কিতাবঃ মাসালিকুল হুনাফা ফিল ওয়ালাইল মোস্তফা (ﷺ)

মূলঃ ইমাম জালালুদ্দিন আব্দুর রহমান সুয়ূতী (রহ.)

অনুবাদকঃ হাফেজ মুফতি মুহাম্মদ ইকরাম উদ্দীন

টেক্সট রেডীঃ কাজী আজিজুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম চৌধুরী।

টেক্সট সংগ্রহঃ (এপ্স ডেভেলপার) আব্দুল বাতেন মিয়াজী 


ইমাম সুয়ূতী (রহ.) এর জীবনীঃ


নাম ও নসবনামা: তাঁর নাম আব্দুর রহমান। উপনাম আবুল ফদল। পিতার নাম কামাল উদ্দিন। কিন্তু তিনি সারাবিশ্বে জালাল উদ্দিন সুয়ুতি নামে পরিচিত। তাঁর নসবনামা হল ‘আবুল ফদল জালাল উদ্দিন আব্দুর রহমান বিন কামাল উদ্দিন আবি বকর বিন মুহাম্মদ বিন সাবিক উদ্দিন বিন উসমান আস সুয়ুতি আশ শাফেয়ী।’


বেলাদতশরীফ: ইমাম সুয়ুতি ৮৪৯ হিজরি পহেলা রজব মিশরের নীল নদীর পশ্চিম তীঁরে অবস্থিত সুয়ুত নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র পাঁচবছর বয়সেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন।


ইলম অর্জন: বাল্যকাল থেকেই ইমাম সুয়ুতি অত্যন্ত মেধাবী ও চমৎকার স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। মাত্র আটবছর বয়সে তিনি কুরআনুল কারীম হিফ্জ করেন। যেমন তিনি নিজেই বলেছেন-


قال ونشأت يتيما- فحفظت القران ولى دون ثمانى حسنين ثم حفظت العمدة ومنهاج الفقه والاصول والفية ابن مالك


অর্থ: আমি এতিম হিসেবে জীবন শুরু করি। প্রথমে আমি আটবছর বয়সে কুরআনুল কারীম হিফ্জ করি। অতঃপর উমদাহ ‘মিনহাজুল ফিক্হ’ ‘আল উসূল’ এবং ‘আল ফিয়াতু ইবনে মালিক’ মুখস্ত করি।


ইমাম সুয়ুতি জগতবিখ্যাত উলামায়ে কেরামদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- ورزقت التبحر فى سبعة علوم অর্থ: আমি সাতটি বিষয়ে পারদর্শীতা অর্জন করি। তা হলো- তাফসির, হাদিস, ফিক্হ, নাহু, মায়ানী, বায়ান এবং মানতিক। এছাড়াও তিনি ফারাইয ও আরবি ভাষাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর ইলম অর্জন করেন। তিনি দুইল হাদিসের হাফিজ ছিলেন।


আসাতিযায়ে কেরামগণ: ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ুতি কুরআন হাদিসের ইলম অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তিনি শ্যাম, হিজাজ, ইয়ামন, হিন্দ, মাগরিব তাকরুরসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। তিনি কামালউদ্দিন ইবনে হুমাম, জালাল উদ্দিন মহল্লী, ইলমুদ্দিন বুলকিনী, শিহাবউদ্দিন আশ শারমাসাহী, ইমাম মানাভী, ইমাম শামনী, ইমাম আল কাফিজীসহ অসংখ্য উলামায়ে কিরামদের কাছ থেকে ইলম অর্জন করেন। তাঁর ছাত্র শা’রানী বলেছেন- ইমাম সুয়ুতি ছয় শতাধিক শায়খের কাছ থেকে ইলম অর্জন করেছেন।


আখলাক: ইমাম সুয়ুতি অত্যন্ত খোদাভীরু, তাকওয়াবান ও পরহেজগার লোক ছিলেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি দ্বীনি খেদমতে কাটিয়েছেন। নাজমুদ্দিন আল কুরী الكوكب السائرة باعيان المائة العاشر গ্রন্থে বলেছেন- চল্লিশ বছর বয়স হবার পর থেকে তিনি দুনিয়ার আরাম-আয়েশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তিনি একাকী ও নির্জনতাকে পছন্দ করতেন। এমনকি পরিবার-পরিজন থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেন, যেন তিনি কাউকে চিনেন না। সদা-সর্বদা কিতাবাদী গবেষণাতে মশগুল থাকতেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ‘রওদাতুল মিকয়াছ’ নামক স্থানে অবস্থান করেন। ঘরের দরজা জানালা পর্যন্ত খুলতেন না। বিভিন্ন বিত্তশালী আমিরগণ মূল্যবান উপঢৌকন নিয়ে তাঁর জিয়ারতে আসতেন। কিন্তু তিনি তা ফিরিয়ে দিতেন।


কিতাবাদী: ইমাম সুয়ুতি বিভিন্ন বিষয়ের উপর অসংখ্য কিতাবাদী রচনা করেছেন। আল ইদরূসী النور السافرة  গ্রন্থে বলেছেন-


ووصلت مصنفاته نحو الستمائة مصنفا-

অর্থ: তাঁর রচনাবলী ছয়শত পর্যন্ত পৌঁছেছে। নিম্নে তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি কিতাবের নাম প্রদত্ত হলো-

১. আল ইতকান ফি উলুমিল কুরআন।

২. আদ দুররুল মানসুর ফি তাফসিরি বিল মা’ছুর।

৩. লুবানুন নুকুল ফি আসবাবিন নুজুল।

৪. তাফসিরে জালালাইন।

৫. হাশিয়াতু আলা তাফসিরে বায়জাবী।

৬. শরহু ইবনে মাজাহ।

৭. তাদরীবুর রাওয়ী।

৮. শরহুস সুদুর বি শরহে হালিল মাওতা ওয়াল কুবুর।

৯. আল বুদুরুস সাফিরাহ আন উমুরিল আখিরাহ।

১০. আত তিব্বুন নাবাওয়ী।

১১. আল আশবাহু ওয়ান নাজাইর।

১২. আল হাবী লিল ফাতাওয়া।

১৩. তারিখুল খুলাফা।



অভিমতঃ


ওফাত শরীফ: ইসলামের এই মহান খাদিম, মুজাদ্দিদে দ্বীন ইমাম সুয়ুতি ৯১১ হিজরি সনের ১৯ জামাদিউল উলা, শুক্রবার রাতে ‘রওদাতুল মিকয়াস’ নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬১ বৎসর ১০ মাস ১৮ দিন।

আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।


উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন উস্তাযুল আসাতিযাহ সুলতানুল মুনাযিরীন নায়েবে আ’লা হযরত রাহবরে আহলে সুন্নাত বহু গ্রন্থ প্রণেতা মুহিউস সুন্নাহ বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মুর্শিদে বরহক হযরতুল আল্লামা সিরাজনগরী ছাহেব ক্বিবলা (মা.জি.আ.) এর   


দোয়া ও অভিমত    

=========

بسم الله الرحمن الرحيم    


নূর নবী (ﷺ) এর সম্মানিত পিতা-মাতা এবং তাদের উর্দ্ধতন পিতৃপুরুষগণ হযরত আদম আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকলই জান্নাতী এবং মু’মিন মুসলমান ছিলেন। এ বিষয়ের স্বপে কুরআন সুন্নাহর দলিল ও আইম্মায়ে কেরামদের অভিমত উপস্থাপনার মাধ্যমে খুব চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন নবম শতকের মুজাদ্দিদ ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ুতি (رضي الله عنه) তদীয় ‘মাসালিকুল হুনাফা ফি ওয়ালিদাইল মোস্তফা’ নামক প্রসিদ্ধ আরবি গ্রন্থে। সেই অমূল্য গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন তরুণ লেখক বৃস্টল সেন্ট্রাল মসজিদের খতিব আমার স্নেহের ছাত্র হাফিজ মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ ইকরাম উদ্দিন।  


আশা করি উহা পাঠ করে সর্বস্তরের মুসলমানগণ উপকৃত হবেন। দোয়া করি আল্লাহ যেন অনুবাদক ও সংশ্লিষ্ট সকলের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ নসিব করেন। আমিন।    


শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী   

**************************

   

**************************

আঞ্জুমানে ছালেকীনের মহাসচিব, পীরে তরিকত উস্তাযুল উলামা ক্বারীউল কুররা মুনাযিরে আহলে সুন্নাহ মুফাসসিরে কোরআন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সিরাজনগর ফাজিল মাদ্রাসার আরবি প্রভাষক আমার পরমশ্রদ্ধেয় উস্তাদ আল্লামা শেখ জুবাইর আহমদ রহমতাবাদী হুজুরের  


অভিমত    

====

بسم الله الرحمن الرحيم    


মাসালিকুল হুনাফা ফি ওয়ালিদাইল মোস্তফা নামক কিতাবটির রচয়িতা বিশ্ববিখ্যাত আলেমেদ্বীন, যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম ও শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ুতি (رضي الله عنه)। তিনি অত্র কিতাবে কুরআন সুন্নাহর আলোকে প্রমাণ করেছেন যে, আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পিতা-মাতাগণ ছিলেন তৎকালীন যুগে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও বংশগতভাবে যুগশ্রেষ্ঠ আভিজাত্যের অধিকারী। তারা ছিলেন আল্লাহতায়ালার একত্ববাদে বিশ্বাসী মু’মিন মুসলমান এবং জান্নাতী। তাদেরকে কখনো কোন প্রকার শিরক ও কুফুরির কালিমা স্পর্শ করতে পারেনি। এমনকি নবীজীর মাতৃকূল পিতৃকূল তথা হযরত আব্দুল্লাহ থেকে আদিপিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম পর্যন্ত কেহই অমুসলিম ছিলেন না। তাছাড়া পবিত্র কুরআন মজিদে উল্লেখিত ‘আযর’ ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের পিতা ছিলেন না বরং ‘আযর’ ছিল ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের চাচা।   


এ বিষয়ের স্বপক্ষে আইম্মায়ে কেরামগণ কুরআন ও সুন্নাহর অকাট্য দলীলের দ্বারা বিশেষ করে নবীজীর পিতা-মাতা সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য তিনটি মসলক বা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। 


প্রথম মসলকঃ নবী করীম (ﷺ) এর সম্মানিত পিতা-মাতাগণ নবীজীর নবুয়ত প্রকাশ লাভ করার পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন। সুতরাং তাদের উপর কোন প্রকার আযার হবে না। বরং তারা জান্নাতী। 


দ্বিতীয় মসলকঃ নবী করীম (ﷺ) এর সম্মানিত পিতা-মাতার পক্ষ থেকে কোন প্রকার শিরকি কার্যকলাপ প্রমাণিত হয়নি বরং তারা ছিলেন হানিফ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তারা জান্নাতী।


তৃতীয় মসলকঃ নবী করীম (ﷺ) এর সম্মানিত পিতা-মাতা ইন্তেকাল করার পর আল্লাহ্‌তাআলা তাদেরকে আবার পুনর্জীবিত করেছেন। অতঃপর তারা নবীজীর উপর ঈমান আনয়ন করেছেন, সতরাং তারা জান্নাতী। 


এতদ্ব্যতীত উলামায়ে কেরামগণ আরো দুটি মসলকের উল্লেখ করেছেন। যা অত্র কিতাবের শেষের দিকে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। যুগের চাহিদানুসারে এই মহামূল্যবান আরবি কিতাবটির বাংলায় অনুবাদ হওয়া অত্যন্ত জরুরী ছিল। আল্লাহর শোকর! তরুণ লেখক বৃস্টল সেন্ট্রাল মসজিদের খতীব সিরাজনগর ফাজিল মাদাসার প্রাক্তন ছাত্র উদীয়মান মুহাক্কিক আলেম আমার একান্ত স্নেহের ছাত্র হাফিজ মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ ইকরাম উদ্দিন কিতাবটির অনুবাদ করায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত।


প্রায় শত পৃষ্ঠার এই পাণ্ডুলিপির উপর আমি খুব মনোযোগ সহকারে একাধিকবার নজর দিয়েছি। বাংলা অনুবাদ ও বিষয়বস্তুকে সহজ-সরলভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে অনুবাদক আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। অনুবাদকের পক্ষ থেকে নতুন কিছু শিরোনাম সংযুক্ত করায় বিষয়বস্তুর অনুধাবন আরো সহজ হয়েছে। 


দোয়া করি আল্লাহ্‌তাআলা যেন তার মেধা ও শ্রম নবীজীর মহব্বতে সুন্নিয়তের খেদমতে কবুল করেন। শক্তি, সাহস দীর্ঘায়ু দান করেন। আমীন। 


শেখ জুবাইর আহমদ রহমতাবাদী

***********************************************


প্রকাশকের কলম হতে

===========

আল্লাহর নামে শুরু যিনি রাব্বুল আলামীন

বেশুমার দরূদ-সালাম যিনি রাহমাতুল্লিল আলামীন। 


চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া ও সিরাজনগর গাউছিয়া সুন্নিয়া ফাযিল মাদ্রাসার সাবেক মেধাবী শিক্ষার্থী, বর্তমানে ইউ.কে বৃস্টল সেন্ট্রাল মসজিদের খতীব মুহতারাম হাফিজ মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ ইকরাম উদ্দিন অনূদিত, হিজরি ৯ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখিত অতীব সময়োপযোগী গ্রন্থ “মাসালিকুল হুনাফা ফি ওয়ালিদাইল মোস্তফা” (ﷺ) সম্প্রতি জামেয়া ছাত্র হুসাইনের মাধ্যমে আমার হস্তগত হয়। বইটির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এটি জাগরণ প্রকাশনির তত্ত্বাবধানে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি। গ্রন্থটিতে তাজেদারে কায়েনাত, রাহমাতুল্লিল আলামিন হুজুরে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম'র শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা ও পূর্ব পুরুষগণের ঈমান সম্পর্কিত বিষয়ে কোরআন- হাদিসের দৃষ্টিতে চমৎকার আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি এই বিষয়ে দ্বিমত পোষণ কারীদের মোকাবিলায় গ্রন্থটি শক্তিশালী দলীল হিসেবে বিবেচিত হবে। গ্রন্থটি অধ্যয়নে প্রত্যেকেই যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা-মাতা ও পূর্ব পুরুষের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে ঈমান মজবুত করতে পারে তবেই প্রকাশনা স্বার্থক হয়েছে মনে করবো। আল্লাহ্‌ সকলের ত্যাগ ও অবদানকে কবুল করুন। আমিন। 


সৈয়দ মুহাম্মদ আবু আজম

পরিচালক, জাগরণ প্রকাশনী, চট্টগ্রাম।


অনুবাদকের কথাঃ



بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله  رب العالمين - والصلوة والسلام على اشرف الانبياء والمرسلين- وعلى اله واصحابه اجمعين- اما بعد


ইমাম জালালউদ্দিন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হচ্ছেন নবম শতকের মুজাদ্দিদ। তাফসির, হাদিস, ফিকাহসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অসংখ্য কিতাবাদি রচনা করে গেছেন। الحاوي للفتاوى তাঁর একটি বিখ্যাত ফতোয়ার কিতাব। সেখানে ৮০টি বিষয়ের উপর প্রদত্ত ফতোয়াকে একত্রিত করা হয়েছে। যার প্রতিটি বিষয়ই স্বতন্ত্রভাবে একেকটি পুস্তকের সমতুল্য ৷ “মাসালিকুল হুনাফা ফি ওয়ালিদাইল মোস্তফা” গ্রন্থটি তাঁর সেই বিখ্যাত কিতাব থেকে সংকলিত। 


এ গ্রন্থে ইমাম সুয়ূতি নবী করীম (ﷺ) এর সম্মানিত পিতা-মাতার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের উপর ব্যাপক আলোচনা করেছেন। তার লিখনীতে একথা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, তৎকালীন যুগে নবীজীর মাতা-পিতা বংশগত, গোষ্ঠীগত বা ব্যক্তিগতভাবে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তাঁরা ধর্মীয় দিক থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষ হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের হানিফ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাঁরা ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ খোদাভীরু মু’মিন মুসলমান। এমনকি মা আমেনা ও খাজা আবদুল্লাহ হতে হযরত আদম আলাইহিস সালাম পর্যন্ত নবীজীর পূর্বপুরুষগণ সকলেই মু’মিন ছিলেন, কেহই কাফের-মুশরিক ছিলেন না। তাঁরা সকলেই জান্নাতী। 


কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান যুগে কিছু নামধারী ওয়াজী মৌলভী আছেন যারা বলেন- নবী করীম (ﷺ) এর পিতা-মাতা মুসলমান ছিলেন না। একজন বলেছেন- “ঈমান না আনলে নবীর বাপ হইলেও খাতির নাই’। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এর পিতা সম্বন্ধে বলেছেন- তাঁকে নাকি আল্লাহ্‌তাআলা একটা অদ্ভুত প্রাণীতে রুপান্তরিত করে জাহান্নামে জ্বালাচ্ছেন। নাউজুবিল্লাহ!


এ ধরণের ওয়াজ শুনে অনেক সাধারণ মুসলমান বিভ্রান্তির শিকার হন। তাই আমি উক্ত কিতাবটি অনুবাদ করতে সচেষ্ট হই। আশা করি কিতাবটি পাঠ করে সর্বস্তরের মুসলমান উপকৃত হবেন। 


এমনিতেই অনুবাদ তত সহজ নয়। তাছাড়া স্বীয় দুর্বলতা তো আছেই। তা স্বত্ত্বেও আমি মৌলিক অর্থকে ঠিক রেখে ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আলোচ্য বিষয়ের পুনরাবৃত্তির কারণে কোন কোন জায়গায় সামান্য কিছু অংশ বাদ দিয়েছি। তবে আশা করি এতে মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটবে না। 


একান্ত আন্তরিকতা থাকা স্বত্তেও ভাষাগত ও অনুবাদ্গত ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। যদি কোথাও এধরণের কোন ত্রুটিবিচ্যুতি পাঠকদের কাছে পরিলক্ষিত হয় তাহলে ক্ষমা ও অবহিত করবেন। 


বইটি প্রকাশনার ক্ষেত্রে যার নিকট আমি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ তিনি হচ্ছেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাদ সিরাজনগর ফাজিল মাদ্রাসার আরবি প্রভাষক উস্তাযুল উলামা পীরে তরিকত হযরতুল আল্লামা শেখ জুবাইর আহমদ রহমতাবাদী। তিনি বইটির আদ্যোপান্ত দেখে আরবি ইবারতগুলো যাচাই বাচাই করে বইটির গুণগত মান বৃদ্ধি করেছেন। বিশেষ করে প্রকাশনার যাবতীয় দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন।


অতঃপর আমি যার নিকট বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ তিনি হচ্ছেন বৃস্টল মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আশিকে রাসূল জনাব মোহাম্মদ শফিক চৌধুরী। যার আর্থিক বদন্যতায় বইটি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বৃস্টল মসজিদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যাবদি প্রতিটি ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। যার বদৌলতে আজ এ মসজিদটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মারকাজ হিসেবে পরিচিত। ইতিপূর্বে আমার ‘বিশ্ব নবীর অনন্য বৈশিষ্ট্য’ ও ‘বিভ্রান্তির অবসান’ বই দুইটি তাঁর আর্থিক সহযোগিতায় প্রকাশিত হয়। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাঁকে সুন্নিয়তের অতন্ত্রপ্রহরী হিসেবে কবুল করেন এবং নেক হায়াত দান করেন। 


পরিশেষে ফরিয়াদ, হে আল্লাহ! আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াসটুকু তোমার বন্ধু নবী মোস্তফার মাতা-পিতার প্রেমে কবুল কর। এর বিনিময়ে আমার মরহুম আব্বাকে জানাতুল ফিরদাউস নসীব কর এবং আমার আম্মাকে নেক হায়াত দান কর। এর আমাকে তৌফিক দান কর যেন আমরণ তোমার হাবিবের শানে কলম চালিয়ে যেতে পারি। আমিন।


স্থায়ী ঠিকানাঃ মুহাম্মদ ইকরাম উদ্দিন

গ্রাম: একাসন্তোষ

পো: তারাপাশা

রাজনগর, মৌলভীবাজার।                


খতিব, বৃস্টল সেন্ট্রাল মসজিদ 

০৭৯১০৬২১৩৫৯



মাসআলা

উলামায়ে কেরামদের প্রথম মসলক বা অভিমত


بسم الله الرحمن الرحيم  

الحمد لله رب العالمين - والصلوة والسلام على اشرف الانبياء والمرسلين- وعلى اله واصحابه اجمعين-    


মাসআলা

=====

নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত পিতা-মাতা সম্বন্ধে শরয়ি হুকুম হল তাঁরা উভয়ে নাজাতপ্রাপ্ত এবং তাঁরা জাহান্নামী নন। অনেক উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। এ মাসআলার উপর আলোচনাকারীদের পক্ষ থেকে কয়েকটি মসলক বা অভিমত প্রকাশ পেয়েছে। 


এ মাসআলার উপর উলামায়ে কেরামদের প্রথম মসলক বা অভিমত    

==================

প্রথম মসলক বা অভিমত হল নবী করিম (ﷺ) এর পিতা-মাতা নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন। সুতরাং তাদের উপর কোন আযাব হবে না। যেমন আল্লাহর বাণী-  


وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا    

অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। (সূরা বনি ইসরাইল- ১৫)  


আমাদের আশআরী ইমামদের মধ্যে আকাইদ ও উসুলবিদগণ এবং শাফেয়ী মাযহাবের ফোকাহাগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, দাওয়াত পৌঁছার পূর্বে যদি কেউ মুত্যুবরণ করে তাহলে সে নাজাতপ্রাপ্ত হবে। এবং ইসলামের দাওয়াত না দেওয়া পর্যন্ত কাউকে হত্যা করা যাবে না। এমতাবস্থায় যদি তাকে হত্যা করা হয় তাহলে এর রক্তপণ ও কাফ্ফারা প্রদান করতে হবে।    


ইমাম শাফেয়ী (رضي الله عنه) সহ তাঁর অনুসারীবৃন্দ এর উপর দলিল প্রয়োগ করেছেন। বরং কোন কোন অনুসারীগণ বলেছেন এমতাবস্থায় কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা প্রয়োগ করতে হবে। তবে বিশুদ্ধ মত হল এক্ষেত্রে কিসাস প্রয়োগ করা যাবে না। কারণ সে প্রকৃত অর্থে মুসলমান নয়। এবং কিসাসের জন্য শর্ত হলো উভয় ব্যক্তি সমপর্যায়ের হতে হবে।    


এজন্য কোন কোন ফোকাহাগণ বলেছেন- এমতাবস্থায় কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার শাস্তি হবে না। কারণ সে ফিতরাতের উপর ছিল এবং তার প থেকে কোন শত্র“তা প্রকাশ পায়নি। এবং তার কাছে এমন কোন রাসূল আগমন করেননি যাকে সে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে।    


এই মসলক বা অভিমতের মধ্যে সর্বপ্রথম যার অভিমত শুনেছি তিনি হচ্ছেন শাইখুল ইসলাম শরফুদ্দিন আল মানাওয়ী। তাকে নবী করিম (ﷺ) এর পিতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হল ‘তিনি কি জাহান্নামী?’ এতে তিনি প্রশ্নকারীকে কঠোরভাবে ধমক দিলেন। অতঃপর প্রশ্নকারী বললেন- তাঁর ইসলাম সম্বন্ধে কোন প্রমাণ আছে কি? জবাবে তিনি বললেন- নবীজীর পিতা ফাতরাতের যুগে ইন্তেকাল করেছেন এবং নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে কোন শাস্তি নেই।    


সিবত ইবনুল জুযি তাঁর কিতাব ‘মিরআতুয যামানে’ একটি জামাত থেকে এ মতটি বর্ণনা করেছেন। তিনি তার দাদার সূত্রে নবীজীর মায়ের পুনর্জীবনসংক্রান্ত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। অতঃপর বলেন- এ ব্যাপারে দলিল হল আল্লাহতায়ালার বাণী-  

وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا  


অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।    


অতএব রাসূল (ﷺ) এর পিতা-মাতার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নেই। সুতরাং তাদের কোন গোনাহ নেই। এ বিষয়টি উবাই তাঁর ‘শরহে মুসলিম’ কিতাবে শক্তভাবে বর্ণনা করেছেন। তার ইবারতটুকু আমি অচিরেই উল্লেখ করব।    


আহলে ফাতরাত বা ফাতরাতের অধিবাসীদের সম্বন্ধে অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে, কিয়ামত দিবসে তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে। আর আয়াতে কারীমাগুলোও ইঙ্গিত বহন করে যে তাদের কোন শাস্তি হবে না।  


এ মতটিই গ্রহণ করেছেন তৎকালীন যুগের হাফিজুল হাদিস শাইখুল ইসলাম আবুল ফদল বিন হাজর। তিনি তাঁর কোন একটি কিতাবে উল্লেখ করেছেন- রাসূল (ﷺ) এর পরিবার-পরিজন যারা নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই রাসূল (ﷺ) এর নিকটাত্মীয় হবার দরুণ তাঁর সম্মানার্থে সে পরীায় আনুগত্য প্রকাশ করবেন।    


অতঃপর তাকে দেখেছি তিনি ‘ইসাবা’ গ্রন্থে বলেছেন- এ ব্যাপারে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, অধিক বৃদ্ধ ব্যক্তি, ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণকারী, জন্ম থেকে অন্ধ, বোবা ও বধির ব্যক্তি, জন্ম থেকে পাগলব্যক্তি, অথবা নাবালিগ অবস্থায় পাগলব্যক্তি এ রকম অন্যান্য সকল ব্যক্তিবর্গ দলিল হিসেবে দাবি করবে যে, যদি আমি সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন হতাম অথবা যদি আমাকে স্মরণ করানো হতো তবে আমি ঈমান আনয়ন করতাম।  


তখন তাদের জন্য অগ্নি প্রজ্বলিত করে বলা হবে এতে প্রবেশ কর। তখন যে ব্যক্তি আগুনে প্রবেশ করবে সে শান্তি ও শীতলতা লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত রেওয়ায়েতগুলোর ইহাই ভাবার্থ।    


তিনি বলেন- এ সমস্ত রেওয়ায়েতগুলো আমি স্বতন্ত্রভাবে সন্নিবেশিত করেছি। আমরা আশা করি আব্দুল মোত্তালিব ও তার পরিবারবর্গ তাদের অন্তর্ভুক্ত হবেন যারা আনুগত্য প্রকাশ করে মুক্তিপ্রাপ্ত হবেন। তবে আবু তালিব ব্যতিত। কারণ তিনি নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কিন্তু ঈমান আনয়ন করেননি। সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে তিনি জাহান্নামের লেলিহান শিখার মধ্যে থাকবেন।    


কিয়ামতের দিন পরীা নেওয়ার বিষয়টি আমি প্রথম মসলকের অন্তর্ভুক্ত করেছি। যদিও বাহ্যিকভাবে ইহা স্বতন্ত্র মসলকের দাবিদার। কিন্তু আমি ইহাকে এমন সুক্ষ্ণ অর্থবিশিষ্ট পেয়েছি যা জ্ঞানবানদের নিকট অস্পষ্ট নয়।



প্রথম মসলকের স্বপক্ষে বর্ণিত আয়াতসমূহ


আয়াত- ১.  

=====

আল্লাহতায়ালার বাণী-  

وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا    


অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। (সূরা বনি ইসরাইল- ১৫)  


এ আয়াত দ্বারা আহলে সুন্নাতের ইমামগণ দলিল পেশ করেন যে, নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে কোন আযাব নেই এবং এ আয়াত দ্বারা সুন্নি ইমামগণ মু’তাজিলা ও তাদের অনুগামী সম্প্রদায়ের মতবাদ খণ্ডন করেন। তাদের দাবি হলো আকল তথা বুদ্ধিমত্তার উপর ফয়সালা করা হবে।    


ইবনে জারির এবং ইবনে আবি হাতিম স্ব-স্ব তাফসির গ্রন্থে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত কাতাদাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  

قال ان الله ليس بمعذب احدا حتى يسبق اليه من الله خبر او تأتيه من الله بينة-    


অর্থ: তিনি বলেন- আল্লাহতায়ালা ততণ পর্যন্ত কাউকে শাস্তি প্রদান করেন না যতণ পর্যন্ত তার নিকট আল্লাহর পক্ষে থেকে কোন সংবাদ বা কোন প্রমাণ না পৌঁছবে।    


আয়াত- ২.  

=====

আল্লাহর বাণী-   

ذلك ان لم يكن ربك مهلك القرى بظلم واهلها غفلون-    


অর্থ: এটা এজন্য যে আপনার প্রতিপালক কোন জনপদের অধিবাসীদেরকে জুলুমের কারণে ধ্বংস করেন না এমতাবস্থায় যে তথাকার অধিবাসীরা অজ্ঞ থাকে। (আনআম- ১৩১)    


ইমাম যারকাশী এ আয়াতটিকে তাঁর شرح جمع الجوامع কিতাবে ঐ মূলনীতির দলিল হিসেবে পেশ করেছেন যে, আকলী তথা বুদ্ধিভিত্তিক দলিল দ্বারা নিয়ামতের শোকরিয়া আদায় করা ওয়াজিব হয় না। বরং ছেমায়ী বর্ণিত দলিল প্রয়োজন।    


আয়াত- ৩.  

===== 

আল্লাহর বাণী-  

ولو لا ان تصيبهم مصيبة بما قدمت ايديهم فيقولوا ربنا لو لا ارسلت الينا رسولا فنتبع ايتك ونكون من المؤمنين-    


অর্থ: আর এজন্য যে, তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের কোন বিপদ হলে তারা বলতো হে আমাদের পালনকর্তা আপনি আমাদের কাছে কোন রাসূল প্রেরণ করলেন না কেন? করলে আমরা তোমার আয়াতসমূহের অনুসরণ করতাম এবং আমরা বিশ্বাস স্থাপনকারী হয়ে যেতাম। (সূরা কাসাস- ৪৭)    


উক্ত আয়াতটিও ইমাম যারকাশী রেওয়ায়েত করেছেন। তাছাড়া ইবনে আবি হাতিম স্বীয় তাফসিরগ্রন্থে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাসান সনদে আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الها لك فى الفترة يقول رب لم يأتنى كتاب ولا رسول- ثم قرء هذه الاية-    


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তি বলবে- হে প্রতিপালক আমার কাছে কোন কিতাব কিংবা কোন রাসূল আগমন করেননি। অতঃপর নবীজী উক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন।    


আয়াত- ৪.  

=====

আল্লাহর বাণী-  

ولو انا اهلكنهم بعذاب من قبله لقالوا ربنا لولا ارسلت الينا رسولا فنتبع ايتك من قبل ان نذل ونخزى-    


অর্থ: যদি আমি এদেরকে ইতোপূর্বে কোন শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করতাম, তবে এরা বলত হে আমাদের পালনকর্তা আপনি আমাদের কাছে একজন রাসূল প্রেরণ করলেন না কেন? তাহলেতো আমরা অপমানিত ও হেয় হবার পূর্বেই আপনার নির্দেশসমূহ মেনে চলতাম। (ত্ব-হা- ১৩৪)    


ইবনে আবি হাতিম স্বীয় তাফসির গ্রন্থে এ আয়াতের অধীনে আতিয়্যাহ আল উফি থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال- الهالك فى الفترة يقول رب لم يأتنى كتاب ولا رسول    


অর্থ: তিনি বলেন ফাতরাতের যুগে নিহত ব্যক্তি বলবে হে রব আমার কাছে কোন কিতাব কিংবা কোন রাসূল আগমন করেননি। অতঃপর তিনি উক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন।    


আয়াত- ৫.  

=====

আল্লাহর বাণী-  

وما كان ربك مهلك القرى حتى يبعث فى امها رسولا يتلوا عليهم ايتنا-  


অর্থ: আপনার পালনকর্তা জনপদসমূহকে ধ্বংস করেন না যে পর্যন্ত তার কেন্দ্রস্থলে কোন রাসূল প্রেরণ না করেন। যিনি তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করেন। (কাসাস- ৫৯)    


ইবনে আবি হাতিম উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও কাতাদাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন-  


قال لم يهلك الله ملة حتى يبعث اليهم محمدا صلى الله عليه وسلم فلما كذبوا وظلموا بذالك هلكوا-    


অর্থ: তারা উভয়ে বলেন- আল্লাহতায়ালা মুহাম্মদ (ﷺ)কে প্রেরণ না করা পর্যন্ত তার জাতিকে ধ্বংস করেননি। অতঃপর যখন তারা নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল এবং তাঁর উপর যুলুম করল তখন তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো।    


আয়াত- ৬.  

=====

আল্লাহর বাণী-  

وهذا كتاب انزلنه مبرك فاتبعوه واتقوا لعلكم ترحمون- ان تقولوا انما انزل الكتاب على طائفتين من قبلنا- وان كنا عن دراستهم لغفلين-    


অর্থ: ইহা এমন একটি গ্রন্থ যা আমি অবতীর্ণ করেছি খুব বরকতপূর্ণ। অতএব তোমরা এর অনুসরণ কর এবং ভয় কর যাতে তোমরা করুণা প্রাপ্ত হও। এ জন্য যে কখনো তোমরা বলতে শুরু কর, গ্রন্থতো কেবল আমাদের পূর্ববর্তী দু’সম্প্রদায়ের প্রতিই অবতীর্ণ হয়েছে এবং আমরা সেগুলোর পাঠ ও পঠন সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। (আনআম- ১৫৫-১৫৬)    


আয়াত- ৭.  

=====

আল্লাহর বাণী-  

وما اهلكنا من قرية الا لها منذرون- ذكرى وما كنا ظلمين-  


অর্থ: আমি কোন জনপদ ধ্বংস করিনি, কিন্তু এমতাবস্থায় যে, তার সতর্ককারী ছিল। স্মরণ করানোর জন্য এবং আমার কাজ অন্যায় আচরণ নয়। (সূরা- শুআরা, ২০৮-২০৯)    


হযরত আব্দ বিন হুমাইদ, হযরত ইবনুল মুনজির এবং ইবনে আবি হাতিম প্রত্যেকে তাদের তাফসিরগ্রন্থে হযরত কাতাদাহ (رضي الله عنه) থেকে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেছেন-  


ما اهلك الله من قرية الا من بعد الحجة والبينة والعذر حتى يرسل الرسل وينزل الكتب تذكرة لهم وموعظة وحجة لله ذكرى وما كنا ظالمين-    


অর্থ: আল্লাহতায়ালা ততণ পর্যন্ত কোন জনপদকে ধ্বংস করেন না যতণ পর্যন্ত তাদের নিকট কোন রাসূল সুস্পষ্ট প্রমাণ ও কিতাবাদীসহ আগমন করে তাদেরকে ভয় প্রদর্শন না করেন। যেমন আল্লাহর বাণী- স্মরণ করানোর জন্য এবং আমার কাজ অন্যায় আচরণ নয়।    


আয়াত- ৮.  

=====

আল্লাহর বাণী-  

وهم يصطرخون فيها- ربنا اخرجنا نعمل صالحا غير الذى كنا نعمل- او لم نعمركم ما يتذكر فيه من تذكر وجاء كم النذير-    


অর্থ: সেখানে তারা আর্ত চিৎকার করে বলবেন হে আমার রব আমাদেরকে বের করুন, আমরা সৎকাজ করব। পূর্বে যা করতাম তা করব না। (আল্লাহ বলবেন) আমি কি তোমাদের এতটা বয়স দেইনি যাতে যা চিন্তা করার বিষয় চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। (ফাতির- ৩৭)    


মুফাসসিরীনে কিরামগণ বলেন- উক্ত আয়াতে নাযির বা সতর্ককারী বলতে নবী মুহাম্মদ (ﷺ)কে বুঝানো হয়েছে।


পবিত্র হাদিস ভিত্তিক দলিল


নিম্নে সে সমস্ত হাদিস উল্লেখ করা হল যা প্রমাণ করে যে, কিয়ামতের দিবসে ফাতরাতের যুগের লোকদেরকে পরীক্ষা করা হবে। তখন যারা আনুগত্য প্রকাশ করবে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আর যারা নাফরমানী করবে তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে।    


হাদিস- ১.  

=====

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رضي الله عنه) এবং ইসহাক বিন রাহওয়ায় স্বীয় মসনদ গ্রন্থে এবং ইমাম বায়হাকী ‘কিতাবুল ইতেকাদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বায়হাকী ইহাকে সহীহ বলেছেন-  


عن الاسود بن سريع- ان النبى صلى الله عليه وسلم قال اربعة يمتحنون يوم القيامة- رجل اصم لايسمع شيأ- ورجل احمق ورجل هرم ورجل مات فى فترة فاما الاصم فيقول رب لقد جاء الاسلام وما اسمع شيأ- واما الاحمق فيقول رب لقد جاء الاسلام والصبيان يحذفونى بالبعر- واما الهرم فيقول رب لقد جاء الاسلام وما اعقل شيأ- واما الذى مات فى الفترة فيقول رب ما اتانى لك رسول فيأخذ مواثيقهم ليطيعنه فيرسل اليهم ان ادخلوا النار فمن دخلها كانت عليه بردا وسلاما ومن لم يدخلها يسحب اليها-    


অর্থ: আসওয়াদ বিন সারি (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত নবী করিম (ﷺ) বলেছেন- কিয়ামদের দিন চার প্রকার লোকের কাছ থেকে পরীা নেয়া হবে। ১. বধির ব্যক্তি, যে কিছুই শুনতে পায় না। ২. বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি ব্যক্তি। ৩. অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি। ৪. এবং ফাতরাতের যুগে নিহত ব্যক্তি।  


অতএব বধির ব্যক্তি বলবে হে প্রভু, ইসলাম এসেছিল কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পাইনি। বোকা ব্যক্তি বলবে, প্রভূ ইসলাম এসেছিল কিন্তু আমি অনুধাবন করতে পারিনি। অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি বলবে হে প্রভূ এব্যাপারে আমার কোন জ্ঞান ছিল না। ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণকারী বলবে, হে প্রভু আমার কাছে তোমার কোন রাসূল আগমন করেননি। অতঃপর তাদেরকে পরীা করা হবে এবং বলা হবে জাহান্নামে প্রবেশ কর। তখন যে ব্যক্তি আগুনে প্রবেশ করবে তার প্রতি শীতল শান্তি বর্ষিত হবে। আর যে ব্যক্তি প্রবেশ করবে না তাকে জাহান্নামে নিপে করা হবে।    


হাদিস-২.  

=====

ইমাম আহমদ, ইসহাক বিন রাহ্ওয়ায় তাদের মসনাদ গ্রন্থে, ইবনে মারদুভীয়াহ স্বীয় তাফসির গ্রন্থে এবং ইমাম বায়হাকী ‘কিতাবুল ইতেক্বাদ’ গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


ان النبى صلى الله عليه وسلم قال اربعة يمتحنون    


অর্থ: নবী করিম (ﷺ) বলেন- চার শ্রেণির লোকদেরকে পরীা করা হবে। হাদিসের বাকী অংশ পূর্বে বর্ণিত আসওয়াদ বিন সারি কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের অনুরূপ।    


হাদিস- ৩.  

=====

ইমাম বাযযার স্বীয় মুসনাদ গ্রন্থে আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يؤتى بالهالك فى الفترة والمعتوه والمولود- فيقول الها لك فى الفترة لم يأتنى كتاب ولا رسول ويقول المعتوه اى رب لم تجعل لى عقلا اعقل به خيرا ولا شرا ويقول المولود لم ادرك العمل- قال فيرفع لهم نار فيقال لهم ردوها او قال ادخلوها فيدخلها من كان فى علم الله سعيدا لو ادرك العمل- ويمسك عنها من كان فى علم الله شقيا لو ادرك العمل- فيقول تبارك وتعالى اياى عصيتم فكيف برسلى بالغيب-    


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন- ফাতরাতের যুগে মৃত্যুপ্রাপ্ত, মস্তিষ্ক বিকৃত এবং শিশুকালে নিহত ব্যক্তিদেরকে উপস্থাপন করা হবে। ফাতরাতের যুগে নিহত ব্যক্তি বলবে আমার কাছে কোন কিতাব বা কোন রাসূল আগমন করেননি। মস্তিষ্ক বিকৃত ব্যক্তি বলবে হে প্রভু, আমার ভাল মন্দ বুঝার মত কোন জ্ঞান বুদ্ধি ছিল না। শিশুকালে মৃত্যুপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলবে আমি আমল করার মত অবকাশ পাইনি।    


অতঃপর তাদের জন্য আগুন প্রস্তুত করা হবে। এবং বলা হবে এতে প্রবেশ কর। তখন আল্লাহর ইলমে যারা সৌভাগ্যশীল অর্থাৎ অবকাশ পেলে আমল করত তারা আগুনে প্রবেশ করবে। কিন্তু আল্লাহর ইলমে যারা দূর্ভাগা সময় পেলেও আমল করত না, তারা প্রবেশ করবে না। তখন আল্লাহতায়লা বলবেন- তোমরা সরাসরি আমার হুকুম অমান্য করেছ। অতএব আমাকে না দেখে কিভাবে আমার রাসূলের আনুগত্য করবে?    


উল্লেখিত হাদিসের সনদে ‘আতিয়্য আল উফি’ বর্ণনাকারী রয়েছেন। তার মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। তবে ইমাম তিরমিজি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।    


এ হাদিসের পে আরো অনেক হাদিস রয়েছে যা এ হাদিসটিকে হাসান এবং শক্তিশালী হবার প্রমাণ বহন করে।    


হাদিস- ৪.  

=====

ইমাম বাযযার ও আবু ইয়ালা তাদের মুসনাদ গ্রন্থে হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يؤتى باربعة يوم القيامة- بالمولود والمعتوه ومن مات فى الفترة وبالشيخ الفانى كلهم يتكلم بحجته- فيقول الله تعالى لعنق من جهنم ابرزى فيقول لهم انى كنت ابعث الى عبادى رسلا من انفسهم وانى رسول نفسى اليكم ادخلوا هذه- فيقول من كتب الله عليه الشفاء- يا رب اتدخلناها ومنها كنا نفرق ومن كتب له السعادة فيمضى فيقتحم فيها مسرعا- فيقول الله قد عصيتمونى فانتم لرسلى اشد تكذيبا ومعصية فيدخل هؤلاء الجنة وهؤلاء النار-    


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- কিয়ামতের দিন চার শ্রেণির লোকদেরকে আনয়ন করা হবে। ১. নাবালেগ সন্তান। ২. মস্তিষ্ক বিকৃত ব্যক্তি। ৩. ফাতরাতের সময় মৃত্যুবরণকারী ও ৪. অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি। তখন আল্লাহতায়ালা জাহান্নামকে আদেশ করবেন উত্তপ্ত হবার জন্য। অতঃপর বলবেন আমি আমার বান্দাদের প্রতি তাদের মধ্যে থেকে রাসূল প্রেরণ করেছি। আমি স্বয়ং তোমাদের প্রতি রাসুল হয়ে হুকুম দিচ্ছি জাহান্নামে প্রবেশ কর। তখন যারা দুর্ভাগা তারা বলবে- হে প্রভু আপনি কি আমাদেরকে আগুনে প্রবেশ করাবেন? আমরা তো আগুনকে ভয় করি। আর যাদের নসিবে কল্যাণ নিহিত রয়েছে সে আগুনের দিকে দ্রুত গমন করবে। তখন আল্লাহ বলবেন- তোমরা আমার অবাধ্যতা করেছ অতএব তোমরা আমার রাসূলের অধিক অবাধ্যতা করতে। তখন তাদেরকে জাহান্নামে এবং এদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।    


হাদিস- ৫.  

=====

আব্দুর রাজ্জাক ইবনে জারির ইবনুল মুনজির এবং ইবনে আবি হাতিম প্রত্যেকে আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال اذا كان يوم القيامة جمع الله اهل الفترة والمعتوه والاصم والابكم والشيوخ الذين لم يدركوا الاسلام ثم ارسل اليهم رسولا ان ادخلوا النار- فيقولون كيف ولم تأتنا رسل؟ قال وايم الله لو دخلوها لكانت عليهم بردا وسلاما ثم يرسل اليهم فيطيعه من كان يريد ان يطيعه- قال ابوهريرة اقرؤوا ان شئتم (وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا)    


অর্থ: আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন- কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা ফাতরাতের যুগের অধিবাসী, পাগল, বধির, বোবা ও অতিশয় বৃদ্ধ যে ইসলাম সম্বন্ধে কিছুই অনুধাবন করতে পারেনি, তাদের প্রত্যেককে একত্রিত করবেন। অতঃপর তাদের প্রতি একজন ফেরেশতা পাঠাবেন তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানোর জন্য। তখন তারা বলবে এটা কিভাবে সম্ভব? অথচ আমাদের কাছে কোন রাসূল আসেননি। আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন- আল্লাহর কসম যদি তারা তখন জাহান্নামে প্রবেশ করত তাহলে তাদের প্রতি শান্তি ও শীতলতা অবতীর্ণ হত। অতঃপর তাদের কাছে আবার পাঠনো হবে। তখন যারা আনুগত্যকারী তারা আনুগত্য প্রকাশ করবে। অতঃপর আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন- যদি তোমরা চাও তবে এ আয়াতটি পড়ে নাও। وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। (বনি ইসরাইল-১৫)  


এ হাদিসটির সনদ বুখারী মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহিহ।    


হাদিস- ৬.  

=====

ইমাম বাযযার এবং ইমাম হাকিম স্বীয় মুস্তাদরাক গ্রন্থে হযরত ছাওবান (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (ﷺ) বলেন- কিয়ামতের দিন জাহিলিয়াত যুগের লোকগণ তাদের গোনাহসমূহ পিঠে নিয়ে আগমন করবে। তখন আল্লাহতায়ালা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন। জবাবে তারা বলবে হে আমাদের রব আমাদের কাছে কোন রাসূল কিংবা আপনার কোন বিধান আগমন করেনি। যদি আমাদের কাছে রাসূল প্রেরণ করতেন তাহলে আমরা আপনার অনুগত বান্দা হতাম।    


অতঃপর আল্লাহতায়ালা বলবেন- তোমরা কি জান যে, আমার নির্দেশ অবশ্যই পালনীয়? তারা বলবে হ্যাঁ।  


অতঃপর তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হবে জাহান্নামে প্রবেশ করার জন্য। তখন তারা জাহান্নামের দিকে গমন করবে। যখন জাহান্নামের নিকটবর্তী হবে তখন তারা এর ভয়াবহ গর্জন ও হুংকার শুনতে পাবে। তখন সবাই তাদের প্রভুর কাছে ফিরে আসবে এবং বলবে হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করুন।  


তখন তিনি বলবেন- তোমরা কি জাননা যে আমার নির্দেশ অবশ্যই পালনীয়? অতঃপর এ ব্যাপারে তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে। আল্লাহ বলবেন- যাও জাহান্নামে প্রবেশ কর। তখন সবাই সেদিকে গমন করবে। যখন তারা জাহান্নাম দর্শন করবে তখন প্রত্যাবর্তন করে আসবে এবং বলবে- হে আমাদের রব আমাদেরকে রা কর। আমরা এতে প্রবেশ করতে পারব না। তখন আল্লাহ বলবেন- যাও অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ কর।    


অতঃপর নবী করিম (ﷺ) বলেন- যদি তারা প্রথমেই জাহান্নামে প্রবেশ করত তাহলে তাদের উপর শান্তি ও শীতলতা বর্ষিত হত।  


ইমাম হাকিম বলেন এ হাদিসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহিহ।    


হাদিস- ৭.  

=====

ইমাম তাবরানী ও আবু নঈম হযরত মায়াজ বিন জাবাল (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (ﷺ) বলেন- কিয়ামতের দিন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি, ফাতরাতের সময় নিহত এবং বাল্যকালে নিহত ব্যক্তিদেরকে আনয়ন করা হবে।    


তখন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি ব্যক্তি বলবে, হে প্রভু, যদি আমাকে বুদ্ধি প্রদান করতেন। যাদেরকে বুদ্ধি প্রদান করেছেন তারা আমার চেয়ে অধিক সৌভাগ্যশীল হয়েছে। ঠিক এমনিভাবে ফাতরাতের সময় নিহত ও বাল্যকালে নিহত ব্যক্তি আপত্তি করবে।    


তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন- আমি তোমাদেরকে আদেশ করব তোমরা তা মান্য করবে তো? তারা বলবে হ্যাঁ। আল্লাহ বলবেন তবে যাও জাহান্নামে প্রবেশ কর। নবীজী বলেন- যদি তারা প্রবেশ করে তাহলে তাদের কোন তি হবে না। অতঃপর তাদের জন্য জাান্নামের উত্তপ্ত পানি প্রস্তুত করা হবে। তখন তাদের মনে হবে যেন আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টিরাজি ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন তারা দ্রুতগতিতে ফিরে আসবে। অতঃপর তাদেরকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেয়া হবে। তথাপি তারা প্রত্যাবর্তন করবে। তখন প্রভূ বলবেন- তোমাদের সৃষ্টির পূর্বেই আমি জানতাম তোমরা কি আমল করবে এবং তোমাদের কি পরিণতি হবে। অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করা হবে।


আইম্মায়ে কিরামদের অভিমত


আল কিয়া আল হিরাসীর অভিমত: আল কিয়া আল হিরাসী স্বীয় উসূল গ্রন্থে নিয়ামতের শোকরিয়া সংক্রান্ত মাসআলার অধীনে বলেছেন- জেনে রাখুন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ইমামদের মূলনীতি হল শরয়ী দলিল ব্যতিত কোন আহকাম প্রতিষ্ঠা হয় না। শুধুমাত্র বুদ্ধিভিত্তিক ফয়সালা দ্বারা হুকুম সাব্যস্ত হয় না। অতএব সর্বপ্রথম যারা এ ব্যাপারে আহলে হকের সাথে বিরোধিতা করেছেন তারা হলেন রাফেজী, কারামিয়া ও মুতাজিলা প্রমূখ। তাদের মতে আহকাম কয়েক প্রকার। তার মধ্যে একটি হল, যা শরয়ী দলিল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। অন্যটি হল যা বুদ্ধিভিত্তিক যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত।  


আল হিরাসী বলেন আমাদের মতে কোন রাসূল আগমনের পূর্ব পর্যন্ত কিছুই ওয়াজিব হয় না। অতএব যখন রাসূল আগমন করে মুজিযা প্রতিষ্ঠা করলেন তখন জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে চিন্তা গবেষণা করা সম্ভব।    


ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (রা.) এর অভিমত  

==========

ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (رضي الله عنه) স্বীয় ‘আল মাহসুল’ গ্রন্থে বলেছেন, যুক্তিভিত্তিক দলিল দ্বারা ‘নিয়ামতের শোকরিয়া’ ওয়াজিব সাব্যস্ত হয় না। তবে এক্ষেত্রে মুতাজিলাদের মতামত আমাদের ব্যতিক্রম। যদি নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই ওয়াজিব সাব্যস্ত করা হয় তাহলে তার অস্বীকারকারীকে এমন কারণে শাস্তি দেওয়া হবে যা আবশ্যক নয়। এখানে মতানৈক্যের বিষয়টি সুস্পষ্ট। তাকে যে শাস্তি দেয়া হবে না তা আল্লাহর বাণীতেই রয়েছে। وما كنامعذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।    


উক্ত আয়াতে নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত শাস্তি না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তথাপি যদি শাস্তি প্রদান করা হয় তাহলে আল্লাহর কথার মধ্যে ব্যতিক্রম দেখা দিবে। যা অসম্ভব।  


এ অভিমতটি الحاصل والتحصيل গ্রন্থের মুসান্নিফ এবং ইমাম বায়জাভী তাঁর ‘মিনহাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।    


কাজী তাজ উদ্দিন সুবুকি (রা.) এর অভিমত  

==========

ইমাম সুবুকি (رضي الله عنه) شرح مختصر ابن الحاجب কিতাবে নিয়ামতের শোকরিয়াসংক্রান্ত মাসআলায় বলেছেন- যাদের নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই আমাদের মাযহাব অনুযায়ী তারা নাজাতপ্রাপ্ত হিসেবেই মৃত্যুবরণ করেছেন। ইসলামের দাওয়াত না দেওয়া পর্যন্ত কাউকে হত্যা করা যাবে না। যদি হত্যা করা হয়, তবে রক্তপণ ও কাফ্ফারা প্রদান করতে হবে। তবে হত্যাকারীর উপর কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা ওয়াজিব হবে না। ইহাই বিশুদ্ধ মত।    


ইমাম বগভী (রা.) এর অভিমত  

==========

ইমাম বগভী (رضي الله عنه) ‘তাহযিব’ গ্রন্থে বলেছেন যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে হত্যা করা জায়েয নাই। ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে যদি তাকে হত্যা করা হয় তবে এক্ষেত্রে কাফফরা ও রক্তপণ আবশ্যক হবে।    


ইমাম আবু হানিফা (رضي الله عنه) এর মতে এ হত্যার জন্য রক্তপণ আবশ্যক হবে না। কারণ তার আকল তথা বুদ্ধির উপর দলিল প্রয়োগ করা হবে। তবে আমাদের মতে দাওয়াত পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত তার উপর কোন হুজ্জত প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। যেমন আল্লাহর বাণী- وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।    


অতএব প্রমাণিত হল যে, রাসূল আগমনের পূর্ব পর্যন্ত তার উপর কোন হুজ্জত নাই।  


এমনিভাবে ইমাম রাফেয়ী বলেছেন- যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার পূর্বে হত্যা করা জায়েয নাই। যদি তাকে হত্যা করা হয় তবে তার রক্তপণ প্রদান করতে হবে। তবে ইমাম আবু হানিফা (رضي الله عنه) এর মত ব্যতিক্রম। তাঁর নিকট এই ব্যতিক্রমের মূল ভিত্তি হল, সে ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার উপর হুজ্জত প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের নিকট যার কাছে দাওয়াত পৌঁছে নাই তার উপর হুজ্জত প্রতিষ্ঠিত হবে না। যেমন আল্লাহর বাণী وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না।    


ইমাম গাজ্জালী (রা.) এর অভিমত  

============

ইমাম গাজ্জালী (رضي الله عنه) ‘আল বাসিত’ গ্রন্থে বলেছেন- যার নিকট দাওয়াত পৌঁছে নাই তার হত্যার জন্য কাফফারা ও রক্তপণ প্রদান করতে হবে। তবে কিসাস বা হত্যার বদলে হত্যা করা যাবে না ইহাই বিশুদ্ধ মত। কেননা হাকিকী অর্থে সে মুসলিম নয়। শুধুমাত্র অর্থগতভাবে সে মুসলিম। এমনিভাবে ইবনে রিফায়া বলেছেন ‘আল কিফায়া’ গ্রন্থে কেননা সে ব্যক্তি ফাতরাতের যুগে জন্মগ্রহণকারী এবং তার থেকে কোন শত্র“তা প্রকাশ পায়নি।    


ইমাম নবভী (রা.) এর অভিমত  

==========

ইমাম নববী (رضي الله عنه) ‘শরহে মুসলিম’ গ্রন্থে মুশরিক শিশুদের মাসআলায় বলেছেন- এব্যাপারে মুহাক্কিক উলামাযে কেরামদের সহিহ অভিমত হল মুশরিকদের শিশুগণ জান্নাতী। যেমন আল্লাহর বাণী- وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল প্রেরণ না করে আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। তিনি বলেন-দাওয়াত না পৌঁছার কারণে যদি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে আযাব না দেওয়া হয় তাহলে অপ্রাপ্ত শিশুদের বেলায়ও আযাব হবে না।    


একটি প্রশ্ন ও তার জবাব  

==========

ইমাম সুয়ুতি (رضي الله عنه) বলেন- তুমি যদি প্রশ্ন কর উল্লেখিত মসলক বা অনুসারীদের যে মতামত আপনি উল্লেখ করেছেন তা কি জাহিলিয়াত যুগের সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য?  


জবাবে আমি বলব ‘না’। বরং ইহা শুধুমাত্র তাদের জন্য নির্দিষ্ট যাদের নিকট প্রকৃত পে কোন নবীর দাওয়াত পৌঁছে নাই। কেননা যার নিকট পূর্ববর্তী কোন নবীর দাওয়াত পৌঁছেছে, তথাপি সে কুফুরির উপর অটল ছিল সে অবশ্যই জাহান্নামী হবে, এতে কোন মতবিরোধ নেই।    


অতএব রাসূলেপাক (ﷺ) এর সম্মানিত পিতা-মাতার ব্যাপারটি সুস্পষ্ট। উল্লেখিত মসলকটি এ অভিমতই গ্রহণ করেছেন যে, তাদের কাছে কোন দাওয়াত পৌঁছে নাই। আর এর পিছনে কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। যেমন তাদের যুগ ছিল অনেক পরবর্তী যুগ এবং তাদের ও পূর্ববর্তী নবীদের মধ্যখানে ছিল বিরাট ব্যবধান। যেমন আমাদের নবী (ﷺ) এর পূর্বে সর্বশেষ নবী ছিলেন ঈসা আলাইহিস সালাম তিনি ও আমাদের নবীর মধ্যখানে ফাতরাতের সময় ছিল প্রায় ছয়শত বছর।  


তথাপি নবীজীর পিতা-মাতার যুগ ছিল জাহিলিয়াতের যুগ। পূর্ব পশ্চিম, সমগ্র পৃথিবী জাহিলিয়াতে ঢেকে গিয়েছিল। হাতেগোনা কিছুসংখ্যক আহলে কিতাব পাদ্রী ব্যতিত শরিয়ত সম্বন্ধে অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিই ছিল না। তদুপরি তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। যেমন শ্যাম ও অন্যান্য দেশ। মদিনাশরীফ ছাড়া অন্য কোন দেশে নবীজীর পিতা-মাতা ভ্রমণ করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া তারা উভয়ে এমন লম্বা হায়াতও পাননি যাতে করে এ ব্যাপারে অধিক খোঁজখবর করতে পারেন। কেননা নবী করিম (ﷺ) এর পিতা সামান্য কিছু দিনের হায়াত পেয়েছিলেন।    


হাফিজ সালাহউদ্দিন আল আলায়ীর অভিমত  

==========

ইমাম হাফিজ সালাহ উদ্দিন আল আলায়ী الدرة السنية فى مولد سيد البرية কিতাবে বলেছেন, মা আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহা যখন রাসূল (ﷺ)কে গর্ভধারণ করেন তখন আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) এর বয়স মাত্র আঠারো বৎসর। অতঃপর তিনি খেজুর সংগ্রহের জন্য মদিনাশরীফ গমন করেন এবং সেখানে মামার বাড়ি বনি নাজ্জার গোত্রে ইন্তেকাল করেন।    


মা আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহাও প্রায় একই রকম বয়স পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন পর্দাশীল মহিলা। তিনি সবসময় পুরুষদের মেলামেশা থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য বাড়িতে অবস্থান করতেন। তখনকার অধিকাংশ মহিলারাই জানতেন না ধর্মীয় ও শরিয়তের ব্যাপারে পুরুষদের কি দায়িত্ব। বিশেষ করে জাহিলিয়াতের যুগে পুরুষগণও জানতেন না মহিলাদের উপর তাদের কি প্রাধান্য রয়েছে। এজন্য যখন নবী মুহাম্মদ (ﷺ) প্রেরিত হলেন তখন আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগলো ابعث الله بشرا رسولا অর্থ: আল্লাহ কি মানুষকে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন (ইসরা- ৯৪) এবং তারা বলতো-  


ولو شاءالله لانزل ملئكة ما سمعنا بهذا فى ابائنا الاولين-    


অর্থ: আল্লাহ ইচ্ছা করলে ফেরেশতাই নাজিল করতেন। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে এরূপ কথা শুনিনি। (মুমিনুন- ২৪)    


অতএব যদি তাদের নিকট রাসূল প্রেরণের জ্ঞান থাকতো তবে তারা ইহা অস্বীকার করতো না। আবার কখনো তারা ধারণা করত তারা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর শরিয়তের উপরেই আছে। কারণ ইব্রাহিমী শরিয়তের জ্ঞানসম্পন্ন কারো সাাত তারা পায়নি। কেননা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও তাদের মধ্যখানে প্রায় তিনহাজার বছরের অধিক ব্যবধান ছিল।    


অতএব এ আলোচনার দ্বারা ইহাই স্পষ্ট হয় যে, রাসূল (ﷺ) এর পিতা-মাতা এ মসলকেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।    


শেখ ইজ্জুদ্দিন বিন সালাম (রা.) এর অভিমত  

==========

শেখ ইজ্জুদ্দিন বিন সালাম ‘আমালী’ গ্রন্থে বলেছেন- আমাদের নবী (ﷺ) ব্যতিত অন্যান্য সমস্ত নবীগণ শুধুমাত্র তাদের সম্প্রদায়ের প্রতিই প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন এ মূলনীতি অনুযায়ী আহলে ফাতরাতের সমস্ত অধিবাসীগণ তাদের পূর্ববর্তী নবীর বংশধর। তাদের পূর্ববর্তী নবীর দিকে সম্বোধন করা হয়। এবং তারা তাদের পূর্ববর্তী শরিয়তকে অনুসরণ করেন। অতএব তারাই হলেন আহলে ফাতরাত।    


উক্ত আলোচনা দ্বারা ইহাই সুস্পষ্ট হয় যে, রাসূলেপাক (ﷺ) এর সম্মানিত পিতা-মাতা আহলে ফাতরাতের অন্তর্ভুক্ত এতে কোন সন্দেহ নাই। কেননা তারা ঈসা আলাইহিস সালাম এর বংশধর নয় এবং তার সম্প্রদায় এর অন্তর্ভুক্ত নয়।    


ইবনে হাজর আসকালনী (রা.) এর অভিমত  

==========

হাফিজুল আসর আবুল ফজল বিন হাজর (رضي الله عنه) বলেন- রাসূলেপাক (ﷺ) এর পিতামাতা সম্বন্ধে যে ধারণা করা হয় তারা কিয়ামতের দিন পরীক্ষায় আনুগত্যশীল হবেন এর দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে।  


প্রথম ব্যাখ্যা  

=====

ইমাম হাকিম (رضي الله عنه) মুস্তাদরাক কিতাবে ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং সহিহ বলেছেন-  


قال قال شاب من الانصار (لم ار رجلا كان اكثر سوالا لرسول الله صلى الله عليه وسلم منه) يا رسول الله أرأيت ابواك فى النار- فقال ما سألتها ربى فيطيعنى فيها وانى لقائم يومئذ المقام المحمود-    


অর্থ: ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন- একদা আনসারী এক যুবক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে প্রশ্ন করল (ইবনে মাসউদ বলেন তার চেয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে অধিক প্রশ্ন করতে কাউকে দেখিনি) ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ) আপনি কি মনে করেন, আপনার পিতা-মাতা জাহান্নামী? তখন তিনি বললেন- আমি তাদের সম্বন্ধে আমার প্রভুর নিকট যা চাইব আমাকে তাই দেয়া হবে। আর সেদিন আমি মাকামে মাহমুদে অবস্থান করব।    


উল্লেখিত হাদিসটি প্রমাণ করে যে, রাসূলেপাক (ﷺ) যখন মাকামে মাহমুদে অবস্থান করবেন তখন তিনি তাঁর পিতা-মাতার কল্যাণ কামনা করবেন। আর তা হল যখন আহলে ফাতরাতদেরকে পরীক্ষা করা হবে তখন রাসূল (ﷺ) সুপারিশ করবেন যেন তারা উভয়ে পরীক্ষায় আনুগত্যশীল হন। এতে কোন সন্দেহ নাই যখন নবীজী মাকামে মাহমুদে সমাসীন হবেন তখন তাকে বলা হবে سل تعط واشفع تشفع অর্থ: আপনি সুয়াল করুন, দেয়া হবে। সুপারিশ করুন, কবুল করা হবে। ইহা সহিহ হাদিসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত। অতএব যখন তিনি পিতা-মাতার ব্যাপারে সুয়াল করবেন তখন তা কবুল হবে।    


দ্বিতীয় ব্যাখ্যা  

=====

ইবনে জারির স্বীয় তাফসির গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে-ولسوف يعطيك ربك فترضى আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেন-  


قال من رضا محمد صلى الله عليه وسلم ان لايدخل احد من اهل بيته النار    


অর্থ: ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেনÑ মুহাম্মাদ (ﷺ) এর রেযা বা সন্তুষ্টি হচ্ছে তাঁর পরিবারের কোন সদস্য জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। এজন্য হাফিজ ইবনে হাজর (رضي الله عنه) তার উক্তিতে বলেছেন-  

الظن بال بيته كلهم ان يطيعوا عند الامتحان    


অর্থ: নবী করিম (ﷺ) এর পরিবার সম্বন্ধে ধারণা করা হয় যে, তারা প্রত্যেকেই পরীার সময় আনুগত্যশীল হবেন।    


তৃতীয় হাদিস: হযরত আবু সাঈদ (رضي الله عنه) شرف النبوة গ্রন্থে এবং মুল্লা তার সীরাতগ্রন্থে ইমরান বিন হোসাইন (رضي الله عنه) থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم سألت ربى ان لا يدخل النار احدا من اهل بيتى فاعطانى ذالك-    


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন- আমি আমার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করেছি যেন আমার পরিবার থেকে কাউকে জাহান্নামে প্রবেশ না করান। অতঃপর আমাকে তা প্রদান করা হয়েছে।  


এ হাদিসটি হাফিজ মুহিব উদ্দিন তাবারী তাঁর ذخائر العقبى গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।    


আবু তালিবের জন্য শাফায়াত  

==========

চতুর্থ হাদিস: এ হাদিসটি উল্লেখিত হাদিসদ্বয়ের চেয়ে অধিক স্পষ্ট। ইহা তামাম আর রাযি জয়িফ সনদে তাঁর فوائد গ্রন্থে হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كان يوم القيامة شفعت لابى وامى وعمى ابى طالب واخ لى كان فى الجاهلية-    


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন- আমি কিয়ামতের দিন আমার পিতা, মাতা, চাচা আবু তালিব ও আমার জাহিলিয়াতের যুগের ভাইয়ের জন্য শাফায়াত করব।    


এ হাদিসটি ইমাম তাবারী ذخائر العقبى فى مناقب ذوى القربى গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন হাফিজুল হাদিস ও ফকীহ। তিনি বলেন- এখানে আবু তালিবের ব্যাপারটি তাওয়িল বা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যেমন সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে রাসূল (ﷺ) এর শাফায়াতে আবু তালিবের আযাব হ্রাস করা হবে।    


তবে এ তাওয়িলটি শুধুমাত্র আবু তালিবের ব্যাপারে প্রযোজ্য। অন্যান্য তিনজন তথা নবীজীর পিতা, মাতা ও দুধভাইয়ের জন্য আবশ্যক নয়। কেননা আবু তালিব নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত হায়াত পেয়েছিলেন কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করেননি। অন্যান্য তিনজন ফাতরাতের সময়েই ইন্তেকাল করেছেন। এ হাদিসটি অন্য একটি সূত্রে ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে। যদিও এ সূত্রটি অধিক জয়িফ। যা আবু নাঈম সহ অন্যান্যগণ বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, এখানে ভাই বলতে দুধভাইকে বুঝানো হয়েছে।  


فهذه احاديث عدة يشد بعضها بعضا- فان الحديث الضعيف يتقوى بكثرة طرقه-    


অর্থ: এ সমস্ত হাদিসগুলি একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে। কেননা জয়িফ হাদিস যখন বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয় তখন তা শক্তিশালী হয়ে যায়।    


যার উদাহরণ হল ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) এর হাদিস, ইমাম হাকিম ইহাকে সহিহ বলেছেন।  


এ ব্যাপারটি ইবনে আবি দুনিয়ার বর্ণনা দ্বারা আরো স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন- আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন কাসিম বিন হাশিম সিমসার, তিনি মাকাতিল বিন সুলাইমান রমলী থেকে, তিনি আবি মু’শার থেকে, তিনি সাঈদ মাকবারী থেকে, তিনি আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلو سألت ربى ابناء العشرين من امتى فوهبهم لى-    


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- আমি আমার প্রভূর কাছে আমার উম্মতের বিশবছর বয়সি যুবকদের জন্য প্রার্থনা করেছি। অতঃপর তিনি তাদেরকে আমাকে দান করেছেন।  


এ প্রসঙ্গে আরো একটি বর্ণনা রয়েছে, যদিও ইহা আলোচনার সাথে সরাসরি যুক্ত নয়। যা ইমাম দায়লামী হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন।  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اول من اشفع له يوم القيامة اهل بيتى ثم الاقرب فا لاقرب-    


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- কিয়ামতের দিন আমি সর্বপ্রথম শাফায়াত করব আহলে বাইতের জন্য। অতঃপর নিকটাত্মীয়দের জন্য। অতঃপর তাদের নিকটাত্মীয়দের জন্য।  


ইমাম তাবারী ذخائر العقبى গ্রন্থে এবং ইমাম আহমদ মানাকিব গ্রন্থে হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يا معشر بنى هاشم والذى بعثنى بالحق نبيا لو اخذت بحلقة الجنة ما بدأت الابكم-    


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন- হে হাশিম সম্প্রদায়ের লোকেরা! সে সত্ত্বার কসম, যিনি আমাকে সত্য সহ নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, যদি আমি জন্নাতের কড়া ধারণ করি তাহলে আমি তোমাদেরকে নিয়েই জান্নাতে প্রবেশ করব।    


ইহা খতিব তাঁর তারিখ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এমনিভাবে আবুল বখতারী হযরত জাবির (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ما بال اقوام يزعمون ان رحمى لا ينتفع بلى حتى تبلغ حكم وهم احد قبيلتين من اليمن- انى لاشفع فاشفع حتى ان من اشفع له فيشفع حتى ان ابليس ليتطاول طمعا فى الشفاعة-    


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- সে সমস্ত সম্প্রদায়ের কি হয়েছে যারা ধারণা করে যে, আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক কোন উপকার করবে না। কিন্তু না অবশ্যই উপকার করবে। এমনকি ‘হুকুম’ সম্প্রদায় পর্যন্ত উপকৃত হবে। (হুকুম হল ইয়ামনের একটি গোত্র)। আমি শাফায়াত করব এবং যার জন্য শাফায়াত করব তা গ্রহণ করা হবে। শেষ পর্যন্ত ইবলিসও শাফায়াতের জন্য আকাক্সা করবে।  


এমনিভাবে তাবরানী উম্মে হানী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


ان النبى صلى الله عليه وسلم قال ما بال اقوام يزعمون ان شفاعتى لا تنال اهل بيتى وان شفاعتى تنال حاء وحكم-    


অর্থ: নবী করিম (ﷺ) বলেন- সে সমস্ত সম্প্রদায়ের কি হয়েছে যারা ধারণা করে আমার পরিবারগণ আমার শাফায়াত লাভ করবে না। নিশ্চয় আমার শাফায়াত ‘হা’ ও ‘হুকুম’ গোত্রদ্বয় পর্যন্ত লাভ করবে।    


সূক্ষ্মকথা  

=====

ইমাম যারকাশী ‘খাদিম’ গ্রন্থে ইবনে দাহইয়া থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি প্রতি সোমবারে আবু লাহাবের আযাব হ্রাসকরণকে শাফায়াতের প্রকারভেদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তা হচ্ছে রাসূলেপাক (ﷺ) এর মিলাদশরীফে খুশি হয়ে আবু লাহাব সুয়াইবা দাসীকে মুক্ত করেছিল, যখন সুয়াইবা তাকে এ সংবাদ প্রদান করেছিলেন। তিনি বলেন- ইহা হচ্ছে রাসূলেপাক (ﷺ) এর কিরামত বা মর্যাদা।    


সতর্কবাণী  

=====

অতঃপর দেখেছি ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন খালফ আল উবাই ‘শরহে মুসলিম’ গ্রন্থে এই মাসআলার উপর দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তিনি- ان ابى واباك فى النار অর্থ আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামী’ এ হাদিসের অধীনে ইমাম নবভীর উক্তি উল্লেখ করেছেন। নবভী বলেন- যে ব্যক্তি কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামী এবং তার নিকটাত্মীয়গণ তার কোন উপকার করতে পারবে না।  


অতঃপর আল উবাই বলেন- আমি বলব এই সম্বোধনটির প্রতি লক্ষ্য করুন।


এমনিভাবে সুহাইলী বলেছেন- এভাবে মন্তব্য করা আমাদের জন্য উচিত নয়। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেছেন-  


لا تؤذوا الاحياء بسب الاموات    

অর্থ: তোমরা মৃতদেরকে গালি দেয়ার মাধ্যমে জীবিতদেরকে কষ্ট দিও না।  


আল্লাহতায়ালা বলেছেন- ان الذين يؤذون الله ورسوله لعنهم الله অর্থ: যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত। (আহযাব- ৫৭)    


সম্ভবত এজন্য ইহা সঠিক যে রাসূল (ﷺ) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। তখন আল্লাহতায়ালা তাঁর পিতামাতাকে জীবিত করে দিলেন। অতঃপর তারা নবীজীর প্রতি ঈমান আনয়ন করলেন। কারণ আল্লাহর নিকট কোন কিছুই অসম্ভব নয়।    


অতঃপর তিনি ইমাম নবভীর উক্তি পেশ করেন। তিনি বলেন- এমনিভাবে যে ব্যক্তি ফাতরাতের যুগে মৃত্যুবরণ করছে ঐ বিশ্বাসের উপর যার উপর আরবগণ ছিল অর্থাৎ মূর্তিপূজক হিসেবে সেও জাহান্নামী।  


আর এ শাস্তি এ জন্য নয় যে, তার নিকট কোন দাওয়াত পৌঁছেনি। বরং তাদের নিকট ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নবীদের দাওয়াত পৌঁছেছে।  


অতঃপর আল উবাই বলেন, আমি বলব তার বক্তব্যের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কারণ যার নিকট দাওয়াত পৌঁছেছে তারা আহলে ফাতরাত নয়। কেননা আহলে ফাতরাত হল ঐ সমস্ত লোক যারা দু’জন রাসূলের মধ্যবর্তী সময়ে ছিলেন। পূর্বেকার নবী তাদের প্রতি প্রেরিত হননি। আবার পরবর্তী নবীকেও তারা পাননি। যেমন আরবজাতী, তাদের প্রতি ঈসা আলাইহি সালামকে প্রেরণ করা হয়নি। আবার তারা মুহাম্মদ (ﷺ) এর সাক্ষাতও পায়নি।  


এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী ফাতরাত বললে ঐ যুগকে বুঝায় যা দু’জন রাসূলের মধ্যবর্তী সময়।  


কিন্তু ফুকাহায়ে কিরামগণ যখন ফাতরাত সম্পর্কে আলোচনা করেন তখন তারা শুধুমাত্র ঈসা আলাইহিস সালাম ও আমাদের নবীর মধ্যবর্তী সময়কে নির্দিষ্ট করেন।  


অতএব যখন অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত হল যে, হুজ্জত প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত কোন শাস্তি নাই। তখন আমরা বুঝতে পারলাম তাদের কোন শাস্তি হবে না।


উলামায়ে কেরামদের দ্বিতীয় মসলক বা অভিমত


দ্বিতীয় মসলক বা অভিমত হল নবী করিম (ﷺ) এর পিতা-মাতার প থেকে কোন শিরকি কার্যকলাপ প্রমাণিত হয়নি। বরং তারা ছিলেন হানিফ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তারা হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন আরবদের মধ্যে এ রকম আরো অনেক লোক বিদ্যমান ছিলেন। যেমন যায়দ বিন আমর বিন নুফাইল, ওয়ারাকা বিন নওফেল প্রমুখ।    


দ্বিতীয় মসলকের স্বপে ইমাম রাযী (রা.) এর বক্তব্য  

==========

এ মসলক বা অভিমতের অন্যতম প্রবক্তা হলেন ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (رضي الله عنه)। তিনি স্বীয় اسرار التنزيل কিতাবে দলিলভিত্তিক আলোচনায় বলেছেন- বলা হয়েছে আযর ইব্রাহিম আলাইহি সালাম এর পিতা ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন ইব্রাহিম আলাইহি সালাম এর চাচা। এ ব্যাপারে তারা কয়েকটি দলিল পেশ করেছেন।  


প্রথম দলিল  

=====

আম্বিয়ায়ে কিরামদের পিতৃপুরুষদের মধ্যে কোন কাফির ছিল না। এর উপর কয়েকটি দলিল বিদ্যমান। যেমন আল্লাহর বাণী-  


الذى يرك حين تقوم- وتقلبك فى السجدين  


অর্থ: যিনি আপনাকে দেখেন যখন আপনি নামাযে দণ্ডায়মান হন এবং নামাযীদের মধ্যে আপনার চলাচল। (শুয়ারা- ২১৮-২১৯)  


বলা হয়েছে এ আয়াতের অর্থ হল নবী করিম (ﷺ) এর নূর মোবারক সিজদাকারী থেকে সিজদাকারীর মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়েছে। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী উক্ত আয়াত দ্বারা ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, মুহাম্মদ (ﷺ) এর পূর্ব পুরুষদের মধ্যে প্রত্যেকেই মুসলমান ছিলেন। অতএব ইহা অকাট্যভাবে আবশ্যক যে ইব্রাহিম আলাইহি সালাম এর পিতা কাফির ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন তাঁর চাচা। ইহাই উক্ত আয়াতের ভাবার্থ।    


দ্বিতীয় দলিল  

=====

রেওয়ায়ত তথা বর্ণনাসমূহ যখন কুল্লি বা সমষ্টিগতভাবে প্রয়োগ হয় এবং এর মধ্যে কোন নিষেধাজ্ঞা পাওয়া না যায় তখন আয়াতের অর্থ ‘কুল্লি’ বা সমষ্টির উপর প্রয়োগ করা আবশ্যক।  


এ মূলনীতিটি যখন বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হল তখন ইহাই প্রতীয়মান হল যে, ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতা মূর্তিপূজক ছিলেন না। অতঃপর ফখরুদ্দিন রাযী বলেন মুহাম্মদ (ﷺ) এর পিতৃপুরুষদের মধ্যে যে কেহই মুশরিক ছিলেন না তার দলিল হল রাসূল (ﷺ) এর বাণী-  


لم ازل انقل من اصلاب الطاهرين الى ارحام الطاهرات  

অর্থ: আমি পবিত্র পুরুষদের পৃষ্ঠদেশ থেকে পবিত্র রমণীগণের গর্ভের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়েছি  


এবং আল্লাহ বলেছেন-انما المشركون نجس অর্থ: নিশ্চয় মুশরিকগণ অপবিত্র। (তাওবা- ২৮)  


অতএব ইহা আবশ্যক যে, রাসূল (ﷺ) এর পিতৃপুরুষদের মধ্যে কেউ মুশরিক হতে পারবে না। ইহা হচ্ছে ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (رضي الله عنه) এর হুবহু বক্তব্য।  


তিনি ছিলেন তাঁর যুগের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ইমাম। বেদআতী মতবাদের খণ্ডনকারী এবং আশআরী জামাতের সাহায্যকারী। তিনি হিজরি ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রেরিত হয়েছিলেন উম্মতে মুহাম্মদী (ﷺ) এর দ্বীনি সংস্কার সাধন করার জন্য। অর্থাৎ তিনি ছিলেন একজন মুজাদ্দিদ।    


দু’টি মুকাদ্দামা  

=====

ইমাম সুয়ুতি বলেন, এ মসলকের স্বপে ইমাম ফখরুদ্দিন যে বক্তব্যটি পেশ করেছেন সে ব্যাপারে আমার নিকট কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়েছে।  


প্রথমত, তিনি যে দলিল পেশ করেছেন তা দু’টি মুকাদ্দামা বা ভূমিকার সাথে যুক্ত।  

প্রথম মুকাদ্দামা: নবীজীর পিতৃপুরুষগণ ছিলেন স্ব-স্ব যুগে সর্বশ্রেষ্ঠ  


বিশুদ্ধ হাদিসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত যে, নবীয়েপাক (ﷺ) এর পিতৃপুরুষগণ আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) পর্যন্ত সর্বযুগে তারা ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।  


দ্বিতীয় মুকাদ্দামা: পৃথিবীতে সর্ব যুগেই এমন কিছু লোক থাকেন যারা ফিতরাতের উপর বিশ্বাসী  


অসংখ্য হাদিস ও আছার দ্বারা প্রমাণিত যে হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে মুহাম্মদ (ﷺ) পর্যন্ত এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত এ পৃথিবীতে সদাসর্বদা এমন কিছু লোক বিদ্যমান থাকবেন যারা হবেন ফিতরাতের উপর বিশ্বাসী। তারা আল্লাহর ইবাদত করবেন এবং তারা হবেন একত্ববাদে বিশ্বাসী। তাদের মাধ্যমেই পৃথিবীকে হিফাজত করা হবে। যদি তারা না থাকতেন তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত।  


এখন তুমি যদি উভয় মুকাদ্দামাকে একত্রিত কর তাহলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে যে নবী করিম (ﷺ) এর পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোন মুশরিক ব্যক্তি ছিলেন না। কারণ তাদের ব্যাপারে প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব যুগে সর্বোত্তম লোক ছিলেন।   

এখন যদি রাসূল (ﷺ) এর পিতৃপুরুষগণ তাদের অন্তর্ভুক্ত হন যারা ফিতরাতের উপর বিশ্বাসী ছিলেন, তাহলে সেটাইতো আমাদের দাবি। কিন্তু যদি তারা অন্যান্য লোকদের অন্তর্ভুক্ত হন যারা ছিলেন মুশরিক তাহলে দুটি বিষয়ের যে কোন একটি অবশ্যক হয়।  


হয়তো মুশরিকগণ মুসলমানদের চেয়ে উত্তম হবে। ইহা সর্বসম্মতিক্রমে বাতিল বা অগ্রহণযোগ্য। অথবা অন্যান্য লোকগণ তাদের চেয়ে উত্তম হবে। ইহাও বাতিল। কারণ ইহা সহিহ হাদিসসমূহের ব্যতিক্রম। অতএব অকাট্যভাবে ইহাই প্রমাণিত হয় যে, তাদের মধ্যে কোন মুশিরিক ছিলেন না। তাদের যুগে তারাই ছিলেন উত্তম লোক।    


প্রথম মুকাদ্দামার দলিলসমূহ  

==========

ইমাম বুখারী হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم بعثت من خير قرون بنى ادم قرنا فقرنا حتى بعثت من القرن الذى كنت فيه  


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন- আমি আদম সন্তানদের মধ্যে উত্তম যুগ থেকে উত্তম যুগে প্রেরিত হয়েছি। সর্বশেষ আমি বর্তমান যুগে এসে পৌঁছেছি।  


ইমাম বায়হাকী دلائل النبوة কিতাবে হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


ان النبى صلى الله عليه وسلم قال ما افترق الناس فرقتين الا جعلنى الله فى خيرهما- فا خرجت من بين ابوى فلم يصبنى شئ من عهد الجاهلية- وخرجت من نكاح ولم اخرج من سفاح من لدن ادم حتى انتهيت الى ابى وامى فانا خيركم نفسا وخيركم أبا-  


অর্থ: নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন- আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে দুভাগে বিভক্ত করে আমাকে তাদের উত্তমভাগে মনোনীত করেছেন। আমি আমার পিতামাতার মাধ্যমে আগমন করেছি। অতএব জাহিলিয়াতের কোন জিনিস আমাকে স্পর্শ করেনি। আমি বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে আগমন করেছি। আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে আমার পিতামাতা পর্যন্ত কোন অবৈধ সূত্র ছিল না। অতএব আমি তোমাদের মধ্যে ব্যক্তিগত ও বংশগত উভয় সূত্রেই উত্তম।  


আবু নাঈম دلائل النبوة গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- لم يزل الله ينقلنى من الاصلاب الطيبة الى الارحام الطاهرة مصنفا مهذبا- لا تنشعب شعبتان الا كنت فى خيرهما-  


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন- আল্লাহতায়ালা পবিত্র পৃষ্ঠদেশসমূহ থেকে পবিত্র গর্ভের মাধ্যমে আমাকে স্থানান্তর করেছেন। যখনই কোন দুটি শাখা তৈরি হয়েছে তখন আমি তাদের উত্তম শাখায় ছিলাম।  


ইমাম মুসলিম এবং ইমাম তিরমিজি সহিহ সূত্রে ওয়াসিলা বিন আসকা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله اصطفى من ولد ابراهيم واسماعيل واصطفى من ولد اسماعيل بنى كنانة- واصطفى من بنى كنانة قريشا واصطفى من قريش بنى هاشم واصطفنى من بنى هاشم-  


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- আল্লাহতায়ালা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর বংশধর থেকে ইসমাইল আলাইহিস সালামকে মনোনীত করেছেন। অতঃপর ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর বংশ থেকে বনী কেনানাকে মনোনীত করেছেন। অতঃপর বনী কেনানা থেকে কুরাইশকে মনোনীত করেছেন। কুরাইশ থেকে বনী হাশিমকে নির্বাচন করেছেন। অতঃপর বনি হাশিম থেকে আমাকে মনোনীত করেছেন।  


হাফিজ আবুল কাশিম হামসাহ বিন ইউসুফ সাহমী হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) এর ফজিলতসংক্রান্ত একটি হাদিস ওয়াসিলাহ থেকে বর্ণনা করেছেন-  


ان الله اصطفى من ولد ادم ابراهيم واتخذه خليلا- واصطفى من ولد ابراهيم اسماعيل- ثم اصطفى من ولد اسماعيل نزار- ثم اصطفى من ولد نزار مضر ثم اصطفى من مضر كنانة ثم اصطفى من كنانة قريشا ثم اصطفى من قريش بنى هاشم ثم اصطفى من بنى هاشم بنى عبد المطلب ثم اصطفنى من عبد المطلب  


অর্থ: আল্লাহতায়ালা আদম সন্তানদের মধ্যে ইব্রাহিম আলাইহি সালামকে মনোনীত করেছেন এবং তাকে খলিল উপাধি প্রদান করেছেন। অতঃপর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর বংশ থেকে ইসমাইল আলাইহিস সালামকে নির্বাচন করেছেন। অতঃপর ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর বংশ থেকে নাজ্জার গোত্রকে নির্বাচন করেছেন। অতঃপর নাজ্জার থেকে মুদার গোত্রকে নির্বাচন করেছেন। অতঃপর মুদার থেকে কেনানা গোত্রকে মনোনীত করেছেন। অতঃপর কেনানা থেকে কুরাইশ, কুরাইশ থেকে বনি হাশিম, বনি হাশিম থেকে বনি আব্দুল মুত্তালিব গোত্রকে মনোনীত করেছেন। অতঃপর আমাকে বনী আব্দুল মুত্তালিব গোত্র থেকে নির্বাচন করেছেন।  


মুহিব তাবারী- ذخائر العقبى গ্রন্থে এবং ইবনে সা’দ তাকাত গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم خير العرب مضر وخير مضر بنى عبد مناف (وخير بنى مناف) بنو هاشم وخير بنى هاشم بنو عبد المطلب والله ما افترق فرقتان منذ خلق الله ادم الا كنت فى خيرهما-  


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন- আরবদের মধ্যে মুদার গোত্র উত্তম। মুদার গোত্রের মধ্যে আব্দে মনাফ শাখা উত্তম। বনী মনাফের মধ্যে বনু হাশিম উত্তম। হাশেমী শাখার মধ্যে বনু আব্দুল মুত্তালিব উত্তম।  


আল্লাহর শপথ, আদম আলাইহিস সালাম এর সৃষ্টি থেকে শুরু করে যখনই দুটি শাখা তৈরি হয়েছে তখন তাদের উত্তম শাখায় ছিলাম।  


ইমাম তাবরানী, বায়হাকী এবং আবু নাঈম হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه ان الله خلق الخلق فاختار من الخلق بنى ادم واختار من بنى ادم العرب واختار من العرب مضر واختار من مضر قريشا واختار من قريش بنى هاشم واختارنى من بنى هاشم فانا من خيار الى خيار-  


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিরাজীর মধ্যে বনী আদমকে মনোনীত করলেন। বনী আদম থেকে আরবদেরকে নির্বাচন করলেন। অতঃপর আরবদের মধ্যে মুদার গোত্র, মুদার থেকে কুরাইশ এবং কুরাইশ থেকে বনি হাশিমকে মনোনীত করলেন। অতঃপর বনী হাশিম থেকে আমাকে নির্বাচন করলেন। অতঃপর আমি উত্তম থেকে উত্তম গোত্রে মনোনীত হয়েছি।  


ইমাম তিরমিজি হাসান সূত্রে এবং ইমাম বায়হাকী হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله حين خلقنى جعلنى من خير خلقه ثم حين خلق القبائل جعلنى من خيرهم قبيلة وحين خلق الانفس جعلنى من خير انفسهم ثم حين خلق البيوت جعلنى من خير بيوتهم فاناخيرهم بيتا وخيرهم نفسا-  


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন- আল্লাহতায়ালা আমাকে সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে মনোনীত করলেন। অতঃপর যখন গোত্র নির্ধারণ করলেন তখন আমাকে শ্রেষ্ঠ গোত্রে মনোনীত করলেন। অতঃপর ব্যক্তি হিসেবে আমাকে শ্রেষ্ঠ মনোনীত করলেন। অতঃপর যখন পরিবার নির্ধারণ করলেন তখন আমাকে শ্রেষ্ঠ পরিবারে মনোনীত করলেন। অতএব আমি তাদের মধ্যে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত উভয়ভাবে উত্তম।  


ইমাম তাবরানী, ইমাম বায়হাকী ও আবু নাঈম হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- ان الله قسم الخلق قسمين فجعلنى فى خيرهما قسما- ثم جعل القسمين اثلاثا فجعلنى فى خيرهما ثلثا ثم جعل الاثلاث قبائل فجعلنى فى خيرها- ثم جعل القبائل بيوتا فجعلنى فى خيرها بيتا-  


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিরাজিকে দু’ভাগে বিভক্ত করলেন এবং আমাকে উত্তম ভাগে মনোনীত করলেন। অতঃপর উভয় দলকে তিনটি করে ভাগ করলেন এবং আমাকে উত্তম ভাগে মনোনীত করলেন। অতঃপর তাদেরকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করলেন এবং আমাকে উত্তম গোত্রে মনোনীত করলেন। অতঃপর গোত্রসমূহকে বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত করলেন এবং আমাকে তাদের উত্তম পরিবারে মনোনীত করলেন।  


(এ ব্যাপারে আরো কয়েকটি হাদিস রয়েছে। এখানে সংপ্তি করা হয়েছে) অনুবাদক।    


দ্বিতীয় মুকাদ্দামার দলিলসমূহ  

===========

ইমাম আব্দুর রাজ্জাক মুসান্নাফ গ্রন্থে মা’মার ইবনে জুরাইজ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন ইবনুল মুসাইয়াব বর্ণনা করেছেন। তিনি আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন।  


لم يزل على وجه الدهر فى الارض سبعة مسلمون فصاعدا- فلولا ذالك هلكت الارض ومن عليها  


অর্থ: আলী (رضي الله عنه) বলেন- প্রতিটি যুগে পৃথিবীর মধ্যে এমন সাতজন বা অধিক লোক বিদ্যমান থাকেন। যদি তারা না থাকতেন তাহলে পৃথিবী তার বাসিন্দাসহ ধ্বংস হয়ে যেত।  


এ হাদিসের সনদ বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহিহ।  


ইমাম ইবনে জারির তদীয় তাফসির গ্রন্থে শাহর বিন হুসাব থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال لم تبق الارض الا وفيها اربعة عشر يدفع الله بهم عن اهل الارض وتخرج بركتها الا زمن ابراهيم فانه كان وحده-  


অর্থ: তিনি বলেন- পৃথিবীতে সদা-সর্বদা এমন চৌদ্দজন লোক অবশিষ্ট থাকেন যাদের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা জগতবাসীর উপর থেকে বিপদ মুসিবত দূর করেন এবং বরকত নাজিল করেন। তবে ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর যামানা ব্যতিত। কারণ সে সময় তিনি একা ছিলেন।  


ইমাম মুনজির স্বীয় তাফসির গ্রন্থে হযরত কাতাদাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহতায়ালার বাণী-  


قلنا اهبطوا منها جميعا- فاما يأتينكم منى هدى فمن تبع هداى فلا خوف عليهم ولاهم يحزنون-  


অর্থ: আমি বললাম তোমরা সবাই এখান থেকে নিচে নেমে যাও। অতঃপর যদি তোমাদের নিকট আমার প থেকে কোন হিদায়ত পৌঁছে তবে যে ব্যক্তি আমার হিদায়ত অনুসরণ করবে তাদের উপর কোন ভয় নাই এবং তারা চিন্তাগ্রস্তও হবে না। (বাকারা- ৩৮)  


উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় কাতাদাহ বলেন-  


فما زال الله فى الارض اولياء منذ هبط ادم ما اخلى الله الارض لابليس الا وفيها اولياء له يعملون لله بطاعته-  


অর্থ: হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর আগমন থেকে আল্লাহতায়ালা এই পৃথিবীকে কখনো ইবলিসের জন্য আউলিয়া শূন্য করেন নাই। অর্থাৎ সবসময় কিছু আউলিয়া বিদ্যমান থাকেন। তারা আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদত করেন।  


ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رضي الله عنه) ‘যাহদ’ গ্রন্থে এবং খিলাল (رضي الله عنه) ‘কিরামাতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে বুখারি ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহিহ সনদে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال ما خلت الارض من بعد نوح من سبعة يدفع الله بهم عن اهل الارض  


অর্থ: তিনি বলেন- হযরত নুহ আলাইহিস সালাম এর পর থেকে পৃথিবীতে সবসময় এমন সাতজন লোক বিদ্যমান থাকেন যাদের উসিলায় আল্লাহতায়ালা জগতবাসীর উপর থেকে বালামুসিবত দূর করেন। (এ হাদিসটি মরফু পর্যায়ের)  


ইমাম আরযুকী ‘তারিখে মক্কা’ গ্রন্থে যুহাইর বিন মুহাম্মদ থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال لم يزل على وجه الارض سبعة مسلمون فصاعدا لولا ذلك لاهلكت الارض ومن عليها-  


অর্থ: তিনি বলেন- পৃথিবীতে সদা-সর্বদা সাতজন অথবা তার অধিক মুসলমান বিদ্যমান থাকেন। যদি তারা না থাকতেন তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত।  


ইবনে মুনজির স্বীয় তাফসির গ্রন্থে সহিহ সনদে ইবনে জুরাইজ থেকে বর্ণনা করেছেন-  


فى قوله رب اجعلنى مقيم الصلوة ومن ذريتى- قال فلن يزال من ذرية ابراهيم ناس على الفطرة يعبدون الله-  


অর্থ: আল্লাহর বাণী- হে প্রভূ আমাকে নামায কায়েমকারী করুন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে থেকেও। (ইব্রাহিম-৪০)  


এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন- ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর বংশধরদের মধ্যে সদা-সর্বদা এমন কিছু লোক অবশিষ্ট ছিল যারা ফিতরাতের উপর বিশ্বাস করত এবং আল্লাহর ইবাদত করত।  


ইমাম বাযযার তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে এবং ইবনে জারির ইবনে মুনজির ও ইবনে আবি হাতিম প্রত্যেকে তাদের তাফসির গ্রন্থে এবং ইমাম হাকিম তাঁর মুস্তাদরিক গ্রন্থে ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন এবং হাকিম ইহাকে সহিহ বলেছেন-  


فى قوله تعالى كان الناس امة واحدة قال كان بين ادم ونوح عشرة قرون كلهم على شريعة من الحق فاختلفوا فبعث الله النبيين-  


অর্থ: আল্লাহর বাণী সকল মানুষ একই জাতিসত্ত্বার অন্তর্ভুক্ত ছিল। (বাকারা- ২১৩) ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন- আদম আলাইহিস সালাম থেকে নুহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত দশটি যুগ ছিল। তারা প্রত্যেকেই সত্য শরিয়তের উপর ছিলেন। অতঃপর তারা মতানৈক্য তৈরি করল, তখন আল্লাহ নবীদেরকে প্রেরণ করলেন।  


ইবনে আবি হাতিম হযরত কাতাদাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال ذكر لنا انه كان بين ادم ونوح عشرة قرون كلهم على الهدى وعلى شريعة من الحق ثم اختلفوا بعد ذالك فبعث الله نوحا وكان اول رسول الله ارسله الله الى اهل الارض-  


অর্থ: তিনি বলেন- বর্ণিত আছে যে, আদম আলাইহিস সালাম থেকে নুহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত দশটি স্তর ছিল। তারা প্রত্যেকেই সত্য শরিয়তের উপর হিদায়তপ্রাপ্ত ছিলেন। অতঃপর তারা বিভিন্ন মতানৈক্য তৈরি করল। তখন আল্লাহ নূহ আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করলেন। তিনি ছিলেন পৃথিবীতে আল্লাহর প্রেরিত সর্বপ্রথম রাসূল।


আযর ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের পিতা নয়

প্রথম বিষয়ঃ


প্রথম বিষয়: আযর প্রসঙ্গ  

==========

উপরে বর্ণিত সমস্ত দলিল আদিল্লাহ দ্বারা ইহাই প্রমাণিত হয় যে, হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে নমরুদের যামানা পর্যন্ত রাসূলেপাক (ﷺ) এর পূর্বপুরুষগণ প্রত্যেকে অকাট্যভাবে মু’মিন ছিলেন। নমরূদের যামানায় ছিলেন হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এবং আযর।  


এখন যদি আযর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতা হয় তাহলে নবী মুহাম্মদ (ﷺ) এর নসবনামার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে। কিন্তু যদি আযর চাচা হয় তবে কোন বিচ্ছেদ ঘটবে না। ইহাই মূলকথা। অর্থাৎ আযর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতা নন।  


ইবনে আবি হাতিম ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে দুর্বল সনদে একটি বর্ণনা নকল করেছেন-  


فى قوله- واذ قال ابراهيم لا بيه ازر- قال ان ابا ابراهيم لم يكن اسمه ازر وانما كان اسمه تارح  


অর্থ: আল্লাহর বাণী (যখন ইব্রাহিম তাঁর পিতা আযরকে বললেন-) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন- ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতার নাম আযর ছিল না। তার নাম ছিল তারিহ।  


ইবনে আবি শাইবা, ইবনুল মুনজির এবং ইবনে আবি হাতিম বিভিন্ন সনদে বর্ণনা করেছেন। তার কোনটি সহিহ পর্যায়ের।  


عن مجاهد قال ليس ازر ابا ابراهيم  

অর্থ: মুজাহিদ বলেন- আযর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতা ছিলেন না।  


ইবনুল মুনজির সহিহ সনদে ইবনে জুরাইজ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال ليس ازر بابيه انما هو ابراهيم بن تيرح او تارح بن شاروخ بن ناحوربن فالخ  


অর্থ: তিনি বলেন- আযর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতা ছিলেন না। বরং বংশ তালিকা হল এভাবে ইব্রাহিম বিন তাইরিহ অথবা তারিহ বিন শারুখ বিন নাহুর বিন ফালিখ।  


ইবনে আবি হাতিম সহিহ সনদে সুদ্দি থেকে বর্ণনা করেছেন-  


انه قيل له اسم ابى ابراهيم ازر فقال بل اسمه تارح- وقد وجه من حيث اللغة بان العرب تطلق لفظ الاب على العم اطلاقا شائعا وان كان مجازا  


অর্থ: কেউ বললেন ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতার নাম হল আযর। তখন সুদ্দি বললেন- বরং তাঁর নাম হল তারিহ। ইহা ভাষাগতভাবে ব্যবহৃত হয়। কারণ আরবগণ ‘আবুন’ তথা বাবা শব্দটিকে ‘আম্মুন’ তথা চাচা শব্দের উপর প্রয়োগ করে থাকে। যদিও ইহা রূপক অর্থে ব্যবহার হয়।  


‘তানযিল’ কিতাবে নিুের আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয়েছে-  


(ام كنتم شهداء اذ حضر يعقوب الموت اذ قال لبنيه ما تعبدون من بعدى- قالوا نعبد الهك واله ابائك ابراهيم واسماعيل واسحق-) فاطلق على اسماعيل لفظ الاب وهوعم يعقوب- كما اطلق على ابراهيم وهو جده-  


অর্থ: আল্লাহর বাণী যখন ইয়াকুবের মৃত্যু নিকটবর্তী হয় তখন তোমরা কি উপস্থিত ছিলে? যখন সে সন্তানদের বলল আমার পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা বলল, আমরা ইবাদত করব তোমার প্রভূর, এবং তোমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহিম, ইসমাইল ও ইসহাকের প্রভূর। (বাকারা- ১৩৩)  


উক্ত আয়াতে ইসমাইল আলাইহিস সালামকে পিতা বলা হয়েছে। অথচ তিনি হলেন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর চাচা। ঠিক তেমনিভাবে ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকেও পিতা সম্বোধন করা হয়েছে। অথচ তিনি ছিলেন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর দাদা।  


ইবনে আবি হাতিম হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


انه كان يقول- الجد اب- ويتلو- قالوا نعبد الهك واله ابائك-  


অর্থ: ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলতেন-দাদা পিতার মত। এবং তিনি উক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করতেন।  


এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবুল আলিয়া থেকে বর্ণনা করেছেন- قال سمى العم أبا অর্থ: তিনি বলেন- চাচাকে পিতা বলা হয়। এমনিভাবে মুহাম্মদ বিন কা’ব আল কারজী থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال- الخال والد والعم والد وتلا هذه الاية-  

অর্থ: তিনি বলেন- খালু পিতার মত এবং চাচা পিতার মত। অতঃপর তিনি উক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন।  


এ হচ্ছে উক্ত বিষয়ের উপর সলফে সালেহীন সাহাবি ও তাবেয়ীনদের বক্তব্য।  


এ প্রসঙ্গে আরো একটি স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে যা ইবনুল মুনযির স্বীয় তাফসির গ্রন্থে সহিহ সনদে সুলাইমান বিন সারদ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন- যখন লোকেরা ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে আগুনে নিপে করতে চাইল তখন অসংখ্য জ্বালানী সংগ্রহ করে বিরাট অগ্নিকুণ্ড তৈরি করল। অবশেষে যখন তাকে আগুনে নিপে করতে চাইল তখন তিনি বললেন- حسبى الله ونعم الوكيل অর্থ: আমার আল্লাহ আমার জন্য কতইনা উত্তম অভিভাবক। যখন তারা ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে আগুনে নিপে করল তখন আল্লাহতায়ালা বললেন-  


يا نار كونى بردا وسلاما على ابراهيم-  

অর্থ: হে আগুন, তুমি ইব্রাহিমের উপর শীতল ও শান্তি হয়ে যাও। (আম্বিয়া- ৬৯)  


অতঃপর ইব্রাহিমের চাচা বললেন। আমার কারণেই তার উপর থেকে বিপদ দূরিভূত হয়েছে। তখন আল্লাহতায়ালা তার উপর অগ্নিপিণ্ড নিপে করলেন। যা তার পায়ে আঘাত করল এবং জ্বালিয়ে দিল।  


উক্ত বর্ণনার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আযর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর চাচা ছিলেন।  


এখানে আরো একটি ল্যণীয় বিষয় হল যে, আযর নিহত হয়েছিল সে সময় যখন ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে আগুনে নিেেপর ঘটনা ঘটেছিল এবং আল্লাহতায়ালা কুরআনে পাকে বর্ণনা করেছেন যে, যখন ইব্রাহিমের নিকট ব্যাপারটি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, আযর আল্লাহর শত্র“ তখন তিনি তার জন্য প্রার্থনা করা বন্ধ করেছেন। আবার হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে ইব্রাহিমের নিকট তখন বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যখন আযর মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছে। এরপর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম তার জন্য আর দোয়া করেননি।  


ইবনে আবি হাতিম সহিহ সনদে ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال ما زال ابراهيم يستغفر لابيه حتى مات فلما مات تبين له انه عدو لله فلم يستغفرله-  


অর্থ: তিনি বলেন ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের পিতা আযরের জন্য তার মৃত্যু পর্যন্ত দোয়া করেছেন। যখন আযর মৃত্যুবরণ করল তখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে সে আল্লাহর দুশমন। অতঃপর আর দোয়া করেননি।  


আরো একটি রেওয়ায়ত মুহাম্মদ বিন কা’ব, কাতাদাহ, মুজাহিদ, হাসান এবং অন্যান্যদের থেকে বর্ণিত হয়েছে। তারা বলেছেন- আযর জীবীত থাকাবস্থায় ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম তার জন্য আকাঙ্খা করতেন। যখন সে মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল তখন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। অতঃপর আগুনে নিক্ষেপের ঘটনার পর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম শ্যাম দেশে চলে যান। এব্যাপারে কুরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা বর্ণনা করেছেন।  


অতঃপর কিছুদিন পর তিনি মিশরে গমন করেন। সেখানে সারা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর ব্যাপারে জালিম বাদশার সাথে বাদানুবাদ ঘটে। অতঃপর হাজেরা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে খাদিমা হিসেবে প্রদান করা হয়। অতঃপর আবার শ্যাম দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দেন ইসমাইল আলাইহিস সালাম ও হাজেরা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে মক্কাশরীফে নিয়ে যাবার জন্য এবং তিনি তাই করেন। অতঃপর দোয়া করেন এভাবে-  


ربنا انى اسكنت من ذريتى بواد غير ذى زرع عند بيتك المحرم الى قوله ربنا اغفر لى ولوالدى وللمؤمنين يوم يقوم الحساب-  


অর্থ: হে আমাদের প্রতিপালক, আমি আমার এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় অবস্থান করিয়েছি। হে আমাদের প্রভু, আমার পিতা-মাতাকে ও সব মু’মিনকে মা করুন। যেদিন হিসেব কায়েম হবে। (ইব্রাহিম- ৩৭-৪১)  


অতঃপর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম পিতা-মাতার জন্য দোয়া করেছিলেন তাঁর চাচার মৃত্যুর অনেকদিন পর।  


সুতরাং উক্ত আলোচনা থেকে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, কুরআনুল কারীমে যে কুফুরির বর্ণনা ও ইস্তেগফার থেকে বারণ করা হয়েছে তা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর চাচার ব্যাপারে। প্রকৃত পিতার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা নয়। (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর)


অতঃপর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর সন্তানদের মধ্যে তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ চলতে থাকে।  


ইমাম শাহরাস্তানী- الملل والنحل গ্রন্থে বলেছেন- আরবের বুকে দ্বীনে ইব্রাহিম ও তাওহীদ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সর্বপ্রথম আমর বিন লুয়াই ইহা পরিবর্তন করে মূর্তিপূজা চালু করে। আমি বলব এ ব্যাপারটি সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন ইমাম বুখারী ও মুসলিম আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال رسول الله صلى الله عليه وسلم رأيت عمرو بن عامر الخزاعى يجر قصبة فى النار كان اول من سيب السوائب-  


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- আমি দেখেছি আমর বিন আমির খাযায়িকে নাড়িভূঁড়ি টেনে জাহান্নামে ফেলা হয়েছে। সেই সর্বপ্রথম সাইয়্যিবা তথা দেবতার নামে উৎসর্গকৃত পশুর উপাসনা শুরু করে।  


ইমাম আহমদ (رضي الله عنه) মুসনাদ গ্রন্থে ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন নবী করিম (ﷺ) বলেন-  


ان اول من سيب السوائب وعبد الاصنام ابو خزاعة عمرو بن عامر وانى رأيته يجر امعائه فى النار-  


অর্থ: নিশ্চয় আবু খাযামা আমর বিন আমির সর্বপ্রথম সাইয়্যিবার প্রচলন এবং মূর্তিপূজা চালু করে। আমি দেখেছি তাকে নাড়িভূঁড়ি টেনে জাহান্নামে নিপে করা হচ্ছে।  


فثبت ان اباء النبى صلى الله عليه وسلم من عهد ابراهيم الى زمان عمرو المذكور كلهم مؤمنون بيقين-  


অর্থ: অতএব ইহা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হল যে, নবী করিম (ﷺ) এর পূর্বপুরুষগণ ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে উল্লেখিত আমর এর যামানা পর্যন্ত প্রত্যেকেই মু’মিন ছিলেন।


দ্বিতীয় বিষয়:

আলোচ্য মসলকের স্বপক্ষে আয়াত ও রেওয়ায়েত


উল্লেখিত মসলক বা মতানুসারীদের স্বপে অনেকগুলো আয়াত এবং রেওয়ায়েত রয়েছে, যা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর বংশধরদের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে।  


প্রথম আয়াত  

=======

আল্লাহতায়ালা বলেন-  

واذ قال ابرهيم لابيه وقومه اننى براء مماتعبدون- الا الذى فطرنى فانه سيهدين- وجعلها كلمة باقية فى عقبه لعلهم يرجعون-  


অর্থ: যখন ইব্রাহিম তাঁর পিতা ও সম্প্রদায়কে বলল- তোমরা যাদের পূজা কর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই। তবে আমার সম্পর্ক তার সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব তিনিই আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করবেন। এ কথাটিকে সে অয় বাণীরূপে তার সন্তানদের মধ্যে রেখে গেছে। যাতে তারা প্রবত্যাবর্তন করে। (যুখরুফ- ২৬-২৮)  


এ আয়াতের তাফসিরে আব্দ বিন হুমাইদ সনদসহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قال لا اله الا الله باقية فى عقب ابراهيم  


অর্থ: ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর বংশধরদের মধ্যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ কালিমাটি অবশিষ্ট ছিল।  


এমনিভাবে আব্দ বিন হুমাইদ ইবনে জারির এবং ইবনে মুনজির প্রত্যেকে হযরত মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেছেন। এখানে কালিমা দ্বারা মুরাদ হল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।  


আব্দ বিন হুমাইদ বলেন- আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন ইউনুস। তিনি শাইবান থেকে। তিনি কাতাদাহ (رضي الله عنه) থেকে-  


قال شهادة ان لا اله الا الله فا لتوحيد لا يزال فى ذريته من يقولها من بعده-  


অর্থ: কাতাদাহ (رضي الله عنه) বলেন- ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর বংশধরদের মধ্যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর শাহাদত এবং তাওহীদ সর্বদা বিদ্যমান ছিল।  


ইমাম আব্দুর রাজ্জাক তাঁর তাফসির গ্রন্থে মা’য়মার থেকে তিনি কাতাদাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন।  


قال الاخلاص والتوحيد لايزال فى ذريته من يوحد الله ويعبده  


অর্থ: কাতাদাহ (رضي الله عنه) বলেন- ইখলাস এবং তাওহীদ ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর সন্তানদের মধ্যে সবসময় বিদ্যমান ছিল। তারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল এবং আল্লাহর ইবাদত করত।  


দ্বিতীয় আয়াত  

=====

আল্লাহ বলেন-  

واذ قال ابرهيم رب اجعل هذا البلد امنا واجنبنى وبنى ان نعبد الاصنام-  


অর্থ: যখন ইব্রাহিম বলল- হে প্রভু এ শহরকে নিরাপদ করে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তান সন্ততিকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখুন। (ইব্রাহিম- ৩৫)  


ইবনে জারির স্বীয় তাফসির গ্রন্থে মুজাহিদ (رضي الله عنه) থেকে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন-  


قال فاسجاب الله لابراهيم دعوته فى ولده فلن يعبد احد من ولده صنما بعد دعوته- واستجاب الله له وجعل هذا البلد أمنا ورزق اهله من الثمرات وجعله اماما وجعل من ذريته من يقيم الصلوة-  


অর্থ: মুজাহিদ (رضي الله عنه) বলেন- আল্লাহতায়ালা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর দোয়ার জবাব দিয়েছিলেন তাঁর সন্তানদের মাধ্যমে। এজন্য তাঁর দোয়ার পর তাঁর সন্তানদের মধ্যে কেউ কখনো মূর্তিপূজা করেনি। আল্লাহ ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর দোয়ার কারণে এ শহরকে নিরাপদ রাখেন এবং এর অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন ফলমূল দ্বারা খাবারের ব্যবস্থা করেন। আল্লাহ তাকে ইমাম মনোনীত করেন এবং তাঁর সন্তানদেরকে নামায প্রতিষ্ঠাকারী করেন।  


এতে কোন সন্দেহ নাই যে বাইতুল্লাহ শরীফের অভিভাবকত্ব শুধুমাত্র নবী করিম (ﷺ) এর পিতৃপুরুষদের মধ্যেই নির্দিষ্ট ছিল। ইব্রাহিম আলাইহিসসালাম এর অন্যান্য বংশধরগণ এ দায়িত্ব পায়নি।  


অবশেষে আমর আল খাযায়ী তাদের কাছ থেকে এ দায়িত্ব জোরপূর্বক নিয়ে যায়। পরবর্তীতে আবার তাদের কাছে এ দায়িত্ব ফিরে আসে-  


فان اولى الناس به سلسة الاجداد الشريفة الذين خصوا بالاصطفاء وانتقل اليهم نور النبوة واحدا بعد واحد- فهم اولى بان يكونواهم البعض المشار اليهم- فى قوله- رب اجعلنى مقيم الصلوة ومن ذريتى-  


অর্থ: অতএব সর্বোত্তম লোক হলেন রাসূলেপাক (ﷺ) এর পূর্বপুরুষদের নসবনামা। তাদেরকেই নবীজীর জন্য মনোনীত করা হয়েছে। এবং তাদের মাধ্যমেই নবুয়তের নূর মোবারক ক্রমান্বয়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। সুতরাং আল্লাহর বাণীর মধ্যে যে বংশধরদের কথা বলা হয়েছে তাদের অধিক হকদার রাসূল (ﷺ) এর পূর্বপুরুষগণ। আল্লাহর বাণী- হে প্রভু আমাকে নামায প্রতিষ্ঠাকারী কর এবং আমার বংশধরদের থেকে। (ইব্রাহিম-৪০)  


ইবনে আবি হাতিম সুফিয়ান বিন উয়াইনা থেকে বর্ণনা করেছেন-তাকে প্রশ্ন করা হল ‘ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর সন্তানদের মধ্যে কি কেউ মূর্তিপূজা করেছে? তিনি বলেন- ‘না’ তুমি কি শুননাই আল্লাহর বাণী- واجنبنى وبنى ان نعبد الاصنام অর্থ: আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখুন। (ইব্রাহিম- ৩৫)  


প্রশ্ন করা হল ‘ইসহাক আলাইহিস সালামের সন্তান এবং ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর অন্যান্য সন্তানগণ কিভাবে এর অন্তর্ভুক্ত হলেন না?  


তিনি বললেন- কারণ ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম শুধুমাত্র এ শহরের অধিবাসীদের জন্য দোয়া করেছিলেন তারা যেন মূর্তিপূজা না করে। তিনি অন্যান্য শহরের জন্য দোয়া করেননি। যেমন বলেছিলেন- আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখুন। এখানে তিনি শুধুমাত্র তাঁর পরিবারকে নির্দিষ্ট করেছিলেন। যেমন আল্লাহর বাণী-  


ربنا انى اسكنت من ذريتى بواد غير ذى زرع عند بيتك المحرم ربنا ليقيموا الصلوة-  


অর্থ: হে আমাদের প্রভূ আমি আমার এক সন্তানকে তোমার পবিত্র ঘরের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় অবস্থান করিয়েছি। তারা যেন নামায কায়েম করে।  


ইমাম সূয়ুতি বলেন- সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার জবাবটি ল্য করুন। তিনি ছিলেন একজন মুজতাহিদ ইমাম এবং আমাদের শায়খ ইমাম শাফেয়ী (رضي الله عنه) এর শায়খ বা উস্তাদ।    


তৃতীয় আয়াত  

=====

আল্লাহতায়ালা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর ঘটনা সম্পর্কে বলেন-  

رب اجعلنى مقيم الصلوة ومن ذريتى-  

অর্থাৎ হে প্রভূ আমাকে নামায কায়েমকারী করুন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে থেকেও। (ইব্রাহিম- ৪০)  


এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল মুনযির হযরত ইবনে জুরাইজ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন-  


قال فلن يزال من ذرية ابراهيم نا س على الفطرة يعبدون الله-  


অর্থ: তিনি বলেন- ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর সন্তানদের মধ্যে সদাসর্বদা এমন কিছু লোক বিদ্যমান ছিল যারা ফিতরাতের উপর বিশ্বাসী ছিল এবং আল্লাহর ইবাদত করত।    


চতুর্থ আয়াত  

=====

আবু শায়খ তদীয় তাফসির গ্রন্থে যায়দ বিন আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন। যখন সারাকে একজন ফেরেশতা সুসংবাদ দিয়েছিলেন তখন সারা বলেছিলেন-  

يويلتى ءالد وانا عجوز وهذا بعلى شيخا- ان هذا لشيئ عجيب-  


অর্থ: কি দূর্ভাগ্য আমার, আমি সন্তান প্রসব করব? অথচ আমি বার্ধক্যে এসে পৌঁছেছি আর আমার স্বামীও বৃদ্ধ। এতো ভীষণ আশ্চর্য কথা। (হুদ- ৭২)  


তখন সারার কথার জবাবে ফিরিশতা বললেন-  

اتعجبين من امر الله رحمة الله وبركته عليكم اهل البيت انه حميد مجيد  


অর্থ: তুমি আল্লাহর হুকুম সম্পর্কে বিস্ময়বোধ করছ? হে গৃহবাসীরা তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত ও প্রভুর বরকত রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রশংসিত মহিমাময়। (হুদ- ৭৩)  


বর্ণনাকারী বলেন- এ আয়াতটি আল্লাহর ঐ কথার মত- وجعلها كلمة باقية فىعقبه অর্থ: এবং এ কথাটিকে সে অয় বাণীরূপে তার সন্তানদের মধ্যে রেখে গেছে।  


মুহাম্মদ (ﷺ) ও তাঁর বংশীয় পূর্বপুরুষগণ ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর সন্তানদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।    


আবুল হাসান মাওরিদির বক্তব্য  

=====

অতঃপর দেখেছি ইমাম আবুল হাসান মওরিদি (رضي الله عنه) সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন যা ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী বর্ণনা করেছেন। তিনি স্বীয় اعلام النبوة গ্রন্থে বলেছেন- আম্বিয়ায়ে কিরামগণ হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও শ্রেষ্ঠ মাখলুকাত। আল্লাহ তাদেরকে তাঁর হক প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রতিনিধি নির্ধারণ করেছেন। তিনি তাদেরকে সম্মানিত বংশের মাধ্যমে মনোনীত করেছেন। অতএব তাদের নসবনামার কোন দোষত্রুটি কিংবা অশ্লীলতা ছিল না। যাতে করে মানুষের হৃদয়, প্রাণ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাহলে তাদের আহ্বানে লোকজন দ্রুত সাঁড়া দিবে এবং তাদের নির্দেশ মান্য করবে। আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় রাসূলকে পবিত্র বৈবাহিকসূত্রে নির্বাচন করেছেন এবং তাঁকে বংশীয় ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে হিফাজত রেখেছেন এবং তাকে পবিত্র পুরুষের পৃষ্ঠদেশ থেকে পবিত্র রেহেমের মাধ্যমে স্থানান্তরিত করেছেন। যেমন ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) আল্লাহর বাণী- وتقلبك فى السجدين আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন-  


اى تقلبك من اصلاب طاهرة من اب بعد اب الى ان جعلك نبيا فكان نور النبوة ظاهرا فى أبائه-  


অর্থ: পবিত্র নসবনামার মাধ্যমে আপনার স্থানান্তর তথা এক পিতা থেকে অন্য পিতার মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে আপনি নবী হিসেবে আগমন করেছেন। অতএব নবীজীর নবুয়তের নূর মোবারক তাঁর প্রত্যেক পিতৃপুরুষদের মধ্যে প্রকাশিত ছিল।  


অতঃপর আল্লাহতায়ালা নবীজীর পিতা-মাতা থেকে তাঁর অন্য কোন ভাই-বোন অংশিদার করেননি। যাতে করে তাদের বিশুদ্ধতা চুড়ান্তভাবে নবীজীর সাথে সম্পর্কযুক্ত হয় এবং তাঁর মাধ্যমে তাদের বংশ তালিকা সমাপ্তি ঘটে।  


অতএব আল্লাহতায়ালা নবীর সাথে অন্যান্যদের অংশিদারত্ব ও সাদৃশ্যতাকে দূরীভূত করেছেন। এজন্য বাল্যকালেই তাঁর পিতা মাতা ইন্তেকাল করেন। তিনি মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন এবং ছয় বছর বয়সে তার মাতা ইন্তেকাল করেন।  


আপনি যখন নবী করীম (ﷺ) এর নসবনামা সম্বন্ধে অবগত হলেন এবং তাঁর পবিত্র মিলাদশরীফ সম্বন্ধে জানতে পারলেন তখন আপনি তাঁর সম্মানিত পিতৃপুরুষদের মর্যাদা সম্বন্ধে অবগত হলেন। তাদের মধ্যে কেউ অসৎ ও মন্দ চরিত্রের লোক ছিলেন না। বরং তারা প্রত্যেকেই ছিলেন সম্মানিত ও নেতৃস্থানীয় লোক। তাঁর নসবনামা ও মিলাদশরীফ ছিল নবুয়তের শর্তানুযায়ী পূতঃপবিত্র। এ পর্যন্ত হচ্ছে ইমাম মাওরিদির হুবহু বক্তব্য।  


এমনিভাবে আবু জাফর আননুহাস- معانى القران গ্রন্থে- وتقلبك فى السجدين আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেছেন-  


روى عن ابن عباس انه قال تقلبه فى الظهور حتى اخرجه نبيا-  


অর্থ: ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন- নবীজীর প্রকাশের ব্যাপারে তাঁর স্থানান্তর। অবশেষে তিনি নবী হিসেবে প্রকাশিত হন।    


হাফিজ শামসুদ্দিন দামেস্কীর কাসিদা  

==========

এ প্রসঙ্গে হাফিজ শামসুদ্দিন বিন নাসিরুদ্দিন দামেস্কী (رضي الله عنه) চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন-  


تنقل احمد نورا عظيما – تلأ لأ فى جباه الساجدينا  

تقلب فيهم قرنا فقرنا – الى ان جاء خير المرسلينا  

حفظ الاله كرامة لمحمد – أباءه الامجاد صونا لاسمه  

تركوا السفاح فلم يصبهم عاره- من ادم حتى ابيه وأمه  


অর্থ: আহমদ এর মহান নূর স্থানান্তরিত হয়েছে। ইহা সিজদাকারীদের ললাটে চাকচিক্যময় ছিল। যুগে যুগে তাদের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়েছে। অবশেষে আগমন করেন সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। আল্লাহতায়ালা মুহাম্মদ (ﷺ) এর নামের বরকতে তাঁর মহান পিতৃপুরুষদেরকে মন্দ কাজ থেকে নিরাপদ রেখেছেন। তারা সবাই অশ্লীল কাজ থেকে মুক্ত ছিলেন। আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে তাঁর পিতা-মাতা পর্যন্ত প্রত্যেকে ছিলেন পুতঃপবিত্র।   


ফায়দা  

===

ইবনে আবি হাতিম স্বীয় তাফসির গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন-  

عن عثمان بن عطاء عن ابيه قال بين النبى صلى الله عليه وسلم وبين ادم تسعة واربعون أبا-  


অর্থ: উসমান বিন আত্বা তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন- তিনি বলেন আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে নবী মুহাম্মদ (ﷺ) পর্যন্ত ঊনপঞ্চাশ জন পিতৃপুরুষ ছিলেন।


তৃতীয় বিষয়:

মা আমিনা (রা.) সম্বন্ধে বর্ণিত হাদিসসমূহ


আবু নাঈম- دلائل النبوة গ্রন্থে জয়িফ সনদে ইমাম যুহরির সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি উম্মে সামায়া বিনতে আবি রাহম থেকে তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর মা আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর মৃত্যুকালীন অসুখের সময় আমি তাকে দেখতে পেলাম। তখন পাঁচ বৎসর বয়সী ছেলে মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর শিয়রের পাশে ছিলেন। আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহা তখন ছেলের চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন-  


بارك فيك الله من غلام – يا ابن الذى من حومة الحمام  

نجابعون الملك المنعام – فودى غداة الضرب بالسهام  

بمائة من ابل سوام - ان صح ما ابصرت فى المنام  

فانت مبعوث الى الانام – من عند ذى الجلال والاكرام  

تبعث فى الحل وفى الحرام – تبعث بالتحقيق والاسلام  

دين ابيك البر ابراهام – فا الله انهاك عن الاصنام  

ان لا تواليها مع الاقوام  


অর্থ: হে আমার প্রাণপ্রিয় সন্তান আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুক। মহান আল্লাহর অনুগ্রহে তোমাকে নাজাত দেয়া হয়েছে। হে আমার কলিজার টুকরা, লটারীর মাধ্যমে একশত উটের বিনিময়ে। আমি যে স্বপ্ন দেখেছি তা যদি সত্য হয়, তাহলে তুমিই হচ্ছ মহা পরাক্রমশালীর পক্ষ থেকে মানবজাতীর প্রতি প্রেরিত। তুমি ‘হিল্ল’ ও হারাম তথা সমগ্র বিশ্বের জন্য সত্য ধর্ম ইসলাম সহকারে প্রেরিত হয়েছ। যা ছিল তোমার পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর ধর্ম। আল্লাহ তোমাকে মূর্তিপূজা থেকে বারণ করেছেন। যাতে তুমি তোমার সম্প্রদায়সহ মূর্তিদেরকে প্রভূ না বানাও।  


অতঃপর আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন- প্রতিটি প্রাণী মরণশীল, প্রত্যেক নতুন জিনিস পুরাতনশীল, প্রত্যেক বড় জিনিস ধ্বংসশীল এবং আমি মরণশীল। কিন্তু আমার যিকর অবশিষ্ট থাকবে। আমি কল্যাণ রেখে যাচ্ছি। আমি পবিত্র সন্তান জন্ম দিয়েছি। অতঃপর তিনি ইন্তেকাল করেন।  


বর্ণনাকারী বলেন- আমরা আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর মৃত্যুতে জ্বিনদের আহাজারী শুনেছি। সেখান থেকে নিয়ে উল্লেখ করছি  


نبكى الفتاة البرة الامينة - ذات الجمال العفة الرزينة  

زوجة عبد الله والقرينه - ام نبى الله ذى السكينة  

وصاحب المنبر بالمدينة - صارت لدى حفرتها رهينه  


অর্থ: আমরা পূণ্যময় রমনী আমিনার জন্য কাঁদছি।  

যিনি হচ্ছেন পুতঃপবিত্র সৌন্দর্যের অধিকারী।  

তিনি হচ্ছেন আব্দুল্লাহর পত্নী ও তার নিকটবর্তী।  

তিনি হচ্ছেন আল্লাহর নবীর মাতা ও আশ্রয়স্থল।  

যে নবী হচ্ছেন মদিনার মিম্বরের অধিপতি।  

তাঁর নিকট সকল কিছু হয়েছে নিরাপদ।  


অতএব তুমি দেখ আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর উক্ত বক্তব্যটিতে মূর্তিপূজা সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তিনি দ্বীনি ইব্রাহিম সম্বন্ধে পূর্ণ অবগত ছিলেন। তাছাড়া তাঁর সন্তানটি যে আল্লাহর প থেকে ইসলাম সহকারে প্রেরিত তাও তিনি জ্ঞাত ছিলেন। এ শব্দগুলীতে শিরক সম্বন্ধে সুস্পষ্ট অস্বীকৃতি রয়েছে।


সকল আম্বিয়ায়ে কেরামদের জননীগণ ছিলেন মুসলমান


ইমাম সুয়ুতি বলেন- অতঃপর আমি সমস্ত আম্বিয়া কেরামদের জননী সম্বন্ধে গবেষণা করেছি এবং তাদের সবাইকে মু’মিনাত হিসেবে পেয়েছি।  


অতএব হযরত ইসহাক, হযরত মুসা, হযরত হারুন ও হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাদের মাতাগণ এবং শীষ আলাইহিস সালাম এর মা হাওয়া তাদের সম্বন্ধে কুরআনে বর্ণনা রয়েছে। বরং কেউ কেউ তাদেরকে নবী বলেছেন।  


আবার ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর মা হাজেরা. ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর মা এবং তাঁর সন্তানদের মাতাগণ, এবং দাউদ আলাইহিস সালাম, সুলাইমান আলাইহিস সালাম, যাকারিয়া আলাইহিস সালাম, ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম, শামাভীল আলাইহিস সালাম, শামাউন আলাইহিস সালাম ও যুলকিফল আলাইহিমুস সালাম তাদের মাতাগণের ঈমান সম্বন্ধে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।  


আবার কোন কোন মুফসসিরীনগণ হযরত নূহ ও ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর মায়ের ঈমান সম্বন্ধে দলিল পেশ করেছেন। যেমন আবু হাইয়ান স্বীয় তাফসিরগ্রন্থে ইহাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইতোপূর্বে ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে নূহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত কারো পিতা কাফির ছিলেন না। এজন্য নূহ আলাইহিস সালাম বলেছেন-  


رب اغفرلى ولوالدى ولمن دخل بيتى مؤمنا-  

অর্থ: হে প্রভূ আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং যারা মুমিন হয়ে আমার গৃহে প্রবেশ করেছে তাদেরকে মা কর। (নূহ- ২৮)  


ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম বলেছেন-  

ربنا اغفرلى ولوالدى وللمؤمنين يوم يقوم الحساب-  


অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং সকল মু’মিনকে মা করুন, যেদিন হিসাব কায়েম হবে। (ইব্রাহিম-৪১)  


কুরআনুল কারীমে ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে শুধুমাত্র পিতার জন্য দোয়ার ব্যাপারে আপত্তি করা হয়েছে। মাতার জন্য আপত্তি করা হয় নাই। ইহা প্রমাণ করে যে তিনি মুমিনাহ ছিলেন।  


ইমাম হাকিম মুস্তাদরাক গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করে ইহাকে সহিহ বলেছেন-  


قال كانت الانبياء من بنى اسرائيل الاعشرة- نوح وهود وصالح ولوط- وشعيب وابراهيم- واسماعيل واسحاق ويعقوب ومحمد عليهم السلام-  


অর্থ: ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন- দশজন নবী ব্যতিত অন্যান্য সবাই ছিলেন বনী ইসরাইল বংশের। এ দশজন হলেন নূহ আলাইহিস সালাম, হুদ আলাইহিস সালাম, সালিহ আলাইহিস সালাম, লুৎ আলাইহিস সালাম, শুয়াইব আলাইহিস সালাম, ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম, ইসমাইল আলাইহিস সালাম, ইসহাক আলাইহিস সালাম, ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ও হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)।  


বনু ইসরাইলের প্রত্যেকেই মু’মিন ছিলেন। ঈসা আলাইহিস সালাম এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত তাদের মধ্যে কেউ কাফির ছিল না। অতঃপর যে কুফুরি করার সে কুফুরি করল। অতএব বনি ইসরাইলী সমস্ত নবীদের মাতাগণ মুমিনাহ ছিলেন।  


তাছাড়া বনী ইসরাইলের অধিকাংশ নবীগণই ছিলেন কোন নবীর সন্তান অথবা তাদের সন্তানদের সন্তান। অতএব নবুয়ত তাদের সন্তানদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে জারি ছিল, ইহাই প্রসিদ্ধ।  


বনি ইসরাইলের বাহিরে যে দশজন নবীর কথা উল্লেখিত হয়েছে তাদের মধ্যে হযরত নূহ আলাইহিস সালাম, হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম, হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম, হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম ও হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম তাদের মাতাগণের ঈমান প্রমাণিত।  


এখন অবশিষ্ট রইল হযরত হুদ, হযরত সালেহ, হযরত লুত ও হযরত শুয়াইব আলাইহিমুস সালামগণ তাদের মাতাগণের ব্যাপারটি। এ ব্যাপারে দলিল প্রমাণের প্রয়োজন। তবে প্রকাশ্য অভিমত হল তারা ঈমানদার ছিলেন।  


এমনিভাবে নবী মুহাম্মদ (ﷺ) এর মায়ের ব্যাপারটিও প্রমাণিত। এ ব্যাপারে সুক্ষ কথা হল তাঁকে নবী করিম (ﷺ) এর নূর মোবারক দেখানো হয়েছে। এ হাদিসটি ইমাম আহমদ, ইমাম বাযযার, তাবরানী, হাকিম, এবং ইমাম বায়হাকী হযরত ইরবাদ বিন সারিয়া (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال- انى عند الله لخاتم النبيين وان ادم لمنجدل فى طينة وسأخبركم عن ذلك- دعوة ابى ابراهيم وبشارة عيسى ورؤيا امى التى رأت-  


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- যখন আদম আলাইহিস সালাম মাটির সাথে মিশ্রিত ছিলেন তখন আমি আল্লাহর নিকট খাতামুন নাবিয়্যিন মনোনীত ছিলাম। এ ব্যাপারে অচিরেই আমি তোমাদেরকে সংবাদ দেব। আমি হচ্ছি আমার পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর দোয়া ও ঈসা আলাইহিস সালাম এর সুসংবাদ এবং আমার মায়ের দর্শন, যখন তিনি নূর দেখেছিলেন। এমনিভাবে সমস্ত নবীগণের মাতাগণ সে নূর দেখেছেন। রাসূলেপাক (ﷺ) এর মা আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহা বেলাদতের সময় এমন একটি নূর দেখতে পেলেন যার রশ্মিতে সিরিয়ার প্রাসাদগুলো আলোকিত হয়ে গেল।  


এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নবী করিম (ﷺ) এর মা আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহা গর্ভকালীন সময়ে এবং বেলাদতের সময় সে কুদরতি নিদর্শন অবলোকন করেছেন তা অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরামদের জননীর দর্শনের চেয়ে অধিক আশ্চর্যজনক ছিল। এ ব্যাপারে আমি অনেকগুলো বর্ণনা ‘মুজিজার’ কিতাবে উল্লেখ করেছি।    


নবীজীর দুধমাতাগণ ইসলাম গ্রহণ করেছেন  

==========

কোন কোন উলামায়ে কেরাম উল্লেখ করেছেন- যে সমস্ত মাতাগণ নবীজীকে দুধপান করিয়েছিলেন তারাও ইসলাম গ্রহণ করেছেন-  

قال ومرضعاته اربع- امه وحليمة السعدية وثويبة- وام ايمن-  


অর্থ: চারজন মহিলা নবীজীকে দুধপান করিয়েছিলেন। মা আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহা হালিমা সাদিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা, সুয়াইবা রাদিয়াল্লাহু আনহা এবং উম্মে আয়মন রাদিয়াল্লাহু আনহা।


সওয়াল  

====

যদি তুমি বল ঐ সমস্ত হাদিসের কি জবাব দেবেন যেগুলো দ্বারা বুঝা যায় যে আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহা জাহান্নামী? যেমন একটি হাদিসে রাসূল (ﷺ) বলেছেন-  


ليت شعرى ما فعل ابواى؟ فنزلت (ولا تسئل عن اصحب الجحيم)  

অর্থ: হায়! আমার পিতামাতার কি হবে? তখন অবতীর্ণ হল আপনি দোযখবাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন না। (বাকারা- ১১৯)  


অন্য হাদিসে রয়েছে রাসূল (ﷺ) তাঁর মায়ের জন্য মা প্রার্থনা করলে জিব্রাইল আলাইহিস সালাম তাঁর বে আঘাত করে বললেন মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীর জন্য মা প্রার্থনা করবেন না।  


অন্য হাদিসে রয়েছে ‘আল্লাহতায়ালার বাণী-  

ما كان للنبى والذين امنوا ان يستغفروا للمشركين-  


অর্থ: নবী ও মু’মিনদের উচিত নয় মুশরিকদের মাগফিরাত কামনা করা। (তাওবা- ১১৩)  


অন্য হাদিসের মধ্যে রয়েছে, রাসূল (ﷺ) মালিকার দু’সন্তানকে বললেন- তোমাদের মাতা জাহান্নামী। ইহা শুনে তারা দুঃখিত হল। তখন নবীজী তাদেরকে ডেকে বললেন- আমার মা তোমাদের মায়ের সাথে আছেন।  


জবাব  

====

আমি বলব এ ব্যাপারে উল্লেখিত বর্ণনাগুলোর অধিকাংশই জয়িফ। নবী করিম (ﷺ) এর মাতা সম্পর্কে বর্ণিত কোন সহিহ হাদিস নাই। শুধুমাত্র একটি ব্যতিত। তাহল, তিনি তাঁর জন্য মা প্রার্থনার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে অনুমতি দেয়া হয়নি।  


ঠিক তেমনিভাবে রাসূল (ﷺ) এর পিতা সম্বন্ধে মুসলিমশরীফের একটি হাদিস ব্যতিত অন্য কোন সহিহ হাদিস নাই, এ দু’টি হাদিসের জবাব কিছুণ পরে আসবে।  


অতএব উল্লেখিত হাদিসগুলোর মধ্যে- ليت شعرى ما فعل ابواى হাদিসটি কোন গ্রহণযোগ্য হাদিসের কিতাবে উল্লেখিত হয়নি। তবে কোন কোন তাফসির গ্রন্থে বিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। তাই এর দ্বারা দলিল প্রদান করা যায় না।  


এ হাদিসের বিপরীতে অন্য একটি হাদিস ইবনুল জুযি হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে মরফু সনদে বর্ণনা করেছেন-  


هبط جبريل على فقال ان الله يقرئك السلام ويقول انى حرمت النار على صلب انزلك وبطن حملك وحجر كفلك-  


অর্থ: রাসূল বলেন- জিব্রাইল আলাইহিস সালাম আমার কাছে এসে বললেন- আল্লাহ আপনাকে সালাম দিয়ে বলেছেন- আমি তাদের জন্য জাহান্নামকে হারাম করেছি। যাদের পৃষ্ঠদেশের মাধ্যমে আপনাকে প্রেরণ করা হয়েছে, যে গর্ভ আপনাকে বহন করেছে এবং যে ঘর আপনাকে লালন পালন করেছে।  


তাছাড়া উসূল, বালাগাত ও আসরারুল বয়ানের কায়দা অনুযায়ী ও উল্লেখিত হাদিসের মর্মটি প্রত্যাখ্যাত। তা হলো উল্লেখিত আয়াতটির পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবগুলো আয়াত ইহুদিদের ব্যাপারে আলোচিত হয়েছে।  


যেমন সূরা বাকারার ৪০নং আয়াত- يبنى اسرائيل اذكروا نعمتى থেকে ১২৪নং আয়াত- واذ ابتلى ابراهيم ربه بكلمة পর্যন্ত ইহুদিদের আলোচনা করা হয়েছে।  


অতএব বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল যে- اصحب الجحيم তথা দোযখবাসী দ্বারা আহলে কিতাবদের কুফফারদেরকে বুঝানো হয়েছে। এ ব্যাপারটি স্পষ্টভাবে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।  


যেমন আব্দ বিন হুমাইদ ইমাম ফিরইয়াব, ইবনে জারির এবং ইবনে মুনযির তারা প্রত্যেকে তাদের তাফসির গ্রন্থে হযরত মুজাহিদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন- সূরা বাকারার প্রথম চার আয়াত মুমিনদের প্রশংসাসংক্রান্ত এবং পরবর্তী তের আয়াত মুনাফিকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। এবং চল্লিশ আয়াত থেকে একশত বিশ আয়াত পর্যন্ত বনী ইসরাইলের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে। এ হাদিসের সনদ সহিহ। তাছাড়া এ সুরাটি হচ্ছে মাদানি। আর অধিকাংশ মাদানী সূরা ইহুদিদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।  


এ ব্যাপারটি অভিধান ও হাদিস দ্বারা আরো স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে ‘জাহিম’ শব্দটি জাহান্নামের ভয়াবহ স্তরের নাম।  


যেমন ইবনে আবি হাতিম হযরত আবু মালিক থেকে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন- ‘জাহিম’ হচ্ছে জাহান্নামের ভয়াবহ স্তর।  


ইমাম ইবনুল জারির এবং ইবনুল মুনজির হযরত ইবনে জুরাইজ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন আল্লাহর বাণী- لها سبعة ابواب অর্থ: (জাহান্নামের সাতটি স্তর রয়েছে) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন- প্রথম স্তর হল জাহান্নাম, অতঃপর লাযা, অতঃপর হুমাযাহ, অতঃপর সাঈর. অতঃপর সাকার, অতঃপর জাহিম, অতঃপর হাবিয়া। তিনি বলেন- জাহিম হচ্ছে ষষ্ঠ স্তর। আর সেখানে থাকবে আবু জেহেল। এ হাদিসটির সনদ সহিহ।  


অতএব ‘জাহিম’ স্তরের আযাবের যোগ্য ঐ ব্যক্তি যে ভয়াবহ কুফুরি করেছে। তাওহীদের দাওয়াতকে অস্বীকার করেছে এবং জেনে শুনে সত্যকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও গোপন করেছে। এ শাস্তি ঐ ব্যক্তির জন্য নয় যে এ রকম কুফুরি করেনি।  


আবার আবু তালিবের ব্যাপারে সহিহ হাদিস রয়েছে যে, জাহান্নামের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরের শাস্তি হবে তার। আর ইহা রাসূল (ﷺ) এর নিকটাত্মীয় হবার দরুণ লাভ করবে। অথচ তিনি লম্বা হায়াত পেয়েছিলেন। তাওহীদের দাওয়াত তার কাছে পৌঁছেছিল এবং তিনি সে দাওয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন।  


অতএব রাসূলেপাক (ﷺ) এর পিতা-মাতা সম্পর্কে আপনি কি ধারণা করেন, যারা ছিলেন তাঁর অধিক নিকটবর্তী, প্রাণের চেয়ে প্রিয়। এবং তাদের গ্রহণযোগ্য উযর ছিল তাছাড়া তাদের হায়াত ছিল অতি সামান্য?  


فمعاذ الله ان يظن بهما انهما فى طبقة الجحيم- وان يشدد عليهما العذاب العظيم- هذا لا يفهمه من له ادنى ذوق سليم-  


অর্থ: অতএব আল্লাহর আশ্রয় চাই তাদের থেকে যারা ধারণা করে যে, নবীজীর পিতা-মাতা ‘জাহিম’ স্তরের জাহান্নামী এবং তাদের উপর ভয়াবহ আযাব রয়েছে। যে ব্যক্তির সামান্যতম বিবেক-বুদ্ধি আছে সেও একথাটি মেনে নিতে পারবে না।  


অতঃপর ঐ হাদিস জিব্রাইল আলাইহিস সালাম রাসূল (ﷺ) এর বে আঘাত করে বলেছিলেন মুশরিক অবস্থায় মৃত্যু বরণকারী ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না।  


ইমাম বাযযার ইহা বর্ণনা করেছেন যার সনদের মধ্যে অজ্ঞাত বর্ণনাকারী রয়েছেন।  


অতঃপর ما كان للنبى والذين امنوا আয়াতের শানে নুযুল সংক্রান্ত হাদিসটিও জয়িফ। বরং বুখারী ও মুসলিম দ্বারা প্রমাণিত যে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে আবু তালিবের ব্যাপারে। যেমন রাসূল (ﷺ) তাকে বলেছিলেন ‘আমি তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব’।  


অতঃপর আমার মা তোমাদের মায়ের সাথে রয়েছে হাদিসটি ইমাম হাকিম মুস্তাদরাক গ্রন্থে বর্ণনা করে ইহাকে সহিহ বলেছেন। মুস্তাদরাক কিতাবটিতে স্বাভাবিকভাবে সহিহ বলার রীতিটি প্রসিদ্ধ।  


অথচ উসূলে হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে এককভাবে বর্ণিত হাদিস সহিহ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।  


অতঃপর ইমাম যাহাবী مختصر المستدرك গ্রন্থে এ হাদিসটি বর্ণনা করার পর ইমাম হাকিম (رضي الله عنه) এর উক্তি ‘সহিহ’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন।  


উকবা বলেন- আমি বলব ‘না’ আল্লাহর শপথ উসমান বিন উমাইরকে ইমাম দারে কুতনী জয়িফ বলেছেন।  


অতঃপর ইমাম যাহাবী হাদিসটির জয়িফ বা দুর্বলতা বর্ণনা করেছেন এবং এর উপর শরয়ি শপথ করেছেন।  


অতএব এ মাসআলায় যখন কিছু জয়িফ হাদিস ব্যতিত অন্য কোন সহিহ হাদিস নাই তখন এর বিপরীত দিকেই দৃষ্টিপাত করতে হবে।


চতুর্থ বিষয়:

জাহিলিয়াতের যুগে হানিফ সম্প্রদায়


এ মসলকের সাহায্যকারী আরো একটি বিষয় হল যে, বড় একটি জামাত থেকে প্রমাণিত যে- জাহিলিয়াতের যুগে অনেক হানিফ লোক ছিলেন যারা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর ধর্মের অনুসারি ছিলেন এবং তারা শিরক থেকে মুক্ত ছিলেন। তাহলে নবী করিম (ﷺ) এর পিতা-মাতাগণ এ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে নিষেধ কোথায়?  


হাফিজ আবুল ফারজ বিন জুযি ‘তালকীহ’ গ্রন্থে বলেছেন জাহিলিয়াতের যুগে যারা মূর্তিপূজা থেকে বিরত ছিলেন, তাদের মধ্যে আবু বকর সিদ্দিক, যায়দ বিন আমর বিন নুফাইল, উবাইদুল্লাহ বিন জাহাশ, উসমান বিন হুওয়াইরিছ ওয়ারাকা বিন নওফেল, রুবাব বিন বারা, আসাদ আবু কুরাইব হুমাইনী, ক্বিছ বিন সাঈদ, আল ওয়াইদী, আবু কাইছ বিন সারমাহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।  


তাছাড়া যায়দ বিন আমর, ওয়ারাকাহ, এবং কায়ছ এর হানিফ হবার ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।  


ইবনে ইসহাক সহিহ সূত্রে আসমা বিনতে আবু বকর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন- আমি যায়দ বিন আমর বিন নুফাইলকে দেখেছি সে কাবাশরীফে পিঠ ঠেকিয়ে বলতেছে- হে কুরাইশ সম্প্রদায়, আজ তোমাদের মধ্যে আমি ব্যতিত অন্য কোন লোক ইব্রাহিমী ধর্মের উপর বিদ্যমান নেই। অতঃপর বলেন- হে আল্লাহ যদি আমি জানতাম কে তোমার অধিক প্রিয়পাত্র তাহলে তার মাধ্যমে তোমার ইবাদত করতাম। কিন্তু আমি তা জানি না।  


ইমাম সুয়ুতি বলেন- উক্ত বর্ণনাটি পূর্বে উল্লেখিত প্রথম মসলকের পক্ষে সহযোগী দলিল। অর্থাৎ সে সময় এমন কোন লোক ছিল না যার নিকট দাওয়াত পৌঁছেছে এবং সে এর হাকিকত অনুধাবন করেছে।  


আবু নাঈম ‘দালাইলুন নবুয়ত’ গ্রন্থে আমর বিন উসাবাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন- জাহিলিয়াত যুগে আমার সম্প্রদায়ের ‘ইলাহ’ বা দেবতাদের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পায়। অতঃপর দেখতে পাই ইহা বাতিল বা অমূলক। তারা পাথরের পূজা করে।  


ইমাম বায়হাকী ও আবু নাঈম উভয়ে ‘দালাইল’ কিতাবে হযরত শা’বীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি জুহাইনার শায়খ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উমাইর বিন হাবিব আল জুহানী জাহিলিয়াত যুগে শিরক থেকে মুক্ত ছিল এবং আল্লাহর ইবাদত করত। সে ইসলাম আগমন পর্যন্ত জীবীত ছিল।  


আশআরী জামাতের ইমাম শায়খ আবুল হাসান আশআরী বলেছেন- এবং আবু বকর (رضي الله عنه)ও তাদের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম আশআরী (رضي الله عنه) এর উক্তির ভাবার্থ সম্পর্কে মতানৈক্য পরিলতি হয়। কেউ কেউ বলেছেন- এর অর্থ হল আবু বকর (رضي الله عنه) ইসলাম আগমনের পূর্বেও মু’মিন ছিলেন। অন্যান্যগণ বলেন বরং ইমাম আশআরী (رضي الله عنه) এর কথার অর্থ হলো- আবু বকর (رضي الله عنه) সবসময় তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা অভিশপ্ত নয়। আল্লাহতায়ালা জানতেন যে তিনি অচিরেই মু’মিন এবং পূণ্যশীলদের দলভুক্ত হবেন।  


শায়খ তকি উদ্দিন সুবুকি (رضي الله عنه) বলেন- ইমাম আশআরীর বক্তব্যের ভাবার্থ যদি ইহা হয় তাহলে আবু বকর (رضي الله عنه) ও অন্যান্য সাহাবাগণ এ ব্যাপারে বরাবর হয়ে যাবেন। কিন্তু আশআরী (رضي الله عنه) আবু বকর (رضي الله عنه) এর ব্যাপারে যে কথা বলেছেন অন্যান্য সাহাবীদের ব্যাপারে এ রকম কথা বলা হয়নি।  


অতএব সঠিক কথা হল আবু বকর (رضي الله عنه) থেকে কোন কুফুরি প্রকাশ হয়নি। সুতরাং ইসলাম আগমন পূর্বে তিনি যায়দ বিন আমর বিন নুফাইল এবং এ রকম অন্যান্যদের মত ছিলেন। এ জন্য ইমাম আশআরী অন্যান্য সাহাবি ব্যতিত শুধুমাত্র সিদ্দিক (رضي الله عنه) এর উল্লেখ করেছেন।  


ইমাম সুয়ুতি বলেন- আমরা বলব নবী করিম (ﷺ) এর মাতাপিতার অবস্থা ও ঠিক তদ্রুপ ছিল। তাদের পক্ষে থেকেও কোন কুফুরি প্রমাণিত হয়নি। তাদের অবস্থা যায়দ বিন আমর বিন নুফাইল এবং আবু বকর (رضي الله عنه) এর মত।


একটি সওয়াল ও তার জবাব


সওয়াল  

====

তুমি যদি বল, আরো একটি সমস্যা রয়ে গেল যা ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন-  


ان رجلا قال يا رسول الله- اين ابى؟ قال فى النار- فلما قفى دعاه فقال- ان ابى واباك فى النار-  


অর্থ: এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল- হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতা কোথায়? তিনি বললেন- জাহান্নামে। তখন ইহা তার নিকট কষ্টদায়ক হল। নবীজী তাকে ঢেকে বললেন- আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামে।  


এবং আরো একটি হাদিস ইমাম মুসলিম ও আবু দাউদ আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন।  


انه صلى الله عليه وسلم استأذن فى الاستغفار لامه فلم يؤذن له  


অর্থ: নবী করিম (ﷺ) তাঁর মায়ের ইস্তেগফারের জন্য অনুমতি চাইলে তাঁকে অনুমতি দেয়া হয়নি। অতএব এ সমস্যার সমাধান করুন।    


জবাব  

=== 

উল্লেখিত ইবারতটি ‘আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামী’ এর ব্যাপারে বর্ণনাকারীগণ ঐকমত্য পোষণ করেননি। ইহা বর্ণনা করেছেন হাম্মাদ বিন সালমা। তিনি ছাবিত থেকে, তিনি হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে ইমাম মুসলিম এই সূত্রেই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। অথচ মা’মার হযরত ছাবিত থেকে ব্যতিক্রমভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি ‘আমার পিতা ও তোমার পিতা জাহান্নামী’ বাক্যটি উল্লেখ করেননি। বরং নবীজী বলেছেন- اذا مررت بقبر كافر فبشره بالنار অর্থ: যখন তুমি কোন কাফিরের কবরের পাশ দিয়ে গমন করবে তখন তাকে জাহান্নামের সুসংবাদ দাও।  


এই ইবারতটি কখনো রাসূল (ﷺ) এর পিতাকে এর অন্তর্ভুক্ত করে না। এ সনদটি অধিক শক্তিশালী। কারণ হাম্মাদের চেয়ে মা’মার অধিক নির্ভরযোগ্য।  


তাছাড়া হাম্মাদের স্মৃতিশক্তির ব্যাপারে বিভিন্ন মন্তব্য রয়েছে এবং তাঁর বর্ণনার মধ্যে অনেক মুনকার হাদিস রয়েছে।  


বর্ণিত আছে যে, রবিয়াহ তার কিতাবে ভুলক্রমে বিষয়টি ছেড়ে দিলেন। কিন্তু হাম্মাদ বিষয়টি সংরণ রাখতে পারেননি এবং এভাবেই বর্ণনা করলেন। সুতরাং এ ব্যাপারটি ল্যণীয়। তদুপরি ইমাম বুখারী হাম্মাদ থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করেননি। ইমাম মুসলিমও প্রকৃতপে হাম্মাদ থেকে উক্ত ছাবিতের হাদিস ছাড়া অন্য কোন বর্ণনা করেননি।  


যেমন ইমাম হাকিম ‘মুদখাল’ কিতাবে বলেছেন-  


ما خرج مسلم لحماد فى الاصول الا من حديثه عن ثابت-  

অর্থ: ইমাম মুসলিম হাম্মাদ থেকে ছাবিতের হাদিস ব্যতিত অন্য কোন হাদিস বর্ণনা করেননি।  


কিন্তু মা’মারের স্মৃতিশক্তি সম্বন্ধে কেউ কোন আপত্তি করেননি। এবং তাঁর কোন হাদিস মুনকার পর্যায়ের নেই। তাছাড়া শাইখান তথা বুখারী ও মুসলিম তাঁর থেকে হাদিস গ্রহণের েেত্র ঐকমত্য পোষণ করেছেন। অতএব তাঁর বর্ণনা অধিক নির্ভরযোগ্য।  


অতঃপর আরো একটি হাদিস আমরা সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (رضي الله عنه) থেকে পেয়েছি যা মা’মার কর্তৃক ছাবিত থেকে বর্ণিত হাদিসের অনুরূপ।  


তাছাড়া ইমাম বাযযার, ইমাম তাবরানী ও ইমাম বায়হাকী একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন ইব্রাহিম বিন সাদ থেকে, তিনি যুহরি থেকে, তিনি আমির বিন সাদ থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন-  


ان اعرابيا قال لرسول الله صلى الله عليه وسلم اين ابى؟ قال فى النار- قال فاين ابوك؟ قال حيثما مررت بقبر كافر فبشره بالنار-  


অর্থ: এক বেদুইন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে বলল- ‘আমার পিতা কোথায়? নবীজী বললেন জাহান্নামে। অতঃপর লোকটি বলল আপনার পিতা কোথায়? নবীজী বললেন- যখন তুমি কোন কাফিরের কবরের পাশ দিয়ে গমন করবে তখন তাকে জাহান্নামের সুসংবাদ দিবে।  


এ হাদিসটির সনদ বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুরূপ। তাই ইহা অন্যান্য বর্ণনার উপর প্রাধান্য পাবে।  


ইমাম তাবরানী ও ইমাম বায়হাকী এ হাদিসের শেষে আরো একটু অতিরিক্ত শব্দ উল্লেখ করেছেন- তা হলো পরবর্তীতে এ বেদুইন লোকটি ইসলাম গ্রহণ করল এবং বলল-  


لقد كلفنى رسول الله صلى الله عليه وسلم تعبا ما مررت بقبر كافر الا بشرته با لنار-  


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে এমন একটি কঠিন নির্দেশ দিয়েছেন যে যখনই আমি কোন কাফিরের কবরের পাশ দিয়ে গমন করেছি তখন তাকে জাহান্নামের সংবাদ দিয়েছি।  


ইমাম ইবনে মাজাহ আরো একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।  


ইব্রাহিম বিন সাদ থেকে তিনি যুহরি থেকে তিনি সালিম থেকে তিনি তাঁর পিতা থেকে তিনি বলেন- নবী করিম (ﷺ) এর নিকট একজন বেদুইন এসে প্রশ্ন করল- হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতেন। বর্তমানে তিনি কোথায়? তিনি বললেন- জাহান্নামে। এতে লোকটি কিছুটা মর্মাহত হল।  


অতঃপর বলল- হে আল্লাহর রাসূল আপনার পিতা কোথায়? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন- তুমি যখন কোন মুশরিকের কবরের পাশ দিয়ে গমন করবে তখন তাকে জাহান্নামের সুসংবাদ দিবে। পরবর্তীতে লোকটি মুসলমান হয়ে গেল এবং বলল রাসূলুল্লাহ আমাকে এমন একটি কঠিন কাজের নির্দেশ দিয়েছেন যখনই আমি কোন কাফিরের কবরের পাশ দিয়ে গমন করেছি তখন তাকে জাহান্নামের সুসংবাদ দিয়েছি। এ অতিরিক্ত বর্ণনা দ্বারা একথাই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলেপাক (ﷺ) থেকে বর্ণিত আম শব্দটি এবং ঐ বেদুইনের ইসলাম গ্রহণ পরবর্তী অভিমতটি একটি উদাহরণমূলক বক্তব্য।  


অতএব যদি প্রথমোক্ত জবাবটি গ্রহণ করা হয় তাহলে এতে কোন সমস্যাই থাকে না। অর্থাৎ প্রথমোক্ত ইবারতটি হচ্ছে বর্ণনাকারীর প থেকে পরিবর্তন। তিনি তার অনুধাবন অনুযায়ী অর্থ বর্ণনা করেছেন। এ ধরণের অনেক বর্ণনা বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে যা রাবী তার অনুধাবন অনুযায়ী বর্ণনা করেছেন। অথচ অন্য রাবীগণ তার চেয়ে অধিক নির্ভরশীল।  


যেমন মুসলিমশরীফে আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে নামাযে বিসমিল্লাহ পড়তে বারণ করা হয়েছে। ইমাম শাফেয়ী (رضي الله عنه) এ হাদিসটির ইল্লত বর্ণনা করেছন এভাবে- তিনি বলেন- হযরত ছাবিত অন্য একটি সূত্রে বিসমিল্লাহ’ শ্রবণকে অস্বীকার করেছেন। এতে বর্ণনাকারী অনুধাবন করেছেন বিসমিল্লাহ পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। তাই তিনি তার ধারণা অনুযায়ী হাদিসটির অর্থ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং তিনি ভুল করেছেন।  


আমরা এখানে ইমাম মুসলিমের হাদিসের জবাব এভাবেই প্রদান করব। যেভাবে আমাদের ইমাম শাফেয়ী (رضي الله عنه) ইমাম মুসলিমের বিসমিল্লাহ না পড়াসংক্রান্ত হাদিসের জবাব প্রদান করেছেন।  


অতএব যদি প্রথমোক্ত বর্ণনার উপর রাবীদের ঐকমত্য আবশ্যক হয় তাহলে ইহা পূর্বে উল্লেখিত অনেক দলিল ও সহিহ হাদিসসমূহের সাথে সাংঘর্ষিক হবে।  


যখন কোন সহিহ হাদিসের সাথে অন্য কোন দলিল সাংঘর্ষিক হয় তখন ক্ষেত্রে সহিহ হাদিসকে প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক। ইহা উসুলের একটি নীতি।  


এ শেষোক্ত জবাবটি ঐ হাদিসের জবাবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যে হাদিস রাসূল (ﷺ)কে মায়ের ইস্তেগফারের অনুমতি প্রদান করা হয়নি। সম্ভবত এতে এমন দোয়ার কথা বলা হয়েছে যা আবশ্যক নয়।  


যেমন দলিলস্বরূপ বলা যায় ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ নিয়ম ছিল। যদি কোন মুসলমানের ঋণ থাকে তাহলে তার উপর নামায পড়া নিষেধ।  


সম্ভবত আমেনা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর উপর কুফুরি ব্যতিত অন্যান্য সমস্যাবলী ছিল। যার দরুণ তাঁর জন্য ইস্তেগফার করতে বারণ করা হয়েছে। তবে প্রথম জবাবটিই অধিক শক্তিশালী এবং ইহাই গ্রহণযোগ্য।  


অতঃপর আমি ‘মা’য়মার’ কৃর্তৃক বর্ণিত হাদিসের মতো অন্য একটি হাদিস ভিন্ন সূত্রে পেয়েছি। ব্যাখ্যাস্বরূপ যে হাদিসটি এখানে উল্লেখ করব। সেখানে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে প্রশ্নকারী ইচ্ছা করেছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পিতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে। কিন্তু আদব ও সৌন্দর্য্য রা করতে সে প্রশ্নের ধরণ পরিবর্তন করেছে। যেমন ইমাম হাকিম মুস্তাদরিক গ্রন্থে লাকিত বিন আমির থেকে বর্ণনা করে ইহাকে সহিহ বলেছেন।  


একবার তিনি একটি প্রতিনিধি দলের সাথে রাসূলেপাক (ﷺ) এর দরবারে আসলেন। তার সাথে তখন নুহাইক বিন আসিম বিন মালিক বিন মুন্তাফিক ছিলেন। তিনি বলেন আমরা রজব মাসে মদিনাশরীফে পৌঁছলাম। অতঃপর নবীজীর সাথে নামায পড়লাম। নামায শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লোকদের প্রতি ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। (অতঃপর বর্ণনাকারী হাদিসের বাকী অংশ বর্ণনা করলেন) অবশেষে বলেন- তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ) আমাদের মধ্যে যারা জাহিলিয়াত যুগে মৃত্যুবরণ করেছে তাদের মধ্যে কোন ভাল লোক আছে কি? তখন কুরাইশ বংশীয় এক ব্যক্তি বলল। তোমার পিতা মুন্তাফিক জাহান্নামী।  


উপস্থিত জনতার সামনে আমার পিতা সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করায় আমার চেহারায় আগুন ঝরতে লাগল। তাই আমি জিজ্ঞাসা করতে চাইলাম- হে আল্লাহর রাসূল, আপনার পিতাও কি জাহান্নামী। কিন্তু যখন আমি দৃষ্টিপাত করলাম তখন অন্য একটি সৌন্দর্য্য আমাকে মোহিত করল। তাই আমি অন্যভাবে প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার পরিবারও কি জাহান্নামী? তখন নবীজী বললেন- যখন তুমি কোন মুশরিকের কবরের পাশ দিয়ে গমন করবে তখন বলবে, আমাকে মুহাম্মদ (ﷺ) তোমার প্রতি প্রেরণ করেছেন। অতএব তোমাকে তোমার মন্দ অবস্থার সুসংবাদ দিচ্ছি।  


এ বর্ণনাটিতে কোন জটিলতা নাই। ইহা একটি সুস্পষ্ট বর্ণনা।    


অন্য একটি ব্যাখ্যা  

========

প্রশ্নকারী ব্যক্তির প্রশ্নটি ‘আপনার পিতা কোথায়?’ এভাবে বলতে কি সমস্যা ছিল? এমনিভাবে আনাস (رضي الله عنه) এর হাদিসে আমার পিতা ‘বাক্য দ্বারা আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه)কে পিতা মুরাদ না নিয়ে চাচা আবু তালিবকে মুরাদ নিতে সমস্যা কোথায়?  


যেমন ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (رضي الله عنه) ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পিতা দ্বারা তাঁর চাচাকে মুরাদ নিয়েছেন। যা ইতোপূর্বে ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) মুজাহিদ (رضي الله عنه) ইবনে জুরাইজ ও সুদ্দি (رضي الله عنه) থেকে দলিল পেশ করা হয়েছে। এখানে বিষয়টি দুটি ব্যাখ্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত।    


প্রথম ব্যাখ্যা  

======

‘পিতা’ শব্দটি আবু তালিবের উপর প্রয়োগ করা নবী করিম (ﷺ) এর যামানায়ও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত ছিল। এজন্য মক্কাবাসীরা আবু তালিবকে বললো- তোমার পুত্রকে বল আমাদের দেবদেবীদেরকে গালি না দিতে।  


একবার তারা আবু তালিবকে বলল তোমার পুত্রকে আমাদেরকে দিয়ে দাও। আমরা তাকে হত্যা করব এবং তুমি তার স্থলে এই ছেলেকে গ্রহণ কর। তখন আবু তালিব তাদেরকে বলেছিলেন-  


اعطيكم ابنى تقتلونه واخذ ابنكم اكفله لكم-  


অর্থ: আমার পুত্রকে তোমাদেরকে দিয়ে দেব তোমরা তাকে হত্যা করবে আর আমি তোমাদের পুত্রকে গ্রহণ করে লালন পালন করব।  


যখন আবু তালিব নবী করিম (ﷺ)কে নিয়ে সিরিয়া গমন করেছিলেন তখন একজন পাদ্রীর সাাত হলে সে আবু তালিবকে জিজ্ঞাসা করল এ ছেলেটি তোমার কি হয়? তিনি বললেন সে আমার পুত্র। তখন পাদ্রী বলল এটা কি করে সম্ভব যে এ বালকের পিতা এখনোও জীবিত?  


অতএব আবু তালিবকে নবী করিম (ﷺ) এর পিতা সম্বোধন করা তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। কারণ তিনি ছিলেন নবীজীর চাচা। ছোটবেলা থেকেই তিনি নবীজীকে লালনপালন, সাহায্য-সহযোগিতা ও দেখাশোনা করেছেন।    


দ্বিতীয় ব্যাখ্যা  

======

ইমাম তাবরানী উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেছেন, বিদায় হজ্জের সময় হারিছ বিন হিশাম নবী করিম (ﷺ) এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল আপনি উৎসাহিত করেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতে। প্রতিবেশির প্রতি সদয় ব্যবহার করতে, ইয়াতিমের লালপালন করতে, এবং অতিথি ও গরিব মিসকিনদের খাদ্য প্রদান করতে। আর হিশাম বিন মুগিরা এর সবগুলোই করতেন। অতএব তার সম্বন্ধে আপনার ধারণা কি ইয়া রাসূলাল্লাহ? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন-  


كل قبر لا يشهد صاحبه ان لا اله الا الله فهو جذوة من النار وقد وجدت عمى ابا طالب فى طمطام من النار- فاخرجه الله لمكانه منى واحسانه الى فجعله فى ضحضاح من النار-  


অর্থ: এমন প্রত্যেক কবরের অধিবাসী যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর স্ব্যা প্রদান করেনি সে জাহান্নামী। আমি আমার চাচা আবু তালিবকে জাহান্নামের সর্বনিু স্তরে পেয়েছি। অতঃপর আল্লাহতায়ালা আমার কারণে তাকে সেখান থেকে বের করে নিয়েছেন এবং তাকে জাহান্নামের শিখার মধ্যে রেখেছেন।    


সতর্কবাণী  

=====

একদল উলামায়ে কেরাম উল্লেখিত জবাবসমূহের সাথে ভিন্ন একটি মত পোষণ করেছেন। তারা রাসূলেপাক (ﷺ) এর পিতা-মাতা সম্বন্ধে বর্ণিত হাদিসসমূহের জবাবে বলেছেন এগুলো রহিত হয়ে গেছে। যেমনিভাবে রহিত হয়ে গেছে ‘মুশরিক শিশুরা জাহান্নামী’ সংক্রান্ত হাদিসগুলো। তারা বলেন- মুশরিক শিশুদের ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসগুলো রহিতকারী আয়াত হল-  


ولا تزر وازرة وزر اخرى  


অর্থ: কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। (আনআম- ১৬৪)  


আর নবী করিম (ﷺ) এর পিতা-মাতা সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলোকে রহিতকারী আয়াত হল- وما كنا معذبين حتى نبعث رسولا অর্থ: কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকে শাস্তি প্রদান করি না। (বনি ইসরাইল- ১৫)  


এখানে একটি সুক্ষ বিষয় হলো- উল্লেখিত দুটি ফারিক বা দলের জন্য দুটি বাক্য একই আয়াতে সংযুক্তভাবে ছন্দাকারে বর্ণিত হয়েছে। এ জবাবটি সংপ্তি কিন্তু অত্যন্ত অর্থবহ। ইহা অন্যান্য সকল জবাবের মধ্যে উত্তম। তবে ইহা প্রথম মসলক বা অনুসারীদের স্বপরে দলিল। অতএব দ্বিতীয় মসলকের পক্ষে অন্যান্য দলিল প্রয়োগ করতে হবে।


শেষকথা


সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে জাহান্নামীদের মধ্যে সর্বনিু আযাব হলো আবু তালিবের। সে থাকবে জাহান্নামের আগুনের শিখার মধ্যে। তার পায়ে দুটি জুতা পরানো হবে এবং এর তাপে তার মগজ গলে বের হবে। ইহা দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে নবী করিম (ﷺ) এর পিতা-মাতা জাহান্নামী নয়। কারণ যদি তারা জাহান্নামী হন তাহলে আবু তালিবের চেয়ে তাদের শাস্তি কম হতে হবে। কেননা তারা হচ্ছেন নবীজীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং তাদের রয়েছে অনেক উযর বা অপারগতা। তারা নবুয়ত প্রকাশ পর্যন্ত অবকাশ পাননি এবং এমন হয়নি যে, তাদের কাছে ইসলাম পেশ করা হয়েছে তথাপি তারা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু আবু তলিবের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।  


অতএব অধিক সত্যবাদী নবীর হাদিস অনুযায়ী সর্বনিম্ন শাস্তি হবে আবু তালিবের। সুতরাং নবীজীর পিতা-মাতা জাহান্নামী নন-  

وهذا يسمى عند اهل الاصول دلالة الاشارة-  

অর্থ: আহলে উসূলদের ভাষায় ইহাকে বলা হয় ইঙ্গিতসূচক দলিল।    


ঝগড়ার ময়দান  

=======

বর্তমান যুগে ঝগড়াকারীর অভাব নেই। বিশেষ করে উল্লেখিত মাসআলার ব্যাপারে। তাদের অধিকাংশই দলিল প্রমাণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে অজ্ঞ। সুতরাং তাদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করা অনর্থক। তবে তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি যারা একটু যুক্তিযুক্ত তর্ক করেন তাদের অনেকেই শুধুমাত্র মুসলিমশরীফের ঐ হাদিসটি দলিল হিসেবে পেশ করে বলেন- ইহা আপনার মতের ব্যতিক্রম।  


অতএব ঝগড়াকারী ব্যক্তি যদি আমাদের শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী হয় তাহলে তার ক্ষেত্রে আমি বলব- সহিহ মুসিলমশরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) নামাযে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ পড়েন নাই। অথচ আপনার মতে ‘বিসমিল্লাহ’ ব্যতিত নামায সহিহ হয় না।  


এমনিভাবে বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে রাসূল (ﷺ) বলেছেন ইমাম নির্ধারণ করা হয় তাকে অনুসরণ করার জন্য। সুতরাং ইমামের ব্যতিক্রম কর না। যখন তিনি রুকু করেন তোমরাও রুকু কর। যখন মাথা উত্তোলন করেন তোমরাও উত্তোলন কর। যখন ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদা’ বলেন তখন তোমরা ‘রাব্বানা লাকাল হাম্দ’ বল। যখন বসে নামায পড়েন তখন তোমরাও সবাই বসে নামায পড়।  


অথচ আপনার মত হল- ইমাম যখন ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদা’ বলেন তখন আপনিও ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলেন।  


আবার ইমাম যদি উযরের কারণে বসে নামায পড়েন, আর আপনি সুস্থ্য ব্যক্তি হন তাহলে আপনি ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়েন, বসে পড়েন না। এমনিভাবে বুখারী মুসলিমে তাইয়াম্মুমের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে ‘তোমাদের জন্য যথেষ্ট যে একবার মাটিতে হাত দ্বারা আঘাত করবে। অতঃপর বাম হাত দ্বারা ডানহাতের তালুও চেহারা মাসেহ করবে।  


অথচ আপনি তাইয়াম্মুমের মধ্যে একবার আঘাত করাকে যথেষ্ট মনে করেন না এবং হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসেহ করাকে যথেষ্ট মনে করেন না।  


অতএব বুখারী ও মুসলিম উভয়টি অথবা একটির মাধ্যমে প্রমাণিত বিষয়ের ব্যতিক্রম আপনি কিভাবে করেন?  


যদি তাঁর নিকট ইলমের একটু গন্ধ থাকে তাহলে সে বলবে এ ব্যাপারে অন্যান্য দলিল রয়েছে যা এর সাথে সাংঘর্ষিক। তাই আমি অন্য দলিলকে এর উপর প্রাধান্য দিয়েছি।  


ইমাম সুয়ুতি বলেন- তাহলে আমি তাকে বলব আলোচ্য ব্যাপারটিও এরকম একটি মাসআলাহ। এর পে শুধুমাত্র মুসলিমের ঐ হাদিস ব্যতিত অন্য কোন হাদিস নেই।  


যদি ঝগড়াকারী ব্যক্তি মালিকি মাযহাবের অনুসারী হয় তবে তার ক্ষেত্রে বলব বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে ক্রেতা ও বিক্রেতার কিয়ার তথা গ্রহণ বা বর্জনের অধিকার উভয়ে পৃথক হওয়া পর্যন্ত থাকবে। অথচ আপনি খিয়ারে মজলিসকে গ্রহণ করেন না।  


এমনিভাবে সহিহ মুসলিমশরীফে বর্ণিত হয়েছে- রাসূল (ﷺ) অজুর সময় সম্পূর্ণ মাথা মাসাহ করতেন না। অথচ আপনার মতে অজুতে সম্পূর্ণ মাথা মাসাহ করা ওয়াজিব। অতএব সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের বিরোধিতা আপনি কিভাবে করেন? তিনি জবাবে বলবেন- এ ব্যাপারে সাংঘর্ষিক অন্যান্য দলিল রয়েছে। তাই আমি অন্যটিকে প্রাধান্য দিয়েছি।  


সুয়ুতি বলেন- আলোচ্য মাসআলাটিও এ ধরণের একটি বিষয়। যদি ঝগড়াকারী ব্যক্তি হানাফি মাযহাবের অনুসারী হয় তাহলে তার েেত্র বলব- সহিহ হাদিসে বর্ণিত আছে ‘যদি কুকুর তোমাদের কারো পাত্রে মুখ লাগায় তাহলে ইহাকে সাতবার ধৌত কর।’ অথচ আপনি সাতবার ধৌত করা শর্তারোপ করেন না।  


এমনিভাবে বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পড়বে না তার নামায শুদ্ধ হবে না’ অথচ আপনি এ ক্ষেত্রে সূরা ফাতিহা ব্যতিত নামায শুদ্ধ মনে করেন।’  


এমনিভাবে বুখারী ও মুসলিমে ছাবিত হয়েছে ‘অতঃপর রুকু থেকে মাথা উত্তোলন কর এবং তাদিল তথা বিলম্ব সহকারে দাঁড়াও অথচ আপনি তাদিল ব্যতিত নামায শুদ্ধ মনে করেন।  


অনুরূপভাবে সহিহ হাদিসে বর্ণিত ‘পানি যখন দুই কুল্লা পর্যন্ত পৌঁছবে তখন অপবিত্র হবে না। অথচ আপনি দুই কুল্লা ধর্তব্য করেন না।  


এমনিভাবে বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে রাসূল (ﷺ) বাইয়ে মুদাব্বির করতেন। অথচ আপনি ‘বাইয়ে মুদাব্বির’ গ্রহণ করেন না।  


অতএব কিভাবে এ সমস্ত সহিহ হাদিসসমূহের বিরোধিতা করেন?  


তিনি বলবেন, এ সমস্ত ব্যাপারে অন্যান্য দলিল রয়েছে যা এগুলোর সাংঘর্ষিক। তাই আমি অন্যান্য দলিলকে এগুলোর উপর প্রাধান্য দিয়েছি।  


সুয়ুতি বলেন- আমি বলব আমাদের আলোচ্য মাসআলাটিও এ ধরণের একটি বিষয়।  


যদি ঝগড়াকারী ব্যক্তি হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী হন তাহলে তার ক্ষেত্রে বলব- বুখারী মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে- যে ব্যক্তি সন্দেহের দিন রোযা রাখল সে আবুল কাশিম তথা নবীয়েপাকের অবাধ্যতা করল।  


এমনিভাবে উভয় কিতাবে বর্ণিত হয়েছে- রোযা রাখার ক্ষেত্রে রমজান মাসকে একদিন বা দুইদিন অগ্রবর্তী করো না। অথচ আপনি সন্দেহের দিন রোযা রাখতে বলেন। অতএব সহিহাইন দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের বিরোধিতা আপনি কিভাবে করেন?  


তিনি বলবেন এ ব্যাপারে অন্যান্য দলিল রয়েছে যা একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক। তাই আমি সেগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছি। আমি বলব- আমাদের আলোচিত বিষয়বস্তুটিও এ রকমই একটি মাসআলাহ। এ আলোচনাটি বর্তমান সময়ে বিবেকবানদের জন্য একটি চমৎকার। যদি ঝগড়াকারী ব্যক্তি এমন হয় যার নিকট হাদিস রয়েছে কিন্তু কোন ফিকাহ নাই তাহলে তার ক্ষেত্রে বলা হবে-  


قد قالت الاقدمون- المحدث بلا فقه كعطار غير طبيب- فالادوية حاصلة فى دكانه ولا يدرى لماذا تصلح- والفقيه بلا حديث كطبيب ليس بعطار يعرف ما تصلح له الادوية الا انها ليست عنده-  


অর্থ: পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামগণ বলেছেন- ফিকাহ ব্যতিত মুহাদ্দিস ঐ আতর ব্যবসায়ীর মতো। যার নিকট কোন ডাক্তার নেই। তার দোকানে ঔষধ আছে কিন্তু সে জানে না এগুলো কোন রোগের নিরাময়ক।  


আবার হাদিস ব্যতিত ফকিহ ঐ ডাক্তারের মতো, যার কাছে কোন ঔষধ নাই। সে জানে কোন রোগের কোন প্রতিষেধক। কিন্তু তার নিকট সে ঔষধ মওজুদ নাই।  


আল্লাহর শোকরিয়া, আমার নিকট হাদিস, ফিকাহ, উসূল, সমস্ত আরবি ব্যাকরণ, মায়ানী, বয়ান ইত্যাদি মজুদ আছে। অতএব আমি জানি কিভাবে কথা বলতে হবে। কিভাবে দলিল প্রদান করতে হবে। এবং কিভাবে কোনটিকে প্রাধান্য দিতে হবে।  


কিন্তু ভাই (আল্লাহ আমাকে ও তোমাকে তৌফিক দান করুক) এ বিষয়টি তোমার বুঝে আসবে না। কারণ তুমি ফিকাহ, উসূল এমনি আরবি উপকরণের কোনটিই জান না। হাদিসশাস্ত্রে কথা বলা এবং দলিল পেশ করা এত সহজ ব্যাপার নয়।  


অতএব এ ব্যাপারে যিনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী কথা বলতে গিয়ে তার উপর অগ্রসর হওয়া উচিত নয়।  


অতএব আল্লাহ তোমাকে যতটুকু জ্ঞান দান করেছেন তার উপর সীমাবদ্ধ থাক। অর্থাৎ যখন কোন হাদিস সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন শুধুমাত্র এ কথাই বল ইহা বর্ণিত আছে অথবা বর্ণিত হয় নাই। হাফিজে হাদিসগণ ইহাকে সহিহ হাসান অথবা জয়িফ বলেছেন। এর চেয়ে অধিক কিছু ফতোয়া দেয়া তোমার জন্য জায়েয নয়। কবি বলেন-  


لا تحسب المجد تمرا انت اكله - لن تبلغ المجد حتى تلعق الصبرا  


অর্থ: তুমি খেজুরের সম্মান বুঝবে না। কারণ তুমি শুধুমাত্র একজন ভণকারী। ধৈর্য্য ধরে চেটে না খাওয়া পর্যন্ত এর সম্মান তোমার কাছে পৌঁছবে না।  


অতঃপর আমি অন্য একটি বিষয় চার মাযহাবের সকল অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বলব, তা হলো ইমাম মুসলিম (رضي الله عنه) স্বীয় সহিহ গ্রন্থে ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে একটি রেওয়ায়ত বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর যুগ, আবু বকর (رضي الله عنه) এর যুগ এবং উমর (رضي الله عنه) এর প্রাথমিক যুগ পর্যন্ত তিন তালাককে এক তালাক ধর্তব্য করা হত।  


এখন আমি সকল জ্ঞান অন্বেষণকারীদের বলব- আপনি কি উক্ত হাদিসের মর্মার্থ গ্রহণ করেন? যদি কেউ তার স্ত্রীকে বলে তোমাকে তিন তালাক দিলাম, তাহলে আপনি কি এক্ষেত্রে এক তালাক ধর্তব্য করবেন?  


যদি জবাবে সে বলে ‘হ্যাঁ’ আমি এক তালাক মনে করি। তবে তার থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম।  


যদি বলে না আমি এক তালাক মনে করি না। তাহলে আমি তাকে বলব, কিভাবে তার বিরোধিতা কর, যা সহিহ মুসলিম দ্বারা প্রমাণিত। যদি বলে এব্যাপারে অন্যান্য সাংঘর্ষিক দলিল রয়েছে। তাহলে আমি বলব আমাদের আলোচ্য মাসআলাটিকেও সেরকম মনে কর।  


والمقصود من سياق هذا كله انه ليس كل حديث فى صحيح مسلم يقال بمقتضاه لوجود المعارض له-  


অর্থ: পূর্বে উল্লেখিত আলোচনার মকসুদ হলো যে, মুসলিমশরীফে বর্ণিত সকল হাদিস তার মর্মার্থ অনুযায়ী গ্রহণ করা হয় না। যখন এর সাংঘর্ষিক অন্য কোন দলিল বিদ্যমান থাকে।


এ মাসআলার উপর উলামায়ে কিরামদের তৃতীয় মসলক বা অভিমত


আল্লাহতায়ালা নবীয়েপাক (ﷺ) এর পিতামাতাকে পূনর্জীবিত করেছেন। অতঃপর তারা নবীজীর উপর ঈমান আনয়ন করেছেন।  


হুফফাজে মুহাদ্দিসিনে কিরামদের বিরাট একটি জামাত এ মসলকের প্রতি সমর্থন করেছেন। তাদের মধ্যে ইবনে শাহীন হাফিজ আবু বকর আল খতিব বাগদাদী, সুহাইলী, কুরতুবী, মুহিব তাবারী, আল্লামা নাছিরুদ্দিন বিন আল মুনির প্রমুখ অন্যতম। তারা প্রত্যেকে এ ব্যাপারে দলিল প্রদান করেছেন যা ইবনে শাহীন- الناسخ والمنسوخ গ্রন্থে খতিব আল বাগদাদী السابق والاحق গ্রন্থে এবং দারে কুতনী ও ইবনু আসাকির উভয়ে غرائب গ্রন্থে জয়িফ সনদে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেছেন-  


قالت حج بنا رسول الله صلى الله عليه وسلم حجة الوداع فمربى على عقبة بالحجون وهو باك حزين مغتم فنزل فمكث عنى طويلا ثم عاد الى وهو فرح متبسم فقلت له؟ فقال ذهبت لقبر امى فسألت الله ان يحييها فاحياها فامنت بى وردها الله-  


অর্থ: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন- বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে নিয়ে হজ্জ করতে গেলেন। তখন আমাকে নিয়ে হুজুন নামক স্থানে উকবার কাছ দিয়ে গমন করলেন। তখন তিনি খুবই চিন্তিত ও ক্রন্দনরত অবস্থায় ছিলেন। তখন তিনি আমাকে রেখে অন্যথায় চলে গেলেন। দীর্ঘণ পরে যখন আসলেন তখন দেখলাম তিনি ভীষণ খুশি এবং মুচকি হাসছেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি। তিনি বললেন আমি আমার মায়ের কবরের কাছে গিয়েছিলাম। অতঃপর আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি যেন তাকে জীবিত করে দেন। তখন আল্লাহ তাকে জীবিত করেছেন। অতঃপর আমার উপর ঈমান আনয়ন করেছেন। অতঃপর আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে নিয়েছেন।  


মুহাদ্দিসিনে কেরামদরে ঐকমত্য এ হাদিসটি জয়িফ। কেউ কেউ মওজু বলেছেন। তবে সঠিক কথা হল ইহা মওজু নয় জয়িফ। এর উপর আমি পৃথক একটি অধ্যায় রচনা করেছি।  


ইমাম সুহাইলী الروض الانف গ্রন্থে সনদসহ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এ সনদে অজ্ঞাত রাবী রয়েছেন-  


ان رسول الله صلى الله عليه وسلم سأل ربه ان يحيى ابويه فاحياهما له فامنأ به ثم اماتهما-  


অর্থ: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন তিনি যেন তাঁর পিতা-মাতাকে জীবীত করে দেন। তখন আল্লাহ তাদেরকে জীবীত করে দেন। অতঃপর তারা নবীর প্রতি ঈমান আনয়ন করলেন। অতঃপর তারা মৃত্যুবরণ করলেন।  


এ হাদিসটি বর্ণনা করার পর সুহাইলী বলেন- আল্লাহ সর্ব বিষয়ে মতার অধিকারী। তাঁর রহমত ও কুদরতের কাছে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। আর নবী মুহাম্মদ (ﷺ) হচ্ছেন আল্লাহর এমন প্রিয়পাত্র যার জন্য তিনি তাঁর অনুগ্রহ দ্বারা যে কোন বিষয় নির্দিষ্ট করতে পারেন এবং তাকে যা ইচ্ছা নিয়ামত প্রদান করতে পারেন।  


ইমাম কুরতুবী বলেছেন- পুনর্জীবনসংক্রান্ত হাদিস ও ইস্তেগফার নিষেধ এর মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ পূণর্জীবন সংক্রান্ত ঘটনা ইস্তেগফারসংক্রান্ত ঘটনার অনেক পরে হয়েছে। যেমন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কর্তৃক বর্ণিত হাদিস তার প্রমাণ। তিনি বলেছেন- পূনর্জীবন এর ঘটনা বিদায় হজ্বের সময় ঘটেছিল। এ জন্য ইবনে শাহীন এ হাদিসকে অন্যান্য হাদিসের নাসিখ ও বা রহিতকারী নির্ধারণ করেছেন।  


আল্লামা নাছিরুদ্দিন ইবনে মুনির মালিকী স্বীয় المقتفى فى شرف المصطفى গ্রন্থে বলেছেন- আমাদের নবী (ﷺ) এর মাধ্যমে মৃতকে জীবিত করা ঈসা ইবনে মরিয়ম কর্তৃক মৃতকে জীবিত করার অনুরূপ। অতঃপর তিনি বলেন- হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম (ﷺ)াকে যখন কাফিরদের জন্য ইস্তেগফার করতে বারণ করা হল তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন তাঁর পিতা-মাতাকে জীবিত করার জন্য। তখন আল্লাহ তাদেরকে জীবিত করে দিলেন। অতঃপর তারা নবীর প্রতি ঈমান আনয়ন করলেন। অবশেষে মু’মিন হিসেবে ইন্তেকাল করলেন।  


ইমাম কুরতুবী বলেন- নবী করিম (ﷺ) এর ফজিলত কখনো শেষ হয়নি। অতএব ইহাও আল্লাহর প থেকে একটি ফজিলত ও মর্যাদা। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত করেছেন।  


তিনি বলেন- নবী করিম (ﷺ) এর পিতা-মাতার পূনর্জীবন লাভ এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন এগুলো বিবেক বুদ্ধি ও শরিয়ত কোনটাই নিষেধ করে না।  


যেমন কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে বনী ইসরাইলের নিহিত ব্যক্তির পূনর্জীবন লাভ এবং তার হত্যাকারীর সংবাদ প্রদান করার ঘটনা।  


অনুরূপভাবে ঈসা আলাইহিস সালাম ও মৃতকে জীবীত করেছেন এমনিভাবে আমাদের নবীর হাতে আল্লাহতায়ালা অনেক মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করেছেন। কুরতুবী বলেন- এগুলো যখন প্রমাণিত হল তখন রাসূল (ﷺ) এর অধিক ফজিলত ও মর্যাদার কারণে তাঁর পিতা-মাতাকে পূণর্জীবন করা এবং ঈমান আনয়ন করাতে সমস্যা কোথায়?  


হাফিজ ফাতাহ উদ্দিন বিন সাইদুল নাস তদীয় সীরাত গ্রন্থে পূণর্জীবন সংক্রান্ত ঘটনা ও আযাবসংক্রান্ত হাদিসসমূহ বর্ণনার পর বলেছেন কোন কোন আহলে ইলমগণ উল্লেখিত বর্ণনাগুলোর সামঞ্জস্য করতে গিয়ে বলেছেন নবী করিম (ﷺ) এর পবিত্র রূহ মোবারক আল্লাহর নিকট ফিরিয়ে নেয়া পর্যন্ত তিনি উচ্চ মর্যাদা ও মহান সম্মানের উচ্চাসনে আরোহন করতে থাকেন।  


অতএব ইহাই বলা জায়েয যে উক্ত সম্মান আল্লাহতায়ালা তাঁকে পরবর্তীতে প্রদান করেছিলেন। অর্থাৎ পূনর্জীবন লাভ ও ঈমান আনয়ন ঐ সমস্ত হাদিসের পরবর্তী ঘটনা। সুতরাং এতে কোন সংঘর্ষ নাই। কোন কোন উলামায়ে কেরামগণ এদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তারা হালিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর সংবাদ বর্ণনা করার পর বলেছেন-  


هذا جزاء الام عن ارضاعه – لكن جزاء الله عنه عظيم  

وكذالك ارجو ان يكون لامه – عن ذاك امنة يد ونعيم  

ويكون احياها الا له وامنت – بمحمد فحديثها معلوم  

فلربما سعدت به ايضا كما – سعدت به بعد الشقاء حليم  


অর্থ: ইহা হচ্ছে দুধমাতার প্রতিদান। বরং আল্লাহর নিকট আরো অধিক প্রতিদান রয়েছে।  


আশা করি এমনিভাবে তাঁর আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহা আরো অধিক প্রতিদান প্রদান করা হবে।  


আল্লাহ তাঁকে পূনর্জীবিত করেছেন। অতঃপর তিনি মুহাম্মদ (ﷺ) এর প্রতি ঈমান এনেছেন। এ হাদিসটি প্রসিদ্ধ।  


হালিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা যেমনিভাবে সৌভাগ্য লাভ করেছেন ঠিক তেমনিভাবে তিনিও সৌভাগ্য লাভ করেছেন।  


হাফিজ শামসুদ্দিন বিন নাছিরুদ্দিন দামেস্কী স্বীয়- مورد الصادى فى مولد الهادى গ্রন্থে উল্লেখিত হাদিসটি বর্ণনার পর বলেছেন-  


حبا الله النبى مزيد فضل – على فضل وكان به رؤوفا  

فاحيا امه وكذا ابوه – لايمان به فضلا لطيفا  

فسلم فالقديم بذا قدير – وان كان الحديث به ضعيفا  


অর্থ: আল্লাহতায়ালা তাঁর নবী (ﷺ) এর অসংখ্য অগণিত মহব্বত ও অনুগ্রহ করেছেন। তিনি হচ্ছেন অত্যন্ত স্নেহশীল। অতঃপর তিনি তাঁর পিতা-মাতাকে জীবিত করেছেন। সাথে তারা তাঁর প্রতি ঈমান আনেন। ইহা একটি সুক্ষ অনুগ্রহ। অতঃপর তার উপর সালাম। যদিও এ সংক্রান্ত হাদিস জয়িফ।


শেষকথা-ভিন্ন মসলক


একদল উলামায়ে কেরাম উল্লেখিত তিনটি মসলককেই শক্তিশালী মনে করেন না। তারা মুসলিমশরীফের হাদিসসহ এ ধরণের বর্ণনাগুলোকে রহিত বা পরিবর্তন না করে প্রকাশ্য অর্থের উপর রেখে দিয়েছেন। তারা বলে এগুলো বর্ণনা করা কারো জন্য জায়েয নয়।  


ইমাম সুহাইলী- الروض الانف গ্রন্থে মুসলিমের হাদিসটি উল্লেখ করার পর বলেছেন রাসূলেপাক (ﷺ) এর পিতা-মাতা সম্বন্ধে এ ধরণের মন্তব্য করা আমাদের জন্য উচিত নয়। যেমন নবী করিম (ﷺ) বলেছেন-  

لا تؤذوا الاحياء بسب الاموات-  


অর্থ: মৃতদেরকে গালি দেয়ার মাধ্যমে জীবিতদেরকে কষ্ট দিও না।’ আল্লাহতায়ালা বলেছেন-  

ان الذين يؤذون الله ورسوله لعنهم الله فى الدنيا والاخرة-  


অর্থ: যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকাল ও পরকালে অভিসম্পাত করেন। (আহযাব- ৫৭)  


মালেকী মাযহাবের একজন ইমাম কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবিকে জিজ্ঞাসা করা হল ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে যে বলে- নবী করিম (ﷺ) এর পিতা জাহান্নামী। তিনি জবাবে বললেন- من قال ذلك فهو ملعون অর্থ: যে ব্যক্তি ইহা বলবে সে মালউন বা অভিশপ্ত। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন-  

ان الذين يؤذون الله ورسوله لعنهم الله فى الدنيا والاخرة-  


অর্থ: যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তাদের প্রতি দুনিয়াতে ও আখেরাতে অভিসম্পাত করেন।  


তিনি বলেন- রাসূলেপাক (ﷺ) এর পিতা জাহান্নামী এ কথা বলার চেয়ে অধিক কোন কষ্টদায়ক ব্যাপার নেই।    


অপর একটি মসলক  

=========

তাছাড়া কোন কোন উলামায়ে কেরাম পঞ্চম মত ব্যক্ত করেছেন। তা হলো এ ব্যাপারে চুপ থাকা।  


শেখ তাজ উদ্দিন ফাকিহানী الفجر المنير কিতাবে বলেছেন- নবীজীর পিতা-মাতার হাকিকত আল্লাহই ভাল জানেন।  


আল বাজী শরহে মুয়াত্তা গ্রন্থে বলেছেন- কোন কোন উলামা বলেছেন- কোন মুবাহ বা বৈধ কাজের মাধ্যমেও নবী করিম (ﷺ)কে কষ্ট দেয়া জায়েয নয়। তবে অন্যান্য লোকের বেলায় তা জায়েয। তাই এ কাজে বাঁধা দেয়া যাবে না। এতে মুবাহ আমলকারীর কোন গোনাহ হবে না। যদিও এর মাধ্যমে অন্যের কষ্ট হয়।  


এ জন্য নবী করিম (ﷺ) বলেছেন-  


اذا اراد على بن ابى طالب ان بتزوج ابنة ابى جهل انما فاطمة بضعة منى وانى لا احرم ما احل الله ولكن والله لا تجتمع ابنة رسول الله وابنة عدو الله عند رجل ابدا-  


অর্থ: যখন আলী বিন আবি তালিব আবু জেহেলর মেয়েকে বিবাহ করতে ইচ্ছা করলেন তখন নবীজী বললেন- নিশ্চয় ফাতিমা আমার কলিজার টুকরা। আল্লাহ যা হালাল করেছেন আমি তা হারাম করব না। তবে আল্লাহর কসম রাসূলুল্লাহর মেয়ে ও আল্লাহর দুশমনের মেয়ে কখনো কোন লোকের নিকট একত্রিত হতে পারবে না।  


অতএব এ ব্যাপারে হুকুম হলো মুবাহ কাজের মাধ্যমে ও নবী করিম (ﷺ)কে কষ্ট দেয়া জায়েয নাই। যেমন আল্লাহর বাণী ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ।’  


ইবনে আসাকির তদীয় তারিখ গ্রন্থে ইয়াহইয়া বিন আব্দুল মালিক বিন আবি গুনিয়ার সূত্রে বর্ণনা করেছেন-  


قال حدثنا نوفل بن الفرات- وكان عاملا لعمر بن عبد العزيز قال: كان رجل من كتاب الشام مأمونا عندهم- استعمل رجلا على كورة الشام وكان ابوه يزن بالمنانية- فبلغ ذلك عمربن عبد العزيز فقال ماحملك على ان تستعمل رجلا على كورة من كور المسلمين كان ابوه يزن بالمنانية؟ قال اصلح الله امير المؤمنين وما على كان ابو النبى صلى الله عليه وسلم مشركا- فقال عمرأه! ثم سكت ثم رفع رأسه فقال اقطع لسانه أأقطع يده ورجله؟ أأضرب عنقه؟ ثم قال لا تلى لى شيئا ما بقيت-  


অর্থ: তিনি বলেন- আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন নওফেল বিন ফুরাত। তিনি ছিলেন উমর বিন আব্দুল আযিয (رضي الله عنه) এর কর্মচারী। তিনি বলেন শ্যাম দেশের একজন লোক যিনি তাদের নিকট বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি সেখানে এমন একজন ব্যক্তিকে কর্মচারী নিযুক্ত করলেন যার পিতা ছিল একজন অগ্নিপূজক। এ খবরটি উমর বিন আব্দুল আযিযের নিকট পৌঁছল। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- তিনি কিভাবে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এমন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করলেন যার পিতা ছিল একজন অগ্নিপূজক? তখন সে ব্যক্তি বলল- আল্লাহ আমিরুল মো’মিনীনকে বিশুদ্ধ করুক। এতে আমার কি ত্রুটি হয়েছে। নবী (ﷺ) এর পিতাও মুশরিক ছিলেন। তখন উমর (رضي الله عنه) বললেন- আহ! অতঃপর নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। কিছুণ পর মাথা উত্তোলন করে বললেন- আমি কি তার জিহবা কেটে ফেলব?। আমি কি তার হাত পা কেটে ফেলব? আমি কি তার গর্দান উড়িয়ে দেব? অতঃপর বললেন- আমি তোমাকে এ পদে রাখার মত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।    


ইমাম সুয়ুতির কবিতা  

========

ইমাম সুয়ুতি বলেন- আমাকে অনুরোধ করা হয়েছে যেন উক্ত মাসআলার উপর কিছু কবিতা রচনা করি এবং এর মাধ্যমে আমার আলোচনা সমাপ্ত করি। তাই আমি লিখেছি।    


কবিতার অনুবাদ  

=======

নিশ্চয় যিনি নবী মুহাম্মদ (ﷺ)কে প্রেরণ করেছেন, তিনি তাঁর মাধ্যমে মানব ও জ্বীন জাতিকে পরিত্রান দিয়েছেন। তাঁর পিতা ও মাতা সম্পর্কে আহলে ইলমগণ তাদের কিতাবাদীতে সুস্পষ্ট বর্ণনা করে গেছেন। অতএব একটি জামাত তাদেরকে ঐ দলে রেখেছেন যাদের কাছে কোন আহবানকারীর সংবাদ পৌঁছেনি। সুতরাং যাদের নিকট কোন আহ্বানকারী আগমন করেনি তাদের হুকুম হলো তাদের কোন আযাব নাই। শাফেয়ী মাযহাবের সমস্ত উলামাগণ এ মতকে গ্রহণ করেছেন এবং আশআরীগণও এ মতকে সমর্থন করেছেন।  


সূরা ইসরার মধ্যে এ ব্যাপারে হুজ্জত বা দলিল রয়েছে। অনুরূপ হাদিসের মধ্যেও স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কোন কোন আহলে ফিকহগণ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন ইহা একটি অতীব সুক্ষ ও মৌলিক বিষয়। তাদের মধ্যে ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী অন্যতম। তিনি চমৎকার ভাষায় শ্রুতাদের জন্য ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর পিতৃপুরুষ প্রত্যেকেই ছিলেন ফিতরাতের উপর বিশ্বাসী। তাদের প থেকে কোন শত্রুতা বা কুফুরি প্রকাশ পায়নি। প্রাথমিক উলামাগণ বলেছেন নবী মোস্তফা (ﷺ) এর পূর্বপুরুষগণ সবাই তাওহীদের উপর বিশ্বাসী হানিফ সম্প্রদায় ছিলেন। আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ পর্যন্ত কেউ মুশরিক কিংবা নাস্তিক ছিলেন না।  


যেমন সূরা তাওবায় রয়েছে মুশরিকগণ হলেন অপবিত্র। অতএব তারা প্রত্যেকেই ছিলেন পবিত্রতার গুণে গুণান্বিত।  


সূরা শুরাতে রয়েছে- ‘তাকাল্লুবাকা ফিস সাজিদীন’ অতএব তারা প্রত্যেকেই ছিলেন হানিফ বা একনিষ্ট।  


ইহা হচ্ছে শেখ ফখরুদ্দিন (رضي الله عنه) এর বক্তব্য। তিনি তাঁর আসরার গ্রন্থে ইহা বর্ণনা করেছেন। তাঁর উপর রহমত বর্ষিত হোক। অবশেষে অধিপতি তাকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। তাকে যেন আল্লাহ জান্নাতুন নাঈম নসিব করেন।  


অতএব জাহিলিয়াতের যুগে এমন কিছু লোক বিদ্যমান ছিলেন, তারা সঠিক দ্বীন ও হিদায়তের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। যায়দ বিন আমর এবং ইবনুল নওফেল তাদের অন্যতম।  


এমনিভাবে আবু বকর সিদ্দিক। তিনিও কখনো শিরক করেননি। ইমাম সুবুকি তার বক্তব্যে এভাবে তাফসির করেছেন। আশআরীসহ অন্যান্য ইমামগণ ইহা গ্রহণ করেছেন। যখন সন্তুষ্টির চক্ষু সদা সর্বদা সিদ্দিকের প্রতি অবধারিত। এবং তিনি দীর্ঘ হায়াত পর্যন্ত সত্যনিষ্ট ছিলেন। তিনি হিদায়ত দানকারী নবী মুহাম্মদ (ﷺ) এর সোহবতে এসেছেন। সুতরাং জাহিলিয়াত যুগে তিনি ভ্রান্ত পথে ছিলেন না। এবং আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহা দেখেছিলেন অসংখ্য কুদরত যা বর্ণনাতীত। অন্য একটি জামাতের মত হলো রাসূল (ﷺ) এর পিতা মাতাকে পূণর্জীবন করা হয়েছে। অতঃপর তারা ঈমান আনয়ন করেছেন। ইবনে শাহীন এ ব্যাপারে সনদসহ একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। যদিও হাদিসটি জয়িফ পর্যায়ের।  


উল্লেখিত মসলকগুলি থেকে যে কোন একটি মসলক অনুসরণ করলেই যথেষ্ট। সুতরাং কিভাবে ইহা অস্বীকার করবে। যদি কেউ এ গুলোতে সন্তুষ্ট না হয় তবে তার জন্য চুপ থাকাটাই আদব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইনসাফ কোথায়? আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী মুহাম্মদ (ﷺ) এর প্রতি সালাত প্রেরণ করেন। তিনি সত্য ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।    


এ প্রসঙ্গে আরো একটি হাদিস  

========

ইমাম বায়হাকী শুয়াবুল ঈমান গ্রন্থে বলেছেন আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আবুল হোসাইন বিন বাশরান, তিনি আবু জাফর বাযযার থেকে, তিনি ইয়াহইয়া বিন জাফর থেকে, তিনি যায়দ বিন হাব্বাব থেকে, তিনি ইয়াসিন বিন মায়াজ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ বিন কাবিদ থেকে, তিনি তলক বিন আলী থেকে, তিনি বলেন আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন-  


لو ادركت والدى او احدهما وانا فى صلاة العشاء- وقد قرأت فيها بفاتحة الكتاب تنادى يا محمد لاجبتها لبيك-  


অর্থ: যদি আমার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেতাম এমতাবস্থায় আমি ইশার নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠে রত। তখন যদি হে মুহাম্মদ বলে ডাকতেন তাহলে আমি লাব্বাইক বলে জবাব দিতাম। ইমাম বায়হাকী বলেন- উক্ত হাদিসের সনদে ইয়াসিন বিন মায়ায জয়িফ।    


ফায়দা-১  

====

আযরুকী ‘তারিখে মক্কাহ’ গ্রন্থে বলেছেন- আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ বিন ইয়াহইয়া, তিনি আব্দুল আযিয বিন ইমরান থেকে, তিনি হিশাম বিন আসিম আল আসলামী থেকে তিনি বলেন- কুরাইশগণ যখন নবী করিম (ﷺ) এর বিরোদ্ধে উহুদ যুদ্ধে বের হল, তখন তারা আবওয়া নামক স্থানে অবস্থান করল। তখন হিন্দা বিনতে উতবা আবু সুফিয়ান বিন হারবকে বলল- যদি তোমরা মুহাম্মদ (ﷺ) এর জননী আমিনা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর কবর অন্বেষন করতে। কারণ ইহা আবওয়াতেই রয়েছে। তাহলে যদি তোমাদের কেউ বন্দি হয় তবে এর বিনিময়ে তোমরা তাকেসহ সমস্ত মানুষকে মুক্ত করতে পারবে। আবু সুফিয়ান ব্যাপারটি কুরাইশদেরকে বলল। তখন তারা বলল, আমাদের জন্য এ দরজাটি মুক্ত কর না। তাহলে বনু বকর গোত্র আমাদের মৃতদেরকে অন্বেষণ করবে।    


ফায়দা-২  

====

রাসূলেপাক (ﷺ) এর পিতা আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) এর কয়েকটি পঙ্ক্তি, যা সালাহ সাফদী তাঁর ‘তাযকিরাহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন-  


لقد حكم السارون فى كل بلدة – بأن لنا فضلا على سادة الارض  

وان ابى ذو المجد والسؤدد الذى- يشاربه ما بين نشز الى خفض  

وجد وأباء له اثلوا العلا - قديما بطيب العرق الحسب المحض  


অর্থ: সারুন সকল দেশে এ নির্দেশ প্রদান করলেন যে, পৃথিবীর বুকে সবার উপরে আমাদের মর্যাদা।  

আমার পিতা হচ্ছেন এমন সম্মানী ব্যক্তি, তিনি উঁচু নিচু সবার উপরে কর্তৃত্ব করেছেন।  

আমার দাদা ও পূর্বপুরুষদের রয়েছে সুউচ্চ মর্যাদা। প্রাচীনকাল থেকেই তারা পবিত্র ও বিশুদ্ধ বংশের অধিকারী।    


ফায়দা-৩  

====

ইমাম মুত্তাফিক উদ্দিন বিন কুদামাহ আল হাম্বলী المقنع গ্রন্থে বলেছেন-  

ومن قذف ام النبى صلى الله عليه وسلم قتل مسلما كان او كافرا  


অর্থ: যে ব্যক্তি নবী করিম (ﷺ) এর মায়ের প্রতি অপবাদ দিবে তাকে হত্যা করা হোক। হোক সে মুসলিম অথবা কাফির।

Top