❏ জিন সৃষ্টি ও শয়তানের কাহিনী

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ * وَخَلَقَ الْجَانَّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ * فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ)


[Surat Ar-Rahman ১৪ - ১৬]


অর্থাৎ মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির মত শুকনো মাটি থেকে এবং জিনকে সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াবিহীন অগ্নিশিখা থেকে। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? (৫৫ঃ ১৪-১৬)


(وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ * وَالْجَانَّ خَلَقْنَاهُ مِنْ قَبْلُ مِنْ نَارِ السَّمُومِ)


[Surat Al-Hijr ২৬ - ২৭]


অর্থাৎ- আমি তো মানুষ সৃষ্টি করেছি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে এবং তার পূর্বে সৃষ্টি করেছি জিন লু-হাওয়ার আগুন থেকে। (১৫ঃ ২৬-২৭)


ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), ইকরিমা, মুজাহিদ ও হাসান (رحمة الله) প্রমুখ বলেন, من مارج من نار অর্থ من طرف اللھب অর্থাৎ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের শীর্ষ প্রান্ত থেকে...। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, من مارج من نار অর্থ من خالصه وأحنه অর্থাৎ তার নির্যাস ও সর্বোত্তম অংশ থেকে...। আর একটু আগে আমরা যুহরী, উরওয়া ও আয়েশা (رضي الله عنه) সূত্রে উল্লেখ করে এসেছি যে, আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “ফেরেশতাকুলকে নূর থেকে এবং জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে সে উপাদান দ্বারা যার বিবরণ তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে। (মুসলিম)


বেশ কিছু তাফসীর বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, জিন জাতিকে আদম (عليه السلام)-এর পূর্বেই সৃষ্টি করা হয়। তাদের পূর্বে পৃথিবীতে হিন ও বিনদের (এরা জিনদেরই একটি সম্প্রদায় বিশেষ) বসবাস ছিল। আল্লাহ তা’আলা জিনদেরকে তাদের উপর বিজয়ী করলে তারা তাদের কতককে হত্যা করে এবং কতককে পৃথিবী থেকে নির্বাসন দেয়। তারপর নিজেরাই সেখানে বসবাস করতে শুরু করে।


সুদ্দী (رحمة الله) তাঁর তাফসীরে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) ও ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) প্রমুখ সাহাবা থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তা’আলা যা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তা সৃষ্টি করা শেষ করে আরশে সমাসীন হন। তারপর ইবলীসকে দুনিয়ার ফেরেশতাদের প্রধান নিযুক্ত করেন। ইবলীস ফেরেশতাদেরই একটি গোত্রভুক্ত ছিল যাদেরকে জিন বলা হতো। তাদেরকে জিন নামে এজন্য অভিহিত করা হতো, কারণ তারা হলো জান্নাতের রক্ষীবাহিনী। ইবলীসও তার ফেরেশতাদের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করত। এক পর্যায়ে তার মনে এভাবের উদয় হয় যে, ফেরেশতাদের উপর আমার শ্রেষ্ঠত্ব আছে বলেই তো আল্লাহ আমাকে এ ক্ষমতা দান করেছেন।


যাহহাক (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, জিনরা যখন পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে ও রক্তপাত করে তখন আল্লাহ্ তা’আলা ইবলীসকে তাদের নিকট প্রেরণ করেন। তার সঙ্গে ছিল ফেরেশতাগণের একটি বাহিনী। তারা কতককে হত্যা করে এবং কতককে পৃথিবী থেকে তাড়িয়ে বিভিন্ন দ্বীপে নির্বাসন দেয়।


মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, পাপে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে ইবলীসের নাম ছিল আযাযীল। সে ছিল পৃথিবীর বাসিন্দা। অধ্যবসায় ও জ্ঞানের দিক থেকে ফেরেশতাদের মধ্যে সেই ছিল সকলের সেরা। সে যে সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল তাদেরকে জিন বলা হয়।


ইবন আবু হাতিম (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবলীসের নাম ছিল আযাযীল। চার ডানাবিশিষ্ট ফেরেশতাগণের মধ্যে সে ছিল সকলের সেরা। হাজ্জাজ ও ইবন জুরায়েজের সূত্রে বর্ণিত আছে যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেছেন, ইবলীস গোত্রের দিক থেকে আর সব ফেরেশতার চেয়ে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানিত ছিল। সে ছিল জান্নাতসমূহের রক্ষণাবেক্ষণকারী। তার হাতে ছিল নিম্ন আসমান ও পৃথিবীর কর্তৃত্ব।


সালিহ (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ ইবলীস আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করত। ইবন জারীর এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। কাতাদা (رحمة الله) সাঈদ ইবন মুসায়্যাব (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবলীস নিম্ন আকাশের ফেরেশতাগণের প্রধান ছিল। হাসান বসরী (رحمة الله) বলেন, ইবলীস এক পলকের জন্যও ফেরেশতার দলভুক্ত ছিল না। সে হলো আদি জিন, যেমন আদম হলেন আদি মানব। শাহর ইবন হাওশাব প্রমুখ বলেন, ইবলীস ঐসব জিনের একজন ছিল, যাদেরকে ফেরেশতাগণ বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইবলীসকে কয়েকজন ফেরেশতা বন্দী করে আকাশে নিয়ে যায়। ইবন জারীর (رحمة الله) এ কথাটি বর্ণনা করেছেন।


তাঁরা বলেন, তারপর যখন আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করার সংকল্প করেন, যাতে পৃথিবীতে তিনি এবং পরে তার বংশধরগণ বসবাস করতে পারে এবং তিনি মাটি দ্বারা তার দেহাবয়ব তৈরি করেন, তখন জিনদের প্রধান এবং তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী আযাযীল বা ইবলীস তার চারদিকে ঘুরতে শুরু করে। যখন সে দেখতে পেল যে, তা একটি শূন্য গর্ভ, মূর্তি। তখন সে আঁচ করতে পারল যে, এটি এমন একটি দেহাবয়ব যার আত্মসংযম থাকবে না। তারপর সে বলল, যদি তোমার উপর আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হয় তাহলে অবশ্যই আমি তোমাকে ধ্বংস করব আর যদি আমার উপর তোমাকে ক্ষমতা দেয়া হয়, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাকে অবাধ্যতা করব। তারপর যখন আল্লাহ তা’আলা আদমের মধ্যে তার রূহের সঞ্চার করেন এবং তাঁকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে আদেশ দেন, তখন প্রবল হিংসাবশে ইবলীস তাকে সিজদা করা থেকে বিরত থাকে এবং বলে, আমি তার চাইতে উত্তম। আমাকে তুমি আগুন থেকে সৃষ্টি করেছ। আর তাকে সৃষ্টি করেছ কাদা মাটি থেকে। এভাবে ইবলীস আল্লাহ তা’আলার আদেশ অমান্য করে এবং মহান প্রতিপালকের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলে। সে ভুল যুক্তি প্রদর্শন করে তাঁর প্রতিপালকের রহমত থেকে দূরে সরে যায় এবং ইবাদত করে যে মর্যাদা লাভ করেছিল তা থেকে বিচ্যুৎ হয়। উল্লেখ্য যে, ইবলীস ফেরেশতাগণের মতই ছিল বটে। তবে সে ফেরেশতা জাতিভুক্ত ছিল না। কারণ সে হলো আগুনের সৃষ্টি আর ফেরেশতারা হলেন নূরের সৃষ্টি। এভাবে তার সর্বাধিক প্রয়োজনের মুহূর্তে তার প্রকৃতি তাকে প্রতারিত করে এবং সে তার মূলের দিকে ফিরে যায়।


এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ. إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ أَنْ يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ.


অর্থাৎ তখন ফেরেশতাগণ সকলেই একত্রে সিজদা করল, কিন্তু ইবলীস করল না। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল। (১৫ঃ ৩০-৩১)


আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ


وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ ۗ أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ ۚ بِئْسَ لِلظَّالِمِينَ بَدَلًا


অর্থাৎ- এবং স্মরণ কর, আমি যখন ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম, আদমের প্রতি সিজদা কর, তখন সকলেই সিজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে জিনদের একজন, সে তার প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল। তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করছ? তারা তো তোমাদের শত্রু। জালিমদের এ বিনিময় কত নিকৃষ্ট! (১৮ঃ ৫০)


অবশেষে ইবলীসকে ঊর্ধ্বজগত থেকে নামিয়ে দেয়া হয় এবং সেখানে কোনরকম বাস করতে পারে এতটুকু স্থানও তার জন্য হারাম করে দেয়া হয়। অগত্যা সে অপদস্থ লাঞ্ছিত ধিকৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় পৃথিবীতে নেমে আসে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে এবং তার অনুসারী জিন ও মানুষের জন্য জাহান্নামের সতর্ক বাণী জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সকল পথে ও ঘাটিতে আদম-সন্তানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োেগ করে চেষ্টা চালায়। যেমন সে বলেছিলঃ


(قَالَ أَرَأَيْتَكَ هَٰذَا الَّذِي كَرَّمْتَ عَلَيَّ لَئِنْ أَخَّرْتَنِ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَأَحْتَنِكَنَّ ذُرِّيَّتَهُ إِلَّا قَلِيلًا * قَالَ اذْهَبْ فَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ فَإِنَّ جَهَنَّمَ جَزَاؤُكُمْ جَزَاءً مَوْفُورًا * وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِمْ بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ وَعِدْهُمْ ۚ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا * إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ ۚ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ وَكِيلًا)


[Surat Al-Isra' ৬২ - ৬৫]


অর্থাৎ- সে বলল, বলুন- তাকে যে আপনি আমার উপর মর্যাদা দান করলেন কেন? কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যদি আমাকে অবকাশ দেন তাহলে আমি অল্প কয়েকজন ব্যতীত তার বংশধরকে কর্তৃত্বাধীন করে ফেলব।


আল্লাহ বললেন, যাও, তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, জাহান্নামই তোমাদের সকলের শাস্তি - পূর্ণ শাস্তি। তোমার আহ্বানে তাদের মধ্যে যাকে পার তুমি পদস্খলিত কর, তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা তাদেরকে আক্রমণ কর এবং ধনে ও সন্তান-সন্তুতিতে শরীক হয়ে যাও এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দাও। শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা ছলনা মাত্র।


আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট। (১৭ঃ ৬২-৬৫)।


পরে আদম (عليه السلام)-এর সৃষ্টির আলোচনায় আমরা কাহিনীটি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করব। সারকথা, জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা আদম সন্তানদের মত পানাহার ও বংশ বিস্তার করে। তাদের কতক ঈমানদার ও কতক কাফির।


যেমন আল্লাহ তা’আলা তাদের সম্পর্কে সূরা আহকাফে বলেনঃ


(وَإِذْ صَرَفْنَا إِلَيْكَ نَفَرًا مِنَ الْجِنِّ يَسْتَمِعُونَ الْقُرْآنَ فَلَمَّا حَضَرُوهُ قَالُوا أَنْصِتُوا ۖ فَلَمَّا قُضِيَ وَلَّوْا إِلَىٰ قَوْمِهِمْ مُنْذِرِينَ * قَالُوا يَا قَوْمَنَا إِنَّا سَمِعْنَا كِتَابًا أُنْزِلَ مِنْ بَعْدِ مُوسَىٰ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ يَهْدِي إِلَى الْحَقِّ وَإِلَىٰ طَرِيقٍ مُسْتَقِيمٍ * يَا قَوْمَنَا أَجِيبُوا دَاعِيَ اللَّهِ وَآمِنُوا بِهِ يَغْفِرْ لَكُمْ مِنْ ذُنُوبِكُمْ وَيُجِرْكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ * وَمَنْ لَا يُجِبْ دَاعِيَ اللَّهِ فَلَيْسَ بِمُعْجِزٍ فِي الْأَرْضِ وَلَيْسَ لَهُ مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءُ ۚ أُولَٰئِكَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ)


[Surat Al-Ahqaf ২৯ - ৩২]


অর্থাৎ স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জিনকে, যারা কুরআন পাঠ শুনছিল, যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হলে তারা একে অপরকে বলতে লাগল, চুপ করে শুন! যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হলো, তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট সতর্ককারীরূপে ফিরে গেল।


তারা বলেছিল, হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শুনে এসেছি যা অবতীর্ণ হয়েছে মূসার পরে, যা তার পূর্ববর্তী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। হে আমাদের সম্প্রদায়! আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, আল্লাহ তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন এবং মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে তোমাদের রক্ষা করবেন।


কেউ যদি আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া না দেয়, তবে সে পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় ব্যর্থ করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না। তারাই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে। (৪৬ঃ ২৯-৩২)


আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنَ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا * يَهْدِي إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ ۖ وَلَنْ نُشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَدًا * وَأَنَّهُ تَعَالَىٰ جَدُّ رَبِّنَا مَا اتَّخَذَ صَاحِبَةً وَلَا وَلَدًا * وَأَنَّهُ كَانَ يَقُولُ سَفِيهُنَا عَلَى اللَّهِ شَطَطًا * وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَنْ تَقُولَ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا * وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِنَ الْإِنْسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِنَ الْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًا * وَأَنَّهُمْ ظَنُّوا كَمَا ظَنَنْتُمْ أَنْ لَنْ يَبْعَثَ اللَّهُ أَحَدًا * وَأَنَّا لَمَسْنَا السَّمَاءَ فَوَجَدْنَاهَا مُلِئَتْ حَرَسًا شَدِيدًا وَشُهُبًا * وَأَنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَاعِدَ لِلسَّمْعِ ۖ فَمَنْ يَسْتَمِعِ الْآنَ يَجِدْ لَهُ شِهَابًا رَصَدًا * وَأَنَّا لَا نَدْرِي أَشَرٌّ أُرِيدَ بِمَنْ فِي الْأَرْضِ أَمْ أَرَادَ بِهِمْ رَبُّهُمْ رَشَدًا * وَأَنَّا مِنَّا الصَّالِحُونَ وَمِنَّا دُونَ ذَٰلِكَ ۖ كُنَّا طَرَائِقَ قِدَدًا * وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَنْ نُعْجِزَ اللَّهَ فِي الْأَرْضِ وَلَنْ نُعْجِزَهُ هَرَبًا * وَأَنَّا لَمَّا سَمِعْنَا الْهُدَىٰ آمَنَّا بِهِ ۖ فَمَنْ يُؤْمِنْ بِرَبِّهِ فَلَا يَخَافُ بَخْسًا وَلَا رَهَقًا * وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُونَ وَمِنَّا الْقَاسِطُونَ ۖ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُولَٰئِكَ تَحَرَّوْا رَشَدًا * وَأَمَّا الْقَاسِطُونَ فَكَانُوا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا * وَأَنْ لَوِ اسْتَقَامُوا عَلَى الطَّرِيقَةِ لَأَسْقَيْنَاهُمْ مَاءً غَدَقًا * لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ ۚ وَمَنْ يُعْرِضْ عَنْ ذِكْرِ رَبِّهِ يَسْلُكْهُ عَذَابًا صَعَدًا)


[Surat Al-Jinn ১ - ১৭]


অর্থাৎ- বল, আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে শুনেছে এবং বলেছে, আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি যা সঠিক পথ-নির্দেশ করে, ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকের কোন শরিক স্থির করব না।


এবং নিশ্চয় সমুচ্চ আমাদের প্রতিপালকের মর্যাদা; তিনি গ্রহণ করেননি কোন পত্নী অথবা কোন সন্তান। এবং যে আমাদের মধ্যকার নির্বোধরা আল্লাহর সম্বন্ধে অতি অবাস্তব উক্তি করত, অথচ আমরা মনে করতাম মানুষ এবং জিন আল্লাহ সম্বন্ধে কখনো মিথ্যা আরোপ করবে না।


আর যে কতিপয় মানুষ কতক জিনের শরণ নিত, ফলে তারা জিনদের অহংকার বাড়িয়ে দিত। আর জিনরা বলেছিল, তোমাদের মত মানুষও মনে করে যে, মৃত্যুর পর আল্লাহ কাউকেও পুনরুত্থিত করবেন না।


এবং আমরা চেয়েছিলাম আকাশের তথ্য সংগ্রহ করতে কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিণ্ড দ্বারা আকাশ পরিপূর্ণ; আর পূর্বে আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাটিতে সংবাদ শোনার জন্য বসতাম, কিন্তু এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে তার উপর নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের সম্মুখীন হয়।


আমরা জানি না জগদ্বাসীর অমঙ্গলই অভিপ্রেত, না তাদের পালনকর্তা তাদের মঙ্গল সাধন করার ইচ্ছা রাখেন। এবং আমাদের কতৃক সর্মপরায়ণ এবং কতক তার ব্যতিক্রম, আমরা ছিলাম বিভিন্ন পথের অনুসারী; এখন আমরা বুঝেছি যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাভূত করতে পারব না এবং পলায়ন করেও তাকে ব্যর্থ করতে পারব না।


আমরা যখন পথ-নির্দেশক বাণী শুনলাম তখন তাতে বিশ্বাস স্থাপন করলাম। যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস করে তার কোন ক্ষতি ও কোন অন্যায়ের আশংকা থাকবে না। আমাদের কতক আত্মসমর্পণকারী, এবং কতক সীমালঙ্ঘনকারী। যারা আত্মসমর্পণ করে তারা সুনিশ্চিতভাবে সত্য পথ বেছে লয়। অপরপক্ষে সীমালংঘনকারী তো জাহান্নামেরই ইন্ধন!


তারা যদি সত্য পথে প্রতিষ্ঠিত থাকত তাদেরকে আমি প্রচুর বারি বর্ষণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করতাম, যা দিয়ে আমি তাদেরকে পরীক্ষা করতাম। যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের স্মরণ থেকে বিমুখ হয়, তিনি তাকে দুঃসহ শাস্তিতে প্রবেশ করাবেন। (৭২ঃ ১-১৭)


সূরা আহকাফের শেষে আমরা এ সূরাটির তাফসীর এবং পূর্ণ কাহিনী উল্লেখ করেছি এবং সেখানে এ সংক্রান্ত হাদীসসমূহও উল্লেখ করেছি।


এরা ছিল নসীবীন-এর জিনদের একটি দল। কোন কোন বর্ণনা মতে, তারা ছিল বুসরার জিন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কাভূমির ‘বৎনে নাখলা’য় তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে নামায় পড়ছিলেন। এ সময় তারা তাঁর নিকট দিয়ে অতিক্রমকালে থেমে মনোযোগ সহকারে তার কুরআন তিলাওয়াত শুনতে থাকে। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের নিয়ে সারারাত ধরে বৈঠক করেন। এ সময় তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে তার আদেশ-নিষেধ সংক্রান্ত কিছু বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তারা তাকে খাদ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি তাদেরকে বললেনঃ যেসব হাড়ের উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হবে সেগুলোকে তোমরা গোশতে পরিপূর্ণ পাবে। আর গোবর মাত্রই তোমাদের জীব-জানোয়ারের খাদ্য। আর নবী করীম (ﷺ) এ দুটো বস্তু দ্বারা ইসতিনজা করতে নিষেধ করে বলেছেনঃ এ দু’টো বস্তু তোমাদের ভাইদের (জিনের) খাদ্য এবং রাস্তায় পেশাব করতে তিনি নিষেধ করেছেন। কারণ, তা জিনদের আবাসস্থল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে সূরা আর-রাহমান পাঠ করে শুনান। যখনই তিনি فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (তবে তোমাদের প্রতিপালকের কোন নিয়ামত তোমরা অস্বীকার করবে?) এ আয়াতটি পাঠ করতেন— তারা বলতো ولا بشي من الائك ربنا نكذب فلك الحمد-হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার কোন অবদানই আমরা অস্বীকার করি না। প্রশংসা তো সব তোমারই প্রাপ্য।’


পরবর্তীতে নবী করীম (ﷺ) যখন লোকদেরকে এ সূরাটি পাঠ করে শুনান আর তারা নিশ্চুপ বসে থাকে, তখন তিনি এ ব্যাপারে জিনদের প্রশংসা করে বললেনঃ “উত্তরদানে তারা তোমাদের চেয়ে উত্তম ছিল। যতবারই আমি তাদের নিকট فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ এ আয়াতটি পাঠ করেছি ততবারই তারা বলেছিলঃ ‘হে আমাদের প্রপািলক! তোমার কোন নিয়ামতই আমরা অস্বীকার করি না। প্রশংসা তো সব তোমারই প্রাপ্য। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) যুবায়র (رضي الله عنه) সূত্রে এবং ইবন জারীর (رحمة الله) ও বাযযার (رحمة الله) ইবন উমর (رضي الله عنه) সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


মুমিন জিনদের ব্যাপারে এ মতভেদ আছে যে, তারা কি জান্নাতে প্রবেশ করবে, না কি তাদের পুরস্কার শুধু এ-ই হবে যে, তাদেরকে আগুন দ্বারা শাস্তি দেয়া হবে না। তবে সঠিক কথা হলো, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। কুরআনের বক্তব্যের ব্যাপ্তিই এর প্রমাণ। তাছাড়া আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَان. وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَان.


অর্থাৎ- আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় পোষণ করে তার জন্য আছে দু’টো জান্নাত। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? (৫৫ঃ ৪৬-৪৭)


এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা জান্নাতের কথা উল্লেখ করে জিনদের প্রতি তার অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কাজেই তারা জান্নাত না পাওয়ার হলে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে নেয়ামত দানের ওয়াদার কথা উল্লেখই করতেন না। এ ব্যাপারে এ দলীলটিই যথেষ্ট।


ইমাম বুখরী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) রাবী আবদুল্লাহকে বলেন, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি ছাগল ও মুক্ত প্রান্তর পছন্দ কর। অতএব, যখন তুমি তোমার বকরীর পালে ও মাঠে-ময়দানে থাকবে, তখন উচ্চৈঃস্বরে আযান দেবে। কারণ জিন, মানুষ ও অন্য বস্তু যে-ই মুআযযিনের শব্দ শুনতে পায়, কিয়ামতের দিন সে-ই তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) বলেন, এ কথাটি আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে শুনেছি। (বুখারী)


পক্ষান্তরে জিনদের মধ্যে যারা কাফির, শয়তান এদেরই অন্তর্ভুক্ত। আর তাদের প্রধান নেতা হলো মানব জাতির আদি পিতা আদম (عليه السلام)-এর শত্রু ইবলীস। আল্লাহ তা’আলা তাকে এবং তার বংশধরকে আদম (عليه السلام) ও তার বংশধরের উপর ক্ষমতা দান করেছেন এবং যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে, তাঁর রাসূলগণকে বিশ্বাস করবে ও তাঁর শরীয়াতের অনুসরণ করবে; তিনি তাদের হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ ۚ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ وَكِيلًا


অর্থাৎ- আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট। (১৭ঃ ৬৫)


অন্য আয়াতে তিনি বলেনঃ


(وَلَقَدْ صَدَّقَ عَلَيْهِمْ إِبْلِيسُ ظَنَّهُ فَاتَّبَعُوهُ إِلَّا فَرِيقًا مِنَ الْمُؤْمِنِينَ * وَمَا كَانَ لَهُ عَلَيْهِمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ يُؤْمِنُ بِالْآخِرَةِ مِمَّنْ هُوَ مِنْهَا فِي شَكٍّ ۗ وَرَبُّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ حَفِيظٌ)


[Surat Saba' ২০ - ২১]


অর্থাৎ তাদের সম্বন্ধে ইবলীস তার ধারণা সত্য প্রমাণ করল। ফলে তাদের মধ্যে একটি মু’মিন দল ব্যতীত সকলেই তার অনুসরণ করল; তাদের উপর শয়তানের কোন আধিপত্য ছিল না। কারা আখিরাতে বিশ্বাসী এবং কারা তাতে সন্দিহান তা প্রকাশ করে দেয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। তোমার প্রতিপালক সর্ববিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক (৩৪ঃ ২০-২১)


অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(يَا بَنِي آدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْآتِهِمَا ۗ إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ۗ إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ) [Surat Al-A'raf ২৭]


হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রলুব্ধ না করে, যেভাবে অর্থাৎ তোমাদের পিতা-মাতাকে সে জান্নাত থেকে বহিস্কৃত করেছিল, তাদের লজ্জাস্থান দেখার জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দলবল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না, যারা ঈমান আনে না শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।


মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ


(وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ * فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ * فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ * إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ أَنْ يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ * قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا لَكَ أَلَّا تَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ * قَالَ لَمْ أَكُنْ لِأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ * قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ * وَإِنَّ عَلَيْكَ اللَّعْنَةَ إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ * قَالَ رَبِّ فَأَنْظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ * قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِينَ * إِلَىٰ يَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ * قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ * إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ * قَالَ هَٰذَا صِرَاطٌ عَلَيَّ مُسْتَقِيمٌ * إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ إِلَّا مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِينَ * وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمَوْعِدُهُمْ أَجْمَعِينَ * لَهَا سَبْعَةُ أَبْوَابٍ لِكُلِّ بَابٍ مِنْهُمْ جُزْءٌ مَقْسُومٌ)


[Surat Al-Hijr ২৮ - ৪৪]


অর্থাৎ-স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করছি। তারপর যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তার মধ্যে আমার রূহ সঞ্চার করব তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো।


তখন ফেরেশতাগণ সকলেই সিজদা করল কিন্তু ইবলীস করল না, সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল। আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! তোমার কি হলো যে, তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলে না।


সে বলল, আপনি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আমি তাকে সিজদা করবার নই। তিনি বললেন, তবে তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, কারণ তুমি বিতাড়িত এবং কর্মফল দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি রইল লা’নত।


সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন। তিনি বললেন, যাদেরকে অবকাশ দেওয়া হয়েছে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হলে, অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত।


সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে বিপথগামী করলেন তজ্জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপ কর্মকে শোভন করে তুলব এবং আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করব, তবে তাদের মধ্যে তোমার নির্বাচিত বান্দাদেরকে নয়।


আল্লাহ বললেন, এটাই আমার নিকট পৌঁছানোর সরল পথ, বিভ্রান্তদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে তারা ব্যতীত আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা থাকবে না। অবশ্যই তোমার অনুসারীদের সকলেরই নির্ধারিত স্থান হবে জাহান্নাম; তার সাতটি দরজা আছে— প্রতি দরজার জন্য পৃথক পৃথক দল আছে। (১৫ঃ ২৮-৪৪)


এ কাহিনী আল্লাহ্ তা’আলা সূরা বাকারা, আরাফ, ইসরা, তা-হা ও সা’দ-এ উল্লেখ করেছেন। আমার তাফসীরের কিতাবে যথাস্থানে সে সব বিষয়ে আমি আলোচনা করেছি। সকল প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য। আর আদম (عليه السلام)-এর কাহিনীতে ও তা উপস্থাপন করব, ইনশাআল্লাহ।


মোটকথা, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য ইবলীসকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ প্রদান করেন।


যেমন আল্লাহ বলেনঃ


وَمَا كَانَ لَهُ عَلَيْهِمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ يُؤْمِنُ بِالْآخِرَةِ مِمَّنْ هُوَ مِنْهَا فِي شَكٍّ ۗ وَرَبُّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ حَفِيظٌ


অর্থাৎ তাদের উপর শয়তানের কোন আধিপতা ছিল না। কারা আখিরাতে বিশ্বাসী এবং কারা তাতে সন্দিহান তা প্রকাশ করে দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। তোমার প্রতিপালক সর্ব বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক। (৩৪ঃ ২১)


অন্যত্র তিনি বলেনঃ


(وَقَالَ الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الْأَمْرُ إِنَّ اللَّهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدْتُكُمْ فَأَخْلَفْتُكُمْ ۖ وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا أَنْ دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي ۖ فَلَا تَلُومُونِي وَلُومُوا أَنْفُسَكُمْ ۖ مَا أَنَا بِمُصْرِخِكُمْ وَمَا أَنْتُمْ بِمُصْرِخِيَّ ۖ إِنِّي كَفَرْتُ بِمَا أَشْرَكْتُمُونِ مِنْ قَبْلُ ۗ إِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ * وَأُدْخِلَ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ ۖ تَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ)


[Surat Ibrahim ২২ - ২৩]


অর্থাৎ যখন সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে, আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি। আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি। আমার তো তোমাদের উপর কোন আধিপত্য ছিল না, আমি কেবল তোমাদেরকে আহ্বান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করো না, তোমরা নিজেদের প্রতি দোষারোপ কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরীক করেছিলে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। জালিমদের জন্য তো মর্মস্তুদ শাস্তি আছেই। যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের দাখিল করা হবে জান্নাতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা স্থায়ী হবে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। সেখানে তাদের অভিবাদন হবে সালাম। (১৪ঃ ২২-২৩)


ফলকথা, কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী ইবলীস এখনো জীবিত এবং কিয়ামতের দিন পর্যন্ত অবকাশপ্রাপ্ত। তার প্রতি আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হোক। সমুদ্র পৃষ্ঠে তার একটি সিংহাসন আছে আর তাতে সমাসীন হয়ে সে তার বাহিনী প্রেরণ করে, যারা মানুষের মাঝে অনিষ্ট করে এবং বিপর্যয় বাঁধায়। তবে আল্লাহ্ তা’আলা আগেই বলে রেখেছেনঃ


إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا


শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল। (৪ঃ ৭৬)


মহাপাপের আগে ইবলীসের নাম ছিল আযাযীল। নাক্কাশ বলেন, তার উপনাম হলো আবু কারদূস। আর এ জন্যই নবী করীম (ﷺ) যখন ইব্‌ন সায়াদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি দেখতে পাও? সে বলেছিল, আমি পানির উপর একটি সিংহাসন দেখতে পাই। তখন নবী করীম (ﷺ) তাকে বলেছিলেন, “তুই লাঞ্ছিত হ, তুই কিছুতেই তোর নির্ধারিত সীমা ডিংগাতে পারবি না।’ মোটকথা, নবী করীম (ﷺ) এ কথা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার ভবিষ্যদ্বাণীসমূহের শক্তি হলো সেই শয়তানের প্রদত্ত। যার সিংহাসন সমুদ্রের উপর বিছানো বলে সে দেখে থাকে। আর এজন্যই নবী করীম (ﷺ) বলেছিলেন, তুই লাঞ্ছিত হ। কিছুতেই তুই তোর সীমা ডিংগাতে পারবি না। অর্থাৎ কোন রকমেই তুই তোর হীন ও তুচ্ছ মর্যাদা অতিক্রম করতে পারবি না।


ইবলীসের সিংহাসন সমুদ্রের উপর অবস্থিত হওয়ার প্রমাণ হলো, ইমাম আহমদ (رحمة الله)-এর হাদীস। তাতে জাবির ইব্‌ন আবদুল্লাহ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ ইবলীসের সিংহাসন হলো সমুদ্রের উপর। প্রত্যহ সে তার বিভিন্ন বাহিনী প্রেরণ করে, যারা মানুষের মধ্যে হাঙ্গামা সৃষ্টি করে থাকে। মানুষের জন্য সেরা ফেতনা সৃষ্টি করে যে অনুচর, ইবলীসের নিকট মর্যাদায় সে সকলের চাইতে সেরা।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, জাবির ইবন আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, ইবলীসের সিংহাসন হলো সমুদ্রের উপর। সে তার বাহিনীসমূহ প্রেরণ করে, যারা জনসমাজে হাঙ্গামা সৃষ্টি করে বেড়ায়। ফেতনা সৃষ্টিতে যে তাদের সেরা, তার কাছে সে-ই সকলের বড়। এ সূত্রে ইমাম আহমদ (رحمة الله) এককভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


জাবির ইবন আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) সূত্রে ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইবন সায়াদকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী দেখতে পাও? সে বলল, আমি পানির উপর কিংবা (বলল) সমুদ্রের উপর একটি সিংহাসন দেখতে পাচ্ছি, যার আশেপাশে আছে কয়েকটি সাপ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ওটাই ইবলীসের সিংহাসন।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) ‘মুসনাদে আবু সাঈদ’-এ বর্ণনা করেন যে, আবু সাঈদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইবন সায়াদকে বললেন, তুমি কী দেখতে পাচ্ছ? ইবন সায়াদ বলল, আমি সমুদ্রের উপর একটি সিংহাসন দেখতে পাচ্ছি, যার আশেপাশে আছে সর্পরাজি। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ ও যথার্থ বলেছে। ওটাই ইবলীসের সিংহাসন।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, জাবির (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “শয়তান এ ব্যাপারে নিরাশ যে, সালাত আদায়কারীরা তার ইবাদত করবে। কিন্তু পরস্পরে বিভেদ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা তার অব্যাহত রয়েছে।”


ইমাম মুসলিম (رحمة الله) জাবির (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণিত আ’মাশের হাদীস থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (ﷺ) বলেন : “শয়তান তার সিংহাসনকে পানির উপর স্থাপন করে। তারপর জনসমাজে তার বাহিনীসমূহ প্রেরণ করে। তার দৃষ্টিতে ফেতনা সৃষ্টি করায় যে যত বড়, মর্যাদায় সে তার তত বেশি নৈকট্যের অধিকারী। তাদের কেউ একজন আসে আর বলে যে, আমি অমুকের পেছনে লেগেই থাকি। অবশেষে তাকে এমন অবস্থায় রেখে এসেছি যে, সে এমন এমন জঘন্য কথা বলে বেড়াচ্ছে। একথা শুনে ইবলীস বলে না, আল্লাহর শপথ! তুমি কিছুই করনি। আবার আরেকজন এসে বলে- আমি অমুক ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়েই তবে ছেড়েছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, একথা শুনে শয়তান তাকে কাছে টেনে আনে আর বলে, نعم أنت কত উত্তম কাজই না তুমি করেছো! এক বর্ণনায় نعم -এর নূনকে ফাতহা দ্বারা পড়া হয়েছে। যার অর্থ نعم أنت ذلك الذي تستحق الإكرام অর্থাৎ তুমি মর্যাদা পাওয়ার উপযুক্ত বটে! আবার কাসরা দ্বারা পড়ার কথাও আছে।


আমাদের শায়খ আবুল হাজ্জাজ প্রথমটিকে সমর্থন করে তাঁকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।


এ হাদীসটি আমরা ما يقرفو به بين المرءو زوجه আয়াতের ব্যাখ্যায় এনেছি। আয়াতটির অর্থ হলো, শয়তানদের থেকে লব্ধ যাদু-মানুষ-শয়তান হোক বা জিন শয়তান—দুই পরম আপনজনের মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি হওয়াই তার পরিণতি। এজন্যই শয়তান সে ব্যক্তির চেষ্টা-সাধনায় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে থাকে, যার দ্বারা এ কাজ সাধিত হয়। মোটকথা, আল্লাহ যাকে নিন্দা করেছেন, ইবলীস করে তার প্রশংসা এবং যার প্রতি আল্লাহ হন রুষ্ট, শয়তান হয় তার প্রতি প্রসন্ন। তার প্রতি আল্লাহর লা’নত!


এদিকে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন প্রকার অনিষ্ট—সেগুলোর মাধ্যমসমূহ এবং সেগুলোর অশুভ পরিণাম থেকে রক্ষার উপায় হিসেবে ফালাক ও নাস দু’টো সূরা নাযিল করেছেন। বিশেষত সূরা নাস যার মর্ম হলোঃ


“বল, আমি শরণ নিচ্ছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধিপতির, মানুষের ইলাহের নিকট আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, জিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে।" (১১৪ঃ ১-৬)


সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আনাস (رضي الله عنه) সূত্রে এবং সহীহ বুখারীতে হুসায়ন কন্যা সাফিয়া (رحمة الله) সূত্রে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, শয়তান আদম সন্তানের শিরায় শিরায় চলাচল করে থাকে।


হাকিম আবু ইয়ালা আল-মুসিলী বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ শয়তান আদম সন্তানের হৃৎপিণ্ডের উপর তার নাকের অগ্রভাগ স্থাপন করে আছে। যদি আদম সন্তান আল্লাহকে স্মরণ করে তাহলে শয়তান পিছিয়ে যায়। আর যদি সে আল্লাহকে বিস্মৃত হয়, তাহলে শয়তান তার হৃদয়কে কব্জা করে নেয়। এটাই হলো, الوسواس الخناس বা আত্মগোপনকারীর কুমন্ত্রণা। উল্লেখ্য, যেভাবে আল্লাহর (মৌখিক) যিকর অন্তর থেকে শয়তানকে বিতাড়িত করে, ঠিক সেভাবে তা মানুষকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ভুলে যাওয়া ব্যক্তিকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ


وَاذْكُرْ رَبَّكَ إِذَا نَسِيتَ


“যদি তুমি ভুলে যাও, তবে তোমার প্রতিপালককে স্মরণ করবে। (১৮ঃ ২৪)


আবার মূসা (عليه السلام)-এর সঙ্গী তাকে বলেছিলেনঃ


وَمَا أَنْسَانِيهُ إِلَّا الشَّيْطَانُ أَنْ أَذْكُرَهُ


অর্থাৎ শয়তানই তার কথা বলতে আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। (১৮ঃ ৬৩)


অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


فَأَنْسَاهُ الشَّيْطَانُ ذِكْرَ رَبِّهِ


অর্থাৎ- শয়তান তাকে তার প্রভুর নিকট তার বিষয় বলার কথা ভুলিয়ে দিল (১২ঃ ৪২)


অর্থাৎ ইউসুফ (عليه السلام) যখন সাকীকে বলেছিলেন যে, তুমি তোমার মনিবের নিকট আমার কথা বলবে, সে তার মনিব বাদশাহর নিকট তা বলতে ভুলে গিয়েছিল। আর এ ভুলে যাওয়াটা ছিল শয়তানের পক্ষ থেকে। ফলে ইউসুফ (عليه السلام) কয়েক বছর কারাগারে অবরুদ্ধ থাকেন। এ জন্যই আল্লাহ তা’আলা পরে বলেনঃ


وَقَالَ الَّذِي نَجَا مِنْهُمَا وَادَّكَرَ بَعْدَ أُمَّةٍ


অর্থাৎ- দু’জন কারাবন্দীর মধ্যে যে মুক্তি পেয়েছিল এবং দীর্ঘকাল পরে যার স্মরণ হলো সে বলল, .....। (ইউসুফঃ ৪৫)।


بعد امة অর্থাৎ দীর্ঘকাল পরে। আবার কেউ কেউ بعد امة এর অর্থ করেছেন بعد نسيان অর্থাৎ ভুলে যাওয়ার পর। আর এই যে আমরা বললাম, সে লোকটি ভুলে গিয়েছিল; সে হলো সাকী; দু’অভিমতের মধ্যে এটাই সঠিক কথা। তাফসীরে আমরা একে সপ্রমাণ বর্ণনা করেছি। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আসিম (رحمة الله) বলেন যে, আমি আবু তামীমা (رحمة الله) কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সওয়ারীতে তার পেছনে উপবেশনকারী এক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করতে শুনেছি যে, একদিন নবী করীম (ﷺ)-কে নিয়ে তার গাধা হোঁচট খায়। তখন আমি বললাম, শয়তান বদনজর করেছে। আমার একথা শুনে নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ শয়তান বদনজর করেছে, বলো না। কেননা, যখন তুমি বলবে শয়তান বদনজর করেছে; তখন সে গর্বিত হয়ে যাবে আর বলবে; আমার শক্তি দ্বারা আমি তাকে ধরাশায়ী করেছি। আর যখন তুমি বলবে, ‘বিসমিল্লাহ্’ তখন ছোট হতে হতে সে মাছির ন্যায় হয়ে যায়। এ হাদীসটি কেবল ইমাম আহমদই বর্ণনা করেছেন। এর সনদ উত্তম।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের কেউ মসজিদে এলে শয়তান মানুষকে এভাবে বশীভূত করে, যেভাবে কেউ তার বাহনকে শান্ত করে একান্তে বসার ন্যায়, তারপর তাকে লাগাম পরিয়ে দেয়।


আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, লক্ষ্য করলে তোমরা তা দেখতে পাবে। শয়তান যাকে কোণঠাসা করে, দেখবে সে নত হয়ে কেবল আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকে। আর যাকে লাগাম পরায় সে মুখ খুলে হা করে বসে থাকে আল্লাহর যিকর করে না। ইমাম আহমদ (رحمة الله) এককভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “বদনজর যে হয়ে থাকে তা সত্য। তাতে শয়তান ও বনী আদমের হিংসা বিদ্যমান থাকে।"


তার আরেক বর্ণনায় আছে যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বললঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মনে এমন এমন কল্পনা জাগ্রত হয় যে, তা ব্যক্ত করার চাইতে আকাশ থেকে পড়ে যাওয়াই আমার নিকট শ্রেয় মনে হয়। শুনে নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ “আল্লাহু আকবার। সমস্ত প্রশংসা সে আল্লাহর যিনি শয়তানের চক্রান্তকে কুমন্ত্রণায় পরিণত করে দিয়েছেন।”


ইমাম আবু দাউদ ও নাসাঈ (رحمة الله) মানসূর-এর হাদীস থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। নাসাঈ এবং আমাশ হযরত আবু যর (رضي الله عنه) সূত্রেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “শয়তান তোমাদের এক একজনের কাছে এসে বলে, এটা কে সৃষ্টি করেছে, ওটা কে সৃষ্টি করেছে? শেষ পর্যন্ত বলে যে, তোমার রবকে কে সৃষ্টি করেছে? সুতরাং কেউ এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে যেন সে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং এখানেই ক্ষান্ত দেয়। ইমাম মুসলিম (رحمة الله) লায়ছ, যুহরী ও হিশামের হাদীস থেকে, পরের দুজন উরওয়া থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ


অর্থাৎ- যারা তাকওয়ার অধিকারী হয় তাদেরকে শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আত্মসচেতন হয় এবং তৎক্ষণাৎ তাদের চোখ খুলে যায়। (৭ঃ ২০১ )


অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَقُلْ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ * وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونِ)


[Surat Al-Mu'minun ৯৭ - ৯৮]


অর্থাৎ- বল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি শয়তানের প্ররোচনা থেকে। হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার নিকট তাদের উপস্থিতি থেকে। (২৩ঃ ৯৭-৯৮)


অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেনঃ


وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ ۚ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ


অর্থাৎ- যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তবে আল্লাহর শরণ নেবে, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (৭ঃ ২০০)


আরেক জায়গায় তিনি বলেনঃ


(فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ * إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ * إِنَّمَا سُلْطَانُهُ عَلَى الَّذِينَ يَتَوَلَّوْنَهُ وَالَّذِينَ هُمْ بِهِ مُشْرِكُونَ)


[Surat An-Nahl ৯৮ - ১০০]


অর্থাৎ যখন তুমি কুরআন পাঠ করবে তখন অভিশপ্ত শয়তান থেকে তুমি আল্লাহর শরণ নেবে। যারা ঈমান আনে ও তাদের প্রতিপালকেরই উপর নির্ভর করে তাদের উপর তার আধিপত্য নেই। তার আধিপত্য তো কেবল তাদেরই উপর যাকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে এবং যারা আল্লাহর শরীক করে। (১৬ঃ ৯৮ - ১০০)


ইমাম আহমদ (رحمة الله) ও সুনান সংকলকগণ আবূ সাঈদ (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণিত আবুল মুতাওয়াক্কিল-এর হাদীস থেকে বর্ণনা করেন যে, আবু সাঈদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতেনঃ


اعوذ با لله السميع العليم من الشيطان الرجيم من همزه ونفخه ونفثه .


অর্থাৎ- আমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তানের হামায, নাফাখ ও নাফাছ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।


জুবায়র ইবন মুতইম, আবুল্লাহ ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) এবং আবু উমামা বাহিলীর বর্ণনা থেকেও এরূপ পাওয়া যায়। আর হাদীসে এর এরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, অর্থ হচ্ছে শয়তান কর্তৃক শ্বাসরুদ্ধকরণ বা কাবু করা; তার অহংকার আর তার কাব্য।


সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন শৌচাগারে প্রবেশ করতেন তখন তিনি বলতেনঃ


اعوذ با لله من الخبث والخبائث.


অর্থাৎ- “আমি আল্লাহর নিকট خبث ও خبئث থেকে আশ্রয় চাই।" বহু সংখ্যক আলিম বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুরুষ শয়তনি ও মহিলা শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। (অর্থাৎ তাদের মতে خبث অর্থ পুরুষ শয়তানের দল ও خبئث অর্থ মহিলা শয়তানের দল)।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ কেউ পায়খানায় গেলে সে যেন আড়াল করে নেয়। যদি সে মাটিকে স্তুপীকৃত করা ব্যতীত অন্য কিছু না পায় তবে যেন তা-ই করে তা পেছনে রেখে বসে। কারণ, শয়তান আদম সন্তানের নিতম্ব নিয়ে খেলা করে। যে ব্যক্তি এরূপ করে সে ভালো করবে আর একান্ত তা না পারলে ক্ষতি নেই। ইমাম আবু দাউদ ও ইবন মাজাহ্ ছাওর ইবন য়াযীদ-এর হাদীস থেকে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, সুলায়মান ইবন সুরাদ বলেছেন, নবী করীম (ﷺ) -এর দরবারে দু’জন লোক একে অপরকে গালাগাল করে। আমরা তখন তাঁর নিকট বসা ছিলাম। দেখলাম, ওদের একজন তার সঙ্গীকে এমন রাগান্বিত হয়ে গালাগাল করছে যে, তার চেহারা লাল হয়ে গেছে। তা দেখে নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ আমি অবশ্য এমন একটি কথা জানি, যদি সে তা বলে তাহলে তার রাগ দূরীভূত হবে। যদি সে বলেঃ


أعوذ با لله من الشيطان الرجيم


‘আমি বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই।’ একথা শুনে উপস্থিত লোকজন লোকটিকে বলল, তুমি কি শুনছ না নবী করীম (ﷺ) কি বলছেনঃ উত্তরে সে বলল, ‘আমি পাগল নই।’ ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ এবং নাসাঈও আমাশ থেকে বিভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন উমর (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যেন বাম হাতে পানাহার না করে। কারণ শয়তান বাম হাতে পানাহার করে থাকে।’ এ সনদে এটা ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ। আর সহীহ বুখারীতে এ হাদীসটি অন্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি তার বাম হাতে আহার করে, তার সঙ্গে শয়তান আহার করে আর যে ব্যক্তি তার বাম হাতে পান করে শয়তানও তার সঙ্গে পান করে।"


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু যিয়াদ তাহহান (رحمة الله) বলেন, আমি আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه)-কে বলতে শুনেছি যে, নবী করীম (ﷺ) এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে পান করতে দেখে তাকে বললেনঃ বমি কর। লোকটি বলল, কেন? নবী করীম (ﷺ) বললেন, তুমি কি এতে খুশী হবে যে, তোমার সঙ্গে বিড়াল পান করুক? সে বলল, জ্বী না। তখন নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ কিন্তু তোমার সঙ্গে তো এমন এক প্রাণী পান করেছে, যে বিড়ালের চাইতেও নিকৃষ্ট অর্থাৎ শয়তান। এ সূত্রে ইমাম আহমদ (رحمة الله) এককভাবেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


তিনি আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে আরও বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে পান করে, যদি সে জানত তার পেটে কি আছে, তাহলে অবশ্যই সে ইচ্ছে করে বমি করত।’ এ হাদীসটি ভিন্ন সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র জাবির (رضي الله عنه)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আপনি কি নবী করীম (ﷺ)-কে একথা বলতে শুনেছেন যে, মানুষ ঘরে প্রবেশকালে এবং আহারের সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বললে শয়তান তার সঙ্গীদেরকে বলে, এখানে তোমাদের থাকাও নেই, খাবারও নেই। আর প্রবেশকালে বিসমিল্লাহ না বললে শয়তান বলে, তোমরা রাত যাপনের জায়গা পেয়ে গেছ এবং আহারের সময় ‘বিসমিল্লাহ না বললে শয়তান বলে, তোমরা রাত যাপনের জায়গা এবং রাতের খাবার পেয়ে গেছ? জবাবে জাবির (رضي الله عنه) বললেন, হ্যাঁঁ।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন উমর (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ সূর্যোদয়কালে যখন তার প্রান্তদেশ দেখা যায়, তখন পুরোপুরি তা উদিত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা সালাত স্থগিত রাখ এবং যখন সূর্য অস্ত যেতে থাকে তা পুরোপুরি না ডুবা পর্যন্ত সালাত স্থগিত রাখ। আর সূর্যের উদয় ও অস্তকে তোমরা নামাযের সময় সাব্যস্ত করো না। কারণ সুর্য শয়তানের দু’ শিং-এর মধ্যবর্তী স্থানে উদিত হয়ে থাকে। ইমাম মুসলিম এবং নাসাঈও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইব্‌ন উমর (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখেছি যে, তিনি পূর্বদিকে ইশারা করে বলেছিলেনঃ শুনে রেখ, ফেতনা এখানে, ফেতনা এখানে, যেখান থেকে শয়তানের শিং আত্মপ্রকাশ করে থাকে।


আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ শরীফে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রৌদ্র ও ছায়ার মাঝখানে বসতে নিষেধ করে বলেছেন; তা হলো শয়তানের মজলিস। হাদীস বিশারদগণ এর কয়েকটি অর্থের উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে সর্বোত্তম হলো এই যে, যেহেতু অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, এরূপ স্থানে বসলে অঙ্গ সৌষ্ঠব নষ্ট হয়, তাই শয়তান তা পছন্দ করে। কেননা, তার নিজের অবয়বই কুৎসিত। আর এটা সর্বজন বেদিত।


এজন্যই আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃطَلْعُهَا كَأَنَّهُ رُءُوسُ الشَّيَاطِينِ


অর্থাৎ তার (জাহান্নামের তলদেশ থেকে উদ্গত যাক্কুম বৃক্ষের) মোচা যেন শয়তানের মাথা। (৩৭ঃ ৬৫)


সঠিক কথা হলো, আয়াতে শয়তান বলতে শয়তানই বুঝানো হয়েছে- এক শ্রেণীর গাছ নয় যেমন কোন কোন তাফসীরবিদের ধারণা। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। কেননা, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষের মনে এ বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে, শয়তান কদর্যতার এবং ফেরেশতাগণ সৌন্দর্যের আধার।


আর এজন্যই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ طَلْعُهَا كَأَنَّهُ رُءُوسُ الشَّيَاطِينِ তার মোচা যেন শয়তানের মাথা।


পক্ষান্তরে ইউসুফ (عليه السلام)-এর রূপ দেখে মহিলাগণ বলেছিলোঃ


حَاشَ لِلَّهِ مَا هَٰذَا بَشَرًا إِنْ هَٰذَا إِلَّا مَلَكٌ كَرِيمٌ


অর্থাৎ-অদ্ভুত আল্লাহর মাহাত্ম্য! এতো মানুষ নয় এতো এক মহিমান্বিত ফেরেশতা। (১২ঃ ৩১)


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, জাবির (رضي الله عنه) বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ “রাত যখন ছায়াপাত করে তখন তোমরা তোমাদের শিশু-কিশোরদেরকে ঘরে আটকে রাখবে। কারণ শয়তানগণ এ সময়ে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর রাতের কিছু সময় পার হয়ে গেলে তাদেরকে ছেড়ে দেবে এবং দরজা বন্ধ করে আল্লাহর নাম নেবে। বাতি নিভিয়ে দেবে ও আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে, পানপাত্রের মুখ বেঁধে রাখবে ও আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে এবং বরতন ঢেকে রাখবে ও আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে। তার উপর কিছু একটা ফেলে রেখে হলেও তা করবে।”


ইমাম আহমদ (رحمة الله) ইয়াহয়া ও ইব্‌ন জুরায়জের সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় আছে فان الشيطان لا يفتع مغلقا শয়তান বন্ধ জিনিস খুলতে পারে না।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, জাবির (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “তোমরা তোমাদের দরজাগুলো বন্ধ করে দাও, বরতনগুলো ঢেকে রাখ, পানপাত্রগুলোর মুখ বেঁধে রাখ এবং বাতিগুলো নিভিয়ে দাও। কারণ শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারে না, ঢাকনা উন্মুক্ত করে না এবং বন্ধন খুলে না, আর ইদুর তো বসবাসকারীদেরসহ ঘরে আগুনই ধরিয়ে দেয়।”


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ আপন স্ত্রীগমনকালে তোমাদের কেউ যদি বলেঃ


اللهم جنبنا الشيطان وجنب الشيطان مارزقتنی


“হে আল্লাহ! আমাদেরকে তুমি শয়তান থেকে দূরে রাখ এবং আমাকে তুমি যা দান করেছ, তা থেকে শয়তানকে দূরে রাখ।’ তাহলে এ মিলনে তাদের কোন সন্তান জন্মালে শয়তান তার ক্ষতি করতে পারে না এবং তার উপর তার আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না।


হাদীসটি ভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আরেকটি রিওয়ায়তে ঈষৎ পরিবর্তনসহ উক্ত দু’আর পূর্বে বিসমিল্লাহ শব্দটি অতিরিক্ত এসেছে। ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “তোমাদের কেউ ঘুমালে শয়তান তার মাথার পশ্চাদ্ভাগে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতিটি গিট দেওয়ার সময় সে বলে, দীর্ঘ রাত আছে তুমি ঘুমাও! যদি সে জেগে ওঠার পর আল্লাহকে স্মরণ করে, তাহলে একটি গিট খুলে যায়। তারপর যদি ওযু করে তাহলে আরেকটি গিট খুলে যায়। তারপর যদি সে সালাত আদায় করে তাহলে সবকটি গিটই খুলে যায়। ফলে সে প্রফুল্ল ও প্রশান্ত চিত্তে সকালে ওঠে। অন্যথায় সে সকালে ওঠে কলুষিত মন ও অলস দেহ নিয়ে।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যখন তোমাদের কেউ ঘুম থেকে জেগে ওঠে এবং ওযূ করতে যায় তখন সে যেন তিনবার পানি নিয়ে নাক ঝেড়ে নেয়। কেননা, শয়তান তার নাকের ছিদ্রে রাতযাপন করে থাকে।


ইমাম মুসলিম এবং ইমাম নাসাঈ ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আলোচনা হলো যে, এক ব্যক্তি সারারাত নিদ্রা যায়। তারপর ভোর হলে জাগ্রত হয়। শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, লোকটির দু’কানে তো শয়তান পেশাব করে দিয়েছে।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দু’ কানে বললেন, নাকি শুধু কানে বললেন—এ ব্যাপারে রাবী সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ইমাম মুসলিম, ইমাম বুখারী, নাসাঈ এবং ইবন মাজাহ্ ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “যখন নামাযের আযান দেওয়া হয়, তখন শয়তান বায়ু নিঃসরণ করতে করতে পিছু হটে যায়। আযান শেষ হয়ে গেলে আবার এসে পড়ে। তারপর ইকামতকালে শয়তান আবার হটে যায়। ইকামত শেষ হয়ে গেলে আবার এসে সে মানুষ ও তার অন্তরের মাঝে অবস্থান নেয় এবং বলতে শুরু করে যে, তুমি এটা স্মরণ কর, ওটা স্মরণ কর। শেষ পর্যন্ত লোকটি ভুলেই যায় যে, সে নামায তিন রাকআত পড়ল, নাকি চার রাকআত। তারপর তিন রাকআত পড়ল, নাকি চার রাকআত পড়ল তা নির্ণয় করতে না পেরে দুটি সিজদা সাহু করে নেয়।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “তোমরা (নামাযের) সারিগুলো ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট করে নাও। কারণ শয়তান ফাঁকে দাঁড়িয়ে যায়।”


আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতেনঃ তোমরা সারিগুলো ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট করে নাও, এক সারিকে আরেক সারির কাছাকাছি করে নাও এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাও। যে সত্তার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, তাঁর শপথ! নিঃসন্দেহে আমি দেখতে পাচ্ছি যে, শয়তান সারির ফাঁকা জায়গায় ঢুকে পড়ে, যেন সে একটি পাখি।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু সাঈদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “তোমাদের কারো সম্মুখ দিয়ে কোন কিছু অতিক্রম করলে, যেন সে তাকে বাধা দেয়। যদি সে অগ্রাহ্য করে তাহলে যেন আবারও বাধা দেয়। এবারও যদি অগ্রাহ্য করে, তাহলে যেন সে তার সঙ্গে লড়াই করে। কারণ সে আস্ত শয়তান।” মুসলিম এবং আবূ দাউদ (رحمة الله)-ও ভিন্ন সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবূ উবায়দ (رحمة الله) বলেন, আমি আতা ইব্‌ন য়াযীদ লায়ছী (رحمة الله)-কে দেখলাম যে, তিনি দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন। তারপর আমি তাঁর সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করতে চাইলে তিনি আমাকে ফিরিয়ে দেন। পরে তিনি বললেন, আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন ফজর নামায আদায় করছিলেন আর তিনি [আবু সাঈদ (رضي الله عنه)] তাঁর পেছনে কিরাআত পড়ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কিরাআত পাঠে বিঘ্ন ঘটে। সালাত শেষ করে তিনি বললেনঃ যদি তোমরা আমার ও ইবলীসের ব্যাপারটি দেখতে! হাত বাড়িয়ে আমি ওর গলাটিপে ধরেছিলাম। এমনকি আমি আমার বৃদ্ধাঙ্গুলিও তার পাশের অঙ্গুলির মাঝখানে ওর মুখের লালার শীতলতা অনুভব করি। আমার ভাই সুলায়মানের দু’আ না থাকলে নিঃসন্দেহে ও মসজিদের কোন একটি খুঁটির সঙ্গে শৃংখলাবদ্ধ হয়ে যেত আর মদীনার শিশুরা তাকে নিয়ে খেলতো। অতএব, তোমাদের মধ্যকার যার এ ক্ষমতা আছে যে, সে তার ও কেবলার মধ্যকার অন্তরায় ঠেকাতে পারবে তাহলে সে যেন তা অবশ্যই করে।"


ইমাম আবু দাউদ হাদীসটির ‘যার ক্ষমতা আছে’... অংশটি বর্ণনা করেছেন।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন কোন এক সালাত আদায় করে বললেন, “শয়তান এসে আমার সালাত নষ্ট করে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ তাকে কাবু করার শক্তি আমাকে দান করেছেন।” ইমাম মুসলিম ও নাসাঈ (رحمة الله) হাদীসটি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।


সুলায়মান (عليه السلام) সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা সংবাদ প্রদান করেন যে, তিনি বলেছিলেনঃ


قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكًا لَا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدِي ۖ إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ


অর্থাৎ- হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে দান কর এমন এক রাজ্য যার অধিকারী আমি ছাড়া আর কেউ যেন না হয়, তুমি তো পরম দাতা। (৩৮ঃ ৩৫)


এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আমার সালাত বরবাদ করার জন্য গত রাতে দুষ্ট এক জিন আমার উপর চড়াও হয়। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা তাকে কাবু করার শক্তি আমাকে দান করেন। ফলে আমার ইচ্ছে হলো, তাকে ধরে এনে মসজিদের একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখি আর ভোরে উঠে তোমরা সকলেই তাকে দেখতে পাও। কিন্তু পরক্ষণে আমার ভাই সুলায়মান (عليه السلام)-এর


رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي الخ.


এ উক্তিটি মনে পড়ে যায়। রাবী বলেন, ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ব্যর্থ মনোরথ করে ফিরিয়ে দেন।


মুসলিম (رحمة الله) আবুদারদা (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) একদিন সালাত আদায়ে রত হন। এমন সময় আমরা হঠাৎ শুনতে পেলাম যে, তিনি বলছেনঃ اعوذ با لله منك (তোমার থেকে আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই)। তারপর তিনি বললেনঃ العنك بلعنة الله (তোমার প্রতি আল্লাহর লা’নত হোক!) এ কথাটি তিনবার বলে তিনি তাঁর হাত প্রসারিত করলেন, যেন তিনি কিছু একটা ধরছেন। তারপর সালাত শেষ হলে আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সালাতের মধ্যে আমরা আপনাকে এমন কিছু বলতে শুনলাম যা ইতিপূর্বে আমরা আপনাকে বলতে শুনিনি! আবার আপনাকে দেখলাম যে, আপনি আপনার হাত প্রসারিত করলেন! জবাবে তিনি বললেনঃ “আমার মুখে নিক্ষেপ করার জন্য আল্লাহর দুশমন ইবলীস একটি অগ্নিপিণ্ড নিয়ে আসে। তাই আমি তিনবার বললাম, اعوذ با لله منك তারপর বললাম, العنك بلعنة الله التا مة কিন্তু সে সরলো না, তারপর আমি তাকে ধরতে মনস্থ করি। আল্লাহর শপথ! যদি আমাদের ভাই সুলায়মানের দুআ না থাকত; তাহলে সে বন্দী হয়ে যেত আর মদীনাবাসীদের শিশু সন্তানরা তাকে নিয়ে খেলা করত।”


আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ


অর্থাৎ-পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে এবং সেই প্রবঞ্চক (অর্থাৎ শয়তান) যেন তোমাদেরকে কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে প্রবঞ্চিত না করে। (৩১ঃ ৩৩)।


অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوًّا ۚ إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيرِ


অর্থাৎ-শয়তান তোমাদের দুশমন, সুতরাং তাকে তোমরা শত্রু হিসেবে গ্রহণ কর। সে তো তার দলবলকে কেবল এ জন্য আহ্বান করে, যেন তারা জাহান্নামী হয়।(৩৫ঃ ৬)


মোটকথা, চলা-ফেরা, উঠা-বসা ইত্যাদি অবস্থায় শয়তান মানুষের সর্বনাশ করার ব্যাপারে তার চেষ্টা ও শক্তি প্রয়োগে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না। যেমনঃ হাফিজ আবু বকর ইবন আবুদ্দুনিয়া (رحمة الله) ‘মাসায়িদিশ শয়তান’ (শয়তানের ফাঁদ) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটি অত্যন্ত মূল্যবান।


আবু দাউদ শরীফে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর দু’আয় বলতেনঃ


واعوذ بك أن يتخبطني الشيطان عند الموت.


মৃত্যুর সময় শয়তানের ছোবল থেকে আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি!


কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, শয়তান বলেছিলঃ


یا رب و عزك و جلالك لا ازال اغو بهم مادامت أرواحهم في أجسادهم.


অর্থাৎ-‘হে আমার প্রতিপালক! তোমার ইযযত ও জালাল-এর শপথ করে বলছি, তাদের দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত আমি তাদেরকে বিভ্রান্ত করতেই থাকব।’


আর আল্লাহ্ তা’আলা এর জবাবে বলেছিলেনঃ


وعزتي وجلالي و لا ازال اغفر لهم ما استغفروني.


অর্থাৎ- আর আমি আমার ইযযত ও জালাল-এর শপথ করে বলছি, তারা যতক্ষণ পর্যন্ত আমার নিকট ক্ষমা চাইতে থাকবে; আমি তাদেরকে ক্ষমা করতেই থাকব।


আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَاءِ ۖ وَاللَّهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا ۗ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ


অর্থাৎ-শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং কার্পণ্যের নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা এবং অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। আল্লাহ্ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (২ঃ ২৬৮)


মোটকথা, আল্লাহ্ তা’আলার প্রতিশ্রুতিই সঠিক ও সত্য। আর শয়তানের প্রতিশ্রুতি মাত্রই বাতিল।


তিরমিযী ও নাসাঈ এবং ইবন হিব্বান (رحمة الله) তাঁর সহীহে আর ইবন আবু হাতিম (رحمة الله) তার তাফসীরে ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ আদম সন্তানের সঙ্গে শয়তানের একটি ছোঁয়াচ আছে এবং ফেরেশতাদের একটি ছোঁয়াচ আছে। শয়তানের ছোঁয়াচ হলো, মন্দের প্রতিশ্রুতি প্রদান এবং সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা আর ফেরেশতাদের ছোঁয়াচ হলো, কল্যাণের প্রতিশ্রুতি প্রদান ও সত্যকে সত্য বলে গ্রহণ করা। সুতরাং কেউ এটি অনুভব করলে সে যেন বুঝে নেয় যে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। ফলে যেন সে আল্লাহর প্রশংসা করে। আর যে ব্যক্তি অপরটি অনুভব করবে, সে যেন শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে। তারপর তিনি الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ الخ আয়াতটি পাঠ করেন।


সূরা বাকারার ফযীলতে আমরা উল্লেখ করেছি যে, শয়তান সে ঘর থেকে পালিয়ে যায়, যে ঘরে সূরা বাকারা পাঠ করা হয়। আবার আয়াতুল কুরসীর ফযীলতে উল্লেখ করেছি যে, যে ব্যক্তি রাতে আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে ভোর হওয়া পর্যন্ত শয়তান তার কাছে ঘেঁষতে পারে না।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি একশ’ বার


لا اله الا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد


পাঠ করবে; তা তার জন্য দশটি গোলাম আযাদ করার তুল্য হবে, তার নামে একশ নেকী লেখা হবে ও তার একশ গুনাহ মুছে ফেলা হবে এবং তা সে দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য শয়তান থেকে নিরাপত্তাস্বরূপ হবে। আর তার চাইতে অধিক আমলকারী ব্যতীত অন্য কেউই তার থেকে উত্তম আমলের অধিকারী বলে বিবেচিত হবে না।


ইমাম মুসলিম, তিরমিযী ও ইবন মাজাহ (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন।


বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় প্রত্যেক বনী আদমের দু’পার্শ্বে শয়তান তার আঙ্গুল দ্বারা খোঁচা দেয়। তবে মারয়াম পুত্র ঈসা (عليه السلام) তার ব্যতিক্রম। তাঁকে খোঁচা দিতে গিয়ে শয়তান তার দেহে জড়ানো আবরণে খোঁচা দিয়ে আসে।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ


التثاؤب من الشيطان فاذا تثاؤب احدكم فليرده ما استطاع فان احدکم اذا قال (ها) ضحك الشيطان.


অর্থাৎ- “হাই তোলা হয় শয়তানের পক্ষ থেকে। অতএব, তোমাদের কারো হাই আসলে, সে যেন যথাসম্ভব তা রোধ করে। কারণ (হাই আসার সময়) তোমাদের কেউ ‘হা’ বললে শয়তান হেসে দেয়।


আহমদ, আবু দাউদ এবং তিরমিযী (رحمة الله) ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) হাদীসটি সহীহ বলে রায় দিয়েছেন। এ হাদীসের অন্য পাঠে আছে—


اذا تثاؤب أحدكم فليكظم ما استطاع فإن الشيطان يدخل.


অর্থাৎ তোমাদের কারো হাই আসলে সে যেন যথাসম্ভব তা দমন করে। কারণ (হাই তোলার সময়) শয়তান ভিতরে ঢুকে পড়ে।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ


ان الله يحب العطاس ويبغض او يكره التثاؤب فإذا قال احدكم ها ها فانما ذالك الشيطان يضحك من جوفه.


অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা হাঁচি পছন্দ করেন আর হাই তোলা ঘৃণা করেন অথবা (রাবী বলেন, অপছন্দ করেন) (হাই তোলার সময়) তোমাদের কেউ হা-হা বললে শয়তান একেবারে তার পেট থেকে হাসতে থাকে। ইমাম তিরমিযী ও নাসাঈ (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আয়েশা (رضي الله عنه) বলেছেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে মানুষের সালাতের মধ্যে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। উত্তরে তিনি বললেনঃ


هو اختلا يختلسه الشيطان من صلاة أحدكم


অর্থাৎ— “এ হলো, ছিনতাই যা তোমাদের কারো সালাত থেকে শয়তান ছিনিয়ে নিয়ে যায়।”


ইমাম আবূ দাউদ ও নাসাঈ (رحمة الله) ভিন্ন সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু কাতাদা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ


الروبا الصالحة من الله والحلم من الشيطان فإذا حلم احدكم حلما يخافه فليبصق عن يساره واليتعوذ بالله من شرها فانها لا تضره.


অর্থাৎ সুস্বপ্ন হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর অলীক স্বপ্ন হয় শয়তানের পক্ষ থেকে। অতএব, তোমাদের কেউ ভয়ংকর কোন দুঃস্বপ্ন দেখলে, সে যেন তার বাম দিকে থুথু ফেলে এবং তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে। এতে সে তার অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা পাবে।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ


لا يشيرن أحدكم الى اخيه بالسلاح فإنه لايدري احدكم لعل الشيطان أن ينزغ في بده فيقع في حفرة من النار.


অর্থাৎ তোমাদের কেউ কিছুতেই যেন তার কোন ভাইয়ের প্রতি অস্ত্র দ্বারা ইশারা না করে। কারণ কি জানি, হয়ত শয়তান তার হাতে এসে ভর করবে যার ফলে সে জাহান্নামের কুণ্ডে গিয়ে নিক্ষিপ্ত হবে। ইমাম বুখারী ও মুসলিম (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


وَلَقَدْ زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَجَعَلْنَاهَا رُجُومًا لِلشَّيَاطِينِ ۖ وَأَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابَ السَّعِيرِ.


অর্থাৎ আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা দ্বারা এবং তাদেরকে করেছি শয়তানের প্রতি নিক্ষেপের উপকরণ এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি। (৬৭ঃ ৫)


অন্য আয়াতে তিনি বলেনঃ


إِنَّا زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِزِينَةٍ الْكَوَاكِبِ. وَحِفْظًا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ مَارِدٍ. لَا يَسَّمَّعُونَ إِلَى الْمَلَإِ الْأَعْلَىٰ وَيُقْذَفُونَ مِنْ كُلِّ جَانِبٍ. دُحُورًا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ وَاصِبٌ.إِلَّا مَنْ خَطِفَ الْخَطْفَةَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ ثَاقِبٌ.


অর্থাৎ আমি নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্ররাজির সুষমা দ্বারা সুশোভিত করেছি এবং রক্ষা করেছি প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তান থেকে। ফলে তারা উর্ধজগতের কিছু শুনতে পায় না এবং তাদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয় সকল দিক থেকে বিতাড়নের জন্য এবং তাদের জন্য আছে অবিরাম শাস্তি। তবে কেউ হঠাৎ কিছু শুনে ফেললে উল্কাপিণ্ড তার পিছু ধাওয়া করে। (৩৭ঃ ৬-১০)


অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেনঃ


وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاءِ بُرُوجًا وَزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِينَ. وَحَفِظْنَاهَا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ رَجِيمٍ. إِلَّا مَنِ اسْتَرَقَ السَّمْعَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ مُبِينٌ.


অর্থাৎ— আকাশে আমি গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি করেছি এবং দর্শকের জন্য তাকে সুশোভিত করেছি; এবং প্রত্যেক অভিশপ্ত শয়তান থেকে আমি তাকে রক্ষা করে থাকি; আর কেউ চুরি করে সংবাদ শুনতে চাইলে তার পিছু ধাওয়া করে প্রদীপ্ত শিখা। (১৫ঃ ১৬-১৮)


আরেক জায়গায় আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


وما تنزلت به الشيطين . وما ينبغي لهم وما يستطيعون. انهم عن الشمع لمعزولون.


অর্থাৎ শয়তানরা তা সহ অবতীর্ণ হয়নি। তারা এ কাজের যোগ্য নয় এবং তারা এর সামর্থ্যও রাখে না। তাদেরকে তো শ্রবণের সুযোগ থেকে দূরে রাখা হয়েছে।


অন্যত্র আল্লাহ্ তা’আলা জিন জাতি সম্পর্কে সংবাদ দিতে গিয়ে বলেনঃ


وَأَنَّا لَمَسْنَا السَّمَاءَ فَوَجَدْنَاهَا مُلِئَتْ حَرَسًا شَدِيدًا وَشُهُبًا. وَأَنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَاعِدَ لِلسَّمْعِ ۖ فَمَنْ يَسْتَمِعِ الْآنَ يَجِدْ لَهُ شِهَابًا رَصَدًا.


অর্থাৎ- এবং আমরা চেয়েছিলাম আকাশের তথ্য সংগ্রহ করতে কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিণ্ডে আকাশ পরিপূর্ণ; আর পূর্বে আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শোনার জন্য বসতাম। কিন্তু এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে তার উপর নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের সম্মুখীন হয়। (৭২ঃ ৮-৯)


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ


الملائكة تحدث في العنان بالأمر يكون في الأرض فتسمع الشياطين الكلمة فتقرها في أذن الكاهن كما نقرالقارورة فيزيدون معها مأة


অর্থাৎ- ফেরেশতাগণ মেঘমালায় বসে পৃথিবীতে যা ঘটবে সে সব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে থাকেন। শয়তানরা তার শব্দ বিশেষ শুনে এসে জ্যোতিষীর কানে ঢেলে দেয়, যেমন বোতলে কোন কিছু ঢালা হয়ে থাকে। পরে তারা তার সাথে আরো একশ কথা জুড়ে দেয়।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) ইবলীস পরিচিতি অধ্যায়ে লায়ছ (رحمة الله) থেকে মু’আল্লক সূত্রেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


ইমাম বুখারী ও মুসলিম (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আয়েশা (رضي الله عنه) বলেছেনঃ কিছু লোক রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর নিকট জ্যোতিষীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ انهم ليسوا بشي ওরা কিছু নয়। তাঁরা বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! তারা তো কখনো কখনো কোন কিছু সম্পর্কে আমাদেরকে এমন কথা বলে থাকে, যা সঠিক প্রমাণিত হয়ে যায়। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন।


تلك الكلمة من الحق غطفها من الجني فيقرقرها في اذن وليه كقرقرة الدجاجة فيخلطون معها مائة كذبة.


অর্থাৎ ঐ সত্য কথাটি জিনদের কেউ ছোঁ মেরে এনে মুরগীর কড় কড় শব্দের ন্যায় শব্দ করে তার সাঙ্গাতের কানে দিয়ে দেয়। পরে তার সাথে তারা শত মিথ্যা কথা জুড়ে দেয়। এ পাঠটি হচ্ছে ইমাম বুখারী (رحمة الله)-এর।


বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ ‘আল্লাহ্ তা’আলা ঊর্ধজগতে কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিলে আনুগত্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে ফেরেশতাগণ তাদের ডানা ঝাপটাতে শুরু করেন, যেন তা মসৃণ পাথরের উপর জিঞ্জিরের ঝনঝনানি, তারপর তারা শান্ত ও নির্ভয় হলে তারা বলাবলি করেন যে, তোমাদের প্রতিপালক কি বললেন? উত্তরে তারা বলেন, তিনি যা বললেন, তা নির্ঘাত সত্য। তিনি তো মহীয়ান গরীয়ান। এ সুযোগে চুরি করে শ্রবণকারী তা শুনে ফেলে। চুরি করে শ্রবণকারী দল এবারে একজন আরেকজনের উপর অবস্থান করে। সুফয়ান তাঁর হাতটি একদিকে সরিয়ে নিয়ে আঙ্গুলগুলোর মাঝে ফাঁক করে তার বিবরণ দেন। (তারপর বলেন) তারপর একজন কোন কথা শুনে নিয়ে তা তার নিচের জনের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। সে আবার তার নিচের জনের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। এভাবে কথাটি জাদুকর কিংবা জ্যোতিষীর মুখে পৌঁছানো হয়। তবে অনেক সময় তা পৌঁছানোর আগেই উল্কাপিণ্ডের কবলে পড়ে যায় আবার অনেক সময় উল্কাপিণ্ড ধরে ফেলার আগে-ভাগেই তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়। সে তখন তার সঙ্গে শত মিথ্যা জুড়ে দেয়। তারপর বলাবলি হয় যে, অমুক দিন কি সে আমাদেরকে এমন এমন বলেনি? ফলে আকাশ থেকে শ্রুত কথাটির ভিত্তিতে তাকে সত্যবাদী বলে মেনে নেওয়া হয়। ইমাম মুসলিম (رحمة الله)-ও অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন।


আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَٰنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ. وَإِنَّهُمْ لَيَصُدُّونَهُمْ عَنِ السَّبِيلِ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ مُهْتَدُونَ. حَتَّىٰ إِذَا جَاءَنَا قَالَ يَا لَيْتَ بَيْنِي وَبَيْنَكَ بُعْدَ الْمَشْرِقَيْنِ فَبِئْسَ الْقَرِينُ.


অর্থাৎ যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয় আমি তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান, তারপর সে হয় তার সহচর। শয়তানরাই মানুষকে সৎপথ থেকে বিরত রাখে অথচ মানুষ মনে করে তারা সৎপথে পরিচালিত হচ্ছে। অবশেষে যখন সে আমার নিকট উপস্থিত হবে, তখন সে শয়তানকে বলবে, হায়! আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান থাকত। কত নিকৃষ্ট সহচর সে! (৪৩ঃ ৩৬-৩৮)


অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


وَقَيَّضْنَا لَهُمْ قُرَنَاءَ فَزَيَّنُوا لَهُمْ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ


অর্থাৎ আমি তাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সহচর, যারা তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা আছে তা তাদের দৃষ্টিতে শোভন, করে দেখিয়েছিল। (৪১ঃ ২৫)


অন্যত্র মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


قَالَ قَرِينُهُ رَبَّنَا مَا أَطْغَيْتُهُ وَلَٰكِنْ كَانَ فِي ضَلَالٍ بَعِيدٍ. قَالَ لَا تَخْتَصِمُوا لَدَيَّ وَقَدْ قَدَّمْتُ إِلَيْكُمْ بِالْوَعِيدِ. مَا يُبَدَّلُ الْقَوْلُ لَدَيَّ وَمَا أَنَا بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ.


অর্থাৎ তার সহচর শয়তান বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমি তাকে অবাধ্য হতে প্ররোচিত করিনি। বস্তুত সে নিজেই ছিল ঘোর বিভ্রান্ত।


আল্লাহ্ বলবেন, আমার সামনে বাক-বিতণ্ডা করো না, তোমাদেরকে আমি তো পূর্বেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম। আমার কথার রদবদল হয় না এবং আমি আমার বান্দাদের প্রতি কোন অবিচার করি না। (৫০ঃ ২৭-২৯)


অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেনঃ


وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا ۚ وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُ ۖ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ. وَلِتَصْغَىٰ إِلَيْهِ أَفْئِدَةُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَلِيَرْضَوْهُ وَلِيَقْتَرِفُوا مَا هُمْ مُقْتَرِفُونَ.


অর্থাৎ- এরূপ মানব ও জিনের মধ্যে শয়তানদেরকে আমি প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছি; প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে, যদি তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন; তবে তারা তা করতো না। সুতরাং তুমি তাদেরকে ও তাদের মিথ্যা রচনাকে বর্জন কর।


এবং তারা এ উদ্দেশ্য প্ররোচিত করে যে, যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তাদের মন যেন তার প্রতি অনুরাগী হয় এবং তাতে যেন তারা পরিতুষ্ট হয় আর যে অপকর্ম করে তারা যেন তাই করতে থাকে। (৬৪ঃ ১১২-১১৩)


ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে ইমাম আহমদ ও মুসলিম (رحمة الله) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস আমরা ফেরেশতা পরিচিতি অধ্যায়ে উল্লেখ করে এসেছি। তাতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ


ما منكم من احد الا وقد وكل به قرينه من الجن وقرينه من الملئكة.


অর্থাৎ “কেউ বাদ নেই, তোমাদের প্রত্যেকের জিন সহচর ও ফেরেশতা সহচরকে তার দায়িত্বে রাখা হয়েছে।”


এ কথা শুনে সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, এবং আপনারও ইয়া রাসূলাল্লাহ? তিনি বললেনঃ আমারও কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে তার উপর সাহায্য করেছেন। ফলে সে আমাকে মঙ্গল ছাড়া অন্য কিছুর আদেশ করে না।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ


ليس منكم من احد الا وقد وكل به قرينه من الشياطين.


অর্থাৎ তোমাদের কেউ এমন নেই, যার উপর তার শয়তান সহচরকে নিয়োজিত করে রাখা হয়নি।


একথা শুনে সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, আর আপনিও ইয়া রাসূলাল্লাহ? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, “হ্যাঁ, তবে আল্লাহ্ আমাকে তার উপর সাহায্য করেছেন, ফলে সে আমার অনুগত হয়ে গেছে।” ইমাম আহমদ (رحمة الله) একাই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং এ রিওয়ায়েতটি সহীহ বুখারীর শর্তে উত্তীর্ণ।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (رضي الله عنه) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক রাতে তাঁর নিকট থেকে বের হয়ে যান। তিনি বলেন, তার এভাবে চলে যাওয়ায় আমি মনঃক্ষুন্ন হই। আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে তিনি আমার অবস্থা দেখে বললেনঃ কী ব্যাপার, আয়েশা! তুমি মনঃক্ষণ হয়েছ? আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, জবাবে আমি বললাম, আমার মত মানুষ আপনার মত লোকের উপর মনঃক্ষুন্ন হবে না তো কী? এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেনঃ কি ব্যাপার, তোমার শয়তানটা তোমাকে পেয়ে বসেছে না কি? আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, আমি বললাম, আমার সঙ্গে শয়তান আছে নাকি হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। আমি বললাম, সব মানুষের সঙ্গেই আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, আপনার সঙ্গেও আছে কি, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেনঃ ‘হ্যাঁ’ আছে বটে কিন্তু আল্লাহ্ তার উপর আমাকে সাহায্য করেছেন। ফলে সে অনুগত হয়ে গিয়েছে। অনুরূপ ইমাম মুসলিম (رحمة الله)-ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ


إن المؤمن لينصي شيطانه كما ينصي أحدكم بعيره في السفر.


অর্থাৎ মু’মিন তার শয়তানের মাথার সম্মুখ ভাগের কেশ গুচ্ছ ধরে তাকে পরাভূত করে থাকে, যেমনটি তোমাদের কেউ সফরে তার অবাধ্য উটকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।


ইবলীস সম্পর্কে সংবাদ দিতে গিয়ে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ. ثُمَّ لَآتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ.


অর্থাৎ সে বলল, তুমি আমাকে শাস্তিদান করলে, এ জন্য আমিও তোমার সরল পথে মানুষের জন্য নিশ্চয় ওঁৎ পেতে থাকব। তারপর আমি তাদের নিকট আসবই তাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ, দক্ষিণ ও বাম দিক থেকে এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবে না। (৭ঃ ১৬-১৭)


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, সুবরা ইবন আবু ফাকিহ্ (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, শয়তান আদম সন্তানের জন্য বিভিন্ন পথে ওঁৎ পেতে বসে আছে। ইসলামের পথে বসে থেকে সে বলে, তুমি কি তোমার ও তোমার পিতৃ-পুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছ? রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেনঃ কিন্তু আদম সন্তান তাকে অগ্রাহ্য করে ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর সে হিজরতের পথে বসে থেকে বলে, তুমি কি আপন মাটি ও আকাশ (মাতৃভূমি) ত্যাগ করে হিজরত করছ? মুহাজির তো দূরত্ব অতিক্রমে ঘোড়ার ন্যায়। কিন্তু সে তাকে অগ্রাহ্য করে হিজরত করে। তারপর শয়তান জিহাদের পথে বসে যায়— জিহাদ হলো জান ও মাল উৎসর্গ করা— তারপর বলল, তুমি লড়াই করে নিহত হবে আর তোমার স্ত্রী অন্য স্বামী গ্রহণ করবে ও তোমার ধন-সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাবে? রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেন, এবারও সে তাকে উপেক্ষা করে ও জিহাদ করে। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ আদমের সন্তানদের যে কেউ তা করবে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর যিম্মায় থাকবে। সে শহীদ হয়ে গেলে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর যিম্মায় থাকবে। সে ডুবে গেলে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর যিম্মায় থাকবে এবং তার সওয়ারী তাকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেললেও তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর যিম্মায় থাকবে।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবদুল্লাহ ইবন উমর (رضي الله عنه) সূত্রে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রতিদিন সকাল-বিকাল এ দুআগুলো পাঠ করতেন—কখনো ছাড়তেন না।


اللهم إني أسئلك العافية في الدنيا والاخرة - اللهم إني أسئلك العفو والعافية في ديني ودنياي وأهلي ومالي - اللهم استر عوراتی وآمن روعاتي - اللهم احفظني من بين يدي و من خلفي وعن يميني و عن شمالي ومن هوقي وأعوذ بعظمتك أن أغتال من تحتي.


অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট দুনিয়া ও আখিরাতে নিরাময়তা প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ক্ষমা এবং আমার দীন-দুনিয়া, পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! তুমি আমার সে সব বিষয় গোপন রাখ, যা প্রকাশ পেলে আমার লজ্জা পেতে হবে আর আমার ভীতিকর বিষয়সমূহকে তুমি নিরাপদ করে দাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে অগ্র-পশ্চাৎ, আমার ডান-বাম ও আমার উপর থেকে হেফাজত কর। আর তোমার মর্যাদার উসিলায় আমার নিচের থেকে আমাকে ধ্বংস করার ব্যাপারে আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি।”


ওকী (رحمة الله) বলেন, নিচের থেকে ধ্বংস করা মানে ধসিয়ে দেয়া। ইমাম আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবন মাজাহ, ইবন হিব্বান ও হাকিম (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাকিম (رحمة الله) একে সহীহ সনদের হাদীস বলে আখ্যায়িত করেছেন।

Top