কিতাবঃ কারবালা প্রান্তরে
মূল: খতীবে পাকিস্তান মুহাম্মদ শফী উকাড়ভী (রহ.)
অনুবাদে: মিসেস হাসিনা রহমান
সিনিয়র শিক্ষিকা
মেনন গ্ৰামার স্কুল
নন্দনকানন, চট্টগ্রাম
টেক্সট রেডীঃ
তানভীর বিন শাব্বির
হাফেজ মুহাম্মদ মামুনুর রশিদ
ডা. মাসুম বিল্লাহ সানি
প্রারম্ভিক বক্তব্য
সৈয়্যদুশ শােহাদা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) চতুর্থ হিজরীর শাবান মাসের ৫ তারিখ পবিত্র মদীনা শরীফে জন্ম গ্রহন করেন। জন্মের পর সরকারে মদীনা (ﷺ) তার কানে আযান দিয়ে দুআ করেছিলেন। সাত দিন পর আকীকা করে হুসাইন নাম রাখা হয়েছিল। হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে,
اَلْحَسَنَ وَاَلْحُسَيْنُ اِسْمَانِ مِنْ اَهْلِ الْجَنَّةِ-
অর্থাৎ, হাসান ও হুসাইন জান্নাতী নাম সমূহের মধ্যকার দুটি নাম। এর আগে আরবের জাহিলিয়াত যুগে এ দু'নামের প্রচলন ছিল না।
হযরত হাসান ও হুসাইন (রাদি আল্লাহ তাআলা আনহুমা) হুযুর আকরম (ﷺ) এর খুবই প্রিয় পাত্র ছিলেন। তাঁদের ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীছ বর্ণিত আছে। হুযুর (ﷺ) ইরশাদ করেছেন-
اِنَّ الْحَسَنَ والْحُسَيْنَ هُمَا رَيْحَانِيْ مِنَ الدُّنْيَا -
অর্থাৎ নিশ্চয়ই হাসান-হুসাইন দুনিয়াতে আমার দুটি ফুল। আপন সন্তান থেকেও তিনি (ﷺ) তাদেরকে (رضي الله عنه) অধিক ভালবাসতেন।
হযরত আল্লামা জামী (রহমতুল্লাহে তাআলা আলাইহে) বর্ণনা করেন, একদিন সরকারে দু'আলম (ﷺ) হযরত ইমাম হােসাইন (رضي الله عنه) কে ডানে ও স্বীয় সাহেবজাদা হযরত ইব্রাহিম (رضي الله عنه) কে বামে বসিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) উপস্থিত হয়ে আরয করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ (ﷺ)! আল্লাহ তাআলা এ দু'জনকে আপনার কাছে এক সঙ্গে রাখতে দেবেন না। ওনাদের মধ্যে একজনকে ফিরিয়ে নিবেন। অতএব আপনি দু'জনের মধ্যে যাকে ইচ্ছে পছন্দ করুন। হুযুর (ﷺ) ফরমালেন, যদি হুসাইনকে নিয়ে যায়, তাহলে ওর বিরহে ফাতেমা ও আলীর খুবই কষ্ট হবে এবং আমার মনটাও ক্ষুন্ন হবে আর যদি ইব্রাহিম এর ওফাত হয়, তাহলে সবচে বেশী দুঃখ একমাত্র আমিই পাব। এজন্য নিজে দুঃখ পাওয়াটাই আমি পছন্দ করি। এ ঘটনার তিন দিন পর হযরত ইব্রাহিম (رضي الله عنه) ইন্তেকাল করেন। এরপর থেকে যখনই হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) হুযুর (ﷺ) এর সমীপে আসেন, হুযুর ওকে মুবারকবাদ দিতেন, ওর কপালে চুমু দিতেন এবং উপস্থিত লােকদেরকে সম্বোধন করে বলতেন- আমি হুসাইনের জন্য আপন সন্তান ইব্রাহিমকে কুরবানী দিয়েছি। (শওয়াহেদুন নবুয়ত)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) ইরশাদ ফরমাইয়াছেন ; অর্থাৎ হাসান-হুসাইন
اَلْحَسَنْ واَلْحُسَيْنُ سَيَّدًا شَبَابِ اَهْلِ الْجَنَّةِ -
অর্থাৎ, হাসান-হুসাইন জান্নাতী যুবকদের সরদার।
হযরত আবু হুরাইরা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রসূলে আকরাম (ﷺ) একদিন এমন অবস্থায় বাহিরে তশরীফ আনলেন যে, তাঁর এক কাঁধের উপর হযরত হাসান এবং অন্য কাধের উপর হযরত হুসাইনকে বসিয়ে ছিলেন। এ ভাবেই আমাদের সামনে তশরীফ আনলেন এবং ফরমালেন
مَنْ اَحَبَّاهُمَا فَقَدْ أَحَبَّنِيْ وَمَنْ اَبْغَضَهُمَا فَقَدْ اَبْغَضَانِيْ -
অর্থাৎ যে এ দুজনকে মহব্বত করলাে, সে আমাকে মহব্বত করলাে আর যে এদের সাথে দুশমনী করলাে, সে আমার সাথে দুশমনী করলাে।
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর জন্মের সাথে সাথে হুযুর (ﷺ) এর বদৌলতে তার শাহাদাতের কথা সবার জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। হযরত আলী, হযরত ফাতেমাতুয যােহরা, অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম ও আহলে বাইতের সংশ্লিষ্ট সবাই (রাদি আল্লাহু তাআলা আনহুম) হুসাইন (رضي الله عنه) এর শৈশব অবস্থায় জানতে পেরেছিলেন যে, এ ছেলেকে একান্ত নির্মমভাবে শহীদ করা হবে এবং কারবালা ময়দান তার রক্তে রঞ্জিত হবে। তার (رضي الله عنه) শাহাদাতের ভবিষ্যত বানী সম্বলিত অনেক হাদীছ বর্ণিত আছে।
হযরত উম্মুল ফজল বিনতে হারেছ (رضي الله عنه) (হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) এর স্ত্রী) বলেন, আমি একদিন নবী করীম (ﷺ) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে তার কোলে দিলাম। এরপর আমি দেখলাম, হুযুর (ﷺ) এর চোখ মুবারক থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! (ﷺ) ব্যাপার কি? তিনি ফরমালেন, আমার কাছে জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) এসে খবর দিয়ে গেল
اِنَّ اُمَّتِيْ سَتَقْتَلَ اِبْنِي هَذَا -
(আমার উম্মত আমার এ শিশুকে শহীদ করবে ।) হযরত উম্মুল ফজল বলেন, আমি আশ্চর্য হয়ে আরয করলাম, “ইয়া রাসুলল্লাহ, এ শিশুকে শহীদ করবে! হুযুর (ﷺ) ফরমালেন, হা! জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) ওর শাহাদত স্থলের লাল মাটিও এনেছেন। হযরত ইবনে সাদ (رضي الله عنه), হযরত শাবী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত আলী (রাদি আল্লাহ তাআলা আনহু) জংগে সিফফীনের সময় কারবালার পথ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সেই জায়গার নাম জানতে চাইলেন। লােকেরা বললাে, এ জায়গার নাম
কারবালা। কারবালার নাম শুনেই তিনি এত কান্নাকাটি করলেন যে, মাটি চোখের পানিতে ভিজে গিয়েছিল । অতঃপর ফরমালেন, আমি একদিন হুযুর (ﷺ) এর খেদমতে হাজির হয়ে দেখতে পেলাম, তিনি (ﷺ) কাঁদছেন। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসুলল্লাহ! (ﷺ) আপনি কেন কাঁদছেন? ফরমালেন, এ মাত্র জিব্রাইল এসে আমাকে খবর দিয়ে গেল।
ان ولدي الحسين يقتل بشاطئ الفرأت بموضع يقال له کربلا-
(আমার ছেলে (দৌহিত্র) হুসাইনকে ফোরাত নদীর তীরে সেই জায়গায় শহীদ করা হবে, যে জায়গার নাম কারবালা (সওয়ায়েকে মুহারাকা) বিভিন্ন হাদীছ থেকে জানা যায় যে, ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)এর শাহাদাত সম্পর্কে হুযুর (ﷺ) অনেকবার ভবিষ্যত বাণী করেছেন। ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শৈশব কালেই এটা সবার জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। হুযুর (ﷺ) খােদ্বাওয়ান্দ তাআলার ইচ্ছায় রেজামন্দি জ্ঞাপন করেন। জলেস্থলে যার হুকুম চলে, পাথর বৃক্ষ পশু-পাখী যাকে সালাম করে, যার ইশারায় চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়, যার হুকুমে ডুবন্ত সূর্য ফিরে আসে এবং খােদা প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সৃষ্টিকূলের প্রতিটি কণায় কণায় যার রাজত্ব চলে, সেই নবী (ﷺ) তাঁর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্রের শাহাদত হওয়ার খবর পেয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন বটে কিন্তু রক্ষা করার জন্য খােদার বারগাহে দুআ করেননি। এমনকি হযরত আলী ও হযরত ফাতিমা (রাদি আল্লাহু তাআলা আনহুমা) এ বলে আরয করেননি- 'ইয়া রাসুলাল্লাহ! হুসাইনের শাহাদাতের খবর শুনে আমাদের বুক ফেটে যাচ্ছে। আপনি আল্লাহর দরবারে ওকেএ মসীবত থেকে রক্ষার জন্য দুআ করুন।
মােট কথা, কেউ ওকে রক্ষার জন্য দুআ করেননি, সবাই চেয়েছেন যে, হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) যেন এ মহা পরীক্ষায় কামিয়াব হয়ে আল্লাহ (আযযা ওয়াজাল্লা) এর দরবারে উচ্চস্থান লাভ করেন।
অতি পরিতাপের বিষয়, আমাদের মধ্যে মুসলমান নামধারী কেউ কেউ বলে থাকে যে, নবী করীম (ﷺ) পরের উপকারতাে দূরের কথা, নিজের উপকার করতেও অক্ষম (নাউযুবিল্লাহ) তাদের প্রধান দলীল হলাে, রসুলুল্লাহ যখন স্বীয় দৌহিত্রকে হত্যা থেকে বাঁচাতে পারেননি, সে
ক্ষেত্রে অন্যদেরকে মসীবত থেকে কিভাবে রক্ষা করতে পারবেন। এর জবাব হচ্ছে, আল্লাহর প্রিয় হাবীব (ﷺ) হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে শহীদ হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করেননি। তিনি (ﷺ) ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে হত্যা থেকে রক্ষার জন্য দুআ করেননি। যখন তিনি (ﷺ) রক্ষা করার জন্য চেষ্টাই করেন নি, তখন এটাকে অক্ষমতা বলাটা মারাত্মক ভুল।
মনে করুন, আমাদের কোন লােক নদীতে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের কাছে নৌযান ইত্যাদি থাকা সত্বেও ওকে রক্ষা করার জন্য আমরা চেষ্টা করিনি। এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে কি অক্ষম বলা যাবে? অবশ্য আমরা যদি চেষ্টা করে বিফল হতাম তাহলে অক্ষম বলা যেত।
আমাদের সমাজে এখনও অনেক ইয়াজিদের প্রেতাত্মা রয়ে গেছে। ওরা সুযােগ বুঝে আহলে বায়ত ও ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর সমালােচনা করতে দ্বিধাবােধ করে না। এদেরকে চিনে রাখা এবং এদের সম্পর্কে সদা সজাগ থাকা দরকার।
শাহাদাতে কারবালা
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান
ولاتقولوا لمن يقتل في سبيل الله أموات
যারা আল্লাহর রাস্তায় কতল বা শহীদ হয়ে যায়, তাদেরকে মৃত বলনা।
১ بَلْ اَحْيَاءُ وَّلَكِنْ لَا تَشْعُرُوْنَ : বরং তারা জীবিত কিন্তু তােমরা অবহিত নও। হুযুর (ﷺ) এর উম্মতের মধ্যে অনেকেই শাহাদাত বরণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা অনেক লােককে এই নিয়ামত দান করেছেন। যেমন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) এ নিয়ামত লাভ করেছেন। হযরত উমর ফারুক (رضي الله عنه), হযরত ওছমান গণি (رضي الله عنه) ও হযরত আলী মরতুজা (رضي الله عنه)ও এই নিয়ামত লাভে ধন্য হয়েছেন। জংগে উহুদ, বদর, গজওয়ায়ে খায়বরেও অনেক সাহাবায়ে কিরাম এ নিয়ামত লাভ করেছেন। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শাহাদাত এমন এক অসাধারণ ও অদ্বিতীয় শাহাদাত এবং এমন এক হৃদয় বিদারক ঘটনা, যার সাথে আগের এবং পরের যুগের কোন ঘটনার তুলনা হয় না।
ইয়াজিদের মসনদ দখল
হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর ইন্তেকালের পর ইয়াজিদ সিংহাসনে আরােহন করলাে এবং সিংহাসনে আরােহন করার সাথে সাথেই তার মনের মধ্যে সীমাহীন অহংকার ও গর্ববােধের সৃষ্টি হলাে। যার ফলে সে এমন কাজকর্ম শুরু করলাে, যা পবিত্র শরীয়তের সম্পূর্ণ বিপরীত। মানুষ ক্ষমতার মােহে বিভোর হয়ে অনেক সময় ধরাকে সরা জ্ঞান করে। যেমন ফেরাউন প্রথমে গরীব লােক ছিল, কিন্তু ভাগ্যক্রমে বাদশা হয়ে সিংহাসনে আরােহন করার সাথে সাথে এমন অহংকারী হয়ে বসলাে যে, শেষ পর্যন্ত নিজেকে খােদা বলে ঘােষণা করলাে এবং বলতে লাগলাে-
اَنَا رَبُّكُمُ الْاَعْلٰي
অর্থাৎ আমি তােমাদের সবচেয়ে বড় খােদা; আমার পূজা, আরাধনা কর; সে-ই রক্ষা পাবে, যে আমার পূজা করবে; আর যে আমার পূজা করতে অস্বীকার করবে, তাকে আমি খতম করবাে। একমাত্র এ কারণেই সে অনেক লােকের গর্দান দ্বিখন্ডিত করেছিল। তাদের অপরাধ ছিলাে, তারা তার পূজা করতে এবং তাকে মা'বুদ মানতে অস্বীকার করেছিল। ইয়াজিদও যখন সিংহাসনে বসলাে, তখন সে বাপের বর্তমানে যে সব গর্হিত কাজ কর্ম গােপনে করতাে, সে সব এখন প্রকাশ্যে করতে লাগলাে। যেহেতু এখন তাকে নিষেধ করা বা বাধা দেয়ার কেউ নেই সেহেতু সে এখন যা খুশী তা করতে লাগলাে। মদ্য পান, জেনা এবং অন্যান্য কু-কর্ম তার নিত্য দিনের অভ্যাসে পরিণত হল। সে মনে মনে ভাবলাে 'আমার যে চাল-চলন এবং স্বভাব-চরিত্র, তা কেউ সহজে মেনে নিবে না। বিশেষ করে যে সব গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আছেন তাঁরা তার এ রাজত্ব মেনে নিবেন না; তাঁরা তার হাতে বায়াত করবেন না; তাঁদের অস্বীকৃতির কারণে অন্যদের মধ্যেও অস্বীকৃতির প্রভাব বিস্তৃত হবে। এজন্য এটাই সমীচীন হবে যে, আমি তাঁদের বায়াত তলব করবাে। যদি তারা অস্বীকার করেন, তখন তাদেরকে কতল করাবাে, যাতে আমার রাস্তার এ সব বড় বড় প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হয় এবং আমার খেলাফতের রাস্তা যেন কন্টক মুক্ত হয়ে যায়। তাই সে ক্ষমতায় আরােহণ করার পর পরই হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه), হযরত আবদুল্লাহ বিন্ জুবাইর (رضي الله عنه) হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (رضي الله عنه) প্রমূখ থেকে বায়াত তলব করলাে। এ সব ব্যক্তিগণ বিশেষ সম্মানিত ছিলেন এবং বিশেষ গণ্যমান্যদের বংশধর ছিলেন। তাই তারা কিভাবে ফাসিক-ফাজির ইয়াজিদের হাতে বায়াত করতে পারেন? সুতরাং তারা অস্বীকার করলেন এবং এটা তাঁদের মর্যাদাগত আচরণই ছিল। অস্বীকার করার পর হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (رضي الله عنه) ও হযরত আবদুল্লাহ বিন জুবাইর (رضي الله عنه) মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফ চলে গেলেন।
হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) মদিনার গভর্নর ওয়ালিদের আহবানে তাব দরবারে তশরীফ নিয়ে গেলেন, তার সঙ্গে আলােচনা করলেন। মদীনার গভর্ণর বললাে, ইয়াজিদ আপনার বায়াত তলব করেছেন। তিনি বললেন, 'আমি ইয়াজিদের হাতে বায়াত করতে পারিনা। ইয়াজিদ হলাে ফাসিক-ফাজির। এ ধরনের অনুপযুক্ত লােকের হাতে আমি বায়াত করতে পারিনা। আমি কোন অবস্থাতেই ওর হাতে বায়াত করতে রাজি নই।' তিনি সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করলেন। এটা ছিল তাঁর মর্যাদাগত আচরণ। দেখুন, তিনি যদি বায়াত করতেন, তাহলে নিজের প্রাণ বাঁচতে, পরিবার-পরিজন বাঁচতাে, এমনও হয়তাে হত যে, অগাধ সম্পত্তির মালিকও তিনি হয়ে যেতেন। কিন্তু ইসলামের আইন-কানুন ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত এবং কিয়ামত পর্যন্ত ফাসিক-ফাজিরের আনুগত্য বৈধ হয়ে যেত এবং তাদের কাছে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর আনুগত্য প্রধান দলিল হিসাবে পরিণত হত। লােকেরা বলতাে, ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) যখন ফাসিক-ফাজিরের আনুগত্য স্বীকার করেছেন, তাহলে নিশ্চয় এটা জায়েয। কিন্তু ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) অস্বীকারের মাধ্যমে দুনিয়াবাসীর সামনে প্রমাণ করে দিলেন, হুসাইন (رضي الله عنه) শত দুঃখ-কষ্ট ভােগ করতে পারেন, অনেক বিপদ-আপদের মােকাবেলা করতে পারেন, এমন কি আপন পরিজনের শহীদ হওয়াটা অবলােকন করতে পারেন; নিজেও বর্বরােচিত ভাবে শাহাদাত বরণ করতে পারেন, কিন্তু ইসলামের নেজাম ছত্রভঙ্গ হওয়া কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না, নিজের নানাজান (ﷺ) এর ধর্ম ধ্বংস হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) নিজের কাজ ও কর্মপন্থা দ্বারা তা প্রমাণিত করেছেন এবং দুনিয়াবাসীকে এটা দেখিয়ে দিয়েছেন, খােদার বান্দার এটাই শান যে, বাতিলের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং তীর তলােয়ারের সামনে বুক পেতে দেন, কিন্তু কখনও বাতিলের সামনে মাথা নত করেন না। ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) নিজের আমল দ্বারা তাঁর উচ্চ মর্যাদার পরিচয় দান করেছেন এবং জনগণের সামনে নিজের পদ মর্যাদা তুলে ধরেছেন।
ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর মক্কার উদ্দেশ্যে মদীনা ত্যাগ
ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এভাবে অস্বীকার করে ওয়ালিদের দরবার থেকে আপন জনদের কাছে ফিরে আসলেন এবং সবাইকে একত্রিত করে বললেন, আমার প্রিয়জনেরা! যদি আমি মদীনা শহরে অবস্থান করি, আমাকে ইয়াজিদের হাতে বায়াত করার জন্য বাধ্য করবে, কিন্তু আমি কখনও বায়াত করতে পারবাে না। বাধ্য করলে নিশ্চয় যুদ্ধ হবে, ফ্যাসাদ হবে, কিন্তু আমি চাইনা আমার কারণে মদীনা শরীফে লড়াই বা ফ্যাসাদ হােক। আমার মতে এটাই সমীচীন হবে যে, এখান থেকে হিজরত করে মক্কা শরীফে চলে যাওয়া। নিজের আপনজনেরা বললেন, আপনি আমাদের সর্দার, আমাদেরকে যা হুকুম করবেন তা মেনে নেব। অতঃপর তিনি (رضي الله عنه) মদীনা শরীফ থেকে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আহ! অবস্থা কেমন কঠিন হয়ে গিয়েছিল যে, ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে সেই মদীনা শরীফ ত্যাগ করতে হচ্ছিল, যে মদীনা শরীফে তাঁর (رضي الله عنه) নানাজান (ﷺ) এর রওজা মুবারক অবস্থিত। তাঁর (رضي الله عنه) নানাজান (ﷺ) এর রওজা মুবারক যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার টাকা-পয়সা ব্যয় করে, আপন জনদের বিরহ-বেদনা সহ্য করে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দূর-দূরান্ত থেকে লােকেরা আসে এই মদীনায়। কিন্তু আফসােস্, আজ সেই মদীনা তিনি (رضي الله عنه) ত্যাগ করছেন, যেই মদীনা তাঁরই (رضي الله عنه) ছিল। নবীজী (ﷺ) এর নয়নের তারা ছিলেন তিনি (رضي الله عنه)। ক্রন্দনরত অবস্থায় তিনি (رضي الله عنه) নানাজান (ﷺ) এর রওজা পাকে উপস্থিত হয়ে বিদায়ী সালাম পেশ করলেন এবং অশ্রুসজল নয়নে নানাজান (ﷺ) এর অনুমতি নিয়ে আত্মীয় পরিজনসহ মদীনা শরীফ থেকে হিজরত করে মক্কায় চলে গেলেন। মক্কা শরীফ তিনি (رضي الله عنه) কেন গিয়েছিলেন? আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ ফরমান-
وَمَنْ دَخَلَهُ كَانَ اَمِنًا -
(যে হেরেম শরীফে প্রবেশ করলাে, সে নিরাপদ আশ্রয়ে এসে গেল।) কেননা হেরেম শরীফের অভ্যন্তরে ঝগড়া-বিবাদ, খুন-খারাবী না জায়েয, হারাম। এমনকি হেরেম শরীফের সীমানায় উকুন মারা পর্যন্ত নিষেধ। আজকাল সাপ বিচ্ছু ইত্যাদি মারা যায়। কিন্তু যে সব পশু-পাখি মানুষের কোন ক্ষতি করে না ঐগুলাে মারা জায়েয নাই। মুমিনদের ইজ্জত-শান আলাদা, তাদের মান-সম্মান অনেক উচ্চ হয়ে থাকে। তাই ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) চিন্তা করলেন যে, হেরেম শরীফের সীমানায় অবস্থান করে আল্লাহ তাআলার ইবাদত বন্দেগীতে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবে- এ মনােভাব নিয়ে তিনি (رضي الله عنه) মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফ চলে আসলেন।
কুফার চিঠি
মক্কা শরীফে আগমনের সাথে সাথে কুফা থেকে লাগাতার চিঠিপত্র এবং সংবাদ-বাহক আসতে শুরু করলাে। অল্প সময়ের মধ্যে হুসাইন (رضي الله عنه) এর কাছে দেড়শ' চিঠি এসে পৌছল। অপর এক বর্ণনায় বারশ' চিঠি এসেছিল। কোন কোন উলামায়ে কিরাম তাঁদের কিতাবে বারশ' চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ কিতাবে দেড়শ' চিঠির কথা উল্লেখিত আছে। দেড়শ’ চিঠির বিশেষ নির্ভরযােগ্য। কারণ সেই যুগে ডাক আদান-প্রদান অত সহজ ছিল না। লােকেরা চিঠি-পত্র, পত্র বাহকের মাধ্যমে প্রেরণ করত এবং পত্র-বাহক পায়ে হেঁটে বা ঘােড়ায় চড়ে গন্তব্যস্থানে চিঠি পৌছিয়ে দিত। এমতবস্থায় দেড়শ' চিঠি পৌছাটা অত সহজ ব্যাপার নয়। যা হােক, ধরা যাক ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর কাছে দেড়শ চিঠি পৌছেছিল। প্রত্যেক চিঠির বিষয়বস্তু ছিল খুবই আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক চিঠির সার সংক্ষেপ হচ্ছে হে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)! আমরা আপনার পিতা হযরত আলী (رضي الله عنه)এরই অনুসারী এবং আহলে বায়তের ভক্ত। আমরাতাে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে সমর্থন করিনি, আর তাঁর অনুপযুক্ত ছেলে ইয়াজিদকে মানার প্রশ্নই উঠতে পারে না। আমরা আপনার পিতা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (رضي الله عنه) ও আপনার ভাই হযরত হাসান (رضي الله عنه) এর সমর্থনকারী। আমরা ইয়াজিদের অনুসারী নই। ইয়াজিদ এখন তখতারােহন করেছে, কিন্তু আমরা ইয়াজিদকে খলিফা বা ইমাম মানতে পারিনা। আপনাকেই বরহক ইমাম, বরহক খলিফা মনে করি। আপনি মেহেরবানী করে কুফায় তশরিফ নিয়ে আসুন। আমরা আপনার হাতে বায়াত করবাে এবং আপনাকে খলিফা হিসেবে গ্রহণ করবাে। আপনার জন্য আমাদের জানমাল কুরবান করতে প্রস্তুত এবং আপনার হাতে বায়াত করে আপনার অনুসরণে জিন্দেগী অতিবাহিত করতে ইচ্ছুক। তাই আপনি আমাদের কাছে তশরিফ আনুন, আমাদের প্রতি মেহেরবানী করুন এবং আমাদেরকে আপনার সুহবতে রেখে আপনার ফয়েজ-বরকত দ্বারা আমাদেরকে উপকৃত করুন।” সমস্ত কাবিলা- খানদানের থেকে তাঁর (رضي الله عنه) কাছে এই ধরণের চিঠি এসেছে। অনেকেই এই ধরণের চিঠি লিখেছিল, 'হে মহান ইমাম! আপনি যদি আমাদের কাছে না আসেন, আমাদেরকে বাধ্য হয়ে ইয়াজিদের হাতে বায়াত করতে হবে। কারণ সরকারের মোকাবেলা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাল কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ তা'আলা যখন জিজ্ঞেস করবেন- কেন আমরা নালায়েক ইয়াজিদের হাতে বায়াত গ্রহণ করলাম, তখন আমরা পরিস্কার বলব, হে মওলা! আমরা আপনার নবী করিম (ﷺ) এর দৌহিত্রের কাছে চিঠি লিখেছিলাম, সংবাদ পাঠিয়েছিলাম, জান-মাল কুরবানী করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি (رضي الله عنه) যেহেতু তাশরীফ আনেন এবং আমরা সরকারের বিরােধিতা করতে পারিনি, সেহেতু আমরা বাধ্য হয়ে ইয়াজিদের হাতে বায়াত করেছি। তাই হে ইমাম! আপনি স্মরণ রাখবেন, আমাদের এ বায়াতের জন্য আপনিই দায়ী হবেন।
হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এর কুফা গমন
এ ধরণের চিঠি লিখার পরিপ্রেক্ষিতে শরীয়তের বিধান অনুসারে তিনি (رضي الله عنه) বিবেচনা করতে বাধ্য হলেন যে, যাবেন কিনা। তিনি (رضي الله عنه) অনেকের সাথে শলা পরামর্শ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, প্রথমে একজন নির্ভরযােগ্য ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি ঐখানে গিয়ে স্বচক্ষে অবস্থা যাচাই করে দেখবেন, ওরা বাস্তবিকই তাঁকে (رضي الله عنه) চায় কিনা, তাঁর (رضي الله عنه) প্রতি আন্তরিক মহব্বত এবং আকীদা আছে কিনা। সঠিক বিবরণ পাওয়ার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন, যাবেন কি, যাবেন না।
অতঃপর তাঁর (رضي الله عنه) চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম বিন আকিল (رضي الله عنه) কে এ কাজের জন্য মনােনীত করলেন এবং ফরমালেন, 'প্রিয় মুসলিম! কুফা থেকে যে ভাবে চিঠি আসছে, তা তলিয়ে দেখার জন্য তােমাকে আমার প্রতিনিধি করে ঐখানে পাঠানাের মনস্থ করেছি। তুমি সেখানে গিয়ে স্বচক্ষে অবস্থা উপলব্ধি এবং যাচাই বরে যদি অবস্থা বাস্তবিকই সন্তোষজনক পাও, তাহলে আমার কাছে চিঠি লিখবে। চিঠি পাওয়ার পর আমি রওয়ানা হবে, অন্যথায় তুমি ফিরে এসে যাবে। তাঁর (رضي الله عنه) চাচাতাে ভাই হযরত মুসলিম বিন আকিল (رضي الله عنه) যাবার জন্য তৈরী হয়ে গেলেন। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কুফাবাসীদের কাছে একটি চিঠি লিখলেন হে কুফাবাসী! পরপর তােমাদের অনেক চিঠি আমার কাছে পৌছেছে। তাই আমি আমার চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম বিন আকিল (رضي الله عنه) কে আমার প্রতিনিধি করে তােমাদের কাছে পাঠালাম। তােমরা সবাই তার হাতে বায়াত করাে এবং তার খেদমত করাে। সে তােমাদের মনােভাব যাচাই করে আমার কাছে চিঠি লিখবে। যদি তােমাদের মনােভাব সন্তোষজনক হয়, তাঁর চিঠি আসার পর পরই আমিও তােমাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাব।' এ ভাবে চিঠি লিখে সীল মােহর লাগিয়ে হযরত মুসলিম বিন আকিল (رضي الله عنه) কে দিলেন। হযরত মুসলিম বিন আকিল (رضي الله عنه) এর দুই ছেলে হযরত মুহাম্মদ ও হযরত ইব্রাহিম তার সাথে যেতে জেদ
ধরলেন। তারা বলতে লাগলেন, আব্বাজান! আমাদেরকে ফেলে যাবেন না, আমাদেরকে সাথে নিয়ে যান। হযরত মুসলিম (رضي الله عنه) ছেলেদের অন্তরে আঘাত দিতে চাইলেন না। তাই ছেলেদ্বয়কেও সাথে নিলেন। তিনি মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফ গেলেন এবং আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করার পর কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
হযরত ইমাম মুসলিমের প্রতি প্রাণঢালা সংবর্ধনা
কুফায় পৌছে মুখতার বিন উবায়দুল্লাহ সাক্ফী, যে আমন্ত্রণকারীদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিল ও আহলে বায়তের অনুরক্ত ছিল, তার ঘরেই হযরত মুসলিম (رضي الله عنه) তশরীফ রাখলেন। যখন কুফাবাসীরা খবর পেল যে, হযরত মুসলিম, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন, তখন কুফাবাসীরা দলে দলে এসে তার হাতে বায়াত হতে লাগলো। অল্প দিনের মধ্যে চল্লিশ হাজার লােক তাঁর হাতে বায়াত হয়ে গেল এবং এমন ভালবাসা ও মহব্বত দেখালাে যে, হযরত মুসলিম (رضي الله عنه) অবিভূত হয়ে গেলেন। তিনি যেখানে যাচ্ছেন, শত শত লােক তাঁর সাথে যাচ্ছে, দিন রাত মেহমানদারী করছে, হাত-পায়ে চুমু খাচ্ছে এবং একান্ত আনুগত্যের পরিচয় দিচ্ছে। এতে হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) ভীষণভাবে আকৃষ্ট হলেন এবং মনে মনে বললেন, এরাতাে সত্যিই ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর বড়ই আশেক এবং তাঁর জন্য একেবারে পাগল। তিনি আরও ভাবলেন, আমাকে পেয়ে তাদের যে অবস্থা হয়েছে, জানিনা, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) আসলে তারা কী যে করবে। হযরত ইমাম মুসলিম এ ভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে সমস্ত অবস্থার বর্ণনা দিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর কাছে চিঠি লিখলেন- “চল্লিশ হাজার লােক বায়াত হয়েছে, সব সময় আমার সাথেই রয়েছে, আমার যথেষ্ট খেদমত করছে এবং তাকে
নাদের অন্তরে আপনার (رضي الله عنه) প্রতি অসীম মহব্বত রয়েছে। তাই আপনি আমার চিঠি পাওয়া মাত্রই চলে আসুন। এখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক।” এ ভাবে হযরত মুসলিম, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর কাছে চিঠি লিখলেন। এ দিকে পত্র- বাহক পত্র নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। আর ঐ দিকে দেখুন, অদৃষ্ঠে যা লিখা ছিল, তা কি ভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
কুফাবাসীর বেঈমানী ও হযরত ইমাম মুসলিমের শাহাদাত
ইয়াজিদের অনেক অনুসারীরাও কুফায় অবস্থান করতাে। তারা যখন দেখলাে, হযরত ইমাম মুসলিমের হাতে চল্লিশ হাজার লােক বায়াত গ্রহণ করেছে, তখন তারা ইয়াজিদকে এ ব্যাপারটা জানিয়ে চিঠি দিল। তারা ইয়াজিদকে লিখলাে, ওহে ইয়াজিদ! তুমিতাে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছাে, আর এদিকে তােমার বিরুদ্ধে কুফায় বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছে, যা তােমার পক্ষে প্রতিরােধ করা খুবই কষ্টসাধ্য হবে। তােমারতাে খবরই নেই, তােমার বিরুদ্ধে চল্লিশ হাজার লােক বায়াত গ্রহন করেছে। এবং আরও অনেক লােক বায়াত গ্রহন করছে। যদি এ ভাবে চলতে থাকে, তাহলে এখান থেকে এমন এক ভয়ানক ঝড়-তুফানের সৃষ্টি হবে, যা তােমাকে খড়-খুটার মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তাই তুমি যে ভাবে হােক এটাকে প্রতিরােধ করার চেষ্টা কর। যখন ইয়াজিদ এ খবর পেল, সে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হল। সে অজানা নয় যে, রাজ-ক্ষমতা বড় জিনিস। কেউ নিজ ক্ষমতা সহজে ত্যাগ করতে চায়না। আপ্রাণ চেষ্টা করে সেই ক্ষমতা, সেই সিংহাসন নিজ হাতে আঁকড়ে রাখতে চায়। তাই ইয়াজিদ এর কাছে যখন তার রাজত্ব হুমকির সম্মুখীন মনে হলাে, তখন কুফার গভর্ণর নুমান বিন বশীর’ যিনি হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিকার নেননি, তাকে পদচ্যুত করলাে এবং তার স্থলে ইবনে জিয়াদ, যার আসল নাম ছিল, উবায়দুল্লাহ যে বড় জালিম ও কঠোর ব্যক্তি ছিল এবং যে বসরার গভর্ণর ছিল, ওকে কুফার গভর্ণর নিয়ােগ করলাে। তার কাছে চিঠি লিখলাে- তুমি বসরার গভর্ণরও থাকবে, সাথে সাথে তােমাকে কুফারও গভর্ণর নিয়োগ করা হলাে। তুমি শীঘ্রই কুফা এসে আমার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছে, তা যে ভাবে হােক দমিয়ে ফেলাে। এ ব্যাপারে যা করতে হয়, তা করার জন্য তােমাকে পূর্ণ ইখতিয়ার দেয়া হলাে। যে ভাবেই হােক, যে ধরণের পদক্ষেপই নিতে হােক না কেন, এ বিদ্রোহকে নির্মূল করে দাও । ইবনে জিয়াদ ইয়াজিদ এর পক্ষ থেকে পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে কুফায় আসলাে। সে কি ভাবে কুফায় আসল, এর একটা দীর্ঘ কাহিনী আছে। সেই বিষয়ে এখানে আলােচনা করছিনা। সে কুফায় এসে সর্ব প্রথম যে কাজটি করল, তা হচ্ছে, যত বড় বড় সর্দার ছিল এবং যারা হযরত মুসলিম (رضي الله عنه) এর সাথে ছিল ও বায়াত গ্রহণ করেছিল, তাদের সবাইকে বন্দী করে ফেললাে এবং বন্দী করার পর কুফার গভর্ণর ভবনে নজরবন্দী করে রাখলাে। এ খবর বিদ্যুৎ বেগে সমগ্র কুফায় ছড়িয়ে পড়লাে এবং সমস্ত লােক হতভম্ব ও অস্থির হয়ে গেল, সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাে, এখন কি করা যায়। সমস্ত বড় বড় সর্দারকে বন্দী করে ফেলছে এবং ইমাম মুসলিমকে বন্দীর কৌশল নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে। ইমাম মুসলিম যখন দেখলেন যে, বড় বড় সর্দারদেরকে বন্দী করা হয়েছে এবং আরও নতুন নতুন লােক বন্দী করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন তিনি তাঁর সমস্ত অনুসারী ও বায়াত গ্রহণকারীদের আহবান করলেন। তাঁর ডাকের সাথে সাথে সবাই সাড়া দিল। ঐ চল্লিশ হাজার ব্যক্তি, যারা তাঁর হাতে বায়াত করেছিল, তারা সবাই সমবেত হলাে। তিনি এ চল্লিশ হাজার লােকদের হুকুম দিলেন- 'গভর্ণর ভবন ঘেরাও কর। হযরত মুসলিম (رضي الله عنه) এ চল্লিশ হাজার অনুসারীদেরকে নিয়ে গভর্ণর ভবন ঘেরাও করলেন। তখন অবস্থা এমন উত্তপ্ত ছিল যে, তিনি একটু ইশারা করলে এ চল্লিশ হাজার লােক এক মুহুর্তের মধ্যে গভর্ণর ভবন ধূলিস্যাৎ করে ফেলে এবং ইবনে জিয়াদ এর কোন প্রতিরােধ করতে পারতাে না।
কারণ, এ চল্লিশ হাজার লােকের মােকাবেলা করার ক্ষমতা তখন তার ছিল না এবং তখন তার কাছে এত সৈন্যও ছিল না। কিন্তু তকদিরে যা ছিল, তা খন্ডানাের কোন উপায় নেই, আল্লাহ তাআলার যা মঞ্জুর ছিল, তাতাে হবেই। চল্লিশ হাজার লােকের ঘেরাও অভিযান দেখে ইবনে জিয়াদ খুবই ভয় পেল। তবে সে বড় চালাকী ও ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিল। যে সব বড় বড় সর্দারদেরকে গভর্ণর ভবনে নজর বন্দী করে রাখা হয়েছিল, তাদের সবাইকে একত্রিত করে বলে, দেখুন,আপনারা যদি আপনাদের পরিবার-পরিজনের মঙ্গল চান, তাহলে আমার পক্ষ অবলম্বন করুন, আমার সাথে সহযােগিতা করুন। অন্যথায় আমি আপনাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিব এবং আপনাদের পরিবারের ও আপনাদের সন্তান-সন্ততিদের যে হাশর হবে, তা দুনিয়াবাসী দেখবে। বন্দী সর্দারেরা বললেন, "আপনি কি চান? কি ব্যাপারে আমাদের সহযােগিতা চান?’ ইবনে জিয়াদ বলল- যারা এ মুহুর্তে গভর্ণর ভবন ঘেরাও করে রেখেছে, তারা হয়তাে আপনাদের ছেলে হবে বা ভাই হবে বা অন্যান্য আত্মীয় স্বজন হবে। আমি এখন আপনাদেরকে গভর্ণর ভবনের ছাদের উপর নিয়ে যাচ্ছি; আপনারা নিজ নিজ আপনজনদেরকে ডেকে বুঝান, যেন তারা ঘেরাও প্রত্যাহার করে নেয় এবং হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এর সঙ্গ ত্যাগ করে। যদি আপনারা এই রকম না করেন, তা হলে সবার আগে আপনাদের হত্যা করার নির্দেশ দিব এবং অতি শীঘ্রই আমার যে সৈন্য বাহিনী আসতেছে, তারা কুফা আক্রমন করবে, আপনাদের ঘর বাড়ী জ্বালিয়ে দিবে, আপনাদের শিশুদের বর্শার অগ্রভাগে উঠাবে এবং ওদের যে পরিণাম বা হাশর হবে, তা দুনিয়াবাসী দেখবে। তাই আমি আপনাদেরকে বলছি- আমার পক্ষ অবলম্বন করুন, যদি নিজের এবং পরিবার পরিজনের মঙ্গল চান। এভাবে যখন সে হুমকি দিল, তখন বড় বড় সর্দারেরা ঘাবড়িয়ে গেল এবং সবাই বলতে লাগল, জনাব! আপনি যা করতে বলেন, আমরা তা করব। ইবনে জিয়াদ বলল, চলুন, ছাদে উঠুন এবং আমি যা বলছি, তা করুন। সর্দারেরা সাথে সাথে ছাদের উপর উঠলাে এবং নিজ নিজ আপনজনদেরকে ডাকতে লাগলাে। ডেকে চুপি চুপি বুঝাতে লাগলাে, দেখ! ক্ষমতা এখন ইয়াজিদের হাতে, সেনাবাহিনী ইয়াজিদ এর হাতে, অস্ত্র-সস্ত্র, ধন-সম্পদ ইয়াজিদের হাতে। হযরত ইমাম হােসাইন (رضي الله عنه) অবশ্যই রসুল (ﷺ) এর বংশধর। কিন্তু তাঁর (رضي الله عنه) কাছে না আছে রাজত্ব, না আছে সম্পদ, সৈন্য-সামন্ত, না অস্ত্র-শস্ত্র । তিনি (رضي الله عنه) সৈন্য-সামন্ত, অস্ত্র-শস্ত্র ও ধন-সম্পদ ব্যতিরেকে কি ভাবে ইয়াজিদের মােকাবিলা করবেন? মাঝখানে আমরা বিপদগ্রস্থ হব। এটা রাজনৈতিক ব্যাপার। তাই তােমরা এখন এ ঘেরাও উঠিয়ে নাও এবং হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এর সঙ্গ ছেড়ে দাও। স্মরণ রাখিও, তােমরা যদি এ রকম না কর, তা হলে না তােমরা আমাদের মুখ দেখবে আর না আমরা তােমাদের মুখ দেখবাে। আমাদেরকে এক্ষুনি কতল করে ফেলবে আর তােমাদের পরিনামও খুব ভয়াবহ হবে'।
যখন বড় বড় সর্দারেরা নিজ নিজ আপনজনদেরকে এ ভাবে বুঝাতে ও পরামর্শ দিতে লাগল, তখন লােকেরা অবরােধ ছেড়ে দিয়ে নীরবে চলে যেতে লাগল। দশ বিশজন করে এদিক ওদিক থেকে লােক চলে যেতে লাগল। হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) চল্লিশ হাজার লােক নিয়ে গভর্ণর ভবন ঘেরাও করেছিলেন কিন্তু আসরের পর মাগরিবের আগে মাত্র পাঁচশ জন লােক ছাড়া বাকী সব চলে গেল। এতে হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) খুবই মর্মাহত হলেন। তিনি (رضي الله عنه) বলেন, চল্লিশ হাজার লােক থেকে সাড়ে উনচল্লিশ হাজার চলে গেছে। কেবল পাঁচশ জন রয়ে গেল, তাদের উপরও বা কি করে আস্থা রাখা যায়। হযরত ইমাম মুসলিম যখন এ অবস্থা দেখলেন, তখন যে পাঁচশ জন রয়ে গেল, তাদেরকে বললেন, চলুন আমরা জামে মসজিদে গিয়ে মাগরিবের নামায আদায় করি । নামাযের পর পরামর্শ করব,কি করা যায়। সবাই বললেন, ঠিক আছে, চলুন। তিনি পাঁচশ জন লােককে নিয়ে মসজিদে গেলেন। তখন নামাযের সময় হয়ে গিয়েছিল, আযান হয়েছে। তিনি ইমাম হলেন। পাঁচশ জন পিছনে ইকতেদা করলেন। তিন রাকাত ফরয নামায পড়ার পর যখন সালাম ফিরালেন, তখন দেখলেন, ঐ পাঁচশ জনের মধ্যে কেউ নেই। আহ! সকালে চল্লিশ হাজার লােক সাথে ছিল, এখন একজনও নেই। এরা তারাই, যারা নিজেদেরকে আহলে বায়াতের একান্ত ভক্ত বলে দাবী করতাে, যাদের পূর্ব পুরুষেরা আহলে বায়াতের অনুসারী বলে দাবীদার ছিল। এরাই চিঠি লিখেছিল, এরাই হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে কুফায় আসার জন্য আহবান জানিয়েছিল, এরাই জান কুরবানের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। এরাই হযরত ইমাম মুসলিমের হাতে বায়াত করেছিল এবং বড় বড় শপথ করে ওয়াদা করেছিল যে, 'জান দেবে তবুও তাঁর (رضي الله عنه) সঙ্গ ত্যাগ করবে না। কিন্তু তাদের জানও দিতে হল না, তীর দ্বারা আহতও হতে হল না, গুলি বিদ্ধ হতে হল , কেবল ইবনে জিয়াদের ধমকেই তাঁর (رضي الله عنه) সঙ্গ ছেড়ে দিল এবং বিশ্বাসঘাতকতা করল। হযরত মুসলিম নামায শেষে আল্লাহ! আল্লাহ! করছিলেন এবং মনে মনে ভাবছিলেন, এখন কি করা যায়, সব লােকতাে আমাকে ছেড়ে চলে গেল। এ দিকে আমি হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে চিঠি লিখে দিয়েছি যে, এখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক। এখানকার লােকদের মনে তাঁর (رضي الله عنه) প্রতি আন্তরিক ও অসীম মহব্বত রয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাে এক মুহুর্তও বিলম্ব করবেন না। তিনি (رضي الله عنه) খুবই জলদি এসে যাবেন। তখন তাঁর (رضي الله عنه) কি যে প্রতিক্রিয়া হবে, যখন দেখবেন এ সব লােকেরা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকা করেছে। যা হােক তিনি (رضي الله عنه) মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজ মুরিদদের কাছে গেলেন। কিন্তু যেই মুরিদের কাছেই গেলেন, দেখলেন যে, ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ডাকাডাকি করার পরও ঘরের দরজা খুলে না।
হায়রে! যারা বড় বড় ওয়াদা করেছিল এবং আহলে বায়তের ভক্ত বলে দাবী করেছিল, তারা ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখল। হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) কুফার রাস্তায় এমন অসহায় অবস্থায় ঘুরতে লাগলেন, যেমন একজন সহায়-সম্বলহীন মুসাফির ঘুরাফিরা করে। তিনি (رضي الله عنه) বড় পেরেশানির সাথে অলি-গলিতে হাঁটতে লাগলেন। এ ভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় গিয়ে এক বৃদ্ধাকে দেখলেন, যিনি ঘরের দরজা খুলে বসেছিলেন। তিনি (رضي الله عنه) তার কাছে গিয়ে পানি চাইলেন। বৃদ্ধা পানি দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন- তিনি (رضي الله عنه) কে? কোথা থেকে আসছেন? কার সঙ্গে দেখা করবেন এবং কোথায় যাবেন? যখন বৃদ্ধা তাঁর (رضي الله عنه) অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন তিনি (رضي الله عنه) অকপটে বললেন, ওহে বােন! আমি মুসলিম বিন আকিল, হযরত হুসাইন বিন আলী (رضي الله عنه) এর প্রতিনিধি হয়ে কুফায় এসেছিলাম। মহিলাটি আশ্চর্য হয়ে বললেন, আপনি মুসলিম বিন আকিল! আপনি এ ভাবে অসহায়ভাবে ঘুরাফিরা করছেন! কুফার সবাই জানে যে, আপনার হাতে হাজার হাজার লােক বায়াত হয়েছে এবং সবাই আপনার জন্য জান-মাল কুরবান করতে প্রস্তুত। কিন্তু এখন আমি কি দেখছি! আপনি যে এ ভাবে অসহায়, একাকী ঘুরাফিরা করছেন! হযরত মুসলিম বিন আকিল (رضي الله عنه) বললেন- 'হা বোন। বাস্তবিকই তা ছিল। কিন্তু তারা আমার সাথে বেঈমানী করেছে। তাই আপনি আমাকে এই অবস্থায় দেখছেন। কুফার কোন ঘরের দরজা আজ আমার জন্য খােলা নেই, এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে আমি রাত্রি যাপন করতে পারি এবং আশ্রয় নিতে পারি। বৃদ্ধা বললেন, আমার গরীবালয় আপনার জন্য খােলা আছে, আমার জন্য এর থেকে বড় সৌভাগ্য আর কি হতে পারে যে, রসুলুল্লাহ (ﷺ) এর একজন আওলাদ আমার ঘরে মেহমান হয়েছেন। সেই বৃদ্ধাটি তাঁকে (رضي الله عنه) ঘরে জায়গা দিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি (رضي الله عنه) বুড়ীর ঘরে আশ্রয় নিলেন। সেখানে তিনি (رضي الله عنه) রাত যাপন করলেন। খােদার কুদরত! ঐ বুড়ীর এক ছেলে ছিল বড় নাফরমান। এটা খােদারই শান,নেককার থেকে বদকার এবং বদকার থেকে নেক্কার পয়দা হয়।
يُخْرِجُ الٍحَيَّ مِنَ الْمَيَّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيَّتَ مِنَ الْحَيِّ -
অর্থাৎ তিনি জিন্দা থেকে মুর্দা বাহির করেন এবং মুর্দা থেকে জিন্দা। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের ঘরে কাফির সৃষ্টি করেন এবং কাফিরদের ঘরে মুমিন। কাফিরের ঘরে লালিত খলিলুল্লাহ (আঃ) মুর্তি নিধনকারী হয়ে যায়। আবার নূহ (আঃ) এর ঘরে জন্ম ও লালিত পালিত হয়ে তাঁর ছেলে কাফির হয়ে যায়। ফেরাউনের স্ত্রী বেহেস্তের সর্দারণী হয়ে যায় আর হযরত লুত (আঃ) এর স্ত্রী হয়ে যায় কাফির। কোন এক কবি খুব সুন্দর বলেছেন
که زاده آذر خليل ال له بو - اور بیٹا نوح کا گمراه بو
اهلية لوط نبی بو کافره-اور زوجه فر عون ہوئی طاہره
অর্থাৎ ফেরাউনের ঘরে লালিত পালিত হযরত মুসা (আঃ) খলিলুল্লাহ হয়ে যান। আর নূহ (আলাইহিস সালাম) এর পুত্র হয়ে যায় গােমরাহ। লুত (আলাইহিস সালাম) এর স্ত্রী হয়ে যায় কাফেরা আর ফেরাউনের স্ত্রী হয়ে যায় তাহেরা (পবিত্র)। এটা খােদা তাআলারই শান, খােদার শানের অদ্ভুত প্রকাশ। তিনি মুমিনের ঘরে কাফির এবং কাফিরের ঘরে মুমিন সৃষ্টি করেন। তিনি বদ্বখতের ঘরে নেকবখত এবং নেকবখতের ঘরে বদবখ্ত পয়দা করেন । যিনি বেনিয়াজ, তিনি যা ইচ্ছে তা করতে পারেন- : يَفْعَلُ اللّٰهُ مَا يَشَاءُ , শেষ রাতে বুড়ীর ছেলে ঘরে আসল, মাকে পেরেশান দেখে জিজ্ঞাসা করল, মা, তুমি চিন্তিত কেন? মা বললেন, বেটা! মুসলিম বিন আকিল (رضي الله عنه) যিনি আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ) এর খানদানের একজন, তিনি (رضي الله عنه) কুফায় এসেছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর প্রতিনিধি হয়ে। কুফাবাসী তাঁর (رضي الله عنه) হাতে বায়াত করেছিল, তারা তাঁর (رضي الله عنه) সাথে সাথে থাকত এবং জান মাল কুরবানী করার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান গভর্ণরের ধমকীতে সবাই তাঁর (رضي الله عنه) সঙ্গ ত্যাগ করেছে এবং বেঈমানী করে তাঁর (رضي الله عنه) জন্য প্রত্যেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি অসহায় অবস্থায় অলি গলিতে ঘুরছিলেন। যাক, খােদা আমাকে সৌভাগ্যবান করেছেন, আজ তিনি আমার ঘরে মেহমান এবং আমার ঘরে অবস্থান করছেন। তিনি আজ আমার গরীবালয়ে কদম রেখেছেন। এর জন্য আমি আজ গর্ববােধ করছি যে, আমি তাঁর (رضي الله عنه) মেহমানদারীর সুযােগ লাভ করলাম। এই জন্য এক দিকে আজ আমি খুবই আনন্দিত আর অন্যদিকে আমি খুবই দুঃখিত, এই জন্য যে, কুফাবাসীরা একজন সম্মানিত মেহমানের সাথে এ ধরণের বেঈমানী করতে পারি। মা যখন এ সব ঘটনা বলছিল, ছেলে মনে মনে খুবই খুশী হল এবং মনে মনে বলতে লাগল শিকার হাতের মুঠোয়, এটাতাে বড় সৌভাগ্যের বিষয়। আমার মা'তাে একজন সাদাসিধে মহিলা। তিনি কি জানেন ইবনে জিয়াদের ঘােষণার কথা? ইবনে জিয়াদ তাে ঘােষণা করেছে, যে মুসলিম বিন আকিলকে গ্রেফতার করতে পারবে, তাকে এত হাজার দেরহাম পুরস্কার দেয়া হবে। যা হােক, তিনি যখন সৌভাগ্যবশতঃ আমার ঘরে এসে গেলেন, আমি খুবই সকালে গিয়ে খবর দিয়ে উনাকে আমার ঘর থেকে গ্রেফতার করাবো এবং হাজার দেরহাম পুরস্কার লাভ করব। ছেলের এই অসৎ উদ্দেশ্যে ও ইচ্ছা মার কাছে গােপন রাখলাে। এ দিকে সে অস্থির হয়ে পড়ল, কখন সকাল হবে, কখন খবর পৌছাবে এবং পুরস্কার লাভ করবে। ফজর হওয়া মাত্রই সে তার কয়েক জন বন্ধুদের সাথে নিয়ে ইবনে জিয়াদকে খবর দিল যে, হযরত মুসলিম (رضي الله عنه) ওর ঘরে, সে হল সংবাদদাতা এবং সে পুরস্কারের দাবীদার। ইবনে জিয়াদ বলল, তােমার পুরস্কার তুমি নিশ্চয় পাবে, প্রথমে ওনাকে গ্রেফতার করার ব্যবস্থা কর। সে বলল, ঠিক আছে, আমার সাথে সৈন্য পাঠিয়ে দিন। তার কথামত তার সাথে সত্তরজন সৈন্য গেল এবং সেই মহিলাটির ঘর চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলল । হযরত মুসলিম (رضي الله عنه) অবস্থা বেগতিক দেখে তলােয়ার নিয়ে বের হলে সৈন্যরা জঘন্যভাবে বেয়াদবী করল এবং এমন ভাষা উচ্চারণ করল, যা মােটেই সহনীয় নয়। ওরা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর কঠোর সমালােচনা করলাে এবং ইয়াজিদের প্রশংসা করলাে। আর তাঁর (رضي الله عنه) বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযােগ আনল। হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এ সবের যথার্থ উত্তর দিলেন। কিন্তু ইত্যবসরে ওরা তীর নিক্ষেপ করল। হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) বললেন, যদি আলােচনা করতে চাও তাহলে বুদ্ধিমত্তার সহিত আলােচনা কর । আর যদি তীর নিক্ষেপ করার ইচ্ছা করাে, আমিও এর যথােচিত জবাব দেব। ওরা বলল, ঠিক আছে শক্তি থাকলে জবাব দিন। তাদের কথা শুনে হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) তাদের সামনা-সামনি এসে গেলেন এবং তলােয়ার চালাতে শুরু করলেন। তিনি একাই সত্তরজনের সাথে মােকাবিলা করতে লাগলেন আর এ দিকে ওরা তাঁর (رضي الله عنه) বীর বিক্রম আক্রমণে হতভম্ভ হয়ে গেল এবং তারা মনে মনে বলল, আমরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে ভুল করলাম। তাঁর (رضي الله عنه) সুনিপূণ তলােয়ার চালনার সামনে ওরা টিকতে না পেরে পিছ পা হল। তবুও তিনি কয়েক জনকে হত্যা করতে সক্ষম হলেন এবং অনেককে আহত করলেন। এই অবস্থায় তিনি নিজেও আহত হলেন। একটা তীরের আঘাতে তাঁর (رضي الله عنه) সামনের একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল এবং রক্ত বের হচ্ছিল। তিনি বৃদ্ধার কাছে পানি চাইলেন। বৃদ্ধা তাঁকে (رضي الله عنه) পান করার জন্য এক গ্লাস পানি দিলেন। যখন তিনি পানি মুখে নিলেন, তখন সেই পানি মুখের রক্তে লাল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনি পানি পান করলেন না। গ্লাসটা মাটিতে রেখে তিনি মনে মনে বললেন, হয়তঃ দুনিয়ার পানি আমার কপালে আর নেই। আমি জান্নাতুল ফেরদাউসে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করব। অত:পর হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) পুনরায় লড়তে শুরু করলেন। এ খবর যখন ইবনে জিয়াদের কাছে পৌছল তখন সে মুহাম্মদ বিন আশআসকে পাঠালাে এবং তাকে বলল, তুমি গিয়ে কুটনৈতিক ও রাজনৈতিক পন্থায় তাঁকে (رضي الله عنه) বন্দী করে আমার কাছে নিয়ে এসাে। ইবনে আশআস হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এর কাছে এসে বলল, ওরা আসলে বােকামী করেছে। ওদেরকে ইবনে জিয়াদ মােকাবিলা বা লড়াই করার জন্য পাঠায়নি। তাদেরকে পাঠানাে হয়েছিল আপনাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনি আমার সাথে গভর্ণর ভবনে চলুন। আপনি গভর্ণরের সাথে কথা বলুন, তিনি আপনার সাথে মত বিনিময় করতে চান। কারণ কয়েক দিনের মধ্যে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)ও কুফায় এসে পৌছবেন। তাই তিনি চাচ্ছেন, এ সময়ে যেন কোন ফিতনা ফ্যাসাদের সৃষ্টি না হয়। গভর্ণরের কাছে চলুন, কথাবার্তার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হােন। মত বিনিময়ের মাধ্যমে হয়ত বন্ধু হয়ে যেতে পারে। হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) বললেন, আমি তো তাই চাচ্ছি। তা না হলে আমি যখন চল্লিশ হাজার সমর্থক নিয়ে গভর্ণর ভবন ঘেরাও করেছিলাম, তখন আমার একটু ইশারায় গভর্ণর ভবন তছনছ হয়ে যেতাে এবং ইবনে জিয়াদকে গ্রেফতার করা কোন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু আমি এটা নিজে পছন্দ করি না যে, মারামারি বা খুন-খারাবী হােক। মুহাম্মদ বিন 'আশ আস' বলল, আমার সাথে চলুন, সৈন্যদেরকে ধমকের সুরে বলল, তলােয়ার খােলা রেখেছ কেন? বেকুবের দল কোথাকার,তলােয়ার খাপের মধ্যে ভরে রেখ। এ ভাবে ওদেরকে ধমক দিল আর উনাকে (رضي الله عنه) নিয়ে গেল। হযরত মুসলিম তার সাথে গেলেন এবং গভর্ণর ভবনে প্রবেশ করার সময় এই দুআটি পড়লেন-
رَبَّنَا اَفْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمَنَا بِالْحَقِّ وَاَنْتَ خَيْرُ الْفَاتِحِيْنَ -
এই দুআটি পড়তে পড়তে তিনি (رضي الله عنه) গভর্ণর ভবনের শাহী দরজায় প্রবেশ করলেন। এ দিকে ইবনে জিয়াদ উন্মুক্ত তলােয়ারদারী কিছু সিপাহীকে দরজার দু'পাশে নিয়ােজিত করে রেখেছিল এবং তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করা মাত্রই দু'দিক থেকে আক্রমণ করে যেন হত্যা করা হয়। নির্দেশ মত যখনই তিনি (رضي الله عنه) গভর্ণর ভবনের দরজায় পা রাখলেন, তখনই তাঁর (رضي الله عنه) উপর দু'দিক থেকে তলােয়ার দ্বারা আক্রমন করা হল এবং সেখানেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।)
কতেক উলামায়ে কিরাম তাদের কিতাবে লিখেছেন যে, তিনি (رضي الله عنه) যথারীতি ইবনে জিয়াদের কাছে পৌছেন এবং আলােচনা করেন। ইবনে জিয়াদ হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) কে বলল, দেখুন, আপনি বড় অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন। তথাপি একটি শর্তে আমি আপনাকে রেহাই দিতে পারি। শর্তটি হচ্ছে, আপনি ইয়াজিদের বায়াত গ্রহণ করুন এবং প্রতিশ্রুতি দিন যে, যখন হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) আসবেন, তাঁকেও ইয়াজিদের বায়াত করিয়ে দিবেন। এতে সম্মত হলে আপনাকে আমি মুক্তি দিতে পারি। অন্যথায় আপনার ও হযরত হুসাইন ইবনে আলী (رضي الله عنه) এর কোন নিস্তার নেই। হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) উত্তরে বললেন, 'প্রস্তাব মন্দ নয়, তবে আমি কিংবা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ইয়াজিদের হাতে বায়াত করতে পারি না। এটা কখনাে কল্পনাও করা যায় না যে, আমরা ইয়াজিদের কাছে বায়াত হবাে। তাই তােমার যা ইচ্ছা তা করতে পার। ইবনে জিয়াদ পুনরায় বলল, যদি আপনি বায়াত গ্রহণ না করেন ও ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে বায়াত করার ব্যবস্থা করেন, তাহলে আমি আপনাকে হত্যা করার নির্দেশ দিব। হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) দৃঢ়কণ্ঠে বললেন- 'তোমার যা ইচ্ছে তাই করতে পার। ইবনে জিয়াদ জল্লাদদেরকে নির্দেশ দিল উনাকে গভর্ণর ভবনের ছাদের উপর নিয়ে গিয়ে কতল করে দাও এবং মাথা কেটে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও আর দেহকে রশি বেধে বাজারে হেঁচড়াও যাতে হাড় চুরমার হয়ে যায় এবং লােকেরা যেন এই দৃশ্য অবলােকন করে। জল্লাদদেরকে হুকুম করার পর, ওরা যখন তাঁকে (رضي الله عنه) ধরতে আসল, তখন হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) দেখলেন যে, গভর্ণর ভবনের চারিদিকে লােকে লােকারণ্য। তারা সব এসেছে তামাশা দেখার জন্য। কিন্তু আফসােস! এদের মধ্যে এমন অনেক লােক এসেছে যারা হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এর হাতে বায়াত গ্রহন করেছিল, যারা চিঠি লিখে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে কুফা আসার আমন্ত্রন জানিয়েছিল। হযরত ইমাম মুসলিম(رضي الله عنه) ওদেরকে দেখে বললেন, 'ওহে কুফাবাসীরা! তােমরা বেঈমানী করেছ, তা সত্ত্বেও আমি তােমাদেরকে তিনটি কাজের দায়িত্ব দিচ্ছি। যদি পার, এই তিনটি কাজ তােমরা নিশ্চয় করবে। প্রথম কাজ হচ্ছে, আমার কাছে যে হাতিয়ারগুলাে আছে, এ গুলাে বিক্রি করে টাকা গুলাে অমুক অমুককে দিও। কারণ, আমি ওদের কাছে ঋণী। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, যখন আমার মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে এবং আমার লাশ বাইরে নিক্ষেপ করবে, তােমরা আমার লাশটি যথাস্থানে দাফন করিও। তৃতীয় কাজ হচ্ছে, যদি তােমাদের কাছে এক তিল পরিমাণও ঈমান থাকে এবং আহলে বায়তের প্রতি এক কণা পরিমাণও মহব্বত থাকে, তাহলে যে কোন উপায়ে তােমরা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর কাছে এ সংবাদ পৌছে দিও, যেন তিনি কুফায় তশরীফ না আনেন।
ইহা শুনে ইবনে জিয়াদ খুবই রাগান্বিত হল এবং চারিদিকে ঘুরে সবাইকে বলল, খবরদার! 'যারা মুসলিমের এ সব কথামত কাজ করবে, আমি তাদেরকে কতল করবে এবং তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে বর্শার অগ্রভাগে উঠাবাে, যাতে কেউ যেন মুসলিমের কথা অনুসরণ করতে না পারে এবং হযরত ইমাম মুসলিমকে লক্ষ্য করে বলল- আমি আপনার হাতিয়ারগুলাে আমাদের মুজাহিদ বাহিনীর মধ্যে বন্টন করব এবং আপনার লাশকে দাফন করতে দেব না। বরং কুফার অলিতে-গলিতে ঘুরাবাে এবং জনগণকে দেখাবে। তাই যারা আমার পক্ষ অবলম্বন করবে, তারা যেন মুসলিমের কোন কথা না শুনে। আর হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) কে খবর দেওয়া থেকে বাধা দেয়ার কারণ হল, তাঁকে (رضي الله عنه) এখানে আনা চাই এবং তাঁকেও বিদ্রোহীতার স্বাদ উপভােগ করাতে চাই। ইবনে জিয়াদের এ দম্ভোক্তি শুনে ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) অস্থির হয়ে উঠলেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর পরিণতির কথা চিন্তা করে ও কুফাবাসীর বিশ্বাস-ঘাতকতার কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। এমনি সময়ে জল্লাদেরা তাঁকে ধরে ছাদের এক কিনারে নিয়ে গেল। তিনি তাদের কাছে দুই রাকাত নফল নামায পড়ার অবকাশ চাইলেন। কিন্তু তারা সেই সুযােগটাও দিল না। তিনি অশ্রু সজল নয়নে মক্কা-মদীনার দিকে তাকায়ে বললেন, ওহে আমার মওলা হুসাইন! আমার এই অবস্থার খবর আপনাকে কে পৌছাবে, আমার সাথে কী যে নির্মম আচরণ করা হচ্ছে। হায়রে! আমি যদি আপাকে চিঠি না লিখতাম এবং কুফার অবস্থা সন্তোষজনক না জানাতাম, তাহলে আপনি এখানে কখনো আসতেন না। কুফাবাসীরা আজ আমার সাথে কিভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করলাে, জানিনা আপনার সাথে কি ধরণের আচরণ করবে এবং আপনার কি হাশর হবে। তিনি এ সব চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এদিকে জল্লাদেরা তাঁকে ছাদে শােয়ায়ে শরীর থেকে মস্তক মুবারক বিচ্ছিন্ন করে ফেলল।
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর কুফা যাত্রা
খােদার কীযে লীলা! যে দিন হযরত মুসলিম কুফায় শহীদ হলেন, সে দিন হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) প্রিয়জন ও আপনজনদের নিয়ে মক্কা শরীফ থেকে যাত্রা করলেন। কারণ, উনার কাছে চিঠি পৌছেছিল যে, কুফার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক, তিনি যেন বিনা দ্বিধায় অনতিবিলম্বে তশরীফ নিয়ে আসেন। তিনি তাঁর (رضي الله عنه) বিবিগণ, বােন, ছেলেমেয়ে এমনকি দুগ্ধপােষ্য শিশুর সঙ্গে নিলেন এবং মক্কা মুকাররমা থেকে বের হলেন। উলামায়ে কিরাম লিখেছেন যে, তার (رضي الله عنه) কাফেলায় তিরাশিজন ছিল, যাদের মধ্যে মহিলা, দুগ্ধপােষ্য শিশুর ছিল। তাঁর (رضي الله عنه) সঙ্গে কয়েকজন যুবক বন্ধু-বান্ধবও ছিল। আল্লাহ! আল্লাহ! এখানে একটি কথা বিশেষভাবে স্মরনীয় যে, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কিংবা মােকাবিলা করার উদ্দেশ্যে বের হন নি। আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে যারা যুদ্ধ বা মােকাবিলা করার উদ্দেশ্যে বের হয়, তারা কখনাে মেয়ে লোক ও দুগ্ধপােষ্য শিশুদের নিয়ে বের হয় না। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর নিজের বিবি ও দুগ্ধপােষ্য শিশুদের নিয়ে বের হওয়াটা এটাই প্রমাণিত করে যে, তিনি যুদ্ধ কিংবা মােকাবিলার উদ্দেশ্যে বের হননি। তাঁর (رضي الله عنه) কাছে তাে চিঠি এসেছে যে, সেখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক, চল্লিশ হাজার লােক বায়াত করেছে, কুফাবাসীরা দারুণ মেহমানদারী করছে। তাই তিনি তাঁর আপন জনদের নিয়ে বের হয়েছেন এবং যুদ্ধ করার কোন অস্ত্র শস্ত্র রাখেননি। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) মক্কা শরীফ থেকে কুফার উদ্দেশ্যে বের হয়ে কিছু দূর যাবার পর পথে তিনি হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এর শাহাদাত বরণের খবর পেলেন। হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এর শাহাদাতের খবর শুনে তিনি এবং তাঁর সফরসঙ্গীগণ একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। কোথা থেকে কি হয়ে গেল। মাত্র কয়েকদিন আগে হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এর চিঠি আসলে, কুফার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক অথচ এখন শুনছি তাকে শহীদ করে ফেলেছে। এটা কি ধরণের ঘটনা! যা হােক, তাঁরা পিছপা হলেন না, সম্মুখপানে অগ্রসর হলেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত হল, ওখানে যাওয়া যাক এবং কি ভাবে এত তাড়াতাড়ি এ ধরণের ঘটনা ঘটে গেল, তা জানা দরকার। এ মনােভাব নিয়ে তাঁরা কুফার দিকে ধাবিত হলেন।
কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু
কুফা থেকে দুই মঞ্জিল দূরত্বে কারবালার প্রান্তরে যখন তারা পৌছলেন, তখন হুর বিন ইয়াজিদ রিয়াহী এক হাজার সৈন্য নিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর সাথে মােলাকাত করলেন এবং বললেন
- জনাব ইমামে আ'লা (رضي الله عنه)! আমি আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য এসেছি। তিনি (رضي الله عنه) জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? সে বললাে, তা আমি জানিনা, তবে কুফার গভর্ণর ইবনে জিয়াদ নির্দেশ দিয়েছে আপনাকে যেখানে পাওয়া যায়, গ্রেফতার করে তাঁর কাছে যেন পৌছে দেয়া হয়। তিনি (رضي الله عنه) ফরমালেন, আমার কি অপরাধ? সে বলল, আপনি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, ইয়াজিদের বিরুদ্ধে এখানে জনগনের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছেন এবং জনগণের বায়াত গ্রহণ করেছেন। তিনি (رضي الله عنه) বললেন- আমি তাে কোনজনকে অসন্তোষ সৃষ্টি করিনি এবং ক্ষমতা দখলেরও কোন ইচ্ছা আমার নেই। আসল কথা হলাে, কুফাবাসী আমার কাছে চিঠি লিখেছে, যার ফলে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে আমি এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি। তবে যদি কুফাবাসী বেঈমানী করে এবং অবস্থার যদি পরিবর্তন হয়, তা হলে আমি ফিরে যেতে রাজি আছি। যখন হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) হুরের সঙ্গে আলােচনা করলেন এবং হুরকে সমস্ত বিষয় অবহিত করালেন, তখন সে খুবই দুঃখিত হল। হুর বলল, এই মূহুর্তে যদি আমি আপনাকে চলে যেতে দিই, আমার সঙ্গী সাথীদের মধ্যে কেউ নিশ্চয় ইবনে জিয়াদের কাছে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযােগ করবে এবং ইবনে জিয়াদ আমার উপর জুলুম করবে। সে বলবে তুমি জেনে শুনে দুশমনকে ছেড়ে দিয়েছ, আপােষে যাওয়ার সুযােগ করে দিয়েছ। ফলে আমার উপর মুসিবতের পাহাড় নাযিল হবে। তাই আপনি একটা কাজ করতে পারেন- এ ভাবে আমার সঙ্গে সারাদিন কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকেন, যখন রাত হবে আমার সৈন্যরা শুয়ে পড়বে এবং চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসবে, তখন আপনি আপনার আপনজনদের নিয়ে এখান থেকে চলে যাবেন। সকালে আমরা আপনাকে খোঁজ করব না, আপনার পিছু নেব না। সােজা ইবনে জিয়াদের কাছে গিয়ে বলব, উনি রাতের অন্ধকারে আমাদের অজান্তে চলে গেছেন এবং উনি কোন্ দিকে গেছেন কোন হদিস পাইনি। এরপর যা হওয়ার আছে, তাই হবে। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, ঠিক আছে। যখন রাত হল, চারিদিকে অন্ধকার ঘণীভূত হয়ে আসল এবং সৈন্যরা ঘুমিয়ে পড়ল, তখন হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) নিজের সঙ্গী সাথীদেরকে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। সবাই বের হয়ে গেলেন। সারা রাত হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর কাফেলা পথ চললাে, কিন্তু ভােরে তারা তাদেরকে ঐ জায়গাতেই দেখতে পেলেন, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। এই অবস্থা দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল, এটা কেমনে হলাে! আমরা সারা রাত পথ চললাম, কিন্তু সকালে আবার একই জায়গায়। এ কেমন কথা! হুর তাঁদেরকে দেখে জিজ্ঞাসা করলাে, আপনারা কি যাননি? ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, আমরা ঠিকই চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু যাওয়ার পরওতাে যেতে পারলাম না, দিক হারা হয়ে আবার একই জায়গায় ফিরে আসলাম। হুর বলল, ঠিক আছে, চিন্তার কিছু নেই। আজ আমরা পুনরায় দিন ভর আলােচনা করতে থাকব এবং আমার সৈন্যদেরকে বলব, আমাদের মধ্যে এখনও কোন ফয়সালা হয়নি, আলােচনা অব্যাহত রয়েছে। আজ রাত্রেই আপনি চলে যাবেন। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) দ্বিতীয় রাত্রিতেও সঙ্গী সাথীদেরকে নিয়ে বের হলেন। সারা রাত তিনি ও তাঁর সফরসঙ্গীগণ পথ চললেন। ভাের যখন হল, তখন পুনরায় তারা তাদেরকে সেই একই জায়গায় পেলেন, যেখান থেকে তাঁরা বের হয়েছিলেন। উপর্যুপরি তিন রাত এ রকম হল। সারা রাত তাঁরা পথ চলতেন, কিন্তু ভাের হতেই তাঁদেরকে ঐ জায়গায় পেতেন, যেখান থেকে তারা বের হতেন। চতুর্থ দিন জনৈক পথিক তাদের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিল, তিনি (رضي الله عنه) ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই, যে জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এই জায়গাটার নাম কি? লােকটি বললাে, জনাব! এই জায়গাটার নাম কারবালা'। কারবালা শব্দটি শুনার সাথে সাথেই হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) আঁতকে উঠলেন এবং বললেন, আমার নানাজান (ﷺ) ঠিকই বলেছেন, 'হোসাইন কারবালার ময়দানে শহীদ হবে। এটা আমার শাহাদাতের স্থান। আমি এখান থেকে কি ভাবে চলে যেতে পারি। উপর্যুপরি তিন রাত্রি প্রস্থান করার পর পুনরায় একই জায়গায় প্রত্যাবর্তন এ কথাই প্রমাণিত করে যে, এটা আমার শাহাদাতের স্থান। এখান থেকে আমি কিছুতেই বের হতে পারব না। তিনি তাঁর প্রিয়জনদের বললেন, 'সওয়ারী থেকে অবতরণ করে তাঁবু খাটাও। নির্দেশ মত তাঁর (رضي الله عنه) সাথীরা সওয়ারী থেকে অবতরণ করে তাঁবু খাটাতে শুরু করলেন। কিন্তু যেখানেই তাঁবুর খুটি পুঁততে গেলেন, সেখান থেকে টাটকা রক্ত বের হলাে। এই দৃশ্য দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) যখন দেখলেন যে, মাটিতে যেখানেই খুঁটি পুঁততে চাইলেন, সেখান থেকে রক্ত বের হয়ে আসছে, তখন হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) কে বললেন, প্রিয় ভাই জান! চল, আমরা এখান থেকে সরে যাই। এই রক্তাক্ত ভূমি দেখে আমার খুব ভয় করছে, আমার খুবই খারাপ লাগছে। এই রক্ত ভুমিতে অবস্থান করােনা। চল, আমরা এখান থেকে অন্যত্র চলে যাই। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, ওগাে আমার প্রাণ প্রিয় বােন! এখান থেকে আমি বের হতে পারব না। এটা আমার শাহাদাত গাহ'। এখানেই আমাকে শাহাদাত বরণ করতে হবে। এখানেই আমাদের রক্তের নদী প্রবাহিত হবে। এটা সেই ভূমি, যেটা আহলে মুস্তাফা (ﷺ) এর রক্তে রঞ্জিত হবে। এটাই সেই জায়গা, যেখানে ফাতেমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর বাগানের বেহেস্তী ফুল টুকরাে টুকরাে হয়ে পতিত হবে এবং তাঁদের রক্তে এই ভূমি লালে লাল হয়ে যাবে। তাই সবাই অবতরণ কর, সবর, ধৈর্য এবং সাহসের সাথে তাঁবুতে অবস্থান কর। আমরা এখান থেকে কখনও যেতে পারব না। এখানেই আমাদেরকে ধৈর্য ও সাহসিকতার পরাকাষ্টা দেখাতে হবে এবং এখানেই শাহাদাত বরণ করতে হবে। মােট কথা হলাে, মদীনাবাসী মদীনা থেকে মক্কায় গিয়েছিলেন এবং মক্কা থেকে বের হয়ে কারবালায় এসে গেছেন। তকদির তাঁদেরকে কারবালায় নিয়ে এসেছে। কেননা কিয়ামত পর্যন্ত সবাই যেন তাদের কারবালাবাসী বলে অভিহিত করেন। যা হােক, তাঁবু খাটিয়ে তারা কারবালায় অবস্থান নিলেন।
তাঁর (رضي الله عنه) অবস্থান নেওয়ার পর থেকে ইবনে জিয়াদ ও ইয়াজিদের পক্ষ থেকে দলের পর দল সৈন্যবাহিনী আসতে থাকে। যেই দলই আসে, ইয়াজিদের পক্ষ থেকে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর কাছে এ নির্দেশটাই নিয়ে আসে হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) কে গিয়ে বল যেন ইয়াজিদের বায়াত গ্রহণ করেন। যদি তিনি বায়াত গ্রহণ করতে রাজী হন, তখন তাঁকে কিছু বলােনা, তাঁকে ধরে আমার কাছে নিয়ে এস, আর যদি বায়াত করতে অস্বীকার করে, তখন তাঁর সাথে যুদ্ধ কর
এবং তাঁর মস্তক কর্তন করে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।' এ ভাবে সৈন্য বাহিনীর যেই দলটিই আসলাে, একই হুকুম নিয়ে আসলাে। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, এটাতাে হতেই পারে না যে, আমি ইয়াজিদের হাতে বায়াত করি । আফসােসের বিষয়, আমাকে আহবান করা হয়েছে, আমার হাতে বায়াত গ্রহণ করার জন্য, আর এখন আমাকে বাধ্য করা হচ্ছে ইয়াজিদের হাতে বায়াত করার জন্য। এই বায়াত না করার জন্যইতাে আমি মদীনা ছেড়ে মক্কা চলে গিয়েছিলাম। তাহলে কি আমি এখন মক্কা থেকে এখানে এসেছি ইয়াজিদের হাতে বায়াত হওয়ার জন্য? এটা কিছুতেই হতে পারে না। আমি ইয়াজিদের হাতে কখনো বাইয়াত করব না। ওরা বলল, আপনি যদি ইয়াজিদের হাতে বায়াত করতে রাজী না হন, হা হলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। তিনি (رضي الله عنه) বললেন, আমিতাে যুদ্ধের জন্যও আসিনি। যুদ্ধের কোন ইচ্ছাও পােষণ করিনা। ওরা বলল, এ রকমতাে কিছুতেই হতে পারে না, হয়তাে বায়াত করতে হবে, নতুবা যুদ্ধ করতে হবে। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) যখন দেখলেন, এদের উদ্দেশ্য খুবই খারাপ, অবস্থা খুবই সঙ্গীন রূপ ধারণ করছে, তখন তিনি তাদের সামনে তিনটি শর্ত পেশ করলেন। তিনি (رضي الله عنه) বললেন, 'শুন! কুফাবাসীরা আমার কাছে চিঠি লিখেছে এবং চিঠিতে এমন কথা লিখা ছিল, যার জন্য শরীয়ত মতে আমি এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি। এখন যখন তারা বেঈমানী করেছে, আমি তােমাদের সামনে তিনটা শর্ত পেশ করছি; তােমাদের যেটা ইচ্ছা সেটা গ্রহণ কর এবং সেই অনুসারে কার্য সম্পাদন কর। শর্তগুলাে- (১) হয়তাে আমাকে মক্কায় চলে যেতে দাও। সেখানে গিয়ে হেরেম শরীফে অবস্থান করে ইবাদত বন্দেগীতে নিয়ােজিত থেকে বাকী জীবনটা অতিবাহিত করব। (২) যদি মক্কায় যেতে না দাও, তা হলে অন্য কোন দেশে যাওয়ার সুযােগ দাও, যেখানে কাফির বা মুশরিকরা বসবাস করে। ঐখানে আমি আমার সমস্ত জীবন দ্বীনের তাবলীগে ব্যয় করব এবং ওদেরকে মুসলমান বানানাের প্রচেষ্টা চালাতে থাকব। আর (৩) যদি অন্য কোন দেশে যেতে না দাও, তা হলে এমন করতে পার যে আমাকে ইয়াজিদের কাছে নিয়ে চল। আমি তার সাথে বসে আলােচনা করব । হয়তাে কোন সন্ধি হয়ে যেতে পারে, এই নাজুক অবস্থার উন্নতিও হতে পারে এবং রক্তপাতের সম্ভাবনাও দূরীভূত হতে পারে। ইয়াজিদ বাহিনী এ তিনটি শর্ত কুফার গভর্নর ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দিল। সে এ শর্তগুলোর কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল এবং আমর বিন সাদ, যিনি সেনাপতি ছিল, তাকে লিখল যে, আমি তােমাকে সালিশকার বা বিচারক বানিয়ে পাঠাইনি যে, তুমি আমার এবং হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) এর মধ্যে সন্ধি করার ব্যবস্থা করবে; আমি তােমাকে পাঠিয়েছি হুসাইন (رضي الله عنه) কে বায়াত করতে বলার জন্য অথবা তার সাথে যুদ্ধ করে তাঁর মস্তক আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। অথচ তুমি সন্ধির চিন্তা ভাবনা করছ এবং এর জন্য বিভিন্ন তদবীর করছ। আমি আবার তােমাকে শেষবারের মত নির্দেশ দিচ্ছি, ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) যদি বায়াত করতে অস্বীকার করেন, তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ কর এবং তাঁর মস্তক কেটে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। যখন ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে এই নির্দেশের কথা শুনানাে হল, তখন তিনি (رضي الله عنه) বললেন, 'আমার পক্ষ থেকে যা প্রমাণ করার ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে এবং যা বলার ছিল তা বলা হয়েছে। এখন তােমাদের যা মর্জি তাই কর। আমি ইয়াজিদের হাতে বায়াত কিছুতেই করব না। ওরা বলল, তা হলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হােন। তিনি (رضي الله عنه) বললেন, তোমাদের পক্ষ থেকে যা করার তােমরা করো। আমার পক্ষ থেকে যা করার আমি করব।
অবরােধ সৃষ্টি ও পানি বন্ধ
ওদের চিন্তাধারা এত জঘন্য রূপ ধারণ করল যে, সাতই মুহররম থেকে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ও তাঁর প্রিয় জনদের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দিল। প্রায় চার হাজার সৈন্য ফোরাত নদীর তীরে এই কাজে নিয়ােজিত করল। এদের মধ্যে দুই হাজার ছিল স্থল বাহিনী আর দুই হাজার ছিল অশ্বারােহী'। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, উনাদেরকে যেন এক ফোঁটা পানিও নিতে দেয়া না হয়। সে মতে পানি বন্ধ করে দিল। ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর তিরাশিজন কাফেলার মধ্যে দুগ্ধপােষ্য শিশু ছিল এবং পর্দানশীন মহিলাও ছিলেন। তাদের মােকাবিলা করার জন্য বাইশ হাজার সৈন্য এসেছে। কী আশ্চর্য! তিরাশিজনের মােকাবিলায় বাইশ হাজার সৈন্য! আবার এই তিরাশিজনের মধ্যে শিশু ও মহিলা রয়েছে। অথচ এদের মােকাবিলায় যে বাইশ হাজার সৈন্য, তারা সবাই যুবক এবং সকল প্রকারের অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত। এরপরও তারা পানি বন্ধ করে দিল। কারণ তাদের ধারণা, উনারা যদি পানি পান করে যুদ্ধ করে, তাহলে সম্ভবতঃ আমরা বাইশ হাজার হয়েও মােকাবিলা করে কামিয়াব হতে পারব না। তাই পানি বন্ধ করে দিল। এটা জুলুমের উপর জুলুম ছিল। আফসোস! আপনার জন্যই পানি বন্ধ করে দিল, যিনি সাকিয়ে কাওছার (ﷺ) এর দৌহিত্র। কোন এক উর্দু কবি এ প্রসঙ্গে খুবই সুন্দর একটি কবিতা লিখেছেন
حاکم کا یه حکم تها که پانی بشرپیئر
گھوڑے پیئر اونٹ پیئ اہل ہنر پیئر
سب پیئ چر ندے پرندے پئیں منع تم نه کيجيو
مگر ایك فاطمه (رض) کے لال کو پانی نه ديجيؤ
অর্থাৎ হাকিমের নির্দেশ ছিল মানুষ, জীব-জন্তু, গরু-ছাগল, পশু-পাখি সবাই এই নদীর পানি পান করবে, তােমরা বাধা দিও না। কিন্তু হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর এই ছেলেকে পানি পান করতে দিও না। যেই ফোরাত নদীর' পানি সবার পান করার অনুমতি ছিল, জীব-জন্তু, পশু-পাখি কারাে জন্য বাধা ছিল না, কিন্তু সেই ফোরাত নদীর পানি পান করা থেকে বাঁধা দিল সাকিয়ে কাওছার (ﷺ) এর দৌহিত্রকে।
ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর আকুল আহবান
আল্লাহ! আল্লাহ! যখন হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) দেখলেন যে, পানিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি ঘােড়ায় সওয়ার হয়ে ইয়াজিদের সৈন্য বাহিনীর নিকট গেলেন এবং তাদের সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। তিনি (رضي الله عنه) তাদেরকে একান্ত যুক্তির মাধ্যমে বুঝালেন, 'জুলুম অত্যাচার থেকে বিরত থেকো, আমাদের রক্ত দ্বারা তােমাদের হাতকে রঞ্জিত করােনা। জেনে শুনে কোন মুমিনকে হত্যা করা মানে জাহান্নামকে নিজের ঠিকানায় পরিণত করা। আমি হলাম তােমাদের রাসূল (ﷺ) এর দৌহিত্র, যার কলেমা তােমরা পড়। আর এই মূহুর্তে আমি ছাড়া তােমাদের রাসুল (ﷺ) এর অন্য কোন দৌহিত্র নেই। আর আমার সম্পর্কে তােমরা ভাল মতে জান। আমি ঐ হুসাইন, যার সম্পর্কে নবী করিম (ﷺ) এরশাদ করেছেন
اَلْحَسَنْ واَلْحُسَيْنُ سَيَّدًا شَبَابِ اَهْلِ الْجَنَّةِ -
অর্থাৎ হাসান-হোসাইন বেহেস্তের নওজোয়ানদের সর্দার। আমি সেই হুসাইন, যখন নিজ মায়ের কোলে .. ক্রন্দন করতাম, তখন আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (ﷺ) বলতেন, ওগাে ফাতিমা! ওকে কাদাইওনা। কারণ ও কাঁদলে আমার খুবই কষ্ট হয়। দেখ, যখন প্রিয়. আপন মায়ের কোলে আমার কান্নাটা নবীজী (ﷺ) এর জন্য কষ্টদায়ক ছিল, এখন তােমরা যদি আমাকে ভিন দেশে কষ্ট দাও এবং আমার রক্ত দ্বারা তােমাদের হাতকে রঞ্জিত কর, আমার ছেলে মেয়েদেরকে শােকাভিভূত কর, তাহলে কল্পনা করে দেখ, নবীজী (ﷺ) কী রকম কষ্ট পাবেন! আর যে রসুল (ﷺ) কে কষ্ট দেবে, ওর পরিণাম সম্পর্কে তােমরা. পবিত্র কুরআনেই পড়েছ
إن الذين يؤذون الله ورسوله لعنهم الله في الدنيا والاخرة
নিশ্চয় যে সব ব্যক্তি আল্লাহ এবং আল্লাহর রসুল (ﷺ) কে কষ্ট দেয়, তাদের প্রতি দুনিয়া ও আখেরাতে খােদার লানত এবং আল্লাহ তাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তিনি (رضي الله عنه) তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে বুঝালেন যে, জুলুম অত্যাচার থেকে বিরত থেকো এবং আমার রক্ত দ্বারা তোমাদের হাত রঞ্জিত করাে । আমি তােমাদের কোন ক্ষতি করিনি, তােমাদের সন্তানাদি হত্যা করিনি, তােমাদের প্রতি কোন অত্যাচার করিনি। আমিতাে কুফাবাসীর আহবানে এসেছি। তারা যখন বিশ্বাস ঘাতকতা করল, আমাকে চলে যেতে, দাও। তাঁর এ হৃদয় বিদারক বক্তব্য ওদের মনে কোন প্রভাব বিস্তার করলাে না। ওদের কপালে জাহান্নাম অবধারিত ছিল। তাই ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর আকূল আবেদন তাদের মনে কোন রেখাপাত করলােনা। বরং তারা হৈ-হুল্লা শুরু করে দিল এবং বলতে লাগল, আমরা আপনার বক্তৃতা শুনতে আসিনি। হয় ইয়াজিদের বায়াত গ্রহণ করুন অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হােন। তিনি বললেন, 'আমি আমার পক্ষে যা প্রমাণ করার ছিল তা প্রমাণ করলাম যেন কাল কিয়ামতের মাঠে তােমাদের এ কথাটুকু বলার সুযােগ না থাকে- ইয়া আল্লাহ! আমাদের জানা ছিলনা, আমাদেরকে কেউ বুঝায়নি। এখন আর তােমরা খােদার দরবারে এ ধরনের কোন আপত্তি পেশ করতে পারবে না। এখন সব প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান
وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِيْنَ حَتّٰي نَبْعَثُ رَسُوْلَا -
যা প্রমাণ করার ছিল তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে, এখন তোমাদের যা ইচ্ছা তা কর।
মুহররমের নয় তারিখ আসলাে এবং ইয়াজিদ বাহিনীর মধ্যে আনন্দ উল্লাশ শুরু হয়ে গেল। এটা পূর্ণ যুদ্ধ ঘােষণার পুর্বাভাস ছিল। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাঁর এক সঙ্গীকে ওদের কাছে পাঠালেন এবং বললেন- ওদেরকে গিয়ে বল,আমাদেরকে যেন এক রাত্রি সময় দেয়। ইয়াজিদী বাহিনী এ কথাটি গ্রহণ করল এবং এক রাত্রি সুযােগ দিল।
ঐতিহাসিক ১০ই মহররম
দশ তারিখের রাত্রি হল, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাঁর সফর সঙ্গীদের সবাইকে একত্রিত করলেন এবং বললেন- 'আমার প্রাণ প্রিয় সাথীরা! আমি তােমাদের সকলের প্রতি আন্তরিকভাবে সন্তুষ্ট। আমি সানন্দে তােমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি যে, আজ রাত্রে তােমরা যে যে দিকে পার চলে যাও। এই সব ইয়াজিদ বাহিনীর লােকেরা আমার রক্ত পিপাসু। এরা একমাত্র আমার রক্তেই পরিতৃপ্ত হবে। তোমরা চলে যাও, তোমার জান বেঁচে যাবে। কিন্তু তাঁর সাথীদের মধ্যে একজনও যেতে রাজী হলেন না। বরং বললেন, এ নাজুক সময়ে আপনাকে শত্রুদের হাতে সােপর্দ করে কিভাবে চলে যেতে পারি! এ রকম পরিস্থিতিতে যদি আপনাকে ফেলে আমরা চলে যাই, কাল কিয়ামতের মাঠে আমরা আল্লাহর রাসুল (ﷺ) কে কিভাবে মুখ দেখাব? আল্লাহর রসুল (ﷺ) বলবেন, তােমরা নিজেদের জানকে আমার প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন এর জান থেকে প্রিয় মনে করেছ এবং তােমরা আমার দৌহিত্রকে শত্রুদের অস্ত্রের মুখে সােপর্দ করে চলে গেছ। ! না!! কিছুতেই আমরা আপনাকে ফেলে চলে যেতে পারিনা। আমরা আপনার সাথেই থাকব এবং আমরা আমাদের জানকে পতঙ্গের মত উৎসর্গ করব। যখন কেউ যেতে রাজী হল না, তখন হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, তাহলে শুন! যদি তােমরা হুসাইনের সাথে থাকার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হও, তাহলে তােমরা ধৈর্য্য এবং আত্মবিশ্বাসে সীসাঢালা প্রাচীরের মত অটল হয়ে যাও। এমন দৃঢ় ও অটল পাহাড়ের মত হয়ে যাও, যেন জুলুম-অত্যাচারের বিভীষিকা তােমাদের পদস্খলন ঘটাতে না পারে। বাতিলের সাথে মােকাবিলা করার সময়টা হল আমাদের পরীক্ষার সময়। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের থেকে পরীক্ষা নিয়ে থাকে। এখন আমাদের সামনে মসিবতের পাহাড়। সমস্ত দুঃখ-দূর্দশা আমাদেরকে ধৈর্য সহকারে অতিক্রম করতে হবে, আল্লাহর রাস্তায় অটল থাকতে হবে এবং এ ভাবে অটল থেকে শাহাদাতের শরবত পান করতে হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদাহরণ রেখে যেতে হবে। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর কথা তাঁর সাথীদের মধ্যে যথেষ্ট ধৈর্য শক্তি সৃষ্টি করলাে, তাঁর (رضي الله عنه) সকল সাথী তাঁর জন্য জান কুরবান করতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তাঁর (رضي الله عنه) সকল সাথী শাহাদাত বরণের জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে গেলেন এবং ধৈর্য ও ত্যাগ স্বীকারের জন্য দৃঢ় পাহাড় হয়ে গেলেন। রাত একটু গভীর হলে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তার সাথীদেরকে বললেন, তােমরা ক্ষণের জন্য বিশ্রাম কর। সকাল বেলা আল্লাহর হুকুমে যা হওয়ার আছে তাই হবে। তাঁর (رضي الله عنه) সাথীরা সবাই নিজ নিজ তাঁবুতে চলে গেলেন এবং তিনি নিজের তাঁবুতে কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন হলেন। কুরআন তিলাওয়াত করতে করতে তাঁর (رضي الله عنه) তন্দ্রাভাব আসায় তিনি কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লেন। তখন তিনি স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর (رضي الله عنه) নানাজান (ﷺ) তশরীফ এনেছেন এবং তাঁকে কোলে নিয়ে নিলেন এবং তাঁর বুকে হাত রেখে বললেন
اللهم اعطي الحسين صبرا واجرا
হে আল্লাহ! হুসাইনকে ধৈর্য ও পূণ্য দান কর এবং হুসাইনকে আরও বললেন, তােমার উপর যা হচ্ছে, তা থেকে আমি বেখবর নই। আমি সব কিছু দেখছি। নানু! তােমার বিরুদ্ধে যারা তলােয়ার, তীর ইত্যাদি নিয়ে এসেছে, সকলেই আমার শাফায়াত থেকে বঞ্চিত। হুযুর (ﷺ) এটা বলে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর অন্তরকে ধৈর্য এবং স্থিরতার খনি বানিয়ে চলে গেলেন। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ঘুম থেকে উঠে তাঁর সাথীগণ এবং পরিবার পরিজনকে স্বপ্নের কথা শুনালেন। ফজরের নামাযের পর তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন- 'ইয়া আল্লাহ! আপনার রাস্তায় আমাকে অটল রাখ, মওলা! ধৈর্য এবং সহনশীলতা দান করুন। হে মওলা! জুলুম অত্যচারের ঝড় তুফান আমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে, আপনি আমাকে অটল থাকার তৌফিক দান করুন, যেন, জুলুম অত্যাচার আমাকে পদচ্যুত করতে না পারে। এ ভাবে তিনি মুনাজাত করছিলেন, আর তার (رضي الله عنه) সাথীরা আমীন, আমীন বলছিলেন।
এদিকে পিপাসাকাতর আল্লাহর নেক বান্দাগণ ধৈর্য এবং সহনশীলতার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন, অন্যদিকে ইয়াজিদের সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য মহড়া দিচ্ছে। দূর্যোগের কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল, ইয়াজিদের সৈন্যরা লক্ষ ঝক্ষ দিতে লাগল, তাদের মধ্যে কতেক জাহান্নামী ঘােড়ায় সওয়ার হয়ে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর তাঁবুর আশে পাশে চক্কর দিতে লাগল এবং গর্ব ও অহংকারভরে হুংকার দিয়ে বলতে লাগল, কোন বীর বাহাদুর থাকলে আমাদের মােকাবিলায় আস। এ ভাবে তারা মােকাবিলার জন্য আহবান জানাতে লাগলাে। ইত্যবসরে জালিমদের মধ্যে কেউ হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর তাঁবুর দিকে তীর নিক্ষেপ করলাে।
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর অনুসারীদের শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর সাথীরা, যারা শাহাদাত বরণ করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, তারা মােকাবিলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর অনুমতি প্রার্থনা করলেন। ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাদেরকে অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে তাঁরা বীর বিক্রমে যুদ্ধ ময়দানে ঝাপিয়ে পড়লেন। তিন দিনের পিপাসা কাতর এবং ভুখা সঙ্গীরা সবর এবং ধৈর্যের পরাকাষ্টা দেখালেন। ভূখা ও পিপাসার্ত হলে কি হবে, তার ঈমানের বলে বলীয়ান ছিলেন। এদের একজন ওদের দশজনের থেকেও অধিক শক্তিশালী ছিলেন। প্রচন্ড যুদ্ধ করে অনেক ইয়াজিদী বাহিনীকে জাহান্নামে পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেরা এক এক করে শাহাদাত বরণ করেন। হযরত ইমাম হোসাইন (رضي الله عنه) নিজের চক্ষুর সামনে তাঁর এই পঞ্চাশজন সাথীর শাহাদাত বরণ দেখলেন। এত কিছু দেখার পরও তিনি ধৈর্যচ্যুত হলেন না, তাঁর (رضي الله عنه) সাথীদের বুকে তীর নিক্ষেপ অবলােকন করছেন আর বলছেন
رضيت بقضاءك
অর্থাৎ মওলা! আমি আপনার ইচ্ছে এবং আপনার সিদ্ধান্তের উপর রাজী। পঞ্চাশজন সাথীর শহীদ হওয়ার পর তাঁর (رضي الله عنه) সাথে মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন আপনজন ছাড়া আর কেউ রইলাে না।
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর মর্মস্পর্শী ভাষণ এবং সুরের সপক্ষ ত্যাগ
আপনজনের মধ্যে ভাই ছিল, ভ্রাতুষপুত্র ছিল, ভাগিনা ছিল এবং ছেলে ছিল। তিনি কাউকে কিছু না বলে ঘােড়ায় সওয়ার হয়ে ইয়াজিদের সৈন্যদের সামনে গেলেন এবং বললেন, 'তােমাদের মধ্যে আহলে রসুল (ﷺ) এর সাহায্যকারী কেউ আছ কি? এ সংকটময় মূহুর্তে আওলাদে রাসূল (ﷺ) এর সাহায্যকারী কেউ আছ কি? আহলে রসুল (ﷺ) এর সাহায্য করে বেহেস্তে গমনের ইচ্ছুক কেউ আছ কি? তাঁর (رضي الله عنه) এ আহবানে ইয়াজিদী বাহিনীর হুর বিন ইয়াজিদ বিয়াহীর অন্তরে বিপ্লব শুরু হয়ে গেল। সে ঘােড়ার উপর অস্বস্থিবােধ এবং ছটফট করতে লাগল। তার এই অবস্থা দেখে তার এক সঙ্গী জিজ্ঞাসা করল- হুর! কি হল? তােমার এই অবস্থা কেন? তােমাকে বড়ই ব্যতিব্যস্ত দেখাচ্ছে কেন? আমি তােমাকে অনেক বড় বড় যুদ্ধ ময়দানে দেখেছি। কিন্তু কোন সময় তােমাকে আমি এ রকম অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখিনি। কিন্তু এখন তােমার এই অবস্থা কেন? হুর বললাে- কি বলব, আমি আমার এক দিকে দেখছি বেহেস্ত আর অন্য দিকে দেখছি দোযখ। মাঝখানে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছি এবং কি করব চিন্তা করছি। এক দিক আমাকে দোযখের দিকে টানছে আর এক দিক বেহেস্তের দিকে আহবান করছে। এটা বলার পর পরই তিনি ঘােড়াকে চাবুক মেরে এক নিমিষে ইয়াজিদী বাহিনী থেকে এ বলে বের হয়ে গেল- যেতে হলে বেহেস্তেই যাবে।
نکالا يه نعره حرکا تها جس وقت فوج شام سے والے خدا
. که دیکهو یوں نکلتے ہیں جہنم سد
অর্থাৎ, শত্রু বাহিনী থেকে বের হয়ে হুর জোর গলায় বললাে, দেখ জাহান্নাম থেকে আল্লাহওয়ালা বের হচ্ছে। একজন বের হয়ে আসার দ্বারা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর বাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হল না, আর ইয়াজিদী বাহিনীরও হাজারের মধ্যে একজন চলে যাওয়ায় তেমন কোন ক্ষতি হলাে । কিন্তু আসল কথা হলাে, হুর ছিল বেহেস্তী, অবস্থান করেছিলেন দোযখীদের সাথে। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাঁর আধ্যাত্মিক দূরদৃষ্টি দ্বারা অবলােকন করলেন যে, জান্নাতী দোযখীদের মধ্যে অবস্থান করছে। তাই হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ডাক দিলেন, তাঁর (رضي الله عنه) ডাকটা ছিল হুরের ইয়াজিদ বাহিনী থেকে বের হয়ে আসার একটা উপলক্ষ মাত্র। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর দ্বারা তার বেহেস্তের রাস্তা পরিস্কার হয়ে গেল। হুর বের হয়ে সােজা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর সামনে আসল এবং বলতে লাগল, ওগাে রসুল (ﷺ) এর আওলাদ! আপনি যে "ডাক দিয়েছেন, এ নাজুক সময়ে আওলাদে রসুল (ﷺ) এর সাহায্য করে বেহেস্তে যাওয়ার মত কেউ আছে কিনা, আমি সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ইয়াজিদ বাহিনী থেকে বের হয়ে এসেছি। তাই আমি যদি আজ আপনার সাহায্যার্থে জান কুরবান করি, তাহলে সত্যিই কি আপনার নানাজান (ﷺ) এর শাফায়াত নসীব হবে? তিনি (رضي الله عنه) বললেন, ইনশাআল্লাহ। হুর বললেন, আপনি আমার জন্যে দুআ করুন, আল্লাহ তাআলা যেন আমার বিগত দিনের পাপ মাফ করে দেন এবং আমার গরিমসিকে ক্ষমা করে দেন। আমি আপনার পক্ষে জান কুরবানী করার জন্য যাচ্ছি। এ বলে হুর কোমর থেকে তলােয়ার বের করে ইয়াজিদ বাহিনীর সামনে গেলেন। হুরকে দেখে ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি আমর বিন সাদ সৈন্যদেরকে বলল, দেখ, হুর ছিল আমাদের বাহিনীর সেনা প্রধান। সে এখন আমাদের শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়েছে। সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তোমরা তাকে এমন শিক্ষা দাও, যেন ' ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে শিক্ষনীয় হয়ে থাকে। এর পর ইয়াজিদ বাহিনী চারিদিক থেকে আক্রমণ শুরু করল । হযরত হুরও এমন জোরে আক্রমণ শুরু করে দিলেন যে, ইয়াজিদী বাহিনীর জন্য যেন খােদার গজব নাযিল হল। শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন।
চাচাতো ভাই ও সৎ ভাই এর শাহাদাত
হযরত হুরের শাহাদাতের পর হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর সামনে হযরত আকিলের বংশধর, হযরত মুসলিমের ভাই আবদুল্লাহ বিন আকিল (رضي الله عنه) এসে দাড়ালেন এবং অনুমতি প্রার্থনা করলেন। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং কপালে চুমু দিয়ে অনুমতি দিলেন। তিনি যুদ্ধ ময়দানে গিয়ে নিজের শৌর্য বীর্য প্রদর্শন করে অনেক ইয়াজিদী সৈন্যকে হত্যা করে পরিশেষে শাহাদাত বরণ করেন। এবার হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর ভাই হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) অনুমতি নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হলেন। শেরে খােদার আওলাদ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রমাণ করলেন যে, তাদের বাহুতে শেরে খােদার শক্তি রয়েছে। যুদ্ধের মাঠে তাঁরা যে বীর বিক্রমের পরিচয় দিয়েছেন, তা কারবালার মাটিতে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তিনিও অনেক ইয়াজিদী বাহিনীকে খতম করে শেষ পর্যন্ত নিজে শাহাদাত বরণ করেন।
হযরত আবদুল্লাহ বিন হাসান (رضي الله عنه) এর শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর সামনে তার আপন ভাতিজা, ইমাম হাসান (رضي الله عنه) এর নয়নের মনি এবং মা ফাতেমা তুয যুহরা (رضي الله عنه) ও হযরত আলী (رضي الله عنه) এর দৌহিত্র উপস্থিত হলেন। তিনি যুদ্ধে গমনের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তিনি (رضي الله عنه) তাঁর ভাতিজার প্রতি অশ্রুসজল নয়নে তাকালেন এবং বললেন, 'তোমরা আমার সাথে এসেছিলে এ উদ্দ্যেশে যে, চাচার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় তার ভক্ত ও মুরিদানদের বাড়ীতে যাবে ঐবং কয়েকদিন আনন্দ আহলাদ করবে। আমিও তােমাদেরকে তলােয়ার ও তীরের আঘাত খাওয়ার জন্য সঙ্গে আনিনি। শােন! ওরা আমার রক্তের পিপাসু, তােমাদের রক্তের জন্য লালায়িত নয়। তােমাকে আমি অনুমতি দিতে পারিনা। তুমি আশ্রয় শিবিরে ফিরে যাও এবং তােমার মা বােনদের সাথে মদীনা মনােয়ারায় চলে যেও। কিন্তু ভাতিজা বার বার বলতে লাগল, চাচাজান! আমাকে আপনার হাতে বিদায় দিন এবং আপনার বর্তমানেই জিহাদের ময়দানে যাওয়ার অনুমতি দিন। আমি জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌছার জন্য অস্থির। চাচাজান! দীর্ঘ তিন দিনের পিপাসায় খুবই কষ্ট পাচ্ছি। এখন মন চাইছে যে, যত তাড়াতাড়ি পারি জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌছে আপন পিতা ও দাদা জানের হাতে হাউজে কাওছারের, পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করি। ভাতিজার জান কুরবানীর জন্য এরকম দৃঢ় সংকল্পবােধ দেখে তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অত:পর অশ্রুসজল নয়নে অনুমতি দিলেন।
হযরত আলী (رضي الله عنه) এর দৌহিত্র, ইমাম হাসানের নয়নমনি হযরত আবদুল্লাহ বিন হাসান (رضي الله عنه) কারবালার মাঠে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত চমকাতে লাগলেন এবং ইয়াজিদ বাহিনীর সাথে মোকাবিলা করে অনেক ইয়াজিদ সৈন্যকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে নিজে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত শাহাদাত বরণ করেন।
হযরত ইমাম কাসেম (رضي الله عنه) এর শাহাদাত
আল্লাহ! আল্লাহ! এবার হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর সামনে যিনি এসে উপস্থিত, তিনি হলেন তাঁর (رضي الله عنه) প্রিয় ভাতিজা হযরত কাসেম (رضي الله عنه), যার সাথে তার মেয়ে সখিনার বিবাহের আগাম ওয়াদা ছিল। হযরত কাসেম ছিলেন উনিশ বছরের নওজোয়ান । যখন তিনি (رضي الله عنه) তাঁর নওজোয়ান ভাতিজা তথা সখিনার হবু জামাতাকে সামনে দেখলেন, তখন তিনি কেঁদে দিলেন এবং বললেন, বাবা! আমি তােমাকে কিভাবে বিদায় দিতে পারি? তােমাকে কিভাবে আমি তীর খাওয়ার অনুমতি দিতে পারি? তােমাকে কি আমি তলােয়ারের আঘাত খাওয়ার অনুমতি দিতে পারি? প্রিয় ভাতিজা! দেখ, আমার ভাইয়ের এটা একান্ত আশা ছিল যে, সখিনার বিবাহ যেন তােমার সাথে হয়। ওগাে আমার প্রিয় ভাতিজা! তুমি মদীনায় ফিরে গিয়ে আমার মেয়ে সখিনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমার ভাইয়ের আশা পূর্ণ কর। কিন্তু হযরত কাসেম (رضي الله عنه) বললেন, চাচাজান! আমার আব্বাজানের আরও একটি আশা ছিল, সেটা হল, আমার আব্বাজান আমার গলার. একটা তাবিজ দিয়েছিলেন এবং ওসীয়ত করে গিয়েছেন যে, বাবা, এ তাবিজটা তখনই খুলে দেখিও, যখন কোন বড় মুসিবতের সম্মুখীন হও এবং সেই মতে আমল করিও।' আমি এ মুহুর্তে তাবিজটা খুলে দেখলাম, কারণ এর থেকে বড় মুসিবত আর কি হতে পারে। তাবিজ খুলে যা লিখা দেখলাম, তা হলাে- ওগাে আমার প্রিয় বৎস কাসেম! এমন এক সময় আসবে, যখন আমার ভাই কারবালার মাঠে শত্রু পরিবেষ্টিত হবে, শত্রুরা তার জানের পিপাসু হবে। বেটা! তুমি যদি সত্যিকার আমার ছেলে হও, তখন নিজ জানের কোন পরােয়া করনা। বরং নিজের জান চাচার জন্য উৎসর্গ করে দিও। কারণ, সেই সময় হুসাইনের জন্য যে জান কুরবানী দেবে, আল্লাহর দরবারে সৈ খুবই উচ্চ মর্যাদা পাবে। তাই চাচাজান! আমাকেও আপনার হাতে বিদায় দিন। আমি আপনার পরে জীবিত থাকতে চাইনা। আমাকে বিদায় দিন, আমি যাতে সহসা জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌছে তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারি এবং আব্বাজানকে গিয়ে বলতে পারি, আব্বাজান! আমি আপনার আশা পূর্ণ করে এসেছি
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) শেষ পর্যন্ত তাঁকেও বুকে জড়িয়ে ধরে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে বিদায় দিলেন। হযরত ইমাম কাসেম (رضي الله عنه) ইয়াজিদ বাহিনীর বড় বড় যােদ্ধাকে টুকরাে টুকরাে করে ফেললেন। ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি
যুদ্ধক্ষেত্রে যে বাহাদুরি দেখিয়েছেন, তা দেখে ইয়াজীদী বাহিনীর জাদরেল সৈন্যরাও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এ বাহাদুরও আঘাতের পর আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে ঘােড়া থেকে পড়ে গেলেন এবং জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌছে গেলেন। এ ভাবে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর চারজন ভাতিজা শহীদ হয়ে গেলেন।
ভাগিনাদ্বয়ের শাহাদাত
চার ভাতিজার শাহাদাতের পর তাঁর (رضي الله عنه) আপন বোন হযরত জয়নাব (رضي الله عنه) তাঁর অবুঝ সন্তান হযরত মুহাম্মদ ও হযরত আউনকে নিয়ে তাঁর (رضي الله عنه) সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন- ভাইজান, তােমার এ ভাগিনাদ্বয়ও তােমার জন্য জান কুরবান করতে প্রস্তুত। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, বােন! এদেরকে তীরের আঘাত খাওয়ার জন্য সাথে আনা হয়নি। আমার সামনে তাদেরকে বর্শার অগ্রভাগে ঝুলানাে হবে, তা আমার সহ্য হবে না। তুমি তাদেরকে নিয়ে যাও এবং আশ্রয় শিবিরে গিয়ে অবস্থান কর। বােন বললেন, ভাইজান কক্ষনাে তা হতে পারে না, আমি চাই আমার সন্তানদ্বয় তােমার জন্য কুরবান হােক। আমি যেন জান্নাতুল ফেরদাউসে গিয়ে আমার আব্বাজানকে বলতে পারি, আমার দুটি ছেলে আপনার সন্তানের জন্য কুরবানী দিয়েছি। তাই তুমি এদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরুন এবং বিদায় দিন।
বােনের বার বার আকুতি-মিনতির কারণে তিনি (رضي الله عنه) তাদেরকেও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠালেন। হযরত জয়নাব (رضي الله عنه) তাঁর নয়নমনি ও জানের জান সন্তানদের প্রতি নিজের অগাধ মায়া মমতাকে ধামা চাপা দিয়ে সন্তানদ্বয়কে বিদায় দিলেন। এ কঁচি ছেলেদ্বয় বেশী দূর অগ্রসর হতে পারল না, ইয়াজিদী বাহিনীর জালিমেরা এসে তাদেরকে বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে নিল। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এ দৃশ্য দেখে দৌড়ে গেলেন এবং তাঁর ভাগিনাদ্বয়ের লাশ কাঁধে নিয়ে আশ্রয় শিবিরের কাছে এনে রাখলেন এবং বােনকে ডাক দিয়ে বললেন, ওহ্ জয়নাব! তােমার আরজু পূরণ হলাে, তােমার সন্তানদ্বয় জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌছে তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। মা ছেলেদের লাশের পাশে এসে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করলেন এবং ছেলেদের মাথার চুলে আঙ্গুলি বুলিয়ে বুলিয়ে বলতে লাগলেন- বাবা! তােমাদের প্রতি তােমার মা খুবই সন্তুষ্ট। তােমরা তােমার মামার জন্য জান কুরবান করেছ এবং জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌছে গেছ।
হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) এর শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বোনের হাত ধরে এক প্রকার জোর করে বােনকে নিয়ে তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। তথায় গিয়ে আর এক দৃশ্য দেখলেন, তাঁর (رضي الله عنه) ছয় মাসের দুগ্ধ পােষ্য সন্তান হযরত আলী আসগর তৃষ্ণায় ছটপট করছিল এবং তাঁর জিহবা বের হয়ে গিয়েছিল। ছেলের মা বললেন, বাচ্চার এই অবস্থা আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। মুখ দিয়ে ওর কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। যে কোন প্রকারে ওর জন্য একটু পানি সংগ্রহ করুন। হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এ কথা শুনে একেবারে ব্যাকুল হয়ে পড়লেন এবং বললেন, ভাইজান! আমাকে অনুমতি দাও, আমি এ মূহুর্তে গিয়ে ফোরাত নদী থেকে পানি নিয়ে আসি এবং সেই পানি পান করিয়ে এ বাচ্চার তৃষ্ণা নিবারণ করি । হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, ভাই একটু সবর কর, এর তৃষ্ণা জান্নাতুল ফেরদাউসে গিয়ে নিবারণ করবে। কিন্তু আব্বাস (رضي الله عنه) বললেন, ভাই! বড় পরিতাপের বিষয়! আমাদের বর্তমানে একটি মাসুম শিশু এ ভাবে তৃষ্ণায় মারা যাবে, তা কখনাে হতে পারে না। আমরা কি সেই শেরে খােদার আওলাদ নই? যিনি খায়বরের বৃহৎ দরজা হাতের উপর তুলে নিয়েছিলেন। আমি কোন বাধা মানতে রাজী নই, এ মূহুর্তে পানি নিয়ে এসে এ মাসুম বাচ্চার তৃষ্ণা মিটাব।
অতঃপর মশক নিয়ে ঘােড়ায় চড়ে তিনি ফোরাত নদীর দিকে ধাবিত হলেন এবং ফোরাত নদীর কাছে গিয়ে অতি দ্রুততার সাথে ঘােড়া থেকে অবতরণ করে মশক ভরে পানি নিলেন ও মুখ বন্ধ করে কাধের উপর উঠালেন এবং নিজ হাতে এক অঞ্জলি পানি মুখের কাছে নিলেন কিন্তু সেই মূহুর্তে তৃষ্ণার্ত ভাতিজার কথা মনে উদিত হলাে। ভাতিজা যেন বলছে, 'চাচাজান! আপনার উচিত নয় যে, আমার আগে পানি পান করা। আপনি আলী আসগরের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পানি নিতে এসেছেন, নিজের জন্য নয়। প্রথমে আপনার মাসুম ভাতিজার তৃষ্ণা নিবারণ করান। এর পরেই আপনি পান করুন। শেষ পর্যন্ত হাতে নেয়া পানি ফেলে দিলেন এবং ঘােড়াকে নদীর কিনারা থেকে যখন উপরে উঠালেন, তখন ইয়াজিদের জালিম বাহিনীরা তাঁকে ঘিরে ফেলল। তিনি এ অবরােধ ভেদ করে অগ্রসর হলেন। ওরা পুনরায় অবরােধ করলাে। তিনি এটাও প্রতিহত করলেন। এভাবে অবরােধ প্রতিহত করে ইয়াজিদ বাহিনীর অনেককেই জাহান্নামে পাঠিয়ে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন।
কিন্তু তিনি ছিলেন একা আর এরা ছিল চার হাজারেরও অধিক। ওরা পুনরায় চারিদিক থেকে ঘিরে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করতে লাগল এবং তাঁর শরীর তীরের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল। এ ভাবে যখন তার শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে গেল, কাপুরুষ ইয়াজিদ বাহিনী বুঝতে পারল যে তিনি অনেক কাবু হয়ে গিয়েছেন। তাই নিকটবর্তী হয়ে পিছন দিক থেকে একজন তরবারীর আঘাতে তাঁর বাম হাত কেটে ফেলল। বাম হাত কেটে ফেলার ফলে মশক পড়ে যাচ্ছিল, শেরে খােদার আওলাদ তখনও সাহস হারাননি। তিনি মশক ডান কাঁধে নিয়ে নিলেন। সেই জালিমরা ডান হাতটাও কেটে ফেলল। মশক তখন পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেরে খােদার আওলাদের হিম্মত দেখুন, তিনি দুই বাজু দিয়ে মশক আঁকড়িয়ে ধরলেন। এবার বাজুদ্বয়ও কেটে ফেলল। এখন এমন কোন কিছু নেই যে, যেটা দিয়ে ঘােড়ার লাগাম ধরবেন, এমন কোন হাত নেই যে, যেটা দিয়ে তলােয়ার চালনা করবেন, এমন কিছু নেই যে, যেটা দিয়ে মশক আঁকড়িয়ে ধরবেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি দাঁত দিয়ে মশকের মুখ কামড়িয়ে ধরলেন। জালিমরা তীর নিক্ষেপ করে মশক ফুটা করে দিল এবং সব পানি পড়ে গেল। এই অবস্থা দেখে তিনি দাঁতের কামড় থেকে মশক ছেড়ে দিলেন এবং বলতে লাগলেন, হে আলী আসগর! এ অবস্থায় আমি কিভাবে তােমার তৃষ্ণা নিবারণ করি? আমিতাে তােমার তৃষ্ণা নিবারণে কামিয়াব হতে পারলাম না। তিনি ঘােড়ার উপর বসা অবস্থায় ছিলেন। ইয়াজিদী বাহিনীর সৈন্যরা তীরের আঘাতে তাঁকে ঘােড়া থেকে মাটিতে ফেলে দিল এবং চারিদিক থেকে তলােয়ার দ্বারা আঘাত করতে লাগলো। হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) দূর থেকে দেখলেন হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) ঘােড়া থেকে মাটিতে পড়ে গেছেন। তখন তিনি গুমরিয়ে কেঁদে উঠলেন এবং বললেন, 'আমার কোমর ভেঙ্গে গেল। তিনি একেবারে ধৈর্য হারা হয়ে পড়লেন। তাঁর সকল সঙ্গীরা চলে গেলেন এবং তাঁর ডান হাত হয়রত আব্বাসও চলে গেলেন। এখন হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) একেবারে একা হয়ে গেলেন। তিনি (رضي الله عنه) আত্মহারা হয়ে তাঁর ভাইয়ের লাশের কাছে ছুটে গেলেন। হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) এর দুই বাহু কাটা ছিল, শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল এবং সেই জালিমরা তার মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছিল। লাশের কাছে পৌছে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, ভাই! তুমিতাে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, তােমার সাথে অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। অতঃপর ভাইয়ের রক্ত রঞ্জিত লাশ সেখানে ফেলে কেঁদে কেঁদে ফিরে আসলেন।
হযরত আলী আকবর (رضي الله عنه) এর শাহাদাত
ফিরে এসে দেখলেন, তাঁর (رضي الله عنه) আঠার বছরের ছেলে হযরত আলী আকবর (رضي الله عنه) যিনি আপাদমস্তক প্রিয় নবী (ﷺ) এর প্রতিচছবি ছিলেন, তিনি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে রইলেন এবং হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) কে বললেন, আব্বাজান! আমাকেও বিদায় দিন। আমি চাইনা, আপনার পরে জীবিত থাকতে। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, বেটা শােন! তুমিতো মুস্তাফা (ﷺ) এরই প্রতিচ্ছবি। তােমাকে যখন কেউ দেখে, তখন তার দিলের তৃষ্ণা মিটে যায়। তুমিতাে আমার নানাজান (ﷺ) এরই প্রতিচ্ছবি। তােমাকে দেখলেই আমার নানাজান (ﷺ) এর আকৃতি সামনে এসে যায়। তােমাকে যদি আজ বিদায় দিই, আমাদের ঘর থেকে আমার নানাজান (ﷺ) এর প্রতিচ্ছবি চলে যাবে। বাবা! তুমি যেও না। ওরা আমারই রক্তের পিপাসু। আমার রক্তের দ্বারাই ওদের পিপাসা নিবারণ হবে। কিন্তু হযরত আলী আকবর বললেন, আব্বাজান! আমিও ওখানে যেতে চাই যেখানে আমার ভাই কাসেম গিয়েছে, যেখানে আমার চাচাজান গিয়েছেন। আমি কাপুরুষের মত পিছনে পড়ে থাকতে চাই না। আমিও জান্নাতুল ফেরদাউসে গিয়ে নিজের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ব্যাকুল। আমাকেও আপনার হাতে বিদায় দিন। আব্বাজান! আমাকে আপনার হাতে বিদায় দিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌছিয়ে দিন। আমাকে জালিমদের হাতে সােপর্দ করে যাবেন না। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তাঁর আঠার বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বিদায় দিলেন। হযরত আলী আকবর (رضي الله عنه) রওয়ানা হলেন। আল্লাহ! আল্লাহ! ইনি কে যাচ্ছেন? মুস্তাফা (ﷺ) এর প্রতিচ্ছবি যাচ্ছেন। হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) এর জানের জান যাচ্ছেন। ইনি আলী আকবর নয়, সরকারে দো আলম হযরত মুস্তাফা (ﷺ) এর নয়নমনি যাচ্ছেন। ইনি হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর বাগানের ফুল যাচ্ছেন। উনি হুযুর (ﷺ) এর বাগানের ফুলের কলি যাচ্ছেন। আল্লাহ! আল্লাহ! হযরত আলী আকবর যেতে যেতে এটা পড়তে ছিলেন
أنا على بن الحسين بن علي- عن أهل البيت أولى بالنبي
আমি আলী আকবর, হুসাইন (رضي الله عنه) এর বেটা, যে হুসাইন (رضي الله عنه) হযরত আলী মর্তুজা (رضي الله عنه) এর বংশধর। আমরাই হলাম আহলে বায়ত, রসুলে খােদা (ﷺ) এর সবচেয়ে প্রিয় বংশধর। এ 'শের পড়তে পড়তে ইমাম আলী আকবর সামনে অগ্রসর হলেন এবং ইয়াজিদী বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন, আমার দিকে লক্ষ্য কর, আমি হুসাইন (رضي الله عنه) এর সন্তান। আলী আকবর আমার নাম। হে নবী (ﷺ) এর ঘরকে উজারকারী! হযরত ফাতেমা (رضي الله عنه) এর বাগানের ফুল ও কলি সমূহকে কারবালার উত্তপ্ত বালিতে ছিন্ন-ভিন্ন কারী! আমার রক্ত দ্বারা তােমাদের হাতকে রঞ্জিত কর, আমার প্রতিও তীর নিক্ষেপ করে। হযরত ইমাম আলী আকবর (رضي الله عنه) আরও বললেন, জালিমদের সাহস নেই, এ নওজোয়ানের প্রতি তীর নিক্ষেপ করার বা অসি চালানাের। আমর বিন সাদ নিজ সৈন্যদেরকে বলল- হে কাপুরুষ! তােমাদের কি হলাে? সত্বর একেও বর্শায় উঠিয়ে নাও। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যে সকলের আগে এ নওজোয়ানকে হত্যা করতে পারবে, আমি ওকে মােছলের'র রাজত্ব প্রদান করব। এমন কোন ব্যক্তি আছে কি? যে মা ছেলের শাসক হতে চায়? মা ছেলের রাজত্ব পেতে চায়? তারেক বিন শিশ নামক এক বাহাদুর পালােয়ান ব্যক্তি ছিল। ওর মনে আমরের কথায় প্রভাব সৃষ্টি করল এবং সে আগে বাড়ল এবং মনে মনে বললাে,দেখি ভাগ্যে মােছলের গভর্ণরগিরী আছে কিনা। সে তীর হাতে নিয়ে হযরত আলী আকবর (رضي الله عنه) কে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। আহ! হযরত ইমাম আলী আকবর (رضي الله عنه) দৃঢ় স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। যখনই সে কাছে আসল, হযরত ইমাম আলী আকবর ঘােড়াকে ফিরায়ে ওর পিছনে এসে গেলেন এবং এমন জোরে আঘাত হানলেন যে এক পলকে ওর মাথাকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।
এই দৃশ্য দেখে ওর ছেলে 'উমর বিন তারেক’ রাগে প্রজ্জ্বলিত হয়ে তলােয়ার উঁচু করে এগিয়ে আসল। যখন উভয়ের তলােয়ার একটার সাথে আর একটা আঘাতে ঝনঝনিয়ে উঠল, তখন যারা উপস্থিত ছিল তারা দেখলাে, ওর লাশ মাটিতে পরে ছট্ফট করছে। দ্বিতীয় পুত্র তালহা বিন তারেক, সেও বাপ ভাইয়ের খুনের বদলা নেয়ার জন্য অগ্নিশর্মা হয়ে হযরত আলী আকবর (رضي الله عنه) এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হযরত আলী আকবর (رضي الله عنه) একেও উৎখাত করলেন। এ তিনজনকে হত্যা করার পর হযরত ইমাম আলী আকবর (رضي الله عنه) ঘােড়া ফিরিয়ে তাবুর দিকে গেলেন! হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) যখন দেখলেন তাঁর কলিজার টুকরা যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসছে, তিনি (رضي الله عنه) এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেসা করলেন, বাবা কি খবর? হযরত ইমাম আলী আকবর ঘােড়া থেকে অবতরণ করে আব্বাজানের কাছে আরজি পেশ করলেন, আব্বাজান! তৃষ্ণা খুবই কষ্ট দিচ্ছে, খুবই তৃষ্ণা অনুভব করছি। যদি এক গ্লাস পানি পাওয়া যায়, তাহলে এদের সবাইকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিতে পারব ইনশাআল্লাহ। আব্বাজান! আমি ওদের তিন বাহাদুরকে হত্যা করে এসেছি, কিন্তু আমার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, আমার গলাও শুকিয়ে গিয়েছে, আমার নিশ্বাসটাও সহজভাবে আসছে না। আমি খুবই কাহিল হয়ে গিয়েছি। ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, প্রিয় বৎস, ধৈর্য ধারণ কর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌছে যাবে এবং হাউজে কাউছারের পানি দ্বারা তােমার তৃষ্ণা মিঠাবে। কিন্তু বেটা! তুমি যখন আমার কাছে এসেছ, এসাে-এ বলে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাঁর ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বলরেন, মুখ খােল! হযরত আলী আকবর (رضي الله عنه) মুখ খুললেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাঁর শুষ্ক জিহবা ওর মুখের ভিতর প্রবেশ করিয়ে দিলেন এবং বললেন, আমার জি হবাটা চুষে নাও, হয়তাে কিছুটা আরামবােধ করবে। হযরত আলী আকবর রাঃ তাঁর আব্বার জিব চুষলেন। জিব চুষে কিছুটা আরাম বােধ করলেন। এরপর হযরত,ইমাম আলী আকবর (رضي الله عنه) পুনরায় যুদ্ধের ময়দানের দিকে এগিয়ে গেলেন। হযরত ইমাম আলী আকবর যুদ্ধের ময়দানে প্রমাণ করে দিয়েছেন, তিনি শেরে খােদার দৌহিত্র। তার শিরা-উপশিরায় হযরত আলী মর্তুজা রাঃ এর রক্ত রয়েছে এবং তাঁর চোখে হযরত আলী মর্তুজা (رضي الله عنه) এর শক্তি কাজ হনি আশিজন ইয়াজিদী বাহিনীকে হত্যা করে নিজে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার কালে শাহাদাত বরণ করার আগে ডাক দিয়ে বললেন,
يا ابتاه ادركني
ওহে আব্বাজান! আমাকে ধরুন, আমাকে নিয়ে যান, আপনার আলী আকবর পড়ে যাচ্ছে। এ আহবান শুনে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) দৌড়ে গেলেন। তিনি (رضي الله عنه) ছেলের কাছে পৌছার আগেই জালিমরা হযরত আলী আকবর (রাঃ এর মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললাে। জওয়ান ছেলের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি (رضي الله عنه) চোখের পানি ফেলছিলেন এবং অশ্রু সজল নয়নে তাঁর (رضي الله عنه) জওয়ান ছেলের লাশকে কাঁধে উঠিয়ে তাঁবুর পার্শ্বে নিয়ে আসলেন। হযরত আলী আকবর (رضي الله عنه) এর এ শাহাদাতে প্রত্যেকেই দারুনভাবে আঘাত পেলেন। হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে হযরত আলী আকবর (رضي الله عنه) এর লাশ দেখে চিৎকার করে বলে উঠলেন, আহা! জালিমরা প্রিয় নবী (ﷺ) এর প্রতিচ্ছবিকেও শেষ করে দিল। এ জালিমরা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর চিহ্নকেও নিঃচিহ্ন করে দিল। নবী করিম (ﷺ) এর প্রতিচ্ছবিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিল।
হযরত আলী আসগর (رضي الله عنه) এর শাহাদাত
হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) ভাতিজার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে এ ভাবে আহাজারি করতে ছিলেন। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বোনের হাত ধরে তাঁবুর অভ্যন্তরে নিয়ে গেলেন এবং বললেন- বােন! সবর কর, আল্লাহ তাআলা সবরকারীদের সাথে আছেন। সবর এবং ধৈর্যের আঁচল হাত ছাড়া করনা। যা কিছু হচ্ছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে হচ্ছে, আমাদের সবর ও ধৈর্যের মাধ্যমে কামিয়াবী হাসিল করতে হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে মহাপরীক্ষা।
لَنْ يُّصِبَنَا اِلَّا مَا كَتَبَ الله لَنَا-
বোনকে নিয়ে যখন তাঁবুর অভ্যন্তরে গেলেন, তখন সৈয়দা শহর বানু হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর সামনে এসে বললেন, আপনার ছেলে আলী আসগর পানির তৃষ্ণায় কেমন করছে, গিয়ে দেখুন। পানির তৃষ্ণায় ওর অবস্থা খুবই সঙ্গীন হয়ে গিয়েছে। ধরফর করছে কিন্তু নড়াচড়া করতে পারছে না। কাদছে কিন্তু চোখের পানি আসছে না। মুখ হা করে আছে, কিন্তু কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। এ অবস্থা দেখে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গিয়েছে। শুনুন, জালিমেরা হয়তাে জানেনা যে, আমাদের সাথে ছােট ছােট শিশুরা রয়েছে। আমার মনে হয়, এ ছােট শিশুকে কোলে করে আপনি ওদের সামনে নিয়ে গেলে নিশ্চয় ওদের রহম হতে পারে। কারণ এরকম শিশু ওদের ঘরেও রয়েছে। তাই আপনি এ শিশুকে কোলে করে ওদের সামনে নিয়ে যান এবং বলুন, আমাকে পানি দাও, তোমাদের হাতে কয়েক ফোঁটা পানি এ শিশুর মুখে দাও। তাহলে তারা নিশ্চয় দিবে। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বললেন, শহর বানু! তােমার যদি এটা আরজু এবং ইচ্ছা হয়ে থাকে, তা হলে তােমার এ ইচ্ছা পূর্ণ করতে আমি রাজি আছি। কিন্তু এ বদ বখতদের প্রতি আমার আদৌ আস্থা নেই।
যাহােক, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ছয় মাসের দুগ্ধপােষ্য শিশুকে কোলে নিয়ে ইয়াজিদ বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন, দেখ! এটা ছয় মাসের দূগ্ধপোষ্য শিশু। এটা আমার ছেলে আলী আসগর। এটা তােমাদের সেই নবী করিম (ﷺ) এর বংশধর, তােমরা যার কলেমা পাঠ কর। শােন! আমি তােমাদের কোন ক্ষতি করে থাকতে পারি, আমার থেকে তােমরা এর বদলা নেবে। কিন্তু এ মাসুম শিশুতাে তােমাদের কোন ক্ষতি করেনি। এ শিশু পানির তৃষ্ণার ধরফর করছে। শােন! আমার হাতে কোন পানির গ্লাস দিওনা, তােমাদের হাতে এ শিশুর মুখে কয়েক ফোঁটা পানি দাও। আর এ শিশু পানি পান করার পর তলােয়ার হাতে নিয়ে তােমাদের বিরুদ্ধে লড়বেনা। তাই এর তৃষ্ণাটা নিবারণ কর। দেখ, তৃষ্ণায় এর কি অবস্থা হয়েছে। তাঁবুর পর্দানশীন মহিলাদের কাকুতি-মিনতিতে টিকতে না পেরে একে নিয়ে এসেছি। তিনি (رضي الله عنه) এ করুণ বর্ণনা দিচ্ছিলেন, আর এ দিকে আলী আসগর (رضي الله عنه) কে লক্ষ্য করে হরমেলা বিন কাহেল' নামক এক বদবখ্ত জালিম তীর নিক্ষেপ করল এবং সেই তীর এসে আলী আসগর (رضي الله عنه) এর গলায় বিধল। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) দেখলেন, শিশুটি একটু গা নাড়া দিয়ে চির দিনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেল।
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) হু ইু করে কেঁদে দিলেন এবং বললেন, ওহে জালিমেরা! তােমরাতাে তােমাদের নবী করিম (ﷺ) এর প্রতিও কোন সমীহ করলে না। তােমাদের মনতাে কাফিরদের থেকেও কঠোর। শিশুদের প্রতি কাফিরেরাও সহানুভূতি দেখায়। তোমরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী কর। তিনি (رضي الله عنه) ছেলের গলা, থেকে তীর বের করলেন এবং মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন,
اللهم اني اشهدك علي هؤلاء القوم-
মওলা! এ লােকেরা যা কিছু করছে, এর জন্য আমি তােমাকে সাক্ষ্য করছি। অত:পর লাশ কাধে নিয়ে তাঁবুর কাছে নিয়ে এসে হযরত আলী আকবর (رضي الله عنه) এর পাশে রেখে ডাক দিয়ে বললেন, ওহে শহরবানু! ওহে জয়নাব! আলী আসগর আর ধরফর ধরফর করবে না এবং তৃষ্ণার কারণে হাত পা নড়াচড়া করবে না। এর তৃষ্ণার্ত অবস্থা দেখে তােমাদের অস্থিরতা আর বৃদ্ধি পাবে না। সে জান্নাতুল ফেরদাউসে গিয়ে দাদীজান (رضي الله عنه) এর কোলে বসে হাউজে কাউছারের পানি পান করছে।
زمین کر بلا پر فاطمه کی پھول بکهرے ہیں
شہیدوں کی یہ خوشبو ہر جگہ مہکتے ہیں
আহ! কারবালার মাঠে হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর বাগানের ফুল ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে রয়েছে। কোন জায়গায় আব্বাস (رضي الله عنه) পড়ে রয়েছে, কোন জায়গায় কাসেম (رضي الله عنه) পড়ে রয়েছে, কোন জায়গায় আলী আকবর (رضي الله عنه) পড়ে রয়েছে, কোন জায়গায় আলী আসগর পড়ে রয়েছে।
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শেষ উপদেশ ও যুদ্ধের ময়দানে গমন
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাঁবুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। তখন তার (رضي الله عنه) বাইশ বছর বয়স্ক রুগ্ন ছেলে হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه), যিনি মারাত্মক রোগ ও জ্বরে ভূগছিলেন, হেলিয়ে দুলিয়ে কোন মতে আব্বাজানের সামনে এসে আরজ করলেন- আব্বাজান! আমাকেও বিদায় দিন, আমি শাহাদাত বরণ করতে চাই। তিনি (رضي الله عنه) নিজের রুগ্ন ছেলেকে সান্ত্বনা দিলেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, জয়নুল আবেদীন! তােমাকেও যদি বিদায় দিই, তাহলে ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর 'সিলসিলা' কার থেকে জারী হবে? বেটা! তােমার থেকেই আমার বংশধরের 'সিলসিলা' জারী হবে। আমি দুআ করি, আল্লাহ তােমাকে জীবিত রাখুক এবং তােমার থেকে আমার বংশধরের 'সিলসিলা' জারী হােক। তিনি তাঁকে বাতেনী খেলাফত ও ইমামত প্রদান করলেন। তাঁকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে বাতেনী নেয়ামত প্রদান করলেন এবং কিছু ওসীয়ত করার পর ফরমালেন, বেটা! আমি চলে যাওয়ার পর মদীনায় পৌছার যদি সৌভাগ্য হয়, তাহলে সবার আগে নানাজান (ﷺ) এর রওজায় গিয়ে সর্ব প্রথম আমার সালাম বলিও এবং কারবালায় তােমার দেখা সমস্ত ঘটনা নানাজান (ﷺ) কে শুনিও।
ছেলেকে ওসীয়ত করার পর হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তাঁর প্রস্তুতি শুরু করলেন, নবী করিম (ﷺ) এর পাগড়ী মুবারক মাথার উপর রাখলেন, সৈয়দুশ শুহাদা হযরত হামযা (رضي الله عنه) এর ঢাল পিঠের উপর রাখলেন। বড় ভাই হযরত ইমাম হাসান (رضي الله عنه) এর কোমর বন্ধনী নিজ কোমরে বাঁধলেন এবং আব্বাজান শেরে খােদা হযরত আলী মুর্তুজা (رضي الله عنه) এর তলােয়ার জুলফিকার হাতে নিলেন। অতঃপর কারবালার দুলহা, কারবালার সুলতান শাহীন শাহে কারবালা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ময়দানের দিকে যাত্রা দিলেন। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) তলোয়ার হাতে নিয়ে বের হওয়ার মুহুর্তে সেই পর্দানশীন মজলুম মহিলাদের দিকে এক নজর তাকালেন, তখন সবাই তাকে (رضي الله عنه) সবর ও ধৈর্যে অটল দেখালেন, কারাে চোখে পানি নেই, সবাই অধিক শােকে পাথর হয়ে রইলেন। কিন্তু উনাদের অন্তর হু হু করে কাঁদছিল। যাদের ভরা ঘর আজ খালি হয়ে গিয়েছে। সর্বশেষ যে আশ্রয়টা ছিল, তিনি (رضي الله عنه)ও এখন তাদেরকে বিদায়ী সালাম দিয়ে রওয়ানা হচ্ছেন।
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এক এক জনকে সম্বােধন করে বললেন, শহরবানু? আমার আখেরী সালাম গ্রহণ করাে, 'রােবাব! হুসাইন (رضي الله عنه) এর চেহারা দেখে নাও, সম্ভবতঃ এ চেহারা দেখার তােমার নসীব আর নাও হতে পারে। জয়নাব! তােমার ভাই যাচ্ছে, জয়নাব! তুমি খায়বার যুদ্ধে বিজয়ী কন্যা, তুমি ধৈর্যশীলা ফাতিমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর কন্যা, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ সবরকারী (ﷺ) এর আওলাদ। সবর ও ধৈর্যের আঁচল হাতছাড়া করনা। দেখ, এমন কোন কাজ করিও না, যাদ্বারা আল্লাহ ও তাঁর রসূল নারাজ হয়। যে কোন অবস্থায় ধৈর্যহারা হইওনা। জয়নাব! আর একটি কথা শােন, আমার প্রিয় কন্যা সখিনাকে কাঁদতে দিওনা। সে আমার সব চেয়ে আদরের মেয়ে। ওকে আদর করিও এবং সদা বুকে জড়িয়ে রাখিও। আমি যাচ্ছি, তােমাদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করলাম। তিনি (رضي الله عنه) এ কথাগুলাে বলছিলেন, আর এদিকে তাঁর মাসুম কন্যা এসে জড়িয়ে ধরলাে। হযরত রােবাব (رضي الله عنه) এসে হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) এর কাধে মুখ রেখে ফুঁফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, আমাদেরকে ফেলে আপনি কোথায় যাচ্ছেন, এ দুর্দিনে আমাদেরকে এ অবস্থায় ফেলে কোথায় যাচ্ছেন? জালিমদের হাতে আমাদের সােপর্দ করে কোথায় যাচ্ছেন? আমাদের পরিণাম কি হবে! এ পশুরা আমাদের সাথে কী যে আচরণ করবে। তিনি (رضي الله عنه) বললেন, আল্লাহ তাআলা তােমাদের সাথে আছেন। তােমরা আল্লাহর নবী (ﷺ) এর আওলাদ, আহলে বাইতের অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ তাআলা তােমাদের ইজ্জত সম্মানের হেফাজতকারী। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) সবাইকে ধৈর্য ধারণের জন্য তাগিদ দিলেন। কিন্তু নিজে অধৈর্যের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলেন। তবুও একান্ত কষ্টে আত্মসংবরণ করে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘােড়ার কাছে আসলেন এবং যে মাত্র ঘােড়ায় আরােহন করতে যাচ্ছিলেন, সে মূহুর্তে হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) মাথায় পর্দা দিয়ে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন, ভাইজান! যে মায়ের তুমি দুধ পান করেছ, আমিও সে মায়ের দুধ পান করেছি, আমিও হযরত আলী মর্তুজা (رضي الله عنه) এর কন্যা। ভাইজান! তুমি সবাইকে ঘােড়ায় আরােহণ করিয়ে ময়দানে পাঠিয়েছ, কিন্তু তােমাকে আরােহণ করার মত এখন আর কেউ নেই। তাই এ মজলুম বােন তােমাকে ঘােড়ায় আরােহণ করাবে। আমি তােমার ঘােড়ার লাগাম ধরলাম, তুমি আরােহণ কর। হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) ঘােড়ায় আরােহণ করে ময়দানের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর নয়নমনি ইয়াজিদ বাহিনীর সামনা সামনি হতে চলছেন। নবী করিম (ﷺ) এর দৌহিত্র পরিবারের সবার শাহাদাত বরণ করার পর নিজে শাহাদাত বরণ করতে চলছেন।
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর বীর বিক্রম আক্রমণ
আল্লাহ! আল্লাহ! হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) ইয়াজিদ বাহিনীর সামনে গিয়ে লন, দেখ, আমি কে? আমি জান্নাতের যুবকদের সর্দার। আমি ঐ হুসাইন ), যাকে রসুলুল্লাহ (ﷺ) চুমু দিতেন এবং ফরমাতেন, এটা আমার ফুল। আমি ঐ হুসাইন (رضي الله عنه) যার মা হযরত ফাতিমাতুয যুহরা (رضي الله عنه), আমি ঐ হুসাইন (رضي الله عنه), যার পিতা হযরত আলী মর্তুজা (رضي الله عنه) খায়বর বিজয়ী, আমি ঐ হুসাইন (رضي الله عنه), যার নানা আল্লাহর নবী খাতেমুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (ﷺ), আমি ঐ হুসাইন (رضي الله عنه), যখন আল্লাহর নবী (ﷺ) সিজদারত অবস্থায় থাকতেন, আমি পিঠের উপর সওয়ার হয়ে যেতাম। তখন তিনি (ﷺ) সিজদাকে দীর্ঘায়িত করতেন। ওহে নবী (ﷺ) এর ঘর উচ্ছেদকারীরা! ফাতেমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর বাগানের ফুলকে ছিড়ে ছিন্ন ভিন্ন করে কারবালার উত্তপ্ত বালিতে নিক্ষেপকারীরা! এসাে, আমার রক্তের দ্বারাও তােমাদের হাতকে রঞ্জিত কর। কি দেখছ? আমার পিছনে আর কেউ নেই। একমাত্র আমিই রয়েছি। এগিয়ে এসাে! তখন ওরা তলােয়ার খাপ থেকে বের করে তীর উত্তোলন করে এগিয়ে আসল। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) যখন খাপ থেকে তলােয়ার বের করে ওদের উপর আক্রমন করলেন, তখন ওরা মেষের পালের মত পালাতে লাগল। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এমন বিদ্যুৎ বেগে ওদের উপর তলােয়ার চালাতে লাগলেন যে ওদের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে এমনভাবে পতিত হতে লাগল যেমন শীতকালে বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়ে। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) অল্প সময়ের মধ্যে লাশের স্তুপ করে ফেললেন। তিনি (رضي الله عنه) নিজে তীরের আঘাতে জর্জরিত এবং তিন দিনের তৃষ্ণায় কাতর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর (رضي الله عنه) তলােয়ার জুলফিকার তখনও সেই নৈপুণ্য দেখিয়ে যাচ্ছিল, যে ভাবে বদরের যুদ্ধে দেখিয়েছিল। বদরের যুদ্ধে এ তলােয়ার যখন হযরত আলী (رضي الله عنه) এর হাতে ছিল এবং চালানাে হচ্ছিল, তখন অদৃশ্য থেকে আওয়াজ আসছিল
لافتي الاعلي لاسيف الا ذو الفقار-
অর্থাৎ আলী (رضي الله عنه) এর মত যেমন কোন জওয়ান নেই, তেমন জুলফিকারের মত কোন তলােয়ার নেই। এখনও সেই তলােয়ার সেই নৈপুণ্য দেখাচ্ছিল। মােট কথা, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) লাশের স্তুপ করে ফেলেছেন। ইয়াজিদী বাহিনীকে কেটে কেটে মাটি রঞ্জিত করে ফেললেন। একদিকে তিনি (رضي الله عنه) যেমন অনেক ইয়াজিদী সৈন্যকে কচুকাটা করলেন, অন্য দিকে ওরাও তাঁকে (رضي الله عنه) আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেললাে।
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শাহাদাত
নিজেদের মারাত্মক পরিণতির কথা উপলব্ধি করে আমর বিন সাদ' নির্দেশ দিল, সবাই মিলে চারিদিক থেকে ওনাকে (رضي الله عنه) লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ কর। নির্দেশমত ইয়াজিদ বাহিনী নবী (ﷺ) এর দৌহিত্রকে চারিদিক থেকে ঘিরে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। ফলে চারি দিক থেকে তীর এসে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে আঘাত হানতে লাগল। কোনটা ঘোড়ের গায়ে লাগছিল, কোনটা তাঁর (رضي الله عنه) নিজের গায়ে পড়ছিল। এ ভাবে যখন তীরের আঘাতে তাঁর (رضي الله عنه) পবিত্র শরীর ঝাঁঝরা হয়ে ফিনকি দিয়ে সারা শরীর থেকে রক্ত বের হতে লাগলাে, তখন তিনি (رضي الله عنه) বার বার মুখে হাত দিয়ে বললেন, বদবখত! তােমরাতাে তােমাদের নবী (ﷺ) এর লেহাজও করলেনা। তােমরা নবী (ﷺ) এর বংশধরকে হত্যা করেছ। এ ভাবে যখন তিনি (رضي الله عنه) আর একবার মুখের উপর হাত দিলেন, তাঁর (رضي الله عنه) চোখের সামনে আর একটা দৃশ্য ভেসে উঠল, তিনি (رضي الله عنه) দেখতে পেলেন, নবী করিম (ﷺ) হাতে একটি বােতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হযরত আলী মর্তুজা (رضي الله عنه) ও হযরত ফাতেমা যুহরা (رضي الله عنه)ও পার্শ্বে আছেন, আর বলছেন, 'হুসাইন! আমাদের দিকে তাকাও, আমরা তােমাকে নিতে এসেছি।
হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর কাপড় রক্তে ভিজে যাচ্ছিল আর হুযুর (ﷺ) সেই রক্ত বােতলে ভরে নিচ্ছে এবং বললেন, (হে আল্লাহ! হুসাইনকে পরম ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দান কর।) আল্লাহ! আল্লাহ! নবী (ﷺ) এর দৌহিত্র নিজের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলেন। শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়ে একেবারে রক্তশুণ্য হয়ে গেলেন এবং আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘােড়া থেকে পড়ে গেলেন। যে মুহুর্তে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ঘােড়া থেকে পড়ে গেলেন, আল্লাহর আরশ দুলিয়ে উঠলাে, ফাতিমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর আত্মা ছটফট করতে লাগল, হযরত আলী (رضي الله عنه) এর রূহ মুবারক থেকে 'আহ' শব্দ বের হল। সেই হুসাইন (رضي الله عنه) পতিত হলেন, যাকে প্রিয় নবী (ﷺ) নিজের কাঁধে নিতেন। ঘােড়া থেকে পতিত হওয়ার পর কমবখত সীমার, হাওলা বিন ইয়াজিদ, সেনান বিন আনস প্রমূখ বড় বড় জালিম এগিয়ে আসলাে এবং হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শরীরের উপর চেপে বসল। সীমার বুকের উপর বসল। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) বুকের উপর সীমারকে দেখে বললেন, আমার নানাজান (ﷺ) কি বলেছেন “এক হিংস্র কুকুর' আমার আহলে বায়তের রক্তের উপর মুখ দিচ্ছে, আমার নানাজান (ﷺ) এর কথা ষোল আনা সত্য, তুমিই আমার হত্যাকারী। আজ জুমার দিন, এ সময় লােকেরা আল্লাহর দরবারে সিজদারত। আমার মস্তকটা তখনই আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন কর, যখন আমিও সিজদারত থাকি। আহ! দেখুন, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) জীবন সায়াহ্নের সেই মূহুর্তেও পানি পান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি, নিজের ছেলে মেয়েকে দেখার জন্য আরজু করেননি, সেই সময়ও কোন আকাঙ্খা বা আরজু থাকলে এটাই ছিল যে, আমার মাথা নত হলে যেন আল্লাহর সমীপেই নত হয়। সে সময়ও তিনি (رضي الله عنه) বাতিলের সামনে মাথা নত করেন নি। সেই সময়ও তিনি (رضي الله عنه) সিজদা করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন, নামায পড়ে দেখিয়েছেন, দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, হুসাইন (رضي الله عنه) আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও নামায ত্যাগ করেননি। তিনি (رضي الله عنه) দুনিয়াবাসীকে এটাই যেন বলতে চেয়েছিলেন, আমাকে যদি ভালবাসেন, আমার জিন্দেগী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) সিজদায় মাথা রাখলেন এবং
سبحان ربي الاعلى
তাসবীহ পাঠ করে বললেন- মওলা! যদি হুসাইন (رضي الله عنه) এর কুরবানী তােমার দরবারে গৃহীত হয়, তাহলে এর সওয়াব নানাজান (ﷺ) এর উম্মতের উপর বখশিশ করে দাও। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর মস্তক মুবারক যখন শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল তখন তাঁর (رضي الله عنه) ঘােড়া স্বীয় কপালকে তাঁর (رضي الله عنه) রক্তে রঞ্জিত করল এবং দৌড়ে চলে যেতে লাগল, তখন সীমার লােকদেরকে বলল, ঘােড়াটিকে ধর, কিন্তু যতজন লােক ঘােড়াটি ধরতে এগিয়ে গেল, সে সবাইকে আক্রমন করল এবং দাত আর পা দিয়ে জখম করে ওদেরকে শেষ করে দিল। সতের জন লােককে এ ভাবে খতম করল। শেষ পর্যন্ত সীমার বলল, ছেড়ে দাও, দেখি কি করে। ঘােড়া ছুটে গিয়ে তাঁবুর কাছে গেল এবং কান্না ও চিৎকার করতে লাগল।
লাশের পার্শ্বে হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) ও সখিনা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহা
হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) যখন ঘোড়ার কান্না ও চিৎকার শুনলেন, তখন হযরত সৈয়দা সখিনা (رضي الله عنه) কে ডেকে বললেন, বেটি! একটু দাঁড়াও, আমি বের হয়ে দেখে আসি, সম্ভবতঃ তােমার আব্বা এসেছেন। মজলুম বােন বের হয়ে দেখলেন, ঘােড়ার জ্বিন খালি এবং ঘােড়ার কপাল রক্ত রঞ্জিত। তা দেখে হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) বুঝতে পারলেন, হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) শাহাদাত বরণ করেছেন এবং তিনি চিৎকার দিয়ে, واه حسينا واه غريبا তাঁর (رضي الله عنه) বলে উঠলেন আওয়াজ শুনার সাথে সাথে তাঁবুর অভ্যন্তরে ক্রন্দনের রােল পড়ে গেল। হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) ডাক দিয়ে বললেন, শহরবানু! সখিনাকে থামিয়ে রেখ, আমি ভাইয়ের খবর নিতে যাচ্ছি। হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর কন্যা হযরত সৈয়দা জয়নাব, যার মাথার ওড়নাও কোন অপরিচিত ব্যক্তি কখনো দেখেনি, যিনি ঘরের চৌহদ্দি থেকে কখনাে বের হননি, আজ পরদেশে অসহায় অবস্থায় মুখের উপর পর্দা ফেলে ভাইয়ের লাশকে দেখার জন্য কারবালার ময়দানের দিকে ছুটে চললেন।
القصه گرتی پڑتی گئیں فوج کی قریں
آیا نظر نه فاطمه(رض) زبرا کا مه جبيں
گھیرے ہوئے تھی چار طرف سے سپاه کیں
چلا ئی راه دو مجهے ای دشمنان دين
ية ابن فاطمه ہے میں زہرا کی جائی ہوں
دیدار آخری کی تمنا میں آئی ہوں
ওহে জালিমগণ পথ ছেড়ে দাও, আমার ভাইকে দেখতে দাও, আমার ভাইকে আমি দেখতে চাই। ওরা বলল, তুমি ওকে কি দেখবে, ওর মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।
قاتل تو اس طرف کو سر پاك لی چلا
تڑ پا زمین په ياں بدن شاه کربلا
طبل ظفر بجانے لگے دشمن خدا
غل پزشکی شهید بوا ابن مر تضی
کھیتی علی کی کث گی بستی اجڑ گی
پردیس میں حسین سے زینب بچهڑ گی
হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) গিয়ে দেখলেন
ناگاه بہن کو آیا نظر لاشئه امام
بغلوں میں ہاتھ ڈال کے لپٹی وه تشنه کام
رکھ کر کٹے گلے په گلايه كيا كلام
اپنی کهی نه میری سئی ہو گئے تمام
ہائے ہائے يه ميرے آتے ہی بے داد ہو گی
تم ہو گئے شہید میں برباد ہو گئی
হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) ভাইয়ের লাশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, ভাইয়া! তুমিতাে আমাদেরকে জালিমদের হাওলা করে চলে গেলে। আল্লাহ! আল্লাহ! হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর নিস্প্রাণ দেহ পড়ে রইল। যে সব লােকেরা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর লাশ দাফন করেছিলেন, তারা বলেছেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শরীরে চৌত্রিশটি বর্শার ছিদ্র ছিল, চল্লিশটা তলােয়ারের আঘাত ছিল এবং একশত একুশটি তীরের জখম ছিল।
হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) নিজের ভাইয়ের লাশ মুবারকের পাশে বিভাের হয়ে পড়ে রইলেন। এ দিকে হযরত সৈয়দা সখিনা হযরত সৈয়দা শহরবানু (رضي الله عنه) থেকে নিজেকে মুক্ত করে কারবালার ময়দানের দিকে অঝাের ক্রন্দনরত অবস্থায় ছুটে গেল এবং চিৎকার করে বলতে লাগলাে- ফুফু, তুমি কোথায়? আব্বু আমার কোথায়? আওয়াজ শুনে ফুফু ডাক দিলেন- বেটী, এ দিকে এসাে, তােমার মজলুম ফুফু, তােমার আব্বুর পাশে বসে আছে। হযরত সৈয়দা সখিনা যখন নিজের আব্বাজানকে দেখলাে, চিনতে পারলােনা। কারণ, তাঁর (رضي الله عنه) সমস্ত শরীর রক্ত রঞ্জিত ছিল এবং মস্তক মুবারক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। মাসুম সখিনা আব্বাজানের লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেহুস হয়ে গেল। হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) সখিনার হাত ধরে টেনে বলল- মা সখিনা! উঠ, আমি তােমাকে তাঁবুতে দিয়ে আসি। আমার ভাইয়া আমাকে বলেয গেছেন যে, তােমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। জোর করে সখিনাকে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর বুক থেকে ছাড়িয়ে তাঁবুতে নিয়ে গেলেন।
আল্লাহ! আল্লাহ! হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গী সাথীদের লাশ কারবালার ময়দানে পড়ে রইলাে। ইয়াজিদ বাহিনী তাদের লােকদের লাশ গুলাে খুঁজে খুঁজে দাফন করলাে। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ও আহলে বায়তের লাশ যে ভাবে ছিল, সে ভাবে পড়ে রইল। আল্লাহ! আল্লাহ! এরা এক রাত সেখানে অবস্থান করলাে। পরের দিন তাদের চলে যাওয়ার কথা। যখন রাত হল, ইয়াজিদ বাহিনীরা, যারা ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হয়ে মনে করেছিল তারা বিজয়ী হয়েছে, বাস্তবে তাদের এমন পরাজয়ই হলাে, যা আর কারাে কখনাে হয়নি। যাক, যখন তারা শুয়ে পড়ল, হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) মুখে পর্দা ফেলে তাঁবু থেকে পুনরায় বের হলেন। দেখলেন, হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর বাগানের জান্নাতি ফুল কারবালার প্রান্তরে পড়ে রয়েছে। নবী করিম (ﷺ) এর নয়নের মনি চকমক করছে। সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) এক পলক সকল প্রিয়জনকে দেখলেন। সবর ও ধৈর্যে অটল থাকা সত্বেও অঝােরে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে এক এক জনকে দেখে দেখে শেষে ভাইয়ের লাশের পাশে আসলেন এবং বললেন,
سرميرے کونی دوس نه ديويں بہن تیری مجبور اے
کتھوں لیا واں کفن میں تيرا ايتهوں شهر مدينه دوراے
ওগাে আমার ভাইয়া! আমি অসহায়, অপারগ, ভিন দেশের মুসাফির, মদীনা মনােয়ারা অনেক দূর। আমি কি ভাবে ওখানে তােমার খবর পৌছাবাে? আমি কি ভাবে তােমার দাফন করব? আহ! হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর কলিজার টুকরা, নবী করিম (ﷺ) এর আদরের দৌহিত্র কারবালার প্রান্তরে বেওয়ারীশের মত পড়ে রইল।
হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) মদীনার দিকে মুখ করে ক্রন্দনরত অবস্থায় হাত তুলে বলতে লাগলেন
یا رسول الله: يا محمد صلى عليك الله وملك الشماه-
هذا حسيت بالعراه مذمل بالدماه- مقط الأعضایا
ইয়া রাসুলাল্লাহ (ﷺ) আপনার দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কাফন ও দাফনহীন রক্ত রঞ্জিত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। আর এদিকে রুগ্ন হযরত জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) হাত তুলে বলছেন,
یا رحمت للعالمين ادرکنی زين العابدين
হে সমগ্র জগতের রহমত! জয়নাল আবেদীনকে প্রবোধ দান করুন।
আল্লাহ! আল্লাহ! এ ভাবে রাত্রি অতিবাহিত করলেন। উলামায়ে কিরাম লিখেছেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শাহাদাতের সময় সূর্য গ্রহণ হয়েছিল, আসমান ঘাের অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, ফলে দিনে তারকারাজি দৃষ্টিগােচর হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর দিগন্ত লালিমাতে পরিণত হয়েছিল এবং আসমান থেকে রক্ত বর্ষিত হয়েছিল। সাত দিন পর্যন্ত এ রক্ত বর্ষন অব্যাহত ছিল। সমস্ত ঘর বাড়ীর দেয়াল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল এবং যে সব কাপড়ের উপর রক্ত পতিত হয়েছিল,সেগুলাে ছিড়ে টুকরাে টুকরাে হওয়ার পরও সেই লালিমা যায়নি। জমিনও কান্নাকাটি করেছে। পানি ভর্তি কলসী রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ইয়াজিদী বাহিনীরা যখন উট যবেহ করেছিল তখন এর ভিতর থেকে রক্তের পরিবর্তে আগুনের লেলিহান শিখা বের হয়েছিল। জ্বীনদের মধ্যেও শোকের মাতম ছড়িয়ে পড়েছিল। এক অদ্ভুত ও বিস্ময়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক দূর্লভ, লােমহর্ষক ঘটনার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শাহাদাতের ঘটনা অতুলনীয়। এর নকশা চোখের সামনে ভেসে উঠলে মন প্রাণ শিহরিয়ে উঠে।
শহীদ পরিবারকে কুফায় আনয়ন
ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শাহাদাতের পর ইয়াজিদী বাহিনী একরাত কারবালার প্রান্তরে অবস্থান করেছিল। পর দিন সকালে তারা তাদের মৃতদেরকে দাফন করলাে। কিন্তু শহীদদের লাশ দাফন ও কাফন বিহীন অবস্থায় যেমনি ছিল, তেমনি অবস্থায় ফেলে রেখে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর পরিবারের অবশিষ্ট মহিলা ও শিশুদেরকে বন্দী করে উটের উপর উঠিয়ে কুফার দিকে যাত্রা দিল। চলতে চলতে তারা রাত্রি বেলা কুফার কাছে পৌছল। ঐখান থেকে মাত্র দুই মঞ্জিল দূরত্বে ছিল কুফার রাজধানী। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর মস্তক মুবারক নিয়ে হাওলা বিন ইয়াজিদ' যখন রাত্রে কুফার রাজধানীতে এসে পৌছেছিল, তখন গভর্নর ভবনের শাহী দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মস্তকের জিম্মাদারী যেহেতু ওর হাতে, সেহেতু অন্য কাউকে হস্তান্তর না করে মস্তক মুবারক নিজের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে নিয়ে গিয়ে একটি মাটির বাসনের নীচে মস্তক মুবারক রেখে দিল। ওর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি এনেছ? সে উত্তরে হযরত হুসাইন বিন আলী (رضي الله عنه) এর মস্তক মুবারকের কথা বললাে। এটা শুনে সে শিহরিয়ে উঠলাে এবং বললাে- কী জঘন্য ব্যাপার! তােমার ঘর ধ্বংস হয়ে যাবে। হযরত হুসাইন বিন আলী (رضي الله عنه) এর মস্তক মুরারক! নবী মুস্তাফা (ﷺ) এর দৌহিত্রের মস্তক মুবারক তুমি মাটির থালার নীচে রাখতে পেরেছ? আফসােস! মানুষ ঘরে সােনা-চান্দি আনে, আর তুমি এনেছ নবী করিম (ﷺ) এর দৌহিত্রের ছিন্ন মস্তক মুবারক। আর এ ভাবে বেয়াদবী এবং অবজ্ঞাভরে রেখে দিয়েছ! আমি তােমার মত বদবখত লােকের সাথে থাকতে চাইনা' এ বলে সে মস্তক মুবারকের কাছে এসে সম্মান সহকারে মস্তকে মাটি থেকে উঠিয়ে উচ্চস্থানে রাখলাে এবং পাশে বসে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় চিন্তা করতে লাগল, কী জানি আমাদের ঘরে আল্লাহর কোন্ গজব নাযিল হয়। এমন সময় সে কী দেখতে পেল, তা ওর ভাষায় ওনুন, 'আমি দেখলাম, আসমান থেকে ছােট ছােট সাদা পাখির আগমন হল এবং এগুলাে উনার মস্তক মুবারকের এদিক সেদিক উড়ছিল এবং ঘুরাঘুরি করছিল। একবার চলে যেত, আবার আসত। সারারাত এ অবস্থায় ছিল এবং মাঝে মধ্যে মস্তক মুবারক থেকে এমন উজ্জ্বল আলাে বিচ্ছুরিত হতে দেখলাম, যা আসমান পর্যন্ত আলােকিত করে ফেলতাে।
ইবনে জিয়াদের নিষ্ঠুর আচরণ
রাত অতিবাহিত হওয়ার পর ভাের হল। ইবনে জিয়াদ দরবারে আগমন করল এবং তাকে কারবালার তথাকথিত বিজয় সম্পর্কে অভিহিত করা হল। হাওলা বিন ইয়াজিদ হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) এর মস্তক মুবারক দরবারে নিয়ে পেশ করল এবং একটা পাত্রের উপর রেখে তা ইবনে জিয়াদের সামনে রাখল। ইবনে জিয়াদের হাতে একটি ছড়ি ছিল। সে ছড়ির মাথা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর ঠোঁটের উপর লাগাল এবং দাঁতের সাথে ঘষতে লাগল। সেই সময় তার দরবারে নবী করিম (ﷺ) এর এক বৃদ্ধ সাহাবী হযরত জায়েদ বিন হাসান উপস্থিত ছিলেন। তিনি এ বেয়াদবী দেখে কেঁদে দিলেন এবং বলে উঠলেন, 'হে ইবনে জিয়াদ! যে ঠোট এবং দাঁতের উপর তুমি আঘাত হানছ, খােদার কসম করে বলছি, আমি স্বয়ং দেখেছি, সে দাঁত ও ঠোটের উপর নবী করিম (ﷺ) চুমু দিতেন। আর আজ তুমি সে ঠোট এবং দাঁতের সাথে বেয়াদবী করছ। ভরপুর দরবারে একথাগুলাে বলার কারণে ইবনে জিয়াদ খুবই রাগান্বিত হল এবং বলল, 'এ বৃদ্ধকে দরবার থেকে বের করে দাও। বৃদ্ধ না হলে আমি এ মূহুর্তে ওর গর্দান দ্বিখন্ডিত করে ফেললাম। হযরত জায়েদ বললেন, তােমার জন্য আফসােস! তুমি আমাকে বৃদ্ধ হিসাবে সহানুভূতি দেখালে কিন্তু রসুল্লাল্লাহ (ﷺ) এর শরাফতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলে না। আমি বৃদ্ধ বলে তুমি আমাকে রেহাই দিলে, কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) এর কলিজার টুকরা ও দৌহিত্র হওয়া সত্বেও কোন সমীহ করলেনা। তাঁর কথার প্রতি আদৌ কর্ণপাত না করে ইবনে জিয়াদের অনুচরেরা তাকে বেত্রাঘাত করে দরবার থেকে বের করে দিল।
ইবনে জিয়াদ দরবারে দাঁড়িয়ে কয়েকটি দাম্ভিকতাপূর্ণ কথা বলল। যেমন, সব প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্যে, যিনি দুশমনকে নাজেহাল করল, যিনি দুশমনদেরকে পরাজিত করল এবং যিনি ইবনে জিয়াদকে বিজয় দান করল। সেই সময় খায়বর বিজয়ী বীরের অগ্নিকন্যা হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) সেখানে কয়েদী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন
الحمد لله الذي أكرمنا بمحمد (صلى الله عليه وسلم) وطهرنا تطهيرا
অর্থাৎ সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (ﷺ) এর বংশধর হওয়ার কারণে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন আর যিনি আমাদের সম্পর্কে পবিত্র আয়াত নাযিল করেছেন এবং আমাদের পুত পবিত্রতার কথা ঘােষণা করেছেন। ইবনে জিয়াদ বলে উঠলাে, তুমি কি এখনও সেই কথা বলছ? তুমি কি দেখনি তােমার ভাইয়ের কি পরিণতি হয়েছে? হযরত জয়নাব (رضي الله عنه) কেঁদে দিলেন এবং কেঁদে কেঁদে বললেন, হে ইবনে জিয়াদ। সেই সময় বেশী দুর নয়, যখন হাশরের ময়দানে একদিকে নবী করিম (ﷺ) থাকবেন, আর একদিকে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) থাকবেন, তখন তুমি দেখবে জালিমদের কী পরিণতি হয়। আমাদের আরজি আল্লাহর দরবারে পেশ করেছি এ কথাগুলাে বলে তিনি (رضي الله عنه) নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
ইত্যবসরে হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) এর প্রতি ইবনে জিয়াদের চোখ পড়ল। সে জিজ্ঞাসা করল, এ কে? ইয়াজিদরা বলল, এ হল হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর ছেলে। ইবনে জিয়াদ বলল, তােমরা একে কেন রেখে দিয়েছ? একে কেন হত্যা করনি? ওরা বলল, 'এ অসুস্থ ছিল এবং আমাদের সাথে মােকাবেলা করতে আসেনি। এ জন্য আমরা একে হত্যা করিনি। ইবনে জিয়াদ বলল, একেও হত্যা করে দাও। আমি চাইনা যে, এদের একজনও বাকী থাকুক। এ পাপিষ্ঠ এ কথাগুলাে বলার সাথে সাথে জল্লাদ তলােয়ার নিয়ে এগিয়ে আসলাে। হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) হযরত জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) কে নিজের কাছে টেনে নিলেন এবং বললেন, জালিমরা? আমাদের সাথে কোন মােহরেম (আপনজন) নেই। এ একমাত্র আমাদের মহরম (আপনজন)।
যদি তোমরা একে হত্যা কর, আমাদের সাথে কোন মােহরেম থাকবে না। তাই তুমি এটা জেনে রেখ, আমাকে হত্যা করার আগে তুমি এর কাছেও পৌছতে পারবে না। যদি একে হত্যা করতে চাও তা হলে প্রথমে আমাকে হত্যা কর। জালিমরা! একে বাঁচতে দাও, যদি তােমরা একেও হত্যা করে ফেল, তা হলে আওলাদে রসুল (ﷺ) এর 'সিলসিলা কি ভাবে জারী থাকবে? এ কথাগুলাে বলার পর আল্লাহ তাআলা ইবনে জিয়াদের মনে এমন এক ভীতি সৃষ্টি করে দিল, শেষ পর্যন্ত সে তার এ ঘৃণিত সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রইল।
এরপর ইবনে জিয়াদ কুফা শহরে সাধারণ সমাবেশের আয়ােজন করল এবং সমবেত লােকদের ধমকি ও হুমকি দিয়ে বলল, দেখ! যারা ইয়াজিদের বিরােধীতা করেছে, তাদের কী পরিণতি হয়েছে। তােমরাও যদি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কোন কথা বল, তাহলে তােমাদেরও একই পরিণতি হবে। সে নির্দেশ দিল, শহীদদের মস্তক সমূহ বর্শার অগ্রভাগে নিয়ে এবং আহলে বায়তের অবশিষ্ট সদস্যদেরকে উটের পিঠে উঠিয়ে কুফার অলিতে গলিতে যেন ঘুরানাে হয়, যাতে লােকেরা দেখে শিক্ষা গ্রহন করে এবং আগামীতে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ করার সাহস না পায়। নির্দেশ মােতাবেক মস্তক সমূহ বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে কুফার অলিতে গলিতে ঘুরানাে হলাে এবং সাথে আহলে বায়তের সেই পর্দানশীন সম্মানিতা মহিলাগণও ছিলেন, যাদের দোপাট্টা পর্যন্ত লােকেরা আগে কখনও দেখার সুযােগ পায়নি। আফসােস! আজ তাদের বেপর্দাভাবে কুফার অলিতে গলিতে ঘুরানাে হচ্ছে। যখন তাঁদেরকে ঘুরানাে হচ্ছিল তখন বেওফা কুফাবাসী, যারা চিঠি লিখে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে দাওয়াত দিয়েছিল, যারা হযরত ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) এর হাতে বায়াত করেছিল এবং যারা বড় বড় শপথ করে বলেছিল, জান- মাল উৎসর্গ করে দিব তবুও আপনার সঙ্গ ত্যাগ করব না যারা আহলে বায়তের মহব্বতের বড় দাবীদার ছিল, যারা নিজেদেরকে আহলে বায়তের প্রেমিক বলত,সেই কুফাবাসীরা, মস্তক সমূহ বর্শার অগ্রভাগে নিয়ে এবং আহলে বায়তের অবশিষ্ট সদস্যগণকে একান্ত অমানবিকভাবে কুফার অলিতে গলিতে যখন ঘুরাতে দেখল, তখন তারা নিজেদের ঘরের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে, কেউ ঘরের জানালার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল ।
যখন হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) তাদের এ কান্না ও চিৎকার করতে দেখলেন, তখন তিনি উটকে থামাতে বললেন এবং ওদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ওহে কুফাবাসী! আজ তােমরা কেন মাতম করছ? হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর কাছে চিঠি প্রেরণকারী ছিল কারা? আসার জন্য দাওয়াত দানকারী ছিল কারা? হযরত ইমাম মুসলিমকে যখন প্রতিনিধি করে পাঠানাে হয়েছিল, তখন তাঁর হাতে বায়াত করেছিল কারা? এবং বড় বড় শপথ করে জানমাল কুরবানী করার নিশ্চয়তাদানকারী ছিল কারা? জালিমরা! তােমরাইতাে চিঠি লিখেছিলে, তােমরাইতাে নবী করিম (ﷺ) এর দৌহিত্রকে দাওয়াত করে এনেছিলে। এরপর তােমরাইতাে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ এবং উনাদেরকে জালিমদের হাতে সােপর্দ করেছ। ফলে নবী (ﷺ) এর দৌহিত্রকে একান্ত অমানুষিকভাবে শহীদ হতে হলে। আর এখন তােমরা অশ্রুপাত করছ। বিশ্বাস ঘাতকদের দল! তােমরা কি মনে করেছ, তােমাদের এ অশ্রুপাতের ফলে তােমাদের কপাল থেকে আহলে বায়তের রক্তের দাগ মুছে যাবে? না! না! কক্ষনাে না হবে না, কিয়ামত পর্যন্ত তােমরা কাঁদতে থাকে তোমার ললাট থেকে এ রক্তের দাগ মুছবে না। আমি অভিশাপ দিচ্ছি, তােমরা কিয়ামত পর্যন্ত এ ভাবে কাঁদতে ও চিতকার করতে থাক। হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) কথাগুলাে বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
শহীদ পরিবার ও খন্ডিত মস্তক দামেস্কে প্রেরণ
এ ভাবে তিন দিন পর্যন্ত মস্তক সমূহ ও শহীদ পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদেরকে ঘুরানাের পর ইবনে জিয়াদ নির্দেশ দিল, এ বার এ মস্তক সমূহ ও শহীদ পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদেরকে দামেস্কে ইয়াজিদের কাছে নিয়ে যাও। ইবনে জিয়াদ আরও বলল যে, পথের মধ্যে কোন গ্রাম, বাজার, কোন লােক বসতি সামনে পড়লে যেন তকবীর ইত্যাদি বলে শাের গােল করে যাওয়া হয়, যাতে লােকেরা ভয় পায় এবং ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করার সাহস না পায়। অতঃপর ইয়াজিদী বাহিনী মস্তক সমূহ বর্শায় বিদ্ধ করে এবং শহীদ পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদেরকে উটের উপর উঠিয়ে কুফা থেকে দামেস্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা দিল। চলতে চলতে রাত্রি বেলা তারা এক গীর্জার সন্নিকটে উপনীত হল। যখন এ কাফেলা গীর্জার কাছে পৌছল, তখন গীর্জা থেকে এর প্রধান পাদ্রী বের হয়ে ওদের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, তােমরা কে? কোথা থেকে আসছে মস্তক গুলো কাদের? এ মহিলাগণ কারা? তােমরা যাচ্ছ কোথায়? ঘটনা কি? তারা সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করল। পাদ্রী সম্পূর্ণ ঘটনা শুনার পর বলল, তােমরা চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ, রাতটা এখানেই কাটাও এবং এক রাতের জন্য হযরত ইমাম হোসাইন (رضي الله عنه) এর এ মস্তক মুবারকটি আমার কাছে আমানত রাখ এবং এ সব পুঁত পবিত্র মহিলাগণের খেদমত করার সুযোগ দাও। ওরা বলল, তা কিছুতেই হতে পারে না। সরকার গুরুদায়িত্ব আমাদের কাধে অর্পণ করা হয়েছে, এ মস্তক আমরা কারাে হাতে দিতে পারি না। মস্তক ও এদেরকে ইয়াজিদের কাছে পৌছাতে হবে। পাদ্রী বলল, ঠিক আছে পৌছাবে, কিন্তু এ রাতেতাে আর পৌছাতে পারবে না। ওরা বলল, আমরা এখানে রাত অতিবাহিত করতে রাজী আছি। কিন্তু মস্তক দিতে রাজী নই। পাদ্রী বলল, আমার থেকে টাকা নিয়ে হলেও এক রাতের জন্যে মস্তকটি আমার হেফাজতে দাও এবং আমি ওয়াদা করছি, তােমাদের মস্তক ফিরিয়ে দেব। ওরা বলল, আমাদেরকে কত টাকা দিবেন? পাদ্রী বলল, আমার কাছে আমার সারা জীবনের উপার্জিত আশি হাজার দেরহাম জমা রয়েছে। আমি সব তােমাদেরকে দিয়ে দিব। তােমরা শুধু এক রাতের জন্য মস্তকটি দাও। ওরা চিন্তা করল, ইয়াজিদ থেকে তাে বখশিশ পাবই, আর এদিকে মস্তক আশি হাজার দিরহাম হাতছাড়া করব কেন? শেষ পর্যন্ত তারা রাজী হয়ে গেল এবং এক রাত্রের জন্য মস্তক দিয়ে দিল।
পাদ্রি গীর্জার এক পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন কামরা ভদ্র মহিলাদের বিশ্রামের জন্য দিয়ে দিল এবং ওনাদের খেদমত করার জন্য কয়েকজন খাদেম নিয়ােজিত করল। আর ওদেরকে বলে দিল যেন ওনাদের কোন কষ্ট না হয়। আহলে বায়তের মহিলাগণ পাদ্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, পাদ্রী সাহেব! আমাদের আগমণের খবর আপনি কেমন করে জানতে পারলেন? পাদ্রী বলল, আমি ভিতরে বসা ছিলাম, তখন আপনাদের কাফেলা বেশ কিছু দূরে ছিল, আমি হঠাৎ শুনলাম, আমার গীর্জার বড় দেয়ালটা কাঁদছে। আমি আমার জীবনে এ রকম কান্না আরও কয়েকবার শুনেছি। কান্না শুনার পর আমি বুঝতে পারলাম, কোন একটা অঘটন ঘটেছে। তখন আমি বের হলাম, কি ঘটনা ঘটল তা দেখার জন্য। আপনাদের কাফেলা দেখে এবং সমস্ত ঘটনা শুনে বুঝতে পারলাম,আপনাদের প্রতি অমানুষিক জুলুম করা হয়েছে। নবী মুস্তাফা (ﷺ) এর দৌহিত্রকে নিদারুন অত্যাচারের সাথে শহীদ করা হয়েছে। এ জন্যই বড় দেয়ালটা কাঁদছিল।
অতঃপর পাদ্রী তাঁদেরকে ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিলেন এবং বললেন আল্লাহর নেক বান্দাগণের প্রতি এ রকম মসিবত আগেও এসেছে, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও আসবে। আপনাদেরকে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরাকাষ্টা দেখাতে হবে। আল্লাহ তাআলা আপনাদের নাম কিয়ামত পর্যন্ত চির জাগরুক রাখবে।
এরপর পাদ্রী ইয়াজিদ বাহিনীকে আশি হাজার দেরহাম দিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর মস্তক মুবারক নিয়ে নিলেন। মস্তক মুবারক নিয়ে তিনি তাদের উপাসনাগারে চলে গেলেন। চেহারা মুবারকে. যে সব রক্তের দাগ ছিল, তিনি সব পরিস্কার করলেন এবং নিজের কাছে যা সুগন্ধী ছিল সব হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর চুল ও দাড়ী মুবারকে ঢেলে দিলেন এবং একটি রেশমী কাপড়ে জড়িয়ে উঁচু জায়গায় রাখলেন আর সারারাত তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন ও কান্নাকাটি করলেন। তিনি হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর মস্তক মুবারকের যত্ন নিলেন এবং সম্মান করলেন। ফলে, আল্লাহর রহমতের শান দেখুন, সকাল বেলা ওনার মুখ থেকে কলেমা তৈয়্যবা জারী হয়ে গেল। মস্তক মুবারকের তাজিম করার ফলে আল্লাহ তাআলা ওনাকে ঈমানী দৌলত দ্বারা পরিতুষ্ট করলেন এবং তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন। তিনি দুনিয়াবী দৌলত ত্যাগ করলেন, আল্লাহ তাআলা তাকে ঈমানী দৌলত দান করলেন। তিনি অস্থায়ী দৌলত (আশি হাজার দেরহাম) প্রদান করলেন, আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তাঁকে স্থায়ী দৌলত (ঈমান) দান করলেন।
সকালে ইয়াজিদ বাহিনী মস্তক সমূহ ও শহীদ পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদেরকে নিয়ে পুনরায় যাত্রা দিল। কিছুদূর যাওয়ার পর ইয়াজিদী বাহিনী পরস্পর পরামর্শ করে পাদ্রী প্রদত্ত আমি হাজার দেরহাম তাদের মধ্যে বন্টন করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কারণ, ইয়াজিদ জানতে পারলে সব দেরহাম নিয়ে নিতে পারে। সিদ্ধান্ত মােতাবেক বন্টন করার জন্য যেই মাত্র দেরহামের পুটলি খুললাে, তখন দেখতে পেল সব মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকরা এবং প্রতিটি টুকরার দুই পিঠে পবিত্র কুরআনের আয়াত লিখা।
এক পিঠে লিখা ছিল
وسيعلم الذين ظلموا ای منقلب ينقلبون
অর্থাৎ জুলুমকারী অতি সহসা জানতে পারবে, সে কোন দিক হয়ে বসে আছে। অপর পিঠে লিখা ছিল
ولاتحسبن الله غافلا عما يعمل الظاليمون-
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলাকে জালিমের কাজ কর্মের প্রতি উদাসীন মনে করাে না। জালিমরা যা কিছু করছে, আল্লাহ তাআলা সব জানেন। এ ব্যাপারে আল্লাহকে অজ্ঞ মনে করাে না। দেখুন, আশি হাজার দেরহাম ওরা নিয়েছিল কিন্তু তা মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকরা হয়ে গেল- خير الدنيا والأخيرة তাড়াতাড়ি দীনের পরিবর্তে দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, সেটাতেও বিফল হল। কিন্তু যারা দুনিয়াকে অবজ্ঞা করে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরে, দুনিয়াবাসী ওদের পিছনে ঝুঁকে পড়ে, সম্পদ ওদের পদতলে গড়াগড়ি খায় ।
ইয়াজিদের দরবারে শহীদ পরিবার ও ইয়াজিদের ভন্ডামী
যাক, আশি হাজার দেরহামের অনুশােচনা করতে করতে তারা দামেস্কে পৌছল এবং ইয়াজিদের দরবারে গিয়ে সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিল। ইয়াজিদ সমস্ত ঘটনা শুনে, বলল, ইবনে জিয়াদ খুবই বাড়াবাড়ি করেছে। আমি ওকে এতটুকু করতে বলিনি। এমনকি অনেক কিতাবে লিখা হয়েছে যে, ইয়াজিদ ইবনে জিহাদের প্রতি লানত দিয়েছিল। অর্থাৎ সে বলেছিল, আল্লাহ ইবনে জিয়াদের উপর লানত করুক, আল্লাহ হুসাইন (رضي الله عنه) এর প্রতি রহম করুক। ইবনে জিয়াদ খুবই অত্যাচার করেছে, আমার উদ্দেশ্য তা ছিল না। আমার উদ্দেশ্য ছিল ওনাকে (رضي الله عنه) যেন নজরবন্দী করা হয়, যাতে লােকেরা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে। কিন্তু এ ধরণের কথা ইয়াজিদকে রক্ষা করতে পারে না, এ ধরণের কথার দ্বারা ইয়াজিদ রেহাই পেতে পারে না। যা কিছু হয়েছে ইয়াজিদের ইঙ্গিতেই হয়েছে। ইয়াজিদ ইবনে জিয়াদকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করেছিল যেন সে যা প্রয়ােজন হয়, তা করে, যাতে ওর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বিদ্রোহ দমন হয়ে যায়। সে এ ধরণের দরদমাখা কথা এ জন্যে বলেছিল, যাতে লােক ওর বিরুদ্ধে চলে না যায় এবং লােকেরা যেন মনে করে- সে এ ধরণের আচরণ করার পক্ষপাতি ছিল না। এ সব কথার দ্বারা অনেক লােক ইয়াজিদকে ভাল মানুষ বলে আখ্যায়িত করেছিল এবং তাদের বিভিন্ন কিতাবে লিখেছে যে, ইয়াজিদ এ শাহাদাতে রাজি ছিল না। সুতরাং ইয়াজিদ নয়, ইবনে জিয়াদই এ ঘটনার জন্য দায়ী ছিল।
ইয়াজিদিই মূলত: দায়ী
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নির্ভরযােগ্য কিতাব ‘কিতাবুল আকায়েদ এ লিখা হয়েছে, 'ইয়াজিদের উপর, ইবনে জিয়াদের উপর ও আহলে বাইতের সদস্যদের হত্যাকারীদের উপর লানত বর্ষিত হােক'। যদি ইয়াজিদ নিষ্পাপ হত, তা হলে ইমাম নসফী তাঁর কিতাবুল আকায়েদে এ ধরণের কথা কক্ষনাে লিখতেন না। আর ইয়াজিদের পরবর্তী আচরনে তার আসল রূপ ধরা পড়ে। এত কিছু বলার পরও সে মস্তকগুলােকে রাত্রে রাষ্ট্রীয় ভবনের শাহী দরজায় টাঙ্গানাের জন্য এবং দিনে দামেস্কের অলি-গলিতে ঘুরানাের নির্দেশ দিয়েছিল। নির্দেশমত মস্তকসমূহ দামেস্কের অলি-গলিতে ঘুরানাে হয়েছিল। হুযুর (ﷺ) এর বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত মিনহাল বিন আমর ফরমায়েছেন, খােদার কসম, আমি স্বচক্ষে দেখেছি যে, যখন হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর মস্তক মুবারক বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে দামেস্কের গলিতে এবং বাজারসমূহে ঘুরানাে হচ্ছিল, তখন মিছিলের আগে আগে এক ব্যক্তি কুরআন শরীফের সূরা কাহাফ তিলওয়াত করছিল। যখন সে-
أم حسبت أن أصحاب الكهف والرقيم كانوا من التنا عجبا
(নিশ্চয় আসহাবে কাহাফ ও রকিম আমার নিদর্শন সমূহের মধ্যে এক أصحابআজব নিদর্শন ছিল।) পড়ছিল, তখন হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর বিচ্ছিন্ন মস্তক মুবারক থেকে আওয়াজ বের হলাে-
اعجب من الكهف قتلى وملي
অর্থাৎ আসহাবে কাহাফের ঘটনা থেকে আমার হত্যা এবং আমার মস্তক নিয়ে ঘুরাফেরা আরও অধিক আশ্চর্যজনক। আল্লাহ তাআলা ফরমান, যারা শহীদ হয়েছে,তাঁদেরকে মৃত বলনা। হযরত ইমাম হোসাইন (رضي الله عنه) এর বিচ্ছিন্ন মস্তক মুবারক তা প্রমাণ করে গেল।
শহীদ পরিবারের মদীনা প্রত্যাবর্তন
ইয়াজিদ নােমান বিন বশীরকে তলব করল, যিনি একজন বিশিষ্ট তাবেঈ ছিলেন। ওনাকে ডেকে বলল, আপনার সাথে আরও ত্রিশজন লােক নিয়ে শহীদ পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদেরকে বাহন যােগে মদীনায় পৌছিয়ে দিয়ে আসুন। হযরত নােমান বিন বশীর এ প্রস্তাবকে সানন্দে গ্রহণ করলেন এবং নিজের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় মনে করলেন। অতঃপর ত্রিশজন সহকর্মীসহ হুসাইন (رضي الله عنه) এর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) নােমান বিন বশীরকে বললেন, আমাদেরকে কারবালার পথ দিয়ে নিয়ে যান। আমরা দেখে যেতে চাই, আমাদের শহীদদের লাশ কি সেই ভাবে পড়ে আছে, না কি কেউ দাফন করেছে। যদি দাফন বিহীন অবস্থায় পড়ে থাকে, প্রথমে আমরা ওদেরকে দাফন করব, এরপর ওখান থেকে রওয়ানা হব। আর যদি কেউ দাফন করে থাকে, তাহলে তা দেখে অন্ততঃ কিছুটা সান্ত্বনা পাব। হযরত নােমান বিন বশীর হযরত সৈয়দা জয়নাব (رضي الله عنه) এর কথার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করলেন এবং কারবালার পথ ধরলেন। কারবালায় গিয়ে সেই প্রান্তর যখন দেখলেন, যেই প্রান্তরে তাঁদের আপনজনদেরকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়েছিল, হঠাৎ তিনি (رضي الله عنه) অপ্রত্যাশিতভাবে চিৎকার দিয়ে উঠলেন এবং অঝােরে কাঁদতে শুরু করলেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন এখানে আলী আসগরের লাশ পড়ে রয়েছিল, ওখানে আলী আকবরের লাশ পড়েছিল, এখানে আমার ভাই হুসাইনের পড়ে ছিল। তিনি এ ভাবে যখন হাতের আঙ্গুল দ্বারা দেখিয়ে দেখিয়ে যুদ্ধে অবস্থানের কথা বলছিলেন, তখন সবাইর মুখ থেকে ক্রন্দনের করুণ সুর হচ্ছিল। কারবালার নিকটবর্তী একটি গ্রাম ছিল, যার নাম ছিল 'আমরিয়া গ্রামের লােকেরা ইয়াজিদ বাহিনী চলে যাওয়ার পর এসে শহীদদের লাশ নুহ দাফন করেছিল। মদীনা শরীফ থেকেও একটি দল হযরত জাবের বিন আকারে নেতৃত্বে কারবালায় এসে পৌছে ছিল।
এই কাফেলা যখন কারবালার প্রান্তরে পৌছেছিল, সেই সময় মদীনা থেকে আগত দল ও আমরিয়া গ্রামের অধিবাসীরা উপস্থিত ছিল এবং এ মজলুম কাফেলাকে দেখে আর এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। ঘটনাক্রমে সে দিন ছিল ২০শে সফর অর্থাৎ শহীদদের 'চেহলামের' দিন। কাফেলা সেই রাত সেখানেই অতিবাহিত করেন। সারা রাত তাঁরা কুরআন শরীফ তেলওয়াত করেন, দুআ দরুদ পাঠ করেন এবং খাবারের জন্য খিচুড়ি পাকান। আজকাল সুন্নি মুসলমানদের ঘরে মহররম মাসে যেই খিচুড়ি পাকানাে হয় সেটা তাঁদের স্মৃতিচারণ। এক দিন এক রাত সেখানে অবস্থানের পর তাঁরা মদীনার পথে যাত্রা দিলেন।
কাফেলা যখন মদীনা মনােয়ারার সন্নিকটে পৌছল এবং চোখের সামনে মদীনা শরীফের দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল, তখন সবাইর চোখ আবার অশ্রু সজল হয়ে উঠল। এ দিকে তাদের আগমনের খবর বিদ্যুৎ গতিতে সমগ্র মদীনায় ছড়িয়ে পড়ল। সেই সময় হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর বড় মেয়ে হযরত ফাতেমা (رضي الله عنه) মদীনায় ছিলেন, যার সাথে হযরত ইমাম হাসান (رضي الله عنه) এর বড় ছেলের বিয়ে হয়েছিল। হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) এর ভাই হযরত মুহাম্মদ বিন হানাফিয়া (رضي الله عنه) মদীনায় ছিলেন, হযরত মুসলিম বিন আকিল (رضي الله عنه) এর মেয়ে ও বােনেরাও তখন মদীনায় ছিলেন। হুযুর (ﷺ) এর বিবি উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه)ও মদীনায় ছিলেন। ওনারা সবাই এবং মদীনার প্রতিটি ঘরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা মজলুম কাফেলাকে এক নজর দেখার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর মেয়ে ফাতেমা (رضي الله عنه) যখন মজলুম কাফেলাকে এগুতে দেখলেন, তখন সে একান্ত সবর ও ধৈর্যশীলা হওয়া সত্বেও অজান্তে হু হু করে কেঁদে উঠলেন এবং হযরত জয়নাব (رضي الله عنه) কে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, ফুফি! আমার আব্বাজানকে কোথায় রেখে এসেছ? আমার ভাই আলী আসগর ও আলী আকবর কোথায়? আমার চাচাত ভাই কাসেমকে কোথায় ফেলে এসেছ? আমার আব্বাস চাচ্চু কোথায়? আমাদের ভরপুর ঘর কোথায় লুষ্ঠিত হল? হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) এর সুশােভিত বাগানকে ছিন্ন ভিন্ন কারা করল? এ ভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলেন এবং এমন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল, তখন চারিদিকে শুধু কান্না আর কান্নার রােল শুনা যাচ্ছিল। মহিলাদের এমন অবস্থা হয়েছিল যে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অনেকে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল। লােকেরা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সবর ও ধৈর্যের পরামর্শ দিয়ে কাফেলাকে মদীনা শরীফে নিয়ে আসলেন।
রওজা পাকে ইমাম জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) এর হাজেরী
মজলুম কাফেলার একমাত্র জীবিত পুরুষ সদস্য হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) শোকে পাথর হয়ে এক কিনারে দাঁড়িয়েছিলেন। সবাই যখন তাঁকে ঘরে যাওয়ার জন্য জোর করলেন, তিনি বললেন, আমার আব্বাজান ওসীয়ত করেছেন, মদীনা শরীফ পৌছে যেন সবার আগে তার নানাজান (ﷺ) এর রওজা পাকে হাজিরা দিই। তাই আমি রওজা পাকে যাওয়ার আগে কোথাও যাবনা। অতঃপর তিনি (رضي الله عنه) রওজা পাকে পৌছলেন। হযরত জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) যিনি এতক্ষণ সবর ও ধৈর্যের পরাকাষ্টা দেখিয়ে নিশ্চুপ ছিলেন, কিন্তু রওজা পাকের সামনে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। শুধু এতটুকু বলতে পেরেছিলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (ﷺ) আপনার দৌহিত্র হুসাইন (رضي الله عنه) এর সালাম গ্রহণ করুন। এরপর তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ছুটে গেল এবং অঝােরে কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের দেখা কারবালার সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলেন। আর তাঁর কাদার সাথে সাথে মদীনা শরীফের সমস্ত দেয়াল থেকে কান্নার রােল বের হলাে এবং রওজা মুবারকও থরথর করে কাঁপতে লাগলাে এবং এর থেকে আওয়াজ বের হলাে, 'জয়নুল
আবেদীন! তুমি আমাকে কী শুনাচ্ছ? আমি তাে সব কিছু স্বচক্ষে দেখেছি। মদীনাবাসীরা হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) কে ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিয়ে বললেন, আল্লাহর যা হুকুম ছিল, তা হয়েছে। হুযুর (ﷺ) এর সম্মানিত বিবি হযরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) ফরমান, মদীনা শরীফে একবার সেই দিনেই কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেই দিন হুযুর (ﷺ) আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন, আর একদিন কিয়ামত কায়েম হল, যে দিন হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) কারবালা থেকে ফিরে এল। হযরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) আরও বলেন, হুযুর (ﷺ) এর ওফাতের দিন অদৃশ্য থেকে কিভাবে ক্রন্দনের আওয়াজ শুনা গিয়েছিল, সে ভাবে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শাহাদাতের সময় একই ভাবে অদৃশ্য থেকে কান্নার আওয়াজ শুনা গিয়েছিল।
যা হােক, রওজা পাকে হাজিরা দিয়ে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করার পর তিনি ঘরে গেলেন এবং একান্ত সবর ও ধৈর্য সহকারে মদীনা শরীফে অবস্থান করতে লাগলেন। হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) এর এমন অবস্থা হয়েছিল যে, যখন তিনি পানি দেখতেন সীমাহীন কান্নাকাটি করতেন এবং বলতেন এই সেই পানি, যা আলী আসগরের ভাগ্যে জোটেনি, আলী আকবরের ভাগ্যে জোটেনি, আহলে বায়তের সদস্যদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তাঁর সামনে খাবার আনা হলে দু'এক গ্রাস মুখে দিয়ে বাদ-বাকীগুলাে সামনে থেকে নিয়ে যেতে বলতেন। সব সময় একাকী থাকতে পছন্দ করতেন। সাধারণ লােকদের সাথে মেলামেশা করতেন না এবং যতদিন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন, কোন দিন হাসেননি। ওনার ছেলে, ইমাম মুহাম্মদ বাকের (رضي الله عنه) একদিন ওনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আব্বাজান! কী ব্যাপার? আমি আপনাকে কোন দিন হাসতে দেখিনি। তিনি ফরমালেন, বেটা! আমার চোখের সামনে কারবালার যে দৃশ্য ফুটে রয়েছে, তা দেখলে তােমার মুখ থেকেও চিরদিনের জন্য হাসি বন্ধ হয়ে যেত। তুমিও সারা জীবন কোন দিন হাসতে না। বেটা! আমি পুত-পবিত্র শরীরকে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দেখেছি, প্রিয় নবী করিম (ﷺ) এর প্রতিচ্ছবিকে দাফন-কাফন বিহীন অবস্থায় কারবালার প্রান্তরে পড়ে থাকতে দেখেছি। আমি নবী করিম (ﷺ) এর প্রিয় দৌহিত্রকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে কারবালার তপ্ত বালি-রাশির উপর দাফন-কাফনহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি।
উলামায়ে কিরামগণ লিখেছেন, এই পৃথিবীতে পাঁচজন ব্যক্তি খুব বেশী কান্নাকাটি করেছেন, এরা হলেন, (এক) হযরত আদম (আঃ) জান্নাত থেকে বের হয়ে আসার পর খুবই কান্নাকাটি করেছেন। (দুই) হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) আল্লাহর ভয়ে খুবই কেঁদেছিলেন, তিনি এত বেশী কান্নাকাটি করেছিলেন যে, তার দুগন্ড বেয়ে চোখের পানি পড়তে পড়তে চেহারায় দাগ পড়ে গিয়েছিল। (তিন) হযরত ইয়াকুব (আঃ) হযরত ইউসুফ (আঃ) এর বিচ্ছেদের কারণে খুবই কেঁদেছিলেন এবং অনেক চোখের পানি ফেলেছিলেন। (চার) হযরত সৈয়দা ফাতেমাতুয যুহরা (رضي الله عنه) হুযুর (ﷺ) এর ওফাতের পর খুবই কেঁদেছিলেন। (পাঁচ) হযরত জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) কারবালার ঘটনার পর অনেক কেঁদেছিলেন।
ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দাবানল
হঠাৎ এমন একটি লােমহর্ষক ঘটনা ঘটে যাওয়ায় এবং ইয়াজিদের জুলুম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে চারিদিক থেকে বিদ্রোহের দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলাে। বিশেষ করে মক্কা-মদীনার অধিবাসীগণ ইয়াজিদের প্রতি খুবই ক্ষ্যাপা ছিল এবং ইয়াজিদের বিরুদ্ধে সমালােচনামুখর ছিল। এই খবর ইয়াজিদের কানে পৌছলে সে কয়েকজন প্রতিনিধিকে মক্কা-মদীনায় পাঠালাে এবং ওদেরকে বলে, মক্কা-মদীনাবাসীকে গিয়ে বুঝাও, যেন আমার বিরুদ্ধে সমালােচনা না করে, আর আমার প্রতি যেন অসন্তুষ্টি প্রকাশ না করে। মদীনাবাসীরা বললেন, সে জালিম, ফাসিক, অত্যাচারী, সে অমানবিক জুলুম করেছে। আমরা কি করে ওকে ঘৃণা না করে থাকতে পারি? এরপর মদীনাবাসীরাও একটি প্রতিনিধিদল দামেস্কে প্রেরণ করেছিলেন, ইয়াজিদের হাল-অবস্থা দেখার জন্য। ওনারা ফিরে এসে যা বিবরণ দিলেন, তা হলাে “ইয়াজিদের আমলে যা হচ্ছে, ইতিপূর্বে আর কারাে আমলে এরকম হয়নি। ইয়াজিদের রাজ্যে হারাম বলতে কিছু নেই। মদ, জুয়া, ঘুষ, দুর্নীতি, যেনা, ব্যভিচার, ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে ইত্যাদি সব কিছু জায়েয। এ সবের বিরুদ্ধে ইয়াজিদের কোন উচ্চ বাচ্য নেই বরং প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে উৎসাহ দিচ্ছে। ফলে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আরাে ব্যাপক আকার ধারণ করলাে। মক্কা-মদীনাবাসীরা অহরহ ওর উপর খােদার লানত দিচ্ছিল এবং প্রকাশ্যভাবে ওর রাজত্বকে অবৈধ ঘােষনা করল।
ইয়াজিদ বাহিনীর মক্কা-মদীনা আক্রমণ
ইয়াজিদ একটি জল্লাদ বাহিনী মদীনা আক্রমণ করার জন্য পাঠাল এবং নির্দেশ দিল, প্রথমে ওদেরকে বুঝাও, বুঝে আসলেতাে ভালাে, অন্যথায় তাদেরকে কঠোরভাবে দমন কর। নির্দেশমত ইয়াজিদের জল্লাদ বাহিনী মদীনা শরীফ আক্রমণ করল। মদীনা শরীফের নওজোয়ানরা ওদেরকে প্রতিরােধ করার জন্য এগিয়ে আসলেন। কিন্তু ইতিপূর্বে জল্লাদ বাহিনীর আগমণের খবর পেয়ে অনেক লােক এদিক ওদিক সরে গিয়েছিল। তাই সবাইকে একত্রিত করার সুযােগ পেলেন । তবুও ওনারা বীর বিক্রমে ইয়াজিদের জল্লাদ-বাহিনীকে রুখে দিয়ে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ মুষ্ঠিমেয় যুবক ইয়াজিদের দুর্ধর্ষ জল্লাদ বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। এ যুবকগণ শহীদ হওয়ার পর ইয়াজিদ বাহিনী শহরে প্রবেশ করে পবিত্র মদীনা শরীফে এমন জঘন্য কান্ড-কীর্তন করেছিল, যা কল্পনা করলেও লােম শিউরে ওঠে। তারা দশ হাজার লােককে হত্যা করেছিল, মসজিদে নব্বীতে ঘােড়া বেঁধেছিল মােটকথা হুযুর (ﷺ) এর ইজ্জতের প্রতি আদৌ ভ্রুক্ষেপ করেনি। বাচ্চাদের হত্যাকরে বর্শার অগ্রভাগে নিয়ে ঘুরিয়েছিল। মদীনা শরীফে অবস্থানরত পবিত্র মহিলাদের ইজ্জত হরণ করেছিল।
বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত সায়েদ বিন মসীয়ব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে, মদীনা শরীফের কোন লােককে ওরা জীবিত ছাড়েনি। রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে লাশ আর লাশ পড়ে ছিল। এমন কোন ঘর দেখা যায়নি, যে ঘর লুন্ঠিত হয়নি। হযরত সায়েদ (رضي الله عنه) আরও বলেন, আমি পাগলের ছদ্মবেশ ধারণ করে মসজিদে নব্বীতে প্রবেশ করেছিলাম। যখন ওরা চারিদিকে রক্তপাত করে মসজিদে নববীতে ঘােড়া বাঁধতে আসলাে, আমাকে দেখে বলল, একেও ধর এবং মার। তখন.আমি পাগলের মত আচরণ করতে লাগলাম।, তা দেখে এদের সরদার বললাে, ওকে ছেড়ে দাও, এ পাগল মনে হয়, হয়তাে মসজিদে থাকে। অতঃপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে ওরা চলে গেল। তিনি আরও বলেন, তিন দিন পর্যন্ত মসজিদে নব্বীতে কোন আযান, ইকামত ও কোন জামাত হয়নি। কিন্তু যখন আযানের সময় হতাে, তখন যথারীতি আযানের শব্দ শােনা যেতাে। আমি আশ্চর্য হয়ে যেতাম। কোন লােকজন নেই, এ আযানের ধ্বনি কোথেকে আসে। শেষ পর্যন্ত আযানের ধ্বনির রেশ ধরে অগ্রসর হয়ে দেখলাম স্বয়ং রওজা পাক থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এ ভাবে আমি তিন দিন সেই আযানের ধ্বনি শুনে পনের ওয়াক্ত নামায আদায় করি। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত রওজা পাক থেকে আযান, ইকামত ও জামাতের আওয়াজ আসতাে।
তিন দিন পর ইয়াজিদ বাহিনী যখন মদীনা-মনােয়ারা থেকে চলে গেল, তখন চারিদিক থেকে লােক ফিরে আসেন এবং এসে লাশ সমূহ দাফন করেন। এরপর তারা পুনরায় মদীনা-মনােয়ারাতে বসবাস করতে লাগলেন। ইয়াজিদী বাহিনী মদীনা শরীফে যা করেছে এর পরিণাম সম্পর্কে আমাদের প্রিয় নবী (ﷺ) কি বলেছেন, তা শুনুন- “যে মদীনাবাসীকে অত্যাচার করে, ভয় দেখায়, আল্লাহু তাআলা ওকে ভীতু করবেন। ওর প্রতি আল্লাহ, ফেরেস্তাগণ ও সমস্ত মানুষগণের লানত। এ বার অনুমান করুন, যারা মদীনাবাসীকে ভয় দেখায়, ওদের প্রতি আল্লাহর লানত পতিত হয়, কিন্তু যারা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তাদের কি পরিণতি হবে?
ইয়াজিদী বাহিনী মদীনা শরীফে ধ্বংসযজ্ঞ চালােনাের পর মক্কা শরীফের দিকে ধাবিত হল। সেই সময় মক্কার সমস্ত লােকেরা হযরত আবদুল্লাহ বিন জোবাইয়ের (رضي الله عنه) এর সাথে ছিল। তা ছাড়া সে সময় অনেক সাহাবীও সেখানে ছিলেন। তারা সবাই ইয়াজিদী বাহিনীকে প্রতিরােধ করার জন্য পুর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কারণ ইতিপূর্বে তাদের কাছে মদীনা শরীফের খবর পৌঁছে ছিল। যখন ইয়াজিদী বাহিনী মক্কা গিয়ে আক্রমণ করল, হযরত আবদুল্লাহ বিন জোবাইর তাঁর সমর্থকদের নিয়ে পাল্টা আক্রমন চালালেন। ফলে, ইয়াজিদী বাহিনী সেখানে কৃতকার্য হতে পারল । তবে, মক্কা শরীফকে ঘিরে ফেলল। সে সময় হযরত আবদুল্লাহ বিন জোবাইর তাঁর সকল সমর্থকসহ হেরেম শরীফের অভ্যন্তরে ছিলেন। ইয়াজিদী বাহিনী দূর থেকে পাথর নিক্ষেপণ হাতিয়ার দ্বারা এমনভাবে পাথর নিক্ষেপ করেছিল যে, পবিত্র কাবা শরীফের আঙ্গিনা পাথরে ভরে গিয়েছিল। মানুষ যেখানে তওয়াফ করতে সেখানেও পাথরের স্তুপ পড়ে গিয়েছিল।
যে সব পাথর খুব জোরে এসে দেয়ালের সাথে লেগেছিল, এর থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়ে কাবা শরীফের গিলাফ জ্বলে গিয়েছিল। তখন বায়তুল্লাহ শরীফের ছাদ কাঠের ছিল, সেখানেও আগুন লেগে যায়। সেই ছাদের উপর সেই দুম্বার শিং তাবরুক হিসেবে হিফাজত করে রাখা হয়েছিল, যেটা হযরত ইসমাঈল (আঃ) এর কুরবানীর পরিবর্তে বেহেস্ত থেকে অবতীর্ণ হয়েছিল, সেটাও জ্বলে গিয়েছিল।
ইয়াজিদের উপর খােদার লানত
আল্লাহর কুদরাত দেখুন, যে দিন কাবা শরীফে আগুন লেগেছিল, সে দিন ইয়াজিদ এক মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে দামেস্কে মারা যায়। ইয়াজিদের সৈন্য বাহিনীরা ওর মৃত্যুর খবর শুনে হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ বিন জোবাইর ও তাঁর সাথীদের মধ্যে নূতন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় এবং তাঁরা বীরদর্পে ইয়াজিদী বাহিনীর উপর আক্রমণ করে বসেন এবং অনেক ইয়াজিদী সেনাকে খতম করেন। অবশিষ্ট সৈন্যরা যে যে দিকে পারলাে পালিয়ে গেল এবং মক্কাবাসী ওদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেল। ইয়াজিদী বাহিনী চলে যাওয়ার পর মক্কা মদীনার অধিবাসীগণ হযরত আবদুল্লাহ বিন জোবাইরের হাতে বায়াত করলেন।
ঐদিকে দামেস্কে ইয়াজিদের মৃত্যুর পর তার ছেলে মারিয়া আসগরের হাতে লােকেরা বায়াত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করল। এ ছেলে খুবই নরম মেজাজ ও পরহেজগার ছিল। সে লােকদের ইচ্ছের প্রত্যুত্তরে বলল, আমি রাজত্ব পরিচালনা করতে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। আমার বাপও অনুপযুক্ত ছিল। সত্যিকার খলিফা হওয়ার হকদার ছিল হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه)। কিন্তু আমার পিতা, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর হক আত্মসাত করেছে এবং জুলুম করে তাঁকে (رضي الله عنه) হত্যা করেছে। আমি আমার আব্বার পরিণতি সম্পর্কে খুবই উদ্বিগ্ন। তাই আপনারা আমার হাতে বাইয়াত করার ইচ্ছা পোষণ করে আমি তাতে রাজি নই। আপনারা হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (رضي الله عنه) এর হাতে বায়াত করুন। এরপর সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং চল্লিশ দিন পর ইন্তিকাল করে। আল্লাহ তাআলা নেককারের ঘরে বদকার, বদকারের ঘরে নেককার সৃষ্টি করেন।
যখন ইয়াজিদের ছেলে মারা গেল, তখন দামেস্ক ও সিরিয়ার অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে পড়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত মারােয়ান’ নিজেকে আমীর ঘােষণা করল। ঐ দিকে কুফার গভর্ণর ইবনে জিয়াদও কুফা থেকে পালিয়ে ওর সাথে হাত মিলালাে। লােকেরা বাধ্য হয়ে ওকে আমীর মেনে নিল এবং ইবনে জিয়াদ ওর প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেল । আর ঐ দিকে মক্কা-মদীনায় আবদুল্লাহ বিন জোবাইরের হুকুমত কায়েম রইল। তবে সমগ্র আরব দেশে একটা মারাত্মক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে গেল।
ইয়াজিদ বাহিনীর যমদূত মুখতার সাক্ফীর আবির্ভাব
মরােয়ান ক্ষমতা দখল করে বিশেষ সুবিধা করতে পারলাে না। চারিদিক থেকে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলাে। কুফার মধ্যে বিদ্রোহটা চরম আকার ধারণ করলাে। কারণ, কুফাবাসীরা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে অগণিত চিঠি লিখে কুফায় আসার আহবান জানিয়েছিল এবং জান মাল দিয়ে সার্বিক সাহায্যের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কিন্তু পরে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, যার ফলে সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য অধিকাংশ কুফাবাসী খুবই অনুতপ্ত ছিল এবং তারা এই কলঙ্ককে কি ভাবে মুছা যায়, কি ভাবে এর প্রায়শ্চিত্ত করা যায়, সেই চিন্তায় মগ্ন ছিল। ধূরন্ধর মুখতার বিন ওবায়দা সক্ফী কুফাবাসীর মনােভাব উপলব্ধি করে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর রক্তের বদলা নেয়ার শ্লোগান তুললাে, সবাইকে তাঁর সাথে যােগ দেয়ার জন্য আহবান জানাল এবং সে দীপ্ত কণ্ঠে ঘােষণা করল, 'আমি হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর হত্যাকারীদের একজনকেও দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে দেবনা। আমি যদি এরকম না করি, আমার উপর খােদার লানত হােক'। তাঁর এ ধরণের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে কুফার অধিকাংশ লোক তার দলে ভিড়ে গেল এবং কুফর সর্বময় কর্তৃত্ব তার হাতে এসে গেল। এরপর সে প্রতিশােধ নিতে শুরু করলাে।
যথার্থ প্রতিশােধ
মুখতার সাকাফী সর্বপ্রথম এই সব জালিমদের একটা তালিকা প্রণয়ন করল, যারা কারবালার লোমহর্ষক ঘটনা সংঘটিত করেছিল। এরপর এক এক জনের প্রতিশােধ নিতে শুরু করল।
আমর বিন সাদ ও তার ছেলে
সর্বপ্রথম সেই পাপিষ্ঠ আমর বিন সাদ কে তলব করলাে, যে ইয়াজিদী বর্বর বাহিনীর সেনাপতি ছিল এবং তারই পরিচালনায় কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তার ছেলে এসে বললাে, আমার পিতা এখন সবকিছু ত্যাগ করে ভাল মানুষ হয়ে গেছে এবং নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছে। কারও সংগে কোন সংস্রব নেই। ঘর থেকে বের হয় না। সাক্ফি হুংকার দিয়ে বলে, কোন অজুহাত শুনতে চাইনা, আমি ওকে চাই। অতঃপর ওকে ধরে এনে পিতাপুত্র উভয়ের মাথা কেটে মদীনা শরীফে হযরত মুহাম্মদ বিন হানফিয়া (رضي الله عنه) এর কাছে পাঠিয়ে দিল।
হাওলা বিন ইয়াজিদ
হাওলা বিন ইয়াজিদ, যে হযরত ইমাম হোসাইন (رضي الله عنه) এর পবিত্র মস্তক মুবারককে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল, ওকে ধরে এনে মুখতার সকফীর নির্দেশে হাত পা কেটে শূলে চড়ানাে হলাে। অতঃপর ওর লাশ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওকে ধরার ব্যাপারে ওর স্ত্রী উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। কারণ সে আহলে বায়তের অনুরক্ত ছিল। হাওলা হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) এর মস্তক নিয়ে ঘরে আসায় সে খুবই মর্মাহত হয়েছিল।
পাপিষ্ঠ সীমারের পরিণতি
মুখতার সাকাফী যখন হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) এর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারী এক এক জনকে নির্মমভাবে হত্যা করছিল, তখন পাপিষ্ঠ সীমার কুফা থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ পাপিষ্ঠ রক্ষা পায়নি। মুখতার সক্ফীর অনুসারীদের হাতে ধরা পড়েছিল। ওকে দু টুকরা করে মাথা মুখতার সকফীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল এবং লাশ কুকুরকে সােপর্দ করেছিল।
হাকিম বিন তােফায়েলের পরিণতি
হাকিম বিন তােফায়েল, যে হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) এর শরীর থেকে পােশাক খুলে নিয়েছিল এবং হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর প্রতি তীর নিক্ষেপ করেছিল, ওকেও ধরে হত্যা করা হয়েছিল এবং ওর মাথা বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে মুখতার সকফীর সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল।
জায়েদ বিন রাকাত
জায়েদ বিন রেকাত, যে জালিম, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুসলিম ইবনে আকিল (رضي الله عنه) এর কপালে তীর নিক্ষেপ করে রক্ত রঞ্জিত করেছিল, ওকে ধরে জীবিত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
উমর বিন সবী
উমর বিন সবী, যে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর সাথীদেরকে তীর নিক্ষেপ করে আহত করেছিল, ওকেও ধরে তীরের আঘাতে ঝাঁঝরা করে হত্যা করা হয়েছিল।
আমর বিন ছবির পরিণতি
আমর বিন ছবি, যে গর্ব করে বলে বেড়ায় যে 'আমি হুসাইনের কোন সাথীকে হত্যা করার সুযােগ পাইনি বটে, কিন্তু তীর নিক্ষেপ করে অনেককে যখম করতে সক্ষম হয়েছিলাম। মুখতার সকফীর কাছে ওকে ধরে নিয়ে আনা হয়েছিল এবং ওকে বর্শার আঘাতে ঘায়েল করে হত্যা করা হয়েছিল।
এ ভাবে মুখতার সকফী কঠোর হাতে ইমাম হোসাইন (رضي الله عنه) এর রক্তের বদলা নেয়ার কারণে অধিকাংশ সাধারণ ও বিশিষ্ট লােক তার সমর্থক হয়ে গিয়েছিল । সেও যথেষ্ট অনুপ্রেরণা লাভ করে একে একে সবাইকে হত্যা করতে লাগল।
নরাধম ইবনে জিয়াদের পরিণতি
মুখতার সকফী আমর ইবনে সা'আদ, সীমার, হাওলা বিন ইয়াজিদ প্রমূখ জালিমদের হত্যা করার পর নরাধম ইবনে জিয়াদকে হত্যা করার চিন্তা ভাবনা করতে লাগল। কারণ, ইয়াজিদের পর সবচেয়ে মারাত্মক ও জঘন্যতম অপরাধী ব্যক্তি ছিল ইবনে যিয়াদ। তার ইবনে জিয়াদের খতম না করা পর্যন্ত মুখতার সাক্ফি কিছুতেই স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে পারল না। সে ইব্রাহিম বিন মালেক আশতরকে এক বিরাট সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব প্রদান করে ইবনে জিয়াদকে পরাস্থ করার জন্য প্রেরণ করল। এদিকে ইবনে জিয়াদ যখন এ খবর জানতে পারল, সেও মুখতার সকফীর সৈন্যদেরকে দমনের জন্য এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হল। মুসল' শহরের অনতিদুরে 'ফোরাত নদীর তীরে উভয় সৈন্য বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ইব্রাহিম বিন মালেকের হাতে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু রক্ষা পেলনা। ইব্রাহিম বিন আশতরের সৈন্যরা তলােয়ারের আঘাতে শরীর থেকে ওর মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলল এবং দেহকে জ্বালিয়ে ফেলে মাথা বর্শার অগ্রভাগে উঠায়ে কুফায় নিয়ে আসল। যে দিন ইবনে জিয়াদের মাথা কুফায় আনা হয়েছিল এবং মুখতার সকফীর সামনে রাখা হয়েছিল, ঘটনাক্রমে সে দিন ছিল মহররমের দশ তারিখ। মুখতার সকফী উপস্থিত কুফাবাসীদেরকে লক্ষ্য করে বলল- দেখ আজ থেকে ছয় বছর আগে এই দিনেই, এই জায়গায় এই জালিমের সামনে হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর মস্তক মুবারক রাখা হয়েছিল। আজ আমার সামনে সেই জালিমের মাথা রাখা হয়েছে। মুখতার সক্ফী, ইবনে জিয়াদ ও অন্যান্য জালিমদের মাথা সমূহ জনগণকে প্রদর্শনের জন্য এক প্রকাশ্য জায়গায় রেখে দিল, যে ভাবে ইবনে জিয়াদ, হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) ও অন্যান্য আহলে বায়তের মস্তক রেখেছিল।
তিরমিযী শরীফের সহীহ হাদীছে বর্ণিত আছে, যে সময় ইবনে জিয়াদ ও ওর বিশিষ্ট অনুসারীদের মাথা সমূহ মুখতার সকফীর সামনে রাখা হয়েছিল, তখন এক ভয়াল সাপের আবির্ভাব হয়েছিল এবং ওটার ভয়াল আকৃতি দেখে লােকেরা ঘাবড়িয়ে গিয়েছিল। সাপটি সকল মাথাসমূহের উপর চক্কর দিয়ে যখন ইবনে জিয়াদের মাথার কাছে পৌছলাে, তখন ওর নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবশে করে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর ওর মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলাে। এ ভাবে তিন বার সাপটি ওর মাথায় প্রবেশ করেছিল, অতঃপর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
উপসংহার
মােট কথা, মুখতার সাকাফী কারবালার শহীদদের পবিত্র রক্তের যথাযথ বদলা নিয়ে গেছে প্রায় ষাট হাজার ইয়াজিদ সমর্থক কুফাবাসীদেরকে হত্যা করেছিল। কারাে প্রতি কোন প্রকার সহানুভূতি দেখায়নি। এমন কি এক বর্ণনা মতে সীমার ছিল তার ভগ্নিপতি এবং সীমারের ছেলে ছিল তার ভাগিনা। সে এক সাথে ওদের দুজনকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। ভাগিনা যখন আপত্তি করে বলেছিল,আমার কি অপরাধ? আমি তো কারবালার যুদ্ধে শরীক হইনি, তখন মুখতার সাকাফী বলেছিল, তা ঠিক কিন্তু তুমি গর্ব করে বলে বেড়াতে আমার পিতা হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) কে হত্যা করেছে।
মুখতার সাকাফী হযরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর হত্যাকারীদের ব্যাপারে যথাযথ প্রতিশোধ নিয়ে অতি প্রশংসনীয় কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শেষকালে সে নিজেকে নবী বলে দাবী করে মুরতাদ হয়ে গেল। নতুবা, সে মুসলিম জাহানে এক অনন্য বীর পুরুষ হিসেবে চির স্মরনীয় হয়ে থাকতাে। অন্যান্য মুসলিম বীর পুরুষদের নামের সাথে ওর নামও স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকত। হযরত আবদুল্লাহ বিন জোবাইর যখন ওর নবুয়ত দাবীর খবর পেলেন, তখন তিনি এক বিরাট সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করেন এবং ওকে পরাভূত করে সাতষট্টি হিজরীর রমজান মাসে এ ফিত্নার অবসান ঘটান।
-সমাপ্ত -
-•-