কুরবানি (ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আহকাম)


গ্রন্থনা ও সংকলন:

মুফতি মুহাম্মদ আলমগীর হোসাইন আন-নাজিরী

অধ্যক্ষ, জামি‘আ-এ-‘ইলমে মদীনা, নেত্রকোণা

আরবি শিক্ষক, মুঈনীয়া ইসলামিয়া আলিয়া মাদরাসা, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা

পরিচালক, আল-ইখলাস ইসলামিক সেন্টার


টেক্সট রেডীঃ মাসুম বিল্লাহ সানি


গ্রন্থনা ও সংকলন:


মুফতি মুহাম্মদ আলমগীর হোসাইন আন-নাজিরী

মোবাইল: +৮৮ ০১৭৪৭ ১৩৮১৮১


স্বত্ত্ব:

গ্রন্থকার কর্তৃক্ব সংরক্ষিত


প্রকাশনায়:

আল-ইখলাস ইসলামিক সেন্টার


১ম প্রকাশ:


সেপ্টেম্বর, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ


২য় প্রকাশ:


১৮ যুলক্বা‘দাহ, ১৪৪১ হিজরি


২৫ আষাঢ়, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ


১০ জুলাই, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ


প্রচ্ছদ সহযোগী:

শেখ সাঈদা হাবীব শান্তা


হাদিয়া: ৮০.০০ টাকা মাত্র




উৎসর্গ


প্রাণপ্রতিম, মাখদুমে মিল্লাত, ফকিহুল উম্মাত, সায়্যিদী, মুরশিদী আল্লামা মুফতি নাজিরুল আমিন রেজভী হানাফী ক্বাদেরী (মা.জি.আ.)


যাদের ওসিলায় অস্তিত্বের বিকাশ প্রিয় বাবা-মা জনাব মুহাম্মদ আবুল কাসেম

জনাবা আমেনা বেগম


প্রিয় শ্বশুর-শ্বাশুড়ী

জনাব শেখ হাবীবুর রহমান

জনাবা বিনা রহমান


-সকলের পবিত্র আমল নামায় আল্লাহ্ কবুল করুন। আমিন।


পীরে তরিকত, মাখদুমে মিল্লাত, ফকিহুল উম্মাত, হযরতুল আল্লামা মুফ্তী নাজিরুল আমিন রেজভী হানাফী ক্বাদেরী (মা.জি.আ.)

খলিফায়ে সুবহানী, খানদানে আ‘লা হযরত, ইউ.পি, ভারত; রেজভীয়া দরগাহ্ শরীফ, নেত্রকোণা


মাননীয় চেয়ারম্যান: বাংলাদেশ রেজভীয়া তা‘লিমুস্ সুন্নাহ্ বোর্ড ফাউন্ডেশন


আন্তর্জাতিক রেজভীয়া উলামা পরিষদ

প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক: জামি‘আ-এ-‘ইলমে মদীনা, নেত্রকোণা-এর


দু‘আ ও অভিমত


حَامِدًا وَّمُصَلِّيًا وَّمُسَلِّمًا


বিষয়টি দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি যে, কুরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ফযিলত ও আহ্কাম সম্বলিত অত্যন্ত সুন্দর এ পুস্তিকাটির আত্মপ্রকাশ করছে ‘কুরবানি (ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আহকাম)’ নামে। বইটির আদ্যপ্রান্ত একবার নজর বুলিয়েছি। বাস্তবিকই ছোট্ট পরিসরে হলেও গবেষণাধর্মী এ পুস্তিকাটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। সম্ভবত ইতোপূর্বে এ বিষয়বস্তুর উপর স্বতন্ত্র কোন পুস্তিকা আমার নজরে আসে নি, যাতে কুরবানির আহকাম বর্ণনার পাশাপাশি শানে রিসালাতও এভাবে ফুটে উঠেছে। আশা করছি রবের ফযল ও করমে পুস্তিকাটি অনুসন্দিৎসু পাঠকের চাহিদা পূরণ করবে এবং জনসাধারণের উপকারে কাজে আসবে।


রব্বে ইজ্জতের দরগাহে আলিয়ায় ফরিয়াদ, এর লেখক আমার অত্যন্ত স্নেহাষ্পদ মুহাম্মদ আলমগীর হোসাইন আন-নাজিরীকে নবীয়ে কায়েনাতের সদকায় কবুল করুন। আমিন!


بِرَحْمَتِكَ يَااَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ


মুফ্তী নাজিরুল আমিন রেজভী হানাফী ক্বাদেরী

রেজভীয়া দরগাহ্ শরীফ, নেত্রকোণা

সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ইং




সূচিপত্র

উৎসর্গ

দু‘আ ও অভিমত

 

সূচিপত্র

  • কুরবানির অর্থ ও পরিচিতি 

  • কুরবানি করা হযরত ইবরাহিম (عليه السلام)-এর সুন্নাত 

  • কুরবানি করা সায়্যিদুল আম্বিয়া হুযুর (ﷺ)-এর সুন্নাত

  • কুরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট 

  • মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানি

  • কুরবানি পূর্ববর্তী সকল যুগেই ছিল

  • মানুষের সবচেয়ে প্রিয় দু’টি বস্তু এবং এর কুরবানি

  • স্বীয় জান কুরবানির মাধ্যমে পরীক্ষা

  • সন্তানের কুরবানির মাধ্যমে পরীক্ষা

  • ইবরাহিম (عليه السلام)-এর কুরবানি কবুল এবং

  • বর্তমান কুরবানির প্রচলন

  • হযরত জিবরাইল (عليه السلام)-এর পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ

  • উম্মতে মুহাম্মদি (ﷺ)’র প্রত্যাবর্তনের ক্ষমতা

  • হুযুর পাক (ﷺ)-এর নিকট আল্লাহ’র সৃষ্টি জগত

  • আমাদের নবী (ﷺ) সকল নবী (আলাইহিমুস সালাম) থেকে শ্রেষ্ঠ

  • হুযুর পাক (ﷺ) ইবরাহিম (عليه السلام) হতেও শ্রেষ্ঠ

  • একটি সন্দেহ ও এর অপনোদন

  • হুযুর পাক (ﷺ)-এর স্বীয় জানের কুরবানি

  • হুযুর পাক (ﷺ)-এর স্বীয় সন্তানকে কুরবানি

  • হাদিস শরিফের আলোকে কুরবানির ফযিলত

  • কুরবানি করার হুকুম: সুন্নাত না-কি ওয়াজিব?

  • যারা কুরবানি করবে তাদের ক্ষৌরকার্য

  • কুরবানি করার সামর্থ না থাকলে কী করনীয়? 

  • যাদের উপর কুরবানি করা ওয়াজিব এবং যাদের উপর ওয়াজিব নয়

  • কিছু জরুরি মাসআলা

  • কুরবানিতে নিসাব কী?

  • নাবালিগ-এর পক্ষ থেকে কুরবানি

  • মুসাফির-এর উপর কুরবানি

  • দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানি

  • মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি

  • উম্মতের পক্ষে সরকারে দু”আলমের কুরবানি

  • নবীজির পক্ষ থেকে কুরবানি

  • কুরবানি করার নির্ধারিত সময়

  • রাতের বেলা কুরবানি করা

  • কুরবানির পশু নির্ধারিত সময়ের পরে জবাই করা

  • কুরবানির পশু এবং এদের বয়স

  • পশুর বয়স

  • যে সকল পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়িয

  • যে সকল পশু দ্বারা কুরবানি করা উত্তম

  • খাসি কুরবানি করার বিধান

  • পশুর যে সকল ত্রুটিতে এর দ্বারা কুরবানি করা জায়িয নয়

  • পশুতে যে সকল ত্রুটি থাকলেও এর দ্বারা কুরবানি করা জায়িয

  • কুরবানির পশুতে অংশীদারিত্ব

  • একটি পশুতে কতজন শরিক কুরবানি দিতে পারবে?

  • শরিকে কুরবানির ক্ষেত্রে কতিপয় জ্ঞাতব্য

  • কুরবানির অন্যান্য মাসআলাসমূহ

  • দরীদ্র থাকাকালীন কুরবানি করার পর ধনী হলে

  • কুরবানির পরিবর্তে সদকা করলে

  • নির্ধারিত সময়ে কুরবানি করতে না পারলে 

  • কুরবানি করার সময় পশুতে ত্রুটি সৃষ্টি হলে

  • পশু কেনার পর মারা গেলে বা হারিয়ে গেলে

  • পশুর পেটে বাচ্চা পাওয়া গেলে

  • পশু কেনার পর শরিকদারের মৃত্যু হলে

  • মান্নতের কুরবানির বিধান

  • কুরবানির জন্য ওসিয়তের বিধান

  • কুরবানি করার পদ্ধতি

  • জবাই সম্পর্কিত কিছু জরুরি মাসআলা

  • অমুসলিমের হাতে পশু জবাই করা হলে

  • দু’জনে মিলে জবাই করতে চাইলে

  • কুরবানির গোশত এবং চামড়ার বিধান

  • হালাল পশুর অংঙ্গ-প্রতঙ্গের বিধান

  • আকিকার মাসাইল



ভূমিকা

بِسِمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ


نَحْمَدُهُ وَنُصَلِّي وَنُسَلِّمُ عَلٰي رَسُوْلِهِ الْكَرِيْمِ


‘কুরবানি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদতে মালি’ তথা সম্পদের মাধ্যমে ইবাদত এবং এটি ইসলামের একটি শে‘য়ার বা নিদর্শনও বটে। হুযুর পাক (ﷺ) হিজরতের পর ১০ বছর পর্যন্ত মদিনা তায়্যিবায় অবস্থান করেছেন এবং প্রতি বছরই কুরবানি করেছেন। এ থেকে বুঝা যায়, কুরবানি শুধু হজ্জ পালনের সময় মক্কা মুয়াজ্জমার জন্যই নির্দিষ্ট নয়, বরং শরিয়ত কর্তৃক নির্দিষ্ট পরিমাণ (নিসাব পরিমাণ) সম্পদের মালিক সকল ব্যক্তির জন্যই কুরবানি করা ওয়াজিব; সে যেখানেই অবস্থান করুক-না-কেন।


হাদিস অস্বীকারকারী কথিত মুক্তমনা-মুসলমান, যারা এ ব্যাপারে আপত্তি করে থাকে যে, “এ কুরবানির জন্য অনেক পয়সা খরচ হয়; কাজেই এতে খরচ না করে জনকল্যানমূলক কাজ যেমন- শরণার্থী শিবির, দাতব্য হাসপাতাল প্রভৃতি নির্মাণ করে দেয়া উচিত,” তাদের এ আপত্তিটি শুধু খামখেয়ালী বসত মনগড়াই মাত্র। অন্যথায় হজ্জ-ও একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদতে মালি’ এবং ইসলামের অন্যতম একটি নিদর্শন, এটাও এ বলেই বন্ধ করে দিতে হবে যে, “লাখ-লাখ টাকা প্রত্যেক বছর হজ্জের জন্য খরচ না করে এগুলো জনকল্যানমূলক কাজে ব্যয় করাই বেশি উত্তম হবে। এভাবে রবের বিধান উপেক্ষা করে ইসলামের নিদর্শনসমূহের সব ক’টি বাদ দেয়াটা আর যাই হোক অন্তত কোন মুসলমানের কাজ হতে পারে না।


আর শুধু এ বলা যে- “কুরবানি কেবল মাত্র হজ্জের সময় মক্কা মুয়াজ্জমা-ই হবে, অন্যত্র অন্য কোন সময় নয়”- তাও মারাত্মক ভুল এবং পবিত্র হাদিসের অস্বীকারের নামান্তর। অবশ্যই হজ্জের কুরবানি নিঃসন্দেহে মক্কা মু‘য়াযযমার জন্যই নির্দিষ্ট। কিন্তু ঈদুল আদ্বহা’র কুরবানি প্রত্যেক নির্দিষ্ট পরিমাণ (নিসাব পরিমাণ) সম্পদের মালিকের উপরই ওয়াজিব; সে যেখানেই অবস্থান করুক।


কুরবানির অর্থ ও পরিচিতি


আরবি ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসি বা উর্দুতে ‘কুরবানি’ রূপে পরিচিত ও ব্যবহৃত। যার অর্থ- নৈকট্য। আর ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবাতুন’ শব্দমূল থেকে উৎপন্ন। যার শাব্দিক অর্থও নিকটবর্তী হওয়া বা কারো নৈকট্য লাভ করা।


ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, ‘কুরবানি’ বলা হয় ঐ মাধ্যমকে, যার দ্বারা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন ও তাঁর ইবাদাতের জন্য পশু জবাই করা হয়। ১

১ - ইমাম রাগিব, আল-মুফরাদাত, ৩/২৮৭।


হাদিস ও ফিকহের কিতাবসমূহে অবশ্যই কুরবানি শব্দের পরিবর্তে ‘উদ্বহিয়্যাহ্’ শব্দটিই ব্যবহার হয়েছে।


অতএব, নির্দিষ্ট পশুকে নির্দিষ্ট দিনে (অর্থাৎ ১০ যুলহাজ্জ থেকে ১২ যুলহাজ্জ) আল্লাহ’র নৈকট্য অর্জন এবং ছাওয়াবের নিয়্যতে নির্দিষ্ট পশু জবাই করা হলো কুরবানি। যা হযরত ইবরাহিম (عليه السلام)-এর সুন্নাত। হুযুর পুরনুর সরকারে দু’আলম (ﷺ)-কেও এ ব্যাপারে বলা হয়েছে যে,


فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ


-“সুতরাং আপনি স্বীয় রবের উদ্দেশ্যে নামায পড়–ন এবং কুরবানি করুন। ২

২ - সূরা আল-কাউছার: ০২।


কুরবানি করা হযরত ইবরাহিম (عليه السلام)-এর সুন্নাত


হাদিস শরিফে এসেছে, হযরত যায়দ বিন আরকাম (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত যে, সাহাবা কিরাম একবার আল্লাহ’র রাসুল (ﷺ)-এর নিকট আরয করলেন-


عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ قَالَ قُلْتُ أَوْ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا هَذِهِ الْأَضَاحِيُّ قَالَ سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ


-“ইয়া রাসুলাল্লাহ্! এ কুরবানিটা কী? তিনি ইরশাদ করলেন- তা তোমাদের পিতা ইবরাহিম (عليه السلام)-এর সুন্নাত (বা প্রচলন-পন্থা-পদ্ধতি)।” ৩

৩ - ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদিস নং- ১৯২৮৩;

   ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান, হাদিস নং- ৩১২৫।


কুরবানি করা সায়্যিদুল আম্বিয়া হুযুর (ﷺ)-এর সুন্নাত


হযরত জাবির (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:


عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ ذَبَحَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- يَوْمَ الذَّبْحِ كَبْشَيْنِ أَقْرَنَيْنِ أَمْلَحَيْنِ مُوجَأَيْنِ


-“নবী করিম (ﷺ) কুরবানির দিন চিত্রা রঙের শিংবিশিষ্ট দু’টি খাসি কুরবানি করেছেন।”৪

৪ - ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, হাদিস নং- ২৭৯৭।


বুঝা গেল, কুরবানি করা আমাদের প্রিয় নবীজিরও সুন্নাত। অন্য হাদিসে এসেছে যে, হুযুর পাকের কুরবানির পশুর বৈশিষ্ট্য ছিল- হৃষ্টপুষ্ট, শিংবিশিষ্ট, অধিক গোশতসম্পন্ন, চিত্রা রঙের এবং অন্ডকোষ কর্তৃত (খাসি)।৫

৫ - ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান, হাদিস নং- ৩১২২।


কুরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট


মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানি:


মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানি হলো, হযরত আদম (عليه السلام)-এর দুই পূত্র হাবিল ও কাবিল-এর প্রদত্ত কুরবানি। পবিত্র কুরআন কারিমে বর্ণিত হয়েছে-


وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ


-“হযরত আদমের দুই পূত্রের বৃত্তান্ত আপনি তাদেরকে যথাযথভাবে (যেমনটি ঘটেছিল) শুনান, যখন তারা উভয়ে কুরবানি করেছিল, তখন তাদের একজনের কুরবানি কবুল হল এবং অপরজনের কবুল হল না।” ৬

৬ - সূরা আল-মায়িদাহ: ২৭।


সংক্ষেপে ঘটনাটি হল- হযরত মা হাওয়া-এর গর্ভে হাবিলের সাথে ‘লিওয়া’ আর কাবিলের সাথে ‘এক্বলিমা’ জন্মগ্রহণ করেন। আর ঐ শরিয়তের বিধি অনুযায়ী ‘এক্বলিমা’ কাবিলের জন্য হারাম ছিল, তার জন্য হালাল ছিল ‘লিওয়া’। কিন্তু ‘এক্বলিমা’ অধিকতর সুন্দরী হওয়ায় কাবিল তাকেই বিয়ে করতে চাইল। হযরত আদম (عليه السلام) নিষেধ করলে কাবিল বলল, এটা আপনার নিজস্ব অভিমত, রবের হুকুম নয়। তখন তিনি বললেন, তোমরা দু’জনেই কুরবানি করো, যার কুরবানিকে আগুন এসে জালিয়ে দিয়ে যায়, সেই সত্য। সুতরাং কাবিল গমের স্তুপ, আর হাবিল উট কিংবা দুম্বা জবাই করে পাহাড়ের উপর রাখল। অদৃশ্য আগুন এসে হাবিলের গোশতগুলো জালিয়ে দিয়ে গেল, আর কাবিলের গমগুলো এমনি পড়ে রইল। এটা দেখে কাবিল হিংসায় জ্বলে উঠল। ৭

৭ - ইবনু কাছীর ও খাযাইনুল ইরফান থেকে সংক্ষেপিত।


এ ছিল মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানি এবং কুরবানি করার পদ্ধতি।


কুরবানি পূর্ববর্তী সকল যুগেই ছিল:


এ কুরবানির বিধান যুগে যুগে রবের পক্ষ হতে অবতীর্ণ সকল শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন:


وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ


-“আমি প্রত্যেক স¤প্রদায়ের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে আমি তাদেরকে জীবনপোকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি, সেগুলোর উপর তারা আল্লাহ’র নাম উচ্চারণ করে।” ৮

৮ - সূরা আল-হাজ্জ: ৩৪।


মানুষের সবচেয়ে প্রিয় দু’টি বস্তু এবং এর কুরবানি:


আল্লাহ্ তা‘আলার যে যত নিকটে, যে যত প্রিয় তাঁর পরীক্ষাগুলো ততই কঠিন হয়ে থাকে। তা ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত। পবিত্র কুরআন কারিমেও এসেছে:


وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ


-“আর অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুদা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে; তবে সুসংবাদ দিন ধৈর্য্যশীলদের।” ৯

৯ - সূরা আল-বাক্বারা: ১৫৫।


হযরত ইবরাহিম (عليه السلام)কে আল্লাহ্ পাক স্বীয় খলিল হিসেবে মনোনিত করেছেন। কাজেই তাঁকে এমন দু’টি বিষয়ের কুরবানি করার মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়েছেন যে দু’টি বস্তু মানুষের সবচেয়ে প্রিয়।


প্রথমটি হল, তাঁর জান;

দ্বিতীয়টি হল, তাঁর সন্তান।


আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নবী হযরত ইবরাহিম খলিল (عليه السلام)কে এ দু’টি বিষয়ের মাধ্যমেই পরীক্ষা নিয়েছেন এবং তিনি দু’টিতেই অত্যন্ত সাফল্যের সাথে কামিয়াব হয়েছেন।


স্বীয় জান কুরবানির মাধ্যমে পরীক্ষা:


আল্লাহ’র নবী হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) আল্লাহ’র দ্বিনের দাওয়াত দিতে লাগলেন। এতে নমরূদ ক্ষিপ্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল যে, তাঁকে সম্পূর্ণ বিলীন করে দিতে হবে। সে অনুযায়ী নমরূদের প্রজ্জ্বলিত আকাশচুম্বী আগুনের লেলিহান শিখায় ফেলার জন্য খলিলুল্লাহকে চাক্কিতে ঘুরানো হচ্ছিল অথবা ‘মিনজানিক’ দ্বারা নিক্ষেপ করার আয়োজন করছিল। কাফিররা উল্লাসে মেতে উঠল যে, আজ থেকে তাদের কথিত মা‘বুদদেরকে গালি দেয়ার আর কেউ থাকবে না, চিরদিনের জন্য তাঁকে ধ্বংস করে দেয়া হবে। এদিকে হযরত জিবরাইল (عليه السلام) উপস্থিত হয়ে গেলেন। বললেন, হে আল্লাহ’র খলিল! কোন নির্দেশ কি আছে? কিংবা কোন প্রয়োজন? আল্লাহ’র নবী খলিল বললেন, তোমার কাছে আমার কোন প্রয়োজন নেই। জিবরাইল বললেন, তবে রবের নিকটই আবেদন করুন। তিনি বললেন:


جانتا ہے وہ میرا رب جلیل ٭ آگ میں پرتا ہے اب اسکا خلیل


“তিনি আমার পরাক্রমশালী রব, তিনি জানেন যে, এখনই তাঁর বন্ধু আগুনে পড়ছেন।” ১০

১০ - আল্লামা শরীফ নূরী, বারাহ্ তাক্বরীরী, ১২তম খুতবাহ্।


এদিকে আল্লাহ’র নবী হযরত ইবরাহিম (عليه السلام)কে আগুনে নিক্ষেপ করা হল, ঐদিকে আল্লাহ্ তা‘আলা আগুনকে আদেশ করলেন:


يَا نَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَى إِبْرَاهِيمَ


-“হে অগ্নি! তুমি ইবরাহিমের উপর আরামদায়ক শীতল হয়ে যাও।” ১১

১১ - সূরা আল-আম্বিয়া: ৬৯।


আল্লাহ’র নবী খলিল (عليه السلام) প্রথম এবং সবচেয়ে প্রিয় জানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন।


সন্তানের কুরবানির মাধ্যমে পরীক্ষা:


জানের কুরবানির পর এখন প্রিয় সন্তানের কুরবানি। আল্লাহ’র আদেশে জনমানবহীন, পানি-রসদবিহীন, গাছ-গাছালীশূণ্য কঠিন মরু প্রান্তরে নির্বাসন দিয়ে আসলেন স্ত্রী হাজার-সহ প্রিয় সন্তান হযরত ইসমাইল (عليه السلام)কে। পরীক্ষার শুরু এখান থেকেই। আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে খাদ্য-পানীয়, গাছ-গাছালী ও মানুষের বসতি বানিয়ে দিলেন সে মরুময় মক্কাকে, ইসমাইল নবীর বরকতে। তিনি আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলেন। যখন হযরত ইসমাইল (عليه السلام) যৌবনে পদার্পনের কাছাকাছি হলেন, পিতা হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) একাধারে তিনদিন স্বপ্নে দেখলেন যে, আল্লাহ পাক তাঁর নিকট প্রিয় সন্তানের কুরবানি তলব করছেন। তৃতীয় দিন সকাল বেলা হযরত হাজার-এর নিকট থেকে সাজিয়ে গুছিয়ে, উত্তম পোষাক পরিয়ে ছুরি এবং রশি সাথে করে ইসমাইল (عليه السلام)কে নিয়ে রওয়ানা দিলেন জঙ্গলের দিকে।


শয়তান ধোঁকা দেয়ার নিমিত্তে হযরত হাজার, ইসমাইল এবং ইবরাহিম (عليه السلام)-এর নিকট ক্রমান্বয়ে গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে আসল। হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) হযরত ইসমাইল (عليه السلام)কে যা বললেন এবং ইসমাইল (عليه السلام)-এর জবাব যা ছিল পবিত্র কুরআন কারিমে আল্লাহ পাক তা এভাবে চিত্রায়ণ করেছেন:


فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ


-“অতঃপর যখন সে পিতার সাথে চলাফেরার বয়সে উপনীত হল, ইবরাহিম তাঁকে বললেন, হে বৎস! স্বপ্নে আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে যে, আমি তোমাকে কুরবানি করছি; এখন তোমার অভিমত কী দেখ। সে বলল, পিতা! আপনার প্রতি যা ওহি হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করুন। আল্লাহ চাহে তো আমাকে ধৈর্য্যশীল হিসেবে পাবেন।” ১২

১২ - সূরা আস-সাফফাত: ১০২।


ইবরাহিম (عليه السلام)-এর কুরবানি কবুল এবং বর্তমান কুরবানির প্রচলন


কেমন আশ্চর্যের দৃশ্য! আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য পিতা কর্তৃক পূত্রকে কুরবানি!! (আল্লাহু আকবার)। যখন পিতা-পূত্র উভয়েই রবের ফায়সালার উপর অবনতচিত্তে রাজি, তখন পিতা পূত্রকে উপোর করে শোয়ালেন। কুরআনের ভাষায়:


فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ


-“যখন পিতা-পূত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং ইবরাহিম তাঁকে জবাই করার জন্য শায়িত করলেন।” ১৩

১৩ - সূরা আস-সাফফাত: ১০৩।


ছুরি চালাবার আগে পূত্র বলল, আব্বাজান! তিনটি আবদার রক্ষা করুন:


প্রথমত, আমার হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে দিন, যেন নড়াচড়ার কারণে আপনার কষ্ট না হয় এবং আপনার শরীরে রক্তের ছিটা না পড়ে।


দ্বিতীয়ত, আমার চোখে কাপড় বেঁধে দিন, যেন মুহাব্বতের আতিশয্যে ছুরি চালানো বন্ধ না হয়ে যায়।


তৃতীয়ত, আমার রক্ত মাখা জামাটি আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দিবেন, যেন তাঁর অন্তরে একটু স্বস্তি আসে।


এদিকে পিতা পূত্রের গলায় ছুরি চালাচ্ছেন, ঐদিকে ছুরি ভোতা হয়ে গেছে। দু’বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ছুরিটি যখন পাহাড়ের দিকে নিক্ষেপ করলেন, তখন একটি পাথরের উপর পড়ে তা ছুরির আঘাতে দু’খন্ড হয়ে যায়। ছুরির বক্তব্য যেন এমন:


اَلْخَلِيْلُ يَأْمُرُنِيْ بِالْقَطْعِ وَالْجَلِيْلُ يَنْهَانِيْ


-‘খলিল আমাকে কাটতে হুকুম করেন, আর জলিল (আল্লাহ) আমাকে নিষেধ করেন।’


আবার ছুরি হাতে যখন পূত্রকে কুরবানি করতে প্রস্তুত হলেন, তৎক্ষনাৎ হযরত জিবরাইল আমিন বেহেশত হতে একটি দুম্বা নিয়ে ইবরাহিম (عليه السلام)-এর ছুরি ইসমাইল (عليه السلام)-এর গলায় পৌঁছার আগেই হাজির হলেন এবং ইসমাইল (عليه السلام)কে সরিয়ে তদস্থলে দুম্বাটি রেখে দিলেন। দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল। রবের পক্ষ হতে আওয়াজ আসল:


وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ - قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ - إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ - وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ - وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ


-“তখন আমি তাঁকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দেই। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম জবাই করার জন্য এক মহা জন্তু। আমি তার জন্য এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য রেখে দিয়েছি।” ১৪

১৪ - সূরা আস-সাফফাত: ১০৪-১০৮।


জ্ঞাতব্য যে, ইবনু কাছির বর্ণনা করেন, হযরত ইসমাইল (عليه السلام)-এর পরিবর্তে জান্নাতি যে দুম্বা বা ভেড়াটি দান করা হয়েছিল, এর নাম জারির, রং ছিল সাদা, বড় বড় চক্ষু ও শিং বিশিষ্ট। এটা জান্নাতে ৪০ বছর প্রতিপালিত হয়েছিল। এটা সে জন্তু যা হযরত আদম (عليه السلام)-এর বড় ছেলে হযরত হাবিল কুরবানি করেছিলেন।


হযরত ইবরাহিম (عليه السلام)-এর কুরবানি আল্লাহ কবুল করে নিলেন, আর এ স্মরণিকা স্বরূপ সেই কুরবানি ধারা কিয়ামত পর্যন্ত জারি করে দিলেন। এখনো প্রতি বৎসর সে স্মরণকেই উজ্জীবিত করা হয়।


হযরত জিবরাইল (عليه السلام)-এর পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ:


‘ফাতহুল বারী শারহু সাহীহিল বুখারী’ এবং ‘উমদাতুল ক্বারী শারহু সাহীহিল বুখারী’তে এসেছে যে, একবার হুযুর পাক (ﷺ) হযরত জিবরাইল আমিনকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কখনো তোমার পূর্ণাঙ্গ শক্তি প্রয়োগ করেছো? জবাবে জিবরাইল আমিন বললেন আমি চারবার আমার পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেছি।


  প্রথমবার, ইবরাহিম (عليه السلام)কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছিল, তখন আমি সিদরাতুল মুনতাহায় ছিলাম আল্লাহ’র আদেশে ততক্ষনাৎ আমি তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করার পূর্বেই হাজির হয়ে যাই এবং আগুনকে ফুলবাগানে পরিণত করে দেই।


  দ্বিতীয়বার, আমি সিদরায় ছিলাম, ছুরি হযরত ইসমাইল (عليه السلام)-এর দিকে আসছিল। মাত্র দু’ফুট দুরত্বের ব্যবধান এবং ছুরি সে দু’ফুট অতিক্রম করার আগেই জান্নাত হতে দুম্বা নিয়ে সেখানে পৌঁছাই।


  তৃতীয়বার, ইউসুফ (عليه السلام)কে যখন তাঁর ভাইয়েরা কূপে ফেলে দেওয়ার জন্য তাঁর বাহুতে রশি বেঁধে কূপের ভেতরে ঝুলিয়ে দিল এবং তরবারী দিয়ে রশি কাটতে এখনো অর্ধেক বাকি, তখন রবের আদেশ হলো এবং আমি জান্নাত হতে তখত এনে তিনি নিচে পড়ার পূর্বেই বিছিয়ে দিলাম।


  চতুর্থবার, উহুদ যুদ্ধে যখন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার দাঁত মুবারক শহিদ হলো, জমিনে আপনার রক্ত মুবারক পড়তে ছিল, তখন আল্লাহ পাক আদেশ করলেন, হে জিবরাইল সিদরা থেকে তারাতারি যাও এবং আমার হাবিবের রক্ত মুবারক মাটিতে পড়ার পূর্বেই সংরক্ষণ করো; না হয় জমিন পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাবে। তখন আমি এসে তা সংরক্ষণ করি।  ১৫

১৫ - আল্লামা শরীফ নূরী, বারাহ্ তাক্বরীরী, ১২তম খুতবাহ।


উম্মতে মুহাম্মদি (ﷺ)’র প্রত্যাবর্তনের ক্ষমতা:


এতক্ষণ দেখলেন হযরত জিবরাইল ফেরেশতা’র প্রত্যাবর্তনের ক্ষমতা। এখন একটি দৃষ্টি দিন উম্মতে মুহাম্মদি (ﷺ)’র প্রত্যাবর্তনের ক্ষমতার প্রতি-


* হযরত আব্দুল আযিয দাব্বাগ মাগরিবি রাদ্বিযাল্লাহু আনহু সম্পর্কে প্রসিদ্ধি রয়েছে যে, একদিন তিনি ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি পা উঠাতেন কিন্তু মাটিতে রাখার পূর্বেই পুনরায় ফিরিয়ে নিতেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত এমনটি করছিলেন। কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল যে, এটা কী কাজ? আপনি পা উঠাচ্ছেন কিন্তু জমিনের উপর রাখছেন না। তিনি বললেন:


گفتند کہ زمیں اولیا را دو قدم ست مرا یک قدم میسر نمی شد


-“বলা হয় যে, জমিন ওলিগণের দুই কদমের জায়গা, কিন্তু আমি এক কদমও রাখার জায়গা পাচ্ছি না। পা উঠালেই জমিনের উপারে চলে যায়।” ১৬

১৬ - আল্লামা শরীফ নূরী, বারাহ্ তাক্বরীরী, ১২তম খুতবাহ।


* এদিকে হুযুর গাউসুল আ‘যম আবদুল কাদের জিলানি (رضي الله عنه) বলেন:


نَظَرْتُ اِلٰي بِلَادِ اللّٰهِ جَمْعًا * كَخَرْدَلَةٍ عَلٰي حُكْمِ اتِّصَالِيْ


“আমি আল্লাহ’র সকল সম্রাজ্যে নজর করলাম, যেন তা আল্লাহ’র হুকুমে শরিষার দানার ন্যায় পরস্পর সন্নিবেশিত হয়ে আছে।” ১৭

১৭ - শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী, কাছিদায়ে গাউছিয়া। 


* আবার ফাতাওয়ায়ে শামিতে রয়েছে:


وَطَيُّ الْمَسَافَةِ مِنْهُ لِقَوْلِهِ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ {زُوِيَتْ لِي الْأَرْضُ} ৃ. قُلْتُ وَيَدُلُّ لَهُ مَا قَالُوا فِيمَنْ كَانَ بِالْمَشْرِقِ وَتَزَوَّجَ امْرَأَةً بِالْمَغْرِبِ فَأَتَتْ بِوَلَدٍ يَلْحَقُهُ فَتَأَمَّلْ . وَفِي التَّتَارْخَانِيَّة أَنَّ هَذِهِ الْمَسْأَلَةَ تُؤَيِّدُ الْجَوَازَ


-“নবীজি (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, আমার জন্যে পৃথিবীকে সংকুচিত করা হয়েছে। .... এতে ফক্বিহগণের নিম্নোক্ত মাসআলাটি’র সমাধান হয়ে যায় যে, পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে অবস্থানকারী ব্যক্তি (আল্লাহ’র ওলি) যদি পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থানকারী কোন মহিলাকে বিবাহ করেন এবং স্ত্রীর সন্তান ভূমিষ্ট হয়, তাহলে শিশুটি উক্ত স্বামীর বলে গণ্য হবে। তাতারখানিয়া কিতাবেও এর বৈধতার উপর সমর্থন রয়েছে।” ১৮

১৮ - আল্লামা ইবনু আবেদিন শামী, রদ্দুল মুহতার: ৬/৪০৯-৪১০,

     কিতাবুল জিহাদ, বাবুল মুরতাদ, কারামাতুল আওলিয়া।


আল্লাহ’র ওলিগণের ক্ষমতা হচ্ছে যে, পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তের দূরত্ব তাঁদের জন্য কোন প্রতিবন্ধকই নয়।


হুযুর পাক (ﷺ)-এর নিকট আল্লাহ’র সৃষ্টি জগত


হযরত ছাওবান (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:


عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- إِنَّ اللَّهَ زَوَى لِىَ الأَرْضَ فَرَأَيْتُ مَشَارِقَهَا وَمَغَارِبَهَا


-“নবী পাক (ﷺ) ইরশাদ করেন: নিশ্চই আল্লাহ আমার জন্য জমিন সংকুচিত করে দিয়েছেন। কাজেই আমি এর পূর্ব-পশ্চিম সব দেখলাম।” ১৯

১৯ - ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, কিতাবুল ফিতান, হাদিস নং- ৭৪৪০।


হুযুর পাকের খাদিম হযরত জিবরাইল, গাউছে পাক ও অন্যান্য উম্মতের জন্য যদি আল্লাহ’র সকল সৃষ্টিজগত এত ছোট হয়, স্বয়ং সেই দয়াল মুনিব আক্বা-মাওলার জন্য ছোট করা হলে তা কতটুকু ছোট হবে, যার কদমে হাজারো জিবরাইল, হাজারো গাউছে পাক কুরবান! (সুবহানাল্লাহ)


সুতরাং এখান থেকে এ মাসআলাটিও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সর্ব সৃষ্টিতে নবীজি হাযির ও নাজির। বরং তা-ই নয়, সকল সৃষ্টিই হুযুর পাকের নিকট হাযির রয়েছে। সে ক্ষমতা তাঁকে আল্লাহ পাক দান করেছেন।


আমাদের নবী (ﷺ) সকল নবী (আলাইহিমুস সালাম) থেকে শ্রেষ্ঠ


অন্যান্য সকল নবীগণকে নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায় বা ভূখন্ডের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু হুযুর পাককে সকল সৃষ্টির নবী করে পাঠানো হয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে:


عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ فُضِّلْتُ عَلَى الأَنْبِيَاءِ بِسِتٍّ أُعْطِيتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ وَنُصِرْتُ بِالرُّعْبِ وَأُحِلَّتْ لِىَ الْغَنَائِمُ وَجُعِلَتْ لِىَ الأَرْضُ طَهُورًا وَمَسْجِدًا وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً وَخُتِمَ بِىَ النَّبِيُّونَ


-“হযরত আবু হুরায়রাহ্ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: অন্য সব নবীদের চাইতে আমাকে ছয়টি বিশেষ মর্যাদা দান করা হয়েছে:


১. আমাকে সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক অর্থবোধক কথা বলার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।


২. আমাকে অত্যন্ত প্রভাব দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে।


৩. আমার জন্য গণীমাতের (যুদ্ধলব্ধ) অর্থ সম্পদ হালাল করা হয়েছে।


৪. আমার জন্য গোটা পৃথিবীর ভূমি বা মাটি পবিত্রতা হাসিলকারী বা মসজিদ করা হয়েছে।


৫. আমাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য (নবী করে) পাঠানো হয়েছে।


৬. আর আমাকে দিয়ে নবীদের আগমন-ধারা সমাপ্ত করা হয়েছে।” ২০

২০ - ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, কিতাবুল মাসাজিদ, হাদিস নং- ১১৯৫।


তাঁকে সকল সৃষ্টি এমনকি সকল নবীগণের উপরও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে:


عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ إِنَّ اللَّهَ فَضَّلَ مُحَمَّداً -صلى الله عليه وسلم- عَلَى الأَنْبِيَاءِ وَعَلَى أَهْلِ السَّمَاءِ


-“হযরত ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه)মা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-কে সকল নবীগণের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং আসমানবাসীর উপরও।”২১

২১ - সুনানুদ দারেমী, বাবু মা উ‘তিয়ান নাবিয়্যু মিনাল ফাদ্বল, হাদিস নং- ৪৭,

     ইমাম বায়হাকী, দালাইলুন নবুয়্যাত, হাদিস নং- ২২৩৯।


হুযুর পাক (ﷺ) ইবরাহিম (عليه السلام) হতেও শ্রেষ্ঠ


হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) রব্বে ইজ্জতের দরবারে যা আরয করেছেন কিংবা প্রার্থনা করেছেন, আমাদের নবী পাক (ﷺ)কে এগুলো এমনিতেই আল্লাহ্ পাক দান করেছেন। যেমন-


 হযরত খলিলুল্লাহ আল্লাহ’র দরবারে ফরিয়াদ করেছেন:


وَلَا تُخْزِنِي يَوْمَ يُبْعَثُونَ


-“হে আল্লাহ! পুনরুত্থান দিবসে তুমি আমায় লাঞ্চিত করো না।” ২২

২২ - সূরা আশ-শু‘আরা: ৮৭।


আর এদিকে নবী পাক সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক নিজেই বলেছেন:


يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ


-“ঐদিন আল্লাহ নবীজিকে এবং তাঁর সাথী ঈমানদারগণ কে লাঞ্চিত করবেন না।” ২৩

২৩ - সূরা আত-তাহরীম: ৮।


হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এসেছে:


وَقَالَ إِنِّي ذَاهِبٌ إِلَى رَبِّي سَيَهْدِينِ


-“ইবরাহিম নবী বললেন, আমি আমার রবের দিকে চললাম, তিনি আমাকে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখবেন।” ২৪

২৪ - সূরা আস-সাফফাত: ৯৯।


আর এদিকে নবীজিকে আল্লাহ নিজেই দাওয়াত করে নিয়েছেন প্রিয়তম বান্দাহ্ হিসেবে। ইরশাদ করেছেন:


سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ


-“আমার প্রিয়তম বান্দাহ্কে আমি ভ্রমণ করিয়েছি।” ২৫

২৫ - সূরা বনী ইসরাইল: ০১।


 হযরত ইবরাহিম নবী বললেন:


فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ


-“অতএব, তিনিই আমাকে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখবেন।” ২৬

২৬ - সূরা আয-যুখরুফ: ২৭।


এদিকে হাবিব পাক (ﷺ)কে নিজে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:


وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا


-“আর হাবিব, আপনাকে আমি প্রতিষ্ঠিত করি হিদায়াতের উপর।” ২৭

২৭ - সূরা আল-ফাতহ: ০২।


হযরত ইবরাহিম নবীর নিকট যে-সকল ফেরেশতারা আসে তাঁরা তাঁর সম্মানিত মেহমান। যেমন- ইরশাদ হয়েছে:


هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ


-“আপনার নিকট কি ইবরাহিমের সম্মানিত মেহমানের বৃত্তান্ত আসে নি?” ২৮

২৮ - সূরা আয-যারিয়াত: ২৪।


আর হাবিব পাকের নিকট আসা ফেরেশতারা হলেন তাঁর খাদিম বা সৈন্য-সামন্ত। যেমন- আল্লাহ’র বাণী:


وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا


-“আর তাঁর সাহায্যে এমন সৈন্য নিয়োজিত করেছি, যাদের তোমরা দেখ নি।” ২৯

২৯ - সূরা আত-তাওবাহ্: ৪০।


অন্যত্র এসেছে:


يُمْدِدْكُمْ رَبُّكُمْ بِخَمْسَةِ آلَافٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ مُسَوِّمِينَ


-“তোমাদের রব চিহ্নিত ঘোড়ার উপর পাঁচ হাজার ফেরেশতা নিয়োজিত করেছেন তোমাদের সাহায্য করতে।”৩০

৩০ - সূরা আলে ইমরান: ১২৫।


অতত্রব, প্রমাণিত হলো যে, হুযুর পুরনুর সকল নবীগণ হতে এমনকি ইবরাহিম নবী হতেও শ্রেষ্ঠ।


একটি সন্দেহ ও এর অপনোদন


এখানে একটি সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে যে, নবীজি (ﷺ) ইবরাহিম (عليه السلام) হতে শ্রেষ্ঠ এমনকি সকল নবীগণ হতেও। কিন্তু এ শ্রেষ্ঠত্বের জন্য সর্বদিক থেকেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বতা থাকা আবশ্যক। হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) তো স্বীয় জান এবং স্বীয় সন্তান রবের রাহে কুরবানি করেছেন, তাই আমাদের নবীজিও কি এমনটি করেছেন? আর না করলে এদিক দিয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব কী করে হয়? 


এর জবাব হলো এই যে,

হ্যাঁ, আমাদের নবী পাক (ﷺ)ও স্বীয় জান ও আপন সন্তানকে কুরবানি করেছেন। আর তা হযরত ইবরাহিম (عليه السلام) থেকেও উত্তম পন্থায়। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়াস রাখছি।


হুযুর পাক (ﷺ)-এর স্বীয় জানের কুরবানি


হযরত আবু সালমাহ্ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:


عَنْ أَبِي سَلْمَةَ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللّٰهِ -صلى الله عليه وسلم- لَا يَأْكُلُ الصَّدَقَةَ وَيَأْكُلُ الْهَدِيَّةَ، فَأَهْدَتْ إِلَيْهِ يَهُوْدِيَّةُ شَاةً مَصْلِيَةً فَأَكَلَ رَسُوْلُ اللّٰهِ -صلى الله عليه وسلم- مِنْهَا هُوَ وَأَصْحَابُهُ، فَقَالَتْ: إِنِّي مَسْمُوْمَةٌ، فَقَالَ: لِأَصْحَابِهِ: اِرْفَعُوْا أَيْدِيَكُمْ فَإِنَّهَا قَدْ أَخْبَرَتْ اَنَّهَا مَسْمُوْمَةٌ، قَالَ: فَرَفَعُوْا أَيْدِيَهُمْ، قَالَ: فَمَاتَ بِشَرُ بْنُ الْبَرَاءِ، فَأَرْسَلَ إِلَيْهَا رَسُوْلُ اللّٰهِ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ: مَا حَمْلُكِ عَلٰى مَا صَنَعْتِ؟ قَالَتْ: أَرَدْتُّ أَنْ أَعْلَمَ إِنْ كُنْتَ نَبِيًّا لَمْ يَضْرُرْكَ. وَإِنْ كُنْتَ مَلِكاً أَرْحَتَ النَّاسُ مِنْكَ، قَالَ: فَأَمَرَ بِهَا فَقُتِلَتْ


-“রাসুল পাক (ﷺ) সদকা/যাকাত ভক্ষন করতেন না, বরং হাদিয়া গ্রহণ করতেন। (খায়বর যুদ্ধে যয়নব বিনতে হারেসা নামের) জনৈকা ইহুদি রমনী বকরির ভূনা গোশতে বিষ মিশ্রিত করে হুযুর পাককে হাদিয়া পাঠায়। আর তা থেকে রাসুল পাক ও তাঁর সাহাবিগণ কিছু খেয়েও নিলেন। তখন স্বয়ং ভূনা গোশত তাঁকে জানিয়ে দেয় যে, আমি বিষ মিশ্রিত গোশত। অতঃপর নবীজি সাহাবাগণকে বললেন, এ খাবার থেকে তোমাদের হাত উঠিয়ে নাও। কেননা, তা আমাকে জানিয়েছে যে, এগুলো বিষ মিশ্রিত। বর্ণনাকারী বলেন, সকলে তাঁদের হাত উঠিয়ে নিল। তবে, সাহাবি হযরত বিশর ইবনু বারা ঐ বিষক্রিয়ায় তখনই শাহাদাত বরণ করেন। তখন নবী পাক ওই ইহুদি মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এরূপ করেছ কেন? উত্তরে মহিলা বলল, আমি জানতে চেয়েছি, আপনি নবী না বাদশাহ! যদি নবী হন, তবে এই বিষ আপনার কোন ক্ষতি করবে না; আর যদি না হন, আপনার হাত থেকে মানুষজন স্বস্তি পাবে। যাহোক, ঐ ইহুদি মহিলাকে তাঁর নির্দেশে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।” ৩১

৩১ - ইবনু সা‘দ, আত-তবাক্বাতুল কুবরা, ১/১৭২।


আল্লামা ইমাম আহমাদ কাসতালানী এ বিষয়ে উল্লেখ করেন যে:


وَقَدْ ثَبَتَ اَنَّ نَبِيَّنَا صلي الله عليه وسلم مَاتَ شَهِيْدًا لِاَكْلِهِ يَوْمَ خَيْبَرَ مِنْ شَاةٍ مَسْمُوْمَةٍ سَمًّا قَاتِلًا مِنْ سَاعَتِهِ حَتَّي مَاتَ مِنْهُ بِشَرُ بْنُ الْبَرَاءِ وَصَارَ بَقَاؤُهُ صلي الله عليه وسلم مُعْجِزَةٌ فَكَانَ أَلَمُ السَّمِّ يَتَعَاهَدُهُ اِلَي أَنْ مَاتَ بِهِ


-“নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হলো, আমাদের প্রিয় নবী শহিদি ওফাত লাভ করেছেন। কেননা তিনি খায়বরের দিন এমন তীব্র বিষ মিশ্রিত বকরির গোশতের কিছু খেয়ে ছিলেন, যে বিষের প্রতিক্রিয়ায় মানুষের ততক্ষনাৎ মৃত্যু হয়। যেভাবে সে বিষক্রিয়ায় বিশর ইবনে বারা সেই মূহুর্তেই প্রাণ ত্যাগ করেছিলেন। আর হুযুর পাকের বেঁচে থাকা (অর্থাৎ তখনই বিষ ক্রিয়ায় আক্রান্ত না হওয়া) তাঁর অন্যতম মু‘জিযা ছিল। কিন্তু সেই বিষ তাঁকে প্রায়শঃ যন্ত্রণা দিতে থাকত। এমনকি শেষ পর্যন্ত এরই প্রভাবে তাঁর ওফাত সংঘটিত হয়।” ৩২

৩২ - আল্লামা আহমাদ কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ, ৩/৪১৫।


সুতরাং সুস্পষ্ট হলো, হুযুর পাকের জানের কুরবানি হযরত ইবরাহিম থেকেও উত্তম ছিল। কেননা হযরত ইবরাহিম কুরবানির পরেও জীবিত ছিলেন, আর নবী পাক কুরবানি করেছেন এবং জাহেরিভাবে ওফাতও বরণ করেছেন। নবীজি আরও ইরশাদ করেন:


مَا أَوْذَي نَبِيٌّ مِثْلُ مَا أَوْذَيْتُ


-“আল্লাহ’র রাহে আমি যতটা যাতনাগ্রস্থ হয়েছি, আর কোন নবী তেমনটি হন নি।” ৩৩

৩৩ - মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ৩/১৩০।


হুযুর পাক (ﷺ)-এর স্বীয় সন্তানকে কুরবানি


হযরত আল্লামা জামি (رحمة الله) বর্ণনা করেন, একদিন সরকারে দু’আলম (ﷺ) হযরত ইমাম হুসাইনকে ডানে এবং স্বীয় সাহেবজাদা হযরত ইবরাহিমকে বামে বসিয়ে ছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত জিবরাইল উপস্থিত হয়ে আরয করলেন: ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আল্লাহ্ তা‘আলা এ দু’জন আপনার কাছে এক সঙ্গে রাখতে দিবেন না, উনাদের মধ্যে একজনকে ফিরিয়ে নিবেন। অতএব, এ দু’জনের মধ্যে আপনি যাকে ইচ্ছা পছন্দ করুন। হুযুর ফরমালেন: যদি হুসাইনকে নিয়ে যায় তাহলে এর বিরহে হযরত ফাতিমা ও হযরত আলি উভয়েরই কষ্ট হবে এবং আমার মনটাও ক্ষুন্ন হবে। আর যদি ইবরাহিমের ওফাত হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি দুঃখ একমাত্র আমিই পাব। এজন্য নিজে দুঃখ পাওয়াটাই আমি পছন্দ করি। এ ঘটনার তিনদিন পর হযরত ইবরাহিম ইনতিকাল করেন।


এরপর থেকে যখনই ইমাম হুসাইন হুযুর পাকের সমীপে আসতেন, হুযুর পাক তাঁকে মুবারকবাদ দিতেন ও কপালে চুমু দিতেন এবং উপস্থিত লোকদেরকে সম্বোধন করে বলতেন, আমি হুসাইন-এর জন্য আপন সন্তান ইবরাহিমকে কুরবানি দিয়েছি। ৩৪

৩৪ - শাওয়াহিদুন নবুওয়্যাত।


এদিকে ফোরাতকূলে ইমাম হুসাইনও কুরবানি হলেন নানাজির আদর্শের জন্য-দ্বিন ইসলামের জন্য। নবীজি এ কুরবানির কথা জেনেও তাঁর হিফাযতের জন্য দু‘আ করলেন না, শুধু দু‘আ করলেন, যেন আল্লাহ ধৈর্য্য ধারণের তাওফিক দান করেন। আল্লাহু আকবার! কতই-না উত্তম কুরবানি।


শুধুই কি তাই? একে একে সকল সাহেবজাদাগণ যুবক পুরুষ হওয়ার আগেই ইনতিকাল করলেন। এর বিনিময়ে উম্মতের জন্য যাবতীয় কল্যাণ-বেহেশত-কাউছার গ্রহণ করে নিলেন। সুরা কাউছার এরই প্রমাণ বহন করে।


অতএব, উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে সুস্পষ্ট হল যে, হুযুর পাকের কুরবানি আল্লাহ’র সকল সৃষ্টির কুরবানি হতে উত্তম।


হাদিস শরিফের আলোকে কুরবানির ফযিলত


 হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত:


عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ النَّبِيَّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ قَالَ‏ مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ يَوْمَ النَّحْرِ عَمَلاً أَحَبَّ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ هِرَاقَةِ دَمٍ وَإِنَّهُ لَيَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقُرُونِهَا وَأَظْلاَفِهَا وَأَشْعَارِهَا وَإِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ عَلَى الأَرْضِ فَطِيبُوا بِهَا نَفْسًا


-“হুযুর নবী করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন: কুরবানির দিন আদম সন্তান এমন কোন কাজ করতে পারে না, যা মহামহিম আল্লাহর নিকট রক্ত প্রবাহিত (কুরবানি) করার তুলনায় অধিক পছন্দনীয় হতে পারে। কুরবানির পশুগুলো কিয়ামতের দিন এদের শিং, খুর ও পশমসহ উপস্থিত হবে। কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই (কুরবানি) মহান আল্লাহর নিকট সম্মানের স্থানে পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা আনন্দ সহকারে কুরবানি করো।”৩৫

৩৫ - ইবনু মাজাহ, আস-সুনান, হাদিস: ৩১২৬;

     ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, হাদিস: ১৪৯৩।


হাদিস শরিফে এসেছে:


عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ قَالَ قَالَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا هَذِهِ الأَضَاحِيُّ قَالَ‏ سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ قَالُوا فَمَا لَنَا فِيهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ بِكُلِّ شَعَرَةٍ حَسَنَةٌ قَالُوا فَالصُّوفُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ بِكُلِّ شَعَرَةٍ مِنَ الصُّوفِ حَسَنَةٌ


-“হযরত যায়দ বিন আরকাম (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবাগণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! এই কুরবানি কী (কুরবানির এ পদ্ধতি কার থেকে আসল)? হুযুর পাক (ﷺ) ইরশাদ করলেন- এটি তোমাদের পিতা ইবরাহিম আলাইহিস্ সালাম-এর সুন্নাত। তাঁরা আবার আরয করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আমাদের জন্য এতে কী ছাওয়াব রয়েছে? ইরশাদ করলেন, এতে (কুরবানির পশুটির) প্রত্যেক পশমের সমান নেকি রয়েছে। আবার জিজ্ঞেস করলেন, দুম্বা বা ভেড়ার পশমের হুকুম কী? ফরমালেন, দুম্বা বা ভেড়ার প্রত্যেক পশমের পরিবর্তেও নেকি রয়েছে।” ৩৬

৩৬ - সুনানু ইবনি মাজাহ, হাদিস নং- ৩১২৭;

     সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী, হাদিস নং- ১৮৭৯৫;

     আল-মু‘জামুল কাবীর লিত্-তাবারানী, হাদিস নং- ৫০৭৫।


ইমাম মুসলিম উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন:


عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَمَرَ بِكَبْشٍ أَقْرَنَ يَطَأُ فِي سَوَادٍ وَيَنْظُرُ فِي سَوَادٍ وَيَبْرُكُ فِي سَوَادٍ فَأُتِيَ بِهِ فَضَحَّى بِهِ فَقَالَ‏ يَا عَائِشَةُ هَلُمِّي الْمُدْيَةَ  ثُمَّ قَالَ اشْحَذِيهَا بِحَجَرٍ‏ فَفَعَلَتْ فَأَخَذَهَا وَأَخَذَ الْكَبْشَ فَأَضْجَعَهُ وَذَبَحَهُ وَقَالَ‏ بِسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ‏ ثُمَّ ضَحَّى بِهِ صلى الله عليه وسلم


-“রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এমন দুম্বা কুরবানি করতে নির্দেশ করেন, যার শিং নিখুঁত, হাঁটা কালো, দেখতে কালো এবং শোয়াও কালো (অর্থাৎ পা, চোখ, পেট সবই কালো রঙের)। তিনি বললেন: হে আয়েশা! ছুরি দাও। এরপর বললেন: এটা পাথরে ঘষে ধারালো করো। আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, আমি তাই করলাম। তিনি ছুরি নিলেন, দুম্বাকে ধরে কাৎ করে শোয়ান এবং জবাই করার সময় বললেন: ‘বিসমিল্লাহ; হে আল্লাহ! আপনি এ কুরবানি মুহাম্মাদ (ﷺ), মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পরিবার ও তাঁর উম্মতের পক্ষ হতে কবুল করুন।’ অতঃপর তিনি দুম্বাটি কুরবানি করলেন।”৩৭

৩৭ - আবু দাউদ,আস-সুনান, হাদিস নং- ২৭৯২।


ইমাম আবু দাউদ বর্ণনা করেন:


عَنِ الْبَرَاءِ قَالَ خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ النَّحْرِ بَعْدَ الصَّلاَةِ فَقَالَ مَنْ صَلَّى صَلاَتَنَا وَنَسَكَ نُسُكَنَا فَقَدْ أَصَابَ النُّسُكَ وَمَنْ نَسَكَ قَبْلَ الصَّلاَةِ فَتِلْكَ شَاةُ لَحْمٍ‏ فَقَامَ أَبُو بُرْدَةَ بْنُ نِيَارٍ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَاللَّهِ لَقَدْ نَسَكْتُ قَبْلَ أَنْ أَخْرُجَ إِلَى الصَّلاَةِ وَعَرَفْتُ أَنَّ الْيَوْمَ يَوْمُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ فَتَعَجَّلْتُ فَأَكَلْتُ وَأَطْعَمْتُ أَهْلِي وَجِيرَانِي فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم‏ تِلْكَ شَاةُ لَحْمٍ‏ فَقَالَ إِنَّ عِنْدِي عَنَاقًا جَذَعَةً وَهِيَ خَيْرٌ مِنْ شَاتَىْ لَحْمٍ فَهَلْ تُجْزِئُ عَنِّي قَالَ نَعَمْ وَلَنْ تُجْزِئَ عَنْ أَحَدٍ بَعْدَكَ


-“হযরত বারাআ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কুরবানির দিন ঈদের নামাযের পর আমাদের সম্মুখে ভাষণ দিলেন এবং বললেন: যে ব্যক্তি আমাদের মত সলাত আদায় করলো, আমাদের মত কুরবানি করলো, তার কুরবানি সঠিক হলো। আর যে ঈদের সলাতের পূর্বে কুরবানি করলো, তা (কুরবানি না হয়ে) গোশত খাওয়ার বকরি হলো। আবু বুরদাহ ইবনু নিয়ার (رضي الله عنه) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহর শপথ! আমি তো সলাতের জন্য বের হওয়ার আগেই কুরবানি করে ফেলেছি। আমি ভেবেছিলাম, আজ পানাহারের দিন। তাই তাড়াহুড়া করে কুরবানির গোশত নিজে খেয়েছি, পরিবার-পরিজন এবং প্রতিবেশীদেরও খেতে দিয়েছি। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: এটা গোশত খাওয়ার বকরি হলো। আবু বুরদাহ বলেন, আমার কাছে ছয় মাস পূর্ণ বয়সের একটি ছাগল আছে, যা আমার গোশত খাওয়ার বকরির চেয়েও উত্তম। এটা কি আমার কুরবানির স্থান পূর্ণ করবে? তিনি বললেন: হ্যাঁ, কিন্তু তোমার পরে আর কারো জন্য এরূপ করা জায়িয হবে না।” ৩৮

৩৮ - আবু দাউদ,আস-সুনান, হাদিস নং- ২৮০০।


কুরবানি করার হুকুম: সুন্নাত না-কি ওয়াজিব?


হাদিস শরিফে এসেছে:


عن زيد بن أرقم قَالَ قَالَ أَصْحَابُ رَسُوْلِ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ مَا هَذِهِ الأَضَاحِىُّ قَالَ سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ


-“সাহাবাগণ হুযুর পাক (ﷺ)কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! এই কুরবানি কী (কুরবানির এ পদ্ধতি কার থেকে আসল)? হুযুর পাক (ﷺ) ইরশাদ করলেন- এটি তোমাদের পিতা ইবরাহিম (عليه السلام)-এর সুন্নাত।” ৩৯

৩৯ - সুনানু ইবনি মাজাহ, হাদিস নং- ৩১২৭;

     সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী, হাদিস নং- ১৮৭৯৫;

     আল-মু‘জামুল কাবীর লিত্-তাবারানী, হাদিস নং- ৫০৭৫।


এখানে ‘হযরত ইবরাহিম আলাইহিস্ সালাম-এর সুন্নাত’ বলতে তাঁর নিয়ম, পথ, পদ্ধতি, সিরাত প্রভৃতি বুঝায়- ইলমে ফিকহের পরিভাষায় ব্যবহৃত ‘সুন্নাত’ নয়। যেমন, অন্য হাদিসে এসেছে, নবীজি (ﷺ) ফরমান:


فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ


-“তোমাদের উপর আমার সুন্নাত তথা তরিকা-পন্থা-সিরাত ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খলিফায়ে রাশিদাগণের সুন্নাত আঁকড়ে ধরা আবশ্যক।” ৪০

৪০ - সুনানু আবী দাউদ, হাদিস নং- ৪৬০৭,

     জামিউত তিরমিযী, হাদিস নং- ২৬৭৬।


শরিয়ত তথা ইলমে ফিকহের পরিভাষায়, এমন প্রত্যেক জ্ঞানবান, বালিগ ও মুকিম ব্যক্তি- যারা ১০ যুলহাজ্জের ফজর হতে ১২ যুলহাজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাদের উপর কুরবানি করা ‘ওয়াজিব’। ৪১

৪১ - আল্লামা ইবনু আবিদীন শামী, রদ্দুল মুহতার।


কুরবানি করা ওয়াজিব হওয়ার দলিল হলো-


* মহান আল্লাহ্ পাকের বাণী-


فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ


-“অতএব, আপনি স্বীয় রবের জন্য নামায পড়–ন এবং কুরবানি করুন।” ৪২

৪২ - সূরা কাউছার: ০২।


আলোচ্য আয়াতে কারিমায় বর্ণিত انْحَرْ আদেশসূচক শব্দটি দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে- এ ব্যাপারে ‘তাফসিরে ইবনে কাছির’-এ বিভিন্ন মতামত উল্লেখ করার পর আল্লামা ইবনু কাছির বলেন:


كُلُّ هَذِهِ الْأَقْوَالِ غَرِيْبَةٌ جِدًّا وَالصَّحِيْحُ الْقَوْلُ الْأَوَّلُ أَنَّ الْمُرَادَ بِالنَّحْرِ ذَبْحُ الْمَنَاسِكِ وَلِهَذَا كَانَ رَسُوْلُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُصَلِّي الْعِيْدَ ثُمَّ يَنْحَرُ نُسُكَهُ


-“এ সকল মতামতই অত্যন্ত দূর্বল। সহিহ মত হচ্ছে, ‘কুরবানির পশু জবাই করা তথা কুরবানি করা’। আর এ জন্যই নবীজি (ﷺ) ঈদের নামায আদায় করতেন এবং এরপরে স্বীয় পশু কুরবানি করতেন।” ৪৩

৪৩ - ইবনু কাছীর, আত-তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৮/৫০৩।


*সুনানু ইবনি মাজাহ্ কিতাবের কুরবানি অধ্যায়ের ‘কুরবানি ওয়াজিব নাকি না?’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে এবং ইমাম হাকিম নাইসাবুরি-সহ আরো অনেক ইমাম তাঁদের স্ব-স্ব গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) হতে মারফূ‘ সূত্রে ‘সহিহ্’ সনদে বর্ণনা করেছেন-


أخبرنا الحسن بن الحسن بن أيوب ثنا أبو حاتم الرازي ثنا عبد الله بن يزيد المقري ثنا عبد الله بن عياش ثنا عبد الرحمن الأعرج عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ كَانَ لَهُ مَالٌ فَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا وَقَالَ مَرَّةً مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يَذْبَحْ فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا هَذَا حَدِيْثٌ صَحِيْحُ الْإِسْنَادِ ولم يخرجاه


-“রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ) ইরশাদ করেন: যার নিকট (নিসাব পরিমাণ) সম্পদ আছে, অথচ কুরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের দিকেও না আসে।” হাকিম নাইসাবুরি তাঁর ‘আল-মুসতাদরাক’ কিতাবে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।” ৪৪

৪৪ - ইমাম হাকিম, আল-মুসতাদরাক, হাদিস নং- ৭৫৬৫;

     সুনানু ইবনি মাজাহ, হাদিস নং- ৩১২৩;

     কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ১২২৬১।


এ হাদিসের রাভি হযরত আইয়াশ সম্পর্কে কেউ কেউ আপত্তি করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, তিনি মুসলিম শরিফের বর্ণনাকারী। আবু হাতিম রাযি তাকে ‘সাদূক্ব’ এবং ইবনু হিব্বান তাঁকে ‘ছিক্বাত’ হিসেবে গণ্য করেছেন। আবার হাদিসটি ‘মাওকূফ’ হিসেবেও হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত হয়েছে। আর ‘উসূলুল হাদিস’-এর একটি কায়দা হচ্ছে, যখন একই হাদিস মারফূ‘ ও মাওকূফ দু’টি সূত্রেই সহিহ হিসেবে বর্ণিত হয়, তখন মারফূ‘ হিসেবেই প্রাধান্য পাবে। যেমন, ইমাম নবভি তার (আল-মিনহাজ শারহু সহীহ মুসলিম, ৭/১৬) কিতাবে বলেন:


وَلِأَكْثَرِ الْمُحَدِّثِينَ أَنَّهُ إِذَا تَعَارَضَ فِي رِوَايَةِ الْحَدِيثِ وَقْفٌ وَرَفْعٌ أَوْ إِرْسَالٌ وَاِتِّصَالٌ حُكِمُوا بِالْوَقْفِ وَالْإِرْسَالِ وَهِيَ قَاعِدَةٌ ضَعِيْفَةٌ مَمْنُوعَةٌ وَالصَّحِيحُ طَرِيْقَةُ الْأُصُولِيِّيْنَ وَالْفُقُهُاءِ وَالْبُخَارِيِ وَمُسْلِمٍ وَمُحَقِّقِي الْمُحَدِّثِينَ أَنَّهُ يُحْكَمُ بِالرَّفْعِ وَالْاِتِّصَالِ لِأَنَّهَا زِيَادَةُ ثِقَةٍ


উল্লেখিত কুরআনের আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরবানি করার হুকুম হলো ‘ওয়াজিব’।


তবে ইমাম শাফেয়িসহ কিছু কিছু ইমামের মতে কুরবানি করা ‘সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ’। কেননা হাদিস শরিফে এসেছে- مَنْ اَرَادَ اَنْ يُّضَحَّي مِنْكُمْ فَلَا يَأْخُذُ مِنْ شَعْرَةٍ وَاَظْفَارِهِ شَيْئًا -“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কুরবানি করতে ইচ্ছা করবে, সে যেন চুল ও শরীরের চামড়া হতে কোন কিছু না কাটে।” এ বর্ণনায় যেহেতু ‘ইচ্ছা করবে’ বলে কুরবানিকে ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে, তাই তা ওয়াজিব হবে না, বরং সুন্নাত হবে।


আমাদের পক্ষ হতে এর জবাব হলো- ‘ইচ্ছা করা’ শব্দটি এখানে ওয়াজিবের বিপরীতার্থে ব্যবহার হয় নি, বরং ‘নিয়্যত করা’ অর্থে ব্যবহার হয়েছে। হাদিস শরিফে ‘ইচ্ছা করা’-র কথাটি ফরয ইবাদাতের ক্ষেত্রেও বর্ণিত হয়েছে। যেমন, হজ্জ সম্পর্কে নবীজি ফরমান-

 مَنْ اَرَادَ مِنْكُمُ الْحَجَّ فَلْيَتَعَجَّلْ 

-“তোমাদের মধ্যে যে হজ্জ আদায়ের ইচ্ছা করল, সে যেন তারাতারি করে।” ৪৫

৪৫ - আবু দাউদ, আস-সুনান।


যারা কুরবানি করবে তাদের ক্ষৌরকার্য


হযরত উম্মু সালামাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: 


أُمَّ سَلَمَةَ تَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم‏ مَنْ كَانَ لَهُ ذِبْحٌ يَذْبَحُهُ فَإِذَا أَهَلَّ هِلاَلُ ذِي الْحِجَّةِ فَلاَ يَأْخُذَنَّ مِنْ شَعْرِهِ وَلاَ مِنْ أَظْفَارِهِ شَيْئًا حَتَّى يُضَحِّيَ‏


-“রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: যার কুরবানির পশু রয়েছে, সে যেন যুলহাজ্জ মাসের নতুন চাঁদ উঠার পর থেকে কুরবানি করার পূর্ব পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে।” ৪৬

৪৬ - আবু দাউদ, আস-সুনান, হাদিস নং- ২৭৯১।


কুরবানি করার সামর্থ না থাকলে কী করনীয়?


হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত:


عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ أُمِرْتُ بِيَوْمِ الأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لِهَذِهِ الأُمَّةِ قَالَ الرَّجُلُ أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلاَّ أُضْحِيَةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا قَالَ لاَ وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَأَظْفَارِكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَتِلْكَ تَمَامُ أُضْحِيَتِكَ عِنْدَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ


-“নবী পাক (ﷺ) বলেন: আমি কুরবানির দিনকে ঈদ উদযাপন করতে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছি। আল্লাহ এ দিনকে এ উম্মতের জন্য ঈদ হিসাবে নির্দিষ্ট করেছেন। এক ব্যক্তি বললো, আপনার অভিমত ব্যক্ত করুন, আমি (আমার প্রতিপালিত) দুগ্ধবতী বা মালবাহী পশু ছাড়া অন্য পশু না পেলে কি তা দিয়েই কুরবানি করবো? তিনি বললেন: না, বরং তুমি তোমার চুল ও নখ কাটবে, গোঁফ ছোট করবে এবং নাভীর নীচের লোম কাটবে। এ কাজগুলোই আল্লাহর নিকট তোমার পূর্ণাঙ্গ কুরবানি।” ৪৭

৪৭ - আবু দাউদ, আস-সুনান, হাদিস নং- ২৭৮৯;

     ইমাম সুয়ুতী, আল-জামি‘উস সাগীর, হাদিস নং- ১২৬৫।


যাদের উপর কুরবানি করা ওয়াজিব এবং যাদের উপর ওয়াজিব নয়


কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। তা হলো-


১. মুসলিম হওয়া; সুতরাং অমুসলিমদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়।


২. মুকিম হওয়া; কাজেই মুসাফিরদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়।


৩. বালিগ হওয়া; সুতরাং নাবালিগ-এর উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়, তবে করলে ভাল। যদি কেউ বালেগ ছেলে অথবা স্ত্রীর পক্ষ হতে কুরবানি করতে চায় তবে তাদের থেকে অনুমতি নেয়া শর্ত। অনুমতি ব্যতীত ওয়াজিব আদায় হবে না।


উল্লেখ্য যে, নিজের পক্ষ থেকেই কুরবানি করা ওয়াজিব। সন্তানের পক্ষ হতে পিতার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব নয়। তবে পিতা নাবালেগ সন্তানের পক্ষ হতে চাইলে তা নফল হিসেবে করতে পারবে।


৪. ধনী হওয়া অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া। এখানে নিসাব-এর অর্থ হলো, যার উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। এটা উদ্দেশ্য নয় যে, যার উপর যাকাত ফরয হয় (অর্থাৎ মাল এক বছর মালিকানায় থাকা শর্ত নয়, বরং ঈদের দিন যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকে তবেই তার উপর কুরবানি ওয়াজিব)। যে ব্যক্তি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের মালিক, কিংবা মৌলিক প্রয়োজন ছাড়া যে ব্যক্তি এ পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, যার মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের সমান, তবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব।


৫. কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। সম্পদশালী মহিলাদের উপরও কুরবানি ওয়াজিব হয়, যেমনটি পুরুষের উপর হয়।


৬. সময় পাওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ দশ যুলহজ্জ সুবহে সাদিকের পর হতে বার যুলহজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনদিন দু’রাত- এ দিনসমূহকে কুরবানির দিন বা আইয়ামুন নাহর বলা হয়।


* জ্ঞাতব্য যে, কুরবানি ওয়াজিব নয় এমন গরীব ব্যক্তি কুরবানির নিয়্যত করলে বা কুরবানির নিয়্যতে পশু ক্রয় করলে, তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হয়ে যাবে। ৪৮

৪৮ - ফাতাওয়ায়ে শামী ও বাহারে শরীয়ত অবলম্বনে।


কিছু জরুরি মাসআলা


 মাসআলা-১:


শহরে কুরবানি করার বিধান হলো, ঈদের নামাযের পরেই তা করতে হবে নামাযের পূর্বে হবে না। আর গ্রামে কুরবানির জন্য এই শর্ত নেই। গ্রামে সুবহে সাদিকের পর থেকেই কুরবানি হয়। কেননা গ্রামে ঈদের নামায নেই।


উল্লেখ্য যে, বর্তমান আমাদের বাংলাদেশের গ্রামগুলোর অধিকাংশই শহরের হুকুমের আওতাভূক্ত।


 মাসআলা-২:


নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে কুরবানি হবে না। যদি কেউ করে ফেলে কুরবানি হয় নি, আবার কুরবানি করবে। আর সময়ের পরে কুরবানি করলেও কুরবানি হবে না। তবে তখন কুরবানির পশুর মূল্যের সমান সদকা করবে।


 মাসআলা-৩:


কুরবানির সময় কুরবানি করাই আবশ্যক, অন্যকিছু এর স্থলাভিষিক্ত হবে না। যেমন, কুরবানির পরিবর্তে লাখ টাকা সদকা করে দেয়া প্রভৃতি।


 মাসআলা-৪:


শর্তগুলো নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ণ অংশেই পাওয়া জরুরি নয় বরং কুরবানির জন্য যে সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছে ঐ সময়ের যে কোন অংশে শর্তগুলো পাওয়া যাওয়াই কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যেমন, কোন ব্যক্তি কুরবানির নির্দিষ্ট সময়ের প্রথম দিকে দরিদ্র ছিল এবং কুরবানির দিনসমূহের পরবর্তি যে কোন সময়ে ধনী হয়ে গেল, অনুরূপ মুসাফির মুকিম হয়ে গেল, অমুসলিম মুসলিম হয়ে গেল, কিংবা নাবালিগ বালিগ হয়ে গেল, তবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হয়ে যাবে।


কুরবানিতে নিসাব কী?


কুরবানির ক্ষেত্রে নিসাব-এর অর্থ হলো, যার উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। এটা উদ্দেশ্য নয় যে, যার উপর যাকাত ফরয হয়। ৪৯

৪৯ - বাহারে শরীয়ত, ১৫তম খন্ড।


অর্থাৎ যে ব্যক্তি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের মালিক, কিংবা মৌলিক প্রয়োজন ছাড়া যে ব্যক্তি এ পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, যার মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের সমান, তবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব। তবে তা যাকাতের নিসাবের মত পূর্ণ এক বছর মালিকানায় থাকা শর্ত নয়। বরং ঈদের দিন যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকে তবেই তার উপর কুরবানি ওয়াজিব।


নাবালিগ-এর পক্ষ থেকে কুরবানি


নাবালিগ-এর উপর কুরবানি করা ওয়াজিব নয় এবং তার পক্ষ হতে তার পিতা বা অভিবাবকের উপরও কুরবানি করা ওয়াজিব নয়। ৫০

৫০ - শামী ও বাহারে শরীয়ত।


মুসাফির-এর উপর কুরবানি


মুসাফিরের উপর কুরবানি করা ওয়াজিব নয়। তবে মুসাফির যদি কুরবানি করে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে।৫১

৫১ - আলমগীরী, শামী, বাহারে শরীয়ত।


দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানি


দরিদ্র বলতে কোন ব্যক্তি যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হয়, তাহলে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব নয়। যদি সে কুরবানির নিয়্যত বা মান্নত না করে, অথবা কুরবানির নিয়্যতে পশু ক্রয় না করে, তাহলে তার উপর কুরবানি করা নফল হবে। ৫২

৫২ - ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, বাহারে শরীয়ত।


তবে, কুরবানি ওয়াজিব নয় এমন গরিব ব্যক্তি কুরবানির নিয়্যত বা মান্নত করলে বা কুরবানির নিয়্যতে পশু ক্রয় করলে, তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হয়ে যাবে।


মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি


মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করা জায়িয এবং ছাওয়াবের কাজ। সামর্থবান ব্যক্তি প্রথমে নিজের পক্ষ থেকে কুরবানি করবে, এরপর সম্ভব হলে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করবে। এ ব্যাপারে সহিহ হাদিস ও ফিকহের সমর্থন পাওয়া যায়। এমনকি এ বিষয়ে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ) হযরত আলি (رضي الله عنه)কে ওসিয়ত-ও করেছেন। ইমাম আবু দাউদ তাঁর ‘আস-সুনান’ গ্রন্থের ‘কুরবানি’ অধ্যায়ে ‘ (মৃত বক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি)’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে বর্ণনা করেন:


حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ أَبِى شَيْبَةَ حَدَّثَنَا شَرِيكٌ عَنْ أَبِى الْحَسْنَاءِ عَنِ الْحَكَمِ عَنْ حَنَشٍ قَالَ رَأَيْتُ عَلِيًّا يُضَحِّى بِكَبْشَيْنِ فَقُلْتُ مَا هَذَا فَقَالَ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَوْصَانِى أَنْ أُضَحِّىَ عَنْهُ فَأَنَا أُضَحِّى عَنْهُ


-“হযরত হানাশ বলেন, আমি হযরত আলি (رضي الله عنه)কে দেখলাম দু’টি মেষ কুরবানি করছেন। অতঃপর তাঁকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানি করতে আমাকে ওসিয়ত করে গেছেন। তাই আমি তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানি করছি’।” ৫৩

৫৩ - আবু দাউদ, আস-সুনান, হাদিস নং- ২৭৯২;

     ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, হাদিস নং- ১৪৯৫।


আলোচ্য হাদিসের দু’জন বর্ণনাকারী- হযরত আবুল হাসনা এবং হযরত হানাশ সম্পর্কে কেউ কেউ ‘জরাহ-সমালোচনা’ করে হাদিসটিকে ‘দূর্বল’ বলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের এ দাবী কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ইমাম আবু দাউদ এ হাদিসটি সংকলন করার পর কোন মন্তব্য করা হতে বিরত থেকেছেন। আর ইমাম আবু দাউদের হাদিস বর্ণনার পর মন্তব্য করা থেকে নিরব থাকার অর্থ হলো- ‘হাদিসটি দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য’।


আবু উমর বিন আব্দুল বার বলেন:


كُلُّ مَا سَكَتَ عَلَيْهِ فَهُوَ صَحِيْحٌ عِنْدَهُ


-“যে হাদিস উল্লেখ করে ইমাম আবু দাউদ মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন, ওই হাদিসটি তাঁর নিকট ‘সহিহ’ হিসেবে সাব্যস্ত।” ৫৪

৫৪ - ফাতহুল মুগীছ, ১/৯১।


ইমাম মুনযিরি বলেন:


كُلُّ حَدِيثٍ عَزَوْتَهُ اِلَي اَبِي دَاؤُدَ وسَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ كَمَا ذَكَرَ اَبُو دَاؤُدَ وَلَا يَنْزِلُ عَنْ دَرْجَةِ الْحَسَنِ وَقَدْ يَكُونُ عَلَي شَرْطِ الصَّحِيْحَيْنِ


-“যে সকল হাদিস ইমাম আবু দাউদ বর্ণনা করে মন্তব্য করা হতে নিরব থেকেছেন, ঐ সকল হাদিস তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী-ই হবে। অর্থাৎ এ সকল হাদিস ‘হাসান’-এর থেকে তো নিম্ন মানের হবেই না। বরং তা বুখারি ও মুসলিমের শর্তের উপরই সাব্যস্ত হবে।” ৫৫

৫৫ - আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, ১/১১।


তবে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করার দুটি অবস্থা রয়েছে:


১. মৃত ব্যক্তি তার পক্ষ হতে কুরবানি করার ওসিয়ত করে গেলে তার পক্ষ হতে কুরবানি করা। আর এ ক্ষেত্রে কুরবানির সম্পূর্ণ গোশত গরিবদের মাঝে বন্টন করে দিতে হবে। যেমন, ফাতাওয়ায়ে শামি ও আলমগীরিতে এসেছে:


لَوْ ضَحَّى عن مَيِّتٍ وَارِثُهُ بِأَمْرِهِ أَلْزِمْهُ بِالتَّصَدُّقِ بِهَا وَعَدَمِ الْأَكْلِ مِنْهَا


২. আর যদি ওসিয়ত না করে যায়, তাহলে সাধারণ কুরবানির মতই এর গোশত সকলে খেতে পারবে। যেমন, ফাতাওয়ায়ে শামি ও আলমগীরিতে এসেছে:


مَنْ ضَحَّى عَنْ مَيِّتٍ جَازَ الْأَكْلَ مِنْهَا وَالْهَدِيَةَ وَالصَّدَقَةَ وَالْاَجْرَ لِلْمَيِّتِ لِلذَّابِحِ


উম্মতের পক্ষে সরকারে দু”আলমের কুরবানি


হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে,


عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه و سلم كَانَ إِذَا أَرَادَ أَنْ يُّضَحِّيَ اِشْتَرَى كَبْشَيْنِ عَظِيْمَيْنِ أَقْرَنَيْنِ أَمْلَحَيْنِ مَوْجُوْءَيْنِ فَذَبَحَ أَحَدَهُمَا عَنْ أُمَّتِهِ لِمَنْ شَهِدَ لِلَّهِ بِالتَّوْحِيدِ وَشَهِدَ لَهُ بِالْبَلَاغِ وَذَبَحَ الْآخَرَ عَن مُحَمَّدٍ وَعَنْ آلِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ


-“রাসুলুল্লাহ (ﷺ) যখন কুরবানির ইচ্ছা করতেন তখন দুটি মোটাতাজা, গোশতওয়ালা, শিং বিশিষ্ট, চিত্রা রঙ্গের খাসিকৃত দুম্বা (মেষ) ক্রয় করতেন। অতঃপর এর একটি আপন উম্মতের যারা আল্লাহ্’র তাওহিদের স্বাক্ষী দেয় এবং তার নবুওয়্যাতের প্রচারের স্বাক্ষী দেয়, তাঁদের পক্ষ থেকে এবং অপরটি মুহাম্মদ (ﷺ) ও তাঁর পরিবার বর্গের পক্ষ থেকে কুরবানি করতেন।” ৫৬

৫৬ - ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান, হাদিস নং- ৩১২২;

     আল-মুসতাদরাক লিল-হাকীম: ৭৫৪৭;

     আস-সুনানুল কুবরা লিল-বায়হাক্বী: ১৮৮২৬।


নবীজির পক্ষ থেকে কুরবানি


আমাদের আক্বা-মাওলা হুযুর (ﷺ)-এর বিশাল দয়াকে লক্ষ্য করুন। তিনি স্বয়ং এ ভাগ্যবান উম্মতের পক্ষ হতে কুরবানি করেছেন এবং সে স্থানেও উম্মতকে স্মরণ করেছেন। এজন্য যে সকল মুসলমানদের সামর্থ্য হয় যে, হুযুর পাকের পক্ষ হতে কুরবানি করবে তাঁর কেমন সৌভাগ্য। ৫৭

৫৭ - সদরুশ শরিয়ত মফতি আমজাদ আলী আযমী, বাহারে শরিয়ত, খন্ড: ১৫।


ইমাম আবু দাউদ বর্ণনা করেন:


عَنْ حَنَشٍ قَالَ رَأَيْتُ عَلِيًّا يُضَحِّى بِكَبْشَيْنِ فَقُلْتُ مَا هَذَا فَقَالَ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- أَوْصَانِى أَنْ أُضَحِّىَ عَنْهُ فَأَنَا أُضَحِّى عَنْهُ


-“হযরত হানাশ বলেন, আমি হযরত আলি (رضي الله عنه)কে দেখলাম দু’টি মেষ কুরবানি করছেন। অতঃপর তাঁকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানি করতে আমাকে ওসিয়ত করে গেছেন। তাই আমি তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানি করছি’।” ৫৮

৫৮ - আবু দাউদ, আস-সুনান, হাদিস নং- ২৭৯২;

     ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, হাদিস নং- ১৪৯৫।


কুরবানি করার নির্ধারিত সময়


* কুরবানি করার সময় ১০ যুলহাজ্জ-এর সুবহে সাদিক থেকে ১২ যুলহাজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। অর্থাৎ তিনদিন, দুই রাত। এ দিনগুলোকে ‘আইয়্যামে নাহর’ বলা হয়। আর ১১ যুলহাজ্জ থেকে ১৩ যুলহাজ্জ পর্যন্ত তিনদিনকে ‘আইয়্যামে তাশরিক’ বলা হয়। সুতরাং মাঝের দুইদিন ‘আইয়্যামে নাহর’ ও ‘আইয়্যামে তাশরিক’ উভয়টি-ই। আর প্রথমদিন অর্থাৎ ১০ যুলহাজ্জ শুধুমাত্র ‘আইয়্যামে নাহর’ এবং শেষের দিন অর্থাৎ ১৩ যুলহাজ্জ শুধুমাত্র ‘আইয়্যামে তাশরীক্ব’। ৫৯

৫৯ - বাহারে শরীয়ত, ১৫তম খন্ড; দুররে মুখতার।


‘আইয়্যামে নাহর’-এর প্রথম দিন তথা ১০ যুলহাজ্জ কুরবানি করাই সর্বোত্তম। এরপর ১১, এরপর ১২ যুলহাজ্জ-এর মর্যাদা। ৬০

৬০ - বাহারে শরীয়ত, ১৫তম খন্ড।


* যার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব সে ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কুরবানি দিতে না পারলে, পরে কুরবানির পশুর মূল্যের সমান সদকা করবে।


রাতের বেলা কুরবানি করা


হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه)মা হতে বর্ণিত যে,


عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه و سلم نَهَى أَنْ يُّضَحِّىَ لَيْلًا


-“নিশ্চয় নবী পাক (ﷺ) রাতে কুরবানি করতে নিষেধ করেছেন।” ৬১

৬১ - আল-মু‘জামুল কাবীর লিত্-তাবারানী, ১১/১৯০, হাদিস নং- ১১৪৫৮।


ফাতাওয়ার কিতাবে এসেছে- “১০ যুলহাজ্জ-এর পরের দুই রাত্র-ও ‘আইয়্যামে নাহর’-এর অন্তর্ভূক্ত। এরমধ্যেও কুরবানি হতে পারে। তবে রাতে জবাই করা ‘মাকরূহ্’।” ৬২

৬২ - বাহারে শরীয়ত, ১৫তম খন্ড; দুররে মুখতার।


কুরবানির পশু নির্ধারিত সময়ের পরে জবাই করা


‘আইয়্যামুন নাহর’ তথা কুরবানির দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে এবং যার উপর কুরবানি ওয়াজিব ছিল, সে কুরবানি করে নাই, তখন কুরবানি বাদ হয়ে গেছে, এখন করলে হবে না। তবে কুরবানির পশু কিনে থাকলে, তা সদকা করে দিবে অথবা না কিনলে এর সমপরিমাণ মূল্য সদকা করে দিবে। আর যদি নির্ধারিত সময়ের পরে পশু জবাই করে ফেলে, তাহলে সম্পূর্ণ গোশত সদকা করে দিবে, এর থেকে সামান্যও খাওয়া যাবে না। যদি খেয়ে ফেলে, তবে যতটুকু খাওয়া হয়েছে, এর মূল্য সদকা করে দিতে হবে।৬৩

৬৩ - বাহরে শরীয়ত, শামী, আলমগীরী, আহ্কামে কুরবানি।


কুরবানির পশু এবং পশুর বয়স:


কুরবানির পশুর বয়স এমন হতে হবে যে-


* উট: পাঁচ বছর।


* গরু বা গরু জাতীয় পশু: দুই বছর।


* ছাগল বা এ জাতীয় পশু: এক বছর।


এর থেকে যদি কম বয়স্ক হয়, তাহলে কুরবানি জায়িয হবে না, বেশি হলে জায়িয বরং উত্তম। তবে যদি দুম্বা অথবা ভেড়ার ছয় মাসের বাচ্চা দূর থেকে দেখতে এক বছরের বাচ্চার মতো মনে হয়, তবে তা দ্বারাও কুরবানি জায়িয। ৬৪

৬৪ - বাহারে শরীয়ত, ১৫তম খন্ড, দুররে মুখতার।


যে সকল পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়িয:


কুরবানির পশু তিন প্রকার:


উট,


গরু ও


ছাগল।


আর এগুলোর যত প্রজাতি রয়েছে সবগুলোও এ তিন প্রকারের মধ্যে শামিল। নর হউক বা মাদি কিংবা খাসি বা গাইরে খাসি সবগুলোর হুকুম একই। অর্থাৎ সবগুলোর দ্বারাই কুরবানি শুদ্ধ হবে। মহিষ- এটি গরুর মধ্যে শামিল, এর দ্বারাও কুরবানি হবে। আর ভেড়া ও দুম্বা- এ দুটিও ছাগলের মধ্যে শামিল, এগুলো দ্বারাও কুরবানি হবে। ৬৫

৬৫ - বাহারে শরীয়ত, আলমগীরী।



যে সকল পশু দ্বারা কুরবানি করা উত্তম:


ছাগলের দাম ও গোশত যদি গরুর এক-সপ্তমাংশ (সাত ভাগের এক ভাগ)’র সমান হয়, তাহলে ছাগল কুরবানি করা উত্তম। আর যদি গরুর এক-সপ্তমাংশের মধ্যে ছাগল থেকে বেশি গোশত হয়, তাহলে গরু দ্বারা কুরবানি করাই উত্তম। অর্থাৎ যখন গরুর এক-সপ্তমাংশ ও ছাগল উভয়টির মূল্য সমান হয় এবং পরিমাণও এক হয়, তাহলে যেটার গোশত ভাল বা সুস্বাদু তা দ্বারা কুরবানি করা উত্তম। আর যদি গোশতের পরিমাণের মধ্যে কমবেশি হয়, তাহলে যেটাতে গোশত বেশি হবে তা দ্বারা কুরবানি করাই উত্তম।


মেষ থেকে ভেড়া উত্তম।


দুম্বি থেকে দুম্বা উত্তম, যদি উভয়টির মূল্য সমান হয় এবং উভয়টির মধ্যে গোশতও সমান হয়।


ছাগল থেকে ছাগী উত্তম। কিন্তু খাসী ছাগল ও ছাগী উভয়টি থেকে উত্তম।


উট থেকে উটনি উত্তম, যদি উভয়টির মূল্য এবং গোশত সমান হয়। ৬৬

৬৬ - বাহারে শরীয়ত, ১৫তম খন্ড, দুররে মুখতার, শামী।


খাসি কুরবানি করার বিধান:


খাসির পরিচয়:


খাসির আরবি প্রতিশব্দ হিসেবে আরবিতে সাধারণত তিনটি শব্দ অধিক ব্যবহার হয়। তা হলো: خَصِي (খাসিয়্যুন), مَوْجُوءُ (মাওজূউন) ও مَجْبُوْب (মাজবূবুন)।


খাসির পরিচয় প্রদানে সদরুশ শরিয়াহ্ আল্লামা মুফতি আমজাদ আলী আ‘যমী রেজভী হানাফী (رحمة الله) বলেন:


خصی یعنی جس کے خصیے نکال لیے گئے ہیں


-“খাসি, অর্থাৎ যার অন্ডকোষ বের করে ফেলা হয়েছে।”৬৭

৬৭ - বাহারে শরীয়ত, ১৫ তম খন্ড, ৬৮৯ পৃষ্ঠা।


ইমামে আহলে সুন্নাত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত, আ‘লা হযরত শাহ্ ইমাম আহমাদ রেযা খান ফাযিলে বেরেলভি (رحمة الله) বলেন:


اَلْمَجْبُوبُ الْعَاجِزُ عَنِ الْجِمَاعِ


-“মাজবুব হল যৌন সঙ্গম থেকে অক্ষম। আর যে প্রাণী যৌন সঙ্গম থেকে অক্ষম তাকেই ‘খাসি’ বলা হয়।” ৬৮

৬৮ - ফাতাওয়ায়ে রেজভীয়া, খন্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৪৬৮।


হানাফি মাযহাবের বিখ্যাত ইমাম, যুগের ইমাম আবু হানিফা, আল্লামা শায়খ যাইনুদ্দিন ইবনু নুজাইম (رحمة الله) বলেন:


اَلْمَوْجُوْءُ الْمُخْصِيُ مِنَ الْوَجْئِ وَهُوَ اَنْ يَّضْرِبَ عُرُوقَ الْخِصِيَةِ بِشَيْءٍ


-“মাওজূউন হলো খাসি। অর্থাৎ কোন যন্ত্রের দ্বারা অন্ডকোষের রগসমূহ থেতলে দেয়া হয়েছে এমন প্রাণী।”৬৯

৬৯ - আল-বাহরুর রায়িক, খন্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ১৭৬।


অতএব, ‘আরবে পাঠাকেই খাসি বলা হয়’ বলার কোন অবকাশ নাই। ইলমে দ্বীন ও কিতাবের সাথে যাদের সামান্যতমও সম্পর্ক রয়েছে তাদের নিকট এ উক্তিটি- ‘আরবে পাঠাকেই খাসি বলা হয়’- নিতান্তই হাস্যকর ও মূর্খতা বৈ-কি?


হানাফি মাযহাবের সকল উলামায়ে কিরাম আইম্মায়ে ইযাম এ বিষয়ে একমত যে, খাসি কুরবানি করা জায়িয, সুন্নাতে রাসুল এবং উত্তম।


 খাসি কুরবানি করার দলিল:


* হযরত জাবির (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন:


عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ ذَبَحَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- يَوْمَ الذَّبْحِ كَبْشَيْنِ أَقْرَنَيْنِ أَمْلَحَيْنِ مُوجَأَيْنِ


-“নবী করিম (ﷺ) ঈদের দিন চিত্রা রঙ্গের শিং বিশিষ্ট দু’টি খাসি ছাগল (মেষ) কুরবানি করেছেন।” ৭০

৭০ - আবু দাউদ: ২৭৯৭;  মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা: ২২৮।


* হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে,


عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه و سلم كَانَ إِذَا أَرَادَ أَنْ يُّضَحِّيَ اِشْتَرَى كَبْشَيْنِ عَظِيْمَيْنِ أَقْرَنَيْنِ أَمْلَحَيْنِ مَوْجُوْءَيْنِ فَذَبَحَ أَحَدَهُمَا عَنْ أُمَّتِهِ لِمَنْ شَهِدَ لِلَّهِ بِالتَّوْحِيدِ وَشَهِدَ لَهُ بِالْبَلَاغِ وَذَبَحَ الْآخَرَ عَن مُحَمَّدٍ وَعَنْ آلِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ 


-“রাসুলুল্লাহ (ﷺ) যখন কুরবানির ইচ্ছা করতেন তখন দু’টি মোটাতাজা, গোশতওয়ালা, শিং বিশিষ্ট, চিত্রা রঙ্গের খাসিকৃত দুম্বা (মেষ) ক্রয় করতেন। অতঃপর এর একটি আপন উম্মতের যারা আল্লাহ্’র তাওহিদের স্বাক্ষী দেয় এবং তার নবুওয়্যাতের প্রচারের স্বাক্ষী দেয়, তাঁদের পক্ষ থেকে এবং অপরটি মুহাম্মদ (ﷺ) ও তাঁর পরিবার বর্গের পক্ষ থেকে কুরবানি করতেন।” ৭১

৭১ - ইবনু মাজাহ: ৩১২২; আল-মুসতাদরাক লিল-হাকীম: ৭৫৪৭; আস-সুনানুল কুবরা লিল-বায়হাক্বী: ১৮৮২৬।


* আল্লামা শায়খ যাইনুদ্দিন ইবনু নুজাইম (رحمة الله) বলেন: 


وَالْخَصِيُّ وَعَنْ اَبِي حَنِيفَةَ رَحِمَهُ اللَّهُ تَعَالَي هُوَ اَوْلَي لِاَنَّ لَحْمَهُ اَطْيَبُ وَقَدْ صَحَّ اَنَّهُ عليه الصلاة والسلام ضَحَّي بِكَبْشَيْنِ اَمْلَحَيْنِ مَوْجُوئَيْنِ


-“হযরত ইমাম আ‘যম আবু হানিফা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, ‘খাসি কুরবানি করা উত্তম। কেননা নিশ্চয় খাসির গোশত অধিক সুস্বাদু।’ আর তিনি সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, নিশ্চয় রাসুল পাক (ﷺ) চিত্রা রঙ্গের দু’টি খাসি কুরবানি করেছেন।” ৭২

৭২ - আল-রাহরুর রাইক, খন্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ১৭৬।


* ১২শত শতাব্দীর মুজাদ্দিদ মুহিউদ্দিন আওরঙ্গজেব বাদশাহ আলমগীর প্রায় সাতশ’ ফক্বিহ ও মুজতাহিদ দ্বারা ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী সংকলন করিয়েছেন। সে ফাতাওয়ার কিতাবে এসেছে-


وَالْخَصِيُّ اَفْضَلُ مِنَ الْفَحَلِ لِاَنَّهُ اَطْيَبُ لَحْمًا كَذَا فِي الْمُحِيْطِ


-“পাঠা থেকে খাসি কুরবানি করা উত্তম। কেননা খাসির গোশত অধিক সুস্বাদু।” ৭৩

৭৩ - ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খন্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ২৯৯।


* বিখ্যাত ‘হিদায়া’ নামক কিতাবে রয়েছে-


وَالْخَصِيُّ لِاَنَّ لَحْمَهَا اَطْيَبُ وَقَدْ صَحَّ اَنَّ النَّبِيَّ صلي الله عليه وسلم ضَحَّي بِكَبْشَيْنِ اَمْلَحَيْنِ مَوْجُوْئَيْنِ


-“খাসিী দ্বারা কুরবানি জায়িয। কেননা খাসির গোশত অধিক উত্তম। সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসুল পাক (ﷺ) সাদা-কালো মিশ্রিত রঙ্গের দু’টি খাসি কুরবানি করেছেন।” ৭৪

৭৪ - হিদায়া, খন্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪৪৮।


* চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, ইমামে আহলে সুন্নাত, আ‘লা হযরত শাহ্ ইমাম আহমাদ রেযা খান ফাযিলে বেরেলভি (رحمة الله) বলেন:


خصی قربانی افضل ہے اور اس میں ثواب زیادہ ہے۔


-“খাসি কুরবানি উত্তম এবং এতে অধিক ছাওয়াব রয়েছে।” ৭৫

৭৫ - ফাতাওয়ায়ে রেজভীয়া, খন্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৪৪২।


* সদরুশ শরিয়ত খলিফায়ে আ‘লা হযরত আল্লামা মুফতি আমজাদ আলী আ‘যমী রেজভী হানাফী বলেন:


بکری بکرے سے افضل ہے مگر خصی بکرا بکری سے افضل ہے۔


-“ছাগল থেকে ছাগী উত্তম। কিন্তু খাসি কুরবানি করা ছাগ ও ছাগী উভয়টি থেকে উত্তম।” ৭৬

৭৬ - বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ১৫, পৃষ্ঠা: ৬৮৯।


অতএব, উপর্যুক্ত এ সরিহ-স্পষ্ট ও অকাট্য দলিলাদির বিপরীতে কিছু ব্যাখ্যামূলক কথা বা সনদহীন বর্ণনার দ্বারা খাসি কুরবানি করা হারাম প্রমাণ করতে আদাজল খেয়ে নামাটাই হলো মূর্খতা ও কিতাবের সাথে সম্পর্কহীনতার পরিচায়ক।


পশুর যে সকল ত্রুটিতে এর দ্বারা কুরবানি করা জায়িয নয়


অন্ধ হলে।


কানা বা এক চক্ষু বিশিষ্ট হলে অর্থাৎ যার কানা হওয়া স্পষ্ট।


তিন ভাগের একভাগ হতে বেশি দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে গেলে।


বেশি ক্ষীণ হলে। অর্থাৎ এমন কম জোর হওয়া যে, এর  হাড়ের মাঝে মগজ না থাকা।


এমন লেংড়া হওয়া, যাতে কুরবানির স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে না পারে।


অসুস্থ হওয়া, যা প্রকাশ্য হয়।


কান বা লেজ এর এক তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশি যদি কাটা হলে।


জন্ম হতেই কান না থাকলে।


এক কান থাকলে।


দাঁত না থাকলে।


স্তন কাটা বা শুকনা হলে।


নাক কাটা হলে।


ঔষধের মাধ্যমে স্তন শুকিয়ে গেলে।


হিজরা পশু যেগুলোর মাঝে নর ও মাদী দুটোই আলামত রয়েছে।


ঐ পশু যা শুধু নাপাকি, ময়লা-আবর্জনা ভক্ষন করে।


এক পা কেটে নেওয়া হলে।


পশু এমন পাগল হলে, যা ঘাস পানি মাঠে চড়ে না খেতে পারে।


শিং যদি গোড়া থেকে উঠে যায়, তবে এধরনের পশুদ্বারা কুরবানি জায়িয হবে না।



পশুতে যে সকল ত্রুটি থাকলেও এর দ্বারা কুরবানি করা জায়িয


চক্ষু টেরা হলে।


দৃষ্টি শক্তি তিন ভাগের এক ভাগ অথবা এর চেয়ে কম নষ্ট হলে।


যার মধ্যে সামান্য পাগলামি রয়েছে অর্থাৎ পশুটি পাগল হলেও মাঠে চড়ে ঘাস খেতে পারে।


যে পশুর খুজলি রয়েছে, তবে মোটা তাজা।


লেজ অথবা কান এক-তৃতীয়াংশ অথবা এর থেকে কম কাটা থাকলে বা কান ছোট হলে।


পশুটি খাসি করা হলে; বরং এর দ্বারা কুরবানি করা উত্তম।


ভেড়া অথবা দুম্বার পশম কাটা থাকলে।


শরীরে দাগ থাকলে।


যে পশুর দুধ বের হয় না।


গাভী বা উটনীর শুধু একটি মাত্র ওলান যদি ঔষধের মাধ্যমে শুকিয়ে যায়।


যে ল্যাংড়া পশু চলার সময় ল্যাংড়া পায়ের সাহায্য নিয়ে থাকে।


যে পশুর শিং গোড়া থেকে ভাঙ্গে নি, তবে এ ধরনের পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়িয।


কুরবানির পশুতে অংশীদারিত্ব


একটি পশুতে কতজন শরিক কুরবানি দিতে পারবে?

ছোট পশু তথা ছাগল বা এ জাতীয় পশুর ক্ষেত্রে একটি পশু একজনের পক্ষ থেকেই দিতে হবে।


আর উট ও গরু এবং গরু জাতীয় পশুর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত শরিক হতে পারবে। ইমাম মুসলিম তাঁর ‘আস-সহিহ’ গ্রন্থে, ইমাম তিরমিযি তাঁর আল-জামি‘ গ্রন্থের ‘কুরবানি’ অধ্যায়ের ‘باب ما جاء في الإشتراك في الأضحية (কুরবানিতে অংশীদার)’ নামক পরিচ্ছেদে এবং আরো অনেক ইমাম তাঁদের স্ব-স্ব গ্রন্থে হযরত জাবির (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন:


حَدَّثَنَا قتيبة حَدَّثَنَا مالك بن أنس عَنْ أَبِى الزُّبَيْرِ الْمَكِّىِّ عَنْ جَابِرِ قَالَ نَحَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- بِالْحُدَيْبِيَةِ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ


-“তিনি বলেন, আমরা হুদায়বিয়াতে রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর সাথে উট সাত জনের পক্ষ থেকে এবং গরু-ও সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানি করেছি।” ৭৭

৭৭ - মুসলিম, হাদিস নং- ৩২৪৬; তিরমিযী, হাদিস নং- ১৫০২;

     আবু দাউদ, হাদিস নং- ২৮১১; ইবনু মাজাহ, হাদিস নং- ৩১৩২।


হাদিসটি বর্ণনা করে ইমাম তিরমিযি বলেন:


قَالَ اَبُو عِيْسَى هَذَا حَدِيْثٌ حَسَنٌ صَحِيْحٌ وَالْعَمَلُ عَلَى هَذَا عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَغَيْرِهِمْ وَهُوَ قَوْلُ سُفْيَانَ الثَّوْرِي وَابْنِ الْمُبَارَكِ وَالشَّافِعِيِّ وَاَحْمَدَ وَإِسْحٰقَ


-“এ হাদিসটি ‘হাসান-সহিহ’। এর উপরই হুযুর পাকের সাহাবায়ে কিরাম ও অন্যান্যদের আমল ছিল। এবং এটাই ইমাম সুফয়ান ছাওরি, আব্দুল্লাহ্ ইবনু মুবারক, ইমাম শাফেয়ি, ইমাম আহমদ ও ইমাম ইসহাক-এর অভিমত।”


অনুরূপ হযরত ইবনু আব্বাস, ইবনু উমর, ইবনু মাস‘উদসহ অনেক প্রখ্যাত সাহাবি থেকে মারফূ‘ ও সহিহ সনদে উট ও গরুতে সাত ভাগে কুরবানি করার কথা বর্ণিত হয়েছে। অনেকে এ হাদিসগুলো রাসুল পাকের সফরকালীন সময়ের আমল বলে মুক্বিম অবস্থায় সাতভাগে কুরবানি করা যাবে না মর্মে ফিতনা ছড়ায়। এটা তাদের অজ্ঞতা ও গোড়ামীর পরিচায়ক। কেননা হাদিসসমূহে মুসাফির বা মুক্বিম হওয়ার বিষটি নির্দিষ্ট করা হয় নি। তদুপরি ইমাম আবু দাউদ তাঁর আস-সুনান কিতাবে ‘গরু ও উট কতজনের পক্ষ থেকে কুরবানি করা যাবে’ (باب فِى الْبَقَرِ وَالْجَزُورِ عَنْ كَمْ تُجْزِئُ) নামক অধ্যায়ে সাতভাগে কুরবানির পক্ষের হাদিস এনেছেন। আবার আলাদা করে ‘মুসাফিরের কুরবানি’ (باب فِى الْمُسَافِرِ يُضَحِّى) নামক পরিচ্ছেদ-ও ক্বায়েম করেছেন। অথচ সেখানে সাতভাগের হাদিসটি আনেন নি। যাতে প্রমাণিত হয় যে, মুহাদ্দিসগণ সাতভাগের বিষয়টি সফরের সাথে নির্দিষ্ট করেন নি। আবার হুযুর পাকের ‘ক্বওলি’ হাদিস দ্বারাও সাতভাগে কুরবানির কথা প্রমাণিত রয়েছে। যাতে তিনি মুসাফির বা মুক্বিম হওয়ার প্রতি নির্দিষ্ট করেন নি। যেমন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ থেকে বর্ণিত-


عَنْ عَبْدِ اللَّهِ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ الْبَقَرَةُ عَنِ سَبْعَةٍ وَالْجَزُوْرَ عَنْ سَبْعَةٍ فِي الْأَضَاحِي


-“নবী পাক (ﷺ) ইরশাদ করেন: কুরবানিতে গরু সাত জনের পক্ষ থেকে এবং উট-ও সাত জনের পক্ষ থেকে।”৭৮

৭৮ - আল-মু‘জামুল কাবীর লিত-তাবারানী, হাদিস নং- ১০০৪৬।


আবার উট ‘দশজনের পক্ষ থেকে’ বলেও একটি হাদিস পাওয়া যায়। এখানে ‘দশজনের পক্ষ থেকে’ কথাটি ‘শায’, যা অনেক রিওয়ায়াতে বর্ণিত সহিহ সনদের ‘সাতজনের পক্ষ থেকে’ কথাটির বিপরীত। কাজেই তা গ্রহণযোগ্য নয়। চূড়ান্ত ফাতাওয়া হলো- ‘গরু, মহিষ ও উট সর্বোচ্চ সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানি করা যাবে।’


শরিকে কুরবানির ক্ষেত্রে কতিপয় জ্ঞাতব্য:


গরু এবং উটের মধ্যে সাত ব্যক্তি শরিক হতে পারবে, কিন্তু অংশীদারদের মধ্যে যদি কারো সাত ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম হয়, তবে কারো কুরবানি হবে না। তবে হ্যাঁ, সাতের এক অংশের চেয়ে বেশি হলে সমস্যা নেই। যেমন, গরু অথবা উটে ছয় বা পাঁচ জনের পক্ষ হতে কুরবানি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সকলের অংশ সমান হওয়া আবশ্যক নয়। তবে তা আবশ্যক যে, কারো অংশ যেন সাতের এক অংশের কম না হয়।


গরু বা উটের শরিকদারদের মধ্যে যদি কোন একজনও কাফির বা বেদ্বিন অথবা বদ-মাযহাবি কিংবা তাদের মধ্যে কারো উদ্দেশ্য যদি শুধু এমন হয় যে, গোশত খাবে তবে কারো কুরবানি হবে না।


কুরবানির সকল অংশীদারদের নিয়্যত আল্লাহর নৈকট্য অর্জন হতে হবে। অর্থাৎ কারো উদ্দেশ্য যেন গোশত নেয়া না হয়। কিন্তু এটা আবশ্যক নয় যে, ঐ নিয়্যত এক রকমের হবে। যেমন, কুরবানির সাথে আকিকারও অংশীদার হতে পারবে। কেননা আকিকা’র নিয়্যতও নৈকট্য অর্জন করা।


অংশীদারদের সাথে কুরবানি হলে আবশ্যক যে, গোশত ওজন করে বন্টন করা, অনুমানের ভিত্তিতে বণ্টন করা নয়। কেননা হতে পারে কারো বেশি হয়ে যাবে আবার কারো কম হবে; এটা নাজায়িয। কেউ যদি মনে করে, কম হোক বা বেশি হোক একে অন্যকে মাফ করে দিবে; এরূপ শুদ্ধ নয়। তবে সকল অংশীদার যদি একজনকে মালিক বানিয়ে দেয় যে, যাকে চায় সে গোশত দিবে, যাকে চায় না দিবে এবং তার না দেয়ার জন্য কোন অংশীদার অসন্তুষ্ট হবে না; তবে এক্ষেত্রে তা জায়িয হবে এবং তখন ওজন করাও আবশ্যক নয়। ৭৯

৭৯ - ওয়াকারুল ফাতাওয়া, চতুর্থ খন্ড।


কুরবানির অন্যান্য মাসআলাসমূহ


দরীদ্র থাকাকালীন কুরবানি করার পর ধনী হলে:


কোন ব্যক্তি দরিদ্র ছিল আর এমতাবস্থায় কুরবানি করে ফেলেছে, কুরবানি করার পর কুরবানির সময় বাকি থাকতে সে ধনী হয়ে গেল, তবে তার জন্য আবার কুরবানি করতে হবে। কেননা প্রথমে যা করেছে তা ওয়াজিব ছিল না। ৮০

৮০ - ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী।


কুরবানির পরিবর্তে সদকা করলে:


কুরবানির সময় কুরবানি করাই আবশ্যক, অন্য কোন বিষয় এর স্থলাভিষিক্ত হবে না। যেমন, কুরবানি করার পরিবর্তে কোন বকরি বা এর মূল্য সদকা দেওয়া যথেষ্ট নয়। কুরবানির মধ্যে অন্যকে স্থলাভিষিক্ত করা যায়। অর্থাৎ নিজে কুরবানি করা জরুরি নয়, অন্য কাউকে অনুমতি দিলে সে যদি আপনার পক্ষ থেকে করে দেয়, তবে কুরবানি হয়ে যাবে। ৮১

৮১ - বাহারে শরিয়ত।


নির্ধারিত সময়ে কুরবানি করতে না পারলে:


আইয়ামুন নাহর তথা কুরবানির দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে এবং যার উপর কুরবানি ওয়াজিব ছিল সে কুরবানি করে নাই, তখন কুরবানি বাদ হয়ে গেছে, এখন করলে হবে না। তবে কুরবানির পশু কিনে থাকলে তা সদকা করে দিবে, অথবা না কিনলে এর সমপরিমাণ মূল্য সদকা করে দিবে।


কুরবানির দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে এবং কুরবানিও করে নাই, আবার পশু অথবা এর মূল্যও সদকা করে নাই, এ অবস্থায় দ্বিতীয় কুরবানির ঈদ চলে এসেছে, এখন সে ব্যক্তি পূর্বোক্ত বছরের কুরবানি কাযা করলে হবে না। বরং এখনো ঐ হুকুমই যে, পশু অথবা এর মূল্য সদকা করবে।৮২

৮২ - ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী।


যে পশু কুরবানি ওয়াজিব ছিল, কুরবানির সময় কুরবানি না করে কুরবানির দিন অতিবাহিত হওয়ার পর এটাকে বেঁচে দিল, তবে এর মূল্যটা সদকা করা ওয়াজিব। ৮৩

৮৩ - ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী।


কুরবানি করার সময় পশুতে ত্রুটি সৃষ্টি হলে:


কুরবানি করার সময় পশুর লাফ-ঝাঁপ দেয়ার কারণে কিংবা অন্য যে কারনেই পশুতে ত্রুটি সৃষ্টি হয়ে থাকলে, এতে কুরবানি হয়ে যাবে। ৮৪

৮৪ - ফাতওয়ায়ে শামী।


পশু কেনার পর মারা গেলে বা হারিয়ে গেলে:


কুরবানির পশু কেনার পর মারা গেছে, তখন ধনী ব্যক্তির উপর আবশ্যক যে অন্য আরেকটি পশু কুরবানি করবে। আর দরিদ্র ব্যক্তির উপর তা ওয়াজিব নয়। ৮৫

৮৫ - ফাতওয়ায়ে শামী।


যদি কুরবানির পশু হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায় এবং এর স্থানে অন্য পশু ক্রয় করে ফেলেছে, এমতাবস্থায় হারিয়ে যাওয়া বা চুরি হওয়া পশুটি আবার ফিরে পেয়েছে, তখন ধনী ব্যক্তির এখতিয়ার রয়েছে যে দুটোর মধ্যে যে কোন একটি কুরবানি করবে। আর দরিদ্র ব্যক্তি দুটোই কুরবানি করতে হবে। তবে ধনী ব্যক্তি যদি দ্বিতীয় পশুটিকে কুরবানি করে এবং এর মূল্য প্রথমটি হতে কম হয়, তবে যে মূল্যটা প্রথমটি হতে কম হয়েছে তা সদকা করে দিতে হবে। কিন্তু প্রথমটিও কুরবানি করে দিলে আর সদকা ওয়াজিব থাকবে না। ৮৬

৮৬ - ফাতওয়ায়ে শামী।


পশুর পেটে বাচ্চা পাওয়া গেলে:


কুরবানি করা হয়েছে এবং কুরবানিকৃত পশুটির পেটে জীবিত বাচ্চা পাওয়া গেছে, তখন বাচ্চাটি সদকা করে দিবে অথবা এটাকে জবাই করে দিবে। আর যদি বাচ্চাটি মৃত পাওয়া যায়, তবে এটা ফেলে দিবে। কেননা তা মৃত; কুরবানি হয়ে যাবে। ৮৭

৮৭ - বাহারে শরিয়ত।


পশু কেনার পর শরিকদারের মৃত্যু হলে:


কয়েকজন অংশীদার মিলে কুরবানির জন্য একটি গরু ক্রয় করল, অতঃপর এদের মধ্যে একজন শরিকদারের মৃত্যু হয়ে গেল, তখন মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ যদি অন্যান্য অংশীদারদেরকে বলে দেয় যে, তোমরা তা নিজেদের পক্ষ হতে এবং তার (মৃত্য ব্যক্তির) পক্ষ হতে কুরবানি করে দাও এবং তারা করেও দিল তবে তা জায়িয হবে। আর যদি ওয়ারিশদের বিনা অনুমতিতে কুরবানি করে দেয়, তবে কারো কুরবানি হবে না। ৮৮

৮৮ - হিদায়া।


মান্নতের কুরবানির বিধান:


কুরবানি যদি মান্নতের হয়, তবে এর গোশত নিজেও খেতে পারবে না এবং কোন ধনী ব্যক্তিদেরকেও খাওয়াতে পারবে না। বরং তা সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। যদিও মান্নতকারী দরিদ্র হয়, তথাপিও নিজে খেতে পারবে না।৮৯

৮৯ - বাহারে শরিয়ত।


মালিকে নিসাব বা যার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব, সে যদি কুরবানি করার জন্য মান্নত করে, তবে তার উপর দু’টো কুরবানি করা ওয়াজিব। একটি মান্নতের জন্য, অন্যটি তার উপর যা ওয়াজিব ছিল এজন্য। যতটি মান্নত করা হয়, ততটি কুরবানি করা ওয়াজিব। ৯০

৯০ - ফাতওয়ায়ে শামী।


কুরবানির জন্য ওসিয়তের বিধান:


মৃত ব্যক্তির পক্ষ হতে কুরবানি করলে এর গোশত নিজেও খেতে পারবে এবং অন্যদেরকেও খাওয়াতে পারবে। তবে যদি মৃত ব্যক্তি ওসিয়ত করে থাকে যে, ‘আমার পক্ষ হতে কুরবানি করে দিও’, তখন কুরবানিদাতা গোশত খাবে না। বরং সম্পূর্ণ গোশত সদকা করে দিবে। ৯১

৯১ - ফাতওয়ায়ে শামী।


কুরবানি করার পদ্ধতি


রাসুল পাক (ﷺ) কুরবানি কীভাবে করেছেন এ ব্যাপারে আম্মাজান আয়েশা ছিদ্দিকা (رضي الله عنه) বলেন: “নবীজি আমাকে বললেন, ‘হে আয়েশা! ছুরি দাও।’ এরপর বললেন, ‘এটা পাথরে ঘষে ধারালো করো।’ আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, আমি তাই করলাম। তিনি ছুরি নিলেন, দুম্বাকে ধরে কাৎ করে শোয়ান এবং জবাই করার সময় বললেন:


بِسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ‏


-‘বিসমিল্লাহ; হে আল্লাহ! আপনি এ কুরবানি মুহাম্মাদ (ﷺ), মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পরিবার ও তাঁর উম্মতের পক্ষ হতে কবুল করুন।’ অতঃপর তিনি দুম্বাটি কুরবানি করলেন।”৯২

৯২ - আবু দাউদ,আস-সুনান, হাদিস নং- ২৭৯২।


আবু দাউদের বর্ণনায় এসেছে:


عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ ضَحَّى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ ذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ وَسَمَّى وَكَبَّرَ وَوَضَعَ رِجْلَهُ عَلَى صِفَاحِهِمَا


-“হযরত আনাস ইবনু মালিক (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) দুই শিংযুক্ত ধূসর রঙের দু’টি মেষ কুরবানি করেছেন। তিনি এ দু’টিকে বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বলে নিজ হাতে জবাই করেছেন- এর পাঁজরে নিজের পা রেখে চেপে ধরে।” ৯৩

৯৩ - আবু দাউদ, আস-সুনান, হাদিস নং- ১৪৯৪।


কুরবানি বা জবাই করার নিয়ম হলো-


কুরবানি করার পূর্বে পশুকে ঘাস-পানি দিবে, যেন ক্ষুদার্ত ও পিপাসার্ত অবস্থায় জবাই করা না হয়।


একটি পশুর সামনে অন্যটি জবাই করবে না।


প্রথমে ছুরি দাড়ালো করে নিতে হবে।


অতঃপর পশুটিকে বাম পাশে কেবলামুখী করে শুইয়ে দিবে এবং নিজের ডান পা পশুটির গলার উপর রেখে তারাতারি জবাই করে দিবে। 


জবাই করার প্রথমে এ দু‘য়া পড়ে নিবে:


إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمٰوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيْفًا وَّمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ إنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ


উচ্চারণ: ইন্-নী ওয়াজ্জাহতু ওযাজহিয়া লিল্লাযী ফাতারাস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ্বা হানীফাও ওয়ামা আনা- মিনাল্ মুশরিকীন। ইন্না ছলা-তী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়া-ইয়া ওয়া মামা-তী লিল্লা-হি রাব্বিল ‘আ-লামীন। লা-শারীকা লাহূ ওয়া বিযা-লিকা উমিরতু ওয়া আনা- মিনাল্ মুসলিমীন।


কুরবানি নিজের পক্ষ হতে হলে জবাই করার পর নিম্নোক্ত এ দু‘আটি পড়বে:


اَللّٰهُمَّ تَقَبَّلْ مِنِّيْ كَمَا تَقَبَّلْتَ مِنْ خَلِيْلِكَ اِبْرَاهِيْمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ وَحَبِيْبِكَ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ صَلَّي اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা তাক্বাব্বাল্ মিন্নী কামা- তাক্বাব্বালতা মিন খালীলিকা ইবরা-হীমা ‘আলাইহিস্ সালাম, ওয়া হাবীবিকা সায়্যিদিনা- মুহাম্মাদিন ছল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম।


আর যদি অন্যদের পক্ষ হতে জবাই করা হয় তবে مِنِّيْ (মিন্নী)-এর স্থলে - مِنْ (মিন্) বলে তাদের নাম বলবে।


যতক্ষণ পর্যন্ত পশুটি নিরব ও ঠান্ডা না হয়ে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত হাত-পা কাটবে না, চামড়া আলাদা করবে না।


জবাই সম্পর্কিত কিছু জরুরি মাসআলা


নিজের কুরবানির পশু নিজ হাতে জবাই করাই উত্তম। অন্যের দ্বারা জবাই করালেও জায়িয হবে, তবে জবাই করার স্থানে উপস্থিত থাকা উত্তম। ৯৪

৯৪ - ফাতওয়ায়ে শামী।


জবাই করার সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলতে ভুলে গেলে, পরে পড়ে নিবে।


জবাইকারী ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়ানো সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। বিনা-প্রয়োজনে ছেড়ে দেওয়া মাকরূহ।


প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষ, বালিগ-নাবালিগ, সুস্থ-পাগল, পবিত্র বা অপবিত্র সকলের জন্যই জবাই করা জায়িয। তবে শর্ত হলো, জবাই করার শরয়ি পদ্ধতি জানতে হবে এবং জবাই করার সময় বিসমিল্লাহ পড়তে হবে। ৯৫

৯৫ - মালাবুদ্দামিনহু।


শরয়ি নিয়ম অনুযায়ী জন্তু জবাই করার সময় চারটি রগ কাটতে হয়। শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং এর দুই পাশে দু’টি রক্তের মোটা রগসহ কমপক্ষে তিনটি কাটা গেলে খাওয়া হালাল হবে। অথবা উল্লেখিত চার রগের বেশির ভাগ কাটা গেলে জন্তু খাওয়া হালাল হবে, অন্যথায় হারাম হবে। ৯৬

৯৬ - ফাতওয়ায়ে শামী।


জবাই করার সময় সম্পূর্ণ গলা কেটে ফেলা মাকরূহ। ৯৭

৯৭ - ফাতহুল কাদির।


কুরবানির জন্তু মেশিন দ্বারা জবাই করা জায়িয। কিন্তু শর্ত হলো, সুইচ চালু করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে এবং উল্লেখিত রগসমূহ কাটতে হবে। 

জবাই করার সময় জন্তুর গলার উপর পা রাখা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

‘বিসমিল্লাহ’ পড়ার পর জন্তু পালিয়ে গেলে দ্বিতীয়বার জবাই করতে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া ওয়াজিব।


অমুসলিমের হাতে পশু জবাই করা হলে:


কুরবানির পশু মুসলমানদের দ্বারা জবাই করানো চাই। যদি কোন অগ্নি উপাসক, কাফির, মুশরিক, হিন্দু, বেদ্বিন, অথবা মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) দ্বারা কুরবানির পশুটি জবাই করা হয়, তবে কুরবানি হবে না এবং গোশত খাওয়াও হারাম হবে। ৯৮

৯৮ - বাহারে শরিয়ত।


দু’জনে মিলে জবাই করতে চাইলে:


অন্যকাউকে দিয়ে পশু জবাই করালো এবং নিজের হাতও ছুরির উপর রাখল, যেন দু’জন মিলেই জবাই করল। এঅবস্থায় দু’জনকেই ‘বিসমিল্লাহ’ বলা ওয়াজিব। একজনও যদি ইচ্ছা করে ছেড়ে দেয় এই ভেবে যে, দ্বিতীয় ব্যক্তি তো বলেই দিয়েছে, আমার বলার প্রয়োজন কী, তবে পশু হারাম হবে। ৯৯

৯৯ - আদ-দুররুল মুখতার।


কুরবানির গোশত এবং চামড়ার বিধান


উত্তম এই যে, গোশত তিন ভাগ করবে। একভাগ ফকির মিসকিনদের জন্য, একভাগ বন্ধু-আত্মীয়-নিকটজনদের জন্য এবং আরেক ভাগ নিজেদের জন্য।


গোশত, চামড়া ইত্যাদি কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়া যাবে না।


যদি মৃত ব্যক্তির পক্ষ হতে কুরবানি করা হয়, তবে এরও একই হুকুম। নিজে খাবে অন্যকেও দিবে। আর যদি মৃত ব্যক্তির ওসিয়ত থাকে যে, তার পক্ষ হতে যেন কুরবানি করে দেওয়া হয় তবে কুরবানিকারী গোশত খাবে না। বরং সম্পূর্ণ গোশত সদকা করে দিতে হবে।


কুরবানির চামড়া সদকাও করে দিতে পারবে, আবার নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। যেমন, নামাযি বানিয়ে নিজে ব্যবহার করা জায়িয, কিন্তু যদি তা বিক্রি করে দেওয়া হয়, এর মূল্য সদকা করে দিতে হবে।


দ্বিনি মাদরাসা এবং মসজিদেও তা দান করা জায়িয। তবে মসজিদের ইমামকে বেতন হিসেবে দেওয়া জায়িয না।


জবাই করার আগে কুরবানির পশুর পশম ও দুধ গ্রহণ করা মাকরূহ এবং পশু থেকে কোন উপকার হাসিল করাও মাকরূহ। যেমন, এর উপর সাওয়ার হওয়া বা বোঝা বহন করানো ইত্যাদি।


কুরবানির পশু থেকে যদি পশম কাটা হয়, তাও সদকা করে দিবে।


দ্বিনি মাদরাসার গরিব ছাত্রদেরকেই চামড়া সদকা করা উত্তম। কেননা এতে সদকার ছাওয়াবও হলো এবং দ্বিনের খিদমতও হলো, কিন্তু এর মধ্যে অত্যধিক সর্তক হওয়া প্রয়োজন যে, তা যেন সুন্নি-সহিহ মাদরাসা হয়। বেদ্বিন, বদ-মাযহাবকে কখনই দেয়া যাবে না। এগুলি ঈমানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এমন যেন না হয়ে যায় যে, তারা কুরবানির চামড়ার সাথে ঈমানও ছিনিয়ে নেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


কুরবানির গোশত কাফির, হিন্দু, মুরতাদ, বেদ্বিন বা এ জাতীয় কাউকে দেয়া যাবে না। ১০০

১০০ - বাহারে শরিয়ত।


হালাল পশুর অংঙ্গ-প্রতঙ্গের বিধান


 হালাল পশুর সব অংশই হালাল। তবে কিছু অংশ রয়েছে হারাম, অথবা নিষিদ্ধ, অথবা মাকরূহ্। এগুলো মোট ২২টি। তা হলো:


১. রগের রক্ত।


২. পিত্ত।


৩. মূত্রথলি।


৪. পুংলিঙ্গ।


৫. স্ত্রী লিঙ্গ।


৬. অন্ডকোষ।


৭. জোড়া, শরীরের গাঁট।


৮. হারাম মজ্জা।


৯. ঘাড়ের দো পাট্টা, যা কাধ পর্যন্ত টানা থাকে।


১০. কলিজার রক্ত।


১১. তিলির রক্ত।


১২. মাংসের রক্ত, যা জবাই করার পর গোশত থেকে বের হয়।


১৩. হৃদপিন্দের রক্ত।


১৪. পিত্ত অর্থাৎ ঐ হলদে পানি যা পিত্তের মধ্যে থাকে।


১৫. নাকের আর্দ্রতা (ভেড়া-ভেড়ীর মধ্যে অদিক হারে হয়ে থাকে) ।


১৬. পায়খানার রাস্তা।


১৭. পাকস্থলি বা ওজুরী।


১৮. নাড়িভূড়ি।


১৯. বীর্য।


২০. ঐ বীর্য, যা রক্ত হয়ে গেছে।


২১. ঐ বীর্য, যা মাংসের টুকরা হয়ে গেছে।


২২. ঐ বীর্য, যা পূর্ণ জানোয়ার হয়ে গেছে এবং মৃত অবস্থাই বের হয়েছে অথবা জবাই করা ছাড়া মারা গেছে।১০১

১০১ - ফাতাওয়ায়ে রেজভীয়া, খন্ড: ২০, পৃষ্ঠা: ২৪০-২৪১।


কলিজা, বকরির সিনা এবং সামনের দু’পা  হুযুর পাক (ﷺ)-এর খুবই পছন্দের ছিল।


আকিকার মাসাইল


আকিকা করা হানাফি মাযহাব মতে মুস্তাহাব। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সপ্তম দিনে তার নাম রাখবে এবং আকিকা করবে। এর দ্বারা শিশুর বিভিন্ন বালা-মুসিবত দূর হয়ে যায়। 


সপ্তম দিনের পূর্বে নাম রাখাও জায়িয। আকিকা সপ্তম দিনে না করতে পারলে পরে যখনই সামর্থ্য হয় করে নেয়া জায়িয।


কুরবানির পশুর জন্য যে শর্ত রয়েছে আকিকার জন্যও তাই প্রজোয্য। যে পশুর দ্বারা কুরবানি জায়িয নয়, সে পশু দ্বারা আকিকাও জায়িয নয়।


কুরবানির পশুর সাথে আকিকার অংশিদারও হতে পারবে।


আকিকার গোশত পিতা-মাতা সকলেই খেতে পারবে। এমনকি যার আকিকা হয় সে যদি খাওয়ার উপযুক্ততা রাখে, সে নিজেও খেতে পারবে।


আকিকার পশুর চামড়ার হুকুম কুরবানির পশুর চামড়ার হুকুমের মতই।


মৃত বাচ্চার আকিকা করা জরুরি নয়। এমনিভাবে জীবিত ভূমিষ্ট হওয়ার পর মারা গেলেও জরুরি নয়।


আকিকার নিয়ম হলো, ছেলে হলে দু’টি বকরি বা দু’টি ভেড়া এবং মেয়ে হলে একটি বকরি বা একটি ভেড়া জবাই করবে এবং শিশুর মাথা মুন্ডন করবে। আর চুলের সমপরিমাণ স্বর্ণ্য বা রৌপ্য দান করবে। আর গরু, উট বা এ জাতীয় পশু দিয়ে করলে ছেলে হলে দু’ভাগ এবং মেয়ে হলে একভাগ আকিকা করবে। অবশ্যই ছেলের জন্য একভাগ দিলেও আদায় হয়ে যাবে।


আকিকার জন্তু জবাই করার সময় নিম্নের দু‘আ পড়বে:


اَللّٰهُمَّ هٰذِهِ عَقِيْقَةُ اِبْنِ فُلَانٍ دَمُهَا بِدَمِهِ وَلَحْمُهَا بِلَحْمِهِ وَجِلْدُهَا بِجِلْدِهِ وَشَعْرُهَا بِشَعْرِهِ – اَللّٰهُمَّ اجْعَلْهَا فِدَاءً لِّاِبْنِيْ مِنَ النَّارِ


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা হা-যিহী ‘আক্বীক্বাতু ইবনি ফুলা-নিন্ দামুহা- বিদামিহী ওয়া লাহমুহা- বিলাহমিহী ওয়া জিলদুহা- বিজিলদিহী ওয়া শা‘রুহা- বিশা‘রিহী। আল্লা-হুম্মাজ‘আলহা- ফিদা----আল্ লিইবনী মিনান্না---র।


اِبْنِ فُلَانٍ (ইবনি ফুলা-নিন) এর স্থানে ছেলের নাম ও পিতার নাম বলবে অতঃপর নিম্নোক্ত দু‘আটি পড়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করবে। দু‘আটি হলো:


إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمٰوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيْفًا وَّمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ إنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ – اَللّٰهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ


উচ্চারণ: ইন্নী ওয়াজ্জাহতু ওযাজহিয়া লিল্লাযী ফাতারাস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ্বা হানীফাও ওয়ামা আনা- মিনাল্ মুশরিকীন। ইন্না ছলা-তী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়া-ইয়া ওয়া মামা-তী লিল্লা-হি রাব্বিল ‘আ-লামীন। লা-শারীকা লাহূ ওয়া বিযা-লিকা উমিরতু ওয়া আনা- মিনাল্ মুসলিমীন। আল্লা-হুম্মা মিনকা ওয়া লাক।


وَصَلَّي اللّٰهُ تَعَالٰي عَلٰي خَيْرِ خَلْقِهِ مُحَمَّدٍ وَّاٰلِهِ وَصَحْبِهِ اَجْمَعِيْنَ


بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ

















Top