কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


[Book on Sufi Song and Music]


উৎসর্গ: পীর ও মুর্শীদ হযরত মওলানা শাহ সূফী সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-ক্বাদেরী ওয়াল-চিশ্তী সাহেব ক্বেবলা (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর পুণ্যস্মৃতিতে।


بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

نَحْمَدُهُ وَنُصَلِّيْ عَلَى رَسُوْلِهِ الْكَرِيْمِ ، 


ভূমিকা


মহান প্রভু আল্লাহতা’লার নামে আরম্ভ করছি, যিনি পরম দয়ালু ও দাতা। শতসহস্র সালাত-সালাম জানাই আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্যে সুপারিশকর্তা ও আল্লাহরই সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর প্রতি। তাঁর সম্মানিত আহলে বায়ত ও আসহাব (رضي الله عنهم)’বৃন্দের প্রতিও জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম। অতঃপর সকল আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) ও আউলিয়া কেরাম (رحمة الله عليهم)’এর প্রতি নিবেদন করি আমাদের সালাম ও শ্রদ্ধাঞ্জলি। বিশেষ করে আমাদের তরীক্বতের ওলীকুল শিরোমণি কুতুবে জমান, জনাব মওলানা, কাজী আসাদ আলী সাহেব ক্বেবলা (رحمة الله عليه), হাজতে রওয়া, মুশকিল কুশা, সুলতানুল মুনাযেরীন, হযরত মওলানা শাহ সূফী আবূল মোকারেম মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম আল-ক্বাদেরী আল-চিশ্তী সাহেব ক্বেবলা (رحمة الله عليه) এবং আপন পীর ও মুর্শীদ সৈয়দ মওলানা এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-ক্বাদেরী আল-চিশ্তী সাহেব ক্বেবলা (رحمة الله عليه)’এর প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম পেশ করে আমরা এ বইটি লেখার প্রয়াস পাচ্ছি। আল্লাহ পাক ক্ববূল করুন, আমীন।


বস্তুতঃ এই বইখানির তথ্য-উপাত্ত আমাদের মুর্শীদ ক্বেবলা (رحمة الله عليه)’এর যাহেরী জিন্দেগীতে তাঁরই তত্ত্বাবধানে আমরা ‘ফায়সালা’ শীর্ষক তরীক্বতের গবেষণামূলক ডজন খানেক স্মরণিকায় সংকলন করেছিলাম। অতঃপর সেসব লেখনী তাঁর বেসাল শরীফ তথা পরলোকে খোদাতা’লার সাথে মিলিত হওয়ার পরে আমরা ক্রমানুসারে সাজিয়ে ‘সেমা: আধ্যাত্মিক সঙ্গীত’ শিরোনামে পুস্তিকা আকারে ২০১১ সালের আগষ্ট মাসে প্রকাশ করি। বর্তমানে প্রকাশের উদ্দেশ্যে এটাকে আরো সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের তাসাউফ/সূফীপন্থী আলেম-উলামার লেখনীও এতে সংযোজন করা হয়েছে। বিরোধী মতের আলেম-উলামার পেশকৃত যুক্তিরও চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সমাধান দেয়া হয়েছে। এই সমাধান আমাদের মনগড়া মতামত নয়, বরং সূফীবাদী ইমামবৃন্দেরই প্রদত্ত ফায়সালা। সবার স্মরণ রাখা উচিৎ যে, ইমামবৃন্দ কোনো বিষয়ে মতপার্থক্যবশতঃ দুটো আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে তৃতীয় মত গ্রহণ করার কোনো অবকাশ থাকে না; এর পাশাপাশি এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর জোর জবরদস্তি নিজেদের মতও চাপিয়ে দিতে পারেন না। এই সুনীতির প্রতি আস্থা রেখেই আমরা এই বইটি প্রণয়ন করেছি।


উসূল/মূলনীতিগত ক্বায়দা বা নিয়ম    


প্রথমেই জানা আবশ্যক যে, ইসলামী শরীয়তের বিধান মোতাবেক সকল বস্তু (বা বিষয়ের) আসল বা মূল মোবাহ, অর্থাৎ, বৈধ। যথা - কাজী খাঁন, দুর্রে মুখতার ইত্যাদি ফেক্বাহ’র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে:


أن الأصل في الأشياء الإباحة


অর্থ: সকল বস্তুর মূল বৈধ বা হালাল। আল্লাহর কিতাবে বা রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর সুন্নাহতে নিষেধাজ্ঞা দ্বারাই কেবল এই বৈধতা রহিত হতে পারে। শায়খ ইঊসুফ ক্বারাদাউয়ী সাহেব এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে এর সপক্ষে শরঈ দলিল উপস্থাপন করেছেন তাঁর অনলাইন সাইটে [লিঙ্ক: https://www.al-qaradawi.net/node/2241 এবং http://www.usislam.org/pdf/Lawful&Prohibited.pdf]। সার সংক্ষেপ হলো, ক্বুর’আন মজীদ, হাদীস শরীফ, ইজমায়ে উম্মত ও ক্বিয়াস দ্বারা যেসব বিষয় হারাম ঘোষিত হয়নি, সেগুলো বৈধ এবং উদ্দেশ্যভেদে সওয়াব ও পুণ্যের কাজ বলে বিবেচিত। সৎ উদ্দেশ্যে কৃত কর্মসমূহ সওয়াবের উৎস হবে এবং অসৎ উদ্দেশ্যে কৃত কর্মসমূহ গুনাহের উৎস হবে। যথা - হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান - إنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ - নিশ্চয় কর্মসমূহ নিয়্যত তথা উদ্দেশ্য দ্বারা বিবেচিত। [ইমাম নববী কৃত হাদীসে আরবাঈন গ্রন্থ, ১ নং হাদীস]


সেমা’ (মরমী সঙ্গীত) ক্বুরআন মজীদ, হাদীস শরীফ, এজমা’-এ-উম্মত ও ক্বিয়াস-এ-ফুক্বাহা তথা ইসলামের চারটি উৎসের কোথাও হারাম ঘোষিত হয়নি। সূফী-দরবেশ ও বুযূর্গানে দ্বীন সেমা’কে জায়েয জ্ঞান করেছেন এবং রেয়াযত (সাধনা) পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। হুজ্জাতুল ইসলাম (ইসলামের দলিল) ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه) তাঁর প্রণীত ‘কিমিয়ায়ে সায়াদাত’ পুস্তকে সেমা’কে সর্বশ্রেষ্ঠ রেয়াযত-পদ্ধতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) তাঁর সাহাবাবৃন্দ (رضي الله عنهم)’কে সাথে নিয়ে সেমা’ শুনেছেন। এমতাবস্থায় সকল প্রকারের গান-বাজনাকে হারাম আখ্যা দেয়া কতোটুকু ইসলামসম্মত তা পাঠকমণ্ডলী বিবেচনা করবেন। 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকায় গবেষণাপত্র


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা ১৯৯২ সালের জুন মাসের সংখ্যায় প্রকাশিত ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের পিএইচডি জনাব আবূল কালাম মুহাম্মদ আবদুল্লাহর রচিত ‘ইসলামের দৃষ্টিতে সঙ্গীত’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটিতে তিনি সেমা’র বৈধতার পক্ষে প্রামাণ্য দলিলগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। পত্রের শেষে লেখক সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন, “ইসলাম প্রকৃত ধর্ম - ক্বুরআনের এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে সকল শ্রেণির সকল সঙ্গীতকে ইসলাম সকল অবস্থায় হারাম বলেনি” [৯৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য]। মরমী গান-বাজনার পক্ষে দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি আরো লেখেন, “হযরত রাসূলে করীম (صلى الله عليه وسلم) কোনো এক যুদ্ধ অভিযান হতে ফিরে এলে জনৈকা মহিলা তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করেন: ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)! আল্লাহ আপনাকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনলে আমি আপনার সামনে দফ (খঞ্জনি) বাজাবো আর গান পরিবেশন করবো বলে মানত করেছিলাম।’ হযরত রাসূল (صلى الله عليه وسلم) বল্লেন, ‘তুমি তোমার মানত (নজর) পূরণ করো।’ তখন সেই নারী গান করতে লাগলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, হারাম কাজে নজর-মানত মানলে তা পূর্ণ করা জায়েয বলে পরিগণিত না। সুতরাং গান-বাজনা একদম হারাম হলে হযরত রাসূল (صلى الله عليه وسلم) বলে দিতেন, ‘তোমার নজর-ই সঠিক নয়। অতএব, তা আর তোমাকে পুরো করতে হবে না। কোনো পাপ কার্যের নজর পুরো করা অসঙ্গত।’ এটা হযরত (صلى الله عليه وسلم)’এর স্পষ্ট হাদীস। নির্দোষ গান-বাজনা যে অবৈধ নয়, এ হাদীস তার অকাট্য প্রমাণ।” [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, জুন ১৯৯২ সংখ্যা, ৯৫ পৃষ্ঠা]


সূফী/দরবেশবৃন্দ যে মরমী গান-বাজনাকে রেয়াযতের পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তা শুধু নির্দোষ-ই নয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم) এবং বুযূর্গানে দ্বীনের এশক্ব-মহব্বতে পরিপূর্ণও। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) এই শ্রেণির সেমা’ শুনেছেন। আমরা এক্ষণে সেসব প্রামাণিক দলিল উপস্থাপন করবো, ইনশা’আল্লাহ। 


প্রামাণ্য দলিল নং ১


বুখারী ও মুসলিম শরীফ হতে ‘মিশকাতুল মাসাবিহ’ নামের গ্রন্থের ‘সালাতুল ঈদাঈন’ শীর্ষক অধ্যায়ে একটি হাদীস শরীফ উদ্ধৃত হয়েছে:


حدثنا يحيى بن بكير، قال حدثنا الليث، عن عقيل، عن ابن شهاب، عن عروة، عن عائشة، أن أبا بكر ـ رضي الله عنه ـ دخل عليها وعندها جاريتان في أيام منى تدففان وتضربان، والنبي صلى الله عليه وسلم متغش بثوبه، فانتهرهما أبو بكر فكشف النبي صلى الله عليه وسلم عن وجهه فقال ‏"‏ دعهما يا أبا بكر فإنها أيام عيد ‏"‏‏. وفي رواية يا أبا بكر إن لكل قوم عيدا وهذا عيدنا.


অর্থ: হযরত মা আয়েশাহ (رضي الله عنها) বর্ণনা করেন যে, এক ঈদের দিনে তাঁর পিতা হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) তাঁর গৃহে প্রবেশ করেন। ওই সময় দু জন মেয়ে দফ (খঞ্জনি) বাজাচ্ছিলো। আরেক বর্ণনায় আছে, তারা বোয়াস যুদ্ধের দিনে প্রদর্শিত আনসার সাহাবা (رضي الله عنهم)’বৃন্দের বীরত্বগাথা গেয়ে শুনাচ্ছিলো - وعندي جاريتان من جواري الأنصار تغنيان بما تقاولت الأنصار يوم بعاث - আর রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) চাদর দ্বারা পবিত্র মুখমণ্ডল আবৃত করে শুয়েছিলেন। অতঃপর হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) ওই দুই মেয়েকে ভর্ৎসনা করলে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) তাঁর পবিত্র চেহারা মোবারক চাদর হতে বের করে এরশাদ করেন, “হে আবূ বকর, তাদের দু জনকে ছেড়ে দাও। আজকে ঈদের দিন।” অপর এক বর্ণনায় আছে, “হে আবূ বকর, নিশ্চয় সকল জাতির জন্যে ঈদের দিন আছে; এটা আমাদের ঈদ।” (সহীহ হাদীস)


হাদীসটিতে প্রতীয়মান হয় যে, মেয়ে দু জন জ্বিহাদে অংশগ্রহণকারী ও আল্লাহতা’লার নৈকট্যপ্রাপ্ত আনসারবৃন্দের বীরত্বগাথাসূচক সঙ্গীত পরিবেশন করছিলো এবং প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) তাদের বাদ সাধেন নি। বরং যখন হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) তাদেরকে থামিয়ে দেন, তখন তিনি হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)’কেই বলেন ওদেরকে ছেড়ে দিতে, কেননা এটা ঈদের দিন। সিদ্দিকীন-সোয়ালেহীন তথা আউলিয়ামণ্ডলীর প্রশংসাসূচক সঙ্গীত যদি হারাম হতো, তাহলে তিনি নিজেই ওই মেয়ে দু জনকে থামিয়ে দিতেন। যেহেতু তিনি তাদেরকে না থামিয়ে হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)’কেই বলেছেন তাদের ছেড়ে দিতে, সেহেতু ওই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর রেযামন্দি/সন্তুষ্টি-ই এখানে প্রমাণিত হয়। আর রাসূলে পাক (صلى الله عليه وسلم)’এর সন্তুষ্টি তো আল্লাহতা’লারই রেযামন্দি ( قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ ٱللهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ ٱللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَٱللهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ) । [সূরা আলে ইমরা’ন, ৩১ আয়াত]


প্রামাণ্য দলিল নং ২


মিশকাত শরীফে ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله عليه) হতে বর্ণিত:


عن عمرو بن شعيب عن أبيه وعن جده أن امرأة قالت يا رسول الله إني نذرت أن أضرب على رأسك بالدف قال أوفي بنذرك.


অর্থ: শোয়াইবের পুত্র আমরু তাঁর পিতা ও পিতামহ হতে বর্ণনা করেন যে, একবার জনৈকা মহিলা আরয করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (صلى الله عليه وسلم), আমি নযর/মানত করেছি যেনো আপনার সামনে দফ (বাদ্য) বাজাতে পারি।” এমতাবস্থায় মহানবী (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ করেন, “তুমি তোমার মানত পূর্ণ করো।” হাদীসটি সর্ব-ইমাম আহমদ, তিরমিযী ও বায়হাক্বী (رحمة الله عليهم) বর্ণনা করেছেন। অপর বর্ণনায় এসেছে ওই মহিলা গান পরিবেশনেরও মানত করেছিলেন।


এই সহীহ হাদীসটির ব্যাখ্যায় মহান আলেমে হক্কানী হযরতুল আল্লামা আবদুস সালাম ঈসাপুরী (رحمة الله عليه) বলেন, “গান-বাজনা যে আসলে না-জায়েয নয়, বরং মোবাহ, এবং স্থলবিশেষে তা সুন্নাত, মোস্তাহাব, মনদুব, ক্বুরবাত (নৈকট্যপ্রাপ্তি) ও এবাদতে পরিগণিত হয়, এই সহীহ হাদীস-ই তার অকাট্য প্রমাণ। কারণ ইসলামের সর্বমতবাদী আলেম-উলামা এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, কোনো গুনাহ’র কাজ করার জন্যে নযর বা মানত করলে তা পূর্ণ করা জায়েয নেই। - যদি দফ (খঞ্জনি) বাজিয়ে গান করা না-জায়েয হতো, তাহলে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) সেই মহিলাকে দফ বাজিয়ে গান করে নজর পুরো করার জন্যে কখনোই আদেশ করতেন না, অথবা অনুমতি দিতেন না। যখন আদেশ করেছেন, তা দ্বারা বোঝা গেলো যে দফ বাজিয়ে গান করা না-জায়েয বা গুনাহ’র কাজ নয়।” [পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’, ৪৬ পৃষ্ঠা, ডিসেম্বর ১৯৭৯ সংস্করণ; সাধু ভাষা হতে চলিতে রূপান্তরিত]


প্রামাণ্য দলিল নং ৩


ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رحمة الله عليه) তাঁর ‘সনদ’ গ্রন্থে নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেন: একবার কয়েক জন হাবশী (আফ্রিকী) প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর সামনে দফ (খঞ্জনি) বাজিয়ে গান করছিলেন - محمد عبد الصالح - অর্থাৎ, নবী করীম (صلى الله عليه وسلم) পুণ্যবান বান্দা। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা কী গাইছো?” তাঁরা আবারো তাই গাইলেন [খাঁন সাহেব মৌলানা হামিদুর রহমান বিএ কৃত ‘শরফুল ইন্সান’, ২৫০ পৃষ্ঠা, ১৯৯০ সংস্করণ]। এ হাদীসটিতে প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর প্রশংসাসূচক গান-বাজনা তিনিও পছন্দ করেন। নইলে তিনি ওই হাবশীদেরকে এই কাজ হতে বারণ করতেন।


প্রামাণ্য দলিল নং ৪


حَدَّثَنَا مُسَدَّدٌ، حَدَّثَنَا بِشْرُ بْنُ المُفَضَّلِ، حَدَّثَنَا خَالِدُ بْنُ ذَكْوَانَ، قَالَ: قَالَتِ الرُّبَيِّعُ بِنْتُ مُعَوِّذِ ابْنِ عَفْرَاءَ، جَاءَ النَّبِيُّ ﷺ فَدَخَلَ حِينَ بُنِيَ عَلَيَّ، فَجَلَسَ عَلَى فِرَاشِي كَمَجْلِسِكَ مِنِّي، فَجَعَلَتْ جُوَيْرِيَاتٌ لَنَا، يَضْرِبْنَ بِالدُّفِّ وَيَنْدُبْنَ مَنْ قُتِلَ مِنْ آبَائِي يَوْمَ بَدْرٍ، ( قــ :4869 ... غــ : 5147)


অর্থ: যকওয়ানের পুত্র খালেদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে, রুবাইয়্যে বিনতে মুয়াব্বেয ইবনে আফরা (আফরা’র পুত্র মুয়াব্বেয, তাঁর কন্যা রুবাইয়্যে তাঁকে (খালেদ বিন যকওয়ানকে) বলেছেন: “আমার বাসর রজনীতে নবী করীম (صلى الله عليه وسلم) এসে আমার ঘরে প্রবেশ করেন। অতঃপর তুমি (খালেদ) যেভাবে বসেছো, ঠিক সেভাবে তিনিও আমার বিছানার ওপর বসেন। ওই সময় আমাদের (তথা আনসার সাহাবাবৃন্দের) মেয়েরা দফ (খঞ্জনি) বাজাচ্ছিলো এবং আমার পিতা প্রমুখ যাঁরা বদরের জ্বিহাদে শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের প্রতি শোক প্রকাশক ও মাহাত্ম্য বর্ণনাকারী গান গাচ্ছিলো।” [আল-বুখারী]


এই হাদীসটিতে পরিস্ফুট হয় যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং আল্লাহ ও মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর প্রতি ভালোবাসায় অনুপ্রাণিত হয়ে যাঁরা ধর্মযুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন, তাঁদের প্রশংসাসূচক গান-বাজনা রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর সামনে পরিবেশিত হয়েছে এবং হুযূর পাক (صلى الله عليه وسلم) তা নিষেধ করেন নি। অতএব, নফসের (আপন কুপ্রবৃত্তির) সঙ্গে জ্বিহাদে আকবর তথা সর্ববৃহৎ ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার মর্যাদাপ্রাপ্ত আউলিয়াবৃন্দের (رحمة الله عليهم) প্রশংসাসূচক সেমা’-ক্বাওয়ালী এই দলিলে অবশ্যঅবশ্য মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়।


সেমা’-ক্বাওয়ালীর অর্থ


সেমা’ অর্থ মরমী সঙ্গীত। তবে এর আভিধানিক অর্থ শ্রবণ করা। পুণ্যাত্মা সূফী-দরবেশমণ্ডলী (رحمة الله عليهم) মজলিসের আকারে আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم) এবং আউলিয়া কেরাম (رحمة الله عليهم)’এর প্রতি এশক্ব-মহব্বত বৃদ্ধিকারী যে গানবাদ্য শুনে থাকেন, তাকেই ব্যবহারিক ও প্রচলিত অর্থে সেমা’ বলে। ভারত উপমহাদেশে এটাকে ক্বাওয়ালী-ও বলা হয়। সেমা’ শ্রবণকালে বুযূর্গানে দ্বীন (رحمة الله عليهم) অনেক সময় আধ্যাত্মিক ভাবে তন্ময় হয়ে ‘ওয়াজদ’ বা ‘রকস্’ করে থাকেন, যেমনিভাবে রাসূলে করীম (صلى الله عليه وسلم) করেছিলেন [সামনের দলিল নং ৯ দ্রষ্টব্য]।


ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه)’এর ভাষ্য


ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه) নিজ ‘কিমিয়ায়ে সায়াদত’ গ্রন্থের ‘সেমা’ অধ্যায়ে লিখেছেন: ”আল্লাহতা’লার প্রেমের আগুন অন্তরে প্রজ্জ্বলিত করার জন্যে মা’রেফতী সেমা’র ক্ষমতা অসীম ও অতুলনীয়। সূফীদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা মেসা’র মোহে তন্ময় থাকাকালীন মুকাশাফাত (مكاشفات) তথা দিব্যদৃষ্টি বিকশিত করতে সমর্থ হয়েছেন। ওই অবস্থায় তাঁরা এমন এক বর্ণনাতীত সুখ অনুভব করেন, যা সেমা’ ভিন্ন অন্য কোনো বস্তুর সাহায্যে অনুভব করার উপায় নেই। সেই তন্ময় অবস্থায় এই সেমা’র প্রভাবে তাঁদের অন্তরে যে সমস্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হাল/অবস্থা প্রকাশ পায়, তাকে সূফীয়ায়ে কেরাম ওয়াজদ (وجد) বা সেমা‘জনিত মোহমত্ততা আখ্যায়িত করে থাকেন। ….অন্তরের মধ্যে দহনশীলতার উৎপত্তি করে তা হতে মলিনতা দূর করতে সেমা’র যতোটুকু ক্ষমতা রয়েছে, আর অন্য কোনো রিয়াযত বা আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে ততোটুকু নেই।” [ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه) রচিত ‘কিমিয়ায়ে সায়াদত’ বাংলা সংস্করণ, ২২১ পৃষ্ঠা, এপ্রিল ১৯৭৪ ইং; দেওবন্দী মৌলভী নূরুর রহমান অনূদিত এবং মৌলভী শামসুল হক ফরিদপুরীর লিখিত ভূমিকাসম্বলিত]


সেমা’র শর্তাবলী


সেমা’/মরমী সঙ্গীত শোনার কিছু শর্ত বিদ্যমান। এসব শর্ত আহলে সেমা’ (সেমা’পন্থী) তরীক্বতের ইমামবৃন্দ-ই আরোপ করেছেন। যথা - (১) সেমা’র মজলিশে নারী-পুরুষের সংমিশ্রণ হতে পারবে না। নারীকুল সেমা’ শুনতে পারবেন, তবে পর্দার অন্তরালে। (২) মজলিশের সবাইকে আহলে সেমা’ তথা সেমা’র প্রতি আগ্রহী হতে হবে। (৩) সেমা’র নিয়্যত খাঁটি হতে হবে। (৪) আত্মহারা না হলে ওঠে দাঁড়ানো যাবে না। (৫) গানগুলো শরীয়তবিরোধী হতে পারবে না [মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব (রহ:) কৃত ‘জায়াল হক্ক গ্রন্থের সেমা’অধ্যায় ও ইমাম গাজ্জালী (রহ:)’এর প্রণীত ‘কিমিয়ায়ে সায়াদত’ পুস্তকের সেমা’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য]। আমাদের পীর ও মুর্শীদ সৈয়দ মওলানা এ,জেড,এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব ক্বেবলা (رحمة الله عليه)’এর মজলিশে আরো কয়েকটি আদব পালিত হতে দেখেছি আমরা। সবাইকে তাতে অযূ করে মাথায় টুপি পরে বসতে হতো। ইমামবৃন্দের আরোপিত শর্তাবলী মানা না হলে মজলিশের শরঈ বৈধতা থাকবে না।


প্রামাণ্য দলিল নং ৫


হযরত আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ ফরমান:


حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ، حَدَّثَنَا أَبُو عَاصِمٍ، أَخْبَرَنَا ابْنُ جُرَيْجٍ، أَخْبَرَنَا ابْنُ شِهَابٍ، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ ‏"‏‏.‏ وَزَادَ غَيْرُهُ ‏"‏ يَجْهَرُ بِهِ ‏"‏‏.


অর্থ: যে ব্যক্তি সুরের সাথে (গুন্না করে) ক্বুর’আন মজীদ পাঠ করে না, সে আমার দলভুক্ত নয়। (অন্যরা আরো বলেন এর মানে উচ্চস্বরে পাঠ) [সহীহ বুখারী, বই নং ৯৮, হাদীস নং ৭৬২১]


এই হাদীসটি প্রতীয়মান করে যে, হুজূর পূর নূর (صلى الله عليه وسلم) সুর পছন্দ করেন। 


প্রামাণ্য দলিল নং ৬


হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) হতে বর্ণিত যে, তিনি একবার জনৈকা তরুণীকে কোনো এক আনসার ব্যক্তির সাথে বিয়ে দেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) ফরমান:


حدثنا الفضل بن يعقوب ،‏‏‏‏ ‏‏‏‏ حدثنا محمد بن سابق ،‏‏‏‏ ‏‏‏‏ حدثنا إسرائيل ،‏‏‏‏ ‏‏‏‏ عن هشام بن عروة ،‏‏‏‏ ‏‏‏‏ عن أبيه ،‏‏‏‏ ‏‏‏‏ عن عائشة ،‏‏‏‏ ‏‏‏‏ أنها زفت امرأة إلى رجل من الأنصار فقال نبي الله صلى الله عليه وسلم ‏"‏ يا عائشة ما كان معكم لهو فإن الأنصار يعجبهم اللهو ‏"‏‏.‏


অর্থ: হে আয়েশা, তোমার কাছে কি কোনো গানের বন্দোবস্ত নেই? নিশ্চয় আনসারবৃন্দ গান পছন্দ করে। [সহীহ বুখারী ৫১৬২]


এই হাদীসে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর সমর্থন দ্বারা নির্দোষ গান-বাজনা জায়েয প্রমাণিত হয়।


প্রামাণ্য দলিল নং ৭


ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله عليه) তাঁর ‘দালায়েলুন্ নুবুওয়্যত’ পুস্তকে এবং ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه ) তাঁর ‘এহইয়া’ কিতাবে লিখেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) তাবুকের যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তন করলে মদীনাবাসী মহিলাবৃন্দ দফ (খঞ্জনি) বাজিয়ে নিম্নোক্ত শ্লোকটি গেয়ে শোনান:


طلع البدر علينا من ثنيات الوداع

وجب الشكر علينا ما دعا لله داع


অর্থ: হেদায়াতের পূর্ণচন্দ্র মোদের ভাগ্যাকাশে ‘আল-ওয়াদা’আ উপত্যকা হতে হয়েছেন উদিত,  

যতোদিন আল্লাহর কোনো এবাদতকারী আছেন আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশে হবো বাধিত।


এই সেমা’র প্রতি মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর সম্মতি ছিলো বলেই সাব্যস্ত হয়।


প্রামাণ্য দলিল নং ৮


حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ مَنْصُورٍ، أَنْبَأَنَا جَعْفَرُ بْنُ عَوْنٍ، أَنْبَأَنَا الأَجْلَحُ، عَنْ أَبِي الزُّبَيْرِ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ أَنْكَحَتْ عَائِشَةُ ذَاتَ قَرَابَةٍ لَهَا مِنَ الأَنْصَارِ فَجَاءَ رَسُولُ اللهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ فَقَالَ ‏"‏ أَهْدَيْتُمُ الْفَتَاةَ ‏"‏ ‏.‏ قَالُوا نَعَمْ ‏.‏ قَالَ ‏"‏ أَرْسَلْتُمْ مَعَهَا مَنْ يُغَنِّي قَالَتْ لاَ ‏.‏ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏"‏ إِنَّ الأَنْصَارَ قَوْمٌ فِيهِمْ غَزَلٌ فَلَوْ بَعَثْتُمْ مَعَهَا مَنْ يَقُولُ أَتَيْنَاكُمْ أَتَيْنَاكُمْ فَحَيَّانَا وَحَيَّاكُمْ ‏"‏ ‏.


অর্থ: হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; একবার হযরত মা আয়েশাহ (رضي الله عنها) এক আত্মীয়াকে জনৈক আনসারের সাথে বিয়ে দেন। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) এসে জিজ্ঞেস করেন, “নববধূকে কি তোমরা স্বামীগৃহে পাঠিয়ে দিয়েছো?” তাঁরা উত্তর দেন, “জি।” তিনি জিজ্ঞেস করেন, “গান গাইতে এমন কাউকে কি তার সাথে পাঠিয়েছো?” মা আয়েশা (رضي الله عنها) উত্তর দেন, “না।” অতঃপর রাসূল (صلى الله عليه وسلم) বলেন, “আনসার এমন এক জাতি যারা সঙ্গীত ভালোবাসে। তোমাদের উচিৎ ছিলো নববধূর সাথে গান গাইতে পারে এমন কাউকে পাঠানো, যে বরের বাড়িতে গিয়ে গাইতো - আমরা এসেছি, আমরা এসেছি, খোদা আমাদের ও আপনাদের হায়াত দান করুন, (তাঁর শান্তি বর্ষণ করুন)।” [সুনানে ইবনে মাজাহ, বই নং ৯, হাদীস নং ১৯৭৫]


ওপরে উদ্ধৃত হাদীসটিতে পরিস্ফুট হয় যে, আল্লাহতা’লার রহমত, বরকত ও ফযীলত কামনা করে সেমা’ মাহফিল অনুষ্ঠান করা ইসলামী শরীয়তে সম্পূর্ণ বৈধ ও সওয়াবদায়ক আমল। রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর সমর্থন-ই তার প্রামাণিক দলিল।


প্রামাণ্য দলিল নং ৯


عن أنس رضي الله عنه قال كنا عند رسول الله إذ نزل جبريل عليه السلام فقال يا رسول الله إن فقراء أمتك يدخلون الجنة قبل الأغنياء بخمس مائة عام وهو نصف يوم ففرح رسول الله فقال أفيكم من ينشد فقال بدوي نعم فقال هات هات فأنشد البدوي

(قد لسعت حية الهوى كبدي فلا طبيب لها ولا راقي)

(إلا الطبيب الذي شغفت به فعنده رقيتي وترياقي)

فتواجد رسول الله وتواجد الأصحاب حتى سقط رداؤه عن منكبه فلما فرغوا أوى كل واحد إلى مكانه فقال معاوية بن أبي سفيان ما أحسن لعبكم يا رسول الله فقال يا معاوية ليس بكريم من لم يهتز عند سماع ذكر الحبيب ثم اقتسم رداء رسول الله من حضر بأربعمائة قطعة.  


অর্থ: হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: একবার আমরা মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। ওই সময় ফেরেশতা জিবরীল আমিন (আলাইহিস্ সালাম) অবতরণ করে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল (صلى الله عليه وسلم)! আপনার গরিব উম্মতবৃন্দ ধনাঢ্য উম্মতদের চেয়ে (ক্বেয়ামতে) অর্ধ দিবস যা দুনিয়ার পাঁচ শ বছরের সমান, তার আগেই বেহেশতে প্রবেশ করবেন।” এ কথা শুনে রাসূল (صلى الله عليه وسلم) খুশি হয়ে বলেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে আমাকে সেমা’/নাশিদ শোনাতে পারে?” জনৈক বদভী/বেদুঈন বলেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (صلى الله عليه وسلم), আমি পারি। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) বলেন, “তবে গাও।” অতঃপর বদভী গাইলেন:


দংশিয়াছে প্রেম-সর্প হৃদয় আমার,

নাহিকো ডাক্তার আর নাহি মন্ত্রকার,

কিন্তু মম প্রাণ নিধি সকাশে যাঁহার,

দাওয়াই আর মন্ত্র মোর আছে অনিবার।। [সংগৃহীত কাব্যানুবাদ]


এতদশ্রবণে রাসূল (صلى الله عليه وسلم) ওয়াজদ করেন এবং তাঁর সাহাবাবৃন্দ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-ও তাঁর সাথে ওয়াজদ করেন। এই ওয়াজদের সময় তাঁর পবিত্র চাদর আপন কাঁধ মোবারক হতে পড়ে যায়। যখন সবার ওয়াজদ শেষ হয়, তখন প্রত্যেকে নিজ নিজ স্থানে উপবেশন করেন। এমতাবস্থায় হযরত মুয়াবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ান (رضي الله عنه) আরয করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) কী সুন্দর আপনাদের খেলা!” হুজূর পাক (صلى الله عليه وسلم) উত্তরে বলেন, “যে ব্যক্তি প্রিয়তমের স্মরণে হৃদ-স্পন্দন অনুভব করে না, সে করীম বা মহৎ ব্যক্তি নয়।” এরপর তিনি নিজ চাদর মোবারক চার শ টুকরো করে উপস্থিত সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’বৃন্দের মাঝে বিতরণ করে দেন। [মুফতী আবদুস্ সালাম ঈসাপুরী সাহেব (رحمة الله عليه) কৃত ‘পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’, ৪৭-৪৯ পৃষ্ঠা, ডিসেম্বর ১৯৭৯ সংস্করণ]


এই রওয়ায়াত/বিবরণটি সম্পর্কে সেমা’বিরোধী কিছু অনলাইন আরবী সাইটে ’বানোয়াট’ বা জাল বলা হয়েছে। তাই আমরা মুফতী ঈসাপুরী সাহেব (رحمة الله عليه)’এর বই হতে কিছু উদ্ধৃতি এখানে পেশ করবো: 


“আওয়ারেফ গ্রন্থপ্রণেতা [সুলতানুল আরেফীন শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمة الله عليه)] হাফেয আবূ জার্রাহ তাহের হতে, তিনি তাঁর পিতা আবূ ফজল হাফেজ মাক্বদেসী হতে, তিনি আবূ মানসূর মুহাম্মদ ইবনে আবদিল মালেক মোজাফফরী সারখসী হতে, তিনি আবূ আলী ফজল ইবনে মানসূর ইবনে নসর হতে, তিনি হাশেম ইবনে কলিব হতে, তিনি আবূ বকর আম্মার ইবনে ইসহাক্ব হতে, তিনি সা’আদ ইবনে আমের হতে, তিনি শোয়াব হতে, তিনি আবদুল আজিজ ইবনে সোহাইব হতে, তিনি হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে এই রওয়ায়াত বর্ণনা করেন।….এটা ‘তাফসীরে আহমদী,’ ‘আওয়ারেফ’ ও জম্উল জওয়াম’ ইত্যাদি গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীস যাঁরা রওয়ায়াত করেছেন, সেসব রাবী/বর্ণনাকারী বিশ্বাসী ও সর্বজনমান্য; কোনো রাবী’কে দুর্বল বা অবিশ্বাসযোগ্য বলে কোনো মুহাদ্দিস বলেননি। উসূলে হাদীস অনুসারে এ হাদীস শরীফকে দলিলের অযোগ্য বলার কোনো হেতু নেই। ‘মহাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’ ও ‘ওয়াজদ’ হালত-অবস্থার বিরোধী কোনো জাহেরী এলমে পণ্ডিত ব্যক্তি যদি মনগড়া খেয়ালের বশবর্তী হয়ে এটাকে হাদীস হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি না-ও হয়, তথাপিও সহীহ হাদীস কখনো পরিত্যাজ্য হতে পারে না।” [প্রাগুক্ত ‘পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’, ৪৯ পৃষ্ঠা; উল্লেখ্য যে, হাফেয মাক্বদেসী’র পুরো নাম শায়খুল ইসলাম আবূল ফারাজ আবদীর রহমান ইবনে আবী উমর মাক্বদেসী (رحمة الله عليه)]


উপরোক্ত হাদীস শরীফে পরিস্ফুট হয় যে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) ও তাঁর সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم) সেমা’র অনুষ্ঠান করেছিলেন এবং সেমা’ শুনতে শুনতে ওয়াজদ করেছিলেন। এ হাদীস দ্বারা বুযূর্গানে দ্বীন ও সূফীবৃন্দের সেমা’ ও ওয়াজদ শরীয়তসিদ্ধ প্রমাণিত হয়। এখানে লক্ষণীয় যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)’কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি মাহবূবের যিকর তথা স্মরণে হৃদ-স্পন্দন অনুভব করে না, সে মহৎ নয়।’ অর্থাৎ, সেমা’ বা মরমী সঙ্গীত হলো মাশুক (প্রেমাস্পদ) তথা আল্লাহতা’লা, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) ও আউলিয়াবৃন্দের দরবারে এক প্রকার যিকর-বিশেষ।


প্রামাণ্য দলিল নং ১০


حَدَّثَنَا هِشَامُ بْنُ عَمَّارٍ، حَدَّثَنَا عِيسَى بْنُ يُونُسَ، حَدَّثَنَا عَوْفٌ، عَنْ ثُمَامَةَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، أَنَّ النَّبِيَّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ مَرَّ بِبَعْضِ الْمَدِينَةِ فَإِذَا هُوَ بِجَوَارٍ يَضْرِبْنَ بِدُفِّهِنَّ وَيَتَغَنَّيْنَ وَيَقُلْنَ نَحْنُ جَوَارٍ مِنْ بَنِي النَّجَّارِ يَا حَبَّذَا مُحَمَّدٌ مِنْ جَارِ ‏.‏ فَقَالَ النَّبِيُّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏ "‏ يَعْلَمُ اللهُ إِنِّي لأُحِبُّكُنَّ ‏"‏ ‏.‏


অর্থ: হযরত আনাস বিন মালিক (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত: একবার রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) মদীনা শরীফের কোনো এক গলি দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখতে পান কয়েকজন তরুণী দফ বাজিয়ে গান করছিলেন এই বলে, ‘আমরা বনূ নাজ্জার গোত্রের তরুণী। রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) আমাদের কতো উত্তম প্রতিবেশি।’ এমতাবস্থায় তিনি (তাঁদেরকে) বলেন, ‘আল্লাহতা’লা ভালোভাবে জানেন, আমি তোমাদেরকে কতো ভালোবাসি।’ [সুনানে ইবনে মাজাহ, বই নং ৯, হাদীস নং ১৯৭৪]


এটা সহীহ হাদীস। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর শান-মান প্রকাশক গান-বাজনা ইসলামে বৈধ এবং তিনিও তা পছন্দ করেন।


প্রামাণ্য দলিল নং ১১


 তিরমিযী শরীফে লিপিবদ্ধ আছে - 


حَدَّثَنَا الْحُسَيْنُ بْنُ حُرَيْثٍ، حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ الْحُسَيْنِ بْنِ وَاقِدٍ، حَدَّثَنِي أَبِي، حَدَّثَنِي عَبْدُ اللهِ بْنُ بُرَيْدَةَ، قَالَ سَمِعْتُ بُرَيْدَةَ، يَقُولُ خَرَجَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِي بَعْضِ مَغَازِيهِ فَلَمَّا انْصَرَفَ جَاءَتْ جَارِيَةٌ سَوْدَاءُ فَقَالَتْ يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّي كُنْتُ نَذَرْتُ إِنْ رَدَّكَ اللَّهُ سَالِمًا أَنْ أَضْرِبَ بَيْنَ يَدَيْكَ بِالدُّفِّ وَأَتَغَنَّى ‏.‏ فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ إِنْ كُنْتِ نَذَرْتِ فَاضْرِبِي وَإِلاَّ فَلاَ ‏"‏ ‏.‏ فَجَعَلَتْ تَضْرِبُ فَدَخَلَ أَبُو بَكْرٍ وَهِيَ تَضْرِبُ ثُمَّ دَخَلَ عَلِيٌّ وَهِيَ تَضْرِبُ ثُمَّ دَخَلَ عُثْمَانُ وَهِيَ تَضْرِبُ ثُمَّ دَخَلَ عُمَرُ فَأَلْقَتِ الدُّفَّ تَحْتَ اسْتِهَا ثُمَّ قَعَدَتْ عَلَيْهِ ‏.‏ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ إِنَّ الشَّيْطَانَ لَيَخَافُ مِنْكَ يَا عُمَرُ إِنِّي كُنْتُ جَالِسًا وَهِيَ تَضْرِبُ فَدَخَلَ أَبُو بَكْرٍ وَهِيَ تَضْرِبُ ثُمَّ دَخَلَ عَلِيٌّ وَهِيَ تَضْرِبُ ثُمَّ دَخَلَ عُثْمَانُ وَهِيَ تَضْرِبُ فَلَمَّا دَخَلْتَ أَنْتَ يَا عُمَرُ أَلْقَتِ الدُّفَّ ‏"‏ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ مِنْ حَدِيثِ بُرَيْدَةَ وَفِي الْبَابِ عَنْ عُمَرَ وَسَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ وَعَائِشَةَ ‏.


অর্থ: হযরত আবূ বুরায়দাহ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত রাসূলে খোদা (صلى الله عليه وسلم) কোনো এক জ্বেহাদে বের হয়ে প্রত্যাবর্তন করার পর জনৈকা কৃষ্ণবর্ণের (হাবশী) তরুণী দাসী তাঁর খেদমতে আরয করেন, “হে আল্লাহর রাসূল (صلى الله عليه وسلم)! আমি মানত করেছিলাম যে, আল্লাহতা’লা আপনাকে সহি-সালামতে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফেরত আনলে আমি আপনার সামনে দফ (খঞ্জনি) বাজাবো এবং গান গাইবো।” প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) উত্তরে বলেন, “যদি তুমি নজর/মানত করে থাকো, তাহলে তোমার নজর পুরো করো।” অতঃপর তরুণীটি গান গাইতে আরম্ভ করেন। এমতাবস্থায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي الله عنه) সেখানে এলে তরুণীটি বাজাতে থাকেন। অতঃপর হযরত আলী (رضي الله عنه) সেখানে আসেন, কিন্তু তরুণী তখনো বাজাতে থাকেন। এরপর হযরত উসমান (رضي الله عنه) সেখানে আসেন, আর তরুণী তখনো বাজাতে থাকেন। কিন্তু যখন-ই হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) সেখানে উপস্থিত হন, তৎক্ষণাৎ ওই তরুণী দাসী দফটি তাঁর নিতম্বের নিচে রেখে দেন। এতে রাসূলে খোদা (صلى الله عليه وسلم) বলেন, “হে উমর! শয়তানও তোমাকে ভয় পায়। আমি বসেছিলাম, আর তরুণীটি দফ বাজাচ্ছিলো; আবূ বকর (رضي الله عنه) আসার পরও সে বাজাচ্ছিলো; আলী (رضي الله عنه) যখন আসে, তখন-ও সে বাজাচ্ছিলো; উসমান (رضي الله عنه) আসাতেও সে দফ বাজানো থামায় নি। কিন্তু হে উমর, তুমি যেই আগমন করলে অমনি সে দফটি রেখে দিলো।” [জামেউত্ তিরমিযী, বই নং ৪৯, হাদীস নং ৪০৫৪]


হাদীসটি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’কে সহি-সালামতে আল্লাহতা’লা জ্বেহাদের ময়দান থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন বলে খুশি প্রকাশের ও শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে তরুণীটি গান করেছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে মানত মেনেছিলেন। রাসূল (صلى الله عليه وسلم) তাতে বাদ সাধেন নি। গান-বাজনা যদি মূলতঃ হারাম-ই হতো, তাহলে তিনি তাঁকে কখনোই তা করার অনুমতি দিতেন না। কেননা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে - نذر المعصية معصية - পাপ কাজে মানত পূরণ করাও গুনাহ (আল-হাদীস)। এমতাবস্থায় প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) তরুণীটিকে নজর পূরণ করার এজাযত/অনুমতি দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে নেক/সৎ উদ্দেশ্যে কৃত সেমা’ জায়েয। কেননা কেউ যদি এই নিয়্যত করে যে হজ্জ্ব পালন শেষে সহি-সালামতে প্রত্যাবর্তন করলে শূকরের গোস্ত দ্বারা মেজবান খাওয়াবে, তাহলে তার এই নিয়্যত পূরণ করা বৈধ নয়। ঠিক একইভাবে সেমা’ যদি মূলতঃ হারাম হতো, তাহলে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)কখনোই তরুণীটিকে এজাযত দিতেন না।


দ্বিতীয়তঃ হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) আসার পর তরুণীটি গান-বাজনা বন্ধ করে দিলে মহানবী (صلى الله عليه وسلم) তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “হে উমর, শয়তানও তোমাকে ভয় পায়।” এ কথা থেকে কেউ যাতে ভুল বুঝতে না পারেন, সে জন্যে আমরা বলছি: তরুণীটির গান-বাজনা শয়তানী ছিলো এমন ধারণা কোনোক্রমেই গ্রহণ করা যায় না। স্বয়ং রাসূল (صلى الله عليه وسلم) ও তাঁর তিন জন বিশিষ্ট সাহাবা (রা:) শয়তানী কার্যে মশগুল হবেন অথবা বেহুদা কর্মে সময় অপচয় করবেন, এমন ধারণা পোষণ করা যে কোনো মুসলমানের পক্ষেই ঈমানের দুর্বলতা বা ঘাটতি। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর উক্ত কথার সারমর্ম হলো, হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه)’কে দেখলে শয়তানই ভয় পায়, আর এ তো একজন তরুণী মাত্র।


প্রামাণ্য দলিল নং ১২


হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে, মহানতম নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যেয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কায় প্রবেশ করলে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়া’হা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর অগ্রভাগে হাঁটছিলেন এবং নিম্নের পংক্তিগুলো উচ্চস্বরে (শে’র আকারে) আবৃত্তি করছিলেন:

خَلُّوا بَنِي الْكُفَّارِ عَنْ سَبِيلِهِ

الْيَوَمَ نَضْرِبُكُمْ عَلَى تَنْزِيْلِ

ضَرْبًا يُزِيلُ الْهَامَ عَنْ مَقِيلِهِ 

وَيُذْهِلُ الْخَلِيلَ عَنْ خَلِيلِهِ   

ওহে কুফফার সন্তানবর্গ, হও বিমুখ হতে নবী (দ:)’র পথ,

কেননা তাঁর আগমন দিবসে আমরা তোমাদের করবো আঘাত,

যা এমনই যে (ঘাড় থেকে) করবে মুণ্ডপাত,

যার ফলে এক মিত্র ভুলবে তারই (আপন) মিত্রের জাত! (ভাবানুবাদ)

এতদশ্রবণে হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন:

يَا ابْنَ رَوَاحَةَ! بَيْنَ يَدَيْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَفِي حَرَمِ اللهِ تَقُولُ الشِّعْرَ؟

অর্থ: ওহে ইবনে রাওয়াহা, তুমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর সামনে এবং আল্লাহরই হারাম (মানে বায়তুল্লাহ) শরীফের স্থানে কাব্য পাঠ করছো/শে’র-গজল গাইছো?

এমতাবস্থায় মহানতম পয়গম্বর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর প্রশ্নের উত্তরে বলেন:

خَلِّ عَنْهُ يَا عُمَرُ، فَلَهِيَ أَسْرَعُ فِيْهِمْ مِنْ نَضْحِ النَّبْلِ

অর্থ: হে উমর, ওকে ছেড়ে দাও; কেননা (ওর) এই কাব্য/শে’র-গজল কুফফারদের (গায়ে) তীরের চেয়েও বেশি জোরে আঘাত করছে। [ইমাম তিরমিযী কৃত ‘আল-জামেউস্ সহীহ’: ‘কিতা’বুল আদব’, ‘কবিতা পাঠ সম্পর্কে আমাদের কাছে যা এসেছে’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:১৩৯ #২৮৪৭, আর তিনি এটাকে হাসান সহীহ হাদীস ঘোষণা করেন; আল-নাসাঈ প্রণীত ‘আল-সুনান’: ‘কিতা’ব মানা’সিক আল-হাজ্জ্ব’, ‘হারাম শরীফে পদ্য আবৃত্তি’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২০২ #২৮৭৩; এবং আল-ক্বুরতুবী রচিত ‘আল-জামেউ লি-আহকামিল-ক্বুরআন’, ১৩:১৫১]

এই বর্ণনায় জানা যায়, মরমী সঙ্গীত জ্বেহাদের মতো এবাদতেও ব্যবহৃত হয়েছে, যেখানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর প্রশংসা করে কাফেরদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে। এতে আরো প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) এই শে’র গাওয়াতে সন্তুষ্ট ছিলেন। ঘটনাটিতে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) কবির ওই শে’র পরিবেশনায় প্রথমে অবৈধ জেনে বাধা দিলেও রাসূলে পাক (صلى الله عليه وسلم)’এর এজাযত সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার পর তিনি এটাকে বৈধ জেনেছেন। বস্তুতঃ তিনি যে না’ত/শে’র-গজল তথা সেমা’কে বৈধ জানতেন, এ ঘটনা তারই একটি অকাট্য দলিল।


প্রামাণ্য দলিল নং ১৩


ইসলামী মনীষীদের সমর্থন 


হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবূ হানীফা (رحمة الله عليه) প্রতি রাতে তাঁর এক প্রতিবেশির কাছে গান শুনতেন (তাযকেরাতুল হামদাদিয়া)। ইমাম আবদুল গনী নাবলূসী হানাফী (رحمة الله عليه) এই কথা উল্লেখ করে বলেন যে, একদিন সেই প্রতিবেশিকে খুঁজে না পেয়ে ইমাম আবূ হানীফা (رحمة الله عليه) অনুসন্ধান করে জানতে পারেন যে আমির আদনী তাঁকে গ্রেফতার করেছেন। হযরত ইমাম (رحمة الله عليه)’এর অনুরোধে আমির সাহেব ওই গায়ককে মুক্তি দেন। ইমাম আবূ ইঊসুফ (رحمة الله عليه) খলীফা হারূন-উর-রশীদের মজলিশে সঙ্গীত শ্রবণ করতেন এবং অনেক সময় ভাবে তন্ময় হয়ে কান্নাকাটি করতেন। তাঁকে সঙ্গীত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ইমাম আবূ হানীফা (رحمة الله عليه)’এর ওই ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলতেন, সঙ্গীত নিষিদ্ধ হলে হযরত ইমাম (رحمة الله عليه) কখনোই প্রতি রাতে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করতেন না। [প্রাগুক্ত ‘ইসলামের দৃষ্টিতে সঙ্গীত’ শীর্ষক গবেষণাপত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, জুন ১৯৯২ সংখ্যা, ৯৬ পৃষ্ঠা]


ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه) তাঁর পুত্রের মজলিশে উপস্থিত হয়ে জনৈক গায়কের গান শ্রবণ করলে তাঁর পুত্র তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বাবা, আপনি তো সঙ্গীতকে জায়েয মনে করেন না।’ হযরত ইমাম (رحمة الله عليه) উত্তর দেন, ‘যে গান পাপের প্রবৃত্তি দেয়, শুধুমাত্র তা-ই নিষিদ্ধ। [প্রাগুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, জুন ১৯৯২ সংখ্যা, ৯৬ পৃষ্ঠা]


ইমাম মালেক (رحمة الله عليه)’কে একবার সঙ্গীত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাব দেন, ‘নেহাত অজ্ঞ-মূর্খ ও হৃদয়হীন লোক ছাড়া সঙ্গীতকে অন্য কেউ হারাম বলতে পারে না। [প্রাগুক্ত, ৯৬ পৃষ্ঠা]


ইমাম শাফেঈ (رحمة الله عليه)’এর কাছ থেকেও সঙ্গীত শ্রবণের বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। [প্রাগুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, জুন ১৯৯২, ৯৬ পৃষ্ঠা]


ইমাম ইবনে আবেদীন শামী আল-হানাফী (رحمة الله عليه): 


قال ابن عابدين في ردّ المحتار: (6/349)أقول : وهذا يفيد أن آلة اللهو ليست محرمة لعينها بل لقصد اللهو منها إما من سامعها أو من المشتغل بها وبه تشعر الإضافة ألا ترى أن ضرب تلك الآلة بعينها حل تارة وحرم أخرى باختلاف النية بسماعها و الأمور بمقاصدها وفيه دليل لساداتنا الصوفية الذين يقصدون أمورا هم أعلم بها فلا يبادر المعترض بالإنكار كي لا يحرم بركتهم فإنهم السادة الأخيار أمدنا الله تعالى بإمداداتهم وأعاد علينا من صالح دعواتهم وبركاتهم


অর্থ: নিশ্চয় বাদ্যযন্ত্র মূলতঃ হারাম নয়। বরং অসৎ উদ্দেশ্য দ্বারা তা শ্রোতা ও বাদকদের কারণেই হারাম হয়ে যায়। এতে বোঝা যায়, এ বিষয়টি শ্রোতা ও বাদকের সাথেই সম্পর্কযুক্ত। তুমি কি দেখো নি যে, বাদ্যযন্ত্র বাজানো ও তা শ্রবণ করা উদ্দেশ্যের (নিয়্যতের) দরুনই একবার হালাল এবং আরেকবার হারাম সাব্যস্ত হয়েছে। আর সমস্ত কার্য-ই নিয়্যত বা উদ্দেশ্য অনুযায়ী বিবেচিত হবে। এতে (ওপরের দলিলে) আমাদের গুরুজন সূফীবৃন্দের বাদ্যযন্ত্র হালাল হওয়ার দালিলিক প্রমাণ বিদ্যমান। যাঁরা উক্ত কার্যে (মানে বাদ্যযন্ত্র শ্রবণে) মনোনিবেশ করেন, সেই সকল পুণ্যাত্মা সূফী-দরবেশবৃন্দ বাদ্যযন্ত্রের হালাল ও হারাম হওয়া সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত আছেন। সুতরাং সূফীমণ্ডলীর কৃত বাদ্যযন্ত্রের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপনকারীরা সাবধান! অবজ্ঞা ও অবহেলা প্রদর্শন কোরো না, যাতে তাঁদের বরকত-আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে না যাও! কেননা তাঁরাই শ্রেষ্ঠতম পথপ্রদর্শক। আল্লাহতা’লা তাঁদের বরকতে আমাদেরকে সাহায্য করুন এবং তাঁদের পুণ্যময় আহ্বান ও তাঁদের প্রতি তাঁরই প্রদত্ত রহমত আমাদের প্রতি বারবার বর্ষণ বা মঞ্জুর করুন (আমিন)। [রাদ্দুল মোহতার/ফতোয়ায়ে শামী, ৬:৩৪৯]


মিসরীয় সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী আলী জুমুআ’র সঙ্গীতবিষয়ক ফতোয়া



প্রশ্ন: সঙ্গীত সম্পর্কে ইসলামের হুকুম কী?



উত্তর: 'Music' তথা সঙ্গীত (সেমা) শব্দটির উৎপত্তি প্রাচীন গ্রীস (রাজ্য) হতে এবং তা বলতে বোঝায়, “বিভিন্ন আওয়াজের নির্দিষ্ট এক বিন্যাসযুক্ত শিল্পকলা যার উদ্দেশ্য নান্দনিক প্রভাব বিস্তার।” এটা এসব আওয়াজকে সুর-মূর্ছনায় পরিণত করে। অতএব, কোন্ কোন্ আওয়াজ একত্রে খাপ খায়, আর কোন্ কোন্ আওয়াজ খায় না, সে বিষয়ে সঙ্গীত গবেষণা করে থাকে। আর এটা অর্জিত হয়ে থাকে মানুষের কণ্ঠস্বর ও বাদ্যযন্ত্র উভয়েরই মাধ্যমে।



গান শোনা ইসলামী বিধানে এমন এক বিষয়, যার ব্যাপারে মতপার্থক্য বিরাজমান। এটা ধর্মীয় আক্বীদা-বিশ্বাস বা ধর্ম হতে অবশ্যম্ভাবীরূপে জ্ঞাত বিষয়গুলোর একটি নয়। তাই এ ধরনের বিষয়গুলোতে মুসলমানদের একে অপরকে নিন্দা করাটা বিচক্ষণতার পরিচায়ক নয়, কেননা যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেবল সেগুলোর ব্যাপারেই (মানে সেগুলো হতে বিচ্যুতির ক্ষেত্রেই) সমালোচনা সাজে, মতপার্থক্যের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তা সাজে না। যেহেতু সঙ্গীত শোনা জায়েয/বৈধ বলে এর পক্ষে বেশ কিছু ফক্বীহ (ধর্মীয় আইনশাস্ত্রজ্ঞ) রায় দিয়েছেন এবং তাঁদের শরঈ-গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তের অনুসরণ করাটা যেহেতু অনুমতিপ্রাপ্ত, সেহেতু যে সকল মুসলমান সেমাপন্থী ফক্বীহদের এ ধরনের রায়কে অনুসরণ করেন তাঁদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করার কোনো অনুমতি-ই নেই। এটা আরো জরুরি হয় তখন-ই, যখন দেখা যায় যে সঙ্গীতকে বিশেষতঃ হারাম বলার পক্ষে শরঈ একটি দলিল-ও নেই।



সেমা ও এর শ্রবণকে জায়েয যে সকল হ্ক্কানী আলেম বলেছেন, তাঁদের মধ্যে ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন:



فَالْعُطَلَةُ مُعَوِنَةٌ عَلَىْ الْعَمَلِ وَالَّلهْوُ مُعَيِنٌ عَلَىْ الجْدِّ وَلَا يَصْبِرُ عَلَىْ الْجِدِّ المْحْضِ وَالْحَقِّ المْر إِلاَّ نُفُوْسِ الأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمْ السَّلَامُ فَالْلَهْوُ دَوَاءُ القَلْبِ مِنْ دَاءِ الإِعْيَاءِ وَالْمِلاَلِ فَيَنْبَغِيُ أَنْ يَكُوْنَ مُبَاحًا وَلَكِنَّ لَا يَنْبَغِي أَنْ يَسْتَكْثِرَ مِنْهُ كَمَا لَا يَسْتَكْثِرُ مِنَ الدَّوَاءِ فَإِذَا الَّلهْوِ عَلَىْ هَذِهِ النِّيَّةِ يَصِيْرُ قُرْبَةً هَذَا فِيْ حَقِّ مَنْ لَا يَحْرِكُ السِّمَاعَ مِنْ قَلْبِهِ صِفَةٌ مَحْمُوْدَةٌ يَطْلُبُ تَحْرِيْكُهَا بَلْ لَيْسَ لَهُ إِلاَّ الَّلذَّةُ وَاِلاِسْتِرَاحَةُ الْمُحْضَةُ فَيَنْبَغِي أَنْ يَسْتَحَبَّ لَهُ ذَلِكَ لِيَتَوَصَّلُ بِهِ إِلَى الْمَقْصُوْدِ الَّذِيْ ذَكَرَنَاهُ نَعَمْ هَذَا يَدِلُّ عَلَىْ نُقْصَان عَنْ ذَرْوَةِ الْكَمَالِ فَإِنَّ الْكَامَلَ هُوَ الَّذِيْ لَا يَحْتَاجُّ أَنْ يَرُوْحَ نَفْسَهُ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَلَكِنَّ حَسَنَاتُ الأَبْرَارِ سَيِّئَاتٌ الْمُقَرَّبِيْنَ وَمَنْ أَحَاطَ بِعِلْمٍ عِلَاجَ الْقُلُوْبِ وَوُجُوْهَ التَّلْطُفِّ بِهَا لِسَيَاقَتِهَا إِلْىْ الْحَقِّ عِلُمٌ قطعاً أَنْ تَرَوِيْحَهَا بِأَمْثَالِ هَذِهِ الأُمْوْرِ دَوَاءٌ نَافِعٌ لَا غِنَىْ عَنْهُ.



আনন্দ-বিনোদন কাউকে (জীবনের) গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর বিষয়গুলোতে সাহায্য করে; কেননা এ ধরনের সহায়ক বস্তু ছাড়া কারো পক্ষে তা (অর্থাৎ, গুরুতর বিষয়াদি) সহ্য করা অসম্ভব; এর ব্যতিক্রম শুধু পয়গম্বরবৃন্দ (আলাইহিমুস্ সালাম)। অতএব, ক্লান্তি-অবসাদ হতে অন্তরের ব্যাধির আরোগ্য হচ্ছে আনন্দ-বিনোদন, আর তাই তা সে অনুযায়ী জায়েয (অনুমতিপ্রাপ্ত)। তবে কেউ তাতে মাত্রাতিরিক্তভাবে জড়িত হতে পারবে না, ঠিক যেমনটি কেউ মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবন করতে পারে না। এই নিয়্যতের (অর্থাৎ, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর বিষয়গুলো হতে জিরানোর উদ্দেশ্যের) ওপর ভিত্তি করেই আনন্দ ও বিনোদন আল্লাহতা’লার নৈকট্যলাভের (পুণ্যদায়ক) কর্মে পরিণত হয়; আর এটা সে ব্যক্তির জন্যেই প্রযোজ্য যিনি সেমা শ্রবণে বিশেষ যে প্রশংসনীয় গুণ বিকাশের পথ অন্বেষণ করছেন, তা (তাঁর মাঝে) বিকশিত হয় না। বরঞ্চ এ ধরনের ব্যক্তি স্রেফ আনন্দ ও বিনোদন তালাশ করেন। তাই এ ধরনের আমল (কর্ম/অনুশীলন) তাঁর জন্যে প্রশংসনীয় হওয়া জরুরি যাতে তিনি সেটার অনুশীলন দ্বারা উপরোল্লিখিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারেন।



“তবে এই পরিস্থিতি পূর্ণতা হতে নিম্নতর এক স্তরের ইঙ্গিত বহন করে। কেননা পূর্ণতাপ্রাপ্ত জন তিনি-ই, যাঁর সাহায্যের জন্যে সত্য ছাড়া অন্য কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। অবশ্য সাধারণ মানুষের সওয়াব তথা পুণ্যদায়ক কর্ম হচ্ছে আধ্যাত্মিকতায় উচ্চস্তরের সিদ্ধপুরুষদের জন্যে হারাম-কর্ম। অন্তরের ব্যাধি নিরাময় ও অন্তরকে (খোদার প্রতি) বিগলিত করার বিদ্যা যিনি রপ্ত করেছেন, তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন এ ধরনের আনন্দ-বিনোদন এমন-ই বিষয়াবলী যা কেউ পরিহার করতে পারে না।[গাযালী : ইহইয়া উলূমুদ্দীন, ২:২৮৭]



ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি আরো লেখেন, 



- বাদ্যযন্ত্র যদি মদ্যপায়ীদের বা লাম্পট্যের (সাথে সংশ্লিষ্টতার) চিহ্ন হয়, হারমোনিকা, ফুঁ দ্বারা বাজানো যন্ত্র, তারবিশিষ্ট বাদ্য, কিম্বা মদ্যপায়ীদের ব্যবহৃত ঢোল জাতীয় বাদ্য হয়, তাহলে তা অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র, যেমন ঝুনঝুনির সাথে খঞ্জনি, (দফ), ঢোল, ডালপালা দ্বারা আঘাতকৃত ঢোল, তারবিশিষ্ট গিটার জাতীয় বাদ্য ও অনুরূপ বাজনা, এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র শোনা জায়েয।



অপরাপর উলামামণ্ডলী সঙ্গীত ও তা শ্রবণের মাঝে দেখতে পেয়েছেন সমঝদারদের এবং উচ্চ মক্বামের পুণ্যাত্মাদের জন্যে শিক্ষা ও পরোক্ষ (আধ্যাত্মিক) জ্ঞানের দিকনির্দেশনা। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম কাজী আয়াজ শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি যাঁকে সঙ্গীত শ্রবণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি এর উত্তরে বলেন, “সঙ্গীতের স্পষ্ট প্রতীয়মান প্রকৃতি হচ্ছে চিত্তাকর্ষক ও প্রলুব্ধকর; পক্ষান্তরে দীক্ষিত ব্যক্তিদের (মানে আহলে সেমার) জন্যে এতে নিহিত রয়েছে পূর্ণ (আধ্যাত্মিক) শিক্ষা। অতএব, যাঁরা পরোক্ষ (আধ্যাত্মিক) জ্ঞানের দিকনির্দেশনাসমূহ বুঝতে সক্ষম, তাঁদের জন্যে সেমা শ্রবণ জায়েয।”



অনুরূপ বক্তব্য পাওয়া যায় সুলতানুল উলামা ইমাম আল-’ইযয ইবনে ‘আবদ আল-সালাম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাছ থেকেও, যিনি বলেন, “অন্তরের ব্যাধি নিরাময়ের পথগুলো বহু, যেমন ক্বুরআন তেলাওয়াত শোনা, যেটা শ্রবণের বেলায় সেরা জিনিস; এটা আরো করা যায় উপদেশ ও যিকর-তাযকেরাসূচক ওয়ায-নসীহত শুনে, গান (সেমা) ও কবিতা আবৃত্তি শুনে; আরো করা যায় সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র শ্রবণ করে, তবে এর অনুমতি নিয়ে (উলামাদের মধ্যে) মতপার্থক্য বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, বাঁশি শ্রবণ জায়েয হলে এর শ্রোতার মাঝে উদ্ভূত হাল (আধ্যাত্মিক মত্ততা) প্রশংসাযোগ্য; আর যেসব (বাদ্যযন্ত্রের) ক্ষেত্রে মতপার্থক্য বিরাজমান, তা শ্রবণে ধর্মীয় সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে।



ইমাম আল-কুরতুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজ ‘আল-জামেউ আল-আহকাম আল-ক্বুরআন’ শীর্ষক তাফসীরগ্রন্থে বর্ণনা করেন যে,


ضُرِبَ بَيْنَ يَدَيِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ دَخَلَ الْمَدِينَةَ، فَهَمَّ أَبُو بَكْرٍ بِالزَّجْرِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: (دَعْهُنَّ يَا أَبَا بَكْرٍ حَتَّى تَعْلَمَ الْيَهُودُ أَنَّ دِينَنَا فَسِيحٌ) فَكُنَّ يَضْرِبْنَ وَيَقُلْنَ: نَحْنُ بَنَاتُ النَّجَّارِ، حَبَّذَا مُحَمَّدٌ مِنْ جَارِ. وَقَدْ قِيلَ: إِنَّ الطَّبْلَ فِي النِّكَاحِ كَالدُّفِّ، وَكَذَلِكَ الْآلَاتُ الْمُشْهِرَةُ لِلنِّكَاحِ يَجُوزُ اسْتِعْمَالُهَا فِيهِ بِمَا يَحْسُنُ مِنَ الْكَلَامِ وَلَمْ يَكُنْ فِيْهِ رَفَثُ.


মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে যেদিন মদীনা মোনাওয়ারায় প্রবেশ করেন, সেদিন কিছু ক্বুরাইশ বংশীয় (তরুণী) তাঁর উপস্থিতিতে গান গাইছিলেন। হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এতে বিরক্ত হন। এমতাবস্থায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেন, “এদের ছেড়ে দাও, ওহে আবূ বকর, যাতে ইহুদী সম্প্রদায় দেখতে পায় যে আমাদের পথ ও মত প্রসারণশীল।” ওই মেয়েরা দফ (ঢোল) বাজিয়ে গান করছিল এই বলে, “আমরা বনি নাজ্জার বংশের তরুণী, আর আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রতিবেশী হিসেবে পাওয়া পছন্দ করি।” ইমাম আল-ক্বুরতুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি অতঃপর বলেন, “কথিত আছে যে বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত দফ ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র জায়েয - যতোক্ষণ গানের কথা আদবশীল ও নির্ভরযোগ্য হয় এবং মন্দ/অশ্লীল না হয়।” [কুরতুবী : আত তাফসীর, লুকমান, ৩১:৬]



আল-শওকানী তার কৃত ‘নায়ল আল-আওতার’ গ্রন্থের ‘সঙ্গীত ও আনন্দ-উল্লাসের বাদ্যযন্ত্র’ পরিচ্ছেদে সঙ্গীতকে জায়েয ও হারাম ঘোষণাকারী উলামাদের উভয় পক্ষের যুক্তিপূর্ণ ভাষ্যই উদ্ধৃত করেন। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেই হাদীসটি নিয়ে আলোচনা করেন, যা’তে এরশাদ হয়েছে:



كُلُّ لَهْوٍ يَلْهُو بِهِ الْمُؤْمِنُ فَهُوَ بَاطِلٌ إلَّا ثَلَاثَةٌ: مُلَاعَبَةُ الرَّجُلِ أَهْلَهُ، وَتَأْدِيبُهُ فَرَسَهُ، وَرَمْيُهُ عَنْ قَوْسِهِ.



ঈমানদারের জন্যে ফুর্তির সকল ধরনই ফায়দাহীন, তিনটি ছাড়া: স্ত্রীর সাথে তার স্বামীর আনন্দ, কোনো লোকের দ্বারা আপন ঘোড়া নিয়ে খেলা, এবং তীরন্দাজের খেলা।[শাওকানী : নায়লুল আওতার, ৮:১১৮]



অতঃপর আল-শওকানী এ হাদীসের ব্যাপারে ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন,



قَالَ الْغَزَالِيُّ: قُلْنَا قَوْلَهُ - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ـ " فَهُوَ بَاطِلٌ " لَا يَدُلُّ عَلَى التَّحْرِيمِ، بَلْ يَدُلُّ عَلَى عَدَمِ فَائِدَةٍ انْتَهَى.



“হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘নিরর্থক’ মর্মে কথাটি ওই বিষয়ের হারাম হওয়াকে আবশ্যিক করে না, বরঞ্চ ইঙ্গিত করে যে এতে ফায়দা নিহিত নেই।” এরপর আল-শওকানী যোগ করেন, “এটা বাস্তবিকই একটা নির্ভরযোগ্য বক্তব্য। কেননা সরাসরি ফায়দা নেই এমন যে কোনো বিষয়-ই জায়েয শ্রেণিভুক্ত।”



আল-শওকানী এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য শরঈ দলিলও উপস্থাপন করেন; উদাহরণস্বরূপ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো একটি জ্বেহাদ থেকে সহি-সালামতে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর সামনে দফ বাজিয়ে গান করার মানতকারিনী নারীর ঘটনাটি, যার অনুমতি তিনি নিরাপদে ফেরার পর কোনো ভর্ৎসনা ছাড়াই দিয়েছিলেন। এই অনুমতি প্রমাণ করে যে ওই ধরনের পরিস্থিতিতে মহিলাটি যা করেছিলেন, তা অবাধ্যতার কোনো অনুশীলন ছিলো না।



ইবনে হাযম বর্ণনা করেন যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান,



قَالَ رَسُوْلُ اللهِ: " إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالْنِّيَاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ اِمْرِئٍ مَا نَوَىَ " فَإِذَا نَوَى الْمَرْءُ بِذَلِكَ تَرْوْيْحِ نَفْسِهِ وَإِجْمَالِهَا (1) لِتَقَوْى عَلَىْ طَاعَةِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ فَمَا أَتِىْ ضَلَالاً.



সকল কর্ম-ই নিয়্যত তথা উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভরশীল, আর সেটা প্রত্যেকের প্রতি তা-ই (বর্তায়) যা সে নিয়্যত করেছিল।” অতএব, যে কেউ আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতার হাতিয়ারস্বরূপ গান শুনলে বা অন্য কোনো কাজে লিপ্ত হলে, তা মন্দ কর্ম বলে সাব্যস্ত হবে; আর যে কেউ গান শোনার নিয়্যত যদি করেন এ মর্মে যে এতে তাঁর আত্মার প্রশান্তি লাভ হবে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও সৎকর্মের অনুশীলনের প্রতি তা এক হাতিয়ার হবে, তবে তিনি আনুগত্যপূর্ণ কর্মে লিপ্ত হবেন এবং এতে তিনি পুরস্কারও পাবেন, আর এ কাজটি প্রকৃত ও নির্ভরযোগ্য আমল বটে।[ইবনে হাযম : আর রাসায়িল, রিসালাতু ফিল গিনায়ী ১:৪৩৯]



যে কেউ কোনো কাজে আনুগত্য বা অবাধ্যতার নিয়্যত না করলে তার এ কাজটি স্রেফ আনন্দ-ফুর্তি বলে সাব্যস্ত হবে। আর এতে কোনো (ধর্মীয়) ফায়দা নেই। বস্তুতঃ এ ধরনের কাজকে ক্ষমা করা হবে; যেমন - কেউ তার বাগানে হাঁটা, অথবা নিজ গৃহের দরজায় বসে থাকা ইত্যাদি।



সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি যে, বাদ্যসহ বা বিহীন সেমা-কাওয়ালীর বিষয়টি এমন এক বিষয় যা সকল যুগেই উলামাদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি করেছে। এ সকল আলেম কিছু বিষয়ে একমত হয়েছেন, আবার অন্য বিষয়গুলোতে পারস্পরিক ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁরা ঐকমত্য পোষণ করেছেন এ মর্মে, (খোদায়ী) অবাধ্যতা সৃষ্টিকর বা তাতে সহায়ক যে কোনো ধরনের গান-বাদ্য হারাম। যেহেতু গানের মধ্যে কথা রয়েছে, সেহেতু ভালো কথা জায়েয এবং মন্দ/অশ্লীল কথা না-জায়েয। এই আলেমবৃন্দ আরো একমত হয়েছেন যে বিয়ে-শাদী, কারো গৃহে প্রত্যাবর্তন ও ঈদের দিনের মতো খুশির দিনগুলোতে আনন্দপূর্ণ গান পরিবেশনা জায়েয; তা অবশ্য বিশেষ শর্তসাপেক্ষে, যেমন কোনো নারী তাঁর অনাত্মীয় পুরুষদের সামনে গান পরিবেশন করতে পারবেন না।



উলামাবৃন্দের মতানৈক্যের ক্ষেত্রগুলো হলো বাদ্যযন্ত্র জায়েয, না হারাম এবং ইতিপূর্বে উল্লেখিত বিষয়াদি।



এই আলোচনার আলোকে আমরা দেখতে পাই, বাদ্যসহকারে বা বাদ্যবিহীন গান জায়েয এই শর্তে যে, তা (খোদার প্রতি) অবাধ্যতা, লাম্পট্য কিংবা শরীয়তবিরোধী কোনো বক্তব্যসহ হতে পারবে না। আরো উল্লেখ্য যে, সঙ্গীতের মাত্রাহীনতা এর অনুমতিকে নাকচ করে অপছন্দনীয় কাজে পরিণত করতে পারে, হয়তো বা হারামেও।



আল্লাহ তা’লাই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বজ্ঞানী।



- আলী জুমুআ’



[মিসরীয় সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী শায়খ আলী জুমুআ’ সাহেবের ফতোয়া এখানে সমাপ্ত। এই লেখাটিতে আরবী এবারত সংকলন করেন মওলানা মুহাম্মদ রুবাইয়াৎ মূসা]



ইমাম নাবলূসী হানাফী (রহ:) সম্পর্কে গবেষণাপত্র



ইমাম আবদুল গনী নাবলূসী (رحمة الله عليه) মূলতঃ নক্বশবন্দীয়া তরীক্বতের আলেম (এবং হানাফী ফেক্বাহবিদও)। তবে জীবনের কোনো এক পর্যায়ে তিনি মওলানা জালালউদ্দীন রূমী (رحمة الله عليه)’এর মাযার শরীফ যেয়ারত করতে গেলে তিনি মওলানা রূমী (رحمة الله عليه) হতে রূহানী ফয়েয/আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন [গাযযী, আল-উইর্দ, ষষ্ঠ অধ্যায়, ৩৪০ পৃষ্ঠা]। এতে তিনি মওলানা (رحمة الله عليه)’এর মৌলভীয়া তরীক্বায় দীক্ষা নেন। তরীক্বার রীতি অনুসারে তিনি সেমা’র ক্বায়েল/প্রবক্তা হন, যা তাঁরই রচিত ‘ইদা’হুদ্দালা’লা’ত ফী সামা’য়িল আলা’ত’ (বাদ্যযন্ত্র শ্রবণের দলিলাদির ব্যাখ্যা) শিরোনামের বইটি সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর এতদসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর (সম্ভবতঃ সিরীয় বংশোদ্ভূত) জনাব আহমদ সুক্কার ২০১৪ সালে একটি গবেষণাপত্র লেখেন। জনাব সুক্কার যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের অধীন বার্কবেক কলেজের একটি একাডেমিক প্রোগ্রাম ‘লন্ডন কনসোর্টিয়াম’-এ ডক্টরাল ক্যানডিডেট ছিলেন। তিনি আর্কিটেক্ট হলেও তাঁর গবেষণাপত্র ছিলো সর্ব-ইমাম নাবলূসী, সোহরাওয়ার্দী ও ইবনে আরবী (رحمة الله عليهم) প্রমুখ সম্পর্কে। আমরা তাঁর ওই গবেষণাপত্র হতে উদ্ধৃতিসমূহ এখানে পেশ করবো। তবে ইমাম নাবলূসী (رحمة الله عليه)’এর আরবী বইটি যাঁরা পড়তে চান, তাঁরা নিচের লিঙ্ক থেকে তা ডাউনেলোড করে নিতে পারেন: https://mega.nz/#!9mI0DYAB!7di8nBNLC9CLDuBEiau3dB7yEjGJ6u2MWo89BniAi08 



গবেষণাপত্র



ইমাম নাবলূসী (رحمة الله عليه) তাঁর ‘ইদা’হুদ্দালা’লাত’ পুস্তকে বলেন, “...ঐশী জ্ঞান ও খোদায়ী একত্ব সম্পর্কে বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে আমি যতোটুকু উপলব্ধি করেছি, তার কিছু কিছু ওতে (তোহফাত বা ফাতহু’তে) উল্লেখ করেছি, যদিও আমি এমন আল্লাহ-ওয়ালাদের একজন, যার মর্যাদা ও যোগ্যতা অন্যদের চেয়ে কম” [১০৮ পৃষ্ঠা]। হযরত ইমাম ব্যাখ্যা করেন যে, তিনি সেটা রচনা করেছেন তাঁরই কতিপয় রূহানী ভাইয়ের অনুরোধে। ক্বুরআন মজীদে ‘উলূল আলবা’ব’ (উপলব্ধিসম্পন্ন মানুষেরা) ষোলবার উল্লেখিত হয়েছে (যথা - ২:১৭৯, ২:১৯৭, ২:২৬৯; ৩:৭, ৩:১৯০, ৫:১০০)। এর একবচন ‘লুব’ (বহুবচন ‘আলবা’ব’) উদ্দেশ্য করে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ অংশ ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিকে, যা আধ্যাত্মিক অর্থে বোঝায় রূহ/আত্মার সূক্ষ্ম বাস্তবতাকে। ‘ইদাহ’ পুস্তকের ভাষানুযায়ী, এই সংজ্ঞাটি সেসব খোদাজ্ঞানীকে উদ্দেশ্য করেছে, যাঁরা অবৈধ যৌনাচার, মদ্যপান ও দুনিয়াবী বিষয়াদিমুক্ত মজলিশে সেমা’ শোনার অনুমতি পেয়েছেন এবং যাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রয়েছে।



ইমাম নাবলূসী (رحمة الله عليه) ‘উপলব্ধিসম্পন্ন মানুষ’দের ক্ষেত্রে সেমা’কে শুধু জায়েয/অনুমতিপ্রাপ্ত-ই বিবেচনা করেন না, বরং ‘উপকারী ও ফলপ্রসূ’-ও বিবেচনা করেন; কেননা এটা তাঁদেরকে ’খোদায়ী একত্বের নিদর্শনগুলো’ প্রত্যক্ষ করার ব্যাপারে সহায়তা করে থাকে [প্রাগুক্ত ‘ইদাহ’, ১০৮ পৃষ্ঠা]। তিনি আরো যোগ করেন, যদিও বোকা লোকেরা ওই ধরনের ব্যক্তিত্বদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে অক্ষম হয়, তবুও তাঁরা প্রতিটি স্থানে ও সময়েই অস্তিত্বশীল এবং শেষ বিচার দিবস পর্যন্ত অস্তিত্বশীল থাকবেন [প্রাগুক্ত ‘ইদাহ’, ১০৮ পৃষ্ঠা]। বইটির প্রারম্ভে তিনি লিখেন যে, এ বইটি তিনি ‘উপলব্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের’ জন্যেই লিখেছেন [৮০ পৃষ্ঠা]। তবে তাঁর বইটি ও তাতে আলোচ্য বিষয় সেমা’র কড়া সমালোচনা করেন ‘তাফসীরে রূহুল মা’আনী’-প্রণেতা মাহমূদ আলূসী-সহ অনেকেই। উক্ত তাফসীরগ্রন্থে শায়খ আলূসী ‘ইদাহ’ পুস্তকে সেমা’র পক্ষে উপস্থাপিত দলিলগুলোকে দুর্বল ও ভিত্তিহীন মিথ্যাচার বলে আখ্যায়িত করেন। প্রাক-আধুনিক যুগের ওই বিতর্ক আধুনিক যুগেও চলে এসেছে। মাশহূর হাসান মাহমূদ সালমা’ন নামের এক সালাফী আলেম বিষয়টির আলোচনায় একাডেমিক যথাযর্থতা ছাড়াই মাহমূদ আলূসীর কথাকে পুনর্ব্যক্ত করেন। আলূসী ও তাঁর অনুসরণকারী সালমা’ন আল্লাহর কাছে এ মর্মে প্রার্থনা করেন, যাতে ইমাম নাবলূসী (رحمة الله عليه)’কে ক্ষমা করা হয় ক্বুরআন মজীদে উদ্ধৃত ‘লাহ্উ’ (রঙ্গ/প্রমোদ) শব্দটির ব্যাখ্যায় তাঁদের বিবেচনায় ‘ভুল’ করার কারণে। সালমা’ন কোনো রেফারেন্স উপস্থাপন ছাড়াই দাবি করেন যে ইমাম নাবলূসী (رحمة الله عليه)’এর রচিত ‘ইদা’হুদ্দালা’লা’ত ফী সামা’য়িল আলা’ত’ বইটি অনেক ইসলামী পণ্ডিতের দ্বারা রদ করা হয়েছে। [জনাব আহমদ সুক্কার কৃত গবেষণাপত্র Abdul Ghani Nabulusi of Damascus and the Mawlawi Sufi Tradition] {এডমিনের নোট: আমরা ‘লাহ্উ’-সংক্রান্ত ক্বুরআনী আয়াতটির বিশ্লেষণ ‘আপত্তি ও তার জবাব’ অংশে উপস্থাপন করবো, ইন-শা-আল্লাহ} 



হযরত কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (رحمة الله عليه) তাঁর প্রণীত ‘রেসালায়ে সেমা’ পুস্তিকায় লিখেন: “বিয়ে প্রকাশ করার জন্যে যদি দফ বাদ্যযন্ত্র জায়েয বা মোস্তাহাব হয়, তাহলে ঢোল, তাম্বুরা এবং নাকারা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে কী পার্থক্য থাকতে পারে? মন্দ উদ্দেশ্য হলে সবই হারাম ও সৎ উদ্দেশ্য হলে সবই জায়েয হবে। দফ ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য করা একটি জ্ঞানহীন তথা তাৎপর্যহীন কাজ। [রেসালায়ে সেমা’; এই পুস্তিকার রেফারেন্সটি ‘বোরহানুল আশেক্বীন’ শিরোনামের একটি বই থেকে নেয়া হয়েছে - লেখক]



সর্ব-হযরত আবদৃল্লাহ ইবনে যুবায়র, নুমান ইবনে বশীর, উমর ইবনে আবদীল আযীয, আমীরে মুয়াবিয়া, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস প্রমুখ সাহাবা (رضي الله عنهم) সঙ্গীত শ্রবণ করতেন বলে জানা যায় [তারীখুল মোগান্নী, ১-১০ পৃষ্ঠা; বুরহানুল আশেক্বীন, শরফুল ইনসান ইত্যাদি পুস্তকে উদ্ধৃত]



শায়খ ইবরাহীম রমাদা’ন আল-মারদিনীর ভাষ্য



লেবাননের বৈরুত স্টাডিজ এন্ড ডকুমেনটেশন সেন্টারের ইসলামী জ্ঞান বিশারদ শায়খ ইবরাহীম রমাদা’ন আল-মারদিনী সাহেব ২০০৫ সালে সেখানে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে সঙ্গীত সম্পর্কে প্রধান আলোচকের বক্তব্যে বলেন: 



“আল-ক্বুরআনে সঙ্গীতের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই; যারা অমুক সঙ্গীত হারাম আর অমুক সঙ্গীত জায়েয বলছে, তাদের প্রামাণ্য দলিল খুবই দুর্বল (যয়ীফ)।” তাঁর এ বক্তব্যের প্রেক্ষাপট ছিলো সৌদি আরবের জেদ্দাস্থ আবূল কাসেম পাবলিশার্স/প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত আবূ বেলাল মুস্তাফা আল-কানাদীর সঙ্গীতবিষয়ক ‘ইসলামী’ ফতোয়া, যা’তে ওই বইয়ের লেখক বলেন - দফ ছাড়া সব বাদ্যযন্ত্র হারাম। সৌদি ওহাবীদের এই ফতোয়ার পাশাপাশি ইরানী শিয়ারাও ২০০৫ সালে গান-বাজনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো, যার পরিপ্রেক্ষিতে শায়খ রমাদা’ন আল-মারদিনী এই মন্তব্য করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, “ইসলাম ধর্মে সুলতান (শাসক) শুধু তখন-ই হস্তক্ষেপ করেন, যখন মানুষেরা খোদার বিচার তথা আইন থেকে বিচ্যুত হয়; সুলতান ও ফক্বীহ পরস্পরনির্ভরশীল। আর উদাহরণস্বরূপ, সঙ্গীতকে হারাম প্রমাণ করার জন্যে ৮০টি হাদীস ব্যবহার করা হয়েছে (সৌদিদের ওই বইতে); অথচ এর মধ্যে ৭০টি-ই যয়ীফ অথবা খুব দুর্বল। সার কথা হলো, এই নিষেধাজ্ঞা (ওহাবী বা শিয়া) হুকুমাত তথা শাসন টিকিয়ে রাখার জন্যেই।”



শায়খ মারদিনী তাঁর বক্তব্যে এই নিষেধাজ্ঞাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “কোনো ফক্বীহের মিশন এই নয় যে তিনি কোনো কিছুকে বাতিল বা ব্যবহারের অযোগ্য বলে ঘোষণা করবেন, বরং তাঁর কাজ হলো স্রেফ ঈমানদারবৃন্দকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দেয়া। ইসলামে গোঁড়ামির কোনো স্থান নেই। ফতোয়ার কোনো মূল্য নেই যদি তার ক্রমোন্নয়ন না হয়; অর্থাৎ, বিবর্তন না হয়। এটা স্থবির হওয়া চলবে না, ফক্বীহকে নমনীয় হতে হবে। তাঁকে সময়ের সাথে এগোতে হবে এবং সময়কে বুঝতে হবে।” শায়খ মারদিনী আরো বলেন, “সংস্কৃতি সবার এবং তা কিছু লোকের সিদ্ধান্তের মুখাপেক্ষী হওয়া উচিৎ নয়। গত শতাব্দীতে (মানে পূর্ববর্তী যুগগুলোতে) ইসলামী উলামা কেরাম সংস্কৃতি ও কলা বিষয়ে বেশ ভালো জ্ঞান রাখতেন। ইসলাম ধর্মে হাদীস-শাস্ত্র পাঠের সময় ঐতিহ্যগতভাবে সঙ্গীতও যুক্ত হতো। মানুষেরা যখন (সরল) পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তখন আলেম-উলামা আইনগুলোর ব্যাখ্যা দেন এবং তাদেরকে (সঠিক) পথে ফিরিয়ে আনেন; মানে সংশোধন করেন।” সঙ্গীতের যথার্থতা নিরূপণের উদ্দেশ্যে শায়খ মারদিনী জনৈক সাহাবী (رضي الله عنه)’এর প্রতি উচ্চারিত প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দেন; রাসূল (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ করেন, “তুমি খুব ভালো কান (মানে শ্রুতিশক্তি) নিয়ে আবির্ভূত হয়েছো।” শায়খ মারদিনী বলেন, “ক্বুরআন, হাদীস ও সুন্নাহের ওপর ভিত্তি করে মুফতীকে আল্লাহর বিধি-নিষেধ প্রকাশ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ইসলামে গান-বাদ্য নিষিদ্ধ নয়, বরং তা জায়েয হওয়ার শক্তিশালী পাল্টা দলিলাদি বিদ্যমান।” [ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত; Freemuse, ১৪ অক্টোবর, ২০০৫ খৃষ্টাব্দ; বর্তমানে সৌদি বা ইরান তাদের কট্টর অবস্থান থেকে সরে এসেছে ঠিকই, কিন্তু উল্টো ইসলামে অপছন্দনীয় সঙ্গীতকে প্রমোট করছে, যেটা সূফী-দরবেশবৃন্দের সেমা’ নয়]



সুলতানুল আরেফীন শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (রহ:)



বড় পীর গাউসুল আযম শায়খ আবদুল ক্বাদের জিলানী (رحمة الله عليه)’এর অন্যতম খলীফা সুলতানুল আরেফীন শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمة الله عليه) একটি কিতাব লিখেছিলেন যার শিরোনাম ‘আ্ওয়ারিফুল মা’আরিফ।’ তাতে সেমা’ ও ওয়াজদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আমরা তাঁর ওই বই থেকে উদ্ধৃতিসমূহ এখানে উপস্থাপন করবো। হযরত শায়খ (رحمة الله عليه) বইটির ‘সেমা’ অধ্যায়ে লেখেন: 



“যাহেরী/বাহ্যিক জ্ঞানের উলামাদের অস্বীকারকৃত সবচেয়ে প্রশংসনীয় সূফী-রহস্যগুলোর একটি হচ্ছে মাহফিল, যা’তে নিহিত - 

(ক) গেনা (গান) ও ইলহান (সুর)’এর শ্রবণ;

(খ) ক্বাওয়াল (গায়ক)’কে তলব/ডাকা।”



হযরত শায়খ (رحمة الله عليه) অন্যত্র লেখেন, “সেমা’ তিনটি ফায়দা ধারণ করে: 



১/ কৃচ্ছ্রসাধনার সাথী ও (পাপের বিরুদ্ধে) সংগ্রামরত মনিববৃন্দের আত্মা ও অ্ন্তর অনেক কাজের দরুন হয়রান, দুঃখ-ভারাক্রান্ত, কবজ (আটক) ও হতাশাগ্রস্ত হয়। অতঃপর এই দুর্যোগ প্রতিরোধ করতে বর্তমানকালের মাশায়েখ-মণ্ডলী (ঐশী) প্রেমাবেগ জাগ্রত করে এমন মিষ্টি ও সুরেলা আওয়াজ এবং শ্লোক দ্বারা সেমা’র এক আধ্যাত্মিক গ্রন্থন করেছেন। আর প্রয়োজনের সময় তাঁদেরকে এটার (মানে সেমা’র) জন্যে আগ্রহী করে তুলেছেন।



২/ নফসের প্রকাশ ও ক্ষমতার দ্বারা পুণ্যাত্মা পথিকের জন্যে (খোদাতা’লার মহিমা উপলব্ধিতে) প্রতিবন্ধকতা ও পর্দা দেখা দেয়। ফলে ‘হাল’ (আত্মিক আবেগ-উচ্ছ্বাস) বৃদ্ধি থেমে যায়। আর (খোদার সাথে) দীর্ঘ বিচ্ছেদের কারণে (আল্লাহকে পাবার) আকাঙ্ক্ষা কমে যায়। অতঃপর (নিজ ‘হাল’ বর্ণনাকারী) মিষ্টি সুর-মূর্ছনা ও গজল শ্রবণের দ্বারা ওই আজব হাল (যা প্রেমাবেগ জাগ্রত করেছিলো) শ্রোতার মাঝে আবির্ভূত হয়। এতে প্রতিবন্ধকতা ও পর্দা ওঠে যায় এবং তা তাঁর সামনে থেকে সরে যায়। আর সম্বৃদ্ধির দরজা খুলে যায়।



৩/ তরীক্বতের (তথা আধ্যাত্মিক পথের) ব্যক্তিত্ব, যাঁদের হাল-অবস্থা (ধীরগতির) ভ্রমণ হতে (দ্রুত) উড়ে চলা, (কষ্টকর) ভ্রমণ হতে (দুর্নিবার) আকর্ষণ, খোদাপ্রেমিক থেকে খোদার প্রেমাস্পদে পরিণত হওয়া শেষ হবার নয়; এটা সম্ভব যে সেমা’র সময় আত্মার কান খুলে যেতে পারে এবং অনাদিকালে উচ্চারিত (ঐশী) ভাষণ ও ‘প্রথম অঙ্গীকারের’ (আলাসতু বি-রাব্বিকুমের) পরমানন্দ অর্জন করতে পারে। আর এক ঝাঁকুনি দ্বারা আত্মার পাখিটি অস্তিত্বের সমস্ত ধূলি ও অপবিত্রতার আঠাল ভাব ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে এবং অন্তরের দূষণ, কাম ও অস্তিত্বের ভিড় থেকে মুক্ত হতে পারে।”



সুলতানুল আরেফীন শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمة الله عليه) আরো লেখেন: 



“(সেমা’র মজলিশে) রূহ/আত্মা দ্রুত উড়ে চলে আল্লাহর নৈকট্য পেয়ে থাকেন; এমতাবস্থায় (খোদার) পুণ্যবান পথযাত্রীর ধীরগতিসম্পন্ন যাত্রা উড়ন্ত দ্রুতগতি পায়; তাঁর কষ্টসাধ্য যাত্রা পরিণত হয় অনির্বার আকর্ষণে; আর তিনি খোদাপ্রেমিক থেকে পরিণত হন খোদার প্রেমাস্পদে। অতঃপর এক মুহূর্তে তিনি এমন (দূরত্ব) সফর করেন, যা সেমা’ ছাড়া বহু বছরেও পার হতে পারতেন না।….মানবতার ওপর যা কিছুর আধিপত্য বিরাজমান, সেমা’ সেটাকে শক্তিশালী করে। যাঁরা আল্লাহর এশক্ব-মহব্বতে সিক্ত, সেমা’ কামেলিয়ত তথা পূর্ণতাপ্রাপ্তিতে সহায়তা দানকারী। কিন্তু যারা কামভাবে ভরা, তাদের জন্যে এটা বিপর্যয়ের কারণ।” [আওয়ারিফুল মা’আরিফ, সেমা’ অধ্যায়]



সেমা’র শর্তাবলী সম্পর্কে হযরত শায়খ সোহরাওয়ার্দী (رحمة الله عليه) লেখেন: 



“সেমা’র প্রথম শর্ত হচ্ছে ওই মজলিশে তাদের (শ্রোতাদের) পরম আন্তরিকতাপূর্ণ নিয়্যত রাখা এবং এর কারণ খোঁজা উচিৎ: (ক) যদি তা হয় কামভাবপূর্ণ, তাহলে তাদের তা বাদ দিতে হবে; (খ) কিন্তু যদি আন্তরিকতা ও আকাঙ্ক্ষার দাবি এবং ‘হাল’ বৃদ্ধির ও (খোদার) আশীর্বাদ উপলব্ধির অন্বেষণ ঐক্যবদ্ধ হয়, আর তা কামভাবের অপবিত্রতা হতে মুক্ত হয়, তাহলে ওই ধরনের সেমা’ মাহফিল এক মহা অর্জন।...যদি সেমা’তে অন্তর্ভুক্ত থাকে (ক) হারাম বিষয়াদি, যেমন - অত্যাচারী (রাজন্যবর্গের) গ্রাস; নারী সঙ্গ; দাড়িবিহীন ছেলে; (খ) ঘৃণিত বস্তু, যথা - এমন এক যাহিদ/কৃচ্ছ্রব্রতকারীর উপস্থিতি, যাঁর ওই মাহফিলকারীদের সাথে কোনো সম্বন্ধ নেই, যিনি সেমা’ শুনে মজা পান না; দুনিয়ার মালিকদের মর্যাদার অধিকারী এমন কেউ, যাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন; আর ওই লোকের উপস্থিতি, যে ওয়াজদের মিথ্যে প্রদর্শনী দেয় এবং উপস্থিতদের সময় ভুয়া তাওয়া’জুদ দ্বারা নষ্ট করে। প্রকৃত খোদা-অন্বেষণকারীদের ওই ধরনের মাহফিল এড়িয়ে চলা উচিৎ। 



“সেমা’র মজলিশে উপস্থিত মানুষদের জন্যে শ্রদ্ধা ও গাম্ভীর্য নিয়ে বসা উচিৎ। অতিরিক্ত শারীরিক নড়াচড়া বাদ দিতে হবে, বিশেষ করে শায়খবৃন্দের উপস্থিতিতে; ওয়াজদের সামান্য দ্যুতিতে অশান্ত হওয়া উচিৎ হবে না; (আল্লাহর এশক্বের) খাঁটি শরাবের অল্প স্বাদ দ্বারা মাতাল হওয়া উচিৎ হবে না; আরো উচিৎ হবে না স্বেচ্ছায় ‘শাহকাত’ (ফিসফিস আওয়াজ) বা ‘যা’ক’ (চিৎকার) প্রকাশও।” [আওয়ারিফুল মা’আরিফ, সেমা’ অধ্যায়]



আপত্তি নং ১



মহান আল্লাহ পাক গান-বাজনা হারাম ঘোষণা করতে ক্বুরআন মজীদে ফরমান:



 وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ ٱلْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ ٱللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُواً أُوْلَـٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ



অর্থ: মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে মূর্খতাপ্রসূত ‘লাহ্উল্ হাদীস’ তথা গান-বাজনা ক্রয় করে এবং আল্লাহতা’লার দ্বীনকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তাদের জন্যে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি [সূরা লোক্বমান, ৬ আয়াত]। এ আয়াতে উল্লেখিত ‘লাহ্উল হাদীস’ শব্দটিকে বিশিষ্ট সাহাবা সর্ব-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنهما) বাজনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন (তাফসীরে রূহুল মা’আনী দ্রষ্টব্য)। অতএব, গান-বাজনা হারাম।



জবাব



সেমা’বিরোধীদের ওপরের আপত্তি খণ্ডন করে জবাব দেয়ার আগে আলোচ্য আয়াতটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তাহলেই বোঝা যাবে ‘লাহ্উল হাদীস’ শব্দটির মানে কী। আয়াতটিতে লক্ষণীয় - لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ ٱللهِ - বাক্যটি ব্যবহৃত হয়েছে। বাক্যটির অর্থ ‘আল্লাহতা’লার পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্যে।’ অর্থাৎ, ‘লাহ্উল হাদীস’ ক্রয় করার উদ্দেশ্য জানা গেলো এবং তা হলো দ্বীন-ইসলাম হতে পথভ্রষ্ট করা। এবার আমরা ‘লাহ্‌উল হাদীস’ শব্দটি সম্পর্কে আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো। এই আলোচনায় মূলতঃ সর্ব-মুফতী আবদুস্ সালাম ঈসাপুরী ও আহমদ এয়ার খাঁন (رحمة الله عليهما) বিরচিত যথাক্রমে ‘পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’ ও ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’ পুস্তক দুটোর ভাষ্যের অনুসরণ করা হবে।



সেমা’বিরোধীদের আপত্তি হলো, এর অর্থ গান-বাজনা, যা বিশিষ্ট সাহাবা দু জন বর্ণনা করেছেন। অথচ বিরোধিতাকারীদের ফতোয়া-গ্রন্থ ‘ফুতুহাতে ইলাহিয়্যা’তে ইমাম সৈয়ূতী (رحمة الله عليه) রচিত ‘তাফসীরে জালালাইন’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, ‘তাফসীরে জালালাইন’ গ্রন্থে ‘লাহ্উল হাদীস’ শব্দটির ব্যাখ্যা - ما يليها - তথা ওর সাথে সম্পৃক্ত বিষয় বলে করা হয়েছে এবং হযরত হাসান বসরী (رحمة الله عليه)’এর কথার অনুসরণে ‘লাহ্উল হাদীস’-এর সাথে সম্পৃক্ত বিষয় হিসেবে গল্পগুজব, হাসি-তামাশা সৃষ্টিকারী কথাবার্তা, মিথ্যে কথা ইত্যাদিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোই আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে (ফুতুহাতে ইলাহিয়্যা, জুয নং ৩, ৪০১ পৃষ্ঠা)। এই পদ্ধতি হতে প্রমাণিত হয় যে, আয়াতোক্ত ‘লাহ্উল হাদীস’ বলতে শুধু গান-বাজনাকেই বোঝানো হয় নি, বরং আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুতি সৃষ্টিকারী সব ধরনের ফায়দাহীন গল্পগুজব, হাসি-তামাশাপূর্ণ কথা ইত্যাদিকেও বোঝানো হয়েছে। আমরাও বলি, পথভ্রষ্টকারী গান-বাজনা হারাম। কিন্তু যে গান-বাজনা আল্লাহর পথের দিকে আকর্ষণ করে, তা জায়েয ও এবাদত।



ওপরে উল্লেখিত আয়াতটির মধ্যে ব্যবহৃত ‘লাহ্উল হাদীস’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ এক্ষণে ব্যাখ্যা করা দরকার। আরবী অভিধানে ‘লাহ্উ’ শব্দটির অর্থ বেহুদা খেলা ও রং-তামাশা, যার দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে সাময়িকভাবে বিরত থাকতে হয়। হাদীস শব্দের অর্থ কথা (রাগেব ও মওয়ারেদ আরবী অভিধান দ্রষ্টব্য)। ‘লাহ্উল হাদীস’ বল্লে ‘লাহ্উ’ শব্দের সাথে ‘হাদীস’ শব্দের সম্বন্ধ বোঝায়। সুতরাং তা দ্বারা শুধু বাচনিক বা কথা-সংক্রান্ত ‘লাহ্‌উ’ বুঝতে হবে। গায়িকা দাসী, গান-বাজনা ইত্যাদি অন্য প্রকারের ‘লাহ্‌উ’ বিবেচনা করা যাবে না (মজমাউল বিহার)। প্রকৃতপক্ষে, ‘লাহ্‌উল হাদীসের’ অর্থ নাটক, উপন্যাস, হাসি-ঠাট্টা, বিদ্রূপ ও উপহাসাত্মক কথাবার্তা, গদ্য, কবিতা, গান, গল্প, বক্তৃতা ইত্যাদি। এর অর্থ গায়িকা দাসী, বেশ্যা, শরাব ও বাদ্যযন্ত্র নয়। কারণ এগুলোর সঙ্গে কথার কোনো সম্পর্ক নেই। এটাও জানা আবশ্যক যে, ‘লাহ্উল হাদীস’ আসলে হারাম বা মকরূহ নয়, বরং এটা মোবাহ। কেননা নির্দোষ ‘লাহ্উ’ মোবাহ। যেমনটি আল্লাহতা’লা ফরমান:



ٱعْلَمُوۤاْ أَنَّمَا ٱلْحَيَٰوةُ ٱلدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ



অর্থ: জেনে রাখো, দুনিয়ার জিন্দেগী খেলা ও লাহ্উ বটে। [আল-ক্বুরআন, ৫৭:২০]



ওপরের আয়াতটিতে আল্লাহতা’লা দুনিয়াকে ‘লাহ্উ’ বলেছেন, কিন্তু দুনিয়াদারী বা সংসার-কর্মকে হারাম বলেন নি। আরেক কথায়, দুনিয়াদারী করা মোবাহ (বৈধ)। অপর পক্ষে, যে ব্যক্তি দুনিয়াদারীর মোহাচ্ছন্ন হয়ে ইসলামবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, সে পাপিষ্ঠ এমন কী কাফের, মুরতাদ্দও হয়ে যেতে পারে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়াকে পরকালের শস্যক্ষেত্রতুল্য মনে করে সংসার জীবনের যাবতীয় কাজ-কারবার সম্পাদন করার সাথে সাথে পারলৌকিক মঙ্গল, উন্নতি ও সুখশান্তি লাভের জন্যে এবাদত, রেয়াযত/সাধনা ইত্যাদি সুচারুভাবে পালন করেন, তিনি আল্লাহতা’লার প্রিয় বান্দা তথা ওলীআল্লাহ হতে পারেন। এতে বোঝা যায়, যাবতীয় নির্দোষ ‘লাহ্উ’ মূলতঃ মোবাহ। কিন্তু স্থান, কাল, পাত্র, নিয়্যত ও অবস্থাভেদে এবং পারিপার্শ্বিকতা অনুসারে তা এবাদত কিংবা গুনাহ হিসেবে বিবেচিত হয়। উপরোক্ত আয়াতটিতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ‘লাহ্উল হাদীস’-এর কেনাবেচাকারীরা আল্লাহতা’লার পথ থেকে মানুষদেরকে পথভ্রষ্ট করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। অতএব, যে সব তামাশাপূর্ণ কথাবার্তা ইসলাম থেকে মানুষকে দূরে রাখে, সেগুলোই ‘লাহ্উল হাদীস।’ 



‘লাহ্উল হাদীস’-সংক্রান্ত আয়াতটির শানে নুযূল বা অবতীর্ণ হওয়ার পটভূমি হচ্ছে এই যে, একবার হারেসের পুত্র নযর বাণিজ্য উপলক্ষে পারস্যদেশে গিয়ে ‘রুস্তম’ ও ‘ইস্কান্দিয়ারের’ উপন্যাস কিনে আনে এবং তা রঙ্গরসের সাথে ক্বুরাইশদের মধ্যে পড়ে শুনাতে থাকে। ফলে অনেকেই তার পারসিক উপন্যাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। নযর ইবনে হারিস্ গর্বভরে বলতো, “(হযরত) মুহাম্মদ (صلى الله عليه وسلم) তোমাদেরকে ক্বুরআন হতে আদ ও সামূদ গোত্রের গল্প আর হযরত সুলাইমান (عليه السلام) ও দাউদ (عليه السلام)-এর সাম্রাজ্যের বিশালতা ও রওনকের খবর শোনান, কিন্তু আমি তোমাদেরকে আজম (অনারব) অঞ্চলের রাজন্যবর্গের রাজ্যের বিস্তৃতি, সমৃদ্ধি, মহা জাঁকজমক ও আড়ম্বরের কাহিনি শুনাই। এ দুটোর মধ্যে কোনটা বেশি মর্মস্পর্শী ও শ্রুতিমধুর তা তোমরাই ভেবে দেখো [মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন, ‘নূরুল এরফান তাফসীরগ্রন্থ,’ ৩১:৬-এর টীকা-৭ (শানে নুযূল)]।” নূরুল এরফান তাফসীরগ্রন্থে ৩১:৬-এর ৮ নং টীকায় মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (رحمة الله عليه) লেখেন: সূফীবৃন্দ বলেন, “যে জিনিস আল্লাহর যিকর থেকে উদাসীন করে দেয়, তা-ই ‘লাহ্উল্ হাদীস’-এর অন্তর্ভুক্ত ও হারাম। দেখুন, জুমুআর আযানের পর ব্যবসা ও পার্থিব কাজ-কারবার, যা নামাযের প্রস্তুতিতে বাধা সৃষ্টি করে, তা-ই ‘লাহ্উ’ (খেলাধূলা), এমন কী স্ত্রী-পুত্রও ‘প্রকৃত বন্ধু’র স্মরণে অন্তরায় হলে তা-ও ‘লাহ্উ’ (অনর্থক)। ওই অনর্থকের জাল ছিন্ন করো।” মুফতী সাহেব ‘তাফসীরে রূহুল বয়ান’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেন: “গানবাদ্য হচ্ছে পরোক্ষ বা কারণসাপেক্ষে হারাম। অর্থাৎ, ‘লাহ্উ’ হলে হারাম, নতুবা নয়। দেখুন, যোদ্ধার ‘নাকারা’ বাজানো জায়েয, কেননা তা ‘লাহ্উ’ (খেলাধূলা) নয়।” [তাফসীরে নূরুল এরফান, ৩১:৬-এর টীকা নং ৮]



আল্লাহতা’লা নযর বিন হারিসের ওই ভাঁওতাবাজীর জবাবেই আয়াতটিতে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেন। আয়াতটির সাথে ভ্রষ্টা গায়িকা দাসী, গান-বাজনা, শরাব/মদ ইত্যাদি বিষয়-সংক্রান্ত যে সব শানে নুযূল রয়েছে, তা মুহাদ্দেসবৃন্দের মতে সহীহ নয়। বিশেষ করে, আয়াতের মর্মের সাথে সে সব রওয়ায়াতের (বিবরণের) কোনো মিলই নেই। সুতরাং উসূলের কায়দা অনুসারে তা পরিত্যাজ্য।



এবার আমরা সর্ব-হযরত ইবনে আব্বাস ও ইবনে মাসউদ (رضي الله عنهما)’এর উক্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেবো। সাহাবা দু জনের বক্তব্য অনুযায়ী যদি আমরা ধরেও নেই যে ‘লাহ্উল্ হাদীস’ অর্থ গান-বাজনা, তাহলে আমাদের ইসলামী শরীয়তের বিধানদাতা প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)-ও ‘লাহ্উল্ হাদীস’ কেনাবেচা করেছেন; কেননা তিনি ঈদের দিনে, বিয়ের আসরে, যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করে ‘দফ’ বা খঞ্জনি (বাদ্যযন্ত্র) সহকারে গান শুনেছেন [বুখারী ও মুসলিম]। নাউযুবিল্লাহ! তা তো কথনো সম্ভব নয়। অতএব, সেমা’বিরোধীরা বাধ্য হয়ে স্বীকার করবেন যে, সাহাবা দু জন ‘লাহ্উল্ হাদীস’ বলতে সব ধরনের গান-বাজনা বোঝান নি। তাঁরা হয়তো বুঝিয়ে থাকবেন, যে সব গান-বাজনা ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখে সেগুলোই ‘লাহ্উল্ হাদীস।’



মিসরীয় সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী ও শায়খুল আযহার (বিশ্ববিদ্যালয়) জা’দ আল-হক্ব আলী জা’দ আল-হক্ব সাহেবকে একবার এক পত্রে শরীয়তে গান-বাজনা সংক্রান্ত ইসলামী ফতোয়া কী হবে, তা জানানোর জন্যে অনুরোধ করা হয় [মিম্বর আল-ইসলাম ম্যাগাজিন পত্রিকা নং ২১৭, ১৯৮০]। এই বিষয়টি নিয়ে সে দেশের উলামাবৃন্দ দুইটি মতে বিভক্ত হয়ে পড়লে শায়খের কাছে ফায়সালা চাওয়া হয়। চিঠির উত্তরে তিনি ইমাম শাফেঈ (رحمة الله عليه)’কে উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন: 



“ইসলামী আইনের মূল উৎসগুলো হচ্ছে ক্বুরআন ও সুন্নাহ। কেউ তাতে (কোনো বিষয় সম্পর্কে) উত্তর খুঁজে না পেলে সেগুলো হতে (নিঃসৃত) নিজের ক্বিয়াস (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) প্রয়োগ করতে পারেন। কোনো হাদীস যদি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) হতে অবিচ্ছিন্ন এসনাদ/পরম্পরা দ্বারা বর্ণিত হয় এবং এসনাদটি সহীহ হিসেবে প্রমাণিত হয়, তাহলে ওই হাদীসটি সুন্নাহর মান অর্জন করে। (তবে) স্রেফ একটি সনদে বর্ণিত হাদীসের চেয়ে ইজমা’ (ইমামবৃন্দের ঐকমত্য) অধিকতর গ্রহণযোগ্য; আর যাহেরী/প্রকাশ্য অর্থ অন্যান্য অর্থের চেয়ে বেশি বিবেচনা পাবে। আরেক কথায়, কোনো হাদীসে একাধিক অর্থের সম্ভাবনা থাকলে বাহ্যিক (মানে আক্ষরিক) অর্থ সর্বপ্রথম বিবেচনা করা হবে এবং অন্যান্য অর্থের ওপরে প্রাধান্য পাবে। দুই বা ততোধিক হাদীস একই হলে এসনাদ হিসেবে যেটা শক্তিশালী, সেটাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। বিচ্ছিন্ন কোনো এসনাদ গ্রহণযোগ্য নয়, ব্যতিক্রম শুধু সেগুলো হবে, যেগুলো ইবনে আল-মুসাইয়্যেব বর্ণনা করেছেন।” [ইবনে আল-ক্বায়সারানী কৃত ‘আল-সামা’ পুস্তক, লাইন-৩১, ৬৩ পৃষ্ঠা, মিসরের ইসলাম-বিষয়ক সুপ্রীম কাউন্সিল কর্তৃক প্রকাশিত, ১৩৯০ হিজরী/১৯৭০ খৃষ্টাব্দ]  



শায়খ জা’দ আল-হক্ব এরপর তাঁর দেশের ইসলাম-বিষয়ক সুপ্রীম কাউন্সিলের প্রকাশিত প্রাগুক্ত ‘আল-সামা’ পুস্তকের সিদ্ধান্তের অনুসরণে বলেন: 



“অতএব, সব ধরনের বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে ইসলামী সিদ্ধান্ত একই - সেগুলোকে হারাম বা জায়েয বলার পক্ষে শরীয়তে একটি প্রমাণও নেই। বাদ্যযন্ত্রকে হারাম সাব্যস্ত করতে পেশ করা যাবতীয় বিবরণ (রওয়ায়াত) সাবেত/প্রতিষ্ঠা করা যায় না এবং প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর কাছ থেকে এসেছে বলেও প্রমাণ করা যায় না; আর এটাই আহলে মদীনা (মদীনাবাসী)’দের প্রাধান্য-প্রাপ্ত উলামাবৃন্দের (মানে মালেকী মাযহাবের) দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁরা সর্বসম্মত এ ব্যাপারে যে, বাদ্যযন্ত্র শোনা জায়েয। অনুরূপভাবে, আহলে যাহের (বাহ্যিক বিষযাদির ফতোয়াবিদ)’বৃন্দ জায়েয হওয়ার উসূল/মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন (أن الأصل في الأشياء الإباحة - সকল বস্তুর মূল বৈধ বা হালাল)। 



“ফুঁ দ্বারা বাদ্যযন্ত্র (মাযামির) ও অন্যান্য সব বাজনা (মালাহি)’এর ক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক সহীহ হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে যা’তে প্রমাণিত হয় যে সেগুলো জায়েয (প্রাগুক্ত আল-সামা’ পুস্তকের ৭১ ও তৎপরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহ)। ওই ধরনের বাজনা শোনা নিম্নবর্ণিত আয়াতে করীমা দ্বারাও সাবেত/প্রতিষ্ঠিত হয়:



وَإِذَا رَأَوْاْ تِجَارَةً أَوْ لَهْواً ٱنفَضُّوۤاْ إِلَيْهَا وَتَرَكُوكَ قَآئِماً قُلْ مَا عِندَ ٱللهِ خَيْرٌ مِّنَ ٱللَّهْوِ وَمِنَ ٱلتِّجَارَةِ وَٱللهُ خَيْرُ ٱلرَّازِقِينَ 



অর্থ: এবং যখন তারা কোনো ব্যবসা (تِجَارَةً) অথবা খেলাধূলা (لَهْواً) দেখতে পেলো, তখন সেটার দিকে ছুটে গেলো আর আপনাকে (খুতবার মধ্যে) দণ্ডায়মান রেখে গেলো। আপনি বলুন: তা-ই যা আল্লাহর কাছে রয়েছে, খেলাধূলা ও ব্যবসা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট; এবং আল্লাহর রিযক্ব্ সর্বাপেক্ষা উত্তম। [তাফসীরে নূরুল এরফান, ৬৩:১১] 



“ওপরের এই আয়াতের তাফসীর/ব্যাখ্যা ইমাম মুসলিম (رحمة الله عليه) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে পেশ করা হয়েছে, যা লিপিবদ্ধ আছে তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থের জুমুআ’ অধ্যায়ে। হযরত জাবির ইবনে সামুরা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত:



وَحَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ يَحْيَى، أَخْبَرَنَا أَبُو خَيْثَمَةَ، عَنْ سِمَاكٍ، قَالَ أَنْبَأَنِي جَابِرُ بْنُ، سَمُرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَخْطُبُ قَائِمًا ثُمَّ يَجْلِسُ ثُمَّ يَقُومُ فَيَخْطُبُ قَائِمًا فَمَنْ نَبَّأَكَ أَنَّهُ كَانَ يَخْطُبُ جَالِسًا فَقَدْ كَذَبَ فَقَدْ وَاللهِ صَلَّيْتُ مَعَهُ أَكْثَرَ مِنْ أَلْفَىْ صَلاَةٍ.



অর্থ: রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) দাঁড়িয়ে (জুমুআর) খুতবা দিতেন এবং এরপর বসতেন; অতঃপর আবার দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। যে ব্যক্তি বলে তিনি বসে বসে খুতবা দিতেন, সে একজন মিথ্যুক। কেননা, নিশ্চয় আমি তাঁর সাথে (মানে তাঁর ইমামতিতে) এক হাজার বার নামায পড়েছি! [মুসলিম শরীফ, ৮৬৩ b, বই - ৭, হাদীস - ৪৬] 



“অপর এক সাহাবী হযরত জাবির ইবনে আবদীল্লাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে জানা যায়:



حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، وَإِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، كِلاَهُمَا عَنْ جَرِيرٍ، قَالَ عُثْمَانُ حَدَّثَنَا جَرِيرٌ، عَنْ حُصَيْنِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، عَنْ سَالِمِ بْنِ أَبِي الْجَعْدِ، عَنْ جَابِرِ، بْنِ عَبْدِ اللهِ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَخْطُبُ قَائِمًا يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَجَاءَتْ عِيرٌ مِنَ الشَّامِ فَانْفَتَلَ النَّاسُ إِلَيْهَا حَتَّى لَمْ يَبْقَ إِلاَّ اثْنَا عَشَرَ رَجُلاً فَأُنْزِلَتْ هَذِهِ الآيَةُ الَّتِي فِي الْجُمُعَةِ ‏{‏ وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً أَوْ لَهْوًا انْفَضُّوا إِلَيْهَا وَتَرَكُوكَ قَائِمًا‏}



অর্থ: একবার মহানবী (صلى الله عليه وسلم) দাঁড়িয়ে জুমুআ’র খুতবা দানকালে অকস্মাৎ একটি কাফেলা শা’ম (বর্তমান সিরিয়া-ফিলিস্তিন-জর্দান-লেবানন অঞ্চল) হতে আগমন করে। জামা’আতের সবাই ওই কাফেলার কাছে যায়, স্রেফ ১২ জন রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর সাথে থেকে যান। এর পরপরই এই আয়াতখানা অবতীর্ণ হয়। [সহীহ মুসলিম, ৮৬৩ a, বই - ৭, হাদীস - ৪৭] 



“ইবনে আল-ক্বুশায়রী (رحمة الله عليه) বিবৃত করেন (প্রাগুক্ত ‘আল-সামা’, ৭২ পৃষ্ঠা): এই আয়াতে আল্লাহতা’লা ‘লাহ্উ’ (বাজনাসহ আনন্দফুর্তি)’কে ‘তিজারাত’ (ব্যবসা-বাণিজ্য)’এর সাথে সম্বন্ধযুক্ত করেছেন আরবী ‘ওয়া’ (এবং) অব্যয় পদ দ্বারা, যার মানে ওগুলোর একটির ব্যাপারে যে শরঈ বিধান প্রযোজ্য হবে, অপরটির বেলায়ও তা-ই প্রযোজ্য হবে। কেননা ওগুলো পরস্পর যুক্ত। আমরা জানি, মুসলিম (আলেম-উলামা) সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ‘তিজারাত’ (ব্যবসা-বাণিজ্য) বৈধ। অতএব, এই আয়াতে আল-ক্বুরআন বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে স্থিতি রক্ষা করেছে, যেহেতু প্রাক-ইসলামী যুগ থেকেই গানবাদ্য আরবীয় রীতি ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চলে আসছিলো। এ কথা বলা অসম্ভাব্য যে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছিলেন এই ঘটনার আগেই; অথচ যখন বাদক দল মসজিদে নববীর দরজার সামনে দিয়ে অতিক্রম করছিলো, তখন ওই মুহূর্তে একটি আয়াতও নাযেল/অবতীর্ণ হয়নি এ কথা স্পষ্ট ও চূড়ান্তভাবে ব্যক্ত করতে যে গান-বাজনা হারাম (নিষিদ্ধ)। বরঞ্চ বাদক দলের বাজনা শুনতে যারা নবী করীম (صلى الله عليه وسلم)’কে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে গিয়েছিলো, তাদেরকে আল্লাহতা’লা কেবল ‘ইতা’ব’ তথা ভর্ৎসনা বা তিরস্কার করতেই আয়াতখানি নাযেল করেন। ওই শুক্রবারের ঘটনার পরে গান-বাজনা সম্পর্কে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) স্পষ্টভাবে তাঁর সুন্নাহসম্মত সিদ্ধান্ত বিবৃত না করার পক্ষ নেয়াটাও ইতিবাচক দিক।  



“অতএব, এতদসংক্রান্ত (মানে গান-বাজনার) সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত হওয়া চাই উসূলের ক্বায়দা অনুসারে এবাহত/বৈধতার ভিত্তিতে (আরেক কথায়, আমরা জানি গান-বাজনা জায়েয ছিলো এবং তার বিধান বদলেছে মর্মে সাবেত করতে কোনো পরিপন্থী আয়াত বা সুন্নাহ আমাদের কাছে নেই)। বরং এর পক্ষে সমর্থনসূচক বিবরণ হযরত মা আয়েশাহ (رضي الله عنها) হতে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে তিনি তাঁর এক সাথীকে জনৈক আনসার ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। এতদশ্রবণে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) তাঁকে বলেন, কনের সাথে ‘লাহ্উ’ (আনন্দ-ফুর্তিদায়ক গান-বাজনা) পাঠাও নি কেন? নিশ্চয় আনসার গোত্র ‘লাহ্উ’ ভালোবাসে।” [আল-বুখারী, ইতিপূর্বে উদ্ধৃত] {মিসরীয় সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী ও শায়খুল আযহার (বিশ্ববিদ্যালয়) জা’দ আল-হক্ব আলী জা’দ আল-হক্ব সাহেবের ফতোয়া সমাপ্ত}



আপত্তি - ২



আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কালামে বলেন:



 أَفَمِنْ هَـٰذَا ٱلْحَدِيثِ تَعْجَبُونَ ـ وَتَضْحَكُونَ وَلاَ تَبْكُونَ ـ وَأَنتُمْ سَامِدُونَ



অর্থ: তোমরা কি এ বাণীতে বিস্মিত হও? হাসছো এবং কাঁদছো না? এবং তোমরা খেলাধূলায় মগ্ন (সা’মেদূন) আছো! [আল-ক্বুরআন, ৫৩:৫৯-৬১]



ওপরের আয়াতে উল্লেখিত ‘সামেদ’ শব্দটির মানে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)’এর বর্ণনানুযায়ী সঙ্গীতকারী বলেই সাব্যস্ত হয়। অতএব, গান-বাজনা হারাম।



জবাব 



আমরা এ আপত্তির উত্তর মুফতী আবদুস্ সালাম ঈসাপুরী সাহেব (رحمة الله عليه) বিরচিত ‘পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’ শীর্ষক পুস্তিকার অনুসরণে লিপিবদ্ধ করবো। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ‘সা’মেদ’ শব্দটিকে সঙ্গীতকারী বলেছেন মর্মে যে রওয়ায়াত (বিবরণ) এসেছে, তা সহীহ (বিশুদ্ধ) নয়। ইমাম সৈয়ূতী (رحمة الله عليه)’এর ‘দুর্রে মানসূর’ শীর্ষক তাফসীরগ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখা হয়েছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ‘সা’মেদ’ শব্দটিকে আরবী ভাষার শব্দ হিসেবে প্রমাণ করেন। অতএব, এর অর্থ - ‘গাফেল,’ ‘উদাসীন,’ ‘বে-খবর।’ ইমাম রাযী (رحمة الله عليه )’এর ‘তাফসীরে কবীর’ গ্রন্থেও অনুরূপ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, একবার তিনি কতোগুলো লোককে মসজিদে বসে বাজে কথাবার্তা বলতে দেখে তাদের বলেছিলেন: আমি তোমাদেরকে সা’মেদ অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি কেন? অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী, যিকর-আযকার, তাসবীহ-তাহলিল ইত্যাদি না করে আল্লাহতা’লা হতে সা’মেদ বা গাফেল হয়ে বাজে কথা বলছো কেন? [‘পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’, ২৫ পৃষ্ঠা, ১৯৭৯]



এতদসত্ত্বেও আমরা Towards Understanding the Qur’an শীর্ষক অনলাইন সাইট থেকে উদ্ধৃতি পেশ করে দেখাবো তাফসীরকারকবৃন্দ শব্দটির কী অর্থ করেছেন। তাঁরা ‘সামেদ’ শব্দটির দুটো অর্থ করেন:



প্রথমটিতে সর্ব-হযরত ইবনে আব্বাস, ইকরিমাহ ও ব্যাকরণবিদ আবূ উবায়দাহ (رضي الله عنهم) অভিমত ব্যক্ত করেন যে, Yarnanite (এয়ারনানাইট) ভাষায় ‘সুমূদ’ মানে গান গাওয়া ও খেলাধূলা করা; আর এ আয়াতটি মক্কার কুফফার-বর্গের প্রতি ইশারা করেছে, যারা ক্বুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজকে চাপা দিতে এবং মানুষের মনোযোগকে পবিত্র গ্রন্থ হতে দূরে সরাতে উচ্চস্বরে গান ধরতো। এখানে স্পষ্ট বোঝা যায়, আয়াতটি কুফফার-দের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু সেটা তো সাহাবা (রা:) বা মুসলমানবৃন্দের সেমা’ শ্রবণ নয়! 



দ্বিতীয়টিতে সর্ব-হযরত ইবনে আব্বাস ও মুজাহিদ (رضي الله عنهما) অপর যে অর্থ করেছেন, তাতে ‘সুমূদ’ হলো, দম্ভ প্রদর্শন করতে মাথা বাঁকিয়ে চলা; প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে অতিক্রম করার সময় মক্কার কুফফার-বর্গ রাগান্বিত অবস্থায় মুখমণ্ডল ওপরের দিকে উঁচিয়ে যেতো। রাগীব ইস্পাহানী তাঁর ‘মুফরাদাত’ পুস্তকে একই অর্থ করেছেন। হযরত ক্বাতাদাহ (رضي الله عنه) ‘সামেদুন‘কে ‘গাফেল (উদাসীন) অর্থ করেন [অনলাইন সাইট Towards Understanding the Qur’an; ৫৩:৫৯-৬১]। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)’এর এই দ্বিতীয় মতটি কিন্তু সেমা’বিরোধী গং উদ্ধৃত করেন না।    



সেমা’বিরোধীদের যুক্তির খণ্ডনে মুফতী আবদুস্ সালাম ঈসাপুরী (رحمة الله عليه) লেখেন: 



“উক্ত আয়াতে কেয়ামতে অবিশ্বাসীদেরকে আল্লাহতা’লা ‘সামেদুন’ বা সঙ্গীতকারী বলেছেন বিধায় সঙ্গীতকে হারাম বলে যাঁরা বলেছেন, তাঁদেরকে হাস্য করা এবং কান্নাকাটি না করাকেও হারাম বলতে হবে। যেহেতু উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহতা’লা কিয়ামতে অবিশ্বাসী লোকেরা হাসে এবং কাঁদে না বলেও বর্ণনা করেছেন। সুতরাং হাসা এবং না কাঁদাও তাঁদের (সেমা’বিরোধীদের) ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা হারাম হয়ে যাবে। যদি তাঁরা বলেন, হাসা স্থলবিশেষে হারাম আর খোশখবরী/সুসংবাদ শুনে হাসা জায়েয, তাহলে আমরাও বলবো, লোকদেরকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করার জন্যে গান গাওয়া হারাম, আর আল্লাহ, রাসূল (صلى الله عليه وسلم), ইসলাম ও ক্বুরআনের দিকে আকর্ষণ করার জন্যে গান করা জায়েয ও এবাদত।” [পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’, ২৫-২৬ পৃষ্ঠা]     



মোট কথা, এই দলিলকে সেমা’র বিরুদ্ধে ব্যবহার করার কোনো অবকাশ-ই নেই।



আপত্তি নং ৩



আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন:



 وَٱسْتَفْزِزْ مَنِ ٱسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ



অর্থ: (হে ইবলীস শয়তান), এবং পদস্খলিত করে দাও তাদের মধ্যে যাকে পারো আপন আওয়াজ দ্বারা। [আল-ক্বুরআন, ১৭:৬৪]



আয়াতোক্ত ‘সওত’ (আওয়াজ) শব্দটিকে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত মুজাহিদ (رضي الله عنه) সঙ্গীত বলেছেন। সুতরাং সঙ্গীত হারাম।



জবাব



সেমা’বিরোধীদের এই রওয়ায়াত/বিবরণটি সহীহ নয়। কারণ মোয়ালেমুত্ তানযিল’ শীর্ষক তাফসীরগ্রন্থ হতে ‘খোলাসাতুত্ তাফাসির’ পুস্তকে অনূদিত হয়েছে, হযরত মুজাহিদ (رضي الله عنه) বলেন: “এই আয়াতোক্ত শব্দের অর্থ শয়তানী (উদ্দেশ্যে কৃত) গান ও বাদ্য।” [খোলাসাতুত্ তাফাসির, ৩য় খণ্ড, ৪০ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য; মুফতী আবদুস্ সালাম ঈসাপুরী (رحمة الله عليه) প্রণীত ‘পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’ পুস্তিকার রেফারেন্স]



মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (رحمة الله عليه) নিজের ‘নূরুল এরফান’ তাফসীরগ্রন্থে সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)’এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন: “যে আওয়াজ (صوت) মহান প্রতিপালকের মর্জির বিরুদ্ধে বের হয়, তা-ই শয়তানী আওয়াজ।” মুফতী সাহেব (رحمة الله عليه) এরপর বলেন: “(এটা) চাই গান-বাদ্যের আওয়াজ হোক, অথবা মিথ্যে ওয়াজ, কিংবা ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্টকারী তাফসীরের আওয়াজ-ই হোক।” [নূরুল এরফান, ১৭:৬৪; টীকা নং - ১৪১]



আমরা এক্ষণে মুফতী আবদুস সালাম ঈসাপুরী সাহেব (رحمة الله عليه)’এর লেখা ‘পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’ পুস্তিকাটির অনুসরণে আমাদের জবাব এখানে তুলে ধরছি।



অতএব, এর (অর্থাৎ, ওপরের বিবরণ) দ্বারা বোঝা যায়, শয়তানের ওয়াসওয়াসায় প্ররোচিত হয়ে আল্লাহ, তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم), ক্বুরআন ও ইসলাম হতে ফিরিয়ে রাখার জন্যে অথবা শরাব/মদ, জুয়া, বেশ্যা, যেনা ইত্যাদি পাপের দিকে আকর্ষণ করার জন্যে লোকদের দ্বারা যে গান গাওয়া হয় কিংবা যে বাদ্য বাজানো হয়, তা-ই শয়তানের আওয়াজ বা ওয়াসওয়াসার প্রতিধ্বনি ও অভিব্যক্তি, আর তা-ই হারাম। এ ছাড়া নেক/পুণ্যদায়ক কাজ ও ইসলাম হতে ফিরিয়ে রাখার অসৎ উদ্দেশ্যে কিংবা পাপের দিকে আকর্ষণ করার লক্ষ্যে যে বক্তৃতা, পুস্তক প্রণয়ন ও প্রচার এবং বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়, তা-ও শয়তানের আওয়াজেরই অভিব্যক্তি, যদিও তা পদ্যে, ছন্দে, রাগ-রাগিনী ও তাল-মান সংযোগ না হয়ে শুধু গদ্যে বা কথ্য ভাষায় প্রচার করা হয়। মোট কথা, শয়তানী ওয়াসওয়াসায় প্ররোচিত হয়ে লোকেরা যা করে, তা-ই হারাম ও শয়তানী কাজ - সেটা গান-বাদ্য হোক, অথবা নাটক, নোভেল, থিয়েটার হোক, কিংবা ভ্রান্তদের তাফসীর/সীরাতুন্নবী (দ:) মাহফিল-ই হোক।



শয়তানের ‘সওত’ বা আওয়াজ যদি কেবল গান-বাজনাকে আখ্যায়িত করা হয়, তাহলে বলতে হবে শয়তান মানুষের দ্বারা গান-বাদ্য করিয়েই তাদেরকে গুনাহগার করে থাকে; কিন্তু সে অন্য কোনো কিছু করিয়ে গুনাহগার করে না। এক্ষণে আমাদের প্রশ্ন হলো: মানুষ অন্য যতো ধরনের গুনাহ করে, সেগুলো কার আওয়াজে প্ররোচিত হয়ে করে থাকে? এ রকম হাস্যকর ও অচল কথা হযরত মুজাহিদ (رضي الله عنه) বলেছেন বলে যারা বিশ্বাস করে, তারা কতো বড় আহাম্মক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া ইবলীসের ‘সওত’ বা আওয়াজ যদি ইবলীসের গান হয়, তাহলে তা ইবলীসের জন্যে এবং যে লোকেরা তা শুনে তাদেরই জন্যে হারাম হবে। যারা ইবলীসকে দেখে না, তারা ইবলীসের শব্দ, কথা ও গান কিছুই শোনে না। অতএব, তারা এ আয়াতের আওতাভুক্ত হয়ে গুনাহগার হবে কেন? যে লোকেরা বলে, ‘ইবলীসের সওত’ অর্থ (সার্বিক) গান-বাজনা, তারা ভ্রান্ত এবং হারাম প্রচারকারী। আমরা বলি: দুনিয়ার কোনো অভিধানেই নেই যে ‘সওত’ অর্থ গান-বাজনা। ক্বুরআন মজীদে উল্লেখিত হয়েছে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর সওত এবং আসহাবে কেরাম (رضي الله عنهم)’এর সওত:



يٰأَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَرْفَعُوۤاْ أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ ٱلنَّبِيِّ



অর্থ: হে ঈমানদারবর্গ! নিজেদের কণ্ঠস্বর (আওয়াজ)’কে উঁচু কোরো না ওই নবী পাকের কণ্ঠস্বরের (আওয়াজের) ওপরে। [আল-ক্বুরআন, ৪৯:২]



হযরত লোক্বমান (আলাইহিস্ সালাম) তাঁর পুত্রকে উপদেশ দেয়ার সময় বলেন: 



 وَٱغْضُضْ مِن صَوْتِكَ



অর্থ: আর আপন কণ্ঠস্বর নিচু করো। [আল-ক্বুরআন, ৩১:১৯]



এ সব ক্ষেত্রে ‘সওত’ শব্দের অর্থ গান হতে পারে কি? সূরা লোক্বমানে আরো ঘোষিত হয়েছে - 



إِنَّ أَنكَرَ ٱلأَصْوَاتِ لَصَوْتُ ٱلْحَمِيرِ



অর্থ: নিশ্চয় সমস্ত স্বরের (সওতের) মধ্যে অপ্রীতিকর স্বর হচ্ছে গাধার। [আল-ক্বুরআন, ৩১:১৯]



এখানে ‘সওত’ শব্দের অর্থ কখনো গান হতে পারে কি? আমরা আয়াতোক্ত ‘ইবলীসের সওত’-এর অর্থ ‘ইবলীসের ওয়াসওয়াসা’ (কুমন্ত্রণা) বলে জানি, যার থেকে আল্লাহতা’লার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেন:



 مِن شَرِّ ٱلْوَسْوَاسِ ٱلْخَنَّاسِ ـ ٱلَّذِى يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ ٱلنَّاسِ ـ 



অর্থ: (হে রাসূল, আপনি বলুন, আমি আশ্রয় নিচ্ছি) সেই খান্নাসের অনিষ্ট থেকে, যে অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। [আল-ক্বুরআন, ১১৪:৩-৪]



প্রকৃতপক্ষে ওপরের আয়াতটি দ্বারাই ‘শয়তানের সওত’ সংক্রান্ত আয়াতটির ব্যাখ্যা হয়ে যায়। অতএব, উক্ত ‘শয়তানের সওত’-বিষয়ক আয়াতটি দ্বারা কোনোক্রমেই সঙ্গীতকে হারাম সাব্যস্ত করা যায় না। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সূরা লোক্বমানের ১৮ নং আয়াতটিকেও সেমা’বিরোধীরা দলিল হিসেবে পেশ করে থাকেন। লোক্বমান (আলাইহিস্ সালাম) তাঁর পুত্রকে উপদেশ দানকালে বলেন - وَلاَ تَمْشِ فِي ٱلأَرْضِ مَرَحاً إِنَّ ٱللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ - এবং দুনিয়ায় অহঙ্কার করে বিচরণ কোরো না; নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না কোনো উদ্ধত অহঙ্কারীকে [৩১:১৮]। কতিপয় সেমা’বিরোধীর মতে, সূফীবৃন্দের ওয়াজদ নাকি দুনিয়ার বুকে দম্ভভরে চলার মতোই! আসলে তাঁরা এই আয়াতটির অপব্যাখ্যা করেছেন। সালাফী গোমরাহদের গুরু ইবনে তাইমিয়া-ই প্রথম এটা চালু করেন। কোথায় আউলিয়াবৃন্দের খোদাপ্রেমে বিভোর হয়ে তাওয়াজুদ, আর কোথায় গোমরাহদের অহঙ্কারপূর্ণ বিচরণ! দুটো কি কখনো এক হতে পারে?



আপত্তি নং ৪  



একটি হাদীসে বিবৃত হয়:



 لا يحل بيعُ المُغنّياتِ ولا شِراؤهنّ وثمنهنّ حرامٌ 



অর্থ: জাহেলীয়্যা যুগের নারী গায়িকাদের কেনাবেচা করা হারাম/নিষিদ্ধ। ওই লেনদেনের মূল্যও হারাম [আল-হাদীস]। অতএব, গান হারাম।



জবাব



এরকম আরো রওয়ায়াত/বর্ণনা সেমা’বিরোধীরা উদ্ধৃত করে থাকেন। তাঁদের মতে ‘লাহ্উল হাদীস’-সংক্রান্ত আয়াতটিকে সমর্থন দানের জন্যেই এগুলো বিবৃত হয়েছিলো। তবে এ সমস্ত বিবরণকে উলামাবৃন্দ যয়ীফ তথা দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সুপ্রসিদ্ধ ‘তাফসীরে ফাতহুল বয়ান’ গ্রন্থের ২০৯ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, “এ সম্পর্কে (অর্থাৎ, গান-বাজনা হারাম হওয়া সম্পর্কে) একটি হাদীসও (তথা এমর্মে হাদীস বর্ণনাকারীদের কেউই) ‍নির্দোষ নয়। সুতরাং সেগুলো শরীয়তের দলিল হতে পারে না।” [পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’, বুরহানুল আশেক্বীন ও শরফুল ইন্সান দ্রষ্টব্য]



বস্তুতঃ এ ধরনের বিবরণকে আমরা রাসূল (صلى الله عليه وسلم) অথবা তাঁর সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم)’এর বাণী বলে স্বীকার করতে পারি না। কারণ তাঁরা গায়িকা জারিয়া-দের গান শুনেছিলেন মর্মে বেশ কিছু সহীহ রওয়ায়াত রয়েছে। তা ছাড়া, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) যদি সত্যি ওই কথা বলতেন, তাহলে গায়িকা জারিয়ার পাশাপাশি গায়ক গোলামদের কেনাবেচাও বন্ধ হয়ে যেতো। কেননা যদি গায়িকা জারিয়ার গান শুনে পুরুষ লোকের মনে কামভাব জাগ্রত হতে পারে, তাহলে গায়ক গোলামের গান শুনেও নারীদের মনে কামভাব জাগ্রত হতে পারে। অথচ আমাদের নবী (صلى الله عليه وسلم) একবার সপরিবার উটের পিঠে চড়ে মদীনা মোনাওয়ারা অভিমুখে যাচ্ছিলেন। উটচালক আঞ্জাশা উটকে দ্রুত চালাবার উদ্দেশ্যে গান জুড়ে দেন। গান শুনে উট নাচতে নাচতে দ্রুতগতিতে ছুটে চল্লো। এমতাবস্থায় প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) বলেন: 



حَدَّثَنَا أَبُو الرَّبِيعِ الْعَتَكِيُّ، وَحَامِدُ بْنُ عُمَرَ، وَقُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، وَأَبُو كَامِلٍ جَمِيعًا عَنْ حَمَّادِ بْنِ زَيْدٍ، قَالَ أَبُو الرَّبِيعِ حَدَّثَنَا حَمَّادٌ، حَدَّثَنَا أَيُّوبُ، عَنْ أَبِي قِلاَبَةَ، عَنْ أَنَسٍ، قَالَ كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِي بَعْضِ أَسْفَارِهِ وَغُلاَمٌ أَسْوَدُ يُقَالُ لَهُ أَنْجَشَةُ يَحْدُو فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ يَا أَنْجَشَةُ رُوَيْدَكَ سَوْقًا بِالْقَوَارِيرِ ‏"‏ ‏.



অর্থ: হে আঞ্জাশা, উটের ওপর কাঁচদ্রব্য বোঝাই। উট ধীরে চালাও। [মুসলিম শরীফ, ২৩২৩ a, বই ৪৩, হাদীস নং ৯৪]



এই হাদীসটিতে পরিস্ফুট হয়, মহানবী (صلى الله عليه وسلم) গানকে হারাম বলেন নি। শুধুমাত্র উটকে ধীরে চালাতে আদেশ দিয়েছেন, যাতে উটের পিঠে উপবিষ্ট মহিলাবৃন্দের কোমল শরীরে ঝাঁকি না লাগে। হাদীসটির মূল বর্ণনাকারী হযরত আনাস (رضي الله عنه)। 



আপত্তি নং ৫ 



হযরত জাবের (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর হাদীস:



كان إبليس أول من ناح وأول من تغنى



অর্থ: “সর্বপ্রথম শয়তান-ই নাওহা বা বিলাপ করেছিলো এবং সর্বপ্রথম গান করেছিলো।” অতএব, গান-বাজনা হারাম।



জবাব



মুফতী আবদুস সালাম ঈসাপুরী সাহেব (رحمة الله عليه) লিখেছেন, এ রওয়ায়াত সম্পর্কে মুহাদ্দিসমণ্ডলীর কাছে বিশ্বাস্য বিখ্যাত ‘তাখরিজাতে এরাক্বী’ শীর্ষক কিতাব হতে অনুবাদ করে ‘মজাকুল আরেফীন’ শিরোনামের গ্রন্থের ৫২৯ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে যে, (এরাক্বী বলেন) এই রওয়ায়াতের আসল বা বিশ্বাস্য ‘সনদ’ আমি প্রাপ্ত হই নি। ‘ফেরদৌস’ পুস্তকে এটার উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু ‘ফেরদৌস’ গ্রন্থপ্রণেতার পুত্র তাঁর ‘মুসনাদ’ শীর্ষক হাদীসগ্রন্থে এটা বর্ণনা করেন নি। সুতরাং এই অজ্ঞাত বিবরণ শরীয়তের দলিল হতে পারে না। এটা সহীহ হলেও এর দ্বারা সব ধরনের নাওহা ও সব ধরনের সঙ্গীত না-জায়েয প্রমাণিত হয় না। শুধুমাত্র শয়তানী নাওহা ও শয়তানী গানই হারাম সাব্যস্ত হতে পারে। অপর পক্ষে, পয়গাম্বর দাউদ (عليه السلام)’এর নাওহা ও গুনাহগারবৃন্দ গুনাহ মাফ হওয়ার উদ্দেশ্যে যে নাওহা করেন, তা সর্বসম্মতিক্রমে জায়েয ও বিশেষ সওয়াবের কাজ বলে সাব্যস্ত। ঠিক একইভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم) এবং আউলিয়া কেরাম (رحمة الله عليهم)’এর এশক্ব-মহব্বত বৃদ্ধিকারী গান-বাজনাও জায়েয ও মহা সওয়াবদায়ক। [পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’, ৩২ পৃষ্ঠা]



পয়গাম্বর দাউদ (عليه السلام)’এর গান প্রসঙ্গে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নও-মুসলিম ও ইসলামধর্ম প্রচারক জন ইয়াহইয়া এডেরার সাহেবের Regarding Permissibility of Music (ইসলামে সঙ্গীতের বৈধতা) শীর্ষক অনলাইন লেখাটি হতে উদ্ধৃতি পেশ করবো। তিনি লেখেন:



সৎ ও নৈতিকতাপূর্ণ সঙ্গীতের প্রমাণ



১/ সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنهم) গান-বাজনা নিষেধ করতেন মর্মে মিথ্যে দাবি করা হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র (رضي الله عنه)’এর সামনে মেয়েরা গীটার-জাতীয় তারবিশিষ্ট বাদ্যযন্ত্রসহ গান পরিবেশন করতেন। [ইমাম আবদুল গনী নাবলূসী (রহমতুল্লাহে আলাইহে) কৃত ‘ইদা’হুদ্দালা’লা’ত ফী সামা’য়িল আলা’ত’, ৯৬ পৃষ্ঠা]



২/ হযরত ইবরাহীম বিন সা’আদ বিন আবদির রাহমান বিন আউফ (رضي الله عنه) কর্তৃক গীটার-জাতীয় তারবিশিষ্ট বাদ্যযন্ত্রসহ সঙ্গীত শ্রবণের ব্যাপারে (ইমামমণ্ডলীর মাঝে) কোনো মতানৈক্য নেই। [ইবনে তাহির কৃত ‘আল-সামা’, ৬৩ পৃষ্ঠা]



৩/ ইহুদীবৃন্দ সর্বদা পয়গাম্বর দাউদ (عليه السلام)’এর প্রতি সঙ্গীত শ্রবণের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। বাইবেলে (পুরাতন নিয়ম যাকে তৌরীত বলে তাঁরা মনে করেন) উল্লেখিত হয়েছে: “আর যাজকবর্গ আপন আপন পদানুসারে দাঁড়িয়েছিলো, এবং লেবীয়রাও সদাপ্রভুর (মানে খোদাতা’লার) সঙ্গীতের জন্যে বাদ্যযন্ত্রসহ দাঁড়িয়েছিলো; যখন দাউদ (عليه السلام) তাদের দ্বারা প্রশংসা করেন, তখন সদাপ্রভুর দয়া অনন্তকালস্থায়ী বলে যেনো তাঁর স্তব করা হয়, এই জন্যে দাউদ রাজা (عليه السلام) সেই সব (বাদ্য) যন্ত্র নির্মাণ করেছিলেন” [২ বংশাবলী, ৭:৬, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ১৯৮৪ খৃষ্টাব্দ]। এমতাবস্থায় নিম্নোক্ত হাদীস শরীফে আমরা সদুদ্দেশ্যে কৃত সেমা’র পক্ষে একটি শক্তিশালী দলিল দেখতে পাই: 



يا أبا موسى ، لقد أوتيتَ مِزمارًا مِن مزاميرِ آلِ داود



অর্থ: হে আবূ মূসা, নিশ্চয় তোমাকে পয়গাম্বর দাউদ (عليه السلام)’এর বাজনার মতো (সুললিত) কণ্ঠস্বর দান করা হয়েছে। [বুখারী ৫০৪৮]



উলামাবৃন্দের অনেকে এটাকে স্রেফ সুললিত কণ্ঠস্বর বলে বোঝাতে চান। কিন্তু আমরা যখন ইমাম ইবনে হাজর আসক্বালানী (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র এতদসংক্রান্ত ব্যাখ্যার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, আমরা দেখতে পাই তিনি আরেকটি সহীহ হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: “আমি আবূ মূসার ঘরে প্রবেশ করে তার সুললিত কণ্ঠের (গানের) চেয়ে মধুর কোনো তারবিশিষ্ট বাদ্যযন্ত্র বা বাঁশি শুনিনি” (আল-ফাতহুল বারী)। [জন ইয়াহইয়া এডেরার সাহেবের উদ্ধৃতি সমাপ্ত]



ইমাম নববী (رحمة الله عليه) বলেন: 



وأصل الزمر: الغناء 



অর্থ: (হাদীসে ব্যবহৃত আরবী) মাযামির/বাঁশি-জাতীয় শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে গান। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮৪৯]



ইমাম ইবনে হাজর আসক্বালানী (رحمة الله عليه) বলেন:



والمراد بالمزمار: الصوت الحسن وأصله الآلة



অর্থ: উল্লেখিত ‘মাযামির’ শব্দটির অর্থ সুমধুর কণ্ঠস্বর এবং মূলতঃ এর অর্থ বাদ্যযন্ত্র। [ফাতহুল বারী, হাদীস নং ৫০৪৮]



উপরোক্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে Hadith Answers ওয়েবসাইটের মৌলানা সুহায়ল মোতা’লা সাহেব সিদ্ধান্ত নেন: “অতএব, ‘মিযমার’ শব্দটি সাধারণতঃ ‘বাদ্যযন্ত্র’ হিসেবে অনূদিত হয়, কেননা এতে ওপরের সব উপাদান নিহিত, বিশেষতঃ এর মূল শব্দ খোদ সঙ্গীতকে কিংবা যে কোনো বাদ্যযন্ত্রকে বোঝায়, যেমনিভাবে হাফেয ইবনে হাজর আসক্বালানী (رحمة الله عليه) উল্লেখ করেছেন।” [Meaning of the word ‘Mazamir’ পেইজ, Hadith Answers ওয়েবসাইট]



ইমামমণ্ডলী বাদ্যযন্ত্রসহ গান শোনার বিষয়ে পারস্পরিক ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁদের মতামতের ব্যাপারে ধর্ম প্রচারক জন ইয়াহইয়া এডেরার সাহেব বলেন: “আপনারা (ইমামবৃন্দের) যে মতকে শক্তিশালী মনে করেন, তাকে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে স্বাগত। কিন্তু অনুগ্রহ করে আপনাদের থেকে ভিন্ন (ইমামবৃন্দের) মতের কাউকে বিচার করবেন না। আমাদের আলেম-উলামা আমাদেরকে শাস্ত্রীয় বিধান নির্ধারণে শিক্ষা দেন নিম্নোক্ত সুনীতি - لا إنكار في مسائل الاختلاف - এখতেলাফী মাস’আলা তথা বিরোধপূর্ণ বিষয়াদিতে (একে অপরকে) নিষেধ করতে পারবেন না (মানে হারাম ফতোয়া দিতে পারবেন না)।” [জন ইয়াহইয়া এডেরার রচিত Regarding the permissibility of music শীর্ষক অনলাইন লেখা]



আপত্তি নং ৬



হযরত আবূ ওমামা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) ফরমান: “যখন কোনো ব্যক্তি উচ্চস্বরে গান গায়, তখন আল্লাহতা’লা দুই জন ফেরেশতা পাঠিয়ে এবং তাঁদেরকে গায়কের কাঁধে বসিয়ে সে চুপ না করা পর্যন্ত নিজ নিজ পায়ের গোড়ালি দ্বারা তার বুকে আঘাত করাতে থাকেন।”



এই হাদীসে প্রমাণিত হয়, গানকে আল্লাহতা’লা পছন্দ করেন না। তাই গান-বাজনা হারাম।



জবাব



উক্ত বর্ণনা সম্পর্কে পূর্বোক্ত ‘তাখরীজাতে এরাক্বী’ শীর্ষক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে যে, এটা ইমাম ইবনে আবীদ্ দুনইয়া (رحمة الله عليه) ‘ফী জামঈ মালাহী’ শিরোনামের কিতাবে এবং ইমাম তাবারানী (رحمة الله عليه) ‘কবীর’ শীর্ষক পুস্তকে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে এ রওয়ায়াতের (বিবরণের) সনদ সহীহ/বিশুদ্ধ নয়, বরং যয়ীফ/দুর্বল; সুতরাং দলিলের অযোগ্য। [‘মজাকুল আরেফীন, ৫২-৫৯ পৃষ্ঠা]



বস্তুতঃ এই বিবরণটি উসূলে দ্বীন তথা ধর্মের ভিত্তির খেলাফ, সুতরাং গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা আল্লাহতা’লা আম্বিয়াবৃন্দ (عليهم السلام)’কে আসমানী কিতাব (ঐশীগ্রন্থ) দান করে তা দ্বারা মানুষদেরকে গুনাহ ও সওয়াবের কাজকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবহিত করেছেন। তিনি মানুষদেরকে সত্য-মিথ্যে যাচাইয়ের সামর্থ্য-ও দান করেছেন। এমতাবস্থায় পাপীকে তার পাপ কাজ থেকে সরিয়ে রাখবার জন্যে ফেরেশতা পাঠিয়ে তাকে মেরে পিটে সংশোধন করার প্রক্রিয়াটি একেবারেই অবান্তর। এতে বেহেশ্ত-দোযখ সৃষ্টির কোনো মর্মই আর থাকে না! অতএব, নবী করীম (صلى الله عليه وسلم) উসূলের পরিপন্থী এ রকম কোনো কথা বলতে পারেন বলে আমরা বিশ্বাস করি না।



এই প্রসঙ্গে মুফতী আবদুস্ সালাম ঈসাপুরী সাহেব (رحمة الله عليه) লেখেন: 



“আর যদি কোনো অতি চালাক এবং মিথ্যে হাদীস বর্ণনাকারী লোক বলে যে, আল্লাহতা’লা গায়ককে বাধা দেবার জন্যে ফেরেশতা পাঠান না বটে, কিন্তু গায়ক মহাপাপী বিধায় তাকে শরীয়ত মোতাবেক তওবা করার একটুও অবসর না দিয়ে অমনি দু জন ফেরেশতা গায়কের বুকে পদাঘাত করে আযাব করবার জন্যে পাঠিয়ে দেন, তাহলে আমরাও তাকে বলবো গায়কদেরকে প্রশ্ন করা হোক এ মর্মে যে তারা গান-বাজনা করার সময় নিজ নিজ বুকে ফেরেশতা দু জনের পদাঘাতের যন্ত্রণা কখনো অনুভব করেছে কি না? যদি তারা অনুভব করে নি বলে উত্তর দেয়, তাহলে আযাব হলো কীভাবে? অতএব, যারা এ রকম কাল্পনিক রওয়ায়াত বর্ণনা করে, তারা অন্ততঃ একবার পরীক্ষাস্বরূপ গান-বাদ্য করে দেখুক, তাদের বুকের ওপরে ফেরেশতা দু জনের পায়ের গোড়ালির আঘাত পড়ে কি না! ফেরেশতার পদাঘাত কি সহজ? হযরত জিবরীল আমীন (عليه السلام)’এর পদাঘাতে ওলট-পালট হয়ে পয়গাম্বর লূত (عليه السلام)’এর ক্বওম/জাতির দেশটি কোন্ অতলে তলিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো, তার কোনো খোঁজই পাওয়া যায় নি। গায়কের বুকে ফেরেশতা দু জনের পদাঘাত হলে তার অস্থিগুলো কি চুরমার হবে না? যদি ওই ধূর্ত লোক (অপযুক্তিস্বরূপ) বলে, না ভাঙ্গে মতো ধীরে ধীরে মারে, তাহলে আমরা বলবো, সেটা আযাব নয়, বরং পা বুলানো, ফুসলানো আদর। মোট কথা, এসব শ্রুতিকটু কথা লেখার উদ্দেশ্য হলো, ওই ধরনের মিথ্যে বর্ণনাকারীদেরকে শিক্ষা দেয়া যেনো তারা রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর নামে এ ধরনের ভুয়া, মিথ্যে কথা বলে ইসলাম ধর্মকে হাস্যকর (বস্তুতে পরিণত) না করে। বাস্তবিকপক্ষে, এ ধরনের মিথ্যে বিবরণই ‘লাহ্উল্ হাদীস’, হারাম ও শয়তানের ‘সওত’ এবং যারা এ রকম বিবরণ ও আবোল-তাবোল কথা শরীয়তের দলিলস্বরূপ পেশ করে, তারাই ‘সামেদুন’ বা গাফেল লোক।” [পুণ্যাত্মা সূফীবৃন্দের সেমা’, ৩৩-৩৫ পৃষ্ঠা]



আপত্তি নং ৭



বুখারী শরীফ হাদীসগ্রন্থে লিপিবদ্ধ একটি হাদীসে মহানবী (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ করেন:



وَقَالَ هِشَامُ بْنُ عَمَّارٍ حَدَّثَنَا صَدَقَةُ بْنُ خَالِدٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ يَزِيدَ بْنِ جَابِرٍ، حَدَّثَنَا عَطِيَّةُ بْنُ قَيْسٍ الْكِلاَبِيُّ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ غَنْمٍ الأَشْعَرِيُّ، قَالَ حَدَّثَنِي أَبُو عَامِرٍ ـ أَوْ أَبُو مَالِكٍ ـ الأَشْعَرِيُّ وَاللهِ مَا كَذَبَنِي سَمِعَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ "‏ لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الْحِرَ وَالْحَرِيرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ،



অর্থ: আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল রেশমবস্ত্র, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল/বৈধ বিবেচনা করবে...। [আল-বুখারী ৫৫৯০, বই নং ৭৪, হাদীস নং ১৬]



অতএব, গান-বাজনা শোনা হারাম।



জবাব



মার্কিনী ইসলাম প্রচারক জন ইয়াহইয়া এডেরার সাহেব তাঁর রচিত ‘Regarding the permissibility of music’ শিরোনামের অনলাইন লেখায় বলেন: এই হাদীসটি বুখারী শরীফের সহীহ সংকলনে একটি পরিচ্ছেদে معلق তথা সংযুক্তি হিসেবে উল্লেখিত, যা মদ্যপান অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত #৫৫৯০; ওর শিরোনাম ‘যারা মদ্য পান করার অনুমতি চায় সেটাকে ভিন্ন নামে অভিহিত করে।’ ইমাম বুখারী (رحمة الله عليه) তাঁর সহীহ সংকলনে এটাকে সমর্থিত হাদীস হিসেবে রাখেন নি। ইমাম আল-মুহাল্লাব (رحمة الله عليه)’এর মতানুসারে এর কারণ হলো, বর্ণনাকারী হিশাম (মূল বর্ণনাকারী) সাহাবীর নাম সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না (আল-ইবতাল আল-শওকানী, ৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। 



কতিপয় মুহাদ্দিসীন-উলামা (মানে হাদীসশাস্ত্রবিদ) এই ধরনের হাদীসের জন্যে একটি সংযুক্ত এসনাদ/পরম্পরা খুঁজে পান। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছে ইমাম ইবনে হাজর হায়সামী মক্কী (رحمة الله عليه)’এর বই - تغليق التعليق - সংযুক্তিসমূহের বদ্ধকরণ। কিছু আলেম তাঁর সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে বিতর্ক করেন বটে; কিন্তু আমরা যদি আল-বুখারী ও হিশাম বিন আম্মারের মধ্যে যোগসূত্র-সংক্রান্ত তাঁর গবেষণাকে মেনেও নেই, তথাপিও প্রখ্যাত মুহাদ্দেসীন উলামাবৃন্দের কাছে রাবী/বর্ণনাকারী হিসেবে হিশামের ব্যাপারে সমস্যা বিরাজমান।



এই হাদীসটি নিয়ে অনেক আপত্তি রয়েছে। ইমাম আল-তাহাবী (رحمة الله عليه)’এর প্রণীত বিখ্যাত ৪-খণ্ডের দুর্বল হাদীসের সংকলনগ্রন্থ ‘মীযান আল-এ’তেদা’ল।’ তাতে তিনি উল্লেখ করেন যে হিশাম বিন আম্মার বিশ্বাসভাজন বর্ণনাকারী ছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি পরিবর্তিত হন। তিনি এমন ৪০০টি হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার কোনো ভিত্তি-ই নেই। কেউ পয়সা না দিলে তিনি বর্ণনা করতেন না। তাঁর বিরুদ্ধে লিপি পরিবর্তন করার অভিযোগও উঠেছে। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رحمة الله عليه) বলেন তিনি দায়িত্বহীন ছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন যে হিশাম দাবি করতেন ক্বুরআন মজীদে জিবরীল (আলাইহিস্ সালাম) ও রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর বাণী বিদ্যমান এবং সেটা (মানে ক্বুরআন) সৃষ্ট।



ইমাম ইবনে হাজর হায়সামী (رحمة الله عليه) এই বিষয়টি স্বীকার করেন, কিন্তু হাদীসটি সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করতে হিশাম ভিন্ন অন্য একজনের বর্ণনা আনেন। ওই বর্ণনাটির শব্দচয়নে পার্থক্য বিদ্যমান, তবে তাতে সেসব মানুষের উল্লেখ রযেছে যারা বাদ্যযন্ত্রকে বৈধ জ্ঞান করে (যা ভাষাগত ও যৌক্তিকভাবে এ কথা বোঝায় না যে তা হারাম/নিষিদ্ধ)। এর পরের সমস্যা, যা ইমাম ইবনে হাজর (رحمة الله عليه)’এর বইয়ে সমাধান দেয়া হয়নি, তা হচ্ছে আতিয়্যাহ বিন ক্বায়স নামের এক বর্ণনাকারী।



আতিয়্যাহ বিন ক্বায়স একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন, যাঁর চরিত্র ও সততার (عدالة) ব্যাপারে মুহাদ্দেসীনবৃন্দ একমত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্মরণশক্তি ও বর্ণনার (ضبط) ব্যাপারে কিছু উলামা আপত্তি করেন। কিছু উলামা তাঁকে বিশ্বস্ত বলেছিলেন স্রেফ তাঁরই ধার্মিকতার প্রসিদ্ধির কারণে, কিন্তু হাদীসশাস্ত্রে তাঁর পারদর্শিতা/উপযুক্ততা অজ্ঞাত (مجهول)। কেউ কেউ বলেছেন তিনি গ্রহণযোগ্য (সহীহ হওয়া থেকে বহু দূরে) হলেও তাঁর থেকে রওয়ায়াত/বিবরণ নেয়ার বেলায় সতর্ক হতে হবে। এ কথা হাদীসশাস্ত্রবিদ ইমাম আবূ হাতেম আল-রাযী নিজ ‘আল-জারহু ওয়াল-তা’দীল’ ২:৩৭ পুস্তকে এবং ইমাম আবূ বকর আল-বাযযার (رحمة الله عليه) তাঁর ‘কাশফ আল-আসতার’ ১:১০৬ গ্রন্থে উল্লেখ করেন। [জন ইয়াহইয়া এডেরার সাহেব রচিত ‘Regarding the permissibility of music’ লেখাটির উদ্ধৃতি সমাপ্ত]



ইকরাম হাওরামানী সাহেব নিজস্ব Hawramani-ডট-কম ওয়েবসাইটে ‘সঙ্গীত শ্রবণ জায়েয’ শিরোনামের প্রশ্ন-উত্তরে দুটো ডায়াগ্রাম/রেখাচিত্র উপস্থাপন করে বলেন, “কোনো হাদীসকে সন্দেহাতীতভাবে সহীহ প্রমাণের জন্যে সেটাকে দুটো মূল উৎস হতে আসতে হবে। যেমন -  



কিন্তু আল-বুখারী আমাদের কাছে এসেছে নিম্নের রেখাচিত্র অনুসারে, যা’তে লাল চিহ্নগুলো দ্বারা বিচ্ছিন্ন বর্ণনাকারীদের দেখানো হয়েছে। এই ডায়াগ্রাম আরো বড় হতো, কেননা ১২০ জন বর্ণনাকারীর হদিস এখানে নেই। স্রেফ ৬ জন বর্ণনাকারী এই বিবরণে বিদ্যমান। দেখুন -                  



    

যখন হদিসহীন বর্ণনাকারীর সংখ্যা অস্তিত্বশীল বর্ণনাকারীদের চেয়ে ঢের বেশি হয়, তখন ওই হাদীসের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার শক্তিশালী কারণ দেখা দেয়। [ইকরাম হাওরামানি, Listening to music is permissible in Islam শীর্ষক লেখা]



রেশমের বস্ত্রসম্পর্কিত হাদীসটি ইমাম আবূ দাউদ-ও (رحمة الله عليه) তাঁর ‘সুনান’ পুস্তকে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাতে তিনি বুখারী শরীফের বিভিন্ন সংস্করণে ভুলভাবে উদ্ধৃত ‘আল-হার্র’ শব্দটির সঠিক রূপ ‘আল-খায্’ উদ্ধৃত করে সংশোধন করেন। প্রাচীন আরবী লিপিতে দুটো শব্দ একদম একই রকম দেখতে (আল-হাওরামানী, ‘সঙ্গীত শ্রবণ বৈধ’ শীর্ষক অনলাইন প্রশ্নোত্তর)। হাদীসটির আরবী এবারত নিচে দেয়া হলো:



حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَهَّابِ بْنُ نَجْدَةَ، حَدَّثَنَا بِشْرُ بْنُ بَكْرٍ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ يَزِيدَ بْنِ جَابِرٍ، حَدَّثَنَا عَطِيَّةُ بْنُ قَيْسٍ، قَالَ سَمِعْتُ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ غَنْمٍ الأَشْعَرِيَّ، قَالَ حَدَّثَنِي أَبُو عَامِرٍ، أَوْ أَبُو مَالِكٍ ء وَاللهِ يَمِينٌ أُخْرَى مَا كَذَبَنِي ء أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏"‏ لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الْخَزَّ وَالْحَرِيرَ ‏"‏.



অর্থ: আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল الْخَزَّ (আল-খায্ বস্ত্র) ও রেশমকে হালাল/বৈধ করে নেবে...। [সুনানে আবী দাউদ, ৪০৩৯, বই নং ৩৪, হাদীস নং ২০]



অতঃপর ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله عليه) বলেন:



 قَالَ أَبُو دَاوُدَ وَعِشْرُونَ نَفْسًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَوْ أَكْثَرُ لَبِسُوا الْخَزَّ مِنْهُمْ أَنَسٌ وَالْبَرَاءُ بْنُ عَازِبٍ ‏.



অর্থ: রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর সাহাবায়ে কেরামের (রা:) মাঝে বিশ জনেরও অধিক সাহাবা (রা:) আল-খায্ পরিধান করতেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন সর্ব-হযরত আনাস ও বারা’আ বিন আযিব (رضي الله عنهما)। [প্রাগুক্ত সুনানে আবী দাউদ, ৪০৩৯, বই নং ৩৪, হাদীস নং ২০]



ইকরাম হাওরামানী সাহেব তাঁর Listening to music is permissible in Islam শীর্ষক লেখায় (Hawramani-ডট-কম সাইট দ্রষ্টব্য) লেখেন, “এতে এ বিষয়টি সুদৃঢ় হয় যে আলোচ্য হাদীসটি বানোয়াট; কেননা সাহাবাবৃন্দ (রা:) হতে প্রমাণিত হয় যে ওই বস্ত্রটি ( তথা আল-খায্) হালাল, যার বিপরীতে বুখারী শরীফে বলা হয়েছে পথভ্রষ্ট মুসলমানবর্গ তা পরিধান করবে। অতএব, এতোগুলো সহীহ (মজবুত এসনাদের) হাদীসে যেখানে সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রকে বৈধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেখানে এই সন্দেহজনক বিবরণকে তর্কের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যায় না।” [ইকরাম হাওরামানী, Listening to music is permissible in Islam]



আপত্তি নং ৮



আজকাল বহু ‘দরবারে’ নারী-পুরুষ একত্রে বসে সেমা’ শোনে। তারা বলে এটা বৈধ। অথচ নারী-পুরুষ একত্রে সমবেত হওয়াটা শরীয়তমতে হারাম। সুতরাং এভাবে সেমা’ শোনা হারাম।



জবাব



হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه), সুলতানুল আরেফীন শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাহওয়ার্দী (رحمة الله عليه) প্রমুখ সূফী সাধক তাঁদের বইপত্রে সেমা’র শর্তগুলো বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। সে সব শর্তের একটি হলো, সেমা’র মজলিশে কোনো নারী থাকতে পারবে না। শর্তের খেলাফ হলে মাহফিল বৈধ হবে না, বরং রং-তামাশার মেলা হয়ে যাবে। তবে কোনো ব্যক্তি-বিশেষের জন্যে তো ঢালাওভাবে সব মাহফিল হারাম হতে পারে না।



এই প্রসঙ্গে মার্কিন নও-মুসলিম ও ইসলাম প্রচারক জন ইয়াহইয়া এডেরার সাহেব নিজ ‘Regarding the permissibility of music’ (ইসলামে সঙ্গীতের বৈধতা) শীর্ষক অনলাইন লেখায় একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দেন:



ليكونن في هذه الأمة خسف، وقذف، ومسخ، وذلك إذا شربوا الخمور، واتخذوا القينات، وضربوا بالمعازف.



অর্থ: এই উম্মতের ধ্বংস ও অপমান নেমে আসবে যখন তারা মদ্যপান করবে এবং সঙ্গীত ও দফ-বাদ্য শ্রবণ করবে (নারীদের দ্বারা)। [ইমাম সৈয়ূতী কৃত ‘জামেউস্ সগীর’, ৭৭২০]



অতঃপর এডেরার সাহেব লেখেন: “যে কোনো সাধারণ শিক্ষিত মানুষও দেখতে পাবেন যে এখানে ব্যক্ত ভাষাগত অর্থ কোনোভাবেই সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ করে না, বরঞ্চ ‘পার্টি-দৃশ্য’ তথা রং-তামাশার মেলাকে নিষেধ করে।...মদ ও (নারীসহ) সঙ্গীতের সমন্বয় লজ্জাদায়ক ও অনৈতিক একটি বিষয়। এ ব্যাপারে ইমামবৃন্দের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত।” [জন ইয়াহইয়া এডেরার, ‘Regarding the permissibility of music’ (ইসলামে সঙ্গীতের বৈধতা)]



আপত্তি নং ৯



আমরা বিশ্বাস করি, সূফী-দরবেশবৃন্দের সেমা’ স্রেফ তাঁদেরই জন্যে জায়েয ও মোস্তাহাব। কিন্তু এ জমানায় এটা জায়েয নয়। কারণ ফতোয়া-এ-শা’মী গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে যে হযরত জুনায়দ বাগদাদী (رحمة الله عليه) তাঁর জমানায় সেমা’র শর্ত খুঁজে পান নি। তাই তিনি সেমা’র মজলিশে যেতেন না। হযরত জুনায়দ বাগদাদী (رحمة الله عليه)’এর যুগেই যদি শর্ত পূরণ না হয়, তাহলে বর্তমানকালে তো সেমা’ একেবারেই হারাম/নিষিদ্ধ।



জবাব



[এ জবাবটি আমার পীর ও মুর্শীদ সৈয়দ মওলানা এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব ক্বেবলা (رحمة الله عليه) ডিক্টেশান দিয়েছিলেন আর আমি লিখেছিলাম, যা পরে ‘ফায়সালা’ স্মরণিকায় ছাপানো হয়েছিলো]



প্রথমতঃ উপরোক্ত অভিমত পোষণকারীরা এ সত্যটি অস্বীকার করেছেন যে আহলে সেমা’ তথা সেমা’কারী সূফী-দরবেশমণ্ডলীর ফয়েয-বরকত এখনো জারি আছে। অর্থাৎ, তাঁরা বলতে চেয়েছেন সেমা’কারী সূফী-দরবেশমণ্ডলী এখন আর দুনিয়ায় নেই। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত মত। দ্বিতীয়তঃ সেমা’ জমানা বা যুগ দ্বারা বিবেচ্য নয়। যদি সেমা’র শর্ত পূরণ করা যায়, তাহলে তা জায়েয। হযরত জুনায়দ বাগদাদী (رحمة الله عليه) তাঁর যুগে সেই মুহূর্তে কতিপয় লোকের কারণে শর্তগুলো খুঁজে পান নি। তাই তিনি সেমা’র মজলিশে বসেন নি। কিন্তু তিনি সেমা’কে এনকার তথা নিষেধ বা অবজ্ঞা করেন নি। এ কথাও তিনি বলেন নি, “আমি সেমা’কে এখন থেকে হারাম জানলাম।” শুধুমাত্র কিছু লোকের জন্যেই তিনি সেমা’র মজলিসে বসেন নি। সে সব লোকের অবস্থার দৃষ্টান্ত হলো ওই ব্যক্তির মতো, যার পেটের পীড়া হয়েছে। পীড়ার কারণে সেই ব্যক্তির পক্ষে মাছ, গোস্ত খাওয়া একেবারেই অনুচিৎ। কিন্তু সুস্থতার পর সে আবারো মাছ, গোস্ত খেতে পারবে। পেটের অসুস্থতাটি শুধু তারই হাল বা অবস্থা মাত্র। অথচ অন্যান্য যারা সুস্থ, তাদের জন্যে একই অবস্থা প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ, তারা মাছ-গোস্ত অবাধে খেতে পারবে। অনুরূপভাবে, পূর্বোক্ত কতিপয় লোকের সেমা’ শ্রবণের অযোগ্যতার কারণেই হযরত জুনায়দ বাগদাদী (رحمة الله عليه) সেমা’র মজলিসে বসেন নি। কিন্তু তাঁর পরবর্তী যুগের সুলতানুল আরেফীন হযরত শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمة الله عليه), সুলতানুল হিন্দ্ হযরত খাজা মুঈনউদ্দীন চিশ্তী (رحمة الله عليه) এবং আরো অগণিত আহলে সেমা’ পীর-মাশায়েখবৃন্দ সেমা’র মজলিশে নিয়মিত বসতেন। এ ব্যাপারে তাঁরা অসংখ্য বইপত্র লিখে সেমা’র শর্তগুলো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউই জমানাকে সেমা’র শর্তস্বরূপ উল্লেখ করেন নি।



আপত্তি নং ১০



সূফী-দরবেশমণ্ডলীর আরোপিত শর্তগুলোর মধ্যে একটি হলো, গানের কথার দিকে মনোনিবিষ্ট হতে হবে এবং সেই মজলিশে কোনো দুনিয়াদার বা দুনিয়ার মোহাচ্ছন্ন লোক থাকতে পারবে না। অর্থাৎ, সেমা’র মজলিশে দুনিয়ার চিন্তা করা যাবে না। কিন্তু আজকাল বহু ‘দরবারে’ আমলে ফাসিক্ব (তথা বদকার) লোকেরা সেমা’র মজলিসে বসে। ওই শর্তের খেলাফ/বিরোধী হওয়ার কারণে সেমা’র মজলিশ হারাম হয়ে যাচ্ছে।



জবাব 



আহলে সেমা’ বা সেমা’পন্থী সূফী-দরবেশমণ্ডলীর তরীক্বতের অনুসারী ফাসিক্ব/পাপী লোকেরা তাঁদের পীর সাহেবানের উপস্থিতিতে সেমা’র মজলিশে বসেন। পীর সাহেব সেমা’র মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে আল্লাহতা’লা, তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم) ও আউলিয়া কেরামের (رحمة الله عليهم) মহব্বত্ বৃদ্ধির রূহানী ওষুধ দান করেন। ফলে আমলে ফাসিক্ব লোকেরা অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের পরশ অনুভব করেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে অনেকে ওলী-আউলিয়ার স্তরে পৌঁছেছেন। বস্তুতঃ কেউই রাতারাতি সেমা’র উপযুক্ত শ্রোতা হতে পারেন না। অতএব, এক্ষেত্রে ভুল বোঝার অবকাশ নেই। আর যদি কেউ বলে, সেমা’য় মনোনিবেশ না করতে পারলে সেমা’ শোনা হারাম, তাহলে আমরাও একটি উদাহরণ এখানে পেশ করবো। দেখুন, হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) নামায পড়তেন গভীর মনোযোগ সহকারে। ফলে একবার তাঁর পায়ে যখন বর্শা বিঁধেছিলো, তখন নামাযের মধ্যেই তা সরানো সম্ভব হয়েছিলো; অন্য সময় ব্যথা অনুভূত হওয়ার দরুন তা সম্ভব হয় নি। কিন্তু নামাযে তিনি খোদার সাথে মে’রাজে থাকায় ব্যথা অনুভব করেন নি। কিন্তু আজকাল যাঁরা নামায পড়েন, তাঁদের অনেকেই আল্লাহর দিকে সেভাবে মোতাওয়াজ্জুহ্ তথা মনোনিবিষ্ট হতে পারেন কি? দুনিয়ার লেনদেন ও ধান্ধা চিন্তাকে গ্রাস করে থাকে। এমতাবস্থায় সওয়াবের পরিবর্তে গুণাহ হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে বেশি। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁদেরকে নামায থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করাটা বৈধ হবে কি? যদি কেউ দাবি করে, সেটা তো নামায যা শরীয়তের আদেশ, তাহলে আমরা জবাবে বলবো, এটা আমরা উদাহরণস্বরূপ পেশ করেছি। একদিনে নামাযে মোতাওয়াজ্জুহ তথা মনোনিবিষ্ট হওয়াটা যেমন অসম্ভব, তেমনি সেমা’র মজলিশের মতো তরীক্বতের সাধনায়ও এক দিনে একাগ্রচিত্ত হওয়াটা অসম্ভব। এটা ধীরে ধীরে অর্জিত হয়।



আপত্তি নং ১১



হযরত আয়েশাহ (رضي الله عنها)’এর ঘরে ঈদের দিনে রাসূলে আকরাম (صلى الله عليه وسلم) কর্তৃক দু জন বালিকার দফ সহকারে গাওয়া বুয়াস্ যুদ্ধের বীরত্বগাথা শ্রবণ সেমা’কে বৈধ প্রমাণ করে না। কেননা, তারা বালিকা ছিলো। তাদের এ কাজটি ছিলো ঈদের দিনের ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের শিশুসুলভ আমোদ-প্রমোদ। এতে ব্যাপকভাবে সেমা’ মোবাহ/বৈধ হওয়া প্রমাণিত হয় না। তাছাড়া, সেমা’ বা গান বলতে আমরা যা বুঝি, এটা তা ছিলো না। বরং এটা ছিলো বুয়াস্ জ্বেহাদের বীরত্বগাথা।



জবাব



বুখারী ও মুসলিম শরীফের এ হাদীসটাই প্রমাণ করে যে সেমা’ মূলতঃ বৈধ। কে বা কারা সেমা’ করেছে তা এখানে অগ্রগণ্য বিষয় নয়, বরং কী গাওয়া হয়েছে তা-ই মুখ্য বিবেচ্য বিষয়। আনসারবৃন্দের (رضي الله عنهم) প্রতি সম্মানসূচক সঙ্গীত বাদ্যসহ উক্ত দু জন তরুণী পরিবেশন করেছিলেন। আর রাসূলুল্লাহ-ও (صلى الله عليه وسلم) তাতে বাদ সাধেন নি। তাই এতে পরিস্ফুট হয়েছে যে বুযূর্গানে দ্বীনের মান-মর্যাদা প্রকাশক গান-বাজনা শর্তসাপেক্ষে শরীয়তে জায়েয/বৈধ। আর বৈধতার জন্যে তো কোনো দিন-তারিখ প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া, অন্যান্য রওয়ায়াত/বিবরণে এ ধরনের গান-বাজনা ঈদের দিনেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। যথা - 



عن عمرو بن شعيب عن أبيه وعن جده أن امرأة قالت يا رسول الله إني نذرت أن أضرب على رأسك بالدف قال أوفي بنذرك.



অর্থ: একবার জনৈকা মহিলা আরয করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (صلى الله عليه وسلم), আমি নযর/মানত করেছি যেনো আপনার সামনে দফ (বাদ্য) বাজাতে পারি।” এমতাবস্থায় মহানবী (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ করেন, “তুমি তোমার মানত পূর্ণ করো।” হাদীসটি সর্ব-ইমাম আহমদ, তিরমিযী ও বায়হাক্বী (رحمة الله عليهم) বর্ণনা করেছেন। অপর বর্ণনায় এসেছে ওই মহিলা গান পরিবেশনেরও মানত করেছিলেন [প্রামাণ্য দলিল নং ২ দ্রষ্টব্য]। লক্ষণীয় যে, এ ক্ষেত্রে সেমা’কারিনী একজন নারী। আর দিনটিও ঈদের দিন ছিলো না। আরো লক্ষণীয় যে, কোনো হারাম কাজে মানত করলে তা পূর্ণ করা শরীয়তে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। যথা - কেউ সহি-সালামতে হজ্জ্ব পালনের উদ্দেশ্যে কুকুর দ্বারা মেজবান খাওয়ানোর মানত করলে তা হারাম। অথচ শরীয়তের বিধানদাতা নবী করীম (صلى الله عليه وسلم) ওই নারীকে মানত পূর্ণ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় সেমা’ মূলতঃ বৈধ। তবে হ্যাঁ, যেনা বা যৌনতার দিকে আকর্ষণকারী গান-বাজনা সেটার কু-নিয়্যত তথা মন্দ উদ্দেশ্যের কারণে অবশ্যই হারাম হয়ে যাবে।



আপত্তি নং ১২



সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত দু জন বালিকার কাছ থেকে ঈদের দিনে নবী করীম (صلى الله عليه وسلم) কর্তৃক গান (غناء) শ্রবণের কথাটি প্রকৃতপক্ষে সত্য নয়। আসলে তিনি বালিকাদের কাছে বয়াত পাঠ শুনেছিলেন। কেননা, মুসলিম শরীফে অপর এক বর্ণনায় হযরত আয়েশাহ (رضي الله عنها) বলেন - ليستا بمغنيتين - ‘মেয়ে দু জন গায়িকা ছিলো না।’ অতএব, হাদীস শরীফে রূপকার্থে (مجازى) বয়াত পাঠকেই গান (غناء) আখ্যায়িত করা হয়েছে। বয়াত পাঠ ও গান দুটো ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। গান হারাম হওয়া সম্বলিত হাদীসসমূহে ব্যবহৃত غناء শব্দটির অর্থ গান। আর হুজূর পাক (صلى الله عليه وسلم) ও সাহাবা কেরামের (رضي الله عنهم) শানে ব্যবহৃত غناء (গান) শব্দটির অর্থ আরবী লাহানে ক্বুরআন তেলাওয়াত বা বয়াত পাঠ। 



জবাব



সেমা’বিরোধীদের এই অপযুক্তি খণ্ডন করার আগে সহীহ বুখারী শরীফের আলোচ্য সেই হাদীসটি পেশ করা দরকার। হাদীসের বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপ: হযরত আয়েশাহ (رضي الله عنها) হতে বর্ণিত; এক ঈদের দিনে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي الله عنه) হযরত আয়েশাহ (رضي الله عنها)’এর ঘরে প্রবেশ করেন। সেই সময় দু জন তরুণী দফ বাজাচ্ছিলেন। অপর এক বর্ণনায় এসেছে - তাঁরা বুয়াস্ জ্বেহাদে আনসার সাহাবা (رضي الله عنهم)’বৃন্দের বীরত্বগাথা গেয়ে শুনাচ্ছিলেন। আর প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) কাপড় দ্বারা তাঁর পবিত্র মুখ ঢেকে শুয়েছিলেন। অতঃপর হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) তরুণীদেরকে তিরস্কার করেন। এমতাবস্থায় হুজূর পূর নূর (صلى الله عليه وسلم) তাঁর চেহারা মোবারক হতে চাদর সরিয়ে বলেন, “হে আবূ বকর, ওদেরকে ছেড়ে দাও (অর্থাৎ, গান-বাজনা করতে দাও)। আজ ঈদের দিন।” অপর এক বর্ণনায় এসেছে - “নিশ্চয় প্রত্যেক জাতির জন্যে ঈদ উৎসব আছে; এটা আমাদের ঈদ।” [প্রামাণ্য দলিল নং ১ দ্রষ্টব্য]



উপরোক্ত হাদীসে ব্যবহৃত ‘গান’ (غناء) শব্দটিকে আমরা বয়াত পাঠ হিসেবে কোনোক্রমেই ধরে নিতে পারি না। কেননা, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) হাদীসটির কোথাও হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي الله عنه)’কে বলেন নি এটা গান নয় বরং বয়াত পাঠ। অতএব, তরুণীদের غناء বা গান-বাজনাকে আমরা মাজাযী তথা রূপকভাবে গ্রহণ করতে পারি না। তাছাড়া, হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) গান ও বয়াত পাঠের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন নি মর্মে কথাটাও আমরা গ্রহণ করতে পারি না। সর্বোপরি, তরুণীদের দ্বারা দফ-বাদ্য সহকারে গান করার মধ্যেই চূড়ান্ত ফায়সালা নিহিত রয়েছে। দফ বা ঢোল-জাতীয় বাদ্য তাল ও লয় সৃষ্টি করে। আর তাল, লয় ইত্যাদি দ্বারাই তো গানের সৃষ্টি। অতএব, প্রমাণিত হয়ে গেলো যে হাদীস শরীফে বর্ণিত غناء বা গান হাক্কীক্বী বা প্রকৃত অর্থেই গান ছিলো। এ কারণেই হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (رضي الله عنه) প্রথমাবস্থায় তরুণী দু জনকে বাধা দিয়েছিলেন। 



হযরত আয়েশাহ (رضي الله عنها) সহীহ মুসলিম শরীফে বলেছিলেন যে তরুণী দু জন গায়িকা ছিলেন না (ليستا بمغنيتين)। অর্থাৎ, তাঁরা (জাহেলীয়্যা যুগের) পেশাদার গায়িকা ছিলেন না। পেশাদার গায়িকারা সেই জমানায় গান-বাজনা করে লোকদেরকে যেনা/যৌনতার কুমন্ত্রণা দিতো। তাই হযরত আয়েশাহ (رضي الله عنها) ওই কথা বলে সবাইকে জানিয়ে দেন যে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) পেশাদার গায়িকার গান শোনেন নি, বরং সেমা’ শুনেছেন। আলোচ্য বর্ণনাসমূহে আরো প্রতীয়মান হয় যে, পেশাদার গায়ক-গায়িকাদের যৌন উত্তেজক গান ভিন্ন অপর এক শ্রেণির গান-বাজনাও জগতে বিরাজমান। এটাকেই সূফী-দরবেশমণ্ডলী সেমা’ আখ্যায়িত করেছেন। আমরা এ শ্রেণির সেমা’কেই বৈধ প্রমাণ করতে সচেষ্ট। আল্লাহতা’লা সবাইকে সহি-সমঝ দান করুন, আমীন।



আপত্তি নং ১৩



সেমা’ সন্দেহজনক বস্তু। আমাদের নবী করীম (صلى الله عليه وسلم) একটি হাদীস শরীফে বলেন, যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বস্তু হতে নিজেকে রক্ষা করে, সে ইজ্জত ও ধর্মকে রক্ষা করে। শরীয়তের আলেম-উলামার মধ্যে সেমা’র ব্যাপারে এখতেলাফ বা মতভেদ থাকায় বোঝা যায় যে, সেমা’ সন্দেহজনক বস্তু। অতএব, এর থেকে দূরে সরে থাকা অপরিহার্য।



জবাব



শরীয়ত ও তরীক্বতের হক্কানী আলেম-উলামার মধ্যে সেমা’ সম্পর্কে কোনো মতপার্থক্য নেই। হক্কানী আলেমবৃন্দের অনেকেই সেমা’র প্রবক্তা (ক্বায়েল), আর বাকি আলেম-উলামা পালন না করলেও এটাকে এনকার তথা নিষেধ করেন নি। কেননা ইমামমণ্ডলীর মাঝে জারি রয়েছে নিম্নোক্ত সুনীতি - لا إنكار في مسائل الاختلاف - অর্থাৎ, বিভিন্ন এখতেলাফী মাসআলায় (তথা বিতর্কের বিষয়াদিতে) একে অপরকে নিষেধ করা চলবে না; হারাম ফতোয়া দেয়া যাবে না। এই যখন অবস্থা, তখন হক্কানী-রব্বানী আলেম-উলামার পবিত্র নামগুলোর দিকে লক্ষ্য করুন: সেমা’র ক্বায়েল/প্রবক্তা হলেন সর্ব-হযরত গরীবে নওয়াজ খাজা মুঈনউদ্দীন চিশ্তী, হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী, শায়খ মহিউদ্দীন ইবনে আরবী, সুলতানুল আরেফীন শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী, মৌলানা জালালউদ্দীন রূমী, শায়খ আহমদ কবীর রেফাঈ প্রমুখ বুযূর্গানে দ্বীন (رحمة الله عليهم)। অপর দিকে, নিজেরা পালন করেন নি কিন্তু এনকারও করেন নি এমন বুযূর্গানে দ্বীন হলেন সর্ব-হযরত গাউসুল আযম শায়খ মহিউদ্দীন আবদুল ক্বাদের জিলানী, মোজাদ্দিদে আলফে সানী, বাহাউদ্দীন নক্বশবন্দ আল-বুখারী প্রমুখ (رحمة الله عليهم)। এঁরা সবাই আমাদের রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর ওয়ারিস্ বা উত্তরাধিকারী। অতএব, সেমা’ বাতিলপন্থীদের আবিষ্কৃত কোনো সন্দেহজনক বস্তু নয় যে তা পরিত্যাজ্য হবে!  



আপত্তি নং ১৪



সেমা’পন্থীরা দাবি করে, সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) যিনি ‘লাহ্উল হাদীস’ শব্দের অর্থ গান বলেছিলেন, তিনি নিজেই গান শুনেছেন। আসলে তিনি গান শোনেন নি, বরং বয়াত পাঠ শুনেছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)’কে ‘রইসুল মুফাস্সেরীন’ (তাফসীরবিদ প্রধান) বলা হয়। সেমা’পন্থী ফকিরবর্গ ‘লাহ্উল হাদীস’-এর মনগড়া ব্যাখ্যা করে কখনো আভিধানিক অর্থ বলে, কখনো বৈজ্ঞানিক যুক্তির অবতারণা করে। ‘সালাত’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘দুআ’; আর পারিভাষিক অর্থ নির্দিষ্ট রোকনসমূহ। এখন যদি কেউ দুআ’ করে, তবে কি তার নামায আদায় হবে? তাফসীর করতে অভিধানসহ ১৫টি এলম/জ্ঞানের প্রয়োজন। অজ্ঞ সেমা’পন্থী ফকিরদের মনোক্তি থেকে সাবধান।



জবাব



হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) গানকে জায়েয জানতেন। কেননা তিনি নিচের এই সহীহ হাদীসটির বর্ণনাকারী। যথা - 



عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ أَنْكَحَتْ عَائِشَةُ ذَاتَ قَرَابَةٍ لَهَا مِنْ الْأَنْصَارِ فَجَاءَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ أَهْدَيْتُمْ الْفَتَاةَ قَالُوا نَعَمْ قَالَ أَرْسَلْتُمْ مَعَهَا مَنْ يُغَنِّي قَالَتْ لَا فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ الْأَنْصَارَ قَوْمٌ فِيهِمْ غَزَلٌ فَلَوْ بَعَثْتُمْ مَعَهَا مَنْ يَقُولُ أَتَيْنَاكُمْ أَتَيْنَاكُمْ فَحَيَّانَا وَحَيَّاكُمْ



অর্থ: হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; একবার হযরত মা আয়েশাহ (رضي الله عنها) এক আত্মীয়াকে জনৈক আনসারের সাথে বিয়ে দেন। প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) এসে জিজ্ঞেস করেন, “নববধূকে কি তোমরা স্বামীগৃহে পাঠিয়ে দিয়েছো?” তাঁরা উত্তর দেন, “জি।” তিনি জিজ্ঞেস করেন, “গান গাইতে এমন কাউকে কি তার সাথে পাঠিয়েছো?” মা আয়েশা (رضي الله عنها) উত্তর দেন, “না।” অতঃপর রাসূল (صلى الله عليه وسلم) বলেন, “আনসার এমন এক জাতি যারা সঙ্গীত ভালোবাসে। তোমাদের উচিৎ ছিলো নববধূর সাথে গান গাইতে পারে এমন কাউকে পাঠানো, যে বরের বাড়িতে গিয়ে গাইতো - আমরা এসেছি, আমরা এসেছি, খোদা আমাদের ও আপনাদের হায়াত দান করুন, (তাঁর শান্তি বর্ষণ করুন)।” [সুনানে ইবনে মাজাহ, বই নং ৯, হাদীস নং ১৯৭৫]



হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণিত উপরোক্ত হাদীস শরীফে ‘গান’ বলতে গানকেই বোঝানো হয়েছে, যা আমরা ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছি (১২ নং আপত্তির জবাব)। অতএব, এই মহান সাহাবী (رضي الله عنه) ‘লাহ্উল হাদীস’ শব্দটির তাফসীরে সব ধরনের গানকে বুঝিয়েছেন বলে সেমা’বিরোধীদের দাবিটি আমরা মেনে নিতে পারছি না।



আপত্তি নং ১৫



حَدَّثَنَا مُسْلِمُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، قَالَ حَدَّثَنَا سَلاَّمُ بْنُ مِسْكِينٍ، عَنْ شَيْخٍ، شَهِدَ أَبَا وَائِلٍ فِي وَلِيمَةٍ فَجَعَلُوا يَلْعَبُونَ يَتَلَعَّبُونَ يُغَنُّونَ فَحَلَّ أَبُو وَائِلٍ حَبْوَتَهُ وَقَالَ سَمِعْتُ عَبْدَ اللهِ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ "‏ الْغِنَاءُ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِي الْقَلْبِ ‏"‏ ‏.‏



অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) এরশাদ করেন: “সঙ্গীত অন্তরে মোনাফেক্বী/কপটতার জন্ম দেয়।” [সুনানে আবী দাউদ, ৪৯২৭, বই নং ৪৩, হাদীস নং ১৫৫]



এই হাদীসে প্রমাণিত হয় গান-বাজনা হারাম।



জবাব



উপরোক্ত হাদীস ও অনুরূপ বিবরণগুলো যয়ীফ নয়তো অ-সহীহ। এমন কী সালাফী গুরু শায়খ আলবানীও এটাকে যয়ীফ (দুর্বল সনদের) রওয়ায়াত বা বর্ণনা হিসেবে শ্রেণিকরণ করেছেন [অনলাইন Sunnah-ডট-কম, কিতাবুল আদব (৪৩), বাবু কারা’হিয়াতিল্ গেনা’য়ি ওয়ায্ যামরে অধ্যায় ৬০]। একই ধরনের আরেকটি বর্ণনায় এসেছে:



الْغِنَاءُ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِي الْقَلْبِ كَمَا يُنْبِتُ الْمَاءُ الْبَقْلَ



এ সম্পর্কে ইমাম নববী (رحمة الله عليه) বলেন - قَالَ النَّوَوِيُّ: لَا يَصِحُّ - ‘এটা সহীহ নয়।’ ইমাম ইবনে ক্বুদামা (رحمة الله عليه) বলেন - وَقَالَ ابْنُ قُدَامَةَ فِي الْمُغْنِي: الصَّحِيحُ أَنَّهُ مِنْ قَوْلِ ابْنِ مَسْعُودٍ - ‘এটা হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه)’এর বাণী (যা হাদীস নয়)’ [দেখুন অনলাইন ‘ইসলাম ওয়েব’-ডট-নেট]। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه)-ও এগুলোকে অ-সহীহ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, “আমরা সঙ্গীত সম্পর্কে গবেষণা করে জেনেছি সেটা মূলতঃ হারাম হওয়ার কোনো দলিল ক্বুরআন, হাদীস, এজমা’ ও ক্বেয়াসে পাওয়া যায় না।” [এহইয়াও উলূম, ২য় খণ্ড, ২৫২ পৃষ্ঠা, ৩ নং টীকা]। 



সহীহ মুসলিম শরীফের টীকায় লেখা হয়েছে: 



ذهب الإمام إبن حزم إلى إباحة الغناء والملاهي وقال لم يصح في تحريمها



অর্থ: ইমাম ইবনে হাযম আন্দালূসী (رحمة الله عليه) সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রকে মোবাহ (বৈধ) বলে মত প্রকাশ করেন এবং বলেন এ দুটোকে হারাম প্রমাণ করার পক্ষে কোনো সহীহ হাদীস বিদ্যমান নেই। [এমাজন-ডট-কম থেকে তাঁর এতদসংক্রান্ত বইটি অর্ডার দিতে যাচ্ছি - লেখক] 



সেমা’বিরোধীদের প্রদর্শিত হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه)’এর ক্বওল বা বাণী অনুসারে গান-বাজনা দ্বারা অন্তরে কপটতা জন্মানোর কথা সত্য হিসেবে ধরে নিলেও মূল গান-বাজনার এবাহত তথা বৈধতা এতে খর্ব হয় না। কেননা, ধনসম্পত্তি আহরণ, গাড়ি হাঁকানো, মূল্যবান বস্ত্র পরিধান ইত্যাদি দ্বারাও অন্তরে কপটতা হয়তো জন্মাতে পারে। তাই বলে ওগুলোর মৌলিক বৈধতা নষ্ট হয়নি। একইভাবে, গান-বাজনার এবাহত উপরোক্ত বিবরণগুলোতে খর্ব করা হয়নি।



আপত্তি নং ১৬



عن نافع أنه قال كنت مع ابن عمر رضي الله عنه في طريق فسمع زمارة راع فوضع اصبعيه في اذنيه ثم عدل عن الطريق فلم يزل يقول يا نافع أتسمع ذلك حتى قلت لا فأخرج أصبعيه وقال هكذا رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم صنع.



অর্থ: বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত নাফে’ (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেন, একবার তিনি বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)’এর সফরসঙ্গি হয়েছিলেন। জনৈক রাখালের বাঁশির সুর তাঁর কানে প্রবেশ করা মাত্রই তিনি দুটো আঙ্গুল কানে প্রবেশ করিয়ে দেন এবং সেই পথ থেকে ফেরত এসে বলেন, ‘হে নাফে’, তুমি কি এখন বাঁশির সুর শুনতে পাচ্ছো? যখন বাঁশির সুর আর শোনা গেলো না, তখন নাফে’ (رحمة الله عليه) বলেন, না, এখন আর শোনা যাচ্ছে না। অতঃপর হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) কান হতে আঙ্গুল বের করে বলেন, ‘আমি যা করলাম, তা আমি রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)-কেও করতে দেখেছি (আবূ দাউদ শরীফ, ৪৭৪ পৃষ্ঠা)।’ 



অতএব, প্রমাণিত হলো যে গান-বাজনা হারাম। হারাম হওয়ার কারণেই রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর অনুকরণে হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)-ও এটা শ্রবণ করেন নি।



জবাব



হযজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه) নিজ ‘কিমিয়ায়ে সাআদত’ গ্রন্থের সেমা’ অধ্যায়ে লিখেছেন, “ইমাম শাফেঈ (رحمة الله عليه) বলেন, শাহীন নামের বাঁশি ব্যবহার করা হালাল হওয়ার পক্ষে এই প্রমাণটুকুই যথেষ্ট যে, একদিন প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) শাহীনের শব্দ শুনতে পেয়ে কর্ণ মোবারকে নিজের আঙ্গুল প্রবেশ করান এবং হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)-কে বলেন: ‘এর আওয়াজ যখন থামবে তখন আমাকে জানাবে।’ তিনি হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)-কে বাঁশির সুর শ্রবণ করতে বারণ না করায় বোঝা যায়, বাঁশি বাজানো মোবাহ/বৈধ। নতুবা তিনি হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)-কে কখনোই এ রকম বলতেন না। কিন্তু তিনি নিজে কানে আঙ্গুল দেয়ায় বোঝা যায়, তিনি তখন কোনো উন্নত স্তরের আধ্যাত্মিক অবস্থায় বিরাজ করছিলেন। তিনি সম্ভবতঃ মনে করেছিলেন, এই সুর তাঁর সেই আধ্যাত্মিক হালে বা অবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে এবং তাঁর অন্তরকে সেই মহান অবস্থা থেকে বিচ্যুত করবে” [‘কিমিয়ায়ে সাআদত’ বাংলা সংস্করণ ১৯৭৪ খৃষ্টাব্দ, ২২৫ পৃষ্ঠা]। 



ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه)’এর উপরোক্ত উদ্ধৃতি থেকে পরিস্ফুট হয় যে, হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)-ও প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর মতোই বিশেষ কোনো আধ্যাত্মিক অবস্থায় ছিলেন এবং তাই তিনি ইমাম নাফে’ (رحمة الله عليه)’এর সামনে কানে আঙ্গুল দিয়েছিলেন। এতে বাঁশির তথা বাদ্যযন্ত্রের বৈধতা খর্ব হয় না। সেমা’বিরোধীরা ইমাম নাফে’ (رحمة الله عليه)’এর বর্ণনার শেষাংশে তাঁর নিজের কথা যোগ করেন:



كنت إذ ذلك صغيراً



অর্থ: ‘ওই সময় আমি (নাফে’) ছোট ছিলাম।’ অতঃপর সেমা’বিরোধীরা দাবি করেন, এই দলিলে নাকি প্রমাণিত হয় যে হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه)’এর উপরোক্ত রায়কে রদ করে দিয়েছেন। আর ইমাম নাফে’ (رحمة الله عليه)-কে সেমা’ শ্রবণে বারণ না করার কারণ হলো, তিনি গায়রে মোকাল্লেফ বিশ্ শরা’ অর্থাৎ ছোট হওয়ার কারণে শরীয়তের হুকুম তাঁর প্রতি বহাল বা জারি ছিলো না। আমাদের জবাব হলো, হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) যখন রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর ওই ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন, তখন তো তিনি ছোট ছিলেন না। হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) অসংখ্য হাদীসের বর্ণনাকারী যা শরীয়তের হুকুম জারির জন্যে প্রামাণ্য দলিলস্বরূপ। তাঁকে যখন বারণ করা হয়নি, তখন এর মোকাবেলায় সেমা’বিরোধীদের অভিমত গ্রহণযোগ্য নয়। উপরন্তু, ইমাম নাফে’ (رحمة الله عليه)’এর সাথে যে ঘটনায় তিনি বলেন রাসূল (صلى الله عليه وسلم)-ও কানে আঙ্গুল দিয়েছিলেন, তাতে কোনোভাবেই প্রমাণ হয় না যে সেমা’ শ্রবণ হারাম। তাঁর কথায় কোনো নিষেধাজ্ঞার বিন্দুমাত্র আভাসও পাওয়া যায় না। এ ছাড়া, এই ঘটনার ব্যাখ্যা এ-ও হতে পারে যে, সেমা’ শ্রবণে হালত্ বা আধ্যাত্মিক অবস্থা পয়দা হতে পারে এই কথা ভেবে হযরত রাসূল পাক (صلى الله عليه وسلم) ও হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) কানে হাত দিয়েছিলেন। তাঁরা যে কাজে যাচ্ছিলেন তার ব্যাঘাত ঘটতে পারে বিধায় তাঁরা কানে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়েছিলেন এবং সেমা’ শ্রবণ করেন নি [এই বক্তব্য আমার নূরী দাদাজান ক্বেবলা (رحمة الله عليه)’এর, যা শায়খ সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব ক্বেবলা (رحمة الله عليه)’এর কাছ থেকে আমি জেনেছি]। 



আপত্তি নং ১৭



সেমা’ করা মোবাহ/বৈধ এই শর্তে যে, এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। যেমন সগীরা (ক্ষুদ্র) গুণাহ বারবার করলে কবীরা গুণাহে পরিণত হয়। ঠিক একইভাবে শরীয়তে স্থান বিশেষে কোনো কোনো জিনিস অল্প হলে মোবাহ, কিন্তু অধিক হলে হারাম। একবার কিছু হাবশী মসজিদে খেলছিলো। রাসূলে আকরাম (صلى الله عليه وسلم) নিষেধ করেন নি; যদি তারা মসজিদের মধ্যে কয়েকবার করতো, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি নিষেধ করতেন। ওই সময় হযরত আয়েশাহ (رضي الله عنها)-কেও খেলতে দেখেছিলেন, কিন্তু বাদ সাধেন নি। কেননা, এ ঘটনা মাত্র একবার ঘটেছিলো। কৌতূহলস্বরূপ হাস্যকর আলাপ করা কোনো কোনো সময় দুরস্ত বা জায়েয আছে, কিন্তু সর্বদা নয়।



জবাব



বিরোধীদের সেমা’র প্রতি বিরোধিতা এমনই এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, যেখানে জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক সব কিছুই লোপ পেয়েছে। দেখুন, কী হাস্যকর যুক্তির অবতারণা করেছেন তাঁরা! হাবশীদের মসজিদে খেলার সাথে মা’রেফতী সেমা’র অবৈধতা কীভাবে সম্পর্কিত হতে পারে, তা মোটেও বোধগম্য নয়। মনে রাখতে হবে, হাবশী দলটি যখন মসজিদে খেলছিলেন, তখন এবাদতের কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হয় নি। যদি বিঘ্ন সৃষ্টি হতো, তাহলে অবশ্যই প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) তাঁদেরকে নিষেধ করতেন। কিন্তু আমরা তো মা’রেফতী সেমা’ মসজিদ কিংবা অন্য কোনো এবাদতগাহে মুসুল্লিদের এবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে পালন করছি না। উপরন্তু, যে গান-বাজনা আধ্যাত্মিক সাধনার পাথেয় ও ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه)’এর মতো মহান ইসলামী মনীষীর দৃষ্টিতে সর্বশ্রেষ্ঠ রেয়াযত-পদ্ধতি এবং যে সেমা’ (গান-বাজনা) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم) এবং বুযূর্গানে দ্বীনের যিকর-তাযকেরা (স্মরণ), সেই সেমা’ বেশি বেশি শ্রবণ করা অতিশয় মঙ্গলজনক ও তরক্কী তথা আধ্যাত্মিক উন্নতি। এই সাধনা-পদ্ধতি বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদীসে ক্বুদসীতে উদ্ধৃত ‘নওয়াফেল’ হিসেবে পরিগণিত, যা ফরয এবাদতের পরপর পালনের ফলশ্রুতিতে আল্লাহতা’লার ‘ক্বুরবাত’ বা নৈকট্য এনে দেয়। শায়খ সানাউল্লাহ পানিপথী (رحمة الله عليه)-সহ অনেক পীর-মাশায়েখ হাদীসে উদ্ধৃত এই ‘নফল’-কে তরীক্বতের সাধনা হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। 



আপত্তি নং ১৮



তাফসীরে রূহুল মা’আনী গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে, “কোনো কোনো নামধারী সূফী তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র জায়েয হওয়ার পক্ষে বই-পুস্তক লিখেছেন। এ সব বইয়ে তাঁরা আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম), তাবেঈন (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) ও আমলদার উলামায়ে কেরামের প্রতি জঘন্য মিথ্যে আরোপ করেছেন। পরকালের নেআমত হতে বঞ্চিত শয়তানের চেলারা এই মিথ্যেবাদীদের অনুসরণ করেছে। এটা একদম মিথ্যে এবং প্রকৃত তাসাউফ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে।” [২১ নং জুয, ৭৭ পৃষ্ঠা]



জবাব



তাসাউফপন্থী তথা সূফীবাদী আলেম-উলামা বাদ্যযন্ত্রকে জায়েয ফতোয়া দিয়ে বহু বইপত্র প্রণয়ন করেছেন। এ সম্পর্কে ‘ফতোয়ায়ে শা’মী’র উদ্ধৃতি আমরা ইতিপূর্বে এই বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছি। ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه) নিজের রচিত ‘কিমিয়ায়ে সাআদত’ গ্রন্থে লেখেন, “দফ বাদ্যযন্ত্রের সাথে জালাজিল জুড়িযন্ত্র থাকলেও অবৈধ হবে না। কেননা এ সমস্ত বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে হাদীসে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে নি” [সেমা’ অধ্যায়, ২২৫ পৃষ্ঠা, ১৯৭৪ খৃষ্টাব্দ, বাংলা সংস্করণ]। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه)’এর মতো মহান সূফী-দরবেশবৃন্দ যেখানে বাদ্যযন্ত্রকে জায়েয বলেছেন, সেখানে ‘তাফসীরে রূহুল মা’আনী’র লেখক যামাখশারীর মতো একজন বাতেল মো’তাযেলাপন্থীর বক্তব্য কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? স্বয়ং রাসূলে খোদা (صلى الله عليه وسلم) বাদ্যযন্ত্রসহ সেমা’ শুনেছেন। দফ-বাদ্যসহ তাঁর দ্বারা শ্রুত সেমা’র প্রামাণ্য দলিলগুলো আমাদের এ বইয়ে আমরা ইতিপূর্বে প্রকাশ করেছি। ‘হেদায়া’ শীর্ষক কেতাবে লেখা আছে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর কৃত কোনো কাজের প্রতি হারাম (নিষিদ্ধ) অথবা কুফর (অবিশ্বাস)’এর ফতোয়া আরোপ করা দ্বীন ইসলামে নিষিদ্ধ। এমতাবস্থায় হযরত মাহবূবে এলাহী খাজা নিযামউদ্দীন চিশ্তী (رحمة الله عليه) ঢালাওভাবে বাদ্যযন্ত্রকে হারাম ফতোয়া দিয়েছেন মর্মে কোনো দাবিকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না। তিনি ভণ্ড লোকদের কৃত কথিত সেমা’র মজলিশকেই নিষেধ করে থাকবেন হয়তো। যেখানে খোদ রাসূলূল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) ও বুযূর্গানে দ্বীনবৃন্দ বাদ্যসহ সেমা’ শুনেছেন, সেখানে তাঁদের ‘আহওয়াল’ (আধ্যাত্মিক অবস্থা)-কে কীভাবে হারাম বলা যায়? ‘আল-হাদিক্বা’ পুস্তকে ইমাম আবদুল গনী নাবলূসী (رحمة الله عليه) ‘হাত দ্বারা সংঘটিত ক্ষতি’ শীর্ষক অধ্যায়ে লেখেন, “মদ, খেলাধূলা, নাচ ও নারীর সাথে আনন্দ করার সময় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হারাম। কিন্তু বিবাহের মজলিশে দফ-বাদ্য বাজাতে একটি হাদীসে আদেশ দেয়া হয়েছে। এটা সত্য যে, এই আদেশটি পুরুষদের বেলায়ও প্রযোজ্য। হজ্জ্বে গমনের সময় এবং সেনাবাহিনীতে ঢোল ও অনুরূপ বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা জায়েয/অনুমতিপ্রাপ্ত” [আল-হাদিক্বাতুন্ নদীয়া, হাক্বীক্বত কিতাবেভী, তুরস্ক; বইটির আরবী কপি আমাদের কাছে মওজূদ]। 



হজ্জ্ব ও জ্বেহাদের মতো এবাদতের ক্ষেত্রে যদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা জায়েয হয়, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم) এবং আউলিয়া কেরাম (রহমতুল্লাহে আলাইহিম)’এর শানে যিকির-তাযকেরার বেলায় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার কেন না-জায়েয বা নিষিদ্ধ হবে? ইমাম খায়রুদ্দীন রামলী (رحمة الله عليه) নিজের প্রণীত ‘ফতোয়ায়ে খায়রীয়্যা’ গ্রন্থে লেখেন, “রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) যে সব বস্তুকে হারাম ঘোষণা করেছেন সেগুলোকে হালাল এবং যে সব বস্তুকে হালাল ঘোষণা করেছেন সেগুলোকে হারাম হিসেবে জানা শরীয়তে অবৈধ।”



বুযূর্গানে দ্বীনের একাংশ সেমা’ শ্রবণ করেছেন, অপর অংশ শোনেন নি। কিন্তু তাঁরা সেমা’কে এনকার বা নিষেধ করেন নি। যখন শায়খ বাহাউদ্দীন নক্বশবন্দ আল-বুখারী (رحمة الله عليه)’এর কাছে ‘নাঈ’ (তারবিশিষ্ট বাদ্য) ও ‘সায্’ (বাঁশি জাতীয় বাদ্য) নেয়া হয়, তখন তিনি বলেন, “আমি এগুলো শুনি না, কিন্তু এগুলোর শ্রোতা মুতাসাউয়ীফ (সূফী)’বৃন্দকেও অস্বীকার করি না” [শায়খ আবদুল্লাহ দেহেলভী কৃত ‘মকতুবাত’, ৯৯ নং চিঠি]। অতএব, সূফীবৃন্দের শ্রুত সেমা’ সম্পর্কে প্রকৃত (হক্কানী/রব্বানী) আলেম-উলামামণ্ডলীর মাঝে কোনো বিতর্কই নেই। মওলানা জালালউদ্দীন রূমী (رحمة الله عليه) বলেন, “সেমা’ খোদাপ্রেমিকদের আত্মার খোরাক।” খোদাপ্রেমিকমণ্ডলী কীভাবে হারাম কাজ সংঘটন করতে পারেন? হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه) লেখেন, “আমরা কীভাবে সেমা’কে এনকার/নিষেধ করতে পারি? সর্ব-হযরত জুনায়দ বাগদাদী (رحمة الله عليه), যুন্নুন মিসরী (رحمة الله عليه), ইমাম জাফর সাদেক্ব (رحمة الله عليه) প্রমুখ যাঁরা আমাদের চেয়ে বহু উত্তম, তাঁরা সেমা’ শুনেছেন। আমরা কীভাবে এনকার করতে পারি?” [কিমিয়ায়ে সাআদত ও এহইয়াও উলূম]



আপত্তি নং ১৯



একবার একদল লোক হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে এহরাম বেঁধে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه)’এর কাছে আগমন করে। তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি গান গাইছিলো দেখে তিনি তাদেরকে বলেন, “আল্লাহতা’লা কি তোমাদের জন্যে শ্রবণকারী হিসেবে যথেষ্ট নন?” এ কথা তিনি দু বার বলেন। এতে বোঝা যায়, গান গাওয়া হারাম।



জবাব



হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه) লেখেন:



فلا يدل على التحريم من حيث إنه غناء بل كانوا محرمين ولا يليق لهم الرفث وظهر له من مخايله أن سماعهم لم يكن لوجد وشوق إلى زيارة بيت الله تعالى بل لمجرد اللهو فانكر ذلك عليهم لكونه بالإضافة إلى حالهم .

 

অর্থ: “হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)’এর উপরোক্ত কথা দ্বারা গান-বাজনা হারাম সাব্যস্ত হয় না। বরঞ্চ ওই লোকেরা হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে এহরাম বেঁধেছিলো। এমতাবস্থায় অশ্লীল কথাবার্তা বলা তাদের উচিৎ হয়নি। কিন্তু তাদের প্রকৃতির দরুন দৃশ্যমান হয়েছিলো যে, তাদের গান বায়তুল্লাহ শরীফের শান-শওকত ও প্রেমোচ্ছ্বাস হতে উদ্ভূত ছিলো না, বরং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিঃসৃত হয়েছিলো। এই কারণেই (অর্থাৎ, তাদের অসৎ উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণেই) হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) তাদের গানকে নিষেধ করেছিলেন।” [এহইয়াও উলূম, ২য় খণ্ড, ২০২ পৃষ্ঠা]



অথচ হজ্জ্বের শান-শওকত প্রকাশ করার জন্যে সেমা’ করা জায়েয বলে ইমাম আবদুল গনী নাবলূসী (رحمة الله عليه) রায় দিয়েছেন। [আল-হাদিক্বাতুন্ নদীয়া, ‘হাত দ্বারা সংঘটিত ক্ষতি’ অধ্যায়]



আপত্তি নং ২০



রাসূলে পাক (صلى الله عليه وسلم) গান-বাজনা শুনেছিলেন সত্য, কিন্তু শেষ জীবনে তিনি এগুলো শুনতে নিষেধ করেছিলেন। বহু হাদীসে তা প্রমাণিত হয়। অতএব, গান-বাজনা শোনা হারাম।



জবাব



রাসূল (صلى الله عليه وسلم) যে নির্দোষ ও সওয়াবদায়ক গান-বাজনা শুনেছিলেন, তা শুনতে তিনি কোনো নিষেধাজ্ঞা কখনোই আরোপ করেননি। কবর যেয়ারত সম্পর্কে তিনি এরশাদ করেন: “আমি আগে তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে বারণ করেছিলাম, এখন আদেশ দিচ্ছি - যেয়ারত করো (মুসলিম শরীফ)!” অনুরূপভাবে প্রদত্ত কোনো নিষেধাজ্ঞা কি সেমা’বিরোধীরা সেমা’র খেলাফে দেখাতে পারবেন? রাসূলে পাক (صلى الله عليه وسلم) কোথাও এ কথা কি বলেছেন, “আমি আগে সেমা’ শুনেছি, এখন থেকে তা নিষেধ করছি?” যেহেতু এ ধরনের কোনো প্রামাণ্য দলিল শরীয়তের কোথাও বিদ্যমান নেই, সেহেতু রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর শ্রুত সেমা’র বৈধতা পুরো দমে জারি আছে। অতএব, সেমা’বিরোধীদের এই দাবি অলীক ও অন্তঃসারশূন্য।



আপত্তি নং ২১



তিরমিযী শরীফে হযরত ইমরান ইবনে হাসীন (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে; রাসূল (صلى الله عليه وسلم) ফরমান: “আমার উম্মতের মধ্যে কেয়ান, ময়াজেফা ও মদ্যপান সার্বিকভাবে প্রচলিত হবে।” তাই বোঝা যায়, কেয়ান ও ময়াজেফা নামের বাদ্যযন্ত্র হারাম। কেননা, এগুলোকে মদ্যপানের মতো হারাম কাজের সাথে একই কাতারবদ্ধ করা হয়েছে। অতএব, সঙ্গীত হারাম।



জবাব



কেয়ান ও ময়াজেফা’র অর্থ বিভিন্ন, কোনটি যে এক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নির্ধারণ করা যায় না। কেননা উসূলের কায়দা মোতাবেক বিভিন্ন অর্থজ্ঞাপক দলিল ব্যবহার করে শরীয়তের বিষয়াদির মীমাংসা করা অবৈধ। বিশেষ করে, মদ্যপানের মজলিশে গান-বাজনা করাকে আমরাও হারাম বলি। ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه)-ও তাই বলেছেন। এই হাদীস ও এ শ্রেণিভুক্ত আরো দুটো হাদীস তিরমিযী শরীফের ‘বাবুল ফিতান’ তথা ফিতনা অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ আছে। অতএব, হাদীসের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফিতনা-সংক্রান্ত বয়ান। সকল প্রকার ফিতনা-ই অবৈধ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। গান-বাজনার উদ্দেশ্য যদি হয় ফিতনা সৃষ্টি, তাহলে অবশ্যই তা হারাম হবে।



আপত্তি নং ২২



তিরমিযী শরীফের ’ফিতান’ (ফিতনা-ফাসাদ) অধ্যায়ের ২২১০ নং হাদীস; হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হতে বর্ণিত; প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) ফরমান:



حَدَّثَنَا صَالِحُ بْنُ عَبْدِ اللهِ التِّرْمِذِيُّ، حَدَّثَنَا الْفَرَجُ بْنُ فَضَالَةَ أَبُو فَضَالَةَ الشَّامِيُّ، عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَمْرِو بْنِ عَلِيٍّ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ إِذَا فَعَلَتْ أُمَّتِي خَمْسَ عَشْرَةَ خَصْلَةً حَلَّ بِهَا الْبَلاَءُ ‏"‏ ‏.‏ فَقِيلَ وَمَا هُنَّ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ ‏"‏ إِذَا كَانَ الْمَغْنَمُ دُوَلاً وَالأَمَانَةُ مَغْنَمًا وَالزَّكَاةُ مَغْرَمًا وَأَطَاعَ الرَّجُلُ زَوْجَتَهُ وَعَقَّ أُمَّهُ وَبَرَّ صَدِيقَهُ وَجَفَا أَبَاهُ وَارْتَفَعَتِ الأَصْوَاتُ فِي الْمَسَاجِدِ وَكَانَ زَعِيمُ الْقَوْمِ أَرْذَلَهُمْ وَأُكْرِمَ الرَّجُلُ مَخَافَةَ شَرِّهِ وَشُرِبَتِ الْخُمُورُ وَلُبِسَ الْحَرِيرُ وَاتُّخِذَتِ الْقَيْنَاتُ وَالْمَعَازِفُ وَلَعَنَ آخِرُ هَذِهِ الأُمَّةِ أَوَّلَهَا فَلْيَرْتَقِبُوا عِنْدَ ذَلِكَ رِيحًا حَمْرَاءَ أَوْ خَسْفًا وَمَسْخًا ‏"‏ ‏.‏



অর্থ: “যখন আমার উম্মত ১৫টি (বদ) অভ্যাস ধারণ করবে, তখনই তাদের ওপর বালা-মুসীবত অবতীর্ণ হবে।” সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) আরয করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (صلى الله عليه وسلم), সেগুলো কী কী?” উত্তরে তিনি ফরমান: “যখন গরিব লোকজন ধনাঢ্য হবে; আমানতের খেয়ানত করা হবে; যাকাত আদায় করতে লোকেরা কুণ্ঠিত হবে; পুরুষ লোকেরা স্ত্রীলোকদের অনুগত হবে; মায়ের প্রতি অত্যাচার করবে, বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবে; পিতার প্রতি বেয়াদবি করবে; মসজিদগুলোতে ঝগড়া-বিবাদ হবে; নিচু জাতের লোকেরা মাতব্বর হবে; অত্যাচারের ভয়ে অত্যাচারীকে সম্মান করা হবে; পুরুষেরা রেশমবস্ত্র পরিধান করবে; মদ্যপান ব্যাপক আকার ধারণ করবে; (পেশাদার) গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রাদি গ্রহণ করা হবে; আর এই উম্মতের অন্তিম লগ্নের অংশ ঊষা লগ্নের অংশকে অভিসম্পাত দেবে। ওই সময় লাল বাতাস (প্রবাহিত) ও দুনিয়া ওলট-পালট হবার জন্যে তৈরি থেকো।” [তিরমিযী ৪র্থ খণ্ড, ফিতান অধ্যায়, হাদীস নং ২২১০]



অতএব, গান-বাজনা হারাম।



জবাব



মুহাদ্দিস আবূ ঈসা (رحمة الله عليه) এই বর্ণনাটি সম্পর্কে বলেন:



قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ لاَ نَعْرِفُهُ مِنْ حَدِيثِ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ إِلاَّ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ وَلاَ نَعْلَمُ أَحَدًا رَوَاهُ عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ الأَنْصَارِيِّ غَيْرَ الْفَرَجِ بْنِ فَضَالَةَ ‏.‏ وَالْفَرَجُ بْنُ فَضَالَةَ قَدْ تَكَلَّمَ فِيهِ بَعْضُ أَهْلِ الْحَدِيثِ وَضَعَّفَهُ مِنْ قِبَلِ حِفْظِهِ وَقَدْ رَوَاهُ عَنْهُ وَكِيعٌ وَغَيْرُ وَاحِدٍ مِنَ الأَئِمَّةِ ‏.‏



অর্থ: (বিরোধীদের পেশকৃত) হাদীসটি গরিব (অপরিচিত), আর এটা হযরত আলী ইবনে আবী তালেব (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হতে কোনো নির্ভরযোগ্য রাবী/বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত হয় নি। আরেক কথায়, এটা সহীহ বিবরণ নয়। [muflihun-ডট-কম, ৩৩:২২১০ দেখুন; শ্রেণিকরণ - সহীহ নয়]

 

গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র প্রসঙ্গে ‘তাফসীরে আহমদী’ পুস্তকে লিপিবদ্ধ রয়েছে, “আমাদের জমানায় যা লোকেরা নিয়ম বানিয়ে নিয়েছে; মজলিশ বসিয়ে মদ্যপান করে চরিত্রহীন লোকেরা ভ্রষ্টা নারীদের সাথে মেলামেশা করছে এবং গান-বাজনা শ্রবণ করছে। তারা শয়তানী নফস্ দ্বারা পরিচালিত হয়ে রাগিনীর স্বাদ আস্বাদন করছে। এটা কবীরাহ গুণাহ এবং এটাকে হালাল মনে করা কুফর/অবিশ্বাস। কেননা লাহ্উল হাদীসের আয়াতটি এদের উদ্দেশে নাযেল হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ-ওয়ালা আউলিয়াবৃন্দ এদের অন্তর্ভুক্ত নন। লাহ্উল হাদীসের মধ্যে তাঁরা সামিল নন; বরং তাঁদের সেমা’ মজলিশ আল্লাহতা’লার কাছে মর্তবা (উচ্চমর্যাদা) ও কামালিয়াত (আধ্যাত্মিক পূর্ণতা) পাওয়ার মানসেই করা হয়ে থাকে।” [তাফসীরে আহমদী, ৬০৪ পৃষ্ঠা]



আপত্তি নং ২৩



হ্যাঁ, দলিল-আদিল্লাহ’তে সেমা’র বৈধতার পক্ষে অনেক প্রমাণ আছে সত্য, কিন্তু প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) শুধু দফ সহকারেই সেমা’ শুনেছিলেন। তিনি আধুনিক যুগের বাজনা শোনেন নি। অতএব, এগুলো সুন্নতী নয়।



জবাব



ইসলামী স্বর্ণযুগের দফ (ঢোল জাতীয় বাজনা), জালাজিল (তারবিশিষ্ট বাজনা) ও শাহীন (বাঁশি)-এর আধুনিকায়ন করে বর্তমান যুগের অনেক বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। যেমন - হারমোনিয়াম, ঢোল-তবলা, ব্যান্ডপাইপ ইত্যাদি। এ সব বাজনা ব্যবহারে ক্ষতি নেই। যদি দফকে বৈধ বাদ্য বলে বাকি সব বৈধ বাজনাকে বাদ দেয়া হয়, তাহলে আমাদের উত্তর হবে: বর্তমান যুগে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র বাদ দিয়ে সুন্নতী অস্ত্র শুধুমাত্র তরবারি, তীর-ধনুক নিয়ে ইসরাঈলীদের সাথে জ্বেহাদ করা উচিৎ। সুন্নতী অস্ত্রশস্ত্রের যদি আধুনিকায়ন করা যায়, তাহলে দফের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না কেন? এ কারণেই শায়খ কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (رحمة الله عليه) তাঁর বিখ্যাত ‘সফরুস্ সাআদত’ পুস্তকে লেখেন, দফ আর ঢোলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ধর্মযুদ্ধে (মানে জ্বেহাদে) ও আধ্যাত্মিক সেমা’র ক্ষেত্রে এটা বৈধ। 



আপত্তি নং ২৪



আগের যুগে আহলে সেমা’ (মানে সেমাপন্থী) সূফী-দরবেশবৃন্দ এক সপ্তাহ না খেয়েও খাদ্য গ্রহণের চেয়ে সেমা’ শ্রবণকে অগ্রাধিকার দিতেন। কিন্তু এখনকার তরীক্বাপন্থীবর্গ অনেকেই আমলে ফাসিক্ব বা গুনাহগার। উপরন্তু, তারা সব সময় এক মনে এক ধ্যানে সেমা’ শ্রবণ করতে পারে না। অতএব, সেমা’র শর্ত পূরণ হয় না।



জবাব



বর্তমানকালে যাঁরা (প্রকৃত) সেমা’পন্থী তরীক্বাধারী, তাঁদের বেশির ভাগই সেমা’র প্রতি আগ্রহ রাখেন। মনোযোগের বিচ্যুতি ঘটলেই শর্ত ভঙ্গ হবে না। কেননা কেউই প্রথমাবস্থায় ওই সকল পূর্বযুগের সূফী-দরবেশবৃন্দের অভিজ্ঞ চিত্তের পর্যায়ে পৌঁছুতে সক্ষম নয়। এর জন্যে সময় প্রয়োজন; তরীক্বতের পথে পদচারণা দরকার। স্বর্ণযুগের ঈমানদারবৃন্দ আমাদের চেয়ে অনেক উচ্চমর্যাদা ও একাগ্র চিত্তসম্পন্ন ছিলেন। যেমন - হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’এর পায়ে যখন শর বিঁধেছিলো, তখন তা বের করা যাচ্ছিলো না তাঁরই অনুভূত ব্যথার কারণে। কিন্তু যখন তিনি নামাযে দাঁড়ান, তখন এতোই ধ্যানমগ্ন হন যে তাঁর পা থেকে শরটি অপসারণের সময়ে কোনো ব্যথা অনুভব করেন নি। আমাদেরকে সমস্ত এবাদত ও আমলে ওই রকম একাগ্রতা হাসিল করতে হবে।



আপত্তি নং ২৫



যদি ঢোল পিটে খোদাকে পাওয়া যেতো, তাহলে জেলে সম্প্রদায়-ই আগে পেতো। কেননা তারা সবাই ঢোল পিটে থাকে।



জবাব



যদি দাড়ি রেখে খোদাকে পাওয়া যেতো, তাহলে দাড়ি রাখে এমন জাতিগোষ্ঠীও আগে পেতো। যথা - ইসরাঈলী রাব্বি ও শিখ সম্প্রদায়। দেখুন, মূর্তিপূজারী সম্প্রদায়গুলো তাঁদের মূর্তিগুলোর সামনে চিড়া, মুড়ি, নারিকেলসহ নানা খাদ্য অর্ঘ্য হিসেবে উৎসর্গ করেন। কিন্তু একই খা্বারের আইটেম রোযা-রমযানের সময় ইফতারে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এগুলোকে অর্ঘ্য হিসেবে তুলনা করা যায় কি? সেমা’বিরোধীদের এ দাবি তাই একেবারেই অবান্তর।



একটি পত্রিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগে আরো কিছু আপত্তি



প্রায় ত্রিশ বছর আগে একটি পত্রিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগে উত্তরদাতা আলেম সাহেব সেমা’ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “বাদ্য সহকারে এবাদত বা যিকির-আযকার করা অধিকাংশ ইমাম-মুজতাহিদের দৃষ্টিতে সাধারণতঃ হারাম সাব্যস্ত। অবশ্য কোনো কোনো মজযুব ওলী-আল্লাহ বাদ্যযন্ত্র সহকারে যিকির করেছেন, যা তাঁদের বিশেষ অবস্থার পরিচায়ক। সাধারণ মুসলমান সমাজ মজযুব আউলিয়ামণ্ডলীর বিশেষ অবস্থার অনুসরণ করতে পারেন না (ফতোয়ায়ে আলমগীরী দ্রষ্টব্য)।”



জবাব



এ বিভ্রান্তিকর ফতোয়ার প্রত্যুত্তরে ওই পত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের লেখায় আমরা সর্বপ্রথমে মৌলভী হামিদুর রহমান বি,এ, সাহেবের ভাষ্য উদ্ধৃত করেছিলাম। তিনি লিখেছিলেন, “...হাদীসের আলোকে মুহাদ্দিসীন উলামা ও মাশায়েখীন সুফীবৃন্দ সেমা’ তথা মরমী গান-বাজনাকে মোবাহ/বৈধ সাব্যস্ত করেছেন। এমতাবস্থায় সেমা’কে বিনা কারণে হারাম সাব্যস্ত করা যে কতিপয় ফক্বিহ’র কতোদূর গোঁড়ামি ও ভ্রম, তা পাঠকবৃন্দই বিচার করবেন। ফক্বিহমণ্ডলী-ই স্থির করেছেন যে রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর কোনো কাজের (ফে’লের) প্রতি হারাম বা কুফর শব্দ আরোপিত হতে পারে না। যথা - لم يطلق لفظ الحرام والكفر على فعل رسول الله صلى الله عليه وسلم - এমতাবস্থায় যে গান রাসূলুল্লাহ (صلى لله عليه وسلم) শুনেছেন এবং শুনতে আদেশ দিয়েছেন, সেটাকে যে ব্যক্তি হারাম ফতোয়া দেয়, তার প্রতি ধর্মদ্রোহিতার ফতোয়া হয় কি না তা পাঠকমণ্ডলী-ই বিবেচনা করবেন” [শরফুল ইন্সান, ২৮৪ পৃষ্ঠা]। উপরন্তু, সেমা’ হলো তরীক্বতের একটি রীতি/প্রথা। তরীক্বতের ওপর এজতেহাদকে উচ্চমর্যাদা দিতেন না আমাদের মাযহাবের ইমাম হযরত আবূ হানীফা (رحمة الله عليه); এটাই ছিলো তাঁর নীতি। যেমন - তাঁর জীবনের শেষ দুই বছর তিনি তরীক্বতের বিশিষ্ট ইমাম হযরত জা’ফর সাদেক্ব (رحمة الله عليه)’এর দরবারে খেদমত করেছিলেন। অতঃপর জীবন সায়াহ্নে তিনি বলেছিলেন, “ওই দুই বছর না হলে নু’মান বিন সাবিত (মানে তিনি নিজে) হালাক/লয়প্রাপ্ত হতাম।” আমাদের প্রশ্ন: এজতেহাদ বা ফেক্বাহ-শাস্ত্র দিয়ে কি তিনি রক্ষা পেতে পারতেন না? কেন তিনি এ উক্তি করতে গেলেন? জ্ঞানীদের জন্যে এখানে অবশ্যই চিন্তার খোরাক রয়েছে। যে তরীক্বতকে ইমাম আবূ হানীফা (رحمة الله عليه) সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন, সেই তরীক্বতেরই একটি সাধনা-পদ্ধতি হলো সেমা’। এমতাবস্থায় হানাফী মাযহাবের ফক্বীহবৃন্দ কি তাঁর কথা বিবেচনায় নেবেন না? [বি:দ্র: আমরা ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه)’এর সাক্ষ্য অনুযায়ী জানি যে ইমাম জা’ফর সাদেক্ব (رحمة الله عليه) সেমা’ শুনতেন]



দ্বিতীয়তঃ সেমা’পন্থী সূফীবৃন্দ মজযুব ছিলেন না। আমাদের ভারত উপমহাদেশে ইসলাম এনেছিলেন সুলতানুল হিন্দ্ হযরত খাজা মুঈনউদ্দীন চিশ্তী (رحمة الله عليه)। তিনিও সেমা’পন্থী পীর ছিলেন। তিনি যদি মজযুব হতেন এবং যদি তাঁর সেমা’ শ্রবণ ‘বিশেষ অবস্থা’ হতো, তাহলে তাঁর মাধ্যমে ইসলাম পাওয়াও ‘বিশেষ অবস্থা’র পরিচায়ক। যে আলেম সাহেবান উপমহাদেশে বসবাস করেন, তাঁরা সবাই বাপ-দাদার সূত্রে ওই ‘বিশেষ অবস্থার’ ইসলাম পেয়েছেন। তাই পত্রিকার মুফতী সাহেবের ফতোয়া অনুযায়ী তো মুসলমান সাধারণের জন্যে সেই ‘বিশেষ অবস্থার’ ইসলাম অনুসরণযোগ্য হতে পারে না! আল্লাহ মাফ করুন আমাদের, এ চিন্তা হতে। আমরা বলি, সেমা’পন্থী পীর-মাশায়েখমণ্ডলী সবাই সালেক তথা স্বাভাবিক সমাজবদ্ধ খোদাপ্রেমিক ছিলেন। তাঁরা দুনিয়াদারী ও বিয়ে-শাদী করেছিলেন, হাট-বাজার করেছিলেন, আর দুনিয়ার মানুষের মাঝেই বসবাস করে তাদেরকে হেদায়াত দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সর্ব-শায়েখ হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه), সুলতানুল আরেফীন শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمة الله عليه), আহমদ তিজানী (رحمة الله عليه) প্রমুখ। এঁরা কেউই মজযুব ছিলেন না।



অতঃপর পত্রিকার মুফতী সাহেবের আপত্তি



ইসলামী শরীয়তে কোনো বিষয়ে হালাল-হারাম তথা হুকুম নিরূপণের স্বাভাবিক পদ্ধতি ও কানুন নির্ধারিত হয়েছে। এগুলোর ব্যত্যয় ঘটাবার অধিকার আমাদের কারো হাতেই নেই। সেমা’ প্রসঙ্গে আমরা যা বলেছি, তা আমাদের মতামত ছিলো না। আমরা বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী আইন সংকলন ‘ফতোয়া আলমগীরী’ হতেই উক্ত উত্তর প্রদান করেছি। এ উদ্ধৃতি থেকে অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে। এখানে বলা হয়েছে, সেমা’ তথা বাদ্যযন্ত্র সহকারে গান ও নাচানাচি যা অধুনা সাধারণ মানুষদের করতে দেখা যায়, এটা সম্পূর্ণ হারাম। কোনো কোনো বুযূর্গানে দ্বীন যে সেমা’ করেছেন, তাঁদের সেমা’ আর বর্তমানের সাধারণ মানুষের সেমা’ এক কথা নয়। এ কথা জাওয়াহেরুল ফতোয়া শীর্ষক বিখ্যাত ফতোয়ার কিতাবেও উল্লেখিত হয়েছে [আলমগীরী, ৫ম খণ্ড, ৩৫২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য]। এমনিভাবে সর্বজনস্বীকৃত হযরত ইবনে আবেদীন শা’মী হানাফী (رحمة الله عليه) ও মোল্লা আহমদ জিয়ন (رحمة الله عليه) অতি নিপুণতার সাথে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের পর এই সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন যে, সেমা’ ও বাদ্যযন্ত্র সহকারে কৃত এ অনুষ্ঠান আহল্ বা বিশেষ ব্যক্তিবৃন্দের জন্যে শর্তসাপেক্ষে জায়েয। তবে এটা সাধারণের জন্যে নয়। [ফতোয়ায়ে শা’মী, ৫শ খণ্ড, কিতাবুল কিরাহিয়া ও তাফসীরাতে আহমদীয়া, সূরা লোক্বমান, ২১ পারা]



আহলে সেমা’ বা সেমা’র আহলবৃন্দের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব (رحمة الله عليه) বলেন, ‘যাঁদেরকে জযবার হালতে মত্ত অবস্থায় তলোয়ারের আঘাত করলেও অনুভূত হবে না, তাঁরাই এর আহল।’ তিনি আরো বলেন, ‘কোনো কোনো সূফী-দরবেশ মত ব্যক্ত করেন, যদি কোনো ব্যক্তিকে সাত দিন ধরে আহারাদি বন্ধ রাখার পর একদিকে আহার্য সামগ্রী এবং অন্যদিকে সেমা’র অনুষ্ঠান হয়, আর সে ব্যক্তি এ অবস্থাতে আহার্য ত্যাগ করে সেমা’র মধ্যে যোগদান করেন, তবে সেই ব্যক্তি-ই সেমা’র আহল্ বিবেচিত হবেন। [জায়াল হক্ক, ১ম খণ্ড, উরস অধ্যায়, ৩১৪ পৃষ্ঠা]



বলা বাহুল্য, হযরত খাজা গরীবে নওয়াজ (رحمة الله عليه), শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمة الله عليه) ও ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه) প্রমুখ আউলিয়া কেরাম-সহ যাঁরা সেমা’ করেছেন, তাঁরা আহলে সেমা’ ছিলেন। এ মহান মনীষীবৃন্দ শর্তসাপেক্ষে বিশেষ স্তরে পৌছার পর সেমা’ করেছিলেন, যার প্রতি কোনো আপত্তির বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। কিন্তু বর্তমানে সর্বসাধারণের ক্ষেত্রে সেমা’র শর্তসমূহের অনুপস্থিতির দরুন অধিকাংশ আলেম-উলামা তাদের জন্যে সেমা’ হারাম সাব্যস্ত করেছেন। [পত্রিকার মুফতী সাহেবের বক্তব্য সমাপ্ত]



আমাদের জবাব [ওই পত্রিকা এটা প্রকাশ করেনি বা করতে পারেনি]



প্রথমতঃ আমরা একমত যে, সেমা’ তরীক্বত-বহির্ভূত যদু, মধু, রাম, শামদের জন্যে নয়। আমরা এ দাবি করি নি। আমরা দাবি করেছি, সেমা’ আহল্ বা সেমা’র মানুষদের জন্যেই নির্ধারিত। পক্ষান্তরে, পত্রিকার মুফতী সাহেব তাঁর বক্তব্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে সেমা’পন্থী পীর-মাশায়েখবৃন্দ সালেক তথা স্বাভাবিক, সমাজবদ্ধ খোদাপ্রেমিক ছিলেন। কেননা, আমাদের বক্তব্যে আমরা এ দাবিটি করেছিলাম এবং তিনি এর খণ্ডন করেন নি বা করতে পারেন নি। যেহেতু সালেক পীর-মুর্শীদমণ্ডলীকে সমাজের মানুষ অনুসরণ করতে পারেন, সেহেতু প্রমাণিত হয় যে সেমা’পন্থী সালেক পীর-মুর্শীদবৃন্দের একনিষ্ঠ অনুসারী তরীক্বাধারী মুরীদান তাঁদের পীরের তরীক্বতের রীতি/প্রথা পূর্ণ দমে জারি রাখতে পারেন। এ পরিপ্রেক্ষিতেই আলেম-উলামার উচিৎ নয় জমানার দোহাই দিয়ে আহলে সেমা’ পীর-মাশায়েখমণ্ডলীর তরীক্বার অনুসারীদের সেমা’কে হারাম ফতোয়া দেয়া।



পত্রিকার মুফতী সাহেব বারবার জমানার দোহাই দিয়েছেন। অথচ সেমা’ জমানা দ্বারা বিচার্য নয়, বরং বুযূর্গানে দ্বীনের আরোপিত শর্তাবলী দ্বারাই বিচার্য [মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব (رحمة الله عليه) রচিত ‘জায়াল হক্ক,’ ২য় খণ্ড, উরস্ অধ্যায়, ১৯৩ পৃষ্ঠা, বাংলা সংস্করণ]। তাঁদের শর্তাবলীর মধ্যে জমানাকে উল্লেখ করা হয়নি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, জমানার দোহাই দিয়ে মুফতী সাহেব পূর্ববর্তী বুযূর্গানে দ্বীনের রূহানী ফয়েয (আধ্যাত্মিকতার জ্যোতি) জারি থাকার বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন। অর্থাৎ, পূর্ববর্তী সেমা’পন্থী বুযূর্গানে দ্বীনবৃন্দের বেসালপ্রাপ্তির পর তাঁদের তরীক্বত ও রূহানী ফয়েয এখন আর জারি নেই - এ দাবি-ই পত্রিকার মুফতী সাহেব প্রকারান্তরে উত্থাপন করেছেন। তাঁর এ দাবিটি সুন্নী আদর্শের খেলাফ এবং অবাস্তব-ও। ইমাম আবদুল গনী নাবলূসী (رحمة الله عليه) বলেছেন, সেমা’পন্থী আউলিয়া কেরাম সর্বযুগে বিরাজ করবেন। আমরা তাঁর এ বাণী ইতিপূর্বে উদ্ধৃত করেছি।



আমাদের বক্তব্যে আমরা বলেছিলাম, শরীয়তের হুকুম-আহকাম তথা নামায, রোযা ইত্যাদি মাসয়ালা জানবার জন্যে আমরা ফক্বীহদের শরণাপন্ন হলেও তাসাউফ-তরীক্বত বিষয়ক ফায়সালার জন্যে আমাদেরকে তরীক্বতের ইমামবৃন্দের শরণাপন্ন হতে হবে, যেমনিভাবে সর্ব-ইমাম আবূ হানীফা (رحمة الله عليه), আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله عليه) হয়েছিলেন। তাই সেমা’র মতো আধ্যাত্মিকতা-সংক্রান্ত ধর্মীয় বিধানের ব্যাপারে জানতে হলে ফতোয়া আলমগীরী শীর্ষক ফেক্বাহ-পুস্তকের শরণাপন্ন না হয়ে হুজ্জাতুল ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه)’এর ‘এয়াহইয়াও উলূম’ ও ‘কিমিয়ায়ে সাআদত’, সুলতানুল আরেফীন শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمة الله عليه)’এর ‘আওয়ারিফুল মা’আরিফ’, ইমাম আবদুল গনী নাবলূসী (رحمة الله عليه)’এর ‘ইদা’হুদ্দালা’লা’ত ফী সামা’য়িল আলা’ত’ (বাদ্যযন্ত্র শ্রবণের দলিলাদির ব্যাখ্যা) ইত্যাদি মহামূল্যবান তাসাউফের বইপত্রের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।



ফতোয়ায়ে আলমগীরীর যে উদ্ধৃতিটি ওপরে পেশ করা হয়েছে, তাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে যে বুযূর্গানে দ্বীনের শ্রুত সেমা’র সাথে আধুনিককালের সাধারণ মানুষের শ্রুত গান-বাজনা ও নাচানাচির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান। আমরা এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, আমরা আধুনিককালের তরীক্বাপন্থীদের ব্যাপারেই আলোকপাত করেছি, যদু, মধু, রাম, শামদের ব্যাপারে নয়। ফতোয়ায়ে আলমগীরীর উদ্ধৃতিটিতে এ বিষয়টি অনুল্লিখিত থেকে গেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সেমা’ ও ওয়াজদ (দৈহিক স্পন্দন) বুযূর্গানে দ্বীন হতে সিদ্ধ প্রমাণিত। স্বয়ং রাসূলে পাক (صلى الله عليه وسلم) জনৈক বেদুঈন আরবের কাছ থেকে সেমা’ শ্রবণের সময় ওয়াজদ করেছিলেন [প্রামাণ্য দলিল নং ৯ দ্রষ্টব্য]। একবার হযরত আলী (كرم الله وجهه)-কে রাসূল (صلى الله عليه وسلم) বলেন, “তুমি আমা হতে, আমি তোমা হতে।” এ কথা শুনে হযরত আলী (كرم الله وجهه) আনন্দে ওয়াজদ করেন। [শরফুল ইন্সান, ২৮৫ পৃষ্ঠা]



ওয়াজদ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (رحمة الله عليه)’এর ভাষ্য            



একবার ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (رحمة الله عليه)-কে সূফী বুযূর্গবৃন্দের তাওয়াজুদ তথা আধ্যাত্মিক ভাবোন্মত্ত অবস্থায় রকস্ অর্থাৎ ওয়াজদ বা শারীরিক স্পন্দন করা সম্পর্কে এই মর্মে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো যে, এর কোনো বৈধতা আসল তথা মূলে আছে কি না? তিনি উত্তরে বলেন, “হ্যাঁ, এর শরয়ী ভিত্তি রয়েছে। কেননা অবশ্যঅবশ্য হযরত জা’ফর ইবনে আবী তালেব (رضي الله عنه)-কে মহানবী (صلى الله عليه وسلم) বলেছিলেন:



ثم قال لجعفر : ( أما أنت فتشبهني في خَلقي وخُلقي ) فحجل جعفر كذلك



অর্থ: তুমি (দেহসৌষ্ঠব ও চরিত্রে) আমারই প্রতিরূপ। [ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, ‘মুসনাদ’, ২:২১৩]



এতদশ্রবণে তিনি আনন্দ অনুভব করে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর সামনে ওয়াজদ করেন। নির্ভরযোগ্য সনদে আরো বর্ণিত আছে যে, বেশ কয়েকজন স্বনামখ্যাত ইমাম আল্লাহতা’লার যিকরের মজলিসে দাঁড়িয়ে ওয়াজদ করেছেন। এঁদের মধ্যে শায়খুল ইসলাম ইযয আল-দ্বীন ইবনে আবদিস্ সালাম (رحمة الله عليه) অন্যতম।” [ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (رحمة الله عليه) কৃত ‘ফতোয়ায়ে হাদিসিয়্যা’, কায়রো: মুস্তফা বাবিল হালাবী, ২য় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২৯৮; রেফারেন্স - শায়খ মারদিনী, লেবানন]



অতএব, বুযূর্গানে দ্বীন যা করেছেন, তাকে ‘নাচানাচি’ ও হারাম বলে কটাক্ষ করা মোটেও উচিৎ নয়। অধিকন্তু, ওই পত্রিকার মুফতী সাহেব সেমা’র আহল-বৃন্দের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব (رحمة الله عليه)’এর ‘জায়াল হক্ক’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তাতে লেখা আছে, “যাঁদেরকে জযবার হালতে মত্ত অবস্থায় তলোয়ারের আঘাত করলেও অনুভূত হবে না, তাঁরাই এর (মানে সেমা’র) আহল।” এ কথাটি পূর্বযুগের কিছু কিছু সূফী বলে থাকলেও সূফীবৃন্দের দ্বারা সার্বিকভাবে আরোপিত শর্তাবলীর অন্তর্ভুক্ত নয় [দেখুন - ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه)’এর ‘ইয়াহইয়া’, শায়খ শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمة الله عليه)’এর ‘আওয়ারিফুল মা’আরিফ’ ইত্যাদি গ্রন্থাবলী]। তাই শর্ত হিসেবে এটা বিবেচ্য নয়। দ্বিতীয়তঃ সেমা’ হলো তাসাউফ-তরীক্বতের একটি সাধনা-পদ্ধতি যা অনেক তরীক্বার ইমামবৃন্দ গ্রহণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে একটি হাদীসে ক্বুদসী উদ্ধৃত করা যথাযথ হবে বলে মনে করি:



عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَالَ: مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا، فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ، وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ، وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ، فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ، كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا، وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا، وَإِنْ سَأَلَنِي لَأُعْطِيَنَّهُ، وَلَئِنْ اسْتَعَاذَنِي لَأُعِيذَنَّهُ، وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَيْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِي عَنْ نَفْسِ عَبْدِي الْمُؤْمِنِ، يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ". رواه البخاري



অর্থ: “আমার (প্রিয়) বান্দা ফরয পালনের পর নফল এবাদত (মাওলানা সানাউল্লাহ্ পানিপথীর মতে এর অর্থ তরীকতের সাধনা) পালন দ্বারা আমার এমন নিকটবর্তী তথা সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হন যে আমি তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসি; এমন ভালোবাসি যে আমি তাঁর কুদরতী কান হই যা দ্বারা তিনি শোনেন; তাঁর কুদরতী চোখ হই যা দ্বারা তিনি দেখেন; তাঁর কুদরতী হাত হই যা দ্বারা তিনি কাজ করেন এবং তাঁর কুদরতী পা হই যা দ্বারা তিনি চলাফেরা করেন। তিনি আমার কাছে যা-ই চান আমি তা মঞ্জুর করি।” (সহীহ বুখারী, বই নং ৮১, হাদীস নং ৯১)।



হাদীসে ক্বুদসীটিতে উল্লেখিত ‘নওয়াফেল’ শব্দটির উদ্দেশ্য যে তরীক্বতের সাধনা, তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে আমার অনূদিত ‘তাসাউফ প্রবন্ধ সমগ্র’ বইয়ে [সানজেরী পাবলিকেশন, চট্টগ্রাম কর্তৃক ২০১৭ সালে প্রকাশিত]। এই রেয়াযত/সাধনা তরীক্বতপন্থীদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে জারি রাখা অবশ্য কর্তব্য। [বি:দ্র: আমরা পত্রিকার মুফতী সাহেবের প্রতি এই জবাবটি এখানে সুবিন্যস্ত করেছি, যাতে সামগ্রিক একটা চিত্র পাওয়া যায়]



উপসংহার



এই প্রসঙ্গে আমাদের শেষ কথা হলো, এখলাস্ বা নিষ্ঠা সহকারে সেমা’ শ্রবণকারী তরীক্বাপন্থীদের জন্যে সেটার চর্চা বজায় রাখা তরীক্বতেরই আদেশ। কেউই রাতারাতি উচ্চ বা বিশেষ স্তরে পৌঁছুতে সক্ষম নন, বরং চর্চা করেই সেই মক্বামে উপনীত হতে পারেন। এটা মনের আগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। সেই মনের আগ্রহের দিকে খেয়াল না করে ফতোয়া জুড়ে দেয়া আর যাই হোক, জ্ঞানী মানুষের কাজ নয়। কেননা, বুখারী শরীফের একটি হাদীসে বলা হয়েছে: “নিশ্চয় আমল/কর্ম নিয়্যত তথা উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভরশীল।” তাই ফতোয়াসমূহ এ হাদীস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া অত্যাবশ্যক।  



                                                      সমাপ্ত

Top