হাজেরার গর্ভে ইসমাঈল (عليه السلام)-এর জন্ম প্রসঙ্গ

আহলি কিতাবদের বর্ণনা মতে, হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) আল্লাহর নিকট সুসন্তানের জন্য দু’আ করেন। আল্লাহ তাকে এ বিষয়ে সুসংবাদ দানও করেন। কিন্তু এরপর বায়তুল মুকাদ্দাসে তার বিশটি বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। এ সময় একদিন সারাহ্ হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-কে বললেন, আমাকে তো আল্লাহ সন্তান থেকে বঞ্চিতই রেখেছেন। সুতরাং আপনি আমার বাদীর সাথে মিলিত হন। তার গর্ভে আল্লাহ  আমাকে একটা সন্তান দিতেও পারেন। সারাহ্ হাজেরাকে ইবরাহীমের জন্যে হেবা করে দিলে ইবরাহীম (عليه السلام) তার সাথে মিলিত হন। তাতে হাজেরা সন্তান-সম্ভবা হন। এতে আহলি কিতাবগণ বলে থাকেন, হাজেরা অনেকটা গৌরববোধ করেন। এবং আপন মনিব সারাহর তুলনায় নিজেকে ভাগ্যবতী বলে মনে করতে থাকেন। সারাহর মধ্যে আত্মমর্যাদা বোধ জাগ্রত হয় এবং তিনি এ সম্পর্কে ইবরাহীম (عليه السلام)-এর নিকট অভিযোগ করেন। জবাবে ইবরাহীম (عليه السلام) বললেন, “তার ব্যাপারে তুমি যে কোন পদক্ষেপ নিতে চাও নিতে পার।” এতে হাজেরা শংকিত হয়ে পলায়ন করেন এবং অদূরেই এক কূপের নিকটে অবতরণ করেন। সেখানে জনৈক ফেরেশতা তাকে বলে দেন যে, তুমি ভয় পেয় না; যে সন্তান তুমি ধারণ করেছ আল্লাহ তাকে গৌরবময় করবেন। ফেরেশতা তাঁকে বাড়িতে ফিরে যেতে বলেন। এবং সুসংবাদ দেন যে, তুমি পুত্র-সন্তান প্রসব করবে। তার নাম রাখবে ইসমাঈল। সে হবে এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। সকল লোকের উপর তার প্রভাব থাকবে এবং অন্য সবাই তার দ্বারা শক্তির প্রেরণা পাবে। সে তার ভাইদের কর্তৃত্বাধীন সমস্ত এলাকার অধিকারী হবে। এসব শুনে হাজেরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। এই সুসংবাদ হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর অধঃস্তন সন্তান মুহাম্মদ (ﷺ)-এর ক্ষেত্রে পূর্ণমাত্রায় প্রযোজ্য। কেননা, গোটা আরব জাতি তার দ্বারা গৌরবের অধিকারী হয়। পূর্ব-পশ্চিমের সমস্ত এলাকায় তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাকে আল্লাহ এমন উন্নত ও কল্যাণকর শিক্ষা এবং সৎকর্ম-কুশলতা দান করেন যা পূর্বে কোন উম্মতকেই দেওয়া হয়নি। আরব জাতির এ মর্যাদা পাওয়ার কারণ হচ্ছে তাদের রাসূলের মর্যাদা যিনি হচ্ছেন নবীকুল শিরোমণি। তাঁর রিসালত হচ্ছে বরকতময়। তিনি হচ্ছেন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যে রাসূল। তাঁর আনীত আদর্শ হচ্ছে পুণ্যতম আদর্শ। হাজেরা ঘরে ফেরার পর ইসমাঈল (عليه السلام) ভূমিষ্ঠ হন। এ সময় ইবরাহীম (عليه السلام)-এর বয়স হয়েছিল ছিয়াশি বছর। এটা হচ্ছে ইসহাক (عليه السلام)-এর জন্মের তের বছর পূর্বের ঘটনা। ইসমাঈল (عليه السلام)-এর জন্মের পর আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-কে সারাহর গর্ভে ইসহাক নামের সন্তান জন্মের সুসংবাদ দেন। ইবরাহীম (عليه السلام) তখন আল্লাহর উদ্দেশে শোকরানা সিজদা আদায় করেন। আল্লাহ তাকে জানান যে, আমি তোমার দু’আ ইসমাঈলের পক্ষে কবুল করেছি। তাকে বরকত দান করেছি। তার বংশের বিস্তৃতি দান করেছি। তার সন্তানদের মধ্য থেকে বারজন প্রধানের জন্ম হবে। তাঁকে আমি বিরাট সম্প্রদায়ের প্রধান করব। এটাও এই উম্মতের জন্যে একটা সুসংবাদ। বারজন প্রধান হলেন সেই বারজন খলীফায়ে রাশিদা— যাঁদের কথা জাবির ইবন সামূরা সূত্রে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যাতে বলা হয়েছে যে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, ‘বারজন আমীর হবে।’ জাবির (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরপর একটা শব্দ বলেছেন, কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি। তাই সে সম্পর্কে আমার পিতার কাছে জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন, রাসূলের সে শব্দটি হল-


كلهم من قريش


অর্থাৎ তারা সবাই হবেন কুরায়শ গোত্রের লোক।’ বুখারী ও মুসলিম এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। অপর এক বর্ণনায় আছেঃ


لا يزال هذا الأمر قائما وفي رواية عزيزا حتى يكون اثنا عشرة


خليفة كلهم من قريش.


অর্থাৎ এই খিলাফত বারজন খলীফা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত বা শক্তিশালী থাকবে- এরা সবাই হবে কুরায়শ গোত্রের লোক। উক্ত বারজনের মধ্যে চারজন হলেন প্রথম চার খলীফা আবু বকর (رضي الله عنه), উমর (رضي الله عنه), উসমান (رضي الله عنه) ও আলী (رضي الله عنه); একজন উমর ইবন আবদুল আযীয (رحمة الله); কতিপয় বনী আব্বাসীয় খলীফা। বারজন খলীফা ধারাবাহিকভাবে হতে হবে এমন কোন কথা নাই, বরং যে কোনভাবে বারজনের বিদ্যমান হওয়াটাই জরুরী। উল্লিখিত বারজন ইমাম রাফিজী সম্প্রদায়ের কথিত ‘বার ইমাম’ নয়— যাদের প্রথমজন আলী ইবন তালিব (رضي الله عنه) আর শেষ ইমাম মুহাম্মদ ইবন হাসান আসকারী। এই শেষোক্ত ইমামের ব্যাপারে তাদের বিশ্বাস এই যে, তিনি সামেরার একটি ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠ থেকে তিনি বের হয়ে আসবেন— এরা তার প্রতীক্ষায় আছে। কারণ এই ইমামগণ হযরত আলী (رضي الله عنه) ও তার পুত্র হাসান ইব্‌ন আলী (رضي الله عنه) অপেক্ষা অধিকতর কল্যাণকামী হতে পারেন না। বিশেষ করে যখন স্বয়ং হাসান ইবন আলী (رضي الله عنه) যুদ্ধ পরিত্যাগ করে হযরত মু’আবিয়া (رضي الله عنه)-এর অনুকূলে খিলাফত ত্যাগ করেন। যার ফলে ফিতনার আগুন নির্বাপিত হয়, মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়। অবশিষ্ট ইমামগণ তো অন্যদের শাসনাধীন ছিলেন। উম্মতের উপরে কোন বিষয়েই তাদের কোন আধিপত্য ছিল না। সামিরার ভূগর্ভস্থিত প্রকোষ্ঠ সম্পর্কে রাফিজীদের যে বিশ্বাস তা নিতান্ত অবাস্তব কল্পনা ও হেঁয়ালীপনা ছাড়া আর কিছুই নয়, এর কোন ভিত্তি নেই।


হাজেরার গর্ভে ইসমাঈল (عليه السلام)-এর জন্ম হলে সারাহর ঈর্ষা পায়। তিনি হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর নিকট আবেদন জানান, যাতে হাজেরাকে তার চোখের আড়াল করে দেন। সুতরাং ইবরাহীম (عليه السلام) হাজেরা ও তার পুত্রকে নিয়ে বের হয়ে পড়েন এবং মক্কায় নিয়ে রাখেন। বলা হয়ে থাকে যে, ইসমাঈল (عليه السلام) তখন দুধের শিশু ছিলেন। ইবরাহীম (عليه السلام) যখন তাদেরকে সেখানে রেখে ফিরে আসার জন্যে উদ্যত হলেন, তখন হাজেরা উঠে তার কাপড় জড়িয়ে ধরে বললেন, হে ইবরাহীম! আমাদেরকে এখানে খাদ্য-রসদহীন অবস্থায় রেখে কোথায় যাচ্ছেন? ইবরাহীম (عليه السلام) কোন উত্তর দিলেন না, বারবার পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও তিনি যখন জওয়াব দিলেন না, তখন হাজেরা জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘আল্লাহ কি এরূপ করতে আপনাকে আদেশ করেছেন?’ ইবরাহীম (عليه السلام) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ হাজেরা বললেনঃ তাহলে আর কোন ভয় নেই। তিনি আমাদেরকে ধ্বংস করবেন না। শায়খ আবু মুহাম্মদ ইবন আবী যায়দ (رحمة الله) ‘নাওয়াদির’ কিতাবে লিখেছেনঃ সারাহ্ হাজেরার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে কসম করলেন যে, তিনি তাঁর তিনটি অঙ্গ ছেদন করবেন। ইবরাহীম (عليه السلام) বললেন, দু’টি কান ছিদ্র করে দাও ও খাৎনা করিয়ে দাও এবং কসম থেকে মুক্ত হয়ে যাও। সুহায়লী বলেছেনঃ ‘এই হাজেরাই প্রথম নারী যার খাৎনা করা হয়েছিল, সর্বপ্রথম যার উভয় কান ছিদ্র করা হয় এবং তিনিই সর্বপ্রথম দীর্ঘ আঁচল ব্যবহার করেন।’

Top