ইমাম আবি আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক্ব ইবনুল আব্বাস আল ফাকিহি আল মাক্কি (২৭৫ হি.) লিখেছেন-
وأهل مکة فیما مضی إلی یوم إذا کان لیلة النصف من الشعبان، خرج عامة الرجال والنساء إلی المسجد، فصلوا وطافوا وأحیوا لیلتهم حتی الصباح بالقراءة في المسجد الحرام، حتی یختموا القرآن کله، ویصلوا، ومن صلي منهم تلك اللیلة ماٸة رکعة یقرأ في كل رکعة {الحمد} و{قل هو اللّٰه أحد} عشر مرات، وأخذا من ماء زمزم تلك اللیلة فشربوه، واغتسلوا به، وخبٶوه عندهم للمرضی، یبتعون بذلك البرکة في هذه اللیلة، ویروي فیه أحادیث كثيرة.
-
"মক্কার বাসিন্দাগণ, আজ পর্যন্ত (লিখকের সময়কাল অব্দি) তাদের রেওয়াজ ছিলো যে, যখনই শবে বরাত আসতো, মুসলমান নরনারীগণ মাসজিদুল হারামের দিকে আসতেন। তাঁরা এখানে নামাজ আদায় করতেন, (কা'বা ঘরের) তাওয়াফ করতেন, সারা রাত নিদ্রাহীন (ইবাদত করে) কাটাতেন, এবং সকাল পর্যন্ত কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর এভাবে তিলাওয়াতের মাঝেই রাত পার হয়ে যেতো মাসজিদুল হারামে। তাঁদের মধ্যে কিছু কিছু লোক ১০০ (একশত) রাক'আত নফল নামাজ আদায় করতেন, প্রতি রাক'আতে সূরা ফাতিহা (১বার) এবং 'কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ' পাঠ করতেন ১০বার। এই রাতে তাঁরা যমযমের পানি পান করতেন, সেটি দিয়ে গোসল করতেন এবং এর দ্বারা (শারীরিক-আত্মিক) রোগব্যাধির চিকিৎসা করতেন। তাঁরা এই রাতের আমলসমূহ দ্বারা বরকত অর্জন করতেন। এই বিষয়ে অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে।"
[আখবারু মাক্কাহ ফি ক্বাদিমিদ দাহরি ওয়া হাদিছিহি, ৩/৮৪ পৃ. দারু খিদ্বর লিন নাশরি ওয়াত ত্ববা'আতি ওয়াত তাওযি', বয়রুত, লেবানন হতে প্রকাশিত]
ইমাম আবি আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনু ঊমার ইবনু ওয়াক্বিদ আল আসলামি আল ওয়াক্বিদি আল মাদিনি (২০৭ হি.) লিখেছেন-
قال الواقدي: وکان في هذه السریة مع عبد اللّٰه بن جعفر واثلة بن الأسقع وکان خروجهم من أرض الشام وهي دمشق إلی دیر أبي القدس في لیلة النصف من شعبان وکان القمر زاٸد النور. وقال وأنا إلی جانب عبد اللّٰه بن جعفر. فقال لي: یا ابن الأسقع ما أحسن قمر هذه اللیلة وأنوره، فقلت: یا ابن عم رسول اللّٰه ﷺ هذه لیلة النصف من شعبان وهي لیلة مباركة عظیمة، وفي هذه تکتب الأرزاق والآجال وتغفر فیها الذنوب والسیٸات وکنت أردت أن أقومها. فقلت: إن سیرنا في سبل اللّٰه خیر من قیامها واللّٰه جزيل العطاء. فقال: صدقت ثم إننا سرنا لیلتنا،...
অনুবাদ: "ইমাম আল ওয়াক্বিদি বলেন- এই ছোট যুদ্ধে হযরত আবদুল্লাহ ইবনু জা'ফর (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) এঁর সাথে হযরত ওয়াছিলাহ ইবনুল আসক্বা' (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু)-ও শামিল ছিলেন; এবং অর্ধ শা'বান (১৫ই শা'বান) এর রাতে তাঁরা শাম (দামিশক্ব) হতে আবিল ক্বুদসের গীর্জা জয় করার জন্য বের হয়েছিলেন, আর সেদিন (আকাশে) ছিলো আলোকোজ্জ্বল পূর্ণিমার চাঁদ। (হযরত ওয়াছিলাহ ইবনুল আসক্বা বলেন) আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনু জা'ফর (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) এঁর পাশে পাশে চলছিলাম। তিনি আমাকে বললেন- হে ইবনুল আসক্বা', আজকের চাঁদ কতোই না সুন্দর দেখাচ্ছে, আর কি সুন্দর আলো ছড়াচ্ছে! আমি বললাম- হে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এঁর চাচাতো ভাইয়ের ছেলে! আজকের রাত হলো অর্ধ শা'বান (১৫ই শা'বান) এর রাত, এবং এটি অত্যন্ত বরকতময় রাত। এই রাতে রিযক্ব এবং মৃত্যু লিখিত হয়, এবং গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। আমার ইচ্ছা এই যে, আজকের রাত জাগ্রত থেকে (অর্থাৎ ইবাদত করে) কাটিয়ে দিই। এরপর...
আমি (হযরত ওয়াছিলাহ ইবনুল আসক্বা') বললাম- নিশ্চয় আল্লাহ'র রাস্তায় আমাদের পথচলা, আমাদের রাতে জাগ্রত থাকা (ইবাদত করা) এর চাইতে উত্তম। এবং আল্লাহ তা'আলা হলেন অধিক প্রদানকারী।
তিনি (হযরত আবদুল্লাহ ইবনু জা'ফর) বললেন: নিশ্চয়ই তুমি সঠিক বলেছো! এরপর আমরা রাতভর চলতে রইলাম...!"
[ফুতুহুশ শাম, ১/৯০ পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন হতে প্রকাশিত]
২টি বিষয় এখানে প্রমাণিত-
১. অর্ধ শা'বানের রাতে সাহাবা-এ কেরাম ইবাদত করতেন এবং ইবাদত করাটা তাঁদের পছন্দনীয় ছিলো (এই ঘটনায় ইবাদত হতে বিরত ছিলেন, কারণ তাঁরা একটি যুদ্ধের পথে ছিলেন)।
২. এই রাতে মানুষের রিযক্ব এবং মৃত্যু লিখিত হয়; এবং মানুষের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।
ইমাম আবু ত্বালিব মুহাম্মদ ইবনু আলি ইবনু আত্বিয়্যাহ আল হারিছি আল মাক্কি আশ শাফিয়ি (৩৮৬ হি.) লিখেছেন-
ویستحب إحیاء خمس عشرة لیلة في السنة، خمس منها في شهر رمضان، وهي وتر لیالي العشر الأخیر منه. ولیلة سبع عشرة من رمضان، وهي صبیحة یوم الفرقان یوم التقي الجمعان، فیه کانت وقعة بدر. وکان ابن الزبير یذهب إلی أنها لیلة القدر.
وأما التسعة الأخر: فأول لیلة من شهر المحرم، ولیلة عاشوراء، وأول لیلة من شهر رجب، ولیلة النصف منه، ولیلة سبع وعشرین منه، وفیها أسري برسول اللّٰه ﷺ، ولیلة المعراج، ولیلة العرفة، ولیلة العیدین، ولیلة النصف من شعبان. وقد کانوا یصلون في هذه اللیلة ماٸة رکعة بألف مرة: {قل هو اللّٰه أحد} عشرا في کل رکعة، ویسمون الصلاة صلاة الخیر، ويتعرفون برکتها ویجتمعون فیها، وربما صلوها جماعة.
وروینا عن الحسن قال: حدثني ثلاثون من أصحاب النبي ﷺ: أن من صلی هذه الصلاة في هذه اللیلة نظر اللّٰه عز وجل إلیه سبعین نظرة، وقضي له بکل نظرة سبعین حاجة أدناها المغفرة.
অনুবাদ: "পুরো বছরে ১৫টি রাত এমন রয়েছে, যেগুলোতে জাগ্রত থাকা মুস্তাহাব। এগুলোর মধ্যে ৫টি রয়েছে রমজান মাসে, অর্থাৎ শেষ দশ রাতের বিজোড় রাতগুলো। আর ৬নং রাতটি হলো রমজানের ১৭তম রাত, অর্থাৎ যেটির সকালে হক্ব-বাতিলের পার্থক্যকারী ঘটনা, বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) এঁর মাযহাব এটিই ছিলো যে, এই রাতটিই ক্বদরের রাত। আর বাকি ৯টি রাত হলো- (১) মুহাররম মাসের প্রথম রাত, (২) আশুরার রাত, (৩) রজবের প্রথম রাত, (৪) রজবের পনেরতম রাত, (৫) রজবের সাতাশতম রাত, এই রাতে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এঁর মে'রাজ হয়েছিলো, (৬) আরাফার রাত, (৭-৮) দুই ঈদের রাত, এবং (৯) শা'বানের পনেরতম রাত।
আমাদের বুযুর্গগণ, শা'বানের পনেরতম রাতে ১০০ রাক'আত নফল এমনভাবে পাঠ করতেন যে, এর মধ্যে ১০০০ বার "ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ" (সূরা ইখলাস) পাঠ করতেন, প্রতি রাক'আতে ১০ বার করে; এবং এই নামাজের নামকরণ তাঁরা করেছিলেন 'সালাতুল খায়র' নামে। তাঁরা সকলেই এই নামাজের বরকত সম্পর্কে অবগত ছিলেন, এবং এই রাতে সকলে সমবেত হতেন, এবং কোনো কোনো সময় সবাই মিলে জামা'আতবদ্ধ হয়ে এই নামাজ আদায় করতেন।
হযরত হাসান বাসরি (১১০ হি.) বর্ণনা করেছেন যে, আমাকে ৩০ এর অধিক সাহাবা-এ কেরাম (আলাইহিমুর রিদ্বওয়ান) জানিয়েছেন: যে ব্যক্তি এই রাতে এই নামাজ আদায় করে, আল্লাহ তা'আলা তার দিকে ৭০ বার রহমতের দৃষ্টি প্রদান করেন, এবং প্রতি নজরে ৭০টি প্রয়োজন পূরণ করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট প্রয়োজন হলো মাগফিরাত।
[ক্বুওয়াতুল ক্বুলুব ফি মু'আমালাতিল মাহবুব ওয়া ওয়াসফি ত্বরিক্বিল মুরিদি ইলা মাক্বামিত তাওহিদ, ১/১৮৯ পৃ. মাকতাবাহ দারুত তুরাছ, কায়রো, মিশর হতে প্রকাশিত]
ইমাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনু ইদরিস আশ শাফিয়ি (২০৪ হি.) লিখেছেন:
وبلغنا أنه کان یقال: إن الدعاء یستجاب في خمس لیال: في لیلة الجمعة، ولیلة الأضحي، ولیلة الفطر، وأول لیلة من رجب، ولیلة النصف من الشعبان.
অনুবাদ: "আমাদের নিকট এই বর্ণনা পৌঁছেছে যে, পাঁচ রাতের দু'আ ক্ববুল করা হয়- জুমু'আর রাত, ঈদুল আযহার রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, রজবের প্রথম রাত এবং অর্ধ শা'বান (১৫ই শা'বান) এর রাত।"
[কিতাবুল উম্মু, ২/৪৮৫ পৃ. দারুল ওয়াফা, আল মানসুরা, মিশর হতে প্রকাশিত]
একটু এগিয়ে তিনি নিজের ফতোয়া লিখেছেন এভাবে:
وأنا أستحب کل ما حکیت في هذه اللیالي من غیر أن یکون فرضا.
অনুবাদ: "এবং এসব রাতের (আমল করার) ব্যাপারে যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে, তা আমি অত্যন্ত পছন্দ করি। তবে এসব রাতে ইবাদত করাটা ফরজ মনে করি না।"
[কিতাবুল উম্মু, ২/৪৮৬ পৃ. দারুল ওয়াফা, আল মানসুরা, মিশর হতে প্রকাশিত]
বড় আশ্চর্যের বিষয়! কয়েক লক্ষ হাদিসের হাফিয এবং প্রসিদ্ধ এক মাজহাবের ইমামের নিকট ওহাবী সালাফীদের তথাকথিত এই বিদ'আতটি খুব পছন্দনীয়! এটি যে একটি বিদ'আত, তারা তা বুঝতেই পারেননি! (নাউযুবিল্লাহ)
আল্লাহ তা'আলা আমাদের সবাইকে এই আসলাফদের বুঝ অনুসারে চলার তাওফিক প্রদান করুন, আমিন!
ইসলামী বিশ্বকোষ ও আল-হাদিস অ্যাপ [Download]