গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ- কী ও কেন?


এডভােকেট মােছাহেব উদ্দীন বখতেয়ার

দ্বিতীয় প্রকাশঃ ৬ মুহররম ১৪৩৪ হিজরি ২১ নভেম্বর ২০১২ ইংরেজি 

সৌজন্যেঃ গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় পরিষদ 

প্রকাশনায়ঃ [আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট] 

৩২১, দিদার মার্কেট ২য় তলা দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম-৪০০০, বাংলাদেশ। 

ফোন : ০৩১-২৮৫৫৯৭৬,

e-mail:

anjumantrust@yahoo.com, anjumantust@gmail.com

টেক্সট: শেখ হাসনাত আবেদীন ও মাসুম বিল্লাহ সানি


গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ- কী ও কেন?


প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্যঃ


হাদীস শরীফের পবিত্র ভাষ্য অনুসারে মুসলমানরা ৭৩ দলে বিভক্ত হয়েছে বা হয়ে থাকবে। এর মধ্যে ৭২ দলই জাহান্নামী। শুধুমাত্র একটি দলই জান্নাতি। ইসলামের একমাত্র নাজাতপ্রাপ্ত দল তথা মূলধারার নাম আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত।

 [সূত্র : মােল্লা আলী ক্বারী, মিরকাত, শরহে মিশকাত]

হানাফী, শাফেঈ, মালেকী ও হাম্বলী- এ চার মাযহাব আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’র এক একটি শাখা বিধায় নাজাতপ্রাপ্ত মূলধারার অন্তর্ভুক্ত। ঠিক তেমনি কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, সােহরাওয়ার্দিয়া ইত্যাদি ত্বরিকাগুলােও একই শ্রেণীভুক্ত আধ্যাত্মিক ধারা। এসব ত্বরীকার মানুষগুলাে কেউ হানাফী, কেউ মালেকী এভাবে কোন না কোন মাযহাবের অনুসারী সুন্নী মুসলমান। এর বাইরের অর্থাৎ সুন্নী মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত মানুষগুলােই পথভ্রষ্ট বা জাহান্নামী ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত। হযরত বড়পীর গাউসুল আযম আবদুল কাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু জন্মগ্রহণ করেন ৪৭০ হিজরিতে। অর্থাৎ রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র জন্মের প্রায় পাঁচশত বছর পরে। অথচ এ সময়েই ইসলামের নামে ভ্রান্ত ৭২ দলের আবির্ভাব পূর্ণ হয়ে যায়। গাউসুল আযম জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু স্বলিখিত ‘গুনিয়াতুত তালেবীন’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে উক্ত হাদীস শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতই একমাত্র নাজাত প্রাপ্ত দল। অন্যান্য ৭২ দল জাহান্নামী। তিনি সুন্নী জামাত’র পরিচয়ের সাথে সাথে পাশাপাশি ৭২ দলের পরিচয়সহ একটি তালিকা প্রদান করেন। ওই ৭২ দলে খারেজী, রাফেযী, শিয়া, মু'তাযিলা, কদরিয়া, জবরিয়া, মুশাব্বেহা ইত্যাদি মূল বাতেল দল ও এদের শাখা- প্রশাখাগুলাের নাম রয়েছে। সব মিলিয়ে গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’র সময়ে বাতিলের সংখ্যা ৭২ পূর্ণ হয়। ফলে ওই সময়ে ৭২ টি ভ্রান্ত দল- উপদলের সাথে মােকাবেলা করতে গিয়ে একটি মূলধারার এমন নাজুক এবং মুমূর্ষ অবস্থা বিরাজ করছিলাে যে, একে রক্ষা করতে এমন মহান সংস্কারকের আগমন অপরিহার্য হয়েছিলাে। ঠিক এই সময়েই হযরত বড়পীর জীলানীর আগমনে এবং তাঁরই পরিচর্যায় ইসলাম পায় নতুন জীবন। যে কারণে গাউসুল আ'যম জীলানীর অপর নাম হলাে 'মহীউদ্দীন' অর্থাৎ দ্বীনকে পূনর্জীবনদানকারী। এ সংক্রান্ত অলৌকিক ঘটনাটি হলাে- গাউসে পাক বাগদাদের রাস্তায় চলার পথে দেখলেন এক বৃদ্ধ রােগাক্রান্ত মুমূর্ষ মানুষ তাঁকে আহ্বান করছে সাহায্যের জন্য। গাউসে পাক ওই মরণযাত্রীকে টেনে তুলে দাঁড় করাবার জন্য স্পর্শ করতেই লােকটি অলৌকিকভাবে সুস্থ সবল নওজোয়ান হয়ে যায়। গাউসে আযম এ ঘটনায় অবাক হয়ে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে লােকটি উত্তর দিলাে আরাে অলৌকিকভাবে যে, "আমি কোনাে মানুষ নই' মূলতঃ পাঁচশ বছর পূর্বে আপনার পূর্বপুরুষ রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে দ্বীন ইসলাম রেখে যান আমি তারই প্রতিরূপ, যা এমন মুমূর্ষ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিলাে, কিন্তু আজ আপনার হাতে এ মুমূর্ষ দ্বীন লাভ করলাে পুনর্জীবন। [বাহাতুল আসরার]

 

হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী তাঁর 'শামায়েলে এমদাদীয়া’য় গাউসুল আ'যম দস্তগীর রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে 'দ্বীনের ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধারকারী' বলে মন্তব্য করেন- যা 'মুহীউদ্দিন' উপাধির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দ্বীনের ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধারকারী তথা দ্বীনকে পূনর্জীবন দানকারী মুহীউদ্দীন' গাউসুল আযম আবদুল কাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’র মহান আদর্শ এই সমাজে বাস্তবায়নের জন্যই মূলতঃ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে 'গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ। অপর কথায় বলা যায়, গাউসুল আযম কর্তৃক পুনর্জীবিত এবং প্রদর্শিত পথ ও মতকে সমাজে মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্যই 'গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কী এই পথ, মত বা আদর্শ ? গাউসে পাকের ‘গাউসিয়াত’- এর এ আদর্শকে তাঁর কর্মময় জীবন, লেখালেখি ও বক্তব্য- মন্তব্যের আলােকে বিশ্লেষণ করলে আমরা তিনটি অলঙ্ঘনীয়, কর্মসূচী দেখতে পাই- 

১. ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত- এর আদর্শ তথা সুন্নিয়াত'- এর প্রচার- প্রসারে আত্মনিয়ােগ করা। 

২. ইসলামের নামে আবির্ভূত বাতেল দল এবং ভ্রান্ত মানব গড়া মতবাদ ( যেমন গ্রীক দর্শন )-এর মূলােৎপাটন, এবং

৩. আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে খােদা তালাশের একটি সহজ পথ ‘সিলসিলাহ আলীয়া কাদেরিয়া’র পথ প্রদর্শন। গাউসে পাক উক্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে নেতৃত্ব দিয়ে এবং সংস্কার করে দ্বীনকে পুর্নজীবন দিয়ে গেছেন- যা পরবর্তীতে তাঁর প্রতিনিধি তথা খলীফাগণের পরিচর্যায় দুনিয়ার দেশে দেশে অনুসৃত ও প্রদর্শিত হয়ে দ্বীন ইসলামের সংরক্ষণ ও পরিধিবৃদ্ধিকে নিশ্চিত করেছে। 

বাংলাদেশের মানুষ বিংশ শতাব্দিতে, গাউসে পাকের যে প্রতিনিধির সংস্পর্শে এসে সুন্নিয়াত ও ত্বরীকৃতের আলােকে অধিকতর আলােকিত হয়েছেন তিনি শাহানশাহে সিরিকোট, পেশওয়ােয়ে আহলে সুন্নাত এবং সৈয়্যদুল আউলিয়া ' হিসেবে । তিনি হলেন আল্লামা হাফেয কৃারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটী পেশােয়ারী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি। বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে দরবারে আলীয়া কাদেরিয়া, সিরিকোট শরীফ তার ঠিকানা। সেখানেই ১৮৫৬-৫৭’র দিকে তাঁর জন্ম এবং ১৯৬১ সনে (১১ জিলক্বদ ১৩৮০ হিজরি) ইনতিকাল করেন। রাসুল করীম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ৩৯ তম অধঃস্তন পুরুষ সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটী তাঁর পূর্বপুরুষ আহলে বায়তদের অনুসরণে মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে দ্বীনের মশাল হাতে নিয়ে প্রথমে হিজরত করেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানেই স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ বিধর্মীদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে নবদীক্ষিত মুসলমানদের ইবাদতের জন্য ১৯১১ সনে সেখানকার প্রথম জামে মসজিদ নির্মাণ করেন। শুধু তাই নয়, পারস্য থেকে একদল শিয়া ধর্ম প্রচারক তাদের ভ্রান্ত মতবাদ প্রচারে গিয়েছিলাে সেখানে, কিন্তু হযরত সৈয়্যদ আহমদ পেশােয়ারী’র নেতৃত্বে সেখানে সুন্নিয়াতই শুধু স্থান পায় এবং শিয়া সম্প্রদায় প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হয় (Dr. Ibrahim M Mahdi, A Short history of the Muslims in South Africa) গাউসে পাক যেভাবে ইসলামের মূলধারা সুন্নিয়াতকে শিয়া ইত্যাদি মতবাদের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন ঠিক তেমনি সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হিও আফ্রিকায় বাতিল সম্প্রদায়ের মূলােৎপাটনের মাধ্যমে তার দ্বীন প্রচারের কর্মসূচি শুরু করেন জীবনের প্রথম ভাগে। এরপরই তিনি গ্রহণ করলেন গাউসে পাক প্রতিষ্ঠিত সিলসিলাহ-এ আলিয়া কাদেরিয়া’র শিষ্যত্ব। তাঁর পীর- মুর্শিদ গাউসে দাওরা হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি’র খিদমতে তিনি নিজের আমিত্ব, অহঙ্কার বিসর্জন দিয়ে ত্বরীকতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খেলাফত লাভে ধন্য হন এবং পীরের নির্দেশে সুন্নীয়ত ও ত্বরীকতের এ মিশন হাতে নিয়ে ১৯২০ সনে তশরীফ নিয়ে যান সুদূর রেঙ্গুনে। দীর্ঘ দুই দশকের রেঙ্গুন জীবন (১৯২০-১৯৪১)-এর এক পর্যায়ে তিনি তাশরীফ আনলেন বাংলাদেশে। এখানে তিনি এই মিশনের জন্য কাজ করেন ১৯৩৫-১৯৬১ অর্থাৎ জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। ১৯২৫ সনে তাঁর পীর সাহেব হযরত খাজা চৌহরভী’র ইন্তেকালের পর থেকে স্বদেশের হরিপুরে প্রতিষ্ঠিত "দারুল উলুম রহমানিয়া ' (১৯০২) কে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। এ বছর (১৯২৫) থেকেই তিনি আপন পীরের প্রধান খলিফা হিসেবে শরিয়ত ও ত্বরীকতের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব প্রাপ্ত হন এবং এ দায়িত্বকে যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে বিশেষতঃ সুন্নীয়তের প্রচার- প্রসার, বাতিল পন্থীদের স্বরূপ উন্মােচন এবং কাদেরিয়া ত্বরীকা প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব গাউসুল আযম জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু’র পক্ষ থেকে সিলসিলাহ পরম্পরায় তাঁর উপর অর্পিত হয়। এমন কর্মসূচীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় তাঁর সাধারণ মুরীদ- ভক্তদেরও অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করে তাদের দুনিয়া- আখিরাত উজ্জ্বল করতে, বিশেষত সংশ্লিষ্ট সমাজকে আলােকিত করতে তিনি রেঙ্গুনে প্রতিষ্ঠা করেন এ সিলসিলাহর প্রথম সংগঠন- ‘আনজুমানে শূরা- এ রহমানিয়া' (১৯২৫)। এই সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় রহমানিয়া মাদরাসা এক বিশাল দ্বীনি মারকাযে পরিণত হয়। বিশেষ করে তার পীর খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি, জীবনে কোনাে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযােগ ছাড়া মাত্র ৭ বছর বয়সে স্বীয় আব্বা হুযুর গাউসে যামান খাজা ফকীর মুহাম্মদ খিদ্বীর স্থলাভিষিক্ত হন, অথচ জীবন সায়াহ্নে এসে এমন এক উচ্চ মানের আরবী ভাষার দরূদ গ্রন্থ লিখে যান, যা এই দুনিয়ায় এক অদ্বিতীয় গ্রন্থ মজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল নামে পরিচিত। আল্লাহর কালাম আল কুরআন আর রাসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের সহীহ হাদীস সংকলন বােখারী শরীফের পর, এটিই কোনাে মানুষের রচিত ৩০ পারা সম্বলিত গ্রন্থ যার প্রতিটি পারায় রয়েছে ৪৮ পৃষ্ঠা করে। আর এ গ্রন্থটি হলাে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সৃষ্টি, যাবতীয় অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ ও গুণাগুণ- জাত-সিফাত এবং আত্বীদা ও আমলের বর্ণনাসহ দুরূদ- সালামের এক অপূর্ব বর্ণনা সম্ভার। আর এ বিরল গ্রন্থটি চার হাজার টাকা ব্যয়ে ছাপিয়ে ছিলাে আজ থেকে আশি বছর আগে এ ‘শূরা- এ রহমানিয়া'। হুযূরের চট্টগ্রাম আগমনের সাথে সাথে চট্টগ্রামবাসী রেঙ্গুনের মুরীদদের নেতৃত্বে ১৯৩৭ সনে গঠিত হয় ‘আনজুমান-এ শূরায়ে রহমানিয়া চট্টগ্রাম শাখা। এরই ব্যবস্থাপনায় এখানে চলতে থাকে ত্বরীকতের প্রচার-প্রসার এবং রহমানিয়া মাদরাসার সহযােগীতা।

 হুযূর কেবলা চট্টগ্রাম এসে দেখলেন খারেজী সম্প্রদায়ের উত্তরসূরীরা এখানে বেশ তৎপর। এরা প্রতিনিয়ত নবী- ই আকরামের দুরূদ- সালাম এবং সম্মান বিরােধী বক্তব্য প্রচার করে মুসলমানদের ঐক্য এবং ঈমান আকীদা বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু এদের এ ঈমান বিধ্বংসী অপতৎপরতা রুখে দেওয়ার মতাে যােগ্যতা সম্পন্ন সাচ্চা আলিম বলতে এক ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাযী শেরে বাংলা ছাড়া তেমন কেউ নেই। তাছাড়া, ভ্রান্তমতবাদীদের প্রাতিষ্ঠানিক মােকাবেলার জন্য বিদ্যমান মাদরাসাগুলােও যথেষ্ট নয়। অধিকন্তু চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শেখের খিলে তার এক মাহফিলে তিনি "ইন্নাল্লা- হা ওয়ামালা-ই-কাতুহু ইয়ূসাল্লু- না আলাবীয়্যি, এয়া আইয়ুহাল্লাযীনা আ- মা- নূ সাল্লু-' আলায়হি ওয়াসাল্লিমূ- তাসলী-মা' এ"  আয়াতে করীম তেলাওয়াতের পর সমবেত স্থানীয় অধিবাসীরা দুরূদ শরীফ তাে পড়ে নি; বরং বেয়াদবী করেছিলাে। এ ঘটনার পরই হুযূর কেবলা দুরূদ- সালাম বিরােধী নবীর এ দুশমনদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরােধ গড়ে তুলতে নির্দেশ দেন এবং চট্টগ্রামের ষােলশহরে ১৯৫৪ সনে প্রথমে ‘মাদরাসা-এ আহমদিয়া সুন্নিয়া’র বুনিয়াদ স্থাপন করেন এবং পরে ১৯৫৬ সনে একে অপ্রতিদ্বন্দ্বী সর্বোচ্চ দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার জন্য উক্ত নামের সাথে ‘জামেয়া’ (অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়) শব্দটি যােগ করেন। সাথে সাথে বেলায়তী কণ্ঠে ঘােষণা করলেন, "কাম করাে দ্বীন কো বাঁচাও, ইসলাম কো বাঁচাও, সাচ্চা আলিম তৈয়ার করাে।"

যে দ্বীন ইসলামকে একদিন বাঁচিয়ে ছিলেন হুযূর গাউসুল আযম আবদুল কাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু (৪৭০-৫৬১হিজরী) আজ আবারাে দ্বীন কো বাচাও’ ঘােষণা করলেন তাঁরই যুগশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটী (১২৭৬-১৩৮০হিজরী) প্রায় নয়শত বছর পরে এই চট্টগ্রামে। তিনি আরাে ঘােষণা করলেন- 

‘মুঝেহ দেখনা হ্যায় তাে মাদরাসা কো দেখাে, মুঝসে মুহাব্বত হ্যায় তাে মাদরাসাকো মুহাব্বত করাে। ' 

(আমাকে দেখতে চাইলে মাদরাসাকে দেখাে, আমার সাথে ভালবাসা রাখতে চাইলে মাদরাসাকে ভালবাসাে।) 


তিনি শুধু মাদরাসা বানিয়েই ক্ষান্ত হন নি বরং প্রত্যেকের মুহাব্বতের পূর্বশর্ত হিসেবে মাদরাসার মুহাব্বতকেও ঘােষণা করে দিয়েছেন, যাতে মুরীদ- ভক্তগণ দ্বীনি খিদমতে ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্বীন রক্ষার অতন্ত্র প্রহরী 'সাচ্চা আলিম' তৈরিতে উৎসর্গিত হয়ে যায়। হয়েছিলােও তাই। ফলে আজ এ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া দেশের শীর্ষস্থানীয় দ্বীনি প্রতিষ্ঠান এবং সুন্নিয়াতের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৫৬ সনে আঞ্জুমানে শূরা- এ রহমানিয়াকে করা হলাে- "আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ নামে। এখন থেকে সুন্নিয়াত ও ত্বরীকতের মিশন ব্যবস্থাপনায় মাঠে নামে এই ‘আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ যার আজীবন সভাপতি স্বয়ং হুযূর কেবলা। শাহানশাহে সিরিকোট’র ইন্তিকালের পর হতে আজীবন সভাপতির এ দায়িত্বে আসেন তাঁরই সাহেবযাদা, মাতৃগর্ভের ওলী নামে খ্যাত আল্লামা হাফেয সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ। হুযূর কেবলা তৈয়্যব শাহকে ১৯৫৮ সনে এই চট্টগ্রামেই জনসম্মুখে খেলাফত দেওয়া হয় এবং আঞ্জুমানের নীতি নির্ধারণী কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে থেকে গাউসে পাকের এই মিশনের লাগাম থাকে গাউসে যামান সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ’র হাতে, যিনি এই প্রতিষ্ঠানকে এবং এর কর্মসূচীকে দিয়েছেন আরাে বেশি ব্যাপকতা। তাঁর হাতে ত্বরীকতভুক্ত হন লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষ। তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকার মুহাম্মদপুরের কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলীয়া, চন্দ্রঘােনার 

(চট্টগ্রাম) তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া এবং হালিশহরের (চট্টগ্রাম) তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া সহ অনেকগুলাে মাদরাসা, খানকাহ এবং মসজিদ। ফলে, দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তাঁর লক্ষ লক্ষ মুরীদ ভক্তদের জন্য সুযােগ সৃষ্টি হলাে মাদ্রাসার খেদমত করার মাধ্যমে সাচ্চা আলেম তৈরির নির্দেশ পালনের। হুযূর কেবলা তৈয়্যব শাহর নির্দেশে ১৯৭৬ সনের ১৬ ডিসেম্বরে এক সভায় ‘তরজুমান ' নামে একটি মাসিক পত্রিকা চালুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৭৫ সন থেকে তাঁরই নির্দেশে শুরু হয়েছে চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশে 'জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- এর মতাে একটি শরীয়ত সম্মত বর্ণাঢ্য মিছিলের কর্মসূচী ; যাতে আজ লক্ষ লক্ষ মানুষ শামিল হয়ে এ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ সংস্কারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বিশেষ করে গাউসে পাক’র স্মরণে প্রতি মাসের গেয়ারভী শরীফ এবং খতমে গাউসিয়া শরীফসহ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি’র যুগান্তকারী মসলকে আ'লা হযরত প্রচার- প্রসারের যে যাত্রা হযরত সিরিকোটী হুযূরের হাতে শুরু হয় তা তাঁর হাতে লাভ করে ব্যাপক গ্রহণযােগ্যতা। মােট কথা ১৯৮৬ পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই গাউসে পাকের এই কাফেলায় শামিল হয় দেশ- বিদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। দেশের আনাচে কানাচে চলতে থাকে এ মিশনের কার্যক্রম। এ বিশাল কর্মী বাহিনীকে একটি সাংগঠনিক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে, দ্বীনের সাহায্যের কাজে নিয়ােজিত করে তাদের সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য গাউসে যামান তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি ১৯৮৬ সনে নির্দেশ দিলেন ‘গাউসিয়া কমিটি প্রতিষ্ঠা করতে। এরই বাস্তবায়নে ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলাে। দেশব্যাপী এমন কি সুদূর মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত এটা ব্যাপৃত হলাে। বর্তমানে এর লক্ষ লক্ষ কর্মী- সমর্থকদের হাতে এলাকায় এলাকায় পরিচালিত হচ্ছে সুন্নিয়াত প্রচার, বাতিলের পথরােধ এবং কাদেরিয়া ত্বরীকা প্রতিষ্ঠার শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ড। 


গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ 


গাউসিয়া কমিটি মূলত একটি সমাজ সংস্কার মূলক অরাজনৈতিক আন্দোলন। সমাজ সংস্কারের পূর্বশর্ত হলাে ব্যক্তি সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ; অর্থাৎ যারা এই সমাজ সংস্কারে নেতৃত্ব দেবে প্রথমে তাদের আত্মশুদ্ধি নিশ্চিতকরণ। এজন্যে গাউসিয়া কমিটির পরিকল্পনা হলাে- 

১. গাউসুল আ'যম জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু'র সিলসিলাহর কামিল প্রতিনিধির হাতে বায়'আত ও সবক গ্রহণের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির এ পাঠশালায় অন্তর্ভুক্তকরণ। 

২. গাউছিয়া কমিটির সদস্য বানিয়ে তাদেরকে এমন প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে তারা ধীরে ধীরে আমিত্ব, হিংসা বিদ্বেষ, লােভ- লালসা ও অহঙ্কারমুক্ত পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে পরিণত হয়। 

৩. সুন্নীয়তের আকীদা এবং ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির সাথে সাথে উভয় বিষয়ে প্রয়োজনীয় মৌলিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নেত্বকের উপযােগী। কর্মি হিসেবে গড়ে তােলা। 

৪. সুন্নীয়ত ও ত্বরীকতের দায়িত্ব পালনে, বিশেষত মাদরাসা, আনজুমান এবং মুর্শিদে বরহকের নির্দেশের প্রতি আস্থাশীল এবং মুর্শিদের বাতলানাে পথে নিবেদিত হয়ে নবী প্রেমিক এবং খােদাপ্রাপ্তির পথ সুগম করার অনুশীলনে নিরলসভাবে এগিয়ে চলার শপথ গ্রহণ করা। উপরােক্ত বৈশিষ্ট্যে গড়ে উঠা গাউসিয়াতের কর্মী বাহিনীর হাতে এ সমাজের পরিকজির দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে সমাজ সংস্কারের মধামে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া। কারণ বর্তমানে এ সমাজ, নারী এবং সমগ্র বিশ্বে অশান্তির পেছনে যে কারণটি প্রধান তা তাহলে অযােগ্য, অশুদ্ধ, লােভী, হিংসুক, অহংকারী এবং দাম্ভিক ব্যক্তিদের নেতৃত্বে সমাজ রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়া। বদ- আক্বীদা এবং কোরআন সুন্নাহ বিরােধী শিক্ষা ও চেতনাসম্পন্ন নেতারা সমাজকে ধরে ধীরে ধীরে জাহেলিয়াতের দিকেই নিয়ে গিয়েছে। তাই জাহেলিয়াত দূর করে অবারো ইসলামের দিকে এ সমাজকে যারা নিয়ে আসবে, আগে তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে আলােকিত মানুষ হিসেবে। এ আলােকিত নেতাদের বাতি থেকে হাজার হাজার বাতি প্রজ্জ্বলিত হয়ে সমস্ত অন্ধকার দূর হবে। তাই, গাউসিয়া কমিটির পরিকল্পনা হলাে প্রথমে পরিশুদ্ধ নেতা সৃষ্টি করা এর পরে তাদের দিয়ে সমাজ শুদ্ধি করণ নিশ্চিত করা। সিলসিলাহর মাশায়েখ হযরাত প্রদত্ত ফজর, মাগরিব এবং এশার নামাজান্তে পঠিতব্য ছবক, জিকির, দরূদ ও সালাতে আওয়াবীন আদায় করা হয় নিজের আত্মার উন্নয়নের জন্য, আর গাউসিয়া কমিটির কর্মসূচি বাস্তবায়নের ছবক ও নির্দেশ হলাে আ সমাজের বহুমুখী উন্নয়নে। হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটী তার পীর খাজা চৌহরীর খিদমতে খােদা তালাশের জন্য পাহাড়ে জঙ্গলে ইবাদতে মশগুল হবার অনুমতি চেয়েছিলেন, কিন্তু পান নি, বরং পীর সাহেব কেবলা বলেছিলেন, একা একা খোদা তালাশের চেয়ে সমাজের অন্যানা মানুষকে পথ দেখানাের কাজে নিয়ােজিত থাকা অনেক উত্তম। সাথে সাথে নির্দেশ দেওয়া হলাে রেঙ্গুনে গিয়ে মানব সেবা ও দ্বীনি সংস্কারে নেতৃত্ব দিতে। সে নির্দেশ তিনি ১৯২০ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত রেঙ্গুন ও বাংলাদেশে যথাযথভাবে পালন করেছেন। আর সেই একই মিশনে এক একজন কর্মী হবার সৌভাগ্য অর্জিত হয়েছে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশর সদস্যদের। সুতরাং বুঝতে হবে যে, গাউসে পাক শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাদ্বীয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যেভাবে দ্বীনের পুনর্জীবনের জন্য শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ হিসেবে এসেছিলেন ঠিক তেমনি তাঁর এ মিশনের যুগশ্রেষ্ঠ খলীফা শাহানশাহে সিরিকোটী এবং গাউসে যামান তৈয়াব শাহ'র আগমনও হয়েছে জানি সংস্কারের মাধ্যমে এ সমাজ শুদ্ধি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে। গাউসিয়া কমিটির সদস্যগণ হলেন এ আন্দোলনের এক এক পর্যায়ের এক এক জন নিবেদিত প্রাণ সৈনিক। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বন্ধু আউলিয়ায়ে কেরাম সম্পর্কে বলেছেন, 


'আলা--- ইন্না আউলিয়া- আল্লাহি লা- খাওফুন ' আ'লাইহিম ওয়ালা-হুম ইয়াহযানুন, আল্লাযীনা আ-মানূ ওয়া কা-নূ ইয়াত্তাকূন, লাহুমুল বুশরা- ফিল হায়া-তিত দুনিয়া ওয়া ফিল আ-খিরাহ।"

অর্থাৎ, জেনে রাখ! নিশ্চয়ই ওলীগণের কোন ভয় নেই এবং দুঃখও নেই। যারা ঈমান এনেছে এবং পরহেযগারী অবলম্বন করেছে, তাদের জন্য দুনিয়া এবং আখিরাতে রয়েছে সুসংবাদ।

(আল- কোরআন) 


যাদের ঈমান আক্কীদা এবং আমলী যিন্দেগী পরিশুদ্ধ ও উত্তম তারাই আল্লাহর বন্ধু তাঁদের দুনিয়া এবং আখিরাতে রয়েছে অভয়, সুখ আর সুসংবাদ। গাউসিয়া কমিটি মূলত এমন একদল মানুষই সৃষ্টি করতে চায়- যারা ঈমান আকীদা, তাকওয়া অর্জন এবং প্রতিষ্ঠায় অপ্রকাশ্য শত্রু নাফসে আম্মারার এবং সামাজিক শত্রু বাতিল সম্প্রদায়ের সাথে যুগপৎ জেহাদে নিয়ােজিত সাহসী সৈনিক হিসেবে কাজ করবে। তারা একদিকে কাদেরিয়া ত্বরিকাভুক্ত এবং অন্যদিকে গাউসিয়াতের সামাজিক আন্দোলনের কর্মী হবার কারণে স্বয়ং গাউসুল আযম দস্তগীরের পক্ষ থেকেও অভয় বাণী ও সুসংসাদ পেয়েছেন। 


গাউসে পাক তাঁর এমন মুরীদদের উদ্দেশ্যে বার বার বলেছেন- মুরীদি লা- তাখাফ' অর্থাৎ হে আমার মুরীদ! ভয় করাে না। 


একদিকে আল্লাহর অভয় বাণী, অন্যদিকে এই মিশনের মহান ইমাম গাউসুল আ'যমের 'অভয়বাণী' সংগঠনের কর্মীদের প্রাণচাঞ্চল্যে এনেছে বাঁধভাঙ্গা জোয়ার। এ জোয়ারই একদিন সব বাতিলের ভিত ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে। কারণ, আল্লাহপাক ঘােষণা করেন, 

‘ওয়াকূল জা---- আল হাক্বক্বু ওয়া যাহাকাল বাতিল, ইন্নাল বা-ত্বিলা কা-না যাহু-কা।

অর্থাৎ, "বলুন! সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত, নিশ্চয়ই মিথ্যা অপসৃত হবারই। (আল কুরআন) 


তাই, সত্যের নিশান হাতে এ কাফেলার সফলতা অব্যাহত থাকবে- ইনশাআল্লাহু তাআলা। 


দ্বীনী খিদমতই আমাদের মিশন- ভিশন


দ্বীন রক্ষার্থে নিবেদিত প্রাণ এক ঝাঁক নিরলস কর্মির সাংগঠনিক নাম গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ। সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরিয়ার মহান রূপকার গাউসুল আযম আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু'র হাতে আজ থেকে সাড়ে নয় শত বছর পূর্বে দ্বীন ইসলাম লাভ করেছিল পূণজীবন। তাই তিনি মুহীউদ্দীন উপাধিতে পরিচিত হয়েছেন সৃষ্টিজগতে। গাউসুল আ'যম জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যেভাবে দ্বীনরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন- ঠিক সেভাবে হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সহ এ সিলসিলাহর মাশায়েখ হযরাতে কেরামের তরিকত দর্শনে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে আসছে দ্বীন রক্ষার মিশন। "দ্বীনকো বাচাও' নির্দেশটিকে যারা জীবনের প্রধান ব্রত হিসেবে কবুল করে "দ্বীন রক্ষা বাহিনীতে যােগ দিয়েছে তাদের এ মিশনের ধারাবাহিকতার সংযােগ ঘটবে অদূর ভবিষ্যতে ইমাম মাহদী আলায়হিস্ সালাম’র বাহিনীর সাথে এটাই তাদের বিশ্বাস। কারণ গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ ( ১৯৮৬ )'র প্রতিষ্ঠাতা গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছিলেন- 

'মেরে বাচ্চে, মাহদী আলায়হিস সালামকা ফৌজ বনেগা, আউর দাজ্জাল কা সাত জেহাদ করেগা।" 


প্রথম গাউসুল আজম আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি’র এই মিশনের মিলন ঘটবে শেষ গাউসুল আজম ইমাম মাহদী আলায়হিস সালাম’র চূড়ান্ত মিশনের সাথে। এ লক্ষে আজ এই সংগঠনের বিস্তৃতি এবং এর কর্মিদের আত্মশুদ্ধি ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান হবার প্রশিক্ষণ (তরবিয়াত) চলছে। দেশে বিদেশে সক্রিয় এর সকল সদস্যকে পর্যায়ক্রমে এ প্রশিক্ষনের আওতায় এনে একজন আদর্শ দ্বীনী সৈনিকে রূপান্তরিত করতে ইতােমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে- ‘গাউসিয়া তারবিয়াতি নেসাব’ নামক একটি সিলেবাস ভিত্তিক প্ররিপূর্ণ গ্রন্থ। ঈমান- আকিদা- আমল আখলাকের জ্ঞানসর্বস্ব এ কেতাবের প্রশিক্ষণ- এর প্রতিটি কর্মিকে কুরআন- সুন্নাহ ভিত্তিক জীবনাচারে অভ্যস্থ করে, পরিপূর্ণ সুন্নি মুসলমান হয়ে দ্বীনি নেতৃত্ব দিতে তৈরি করবে। একদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাচ্চা আলেম তৈরীর জন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা চলছে, অন্যদিকে সাধারণ মুসলমানদের ‘গাউসিয়া তরবিয়াতি নেসাব' ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। মােট কথা, এ সিলসিলার সাথে ওতােপ্রােতভাবে জড়িত মুরীদগণ দ্বীন রক্ষার আন্দোলনের আদর্শ কর্মি ও নেতৃত্ব হয়েই গড়ে ওঠছে। সিলসিলায়ে কাদেরিয়ার মুরীদদের শুধু 'মুরীদ' হিসেবে নয়, বরং মুরাদ হিসেবেও গণ্য করা হয়। কারণ তারা দ্বীনের খিদমত করবে। আর খিদমতে উৎসর্গিতদের জন্যই রয়েছে ত্বরিকতের প্রকৃত নিয়ামত। 


হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলতেন- 

‘বেগায়ার খেদমত সে কুচ দেনে কেলিয়ে জি- নেহী চাহতেহে'। 


সুতরাং খিদতম ছাড়া কিছু মিলবেনা। তা, এ ত্বরিকার সকলকেই দ্বীনের সেবক হয়ে মাঠে নামতে হবে। নবী- অলীগণ যুগেযুগে যে দায়িত্ব পালন করে এ দ্বীনকে রক্ষা করে গেছেন- সে মহান কাজে নিয়ােজিত থাকাটাই সবচেয়ে বড় ত্বরিকত দর্শন। 


শাহেনশাহে সিরিকোট রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলতেন, "ইয়ে ফকিরী কুচ নেহী হ্যায়- মখলুককা খিদমত বহুত বড়া ইবাদত হ্যায়'। 


তাঁর এ দর্শনকে শির ধার্য করেই এগিয়ে যাচ্ছে গাউসিয়া কিমিটি বাংলাদেশ। হযরত শেখ সাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, 


ত্বরিকত ব-জুজে খেদমতে খলকে নিস্ত 

না তসবিহ না সাজ্জাদাহ ওয়া দলকে নিস্ত


অর্থাৎ, ত্বরিকত বলতে ‘খেদমতে খলক’ বুঝায়, 

তসবিহ, জায়নামায কিংবা আলখেল্লা নয়। 


আর এর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট এবং অপরিহার্য হলাে দ্বীনি খিদমত। দ্বীন মানুষের দুনিয়া- আখেরাত উভয় জগৎ এবং দেহ- রূহ উভয় প্রয়ােজন মেটানাের কথা বলে। মানুষের জন্য উত্তম সেবা হলাে দ্বীনি সেবা- যা তাঁর শরীর-আত্মা দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ নিশ্চিতকারী। তাই ‘দ্বীনকো বাচাও’ বলতে আমরা খিদমতে খলক’র সবোচ্চ প্রয়াস বুঝতে হবে। এই সিলসিলার সবক এবং উপদেশগুলাের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলাে, 

১.আত্মশুদ্ধি করন বা আত্মােন্নয়ন 

২.অপরকে শুদ্ধিকরন ও উন্নয়ন 


যা খিদমতে খালক্ হিসেবে গণ্য। সিলসিলার মাশায়েশ হযরাতে কেরাম ফজর, মাগরিব এবং এশা নামাযের পর আদায়ের জন্য যে সব সবক দিয়ে থাকেন তা হলাে নিজের উন্নয়নের জন্য। আত্মশুদ্ধিমূলক এই সবকের সমান্তরালে সমাজের অপরাপর মানুষকে সত্যের উপর অটল রাখতে বলা হয়, দ্বীনের খেদমত করতে নিজেকে বাঁচাতে বলা হয়- নফস শয়তান হামারা দুশমন হ্যায় উসকো মুকাবেলা করাে, আর অন্যদের বাঁচাতে বলা হয়- ‘বাতেল ফেরকো কি মুকাবেলা করো। 


হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, 

"শুধু নিজের পেট ভরানােতাে কুকুরের কাজ। 

অর্থাৎ মানুষ সামজিক জীব বিধায় তাকে এ সমাজের অন্যদের প্রয়ােজনের কথা স্মরণ রাখতে হবে। 


প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হযরত সিরিকোটি সাহেব তাঁর পীর খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র কাছে আরজ করেছিলেন যেন তাকে নির্জন পাহাড়ে জঙ্গলে গিয়ে গােপনে ইবাদত করার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু খাজা চৌহরভী তাঁকে সেই এজাজত না দিয়ে বলেছিলেন যে, এরূপ জনমানব শূন্য অঞ্চলে গিয়ে নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য ইবাদত করার চেয়ে সর্বসাধারণে গিয়ে দ্বীনের খিদতম করা অনেক উত্তম। মূলত এ সিলসিলাহর মুরীদদের আধ্যাত্মিক উন্নতির সিড়ি হলাে দ্বীনি খিদমত যা মানুষের সর্বোত্তম সেবা। আর এ কারণেই এ ত্বরিকার মুরীদদের জন্য রয়েছে ‘মুরাদ হবার সৌভাগ্য, আর এর কারণ হলাে যে তারা দ্বীনী খিদমতে সমগ্র জীবন অতিবাহিত করবে। জানা যায়, হযরত ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু’র মধ্যেও জীবনের কোন এক বিশেষ মুহূর্তে খােদা প্রেমের প্রবল জোয়ারের ধাক্কা লাগে এবং তিনি ও পাহাড় জঙ্গলের নির্জনতায় গিয়ে ইবাদত- বন্দেগীতে লিপ্ত হবার মনস্থ করেছিলেন। আর স্বয়ং রাসুল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হাজির হয়ে তাঁকে সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনেন এবং উপদেশ দিলেন যে, হে নােমান তােমাকে তাে নিজের জন্য নয় বরং সমগ্র মুসলিম মিল্লাতের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই তিনি আর অরণ্যে না গিয়ে মুসলিম মিল্লাতের খিদমতে মনােনিবেশ করলেন। তাঁর বে- মেসাল খিদমতের বদৌলতে আজ ইসলামের মূলধারা সুন্নিয়াতের সংরক্ষণে হানাফী মাজহাব এক অনন্য অবদানের জীবন্ত সাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান। আল্লাহর মেহেরবানী যে, আজ আমরা শুধু শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী রাহমাতুল্লিল আ’লামীনের উম্মত নই, সাথে সাথে শ্রেষ্ঠ মাজহাব হানাফী এবং শ্রেষ্ঠ ত্বরিকা 'কাদেরিয়া’র অন্তর্ভুক্ত হবার সৌভাগ্য অর্জনের সুবাধে 'দ্বীনি খিদমত’র মতাে শ্রেষ্ঠ সেবার আদর্শিক ধারাবাহিকতার অনুকুলে শামিল থাকতে পেরেছি। 


কুরআনে করিমের ভাষায়-

‘কুনতুম খায়রা উম্মতি উখরেজাত লিনাস তামুরুনা বিল মারুফ ওয়াতান হাওনা আনিল মুনকার' 

"তােমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত মানব জাতিকে সৎ কাজের আদেশ দিতে আর অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখতে ....। "( আল- কুরআন)


তাই, নিজের দরবেশ সন্ন্যাসি হবার মতাে আত্মকেন্দ্রিক প্রয়াসকে নিরুৎসাহিত করে সমগ্র সৃষ্টির মহাকল্যাণ সাধনের ব্রতই এই সিলসিলার তথা গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ এর আসল মিশন। কবি যথার্থই বলেছেন, 

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে- আসে নাই কেহ অবনী পরে, 

সকলের তরে সকলে আমরা- প্রত্যেকে মােরা পরের তরে। 


তাই, এই মহা দ্বীনি মিশনের পথিকৃৎ বারবার তাগিদ দিতেন 'কাম করাে দ্বীনকো বাঁচাও- সাচ্চা আলেম তৈয়ার করাে। তিনি বলতেন- 'ওহাবী- কাদিয়ানী দ্বীন ও দেশের শত্রু- তাদের কবল থেকে নিজকে এবং অন্যদেরকে বাঁচাও '। 

গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ ও বলতেন, বাতেলের সাথে আদর্শিক মােকাবেলায় লিপ্ত থাকতে। 

অদৃশ্য দুশমন নফস শয়তান’ এবং প্রকাশ্য দুশমন ভ্রান্ত মতবাদীদের কবল থেকে আত্মরক্ষা এবং অন্যদের বাঁচানাের আদর্শিক যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে দরকার শরিয়তের সাচ্চা আলেম, আর ত্বরিকতের খিদমতে জীবন উৎসর্গকারী 'মুরাদ' স্তরের সৌভাগ্যবানদের। আর 'মুরাদ' বলতে বুঝায় সে সব মুরীদগণকে যাদের নিজের পীর মুর্শিদ পছন্দ করে মনােনীত করেছেন- দ্বীনি খিদমতের জন্য। এসব মুরীদ তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করবে দ্বীনি খিদমতে- এটাই কামনা করেন- পীরে কামেল। হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর মুরীদ আলহাজ উজির আলী সওদাগরেরকে বলেছিলেন 'তুম একিলা জান্নাতমে জায়েগা তাে মখলুককা কেয়া ফায়দা হােগা ? কারণ তিনিও ভেবেছিলেন যে, ব্যবসায়- বাণিজ্য থেকে ইস্তফা দিয়ে মসজিদে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়তে। আর এ আত্মকেন্দ্রিকতা পছন্দ করলেন না এ মহান 'পীর এ মাঁগা' হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-কারণ তিনি তাঁকে ‘মুরাদ' হিসেবে কবুল করেছিলেন। হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর শতবর্ষ বয়সের শারীরিক পিছুটানকে উপেক্ষা করে এ দেশে প্রতিনিয়ত সফর করছেন দ্বীনি বাগানকে সতেজ রাখতে। একবার বাংলাদেশে রওনা হবার প্রাক্কালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন লাহােরে। সঙ্গত কারণে শাহেজাদা হুযূর আল্লামা তৈয়্যব শাহ কেবলা তাঁকে সফর স্থগিত রাখবার জন্য আরজ করেছিলেন। কিন্তু গুরুতর অসুস্থতা সত্ত্বেও এ বর্ষীয়ান দ্বীনি খাদেম হাজার হাজার মাইলের বাংলাদেশ সফর স্থগিত করার প্রস্তাব অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন- 

"নেহী, মুঝেহ প্লেন মে চড়া দো, 

আগর রাস্তে মে মেরী মউত হােগী, 

তাে মাই আল্লাহ সে কেহ চেকুঙ্গা কে, 

এয়া আল্লাহ তেরী মাখলুককি খিদমত করতে করতে, 

মেরী মউত হুই।"


হযরত সিরিকোটি হুজুর যেভাবে জীবনের শেষ মুহূর্তটিও দ্বীনি খিদমতে ব্যয় করেছেন ঠিক সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এদেশে সুন্নিয়াতের পূণর্জাগরণে এবং সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরিয়ার প্রসারে বে মেসাল খিদমত আনজাম দিয়েছেন- যা আজ সর্বজন স্বীকৃত। বর্তমানে খিদমতের এ নজীর বিহীন ঐতিহ্যের ধারক- বাহক হয়ে এ মিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। হুজুর কেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ মাদ্দাজিল্লুহুল আলী  এর অব্যবহিত পরই শুরু হবে আল্লামা পীর সাবির শাহ মাদ্দাজিল্লুহুল আলীর নেতৃত্ব। এভাবে চলতে থাকবে এ মিশনের অগ্রযাত্রা- যা মিলিত হবে সর্বশেষ ইমাম এবং গাউসুল আজম মাহদী আলায়হিস সালামের সৈনিকদের মােহনায়।

 

কর্মক্ষেত্র : সংক্ষিপ্ত নমূনা 


আত্মশুদ্ধি ও উন্নয়ন : প্রথমে নিজের কথা ভাবতে হবে, তারপর পরিবার এবং সমাজের অপরাপর মানুষের কথা- এটাই কুরআনের নির্দেশ। বলা হয়েছে-

‘কু আনফুসেকুম ওয়া আহলে কুম নারা'-

তুমি নিজেকে রক্ষা কর আগুন থেকে এবং তােমার পরিবার- পরিজনকে।  (আল- কুরআন)


রাহনুমায়ে শরিয়ত ও ত্বরিকত আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ মাদ্দাজিল্লুহুল আলী সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরিয়ায় মুরীদ করানাের অব্যবহিত পর যে, অসিয়ত নসীহত করেন এর একটি হলাে- 'নফসে শয়তানকা মুকাবেলা করে আউর বাতেল ফেরকোসে আপ আপকো বাচায়ে। সিলসিলাহর একজন মুরীদ হিসেবে আমাদের সকলের জন্য নির্ধারিত সবক আদায়সহ এ নির্দেশের আনুগত্য আপরিহার্য। তাই গাউসিয়া কমিটির কর্মি সমর্থক- নেতৃবৃন্দ নির্বিশেষে নিজের আধ্যাত্মিক উন্নয়ন এবং আত্মরক্ষামূলক আধ্যাত্মিক প্রয়াস হিসেবেঃ


১.পাঞ্জেগানা নামাযের সাথে সাথে ফজর- মাগরিব ও এশা নামাযের সবক গুলাে আন্তরিকতা ও মহব্বত সহকারে আদায় করবে যাতে রূহানি তরক্কি অব্যাহত থাকে। 

২.সিলসিলা'র মারকাজ খানকাহ- মাদরাসা গুলােতে নিয়মিত আসা- যাওয়া করবে এবং এর অনুষ্ঠানগুলােতে যথাসাধ্য অংশ নেবে। (খতমে গাউসিয়া, গেয়ারভী শরীফ, ওরস শরীফ ও অন্যান্য)। 

৩.নফস শয়তানের মুকাবেলা জেহাদে আকবর। শয়তানের কুপ্ররােচনার কারণেই আমিত্ব- অহংকার প্রশ্রয় পায়। 


হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি বলতেন- 

“যার মধ্যে আমিত্ব আছে তার মধ্যে ত্বরিকতের গন্ধও নাই। তাই সব সময় নিজেকে সর্বনিকৃষ্ট মনে করাই ত্বরিকতের প্রধান সবক তা নিজের জীবনের প্রতিটি আচার-আচরণে, চাল- চলনে এমকি মনােভাবে অনুশীলনের নিরন্তর প্রয়াস চালানােকে অভ্যেসে পরিণত করে নিতে হবে। যে যত বড় পদবী ধারন করবে সে ততবেশি আমিত্ব-অহংকার ঝেড়ে ফেলবে। এর ব্যতিক্রম কখনাে কাম্য হতে পারে না। 


৪. বাতিল ফেরকা থেকে আত্মরক্ষার জন্য দরকার প্রয়ােজনীয় ইলম বা জ্ঞান। দরকার সৎসঙ্গ। পীরভাইদের সাথে চলাফেরা-সুন্নি প্রতিষ্ঠানগুলাের সাথে যােগাযােগ রাখা ত্বরিকতের কাজে মনােনিবেশ করা এ জন্য জরুরি। বিশেষত ঈমান- আকিদা- আমল- আখলাক এবং ত্বরিকত সুন্নিয়ত সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে কমপক্ষে ‘গাউসিয়া ত্বরবিয়াতি নেসাব ' এবং মাসিক তরজুমান নিয়মিত অধ্যয়নের অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। সুন্নি আক্বিদা, বাতিলের বক্রোক্তির জবাব, বিশেষত, নিজ সিলসিলাহ সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় জ্ঞান হাসিল না করলে অন্যদের বুঝানাে তাে দূরের কথা নিজেকে রক্ষা করাও কঠিন হয়ে যেতে পারে। আর যারা বাইরের লােকদের দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব নেবে- তাদের দরকার কুরআন- সুন্নাহ- ফেকাহ- ত্বরিকা সম্পর্কিত আরাে বেশি জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ। 


সমাজ ও দ্বীনি সংস্কার 


আত্মশুদ্ধি ও আত্ম প্রতিষ্ঠ যােগ্য কর্মিদের নিয়েই খিদমতের মাধ্যমে সমাজের সংস্কারের মহাব্রত পালনে এগিয়ে আসতে হবে। নিজে বাঁচ- তারপর পরিবারকে বাঁচাও, এ কুরআনী নির্দেশ অনুসরণ করে নিজ পরিবার, প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন সহ সমাজের অন্যান্য মানুষের কাছে সত্য ও শান্তির বানী পৌঁছিয়ে দেওয়াই এই মিশনের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যের সর্বোচ্চ অর্জন নির্ভর করে এক ঝাঁক প্রশিক্ষিত 'দায়ী ( দাওয়াত দাতা )' র নিরন্তর প্রয়াস এবং যুগােপযােগি কর্মকৌশল নির্ধারণের উপর।


আল্লাহ জাল্লা শানুহু এ সম্পর্কে এরশাদ করেন- 

"উদউ ইলা সাবিলে রাব্বিকা বিল হিকমতে ওয়াল মাউয়েজাতুল হাসানা'- 

অর্থাৎ তােমরা মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় ডাক হিকমত (কৌশল) সহকারে এবং উত্তম উপস্থাপনার মাধ্যমে।' (আল- কুরআন)


আর তাই হিকমত ও উত্তম উপস্থাপনা শিক্ষা দিতে দরকার নিয়মিত কর্মি প্রশিক্ষণ। যে যত বেশি তাই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ আয়ত্ব করে তা কর্মক্ষেত্রে প্রয়ােগ সাফল্য দেখাতে পারবে- তাকে ততবেশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেতৃত্বের জন্য মনােনীত করতে হবে। এভাবে সুন্দর কর্মকৌশল ও কর্মসূচির উপর ভিত্তি করে আদর্শ কর্মি বাহিনীর রুটিন ওয়ার্কগুলাের অতিসংক্ষেপ রূপরেখা হবে নিম্নরূপ। দাওয়াত-দাওয়াতী দায়িত্ব পালনকারীরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত। 


বলা হয়েছে- 'কুনতুম খায়রা উম্মতি উখরেজাত লিননাস তা মুরুনা বিল মারূফি ওয়াতান হাওনা আনিল মুনকার। 

এ আয়াতে এ সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের শ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে- 

যারা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎকাজ হতে বিরত রাখার কাজে নিয়ােজিত। 


আর একাজে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ হলেন স্বয়ং আল্লাহর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। কুরআনে করিমে যাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে- 


ইন্না আরসাল। নাকা শাহেদাঁও ওয়া মুবাশ্বেরাঁও ওয়ানাযিরা ওয়া দায়ীয়ান ইলাল্লাহে বেইজনিহি। ওয়া সেরাজাম মুনীরা’- 

অর্থাৎ হে হাবিব! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী (হাজির- নাজর), সুসংবাদদাতা এবং ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে দাওয়াতদাতা হিসেবে এবং উজ্জ্বল আলােকবর্তিকারূপে। (আল কুরআন)


যুগে যুগে অন্যান্য নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং আহলে বাইত- অলি-আউলিয়াগণ 'দায়ী’র দায়িত্ব পালন করে এ পৃথিবীতে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছেন। তাই এ দায়িত্ব মূলত নবী আলাইহিস সালামগণের দায়িত্ব যা পালনের সুযােগ লাভ আমাদের জন্য সৌভাগ্যই বটে। এজন্য হুজুর কেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ মাদ্দাজিলুহুল আলী একবার ঢাকা মুহাম্মদপুরস্থ কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলীয়া মাদরাসাস্থ খানকা শরীফের হুজরায় গাউসিয়া কমিটির খিদমদ সম্পর্কে (এ অধমকে) বলেছিলেন- 

'শুকরিয়া আদা করাে কে আপ লােক আম্বিয়া আলাইহিস সালাম কা ডিউটি মে দাখেল হ্যায়। 


অবশ্য এর সাথে সাথে একথাও বলেছিলেন যে- 

এ দায়িত্বকে যে যতটুকু কদর করবে (সম্মানের সাথে পালন করবে), সে ততটুকু ফায়দা লাভ করবে, আর বেকদরীর পরিণতিতে অর্থাৎ এ সুযােগের সদ্ব্যবহার না করলে তা কেড়ে নিয়ে অন্যকে দেওয়া হবে। 


শুধু তাই নয়- হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি বলতেন- 

'বাজি আগর চাহে তাে সুকনা লাকড়ি সে ভি কাম লে সেকতা।'


সুতরাং এ দায়িত্ব পালনকারী কোন নেতা-কর্মীর আমিত্ব- অহমিকা বরং তার নিজের জন্যই বিপদজনক হবে। কারণ, আমাদের 'সাহেবে কাশফ' মাশায়েখগণ যে কোন অনুপযুক্ত ব্যক্তি (শুকনা লাকড়ি) কে দিয়ে অধিকতর কাজ আদায়ের ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। তাই এ সংগঠনের দায়িত্ব প্রাপ্ত যােগ্য 'দায়ী' (দাওয়াতদাতা) আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে বদ্ধপরিকর। দাওয়াতের কয়েকটি ধরণ নিম্নরূপ :    


              গাউসিয়া তারবিয়াতি মজলিশ 

এ মজলিশে পঠিতব্য সিলেবাসভিত্তিক অনবদ্য গ্রন্থ হলাে 'গাউসিয়া তারবিয়াতি নেসাব '। স্থানীয় গাউসিয়া কমিটি কিংবা বিদ্যমান পীরভাই বা শুভাকাঙ্খীদের উদ্যোগে ডাকা হবে এ মজলিশ। এতে দাওয়াত দেওয়া হবে সে সমাজের অন্যান্যদের। প্রতি সপ্তাহের সুবিধাজনক দিবস ও সময়ে এ মজলিশ কায়েম করতে সক্ষম হলে এক বা দুই বছরের মধ্যে কোন এলাকায় এই কিতাব খতম করা সম্ভব। হবে। কোন এলাকায় এর খতম উপলক্ষে একটি আড়ম্বরপূর্ণ মাহফিলও আয়ােজন করা যেতে পারে। এ মাহফিলে সর্বোচ্চ অংশ গ্রহণকারী এবং জ্ঞান আহরণকারী ব্যক্তিদের বাছাই করে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। সংগঠনের যে শাখা এ আয়ােজনে যতবেশি সাফল্য দেখাতে পারবে তাদের কেন্দ্রীয়ভাবে পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে- যা এই শিক্ষা প্রশিক্ষণ কর্মশালার সফল বিস্তারের সহায়ক হতে পারে। কর্মিদের মধ্যে যারা এ নেসাব আয়ত্ব করবে তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেতৃত্বে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। গাউসিয়া তরবিয়াতি নেসাব ' পাঠের মজলিশ কী রূপ হবে তা উক্ত গ্রন্থে বর্ণিত আছে- পরিস্থিতি এবং প্রয়ােজনানুসারে একে আরাে সুন্দরভাবে সাজানাে যেতে পারে। বিশেষ করে, এ সিলসিলাহর প্রতিটি খতমে গাউসিয়া এবং গেয়ারভী শরীফ মাহফিলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এ নেসাব পাঠের মজলিশকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কখনাে স্থানীয় মসজিদ, কখনাে স্থানীয় খানকাহ কিংবা কারাে বাড়ি- ঘর এ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতিটি মজলিশে প্রশ্নোত্তর পর্ব রাখা যেতে পারে। যা উপস্থিত সকলের জন্য কল্যাণকর হতে পারে। বছরে কমপক্ষে একবার দাওয়াতী সপ্তাহ বা দাওয়াতী পক্ষ বা দাওয়াতী মাস ঘােষণা করে সে মাস ব্যাপক মানুষকে এ তরবিয়াতি মজলিশ মুখী করার উদ্দ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। রমজানুল মুবারককে আমরা এ কাজের জন্য সুবিধাজনক সময় মনে করতে পারি। উল্লেখ্য, গাউসিয়া তারবিয়াতি নেসাব’ যাঁর নিদের্শে রচিত হয়েছে তিনি হলেন। হযরত পীর সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ মাদ্দাজিলুহুল আলী। তিনি গাউসিয়া তারবিয়াতি মজলিশ' এর দাওয়াত কার্যক্রমকে দাওরাহ এ দাওয়াতুল খায়ের (কল্যাণের পথে আহবান) নামকরণ করেছেন। তাঁর পরামর্শ অনুসারে গাউসিয়া কমিটির ভাইয়েরা প্রত্যেক বৃহস্পতিবার  বাদ মাগরিব মহল্লার কোন মসজিদে এ মজলিশ আয়ােজন করবে। এবং এ উপলক্ষে উক্ত মসজিদের মুসল্লি এবং মহল্লার সর্বসাধারণকে বাদ আসর থেকে মাগরিবের আজানের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জনে জনে সাক্ষাৎ করে মজলিশে উপস্থিত থাকার দাওয়াত জানাবে এবং কীভাবে উক্ত মজলিশকে সফলকাম করা যেতে পারে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন- এর কিয়দংশ 'গাউসিয়া তারবিয়াতি নেসাব ' গ্রন্থটির শুরুতে প্রদত্ত হয়েছে। সুতরাং 'দাওরাহ এ দাওয়াইতুল খায়ের' কে আমাদের সাংগঠনিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করে- এ সংক্রান্ত হুজুর কেবলার উপরােক্ত দিক- নির্দেশনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ কাজে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।


 সেমিনার- ওয়াজ মাহফিল

 

বিভিন্ন উপলক্ষে বা বিষয়ে আমরা সভা সেমিনার সিম্পােজিয়াম, ওয়ার্কসপ, আলােচনা, ওয়াজ মাহফিল আয়ােজন করে ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’র চিন্তা- চেতনা, আকিদা- আমল, সংস্কৃতি প্রচার প্রসারে ভূমিকা রেখে আসছি। যা আরাে জোরদার করা প্রয়ােজন। বিশেষত আয়ােজনগুলাে বিষয় ভিত্তিক গবেষণা মূলক আলােচনা হলে বেশি ফলদায়ক হতে পারে। 


ত্বরিকতের দাওরা 


গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলাে সিলসিলার দাওরা বিশেষত ত্বরিকতের নতুন ভাই বােনদের জন্য প্রয়ােজনীয় শিক্ষা- প্রশিক্ষণ ও নসীহতের ব্যবস্থা করা। এ ধরনের অনুষ্ঠান কোন অঞ্চলে হুজুর কেবলা’র মাহফিল এবং বায়াতী কার্যক্রম সম্পন্ন হবার অব্যবহিত পরেই করতে হয় যাতে নবাগত পীর ভাই-বােনরা তাদের জীবনের এ নতুন আধ্যাত্মিক অধ্যায় সুন্দর ও সহজভাবে গ্রহণ করে অগ্রসর হতে পারে। এ মাহফিলটিতে সিলসিলাহ’র সবক নসীহত, দ্বীনি খিদমত, আনজুমানের আনুগত্য করা এবং খতমে গাউসিয়া, গেয়ারভী শরীফ, মাদরাসা-খানকা পরিচিতি সহ প্রয়ােজনীয় করণীয়- বর্জনীয় বিষয়ে শিক্ষা-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মাহফিলটি একই সাথে নুতন- পুরাতনদের পরিচিতি ও মিলন মেলা হিসেবে পরিণত হতে পারে। একে আমরা পীর ভাই- বােনদের সম্মেলন নাম দিয়ে প্রতি বছর প্রতিটি কমিটির আওতায় অন্তত একবার আয়ােজন করা উচিত বলে মনে করি। সাচ্চা আলেম তৈয়ার করাে এই সিলসিলাহ’র মুরীদদের প্রতি আমাদের মাশায়েখ হযরতে কেরামের প্রধান বাণী হলাে- 

"কাম করাে দ্বীন কো বাঁচাও, সাচ্চা আলেম তৈয়ার করাে।"


তাই সাচ্চা আলেম তৈরীর লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদরাসা সহ আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া পরিচালিত মাদরাসা সমূহের প্রয়ােজনে সর্বাত্মক সহযােগিতা দেওয়া সংগঠনের কর্মিদের অপরিহার্য দায়িত্ব। প্রয়ােজন ও সামর্থ অনুসারে নতুন মাদরাসা কায়েমের প্রয়াস চালানাে আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। শাহেন শাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি বলেছেন, "মুঝেহ দেখনা হ্যায় তাে মাদরাসা কো দেখাে, মুঝসে মুহাব্বাত হ্যায় তাে মাদরাসা কো মুহাব্বাত করাে। সাচ্চা আলেম তৈরী’র এসব মারকাজ গুলােকে যে যত বেশি মুহাব্বাত সহকারে লালন পালন করবে সে ততবেশি ত্বরিকতের সুফল লাভ করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। 


খানকাহ প্রতিষ্ঠা


“মাদরাসা সে আলেম নিকেলতে আউর খানকাহসে অলী নিকেলতে মাশায়েখ হযরতের এই বাণী’র সফল বাস্তবায়নে আমাদেরকে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি খানাকাহ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে ও গুরুত্ব দিতে হবে। সম্ভাব্য সকল উপজেলায় অন্তত একটি খানকাহ প্রতিষ্ঠা সিলসিলাহ’র কর্মকাণ্ডকে মজবুত এবং দীর্ঘস্থায়ী করে রাখতে অত্যন্ত জরুরি। আজ এখানে কাল ওখানে করে সিলসিলাহ’র নিজস্ব কর্মকাণ্ড ধরে রাখা সহজ নয়। তাই দরকার নিজস্ব আধ্যত্মিক মারকাজ 'খানকাহ  শরীফ। নিয়মিত খতমে গাউসিয়া, গেয়ারভী শরীফ, তরবিয়াতি মজলিশ, পীর ভাই- বােনদের যােগাযােগ রক্ষা, এমনকি সংগঠনের দফতর হিসেবেও এ প্রতিষ্ঠানটির কোন বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, এই উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগত বিদেশী পীর দরবেশদের প্রথম প্রতিষ্ঠান ছিল খানকাহ নামক আস্তানা। তারপরই মসজিদ, তারপর মাদরাসা। আমাদের গাউসিয়া তারবিয়াতি মজলিশ’র নিয়মিত আয়ােজন এ সব খানকাহর অন্যতম দায়িত্ব হয়ে ওঠতে পারে। খানকাহগুলাে শরিয়ত- ত্বরিকতের শিক্ষা-প্রশিক্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আদিকালে- এখনও হয়ে ওঠতে পারে সে ঐতিহ্যের পথ ধরে। 


আনজুমানের আনুগত্য 


‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ মূলত আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার অংগ সংগঠন। তাই সর্বক্ষেত্রে আনজুমানের আনুগত্য করা এবং আনজুমান প্রদত্ত নিয়মিত অনিয়মিত- তাৎক্ষণিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঝাপিয়ে পড়া আমাদের দায়িত্ব। 


শাহেনশাহে সিরিকোট বলেছেন, 

“আনজুমান চালানা হুকুমত চালানা। 

হুজুর কেবলা তাহের শাহ মাদ্দাযিলুহুল আলী বলেছেন- 

"হুকুমত কে লিয়ে ফৌজ কা জরুরত হ্যায়- গাউসিয়া কমিটি আনজুমান কা ফৌজ হ্যায়।"


তাই বর্তমানে গাউসিয়া কমিটির প্রত্যেকটি কর্মি আনজুমানের এক একজন ফৌজ বা সৈনিক। ইনশাআল্লাহ, আমাদের জন্য এমন এক শুভদিন অপেক্ষা করছে- যেদিন এই ফৌজরা মিলিত হবে মাহদী আলায়হিস সালামের ফৌজদের কাফেলায়। 


হুজুর গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি বলেছেন-

"মেরে বাচ্চা মাহদী আলায়হিস্ সালাম কা ফৌজ বনেগা আউর দাজ্জাল কা সাত জেহাদ করেগা।"


সমাজ সেবা 


আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, মানুষের মৌলিক প্রয়ােজন- "অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে সরকার। এরপর ও মানুষ-মানুষের জন্য। যেহেতু ত্বরিকত-মানব সেবার প্রয়ােজনীয় দায়িত্ব পালনকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে। আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রেখে আসছি শুরু থেকেই। বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের বিভিন্ন কমিটি দাতব্য চিকিৎসা, অন্ন-বস্ত্র বিতরণ কর্মসূচিসহ সম্ভাব্য সব সেবামূলক কাজে অংশ নিতে হবে। মানুষকে জাগতিক সেবা দিলে তারা সহজেই আধ্যাত্মিক সেবা নিতে অনুপ্রাণিত হবে এটাই স্বভাবিক। 


জশনে জুলুছ ও বার্ষিক মাহফিল 


এ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ সংস্কার 'জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। আর এর রূপকার হলেন গাউসে জামান সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি- যিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। চট্টগ্রামে ১২ রবিউল আউয়াল এবং ঢাকায় ৯ রবিউল আউয়াল অনুষ্ঠিতব্য জশনে জুলুছকে সর্বাত্মক সফল করার দায়িত্ব আমাদের। এজন্য অন্তত তিন মাসের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার প্রত্যেকটি কমিটিকে। সাথে সাথে স্থানীয় ভাবে প্রয়ােজনীয় ক্ষেত্রে নতুন নতুন জশনে জুলুছ’র জন্ম দিতে হবে। জেলায় জেলায়, শহরে-বন্দরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে এ সংস্কৃতিকে। এছাড়া ১১ রবিউস সানি গাউসুল আজম আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি’র ওরস শরীফ ফাতেহা এয়াজদাহুম, ১১ জিলক্বদ শাহেন শাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি’র ওরস শরীফ, বিশেষত ১৫ জিলহজ্ব গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি’র ওরস শরীফসহ সম্ভাব্য ক্ষেত্রে অন্যান্য সব বার্ষিক আয়ােজনের প্রয়াস চালাতে হবে। যেমন মহররম মাসে শােহাদায়ে কারবালা স্মরণে, জমাদিউস সানিতে (২২ তারিখে) ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু’র স্মরণে মাহফিল আয়ােজন করা যেতে পারে। 


প্রকাশনাগুলাের প্রচার প্রসার


আনজুমানের প্রকাশনাগুলােকে মানুষের হাতে হাতে পৌছে দেওয়া আমাদের অন্যতম দায়িত্ব-কর্তব্য। গাউসে দাঁওরা খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি’র লিখিত ৩০ পারা দরূদ প্রন্থ মজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল 

(সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) ইসলামি দুনিয়ার এক বিরল সম্পদ। এটি বর্তমানে বাংলায় তরজমা সহ প্রকাশিত হচ্ছে পর্যায়ক্রমে। ৩০ পারা কুরআন এবং বুখারী শরীফের পর এমন উচ্চাঙ্গের আধ্যাত্মিক খনির আধার সম্পর্কে এখনাে ইসলামি জগত বেখবর বলা চলে। অথচ, এ কেতাবের মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের সিলসিলাহ’র বিশালতা ও গভীরতা- রূপ মাধুর্য।


১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৬ তারিখে গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত 'তরজুমান' ১ জানুয়ারী ১৯৭৭ থেকে যাত্রা করে অদ্যবধি ইসলামের মূলধারার প্রচার-প্রসারে প্রধান মাসিক পত্রিকার অবদান রেখে যাচ্ছে। গাউসিয়া তারবিয়াতি নেসাব একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার (Complete code of life) প্রতিচ্ছবি। শরিয়ত’র যাবতীয় মৌলিক জ্ঞান আকিদা আমল আখলাক সম্পর্কে অন্তত প্রয়ােজনীয় জ্ঞান অর্জন করে একজন সত্যিকারের মুমিন- মুসলমান হয়ে কবরে যেতে এই বইটি হতে পারে আমাদের নিত্যসঙ্গী। সিলসিলাহ’র সাজরা শরীফ প্রত্যেক পীর- ভাই বােনদের মুখস্থ থাকা উচিত। আওরাদুল কাদেরিয়াতুর রহমানিয়া গ্রন্থটি সিলসিলাহ'র মাশায়েখ হযরাতে কেরামের দৈনিক অজিফা সংকলন- যা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির সােপান হিসেবে কাজে লাগতে পারে। এছাড়া রয়েছে আনজুমানের প্রকাশনা বিভাগের অনেকগুলাে নিয়মিত অনিয়মিত গ্রন্থ- যা মানুষের ঘরে ঘরে পৌছানাের দায়িত্ব আমাদেরই। এ আখেরী যুগে ঈমান- ইসলামের হেফাজতে এপ্রকাশণাগুলাের গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং এ প্রকাশনাগুলাের স্বাদ গ্রহণ করে প্রথমত আমরা নিজেই উপকৃত হবাে এবং সাথে সাথে অন্যদের ও উপকৃত করার নিরন্তর প্রয়াস চালাতে হবে। উপরােক্ত কর্মকাণ্ডগুলাের সাথে সাথে আমাদের রয়েছে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’র গঠনতন্ত্রে বর্ণিত কর্মসূচি সমূহ। গঠনতন্ত্রে বর্ণিত লক্ষ্য- উদ্দেশ্য কর্মসূচির আলােকে যুগের দাবী এবং যে কোন পরিস্থিতির প্রয়ােজনে কেন্দ্রিয় কমিটি এবং আনজুমান ট্রাষ্ট'র পরামর্শ, নির্দেশ এবং অনুমােদনক্রমে আরাে বহু কার্যক্রম গ্রহণের সুযােগ রয়েছে। আমাদের পৃষ্ঠপােষক তথা দরবারে আলীয়া কাদেরিয়া সিরিকোট শরীফের সাজ্জাদানশীন হযরাতে কেরামের নির্দেশ এবং পরামর্শক্রমে এই সংগঠন এগিয়ে যাবে নিত্য- নতুন খিদমত কৌশল গ্রহণ করে।


এ সাথে উল্লেখ্য যে, এই সংগঠনের কেন্দ্রিয় দফতর বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত হলেও কর্মপরিধি বর্তমানে বাংলাদেশ অতিক্রম করে মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের বিভিন্নদেশে সম্প্রসারিত হয়েছে। হযরত বড় পীর গাউসুল আ'যম আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি’র গাউসিয়্যতের সমগ্র সীমানা জুড়ে এ মিশনকে পৌছিয়ে দেওয়া আমাদের ভিশন। গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন, বেলাদুল্লাহে মুলকী তাহতা হুকমী ওয়া ওয়াকতি কবলা কবলি কদ সফালী


(কসিদায়ে গাউসিয়া) ইনশাআল্লাহ একদিন বিশাল রাজ্য ব্যাপি চলবে এ দ্বীনি মিশন যার রূহানী নেতৃত্ব আসবে সে পর্বত শীর্ষের সাজ্জাদানশীন হযরতের পক্ষ থেকে-গাউসিয়্যতের আদর্শবাহী সে পতাকা পত পত করে উড়ছে সে পর্বতের শিরােপরি। ওয়া আলামী আলা রাসিল জেবালী। সত্যিই, আজ সে পর্বত চূড়া থেকেই আসছে গাউসিয়াতের এ মহামিশনের আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব। বর্তমানে এ নেতৃত্বে আছেন হযরত কেবলা তাহের শাহ ( মা.জি.আ. )। এরপরই দায়িত্ব নেবেন পীরে বাঙ্গাল খ্যাত আল্লামা পীর সাবির শাহ। 


এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলায়হি ভবিষ্যত্বাণী করেছিলেন যে, 

"তৈয়্যব ও তাহের কাম সাম্বালেগা আউর সাবির শাহ বাঙ্গালকা পীর হােগা।"


আর পীর সাবির শাহ’র জন্মের অব্যবহিত পর বাংলাদেশের মুরীদ ভক্তদের চিঠি দিয়ে জানান যে- সাবির শাহ পাকিস্তান কা লিডার হােগা আউর বাঙ্গালকা পীর হােগা। পীর সাবির শাহ’র নেতৃত্ব অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় প্রভাবশালী ও ব্যাপকতর হবে এতে সন্দেহ নেই। তিনি এখন পাকিস্তানের প্রভাবশালী নেতা হয়েছেন। সুতরাং বাঙ্গালীদের প্রভাবশালী পীর হিসেবে আবির্ভূত হবেন শীঘ্রই- সময়ের প্রয়ােজনে। তাঁর নেতৃত্বে এ মিশনের ব্যাপৃতি ছড়িয়ে পড়বে সবখানে- গাউসে পাকের গাউসিয়াতের সীমানা জুড়ে।


তাই আসুন ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’র সদস্য হয়ে এ মহা মিশনে নিজেকে শামিল করি। নিশ্চিত করি। দুনিয়া আখেরাতের উচ্চতর সম্মান- শান্তি ও কল্যাণ। আমিন। বেহুরমতে সায়্যিদিল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। 


সমাপ্ত


নিয়মিত পড়ুন ও সংগ্রহে রাখুন 

১. মাসিক তরজুমান' প্রতি চান্দ্রমাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত হয়। নিকটস্থ লাইব্রেরি, বুকস্টল ও হকারের কাছ থেকে আপনার কপি সংগ্রহ করতে পারেন। 

২. মাজমূ'আহ- এ সালাওয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৩০ পারা দরূদগ্রন্থ, প্রতি পারা ৪৮ পৃষ্ঠা, লেখক- গাউসে দওরা খাজা আবদুর রহমান চৌহভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। আপনার যে কোন বিপদ- আপদ, রােগ- বালাই থেকে মুক্তি এবং সৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে এ অলৌকিক দরূদ গ্রন্থটি তিলাওয়াত করুন, এবং খতম আদায় করুন। উপকৃত হবেন। উচ্ছারণসহ ১-৫ পারা বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। *

৩. ‘সিলসিলাহ এ আলিয়া কাদেরিয়ার শাজরা শরীফ'। 

৪. ‘আওরাদুল কাদেরিয়াতুর রহমানিয়া’ : এটি সিলসিলাহর মাশায়েখ হযরাতে কেরামের দৈনন্দিন অযীফার এক বিরল সংকলন। যা গাউসে জামান সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রাহ.) সংকলন করেন। 

৫. গাউসিয়া তারবিয়াতী নেসাব 

৬. 'নজরে শরীয়ত' : ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়ােজনীয় বিষয়াবলীর অনবদ্য এক সৃষ্টি। 

 ৭. ‘আমলে শরীয়ত' (নামায শিক্ষা) : ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়ােজনীয় বিষয়াবলীর অনবদ্য সংযােজন। শরিয়তের বিভিন্ন মাসআলার নির্ভরযােগ্য ব্যাখ্যা। 

৮. দরসে হাদীস। 

৯. এরশাদ-ই আ’লা হযরত।





Top