❏ ইদরীস (عليه السلام)

আল্লাহ তাআলা বলেন,


(وَٱذۡكُرۡ فِی ٱلۡكِتَـٰبِ إِدۡرِیسَۚ إِنَّهُۥ كَانَ صِدِّیقࣰا نَّبِیࣰّا ۝ وَرَفَعۡنَـٰهُ مَكَانًا عَلِیًّا)


[Surat Maryam ৫৬ - ৫৭]


অর্থাৎ—স্মরণ কর, এ কিতাবে উল্লেখিত ইদরীস-এর কথা। সে ছিল সত্যনিষ্ঠ, নবী এবং আমি তাকে উন্নীত করেছিলাম উচ্চ মর্যাদায়। (১৯: ৫৬-৫৭)


এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইদ্রীস (عليه السلام)-এর প্রশংসা করেছেন এবং তাঁর নবী ও সিদ্দীক হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনিই হলেন, উপরে বর্ণিত খানুখ। বংশ বিশেষজ্ঞদের অনেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশ লতিকার অন্যতম স্তম্ভ। আদম (عليه السلام) ও শীছ (عليه السلام)-এর পরে তিনিই সর্বপ্রথম আদম সন্তান যাকে নবুওত দান করা হয়েছিল। ইবন ইসহাক (رحمة الله) বলেন, ইনিই সর্বপ্রথম কলম দ্বারা লেখার সূচনা করেন। তিনি আদম (عليه السلام)-এর জীবন কালের তিনশত আশি বছর পেয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেন, মু’আবিয়া ইবন হাকাম সুলামী-এর হাদীসে এ ইদরীস (عليه السلام)-এর প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, একজন নবী ছিলেন যিনি এ বিদ্যার সাহায্যে রেখা টানতেন। সুতরাং যার রেখা চিহ্ন তাঁর রেখা চিহ্নের অনুরূপ হবে তাঁরটা সঠিক। বেশকিছু তাফসীরকার মনে করেন যে, ইদরীস (عليه السلام)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তারা তাঁকে দুর্ধর্ষ সিংহকুলের জ্যোতিষী বলে অভিহিত করেন এবং তাদের বক্তব্যে অনেক অসত্য তথ্য তাঁর প্রতি আরোপ করা হয়েছে যেমনটি অন্য অনেক নবী-রসূল, দার্শনিক, পণ্ডিতবর্গ ও ওলীর প্রতি আরোপ করা হয়েছিল।


আল্লাহর বাণীঃ


(وَرَفَعۡنَـٰهُ مَكَانًا عَلِیًّا)


[Surat Maryam ৫৭]


(আর আমি তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছিলাম।) (১৯: ৫৭) প্রসঙ্গে সহীহ বুখারী ও মুসলিমে মিরাজ সংক্রান্ত হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চতুর্থ আসমানে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। ইবন জারীর (رحمة الله) হিলাল ইব্‌ন য়াসাফ (رحمة الله) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) আমার উপস্থিতিতে কা’ব (رضي الله عنه)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ইদ্রীস (عليه السلام) সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলার উক্তি وَرَفَعۡنَـٰهُ مَكَانًا عَلِیًّا -এর অর্থ কী? উত্তরে কা’ব (رضي الله عنه) বলেছিলেন, আল্লাহ তাআলা ইদ্রীস (عليه السلام)-এর কাছে ওহী প্রেরণ করেন যে, প্রতিদিন আমি আদম সন্তানদের সমস্ত আমলের সমপরিমাণ প্রতিদান দেবো। সম্ভবত তাঁর সমকালীন মানব সন্তানদেরকেই বুঝানো হয়েছে। এতে তিনি তাঁর আমল আরো বৃদ্ধি করতে আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েন। এরপর তাঁর এক ফেরেশতা বন্ধু তাঁর নিকট আগমন করলে তিনি তাকে বললেন, আল্লাহ তা’আলা আমার প্রতি এরূপ এরূপ ওহী পাঠিয়েছেন। আপনি মালাকুল মউত-এর সঙ্গে কথা বলুন, যাতে আমি আরো বেশি আমল করতে পারি। ফলে সেই ফেরেশতা তাঁকে তার দু’ডানার মধ্যে বহন করে আকাশে নিয়ে যান। তিনি চতুর্থ আসমানে পৌঁছলে তার সঙ্গে মালাকুল মউতের সাক্ষাত ঘটে। ফেরেশতা তার সঙ্গে ইদ্রীস (عليه السلام)-এর বক্তব্য সম্পর্কে আলাপ করেন। মালাকুল মউত বললেন, ‘ইদরীস (عليه السلام) কোথায়?’ জবাবে তিনি বললেনঃ ‘এই তো তিনি আমার পিঠের উপর।’ মালাকুল মউত বললেন, ‘আশ্চর্য! চতুর্থ আকাশে ইদ্রীস (عليه السلام)-এর রূহ্ কবয করার আদেশ দিয়ে আমাকে প্রেরণ করা হলে আমি ভাবতে লাগলাম যে, কিভাবে আমি চতুর্থ আকাশে তাঁর রূহ্ কবয করব, অথচ তিনি পৃথিবীতে রয়েছেন।’ যা হোক, মালাকুল মউত সেখানেই তাঁর রূহ কবয করেন।


আল্লাহ তা’আলার কালামঃ وَرَفَعۡنَـٰهُ مَكَانًا عَلِیًّا -এর অর্থ এটাই। ইবন আবু হাতিম (رحمة الله) এ আয়াতের তাফসীরে এ তথ্যটি বর্ণনা করেছেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, তখন ইদ্রীস (عليه السلام) সে ফেরেশতাকে বলেছিলেন যে, ‘আপনি মালাকুল মউতকে একটু জিজ্ঞাসা করুন, আমার আয়ু আর কতটুকু বাকি আছে?’ ফেরেশতা তাঁকে তা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ‘আমি না দেখে বলতে পারব না।’ তারপর দেখে তিনি বললেন, ‘তুমি আমার নিকট এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছ, যার আয়ুর এক পলক ব্যতীত আর কোন সময় অবশিষ্ট নেই।’ তারপর ঐ ফেরেশতা তার ডানার নীচের দিকে ইদ্রীস (عليه السلام)-এর প্রতি দৃষ্টিপাত করে দেখেন যে, তাঁর মৃত্যু হয়ে গেছে অথচ তিনি তা টেরই পাননি। এ তথ্য ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে গৃহীত হয়েছে। এর কিছু কিছু অংশ মুনকার পর্যায়ের। وَرَفَعۡنَـٰهُ مَكَانًا عَلِیًّا -এর ব্যাখ্যায় ইবন আবূ নাজীহ মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, ইদ্রীস (عليه السلام)-কে তুলে নেয়া হয়েছে; তার মৃত্যু হয়নি, যেমন তুলে নেয়া হয়েছে হযরত ঈসা (عليه السلام)-কে। তার এ কথার অর্থ যদি এই হয় যে, তিনি এখন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেননি, তা হলে এতে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আর যদি তার অর্থ এই হয় যে, তাঁকে জীবিতাবস্থায় তুলে নেয়া হয়েছে, তারপর সেখানে তার মৃত্যু হয়-তাহলে কাব আহবারের পূর্ব বর্ণিত অভিমতের সঙ্গে এর কোন বিরোধ নেই। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।


আওফী বলেনঃ وَرَفَعۡنَـٰهُ مَكَانًا عَلِیًّا -এর ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, ইদ্রীস (عليه السلام)-কে ষষ্ঠ আকাশে তুলে নেয়া হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। যাহহাক (رحمة الله)-এর অভিমতও তাই। ইদরীস (عليه السلام)-এর চতুর্থ আকাশে থাকা সম্পর্কিত ইমাম বুখারী ও মুসলিম (رحمة الله) বর্ণিত হাদীসটিই বিশুদ্ধতর। মুজাহিদ (رحمة الله) প্রমুখের অভিমতও তাই। হাসান বসরী (رحمة الله) বলেন, وَرَفَعۡنَـٰهُ مَكَانًا عَلِیًّا অর্থ তাকে আমি জান্নাতে তুলে নিয়েছি। অনেকের মতে, ইদরীস (عليه السلام)-কে তার পিতা য়ারদ ইবন মালাইল-এর জীবদ্দশাতেই তুলে নেয়া হয়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। কারো কারো মতে, ইদ্রীস (عليه السلام) নূহ (عليه السلام)-এর পূর্বসূরি নন বরং তিনি বনী ইসরাঈলের আমলের লোক।


ইমাম বুখারী (رحمة الله) বলেন, ইবন মাসউদ ও ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর বরাতে বলা হয়ে থাকে যে, ইলিয়াস (عليه السلام) ও ইদ্রীস (عليه السلام) অভিন্ন ব্যক্তি। মি’রাজ সম্পর্কে আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যুহরীর হাদীসের বক্তব্য দ্বারা তারা এর প্রমাণ পেশ করেন যে, উক্ত হাদীসে আছে, নবী করীম (ﷺ) যখন ইদরীস (عليه السلام)-এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন, তখন তিনি বলেছিলেন, পুণ্যবান ভাই ও পুণবান নবীকে খোশ আমদেদ। আদম (عليه السلام) ও ইবরাহীম (عليه السلام)-এর ন্যায় এ কথা বলেননি যে, পুণ্যবান নবী ও পুণ্যবান পুত্রকে খোশ আমদেদ। তারা বলেন, ইদ্রীস (عليه السلام) যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশের ঊর্ধ্বতন পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হতেন, তাহলে আদম (عليه السلام) ও ইবরাহীম (عليه السلام) যা বলেছিলেন, তিনিও তাই বলতেন। কিন্তু এতে তাদের দাবি সপ্রমাণিত হয় না। তাছাড়া বর্ণনাকারী হাদীসের বক্তব্য সুষ্ঠুভাবে মুখস্থ রাখতে না পারার সম্ভাবনাও রয়েছে। অথবা বিনয় স্বরূপ তিনি পিতৃত্বের পরিচয় না দিয়ে এরূপ বলেছেন, আদি পিতা আদম (عليه السلام) এবং আল্লাহর বন্ধু ও মুহাম্মদ (ﷺ) ব্যতীত সর্বশ্রেষ্ঠ মহান নবী ইবরাহীম (عليه السلام)-এর মত নিজের পিতৃত্বের উল্লেখ করেননি।

Top