❏ নূহ (عليه السلام)-এর কাহিনী

তিনি হলেন নূহ ইবন লামাক ইবন মুতাওশশালিখ ইবন খানুখ। আর খানুখ হলেন ইদ্রীস ইবন য়ারদ ইবন মাহলাইল ইবন কীনন ইবন আনুশ ইবন শীছ ইবন আবুল বাশার আদম (عليه السلام)। ইবন জারীর প্রমুখের বর্ণনা মতে, আদম (عليه السلام)-এর ওফাতের একশ’ ছাব্বিশ বছর পর তাঁর জন্ম। আহলি কিতাবদের প্রাচীন ইতিহাস মতে নূহ (عليه السلام)-এর জন্ম ও আদম (عليه السلام)-এর ওফাতের মধ্যে একশ’ ছেচল্লিশ বছরের ব্যবধান ছিল। দু’জনের মধ্যে ছিল দশ করন (যুগ)-এর ব্যবধান। যেমন হাফিজ আবূ হাতিম ইবন হিব্বান (رحمة الله) তাঁর সহীহ গ্রন্থে আবু উমামা (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আদম (عليه السلام) কি নবী ছিলেন?’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন ‘হ্যাঁ, আল্লাহ তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন।’ লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘তাঁর ও নূহ (عليه السلام)-এর মাঝে ব্যবধান ছিল কত কালের?’ রাসূলুরাহ্ (ﷺ) বললেন, ‘দশ যুগের।’ বর্ণনাকারী বলেন, এ হাদীসটি মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ। তবে তিনি তা রিওয়ায়াত করেননি। সহীহ বুখারীতে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আদম (عليه السلام) ও নূহ (عليه السلام)-এর মাঝখানে ব্যবধান ছিল দশ যুগের। তারা সকলেই ইসলামের অনুসারী ছিলেন।


এখন করন বা যুগ বলতে যদি একশ’ বছর বুঝানো হয়—যেমনটি সাধারণ্যে প্রচলিত তাহলে তাদের মধ্যকার ব্যবধান ছিল নিশ্চিত এক হাজার বছর। কিন্তু এক হাজার বছরের বেশি হওয়ার কথাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) তাঁকে ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। আর তাদের দু’জনের মধ্যবর্তী সময়ে এমন কিছু যুগও অতিবাহিত হয়ে থাকবে, যখন লোকজন ইসলামের অনুসারী ছিল না। কিন্তু আবু উমামার হাদীস দশ করন-এ সীমাবদ্ধ হওয়ার কথা প্রমাণ করে আর ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) একটু বাড়িয়ে বলেছেন, তাঁরা সকলে ইসলামের অনুসারী ছিলেন। এসব তথ্য আহলি কিতাবদের সে সব ঐতিহাসিক ও অন্যদের এ অনুমানকে বাতিল বলে প্রমাণ করে যে, কাবীল ও তার বংশধররা অগ্নিপূজা করতো। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।


আর যদি করন দ্বারা প্রজন্ম বুঝানো হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন,


(وَكَمۡ أَهۡلَكۡنَا مِنَ ٱلۡقُرُونِ مِنۢ بَعۡدِ نُوحࣲۗ


[Surat Al-Isra' ১৭]


“নূহের পর আমি কত প্রজন্মকে ধ্বংস করেছি।” (১৭:১৭)


(ثُمَّ أَنشَأۡنَا مِنۢ بَعۡدِهِمۡ قُرُونًا ءَاخَرِینَ)


[Surat Al-Mu’minun ৪২]


“তারপর তাদের পরে আমি বহু প্রজন্ম সৃষ্টি করেছি।” (২৩: ৪২)


(وَعَادࣰا وَثَمُودَا۟ وَأَصۡحَـٰبَ ٱلرَّسِّ وَقُرُونَۢا بَیۡنَ ذَ ٰ⁠لِكَ كَثِیرࣰا)


[Surat Al-Furqan ৩৮]


“তাদের অন্তবর্তীকালের বহু প্রজন্মকেও।” (২৫: ৩৮)


(وَكَمۡ أَهۡلَكۡنَا قَبۡلَهُم مِّن قَرۡنٍ هُمۡ أَحۡسَنُ أَثَـٰثࣰا وَرِءۡیࣰا)


[Surat Maryam ৭৪]


“তাদের পূর্বে কত প্রজন্মকে আমি বিনাশ করেছি।” (১৯: ৭৪)


আবার যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, خير القرون قرني উত্তম প্রজন্ম আমার প্রজন্ম।


এ-ই যদি হয়, তাহলে নূহ (عليه السلام)-এর পূর্বে বহু প্রজন্ম দীর্ঘকাল যাবত বসবাস করেছিল। এ হিসাবে আদম (عليه السلام) ও নূহ (عليه السلام)-এর মধ্যে ব্যবধান দাঁড়ায় কয়েক হাজার বছরের। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।


মোটকথা, যখন মূর্তি ও দেব-দেবীর পূজা শুরু হয় এবং মানুষ বিভ্রান্তি ও কুফরীতে নিমজ্জিত হতে শুরু করে, তখন মানুষের জন্য রহমতস্বরূপ আল্লাহ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-কে প্রেরণ করেন। অতএব, জগদ্বাসীর প্রতি প্রেরিত তিনিই সর্বপ্রথম রাসূল, যেমন কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে উপস্থিত লোকজন তাকে সম্বোধন করবে। আর ইবন জুবায়র (رحمة الله) প্রমুখের বর্ণনা মতে নূহ (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়কে বনূ রাসিব বলা হতো।


নবুওত লাভের সময় নূহ (عليه السلام)-এর বয়স কত ছিল, এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, তখন তার বয়স ছিল পঞ্চাশ বছর। কেউ বলেন, তিনশ’ পঞ্চাশ বছর। কারো কারো মতে, চারশ’ আশি বছর। এ বর্ণনাটি ইবন জারীরের এবং তৃতীয় অভিমতটি ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর বলে তিনি বর্ণনা করেছেন।


আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে নূহ (عليه السلام)-এর কাহিনী তাঁর সম্প্রদায়ের যারা তাকে অস্বীকার করেছিল প্লাবন দ্বারা তাদের প্রতি অবতীর্ণ শাস্তির কথা এবং কিভাবে তাঁকে ও নৌকার অধিবাসীদেরকে মুক্তি দান করেছেন তার বিবরণ উল্লেখ করেছেন। সূরা আরাফ, ইউনুস, হুদ, আম্বিয়া, মু’মিনূন, শুআরা, আনকাবুত, সাফফাত ও সূরা কমরে এসবের আলোচনা রয়েছে। তাছাড়া এ বিষয়ে সূরা নূহ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরাও অবতীর্ণ হয়েছে।


সূরা আ’রাফে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


لَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوۡمِهِۦ فَقَالَ یَـٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَـٰهٍ غَیۡرُهُۥۤ إِنِّیۤ أَخَافُ عَلَیۡكُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیمࣲ ۝ قَالَ ٱلۡمَلَأُ مِن قَوۡمِهِۦۤ إِنَّا لَنَرَىٰكَ فِی ضَلَـٰلࣲ مُّبِینࣲ ۝ قَالَ یَـٰقَوۡمِ لَیۡسَ بِی ضَلَـٰلَةࣱ وَلَـٰكِنِّی رَسُولࣱ مِّن رَّبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ أُبَلِّغُكُمۡ رِسَـٰلَـٰتِ رَبِّی وَأَنصَحُ لَكُمۡ وَأَعۡلَمُ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ۝ أَوَعَجِبۡتُمۡ أَن جَاۤءَكُمۡ ذِكۡرࣱ مِّن رَّبِّكُمۡ عَلَىٰ رَجُلࣲ مِّنكُمۡ لِیُنذِرَكُمۡ وَلِتَتَّقُوا۟ وَلَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ۝ فَكَذَّبُوهُ فَأَنجَیۡنَـٰهُ وَٱلَّذِینَ مَعَهُۥ فِی ٱلۡفُلۡكِ وَأَغۡرَقۡنَا ٱلَّذِینَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَاۤۚ إِنَّهُمۡ كَانُوا۟ قَوۡمًا عَمِینَ


[Surat Al-A'raf ৫৯ - ৬৪]


অর্থাৎ—আমি তো নূহকে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের নিকট এবং সে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন ইলাহ নেই। আমি তোমাদের জন্য মহাদিবসের শাস্তির আশংকা করছি। তার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলেছিল, আমরা তো তোমাকে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখতে পাচ্ছি।


সে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আমাতে কোন ভ্রান্তি নেই। আমি তো জগতসমূহের প্রতিপালকের রাসূল। আমার প্রতিপালকের বাণী আমি তোমাদের নিকট পৌছাচ্ছি ও তোমাদেরকে হিতোপদেশ দিচ্ছি এবং তোমরা যা জান না আমি তা আল্লাহর নিকট হতে জানি।


তোমরা কি বিস্মিত হচ্ছ যে, তোমাদেরই একজনের মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে তোমাদের কাছে উপদেশ এসেছে, যাতে সে তোমাদেরকে সতর্ক করে তোমরা সাবধান হও এবং তোমরা অনুকম্পা লাভ কর।


তারপর তারা তাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করে। তাকে ও তার সঙ্গে যারা নৌকায় ছিল আমি তাদেরকে উদ্ধার করি এবং যারা আমার নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদেরকে ডুবিয়ে দেই। তারা ছিল এক অন্ধ সম্প্রদায়। (৭: ৫৯-৬৪)


সূরা ইউনুসে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


( وَٱتۡلُ عَلَیۡهِمۡ نَبَأَ نُوحٍ إِذۡ قَالَ لِقَوۡمِهِۦ یَـٰقَوۡمِ إِن كَانَ كَبُرَ عَلَیۡكُم مَّقَامِی وَتَذۡكِیرِی بِـَٔایَـٰتِ ٱللَّهِ فَعَلَى ٱللَّهِ تَوَكَّلۡتُ فَأَجۡمِعُوۤا۟ أَمۡرَكُمۡ وَشُرَكَاۤءَكُمۡ ثُمَّ لَا یَكُنۡ أَمۡرُكُمۡ عَلَیۡكُمۡ غُمَّةࣰ ثُمَّ ٱقۡضُوۤا۟ إِلَیَّ وَلَا تُنظِرُونِ ۝ فَإِن تَوَلَّیۡتُمۡ فَمَا سَأَلۡتُكُم مِّنۡ أَجۡرٍۖ إِنۡ أَجۡرِیَ إِلَّا عَلَى ٱللَّهِۖ وَأُمِرۡتُ أَنۡ أَكُونَ مِنَ ٱلۡمُسۡلِمِینَ ۝ فَكَذَّبُوهُ فَنَجَّیۡنَـٰهُ وَمَن مَّعَهُۥ فِی ٱلۡفُلۡكِ وَجَعَلۡنَـٰهُمۡ خَلَـٰۤىِٕفَ وَأَغۡرَقۡنَا ٱلَّذِینَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَاۖ فَٱنظُرۡ كَیۡفَ كَانَ عَـٰقِبَةُ ٱلۡمُنذَرِینَ)[Surat Yunus ৭১ – ৭৩]


অর্থাৎ, তাদেরকে তুমি নূহ-এর বৃত্তান্ত শোনাও। সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আমার অবস্থিতি ও আল্লাহর নিদর্শন দ্বারা আমার উপদেশ দান তোমাদের নিকট যদি দুঃসহ হয় তবে আমি তো আল্লাহর উপর নির্ভর করি, তোমরা যাদেরকে শরীক করেছ সেগুলোর সঙ্গে তোমাদের কর্তব্য স্থির করে নাও, পরে যেন কর্তব্য বিষয়ে তোমাদের কোন সংশয় না থাকে। আমার সম্বন্ধে তোমাদের কর্ম নিম্পন্ন করে ফেল এবং আমাকে অবকাশ দিও না।


তারপর তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে নিতে পার, তোমাদের নিকট আমি তো কোন পারিশ্রমিক চাইনি, আমার পারিশ্রমিক আছে আল্লাহর নিকট। আমি তো আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে আদিষ্ট হয়েছি।


আর তারা তাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করে তারপর তাকে ও তার সঙ্গে যারা নৌকায় ছিল তাদেরকে আমি উদ্ধার করি এবং তাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করি ও যারা আমার নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদেরকে নিমজ্জিত করি। সুতরাং দেখ যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল তাদের পরিণাম কি হয়েছে? (১০: ৭১-৭৩)


সূরা হুদ-এ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوۡمِهِۦۤ إِنِّی لَكُمۡ نَذِیرࣱ مُّبِینٌ ۝ أَن لَّا تَعۡبُدُوۤا۟ إِلَّا ٱللَّهَۖ إِنِّیۤ أَخَافُ عَلَیۡكُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ أَلِیمࣲ ۝ فَقَالَ ٱلۡمَلَأُ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ مِن قَوۡمِهِۦ مَا نَرَىٰكَ إِلَّا بَشَرࣰا مِّثۡلَنَا وَمَا نَرَىٰكَ ٱتَّبَعَكَ إِلَّا ٱلَّذِینَ هُمۡ أَرَاذِلُنَا بَادِیَ ٱلرَّأۡیِ وَمَا نَرَىٰ لَكُمۡ عَلَیۡنَا مِن فَضۡلِۭ بَلۡ نَظُنُّكُمۡ كَـٰذِبِینَ ۝ قَالَ یَـٰقَوۡمِ أَرَءَیۡتُمۡ إِن كُنتُ عَلَىٰ بَیِّنَةࣲ مِّن رَّبِّی وَءَاتَىٰنِی رَحۡمَةࣰ مِّنۡ عِندِهِۦ فَعُمِّیَتۡ عَلَیۡكُمۡ أَنُلۡزِمُكُمُوهَا وَأَنتُمۡ لَهَا كَـٰرِهُونَ ۝ وَیَـٰقَوۡمِ لَاۤ أَسۡـَٔلُكُمۡ عَلَیۡهِ مَالًاۖ إِنۡ أَجۡرِیَ إِلَّا عَلَى ٱللَّهِۚ وَمَاۤ أَنَا۠ بِطَارِدِ ٱلَّذِینَ ءَامَنُوۤا۟ۚ إِنَّهُم مُّلَـٰقُوا۟ رَبِّهِمۡ وَلَـٰكِنِّیۤ أَرَىٰكُمۡ قَوۡمࣰا تَجۡهَلُونَ ۝ وَیَـٰقَوۡمِ مَن یَنصُرُنِی مِنَ ٱللَّهِ إِن طَرَدتُّهُمۡۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ۝ وَلَاۤ أَقُولُ لَكُمۡ عِندِی خَزَاۤىِٕنُ ٱللَّهِ وَلَاۤ أَعۡلَمُ ٱلۡغَیۡبَ وَلَاۤ أَقُولُ إِنِّی مَلَكࣱ وَلَاۤ أَقُولُ لِلَّذِینَ تَزۡدَرِیۤ أَعۡیُنُكُمۡ لَن یُؤۡتِیَهُمُ ٱللَّهُ خَیۡرًاۖ ٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِمَا فِیۤ أَنفُسِهِمۡ إِنِّیۤ إِذࣰا لَّمِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ ۝ قَالُوا۟ یَـٰنُوحُ قَدۡ جَـٰدَلۡتَنَا فَأَكۡثَرۡتَ جِدَ ٰ⁠لَنَا فَأۡتِنَا بِمَا تَعِدُنَاۤ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ ۝ قَالَ إِنَّمَا یَأۡتِیكُم بِهِ ٱللَّهُ إِن شَاۤءَ وَمَاۤ أَنتُم بِمُعۡجِزِینَ ۝ وَلَا یَنفَعُكُمۡ نُصۡحِیۤ إِنۡ أَرَدتُّ أَنۡ أَنصَحَ لَكُمۡ إِن كَانَ ٱللَّهُ یُرِیدُ أَن یُغۡوِیَكُمۡۚ هُوَ رَبُّكُمۡ وَإِلَیۡهِ تُرۡجَعُونَ ۝ أَمۡ یَقُولُونَ ٱفۡتَرَىٰهُۖ قُلۡ إِنِ ٱفۡتَرَیۡتُهُۥ فَعَلَیَّ إِجۡرَامِی وَأَنَا۠ بَرِیۤءࣱ مِّمَّا تُجۡرِمُونَ ۝ وَأُوحِیَ إِلَىٰ نُوحٍ أَنَّهُۥ لَن یُؤۡمِنَ مِن قَوۡمِكَ إِلَّا مَن قَدۡ ءَامَنَ فَلَا تَبۡتَىِٕسۡ بِمَا كَانُوا۟ یَفۡعَلُونَ ۝ وَٱصۡنَعِ ٱلۡفُلۡكَ بِأَعۡیُنِنَا وَوَحۡیِنَا وَلَا تُخَـٰطِبۡنِی فِی ٱلَّذِینَ ظَلَمُوۤا۟ إِنَّهُم مُّغۡرَقُونَ وَیَصۡنَعُ ٱلۡفُلۡكَ وَكُلَّمَا مَرَّ عَلَیۡهِ مَلَأࣱ مِّن قَوۡمِهِۦ سَخِرُوا۟ مِنۡهُۚ قَالَ إِن تَسۡخَرُوا۟ مِنَّا فَإِنَّا نَسۡخَرُ مِنكُمۡ كَمَا تَسۡخَرُونَ ۝ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَ مَن یَأۡتِیهِ عَذَابࣱ یُخۡزِیهِ وَیَحِلُّ عَلَیۡهِ عَذَابࣱ مُّقِیمٌ ۝ حَتَّىٰۤ إِذَا جَاۤءَ أَمۡرُنَا وَفَارَ ٱلتَّنُّورُ قُلۡنَا ٱحۡمِلۡ فِیهَا مِن كُلࣲّ زَوۡجَیۡنِ ٱثۡنَیۡنِ وَأَهۡلَكَ إِلَّا مَن سَبَقَ عَلَیۡهِ ٱلۡقَوۡلُ وَمَنۡ ءَامَنَۚ وَمَاۤ ءَامَنَ مَعَهُۥۤ إِلَّا قَلِیلࣱ ۝ ۞ وَقَالَ ٱرۡكَبُوا۟ فِیهَا بِسۡمِ ٱللَّهِ مَجۡرٜىٰهَا وَمُرۡسَىٰهَاۤۚ إِنَّ رَبِّی لَغَفُورࣱ رَّحِیمࣱ ۝ وَهِیَ تَجۡرِی بِهِمۡ فِی مَوۡجࣲ كَٱلۡجِبَالِ وَنَادَىٰ نُوحٌ ٱبۡنَهُۥ وَكَانَ فِی مَعۡزِلࣲ یَـٰبُنَیَّ ٱرۡكَب مَّعَنَا وَلَا تَكُن مَّعَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ ۝ قَالَ سَـَٔاوِیۤ إِلَىٰ جَبَلࣲ یَعۡصِمُنِی مِنَ ٱلۡمَاۤءِۚ قَالَ لَا عَاصِمَ ٱلۡیَوۡمَ مِنۡ أَمۡرِ ٱللَّهِ إِلَّا مَن رَّحِمَۚ وَحَالَ بَیۡنَهُمَا ٱلۡمَوۡجُ فَكَانَ مِنَ ٱلۡمُغۡرَقِینَ ۝ وَقِیلَ یَـٰۤأَرۡضُ ٱبۡلَعِی مَاۤءَكِ وَیَـٰسَمَاۤءُ أَقۡلِعِی وَغِیضَ ٱلۡمَاۤءُ وَقُضِیَ ٱلۡأَمۡرُ وَٱسۡتَوَتۡ عَلَى ٱلۡجُودِیِّۖ وَقِیلَ بُعۡدࣰا لِّلۡقَوۡمِ ٱلظَّـٰلِمِینَ ۝ وَنَادَىٰ نُوحࣱ رَّبَّهُۥ فَقَالَ رَبِّ إِنَّ ٱبۡنِی مِنۡ أَهۡلِی وَإِنَّ وَعۡدَكَ ٱلۡحَقُّ وَأَنتَ أَحۡكَمُ ٱلۡحَـٰكِمِینَ ۝ قَالَ یَـٰنُوحُ إِنَّهُۥ لَیۡسَ مِنۡ أَهۡلِكَۖ إِنَّهُۥ عَمَلٌ غَیۡرُ صَـٰلِحࣲۖ فَلَا تَسۡـَٔلۡنِ مَا لَیۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٌۖ إِنِّیۤ أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ ٱلۡجَـٰهِلِینَ ۝ قَالَ رَبِّ إِنِّیۤ أَعُوذُ بِكَ أَنۡ أَسۡـَٔلَكَ مَا لَیۡسَ لِی بِهِۦ عِلۡمࣱۖ وَإِلَّا تَغۡفِرۡ لِی وَتَرۡحَمۡنِیۤ أَكُن مِّنَ ٱلۡخَـٰسِرِینَ ۝ قِیلَ یَـٰنُوحُ ٱهۡبِطۡ بِسَلَـٰمࣲ مِّنَّا وَبَرَكَـٰتٍ عَلَیۡكَ وَعَلَىٰۤ أُمَمࣲ مِّمَّن مَّعَكَۚ وَأُمَمࣱ سَنُمَتِّعُهُمۡ ثُمَّ یَمَسُّهُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِیمࣱ ۝ تِلۡكَ مِنۡ أَنۢبَاۤءِ ٱلۡغَیۡبِ نُوحِیهَاۤ إِلَیۡكَۖ مَا كُنتَ تَعۡلَمُهَاۤ أَنتَ وَلَا قَوۡمُكَ مِن قَبۡلِ هَـٰذَاۖ فَٱصۡبِرۡۖ إِنَّ ٱلۡعَـٰقِبَةَ لِلۡمُتَّقِینَ[Surat Hud ২৫ - ৪৯]


অর্থাৎ-আমি তো নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, আমি তোমাদের জন্য প্রকাশ্য সতর্ককারী। যাতে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর ইবাদত না কর; আমি তোমাদের জন্য এক মর্মন্তুদ শাস্তির আশংকা করি।


তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা যারা ছিল কাফির-বলল, আমরা তো তোমাকে আমাদের মতই মানুষ দেখছি। অনুধাবন না করে তোমার অনুসরণ করছে তারাই, যারা আমাদের মধ্যে অধম এবং আমরা আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব দেখতে পাচ্ছি না, বরং আমরা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করি।


সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আমাকে বল, আমি যদি আমার প্রতিপালক প্রেরিত স্পষ্ট নিদর্শনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি এবং তিনি যদি আমাকে তার নিজ অনুগ্রহ দান করে থাকেন, অথচ এ বিষয়ে তোমরা জ্ঞানান্ধ হও, আমি কি এ বিষয়ে তোমাদেরকে বাধ্য করতে পারি, যখন তোমরা এটা অপছন্দ কর?


হে আমার সম্প্রদায়! এর পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন-সম্পদ যাজ্ঞা করি না। আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহরই নিকট এবং মুমিনদেরকে তাড়িয়ে দেয়া আমার কাজ নয়, তারা নিশ্চিতভাবে তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাৎ লাভ করবে। কিন্তু আমি দেখছি, তোমরা এক অজ্ঞ সম্প্রদায়।


হে আমার সম্প্রদায়! আমি যদি তাদের তাড়িয়ে দেই তবে আল্লাহর শাস্তি থেকে আমাকে কে রক্ষা করবে? তবুও কি তোমরা চিন্তা করবে না?


আমি তোমাদেরকে বলি না, আমার নিকট আল্লাহর ধন-ভাণ্ডার আছে, আর না অদৃশ্য সম্বন্ধে আমি অবগত এবং আমি এও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। তোমাদের দৃষ্টিতে যারা হেয় তাদের সম্বন্ধে আমি বলি না যে, আল্লাহ তাদেরকে কখনো মঙ্গল দান করবেন না, তাদের অন্তরে যা আছে, তা আল্লাহ সম্যক অবগত। তাহলে আমি অবশ্যই জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হব।


তারা বলল, হে নূহ! তুমি আমাদের সাথে বচসা করেছ—তুমি আমাদের সাথে অতিমাত্রায় বচসা করছ। তুমি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছি তা নিয়ে আস। সে বলল, ইচ্ছা করলে আল্লাহই তা তোমাদের নিকট উপস্থিত করবেন এবং তোমরা তা ব্যর্থ করতে পারবে না।


আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিতে চাইলেও আমার উপদেশ তোমাদের উপকারে আসবে, যদি আল্লাহ তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চান। তিনিই তোমাদের প্রতিপালক এবং তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তন করবে।


তারা কি বলে যে, সে তা রচনা করেছে? বল, আমি যদি তা রচনা করে থাকি তবে আমিই আমার অপরাধের জন্য দায়ী হব। তোমরা যে অপরাধ করছ তার জন্য আমি দায়ী নই।


নূহের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছিল, যারা ঈমান এনেছে তারা ছাড়া তোমার সম্প্রদায়ের অন্য কেউ কখনো ঈমান আনবে না। সুতরাং তারা যা করে সে জন্যে তুমি ক্ষোভ করো না।


তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার প্রত্যাদেশ অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ কর এবং যারা সীমালংঘন করেছে তাদের সম্পর্কে তুমি আমাকে কিছু বলো না, তারা তো নিমজ্জিত হবে।


সে নৌকা নির্মাণ করতে লাগল এবং যখনই তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা তার নিকট দিয়ে যেত, তাকে উপহাস করত; সে বলত, তোমরা যদি আমাকে উপহাস কর তবে আমরাও তোমাদেরকে উপহাস করব, যেমন তোমরা উপহাস করছ। এবং তোমরা অচিরেই জানতে পারবে, কার উপর আসবে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আর কার উপর আপতিত হবে স্থায়ী শাস্তি।


অবশেষে যখন আমার আদেশ আসল এবং উনুন উথলে উঠল, আমি বললামঃ এতে উঠিয়ে নাও প্রত্যেক শ্রেণীর যুগল, যাদের বিরুদ্ধে পূর্ব-সিদ্ধান্ত হয়েছে তারা ব্যতীত তোমার পরিবার-পরিজনকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে। তার সঙ্গে ঈমান এনেছিল গুটি কতেক লোক।


সে বলল, এতে আরোহণ কর, আল্লাহর নামে এর গতি ও স্থিতি। আমার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।


পর্বত-প্রমাণ ঢেউয়ের মধ্যে তা তাদের নিয়ে বয়ে চলল, নূহ তার পুত্র যে তাদের থেকে পৃথক ছিল, তাকে আহ্বান করে বলল, ‘হে আমার পুত্র! আমাদের সঙ্গে আরোহণ কর এবং কাফিরদের সঙ্গী হয়ো না।’


সে বলল, ‘আমি এমন এক পর্বতে আশ্রয় নিব যা আমাকে প্লাবন থেকে রক্ষা করবে।’ সে বলল, ‘আজ আল্লাহর বিধান থেকে রক্ষা করার কেউ নেই, যাকে আল্লাহ দয়া করবেন সে ব্যতীত।’ তারপর ঢেউ তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিল এবং সে নিমজ্জিতদের অন্তর্ভুক্ত হলো।


এরপর বলা হলো, হে পৃথিবী! তুমি তোমার পানি গ্রাস করে লও এবং হে আকাশ! ক্ষান্ত হও। তারপর বন্যা প্রশমিত হলো এবং কার্য সমাপ্ত হলো, নৌকা জুদী পর্বতের উপর স্থিত হলো এবং বলা হলো জালিম সম্প্রদায় ধ্বংস হোক।


নূহ তার প্রতিপালককে সম্বোধন করে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার পুত্র আমার পরিবারভুক্ত এবং আপনার প্রতিশ্রুতি সত্য এবং আপনি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক।’


তিনি বললেন, ‘হে নূহ! সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়। সে অসৎ কর্মপরায়ণ। সুতরাং যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করো না। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, তুমি যেন অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হও।’


সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে যাতে আপনাকে অনুরোধ না করি এ জন্য আমি আপনার শরণ নিচ্ছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমাকে দয়া না করেন তবে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’


বলা হলো, ‘হে নূহ! অবতরণ কর আমার দেয়া শান্তিসহ এবং তোমার প্রতি ও যে সমস্ত সম্প্রদায় তোমার সঙ্গে আছে তাদের প্রতি কল্যাণসহ। অপর সম্প্রদায় সমূহকে জীবন উপভোগ করতে দেব, পরে আমার পক্ষ থেকে মর্মন্তুদ শাস্তি তাদেরকে স্পর্শ করবে।


এ সমস্ত অদৃশ্য লোকের সংবাদ আমি তোমাকে ওহী দ্বারা অবহিত করছি, যা এর আগে তুমি জানতে না এবং তোমার সম্প্রদায়ও জানত না। সুতরাং ধৈর্যধারণ কর, শুভ পরিণাম মুত্তাকীদেরই জন্য।’ (১১: ২৫-৪৯)


সূরা আম্বিয়ায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَنُوحًا إِذۡ نَادَىٰ مِن قَبۡلُ فَٱسۡتَجَبۡنَا لَهُۥ فَنَجَّیۡنَـٰهُ وَأَهۡلَهُۥ مِنَ ٱلۡكَرۡبِ ٱلۡعَظِیمِ ۝ وَنَصَرۡنَـٰهُ مِنَ ٱلۡقَوۡمِ ٱلَّذِینَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَاۤۚ إِنَّهُمۡ كَانُوا۟ قَوۡمَ سَوۡءࣲ فَأَغۡرَقۡنَـٰهُمۡ أَجۡمَعِینَ)


[Surat Al-Anbiya' ৭৬ - ৭৭]


অর্থাৎ—স্মরণ কর নূহকে, পূর্বে সে যখন আহ্বান করেছিল, তখন আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে ও তার পরিজন বর্গকে মহান সংকট থেকে উদ্ধার করেছিলাম, এবং আমি তাকে সাহায্য করেছিলাম সে সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে, যারা আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করেছিল, তারা ছিল এক মন্দ সম্প্রদায়। এ জন্য আমি তাদের সকলকেই নিমজ্জিত করেছিলাম। (২১: ৭৬-৭৭)


সূরা মুমিনূনে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوۡمِهِۦ فَقَالَ یَـٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَـٰهٍ غَیۡرُهُۥۤۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ ۝ فَقَالَ ٱلۡمَلَؤُا۟ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ مِن قَوۡمِهِۦ مَا هَـٰذَاۤ إِلَّا بَشَرࣱ مِّثۡلُكُمۡ یُرِیدُ أَن یَتَفَضَّلَ عَلَیۡكُمۡ وَلَوۡ شَاۤءَ ٱللَّهُ لَأَنزَلَ مَلَـٰۤىِٕكَةࣰ مَّا سَمِعۡنَا بِهَـٰذَا فِیۤ ءَابَاۤىِٕنَا ٱلۡأَوَّلِینَ ۝ إِنۡ هُوَ إِلَّا رَجُلُۢ بِهِۦ جِنَّةࣱ فَتَرَبَّصُوا۟ بِهِۦ حَتَّىٰ حِینࣲ ۝ قَالَ رَبِّ ٱنصُرۡنِی بِمَا كَذَّبُونِ ۝ فَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَیۡهِ أَنِ ٱصۡنَعِ ٱلۡفُلۡكَ بِأَعۡیُنِنَا وَوَحۡیِنَا فَإِذَا جَاۤءَ أَمۡرُنَا وَفَارَ ٱلتَّنُّورُ فَٱسۡلُكۡ فِیهَا مِن كُلࣲّ زَوۡجَیۡنِ ٱثۡنَیۡنِ وَأَهۡلَكَ إِلَّا مَن سَبَقَ عَلَیۡهِ ٱلۡقَوۡلُ مِنۡهُمۡۖ وَلَا تُخَـٰطِبۡنِی فِی ٱلَّذِینَ ظَلَمُوۤا۟ إِنَّهُم مُّغۡرَقُونَ ۝ فَإِذَا ٱسۡتَوَیۡتَ أَنتَ وَمَن مَّعَكَ عَلَى ٱلۡفُلۡكِ فَقُلِ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ ٱلَّذِی نَجَّىٰنَا مِنَ ٱلۡقَوۡمِ ٱلظَّـٰلِمِینَ ۝ وَقُل رَّبِّ أَنزِلۡنِی مُنزَلࣰا مُّبَارَكࣰا وَأَنتَ خَیۡرُ ٱلۡمُنزِلِینَ)


[Surat Al-Mu'minun ২৩ - ২৯]


অর্থাৎ—আমি তো নূহকে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের নিকট। সে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না?


তার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ-যারা কুফরী করেছিল তারা বলল, ‘এতো তোমাদের মত একজন মানুষই তোমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে চাচ্ছে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে ফেরেশতাই পাঠাতেন, আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদের কালে এরূপ ঘটেছিল এমন কথা শুনিনি। এতো এমন লোক, একে উন্মত্ততা পেয়ে বসেছে। সুতরাং এর সম্পর্কে কিছুকাল অপেক্ষা কর।’


নূহ বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সাহায্য কর, কারণ তারা আমাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করছে। তারপর আমি তার প্রতি ওহী নাযিল করলাম, তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার ওহী অনুযায়ী নৌযান নির্মাণ কর, তারপর যখন আমার আদেশ আসবে ও উনুন উথলে উঠবে, তখন উঠিয়ে নিও প্রত্যেক জীবের এক এক জোড়া এবং তোমার পরিবার-পরিজনকে তাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে পূর্বে সিদ্ধান্ত হয়েছে তাদের ব্যতীত। জালিমদের সম্পর্কে তুমি আমাকে কিছু বলল না, তারা তো নিমজ্জিত হবে।


যখন তুমি ও তোমার সঙ্গীরা নৌযানে আসন গ্রহণ করবে তখন বলবেঃ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাদেরকে উদ্ধার করেছেন জালিম সম্প্রদায় থেকে।


আরো বলিও, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমনভাবে অবতরণ করাও যা হবে কল্যাণকর; আর তুমিই শ্রেষ্ঠ অবতারণকারী। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। আমি তো তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম।’ (২৩: ২৩-২৯)


সূরা শু’আরায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(كَذَّبَتۡ قَوۡمُ نُوحٍ ٱلۡمُرۡسَلِینَ ۝ إِذۡ قَالَ لَهُمۡ أَخُوهُمۡ نُوحٌ أَلَا تَتَّقُونَ ۝ إِنِّی لَكُمۡ رَسُولٌ أَمِینࣱ ۝ فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِیعُونِ ۝ وَمَاۤ أَسۡـَٔلُكُمۡ عَلَیۡهِ مِنۡ أَجۡرٍۖ إِنۡ أَجۡرِیَ إِلَّا عَلَىٰ رَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِیعُونِ ۝ ۞ قَالُوۤا۟ أَنُؤۡمِنُ لَكَ وَٱتَّبَعَكَ ٱلۡأَرۡذَلُونَ ۝ قَالَ وَمَا عِلۡمِی بِمَا كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ ۝ إِنۡ حِسَابُهُمۡ إِلَّا عَلَىٰ رَبِّیۖ لَوۡ تَشۡعُرُونَ ۝ وَمَاۤ أَنَا۠ بِطَارِدِ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ ۝ إِنۡ أَنَا۠ إِلَّا نَذِیرࣱ مُّبِینࣱ ۝ قَالُوا۟ لَىِٕن لَّمۡ تَنتَهِ یَـٰنُوحُ لَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡمَرۡجُومِینَ ۝ قَالَ رَبِّ إِنَّ قَوۡمِی كَذَّبُونِ ۝ فَٱفۡتَحۡ بَیۡنِی وَبَیۡنَهُمۡ فَتۡحࣰا وَنَجِّنِی وَمَن مَّعِیَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ ۝ فَأَنجَیۡنَـٰهُ وَمَن مَّعَهُۥ فِی ٱلۡفُلۡكِ ٱلۡمَشۡحُونِ ۝ ثُمَّ أَغۡرَقۡنَا بَعۡدُ ٱلۡبَاقِینَ ۝ إِنَّ فِی ذَ ٰ⁠لِكَ لَـَٔایَةࣰۖ وَمَا كَانَ أَكۡثَرُهُم مُّؤۡمِنِینَ ۝ وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ ٱلۡعَزِیزُ ٱلرَّحِیمُ)[Surat Ash-Shu'ara ১০৫ - ১২২]


অর্থাৎ—নূহের সম্প্রদায় রাসূলগণের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল। যখন তাদের ভাই নূহ তাদেরকে বলল, ‘তোমরা কি সাবধান হবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল! অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোন প্রতিদান চাই না; আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকটই আছে। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর।’


তারা বলল, ‘আমরা কি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব, অথচ ইতরজনরা তোমার অনুসরণ করছে?’


নূহ বলল, ‘তারা কী করত তা আমার জানা নেই। তাদের হিসাব গ্রহণ তো আমার প্রতিপালকেরই কাজ, যদি তোমরা বুঝতে। মুমিনদেরকে তাড়িয়ে দেয়া আমার কাজ নয়। আমি তো কেবল একজন স্পষ্ট সতর্ককারী।’ তারা বলল, ‘হে নূহ! তুমি যদি নিবৃত্ত না হও তবে নিশ্চয় তুমি প্রস্তরাঘাতে নিহতদের শামিল হবে।’


নূহ বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো আমাকে অস্বীকার করছে। সুতরাং আমার ও তাদের মধ্যে স্পষ্ট মীমাংসা করে দাও এবং আমাকে ও আমার সাথে যে সব মু’মিন আছে তাদেরকে রক্ষা কর।’


তারপর আমি তাকে ও তার সঙ্গে যারা ছিল তাদেরকে রক্ষা করলাম বোঝাই নৌযানে। তারপর অবশিষ্ট সকলকে নিমজ্জিত করলাম। এতে অবশ্যই রয়েছে নিদর্শন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী নয় এবং তোমার প্রতিপালক, তিনি তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (২৬: ১০৬-১২২)


সূরা আনকাবূতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوۡمِهِۦ فَلَبِثَ فِیهِمۡ أَلۡفَ سَنَةٍ إِلَّا خَمۡسِینَ عَامࣰا فَأَخَذَهُمُ ٱلطُّوفَانُ وَهُمۡ ظَـٰلِمُونَ ۝ فَأَنجَیۡنَـٰهُ وَأَصۡحَـٰبَ ٱلسَّفِینَةِ وَجَعَلۡنَـٰهَاۤ ءَایَةࣰ لِّلۡعَـٰلَمِینَ)


[Surat Al-Ankabut ১৪ - ১৫]


অর্থাৎ-আমি তো নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। সে তাদের মধ্যে অবস্থান করেছিল পঞ্চাশ বাদ এক হাজার বছর। তারপর প্লাবন তাদেরকে গ্রাস করে; কারণ তারা ছিল সীমালঙ্ঘনকারী। তারপর আমি তাকে এবং যারা নৌযানে আরোহণ করেছিল তাদেরকে রক্ষা করলাম এবং বিশ্বজগতের জন্য একে করলাম একটি নিদর্শন। (২৯ ও ১৪-১৫)


সূরা সাসফাতে মহান আল্লাহ বলেনঃ


(وَلَقَدۡ نَادَىٰنَا نُوحࣱ فَلَنِعۡمَ ٱلۡمُجِیبُونَ ۝ وَنَجَّیۡنَـٰهُ وَأَهۡلَهُۥ مِنَ ٱلۡكَرۡبِ ٱلۡعَظِیمِ ۝ وَجَعَلۡنَا ذُرِّیَّتَهُۥ هُمُ ٱلۡبَاقِینَ ۝ وَتَرَكۡنَا عَلَیۡهِ فِی ٱلۡـَٔاخِرِینَ ۝ سَلَـٰمٌ عَلَىٰ نُوحࣲ فِی ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ إِنَّا كَذَ ٰ⁠لِكَ نَجۡزِی ٱلۡمُحۡسِنِینَ ۝ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُؤۡمِنِینَ ۝ ثُمَّ أَغۡرَقۡنَا ٱلۡـَٔاخَرِینَ )


[Surat As-Saaffat ৭৫ - ৮২]


অর্থাৎ-নূহ আমাকে আহ্বান করেছিল, আর আমি কত উত্তম সাড়া দানকারী। তাকে এবং তার পরিবারবর্গকে আমি উদ্ধার করেছিলাম মহা সংকট থেকে এবং তার বংশধরদেরকে আমি বংশ পরম্পরায় বিদ্যমান রেখেছি। আমি এটা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে মূহের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবেই আমি সঙ্কর্ম পরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি। সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম। তারপর অবশিষ্ট সকলকে আমি নিমজ্জিত করেছিলাম। (৩৭ ও ৭৫-৮২)


সূরা কামারে আল্লাহ বলেনঃ


(۞ كَذَّبَتۡ قَبۡلَهُمۡ قَوۡمُ نُوحࣲ فَكَذَّبُوا۟ عَبۡدَنَا وَقَالُوا۟ مَجۡنُونࣱ وَٱزۡدُجِرَ ۝ فَدَعَا رَبَّهُۥۤ أَنِّی مَغۡلُوبࣱ فَٱنتَصِرۡ ۝ فَفَتَحۡنَاۤ أَبۡوَ ٰ⁠بَ ٱلسَّمَاۤءِ بِمَاۤءࣲ مُّنۡهَمِرࣲ ۝ وَفَجَّرۡنَا ٱلۡأَرۡضَ عُیُونࣰا فَٱلۡتَقَى ٱلۡمَاۤءُ عَلَىٰۤ أَمۡرࣲ قَدۡ قُدِرَ ۝ وَحَمَلۡنَـٰهُ عَلَىٰ ذَاتِ أَلۡوَ ٰ⁠حࣲ وَدُسُرࣲ ۝ تَجۡرِی بِأَعۡیُنِنَا جَزَاۤءࣰ لِّمَن كَانَ كُفِرَ ۝ وَلَقَد تَّرَكۡنَـٰهَاۤ ءَایَةࣰ فَهَلۡ مِن مُّدَّكِرࣲ ۝ فَكَیۡفَ كَانَ عَذَابِی وَنُذُرِ ۝ وَلَقَدۡ یَسَّرۡنَا ٱلۡقُرۡءَانَ لِلذِّكۡرِ فَهَلۡ مِن مُّدَّكِرࣲ)[Surat Al-Qamar ৯ - ১৭]


অর্থাৎ—এদের আগে নূহের সম্প্রদায়ও মিথ্যা আরোপ করেছিল। মিথ্যা আরোপ করেছিল আমার বান্দার প্রতি এবং বলেছিল, এতো এক পাগল। আর তাকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল। তখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল, আমি তো অসহায়, অতএব তুমি প্রতিবিধান কর। ফলে আমি আকাশের দ্বার উন্মুক্ত করে দিলাম প্রবল বারি বর্ষণে এবং মাটি হতে উৎসারিত করলাম প্রস্রবণ; তারপর সকল পানি মিলিত হলো এক পরিকল্পনা অনুসারে।


তখন আমি নূহকে আরোহণ করালাম কাঠ ও পেরেক নির্মিত এক নৌযানে, যা চলত আমার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে; এটা পুরস্কার তার জন্য যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। আমি একে রেখে দিয়েছি এক নিদর্শনরূপে, অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? কী কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী! কুরআন আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, কে আছে?(৫৪: ৯-১৭)


সূরা নূহ-এ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ إِنَّاۤ أَرۡسَلۡنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوۡمِهِۦۤ أَنۡ أَنذِرۡ قَوۡمَكَ مِن قَبۡلِ أَن یَأۡتِیَهُمۡ عَذَابٌ أَلِیمࣱ ۝ قَالَ یَـٰقَوۡمِ إِنِّی لَكُمۡ نَذِیرࣱ مُّبِینٌ ۝ أَنِ ٱعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ وَٱتَّقُوهُ وَأَطِیعُونِ ۝ یَغۡفِرۡ لَكُم مِّن ذُنُوبِكُمۡ وَیُؤَخِّرۡكُمۡ إِلَىٰۤ أَجَلࣲ مُّسَمًّىۚ إِنَّ أَجَلَ ٱللَّهِ إِذَا جَاۤءَ لَا یُؤَخَّرُۚ لَوۡ كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ۝ قَالَ رَبِّ إِنِّی دَعَوۡتُ قَوۡمِی لَیۡلࣰا وَنَهَارࣰا ۝ فَلَمۡ یَزِدۡهُمۡ دُعَاۤءِیۤ إِلَّا فِرَارࣰا ۝ وَإِنِّی كُلَّمَا دَعَوۡتُهُمۡ لِتَغۡفِرَ لَهُمۡ جَعَلُوۤا۟ أَصَـٰبِعَهُمۡ فِیۤ ءَاذَانِهِمۡ وَٱسۡتَغۡشَوۡا۟ ثِیَابَهُمۡ وَأَصَرُّوا۟ وَٱسۡتَكۡبَرُوا۟ ٱسۡتِكۡبَارࣰا ۝ ثُمَّ إِنِّی دَعَوۡتُهُمۡ جِهَارࣰا ۝ ثُمَّ إِنِّیۤ أَعۡلَنتُ لَهُمۡ وَأَسۡرَرۡتُ لَهُمۡ إِسۡرَارࣰا ۝ فَقُلۡتُ ٱسۡتَغۡفِرُوا۟ رَبَّكُمۡ إِنَّهُۥ كَانَ غَفَّارࣰا ۝ یُرۡسِلِ ٱلسَّمَاۤءَ عَلَیۡكُم مِّدۡرَارࣰا ۝ وَیُمۡدِدۡكُم بِأَمۡوَ ٰ⁠لࣲ وَبَنِینَ وَیَجۡعَل لَّكُمۡ جَنَّـٰتࣲ وَیَجۡعَل لَّكُمۡ أَنۡهَـٰرࣰا ۝ مَّا لَكُمۡ لَا تَرۡجُونَ لِلَّهِ وَقَارࣰا ۝ وَقَدۡ خَلَقَكُمۡ أَطۡوَارًا ۝ أَلَمۡ تَرَوۡا۟ كَیۡفَ خَلَقَ ٱللَّهُ سَبۡعَ سَمَـٰوَ ٰ⁠تࣲ طِبَاقࣰا ۝ وَجَعَلَ ٱلۡقَمَرَ فِیهِنَّ نُورࣰا وَجَعَلَ ٱلشَّمۡسَ سِرَاجࣰا ۝ وَٱللَّهُ أَنۢبَتَكُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ نَبَاتࣰا ۝ ثُمَّ یُعِیدُكُمۡ فِیهَا وَیُخۡرِجُكُمۡ إِخۡرَاجࣰا ۝ وَٱللَّهُ جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ بِسَاطࣰا ۝ لِّتَسۡلُكُوا۟ مِنۡهَا سُبُلࣰا فِجَاجࣰا ۝ قَالَ نُوحࣱ رَّبِّ إِنَّهُمۡ عَصَوۡنِی وَٱتَّبَعُوا۟ مَن لَّمۡ یَزِدۡهُ مَالُهُۥ وَوَلَدُهُۥۤ إِلَّا خَسَارࣰا ۝ وَمَكَرُوا۟ مَكۡرࣰا كُبَّارࣰا ۝ وَقَالُوا۟ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدࣰّا وَلَا سُوَاعࣰا وَلَا یَغُوثَ وَیَعُوقَ وَنَسۡرࣰا ۝ وَقَدۡ أَضَلُّوا۟ كَثِیرࣰاۖ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّـٰلِمِینَ إِلَّا ضَلَـٰلࣰا ۝ مِّمَّا خَطِیۤـَٔـٰتِهِمۡ أُغۡرِقُوا۟ فَأُدۡخِلُوا۟ نَارࣰا فَلَمۡ یَجِدُوا۟ لَهُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ أَنصَارࣰا ۝ وَقَالَ نُوحࣱ رَّبِّ لَا تَذَرۡ عَلَى ٱلۡأَرۡضِ مِنَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ دَیَّارًا ۝ إِنَّكَ إِن تَذَرۡهُمۡ یُضِلُّوا۟ عِبَادَكَ وَلَا یَلِدُوۤا۟ إِلَّا فَاجِرࣰا كَفَّارࣰا ۝ رَّبِّ ٱغۡفِرۡ لِی وَلِوَ ٰ⁠لِدَیَّ وَلِمَن دَخَلَ بَیۡتِیَ مُؤۡمِنࣰا وَلِلۡمُؤۡمِنِینَ وَٱلۡمُؤۡمِنَـٰتِۖ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّـٰلِمِینَ إِلَّا تَبَارَۢا)


[Surat Nuh ১ - ২৮]


অর্থাৎ-নূহকে আমি প্রেরণ করেছিলাম তার সম্প্রদায়ের প্রতি এ নির্দেশ দিয়ে—তুমি তোমার সম্প্রদায়কে সতর্ক কর তাদের প্রতি শাস্তি আসার পূর্বে।


সে বলেছিল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! আমি তো তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও তাঁকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর; তিনি তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে অবকা দেবেন এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত। নিশ্চয় আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত কাল উপস্থিত হলে তা বিলম্বিত হয় না, যদি তোমরা তা জানতে।’


সে বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি তো আমার সম্প্রদায়কে দিবা-রাত্রি আহ্বান করেছি, কিন্তু আমার আহ্বান তাদের পলায়ন প্রবণতাই বৃদ্ধি করেছে। আমি যখনই তাদেরকে আহ্বান করি যাতে তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর, তারা কানে আঙ্গুল দেয়, বস্ত্রাবৃত করে নিজেদেরকে ও জিদ করতে থাকে এবং অতিমাত্রায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। তারপর আমি তাদেরকে আহ্বান করেছি প্রকাশ্যে, পরে আমি সোচ্চার প্রচার করেছি ও উপদেশ দিয়েছি গোপনে।


আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, তিনি তো মহা ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন এবং তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা।


তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে চাচ্ছ না। অথচ তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে। তোমরা কি লক্ষ্য করনি? আল্লাহ কিভাবে সাত স্তরে বিন্যস্ত আকাশমণ্ডলী সৃষ্টি করেছেন এবং সেখানে চাঁদকে স্থাপন করেছেন আলোরূপে ও সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে।


তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে উদ্ধৃত করেছেন তারপর তাতে তিনি তোমাদেরকে প্রত্যাবৃত্ত করবেন ও পরে পুনরুপিত করবেন এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য ভূমিকে করেছেন বিস্তৃত যাতে তোমরা চলাফেরা করতে পার প্রশস্ত পথে।’


নূহ বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো আমাকে অমান্য করেছে এবং অনুসরণ করেছে এমন লোকের যার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তার ক্ষতি ব্যতীত আর কিছুই বৃদ্ধি করেনি।’


তারা ভয়ানক ষড়যন্ত্র করেছিল এবং বলেছিল, তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের দেব-দেবীকে, পরিত্যাগ করো না ওয়াদ, সূওয়া, আগূছ, য়াউক ও নাসরকে। তারা অনেককে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং জালিমদের বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কিছুই বৃদ্ধি করো না।


তাদের অপরাধের জন্য তাদেরকে নিমজ্জিত করা হয়েছিল এবং পরে তাদেরকে প্রবিষ্ট করা হয়েছিল আগুনে, পরে তারা কাউকেও আল্লাহর মুকাবিলায় সাহায্যকারী পায়নি।


নূহ আরো বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরদের মধ্য থেকে কোন ঘরের লোককে অব্যাহতি দিও না। তুমি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে তারা তোমার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে কেবল দুষ্কৃতকারী ও কাফির।


হে আমার প্রতিপালক! তুমি ক্ষমা কর আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং যারা মুমিন হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করে তাদেরকে এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে আর জালিমদের শুধু ধ্বংসই বৃদ্ধি কর।’ (৭১১-২৮)


তাফসীরে আমরা এর প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছি। পরে আমরা এ বিক্ষিপ্ত তথ্যাবলী একত্র করে এবং হাদীস ও রিওয়ায়াতসমূহের আলোকে কাহিনীর মূল বিষয়বস্তু একত্রে উল্লেখ করব। এ ছাড়া কুরআনের আরো বিভিন্ন স্থানে নূহ (عليه السلام)-এর আলোচনা এসেছে যাতে তাঁর প্রশংসা এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে।


যেমন সূরা নিসায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(۞ إِنَّاۤ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَیۡكَ كَمَاۤ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ نُوحࣲ وَٱلنَّبِیِّـۧنَ مِنۢ بَعۡدِهِۦۚ وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰۤ إِبۡرَ ٰ⁠هِیمَ وَإِسۡمَـٰعِیلَ وَإِسۡحَـٰقَ وَیَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطِ وَعِیسَىٰ وَأَیُّوبَ وَیُونُسَ وَهَـٰرُونَ وَسُلَیۡمَـٰنَۚ وَءَاتَیۡنَا دَاوُۥدَ زَبُورࣰا ۝ وَرُسُلࣰا قَدۡ قَصَصۡنَـٰهُمۡ عَلَیۡكَ مِن قَبۡلُ وَرُسُلࣰا لَّمۡ نَقۡصُصۡهُمۡ عَلَیۡكَۚ وَكَلَّمَ ٱللَّهُ مُوسَىٰ تَكۡلِیمࣰا ۝ رُّسُلࣰا مُّبَشِّرِینَ وَمُنذِرِینَ لِئَلَّا یَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى ٱللَّهِ حُجَّةُۢ بَعۡدَ ٱلرُّسُلِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِیزًا حَكِیمࣰا)


[Surat An-Nisa' ১৬৩ - ১৬৫]


অর্থাৎ—তোমার নিকট আমি ওহী প্রেরণ করেছি যেমন নূহ ও তার পরবর্তী নবীদের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তার বংশধরগণ, ঈসা, আয়ুব, ইউনুস, হারূন এবং সুলায়মানের নিকট ওহী প্রেরণ করেছিলাম এবং দাউদকে যাবুর দিয়েছিলাম।


অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের কথা পূর্বে তোমাকে বলেছি এবং অনেক রাসূল যাদের কথা তোমাকে বলিনি এবং মূসার সঙ্গে আল্লাহ সাক্ষাৎ বাক্যালাপ করেছিলেন। সুসংবাদবাহী ও সাবধানকারী রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি যাতে রাসূলগণ আসার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (৫: ১৬৩-১৬৫)


সূরা আনআমে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَتِلۡكَ حُجَّتُنَاۤ ءَاتَیۡنَـٰهَاۤ إِبۡرَ ٰ⁠هِیمَ عَلَىٰ قَوۡمِهِۦۚ نَرۡفَعُ دَرَجَـٰتࣲ مَّن نَّشَاۤءُۗ إِنَّ رَبَّكَ حَكِیمٌ عَلِیمࣱ ۝ وَوَهَبۡنَا لَهُۥۤ إِسۡحَـٰقَ وَیَعۡقُوبَۚ كُلًّا هَدَیۡنَاۚ وَنُوحًا هَدَیۡنَا مِن قَبۡلُۖ وَمِن ذُرِّیَّتِهِۦ دَاوُۥدَ وَسُلَیۡمَـٰنَ وَأَیُّوبَ وَیُوسُفَ وَمُوسَىٰ وَهَـٰرُونَۚ وَكَذَ ٰ⁠لِكَ نَجۡزِی ٱلۡمُحۡسِنِینَ ۝ وَزَكَرِیَّا وَیَحۡیَىٰ وَعِیسَىٰ وَإِلۡیَاسَۖ كُلࣱّ مِّنَ ٱلصَّـٰلِحِینَ ۝ وَإِسۡمَـٰعِیلَ وَٱلۡیَسَعَ وَیُونُسَ وَلُوطࣰاۚ وَكُلࣰّا فَضَّلۡنَا عَلَى ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ وَمِنۡ ءَابَاۤىِٕهِمۡ وَذُرِّیَّـٰتِهِمۡ وَإِخۡوَ ٰ⁠نِهِمۡۖ وَٱجۡتَبَیۡنَـٰهُمۡ وَهَدَیۡنَـٰهُمۡ إِلَىٰ صِرَ ٰ⁠طࣲ مُّسۡتَقِیمࣲ)


[Surat Al-An'am ৮৩ - ৮৭]


অর্থাৎ—এবং এটা আমার যুক্তি-প্রমাণ যা ইবরাহীমকে দিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের মুকাবিলায়; যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় আমি উন্নীত করি; তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, জ্ঞানী।


এবং তাকে দান করেছিলাম ইসহাক ও ইয়াকূব ও এদের প্রত্যেককে সৎপথে পরিচালিত করেছিলাম; পূর্বে নূহকেও সৎপথে পরিচালিত করেছিলাম এবং তার বংশধর দাউদ, সুলায়মান, আয়ুব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকেও; আর এভাবেই আমি সৎকর্ম পরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করি।


এবং যাকারিয়া, ইয়াহয়া, ঈসা এবং ইলিয়াসকেও সৎপথে পরিচালিত করেছিলাম, এরা সকলেই সজ্জনদের অন্তর্ভুক্ত। আরো সৎপথে পরিচালিত করেছিলাম ইসমাঈল, আল-য়াসা’আ, ইউনুস ও লূতকে এবং প্রত্যেককে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম বিশ্ব জগতের উপর এবং এদের পিতৃ-পুরুষ, বংশধর, এবং ভ্রাতৃবৃন্দের কতককে; তাদেরকে মনোনীত করেছিলাম এবং সরল পথে পরিচালিত করেছিলাম। (৬: ৮৩-৮৭)


সূরা তাওবায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(أَلَمۡ یَأۡتِهِمۡ نَبَأُ ٱلَّذِینَ مِن قَبۡلِهِمۡ قَوۡمِ نُوحࣲ وَعَادࣲ وَثَمُودَ وَقَوۡمِ إِبۡرَ ٰ⁠هِیمَ وَأَصۡحَـٰبِ مَدۡیَنَ وَٱلۡمُؤۡتَفِكَـٰتِۚ أَتَتۡهُمۡ رُسُلُهُم بِٱلۡبَیِّنَـٰتِۖ فَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِیَظۡلِمَهُمۡ وَلَـٰكِن كَانُوۤا۟ أَنفُسَهُمۡ یَظۡلِمُونَ)


[Surat At-Tawbah ৭০]


অর্থাৎ তাদের পূর্ববর্তী নূহ, আদ ও ছামূদের সম্প্রদায়, ইবরাহীমের সম্প্রদায় এবং মাদয়ান ও বিধ্বস্ত জনপদসমূহের অধিবাসীদের সংবাদ কি তাদের কাছে আসেনি? তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের রসূলগণ এসেছিল। আল্লাহ এমন নন যে, তাদের উপর জুলুম করেন, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করে। (৯: ৭০)


সূরা ইবরাহীমে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(أَلَمۡ یَأۡتِكُمۡ نَبَؤُا۟ ٱلَّذِینَ مِن قَبۡلِكُمۡ قَوۡمِ نُوحࣲ وَعَادࣲ وَثَمُودَ وَٱلَّذِینَ مِنۢ بَعۡدِهِمۡ لَا یَعۡلَمُهُمۡ إِلَّا ٱللَّهُۚ جَاۤءَتۡهُمۡ رُسُلُهُم بِٱلۡبَیِّنَـٰتِ فَرَدُّوۤا۟ أَیۡدِیَهُمۡ فِیۤ أَفۡوَ ٰ⁠هِهِمۡ وَقَالُوۤا۟ إِنَّا كَفَرۡنَا بِمَاۤ أُرۡسِلۡتُم بِهِۦ وَإِنَّا لَفِی شَكࣲّ مِّمَّا تَدۡعُونَنَاۤ إِلَیۡهِ مُرِیبࣲ)[Surat Ibrahim ৯]


অর্থাৎ—তোমাদের নিকট কি সংবাদ আসেনি তোমাদের পূর্ববর্তীদের, নূহের সম্প্রদায়ের, ‘আদের ও ছামূদের এবং তাদের পূর্ববর্তীদের? তাদের বিষয় আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের রাসূল এসেছিল, তারা তাদের হাত তাদের মুখে স্থাপন করত এবং বলত, ‘যা সহ তোমরা প্রেরিত হয়েছ তা আমরা প্রত্যাখ্যান করি এবং আমরা অবশ্যই বিভ্রান্তিকর সন্দেহ পোষণ করি সে বিষয়ে, যার প্রতি তোমরা আমাদেরকে আহবান করছ।’ (১৪: ৯)


সূরা ইসরায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(ذُرِّیَّةَ مَنۡ حَمَلۡنَا مَعَ نُوحٍۚ إِنَّهُۥ كَانَ عَبۡدࣰا شَكُورࣰا)


[Surat Al-Isra' ৩]


অর্থাৎ,  হে ঐ সব লোকের বংশধরগণ! যাদেরকে আমি নূহের সঙ্গে আরোহণ করিয়েছিলাম, সে তো ছিল পরম কৃতজ্ঞ বান্দা। (১৭: ৩)


(وَكَمۡ أَهۡلَكۡنَا مِنَ ٱلۡقُرُونِ مِنۢ بَعۡدِ نُوحࣲۗ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ بِذُنُوبِ عِبَادِهِۦ خَبِیرَۢا بَصِیرࣰا)


[Surat Al-Isra' ১৭]


অর্থাৎ-নূহের পর আমি কত মানব গোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছি। তোমার প্রতিপালকই তার বান্দাদের পাপাচরণের সংবাদ রাখা ও পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট। (১৭: ১৭)


সূরা আম্বিয়া, মুমিনূন, শুআরা ও আনকাব্যুতে তার ঘটনা পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে। সূরা আহযাবে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِنَ ٱلنَّبِیِّـۧنَ مِیثَـٰقَهُمۡ وَمِنكَ وَمِن نُّوحࣲ وَإِبۡرَ ٰ⁠هِیمَ وَمُوسَىٰ وَعِیسَى ٱبۡنِ مَرۡیَمَۖ وَأَخَذۡنَا مِنۡهُم مِّیثَـٰقًا غَلِیظࣰا) [Surat Al-Ahzab ৭]


অর্থাৎ—স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমার কাছ থেকেও এবং নূহ, ইবরাহীম , মূসা, মারয়ামের পুত্র ঈসার কাছ থেকে। তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার। (৩৩: ৭)


সূরা সাদে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(كَذَّبَتۡ قَبۡلَهُمۡ قَوۡمُ نُوحࣲ وَعَادࣱ وَفِرۡعَوۡنُ ذُو ٱلۡأَوۡتَادِ ۝ وَثَمُودُ وَقَوۡمُ لُوطࣲ وَأَصۡحَـٰبُ لۡـَٔیۡكَةِۚ أُو۟لَـٰۤىِٕكَ ٱلۡأَحۡزَابُ ۝ إِن كُلٌّ إِلَّا كَذَّبَ ٱلرُّسُلَ فَحَقَّ عِقَابِ)[Surat Sad ১২ - ১৪]


অর্থাৎ—এদের পূর্বেও রাসূলদেরকে মিথ্যাবাদী বলেছিল নূহের সম্প্রদায়, আদ ও বহু শিবিরের অধিপতি ফিরআউন। ছামূদ, লূত ও আয়কার অধিবাসী, তারা ছিল এক একটি বিশাল বাহিনী। এদের প্রত্যেকেই রাসূলগণকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছিল। ফলে তাদের ক্ষেত্রে আমার শাস্তি হয়েছে বাস্তব। (৩৮: ১২-১৪)


সূরা গাফির তথা সূরা মুমিনে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(كَذَّبَتۡ قَبۡلَهُمۡ قَوۡمُ نُوحࣲ وَٱلۡأَحۡزَابُ مِنۢ بَعۡدِهِمۡۖ وَهَمَّتۡ كُلُّ أُمَّةِۭ بِرَسُولِهِمۡ لِیَأۡخُذُوهُۖ وَجَـٰدَلُوا۟ بِٱلۡبَـٰطِلِ لِیُدۡحِضُوا۟ بِهِ ٱلۡحَقَّ فَأَخَذۡتُهُمۡۖ فَكَیۡفَ كَانَ عِقَابِ ۝ وَكَذَ ٰ⁠لِكَ حَقَّتۡ كَلِمَتُ رَبِّكَ عَلَى ٱلَّذِینَ كَفَرُوۤا۟ أَنَّهُمۡ أَصۡحَـٰبُ ٱلنَّارِ)[Surat Ghafir ৫ - ৬]


অর্থাৎ-এদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায় এবং তাদের পরে অন্যান্য দলও মিথ্যা আরোপ করেছিল। প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ রাসূলকে পাকড়াও করার অভিসন্ধি করেছিল এবং তারা অসার তর্কে লিপ্ত হয়েছিল, সত্যকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য। ফলে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম এবং কত কঠোর ছিল আমার শাস্তি! এভাবে কাফিরদের ক্ষেত্রে সত্য হলো তোমার প্রতিপালকের বাণী—এরা জাহান্নামী। (৪০: ৫-৬)


সূরা শূরায় মহান আল্লাহ বলেনঃ


(۞ شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّینِ مَا وَصَّىٰ بِهِۦ نُوحࣰا وَٱلَّذِیۤ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَیۡكَ وَمَا وَصَّیۡنَا بِهِۦۤ إِبۡرَ ٰ⁠هِیمَ وَمُوسَىٰ وَعِیسَىٰۤۖ أَنۡ أَقِیمُوا۟ ٱلدِّینَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا۟ فِیهِۚ كَبُرَ عَلَى ٱلۡمُشۡرِكِینَ مَا تَدۡعُوهُمۡ إِلَیۡهِۚ ٱللَّهُ یَجۡتَبِیۤ إِلَیۡهِ مَن یَشَاۤءُ وَیَهۡدِیۤ إِلَیۡهِ مَن یُنِیبُ) [Surat Ash-Shura ১৩]


অর্থাৎ—তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে আর যা ওহী করেছি আমি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এ বলে যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি করো না। তুমি মুশরিকদেরকে যার প্রতি আহবান করছ তা তাদের নিকট দুর্বল মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দীনের প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং যে তার অভিমুখী তাকে দীনের দিকে পরিচালিত করেন। (৪২: ১৩)


সূরা কাফে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(كَذَّبَتۡ قَبۡلَهُمۡ قَوۡمُ نُوحࣲ وَأَصۡحَـٰبُ ٱلرَّسِّ وَثَمُودُ ۝ وَعَادࣱ وَفِرۡعَوۡنُ وَإِخۡوَ ٰ⁠نُ لُوطࣲ ۝ وَأَصۡحَـٰبُ ٱلۡأَیۡكَةِ وَقَوۡمُ تُبَّعࣲۚ كُلࣱّ كَذَّبَ ٱلرُّسُلَ فَحَقَّ وَعِیدِ)[Surat Qaf ১২ - ১৪]


অর্থাৎ—এদের পূর্বেও সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল নূহের সম্প্রদায়, রাসস ও ছামূদ সম্প্রদায়, আদ, ফিরআউন ও লূত সম্প্রদায় এবং আয়কার অধিবাসী ও তুব্বা সম্প্রদায়, তারা সকলেই রাসূলগণকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছিল। ফলে তাদের উপর আমার শান্তি আপতিত হয়। (৫০: ১২-১৪)


সূরা যারিয়াতে আল্লাহ বলেনঃ


(وَقَوۡمَ نُوحࣲ مِّن قَبۡلُۖ إِنَّهُمۡ كَانُوا۟ قَوۡمࣰا فَـٰسِقِینَ)


[Surat Adh-Dhariyat ৪৬]


অর্থাৎ—আমি ধ্বংস করেছিলাম এদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়কে, তারা ছিল সত্যত্যাগী সম্প্রদায়। (৫১: ৪৬)


সূরা নাজমে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَقَوۡمَ نُوحࣲ مِّن قَبۡلُۖ إِنَّهُمۡ كَانُوا۟ هُمۡ أَظۡلَمَ وَأَطۡغَىٰ)


[Surat An-Najm ৫২]


অর্থাৎ—আর এদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়কেও (আমি ধ্বংস করেছিলাম) তারা ছিল অতিশয় জালিম, অবাধ্য। (৫৩: ৫২) সূরা কামারে (৫০) তাঁর ঘটনা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।


সূরা হাদীদে মহান আল্লাহ বলেনঃ


(وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا نُوحࣰا وَإِبۡرَ ٰ⁠هِیمَ وَجَعَلۡنَا فِی ذُرِّیَّتِهِمَا ٱلنُّبُوَّةَ وَٱلۡكِتَـٰبَۖ فَمِنۡهُم مُّهۡتَدࣲۖ وَكَثِیرࣱ مِّنۡهُمۡ فَـٰسِقُونَ)


[Surat Al-Hadid ২৬]


অর্থাৎ—আমি নূহ এবং ইবরাহীমকে রাসূলরূপে প্রেরণ করেছিলাম এবং আমি তাদের বংশধরগণের জন্য স্থির করেছিলাম নবুওত ও কিতাব কিন্তু তাদের অল্প কিছু লোক সৎপথ অবলম্বন করেছিল এবং অধিকাংশই ছিল সত্যত্যাগী। (৫৭ : ২৬)


সূরা তাহরীমে মহান আল্লাহ্ বলেনঃ


(ضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلࣰا لِّلَّذِینَ كَفَرُوا۟ ٱمۡرَأَتَ نُوحࣲ وَٱمۡرَأَتَ لُوطࣲۖ كَانَتَا تَحۡتَ عَبۡدَیۡنِ مِنۡ عِبَادِنَا صَـٰلِحَیۡنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمۡ یُغۡنِیَا عَنۡهُمَا مِنَ ٱللَّهِ شَیۡـࣰٔا وَقِیلَ ٱدۡخُلَا ٱلنَّارَ مَعَ ٱلدَّ ٰ⁠خِلِینَ)


[Surat At-Tahrim ১০]


অর্থাৎ-আল্লাহ কাফিরদের জন্য নূহ ও লুতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছেন, তারা ছিল আমার বান্দাদের মধ্যে দুই সৎকর্মপরায়ণ বান্দার অধীন। কিন্তু তারা তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল; ফলে নূহ ও লূত তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারল না এবং তাদেরকে বলা হলো, জাহান্নামে প্রবেশকারীদের সঙ্গে তোমরাও তাতে প্রবেশ কর। (৬৬: ১০)


কুরআন, হাদীস ও বিভিন্ন রিওয়ায়াতের তথ্য মোতাবেক আপন সম্প্রদায়ের সঙ্গে নূহ (عليه السلام)-এর যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছিল তার সারমর্ম উল্লেখ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারী (رحمة الله) কর্তৃক বর্ণিত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর হাদীসে পূর্বেই আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, আদম (عليه السلام) ও নূহ (عليه السلام)-এর মধ্যে ব্যবধান ছিল দশ করন। তারা সকলেই ইসলামের অনুসারী ছিলেন। আর আমরা এও উল্লেখ করেছি যে, করন বলতে হয় তো প্রজন্ম কিংবা যুগ বুঝানো হয়েছে। তারপর এ সকর্মশীলদের করনসমূহের পর এমন কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়; যার ফলে সে যুগের অধিবাসীরা মূর্তিপূজার দিকে ঝুঁকে পড়ে। وقالوا لاتذرن الح -এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে ইমাম বুখারী (رحمة الله) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী তাঁর করন ছিল এই যে, (ওয়াদ, সূওয়া, আগূছ ইত্যাদি) এসব হলো নূহ (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের কয়েকজন পুণ্যবান ব্যক্তির নাম। এদের মৃত্যর পর শয়তান তাদের সম্প্রদায়ের প্রতি মন্ত্রণা দেয় যে, এঁরা যে সব স্থানে বসতেন তোমরা সে সব স্থানে কিছু মূর্তি নির্মাণ করে তাদের নামে সে সবের নামকরণ করে দাও। তখন তারা তাই করে। কিন্তু তখনও এগুলোর পূজা শুরু হয়নি। তারপর যখন তাদের মৃত্যু হয় এবং ইলম লোপ পায় তখন থেকে এ সবের পূজা শুরু হয়। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, নূহ (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের এ দেব-দেবীগুলো পরে আরবেও প্রচলিত হয়ে পড়ে। ইকরিমা, যাহহাক, কাতাদা এবং মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله)-ও অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন। ইবন জারীর (رحمة الله) আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে মুহাম্মদ ইবন কায়স (رحمة الله)-এর বরাতে বলেন, তারা ছিলেন আদম (عليه السلام) ও নূহ (عليه السلام)-এর মধ্যবর্তী কালের পুণ্যবান ব্যক্তিবর্গ। তাদের বেশ কিছু অনুসারী ছিল। তারপর যখন তাদের মৃত্যু হয়, তখন তাদের অনুসারীরা বলল, আমরা যদি এঁদের প্রতিকৃতি তৈরী করে রাখি, তাহলে তাঁদের কথা স্মরণ করে ইবাদতে আমাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। তখন তারা তাদের প্রতিকৃতি নির্মাণ করে রাখে। তারপর যখন তাদের মৃত্যু হয় এবং অন্য প্রজন্ম আসে; তখন শয়তান তাদের প্রতি এ বলে প্ররোচণা দেয় যে, লোকজন তাদের উপাসনা করত এবং তাঁদের ওসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করত। তখন তারা তাদের পূজা শুরু করে দেয়। ইবন আবু হাতিম উরওয়া ইবন যুবায়র সূত্রে বর্ণনা করেন যে, উরওয়া ইবন যুবায়র বলেন, ওয়াদ আগূছ, য়াউক, সূওয়া ও নাসর আদম (عليه السلام)-এর সন্তান। ওয়াদ ছিলেন এদের বয়সে সকলের চাইতে প্রবীণ এবং সর্বাধিক পুণ্যবান ব্যক্তি।


ইব্‌ন আবূ হাতিম বর্ণনা করেন যে, আবুল মুতাহার বলেন, একদা আবু জাফর আল বাকির সালাতরত অবস্থায় ছিলেন। তখন লোকজন য়াযীদ ইবন মুহাল্লাবের কথা আলোচনা করছিল। সালাত শেষে তিনি বললেন, ‘তোমরা য়াযীদ ইবন মুহাল্লাবের কথা বলছ। সে এমন স্থানে নিহত হয়, যেখানে সর্বপ্রথম গায়রুল্লাহর পূজা হয়েছিল।’ আবুল মুতাহার বলেন, তারপর তিনি ওয়াদ সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি একজন পুণ্যবান এবং জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। মৃত্যুর পর বাবেলে জনতা তাঁর কবরের চতুপার্শ্বে সমবেত হয়ে শোক প্রকাশ করতে শুরু করে। ইবলীস তা দেখে মানুষের রূপ ধরে তাদের কাছে এসে বলল, এ ব্যক্তির জন্য তোমাদের হা-হুঁতাশ আমি লক্ষ্য করছি। আমি কি তোমাদের জন্য তাঁর অনুরূপ প্রতিকৃতি তৈরি করে দেব? তা তোমাদের মজলিসে থাকবে আর তোমরা তাকে স্মরণ করবে। তারা বলল, হ্যাঁ, দিন। ইবলীস তাদেরকে তার অনুরূপ প্রতিকৃতি তৈরি করে দিল। বর্ণনাকারী বলেন, আর তারা তা তাদের মজলিসে স্থাপন করে তাকে স্মরণ করতে শুরু করে। ইবলীস তাদেরকে তাকে স্মরণ করতে দেখে এবার বলল, আচ্ছা, আমি তোমাদের প্রত্যেকের ঘরে এর একটি করে মূর্তি স্থাপন করে দেই? তাহলে নিজের ঘরে বসেই তোমরা তাকে স্মরণ করতে পারবে। তারা বলল, ‘হ্যাঁ, দিন!’ বর্ণনাকারী বলেন, তখন ইবলীস প্রত্যেক গৃহবাসীর জন্য তাঁর একটি করে মূর্তি নির্মাণ করে দেয় আর তারা তা দেখে দেখে তাকে স্মরণ করতে শুরু করে। বর্ণনাকারী বলেন, এভাবে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে দেবতা সাব্যস্ত করে আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাঁকে পূজা করতে শুরু করে। এ ওয়াদই সেই দেবতা; আল্লাহর পরিবর্তে সর্বপ্রথম যার পূজা করা হয়।


উপরোক্ত বক্তব্য প্রমাণ করে যে, এর প্রতিটি মূর্তিকেই কোন না কোন মানব গোষ্ঠী পূজা করেছিল। তাছাড়া বর্ণিত আছে যে, কালক্রমে তারা সে প্রতিকৃতিগুলোকে দেহবিশিষ্ট মূর্তিতে পরিণত করে। তারপর আল্লাহর পরিবর্তে তাদেরই উপাসনা শুরু হয়ে যায়। এসবের উপাসনার অসংখ্য পদ্ধতি ছিল। তাফসীরের কিতাবে যথাস্থানে আমরা তা উল্লেখ করেছি। সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য।


সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে যে, উম্মে সালামা ও উম্মে হাবীবা (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে তাদের হাবশায় দেখে আসা মারিয়া নামক গির্জা এবং তার রূপ-সৌন্দর্য ও তাতে স্থাপন করে রাখা প্রতিকৃতির কথা উল্লেখ করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ “তাদের নিয়ম ছিল তাদের মধ্যে সকর্মপরায়ণ কেউ মারা গেলে তার কবরের উপর তারা একটি উপাসনালয় নির্মাণ করত। তারপর তাতে তার প্রতিকৃতি স্থাপন করে রাখত। আল্লাহর নিকট তারা সৃষ্টির সব চাইতে নিকৃষ্ট জাতি।”


মোটকথা, বিকৃতি যখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রসার ঘটে তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দা ও রসূল নূহ (عليه السلام)-কে প্রেরণ করেন। তিনি এক লা-শরীক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহবান জানান এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের উপাসনা করতে নিষেধ করেন। এ নূহ (عليه السلام)-ই সর্বপ্রথম রাসূল যাকে আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীবাসীর কাছে প্রেরণ করেন। যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিমে নবী করীম (ﷺ) থেকে আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণিত শাফা’আতের হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “তারা আদম (عليه السلام)-এর কাছে এসে বলবে, ‘হে আদম! আপনি মানব জাতির পিতা। আলাহ তা’আলা আপনাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, আপনার মধ্যে তার রূহ সঞ্চার করেছেন, তার আদেশে ফেরেশতারা আপনাকে সিজদা করে এবং তিনি আপনাকে জান্নাতে বসবাস করতে দেন। আপনার রবের কাছে আপনি আমাদের জন্য একটু সুপারিশ করবেন কি? আমাদের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন।’ তখন আদম (عليه السلام) বলবেন, ‘আমার প্রতিপালক এত বেশি রাগান্বিত হয়েছেন যে, এত বেশি রাগান্বিত তিনি কখনো হননি এবং পরেও কখনো হবেন না। তিনি আমাকে বৃক্ষের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু আমি তা অমান্য করি। নাফসী! নাফসী! তোমরা অন্য কারো কাছে যাও, তোমরা নূহের কাছে যাও।’ তখন তারা নূহ (عليه السلام)-এর নিকট গিয়ে বলবে, ‘হে নূহ! আপনি পৃথিবীবাসীর কাছে প্রেরিত প্রথম রাসূল এবং আল্লাহ আপনাকে কৃতজ্ঞ বান্দা আখ্যা দিয়েছেন। আমরা কী অবস্থায় এবং কেমন বিপদে আছি তা কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? আপনি আপনার প্রতিপালকের নিকট আমাদের জন্য একটু সুপারিশ করবেন কি?’ তখন তিনি বলবেন, ‘আমার রব আজ এত বেশি রাগান্বিত হয়েছেন যে, এত রাগ ইতিপূর্বে তিনি কখনো করেননি এবং পরেও করবেন না। নাফসী! নাফসী!’ বর্ণনাকারী এভাবে হাদীসটি সবিস্তারে বর্ণনা করেন যেমনটি ইমাম বুখারী (رحمة الله) নূহ (عليه السلام)-এর কাহিনীতে তা উল্লেখ করেছেন।


যা হোক, আল্লাহ তাআলা নূহ (عليه السلام)-কে প্রেরণ করলে তিনি সম্প্রদায়-কে একমাত্র লা-শরীক আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাঁর সঙ্গে কোন প্রতিকৃতি, মূর্তি ও তাগূতের ইবাদত না করার এবং তাঁর একত্ব স্বীকার করে নেয়ার আহ্বান জানান এবং ঘোষণা দেন যে, তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, কোন রব নেই। যেমন, আল্লাহ তা’আলা তার পরবর্তী সকল নবী-রাসূলকে এ আদেশ দান করেন, যারা সকলেই তারই বংশধর ছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,


(وَجَعَلۡنَا ذُرِّیَّتَهُۥ هُمُ ٱلۡبَاقِینَ)


[Surat As-Saaffat ৭৭]


“আর তার বংশধরদেরকেই আমি বংশ পরম্পরায় বিদ্যমান রেখেছি।” (৩৭: ৭৭) হযরত নূহ (عليه السلام) ও ইবরাহীম (عليه السلام) সম্পর্কে বলেনঃ


(وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا نُوحࣰا وَإِبۡرَ ٰ⁠هِیمَ وَجَعَلۡنَا فِی ذُرِّیَّتِهِمَا ٱلنُّبُوَّةَ وَٱلۡكِتَـٰبَۖ فَمِنۡهُم مُّهۡتَدࣲۖ وَكَثِیرࣱ مِّنۡهُمۡ فَـٰسِقُونَ)[Surat Al-Hadid ২৬]


“এবং তার বংশধরদের মধ্যে আমি নবুওত ও কিতাব রেখেছি।” (৫৭ : ২৬) অর্থাৎ নূহ (عليه السلام)-এর পরে যত নবী এসেছিলেন, তাঁরা সকলেই তাঁর বংশধর ছিলেন। এমনকি ইবরাহীম (عليه السلام)-ও।


সূরা নাহলে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِی كُلِّ أُمَّةࣲ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُوا۟ ٱلطَّـٰغُوتَۖ )


[Surat An-Nahl ৩৬]


অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগূতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। (১৬: ৩৬)।


অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَسۡـَٔلۡ مَنۡ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رُّسُلِنَاۤ أَجَعَلۡنَا مِن دُونِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ءَالِهَةࣰ یُعۡبَدُونَ)


[Surat Az-Zukhruf ৪৫]


অর্থাৎ—তোমার পূর্বে আমি যেসব রাসূল প্রেরণ করেছিলাম, তাদেরকে তুমি জিজ্ঞেস কর, আমি কি দয়াময় আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য সাব্যস্ত করেছিলাম, যাদের ইবাদত করা যায়? (৪৩: ৪৫)


অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ


(وَمَاۤ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِیۤ إِلَیۡهِ أَنَّهُۥ لَاۤ إِلَـٰهَ إِلَّاۤ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ)


[Surat Al-Anbiya' ২৫]


অর্থাৎ—আমি তোমার পূর্বে এমন রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এ ওহী ব্যতীত যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর। (২১: ২৫)


এ কারণেই নূহ (عليه السلام) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেনঃ


(لَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوۡمِهِۦ فَقَالَ یَـٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَـٰهٍ غَیۡرُهُۥۤ إِنِّیۤ أَخَافُ عَلَیۡكُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیمࣲ)[Surat Al-A'raf ৫৯]


অর্থাৎ—(হে আমার সম্প্রদায়!) তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। আমি তোমাদের জন্য এক মহা দিনের শাস্তির আশংকা করছি। (৭: ৫৯)


সূরা হূদে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


(أَن لَّا تَعۡبُدُوۤا۟ إِلَّا ٱللَّهَۖ إِنِّیۤ أَخَافُ عَلَیۡكُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ أَلِیمࣲ)


[Surat Hud ২৬]


অর্থাৎ—তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত কর না। আমি তোমাদের জন্য এক মর্মান্তিক দিনের শাস্তির আশংকা করছি। (১১: ২৬)


তিনি আরো বলেনঃ


( یَـٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَـٰهٍ غَیۡرُهُۥۤۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ)


[Surat Al-A’raf ৬৫]


অর্থাৎ-হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, তোমরা কি সাবধান হবে না? (৭: ৬৫)


মোটকথা, আল্লাহ তা’আলা একথা জানিয়ে দেন যে, নূহ (عليه السلام) তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহর প্রতি দাওয়াতের যত পদ্ধতি আছে তার সবই প্রয়োগ করেছেন। রাতে-দিনে, গোপনে-প্রকাশ্যে কখনো উৎসাহ দিয়ে, কখনো বা ভয় দেখিয়ে। কিন্তু এর কোনটিই তাদের মধ্যে কার্যকর ফল বয়ে আনতে পারেনি বরং তাদের অধিকাংশই গোমরাহী, সীমালঙ্ঘন এবং মূর্তিপূজায় অটল থাকে এবং সর্বক্ষণ তার বিরুদ্ধে শত্রুতা করতে থাকে। তাকে ও তার ঈমানদার সঙ্গীদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকে এবং তাঁদেরকে প্রস্তরাঘাতে মেরে ফেলার ও দেশ থেকে বের করে দেয়ার ভয় দেখাতে থাকে। তারা তাদের ক্ষতিসাধন করে এবং এ ব্যাপারে সীমা ছাড়িয়ে যায়।


(قَالَ ٱلۡمَلَأُ مِن قَوۡمِهِۦۤ إِنَّا لَنَرَىٰكَ فِی ضَلَـٰلࣲ مُّبِینࣲ ۝ قَالَ یَـٰقَوۡمِ لَیۡسَ بِی ضَلَـٰلَةࣱ وَلَـٰكِنِّی رَسُولࣱ مِّن رَّبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ أُبَلِّغُكُمۡ رِسَـٰلَـٰتِ رَبِّی وَأَنصَحُ لَكُمۡ وَأَعۡلَمُ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ)


[Surat Al-A'raf ৬০ - ৬২]


অর্থাৎ—তাঁর সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলেছিল, আমরা তো তোমাকে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখতে পাচ্ছি। সে বলেছিল, ‘হে আমর সম্প্রদায়! আমাতে কোন ভ্রান্তি নেই, আমি তো জগতসমূহের প্রতিপালকের রাসূল। (অর্থাৎ তোমরা যে ধারণা করছ আমি ভ্রান্ত, আমি তা নই। বরং আমি সঠিক পথ ও হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমি জগতসমূহের সে প্রতিপালকের রাসূল, যিনি কোন বস্তুকে ‘হও’ বললেই তা হয়ে যায়।) আমার প্রতিপালকের বাণী আমি তোমাদের কাছে পৌঁছাচ্ছি ও তোমাদেরকে হিতোপদেশ দিচ্ছি এবং তোমরা যা জান না, আমি তা আল্লাহর নিকট হতে জানি।’ (৭: ৬০-৬২)


বলাবাহুল্য যে, একজন রাসূলের শান এমনিই হওয়া দরকার যে, তিনি হবেন বাকপটু। তাঁর ভাষা হবে সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল, লোকদেরকে তিনি হিতোপদেশ দিবেন এবং আল্লাহ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান হবে সর্বাধিক।


নূহ (عليه السلام)-এর বক্তব্যের জবাবে তারা বললঃ


(فَقَالَ ٱلۡمَلَأُ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ مِن قَوۡمِهِۦ مَا نَرَىٰكَ إِلَّا بَشَرࣰا مِّثۡلَنَا وَمَا نَرَىٰكَ ٱتَّبَعَكَ إِلَّا ٱلَّذِینَ هُمۡ أَرَاذِلُنَا بَادِیَ ٱلرَّأۡیِ وَمَا نَرَىٰ لَكُمۡ عَلَیۡنَا مِن فَضۡلِۭ بَلۡ نَظُنُّكُمۡ كَـٰذِبِینَ)


[Surat Hud ২৭]


অর্থাৎ—আমরা তো তোমাকে আমাদের মতই দেখছি; অনুধাবন না করে তোমার অনুসরণ করছে তারাই, যারা আমাদের মধ্যে অধম এবং আমরা আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব দেখছি না, বরং আমরা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করি। (১১: ২৭)


নূহ (عليه السلام) মানুষ হয়ে রাসূল হওয়ায় তার সম্প্রদায় বিস্মিত হয় এবং যারা তাঁর অনুসরণ করেছিল তাদেরকে তাচ্ছিল্য করে ও হেয়প্রতিপন্ন করে। কথিত আছে যে, নূহ (عليه السلام)-এর বিরোধী সম্প্রদায় ছিল নেতৃস্থানীয় আর তার অনুসারীরা ছিল সমাজের দুর্বল শ্রেণীর লোক। যেমনঃ রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস বলেছিলেন, নবী-রাসূলদের অনুসারীরা দুর্বল শ্রেণীরই হয়ে থাকেন। এর কারণ হলো—সত্য অনুসরণের ব্যাপারে তাদের সম্মুখে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকে না।


বিরুদ্ধবাদীদের উক্তি بادي رائي -এর অর্থ হলো চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিবেচনা না করে স্রেফ তোমার দাওয়াত শুনেই তারা সাড়া দিয়েছে। কিন্তু এ কটাক্ষটি মূলত এমনই একটি গুণ যে কারণে তারা প্রশংসাৰ্হ। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। কারণ প্রকাশ্য সত্য চাক্ষুস দর্শন ও চিন্তা-ভাবনার অপেক্ষা রাখে না বরং তা প্রকাশ পাওয়া মাত্র তা স্বীকার করে নিয়ে তাঁর অনুসরণ করাই আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণেই নবী করীম (ﷺ) আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه)-এর প্রশংসা করে বলেছিলেনঃ যাকেই আমি ইসলামের প্রতি আহবান করেছি প্রত্যেকেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিল। কিন্তু আবু বকর এর ব্যতিক্রম। কারণ তিনি এতটুকু বিলম্বও করেন নি। আর এ কারণেই ছাকীফার দিনেও কোনরূপ চিন্তা-বিবেচনা না করেই দ্রুত তার বায়আত সম্পন্ন হয়। কেননা, সাহাবাগণের কাছে অন্যদের উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব ছিল দিবালোকের মত স্পষ্ট। আর এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর খিলাফত সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়েও তা বাদ দিয়ে বলেছিলেনঃ “আল্লাহ ও ঈমানদারগণ আবু বকর (رضي الله عنه) ছাড়া আর কারো ব্যাপারে রাযী হবেন না।”


নূহ (عليه السلام) ও তাঁর ঈমানদার অনুসারীদের উদ্দেশে তাঁর সম্প্রদায়ের কাফিরদের উক্তি


( وَمَا نَرَىٰ لَكُمۡ عَلَیۡنَا مِن فَضۡلِۭ بَلۡ نَظُنُّكُمۡ كَـٰذِبِینَ) -এর অর্থ হলো, তোমাদের ঈমান আনার পর আমাদের ওপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়নি। আমরা বরং তোমাদেরকে মিথ্যাবাদীই মনে করি। এর জবাবে নূহ (عليه السلام) বললেনঃ


(قَالَ یَـٰقَوۡمِ أَرَءَیۡتُمۡ إِن كُنتُ عَلَىٰ بَیِّنَةࣲ مِّن رَّبِّی وَءَاتَىٰنِی رَحۡمَةࣰ مِّنۡ عِندِهِۦ فَعُمِّیَتۡ عَلَیۡكُمۡ أَنُلۡزِمُكُمُوهَا وَأَنتُمۡ لَهَا كَـٰرِهُونَ)[Surat Hud ২৮]


অর্থাৎ—সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আমাকে বল, আমি যদি আমার প্রতিপালক প্রেরিত স্পষ্ট নিদর্শনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি এবং তিনি যদি আমকে তার নিজ অনুগ্রহ দান করে থাকেন, অথচ এ বিষয়ে তোমরা জ্ঞানান্ধ হও, আমি কি এ বিষয়ে তোমাদেরকে বাধ্য করতে পারি, যখন তোমরা তা অপছন্দ কর। (১১: ২৮)


এই হলো তাদেরকে সম্বোধনে নূহ (عليه السلام)-এর কোমলতা অবলম্বন এবং সত্যের দাওয়াতের ক্ষেত্রে তাদের সাথে নম্রতার অভিব্যক্তি। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(فَقُولَا لَهُۥ قَوۡلࣰا لَّیِّنࣰا لَّعَلَّهُۥ یَتَذَكَّرُ أَوۡ یَخۡشَىٰ)


[Surat Ta-Ha ৪৪]


অর্থাৎ—তার সঙ্গে তোমরা নম্র কথা বলবে, হয়ত সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে। (২০: ৪৪)


অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِیلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَـٰدِلۡهُم بِٱلَّتِی هِیَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِیلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِینَ)[Surat An-Nahl ১২৫]


অর্থাৎ—তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা কর সদ্ভাবে। (২১: ১২৫)


ঠিক এ ধারায়ই নূহ (عليه السلام) বলেছিলেনঃ


( أَرَءَیۡتُمۡ إِن كُنتُ عَلَىٰ بَیِّنَةࣲ مِّن رَّبِّی وَءَاتَىٰنِی رَحۡمَةࣰ مِّنۡ عِندِهِۦ فَعُمِّیَتۡ عَلَیۡكُمۡ أَنُلۡزِمُكُمُوهَا وَأَنتُمۡ لَهَا كَـٰرِهُونَ)[Surat Hud ২৮]


অর্থাৎ—তোমরা আমাকে বল, আমি যদি আমার প্রতিপালক প্রেরিত স্পষ্ট নিদর্শনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি এবং তিনি যদি আমাকে তার নিজ অনুগ্রহ (তথা নবুওত ও রিসালাত) দান করে থাকেন, অথচ তোমরা এ বিষয়ে জ্ঞানান্ধ হও, (অর্থাৎ তোমরা তা বুঝতে না পার ও তার দিশা না পাও,) আমি কি এ বিষয়ে তোমাদেরকে বাধ্য করতে পারি (অর্থাৎ আমার কোন জোর চলে না,) যখন তোমরা তা অপছন্দ কর? (অর্থাৎ তোমরা যখন তা অপছন্দ কর তখন তোমাদের ব্যাপারে আমার কোন কৌশল চলে না।)


(وَیَـٰقَوۡمِ لَاۤ أَسۡـَٔلُكُمۡ عَلَیۡهِ مَالًاۖ إِنۡ أَجۡرِیَ إِلَّا عَلَى ٱللَّهِۚ وَمَاۤ أَنَا۠ بِطَارِدِ ٱلَّذِینَ ءَامَنُوۤا۟ۚ إِنَّهُم مُّلَـٰقُوا۟ رَبِّهِمۡ وَلَـٰكِنِّیۤ أَرَىٰكُمۡ قَوۡمࣰا تَجۡهَلُونَ)[Surat Hud ২৯]


অর্থাৎ—হে আমার সম্প্রদায়! এর পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন-সম্পদ চাই না। আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহরই কাছে অর্থাৎ তোমাদের কাছে তোমাদের দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণকর বাণী পৌঁছানোর বিনিময়ে তোমাদের কাছে আমি কোন পারিশ্রমিক চাই না। তা চাই আমি একমাত্র আল্লাহর কাছে, যার প্রতিদান আমার জন্য তোমরা আমাকে যা দিবে তদপেক্ষা অনেক উত্তম ও স্থায়ী। (১১: ২৯)


এ আয়াত প্রমাণ করে যে, সম্প্রদায়ের লোকেরা নূহ (عليه السلام)-এর নিকট তাঁর দুর্বল শ্রেণীর অনুসারীদেরকে তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি করেছিল এবং এ দাবি পূরণ করা হলে তারা তাঁর দলে ভিড়বে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু নূহ (عليه السلام) তা প্রত্যাখ্যান করে বললেনঃ إِنَّهُم مُّلَـٰقُوا۟ رَبِّهِمۡ এরা এদের প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষ্যৎ করবে।’ অর্থাৎ আমার ভয় হয়, যদি আমি তাদের তাড়িয়ে দেই; তাহলে আল্লাহ তা’আলার কাছে আমার বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ আনবে। তাই তিনি বললেনঃ


(وَیَـٰقَوۡمِ مَن یَنصُرُنِی مِنَ ٱللَّهِ إِن طَرَدتُّهُمۡۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ)


[Surat Hud ৩০]


অর্থাৎ—আর হে আমার সম্প্রদায়! আমি যদি তাদেরকে তাড়িয়ে দেই, তবে আল্লাহর শাস্তি থেকে আমাকে কে রক্ষা করবে? তবুও কি তোমরা চিন্তা করবে না? (১১: ৩০)


আর এ কারণেই কুরায়শ কাফিররা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আম্মার, সুহায়ব, বিলাল ও খাব্বাব (رضي الله عنه) প্রমুখ সমাজের দুর্বল শ্রেণীর মুমিনকে তাঁর সান্নিধ্য থেকে তাড়িয়ে দেয়ার যখন দাবি করেছিল; তখন আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এ কাজ করতে নিষেধ করে দেন। সূরা আনআম ও সূরা কাহফে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছি।


(وَلَاۤ أَقُولُ لَكُمۡ عِندِی خَزَاۤىِٕنُ ٱللَّهِ وَلَاۤ أَعۡلَمُ ٱلۡغَیۡبَ وَلَاۤ أَقُولُ إِنِّی مَلَكࣱ وَلَاۤ أَقُولُ لِلَّذِینَ تَزۡدَرِیۤ أَعۡیُنُكُمۡ لَن یُؤۡتِیَهُمُ ٱللَّهُ خَیۡرًاۖ ٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِمَا فِیۤ أَنفُسِهِمۡ إِنِّیۤ إِذࣰا لَّمِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ)


[Surat Hud ৩১]


অর্থাৎ—আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভাণ্ডার আছে আর না অদৃশ্য সম্বন্ধে আমি অবগত এবং আমি এও বলি না যে, আমি ফেরেশতা বরং আমি বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ আমাকে যা অবগত করিয়েছেন তা ব্যতীত তাঁর ইমের কিছুই আমি জানি না, তিনি আমাকে যে কাজের শক্তি দান করেছেন; তা ব্যতীত কোন শক্তিই আমি রাখি না এবং তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত আমার নিজের কোন উপকার ও অপকারের ক্ষমতা আমার নেই। তোমাদের দৃষ্টিতে (আমার অনুসারীদের মধ্যকার) যারা হেয় তাদের সম্বন্ধে আমি একথা বলি না যে, আল্লাহ তাদেরকে কখনোই মঙ্গল দান করবেন না। তাদের অন্তরে যা আছে তা আল্লাহ সম্যক অবগত। তাহলে আমি অবশ্যই জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হব। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে আমি এ সাক্ষ্য দেই না যে, আল্লাহর নিকট কিয়ামতের দিন তাদের জন্য কোন কল্যাণ নেই। তাদের সম্বন্ধে আল্লাহই ভালো জানেন এবং তাদের অন্তরে যা আছে অদূর ভবিষ্যতে আল্লাহ তার প্রতিফল দান করবেন। ভালো হলে ভালো আর মন্দ হলে মন্দ। (১১:৩১)


যেমন অন্যত্র তারা বলেছিলঃ


(۞ قَالُوۤا۟ أَنُؤۡمِنُ لَكَ وَٱتَّبَعَكَ ٱلۡأَرۡذَلُونَ ۝ قَالَ وَمَا عِلۡمِی بِمَا كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ ۝ إِنۡ حِسَابُهُمۡ إِلَّا عَلَىٰ رَبِّیۖ لَوۡ تَشۡعُرُونَ ۝ وَمَاۤ أَنَا۠ بِطَارِدِ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ)


[Surat Ash-Shu'ara ১১১ - ১১৪]


অর্থাৎ—আমরা কি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব অথচ ইতরজনেরা তোমার অনুসরণ করছে? নূহ বলল, ‘তারা কী করত তা আমার জানা নেই। তাদের হিসাব গ্রহণ তো আমার প্রতিপালকেরই কাজ; যদি তোমরা বুঝতে! মুমিনদেরকে তাড়িয়ে দেয়া আমার কাজ নয় আমি তো কেবল একজন স্পষ্ট সতর্ককারী।’ (২৬: ১১১-১১৪)


নূহ (عليه السلام) ও তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে এ বাদানুবাদ চলে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوۡمِهِۦ فَلَبِثَ فِیهِمۡ أَلۡفَ سَنَةٍ إِلَّا خَمۡسِینَ عَامࣰا فَأَخَذَهُمُ ٱلطُّوفَانُ وَهُمۡ ظَـٰلِمُونَ)


[Surat Al-Ankabut ১৪]


অর্থাৎ—সে তাদের মধ্যে অবস্থান করেছিল পঞ্চাশ কম এক হাজার বছর। তারপর প্লাবন তাদেরকে গ্রাস করে। কারণ তারা ছিল সীমালঙ্ঘনকারী। (২৯: ১৪)


অর্থাৎ এত দীর্ঘকাল ধরে দাওয়াত দেওয়া সত্ত্বেও তাদের অল্প সংখ্যক লোকই তার প্রতি ঈমান এনেছিল এবং প্রত্যেক প্রজন্ম পরবর্তীদেরকে নুহ (عليه السلام)-এর প্রতি ঈমান না আনার এবং তার সঙ্গে বিবাদ ও বিরুদ্ধাচরণের ওসীয়ত করে যেত। সন্তান বয়োপ্রাপ্ত ও বোধসম্পন্ন হলে পিতা একান্তে তাকে নূহের প্রতি জীবনে কখনো ঈমান না আনার ওসীয়ত করে দিত। তাদের সহজাত প্রকৃতিই ঈমান ও সত্যের বিরোধী ছিল।


এ জন্যই নূহ (عليه السلام) বলেছিলেনঃ


( وَلَا یَلِدُوۤا۟ إِلَّا فَاجِرࣰا)


তারা কেবল দুষ্কৃতকারী ও কাফির জন্ম দিতে থাকবে। (৭১: ২৭)


আর এ কারণেই সম্প্রদায়ের লোকেরা বলেছিলঃ


(قَالُوا۟ یَـٰنُوحُ قَدۡ جَـٰدَلۡتَنَا فَأَكۡثَرۡتَ جِدَ ٰ⁠لَنَا فَأۡتِنَا بِمَا تَعِدُنَاۤ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ ۝ قَالَ إِنَّمَا یَأۡتِیكُم بِهِ ٱللَّهُ إِن شَاۤءَ وَمَاۤ أَنتُم بِمُعۡجِزِینَ)[Surat Hud ৩২ - ৩৩]


অর্থাৎ—হে নূহ! তুমি আমাদের সঙ্গে বিতণ্ডা করেছ, তুমি বিতণ্ডা করেছ আমাদের সঙ্গে অতিমাত্রায়, সুতরাং তুমি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছ তা আনয়ন কর। সে বলল, ইচ্ছা করলে আল্লাহই তোমাদের নিকট তা উপস্থিত করবেন এবং তোমরা তা ব্যর্থ করতে পারবে না। (১১: ৩২-৩৩)


অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছি তা আনয়ন করার শক্তি আল্লাহর আছে। কোন কিছু তাঁকে ব্যর্থ করতে পারে না এবং কিছুই তাঁকে ব্যর্থকাম করতে পারে না বরং তিনি কোন বস্তুকে বলেন 'হও’ সাথে সাথে তা হয়ে যায়।


(وَلَا یَنفَعُكُمۡ نُصۡحِیۤ إِنۡ أَرَدتُّ أَنۡ أَنصَحَ لَكُمۡ إِن كَانَ ٱللَّهُ یُرِیدُ أَن یُغۡوِیَكُمۡۚ هُوَ رَبُّكُمۡ وَإِلَیۡهِ تُرۡجَعُونَ)[Surat Hud ৩৪]


অর্থাৎ—আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিতে চাইলেও আমার উপদেশ তোমাদের উপকারে আসবে না, যদি আল্লাহ তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চান। তিনিই তোমাদের প্রতিপালক এবং তারই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তন করবে। (১১: ৩৪)


অর্থাৎ আল্লাহ কাউকে বিপথগামী করতে চাইলে তাকে পথে আনবার ক্ষমতা কারো নেই। তিনিই যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন, তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়; কে হিদায়াতের উপযুক্ত এবং কে বিভ্রান্ত হওয়ার যোগ্য সে সম্পর্কে জ্ঞানবান এবং পরম প্রজ্ঞা ও অকাট্য প্রমাণ তারই।


(وَأُوحِیَ إِلَىٰ نُوحٍ أَنَّهُۥ لَن یُؤۡمِنَ مِن قَوۡمِكَ إِلَّا مَن قَدۡ ءَامَنَ فَلَا تَبۡتَىِٕسۡ بِمَا كَانُوا۟ یَفۡعَلُونَ)


[Surat Hud ৩৬]


অর্থাৎ—মূহের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছিল, যারা ঈমান এনেছে তারা ব্যতীত তোমার সম্প্রদায়ের আর কেউ কখনো ঈমান আনবে না। (এটা নূহের প্রতি তাঁর সম্প্রদায়ের শক্রতা ও দুর্ব্যবহারের সান্ত্বনা বাক্য। অর্থাৎ তাদের আচরণ তোমার কোন ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। কারণ সাহায্য নিকটে এবং আশ্চর্যজনক সংবাদ সম্মুখে আসছে।)


(وَٱصۡنَعِ ٱلۡفُلۡكَ بِأَعۡیُنِنَا وَوَحۡیِنَا وَلَا تُخَـٰطِبۡنِی فِی ٱلَّذِینَ ظَلَمُوۤا۟ إِنَّهُم مُّغۡرَقُونَ)


[Surat Hud ৩৭]


অর্থাৎ, আর তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার প্রত্যাদেশ অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ কর এবং যারা সীমালঙ্ঘন করেছে তাদের সম্পর্কে তুমি আমাকে কিছু বলো না। তারা তো নিমজ্জিত হবে। (১১: ৩৬-৩৭)


এর কারণ হলো, নূহ (عليه السلام) যখন তাদের সংশোধন ও মুক্তির ব্যাপারে নিরাশ হন এবং বুঝতে পারেন যে, তাদের মধ্যে কোন মঙ্গল নেই এবং সর্বপ্রকার আচরণ ও উচ্চারণে তাঁর নির্যাতন, বিরুদ্ধাচরণ ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করার শেষ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, তখন তিনি তাদের বিরুদ্ধে বদ দু’আ করেন। ফলে আল্লাহ তাঁর আহবানে সাড়া দেন এবং তাঁর দু’আ কবুল করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَلَقَدۡ نَادَىٰنَا نُوحࣱ فَلَنِعۡمَ ٱلۡمُجِیبُونَ ۝ وَنَجَّیۡنَـٰهُ وَأَهۡلَهُۥ مِنَ ٱلۡكَرۡبِ ٱلۡعَظِیمِ)


[Surat As-Saaffat ৭৫ - ৭৬]


অর্থাৎ-নূহ আমাকে আহবান করেছিল আর আমি কত উত্তম সাড়া দানকারী। তাকে এবং তার পরিবারবর্গকে আমি উদ্ধার করেছিলাম মহা সংকট থেকে। (৩৭: ৭৫-৭৬)


(وَنُوحًا إِذۡ نَادَىٰ مِن قَبۡلُ فَٱسۡتَجَبۡنَا لَهُۥ فَنَجَّیۡنَـٰهُ وَأَهۡلَهُۥ مِنَ ٱلۡكَرۡبِ ٱلۡعَظِیمِ)


[Surat Al-Anbiya' ৭৬]


অর্থাৎ—স্মরণ কর নূহকে, পূর্বে সে যখন আহবান করেছিল তখন আমি তার আহবানে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে ও তার পরিবারবর্গকে মহা সংকট থেকে উদ্ধার করেছিলাম। (২১: ৭৬)


(قَالَ رَبِّ إِنَّ قَوۡمِی كَذَّبُونِ ۝ فَٱفۡتَحۡ بَیۡنِی وَبَیۡنَهُمۡ فَتۡحࣰا وَنَجِّنِی وَمَن مَّعِیَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ)


[Surat Ash-Shu'ara ১১৭ - ১১৮]


অর্থাৎ-নূহ বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো আমাকে অস্বীকার করছে। সুতরাং তুমি আমার ও তাদের মধ্যে স্পষ্ট মীমাংসা করে দাও এবং আমাকে ও আমার সঙ্গে যে সব মুমিন আছে তাদেরকে রক্ষা কর! (২৬: ১১৭-১১৮)


(فَدَعَا رَبَّهُۥۤ أَنِّی مَغۡلُوبࣱ فَٱنتَصِرۡ)


[Surat Al-Qamar ১০]


অর্থাৎ—নূহ তখন তাঁর প্রতিপালককে আহবান করে বলেছিল, আমি তো অসহায়। অতএব, তুমি প্রতিবিধান কর। (৫৪: ১০)


(قَالَ رَبِّ ٱنصُرۡنِی بِمَا كَذَّبُونِ)


[Surat Al-Mu’minun ৩৯]


অর্থাৎ—হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সাহায্য কর, কারণ তারা আমাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করে। (২৩: ৩৯)


(مِّمَّا خَطِیۤـَٔـٰتِهِمۡ أُغۡرِقُوا۟ فَأُدۡخِلُوا۟ نَارࣰا فَلَمۡ یَجِدُوا۟ لَهُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ أَنصَارࣰا ۝ وَقَالَ نُوحࣱ رَّبِّ لَا تَذَرۡ عَلَى ٱلۡأَرۡضِ مِنَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ دَیَّارًا ۝ إِنَّكَ إِن تَذَرۡهُمۡ یُضِلُّوا۟ عِبَادَكَ وَلَا یَلِدُوۤا۟ إِلَّا فَاجِرࣰا كَفَّارࣰا)[Surat Nuh ২৫ - ২৭]


অর্থ তাদের অপরাধের জন্য তাদেরকে নিমজ্জিত করা হয়েছিল এবং পরে তাদেরকে দাখিল করা হয়েছিল আগুনে, তারপর তারা কাউকেও আল্লাহর মুকাবিলার সাহায্যকারী পায়নি।


নূহ আরো বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরদের মধ্য থেকে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিও না।


তুমি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে তারা তোমার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে কেবল দুষ্কৃতকারী ও কাফির। (৭১: ২৫-২৭)


মোটকথা, যখন তাদের কুফরী অনাচার-পাপাচারসমূহ ও নবীর বদ দু’আ একত্র হয় তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁকে নৌকা নির্মাণ করার আদেশ করেন। সে এমন এক বিশাল জাহাজ যার কোন নজীর ছিল না। সাথে সাথে আল্লাহ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-কে আগাম বলে রাখেন যে, যখন তাঁর আদেশ আসবে এবং অপরাধীদের প্রতি তাঁর অপ্রতিরোধ্য আযাব পতিত হয়ে যাবে; তখন যেন তিনি তাদের ব্যাপারে নমনীয়তা না দেখান। কেননা হতে পারে যে, নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি অবতীর্ণ আযাব স্বচক্ষে দেখে তাদের ব্যাপারে তাঁর মনে দয়ার উদ্রেক হবে। কারণ সংবাদ কখনো চাক্ষুস দেখার সমান হয় না। আর এ জন্যই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


(وَٱصۡنَعِ ٱلۡفُلۡكَ بِأَعۡیُنِنَا وَوَحۡیِنَا وَلَا تُخَـٰطِبۡنِی فِی ٱلَّذِینَ ظَلَمُوۤا۟ إِنَّهُم مُّغۡرَقُونَ ۝ وَیَصۡنَعُ ٱلۡفُلۡكَ وَكُلَّمَا مَرَّ عَلَیۡهِ مَلَأࣱ مِّن قَوۡمِهِۦ سَخِرُوا۟ مِنۡهُۚ قَالَ إِن تَسۡخَرُوا۟ مِنَّا فَإِنَّا نَسۡخَرُ مِنكُمۡ كَمَا تَسۡخَرُونَ)[Surat Hud ৩৭ - ৩৮]


অর্থাৎ—যারা সীমালঙ্ন করেছে তাদের ব্যাপারে তুমি আমাকে কিছু বলে না, তারা তো নিমজ্জিত হবে। সে নৌকা নির্মাণ করতে লাগল এবং যখনই তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা তার নিকট দিয়ে যেত তাকে উপহাস করত। (অর্থাৎ নূহ (عليه السلام) তাদেরকে যে আযাবের ভয় দেখিয়েছিলেন তা সংঘটিত হওয়া সুদূর পরাহত মনে করে তারা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করত) (১১: ৩৭-৩৮)


তার জবাবে নূহ (عليه السلام) বললেন।


( إِن تَسۡخَرُوا۟ مِنَّا فَإِنَّا نَسۡخَرُ مِنكُمۡ كَمَا تَسۡخَرُونَ)


[Surat Hud ৩৮]


অর্থাৎ—তোমরা যদি আমাদেরকে উপহাস কর তবে আমরাও তোমাদেরকে উপহাস করব যেমন তোমরা উপহাস করছ। অর্থাৎ তোমাদের কুফরীর উপর অটল থাকা এবং তোমাদের অবাধ্যতার জন্য যা তোমাদের জন্য আযাব ডেকে আনে--আমরাও তোমাদেরকে উপহাস করব। (১১: ৩৮)


(فَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَ مَن یَأۡتِیهِ عَذَابࣱ یُخۡزِیهِ وَیَحِلُّ عَلَیۡهِ عَذَابࣱ مُّقِیمٌ)


[Surat Hud ৩৯]


অর্থাৎ—তোমরা অচিরেই জানতে পারবে যে, কার উপর আসবে লাঞ্ছনাদায়ক শান্তি আর কার উপর আপতিত হবে স্থায়ী শাস্তি। (১১: ৩৯)


বলাবাহুল্য যে, দুনিয়াতে জঘন্যতম কুফরী ও চরম অবাধ্যতা তাদের মজ্জাগত বিষয় হয়ে গিয়েছিল। আখিরাতেও তাদের অবস্থা অনুরূপই হবে। কারণ, কিয়ামতের দিন তারা তাদের কাছে রাসূল আগমন করার বিষয়টিও অস্বীকার করবে।


যেমন ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু সাঈদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ (কিয়ামতের দিন) নূহ (عليه السلام) ও তাঁর উম্মত উপস্থিত হবেন। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, তুমি কি দীনের বাণী পৌঁছিয়েছিলে? নূহ (عليه السلام) বলবেন, ‘জী হ্যাঁ, হে আমার রব!’ তারপর আল্লাহ তাআলা তাঁর উম্মতকে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘নূহ কি তোমাদের নিকট দীনের দাওয়াত পৌঁছিয়েছিল?’ তারা বলবে, ‘আমাদের নিকট কোন নবীই আসেননি।’ তখন আল্লাহ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-কে বলবেন, ‘তোমার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে কে? তিনি বলবেন, মুহাম্মদ (ﷺ) ও তাঁর উম্মত।’ তখন উম্মতে মুহাম্মদী এ সাক্ষ্য দেবে যে, ‘নূহ (عليه السلام) তার তাবলীগের দায়িত্ব পালন করেছেন।’


এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَكَذَ ٰ⁠لِكَ جَعَلۡنَـٰكُمۡ أُمَّةࣰ وَسَطࣰا لِّتَكُونُوا۟ شُهَدَاۤءَ عَلَى ٱلنَّاسِ وَیَكُونَ ٱلرَّسُولُ عَلَیۡكُمۡ شَهِیدࣰاۗ وَمَا جَعَلۡنَا ٱلۡقِبۡلَةَ ٱلَّتِی كُنتَ عَلَیۡهَاۤ إِلَّا لِنَعۡلَمَ مَن یَتَّبِعُ ٱلرَّسُولَ مِمَّن یَنقَلِبُ عَلَىٰ عَقِبَیۡهِۚ وَإِن كَانَتۡ لَكَبِیرَةً إِلَّا عَلَى ٱلَّذِینَ هَدَى ٱللَّهُۗ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِیُضِیعَ إِیمَـٰنَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِٱلنَّاسِ لَرَءُوفࣱ رَّحِیمࣱ)


[Surat Al-Baqarah ১৪৩]


অর্থাৎ—এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি; যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হবে। (২: ১৪৩) الوسط অর্থ العدل তথা ইনসাফ বা মধ্যপন্থা। মোটকথা, এ উম্মত তার সত্যবাদী নবীর সাক্ষ্যের সপক্ষে এ সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-কে সত্যসহ প্রেরণ করেছিলেন, তার উপর সত্য নাযিল করেছিলেন এবং তাঁকে সত্যের অনুসরণ করার আদেশ দিয়েছিলেন আর তিনি তাঁর উম্মতের নিকট পরিপূর্ণরূপে তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। দীনের ক্ষেত্রে তাদের জন্য উপকারী এমন কোন বিষয় সম্পর্কে তাদেকে আদেশ দিতে ছাড়েন নি এবং ক্ষতিকর এমন কোন বিষয় ছিল না, যা করতে তিনি নিষেধ করেননি। সকল নবীর শান এমনই হয়ে থাকে। এমনকি তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে দাজ্জাল সম্পর্কে পর্যন্ত সতর্ক করে দিয়েছিলেন, যদিও তাদের আমলে দাজ্জালের আবির্ভাবের কোন আশংকাই ছিল না। কওমের প্রতি দয়া অনুগ্রহবশত তিনি তা করেছিলেন।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন উমর (رضي الله عنه) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন জনসাধারণের মধ্যে দাঁড়িয়ে আল্লাহ তাআলার শানে উপযুক্ত প্রশংসা বর্ণনা করেন। তারপর দাজ্জালের কথা উল্লেখ করে বললেনঃ “তোমাদেরকে আমি তার ব্যাপারে সাবধান করছি। এমন কোন নবী নেই যে, আপন সম্প্রদায়কে তার ব্যাপারে সাবধান করেন নি। নূহ (عليه السلام) ও আপন সম্প্রদায়কে তার ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন। তবে তার ব্যাপারে তোমাদেরকে আমি এমন একটি কথা বলে দেই যা কোন নবী তার সম্প্রদায়কে বলেননি। তোমরা জেনে রেখ, সে এক-চক্ষুবিশিষ্ট। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা এক-চক্ষুবিশিষ্ট নন।”


সহীহ বুখারী ও মুসলিমে যথাক্রমে আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “আমি কি তোমাদেরকে দাজ্জাল সম্পর্কে এমন একটি কথা বলব যা কোন নবী তাঁর সম্প্রদায়কে বলেন নি? সে হলো কানা। আর সে নিজের সাথে জান্নাত ও জাহান্নামের অনুরূপ কিছু নিয়ে আসবে। যাকে সে জান্নাত বলবে, আসলে তাই হবে জাহান্নাম। আর আমি তোমাদেরকে তার সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি, যেমন নূহ (عليه السلام) তাঁর সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছিলেন।”


কোন কোন পূর্বসূরি আলিম বলেন, আম্লাহ তা’আলা যখন নূহ (عليه السلام)-এর দু’আ কবুল করেন, তখন তাকে নৌকা নির্মাণের উদ্দেশ্যে একটি বৃক্ষ রোপণ করার আদেশ দেন। ফলে নূহ (عليه السلام) একটি বৃক্ষ রোপণ করে একশ বছর অপেক্ষা করেন। তারপর পরবর্তী শতাব্দীতে তা কেটে কাঠ করে নেন। কারো কারো মতে, চল্লিশ বছর পরে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।


মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, সে নৌকাটি শাল কাঠ দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, দেবদারু কাঠ দ্বারা। আর এটি হলো তাওরাতের বক্তব্য। ছাওরী বলেন, আল্লাহ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-কে আরো নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন নৌকাটি দৈর্ঘে আশি হাত, প্রস্থে পঞ্চাশ হাত করে তৈরি করেন। তার ভিতরে ও বাইরে আলকাতরা দ্বারা প্রলেপ দেন এবং তার এমন সরু গলুই নির্মাণ করেন, যা পানি চিরে অগ্রসর হতে পারে। কাতাদা বলেন, তার দৈর্ঘ্য ছিল তিনশ হাত আর প্রস্থ পঞ্চাশ হাত। আমি তাওরাতে এমনই দেখেছি।


হাসান বসরী (رحمة الله) বলেন, দৈর্ঘ্য ছ’শ হাত আর প্রস্থ তিনশ হাত। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত দৈর্ঘ্য এক হাজার দু’শ হাত প্রস্থ ছ’শ হাত। কারো কারো মতে, দৈর্ঘ্য দু’হাজার হাত আর প্রস্থ একশ হাত। এরা সকলেই বলেন, তার উচ্চতা ছিল ত্রিশ হাত আর তা ত্রিতল বিশিষ্ট ছিল।


প্রতি তলা দশ হাত করে। নিচের তলা কীট-পতঙ্গ ও জীব-জানোয়ারের জন্য, দ্বিতীয় তলা মানুষের জন্য আর উপর তলা পাখ-পাখালির জন্য। তার দরজা ছিল পাশে এবং উপর দিকে ঢাকনা দ্বারা আবৃত। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(قَالَ رَبِّ ٱنصُرۡنِی بِمَا كَذَّبُونِ ۝ فَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَیۡهِ أَنِ ٱصۡنَعِ ٱلۡفُلۡكَ بِأَعۡیُنِنَا وَوَحۡیِنَا)


[Surat Al-Mu'minun ২৬ - ২৭]


অর্থাৎ-নূহ বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সাহায্য কর, কারণ তারা আমাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করছে। তারপর আমি তার প্রতি ওহী নাযিল করলাম যে, তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার ওহী অনুযায়ী নৌযান নির্মাণ কর। অর্থাৎ তোমাকে দেয়া আমার আদেশ অনুযায়ী এবং তোমার নির্মাণ কার্য আমার সরাসরি তত্ত্বাবধানে তুমি নৌযান নির্মাণ কর যাতে তা নির্মাণে আমি তোমাকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারি।


فَإِذَا جَاۤءَ أَمۡرُنَا وَفَارَ ٱلتَّنُّورُ فَٱسۡلُكۡ فِیهَا مِن كُلࣲّ زَوۡجَیۡنِ ٱثۡنَیۡنِ وَأَهۡلَكَ إِلَّا مَن سَبَقَ عَلَیۡهِ ٱلۡقَوۡلُ مِنۡهُمۡۖ وَلَا تُخَـٰطِبۡنِی فِی ٱلَّذِینَ ظَلَمُوۤا۟ إِنَّهُم مُّغۡرَقُونَ


অর্থাৎ—তারপর যখন আমার আদেশ আসবে ও উনুন উথলে উঠবে; তখন তাতে তুলে নিও প্রতিটি জীবের এক এক জোড়া এবং তোমার পরিবার-পরিজনকে, তাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে পূর্বে সিদ্ধান্ত হয়ে আছে তারা ব্যতীত। আর জালিমদের সম্বন্ধে তুমি আমাকে কিছু বলো না, তারা তো নিমজ্জিত হবে। (২৩: ২৭)


এখানে আল্লাহ্ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-কে আগাম নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন যে, যখন তার আদেশ আসবে এবং তার শাস্তি আপতিত হবে, তখন যেন তিনি বংশ ধারা রক্ষার জন্য সে নৌকায় প্রত্যেক জীব, সকল প্রাণী ও খাদ্য-দ্রব্য প্রভৃতির এক এক জোড়া উঠিয়ে নেয় এবং নিজের সাথে কাফিরদের ব্যতীত নিজের পরিবার-পরিজনকে তুলে নেন। তাঁর পরিবারের যারা কাফির তাদেরকে এজন্য বাদ দেয়া হয়েছে যে, তাদের ব্যাপারে অপ্রতিরোধ্য বদ দু’আ কার্যকর হয়ে গেছে এবং তারা আযাবে নিপতিত হওয়া অবধারিত হয়ে গেছে। আর আল্লাহ তাআলা তাঁকে এ আদেশও দিয়ে রাখেন যে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের মধ্যে আযাব এসে পড়লে যেন তিনি আল্লাহর নিকট কোন সুপারিশ না করেন।


জমহুর উলামার কাছে التنور দ্বারা ভূ-পৃষ্ঠকে বুঝানো হয়েছে। এ হিসাবে আয়াতের অর্থ হলো, যখন ভূমি সর্বদিক থেকে উৎসারিত হবে এমনকি আগুনের আধার উনুন থেকে পর্যন্ত পানির ফোয়ারা নির্গত হবে। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে, التنور হলো ভারতের একটি কূয়া। শাবী কূয়াটি কুফার এবং কাতাদা (رحمة الله) আরব উপত্যকায় অবস্থিত ছিল বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আলী ইবন আবু তালিব (رضي الله عنه) বলেন, التنور দ্বারা প্রভাতের আলো বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ে তুমি প্রতি জীবের এক এক জোড়া এবং তোমার পরিবার-পরিজনকে নৌযানে তুলে নিও। তবে এ অভিমতটি গরীব পর্যায়ের।


অন্যত্র আল্লাহ্ আ’আলা বলেনঃ


(حَتَّىٰۤ إِذَا جَاۤءَ أَمۡرُنَا وَفَارَ ٱلتَّنُّورُ قُلۡنَا ٱحۡمِلۡ فِیهَا مِن كُلࣲّ زَوۡجَیۡنِ ٱثۡنَیۡنِ وَأَهۡلَكَ إِلَّا مَن سَبَقَ عَلَیۡهِ ٱلۡقَوۡلُ وَمَنۡ ءَامَنَۚ وَمَاۤ ءَامَنَ مَعَهُۥۤ إِلَّا قَلِیلࣱ)[Surat Hud ৪০]


অর্থাৎ এভাবে যখন আমার আদেশ আসল এবং উনুন উথলে উঠল; তখন আমি বললাম, এতে তুমি প্রত্যেক জীবের এক এক জোড়া এবং যাদের বিরুদ্ধে পূর্বে সিদ্ধান্ত হয়েছে তারা ব্যতীত তোমার পরিবার-পরিজনকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আরোহণ করাও। আর অল্প সংখ্যক ব্যতীত কেউ ঈমান আনেনি।


এখানে আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, তাদের প্রতি আযাব আপতিত হলে যেন তিনি তাতে প্রত্যেক জীবের এক এক জোড়া তুলে নেন। আর আহলে কিতাবদের গ্রন্থে আছে, আল্লাহ্ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-কে প্রতি হালাল পশুপাখির সাত জোড়া করে, আর নিষিদ্ধগুলোর নর-মাদা দুই জোড়া করে তুলে নেয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এ কথাটি কুরআনের اثنين শব্দের অর্থের সাথে সংঘাতপূর্ণ, যদি একে আমরা কর্মকারক হিসেবে গণ্য করি। আর যদি একে زوجين শব্দের তাকীদ রূপে সাব্যস্ত করে কর্মকারক উহা মানি; তাহলে কোন সংঘাত থাকে না। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।


কেউ কেউ বলেন এবং ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকেও এরূপ বর্ণিত আছে যে, পক্ষীকুলের মধ্যে সর্বপ্রথম নৌকায় যা প্রবেশ করেছিল তাহলে টিয়া আর প্রাণীকুলের মধ্যে সর্বশেষে যা প্রবেশ করেছিল তাহলো গাধা এবং ইবলীস গাধার লেজের সাথে ঝুলে প্রবেশ করে।


ইব্‌ন আবু হাতিম আসলাম (رحمة الله) সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন, নূহ (عليه السلام) নৌযানে প্রতি জীবের এক এক জোড়া তুলে নিলে তাঁর সংগীরা বললেন, সিংহের সঙ্গে আমরা কিভাবে বা গৃহপালিত প্রাণীরা কিভাবে নিরাপদ বোধ করবে? তখন আল্লাহ্ তা’আলা সিংহকে জ্বরাক্রান্ত করে দেন। পৃথিবীতে এটাই ছিল সর্বপ্রথম জ্বরের আবির্ভাব। তারপর তাঁরা ইঁদুরের ব্যাপারে অনুযোগ করে বললেন, “পাজিগুলো তো আমাদের খাদ্যদ্রব্য ও জিনিসপত্র সব নষ্ট করে ফেলল! তখন আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে সিংহ হাঁচি দেয়। এতে বিড়াল বের হয়ে আসে। বিড়াল দেখে ইঁদুররা সব আত্মগোপন করে।” এ হাদীসটি মুরসাল পর্যায়ের। وَأَهۡلَكَ إِلَّا مَن سَبَقَ عَلَیۡهِ ٱلۡقَوۡلُ এর অর্থ হলো, কাফির হওয়ার কারণে তোমার পরিবারের যাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে গেছে তাদের ব্যতীত অন্য সকলকে নৌকায় তুলে নিও। এদের মধ্যে নূহ (عليه السلام)-এর পুত্র য়ামও ছিল যে নিমজ্জিত হয়েছিল। এর আলোচনা পরে আসছে।


ومن امن এর অর্থ--তোমার উম্মতের যারা তোমার সাথে ঈমান এনেছে তাদেরকেও তুমি। নৌকায় তুলে লও।


আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ وَمَاۤ ءَامَنَ مَعَهُۥۤ إِلَّا قَلِیلࣱ) অর্থাৎ- সম্প্রদায়ের মধ্যে নূহ (عليه السلام)-এর এত দীর্ঘ সময় অবস্থান এবং রাতে-দিনে নরম-গরম নানা প্রকার কথা ও কাজের মাধ্যমে দীনের দাওয়াত দেয়া সত্ত্বেও অল্প সংখ্যক ব্যতীত কেউ ঈমান আনেনি।


নূহ (عليه السلام)-এর সঙ্গে নৌকায় যারা ছিল, তাদের সংখ্যা কত এ ব্যাপারে আলিমগণের মতভেদ আছে। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে, নারী-পুরুষ মিলে তারা ছিলেন আশিজন। কা’ব ইবন আহবাব থেকে বর্ণিত যে, তাঁরা ছিলেন বাহাত্তর জন। কারো কারো মতে দশজন। কেউ কেউ বলেন, তাঁরা ছিলেন নূহ, তাঁর তিন পুত্র ও য়াম-এর স্ত্রীসহ তার চার পুত্রবধু, যে য়াম মুক্তির পথ থেকে সরে গিয়েছিল। তবে এ অভিমতটি স্পষ্ট আয়াতের পরিপন্থী। কারণ নূহ (عليه السلام)-এর সঙ্গে তাঁর পরিবারের লোকজন ব্যতীত অন্য একদল ঈমানদার লোকও ছিল বলে কুরআনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। যেমন নূহ (عليه السلام) বলেছিলেনঃ


( وَنَجِّنِی وَمَن مَّعِیَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ)


[Surat Ash-Shu'ara ১১৮]


অর্থাৎ--“আমাকে ও আমার সঙ্গী মুমিনগণকে মুক্তি দাও।” (২৬: ১১৮)


কেউ কেউ বলেন, তাঁরা ছিলেন সাতজন। আর নূহ (عليه السلام)-এর স্ত্রী তথা তাঁর সব ক’টি ছেলে হাম, সাম, হাফিস ও য়াম-আহলে কিতাবদের মতে যার নাম কানআন এবং তার এ ছেলেটিই ডুবে মরেছিল। এদের মা প্লাবনের আগেই মারা গিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, সেও নিমজ্জিতদের সঙ্গে ডুবে মরেছিল। তার কুফরীর কারণে সেও অনিবার্যরূপে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর আহলে কিতাবদের মতে সে নৌকায় ছিল। একথাটি সঠিক হলে বলতে হবে যে, সে প্লাবনের পরেই কুফরী করেছিল কিংবা তাকে কিয়ামত দিবসের জন্য অবকাশ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু প্রথম অভিমতটিই যুক্তিসঙ্গত।


কারণ নূহ (عليه السلام) বলেছিলেনঃ


(وَقَالَ نُوحࣱ رَّبِّ لَا تَذَرۡ عَلَى ٱلۡأَرۡضِ مِنَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ دَیَّارًا)


[Surat Nuh ২৬]


অর্থাৎ- তুমি পৃথিবীতে কাফিরদের একটি গৃহবাসীকেও অব্যাহতি দিও না। (৭১: ২৬)


আল্লাহ তাআলা বলেনঃ


(فَإِذَا ٱسۡتَوَیۡتَ أَنتَ وَمَن مَّعَكَ عَلَى ٱلۡفُلۡكِ فَقُلِ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ ٱلَّذِی نَجَّىٰنَا مِنَ ٱلۡقَوۡمِ ٱلظَّـٰلِمِینَ ۝ وَقُل رَّبِّ أَنزِلۡنِی مُنزَلࣰا مُّبَارَكࣰا وَأَنتَ خَیۡرُ ٱلۡمُنزِلِینَ)[Surat Al-Mu'minun ২৮ - ২৯]


অর্থাৎ- যখন তুমি ও তোমার সঙ্গীরা নৌযানে আসন গ্রহণ করবে তখন বলবে, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আমাদেরকে জালিম সম্প্রদায় থেকে উদ্ধার করেছেন।’ আরো বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমনভাবে অবতরণ করাও যা হবে কল্যাণকর, আর তুমিই শ্রেষ্ঠ অবতারণকারী।’ (২৩: ২৮-২৯)


এ আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-কে তাঁর প্রতিপালকের প্রশংসা করার আদেশ দিয়েছেন। কারণ তিনি এ নৌযানকে তাঁর বশীভূত করে দিয়ে তা দিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেছেন, তাঁর ও তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে মীমাংসা করে দিয়েছেন এবং যারা তার বিরুদ্ধাচরণ করেছিল এবং তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল তাদের শাস্তি দানের মাধ্যমে তার প্রাণ জুড়িয়েছেন। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


(وَٱلَّذِی خَلَقَ ٱلۡأَزۡوَ ٰ⁠جَ كُلَّهَا وَجَعَلَ لَكُم مِّنَ ٱلۡفُلۡكِ وَٱلۡأَنۡعَـٰمِ مَا تَرۡكَبُونَ ۝ لِتَسۡتَوُۥا۟ عَلَىٰ ظُهُورِهِۦ ثُمَّ تَذۡكُرُوا۟ نِعۡمَةَ رَبِّكُمۡ إِذَا ٱسۡتَوَیۡتُمۡ عَلَیۡهِ وَتَقُولُوا۟ سُبۡحَـٰنَ ٱلَّذِی سَخَّرَ لَنَا هَـٰذَا وَمَا كُنَّا لَهُۥ مُقۡرِنِینَ ۝ وَإِنَّاۤ إِلَىٰ رَبِّنَا لَمُنقَلِبُونَ)[Surat Az-Zukhruf ১২ - ১৪]


অর্থাৎ- যিনি জোড়াসমূহের প্রত্যেককে সৃষ্টি করেন এবং যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেন এমন নৌযান ও পশু যাতে তোমরা আরোহণ কর। যাতে তোমরা তাদের পিঠে স্থির হয়ে বসতে পার। তারপর তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তোমরা তার উপর স্থির হয়ে 'বস এবং বল, পবিত্র ও মহান তিনি যিনি এদেরকে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যদিও আমরা এদেরকে বশীভূত করতে সমর্থ ছিলাম না। আমরা আমাদের প্রতিপালকের কাছে অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব। (৪০: ১২-১৪)


এভাবে যাবতীয় কাজের শুরুতে দু’আ করার আদেশ দেওয়া হয়ে থাকে, যাতে তা মঙ্গলজনক ও বরকতময় এবং তার শেষ পরিণাম শুভ হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন হিজরত করেন তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে বলেছিলেনঃ


(وَقُل رَّبِّ أَدۡخِلۡنِی مُدۡخَلَ صِدۡقࣲ وَأَخۡرِجۡنِی مُخۡرَجَ صِدۡقࣲ وَٱجۡعَل لِّی مِن لَّدُنكَ سُلۡطَـٰنࣰا نَّصِیرࣰا)


[Surat Al-Isra' ৮০]


অর্থাৎ-বল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে প্রবেশ করাও কল্যাণের সাথে এবং আমাকে বের করাও কল্যাণের সাথে এবং তোমার কাছ থেকে আমাকে দান কর সাহায্যকারী শক্তি। (১৭: ৮০) বলাবাহুল্য যে, নূহ (عليه السلام) এ উপদেশ মত কাজ করেন।


( وَقَالَ ٱرۡكَبُوا۟ فِیهَا بِسۡمِ ٱللَّهِ مَجۡرٜىٰهَا وَمُرۡسَىٰهَاۤۚ إِنَّ رَبِّی لَغَفُورࣱ رَّحِیمࣱ)


[Surat Hud ৪১]


অর্থাৎ—এবং বলেন, তোমরা এতে আরোহণ কর, আল্লাহর নামে এর গতি ও স্থিতি, আমার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (১১: ৪১) অর্থাৎ এর চলার শুরু এবং শেষ আল্লাহরই নামে। আমার প্রতিপালক ক্ষমাশীল ও দয়ালু হওয়ার সাথে সাথে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিদাতাও বটে। অপরাধী সম্প্রদায় থেকে তার শাস্তি রোধ করার সাধ্য কারো নেই যেমনটি আপতিত হয়েছিল। তাদের প্রতি, যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করেছিল এবং তাকে বাদ দিয়ে অন্যের পূজা করেছিল।


আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَهِیَ تَجۡرِی بِهِمۡ فِی مَوۡجࣲ كَٱلۡجِبَالِ )


[Surat Hud ৪২]


অর্থাৎ—পাহাড়তুল্য তরঙ্গমালার মধ্যে তা তাদেরকে নিয়ে চলল। (১১: ৪২)


তা এভাবে হয়েছিল যে, আল্লাহ্ তা’আলা আকাশ হতে এমন বৃষ্টি বর্ষণ করেন, যা পৃথিবীতে ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি এবং এমন বৃষ্টি পরেও আর কখনো হবার নয়—যা ছিল মশকের খোলা মুখের মত অঝোর ধারায়। আর আল্লাহ্ তা’আলা ভূমিকে আদেশ দেন, ফলে তা সর্বদিক থেকে উৎসারিত হয়ে উঠে।


যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


(فَدَعَا رَبَّهُۥۤ أَنِّی مَغۡلُوبࣱ فَٱنتَصِرۡ ۝ فَفَتَحۡنَاۤ أَبۡوَ ٰ⁠بَ ٱلسَّمَاۤءِ بِمَاۤءࣲ مُّنۡهَمِرࣲ ۝ وَفَجَّرۡنَا ٱلۡأَرۡضَ عُیُونࣰا فَٱلۡتَقَى ٱلۡمَاۤءُ عَلَىٰۤ أَمۡرࣲ قَدۡ قُدِرَ ۝ وَحَمَلۡنَـٰهُ عَلَىٰ ذَاتِ أَلۡوَ ٰ⁠حࣲ وَدُسُرࣲ ۝ تَجۡرِی بِأَعۡیُنِنَا جَزَاۤءࣰ لِّمَن كَانَ كُفِرَ)[Surat Al-Qamar ১০ - ১৪]


অর্থাৎ- তখন নূহ তার প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল, আমি তো অর্সহায়, অতএব, তুমি প্রতিবিধান কর। ফলে আমি উন্মুক্ত করে দিলাম আকাশের দ্বার প্রবল বারি বর্ষণে এবং মাটি থেকে উৎসারিত করলাম ঝর্ণাধারা। তারপর সকল পানি মিলিত হলো এক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে। তখন নূহকে আরোহণ করালাম কাঠ ও পেরেক নির্মিত এক নৌযানে যা চলত আমার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এটা ছিল প্রতিশোধ তার পক্ষ থেকে যাকে (নূহকে) প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। (৫৪: ১০-১৪)


ইবন জারীর (رحمة الله) প্রমুখ ঐতিহাসিক বর্ণনা করেন যে, কিবতীদের বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী এ মহাপ্লাবন ‘আব’ মাসের ১৩ তারিখে শুরু হয়েছিল। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


(إِنَّا لَمَّا طَغَا ٱلۡمَاۤءُ حَمَلۡنَـٰكُمۡ فِی ٱلۡجَارِیَةِ ۝ لِنَجۡعَلَهَا لَكُمۡ تَذۡكِرَةࣰ وَتَعِیَهَاۤ أُذُنࣱ وَ ٰ⁠عِیَةࣱ)


[Surat Al-Haqqah ১১ - ১২]


অর্থাৎ- যখন জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল তখন আমি তোমাদেরকে আরোহণ করিয়েছিলাম নৌযানে, আমি তা করেছিলাম তোমাদের শিক্ষার জন্যে এবং এজন্য যে, শ্রুতিধর কান তা সংরক্ষণ করে। (৬৯: ১১-১২)


অনেক মুফাসসির বলেন, পানি পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ার পনের হাত উপর পর্যন্ত উঁচু হয়েছিল। আহলি কিতাবদের অভিমতও এটাই। কেউ কেউ বলেন, আশি হাত। সে প্লাবনে সমগ্র পৃথিবীর সমভূমি, পাথুরে ভূমি, পাহাড়, পর্বত ও বালুকাময় প্রান্তর সবই প্লাবিত হয়েছিল, ভূপৃষ্ঠে ছোট-বড় কোন একটি প্রাণীও অবশিষ্ট ছিল না। ইমাম মালিক (رحمة الله) যায়দ ইবন আসলাম (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, সে যুগের অধিবাসীরা সমতল ভূমি ও পাহাড়-পর্বত সবকিছু পরিপূর্ণ করে রেখেছিল। আবদুর রহমান ইবন যায়দ ইবন আসলাম (رضي الله عنه) বলেন, পৃথিবীর প্রতিটি ভূখণ্ডেরই কেউ না কেউ মালিক ছিল। ইবন আবু হাতিম এ দু’টি বর্ণনা দিয়েছেন।


( وَنَادَىٰ نُوحٌ ٱبۡنَهُۥ وَكَانَ فِی مَعۡزِلࣲ یَـٰبُنَیَّ ٱرۡكَب مَّعَنَا وَلَا تَكُن مَّعَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ ۝ قَالَ سَـَٔاوِیۤ إِلَىٰ جَبَلࣲ یَعۡصِمُنِی مِنَ ٱلۡمَاۤءِۚ قَالَ لَا عَاصِمَ ٱلۡیَوۡمَ مِنۡ أَمۡرِ ٱللَّهِ إِلَّا مَن رَّحِمَۚ وَحَالَ بَیۡنَهُمَا ٱلۡمَوۡجُ فَكَانَ مِنَ ٱلۡمُغۡرَقِینَ)[Surat Hud ৪২ - ৪৩]


অর্থাৎ- নূহ তার পুত্র, যে তাদের থেকে পৃথক ছিল, তাকে আহ্বান করে বলল, ‘হে আমার পুত্র! আমাদের সঙ্গে আরোহণ কর এবং কাফিরদের সঙ্গী হয়ো না।’


সে বলল, ‘আমি এমন এক পর্বতে আশ্রয় নেব যা আমাকে প্লাবন থেকে রক্ষা করবে।’ সে বলল, ‘আজ আল্লাহর বিধান থেকে রক্ষা করার কেউ নেই, যাকে আল্লাহ্ দয়া করবেন সে ব্যতীত।’ এরপর তরঙ্গ তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিল এবং সে নিমজ্জিতদের অন্তর্ভুক্ত হলো। (১১: ৪২-৪৩)


এ পুত্ৰই হলো সাম, হাম ও আফিছ-এর ভাই য়াম। কেউ কেউ বলেন, এর নাম কানআন। কাফির ও বদ-আমল হওয়ায় সে পিতার দীন-ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলে ধ্বংসপ্রাপ্তদের সঙ্গে সেও ধ্বংস হয়ে যায়। অপরদিকে তার দীন-ধর্মের সমর্থক অনেক অনাত্মীয়ও তার পিতার সঙ্গে মুক্তিলাভ করেন।


(وَقِیلَ یَـٰۤأَرۡضُ ٱبۡلَعِی مَاۤءَكِ وَیَـٰسَمَاۤءُ أَقۡلِعِی وَغِیضَ ٱلۡمَاۤءُ وَقُضِیَ ٱلۡأَمۡرُ وَٱسۡتَوَتۡ عَلَى ٱلۡجُودِیِّۖ وَقِیلَ بُعۡدࣰا لِّلۡقَوۡمِ ٱلظَّـٰلِمِینَ)[Surat Hud ৪৪]


অর্থাৎ এরপর বলা হলো, হে পৃথিবী! তুমি তোমার পানি গ্রাস করে নাও এবং হে আকাশ! ক্ষান্ত হও। এরপর বন্যা প্রশমিত হলো এবং কার্য সমাপ্ত হলো, নৌকা জুদী পর্বতের উপর স্থির হলো এবং বলা হলো, জালিম সম্প্রদায় ধ্বংস হোক। (১১: ৪৪)


অর্থাৎ প্লাবনে গাইরুল্লাহর পূজারীদের সকলে সমূলে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর আল্লাহ্ তা’আলা পৃথিবীকে তার পানি গ্রাস করে নেয়া এবং আকাশকে বারি বর্ষণ ক্ষান্ত করার আদেশ দেন। غيض الماء অর্থ পানি পূর্বে যা ছিল তার চেয়ে কমে গেল। আর قضي الامر অর্থ আল্লাহ্ তা’আলা ইল্‌ম ও তাঁর নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে তাদের প্রতি যে আযাব ও ধ্বংস আপতিত হওয়ার কথা ছিল তা বাস্তবায়িত হলো ।


(وَقِیلَ بُعۡدࣰا لِّلۡقَوۡمِ ٱلظَّـٰلِمِینَ)


[Surat Hud ৪৪]


অর্থাৎ- (কুদরতের ভাষায় ঘোষণা দেয়া হলো যে), ওরা রহমত ও মাগফিরাত থেকে দূর হোক। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


(فَكَذَّبُوهُ فَأَنجَیۡنَـٰهُ وَٱلَّذِینَ مَعَهُۥ فِی ٱلۡفُلۡكِ وَأَغۡرَقۡنَا ٱلَّذِینَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَاۤۚ إِنَّهُمۡ كَانُوا۟ قَوۡمًا عَمِینَ)


[Surat Al-A'raf ৬৪]


অর্থাৎ তারপর তারা তাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করে। ফলে আমি তাকে ও তার সঙ্গে যারা নৌকায় ছিল তাদেরকে উদ্ধার করি এবং যারা আমার নিদর্শনসমূহ প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদেরকেও নিমজ্জিত করি। তারা ছিল এক অন্ধ সম্প্রদায়। (৭: ৬৪)


(فَكَذَّبُوهُ فَنَجَّیۡنَـٰهُ وَمَن مَّعَهُۥ فِی ٱلۡفُلۡكِ وَجَعَلۡنَـٰهُمۡ خَلَـٰۤىِٕفَ وَأَغۡرَقۡنَا ٱلَّذِینَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَاۖ فَٱنظُرۡ كَیۡفَ كَانَ عَـٰقِبَةُ ٱلۡمُنذَرِینَ)[Surat Yunus ৭৩]


অর্থাৎ-আর তারা তাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করে। তারপর তাকে ও তার সঙ্গে যা নৌকায় ছিল তাদেরকে আমি উদ্ধার করি এবং তাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করি ও যারা আমার নিদর্শনসমূহকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদেরকে নিমজ্জিত করি। সুতরাং দেখ, যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল তাদের পরিণাম কী হয়েছিল? (১০: ৭৩)


(وَنَصَرۡنَـٰهُ مِنَ ٱلۡقَوۡمِ ٱلَّذِینَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَاۤۚ إِنَّهُمۡ كَانُوا۟ قَوۡمَ سَوۡءࣲ فَأَغۡرَقۡنَـٰهُمۡ أَجۡمَعِینَ)


[Surat Al-Anbiya' ৭৭]


অর্থাৎ-এবং আমি তাকে সাহায্য করেছিলাম সে সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যারা আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করেছিল, তারা ছিল এক মন্দ সম্প্রদায়। এজন্য তাদের সকলকেই আমি নিমজ্জিত করেছিলাম। (২১: ৭৭)


(فَأَنجَیۡنَـٰهُ وَمَن مَّعَهُۥ فِی ٱلۡفُلۡكِ ٱلۡمَشۡحُونِ ۝ ثُمَّ أَغۡرَقۡنَا بَعۡدُ ٱلۡبَاقِینَ ۝ إِنَّ فِی ذَ ٰ⁠لِكَ لَـَٔایَةࣰۖ وَمَا كَانَ أَكۡثَرُهُم مُّؤۡمِنِینَ ۝ وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ ٱلۡعَزِیزُ ٱلرَّحِیمُ)


[Surat Ash-Shu'ara ১১৯ - ১২২]


অর্থাৎ--তারপর আমি তাকে ও তার সঙ্গে যারা ছিল তাদেরকে রক্ষা করলাম বোঝাই নৌযানে। তারপর অবশিষ্ট সকলকে নিমজ্জিত করলাম। এতে অবশ্যই রয়েছে নিদর্শন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী নয় এবং তোমার প্রতিপালক! তিনি তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (২৬: ১১৯-১২২)


(فَأَنجَیۡنَـٰهُ وَأَصۡحَـٰبَ ٱلسَّفِینَةِ وَجَعَلۡنَـٰهَاۤ ءَایَةࣰ لِّلۡعَـٰلَمِینَ)


[Surat Al-Ankabut ১৫]


অর্থাৎ--তারপর আমি তাকে এবং যারা নৌকায় আরোহণ করেছিল তাদেরকে রক্ষা করলাম এবং বিশ্বজগতের জন্য একে করলাম একটি নিদর্শন। (২৯: ১৫)


(ثُمَّ أَغۡرَقۡنَا ٱلۡـَٔاخَرِینَ)


[Surat As-Saaffat ৮২]


তারপর অবশিষ্ট সকলকে আমি নিমজ্জিত করি। (৩৭-৮২)


(وَلَقَد تَّرَكۡنَـٰهَاۤ ءَایَةࣰ فَهَلۡ مِن مُّدَّكِرࣲ ۝ فَكَیۡفَ كَانَ عَذَابِی وَنُذُرِ ۝ وَلَقَدۡ یَسَّرۡنَا ٱلۡقُرۡءَانَ لِلذِّكۡرِ فَهَلۡ مِن مُّدَّكِرࣲ)[Surat Al-Qamar ১৫ - ১৭]


অর্থাৎ--আমি একে রেখে দিয়েছি এক নিদর্শনরূপে। অতএব, উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? কি কঠোর ছিল আমার শান্তি ও সতর্কবাণী! কুরআনকে আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, কে আছে উপদেশ গ্রহণের জন্য? (৫৪: ১৫-১৭)


(مِّمَّا خَطِیۤـَٔـٰتِهِمۡ أُغۡرِقُوا۟ فَأُدۡخِلُوا۟ نَارࣰا فَلَمۡ یَجِدُوا۟ لَهُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ أَنصَارࣰا ۝ وَقَالَ نُوحࣱ رَّبِّ لَا تَذَرۡ عَلَى ٱلۡأَرۡضِ مِنَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ دَیَّارًا ۝ إِنَّكَ إِن تَذَرۡهُمۡ یُضِلُّوا۟ عِبَادَكَ وَلَا یَلِدُوۤا۟ إِلَّا فَاجِرࣰا كَفَّارࣰا)[Surat Nuh ২৫ - ২৭]


অর্থাৎ--তাদের অপরাধের জন্য তাদেরকে নিমজ্জিত করা হয়েছিল এবং পরে তাদেরকে দাখিল করা হয়েছিল আগুনে; তারপর তারা কাউকেও আল্লাহর মুকাবিলায় সাহায্যকারী পায়নি।


নূহ আরো বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরদের মধ্য থেকে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিও না। তুমি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে তারা তোমার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে কেবল দুষ্কৃতকারী ও কাফির। (৭১: ২৫-২৭)


বলাবাহুল্য যে, আল্লাহ্ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-এর বদদু’আ কবুল করেছিলেন। সমস্ত প্রশংসা ও অনুগ্রহ তাঁরই। ফলে তাদের একটি প্রাণীও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।।


ইমাম আবু জাফর ইবন জারীর ও আবু মুহাম্মদ ইবন আবু হাতিম আপন আপন তাফসীরে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (رضي الله عنه)-এর বরাতে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ নূহের সম্প্রদায়ের কারো প্রতি যদি আল্লাহ দয়া করতেন, তাহলে অবশ্যই শিশুর মায়ের প্রতি দয়া করতেন। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেনঃ নূহ (عليه السلام) তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে (পঞ্চাশ কম) এক হাজার বছর অবস্থান করেন এবং বৃক্ষ রোপণ করে একশ’ বছর অপেক্ষা করেন। বৃক্ষটি বড় হয়ে পোক্ত হলে তা কেটে তা দিয়ে নৌকা নির্মাণ করেন। নৌকা নির্মাণকালে সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর নিকট দিয়ে অতিক্রম করত, তাকে ঠাট্টা করত এবং বলত, তুমি ডাঙ্গায় নৌকা নির্মাণ করছ, এ চলবে কিভাবে? নূহ (عليه السلام) বলতেন, অচিরেই তোমরা জানতে পারবে।


যখন তিনি নৌকা নির্মাণ শেষ করলেন এবং পানি উৎসারিত হলো ও তা অলিতে-গলিতে ঢুকে পড়ল, তখন একটি শিশুর মা তার ব্যাপারে আশংকা বোধ করল। সে তাকে অত্যন্ত স্নেহ করত। অগত্যা শিশুটিকে নিয়ে সে এক পাহাড়ের এক-তৃতীয়াংশ উপরে গিয়ে উঠে। পানি বাড়তে বাড়তে তার পর্যন্ত পৌঁছুলে এবার সে শিশুটিকে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে ওঠে। এবার পানি তার ঘাড় পর্যন্ত পৌঁছুলে সে তার দু হাত দ্বারা শিশুটিকে উপরে তুলে ধরে। তারপর তারা দুজনই ডুবে যায়। আল্লাহ্ যদি তাদের কাউকে দয়া করতেন, তাহলে ঐ শিশুর মাকে অবশ্যই দয়া করতেন।


এ হাদীসটি গরীব পর্যায়ের। কা’ব আল-আহবার ও মুজাহিদ প্রমুখ থেকে এর অনুরূপ কাহিনী বর্ণিত আছে। এ হাদীসটিও কা’ব আল-আহবারের ন্যায় কারো থেকে মওকুফ হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। আল্লাহ্ ভালো জানেন।


মোটকথা, আল্লাহ্ তা’আলা কাফিরদের একটি গৃহবাসীকেও অবশিষ্ট রাখেননি। সুতরাং কোন কোন মুফাসসির কিভাবে ধারণা করেন যে, আওজ ইবন উনুক মতান্তরে ইবন আনাক নূহ (عليه السلام)-এর পূর্ব থেকে মূসা (عليه السلام)-এর আমল পর্যন্ত বেঁচে ছিল। অথচ তারাই বলেন যে, সে ছিল সীমালংঘনকারী, উদ্ধত ও বিরুদ্ধাচারী কাফির। তারা আরো বলেন যে, সে ছিল আদমের কন্যা আনাকের জারয সন্তান। সমুদ্রের তলদেশ থেকে মাছ ধরে এনে সে সূর্যের তাপে তা সিদ্ধ করত। নূহ (عليه السلام)-কে সে উপহাস ছলে বলত, তোমার এ ছোট্ট পেয়ালাটি কি হে? তারা আরো উল্লেখ করেন যে, তার উচ্চতা ছিল তিন হাজার তিনশ তেত্রিশ হাত ছয় ইঞ্চি। এ ধরনের আরো অনেক অলীক কাহিনী রয়েছে। এ সংক্রান্ত বিবরণসমূহ এতই প্রসিদ্ধ যে, তাফসীর ও ইতিহাস ইত্যাদির বহু গ্রন্থে যদি এসব কথার উল্লেখ না থাকত; তাহলে আমরা তা আলোচনাই করতাম না। তাছাড়া এসব কথা যুক্তি এবং নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েতের পরিপন্থী।


যুক্তি বলে, আল্লাহ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-এর পুত্রকে তার কুফরীর কারণে ধ্বংস করবেন, অথচ তার পিতা হলেন উম্মতের নবী ও ঈমানদারদের প্রধান আর আওজ ইবন আনাক বা আনাককে ধ্বংস করবেন না, অথচ সে হলো চরম অত্যাচারী ও অবাধ্য; এটা হতেই পারে না। তাছাড়া অপরাধীদের কাউকে আল্লাহ দয়া করবেন না, এমনকি শিশুর মাকেও না, শিশুকেও না, আর এ স্বেচ্ছাচারী, অবাধ্য, চরম পাপাচারী কাফির ও বিতাড়িত শয়তানকে অব্যাহতি দিবেন, এটা তো হতে পারে না!


নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়তের ব্যাপারে বলা যায় আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ


(ثُمَّ أَغۡرَقۡنَا ٱلۡـَٔاخَرِینَ)


“তারপর আমি অন্যদেরকে নিমজ্জিত করি।”


(وَقَالَ نُوحࣱ رَّبِّ لَا تَذَرۡ عَلَى ٱلۡأَرۡضِ مِنَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ دَیَّارًا)


[Surat Nuh ২৬]


“সে আরো বলল, হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরদের কোন গৃহবাসীকে তুমি অব্যাহতি দিও না।" (৭১: ২৬)


তাছাড়া উক্ত মুফাসসিরগণ তার যে উচ্চতার কথা উল্লেখ করেছেন তা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীসের পরিপন্থী, যাতে বলা হয়েছে নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ ‘সৃষ্টির সময় আদম (عليه السلام)-এর উচ্চতা ছিল ষাট হাত। তারপর থেকে তা কমতে কমতে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।


এ হলো নিস্পাপ, সত্যবাদী এমন এক মহান সত্তার উক্তি, যিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না, যা প্রত্যাদেশ হয় কেবল তা-ই বলেন। তাঁর মতে, আদম (عليه السلام) থেকে এ যাবত মানুষের উচ্চতা ক্রমেই কমছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এভাবে কমতে থাকবে।


তার এ বক্তব্য প্রমাণ করে যে, আদমের সন্তানদের মধ্যে কাউকে আদম অপেক্ষা দীর্ঘ পাওয়া যায়নি। এমতাবস্থায় তাঁর এ তথ্য বর্জন করে আহলি কিতাবদের সেসব মিথ্যাবাদী কাফিরদের অভিমত কিভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে, যারা আল্লাহ্ তা’আলার নাযিলকৃত কিতাবসমূহকে পরিবর্তন ও বিকৃত করে ফেলেছে এবং তার প্রচুর অপব্যাখ্যা করেছে? এ-ই যেখানে অবস্থা, সেখানে একান্তই তাদের নিজস্ব অভিমত এবং বর্ণনা সম্পর্কে তাদের উপর কতটুকু নির্ভর করা চলে? আমাদের ধারণা, আওজ ইবন আনাক সম্পর্কিত এ তথ্য তাদেরই একদল নাস্তিক ও পাপাচারীর স্বকপোলকল্পিক উক্তি, যারা ছিল নবীদের শত্রু। আল্লাহ্ ভালো জানেন।


তারপর আল্লাহ্ তা’আলা নূহ (عليه السلام) কর্তৃক তাঁর পুত্রের ব্যাপারে তাঁর প্রতিপালকের কাছে ফরিয়াদ করার এবং অবগতি লাভের উদ্দেশ্যে তার নিমজ্জিত হওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করার কথা উল্লেখ করেন। প্রশ্ন করার কারণ হলো এই যে, আপনি আমার পরিবার-পরিজনকে আমার সাথে রক্ষা করার ওয়াদা করেছিলেন। আর এও তো তাদেরই একজন। অথচ সে নিমজ্জিত হলো। এর উত্তরে বলা হলো, সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়, যাদেরকে রক্ষা করার ওয়াদা আমি তোমাকে দিয়েছিলাম অর্থাৎ আমি কি তোমাকে এ কথা বলিনি যে, তোমার পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করবো তবে তাকে নয় যার বিরুদ্ধে পূর্বেই ধ্বংসের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। তোমার এ পুত্র তো তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ পূর্বেই তা আমি বলে দিয়েছিলাম যে, কুফরীর কারণে এ নিমজ্জিত হবে। এজন্যই তো ভাগ্য তাকে ঈমানদারদের পরিবেশ থেকে সরিয়ে নেয়। পরিণামে সে কাফির ও সীমালংঘন কারীদের দলের সঙ্গে নিমজ্জিত হয়েছে।


তারপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(قِیلَ یَـٰنُوحُ ٱهۡبِطۡ بِسَلَـٰمࣲ مِّنَّا وَبَرَكَـٰتٍ عَلَیۡكَ وَعَلَىٰۤ أُمَمࣲ مِّمَّن مَّعَكَۚ وَأُمَمࣱ سَنُمَتِّعُهُمۡ ثُمَّ یَمَسُّهُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِیمࣱ)[Surat Hud ৪৮]


অর্থাৎ- বলা হলো, হে নূহ! অবতরণ কর আমার প্রদত্ত শান্তিসহ এবং তোমার প্রতি ও যে সমস্ত সম্প্রদায় তোমার সঙ্গে আছে তাদের প্রতি কল্যাণসহ; অপর সম্প্রদায়সমূহকে আমি জীবন উপভোগ করতে দেব, পরে আমার পক্ষ থেকে মর্মন্তুদ শাস্তি তাদেরকে স্পর্শ করবে। (১১: ৪৮)


এ হলো নূহ (عليه السلام)-এর প্রতি সে সময়কার আদেশ, যখন পানি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সরে গিয়েছিল, তা চলাচল ও অবস্থান উপযোগী হয়েছিল এবং দীর্ঘ ভ্রমণের পর জুদী পর্বতের পৃষ্ঠদেশে স্থির হয়ে থাকা নৌকা থেকে নেমে যাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠেছিল। জুদী জযিরা অঞ্চলের একটি প্রসিদ্ধ পর্বতের নাম। পর্বত সৃষ্টির অধ্যায়ে আমরা এর আলোচনা করে এসেছি।


( بِسَلَـٰمࣲ مِّنَّا وَبَرَكَـٰتٍ ) অর্থ হলো, তুমি নিরাপদে এবং তোমার প্রতি এবং তোমার ভবিষ্যত বংশধরদের প্রতি বরকতসহ অবতরণ কর। এখানে ভবিষ্যত বংশধর বলতে শুধু নূহ (عليه السلام)-এর বংশধর এজন্য বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা নূহ (عليه السلام) ব্যতীত তাঁর ঈমানদার সঙ্গীদের অন্য কারো বংশ ও উত্তরসুরি সৃষ্টি করেননি।


আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(وَجَعَلۡنَا ذُرِّیَّتَهُۥ هُمُ ٱلۡبَاقِینَ)


[Surat As-Saaffat ৭৭]


অর্থাৎ, আমি তার বংশধরকেই অবশিষ্ট রেখেছি। (৩৭: ৭৭) অতএব, যত আদম সন্তান আজ ভূ-পৃষ্ঠে আছে তারা সকলেই নূহ (عليه السلام)-এর তিন পুত্র সাম, হাম ও য়াফিস-এর বংশধর!


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, সামুরা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ সাম আরবের আদি পুরুষ, হাম আবিসিনিয়ার আদি পুরুষ এবং আফিছ রূমের আদি পুরুষ।


আর ইমাম তিরমিযীও হাদীসটি হুবহু বর্ণনা করেছেন। শায়খ আবু ইমরান ও ইব্‌ন আবদুল বার বলেন যে, ইমরান ইবন হুসায়ন (رضي الله عنه) সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে অনুরূপ বর্ণিত আছে।


উপরোক্ত হাদীসে রূম দ্বারা প্রথম রূম বুঝানো হয়েছে। এরা হলো গ্রীক জাতি। এদের বংশধারা রূমী ইব্‌ন লিবতী ইবন ইউনান ইব্‌ন য়াফিস ইবন নূহ (عليه السلام) পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। সাঈদ ইবন মুসায়্যাব সূত্রে বর্ণিত হাদীসে আছে যে, তিনি বলেছেনঃ নূহ (عليه السلام)-এর তিন পুত্র জন্মলাভ করে। সাম, আফিস ও হাম। আবার এ তিনজনের প্রত্যেকের তিনটি করে পুত্র জন্ম নেয়। সাম-এর পুত্ররা হলো আরব, ফারিস ও রূম। আফিস-এর পুত্ররা হলো তুর্ক, সাকালিবা ও য়াজুজ-মাজুজ এবং হামের পুত্ররা হলো কিবত, সূদান ও বারবার।


হাফিজ আবু বকর বাযযার তাঁর মুসনাদে বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “নূহের ঔরসে সাম, হাম ও আফিস জন্মগ্রহণ করেন। তারপর সামের ঔরসে আরব, ফারিস ও রূমরা জন্মগ্রহণ করে। এদের মধ্যে আফিছ-এর ঔরসে জন্ম নেয় য়াজুজ-মাজুজ, তুর্ক ও সাকালিবা। এদের মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। আর হামের ঔরসে জন্ম নেয় কিবত, বারবার ও সূদান। এ বর্ণনাটি মারফু নাকি মুরসাল পর্যায়ের এ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।


কথিত আছে যে, নূহ (عليه السلام)-এর তিন পুত্রের জন্ম প্লাবনের পরেই হয়েছিল। প্লাবনের পূর্বে তার ঔরসে কানআনের জন্ম হয়েছিল, যে নিমজ্জিত হয়ে যায় এবং তার অপর পুত্র আবির-এর মৃত্যু প্লাবনের পূর্বেই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সঠিক কথা হলো, তার তিন পুত্র তাঁর সঙ্গে নৌকায় ছিলেন। তাদের মাতা এবং স্ত্রীগণও তাদের সঙ্গে ছিলেন। এটাই তাওরাতের ভাষ্য। আরো বর্ণিত আছে যে, হাম নৌকায় তার স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম করেন। ফলে নূহ (عليه السلام) তার জন্য বদ দু’আ করেন যেন তার এ বীর্য দ্বারা কুশ্রী সন্তান সৃষ্টি করা হয়। পরিণামে তার একটি কালো সন্তান জন্ম নেয়। সে হলো সুদানের আদি পুরুষ কানআন ইবন হাম। বরং ঘটনাটি সম্পর্কে কথিত আছে যে, হাম তার পিতাকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিবস্ত্র অবস্থায় দেখেও তার সতর আবৃত করে দেননি। পরে তার অপর দু’ভাই তা আবৃত করে দেন। এজন্য নূহ (عليه السلام) তার জন্য এ বদ দু’আ করেন, যেন তার শুক্রের বিকৃতি ঘটে এবং তার সন্তানগণ যেন তার ভাইদের দাস হয়ে থাকে।


ইমাম আবু জাফর ইবন জারীর ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ হাওয়ারীগণ ঈসা ইবন মরিয়মকে বললেন, নূহ (عليه السلام)-এর নৌযানে ছিলেন এমন একজন লোককে আপনি আমাদের জন্য যদি পুনজীর্বিত করে দিতেন তাহলে তার কাছে আমরা নূহ (عليه السلام)-এর নৌযানের বিবরণ শুনতে পেতাম। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, ফলে ঈসা (عليه السلام) তাদেরকে নিয়ে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একটি মাটির ঢিবির নিকট উপনীত হন এবং তা থেকে এক মুষ্টি মাটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘তোমরা কি জান এগুলো কি?’ তারা বলল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন।’ ঈসা (عليه السلام) বললেন, ‘এ হলো নূহ-এর পুত্র হাম-এর পায়ের গিট।’ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, তারপর তিনি হাতের লাঠি দ্বারা টিবিতে আঘাত করে বললেন, ‘আল্লাহর আদেশে উঠে দাঁড়াও।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি (হাম ইবন নূহ) মাথা থেকে ধুলা-বালি ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর চুল পাকা দেখে ঈসা (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি এ অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছিলেন?’ জবাবে হাম বললেনঃ ‘না, বরং যুবক অবস্থায়ই আমার মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু আমি ধারণা করেছিলাম, এ বুঝি কিয়ামত তাতেই আমার চুল পেকে যায়।’


ঈসা (عليه السلام) বললেন, ‘আমাদেরকে নূহের নৌকার একটি বিবরণ দিন তো!’ জবাবে তিনি বললেনঃ ‘তার দৈর্ঘ্য ছিল এক হাজার দু’শ হাত আর প্রস্থ ছিল ছয়শ হাত। এটি ছিল তিনতলা বিশিষ্ট। একতলায় ছিল জীব-জানোয়ার ও হিংস্র পশ্বাদি। একতলায় মানুষ এবং আরেক তলায় পাখি। জীব-জানোয়ারের মল অধিক হয়ে গেলে আল্লাহ্ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-এর প্রতি ওহী নাযিল করলেন যে, তুমি হাতীর লেজটা উঁচিয়ে ধর। তিনি তা-ই করলেন। ফলে তার মধ্য থেকে একটি শূকর ও একটি শূকরী বেরিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে তারা মল খেতে শুরু করে। আবার ইঁদুর যখন নৌকা ছিদ্র করতে শুরু করে দেয়, তখন আল্লাহ্ তা’আলা নূহ-এর প্রতি প্রত্যাদেশ করেন যে, তুমি সিংহের দু’চক্ষুর মাঝখানে আঘাত কর। তিনি তাই করলেন। ফলে তার নাকের ছিদ্র থেকে একটি বিড়াল এ একটি বিড়ালী বের হয়ে এসে সঙ্গে সঙ্গে ইঁদুরের উপর ঝাপিয়ে পড়ে।


তখন ঈসা (عليه السلام) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‚নূহ (عليه السلام) কিভাবে জানতে পেরেছিলেন যে, গোটা পৃথিবী নিমজ্জিত হয়ে গেছে?’ হাম বললেনঃ ‘সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি একটি কাক প্রেরণ করেছিলেন। কাকটি একটি মড়া দেখতে পেয়ে তা খেতে আরম্ভ করে। এ জন্য নূহ (عليه السلام) তার জন্য বদ দু’আ করেন, যেন সে সর্বদা ভীত থাকে। এ কারণেই কাক ঘড়-বাড়িতে থাকে না। তারপর তিনি কবুতর প্রেরণ করেন। কবুতরটি ঠোঁটে করে একটি যয়তুন পাতা এবং পায়ে করে কিছু কাদা মাটি নিয়ে আসে। এতে নূহ (عليه السلام) বুঝতে পারলেন যে, সমগ্র ভূ-ভাগ নিমজ্জিত হয়ে গেছে। তখন তিনি তার গলায় একটি সবুজ বেষ্টনী দিয়ে দেন এবং তার জন্য দু’আ করলেন, যেন সে লোকালয়ে ও নিরাপদে থাকতে পারে। তখন থেকেই কবুতর ঘরে থাকতে শুরু করে।


ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, তারপর হাওয়ারীগণ বললেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল! একে আমরা আমাদের পরিবার-পরিজনের কাছে নিয়ে যাব কি? এ আমাদের সঙ্গে বসে আমাদের সাথে কথাবার্তা বলবেন!’ ঈসা (عليه السلام) বললেন, ‘এমন ব্যক্তি কিভাবে তোমাদের অনুগমন করবে যার রিযিক অবশিষ্ট নেই!’ ইব্‌ন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, তারপর ঈসা (عليه السلام) বললেন, ‘আল্লাহর আদেশে আপনি পূর্বাবস্থায় ফিরে যান।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে রূপান্তরিত হয়ে যান। এটি একান্তই একটি গরীব পর্যায়ের বর্ণনা।


আলবা ইবন আহমার ইকরিমা (رضي الله عنه) সূত্রে এবং তিনি ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, নৌকায় নূহ (عليه السلام)-এর সঙ্গে আশিজন পুরুষ এবং তাঁদের পরিবার-পরিজন ছিলেন। নৌকায় তারা একশ পঞ্চাশ দিন অবস্থান করেন। আল্লাহ তা’আলা প্রথমে নৌকাটি মক্কা অভিমুখী করে দেন। ফলে তা বায়তুল্লাহর চতুষ্পর্শ্বে চল্লিশ দিন যাবত ঘুরতে থাকে। তারপর তাকে জুদীর দিকে ফিরিয়ে দিলে তথায় গিয়ে তা স্থিত হয়। তখন নূহ (عليه السلام) পৃথিবীর সংবাদ সংগ্রহের জন্য একটি কাক প্রেরণ করেন। কাকটি গিয়ে একটি মড়ার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এতে তার ফিরতে বিলম্ব হয়ে যায়। ফলে নূহ (عليه السلام) এবার একটি পায়রা প্রেরণ করেন। পায়রা তার দু’পায়ে কাদা মাটি মাখা অবস্থায় একটি যয়তুন পাতা নিয়ে ফিরে আসে। এতে নূহ (عليه السلام) বুঝতে পারলেন যে, পানি নেমে গিয়েছে। তাই তিনি জুদী পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসেন এবং একটি পল্লী নির্মাণ করে তার আশিটি নামকরণ করে দেন। ফলে হঠাৎ একদিন তাদের মুখের বুলি আশিটি ভাষায় পরিণত হয়ে যায়। তার একটি হলো আরবী। তখন তারা কেউ কারো ভাষা বুঝত না। নূহ (عليه السلام) একজনের কথা অপরজনকে বুঝিয়ে দিতেন।


কাতাদা (رحمة الله) প্রমুখ বলেন, রজব মাসের দশম তারিখে তারা নৌকায় আরোহণ করে একশ’ পঞ্চাশ দিন ভ্রমণ করেন এবং জুদীর উপর স্থিত অবস্থায় তাদের নিয়ে নৌকাটি একমাস অবস্থান করে। আর মুহাররম মাসের আশুরা দিবসে তারা নৌকা থেকে বেরিয়ে আসেন। ইবন জারীর (رحمة الله) এর সমর্থনে একটি মারফু হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর সেদিন তারা রোযাও রেখেছিলেন।


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন কতিপয় ইহুদীর নিকট দিয়ে অতিক্রম করেন। তাঁরা সেদিন আশুরার দিবসের রোযা রেখেছিল।


তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ কিসের রোযা?’ তারা বলল, ‘সেই দিন যেদিন আল্লাহ তা’আলা মূসা (عليه السلام) ও বনী ইসরাঈলকে নিমজ্জিত হওয়া থেকে উদ্ধার করেন এবং ফিরআউন ডুবে মরে। আর এদিনে (নূহ আ-এর) নৌকা জুদী পর্বতে স্থিত হয়। ফলে নূহ ও মূসা (عليه السلام) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোযা রেখেছিলেন।’ একথা শুনে নবী করীম (ﷺ) বললেন, “মূসা (عليه السلام)-এর উপর আমার হকই বেশি এবং এদিনে রোযা রাখার আমিই বেশি হকদার। আর সাহাবাদেরকে তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যকার যারা আজ রোযা রেখেছে, তারা যেন তা পূর্ণ করে আর যারা খাদ্য গ্রহণ করেছে তারা যেন দিনের বাকি অংশে পানাহার না করে। সহীহ বুখারীতে অন্য সূত্রে হাদীসের সমর্থন রয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে নূহ (عليه السلام)-এর উল্লেখ গরীব পর্যায়ের।


পক্ষান্তরে, বেশ কিছু মূর্খ লোক এ কথা বর্ণনা করে থাকে যে, সেদিন তাঁরা তাঁদের সঙ্গে থাকা খাদ্য-দ্রব্যের অবশিষ্ট টুকু এবং শস্যাদি পিষে খেয়েছিলেন এবং নৌকার অন্ধকারে থাকার দরুন হ্রাসপ্রাপ্ত দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধির জন্য সুরমা ব্যবহার করেছিলেন, এর কোনটিই সঠিক নয়। এসবই হলো বনী ইসরাঈল সূত্রে বর্ণিত ভিত্তিহীন কথা, যার উপর মোটেই নির্ভর করা যায় না এবং যার অনুসরণ করা চলে না। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।


মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) বলেন, আল্লাহ তা’আলা যখন সে প্লাবন বন্ধ করার ইচ্ছা করলেন, তখন তিনি ভূ-পৃষ্ঠের উপর এক ধরনের বায়ু প্রেরণ করেন। এতে পানি শান্ত হয়ে যায় ও পৃথিবীর ঝরনাসমূহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পানি হ্রাস পেতে শুরু করে। তাওরাতওয়ালাদের ধারণা মতে, নৌকার স্থিতি ছিল রজবের আঠার তারিখে এবং শাওয়ালের প্রথম তারিখে পর্বতসমূহের চূড়া দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর চল্লিশদিন অতিবাহিত হওয়ার পরে নূহ (عليه السلام) নৌকার বাতায়ন খুলে ফেলেন। তারপর পানির অবস্থা দেখে আসার জন্য একটি কাক প্রেরণ করেন। কিন্তু সে আর ফিরে না আসায় তিনি একটি কবুতর প্রেরণ করেন। কবুতর এ সংবাদ নিয়ে ফিরে আসে যে, সে পা রাখার এতটুকু স্থানও পায়নি। নুহ (عليه السلام) হাত পেতে কবুতরটি ধরে নৌকায় ঢুকিয়ে রাখেন।


এরপর আরও সাতদিন অতিক্রান্ত হলে পানির অবস্থা দেখে আসার জন্য তিনি আবারও কবুতরটি প্রেরণ করেন। কিন্তু এবার আর সে সহসা ফিরে আসল না। সন্ধ্যার সময় পায়রাটি একটি যয়তুন পাতা মুখে করে ফিরে আসে। এতে নূহ (عليه السلام) বুঝতে পারলেন যে, এবার ভূপৃষ্ঠ থেকে পানি নেমে গেছে। এরপর আরো সাতদিন অবস্থান করে তিনি পায়রাটিকে আবারো প্রেরণ করেন। কিন্তু এবার সে আর তার নিকট ফিরে যায়নি। এতে নূহ (عليه السلام) বুঝতে পারলেন যে, এবার পানি শুকিয়ে গেছে। মোটকথা, আল্লাহ তাআলার প্লাবন প্রেরণ এবং নূহ (عليه السلام)-এর কবুতর প্রেরণের মাঝে এক বছর পূর্ণ হয়ে দ্বিতীয় বছরের প্রথম তারিখ শুরু হলে ভূ-পৃষ্ঠ প্রকাশ পায় ও স্থলপথ আত্মপ্রকাশ করে এবং নূহ (عليه السلام) নৌকার ঢাকনা উন্মুক্ত করেন। ইবন ইসহাকের এ বর্ণনা হুবহু আহলি কিতাবদের হস্তস্থিত তাওরাতের বিবরণের অনুরূপ।


ইবন ইসহাক (رحمة الله) বলেন, পরবর্তী বছরের দ্বিতীয় মাসের ছাব্বিশ তারিখে বলা হলোঃ


(قِیلَ یَـٰنُوحُ ٱهۡبِطۡ بِسَلَـٰمࣲ مِّنَّا وَبَرَكَـٰتٍ عَلَیۡكَ وَعَلَىٰۤ أُمَمࣲ مِّمَّن مَّعَكَۚ وَأُمَمࣱ سَنُمَتِّعُهُمۡ ثُمَّ یَمَسُّهُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِیمࣱ)[Surat Hud ৪৮]


অর্থাৎ- হে নূহ! অবতরণ কর আমার দেয়া শান্তিসহ এবং তোমার প্রতি ও যে সমস্ত সম্প্রদায় তোমার সঙ্গে আছে তাদের প্রতি কল্যাণসহ, অপর সম্প্রদায়সমূহকে জীবন উপভোগ করতে দেব, পরে আমার পক্ষ থেকে মর্মন্তুদ শাস্তি তাদেরকে স্পর্শ করবে। (১১: ৪৮)


আহলে কিতাবদের বর্ণনা মতে, আল্লাহ তা’আলা নূহ (عليه السلام)-এর সঙ্গে এ বলে কথা বলেছিলেন যে, তুমি, তোমার স্ত্রী, তোমার পুত্রগণ, তোমার পুত্রবধুগণ এবং তোমার সঙ্গে সকল প্রাণী নিয়ে নৌকা থেকে বের হয়ে পড়। যাতে তারা পৃথিবীতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ফলে তারা বেরিয়ে যায় এবং নূহ (عليه السلام) আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশে পশু জবাই করার স্থান নির্ধারণ করেন এবং সকল প্রকার হালাল জীব-জানোয়ার ও হালাল পক্ষীকুল থেকে কিছু কিছু নিয়ে কুরবানী করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে এ প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি পুনরায় পৃথিবীবাসীর উপর (এরূপ) প্লাবন আর দিবেন না এবং এ প্রতিশ্রুতির নিদর্শনস্বরূপ মেঘের মধ্যে ধনুক স্থাপন করে রেখেছেন যাকে রঙধনু বলা হয়। ইতিপূর্বে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, রঙধনু হলো নিমজ্জিত হওয়া থেকে নিরাপত্তাস্বরূপ। মোটকথা, মেঘের মধ্যে এ ছিলাবিহীন রঙধনু স্থাপন করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ মেঘমালা থেকে প্রথমবারের ন্যায় আর প্লাবন হবে না।


পারস্য দেশীয় ও ভারত উপমহাদেশীয় কিছু সংখ্যক মূর্খ লোক প্লাবনের কথা অস্বীকার করেছে। আবার তাদেরই কেউ কেউ তা স্বীকার করে বলেছে যে, প্রাবন হয়েছিল বাবেল ভূখণ্ডে, আমাদের অঞ্চল পর্যন্ত তা পৌঁছেনি। তাদের দাবি হলো, কাইউমার্স তথা আদম (عليه السلام) থেকে এ পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে আমরা এদেশের উত্তরাধিকার ভোগ করে আসছি। এসব হলো অগ্নিপূজারী মজুসী ও শয়তানের অনুচর ধর্মদ্রোহীদের উক্তি।


এ হলো ভিত্তিহীন বাজে ধারণা, জঘন্য কুফরী ও চরম অজ্ঞতা এবং বাস্তবতার প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, আসমান-যমীনের রবকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার নামান্তর। অথচ সর্বকালের সর্ব ধর্মের সকলে প্লাবন সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে একমত। আর এ ব্যাপারেও তাদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই যে, তা হয়েছিল বিশ্বব্যাপী এবং নূহ নবীর দু’আ এবং তাকদীরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নস্বরূপ আল্লাহ তা’আলা কাফিরদের একটি প্রাণীকেও অবশিষ্ট রাখেননি।

❏ নূহ (عليه السلام) সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ


(ذۚ إِنَّهُۥ كَانَ عَبۡدࣰا شَكُورࣰا)


[Surat Al-Isra’ ৩]


“নিশ্চয়ই সে ছিল এক পরম কৃতজ্ঞ বান্দা।” কেউ কেউ বলেন, নূহ (عليه السلام) পানাহার ও পোশাক পরিধানসহ সকল কাজেই আল্লাহ তা’আলার প্রশংসা করতেন।৭৭ (গোটা সূরাটির অনুবাদ ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে। - সম্পাদক)


ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা সে বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হন, যে খাদ্য খেয়ে কিংবা পানীয় পান করে তার প্রশংসা জ্ঞাপন করে। এভাবে ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, আবু উসামা (رضي الله عنه) সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


বলাবাহুল্য যে, شكور সে ব্যক্তিকে বলা হয়, যে যাবতীয় ইবাদত পালন করে অন্তর, রসনা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা। কারণ শোকর আদায় এসব পদ্ধতিতেই হয়ে থাকে। যেমন কবি বলেনঃ


افادتكم النعماء مني ثلاثة – يذی و لسانی و الضمير المحجبا


অর্থাৎ আমার পক্ষ থেকে তিনটি নিয়ামত তোমাদেরকে উপকৃত করেছে। আমার হাত, আমার রসনা ও আমার সে হৃদয় যা দৃশ্যমান নয়।

❏ নূহ (عليه السلام)-এর সাওম পালন

ইবন মাজাহ (رحمة الله) নূহ (عليه السلام)-এর রোযা অধ্যায়ে বলেছেন যে, আবু ফিরাস (رحمة الله) বলেন, তিনি আবদুল্লাহ ইবন আমর (رضي الله عنه)-কে বলতে শুনেছেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, নূহ (عليه السلام) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন ব্যতীত সারা বছর সাওম পালন করতেন। এভাবে ইবন মাজাহ্ (رحمة الله) অন্য সূত্রে এবং অন্য পাঠেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।


তাবারানী আবদুল্লাহ ইবন আমর (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ নূহ (عليه السلام) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন ব্যতীত সারা বছর, দাউদ (عليه السلام) বছরের অর্ধেক এবং ইবরাহীম (عليه السلام) প্রতি মাসে তিনদিন করে রোযা রাখতেন।

❏ নূহ (عليه السلام)-এর হজ্জ

হাফিজ আবু ইয়ালা বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হজ্জ করেন। এক পর্যায়ে তিনি উসফান উপত্যকায় এসে উপনীত হলে বললেন, ‘আবু বকর! এ কোন উপত্যকা?’ আবু বকর (رضي الله عنه) বললেন, ‘এ হলো উসফান উপত্যকা।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ ‘এ প্রান্তর দিয়ে নূহ (عليه السلام), হুদ (عليه السلام) ও ইবরাহীম (عليه السلام) তাদের লাল রঙের জওয়ান উটনীতে চড়ে অতিক্রম করেছেন। ওগুলোর লাগাম ছিল খেজুর গাছের ছালের তৈরি। তাদের পরনে তখন থাকতো চোগা ধরনের লুঙ্গি এবং গায়ে থাকতো চিত্র-বিচিত্র চাদর। তাঁরা আদিঘর কাবায় হজ্জ পালন করতেন।’ বর্ণনাটি গরীব পর্যায়ের।


Top