❏ হাদীসে আদম (عليه السلام)-এর সৃষ্টি প্রসঙ্গ
আবু মূসা আশআরী (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সমগ্র পৃথিবী থেকে সংগৃহীত এক মুঠো মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেন। তাই মাটি অনুপাতে আদমের সন্তানদের কেউ হয় সাদা, কেউ হয় গৌরবর্ণ, কেউ হয় কালো, কেউ মাঝামাঝি বর্ণের। আবার কেউ হয় নোংরা, কেউ হয় পরিচ্ছন্ন, কেউ হয় কোমল, কেউ হয় পাষাণ, কেউ বা এগুলোর মাঝামাঝি। ঈষৎ শাব্দিক পার্থক্যসহ তিনি ভিন্ন সূত্রে উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আবু দাউদ, তিরমিযী এবং ইবন হিব্বান (رحمة الله) আবু মূসা আশআরী (رضي الله عنه) যার আসল নাম আবদুল্লাহ্ ইবন কায়েস (رضي الله عنه) সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেন। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন।
সুদ্দী (رحمة الله) ইবন আব্বাস ও ইবন মাসউদ (رضي الله عنه)-সহ কতিপয় সাহাবা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তারা বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা কিছু কাদামাটি নেয়ার জন্য জিবরাঈল (عليه السلام)-কে যমীনে প্রেরণ করেন। তিনি এসে মাটি নিতে চাইলে যমীন বলল, তুমি আমার অঙ্গহানি করবে বা আমাতে খুঁত সৃষ্টি করবে; এ ব্যাপারে তোমার নিকট থেকে আমি আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। ফলে জিবরাঈল (عليه السلام) মাটি না নিয়ে ফিরে গিয়ে বললেন, হে আমার রব! যমীন তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করায় আমি তাকে ছেড়ে এসেছি।
এবার আল্লাহ্ তা’আলা মীকাঈল (عليه السلام)-কে প্রেরণ করেন। যমীন তাঁর নিকট থেকেও আশ্রয় প্রার্থনা করে বসে। তাই তিনিও ফিরে গিয়ে জিবরাঈল (عليه السلام)-এর মতই বর্ণনা দেন। এবার আল্লাহ্ তা’আলা মালাকুল মউত (عليه السلام) বা মৃত্যুর ফেরেশতাকে প্রেরণ করেন। যমীন তার কাছ থেকেও আশ্রয় প্রার্থনা করলে তিনি বললেন, আর আমিও আল্লাহ্ তা’আলার আদেশ বাস্তবায়ন করে শূন্য হাতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তার পানাহ চাই। এ কথা বলে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে সাদা, লাল ও কালো রঙের কিছু মাটি সংগ্রহ করে মিশিয়ে নিয়ে চলে যান।
এ কারণেই আদম (عليه السلام)-এর সন্তানদের এক একজনের রঙ এক এক রকম হয়ে থাকে।
আজরাঈল (عليه السلام) মাটি নিয়ে উপস্থিত হলে আল্লাহ্ তা’আলা মাটিগুলো ভিজিয়ে নেন। এতে তা আটালো হয়ে যায়। তারপর ফেরেশতাদের উদ্দেশে তিনি ঘোষণা দেনঃ
وَإِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَـٰۤىِٕكَةِ إِنِّی خَـٰلِقُۢ بَشَرࣰا مِّن صَلۡصَـٰلࣲ مِّنۡ حَمَإࣲ مَّسۡنُونࣲ فَإِذَا سَوَّیۡتُهُۥ وَنَفَخۡتُ فِیهِ مِن رُّوحِی فَقَعُوا۟ لَهُۥ سَـٰجِدِینَ
[Surat Al-Hijr ২৮ - ২৯]
অর্থাৎ কাদামাটি দ্বারা আমি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তাতে আমার রূহ্ সঞ্চার করব; তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো। (১৫: ২৮)
তারপর আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে নিজ হাতে সৃষ্টি করেন, যাতে ইবলীস তার ব্যাপারে অহংকার করতে না পারে। তারপর মাটির তৈরি এ মানব দেহটি থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত যা জুম’আর দিনের অংশ বিশেষ ছিল ৭৪(উর্ধ জগতের একদিন পৃথিবীর হাজার বছরের, বর্ণনান্তরে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান বলে কুরআনের বর্ণনায় পাওয়া যায়। (বিঃ দ্রঃ ২২: ৪৭ ও ৭০: ৪) একইভাবে পড়ে থাকে। তা দেখে ফেরেশতাগণ ঘাবড়ে যান। সবচাইতে বেশি ভয় পায় ইবলীস। সে তার পাশ দিয়ে আনাগোনা করত এবং তাকে আঘাত করত। ফলে দেহটি ঠনঠনে পোড়া মাটির ন্যায় শব্দ করত। এ কারণেই মানব সৃষ্টির উপাদানকে صلصال كالفحار তথা পোড়ামাটির ন্যায় ঠনঠনে মাটি বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর ইবলীস তাঁকে বলত, তুমি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়েছ।
এক পর্যায়ে ইবলীস তার মুখ দিয়ে প্রবেশ করে পেছন দিয়ে বের হয়ে এসে ফেরেশতাগণকে বলল, একে তোমাদের ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। কেননা, তোমাদের রব হলেন সামাদ তথা অমুখাপেক্ষী আর এটি একটি শূন্যগর্ভ বস্তুমাত্র; কাছে পেলে আমি একে ধ্বংস করেই ছাড়ব।
এরপর তার মধ্যে রূহ সঞ্চার করার সময় হয়ে এলে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাগণকে বললেনঃ আমি যখন এর মধ্যে রূহ সঞ্চার করব; তখন তার প্রতি তোমরা সিজদাবনত হয়ো। যথাসময়ে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর মধ্যে রূহ সঞ্চার করলেন যখন রূহ্ তাঁর মাথায় প্রবেশ করে, তখন তিনি হাঁচি দেন। ফেরেশতাগণ বললেন, আপনি ‘আল-হামদুলিল্লাহ্’ বলুন। তিনি ‘আলা-হামদুলিল্লাহ’ বললেন। জবাবে আল্লাহ্ তা’আলা বললেনঃ يرحمك ربك (তোমার রব তোমাকে রহম করুন!) তারপর রূহ্ তাঁর দু’চোখে প্রবেশ করলে তিনি জান্নাতের ফল-ফলাদির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। এবার রূহ্ তার পেটে প্রবেশ করলে তাঁর মনে খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগে। ফলে রূহ্ পা পর্যন্ত পৌঁছানের আগেই তড়িঘরি করে তিনি জান্নাতের ফল-ফলাদির প্রতি ছুটে যান। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
خُلِقَ ٱلۡإِنسَـٰنُ مِنۡ عَجَلࣲۚ
[Surat Al-Anbiya’ ৩৭]
মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই ত্বরাপ্রবণ। (২১: ৩৭)
(فَسَجَدَ ٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةُ كُلُّهُمۡ أَجۡمَعُونَ إِلَّاۤ إِبۡلِیسَ أَبَىٰۤ أَن یَكُونَ مَعَ ٱلسَّـٰجِدِینَ)
[Surat Al-Hijr ৩০ - ৩১]
অথাৎ— তখন ইবলীস ব্যতীত ফেরেশতারা সকলেই সিজদা করল। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল। (১৫: ৩০)
সুদ্দী (رحمة الله) এভাবে কাহিনীটি শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করেন। এ কাহিনীর সমর্থনে আরো বেশ ক’টি হাদীস পাওয়া যায়। তবে তার বেশির ভাগই ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে গৃহীত।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে নিজের ইচ্ছানুযায়ী কিছুদিন তাঁকে ফেলে রাখেন। এ সুযোগে ইবলীস তাঁর চতুম্পার্শ্বে চক্কর দিতে শুরু করে। অবশেষে তাঁকে শূন্যগর্ভ দেখতে পেয়ে সে আঁচ করতে পারল যে, এটাতো এমন একটি সৃষ্টি যার সংযম ক্ষমতা থাকবে না।”
ইবন হিব্বান (رحمة الله) তার সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “আদম (عليه السلام)-এর মধ্যে রূহ সঞ্চারিত হওয়ার পর রুহ্ তার মাথায় পৌঁছুলে তিনি হাঁচি দেন এবং ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ বলেন। উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’। ঈষৎ শাব্দিক পার্থক্যসহ হাফিজ আবু বকর বাযযার (رحمة الله) (য়াহয়া ইবন মুহাম্মদ ইবন সাকান)-ও হাদীসটি বর্ণনা করেন।
উমর ইবন আব্দুল আযীয (رحمة الله) বলেন, “আদম (عليه السلام)-কে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে আদেশ করা হলে সর্বপ্রথম হযরত ইসরাফীল (عليه السلام) সিজদাবনত হন। এর পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তা’আলা তার ললাটে কুরআন অঙ্কিত করে দেন। ইবনে আসাকির এ উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন।
হাফিজ আবূ ইয়ালা (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা হযরত আদম (عليه السلام)-কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেন। প্রথমে মাটিগুলোকে ভিজিয়ে আটালো করে কিছু দিন রেখে দেন। এতে তা ছাঁচে-ঢালা মাটিতে পরিণত হলে আদম (عليه السلام)-এর আকৃতি সৃষ্টি করে কিছুদিন এ অবস্থায় রেখে দেন। এবার তা পোড়া মাটির মত শুকনো ঠনঠনে মাটিতে রূপান্তরিত হয়। বর্ণনাকারী বলেন, ইবলীস তখন তার কাছে গিয়ে বলতে শুরু করে যে, তুমি এক মহান উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়েছ। তারপর আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর মধ্যে রূহ্ সঞ্চার করেন। রূহ্ সর্বপ্রথম তাঁর চোখ ও নাকের ছিদ্রে প্রবেশ করলে তিনি হাঁচি দেন। হাঁচি শুনে আল্লাহ্ বললেনঃ يرحمك ربك তোমার রব তোমার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন।
অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, ‘হে আদম! তুমি ঐ ফেরেশতা দলের কাছে গিয়ে দেখ তারা কী বলে?’ তখন তিনি ফেরেশতা দলের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে সালাম দেন। আর তারা السلام عليك ورحمه الله وبركاته বলে উত্তর দেন। তখন আল্লাহ বললেন, হে আদম! এটা তোমার এবং তোমরা বংশধরের অভিবাদন। আদম (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আমার রব! আমার বংশধর আবার কি?’ আল্লাহ বললেনঃ ‘আদম! তুমি আমার দু’হাতের যে কোন একটি পছন্দ কর।’ আদম (عليه السلام) বললেন, ‘আমি আমার রবের ডান হাত পছন্দ করলাম। আমার বর-এর উভয় হাতই তো ডান হাত বরকতময়।
এবার আল্লাহ্ তা’আলা নিজের হাতের তালু প্রসারিত করলে আদম (عليه السلام) কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী তাঁর সকল সন্তানকে আল্লাহর হাতের তালুতে দেখেতে পান। তন্মধ্যে কিছুসংখ্যকের মুখমণ্ডল ছিল নূরে সমুজ্জ্বল। সহসা তাদের মধ্যে একজনের নূরে অধিক বিমুগ্ধ হয়ে আদম (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আমার রব! ইনি কে?’ আল্লাহ্ বললেন, ‘ইনি তোমার সন্তান দাউদ।’ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এর আয়ু কত নির্ধারণ করেছেন?’ আল্লাহ বললেন, ‘ষাট বছর।’ আদম (عليه السلام) বললেন, ‘আমার থেকে নিয়ে এর আয়ু পূর্ণ একশ’ বছর করে দিন। আল্লাহ তার আবদার মঞ্জুর করেন এবং এ ব্যাপারে ফেরেশতাগণকে সাক্ষী রাখেন। তারপর যখন আদম (عليه السلام)-এর আয়ু শেষ হয়ে আসলো তখন তার রূহ্ কবয করার জন্য আল্লাহ তা’আলা আযরাঈল (عليه السلام)-কে প্রেরণ করেন। তখন আদম (عليه السلام) বললেন, ‘কেন, আমার আয়ু তো আরো চল্লিশ বছর বাকি আছে!’ ফেরেশতা বললেন, ‘আপনি না আপনার আয়ুর চল্লিশ বছর আপনার সন্তান দাউদ (عليه السلام)-কে দিয়ে দিয়েছিলেন!’ কিন্তু আদম (عليه السلام) তা অস্বীকার করে বসেন এবং পূর্বের কথা ভুলে যান। ফলে তার সন্তানদের মধ্যে অস্বীকৃতি ও বিস্মৃতির প্রবণতা সৃষ্টি হয়। হাফিজ আবু বকর বাযযার (رحمة الله) তিরমিযী ও নাসাঈ (رحمة الله) তাঁর ‘ইয়াওম ওয়াল লাইলা’ কিতাবে আবু হুরায়রা সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেন। তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান গরীব পর্যায়ের এবং ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) মুনকার’ তথা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন।
তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর পিঠে হাত বুলান। সাথে সাথে কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী তার সবকটি সন্তান তাঁর পিঠ থেকে ঝরে পড়ে। আর আল্লাহ তাআলা তাদের প্রত্যেকের দু’চোখের মাঝে একটি করে নূরের দীপ্তি স্থাপন করে দিয়ে তাদেরকে আদম (عليه السلام)-এর সামনে পেশ করেন। তখন আদম (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আমার রব! এরা কারা?’ আল্লাহ বললেন, ‘এরা তোমার সন্তান-সন্ততি।’ তখন তাদের একজনের দুচোখের মাঝে দীপ্তিতে বিমুগ্ধ হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আমার রব! ইনি কে?’ আল্লাহ বললেন, ‘সে তোমার ভবিষ্যত বংশধরের দাঊদ নামক এক ব্যক্তি।’ তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর আয়ু কত নির্ধারণ করেছন?’ আল্লাহ বললেনঃ ‘ষাট বছর।’ আদম (عليه السلام) বললেন, ‘হে আমার রব! আমার আয়ু থেকে নিয়ে এর আয়ু আরো চল্লিশ বছর বৃদ্ধি করে দিন।’ তারপর যখন আদম (عليه السلام)-এর আয়ু শেষ হয়ে যায়; তখন জান কবয করার জন্য আযরাঈল (عليه السلام) তাঁর কাছে আগমন করেন। তখন তিনি বললেন, ‘আমার আয়ু না আরো চল্লিশ বছর বাকি আছে?’ আযরাঈল (عليه السلام) বললেন, ‘কেন আপনি না তা আপনার সন্তান দাউদ (عليه السلام)-কে দিয়ে দিয়েছিলেন?’ কিন্তু আদম (عليه السلام) তা অস্বীকার করে বসেন। এ কারণে তার সন্তানদের মধ্যে অস্বীকৃতির প্রবণতা রয়েছে। তিনি পূর্বের কথা ভুলে যান। ফলে তাঁর সন্তানদের মধ্যেও বিস্মৃতির প্রবণতা রয়েছে। আদম (عليه السلام) ত্রুটি করেন, তাই তাঁর সন্তানরাও ত্রুটি করে থাকে।
ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে আরো একাধিক সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। হাকিম (رحمة الله) তার মুস্তাদরাকে আবু নুআয়ম (ফযল ইবনে দুকায়ন)-এর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন, ইমাম মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী হাদীসটি সহীহ। তবে ইমাম বুখারী ও মুসলিমের কেউই হাদীসটি বর্ণনা করেননি। আর ইবনে আবু হাতিম (رحمة الله) হাদীসটির যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে এও আছে যে, আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-এর বংশধরকে তার সামনে পেশ করে বললেন, ‘হে আদম! এরা তোমার সন্তান-সন্ততি।’ তখন আদম (عليه السلام) তাদের মধ্যে কুষ্ঠ ও শ্বেতী রোগী, অন্ধ এবং আরো নানা প্রকার ব্যাধিগ্রস্ত লোক দেখতে পেয়ে বললেন, ‘হে আমার রব! আমার সন্তানদের আপনি এ দশা করলেন কেন?’ আল্লাহ বললেন, ‘করেছি এ জন্য যাতে আমার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা হয়।’ এর পরে বর্ণনটিতে দাঊদ (عليه السلام)-এর প্রসঙ্গও রয়েছে—যা ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে পরে আসছে।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) তার মুসনাদে বর্ণনা করেন যে, আবু দারদা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যথা সময়ে আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে তার ডান কাঁধে আঘাত করে মুক্তার ন্যায় ধবধবে সাদা তাঁর একদল সন্তানকে বের করেন। আবার তার বাম কাঁধে আঘাত করে কয়লার ন্যায় মিশমিশে কালো একদল সন্তানকে বের করে আনেন। তারপর ডান পাশের গুলোকে বললেন, তোমরা জান্নাতগামী, আমি কারো পরোয়া করি না। আর বাম কাঁধের গুলোকে বললেন, তোমরা জাহান্নামগামী, আমি কারো পরোয়া করি না।
ইবনে আবু দুনিয়া (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, হাসান (رحمة الله) বলেন, “আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে আল্লাহ তা’আলা তার ডান পার্শ্বদেশ থেকে জান্নাতীদের আর বাম পার্শ্বদেশ থেকে জাহান্নামীদের বের করে এনে তাদেরকে যমীনে নিক্ষেপ করেন। এদের মধ্যে কিছু লোককে অন্ধ, বধির ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত দেখে আদম (عليه السلام) বললেন, ‘হে আমার রব! আমার সন্তানদের সকলকে এক সমান করে সৃষ্টি যে করলেন না তার হেতু কি?’ আল্লাহ বললেন, “আমি চাই যে, আমার শুকরিয়া আদায় হোক।" আব্দুর রায্যাক অনুরূপ রিওয়ায় বর্ণনা করেছেন।
ইবন হিব্বানের এ সংক্রান্ত বর্ণনার শেষ দিকে আছে—আল্লাহর মর্জি মোতাবেক আদম (عليه السلام) কিছুকাল জান্নাতে বসবাস করেন। তারপর সেখান থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। অবশেষে এক সময় আযরাঈল (عليه السلام) তাঁর নিকট আগমন করলে তিনি বললেন, ‘আমার আয়ু তো এক হাজার বছর। আপনি নির্ধারিত সময়ের আগেই এসে পড়েছেন।’ আযরাঈল (عليه السلام) বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আপনি না আপনার আয়ু থেকে চল্লিশ বছর আপনার সন্তান দাউদকে দিয়ে দিয়েছিলেন।’ কিন্তু আদম (عليه السلام) তা অস্বীকার করে বসেন। ফলে তাঁর সন্তানদের মধ্যেও অস্বীকার করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। তিনি পূর্বের কথা ভুলে যান। ফলে তাঁর সন্তানদের মধ্যে বিস্মৃতির প্রবণতা দেখা দেয়। সেদিন থেকেই পারস্পরিক লেন-দেন লিপিবন্ধ করে রাখার এবং সাক্ষী রাখার আদেশ জারি হয়।”
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “আল্লাহ্ তা’আলা হযরত আদম (عليه السلام)-কে ষাট হাত দীর্ঘ করে সৃষ্টি করেন। তারপর বললেন, ‘ঐ ফেরেশতা দলের কাছে গিয়ে তুমি তাদের সালাম কর এবং লক্ষ্য করে শোন, তারা তোমাকে কি উত্তর দেয়। কারণ এটাই হবে তোমার এবং তোমার সন্তান-সন্ততির অভিবাদন।’ আদেশ মত ফেরেশতাগণের কাছে গিয়ে তিনি السلام عليكم বলে সালাম করেন, আর তারা السلام عليك ورحمة الله বলে উত্তর দেন। উল্লেখ্য যে, আদমের সন্তানদের যারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারা সকলেই আদম (عليه السلام)-এর আকৃতিসম্পন্ন হবে। ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে পেতে মানুষের উচ্চতা এখন এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
অনুরূপ ইমাম বুখারী (رحمة الله) ‘কিতাবুল ইস্তিয়ানে’ আর ইমাম মুসলিম (رحمة الله) তাঁর গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আদম (عليه السلام)-এর উচ্চতা ছিল ষাট হাত আর প্রস্থ সাত হাত।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, বকেয়া লেন-দেন লিপিবদ্ধ করে রাখার আদেশ সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেন, সর্বপ্রথম যিনি অস্বীকার করেন; তিনি হলেন আদম (عليه السلام), সর্বপ্রথম যিনি অস্বীকার করেন, তিনি হলেন আদম (عليه السلام), সর্বপ্রথম যিনি অস্বীকার করেন, তিনি হলেন আদম (عليه السلام)। ঘটনা হলো—আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে তার পৃষ্ঠদেশে হাত বুলিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মানুষকে বের করে এনে তাদের তার সামনে পেশ করেন। তাদের মধ্যে তিনি উজ্জ্বল এক ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘হে আমার রব! ইনি কে?’ আল্লাহ বলেন, ‘সে তোমার সন্তান দাউদ।’ আদম (عليه السلام) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর আয়ু কত?’ আল্লাহ বললেন, ‘ষাট বছর।’ আদম (عليه السلام) বললেন, ‘এর আয়ু আরো বাড়িয়ে দিন।’ আল্লাহ্ বলেন, ‘না হবে না। তবে তোমার আয়ু থেকে কর্তন করে বাড়াতে পারি।’ উল্লেখ্য যে, আদম (عليه السلام)-এর আয়ু ছিল এক হাজার বছর। তার থেকে কর্তন করে আল্লাহ তাআলা দাউদ-এর আয়ু চল্লিশ বছর বৃদ্ধি করেন।
এ ব্যাপারে চুক্তিনামা লিপিবন্ধ করে নেন এবং ফেরেশতাদের সাক্ষী রাখেন। অবশেষে আদম (عليه السلام)-এর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে তার জান কবয করার জন্য একদিন আযরাইল (عليه السلام) তাঁর কাছে আগমন করেন। তখন তিনি বললেন, আমার আয়ুর তো আরো চল্লিশ বছর বাকি আছে! উত্তরে বলা হলো, কেন আপনি না তা আপনার সন্তান দাউদকে দিয়ে দিয়েছিলেন! আদম (عليه السلام) তা অস্বীকার করে বললেন, আমি তো এমনটি করিনি। তখন প্রমাণস্বরূপ আল্লাহ তা’আলা পূর্বের লিখিত চুক্তিনামা তাঁর সামনে তুলে ধরেন এবং ফেরেশতাগণ এ ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করেন।”
ইমাম আহমদের অনুরূপ আরেকটি বর্ণনার শেষাংশে আছেঃ “অবশেষে আল্লাহ দাউদের বয়স একশ বছর আর আদম (عليه السلام)-এর এক হাজার বছর পূর্ণ করে দেন।” তাবারানী (رحمة الله)ও অনুরূপ একটি রিওয়ায়ত বর্ণনা করেছেন।
ইমাম মালিক ইবনে আনাস (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, মুসলিম ইবনে য়াসার (رحمة الله) বলেন, উমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه)-কে واذ اخذ ربك الخ এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, তিনি বললেন, এ আয়াত সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে তার পিঠে নিজের ডান হাত বুলিয়ে তাঁর সন্তানদের একদল বের করে এনে বললেন, এদেরকে আমি জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করলাম। এরা জান্নাতীদের আমলই করবে। তারপর পুনরায় হাত বুলিয়ে আরেক দল সন্তানকে বের করে এনে বললেন, এদের আমি জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। এরা জাহান্নামীদেরই আমল করবে। এ কথা শুনে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে আমল করার প্রয়োজন কি? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, “আল্লাহ যাকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেন, তার থেকে তিনি জান্নাতীদেরই আমল করান। আমৃত্যু জান্নাতীদের আমল করতে করতেই শেষ পর্যন্ত সে জান্নাতে চলে যাবে। পক্ষান্তরে যাকে তিনি জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেন; তার দ্বারা তিনি জাহান্নামীদের আমলই করান। আমৃত্যু জাহান্নামীদের আমল করতে করতেই শেষ পর্যন্ত সে জাহান্নামে পৌঁছে যাবে।”
ইমাম আহমদ আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে জারীর ও ইবনে আবু হাতিম ও আবূ হাতিম ইবন হিব্বান (رحمة الله) বিভিন্ন সূত্রে ইমাম মালেক (رحمة الله) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান সহীহ’ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে উমর (رضي الله عنه) নিকট থেকে মুসলিম ইবন ইয়াসার (رحمة الله) সরাসরি হাদীসটি শুনেননি। আবূ হাতিম ও আবু যুর’আ (رحمة الله) এ অভিমত পেশ করেছেন। আবু হাতিম (رحمة الله) আরো বলেছেন যে, এ দুজনের মাঝে আরেক রাবী নুয়ায়ম ইবনে রবীয়া রয়েছেন। ইমাম আবু দাউদ হাদীসটির সূত্রে ইবনে যায়েদ ইবনে খাত্তাব, মধ্যবর্তী রাবী নুয়ায়ম ইবন রবীয়ার নামও উল্লেখ করেছেন। দারা কুতনী বলেন, “উপরোক্ত সব কটি হাদীস এ কথা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-এর সন্তানদের তাঁরই পিঠ থেকে ছোট ছোট পিঁপড়ার মত বের করে এনেছেন এবং তাদেরকে ডান ও বাম এ দু’দলে বিভক্ত করে ডান দলকে বলেছেন, তোমরা জান্নাতী, আমি কাউকে পরোয়া করি না। আর বাম দলকে বলেছেন, তোমরা জাহান্নামী, আমার কারো পরোয়া নেই।” পক্ষান্তরে তাদের নিকট থেকে সাক্ষ্য এবং আল্লাহর একত্ব সম্পর্কে তাদের থেকে স্বীকারোক্তি নেয়ার কথা প্রামাণ্য কোন হাদীস পাওয়া যায় না। সূরা আরাফের একটি আয়াতকে এ অর্থে প্রয়োগ করার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। যথাস্থানে এ বিষয়ে আমি সবিস্তার আলোচনা করেছি। তবে এ মর্মে ইমাম আহমদ (رحمة الله) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস আছে। ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী যার সনদ উত্তম ও শক্তিশালী। হাদীসটি হলোঃ
ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা জিলহজ্জের নয় তারিখে নু’মান নামক স্থানে আদম (عليه السلام)-এর পিঠ থেকে অঙ্গীকার নেন। তারপর তাঁর মেরুদণ্ড থেকে (কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী) তার সকল সন্তানকে বের করে এনে তার সম্মুখে ছড়িয়ে দেন। তারপর তাদের সাথে সামনা-সামনি কথা বলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করেন, আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলল, নিশ্চয়ই, আমরা সাক্ষী থাকলাম। এ স্বীকৃতি গ্রহণ এ জন্য যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন বলতে না পারো আমরা তো এ ব্যাপারে অনবহিত ছিলাম। কিংবা তোমরা যেন বলতে না পার যে, আমাদের পূর্ব-পুরুষগণই তো আমাদের পূর্বে শিরক ক আর আমরা তো তাদের পরবর্তী বংশধর, তবে কি পথভ্রষ্টদের কৃতকর্মের জন্য তুমি আমাদের ধ্বংস করবে? (৭: ১৭২-১৭৩)
ইমাম নাসাঈ, ইব্ন জারীর ও হাকিম (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাকিম (رحمة الله) হাদীসটির সনদ সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। প্রামাণ্য কথা হলো, বর্ণিত হাদীসটি আসলে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর উক্তি। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকেও মওকূফ, মরফূ উভয় সূত্রেই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। তবে মওফূক সূত্রটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ। তবে অধিকাংশ আলিমের মতে, সেদিন আদম (عليه السلام)-এর সন্তানদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। তাদের দলীল হলো, ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসটি। যাতে আছে -
আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন কোন এক জাহান্নামীকে বলা হবে— ‘আচ্ছা, যদি তুমি পৃথিবীর সমুদয় বস্তু-সম্ভারের মালিক হতে; তাহলে এখন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তার সমস্ত কিছু মুক্তিপণ রূপে দিতে প্রস্তুত থাকতে?’ উত্তরে সে বলবে, ‘জী হ্যাঁ।’ তখন আল্লাহ বলবেন, ‘আমি তো তোমার নিকট থেকে এর চাইতে আরো সহজটাই চেয়েছিলাম। আদম (عليه السلام)-এর পিঠে থাকা অবস্থায় আমি তোমার নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, আমার সাথে তুমি কাউকে শরীক করবে না। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে তুমি শরীক না করে ছাড়োনি।’ শু’বার বরাতে বুখারী (رحمة الله) এবং মুসলিম (رحمة الله) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আবু জাফর রাযী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, উবাই ইবন কা’ব (رضي الله عنه) واذ اخذ ربك الخ এ আয়াত এবং এর পরবর্তী আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মানুষ সৃষ্টি করে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের এক স্থানে সমবেত করেন। তারপর তাদের সাথে কথা বলেন ও তাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন এবং তাদের নিজেদেরকেই তাদের সাক্ষীরূপে রেখে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “আমি কি তোমাদের রব নই?’ তারা বলল, ‘জী হ্যাঁ।’ আল্লাহ্ বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমি সাত আসমান, সাত যমীন এবং তোমাদের পিতা আদমকে সাক্ষী রাখলাম, যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা এ কথা বলতে না পার যে, এ ব্যাপারে তো আমরা কিছুই জানতাম না। তোমরা জেনে রাখ যে, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, আমি ব্যতীত কোন রব নেই। আর আমার সাথে তোমরা কাউকে শরীক করো না। তোমাদের নিকট পর্যায়ক্রমে আমি রাসূল পাঠাব, তারা তোমাদেরকে আমার এ অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে সতর্ক করবেন। আর তোমাদের কাছে আমি আমার কিতাব নাযিল করব।” তারা বলল, ‘আমরা সাক্ষ্য দিলাম যে, আপনি আমাদের বর ও ইলাহ। আপনি ব্যতীত আমাদের কোন রব বা ইলাহ নেই।’ মোটকথা, সেদিন তারা আল্লাহর আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছিল।
এরপর উপর থেকে দৃষ্টিপাত করে আদম (عليه السلام) তাঁদের মধ্যে ধনী-গরীব ও সুশ্রী-কুশ্রী সকল ধরনের লোক দেখতে পেয়ে বললেন, ‘হে আমার রব! আপনার বান্দাদের সকলকে যদি সমান করে সৃষ্টি করতেন!’ আল্লাহ্ বললেন, ‘আমি চাই, আমার শুকরিয়া আদায় করা হোক।’ এরপর আদম (عليه السلام) নবীগণকে তাদের মধ্যে প্রদীপের ন্যায় দীপ্তিমান দেখতে পান। আল্লাহ তাআলা তাদের নিকট থেকে রিসালাত ও নবুওতের বিশেষ অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِنَ ٱلنَّبِیِّـۧنَ مِیثَـٰقَهُمۡ وَمِنكَ وَمِن نُّوحࣲ وَإِبۡرَ ٰهِیمَ وَمُوسَىٰ وَعِیسَى ٱبۡنِ مَرۡیَمَۖ وَأَخَذۡنَا مِنۡهُم مِّیثَـٰقًا غَلِیظࣰا)[Surat Al-Ahzab ৭]
অর্থাৎ স্মরণ কর, যখন আমি নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমার নিকট থেকেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারয়াম তনয় ঈসার নিকট থেকে—এদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার। (৩৩: ৭)
(فَأَقِمۡ وَجۡهَكَ لِلدِّینِ حَنِیفࣰاۚ فِطۡرَتَ ٱللَّهِ ٱلَّتِی فَطَرَ ٱلنَّاسَ عَلَیۡهَاۚ لَا تَبۡدِیلَ لِخَلۡقِ ٱللَّهِۚ )
[Surat Ar-Rum ৩০]
অর্থাৎ, তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে দীনে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। (৩০: ৩০)
(هَـٰذَا نَذِیرࣱ مِّنَ ٱلنُّذُرِ ٱلۡأُولَىٰۤ)
[Surat An-Najm ৫৬]
অর্থাৎ—অতীতের সতর্ককারীদের ন্যায় এ নবীও একজন সতর্ককারী। (৫৩: ৫৬)
(وَمَا وَجَدۡنَا لِأَكۡثَرِهِم مِّنۡ عَهۡدࣲۖ وَإِن وَجَدۡنَاۤ أَكۡثَرَهُمۡ لَفَـٰسِقِینَ)
[Surat Al-A'raf ১০২]
অর্থাৎ আমি তাঁদের অধিকাংশকে প্রতিশ্রুতি পালনকারী পাইনি বরং তাদের অধিকাংশকে তো সত্যত্যাগী পেয়েছি। (৭: ১০২)
ইমাম আব্দুল্লাহ্ ইবন আহমদ, ইবন আবু হাতিম, ইবন জারীর ও ইবন মারদূওয়েহ্ (رحمة الله) তাঁদের নিজ নিজ তাফসীর গ্রন্থে আবু জাফর (رحمة الله) সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মুজাহিদ, ইকরিমা, সাঈদ ইবন জুবায়র, হাসান বসরী, কাতাদা ও সুদ্দী (رحمة الله) প্রমুখ পূর্বসূরি আলিম থেকেও এসব হাদীসের সমর্থনে বর্ণনা পাওয়া যায়। আর পূর্বে আমরা এ কথাটি উল্লেখ করে এসেছি যে, ফেরেশতাগণ আদম (عليه السلام)-কে সিজদা করার জন্যে আদিষ্ট হলে ইবলীস ব্যতীত সকলেই সে খোদায়ী ফরমান পালন করেন। ইবলীস হিংসা ও শত্রুতাবশত সিজদা করা থেকে বিরত থাকে। ফলে আল্লাহ তা’আলা তাকে আপন সান্নিধ্য থেকে বিতাড়িত করে অভিশপ্ত শয়তান বানিয়ে পৃথিবীতে নির্বাসন দেন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “আদমের সন্তানরা সিজদার আয়াত পাঠ করে যখন সিজদা করে; ইবলীস তখন একদিকে সরে গিয়ে কাঁদতে শুরু করে এবং বলে, হায় কপাল! আল্লাহর আদেশ পালনার্থে সিজদা করে আদম সন্তান জান্নাতী হলো আর সিজদার আদেশ অমান্য করে আমি হলাম জাহান্নামী।” ইমাম মুসলিমও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
যাহোক, আদম (عليه السلام) ও তার সহধর্মিনী হাওয়া (عليه السلام) জান্নাতে তা আসমানেরই হোক, বা যমীনেরই কোন উদ্যান হোক— যে মতভেদের কথা পূর্বেই বিবৃত হয়েছে- কিছুকাল বসবাস করেন এবং অবাধে ও স্বচ্ছন্দে সেখানে আহারাদি করতে থাকেন। অবশেষে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল আহার করায় তাদের পরিধানের পোশাক ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং তাদেরকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হয়। অবতরণের ক্ষেত্র সম্পর্কে মতভেদের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
জান্নাতে আদম (عليه السلام)-এর অবস্থানকাল সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে দুনিয়ার হিসাবের একদিনের কিছু অংশ। আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে মরফূ সূত্রে ইমাম মুসলিম (رحمة الله) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস উপরে উল্লেখ করে এসেছি যে, আদম (عليه السلام)-কে জুম’আর দিনের শেষ প্রহরে সৃষ্টি করা হয়েছে। আরেক বর্ণনায় এও আছে যে, জুমআর দিন আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করা হয় আর এদিনেই তাকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করা হয়। সুতরাং যদি এমন হয়ে থাকে যে, যেদিন আদম (عليه السلام)-এর সৃষ্টি হয় ঠিক সেদিনই জান্নাত থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন, তাহলে একথা বলা যায় যে, তিনি একদিনের মাত্র কিছু অংশ জান্নাতে অবস্থান করেছিলেন। তবে এ বক্তব্যটি বিতর্কের ঊর্ধে নয়। পক্ষান্তরে যদি তাঁর বহিষ্কার সৃষ্টির দিন থেকে ভিন্ন কোন দিনে হয়ে থাকে কিংবা ঐ ছয় দিনের সময়ের পরিমাণ ছয় হাজার বছর হয়ে থাকলে সেখানে তিনি সুদীর্ঘ সময়ই অবস্থান করে থাকবেন। যেমন ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), মুজাহিদ ও যাহহাক (رحمة الله) থেকে বর্ণিত এবং ইব্ন জারীর (رحمة الله) কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে বলে পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে।
ইবনে জারীর (رحمة الله) বলেন, এটা জানা কথা যে, আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে জুম’আ দিবসের শেষ প্রহরে। আর তথাকার এক প্রহর দুনিয়ার তিরাশি বছর চার মাসের সমান। এতে প্রমাণিত হয় যে, রূহ সঞ্চারের পূর্বে মাটির মূর্তিরূপে আদম (عليه السلام) চল্লিশ বছর এমনিতেই পড়ে রয়েছিলেন। আর পৃথিবীতে অবতরণের পূর্বে জান্নাতে অবস্থান করেছেন তেতাল্লিশ বছর চার মাস কাল। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আবদুর রাযযাক (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ‘আতা ইবনে আবু রাবাহ (رحمة الله) বলেন, আদম (عليه السلام)-এর পদদ্বয় যখন পৃথিবী স্পর্শ করে তখনো তার মাথা ছিল আকাশে। তারপর আল্লাহ তাঁর দৈর্ঘ্য ষাট হাতে কমিয়ে আনেন। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রেও এরূপ একটি বর্ণনা আছে। তবে এ তথ্যটি আপত্তিকর। কারণ ইতিপূর্বে আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) কর্তৃক সর্বজন স্বীকৃত বিশুদ্ধ হাদীস উদ্ধৃত করে এসেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে ষাট হাত দীর্ঘ করে সৃষ্টি করেন। এরপর তাঁর সন্তানদের উচ্চতা কমতে কমতে এখন এ পর্যন্ত এসে পৌছেছে। এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টিই করা হয়েছে ষাট হাত দৈর্ঘ্য দিয়ে তার বেশি নয়। আর তার সন্তানদের উচ্চতা হ্রাস পেতে পেতে এখন এ পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে।
ইবনে জারীর (رحمة الله) ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে আদম! আমার আরশ বরাবর পৃথিবীতে আমার একটি সম্মানিত স্থান আছে। তুমি গিয়ে তথায় আমার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে তা তাওয়াফ কর, যেমনটি ফেরেশতারা আমার আরশ তাওয়াফ করে। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর কাছে একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তিনি আদম (عليه السلام)-কে জায়গাটি দেখিয়ে দেন এবং তাকে হজ্জের করণীয় কাজসমূহ শিখিয়ে দেন। ইবনে জারীর (رحمة الله) আরো উল্লেখ করেন যে, দুনিয়ার যেখানে সেখানে আদম (عليه السلام)-এর পদচারণা হয়, পরবর্তীতে সেখানেই এক একটি জনবসতি গড়ে ওঠে।
ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, পৃথিবীত আদম (عليه السلام)-এর প্রথম খাদ্য ছিল গম। জিবরাঈল (عليه السلام) তার কাছে সাতটি গমের বীজ নিয়ে উপস্থিত হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলো কি? জিবরাঈল (عليه السلام) বললেন, এ-ই তো আপনার সেই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল, যা আপনি খেয়েছিলেন। আদম (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলো আমি কি করব? জিবরাঈল (عليه السلام) বললেন, যমীনে বপন করবেন। উল্লেখ্য যে, তাঁর প্রতিটি বীজের ওজন ছিল দুনিয়ার এক লক্ষ দানা অপেক্ষা বেশি। বীজগুলো রোপণ করার পর ফসল উৎপন্ন হলে আদম (عليه السلام) তা কেটে মাড়িয়ে পিষে আটা বানিয়ে খামির করে রুটি বানিয়ে বহু ক্লেশ ও শ্রমের পর তা আহার করেন। এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(فَقُلۡنَا یَـٰۤـَٔادَمُ إِنَّ هَـٰذَا عَدُوࣱّ لَّكَ وَلِزَوۡجِكَ فَلَا یُخۡرِجَنَّكُمَا مِنَ ٱلۡجَنَّةِ فَتَشۡقَىٰۤ)
[Surat Ta-Ha ১১৭]
অর্থাৎ, সুতরাং সে যেন তোমাদের কিছুতেই জান্নাত থেকে বের করে না দেয়। দিলে তোমরা দুঃখ পাবে।’ (২০-১১৭)
আদম ও হাওয়া (عليه السلام) সর্বপ্রথম যে পোশাক পরিধান করেন, তা ছিল ভেড়ার পশমের তৈরি। প্রথমে চামড়া থেকে পশমগুলো খসিয়ে তা দিয়ে সুতা তৈরি করেন। তারপর আদম (عليه السلام) নিজের জন্য একটি জুব্বা আর হাওয়ার জন্য একটি কামীজ ও একটি ওড়না তৈরি করে নেন।
জান্নাতে থাকাবস্থায় তাদের কোন সন্তানাদি জন্মেছিল কিনা এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কারো কারো মতে, পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও তাঁদের কোন সন্তান জন্মেনি। কেউ বলেন, জন্মেছে। কাবীল ও তার বোনের জন্ম জান্নাতেই হয়েছিল। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
উল্লেখ্য যে, প্রতি দফায় আদম (عليه السلام)-এর এক সঙ্গে একটি পুত্র সন্তান ও একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিত। আর এক গর্ভের পুত্রের সঙ্গে পরবর্তী গর্ভের কন্যার ও কন্যার সঙ্গে পুত্রের বিবাহ দেওয়ার বিধান দেওয়া হয়। পরবর্তীতে একই গর্ভের দু’ভাই-বোনের বিবাহ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।