণে সকল ভালো কিছুর প্রকাশ হয়েছে, এই মুহূর্তে হযরত আমিনার রেহেমে যাচ্ছে। কিন্তু এর বরকত পুরো কায়েনাতের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে। 

এরপর হযরত সাইয়্যিদুনা আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) (তাঁর স্ত্রী) সাইয়্যেদাহ আমিনা (رضي الله عنه) এঁর নিকট তাশরীফ আনেন এবং প্রশান্তি লাভ করেন। সুতরাং ঐ নূর তাঁর মধ্যে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। এভাবেই তিনি হাবীব ও শাফী' (ﷺ) এঁর অস্তিত্বের ধারণ করে গর্ভবতী হন। এই ঘটনা সোমবারে অথবা রজব মাসের প্রথম জুমাতে মক্কা মুকাররমায় শি'আবে আবি তালিবে সংঘটিত হয়। অন্য বর্ণনা মতে, মিনাতে জামরায়ে উসতার নিকটে আইয়ামে তাশরিকে সংঘটিত হয়।  ১২

12➠  আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ, ১/৭১


তা'লীকঃ


❏ হুযুর আকরাম (ﷺ) এঁর নূর মোবারক হযরত আমিনা (رضي الله عنه) এঁর শেকম মোবারকে আসে সোমবারে অথবা রজব মাসের প্রথম জুমুয়াহর রাতে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে। অন্য মত থাকলেও এটাই অধিক প্রসিদ্ধ। যা মাওয়াহিব ও আনওয়ারে মুহাম্মাদিয়া গ্রন্থে উলে­খ রয়েছে। ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক সূত্রে বর্ণিত আছে, যখন হুযুর আকরাম (ﷺ) হযরত আমিনা (رضي الله عنه) এঁর গর্ভে আসেন তখন তাঁকে স্বপ্নযোগে জানিয়ে দেয়া হয় যে- (إنك قد حملت بسيد هذه الأمة) আপনি এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ সন্তানকে ধারণ করেছেন।   ১৩

13➠  সিরাতে ইবনে ইসহাক, পৃঃ ৪৫


❏ ইবনে সা'দ বর্ণনা করেনঃ (قَدْ حَمَلْتِ بِسَيِّدِ هَذِهِ الأُمَّةِ وَنَبِيِّهَا) আপনি এই উম্মতের সর্দার এবং নবীকে গর্ভে ধারণ করেছেন।  ১৪

14➠  তাবাকাতে ইবনে সা'দ, ১/৭৯


❏ ঐ নূর মোবারক হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) থেকে আমিনা (رضي الله عنه) এঁর মধ্যে চলে গেলে ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের বোন রুকইয়া যে হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) কে বিবাহ করতে চেয়েছিল সে এখন আর তাঁকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিচ্ছিল না। 

━━━━━━━━━━━━━━━━

হযরত আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) জিজ্ঞেস করলে সে বলল-

فَارَقَكَ النُّورُ الَّذِي كَانَ مَعَكَ بِالأَمْسِ، فَلَيْسَ لِي بِكَ الْيَوْمَ حَاجَةٌ، إنما أردت أن يكون النور فيّ فأبى الله، إلا أن يجعله حيث شاء.

অর্থঃ গতকাল আপনার কপালে যে নূর ছিল, আজ সে নূর আপনার থেকে বিদায় নিয়েছে। তাই আজ আপনাকে আমার কোন প্রয়োজন নেই। আমার ইচ্ছে ছিল  সেই নূর আমার মধ্যে স্থানান্তরিত হোক। কিন্তু আল্লাহর তা কবুল করেন নি, তাই তিনি যেখানে চেয়েছেন সেখানেই স্থানান্তরিত করেছেন। ১৫

15➠

১) আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ, ১/৭২

২) সিরাতে ইবনে হিশাম, ১/১৫৭

৩) ইয়ুনুল আছার, ১/৩০

৪) আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৩/৩৪৮

৫) সিরাতে হালবিয়া, ১/৬০


সম্মানিত পিতার ইনতিকাল


যখন হযরত আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) এর বয়স মোবারক ২০ বছর হয় তখন তাঁর পিতা (হযরত আবদুল মুত্তালিব) তাঁকে কিছু ব্যবসায়িক পণ্য নিয়ে আসার জন্য কুরাইশ ব্যবসায়ীদের সাথে শামে সফরে প্রেরণ করেন। শাম থেকে ফেরার পথে মদিনা মুনাওয়ারাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাঁকে তাঁর পিতার আত্মীয়দের একজন বনি আদি ইবনে নাজ্জার এর নিকট রেখে যাওয়া হয়। (এই রোগেই) তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়। এবং নেককারদের শহর তায়বার 'দারু নাবেগা'-তে তাকে দাফন করা হয়।


সহিহ বর্ণনা অনুযায়ী, ওই সময়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর মাতার রেহেমে ছিলেন এবং এটা ছিল ইয়াতিমীর চূড়ান্ত অবস্থা। এরপর ফেরেশতারা বারগাহে ইলাহী তে আরজ করেনঃ হে আমাদের রব! আপনার নবী পিতা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল। এখন তার অভিভাবক কেউ নেই। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ আমি তার অভিভাবক ও সাহায্যকারী এবং রক্ষাকারী। 


❏ হযরত সাইয়্যেদাহ আমিনা (رضي الله عنه) এঁর নিকট যখন ইন্তেকালের খবর পৌঁছায় তখন তিনি শোকার্ত হয়ে বলেনঃ

عفا جانب البطحاء من ابن هاشم ... وجاور لحدا خارجا في الغماغم

دعته المنايا دعوة فأجابها ... وما تركت في الناس مثل ابن هاشم

فإن تك غالته المنايا وريبها ... فقد كان معطاء كثير التراحم

বাতহার জমিন হাশিমের পুত্রকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে ফেললো, সে চিৎকার ও গোলমালের মাঝে সমাধিতে বানানো হলো। মৃত্যু মানুষের মধ্যে ইবনে হাশিমের মত কোন ব্যক্তিকে ছাড়ে নাই। যদিও মৃত্যু এবং মৃত্যুর ঘটনাবলী তার অস্তিত্বকে শেষ করেছে। তবুও তার উন্নততর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে মুছে ফেলতে পারবে না। তিনি ছিলেন বড়ই দয়াবান এবং কোমল অন্তঃকরণের অধিকারী।  ১৬

16➠

১) মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, ১/৭৫

২) সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১/৩৩২

৩) তারিখুল খামিস, ১/১৮৭

  

হাবীবে পাক (ﷺ) এঁর জন্ম


যখন নবুয়তের চাঁদের পূর্ণিমা হওয়ার এবং ঈমান ও হিদায়াতের সূর্যের চমকানোর সময় আসলো (অর্থাৎ প্রিয় রাসূল (ﷺ) এঁর জন্মের সময় আসলো) তখন আসমানসমূহ ও জমিনসমূহে সুসংবাদ দেয়া হল এবং কায়েনাতের মধ্যে খায়ের ও বরকত দান করা হল। কুরাইশদের অত্যন্ত দারিদ্র থেকে সম্পদশালী করা হল এবং নেয়ামতের বৃষ্টি বর্ষিত হল। 


❏ হযরত সাইয়্যেদাহ আমিনা (رضي الله عنه) বলেনঃ আমার অনুভবই হয়নি যে, আমি গর্ভবতী। আর না আমি গর্ভধারণের কোন কষ্ট পেয়েছি। শুধুমাত্র আমার হায়েয বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঘুমে ও জাগ্রত অবস্থায় সর্বদাই শুনতে পেতামঃ 

إِنَّكِ حَمِلْتِ بِنِبِيِّ هَذِهِ الأُمَّةِ سيد الاُنام

"আপনি মানুবকুলের সরদার এবং এই উম্মতের নবী (ﷺ) কে গর্ভে ধারণ করেছেন।" যখন তাঁর (ﷺ) মুবারক জন্ম হলো এবং এই জমিনে তাশরীফ আনলেন তখন আমি (এই কাসীদা) বললামঃ 

أُعِيذُهُ بِالْوَاحِدِ ... مِنْ شَرِّ كُلِّ حَاسِدٍ

আমি তাঁকে সকল হিংসাকারীর অনিষ্ট থেকে মহান এক ও অদ্বিতীয় (জাল্লা জালালুহু) এঁর আশ্রয়ে দিলাম।" ১৭

17➠

১) সীরাতে ইবনে ইসহাক, ১/৪৫

২) সীরাতে ইবনে হিশাম, ১/১৫৮

৩) শারাফুল মুস্তফা, ১/৩৫০

৪) আবু নুয়াইম, দালায়েলুন নবুয়াহ, ১/১৩৬

৫) বায়হাকী, দালায়েন নবুয়াহ, ১/৮২

৬) মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ, ১/৭৩

  

وآيَةُ ذَلِكَ أَنه يَخْرُجَ مَعَهُ نُورٌ يملأ قصور بصرى من أَرْضِ الشَّامِ، فَإِذَا وَقَعَ فَسَمِّيهِ مُحَمَّدًا، فَإِنَّ اسْمَهُ فِي التَّوْرَاةِ والإنجيل أَحْمَدُ، واسْمَهُ في القران محمد يَحْمَدُهُ أَهْلُ السَّمَاءِ وَأَهْلُ الْأَرْضِ 

❏ জন্মের সময়ের একটি মু'জিযা ও নিদর্শন এমনভাবে প্রকাশ হল যে, তাঁর সাথেই এক নূর বের হলো যার দ্বারা শামের বুছরা এলাকার প্রসাদ সমূহ আলোকিত হয়ে গেল। তাঁর নাম মোবারক রাখা হলো মুহাম্মাদ। কারণ, তাওরাত ও ইনজিলে তাঁকে আহমদ বলা হয়েছে এবং কুরআন মাজীদে মুহাম্মাদ বলা হয়েছে। (এবং বলা হয়েছে) আসমান ও জমিনবাসী তাঁর প্রশংসা করবে। ১৮

18➠

১) সীরাতে ইবনে ইসহাক, ১/৪৫

২) বায়হাকী, দালায়েলুন নবুয়াহ, ১/৮২

৩) সুয়ূতী, খাছায়েছুল কুবরা, ১/৭৯

  

❏ এরপর ফেরেশতারা সাইয়্যেদাহ আমিনা (رضي الله عنه) এঁর পবিত্র ঘরে নাযিল হয়ে তাঁকে ঘিরে নিল। তাঁরা আল্লাহর প্রশংসা, পবিত্রতা ও তাকবির বলতে লাগল। তখন হযরত সাইয়্যেদাহ আমিনা (رضي الله عنه) হাবীবে কারীম (ﷺ) কে জন্ম দিলেন। নবী করীম (ﷺ) অত্যন্ত সুন্দর ও পুত পবিত্র রূপে তাশরীফ আনলেন। এসেই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে ঝুকলেন এবং মাথা মোবারক আসমানের দিকে উঁচু করলেন। তাঁর চোখ মুবারকে সুরমা লাগানো ছিল। তিনি (ﷺ) এমন পাক পবিত্র ভাবে জন্ম নিলেন যেখানে অপবিত্রতার কোন চিহ্ন ছিল না। নাভী কর্তিত অবস্থায় ছিল এবং সাদা রঙের খতমে নবুয়তের মোহর লাগানো ছিল। আঙ্গুলসমূহ মুষ্টি করা ছিল শুধু শাহাদাত আঙ্গুল খোলা ছিল। যার দ্বারা তাসবীহের ইশারা করছিলেন। তাঁর (ﷺ) থেকে এমন নূর প্রকাশিত হল যার দ্বারা পূর্ব ও পশ্চিম (সব কিছু) আলোকিত হয়ে গেল। ঐ আলোতেই তাঁর সম্মানিত মাতা নিজ চোখ দিয়ে বসরার প্রাসাদসমূহ দেখলেন।  ১৯

19➠ সহীহ ইবনে হিব্বান; মুসতাদরাক লিল হাকেম; মুসনাদে আহমদ -এ হযরত ইরবায ইবনে সারিয়াহ সুলামি (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। 

  

এই পুরো ঘটনা পবিত্র শহর মক্কা মুকাররামার ঐ পবিত্র ঘরে সংঘটিত হয় যা এখন "মওলিদুন্নবী" নামে পরিচিত। পরবর্তীতে (খলিফা হারুনুর) রশিদের মাতা 'খায়যুরান' সেটা তার বাসগৃহ বানায়। 

 

তা'লীকঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে ঘরে জন্ম নেনঃ


হুযুর নবী করিম (ﷺ) যে ঘরে তাশরীফ আনেন তা অত্যন্ত বরকতময়। যে জায়গায় সরকারে দো আলম (ﷺ) এঁর নূর মোবারক বাশারিয়তের রূপে দুনিয়াতে আগমন করেছে তা নিঃসন্দেহে অন্য কোন সাধারণ স্থানের মত নয়। তাই হুযুর আকরাম (ﷺ) এঁর বিলাদতের ঘর হযরত আমিনা (رضي الله عنه) এঁর ঘর অত্যন্ত বরকতময় একটি ঘর। কেন হবে না? এটা তো সেই ঘর, যে ঘরে হযরত আমেনা (رضي الله عنه) নূরে মোহাম্মাদীর ঝলক দেখেছেন। যে ঘরে হযরত আছিয়া, হযরত মরিয়ম (আলাইহাস সালাম) ও অসংখ্য ফেরেশতা আগমন করেছেন সেই ঘর বরকত হবে না কেন? যে ঘরে রহমাতুল্লিল আলামীন বা সমস্ত জগতের রহমতের আগমন হল সেই ঘর তো রহমতপূর্ণ হবেই। হাজী সাহেবগণ বা মক্কা মদীনার মুসাফিরগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এঁর বিলাদতের বরকতময় ঘরের যিয়ারত করে থাকেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ পাকের নিকট রহমত ও বরকতের চান। সেখানে নামায আদায় করেন।


দেখুন হাদীসে পাকে আছে, 

❏ মে'রাজ রজনীতে যখন বাইতুল লাহাম (বর্তমানে বেতেলহাম) এ পৌছান তখন হযরত জীবরাঈল (عليه السلام) নবী করীম (ﷺ) কে বললেন-

انْزِلْ فَصَلِّ، فَنَزَلْتُ فَصَلَّيْتُ، فَقَالَ: اَتَدْرِي اَيْنَ صَلَّيْتَ؟ صَلَّيْتَ بِبَيْتِ لَّحْمٍ حَيْثُ وُلِدَ عِيْسَى عليه السلام

আপনি (বোরাক থেকে) নামুন এবং নামায আদায় করুন। আমি নেমে নামায আদায় করলাম। তখন জীবরাঈল (عليه السلام) বলেনঃ আপনি কি জানেন আপনি কোথায় নাময আদায় করলেন? আপনি 'বাইতুল লাহম'-এ নামায আদায় করলেন যেখানে ঈসা (عليه السلام) এর জন্ম হয়েছিল।  ২০

20➠

১) নাসায়ী, সুনান, কিতাবুস সালাত, باب فرض الضلاة , ১/২২২, হাদীসঃ ৪৫

২) তাবরানী, মুসনাদ, ১/১৯৪, হাদীসঃ ৩৪১

৩) তাবরানী, মু'জামুল কবীর, ৭/২৮৩, হাদীসঃ ৭১৪২

৪) বাযযার, মুসনাদ, শাদ্দাদ ইবনে আওস থেকে, ৮/৪১০, হাদীসঃ ৩৪৮৪

৫) হায়সমী, মাজমাউয যাওয়াইদ, ১/৮৩

৬) আসকালানী, ফাতহুল বারী, ৮/১৯৯


যদি ঈসা (عليه السلام) এঁর জন্মের ঘরে নামায আদায় করা হয় তাহলে হুযুর আকরাম (ﷺ) এঁর বেলাদতের ঘরে নামায আদায় করলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহর রহমত নাযিল হবে। 


হুযুর আকরাম (ﷺ) এঁর বেলাদতের ঘরে ইমাম হাকেম নিশাপুরী (رحمة الله) এঁর নামায আদায়ঃ


❏ ইমাম হাকেম (رحمة الله) (ওফাত ৪০৫ হি.) যিনি বিখ্যাত হাদীসের কিতাব "আল-মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন" কিতাবের লেখক, তিনি স্বীয় কিতাবে লিখেন-

وُلِدَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الدَّارِ الَّتِي فِي الزِّقَاقِ الْمَعْرُوفِ بِزِقَاقِ الْمَدْكَلِ بِمَكَّةَ، وَقَدْ صَلَّيْتُ فِيهِ وَهِيَ الدَّارُ الَّتِي كَانَتْ بَعْدَ مُهَاجَرِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي يَدِ عَقِيلِ بْنِ أَبِي طَالِبٍ فِي أَيْدِي وَلَدِهِ بَعْدَهُ

নবী করীম (ﷺ) মক্কার সেই গলির ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন যা "যিকাকুল মাদকাল" নামে প্রসিদ্ধ। আমি (ইমাম হাকেম) সেই ঘরে নামায আদায় করেছি। এটা সেই ঘর যা হুযুর (ﷺ) এঁর হিজরতের পর আকীল ইবনে আবী তালিব এঁর দখলে থাকে এবং তার পর তার সন্তানদের দখলে চলে যায়।   ২১

21➠  হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, ২/৬৫৭, হাদীসঃ ৪১৭৭


❏ মাওয়াহিবে আছে-

وقيل لاثنى عشر، وعليه عمل أهل مكة فى زيارتهم موضع مولده فى هذا الوقت

কারো মতে ১২ই রবিউল আউয়াল হুযুর (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেন। আরববাসীগণ এর ওপরই আমল করেন। তাঁরা এই দিনে বিলাদত শরীফের স্থান যিয়ারত করেন।  ২২

22➠  মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, ১/৮৫


❏ পরবর্তীতে হাজ্জায বিন ইউসূফের ভাই মোহাম্মাদ বিন ইউসূফ সাক্বাফী বাড়িটি হযরত আকীল ইবনে আবী তালিব থেকে ক্রয় করে নেয়। এরপর ৭১ হিজরীতে খলিফা হারুন অর রশিদের মাতা খায়যুরান সেটা তার বাসগৃহ; কারো মতে মসজিদ বানায়।  ২৩

23➠  আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৩/৩৭৭


বর্তমানে বাড়িটি ২ তলা বিশিষ্ট একটি লাইব্রেরী বানানো হয়েছে। দুঃখের বিষয় বর্তমানে এই বরকতময় স্থানের যিয়ারত করতে ও সেখান থেকে তাবাররুক হাসিল করতে বাধা দেয়া হয়। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে হেদায়াত দান করুন এবং মুস্তফা করীম (ﷺ) এঁর শাফায়াত আমাদের নসীব করুন। আমীন!

━━━━━━━━━━━━━━━━


হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় জন্ম নেন। এটাই বিশুদ্ধ মত। 


❏ কেউ কেউ বলেন- ৮ রবিউল আউয়াল, শুক্রবার। কেউ বলেন- ২রা রবিউল আউয়াল। আবার ৩ রবিউল আউয়াল ও ১০ রবিউল আউয়াল, রমযান মাস ইত্যাদি মতও বর্নিত আছে। 

ومدة حمله تسعة اشهر على الراجح عند اهل هذا الشان. وذالك بعد خمسين يوما من عام الفيل على الراجح الأقاويل. في ولاية كسرى انوشروان. المشهر بالعدل في العشترين من نيسان. فوافق فصل الربيع اعدل الفصول والأزمان. من سنة ثمان وسبعين وخمسمائة من رفع سيدنا عيسى بن مريم الى السماء على ما نقله بعض العلماء.

আহলে ইলমগণের নিকট বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী নবী করীম (ﷺ) ৯ মাস গর্ভে ছিলেন। তিনি (ﷺ) হস্তীর দিন (يوم الفيل) এঁর ঘটনার ৫০ দিন পর জন্ম গ্রহণ করেন। যখন কিসরার বাদশা নওশেরওয়ানের রাজত্ব ছিল। আর তার ন্যায়পরায়ণতা প্রসিদ্ধ ছিল। ৫৭৮ ইসায়ী সনের ২০ এপ্রিল মোতাবেক রবিউল আউয়াল যা সকল মৌসুমসমূহের মধ্যে উত্তম। যেমনটি উলামায়ে কেরাম বর্ণনা করেন। 


জন্মের মু'জিযাসমূহ


নবী করীম (ﷺ) এঁর জন্মের সময় অনেক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে। কিসরার প্রাসাদসমূহে ভ‚মিকম্প আসে। এটা নবী করীম (ﷺ) এঁর জন্মের সময়ে হওয়া গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন সমূহের মধ্যে একটি। তাছাড়া মূর্তিগুলো উপুড় হয়ে পড়ে যায়। (পারস্যের) অগ্নিপুজকদের জ্বালানো আগুন যা হাজার বছর ধরে নেভেনি তা-ও এক ঝটকা ঠান্ডা হাওয়াতে নিভে যায়। 'সাওয়াহ' হ্রদ শুকিয়ে যায়। সামাওয়াহ উপত্যকা পানিতে ভরে যায়। 


পূর্ববর্তী আলেমগণ তাঁর (ﷺ) জন্মের সুসংবাদ শুনিয়েছেন এবং নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করেছিল। শয়তানগুলোর আসমানে যাওয়া এবং খবর চুরি করা আটকে দেয়া হয়েছিল। তাদেরকে চাবুক মারা শুরু হয়েছিল। জিনেরাও হুযুর (ﷺ) এঁর আগমনকে স্বাগতম জানিয়েছিল।


❏ যে সময় হযরত সাইয়্যেদুনা আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) কে জন্মের সংবাদ দেয়া হয় ঐ সময় তিনি হারামে কা'বায় ছিলেন। ঐ খবর শুনে তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন এবং তিনি কিছু মানুষের সাথে (আমিনা (رضي الله عنه) এঁর ঘরে) চলে যান। হযরত সাইয়্যিদুনা আমিনা (رضي الله عنه) ঐ সকল কথা তাঁকে বললেন যা তিনি হুযুর (ﷺ) এঁর জন্ম হওয়া পর্যন্ত দেখেছিলেন। যা কিছু ঐ বাচ্চার ব্যাপারে বলা হয়েছিল সেসব শুনে হযরত আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) নারীদেরকে বললেন-

এই বাচ্চার খেয়াল রেখো। আমি আশা করি তাঁর উচ্চ মর্যাদা হবে। এরপর তিনি তাঁকে কোলে নিলেন। এবং খানায়ে কা'বা শরীফে প্রবেশ করলেন। এবং তাওয়াফ করে বলতে লাগলেন-

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَعْطَانِي ... هَذَا الْغُلَامَ الطَّيِّبَ الْأَرْدَانِ

قَدْ سَادَ فِي الْمَهْدِ عَلَى الْغِلْمَانِ ... أُعِيذُهُ بِالْبَيْتِ ذِي الْأَرْكَانِ

অনুবাদঃ আমি আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করছি যিনি আমাকে এই পাক ও পবিত্র ছেলে দান করেছেন। ইনি তো কোলেই সকল বাচ্চার সরদার হয়ে গেছে। আমি একে খানায়ে কা'বার রবের আশ্রয়ে দিচ্ছি সকল নযর লাগানো হিংসুকের চোখ থেকে। ২৪

24➠

১) তাবাকাতে ইবনে সা'দ, ১/৮৩

২) রওযুল উনফ, ২/১৫৭

৩) বায়হাকী, দালায়েলুন নবুয়াত, ১/১১২

৪) সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১/৩৬০

৫) তারিখুল খামীস, ১/২০৪

৬) আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া, ৩/৩৮৬

  

নাম মোবারক মুহাম্মাদ (ﷺ) 


❏ নবী করীম (ﷺ) এঁর দাদা জন্মের সপ্তম দিন আকীকা করেন এবং নিজ গোত্রের সম্মানিত ব্যক্তিগনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ান। যখন তারা খাওয়া শেষ করল তখন জিজ্ঞেস করল- হে আবদুল মুত্তালিব! এই বাচ্চার নাম কি রেখেছ? তিনি বলেনঃ হে সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ! আমি তাঁর নাম "মুহাম্মাদ" রেখেছি। তারা বললঃ তুমি তোমার বাপ-দাদা এবং ঘরের সদস্যদের নামের প্রতি কেন উদাসীন? তিনি বলেনঃ আমি আশা করি সে আল্লাহ তায়ালার নিকট আসমানসমূহে এবং জমিনে মানুষের মাঝে প্রশংসিত হবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর (হযরত আবদুল মুত্তালিবের) ইচ্ছাকে পুরন করে দিয়েছেন।  ২৫

25➠

১) সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১/৩৬০

২) খাসায়েসুল কুবরা, ১/৮৫

৩) বায়হাকী, দালায়েলুন নবুয়াহ, ১/১১৩

 

তা'লীকঃ মুহাম্মাদ নামের অর্থঃ 


❏ ইমাম বুরহানুদ্দীন হালবী বলেন-

ولإفادته الكثرة في معناه، لأنه لا يقال إلا لمن حمد المرة بعد المرة، لما يوجد فيه من المحاسن والمناقب.

মুহাম্মাদ নামের অর্থে আধিক্য আছে। মুহাম্মাদ শুধুমাত্র তাকেই বলা যায়, বার বার যার প্রশংসা করা হয়। এই প্রশংসা ঐ সকল মহত্ত্ব ও গুনাবলীর কারণে করা হয়ে থাকে যা ঐ সত্ত্বার মধ্যে পাওয়া যায়।  ২৬

26➠  সিরাতে হালবিয়া, ১/১১৬


❏ ইমাম বায়হাকী আবুল হাসান তান্নুখী থেকে বর্ণনা করেন, 

أنه لما كان يوم السابع من ولادة رسول الله صلى الله عليه وسلم ذبح عنه جدّه ودعا قريشاً، فلما أكلوا قالوا: يا عبد المطلب ما سميته؟ قال: سميته محمداً. قالوا: لم رغبت به عن أسماء أهل بيته. قال: أردت أن يحمده الله في السماء وخلقه في الأرض

হুযুর আকরাম (ﷺ) এঁর বেলাদতের সপ্তম দিনে তাঁর (ﷺ) এঁর দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিব তাঁর তরফ থেকে একটি বকরী জবেহ করে কুরাইশদের দাওয়াত দেন। তারা খাওয়া শেষ করে জিজ্ঞেস করল- "হে আবদুল মুত্তালিব! তুমি এই বাচ্চার নাম কি রেখেছ?" তিনি বলেন, "আমি তাঁর নাম মুহাম্মাদ রেখেছি।" কুরাইশরা বলল, "তুমি তোমার পূর্বপুরুষদের নামে নাম রাখার প্রতি উদাসীন কেন?" তিনি বলেনঃ আমি চাই আসমানে রব তায়ালা এবং জমিনে তাঁর মাখলুক তাঁর (ﷺ) প্রসংশা করবে।"  ২৭

27➠  সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১/৩৬০


عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنه قال: لَمَّا وُلِدَ النَّبِيُّ صلى الله عليه و سلم عَقَّ عَنْهُ عَبْدُ الْمُطَّلِبِ رضى الله عنه بِكَبْشٍ

❏ হযরত  আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেনঃ যখন রাসুলে আকরাম (ﷺ) এঁর জন্ম হয় তখন হযরত আব্দুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) নিজের তরফ থেকে একটি ভেড়া যবাই করে (রাসুল (ﷺ) এঁর) আকীকা করেছিলেন। ২৮

28➠  

১) ইবনে আসাকীর, তারিখে মাদীনাতু দামেশক, ৩/৩২

২) সুয়ুতী, খাছাইছুল কুবরা, ১/১৩৪

৩) সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১/৩৬০

৪) মাওয়াহিবু লাদুন্নিয়া, ১/৪৪২


❏ ইমাম সুহায়লি মুহাম্মাদ নামকরণের কারণ লিখেন এভাবে-

أنه رأى مناماً كأن سلسلة من فضة خرجت من ظهره ولها طرف في السماء وطرف في الأرض وطرف في المشرق وطرف في المغرب، ثم عادت كأنها شجرة على كل ورقة منها نور، وإذا أهل المشرق والمغرب يتعلّقون بها. فقصّها فعبّرت له بمولود يكون من صلبه يتبعه أهل المشرق والمغرب ويحمده أهل السماء والأرض، فلذلك سماه محمداً

হযরত আবদুল মুত্তালিব স্বপ্নে দেখেন যে, একটি রুপার একটি শিকল তাঁর কপাল থেকে বের হয়েছে। সেটার একটি কিনারা আসমানে এবং অপরটি জমিনে। এরপর সেটি একটি গাছের মত হয়ে গেল। সেটার প্রতিটি পাতায় পাতায় নূর ছিল। পূর্ব -পশ্চিমের সবাই সেই গাছের আশে পাশে ঝুলন্ত ছিল। হযরত আবদুল মুত্তালিব একজন জোতিষীনিকে ঐ স্বপ্ন বর্ণনা করলে সে তার ব্যাখ্যায় বলে যে, তার বংশ থেকে একটি বাচ্চার জন্ম হবে। আসমান ও জমিনবাসী যার প্রশংসা করবে। এই জন্য তিনি তাঁর নাম মুহাম্মাদ (ﷺ) রাখেন।  ২৯

29➠  সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১/৩৬০


❏ হযরত আবদুল মুত্তালিব হুযুর (ﷺ) এঁর নাম যে মুহাম্মাদ রেখেছেন তা আল্লাহ তায়ালা তাঁর অন্তরে ইলহাম করে দেন। স্বপ্নে তাকে দেখান যেন তিনি হুযুর (ﷺ) এঁর নাম "মুহাম্মাদ" রাখেন। [সিরাতে হালবিয়া দ্রষ্টব্য]


❏ ইমাম বুরহানুদ্দীন হালবী বলেন-

أمرت آمنة أي في المنام وهي حامل برسول الله صلى الله عليه وسلم أن تسميه أحمد وعن ابن إسحق رحمه الله أن تسميه محمد وقد تقدم قال: والثاني هو المشهور في الروايات أي وعلى الأول اقتصر الحافظ الدمياطي رحمه الله

যখন হুযুর (ﷺ) হযরত আমিনা (رضي الله عنه) এঁর গর্ভে ছিলেন তখন স্বপ্নে তাঁকে হুযুর (ﷺ) এঁর নাম "আহমদ" রাখার হুকুম দেয়া হয়। কিন্তু ইবনে ইসহাক থেকে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে আছে- তাঁর নাম "মুহাম্মাদ" রাখার হুকুম দেয়া হয়। দ্বিতীয় (মুহাম্মাদ নাম রাখার) বর্ণনাটি প্রথম মত থেকে বেশি প্রসিদ্ধ। প্রথম (আহমদ নাম রাখার) রেওয়ায়েতটি হাফেয দিমইয়াতী বর্ণনা করেছেন।  ৩০

30➠  সিরাতে হালবিয়া, ১/১১৫


وخص صلى الله عليه وسلم باشتقاق اسمه من اسم الله تعالى وبأنه صلى الله عليه وسلم سمي أحمد ولم يسم به أحد قبله

❏ 'খাছায়েছে সুগরা' কিতাবে আছে হুযুর (ﷺ) এঁর খুছুছিয়াত হল- আল্লাহ তায়ালার নাম থেকে হুযুর (ﷺ) এঁর নাম মোবারক নির্গত। এটাও হুযুর (ﷺ) এঁর খুছুছিয়াত যে, তাঁর নাম 'আহমদ' রাখা হয়েছে যা তাঁর পূর্বে আর কারও রাখা হয়নি।  ৩১

31➠  সিরাতে হালবিয়া, ১/১১৬


❏ ইমাম বুখারী 'তারিখে সগীর' কিতাবে হযরত আলী ইবনে যায়েদ (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আবু তালিব বলেন-

فشقّ له من اسمه ليجلّه ... فذو العرش محمودٌ وهذا محمّد

হুযুর (ﷺ) এঁর মর্যাদার কারণে তাঁর নাম মোবারক আল্লাহ তায়ালার নাম থেকে নির্গত করেছেন। আরশের অধিপতি (আল্লাহ তায়ালা) হলেন মাহমুদ আর তিনি (হুযুর (ﷺ) ) হলেন মুহাম্মাদ। ৩২

32➠  সিরাতে হালবিয়া, ১/১১৬


হুযুর (ﷺ) এঁর অন্যান্য নামঃ


لِي خَمْسَةُ أَسْمَاءٍ: أَنَا مُحَمَّدٌ وَأَنَا أَحْمَدُ وَأَنَا الْمَاحِي الَّذِي يَمْحُو اللهُ بِيَ الْكُفْرَ وَأَنَا الْحَاشِرُ الَّذِي يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى قَدَمِي وَأَنَا الْعَاقِبُ

❏ হযরত জুবায়র ইবনে মুতইম (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, হুজুর (ﷺ) বলেন- “আমার পাঁচটি নাম আছে। আমি 'মুহাম্মাদ' ও 'আহমাদ' এবং আমি 'মাহি' (অর্থ- ধবংসকারী) কারন আল্লাহ আমার দ্বারা কুফরকে বিলুপ্ত করবেন। এবং আমি 'হাশির'- আমার পদদ্বয়ের উপর লোকজনের হাশর করানো হবে। আমি 'আকিব' (অর্থাৎ সবার শেষে আগত নবী)। ৩৩

33➠  

১) বুখারী, আস-সহীহ, কিতাবুল মানাকিব, باب ما جاء في اسماء رسول , ৩/১২৯৯, হাদীসঃ ৩৩৩৯

২) বুখারী, সহীহ, কিতাবুত তাফসীর, باب تفسير سورة الصف , ৪/১৮৫৮, হাদীসঃ ৪৬১৪

৩) মুসলিম, আস-সহীহ, কিতাবুল ফাদ্বায়েল, باب في اسما ئه , ৪/৮২৮, হাদীসঃ ২৩৫৪

৪) তিরমিযী, আস-সুনান, কিতাবুল আদাব, باب ما جاء في اسماء النبي , ৫/১৩৫, হাদীসঃ ২৮৪, ইমাম তিরমিযী বলেন- "হাদীসখানা হাসান সহীহ"

৫) নাসায়ী, আস-সুনানুল কুবরা, ৬/৪৮৯, হাদীসঃ ১১৫৯০

৬) মালেক, আল মুয়াত্তা, কিতাবুল আসমাউন্নবী, বাবু আসমাউন্নবী, ২/১০০৪

৭) আহমাদ ইবনে হাম্বল, আল মুসনাদ, ৩/৮০, ৮৩

৮) দারমী, আস সুনান, ২/৪০৯, হাদীসঃ ২৭৭৫

৯) ইবনে হিব্বান, আস সহীহ, ১৩/২১৯, হাদীসঃ ৬৩১৩

১০) আবু ইয়া'লা, মুসনাদ, ১৩/৩৮৮, হাদীসঃ ৭৩৯৫

১১)তাবরানী, আল মু'জামুল আওসাত, ৩/৩৩, হাদীসঃ ৩৫৭০

 

وكما أن الله عزّ وجل ألف اسم للنبي صلى الله عليه وسلم ألف اسم

❏ যেভাবে আল্লাহ তায়ালার এক হাজার নাম আছে তেমনি হুযুর (ﷺ) এঁরও এক হাজার নাম আছে।  ৩৪

34➠ সিরাতে হালবিয়া, ১/১১৫


আল্লাহ তায়ালার আসমাউল হুসনা যেগুলো কুরআনে পাকে বর্ণিত হয়েছে তার অনেকগুলো আল্লাহ তায়ালা কুরআনে পাকেই তাঁর হাবীবের শানে ব্যবহার করেছেন।

আলহামদুলিল্লাহ! অনেক আলেমে রাব্বানী, ও শায়খে হাক্কানী হুযুর (ﷺ) এঁর নাম সমূহের ওপর স্বীয় কিতাবসমূহে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বরং স্বতন্ত্র কিতাবও লিখেছেন। মাওয়াহিবের গ্রন্থকার ইমাম কাস্তালানী, আবদুল হক মুহাদ্দীস দেহলভী, ইবনুল আরাবী, আল্লামা ইয়ুসূফ নাবহানী এবং অন্যান্য সীরাত গ্রন্থকারগণ হুযুর আকরাম, নবিয়ে মুকাররাম (ﷺ) এঁর নামসমূহের ওপর বিশদ ও চমৎকার আলোচনা করেছেন। যা তাদের কিতাবসমূহে মুক্তার মত উজ্জ্বল হয়ে আছে। আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আর এই অধম ফকীরকেও তাদের সাথে অন্তর্ভ‚ক্ত করুন। আমীন বিজাহিন নাবিয়্যীল আমিন। 

━━━━━━━━━━━━━━━━


দুধপান


নবী করীম (ﷺ) এঁর সম্মানিত মাতা তাঁকে সাত দিন দুধ পান করান। সুয়াইবাহ আসলামিয়াহ যিনি আবু লাহাবের দাসী ছিলেন, তিনি হুযুর (ﷺ) কে দুধাপান করান। নবী করীম (ﷺ) এঁর চাচা আবু লাহাব নবী করীম (ﷺ) এঁর জন্মের সুসংবাদ শুনে তাঁকে আযাদ করে দিয়েছিল। বর্ণিত আছে, এই (আমলের) কারণে প্রতি সোমবারে তার আযাব কম করে দেয়া হয়।


সুয়াইবা নবী করীম (ﷺ) এঁর পূর্বে তাঁর চাচা হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিবকেও দুধপান করিয়েছিলেন এবং নবী করীম (ﷺ) এঁর পর আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদকেও দুধপান করিয়েছিলেন। সুতরাং তিনি এই সকলের দুধমাতা। নবী করীম (ﷺ) তাঁর জন্য মদীনা মুনাওয়ারা থেকে চাদর এবং অন্যান্য সামগ্রী পাঠাতেন। বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে, তিনি ইসলাম গ্রহন করে ইন্তেকাল করেন। 



হালিমা সা'দিয়ার সৌভাগ্য


❏ এরপর হালিমা সা'দিয়া বিনতে আবি যুওয়াইব নবী করীম (ﷺ) কে দুধ পান করান। বর্ণিত আছে, তিনি অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় (বনী সা'দ ইবনে বকর এর নারীদের সাথে) মক্কা মুকাররমায় আসেন। যাতে সেখান থেকে কোন বাচ্চাকে দুধপান করানোর জন্য সাথে নিয়ে যেতে পারেন। যাতে সেটার প্রতিদানে গরীবী অবস্থা কিছুটা দুর হয়। ঐ সফরে তাঁর স্বামী হারিছ ইবনে আবদুল উযযাও সাথী ছিল। তার কাছে একটি উটনিও ছিল যাতে এক ফোটাও দুধ ছিল না। সারা রাত তার বাচ্চা কাঁদতে থাকে। কিন্তু তাঁর স্তনে এতটুকু দুধও ছিল না যা বাচ্চাকে পান করাতে পারেন। তিনি বলেনঃ কোন মহিলাও এমন ছিল না যার নিকট হুযুর আকরাম (ﷺ) কে নিয়ে যাওয়া হয়নি। কিন্তু কেউ ইয়াতিম হওয়ার কারণে তাঁকে নিতে চায় নি।৩৫

35➠ বরং মনে হয় যেন খোদ হুযুর আকরাম (ﷺ) ই কারো কাছে যেতে চান নি। কারণ, হুযুর (ﷺ) কে দুধপান করানোর সৌভাগ্য হযরত হালিমা সা'দিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এঁর নসীব হবে তা হয়তো রোজে আযল থেকেই নির্ধারিত ছিল। 

  

তারা বললো- "আমাদের বাচ্চার পিতার কাছে যে প্রতিদানের আশা আছে তা মায়ের কাছে থেকে পাওয়ার আশা নেই।" তাই প্রত্যেকেই দুধ পানের জন্য কোন না কোন বাচ্চা পেয়ে যায়। আমি (হালিমা সা'দিয়া) কোন বাচ্চা ছাড়া ফিরে যাওয়া অপছন্দ করলাম। অন্য সব কথা এক পাশে রেখে আমার তাঁর নূরানী চেহারা মোবারক অত্যন্ত পছন্দ হলো। (সুবহানাল্লাহ!) তাই, আমি তাঁকে অর্থাৎ নবী করীম (ﷺ) কে নিয়ে গেলাম।


যখন আমি ফিরে আসার ইচ্ছা করলাম তখন আমি নবী করীম (ﷺ) কে দুধ পান করতে দিলাম। যাতে স্তনে যতটুকু দুধ আছে তিনি পান করে নেন। তখন হুযুর আকরাম (ﷺ) ডান দিকের স্তন থেকে দুধ পান করলেন। এরপর আমি বাম স্তন দিলে তিনি (ﷺ) তা থেকে পান করলেন না। আমি তা আমার পুত্রকে পান করালাম। যখন সন্ধ্যা হলো এবং আমরা খাওয়ার ইচ্ছা করলাম আমার স্বামী ঊটের স্তন একেবারে ভরা দেখতে পেলেন। তিনি দুধ দোহন করলেন এবং আমরা দু'জন পান করলাম যতক্ষন না আমাদের পেট ভরে গেল। এরপর সেই রাত আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের জন্য রহমত ও বরকতে ভরে গেল। আমার স্বামী আমাকে বললেনঃ "হে হালিমা! নিশ্চয়ই তুমি অত্যন্ত মোবারক ও মর্যাদাবান এক বাচ্চা নিয়ে এসেছ।"


এরপর আমরা আমাদের শহরের দিকে ফিরে গেলাম। আমার বাহন সফর সঙ্গীদের (অতিক্রম করে) আগে চলে গেল। মহিলারা একে অন্যকে বলতে লাগল- তুমি কিভাবে আমাদের কাফেলার আগে চলে গেলে? আসার সময় তো তোমার বাহন তোমাকে অনেক কষ্টে এখানে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন আমরা দেখছি এটা অনেক শক্তিশালী ও দ্রুতগামী হয়ে গেছে। আমি তাদেরকে বললামঃ 


"আমাদের অনেকগুলো বকরি ছিল যা চড়ানোর জন্য আমি মাঠে পাঠিয়ে দিতাম। আর আল্লাহ জানেন আমার মাঠ কি রকম খরা ও পরিত্যাক্ত ছিল। কিন্তু আমাদের বকরীগুলো ঐ মাঠেই চড়তে যেত এবং ঐ ফিরে আসলে সেগুলোর স্তন দুধে পূর্ণ থাকত। আমরা যত চাইতাম দুধ পান করে তৃপ্ত হতাম। কিন্তু আমাদের এলাকার অন্যান্য লোকের বকরীগুলোতে এক ফোটাও দুধ থাকত না। তারা রাখালকে বলতঃ "হায়! তোর কি হয়ে গেল! আমাদের বকরীগুলোও তো ঐ জায়গায়ই বিচরণ করে যেখানে আবু যুয়াইবের কন্যার (হালিমা সা'দিয়ার) বকরীগুলো চড়ে। আর তাদের বকরীগুলোও সেখানে বিচরণ করে যেখানে আমাদের বকরীগুলো বিচরণ করত।" কিন্তু তারপরও তাদের বকরীগুলো কোন দুধ ছড়াই ফিরে আসত আর আমাদের বকরীগুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে ফিরত। আমরা যতটা চাইতাম দুধ দোহন করতে পারতাম। 


আল্লাহর বরকত আমাদের ওপর নাযিল হতে থাকে এবং আমরা জানতাম যে, এই সকল কিছুই হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) এঁর সদকায় হচ্ছিল। হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) এঁর বয়স মোবারক দুই বছর হলেও তাঁর শিশুসুলভ আচরণ অন্য বাচ্চাদের চেয়ে আলাদা ছিল। আল্লাহর কসম! তিনি (ﷺ) দুই বছর বয়সে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন। আমরা তাঁকে নিয়ে তাঁর (ﷺ) মাতার নিকট (মক্কায়) ফিরে গেলাম। তাঁকে (ﷺ) দেখে তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন। আমরা তাঁর সীমাহীন বরকতের কারণে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম না। তার ওপর আবার শহরে মহামারীরও ভয় ছিল। তাই আমরা তাঁকে (ﷺ) আমাদের এলাকায় আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসলাম। 


নবী করীম (ﷺ) কে ফিরিয়ে নিয়ে আসার দুই অথবা তিন মাস পরের ঘটনা- নবী করীম (ﷺ) এঁর দুধ ভাই যিনি তাঁর সাথে খেলছিলেন, হঠাৎ দৌড়ে আমাদের কাছে এসে বলল- আমার কুরায়শী ভাইয়ের কাছে দু'জন ব্যক্তি আসলো যারা সাদা রঙের কাপড় পরিহিত ছিল। তারা আমার ভাইকে ধরে শোয়ালো আর পেট চিরে ফেলল। এটা শুনে আমি ও আমার স্বামী দৌড়ে গেলাম। সেখানে গিয়ে হুযুর (ﷺ) কে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। কিন্তু তাঁর অবস্থার কোন পরিবর্তন দেখতে পেলাম না (যেন কিছুই হয়নি)। হুযুর (ﷺ) এঁর দুধ পিতা তাঁকে (ﷺ) কোলে নিলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন- কী হয়েছে? হুযুর (ﷺ) ইরশাদ করলেনঃ আমার কাছে দুইজন ব্যক্তি এলেন যারা সাদা কাপড় পরিহিত ছিল। তারা আমাকে ধরে ফেলল এবং পেট চিরে তা থেকে কিছু একটা বের করে ফেলে দিলেন এবং আগে যেমন ছিল তেমনি আবার লাগিয়ে দিলেন। 


আমার স্বামী বললেনঃ "আমার সাথে চল আমরা তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসি। কারণ, আমার চিন্তা হচ্ছে আমার এই ছেলের ওপর কোন বিপদ না এসে যায়।" তাই, আমরা তাঁকে সাথে নিয়ে তাঁর মায়ের কাছে ফিরে গেলাম। তিনি আমাদেরকে দেখে বললেনঃ "তোমাদের কী হয়েছে? তোমরা তো তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলে। আবার তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছ?" আমরা বললামঃ "আমাদের তাঁর ওপর মুসিবত আসার চিন্তা হচ্ছিল।" তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ "আমাকে বল কী ব্যাপার? " আমরা পুরো ঘটনা বর্ণনা করলাম। যা শুনে তিনি তিনি বললেনঃ "তোমাদের কি তাঁর ব্যাপারে শয়তানের কোন ভয় আছে? কোনভাবে নয়। আল্লাহর কসম! শয়তান তাঁর ওপর কখনোই প্রাধান্য পাবে না। নিঃসন্দেহে আমার পুত্র উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। আমি তোমাদেরকে তাঁর ব্যাপারে কিছু জানাবো? " আমরা বললামঃ "কেন নয়। অবশ্যই বলুন।" তিনি (رضي الله عنه) যা কিছু (গর্ভাবস্থায় এবং জন্মের সময়) দেখেছিলেন এবং যা কিছু শুনেছিলেন তা বর্ণনা করলেন। এরপর তিনি (رضي الله عنه) বললেনঃ "তোমরা তাঁকে (ﷺ) আমার কাছেই রেখে যাও।" 



বক্ষ বিদারণ


❏ সহীহ মুসলিম এ হযরত সাইয়্যেদুনা আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, 

انَّا رسولَ الله صلى الله عليه وسلم أَتَاهُ جِبْرِيلُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَلْعَبُ مَعَ الْغِلْمَانِ، فَأَخَذَهُ فَصَرَعَهُ، فَشَقَّ عَنْ قَلْبِهِ، فَاسْتَخْرَجَ الْقَلْبَ، فَاسْتَخْرَجَ مِنْهُ عَلَقَةً، فَقَالَ: هَذَا حَظُّ الشَّيْطَانِ مِنْكَ، ثُمَّ غَسَلَهُ فِي طَسْتٍ مِنْ ذَهَبٍ بِمَاءِ زَمْزَمَ، ثُمَّ لَأَمَهُ، ثُمَّ أَعَادَهُ فِي مَكَانِهِ، وَجَاءَ الْغِلْمَانُ يَسْعَوْنَ إِلَى أُمِّهِ يَعْنِي ظِئْرَهُ فَقَالُوا: إِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ قُتِلَ، فَاسْتَقْبَلُوهُ وَهُوَ مُنْتَقِعُ اللَّوْنِ "، قَالَ أَنَسٌ: ্রوَقَدْ كُنْتُ أَرَى أَثَرَ ذَلِكَ الْمِخْيَطِ فِي صَدْرِهِ

হুযুর নবী করিম (ﷺ) এঁর নিকট জীবরাঈল (عليه السلام) তাশরীফ আনলেন। নবী করীম (ﷺ) ঐ সময়ে বাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন। হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) নবী করীম (ﷺ) কে ধরলেন এবং বক্ষ বিদারণ করলেন এবং হৃদপিণ্ড বের করে কালো রঙের একটি মাংসপিন্ড বের করে ফেলে দিলেন। এবং বললেনঃ "এটা শয়তানের অংশ ছিল।" এরপর তা (হৃদপিণ্ড) স্বর্ণের পাত্রে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করেন এবং আবার তা (বুকের ভিতরে) দিয়ে সেলাই করে দেন।  ৩৬

36➠

১) সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, বাব- ইসরা বিরাসুলিল্লাহ, ১/৪৭, হাদীসঃ ১৬২

২) ইবনে আবী শায়বা, মুসান্নাফ, ৭/৩৩০, হাদীসঃ ৩৬৫৫৭

৩) মুসনাদে আহমদ, ১৯/২৫১, হাদীসঃ ১২২২১

৪) আবু ইয়া'লা, মুসনাদ, ৬/১০৮, হাদীসঃ ৩৩৭৪

৫) আবু আওয়ানা, মুস্তাখরাজ, ১/১১৩, হাদীসঃ ৩৪২

৬) ইবনে হিব্বান, সহীহ, ১৪/২৪২, হাদীসঃ ৬৩৩৪

৭) হাকেম, মুস্তাদরাক, ২/৫৭৫, হাদীসঃ ৩৯৪৯

৮) আবু নুয়াইম, দালায়েলুন নবুয়াহ, হাদীসঃ ১৬৮

  

বাচ্চারা তাদের মায়েদের কাছে দৌড়ে চলে আসলো এবং বললঃ "মুহাম্মাদ মারা গেছে।" তারা সবাই নবী করীম (ﷺ) এর কাছে গিয়ে দেখল তিনি ঘাবরে গেছেন। 


❏ হযরত সাইয়্যেদুনা আনাস ইবনে মালেক (رضي الله عنه) বলেনঃ 

وَقَدْ كُنْتُ أَرَى أَثَرَ ذَلِكَ الْمِخْيَطِ فِي صَدْرِهِ

আমি ঐ সেলাইয়ের চিহ্ন নবী করীম (ﷺ) এঁর সিনা মোবারকে দেখেছি।  ৩৭

37➠

১) মুসলিম, সহীহ, ১/৪৭, হাদীসঃ ১৬২

২) য়াবু ইয়া'লা মসুলী, মুসনাদ, ৬/১০৮, হাদীসঃ ৩৩৭৪

৩) ইবনে হিব্বান, সহীহ, ১৪/২৪৩, হাদীসঃ ৬৩৩৫

৪) ইবনে মুন্দাহ, আল-ঈমান, ২/৭১৩

 

❏ সহীহাইন (বুখারী ও মুসলিম)-এ বর্ণিত আছে, মে'রাজের রাতেও নবী করীম (ﷺ) এঁর সীনা মোবারক বিদারণ করা হয়েছিল। সুতরাং সীনা চাক হাওয়ার ঘটনা কয়েকবার হয়েছে।



হালিমা সা'দিয়া (رضي الله عنه) এঁর ওপর সাইয়্যিদাতুনা খাদিজা (رضي الله عنه) এঁর দানশীলতা


❏ হযরত সাইয়্যেদা খাদিজা (رضي الله عنه) এর সাথে যখন হুযুর সাইয়্যিদে আলম (ﷺ) এঁর বিবাহ হয় তখনও হযরত হালিমা (رضي الله عنه) জীবীত ছিলেন। ঐ সময়ে তিনি মক্কা মুকাররামাতে আসেন এবং তাঁর এলাকাতে দারিদ্রতার অভিযোগ পেশ করেন। এটা শুনে হযরত খাদিজা (رضي الله عنه) চল্লিশটি বকরী ও একটি ঊট দান করেন যা নিয়ে তিনি তাঁর এলাকায় ফিরে আসেন। এরপর তিনি ইসলামী যুগে আবার (মক্কায়) আসেন এবং তিনি ও তাঁর স্বামী ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু অন্য বর্ণনা মতে তারা ইসলাম কবুল করেননি।  ৩৮

38➠ আলহামদুলিল্লাহ! রেওয়ায়েতে ভিন্নতা থাকলেও সর্বশেষ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো হুযুর আকরাম (ﷺ) এঁর পিতা-মাতা এবং দুধ পিতা-মাতা সবাই ঈমান এনেছেন। আমাদের আকাবির উলামায়ে কেরাম তাঁদের নামের পাশে 'রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম' লিখেছেন। হুযুর (ﷺ) এঁর পিতা মাতার ঈমান আনয়ণের ওপর ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (رحمة الله) এগারোটি কিতাব লিখেছেন। 


দুধবোনের আগমন এবং হুযুর কারীম (ﷺ) এঁর মোহব্বত

নবী করীম (ﷺ) এঁর দুধ ভাই-বোনদের মধ্যে হযরত হালিমা (رضي الله عنه) থেকে ছিল আবদুল্লাহ, উনায়সা এবং সীমা। সাইয়্যেদাহ হালিমা (رضي الله عنه) এঁর স্বামী হারেছ ইবনে আবদুল উযযা যার থেকে তার সন্তান হয় তারা ছিল হাওয়াযিন গোত্রের। আর ঐ দুধপানের সম্পর্কের কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাওয়াযিন গোত্রের ছয় হাজার কয়েদীকে ফেরত দিয়ে দেন। ঐ কয়েদীদের মধ্যে একজন ছিল নবী করীম (ﷺ) এঁর দুধবোন সীমা। হুনাইনের যুদ্ধের সময় তাকে নবী করীম (ﷺ) এঁর সামনে হাজির হয় তখন নবী করীম (ﷺ) তাঁর জন্য চাদর বিছিয়ে তার ওপর তাঁকে বসান এবং বলেনঃ-

যদি তুমি চাও তাহলে আমার কাছেই সম্মানের সাথে থাক অথবা চাইলে তোমার গোত্রের সাথে চলে যেতে পার। তখন সে তার গোত্রের সাথে যেতে চাইল। নবী করীম (ﷺ) তাঁকে অনেক সরঞ্জাম দেন এবং সম্মানের সাথে মুক্তি দেন। 


মায়ের সাথে মদীনা মুনাওয়ারার সফর


❏ নবী করীম (ﷺ) এঁর সম্মানিত মায়ের জীবীত থাকার সময়ে এবং তাঁর ওফাতের পরও সাইয়্যেদাহ উম্মে আয়মান (টিকাঃ ৩৯) নবী করীম (ﷺ) কে লালন পালন করেন এবং তিনি নবী করীম (ﷺ) এঁর সম্মানিত পিতার ক্রীতদাসী ছিলেন। 

টিকা 39➠ হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) তাঁকে বলতেনঃ (انتِ أمى بعد امى) অর্থঃ আমার মায়ের পরে আপনি আমার মা। [মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া, ১/৯৭]


যখন নবী করীম (ﷺ) এঁর বয়স মোবারক ছয় বছর হয় তখন তাঁর (ﷺ) মায়ের সাথে নিয়ে মদীনা মুনাওয়ারায় রাসূল (ﷺ) এঁর মামার বংশ বনী আদী ইবনে নাজ্জার এঁর সাথে দেখা করতে আসেন। সেখানে তিনি এক মাস অবস্থান করেন। এরপর বাইতুল হারামে ফিরে আসার ইচ্ছে করলেন। রাস্তায় 'আবাওয়া' নামক স্থানে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন এবং সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। যখন জ্ঞান ফিরে নবী করীম (ﷺ) কে দেখতে পান তখন কাঁদতে কাঁদতে এই কবিতা বলেনঃ

بَارك فِيك الله من غُلَام ... يَا ابْن الَّذِي من حومة الْحمام

بِمِائَة من إبل سوام ... فودى غَدَاة الضَّرْب بِالسِّهَامِ

إِن صَحَّ مَا أَبْصرت فِي الْمَنَام ... فَأَنت مَبْعُوث إِلَى الْأَنَام

অনুবাদঃ হে আমার পুত্র! আল্লাহ তায়ালা তোমাকে বরকত দান করুন। তুমি তাঁর পুত্র যার ওপর মৃত্যুও ফিদা হয়ে গিয়েছিল। তুমি তাঁর পুত্র যার ওপর পাঁচশত ফাল (ভাগ্য নির্ণায়ক তীর) এর ফিদিয়া দেয়া হয়েছিল। এবং মৃত্যুর স্থান থেকে তাঁকে বের করে আনা হয়েছিল। আমি তোমার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত যা কিছু স্বপ্নে দেখেছি যদি সত্যি হয় তাহলে তোমাকে মানুষের নিকট রাসূল বানিয়ে প্রেরণ করা হবে। 

এরপর তিনি বললেনঃ "প্রত্যেক জীবীতকে মারা যেতে হবে এবং প্রত্যেক নতুনকে পুরাতন হতে হবে। প্রত্যেক বেশী জিনসকেই ধ্বংস হয়ে যেতে হবে আর আমিও মারা যাব। কিন্তু তার আলোচনা চলতে থাকবে। নিশ্চয়ই আমি তোমাকে পবিত্র রূপে জন্ম দিয়েছি আর তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি।" এরপর তাঁর ওফাত হয়ে যায়। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)


এরপর নবী করীম (ﷺ) উম্মে আয়মানের সাথে মক্কা মুকাররামায় ফিরে আসেন। যখন ফিরে আসেন তখন হযরত আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) নবী করীম (ﷺ) কে নিজের বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। তিনি নবী করীম (ﷺ) কে অত্যন্ত মহব্বত করেন। সারা জীবন নবী করীম (ﷺ) কে সম্মান ও মর্যাদার সাথে লালন পালন করেন। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নবী করীম (ﷺ) কে প্রাধান্য দেন। তিনি বলতেনঃ "নিশ্চয়ই আমার এই পুত্রের অনেক মর্যাদা।"


দাদার ইনতিকাল এবং চাচার লালন পালন


যখন নবী করীম (ﷺ) এঁর বয়স মোবারক ৮ বছর হলো তখন তিনি তাঁর আশ্রয়স্থল দাদারও ইন্তেকাল হয়ে যায়। ঐ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ১২০ বছর। বলা হতঃ নবী করীম (ﷺ) তাঁর জানাযার সাথে কাঁদতে কাঁদতে যান যতক্ষন না "হাজুন" নামক জায়গায় তাঁকে দাফন করা হয়। দাদার ইন্তেকালের পর নবী করীম (ﷺ) এঁর লালন পালন করেন তাঁর আপন চাচা হযরত আবু তালিব। কারণ, নবী করীম (ﷺ) এঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁকে নবী করীম (ﷺ) এঁর দেখাশোনা করার জন্য বিশেষভাবে ওসীয়ত করে গিয়েছিলেন। 


ব্যবসায়িক সফর


যখন নবী আকরাম (ﷺ) এঁর বয়স মোবারক ১২ বছর, অন্য বর্ণনামতে ১২ বছর দুই মাস এবং ১০ দিন হয় তখন নবী আকরাম (ﷺ) তাঁর চাচা আবু তালিবের সাথে শামে ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে অংশগ্রহণ করেন। ওই সফরে বাহিরা রাহিব তাকে দেখেই ওই সকল নিদর্শন দ্বারা চিনতে পারে যা সে তার কিতাবের মধ্যে পড়েছিল। তাই তিনি আসেন এবং নবী আকরাম (ﷺ) এর হাত ধরে বলেনঃ

"ইনি কায়েনাতের সরদার এবং আল্লাহর রাসূল। তাঁকে রাহমাতুল্লিল আলামিন বানিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।"

লোকেরা জিজ্ঞেস করলঃ তুমি এটা কিভাবে জানলে? সে বললঃ যখন তোমরা এই দিকে আসছিলে তখন ওই গাছগুলো এবং পাথরগুলো সিজদা করেছিল। এবং এই দুইটি জিনিস (গাছ এবং পাথর) নবী ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করে না। রাহিব হযরত আবু তালিব কে নবী করীম (ﷺ) এর ব্যাপারে আরও জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ সে আমার ভাতিজা। রাহিব বললঃ তুমি কি তাকে মোহাব্বত করো? তিনি বলেনঃ জি হ্যাঁ। তখন রাহিব বললোঃ যদি তুমি তাকে সাথে নিয়ে শাম-এ যাও তাহলে ইয়াহুদিরা তাকে হত্যা করে ফেলবে। এটা শুনে হযরত আবু তালিব ঘাবড়ে গেলেন এবং তিনি কিছু যুবকের সাথে নবী করীম (ﷺ) কে মদিনা-মুনাওয়ারাতে ফেরত পাঠালেন। 


সাইয়্যেদাহ খাদিজা (রাদিয়াল¬াহু আনহা) এঁর ব্যবসায়িক সম্পদ


নবী করীম (ﷺ) শামে দ্বিতীয় সফরে পঁচিশ বছর বয়সে হযরত সাইয়্যেদাহ খাদিজা (رضي الله عنه) এর গোলাম মায়সারাহ এর সাথে যান। নবী করীম (ﷺ) হযরত খাদিজা (رضي الله عنه) এঁর ব্যবসায়িক পন্য নিয়ে রওনা হন। যখন নবী করীম (ﷺ) বসরায় পৌছান তখন নাসতুরা রাহিব এর বাড়ির নিকট একটি গাছের নিকটে দাড়ান। নাসতুরা রাহেব তাকে দেখে বললঃ এই গাছের নিচে কোন নবী ব্যতীত কেউ দাড়ান নি। এরপর সে নবী করীম (ﷺ) এর চোখের লাল রঙের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ হ্যা। এটা এমনই (অর্থাৎ চোখে এই লাল রং সব সময় থাকে)। তখন সে বললঃ এটা কখনও শেষ হবে না। কারণ, আপনি আখেরী নবী।

এরপর নবী করীম (ﷺ) ব্যবসায়ের পণ্যসমূহ বিক্রয় করলেন এবং অনেক মুনাফা করলেন। যখন তিনি ফিরে আসেন তখন প্রচন্ড গরম ছিল। ওই গরমের মধ্যে ফেরেশতারা নবী করীম (ﷺ) কে ছায়া দিয়ে রাখতেন কিন্তু মায়সারা গরমের মধ্যেই ছিল। যখন এই অবস্থায় নবী করীম (ﷺ) মক্কা মুকাররমায় প্রবেশ করলেন তখন হযরত সাইয়েদা খাদিজা (رضي الله عنه) নবী করীম (ﷺ) কে দেখেন। এরপর নবী আকরাম (ﷺ) তাঁকে মুনাফার পরিমাণ শোনালেন এবং মাইসারা তার চোখে দেখা ঘটনা বর্ণনা করলেন। এবং যা কিছু বসরাতে রাহিব বলেছিল সেগুলো বললেন। ওই সময়ই হযরত খাদিজা (رضي الله عنه) নবী আকরাম (ﷺ) কে বিবাহ করার ইচ্ছে করেন। এবং ওইদিনই তাঁদের বিবাহ হয়। ওই সময় হযরত খাদিজা (رضي الله عنه) এর বয়স মোবারক ছিল ৪০ বছর। 


নবী করীম (ﷺ) এঁর সকল আওলাদ তাঁরই গর্ভজাত। শুধুমাত্র হযরত ইবরাহীম (رضي الله عنه) ব্যাতীত। তিনি হযরত সাইয়্যেদাহ মারিয়া কিবতিয়া (رضي الله عنه) এঁর গর্ভে জন্ম নেন। সাইয়্যেদাহ খাদিজা (رضي الله عنه) যতদিন জীবীত ছিলেন ততদিন নবী করীম (ﷺ) দ্বিতীয় কোন বিবাহ করেননি। নবী করীম (ﷺ) বেশিরভাগ সময় তাঁকে স্মরণ করতেন আর বলতেন, খাদিজা তো এমন মর্যাদাবান ছিলেন ........ খাদিজা তো এমন মর্যাদাবান ছিলেন ........। 


খানায়ে কা'বার নির্মাণ


যখন নবী করীম (ﷺ) এঁর বয়স মোবারক পঁয়ত্রিশ বছর ছিল তখন কুরাইশগণ খানায়ে কা'বা নির্মাণ ও মেরামতের ইচ্ছা করল। যখন নির্মাণের সময় হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করার সময় আসলো তখন তাদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়ে গেল যে, সেটা স্থাপনের হকদার কে বেশী? এই বিরোধ যখন খুনোখুনির পর্যায় পর্যন্ত পৌছে গেল তখন সবাই এই সিদ্ধান্তে একমত হল যে, আগামীকাল সকালে বাবে বনী শায়বা দিয়ে সর্বপ্রথম যে প্রবেশ করবে সেই ফয়সালা করবে। পরের দিন নবী করীম (ﷺ) -ই সর্বপ্রথম প্রবেশ করলেন। সবাই বলল- ইনি ন্যায়বিচারক। তাঁর ফয়সালায় আমরা রাজী। তারা সকলেই নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই তাঁকে (ﷺ) "আল-আমীন" বা বিশ্বস্ত বলে মানত। নবী করীম (ﷺ) সকল গোত্রের প্রধানদের ডাকলেন এবং মাটিতে একটি চাদর বিছিয়ে হাজরে আসওয়াদ নিজের হাতে সেখানে রাখলেন। এরপর বললেনঃ প্রত্যেক গোত্রের প্রধান এই চাদরের কিনারা ধরুন। এমনিভাবে সবাই মিলে তা উঠালেন। যখন তা (চাদর) রাখার জায়গায় আসল তখন নবী করীম (ﷺ) হাজরে আসওয়াদ নিয়ে নিজের হাতে রাখলেন। 


নবুয়ত ও রিসালাতের ঘোষণা


যখন নবী করীম (ﷺ) এঁর বয়স মোবারক ৪০ বছর হল তখন আল্লাহ তায়ালা নবী করীম (ﷺ) কে রহমত বানিয়ে কায়েনাতের নিকট প্রেরণ করলেন। এবং নবী করীম (ﷺ) এঁর নিকট ফেরেশতাদের সরদার সাইয়্যিদুনা জীবরাঈল আমীন (عليه السلام) কে প্রেরণ করলেন। নবী করীম (ﷺ) এঁর ওহীর শুরু নেক স্বপ্ন দ্বারা হয়েছিল। নবী করীম (ﷺ) যা কিছুই স্বপ্নে দেখতেন তা ভোরের আলোর মত সত্যি হত। এরপর নবী করীম (ﷺ) হেরা গুহায় একাকী অবস্থান করতে থাকেন এবং সেখানে দিন রাত ইবাদতে মগ্ন থাকেন যতক্ষন না আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এই আয়াতে কারীমা নাযিল হয়-

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ

হে মাহবুব! আপনি পাঠ করুন আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।  ৪০

40➠  সুরা আলাকঃ১


এটা রমজান মাসের ১৭ অথবা ১৮ তারিখ ছিল। কেউ কেউ বলেন, তা রবিউল আউয়াল মাস ছিল। 


সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী সৌভাগ্যবান


নবী করীম (ﷺ) এঁর ওপর নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম ঈমান আনেন হযরত খাদিজা (رضي الله عنه)। আর পুরুষদের মধ্যে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) এবং বালকদের মধ্যে সাইয়্যিদুনা আলী (رضي الله عنه) ঈমান আনেন। হযরত আলী (رضي الله عنه) এঁর বয়স ঐ সময় প্রায় ১০ বছর ছিল। দাসদের মধ্যে সর্বপ্রথম যায়েদ ইবনে হারেসা (رضي الله عنه) ঈমান আনেন। 


আবু তালিবের ইনতিকাল এবং বিপদ আড়ম্ভ


নবুয়তের ঘোষণার ১০ম বছরে; অন্য বর্ণনা মতে ৮ম বছরে নবী করীম (ﷺ) এঁর চাচা হযরত আবু তালেব ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালের তিন দিন অথবা কিছু দিন পর; অন্য এক বর্ণনা মতে তার পূর্বেই উচ্চ ও মহান মর্যাদার অধিকারী হযরত সাইয়্যিদাহ খাদিজা (رضي الله عنه) ও ইন্তেকাল করেন। তখন নবী করীম (ﷺ) অনেক মুসিবতের সম্মুখীন হন। এবং কুরাইশ কাফিরদের পক্ষে যা কষ্ট দেয়া সম্ভব তার সবই তারা দেয়া শুরু করল। হযরত আবু তালিব নবী করীম (ﷺ) কে মাহফুয রাখতেন। এবং নবী করীম (ﷺ) কে কষ্ট দেয়া থেকে কাফিরদের বিরত রাখতেন। (কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের পর) নবী করীম (ﷺ) বারবার কষ্টের সম্মুখীন হন এবং ধৈর্য ধারণ করেন। এমনকি নবী করীম (ﷺ) তায়েফে সফর করেন। নবী করীম (ﷺ) এঁর গোলাম সাইয়্যিদুনা যায়েদ ইবনে হারেসাহ (رضي الله عنه) -ও সফরসঙ্গী হলেন। ঐ সফর ছিল সাক্বীফ গোত্রের লোকদেরকে আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় ডাকার জন্য। কিন্তু তারা অত্যন্ত নীচ চরিত্রের পরিচয় দেয়। তাদের মধ্যে কেউ নবী করীম (ﷺ) এঁর কথা মানেনি। তাই, শান্তির জন্য নবী করীম (ﷺ) মক্কা মুকাররামাতে তাশরীফ আনেন। 


নবী করীম (ﷺ) এঁর মে'রাজ


ঐ সময়েই জ্বিনদের একটি দল হাজির হয় এবং কুরআন মাজীদ শোনে। এরপর আল্লাহ তায়ালা নবী করীম (ﷺ) কে (আরশ, কুরসি, লওহ) ভ্রমন করান এবং মে'রাজের নেয়ামত দান করেন। যা দ্বারা তাঁর (ﷺ) খুশি ও অন্তরের প্রশান্তি বেড়ে যায়। মে'রাজের সময় নবী করীম (ﷺ) এঁর বয়স মোবারক ছিল ৫১ বছর। মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসার সফর তাঁর ভ্রাতাগণ অর্থাৎ আম্বিয়ায়ে কেরামদের সাথে ইবাদতের মাধ্যমে পূর্ণ হয়। আল্লাহ তায়ালা নবী করীম (ﷺ) এবং (হুযুরের সদকায় অন্যান্য) সকল নবীগণের ওপর দুরুদ প্রেরণ করেন। 

এরপর নবী আকরাম (ﷺ) আসমানে তাশরীফ নিয়ে গেলেন। প্রথম আসমানে সাইয়্যেদুনা আদম (عليه السلام), দ্বিতীয় আসমানে সাইয়্যেদুনা ইয়াহিয়া (عليه السلام) ও সাইয়্যেদুনা ঈসা (عليه السلام), তৃতীয় আসমানে সাইয়্যেদুনা ইউসুফ (عليه السلام), চতুর্থ আসমানে সাইয়্যেদুনা ইদ্রিস (عليه السلام), পঞ্চম আসমানে সাইয়েদুনা হারুন (عليه السلام), ষষ্ঠ আসমানে সাইয়্যেদুনা মূসা (عليه السلام) এবং সপ্তম আসমানে সাইয়্যেদুনা ইবরাহীম (عليه السلام) এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। প্রত্যেকের সাথে সাক্ষাৎ করার সময় নবী করীম (ﷺ) সালাম দেন এবং সবাই হুযুর (ﷺ) এর সালামের জবাব দেন এবং বলেনঃ নেক ও পবিত্র নবীর শুভ আগমন। 

এরপর নবী আকরাম (ﷺ) কে আরো উপরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর নবী আকরাম (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহায় তাশরীফ নিয়ে যান যেখানে নবী করীম (ﷺ) কলমের লেখার আওয়াজ শুনতে পান। এটা সেই স্থান যেখানে কোন বাশারের পৌঁছানোর সৌভাগ্য হাসিল হয়নি। সেখানে নবী করীম (ﷺ) কে মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করা হয় এবং আল্লাহ তাআলার দিদার এবং আল্লাহর সাথে কথা বলার নেয়ামত দান করা হয়।

নবী করীম (ﷺ) এঁর উপর এবং তার উম্মতের জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। এরপর নবী আকরাম (ﷺ) বাইতুল মোকাদ্দাসে ফিরে আসেন। জিবরাঈল (عليه السلام) নবী করীম (ﷺ) এর সঙ্গী হন। যখন নবী করীম (ﷺ) মক্কা মুকাররমায় তার বিছানায় তাশরীফ আনেন ওই সময় রজবুল মুরাজজব এর ২৭ তম রাতের কিছু সময় বাকি ছিল। কারো কারো মতে তা ১৭ ই রবিউল আউয়াল অথবা রমজানের রাত ছিল। এই ঘটনা অত্যন্ত মহত্ত্বপূর্ণ এবং স্পষ্ট নিদর্শন ছিল।


মেরাজুন্নবী এবং কুরাইশদের প্রশ্ন


যখন সকাল হলো তখন নবী আকরাম (ﷺ) কুরাইশদেরকে ওই ঘটনা বললেন। কিন্তু তারা তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করল এবং বললঃ যা কিছু আপনি বায়তুল মোকাদ্দাসে দেখেছিলেন তার কিছু চিহ্ন বা নিদর্শন বর্ণনা করুন। যখন নবী করীম (ﷺ) তাদেরকে বাইতুল মুকাদ্দাস এর বর্ণনা দিতে শুরু করলেন তখন বলার মাঝে কিছু জিনিসের ব্যাপারে অস্পষ্টতা হল। তখন আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) কে হুকুম দিলেন যেন তিনি মসজিদে আকসা কে 'দারে আকিল' এর নিকট উপস্থিত করেন। যাতে নবী করীম (ﷺ) নিজ চোখ মোবারক দ্বারা দেখে তাদের প্রশ্ন কৃত জিনিসের ব্যাপারে বর্ণনা করতে পারেন। নবী আকরাম (ﷺ) তাদের সকল প্রশ্নের জবাব দেন। নবী আকরাম (ﷺ) তাদের প্রশ্নের জবাব প্রদান করেন। পরে কুরাইশরা শাম থেকে আগত উট সমূহের (কাফেলার) ব্যাপারে প্রশ্ন করলে নবী আকরাম (ﷺ) সেগুলোর নিদর্শন বর্ণনা করে বলেনঃ "সেগুলো বুধবার নাগাদ এসে যাবে।" যখন বুধবার আসলো এবং সূর্য ডুবে যাওয়ার উপক্রম হল আর কাফেলা তখনও পর্যন্ত পৌঁছালো না তখন নবী আকরাম (ﷺ) আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করলেন যেন সূর্য অস্ত যাওয়া থামিয়ে দেন। যাতে ওই কাফেলা এসে পৌঁছাতে পারে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা সূর্যাস্ত থামিয়ে দেন এবং ওই কাফেলা এসে পৌঁছায়। এতে যদিও কুরাইশরা নবী করীম (ﷺ) এঁর সত্যতা জানতে পারে কিন্তু তারা ইসলাম কবুল করে নি।


দা'ওয়াত ও তাবলীগ


নবী করীম (ﷺ) কাবিলা (গোত্র) সমূহকে নবুয়তের রওশন দলীল ও নিদর্শনের সাথে দা'ওয়াত দিতে থাকেন। এমনকি আল্লাহ তায়ালা আওস এবং খাযরাজের মত পুরোনো শত্রুকেও (নবী করীম (ﷺ) এঁর দা'ওয়াতের সদকায়) নরম করে দেন। এবং তারা (আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা) হিজরতের সময় বায়'আত করে একথার ওপরে যে, তারা তাদের নিজ পরিবার থেকে যেমন দুঃখ কষ্ট দূরে রাখে তেমনি নবী আকরাম (ﷺ) থেকেও দুঃখ কষ্টকে দূরে রাখবে। তখন নবী আকরাম (ﷺ) মক্কা থেকে হিজরত করার ইচ্ছা করলেন। ওই সময় নবী আকরাম (ﷺ) এর বয়স মোবারক ৫৩ বছর ছিল এবং তা ছিল নবুয়তের ১৩ তম বছর।


মদিনা মুনাওয়ারাতে হিজরত


নবী আকরাম (ﷺ) রবিউল আউয়াল এর প্রথম তারিখেই হিজরত করেন। তখন নবী আকরাম (ﷺ) এঁর সাথে ছিলেন সাইয়্যেদুনা আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) এবং তাঁর গোলাম আহমদ ইবনে ফাহিরাহ ও আব্দুল্লাহ ইবনে উরিক্বাত লায়সী। তিনি (আবদুল্লাহ) (মদীনা যাওয়ার) রাস্তা দেখিয়ে দিতেন।


ওই সফরে নবী আকরাম (ﷺ) এবং সিদ্দিকে আকবর (رضي الله عنه) মক্কা মুকাররমাতে গারে সওর এ তিন দিন পর্যন্ত গোপনে অবস্থান করেন। ওই সময়েই (গুহার ডান দিকে) মাকড়সা জাল বানিয়ে দেয় এবং কবুতর এসে ডিম পারে। এছাড়াও আরো অনেক প্রসিদ্ধ ঘটনা ঘটে। এরপর তারা দুইজন গুহা থেকে বের হন এবং মদিনার দিকে রওনা হন।


কুদাইর (قدير) নামক জায়গার এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া ঐ হিজরতের সফরে অনেক প্রসিদ্ধ ও প্রকাশ্য মু'জেযা সংঘঠিত হয়েছে। যেমনঃ সারাকাহ ইবনে মালেক ইবনে জা'শাম এবং তাবুতে বসবাসকারী উম্মে মা'বাদ এর বকরীর ঘটনা। এরপর নবী করীম (ﷺ) ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার দিন মদীনায়ে মুনাওয়ারায় তাশরীফ আনেন। কোন কোন আলেম ৮ রবিউল আউয়ালের কথা বলেন। তবে প্রথম মতটিই গ্রহণযোগ্য। 


নবী করীম (ﷺ) (মদিনা-মুনাওয়ারাতে) পৌঁছে ডান দিকে অগ্রসর হন এবং মদিনার বিপদ পূর্ণ অংশে বনী আমর ইবনে আওফ এর নিকট "কুবা" তে নামেন। এই স্থান নির্ধারণে একটি ভবিষ্যত বানীও ছিল। মদীনাবাসী (নবী করীম (ﷺ) এঁর আগমনে) এতটাই খুশি হয়েছিল যে হাজুমের পার্শ্ববর্তী জায়গা সংকীর্ণ হতে লাগল (অর্থাৎ মানুষের থাকার জায়গার সংকট হয়ে গেল)। তখন নবী আকরাম (ﷺ) উটনীর ওপর বসে তার রশি ছেড়ে দিলেন এবং বললেন একে যেতে দাও। এটাকে হুকুম দেওয়া হয়েছে (সে কোথায় থামবে)। ঊটনী চলতে থাকল এবং গিয়ে নবী করীম (ﷺ) এঁর দাদার মামার বংশ বনী নাজ্জারের ঘরের নিকটে নবী করীম (ﷺ) এর মসজিদের (মসজিদে নববীর) দরজার স্থানে দাড়িয়ে গেল। নবী করীম (ﷺ) সেখানেই অবস্থান করেন এবং সেটাই নবী করীম (ﷺ) এঁর পবিত্র বাসগৃহ হয়। আর আনসারগণ নবী করীম (ﷺ) এঁর প্রতিবেশী হয়। 


সেখানে অবস্থান করার পর নবী করীম (ﷺ) দ্বীনের প্রচার এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর পয়গামের প্রচারে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন। যুদ্ধে প্রয়োজনীয় সৈন্য প্রেরণ করেন এবং কিছু কিছু যুদ্ধে নিজেও শরিক হন। এমনকি তারা যুদ্ধে জয়ীও হন যা বিস্তারিতভাবে সিরাতের অধ্যায় সমূহে প্রসিদ্ধ রয়েছে।


মক্কা বিজয় ও মূর্তি সমূহ ধ্বংস


হিজরতের অষ্টম বছর রমজান মাসে মক্কা মুকাররমা বিজিত হয়। রমজানুল মোবারকে বাইতুল হারামে নামাজ পড়েন এবং তাওয়াফের মধ্যে যখন খানায়ে কাবার চারপাশে ৩৬০ টি মূর্তির কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সেগুলোর প্রত্যেকটিকেই নিজের তীর দ্বারা, অন্য বর্ণনামতে নিজের হাতে থাকা লাঠি দ্বারা ইশারা করে বলেনঃ-

قُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ 

সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলীন হয়েছে।  ৪১

41➠  সুরা বনী ইসরাঈলঃ ৮১

তখন মূর্তিগুলো মুখ উপর করে পড়ে যায়।


নবী করীম (ﷺ) এঁর মু'জিজা সমূহ


আল্লাহ তাআলা নবী করীম (ﷺ) এঁর হাতে অনেক মু'জিজা ও নিদর্শন প্রকাশ করেছেন। নবী করীম (ﷺ) কে খাসায়েস ও কামালাত দ্বারা সম্মানিত করা হয়েছে। যেমনঃ মূর্তিগুলো নবী আকরাম (ﷺ) এঁর ইশারা তে পড়ে যায়। গুইসাপ এবং বাঘ নবী করীম (ﷺ) এঁর নবুয়তের সাক্ষ্য দেয়। চাঁদ নবী আকরাম (ﷺ) এর হাতের ইশারায় দুই টুকরা হয়ে গিয়েছে। হরিণের দুধ পানকারী বাচ্চা নবী আকরাম (ﷺ) এঁর সাথে কথা বলেছে। নবী আকরাম (ﷺ) এর অক্সগুল মোবারক থেকে পানির ঝরণা প্রবাহিত হয়েছে। নবী করীম (ﷺ) এঁর অল্প খাদ্য অনেক লোকের পেট ভরিয়ে দিয়েছে। খেজুরের শুকনো ডাল নবী করীম (ﷺ) এঁর বিরহে কেঁদেছে। খাদ্য নবী আকরাম (ﷺ) এর সামনে এবং পাথর নবী আকরাম (ﷺ) এঁর মুষ্টিতে তসবিহ বয়ান করেছে। কোরআন মাজীদের আয়াতের মু'জিজা তো কোনদিন শেষ হওয়ার নয়-

لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ

এই দিকে মিথ্যার কোন রাস্তা নেই। না সামনে থেকে না পেছন থেকে।  ৪২

42➠  সুরা হা মীম সাজদাহঃ ৪২


খাসায়েছ (বৈশিষ্ট্য) ও কামালাতের (পূর্ণতার) ঝলক


নবী করীম (ﷺ) এর মোজেজা ও কামালাত তো এত যার গণনা করে শেষ করা যাবে না। নবী আকরাম (ﷺ) এর সৌন্দর্য অত্যন্ত মনমুগ্ধকর এবং অধিক পরিমানে ছিল এবং তার গুণাবলী ছিল উজ্জ্বল। তিনি (ﷺ) হলেন মুহাম্মদ যার স্বভাব-চরিত্র কে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করা হয়েছে। তিনি আহমদ যিনি আল্লাহ তাআলার প্রশংসা মাখলুকাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করেছেন এবং তিনি মাহি আল্লাহ তাআলা তার মাধ্যমে গোমরাহী কে শেষ করেছেন। তিনি হাশির কিয়ামতের দিন সবাই তাঁরই কদমে একত্রিত হবে এবং তিনি আকিব অর্থাৎ নবীদের মধ্যে সর্বশেষ আগমনকারী। এমনিভাবে নবী করীম (ﷺ) এর উপাধি (লকব) "নবিউত তওবাহ" কারণ, যে কেউ তার উসিলা দিয়ে তওবা করেছে সে গুনাহ থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে। আরো একটি নাম "নবিউর রহমাত"। আল্লাহ তায়ালা নবী করীম (ﷺ) এর তোফায়েলে মুমিন ও কাফের এবং ফাসেক ও ফাজেরের ওপরও রহমত দান করেন। এগুলো নবী আকরাম (ﷺ) এর প্রসিদ্ধ নাম সমূহের মধ্যে কিছু নাম যা প্রসিদ্ধ কিতাব সমূহের মধ্যে এসেছে।


সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি


নবী করীম (ﷺ) সৃষ্টিগত দিক থেকে সকলের মধ্যে পূর্ণতার অধিকারী। সত্ত্বাগত ভাবে সবচেয়ে সুন্দর এবং গুণাবলির দিক থেকে সর্বোত্তম। পরিমিত উচ্চতা ও গঠন, সুন্দর দেহ মোবারক, দীর্ঘ কপাল, উজ্জল মুখমন্ডল, উত্তম আকৃতি ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ফর্সা ও উজ্জ্বল নূরানী চেহারা মোবারক। চেহারার ঔজ্জ্বলতা এমন যেন চৌদ্দ তারিখের পূর্ণিমার চাঁদ। পেট ও সীনা মোবারক ব্যাতীত পুরো শরীরে (পরিমিত) মাংস (সুঠাম দেহ মোবারক), প্রশস্ত কপাল মোবারক, উঁচু নাক মোবারক, মিলে থাকা ভ্রূ মোবারক এবং (দুই ভ্রূ মোবারকের) মাঝখানে একটি রগ যা (হুযুর (ﷺ) ) নারায হলে দেখা যেত, সুরমা লাগানো চোখ, সুন্দর মুখ মোবারক, প্রশস্ত দাঁত মোবারক যা দেখতে অত্যন্ত সুন্দর, চমৎকার ঘাড় মোবারক, শক্ত ও মজবুত হাতের কব্জিদ্বয়, হাতের তালু মোবারক ও পবিত্র পা মোবারক, দুই হাতের মধ্যে পরিমিত দুরত্ব, উঁচু টাখনু মোবারক, প্রশস্ত সীনা মোবারক, ঘণ দাড়ি মোবারক, চুল মোবারক ঘাড় পর্যন্ত লম্বা, কখনো কখনো কান মোবারক পর্যন্ত ছিল। দৃষ্টি আসমানের দিকে উঁচু না হয়ে সবসময় মাটির দিকে ঝুকে থাকত। তিনি (ﷺ) অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। যে কেউ হুযুর (ﷺ) এঁর কাছে যা কিছু চাইতেন তিনি (ﷺ) তা দিতেন। তিনি অত্যন্ত লজ্জাশীল ছিলেন। এমন লজ্জাশীল ছিলেন যে, পর্দানশীল কুমারী মেয়ের চেয়েও বেশি। বাহাদুরীতে ও সাহসীকতায় তিনি (ﷺ) প্রথম কাতারে। সৃষ্টির মধ্যে তাঁর (ﷺ) মত বাহাদুর আর কেউ নেই। 


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এঁর বীরত্ব ও সাহাবায়ে কেরাম


হযরত সাইয়্যেদুনা আলী (رضي الله عنه) বলেনঃ

যখন কোন যুদ্ধ কঠিন হয়ে যেত তখন আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর ছায়ায় আশ্রয় নিতাম।

হুনাইনের যুদ্ধের দিন যখন লোকেরা কিছুক্ষণের জন্য পিছিয়ে যাচ্ছিল, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার খচ্চরের উপর ছিলেন। নবী করীম (ﷺ) খচ্চর ছোটালেন এবং পূর্ব দিকের দুশমনদের দিকে এগোলেন এবং বললেনঃ 

انَا النَّبِيُّ لاَ كَذِبْ *** انَا بْنُ عَبْدِ المُطَّلِبْ

আমি নবী এতে কোনো মিথ্যে নেই। এবং আমি আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান (বংশধর)। ৪৩

43➠  

১) সহীহ বুখারী, কিতাবুল জিহাদ, হাদীসঃ ২৮৬৪

২) সহীহ মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ, হাদীসঃ ৭৭৬১

৩) সুনানে তিরমিযী, কিতাবুল জিহাদ, হাদীসঃ ৬৮৮১

৪) মুসনাদে আহমদ, হাদীসঃ ৮৪৬৮


ওই যুদ্ধে যখনই হুযুর (ﷺ) এর সাহাবীগণ তাঁর নিকট ফিরে আসতেন, তখন বাতিলরা তাদের থেকে পালিয়ে যেত। আল্লাহ তাআলা তাঁর উপর দুরুদ ও সালাম প্রেরণ করুন।


মোবারক চরিত্র ও ব্যবহার


নবী করীম (ﷺ) কখনোই নিজের জন্য প্রতিশোধ নেননি। এবং না (কখনো তাঁর নিজের জন্য) রাগ করেছেন। শুধুমাত্র যখন আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত শাস্তি প্রদান করতে হতো ওই সময়ই নবী করীম (ﷺ) রাগান্বিত হয়েছেন। নবী করীম (ﷺ) মিসকিন দের অত্যন্ত ভালোবাসতেন, মর্যাদাবান লোকদের সম্মান করতেন, দ্বীনদার ব্যক্তিদের সাহস দিতেন, জানাজায় শরিক হতেন, অসুস্থদের দেখতে যেতেন।


মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গম্ভীর থাকতেন নবী করীম (ﷺ)। অনেক বেশি আল্লাহ তাআলার যিকির করতেন, রোজা রাখতেন, উম্মতের জন্য চিন্তা করতেন এবং অধিক পরিমাণ কিয়াম (নামাজ আদায়) করতেন। 



বিদায় হজ্ব


নবী আকরাম (ﷺ) ১০ হিজরীতে সত্তর হাজার, অন্য বর্ণনামতে ১ লক্ষ সাহাবী সাথে নিয়ে হজ আদায় করেন। ওই সময় নবী করীম (ﷺ) এর বাহনের ওপর (বসার) যে গদি ছিল তার মূল্য ছিল চার দিরহাম। এ সময় নবী করীম (ﷺ) বলছিলেনঃ "হে আল্লাহ এই হজ্বকে এমন করে দিন যাতে কোন রিয়া বা লৌকিকতা না থাকে।" ওই হজ্বে আরাফায় অবস্থানের দিন ছিল জুমার দিন। এইজন্য ঐ দিনকে হুজ্জাতুল ইসলাম এবং হুজ্জাতুল বিদা নামেও স্মরণ করা হয়। ঐ সময় যে সকল সাহাবায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন, বিদায় খুৎবা তে তাদেরকে (উদ্দেশ্য করে) বলা হয়ঃ "যারা এখানে উপস্থিত আছে অচিরেই তারা আমাকে দ্বিতীয়বার দেখতে পাবে না।"

নবী করীম (ﷺ) বিদায় হজ্বের পূর্বেও দুইটি হজ্ব আদায় করেছেন। কারো কারো মতে তার বেশিও আদায় করেছেন। পাশাপাশি চার বার ওমরাও আদায় করেছেন এবং সর্বশেষ ওমরা ঐ হজ্জে আকবর এর সময়ে আদায় করেছেন। ঐ হজ্বের সময় আরাফাতের দিন আল্লাহ তায়ালা এই ওহী নাযিল করেন, যা দেখে মুসলিম উম্মার প্রশান্তি, ঈমান, শুকরিয়া ও ইয়াকিন বেড়ে গিয়েছিল।

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

অনুবাদঃ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত পূর্ণ করে দিলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।  ৪৪

44➠  সূরা মায়েদাঃ ৩


রাসূলে কারীম (ﷺ) -এর ওফাতের সময় এই আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করে সাইয়্যেদুনা ওমর ফারুক (رضي الله عنه) কাঁদতে থাকেন এবং নবী করীম (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের দ্বীন যদিও পূর্ণ হয়ে গেছে কিন্তু আপনি বলে দিন। কেননা পরিপূর্ণ হওয়ার পর যে ক্ষতি (অর্থাৎ নবী করীম (ﷺ) এর বেসাল মোবারক) হবে তা আমরা বরদাস্ত করতে পারবোনা। তখন নবী আকরাম (ﷺ) তাঁর ইঙ্গিতকে সত্যায়ন করলেন।



মৃত্যুকালীন রোগের আরম্ভ


নবী করীম (ﷺ) হজ শেষ করে মদিনা মুনাওয়ারা তে ফিরে আসলেন। এর কিছুদিন পর ১১ হিজরী সনের শেষ বুধবার, অন্যদের মতে সফর মাসের শেষ দুই রাত্রি বাকি ছিল, যখন (নবী করীম (ﷺ) এঁর) অসুস্থতা শুরু হয় এবং অত্যধিক জ্বর হওয়ার দরুন কষ্ট বেড়ে যায়। অসুস্থতার মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন নবী আকরাম (ﷺ) হযরত মায়মুনা (رضي الله عنه) এঁর ঘরে অবস্থান করছিলেন। তখন নবী আকরাম (ﷺ) সকল স্ত্রীদের সম্মতি চাইলেন যে, "অসুস্থতার দিনগুলি আমি (নবী আকরাম (ﷺ)) হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) এঁর ঘরে অবস্থান করবো।" সবাই সম্মতি দিলেন। এরপর নবী করীম (ﷺ) ১২ অথবা ১৪ দিন অসুস্থ থাকেন। ওই দিনগুলোর মধ্যে শুধু মাত্র ৩ দিন ব্যতীত অন্য সব দিন নবী আকরাম (ﷺ) নামাজের জন্য (মসজিদে নববী তে) তাশরীফ আনেন।


একদিন সাইয়্যেদুনা বেলাল (رضي الله عنه) ভোরে (তাহাজ্জুদের) আজান দেন এবং (তা জানানোর জন্য) হুজরা মুবারক-এ হাজির হন এবং সালাম দেন তখন সাইয়েদা ফাতেমা (رضي الله عنه) বলেনঃ "হে বেলাল! রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ অবস্থায় (অসুস্থতায়) আছেন।" এরপর হযরত বেলাল (رضي الله عنه) মসজিদে ফিরে আসেন এবং সকালের (ফজরের) আযান দেন। এবং দ্বিতীয়বার হুজরা মোবারক এ হাজির হয়ে বলেনঃ "আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ!" এরপর তিনি নামাজের সংবাদ প্রদান করেন। তখন নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ "আবু বকরকে বল সে যেন সকলকে নিয়ে নামাজ পড়ায়।" সাইয়্যেদুনা বেলাল (رضي الله عنه) সকলকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এঁর হুকুম জানালেন। যেহেতু সাইয়্যেদুনা সিদ্দিকে আকবর (رضي الله عنه) খুব নরম অন্তরের মানুষ ছিলেন তাই যখন তিনি তার হাবিব (ﷺ) -এঁর জায়গায় নামাজের জন্য দাঁড়ালেন তখন উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। এরপর বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। সাহাবায়ে কেরামও নবী আকরাম (ﷺ) কে না পাওয়ার কারণে কাঁদতে লাগলেন। এমনকি সেই (কান্নার) আওয়ায নবী আকরাম (ﷺ) এঁর হুজরা শরীফ পর্যন্ত পৌছে গেল। নবী আকরাম (ﷺ) বললেনঃ "কি ব্যাপার (কিসের আওয়াজ)?" বলা হলঃ "এটা মুসলমানদের কান্নার আওয়াজ। কারণ তারা তাদের প্রিয় রাসূল খাতামুন্নাবিয়্যীন (ﷺ) এঁর দীদার করেনি।"

এরপর নবী আকরাম (ﷺ) অজু গোসল করেন যাতে তাদের নিকট তাশরিফ আনতে পারেন। কিন্তু অসুস্থতার দুর্বলতার কারণে পারেননি। অন্য বর্ণনামতে নবী করীম (ﷺ) বাইরে তাশরিফ আনেন। এবং নামাজ পড়ান তারপর আবার ভেতরে চলে যান।



জীবন অথবা মৃত্যুর ইখতিয়ার


সাইয়্যেদুনা জিবরাঈল (عليه السلام) উপস্থিত হয়ে আরজ করেনঃ আপনার রব আপনার ওপর সালাম প্রেরণ করেছেন এবং বলেছেন, যদি আপনি চান তো আপনাকে সুস্থতা দান করা হবে এবং যদি চান তো বেসাল দেয়া হবে। নবী করীম (ﷺ) বলেনঃ এটা আমার রবের ব্যাপার। তিনি যা চান আমার সাথে তাই করতে পারেন।


এক বর্ণনায় এসেছে নবী করীম (ﷺ) কে (জীবন অথবা মৃত্যুর) ইখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। নবী করীম (ﷺ) রফিকে আ'লা (আল্লাহর) সান্নিধ্য গ্রহণ করেন।

একজন আহ্বানকারী বললেনঃ হে নেককারদের পথ-প্রদর্শনকারী। আমরা তাকদীর লিখে দিয়েছি এবং (আমরা যা লিখি) তা পূর্ণ হয় আমরা যা বলি তা সংঘটিত হয়।

إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ

অনুবাদঃ নিশ্চয়ই আপনারও ইন্তেকাল হবে এবং তাদেরও মৃত্যু হবে।  ৪৫

45➠  সূরা যুমার ৩৯ঃ ৩০


রাসূলে আকরাম (ﷺ) এঁর বারগাহে মালাকুল মউত (عليه السلام) হাজির হাজির হয়ে বলেনঃ আল্লাহ তাআলা আমাকে আপনার নিকট এই হুকুম দিয়ে পাঠিয়েছেন যে, আপনি আমাকে যে আদেশই করবেন আমি তাই পালন করব। নবী করীম (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেনঃ "আমার মহব্বতের জিব্রাইলকে কোথায় রেখে এসেছো?" তিনি আরজ করলেনঃ দুনিয়ার আসমানের ফেরেশতাগণ তাঁর নিকট বিলাপ করছে। ওই সময়েই হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) উপস্থিত হন। নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ "হে জিবরাঈল আমার জীবনের মুহূর্তগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। আমাকে আমার রবের নিকট থেকে যে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে (তা বর্ণনা করো)। এখন আমি আনন্দের সাথে আমার জীবন (আল্লাহর দরবারে) পেশ করছি।" তখন সাইয়্যেদুনা জিবরাঈল (عليه السلام) আরজ করলেনঃ হে আল্লাহর হাবিব! আসমানের সকল দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে এবং ফেরেশতারা কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে আপনার (ﷺ) জন্য তৈরি। জান্নাতের কোষাধ্যক্ষ রেদওয়ান অত্যন্ত খুশি এবং নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র রুহ মোবারকের জন্য অপেক্ষমান। 

(এটা শুনে) নবী আকরাম (ﷺ) আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করেন এবং বলেনঃ "আমি এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করিনি হে জিবরাঈল! আমাকে সুসংবাদ দাও।" তখন জিব্রাইল (عليه السلام) বলেনঃ জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। ফেরদৌসকে বড় এবং প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার গাছগুলো ফলদায়ক হয়ে ঝুলছে এবং হুরেরা সজ্জিত হয়ে নবী আকরাম (ﷺ) এর পবিত্র রূহ মোবারকের জন্য অপেক্ষা করছে। (এটা শুনে) হুযুর (ﷺ) আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করলেন এবং বললেনঃ "হে জিবরাঈল! আমি এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করিনি।" সাইয়্যেদুনা জিবরাঈল (عليه السلام) আরজ করলেনঃ সর্বপ্রথম আপনার সাথেই হাশর শুরু হবে। আপনিই প্রথম ব্যক্তি হবেন যিনি আল্লাহ তাআলার দরবারে শাফায়াত করবেন। এবং আপনিই সেই প্রথম ব্যক্তি যার শাফায়াত কবুল করা হবে।


নবী করীম (ﷺ) বলেনঃ "আমার প্রশ্ন এই ব্যাপারেও ছিলনা। আর এই সুসংবাদ সম্পর্কেও ছিলনা যা তুমি বর্ননা করেছ।" তখন সাইয়্যেদুনা জিবরাঈল (عليه السلام) আরজ করলেনঃ তাহলে কোন ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন? নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ "হে জিবরাঈল! আমার উম্মতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি। তাদের কষ্ট, তাদের পেরেশানি এবং তাদের দুঃখের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি। আমার উম্মত দুর্বল। কিন্তু আমার উপর ঈমান এনেছে এবং তাদের কাজকর্ম, আমল আমার উপর সোপর্দ করে দিয়েছে। আমার শরীয়ত এবং ধর্ম কে স্বীকার করেছে। আমার আনুগত্য ও অনুসরণ করেছে। আমার উম্মতের পরিণতি কী হবে এবং তাদের আযাবের ব্যাপারে কি হবে?"


সাইয়্যেদুনা জিবরাঈল (عليه السلام) আরজ করলেনঃ "হে আল্লাহর হাবিব! আপনার জন্য সুসংবাদ যে, আল্লাহ তায়ালা আপনার এবং আপনার উম্মতের জন্য ফয়সালা করে দিয়েছেন। আপনার পূর্বে কোন নবী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এবং আপনার উম্মতের পূর্বে কোন উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এটা শুনে নবী আকরাম (ﷺ) অত্যন্ত খুশি হলেন। এরপর আল্লাহ তাআলা তার শান মোতাবেক আমাদের এবং সকল উম্মতের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম প্রতিদান দান করলেন।

এরপর সাইয়্যেদুনা জিবরাঈল (عليه السلام) আরজ করলেনঃ হে আহমদ (ﷺ)! আল্লাহ তাআলা আপনার সাক্ষাতের প্রত্যাশী। এবং তিনি চান যে, আপনি তার দরবারে আসেন। যাতে তিনি আপনাকে (নিজ শান মোতাবেক) দেখতে পান। নবী করীম (ﷺ) মালাকুল মউত কে বললেনঃ "তোমাকে যে হুকুম দেয়া হয়েছে তা পূর্ণ করো।" এরপর হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) নবী করীম (ﷺ) এঁর উপর সালাম প্রেরণ করলেন।




নবীজি (ﷺ) এঁর ওফাত মোবারক


❏ বর্ণিত আছে, নবী আকরাম (ﷺ) সর্ব শেষ (যে) কথা বলেছিলেন (তা হলো)ঃ "আল্লাহ তা'আলাকে ভয় করো। আর আমার পরিবারের (আহলে বায়তের) খেয়াল রাখো।" অন্য বর্ণনামতে, নবী করীম (ﷺ) এঁর সর্বশেষ কথা ছিলঃ "নামাজের খেয়াল রেখো। নামাজের খেয়াল রেখো। আর নিজ গোলাম (দাসদের) খেয়াল রেখো (অর্থাৎ তাদের সাথে ব্যবহার করার সময় আল্লাহর ভয় রেখ)।" ৪৬

46➠  সুনানে ইবনে মাজাহ, কিতাবুল জানায়েজ, হাদিস নং ৬২৫১


মুস্তাফা করীম (ﷺ) নিজের শাহাদত আঙ্গুলি মোবারক উঠালেন এবং বললেনঃ "আর-রফিকুল আলা!" এরপর নবী আকরাম (ﷺ) এঁর বেসাল হয়। ওই সময়ে নবী করীম (ﷺ) হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) এঁর হুজরা মুবারক-এ তাঁর বুকে মাথা রাখা অবস্থায় ছিলেন। তখন প্রায় অর্ধ রাত্রি এবং ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার ছিল। কারো কারো মতে সেদিন রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ ছিল।


বেসাল মোবারকের সময় নবী করীম (ﷺ) এঁর বয়স মুবারক ছিল ৬৩ বছর। কেউ কেউ এর বেশিও বলেছেন। নবী করীম (ﷺ) এঁর চুল ও দাড়ি মোবারক এর মধ্যে প্রায় ২০ টি দাড়ি সাদা ছিল। 


❏ নবী করীম (ﷺ) এঁর বেসাল মোবারকের কারণে অনেক বড় বড় (জলিলুল কদর) সাহাবীও বেঁহুশ হয়ে পড়লেন। অনেক বড় ও কঠিন মুসিবতের সময় এসে পরল। কেউ কেউ তো (শোকে জ্ঞানশূন্য হয়ে) বসে পরলো। আর বাকিরা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল এরপর সাইয়্যেদুনা আবু বকর (رضي الله عنه) এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন।

إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ

নিশ্চয়ই আপনার ইন্তেকাল হবে এবং তাদেরও মৃত্যু হবে। ৪৭

47➠  সূরা যুমার ৩৯ঃ ৩০

  


শেষ বিদায়ের প্রস্তুতি এবং দাফন মোবারক


কিছু সময় পরে যখন সবার নবী করীম (ﷺ) এঁর ওফাতের ইয়াকিন (বিশ্বাস) হয়ে গেল তখন আহলে বায়তগন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) নবী আকরাম (ﷺ) কে গোসল দেওয়ার জন্য একত্র হলেন। তাঁদের মধ্যে সাইয়্যেদুনা আলী (رضي الله عنه), সাইয়্যেদুনা আবুল ফজল আব্বাস (رضي الله عنه), হযরত আব্বাস এঁর দুই পুত্র সাইয়্যেদুনা ফজল ও সাইয়্যেদুনা ক্বাছাম, উসামা ইবনে যায়েদ এবং তাঁর গোলাম 'সালেহ' অংশ নিয়েছিলেন। সাইয়্যেদুনা (আবু লায়লা) আওস (ইবনে খাওলা) আনসারী (رضي الله عنه) দরজার পেছনে থেকে সাইয়্যেদুনা আলী (رضي الله عنه) কে বলেনঃ হে আলী! আমি তোমাকে আল্লাহ তায়ালার কসম এবং আনসারদের রাসুল (ﷺ) এঁর সম্পর্কের ওয়াসতা দিচ্ছি। আমাকেও ভেতরে আসতে দাও। এরপর তিনি বলেনঃ এসো। তখন তিনিও ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং সেখানে রইলেন। কিন্তু তিনি গোসলের কোন কাজে অংশগ্রহণ করেননি।


❏ ইমাম ইবনে মাজাহ উত্তম সনদে হযরত আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেনঃ

إِذَا أَنَا مُتُّ فَاغْسِلُونِي بِسَبْعِ قِرَبٍ مِنْ بِئْرِي بِئْرِ غَرْسٍ

অনুবাদঃ হে আলী যখন আমার ইন্তেকাল হয়ে যাবে তখন আমাকে আমার কূপ অর্থাৎ "বিরে গারাস" থেকে সাত বালতি পানি দিয়ে গোসল দিবে। ৪৮

48➠

১) সুনানে ইবনে মাযাহ, কিতাবুল জানাইয, বাবু মা জা-আ ফি গুসলিন নাবিয়্যী (ﷺ), ১/৪৭১, হাদীসঃ ১৪৬৮

২) মুসনাদে বাযযার, ২/১১৬, হাদীসঃ ৪৭০


এই কূপ (বিরে গারাস) কুবার নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল। নবী করীম (ﷺ) এই কূপের পানি ব্যবহার করতেন। 

আবু জাফর মোহাম্মদ বাকের (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে কুপের পানি দিয়ে গোসল দেয়া হয়েছিল। জামা মোবারক পরিহিত অবস্থায় গোসল দেয়া হয়েছিল। এবং পানি ওই কূপ থেকে নেয়া হয়েছিল যা সা'দ ইবনে খায়সামা কুবার নিকটে খনন করিয়েছিলেন। নবী করীম (ﷺ) এঁর ক্ষেত্রে এমন কোন কিছু দেখা যায়নি যা অন্যান্য মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায়।


❏ সাইয়্যিদুনা হযরত আলী (رضي الله عنه) নবী করীম (ﷺ) এঁর শরীর মুবারক (ডানে-বামে) কাত করতেন আর বলতেনঃ আমার পিতা মাতা আপনার ওপর কুরবান। আপনার চেয়ে অধিক পবিত্র জীবিত অথবা মৃত কেউ নেই। এরপর নবী করীম (ﷺ) কে চারপায়া খাটের উপর আনা হলো এবং তিনটি সাদা ইয়ামানী চাদর দ্বারা কাফন দেয়া হলো। যার মধ্যে জামা মোবারক ও পাগড়ী শরীফ ছিল না।  ৪৯

49➠  সুনানে ইবনে মাযাহ, কিতাবুল জানাইয, বাবু মা জা-আ ফি গুসলিন নাবিয়্যী (ﷺ), ১/৪৭২, হাদীসঃ ১৪৬৯  


অন্য একটি বর্ণনামতে নবী করীম (ﷺ) কে দুটি কাপড়ে এবং একটি হাবরাহ চাদরে কাফন দেয়া হয়েছিল এরপর চারপায়া খাটে রাখা হয়েছিল।

[নোটঃ

كُفِّنَ فِي ثَلَاثَةِ أَثْوَابٍ بِيضٍ يَمَانِيَةٍ، لَيْسَ فِيهَا قَمِيصٌ وَلَا عِمَامَةٌ

..............



জানাযার নামায ও দাফন


লোকেরা (সাহাবায়ে কেরাম) কোন ইমাম ব্যতীত হুযুর (ﷺ) এঁর জানাযার নামায আদায় করেন এই ভাবে যে, কিছু মানুষ এসে দলবদ্ধভাবে উপস্থিত হতেন এবং নামায আদায় করে চলে যেতেন। (পরুষদের নামায আদায় করার পর) মহিলারাও এমনিভাবে নামায আদায় করেন। এরপর দাফনের ব্যাপারে কথা বলাবলি হতে লাগল (কোথায় দাফন হবে এই ব্যাপারে)। তখন সাইয়্যেদুনা আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) ইরশাদ করেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছিঃ

مَا قُبِضَ نَبِيٌّ إِلَّا دُفِنَ حَيْثُ يُقْبَضُ

অনুবাদঃ যে জায়গায় কোন নবীর ইন্তিকাল হয় সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।  ৫০

50➠  

১) সুনানে ইবনে মাযাহ, কিতাবুল জানায়েয, বাব- যিকরি ওফাতিহি ওয়া দাফনিহি (ﷺ), হাদীসঃ ৬২৮১

২) বাযযার, মুসনাদ, ১/৭০, হাদীসঃ ১৮

৩) আবু ইয়া'লা, মুসনাদ, ১/৩১, হাদীসঃ ২২


এই কথার ওপর (একমত পোষণ কর) সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা (رضي الله عنه) ইরশাদ করেনঃ "যেখানে আল্লাহ তাঁর নবীর ইন্তিকাল নির্ধারণ করেছেন তা থেকে ভালো আর কোন জায়গা হতে পারে?"


এরপর সবাই এই ব্যাপারে একমত হন। সেখানেই (আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এঁর হুজরা মোবারকে) হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) এঁর দাফন মোবারক হয়। 


বলা হয়, দাফন মঙ্গলবার সকালে অথবা অপরাহ্নে সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে কেউ কেউ বলেনঃ বুধবার দিন হয়। আর এটাই প্রসিদ্ধ মত। হুযুর (ﷺ) এঁর রওযায়ে আনওয়ারের ওপর পানিও ছিটানো হয়। 


দো জাহানের শাহজাদী সাইয়্যেদাহ ফাতিমাহ যাহরা (رضي الله عنه) কর্তৃক আব্বাজানের মাযার মোবারকে হাযিরী


❏ সাইয়্যেদাহ বাতুল ফাতিমা যাহরা (رضي الله عنه) এঁর জন্য এটা অনেক কঠিন মুহূর্ত ছিল। তিনি রওযা শরীফের মাটি হাতে নিলেন এবং চোখে লাগিয়ে বললেনঃ

مَاذَا عَلَى مَنْ شَمَّ تُرْبَةَ أَحْمَدَ ... أَلا يَشُمُّ مَدَى الزَّمَانِ غَوَالِيَا

صُبَّتْ عَلَيَّ مَصَائِبُ لَوْ أَنَّهَا ... صُبَّتْ عَلَى الأَيَّامِ عُدْنَ لَيَالِيَا

অনুবাদঃ যে কেউ আহমদ মুস্তফা (ﷺ) এঁর রওযায়ে আত্বহারের পবিত্র মাটির ঘ্রাণ নিল তাঁর সারা জীবন অন্য কোন সুগন্ধির ঘ্রাণ নেয়ার প্রয়োজন নেই। আমার ওপর এমন মুসিবত দেয়া হয়েছে, যদি তা কোন উজ্জ্বল দিনের ওপর দেয়া হত তাহলে তা রাতে পরিনত হয়ে যেত। ৫১

51➠

১) ইবনে সাইয়্যেদুন্নাস, উয়ুনূল আছার, ২/৪০৯

২) দিয়ার বাকারী, তারিখুল খামিস, ২/১৭৩

৩) ইয়ুসূফ সালেহী শামী, সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১২/৩৩৭


❏ সাইয়্যেদা ফাতিমা (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এঁর খাদেম সাইয়্যেদুনা আনাস ইবনে মালেক (رضي الله عنه) কে বলেনঃ

يَا اَنَسُ ! اَ طَابَتْ اَنْفُسُكُمْ اَنْ تَحْثُوْا التُّرَابَ عَلَى حَبِيْبِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم

অনুবাদঃ হে আনাস! তোমার অন্তর কিভাবে চাইল আল্লাহর হাবীব (ﷺ) এঁর ওপর মাটি দিতে?  ৫২

52➠

১) মোল্লা আলী ক্বারী, জামেউল ওয়াসায়েল, ২/২১০

২) সুনানে ইবনে মাজাহ, কিতাবুল জানায়েয, বাব- যিকরি ওফাতিহি ওয়া দাফনিহি (ﷺ), হাদীসঃ ৬৩০১

৩) ইমাম যাহাবী, তারিখুল ইসলাম, ৩/৪৩

  

নোটঃ 

❏ একই শব্দে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন মোল্লা আলী ক্বারী "জামেউল ওয়াসায়েল শরহে শামায়েল" গ্রন্থে। এছাড়া ইমাম যাহাবী ও ইমাম ইবনে মাজাহ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে মাজাহ শরীফে হাদীসটি এসেছে এইভাবে -

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَتْ لِي فَاطِمَةُ: يَا أَنَسُ، كَيْفَ سَخَتْ أَنْفُسُكُمْ أَنْ تَحْثُوا التُّرَابَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -؟

-- -- -- -- -- -- -- -- -- -- -- -- -- --- -- -- --

এরপর সাহাবায়ে কেরাম এবং অন্য সকলে অত্যন্ত কষ্ট ও যন্ত্রনায় ডুবে থাকেন। সাহাবায়ে কেরাম এবং উম্মাহাতুল মু'মিনীন সবাই কাঁদতে থাকেন এবং অশ্রুধারা বইতে থাকে। তাদের অন্তরে আল্লাহর হাবীব (ﷺ) এঁর সুরত মোবারকের বিচ্ছেদের কারণে (আরেকবার দীদাদের) আকাক্সক্ষার অশ্রু ছলছল করতে থাকে। 

সাইয়্যেদা ফাতিমা (رضي الله عنه) বলতেনঃ

ياأَبَتَاهُ، أَجَابَ رَبًّا دَعَاهُ ياأَبَتَاهُ جَنَّةُ الْفِرْدَوْسِ مَأْوَاهُ ياأَبَتَاهُ، إِلَى جِبْرَائِيلَ نَنْعَاهُ، 

অনুবাদঃ আব্বাজান! আপনি আপনার রবের আহ্বানে লাব্বাইক বলেছেন। আব্বাজান! জান্নাতুল ফিরদাউস আপনার ঠিকানা। আব্বাজান! আমরা জীবরাঈলকে আমাদের দুঃখ বলি।  ৫৩

53➠সুনানে ইবনে মাজাহ, কিতাবুল জানায়েয, বাব- যিকরি ওফাতিহি ওয়া দাফনিহি (ﷺ), হাদীসঃ ৬৩০১

  

নোটঃ 

❏ এই হাদীসটিও হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, সাইয়্যেদুনা সিদ্দিকে আকবর (رضي الله عنه) বলতেনঃ "হে আমাদের ওপর সন্তুষ্ট (সত্ত্বা)! হে নবী! হে মর্যাদাবান! হে হাবীব! হে খলীল! তাঁর চাচাতো ভাই আবু সুফিয়ান ইবনে হারেছ (ইবনে আবদুল মুত্তালিব) (হুযুর (ﷺ) এঁর) শোকে বলেনঃ

أَرِقْتُ فَبَاتَ لَيْلِيَ لَا يَزُولُ ... وَلَيْلُ أَخِي الْمُصِيبَةِ فِيهِ طُولُ

وَأَسْعَدَنِي الْبُكَاءُ وَذَاكَ فِيمَا ... أُصِيبَ الْمُسْلِمُونَ بِهِ قَلِيلُ

لَقَدْ عَظُمَتْ مُصِيبَتُنَا وَجَلَّتْ ... عَشِيَّةَ قِيلَ قَدْ قُبِضَ الرَّسُولُ

وَأَضَحَتْ أَرْضُنَا مِمَّا عَرَاهَا ... تَكَادُ بِنَا جَوَانِبُهَا تَمِيلُ

فَقَدْنَا الْوَحْيَ وَالتَّنْزِيلَ فِينَا ... يَرُوحُ بِهِ وَيَغْدُوُ جِبْرَئِيلُ

وَذَاكَ أَحَقُّ مَا سَالَتْ عَلَيْهِ ... نُفُوسُ النَّاسِ أَوْ كَرَبَتْ تَسِيلُ

نَبِيٌّ كَانَ يَجْلُو الشَّكَّ عَنَّا ... بِمَا يُوحَى إِلَيْهِ وَمَا يَقُولُ

ويُهْدِيْنَا فَلاَ تَخْشَى ضَلَالًا ... عَلَيْنَا وَالرَّسُولُ لَنَا دَلِيلُ

أَفَاطِمُ إِنْ جَزِعْتِ فَذَاكَ عُذْرٌ ... وَإِنْ لَمْ تَجْزَعِي ذَاكَ السَّبِيلُ

فَقَبْرُ أَبِيكِ سَيِّدُ كُلِّ قَبْرٍ ... وَفِيهِ سَيِّدُ الْخَلْقِ الرَّسُولُ

অনুবাদঃ আমি মাহবূব (ﷺ) এঁর বিরহে রাতভর কাঁদেছি কিন্তু এই রাত শেষই হয় না। যেন এই রাতও মুসিবতের মতই দীর্ঘ।  

কান্না আমার সঙ্গী হল তবে মুসলমানগণ যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল তার তুলনায় এ কান্না নিতান্তই কম। 

যে বিকেলে বলা হল হুযুর (ﷺ) কে (আল্লাহর নিকট) উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, সে সময় আমাদের বিপদ ছিল অত্যন্ত কঠিন।

এই জমিন প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও যেন আমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল।

আমরা ওহীর অবতরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছি যা সাথে করে জীবরাঈল (عليه السلام) সকাল বিকেল আসতেন। 

আর মানুষের চোখ যে সকল কারণে অশ্রু বহায় বা প্রবাহমান হওয়ার উপক্রম করে সে সবের মাঝে সেটাই (হুযুর (ﷺ) এঁর ওফাত) সবচেয়ে উপযুক্ত ছিল। 

(তিনি সেই) নবী, যিনি আমাদের দ্বিধা দ্বন্দ দূর করে দিতেন। তার কাছে আগত ওহী ও তাঁর বানী দিয়ে। 

এবং তিনি আমাদের হেদায়েত করতেন, কাজেই আমাদের গোমরাহীর কোন আশংকা ছিল না। কারণ, মাহবূব (ﷺ) ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক।

হে ফাতিমা! তুমি যদি অশ্রু বহাতে থাক তাহলে এর ওজর আছে; আর যদি অস্থিরতা প্রকাশ না করে পার তাহলে তা-ই উত্তম পন্থা। 

তোমার পিতার রওজা মোবারক সকল কবর থেকে সেরা; কারণ, তার মধ্যে আছেন সৃষ্টিকূলের সেরা (হাবীবে পুরনূর (ﷺ))। ৫৪

54➠

১) সুয়াইলি, রওযুল উনফ, ৭/৫৯৮

২) ইবনে সাইয়্যেদুন নাস, উয়ূনূল আছার, ২/৪১০

৩) আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া, ৫/২৮২

  

আল্লাহ তায়ালা তাঁর ওপর দুরুদ ও সালাম নাযিল করুন এবং তাঁর নিকট হুযুর (ﷺ) এঁর জন্য যে নেয়ামত ও মর্যাদা রেখেছেন তা বৃদ্ধি করে দিন। এবং সেই সকল হকদার ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত (হুযুর (ﷺ) এঁর) সকল মোহব্বতকারীদেরও (হুযুর (ﷺ) এঁর) সম্মান ও মর্যাদার সদকায় সেই নেয়ামতের কিছু অংশ দান করুন। 


রওযায়ে আনওয়ারের বরকত কিয়ামত অবধি থাকবে


রওযায়ে আনওয়ারের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে সওয়াব, নেয়ামত, কারামত ও পবিত্রতার যে সুসংবাদ হুযুর (ﷺ) দিয়েছেন- এগুলো নিশ্চিতভাবেই অর্জিত হবে। যেমন (হুযুর (ﷺ) বারগাহে রিসালাতে সালাম প্রদানকারীর) সালাম শুনবেন এবং তার জবাব দিবেন, আল্লাহ তাআলা প্রতিদান দেবেন।


❏ ইমাম আবু দাউদ (তাঁর সুনানে) সহীহ সনদে সাইয়্যেদুনা আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, হুযুর আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ

مَا مِنْ أَحَدٍ يُسَلِّمُ عَلَيَّ إِلَّا رَدَّ اللَّهُ عَلَيَّ رُوحِي حَتَّى أَرُدَّ عَلَيْهِ السَّلَامَ

অনুবাদঃ যখন তোমাদের মধ্যে কেউ আমার ওপর সালাম প্রেরন করে, আল্লাহ তায়ালা আমার রূহ আমার মধ্যে ফেরত দেন এবং আমি তাঁর সালামের জবাব প্রদান করি।  ৫৫

55➠

১) আবু দাউদ, সুনান, ২/২১৮, হাদীসঃ ২০৪১

২) মুসনাদে ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ, ১/৪৫২, হাদীসঃ ৫২৫

৩) মুসনাদে আহমদ, ১৬/৪৭৭, হাদীসঃ ১০৮১৫

৪) তাবরানী, মু'জামুল আওসাত, ৩/২৬২, হাদীসঃ ৩০৯২

৫) বায়হাকী, সুনানুল কুবরা, ৫/৪০২, হাদীসঃ ১০২৭০

 

❏ হুযুর (ﷺ) আরও ইরশাদ করেনঃ

إِنَّ لِلَّهِ مَلَائِكَةً سَيَّاحِينَ، يُبَلِّغُونِي عَنْ أُمَّتِي السَّلَامَ

অনুবাদঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালার কিছু ভ্রমণরত ফেরেশতা আছে যারা আমার উম্মতের সালাম আমার নিকট পৌছায়।  ৫৬

56➠

১) সুনানে নাসাঈ, ৩/৪৩, হাদীসঃ ১২৮২

২) আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফ, ২/২১৫, হাদীসঃ ৩১১৬

৩) ইবনে আবী শায়বা, মুছান্নাফ, ২/২৫৩, হাদীসঃ ৮৭০৫

৪) মুসনাদে আহমদ, ৬/১৮৩, হাদীসঃ ৩৬৬৬

৫) সুনানে দারেমী, হাদীসঃ ২৮১৬

৬) মুসনাদে বাযযার, ৫/৩০৭, হাদীসঃ ১৯২৪

৭) নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, ২/৭০, হাদীসঃ ১২০৬

৮) আবু ইয়া'লা, মুসনাদ, ৯/১৩৭, হাদীসঃ ৫২১৩

৯) ইবনে হিব্বান, সহীহ, ৩/১৯৫, হাদীসঃ ৯১৪

১০) তাবরানী, মু'জামুল কবীর, ১০/২২০, হাদীসঃ ১০৫২৯

১১) হাকেম, মুসতাদরাক, ২/৪৫৬, হাদীসঃ ৩৫৭৬

  

হুযুর আকরাম (ﷺ) আরও ইরশাদ করেনঃ 

حَيَاتِي خَيْرٌ لَكُمْ تُحَدِّثُونَ وَيُحَدَّثُ لَكُمْ، وَفَاتِي خَيْرٌ لَكُمْ، تُعْرَضُ عَلَيَّ أَعْمَالُكُمْ فَإِنْ رَأَيْتُ خَيْرًا حَمِدْتُ اللَّهَ عَلَيْهِ، وَمَا رَأَيْتُ مِنَ شَرٍّ اسْتَغْفَرْتُ اللَّهَ لَكُمْ 

আমার জীবনও তোমাদের জন্য রহমত। কারণ, আমার ওপর ওহী নাযিল করা হত এবং আমি তোমাদের তা জানিয়ে দিতাম। আর আমার ইন্তেকালও তোমাদের জন্য রহমত হবে। কারণ, তোমাদের আমল আমার নিকট পেশ করা হবে। তার মধ্যে আমি যা কিছু ভালো পাব (তার জন্য) আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করব এবং যা কিছু খারাপ পাব তখন তোমাদের জন্য ইস্তেগফার প্রার্থনা করব। ৫৭

57➠

১) মুসনাদে বাযযার, ৫/৩০৮, হাদীসঃ ১৯২৫

২) মুসনাদে হারেছ, ২/৮৮৪, হাদীসঃ ৯৫৩


নোটঃ

❏ হাদীসটি ইমাম হারেছ এবং বাযযার বর্ণনা করেছেন। শব্দগুলো বাযযারের। 

-- -- -- -- -- -- -- -- -- -- -- -- -- --- -- --

ইমাম বাযযার এই দুইটি হাদীস সহীহ রাবীদের সনদে সাইয়্যেদুনা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন। ঐ সাহাবী (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকেই বর্ণিত, হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ

مَنْ صَلَّى عَلَيَّ عِنْدَ قَبْرِي رَدَدْتُ، وَمَنْ صَلَّى عَلَيَّ فِيْ مَكَانٍ اخَر بَلَغُوْنِيْهِ يَعْنِي بِهِ الْمَلاَئِكَةَ

অনুবাদঃ যে আমার রওযার নিকটে এসে আমার ওপর দুরুদ পাঠ করে তা আমি নিজে ফেরত দেই (জবাব দেই)। আর যে অন্য কোন (দুরবর্তী) স্থান থেকে আমার ওপর দুরুদ প্রেরণ করে তা ফেরেশতাদের মাধ্যমে আমার নিকট পৌছানো হয়।  ৫৮  

58➠ এই শব্দগুলোর সাথে হাদীস আমরা পাই নি। কিন্তু এর উদ্দেশ্য ঠিক আছে। এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হাদীস আমরা পাই। যা সামনে আসছে।


❏ হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ 

مَنْ صَلَّى عَلَيَّ عِنْدَ قَبْرِي سَمِعْتُهُ، وَمَنْ صَلَّى عَلَيَّ نَائِيًا أُبْلَغْتُهُ

অনুবাদঃ যে আমার রওযাতে এসে আমার ওপর দুরুদ পাঠ করে তা (আমি নিজে) শুনি এবং যে দূর থেকে দুরুদ প্রেরণ করে তা আমার নিকট পৌছানো হয়।  ৫৯  

59➠

১) বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, ৩/১৪১, হাদীসঃ ১৪৮১

২) বায়হাকী, হায়াতুল আম্বিয়া, ১০৩ পৃ, হাদীসঃ ১৮

৩) মুনযিরী, আত তারগীব ওয়াত তারহীব, ২/৩১৭, হাদীসঃ ১৬৬৬

৪) খতিব বাগদাদী, ৪/৪৬৯


❏ হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ 

مَنْ حَجَّ فَزَارَ قَبْرِي بَعْدَ وَفَاتِي وَجَبَتْ لَهُ شَفَاعَتِي

অনুবাদঃ যে ব্যক্তি হজ্ব করল অতঃপর আমার ওফাতের পর আমার রওযা যিয়ারতে আসলো তাঁর জন্য আমার শাফায়াত আবশ্যক হয়ে গেল। 


❏ হুযুর নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ

مَنْ زَارَنِي بِالْمَدِينَةِ مُحْتَسِبًا كُنْتُ لَهُ شَفِيعًا اوشَهِيدًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ

অনুবাদঃ যে ব্যক্তি মদীনা তৈয়বাতে নেকীর আশায় আমার যিয়ারত করল, আমি কিয়ামতের দিন তার শাফায়াতকারী অথবা সাক্ষী হব।  ৬০

60➠ বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, ৬/৫০, হাদীসঃ ৩৮৬০

  

❏ হুযুর আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ

إِنَّ لِلَّهِ تعالى مَلَكاً أَعْطَاهُ أَسْمَاعَ الْخَلائِقِ فَهُوَ قَائِمٌ عَلَى قَبْرِيْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لاَ يُصَلِّى عَلَيَّ أَحَدٌ إِلاَّ سَمَّاهُ بِاِسْمِهِ وَاِسْمِ اَبِيْهِ وَيَقُوْلُ صَلَّى عَلَيْكَ فُلانُ بْنُ فُلانٍ وَتَكَفَّلَ لِىْ رَبِّي اَنْ يُصَلِّى عَلَيْهِ بِكُلِّ صَلاَةٍ عَشَرًا

নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালার একজন ফেরেশতা আছে যাকে আল্লাহ তায়ালার সকল মাখলুকাতের কথা শোনার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ঐ ফেরেশতা কিয়ামত পর্যন্ত রওজায়ে আনওয়ারের পাশে দাড়িয়ে থাকবে। যে কেউ আমার ওপর দুরুদ পাঠ করবে, ঐ ফেরেশতা আমাকে ঐ ব্যক্তির ও তাঁর পিতার নাম বলে দেবে যে, অমুকের ছেলে অমুক আপনার ওপর দুরুদ প্রেরণ করেছে। আল্লাহ তায়ালা আমাকে ওয়াদা করেছেন যে, প্রত্যেক দুরুদের বিনিময়ে দুরুদ পাঠকারীর ওপর দশটি রহমত নাযিল করবেন।  ৬১

61➠

১) বুখারী, তারিখুল কবীর, ৬/৪১৬

২) মুনযিরী, তারগীব ওয়াত তারহীব, ২/৩১৯, হাদীসঃ ১৬৭১

৩) সুবকী, শিফাউস সিকাম, ১৭২ পৃ 



فالحمد لله الذى جعلنا من أُمّته وشرّفنا بجواره فنسألك اللهم بجاهه العظيم وآله وصحبه وأزواجه ذوى القدر الفخيم أن توفقنا لاقتفاء آثاره والاقتداء بواضح سبيل مناره والاهتداء بمصباح أنواره



اللهم اغفرلنا والآبائنا وأمهاتنا والمسلمين واختم لنا بخير أجمعين وانظر إلينا بعين الرحمة يا ذا الفضل العظيم وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين






—o সমাপ্ত o—

Top