❏ ফেরেশতা সৃষ্টি ও তাদের গুণাবলীর আলোচনা
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَٰنُ وَلَدًا ۗ سُبْحَانَهُ ۚ بَلْ عِبَادٌ مُكْرَمُونَ * لَا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُمْ بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ * يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَىٰ وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ * وَمَنْ يَقُلْ مِنْهُمْ إِنِّي إِلَٰهٌ مِنْ دُونِهِ فَذَٰلِكَ نَجْزِيهِ جَهَنَّمَ ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ)
[Surat Al-Anbiya' ২৬ - ২৯]
অর্থাৎ—তারা বলে, দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র, মহান! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তার আগে বাড়িয়ে কথা বলে না, তারা তো আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে।
তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। তারা সুপারিশ করে শুধু তাদের জন্য যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট এবং তারা তার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। তাদের মধ্যে যে বলবে, আমিই ইলাহ তিনি ব্যতীত; তাকে আমি প্রতিফল দেব জাহান্নাম; এভাবেই আমি জালিমদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি। (২১ঃ ২৬-২৯)
(تَكَادُ السَّمَاوَاتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْ فَوْقِهِنَّ ۚ وَالْمَلَائِكَةُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِمَنْ فِي الْأَرْضِ ۗ أَلَا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ)
[Surat Ash-Shura ৫]
অর্থাৎ আকাশমণ্ডলী উর্ধ্বদেশ থেকে ভেঙ্গে পড়বার উপক্রম হয় এবং ফেরেশতাগণ তাদের প্রতিপালকের সপ্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং পৃথিবীবাসীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে; জেনে রেখ, আল্লাহ, তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (৪২ঃ ৫)
(الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ * رَبَّنَا وَأَدْخِلْهُمْ جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدْتَهُمْ وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ ۚ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ) [Surat Ghafir ৭ – ৮]
অর্থাৎ যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চারদিক ঘিরে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সাথে এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী; অতএব, যারা তাওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বন করে তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কর।
হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তাদেরকে দাখিল কর স্থায়ী জান্নাতে, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদেরকে দিয়েছ এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরকেও। তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (৪০ঃ ৭-৮)
(فَإِنِ اسْتَكْبَرُوا فَالَّذِينَ عِنْدَ رَبِّكَ يُسَبِّحُونَ لَهُ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَهُمْ لَا يَسْأَمُونَ ۩)
[Surat Fussilat ৩৮]
অর্থাৎ তারা অহংকার করলেও যারা তোমার প্রতিপালকের সান্নিধ্যে তারা তো দিনে ও রাতে তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং তারা ক্লান্তি বোধ করে না। (৪১ঃ ৩৮)
وَمَنْ عِنْدَهُ لَا يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَلَا يَسْتَحْسِرُونَ * يُسَبِّحُونَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لَا يَفْتُرُونَ)
[Surat Al-Anbiya' ১৯ - ২০]
অর্থাৎ—তাঁর সান্নিধ্যে যারা আছে তারা অহংকারবশে তার ইবাদত করা থেকে বিমুখ হয় না এবং ক্লান্তি ও বোধ করে না। তারা দিবারাত্রি তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে; তারা শৈথিল্য করে না। (২১ঃ ১৯-২০)
(وَمَا مِنَّا إِلَّا لَهُ مَقَامٌ مَعْلُومٌ * وَإِنَّا لَنَحْنُ الصَّافُّونَ * وَإِنَّا لَنَحْنُ الْمُسَبِّحُونَ)
[Surat As-Saaffat ১৬৪ - ১৬৬]
অর্থাৎ—আমাদের প্রত্যেকের জন্যই নির্ধারিত স্থান আছে আমরা তো সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান এবং আমরা অবশ্যই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণাকারী। (৩৭ঃ ১৬৪-১৬৬)
وَمَا نَتَنَزَّلُ إِلَّا بِأَمْرِ رَبِّكَ ۖ لَهُ مَا بَيْنَ أَيْدِينَا وَمَا خَلْفَنَا وَمَا بَيْنَ ذَٰلِكَ ۚ وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا
অর্থাৎ আমরা আপনার প্রতিপালকের আদেশ ব্যতীত অবতরণ করি না। যা আমাদের সামনে ও পেছনে আছে এবং যা এ দু’-এর অন্তর্বর্তী তা তাঁরই এবং তোমার প্রতিপালক ভুলবার নন। (১৯ঃ ৬৪)
(وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ * كِرَامًا كَاتِبِينَ * يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ)
[Surat Al-Infitar ১০ - ১২]
অর্থাৎ—অবশ্যই আছে তোমাদের জন্য তত্ত্বাবধায়কগণ; সম্মানিত লিপিকারবৃন্দ; তারা জানে তোমরা যা কর। (৮২ঃ ১০-১২)
وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ
অর্থাৎ তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন। (৭৪ঃ ৩১)
وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِمْ مِنْ كُلِّ بَابٍ * سَلَامٌ عَلَيْكُمْ بِمَا صَبَرْتُمْ ۚ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ)
[Surat Ar-Ra'd ২৩ - ২৪]
অর্থাৎ ফেরেশতাগণ তাদের নিকট প্রবেশ করবে প্রতিটি দরজা দিয়ে এবং বলবে, তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ বলে তোমাদের প্রতি শান্তি; কতই না ভালো এ পরিণাম! (১৩ঃ ২৩-২৪)
الرَّحِيمِ الْحَمْدُ لِلَّهِ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ جَاعِلِ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا أُولِي أَجْنِحَةٍ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ ۚ يَزِيدُ فِي الْخَلْقِ مَا يَشَاءُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ)
[Surat Fatir ১]
অর্থাৎ প্রশংসা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই, যিনি বাণীবাহক করেন ফেরেশতাদেরকে যারা দু’-দু তিন-তিন অথবা চার-চার পক্ষ বিশিষ্ট। তিনি তার সৃষ্টি যা ইচ্ছা বৃদ্ধি করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান। (৩৫ঃ ১)
(وَيَوْمَ تَشَقَّقُ السَّمَاءُ بِالْغَمَامِ وَنُزِّلَ الْمَلَائِكَةُ تَنْزِيلًا * الْمُلْكُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ لِلرَّحْمَٰنِ ۚ وَكَانَ يَوْمًا عَلَى الْكَافِرِينَ عَسِيرًا)
[Surat Al-Furqan ২৫ - ২৬]
অর্থাৎ যেদিন আকাশ মেঘপুঞ্জসহ বিদীর্ণ হবে এবং ফেরেশতাদেরকে নামিয়ে দেওয়া হবে, সেদিন প্রকৃত কর্তৃত্ব হবে দয়াময়ের এবং কাফিরদের জন্য সেদিন হবে কঠিন। (২৫ঃ ২৫, ২৬)
(وَقَالَ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْنَا الْمَلَائِكَةُ أَوْ نَرَىٰ رَبَّنَا ۗ لَقَدِ اسْتَكْبَرُوا فِي أَنْفُسِهِمْ وَعَتَوْا عُتُوًّا كَبِيرًا * يَوْمَ يَرَوْنَ الْمَلَائِكَةَ لَا بُشْرَىٰ يَوْمَئِذٍ لِلْمُجْرِمِينَ وَيَقُولُونَ حِجْرًا مَحْجُورًا)
[Surat Al-Furqan ২১ - ২২]
অর্থাৎ যারা আমার সাক্ষাত কামনা করে না তারা বলে, আমাদের নিকট ফেরেশতা অবতীর্ণ করা হয় না কেন? অথবা আমরা আমাদের প্রতিপালককে প্রত্যক্ষ করি না কেন? তারা তাদের অন্তরে অহংকার পোষণ করে এবং তারা সীমালংঘন করেছে গুরুতররূপে। সেদিন তারা ফেরেশতাদেরকে প্রত্যক্ষ করবে। সেদিন অপরাধীদের জন্য সুসংবাদ থাকবে না এবং তারা বলবে, রক্ষা কর, রক্ষা কর। (২৫ঃ ২১-২২)
مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِلَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللَّهَ عَدُوٌّ لِلْكَافِرِينَ
অর্থাৎ যে কেউ আল্লাহর, তাঁর ফেরেশতাগণের, তাঁর রাসূলগণের এবং জিবরাঈল ও মীকাঈলের শত্রু সে জেনে রাখুক, আল্লাহ নিশ্চয় কাফিরদের শত্রু। (২ঃ ৯৮)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম হৃদয়, কঠোর স্বভাব ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য করে না আল্লাহ যা আদেশ করেন তা এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয় তা-ই করে। (৬৬ঃ ৬)
ফেরেশতা প্রসঙ্গ অনেক আয়াতেই রয়েছে। সেগুলোতে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ইবাদত ও দৈহিক কাঠামো সৌন্দর্যে, অবয়বের বিশালতায় এবং বিভিন্ন আকৃতি ধারণে পারঙ্গমতায় শক্তির অধিকারী বলে পরিচয় প্রদান করেছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(وَلَمَّا جَاءَتْ رُسُلُنَا لُوطًا سِيءَ بِهِمْ وَضَاقَ بِهِمْ ذَرْعًا وَقَالَ هَٰذَا يَوْمٌ عَصِيبٌ * وَجَاءَهُ قَوْمُهُ يُهْرَعُونَ إِلَيْهِ وَمِنْ قَبْلُ كَانُوا يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ
[Surat Hud ৭৭ - ৭৮]
অর্থাৎ এবং যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ লূতের নিকট আসল, তখন তাদের আগমনে সে বিষন্ন হলো এবং নিজকে তাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করল এবং বলল, এ এক নিদারুণ দিন। তার সম্প্রদায় তার নিকট উদ্ৰান্ত হয়ে ছুটে আসল এবং পূর্ব থেকে তারা কুকর্মে লিপ্ত ছিল। (১১ঃ ৭৭-৭৮)
তাফসীরের কিতাবে আমি উল্লেখ করেছি, যা একাধিক আলিম বলেছেন যে, ফেরেশতাগণ তাদের সামনে পরীক্ষাস্বরূপ সুদর্শন যুবকের আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। অবশেষে লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের উপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে পরাক্রমশালী শক্তিধররূপে পাকড়াও করেন।
অনুরূপভাবে জিবরাঈল (عليه السلام) নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট বিভিন্ন আকৃতিতে আগমন করতেন। কখনো আসতেন দিহয়া ইবন খলীফা কালবী (رضي الله عنه)-এর আকৃতিতে, কখনো বা কোন বেদুঈনের রূপে, আবার কখনো তিনি স্বরূপে আগমন করতেন। তার ছ’শ ডানা রয়েছে। প্রতি দু’টি ডানার মধ্যে ঠিক ততটুকু ব্যবধান যতটুকু ব্যবধান পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তদ্বয়ের মধ্যে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ আকৃতিতে তাকে দু’বার দেখেছেন। একবার দেখেছেন আসমান থেকে যমীনে অবতরণরত অবস্থায়। আর একবার দেখেছেন জান্নাতুল মাওয়ার নিকটবর্তী সিদরাতুল মুনতাহার কাছে (মি’রাজের রাতে)।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَىٰ * ذُو مِرَّةٍ فَاسْتَوَىٰ * وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَىٰ * ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ)
[Surat An-Najm ৫ - ৮]
অর্থাৎ তাকে শিক্ষা দান করে শক্তিশালী প্রজ্ঞাসম্পন্ন সে নিজ আকৃতিতে স্থির হয়েছিল, তখন সে ঊর্ধ্ব দিগন্তে, তারপর সে তার নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী। (৫৩ঃ ৫-৮)
এ আয়াতে যার কথা বলা হয়েছে তিনি হলেন জিবরাঈল (عليه السلام) যেমনটি আমরা একাধিক সাহাবা সূত্রে বর্ণনা করেছি। তন্মধ্যে ইবন মাসউদ (رضي الله عنه), আবু হুরায়রা (رضي الله عنه), আবু যর (رضي الله عنه) ও আয়েশা (رضي الله عنه) অন্যতম।
(فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَىٰ * فَأَوْحَىٰ إِلَىٰ عَبْدِهِ مَا أَوْحَىٰ)
[Surat An-Najm ৯ - ১০]
অর্থাৎ ফলে তাদের মধ্যে দু’ ধনুকের ব্যবধান থাকে অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ তার বান্দার প্রতি যা ওহী করবার তা ওহী করলেন। (৫৩ঃ ৯-১০)
তাঁর বান্দার প্রতি অর্থাৎ আল্লাহর বান্দা মুহাম্মদ (ﷺ)-এর প্রতি।
তারপর আল্লাহ বলেনঃ
(وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ * عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَىٰ * عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَىٰ * إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَىٰ * مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَىٰ)
[Surat An-Najm ১৩ - ১৭]
অর্থাৎ নিশ্চয় সে (মুহাম্মদ) তাকে (জিবরাঈল) আরেকবার দেখেছিল প্রান্তবর্তী কুল গাছের নিকট, যার নিকট অবস্থিত বাসোদ্যান। যখন বৃক্ষটি, যাদ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ার তাদ্বারা ছিল আচ্ছাদিত, তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষচ্যুতও হয়নি। (৫৩ঃ ১৩-১৭)
সূরা বনী ইস্রাঈলে মি’রাজের হাদীসসমূহে আমরা উল্লেখ করেছি যে, সিদরাতুল মুনতাহা সপ্তম আকাশে অবস্থিত। অন্য বর্ণনায় আছে, তা ষষ্ঠ আকাশে। এর অর্থ হচ্ছে সিদরাতুল মুনতাহার মূল হলো ষষ্ঠ আকাশে আর তার ডাল-পালা হলো সপ্তম আকাশে।
যখন সিদরাতুল মুনতাহা আল্লাহ তা’আলার আদেশে যা তাকে আচ্ছাদিত করার তা তাকে আচ্ছাদিত করলো এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেন, তাকে আচ্ছাদিত করেছে একপাল সোনার পতঙ্গ। কেউ বলেন, নানা প্রকার রং যার অবর্ণনীয়রূপ তাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। কারো কারো মতে, কাকের মত ফেরেশতাগণ তাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। কেউ কেউ বলেন, মহান প্রতিপালকের নূর তাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে- যার অবর্নণীয় সৌন্দর্য ও ঔজ্জ্বল্য বর্ণনাতীত। এ অভিমতগুলোর মধ্যে কোন পরস্পর বিরোধিতা নেই। কারণ সবগুলো বিষয় একই ক্ষেত্রে পাওয়া যেতে পারে।
আমরা আরো উল্লেখ করেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তারপর আমাকে সিদরাতুল মুনতাহার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি দেখলাম, তার ফুলগুলো ঠিক পর্বতের চূড়ার ন্যায় বড় বড়। অন্য বর্ণনায় আছে, ‘হিজরের পর্বত চূড়ার ন্যায়, আমি আরো দেখতে পেলাম তার পাতাগুলো হাতীর কানের মত।’ আরো দেখলাম, তার গোড়া থেকে দু’টো অদৃশ্য নদী এবং দু’টো দৃশ্যমান নদী প্রবাহিত হচ্ছে। অদৃশ্য দু’টো গেছে জান্নাতে আর দৃশ্যমান দু’টো হচ্ছে নীল ও ফোরাত। “পৃথিবী ও তার মধ্যকার সাগর ও নদ-নদী সৃষ্টি" শিরোনামে পূর্বে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
উক্ত হাদীসে এও আছে যে, তারপর বায়তুল মা’মূরকে আমার সম্মুখে উপস্থাপিত করা হয়। লক্ষ্য করলাম, প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা তাতে প্রবেশ করেন। তারপর আর কখনো তারা সেখানে ফিরে আসে না। নবী করীম (ﷺ) আরো জানান যে, তিনি ইবরাহীম খলীল (عليه السلام)-কে বায়তুল মা’মূরে ঠেস দিয়ে বসা অবস্থায় দেখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আমরা এও বলে এসেছি যে, বায়তুল মা’মূর সপ্তম আকাশে ঠিক তেমনিভাবে অবস্থিত, যেমন পৃথিবীতে কাবার অবস্থান।
সুফিয়ান ছাওরী, শুবা ও আবুল আহওয়াস ইবন ফাওয়া (رحمة الله) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি আলী ইবন আবু তালিব (رضي الله عنه)-কে বায়তুল মা’মূর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, তা আকাশে অবস্থিত যুরাহ নামক একটি মসজিদ। কা’বার ঠিক বরাবর উপরে তার অবস্থান। পৃথিবীতে বায়তুল্লাহর মর্যাদা যতটুকু আকাশে তার মর্যাদা ঠিক ততটুকু। প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা তাতে সালাত আদায় করেন যারা দ্বিতীয়বার আর কখনো সেখানে আসেন না। ভিন্ন সূত্রেও হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে এরূপ বর্ণনা রয়েছে।
ইমাম তাবারানী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “বায়তুল মা’মূর আকাশে অবস্থিত। তাকে যুরাহ নামে অভিহিত করা হয়। বায়তুল্লাহর ঠিক বরাবর উপরে তার অবস্থান। উপর থেকে পড়ে গেলে তা ঠিক তার উপরই এসে পড়বে। প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা তাতে প্রবেশ করেন। তারপর তারা তা আর কখনো দেখেন না। পৃথিবীতে মক্কা শরীফের মর্যাদা যতটুকু আকাশে তার মর্যাদা ঠিক ততটুকু। আওফী অনুরূপ বর্ণনা ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), মুজাহিদ (رحمة الله), ইকরিমা (رضي الله عنه), রবী ইবন আনাস (رحمة الله) ও সুদ্দী (رحمة الله) প্রমুখ থেকেও করেছেন।
কাতাদা (رحمة الله) বলেন, আমাদেরকে জানানো হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন তার সাহাবাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা কি জান, বায়তুল মামূর কী? জবাবে তারা বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল-ই ভালো জানেন। তখন তিনি বললেনঃ “(বায়তুল মা’মূর) কা’বার বরাবর আকাশে অবস্থিত একটি মসজিদ যদি তা উপর থেকে নিচে পড়তো তাহলে কা’বার উপরই পড়তো। প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা তাতে সালাত আদায় করেন। আর কখনো তারা ফিরে আসেন না।’
যাহহাক ধারণা করেন যে, বায়তুল মা’মূরকে ইবলীস গোত্রীয় একদল ফেরেশতা আবাদ করে থাকে। এদেরকে জিন বলা হয়ে থাকে। তিনি বলতেন, তার খাদেমরা ঐ গোত্রভুক্ত। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
অন্যরা বলেনঃ প্রতি আকাশে একটি করে ঘর আছে। সংশ্লিষ্ট আকাশের ফেরেশতাগণ তার মধ্যে ইবাদত করে তাকে আবাদ করে রাখেন। পালাক্রমে তারা সেখানে এসে থাকেন যেভাবে পৃথিবীবাসী প্রতি বছর হজ্জ করে এবং সর্বদা উমরা তাওয়াফ ও সালাতের মাধ্যমে বায়তুল্লাহকে আবাদ করে রাখে।
সাঈদ ইবন ইয়াহয়া ইবন সাঈদ উমাবী তার আল-মাগাযী কিতাবের শুরুতে বলেছেনঃ আবু উবায়দ মুজাহিদ এর হাদীসে বর্ণনা করেছেন যে, সাত আসমান ও সাত যমীনের মধ্যে হারম শরীফ-এর মর্যাদাকে সমুন্নত করা হয়েছে। এটি চৌদ্দটি গৃহের চতুর্থটি, প্রতি আসমানে একটি এবং প্রতি যমীনে একটি করে সম্মানিত ঘর আছে যার একটি উপর থেকে পতিত হলে তা নিচেরটির উপর গিয়ে পতিত হবে।
হাজ্জাজের মুআযযিন আবূ সুলায়মান থেকে আ’মাশ ও আবু মু’আবিয়া সূত্রে সাঈদ ইবন ইয়াহইয়া বর্ণনা করেন যে, আবূ সুলায়মান বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবন আমর (رضي الله عنه)-কে বলতে শুনেছিঃ
إن الحرم محرم في السموت السبع مقداره من الارض وإن بيت المقدس مقدس في السموت السبع مقداره من الأرض
অর্থাৎ- হারম শরীফ সাত আকাশে বিশেষভাবে সম্মানিত। পৃথিবীতে তার অবস্থান। তার বায়তুল মুকাদ্দাসও সাত আকাশে সম্মানিত। তার অবস্থানও পৃথিবীতে।
যেমন কোন এক কবি বলেনঃ
إن الذي سمك السماء بنى لها – بيتا دعائعه اشد واطول.
অর্থাৎ- আকাশকে যিনি ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছেন; তিনি তার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেছেন যার স্তম্ভগুলো অত্যন্ত মজবুত ও দীর্ঘ।
আকাশে অবস্থিত ঘরটির নাম হলো, বায়তুল ইযযাত এবং তার রক্ষণাবেক্ষণকারী ফেরেশতাদের যিনি প্রধান, তার নাম হলো ইসমাঈল। সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রতিদিন বায়তুল মা’মূরে প্রবেশ করেন এবং পরে কোনদিন সেখানে ফিরে আসার সুযোগ পান না। তারা কেবল সপ্তম আকাশেরই অধিবাসী। অন্য আকাশের ফিরিশতাগণের তো প্রশ্নই উঠে না। আর এ জন্যই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ
অর্থাৎ তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন। (৭৪ঃ ৩১)
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু যর (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
‘নিশ্চয় আমি এমন অনেক কিছু দেখি, যা তোমরা দেখতে পাও না এবং এমন অনেক কিছু শুনি, যা তোমরা শুনতে পাও না। আকাশ চড় চড় শব্দ করে। আর তার চড় চড় শব্দ করারই কথা। আকাশে চার আঙ্গুল পরিমাণ জায়গাও খালি নেই যাতে কোন ফেরেশতা সিজদায় না পড়ে আছেন। আমি যা জানি, তোমরা যদি তা জানতে, তাহলে তোমরা অল্প হাসতে ও বেশি কাঁদতে। শয্যায় নারী সম্ভোগ করতে না এবং লোকালয় ত্যাগ করে বিজন প্রান্তরে চলে গিয়ে উচ্চস্বরে আল্লাহর নিকট দু’আ করতে থাকতে।
একথা শুনে আবু যর (رضي الله عنه) বলে উঠলেনঃ
والله لو ردت أني شجرة تعضد
অর্থাৎ আল্লাহর শপথ! আমি খুশি হতাম যদি আমি বৃক্ষ রূপে জন্মগ্রহণ করে কর্তিত হয়ে যেতাম।
ইমাম তিরমিযী ও ইবন মাজাহ (رحمة الله) ইসরাঈলের হাদীস থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান গরীব বলে মন্তব্য করেছেন। আবার আবু যর (رضي الله عنه) থেকে মওকুফ সূত্রেও হাদীসটি বর্ণিত হয়ে থাকে।
তাবারানী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, জাবির (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ সাত আকাশে কোথাও এক পা, এক বিঘত বা এক করতল পরিমাণ স্থান ফাকা নেই। যাতে কোন না কোন ফেরেশতা হয় দাঁড়িয়ে আছেন, কিংবা সিজদায় পড়ে আছেন নতুবা রুকূরত আছেন। তারপর যখন কিয়ামতের দিন আসবে তখন তারা সকলে বলবেন, আমরা আপনার ইবাদতের হক আদায় করতে পারিনি। তবে আমরা আপনার সাথে কোন কিছু শরীক সাব্যস্ত করিনি।
এ হাদীসদ্বয় প্রমাণ করে যে, সাত আকাশের এমন কোন স্থান নেই যেখানে কোন কোন ফেরেশতা বিভিন্ন প্রকার ইবাদতে লিপ্ত নন। কেউ সদা দণ্ডায়মান, কেউ সদা সিজদারত আবার কেউবা অন্য কোন ইবাদতে ব্যস্ত আছেন। আল্লাহ তা’আলার আদেশ মতে তারা সর্বদাই তাদের ইবাদত, তাসবীহ, যিকির-আযকার ও অন্যান্য আমলে নিযুক্ত রয়েছেন। আবার আল্লাহর নিকট তাদের রয়েছে বিভিন্ন স্তর। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(وَمَا مِنَّا إِلَّا لَهُ مَقَامٌ مَعْلُومٌ * وَإِنَّا لَنَحْنُ الصَّافُّونَ * وَإِنَّا لَنَحْنُ الْمُسَبِّحُونَ)
[Surat As-Saaffat ১৬৪ - ১৬৬]
অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকের জন্যই নির্ধারিত স্থান আছে এবং আমরা তো সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান এবং আমরা অবশ্যই তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণাকারী। (৩৭ঃ ১৬৪-১৬৬)
অন্য এক হাদীসে নবী করীম (ﷺ) বলেনঃ ফেরেশতাগণ তাদের প্রতিপালকের নিকট যেভাবে সারিবদ্ধ হয়; তোমরা কি সেভাবে সারিবদ্ধ হতে পার না? সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, তারা তাদের প্রতিপালকের নিকট কিভাবে সারিবদ্ধ হয়? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ তারা প্রথম সারি পূর্ণ করে নেয় এবং সারি যথা নিয়মে সোজা করে নেয়।
অন্য এক হাদীসে তিনি বলেনঃ
فضلنا على الناس بثلات جعلت لنا الأرض مسجدا وتربتها لنا طهورا وجعلت صفوفنا كصفوف الملأكة .
অর্থাৎ তিনভাবে অন্যদের উপর আমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। গোটা পৃথিবীকে আমাদের জন্য মসজিদ এবং তার মাটিকে আমাদের জন্য পাক বানানো হয়েছে। আর আমাদের সারিসমূহকে ফেরেশতাদের সারির মর্যাদা দান করা হয়েছে।
অনুরূপ কিয়ামতের দিন তারা মহান প্রতিপালকের সম্মুখে সারিবদ্ধভাবে উপস্থিত হবে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا)
[Surat Al-Fajr ২২]
অর্থাৎ—আর যখন তোমার প্রতিপালক উপস্থিত হবেন এবং সারিবদ্ধভাবে ফেরেশতাগণও। (৮৯ঃ ২২)
তারপর তারা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا ۖ لَا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَٰنُ وَقَالَ صَوَابًا)
[Surat An-Naba' ৩৮]
অর্থাৎ সেদিন রূহ ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে; দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন; সে ব্যতীত অন্যরা কথা বলবে না এবং সে যথার্থ বলবে। (৭৮ঃ ৩৮)
এখানে الروح শব্দ দ্বারা আদম-সন্তান বুঝানো হয়েছে। ইবন আব্বাস (رحمة الله), হাসান ও কাতাদা (رحمة الله) এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ বলেন الروح হলো, ফেরেশতাদের একটি শ্রেণী; আকারে যারা আদম-সন্তানের সাথে সাদৃশ্য রাখেন। ইবন আব্বাস (رحمة الله), মুজাহিদ, আবূ সালিহ ও আ’মাশ এ কথা বলেছেন। কেউ বলেন, এ হলেন জিবরাঈল (عليه السلام)। এ অভিমত শা’বী, সাঈদ ইবন জুবায়র ও যিহাক (رحمة الله)-এর। আবার কেউ বলেন, الروح এমন একজন ফেরেশতার নাম, যার অবয়ব গোটা সৃষ্টি জগতের সমান। আলী ইবন আবু তালহা ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, الروح এমন একজন ফেরেশতা যিনি দৈহিক গঠনে ফেরেশতা জগতে সর্বশ্রেষ্ঠদের অন্যতম।
ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) সূত্রে ইবন জারীর (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) বলেনঃ روح চতুর্থ আকাশে অবস্থান করেন। আকাশসমূহের সবকিছু এবং পাহাড়-পর্বত অপেক্ষাও বৃহৎ। তিনি ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিদিন তিনি বার হাজার তাসবীহ পাঠ করেন। প্রতিটি তাসবীহ থেকে আল্লাহ তাআলা একজন করে ফেরেশতা সৃষ্টি করেন। কিয়ামতের দিন একাই তিনি এক সারিতে দণ্ডায়মান হবেন। তবে এ বর্ণনাটি একান্তই গরীব শ্রেণীভুক্ত।
তাবারানী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, “আল্লাহর এমন একজন ফেরেশতা আছেন, তাকে যদি বলা হয় যে, তুমি এক গ্রাসে আকাশ ও পৃথিবীসমূহকে গিলে ফেল; তবে তিনি তা করতে সক্ষম। তার তাসবীহ হল سبحانك حيث كنت কোন কোন রিওয়ায়তে হাদীসটি মওকুফ রূপে বর্ণিত।
আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের বিবরণে আমরা জাবির ইবন আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) সূত্রে উল্লেখ করেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “আরশ বহনকারী আল্লাহর ফেরেশতাদের এক ফেরেশতা সম্পর্কে বলার জন্য আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাঁর কানের লতি থেকে কাঁধ পর্যন্ত সাতশ’ বছরের দূরত্ব।" দাউদ ও ইবন আবু হাতিম (رحمة الله) তা বর্ণনা করেছেনঃ আবু হাতিমের পাঠে আছে পাখির গতির সাতশ’ বছর।
জিবরাঈল (عليه السلام)-এর পরিচিতি অধ্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বর্ণিত হয়েছে। অল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَىٰ
তাকে শিক্ষাদান করে শক্তিশালী। (৫৩ঃ ৫)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আলিমগণ বলেন, জিবরাঈল (عليه السلام) তার প্রবল শক্তি দ্বারা লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের বসতিগুলো—যা ছিল সাতটি— তাতে বসবাসকারী লোকজন যারা ছিল প্রায় চার লাখ এবং তাদের পশু-পক্ষী, জীব-জানোয়ার, জমি-জমা, অট্টালিকাদিসহ তার একটি ডানার কোণে তুলে নিয়ে তিনি উর্ধ্ব আকাশে পৌঁছে যান। এমনকি ফেরেশতাগণ কুকুরের ঘেউ ঘেউ ও মুরগীর আওয়াজ পর্যন্ত শুনতে পান। তারপর তিনি তাকে উল্টিয়ে উপর দিক নিচে করে দেন। এটাই হলُ شَدِيدُ الْقُوَىٰ এর তাৎপর্য। আল্লাহর বাণীঃ ذومرة অর্থ অপরূপ সুন্দর আকৃতিসম্পন্ন। যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ
নিশ্চয় এ কুরআন এক সম্মানিত রাসূলের বাহিত বার্তা। (৬৯ঃ ৪০)
رَسُولٍ كَرِيمٍঅর্থাৎ জিবরাঈল (عليه السلام) রাসূলুল্লাহর দূত করীম সুদর্শন।
ذي قوةঅর্থ প্রবল শক্তিমান। ذي قوة عند ذي العرش مكين অর্থ আরশের মহান অধিপতির নিকটে তার উচ্চ মর্যাদা রয়েছে। مطاع অর্থ ঊর্ধ্ব জগতে তিনি সকলের অনুকরণীয়। أمين অর্থ তিনি গুরুত্বপূর্ণ আমানতের অধিকারী। এ জন্যই তিনি আল্লাহ ও নবীগণের মাঝে দূত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন, যিনি তাদের উপর সত্য সংবাদ ও ভারসাম্যপূর্ণ শরীয়ত সম্বলিত ওহী নাযিল করতেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করতেন। তার নিকট তিনি অবতরণ করতেন বিভিন্ন রূপে। যেমন আমরা পূর্বে বর্ণনা করেছি।
আল্লাহ্ তা’আলা জিবরাঈল (عليه السلام)-কে যে আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন; রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সে আকৃতিতে তাকে দু’বার দেখেছেন। তাঁর রয়েছে দু’শ ডানা। যেমন ইমাম বুখারী (رحمة الله) তালক ইবন গান্নাম ও যায়েদা শায়বানী (رحمة الله) সূত্রে বর্ণনা করেন। যায়েদা শায়বানী (رحمة الله) বলেন, আমি যির (رحمة الله)-কে আল্লাহর বাণীঃ
فكان قاب قوسين أو أدنى فأوحي إلي عبده ما أوحى.
সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বললেনঃ আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, মুহাম্মদ (ﷺ) জিবরাঈল (عليه السلام)-কে তার ছ’শ ডানাসহ দেখেছেন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিবরাঈল (عليه السلام)-কে তার নিজ আকৃতিতে দেখেছেন। তার দু’শ ডানা ছিল। প্রতিটি ডানা দিগন্ত আচ্ছাদিত করে ফেলেছিল। তার ডানা থেকে ঝরে পড়ছিল নানা বর্ণের মুক্তা ও ইয়াকুত। এ সম্পর্কে আল্লাহই সমধিক অবহিত।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) ولقدراه نزلة أخري عند سدرة المنتهيএ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আমি জিবরাঈল (عليه السلام)-কে দেখেছি। তার দু’শ ডানা ছিল। তার পালক থেকে নানা বর্ণের মণি-মুক্তা ছড়িয়ে পড়ছিল।
আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আমি সিদরাতুল মুনতাহার নিকট জিবরাঈল (عليه السلام)-কে দেখেছি। তখন ছিল তাঁর দু’শ ডানা।
হুসায়ন (رضي الله عنه) বলেন, আমি আসিমকে ডানাসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তাঁর জনৈক সংগী আমাকে জানান যে, তার ডানা পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। উল্লেখ্য যে, এ রিওয়ায়েতগুলোর সনদ উত্তম ও নির্ভরযোগ্য। ইমাম আহমদ (رحمة الله) এককভাবেই তা বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, শাকীক (رحمة الله) বলেন, আমি ইবন মাসঊদ (رضي الله عنه)-কে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “আমি জিবরাঈলকে তারুণ্য দীপ্ত যুবকের আকৃতিতে দেখেছি, যেন তার সাথে মুক্তা ঝুলছে।" এর সনদ সহীহ।
আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) থেকে ইবন জারীর (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) ما كذب الفواد ماراي এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিবরাঈল (عليه السلام)-কে সূক্ষ্ম রেশমের তৈরি দুই জোড়া পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখেছেন। তিনি তখন আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী গোটা স্থান জুড়ে অবস্থান করছিলেন। এর সনদও উত্তম ও প্রামাণ্য।
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে যে, মাসরূক বলেন, আমি একদিন আয়েশা (رضي الله عنه)-এর নিকট ছিলাম। তখন আমি বললাম, আল্লাহ তা’আলা কি এ কথা বলছেন না যে,
(وَلَقَدْ رَآهُ بِالْأُفُقِ الْمُبِينِ)
[Surat At-Takwir ২৩]
সে তো (মুহাম্মদ) তাকে (জিবরাঈলকে) স্পষ্ট দিগন্তে দেখেছে। (৮১ঃ ২৩)
(وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ)
[Surat An-Najm ১৩]
অর্থাৎ নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল। (৫৩ঃ ১৩) উত্তরে আয়েশা (رضي الله عنه) বললেন, এ উম্মতের আমিই প্রথম ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ “উনি হলেন জিবরাঈল। তিনি তাকে আল্লাহ সৃষ্টি তার আসল অবয়বে মাত্র দু’বার দেখেছেন। তিনি তাকে দেখেছেন আসমান থেকে যমীনে অবতরণরত অবস্থায়। তখন তাঁর সুবিশাল দেহ আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থানকে জুড়ে রেখেছিল।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিবরাঈল (عليه السلام)-কে বললেনঃ “আচ্ছা, আপনি আমার সঙ্গে যতবার সাক্ষাৎ করে থাকেন তার চেয়ে অধিক সাক্ষাৎ করতে পারেন না?” ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, তারপর নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়ঃ
(وَمَا نَتَنَزَّلُ إِلَّا بِأَمْرِ رَبِّكَ ۖ لَهُ مَا بَيْنَ أَيْدِينَا وَمَا خَلْفَنَا وَمَا بَيْنَ ذَٰلِكَ
[Surat Maryam ৬৪]
অর্থাৎ আমরা আপনার প্রতিপালকের আদেশ ব্যতীত অবতরণ করি না। যা আমাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে আছে এবং যা এ দু’-এর অন্তর্বর্তী; তা তারই। (১৯ঃ ৬৪)
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সর্বাপেক্ষা বেশি দানশীল ছিলেন। আর তার এ বদান্যতা রমযান মাসে, যখন জিবরাঈল (عليه السلام) তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন অনেক বেশি বৃদ্ধি পেত। জিবরাঈল (عليه السلام) রমযানের প্রতি রাতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুরআনের দারস দিতেন। মোটকথা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কল্যাণ সাধনে মুক্ত বায়ু অপেক্ষাও অধিকতর উদার ছিলেন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন শিহাব (رحمة الله) বলেন, উমর ইবন আবদুল আযীয (رحمة الله) একদিন আসর পড়তে কিছুটা বিলম্ব করে ফেলেন। তখন উরওয়া (رضي الله عنه) তাকে বললেন, নিশ্চয়ই জিবরাঈল (عليه السلام) অবতরণ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করেছিলেন। এ কথা শুনে উমর (رضي الله عنه) বললেন, হে উরওয়া! তুমি যা বলছ, আমার তা জানা আছে। আমি বশীর ইবন আবু মাসউদকে তার পিতার বরাতে বলতে শুনেছি যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছেনঃ
জিবরাঈল (عليه السلام) অবতরণ করলেন। তারপর তিনি আমার ইমামতি করলেন। আমি তার সঙ্গে সালাত আদায় করলাম, তারপর আমি তার সঙ্গে সালাত আদায় করলাম, তারপর আমি তার সঙ্গে সালাত আদায় করলাম, তারপর আমি তার সঙ্গে সালাত আদায় করলাম। এভাবে আঙ্গুল দ্বারা গুণে গুণে তিনি পাঁচ নামাযের কথা উল্লেখ করেন।
এবার ইসরাফীল (عليه السلام)-এর পরিচিতি জানা যাক। ইনি আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের একজন। ইনি সেই ফেরেশতা, যিনি তার প্রতিপালকের আদেশে শিঙ্গায় তিনটি ফুৎকার দেবেন। প্রথমটি ভীতি সৃষ্টির, দ্বিতীয়টি ধ্বংসের এবং তৃতীয়টি পুনরুত্থানের। এর বিস্তারিত আলোচনা পরে আমাদের এ কিতাবের যথাস্থানে আসবে ইনশাআল্লাহ।
সূর (صور) হলো একটি শিঙ্গা, যাতে ফুঙ্কার দেয়া হবে। তার প্রতিটি আওয়াজ আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। আল্লাহ যখন তাকে পুনরুত্থানের জন্য ফুৎকার দেয়ার আদেশ করবেন, তখন মানুষের রূহগুলো তার মধ্যে অবস্থান নিয়ে থাকবে। তারপর যখন তিনি ফুঙ্কার দেবেন, তখন রূহগুলো বিহ্বল চিত্তে বেরিয়ে আসবে। ফলে আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন, আমার ইযযত ও পরাক্রমের শপথ! প্রতিটি রূহ তার দেহে ফিরে যাক দুনিয়াতে যে দেহকে প্রাণবন্ত রাখতে। ফলে রূহগুলো কবরে গিয়ে দেহের মধ্যে ঢুকে পড়ে এমনভাবে মিশে যাবে যেমনটি বিষ সর্পদষ্ট ব্যক্তির মধ্যে মিশে যায়। এতে দেহগুলো প্রাণবন্ত হয়ে যাবে এবং কবরসমূহ বিদীর্ণ হয়ে যাবে আর তারা দ্রুত গতিতে হাশরের ময়দানের দিকে বেরিয়ে পড়বে। যথাস্থানে এর বিস্তারিত আলোচনা আসবে। আর এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
كيف انعم وصاحب القرن قد التقم القرن وحنى جبهته وانتظر أن يؤذن له
অর্থাৎ আমি কিভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি যেখানে শিঙ্গাধারী ফেরেশতা শিঙ্গা মুখে নিয়ে মাথা ঝুকিয়ে অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছেন।
একথা শুনে সাহাবাগণ বললেন, তাহলে আমরা কি দু’আ পাঠ করবো ইয়া রাসূলাল্লাহ! জবাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমরা বলবেঃ
حسبنا الله ونعم الوكيل على الله توكلنا.
অর্থাৎ আমাদের আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি উত্তম অভিভাবক। আল্লাহর উপরই আমাদের ভরসা।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) ও তিরমিযী (رحمة الله) আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আতিয়্যা আল-আওফী-এর হাদীস থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিঙ্গাধারী ফেরেশতার কথা আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, তার ডানে জিবরাঈল ও বামে মীকাঈল (عليه السلام) অবস্থান করছেন।
তাবারানী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন বসা অবস্থায় ছিলেন। জিবরাঈল (عليه السلام) তখন তার পাশে অবস্থান করছিলেন। এমন সময়ে দিগন্ত ভেদ করে ঝুঁকে ঝুঁকে ইসরাফীল (عليه السلام) পৃথিবীর নিকটবর্তী হতে শুরু করেন। হঠাৎ দেখা গেল একজন ফেরেশতা বিশেষ এক আকৃতিতে নবী করীম (ﷺ)-এর সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে মুহাম্মদ! বান্দা নবী ও বাদশাহ নবী এ দুয়ের কোন একটি বেছে নেয়ার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে আদেশ করছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ তখন জিবরাঈল (عليه السلام) তার হাত দ্বারা আমার প্রতি ইংগিতে বলেন যে, আপনি বিনয় অবলম্বন করুন। এতে আমি বুঝতে পারলাম যে, তিনি আমার মঙ্গলার্থেই বলছেন। ফলে আমি বললামঃ আমি বান্দা নবী হওয়াই পছন্দ করি। তারপর সে ফেরেশতা আকাশে উঠে গেলে আমি বললাম, হে জিবরাঈল। এ ব্যাপারে আমি আপনার নিকট জিজ্ঞেস করব বলে মনস্থ করেছিলাম। কিন্তু আপনার ভাবগতি দেখে আর তা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। এবার বলুন, ইনি কে, হে জিবরাঈল? জবাবে জিবরাঈল (عليه السلام) বললেনঃ ইনি ইসরাফীল (عليه السلام)। যেদিন আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই তিনি তাঁর সম্মুখে পদদ্বয় সোজা রেখে নত মস্তকে দাড়িয়ে আছেন। কখনো তিনি চোখ তুলে তাকান না। তার ও মহান প্রতিপালকের মধ্যে রয়েছে সত্তরটি নূরের পর্দা। তার কোন একটির কাছে ঘেষলে তা তাকে পুড়িয়ে ফেলবে। তাঁর সামনে একটি ফলক আছে। আকাশ কিংবা পৃথিবীর ব্যাপারে আল্লাহ কোন আদেশ দিলে সে ফলকটি উঠে গিয়ে তা তার ললাট-দেশে আঘাত করে। তখন তিনি চোখ তুলে তাকান। সে আদেশ যদি আমার কর্ম সম্পৃক্ত হয়; তাহলে সে ব্যাপারে আমাকে তিনি আদেশ দেন আর যদি তা মীকাঈল-এর কাজ সংক্রান্ত হয় তাহলে তিনি তাকে তার আদেশ দেন। আর যদি তা মালাকুল মউতের কাজ হয় তবে তিনি তাকে তার আদেশ দেন। আমি বললাম, হে জিবরাঈল! আপনার দায়িত্ব কী? তিনি বললেন, বায়ু ও সৈন্য সংক্রান্ত। আমি বললাম, আর মীকাঈল কিসের দায়িত্বে নিয়োজিত? বললেন, উদ্ভিদাদি ও বৃষ্টির দায়িত্বে। আমি বললাম, আর মালাকুল মউত কোন দায়িত্বে আছেন? বললেন, রূহ কবয করার দায়িত্বে। আমি তো মনে করেছিলাম, উনি কিয়ামত কায়েম করার জন্য অবতরণ করেছেন বুঝি! আর আপনি আমার যে ভাবগতি দেখেছিলেন, তা কিয়ামত কায়েম হওয়ার ভয়েই হয়েছিল। এ সুত্রে এটি গরীব হাদীস। সহীহ মুসলিমে আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতে যখন নামায পড়ার জন্য দণ্ডায়মান হতেন, তখন তিনি বলতেনঃ
اللهم رب جبريل وميكائيل و اسرافيل فاطر السموت والأرض عالم الغيب والشهادة أنت تحكم بين عبادك فبما كانوا فيه يختلفون . إهدني لما اختلف فيه من الحق باذنك إنك تهدي من تشاء إلى صراط مستقیم
অর্থাৎ হে আল্লাহ! হে জিবরাঈল, মীকাঈল ও ইসরাফীল-এর প্রতিপালক! হে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, গুপ্ত ও প্রকাশ্য সবকিছুর পরিজ্ঞাতা! তুমিই তো তোমার বান্দাদের মাঝে সে বিষয়ে মীমাংসা করবে, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধে লিপ্ত ছিল। তুমি আমাকে সত্যের বিরোধপূর্ণ বিষয়ে হিদায়ত দান কর। তুমি তো যাকে ইচ্ছা কর তাকেই সঠিক পথের সন্ধান দিতে পার।
শিঙ্গা সম্পর্কিত হাদীসে আছে যে, ইসরাফীল (عليه السلام)-ই হবেন প্রথম, যাকে আল্লাহ ধ্বংসের পর শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়ার জন্য পুনর্জীবিত করবেন।
মুহাম্মদ ইবন হাসান নাক্কাশ (رحمة الله) বলেন, ইসরাফীল (عليه السلام)-ই ফেরেশতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম সিজদা করেছিলেন। এরই পুরস্কারস্বরূপ তাকে লাওহে মাহফুজের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। আবুল কাসিম সুহায়লী (رحمة الله) তার التعريف والاعلام بما انهم في القر ان من الاعلام নামক কিতাবে এ কথাটি বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِلَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالََ
অর্থাৎ যে কেউ আল্লাহর, তাঁর ফেরেশতাদের, তাঁর রাসূলগণের এবং জিবরাঈল ও মীকাঈলের শত্ৰু....। (২ঃ ৯৮)
এ আয়াতে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন হওয়ার কারণে জিবরাঈল ও মীকাঈল (عليه السلام)-কে -এর উপর عطف করা হয়েছে। জিবরাঈল হলেন এক মহান ফেরেশতা। পূর্বেই তার প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আর মীকাঈল (عليه السلام) হলেন বৃষ্টি ও উদ্ভিদাদির দায়িত্বে নিয়োজিত। তিনি আল্লাহ থেকে প্রাপ্ত বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ও নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাদের অন্যতম।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) আনাস ইবন মালিক (رضي الله عنه) সূত্রে রিওয়ায়েত করেন, তিনি বলেছেন যে, নবী করীম (ﷺ) জিবরাঈল (عليه السلام)-কে বললেনঃ “ব্যাপার কি, আমি মীকাঈল (عليه السلام)-কে কখনো হাসতে দেখলাম না যে? উত্তরে জিবরাঈল (عليه السلام) বললেন, মীকাঈল (عليه السلام) জাহান্নাম সৃষ্টির পর থেকে এ যাবত কখনো হাসেন নি।
এ হলো সে সব ফেরেশতার আলোচনা, পবিত্র কুরআনে যাদের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সিহাহ সিত্তায় নবী করীম (ﷺ)-এর দু’আয়ও এদের উল্লেখ রয়েছে। তাহলে,
اللهم رب جبريل وميكائيل وإسرافيل.
জিবরাঈল (عليه السلام)-এর দায়িত্ব ছিল উম্মতের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য নবী-রাসূলগণের নিকট হিদায়াত নিয়ে আসা। মীকাঈল (عليه السلام) বৃষ্টি ও উদ্ভিদাদির দায়িত্বে নিয়োজিত, যার মাধ্যমে এ দুনিয়াতে জীবিকা সৃষ্টি করা হয়। তাঁর অনেক সহযোগী ফেরেশতা আছেন, আল্লাহর আদেশ অনুসারে তিনি যা বলেন তারা তা পালন করেন। আল্লাহ তা’আলার মর্জি অনুযায়ী তারা বাতাস ও মেঘমালা পরিচালিত করে থাকেন। আর পূর্বে আমরা বর্ণনা করে এসেছি যে, আকাশ থেকে যে ফোটাটিই পতিত হয়, তার সাথে একজন ফেরেশতা থাকেন যিনি সে ফোটাটি পৃথিবীর যথাস্থানে স্থাপন করেন। পক্ষান্তরে ইসরাফীল (عليه السلام)-কে কবর থেকে উত্থানের এবং কৃতজ্ঞদের সাফল্য লাভ ও কৃতঘ্নদের পরিণতি লাভ করার উদ্দেশ্যে পুনরুত্থান দিবসে উপস্থিত হওয়ার জন্য শিঙ্গায় ফুক্কার দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত করে রাখা হয়েছে। ঐ দিন কৃতজ্ঞদের পাপ মার্জনা করা হবে এবং তাদের পুণ্য কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে। আর কৃতঘ্নদের আমল বিক্ষিপ্ত ধুলির ন্যায় হয়ে যাবে আর সে নিজের ধ্বংস ও মৃত্যু কামনা করবে।
মোটকথা, জিবরাঈল (عليه السلام) হিদায়েত অবতারণের দায়িত্ব পালন করেন, মীকাঈল (عليه السلام) জীবিকা প্রদানের দায়িত্ব পালন করেন আর ইসরাফীল (عليه السلام) পালন করেন সাহায্য দান ও প্রতিদানের দায়িত্ব। কিন্তু মালাকুল মউতের নাম কুরআন এবং সহীহ হাদীসসমূহের কোথাও স্পষ্ট উল্লেখ নেই। তবে কোন কোন রিওয়ায়েতে তাকে আযরাঈল নামে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
قُلْ يَتَوَفَّاكُمْ مَلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّكُمْ تُرْجَعُونَ
অর্থাৎ- বল, তোমাদের জন্য মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অবশেষে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যানীত হবে। (৩২ঃ ১১)
এ মালাকুল মউতেরও কিছু সহযোগী ফেরেশতা আছেন, যারা মানুষের রূহকে দেহ থেকে বের করে তা কণ্ঠনালী পর্যন্ত নিয়ে আসেন, তারপর মালাকুল মউত নিজ হাতে তা কবয করেন। তিনি তা কবয করার পর সহযোগী ফেরেশতাগণ এক পলকের জন্যও তা তার হাতে থাকতে না দিয়ে সংগে সংগে তারা তাকে নিয়ে উপযুক্ত কাফনে আবৃত করেন। নিম্নের আয়াতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছেঃ
يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ
অর্থাৎ যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী তাদেরকে ইহজীবনে ও পরজীবনে আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন। (১৪ঃ ২৭)
তারপর তারা রূহটি নিয়ে ঊর্ধ্ব জগতের দিকে রওয়ানা হন। রূহ যদি সৎকর্মপরায়ণ হয়, তাহলে তার জন্য আকাশের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয়। অন্যথায় তার সামনেই তা বন্ধ করে দিয়ে তাকে পৃথিবীর দিকে ছুঁড়ে ফেলা হয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ ۖ وَيُرْسِلُ عَلَيْكُمْ حَفَظَةً حَتَّىٰ إِذَا جَاءَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ تَوَفَّتْهُ رُسُلُنَا وَهُمْ لَا يُفَرِّطُونَ * ثُمَّ رُدُّوا إِلَى اللَّهِ مَوْلَاهُمُ الْحَقِّ ۚ أَلَا لَهُ الْحُكْمُ وَهُوَ أَسْرَعُ الْحَاسِبِينَ)
[Surat Al-An'am ৬১ - ৬২]
অর্থাৎ তিনিই তার বান্দাদের উপর পরাক্রমশালী এবং তিনিই তোমাদের রক্ষক প্রেরণ করেন; অবশেষে যখন তোমাদের কারো মৃত্যুকাল উপস্থিত হয়, তখন আমার প্রেরিতরা তার মৃত্যু ঘটায় এবং তার কোন ত্রুটি করে না। তারপর তাদের প্রকৃত প্রতিপালকের দিকে তারা প্রত্যানীত হয়। দেখ, কর্তৃত্ব তো তাঁরই এবং হিসাব গ্রহণে তিনিই সর্বাপেক্ষা তৎপর। (৬ঃ ৬১-৬২)
ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) ও মুজাহিদ (رحمة الله) প্রমুখ থেকে বর্ণিত যে, তারা বলেন, গোটা পৃথিবী মালাকুল মউতের সামনে একটি পাত্রের ন্যায়। তার যে কোন অংশ থেকে ইচ্ছা তিনি হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করতে পারেন। আমরা এও উল্লেখ করেছি যে, মৃত্যুর ফেরেশতাগণ মানুষের নিকট তার আমল অনুপাতে আগমন করে থাকেন। লোক যদি মু’মিন হয়, তবে তার নিকট উজ্জ্বল চেহারা, সাদা পোশাক ও হৃদয়বান ফেরেশতাগণ আগমন করেন। আর লোক যদি কাফির হয় তাহলে এর বিপরীতবেশী ফেরেশতাগণ আগমন করেন। এ ব্যাপারে আমরা মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি।
জাফর ইবন মুহাম্মদ তার পিতাকে বলতে শুনেন যে, একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জনৈক আনসারীর শিয়রে বসে মালাকুল মউতকে দেখতে পেয়ে তাঁকে বললেনঃ হে মালাকুল মউত! আমার সাহাবীর সঙ্গে সদয় ব্যবহার করুন। কারণ সে মু’মিন। জবাবে মালাকুল মউত বললেন,
হে মুহাম্মদ! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন এবং আপনার চোখ জুড়াক, কেননা আমি প্রত্যেকটি মুমিনের ব্যাপারেই সদয়। আপনি জেনে রাখুন, পৃথিবীর কোন মাটির কাচা ঘর বা পশম আচ্ছাদিত তবু, তা জলে হোক বা স্থলে হোক এমন নেই, যেখানে আমি দৈনিক পাঁচবার লোকদের তল্লাশি না করে থাকি। ফলে ছোট-বড় সকলকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। আল্লাহর শপথ! হে মুহাম্মদ, আল্লাহর আদেশ ব্যতীত একটি মশার রূহ কবয করার সাধ্যও আমার নেই।
জাফর ইবন মুহাম্মদ বলেন, আমার আব্বা আমাকে জানিয়েছেন যে, মৃত্যুর ফেরেশতাগণ নামাযের সময়ও লোকদেরকে তল্লাশি করে ফিরেন। তখন কারো মৃত্যুর সময় এসে পড়লে যদি সে নামাযের পাবন্দ হয়ে থাকে তাহলে ফেরেশতা তাঁর নিকটে এসে শয়তানকে তাড়িয়ে দেন এবং সে সঙ্কটময় মূহূর্তে তাকে لا اله الا الله محمد رسول الله তালকীন করেন।
এ হাদীসটি মুরসাল এবং কেউ কেউ এর সমালোচনা করেছেন। শিক্ষা সম্পর্কিত হাদীসে আমরা আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছি। তাতে এও আছে যে, আল্লাহ তা’আলা ইসরাফীল (عليه السلام)-কে ধ্বংসের ফুৎকারের আদেশ করবেন। সে মতে তিনি ফুৎকার দিলে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অধিবাসীরা সকলেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কেবল তারাই নিরাপদ থাকবেন, যাদেরকে আল্লাহ নিরাপদ রাখতে ইচ্ছা করবেন। এভাবে তারা বিনাশ হয়ে গেলে মৃত্যুর ফেরেশতা আল্লাহ তাআলার নিকট এসে বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যাদেরকে রক্ষা করতে ইচ্ছা করেছেন তারা ব্যতীত আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অধিবাসীদের সকলেই তো মারা গিয়েছে। কে কে জীবিত আছে তা জানা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ কে জীবিত রইলো? তিনি বলবেন, জীবিত আছেন আপনি, যিনি চিরঞ্জীব, যাঁর মৃত্যু নেই। আর বেঁচে আছেন আপনার আরশ বহনকারিগণ এবং জিবরাঈল ও মীকাঈল। এ কথা শুনে আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ জিবরাঈল এবং মীকাঈলেরও মৃত্যু হয়ে যাক। তখন আরশ আল্লাহর সঙ্গে কথা বলবে। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! জিবরাঈল এবং মীকাঈলও মারা যাবেন? আল্লাহ বলবেনঃ চুপ কর! আমার আরশের নিচে যারা আছে; তাদের প্রত্যেকের জন্য আমি মৃত্যু অবধারিত করে রেখেছি। তারপর তারা দু’জনও মারা যাবেন।
তারপর মালাকুল মউত মহান আল্লাহর নিকট এসে বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! জিবরাঈল এবং মীকাঈলও তো মারা গিয়েছেন। একথা শুনে আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন– অথচ কে বেঁচে আছে সে সম্পর্কে তিনি সমধিক অবহিত, তাহলে আর কে বেঁচে আছে? তিনি বলবেন, বেঁচে আছেন আপনি চিরঞ্জীব সত্তা, যার মৃত্যু নেই। আর বেঁচে আছে আপনার আরশ বহনকারিগণ ও আমি। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ আমার আরশ বহনকারীদেরও মৃত্যু হোক। ফলে তারা মারা যাবেন এবং আল্লাহর আদেশে আরশ ইসরাফীলের নিকট থেকে শিঙ্গাটা নিয়ে নেবেন। তারপর মালাকুল মউত এসে বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! আপনার আরশ বহনকারিগণ মারা গেছেন। তা শুনে আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন। যদিও কে বেঁচে আছে তা তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন— তাহলে আর কে বেঁচে আছে? তিনি বলবেন, বেঁচে আছেন আপনি চিরঞ্জীব সত্তা, যাঁর মৃত্যু নেই। আর বেঁচে আছি আমি। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ তুমিও আমার সৃষ্টিসমূহের একটি সৃষ্টি। আমি তোমাকে বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছিলাম। অতএব, তুমিও মরে যাও। ফলে তিনিও মারা যাবেন। তারপর অবশিষ্ট থাকবেন শুধু অদ্বিতীয় পরাক্রমশালী এক ও অমুখাপেক্ষী সত্তা, যিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং যাকে কেউ জন্ম দেয়নি, যার তুল্য কেউ নেই, যিনি প্রথমে যেমন ছিলেন, পরেও তেমনি থাকবেন।
ইমাম তাবারানী, ইবন জারীর এবং বায়হাকী (رحمة الله) এ হাদীসটি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। আর হাফিজ আবু মূসা আল-মাদানী ‘আত-তিওয়ালাত’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণনায় কিছু অতিরিক্ত বিরল কথাও আছে। তাহলো “আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ তুমি আমার সৃষ্টিসমূহের একটি সৃষ্টি। তোমাকে আমি বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছিলাম। অতএব, তুমি এমনভাবে মরে যাও, যারপর আর কখনো তুমি জীবিত হবে না।”
কুরআনে যে সব ফেরেশতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে; প্রাচীন যুগের বিপুল সংখ্যক আলিমের মতে তাঁদের মধ্যে হারূত এবং মারূতও রয়েছেন। এদের কাহিনী সম্পর্কে বেশ কিছু রিওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে, যার বেশির ভাগই ইসরাঈলী বর্ণনা।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) এ প্রসংগে ইবন উমর (رضي الله عنه) থেকে একটি মারফু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং ইবন হিব্বান তাঁর ‘তাকাসীম’ গ্রন্থে তাঁকে সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে আমার মতে, বর্ণনাটির বিশুদ্ধতায় সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। হাদীসটি আবদুল্লাহ ইবন উমর (رضي الله عنه)-এর উপর মওকুফ হওয়াই অধিকতর যুক্তিসংগত। সম্ভবত এটি তিনি কা’ব আহবার থেকে গ্রহণ করেছেন, যেমন পরে এর আলোচনা আসছে। উক্ত বর্ণনায় আছে যে, যুহরা তাদের সামনে সেরা সুন্দরী রমণীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
আলী ইবন আব্বাস ও ইবন উমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে, যুহরা একজন রমণী ছিল। হারুত ও মারুত তার নিকট কুপ্রস্তাব দিলে ইসমে আজম শিক্ষা দানের শর্তারোপ করে এবং তারা তাকে তা শিখিয়ে দেন। তখন সে তা পাঠ করে আকাশে উঠে যায় এবং (শুক্র) গ্রহের রূপ ধারণ করে।
হাকিম (رحمة الله) তার মুসতাদরাকে বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, সে যুগে এমন একজন রূপসী রমণী ছিল, নারী সমাজে তার রূপ ছিল ঠিক নক্ষত্র জগতে যুহরার রূপের ন্যায়। যুহরা সম্পর্কে বর্ণিত পাঠগুলোর মধ্যে এটিই সর্বোত্তম।
কেউ কেউ বলেন, হারুত-মারূতের কাহিনীটি ইদরীস (عليه السلام)-এর আমলে ঘটেছিল। আবার কেউ বলেন, এটা সুলায়মান ইবন দাউদের আমলের ঘটনা। তাফসীরে আমরা এ কথাটি উল্লেখ করেছি।
মোটকথা, এসব হচ্ছে ইসরাঈলী বর্ণনা। কা’ব আহবার হলেন এর উৎস। যেমন আবদুর রাযযাক তাঁর তাফসীর গ্রন্থে কা’ব আহবার সূত্রে কাহিনীটি বর্ণনা করেছেন। আর সনদের দিক থেকে এটি বিশুদ্ধতর। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
তাছাড়া কেউ কেউ বলেনঃ
وما انزل علي الئكين ببابل هاروت وماروت
এ আয়াত দ্বারা জিনদের দু’টি গোত্রকে বুঝানো হয়েছে। ইবন হাযম (رحمة الله) এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে এ অভিমতটি একটি বিরল ও কপট কল্পিত অভিমত।
আবার কেউ কেউ وما أنزل علي الملكين যের যোগে পড়েছেন এবং হারুত ও মারূতকে ইরানের সানীপন্থী দুজন লোক বলে অভিহিত করেছেন। এটা যাহহাকের অভিমত।
আবার কারো কারো মতে এরা দু’জন আকাশের ফেরেশতা। কিন্তু আল্লাহর পূর্ব নির্ধারণ অনুযায়ী তাদের এ দশা হয়েছে, যা বর্ণিত হয়েছে। যদি তা সঠিক হয়ে থাকে, তবে তাদের ঘটনা ইবলীসের ঘটনার সাথে তুল্য হবে, যদি ইবলীস ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। কিন্তু বিশুদ্ধতর কথা হলো, ইবলীস জিনদের অন্তর্ভুক্ত। এর আলোচনা পরে আসছে।
হাদীসে যেসব ফেরেশতার নাম এসেছে তন্মধ্যে মুনকার নাকীর অন্যতম। বিভিন্ন হাদীসে কবরের সওয়াল প্রসঙ্গে তাদের আলোচনা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। আমরা يثبت الله الذين الخ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তা আলোচনা করেছি।
এরা দু’জন কবরের পরীক্ষক। মৃত ব্যক্তিকে তার কবরে তার রব, দীন ও নবী সম্পর্কে প্রশ্ন করার দায়িত্বে এঁরা নিয়োজিত। এরা সৎকর্মশীল ও পাপাচারীদের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। এরা নীল রঙের, ভয়ংকর বড় বড় দাত, ভয়ানক আকৃতি ও ভয়ংকর গর্জন বিশিষ্ট। আল্লাহ আমাদের কবরের আযাব থেকে রক্ষা করুন এবং ঈমানের অটল বাণী দ্বারা আমাদেরকে প্রতিষ্ঠিত রাখুন। আমীন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, উরওয়া বলেন, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (رضي الله عنه) একদিন নবী করীম (ﷺ)-কে বললেনঃ অাপনার উপর উহুদের দিনের চাইতে কঠিনতর কোনদিন এসেছে কি? উত্তরে নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ তোমার সম্প্রদায় থেকে আমি যে আচরণ পেয়েছি তন্মধ্যে আকাবার (তায়েফের) দিনের আচরণটি ছিল কঠোরতম। সেদিন আমি ইবন আবদ য়ালাল ইবন আবদ কিলাল-এর নিকট আমার দাওয়াত পেশ করলাম। কিন্তু সে আমার দাওয়াতে কোন সাড়াই দিল না। ফলে আমি বিষণ মুখে ফিরে আসি এবং করনুছ ছাআলিবে পৌঁছা পর্যন্ত আমার হুঁশই ছিল না। সেখানে পৌঁছার পর উপর দিকে মাথা তুলে দেখতে পেলাম যে, একখণ্ড মেঘ আমার উপর ছায়াপাত রেখেছে। সেদিকে তাকিয়ে আমি তার মধ্যে জিবরাঈল (عليه السلام)-কে দেখতে পাই। তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনার সম্প্রদায় আপনাকে যা বলেছে এবং যে জবাব দিয়েছে আল্লাহ তা শুনেছেন। তিনি আপনার নিকট পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাকে প্রেরণ করেছেন, যাতে আপনি তাকে তাদের ব্যাপারে যা ইচ্ছা আদেশ করেন। তখন পাহাড়ের ফেরেশতা আমাকে সালাম দিয়ে বললেন, হে মুহাম্মদ! আপনি যদি বলেন তাহলে এ দু’পাহাড় চাপা দিয়ে ওদেরকে খতম করে দেই। জবাবে নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ “বরং আমি আশা করি যে, আল্লাহ তাদের ঔরস থেকে এমন প্রজন্ম সৃষ্টি করবেন যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না।" ইমাম মুসলিম (رحمة الله) ইবন ওহাবের হাদীস থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
❏ পরিচ্ছেদ
আল্লাহ তা’আলা যেসব উদ্দেশ্যে ফেরেশতাগণকে সৃষ্টি করেছেন সেদিক থেকে ফেরেশতাগণ কয়েক ভাগে বিভক্ত। তন্মধ্যে একদল হলেন আরশ বহনকারী। উপরে তাদের সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। আরেক দল হলেন কারূবীয়ু্ন ফেরেশতাগণ। আরশের চতুর্পার্শ্বে এঁদের অবস্থান। আরশ বহনকারীদের মত এরাও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী এবং নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
لَنْ يَسْتَنْكِفَ الْمَسِيحُ أَنْ يَكُونَ عَبْدًا لِلَّهِ وَلَا الْمَلَائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ
অর্থাৎ (ঈসা) মাসীহ আল্লাহর বান্দা হওয়াকে হেয় জ্ঞান করে না এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাগণও নয়। (৪ঃ ১৭২)
জিবরাঈল এবং মীকাঈল (عليه السلام)-ও তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাদের সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে, তারা অনুপস্থিতিতে মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ * رَبَّنَا وَأَدْخِلْهُمْ جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدْتَهُمْ وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ ۚ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ * وَقِهِمُ السَّيِّئَاتِ ۚ وَمَنْ تَقِ السَّيِّئَاتِ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمْتَهُ ۚ وَذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ)
[Surat Ghafir ৭ - ৯]
অর্থাৎ—এবং তারা মু’মিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। অতএব, যারা তাওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বন করে তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কর।
হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তাদেরকে দাখিল কর স্থায়ী জান্নাতে, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদেরকে দিয়েছ এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সর্ম করেছে তাদেরকেও। তুমি তো পুরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। এবং তুমি তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা কর, সেদিন তুমি যাকে শাস্তি হতে রক্ষা করবে, তাকে তো অনুগ্রহই করবে। এটাই তো মহা সাফল্য। (৪০ঃ ৭-৯)
আর তারা এমন পূত-পবিত্র চরিত্রের অধিকারী হওয়ার কারণে তারা তাদেরকে ভালোবাসেন, যারা এ গুণে গুণান্বিত। যেমন হাদীসে মহানবী (ﷺ) বলেছেনঃ
إذا دعا العبد لا فيه بظهر الغيب قال الملك آمين ولك بمثل .
অর্থাৎ কোন ব্যক্তি তার ভাইয়ের জন্য তার অনুপস্থিতিতে দু’আ করলে ফেরেশতারা বলেন, আমীন, আর তোমার জন্যও তাই হোক।
আরেক দল হলেন সাত আকাশে বসবাসকারী ফেরেশতা। তারা রাত-দিন ও সকাল-সন্ধ্যা অবিরাম ইবাদত করে আকাশসমূহকে আবাদ রাখেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
يُسَبِّحُونَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لَا يَفْتُرُونَ
অর্থাৎ—তারা রাত-দিন তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তারা শৈথিল্য করে না। (২১ঃ২০)
ফেরেশতাদের কেউ কেউ সর্বদা রুকূ অবস্থায় আছেন, কেউ কেউ আছেন দণ্ডায়মান আর কেউ কেউ সিজদারত। আরেক দল আছেন যারা দলে দলে পালাক্রমে প্রত্যহ সত্তর হাজার বায়তুল মা’মূরে গমনাগমন করেন। একবার যারা আসেন তারা পুনরায় আর সেখানে আসেন না।
আরেক দল আছেন যাঁরা জান্নাতসমূহের দায়িত্বে রয়েছেন। জান্নাতীদের সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থাপনা, তাতে বসবাসকারীদের এমন পোশাক-পরিচ্ছদ, বাসস্থান ও খাদ্য-পানীয় ইত্যাদির আয়োজন করাও তাদের দায়িত্ব যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান যা শুনেনি এবং কোন মানুষের হৃদয়ে যার কল্পনাও আসেনি। উল্লেখ্য যে, জান্নাতের দায়িত্বে নিযুক্ত ফেরেশতার নাম রিদওয়ান। বিভিন্ন হাদীসে এর স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
আবার কতিপয় ফেরেশতা জাহান্নামের দায়িত্বেও নিযুক্ত রয়েছেন। তারা হলেন যাবানিয়া। এঁদের মধ্যে উনিশজন হলেন নেতৃস্থানীয়। আর জাহান্নামের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতার নাম মালিক। জাহান্নামের দায়িত্বে নিযুক্ত ফেরেশতাদের তিনিই প্রধান। নিচের আয়াতগুলোতে তাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছেঃ
وَقَالَ الَّذِينَ فِي النَّارِ لِخَزَنَةِ جَهَنَّمَ ادْعُوا رَبَّكُمْ يُخَفِّفْ عَنَّا يَوْمًا مِنَ الْعَذَابِ
অর্থাৎ—জাহান্নামীরা তার প্রহরীদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা কর, যেন তিনি আমাদের থেকে একদিনের শাস্তি লাঘব করে দেন। (৪০ঃ ৪৯)
(وَنَادَوْا يَا مَالِكُ لِيَقْضِ عَلَيْنَا رَبُّكَ ۖ قَالَ إِنَّكُمْ مَاكِثُونَ * لَقَدْ جِئْنَاكُمْ بِالْحَقِّ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَكُمْ لِلْحَقِّ كَارِهُونَ)
[Surat Az-Zukhruf ৭৭ - ৭৮]
অর্থাৎ তারা চিৎকার করে বলবে, হে মালিক! তোমার প্রতিপালক আমাদেরকে নিঃশেষ করে দিন! সে বলবে, তোমরা তো এভাবেই থাকবে।
আল্লাহ বলবেন, আমি তো তোমাদের নিকট সত্য পৌঁছিয়েছিলাম, কিন্তু তোমাদের অধিকাংশই ছিল সত্য-বিমুখ। (৪৩ঃ ৭৭-৭৮)
عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
অর্থাৎ—তাতে নিয়োজিত আছে নির্মম হৃদয়, কঠোর স্বভাবের ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য করে না আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন তা এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয় তাই করে।
(عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ * وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلَّا مَلَائِكَةً ۙ وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلَّا فِتْنَةً لِلَّذِينَ كَفَرُوا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَيَزْدَادَ الَّذِينَ آمَنُوا إِيمَانًا ۙ وَلَا يَرْتَابَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْمُؤْمِنُونَ ۙ وَلِيَقُولَ الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ وَالْكَافِرُونَ مَاذَا أَرَادَ اللَّهُ بِهَٰذَا مَثَلًا ۚ كَذَٰلِكَ يُضِلُّ اللَّهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ ۚ وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ ۚ وَمَا هِيَ إِلَّا ذِكْرَىٰ لِلْبَشَرِ) [Surat Al-Muddaththir ৩০ – ৩১]
অর্থাৎ—তার তত্ত্বাবধানে আছে উনিশজন প্রহরী। আমি ফেরেশতাদেরকে করেছি জাহান্নামের প্রহরী। কাফিরদের পরীক্ষা স্বরূপই আমি তাদের এ সংখ্যা উল্লেখ করেছি— যাতে কিতাবীদের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে, বিশ্বাসীদের বিশ্বাস বর্ধিত হয় এবং বিশ্বাসীগণ ও কিতাবিগণ সন্দেহ পোষণ না করে। এর ফলে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা ও কাফিররা বলবে, আল্লাহ এ অভিনব উক্তি দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছেন। এভাবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা পথ-নির্দেশ করেন। তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন। (৭৪ঃ ৩০-৩১)
আবার এদেরই উপর আদম সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(سَوَاءٌ مِنْكُمْ مَنْ أَسَرَّ الْقَوْلَ وَمَنْ جَهَرَ بِهِ وَمَنْ هُوَ مُسْتَخْفٍ بِاللَّيْلِ وَسَارِبٌ بِالنَّهَارِ * لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ ۗ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ ۚ وَمَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَالٍ)
[Surat Ar-Ra'd ১০ - ১১]
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে কথা গোপন রাখে অথবা যে তা প্রকাশ করে, রাত্রিতে যে আত্মগোপন করে এবং দিবসে যে প্রকাশ্যে বিচরণ করে, তারা সমভাবে আল্লাহর গোচরে রয়েছে।
মানুষের জন্য তার সম্মুখে ও পশ্চাতে একের পর এক প্রহরী থাকে, তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। কোন সম্প্রদায়ের সম্পর্কে যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা রদ করবার কেউ নেই এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোন অভিভাবক নেই। (১৩ঃ ১০-১১)
ওয়ালিবী (رحمة الله) হযরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, له معقبات من بين الخ আয়াতে معقبات দ্বারা ফেরেশতাগণকে বুঝানো হয়েছে।
ইকরিমা (رحمة الله) হযরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, يحفظو من أمر الله অর্থ ফেরেশতাগণ তাকে তার সম্মুখে ও পশ্চাতে রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। পরে আল্লাহর সিদ্ধান্ত এসে পড়লে তারা সরে পড়েন।
মুজাহিদ (رحمة الله) বলেন, প্রতি বান্দার জন্যে তার নিদ্রায় ও জাগরণে জিন, মানব ও হিংস্র জন্তু থেকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন করে ফেরেশতা নিয়োজিত আছেন। কেউ তার ক্ষতি করতে আসলে ফেরেশতা বলেন, সরে যাও। তবে কোন ক্ষেত্রে আল্লাহর অনুমতি থাকলে তার সে ক্ষতি হয়েই যায়।
আবূ উসামা (رضي الله عنه) বলেন, প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে এমন একজন ফেরেশতা আছেন যিনি তার হেফাজতের দায়িত্ব পালন করেন। অবশেষে তিনি তাকে তাকদীরের হাতে সোপর্দ করেন।
আবূ মিজলায (رضي الله عنه) বলেন, এক ব্যক্তি আলী (رضي الله عنه)-এর নিকট এসে বলল, মুরাদ গোত্রের কিছু লোক আপনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছে। একথা শুনে তিনি বললেন, নিশ্চয় প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে দু’জন করে ফেরেশতা আছেন; যারা এমন বিষয় থেকে তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করেন, যা তার তাকদীরে নেই। পরে যখন তাকদীর এসে যায় তখন তারা তার তাকদীরের হাতেই তাকে ছেড়ে দেন। নির্ধারিত আয়ু হচ্ছে এক সুরক্ষিত ঢালস্বরূপ।
আরেক দল ফেরেশতা আছেন, যাঁরা বান্দার আমল সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ * مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ)
[Surat Qaf ১৭ - ১৮]
অর্থাৎ—দক্ষিণে ও বামে বসে তারা কর্ম লিপিবদ্ধ করে। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর ফেরেশতা তার নিকটেই রয়েছে। (৫০ঃ ১৭-১৮)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ * كِرَامًا كَاتِبِينَ * يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ)
[Surat Al-Infitar ১০ - ১২]
অর্থাৎ অবশ্যই আছে তোমাদের জন্য তত্ত্বাবধায়কগণ, সম্মানিত লিপিকরবৃন্দ; তারা জানে তোমরা যা কর। (৮২ঃ ১০-১২)
আবু হাতিম রাযী (رحمة الله) তাঁর তাফসীরে বর্ণনা করেন যে, মুজাহিদ (رحمة الله) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমরা সম্মানিত লিপিকরবৃন্দকে সম্মান কর, যারা গোসল করতে থাকা অবস্থায় ও পেশাব-পায়খানা জনিত নাপাকী অবস্থা এ দুটি অবস্থায় ব্যতীত তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হন না। অতএব, তোমাদের কেউ যখন গোসল করে তখন যেন সে দেয়াল কিংবা উট দ্বারা আড়াল করে নেয় অথবা তার কোন ভাই তাকে আড়াল করে রাখে।
এ সূত্রে হাদীসটি মুরসাল। বাযযার তার মুসনাদে জাফর ইবন সুলায়মান সূত্রে মুত্তাসাল পদ্ধতিতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
‘আলকামা’ মুজাহিদ সূত্রে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ তোমাদেরকে বিবস্ত্র হতে নিষেধ করেন। অতএব, তোমরা লজ্জা করে চল আল্লাহকে এবং তোমাদের সঙ্গের সেসব সম্মানিত লিপিকরদেরকে যারা পেশাব-পায়খানা, জানাবত ও গোসলের সময় এ তিন অবস্থা ব্যতীত কখনো তোমাদের থেকে পৃথক হন না। তাই তোমাদের কেউ খোলা মাঠে গোসল করলে সে যেন তার কাপড় কিংবা দেয়াল বা তার উট দ্বারা আড়াল করে নেয়।
ফেরেশতাগণকে সম্মান করার অর্থ হলো, তাদের ব্যাপারে লজ্জা করে চলা। অর্থাৎ তাদের দ্বারা মন্দ আমল লিপিবদ্ধ করাবে না। কেননা, আল্লাহ তা’আলা তাদের সৃষ্টিতে এবং চারিত্রিক গুণাবলীতে তাদেরকে সম্মানিত করেছেন।
সিহাহ, সুনান ও মাসানীদের বিভিন্ন গ্রন্থে তাদের মর্যাদা সম্পর্কে কিছু সংখ্যক সাহাবা কর্তৃক বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “ফেরেশতাগণ সে ঘরে প্রবেশ করেন না যে ঘরে ছবি, কুকুর ও জুনুবী (গোসল ফরজ হয়েছে এমন ব্যক্তি) রয়েছে।
হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে আসিম (رضي الله عنه) বর্ণিত রিওয়ায়তে অতিরিক্ত শব্দ আছে এবং যে ঘরে প্রশ্রাব রয়েছে।
আবু সাঈদ (رضي الله عنه) থেকে মারফূ সূত্রে বর্ণিত রাফি-এর এক বর্ণনায় আছেঃ যে গৃহে ছবি কিংবা মূর্তি আছে সে গৃহে ফেরেশতা প্রবেশ করেন না।
আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে মারফূ সূত্রে বর্ণিত মুজাহিদের এক বর্ণনায় আছে? ফেরেশতাগণ সে গৃহে প্রবেশ করেন না, যে গৃহে কুকুর বা মূর্তি আছে।
যাকওয়ান আবু সালিহ সাম্মাক-এর বর্ণনায় আছে যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন ও ফেরেশতাগণ সে দলের সঙ্গে থাকেন না, যাদের সাথে কুকুর বা ঘন্টা থাকে। যুরারা ইবন আওফার বর্ণনায় কেবল ঘন্টার কথা উল্লেখিত হয়েছে।
বাযযার (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ নিশ্চয় আল্লাহর ফেরেশতাগণ আদমের সন্তানদেরকে চিনেন (আমার ধারণা তিনি বলেছেন) এবং তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কেও তারা জ্ঞাত। তাই কোন বান্দাকে আল্লাহর আনুগত্যের কোন কাজ করতে দেখলে তাকে নিয়ে তারা পরস্পর আলোচনা করেন এবং তার নাম-ধাম উল্লেখ করে বলেন, আজ রাতে অমুক ব্যক্তি সফল হয়েছে, আজ রাতে অমুক ব্যক্তি মুক্তি লাভ করেছে। পক্ষান্তরে কাউকে আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কোন কাজ করতে দেখলে তারা তাকে নিয়ে। পরস্পরে আলোচনা করেন এবং তার নাম-ধাম উল্লেখ করে বলেন, অমুক ব্যক্তি আজ রাতে ধ্বংস হয়েছে।
এ বর্ণনাটিতে একজন দুর্বল রাবী রয়েছেন। ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “ফেরেশতাগণ পালাক্রমে আগমন করে থাকেন। একদল আসেন রাতে, একদল আসেন দিনে এবং ফজর ও আসর নামাযে দুইদল একত্রিত হন। তারপর যারা তোমাদের মধ্যে রাত যাপন করলেন, তারা আল্লাহর নিকট চলে যান। তখন আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন। অথচ তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন আমার বান্দাদেরকে তোমরা কী অবস্থায় রেখে এসেছ? জবাবে তারা বলেন, তাদেরকে রেখে এসেছি সালাতরত অবস্থায় আর তাদের নিকট যখন গিয়েছিলাম তখনও তারা সালাতরত অবস্থায় ছিল।
এ বর্ণনার শব্দমালা ঠিক এভাবেই ‘সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায়ে ইমাম বুখারী (رحمة الله) এককভাবে বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী ও মুসলিম (رحمة الله) তাদের সহীহ গ্রন্থদ্বয়ে ‘সূচনা’ ভিন্ন অন্য সূত্রেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
বাযযার বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “সংরক্ষণকারী ফেরেশতাদ্বয় দৈনিকের সংরক্ষিত আমলনামা আল্লাহর দরবারে নিয়ে যাওয়ার পর তার শুরুতে ও শেষে ইসতিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) দেখতে পেয়ে তিনি বলেনঃ লিপির দুই প্রান্তের মধ্যখানে যা আছে আমার বান্দার জন্য আমি তা ক্ষমা করে দিলাম।
বাযযার বলেন, তাম্মাম ইবুন নাজীহ এককভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর হাদীস সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসবেত্তার সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও তাঁর বর্ণিত হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য।
মোটকথা, প্রত্যেক মানুষের জন্য দু’জন করে হেফাজতের ফেরেশতা আছেন। একজন তার সম্মুখ থেকে ও একজন তার পেছন থেকে আল্লাহর আদেশে তাকে হেফাজত করে থাকেন। আবার প্রত্যেকের সংগে দু’জন করে লিপিকর ফেরেশতা আছেন। একজন ডানে ও একজন বামে। ডানের জন্য বামের জনের উপর কর্তৃত্ব করে না।
عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ * مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ)
[Surat Qaf ১৭ - ১৮]
এ আয়াতের (৫০ঃ ১৭-১৮) ব্যাখ্যায় আমরা এ বিষয়টি আলোচনা করেছি। ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
ما منكم من أحد الا وقد وكل به قرينه من الجن وقرينه من الملئكة
অর্থাৎ তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই একজন করে জিন সহচর ও ফেরেশতা সহচর দায়িত্বপ্রাপ্ত রয়েছেন।
একথা শুনে সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আর আপনার ও? বললেনঃ
وایای ولكن الله أعانني عليه فلا يأمرني الا بخير .
অর্থাৎ—“হ্যাঁ আমারও। কিন্তু আল্লাহ তার উপর আমাকে সাহায্য করেছেন। ফলে সে আমাকে মঙ্গল ছাড়া অন্য কিছুর আদেশ করে না। (মুসলিম শরীফ)
এ ফেরেশতা সহচর এবং মানুষের সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত সহচর অভিন্ন না হওয়া বিচিত্র নয়। আলোচ্য হাদীসে সে সহচরের কথা বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আল্লাহর আদেশে কল্যাণ ও হেদায়েতের পথে পরিচালিত করার জন্য তিনি নিযুক্ত। যেমন শয়তান সহচর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধ্বংস ও বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় নিয়োজিত। এতে সে চেষ্টার ত্রুটি করে না। আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন, সে-ই রক্ষা পায়। আল্লাহরই সাহায্য কাম্য।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “জুম’আর দিনে মসজিদের প্রতিটি দরজায় একদল ফেরেশতা অবস্থান নিয়ে আগন্তুকদের ধারাবাহিক তালিকা লিপিবদ্ধ করেন, তারপর ইমাম মিম্বরে বসে গেলে তারা লিপিসমূহ গুটিয়ে এসে খুতবা শুনতে থাকেন।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হাদীসটি অন্য সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَقُرْآنَ الْفَجْرِ ۖ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا
অর্থাৎ—এবং ফজরের সালাত কায়েম করবে। ফজরের সালাত বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। (১৭ঃ ৭৮)
কেননা, দিনের ও রাতের ফেরেশতাগণ তা লক্ষ্য করে থাকেন। ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) ও আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) وَقُرْآنَ الْفَجْرِ ۖ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ “ফজরের সালাত রাতের ফেরেশতাগণ ও দিনের ফেরেশতাগণ (একত্রে) প্রত্যক্ষ করে থাকেন।"
তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবন মাজাহ (رحمة الله) ও আসবাতের থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং তিরমিযী হাদীসটি হাসান সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। আমার মতে, হাদীসটি মুনকাতি পর্যায়ের। ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
فصل صلاة الجمع على صلاة الواحد خمس وعشرون درجة ويجتمع ملائكة الليل وملائكة النهار في صلاة الفجر.
অর্থাৎ—“একাকী সালাতের চাইতে জামাতের সালাতের ফযীলত পঁচিশ গুণ বেশি এবং রাতের ফেরেশতাগণ ও দিনের ফেরেশতাগণ ফজরের সালাতে একত্রিত হয়ে থাকেন।"
আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, তোমাদের ইচ্ছে হলে وَقُرْآنَ الْفَجْرِ ۖ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا এ আয়াতটি পাঠ করতে পার। ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
إذا دعا الرجل إمرأته إلى فراشه فأبت فبات غضبان لعنتها الملائكة حتي تصبح
অর্থাৎ—“কেউ তার স্ত্রীকে তার শয্যায় আহবান করার পর যদি সে তা প্রত্যাখ্যান করে আর স্বামী রাগান্বিত অবস্থায় রাত কাটায় তাহলে ভোর পর্যন্ত ফেরেশতাগণ তাকে অভিশাপ দিতে থাকেন।"
শুবা, আবু হামযা, আবু দাউদ এবং আবু মু’আবিয়াও আমাশ (رحمة الله) থেকে এর পরিপূরক হাদীস বর্ণনা করেছেন।
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
إذا أمن الإمام فأمنوا فإن من وافق تأمینه تأمين الملائكة غفرله ما تقدم من ذنبه.
অর্থাৎ—“যখন ইমাম আমীন বলবে তখন তোমরাও আমীন বলবে। কেননা, ফেরেশতাদের আমীন বলার সঙ্গে যার আমীন বলা একযোগে হয়; তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।”
সহীহ বুখারীতে ইসমাঈল (رحمة الله) সূত্রে বর্ণিত হাদীসটির পাঠ হলোঃ
إذا قال الإمام أمين فإن الملكة تقول في السماء أمين فمن وافق تأمینه تأمين الملئكة غفر له ما تقدم من ذنبه.
অর্থাৎ ইমাম যখন আমীন বলেন তখন আকাশে ফেরেশতারাও আমীন বলে। অতএব, ফেরেশতাদের আমীন বলার সঙ্গে যার আমীন বলা যোগ হয়; তার পূর্বের শুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
إذا قال الإمام سمع الله لمن حمده فقولوا اللهم ربنا ولك الحمد فإن من وافق قوله قول الملئكة غفر له ما تقدم من ذنبه.
অর্থাৎ ইমাম যখন سمع الله لمن حمده বলবে, তখন তোমরা ربنا ولك الحمد বলবে কারণ যার কথা ফেরেশতাদের কথার সঙ্গে মিলে যাবে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।
ইবন মাজাহ্ (رحمة الله) ব্যতীত হাদীসের মশহুর ছয় কিতাবের সংকলকগণের অন্য সকলে ইমাম মালিকের সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) কিংবা আবু সাঈদ (رضي الله عنه) সূত্রে (সন্দেহটি রাবী আমাশ-এর) ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ লিপিকর ফেরেশতাদের অতিরিক্ত আল্লাহর কিছু ফেরেশতা আছেন যারা পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ান। তারপর কোন জনগোষ্ঠীকে আল্লাহর যিকররত অবস্থায় পেলে তারা একে অপরকে ডেকে বলেন, এসো এখানেই তোমাদের বাঞ্ছিত বস্তু রয়েছে। তারপর তারা নিম্ন আকাশে চলে গেলে আল্লাহ তা’আলা জিজ্ঞেস করেন, আমার বান্দাদেরকে তোমরা কী কাজে রত রেখে এসেছ? জবাবে তারা বলেন, তাদেরকে আমরা আপনার প্রশংসা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা এবং যিকররাত রেখে এসেছি। আল্লাহ বলেন, তারা কি আমাকে দেখেছে? ফেরেশতাগণ বলেন, না। আল্লাহ বলেন, আমাকে তারা দেখলে কেমন হতো? জবাবে তারা বলেন, তারা যদি আপনাকে দেখত; তাহলে তারা আপনার প্রশংসা জ্ঞাপন, সাহায্য প্রার্থনা ও যিকর করায় আরো বেশি তৎপর হতো। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আল্লাহ বলেন, তারা কী চায়? ফেরেশতাগণ বলেনঃ তারা জান্নাত চায়।
আল্লাহ বলেন, তা কি তারা দেখেছে? ফেরেশতাগণ বলেন, জ্বী না। আল্লাহ বলেন, তা যদি তারা দেখত তাহলে কেমন হতো? জবাবে ফেরেশতারা বলেনঃ যদি তারা তা দেখত তাহলে জান্নাত কামনায় ও তার অন্বেষণে তারা আরো বেশি তৎপর হতো। তারপর আল্লাহ বলবেন, তারা কোন বস্তু থেকে আশ্রয় চায়? ফেরেশতারা বলেনঃ জাহান্নাম থেকে।
আল্লাহ বলেন, তা কি তারা দেখেছে? ফেরেশতাগণ বলেন? জ্বী না। আল্লাহ বলেন, তা দেখলে কেমন হতো? জবাবে তারা বলেনঃ দেখলে তারা তা থেকে আরো অধিক পলায়নপর এবং আরো অধিক সন্ত্রস্ত হতো। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর আল্লাহ বলেন, তোমাদেরকে আমি সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। বর্ণনাকারী বলেন, তখন ফেরেশতারা বলেন, তাদের মধ্যে তো অমুক গুনাহগার ব্যক্তি আছে, যে এ উদ্দেশ্যে তাদের নিকট আসেনি, সে এসেছিল নিজের কোন প্রয়োজনে। জবাবে আল্লাহ বলেন, ওরা এমনই এক সম্প্রদায়, তাদের কাছে যেই বসে, সে বঞ্চিত হয় না। বুখারী, মুসলিম, আহমদ (رحمة الله) (ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে)
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
من نفس عن مؤمن كربة من كرب الدنيا نفس الله عنه كربة من كرب يوم القيامة. ومن ستر مسلما ستره الله في الدنيا والآخرة . والله في عون العبد ماكان العبد في عون أخيه. ومن سلك طريقا يلتمس به علما سهل الله له به طريقا إلى الجنة . وما اجتمع قوم في بيت من بيوت الله يتلون كتاب الله ويتدارسونه بينهم إلا نزلت عليهم السكينة وغشيتهم الرحمة وحفتهم الملئكة وذكرهم الله فيمن عنده . و من بطاء به عمله لم يسرع به نسبه.
অর্থাৎ—‘কেউ কোন মু’মিনের দুনিয়ার একটি সংকট দূর করে দিলে, আল্লাহ তার কিয়ামতের দিনের একটি সংকট দূর করে দেবেন। কেউ কোন মুসলমানের দোষ গোপন রাখলে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত তার ভাইয়ের সাহায্যার্থে তৎপর থাকে, আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত তার সাহায্য করতে থাকেন। কেউ ইলম অন্বেষণের উদ্দেশ্যে পথ চললে তার উসিলায় আল্লাহ তার জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। কোন জনগোষ্ঠী যদি আল্লাহর কোন ঘরে বসে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে ও পরস্পরে তার দারস দান করে, তাহলে তাদের উপর প্রশান্তি নেমে আসে, রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেয়। ফেরেশতাগণ তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখেন এবং আল্লাহ তার নিকটস্থ ফেরেশতাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করেন। আর আমলে যে পিছিয়ে থাকবে; বংশের পরিচয় তাকে এগিয়ে নিতে পারবে না। মুসলিম (رحمة الله) এ হাদীসটি রিওয়ায়ত করেছেন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) ও আবু সাঈদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
ما اجتمع قوم يذكرون الله إلا حفتهم الملئكة وغشيتهم الرحمة ونزلت عليهم السكينة وذكرهم الله فيمن عنده .
অর্থাৎ—কোথাও একদল লোক একত্রিত হয়ে আল্লাহর যিকর করলে ফেরেশতাগণ তাদেরকে বেষ্টন করে নেন, রহমত তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল হয় এবং আল্লাহ তাঁর নিকটে যারা আছেন তাদের সাথে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করেন।
মুসলিম, তিরমিযী, ইবন মাজাহ (رحمة الله) ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। এ মর্মে আরো বহু হাদীস রয়েছে।
মুসনাদে ইমাম আহমদ ও সুনানের গ্রন্থ চতুষ্টয়ে আবু দারদা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
وإن الملائكة لتضع أجنحتها لطالب العلم رضا بما يصنع
অর্থাৎ—“ইলম অন্বেষণকারীর কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশের জন্য ফেরেশতাগণ তাদের ডানা বিছিয়ে দেন।" অর্থাৎ তারা তাদের প্রতি বিনয় প্রকাশ করেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ
মমতাবশে তাদের (পিতা-মাতার) জন্য নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত করবে। (১৭ঃ ২৪)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
“যারা তোমার অনুসরণ করে সেসব মুমিনদের প্রতি তুমি বিনয়ী হও।’ (২৬ঃ২১৫)
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
إن لله ملئكة سياحين في الأرض ليبلغوني عن أمتي السلام.
অর্থাৎ আল্লাহর এমন কিছু ফেরেশতা আছেন যারা আমার নিকট আমার উম্মতের সালাম পৌঁছানোর জন্য পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ান।" ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) হাদীসটি ভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
خلقت الملئكة من نور وخلق الجان من مارج من نار وخلق آدم مما وصف لكم
“ফেরেশতাগণকে সৃষ্টি করা হয়েছে নূর থেকে, জিন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে ধোঁয়াবিহীন আগুন থেকে আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা দ্বারা যা তোমাদেরকে বলা হয়েছে।” ইমাম মুসলিম (رحمة الله) ও ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
বলা বাহুল্য যে, ফেরেশতাগণের আলোচনা সম্পর্কিত বিপুল সংখ্যক হাদীস রয়েছে। এখানে আমরা ঠিক ততটুকু উল্লেখ করলাম, যতটুকুর আল্লাহ তাওফীক দান করেছেন। প্রশংসা সব তারই প্রাপ্য।
মানব জাতির উপর ফেরেশতাগণের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে আলিমগণের মতভেদ রয়েছে। কালাম শাস্ত্রের বিভিন্ন কিতাবেই এ মাস’আলাটি বেশি পাওয়া যায়। এ মাস’আলায় মতবিরোধ হলো, মুতাযিলা ও তাদের সমমনা লোকদের সঙ্গে।
এ ব্যাপারে সর্বপ্রাচীন আলোচনা হাফিজ ইবন আসাকির-এর ইতিহাস গ্রন্থে আমি লক্ষ্য করেছি। তিনি উমায়া ইবন আমর ইবন সাঈদ ইবন আস-এর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি একদিন উমর ইবন আবদুল আযীয (رحمة الله)-এর কোন এক মজলিসে উপস্থিত হন। তার নিকট তখন একদল লোক উপস্থিত ছিল। কথা প্রসঙ্গে খলীফা উমর (رضي الله عنه) বললেন, সচ্চরিত্র আদম সন্তান অপেক্ষা আল্লাহর নিকট সম্মানিত আর কেউ নেই এবং নিচের আয়াতটি দ্বারা তিনি প্রমাণ পেশ করেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَٰئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ
অর্থাৎ যারা ঈমান আনে ও সঙ্কর্ম করে তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। (৯৮ঃ ৭)
উমায়া ইবন আমর ইবন সাঈদ (رحمة الله) তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন। শুনে ইরাক ইবন মালিক বললেন, আল্লাহর নিকট তার ফেরেশতাদের চেয়ে সম্মানিত আর কেউ নেই। তারা উভয় জগতের সেবক এবং আল্লাহর নবীগণের নিকট প্রেরিত তার দূত। নিচের আয়াতটি দ্বারা তিনি এর দলীল প্রদান করেন।
مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَٰذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَنْ تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِينَ
অর্থাৎ- পাছে তোমরা ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা তোমরা স্থায়ী হও এ জন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন। (৭ঃ ২০)
তখন উমর ইবন আবদুল আযীয (رحمة الله) মুহাম্মদ ইব্ন কা’ব কুরাযীকে বললেন, হে আবু হামযা! আপনি এ ব্যাপারে কী বলেন? জবাবে তিনি বললেনঃ আল্লাহ আদম (عليه السلام)-কে সম্মানিত করেছেন। তাঁকে তিনি নিজ কুদরতী হাতে সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে রূহ সঞ্চার করেছেন, তাঁর সামনে ফেরেশতাদেরকে সিজদাবনত করিয়েছেন এবং তার সন্তানদের থেকে নবী-রাসূল বানিয়েছেন এবং যাদের কাছে ফেরেশতাগণ সাক্ষাৎ মানসে উপস্থিত হন।
মোটকথা, আবু হামযা (رحمة الله) মূল বিষয়ে উমর ইবন আবদুল আযীয (رحمة الله)-এর সঙ্গে একমত হয়ে ভিন্ন দলীল পেশ করেন এবং আয়াত দ্বারা তিনি যে দলীল পেশ করেছেন তাকে দুর্বল আখ্যা দেন। তাহলোঃ
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ
এ আয়াতের মর্ম হলো, ঈমান ও সৎকর্ম শুধু মানুষেরই বৈশিষ্ট্য নয়। কারণ, আল্লাহ তা’আলা ويومنون به বলে ফেরেশতাগণকেও ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। তদ্রুপ জিন জাতিও ঈমানের গুণে গুণান্বিত। যেমন তারা বলেছিলঃ
وَأَنَّا لَمَّا سَمِعْنَا الْهُدَىٰ آمَنَّا بِهِ
অর্থাৎ—আমরা যখন পথ-নির্দেশক বাণী শুনলাম, তাতে ঈমান আনলাম। (৭২ঃ ১৩)
وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُونَ
অর্থাৎ আমাদের কতক মুসলিম। (৭২ঃ ১৪)
আমার মতে, আবদুল্লাহ ইবন আমর (رضي الله عنه) থেকে উসমান ইবন সাঈদ দারেমী (رحمة الله) কর্তৃক বর্ণিত মারফু হাদীসটি এ মাসআলার সর্বাপেক্ষা উত্তম দলীল এবং হাদীসটি সহীহও বটে। তাহলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা জান্নাত সৃষ্টি করার পর ফেরেশতাগণ বললেনঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্যও এমনটি বানিয়ে দিন, তা থেকে আমরা পানাহার করব। কারণ, আদম সন্তানের জন্য আপনি দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন। জবাবে আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ আমি যাকে আমার নিজ কুদরতী হাতে সৃষ্টি করেছি তার পুণ্যবান সন্তানদেরকে কিছুতেই ওদের ন্যায় করব না, যাকে বলেছি, হও আর সে হয়ে গেছে।’
❏ জিন সৃষ্টি ও শয়তানের কাহিনী
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ * وَخَلَقَ الْجَانَّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ * فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ)
[Surat Ar-Rahman ১৪ - ১৬]
অর্থাৎ মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির মত শুকনো মাটি থেকে এবং জিনকে সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াবিহীন অগ্নিশিখা থেকে। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? (৫৫ঃ ১৪-১৬)
(وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ * وَالْجَانَّ خَلَقْنَاهُ مِنْ قَبْلُ مِنْ نَارِ السَّمُومِ)
[Surat Al-Hijr ২৬ - ২৭]
অর্থাৎ- আমি তো মানুষ সৃষ্টি করেছি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে এবং তার পূর্বে সৃষ্টি করেছি জিন লু-হাওয়ার আগুন থেকে। (১৫ঃ ২৬-২৭)
ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), ইকরিমা, মুজাহিদ ও হাসান (رحمة الله) প্রমুখ বলেন, من مارج من نار অর্থ من طرف اللھب অর্থাৎ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের শীর্ষ প্রান্ত থেকে...। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, من مارج من نار অর্থ من خالصه وأحنه অর্থাৎ তার নির্যাস ও সর্বোত্তম অংশ থেকে...। আর একটু আগে আমরা যুহরী, উরওয়া ও আয়েশা (رضي الله عنه) সূত্রে উল্লেখ করে এসেছি যে, আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “ফেরেশতাকুলকে নূর থেকে এবং জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে সে উপাদান দ্বারা যার বিবরণ তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে। (মুসলিম)
বেশ কিছু তাফসীর বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, জিন জাতিকে আদম (عليه السلام)-এর পূর্বেই সৃষ্টি করা হয়। তাদের পূর্বে পৃথিবীতে হিন ও বিনদের (এরা জিনদেরই একটি সম্প্রদায় বিশেষ) বসবাস ছিল। আল্লাহ তা’আলা জিনদেরকে তাদের উপর বিজয়ী করলে তারা তাদের কতককে হত্যা করে এবং কতককে পৃথিবী থেকে নির্বাসন দেয়। তারপর নিজেরাই সেখানে বসবাস করতে শুরু করে।
সুদ্দী (رحمة الله) তাঁর তাফসীরে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) ও ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) প্রমুখ সাহাবা থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তা’আলা যা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তা সৃষ্টি করা শেষ করে আরশে সমাসীন হন। তারপর ইবলীসকে দুনিয়ার ফেরেশতাদের প্রধান নিযুক্ত করেন। ইবলীস ফেরেশতাদেরই একটি গোত্রভুক্ত ছিল যাদেরকে জিন বলা হতো। তাদেরকে জিন নামে এজন্য অভিহিত করা হতো, কারণ তারা হলো জান্নাতের রক্ষীবাহিনী। ইবলীসও তার ফেরেশতাদের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করত। এক পর্যায়ে তার মনে এভাবের উদয় হয় যে, ফেরেশতাদের উপর আমার শ্রেষ্ঠত্ব আছে বলেই তো আল্লাহ আমাকে এ ক্ষমতা দান করেছেন।
যাহহাক (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, জিনরা যখন পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে ও রক্তপাত করে তখন আল্লাহ্ তা’আলা ইবলীসকে তাদের নিকট প্রেরণ করেন। তার সঙ্গে ছিল ফেরেশতাগণের একটি বাহিনী। তারা কতককে হত্যা করে এবং কতককে পৃথিবী থেকে তাড়িয়ে বিভিন্ন দ্বীপে নির্বাসন দেয়।
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, পাপে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে ইবলীসের নাম ছিল আযাযীল। সে ছিল পৃথিবীর বাসিন্দা। অধ্যবসায় ও জ্ঞানের দিক থেকে ফেরেশতাদের মধ্যে সেই ছিল সকলের সেরা। সে যে সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল তাদেরকে জিন বলা হয়।
ইবন আবু হাতিম (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবলীসের নাম ছিল আযাযীল। চার ডানাবিশিষ্ট ফেরেশতাগণের মধ্যে সে ছিল সকলের সেরা। হাজ্জাজ ও ইবন জুরায়েজের সূত্রে বর্ণিত আছে যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেছেন, ইবলীস গোত্রের দিক থেকে আর সব ফেরেশতার চেয়ে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানিত ছিল। সে ছিল জান্নাতসমূহের রক্ষণাবেক্ষণকারী। তার হাতে ছিল নিম্ন আসমান ও পৃথিবীর কর্তৃত্ব।
সালিহ (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ ইবলীস আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করত। ইবন জারীর এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। কাতাদা (رحمة الله) সাঈদ ইবন মুসায়্যাব (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবলীস নিম্ন আকাশের ফেরেশতাগণের প্রধান ছিল। হাসান বসরী (رحمة الله) বলেন, ইবলীস এক পলকের জন্যও ফেরেশতার দলভুক্ত ছিল না। সে হলো আদি জিন, যেমন আদম হলেন আদি মানব। শাহর ইবন হাওশাব প্রমুখ বলেন, ইবলীস ঐসব জিনের একজন ছিল, যাদেরকে ফেরেশতাগণ বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইবলীসকে কয়েকজন ফেরেশতা বন্দী করে আকাশে নিয়ে যায়। ইবন জারীর (رحمة الله) এ কথাটি বর্ণনা করেছেন।
তাঁরা বলেন, তারপর যখন আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করার সংকল্প করেন, যাতে পৃথিবীতে তিনি এবং পরে তার বংশধরগণ বসবাস করতে পারে এবং তিনি মাটি দ্বারা তার দেহাবয়ব তৈরি করেন, তখন জিনদের প্রধান এবং তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী আযাযীল বা ইবলীস তার চারদিকে ঘুরতে শুরু করে। যখন সে দেখতে পেল যে, তা একটি শূন্য গর্ভ, মূর্তি। তখন সে আঁচ করতে পারল যে, এটি এমন একটি দেহাবয়ব যার আত্মসংযম থাকবে না। তারপর সে বলল, যদি তোমার উপর আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হয় তাহলে অবশ্যই আমি তোমাকে ধ্বংস করব আর যদি আমার উপর তোমাকে ক্ষমতা দেয়া হয়, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাকে অবাধ্যতা করব। তারপর যখন আল্লাহ তা’আলা আদমের মধ্যে তার রূহের সঞ্চার করেন এবং তাঁকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে আদেশ দেন, তখন প্রবল হিংসাবশে ইবলীস তাকে সিজদা করা থেকে বিরত থাকে এবং বলে, আমি তার চাইতে উত্তম। আমাকে তুমি আগুন থেকে সৃষ্টি করেছ। আর তাকে সৃষ্টি করেছ কাদা মাটি থেকে। এভাবে ইবলীস আল্লাহ তা’আলার আদেশ অমান্য করে এবং মহান প্রতিপালকের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলে। সে ভুল যুক্তি প্রদর্শন করে তাঁর প্রতিপালকের রহমত থেকে দূরে সরে যায় এবং ইবাদত করে যে মর্যাদা লাভ করেছিল তা থেকে বিচ্যুৎ হয়। উল্লেখ্য যে, ইবলীস ফেরেশতাগণের মতই ছিল বটে। তবে সে ফেরেশতা জাতিভুক্ত ছিল না। কারণ সে হলো আগুনের সৃষ্টি আর ফেরেশতারা হলেন নূরের সৃষ্টি। এভাবে তার সর্বাধিক প্রয়োজনের মুহূর্তে তার প্রকৃতি তাকে প্রতারিত করে এবং সে তার মূলের দিকে ফিরে যায়।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ. إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ أَنْ يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ.
অর্থাৎ তখন ফেরেশতাগণ সকলেই একত্রে সিজদা করল, কিন্তু ইবলীস করল না। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল। (১৫ঃ ৩০-৩১)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ ۗ أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ ۚ بِئْسَ لِلظَّالِمِينَ بَدَلًا
অর্থাৎ- এবং স্মরণ কর, আমি যখন ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম, আদমের প্রতি সিজদা কর, তখন সকলেই সিজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে জিনদের একজন, সে তার প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল। তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করছ? তারা তো তোমাদের শত্রু। জালিমদের এ বিনিময় কত নিকৃষ্ট! (১৮ঃ ৫০)
অবশেষে ইবলীসকে ঊর্ধ্বজগত থেকে নামিয়ে দেয়া হয় এবং সেখানে কোনরকম বাস করতে পারে এতটুকু স্থানও তার জন্য হারাম করে দেয়া হয়। অগত্যা সে অপদস্থ লাঞ্ছিত ধিকৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় পৃথিবীতে নেমে আসে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে এবং তার অনুসারী জিন ও মানুষের জন্য জাহান্নামের সতর্ক বাণী জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সকল পথে ও ঘাটিতে আদম-সন্তানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োেগ করে চেষ্টা চালায়। যেমন সে বলেছিলঃ
(قَالَ أَرَأَيْتَكَ هَٰذَا الَّذِي كَرَّمْتَ عَلَيَّ لَئِنْ أَخَّرْتَنِ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَأَحْتَنِكَنَّ ذُرِّيَّتَهُ إِلَّا قَلِيلًا * قَالَ اذْهَبْ فَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ فَإِنَّ جَهَنَّمَ جَزَاؤُكُمْ جَزَاءً مَوْفُورًا * وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِمْ بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ وَعِدْهُمْ ۚ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا * إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ ۚ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ وَكِيلًا)
[Surat Al-Isra' ৬২ - ৬৫]
অর্থাৎ- সে বলল, বলুন- তাকে যে আপনি আমার উপর মর্যাদা দান করলেন কেন? কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যদি আমাকে অবকাশ দেন তাহলে আমি অল্প কয়েকজন ব্যতীত তার বংশধরকে কর্তৃত্বাধীন করে ফেলব।
আল্লাহ বললেন, যাও, তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, জাহান্নামই তোমাদের সকলের শাস্তি - পূর্ণ শাস্তি। তোমার আহ্বানে তাদের মধ্যে যাকে পার তুমি পদস্খলিত কর, তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা তাদেরকে আক্রমণ কর এবং ধনে ও সন্তান-সন্তুতিতে শরীক হয়ে যাও এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দাও। শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা ছলনা মাত্র।
আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট। (১৭ঃ ৬২-৬৫)।
পরে আদম (عليه السلام)-এর সৃষ্টির আলোচনায় আমরা কাহিনীটি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করব। সারকথা, জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা আদম সন্তানদের মত পানাহার ও বংশ বিস্তার করে। তাদের কতক ঈমানদার ও কতক কাফির।
যেমন আল্লাহ তা’আলা তাদের সম্পর্কে সূরা আহকাফে বলেনঃ
(وَإِذْ صَرَفْنَا إِلَيْكَ نَفَرًا مِنَ الْجِنِّ يَسْتَمِعُونَ الْقُرْآنَ فَلَمَّا حَضَرُوهُ قَالُوا أَنْصِتُوا ۖ فَلَمَّا قُضِيَ وَلَّوْا إِلَىٰ قَوْمِهِمْ مُنْذِرِينَ * قَالُوا يَا قَوْمَنَا إِنَّا سَمِعْنَا كِتَابًا أُنْزِلَ مِنْ بَعْدِ مُوسَىٰ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ يَهْدِي إِلَى الْحَقِّ وَإِلَىٰ طَرِيقٍ مُسْتَقِيمٍ * يَا قَوْمَنَا أَجِيبُوا دَاعِيَ اللَّهِ وَآمِنُوا بِهِ يَغْفِرْ لَكُمْ مِنْ ذُنُوبِكُمْ وَيُجِرْكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ * وَمَنْ لَا يُجِبْ دَاعِيَ اللَّهِ فَلَيْسَ بِمُعْجِزٍ فِي الْأَرْضِ وَلَيْسَ لَهُ مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءُ ۚ أُولَٰئِكَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ)
[Surat Al-Ahqaf ২৯ - ৩২]
অর্থাৎ স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জিনকে, যারা কুরআন পাঠ শুনছিল, যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হলে তারা একে অপরকে বলতে লাগল, চুপ করে শুন! যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হলো, তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট সতর্ককারীরূপে ফিরে গেল।
তারা বলেছিল, হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শুনে এসেছি যা অবতীর্ণ হয়েছে মূসার পরে, যা তার পূর্ববর্তী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। হে আমাদের সম্প্রদায়! আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, আল্লাহ তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন এবং মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে তোমাদের রক্ষা করবেন।
কেউ যদি আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া না দেয়, তবে সে পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় ব্যর্থ করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না। তারাই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে। (৪৬ঃ ২৯-৩২)
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنَ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا * يَهْدِي إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ ۖ وَلَنْ نُشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَدًا * وَأَنَّهُ تَعَالَىٰ جَدُّ رَبِّنَا مَا اتَّخَذَ صَاحِبَةً وَلَا وَلَدًا * وَأَنَّهُ كَانَ يَقُولُ سَفِيهُنَا عَلَى اللَّهِ شَطَطًا * وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَنْ تَقُولَ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا * وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِنَ الْإِنْسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِنَ الْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًا * وَأَنَّهُمْ ظَنُّوا كَمَا ظَنَنْتُمْ أَنْ لَنْ يَبْعَثَ اللَّهُ أَحَدًا * وَأَنَّا لَمَسْنَا السَّمَاءَ فَوَجَدْنَاهَا مُلِئَتْ حَرَسًا شَدِيدًا وَشُهُبًا * وَأَنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَاعِدَ لِلسَّمْعِ ۖ فَمَنْ يَسْتَمِعِ الْآنَ يَجِدْ لَهُ شِهَابًا رَصَدًا * وَأَنَّا لَا نَدْرِي أَشَرٌّ أُرِيدَ بِمَنْ فِي الْأَرْضِ أَمْ أَرَادَ بِهِمْ رَبُّهُمْ رَشَدًا * وَأَنَّا مِنَّا الصَّالِحُونَ وَمِنَّا دُونَ ذَٰلِكَ ۖ كُنَّا طَرَائِقَ قِدَدًا * وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَنْ نُعْجِزَ اللَّهَ فِي الْأَرْضِ وَلَنْ نُعْجِزَهُ هَرَبًا * وَأَنَّا لَمَّا سَمِعْنَا الْهُدَىٰ آمَنَّا بِهِ ۖ فَمَنْ يُؤْمِنْ بِرَبِّهِ فَلَا يَخَافُ بَخْسًا وَلَا رَهَقًا * وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُونَ وَمِنَّا الْقَاسِطُونَ ۖ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُولَٰئِكَ تَحَرَّوْا رَشَدًا * وَأَمَّا الْقَاسِطُونَ فَكَانُوا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا * وَأَنْ لَوِ اسْتَقَامُوا عَلَى الطَّرِيقَةِ لَأَسْقَيْنَاهُمْ مَاءً غَدَقًا * لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ ۚ وَمَنْ يُعْرِضْ عَنْ ذِكْرِ رَبِّهِ يَسْلُكْهُ عَذَابًا صَعَدًا)
[Surat Al-Jinn ১ - ১৭]
অর্থাৎ- বল, আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে শুনেছে এবং বলেছে, আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি যা সঠিক পথ-নির্দেশ করে, ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকের কোন শরিক স্থির করব না।
এবং নিশ্চয় সমুচ্চ আমাদের প্রতিপালকের মর্যাদা; তিনি গ্রহণ করেননি কোন পত্নী অথবা কোন সন্তান। এবং যে আমাদের মধ্যকার নির্বোধরা আল্লাহর সম্বন্ধে অতি অবাস্তব উক্তি করত, অথচ আমরা মনে করতাম মানুষ এবং জিন আল্লাহ সম্বন্ধে কখনো মিথ্যা আরোপ করবে না।
আর যে কতিপয় মানুষ কতক জিনের শরণ নিত, ফলে তারা জিনদের অহংকার বাড়িয়ে দিত। আর জিনরা বলেছিল, তোমাদের মত মানুষও মনে করে যে, মৃত্যুর পর আল্লাহ কাউকেও পুনরুত্থিত করবেন না।
এবং আমরা চেয়েছিলাম আকাশের তথ্য সংগ্রহ করতে কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিণ্ড দ্বারা আকাশ পরিপূর্ণ; আর পূর্বে আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাটিতে সংবাদ শোনার জন্য বসতাম, কিন্তু এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে তার উপর নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের সম্মুখীন হয়।
আমরা জানি না জগদ্বাসীর অমঙ্গলই অভিপ্রেত, না তাদের পালনকর্তা তাদের মঙ্গল সাধন করার ইচ্ছা রাখেন। এবং আমাদের কতৃক সর্মপরায়ণ এবং কতক তার ব্যতিক্রম, আমরা ছিলাম বিভিন্ন পথের অনুসারী; এখন আমরা বুঝেছি যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাভূত করতে পারব না এবং পলায়ন করেও তাকে ব্যর্থ করতে পারব না।
আমরা যখন পথ-নির্দেশক বাণী শুনলাম তখন তাতে বিশ্বাস স্থাপন করলাম। যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস করে তার কোন ক্ষতি ও কোন অন্যায়ের আশংকা থাকবে না। আমাদের কতক আত্মসমর্পণকারী, এবং কতক সীমালঙ্ঘনকারী। যারা আত্মসমর্পণ করে তারা সুনিশ্চিতভাবে সত্য পথ বেছে লয়। অপরপক্ষে সীমালংঘনকারী তো জাহান্নামেরই ইন্ধন!
তারা যদি সত্য পথে প্রতিষ্ঠিত থাকত তাদেরকে আমি প্রচুর বারি বর্ষণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করতাম, যা দিয়ে আমি তাদেরকে পরীক্ষা করতাম। যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের স্মরণ থেকে বিমুখ হয়, তিনি তাকে দুঃসহ শাস্তিতে প্রবেশ করাবেন। (৭২ঃ ১-১৭)
সূরা আহকাফের শেষে আমরা এ সূরাটির তাফসীর এবং পূর্ণ কাহিনী উল্লেখ করেছি এবং সেখানে এ সংক্রান্ত হাদীসসমূহও উল্লেখ করেছি।
এরা ছিল নসীবীন-এর জিনদের একটি দল। কোন কোন বর্ণনা মতে, তারা ছিল বুসরার জিন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কাভূমির ‘বৎনে নাখলা’য় তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে নামায় পড়ছিলেন। এ সময় তারা তাঁর নিকট দিয়ে অতিক্রমকালে থেমে মনোযোগ সহকারে তার কুরআন তিলাওয়াত শুনতে থাকে। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের নিয়ে সারারাত ধরে বৈঠক করেন। এ সময় তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে তার আদেশ-নিষেধ সংক্রান্ত কিছু বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তারা তাকে খাদ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি তাদেরকে বললেনঃ যেসব হাড়ের উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হবে সেগুলোকে তোমরা গোশতে পরিপূর্ণ পাবে। আর গোবর মাত্রই তোমাদের জীব-জানোয়ারের খাদ্য। আর নবী করীম (ﷺ) এ দুটো বস্তু দ্বারা ইসতিনজা করতে নিষেধ করে বলেছেনঃ এ দু’টো বস্তু তোমাদের ভাইদের (জিনের) খাদ্য এবং রাস্তায় পেশাব করতে তিনি নিষেধ করেছেন। কারণ, তা জিনদের আবাসস্থল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে সূরা আর-রাহমান পাঠ করে শুনান। যখনই তিনি فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (তবে তোমাদের প্রতিপালকের কোন নিয়ামত তোমরা অস্বীকার করবে?) এ আয়াতটি পাঠ করতেন— তারা বলতো ولا بشي من الائك ربنا نكذب فلك الحمد-হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার কোন অবদানই আমরা অস্বীকার করি না। প্রশংসা তো সব তোমারই প্রাপ্য।’
পরবর্তীতে নবী করীম (ﷺ) যখন লোকদেরকে এ সূরাটি পাঠ করে শুনান আর তারা নিশ্চুপ বসে থাকে, তখন তিনি এ ব্যাপারে জিনদের প্রশংসা করে বললেনঃ “উত্তরদানে তারা তোমাদের চেয়ে উত্তম ছিল। যতবারই আমি তাদের নিকট فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ এ আয়াতটি পাঠ করেছি ততবারই তারা বলেছিলঃ ‘হে আমাদের প্রপািলক! তোমার কোন নিয়ামতই আমরা অস্বীকার করি না। প্রশংসা তো সব তোমারই প্রাপ্য। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) যুবায়র (رضي الله عنه) সূত্রে এবং ইবন জারীর (رحمة الله) ও বাযযার (رحمة الله) ইবন উমর (رضي الله عنه) সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
মুমিন জিনদের ব্যাপারে এ মতভেদ আছে যে, তারা কি জান্নাতে প্রবেশ করবে, না কি তাদের পুরস্কার শুধু এ-ই হবে যে, তাদেরকে আগুন দ্বারা শাস্তি দেয়া হবে না। তবে সঠিক কথা হলো, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। কুরআনের বক্তব্যের ব্যাপ্তিই এর প্রমাণ। তাছাড়া আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَان. وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَان.
অর্থাৎ- আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় পোষণ করে তার জন্য আছে দু’টো জান্নাত। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? (৫৫ঃ ৪৬-৪৭)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা জান্নাতের কথা উল্লেখ করে জিনদের প্রতি তার অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কাজেই তারা জান্নাত না পাওয়ার হলে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে নেয়ামত দানের ওয়াদার কথা উল্লেখই করতেন না। এ ব্যাপারে এ দলীলটিই যথেষ্ট।
ইমাম বুখরী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) রাবী আবদুল্লাহকে বলেন, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি ছাগল ও মুক্ত প্রান্তর পছন্দ কর। অতএব, যখন তুমি তোমার বকরীর পালে ও মাঠে-ময়দানে থাকবে, তখন উচ্চৈঃস্বরে আযান দেবে। কারণ জিন, মানুষ ও অন্য বস্তু যে-ই মুআযযিনের শব্দ শুনতে পায়, কিয়ামতের দিন সে-ই তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) বলেন, এ কথাটি আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে শুনেছি। (বুখারী)
পক্ষান্তরে জিনদের মধ্যে যারা কাফির, শয়তান এদেরই অন্তর্ভুক্ত। আর তাদের প্রধান নেতা হলো মানব জাতির আদি পিতা আদম (عليه السلام)-এর শত্রু ইবলীস। আল্লাহ তা’আলা তাকে এবং তার বংশধরকে আদম (عليه السلام) ও তার বংশধরের উপর ক্ষমতা দান করেছেন এবং যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে, তাঁর রাসূলগণকে বিশ্বাস করবে ও তাঁর শরীয়াতের অনুসরণ করবে; তিনি তাদের হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ ۚ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ وَكِيلًا
অর্থাৎ- আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট। (১৭ঃ ৬৫)
অন্য আয়াতে তিনি বলেনঃ
(وَلَقَدْ صَدَّقَ عَلَيْهِمْ إِبْلِيسُ ظَنَّهُ فَاتَّبَعُوهُ إِلَّا فَرِيقًا مِنَ الْمُؤْمِنِينَ * وَمَا كَانَ لَهُ عَلَيْهِمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ يُؤْمِنُ بِالْآخِرَةِ مِمَّنْ هُوَ مِنْهَا فِي شَكٍّ ۗ وَرَبُّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ حَفِيظٌ)
[Surat Saba' ২০ - ২১]
অর্থাৎ তাদের সম্বন্ধে ইবলীস তার ধারণা সত্য প্রমাণ করল। ফলে তাদের মধ্যে একটি মু’মিন দল ব্যতীত সকলেই তার অনুসরণ করল; তাদের উপর শয়তানের কোন আধিপত্য ছিল না। কারা আখিরাতে বিশ্বাসী এবং কারা তাতে সন্দিহান তা প্রকাশ করে দেয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। তোমার প্রতিপালক সর্ববিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক (৩৪ঃ ২০-২১)
অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(يَا بَنِي آدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْآتِهِمَا ۗ إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ۗ إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ) [Surat Al-A'raf ২৭]
হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রলুব্ধ না করে, যেভাবে অর্থাৎ তোমাদের পিতা-মাতাকে সে জান্নাত থেকে বহিস্কৃত করেছিল, তাদের লজ্জাস্থান দেখার জন্য বিবস্ত্র করেছিল। সে নিজে এবং তার দলবল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না, যারা ঈমান আনে না শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।
মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
(وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ * فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ * فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ * إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ أَنْ يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ * قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا لَكَ أَلَّا تَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ * قَالَ لَمْ أَكُنْ لِأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ * قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ * وَإِنَّ عَلَيْكَ اللَّعْنَةَ إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ * قَالَ رَبِّ فَأَنْظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ * قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِينَ * إِلَىٰ يَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ * قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ * إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ * قَالَ هَٰذَا صِرَاطٌ عَلَيَّ مُسْتَقِيمٌ * إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ إِلَّا مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِينَ * وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمَوْعِدُهُمْ أَجْمَعِينَ * لَهَا سَبْعَةُ أَبْوَابٍ لِكُلِّ بَابٍ مِنْهُمْ جُزْءٌ مَقْسُومٌ)
[Surat Al-Hijr ২৮ - ৪৪]
অর্থাৎ-স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করছি। তারপর যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তার মধ্যে আমার রূহ সঞ্চার করব তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো।
তখন ফেরেশতাগণ সকলেই সিজদা করল কিন্তু ইবলীস করল না, সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল। আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! তোমার কি হলো যে, তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলে না।
সে বলল, আপনি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আমি তাকে সিজদা করবার নই। তিনি বললেন, তবে তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, কারণ তুমি বিতাড়িত এবং কর্মফল দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি রইল লা’নত।
সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন। তিনি বললেন, যাদেরকে অবকাশ দেওয়া হয়েছে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হলে, অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত।
সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে বিপথগামী করলেন তজ্জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপ কর্মকে শোভন করে তুলব এবং আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করব, তবে তাদের মধ্যে তোমার নির্বাচিত বান্দাদেরকে নয়।
আল্লাহ বললেন, এটাই আমার নিকট পৌঁছানোর সরল পথ, বিভ্রান্তদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে তারা ব্যতীত আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা থাকবে না। অবশ্যই তোমার অনুসারীদের সকলেরই নির্ধারিত স্থান হবে জাহান্নাম; তার সাতটি দরজা আছে— প্রতি দরজার জন্য পৃথক পৃথক দল আছে। (১৫ঃ ২৮-৪৪)
এ কাহিনী আল্লাহ্ তা’আলা সূরা বাকারা, আরাফ, ইসরা, তা-হা ও সা’দ-এ উল্লেখ করেছেন। আমার তাফসীরের কিতাবে যথাস্থানে সে সব বিষয়ে আমি আলোচনা করেছি। সকল প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য। আর আদম (عليه السلام)-এর কাহিনীতে ও তা উপস্থাপন করব, ইনশাআল্লাহ।
মোটকথা, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য ইবলীসকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ প্রদান করেন।
যেমন আল্লাহ বলেনঃ
وَمَا كَانَ لَهُ عَلَيْهِمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ يُؤْمِنُ بِالْآخِرَةِ مِمَّنْ هُوَ مِنْهَا فِي شَكٍّ ۗ وَرَبُّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ حَفِيظٌ
অর্থাৎ তাদের উপর শয়তানের কোন আধিপতা ছিল না। কারা আখিরাতে বিশ্বাসী এবং কারা তাতে সন্দিহান তা প্রকাশ করে দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। তোমার প্রতিপালক সর্ব বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক। (৩৪ঃ ২১)
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
(وَقَالَ الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الْأَمْرُ إِنَّ اللَّهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدْتُكُمْ فَأَخْلَفْتُكُمْ ۖ وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا أَنْ دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي ۖ فَلَا تَلُومُونِي وَلُومُوا أَنْفُسَكُمْ ۖ مَا أَنَا بِمُصْرِخِكُمْ وَمَا أَنْتُمْ بِمُصْرِخِيَّ ۖ إِنِّي كَفَرْتُ بِمَا أَشْرَكْتُمُونِ مِنْ قَبْلُ ۗ إِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ * وَأُدْخِلَ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ ۖ تَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ)
[Surat Ibrahim ২২ - ২৩]
অর্থাৎ যখন সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে, আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি। আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি। আমার তো তোমাদের উপর কোন আধিপত্য ছিল না, আমি কেবল তোমাদেরকে আহ্বান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করো না, তোমরা নিজেদের প্রতি দোষারোপ কর। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্য করতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরীক করেছিলে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। জালিমদের জন্য তো মর্মস্তুদ শাস্তি আছেই। যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের দাখিল করা হবে জান্নাতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা স্থায়ী হবে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। সেখানে তাদের অভিবাদন হবে সালাম। (১৪ঃ ২২-২৩)
ফলকথা, কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী ইবলীস এখনো জীবিত এবং কিয়ামতের দিন পর্যন্ত অবকাশপ্রাপ্ত। তার প্রতি আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হোক। সমুদ্র পৃষ্ঠে তার একটি সিংহাসন আছে আর তাতে সমাসীন হয়ে সে তার বাহিনী প্রেরণ করে, যারা মানুষের মাঝে অনিষ্ট করে এবং বিপর্যয় বাঁধায়। তবে আল্লাহ্ তা’আলা আগেই বলে রেখেছেনঃ
إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا
শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল। (৪ঃ ৭৬)
মহাপাপের আগে ইবলীসের নাম ছিল আযাযীল। নাক্কাশ বলেন, তার উপনাম হলো আবু কারদূস। আর এ জন্যই নবী করীম (ﷺ) যখন ইব্ন সায়াদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি দেখতে পাও? সে বলেছিল, আমি পানির উপর একটি সিংহাসন দেখতে পাই। তখন নবী করীম (ﷺ) তাকে বলেছিলেন, “তুই লাঞ্ছিত হ, তুই কিছুতেই তোর নির্ধারিত সীমা ডিংগাতে পারবি না।’ মোটকথা, নবী করীম (ﷺ) এ কথা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার ভবিষ্যদ্বাণীসমূহের শক্তি হলো সেই শয়তানের প্রদত্ত। যার সিংহাসন সমুদ্রের উপর বিছানো বলে সে দেখে থাকে। আর এজন্যই নবী করীম (ﷺ) বলেছিলেন, তুই লাঞ্ছিত হ। কিছুতেই তুই তোর সীমা ডিংগাতে পারবি না। অর্থাৎ কোন রকমেই তুই তোর হীন ও তুচ্ছ মর্যাদা অতিক্রম করতে পারবি না।
ইবলীসের সিংহাসন সমুদ্রের উপর অবস্থিত হওয়ার প্রমাণ হলো, ইমাম আহমদ (رحمة الله)-এর হাদীস। তাতে জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ ইবলীসের সিংহাসন হলো সমুদ্রের উপর। প্রত্যহ সে তার বিভিন্ন বাহিনী প্রেরণ করে, যারা মানুষের মধ্যে হাঙ্গামা সৃষ্টি করে থাকে। মানুষের জন্য সেরা ফেতনা সৃষ্টি করে যে অনুচর, ইবলীসের নিকট মর্যাদায় সে সকলের চাইতে সেরা।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, জাবির ইবন আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, ইবলীসের সিংহাসন হলো সমুদ্রের উপর। সে তার বাহিনীসমূহ প্রেরণ করে, যারা জনসমাজে হাঙ্গামা সৃষ্টি করে বেড়ায়। ফেতনা সৃষ্টিতে যে তাদের সেরা, তার কাছে সে-ই সকলের বড়। এ সূত্রে ইমাম আহমদ (رحمة الله) এককভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
জাবির ইবন আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) সূত্রে ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইবন সায়াদকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী দেখতে পাও? সে বলল, আমি পানির উপর কিংবা (বলল) সমুদ্রের উপর একটি সিংহাসন দেখতে পাচ্ছি, যার আশেপাশে আছে কয়েকটি সাপ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ওটাই ইবলীসের সিংহাসন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) ‘মুসনাদে আবু সাঈদ’-এ বর্ণনা করেন যে, আবু সাঈদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইবন সায়াদকে বললেন, তুমি কী দেখতে পাচ্ছ? ইবন সায়াদ বলল, আমি সমুদ্রের উপর একটি সিংহাসন দেখতে পাচ্ছি, যার আশেপাশে আছে সর্পরাজি। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ ও যথার্থ বলেছে। ওটাই ইবলীসের সিংহাসন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, জাবির (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “শয়তান এ ব্যাপারে নিরাশ যে, সালাত আদায়কারীরা তার ইবাদত করবে। কিন্তু পরস্পরে বিভেদ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা তার অব্যাহত রয়েছে।”
ইমাম মুসলিম (رحمة الله) জাবির (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণিত আ’মাশের হাদীস থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (ﷺ) বলেন : “শয়তান তার সিংহাসনকে পানির উপর স্থাপন করে। তারপর জনসমাজে তার বাহিনীসমূহ প্রেরণ করে। তার দৃষ্টিতে ফেতনা সৃষ্টি করায় যে যত বড়, মর্যাদায় সে তার তত বেশি নৈকট্যের অধিকারী। তাদের কেউ একজন আসে আর বলে যে, আমি অমুকের পেছনে লেগেই থাকি। অবশেষে তাকে এমন অবস্থায় রেখে এসেছি যে, সে এমন এমন জঘন্য কথা বলে বেড়াচ্ছে। একথা শুনে ইবলীস বলে না, আল্লাহর শপথ! তুমি কিছুই করনি। আবার আরেকজন এসে বলে- আমি অমুক ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়েই তবে ছেড়েছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, একথা শুনে শয়তান তাকে কাছে টেনে আনে আর বলে, نعم أنت কত উত্তম কাজই না তুমি করেছো! এক বর্ণনায় نعم -এর নূনকে ফাতহা দ্বারা পড়া হয়েছে। যার অর্থ نعم أنت ذلك الذي تستحق الإكرام অর্থাৎ তুমি মর্যাদা পাওয়ার উপযুক্ত বটে! আবার কাসরা দ্বারা পড়ার কথাও আছে।
আমাদের শায়খ আবুল হাজ্জাজ প্রথমটিকে সমর্থন করে তাঁকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
এ হাদীসটি আমরা ما يقرفو به بين المرءو زوجه আয়াতের ব্যাখ্যায় এনেছি। আয়াতটির অর্থ হলো, শয়তানদের থেকে লব্ধ যাদু-মানুষ-শয়তান হোক বা জিন শয়তান—দুই পরম আপনজনের মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি হওয়াই তার পরিণতি। এজন্যই শয়তান সে ব্যক্তির চেষ্টা-সাধনায় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে থাকে, যার দ্বারা এ কাজ সাধিত হয়। মোটকথা, আল্লাহ যাকে নিন্দা করেছেন, ইবলীস করে তার প্রশংসা এবং যার প্রতি আল্লাহ হন রুষ্ট, শয়তান হয় তার প্রতি প্রসন্ন। তার প্রতি আল্লাহর লা’নত!
এদিকে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন প্রকার অনিষ্ট—সেগুলোর মাধ্যমসমূহ এবং সেগুলোর অশুভ পরিণাম থেকে রক্ষার উপায় হিসেবে ফালাক ও নাস দু’টো সূরা নাযিল করেছেন। বিশেষত সূরা নাস যার মর্ম হলোঃ
“বল, আমি শরণ নিচ্ছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধিপতির, মানুষের ইলাহের নিকট আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, জিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে।" (১১৪ঃ ১-৬)
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আনাস (رضي الله عنه) সূত্রে এবং সহীহ বুখারীতে হুসায়ন কন্যা সাফিয়া (رحمة الله) সূত্রে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, শয়তান আদম সন্তানের শিরায় শিরায় চলাচল করে থাকে।
হাকিম আবু ইয়ালা আল-মুসিলী বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ শয়তান আদম সন্তানের হৃৎপিণ্ডের উপর তার নাকের অগ্রভাগ স্থাপন করে আছে। যদি আদম সন্তান আল্লাহকে স্মরণ করে তাহলে শয়তান পিছিয়ে যায়। আর যদি সে আল্লাহকে বিস্মৃত হয়, তাহলে শয়তান তার হৃদয়কে কব্জা করে নেয়। এটাই হলো, الوسواس الخناس বা আত্মগোপনকারীর কুমন্ত্রণা। উল্লেখ্য, যেভাবে আল্লাহর (মৌখিক) যিকর অন্তর থেকে শয়তানকে বিতাড়িত করে, ঠিক সেভাবে তা মানুষকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ভুলে যাওয়া ব্যক্তিকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَاذْكُرْ رَبَّكَ إِذَا نَسِيتَ
“যদি তুমি ভুলে যাও, তবে তোমার প্রতিপালককে স্মরণ করবে। (১৮ঃ ২৪)
আবার মূসা (عليه السلام)-এর সঙ্গী তাকে বলেছিলেনঃ
وَمَا أَنْسَانِيهُ إِلَّا الشَّيْطَانُ أَنْ أَذْكُرَهُ
অর্থাৎ শয়তানই তার কথা বলতে আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। (১৮ঃ ৬৩)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
فَأَنْسَاهُ الشَّيْطَانُ ذِكْرَ رَبِّهِ
অর্থাৎ- শয়তান তাকে তার প্রভুর নিকট তার বিষয় বলার কথা ভুলিয়ে দিল (১২ঃ ৪২)
অর্থাৎ ইউসুফ (عليه السلام) যখন সাকীকে বলেছিলেন যে, তুমি তোমার মনিবের নিকট আমার কথা বলবে, সে তার মনিব বাদশাহর নিকট তা বলতে ভুলে গিয়েছিল। আর এ ভুলে যাওয়াটা ছিল শয়তানের পক্ষ থেকে। ফলে ইউসুফ (عليه السلام) কয়েক বছর কারাগারে অবরুদ্ধ থাকেন। এ জন্যই আল্লাহ তা’আলা পরে বলেনঃ
وَقَالَ الَّذِي نَجَا مِنْهُمَا وَادَّكَرَ بَعْدَ أُمَّةٍ
অর্থাৎ- দু’জন কারাবন্দীর মধ্যে যে মুক্তি পেয়েছিল এবং দীর্ঘকাল পরে যার স্মরণ হলো সে বলল, .....। (ইউসুফঃ ৪৫)।
بعد امة অর্থাৎ দীর্ঘকাল পরে। আবার কেউ কেউ بعد امة এর অর্থ করেছেন بعد نسيان অর্থাৎ ভুলে যাওয়ার পর। আর এই যে আমরা বললাম, সে লোকটি ভুলে গিয়েছিল; সে হলো সাকী; দু’অভিমতের মধ্যে এটাই সঠিক কথা। তাফসীরে আমরা একে সপ্রমাণ বর্ণনা করেছি। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আসিম (رحمة الله) বলেন যে, আমি আবু তামীমা (رحمة الله) কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সওয়ারীতে তার পেছনে উপবেশনকারী এক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করতে শুনেছি যে, একদিন নবী করীম (ﷺ)-কে নিয়ে তার গাধা হোঁচট খায়। তখন আমি বললাম, শয়তান বদনজর করেছে। আমার একথা শুনে নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ শয়তান বদনজর করেছে, বলো না। কেননা, যখন তুমি বলবে শয়তান বদনজর করেছে; তখন সে গর্বিত হয়ে যাবে আর বলবে; আমার শক্তি দ্বারা আমি তাকে ধরাশায়ী করেছি। আর যখন তুমি বলবে, ‘বিসমিল্লাহ্’ তখন ছোট হতে হতে সে মাছির ন্যায় হয়ে যায়। এ হাদীসটি কেবল ইমাম আহমদই বর্ণনা করেছেন। এর সনদ উত্তম।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের কেউ মসজিদে এলে শয়তান মানুষকে এভাবে বশীভূত করে, যেভাবে কেউ তার বাহনকে শান্ত করে একান্তে বসার ন্যায়, তারপর তাকে লাগাম পরিয়ে দেয়।
আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, লক্ষ্য করলে তোমরা তা দেখতে পাবে। শয়তান যাকে কোণঠাসা করে, দেখবে সে নত হয়ে কেবল আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকে। আর যাকে লাগাম পরায় সে মুখ খুলে হা করে বসে থাকে আল্লাহর যিকর করে না। ইমাম আহমদ (رحمة الله) এককভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “বদনজর যে হয়ে থাকে তা সত্য। তাতে শয়তান ও বনী আদমের হিংসা বিদ্যমান থাকে।"
তার আরেক বর্ণনায় আছে যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বললঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মনে এমন এমন কল্পনা জাগ্রত হয় যে, তা ব্যক্ত করার চাইতে আকাশ থেকে পড়ে যাওয়াই আমার নিকট শ্রেয় মনে হয়। শুনে নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ “আল্লাহু আকবার। সমস্ত প্রশংসা সে আল্লাহর যিনি শয়তানের চক্রান্তকে কুমন্ত্রণায় পরিণত করে দিয়েছেন।”
ইমাম আবু দাউদ ও নাসাঈ (رحمة الله) মানসূর-এর হাদীস থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। নাসাঈ এবং আমাশ হযরত আবু যর (رضي الله عنه) সূত্রেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “শয়তান তোমাদের এক একজনের কাছে এসে বলে, এটা কে সৃষ্টি করেছে, ওটা কে সৃষ্টি করেছে? শেষ পর্যন্ত বলে যে, তোমার রবকে কে সৃষ্টি করেছে? সুতরাং কেউ এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে যেন সে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং এখানেই ক্ষান্ত দেয়। ইমাম মুসলিম (رحمة الله) লায়ছ, যুহরী ও হিশামের হাদীস থেকে, পরের দুজন উরওয়া থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ
অর্থাৎ- যারা তাকওয়ার অধিকারী হয় তাদেরকে শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আত্মসচেতন হয় এবং তৎক্ষণাৎ তাদের চোখ খুলে যায়। (৭ঃ ২০১ )
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(وَقُلْ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ * وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونِ)
[Surat Al-Mu'minun ৯৭ - ৯৮]
অর্থাৎ- বল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি শয়তানের প্ররোচনা থেকে। হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার নিকট তাদের উপস্থিতি থেকে। (২৩ঃ ৯৭-৯৮)
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ ۚ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
অর্থাৎ- যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তবে আল্লাহর শরণ নেবে, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (৭ঃ ২০০)
আরেক জায়গায় তিনি বলেনঃ
(فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ * إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ * إِنَّمَا سُلْطَانُهُ عَلَى الَّذِينَ يَتَوَلَّوْنَهُ وَالَّذِينَ هُمْ بِهِ مُشْرِكُونَ)
[Surat An-Nahl ৯৮ - ১০০]
অর্থাৎ যখন তুমি কুরআন পাঠ করবে তখন অভিশপ্ত শয়তান থেকে তুমি আল্লাহর শরণ নেবে। যারা ঈমান আনে ও তাদের প্রতিপালকেরই উপর নির্ভর করে তাদের উপর তার আধিপত্য নেই। তার আধিপত্য তো কেবল তাদেরই উপর যাকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে এবং যারা আল্লাহর শরীক করে। (১৬ঃ ৯৮ - ১০০)
ইমাম আহমদ (رحمة الله) ও সুনান সংকলকগণ আবূ সাঈদ (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণিত আবুল মুতাওয়াক্কিল-এর হাদীস থেকে বর্ণনা করেন যে, আবু সাঈদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতেনঃ
اعوذ با لله السميع العليم من الشيطان الرجيم من همزه ونفخه ونفثه .
অর্থাৎ- আমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তানের হামায, নাফাখ ও নাফাছ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।
জুবায়র ইবন মুতইম, আবুল্লাহ ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) এবং আবু উমামা বাহিলীর বর্ণনা থেকেও এরূপ পাওয়া যায়। আর হাদীসে এর এরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, অর্থ হচ্ছে শয়তান কর্তৃক শ্বাসরুদ্ধকরণ বা কাবু করা; তার অহংকার আর তার কাব্য।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন শৌচাগারে প্রবেশ করতেন তখন তিনি বলতেনঃ
اعوذ با لله من الخبث والخبائث.
অর্থাৎ- “আমি আল্লাহর নিকট خبث ও خبئث থেকে আশ্রয় চাই।" বহু সংখ্যক আলিম বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুরুষ শয়তনি ও মহিলা শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। (অর্থাৎ তাদের মতে خبث অর্থ পুরুষ শয়তানের দল ও خبئث অর্থ মহিলা শয়তানের দল)।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ কেউ পায়খানায় গেলে সে যেন আড়াল করে নেয়। যদি সে মাটিকে স্তুপীকৃত করা ব্যতীত অন্য কিছু না পায় তবে যেন তা-ই করে তা পেছনে রেখে বসে। কারণ, শয়তান আদম সন্তানের নিতম্ব নিয়ে খেলা করে। যে ব্যক্তি এরূপ করে সে ভালো করবে আর একান্ত তা না পারলে ক্ষতি নেই। ইমাম আবু দাউদ ও ইবন মাজাহ্ ছাওর ইবন য়াযীদ-এর হাদীস থেকে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, সুলায়মান ইবন সুরাদ বলেছেন, নবী করীম (ﷺ) -এর দরবারে দু’জন লোক একে অপরকে গালাগাল করে। আমরা তখন তাঁর নিকট বসা ছিলাম। দেখলাম, ওদের একজন তার সঙ্গীকে এমন রাগান্বিত হয়ে গালাগাল করছে যে, তার চেহারা লাল হয়ে গেছে। তা দেখে নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ আমি অবশ্য এমন একটি কথা জানি, যদি সে তা বলে তাহলে তার রাগ দূরীভূত হবে। যদি সে বলেঃ
أعوذ با لله من الشيطان الرجيم
‘আমি বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই।’ একথা শুনে উপস্থিত লোকজন লোকটিকে বলল, তুমি কি শুনছ না নবী করীম (ﷺ) কি বলছেনঃ উত্তরে সে বলল, ‘আমি পাগল নই।’ ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ এবং নাসাঈও আমাশ থেকে বিভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন উমর (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যেন বাম হাতে পানাহার না করে। কারণ শয়তান বাম হাতে পানাহার করে থাকে।’ এ সনদে এটা ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ। আর সহীহ বুখারীতে এ হাদীসটি অন্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি তার বাম হাতে আহার করে, তার সঙ্গে শয়তান আহার করে আর যে ব্যক্তি তার বাম হাতে পান করে শয়তানও তার সঙ্গে পান করে।"
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু যিয়াদ তাহহান (رحمة الله) বলেন, আমি আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه)-কে বলতে শুনেছি যে, নবী করীম (ﷺ) এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে পান করতে দেখে তাকে বললেনঃ বমি কর। লোকটি বলল, কেন? নবী করীম (ﷺ) বললেন, তুমি কি এতে খুশী হবে যে, তোমার সঙ্গে বিড়াল পান করুক? সে বলল, জ্বী না। তখন নবী করীম (ﷺ) বললেনঃ কিন্তু তোমার সঙ্গে তো এমন এক প্রাণী পান করেছে, যে বিড়ালের চাইতেও নিকৃষ্ট অর্থাৎ শয়তান। এ সূত্রে ইমাম আহমদ (رحمة الله) এককভাবেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
তিনি আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে আরও বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে পান করে, যদি সে জানত তার পেটে কি আছে, তাহলে অবশ্যই সে ইচ্ছে করে বমি করত।’ এ হাদীসটি ভিন্ন সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র জাবির (رضي الله عنه)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আপনি কি নবী করীম (ﷺ)-কে একথা বলতে শুনেছেন যে, মানুষ ঘরে প্রবেশকালে এবং আহারের সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বললে শয়তান তার সঙ্গীদেরকে বলে, এখানে তোমাদের থাকাও নেই, খাবারও নেই। আর প্রবেশকালে বিসমিল্লাহ না বললে শয়তান বলে, তোমরা রাত যাপনের জায়গা পেয়ে গেছ এবং আহারের সময় ‘বিসমিল্লাহ না বললে শয়তান বলে, তোমরা রাত যাপনের জায়গা এবং রাতের খাবার পেয়ে গেছ? জবাবে জাবির (رضي الله عنه) বললেন, হ্যাঁঁ।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন উমর (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ সূর্যোদয়কালে যখন তার প্রান্তদেশ দেখা যায়, তখন পুরোপুরি তা উদিত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা সালাত স্থগিত রাখ এবং যখন সূর্য অস্ত যেতে থাকে তা পুরোপুরি না ডুবা পর্যন্ত সালাত স্থগিত রাখ। আর সূর্যের উদয় ও অস্তকে তোমরা নামাযের সময় সাব্যস্ত করো না। কারণ সুর্য শয়তানের দু’ শিং-এর মধ্যবর্তী স্থানে উদিত হয়ে থাকে। ইমাম মুসলিম এবং নাসাঈও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইব্ন উমর (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখেছি যে, তিনি পূর্বদিকে ইশারা করে বলেছিলেনঃ শুনে রেখ, ফেতনা এখানে, ফেতনা এখানে, যেখান থেকে শয়তানের শিং আত্মপ্রকাশ করে থাকে।
আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ শরীফে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রৌদ্র ও ছায়ার মাঝখানে বসতে নিষেধ করে বলেছেন; তা হলো শয়তানের মজলিস। হাদীস বিশারদগণ এর কয়েকটি অর্থের উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে সর্বোত্তম হলো এই যে, যেহেতু অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, এরূপ স্থানে বসলে অঙ্গ সৌষ্ঠব নষ্ট হয়, তাই শয়তান তা পছন্দ করে। কেননা, তার নিজের অবয়বই কুৎসিত। আর এটা সর্বজন বেদিত।
এজন্যই আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃطَلْعُهَا كَأَنَّهُ رُءُوسُ الشَّيَاطِينِ
অর্থাৎ তার (জাহান্নামের তলদেশ থেকে উদ্গত যাক্কুম বৃক্ষের) মোচা যেন শয়তানের মাথা। (৩৭ঃ ৬৫)
সঠিক কথা হলো, আয়াতে শয়তান বলতে শয়তানই বুঝানো হয়েছে- এক শ্রেণীর গাছ নয় যেমন কোন কোন তাফসীরবিদের ধারণা। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। কেননা, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষের মনে এ বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে, শয়তান কদর্যতার এবং ফেরেশতাগণ সৌন্দর্যের আধার।
আর এজন্যই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ طَلْعُهَا كَأَنَّهُ رُءُوسُ الشَّيَاطِينِ তার মোচা যেন শয়তানের মাথা।
পক্ষান্তরে ইউসুফ (عليه السلام)-এর রূপ দেখে মহিলাগণ বলেছিলোঃ
حَاشَ لِلَّهِ مَا هَٰذَا بَشَرًا إِنْ هَٰذَا إِلَّا مَلَكٌ كَرِيمٌ
অর্থাৎ-অদ্ভুত আল্লাহর মাহাত্ম্য! এতো মানুষ নয় এতো এক মহিমান্বিত ফেরেশতা। (১২ঃ ৩১)
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, জাবির (رضي الله عنه) বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ “রাত যখন ছায়াপাত করে তখন তোমরা তোমাদের শিশু-কিশোরদেরকে ঘরে আটকে রাখবে। কারণ শয়তানগণ এ সময়ে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর রাতের কিছু সময় পার হয়ে গেলে তাদেরকে ছেড়ে দেবে এবং দরজা বন্ধ করে আল্লাহর নাম নেবে। বাতি নিভিয়ে দেবে ও আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে, পানপাত্রের মুখ বেঁধে রাখবে ও আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে এবং বরতন ঢেকে রাখবে ও আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে। তার উপর কিছু একটা ফেলে রেখে হলেও তা করবে।”
ইমাম আহমদ (رحمة الله) ইয়াহয়া ও ইব্ন জুরায়জের সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় আছে فان الشيطان لا يفتع مغلقا শয়তান বন্ধ জিনিস খুলতে পারে না।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, জাবির (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “তোমরা তোমাদের দরজাগুলো বন্ধ করে দাও, বরতনগুলো ঢেকে রাখ, পানপাত্রগুলোর মুখ বেঁধে রাখ এবং বাতিগুলো নিভিয়ে দাও। কারণ শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারে না, ঢাকনা উন্মুক্ত করে না এবং বন্ধন খুলে না, আর ইদুর তো বসবাসকারীদেরসহ ঘরে আগুনই ধরিয়ে দেয়।”
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ আপন স্ত্রীগমনকালে তোমাদের কেউ যদি বলেঃ
اللهم جنبنا الشيطان وجنب الشيطان مارزقتنی
“হে আল্লাহ! আমাদেরকে তুমি শয়তান থেকে দূরে রাখ এবং আমাকে তুমি যা দান করেছ, তা থেকে শয়তানকে দূরে রাখ।’ তাহলে এ মিলনে তাদের কোন সন্তান জন্মালে শয়তান তার ক্ষতি করতে পারে না এবং তার উপর তার আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না।
হাদীসটি ভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আরেকটি রিওয়ায়তে ঈষৎ পরিবর্তনসহ উক্ত দু’আর পূর্বে বিসমিল্লাহ শব্দটি অতিরিক্ত এসেছে। ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “তোমাদের কেউ ঘুমালে শয়তান তার মাথার পশ্চাদ্ভাগে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতিটি গিট দেওয়ার সময় সে বলে, দীর্ঘ রাত আছে তুমি ঘুমাও! যদি সে জেগে ওঠার পর আল্লাহকে স্মরণ করে, তাহলে একটি গিট খুলে যায়। তারপর যদি ওযু করে তাহলে আরেকটি গিট খুলে যায়। তারপর যদি সে সালাত আদায় করে তাহলে সবকটি গিটই খুলে যায়। ফলে সে প্রফুল্ল ও প্রশান্ত চিত্তে সকালে ওঠে। অন্যথায় সে সকালে ওঠে কলুষিত মন ও অলস দেহ নিয়ে।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যখন তোমাদের কেউ ঘুম থেকে জেগে ওঠে এবং ওযূ করতে যায় তখন সে যেন তিনবার পানি নিয়ে নাক ঝেড়ে নেয়। কেননা, শয়তান তার নাকের ছিদ্রে রাতযাপন করে থাকে।
ইমাম মুসলিম এবং ইমাম নাসাঈ ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আলোচনা হলো যে, এক ব্যক্তি সারারাত নিদ্রা যায়। তারপর ভোর হলে জাগ্রত হয়। শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, লোকটির দু’কানে তো শয়তান পেশাব করে দিয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দু’ কানে বললেন, নাকি শুধু কানে বললেন—এ ব্যাপারে রাবী সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ইমাম মুসলিম, ইমাম বুখারী, নাসাঈ এবং ইবন মাজাহ্ ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “যখন নামাযের আযান দেওয়া হয়, তখন শয়তান বায়ু নিঃসরণ করতে করতে পিছু হটে যায়। আযান শেষ হয়ে গেলে আবার এসে পড়ে। তারপর ইকামতকালে শয়তান আবার হটে যায়। ইকামত শেষ হয়ে গেলে আবার এসে সে মানুষ ও তার অন্তরের মাঝে অবস্থান নেয় এবং বলতে শুরু করে যে, তুমি এটা স্মরণ কর, ওটা স্মরণ কর। শেষ পর্যন্ত লোকটি ভুলেই যায় যে, সে নামায তিন রাকআত পড়ল, নাকি চার রাকআত। তারপর তিন রাকআত পড়ল, নাকি চার রাকআত পড়ল তা নির্ণয় করতে না পেরে দুটি সিজদা সাহু করে নেয়।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “তোমরা (নামাযের) সারিগুলো ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট করে নাও। কারণ শয়তান ফাঁকে দাঁড়িয়ে যায়।”
আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতেনঃ তোমরা সারিগুলো ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট করে নাও, এক সারিকে আরেক সারির কাছাকাছি করে নাও এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাও। যে সত্তার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, তাঁর শপথ! নিঃসন্দেহে আমি দেখতে পাচ্ছি যে, শয়তান সারির ফাঁকা জায়গায় ঢুকে পড়ে, যেন সে একটি পাখি।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু সাঈদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “তোমাদের কারো সম্মুখ দিয়ে কোন কিছু অতিক্রম করলে, যেন সে তাকে বাধা দেয়। যদি সে অগ্রাহ্য করে তাহলে যেন আবারও বাধা দেয়। এবারও যদি অগ্রাহ্য করে, তাহলে যেন সে তার সঙ্গে লড়াই করে। কারণ সে আস্ত শয়তান।” মুসলিম এবং আবূ দাউদ (رحمة الله)-ও ভিন্ন সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবূ উবায়দ (رحمة الله) বলেন, আমি আতা ইব্ন য়াযীদ লায়ছী (رحمة الله)-কে দেখলাম যে, তিনি দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন। তারপর আমি তাঁর সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করতে চাইলে তিনি আমাকে ফিরিয়ে দেন। পরে তিনি বললেন, আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন ফজর নামায আদায় করছিলেন আর তিনি [আবু সাঈদ (رضي الله عنه)] তাঁর পেছনে কিরাআত পড়ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কিরাআত পাঠে বিঘ্ন ঘটে। সালাত শেষ করে তিনি বললেনঃ যদি তোমরা আমার ও ইবলীসের ব্যাপারটি দেখতে! হাত বাড়িয়ে আমি ওর গলাটিপে ধরেছিলাম। এমনকি আমি আমার বৃদ্ধাঙ্গুলিও তার পাশের অঙ্গুলির মাঝখানে ওর মুখের লালার শীতলতা অনুভব করি। আমার ভাই সুলায়মানের দু’আ না থাকলে নিঃসন্দেহে ও মসজিদের কোন একটি খুঁটির সঙ্গে শৃংখলাবদ্ধ হয়ে যেত আর মদীনার শিশুরা তাকে নিয়ে খেলতো। অতএব, তোমাদের মধ্যকার যার এ ক্ষমতা আছে যে, সে তার ও কেবলার মধ্যকার অন্তরায় ঠেকাতে পারবে তাহলে সে যেন তা অবশ্যই করে।"
ইমাম আবু দাউদ হাদীসটির ‘যার ক্ষমতা আছে’... অংশটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন কোন এক সালাত আদায় করে বললেন, “শয়তান এসে আমার সালাত নষ্ট করে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ তাকে কাবু করার শক্তি আমাকে দান করেছেন।” ইমাম মুসলিম ও নাসাঈ (رحمة الله) হাদীসটি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।
সুলায়মান (عليه السلام) সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা সংবাদ প্রদান করেন যে, তিনি বলেছিলেনঃ
قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكًا لَا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدِي ۖ إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
অর্থাৎ- হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে দান কর এমন এক রাজ্য যার অধিকারী আমি ছাড়া আর কেউ যেন না হয়, তুমি তো পরম দাতা। (৩৮ঃ ৩৫)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আমার সালাত বরবাদ করার জন্য গত রাতে দুষ্ট এক জিন আমার উপর চড়াও হয়। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা তাকে কাবু করার শক্তি আমাকে দান করেন। ফলে আমার ইচ্ছে হলো, তাকে ধরে এনে মসজিদের একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখি আর ভোরে উঠে তোমরা সকলেই তাকে দেখতে পাও। কিন্তু পরক্ষণে আমার ভাই সুলায়মান (عليه السلام)-এর
رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي الخ.
এ উক্তিটি মনে পড়ে যায়। রাবী বলেন, ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ব্যর্থ মনোরথ করে ফিরিয়ে দেন।
মুসলিম (رحمة الله) আবুদারদা (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) একদিন সালাত আদায়ে রত হন। এমন সময় আমরা হঠাৎ শুনতে পেলাম যে, তিনি বলছেনঃ اعوذ با لله منك (তোমার থেকে আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই)। তারপর তিনি বললেনঃ العنك بلعنة الله (তোমার প্রতি আল্লাহর লা’নত হোক!) এ কথাটি তিনবার বলে তিনি তাঁর হাত প্রসারিত করলেন, যেন তিনি কিছু একটা ধরছেন। তারপর সালাত শেষ হলে আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সালাতের মধ্যে আমরা আপনাকে এমন কিছু বলতে শুনলাম যা ইতিপূর্বে আমরা আপনাকে বলতে শুনিনি! আবার আপনাকে দেখলাম যে, আপনি আপনার হাত প্রসারিত করলেন! জবাবে তিনি বললেনঃ “আমার মুখে নিক্ষেপ করার জন্য আল্লাহর দুশমন ইবলীস একটি অগ্নিপিণ্ড নিয়ে আসে। তাই আমি তিনবার বললাম, اعوذ با لله منك তারপর বললাম, العنك بلعنة الله التا مة কিন্তু সে সরলো না, তারপর আমি তাকে ধরতে মনস্থ করি। আল্লাহর শপথ! যদি আমাদের ভাই সুলায়মানের দুআ না থাকত; তাহলে সে বন্দী হয়ে যেত আর মদীনাবাসীদের শিশু সন্তানরা তাকে নিয়ে খেলা করত।”
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ
অর্থাৎ-পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে এবং সেই প্রবঞ্চক (অর্থাৎ শয়তান) যেন তোমাদেরকে কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে প্রবঞ্চিত না করে। (৩১ঃ ৩৩)।
অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوًّا ۚ إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيرِ
অর্থাৎ-শয়তান তোমাদের দুশমন, সুতরাং তাকে তোমরা শত্রু হিসেবে গ্রহণ কর। সে তো তার দলবলকে কেবল এ জন্য আহ্বান করে, যেন তারা জাহান্নামী হয়।(৩৫ঃ ৬)
মোটকথা, চলা-ফেরা, উঠা-বসা ইত্যাদি অবস্থায় শয়তান মানুষের সর্বনাশ করার ব্যাপারে তার চেষ্টা ও শক্তি প্রয়োগে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না। যেমনঃ হাফিজ আবু বকর ইবন আবুদ্দুনিয়া (رحمة الله) ‘মাসায়িদিশ শয়তান’ (শয়তানের ফাঁদ) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটি অত্যন্ত মূল্যবান।
আবু দাউদ শরীফে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর দু’আয় বলতেনঃ
واعوذ بك أن يتخبطني الشيطان عند الموت.
মৃত্যুর সময় শয়তানের ছোবল থেকে আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি!
কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, শয়তান বলেছিলঃ
یا رب و عزك و جلالك لا ازال اغو بهم مادامت أرواحهم في أجسادهم.
অর্থাৎ-‘হে আমার প্রতিপালক! তোমার ইযযত ও জালাল-এর শপথ করে বলছি, তাদের দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত আমি তাদেরকে বিভ্রান্ত করতেই থাকব।’
আর আল্লাহ্ তা’আলা এর জবাবে বলেছিলেনঃ
وعزتي وجلالي و لا ازال اغفر لهم ما استغفروني.
অর্থাৎ- আর আমি আমার ইযযত ও জালাল-এর শপথ করে বলছি, তারা যতক্ষণ পর্যন্ত আমার নিকট ক্ষমা চাইতে থাকবে; আমি তাদেরকে ক্ষমা করতেই থাকব।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَاءِ ۖ وَاللَّهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا ۗ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
অর্থাৎ-শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং কার্পণ্যের নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা এবং অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। আল্লাহ্ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (২ঃ ২৬৮)
মোটকথা, আল্লাহ্ তা’আলার প্রতিশ্রুতিই সঠিক ও সত্য। আর শয়তানের প্রতিশ্রুতি মাত্রই বাতিল।
তিরমিযী ও নাসাঈ এবং ইবন হিব্বান (رحمة الله) তাঁর সহীহে আর ইবন আবু হাতিম (رحمة الله) তার তাফসীরে ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ আদম সন্তানের সঙ্গে শয়তানের একটি ছোঁয়াচ আছে এবং ফেরেশতাদের একটি ছোঁয়াচ আছে। শয়তানের ছোঁয়াচ হলো, মন্দের প্রতিশ্রুতি প্রদান এবং সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা আর ফেরেশতাদের ছোঁয়াচ হলো, কল্যাণের প্রতিশ্রুতি প্রদান ও সত্যকে সত্য বলে গ্রহণ করা। সুতরাং কেউ এটি অনুভব করলে সে যেন বুঝে নেয় যে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। ফলে যেন সে আল্লাহর প্রশংসা করে। আর যে ব্যক্তি অপরটি অনুভব করবে, সে যেন শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে। তারপর তিনি الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ الخ আয়াতটি পাঠ করেন।
সূরা বাকারার ফযীলতে আমরা উল্লেখ করেছি যে, শয়তান সে ঘর থেকে পালিয়ে যায়, যে ঘরে সূরা বাকারা পাঠ করা হয়। আবার আয়াতুল কুরসীর ফযীলতে উল্লেখ করেছি যে, যে ব্যক্তি রাতে আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে ভোর হওয়া পর্যন্ত শয়তান তার কাছে ঘেঁষতে পারে না।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি একশ’ বার
لا اله الا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد
পাঠ করবে; তা তার জন্য দশটি গোলাম আযাদ করার তুল্য হবে, তার নামে একশ নেকী লেখা হবে ও তার একশ গুনাহ মুছে ফেলা হবে এবং তা সে দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য শয়তান থেকে নিরাপত্তাস্বরূপ হবে। আর তার চাইতে অধিক আমলকারী ব্যতীত অন্য কেউই তার থেকে উত্তম আমলের অধিকারী বলে বিবেচিত হবে না।
ইমাম মুসলিম, তিরমিযী ও ইবন মাজাহ (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন।
বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় প্রত্যেক বনী আদমের দু’পার্শ্বে শয়তান তার আঙ্গুল দ্বারা খোঁচা দেয়। তবে মারয়াম পুত্র ঈসা (عليه السلام) তার ব্যতিক্রম। তাঁকে খোঁচা দিতে গিয়ে শয়তান তার দেহে জড়ানো আবরণে খোঁচা দিয়ে আসে।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ
التثاؤب من الشيطان فاذا تثاؤب احدكم فليرده ما استطاع فان احدکم اذا قال (ها) ضحك الشيطان.
অর্থাৎ- “হাই তোলা হয় শয়তানের পক্ষ থেকে। অতএব, তোমাদের কারো হাই আসলে, সে যেন যথাসম্ভব তা রোধ করে। কারণ (হাই আসার সময়) তোমাদের কেউ ‘হা’ বললে শয়তান হেসে দেয়।
আহমদ, আবু দাউদ এবং তিরমিযী (رحمة الله) ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) হাদীসটি সহীহ বলে রায় দিয়েছেন। এ হাদীসের অন্য পাঠে আছে—
اذا تثاؤب أحدكم فليكظم ما استطاع فإن الشيطان يدخل.
অর্থাৎ তোমাদের কারো হাই আসলে সে যেন যথাসম্ভব তা দমন করে। কারণ (হাই তোলার সময়) শয়তান ভিতরে ঢুকে পড়ে।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
ان الله يحب العطاس ويبغض او يكره التثاؤب فإذا قال احدكم ها ها فانما ذالك الشيطان يضحك من جوفه.
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা হাঁচি পছন্দ করেন আর হাই তোলা ঘৃণা করেন অথবা (রাবী বলেন, অপছন্দ করেন) (হাই তোলার সময়) তোমাদের কেউ হা-হা বললে শয়তান একেবারে তার পেট থেকে হাসতে থাকে। ইমাম তিরমিযী ও নাসাঈ (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আয়েশা (رضي الله عنه) বলেছেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে মানুষের সালাতের মধ্যে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। উত্তরে তিনি বললেনঃ
هو اختلا يختلسه الشيطان من صلاة أحدكم
অর্থাৎ— “এ হলো, ছিনতাই যা তোমাদের কারো সালাত থেকে শয়তান ছিনিয়ে নিয়ে যায়।”
ইমাম আবূ দাউদ ও নাসাঈ (رحمة الله) ভিন্ন সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু কাতাদা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ
الروبا الصالحة من الله والحلم من الشيطان فإذا حلم احدكم حلما يخافه فليبصق عن يساره واليتعوذ بالله من شرها فانها لا تضره.
অর্থাৎ সুস্বপ্ন হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর অলীক স্বপ্ন হয় শয়তানের পক্ষ থেকে। অতএব, তোমাদের কেউ ভয়ংকর কোন দুঃস্বপ্ন দেখলে, সে যেন তার বাম দিকে থুথু ফেলে এবং তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে। এতে সে তার অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ
لا يشيرن أحدكم الى اخيه بالسلاح فإنه لايدري احدكم لعل الشيطان أن ينزغ في بده فيقع في حفرة من النار.
অর্থাৎ তোমাদের কেউ কিছুতেই যেন তার কোন ভাইয়ের প্রতি অস্ত্র দ্বারা ইশারা না করে। কারণ কি জানি, হয়ত শয়তান তার হাতে এসে ভর করবে যার ফলে সে জাহান্নামের কুণ্ডে গিয়ে নিক্ষিপ্ত হবে। ইমাম বুখারী ও মুসলিম (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَلَقَدْ زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَجَعَلْنَاهَا رُجُومًا لِلشَّيَاطِينِ ۖ وَأَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابَ السَّعِيرِ.
অর্থাৎ আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা দ্বারা এবং তাদেরকে করেছি শয়তানের প্রতি নিক্ষেপের উপকরণ এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি। (৬৭ঃ ৫)
অন্য আয়াতে তিনি বলেনঃ
إِنَّا زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِزِينَةٍ الْكَوَاكِبِ. وَحِفْظًا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ مَارِدٍ. لَا يَسَّمَّعُونَ إِلَى الْمَلَإِ الْأَعْلَىٰ وَيُقْذَفُونَ مِنْ كُلِّ جَانِبٍ. دُحُورًا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ وَاصِبٌ.إِلَّا مَنْ خَطِفَ الْخَطْفَةَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ ثَاقِبٌ.
অর্থাৎ আমি নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্ররাজির সুষমা দ্বারা সুশোভিত করেছি এবং রক্ষা করেছি প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তান থেকে। ফলে তারা উর্ধজগতের কিছু শুনতে পায় না এবং তাদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয় সকল দিক থেকে বিতাড়নের জন্য এবং তাদের জন্য আছে অবিরাম শাস্তি। তবে কেউ হঠাৎ কিছু শুনে ফেললে উল্কাপিণ্ড তার পিছু ধাওয়া করে। (৩৭ঃ ৬-১০)
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاءِ بُرُوجًا وَزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِينَ. وَحَفِظْنَاهَا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ رَجِيمٍ. إِلَّا مَنِ اسْتَرَقَ السَّمْعَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ مُبِينٌ.
অর্থাৎ— আকাশে আমি গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি করেছি এবং দর্শকের জন্য তাকে সুশোভিত করেছি; এবং প্রত্যেক অভিশপ্ত শয়তান থেকে আমি তাকে রক্ষা করে থাকি; আর কেউ চুরি করে সংবাদ শুনতে চাইলে তার পিছু ধাওয়া করে প্রদীপ্ত শিখা। (১৫ঃ ১৬-১৮)
আরেক জায়গায় আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وما تنزلت به الشيطين . وما ينبغي لهم وما يستطيعون. انهم عن الشمع لمعزولون.
অর্থাৎ শয়তানরা তা সহ অবতীর্ণ হয়নি। তারা এ কাজের যোগ্য নয় এবং তারা এর সামর্থ্যও রাখে না। তাদেরকে তো শ্রবণের সুযোগ থেকে দূরে রাখা হয়েছে।
অন্যত্র আল্লাহ্ তা’আলা জিন জাতি সম্পর্কে সংবাদ দিতে গিয়ে বলেনঃ
وَأَنَّا لَمَسْنَا السَّمَاءَ فَوَجَدْنَاهَا مُلِئَتْ حَرَسًا شَدِيدًا وَشُهُبًا. وَأَنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَاعِدَ لِلسَّمْعِ ۖ فَمَنْ يَسْتَمِعِ الْآنَ يَجِدْ لَهُ شِهَابًا رَصَدًا.
অর্থাৎ- এবং আমরা চেয়েছিলাম আকাশের তথ্য সংগ্রহ করতে কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিণ্ডে আকাশ পরিপূর্ণ; আর পূর্বে আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শোনার জন্য বসতাম। কিন্তু এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে সে তার উপর নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের সম্মুখীন হয়। (৭২ঃ ৮-৯)
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ
الملائكة تحدث في العنان بالأمر يكون في الأرض فتسمع الشياطين الكلمة فتقرها في أذن الكاهن كما نقرالقارورة فيزيدون معها مأة
অর্থাৎ- ফেরেশতাগণ মেঘমালায় বসে পৃথিবীতে যা ঘটবে সে সব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে থাকেন। শয়তানরা তার শব্দ বিশেষ শুনে এসে জ্যোতিষীর কানে ঢেলে দেয়, যেমন বোতলে কোন কিছু ঢালা হয়ে থাকে। পরে তারা তার সাথে আরো একশ কথা জুড়ে দেয়।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) ইবলীস পরিচিতি অধ্যায়ে লায়ছ (رحمة الله) থেকে মু’আল্লক সূত্রেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী ও মুসলিম (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আয়েশা (رضي الله عنه) বলেছেনঃ কিছু লোক রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর নিকট জ্যোতিষীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ انهم ليسوا بشي ওরা কিছু নয়। তাঁরা বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! তারা তো কখনো কখনো কোন কিছু সম্পর্কে আমাদেরকে এমন কথা বলে থাকে, যা সঠিক প্রমাণিত হয়ে যায়। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন।
تلك الكلمة من الحق غطفها من الجني فيقرقرها في اذن وليه كقرقرة الدجاجة فيخلطون معها مائة كذبة.
অর্থাৎ ঐ সত্য কথাটি জিনদের কেউ ছোঁ মেরে এনে মুরগীর কড় কড় শব্দের ন্যায় শব্দ করে তার সাঙ্গাতের কানে দিয়ে দেয়। পরে তার সাথে তারা শত মিথ্যা কথা জুড়ে দেয়। এ পাঠটি হচ্ছে ইমাম বুখারী (رحمة الله)-এর।
বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ ‘আল্লাহ্ তা’আলা ঊর্ধজগতে কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিলে আনুগত্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে ফেরেশতাগণ তাদের ডানা ঝাপটাতে শুরু করেন, যেন তা মসৃণ পাথরের উপর জিঞ্জিরের ঝনঝনানি, তারপর তারা শান্ত ও নির্ভয় হলে তারা বলাবলি করেন যে, তোমাদের প্রতিপালক কি বললেন? উত্তরে তারা বলেন, তিনি যা বললেন, তা নির্ঘাত সত্য। তিনি তো মহীয়ান গরীয়ান। এ সুযোগে চুরি করে শ্রবণকারী তা শুনে ফেলে। চুরি করে শ্রবণকারী দল এবারে একজন আরেকজনের উপর অবস্থান করে। সুফয়ান তাঁর হাতটি একদিকে সরিয়ে নিয়ে আঙ্গুলগুলোর মাঝে ফাঁক করে তার বিবরণ দেন। (তারপর বলেন) তারপর একজন কোন কথা শুনে নিয়ে তা তার নিচের জনের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। সে আবার তার নিচের জনের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। এভাবে কথাটি জাদুকর কিংবা জ্যোতিষীর মুখে পৌঁছানো হয়। তবে অনেক সময় তা পৌঁছানোর আগেই উল্কাপিণ্ডের কবলে পড়ে যায় আবার অনেক সময় উল্কাপিণ্ড ধরে ফেলার আগে-ভাগেই তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়। সে তখন তার সঙ্গে শত মিথ্যা জুড়ে দেয়। তারপর বলাবলি হয় যে, অমুক দিন কি সে আমাদেরকে এমন এমন বলেনি? ফলে আকাশ থেকে শ্রুত কথাটির ভিত্তিতে তাকে সত্যবাদী বলে মেনে নেওয়া হয়। ইমাম মুসলিম (رحمة الله)-ও অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَٰنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ. وَإِنَّهُمْ لَيَصُدُّونَهُمْ عَنِ السَّبِيلِ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ مُهْتَدُونَ. حَتَّىٰ إِذَا جَاءَنَا قَالَ يَا لَيْتَ بَيْنِي وَبَيْنَكَ بُعْدَ الْمَشْرِقَيْنِ فَبِئْسَ الْقَرِينُ.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয় আমি তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান, তারপর সে হয় তার সহচর। শয়তানরাই মানুষকে সৎপথ থেকে বিরত রাখে অথচ মানুষ মনে করে তারা সৎপথে পরিচালিত হচ্ছে। অবশেষে যখন সে আমার নিকট উপস্থিত হবে, তখন সে শয়তানকে বলবে, হায়! আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান থাকত। কত নিকৃষ্ট সহচর সে! (৪৩ঃ ৩৬-৩৮)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَقَيَّضْنَا لَهُمْ قُرَنَاءَ فَزَيَّنُوا لَهُمْ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ
অর্থাৎ আমি তাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সহচর, যারা তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা আছে তা তাদের দৃষ্টিতে শোভন, করে দেখিয়েছিল। (৪১ঃ ২৫)
অন্যত্র মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
قَالَ قَرِينُهُ رَبَّنَا مَا أَطْغَيْتُهُ وَلَٰكِنْ كَانَ فِي ضَلَالٍ بَعِيدٍ. قَالَ لَا تَخْتَصِمُوا لَدَيَّ وَقَدْ قَدَّمْتُ إِلَيْكُمْ بِالْوَعِيدِ. مَا يُبَدَّلُ الْقَوْلُ لَدَيَّ وَمَا أَنَا بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ.
অর্থাৎ তার সহচর শয়তান বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমি তাকে অবাধ্য হতে প্ররোচিত করিনি। বস্তুত সে নিজেই ছিল ঘোর বিভ্রান্ত।
আল্লাহ্ বলবেন, আমার সামনে বাক-বিতণ্ডা করো না, তোমাদেরকে আমি তো পূর্বেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম। আমার কথার রদবদল হয় না এবং আমি আমার বান্দাদের প্রতি কোন অবিচার করি না। (৫০ঃ ২৭-২৯)
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا ۚ وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُ ۖ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ. وَلِتَصْغَىٰ إِلَيْهِ أَفْئِدَةُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَلِيَرْضَوْهُ وَلِيَقْتَرِفُوا مَا هُمْ مُقْتَرِفُونَ.
অর্থাৎ- এরূপ মানব ও জিনের মধ্যে শয়তানদেরকে আমি প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছি; প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে, যদি তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন; তবে তারা তা করতো না। সুতরাং তুমি তাদেরকে ও তাদের মিথ্যা রচনাকে বর্জন কর।
এবং তারা এ উদ্দেশ্য প্ররোচিত করে যে, যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তাদের মন যেন তার প্রতি অনুরাগী হয় এবং তাতে যেন তারা পরিতুষ্ট হয় আর যে অপকর্ম করে তারা যেন তাই করতে থাকে। (৬৪ঃ ১১২-১১৩)
ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে ইমাম আহমদ ও মুসলিম (رحمة الله) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস আমরা ফেরেশতা পরিচিতি অধ্যায়ে উল্লেখ করে এসেছি। তাতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ
ما منكم من احد الا وقد وكل به قرينه من الجن وقرينه من الملئكة.
অর্থাৎ “কেউ বাদ নেই, তোমাদের প্রত্যেকের জিন সহচর ও ফেরেশতা সহচরকে তার দায়িত্বে রাখা হয়েছে।”
এ কথা শুনে সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, এবং আপনারও ইয়া রাসূলাল্লাহ? তিনি বললেনঃ আমারও কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে তার উপর সাহায্য করেছেন। ফলে সে আমাকে মঙ্গল ছাড়া অন্য কিছুর আদেশ করে না।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ
ليس منكم من احد الا وقد وكل به قرينه من الشياطين.
অর্থাৎ তোমাদের কেউ এমন নেই, যার উপর তার শয়তান সহচরকে নিয়োজিত করে রাখা হয়নি।
একথা শুনে সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, আর আপনিও ইয়া রাসূলাল্লাহ? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, “হ্যাঁ, তবে আল্লাহ্ আমাকে তার উপর সাহায্য করেছেন, ফলে সে আমার অনুগত হয়ে গেছে।” ইমাম আহমদ (رحمة الله) একাই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং এ রিওয়ায়েতটি সহীহ বুখারীর শর্তে উত্তীর্ণ।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (رضي الله عنه) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক রাতে তাঁর নিকট থেকে বের হয়ে যান। তিনি বলেন, তার এভাবে চলে যাওয়ায় আমি মনঃক্ষুন্ন হই। আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে তিনি আমার অবস্থা দেখে বললেনঃ কী ব্যাপার, আয়েশা! তুমি মনঃক্ষণ হয়েছ? আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, জবাবে আমি বললাম, আমার মত মানুষ আপনার মত লোকের উপর মনঃক্ষুন্ন হবে না তো কী? এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেনঃ কি ব্যাপার, তোমার শয়তানটা তোমাকে পেয়ে বসেছে না কি? আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, আমি বললাম, আমার সঙ্গে শয়তান আছে নাকি হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। আমি বললাম, সব মানুষের সঙ্গেই আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, আপনার সঙ্গেও আছে কি, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেনঃ ‘হ্যাঁ’ আছে বটে কিন্তু আল্লাহ্ তার উপর আমাকে সাহায্য করেছেন। ফলে সে অনুগত হয়ে গিয়েছে। অনুরূপ ইমাম মুসলিম (رحمة الله)-ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ
إن المؤمن لينصي شيطانه كما ينصي أحدكم بعيره في السفر.
অর্থাৎ মু’মিন তার শয়তানের মাথার সম্মুখ ভাগের কেশ গুচ্ছ ধরে তাকে পরাভূত করে থাকে, যেমনটি তোমাদের কেউ সফরে তার অবাধ্য উটকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
ইবলীস সম্পর্কে সংবাদ দিতে গিয়ে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ. ثُمَّ لَآتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ.
অর্থাৎ সে বলল, তুমি আমাকে শাস্তিদান করলে, এ জন্য আমিও তোমার সরল পথে মানুষের জন্য নিশ্চয় ওঁৎ পেতে থাকব। তারপর আমি তাদের নিকট আসবই তাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ, দক্ষিণ ও বাম দিক থেকে এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবে না। (৭ঃ ১৬-১৭)
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, সুবরা ইবন আবু ফাকিহ্ (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, শয়তান আদম সন্তানের জন্য বিভিন্ন পথে ওঁৎ পেতে বসে আছে। ইসলামের পথে বসে থেকে সে বলে, তুমি কি তোমার ও তোমার পিতৃ-পুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছ? রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেনঃ কিন্তু আদম সন্তান তাকে অগ্রাহ্য করে ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর সে হিজরতের পথে বসে থেকে বলে, তুমি কি আপন মাটি ও আকাশ (মাতৃভূমি) ত্যাগ করে হিজরত করছ? মুহাজির তো দূরত্ব অতিক্রমে ঘোড়ার ন্যায়। কিন্তু সে তাকে অগ্রাহ্য করে হিজরত করে। তারপর শয়তান জিহাদের পথে বসে যায়— জিহাদ হলো জান ও মাল উৎসর্গ করা— তারপর বলল, তুমি লড়াই করে নিহত হবে আর তোমার স্ত্রী অন্য স্বামী গ্রহণ করবে ও তোমার ধন-সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাবে? রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেন, এবারও সে তাকে উপেক্ষা করে ও জিহাদ করে। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ আদমের সন্তানদের যে কেউ তা করবে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর যিম্মায় থাকবে। সে শহীদ হয়ে গেলে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর যিম্মায় থাকবে। সে ডুবে গেলে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর যিম্মায় থাকবে এবং তার সওয়ারী তাকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেললেও তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর যিম্মায় থাকবে।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবদুল্লাহ ইবন উমর (رضي الله عنه) সূত্রে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রতিদিন সকাল-বিকাল এ দুআগুলো পাঠ করতেন—কখনো ছাড়তেন না।
اللهم إني أسئلك العافية في الدنيا والاخرة - اللهم إني أسئلك العفو والعافية في ديني ودنياي وأهلي ومالي - اللهم استر عوراتی وآمن روعاتي - اللهم احفظني من بين يدي و من خلفي وعن يميني و عن شمالي ومن هوقي وأعوذ بعظمتك أن أغتال من تحتي.
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট দুনিয়া ও আখিরাতে নিরাময়তা প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ক্ষমা এবং আমার দীন-দুনিয়া, পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! তুমি আমার সে সব বিষয় গোপন রাখ, যা প্রকাশ পেলে আমার লজ্জা পেতে হবে আর আমার ভীতিকর বিষয়সমূহকে তুমি নিরাপদ করে দাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে অগ্র-পশ্চাৎ, আমার ডান-বাম ও আমার উপর থেকে হেফাজত কর। আর তোমার মর্যাদার উসিলায় আমার নিচের থেকে আমাকে ধ্বংস করার ব্যাপারে আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি।”
ওকী (رحمة الله) বলেন, নিচের থেকে ধ্বংস করা মানে ধসিয়ে দেয়া। ইমাম আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবন মাজাহ, ইবন হিব্বান ও হাকিম (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাকিম (رحمة الله) একে সহীহ সনদের হাদীস বলে আখ্যায়িত করেছেন।
❏ আদম (عليه السلام)-এর সৃষ্টি
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً ۖ قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ ۖ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ. وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَٰؤُلَاءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ. قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا ۖ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ. قَالَ يَا آدَمُ أَنْبِئْهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ ۖ فَلَمَّا أَنْبَأَهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُلْ لَكُمْ إِنِّي أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنْتُمْ تَكْتُمُونَ. وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ. وَقُلْنَا يَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ. فَأَزَلَّهُمَا الشَّيْطَانُ عَنْهَا فَأَخْرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيهِ ۖ وَقُلْنَا اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ ۖ وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَىٰ حِينٍ. فَتَلَقَّىٰ آدَمُ مِنْ رَبِّهِ كَلِمَاتٍ فَتَابَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ. قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا ۖ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ. وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ.
অর্থাৎ, স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি। তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস স্তুতি ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, আমি যা জানি তোমরা জান না।
এবং তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সে সমুদয় ফেরেশতার সম্মুখে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, তোমরা আমাকে এ সবের নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তারা বলল, আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞানই নেই। বস্তুত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়।
তিনি বললেন, হে আদম! তাদেরকে এ সকল নাম বলে দাও। যখন সে তাদেরকে এ সকল নাম বলে দিল, তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তোমরা যা ব্যক্ত কর বা গোপন রাখ আমি তাও জানি?
আর যখন ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল, সে অমান্য করল ও অহংকার করল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
এবং আমি বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না। হলে তোমরা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু শয়তান সেখান থেকে তাদের পদস্খলন ঘটালো এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করল। আমি বললাম, তোমরা একে অন্যের শত্রুরূপে নেমে যাও, পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল।
তারপর আদম তার প্রতিপালকের নিকট থেকে কিছু বাণী প্রাপ্ত হলো। আল্লাহ তার প্রতি ক্ষমা পরবশ হলেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
আমি বললাম, তোমরা সকলেই এ স্থান থেকে নেমে যাও। পরে যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সৎপথের কোন নির্দেশ আসবে, তখন যারা আমার সৎপথের অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। যারা কুফরী করে ও আমার নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করে তারাই জাহান্নামী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (২ঃ ৩০-৩৯)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ
إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِنْدَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ ۖ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ.
অর্থাৎ আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্তের ন্যায়। আল্লাহ তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন; তারপর তাকে বলেছিলেন, হও; ফলে সে হয়ে যায়। (৩ঃ ৫৯)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا.
অর্থাৎ হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতেই সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দুজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন। এবং আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাজ্ঞা কর এবং সতর্ক থাক আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে। আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন।(৪ঃ ১)
যেমন অন্য আয়াতে বলেনঃ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ.
অর্থাৎ হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকী। আল্লাহ সব কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন। (৪৯ঃ ১৩)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا.
অর্থাৎ তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়। (৭ঃ ১৮৯)
অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَلَقَدْ خَلَقْنَاكُمْ ثُمَّ صَوَّرْنَاكُمْ ثُمَّ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ لَمْ يَكُنْ مِنَ السَّاجِدِينَ. قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ ۖ قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ. قَالَ فَاهْبِطْ مِنْهَا فَمَا يَكُونُ لَكَ أَنْ تَتَكَبَّرَ فِيهَا فَاخْرُجْ إِنَّكَ مِنَ الصَّاغِرِينَ. قَالَ أَنْظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ. قَالَ إِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِينَ. قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ. ثُمَّ لَآتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ. قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُومًا مَدْحُورًا ۖ لَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكُمْ أَجْمَعِينَ. وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ. فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُورِيَ عَنْهُمَا مِنْ سَوْآتِهِمَا وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَٰذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَنْ تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِينَ. وَقَاسَمَهُمَا إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِينَ. فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ ۚ فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ ۖ وَنَادَاهُمَا رَبُّهُمَا أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَكُمَا إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُبِينٌ. قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ. قَالَ اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ ۖ وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَىٰ حِينٍ. قَالَ فِيهَا تَحْيَوْنَ وَفِيهَا تَمُوتُونَ وَمِنْهَا تُخْرَجُونَ.
অর্থাৎ আমিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করি, তারপর রূপদান করি, তারপর ফেরেশতাদের আদমকে সিজদা করতে বলি, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করে। যারা সিজদা করল, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হলো না।
তিনি বললেন, আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন সিজদা করা থেকে কিসে তোমাকে বারণ করল? সে বলল, আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ; আমাকে তুমি আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছ আর তাকে সৃষ্টি করেছ কাদা মাটি দিয়ে। তিনি বললেন, এখান থেকে তুমি নেমে যাও, এখানে থেকে তুমি অহংকার করবে তা হতে পারে না। সুতরাং তুমি বের হয়ে যাও, তুমি অধমদের অন্তর্ভুক্ত।
সে বলল, পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে তুমি অবকাশ দাও। তিনি বললেন, যাদেরকে অবকাশ দেয়া হয়েছে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হলে। ইবলীস বলল, তুমি আমাকে শাস্তি দান করলে, তাই আমিও নিঃসন্দেহে তোমার সরল পথে মানুষের জন্য ওঁৎ পেতে থাকব। তারপর আমি তাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ, ডান ও বাম দিক থেকে তাদের নিকট আসবই এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবে না।
তিনি বললেন, এখান থেকে তুমি ধিকৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় বের হয়ে যাও; মানুষের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবই। আর বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং যা এবং যেখানে ইচ্ছা আহার কর কিন্তু এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। অন্যথায় তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
তারপর তাদের গোপন করে রাখা লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, পাছে তোমরা ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা তোমরা চিরস্থায়ী হও—এ জন্য তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন। এবং সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল, আমি তোমাদের হিতাকাক্ষীদের একজন।
এভাবে সে প্রবঞ্চনা দ্বারা তাদেরকে অধঃপতিত করল। তারপর যখন তারা সে বৃক্ষফল আস্বাদন করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেদেরকে ঢাকতে লাগল। তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছি, তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর; তা হলে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো।
তিনি বললেন, তোমরা একে অন্যের শত্রুরূপে নেমে দাও এবং পৃথিবীতে কিছু দিনের জন্যে তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল। তিনি বললেন, সেখানেই তোমরা জীবন যাপন করবে এবং সেখানেই তোমাদের মৃত্যু হবে এবং সেখান থেকেই তোমাদের বের করে আনা হবে। (৭ঃ ১১-২৫)
যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ
مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَىٰ.
অর্থাৎ এ (মাটি) থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদের ফিরিয়ে দেব এবং সেখান থেকেই পুনরায় তোমাদেরকে বের করে আনব। (২০ঃ ৫৫)
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ. وَالْجَانَّ خَلَقْنَاهُ مِنْ قَبْلُ مِنْ نَارِ السَّمُومِ. وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ. فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ. فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ. إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ أَنْ يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ. قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا لَكَ أَلَّا تَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ. قَالَ لَمْ أَكُنْ لِأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ. قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ. وَإِنَّ عَلَيْكَ اللَّعْنَةَ إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ. قَالَ رَبِّ فَأَنْظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ. قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِينَ. إِلَىٰ يَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ. قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ. إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ. قَالَ هَٰذَا صِرَاطٌ عَلَيَّ مُسْتَقِيمٌ. إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ إِلَّا مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِينَ. وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمَوْعِدُهُمْ أَجْمَعِينَ. لَهَا سَبْعَةُ أَبْوَابٍ لِكُلِّ بَابٍ مِنْهُمْ جُزْءٌ مَقْسُومٌ.
অর্থাৎ আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে এবং তার পূর্বে সৃষ্টি করেছি জিন জাতিকে অতি উষ্ণ বায়ুর উত্তাপ থেকে। স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করব; তখন তোমরা তার সামনে সিজদায় পড়ে যেয়ো। তখন ফেরেশতাগণ সকলেই সিজদা করল কিন্তু ইবলীস সিজদা করল না। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল।
আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! কি ব্যাপার তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলে না যে! সে বলল, আমি এমন মানুষকে সিজদা করবার নই, যাকে আপনি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বললেন, তবে তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। কারণ তুমি বিতাড়িত এবং কিয়ামত পর্যন্ত তোমার প্রতি রইল লা’নত।
সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। আল্লাহ বললেন, যাও অবধারিত সময় আসা পর্যন্ত তোমাকে অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করা হলো। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে পথভ্রষ্ট করলেন, সে জন্য আমি পৃথিবীতে পাপকর্মকে মানুষের সামনে শোভন করে উপস্থাপন করব এবং আপনার মনোনীত বান্দাদের ব্যতীত তাদের সকলকেই আমি বিপথগামী করে ছাড়ব।
আল্লাহ বললেন, এ হলো আমার নিকট পৌঁছুবার সোজা পথ। বিভ্রান্তদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে; তারা ব্যতীত আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা থাকবে না। তোমার অনুসারীদের সকলেরই নির্ধারিত স্থান হবে জাহান্নাম। যার সাতটি দরজা আছে। প্রত্যেক দরজার জন্য আছে পৃথক পৃথক দল। (১৫ঃ ২৬-৪৪)
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا. قَالَ أَرَأَيْتَكَ هَٰذَا الَّذِي كَرَّمْتَ عَلَيَّ لَئِنْ أَخَّرْتَنِ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَأَحْتَنِكَنَّ ذُرِّيَّتَهُ إِلَّا قَلِيلًا. قَالَ اذْهَبْ فَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ فَإِنَّ جَهَنَّمَ جَزَاؤُكُمْ جَزَاءً مَوْفُورًا. وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِمْ بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ وَعِدْهُمْ ۚ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا. إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ ۚ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ وَكِيلًا.
অর্থাৎ স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল। সে বলল, যাকে আপনি কাদা মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, আমি কি তাকে সিজদা করব?
সে আরো বলল, বলুন, ওকে যে আপনি আমার উপর উচ্চ মর্যাদা দান করলেন, তা কেন? আপনি যদি কিয়ামত পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দেন; তবে অল্প কয়েকজন ব্যতীত তার বংশধরকে আমি আমার কর্তৃত্বাধীন করে ফেলব।
আল্লাহ বললেন, যাও তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে; জাহান্নামই হবে তোমাদের সকলের শাস্তি পূর্ণ শাস্তি। তোমার আহবানে ওদের মধ্যকার যাদেরকে পার পদস্খলিত কর, তুমি তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে তাদেরকে আক্রমণ কর এবং তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যাও আর তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দাও। শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়; তা ছলনা মাত্র। আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। কর্মবিধায়ক হিসাবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট।(১৭ঃ ৬১-৬৫)
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ ۗ أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ ۚ بِئْسَ لِلظَّالِمِينَ بَدَلًا.
অর্থাৎ, আর স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত তারা সকলেই সিজদা করল। সে জিনদের একজন, সে তার প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল, তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করছ? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। জালিমদের এ বিনিময় কত নিকৃষ্ট।(১৮ঃ ৫০)
) وَلَقَدْ عَهِدْنَا إِلَىٰ آدَمَ مِنْ قَبْلُ فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا. وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ. فَقُلْنَا يَا آدَمُ إِنَّ هَٰذَا عَدُوٌّ لَكَ وَلِزَوْجِكَ فَلَا يُخْرِجَنَّكُمَا مِنَ الْجَنَّةِ فَتَشْقَىٰ. إِنَّ لَكَ أَلَّا تَجُوعَ فِيهَا وَلَا تَعْرى. وَأَنَّكَ لَا تَظْمَأُ فِيهَا وَلَا تَضْحَىٰ. فَوَسْوَسَ إِلَيْهِ الشَّيْطَانُ قَالَ يَا آدَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَىٰ شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَا يَبْلَىٰ. فَأَكَلَا مِنْهَا فَبَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ ۚ وَعَصَىٰ آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَىٰ. ثُمَّ اجْتَبَاهُ رَبُّهُ فَتَابَ عَلَيْهِ وَهَدَىٰ. قَالَ اهْبِطَا مِنْهَا جَمِيعًا ۖ بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ ۖ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَىٰ. وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ. قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَىٰ وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا. قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا ۖ وَكَذَٰلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَىٰ.
অর্থাৎ আমি তো ইতিপূর্বে আদমের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল, আমি তাকে সংকল্পে দৃঢ় পাইনি। স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, আদমের প্রতি সিজদা কর; তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল; সে অমান্য করল। তারপর আমি বললাম, হে আদম! এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু; সুতরাং সে যেন কিছুতেই তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে না দেয়, দিলে তোমরা দুঃখ পাবে। তোমার জন্য এই রইল যে, তুমি জান্নাতে ক্ষুধার্ত হবে না ও নগ্নও হবে না এবং তথায় পিপাসার্ত হবে না এবং রৌদ্রক্লিষ্টও হবে না।
তারপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল। সে বলল, হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনপ্রদ গাছের কথা ও অক্ষয় রাজ্যের কথা? তারপর তারা তা থেকে ভক্ষণ করল; তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা জান্নাতের গাছের পাতা দিয়ে নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল। আদম তার প্রতিপালকের হুকুম অমান্য করল, ফলে সে ভ্রমে পতিত হলো। এরপর তার প্রতিপালক তাকে মনোনীত করলেন, তার প্রতি ক্ষমাপরায়ণ হলেন ও তাকে পথ-নির্দেশ করলেন।
তিনি বললেন, তোমরা একই সাথে জান্নাত থেকে নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্রু। পরে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার অনুসরণ করবে, সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না। যে আমার স্মরণে বিমুখ তার জীবন যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন তুমি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলে? আমি তো চক্ষুস্মান ছিলাম।
তিনি বলবেন, এরূপই আমার নিদর্শনাবলী তোমার নিকট এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তুমিও বিস্মৃত হলে। (২০ঃ ১১৫-১২৬)
قُلْ هُوَ نَبَأٌ عَظِيمٌ * أَنْتُمْ عَنْهُ مُعْرِضُونَ * مَا كَانَ لِيَ مِنْ عِلْمٍ بِالْمَلَإِ الْأَعْلَىٰ إِذْ يَخْتَصِمُونَ * إِنْ يُوحَىٰ إِلَيَّ إِلَّا أَنَّمَا أَنَا نَذِيرٌ مُبِينٌ * إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ طِينٍ * فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ * فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ * إِلَّا إِبْلِيسَ اسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ * قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ۖ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنْتَ مِنَ الْعَالِينَ * قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ ۖ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ * قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ * وَإِنَّ عَلَيْكَ لَعْنَتِي إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ * قَالَ رَبِّ فَأَنْظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ * قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِينَ * إِلَىٰ يَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ * قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ * إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ * قَالَ فَالْحَقُّ وَالْحَقَّ أَقُولُ * لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكَ وَمِمَّنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ أَجْمَعِينَ * قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِينَ * إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ * وَلَتَعْلَمُنَّ نَبَأَهُ بَعْدَ حِينٍ. [Surat Sad ৬৭ - ৮৮]
অর্থাৎ বল, এ এক মহা সংবাদ, যা থেকে তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ; ঊর্ধ্বলোকে তাদের বাদানুবাদ সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞান ছিল না। আমার কাছে তো এ ওহী এসেছে যে, আমি একজন স্পষ্ট সতর্ককারী।
স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি কাদা মাটি থেকে, যখন আমি তাকে সুষম করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো। তখন ইবলীস ব্যতীত ফেরেশতারা সকলেই সিজদাবনত হলো। সে অহংকার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।
তিনি বললেন, হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি সিজদাবনত হতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, না তুমি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন? সে বলল, আমি তার থেকে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদা মাটি থেকে। তিনি বললেন, তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, নিশ্চয়ই তুমি বিতাড়িত এবং তোমার উপর আমার লা’নত স্থায়ী হবে কমল দিবস পর্যন্ত। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। তিনি বললেন, তুমি অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হলে অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত। সে বলল, আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি তাদের সকলকেই পথভ্রষ্ট করব, তবে তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদের নয়।
তিনি বললেন, তবে এটাই সত্য; আর আমি সত্যই বলি— তোমার দ্বারা ও তোমার অনুসারীদের দ্বারা আমি জাহান্নাম পূর্ণ করবই। বল, এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না এবং যারা মিথ্যা দাবি করে আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। এতো বিশ্ব জগতের জন্য উপদেশ মাত্র। এর সংবাদ তোমরা অবশ্যই জানবে কিছুকাল পরে। (৩৮ঃ ৬৭-৮৮)
এ হলো কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের আলোকে আদম (عليه السلام)-এর সৃষ্টির বিবরণ। আমি তাফসীরে এসব বিষয়ে আলোচনা করেছি। এখানে আমি উপরোক্ত আয়াতসমূহের সারমর্ম এবং এসব আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীসসমূহ উল্লেখ করেছি। আল্লাহই তওফীক দাতা। আল্লাহ্ তা’আলা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি ফেরেশতাদেরকে সম্বোধন করে বলেছিলেনঃ
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
[Surat Al-Baqarah ৩০]
অর্থাৎ “পৃথিবীতে আমি প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি” (২ঃ ৩০)
এ ঘোষণায় আল্লাহ তা’আলা আদম ও তার এমন বংশধরদের সৃষ্টি করার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন; যারা একে অপরের প্রতিনিধিত্ব করবে। যেমন এক আয়াতে তিনি বলেনঃ
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ
অর্থাৎ- “তিনিই তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি বানিয়েছেন। (৬৪ঃ ১৬৫)
যাহোক, এ ঘোষণা দ্বারা আল্লাহ তা’আলা সংকল্প ব্যক্ত করণার্থে ফেরেশতাদেরকে আদম (عليه السلام) ও তাঁর বংশধরদের সৃষ্টি করার কথা জানিয়ে দেন। যেমন বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আগাম সংবাদ দেওয়া হয়ে থাকে। ঘোষণা শুনে ফেরেশতাগণ বললেনঃ
أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ
অর্থাৎ—“আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে সেখানে অশান্তি ঘটাবে এবং রক্তপাত করবে?” (২ঃ ৩০)
উল্লেখ্য যে, ফেরেশতাগণ বিষয়টির তাৎপর্য জানা এবং তার রহস্য সম্পর্কে অবগতি লাভ করার উদ্দেশ্যে এ কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আপত্তি তোলা, আদম সন্তানদের অমর্যাদা বা তাদের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। যেমন কোন কোন অজ্ঞ মুফাসসির ধারণা করেছেন। তারা বলেছিলেন, আপনি কি পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী ও রক্তপাতকারী কাউকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন? এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেন, আদমের পূর্বে যে জিন ও বিন জাতির বসবাস ছিল; তাদের কার্যকলাপ দেখে ফেরেশতাগণ জানতে পেরেছিলেন যে, আগামীতেও এমন অঘটন ঘটবে। এটা কাতাদার অভিমত।
আব্দুল্লাহ ইবন উমর (رضي الله عنه) বলেনঃ আদম (عليه السلام)-এর পূর্বে জিন জাতি দু’হাজার বছর বসবাস করে। তারা রক্তপাতে লিপ্ত হলে আল্লাহ তাআলা তাদের কাছে এক ফেরেশতা বাহিনী প্রেরণ করেন। তারা তাদেরকে বিভিন্ন দ্বীপে তাড়িয়ে দেন। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকেও এরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। হাসান (رحمة الله) থেকে বর্ণিত যে, ফেরেশতাগণের প্রতি এ তথ্য ইলহাম করা হয়েছিল। কেউ বলেন, লাওহে মাহফুজ থেকে তারা এ ব্যাপারে অবগত হয়েছিলেন। কেউ বলেন, মারূত ও হারূত তাদেরকে তা অবগত করেছিলেন। তাঁরা দুজন তা জানতে পেরেছিলেন তাদের উপরস্থ শাজাল নামক এক ফেরেশতা থেকে। ইবন আবু হাতিম (رحمة الله) আবু জাফর বাকির (رحمة الله) সূত্রে এটা বর্ণনা করেন। কেউ কেউ বলেন, তাদের একথা জানা ছিল যে, মাটি থেকে সৃষ্ট জীবের স্বভাব এরূপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
ونحن نسبح بحمدك ونقدسلك.
অর্থাৎ—আমরা সর্বদা আপনার ইবাদত করি। আমাদের মধ্যকার কেউ আপনার অবাধ্যতা করে না। এখন যদি এদেরকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য এই হয় যে, তারা আপনার ইবাদত করবে; তবে আমরাই তো রাত-দিন অবিশ্রান্তভাবে একাজে নিয়োজিত রয়েছি।
قال اني اعلم ما لا تعلمون
অর্থাৎ—এদেরকে সৃষ্টি করার মধ্যে যে কী সার্থকতা রয়েছে; তা আমি জানি—তোমরা জান না। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে এদেরই মধ্য থেকে বহু নবী-রাসূল, সিদ্দীক ও শহীদের আবির্ভাব হবে। তারপর আল্লাহ তা’আলা ইলমের ক্ষেত্রে ফেরেশতাগণের উপর আদমের শ্রেষ্ঠত্বের কথা ব্যক্ত করে বলেন
علم آدم الأسماء
অর্থাৎ- “এবং তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন।” ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, তাহলো, এসব নাম যদ্বারা মানুষ পরিচিতি লাভ করে থাকে। যেমন মানুষ, জীব, ভূমি, স্থলভাগ ও জলভাগ, পাহাড়-পর্বত, উট-গাধা ইত্যাদি। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে ডেগ-ডেকচি, থালা-বাসন থেকে আরম্ভ করে অধঃবায়ু নির্গমনের নাম পর্যন্ত শিক্ষা দেন। মুজাহিদ (رحمة الله) বলেন, আল্লাহ তাঁকে সকল জীব-জন্তু পশু-পক্ষী ও সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন।
সাঈদ ইবন জুবায়র (رضي الله عنه) এবং কাতাদা (رحمة الله) প্রমুখও এরূপ বলেছেন। রাবী বলেন, আল্লাহ তা’আলা তাঁকে ফেরেশতাগণের নামসমূহ শিক্ষা দেন। আবদুর রহমান ইব্ন যায়দ (رحمة الله) বলেন, আল্লাহ তাকে তার সন্তানদের নাম শিক্ষা দিয়েছেন। তবে সঠিক কথা হলো, আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে ছোট-বড় সকল বস্তু ও তার গুণাগুণ বা বৈশিষ্ট্যের নাম শিক্ষা দেন। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) এদিকে ইংগিত করেছেন।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) ও মুসলিম (رحمة الله) এ প্রসংগে আনাস ইবন মালিক (رضي الله عنه), কাতাদা এবং সাঈদ ও হিশামের সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ কিয়ামতের দিন মু’মিনগণ সমবেত হয়ে বলবে, আল্লাহর নিকট সুপারিশ করার জন্য আমরা যদি কারো কাছে আবেদন করতাম! এই বলে তারা আদম (عليه السلام)-এর কাছে এসে বলবে, আপনি মানব জাতির পিতা। আল্লাহ আপনাকে নিজ কুদরতী হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার ফেরেশতাগণকে আপনার সামনে সিজদাবনত করেছেন ও আপনাকে যাবতীয় বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন .....।
ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَٰؤُلَاءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ.
[Surat Al-Baqarah ৩১]
অর্থাৎ “তারপর সেগুলো ফেরেশতাগণের সম্মুখে পেশ করলেন এবং বললেন, তোমরা আমাকে এ সবের নাম বলে দাও যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।” (২ঃ ৩১)।
হাসান বসরী (رحمة الله) বলেন, আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করতে চাইলে ফেরেশতারা বললেন, আমাদের রব যাকেই সৃষ্টি করুন না কেন আমরাই তার চাইতে বেশি জ্ঞানী প্রতিপন্ন হবো। তাই এভাবে তাদেরকে পরীক্ষা করা হয়। ‘যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’ বলে এদিকেই ইংগিত করা হয়েছে। এ প্রসংগে আরো বিভিন্ন মুফাসসির বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। আমি তাফসীরে তা বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا ۖ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ.
[Surat Al-Baqarah ৩২]
অর্থাৎ-“তারা (ফেরেশতারা) বলল, আপনি পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞানই নেই। বস্তুত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়। (২ঃ ৩২)
যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ.
[Surat Al-Baqarah ২৫৫]
তিনি যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া তার জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারে না। (২ঃ ২৫৫)
قَالَ يَا آدَمُ أَنْبِئْهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ ۖ فَلَمَّا أَنْبَأَهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُلْ لَكُمْ إِنِّي أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنْتُمْ تَكْتُمُونَ.
[Surat Al-Baqarah ৩৩]
অর্থাৎ আল্লাহ বললেন, হে আদম! তাদেরকে এগুলোর নাম বলে দাও। যখন সে এ সকল নাম বলে দিল, তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তোমরা যা ব্যক্ত কর বা গোপন রাখ আমি তাও জানি? (২ঃ ৩৩)
অর্থাৎ আমি প্রকাশ্যটা যেমন জানি, গোপনটাও ঠিক তেমনই জানি। কেউ কেউ বলেন, ‘তোমরা যা ব্যক্ত কর’ বলতে তাদের পূর্বেকার বক্তব্য (اتجعل فيها من يفسد فيها) -কে বুঝানো হয়েছে ‘আর তোমরা যা গোপন রাখ’ দ্বারা ইবলীসের মনে গুপ্ত সে অহংকার ও নিজেকে আদম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করাই বুঝানো হয়েছে। সাঈদ ইবন জুবায়র, মুজাহিদ, সুদ্দী যাহ্হাক ও ছাওরী (رحمة الله) এ কথা বলেছেন এবং ইবন জারীর (رحمة الله) তা সমর্থন করেছেন।
আবুল ‘আলিয়া, রবী, হাসান ও কাতাদা (رحمة الله) বলেনঃ وما كنتم تكتمون দ্বারা ফেরেশতাদের বক্তব্য, ‘আমাদের রব যাকেই সৃষ্টি করুন না কেন আমরা তার চেয়ে বেশি জ্ঞানী এবং বেশি সম্মানিত-ই থাকব’ এ বক্তব্যটির কথা বুঝানো হয়েছে। এবং -
وإذ قلنا للملئكة اسجدوا لآدم فسجدوا إلا إبليس أبى واستكبر.
এটা আদমের প্রতি আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত বিরাট বড় সম্মানের বহিঃপ্রকাশ যা তিনি তাঁকে নিজ হাতে সৃষ্টি করে তার মধ্যে রূহ সঞ্চার করার পর প্রদর্শন করেছিলেন। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ.
[Surat Al-Hijr ২৯]
অর্থাৎ “আমি যখন তাকে সুঠাম করব এবং তার মধ্যে রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো।” (১৫ঃ ২৯)
মোটকথা, আদম (عليه السلام)-কে আল্লাহ তাআলা চারটি মর্যাদা দান করেছেনঃ (১) তাঁকে নিজের পবিত্র হাতে সৃষ্টি করা, (২) তাঁর মধ্যে নিজের রূহ থেকে সঞ্চার করা, (৩) ফেরেশতাগণকে তাকে সিজদা করার আদেশ দান ও (৪) তাকে বন্ধু নিচয়ের নাম শিক্ষা দান। এ জন্যই ঊর্ধজগতে মূসা কালীম (عليه السلام) ও আদম (عليه السلام)-এর সাক্ষাৎ হলে বাদানুবাদ প্রসংগে মূসা (عليه السلام) তাকে বলেছিলেনঃ “আপনি মানব জাতির পিতা আদম (عليه السلام)। আল্লাহ আপনাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, আপনার মধ্যে তিনি নিজের রূহ থেকে সঞ্চার করেছেন, তাঁর ফেরেশতাগণকে তিনি আপনার সামনে সিজদাবনত করিয়েছেন এবং আপনাকে বস্তু নিচয়ের নাম শিক্ষা দিয়েছেন।” কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে সমবেত লোকজন এরূপ বলবে। এতদসংক্রান্ত আলোচনা পূর্বেও হয়েছে এবং একটু পরে আবারো আসবে ইনশাআল্লাহ।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ ۖ قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ.
অর্থাৎ—তোমাদেরকে আমি সৃষ্টি করি, তারপর তোমাদের রূপ দান করি, তারপর ফেরেশতাদেরকে বলি, আদমকে সিজদা কর। ইবলীস ব্যতীত তারা সকলেই সিজদাবনত হয়। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলো না।
আল্লাহ বললেন, আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন কিসে তোমাকে সিজদা করতে বারণ করল? সে বলল, আমি তার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আমাকে তুমি সৃষ্টি করেছ আগুন দিয়ে আর তাকে সৃষ্টি করেছ কাদা মাটি দিয়ে। (৭ঃ ১১-১২)
হাসান বসরী (رحمة الله) বলেন, ইবলীস এখানে যুক্তি প্রয়োগের আশ্রয় নিয়েছিল। আর সে-ই সর্বপ্রথম যুক্তি প্রয়োগকারী। মুহাম্মদ ইবন শিরীন (رحمة الله) বলেন, সর্বপ্রথম যে যুক্তির অবতারণা করেছিল, সে হলো ইবলীস। আর যুক্তির উপর নির্ভর করেই সূর্য ও চন্দ্রের পূজা করা হয়ে থাকে। ইবনে জারীর (رحمة الله) এ দুটি রিওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ইবলীস নিজেকে তার ও আদমের মাঝে তুলনামূলক দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করে আদমের চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করে। ফলে তার এবং সকল ফেরেশতার প্রতি সিজদার আদেশ থাকা সত্ত্বেও সে সিজদা করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যুক্তি যখন (نص) স্পষ্ট নির্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক হয়; তখন তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। তদুপরি ইবলীসের এ যুক্তিটিই মূলত ভ্রান্ত। কেননা মাটি আগুন অপেক্ষা বেশি উপকারী ও উত্তম। কারণ মাটির মধ্যে আছে গাম্ভীর্য, সহনশীলতা, কোমলতা ও উর্বরতা। পক্ষান্তরে আগুনে আছে অস্থিরতা, অধীরতা, ঝোঁক প্রবণতা ও দহন প্রবণতা। তাছাড়া আপন কুদরতী হাতে সৃষ্টি করে ও নিজের রূহ থেকে সঞ্চার করে আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। আর এ কারণেই তাকে সিজদা করার জন্য আল্লাহ্ ফেরেশতাগণকে আদেশ করেছিলেন। যেমন, এক স্থানে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ * فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ * فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ * إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ أَنْ يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ * قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا لَكَ أَلَّا تَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ * قَالَ لَمْ أَكُنْ لِأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ * قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ * وَإِنَّ عَلَيْكَ اللَّعْنَةَ إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ
[Surat Al-Hijr ২৮ - ৩৫]
অর্থাৎ—স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক যখন বললেন, আমি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করছি, যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তাতে আমার রূহ্ সঞ্চার করব; তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো। তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল, সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল। আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! তোমার কি হলো যে, তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলে না?
ইবলীস বলল, আপনি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি হতে যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন; তাকে আমি সিজদা করবার নই। আল্লাহ্ বললেন, তবে তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। কারণ তুমি বিতাড়িত এবং কর্মফল দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি রইল অভিশাপ। (১৫ঃ ২৮-৩৫)
আল্লাহ্ তা’আলার শুকনো থেকে ইবলীসের এ পরিণতির কারণ এই ছিল যে, একদিকে আদম (عليه السلام)-কে তুচ্ছ করায় এবং নিজেকে আদমের চাইতে মর্যাদাবান জ্ঞান করায় সে আদম (عليه السلام)-এর ব্যাপারে আল্লাহর সুনির্দিষ্ট আদেশের বিরোধিতা এবং সত্যদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী হয়। অপরদিকে সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে নিষ্ফল যুক্তি-তর্কের অবতারণা করে। বলা বাহুল্য যে, ইবলীস নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার অপচেষ্টা তার মূল অপরাধের চাইতেও জঘন্যতর ছিল। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(أَوْ خَلْقًا مِمَّا يَكْبُرُ فِي صُدُورِكُمْ ۚ فَسَيَقُولُونَ مَنْ يُعِيدُنَا ۖ قُلِ الَّذِي فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ ۚ فَسَيُنْغِضُونَ إِلَيْكَ رُءُوسَهُمْ وَيَقُولُونَ مَتَىٰ هُوَ ۖ قُلْ عَسَىٰ أَنْ يَكُونَ قَرِيبًا * يَوْمَ يَدْعُوكُمْ فَتَسْتَجِيبُونَ بِحَمْدِهِ وَتَظُنُّونَ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا * وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْزَغُ بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنْسَانِ عَدُوًّا مُبِينًا * رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِكُمْ ۖ إِنْ يَشَأْ يَرْحَمْكُمْ أَوْ إِنْ يَشَأْ يُعَذِّبْكُمْ ۚ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ وَكِيلًا
[Surat Al-Isra' ৫১ - ৫৪]
অর্থাৎ—স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল। সে বলল, আমি কি তাকে সিজদা করব যাকে আপনি কাদা মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন?
সে বলেছিল, বলুন তো এ সে ব্যক্তি যাকে আপনি আমার উপর উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন? আপনি যদি কিয়ামত পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দেন, তবে অল্প কয়েকজন ব্যতীত তার বংশধরগণকে আমি আমার কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে আসবো।
আল্লাহ্ বললেন, যাও তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, জাহান্নামই তোমাদের সকলের শাস্তি, পূর্ণ শাস্তি। তোমার আহ্বানে তুমি তাদের মধ্য থেকে যাকে পার পদস্খলিত কর, তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা তাদেরকে আক্রমণ কর এবং তাদের ধনে ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যাও ও তাদের প্রতিশ্রুতি দাও। শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা ছলনা মাত্র। আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট। (১৭ঃ ৫১-৫৪)
সূরা কাহফে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ
[Surat Al-Kahf ৫০]
অর্থাৎ- স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল। সে জিনদের একজন ছিল।ফলে সে ইচ্ছাকৃতভাবে হঠকারিতা ও অহংকারবশত আল্লাহর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে যায়। (১৮ঃ ৫০)
আগুনের সৃষ্ট হওয়ার কারণে তার স্বভাব এবং তার মন্দ উপাদানই তাকে এ অধঃপতনের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। ইবলীস যে আগুনের সৃষ্টি তা তার নিজের বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত।
তাছাড়া সহীহ মুসলিমে আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “ফেরেশতাগণকে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে আর জিনদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে ধোঁয়াবিহীন অগ্নিশিখা হতে এবং আদমকে যা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে তা তো তোমাদের কাছে বিবৃত হয়েছে।”
হাসান বসরী (رحمة الله) বলেনঃ ইবলীস এক পলকের জন্যও ফেরেশতাগণের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। শাহর ইব্ন হাওশাব (رحمة الله) বলেন, ইবলীস জিন দলভুক্ত ছিল। যখন তারা পৃথিবীতে হাঙ্গামা সৃষ্টি করে, তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাদের নিকট একটি ফেরেশতা বাহিনী প্রেরণ করেন। ফেরেশতাগণ তাদের কতককে হত্যা করেন, কতককে বিভিন্ন দ্বীপে নির্বাসন দেন এবং কতককে বন্দী করেন। ইবলীস ছিল বন্দীদের একজন। ফেরেশতাগণ তাকে ধরে সঙ্গে করে আকাশে নিয়ে যান এবং সে সেখানেই রয়ে যায়। তারপর যখন ফেরেশতাগণকে সিজদার আদেশ করা হয় তখন ইবলীস সিজদা থেকে বিরত থাকে।
ইবন মাসউদ ও ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-সহ একদল সাহাবা এবং সাঈদ ইবন মুসায়াব (رضي الله عنه) প্রমুখ বলেন, ইবলীস সর্বনিম্ন আকাশের ফেরেশতাগণের নেতা ছিল। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, তার নাম ছিল আযাযীল। হারিস (رحمة الله) থেকে বর্ণিত এক বর্ণনায় আছে যে, আবূ কারদূস নাক্কাশ (رحمة الله) বলেন, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেছেনঃ ইবলীস ফেরেশতাগণের একটি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদেরকে জিন বলা হতো। এরা জান্নাতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল। ইলম ও ইবাদতে ইবলীস ছিল এদের সকলের সেরা। তখন তার চারটি ডানাও ছিল। পরে তার রূপ বিকৃতি ঘটিয়ে আল্লাহ তা’আলা তাকে বিতাড়িত শয়তানে পরিণত করেন।
সূরা সাদ-এ আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ طِينٍ * فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ * فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ * إِلَّا إِبْلِيسَ اسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ * قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ۖ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنْتَ مِنَ الْعَالِينَ * قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ ۖ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ * قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ * وَإِنَّ عَلَيْكَ لَعْنَتِي إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ * قَالَ رَبِّ فَأَنْظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ * قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنْظَرِينَ * إِلَىٰ يَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ * قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ * إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ * قَالَ فَالْحَقُّ وَالْحَقَّ أَقُولُ * لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكَ وَمِمَّنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ أَجْمَعِينَ
অর্থাৎ—স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বলেছিলেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করছি কাদা মাটি থেকে। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো তখন ফেরেশতারা সকলেই সিজদাবনত হলো—কেবল ইবলীস ব্যতীত, সে অহংকার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।
তিনি বললেন, হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করলাম, তার প্রতি সিজদাবনত হতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, না তুমি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন? সে বলল, আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদা মাটি থেকে।
তিনি বললেন, তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। নিশ্চয় তুমি বিতাড়িত এবং তোমার উপর আমার লা’নত স্থায়ী হবে কর্মফল দিবস পর্যন্ত।
সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে অবকাশ দিন পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত। তিনি বললেন, তুমি অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হলে—অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত। সে বলল, আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি তাদের সকলকেই পথভ্রষ্ট করব। তবে তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদেরকে নয়।
তিনি বললেন, তবে এটাই সত্য আর আমি সত্যই বলি– তোমার দ্বারা ও তোমার অনুসারীদের দ্বারা আমি জাহান্নাম পূর্ণ করবই। (৩৮ঃ ৭১-৮৫)
সূরা আ’রাফে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ * ثُمَّ لَآتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ
[Surat Al-A'raf ১৬ - ১৭]
সে বলল, আপনি আমাকে উদভ্রান্ত করলেন , এ জন্য আমিও তোমার সরল পথে নিশ্চয় ওঁৎ পেতে বসে থাকব। তারপর আমি তাদের নিকট আসবই তাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ, দক্ষিণ ও বাম দিক থেকে এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞরূপে পাবে না। (৭ঃ ১৬-১৭)
অর্থাৎ তোমার আমাকে উদভ্রান্ত করার ফলে আমি ঘাটে ঘাটে তাদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকব এবং তাদের কাছে তাদের সকল দিক থেকেই আসব। অতএব, ভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, আর যে তার অনুসরণ করবে সে হলো হতভাগা।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, সুবরা ইবন আবুল ফাকিহ (رحمة الله) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, শয়তান আদম (عليه السلام)-এর সন্তানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য অলিতে-গলিতে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। ইবলীসের পরিচিতিতে আমি এ হাদীসটি উল্লেখ করেছি।
আদম (عليه السلام)-কে সিজদা করার জন্য আদিষ্ট ফেরেশতাগণের ব্যাপারে মুফাসসিরগণের মতভেদ রয়েছে যে, এ আদেশটি সকল ফেরেশতার জন্য নয়, কেবল পৃথিবীর ফেরেশতাগণের জন্য ছিল? জমহুর আলিমগণের মতে, সকল ফেরেশতার জন্যেই এ আদেশটি ছিল। যেমন কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহের ব্যাপকতার দ্বারা বোঝা যায়। পক্ষান্তরে ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে যাহ্হাক (رحمة الله)-এর সূত্রে ইবন জারীর শুধুমাত্র পৃথিবীর ফেরেশতাগণের আদিষ্ট হওয়ার কথা বর্ণনা করেন। তবে এ সনদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে এবং বর্ণনাটিতে অপরিচিতি জনিত দুর্বলতা রয়েছে। পরবর্তী যুগের আলিমগণের কেউ কেউ এ দ্বিতীয় অভিমতটি প্রাধান্য দিলেও বর্ণনাভঙ্গি অনুসারে প্রথমটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। ‘এবং তিনি তাঁর ফেরেশতাদেরকে তার সম্মুখে সিজদাবনত করান’ এ হাদীসটিও এর সপক্ষে প্রমাণ বহন করে। এ হাদীসটি ব্যাপক। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
اهبط منها ‘তুমি এখান থেকে নেমে যাও’ এবং اخرج منها ‘তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও’ ইবলীসের প্রতি আল্লাহ্ তা’আলার এ আদেশ প্রমাণ করে যে, ইবলীস আকাশে ছিল। পরে তাকে সেখান থেকে নেমে যাওয়ার এবং নিজের ইবাদত ও আনুগত্যে ফেরেশতাগণের সাদৃশ্য অবলম্বনের ফলে যে পদমর্যাদা সে লাভ করেছিল; তা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। তারপর অহংকার, হিংসা ও তার রব-এর বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে তার সে পদমর্যাদা ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং ধিককৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় তাকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে নিজ স্ত্রীসহ জান্নাতে বসবাস করার আদেশ দেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَقُلْنَا يَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ [Surat Al-Baqarah ৩৫]
অর্থাৎ—এবং আমি বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না; হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (২ঃ ৩৫)
সূরা আ’রাফে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, এ স্থান থেকে তুমি ধিকৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় বের হয়ে যাও। মানুষের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবই।
আর হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর; কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (৭ঃ ১৮-১৯)
অন্যত্র আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ * فَقُلْنَا يَا آدَمُ إِنَّ هَٰذَا عَدُوٌّ لَكَ وَلِزَوْجِكَ فَلَا يُخْرِجَنَّكُمَا مِنَ الْجَنَّةِ فَتَشْقَىٰ * إِنَّ لَكَ أَلَّا تَجُوعَ فِيهَا وَلَا تَعْرَىٰ * وَأَنَّكَ لَا تَظْمَأُ فِيهَا وَلَا تَضْحَىٰ [Surat Ta-Ha ১১৬ - ১১৯]
অর্থাৎ—স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, আদমের প্রতি সিজদাবনত হও; তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল, সে অমান্য করল। তারপর আমি বললাম, হে আদম! এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু। সুতরাং সে যেন কিছুতেই তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে না দেয়, দিলে তোমরা দুঃখ পাবে। তোমার জন্য এই রইল যে, তুমি জান্নাতে ক্ষুধার্ত হবে না এবং নগ্নও হবে না; এবং সেথায় পিপাসার্ত হবে না এবং রৌদ্র-ক্লিষ্টও হবে না। (২০ঃ ১১৬-১১৯)
এ আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, হাওয়া (عليه السلام)-এর সৃষ্টি আদম (عليه السلام)-এর জান্নাতে প্রবেশের আগেই হয়েছিল। কারণ আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর।” ইসহাক ইবন বাশার (رحمة الله) স্পষ্টরূপেই এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু সুদ্দী আবূ সালিহ ও আবু মালিকের সূত্রে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে এবং মুররা-এর সূত্রে ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) ও কতিপয় সাহাবা থেকে বর্ণনা করেন যে, তারা বলেনঃ আল্লাহ তাআলা ইবলীসকে জান্নাত থেকে বের করে দেন। আদম (عليه السلام)-কে জান্নাতে বসবাস করতে দেন। আদম (عليه السلام) তথায় নিঃসঙ্গ একাকী ঘুরে বেড়াতে থাকেন। সেখানে তাঁর স্ত্রী নেই, যার কাছে গিয়ে একটু শান্তি লাভ করা যায়। এক সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। জাগ্রত হয়ে দেখতে পেলেন যে, তাঁর শিয়রে একজন নারী উপবিষ্ট রয়েছেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে আদম (عليه السلام)-এর পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করেন। দেখে আদম (عليه السلام) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে হে? তিনি বললেনঃ আমি একজন নারী। আদম (عليه السلام) বললেন, তোমাকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে? জবাবে তিনি বললেন, যাতে আপনি আমার কাছে শান্তি পান। তখন ফেরেশতাগণ আদম (عليه السلام)-এর জ্ঞানবত্তা যাচাই করার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আদম! উনার নাম কি বলুন তো! আদম (عليه السلام) বললেন, হাওয়া। আবার তারা জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা হাওয়া নাম হলো কেন? আদম (عليه السلام) বললেন, কারণ তাকে ‘হাই’ (জীবন্ত সত্তা) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (رحمة الله) ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, হাওয়াকে আদম (عليه السلام)-এর বাম পাজরের সবচাইতে ছোট হাড় থেকে সৃষ্টি করা হযেছে। তখন আদম (عليه السلام) ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। পরে সে স্থানটি আবার গোশত দ্বারা পূরণ করে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً [Surat An-Nisa' ১]
অর্থাৎ—হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন এবং তাদের দু’জন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন। (৪ঃ ১)
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا ۖ فَلَمَّا تَغَشَّاهَا حَمَلَتْ حَمْلًا خَفِيفًا فَمَرَّتْ بِهِ.
অর্থাৎ—তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়। তারপর যখন সে তার সঙ্গে সংগত হয়, তখন সে এক লঘু গর্ভধারণ করে এবং তা নিয়ে সে অনায়াসে চলাফেরা করে। (৭ঃ ১৮৯)
এ বিষয়ে ইনশাআল্লাহ্ পরে আরো আলোচনা করব।
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “মহিলাদের ব্যাপারে তোমরা আমার সদুপদেশ গ্রহণ কর। কেননা, নারীদেরকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের উপরের অংশটুকুই সর্বাধিক বাকা। যদি তুমি তা সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙ্গে ফেলবে এবং আপন অবস্থায় ছেড়ে দিলে তা বাঁকাই থেকে যাবে। অতএব, মহিলাদের ব্যাপারে তোমরা আমার সদুপদেশ গ্রহণ কর।" পাঠটি ইমাম বুখারী (رحمة الله)-এর।
الاتقربا هذه الشجرة এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণের মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, গাছটি ছিল আঙুরের। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), সাঈদ ইবন জুবায়র, শাবী, জা’দা ইবন হুরায়রা, মুহাম্মদ ইবন কায়স ও সুদ্দী (رحمة الله) থেকে এরূপ বর্ণিত আছে। ইবন আব্বাস, ইবন মাসঊদ (رضي الله عنه) এবং আরো কতিপয় সাহাবা থেকে এক বর্ণনায় আছে যে, ইহুদীদের ধারণা হলো গাছটি ছিল গমের। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), হাসান বসরী (رحمة الله), ওহাব ইবন মুনাব্বিহ, অতিয়্যা আওফী, আবু মালিক, মুহারি ইবন দিছার ও আবদুর রহমান ইবন আবু লায়লা থেকেও এ কথা বর্ণিত আছে। ওহাব (رحمة الله) বলেন, তার দানাগুলো ছিল মাখন অপেক্ষা নরম আর মধু অপেক্ষা মিষ্ট। ছাওরী আবু হাসীন ও আবু মালিক (رحمة الله) সূত্রে বলেনঃ فمرت به এ আয়াতে যে বৃক্ষের কথা বলা হয়েছে তাহলো, খেজুর গাছ। ইবন জুরায়জ মুজাহিদ (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন যে, তাহলো ডুমুর গাছ। কাতাদা এবং ইবন জুরায়জও এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আবুল আলিয়া বলেন, তা এমন একটি গাছ ছিল যে, তার ফল খেলেই পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেতো। কিন্তু জান্নাতে পবিত্রতা নষ্ট হওয়া অনুচিত।
তবে এ মতভেদগুলো পরস্পর কাছাকাছি। কিন্তু লক্ষণীয় হলো এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা নির্দিষ্ট করে এর নাম উল্লেখ করেননি। যদি এর উল্লেখ করার মধ্যে আমাদের কোন উপকার নিহিত থাকত; তাহলে আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই নির্দিষ্ট করে তার উল্লেখ করে দিতেন। পবিত্র কুরআনের আরো বহু ক্ষেত্রে এরূপ অস্পষ্ট রাখার নজীর রয়েছে।
তবে আদম (عليه السلام) যে জান্নাতে প্রবেশ করেছিলেন, তার অবস্থান আসমানে না যমীনে; এ ব্যাপারে যে মতভেদ রয়েছে, তা বিস্তারিত আলোচনা ও নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। জমহুর উলামার মতে তা হচ্ছে আসমানে অবিস্থত জান্নাতুল মাওয়া। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং বিভিন্ন হাদীসে যার ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وقلنا يا دم اسكن أنت وزوجك الجنة-
অর্থাৎ আমি বললাম, হে আদম! তুমি এবং তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর।
এ আয়াতে الجنة এর আলিফ-লাম ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি বরং তদ্বারা সুনির্দিষ্ট একটি জান্নাতকে বুঝানো হয়েছে। তাহলে জান্নাতুল মাওয়া। আবার যেমন মূসা (عليه السلام) আদম (عليه السلام)-কে বলেছিলেনঃ কেন আপনি আমাদেরকে এবং নিজেকে জান্নাত থেকে বের করলেন? এটি একটি হাদীসের অংশ, এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে।
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) ও হুযায়ফা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “আল্লাহ্ তা’আলা মানব জাতিকে সমবেত করবেন। ফলে মুমিনগণ এমন সময়ে উঠে দাঁড়াবে, যখন জান্নাত তাঁদের নিকটে এসে যাবে। তারা আদম (عليه السلام)-এর কাছে এসে বলবেন, হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্য আপনি জান্নাত খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করুন! তখন তিনি বলবেন, তোমাদের পিতার অপরাধই তো তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল! ... এ হাদীসাংশ শক্তভাবে প্রমাণ করে যে, আদম (عليه السلام) যে জান্নাতে বসবাস করেছিলেন, তা হলো জান্নাতুল মাওয়া। কিন্তু এ যুক্তিটিও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।
অন্যরা বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে যে জান্নাতে বসবাস করতে দিয়েছিলেন, তা ‘জান্নাতুল খুলদ’ তথা অনন্ত জান্নাত ছিল না। কারণ নির্দিষ্ট একটি গাছের ফল খেতে নিষেধ করে সেখানেও তার উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। তিনি সেখানে নিদ্রাও যান, সেখান থেকে তাকে বহিষ্কারও করা হয় এবং ইবলীসও সেখানে তাঁর নিকটে উপস্থিত হয়। এ সব কটি বিষয়ই তা যে জানাতুল মাওয়া ছিল না তাই নির্দেশ করে। এ অভিমতটি উবাই ইবন কা’ব, আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), ওহাব ইব্ন মুনাব্বিহ ও সুফিয়ান ইবন উয়ায়না (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত। ইবন কুতায়বা তার ‘আল-মা‘আরিফ’ গ্রন্থে এবং কাযী মুনযির ইবন সাঈদ আল-বাতী তাঁর তাফসীরে এ অভিমতটির সমর্থন করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে একটি স্বতন্ত্র পুস্তকও রচনা করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) এবং তাঁর বিশিষ্ট শিষ্যবৃন্দ থেকেও এরূপ অভিমত উদ্ধৃত করেছেন। আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন উমর আর-রাযী ইবন খতীব আর-রাই (رحمة الله) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে আবুল কাসিম আল-বলখী ও আবু মুসলিম ইস্পাহানী (رحمة الله) থেকে এবং কুরতুবী তাঁর তাফসীরে মুতাযিলা ও কাদরিয়্যা থেকে এ অভিমতটি উদ্ধৃত করেছেন। আহলে কিতাবদের হস্তস্থিত তাওরাতের পাঠেও এর স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। আবু মুহাম্মদ ইবন হাম ‘আল-মিলাল ও আননিহল’ গ্রন্থে এবং আবূ মুহাম্মদ ইবন আতিয়্যা ও আবূ ঈসা রুম্মানী আপন আপন তাফসীরে এ বিষয়টির মতভেদের কথা উল্লেখ করেছেন।
জমহুর উলামার বর্ণনায় প্রথম অভিমতের সমর্থন পাওয়া যায়। কাযী মাওয়ারদী (رحمة الله) তাঁর তাফসীরে বলেন, আদম (عليه السلام) ও হাওয়া (عليه السلام) যে জান্নাতে বসবাস করেন, তার ব্যাপারে দু’টি অভিমত রয়েছে। প্রথমত, তা জান্নাতুল খুলদ। দ্বিতীয় অভিমত হলো, তা স্বতন্ত্র এক জান্নাত যা আল্লাহ্ তা’আলা তাঁদের জন্য পরীক্ষা স্থল হিসাবে তৈরি করেন। এটা সে জান্নাতুল খুলদ নয়, যা আল্লাহ্ তা’আলা পুরস্কারের স্থান হিসেবে প্রস্তুত করে রেখেছেন।
এ দ্বিতীয় অভিমতের সমর্থকদের মধ্যে আবার মতভেদ রয়েছে। একদল বলেন, তার অবস্থান আসমানে। কারণ, আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام) ও হাওয়া (عليه السلام)-কে জান্নাত থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন। এটা হাসানের অভিমত। অপর দল বলেন, তার অবস্থান ছিল পৃথিবীতে। কেননা, আল্লাহ তাআলা সে জান্নাতে বহু ফল-ফলাদির মাঝে বিশেষ একটি গাছ সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলেন। ইবন য়াহয়া-এর অভিমতও অনুরূপ। উল্লেখ্য যে, এ ঘটনাটি ঘটেছিল ইবলীসকে আদম (عليه السلام)-এর প্রতি সিজদাবনত হওয়ার আদেশ দেওয়ার পর। তবে এসব অভিমতের কোনটা সঠিক তা মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
এ হলো কাযী মাওয়ারদির বক্তব্য। এতে তিনি তিনটি অভিমত উদ্ধৃত করেছেন। তাঁর এ বক্তব্য থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মাসআলাটিতে তিনি নিজের কোন সিদ্ধান্ত প্রদান থেকে বিরত রয়েছেন। আবু আবদুল্লাহ্ রাযী (رحمة الله) তাঁর তাফসীরে এ মাসআলা সম্পর্কে চারটি অভিমত বর্ণনা করেছেন। কাযী মাওয়ারদির উপস্থাপিত তিনটি আর চতুর্থটি হলো এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। তাছাড়া তিনি আবূ আলী জুবায়ী (رحمة الله) থেকে এ অভিমত বর্ণনা করেন যে, আদম (عليه السلام) যে জান্নাতে বসবাস করেন, তার অবস্থান আসমানে। তবে তা ‘জান্নাতুল মাওয়া নয়।
দ্বিতীয় অভিমতের সমর্থকগণ একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যার জবাব দেওয়া আবশ্যক। তারা বলেন, এটা নিঃসন্দেহ যে, সিজদা করা থেকে বিরত থাকার দরুন আল্লাহ্ তা’আলা ইবলীসকে আপন সানিধ্য থেকে বিতাড়িত করে দেন এবং তাকে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার ও নেমে যাওয়ার আদেশ প্রদান করেন। আর এ আদেশটি কোন শরয়ী আদেশ ছিল না যে, তাঁর বিরুদ্ধাচরণের অবকাশ থাকবে বরং তা ছিল এমন অখণ্ডনীয় তকদীর সংক্রান্ত নির্দেশ যার বিরুদ্ধাচরণ বা প্রতিরোধের কোন অবকাশই থাকে না।
তাই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُومًا مَدْحُورًا
[Surat Al-A'raf ১৮]
অর্থাৎ—এখান থেকে তুমি ধিকৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় বের হয়ে যাও। (৭ঃ ১৮)
قَالَ فَاهْبِطْ مِنْهَا فَمَا يَكُونُ لَكَ أَنْ تَتَكَبَّرَ فِيهَا
[Surat Al-A'raf ১৩]
অর্থাৎ—এ স্থান থেকে তুমি নেমে যাও, এখানে থেকে তুমি অহংকার করবে, এ হতে পারে না। (৭ঃ ১৩)
(قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ
[Surat Al-Hijr ৩৪]
অর্থাৎ—তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, কারণ তুমি অভিশপ্ত। (১৫ঃ ৩৪)।
এ আয়াতগুলোতে منها এর সর্বনামটি দ্বারা الجنة (জান্নাত) কিংবা السما (আসমান) অথবা المنزله (আবাস স্থল) বুঝানো হয়েছে। তা যাই হোক, এটা জানা কথা যে, ইবলীসকে যে স্থান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল, সেখানে সামান্যতম সময়ের জন্যেও তার অবস্থান থাকার কথা নয়—স্থায়িভাবে বসবাস রূপেই হোক, আর কেবল পথ অতিক্রম রূপেই হোক। তারা বলেন যে, কুরআনের বাহ্যিক বর্ণনাভঙ্গী থেকে এটাও প্রমাণিত যে, ইবলীস আদম (عليه السلام)-কে এই বলে কুমন্ত্রণা দিয়েছিল যেঃ
هَلْ أَدُلُّكَ عَلَىٰ شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَا يَبْلَىٰ
অর্থাৎ—হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষের কথা এবং অক্ষয় রাজ্যের কথা? (২০ঃ ১২০)।
(فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُورِيَ عَنْهُمَا مِنْ سَوْآتِهِمَا وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَٰذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَنْ تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِينَ * وَقَاسَمَهُمَا إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِينَ * فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ ۚ فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ ۖ وَنَادَاهُمَا رَبُّهُمَا أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَكُمَا إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُبِينٌ)
[Surat Al-A'raf ২০ - ২২]
অর্থাৎ—আর সে বলল, পাছে তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা তোমরা স্থায়ী হও এ জন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন। সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল, আমি তোমাদের হিতাকাক্ষীদের একজন। এভাবে সে তাদেরকে প্রবন্ধনা দ্বারা অধঃপতিত করল। (৭ঃ ২০-২২)
এ আয়াতগুলো স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, আদম (عليه السلام) ও হাওয়ার সঙ্গে তাঁদের জান্নাতে ইবলীস-এর সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তাদের এ প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে যে, নিয়মিত বসবাসের ভিত্তিতে না হলেও যাতায়াত ও আনাগোনার সুবাদে জান্নাতে আদম (عليه السلام) ও হাওয়া (عليه السلام)-এর সঙ্গে ইবলীস-এর একত্রিত হওয়া বিচিত্র নয়। কিংবা এও হতে পারে যে, জান্নাতের দরজায় দাঁড়িয়ে বা আকাশের নিচে থেকে ইবলীস তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিয়েছিল। তবে তিনটি জবাবের কোনটিই সন্দেহমুক্ত নয়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আদম (عليه السلام) যে জান্নাতে বসবাস করেন, তার অবস্থান পৃথিবীতে হওয়ার সপক্ষে যারা মতপোষণ করেন, তার দলিল নিম্নের হাদীস— তা হলোঃ
উবাই ইবন কা’ব (رضي الله عنه) সূত্রে আবদুল্লাহ ইবন ইমাম আহমদ যিরাদাতে বর্ণনা করেন যে, উবাই ইবন কা’ব (رضي الله عنه) বলেছেন, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে আদম (عليه السلام)-এর জান্নাতের আঙ্গুর খাওয়ার আকাঙক্ষা হলে তাঁর সন্তানরা আঙ্গুরের সন্ধানে বের হন। পথে তাঁদের সঙ্গে ফেরেশতাগণের সাক্ষাৎ ঘটে। তারা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আদমের সন্তানরা! তোমরা যাচ্ছ কোথায়? তারা বললেন, আমাদের পিতা জান্নাতের এক ছড়া আঙ্গুর খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। ফেরেশতাগণ বললেন, “তোমরা ফিরে যাও, তোমরা তার জন্য যথেষ্ট করেছ, আর দরকার নেই।” অগত্যা তারা আদম (عليه السلام)-এর নিকট ফিরে গেলেন। ফেরেশতাগণ আদম (عليه السلام)-এর রূহ কবয করে গোসল দিয়ে সুগন্ধি মাখিয়ে তাকে কাফন পরান। তারপর অন্যান্য ফেরেশতাকে নিয়ে জিবরাঈল (عليه السلام) তার জানাযার নামায আদায় করে তাকে দাফন করেন। এরপর তারা বলল, এ হলো তোমাদের মৃতদের ব্যাপারে তোমাদের করণীয় সুন্নত। সনদসহ হাদীসটি পরে আসছে এবং আদম (عليه السلام)-এর ওফাতের আলোচনায় পূর্ণ হাদীসটি উল্লেখ করা হবে।
এ হাদীসের ভিত্তিতে দ্বিতীয় অভিমতের সমর্থকগণ বলেনঃ আদম (عليه السلام) যে জান্নাতে বসবাস করেছিলেন, তাতে পৌঁছানো যদি সম্ভব না হতো, তাহলে আদম (عليه السلام)-এর সন্তানরা তার অনুসন্ধানে বেরই হতেন না। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, সে জান্নাত ছিল পৃথিবীতে আসমানে নয়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। এ তাঁরা আরো বলেনঃ
ويادم اسكن أنت وزوجك الجنه
আয়াতে الجنة বলতে আসমানের জান্নাত বুঝানো হয়নি বরং আদম (عليه السلام) আসমানে বক্তব্যের পূর্বাপর দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, তা ছিল দুনিয়াতে অবস্থিত। কেননা, আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে পৃথিবী থেকে। আর কোথাও এ কথার উল্লেখ পাওয়া যায় না যে, তাঁকে আসমানে তুলে নেয়া হয়েছিল। তাছাড়া তাঁকে সৃষ্টিই করা হয়েছে পৃথিবীতে থাকার জন্য।
আর আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাগণকে এ বলে তা জানিয়েও দিয়েছিলে যে,
اني جاعل في الارض خليفة
অর্থাৎ—“পৃথিবীতে আমি প্রতিনিধি বানাচ্ছি।” এর সমর্থনে তাঁরা আরেকটি নজীর হিসাবে নিমোক্ত আয়াতটি পেশ করেন।
إِنَّا بَلَوْنَاهُمْ كَمَا بَلَوْنَا أَصْحَابَ الْجَنَّةِ.
অর্থাৎ- ‘আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি যেভাবে পরীক্ষা করেছিলাম উদ্যান ওয়ালাদেরকে। (৬৮ঃ ১৭) এ আয়াতেও الجنة বলতে সকল উদ্যানকে বুঝানো হয়নি বরং তা এক বিশেষ উদ্যান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
তারা আরো বলেন, অবতরণ করার উল্লেখ আদম (عليه السلام)-এর আসমান থেকে নেমে আসার প্রমাণ বহন করে না। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(قِيلَ يَا نُوحُ اهْبِطْ بِسَلَامٍ مِنَّا وَبَرَكَاتٍ عَلَيْكَ وَعَلَىٰ أُمَمٍ مِمَّنْ مَعَكَ
[Surat Hud ৪৮]
অর্থাৎ “বলা হলো, হে নূহ! তুমি নেমে এসো আমার প্রদত্ত শান্তিসহ এবং তোমার প্রতি ও যে সমস্ত সম্প্রদায় তোমার সাথে আছে তাদের প্রতি কল্যাণসহ।” (১১ঃ ৪৮)
এখানে লক্ষণীয় যে, যখন ভূপৃষ্ঠ থেকে পানি শুকিয়ে যায় এবং নৌকাটি জুদী পর্বতে গিয়ে স্থির হয়, তখন নূহ (عليه السلام) ও তাঁর অনুসারীদেরকে সেখান থেকে নেমে আসার আদেশ করা হয়। অন্য আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
اهْبِطُوا مِصْرًا فَإِنَّ لَكُمْ مَا سَأَلْتُمْ
অর্থাৎ তোমরা নগরে অবতরণ কর, তোমরা যা চাও তা সেখানে আছে। (২ঃ ৬১)। আরেক আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ
অর্থাৎ— কতক পাথর এমনও আছে যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে। (২ঃ ৭৪) হাদীস ও অভিধানে এর অসংখ্য নজীর রয়েছে।
তারা আরো বলেনঃ এতে অসুবিধার কিছু নেই বরং এটাই বাস্তব যে, আল্লাহ তাআলা আদম (عليه السلام)-কে যে জান্নাতে থাকতে দিয়েছিলেন, তা ছিল সমগ্র ভূখণ্ড থেকে উঁচু বৃক্ষরাজি, ফল-ফলাদি, ছায়া, ভোগ-সামগ্রী ও সুখ সমৃদ্ধ একটি মনোরম উদ্যান। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّ لَكَ أَلَّا تَجُوعَ فِيهَا وَلَا تَعْرَىٰ
অর্থাৎ সেখানে তোমার অভ্যন্তর ক্ষুধার জ্বালায় এবং বহির্দেহ রৌদ্রের দাহনে ক্লিষ্ট হবে। (২০ঃ ১১৮)
وَأَنَّكَ لَا تَظْمَأُ فِيهَا وَلَا تَضْحَىٰ
অর্থাৎ তথায় তোমার ভেতরাংশ পিপাসার উষ্ণতা এবং বহিরাংশ সূর্যের তাপ স্পর্শ করবে। (২০ঃ ১১৯)
পরস্পর সাযুজ্য থাকার কারণে আল্লাহ্ তা’আলা এ দু’আয়াতে ক্ষুধা ও বিবস্ত্রতাকে একসাথে এবং পিপাসার উষ্ণতা ও সূর্যের দাহনকে একসাথে উল্লেখ করেছেন।
তারপর নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে ফেললে আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে দুঃখ-কষ্ট, পংকিলতা, শ্রম-সাধনা, বিপদাপদ; পরীক্ষা, অধিবাসীদের দীন-ধর্ম, স্বভাব-চরিত্র, কার্যকলাপ, কামনা-বাসনা ও উচ্চারণ আচরণগত বৈপরিত্যপূর্ণ পৃথিবীপৃষ্ঠে নামিয়ে দেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَىٰ حِينٍ
অর্থাৎ— পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রয়েছে। (২ঃ ৩৬)
এতে একথা প্রমাণিত হয় না যে, তারা আগে আসমানে ছিল। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَقُلْنَا مِنْ بَعْدِهِ لِبَنِي إِسْرَائِيلَ اسْكُنُوا الْأَرْضَ فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ الْآخِرَةِ جِئْنَا بِكُمْ لَفِيفًا
অর্থাৎ— এরপর আমি বনী ইসরাঈলকে বললাম, তোমরা ভূ-পৃষ্ঠে বসবাস কর। এবং যখন কিয়ামতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে, তখন তোমাদের সকলকে আমি একত্র করে উপস্থিত করব। (১৭ঃ ১০৪)
কিন্তু এটা সর্বজনবিদিত যে, বনী ইসরাঈলের বসবাস এ পৃথিবীতেই ছিল— আসমানে নয়। তারা আরো বলেন, যারা বর্তমানে জান্নাত ও জাহান্নামের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, আমরা তাদের সে বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করছি না। তাদের বক্তব্য ও আমাদের এ অভিমতের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। এ জন্যই এ দ্বিতীয় মত পোষণকারী প্রাচীন কালের সকল আলিম এবং পরবর্তী যুগের অধিকাংশ আলিমের অভিমত বর্ণিত হয়েছে; তারা বর্তমানেও জান্নাত-জাহান্নামের অস্তিত্ব রয়েছে বলে স্বীকার করেন। যেমন কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বহু বিশুদ্ধ হাদীস তার প্রমাণ বহন করে। যথাস্থানে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হবে। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ।
فَأَزَلَّهُمَا الشَّيْطَانُ عَنْهَا فَأَخْرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيهِ
অর্থাৎ— কিন্তু শয়তান তা থেকে তাদেরকে পদস্খলন ঘটাল (অর্থাৎ বেহেশত থেকে) এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে তাদেরকে বহিস্কৃত করল। (২ঃ ৩৬)
অর্থাৎ—জান্নাত থেকে এবং তারা যে সুখ-সম্ভোগ ও আমোদ-আহলাদে ছিলেন তা থেকে বের করে অশান্তি ও দুর্দশার জগতে নিয়ে আসলো। তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিয়ে এবং মোহে ফেলে শয়তান তাদের দুর্দশা ঘটায়। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُورِيَ عَنْهُمَا مِنْ سَوْآتِهِمَا وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَٰذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَنْ تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِينَ. وَقَاسَمَهُمَا إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِينَ
অর্থাৎ-তারপর তাদের লজ্জাস্থান, যা গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, পাছে তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা তোমরা স্থায়ী হও এ জন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন। সে তাদের উভয়ের কাছে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের হিতাকাঙক্ষীদের একজন। (৭ঃ ২০-২১)
অর্থাৎ শয়তান তাদেরকে বলল যে, আল্লাহ্ তাআলা তোমাদের এ বৃক্ষের ফল খেতে নিষেধ করার কারণ হলো তা খেলে তোমরা ফেরেশতা হয়ে যাবে কিংবা চিরস্থায়ী হয়ে যাবে। আর তাদেরকে এ ব্যাপারে শপথ করে বলল যে, নিঃসন্দেহে আমি তোমাদের হিতকাক্ষীদের একজন। যেমন অন্য আয়াতের আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
فَوَسْوَسَ إِلَيْهِ الشَّيْطَانُ قَالَ يَا آدَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَىٰ شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَا يَبْلَىٰ
অর্থাৎ তারপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল; সে বলল, হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষের কথা ও অক্ষয় রাজ্যের কথা? (২০ঃ ১২০)।
অর্থাৎ আমি কি তোমাকে এমন বৃক্ষের সন্ধান দেব, যার ফল খেলে তুমি স্থায়ী জীবন লাভ করবে, তুমি এখন যে সুখ-সম্ভোগ ও শান্তিতে আছ; চিরজীবন তা ভোগ করতে পারবে এবং তুমি এমন রাজত্ব লাভ করবে, যার কখনো বিনাশ ঘটবে না। ইবলীসের এ বক্তব্য ছিল সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক এবং বাস্তবতা বিবর্জিত।
আলোচ্য আয়াতে شجرة الخلد এর মর্ম হচ্ছে যে, এর ফল ভক্ষণ করলে তুমি অনন্ত জীবন লাভ করবে। আবার তদ্বারা সে বৃক্ষত্ত উদ্দেশ্য হতে পারে, নিম্নোক্ত হাদীসে যার উল্লেখ রয়েছে। তাহলোঃ
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “জান্নাতে এমন একটি বৃক্ষ আছে যে, আরোহী তার ছায়ায় একশ বছর ভ্রমণ করেও তা অতিক্রম করতে পারবে না। তাহলো ‘শাজারাতুল খুলদ’। হাদীসটি অন্যন্য সূত্রেও বর্ণিত আছে এবং ইমাম আবু দাউদ তায়ালিসীও তার মুসনাদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। গুনদুর বলেন, আমি শু’বাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কি সেই শাজারাতুল খুলদ? তিনি বললেন, না বর্ণনায় ‘তাহলো’ বাক্যাংশটি নেই।
فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ ۚ فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ
অর্থাৎ এভাবে সে তাদেরকে প্রবঞ্চনা দ্বারা অধঃপতিত করল। তারপর যখন তারা সে বৃক্ষ-ফলের আস্বাদ গ্রহণ করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং উদ্যানপত্র দ্বারা তারা তাদেরকে আবৃত করতে লাগল। (৭ঃ ২২)
যেমন সূরা তা-হায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
فَأَكَلَا مِنْهَا فَبَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ
অর্থাৎ— তারপর তারা তা থেকে ভক্ষণ করল; তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ল। (২০ঃ ১২১)
আদম (عليه السلام)-এর আগেই হাওয়া (عليه السلام) বৃক্ষ-ফল ভক্ষণ করেছিলেন এবং তিনিই আদম (عليه السلام)-কে তা খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। বুখারীর নিম্নোক্ত হাদীসটি এ অর্থেই নেওয়া হয়ে থাকে।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “বনী ইসরাঈলরা না হলে গোশত পচতো না আর হাওয়া না হলে কোন নারী তার স্বামীর সঙ্গে খেয়ানত করত না।” বুখারী ও মুসলিম, আহমদ ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আহলে কিতাবদের হাতে রক্ষিত তাওরাতে আছে যে, হাওয়া (عليه السلام)-কে বৃক্ষ-ফল খাওয়ার পথ দেখিয়েছিল একটি সাপ। সাপটি ছিল অত্যন্ত সুদর্শন ও বৃহদাকার। তার কথায় হাওয়া (عليه السلام) নিজেও তা খান এবং আদম (عليه السلام)-কেও তা খাওয়ান। এ প্রসঙ্গে ইবলীসের উল্লেখ নেই। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের চোখ খুলে যায় এবং তাঁরা দুজনে আঁচ করতে পারেন যে, তারা দুজন বিবস্ত্র। ফলে তাঁরা ডুমুরের পাতা গায়ে জড়িয়ে নেন। তাওরাতে এও আছে যে, তারা বিবস্ত্রই ছিলেন। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ (رحمة الله) বলেন, আদম (عليه السلام) ও হাওয়া (عليه السلام)-এর পোশাক ছিল তাদের উভয়ের লজ্জাস্থানের উপর একটি জ্যোতির আবরণ।
উল্লেখ্য যে, আহলে কিতাবদের হাতে রক্ষিত বর্তমান তাওরাতে একথাটি ভুল এবং বিকৃত এবং আরবী ভাষান্তরের প্রমাদ বিশেষ। কারণ, ভাষান্তর কর্মটি যার-তার পক্ষে সহজসাধ্য নয়। বিশেষ করে আরবী ভাষায় যার ভালো দক্ষতা নেই এবং মূল কিতাবের ভাব উদ্ধারে যিনি পটু নন, তার পক্ষে তো এ কাজটি অত্যন্ত দুরূহ। এজন্যই আহলে কিতাবদের তাওরাত আরবীকরণে শব্দ ও মর্মগত যথেষ্ট ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে। কুরআনে করীমের নিম্নোক্ত বর্ণনার দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আদম ও হাওয়া (عليه السلام)-এর দেহে বস্ত্র ছিল।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْآتِهِمَا
অর্থাৎ শয়তান তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখাবার জন্য বিবস্ত্র করে। (৭ঃ ২৭)
কুরআনের এ বক্তব্য তো আর অন্য কারো কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
ইবন আবু হাতিম (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, উবাই ইবন কা’ব (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা আদম (عليه السلام)-কে দীর্ঘকায় এবং ঘন কেশবিশিষ্ট পুরুষরূপে সৃষ্টি করেন, যেন তিনি ছিলেন দীর্ঘ এক খেজুর গাছ। তারপর যখন তিনি বৃক্ষ-ফল আস্বাদন করেন, তখন দেহ থেকে তার পোশাক খসে পড়ে। তখন সর্বপ্রথম তার যে অঙ্গটি প্রকাশ পেয়েছিল তাহলে তাঁর লজ্জাস্থান। নিজের লজ্জাস্থান দেখে তিনি জান্নাতের মধ্যে দৌড়াতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তার চুল একটি বৃক্ষে আঁটকে যায়। ফলে তিনি তা টেনে নেন। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে লক্ষ্য করে বললেন, আদম! তুমি কি আমার থেকে পালিয়ে যাচ্ছ? আল্লাহর কথা শুনে আদম (عليه السلام) বললেন, পালাচ্ছি না হে আমার রব! লজ্জায় এমনটি করছি।
ছাওরী (رحمة الله) وطفقا يخصفان من ورق الجنة এর ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেনঃ এখানে জান্নাতের যে বৃক্ষ-পত্রের কথা বলা হয়েছে তা ছিল ডুমুর বৃক্ষের পাতা। এটাই সহীহ সনদ। সম্ভবত তা আহলি কিতাবদের বর্ণনা থেকে নেওয়া হয়েছে। আয়াতে সুস্পষ্টভাবে কোন নির্দিষ্ট পাতার কথা বলা হয়নি। আর এটা মেনে নিলেও কোন ক্ষতি নেই। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
হাফিজ ইবন আসাকির (رحمة الله) উবাই ইবন কা’ব (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “তোমাদের পিতা আদম (عليه السلام) লম্বা খেজুর গাছের ন্যায় ষাট হাত দীর্ঘ ঘন কেশবিশিষ্ট ছিলেন এবং গোপনাঙ্গ আবৃত ছিল। তারপর জান্নাতে অপরাধ করে বসলে তার গোপনাঙ্গ প্রকাশ হয়ে পড়ে। ফলে তাঁকে জান্নাত থেকে বের হতে হয়। তখন একটি বৃক্ষের মুখোমুখি হলে বৃক্ষটি তার মাথার সম্মুখ ভাগের কেশগুচ্ছ ধরে ফেলে। এদিকে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে ডেকে বললেন, আমার নিকট থেকে পালাতে চাও হে আদম? আদম (عليه السلام) বললেন, আল্লাহর শপথ! আপনার লজ্জায় নিজ কৃতকর্মের জন্যে এমনটি করছি, হে আমার রব!
অন্যান্য সূত্রে বিশুদ্ধতর সনদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে অনুরূপ একটি রিওয়ায়ত রয়েছেঃ
وَنَادَاهُمَا رَبُّهُمَا أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَكُمَا إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُبِينٌ. قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
অর্থাৎ— তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হতে বারণ করিনি? এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?
তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে অবশ্য আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব। (৭ঃ ২২-২৩)
এ হলো অপরাধের স্বীকারোক্তি, তাওবার শরণাপন্ন হওয়া এবং উপস্থিত মুহূর্তে আল্লাহর নিকট নিজের হীনতা, বিনয় ও অসহায়ত্বের অভিব্যক্তি। বলা বাহুল্য যে, আদমের সন্তানদের যে-ই অপরাধ স্বীকার করে এরূপ তাওবা করবে ইহকাল ও পরকালে তার পরিণাম মঙ্গলজনকই হবে।
قَالَ اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ ۖ وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَىٰ حِينٍ
অর্থাৎ আল্লাহ্ বললেন, তোমরা নেমে যাও, তোমরা একে অপরের শত্রু এবং পৃথিবীতে তোমাদের কিছুকাল বসবাস ও জীবিকা রয়েছে। (৭ঃ ২৪)।
আদম (عليه السلام), হাওয়া (عليه السلام) ও ইবলীসকে সম্বোধন করে এ আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কারো কারো মতে, তাদের সঙ্গে সাপটিও এ আদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সীমালংঘন করার অপরাধে তাদেরকে জান্নাত থেকে নেমে যাওয়ার এ আদেশ দেওয়া হয়।
আদম ও হাওয়া (عليه السلام)-এর সাথে সাপের উল্লেখের সপক্ষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি হাদীস পেশ করা হয়ে থাকে। তাহলো— রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাপ হত্যার আদেশ দিয়ে বলেন, যেদিনওগুলোর সাথে আমরা লড়াই করেছি, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ওগুলোর সাথে আর আমরা সন্ধি করিনি।’ সূরা তা-হায় আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(قَالَ ٱهۡبِطَا مِنۡهَا جَمِیعَۢاۖ بَعۡضُكُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوࣱّۖ)
[Surat Ta-Ha ১২৩]
অর্থাৎ, তোমরা দুজনে একই সঙ্গে জান্নাত থেকে নেমে যাও। তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্রু। (২০: ১২৩)
এই আদেশ হলো আদম (عليه السلام) ও ইবলীসের প্রতি। আর হাওয়া আদমের এবং সাপ ইবলীসের অনুগামী হিসাবে এ আদেশের আওতাভুক্ত। কেউ কেউ বলেন, এখানে দ্বিবচন শব্দ দ্বারা একত্রে সকলকেই আদেশ করা হয়েছে। যেমন একস্থানে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
(وَدَاوُۥدَ وَسُلَیۡمَـٰنَ إِذۡ یَحۡكُمَانِ فِی ٱلۡحَرۡثِ إِذۡ نَفَشَتۡ فِیهِ غَنَمُ ٱلۡقَوۡمِ وَكُنَّا لِحُكۡمِهِمۡ شَـٰهِدِینَ)
[Surat Al-Anbiya' ৭৮]
অর্থাৎ—এবং স্মরণ কর দাউদ ও সুলায়মানের কথা, যখন তারা বিচার করছিল শস্য ক্ষেত্র সম্পর্কে; তাতে রাত্রিকালে প্রবেশ করেছিল কোন সম্প্রদায়ের মেষ; আমি প্রত্যক্ষ করছিলাম তাদের বিচার। (২১: ৭৮)
সঠিক কথা হলো—এ আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বহুবচন শব্দ দ্বারা দু’ব্যক্তিকে বুঝিয়েছেন। কেননা, বিচারক দু’ব্যক্তির মাঝে বিচার করে থাকেন। একজন বাদী অপরজন বিবাদী। অথচ আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, وَكُنَّا لِحُكۡمِهِمۡ شَـٰهِدِینَ ‘আমি তাদের বিচার প্রত্যক্ষ করছিলাম।
সূরা বাকারায় (৩৬-৩৯) আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(فَأَزَلَّهُمَا ٱلشَّیۡطَـٰنُ عَنۡهَا فَأَخۡرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِیهِۖ وَقُلۡنَا ٱهۡبِطُوا۟ بَعۡضُكُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوࣱّۖ وَلَكُمۡ فِی ٱلۡأَرۡضِ مُسۡتَقَرࣱّ وَمَتَـٰعٌ إِلَىٰ حِینࣲ فَتَلَقَّىٰۤ ءَادَمُ مِن رَّبِّهِۦ كَلِمَـٰتࣲ فَتَابَ عَلَیۡهِۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِیمُ قُلۡنَا ٱهۡبِطُوا۟ مِنۡهَا جَمِیعࣰاۖ فَإِمَّا یَأۡتِیَنَّكُم مِّنِّی هُدࣰى فَمَن تَبِعَ هُدَایَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَلَا هُمۡ یَحۡزَنُونَ وَٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ وَكَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَاۤ أُو۟لَـٰۤىِٕكَ أَصۡحَـٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِیهَا خَـٰلِدُونَ)
[Surat Al-Baqarah ৩৬ - ৩৯]
আয়াতে আল্লাহ তা’আলা দু’বার اهبطوا বলে অবতরণের আদেশ করেছেন। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কোন কোন মুফাসসির বলেন, প্রথম অবতরণ দ্বারা জান্নাত থেকে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসা আর দ্বিতীয়টি দ্বারা নিকটবর্তী আসমান থেকে দুনিয়াতে নেমে আসা বুঝানো হয়েছে। এ ব্যাখ্যাটি দুর্বল। কারণ আল্লাহ তা’আলা প্রথম আদেশে বলেছেনঃ
وَقُلۡنَا ٱهۡبِطُوا۟ بَعۡضُكُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوࣱّۖ وَلَكُمۡ فِی ٱلۡأَرۡضِ مُسۡتَقَرࣱّ وَمَتَـٰعٌ إِلَىٰ حِینࣲ )
অর্থাৎ-“আমি বললাম, তোমরা একে অন্যের শত্রুরূপে নেমে যাও। পৃথিবীতে কিছু কালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল।” এ আয়াত প্রমাণ করে যে, প্রথমবারেই তঁদেরকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
সঠিক কথা হলো- বিষয়বস্তু এক হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা’আলা শব্দগতভাবে কথাটি দু’বার উল্লেখ করেছেন এবং প্রতিবারের সাথে একটি করে অবশ্যম্ভাবী বিধান জুড়ে দিয়েছেন। প্রথমটির সাথে জুড়ে দিয়েছেন তাদের পারস্পরিক শত্রুতা এবং দ্বিতীয়টির সাথে জুড়ে দিয়েছেন যে, পরবর্তীতে তাদের উপর যে হিদায়ত নাযিল করা হবে, যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে সে হবে ভাগ্যবান, আর যে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে হবে ভাগ্যাহত। বলা বাহুল্য যে, কুরআনে করীমে এ ধরনের ভাবভঙ্গির বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে।
হাফিজ ইবন আসাকির (رحمة الله) মুজাহিদ (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام) ও হাওয়া (عليه السلام)-কে তাঁর নৈকট্য থেকে বের করে দেয়ার জন্য দু’জন ফেরেশতাকে আদেশ দেন। ফলে জিবরাঈল (عليه السلام) তাঁর মাথা থেকে মুকুট উঠিয়ে নেন এবং মীকাঈল (عليه السلام) তাঁর কপাল থেকে মুকুট খুলে ফেলেন এবং একটি বৃক্ষশাখা, তাকে জড়িয়ে ধরে। তখন আদম (عليه السلام) ধারণা করলেন যে, এটা তাঁর তাৎক্ষণিক শাস্তি। তাই তিনি মাথা নিচু করে বলতে লাগলেন—ক্ষমা চাই, ক্ষমা চাই। তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন, তুমি কি আমার নিকট থেকে পালাচ্ছো? আদম (عليه السلام) বললেন, বরং আপনার লজ্জায় এমনটি করছি, হে আমার মনিব!
আওযায়ী (رحمة الله) হাসসান ইবন আতিয়্যা (رحمة الله) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আদম (عليه السلام) জান্নাতে একশ’ বছরকাল অবস্থান করেন। অন্য এক বর্ণনায় ষাট বছরের উল্লেখ রয়েছে। তিনি জান্নাত হারানোর দুঃখে সত্তর বছর, অন্যায়ের অনুতাপে সত্তর বছর এবং নিহত পুত্রের শোকে চল্লিশ বছর ক্রন্দন করেন। ইবন আসাকির (رحمة الله) এটি বর্ণনা করেন।
ইবন আবূ হাতিম (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইব্ন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, আদম (عليه السلام)-কে মক্কা ও তায়িফের মধ্যবর্তী দাহনা নামক স্থানে নামিয়ে দেয়া হয়। হাসান (رحمة الله) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আদম (عليه السلام)-কে ভারতে, হাওয়া (عليه السلام)-কে জিদ্দায় এবং ইবলীসকে বসরা থেকে মাইল কয়েক দূরে দস্তমীসান নামক স্থানে নামিয়ে দেয়া হয় আর সর্পটিকে নামানো হয় ইস্পাহানে।
সূদ্দী (رحمة الله) বলেন, আদম (عليه السلام) ভারতে অবতরণ করেন। আসার সময় তিনি হাজারে আসওয়াদ ও জান্নাতের এক মুঠো পাতা নিয়ে আসেন এবং এ পাতাগুলো ভারতের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে দেন। ফলে সে দেশে সুগন্ধির গাছ উৎপন্ন হয়। ইবন উমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আদম (عليه السلام)-কে সাফায় এবং হাওয়া (عليه السلام)-কে মারওয়ায় নামিয়ে দেওয়া হয়। ইবন আবূ হাতিম এ তথ্যটিও বর্ণনা করেছেন।
আব্দুর রাযযাক (رحمة الله) আবু মূসা আশআরী (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়ার সময় যাবতীয় বস্তুর প্রস্তুত প্রণালী শিখিয়ে দেন এবং জান্নাতের ফল-ফলাদি থেকে তার আহার্যের ব্যবস্থা করে দেন। সুতরাং তোমাদের এ ফল-মূল জান্নাতের ফল-মূল থেকেই এসেছে। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, এগুলোতে বিকৃতি আসে আর ওগুলোর কোন বিকৃতি নেই।
হাকিম (رحمة الله) তার মুস্তাদরাকে বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেনঃ আদম (عليه السلام)-কে জান্নাতে শুধুমাত্র আসর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়টুকু থাকতে দেয়া হয়েছিল। হাকিম (رحمة الله) বলেন, হাদীসটি বুখারী, মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ, তবে তারা হাদীসটি বর্ণনা করেন নি।
সহীহ মুসলিমে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “দিনসমূহের মধ্যে জুমু’আর দিন হলো সর্বোত্তম। এ দিনে আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করা হয়, এদিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়, এ দিন তাঁকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করা হয়।” সহীহ বুখারীতে অন্য এক সূত্রে আছে যে, “এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।”
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ দিবসসমূহের মধ্যে জুমুআর দিন হলো সর্বোত্তম। এদিনে আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করা হয়, এদিনে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়, এ দিনে তাকে জান্নাত থেকে বের করা হয় এবং এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। বর্ণনাটি মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ।
ইবন আসাকির (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আদম (عليه السلام) ও হাওয়া (عليه السلام)-কে বিবস্ত্র অবস্থায় একত্রে নামিয়ে দেওয়া হয়। তখন তাদের দেহে জান্নাতের পাতা জড়ানো ছিল। তখন আদম (عليه السلام) অসহ্য গরম অনুভব করেন। এমনকি তিনি বসে কান্নাকাটি করতে শুরু করেন এবং হাওয়াকে লক্ষ্য করে বলেন যে, হাওয়া! গরমে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেন, তারপর জিবরাঈল (عليه السلام) তাঁর কাছে কিছু তুলো নিয়ে আসেন এবং হাওয়াকে সুতা কাটার আদেশ দিয়ে তাকে তা শিখিয়ে দেন। আর আদম (عليه السلام)-কে কাপড় বুননের আদেশ দেন এবং তাকে বুনন কার্য শিক্ষা দেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আদম (عليه السلام) জান্নাতে তার স্ত্রীর সংগে সহবাস করেননি; ইতিমধ্যেই বৃক্ষ-ফল খাওয়ার অপরাধে তাদেরকে জান্নাত থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, তারা উভয়ে আলাদা শয়ন করতেন। একজন বাতহায় এবং অপরজন অন্য প্রান্তে শয়ন করতেন। একদিন জিবরাঈল (عليه السلام) এসে তাঁকে সহবাসের আদেশ দেন এবং তার পদ্ধতিও শিখিয়ে দেন। তারপর যখন আদম (عليه السلام) স্ত্রী সঙ্গম করলেন, তখন জিবরাঈল (عليه السلام) এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, আপনি আপনার স্ত্রীকে কেমন পেয়েছেন? আদম (عليه السلام) বললেন, সতী-সাধ্বী পেয়েছি। ইব্ন আসাকির (رحمة الله) বর্ণিত এ হাদীসটি গরীব পর্যায়ভুক্ত এবং এটি মারফু হওয়া অত্যন্ত ‘মুনকার’। কোন কোন পূর্বসূরি আলিম সাঈদ ইবন মায়সারা সম্পর্কে বলেন, ইনিই আবু ইমরান বিকরী আল-বসরী। ইমাম বুখারী (رحمة الله) এ লোকটিকে মুনকারুল হাদীস বলে অভিহিত করেছেন। ইবন হিব্বান বলেন, এ লোকটি যতসব জাল হাদীস বর্ণনা করে। ইবন আদী (رحمة الله) বলেন, লোকটি একান্তই অজ্ঞাত পর্যায়ের।
فَتَلَقَّىٰۤ ءَادَمُ مِن رَّبِّهِۦ كَلِمَـٰتࣲ فَتَابَ عَلَیۡهِۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِیمُ
অর্থাৎ তারপর আদম তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে কিছু বাণী প্রাপ্ত হলো। ফলে আল্লাহ তার প্রতি ক্ষমা পরবশ হলেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (২: ৩৭)
কেউ কেউ বলেন, আদম (عليه السلام) আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বাণী প্রাপ্ত হয়েছিলেন তাহলোঃ
( رَبَّنَا ظَلَمۡنَاۤ أَنفُسَنَا وَإِن لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَتَرۡحَمۡنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَـٰسِرِینَ)
[Surat Al-A'raf ২৩]
অর্থাৎ হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের উপর অত্যাচার করেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন তাহলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
মুজাহিদ, সাঈদ ইবন জুবায়র, আবুল আলিয়া, রবী ইবন আনাস, হাসান, কাতাদা, মুহাম্মদ ইবন কা’ব, খালিদ ইবন মাদান, আতা আল-খুরাসানী (رحمة الله) ও আবদুর রহমান ইবন যায়দ (رحمة الله) থেকে এ অভিমত বর্ণিত আছে।
ইবন আবু হাতিম (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, উবাই ইবন কা’ব (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ আদম (عليه السلام) বললেন, হে আমার রব! আমি যদি তাওবা করি ও ফিরে আসি; তাহলে আমি কি আবার জান্নাতে যেতে পারব? আল্লাহ্ বললেন, হ্যাঁ। এটাই সে বাণী যার কথা فتلقى ادم الخ আয়াতে বলা হয়েছে। এ সূত্রে হাদীসটি গরীব এবং এতে ইনকিতা তথা বিচ্ছিন্নতা রয়েছে।
ইবন আবু নাজীহ (رحمة الله) মুজাহিদ (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন- ঐ বাণীগুলো হলঃ
اللهم لا اله الا انت سبحانك وبحمدك رب انى ظلمت نفسي فاغفر لي انك خير الغافرين. اللهم لا اله الا انت سبحانك وبحمدك رب اني ظلمت نفسي فاغفرلي انك خير الراحمين. اللهم لا اله الا انت سبحانك وبحمدك رب انى ظلمت نفسي فتب علي انك انت التواب
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আমি তোমার পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করি। হে আমার রব! নিশ্চয় আমি আমার নিজের প্রতি অত্যাচার করেছি। অতএব, তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও। নিশ্চয় তুমি ক্ষমাকারীদের সর্বোত্তম।
হে আল্লাহ! তুমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করি ও প্রশংসা করি। হে আমার রব! নিশ্চয় আমি নিজের প্রতি অবিচার করেছি। আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও। নিশ্চয় তুমি দয়ালুদের সর্বোত্তম।
হে আল্লাহ! তুমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করি ও প্রশংসা করি। হে আমার রব! আমি নিজের প্রতি অন্যায় করেছি। আমার প্রতি তুমি ক্ষমা পরবশ হও। নিশ্চয় তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
فَتَلَقَّىٰۤ ءَادَمُ مِن رَّبِّهِۦ كَلِمَـٰتࣲ فَتَابَ عَلَیۡهِۚ
[Surat Al-Baqarah ৩৭]
হাকিম (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ আদম (عليه السلام) বললেন, হে আমার রব! আপনি কি আমাকে আপনার নিজ কুদরতী হাতে সৃষ্টি করেননি? বলা হলো, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, আপনি কি আমার দেহে আপনার রূহ সঞ্চার করেননি? বলা হলো, হ্যাঁ। তখন তিনি পুনরায় বললেন, আমি হাঁচি দিলে আপনি কি يرحمك الله (আল্লাহ্ তোমাকে রহম করুন) বলেননি এবং আপনার রহমত কি আপনার গযবের উপর প্রবল নয়? বলা হলো, হ্যাঁ। পুনরায় তিনি বললেনঃ আপনি কি একথা নির্ধারণ করে রাখেননি যে, আমি এ কাজ করব? বলা হলো, হ্যাঁ। এবার আদম (عليه السلام) বললেন, আচ্ছা, আমি যদি তাওবা করি; তাহলে আপনি পুনরায় আমাকে জান্নাতে ফিরিয়ে নেবেন কি? আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ। হাকিম বলেন, এর সনদ সহীহ কিন্তু ইমাম বুখারী ও মুসলিম (رحمة الله) হাদীসটি বর্ণনা করেননি।
হাকিম, বায়হাকী ও ইবন আসাকির (رحمة الله) উমর ইবন খাত্তাব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “আদম (عليه السلام) যখন ভুল করে বসলেন তখন বললেন, হে আমার রব! মুহাম্মদের উসিলা দিয়ে আমি আপনার দরবারে প্রার্থনা করছি যে, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন! তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন, তুমি মুহাম্মদকে চিনলে কি করে অথচ এখনও তাঁকে আমি সৃষ্টি-ই করিনি? আদম (عليه السلام) বললেন, হে আমার রব! যখন আপনি আমাকে আপনার নিজ হাতে সৃষ্টি করলেন এবং আমার মধ্যে আপনার রূহ্ সঞ্চার করলেন তখন আমি মাথা তুলে আরশের স্তম্ভসমূহে لا اله الله محمد رسول الله লিখিত দেখতে পাই। তাতে আমি বুঝতে পারলাম যে, আপনার পবিত্র নামের সাথে আপনি সৃষ্টির মধ্যে আপনার সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো নাম যোগ করেননি। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, তুমি যথার্থই বলেছ, হে আদম! নিশ্চয় তিনি সৃষ্টির মধ্যে আমার প্রিয়তম। তাঁর উসিলায় যখন তুমি আমার কাছে প্রার্থনা করেই ফেলেছ, তখন আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। আর মুহাম্মদ (ﷺ)-কে সৃষ্টি না করলে তোমাকে আমি সৃষ্টিই করতাম না।
বায়হাকী বলেন, এ সূত্রে আবদুর রহমান ইব্ন যায়দ ইবন আসলাম-ই হাদীসটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন। আর তিনি হলেন দুর্বল রাবী। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। উল্লেখ্য যে, এ আয়াতটি নিম্নের আয়াতটির অনুরূপঃ
(وَعَصَىٰۤ ءَادَمُ رَبَّهُۥ فَغَوَىٰ ثُمَّ ٱجۡتَبَـٰهُ رَبُّهُۥ فَتَابَ عَلَیۡهِ وَهَدَىٰ)
[Surat Ta-Ha ১২১ - ১২২]
অর্থাৎ- আদম তার প্রতিপালকের হুকুম অমান্য করল, ফলে সে ভ্রমে পতিত হলো। এরপর তার প্রতিপালক তাকে মনোনীত করলেন, তার প্রতি ক্ষমাপরায়ণ হলেন ও তাকে পথ-নির্দেশ করলেন। (২০: ১২১-১২২)
❏ আদম (عليه السلام) ও মূসা (عليه السلام)-এর বাদানুবাদ
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “মূসা (عليه السلام) আদম (عليه السلام)-এর সাথে বাদানুবাদে লিপ্ত হন। তিনি তাকে বলেন, আপনি-ই তো মানুষকে আপনার অপরাধ দ্বারা জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে দুর্বিপাকে ফেলেছেন।” আদম (عليه السلام) বললেন, ‘হে মূসা! আপনি তো সে ব্যক্তি যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর রিসালাত ও কালাম দিয়ে আপনাকে বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছেনঃ আপনি কি আমাকে এমন একটি কাজের জন্য তিরস্কার করছেন, যা আমাকে সৃষ্টি করার পূর্বেই আল্লাহ আমার নামে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন?’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ এতে আদম (عليه السلام) তর্কে মূসা (عليه السلام)-এর উপর জয়লাভ করেন।
মুসলিম, নাসাঈ ও আহমদ (رحمة الله) ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ আদম (عليه السلام) ও মূসা (عليه السلام) বাদানুবাদে লিপ্ত হন। মূসা (عليه السلام) আদম (عليه السلام)-কে বলল যে, আপনি সে আদম যে আপনার ত্রুটি আপনাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে। উত্তরে আদম (عليه السلام) তাঁকে বললেন, আর আপনি তো সে মূসা, যাকে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর রিসালাত ও কালাম দিয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। আপনি আমাকে এমন একটি কাজের জন্য তিরস্কার করছেন, যা আমার সৃষ্টির পূর্বেই স্থির করে রাখা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ এভাবে আদম (عليه السلام) যুক্তিপ্রমাণে মূসা (عليه السلام)-এর উপর জয়লাভ করেন। একথাটি তিনি দু’বার বলেছেন।
ইমাম বুখারী এবং মুসলিম (رحمة الله) ভিন্ন সূত্রে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “আদম (عليه السلام) ও মূসা (عليه السلام) বিতর্কে লিপ্ত হন। মূসা বললেন, হে আদম (عليه السلام)! আপনি সে ব্যক্তি যে, আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন ও আপনার মধ্যে তাঁর রূহ্ সঞ্চার করেছেন। আর আপনি লোকদেরকে ভ্রমে নিপতিত করলেন ও তাদেরকে জান্নাত থেকে বের করিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেনঃ এর উত্তরে আদম (عليه السلام) বললেন, আর আপনি সেই মূসা (عليه السلام) যে, আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে তার কালাম দিয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। আমার এমন একটি কৃতকর্মের জন্য আপনি আমাকে তিরস্কার করছেন, যা আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করার পূর্বেই আল্লাহ্ তা’আলা আমার নামে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেন, ফলে যুক্তিতে আদম (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-এর উপর জয়লাভ করেন।
ইমাম তিরমিযী ও নাসাঈ (رحمة الله) ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেন। তিরমিযী (رحمة الله) বলেন, হাদীসটি গরীব পর্যায়ের। বাযযারও ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ (رحمة الله) আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “আদম (عليه السلام) ও মূসা (عليه السلام) বাদানুবাদে লিপ্ত হন। মূসা (عليه السلام) বললেন, হে আদম (عليه السلام)! আপনি আমাদের পিতা। আপনি আমাদের সর্বনাশ করেছেন এবং আমাদের জান্নাত থেকে বের করিয়ে দিয়েছেন। উত্তরে আদম (عليه السلام) তাঁকে বললেন, আপনি তো সে মূসা যে, আল্লাহ তা’আলা আপনাকে তাঁর কালাম দিয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। কখনো বলেছেন, তাঁর রিসালাতের জন্য এবং তিনি নিজ হাতে আপনাকে মনোনীত করেছেন। আপনি কি আমাকে এমন একটি কাজের জন্য তিরস্কার করছেন, যা আমাকে সৃষ্টির চল্লিশ বছর পূর্বেই আমার নামে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল? রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেনঃ যুক্তি-তর্কে আদম (عليه السلام) মূসার উপর জয়লাভ করেন। আদম (عليه السلام) মূসার উপর জয়লাভ করেন, আদম (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-এর উপর জয়লাভ করেন।
ইবন মাজাহ্ (رحمة الله) ব্যতীত সিহাহ সিত্তার সংকলকগণের অবশিষ্ট পাঁচজনই হাদীসটি দশটি ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে রিওয়ায়াত করেছেন। ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন যে, আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “মূসা (عليه السلام)-এর সংগে আদম (عليه السلام)-এর সাক্ষাৎ হলে মূসা (عليه السلام) তাঁকে বললেন, আপনি সে আদম (عليه السلام) যে, আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে তার নিজ হাতে সৃষ্টি করেন, তাঁর ফেরেশতাদেরকে আপনার সামনে সিজদাবনত করান এবং আপনাকে জান্নাতে স্থান দেন। তারপর আপনি একটি কাজ করে বসেন। আদম (عليه السلام) বললেন, আপনি তো সে মূসা (عليه السلام) যে, আল্লাহ্ তা’আলা আপনার সাথে কথা বলেছেন, তাঁর রিসালতের জন্যে আপনাকে মনোনীত করেছেন এবং আপনার উপর তাওরাত অবতীর্ণ করেছেন। আচ্ছা, আপনি বলুনতো আমার সৃষ্টি আগে হয়েছে নাকি আমার এ কর্মের উল্লেখ আগে হয়েছে? মূসা (عليه السلام) বললেন, না বরং আপনার এ কর্মের উল্লেখ আগে হয়েছে। এভাবে আদম (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-এর উপর জয়লাভ করেন।”
ইব্ন আবূ হাতিম (رحمة الله) বর্ণিত এ হাদীসের শেষাংশে আদম (عليه السلام)-এর উক্তিসহ অতিরিক্ত এরূপ বর্ণনা আছেঃ আল্লাহ্ আপনাকে এমন কয়েকটি ফলক দান করেছেন, যাতে যাবতীয় বিষয়ের সুস্পষ্ট বিবরণ রয়েছে এবং একান্তে নৈকট্য দান করেছেন। এবার আপনি বলুন, আল্লাহ্ তা’আলা তাওরাত কখন লিপিবদ্ধ করেছিলেন? মূসা (عليه السلام) বললেন, সৃষ্টির চল্লিশ বছর পূর্বে। আদম (عليه السلام) বললেন, তাতে কি আপনি (فوَعَصَىٰۤ ءَادَمُ رَبَّهُۥ فَغَوَىٰ ) কথাটি পাননি? মূসা (عليه السلام) বললেন, জী হ্যাঁ। আদম (عليه السلام) বললেন, তবে কি আপনি আমাকে আমার এমন একটি কৃতকর্মের জন্য তিরস্কার করছেন যা আমার সৃষ্টির চল্লিশ বছর আগেই আল্লাহ্ তা’আলা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন যে, আমি তা করব? বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ এভাবে আদম (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-এর উপর জয়লাভ করেন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণিত এ সংক্রান্ত বর্ণনা মূসা (عليه السلام)-এর বক্তব্যে অতিরিক্ত একথাটি ও আছেঃ “আপনি আপনার সন্তানদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। তবে এ অংশটি হাদীসের অংশ কিনা তাতে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
হাফিজ আবু ইয়ালা আল-মূসিলী তার মুসনাদে আমীরুল মু’মিনীন উমর ইব্ন খাত্তাব (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “মূসা (عليه السلام) বললেন, হে আমার রব! আপনি আমাকে সে আদম (عليه السلام)-কে একটু দেখান, যিনি আমাদেরকে এবং তার নিজেকে জান্নাত থেকে বের করিয়ে দেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে আদম (عليه السلام)-কে দেখালেন। দেখে মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘আপনিই আদম (عليه السلام)?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘আপনি সে ব্যক্তি যার মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর রূহ সঞ্চার করেছেন, যাঁর সামনে তার ফেরেশতাদেরকে সিজদাবনত করিয়েছেন এবং যাকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিয়েছেন।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। মূসা (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাদেরকে এবং আপনার নিজেকে জান্নাত থেকে বের করে দিতে কিসে আপনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল?’ উত্তরে আদম (عليه السلام) বললেন, ‘আপনি কে?’ তিনি বললেন, ‘আমি মূসা (عليه السلام)।’ আদম (عليه السلام) বললেন, ‘আপনি কি বনী ইসরাঈলের নবী মূসা যে, আল্লাহ্ তাআলা পর্দার আড়াল থেকে আপনার সাথে এমনভাবে কথা বলেছেন যে, আপনার ও তাঁর মধ্যে কোন দূত ছিল না?’ মূসা (عليه السلام) বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ এবার আদম (عليه السلام) বললেনঃ ‘আপনি আমাকে এমন একটি বিষয়ে তিরস্কার করছেন, যা পূর্ব থেকেই আল্লাহ্ তা’আলা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।’ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেনঃ এভাবে আদম (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-এর উপর জয়যুক্ত হন, এভাবে আদম (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-এর উপর জয়যুক্ত হন।
আবু দাউদ (رحمة الله) ও ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আবু ইয়ালা (رحمة الله) ঈষৎ পরিবর্তনসহ ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
উল্লেখ্য যে, এ হাদীসের ব্যাপারে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়। কাদরিয়া সম্প্রদায়ের একটি দল এ হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কারণ এ হাদীসে পূর্ব সিদ্ধান্ত তথা তাকদীরের প্রমাণ রয়েছে। জাবরিয়া সম্প্রদায়ের একটি দল এ হাদীস দ্বারা তাদের মতের সপক্ষে প্রমাণ পেশ করেছে। আর বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা প্রমাণিত হয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ পূর্ব সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে আদম (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-এর উপর জয়যুক্ত হন। এর জবাব পরে দেওয়া হবে। অন্য একদল আলিম বলেন, আদম (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-এর মতের বিপরীতে এ জন্য যুক্তি প্রদর্শন করেছেন যে, মূসা (عليه السلام) তাকে এমন একটি অপরাধের জন্য তিরস্কার করেছেন, যা থেকে তিনি তাওবা করে নিয়েছিলেন। আর অপরাধ থেকে তাওবাকারী ঠিক সে ব্যক্তির ন্যায়, যার কোন অপরাধ নেই।
কারো কারো মতে, এ জয়লাভের কারণ হলো, আদম (عليه السلام) হলেন মূসা (عليه السلام)-এর চাইতে বয়োজ্যেষ্ঠ ও প্রবীণ। কেউ কেউ বলেন, এর কারণ হলো, আদম (عليه السلام) হলেন তার আদি পিতা। কারো কারো মতে এর কারণ, তারা দু’জন ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন শরীয়তের ধারক। আবার কেউ কেউ বলেন, এর কারণ তারা দু’জনই ছিলেন আলমে-বরযখে।৭৩( যা এ জগতের বা পরকালের ব্যাপার নয়, বরং মধ্যবর্তী আরেক জগতের ব্যাপার।) আর তাদের ধারণায় সে জগতে শরীয়তের বিধান প্রযোজ্য নয়।
সঠিক কথা হলো এই যে, এ হাদীসটি বহু পাঠে বর্ণিত হয়েছে। তার কতক বর্ণিত হয়েছে অর্থগতরূপে। কিন্তু তা সন্দেহমুক্ত নয়। সহীহ বুখারী ও মুসলিমসহ অন্যান্য কিতাবের বেশির ভাগ বক্তব্যের সারকথা হলো, মূসা (عليه السلام) আদম (عليه السلام)-কে তাঁর নিজেকে ও সন্তানদেরকে জান্নাত থেকে বের করিয়ে দেয়ার জন্য দোষারোপ করেছিলেন। তাই উত্তরে আদম (عليه السلام) তাঁকে বলেছিলেন, আপনাদেরকে আমি বের করিনি। বের করেছেন সেই সত্তা যিনি আমার বৃক্ষ-ফল খাওয়ার সাথে বহিষ্কারকে সংশ্লিষ্ট করে রেখেছিলেন; আর যিনি তা সংশ্লিষ্ট করে রেখেছিলেন আমার সৃষ্টির পূর্বেই এবং তা লিপিবদ্ধ ও নির্ধারণ করে রেখেছিলেন, তিনি হলেন মহান আল্লাহ্। সুতরাং আপনি আমাকে এমন একটি কাজের জন্য দোষারোপ করছেন, যার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। বড় জোর এতটুকু বলা যায় যে, আমাকে বৃক্ষ-ফল খেতে নিষেধ করা হয়েছিল, কিন্তু আমি তা খেয়ে ফেলি। এর সাথে বহিষ্কারের সংশ্লিষ্টতা আমার কর্ম নয়। সুতরাং আপনাদেরকে এবং আমার নিজেকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার আমি করিনি। তা ছিল সম্পূর্ণ আল্লাহ্ তা’আলার কুদরতের লীলাখেলা! অবশ্য তাতে আল্লাহর হিকমত রয়েছে। অতএব, এ কারণে আদম (عليه السلام) মূসা (عليه السلام)-এর উপর জয়যুক্ত হয়েছিলেন।
পক্ষান্তরে যারা এ হাদীসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, তারা আসলে একগুঁয়ে। কেননা, হাদীসটি আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আর বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্মৃতিশক্তির ব্যাপারে আবু হুরায়রা (رضي الله عنه)-এর মর্যাদা প্রশ্নাতীত। তাছাড়া আরো কতিপয় সাহাবা থেকেও হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে যা আমরা উপরে উল্লেখ করে এসেছি। আর একটু আগে হাদীসটির যেসব ব্যাখ্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, তা হাদীসের শব্দ ও মর্ম উভয়ের সাথেই অসংগতিপূর্ণ। তাদের মধ্যে অবস্থানের যৌক্তিকতা জাবরিয়া সম্প্রদায়ের চাইতে বেশি আর কারোরই নেই। কিন্তু কয়েক দিক থেকে তাতেও আপত্তি রয়েছেঃ
প্রথমত, মূসা (عليه السلام) এমন কাজের জন্য দোষারোপ করতে পারেন না, যে কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাওবা করে নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, মূসা (عليه السلام) নিজেও আদিষ্ট না হয়েও এক ব্যক্তিকে হত্যা করে আল্লাহ তাআলার নিকট এ বলে প্রার্থনা করেছিলেন। যে, (رَبِّ إِنِّی ظَلَمۡتُ نَفۡسِی فَٱغۡفِرۡ لِی فَغَفَرَ لَهُۥ)
[Surat Al-Qasas ১৬] হে আমার রব! আমি নিজের উপর অত্যাচার করেছি। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। ফলে আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করে দেন। (২৮: ১৬)
তৃতীয়ত, আদম (عليه السلام) যদি পূর্ব লিখিত তকদীর দ্বারা অপরাধের জন্য দোষারোপের জবাব দিয়ে থাকেন, তাহলে কৃতকর্মে তিরস্কৃত সকলের জন্যই এ পথ খুলে যেতো এবং সকলেই পূর্ব নির্ধারিত তকদীরের দোহাই দিয়ে প্রমাণ পেশ করতে পারতো। এভাবে কিসাস ও হুদূদ তথা শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তিসমূহের বিধানের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যেতো। তকদীরকেই যদি দলীল রূপে পেশ করা যেতো, তাহলে যে কেউ ছোট-বড় সকল কৃত-অপরাধের জন্য তার দ্বারা দলীল পেশ করতে পারত। আর এটা ভয়াবহ পরিণতির দিকেই নিয়ে যেতো। এ জন্যই কোন কোন আলিম বলেনঃ আদম (عليه السلام) তকদীর দ্বারা দুর্ভোগের ব্যাপারে দলীল পেশ করেছিলেন আল্লাহর আদেশ অমান্যের সপক্ষের যুক্তি হিসাবে নয়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
❏ হাদীসে আদম (عليه السلام)-এর সৃষ্টি প্রসঙ্গ
আবু মূসা আশআরী (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সমগ্র পৃথিবী থেকে সংগৃহীত এক মুঠো মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেন। তাই মাটি অনুপাতে আদমের সন্তানদের কেউ হয় সাদা, কেউ হয় গৌরবর্ণ, কেউ হয় কালো, কেউ মাঝামাঝি বর্ণের। আবার কেউ হয় নোংরা, কেউ হয় পরিচ্ছন্ন, কেউ হয় কোমল, কেউ হয় পাষাণ, কেউ বা এগুলোর মাঝামাঝি। ঈষৎ শাব্দিক পার্থক্যসহ তিনি ভিন্ন সূত্রে উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আবু দাউদ, তিরমিযী এবং ইবন হিব্বান (رحمة الله) আবু মূসা আশআরী (رضي الله عنه) যার আসল নাম আবদুল্লাহ্ ইবন কায়েস (رضي الله عنه) সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেন। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন।
সুদ্দী (رحمة الله) ইবন আব্বাস ও ইবন মাসউদ (رضي الله عنه)-সহ কতিপয় সাহাবা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তারা বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা কিছু কাদামাটি নেয়ার জন্য জিবরাঈল (عليه السلام)-কে যমীনে প্রেরণ করেন। তিনি এসে মাটি নিতে চাইলে যমীন বলল, তুমি আমার অঙ্গহানি করবে বা আমাতে খুঁত সৃষ্টি করবে; এ ব্যাপারে তোমার নিকট থেকে আমি আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। ফলে জিবরাঈল (عليه السلام) মাটি না নিয়ে ফিরে গিয়ে বললেন, হে আমার রব! যমীন তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করায় আমি তাকে ছেড়ে এসেছি।
এবার আল্লাহ্ তা’আলা মীকাঈল (عليه السلام)-কে প্রেরণ করেন। যমীন তাঁর নিকট থেকেও আশ্রয় প্রার্থনা করে বসে। তাই তিনিও ফিরে গিয়ে জিবরাঈল (عليه السلام)-এর মতই বর্ণনা দেন। এবার আল্লাহ্ তা’আলা মালাকুল মউত (عليه السلام) বা মৃত্যুর ফেরেশতাকে প্রেরণ করেন। যমীন তার কাছ থেকেও আশ্রয় প্রার্থনা করলে তিনি বললেন, আর আমিও আল্লাহ্ তা’আলার আদেশ বাস্তবায়ন করে শূন্য হাতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তার পানাহ চাই। এ কথা বলে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে সাদা, লাল ও কালো রঙের কিছু মাটি সংগ্রহ করে মিশিয়ে নিয়ে চলে যান।
এ কারণেই আদম (عليه السلام)-এর সন্তানদের এক একজনের রঙ এক এক রকম হয়ে থাকে।
আজরাঈল (عليه السلام) মাটি নিয়ে উপস্থিত হলে আল্লাহ্ তা’আলা মাটিগুলো ভিজিয়ে নেন। এতে তা আটালো হয়ে যায়। তারপর ফেরেশতাদের উদ্দেশে তিনি ঘোষণা দেনঃ
وَإِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَـٰۤىِٕكَةِ إِنِّی خَـٰلِقُۢ بَشَرࣰا مِّن صَلۡصَـٰلࣲ مِّنۡ حَمَإࣲ مَّسۡنُونࣲ فَإِذَا سَوَّیۡتُهُۥ وَنَفَخۡتُ فِیهِ مِن رُّوحِی فَقَعُوا۟ لَهُۥ سَـٰجِدِینَ
[Surat Al-Hijr ২৮ - ২৯]
অর্থাৎ কাদামাটি দ্বারা আমি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তাতে আমার রূহ্ সঞ্চার করব; তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো। (১৫: ২৮)
তারপর আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে নিজ হাতে সৃষ্টি করেন, যাতে ইবলীস তার ব্যাপারে অহংকার করতে না পারে। তারপর মাটির তৈরি এ মানব দেহটি থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত যা জুম’আর দিনের অংশ বিশেষ ছিল ৭৪(উর্ধ জগতের একদিন পৃথিবীর হাজার বছরের, বর্ণনান্তরে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান বলে কুরআনের বর্ণনায় পাওয়া যায়। (বিঃ দ্রঃ ২২: ৪৭ ও ৭০: ৪) একইভাবে পড়ে থাকে। তা দেখে ফেরেশতাগণ ঘাবড়ে যান। সবচাইতে বেশি ভয় পায় ইবলীস। সে তার পাশ দিয়ে আনাগোনা করত এবং তাকে আঘাত করত। ফলে দেহটি ঠনঠনে পোড়া মাটির ন্যায় শব্দ করত। এ কারণেই মানব সৃষ্টির উপাদানকে صلصال كالفحار তথা পোড়ামাটির ন্যায় ঠনঠনে মাটি বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর ইবলীস তাঁকে বলত, তুমি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়েছ।
এক পর্যায়ে ইবলীস তার মুখ দিয়ে প্রবেশ করে পেছন দিয়ে বের হয়ে এসে ফেরেশতাগণকে বলল, একে তোমাদের ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। কেননা, তোমাদের রব হলেন সামাদ তথা অমুখাপেক্ষী আর এটি একটি শূন্যগর্ভ বস্তুমাত্র; কাছে পেলে আমি একে ধ্বংস করেই ছাড়ব।
এরপর তার মধ্যে রূহ সঞ্চার করার সময় হয়ে এলে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাগণকে বললেনঃ আমি যখন এর মধ্যে রূহ সঞ্চার করব; তখন তার প্রতি তোমরা সিজদাবনত হয়ো। যথাসময়ে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর মধ্যে রূহ সঞ্চার করলেন যখন রূহ্ তাঁর মাথায় প্রবেশ করে, তখন তিনি হাঁচি দেন। ফেরেশতাগণ বললেন, আপনি ‘আল-হামদুলিল্লাহ্’ বলুন। তিনি ‘আলা-হামদুলিল্লাহ’ বললেন। জবাবে আল্লাহ্ তা’আলা বললেনঃ يرحمك ربك (তোমার রব তোমাকে রহম করুন!) তারপর রূহ্ তাঁর দু’চোখে প্রবেশ করলে তিনি জান্নাতের ফল-ফলাদির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। এবার রূহ্ তার পেটে প্রবেশ করলে তাঁর মনে খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগে। ফলে রূহ্ পা পর্যন্ত পৌঁছানের আগেই তড়িঘরি করে তিনি জান্নাতের ফল-ফলাদির প্রতি ছুটে যান। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
خُلِقَ ٱلۡإِنسَـٰنُ مِنۡ عَجَلࣲۚ
[Surat Al-Anbiya’ ৩৭]
মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই ত্বরাপ্রবণ। (২১: ৩৭)
(فَسَجَدَ ٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةُ كُلُّهُمۡ أَجۡمَعُونَ إِلَّاۤ إِبۡلِیسَ أَبَىٰۤ أَن یَكُونَ مَعَ ٱلسَّـٰجِدِینَ)
[Surat Al-Hijr ৩০ - ৩১]
অথাৎ— তখন ইবলীস ব্যতীত ফেরেশতারা সকলেই সিজদা করল। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল। (১৫: ৩০)
সুদ্দী (رحمة الله) এভাবে কাহিনীটি শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করেন। এ কাহিনীর সমর্থনে আরো বেশ ক’টি হাদীস পাওয়া যায়। তবে তার বেশির ভাগই ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে গৃহীত।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে নিজের ইচ্ছানুযায়ী কিছুদিন তাঁকে ফেলে রাখেন। এ সুযোগে ইবলীস তাঁর চতুম্পার্শ্বে চক্কর দিতে শুরু করে। অবশেষে তাঁকে শূন্যগর্ভ দেখতে পেয়ে সে আঁচ করতে পারল যে, এটাতো এমন একটি সৃষ্টি যার সংযম ক্ষমতা থাকবে না।”
ইবন হিব্বান (رحمة الله) তার সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “আদম (عليه السلام)-এর মধ্যে রূহ সঞ্চারিত হওয়ার পর রুহ্ তার মাথায় পৌঁছুলে তিনি হাঁচি দেন এবং ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ বলেন। উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’। ঈষৎ শাব্দিক পার্থক্যসহ হাফিজ আবু বকর বাযযার (رحمة الله) (য়াহয়া ইবন মুহাম্মদ ইবন সাকান)-ও হাদীসটি বর্ণনা করেন।
উমর ইবন আব্দুল আযীয (رحمة الله) বলেন, “আদম (عليه السلام)-কে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে আদেশ করা হলে সর্বপ্রথম হযরত ইসরাফীল (عليه السلام) সিজদাবনত হন। এর পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তা’আলা তার ললাটে কুরআন অঙ্কিত করে দেন। ইবনে আসাকির এ উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন।
হাফিজ আবূ ইয়ালা (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা হযরত আদম (عليه السلام)-কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেন। প্রথমে মাটিগুলোকে ভিজিয়ে আটালো করে কিছু দিন রেখে দেন। এতে তা ছাঁচে-ঢালা মাটিতে পরিণত হলে আদম (عليه السلام)-এর আকৃতি সৃষ্টি করে কিছুদিন এ অবস্থায় রেখে দেন। এবার তা পোড়া মাটির মত শুকনো ঠনঠনে মাটিতে রূপান্তরিত হয়। বর্ণনাকারী বলেন, ইবলীস তখন তার কাছে গিয়ে বলতে শুরু করে যে, তুমি এক মহান উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়েছ। তারপর আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর মধ্যে রূহ্ সঞ্চার করেন। রূহ্ সর্বপ্রথম তাঁর চোখ ও নাকের ছিদ্রে প্রবেশ করলে তিনি হাঁচি দেন। হাঁচি শুনে আল্লাহ্ বললেনঃ يرحمك ربك তোমার রব তোমার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন।
অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, ‘হে আদম! তুমি ঐ ফেরেশতা দলের কাছে গিয়ে দেখ তারা কী বলে?’ তখন তিনি ফেরেশতা দলের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে সালাম দেন। আর তারা السلام عليك ورحمه الله وبركاته বলে উত্তর দেন। তখন আল্লাহ বললেন, হে আদম! এটা তোমার এবং তোমরা বংশধরের অভিবাদন। আদম (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আমার রব! আমার বংশধর আবার কি?’ আল্লাহ বললেনঃ ‘আদম! তুমি আমার দু’হাতের যে কোন একটি পছন্দ কর।’ আদম (عليه السلام) বললেন, ‘আমি আমার রবের ডান হাত পছন্দ করলাম। আমার বর-এর উভয় হাতই তো ডান হাত বরকতময়।
এবার আল্লাহ্ তা’আলা নিজের হাতের তালু প্রসারিত করলে আদম (عليه السلام) কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী তাঁর সকল সন্তানকে আল্লাহর হাতের তালুতে দেখেতে পান। তন্মধ্যে কিছুসংখ্যকের মুখমণ্ডল ছিল নূরে সমুজ্জ্বল। সহসা তাদের মধ্যে একজনের নূরে অধিক বিমুগ্ধ হয়ে আদম (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আমার রব! ইনি কে?’ আল্লাহ্ বললেন, ‘ইনি তোমার সন্তান দাউদ।’ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এর আয়ু কত নির্ধারণ করেছেন?’ আল্লাহ বললেন, ‘ষাট বছর।’ আদম (عليه السلام) বললেন, ‘আমার থেকে নিয়ে এর আয়ু পূর্ণ একশ’ বছর করে দিন। আল্লাহ তার আবদার মঞ্জুর করেন এবং এ ব্যাপারে ফেরেশতাগণকে সাক্ষী রাখেন। তারপর যখন আদম (عليه السلام)-এর আয়ু শেষ হয়ে আসলো তখন তার রূহ্ কবয করার জন্য আল্লাহ তা’আলা আযরাঈল (عليه السلام)-কে প্রেরণ করেন। তখন আদম (عليه السلام) বললেন, ‘কেন, আমার আয়ু তো আরো চল্লিশ বছর বাকি আছে!’ ফেরেশতা বললেন, ‘আপনি না আপনার আয়ুর চল্লিশ বছর আপনার সন্তান দাউদ (عليه السلام)-কে দিয়ে দিয়েছিলেন!’ কিন্তু আদম (عليه السلام) তা অস্বীকার করে বসেন এবং পূর্বের কথা ভুলে যান। ফলে তার সন্তানদের মধ্যে অস্বীকৃতি ও বিস্মৃতির প্রবণতা সৃষ্টি হয়। হাফিজ আবু বকর বাযযার (رحمة الله) তিরমিযী ও নাসাঈ (رحمة الله) তাঁর ‘ইয়াওম ওয়াল লাইলা’ কিতাবে আবু হুরায়রা সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেন। তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান গরীব পর্যায়ের এবং ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) মুনকার’ তথা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন।
তিরমিযী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর পিঠে হাত বুলান। সাথে সাথে কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী তার সবকটি সন্তান তাঁর পিঠ থেকে ঝরে পড়ে। আর আল্লাহ তাআলা তাদের প্রত্যেকের দু’চোখের মাঝে একটি করে নূরের দীপ্তি স্থাপন করে দিয়ে তাদেরকে আদম (عليه السلام)-এর সামনে পেশ করেন। তখন আদম (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আমার রব! এরা কারা?’ আল্লাহ বললেন, ‘এরা তোমার সন্তান-সন্ততি।’ তখন তাদের একজনের দুচোখের মাঝে দীপ্তিতে বিমুগ্ধ হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আমার রব! ইনি কে?’ আল্লাহ বললেন, ‘সে তোমার ভবিষ্যত বংশধরের দাঊদ নামক এক ব্যক্তি।’ তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর আয়ু কত নির্ধারণ করেছন?’ আল্লাহ বললেনঃ ‘ষাট বছর।’ আদম (عليه السلام) বললেন, ‘হে আমার রব! আমার আয়ু থেকে নিয়ে এর আয়ু আরো চল্লিশ বছর বৃদ্ধি করে দিন।’ তারপর যখন আদম (عليه السلام)-এর আয়ু শেষ হয়ে যায়; তখন জান কবয করার জন্য আযরাঈল (عليه السلام) তাঁর কাছে আগমন করেন। তখন তিনি বললেন, ‘আমার আয়ু না আরো চল্লিশ বছর বাকি আছে?’ আযরাঈল (عليه السلام) বললেন, ‘কেন আপনি না তা আপনার সন্তান দাউদ (عليه السلام)-কে দিয়ে দিয়েছিলেন?’ কিন্তু আদম (عليه السلام) তা অস্বীকার করে বসেন। এ কারণে তার সন্তানদের মধ্যে অস্বীকৃতির প্রবণতা রয়েছে। তিনি পূর্বের কথা ভুলে যান। ফলে তাঁর সন্তানদের মধ্যেও বিস্মৃতির প্রবণতা রয়েছে। আদম (عليه السلام) ত্রুটি করেন, তাই তাঁর সন্তানরাও ত্রুটি করে থাকে।
ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে আরো একাধিক সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। হাকিম (رحمة الله) তার মুস্তাদরাকে আবু নুআয়ম (ফযল ইবনে দুকায়ন)-এর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন, ইমাম মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী হাদীসটি সহীহ। তবে ইমাম বুখারী ও মুসলিমের কেউই হাদীসটি বর্ণনা করেননি। আর ইবনে আবু হাতিম (رحمة الله) হাদীসটির যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে এও আছে যে, আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-এর বংশধরকে তার সামনে পেশ করে বললেন, ‘হে আদম! এরা তোমার সন্তান-সন্ততি।’ তখন আদম (عليه السلام) তাদের মধ্যে কুষ্ঠ ও শ্বেতী রোগী, অন্ধ এবং আরো নানা প্রকার ব্যাধিগ্রস্ত লোক দেখতে পেয়ে বললেন, ‘হে আমার রব! আমার সন্তানদের আপনি এ দশা করলেন কেন?’ আল্লাহ বললেন, ‘করেছি এ জন্য যাতে আমার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা হয়।’ এর পরে বর্ণনটিতে দাঊদ (عليه السلام)-এর প্রসঙ্গও রয়েছে—যা ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে পরে আসছে।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) তার মুসনাদে বর্ণনা করেন যে, আবু দারদা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যথা সময়ে আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে তার ডান কাঁধে আঘাত করে মুক্তার ন্যায় ধবধবে সাদা তাঁর একদল সন্তানকে বের করেন। আবার তার বাম কাঁধে আঘাত করে কয়লার ন্যায় মিশমিশে কালো একদল সন্তানকে বের করে আনেন। তারপর ডান পাশের গুলোকে বললেন, তোমরা জান্নাতগামী, আমি কারো পরোয়া করি না। আর বাম কাঁধের গুলোকে বললেন, তোমরা জাহান্নামগামী, আমি কারো পরোয়া করি না।
ইবনে আবু দুনিয়া (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, হাসান (رحمة الله) বলেন, “আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে আল্লাহ তা’আলা তার ডান পার্শ্বদেশ থেকে জান্নাতীদের আর বাম পার্শ্বদেশ থেকে জাহান্নামীদের বের করে এনে তাদেরকে যমীনে নিক্ষেপ করেন। এদের মধ্যে কিছু লোককে অন্ধ, বধির ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত দেখে আদম (عليه السلام) বললেন, ‘হে আমার রব! আমার সন্তানদের সকলকে এক সমান করে সৃষ্টি যে করলেন না তার হেতু কি?’ আল্লাহ বললেন, “আমি চাই যে, আমার শুকরিয়া আদায় হোক।" আব্দুর রায্যাক অনুরূপ রিওয়ায় বর্ণনা করেছেন।
ইবন হিব্বানের এ সংক্রান্ত বর্ণনার শেষ দিকে আছে—আল্লাহর মর্জি মোতাবেক আদম (عليه السلام) কিছুকাল জান্নাতে বসবাস করেন। তারপর সেখান থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। অবশেষে এক সময় আযরাঈল (عليه السلام) তাঁর নিকট আগমন করলে তিনি বললেন, ‘আমার আয়ু তো এক হাজার বছর। আপনি নির্ধারিত সময়ের আগেই এসে পড়েছেন।’ আযরাঈল (عليه السلام) বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আপনি না আপনার আয়ু থেকে চল্লিশ বছর আপনার সন্তান দাউদকে দিয়ে দিয়েছিলেন।’ কিন্তু আদম (عليه السلام) তা অস্বীকার করে বসেন। ফলে তাঁর সন্তানদের মধ্যেও অস্বীকার করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। তিনি পূর্বের কথা ভুলে যান। ফলে তাঁর সন্তানদের মধ্যে বিস্মৃতির প্রবণতা দেখা দেয়। সেদিন থেকেই পারস্পরিক লেন-দেন লিপিবন্ধ করে রাখার এবং সাক্ষী রাখার আদেশ জারি হয়।”
ইমাম বুখারী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “আল্লাহ্ তা’আলা হযরত আদম (عليه السلام)-কে ষাট হাত দীর্ঘ করে সৃষ্টি করেন। তারপর বললেন, ‘ঐ ফেরেশতা দলের কাছে গিয়ে তুমি তাদের সালাম কর এবং লক্ষ্য করে শোন, তারা তোমাকে কি উত্তর দেয়। কারণ এটাই হবে তোমার এবং তোমার সন্তান-সন্ততির অভিবাদন।’ আদেশ মত ফেরেশতাগণের কাছে গিয়ে তিনি السلام عليكم বলে সালাম করেন, আর তারা السلام عليك ورحمة الله বলে উত্তর দেন। উল্লেখ্য যে, আদমের সন্তানদের যারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারা সকলেই আদম (عليه السلام)-এর আকৃতিসম্পন্ন হবে। ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে পেতে মানুষের উচ্চতা এখন এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
অনুরূপ ইমাম বুখারী (رحمة الله) ‘কিতাবুল ইস্তিয়ানে’ আর ইমাম মুসলিম (رحمة الله) তাঁর গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আদম (عليه السلام)-এর উচ্চতা ছিল ষাট হাত আর প্রস্থ সাত হাত।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন, ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, বকেয়া লেন-দেন লিপিবদ্ধ করে রাখার আদেশ সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বললেন, সর্বপ্রথম যিনি অস্বীকার করেন; তিনি হলেন আদম (عليه السلام), সর্বপ্রথম যিনি অস্বীকার করেন, তিনি হলেন আদম (عليه السلام), সর্বপ্রথম যিনি অস্বীকার করেন, তিনি হলেন আদম (عليه السلام)। ঘটনা হলো—আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে তার পৃষ্ঠদেশে হাত বুলিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মানুষকে বের করে এনে তাদের তার সামনে পেশ করেন। তাদের মধ্যে তিনি উজ্জ্বল এক ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘হে আমার রব! ইনি কে?’ আল্লাহ বলেন, ‘সে তোমার সন্তান দাউদ।’ আদম (عليه السلام) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর আয়ু কত?’ আল্লাহ বললেন, ‘ষাট বছর।’ আদম (عليه السلام) বললেন, ‘এর আয়ু আরো বাড়িয়ে দিন।’ আল্লাহ্ বলেন, ‘না হবে না। তবে তোমার আয়ু থেকে কর্তন করে বাড়াতে পারি।’ উল্লেখ্য যে, আদম (عليه السلام)-এর আয়ু ছিল এক হাজার বছর। তার থেকে কর্তন করে আল্লাহ তাআলা দাউদ-এর আয়ু চল্লিশ বছর বৃদ্ধি করেন।
এ ব্যাপারে চুক্তিনামা লিপিবন্ধ করে নেন এবং ফেরেশতাদের সাক্ষী রাখেন। অবশেষে আদম (عليه السلام)-এর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে তার জান কবয করার জন্য একদিন আযরাইল (عليه السلام) তাঁর কাছে আগমন করেন। তখন তিনি বললেন, আমার আয়ুর তো আরো চল্লিশ বছর বাকি আছে! উত্তরে বলা হলো, কেন আপনি না তা আপনার সন্তান দাউদকে দিয়ে দিয়েছিলেন! আদম (عليه السلام) তা অস্বীকার করে বললেন, আমি তো এমনটি করিনি। তখন প্রমাণস্বরূপ আল্লাহ তা’আলা পূর্বের লিখিত চুক্তিনামা তাঁর সামনে তুলে ধরেন এবং ফেরেশতাগণ এ ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করেন।”
ইমাম আহমদের অনুরূপ আরেকটি বর্ণনার শেষাংশে আছেঃ “অবশেষে আল্লাহ দাউদের বয়স একশ বছর আর আদম (عليه السلام)-এর এক হাজার বছর পূর্ণ করে দেন।” তাবারানী (رحمة الله)ও অনুরূপ একটি রিওয়ায়ত বর্ণনা করেছেন।
ইমাম মালিক ইবনে আনাস (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, মুসলিম ইবনে য়াসার (رحمة الله) বলেন, উমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه)-কে واذ اخذ ربك الخ এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, তিনি বললেন, এ আয়াত সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করে তার পিঠে নিজের ডান হাত বুলিয়ে তাঁর সন্তানদের একদল বের করে এনে বললেন, এদেরকে আমি জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করলাম। এরা জান্নাতীদের আমলই করবে। তারপর পুনরায় হাত বুলিয়ে আরেক দল সন্তানকে বের করে এনে বললেন, এদের আমি জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। এরা জাহান্নামীদেরই আমল করবে। এ কথা শুনে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে আমল করার প্রয়োজন কি? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, “আল্লাহ যাকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেন, তার থেকে তিনি জান্নাতীদেরই আমল করান। আমৃত্যু জান্নাতীদের আমল করতে করতেই শেষ পর্যন্ত সে জান্নাতে চলে যাবে। পক্ষান্তরে যাকে তিনি জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেন; তার দ্বারা তিনি জাহান্নামীদের আমলই করান। আমৃত্যু জাহান্নামীদের আমল করতে করতেই শেষ পর্যন্ত সে জাহান্নামে পৌঁছে যাবে।”
ইমাম আহমদ আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে জারীর ও ইবনে আবু হাতিম ও আবূ হাতিম ইবন হিব্বান (رحمة الله) বিভিন্ন সূত্রে ইমাম মালেক (رحمة الله) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) হাদীসটি হাসান সহীহ’ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে উমর (رضي الله عنه) নিকট থেকে মুসলিম ইবন ইয়াসার (رحمة الله) সরাসরি হাদীসটি শুনেননি। আবূ হাতিম ও আবু যুর’আ (رحمة الله) এ অভিমত পেশ করেছেন। আবু হাতিম (رحمة الله) আরো বলেছেন যে, এ দুজনের মাঝে আরেক রাবী নুয়ায়ম ইবনে রবীয়া রয়েছেন। ইমাম আবু দাউদ হাদীসটির সূত্রে ইবনে যায়েদ ইবনে খাত্তাব, মধ্যবর্তী রাবী নুয়ায়ম ইবন রবীয়ার নামও উল্লেখ করেছেন। দারা কুতনী বলেন, “উপরোক্ত সব কটি হাদীস এ কথা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তা’আলা আদম (عليه السلام)-এর সন্তানদের তাঁরই পিঠ থেকে ছোট ছোট পিঁপড়ার মত বের করে এনেছেন এবং তাদেরকে ডান ও বাম এ দু’দলে বিভক্ত করে ডান দলকে বলেছেন, তোমরা জান্নাতী, আমি কাউকে পরোয়া করি না। আর বাম দলকে বলেছেন, তোমরা জাহান্নামী, আমার কারো পরোয়া নেই।” পক্ষান্তরে তাদের নিকট থেকে সাক্ষ্য এবং আল্লাহর একত্ব সম্পর্কে তাদের থেকে স্বীকারোক্তি নেয়ার কথা প্রামাণ্য কোন হাদীস পাওয়া যায় না। সূরা আরাফের একটি আয়াতকে এ অর্থে প্রয়োগ করার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। যথাস্থানে এ বিষয়ে আমি সবিস্তার আলোচনা করেছি। তবে এ মর্মে ইমাম আহমদ (رحمة الله) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস আছে। ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী যার সনদ উত্তম ও শক্তিশালী। হাদীসটি হলোঃ
ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা জিলহজ্জের নয় তারিখে নু’মান নামক স্থানে আদম (عليه السلام)-এর পিঠ থেকে অঙ্গীকার নেন। তারপর তাঁর মেরুদণ্ড থেকে (কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী) তার সকল সন্তানকে বের করে এনে তার সম্মুখে ছড়িয়ে দেন। তারপর তাদের সাথে সামনা-সামনি কথা বলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করেন, আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলল, নিশ্চয়ই, আমরা সাক্ষী থাকলাম। এ স্বীকৃতি গ্রহণ এ জন্য যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন বলতে না পারো আমরা তো এ ব্যাপারে অনবহিত ছিলাম। কিংবা তোমরা যেন বলতে না পার যে, আমাদের পূর্ব-পুরুষগণই তো আমাদের পূর্বে শিরক ক আর আমরা তো তাদের পরবর্তী বংশধর, তবে কি পথভ্রষ্টদের কৃতকর্মের জন্য তুমি আমাদের ধ্বংস করবে? (৭: ১৭২-১৭৩)
ইমাম নাসাঈ, ইব্ন জারীর ও হাকিম (رحمة الله) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাকিম (رحمة الله) হাদীসটির সনদ সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। প্রামাণ্য কথা হলো, বর্ণিত হাদীসটি আসলে ইবন আব্বাস (رضي الله عنه)-এর উক্তি। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকেও মওকূফ, মরফূ উভয় সূত্রেই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। তবে মওফূক সূত্রটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ। তবে অধিকাংশ আলিমের মতে, সেদিন আদম (عليه السلام)-এর সন্তানদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। তাদের দলীল হলো, ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসটি। যাতে আছে -
আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন কোন এক জাহান্নামীকে বলা হবে— ‘আচ্ছা, যদি তুমি পৃথিবীর সমুদয় বস্তু-সম্ভারের মালিক হতে; তাহলে এখন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তার সমস্ত কিছু মুক্তিপণ রূপে দিতে প্রস্তুত থাকতে?’ উত্তরে সে বলবে, ‘জী হ্যাঁ।’ তখন আল্লাহ বলবেন, ‘আমি তো তোমার নিকট থেকে এর চাইতে আরো সহজটাই চেয়েছিলাম। আদম (عليه السلام)-এর পিঠে থাকা অবস্থায় আমি তোমার নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, আমার সাথে তুমি কাউকে শরীক করবে না। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে তুমি শরীক না করে ছাড়োনি।’ শু’বার বরাতে বুখারী (رحمة الله) এবং মুসলিম (رحمة الله) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আবু জাফর রাযী (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, উবাই ইবন কা’ব (رضي الله عنه) واذ اخذ ربك الخ এ আয়াত এবং এর পরবর্তী আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মানুষ সৃষ্টি করে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের এক স্থানে সমবেত করেন। তারপর তাদের সাথে কথা বলেন ও তাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন এবং তাদের নিজেদেরকেই তাদের সাক্ষীরূপে রেখে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “আমি কি তোমাদের রব নই?’ তারা বলল, ‘জী হ্যাঁ।’ আল্লাহ্ বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমি সাত আসমান, সাত যমীন এবং তোমাদের পিতা আদমকে সাক্ষী রাখলাম, যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা এ কথা বলতে না পার যে, এ ব্যাপারে তো আমরা কিছুই জানতাম না। তোমরা জেনে রাখ যে, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, আমি ব্যতীত কোন রব নেই। আর আমার সাথে তোমরা কাউকে শরীক করো না। তোমাদের নিকট পর্যায়ক্রমে আমি রাসূল পাঠাব, তারা তোমাদেরকে আমার এ অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে সতর্ক করবেন। আর তোমাদের কাছে আমি আমার কিতাব নাযিল করব।” তারা বলল, ‘আমরা সাক্ষ্য দিলাম যে, আপনি আমাদের বর ও ইলাহ। আপনি ব্যতীত আমাদের কোন রব বা ইলাহ নেই।’ মোটকথা, সেদিন তারা আল্লাহর আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছিল।
এরপর উপর থেকে দৃষ্টিপাত করে আদম (عليه السلام) তাঁদের মধ্যে ধনী-গরীব ও সুশ্রী-কুশ্রী সকল ধরনের লোক দেখতে পেয়ে বললেন, ‘হে আমার রব! আপনার বান্দাদের সকলকে যদি সমান করে সৃষ্টি করতেন!’ আল্লাহ্ বললেন, ‘আমি চাই, আমার শুকরিয়া আদায় করা হোক।’ এরপর আদম (عليه السلام) নবীগণকে তাদের মধ্যে প্রদীপের ন্যায় দীপ্তিমান দেখতে পান। আল্লাহ তাআলা তাদের নিকট থেকে রিসালাত ও নবুওতের বিশেষ অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
(وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِنَ ٱلنَّبِیِّـۧنَ مِیثَـٰقَهُمۡ وَمِنكَ وَمِن نُّوحࣲ وَإِبۡرَ ٰهِیمَ وَمُوسَىٰ وَعِیسَى ٱبۡنِ مَرۡیَمَۖ وَأَخَذۡنَا مِنۡهُم مِّیثَـٰقًا غَلِیظࣰا)[Surat Al-Ahzab ৭]
অর্থাৎ স্মরণ কর, যখন আমি নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমার নিকট থেকেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারয়াম তনয় ঈসার নিকট থেকে—এদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার। (৩৩: ৭)
(فَأَقِمۡ وَجۡهَكَ لِلدِّینِ حَنِیفࣰاۚ فِطۡرَتَ ٱللَّهِ ٱلَّتِی فَطَرَ ٱلنَّاسَ عَلَیۡهَاۚ لَا تَبۡدِیلَ لِخَلۡقِ ٱللَّهِۚ )
[Surat Ar-Rum ৩০]
অর্থাৎ, তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে দীনে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। (৩০: ৩০)
(هَـٰذَا نَذِیرࣱ مِّنَ ٱلنُّذُرِ ٱلۡأُولَىٰۤ)
[Surat An-Najm ৫৬]
অর্থাৎ—অতীতের সতর্ককারীদের ন্যায় এ নবীও একজন সতর্ককারী। (৫৩: ৫৬)
(وَمَا وَجَدۡنَا لِأَكۡثَرِهِم مِّنۡ عَهۡدࣲۖ وَإِن وَجَدۡنَاۤ أَكۡثَرَهُمۡ لَفَـٰسِقِینَ)
[Surat Al-A'raf ১০২]
অর্থাৎ আমি তাঁদের অধিকাংশকে প্রতিশ্রুতি পালনকারী পাইনি বরং তাদের অধিকাংশকে তো সত্যত্যাগী পেয়েছি। (৭: ১০২)
ইমাম আব্দুল্লাহ্ ইবন আহমদ, ইবন আবু হাতিম, ইবন জারীর ও ইবন মারদূওয়েহ্ (رحمة الله) তাঁদের নিজ নিজ তাফসীর গ্রন্থে আবু জাফর (رحمة الله) সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মুজাহিদ, ইকরিমা, সাঈদ ইবন জুবায়র, হাসান বসরী, কাতাদা ও সুদ্দী (رحمة الله) প্রমুখ পূর্বসূরি আলিম থেকেও এসব হাদীসের সমর্থনে বর্ণনা পাওয়া যায়। আর পূর্বে আমরা এ কথাটি উল্লেখ করে এসেছি যে, ফেরেশতাগণ আদম (عليه السلام)-কে সিজদা করার জন্যে আদিষ্ট হলে ইবলীস ব্যতীত সকলেই সে খোদায়ী ফরমান পালন করেন। ইবলীস হিংসা ও শত্রুতাবশত সিজদা করা থেকে বিরত থাকে। ফলে আল্লাহ তা’আলা তাকে আপন সান্নিধ্য থেকে বিতাড়িত করে অভিশপ্ত শয়তান বানিয়ে পৃথিবীতে নির্বাসন দেন।
ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “আদমের সন্তানরা সিজদার আয়াত পাঠ করে যখন সিজদা করে; ইবলীস তখন একদিকে সরে গিয়ে কাঁদতে শুরু করে এবং বলে, হায় কপাল! আল্লাহর আদেশ পালনার্থে সিজদা করে আদম সন্তান জান্নাতী হলো আর সিজদার আদেশ অমান্য করে আমি হলাম জাহান্নামী।” ইমাম মুসলিমও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
যাহোক, আদম (عليه السلام) ও তার সহধর্মিনী হাওয়া (عليه السلام) জান্নাতে তা আসমানেরই হোক, বা যমীনেরই কোন উদ্যান হোক— যে মতভেদের কথা পূর্বেই বিবৃত হয়েছে- কিছুকাল বসবাস করেন এবং অবাধে ও স্বচ্ছন্দে সেখানে আহারাদি করতে থাকেন। অবশেষে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল আহার করায় তাদের পরিধানের পোশাক ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং তাদেরকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হয়। অবতরণের ক্ষেত্র সম্পর্কে মতভেদের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
জান্নাতে আদম (عليه السلام)-এর অবস্থানকাল সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে দুনিয়ার হিসাবের একদিনের কিছু অংশ। আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে মরফূ সূত্রে ইমাম মুসলিম (رحمة الله) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস উপরে উল্লেখ করে এসেছি যে, আদম (عليه السلام)-কে জুম’আর দিনের শেষ প্রহরে সৃষ্টি করা হয়েছে। আরেক বর্ণনায় এও আছে যে, জুমআর দিন আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করা হয় আর এদিনেই তাকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করা হয়। সুতরাং যদি এমন হয়ে থাকে যে, যেদিন আদম (عليه السلام)-এর সৃষ্টি হয় ঠিক সেদিনই জান্নাত থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন, তাহলে একথা বলা যায় যে, তিনি একদিনের মাত্র কিছু অংশ জান্নাতে অবস্থান করেছিলেন। তবে এ বক্তব্যটি বিতর্কের ঊর্ধে নয়। পক্ষান্তরে যদি তাঁর বহিষ্কার সৃষ্টির দিন থেকে ভিন্ন কোন দিনে হয়ে থাকে কিংবা ঐ ছয় দিনের সময়ের পরিমাণ ছয় হাজার বছর হয়ে থাকলে সেখানে তিনি সুদীর্ঘ সময়ই অবস্থান করে থাকবেন। যেমন ইবন আব্বাস (رضي الله عنه), মুজাহিদ ও যাহহাক (رحمة الله) থেকে বর্ণিত এবং ইব্ন জারীর (رحمة الله) কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে বলে পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে।
ইবনে জারীর (رحمة الله) বলেন, এটা জানা কথা যে, আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে জুম’আ দিবসের শেষ প্রহরে। আর তথাকার এক প্রহর দুনিয়ার তিরাশি বছর চার মাসের সমান। এতে প্রমাণিত হয় যে, রূহ সঞ্চারের পূর্বে মাটির মূর্তিরূপে আদম (عليه السلام) চল্লিশ বছর এমনিতেই পড়ে রয়েছিলেন। আর পৃথিবীতে অবতরণের পূর্বে জান্নাতে অবস্থান করেছেন তেতাল্লিশ বছর চার মাস কাল। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আবদুর রাযযাক (رحمة الله) বর্ণনা করেন যে, ‘আতা ইবনে আবু রাবাহ (رحمة الله) বলেন, আদম (عليه السلام)-এর পদদ্বয় যখন পৃথিবী স্পর্শ করে তখনো তার মাথা ছিল আকাশে। তারপর আল্লাহ তাঁর দৈর্ঘ্য ষাট হাতে কমিয়ে আনেন। ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রেও এরূপ একটি বর্ণনা আছে। তবে এ তথ্যটি আপত্তিকর। কারণ ইতিপূর্বে আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) কর্তৃক সর্বজন স্বীকৃত বিশুদ্ধ হাদীস উদ্ধৃত করে এসেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা আদম (عليه السلام)-কে ষাট হাত দীর্ঘ করে সৃষ্টি করেন। এরপর তাঁর সন্তানদের উচ্চতা কমতে কমতে এখন এ পর্যন্ত এসে পৌছেছে। এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আদম (عليه السلام)-কে সৃষ্টিই করা হয়েছে ষাট হাত দৈর্ঘ্য দিয়ে তার বেশি নয়। আর তার সন্তানদের উচ্চতা হ্রাস পেতে পেতে এখন এ পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে।
ইবনে জারীর (رحمة الله) ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে আদম! আমার আরশ বরাবর পৃথিবীতে আমার একটি সম্মানিত স্থান আছে। তুমি গিয়ে তথায় আমার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে তা তাওয়াফ কর, যেমনটি ফেরেশতারা আমার আরশ তাওয়াফ করে। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর কাছে একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তিনি আদম (عليه السلام)-কে জায়গাটি দেখিয়ে দেন এবং তাকে হজ্জের করণীয় কাজসমূহ শিখিয়ে দেন। ইবনে জারীর (رحمة الله) আরো উল্লেখ করেন যে, দুনিয়ার যেখানে সেখানে আদম (عليه السلام)-এর পদচারণা হয়, পরবর্তীতে সেখানেই এক একটি জনবসতি গড়ে ওঠে।
ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, পৃথিবীত আদম (عليه السلام)-এর প্রথম খাদ্য ছিল গম। জিবরাঈল (عليه السلام) তার কাছে সাতটি গমের বীজ নিয়ে উপস্থিত হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলো কি? জিবরাঈল (عليه السلام) বললেন, এ-ই তো আপনার সেই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল, যা আপনি খেয়েছিলেন। আদম (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলো আমি কি করব? জিবরাঈল (عليه السلام) বললেন, যমীনে বপন করবেন। উল্লেখ্য যে, তাঁর প্রতিটি বীজের ওজন ছিল দুনিয়ার এক লক্ষ দানা অপেক্ষা বেশি। বীজগুলো রোপণ করার পর ফসল উৎপন্ন হলে আদম (عليه السلام) তা কেটে মাড়িয়ে পিষে আটা বানিয়ে খামির করে রুটি বানিয়ে বহু ক্লেশ ও শ্রমের পর তা আহার করেন। এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
(فَقُلۡنَا یَـٰۤـَٔادَمُ إِنَّ هَـٰذَا عَدُوࣱّ لَّكَ وَلِزَوۡجِكَ فَلَا یُخۡرِجَنَّكُمَا مِنَ ٱلۡجَنَّةِ فَتَشۡقَىٰۤ)
[Surat Ta-Ha ১১৭]
অর্থাৎ, সুতরাং সে যেন তোমাদের কিছুতেই জান্নাত থেকে বের করে না দেয়। দিলে তোমরা দুঃখ পাবে।’ (২০-১১৭)
আদম ও হাওয়া (عليه السلام) সর্বপ্রথম যে পোশাক পরিধান করেন, তা ছিল ভেড়ার পশমের তৈরি। প্রথমে চামড়া থেকে পশমগুলো খসিয়ে তা দিয়ে সুতা তৈরি করেন। তারপর আদম (عليه السلام) নিজের জন্য একটি জুব্বা আর হাওয়ার জন্য একটি কামীজ ও একটি ওড়না তৈরি করে নেন।
জান্নাতে থাকাবস্থায় তাদের কোন সন্তানাদি জন্মেছিল কিনা এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কারো কারো মতে, পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও তাঁদের কোন সন্তান জন্মেনি। কেউ বলেন, জন্মেছে। কাবীল ও তার বোনের জন্ম জান্নাতেই হয়েছিল। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
উল্লেখ্য যে, প্রতি দফায় আদম (عليه السلام)-এর এক সঙ্গে একটি পুত্র সন্তান ও একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিত। আর এক গর্ভের পুত্রের সঙ্গে পরবর্তী গর্ভের কন্যার ও কন্যার সঙ্গে পুত্রের বিবাহ দেওয়ার বিধান দেওয়া হয়। পরবর্তীতে একই গর্ভের দু’ভাই-বোনের বিবাহ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।