ভূমিকা
মহা-পরাক্রমশালী পরম পবিত্র করুনাময় মহান আল্লাহ তা’লার উপর ভরশা করে এবং তাঁর দয়ায়; বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট ও শেষ নবী ও রাসূল, উম্মতের কান্ডারী, করুনার আধার, মানবতার শান্তি-মুক্তি ও অগ্রগতির সর্বোত্তম আদর্শ, দয়াল নবী রাসূলে করীম (ﷺ) এর মহব্বত নিয়ে, অসংখ্য আউলিয়ায়ে কেরাম ও আমার পীর ও মুর্শীদ বিশ্বওলী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কু: ছে: আ:) ছাহেবানদের নজরে করমে, আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এর আকায়েদ সামনে রেখে “নূরে মুজাচ্ছাম” কিতাবখানা আপনাদের সমীপে পেশ করলাম।
প্রিয় পাঠক সমাজ! রাসূলে পাক (ﷺ) এর সৃষ্টি তথ্য নিয়ে বর্তমানে কেউ কেউ মতানৈক্য সৃষ্টি করা অপচেষ্টা করছে। কেউ বলছেন মাটির তৈরী আবার কেউ বলছেন পানির তৈরী আবার কেউ বলছেন নূরের তৈরী। তাই বিষয়টি নিয়ে আমি গবেষণা শুরু করলাম এবং অবশেষে হাতে কলম ধরি ও এই কিতাবখানা লিখতে শুরু করি। কিতাব খানি লিখার সময় পবিত্র কোরআন ও রাসূলে পাক (ﷺ) এর একাধিক ছহীহ্ হাদিসকে প্রাধান্য দিয়েছি। লিখার সময় আমার প্রিয়তমা বেগম সাহেবা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন, এজন্যে আমি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
মহান আল্লাহ পাক জ্ঞান দিয়েছেন সু-বিচার করার জন্য, চক্রান্ত করার জন্য নয়। অত্যান্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, অনেক নামী-দামী দুনিয়াদার আলেমরা রাসূলে পাক (ﷺ) কে আমাদের মত সাধারণ মাটির তৈরী মানুষ বা পানির তৈরী মানুষ প্রমাণের জন্য আদা-জল খেয়ে লেগেছে। এমনকি হযরত আদম (عليه السلام) এর সম্পর্কে নাজিলকৃত আয়াত গুলো এনে রাসূলে পাকের সম্পর্কে দলিল দেওয়ার অপচেষ্টা করে। সত্যকে মিথ্যা বানাচ্ছে আবার মিথ্যাকে সত্য বানাচ্ছে। আল্লাহ পাকই তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন।
প্রিয় মুসলীম ভাই ও বোনেরা! অত্র কিতাবে প্রত্যেকটি বিষয় ছাবিত বা প্রমাণ করার জন্য অগ্রাধিকার রূপে ‘ছহীহ্ ও হাছান’ পর্যায়ের হাদিস এনেছি এবং কোনটি ‘ছহীহ্ হাদিস’ আর কোনটি ‘জয়ীফ হাদিস’ তা ইমামগণের অভিমত সহকারে সু-স্পষ্ট ভাবে কিতাবের হাওয়ালা সহকারে উল্লেখ করেছি। পাশাপাশি কুখ্যাত ওহাবীদের অনেক ভ্রান্ত অভিযোগ স্পষ্ট দালায়েলের মাধ্যমে খন্ডন করেছি। উভয় পক্ষের দলিল উল্লেখ করে বিশ্লেষণ করেছি এবং স্পষ্ট দালায়েলে আলোকে নিরপেক্ষতার সাথে ছহীহ্ ও সঠিক সিদ্ধান্তটি উল্লেখ করেছি। আশাকরি কিতাবখানি অধ্যয়ণ করে আপনারা তৃপ্ত ও উপকৃত হবেন এবং এই ক্ষুদ্র মানুষটির জন্য দোয়া করবেন। কিতাবের খন্ড নাম্বার ও পৃষ্টা নাম্বার যেগুলো দেওয়া হয়েছে সে গুলো আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত কিতাব থেকে দিয়েছি। ছাপার ব্যবধান হলে খন্ড ও পৃষ্টা নাম্বার গুলো মিলবে না, তবে অশ্যই দলিল গুলো ঐ কিতাবে থাকবে। প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য লেখকের সাথে যোগাযোগ করার অনুরুধ রইল।
মুদ্রণের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব নির্ভুল করার চেস্টা করেছি, তথাপিত ভুল থাকাটাই স্বাভাবিক। মহৎ পাঠকগণ ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, ইহাই আশা করি। ভুল-ত্রæটি যা রয়েছে তা মুদ্রণজনিত ও অনিচ্ছাকৃত। কোন ভুল-ত্রটি পরিলক্ষিত হলে আমাকে জানালে পরবর্তী সংস্করণে ইহা সংশোধন করব ইনশা আল্লাহ। সকলের মঙ্গল কামনায়, ইতিঃ-
মুফতী মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জেহাদী।
মৌলভীবাজার, সিলেট।
০১৭২৩-৫১১২৫৩
❏ রাসূল (ﷺ) নূরের তৈরীর বিষয়টি কি?
সায়্যিদুল মুরছালিন, হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) এর সৃষ্টি তত্ত¡টি আকিদার বিষয় কিনা এ সম্পর্কে সু-স্পষ্টভাবে কোন আকায়েদের কিতাবে আলোচনা খুজে পাওয়া যায়না। অর্থাৎ আমার জানা মতে, পূর্ব যুগের কোন ফকিহ্-ইমাম এ বিষয়টিকে আকিদা হিসেবে আকায়েদের কিতাবে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেননি। ১. ইহার কারণ হচ্ছে পূর্ব যুগে এই বিষয়টি নিয়ে কোন এখতেলাফ ছিলনা।
বরং অনেক ফকিহ্ ও ইমামগণ এ বিষয়টিকে রাসূল (ﷺ) এর মর্যাদা হিসেবে তাঁদের স্ব স্ব শামায়েলের কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এ হিসেবে রাসূল (ﷺ) এঁর সৃষ্টি তথ্যের বিষয়টি সরাসরি আকিদার বিষয় না হলেও রাসূলে করিম (ﷺ) এর শান-মান ও মর্যাদা সম্পর্কীত বিষয়।
তবে বর্তমান যুগে কোন কোন আলিম এ বিষয়টিকে আকিদা হিসেবে সমর্থন করে থাকেন। আমরা তাদের এই মতটিকে অমূলক মনে করিনা। কেননা বিষয়টি রাসূল পাক (ﷺ) এঁর সৃষ্টি সম্পর্কীত আকিদা ইহাই যুক্তিসঙ্গত কথা। যেহেতু বিষয়টি কোন আমল বা আহকামের বিষয় নয় বরং বিশ্বাসের সাথে জড়িত বিষয়। অতএব, ইহা রাসূলে পাক (ﷺ) এঁর সৃষ্টিতত্ত¡ সম্পর্কীত আকিদা। উল্লেখ্য যে, আদিকা সাধারণ দুই রকম হয়। ১. আকিদায়ে উসূলী এবং ২. আকিদায়ে ফুরূয়ী। প্রথম প্রকার আকিদা অস্বীকার করলে কুফর হবে ও ঈমান থেকে খারিজ হবে। আর দ্বিতীয় প্রকার আকিদা অস্বীকার করলে মু’দীল বা পথভ্রষ্ট হবে, তবে ঈমান থেকে খারিজ হবেনা। যেমন আকিদার কিতাবে আছে, পবিত্র মেরাজ শরীফের মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত কেউ অস্বীকার করলে কুফর হবে আর মসজিদে আকসা থেকে ছিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত অস্বীকার করলে মু’দীল বা পথভ্রষ্ট হবে। অথচ এই দু’টি বিষয়ই আকিদার অন্তর্ভূক্ত। আকাইদের কিতাব সমূহের মধ্যে প্রসিদ্ধ কিতাব হল ‘শারহু আকাইদিন নাছাফী’। উক্ত কিতাবে রাসূলে আকরাম (ﷺ) এঁর ছিদরাতুল মুন্তাহা এবং আরশ গমন কিংবা আরো উপরে আরোহন সম্পর্কে আল্লামা সাদ উদ্দিন তাফতাজানী (رحمة الله) পরিস্কার করে বলেছেন,
وقوله ثم الى ما شاءالله تعالى اشارة الى اختلاف اقوال السلف فقيل الى الجنة وقيل الى العرش وقيل الى فوق العرش وقيل الى طرف العالم فالاسراء وهو من المسجد الحرام الى بيت المقدس قطعى ثبت بالكتاب والمعراج من الارض الى السماء مشهور ومن السماء الى الجنة او الى العرش او الى غير ذلك احاد
-“অতঃপর আল্লাহ তা’লা যা চেয়েছেন’ এই কথার ব্যাখ্যা হল, পূর্ববর্তীগণের মাঝে এই ঈশারার মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ বলেছেন জান্নাত পর্যন্ত, কেউ বলেছেন আরশ পর্যন্ত, কেউ বলেছেন আরশের উপরে পর্যন্ত, কেউ বলেছেন জগতের শেষ পর্যন্ত। মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত এই ইসরা হল কিতাবুল্লাহ দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। জমীন থেকে আসমান পর্যন্ত মেরাজ হাদিসে মাশহুর দ্বারা প্রমাণিত। আর আসমান থেকে জান্নাত পর্যন্ত অথবা আরশ পর্যন্ত অথবা অন্যান্য স্থানে যাওয়ার বিষয়টি খবরে ওয়াহেদ দ্বারা প্রমাণিত।” ২.আল্লামা সাদ উদ্দিন তাফতাজানী: শারহু আকাইদিন নাছাফী, ১৪৪ পৃ:;
সুতরাং শারহু আকাইদে নাছাফীর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, কোন কোন আকিদা হল আকিদায়ে উসূলী এবং কোন কোন আকিদা হল আকিদায়ে ফুরূয়ী। তাই রাসূল পাক (ﷺ) নূরের তৈরীর বিষয়টি আকিদায়ে ফুরূয়ীর অন্তর্ভূক্ত। কেননা ইহা বহু সংখ্যক হাদিস থেকে প্রমাণিত এবং পবিত্র কোরআনেও এ ব্যাপারে ঈঙ্গিত রয়েছে।
যাই হোক আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এঁর সৃষ্টি তথ্যটি আকিদার বিষয় হোক অথবা শান-মান ও মর্যাদার বিষয় হোক, পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমাদের জানতে হবে মূলত আল্লাহর রাসূল (ﷺ) মাটির তৈরী নাকি নূরের তৈরী।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর উলামায়ে কেরামের আকিদা হচ্ছে, হযরত রাসূল (ﷺ) আল্লাহ তা’লার সর্বপ্রথম সৃষ্টি ও আল্লাহর খাল্কী বা সৃষ্টি নূরের তৈরী। তিনি আল্লাহর জাতের অংশও নয় এবং সিফাতের অংশও নয়, বরং তিনি আল্লাহর খাল্কী নূর বা সৃষ্টি নূর। তবে আল্লাহর জাতী নূরের জ্যোতি বলা যায়। কারণ সূর্য থেকে আলোর উৎপত্তি, কিন্তু আলো সূর্যের অংশ নয়। ঠিক তেমনিভাবে প্রিয় নবীজি (ﷺ) আল্লাহর জাত কর্তৃক হেকমতে কামেলায় বিনা মাধ্যমে তাঁর নূরে সৃষ্টি কিন্তু আল্লাহর অংশ নয়। উল্লেখ্য যে, রাসূলে পাক (ﷺ) এর নূর কুল কায়েনাতে বে-মেছাল ও বে-নজির।
❏ নূর ও তার প্রকারভেদ
النُّورُ (নূর) শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ। যা একাধারে আল্লাহ পাক, রাসূলে করিম (ﷺ) ও পবিত্র কোরআনের গুণবাচক নাম। শব্দটির বিভিন্ন অর্থ পরিলক্ষিত হয়। কারণ النُّورُ (নূর) এর একাধিক অর্থ রয়েছে, যেমন: ضَوْءٌ (ষরমযঃ), আলো; بَهَاءٌ (নৎরমযঃহবংং), উজ্জ্বলতা; কিরণ, ঝলক, প্রদীপ, লন্ঠন, জ্যোতি, সত্য প্রকাশ ইত্যাদি। النُّورُ (নূর) এর বহুবচন হল أنوار (আনওয়ার)। নূর তাকেই বলে যে নিজে প্রকাশ হয় ও অন্যকে প্রকাশ করে।
এখানে আরেকটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন যে, النّور (নূর) দুই ধরণের হয়। যথা محسوس بعين البصر -“চোখে অনুভূত হয় এমন নূর।” সূর্যের নূর বা আলো, চাঁদের নূর বা আলো, তারকার নূর বা আলো ইত্যাদি। আরেকটি হল চোখে অনুভূত হয় না বরং আকল বা জ্ঞান দ্বারা অনুধাবন করা যায় এমন নূর। কোরআনের নূর, ইলিমের নূর, ঈমানের নূর ইত্যাদি। ৩. মুফরাদাতে রাগেব ইস্পাহানী;
সহজে বলা যায়, নূর দুই প্রকার যথা:- একটি মানুষের ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুধাবন করা যায় এবং আরেকটি হল যা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুধাবন করা যায়না। প্রিয় নবীজি (ﷺ) একদিকে পবিত্র কোরআনের ঘোষনা অনুযায়ী ইন্দ্রিয় অগ্রায্য নূর, অপরদিকে একাধিক হাদিস অনুযায়ী ইন্দ্রিয় গ্রায্য নূর। অর্থাৎ রাসূল (ﷺ) উভয় প্রকার নূর। এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
❏ সাধারণ মানুষ কিসের তৈরী?
পবিত্র কোরআনের আলোকে জানার প্রয়োজন যে, মহান আল্লাহ পাক তাঁর নবী হযরত আদম (عليه السلام), হযরত ঈসা (عليه السلام) ও হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) ব্যতীত বাকী সকল মানুষকে কি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কারণ সরাসরি মাটির তৈরী হলেন একমাত্র হযরত আদম (عليه السلام) এবং এ বিষয়ে অকাট্যভাবে অনেক দলিল বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য আদম সন্তান তথা মানুষ কিসের তৈরী, এর জবাবে আল্লাহ তা’লা পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে বর্ণনা করেছেন। নিচে ঐ সকল আয়াত গুলো উল্লেখ করা হল:-
আয়াত নং ১: এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন,
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً -“তিনি ‘বাশার’ তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে মানুষকে আল্লাহ পাক ‘পানি’ তথা শুক্রানু হতে সৃষ্টি করেছেন। এই আয়াতে الْماء ‘মাউন’ এর অর্থ নুতফা বা পিতা-মাতার শুক্রানু-ডিম্বানু। তথাপিও এই আয়াতে বর্ণিত الْماء ‘পানি’ সম্পর্কে মোফাচ্ছেরীনে কেরামের অভিমত গুলো উল্লেখ করা হল। এই আয়াতের তাফছিরে মহিউস সুন্নাহ ইমাম বাগভী (رحمة الله) {ওফাত ৫১৬ হিজরী} বলেন,
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ مِنَ النُّطْفَةِ، بَشَرًا -“তিনি ‘বাশার’ তথা মানুষকে শুক্রানুর পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” ৪. তাফছিরে বাগভী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৯০ পৃ:;
এই আয়াত সম্পর্কে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله) {ওফাত ৬০৬ হি.} বলেন,
أَنَّ الْمُرَادَ النُّطْفَةُ لِقَوْلِهِ: خُلِقَ مِنْ ماءٍ دافِقٍ [الطَّارِقِ: ৬] ، مِنْ ماءٍ مَهِينٍ )الْمُرْسَلَاتِ: ২০(
-“নিশ্চয় এর দ্বারা অর্থ হচ্ছে শুক্রানু, যেমন আল্লাহ তা’লার বাণী হচ্ছে: ‘মানুষতে বেগবান পানি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। আরেক আয়াতে আছে: ‘পানির নির্যাস’ থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।” ৫. তাফছিরে কবীর, ২৪তম খন্ড, ৪৭৫ পৃ:;
এ সম্পর্কে ইমাম শামছুদ্দিন কুরতবী (رحمة الله) {ওফাত ৬৭১ হিজরী} বলেন,
(وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً) أَيْ خَلَقَ مِنَ النُّطْفَةِ إِنْسَانًا.
-“তিনি (আল্লাহ) ‘বাশার’ তথা মানুষকে ‘পানি’ হতে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ মানুষকে শুক্রানু থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ৬. তাফছিরে কুরতবী, ১৩তম খন্ড, ৫৯ পৃ:;
এই আয়াত সম্পর্কে আবুল ফিদা আল্লামা হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله) {ওফাত ৭৭৪ হিজরী} বলেন,
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً الآية، أَيْ خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ
-“তিনি ‘বাশার’ তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ মানুষকে শুক্রানু থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ৭. তাফছিরে ইবনে কাছির, ৬ষ্ঠ খন্ড, ১০৭ পৃ:;
এ আয়াত সম্পর্কে আল্লামা হাফিজ ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) {ওফাত ৯১১ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন,
{وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنْ الْمَاء بَشَرًا} مِنْ الْمَنِيّ إنْسَانًا
-“তিনি (আল্লাহ) ‘বাশার’ তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন। তথা মানুষের ‘মনি’ থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ৮. তাফছিরে জালালাইন, ৪৭৭ পৃ:;
অতএব, মহান আল্লাহ পাকের ঘোষণা অনুযায়ী মানুষকে নুত্ফা তথা শুক্রানু থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই কোন মানুষকে সরাসরি মাটির তৈরী বলা চরম ভ্রষ্টতা এবং কোরআনের বিপরীত কথা যা প্রকাশ্য কুফূরী।
আয়াত নং ২: এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’লা আরো এরশাদ করেন,
خُلِقَ مِنْ مَاءٍ دَافِقٍ -“মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে স্ববেগে নির্গত পানি থেকে।” (সূরা ত্বারেক: ৫ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতদ্বয়ে স্পষ্ট বলা হয়ে, আল্লাহ পাক মানুষকে পানি তথা বেগবান নুতফা বা শুক্রবিন্দু হতে সৃষ্টি করেছেন। ইমাম বাগভী (رحمة الله) ও ছাহেবে খাজেন আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মদ খাজেন (رحمة الله) مَاءٍ دَافِقٍ ‘মাই দাফিক্ব’ তথা ‘বেগবান পানি’ এর ব্যাখ্যায় বলেন: وَهُوَ الْمَنِيُّ -“আর ইহা হল মনী।” ৯. তাফছিরে বাগভী, ৫ম খন্ড, ২৩৯ পৃ:; তাফছিরে খাজেন, ৪র্থ খন্ড, ৪১৫ পৃ:;
হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইমাদুদ্দিন ইবনে কাছির (رحمة الله) বলেন:
يَعْنِي: الْمَنِيُّ؛ يَخْرُجُ دَفقًا مِنَ الرَّجُلِ وَمِنَ الْمَرْأَةِ، -“অর্থাৎ, ইহা হল মনী যা পুরুষ ও মহিলাদের থেকে স্ববেগে প্রবাহিত হয়।” ১০। তাফছিরে ইবনে কাছির, ৮ম খন্ড, ৩৭৫ পৃ:;
ইমাম শামছুদ্দিন কুরতবী (رحمة الله) বলেন: ماءٍ دافِقٍ أَيْ مِنَ الْمَنِيِّ. -“স্ববেগে প্রবাহিত পানি অর্থাৎ মনী থেকে।” ১১। তাফছিরে কুরতবী, ২০তম খন্ড, ৪ পৃ:;
লা-মাজহাবী কাজী শাওকানী তার কিতাবে বলেন: وَالْمَاءُ: هُوَ الْمَنِيُّ، -“পানি হচ্ছে মনী।” ১২। কাজী শাওকানী: তাফছিরে ফাতহুল কাদির, ৫ম খন্ড, ৫০৮ পৃ:;
বর্তমানে বিজ্ঞানের গবেষনার মাধ্যমে স্পষ্টই জানা যায়, মানব দেহে প্রায় ৭০ ভাগ পানি রয়েছে। সুতরাং মানুষ তার পিতা-মাতার মনী বা শুক্রানু-ডিম্বানু থেকে সৃষ্টি হয়েছে। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী আদম (عليه السلام) ব্যতীত পরবর্তী কোন মানুষ’ই সরাসরি মাটির তৈরী নয়, বরং নুতফা বা শুক্রানু-ডিম্বানুর তৈরী।
আয়াত নং ৩: এ বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক আরেক আয়াতে বলেছেন,
إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشاجٍ نَبْتَلِيهِ فَجَعَلْناهُ سَمِيعاً بَصِيراً
-“মানুষকে মিলিত শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি, তাকে পরিক্ষা করার জন্য শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি দান করেছি। (সূরা: ইনছান/দাহর: ২ নং আয়াত)।
লক্ষ্য করুন এই আয়াতে মানুষকে নুতফা দ্বারা সৃষ্টি করার কথা রয়েছে যা স্পষ্ট করেই উল্লেখ আছে। এই আয়াত সম্পর্কে ইমাম আবু জাফর আত্-তাবারী (رحمة الله) {ওফাত ৩১০ হিজরী} তদীয় তাফছির গ্রন্থে বলেন,
إِنَّا خَلَقْنَا ذُرِّيَّةَ آدَمَ مِنْ نُطْفَةٍ، يَعْنِي: مِنْ مَاءِ الرَّجُلِ وَمَاءِ الْمَرْأَةِ،
-“নিশ্চয় আদম (عليه السلام) এর সন্তানদেরকে শুক্রানু থেকে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ পুরুষ ও নারীর পানি তথা শুক্রানু-ডিম্বানু থেকে।” ১৩। তাফছিরে তাবারী, ২৩তম খন্ড, ৫৩১ পৃ:;
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মহিউস সুন্নাহ ইমাম বাগভী (رحمة الله) ফোত ৫১৬ হিজরী তদীয় তাফছিরের কিতাবে বলেন,
{إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ} يَعْنِي وَلَدَ آدَمَ {مِنْ نُطْفَةٍ} يَعْنِي: مَنِيِّ الرَّجُلِ وَمَنِيِّ الْمَرْأَةِ.
-“নিশ্চয় মানুষ সৃষ্টি করেছি’ অর্থাৎ আদম সন্তানকে ‘নুতফা হতে’ অর্থাৎ নারী ও পুরুষের মনি থেকে সৃষ্টি করেছি।” ১৪। তাফছিরে বাগভী, ৮ম খন্ড, ২৮৯ পৃ:;
হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইমাদুদ্দিন ইবনে কাছির (رحمة الله) ওফাত ৭৭৪ হিজরী তদীয় তাফছিরে উল্লেখ করেন,
قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ فِي قَوْلِهِ: {مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ} يَعْنِي: مَاءَ الرَّجُلِ وَمَاءَ الْمَرْأَةِ
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এই আয়াত সম্পর্কে বলেন: ‘মিশ্র শুক্রবিন্দু হতে’ অর্থাৎ নারী ও পুরুষের পানি হতে।” ১৫। তাফছিরে ইবনে কাছির, ৮ম খন্ড, ২৮৫ পৃ:;
এই আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত হয় মানুষ পুরুষের শুক্রানু ও স্ত্রীর ডিম্বানু তথা পানি জাতিয় জিনিস হতে সৃষ্টি। বিজ্ঞানও ইহা প্রমাণ করেছেন, পুরুষের শুক্রানু ও স্ত্রীর ডিম্বানু মিলিত হয়েই মানুষের দেহের গঠন শুরু হয়। অতএব পবিত্র কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী সাধারণ মানুষ সরাসরি মাটির তৈরী নয় বরং নুতফার তৈরী।
আয়াত নং ৪: যেমন আল্লাহ তা’লা অপর আয়াতে এরশাদ করেন:-
أَلَمْ نَخْلُقْكُمْ مِنْ ماءٍ مَهِينٍ (২০) فَجَعَلْناهُ فِي قَرارٍ مَكِينٍ -“আমি কি তোমাদেরকে পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করিনি? অতঃপর তাকে নিরাপদ স্থানে রাখিনি? (সূরা মুরছালাত: ২০-২১ নং আয়াত)।
দেখুন এই আয়াতে ‘পানির নির্যাস’ থেকে মানুষ সৃষ্টির কথা স্পষ্ট করেই আছে। অতএব, আল্লাহ তা’লা سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ তথা মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছেন আদি পিতা হযরত আদম (عليه السلام) কে, যা পবিত্র কোরআনের সূরা মু’মীনুন এর ১২ নং আয়াতে বলা হয়েছে এবং مِنْ ماءٍ مَهِينٍ তথা পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছেন আদম সন্তানদেরকে। যেমন ইমাম আবু জাফর আত্-তাবারী (رحمة الله) {ওফাত ৩১০ হিজরী} তদীয় তাফছির গ্রন্থে উল্লেখ করেন,
حَدَّثَنَا الْقَاسِمُ، قَالَ: ثنا الْحُسَيْنُ، قَالَ: ثنا أَبُو تُمَيْلَةَ، عَنْ عُبَيْدِ بْنِ سُلَيْمَانَ، عَنِ الضَّحَّاكِ بْنِ مُزَاحِمٍ، قَالَ: خَلَقَ آدَمَ مِنْ طِينٍ، وَخَلَقَ النَّاسَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ
-“হযরত দ্বাহ্হাক ইবনে মুজাহিম (رحمة الله) বলেন, আদম (عليه السلام) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে আল্লাহ পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ১৬। তাফছিরে ইবনে কাছির, ৮ম খন্ড, ২৮৫ পৃ:;।
ইমাম আবু জাফর আত্-তাবারী (رحمة الله) {ওফাত ৩১০ হিজরী} তদীয় তাফছির গ্রন্থে আরো বলেন,
إِنَّا خَلَقْنَا ذُرِّيَّةَ آدَمَ مِنْ نُطْفَةٍ، يَعْنِي: مِنْ مَاءِ الرَّجُلِ وَمَاءِ الْمَرْأَةِ،
-“নিশ্চয় আদম (عليه السلام) এর সন্তানদেরকে শুক্রানু থেকে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ পুরুষ ও নারীর পানি তথা শুক্রানু-ডিম্বানু থেকে।” ১৭। তাফছিরে তাবারী, ৯ম খন্ড, ১৫০ পৃ:;
মহিউস সুন্নাহ ইমাম বাগভী (رحمة الله) এভাবে তাফছির করেছেন,
أَلَمْ نَخْلُقْكُمْ مِنْ ماءٍ مَهِينٍ، يَعْنِي النُّطْفَةَ. -“আমি তোমাদেরকে পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করিনি? অর্থাৎ নূতফা বা শুক্রানু থেকে।” ১৮। তাফছিরে তাবারী, ২৩তম খন্ড, ৫৩১ পৃ:; ইমাম বাগভী: তাফছিরে বাগভী, ৫ম খন্ড, ১৯৭ পৃ:;
বিশিষ্ট তাবেঈ ও প্রখ্যাত মুফাচ্ছির হযরত মুজাহিদ (رحمة الله) এর অভিমত,
أنبأ عَبْدُ الرَّحْمَنِ، نا إِبْرَاهِيمُ، نا آدَمُ، نا وَرْقَاءُ، عَنِ ابْنِ أَبِي نَجِيحٍ، عَنْ مُجَاهِدٍ، فِي قَوْلِهِ: مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ قَالَ وَهُوَ نُطْفَةُ الرَّجُلِ
-“হযরত মুজাহিদ (رحمة الله) আল্লাহর বাণী ‘মিম মাইম মাহিন’ এর ব্যাখ্যায় বলেন: আর ইহা হল পুরুষের নুতফা।” ১৯। তাফছিরে মুজাহিদ, ১ম খন্ড, ৫৪৪ পৃ:; তাফছিরে তাবারী, ১৮তম খন্ড, ৬০১ পৃ:;
অতএব, স্পষ্ট প্রমাণিত হল আদম সন্তানরা পানির নির্যাস বা নুতফা থেকে সৃষ্টি। এটাই পবিত্র কোরআন মোতাবেক সঠিক বর্ণনা ও সঠিক আকিদা। এর বিপরীত আকিদা রাখা কুফ‚রী এবং স্পষ্ট জিহালত।
আয়াত নং ৫: এ সম্পর্কে আরেক জায়গায় আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন,
الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسانِ مِنْ طِينٍ (৭) ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلالَةٍ مِنْ ماءٍ مَهِينٍ
-“যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর আকৃতি প্রদান করেছেন, এবং মাটি হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর পানির নির্যাস হতে তাঁর বংশ বিস্তার করেছেন।” (সূরা সাজদা: ৭-৮ নং আয়াত)।
এই আয়াতে পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির শুরুর কথা বয়ান করা হয়েছে। আর পৃথিবীর মানব সৃষ্টির প্রথম হল হযরত আদম (عليه السلام)। যেমন ইমাম বাগভী (رحمة الله) বলেন,
وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسانِ مِنْ طِينٍ، يَعْنِي آدَمَ. ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ، يَعْنِي ذُرِّيَّتَهُ،
-“মানব সৃষ্টির শুরুকে আমি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি অর্থাৎ আদম আ: অতঃপর তার সন্তান তথা বংশধরকে পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি।” ২০। তাফছিরে বাগভী, ৩য় খন্ড, ৫৯৫ পৃ:;
বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ তাফছিরের কিতাব তাফছিরে জালালাইনে আছে:
وَبَدَأَ خلق الإنسان آدم من طين -“মানব সৃষ্টির শুরু আদকে মাটি হতে সৃষ্টি করেছি।” ২১। তাফছিরে জালালাইন, উক্ত আয়াতের তাফছিরে;
অনুরূপ তাফছিরে করেছেন ইমাম আবু জাফর তাবারী (رحمة الله) তদীয় ‘তাফছিরে তাবারী’ গ্রন্থে। ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) অপর তাফছিরে একটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন যেমন,
وَأخرج الْفرْيَابِيّ وَابْن أبي شيبَة وَابْن جرير وَابْن الْمُنْذر عَن مُجَاهِد رَضِي الله عَنهُ فِي قَوْله {وَبَدَأَ خلق الإِنسان من طين} قَالَ: آدم
-“ফিরইয়াবী, ইবনে আবী শায়বাহ, ইবনে জারির ও ইবনে মুনজির (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন, হযরত মুজাহিদ (رضي الله عنه) এই আয়াত “মাটি হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন” এর ব্যাখ্যায় বলেন: তিনি হলেন হযরত আদম আ:।” ২২। ইমাম ছিয়তী: তাফছিরে দুর্রে মানছুর, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৫৪০ পৃ:;
ذِكْرُ مَنْ قَالَ ذَلِكَ: حَدَّثَنَا بِشْرٌ، قَالَ: ثنا يَزِيدُ، قَالَ: ثنا سَعِيدٌ، عَنْ قَتَادَةَ، وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسَانِ مِنْ طِينٍ وَهُوَ خَلْقُ آدَمَ، ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ: أَيْ ذُرِّيَّتَهُ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ مَاءٍ مَهِين وَالسُّلَالَةُ هِيَ الْمَاءُ الْمَهِينُ الضَّعِيفُ
-“হযরত কাতাদা (رحمة الله) বলেন: মানব সৃষ্টি শুরুটা হল মাটি থেকে আর তিনি হলেন আদম (عليه السلام)। অতঃপর তার পরবর্তীদের অর্থাৎ তার বংশধরদেরকে পানির নির্যাস আর ইহা হল স্পষ্ট দুর্বল পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ২৩। তাফছিরে তাবারী, ১৮তম খন্ড, ৬০০ পৃ:;
ইমাম আবুল বারাকাত আন-নাছাফী (رحمة الله) বলেন:
وبدأ خلق الإنسان آدم من طينٍ -“মানব সৃষ্টির শুরু আদম কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি।” ২৪। তাফছিরে নাছাফী, ৩য় খন্ড, ৬ পৃ:;
আল্লামা হাফিজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাছির (رحمة الله) ওফাত ৭৭৪ হিজরী বলেন:
وَبَدَأَ خَلْقَ الإنْسَانِ مِنْ طِينٍ يَعْنِي: خَلَقَ أَبَا الْبَشَرِ آدَمَ مِنْ طِينٍ.
-“মাটি হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন” অর্থাৎ মানব জাতির বাবা আদম আ: কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ২৫। তাফছিরে ইবনে কাছির, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৩৬০ পৃ:;
আল্লামা কাজী নাছিরুদ্দিন বায়জাবী (رحمة الله) বলেন:
وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسانِ يعني آدم. مِنْ طِينٍ. -“মানব সৃষ্টির প্রথম আদম আ: কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ২৬। তাফছিরে বায়জাবী, ৪র্থ খন্ড, ২২০ পৃ:;
অনুরূপ তাফছিরে কুরতবীতে উল্লেখ রয়েছে।
এই আয়াতে স্পষ্ট করেই আল্লাহ তা’লা বলেছেন পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির সূচনা তথা আদি পিতা হযরত আদম (عليه السلام) কে মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন, এবং এর পরবর্তী আদম সন্তানদেরকে পানির নির্যাস বা শুক্রানু-ডিম্বানু হতে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং পবিত্র কোরআন অনুযায়ী সকল আদম সন্তান পানির নির্যাস বা শুক্রানু-ডিম্বানু হতে সৃষ্টি, সরাসরি মাটি হতে সৃষ্টি নয়।
আয়াত নং ৬: এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক আরেক আয়াতে বলেন,
أَوَلَمْ يَرَ الْإِنْسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِنْ نُطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُبِينٌ -“মানুষ কি ভাবেনা তাকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি? ফলে সে বিতর্ককারী হয়।” (সূরা: ইয়াছিন: ৭৭ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, মানুষকে আল্লাহ পাক নুতফা বা শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাফছিরে কিতাবে এ ব্যাপারে যা আছে ইমাম বাগভী (رحمة الله) বলেন: يَعْنِي أَنَّهُ مَخْلُوقٌ مِنْ نُطْفَةٍ
-“অর্থাৎ নিশ্চয় সে (মানুষ) নুতফা থেকে সৃষ্টি হয়েছে।” ২৭। তাফছিরে বাগভী, ৪র্থ খন্ড, ২৩ পৃ:;
সুতরাং আদি পিতা হযরত আদম (عليه السلام) ব্যতীত পরবর্তী বাকী সকল মানুষকে আল্লাহ পাক নুতফা বা শুক্রবিন্দু হতে সৃষ্টি করেছেন। যা বর্তমানে বিজ্ঞানও অকপটে স্বীকার করেছে।
আয়াত নং ৭: এ বিষয়ে আরেক আয়াতে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন,
وَأَنَّهُ خَلَقَ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنْثَى مِنْ نُطْفَةٍ إِذَا تُمْنَى -“তিনি নারী-পুরুষের জোড়া সৃষ্টি করেছেন, স্থলিত শুক্রবিন্দু থেকে।” (সূরা নাজম: ৪৫-৪৬ নং আয়াত)।
এই আয়াতেও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে নারী-পুরুষ সকলকে নুতফা তথা শুক্রবিন্দু হতে সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনের অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেন,
وَاللَّهُ خَلَقَ كُلَّ دَابَّةٍ مِنْ مَاءٍ -“আল্লাহ সকল প্রাণিকে পানি তথা শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা নূর: ৪৫ নং আয়াত)
সকল প্রাণিই শুক্রানু-ডিম্বানু থেকে সৃষ্টি ইহা স্বয়ং আল্লাহ পাকের ঘোষনা। বিজ্ঞানও বলছে, নারী-পুরুষ সকল মানুষ তাদের নিজ নিজ পিতা মাতার শুক্রানু-ডিম্বানু থেকে সৃষ্টি হয়েছেন। আর এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর চ‚ড়ান্ত আকিদা, এর বিপরীত কুফূরী।
আয়াত নং ৮: এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের আরেক আয়াতে আছে,
مِنْ أَيِّ شَيْءٍ خَلَقَهُ مِنْ نُطْفَةٍ خَلَقَهُ فَقَدَّرَهُ -“কোথা হতে তাকে সৃষ্টি করলেন? শুক্রবিন্দু হতে’ই সৃষ্টি করে পরিমিত করলেন।” (সূরা: আবাসা: ১৮-১৯ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতেও স্পষ্ট বলা হয়েছে, আল্লাহ পাক মানুষকে নুতফা তথা শুক্রবিন্দু হতেই সৃষ্টি করেছেন। এটাই পবিত্র কোরআন অনুযায়ী বিশুদ্ধ আকিদা। এর বিপরীত আকিদা রাখা কুফূরী।
আয়াত নং ৯: এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের আরেক আয়াতে আছে,
خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُبِينٌ -“আমি মানুষকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি ফলে। এতদসত্বেও সে প্রকাশ্যে বিতন্ডাকারী হয়ে গেছে।” (সূরা নাহল: ৪ নং আয়াত)
এই আয়াতে স্পষ্ট করেই বলা আছে মানুষকে নুতফা বা শুক্রানু-ডিম্বানু থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব, মানুষকে সরাসরি মাটির তৈরী বলা কোরআনের খেলাফ।
আয়াত নং ১০: যেমনটি অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেন:
خَلَقَ الْإِنْسانَ مِنْ عَلَقٍ -“আমি ইনছান তথা মানুষকে রক্তপিন্ড তথা শুক্রবিন্দু হতে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আলাক্ব: ২ নং আয়াত)।
এই আয়াতে ‘ইনছান’ বলতে আদম (عليه السلام) এর বংশধরদেরকে বুঝানো হয়েছে। কারণ আদম (عليه السلام) কে রক্তপিন্ড থেকে সৃষ্টি করা হয়নি। যেমন ইমাম বাগভী (رحمة الله) বলেন, خَلَقَ الْإِنْسانَ يعني ابْنَ آدَمَ، مِنْ عَلَقٍ
-“ইনছান সৃষ্টি করেছি অর্থাৎ আদমের সন্তানদেরকে রক্তপিন্ড থেকে।” ২৮। তাফছিরে বাগভী, ৫ম খন্ড, ২৮১ পৃ:;
মানুষকে শুধুমাত্র রক্তপিন্ড থেকে সৃষ্টি করা হয়নি বরং নুতফা বা শুক্রানু থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ ঐ শুক্রানু রক্তপিন্ডে পরিনত হয়। যেমন নিচের আয়াতটি লক্ষ্য করলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে,
আয়াত নং ১১: এ বিষয়ে আরেক আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেন,
أَيَحْسَبُ الْإِنْسانُ أَنْ يُتْرَكَ سُدىً (৩৬) أَلَمْ يَكُ نُطْفَةً مِنْ مَنِيٍّ يُمْنى (৩৭) ثُمَّ كانَ عَلَقَةً فَخَلَقَ فَسَوَّى (৩৮)
-“মানুষ কিভাবে ভাবে যে, তাকে এমনিতেই ছেড়ে দেয়া হবে? সে কি স্থলিত শুক্রবিন্দু ছিল না? পরে সে জমাট রক্ত পিন্ড পরিণত হয়েছিল, তিনি তাকে মানব আকৃতিতে সৃষ্টি করেন।” (সূরা: কিয়ামা: ৩৬-৩৭-৩৮ নং আয়াত)।
অতএব, উল্লেখিত পবিত্র কোরআনের ১১টি আয়াত দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, হযরত আদম-হাওয়া, ঈসা (عليه السلام) ও মুহাম্মদ (ﷺ) ব্যতীত পরবর্তী সকল মানুষই নুতফা বা শুক্রবিন্দু হতে তৈরী, সরাসরি মাটির তৈরী নয়। কেননা বিজ্ঞানও প্রমাণ করেছে স্বামীর শুক্রানু ও স্ত্রীর ডিম্বানু মিলিত হয়েই স্ত্রীর রেহেম বা জড়ায়ুতে পর্যায়ক্রমে মানব দেহ গঠিত হয় এবং মানব দেহের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ হচ্ছে পানি আর বাকী ৩০ ভাগ হচ্ছে চামড়া, চুল-পশম, মাংশ, হাড়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এক কথায় কোরআন ও বিজ্ঞানকে এক সাথে করলে দেখা যায় মানুষ সরাসরি মাটি থেকে তৈরী নয় বরং নুতফা বা শুক্রানু-ডিম্বানু থেকে তৈরী। তাই মানুষকে সরাসরি মাটির তৈরী বলা পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতের পরিপন্থি কথা বলার সামিল, যা ‘তাকজিবে কোরআনের’ কারণে প্রকাশ্য কুফূরী।
❏ হাদিসের দৃষ্টিতে প্রথম সৃষ্টি কি?
মহান আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম কি সৃষ্টি করেছেন, এ বিষয়টি নিরশন করতে পারলে আমরা রাসূলে পাক (ﷺ) এর সৃষ্টির বিষয়টি সহজেই সমাধানে পৌছতে পারব। কারণ রাসূল (ﷺ) এর সৃষ্টি সব কিছুর পূর্বে প্রমাণিত হলে তিনি মাটির কিংবা পানির তৈরী বলা অযৌক্তিক প্রমাণিত হবে। কেননা সর্বপ্রথম যিনি সৃষ্টি হয়েছেন তিনি মাটির তৈরী হতে পারেনা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর সকল উলামা, ফোজালা, ফোকাহা ও আইম্মায়ে কেরাম একমত যে, আল্লাহ পাকের সর্বপ্রথম সৃষ্টি হলেন নূরে মুহাম্মদী (ﷺ), অতঃপর বাকী সব কিছু নূরে মুহাম্মদী থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ পর্যায়ে এ বিষয়টি দলিল ভিত্তিক বিস্তারিত ও ধারাবাহিক ভাবে নিম্ন আলোচনা করা হল। এবার লক্ষ্য করুন সর্বপ্রথম আল্লাহ পাক কি সৃষ্টি করেছেন।
❏ ক্বলম কি প্রথম সৃষ্টি!?
প্রথমে ক্বলম সৃষ্টি বিষয়ে কারো কারো মত রয়েছে। তাদের এই মতের পক্ষে ছহীহ্ রেওয়ায়েত রয়েছে। যেমন হযরত উবাদা ইবনে ছামিত (رضي الله عنه) থেকে ছহীহ্ সনদে বর্ণিত আছে,
إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمُ فَقَالَ: اكْتُبْ فَقَالَ: يَا رَبِّ مَا أَكْتُبُ؟ قَالَ: اكْتُبِ الْقَدَرَ مَا كَانَ وَمَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى الْأَبَدِ
-“নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম ‘ক্বলম’ সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ক্বলমকে বললেন, লিখ। ক্বলম বলল: হে প্রভূ! কি লিখব? আল্লাহ বললেন: লিখ ইতিপূর্বে যা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যা কিছু হবে।” ২৯। মুসনাদে আবু দাউদ ত্বয়ালুছী, হাদিস নং ৫৭৮; মুসনাদে ইবনে জা’দ, হাদিস নং ৩৪৪৪; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২২৭০৭; তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ২১৫৫;
সনদ ছহীহ্।
এই হাদিসের প্রথম অংশটি দ্বারা বুঝা যায় প্রথম সৃষ্টি হচ্ছে ‘ক্বলম’। কিন্তু শেষে অংশটি দ্বারা বুঝা যায় ‘ক্বলম’ প্রথম সৃষ্টি নয়। কারণ আল্লাহ তা’লা ক্বলমকে বলেছেন: اكْتُبِ الْقَدَرَ مَا كَانَ وَمَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى الْأَبَدِ -“আল্লাহ বললেন: লিখ ইতিপূর্বে যা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যা কিছু হবে।” এই এবারত দ্বারা বুঝা যায়, ক্বলম সৃষ্টির পূর্বেও অনেক কিছু ছিল। কারণ এখানে مَا كَانَ (মা কানা) দ্বারা অতীতকালের ঘটনা বুঝায়। এখানে ‘ক্বলম’ প্রথম সৃষ্টি ইহা ক্বলমের সম্মানার্থে বলা হয়েছে, মূলত প্রথম সৃষ্টি ‘ক্বলম’ নয়। এখন জানতে হবে ‘ক্বলম’ সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ পাক কি সৃষ্টি করেছেন।
❏ ক্বলমের পূর্বে কি সৃষ্টি?
ছহীহ্ রেওয়ায়েত দ্বারা স্পষ্ট জানা যায়, ক্বলম সৃষ্টি হওয়া বহু পূর্বে আল্লাহর আরশ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ছহীহ্ হাদিসে আছে,
حَدَّثَنِي أَبُو الطَّاهِرِ أَحْمَدُ بْنُ عَمْرِو بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ سَرْحٍ، حَدَّثَنَا ابْنُ وَهْبٍ، أَخْبَرَنِي أَبُو هَانِئٍ الْخَوْلَانِيُّ، عَنْ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْحُبُلِيِّ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللَّهَ قَدَّرَ مَقَادِيرَ الْخَلْقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ
-“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ পাক তাকদীর সৃষ্টি করেছেনে আসমান-জমীন সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর পূর্বে, আর তখন ‘আল্লাহর আরশ’ ছিল পানির উপরে।” ৩০। ছহীহ্ মুসলীম, হাদিস নং ২৬৫৩; তাফছিরে ইবনে কাছির, ৩য় খন্ড, ৪৬৩ পৃ:; ইমাম খারকুশী: শরফুল মুস্তফা, ১ম খন্ড, ৩১০ পৃ:
এই হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, ক্বলম দ্বারা লিখিত ‘তাকদীর’ সৃষ্টি করার ৫০ হাজার বছর পূর্বেও ‘আল্লাহর আরশ’ পানির উপর ছিল। বিষয়টি স্পষ্টত যে, ক্বলমের পূর্বে আল্লাহর আরশ সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব, চ‚ড়ান্তভাবে বলা যায়, আরশ সৃষ্টি হয়েছে ক্বলমের পূর্বে। এর সমাধান কল্পে শারিহে বুখারী আল্লামা ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) {ওফাত ৯২৩ হিজরী} তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন,
فقال الحافظ أبو يعلى الهمدانى: الأصح أن العرش قبل القلم، لما ثبت فى الصحيح عن عبد الله بن عمرو قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم قدر الله مقادير الخلق قبل أن يخلق السماوات والأرض بخمسين ألف سنة وكان عرشه على الماء
-“হাফিজ আবু ইয়ালা হামদানী (رحمة الله) বলেন: অধিক বিশুদ্ধ মত হল, আল্লাহর আরশ সৃষ্টি হয় ক্বলম সৃষ্টির পূর্বে। যেমনটি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (رضي الله عنه) থেকে ছহীহ্ সূত্রে প্রমাণিত আছে যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ পাক তাকদীর সৃষ্টি করেছেনে আসমান-জমীন সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর পূর্বে, আর তখন ‘আরশ’ ছিল পানির উপরে।” ৩১। ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৪৮ পৃ:; ইমাম হুছাইন দুয়ারবকরী: তারিখুল খামিছ, ১ম খন্ড, ১৮ পৃ:;
হাফিজুল হাদিস ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেছেন,
وَحَكَى أَبُو الْعَلَاءِ الْهَمْدَانِيُّ أَنَّ لِلْعُلَمَاءِ قَوْلَيْنِ فِي أَيِّهِمَا خُلِقَ أَوَّلًا الْعَرْشُ أَوِ الْقَلَمُ قَالَ وَالْأَكْثَرُ على سبق خلق الْعَرْش وَاخْتَارَ بن جرير وَمن تبعه الثَّانِي
-“আবু আ’লা হামদানী (رحمة الله) বর্ণনা করেন, নিশ্চয় প্রথম আরশ সৃষ্টি নাকি ক্বলম সৃষ্টি এ নিয়ে দুইটি মত রয়েছে। তিনি বলেন, অধিকাংশ উলামাগণ বলেছেন: আরশ অগ্রগামী। ইমাম ইবনে জারির ও তিনাকে যারা অনুসরন করেন তারা দ্বিতীয় মতটি প্রাধান্য দেন।” ৩২। ইমাম আসকালানী: ফাতহুল বারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ২৮৯ পৃ:;
সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দৃষ্টিতে ক্বলমের পূর্বে আল্লাহর আরশ সৃষ্টি করা হয়েছে ইহাই বিশুদ্ধ অভিমত।
❏ ‘আকল প্রথম সৃষ্টি’ হওয়ার হাদিস কেমন?
কারো কারো দাবী সর্বপ্রথম আল্লাহ আকল সৃষ্টি করেছেন। তাদের এই দাবী যথার্থ নয়। কারণ আকল সৃষ্টির ব্যাপারে হাদিসটি নিম্নে পর্যায়ের জয়ীফ কিংবা জাল পর্যায়ের হাদিস। যেমন أول ما خلق الله العقل
-“আল্লাহ তা’লা সর্ব-প্রথম ‘আকল’ বা জ্ঞান সৃষ্টি করেছেন।” এই রেওয়ায়েত সম্পর্কে আল্লামা হাফিজ যায়নুদ্দিন ইরাকী (رحمة الله) তদীয় ‘তাখরিজে এহইয়া’ গ্রন্থে বলেন: بإسنادين ضعيفين -“এর প্রত্যেকটি সনদ জয়ীফ।” ৩৩। ইমাম আজলুনী: কাশফুল খাফা, ১ম খন্ড, ২৩৭ পৃ: ৭২২ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়; হাফিজ ইরাকী: তাখরিজু আহাদিছিল এহইয়া, ১ম খন্ড, ৯৯ পৃ:;
হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন,
وَأَمَّا حَدِيثُ أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْعَقْلُ فَلَيْسَ لَهُ طَرِيقٌ ثَبْتٌ -“প্রথমে আল্লাহ তা’লা আকল সৃষ্টি কেেছন’ ইহা কোন সূত্রে প্রমাণিত নয়।” ৩৪। ইমাম আসকালানী: ফাতহুল বারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ২৮৯ পৃ:;
قال الصغاني: موضوع باتفاق، -“আল্লামা ছাগানী (رحمة الله) বলেন: সর্বসম্মতিক্রতে এই হাদিস জাল।” ৩৫। ইমাম আজলুনী: কাশফুল খাফা, ১ম খন্ড, ২৬৩ পৃ: ৮২৩ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) উল্লেখ করেন:-
رَوَاهُ دَاوُدُ بْنُ الْمُحَبَّرِ قَالَ السَّخَاوِيُّ ابْنُ الْمُحَبَّرِ كَذَّابٌ -“দাউদ ইবনে মুহাব্বার ইহা বর্ণনা করেছেন। ইমাম ছাখাবী (رحمة الله) বলেন: ইবনে মুহাব্বার একজন মিথ্যাবাদী রাবী।” ৩৬। ইমাম মোল্লা আলী: আসরারুল মারফুয়া, ১০৭ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়; ইমাম ছাখাবী: মাকাছিদুল হাছানা, হাদিস নং ২৩৩ এর ব্যাখ্যায়;
ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) বলেন:
وذكره وابن المحبر كذاب -“মিথ্যাবাদী ইবনে মুহাব্বার ইহা উল্লেখ করেছেন।” ৩৭। ইমাম ছিয়তী: আল লাআলী মাসনূআ, ১ম খন্ড, ১৯৯ পৃ:;
অতএব, এই হাদিস মওজু বা ভিত্তিহীন বা জাল হাদিস।
এ বিষয়ে হিজরী ৮ম শতাব্দির মুজাদ্দিদ, শারিহে বুখারী আল্লামা হাফিজ ইবনে হাজার আস্কালানী (رحمة الله) {ওফাত ৮৫২ হিজরী} সবচেয়ে সুন্দর কথা বলেছেন,
وَقَدْ قَالَ شَيْخُنَا يَعْنِي الْعَسْقَلَانِيَّ وَالْوَارِدُ فِي أَوَّلِ مَا خَلَقَ حَدِيثُ أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمُ وَهُوَ أَثْبَتُ مِنْ حَدِيثِ الْعَقْلِ
-“নিশ্চয় আমাদের শায়েখ হাফিজ আবুল ফজল ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেছেন: প্রথম সৃষ্টির বিষয়ে বর্ণনা করেন যে, ‘আল্লাহ তা’লা প্রথমে আকল সৃষ্টি করেছেন’ এই হাদিস থেকে ‘আল্লাহ তা’লা প্রথম ক্বলম সৃষ্টি করেছেন’ এই হাদিস অধিক প্রমাণিত।” ৩৮। ইমাম মোল্লা আলী: মাওজুয়াতুল কুবরা, হাদিস নং ১০৭; শরহে যুরকানী আলাল মাওয়াহেব, ৬ষ্ঠ খন্ড, ১৫ পৃ:; হাফিজ ইবনে হাজার: ফাতহুল বারী, ৩১৯০ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়; ইমাম ছাখাবী: মাকাছিদুল হাছানা, হাদিস নং ২৩৩ এর ব্যাখ্যায়
অতএব, ‘আকল’ বা জ্ঞান প্রথম সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ছহীহ্ হাদিস থেকে জানা যায়, ক্বলম প্রথম সৃষ্টি, তবে ক্বলম সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর আরশ।
❏ আরশের পূর্বে কি সৃষ্টি হয়েছে?
অধিকাংশ ইমামগণের মতে, আরশের পূর্বে পানি সৃষ্টি হয়েছে। যেমন এ বিষয়ে আল্লামা আবু জাফর ইবনে জারির তাবারী (رحمة الله) {ওফাত ৩১০ হিজরী} তদীয় কিতাবে আরো উল্লেখ করেন,
خَلَقَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ الْمَاءَ قَبْلَ الْعَرْشِ، ثُمَّ خَلَقَ عَرْشَهُ فَوَضَعَهُ عَلَى الْمَاءِ
-“আল্লাহ তা’লা আরশের পূর্বে পানি সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশ সৃষ্টি করে পানির উপর রাখলেন।” ৩৯। ইমাম ইবনে জারির: তারিখে তাবারী, ১ম খন্ড, ৩৯ পৃ:;
যেমন এ বিষয়ে ছহীহ্ হাদিস আছে,
وَقَدْ رَوَى أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَصَحَّحَهُ مِنْ حَدِيثِ أَبِي رَزِينٍ الْعُقَيْلِيِّ مَرْفُوعًا أَنَّ الْمَاءَ خُلِقَ قَبْلَ الْعَرْشِ
-“ইমাম আহমদ ও ইমাম তিরমিজি হাদিস বর্ণনা করেছেন ও ছহীহ্ বলেছেন। হযরত আবু রাজিন উকাইলী (رضي الله عنه) মারফূ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: নিশ্চয় পানি সৃষ্টি হয়েছে আরশের পূর্বে।” ৪০। ইমাম আসকালানী: ফাতহুল বারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ২৮৯ পৃ:; মুসনাদু আহমদ, হাদিস নং ১৬২০০; ইমাম আইনী: উমদাতুল ক্বারী, ১৫তম খন্ড, ১০৯ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: এরশাদুস সারী, ৫ম খন্ড, ২৪৯ পৃ:; ইমাম আজলুনী: কাশফুল খাফা, ১ম খন্ড, ২৬৬ পৃ:
এটা মারফূ ছহীহ্ হাদিস, আর ইহার দ্বারা সু-স্পষ্ট প্রমানিত হয় আরশের পূর্বে পানি সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখযোগ্য,
حَدَّثَنَا مُوسَى بن هارون الهمداني، قال: حدثنا عمرو بن حَمَّادٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَسْبَاطُ بْنُ نَصْرٍ، عَنِ السدي في خبر ذكره، عن أبي مالك وعن أبي صالح، عن ابن عباس وعن مرة الهمداني عن عبد الله بن مسعود وعن ناس من اصحاب رسول الله ص قَالُوا: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ كَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ، وَلَمْ يَخْلُقْ شَيْئًا غَيْرَ مَا خَلَقَ قَبْلَ الْمَاءِ.
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও হামদানীর এক ব্যক্তি হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) ও রাসূল (ﷺ) সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন, তাঁরা সকলেই বর্ণনা করেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ তা’লার আরশ পানির উপর ছিল। আর ‘পানি’ সৃষ্টি করার পূর্বে কোন কিছুই সৃষ্টি করেননি ৪১। পানি সৃষ্টির পূর্বেও নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা রয়েছে।” ৪২। ইমাম ইবনে জারির আত-তাবারী: তারিখে তাবারী, ১ম খন্ড, ৩৯ পৃ:;
অতএব, নূরে মুহাম্মদীর পরে ও আরশের পূর্বে প্রথম সৃষ্টি হল পানি। এ বিষয়টি অধিকাংশ ইমামদের কাছে প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য। এখন জানতে হবে পানির পূর্বে কি সৃষ্টি হয়েছে।
❏ পানির পূর্বে কিছুই সৃষ্টি হয়নি! এই কথার ব্যাখ্যা
হযরত ইসমাঈল সুদ্দী (رحمة الله) থেকে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েত থেকে জানা যায়,
وَلَمْ يَخْلُقْ شَيْئًا غَيْرَ مَا خَلَقَ قَبْلَ الْمَاءِ. পানির পূর্বে আল্লাহ তা’লা কিছুই সৃষ্টি করেনি। হাদিসটি ইমাম ইবনে খুজাইমা (رحمة الله), ইমাম ইবনে জারির (رحمة الله) ও ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) স্ব স্ব কিতাবে হযরত সুদ্দী (رحمة الله) এর মাধ্যমে হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) ও ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে মাওকুফ সনদে উল্লেখ করেছেন। যেমন রেওয়ায়েতটি লক্ষ্য করুন,
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ عُثْمَانَ بْنِ حَكِيمٍ الْأَوْدِيُّ، قَالَ: ثَنَا عَمْرُو بْنُ حَمَّادٍ، يَعْنِي ابْنَ طَلْحَةَ الْقَنَّادَ، قَالَ: ثَنَا أَسْبَاطُ، وَهُوَ ابْنُ نَصْرٍ الْهَمْدَانِيُّ، عَنِ السُّدِّيِّ، عَنْ أَبِي مَالِكٍ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، وَعَنْ مُرَّةَ الْهَمْدَانِيِّ، عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ، عَنْ نَاسٍ، مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالُوا: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ كَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ، وَلَمْ يَخْلُقْ شَيْئًا غَيْرَ مَا خَلَقَ قَبْلَ الْمَاءِ.
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও হামদানীর এক ব্যক্তি হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) ও রাসূল (ﷺ) এর একদল সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন, তাঁরা সকলেই বর্ণনা করেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ তা’লার আরশ পানির উপর ছিল। আর ‘পানি’ সৃষ্টি করার পূর্বে কোন কিছুই সৃষ্টি করেননি ৪৩। পানি সৃষ্টির পূর্বেও নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা রয়েছে।” ৪৪। ইমাম ইবনে খুজাইমা: কিতাবুত তাওহিদ ওয়া ইছবাতু ছিফাতির রাব্বি, ২য় খন্ড, ৮৮৬ পৃ:; ইমাম ইবনে জারির আত-তাবারী: তারিখে তাবারী, ১ম খন্ড, ৩৯ পৃ:; ইমাম বায়হাক্বী: আসমাউস সিফাত, হাদিস নং ৮০৭; তাফছিরে ইবনে কাছির, ১ম খন্ড, ২১৪ পৃ:;
এই হাদিসের সনদে কয়েকটি আপত্তি রয়েছে। প্রথমতঃ এই হাদিসের একজন রাবী হলأَبُو صالح، যাকে باذام (বাজাম) বলা হয়। যিনি أُمُّ هَانِئٍ بِنْتُ أَبِي طَالِبٍ উম্মে হানী বিনতে আবী তালেব এর কৃতদাস ছিলেন। সে ضعيف জয়ীফ ও مدلس মুদাল্লিছ রাবী। ইমাম আহমদ (رحمة الله) তার বর্ণিত হাদিস ترك পরিত্যাগ করেছেন। ৪৫। ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৬৩৬;
ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله) তাকে একবার ليس به بأس বলেছেন, আরেকবার তাকে ليس بشيءٍ সে কিছুই নয় বলেছেন। ৪৬। ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৬৩৬;
ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله) বলেন:يكتب حديثه، ولا يحتج به -“আমি তার হাদিস লিখি কিস্তু তার উপর নির্ভর করিনা।” ৪৭। ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৬৩৬;
ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) বলেছেন: ليس بثقة সে বিশ্বস্ত নয়। ৪৮। ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৬৩৬;।
ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তাকে ضعيف الحديث বলেছেন। ৪৯। ইমাম যাহাবী: দিওয়ানুদ দোয়াফা, রাবী নং ৫৪৪;
ইমাম যুযাজানী, ইমাম আবু আহমদ হাকেম, ইমাম জুরকানী, ইমাম আবু আরব, ইমাম উকাইলী, ইমাম আবু মুহাম্মদ ইবনে জারুদ (رحمة الله) বলেছেন সে ضعيف দুর্বল। ৫০। ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৬৬৯;
وقال أبو حاتم البستي في كتاب المجروحين: يحدث عن ابن عباس ولم يسمع منه، تركه ابن سعيد القطان. وقال أبو الفتح الأزدي فيما ذكره ابن الجوزي: كذاب.
-“ইমাম আবু হাতেম বাছেতী (رحمة الله) ‘মাজরুহীন’ কিতাবে বলেছেন: সে ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে হাদিস বর্ণনা করত কিন্তু ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে কিছুই শুনেনি। ইমাম ইবনে সা’দ কাত্তান (رحمة الله) তাকে পরিত্যাগ করেছেন। আবুল ফাত্তাহ আযদী (رحمة الله) বলেছেন, ইবনে জাওযী (رحمة الله) তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন।” ৫১। ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৬৬৯;
অতএব, এই সূত্রে হাদিসটি মুনকাতে হওয়ার কারণ রয়েছে, যদি আবু সালেহ এর সাথে আবু মালেক সরাসরি রাবী না হয়। কারণ ইমাম ইবনে খুজাইমা (رحمة الله) এর সনদে
عَنْ أَبِي مَالِكٍ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ “আবু মালেক বর্ণনা করেছেন আবু সালেহ থেকে” এরুপ রয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ দ্বিতীয় সূত্রে عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُرَّةَ الْهَمْدَانِيُّ (আব্দুল্লাহ ইবনে র্মুরা হামদানী) রয়েছে। সে বিশ্বস্ত রাবী কিন্তু ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হামদানীর সরাসরি শায়েখ ছিলেন না এবং তিনার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেননি। যেমন ইমাম মুগলতাঈ (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন:
فترك منه المزي ذكر ابن مسعود وابن عمر فلم يذكرهما في أشياخه
-“হামদানীর ঐ রেওয়ায়েত গুলোকে পরিত্যাগ করা হয় যা হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) ও ইবনে উমর (رضي الله عنه) এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা তার শায়েখদের নামের মধ্যে এই দুইজন সাহাবীর নাম উল্লেখ করেননি।” ৫২। ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৩১৯৫;
যাদের কাছ থেকে ‘র্মুরা হামদানী’ হাদিস বর্ণনা করেছেন তাদের মাঝে হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) এর নাম ইমাম মিযযী (رحمة الله) উল্লেখ করেননি। ৫৩। ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৩৫৫৮;
এমনকি ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (رحمة الله) ‘র্মুরা হামদানী’ হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন বলে উল্লেখ করেননি। ৫৪। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৩৬;
এমনকি ইমাম যাহাবী (رحمة الله) ‘র্মুরা হামদানী’ হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন বলে উল্লেখ করেননি। ৫৫। ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ১২৩;
অতএব, এই সূত্রেও হাদিসটি মুনকাতে হওয়ার কারণ রয়েছে।
তৃতীয়তঃ ইসমাঈল সুদ্দী (رحمة الله) সরাসরি নবী করিম (ﷺ) সাহাবীর রেফারেন্স দিয়ে বর্ণনা করেছেন। যেমন عَنْ نَاسٍ، مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: অথচ সুদ্দী (رحمة الله) যাদেরকে দেখেছেন কিংবা যেসব সাহাবীগণের রেফারেন্স দিয়েছেন তাঁরা কেউ অথবা তিনাদের থেকে অন্য কেউ এরুপ হাদিস বর্ণনা করেননি। কেবলমাত্র সুদ্দী (رحمة الله) এরুপ হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই বিচারে হাদিসটি একক।
চতুর্থতঃ এই হাদিসের বর্ণনাকারী ‘সুদ্দী’ এর পুরো নাম হল إِسْمَاعِيلُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي كَرِيمَةَ (ইসমাঈল ইবনু আব্দির রহমান ইবনে আবী কারিমা)। ইমাম মুসলীম (رحمة الله)সহ তিনার উপর এক জামাত ইমাম নির্ভর করেছেন কিন্তু বড় আরেকটি জামাত ইমাম তিনার বর্ণিত হাদিসকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন।
وقال الدوري عن يحيى: في حديثه ضعف -“দাওদী ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন, সুদ্দীর বর্ণিত হাদিসে দুর্বলতা রয়েছে।” ৫৬। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৫৭২;
وقال أبو زرعة: لين وقال أبو حاتم: يكتب حديثه ولا يحتج به
-“ইমাম আবু যুরায়া (رحمة الله) বলেছেন: সে দুর্বল। ইমাম আবু হাতিম বলেছেন: আমি তার হাদিস লিখি কিন্তু তার উপর নির্ভর করিনা।” ৫৭। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৫৭২;
উকাইলী (رحمة الله) তাকে ضعيف দুর্বল বলেছেন। ৫৮। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৫৭২;
وقال الساجي: صدوق فيه نظر -“ইমাম ছাজী (رحمة الله) বলেন: সে সত্যবাদী তবে তার মধ্যে ত্রæটি রয়েছে।” ৫৯। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৫৭২;
وقال الطبري: لا يحتج بحديثه -“ইমাম তাবারী (رحمة الله) বলেন, তার বর্ণিত হাদিসের উপর নির্ভর করা যাবেনা।” ৬০। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৫৭২;
ইমাম ইবনে মাহদি (رحمة الله) তাকে ضعيف দুর্বল বলেছেন। ৬১। ইমাম মুগলাতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৫০২;
ইমাম আহমদ (رحمة الله) এক জায়গায় তাকে ছিক্বাহ বলেছেন, আরেক জায়গায় ضعيف দুর্বল বলেছেন, আরেক জায়গায় مقارب الحديث বলেছেন। ৬২। ইমাম মুগলাতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৫০২;
ইমাম যুযাজানী (رحمة الله) তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। ৬৩। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৫৭২;
ইমাম মু’তামির ইবনে সুলাইমান (رحمة الله) তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। ৬৪। ইমাম মুগলাতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৫০২;
ইবনে হাম্মাদ (رحمة الله) তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। ৬৫। ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৪৬২;
এই বিচারে ইসমাঈল সুদ্দীর বর্ণিত হাদিসের শেষ অংশটি অন্য হাদিসের সামঞ্জস্য না থাকায় গ্রহণযোগ্য হবেনা। বরং ব্যাখ্যা সাপেক্ষ্য হবে, যেমনটি আইম্মায়ে কেরাম বলেছেন।
চতুর্থতঃ এই হাদিসের আরেকজন রাবী أَسْبَاطُ بْنُ نَصْر ‘আসবাত ইবনে নাসর’। এই রাবী ব্যতীত হাদিসটির অন্য কোন সনদ আমি খুজে পাইনি। একমাত্র أَسْبَاطُ (আসবাত) এর মাধ্যমেই সকল ইমামগণ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তবে এই সনদটি ছহীহ্ নয়, কেননা أَسْبَاطُ بْنُ نَصْرٍ (আসবাত ইবনে নাসর) এর ব্যাপারে ইমামগণের সমালোচনা রয়েছে। ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله) একবার তাকে ছিক্বাহ বলেছেন। ৬৬। ইমাম যাহাবী: দিওয়ানুদ দোয়াফা, রাবী নং ৩০৬;
আরেকবার তাকে ليس بشيء সে কিছুই নয় বলেছেন। ৬৭। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৩৯৬;
ইমাম বুখারী (رحمة الله) তাকে صدوق বলেছেন। ৬৮। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৩৯৬;
শারিহে বুখারী হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন: صدوق كثير الخطأ -“সে সত্যবাদী তবে প্রচুর ভুল করত।” ৬৯। ইমাম আসকালানী: তাকরিবুত তাহজিব, রাবী নং ৩২১;
কিন্তু ইমাম আবু নুয়াইম ও ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) তাকে ضعيف দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। ৭০। ইমাম যাহাবী: দিওয়ানুদ দোয়াফা, রাবী নং ৩০৬;
ইমাম আবু হাতিম ও ইমাম আহমদ (رحمة الله) তাকে ضعيف দুর্বল বলেছেন। ৭১। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৩৯৬;
ইমাম ছাজী (رحمة الله) তাকে ضعيف দুর্বল বলেছেন। ৭২। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৩৯৬;
অতএব, সার্বিক বিচারে হাদিসটি ছহীহ্ নয় বরং নিতান্তই জয়ীফ বা দুর্বল।
(পানির পূর্বে কিছুই সৃষ্টি হয়নি) ইসমাঈল সুদ্দী ব্যতীত অন্য কেউ এরুপ বর্ণনা করেননি। আর এই হাদিস দ্বারা মুহাদ্দেছিনে কেরামের কেহই পানিকে قبل الاشياء সকল কিছুর পূর্বের সৃষ্টি বলেনেনি। বরং সবাই বলেছেন এই আলম বা দুনিয়া সৃষ্টির শুরু হয়েছে পানি থেকে। পানি ও আরশ সৃষ্টি সূচনা কখন হয়েছে সে সম্পর্কে শারিহে বুখারী ইমাম বদরুদ্দিন আইনী (رحمة الله) বলেন,
وَكَانَ عَرْشه على المَاء، دلَالَة على أَن المَاء وَالْعرش كَانَا مبدأ هَذَا الْعَالم لكَوْنهم خلقا قبل خلق السَّمَوَات وَالْأَرْض وَلم يكن تَحت الْعَرْش إِذْ ذَاك إلاَّ المَاء.
-“আর আরশ ছিল পানির উপর’ আসমান জমীন সৃষ্টির পূর্বে এই জগত সৃষ্টির শুরু হয়েছে পানি ও আরশ দিয়ে, এই মর্মে এই হাদিস দলিল। তখন আরশের নিচে এই পানি ছাড়া কিছুই ছিলনা।” ৭৩। ইমাম আইনী: উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী, ১৫তম খন্ড, ১০৯ পৃ: ১৯১৩ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
পানি ও আরশ সৃষ্টি সূচনা কখন হয়েছে সে সম্পর্কে শারিহে বুখারী ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন,
لَكِنْ أَشَارَ بِقَوْلِهِ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ إِلَى أَنَّ الْمَاءَ وَالْعَرْشَ كَانَا مَبْدَأُ هَذَا الْعَالَمِ لِكَوْنِهِمَا خُلِقَا قَبْلَ خلق السَّمَاوَات وَالْأَرْضِ وَلَمْ يَكُنْ تَحْتَ الْعَرْشِ إِذْ ذَاكَ إِلَّا الْمَاءُ
-“কিন্তু ‘আর আরশ ছিল পানির উপর’ এই কথা দ্বারা ইশারা হল, আসমান জমীন সৃষ্টির পূর্বে পানি ও আরশ দিয়ে এই জগত সৃষ্টির শুরু হয়েছে, এই মর্মে এই হাদিস দলিল। তখন আরশের নিচে এই পানি ছাড়া কিছুই ছিলনা।” ৭৪। ইমাম আসকালানী: ফাতহুল বারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ২৮৯ পৃ:;
ইমাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল বাক্বী যুরকানী (رحمة الله) ওফাত ১১২২ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন,
فهو إشارة إلى أن الماء والعرش كانا مبدأ هذا العالم، لخلقهما قبل السموات والأرض، فلم يكن تحت العرش إذ ذاك إلا الماء،
-“আর আরশ ছিল পানির উপর’ এই কথা দ্বারা ইশারা হল, আসমান জমীন সৃষ্টির পূর্বে পানি ও আরশ দিয়ে এই জগত সৃষ্টির শুরু হয়েছে, এই মর্মে এই হাদিস দলিল। তখন আরশের নিচে এই পানি ছাড়া কিছুই ছিলনা।” ৭৫। ইমাম যুরকানী: শরহে মাওয়াহেব, ৫ম খন্ড, ১৬৮ পৃ:;
অতএব, পানি ও আরশ হল এই আলমের প্রথম সৃষ্টি। আর প্রিয় নবীজি (ﷺ) (رحمة الله) আলামিন তথা সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রথম সৃষ্টি। এই জগতের সকল প্রাণীর সৃষ্টির সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
والله خلق كل دابة من ماء -“আর আল্লাহ তা’লা সমস্থ প্রাণীকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ৭৬। সূরা নূর: ৪৫ নং আয়াত;
অপর আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেন,
وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ -“প্রানবন্ত সব কিছু আমি পানি হতে সৃষ্টি করলাম। এরপরেও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবেনা।” ৭৭। সূরা আম্বিয়া, ৩০ নং আয়াত;
ইমাম কুরতবী (رحمة الله) বলেছেন,
إِذْ أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ تَعَالَى مِنَ الْعَالَمِ الْمَاءُ، ثُمَّ خَلَقَ منه كل شي. -“প্রথমে আল্লাহ তা’লা এই আলম বা জগৎ সৃষ্টি করলেন পানি হতে। অতঃপর সব কিছু পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” ৭৮। তাফছিরে কুরতবী, ১২তম খন্ড, ২৯১ পৃ:;
অর্থাৎ এই আলমের প্রানবন্ত সকল কিছু পানি হতে সৃষ্টি করেছেন, যেমনটি মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন। ইমাম বাগভী (رحمة الله) উল্লেখ কেেছন,
وَالْمُفَسِّرُونَ يَقُولُونَ: يَعْنِي أَنَّ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ فَهُوَ مَخْلُوقٌ من الماء. لقوله تَعَالَى: وَاللَّهُ خَلَقَ كُلَّ دَابَّةٍ مِنْ ماءٍ
-“মুফাচ্ছিরিনগণ বলেছেন, নিশ্চয় প্রত্যেক জিবীত বস্তুকে সৃষ্টি করা হয়েছে পানি হতে। আল্লাহ তা’লার বাণী: আর আল্লাহ তা’লা সমস্থ প্রাণীকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ৭৯। তাফছিরে বাগভী, ৩য় খন্ড, ২৮৭ পৃ:;
সুতরাং এই আলম বা জগৎ সৃষ্টির শুরু করেছেন পানি থেকে। পানি সৃষ্টির বিষয়টি এই জগতের সাথে জড়িত কিন্তু রাসূলে করিম (ﷺ) এর সৃষ্টির বিষয়টি কুল কায়েনাতের সাথে জড়িত। অপরদিকে আরশ, কুরছী, লাওহ, ক্বলম, জান্নাত সৃষ্টি হয়েছে নূর থেকে। যা অন্যান্য রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত রয়েছ। আর প্রিয় নবীজি (ﷺ) সৃষ্টি হয়েছে এই সবকিছুর পূর্বে।
❏ বায়ু সৃষ্টি হয়েছে পানির পূর্বে
সৃষ্টি জগতে هَوَاءٌ বা বায়ু সৃষ্টির কথাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। هَوَاءٌ বা বায়ু পানির পূর্বে সৃষ্টির কথাটি বিভিন্ন রেওয়ায়েতে পাওয়া যায়। কারণ অনেক হাদিসে পানি সৃষ্টির সাথে বায়ু সৃষ্টির কথা জরিত রয়েছে। যেমন নিচের একটি হাদিস গুলো লক্ষ্য করুন:-
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، وَمُحَمَّدُ بْنُ الصَّبَّاحِ، قَالَا: حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ قَالَ: أَنْبَأَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، عَنْ يَعْلَى بْنِ عَطَاءٍ، عَنْ وَكِيعِ بْنِ حُدُسٍ، عَنْ عَمِّهِ أَبِي رَزِينٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَيْنَ كَانَ رَبُّنَا قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ خَلْقَهُ؟ قَالَ: كَانَ فِي عَمَاءٍ، مَا تَحْتَهُ هَوَاءٌ، وَمَا فَوْقَهُ هَوَاءٌ، وَمَا ثَمَّ خَلْقٌ، عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ
-“হযরত আবু রাজিন (رضي الله عنه) বলেন, আমি বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ পাক তিনার সৃষ্টিকে সৃষ্টি করার পূর্বে কোথায় ছিলেন? (মুদ্দা কথা) আল্লাহ পাকই ছিলে আর কিছুই ছিলনা। (পরবর্তীতে) সৃষ্টির অস্তীত্ব যা করেছিলেন তার উপরে বায়ু ছিল এবং নিচেও বায়ু ছিল। আর কোন সৃষ্টি ছিলনা। আর পানির উপর আল্লাহ আরশ সৃষ্টি করে রাখলেন।” ৮০। সুনানু ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৮২; মুসনাদু আহমদ, হাদিস নং ১৬১৮৮; তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ৩১০৯; ইমাম তাবারানী: মুজামুল কবীর, হাদিস নং ৪৬৮; ইমাম ইবনে আছেম: আস সুন্নাহ, হাদিস নং ৬১২; ইমাম আবুশ শায়েখ: আজমাত, হাদিস নং ৮৩; মুসনাদু আবী দাউদ ত্বয়ালিছী, হাদিস নং ১১৮৯; ছহীহ্ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৬১৪১; ইমাম বায়হাক্বী: আসমাউস ছিফাত, হাদিস নং ৮৬৪;
ইমাম তিরমিজি (رحمة الله) হাদিসটিকে حَسَنٌ হাছান বলেছেন। মাওলানা আজিমাবাদী বলেন: وَهَذَا الْإِسْنَاد صَحَّحَهُ التِّرْمِذِيّ فِي مَوْضِع وَحَسَّنَهُ فِي مَوْضِع -“এই সনদকে ইমাম তিরমিজি (رحمة الله) এক জায়গায় ছহীহ্ বলেছেন এবং আরেক জায়গায় হাছান বলেছেন।” ৮১। আজিমাবাদী: আওনুল মাবুদ, ১৩তম খন্ড, ১৬ পৃ:; তিরমিজি শরীফ হাদিস নং ৩১০৯ ও ২২৭৯;
ইহার সনদে وكيع بْن عُدُس (ওয়াকী ইবনে উদুস) নামক রাবী রয়েছে। তাকে ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) الثقات বিশ্বস্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। ৮২। ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৫০২৯;
ইমাম আহমদ ইবনে আবী খায়ছামা (رحمة الله) বলেন: ووافقه هُشَيْم -“হুশাইম তার উপর নির্ভর করেছেন।” ৮৩। ইমাম আবু বকর আহমদ ইবনে খায়ছামা: তারিখুল কবীর, রাবী নং ১০৬২;
ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তাকেثقة বিশ্বস্ত বলেছেন। ৮৪। ইমাম যাহাবী: কাশেফ, রাবী নং ৬০৫৭;
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) তাকেمقبول মাকবুল বলেছেন। ৮৫। ইমাম আসকালানী: তাকরিবুত তাহজিব, রাবী নং ৭৪১৫;
অতএব, এই হাদিসের মান ছহীহ্। এই হাদিস থেকে বুঝা যায়, পানি সৃষ্টির পূর্বে هَوَاءٌ বায়ু বা বাতাস সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে আরেকটি হাদিস উল্লেখ করা যায়,
نا عَبْدُ الرَّزَّاقِ عَنْ مَعْمَرٍ عَنِ الْأَعْمَشِ عَنْ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ قَالَ: سُئِلَ ابْنُ عَبَّاسٍ عَنْ قَوْلِهِ تَعَالَى: {وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ} عَلَى أَيِّ شَيْءٍ كَانَ الْمَاءُ؟, قَالَ: عَلَى مَتْنِ الرِّيحِ
-“হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর (رحمة الله) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কে জিজ্ঞাসা করা হল আল্লাহ তা’লার বাণী ‘আরশ ছিল পানি উপরে’ সম্পর্কে যে, পানি কোন জিনিসের উপর ছিল? তিনি বলেছেন: পানি বায়ুর তক্তার উপর ছিল।” ৮৬। তাফছিরে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস নং ১১৮৫; তাফছিরে তাবারী, ১২তম খন্ড, ৩৩৩ পৃ:; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস নং ৩২৯৩; ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: মেরকাতুল মাফাতীহ, ৯৪ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
তাহলে বুঝা যাচ্ছে, পানি সৃষ্টির সময় বায়ু ছিল। আর সেই বায়ুর তক্তার উপর পানি ছিল। যেমন ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন,
وَالْمَاءُ عَلَى مَتْنِ الرِّيحِ، وَالرِّيحُ عَلَى الْقُدْرَةِ -“পানি ছিল বায়ুর তক্তার উপর। আর বায়ু ছিল আল্লাহর কুদরতের উপর।” ৮৭। মেরকাত শরহে মেসকাত, ৭৯ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
হযরত আবু রাজিন (رضي الله عنه) রেওয়ায়েত থেকে বুঝা যাচ্ছে বায়ু সৃষ্টি হয়েছে প্রথম অতঃপর পানি সৃষ্টি করে বায়ুর উপর রাখা হয় এবং পানির উপর আরশ সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
❏ বায়ু ও পানির পূর্বে নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) সৃষ্টি
বায়ু ও পানি সৃষ্টির বহু পূর্বে রাসূলে পাক (ﷺ) এর নূরের সৃষ্টি হয়েছে। এই ব্যাপারে আকছার আইম্মায়ে আহলে সুন্নাত একমত। হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) এর বর্ণিত বায়হাক্বীর দালাইলুন নবুয়াতের হাদিস ও হাদিসে জাবের (رضي الله عنه) থেকে সবকিছুর পূর্বে রাসূলে পাক (ﷺ) নূর বিষয়টি পরিস্ফুটিত হয়। যেমন সুদ্দী (رحمة الله) বর্ণিত হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) এর বর্ণিত হাদিসটি সম্পর্কে শারিহে বুখারী ইমাম শিহাবুদ্দিন কাস্তালানী (رحمة الله) বলেন,
أن الله تعالى لم يخلق شيئًا مما خلق قبل الماء. فيجمع بينه وبين ما قبله، بأن أولية القلم بالنسبة إلى ما عدا النور النبوي المحمدي والماء والعرش، انتهى.
-“নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা পানি সৃষ্টির পূর্বে কিছুই সৃষ্টি করেননি। ফলে এই হাদিস ও পূর্বে যা উল্লেখ করেছি সব গুলো একত্রিত করে বুঝা যায়, ক্বলম সৃষ্টির ‘প্রথম’ কথাটি নিছবতী। তবে নূরে মুহাম্মদী, পানি ও আরশ ছাড়া।” ৮৮। ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৪৯ পৃ:;
ঐ হাদিস সম্পর্কে আল্লামা হুছাইন ইবনে মুহাম্মদ দিয়ারবাকরী (رحمة الله) ওফাত ৯৬৬ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন,
أن الله لم يخلق شيئا مما خلق قبل الماء فيجمع بينه وبين ما قبله بأن أوّلية القلم بالنسبة الى ما عدا النور المحمدى والماء والعرش
-“নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা পানি সৃষ্টির পূর্বে কিছুই সৃষ্টি করেননি। ফলে এই হাদিস ও পূর্বে যা উল্লেখ করেছি সব গুলো একত্রিত করে বুঝা যায়, ক্বলম সৃষ্টির ‘প্রথম’ কথাটি নিছবতী। তবে নূরে মুহাম্মদী, পানি ও আরশ ছাড়া।” ৮৯। তারিখুল খামিছ, ১ম খন্ড, ১৮ পৃ:;
অনুরুপ বলেছেন ইমাম ইসমাঈল ইবনে মুহাম্মদ আজলুনী (رحمة الله) ওফাত ১১৬২ হিজরী তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন,
إن الله لم يخلق شيئا مما خلق قبل الماء. فيجمع بينه وبين ما قبله بأن أولية القلم بالنسبة إلى ما عدا النور النبوي والماء والعرش انتهى،
-“নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা পানি সৃষ্টির পূর্বে কিছুই সৃষ্টি করেননি। ফলে এই হাদিস ও পূর্বে যা উল্লেখ করেছি সব গুলো একত্রিত করে বুঝা যায়, ক্বলম সৃষ্টির ‘প্রথম’ কথাটি নিছবতী। তবে নূরে মুহাম্মদী, পানি ও আরশ ছাড়া।” ৯০। ইমাম আজলুনী: কাশফুল খাফা, ১ম খন্ড, ২৬৬ পৃ:;
ইমাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল বাক্বী যুরকানী (رحمة الله) ওফাত ১১২২ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন,
أن الله لم يخلق شيئًا مما خلق" أي: من جميع المخلوقات، "قبل الماء، فيجمع بينه وبين ما قبله" من حديثي جابر وأبي رزين، "بأن أولية" خلقه "القلم بالنسبة إلى ما عدا النور المحمدي والماء والعرش، انتهى.
-“নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা পানি সৃষ্টির পূর্বে কিছুই সৃষ্টি করেননি। অর্থাৎ সমস্থ মাখলুকাতের মাঝে। ফলে এই হাদিস ও পূর্বে যা উল্লেখ করেছি অর্থাৎ হাদিসে জাবের ও আবু রাজিন এর হাদিস। সবগুলো একত্রিত করে বুঝা যায়, ক্বলম সৃষ্টির ‘প্রথম’ কথাটি নিছবতী। তবে নূরে মুহাম্মদী, পানি ও আরশ ছাড়া।” ৯১। ইমাম যুরকানী: শরহে মাওয়াহেব, ১ম খন্ড, ৯৪ পৃ:;
স্পষ্টত যে, আইম্মায়ে কেরাম সৃষ্টির ধারাবাহিক নাম গুলো উল্লেখ করেছেন। যেমন প্রথমে নূরে মুহাম্মদী, অতঃপর পানি, অতঃপর আরশ, অতঃপর ক্বলম। অতএব, সব কিছুর পূর্বে নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) সৃষ্টি হয়েছে।
❏ আরশ, কুরছী, লাওহ, ক্বলম নূরের তৈরী
আরশ, কুরছী, লাওহ, ক্বলম, ফেরেস্তা সবগুলোই নূর থেকে তৈরী। এই বিষয়টি একাধিক রেওয়ায়েতের মাধ্যমেই প্রমাণিত রয়েছে। একটি হাদিস লক্ষ্য করুন,
قَالَ ابْنُ جَرِيرٍ: حَدَّثَنَا الْحُسَيْنُ بْنُ شَبِيبٍ الْمُكْتِبُ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ زِيَادٍ الْجَزَرِيُّ، عَنْ فُرَاتِ بْنِ أَبِي الْفُرَاتِ، عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ قُرَّةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: {ن وَالْقَلَمِ وَمَا يَسْطُرُونَ} قَالَ: لَوْحٌ مِنْ نُورٍ وَقَلَمٌ مِنْ نُورٍ يَجْرِي بِمَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ.
-“মুয়াবিয়া ইবনে র্কুরা (رضي الله عنه) তার পিতা সাহাবী র্কুরাতু ইবনু ইয়্যাস ইবনে হিলাল (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: ‘নূন, ক্বলমের শপত! এবং যা দ্বারা লিখা হয়’ এই আয়াত সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বলেছেন: লাওহ নূর থেকে, ক্বলম নূর থেকে, এভাবেই কেয়ামত পর্যন্ত চলমান থাকবে।” ৯২। হাফিজ ইবনে কাছির: তাফছিরে ইবনে কাছির, ৮ম খন্ড, ১৮৬ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: আল হাবী লিল ফাতওয়া, ১ম খন্ড, ৪২৯ পৃ:; তাফছিরে তাবারী, ২৩তম খন্ড, ১৪৪ পৃ: সূরা ক্বলম এর ১ম আয়াতের ব্যাখ্যায়; ইমাম ছিয়তী: তাফছিরে দুর্রে মানছুর, ৮ম খন্ড, ২৪১ পৃ:;
এই হাদিসের রাবী ‘ফুরাত ইবনে আবী ফুরাত’ সম্পর্কে ইমাম ছাখাবী (رحمة الله) বলেন: حَسَنُ الاستقامة في الروايات -“তার বর্ণিত রেওয়ায়েত গুলো হাসান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।” ৯৩। ইমাম ছাখাবী: ছিক্বাত মিম্মান লা ইয়াকায়া ফি কুতুবি ছিত্তাহ, রাবী নং ৮৮২২;
কেউ কেউ তার ব্যাপারে সমালোচনা করলেও ইমাম আব্দুল ওয়াহেদ ইবনে গিয়াস (رحمة الله) পিতা হতে বলেন: صدوق، لا بأس به -“সে সত্যবাদী ও তার ব্যাপারে অসুবিধা নেই।”৯৪। ইমাম ছাখাবী: ছিক্বাত মিম্মান লা ইয়াকায়া ফি কুতুবি ছিত্তাহ, রাবী নং ৮৮২২;
ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله) তাকে صدوق সত্যবাদী বলেছেন।” ৯৫। ইমাম যাহাবী: দিওয়ানুদ দোয়াফা, রাবী নং ৩৩৪৮;
ইমাম ইবনু হিব্বান (رحمة الله) তাকে الثقات বিশ্বস্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। ৯৬। ইমাম ইবনু হিব্বাস: কিতাবুস সিক্বাত, রাবী নং ১০২৭২;
ইমাম ইবনু হিব্বাস (رحمة الله) বলেছেন: حَسَنُ الاستقامة في الروايات -“তার বর্ণিত রেওয়ায়েত গুলো হাসান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।” ৯৭। ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ১৩১৭; ইমাম ইবনু হিব্বাস: কিতাবুস সিক্বাত, রাবী নং ১০২৭২;
এই হাদিসের আরেকজন রাবী হল مُحَمد بْن زِياد، اليَشكُرِيُّ، الجَزَرِيُّ، (মুহাম্মদ ইবনে যিয়াদ ইয়াশকুরী জাযারী)। তাকে একদল ইমাম জাল রেওয়ায়েতকারী বলেছেন। কিন্তু ইমাম ইবনু হিব্বান (رحمة الله) তাকে الثقات বিশ্বস্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। ৯৮। ইবনে হিব্বান: কিতাবুস সিক্বাত, রাবী নং ১০৮৩৭
একদল ইমাম তাকে দুর্বল বলেছেন। যেমন ইমাম আলী ইবনে মাদিনী (رحمة الله) তাকে ضعيف জয়ীফ বলেছেন। ইমাম তিরমিজি ও ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) তাকে ضعيف جدا দুর্বল বলেছেন। ইমাম বুখারী ও ইমাম ইজলী (رحمة الله) তাকে متروك বলেছেন। ৯৯। ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ২৫৩
তার বর্ণিত হাদিসকে ইমাম আবুল আব্বাস শিহাবুদ্দিন বুয়ূছিরী কেনানী (رحمة الله) ضعيف দুর্বল বলেছেন। ১০০। ইত্তেহাফুল খাইরাতিল মিহরাত, হাদিস নং ৬৪৯৫;
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) তার বর্ণিত রেওয়ায়েতকে ضَعِيفٌ جِدًّا দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। ১০১। ইমাম আসকালানী: ইত্তেহাফুল মিহরাত, হাদিস নং ৯০১৪;
অতএব, সার্বিক বিচারে হাদিসটি সনদান দ্বায়িফ বা দুর্বল, তবে ইহার শাহেদ হিসেবে অন্য রেওয়ায়েত রয়েছে বিধায় হাদিসটি শক্তিশালী হবে। যেমন: নূন, লাওহে মাহফুজ ও ক্বলম নূরের সৃষ্টি এই ব্যাপারে আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন। ইমাম আবুল কাশেম আব্দুল কারিম রাফেয়ী (رحمة الله) ওফাত ৬২৩ হিজরী তদীয় কিতাবে বর্ণনা করেন ও ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন,
وَأخرج الرَّافِعِيّ فِي تَارِيخ قزوين من طَرِيق جُوَيْبِر عَن الضَّحَّاك عَن ابْن عَبَّاس قَالَ: قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم: النُّون اللَّوْح الْمَحْفُوظ والقلم من نور سَاطِع
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে করিম (ﷺ) বলেছেন: নূন, লাওহ মাহফুজ ও ক্বলম উজ্জল নূর থেকে সৃষ্টি।” ১০২
এই হাদিসে লাওহ-ক্বলম নূরের তৈরী এই কথা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। আরেকটি রেওয়ায়েতে পাওয়া যায় ‘আল্লাহর আরশ’ নূর থেকেই তৈরী। যেমন, ইমাম আবুশ শায়েখ ইস্পাহানী (رحمة الله) ওফাত ৩৬৯ হিজরী তদীয় কিতাবে বর্ণনা করেছেন,
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ إِبْرَاهِيمَ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ الْبَرَاءِ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْمُنْعِمِ بْنُ إِدْرِيسَ بْنِ سِنَانٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ وَهْبِ بْنِ مُنَبِّهٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: أَوَّلُ شَيْءٍ خَلَقَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ الْعَرْشَ مِنْ نُورٍ، ثُمَّ الْكُرْسِيَّ،
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, প্রথমে আল্লাহ তা’লা আরশকে নূর হতে সৃষ্টি করেন, অতঃপর কুরছীকে।” ১০৩
এই সনদটি দ্বায়িফ তবে পূর্বের হাদিস দ্বারা শক্তিশালী হবে। ১০২। ইমাম রাফেয়ী: التدوين في أخبار قزوين তাদবীন ফি আখবারে কাযবীন, ২য় খন্ড, ৪১৪ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: তাফছিরে দুর্রে মানছুর, ৮ম খন্ড, ২৪১ পৃ:;
১০৩। আবুশ শায়েখ: আল আজমাত, হাদিস নং ২৩৭
এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
قُرِئَ عَلَى بَحْرِ بْنِ نَصْرٍ الْخَوْلانِيِّ الْمِصْرِيِّ، ثنا أَسَدُ بْنُ مُوسَى ثنا يُوسُفُ، عَنْ أَبِي الْعَبَّاسِ ابْنِ بِنْتِ وَهْبِ بْنِ مُنَبِّهٍ، عَنْ وَهْبِ بْنِ مُنَبِّهٍ قَالَ إِنَّ اللَّهَ خلق العرش من نور.
-“ওহাব ইবনে মুনাব্বাহ (رضي الله عنه) বলেন: নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা আরশকে নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ১০৪
এ বিষয়ে আরেকটি আছার উল্লেখ করা যায়,
وَقَالَ ابْنُ مَسْعُودٍ: إِنَّ رَبَّكُمْ لَيْسَ عِنْدَهُ لَيْلٌ وَلَا نَهَارٌ، نُورُ الْعَرْشِ مِنْ نُورِ وَجْهِهِ.
-“হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেছেন: নিশ্চয় তোমাদের রবের কাছে রাত দিন নেই। আরশের নূর সৃষ্টি আল্লাহর বিশেষ নূর হতে।” ১০৫
এজন্যেই আল্লামা ইবনুল হাজ্ব (رحمة الله) ওফাত ৭৩৭ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন,
فَنُورُ الْعَرْشِ مِنْ نُورِ مُحَمَّد صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنُورُ الْقَلَمِ مِنْ نُورِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنُورُ اللَّوْحِ مِنْ نُورِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنُورُ النَّهَارِ مِنْ نُورِهِ وَنُورُ الْعَقْلِ مِنْ نُورِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنُورُ الْمَعْرِفَةِ وَنُورُ الشَّمْسِ وَنُورُ الْقَمَرِ وَنُورُ الْأَبْصَارِ مِنْ نُورِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ انْتَهَى.
-“নূরে মুহাম্মদী থেকেই আরশের নূর। নূরে মুহাম্মদী থেকে ক্বলমের নূর। নূরে মুহাম্মদী থেকে লাওহ এর নূর। নূরে মুহাম্মদী থেকে দিনের নূর। নূরে মুহাম্মদী থেকে আক্বলের নূর। মারেফাতের নূর, সূর্যের নূর, চন্দ্রের নূর, দৃষ্টি শক্তির নূর, সবই নূরে মুহাম্মদী (رحمة الله) থেকে।” ১০৪। তাফছিরে ইবনে আবী হাতেম, হাদিস নং ১০২১৫;
১০৫।তাফছিরে ইবনে কাছির, ৫ম খন্ড, ৪৯০ পৃ: সূরা মু’মীনুন: ৮৪-৯০; ১০৬. ইবনুল হাজ্ব: আল মাদখাল, ২য় খন্ড, ৩২ পৃ:;
অতএব, আল্লাহর আরশ, কুরছী, লাওহ, ক্বলম সৃষ্টি হয়েছে নূর থেকে। যদি আরশ পানির পরের সৃষ্টিও বুঝায় তার পরেও স্পষ্ট প্রমাণিত হয় নূর সৃষ্টি হয়েছে আরশের পূর্বে। কেননা নূর থেকেই আরশ সৃষ্টি হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন দাড়ায়, পানি আগে সৃষ্টি নাকি নূর আগে সৃষ্টি? এ কারণেই আইম্মায়ে কেরাম রাসূলে পাক (ﷺ) এর নূরের বিষয়টি প্রথম রেখেছেন। অতঃপর পানি ও আরশ। কেননা প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর নূর মুবারক সর্বপ্রথম সৃষ্টি, আর এ বিষয়টি একাধিক রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত।
প্রিয় নবীজি (ﷺ) প্রথম সৃষ্টির ছহীহ্ হাদিস
প্রিয় নবীজি রাসূলে করিম (ﷺ) ছিলেন অতি উজ্জল নূর ও গোটা সৃষ্টি জগতে রাসূলে করীম (ﷺ) হলেন الْأَوَّلُ বা প্রথম সৃষ্টি। এ বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর পবিত্র বাণী শুনুন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: لَمَّا خَلْقِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ آدَمَ خَيَّرَ لِآدَمَ بَنِيهِ، فَجَعَلَ يَرَى فَضَائِلَ بَعْضِهِمْ عَلَى بَعْضٍ، قَالَ: فَرَآنِي نُورًا سَاطِعًا فِي أَسْفَلِهِمْ فَقَالَ يَا رَبِّ! مَنْ هَذَا؟ قَالَ: هَذَا ابْنُكَ أَحْمَدُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخَرُ وَهُوَ أَوَّلُ شَافِعٍ
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: তখন তাঁর সন্তানদেরকে দেখালেন, ফলে তিনি পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিরিক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে তিনি একটি অতি উজ্জল নূর দেখালেন। অতঃপর আদম বলল: ওহে রব! এটা কে? আল্লাহ তা’লা বলেন: সে তোমার পুত্র আহমদ (ﷺ)! তিনিই প্রথম সৃষ্টি, তিনিই শেষ, তিনিই প্রথম শাফায়াতকারী।” ১০৭
এই হাদিস সম্পর্কে স্বয়ং নাছিরুদ্দিন আলবানী তার কিতাবে বলেন:
قلت: وهذا إسناد حسن؛ رجاله كلهم ثقات رجال البخاري؛ -“আমি (আলবানী) বলছি: এই হাদিসের সনদ হাছান, ইহার সকল বর্ণনাকারীগণ ইমাম বুখারী (رحمة الله) এর বর্ণনাকারী।” ১০৮
এই হাদিসের সনদটি হচ্ছে:-
أَخْبَرَنَا أَبُو الْحَسَنِ عَلِيُّ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ سِيمَاءَ الْمُقْرِئُ، قَدِمَ عَلَيْنَا حَاجًّا، حَدَّثَنَا أَبُو سَعِيدٍ الْخَلِيلُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ الْخَلِيلِ الْقَاضِي السِّجْزِيُّ، أَنْبَأَنَا أَبُو الْعَبَّاسِ مُحَمَّدُ بْنُ إِسْحَاقَ الثَّقَفِيُّ، حَدَّثَنَا أَبُو عُبَيْدِ اللهِ يَحْيَى بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ السَّكَنِ، حَدَّثَنَا حَبَّانُ بْنُ هِلَالٍ، حَدَّثَنَا مُبَارَكُ بْنُ فَضَالَةَ حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللهِ بْنُ عُمَرَ، عَنْ خُبَيْبِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، عَنْ حَفْصِ بْنِ عَاصِمٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،
এই হাদিসের সনদে مُبَارَكُ بْنُ فَضَالَةَ ‘মুবারক ইবনে ফাদ্বালাহ’ নামক রাবী সম্পর্কে কেউ কেউ অযথা ভ‚য়া আপত্তি তুলেন। অথচ ইমামগণের বিশাল এক জামাত তাকে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বলেছেন। ১০৭. ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়াত, ৫ম খন্ড, ৪৮৩ পৃ: হাদিস নং ২২১৮; হাদিসু সিরাজ, হাদিস নং ২৬২৮; ইমাম খারকুশী: শরফুল মুস্তফা, ১ম খন্ড, ৩০৯ পৃ:; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৩২০৫৩ ও ৩২০৫৬; ইমাম ছিয়তী: খাছাইছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ১০২ পৃ:; মুখলেছিয়াত, হাদিস নং ২৩৪০;
১০৮. আলবানী: সিলছিলায়ে জয়ীফা, হাদিস নং ৬৪৮২;
যেমন হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) তার ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন:
وقال بن أبي خيثمة عن بن معين معين ثقة وقال محمد بن عثمان بن أبي شيبة عن بن المديني هو صالح وسط وقال العجلي لا بأس به وقال أبو زرعة يدلس كثيرا فإذا قال حدثنا فهو ثقة وقال الآجري عن أبي داود إذا قال حدثنا فهو ثبت وذكره بن حبان في الثقات
-“ইবনে আবী হায়ছামা ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله) বর্ণনা করেন, সে বিশ্বস্ত। মুহাম্মদ ইবনে উছমান ইবনে আবী শায়বাহ ইমাম ইবনে মাদানী (رحمة الله) থেকে বলেন, সে গ্রহণযোগ্য ও মধ্যম। ইমাম ইজলী (رحمة الله) বলেন: তার ব্যাপারে অসুবিধা নেই। ইমাম আবু যুরাআ (رحمة الله) বলেন: তার অনেক তাদলীছ রয়েছে তবে যখন ‘হাদ্দাছানা’ বলবে তখন ঐ হাদিস বিশ্বস্ত প্রমাণিত বুঝাবে। ইমাম আজরী ইমাম আবু দাউদ (رحمة الله) থেকে বলেন: যখন সে ‘হাদ্দাছানা বলবে তখন ঐ হাদিস প্রমাণিত বলে বুঝাবে।” ১০৯
ইমাম শামছুদ্দিন যাহাবী (رحمة الله) উল্লেখ করেন,
وَقَالَ ابْنُ مَعِينٍ: صَالِحُ الْحَدِيثِ. وَقَدِ اسْتَشْهَدَ بِهِ الْبُخَارِيُّ.
-“ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله) বলেন: সে গ্রহণযোগ্য। ইমাম বুখারী (رحمة الله) তার ব্যাপারে ভাল সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।” ১১০
ইমাম মুগলতাঈ (رحمة الله) উল্লেখ করেন,
قال ابن المديني: سمعت أبا الوليد الطيالسي، سمعت هشيما يقول: مبارك بن فضالة ثقة، ولما خرج الحاكم حديثه في المستدرك قال: والمبارك بن فضالة ثقة، وقال أبو الحسن العجلي: يكتب حديثه، جائز الحديث، وذكره ابن شاهين في الثقات.
-“ইবনে মাদিনী বলেন: আমি আবু ওয়ালিদ তায়ালিছী কে বলতে শুনেছি: হুশাইমানকে বলতে শুনেছি ‘মুবারক ইবনে ফাদ্বালাহ’ বিশ্বস্ত। ইমাম হাকেম তার ‘মুস্তাদরাক’ গ্রন্থে তার থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন ও বলেছেন: সে বিশ্বস্ত। ইমাম আবুল হাছান ইজলী (رحمة الله) বলেন: তার হাদিস লিখি সে জায়েযুল হাদিস। ১০৯. ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৫০;
১১০. ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৩৩৭;
ইমাম ইবনে শাহিন (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।” ১১১
ইমাম মিযযী (رحمة الله) উল্লেখ করেন,
وَقَال المفضل بْن غسان الغلابي عَن يحيى بْن مَعِين: الربيع بْن صبيح، والمبارك بْن فضالة صالحان. وَقَال أَبُو بكر بْنُ أَبي خيثمة: سمعت يحيى بْن مَعِين: وسئل عَنِ المبارك، فقال: ضعيف. وسمعته مرة أخرى يقول: ثقة.
وَقَال معاوية بْن صَالِح، عَنْ يحيى بْن مَعِين: ليس به بأس وَقَال مُحَمَّد بْن عُثْمَانَ بْن أَبي شَيْبَة فِي موضع آخر: سألت علي بْن المديني عَنْه، فقال: هو صالح وسط. وَقَال أبو زُرْعَة: يدلس كثيرا، فإذا قال: حَدَّثَنَا فهو ثقة. وَقَال أَبُو حاتم: هو أحب إلي من الربيع بْن صبيح.
-“মুফাদ্দাল ইবনে গাচ্ছান গালাবী ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন: রবিঈ ইবনে ছাবেহ্ এবং মুবারক ইবনে ফাদ্বালাহ দু’জনই গ্রহণযোগ্য বান্দাহ ছিল। ইমাম আবু বকর ইবনে আবী হায়ছামা বলেন, আমি ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (رحمة الله) কে বলতে শুনেছি: তাকে মুবারক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বলেন: সে দুর্বল, আরেকবার তিনি বলেন: সে বিশ্বস্ত। মুয়াবিয়াহ ইবনে ছালেহ্ ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (رحمة الله) থেকে বলেন, তার ব্যাপারে কোন অসুবিধা নেই। মুহাম্মদ ইবনে উছমান ইবনে আবী শায়বাহ্ আরেক জায়গায় বলেন: আলী ইবনে মাদানী (رحمة الله) তার ব্যাপারে কে জিজ্ঞাসা করা হল তিনি বলেন: সে গ্রহণযোগ্য ও মধ্যম। ইমাম আবু যুরাআ (رحمة الله) বলেন: তার অনেক তাদলীছ রয়েছে তবে যখন সে যখন ‘হাদ্দাছানা’ বলেন তখন সে বিশ্বস্ত। ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله) বলেন: সে আমার কাছে ‘রবিঈ ইবনে ছাবিহ্’ এর চেয়ে অধিক প্রিয়।” ১১২
ইমাম হাকেম নিছাপুরী (رحمة الله) তদীয় ‘মুস্তাদরাক’ কিতাবে বহু স্থানে তার রেওয়ায়েতকে ছহীহ্ বলেছেন এবং ইমাম যাহাবী (رحمة الله) একমত পোষণ করেছেন। ১১১. ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৪৪১১;
১১২. ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৫৭৬৬;
ইমাম তিরমিজি (رحمة الله) তার রেওয়ায়েতকে হাছান বলেছেন। অতএব, এই হাদিস নির্ভরযোগ্য ও ছহীহ্।
প্রিয় নবীজি (ﷺ) বা আওয়ালিয়্যাত বা সর্বপ্রথম হওয়ার বিষয়ে শারিহে বুখারী ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে বলেন,
্রالأولগ্ধ فلأنه أول النبيين خلقا كما مر وكما أنه أول فى البدء فهو أول فى العود، فهو أول من تنشق عنه الأرض، وأول من يدخل الجنة،
-“ (الأول) ‘আওয়াল’ কেননা আল্লাহর নবী (ﷺ) সৃষ্টির মধ্যে প্রথম নবী। আর যেমনিভাবে রাসূলে পাক (ﷺ) সৃষ্টির মধ্যেও প্রথম এবং তিনি প্রথম প্রত্যাবর্তনকারী। আর তিনিই প্রথম জমীন থেকে উঠবেন এবং প্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন।” ১১৩
প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর আওয়ালিয়্যাত বা সর্বপ্রথম হওয়ার বিষয়ে ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) বলেছেন,
وَالْأَوَّلُ الْحَقِيقِيُّ هُوَ النُّورُ الْمُحَمَّدِيُّ عَلَى مَا بَيَّنْتُهُ فِي الْمَوْرِدِ لِلْمَوْلِدِ.
-“হাকিকী অর্থে প্রথম সৃষ্টি হল মুহাম্মদ (ﷺ) এর নূর। যা আমি আমার ‘মাওরিদুল মাওলিদ’ কিতাবে বয়ান করেছি।” ১১৪
সুতরাং, এই হাদিস দ্বারা স্পষ্ট করে প্রমাণিত হয়, রাসূলে করিম (ﷺ) সৃষ্টির প্রথম এবং আদি পিতা হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে তিনি নূর অবস্থায় ছিলেন। অতএব রাসূলে করিম (ﷺ) আদম (عليه السلام) সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহর নূর দ্বারা সৃষ্টি হয়েছেন। কারণ মাটির তৈরী সর্বপ্রথম মানব হলেন হযরত আদম (عليه السلام)। ১১৩. ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৪৫৮ পৃ:;
১১৪. মেরকাত শরহে মেসকাত, ৯৪ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
এ জন্যেই হাফিজ আবুল ফারাজ ইবনে জাওযী (رحمة الله) (ওফাত ৫৯৭ হিজরী) তদীয় কিতাবে বলেন:
ولما خلق الله ادم عليه السلام وظهر نوره واسمه مكتوب على ساق العرش سطرا
-“যখন আদম (عليه السلام) কে সৃষ্টি করলেন তখন নবী পাক (ﷺ) এর নূরকে প্রকাশ করলেন এবং প্রিয় নবীজির নাম আরশের খুটিতে উজ্জল রূপে লিখে ছিলেন।” ১১৫
ইমাম আব্দুল মালেক ইবনে মুহাম্মদ আবু সাদ খারকুশী (رحمة الله) ওফাত ৪০৭ হিজরী তদীয় কিতাবে আরেকটি হাদিস বর্ণনা করেন,
وروى عبد الله بن المبارك، عن سفيان الثوري، عن جعفر بن محمد الصادق، عن أبيه، عن جده، عن علي بن أبي طالب أنه قال: إن الله تبارك وتعالى خلق نور محمد صلى الله عليه وسلم قوله: عن علي بن أبي طالب: قبل أن يخلق السماوات والأرض والعرش والكرسي والقلم والجنة
-“হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় তিনি বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা নূরে মুহাম্মদীকে সৃষ্টি করেছেন। ‘হযরত আলী (رضي الله عنه) এর বাণী’ নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি হয় আসমান সমূহ, জমীন, আরশ, কুরছী, ক্বলম ও জান্নাতের পূর্বে।” ১১৬
হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (رحمة الله)। তিনার রেফারেন্স ইমাম আব্দুল মালেক ইবনে মুহাম্মদ আবু সাদ খারকুশী (رحمة الله) ওফাত ৪০৭ হিজরী তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন এবং সনদের সকল রাবীগণ বিশ্বস্ত ও নবীর বংশের রাবী। ১১৫. ইমাম ইবনে জাওযী: মাওলিদুন নববী শরীফ, ২৪ পৃ:;
১১৬. শারফুল মুস্তফা, ৭৯ নং হাদিস;
তবে হাদিসটি সম্পূর্ণ সনদে ‘মাআনীল আখবার’ কিতাবের ৩০৬ পৃষ্টায় ইমাম শায়েখ ছাদুক আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনু আলী ইবনে হুসাইন কুম্মী (رحمة الله) ওফাত ৩৮১ হিজরী তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এই হাদিস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, রাসূলে করীম (ﷺ) এর নূর মুবারক আসমান-জমীন, আরশ-কুরছী, ক্বলম ও জান্নাতের পূর্বে সৃষ্টি। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট তাবেঈ ও আওলাদে রাসূল, ইমাম আবু হানিফা (رضي الله عنه) এর পীর হযরত জাফর সাদেক (رضي الله عنه) এর বক্তব্য সম্পর্কে আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী হানাফী (رحمة الله) উল্লেখ করেন,
قال جعفر الصادق رضى الله عنه أول ما خلق الله نور محمد صلى الله عليه وسلم قبل كل شىء
-“হযরত জাফর সাদিক (رضي الله عنه) বলেন: সকল কিছু সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তা’লা নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি করেছেন।” ১১৭. তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৮ম খন্ড, ৩৯৬ পৃ:;
উল্লেখিত হাদিস সমূহ বিশ্লেষণ করে প্রমাণিত হল, সৃষ্টি জগতে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হল হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ)। ক্বলম, আরশ ও পানি প্রথম সৃষ্টির বিষয়টি এজাফত হয়েছে সম্মানার্থে। মূল সর্র্বপ্রথম সৃষ্টি হল হযরত রাসূলে পাক (ﷺ) এর নূর বা নূরে মুহাম্মদী (ﷺ)। অতএব, ক্বলম, পানি ও আরশের পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে নূূরে মুহাম্মদী (ﷺ)। অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদী হল প্রথম সৃষ্টি। যেহেতু বিষয়টি রাসূলে পাক (ﷺ) থেকে ছহীহ্ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেছে সেহেতু ইহার বিপরীতমুখী কোন কথা বলাও ঈমানের খাতরা।
❏ প্রিয় নবীজি (ﷺ) সৃষ্টির মধ্যে প্রথম মানুষ
সৃষ্টির মধ্যে রাসূলে করীম (ﷺ) হলেন প্রথম নূরানী বে-মেছাল ও বে-নজির মানুষ। এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে সা’দ (رحمة الله) বর্ণনা করেন ও বিশ্ব বিখ্যাত ফকিহ্, আল্লামা আবুল ফজল হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله) {ওফাত ৭৭৪ হি.} স্ব স্ব কিতাবে উল্লেখ করেন:
أَخْبَرَنَا عَبْدُ الْوَهَّابِ بْنُ عَطَاءٍ عَنْ سَعِيدُ بْنُ أَبِي عَرُوبَةَ عَنْ قَتَادَةَ قَالَ: وَأَخْبَرَنَا عُمَرُ بْنُ عَاصِمٍ الْكِلابِيُّ. أَخْبَرَنَا أَبُو هِلالٍ عَنْ قَتَادَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ: كُنْتُ أَوَّلَ النَّاسِ فِي الْخَلْقِ وَآخِرَهُمْ فِي الْبَعْثِ
-“হযরত কাতাদা (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: সৃষ্টির মধ্যে আমিই প্রথম মানুষ এবং প্রেরিত হয়েছি সবার শেষে।” ১১৮
এই হাদিস সম্পর্কে হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله) বলেন: وَهَذَا أَثْبَتُ وَأَصَحُّ -“ইহা প্রমাণিত ও অধিক ছহীহ্।” ১১৯
হযরত কাতাদা (رحمة الله) থেকে দুইটি ধারায় হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে। যেমন প্রথমটি হল:- কাতাদা- সাঈদ ইবনে আবী উরওয়া- আব্দুল ওয়াহ্হাব ইবনে আত্বা। এবং দ্বিতীয়টি হল: কাতাদা- আবু হিলাল- উমর ইবনে আছেম। দুইটি সূত্রই শক্তিশালী।
১১৮. ইমাম ইবনে সা’দ: তাব্কাতে কোবরা, ১ম খন্ড, ১১৯ পৃ:; হাফিজ ইবনে কাছির: আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ১ম খন্ড, ৩২৫ পৃ:; ইমাম খারকুশী: শরফুল মোস্তফা, ২য় খন্ড, ৭২ পৃ:; কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ১ম খন্ড, ১১৪ পৃ:; বাহ্জাতুল মাহফিল, ১ম খন্ড, ১৩ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৪২ পৃ:; শরহে মাওয়াহেব লিয যুরকানী, ১ম খন্ড, ৬৯ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১০ম খন্ড, ২৭৪ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: শরহে শিফা, ১ম খন্ড, ১১৭ পৃ:;
১১৯.হাফিজ ইবনে কাছির: আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ১ম খন্ড, ৩২৫ পৃ:
বর্ণনাকারী তাবেঈ কাতাদা (رحمة الله) তো নিজেই সু-প্রসিদ্ধ তাবেঈ ও বিশ্বস্ত। ‘আবু হিলাল’ أَبُو هِلالٍ এর মূল নাম হল مُحَمَّدُ بْنُ سُلَيْمٍ الرَّاسِبِيُّ (মুহাম্মদ ইবনে সুলাইম রাছেবী) তার ব্যাপারে একদল ইমাম বিশ্বস্ত বলেছেন ও তার উপর নির্ভর করেছেন। যেমন লক্ষ্য করুন:-
وَقَالَ أَبُو حَاتِمٍ: مَحِلُّهُ الصِّدْقُ. قُلْتُ: عَلَّقَ لَهُ الْبُخَارِيُّ. -“ইমাম আবু হাতিম বলেন, সে মূলত সত্যবাদী। আমি (যাহাবী) বলি: ইমাম বুখারী তার থেকে তালিকরূপে হাদিস বর্ণনা করেছেন।” (ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৪৭৪)
استشهد به البخاري في الصحيح، وروى له في كتاب القراءة خلف الإمام -“ইমাম বুখারী (رحمة الله) তার ছহীহ্ গ্রন্থে তার ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। ‘কিরায়াতু খালফাল ইমাম’ গ্রন্থে তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।” ১২০
وقال عثمان الدارمي قلت لابن معين حماد بن سلمة أحب إليك في قتادة أو أبو هلال فقال حماد أحب إلي وأبو هلال صدوق وقال مرة ليس به بأس وقال الآجري منه عن أبي داود وأبو هلال ثقة
-“উছমান দারেমী বলেন, আমি ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله) কে বললাম, আপনার কাছে কাতাদা এর চেয়ে হাম্মাদ ইবনে সালামা কি অধিক পছন্দনীয় অথবা আবু হেলাল? তিনি বললেন: হাম্মাদ আমার কাছে পছন্দনীয়, আবু হেলাল সত্যবাদী। আরেকবার বললেন, তার ব্যাপারে অসুবিধা নেই।” আজরী ইমাম আবু দাউদ (رحمة الله) থেকে বলেন, আবু হেলাল বিশ্বস্ত।” ১২১
বর্ণনাকারী ‘উমর ইবনে আছেম’ হল ইমাম বুখারী (رحمة الله) এর একজন উস্তাদ। যেমন ইমাম বদরুদ্দিন আইনী (رحمة الله) বলেন:
عمر بن عَاصِم هُوَ من شُيُوخ البُخَارِيّ -“উমর ইবনে আছেম তিনি ইমাম বুখারীর শায়েখ।” ১২২
কাজী শাওকানী বলেন: وَقَدْ رَوَاهُ عُمَرُ بْنُ عَاصِمٍ وَهُوَ مِنْ الثِّقَات
-“অবশ্যই ইহা বর্ণনা করেছেন উমর ইবনে আছেন আর তিনি বিশ্বস্তদের একজন।” ১২৩
দ্বিতীয় সনদে হযরত কাতাদা (رحمة الله) নিজেই বিশ্বস্ত তাবেঈ। ‘সাঈদ ইবনে আবী উরওয়াদ বুখারী-মুসলীমের রাবী ও বিশ্বস্ত। বর্ণনাকারী ‘আব্দুল ওয়াহ্হাব ইবনে আত্বা’ ছহীহ্ মুসলীমের রাবী ও বিশ্বস্ত। ‘সাঈদ ইবনে আবী উরওয়া’ ছহীহ্ বুখারী ও মুসলীমের রাবী। সুতরাং দুইটি সনদই শক্তিশালী ও বিশুদ্ধ।
১২০.ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ২৫৫৬;
১২১.হাফিজ ইবনে হাজার: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৩০৩; ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ২৫৫৬;
১২২.ইমাম আইনী: উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী, ২৩তম খন্ড, ১৮১ পৃ: ২৫৬৬ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
১২৩কাজী শাওকানী: নাইলুল আওতার, ১ম খন্ড, ৯৯ পৃ: ৭৯ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
হাদিসটি মুরছাল ছহীহ্ তবে এর মুত্তাছিল ছহীহ্ রেওয়ায়েত রয়েছে। যেমন ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله) এভাবে বর্ণনা করেছেন,
حَدَّثَنَا جَعْفَرُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ عَاصِمٍ، حَدَّثَنا هِشَامُ بْنُ عَمَّارٍ، حَدَّثَنا الوليد، حَدَّثَنا خُلَيْدُ بْنُ دَعْلَجٍ وَسَعِيدٌ، عَن قَتادَة عَنِ الْحَسَنِ، عَن أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيه وسَلَّم قَال: كُنْتُ أَوَّلَ الناس فِي الْخَلْقِ وَآخِرَهُمْ فِي الْبَعْثِ.
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: সৃষ্টির মধ্যে আমিই প্রথম মানুষ এবং প্রেরিত হয়েছি সবার শেষে।” ১২৪
এই সনদে خُلَيْدُ بْنُ دَعْلَجٍ (খুলাইদ ইবনে দালাজ) মজবুত রাবী না হলেও ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله) তাকে صَالِحٌ বা নেক বান্দাহ বলেছেন। ১২৫
এই হাদিসটি خُلَيْدُ بْنُ دَعْلَجٍ (খুলাইদ ইবনে দালাজ) এর একক সূত্রে হলে জয়ীফ হত, কিন্তু সে ইহা এককভাবে বর্ণনা করেননি বরং তার সাথে سَعِيدٌ (সাঈদ) বর্ণনা করেছেন।
১২৪.ইমাম ইবনে আদী: আল-কামিল ফিদ-দোয়াফা, ৩য় খন্ড, ৪৮৮ পৃ:; আল্লামা মানাভী: ফায়জুল কাদীর, হাদিস নং ৬৪২৩; যখিরাতুল হুফ্ফাজ, হাদিস নং ৪৩৭৫;
১২৫. ইমাম যাহাবী: সিয়ারে আলামিন নুবালা, রাবী নং ৭১; ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ১৭১৬;
অর্থাৎ সাঈদ ও খুলাইদ উভয়ে একত্রে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, তাই ইহা শক্তিশালী রেওয়ায়েত হবে। কারণ অন্য রেওয়ায়েত দ্বারাও ইহা শক্তিশালী হয়েছে। এই হাদিসের সনদে سَعِيدُ بْنُ بَشِيرٍ، أَبُو عَبْدِ الرَّحْمَنِ الأَزْدِيُّ (সাঈদ ইবনে বাশির আবু আব্দুর রহমান আযদী) নামক রাবী রয়েছে, তার ব্যাপারে কেউ কেউ সমালোচনা করলেও ইমামদের অনেকেই তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন ও তার উপর নির্ভর করেছেন। যেমন লক্ষ্য করুন:-
وقال أبو بكر البزار هو عندنا صالح ليس به بأس. -“ইমাম আবু বকর বাজ্জার (رحمة الله) বলেন: সে আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ও তার ব্যাপারে অসুবিধা নেই।” ১২৬
ইমাম শামছুদ্দিন যাহাবী (رحمة الله) তার ব্যাপারে বলেন:
الإِمَامُ، المُحَدِّثُ، الصَّدُوْقُ، الحَافِظُ، -“তিনি ইমাম, মুহাদ্দিছ, সত্যবাদী ও হাফিজ ছিলেন।” ১২৭
وقال مَرْوَانُ الطَّاطَرِيّ: سَمِعْتُ سُفْيَانَ بْنَ عُيَيْنَةَ عَلَى جمرة العقبة يقول: حدثنا سَعِيدُ بْنُ بَشِيرٍ، وَكَانَ حَافِظًا.
-“মারওয়ান তাতারী বলেন, আমি সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (رحمة الله) কে ‘জামরায়ে আকাবায়’ বলতে শুনেছি: আমাদেরকে সাঈদ ইবনে বাশির হাদিস বর্ণনা করেছেন আর সে একজন হাফিজ ছিলেন।” ১২৮
وقال دحيم: يُوَثِّقُونَهُ، كَانَ حَافِظًا. -“ইমাম দুহাইম (رحمة الله) বলেন: তাকে বিশ্বস্ত বলা হয় সে একজন হাফিজ ছিলেন।” ১২৯
ذكره ابن شاهين في الثقات -“ইমাম ইবনে শাহিন (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।” ১৩০
قال شعبة بن الحجاج: هو مأمون خذوا عنه. -“ইমাম শুবা ইবনে হাজ্জায (رحمة الله) বলেছেন: সে গ্রহণযোগ্য তোমরা তার থেকে হাদিস গ্রহণ কর।” ১৩১
وذكره الحاكم في الثقات وخرج حديثه في مستدركه -“ইমাম হাকেম (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্তদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন এবং তার ‘মুস্তাদরাক’ গ্রন্থে তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।”
১২৬. ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, ৪র্থ খন্ড, ৮ পৃ:; ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ১৯১০;
১২৭. ইমাম যাহাবী: সিয়ারে আ’লামী নুভালা, রাবী নং ৯৭, ৭ম খন্ড, ৩০৪ পৃ:;
১২৮. ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৪র্থ খন্ড, ৩৭৩ পৃ:; ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ২২৪৩;
১২৯. ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৪র্থ খন্ড, ৩৭৩ পৃ:; ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ২২৪৩;
১৩০. ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ১৯১০;
১৩১. ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ১৯১০; ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ২২৪৩;
১৩২
ذكره ابن خلفون في الثقات -“ইমাম ইবনে খালিফুন (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।” ১৩৩
অতএব, এই হাদিস নিরর্ভরযোগ্য ও ছহীহ্। সুতরাং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সৃষ্টির প্রথম মানুষ। আল্লামা ইবনে ছালেহ শামী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে এর আরেকটি সূত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন,
وروى ابن إسحاق عن قتادة مرسلا قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم، كنت أول الناس في الخلق وآخرهم في البعث
-“ইমাম ইবনে ইসহাক্ব হযরত কাতাদা (رحمة الله) থেকে মুরছাল রূপে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: সৃষ্টির মধ্যে আমি প্রথম মানুষ ছিলাম এবং প্রেরিত হয়েছি সবার শেষে।” ১৩৪
এর সমর্থনে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
১৩২. ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ১৯১০;
১৩৩ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ১৯১০;
১৩৪ইমাম ইবনে ছালেহ: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৬৮ পৃ:;
رَوَى قَتَادَةُ عَنِ الْحَسَنِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُئِلَ عَنْ قَوْلِهِ تَعَالَى وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ قَالَ: كُنْتُ أَوَّلَهُمْ فِي الْخَلْقِ وَآخِرَهُمْ فِي الْبَعْثِ
-“হযরত কাতাদা বর্ণনা করেছেন হাছান বছরী (رحمة الله) থেকে, তিনি আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে এই আয়াত “ইজ আখযনা মিছাকাহুম..” তিনি বলেন: সৃষ্টির মধ্যে আমিই ছিলাম তাঁদের প্রথম, আর প্রেরিত হয়েছি সবার শেষে।” ১৩৫. তারিখে ইবনে আসাকির, তাফছিরে কুরতবী, ১৪তম খন্ড, ১২৭ পৃ:; তাফছিরে ইবনে আবী হাতেম, হাদিস নং ১৭৫৯৫;
সুতরাং সৃষ্টি জগতে স্ব শরীরে প্রথম মানুষ হল আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ)। আদম (عليه السلام) হল মাটির তৈরী প্রথম মানুষ আর আমাদের নবী (ﷺ) হলে তার বহু পূর্বে মানুষ, তাই তিনি কখনোই মাটির কিংবা নূতফার তৈরী মানুষ নয়। সুতরাং আমাদের নবী (ﷺ)’ই ছিলেন প্রথম সৃষ্টি ও নূরের তৈরী মানুষ।
❏ ফোকাহাদের দৃষ্টিতে প্রথম সৃষ্টি
সর্বপ্রথম সৃষ্টি নিয়ে অনেক রকম রেওয়ায়েত বর্ণিত হলেও মূলত সর্বপ্রথম সৃষ্টি হল নূরে মুহাম্মদী। এ কারণেই বিশ্ব বিখ্যাত ইমাম ও হাফিজুল হাদিস, ইমাম ইবনে হাজার মক্কী হায়তামী (رحمة الله) বলেছেন ও হিজরী ১১শ শতাব্দির মুজাদ্দিদ, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) {ওফাত ১০১৪ হিজরী} সংকলন করেছেন,
قَالَ ابْنُ حَجَرٍ: اخْتَلَفَتِ الرِّوَايَاتُ فِي أَوَّلِ الْمَخْلُوقَاتِ، وَحَاصِلُهَا كَمَا بَيَّنْتُهَا فِي شَرْحِ شَمَائِلِ التِّرْمِذِيِّ أَنَّ أَوَّلَهَا النُّورُ الَّذِي خُلِقَ مِنْهُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ، ثُمَّ الْمَاءُ، ثُمَّ الْعَرْشُ
-“হাফিজ ইবনু হাজার (رحمة الله) বলেন: প্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে রেওয়ায়েত গুলোর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। ইহার সার কথা, যেমনটি আমি ‘শরহে শামায়েলে তিরমিজি’ কিতাবে বলেছি, নিশ্চয় এ গুলোর মধ্যে প্রথম সৃষ্টি হল ‘নূর’ যা দ্বারা রাসূলে পাক (ﷺ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর পানি সৃষ্টি করা হয় অতঃপর আরশ সৃষ্টি করা হয়।” ১৩৬. ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১ম খন্ড, ২৪১ পৃ:, ৭৯ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) তিনার অন্য একটি কিতাবে বলেছেন,
كما ذكر فى اثناء ذلك الخلال فى اي اشياء خلقت بعد النور المحمدى: العرش او الماء او القلم فتوصل من خلال المقارنة بين النصوص الورادة فى ذلك الى ان اول الاشياء على الاطلاق النور المحمدي ثم الماء ثم العرش ثم القلم
-“এরই মাধ্যমে আমি উল্লেখ করেছি যে, নূরে মুহাম্মদীর পরে সব কিছু পূর্বে কি সৃষ্টি করা হয়েছে- আরশ অথবা পানি অথবা ক্বলম। নস সমূহ তুলনা করে এ বিষয়ে পৌছা যায় যে, নিশ্চয় প্রথম সম্বন্ধীত হয়ে নূরে মুহাম্মদী অতঃপর পানি অতঃপর আরশ অতঃপর ক্বলম।” ১৩৭
ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) তিনার অন্য একটি কিতাবে বলেছেন,
فعلم ان اول الاشياء على الاطلاق النور المحمدي ثم الماء ثم العرش ثم القلم فذكر الاولية فى غير نوره صلى الله عليه وسلم اضافية
-“জানা যেল, নিশ্চয় সব কিছুর মধ্যে প্রথম সম্বন্ধীত হয়েছে নূরে মুহাম্মদী অতঃপর পানি অতঃপর আরশ অতঃপর ক্বলম। নূরে মুহাম্মদী ব্যতীত বাকীর কিছুর সাথে ‘আওয়াল’ শব্দটি এজাফী হিসেবে এসেছে (হাকিকী অর্থে নয়)।” ১৩৮
হিজরী ১১শ শতাব্দির মুজাদ্দিদ ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) তিনার অন্য একটি কিতাবে বলেছেন,
وَأَمَّا نُورُهُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ فَهُوَ فِي غَايَةٍ مِنَ الظُّهُورِ شَرْقًا وغَرْبًا وَأَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ نُورَهُ وَسَمَّاهُ فِي كِتَابِهِ نُورًا
-“সৃষ্টির সর্বত্র প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর নূরানী সত্বাই সর্বাধিক পরিচিত ও প্রকাশিত। আল্লাহ তা’লা তাঁর নূরানী সত্বাকে সর্বাগ্রে সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনে তাঁকে নূর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।” ১৩৯
ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) তিনার অন্য একটি কিতাবে বলেছেন,
واختلفوا فى أول المخلوقات بعد النور المحمدى، فقيل: العرش -“নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) এর পরে প্রথম সৃষ্টি কোনটি সেটা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে (অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদী প্রথম সৃষ্টি)।” ১৪০
অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদী প্রথম সৃষ্টি এ বিষয়ে মতানৈক্য নেই। অতএব, ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এর ফায়ছালা মোতাবেক রাসূলে পাক (ﷺ) এর নূর মুবারক প্রথম সৃষ্টি, অতঃপর পানি, আরশ ও ক্বলম।
১৩৭. ইমাম মোল্লা আলী: আল মাওরিদুর রাবী ফি মাওলিদুন নববী, পৃ: ৩;
১৩৮. ইমাম মোল্লা আলী: আল মাওরিদুর রাবী ফি মাওলিদুন নববী, পৃ: ১৯;
১৩৯ইমাম মোল্লা আলী: মাওজুয়াতুল কবীর, ৮৬ পৃ:;
১৪০. ইমাম মোল্লা আলী: আল মাওরিদুর রাবী ফি মাওলিদুন নববী, পৃ: ১৮;
এ সম্পর্কে আল্লামা হাফিজ ইবনে হাজার হায়তামী মক্কী (رحمة الله) {ওফাত ৯৭৪ হিজরী} তদীয় কিতাবে অনুরূপ বলেন,
لكن صحّ فى حديث مرفوع: أن الماء خلق قبل العرش فعلم أن أول الأشياء على الإطلاق النور المحمدى، ثم الماء، ثم العرش، ثم القلم لما علمت من حديث أول ما خلق الله القلم
-“মারফূ ছহীহ্ হাদিস হচ্ছে ‘আরশের পূর্বে পানি সৃষ্টি হয়েছে’। যেনে রেখ! প্রথম সৃষ্টি সমূদয় বস্তুর মধ্যে প্রথম সম্ভোধন হয়েছে ‘নূরে মুহাম্মদী, অতঃপর পানি, অতঃপর আরশ, অতঃপর ক্বলম। যা আমরা ‘আল্লাহ প্রথমে ক্বলম সৃষ্টি করেছেন’ এই হাদিস থেকে জানলাম।” ১৪১
এ বিষয়ে হাফিজুল হাদিস ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) আরো বলেন,
واختلفوا فى أول المخلوقات بعد النور المحمدى، فقيل: العرش -“নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) এর পরে প্রথম সৃষ্টি কোনটি সেটা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে (অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদী প্রথম সৃষ্টি)..।” ১৪২
আল্লামা হুছাইন ইবনে মুহাম্মদ দিয়ারবকরী (رحمة الله) (ওফাত ৯৬৬ হিজরী) তদীয় কিতাবে বলেছেন,
واختلفت الروايات فى أوّل المخلوقات ففى رواية نور رسول الله صلى الله عليه وسلم وفى رواية العقل وفى رواية القلم وفى رواية اللوح ومنشأ الاختلاف ورود الاخبار المختلفة فى أوّل ما خلق الله ففى خبر أوّل ما خلق الله نور محمد صلى الله عليه وسلم وفى الانس الجليل ان الله خلق أوّلا نور رسول الله صلى الله عليه وسلم قبل العرش والكرسى واللوح والقلم والسماء والارض والجنة والنار بألف ألف وستمائة وسبعين ألف سنة
-“প্রথম সৃষ্টির রেওয়ায়েত গুলোর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। এক রেওয়ায়েতে আছে, রাসূল (ﷺ) এঁর নূর প্রথম সৃষ্টি। আরেক রেওয়ায়েতে আছে, আকল, আরেক রেওয়ায়েতে আছে ক্বলম, আরেক রেওয়ায়েতে আছে লাওহ্। এভাবে আল্লাহ প্রথম কি সৃষ্টি করেছেন সেই রেওয়ায়েত গুলোর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। হাদিসের মধ্যে আছে, আল্লাহ তা’লা রাসূল (ﷺ) এঁর নূর সৃষ্টি করেছেন।
১৪১. ইমাম ইবনে হাজার মক্কী: আশরাফুল অছাইল, ১ম খন্ড, ৩৭ পৃ:;
১৪২. ইমাম ইবনে হাজার মক্কী: আশরাফুল অছাইল ফি শরহে শামাইল, ১ম খন্ড, ৩৬ পৃ:;
‘উনছে জালিল’ এ আছে, নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা আরশ-কুরছী, লাওহ-ক্বলম, আসমান-জমীন, জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টি করা ৭০ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর নূর সৃষ্টি করেছেন।” ১৪৩
অনুরূপ আল্লামা মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের ইবনে শায়েখ আব্দুল্লাহ আইদারুছ (رحمة الله) (ওফাত ১০৩৮ হিজরী) তদীয় কিতাবে বলেন,
فَعلم ان أول الْأَشْيَاء على الْإِطْلَاق النُّور المحمدي ثمَّ المَاء ثمَّ الْعَرْش ثمَّ الْقَلَم
-“যেনে রেখ, নিশ্চয় প্রত্যেক কিছু প্রথম হওয়ার ব্যাপারে নিছবত হলেও প্রথম হল নবী পাক (ﷺ) এর নূর, অতঃপর পানি, অতঃপর আরশ, অতঃপর ক্বলম।” ১৪৪
যেমন এ বিষয়ে আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী হানাফী (رحمة الله) {ওফাত ১১২৭ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন,
ان السراج الواحد يوقد منه الف سراج ولا ينقص من نوره شىء وقد اتفق اهل الظاهر والشهود على ان الله تعالى خلق جميع الأشياء من نور محمد ولم ينقص من نوره شىء
-“নিশ্চয় একটি প্রদীপ থেকে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালালেও ঐ প্রদীপের আলো সামান্যতমও কমেনা। সকল উম্মত এ বিষয়ে একমত যে, আল্লাহ তা’লা সব কিছুই মুহাম্মদ (ﷺ) এর নূর মোবারক দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। অথচ তাঁর নূর মোবারক সামান্যতমও কমেনি।” ১৪৫
আল্লামা হাফিজ ইবনুল হাজ্জ আল-মালেকী (رحمة الله) {ওফাত ৭৩৭ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন,
وَفِيهِ أَيْضًا أَنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ نُورُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَقْبَلَ ذَلِكَ النُّورُ يَتَرَدَّدُ وَيَسْجُدُ بَيْنَ يَدَيْ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ
-“অনুরূপ রয়েছে যে, নিশ্চয় সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’লা যা সৃষ্টি করেছেন তা হল মুহাম্মদ (ﷺ) এর নূর। অতঃপর ঐ নূর ভূ-কম্পিত হচ্ছিল এবং আল্লাহ তা’লার নিকট সেজদা করছিল।”
১৪৩. আল্লামা দিয়ারবকরী: তারিখুল খামিছ, ১ম খন্ড, ১৭ পৃ:;
১৪৪. নূরুছ ছাফির আনিল কারনিল আশির, ৮ নং পৃষ্টা;
১৪৫. তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৭ম খন্ড, ১৯৭ পৃ:, সূরা আহযাব এর ৪৫-৪৬ নং আয়াতের তাফছিওে;
১৪৬
আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ছিলাহ ছানআনী (رحمة الله) ওফাত ১১৮২ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন:
(كنت أول الناس في الخلق) لأن الله تعالى خلقه نوراً قبل خلق آدم
-“সৃষ্টি জগতে আমি প্রথম মানুষ ছিলাম’ কেননা আল্লাহ তা’লা তাকে নূররূপে আদমের পূর্বেই সৃষ্টি করেছেন।” ১৪৭
বিশ্বখ্যাত মুফাচ্ছির আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী (رحمة الله) {ওফাত ১২৭০ হিজরী} সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতের তাফছিরে উল্লেখ করেন,
ولذا كان نوره صلّى الله عليه وسلّم أول المخلوقات، ففي الخبر أول ما خلق الله تعالى نور نبيك يا جابر
-“আর এ কারণেই তাঁর নূরানী সত্ত্বা সমস্থ মাখলুকাতের পূর্বে সৃষ্টি এবং এ কথাই হাদিস শরীফে আছে: হে জাবের! আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।” ১৪৮
তথাকথিত লা-মাজহাবীদের শিরমনী, মাওলানা কাজী শাওকানী সাহেব তদীয় কিতাবে বলেছেন,
أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ أَجْمَعِينَ، لِأَنَّهُ وَإِنْ كَانَ مُتَأَخِّرًا فِي الرِّسَالَةِ فَهُوَ أَوَّلُهُمْ فِي الْخَلْقِ
-“রাসূল (ﷺ) সকল মুসলমানের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলমান। কেননা তিনি রাসূল হিসেবে সবার পরে আবির্ভূত হলেও তিনি সৃষ্টির মধ্যে প্রথম।” ১৪৯
১৪৬. ইবনুল হাজ্জ: আল্ মাদখাল, ২য় খন্ড, ৩২ পৃ:;
১৪৭. আল্লামা ছানআনী: আত তানভীর শরহে জামেউছ ছাগীর, ৮ম খন্ড, ২৪১ পৃ: ৬৪০৫ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
১৪৮. আল্লামা আলুছী: তাফছিরে রুহুল মাআনী, ৯ম খন্ড, ১০০ পৃ:;
১৪৯. কাজী শাওকানী: ‘তাফছিরে ফাতহুল কাদির, ২য় খন্ড, ২১১ পৃ:;
বিখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা আনওয়ার শাহ্ কাশ্মিরী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে বলেন,
(أول ما خلق الله إلخ) في بعض الروايات: أن أول المخلوقات نور النبي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ذكره القسطلاني في المواهب بطريق الحاكم والترجيح لحديث النور على حديث الباب.
-“আল্লাহ তা’লা প্রথম সৃষ্টি করেছেন’ কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে, নিশ্চয় সৃষ্টির মধ্যে প্রথম হল নবী করিম (ﷺ) এঁর নূর মুবারক। ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) তার মাওয়াহেব গ্রন্থে ইমাম হাকেমের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি সেখানে সব গুলো বর্ণনার মধ্যে (ক্বলম/নূরে মুহাম্মাদী/ আকল/আরশ সর্বপ্রথম সৃষ্টির ভিন্নতার মধ্যে) নূরের হাদিস প্রাধান্য দিয়েছেন।” ১৫০
মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেবের অন্যতম খলিফা ও তাফছিরে মারেফুল কোরআনের মুফাচ্ছির আল্লামা মুফতী শফি সাহেব (পাকিস্থান) তদীয় তাফছির গ্রন্থে বলেন,
“প্রথম মুসলমান হওয়া দ্বারা এদিকেও ঈঙ্গিত হতে পারে যে, সৃষ্টি জগতের মাঝে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নূর সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর সমস্ত নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল ও অন্যান্য সৃষ্ট জগত অস্তিত্ব লাভ করেছে। এক হাদিসে বলা হয়েছে: আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন।” ১৫১
১৫০. আনওয়ার শাহ: আরফুশ শাজী শরহে তিরমিজি, ৩য় খন্ড, ৩৯৪ পৃ: ২১৫১ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
১৫১. মুফতী শফি: তাফছিরে মারেফুল কোরআন, সৌদি সং, ৪২৮ পৃ:;
অতএব, আকল সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে ক্বলম, এবং ক্বলম সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর আরশ। আল্লাহর আরশ সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে পানি। এমনকি পানি সৃষ্টি হওয়ার পূর্বেই সৃষ্টি হয়েছে ‘নূরে মুহাম্মদী’। কেননা ছহীহ্ সনদে হযরত জাবের (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে,
عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي أَخْبِرْنِي عَنْ أَوَلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ اللَّهُ قَبْلَ الأَشْيَاءِ، فَقَالَ: يَا جَابِرُ! إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ قَبْلَ الأَشْيَاءِ نُورُ نَبِيِّكَ مِنْ نُورِهِ، فَجَعَلَ ذَلِكَ النُّورِ يَدُورُ بِالْقُدْرَةِ حَيْثُ شَاءَ اللَّهُ، وَلَمْ يَكُنْ فِي ذَلِكَ الْوَقْتِ لَوْحٌ وَلا قَلَمٌ وَلا جَنَّةٌ وَلا نَارٌ وَلا مُلْكٌ وِلا سِمِاءٌ وَلا أَرْضٌ وَلا شَمْسٌ وَلا قَمَرٌ وَلا جِنِّيٌ وَلا إِنْسٌ.
-“হযরত জাবের আল আনছারী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে পাক (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করলাম আমার পিতা-মাতা আপনার কদমে কুরবান হউক ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে সংবাদ দিন আল্লাহ সব কিছুর পূর্বে কি সৃষ্টি করেছেন? প্রিয় নবীজি বললেন: হে জাবের! নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর পূর্বে তাঁর নূর থেকে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর সেই নূর আল্লাহর কুদরতে পরিক্রমন করতে থাকল যেভাবে আল্লাহ চেয়েছেন। তখন কোন ওয়াক্ত, লওহ-ক্বলম, জান্নাত-জাহান্নাম, ফেরেস্থা, আসমান-জমীন, চন্দ্র-সূর্য, জ্বীন-ইনছান কোন কিছুই ছিলনা।......।”
এই হাদিস খানা নিম্ন লিখিত কিতাব সমূহে মওজুদ আছে,
মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক এর যুয উল মাফকুদ, ৬৩ পৃ:;
আল মাদ্খাল, ১ম খন্ড, ৩২ পৃ: [কৃত: আল্লামা ইবনুল হাজ্জ র:];
মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৭১ পৃ: [শারিহে বুখারী ইমাম কাস্তালানী র:];
শরহে মাওয়াহেব লিয যুরকানী, ১ম খন্ড, ৮৯ পৃ: [আল্লামা ইমাম যুরকানী র:];
তাফহিমাতে ইলাহিয়্যা, ১৯ পৃ [কৃত: শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেছ দেহলবী র:];
নশরুত্তিব, ৫ পৃ: [কৃত: মাওলানা আশরাফ আলী থানভী];
ছিরাতে হালভিয়া, ১ম খন্ড, ৪৭ পৃ: [কৃত: আল্লামা নুরউদ্দিন হালভী র:];
তাফছিরে রুহুল মায়ানী, ১ম জি: ৯০ পৃ: [কৃত: আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী র:];
কাশফুল খফা, ১ম খন্ড, ২৩৭ পৃষ্টা [কৃত: ইমাম আজলুনী র:];
আছারুল মরফূয়া, ৪২-৪৩ পৃ: [কৃত: আব্দুল হাই লাখনভী];
আল মাউরিদুর রাভী, ২২ পৃ: [কৃত: মোল্লা আলী ক্বারী র:];
ফাত্ওয়ায়ে হাদিছিয়্যা, ৪৪ পৃ: [কৃত: ইবনে হাজার হায়তামী মক্কী র:];
আদ দুরারুল বাহিয়্যাহ, ৪-৮ পৃ: [কৃত: আল্লামা নববী র:];
এই হাদিস সম্পর্কে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সুতরাং সর্বপ্রথম সৃষ্টি হল নূরে মুহাম্মদী (ﷺ)। এরপর ধারাবাহিক ভাবে আল্লাহ পাক সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। তাই প্রিয় নবীজি (ﷺ) কে মাটির তৈরী বলা চরম মূর্খতা, কারণ যখন রাসূল (ﷺ) এর সৃষ্টি হয়েছিল তখন মাটি বলতে কোন জিনিস ছিলনা। বরং মাটি সহ সকল সৃষ্টিই রাসূলে পাক (ﷺ) তথা নূরে মুহাম্মদী থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। এক কথায়: সকল সৃষ্টির মূল নবী মুহাম্মদ রাসূল (ﷺ)।
❏ রাসূল (ﷺ) সৃষ্টি না হলে কোন কিছুই সৃষ্টি হতনা
দয়াল নবী রাসূলে পাক (ﷺ) এর একাধিক হাদিস থেকে জানা যায়, মহান আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবীব রাসূলে করিম (ﷺ) কে সৃষ্টি না করলে আসমান-জমীন, জান্নাত-জাহান্নাম ও দুনিয়া এক কথায় কোন কিছুই সৃষ্টি করতেন না। অর্থাৎ সকল সৃষ্টির মূল কারণ বা উছিলা হচ্ছে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। এ বিষয়ে মোট পাঁচজন সাহাবী থেকে হাদিস বর্ণিত আছে। বিষয়টি নিচে ধারাবাহিকভাবে দলিল ভিত্তিক আলোচনা করা হল। এ সম্পর্কে হাদিস শরীফে আছে,
حَدَّثَنَا أَبُو سَعِيدٍ عَمْرُو بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ مَنْصُورٍ الْعَدْلُ، ثنا أَبُو الْحَسَنِ مُحَمَّدُ بْنُ إِسْحَاقَ بْنِ إِبْرَاهِيمَ الْحَنْظَلِيُّ، ثنا أَبُو الْحَارِثِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُسْلِمٍ الْفِهْرِيُّ، ثنا إِسْمَاعِيلُ بْنُ مَسْلَمَةَ، أَنْبَأَ عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَمَّا اقْتَرَفَ آدَمُ الْخَطِيئَةَ قَالَ: يَا رَبِّ أَسْأَلُكَ بِحَقِّ مُحَمَّدٍ لَمَا غَفَرْتَ لِي، فَقَالَ اللَّهُ: يَا آدَمُ، وَكَيْفَ عَرَفْتَ مُحَمَّدًا وَلَمْ أَخْلُقْهُ؟ قَالَ: يَا رَبِّ، لِأَنَّكَ لَمَّا خَلَقْتَنِي بِيَدِكَ وَنَفَخْتَ فِيَّ مِنْ رُوحِكَ رَفَعْتُ رَأْسِي فَرَأَيْتُ عَلَىَ قَوَائِمِ الْعَرْشِ مَكْتُوبًا لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ فَعَلِمْتُ أَنَّكَ لَمْ تُضِفْ إِلَى اسْمِكَ إِلَّا أَحَبَّ الْخَلْقِ إِلَيْكَ، فَقَالَ اللَّهُ: صَدَقْتَ يَا آدَمُ، إِنَّهُ لَأُحِبُّ الْخَلْقِ إِلَيَّ ادْعُنِي بِحَقِّهِ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكَ وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُكَ
-“হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: যখন আদম (عليه السلام) দ্বারা অপ্রত্যাশিত কাজটি হয়ে গেল, তখন তিনি বললেন, হে আমার রব! আমি আপনার সত্য নবী মুহাম্মদ (ﷺ) এর উছিলায় প্রার্থনা করছি আমাকে ক্ষমা করে দিন। অতঃপর আল্লাহ তা’লা বললেন: হে আদম! তুমি কিভাবে মুহাম্মদ (ﷺ) কে চিনলে অথচ আমি তাঁকে সৃষ্টি করিনি? আদম (عليه السلام) বললেন: হে আমার রব! যখন আমাকে আপনি সৃষ্টি করেন এবং রুহ্ আমার ভিতরে প্রবেশ করান, তখন আমি আমার মাথা উপরের দিকে উঠিয়েছি এবং আরশের গায়ে লিখিত দেখেছি: “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। ফলে আমি জানতে পারলাম যে, নিশ্চয় আপনার প্রিয় পাত্র ব্যতীত আপনার নামের পাশে নাম থাকতে পারেনা! তখন আল্লাহ তা’লা বললেন: তুমি সত্য বলেছে হে আদম! সে আমার কাছে খুবই ভালবাসার পাত্র বা সৃষ্টি, তুমি আমাকে তাঁর উছিলায় প্রার্থনা করেছ ফলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমি যদি মুহাম্মদ (ﷺ) কে সৃষ্টি না করতাম তাহলে তোমাকেও সৃষ্টি করতাম না।” ১৫২
এই হাদিস উল্লেখ করে ইমাম হাকেম নিছাপুরী (رحمة الله) ও ইমাম নূরুদ্দিন আলী ইবনে আহমদ ছামহুদী (رحمة الله) বলেন: هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ
-“এই হাদিসের সনদ বিশুদ্ধ।” ১৫৩
এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম তাবারানী (رحمة الله) বলেন: لَا يُرْوَى هَذَا الْحَدِيثُ عَنْ عُمَرَ إِلَّا بِهَذَا الْإِسْنَادِ -“হযরত উমর (رضي الله عنه) থেকে এই সনদ ব্যতীত অন্য কোন সনদে এই হাদিস দেখিনি।” ১৫৪
১৫২ইমাম হাকেম: আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, ১৫৮৩ পৃ:; ইমাম তাবারানী: মু’জামুল আওছাত, ৫ম খÐ, ৩৬ পৃ:; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়্যাত, ৫ম খন্ড, ৩৭৪ পৃ:; আল্লামা ছামহুদী: অফাউল অফা, ৪র্থ জি: ২২২ পৃ:; ইবনে কাছির: মুসনাদে ফারুক, ২য় খন্ড, ৬৭১ পৃ:; ইবনে কাছির: জামেউল মাসানিদ ওয়াস সুনান, ১৭তম খন্ড, ২৯৭ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছাইছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ২৭ পৃ:; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৭ম খন্ড, ২৬৪ পৃ:; ইবনে কাছির: আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ১ম খন্ড, ৩২৫ পৃ:; শরফুল মোস্তফা, ১৬ নং হাদিস; ইবনে কাছির: ‘সিরাতে নববিয়্যা’ গ্রন্থে, ১ম খন্ড, ৩২০ পৃ:; কাছাছুল আম্বিয়া, ১ম খন্ড, ২৯ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৮৫ পৃ:; ছিরাতে হলভিয়া, ১ম খন্ড, ৩১৫ পৃ:; শরহে যুরকানী, ১ম খন্ড, ১১৯ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ৩য় খন্ড, ৬০৫ পৃ:
১৫৩. ইমাম হাকেম: আল মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, ১৫৮৩ পৃ:; আল্লামা ছামহুদী: অফাউল অফা, ৪র্থ জি: ২২২ পৃ:;
১৫৪. ইমাম তাবারানী: মু’জামুল আওছাত, ৫ম খন্ড, ৩৬ পৃ:;
অর্থাৎ, ইমাম তাবারানী (رحمة الله) এর দৃষ্টিতে হাদিসটি গরীব যেহতেু ইহা একজন রাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদিস। এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) বলেছেন যা হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইবনে কাছির (رحمة الله) সমর্থন করেছেন:
قَالَ الْبَيْهَقِيُّ تَفَرَّدَ بِهِ عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ وَهُوَ ضَعِيفٌ
-“আব্দুর রহমান ইবনে জায়েদ আছলাম হতে বর্ণিত ইহা একক বর্ণনা, আর তিনি হলেন জয়ীফ।” ১৫৫
ইমাম আহমদ ও ইমাম দারা কুতনী (رحمة الله) তাকে ضَعِيفٌ দুর্বল বলেছেন। ১৫৬
এই عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ “আব্দুর রহমান ইবনে জায়েদ ইবনে আসলাম” রাবী বা বর্ণনাকারী সম্পর্কে ইমাম মিযযী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন,
وَقَال أَبُو أَحْمَد بْن عدي: له أحاديث حسان. وهو ممن احتمله الناس، وصدقه بعضهم. وهو ممن يكتب حديثه.
-“আবু আহমদ ইবনে আদী (رحمة الله) বলেন: তার অনেক হাদিস হাছান রয়েছে। সে এমন ব্যক্তি যার রেওয়ায়েত লোকেরা গ্রহণ করেছেন এবং অনেকে তাকে সত্যবাদী বলেছেন এবং সে ব্যক্তির হাদিস লিখেছেন।” ১৫৭
ইমাম যাহাবী (رحمة الله) বলেন: وهو صاحب حَدِيثِ -“সে ছাহেবুল হাদিস।” ১৫৮
কিছু কিছু ইমামের মতে عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ “আব্দুর রহমান ইবনে জায়েদ ইবনে আসলাম” জয়ীফ রাবী আবার অনেক ইমামের মতে নির্ভরযোগ্য রাবী। সর্বোপরি বলা যায়, হাদিসটি জাল বা ভিত্তিহীন নয়, বরং এর সনদ বিদ্যমান রয়েছে। কেউ কেউ এর সনদকে ছহীহ্ বা বিশুদ্ধ বলেছেন আবার কেউ কেউ দুর্বল বলেছেন। মুহাদ্দেছীনে কেরাম ইহাকে গ্রহণ করে তাঁদের কিতাবে হাদিসটি স্থান দিয়েছেন। তবে আফছুছের বিষয় হল, নাছিরুদ্দিন আলবানী তার চেলারা, এতজন ইমাম হাদিসটি গ্রহণ করার পরও হাদিসটিকে জাল বলার অপচেষ্টা করেছে।
১৫৫. ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়্যাত, ৫ম খন্ড, ৩৭৪ পৃ:; হাফিজ ইবনে কাছির: আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ২য় খন্ড, ৬২৯ পৃ:;
১৫৬. ইমাম যাহাবী: দিওয়ানুদ দোয়াফা, রাবী নং ২৪৪৬;
১৫৭. ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৩৮২০;
১৫৮. ইমাম যাহাবী: তারিখে ইসলামী, রাবী নং ২০১;
আর প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর শান-মানের ব্যাপারে ইহা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হাদিস। এ সম্পর্কে আরেক হাদিস লক্ষ্য করুন,
حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حَمْشَاذَ الْعَدْلُ، إِمْلَاءً، ثنا هَارُونُ بْنُ الْعَبَّاسِ الْهَاشِمِيُّ، ثنا جَنْدَلُ بْنُ وَالِقٍ، ثنا عَمْرُو بْنُ أَوْسٍ الْأَنْصَارِيُّ، ثنا سَعِيدُ بْنُ أَبِي عَرُوبَةَ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيِّبِ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: أَوْحَى اللَّهُ إِلَى عِيسَى عَلَيْهِ السَّلَامُ يَا عِيسَى آمِنْ بِمُحَمَّدٍ وَأْمُرْ مَنْ أَدْرَكَهُ مِنْ أُمَّتِكَ أَنْ يُؤْمِنُوا بِهِ فَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ آدَمَ وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَا النَّارَ وَلَقَدْ خَلَقْتُ الْعَرْشَ عَلَى الْمَاءِ فَاضْطَرَبَ فَكَتَبْتُ عَلَيْهِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولٌ اللَّهِ فَسَكَنَ
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা’লা ঈসা (عليه السلام) এর প্রতি ওহী করলেন। হে ঈসা! তুমি মুহাম্মদ (ﷺ) এর প্রতি ঈমান আন ও তোমার উম্মতদেরকে আদেশ দাও তারা যেন আমার নবীকে দেখা মাত্র ঈমান আনে। কেননা যদি মুহাম্মদ (ﷺ) কে না বানাইতাম তাহলে আদম (عليه السلام) কেও বানাইতাম না। আমি যদি মুহাম্মদ (ﷺ) কে না বানাইতাম তাহলে জান্নাত ও জাহান্নাম বানাইতাম না। আর অবশ্যই পানির উপরে আমার আরশ সৃষ্টি করেছিলাম ফলে ইহা নড়াচড়া করছিল, অতঃপর ইহার উপর লিখে দিলাম “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” ফলে আরশ থেমে গেল।” ১৫৯
এই হাদিস উল্লেখ করে ইমাম হাকেম নিছাপুরী (رحمة الله) বলেন:
هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ -“এই হাদিসের সনদ ছহীহ্।” ১৬০
১৫৯. ইমাম হাকেম: আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, ১৫৮৩ পৃ:; ইমাম আবুশ শায়েখ ইস্পাহানী: তাবকাতুল মুহাদ্দেছীন, ৩য় খন্ড, ২৮৭ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ২৯ পৃ:; ইমাম আবু বকর ইবনে খিলাল তাঁর ‘আস সুন্নাহ’ গ্রন্থে, ১ম খন্ড, ২৬১ পৃ:, হাদিস নং ৩১৬; শিফাউছ ছিকাম; ইমাম যাহাবী: মিযানুল এ’তেদাল, ৪র্থ খন্ড, ৩০৭ পৃ:; ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, ৫ম খন্ড, ৩৪৩ পৃ:; আলবানী: সিলসিলায়ে আহাদিছুদ দ্বায়িফা, ১ম খন্ড, ৪৪৮ পৃ:
১৬০. মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪র্থ খন্ড, ১৫৮৩ পৃ:;
ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رضي الله عنه) ও আল্লামা নূরুদ্দিন আলী ইবনে আহমদ ছামহুদী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে হাদিসটি ছহীহ্ হওয়ার কথা এভাবে লিখেছেন: وَأخرج الْحَاكِم وَصَححهُ -“হাকেম হাদিসখানা বের করেছেন ও ইহাকে ছহীহ্ বলে সমর্থন করেছেন।” ১৬১
এই হাদিসের সনদে سَعِيدُ بْنُ أَبِي عَرُوبَةَ “ছাঈদ ইবনে আবী উরওয়া” নামক রাবী সম্পর্কে কেউ কেউ জয়ীফ ধারণা করলেও তাঁর সম্পর্কে ইমাম বুখারী (رحمة الله) এর উস্তাদ ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে কাত্তান (رحمة الله) বলেন এবং ইমাম শরফুদ্দিন নববী (رحمة الله) তার ব্যাপারে বলেন,
واتفقوا على توثيقه. روى له البخارى ومسلم، -“তার বিশ্বস্ততার ব্যাপারে সকলেই একমত হয়েছে। ইমাম বুখারী ও মুসলীম তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।” ১৬২
ইমাম ইবনে হিব্বান তাকে বিশ্বস্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। ১৬৩
وقال ابن معين والنسائي ثقة وقال أبو زرعة ثقة مأمون وقال ابن أبي خيثمة أثبت الناس
-“ইমাম ইবনে মাঈন ও ইমাম নাসাঈ তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন। ইমাম আবু যুরাআ বলেছেন, সে বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য। ইমাম আবু হাইছামা বলেন, সে মানুষের মধ্যে প্রমাণিত ব্যক্তি।” ১৬৪
وَقَالَ ابْنُ مَعِينٍ: أَثْبَتُهُمْ فِي قَتَادَةَ سَعِيدٌ، وَالدَّسْتُوَائِيُّ، وَشُعْبَةُ. -“ইমাম ইবনে মাঈন বলেন, সে কাতাদা, সাঈদ, দাসতুয়াঈ ও শুবা (رحمة الله) থেকে হাদিস বর্ণনায় প্রমাণিত।” ১৬৫
وكان سفيان بن حبيب عالما بشعبة وسعيد.
-“প্রখ্যাত ফকিহ্ আল্লামা সুফিয়ান ইবনে হাবীব আলিম হয়েছেন হযরত শুবা (رحمة الله) ও ছাঈদ ইবনে উরওয়া (رحمة الله) এর উছিলায়।” ১৬৬
১৬১. ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ২৯ পৃ:; আল্লামা ছামহুদী: অফাউল অফা, ৪র্থ জি: ২২৪ পৃ:;
১৬২. ইমাম নববী: তাহজিবুল আসমাউ ওয়াস ছিফাত, রাবী নং ২১৩;
১৬৩. ইমাম ইবনে হিব্বান: কিতাবুস ছিক্বাত, রাবী নং ৮১০৪;
১৬৪. ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ১১০;
১৬৫. ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৬৭;
১৬৬. ইমাম যাহাবী: মিযানুল এ’তেদাল, ২য় খন্ড, ৪৬৮ পৃ:;
ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله) বলেন: قال ابن عدي: سعيد من الثقات.
-“ছাঈদ ইবনে উরওয়া বিশ্বস্তদের মধ্যে একজন।” ১৬৭
وَقَال إسحاق بْن مَنْصُور عَنْ يحيى بْن مَعِين، وأبو زُرْعَة ، والنَّسَائي: ثقة.
-“ইসহাক্ব ইবনে মানছুর হযরত ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (رحمة الله), আবু যুরাআ (رحمة الله) ও ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন, সে বিশ্বস্ত।” ১৬৮
وَقَالَ أَبُو حَاتِمٍ: هُوَ ثِقَةٌ -“ইমাম আবু হাতিম বলেন, সে বিশ্বস্ত।” ১৬৯
وقال ابن سعد: كان ثقة. كثير الحديث -“ইমাম ইবনে সাদ বলেন, সে বিশ্বস্ত ও তা প্রচুর হাদিস।” ১৭০
وقال العجلي: ثقة -“ইমাম ইজলী বলেন, সে বিশ্বস্ত।” ১৭১
ইমাম যাহাবী (رحمة الله) নিজেই অন্যত্র বলেন:
سعيد بن أبي عرُوبَة ثِقَة -“সাঈদ ইবনে আবী উরওয়া বিশ্বস্ত।” ১৭২
১৬৭. ইমাম যাহাবী: মিযানুল এ’তেদাল, ২য় খন্ড, ৪৬৮ পৃ:
১৬৮. ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ২৩২৭;
১৬৯. ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৬৭;
১৭০. ইমাম মুগলতাঈ: উকমালু তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ২০১৬;
১৭১. ইমাম মুগলতাঈ: উকমালু তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ২০১৬;
১৭১. ইমাম যাহাবী: আল মুগনী ফিদ দুয়াফা, রাবী নং ২৪৩৩;
sএছাড়া ‘আমর ইবনে আওছ আনছারী’ মাজহুল রাবী হলেও ইমাম হাকেম (رحمة الله) সহ অনেকেই তার উপর নির্ভর করে তার বর্ণিত হাদিস বর্ণনা করেছেন। সর্বোপরি প্রমাণিত হল যে, এই হাদিস নির্ভরযোগ্য। এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) কে সৃষ্টি করেছেন। এমনকি হযরত আদম (عليه السلام) কে বানাইবার পূর্বেই আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) কে সৃষ্টি করেছেন। আর মাটির তৈরী প্রথম মানুষ হল হযরত আদম (عليه السلام), আমাদের নবী এরও পূর্বে সৃষ্টি, তাই তিনি মাটির তৈরী নন, বরং আল্লাহর নূরের তৈরী। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন,
فَقَالَ آدَمُ: لَمَّا خَلَقْتَنِي رَفَعْتُ رَأْسِي إِلَى عَرْشِكَ فَإِذَا فِيهِ مَكْتُوبٌ.. لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ، فَعَلِمْتُ أَنَّهُ لَيْسَ أَحَدٌ أَعْظَمُ قَدْرًا عِنْدَكَ مِمَّنْ جَعَلْتَ اسْمَهُ مَعَ اسْمِكَ .فَأَوْحَى اللَّهُ إِلَيْهِ: وَعِزَّتِي وَجَلَالِي إِنَّهُ لَآخِرُ النَّبِيِّينَ مِنْ ذريتك، ولو لاه مَا خَلَقْتُكَ.
-“হযরত আদম (عليه السلام) বলেন: যখন আমাকে সৃষ্টি করা হল, আমি আমার মাথা আপনার আরশের দিকে উঠালাম এবং এর মধ্যে লিখা দেখলাম “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”। অতঃপর আমি জেনে নিলাম নিশ্চয় তিনি আপনার প্রিয় ভাজন ব্যতীত কেউ নয়। কারণ আপনার নামের পাশে নাম লিখা। তখন আল্লাহ তা’লা ওহী করলেন: আমার ইজ্জত ও জালালের কসম! নিশ্চয় তোমার বংশের মধ্যে সে সর্বশেষ নবী, যদি তাঁকে না বানাইতাম তাহলে তোমাকেও বানাইতাম না।” ১৭৩
উল্লেখিত হাদিস সমূহ দ্বারা স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টি হয়েছে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) এর উছিলায়। আমরা সকলেই অবগত আছি, মাটির তৈরী সর্বপ্রথম মানুষ হল হযরত আদম (عليه السلام) আর আমাদের নবী (ﷺ) তারও পূর্বে সৃষ্টি, সুতরাং তিনি অন্তত মাটির তৈরী নন। যেমন আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়, ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী ও ইমাম ইবনে ছালেহী (رحمة الله) সনদসহ উল্লেখ করেছেন:-
حدثنا عبيد الله بن موسى القرشي حدثنا الفضيل بن جعفر بن سليمان عن عبد الصمد بن علي بن عبد الله ابن عباس عن أبيه عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا مَرْفُوعًا أَتَانِي جِبْرِيلُ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ لَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ النَّارَ
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে মারফূ সূত্রে বর্ণিত আছে যে, জিব্রাইল (عليه السلام) এসে বললেন: হে মুহাম্মদ (ছাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া ছাল্লাম) আল্লাহ তা’লা আপনাকে না বানাইলে জান্নাত ও জাহান্নাম বানাইতেন না।” ১৭৪
১৭৩. কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ২য় জি: ২২১ পৃ:; নশরুত্বিব;
১৭৪. ইমাম ছিয়তী: জামেউল আহাদিস, হাদিস নং ৩৩৮; দায়লামী শরিফ, হাদিস নং ৮০৩১; ছিলছিলাতু আহাদিছিদ দ্বায়িফা, হাদিস নং ২৮২; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, ১১তম খন্ড, ৪৩১ পৃ: হাদিস নং ৩২০২৫; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৭৫ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: মাওজুয়াতুল কবীর, ১০১ পৃ:; ইমাম আজলুনী: কাশফুল খফা, হাদিস নং ৫১; আল্লামা আব্দুল হাই লাখনভী: আছারুল মারফূয়া, ১ম জি ৪৪ পৃ:
আলবানী তার ছিলছিলার মধ্যে ইহার সনদ উল্লেখ করেছেন। এজন্যই হয়ত মহান আল্লাহ হযরত আদম (عليه السلام) কে বলেছেন:-
وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُكَ -“হে আদম! আমি মুহাম্মদ কে না বানাইলে তোমাকেও বানাইতাম না।” ১৭৫
এ সম্পর্কে আরেকটি বর্ণনায় আছে,
وذكر صاحب كتاب شفاء الصدور في مختصره عَن عَليّ بن أبي طَالب، رَضِي الله تَعَالَى عَنهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ أَنَّهُ قَالَ: يَا مُحَمَّدُ وَعِزَّتِي وَجَلَالِي لَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ أَرْضِي، وَلَا سَمَائِي
-“হযরত আলী (رضي الله عنه) হযরত রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, প্রিয় নবীজি (ﷺ) মহান আল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা’লা বলেন: ওহে মুহাম্মদ! আমার ইজ্জত ও জালালের কসম! আপনাকে না বানাইলে আসমান জমীন কিছুই বানাইতাম না।” ১৭৬
এ বিষয়ে অন্য হাদিসে আছে,
أخبرنا أبو يعقوب يوسف بن أيوب بن يوسف بن الحسين بن وهرة الهمذاني بمرو نا السيد أبو المعالي محمد بن محمد بن زيد الحسيني إملاء بأصبهان وأخبرنا أبو محمد بن طاووس أنا أبو القاسم بن أبي العلاء قالا أنا أبو القاسم عبد الرحمن بن عبيد الله بن عبد الله السمسار أنا حمزة بن محمد الدهقان نا محمد بن عيسى بن حبان المدائني نا محمد بن الصباح أنا علي بن الحسين الكوفي عن إبراهيم بن اليسع عن أبي العباس الضرير عن الخليل بن مرة عن يحيى عن زاذان عَنْ سَلْمَانَ قَالَ:.. قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عن الله تعالى لَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ الدُّنْيَا
-“হযরত ছালমান ফারছী (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) আল্লাহ তা’লা হতে বলেছেন: হে নবী! আপনাকে না বানাইলে দুনিয়া বানাইতাম না।” ১৭৭
১৭৫. ইমাম বায়হাক্বী: দালাইলুন্নবুয়াত, ৫ম খন্ড; আল্লামা ছামহুদী: অফাউল অফা, ২য় জি: ২২২ পৃ:; মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪র্থ খন্ড, ১৫৮৩ পৃ: ছহীহ্ সনদে
১৭৬. ইবনে সাবা র: এর ‘শিফাউছ ছুদুর’ গ্রন্থে; নজহাতুল মাজালিস, ২য় খন্ড, ১১৯ পৃ:; আল্লামা নুরুদ্দিন হালভী: ইনসানুল উয়ূন, ১ম খন্ড, ৩১৭ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৭৫ পৃ:; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৩২০২৫
১৭৭. তারিখে ইবনে আসাকির, ৩য় খন্ড, ৫১৭ পৃ:, হাদিস নং ৮০১; কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ২য় খন্ড, ১০৫ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৭৫ পৃ:; যুরকানী: শরহে মাওয়াহেব, ১ম খন্ড, ১৮২ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: মওজুয়াতুল কবির, ১০১ পৃ: মারফূ সনদে;
এ বিষয়ে আরেক রেওয়ায়েত ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) উল্লেখ করেন,
هذا نور نبى من ذريتك اسمه فى السماء أحمد، وفى الأرض محمد، لولاه ما خلقتك
-“আদম (عليه السلام) কে আল্লাহ বললেন ইহা নূরে মুহাম্মদী যে তোমার বংশধরদের মধ্যে একজন। আসমানে তাঁর নাম আহমাদ, জমীনে তাঁর নাম মুহাম্মদ। যদি তিনি না হতেন আমি আসমান-জমীন এমনকি তোমাকেও বানাইতাম না।” ১৭৮
হাফিজুল হাদিস ইমাম আবুল ফারাজ ইবনে জাওযী (رحمة الله) (ওফাত ৫৯৭ হিজরী) তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন,
ولما خلق الله القلم قال له اكتب قال وما اكتب قال اكتب توحدى فى خلقى لا اله الا الله فكتب القلم من كلام الله تعالى مائة عام وسكن القلم فقال الله تعالى اكتب فقال يا رب وما اكتب قال اكتب محمد رسول الله قال القلم: وما محمد الذى قرنت اسمه مع اسمك؟ فقال الله تعالى: تادب يا قلم وعزتى وجلالى لولا محمد ما خلقت احدا من خلقى
-“যখন আল্লাহ তা’লা ক্বলম সৃষ্টি করলেন তখন ক্বলমকে বললেন লিখ, ক্বলম বলল: কি লিখব? আল্লাহ তা’লা বললেন: সৃষ্টি জগতে আমার তাওহীদ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ লিখ। অতঃপর ক্বলম একশ বছর যাবৎ লিখত পরে চুপ হল। অদ:পর আল্লাহ বললেন: লিখ। ক্বলম বলল কি লিখব? আল্লাহ বললেন: লিখ ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। ক্বলম বলল: এই মুহাম্মদ কে যে আপনার নামের সাথে ঐ নাম লিখব? আল্লাহ তা’লা বললেন: আদব রক্ষা কর হে ক্বলম! আমার ইজ্জত ও জালালের কসম! আমি এই মুহাম্মদ (رحمة الله) কে সৃষ্টি না করলে আমার সৃষ্টি জগতে কাউকে সৃষ্টি করতাম না। ১৭৯
এরূপ অনেক হাদিস রয়েছে। যে সকল সাহাবীগণ অনুরূপ রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন তাঁদের তালিকা দেওয়া হল:-
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه),
” আলী ইবনে আবী তালিব (رضي الله عنه),
” ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه),
” ইবনে উমর (رضي الله عنه),
” ছালমান ফারছী (رضي الله عنه) প্রমূখ।
বিষয়টি ৫জন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে, যা মশহুর পর্যায়ের হাদিস। উছুলে হাদিসের দৃষ্টিতে সব কয়টি সনদ দুর্বল হলেও পাঁচটি সূত্র একত্রিত হয়ে ক্বাবী বা শক্তিশালী হয়ে যাবে। সর্বোপরি প্রমাণিত হল যে, রাসূল (ﷺ) এর উছিলায় আল্লাহ সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে না বানাইলে আল্লাহ আসমান জমীন, জান্নাত জাহান্নাম, দুনিয়া এক কথায় কোন কিছুই বানাইতেন না। আর এই কথাটাকেই ‘রেওয়ায়েত বিল মাআনা’ হিসেবে বলা হয়:
لَوْلَاكَ لَمَا خَلَقْتُ الْأَفْلَاكَ
-“হাবীব! আপনাকে না বানাইলে কোন কিছুই বানাইতাম না।”
এই হাদিস খানা নিম্ন লিখিত কিতাব সমূহে উল্লেখ রয়েছে।
তাফছিরে রুহুল বয়ান, [কৃত: আল্লামা ইমাম ইসমাইল হাক্কী (رحمة الله)] ২য় খন্ড, ৩২৯ পৃ:; ও ৪৩০ পৃ:।
মাওজুয়াতুল কবীর, ১০১ পৃ: [কৃত: আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله)]
কাশফুল খফা, ২য় খন্ড, ১৪৮ পৃ:;
শরহে শিফা, ১ম খন্ড, ১৩ পৃ: [কৃত: মোল্লা আলী ক্বারী র:]
মুজাদ্দেদ আলফেছানী (رضي الله عنه) তাঁর “মাকতুবাত ৯ম খন্ড, ১৫৫ পৃ:; মাকতুবাত নং ১২২” -এ উল্লেখ করেছেন।
ছিররুল আছরার, [কৃত: হুজুর গাউছে পাক আব্দুল কাদের জিলানী (رضي الله عنه)] ১০২ পৃ:।
আশ শিহাবুছ ছাকিব, ৫০ পৃ: কৃত: মাওলানা হুছাইন আহমদ মাদানী।
মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী, ৪র্থ খন্ড।
এই হাদিস সম্পর্কে হিজরী ১১শ শতাব্দির মুজাদ্দেদ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) ও আল্লামা ইমাম আজলুনী (رحمة الله) হাদিসটি উল্লেখ করেই বলেছেন:
أَقُولُ لَكِنَّ مَعْنَاهُ صَحِيحٌ -“আমি বলছি: কিন্তু ইহার মাআনা ছহীহ্।” ১৮০। ইমাম মোল্লা আলী: মাওজুয়াতুল কবীর, ১০১ পৃ:; ইমাম আজলুনী: কাশফুল খফা, ২য় খন্ড, ১৪৮ পৃ:;
সুতরাং বারবার একটি বিষয় প্রতিয়মান হচ্ছে যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে না বানাইলে আসমান-জমীন, জান্নাত-জাহান্নাম, দুনিয়া ও আদী পিতা হযরত আদম (عليه السلام) কেও বানাইতেন না। অতএব, মাটির পৃথিবী সৃষ্টিরও পূর্বে আল্লাহর নবী (ﷺ) এর সৃষ্টি। সুতরাং প্রিয় নবীজি (ﷺ) মাটির তৈরী নয়। তাই বলা যায় হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) সকল সৃষ্টির মূল উৎস।
পবিত্র কোরআনের আলোকে রাসূল (ﷺ) নূর
পবিত্র কোরআনে যে কয়টি জিনিসকে ‘নুর’ বলা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রাসূল (ﷺ) একজন। হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) আল্লাহর নূর এবং নূর হয়েই এসেছেন, যা পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে উল্লেখ আছে। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন,
আয়াত নং ১
মহান আল্লাহ তা’লা নবী করিম (ﷺ) সম্পর্কে এরশাদ করেন,
قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتابٌ مُبِينٌ -“অবশ্যই আল্লাহর কাছ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে নূর এবং সু-স্পষ্ট কিতাব।” (সূরা মায়েদা: ১৫ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, আল্লাহর তরফ থেকে نُورٌ নূর এসেছে। এখন জানতে হবে কে সেই نُورٌ ‘নূর’। একথা স্পষ্ট যে, এই নূর হল সকল সৃষ্টির মূল হযরত মুহাম্মদ রাসূল (ﷺ)। এ বিষয়ে স্পষ্ট জানতে হলে নিম্ন লিখিত তাফছিরের কিতাব সমূহ লক্ষ্য করুন:-
এ বিষয়ে প্রাচিনতম আরেকটি তাফছিরের কিতাবে ইমাম আবু জাফর ইবনে জারির আত-তাবারী (رحمة الله) {ওফাত ৩১০ হি.} বলেন,
قَدْ جَاءَكُمْ يَا أَهْلَ التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ مِنَ اللَّهِ نُورٌ يَعْنِي بِالنُّورِ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الَّذِي أَنَارَ اللَّهُ بِهِ الْحَقَّ, وَأَظْهَرَ بِهِ الْإِسْلَامَ
-“হে আহলে তাওরাত ও ইঞ্জিলগণ! আল্লাহর তরফ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে নূর অর্থাৎ নূর দ্বারা অর্থ হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লাম। যার মাধ্যমে আল্লাহ পাক সত্যকে উজ্জল করেছেন এবং যার মাধ্যমে ইসলামকে প্রকাশ করেছেন।” ১৮১। তাফছিরে তাবারী শরীফ, ৬ষ্ঠ খন্ড, ১৭৬ পৃ:;
মুসলীম দর্শনের প্রাচিনতম কিতাব হল তাফছিরে তাবারী, আর সেই কিতাবে আল্লামা আবু জাফর তাবারী (رحمة الله) نُورٌ নূর দ্বারা স্পষ্ট মুহাম্মদ (ﷺ) কে বুঝিয়েছেন। কেননা দয়াল নবীজি (ﷺ) এর মাধ্যমেই হক্ব এসেছে এবং নবীজির মাধ্যমেই ইসলাম এসেছে। উল্লেখ্য যে, ইসলামের মাধ্যমে নবী পাক (ﷺ) আসেননি, বরং নবীজির মাধ্যমেই ইসলাম এসেছে।
আল্লামা আবু ইসহাক্ব জুযায (رحمة الله) {ওফাত ৩১১ হি.} তদীয় তাফছিরের কিতাবে বলেন,
قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ.النور هو: محمدٌ صلى الله عليه وسلم
-“অবশ্যই আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে নূর এবং সু-স্পষ্ট কিতাব’ নূর হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)।” ১৮২
এই আয়াত সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদার ইমাম, আল্লামা আবুল মানছুর মাতুরিদী (رحمة الله) ওফাত ৩৩৩ হিজরী তদীয় তাফছির গ্রন্থে বলেছেন,
وقال غيره: النور: هو مُحَمَّد، والكتاب: هو القرآن، -“(হাছান বছরী ব্যতীত) অন্যান্যরা বলেছেন, নূর হল মুহাম্মদ (ﷺ) ও কিতাব হল কোরআন।” ১৮৩
আল্লামা আবুল লাইছ নছর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে ইব্রাহিম সমরকান্দি (رحمة الله) {ওফাত ৩৭৩ হি.} বলেন,
قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ يعني ضياء من الضلالة، وهو محمد صلى الله عليه وسلم والقرآن،
-“আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর এসেছে অর্থাৎ গোমরাহীর মধ্যে نُورٌ ‘আলো’ আর তিনি হলেন মুহাম্মদ (ﷺ) এবং কুরআন।” ১৮৪
১৮২. তাফছিরে মাআনিল কুরআন ওয়া এ’রাবিহী, ২য় খন্ড, ১৬১ পৃ:;
১৮৩. তাফছিরে মাতুরিদী, ৩য় খন্ড, ৪৮৫ পৃ:;
১৮৪. তাফছিরে সমরকান্দি, ১ম খন্ড, ৩৭৮ পৃ:;
এই আয়াতের তাফছিরে আল্লামা আবু মুহাম্মদ মুক্কী ইবনে আবী তালিব কুরতবী (رحمة الله) ওফাত ৪৩৭ হিজরী বলেছেন,
والمعنى: يا أهل التوراة والإنجيل {قَدْ جَآءَكُمْ مِّنَ الله نُورٌ} وهو محمد صلى الله عليه وسلم. هو نور لمن استنار به، {وَكِتَابٌ مُّبِينٌ} هو القرآن.
-“ইহার অর্থ, হে আহলে তাওরাত ও আহলে ইঞ্জিল! ‘অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে নূর’ আর তিনি হলে মুহাম্মদ (ﷺ)। তিনি নূর, যারা তিনার মাধ্যমে নূর লাভ করেছেন। ‘কিতাবুম মুবীন’ ইহা হল কোরআন।” ১৮৫
এই আয়াত সম্পর্কে ইমাম আবুল হাছান আলী ইবনে মুহাম্মদ মাওয়ারদি (رحمة الله) ওফাত ৪৫০ হিজরী বলেন,
فى النور تأويلان: أحدهما: محمد صلىالله عليه وسلم , وهو قول الزجاج. الثاني: القرآن وهو قول بعض المتأخرين.
-“এই নূরের দু’টি ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রথম نُورٌ (নূর) হল হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) আর ইহা হল জুযায (رحمة الله) এর অভিমত। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, نُورٌ নূর দ্বারা কুরআন, আর ইহা হল শেষ যুগের কিছু কিছু লোকের অভিমত।” ১৮৬
এখানে শেষ যুগের কিছু লোকের মতটিকে قول بعض (কাউলুল বায়াজ) উল্লেখ করে ঐ মতটিকে দুর্বল আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কেননা শেষ যুগের আলিমদের অভিমত দুর্বল, কারণ نُورٌ (নূর) দ্বারা কোরআনকে বুঝানো হলে, (কিতাবুম মুবীন) দ্বারা কি মুরাদ হবে? সর্বেপারি নূর ও কিতাব উভয় কোনদিন কোরআন হতে পারেনা। কারণ মা’তুফ ও মা’তুফ আলায়হি কোন সময় এক জাতের হবেনা, আর এরূপ আকিদা হচ্ছে মুতাজেলী ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের, যেমনটি তাফছিরে রুহুল মাআনী কিতাবে রয়েছে।
১৮৫. হিদায়া ইলা বুলগিন নিহায়া, ৩য় খন্ড, ১৬৫০ পৃ:;
১৮৬. তাফছিরে মাওয়ারদি, ২য় খন্ড, ২২ পৃ:
আল্লামা আবুল হাছান আলী ইবনু আহমদ নিছাপুরী (رحمة الله) ওফাত ৪৬৮ হিজরী তদীয় তাফছির গ্রন্থে বলেন,
{قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ} ضياء من الضلالة وهدى، يعني: الإسلام، وقال قتادة: يعني: النبي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. وهو اختيار الزجاج، قال: النور: محمد صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
-“অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে নূর’ অর্থাৎ গোমরাহীর মধ্যে আলো এবং হেদায়াত আর ইহা হল ইসলাম। হযরত কাতাদা (رحمة الله) বলেছেন: ইহা নবী করিম (ﷺ)। হযরত যুজায (رحمة الله) সহমত পোষন করেছেন। তিনি বলেছেন: এই নূর হল মুহাম্মদ (ﷺ)।” ১৮৭
এই নূর সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত ইমাম মেসকাত শরীফের মূল ‘মাসাবিহুস সুন্নাহ’ কিতাবের মুছান্নেফ আল্লামা ইমাম বাগভী (رحمة الله) {ওফাত ৫১৬ হি.} প্রায় ১ হাজার বছর পূর্বে উল্লেখ করেন,
{قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ} يعني: محمد صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَقِيلَ: الْإِسْلَامُ،
-“আল্লাহর তরফ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে নূর অর্থাৎ মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লাম। কেউ কেউ বলেছেন: ইসলাম।” ১৮৮
এখানে ইমাম বাগভী (رحمة الله) نُورٌ নূর দ্বারা স্পষ্ট নবী করিম (ﷺ) কে বুঝিয়েছেন। পাশাপাশি যারা নূর দ্বারা ইসলামকে বুঝায় তাদের অভিমতকে قِيلَ শব্দ দ্বারা দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন।
এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত ফকিহ্ ও হিজরী ৬ষ্ঠ শতাব্দির মোজদ্দেদ, আল্লামা ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله) {ওফাত ৬০৬ হি.} তিনটি মত উল্লেখ করে একটি অভিমতকে দুর্বল ও বাতিল ঘোষণা করেন এবং নূর দ্বারা নবী পাক (ﷺ) এর বিষয়টি প্রথমেই উল্লেখ করেছেন। যেমন লক্ষ্য করুন,
قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتابٌ مُبِينٌ وَفِيهِ أَقْوَالٌ: الْأَوَّلُ: أَنَّ الْمُرَادَ بِالنُّورِ مُحَمَّدٌ وَبِالْكِتَابِ الْقُرْآنُ، وَالثَّانِي: أَنَّ الْمُرَادَ بِالنُّورِ الْإِسْلَامُ، وَبِالْكِتَابِ الْقُرْآنُ. الثَّالِثُ: النُّورُ/ وَالْكِتَابُ هُوَ الْقُرْآنُ، وَهَذَا ضَعِيفٌ لِأَنَّ الْعَطْفَ يُوجِبُ الْمُغَايَرَةَ بَيْنَ الْمَعْطُوفِ وَالْمَعْطُوفِ عَلَيْهِ
-“‘অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে نُورٌ নূর এসেছেন এবং সু-স্পষ্ট কিতাব’ এই ব্যাপারে একাধিক বক্তব্য রয়েছে। প্রথমত: নিশ্চয় نُور‘নূর’ দ্বারা মুরাদ বা অর্থ হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) আর কিতাব দ্বারা অর্থ হচ্ছে কোরআন। দ্বিতীয়ত: নূর দ্বারা অর্থ হচ্ছে ইসলাম এবং কিতাব দ্বারা কুরআন। তৃতীয়ত: নূর ও কিতাব একই, কিন্তু ইহা দুর্বল অভিমত, কারণ মা’তুফ এবং মা’তুফ আলায়হি ভিন্ন জাত হওয়া আবশ্যক।” ১৮৯
১৮৭. তাফছিরে ওয়াছিত, ২য় খন্ড, ১৬৯ পৃ:
১৮৮. তাফছিরে বাগভী, ২য় খন্ড, ১৩৮ পৃ:;
১৮৯. তাফছিরে কবীর, ১১তম খন্ড, ১৬৩ পৃ:;
এ সম্পর্কে ইমাম কুরতবী (رحمة الله) {ওফাত ৬৭১ হিজরী} তদীয় গ্রন্থে বলেন,
وَقِيلَ: مُحَمَّدٌ عَلَيْهِ السَّلَامُ، عَنِ الزَّجَّاجِ. -“কেউ কেউ বলেছেন: হযরত জুযায (رحمة الله) হতে বর্ণিত, নূর হচ্ছে মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লাম।” ১৯০
এ সম্পর্কে আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইবনে ইব্রাহিম খাজেন (رحمة الله) ওফাত ৭৪১ হিজরী বলেছেন,
قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ يعني محمدا صلى الله عليه وسلم إنما سماه الله نورا
-“অবশ্যই আল্লাহর তরফ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে নূর এর অর্থ হচ্ছে, হযরত মুহাম্মদ (ﷺ), কেননা আল্লাহ তাঁর নামও রেখেছেন নূর।” ১৯১
আল্লামা মজিদুদ্দিন আবু তাহের মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব ফিরুজাবাদী (رحمة الله) {ওফাত ৮১৭ হিজরী} র’ঈছুল মোফাচ্ছেরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর অভিমত উল্লেখ করেন,
{قَدْ جَآءَكُمْ مِّنَ الله نُورٌ} رَسُول يَعْنِي مُحَمَّدًا {وَكِتَابٌ مُّبِينٌ} بالحلال وَالْحرَام
-“আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে নূর’ তিনি রাসূল অর্থাৎ মুহাম্মদ (ﷺ) আর ‘সু-স্পষ্ট কিতাব’ হল হালাল ও হারাম।” ১৯২
স
১৯০.তাফছিরে কুরতবী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ১০৬ পৃ:;
১৯১. তাফছিরে খাজেন শরীফ, ২য় খন্ড, ২৪ পৃ:;
১৯২. তানভিরুল মিকবাছ মিন তাফছিরে ইবনে আব্বাস রা:, ১ম খন্ড, ৯০ পৃ:;
হিজরী ৯ম শতাব্দির মুজাদ্দেদ ও হাফিজুল হাদিস, আল্লামা ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) এই আয়াতের তাফছিরে বলেন,
قَدْ جَاءَكُمْ مِنْ اللَّه نُور هُوَ النَّبِيّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكِتَاب قُرْآن مُبِين
-“অবশ্যই আল্লাহর তরফ থেকে তোমাদের কাছে নূর এসেছে আর তিনি হলেন নবী করিম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লাম। আর কিতাব হল সু-স্পষ্ট কুরআন।” ১৯৩
তাফছিরে জালালাইন কিতাব খানা আলিয়া এবং কওমী উভয় প্রকার মাদ্রাসাতেই পড়ানো হয়। সুতরাং উক্ত এবারত দ্বারা প্রমাণ হয়, نُورٌ নূর হচ্ছেন হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) যিনি স্বয়ং আল্লাহর তরফ থেকে এসেছেন।
এই আয়াত সম্পর্কে আল্লামা আবস সাউদ আমাদী (رحمة الله) ওফাত ৯৮২ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন,
المرادُ بالأول هو الرسول صلى اللهعليه وسلم وبالثاني القرآن -“প্রথমটি দ্বারা অর্থ হল আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আর দ্বিতীয়টি দ্বারা অর্থ হল কোরআন।” ১৯৪
আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী হানাফী (رحمة الله) ওফাত ১১২৭ হিজরী বলেছেন,
قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتابٌ مُبِينٌ فالنور هو محمد عليه السلام والكتاب هو القرآن
-“অবশ্যই আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে নূর: এই নূর দ্বারা মুরাদ বা অর্থ হচ্ছে হযরত রাসূল (ﷺ) এবং কিতাব দ্বারা মুরাদ বা অর্থ হচ্ছে কোরআন।” ১৯৫
আল্লামা ক্বাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি (رحمة الله) ওফাত ১২২৫ হিজরী বলেছেন,
قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ يعنى محمد صلى الله عليه وسلم او الإسلام
-“অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে নূর অর্থাৎ মুহাম্মদ (ﷺ) অথবা ইসলাম।” ১৯৬
১৯৩. তাফছিরে জালালাইন, ৯৭ পৃ:; তাফছিরে ছাবী, ১ম খন্ড, ৪৫১ পৃ:;
১৯৪. তাফছিরে আবু সাঊদ, ৩য় ন্ড, ১৮ পৃ:;
১৯৫. তাফছিরে রুহুল বয়ান, ২য় খন্ড, ৪২৯ পৃ:;
১৯৬. তাফছিরে মাজহারী, ৩য় খন্ড, ৬৮ পৃ:;
হানাফী মাজহাবের নির্ভরযোগ্য আরেকটি কিতাব হচ্ছে ‘তাফছিরে রুহুল মাআনী’ সেই কিতাবে আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী (رحمة الله) ওফাত ১২৭০ হিজরী তদীয় তাফছির গ্রন্থে বলেন,
قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ عظيم وهو نور الأنوار والنبي المختار صلّى الله عليه وسلّم، وإلى هذا ذهب قتادة، واختاره الزجاج،
-“নিশ্চয় আল্লাহর তরফ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে نُورٌ ‘নূর’: তিনি সবচেয়ে বড় নূর এবং তিনি সকল নূরের নূর, তিনি নবী মুখতার ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লাম। এই অভিমত হল হযরত কাতাদা (رحمة الله) এর, এবং হযরত জুযায (رحمة الله) সহমত পোষণ করেছেন।” ১৯৭
সুতরাং আল্লাহর নবী (ﷺ) হলেন সবচেয়ে বড় নূর এবং সকল নূরেরও নূর। ফেরেস্থাদের নূরকে প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর নূরের সাথে তুলনা দেওয়া যাবেনা। এমনকি সৃষ্টি জগতের কোন নূরকে রাসূল (ﷺ) এর নূরের সাথে তুলনা দেওয়া যাবেনা। কারণ তিনি نور الأنوار (নূরুল আনওয়ার) সকল নূরেরও নূর।
যেমন বিশ্ব বিখ্যাত মুহাদ্দিছ হাফিজুল হাদিস আল্লামা হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله) (ওফাত ৭৭৪ হিজরী) তদীয় কিতাবে বলেন,
فَنُورُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ أَظْهَرَ وَأَكْبَرَ وَأَعْظَمَ مِنْهُمْ كُلِّهِمْ.
-“নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) সবকিছুর মধ্যে সু-প্রকাশিত, সবচেয়ে বড় নূর ও অধিক সম্মানিত নূর।” ১৯৮
সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর নবী (ﷺ) জিব্রাইল, মিকাঈল, ইস্রাফিল (عليه السلام) ও সকল নূরের ফেরেস্থার চেয়েও বড় ও শ্রেষ্ঠ নূর। সুতরাং প্রিয় নবী হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) এর সাথে অন্য কোন নূরের তুলনা চলবেনা, যেহেতু তিনি نور الأنوار তথা সকল নূরেরও নূর।
আল্লামা আহমদ ইবনে মুস্তফা মারাগী (رحمة الله) {ওফাত ১৩৭১ হি.} বলেন,
(قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتابٌ مُبِينٌ) النور هو النبي صلى الله عليه وسلم،
-“অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে নূর এবং সু-স্পষ্ট কিতাব’ এখানে নূর হচ্ছে নবী করিম (ﷺ)।” ১৯৯
১৯৭. তাফছিরে রুহুল মাআনী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ২৪ পৃ:;
১৯৮. ইবনে কাছির: আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ১ম খন্ড, ৩২৪ পৃ:;
১৯৯. তাফছিরে মারাগী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৮০ পৃ:;
উল্লেখিত তাফাছির সমূহ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণ হয়, পবিত্র কোরআনে আল্লাহর নবী (ﷺ) কে নূর এসেছে বলা হয়েছে, মাটি এসেছে বলা হয়নি। পবিত্র কোরআনে কোথাও রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে বলা হয়নি যে, তোমাদের কাছে মাটির নবী এসেছে। বরং নূর এসেছে বলা হয়েছে। কেউ যদি পারেন পবিত্র কোরআন থেকে দেখান যে, আল্লাহ তা’লা এরূপ বলেছেন যে: তোমাদের কাছে মাটির নবী এসেছেন। পাশাপাশি আল্লামা আলুছী বাগদাদী (رحمة الله) তাফছির দ্বারা প্রমাণ হয়, আল্লাহর নবী (ﷺ) কোন সাধারণ নূর নয়, বরং তিনি সকল নূরের নূর।
আয়াত নং ২
اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ
-“আল্লাহ আসমান ও জমীনের নূর দাতা, তাঁর নূরের মেছাল হল চেরাগের মত।” (সূরা নূর: ৩৫ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে বলা হয়েছে مَثَلُ نُورِه(তার নূরের মেছাল)। এখানে ه (হা) জমীর নিছবত হয়েছে আল্লাহর দিকে। তাঁর নূরের মেছাল বা উদাহরণ বলতে আল্লাহর নূরের মেছাল বা উদাহরণ বুঝানো হয়েছে। তাহলে জানতে হবে আল্লাহর নূর কি? আল্লাহত নূর নয়, বরং নূরদাতা। কারণ নূর হল সৃষ্টি আর আল্লাহ হল স্রষ্টা। সুতরাং নূর বলতে আল্লাহ নয় বরং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছু। এবার লক্ষ্য করুন তাফছির কারকগণ এই নূর সম্পর্কে কি বলেন,
আল্লামা আবুল হাছান মাকাতিল ইবনে সুলাসইমান ইবনে বাশির বালখী (رحمة الله) {ওফাত ১৫০ হি.} বলেন,
مَثَلُ نُورِهِ مثل نور محمد صلى الله عليه وسلم -“তাঁর নূরের উদাহরণ হল: মুহাম্মদ (ﷺ) এর উদাহরন।” ২০০। তাফছিরে মাকাতিল ইবনে সুলাইমান, ৩য় খন্ড, ১৯৯ পৃ:;
ইমাম আবু জাফর ইবনে জারির আত-তাবারী (رحمة الله) ওফাত ৩১০ হিজরী ও আল্লামা আবু মুহাম্মদ আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ আর-রাজী ইবনে আবী হাতেম (رحمة الله) {ওফাত ৩২৭ হিজরী} উল্লেখ করেন,
حَدَّثَنَا ابْنُ حُمَيْدٍ، قَالَ: ثنا يَعْقُوبُ الْقُمِّيُّ، عَنْ حَفْصٍ، عَنْ شِمْرٍ، قَالَ: جَاءَ ابْنُ عَبَّاسٍ إِلَى كَعْبِ الْأَحْبَارِ، فَقَالَ لَهُ: حَدِّثْنِي عَنْ قَوْلِ اللَّهِ، عَزَّ وَجَلَّ: {اللَّهُ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ}. الْآيَةَ؟ فَقَالَ كَعْبٌ: اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، مَثَلُ نُورِهِ؛ مَثَلُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَمِشْكَاةٍ
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কা’ব আহবার (رضي الله عنه) এর কাছে আসলেন ও বললেন, ‘আল্লাহ আসমান জমীনের নূরদাতা এবং তাঁর নূরের উদারণ’ সম্পর্কে আমাকে বর্ণনা করুন। ‘তাঁর নূরের উদাহরণ’ হল মুহাম্মদ (ﷺ) এর উদারণ যেমন চেড়াগ।” ২০১
আল্লামা আবু মুহাম্মদ আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ আর-রাজী ইবনে আবী হাতেম (رحمة الله) {ওফাত ৩২৭ হি.} আরো উল্লেখ করেন,
حَدَّثَنَا أَبُو سَعِيدٍ الأَشَجُّ، ثنا يحي بْنُ يَمَانٍ، عَنْ أَشْعَثَ، عَنْ جَعْفَرٍ، عَنْ سَعِيدٍ: {مَثَلُ نُورِهِ} قَالَ: مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، وَرُوِيَ عَنْ كَعْبِ الْأَحْبَارِ مِثْلُ ذَلِكَ
-“হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর (رضي الله عنه) বলেন: ‘তার নূরের উদারণ হল’ মুহাম্মদ (ﷺ) এর উদাহরণ। এমনটি হযরত কা’ব আহবার (رضي الله عنه) থেকেও বর্ণিত আছে।” ২০২
এ সম্পর্কে আল্লামা ইমাম বাগভী (رحمة الله) ও ছাহেবে খাজেন (رحمة الله) বলেন,
وَقَالَ سَعِيدُ بْنُ جُبَيْرٍ وَالضَّحَّاكُ: هُوَ مُحَمَّدٌ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. -“হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (رحمة الله) ও দ্বাহ্হাক (رحمة الله) বলেন: এই নূর হল মুহাম্মদ (ﷺ)।” ২০৩
حَدَّثَنِي عَلِيُّ بْنُ الْحَسَنِ الْأَزْدِيُّ، قَالَ: ثنا يَحْيَى بْنُ الْيَمَانِ، عَنْ أَشْعَثَ، عَنْ جَعْفَرِ بْنِ أَبِي الْمُغِيرَةِ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ، فِي قَوْلِهِ: {مَثَلُ نُورِهِ} قَالَ: مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
-“হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর (رحمة الله) হতে বর্ণিত, مَثَلُ نُورِهِ (মাছালু নূরিহী) সম্পর্কে তিনি বলেন নূর হল মুহাম্মদ (ﷺ)।” ২০৪
২০১. তাফছিরে ইবনে আবী হাতেম, ৮ম খন্ড, ২৫৯৬ পৃ: হাদিস নং ১৪৫৭১; তাফছিরে তাবারী, ১৭তম খন্ড, ২১৭ পৃ:;
২০২. তাফছিরে ইবনে আবী হাতেম, হাদিস নং ১৪৫৫৭;
২০৩. তাফছিরে বাগভী, ৪র্থ খন্ড, ১১৫ পৃ:; তাফছিরে খাজেন, ৩য় খন্ড, ২৯৭ পৃ:; তাফছিরে রুহুল মাআনী, ১৮তম খন্ড, ৪৮২ পৃ:;
২০৪. তাফছিরে তাবারী, ১৮তম খন্ড, ১৪৫ পৃ:;
ইমাম কুরতবী (رحمة الله) বলেন,
وَسَمَّى نَبِيَّهُ نُورًا فَقَالَ: قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتابٌ مُبِينٌ -“আল্লাহ তার নবীর নাম রেখেছেন নূর, যেমন আল্লাহ তা’লা বলেন: আল্লাহর তরফ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে নূর ও সু-স্পষ্ট কিতাব।” ২০৫
এ বিষয়ে আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী হানাফী (رحمة الله) উল্লেখ করেন,
المراد بنوره رسوله محمد صلّى الله عليه وسلّم وقد جاء إطلاق النور عليه عليه الصلاة والسلام في قوله تعالى: قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتابٌ مُبِينٌ...... وقيل: الضمير راجع إلى محمد صلّى الله عليه وسلّم وروى ذلك جماعة عن ابن عباس عن كعب الأحبار، وحكاه أبو حيان عن ابن جبير أيضا،
-“তার নূর’ দ্বারা মুরাদ বা অর্থ হল আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) আর অবশ্যই তোমাদের কাছে নূর এসেছে, যেমনটি আল্লাহ তা’লা বলেছেন। “ক্বাদ জা আকুম মিনাল্লাহি নূরু ওয়া কিতাবুম মুবিন”। কেউ কেউ বলেছেন: এখানে (হা) জমীর নবী পাক (ﷺ) দিকে এসেছে, এরূপ একদল বর্ণনা করেছেন হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও উবাই ইবনে কা’ব (رضي الله عنه) থেকে। আর আবু হাইয়ান হযরত ইবনে যুবাইর (رضي الله عنه) থেকে এরূপ বর্ণনা করেছেন।” ২০৬
২০৫. তাফছিরে কুরতবী;
২০৬. তাফছিরে রুহুল মাআনী, ১৮তম খন্ড, ৪৮২ পৃ:;
উল্লেখিত তাফছির সমূহ দ্বারা প্রমাণিত হল, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আল্লাহর নূর তথা নূরের সৃষ্টি। স্বয়ং আল্লাহ পাক প্রিয় নবীজি (ﷺ) কে ‘নূর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পবিত্র কোরআনের কোথাও রাসূল (ﷺ) কে স্পষ্টভাবে মাটি বলে আখ্যায়িত করেননি। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, এখানে مَثَلُ نُورِهِ (মাছালু নূরিহী) দ্বারা নবী করিম (ﷺ) কে ‘আল্লাহর নূর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, কোন হেদায়েতের নূর নয়। তাই রাসূলে করিম (ﷺ) কে ‘আল্লাহর নূর’ বলে আখ্যায়িত করা স্বয়ং পবিত্র কোরআন দ্বারা প্রমাণিত। যারা স্বীকার করবে তারা ঈমানদার, আর যারা ইহা স্বীকার করবেনা তারা ইয়াজিদের দালাল।
❏ আদম (عليه السلام)’র সৃষ্টির পূর্বেই তিনি ‘নবী’ ছিলেন
পবিত্র হাদিস শরীফ থেকে জানা যায়, হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) আল্লাহর নূরে সৃষ্টি। এ ব্যাপারে একাধিক ছহীহ্-হাছান রেওয়ায়েত রয়েছে। কোন কোন জায়গায় ‘ছরীহ্’ এবং কোন কোন জায়গায় ‘কেনায়া’ হিসেবে দলিল গুলো উল্লেখ আছে। পৃথিবীতে মাটির তৈরী সর্বপ্রথম মানুষ হযরত আদম (عليه السلام)। তিনার সৃষ্টির পূর্বেও হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) নবী ছিলেন। মানুষ ছাড়া অন্য কোন জাতি নবী হতে পারেনা। তাই রাসূল (ﷺ) আদম (عليه السلام) সৃষ্টির পূর্বেই মানবরূপী নবী ছিলেন। যেমন একটি ছহীহ্ রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে: كُنْتُ أَوَّلَ النَّاسِ فِي الْخَلْقِ “সৃষ্টির মধ্যে আমিই প্রথম মানুষ”। তাই রাসূলে পাক (ﷺ) তখন থেকেই মানুষ নবী যখন বাবা আদম (عليه السلام) এর সৃষ্টিই হয়নি। নিচে এ বিষয়ে রাসূল (ﷺ) এর হাদিস সমূহ উল্লেখ করছি,
حَدَّثَنَا أَبُو النَّضْرِ الْفَقِيهُ، وَأَحْمَدُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ سَلَمَةَ الْعَنَزِيُّ، قَالَا: ثنا عُثْمَانُ بْنُ سَعِيدٍ الدَّارِمِيُّ، وَمُحَمَّدُ بْنُ سِنَانٍ الْعَوَقِيُّ، ثنا إِبْرَاهِيمُ بْنُ طَهْمَانَ، عَنْ بُدَيْلِ بْنِ مَيْسَرَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ شَقِيقٍ عَنْ مَيْسَرَةَ الْفَجْرِ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَتَى كُنْتَ نَبِيًّا؟ قَالَ: وَآدَمُ بَيْنَ الرُّوحِ وَالْجَسَدِ
-“হযরত মাইছারা আল-ফিখরী (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কখন থেকে নবী ছিলেন? তিনি বললেন: আদম (عليه السلام) যখন রুহ্ ও দেহের মাঝামাঝি ছিলেন আমি তখনো নবী ছিলাম।” ২০৭। মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪র্থ খন্ড, ১৫৭৫ পৃ: হাদিস নং ৪২০৯; ইমাম আবু বকর ইবনে খিলাল: আস-সুন্নাহ, হাদিস নং ২০০; মাদারেজুন্নবুয়াত, ১ম খন্ড, ৭ পৃ:; ইমাম তাবারানী: মু’জামুল কবীর, হাদিস নং ৮৩৩; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়াত, ২য় খন্ড, ৯০ পৃ:; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২০৫৯৬; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৫৮ পৃ:; ইমাম আবু নুয়াইম: হিলিয়াতুল আউলিয়া, ৯ম খন্ড, ৫৩ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ২১ পৃ:; ইমাম বাগভী: শরহে সুন্নাহ, ১ম খন্ড, ২০৭ পৃ:; ইবনে কাছির: আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ২য় খন্ড, ৬২৬ পৃ:; ইমাম আবু নুয়াইম: দালায়েলুন্নবুয়াত-এ, ৫৮ পৃ:; ইমাম তাহাবী: শরহে মুশকিলুল আছার, ৫৯৭৬ নং হাদিস; ছহীহ্ সিরাতে নববিয়া, ১ম খন্ড, ৫৪ পৃ:;
হাদিসটি হযরত মুয়াজ (رضي الله عنه)ও বর্ণনা করেছেন। এই হাদিস উল্লেখ করে দালায়েলুন্নবুয়াত কিতাবের হাশিয়ায় লিখা হয়েছে:
اسناده الصحيح: اخرجه احمد فى مسنده وابن ابى عاصم فى السنة وعبد الله بن احمد فى مسنده
-“এই হাদিসের সনদ ছহীহ্: ইহা বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ (رحمة الله) তাঁর মুসনাদে, ইবনে আবী আছেম (رحمة الله) তাঁর ‘আস সুন্নাহ’ কিতাবে এবং ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ (رحمة الله) তাঁর মুসনাদে।”
ইমাম হাকেম নিছাপুরী (رحمة الله) ও ইমাম শামছুদ্দিন যাহাবী (رحمة الله) হাদিসটিকে صَحِيحُ ছহীহ্ বলেছেন। এই হাদিসের সনদে ‘আব্দুল্লাহ ইবনে শাকিক’ ও ‘বুদাইল ইবনে মাইছারা’ উভয় ছহীহ্ মুসলীমের রাবী। ‘ইব্রাহিম ইবনে তাহমান’ ও ‘মুহাম্মদ ইবনে ছিনান’ বুখারী-মুসলীমের রাবী। ‘উছমান ইবনে সাঈদ দারেমী, আবু নাছর ফকিহ্ ও আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সালামা’ সকলেই বিশ্বস্ত হাদিসের ইমাম। অতএব, হাদিসটি সম্পূর্ণ ছহীহ্। এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির পূর্বেই নবী ছিলেন। كُنْت (কুন্তু) শব্দের ভিতর ‘ফেল ও ফায়েল’ তথা কর্ম ও কর্তা উভয় নিহিত থাকে। তাই আল্লাহর নবী (ﷺ) নিজেই স্ব-শরীরে তখন মানুষ অবস্থায় নবী ছিলেন। কেননা নবী হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে ‘মানুষ’ হওয়া, কারণ মানুষ ছাড়া অন্য কোন জাতির মধ্যে নবী নেই। আর মানুষ হওয়ার পূর্ব শর্ত হচ্ছে ‘দেহ ও রুহ্’ উভয়ই থাকা। যার দেহ আছে রুহ্ নেই তার নাম ‘লাশ’। আর যার রুহ্ আছে দেহ নেই তার নাম ‘আত্ত¡া বা প্রেতাত্ত¡া বা পেতিœ’। সুতরাং আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির পূর্বেই দেহ ও রুহ্ বিশিষ্ট মানুষ নবী ছিলেন। ইহাই এই হাদিসের মূল মর্ম ও ভাবার্থ। এ বিষয়ে আরেক রেওয়ায়েতে আছে,
أَخْبَرَنَا عَلِيُّ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ عَبْدَانَ، قَالَ: أَخْبَرَنَا أَحْمَدُ بْنُ عُبَيْدٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ عَلِيٍّ الْأَبَّارُ قَالَ: حَدَّثَنَا الْعَبَّاسُ بْنُ عُثْمَانَ الدِّمَشْقِيُّ قَالَ حَدَّثَنَا الْوَلِيدُ بْنُ مُسْلِمٍ قَالَ حَدَّثَنِي الْأَوْزَاعِيُّ عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ عَنْ أَبِي سَلَمَةَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وآله وَسَلَّمَ مَتَى وَجَبَتِ لَكَ النُّبُوَّةُ؟ قَالَ: بَيْنَ خَلْقِ آدَمَ وَنَفَخِ الرُّوحِ فِيهِ
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, একদা রাসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার নবুয়াত কখন থেকে ছিল? দয়াল নবীজি (ﷺ) বললেন: আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে অথচ রুহ্ দেওয়া হয়নি তখন থেকেই আমি নবী।” ২০৮
এই হাদিস সম্পর্কে দালায়েলুন্নবুয়াত কিতাবের হাশিয়ায় লিখা আছে: إِسْنَادُهُ صَحِيحٌ -“এই হাদিসের সনদ ছহীহ্।” ইমাম হাকেম (رحمة الله) ও ইমাম তিরমিজি (رحمة الله) হাদিসটিকে صَحِيحٌ ছহীহ্ বলেছেন। এই হাদিসের রাবী ‘আবী ছালামা, ইয়াহইয়া ইবনে আবী কাছির, আওজায়ী, ওয়ালিদ ইবনে মুসলীম’ সকলেই বুখারী-মুসলীমের রাবী।عَبَّاس بن عُثْمَان بن مُحَمَّد البجلي ‘আব্বাস ইবনে উছমান ইবনে মুহাম্মদ বাজলী’ সম্পর্কে ইমাম মিযযী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন: ইমাম ইবনে হিব্বান, ইমাম আবুল হাছান ইবনে ছামিঈ (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন। ২০৯
আরেকজন রাবী أَحْمَد بن عَلِيِّ بنِ مُسْلِمٍ الأَبَّار ‘আহমদ ইবনে আলী ইবনে মুসলীম আব্বারু’ সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (رحمة الله) উল্লেখ করেন:
قَالَ الخَطِيْبُ: كَانَ ثِقَةً حَافِظاً -“খতিব বাগদাদী (رحمة الله) বলেন: সে বিশ্বস্ত ও হাফিজ।” ২১০
বর্ণনাকারী ‘আলী ইবনে আহমদ ইবনে আব্দান’ সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (رحمة الله) ثقة বিশ্বস্ত বলে উল্লেখ করেছেন। ২১১
২০৮ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়াত, ২য় খন্ড, ৯০ পৃ:; ইমাম বূখারী: তারিখুল কবীর, ১৬০৬ নং রাবীর ব্যাখ্যায়; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১০ম খন্ড, ৪৩৯ পৃ:; তিরমিজি শরীফ, ২য় জি: ২০২ পৃ:; মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪র্থ খন্ড, ১৫৭৫ পৃ:; মেসকাত শরীফ, ৫১৩ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৫৭ ও ৬০ পৃ:; মুসনাদে আহমদ, ৪র্থ খন্ড, ১২৭ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ২২ পৃ:
২০৯ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৩১৩১;
২১০. ইমাম যাহাবী: সিয়ারে আলামু নুবালা, রাবী নং ২৪৩৪;
২১১. ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ২০৫;
স অতএব, এই রাবীর বর্ণিত হাদিস ছহীহ্। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েতে আছে,
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرٍ قَالَ: حَدَّثَنَا عَفَّانُ، قَالَ حَدَّثَنَا وُهَيْبٌ، قَالَ حَدَّثَنَا خَالِدٌ الْحَذَّاءُ، عن عبد الله بن شقيق، عن ابن أبي الجدعاء قال: قلت: يا رسول الله: مَتَى كُنْتَ نَبِيًّا؟ قَالَ: كُنْتُ نَبِيًّا وَآدَمُ بَيْنَ الرُّوحِ وَالْجَسَدِ
-“আব্দুল্লাহ ইবনে শাকিক হতে বর্ণিত, তিনি হযরত ইবনে আবী জাদয়া (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কখন থেকে নবী ছিলেন? প্রিয় নবীজি (ﷺ) বলেন: আদম (عليه السلام) এর দেহ ও রুহ্ থাকা অবস্থায় আমি নবী ছিলাম।” ২১২
এ বিষয়ে আরেক হাদিসে আছে,
حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ صَالِحِ بْنِ هَانِئٍ، ثنا أَبُو سَهْلٍ بِشْرُ بْنُ سَهْلٍ اللَّبَّادُ، ثنا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ صَالِحٍ الْمِصْرِيُّ، حَدَّثَنِي مُعَاوِيَةُ بْنُ صَالِحٍ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ سُوَيْدٍ، عَنْ عَبْدِ الْأَعْلَى بْنِ هِلَالٍ، عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ، صَاحِبِ رَسُولِ اللهِ، صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: إِنِّي عَبْدُ اللهِ وَخَاتَمُ النَّبِيِّينَ، وَإِنَّ آدَمَ لَمُنْجَدِلٌ فِي طِينَتِهِ
-“হযরত ইরবাজ ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: আদম (عليه السلام) যখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল আমি তখনও শেষ নবী ছিলাম।” ২১৩
২১২. মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদিস নং ৩৬৫৫৩; ইমাম তাহাবী: শরহে মুশকিলুল আছার, হাদিস নং ৫৯৭৬
২১৩. মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪র্থ খন্ড, ১৪৭৫ পৃ: হাদিস নং ৩৫৬৬; তিরমিজি শরীফ, ২য় জি: ২০৩ পৃ:; শায়েখ আব্দুল হক্ব দেহলভী: মাদারেজুন্নবুয়্যাত, ১ম খন্ড ৭ পৃ:; মেসকাত শরীফ, ৫১৩ পৃ:; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ১৩২২; ইমাম তাবারানী: মুসনাদে শামেঈন, হাদিস নং ১৯৩৯; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১০ম খন্ড, ৪৩৯ পৃ:; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়্যাত, ২য় খন্ড, ৯০ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৭২ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ৭ পৃ:; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৭১৫১; ইমাম তাবারানী তাঁর কবীরে ও আওছাতে, ৩য় খন্ড, ১৫৮ পৃ:; ইমাম বাগভী: শরহে সুন্নাহ, ১ম খন্ড, ২০৭ পৃ:
sএই হাদিস সম্পর্কে দালায়েলুন্নবুয়াত কিতাবের হাশিয়ায় লিখা আছে: إِسْنَادُهُ صَحِيحٌ -“এই হাদিসের সনদ ছহীহ্।” হাদিসটি উল্লেখ করেছেন ইমাম হাকেম (رحمة الله) তাঁর মুস্তাদরাক গ্রন্থে, ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তাঁর ‘আছ-ছহীহ্’ গ্রন্থে, ইমাম আহমদ (رحمة الله) তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে, ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ (رحمة الله) তাঁর ‘আস-সুন্নাহ’ গ্রন্থে صَحِيحٌ ছহীহ্ বলেছেন। ইমাম হায়ছামী (رحمة الله) ও কাঠ মিস্ত্রি নাছিরুদ্দিন আলবানীও হাদিসটিকে صَحِيحٌ ছহীহ্ বলেছেন। ২১৪
এ বিষয়ে আরেক হাদিসে আছে,
حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ الْعَبَّاسِ الْبَجَلِيُّ قَالَ: نا مُحَمَّدُ بْنُ عُمَارَةَ بْنِ صُبَيْحٍ قَالَ: نا نَصْرُ بْنُ مُزَاحِمٍ قَالَ: نا قَيْسُ بْنُ الرَّبِيعِ، عَنْ جَابِرٍ، عَنِ الشَّعْبِيِّ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ: قِيلَ: يَا رَسُولَ اللهُ مَتَى كُتِبْتَ نَبِيًّا؟ قَالَ: وَآدَمُ بَيْنَ الرُّوحِ وَالْجَسَدِ
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কখন থেকে নবী ছিলেন? দয়াল নবীজি (ﷺ) বললেন: আদম (عليه السلام) যখন রুহ্ ও দেহের মাঝামাঝি ছিলেন আমি তখনও নবী ছিলাম।” ২১৫
এ বিষয়ে আরেক হাদিসে আছে,
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ يَحْيَى بْنِ حَمْزَةَ، ثَنَا أَبُو الْجُمَاهِرِ، ثَنَا سَعِيدُ بْنُ بَشِيرٍ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنِ الْحَسَنِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: كُنْتُ أَوَّل النَّبِيِّينَ فِي الْخَلْقِ وَآخِرَهُمْ فِي الْبَعْثِ
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: আমি সৃষ্টি জগতে প্রথম নবী এবং প্রেরিত হয়েছি সবার শেষে।” ২১৬
২১৪. ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়াত, ২য় খন্ড, ৯১ পৃষ্টা হাশিয়া;
২১৫. ইমাম তাবারানী তাঁর আওছাতে, ৩য় খন্ড, ১৫৮ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১০ম খন্ড, ৪৩৯ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ২২ পৃ:; মুসনাদে আহমদ, ১৬৬২৩ নং হাদিস; তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ৩৬০৯; ইমাম ইবনে আছেম: ‘আস সুন্নাহ’, হাদিস নং ৪১০; ইমাম তাহাবী: শরহে মুশকিলুল আছার, ৫৯৭৬ নং হাদিস; ইমাম তাবারানী: মু’জামুল আওছাত, হাদিস নং ৪১৭৫; ইমাম তাবারানী: মুজামুল কবীর, হাদিস নং ১২৫৭১; ইমাম আবু নুয়াইম: হিলিয়াতুল আউলিয়া, ৯ম খন্ড, ৫৩ পৃ:; ইমাম হাকেম: মুস্তাদরাক, হাদিস নং ৪২০৯;
২১৬. ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১০ম খন্ড, ৪৩৯ পৃ:; ইমাম আবু নুয়াইম: দালায়েলুন্নবুয়াত, ৬১ পৃ: হাদিস নং ৩; ইমাম তাবারানী: মুসনাদে শামেঈন-এ, হাদিস নং ২৬৬২; কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ১ম জি: ২৬৬ পৃ:; ইবনে কাছির: আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ২য় খন্ড, ৬২৭ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ২১ পৃ:; শরফুল মোস্তফা, ১ম খন্ড, ২৮৮ পৃ:; উইনুল আছার, ১ম খন্ড, ৯৭ পৃ:; ‘সিরাতে নববিয়্যা’ ইবনে কাছির: ১ম খন্ড, ২৮৯ পৃ:; ইমতাউল আছমা, ৩য় খন্ড, ১৭০ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৬৮ পৃ:; ইমাম ইবনে আদী: আল কামিল, ৪র্থ খন্ড, ৪১৭ পৃ:;
হাদিসটি এই সনদে দুর্বল হলেও অন্যান্য সনদে ছহীহ্ প্রমাণিত আছে। তবে এই সনদ সম্পর্কে আল্লামা ইমাম আজলুনী (رحمة الله), ইমাম ছাখাবী (رحمة الله) ও আল্লামা কাজী শাওকানী তার ‘ফাওয়াইদে মজমুয়া’ কিতাবে বলেন:
وَلَهُ شَاهِدٌ مِنْ حَدِيثِ مَيْسَرَةَ الْفَخْرِ -“হযরত মিছার আল ফিখরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হাদিস এ ব্যাপারে শাহিদ বা সাক্ষ্য রয়েছে।” ২১৭. ইমাম ছাখাবী: মাকাছিদুল হাছানা, ৩২৭ পৃ:; ইমাম আজলুনী: কাশফুল খফা, ২য় খন্ড, ১১৮ পৃ:; কাজী শাওকানী: ফাওয়াইদুল মজমুয়া, ৩০৭ পৃ:;
অতএব, উল্লেখিত হাদিস সমূহ দ্বারা প্রশাণিত হয়, আল্লাহর হাবীব রাসূলে করীম (ﷺ) হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির বহু পূর্বে নবী ছিলেন।
❏ আদম (عليه السلام) এর পূর্বেই প্রিয় নবীজি (ﷺ) স্বশরীরে মানুষ ছিলেন
আবুল বাশার হযরত আদম (عليه السلام) এর সৃষ্টি হওয়ার বহু পূর্বে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) স্বশরীরে মানুষ ও নবী ছিলেন। এ বিষয়ে একাধিক রেওয়ায়েত রয়েছে। নিচে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হল,
حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ صَالِحِ بْنِ هَانِئٍ، ثنا أَبُو سَهْلٍ بِشْرُ بْنُ سَهْلٍ اللَّبَّادُ، ثنا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ صَالِحٍ الْمِصْرِيُّ، حَدَّثَنِي مُعَاوِيَةُ بْنُ صَالِحٍ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ سُوَيْدٍ، عَنْ عَبْدِ الْأَعْلَى بْنِ هِلَالٍ، عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ، صَاحِبِ رَسُولِ اللهِ، صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: إِنِّي عَبْدُ اللهِ وَخَاتَمُ النَّبِيِّينَ، وَإِنَّ آدَمَ لَمُنْجَدِلٌ فِي طِينَتِهِ
-“হযরত ইরবাজ ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: আদম (عليه السلام) যখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল আমি তখনও শেষ নবী ছিলাম।” ২১৮. মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪র্থ খন্ড, ১৪৭৫ পৃ: হাদিস নং ৩৫৬৬; তিরমিজি শরীফ, ২য় জি: ২০৩ পৃ:; শায়েখ আব্দুল হক্ব দেহলভী: মাদারেজুন্নবুয়্যাত, ১ম খন্ড ৭ পৃ:; মেসকাত শরীফ, ৫১৩ পৃ:; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ১৩২২; ইমাম তাবারানী: মুসনাদে শামেঈন, হাদিস নং ১৯৩৯; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১০ম খন্ড, ৪৩৯ পৃ:; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়্যাত, ২য় খন্ড, ৯০ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৭২ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ৭ পৃ:; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৭১৫১; ইমাম তাবারানী তাঁর কবীরে ও আওছাতে, ৩য় খন্ড, ১৫৮ পৃ:; ইমাম বাগভী: শরহে সুন্নাহ, ১ম খন্ড, ২০৭ পৃ:
এই হাদিসে স্পষ্ট বলা আছে হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির পূর্বে রাসূলে পাক (ﷺ) عَبْدُ (আব্দ) ছিলেন। আর মুফাচ্ছেরীন ও মুহাদ্দেছীনদের স্পষ্ট মতামত হলো عَبْدُ (আব্দ) বলতে স্বশরীরে বুঝানো হয়। কেননা এবাদত না করা ব্যতীত عَبْدُ (আব্দ) হয়না। শুধুমাত্র রুহ দ্বারা عَبْدُ (আব্দ) হয়না। বিষয়টি স্পষ্ট করে মুফাচ্ছেরীন ও মুহাদ্দেছীনগণ সূরা বনী ইসরাইলের প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন। আয়াতটি হলো:
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى
-“পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্ত্বা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমন করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আক্বছা পর্যন্ত।”
ইমাম বাগভী ও আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি (رحمة الله) বলেছেন,
وَالْأَكْثَرُونَ عَلَى أنه أسرى بجسده فِي الْيَقَظَةِ وَتَوَاتَرَتِ الْأَخْبَارُ الصَّحِيحَةُ عَلَى ذَلِكَ.
-“অধিকাংশা ইমামগণের মত হল, নিশ্চয় রাসূলে পাক (ﷺ) এর মেরাজ হল জাগ্রত অবস্থায় ও স্বশরীরে। এ বষয়ে তাওয়াতুর পর্যায়ে ছহীহ্ হাদিস রয়েছে।” ২১৯
কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি (رحمة الله) আরো বলেন: وعليه انعقد الإجماع
-“ইহার উপর ইজমা সংগঠিত হয়েছে।” ২২০
২১৯. তাফছিরে বাগভী, ৩য় খন্ড, ১০৫ পৃ:; তাফছিরে মাজহারী, ৫ম খন্ড, ৪০১ পৃ:;
২২০. তাফছিরে মাজহারী, ৫ম খন্ড, ৪০১ পৃ:;
আলোচ্চ আয়াতের بِعَبْدِهِ এর عَبْدُ (আব্দ) এর ব্যাখ্যায় আইম্মায়ে কেরাম স্বশরীরে অর্থ গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে আরেকটি ছহীহ্ হাদিস উল্লেখ করা যায়,
حَدَّثَنَا جَعْفَرُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ عَاصِمٍ، حَدَّثَنا هِشَامُ بْنُ عَمَّارٍ، حَدَّثَنا الوليد، حَدَّثَنا خُلَيْدُ بْنُ دَعْلَجٍ وَسَعِيدٌ، عَن قَتادَة عَنِ الْحَسَنِ، عَن أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيه وسَلَّم قَال: كُنْتُ أَوَّلَ الناس فِي الْخَلْقِ وَآخِرَهُمْ فِي الْبَعْثِ.
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: সৃষ্টির মধ্যে আমিই প্রথম মানুষ, প্রেরিত হয়েছি সবার শেষে।” ২২১
সর্বোপরি এই রেওয়ায়েতটি নির্ভরযোগ্য অর্থাৎ, হাদিসটি ক্বাবী বা শক্তিশালী, কারণ অন্য রেওয়ায়েত দ্বারা ইহা শক্তিশালী হয়েছে। কারণ হযরত আদম (عليه السلام) এর সৃষ্টির পূর্বেও আল্লাহর হাবীব (ﷺ) ‘নবী’ ছিলেন। সুতরাং তিনিই প্রথম নবী এতে কোন সন্দেহ নেই। সামান্য শাব্দিক ব্যবধানে অন্যত্র উল্লেখ আছে: رواه ابن سعد عن قتادة مرسلًا.
-“ইবনে সাদ হযরত কাতাদা (رحمة الله) থেকে ‘মুরছাল ছহীহ্’ রূপে বর্ণনা করেছেন। ২২২
এই সনদটি ছহীহ্, এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত ফকিহ্, আল্লামা আবুল ফজল হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله) {ওফাত ৭৭৪ হি.} উল্লেখ করেন:
أَخْبَرَنَا عَبْدُ الْوَهَّابِ بْنُ عَطَاءٍ عَنْ سَعِيدُ بْنُ أَبِي عَرُوبَةَ عَنْ قَتَادَةَ قَالَ: وَأَخْبَرَنَا عُمَرُ بْنُ عَاصِمٍ الْكِلابِيُّ. أَخْبَرَنَا أَبُو هِلالٍ عَنْ قَتَادَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ: كُنْتُ أَوَّلَ النَّاسِ فِي الْخَلْقِ وَآخِرَهُمْ فِي الْبَعْثِ. وَهَذَا أَثْبَتُ وَأَصَحُّ
-“হযরত কাতাদা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, আমাদেরকে জানানো হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এরূপ বলেছেন: সৃষ্টির মধ্যে আমিই প্রথম মানুষ এবং প্রেরিত হয়েছি সবার শেষে। ইহা প্রমাণিত ও অধিক ছহীহ্।” ২২৩
২২১. ইমাম ইবনে আদী: আল-কামিল ফিদ-দোয়াফা, ৩য় খন্ড, ৪৮৮ পৃ:; আল্লামা মানাভী: ফায়জুল কাদীর, হাদিস নং ৬৪২৩; যখিরাতুল হুফ্ফাজ, হাদিস নং ৪৩৭৫;
২২২. ইমাম আজলুনী: কাশফুল খফা, ২য় খন্ড, ১১৮ পৃ:;
২২৩. ইমাম ইবনে সা’দ: তাবকাতে কোবরা, ১ম খন্ড, ১১৯ পৃ:; ইবনে কাছির: আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ১ম খন্ড, ৩২৫ পৃ: ‘আমর ইবনে র্মুরা জাহনী’ এর কিচ্ছার বর্ণনায়; শারফুল মোস্তফা, ২য় খন্ড, ৭২ পৃ:; কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ১ম খন্ড, ১১৪ পৃ:; বাহ্জাতুল মাহফিল, ১ম খন্ড, ১৩ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৪২ পৃ:; শরহে মাওয়াহেব লিয-যুরকানী, ১ম খন্ড, ৬৯ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১০ম খন্ড, ২৭৪ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: শরহে শিফা, ১ম খন্ড, ১১৭ পৃ:;
এ বিষয়ে আরেকটি হাদিস রয়েছে,
قَالَ عَلَيْهِ الصَّلَاة وَالسَّلَام كُنْتُ نَبِيًّا وَآدَمُ بَيْنَ الْمَاءِ وَالطِّينِ -“আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: আদম যখন মাটি ও পানিতে আমি তখনো নবী ছিলাম।” ২২৪
এই হাদিস সম্পর্কে আল্লামা ইমাম আজলুনী (رحمة الله) লিখেন,
لكن قال العلقمي في شرح الجامع الصغير: حديث صحيح. -“ইমাম আলকামী (رحمة الله) তাঁর ‘শরহে জামেউছ ছাগীর’-এ বলেন: এই হাদিস ‘ছহীহ্’।” ২২৫
এই হাদিস সম্পর্কে আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) বলেন:
وَلَهُ شَاهِدٌ مِنْ حَدِيثِ مَيْسَرَةَ الْفَخْرِ -“হযরত মিছারা ইবনে ফাখর (رضي الله عنه) থেকে এর শাহিদ বা সাক্ষ্য রয়েছে।” ২২৬
অন্যত্র উল্লেখ আছে: فالحديث له اصل ثابت بالالفاظ المذكورة -“এই হাদিসের মূল অন্য অনেক হাদিসের লফজের বা শব্দের দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে।” ২২৭
২২৪. ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৫৬ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১০ম খন্ড, ৪৩৯ পৃ:; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৪৬৫ পৃ:; ইমাম আজলুনী: কাশফুল খফা, ২য় খন্ড, ১৫২ পৃ:; ইমাম ছাখাবী: মাকাছিদুল হাছানা, হাদিস নং ৮৩৭ ও ৮৪২; আদ দুরারুল মুনতাসিরা, হাদিস নং ৩৩১; ইমাম আইনী: শরহে আবু দাউদ, ৩য় খন্ড, ৩৬০ পৃ:; আল্লামা মানাভী: ফায়জুল কাদির, ৫ম খন্ড, ৫৩ পৃ:; মুবারকপুরী: তুহফাতুল আহওয়াজী, ১০ম খন্ড, ৫৬ পৃ:
২২৫. ইমাম আজলুনী: কাশফুল খফা, ২য় খন্ড, ১২১ পৃ:;
২২৬. ইমাম মোল্লা আলী: মওজুয়াতুল কোবরা, ১৭৯ পৃ:;
২২৭. আল মাসনু, ১৪৩ পৃ: হাশিয়া;
উল্লেখিত হাদিস সমূহ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির পূর্বেই দয়াল নবী রাসূলে করিম (ﷺ) ‘নবী’ ছিলেন। সুতরাং বিষয়টি স্পষ্ট যে, আল্লাহর নবী হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির পূর্বেই দেহ ও রুহ্ সহকারে মানুষ অবস্থায় নবী ছিলেন। আমরা সকলেই জানি, মাটির তৈরী প্রথম মানুষ হল হযরত আদম (عليه السلام), আর হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁরও আগে মানব রূপে সৃষ্টি। কেননা ছহীহ্ হাদিসে স্পষ্ট আছে
كُنْتُ أَوَّلَ النَّاسِ فِي الْخَلْقِ -“সৃষ্টির মধ্যে আমিই প্রথম মানুষ।” এখানে النَّاسِ (নাছ) অর্থ মানুষ। সুতরাং আল্লাহর নবী (ﷺ) মাটির তৈরী মানুষ নন, বরং নূরের তৈরী মানুষ।
❏ তাঁরকার সূরতে রাসূল (ﷺ)
নূরের তৈরী ফেরেস্থা স¤্রাট হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) সৃষ্টি হওয়ার বহু পূর্বে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সৃষ্টি হয়ে তারকার সূরতে ছিলেন। এ সম্পর্কেও পবিত্র হাদিস শরীফে বর্ণনা রয়েছে। যেমন পবিত্র হাদিসে আছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَأَلَ جِبْرِيلَ عليه الصلاة والسلام فَقَالَ: يَا جِبْرِيلُ كم عمرت من السنين؟ فقال يَا رَسُولَ اللَّهِ لَسْتُ أَعْلَمُ، غير أن في الحجاب الرابع نجما يطلع في كل سبعين ألف سنة مرة، رأيته اثنين وسبعين ألف مرة فقال: يَا جِبْرِيلُ وعزة ربي جل جلاله أنا ذلك الكوكب رواه البخاري،
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) জিব্রাইল (عليه السلام) কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে জিব্রাইল আপনার বয়স কত? তিনি বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ইহা অবগত নই, তবে চতুর্থ হেজাব-এ একটি তারকা ৭০ হাজার বছর পর পর একবার উদিত হত, আমি তাঁকে ৭২ হাজার বার দেখেছি। নবী করিম (ﷺ) বললেন: হে জিব্রাইল! আমার রবের ইজ্জত ও জালালের কসম! আমিই ছিলাম সেই তারকা।” ২২৮
সিরাতে হালভিয়া কিতাবের মুকাদ্দমায় আছে, প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা নূরুদ্দিন আলী হালভী (رحمة الله) বলেছেন,
ولا يخفى أن السير تجمع الصحيح والسقيم والضعيف والبلاغ والمرسل والمنقطع والمعضل دون الموضوع
-“আর ইহা গোপন নয় যে, সিরাত গ্রন্থ সমূহের মধ্যে মুওজু বা বানোয়াট হাদিস ব্যতীত ছহীহ্, ছাক্বীম, দ্বায়িফ, বালাগ, মুরছাল, মুনকাতে, মু’দাল সকল রেওয়ায়েতই উল্লেখ থাকে।” ২২৯
২২৮. ‘আত তাশরিফাতে ফি খাছায়েছে ওয়াল মুজিজাত; নূরুদ্দিন হালভী: সিরাতে হালভীয়া, ১ম খন্ড, ৪৭ পৃ: ইমাম বূখারীর সূত্রে; যাওয়াহিরুল বিহার, ৩য় খন্ড, ৩৩৯ পৃ:; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৭ম খন্ড, ৩য় খন্ড, ৬৫১ পৃ:; জিকরে হাসীন, ৩০ পৃ:
২২৯. নূরুদ্দিন হালভী: সিরাতে হালভিয়া, ১ম খন্ড ৫ পৃষ্টা মুকাদ্দমা;
অতএব, আল্লামা নূরুদ্দিন হালভী (رحمة الله) এর দৃষ্টিতে এই হাদিসখানা মাওজু নয়। কারণ তিনি এটাকে এই মূলনীতি তোমাবেক তিনার সিরাত গ্রন্থেই উল্লেখ করেছেন। অতএব, মাটির কোন অস্তিত্ব ছিলনা তখনো আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আল্লাহর দরবারে তারকার সূরতে ছিলেন।
❏ ময়ূরের সূরতে রাসূল (ﷺ)
আল্লাহর হাবীব (ﷺ) ময়ূরের সূরতে থাকার হাদিস খানা হচ্ছে,
عبد الرزاق عن معمر عن الزهري عن السائب بن يزيد قال: ان الله تعالى خلق شجرة ولها اربعة اغصان فسماها شجرة اليقين ثم خلق نور محمد صلى الله عليه وسلم فى حجاب من درة بيضاء مثله كمثل الطاووس ووضعه على تلك الشجرة....
-“হযরত সাইব ইবনে ইয়াজিদ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা একটি গাছ সৃষ্টি করলেন যার ৪টি শাখা বা ঢাল ছিল। অতঃপর নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) সৃষ্টি করে ঐ গাছের ঢালের মাঝে ময়ূরের সূরতে রাখলেন।”...... ২৩০. জুয উল মাফকুদ মিন মুছান্নাফে আব্দির রাজ্জাক, ৫১-৫২ পৃ:; ইমাম গাজ্জালী: দাকায়েকুল আখবার;
সনদ ছহীহ্
এই হাদিসটিও সনদের দিকে ছহীহ্। হযরত সাইব ইবনে ইয়াজিদ (رضي الله عنه) এর রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণ হয়ে যায়, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সৃষ্টি জগৎ সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে আল্লাহর দরবারে ময়ূরের সূরতে ছিলেন। তখন মাটি কিংবা মাটির এই পৃথিবীর কোন অস্তিত্বই ছিলনা।
❏ হযরত জাবের (رضي الله عنه) এর নূরের হাদিসের বিস্তারিত
عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي أَخْبِرْنِي عَنْ أَوَلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ اللَّهُ قَبْلَ الأَشْيَاءِ، فَقَالَ: يَا جَابِرُ! إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ قَبْلَ الأَشْيَاءِ نُورُ نَبِيِّكَ مِنْ نُورِهِ، فَجَعَلَ ذَلِكَ النُّورِ يَدُورُ بِالْقُدْرَةِ حَيْثُ شَاءَ اللَّهُ، وَلَمْ يَكُنْ فِي ذَلِكَ الْوَقْتِ لَوْحٌ وَلا قَلَمٌ وَلا جَنَّةٌ وَلا نَارٌ وَلا مُلْكٌ وِلا سِمِاءٌ وَلا أَرْضٌ وَلا شَمْسٌ وَلا قَمَرٌ وَلا جِنِّيٌ وَلا إِنْسٌ.
-“হযরত জাবের আল-আনছারী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে পাক (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার পিতা-মাতা আপনার কদমে কুরবানী ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে সংবাদ দিন আল্লাহ সব কিছুর পূর্বে কি সৃষ্টি করেছেন? প্রিয় নবীজি (ﷺ) বললেন: হে জাবের! নিশ্চয় আল্লাহ পাক সব কিছুর পূর্বে তাঁর নূর থেকে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর সেই নূর আল্লাহর কুদরতে পরিক্রমন করতে থাকল যেভাবে আল্লাহ চেয়েছেন। তখন কোন ওয়াক্ত, লওহ-ক্বলম, জান্নাত-জাহান্নাম, ফেরেস্থা, আসমান-জমীন, চন্দ্র-সূর্য, জ্বীন-ইনছান কোন কিছুই ছিলনা।......।”
এই হাদিস খানা নিম্ন লিখিত কিতাব সমূহে আছে,
মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক এর যুয উল মাফকুদ, ৬৩ পৃ:;
আল মাদ্খাল, ১ম খন্ড, ৩২ পৃ: [কৃত: আল্লামা ইবনুল হাজ্জ র:];
মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৭১ পৃ: [শারিহে বুখারী ইমাম কাস্তালানী র:];
শরহে মাওয়াহেব লিয যুরকানী, ১ম খন্ড, ৮৯ পৃ: [আল্লামা ইমাম যুরকানী র:];
তাফহিমাতে ইলাহিয়্যা, ১৯ পৃ [কৃত: শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেছ দেহলবী র:];
নশরুত্তিব, ৫ পৃ: [কৃত: মাওলানা আশরাফ আলী থানভী];
ছিরাতে হালভিয়া, ১ম খন্ড, ৪৭ পৃ: [কৃত: আল্লামা নুরুদ্দিন হালভী র:];
তাফছিরে রুহুল মায়ানী, ১ম জি: ৯০ পৃ: [কৃত: আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী র:];
কাশফুল খাফা, ১ম খন্ড, ২৩৭ পৃষ্টা [কৃত: ইমাম আজলুনী র:];
আছারুল মারফ‚য়া, ৪২-৪৩ পৃ: [কৃত: আব্দুল হাই লাখনভী];
আল মাউরিদুর রাভী, ২২ পৃ: [কৃত: মোল্লা আলী ক্বারী র:];
ফাত্ওয়ায়ে হাদিছিয়্যা, ৪৪ পৃ: [কৃত: ইবনে হাজার হায়তামী মক্কী র:];
আলহাবী লিল ফাত্ওয়া, ১ম খন্ড, ৩৮৪ পৃ: [কৃত: ইমাম সিয়তী র:];
আদ দুরারুল বাহিয়্যাহ, ৪-৮ পৃ: [কৃত: আল্লামা নববী র:];
এই হাদিসের সনদ হল:
عن عبد الرزاق عن معمر عن ابن منكدر عن جابر بن عبد الله قال قلت.....
-“ইমাম আব্দুর রাজ্জাক, তিনি মামার (رحمة الله) হতে, তিনি ইবনে মুনকাদির (رحمة الله) হতে, তিনি হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম......।”
উল্লেখিত সনদখানা পুরোটাই বিশুদ্ধ বা ছহীহ্। কিন্তু আফছুছের বিষয় হল, ওহাবীরা নতুন ছাপা মুছান্নাফের কিতাব থেকে এই হাদিসটি পুরোটাই বাদ করে দিয়েছে। পুরাতন কিতাবে এই হাদিস খানা সনদসহ মওজুদ আছে। আর সেই পুরাতন আসল নূছখা থেকে আরবের ডুবাই অঞ্চলে আল্লামা ঈসা মানি হিমইয়ারী (হাফিজাহুল্লাহু) এর সংরক্ষনে রয়েছে এবং সেটার হুবহু স্কেনিং করা পৃষ্টা ‘যুয উল মাফকুদ’ কিতাবে তিনি দিয়েছেন। হাদিসখানা যে পূর্ব যুগে ‘মুছান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক’ কিতাবে মওজুদ ছিল তার ব্যাপারে বিভিন্ন কিতাবে ইমামগণ সাক্ষ্য প্রদান রয়েছে। যেমন হাফিজ ইবনে হাজার মক্কী (র), আল্লামা ইমাম আজলুনী (رحمة الله), আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী হানাফী (رحمة الله), আল্লামা নুরুদ্দিন আলী হলভী (رحمة الله), শারিহে বুখারী আল্লামা ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله), আল্লামা শায়েখ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله), আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله), ইমাম যুরকানী (رحمة الله), মাওলানা আব্দুল হাই লাখনভী, আল্লামা নববী (رحمة الله), মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব, প্রমূখ তদীয় কিতাব সমূহে হাদিসটিকে ‘মুছান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক’ এর রেফারেন্সে কত সুন্দর করে উল্লেখ করেছেন। নিচে আলাদা করে প্রত্যেক ইমামরা কিভাবে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন তা দেওয়া হল:-
ইমাম আবুল আব্বাস শিহাবুদ্দিন কাস্তালানী (رحمة الله) (ওফাত ৯২৩ হিজরী) তদীয় কিতাবে এভাবে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন,
روى عبد الرزاق بسنده عن جابر بن عبد الله.... -“ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) তার সনদে হযরত জাবের (رضي الله عنه) হতে হাদিস বর্ণনা করেছেন.....।” ২৩১. ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৪৮ পৃ:;
ইমাম যুরকানী (رحمة الله) তার ‘শরহে মাওয়াহেব’ এর মধ্যেও হাদিসটি ব্যাখ্যাসহ স্বীকৃতি দিয়ে এভাবেই উল্লেখ করেছেন। অনেকে লিখেছেন, ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) এই হাদিস খানা ভুলে মুছান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এর রেফারেন্স দিয়েছে। তারা আরো লিখেছে, ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) এর পূর্বে কেউ এই হাদিস উল্লেখ করেননি। অথচ ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) এর পূর্বেও বহু মুহাদ্দিছ ইমামগণ তাঁদের কিতাবে হাদিস খানা অথবা নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) যে প্রথম সৃষ্টি ইহা বর্ণনা করেছেন। যেমন লক্ষ্য করুন:
ইমাম আবু সা’দ নিছাপুরী খারকুশী (رحمة الله) {ওফাত ৪০৭ হিজরী} তাঁর সু-প্রসিদ্ধ সিরাত গ্রন্থ “শারফুল মোস্তফা” ১ম খন্ড, ৩০৭ পৃষ্টায় (যা দারুল বাশায়েরুল ইসলামিয়্যা, মক্কাতুল মুর্কারামা হতে প্রকাশিত হাদিস খানা নিম্মোক্তভাবে উল্লেখ রয়েছে:-
روى عبد الرزاق بسنده عن جابر بن عبد الله.... -“ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) তাঁর সনদে জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন।” তৎকালীন কোন আলিম এই হাদিসের বিরুদ্ধে কথা বলেননি।
আল্লামা ইয়াহইয়া ইবনে আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া আল-আমরী হারদ্বী (رحمة الله) ওফাত ৮৯৩ হিজরী, তিনি “বাহ্জাতুল মাহফিল ওয়া বাগিয়াতুল আমছালফি তালখিছুল মু’যিজাত ওয়াল সিওরু ওয়াশ শামায়েল” কিতাবে ১ম খন্ড ১৫ পৃষ্টায় (যা দারুস সদর বইরুত থেকে প্রকাশিত) এই হাদিস খানা এভাবে উল্লেখ করেছেন:-
أخرجه عبد الرزاق في مسنده بسند مستقيم من حديث جابر -“ইমাম আব্দুর রাজ্জাক মজবুত সনদে জাবের (رضي الله عنه) এর হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।” তৎকালীন কোন আলিম এর বিরুদ্ধে সমালোচনা করেননি।
আল্লামা ইমাম হুছাইন ইবনে মুহাম্মদ হুছাইন দিয়ারবকরী (رحمة الله) ওফাত ৯৬৬ হিজরী তিনি তাঁর লিখিত “তারিখুল খামিছ” কিতাবে হযরত জাবের (رضي الله عنه) এর হাদিসখানা এভাবে উল্লেখ করেছেন,
كما روى عن جابر بن عبد الله الانصارى أنه قال سألت رسول الله صلى الله عليه وسلم عن أوّل شئ خلقه الله قال هو نور نبيك يا جابر
-“যেমন হযরত জাবের (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, নিশ্চয় তিনি রাসূল (ﷺ) কে আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন। প্রিয় নবীজি (ﷺ) বলেছেন: হে জাবের! সেটা তোমার নবীর নূর।” ২৩২
উল্লেখ্য যে, ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) এর প্রায় সম-সাময়িক বিশ্ব বিখ্যাত ইমাম আল্লামা হাফিজ ইবনে হাজার হায়তামী মক্কী (رحمة الله) ওফাত ৯৭৪ হিজরী, তিনি তাঁর “ফাত্ওয়ায়ে হাদিছিয়্যা” কিতাবের ৪৪ পৃষ্টায় হাদিস খানা মুছান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এর রেফারেন্সে উল্লেখ করেছেন। যেমন:
فقد أخرج عبد الرَّزَّاق بِسَنَدِهِ عَن جَابر بن عبد الله الْأنْصَارِيّ رَضِي الله عَنْهُمَا
-“অবশ্যই আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) তাঁর সনদে হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনছারী (رضي الله عنه) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন.....।” ২৩৩
হাফিজুল হাদিস ইমাম ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) তার অন্য কিতাবে বলেন,
وروى عبد الرزاق فى مسنده أن النبى صلى الله عليه وسلم قال: إن الله خلق نور محمد قبل الأشياء من نوره،
-“ইমাম আব্দুর রাজ্জাক তার মুসনাদে বর্ণনা করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেছেন: অবশ্যই আল্লাহ তা’লা সব কিছুর পূর্বে নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি করেছেন।” ২৩৪
২৩২. ইমাম দিয়ার বকরী: তারিখুল খামিছ, ১ম খন্ড, ১৯ পৃ:;
২৩৩. ফাতওয়ায়ে হাদিছিয়্যা, ৪৪ পৃ:;
২৩৪. হাফিজ ইবনে হাজার মক্কী: আশরাফুল অছাইল ফি শরহে শামাইল, ১ম খন্ড, ৩৬ পৃ:;
হিজরী ১১শ শতাব্দির মুজাদ্দিদ ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) ওফাত ১০১৪ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন,
وروى عبد الرزاق بسنده عن جابر بن عبد الله الأنصارى قال: قلت يا رسول الله، بأبى أنت وأمى، أخبرنى عن أول شىء خلقه الله تعالى قبل الأشياء. قال: يا جابر، إن الله تعالى قد خلق قبل الأشياء نور نبيك من نوره،
-“ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) তার সনদে হযরত জাবের (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন..।” ২৩৫
অনুরূপ আল্লামা মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের ইবনে শায়েখ আব্দুল্লাহ আইদারুছ (رحمة الله) (ওফাত ১০৩৮ হিজরী) তদীয় কিতাবে বলেন,
وروى عبد الرَّزَّاق بِسَنَدِهِ ان النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ إِن الله خلق نور مُحَمَّد قبل الْأَشْيَاء من نوره
-“ইমাম আব্দুর রাজ্জাক তার সনদে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেছেন: আল্লাহ তা’লা সব কিছুর পূর্বে আল্লাহর নূর থেকে নবী পাক (ﷺ) এর নূর সৃষ্টি করেছেন।” ২৩৬
ইমাম শায়েখ ইসমাঈল ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল হাদী আল-আজলুনী (رحمة الله) (ওফাত ১১৬২ হিজরী) তদীয় কিতাবে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন এভাবে,
وروى عبد الرزاق بسنده عن جابر بن عبد الله الأنصارى قال: قلت يا رسول الله، بأبى أنت وأمى، أخبرنى عن أول شىء خلقه الله تعالى قبل الأشياء. قال: يا جابر، إن الله تعالى قد خلق قبل الأشياء نور نبيك من نوره،
-“ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) তার সনদে হযরত জাবের (رضي الله عنه) হতে হাদিস বর্ণনা করেছেন.....।” ২৩৭
২৩৫. আল মাওরিদুর রাবী ফি মাওলিদিন নববী, ১৯ পৃ:;
২৩৬. নূরুছ ছাফির আনি আখবারিল কারনিল আশির, ৮ম পৃ:;
২৩৭. ইমাম আজলুনী: কাশফুল খফা, ১ম খন্ড, ২৩৭ পৃ:
আধুনিক যুগের প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা আব্দুল হাই লাখনভী (رحمة الله) তদীয় কিতাবের বলেন,
هُوَ ظَاهِرُ رِوَايَةِ عَبْدِ الرَّزَّاقِ فِي مُصَنَّفَةٍ عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي أَخْبِرْنِي عَنْ أَوَلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ اللَّهُ قَبْلَ الأَشْيَاءِ، فَقَالَ: يَا جَابِرُ! إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ قَبْلَ الأَشْيَاءِ نُورُ نَبِيِّكَ مِنْ نُورِهِ،
-“ইহা প্রকাশ্য বর্ণনা যে, ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) তাঁর ‘মুছান্নাফ’ গ্রন্থে হযরত জাবের (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত জাবের (رضي الله عنه) বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা-মাতা আপনার কদমে কুরবানী, আমাকে সংবাদ দিন আল্লাহ সব কিছুর পূর্বে কি সৃষ্টি করেছেন? প্রিয় নবীজি (ﷺ) বললেন: হে জাবের! নিশ্চয় আল্লাহ পাক সব কিছুর পূর্বে তাঁর নূর থেকে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।” ২৩৮
এই হাদিসের সনদ সম্পর্কে আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী (رحمة الله) বলেছেন,
قد ثَبت من رِوَايَة عبد الرَّزَّاق أولية النُّور المحمدي -“অবশ্যই প্রথম সৃষ্টি নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টির আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) এর রেওয়ায়েতটি প্রমাণিত।” ২৩৯
হাদিসটি আল্লামা নুরুদ্দিন হালভী (رحمة الله) (ওফাত ১০৪৪ হিজরী) তদীয় কিতাবে এভাবে উল্লেখ করেছেন,
وقد قال له جابر: يا رسول الله أخبرني عن أول شيء خلقه الله تعالى قبل الأشياء؟ قال: يا جابر إن الله خلق قبل الأشياء نور نبيك من نوره،
-“অবশ্যই রাসূল (ﷺ) কে জাবের (رضي الله عنه) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে বলুন সব কিছুর পূর্বে আল্লাহ কি সৃষ্টি করেছেন? প্রিয় নবীজি (ﷺ) বললেন: হে জাবের! সব কিছুর পূর্বে আল্লাহ তার নূর থেকে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।” ২৪০
ইমাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল বাকী যুরকানী (رحمة الله) ওফাত ১১২২ হিজরী তদীয় ‘শরহে মাওয়াহেব’ গ্রন্থে উক্ত হাদিস উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করেছেন ও কোন প্রকার সমালোচনা করেননি। শেষে তিনি বলেছেন- فليراجع من مصنف عبد الرزاق مع تمام الحديث،
-“সম্পূর্ণ হাদিসটি মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক থেকে প্রাধান্য পেয়েছে।” ২৪১
২৩৮. আল্লামা লাখনবী: আছারুল মারফুয়া, ৪২ পৃ:;
২৩৯. আল্লামা আব্দুল হাই লাখনভী: আছারুল মারফ‚য়া, ১ম খন্ড, ৪৩ পৃ:;
২৪০. ছিরাতে হালভিয়া, ১ম খন্ড, ২১৪ পৃ:;
২৪১. ইমাম যুরকানী: শরহে মাওয়াহেব, ১ম খন্ড, ৯১ পৃ:;
ইমাম যুরকানী (رحمة الله) উক্ত কিতাবের আরেক জায়গায় স্পষ্ট করে এভাবে লিখেছেন,
كما في حديث جابر عند عبد الرزاق مرفوعًا: يا جابر إن الله قد خلق قبل الأشياء نور نبيك من نوره،
-“যেমনটি ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) নিকট মারফূ সনদে হাদিস বর্ণিত রয়েছে, হে জাবের! নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা সব কিছুর পূর্বে তাঁর নূর থেকে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।” ২৪২
শায়েখ আব্দুল হাক্ব মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله) তদীয় ‘মাদারেজুন নবুয়াত’ কিতাবের প্রথম খন্ডে হাদিসটিকে ছহীহ্ বলেছেন।
বিশ্বখ্যাত মুফাচ্ছির আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী (رحمة الله) {ওফাত ১২৭০ হিজরী} সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতের তাফছিরে উল্লেখ করেন,
ولذا كان نوره صلّى الله عليه وسلّم أول المخلوقات، ففي الخبر أول ما خلق الله تعالى نور نبيك يا جابر
-“আর এ কারণেই তাঁর নূরানী সত্ত্বা সমস্থ মাখলুকাতের পূর্বে সৃষ্টি এবং এ কথাই হাদিস শরীফে আছে: হে জাবের! আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।” ২৪৩
২৪২. ইমাম যুরকানী: শারহু মাওয়াহিব, ১ম খন্ড, ৫৪ পৃ:;
المقصد الأول: في تشريف الله تعالى له عليه الصلاة والسلام ,مدخل
২৪৩. আল্লামা আলুছী: তাফছিরে রুহুল মাআনী, ৯ম খন্ড, ১০০ পৃ:;
ভারতবর্ষে দেওবন্দীদের অন্যতম বড় আলিম মাও: আশরাফ আলী থানভী সাহেব তদীয় ‘নসরুত্তিব’ কিতাবে
وروى عبد الرزاق بسنده عن جابر بن عبد الله الأنصارى قال: قلت يا رسول الله، بأبى أنت وأمى، أخبرنى عن أول شىء خلقه الله تعالى قبل الأشياء. قال: يا جابر، إن الله تعالى قد خلق قبل الأشياء نور نبيك من نوره،
-“ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) তার সনদে হযরত জাবের (رضي الله عنه) হতে হাদিস বর্ণনা করেছেন.....। এরুপ উল্লেখ করে কোন প্রকার সমালোচনা করেননি।
মাওলানা শামছুল হক্ব ফরিদপুরী সাহেবের ফয়েজে ও বরকতে লিখিত,
শায়খুল হাদিস আজিজুল হক্ব ছাহেবের অনুবাদকৃত বাংলা বোখারী শরীফে ‘সর্বপ্রথম সৃষ্টি হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)’ শিরোনামে হাদিসে জাবের (رضي الله عنه) সম্পর্কে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন:-
“এই হাকিকতে মুহাম্মদিয়াই নিখিল সৃষ্টি জগতের সর্বপ্রথম সৃষ্টি। লৌহ-ক্বলম, বেহস্থ-দোজখ, আসমান জমীন, চন্দ্র সূর্য, ফেরেস্তা এবং মানব-দানব সব কিছুই ঐ হাকিকতে মুহাম্মদিয়া বা নূরে মুহাম্মদীর পরে সৃষ্টি হয়েছে। এই তথ্য সু-স্পষ্টরূপে বিশিষ্ট ছাহাবী জাবের (رضي الله عنه) বর্ণিত এক হাদীছে উল্লেখ রহিয়াছে”।
লালবাগ শাহী মসজিদ এর ইমাম ও খতিব, সম্পাদক-মাসিক আল-বালাগ, সদস্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বোর্ড অফ গভর্ণরস, চেয়ারম্যান তফছিরে তাবারী প্রকল্প সম্পাদনা বোর্ড, তাফছিরে নূরুল কোরআন সহ বহুগ্রন্থ প্রণেতা, মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম সাহেব হাদিসে জাবের (رضي الله عنه) সম্পর্কে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন:-
“আবির্ভাবের পূর্বেই সারা পৃথিবীতে সকল যুগে যাঁর নাম প্রচারিত হয়েছে, শুধু তাই নয়; বরং পৃথিবী সৃষ্টিরও পূর্বে আল্লাহ পাকের মহান আরশে এবং জান্নাতে যাঁর পবিত্র নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে, তিনিই আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম।
এমনকি, এই সমগ্র সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্বপ্রথম যাঁর সৃষ্টি তিনিই আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম।” অতঃপর জাবের (رضي الله عنه) এর নূরের হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। তারপর বলেন: অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদীই হলো আল্লাহ পাকের সর্বপ্রথম সৃষ্টি, কেননা যেসব জিনিসের ব্যাপারে প্রথম সৃষ্টি হওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়, সে সমস্থ সৃষ্টি যে নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টির পর, তা এই হাদিস দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয়।” ২৪৪। নূরে নবী, ১ম খন্ড, ২য় অধ্যায়, ৫ পৃষ্টা; নূরে নবী, ১ম খন্ড, ২য় অধ্যায়, ৫ পৃষ্টা;
দেওবন্দীদের আরেক প্রখ্যাত আলিম শায়খুল হাদিস আল্লামা মুফতী মনসূরুল হক সাহেব হাদিসে জাবের (رضي الله عنه) সম্পর্কে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন:-
“এই ভূমন্ডল, নভোমন্ডল এবং এতদুভয়ের যাবতীয় বস্তু রাসূলে করিম (ﷺ) এর সৃষ্টির বরকতমন্ডিত। তাঁর নূরে রহমত পরশিত করেই এসব কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে। সর্বপ্রথম মহান আল্লাহ মহানবী (ﷺ) এর নূরকে সৃষ্টি করেন। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক) তারপর সেই নূরকে কেন্দ্র করে অন্যান্য সকল কিছু, তথা আসমান-জমীন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, আলো-বাতাস, সমস্থ জীন-ইনছান, এক কথায় সমগ্র জগতের সৃষ্টি হয়।” ২৪৫
হযরত জাবের (رضي الله عنه) এর বর্ণিত নূরের হাদিসটির সত্যতা নিচের রেওয়ায়েত গুলো দ্বারাও পাওয়া যায়।
❏ আরশ, কুরছী, লাওহ, ক্বলম কিসের সৃষ্টি?
হাদিসে জাবের থেকে জানা যায়, আল্লাহর আরশ, কুরছী, লাওহ, ক্বলম নূর থেকেই সৃষ্টি। এবার আমরা সেই বিষয় গুলোই আরো স্পষ্ট করে অন্যান্য রেওয়াতের আলোকে জানব। প্রথমেই একটি হাদিস লক্ষ্য করুন,
قَالَ ابْنُ جَرِيرٍ: حَدَّثَنَا الْحُسَيْنُ بْنُ شَبِيبٍ الْمُكْتِبُ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ زِيَادٍ الْجَزَرِيُّ، عَنْ فُرَاتِ بْنِ أَبِي الْفُرَاتِ، عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ قُرَّةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: {ن وَالْقَلَمِ وَمَا يَسْطُرُونَ} قَالَ: لَوْحٌ مِنْ نُورٍ وَقَلَمٌ مِنْ نُورٍ يَجْرِي بِمَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ.
-“মুয়াবিয়া ইবনে র্কুরা (رضي الله عنه) তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: ‘নূন, ক্বলমের শপত! এবং যা দ্বারা লিখা হয়’ এই আয়াত সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) বলেছেন: লাওহ নূর থেকে, ক্বলম নূর থেকে, এভাবেই কেয়ামত পর্যন্ত চলমান থাকবে।” ২৪৬
২৪৫. মাসিক আদর্শ নারী, জানুয়ারী ২০১২ সংখ্যা, ৩ পৃষ্ঠা;
২৪৬. হাফিজ ইবনে কাছির: তাফছিরে ইবনে কাছির, ৮ম খন্ড, ১৮৬ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: আল হাবী লিল ফাতওয়া, ১ম খন্ড, ৪২৯ পৃ:; তাফছিরে তাবারী, ২৩তম খন্ড, ১৪৪ পৃ: সূরা ক্বলম এর ১ম আয়াতের ব্যাখ্যায়; ইমাম ছিয়তী: তাফছিরে দুর্রে মানছুর, ৮ম খন্ড, ২৪১ পৃ:;
এই হাদিসে লাওহ-ক্বলম নূরের তৈরী এই কথা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। আরেকটি রেওয়ায়েতে পাওয়া যায় ‘আল্লাহর আরশ’ নূর থেকেই তৈরী। যেমন,
ইমাম আবুশ শায়েখ ইস্পাহানী (رحمة الله) ওফাত ৩৬৯ হিজরী তদীয় কিতাবে বর্ণনা করেছেন,
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ إِبْرَاهِيمَ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ الْبَرَاءِ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْمُنْعِمِ بْنُ إِدْرِيسَ بْنِ سِنَانٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ وَهْبِ بْنِ مُنَبِّهٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: أَوَّلُ شَيْءٍ خَلَقَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ الْعَرْشَ مِنْ نُورٍ، ثُمَّ الْكُرْسِيَّ،
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, প্রথমে আল্লাহ তা’লা আরশকে নূর হতে সৃষ্টি করেন, অতঃপর কুরছীকে।” ৩৪৭
এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
وَقَالَ ابْنُ مَسْعُودٍ: إِنَّ رَبَّكُمْ لَيْسَ عِنْدَهُ لَيْلٌ وَلَا نَهَارٌ، نُورُ الْعَرْشِ مِنْ نُورِ وَجْهِهِ.
-“হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেছেন: নিশ্চয় তোমাদের রবের কাছে রাত দিন নেই। আরশের নূর আল্লাহর বিশেষ নূর হতে।” ২৪৮
এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
قُرِئَ عَلَى بَحْرِ بْنِ نَصْرٍ الْخَوْلانِيِّ الْمِصْرِيِّ، ثنا أَسَدُ بْنُ مُوسَى ثنا يُوسُفُ، عَنْ أَبِي الْعَبَّاسِ ابْنِ بِنْتِ وَهْبِ بْنِ مُنَبِّهٍ، عَنْ وَهْبِ بْنِ مُنَبِّهٍ قَالَ إِنَّ اللَّهَ خلق العرش من نور.
-“ওহাব ইবনে মুনিয়া (رضي الله عنه) বলেন: নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা আরশকে নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ২৪৯
নূন, লাওহে মাহফুজ ও ক্বলম নূরের সৃষ্টি এই ব্যাপারে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
وَأخرج الرَّافِعِيّ فِي تَارِيخ قزوين من طَرِيق جُوَيْبِر عَن الضَّحَّاك عَن ابْن عَبَّاس قَالَ: قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم: النُّون اللَّوْح الْمَحْفُوظ والقلم من نور سَاطِع
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে করিম (ﷺ) বলেছেন: নূন, লাওহ মাহফুজ ও ক্বলম উজ্জল নূর থেকে সৃষ্টি।” ২৫০
২৪৭. আবুশ শায়েখ: আল আজমাত, হাদিস নং ২৩৭;
২৪৮. তাফছিরে ইবনে কাছির, ৫ম খন্ড, ৪৯০ পৃ: সূরা মু’মীনুন: ৮৪-৯০;
২৪৯. তাফছিরে ইবনে আবী হাতেম, হাদিস নং ১০২১৫;
২৫০. তাফছিরে দুর্রে মানছুর, ৮ম খন্ড, ২৪১ পৃ:;
সইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) প্রাথমিকভাবে সমালোচনা করে বলেন:
لَيْسَ لَهُ إِسْنَادٌ يُعْتَمَدُ عَلَيْهِ -“এর কোন সনদ নেই।” কিন্তু পরবর্তীতে তিনি হাদিসটির সত্যতা স্বীকার করেছেন এবং তাঁর ‘খাছায়েছুল কোবরা’ কিতাবে হাদিসটি চয়ন করেছিলেন। যেমন ‘শায়েখ আব্দুল্লাহ গুমারী’ তার কিতাবে বলেন:
روى السيوطى فى الخصائص الكبرى لمصنف عبد الرزاق
-“ইমাম ছিয়তী (رحمة الله) তাঁর ‘খাছায়েছুল কুবরা’ কিতাবে মুছান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এর রেফারেন্সে হাদিস খানা বর্ণনা করেছেন।” ২৫১। ইরশাদুত তালেবীন নজীব ইলা মা ফিল মাওলিদিন নাববী মিনাল আকাজিব এবং হাদিসের নামে জালিয়াতী পৃষ্টা নং ৩২৮;
অতীব আফছুছের বিষয় হল, বর্তমানে সেই ‘খাছায়েছুল কুবরা’ কিতাব থেকেও এই হাদিসখানা বাদ করে দিয়েছে। আল্লাহ পাক সব সত্যের পিছনে তার প্রমাণ রেখে দেন। যেমন ভন্ড ছালাফীদের অনুচর ‘শায়েখ আব্দুল্লাহ গুমারী’ তার কিতাবে ‘খাছাইছুল কুবরায়’ এই হাদিস থাকার কথাটি স্বীকার করেছেন।
রাসূলে পাক (ﷺ) নূর সর্বপ্রথম সৃষ্টির বিষয়টি হাফিজুল হাদিস ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) তিনার কিতাবে উল্লেখ করেছেন,
وقال زين العرب في شرح المصابيح: يعارض هذا الحديث ما روى: إنَّ أوَّل ما خلق الله العقل، إنَّ أوَّل ما خلق الله نوري، إنَّ أول ما خلق الله الروح، إنَّ أول ما خلق الله العرش.
ويجابُ بأنَّ الأولوية من الأمور الإضافية، فيؤوَّل أنَّ كل واحد مما ذكر خلق قبل ما هو من جنسه: فالقلم خلق قبل الأشجار. ونوره عليه الصلاة والسلام قبل الأنوار،
-“ইমাম জায়নুল আরব তাঁর ‘শারহু মাসাবিহ’ গ্রন্থে বলেছেন, এই হাদিস উল্লেখ করা হয় যা বর্ণিত হয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বপ্রথম আকল সৃষ্টি করেছেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম আল্লাহ আমার নূর সৃষ্টি করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বপ্রথম রুহ সৃষ্টি করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বপ্রথম আরশ সৃষ্টি করেছেন।
এই সর্বপ্রথম হওয়ার বিষয়ে জবাব হচ্ছে, প্রত্যেক প্রথমটি তার জিনসের মধ্যে প্রথম বুঝাবে। ফলে কলম সকল গাছের পূর্বে সৃষ্টি বুঝাবে, আর নবী করিম (ﷺ) এর নূর মুবারক সকল নূরের পূর্বে সৃষ্টি।”
হে মুসলীম ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ! এ এক কঠিন মচিবতের জামানা! নবীর দুশমনেরা কিতাব থেকে হাদিস বাদ করে দিচ্ছে স্বার্থের কারণে। এখন আল্লাহ’ই তাঁর নবীর ইজ্জত রক্ষা করবেন, ইহাই সর্বশেষ প্রত্যাশা। এছাড়াও মোট ৫২ জন মোহাদ্দিছ হাদিসখানা তাদের স্ব স্ব কিতাবে উল্লেখ করেছেন। বিশ্ব বিখ্যাত মোহাদ্দিছ আল্লামা ইমাম যুরকানী (رحمة الله) এই হাদিস খানা কিতাবে থাকার বিষয়ে সমর্থন করেছেন, কোন প্রকার সমালোচনা করেননি। সুতরাং এই হাদিস সম্পর্কে আর কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। কারণ ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) এর বহু পূর্বেও ইমামগণ এই হাদিস তাঁদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন এবং বিশ্ব বিখ্যাত ইমামগণের কেউ হাদিসটিকে জাল-মওজু বলেননি, বরং তাঁরা তাঁদের স্ব স্ব কিতাবে নূরে মুহাম্মদীর স্বপক্ষে এই হাদিস দলিল হিসেবে পেশ করেছেন। যেসকল ইমামগণ এই হাদিস উল্লেখ করেছেন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত তালিকা দেওয়া হল:
১. আল্লামা আবুল ফারাজ ইবনে জাওযী (رحمة الله),
২. আল্লামা নববী (رحمة الله),
৩. আল্লামা ইবনে হাজার হায়তামী মক্কী (رحمة الله),
৪. আল্লামা ইমাম ইয়াহইয়া আল আমরী আল হারদ্বী (رحمة الله),
৫. আল্লামা ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله),
৬. আল্লামা ইমাম যুরকানী (رحمة الله),
৭. ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله),
৮. আল্লামা ইমাম দিয়ার বকরী (رحمة الله),
৯. ইমাম আবু সাদ নিছাপুরী খারকুশী (رحمة الله),
১০. আল্লামা ইবনুল হাজ্জ মালেকী (رحمة الله),
১১. ইমাম বদরুদ্দিন আইনী (رحمة الله),
১২. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله),
১৩. আল্লামা ইমাম আজলুনী (رحمة الله),
১৪. আল্লামা শাহ্ অলিউল্লাহ মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله),
১৫. আল্লামা নূরউদ্দিন আলী হালভী (رحمة الله),
১৬. আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী (رحمة الله),
১৭. মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব,
১৮. মাওলানা আব্দুল হাই লাখনবী (رحمة الله) সাহেব, প্রমূখ।
প্রথম সৃষ্টি হচ্ছে ‘নূর’ তারপর অন্ধকার সৃষ্টি হয়েছে। এক কথায় নূরের আগে অন্য কিছু সৃষ্টি করা হয়নি। এ বিষয়ে একাধিক সূত্র বর্ণিত আছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও বিশিষ্ট তাবে-তাবেঈ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ব (رحمة الله) বলেন:
حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ حُمَيْدٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا سَلَمَةُ بْنُ الْفَضْلِ، قَالَ: قَالَ مُحَمَّدُ بْنُ إِسْحَاقَ: كَانَ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: النُّورُ وَالظُّلْمَةُ،
-“ইবনে জারির তাবারী (رحمة الله) মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ব (رحمة الله) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম নূর সৃষ্টি করেছেন এরপর অন্ধকার সৃষ্টি করেছেন।” ২৫২
বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত কাতাদা (رضي الله عنه) এর বক্তব্য:
وَرَوَى سَعِيدٌ عَنْ قَتَادَةَ قَالَ: أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ النُّورُ وَالظُّلْمَةُ، -“সাঈদ হযরত কাতাদা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম নূর সৃষ্টি করেছেন এরপরে অন্ধকার সৃষ্টি করেছেন।” ২৫৩
২৫২. তাফছিরে তাবারী শরীফ, ১ম খন্ড, ৪৬০ পৃ: হাদিস নং ৫৯০; ইমাম আইনী: উমদাতুল ক্বারী, ১০ম খন্ড, ৫৪৩ পৃ:;
২৫৩. তাফছিরে কুরতবী, ২০তম জিল্দ ৬১ পৃ:;
সর্বপ্রথম যে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে তা অন্যভাবে আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেছেন। যেমন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর বক্তব্য শুনুন:
أَخْبَرَنَا أَبُو الْحَسَنِ عَلِيُّ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ سِيمَاءَ الْمُقْرِئُ، قَدِمَ عَلَيْنَا حَاجًّا، حَدَّثَنَا أَبُو سَعِيدٍ الْخَلِيلُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ الْخَلِيلِ الْقَاضِي السِّجْزِيُّ، أَنْبَأَنَا أَبُو الْعَبَّاسِ مُحَمَّدُ بْنُ إِسْحَاقَ الثَّقَفِيُّ، حَدَّثَنَا أَبُو عُبَيْدِ اللهِ يَحْيَى بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ السَّكَنِ، حَدَّثَنَا حَبَّانُ بْنُ هِلَالٍ، حَدَّثَنَا مُبَارَكُ بْنُ فَضَالَةَ، حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللهِ بْنُ عُمَرَ، عَنْ خُبَيْبِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، عَنْ حَفْصِ بْنِ عَاصِمٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: لَمَّا خَلق الله عَزَّ وَجَلَّ آدَمَ خَيَّرَ لِآدَمَ بَنِيهِ، فَجَعَلَ يَرَى فَضَائِلَ بَعْضِهِمْ عَلَى بَعْضٍ، قَالَ: فَرَآنِي نُورًا سَاطِعًا فِي أَسْفَلِهِمْ فَقَالَ يَا رَبِّ! مَنْ هَذَا؟ قَالَ: هَذَا ابْنُكَ أَحْمَدُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخَرُ وَهُوَ أَوَّلُ شَافِعٍ
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: তখন তাঁর (আদম আলায়হিস সালাম এর) সন্তানদেরকে দেখালেন, ফলে তিনি পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিরিক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে তিনি আমাকে অতি উজ্জল নূর রূপে দেখতে পেয়ে বললেন: ওহে রব! এই নূর কে? আল্লাহ তা’লা বলেন: সে তোমার পুত্র আহমদ! সেই প্রথম সৃষ্ট, সেই শেষ, সে প্রথম শাফায়াতকারী ও তারই শাফায়াত প্রথম কবুল করা হবে।” ২৫৪
এই হাদিস সম্পর্কে নাছিরুদ্দিন আলবানী তার কিতাবে বলেন:
قلت: وهذا إسناد حسن؛ رجاله كلهم ثقات رجال البخاري؛ -“আমি (আলবানী) বলছি: এই হাদিসের সনদ হাছান, ইহার সকল বর্ণনাকারীগণ ইমাম বুখারী (رحمة الله) এর বর্ণনাকারী।” ২৫৫
এই হাদিস দ্বারা স্পষ্ট করে প্রমাণিত হয়, রাসূলে করিম (ﷺ) সৃষ্টির প্রথম এবং আদি পিতা হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টি হওয়ার পূর্বেও তিনি নূর অবস্থায় ছিলেন। অতএব, রাসূলে করিম (ﷺ) আদম (عليه السلام) সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহর নূর দ্বারা সৃষ্টি হয়েছেন। কারণ মাটির তৈরী সর্বপ্রথম মানব হলে হযরত আদম (عليه السلام)। এর সমর্থনে আরেকটি হাদিস উল্লেখ করছি, আল্লামা ইমাম ছা’লাভী (رحمة الله) {ওফাত ৪২৭ হিজরী} তদীয় তাফছিরে উল্লেখ করেন,
أخبرنا أبو عثمان سعيد بن محمد بن محمد بن إبراهيم العدل قال: حدّثنا أبو الحسين محمد بن منصور الواعظ قال: حدّثنا أبو عمر محمد بن عبد الواحد الزاهد قال: حدّثنا محمد ابن يونس الكديمي قال: حدّثنا عبيد الله بن عائشة قال: حدّثنا حماد بن سلمة عن ثابت عن أنس قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلّم: أنّ الله تعالى خلقني من نوره.....
-“হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা তাঁর নূর থেকে আমাকে সৃষ্টি করেছেন.....।” ২৫৬
২৫৪. ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়াত, ৫ম খন্ড, ৪৮৩ পৃ: হাদিস নং ২২১৮; ইমাম খারকুশী: শরফুল মুস্তফা, ১ম খন্ড, ৩০৯ পৃ:; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৩২০৫৩; ইমাম ছিয়তী: খাছাইছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ১০২ পৃ:;
২৫৫. আলবানী: সিলছিলায়ে জয়ীফা, হাদিস নং ৬৪৮২;
২৫৬. তাফছিরে ছা’লাভী, ৭ম খন্ড, ১১১ পৃ:;
সএই হাদিসের সনদে হযরত আনাস (رضي الله عنه) সাহাবী। ছাবিত আল বুনানী (رحمة الله) প্রসিদ্ধ বিশ্বস্ত তাবেঈ। ‘হাম্মাদ বিন ছালামা’ ছহীহ্ মুসলীমের রাবী ও বিশ্বস্ত। বর্ণনাকারী ‘উবাইদুল্লাহ ইবনে আয়েশা’ সত্যবাদী ও নির্ভরযোগ্য রাবী। খতিবে বাগদাদী উল্লেখ করেন:
أخبرنا علي بن طلحة المقرئ، أَخبرنا أَبُو الفتح مُحَمَّد بْن إِبْرَاهِيمَ الغازي، أخبرنا محمد بن محمد بن داود الكرجي، أَخْبَرَنَا عبد الرحمن بن يوسف بن خراش قَالَ: عبيد الله بن عائشة صدوق بصري.
-“আব্দুর রহমান ইউছুফ ইবনে খারাশ বলেন, উবাইদুল্লাহ ইবনে আয়েশা সত্যবাদী বছরা নিবাসী।” ২৫৭
ইমাম তুরকিমানী তাকে ثقة ছিক্বাহ বলে উল্লেখ করেছেন। ২৫৮
‘মুহাম্মদ ইবনে ইউছুফ কাদেমী’ এর সম্পূর্ণ নাম হল ‘মুহাম্মদ ইবনে আউনূছ ইবনে মূসা ইবনে সুলাইমান ইবনে উবাইদ’। তার ব্যাপারে কিছু কিছু ইমামের সমালোচনা রয়েছে তবে এক জামাত ইমাম তার উপর নির্ভর করেছেন। যেমন, ইমাম আহমদ প্রথমে তার সমালোচনা করলেও পরবর্তীতে তার উপর নির্ভর করেছেন। ইমাম ছাময়ানীও অনুরুপ। পরবর্তীতে তাকে كان حسن الحديث -“হাছানুল হাদিস বলেছেন। ২৫৯
وقال الخطيب: قد قيل إن موسى بن هارون رجع عن الكلام فيه.
-“খাতিব বলেছেন: বলা হয়, নিশ্চয় ইমাম মূসা ইবনে হারুন (رحمة الله) প্রথমে তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন পরবর্তীতে এই বক্তব্য থেকে ফিরে এসেছেন।” ২৬০
ইমাম যাহাবী বলেন: أحد الضعفاء. -“দুর্বল রাবীদের একজন।” ২৬১
وأما إسْمَاعِيل الخطبيّ فَقَالَ: وَكَانَ ثقة.-“ইসমাঈল খাতাবী বলেছেন: সে বিশ্বস্ত।” ২৬২
২৫৭. তারিখে বাগদাদ, ১০ খন্ড, ৩১৭ পৃ:;
২৫৮. জাওহারুন নকী,৭ম খন্ড, ৩৪০ পৃ:;
২৫৯. ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৪৩৭৭;
২৬০. ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৪৩৭৭;
২৬১. ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৫৩০;
২৬২. ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ৫৩০;
হাফিজ ইরাকী উল্লেখ করেন: وَوَثَّقَهُ الْخَطِيب খাতিব তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন। ২৬৩
ইমাম মানাভী (رحمة الله) দৃষ্টিতে তার বর্ণিত হাদিস ضَعِيف দুর্বল। ২৬৪
বর্ণনাকারী ‘আবু উমর মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহেদ’ ثِقَةٌ ছিক্বহ রাবী। ২৬৫
‘আবুল হাছান মুহাম্মদ ইবনে মানছুর’ সম্পর্কে কাউকে সমালোচনা করতে পাইনি।
বর্ণনাকারী ‘আবু উছমান সাঈদ ইবনে মুহাম্মদ’ প্রসিদ্ধ ثِقَةٌ বিশ্বস্ত রাবী।
অতএব, সার্বিক বিচারে হাদিসটির মান হাছান অথবা দ্বায়িফ। যেটা রাসূলে পাক (ﷺ) এঁর শান মান প্রমাণে যথেষ্ঠ। এ বিষয়ে অনুরূপ আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
عن ابْن عَبَّاس إِن الله عز وَجل خلقني من نوره وَخلق أَبَا بكر من نوري وَخلق عمر من نور أبي بكر وَخلق الْمُؤمنِينَ كلهم من نور عمر غير النَّبِيين وَالْمُرْسلِينَ
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা আমাকে তার নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন। আবু বকর (رضي الله عنه) কে আমার নূর হতে, উমর (رضي الله عنه) কে আবু বকরের নূর হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। সকল মুমীনদেরকে উমরের নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধু নবী-রাসূলগণ ব্যতীত।” ২৬৬
২৬৩. তাখরিজু আহাদিছিল এহইয়া, ১ম খন্ড, ১১৪৯ পৃ:;
২৬৪. ইমাম মানাভী: আত তাইছির, ১ম খন্ড, ২৮১ পৃ:;
২৬৫. ইমাম ছাখাবী: আছ ছিক্বাত মিম্মান লা ইয়াকায়া ফি কুতুবি ছিত্তা, রাবী নং ১০৭৮;
২৬৬. আল ফিরদৌছ, হাদিস নং ৬৪০;
তাই প্রমাণিত হল সর্বপ্রথম সৃষ্টি নূর, যেমন বিশ্ব বিখ্যাত ইমাম ও হাফিজুল হাদিস, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) (ওফাত ৮৫২ হিজরী) বলেছেন ও হিজরী ১১শ শতাব্দির মুজাদ্দিদ, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) {ওফাত ১০১৪ হিজরী} সংকলন করেছেন,
قَالَ ابْنُ حَجَرٍ: اخْتَلَفَتِ الرِّوَايَاتُ فِي أَوَّلِ الْمَخْلُوقَاتِ، وَحَاصِلُهَا كَمَا بَيَّنْتُهَا فِي شَرْحِ شَمَائِلِ التِّرْمِذِيِّ أَنَّ أَوَّلَهَا النُّورُ الَّذِي خُلِقَ مِنْهُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ، ثُمَّ الْمَاءُ، ثُمَّ الْعَرْشُ
-“হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন: প্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে রেওয়ায়েতগুলোর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। এর সার কথা, যেমনটি আমি ‘শরহে শামায়েলে তিরমিজি’ কিতাবে বলেছি, নিশ্চয় এ গুলোর মধ্যে প্রথম সৃষ্টি হল ‘নূর’ যা দ্বারা রাসূলে পাক (ﷺ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর পানি সৃষ্টি করা হয় অতঃপর আরশ সৃষ্টি করা হয়।” ২৬৭। ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১ম খন্ড, ২৪১ পৃ:, ৭৯ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
তাই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম নবী পাক (ﷺ) এর নূর সৃষ্টি করেছেন। এই হাদিসের মুখতাছার রুপটি বিভিন্ন কিতাবে এভাবে উল্লেখ আছে,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أول مَا خلق الله نوري -“নবী করিম (ﷺ) বলেন: আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন।”
তাফছিরে রুহুল মায়ানী, [আল্লামা আবুল আলুছি আল বাগদাদী হানাফী (رحمة الله) কৃত:] ৮ম খন্ড ৪২৪ পৃ:; ১ম খন্ড, ৯০ পৃ:।
কাশফুল খাফা, ১ম খন্ড ৩১১ পৃ:; (ইমাম আজলুনী)
মেরকাত শরহে মেসকাত, ১ম খন্ড, ২৭০ পৃ:; (ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী)
তাফছিরে রুহুল বয়ান, [আল্লামা ইমাম ইসমাঈল হাক্কী (رحمة الله) কৃত:] ২য় খন্ড, ৪২৯ পৃ:।
তাফছিরে মাআরেফুল কোরআন, [আল্লামা মুফ্তী শফী (رحمة الله) কৃত:] সূরা আনআমের শেষের দিকে।
মাদারেজুন্নবুয়ত, [আল্লামা শেখ আব্দুল হক্ব মোহাদ্দেস দেহলভী (رحمة الله)] ১ম খন্ড, ৭ পৃ:।
তাফছিরে নিছাফুরী,وَجِئْنا بِكَ عَلى هؤُلاءِ شَهِيداً এই আয়াতের তাফছিরে।
ছিররুল আছরার, [কৃত: গাউছে পাক আব্দুল কাদের জিলানী (رضي الله عنه)] ৪৮ পৃ:;
হিজরী ১০ম শতকের মুজাদ্দেদ, ভারত উপ-মহাদেশে যিনি সর্বপ্রথম জাহাজ দিয়ে হাদিসের কিতাব এনেছেন তিনি হলেন “মারকাজুল আসানিদ আল্লামা শায়েখ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দেছ দেহলভী (رضي الله عنه)” এই হাদিসকে বিশুদ্ধ বলে অভিমত পেশ করেছেন। (মাদারেজুন্নবুয়্যাত, ১ম খন্ড)।
এর সহযোগী হিসেবে আরেকটি হাদিস উল্লেখ করা যায়,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَا مِنْ نُورِ اللَّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ فيض نورى
-“আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: আমি আল্লাহর নূরে সৃষ্ট আর মু’মীনগণ আমার নূরের ফয়েজ থেকে সৃষ্টি।” ২৬৮
অনুরূপ আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
عن عبد الله بن جراد قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم خلقت انا من نور الله وخلق من نورى
-“হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) বলেছেন: আমি আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্টি এবং সৃষ্টিজগৎ আমার নূর থেকে সৃষ্টি।” ২৬৯
হাদিসটি উল্লেখ করে ইমাম ছাখাবী (رحمة الله), ইমাম আজলুনী (رحمة الله), ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) লিখেন:
وَقَالَ السَّخَاوِيُّ هُوَ عِنْدَ الدَّيْلَمِيِّ بِلَا إِسْنَادٍ عَنْ عَبْدِ بْنِ جَرَادٍ مَرْفُوعًا أَنَا مِنَ اللَّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ مِنِّي
-“ইমাম ছাখাবী (رحمة الله) বলেন: এই হাদিস ইমাম দায়লামী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে সনদবিহীন এভাবে উল্লেখ করেছেন: ‘আমি আল্লাহ (নূর) হতে আর সকল কিছু আমার (নূর) হতে।” ২৭০
২৬৮. ইসমাঈল হাক্বী: তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৯ম খন্ড, ৬৩ পৃ:; গাওছ পাক: ছিররুল আছরার, ৪৯ পৃ:;
২৬৯. মাতায়েলুল মুর্ছারাত শরহে দালায়েলুল খয়রাত; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ২য় খন্ড, ৩৭১, ৪২৯ পৃ:; ৪র্থ খন্ড, ২৪১ পৃ:; ছেররুল আছরার, ৪৯ পৃ:; মওজুয়াতুল কবীর, ৪০ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: মওজুয়াতুল কোবরা, ৭২ পৃ:; ইমাম আজলুনী: কাশফুল খফা, ১ম খন্ড, ১৮৫ পৃ:; ইমাম ছাখাবী: মাকাছিদুল হাছানা, ৯৮ পৃ:;
২৭০. ইমাম আজলুনী: কাশফুল খফা, ১ম খন্ড, ১৮৬ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: মওজুয়াতুল কোবরা, ৭২ পৃ:; ইমাম ছাখাবী: মাকাছিদুল হাছানা, ৯৮ পৃ:;
তাই ইমাম দায়লামী (رحمة الله) প্রতি আস্থা রেখে ও অন্যান্য হাদিসের সমার্থক হিসেবে হাদিসটি গ্রহণ করা যায়, কেননা বুখারী শরীফেও এরূপ অনেক সনদবিহীন “তা’লিক হাদিস” রয়েছে যে গুলোকে মুছান্নিফের উপর নির্ভর করে গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম আসকালানী (رحمة الله) কিযব বললেও ইমাম শামছুদ্দিন ছাখাবী (رحمة الله) এই হাদিস সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন,
وقال بعض الحفاظ: لا يعرف هذا اللفظ مرفوعا، لكن ثبت في الكتاب والسنة أن المؤمنين بعضهم من بعض، وفي السنة قوله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لحي الأشعريين: هم مني، وأنا منهم. وقوله لعلي: أنت مني، وأنا منك. وللحسين: هذا مني، وأنا منه. وكله صحيح.
-“কোন কোন হাফিজ বলেছেন, ইহা মারফূভাবে জানা যায়না কিন্তু কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারা ইহা প্রমাণিত আছে। নিশ্চয় মু’মীনগণ এক অপর থেকেই। সুন্নাহ’র মধ্যে রয়েছে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আশয়ারীদের সম্পর্কে বলেছেন: তারা আমার থেকে আমি তাদের থেকে। হযরত আলী (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলেছেন, তুমি আমার থেকে আমি তোমার থেকে। হযরত হুসাইন (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলেছেন, সে আমার থেকে আমি তার থেকে। প্রতিটি রেওয়ায়েত ছহীহ্।” ২৭১
অনুরূপ ইমাম আজলুনী (رحمة الله) বলেছেন,
وقال بعض الحفاظ: لا يعرف بهذا اللفظ مرفوعا بل الذي ثبت في الكتاب والسنة
-“কোন কোন হাফিজ বলেছেন: মারফ‚ভাবে এই হাদিস জানিনা। বরং ইহা পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত।” ২৭২
২৭১. ইমাম ছাখাবী: মাকাছিদুল হাছানা, ৯৮ পৃ:;
২৭২ইমাম আজলুনী: কাশফুল খাফা, ১ম খন্ড, ১৮৬ পৃ:;
উল্লেখিত হাদিস সমূহ দ্বারা প্রমাণ হয়, আল্লাহর নূর থেকে রাসূল (ﷺ) সৃষ্টি এবং আরশ-কুরছী, লওহ-ক্বলম, আসমান-জমীন, জান্নাত-জাহান্নাম সব কিছুই নবী পাক (ﷺ) এর নূরে সৃষ্ট।
❏ আদম সৃষ্টির ১৪ হাজার বছর পূর্বেই তিনি নূর ছিলেন
বিভিন্ন রেওয়ায়েত থেকে জানা যায়, আল্লাহর হাবীব রাসূলে পাক (ﷺ) আল্লাহর দরবারে হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টি হওয়ার ১৪ হাজার কিংবা ১ হাজার বছর পূর্বেই নূর হিসেবে ছিলেন। আর একথা সকলেই অবগত আছেন যে, পৃথিবীর ৫০ হাজার বছর অথবা ১ হাজার বছর সমান আখেরাতের মাত্র একদিন। চিন্তুা করুন! রাসূল করিম (ﷺ) আদম (عليه السلام) সৃষ্টি হওয়ার কত পূর্ব থেকেই নূর হিসেবে ছিলেন। স্বীয় সনদে এভাবে ইমাম বুখারী (رحمة الله) এর উস্তাদ ইমাম আহ্মদ (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন,
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ قثنا أَحْمَدُ بْنُ الْمِقْدَامِ الْعِجْلِيُّ قثنا الْفُضَيْلُ بْنُ عِيَاضٍ قثنا ثَوْرُ بْنُ يَزِيدَ، عَنْ خَالِدِ بْنِ مَعْدَانَ، عَنْ زَاذَانَ، عَنْ سَلْمَانَ قَالَ: سَمِعْتُ حَبِيبِي رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: كُنَّا أَنَا وَعَلِيٌّ نُورًا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ آدَمَ بِأَرْبَعَةَ عَشَرَ أَلْفَ عَامٍ، فَلَمَّا خَلَقَ اللَّهُ آدَمَ قَسَمَ ذَلِكَ النُّورَ جُزْءَيْنِ، فَجُزْءٌ أَنَا، وَجُزْءٌ عَلِيٌّ عَلَيْهِ السَّلَامُ
-“হযরত ছালমান ফারছী (رضي الله عنه) বলেন, আমার প্রিয় হাবীব রাসূলে পাক (ﷺ) কে বলতে শুনেছি: আমি ও আলী হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির ১৪ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহর কাছে নূর হিসেবে ছিলাম। যখন আল্লাহ পাক আদম (عليه السلام) কে সৃষ্টি করলেন তখন ঐ নূরকে দুইটি ভাগে ভাগ করলেন। একটি হলো আমি এবং আরেকটি অংশ হল হযরত আলী (عليه السلام)।” ২৭৩
এই হাদিসের রাবী زاذان أبو عبد الله ‘জাযান আবু আব্দিল্লাহ’ একজন বিশিষ্ট তাবেঈ। তার থেকে ইমাম মুসলীম (رحمة الله) তার ছহীহ্ গ্রন্থে হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং তাকে ইমাম ইবনে মাঈন, ইবনে সাদ, ইমাম ইজলী, ইবনে হিব্বান ও খতিবে বাগদাদী (رحمة الله) বিশ্বস্ত বলেছেন। ইমাম ইবনে আদী বলেন: আমি তার ব্যাপারে কোন অসুবিধা দেখিনা। ২৭৪
২৭৩. ইমাম আহমদ: ফাদ্বাইলে সাহাবা, ২য় খন্ড, হাদিস নং ১১৩০;
২৭৪. ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৫৬৫;
বর্ণনাকারী ‘খালিদ ইবনে মাদান’ বুখারী-মুসলীমের রাবী। ‘ছাওর ইবনু ইয়াজিদ’ ছহীহ্ বুখারীর রাবী ও ইমামদের সকলেই তাকে বিশ্বস্ত সত্যবাদী বলেছেন। ‘ফুদ্বাইল ইবনে আয়্যাদ’ বুখারী-মুসলীমের রাবী। বর্ণনাকারী ‘আহমদ ইবনে মিকদাম আল ইজলী’ ছহীহ্ বুখারীর রাবী এবং ইমাম সকলেই তার উপর নির্ভর করেছেন ও বিশ্বস্ত বলেছেন।
ইহার সনদে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رحمة الله) এর শায়েখ ‘হাছান’ রয়েছে। যার পূর্ণ নাম الْحَسَنُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ زَكَرِيَّا بْنِ صَالِحٍ، أبو سَعِيدٍ الْبَصْرِيُّ الْعَدَوِيُّ ‘হাছান ইবনে আলী ইবনে যাকারিয়া ইবনে ছালেহ আবু সাঈদ বাছরী আদাবী’। ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله) তার ব্যাপারে কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইমাম দারা কুতনী (رحمة الله) তাকে مَتْرُوك মাতরুক বলেছেন। তবে অনেকে তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন। যেমন-
وقال مسلمة بن قاسم كان أبو خليفة يصدقه في روايته ويوثقه -“ইমাম মাসলামাহ ইবনু কাশেম বলেছেন: আবু খালিফা (رحمة الله) তার রেওয়ায়েতের মধ্যে এই রাবীকে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত বলেছেন।” ২৭৫
আল্লামা আবুল ফিদা যায়নুদ্দিন কাশেম কুতলুবুগা রঃ ওফাত ৮৭৯ হিজরী এবং পরবর্তীতে ইমাম ছাখাবী রঃ ওফাত ৯০২ হিজরী বলেছেন,
قال مسلمة: كان أبو خليفة يُصَدِّقُهُ في روايته ويوثقه. قلت: وهو متروك، ذكرته لهذا
-“ইমাম মাসলামাহ ইবনু কাশেম বলেছেন: আবু খালিফা (رحمة الله) তার রেওয়ায়েতের মধ্যে এই রাবীকে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত বলেছেন। আমি (ছাখাবী) বলি: সে মাতরুক রাবী, এ কারণেই ইহাকে উল্লেখ করেছি।” ২৭৬
ইমাম আবু ইয়ালা খালিলী রঃ ওফাত ৪৪৬ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন,
الْحَسَنُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ زَكَرِيَّا الْعَدَوِيُّ الضَّعِيفُ -“হাছান ইবনু আলী ইবনে জাকারিয়া আদাবী জয়ীফ রাবী।” ২৭৭
২৭৫. ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ৯৮৭; ইমাম ছাখাবী: ছিক্বাত মিম্মান লা ইয়াকায়া ফি কুতুবি ছিত্তাহ, রাবী নং ২৮২৫;
২৭৬. ছিক্বাত মিম্মান লা ইয়াকাআ ফি কুতুবি ছিত্তাহ, রাবী নং ২৮২৫;
২৭৭. আল ইরশাদু ফি মারিফাতি উলামাইল হাদিস, ২য় খন্ড, ৫৩০ পৃ:;
বিখ্যাত আসমাউর রিজালবিদ ইমাম মিযযী (رحمة الله) বলেন,
وأبو سَعِيد الْحَسَن بْن عَلِيّ بْن صالح بْن زكريا العدوي أحد الضعفاء المتروكين، وحكيم بْن يحيى المتوثي
-“আবু সাঈদ হাছান ইবনু আলী ইবনে জাকারিয়া আদাবী জয়ীফ ও মাতরুকদের একজন।” ২৭৮
হাফিজুল হাদিস, ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী বলেছেন,
وأبو سعيد العدوي المتروك -“আবু সাঈদ আদাবী মাতরুক।” ২৭৯
এই দৃষ্টিকোন থেকে হাদিসটির সর্বনিম্ন স্তর হবে জয়ীফ।
উসূল মোতাবেক সনদে কোনো একজন বর্ণনাকারী মুনকার, অথবা মুদ্ত্বরাব অথবা মাতরুক থাকলে সে হাদিসকে জাল বলা হবে না।
বর্তমান আহলে হাদিসগণ খুবই ফিতনা ছড়াচ্ছে যে হাদিসের সনদে কোন রাবীর ব্যাপারে যদি মুনকার, মাতরুক ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয় তাহলে তা তাদের দৃষ্টিতে জাল হাদিস হিসেবে গণ্য। অথচ এটি হচ্ছে তাদের মনগড়া নীতিমালা। সকল মুহাদ্দিছগণই বলেছেন সনদের একজন রাবীর প্রতি উপরের বর্ণিত দুর্বলতার ইঙ্গিত দ্বারা সনদটি দ্বায়িফ হবে কিন্তু জাল নয়। যেমন নিচের কয়েকটি মূল নীতি লক্ষ্য করুন,
ক. (সনদ মুনকার হওয়া): এ বিষয়ে ইমাম জালালুদ্দীন ছিয়তী (ৎ) বলেন-
المنكر نوع اخر غير الموضوع وهو قسم الضعيف-التعقبات:৭৩-باب :الاطعمة
-“সর্বসম্মত অভিমত হলো মুনকার সনদ জাল হাদিসের প্রকার নয়, বরং দ্বঈফ হাদিসের প্রকার।’’ ২৮০
ইমাম ছিয়তী (ৎ) তার এ কিতাবের অন্যস্থানে বলেন,
صرح ابن عدى بأن الحديث منكر فليس بموضوع-التعقبات:৬২
-“এটা সুস্পষ্ট কথা ইমাম ইবনু আদী (ৎ) বলেছেন মুনকার সনদের হাদিস জাল নয়।’’ ২৮১
২৭৮. ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ১২৪৬ এর ব্যাখ্যায়;
২৭৯. ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, ৫২৬ নং রাবীর ব্যাখ্যায়;
২৮০. সুয়ূতি, তা‘আকিবাত ‘আলাল মাওদ্বুআত, ৩৭ পৃ.;
২৮১. ছিয়তী, তা‘কিবাত, ৬২ পৃষ্ঠা
আল্লামা ইবনুল র্আরাক কেনানী (৯৬৩ হি.) এ বিষয়ে লিখেন-
وَالْمُنكر من قسم الضَّعِيف وَهُوَ مُحْتَمل فِي الْفَضَائِل.
-“হাদিসের সনদ মুনকার হওয়া দ্বঈফ হওয়ার অর্ন্তভুক্ত, তবে ফাযায়েলে আমলের ক্ষেত্রে তা দলিল হওয়ার সম্ভবনা রাখে।’’ ২৮২
অতএব, এই হাদিস ইমাম ইবনে মারজুক (رحمة الله) ও ইমাম মুসলীম (رحمة الله) এর উস্তাদের রেওয়ায়েতের সাথে সাদৃশ্য বিধায় প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর মর্যাদা প্রমাণে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে। কেননা একই বিষয়ে একাধিক সনদ থাকলে ইহা হাছানের স্তরে পৌছে যায়।
হিজরী ১১শ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, বিখ্যাত উসূলে হাদিসবিদ (যিনি উসূলে হাদিসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ নুখবাতুল ফিকরের শরাহ করেছেন), হানাফী বিখ্যাত ফকিহ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী () লিখেন-
وَتَعَدُّدُ الطُّرُقِ يُبْلِغُ الْحَدِيثَ الضَّعِيفَ إِلَى حَدِّ الْحَسَنِ
-“দ্বঈফ হাদিসও একাধিক সনদে বর্ণিত হলে “হাছান” হাদিস এর পর্যায়ে পৌঁছে যায়।’’ ২৮৩
সুবহানাল্লাহ! দেখুন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির ১৪ অথবা হাজার বছর পূর্বেও নূরের অবস্থায় ছিলেন। এখানে ১৪ হাজার বছর পৃথিবীর হিসেবে নয় বরং আল্লাহর হিসেবে। আল্লাহর হিসেবে একদিন পৃথিবীর হিসেবে ১ হাজার বছর, অথবা আরেক বর্ণনায় আছে ১দিন সমান ৫০ হাজার বছর। এই হাদিসে প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর সাথে হযরত আলী (رضي الله عنه) এর কথাও রয়েছে, কারণ মাওলায়ে আলী (رضي الله عنه) হলেন পাক পাঞ্জাতনের অংশ। যেমন হাদিস শরীফে আছে,
أَخْبَرَنَا أَحْمَدُ بْنُ سُلَيْمَانَ قَالَ: حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ آدَمَ قَالَ: حَدَّثَنَا إِسْرَائِيلُ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ قَالَ: حَدَّثَنِي حَبَشِيُّ بْنُ جُنَادَةَ السَّلُولِيُّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: عَلِيٌّ مِنِّي، وَأَنَا مِنْهُ،
-“হাবাসী ইবনে জুনাদা ছালুলী (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: আলী আমার থেকে আমি তার থেকে।” ২৮৪
২৮২. তানযিহুশ শরিয়াহ, ২/৫০ পৃ.;
২৮৩. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাত : ৩/৭৭ পৃ. হা/১০০৮
২৮৪. ইমাম নাসাঈ: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ৮০৯১; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৭৫১১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১১৯; ইমাম তাবারানী: মুজামুল কবীর, হাদিস নং ৩৫১১; মুসনাদে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদিস নং ৮৪৪
অর্থাৎ আহলে বাইতের সবাই নবীর অংশ। যেমন এ বিষয়ে ইমাম আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল মালেক হিমইয়ারী আল মারুফ আবুল হাছান ইবনে কাত্তান (رحمة الله) ওফাত ৬২৮ হিজরী তদীয় ‘কিতাবুল আহকাম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন,
عن علي بن الحسين عن أبيه عن جده أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: كنت نورًا بين يدي ربي قبل خلق آدم بأربعة عشر ألف عام
-“হযরত আলী ইবনে হুছাইন ইবনে আলী (رضي الله عنه) তাঁর পিতা ও দাদা সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: আমি হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির ১৪ হাজার বছর পূর্বেই আল্লাহর কাছে নূর হিসেবে বিদ্যমান ছিলাম।” ২৮৫
ইমাম আজলুনী, ইমাম ইবনে ছালেহী, ইমাম কাস্তালানী ও ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) সকলেই এভাবে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন:
وفي أحكام ابن القطان فيما ذكره ابن مرزوق عن علي بن الحسين عن أبيه عن جده أن النبي صلى الله عليه وسلم قال...
-“ইবনে কাত্তান তার আহকাম গ্রন্থে উল্লেখ করেন, যা ইবনে মারজুক (رحمة الله) হযরত আলী ইবনে হুছাইন (رضي الله عنه) এর পিতা ও দাদার সূত্রে উল্লেখ করেছেন।” ২৮৬
হাদিসটি মূলত ইমাম ইবনে মারজুক (رحمة الله) এর কিতাবে সনদসহ রয়েছে। ইবনে মারজুক (رحمة الله) এর সম্পূর্ণ নাম হল:أَحْمَدُ بنُ مُحَمَّدِ بنِ القَاسِمِ المِصْرِيُّ “আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে কাশেম আল মিছরী র:”। তিনি ابْنُ مَرْزُوْقٍ ইবনে মারজুক (رحمة الله) নামে প্রসিদ্ধ। তিনার ইন্তেকাল ৪১৮ হিজরী। ২৮৭
২৮৫. ইমাম ইবনে কাত্তান: কিতাবুল আহকাম, ১ম খন্ড, ১৪২ পৃ;; শরফুল মোস্তফা, ১ম খন্ড, ৩০৮ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৭২ পৃ:; ইমাম যুরকানী: শরহে মাওয়াহেব, ১ম খন্ড, ১৯৫ পৃ:; আনওয়ারে মুহাম্মদিয়া; কাশফুল খফা, ১ম খন্ড, ২৩৮ পৃ:; সিরাতে হলবিয়া, ১ম খন্ড, ৪৭ পৃ:; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ২য় খন্ড, ৪২৯ পৃ:; নশরুত্বিব, ২৬ পৃ:; জিকরে হাসীন, ৩০ পৃ:
ইমাম আজলুনী: কাশফুল খাফা; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৯৪ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৬৯ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: আল মাওরিদুর রাবী;
২৮৬. ইমাম যাহাবী: সিয়ারে আলামিন নুবালা, রাবী নং ২৫৬;
২৮৬. ইমাম আযরী: আশ শারিয়াত, হাদিস নং ৯৬০;
হাদিসটি ইমাম আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে হুছাইন আযরী বাগদাদী (رحمة الله) ওফাত ৩৬০ হিজরী তদীয় কিতাবে বর্ণনা করেন,
أَنْبَأَنَا أَبُو مُحَمَّدٍ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ صَالِحٍ الْبُخَارِيُّ قَالَ: ثنا مُحَمَّدُ بْنُ أَبِي عُمَرَ الْعَدَنِيُّ قَالَ: حَدَّثَنِي عُمَرُ بْنُ خَالِدٍ قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو عَبْدِ اللَّهِ مُحَمَّدٌ الْحَلَبِيُّ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الْفُرَاتِ عَنْ عُثْمَانَ بْنِ الضَّحَّاكِ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَنَّ قُرَيْشًا كَانَتْ نُورًا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ آدَمَ بِأَلْفَيْ عَامٍ يُسَبِّحُ ذَلِكَ النُّورُ وَتُسَبِّحُ الْمَلَائِكَةُ بِتَسْبِيحِهِ
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় কুরাইশ আল্লাহ তা’লার কাছে হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির দুই হাজার বছর পূর্বেও নূর হিসেবে ছিলেন। এই নূর আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করছিলেন এবং ফেরেস্তারাও তিনার তাসবীহের সাথে তাসবীহ পাঠ করেছিলেন।” ২৮৮
এই হাদিসে সুরাইশ বলতে প্রিয় নবীজি (ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে। কেননা প্রিয় নবীজি (ﷺ) ছিলেন কুরাইশী। এই হাদিসটির আরেকটি সূত্রের কথা উল্লেখ করেছেন ইমাম ইবনে ছালেহী শামী (رحمة الله) ও ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) তদীয় স্ব স্ব কিতাবে,
وروى الحافظ محمد بن عمر العدني شيخ مسلم في مسنده عن ابن عباس رضي الله عنهما أن قريشاً أي المسعدة بالإسلام كانت نوراً بين يدي الله تعالى قبل أن يخلق آدم بألفي عام يسبّح ذلك النور وتسبّح الملائكة بتسبيحه.
-“ইমাম মুসলীম (رحمة الله) এর শায়েখ ইমাম হাফিজ মুহাম্মদ ইবনে উমর আদানী (رحمة الله) তদীয় মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় কুরাইশ আল্লাহ তা’লার কাছে হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির দুই হাজার বছর পূর্বেও নূর হিসেবে ছিলেন। এই নূর আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করছিলেন এবং ফেরেস্তারাও তিনার তাসবীহের সাথে তাসবীহ পাঠ করেছিলেন।” ২৮৯
২৮৮. ইমাম আযরী: আশ শারিয়াত, হাদিস নং ৯৬০;
২৮৯. ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৬৯ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছাইছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ৬৬ পৃ:;
কোন কোন কিতাবে আছে كانت روحه তবে ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী বলেন: وفي أكثر النسخ أن قريشا -“অধিকাংশ নূছখায় রয়েছে কুরাইশ।” ২৯০
এই হাদিস উল্লেখ করে ইমাম ইবনে ছালেহী শামী (رحمة الله) উল্লেখ করেন,
قال ابن القطّان: فيجتمع من هذا مع ما في حديث عليّ: أن النور النبوي جسّم بعد خلقه باثني عشر ألف عام وزيد فيه سائر قريش وأنطق بالتسبيح.
-“ইমাম ইবনে কাত্তান (رحمة الله) বলেছেন: হযরত আলী (رضي الله عنه) এর বর্ণিত হাদিসে যা রয়েছে ইহার সাথে সকল হাদিস একত্রিত করে বুঝা যায়, নিশ্চয় নবী করিম (ﷺ) এঁর নূর মুবারক তিনার সৃষ্টির ১২শ বৎসর পরে শারিরীকভাবে রুপ লাভ করেন। ফলে কুরাইশদের মাঝে ইহা বিচরন লাভ করে ও তাসবীহ পাঠ করেন।” ২৯১
ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) বলেন,
(قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ آدَمَ بِأَلْفَيْ عَامٍ يُسَبِّحُ ذلك النّور) أي قبل عالم الظهور
-“হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির দুই হাজার বছর পূর্বেও নূর তাসবীহ পাঠ করছিলেন। অর্থাৎ আলম বা জগৎ প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে।” ২৯২
আল্লামা হুছাইন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাছান দিয়ারবকরী (رحمة الله) {ওফাত ৯৬৬ হিজরী} তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ كنت نُورًا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ تَعَالَى، قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ آدَمَ بِأَلْفَيْ عَامٍ،
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, প্রিয় নবীজি (ﷺ) বলেছেন: আমি আদম (عليه السلام) সৃষ্টির দুই হাজার বছর পূর্বেও আল্লাহর কাছে নূর হিসেবে ছিলাম।” ২৯৩
২৯০. ইমাম মোল্লা আলী: শরহে শিফা, ১ম খন্ড, ২০৬ পৃ:;
২৯১. ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৬৯ ও ৭০ পৃ:; ইমাম যুরকানী: শরহে মাওয়াহেব১ম খন্ড, ৯৬ পৃ:;
২৯২. ইমাম মোল্লা আলী: শরহে শিফা, ১ম খন্ড, ২০৬ পৃ:;
২৯৩.তারিখুল খামিছ, ১ম খন্ড, ২১ পৃ:;
হাদিসটি অন্যান্য কিতাবে এভাবেও রয়েছে,
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَانَتْ رُوحُهُ نُورًا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ تَعَالَى، قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ آدَمَ بِأَلْفَيْ عَامٍ،
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর রুহ মোবারক আল্লাহর কাছে আদম (عليه السلام) সৃষ্টির দুই হাজার বছর পূর্বে নূর হিসেবে ছিলেন।” ২৯৪
এই হাদিস গুলো দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণ হয়, আদি পিতা হযরত আদম (عليه السلام) এর সৃষ্টির দুই হাজার বছর পূর্বেই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) নূর হিসেবে ছিলেন। মাটির তৈরী প্রথম মানুষ হল হযরত আদম (عليه السلام), আর সেই আদম (عليه السلام) সৃষ্টির বহুকাল পূর্বে নূর হিসেবে সৃষ্টি ছিলেন।
শারিহে বুখারী আল্লামা ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) আরেকটি হাদিস উল্লেখ করেন, আলমে আরওয়াহ এর জগতে হযরত আদম (عليه السلام) এর সামনে সকলের রুহ উপস্থিত করার পরে একজন নূরে খুব চমকাচ্ছিল। তখন বাবা আদম (عليه السلام) জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহ ঐ লোকটি কে? এর জবাবে আল্লাহ তা’লা বলেন:
هذا نور نبى من ذريتك اسمه فى السماء أحمد، وفى الأرض محمد، لولاه ما خلقتك ولا خلقت سماء ولا أرضا
-“তিনি নূরের নবী তোমার বংশধরের একজন, আসমান জগতে তাঁর নাম আহমদ এবং জমীনে তাঁর নাম মুহাম্মদ। আমি যদি তাঁকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে তোমাকেও বানাইতাম না, এমনকি আসমান-জমীনও বানাইতাম না।” ২৯৫
২৯৪. কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ১ম জি: ১৮২ পৃ:; সিরাতে হালভিয়া, ১ম খন্ড, ৪৬ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৬৯ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ৬৬ পৃ:; শরফুল মুস্তফা, ১ম খন্ড, ৩০৪ পৃ:;
২৯৫. ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৭০ পৃ:; শরহে যুরকানী, ১ম খন্ড, ৮৬ পৃ:;
এই হাদিসে স্পষ্ট বলা আছে,هذا نور نبى (হাজা নূরুন নবী) তথা ইহা নূরের নবী। স্বয়ং আল্লাহ তা’লা এরূপ কথা বলেছেন। সুতরাং আদম (عليه السلام) সৃষ্টির পূর্বেই হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) নূরের সৃষ্টি নবী ছিলেন।
❏ রাসূল (ﷺ) পৃথিবীতে নূর হয়েই এসেছেন
হুজুর পুরনূর (ﷺ) যখন মা আমেনা (رضي الله عنه) এর গর্ভ থেকে পৃথিবীতে আগমন করেন, তখনই রাসূল (ﷺ) নূর হয়ে এসছেন বলে একাধিক ছহীহ্ হাদিস থেকে জানা যায়। এমনকি ঐ সময় রাসূল (ﷺ) কে নূর হিসেবেই মা আমেনা তাঁর চর্ম চক্ষু দ্বারা দেখেছেন এবং ঐ নূরে শাম দেশের বড় বড় অট্টালিকা গুলোও আলোকিত হয়েছিল (সুবহানাল্লাহ)। এ সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। প্রথমেই এ বিষয়ে একটি ছহীহ্ রেওয়ায়েত উল্লেখ করছি,
حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ صَالِحِ بْنِ هَانِئٍ، ثنا أَبُو سَهْلٍ بِشْرُ بْنُ سَهْلٍ اللَّبَّادُ، ثنا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ صَالِحٍ الْمِصْرِيُّ، حَدَّثَنِي مُعَاوِيَةُ بْنُ صَالِحٍ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ سُوَيْدٍ، عَنْ عَبْدِ الْأَعْلَى بْنِ هِلَالٍ، عَنْ عِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ، صَاحِبِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وآله وَسَلَّمَ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وآله وَسَلَّمَ، يَقُولُ: إِنِّي عَبْدُ اللهِ وَخَاتَمُ النَّبِيِّينَ... وإن أم رسول الله صلى الله عليه وآله وَسَلَّمَ رَأَتْ حِينَ وَضَعَتْهُ نُورًا أَضَاءَتْ لَهُ قُصُورُ الشَّامِ
-“হযরত ইরবাজ ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূলে পাক (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, আমি আল্লাহর বান্দাহ্ এবং শেষ নবী।...... নিশ্চয় রাসূল (ﷺ) এর যখন তাঁকে আগমন করেন তখন দেখেছেন নূর বের হচ্ছে, ফলে শাম দেশের বড় অট্টালিকা গুলো আলোকিত হয়ে গেছে।” ২৯৬
এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম হাকেম (رحمة الله) ও ইমাম যাহাবী (رحمة الله) বলেছেন, هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ -“এই হাদিসের সনদ ছহীহ্।” ২৯৭
২৯৬. মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪র্থ খন্ড, ১৪৭৫ পৃ: হাদিস নং ৩৫৬৬; তিরমিজি শরীফ, ২য় জি: ২০৩ পৃ:; মাদারেজুন্নবুয়্যাত, ১ম খন্ড ৭ পৃ:; মেসকাত শরীফ, ৫১৩ পৃ:; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ১৩২২; ইমাম তাবারানী: মুসনাদে শামেঈন, হাদিস নং ১৯৩৯; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১০ম খন্ড, ৪৩৯ পৃ:; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়্যাত, ২য় খন্ড, ৯০ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৭২ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৭১৫১; ইমাম তাবারানী: মুজামুল কবীরে ও মুজামুল আওছাতে, ৩য় খন্ড, ১৫৮ পৃ:; ইমাম বাগভী: শরহে সুন্নাহ, ১ম খন্ড, ২০৭ পৃ:;
২৯৭. মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪র্থ খন্ড, ১৪৭৫ পৃ: হাদিস নং ৩৫৬৬;
এই হাদিস সম্পর্কে হাফিজুল হাদিস ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন,
أخرجه أحمد وصححه بن حبان والحاكم وفي حديث أبي أمامة عند أحمد نحوه
-“ইমাম আহমদ (رحمة الله) ইহা বর্ণনা করেছেন, ইবনে হিব্বান (رحمة الله) ও ইমাম হাকেম (رحمة الله) হাদিসটিকে ছহীহ্ বলেছেন। হযরত আবু উমামা (رضي الله عنه) থেকেও অনুরূপ হাদিস বর্ণিত রয়েছে।” ২৯৮
এই হাদিস সম্পর্কে দালায়েলুন্নবুয়াত কিতাবের হাশিয়ায় আছে,
إِسْنَادَهُ صَحِيحٌ -“এই হাদিসের সনদ ছহীহ্।” এমনকি কুখ্যাত নাছিরুদ্দিন আলবানীও হাদিসটিকে صَحِيحٌ ছহীহ্ বলেছেন। ২৯৯
এই হাদিস সম্পর্কে আল্লামা ইমাম হায়ছামী (رحمة الله) বলেন,
وَأَحَدُ أَسَانِيدِ أَحْمَدَ رِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيحِ، غَيْرَ سَعِيدِ بْنِ سُوِيدٍ وَقَدْ وَثَّقَهُ ابْنُ حِبَّانَ.
-“ইমাম আহমদ (رحمة الله) এর একটি সনদের সকল রাবীগণ বিশুদ্ধ, তবে সাঈদ ইবনে সুয়াইদ’ ব্যতীত। অবশ্যই ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন।” ৩০০
এখানে ‘সাঈদ ইবনে সুয়াইদ’ হচ্ছে سَعِيد بْن سُويد، الكَلبيّ ‘সাঈদ ইবনে সুয়াইদ কালবী’। ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। ৩০১
২৯৮. ইমাম আসকালানী: ফাতহুল বারী শরহে বুখারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৫৮৩ পৃ: ‘আলামাতে নবুয়াত ফিল ইসলাম’ বাবে;
২৯৯. তা’লিকাত হাছান ছহীহ্ ইবনে হিব্বান;
৩০০. ইমাম হায়ছামী: মজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ১৩৮৪৭;
৩০১ইমাম ইবনে হিব্বান: কিতাবুছ ছিক্বাত: রাবী নং ৮১০৭;
ইমাম বুখারী (رحمة الله) سَعِيد بْن سُويد، الكَلبيّ সম্পর্কে ‘তারিখুল কবীরে’ (রাবী নং ১৫৯৩) কোন সমালোচনা করেননি। বরং তার পরবর্তী سَعِيد بْن سُويد নামে আরেকজন রাবী রয়েছে (রাবী নং ১৫৯৪) তার সম্পর্কে তিনি বলেছেন:ولا يُتابَعُ عليه. -“তার অনুস্বরণ করা যাবেনা। দুঃখের বিষয় হল, অনেকে ভুল ব:শত ‘সাঈদ ইবনে সুয়াইদ’ এর অভিযোগ ‘সাঈদ ইবনে সুয়াইদ কালবী’ এর উপর বর্তাচ্ছেন। ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন: ‘সাঈদ ইবনে সুয়াইদ কালবী’ হযরত এরবাজ ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) থেকে রেওয়ায়েত করেছেন। ৩০২
‘তারিখে দামেস্ক’ কিতাবেও (রাবী নং ২৪৮৮) উল্লেখ আছে سَعِيد بْن سُويد، الكَلبيّ সাহাবী হযরত এরবাজ ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। এমনকি তিনি এরবাজ ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) এর রেওয়ায়েতটিও উল্লেখ করেছেন।
ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তদীয় কিতাবেও উল্লেখ করেছেন যে, سَعِيد بْن سُويد، الكَلبيّ হযরত এরবাজ ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। ৩০৩
কিন্তু শুধু ‘সাঈদ ইবনে সুয়াইদ’ হযরত এরবাজ ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) থেকে রেওয়ায়েত করেননি। যার সম্পর্কে ইমাম বুখারী (رحمة الله) সমালোচনা করেছেন। অতএব, হযরত এরবাজ ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) এর বর্ণিত রেওয়ায়েতটি সকল ইমামগণের মতে ছহীহ্।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ লক্ষ্য করুন! এই হাদিসে স্পষ্ট বলা আছে رَأَتْ حِينَ وَضَعَتْهُ نُورًا অর্থাৎ মা আমেনা (رضي الله عنه) চর্ম চক্ষু দ্বারা দেখেছেন নূরের মানুষ বের হচ্ছে। এখানে رَأَتْ মানে চর্ম চক্ষু দ্বারা দর্শন, কল্পনা বা সপ্নে নয়। অপর একটি ছহীহ্ হাদিসে আছে: خَرَجَ مِنْهَا نُورٌ -“মা আমেনার মধ্য হতে নূর বের হচ্ছে।” ৩০৪
৩০২. ইমাম আবু হাতিম: জারহ ওয়া তা’দিল, রাবী নং ১১৯;
৩০৩. ইমাম যাহাবী: তারিখে ইসলামী, রাবী নং ৯৩;
৩০৪. ইবনে কাছির: আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ১ম খন্ড, ৩২৬ পৃ:;
আল্লামা হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله) এর সনদকে বলেছেন: إِسْنَادُهُ جَيِّدٌ
-“এই হাদিসের সনদ উত্তম।” যদি রাসূল (ﷺ) মাটির তৈরী মানুষ হতেন তাহলে নূর আসতে দেখা যেতনা। কারণ মাটির ভিতর থেকে আলো বের হয়না। এমনকি নবী পাক (ﷺ) এর নূরের কারণে শাম দেশের অট্টালিকা গুলো আলোকিত হয়ে গেছে। যেমনিভাবে সূর্য থেকে আলো বের হয় তেমনিভাবে আল্লাহর নবী (ﷺ) থেকেও নূর বের হয়েছে। এ জন্যেই অনেক সময় আল্লাহর নবী (ﷺ) সামনের দুই দাঁত মোবারকের ফাক দিয়ে نُورٌ‘নূর’ বের হয়ে যেত। এ বিষয়ে আরেকটি ছহীহ্ রেওয়ায়েতে আছে,
حَدَّثَنَا أَبُو الْعَبَّاسِ مُحَمَّدُ بْنُ يَعْقُوبَ، ثنا أَحْمَدُ بْنُ عَبْدِ الْجَبَّارِ، ثنا يُونُسُ بْنُ بُكَيْرٍ، عَنِ ابْنِ إِسْحَاقَ، قَالَ: حَدَّثَنِي ثَوْرُ بْنُ يَزِيدَ، عَنْ خَالِدِ بْنِ مَعْدَانَ، عَنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُمْ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَخْبِرْنَا عَنْ نَفْسِكَ، فَقَالَ: دَعْوَةُ أَبِي إِبْرَاهِيمَ، وَبُشْرَى عِيسَى، وَرَأَتْ أُمِّي حِينَ حَمَلَتْ بِي أَنَّهُ خَرَجَ مِنْهَا نُورٌ أَضَاءَتْ لَهُ بُصْرَى وَبُصْرَى مِنْ أَرْضِ الشَّامِ
-“হযরত খালেদ ইবনে মা’দান (رحمة الله) নবী পাক (ﷺ) কিছু সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় তাঁরা বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদেরকে আপনার নিজের সম্পর্কে বলুন। তখন প্রিয় নবীজি (ﷺ) বললেন: আমি ইব্রাহিম (عليه السلام) এর দোয়া, ঈসা (عليه السلام) এর সু-সংবাদ এবং আমার মা দেখেছেন যখন আমাকে গর্ভে ধারণ করেন যে, তাঁর ভিতর থেকে নূর বের হচ্ছে। এতে সব কিছু আলোকিত হল এবং শাম দেশ পর্যন্ত আলোকিত হল।” ৩০৫
৩০৫. মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস নং ৪১৭৪; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়াত, ১ম খন্ড, ৮৩ পৃ:;এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম হাকেম নিছাপুরী (رحمة الله) বলেন,
قَالَ الْحَاكِمُ: خَالِدُ بْنُ مَعْدَانَ مِنْ خِيَارِ التَّابِعِينَ، صَحِبَ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ فَمَنْ بَعْدَهُ مِنَ الصَّحَابَةِ فَإِذَا أَسْنَدَ حَدِيثًا إِلَى الصَّحَابَةِ فَإِنَّهُ صَحِيحُ
-“ইমাম হাকেম (رحمة الله) বলেন: ‘খালেদ ইবনে মা’দান’ একজন উচু মাপের তাবেঈ এবং হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (رضي الله عنه) ও পরবর্তী সাহাবীদের এর সহচর। যখন তাঁর সনদ সাহাবী পর্যন্ত থাকবে তখন ঐ হাদিস ছহীহ্ হবে। এই হাদিসের সনদ প্রসঙ্গে আল্লামা হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله) বলেন, وَهَذَا إِسْنَادٌ جَيِّدٌ قوي -“এই সনদ অতি-উত্তম ও শক্তিশালী।” ৩০৬
৩০৬ইবনে কাছির: আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ২য় খন্ড, ৩৩৫ পৃ:;
এমনকি ইমাম যাহাবী (رحمة الله) হাদিসটিকে صَحِيحُ ছহীহ্ বলেছেন। এ বিষয়ে অন্য একটি সূত্রে বর্ণিত আছে,
حَدَّثَنَا أَبُو الْيَمَانِ الْحَكَمُ بْنُ نَافِعٍ، حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرٍ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ سُوَيْدٍ، عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ، قَالَ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُول ... دَعْوَةُ أَبِي إِبْرَاهِيمَ وَبِشَارَةُ عِيسَى قَوْمَهُ، وَرُؤْيَا أُمِّي الَّتِي رَأَتْ أَنَّهُ خَرَجَ مِنْهَا نُورٌ أَضَاءَتْ لَهُ قُصُورُ الشَّامِ
-“হযরত এরবাজ ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) বলেন, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন:... আমি ইব্রাহিম (عليه السلام) এর দোয়া, ঈসা (عليه السلام) এর কওমের কাছে সু-সংবাদ, আমার মায়ের দেখা, নিশ্চয় তিনি তাঁর মধ্য থেকে নূর বের হতে দেখেছেন, ফলে ঐ নূরে শাম দেশের অট্টালিকা গুলো আলোকিত হয়ে গেছে।” ৩০৭
এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম হাকেম নিছাপুরী (رحمة الله) বলেন,
هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ شَاهِدٌ لِلْحَدِيثِ الْأَوَّلِ -“এই হাদিসের সনদ ছহীহ্ এবং প্রথম হাদিসের সাক্ষ্য।” (আল-মুস্তাদরাক) এ বিষরেয় আরেক হাদিসে আছে,
حَدَّثَنَا أَبُو دَاوُدَ قَالَ: حَدَّثَنَا الْفَرَجُ بْنُ فَضَالَةَ، عَنْ لُقْمَانَ بْنِ عَامِرٍ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، قَالَ: قِيلَ يَا رَسُولَ اللهِ، مَا كَانَ بَدْءُ أَمْرِكَ؟ قَالَ: دَعْوَةُ أَبِي إِبْرَاهِيمَ، وبشرى عيسى بن مَرْيَمَ، وَرَأَتْ أُمِّي أَنَّهُ خَرَجَ مِنْهَا نُورٌ أَضَاءَتْ مِنْهُ قُصُورُ الشَّامِ
-“হযরত আবু উমামা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, কিভাবে আপনার শুরু হল? প্রিয় নবীজি (ﷺ) বলেন: আমি ইব্রাহিম (عليه السلام) এর দোয়া, ঈসা ইবনে মারইয়াম (عليه السلام) এর সু-সংবাদ, নিশ্চয় আমার মা তাঁর ভিতর থেকে নূর বের হতে দেখেন, ঐ নূরে শাম দেশের দালান গুলো আলোকিত হয়ে যায়।” ৩০৮
৩০৭. মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস নং ৪১৭৫; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়াত, ১ম খন্ড, ৮৩ পৃ:; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৭১৬৩; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস নং ৪১৯৯; ছহীহ্ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৬৪০৪; ইমাম আবু নুয়াইম: হিলিয়াতুল আউলিয়া, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৮৯ পৃ:;
৩০৮. ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়াত, ১ম খন্ড, ৮৪ পৃ:; মুসনাদে আবু দাউদ ত্বয়ালুছী, হাদিস নং ১২৩৬; মুসনাদে ইবনে জা’দ, হাদিস নং ৩৪২৮; মুসনাদে হারেছ, হাদিস নং ৯২৭; ইমাম তাবারানী: মু’জামুল কবীর, হাদিস নং ৭৭২৯; ইমাম তাবারানী: মুসনাদে শামেঈন, হাদিস নং ১৫৮২;
এই হাদিসের সনদ প্রসঙ্গে নাছিরুদ্দিন আলবানী বলেন,
أخرجه ابن سعد بإسناد رجاله ثقات -“‘ইবনে সা’দ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, বর্ণনাকারী সকলেই বিশ্বস্ত।” ৩০৯
এই হাদিস সম্পর্কে নাছিরুদ্দিন আলবানী অন্যত্র আরো বলেন,
(صحيح) ... ابن سعد عن أبي أمامة. -“(ছহীহ্)... ইবনে সা’দ বর্ণনা করেছেন হযরত আবু উমামা (رضي الله عنه) থেকে।” ৩১০
লক্ষ্য করুন, এই হাদিসেও বলা হয়েছে: أَنَّهُ خَرَجَ مِنْهَا نُورٌ -“নিশ্চয় মা আমেনার ভিতর থেকে নূর বের হয়েছে।” আর ইহা দেখেছেন জাগ্রত অবস্থায় ও চম চক্ষু দ্বারা। এখানে মাটির কথা বলেননি বরং নূর বের হওয়ার কথাই বলেছেন। এ সম্পর্কে আরেকটি রেওয়ায়েত রয়েছে,
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ عَمْرٍو الْخَلَّالُ الْمَكِّيُّ، ثنا مُحَمَّدُ بْنُ مَنْصُورٍ الْجَوَّازُ، ثنا يَعْقُوبُ بْنُ مُحَمَّدٍ الزُّهْرِيُّ، ثنا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ عِمْرَانَ، عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُثْمَانَ بْنِ أَبِي سُلَيْمَانَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنِ ابْنِ أَبِي سُوَيْدٍ الثَّقَفِيِّ، قَالَ: سَمِعْتُ عُثْمَانَ بْنَ أَبِي الْعَاصِ، يَقُولُ: أَخْبَرَتْنِي أُمِّي، قَالَتْ: شَهِدْتُ آمِنَةَ لَمَّا وَلَدَتْ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،... فَلَمَّا وَلَدَتْ، خَرَجَ مِنْهَا نُورٌ أَضَاءَ لَهُ الْبَيْتُ الَّذِي نَحْنُ فِيهِ وَالدَّارُ، فَمَا شَيْءٌ أَنْظُرُ إِلَيْهِ، إِلَّا نُورٌ
-“ইবনে আবী সুয়াইদ সাকাফী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি উছমান ইবনে আবী আছ কে বলকে শুনেছি, তিনি বলেন আমাকে আমার মা বর্ণনা করেছেন: যখন মুহাম্মদ (ﷺ) কে জন্ম দান করেন তখন আমেনা (رضي الله عنه) এর কাছে উপস্থিত ছিলাম।... যখন রাসূল (ﷺ) আগমন করলেন, তখন আমেনার ভিতর থেকে নূর বের হল, ফলে ঐ ঘর আলোকিত হয়ে যায় যে ঘরে আমরা ছিলাম। তখন আলো ব্যতীত আর কিছুই দেখিনি। ৩১১
৩০৯. আলবানী: সিলসিলায়ে ছহীহা, হাদিস নং ১৯২৫;
৩১০. নাছিরুদ্দিন আলবানী: ছহীহ্ জামেউছ ছাগীর ওয়া যিয়াদা, হাদিস নং ৩৪৫১;
৩১১. ইমাম তাবারানী: মু’জামুল কবীর, হাদিস নং ৩৫৫ ও ৪৫৭
অতএব, উল্লেখিত হাদিস গুলো দ্বারা প্রমাণিত হয়, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) পৃথিবীতে আগমনের সময় নূর অবস্থায় এসেছেন, এবং যা মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রায্য নূর। ফলে মানুষ ঐ নূর ও নূরের আলো দেখতে পায়। তাই প্রিয় নবীজি (ﷺ) আল্লাহর নূরের সৃষ্ট, কারণ মাটির ভিতর থেকে নূর বের হতে পারেনা। প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর নূর যে ইন্দ্রিয়গ্রায্য সে সম্পর্কে আরো কয়েকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন:-
❏ বিভিন্ন সময় রাসূল (ﷺ) থেকে নূর বের হয়েছে
একাধিক রেওয়ায়েত দ্বারা জানা যায়, রাসূলে পাক (ﷺ) থেকে নূর বের হত। কখনো দাঁত মোবারক থেকে, কখনো মুখ বা চেহারা মোবারক থেকে। রাসূল (ﷺ) কে আকাশের চন্দ্র-সূর্যের থেকে অধিক ঔজ্জল্য ও সুন্দর দেখা যেত। যেগুলো মাটির মানুষের বেলায় অসম্ভব। দয়াল নবীজি (ﷺ) যে আল্লাহর নূর ছিলেন সে বিষয়টি বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন নিচের দলিল গুলো লক্ষ্য করুন। যেমন হাদিস শরীফে আছে,
أَخْبَرَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ الْمُنْذِرِ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ أَبِي ثَابِتٍ الزُّهْرِيُّ، حَدَّثَنِي إِسْمَاعِيلُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ ابْنُ أَخِي مُوسَى، عَنْ عَمِّهِ مُوسَى بْنِ عُقْبَةَ، عَنْ كُرَيْبٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُمَا قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفْلَجَ الثَّنِيَّتَيْنِ إِذَا تَكَلَّمَ رُؤِيَ كَالنُّورِ يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ ثَنَايَاهُ.
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, যখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কথা বলতেন তখন তাঁর সামনের দুই দাঁতের ফাক দিয়ে নূর বের হয়ে যেত।” ৩১২
৩১২. সুনানে দারেমী শরীফ, ১ম খন্ড, ৫৮ পৃ:; ইমাম তিরমিজি: শামায়েলে মুহাম্মাদীয়া, হাদিস নং ১৪ পৃষ্টা নং ১৭; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়াত ১ম খন্ড, ২১৫ পৃ:; ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, ৮ম খন্ড, ৪৯৭ পৃ:; তাবারানী তাঁর কবীর ও আওছাতে; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ১০৬ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী:
মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ২য় খন্ড, ১৯ পৃ:; তারিখুল খামিছ, ১ম খন্ড, ১০৬ পৃ:; ইমাম ইবনে হাজার মক্কী: আশরাফুল অছায়েল, ১ম খন্ড, ৬৬ পৃ:;
যেমন এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত রয়েছে,
وأنا سألته فأملي علي بعد جهد أنبأنا محمد بن أحمد بن أبي عون أنبأنا عمار بن الحسن أنبأنا سلمة بن الفضل بن عبد الله عن محمد بن إسحاق بن يسار عن يزيد بن رومان وصالح بن كيسان عن عروة بن الزبير عَن عَائِشَة قَالَت كنت أخيط فِي السحر فَسَقَطت مني الابرة فطلبتها فَلم أقدر عَلَيْهَا فَدخل رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فتبينت الإبرة بشعاع نور وَجهه
-“হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, আমি শেষ রাতে সাহরীর সময় কাপড় সেলাই করছিলাম। হঠাৎ আমার হাঁত থেকে সুঁই পড়ে গেল। অনেক খুজাখুজির পরেও সেটি পাওয়া গেলনা। অতঃপর রাসূল (ﷺ) আগমন করলেন এবং তাঁর মুখমন্ডলের নূরের আলোতে সেই সুইটি দৃষ্টিগোচর হল।” ৩১৩
এ সম্পর্কে আরেকটি রেওয়ায়েত রয়েছে,
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْحَسَنِ بْنِ قُتَيْبَةَ، ثنا أَيُّوبُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ الْهَيْصَمِ، ثنا زِيَادُ بْنُ سَيَّارٍ، عَنْ عَزَّةَ بِنْتِ عِيَاضٍ، عَن ابي قرصافة قَالَ بَايعنَا رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم انا وامي وخالتي فَلَمَّا رَجعْنَا قَالَت لي امي وخالتي يَا بني مَا رَأينَا مثل هَذَا الرجل أحسن وَجها وَلَا أنقى ثوبا وَلَا أَلين كلَاما ورأينا كَأَن النُّور يخرج من فِيهِ
-“হযরত আবু কিরছাফা (رضي الله عنه) বলেন, আমি, আমার মা ও আমার খালা রাসূল (ﷺ) এর কাছে বায়াত গ্রহণ করলাম। অতঃপর আমরা যখন ফিরে আসলাম তখন আমার মা ও খালা বললেন: হে বৎস! আমরা রাসূল (ﷺ) এর মত এমন সুশ্রী, সুভাষী ও ন¤্রভাষী কাউকে দেখিনি। যখন তিনি কথা বলতেন তখন আমরা তাঁর পবিত্র মুখ থেকে নূর বের হতে দেখতাম।” ৩১৪
৩১৩. ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ১০৭ পৃ:; তারিখে ইবনে আসাকির, ৩য় খন্ড, ৩১০ পৃ:; ইমাম খারকুশী: শরফুল মুস্তফা, ২য় খন্ড, ১০৩ পৃ:; ইমাম আবু নুয়াইম: দালাইলুন নবুয়াত, ১ম খন্ড, ১১৩ পৃ: ১১৭ নং হাদিস; ইমাম ছিয়তী: জামেউল আহাদিস, হাদিস নং ৪৩১২২; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৩৫৪৯২;
৩১৪. ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ১০৭ পৃ:; ইমাম তাবারানী: মু’জামুল কবীর, হাদিস নং ২৫১৮; ইমাম হায়ছামী: মজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ১৪০৩২; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৩৭৫৮১;
উল্লেখিত হাদিস গুলো বুঝা যায় প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর নূর মোবারক বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে মানুষের মাঝে প্রকাশিত হয়েছে। ফলে রাসূল (ﷺ) এর নূর ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুধাবন করা গেছে। অতএব, রাসূল (ﷺ) এর নূর ইন্দ্রিয়গ্রায্য ও ইন্দ্রিয় অগোচর উভয় প্রকার নূর। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েতে আছে,
حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا ابْنُ لَهِيعَةَ، عَنْ أَبِي يُونُسَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: وَلَا رَأَيْتُ شَيْئًا أَحْسَنَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَأَنَّ الشَّمْسَ تَجْرِي فِي وَجْهِهِ،
-“হযরত হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন: আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর চেয়ে অধিক সুন্দর কাউকে দেখিনি। যেন তাঁর চেহারা মোবারক থেকে সূর্যের আলো বের হয়ে আসছে।” ৩১৫
এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন,
حَدَّثَنَا أَبُو نُعَيْمٍ، حَدَّثَنَا زُهَيْرٌ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ قَالَ: سَأَلَ رَجُلٌ الْبَرَاءَ بْنَ عَازِبٍ: أَكَانَ وَجْهُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِثْلَ السَّيْفِ؟ قَالَ: لَا، بَلْ مِثْلَ الْقَمَرِ
-“হযরত আবু ইসহাক বলেন, এক ব্যক্তি হযরত বারা ইবনে আজেব (رضي الله عنه) কে জিজ্ঞাসা করলেন, রাসূল (ﷺ) এর চেহারা মোবারক কি তরবারীর মত চকচক ছিল? তিনি বললেন: না বরং চাঁদের মত সুন্দর ছিল।” ৩১৬
৩১৫. ইমাম তিরমিজি: শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস নং ১২৪; ইমাম ইবনে যাওজী: আল ওয়াফা, হাদিস নং ৬৫৫; ইমাম ইস্পাহানী: আখলাকুন নবী, হাদিস ন ৭৮৬; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন নবুয়াত, ১ম খন্ড, ২০৯ পৃ:; শিফা শরীফ, ১ম খন্ড, ১৪৯ পৃ:; ইমতাউল আসমা, ২য় খন্ড, ১৫৬ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ১২৩ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ২য় খন্ড, ৬ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২য় খন্ড, ৬ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী ক্বালী: শরহে শিফা, ১ম খন্ড, ১৬৩ পৃ:; সিরাতে হালভিয়া, ৩য় খন্ড, ৪৬৬ পৃ:; ইবনে হাজার মক্কী: আশরাফুল অছাইল, ১ম খন্ড, ৬৪ পৃ:;
৩১৬. ছহীহ্ বুখারী, হাদিস নং ৩৫৫২; ইমাম বাগভী: শরহে সুন্নাহ, হাদিস নং ৩৬৪৭; ইমাম তিরমিজি: শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস নং ১১; ইমাম ইবনে যাওজী: আল ওয়াফা, হাদিস নং ৬৫৪; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ২য় খন্ড, ৭ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২য় খন্ড, ৩৯ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: জামেউল অছাইল, ১ম খন্ড ৪৭ পৃ:; শরহে যুরকানী, ৫ম খন্ড, ২৪ পৃ:;
এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন,
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَعِيدٍ، أَخْبَرَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ مُحَمَّدٍ، عَنْ أَشْعَثَ بْنِ سَوَّارٍ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ، قَالَ: رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي لَيْلَةٍ إِضْحِيَانٍ، وَعَلَيْهِ حُلَّةٌ حَمْرَاءُ، فَجَعَلْتُ أَنْظُرُ إِلَيْهِ وَإِلَى الْقَمَرِ، فَلَهُوَ أَحْسَنُ فِي عَيْنِي مِنَ الْقَمَرِ
-“হযরত জাবের ইবনে ছামুরা (رضي الله عنه) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) রাতের বেলায় লাল চাদর পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। ফলে আমি নবীজির দিকে ও চাঁদের দিকে তাকালাম, এবং আমার কাছে মনে হল আল্লাহর নবী (ﷺ) চাঁদের চেয়েও সুন্দর।” ৩১৭
সনদ ছহীহ্। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েতে আছে,
وَأخرج أَبُو نعيم عَن أبي بكر الصّديق رَضِي الله عَنهُ قَالَ كَانَ وَجه رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم كدارة الْقَمَر
-“ইমাম আবু নুয়াইম (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) বলেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর চেহারা মোবারক ছিল পূর্ণিমার চাঁদের মত।” ৩১৮
৩১৭. সুনানে দারেমী, হাদিস নং ৫৮; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস নং ৭৩৮৩; ইমাম ইবনে যাওজী: আল ওয়াফা, হাদিস নং ৬৫৬; ইমাম ইস্পাহানী: ‘আখলাকুন নবী’, হাদিস নং ২৬৬; ইমাম ছিয়তী: খাছাইছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ১২৩ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ২য় খন্ড, ৮পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২য় খন্ড, ৫ পৃ:;
৩১৮. ইমাম ইবনে যাওজী: আল ওয়াফা, হাদিস নং ৬৬২; ইমাম ছিয়তী: খাছাইছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ১২৩ পৃ:; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ১৮৫২৬; ইমাম ছিয়তী: জামেউল আহাদিস, হাদিস নং ২৭৮১৩; ইমতাউল আসমা, ২য় খন্ড, ১৭০ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ২য় খন্ড, ১০ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২য় খন্ড, ৪০ পৃ:; শরহে যুরকানী, ৫ম খন্ড, ২৫৩ পৃ:;
হাফিজুল হাদিস ইমাম আবুল ফারাজ ইবনে জাওযী (رحمة الله) (ওফাত ৫৯৭ হিজরী) তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন,
قال ابن عباس رضى الله عنهما: بلغنى ان نور محمد صلى الله عليه وسلم وجمال يوسف تقارعا فى صلب ادم عليه السلام فكان الحسن والجمال ليوسف عليه السلام وكان النور والكمال والبهاء والنبوة والسفاعة والقران والشامة والعلامة والغمامة والجمعة والجماعة والمقام المحمود والحوض والمورود والقضيب لمحمد صلى الله عليه وسلم
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, আমার কাছে রেওয়ায়েত পৌছেছে নিশ্চয় নূরে মুহাম্মদী (رحمة الله) ও ইউছ‚ফ (عليه السلام) এর সৌন্দর্য আদম (عليه السلام) এর পৃষ্টদেশে গড়াচ্ছিল। অতঃপর উত্তমতা ও সৌন্দর্য ইউছ‚ফ (عليه السلام) কে দেওয়া হল। আর নূর, পরিপূর্ণতা, উজ্জল্যতা, নবুয়াত, শাফায়াত, কোরআন, সৌন্দর্য তিলক, অধিক জ্ঞানতা, মেঘচ্ছায়া, জুময়া, জামায়াত, মাকামে মাহমুদ, হাওজে কাউছার, প্রবেশধার, তরবারী আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (ﷺ) এর জন্য রাখা হয়েছে।” ৩১৯. ইমাম ইবনে জাওযী: মাওলিদুন নববী শরীফ, ২৩-২৪ পৃ:;
অতএব, রাসূলে পাক (ﷺ) এর জেসেম মোবারক ছিল আল্লাহর নূরের সৃষ্টি। ফলে সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে চন্দ্র ও সূর্যের আলোর সাথে উপমা দিয়েছেন কিংবা এর চেয়েও উত্তম বলেছেন। আর এ কারণেই তাঁর পবিত্র দেহ মোবারক থেকে নূর বের হত এবং অন্ধকার ঘর আলোকিত হত। সুতরাং রাসূলে পাক (ﷺ) হলে ‘নূরে মুজাচ্ছাম’ বা নূরের দেহদারী তথা নূরের তৈরী।
❏ একটি গুরুত্বপূর্ণ নোট
উল্লেখ্য যে, পবিত্র কোরআনকেও নূর বলা হয়েছে। যেমন পবিত্র কোরআনের আছে: وَأَنْزَلْنا إِلَيْكُمْ نُوراً مُبِيناً -“আর তোমাদের কাছে সু-স্পষ্ট নূর (কোরআন) নাজিল করেছি।’ (সূরা নিসা: ১৭৪ নং আয়াত)
এখানে প্রথমে’ই জানা দরকার কোরআন কি মাখলুক বা সৃষ্টি কি-না? যদি কেউ কোরআনকে মাখলুক বা সৃষ্টি তথা নূরের তৈরী বলে তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে সে ব্যক্তি কাফের, কারণ কোরআন হল আল্লাহ তা’লা কালামে কাদীম, অসীম সত্ত্বার বাণী ইহা সৃষ্টির অন্তর্ভূক্ত হতে পারেনা। (শরহে ফিকহে আকবর, আলমগিরী)
অনেকে কু-যুক্তি খাড়া করে যে, কোরআনকেও নূর বলা হয়েছে তাই বলে কি কোরআন নূরের তৈরী। তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের স্পষ্ট জবাব হল, মূল কোরআন ঠিকই ‘নূর’ কারণ কোরআন মূলত কোন সৃষ্টি নয় বরং কালামে কাদীম। সুতরাং যে কোরআন মাখলুক নয় সেই কোরআনকে’ই নূর বলা হয়েছে, বাহ্যিক কাগজ-কালির কোরআনকে নয়। হাফেজে কোরআনের ছিনার ভিতরে যে কোরআন রয়েছে সেটাই নূর। কারণ পবিত্র কোরআনকে জিব্রাইল (عليه السلام) এর মাধ্যমে প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর ছিনা মোবারকে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ পাক কাগজ-কালির তৈরী কোরআনের পান্ডুলিপি দেননি। মুসলমানদের সুবিধার্থে কাগজ-কালির কোরআন তৈরী করা হয় হযরত উছমান (رضي الله عنه) এর যুগে, এ কারণেই তাঁকে বলা হয় ‘জামেউল কোরআন’। সুতরাং মূল কোরআন নূর ঠিকই আছে, তবে মানুষর তৈরী কাগজ ও কালির কোরআনের কথা আল্লাহ বলেননি। ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহর নবী (ﷺ) কে শুধু ‘নূর’ বলা হয়নি বরং মা আমেনার গর্ভ থেকে বের হওয়ার সময় সরাসরি চর্ম চক্ষু দ্বারা নূরের মানূষ বের হতেও দেখা গেছে। তাই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে মাটির তৈরী বলা রাসূল (ﷺ) এর ছহীহ্ হাদিস অস্বীকার করার নামান্তর।
❏ প্রিয় নবীজি (ﷺ) এঁর ছায়া বিহীন কায়া
একাধিক হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহর হাবীব হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) এঁর দেহ মোবারকের ছায়া ছিলনা। আর এ বিষয়ে কোন ফকিহ্, মুজতাহিদ, মুজাদ্দেদ আউলিয়ায়ে কেরাম কেউ দ্বিমত করেননি। বিশেষ করে মারকাজুল আসানিদ আল্লামা শেখ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله), ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله), আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله), আল্লামা কাজী আয়্যাজ (رحمة الله), হযরত মুজাদ্দেদ আল্ফেছানী (رحمة الله), ইমাম যুরকানী (رحمة الله), ইমাম নাছাফী (رحمة الله), ইমাম ইবনে জাওযী (رحمة الله), ইমাম ইবনে মোবারক (رحمة الله), মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব, মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহী সাহেব প্রমূখ এ বিষয়ে সমর্থন করেছেন ও বিষদ আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে ছহীহ্ হাদিসে আছে,
عن عبد الرزاق عن ابن جريج قال اخبرنى نافع ان ابْن عَبَّاسٍ قَالَ: لَمْ يَكُنْ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ظِلٌّ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ شَمْسٍ قَطُّ إِلَّا غَلَبَ ضَوْءُهُ ضَوْءَ الشَّمْسِ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ سِرَاجٍ قَطُّ إِلَّا غَلَبَ ضَوْءُهُ ضَوْءَ السِّرَاجِ،
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন: হুজুর (ﷺ) এর কোন ছায়া ছিলনা, সূর্যের আলোতে তাঁর ছায়া পড়তনা। বরং তাঁর নূরের ঝলক সূর্যের আলোর উপর প্রভাব বিস্তার করত। কোন বাতির আলোর সামনে দাঁড়ালেও বাতির আলোর উপর তাঁর নূরের আলো বিস্তার করত।” ৩২০
এ বিষয়ে ইমাম তকিউদ্দিন আহমদ ইবনে আলী মাকরীজি (رحمة الله) {ওফাত ৮৪৫ হিজরী} আরেকটি সনদ তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন:
وقال أحمد بن عبد اللَّه الغدافي أخبرنا عمرو بن أبي عمرو عن محمد بن السائب عن أبي صالح عن ابن عباس رضي اللَّه عنه: لم يكن لرسول اللَّه ظل، ولم يقم مع شمس قط إلا غلب ضوء الشمس، ولم يقم مع سراج قط إلا غلب ضوءه على ضوء السراج.
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর কোন ছায়া ছিলনা। বরং তাঁর নূরের ঝলক সূর্যের আলোর উপর বিস্তার করত। কোন বাতির আলোর সামনে দাঁড়ালেও বাতির আলোর উপর তাঁর নূরের আলো বিস্তার করত।” ৩২১
এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে মোবারক (رحمة الله) ও আল্লামা হাফিজ ইবনে জাওযী (رحمة الله) এই রেওয়ায়েত উল্লেখ করেন এভাবে,
وَفِي حَدِيثِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: لَمْ يَكُنْ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ظِلٌّ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ شَمْسٍ قَطُّ إِلَّا غَلَبَ ضَوْءُهُ ضَوْءَ الشَّمْسِ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ سِرَاجٍ قَطُّ إِلَّا غَلَبَ ضَوْءُهُ ضَوْءَ السِّرَاجِ، ذَكَرَهُ ابْنُ الْجَوْزِيِّ،
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর কোন ছায়া ছিলনা। বরং তাঁর নূরের ঝলক সূর্যের আলোর উপর বিস্তার করত। কোন বাতির আলোর সামনে দাঁড়ালেও বাতির আলোর উপর তাঁর নূরের আলো বিস্তার করত।” ৩২২
৩২০. জুযউল মাফকুদ মিন মুছান্নাফে আব্দির রাজ্জাক, ১ম খন্ড, ৫৬ পৃ: হাদিস নং ২৫; ইমাম ইবনে যাওজী: ‘আল ওয়াফা’, হাদিস নং ৬৬৪; সিরাতে হালভিয়া, ৩য় খন্ড, ৪৬৬ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: জামেউল অছাইল, ১ম খন্ড, ১৭৬ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২য় খন্ড, ৭ পৃ:;
৩২১. ইমতাউল আসমাআ বিমা লিন্নাবীয়্যি মিনাল আহওয়াল, ২য় খন্ড, ১৭০ পৃ:;
৩২২. ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: জামেউল ওয়াছাইল ফি শরহে শামাইল, ১ম খন্ড, ২১৭ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২য় খন্ড, ৪০ পৃ:; শরহে মাওয়াহেব; জিকরে জামীল; আল অফা বি’আহওয়ালিল মোস্তফা লিয জাওযী;
যেমন হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে,
أخرج الْحَكِيم التِّرْمِذِيّ من طَرِيق عبد الرَّحْمَن بن قيس الزَّعْفَرَانِي عَن عبد الْملك بن عبد الله بن الْوَلِيد عَن ذكْوَان ان رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لم يكن يرى لَهُ ظلّ فِي شمس وَلَا قمر
-“হযরত যাকওয়ান (رضي الله عنه) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহর নবী (ﷺ) এর দেহ মোবারক এর ছায়া চন্দ্র-সূর্য এর আলোকে দেখা যায়নি।” ৩২৩
ইহার সনদ রয়েছে এবং হাদিসটি সনদসহ উল্লেখ করেছেন ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) তার ‘শরহে শিফা’ কিতাবে। শরফুল মোস্তফা কিতাবে ২য় খন্ড, ১১৫ পৃষ্টায় ইমাম আব্দুল মালেক ইবনে মুহাম্মদ আবু সাঈদ খারকুশী (رحمة الله) ওফাত ৪০৭ হিজরী সনদসহ হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) তার খাছায়েছুল কুবরা কিতাবেও সনদসহ হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। সনদটি যদিও সমালোচিত কিন্তু ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর মতনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সর্বোপরি আইম্মায়ে কেরাম বিষয়টি কবুল করেছেন ও কোন প্রকার মতানৈক্য ছাড়াই বিষয়টি স্ব স্ব কিতাবে বয়ান করেছেন। এ সম্পর্কে আল্লামা ইমাম যুরকানী (رحمة الله) {ওফাত ১১২২ হিজরী} বলেন,
ولم يكن له صلى الله عليه وسلم ظل في شمس ولا قمر. رواه الترمذي الحكيم عن ذكْوَان
-“হযরত রাসূল (ﷺ) এঁর দেহ মোবারকের ছায়া চন্দ্র- সূর্যের আলোকে পড়ত না। ইমাম হাকেম তিরমিজি (رحمة الله) যাকওয়ার (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন” ৩২৪
এ সম্পর্কে আল্লামা কাজী আয়্যাজ (رحمة الله) {ওফাত ৫৪৪ হিজরী} বলেন,
أنه كان لاظل لشخصه فِي شَمْسٍ وَلَا قَمَرٍ لِأَنَّهُ كَانَ نُورًا -“নিশ্চয় নবী করিম (ﷺ) এর ছায়া দিনের সূর্যের আলো কিংবা রাতের চন্দ্রের আলোতে পড়ত না, কেননা তিনি ছিলেন নূর।” ৩২৫
৩২৩. হাকেম তিরমিজি র: ‘নাওয়াদেরুল উছুল’; মাদারেজুন্নুয়াত; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা, ১ম খন্ড ১১৬ ও ১২২ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: শরহে শিফা, ১ম খন্ড, ৭৫৪ পৃ:; শুকরুন নি’মা, ৩৯ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ২য় খন্ড, ৮৫ পৃ:; কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ১ম খন্ড, ৩৬৮ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২য় খন্ড, ৯০ পৃ:; শরহে মাওয়াহেব; ইমাম খারকুশী: শরফুল মোস্তফা, ২য় খন্ড, ১১৫ পৃ:;
৩২৩. যুরকানী শরহে মাওয়াহেব, ৫ম খন্ড, ৫২৪ পৃ:;
৩২৪. কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ১ম খন্ড, ২৪২ পৃ:;
আল্লামা আবুল বারাকাত আন নাসাফী (رحمة الله) {ওফাত ৭১০ হিজরী} বলেন,
وقال عثمان إن الله ما أوقع ظلم على الأرض لئلا يضع إنسان قدمه على ذلك الظل
-“হযরত উছমান ইবনে আফ্ফান (رضي الله عنه) বলেন: হযরত রাসূলে পাক (ﷺ) এর ছায়া মোবারক জমীনে পড়েনি, যাতে কোন মানুষ তাঁর ছায়াতে পা রাখতে না পারে।” ৩২৬
হাফিজুল হাদিস ইমাম শামছুদ্দিন ছাখাভী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে বলেন,
أنه لا ظل لشخصه في شمس ولا قمر لأنه كان نورا، -“নিশ্চয় নবী পাক (ﷺ) এর ছায়া চন্দ্র-সূর্যের আলোতে পড়ত না, কেননা তিনি ছিলেন নূর।” ৩২৭
হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) {ওফাত ৯১১ হিজরী} উল্লেখ করেন,
قَالَ ابْن سبع من خَصَائِصه ان ظله كَانَ لَا يَقع على الأَرْض وَأَنه كَانَ نورا فَكَانَ إِذا مَشى فِي الشَّمْس أَو الْقَمَر لَا ينظر لَهُ ظلّ
-“হযরত ইবনে সাবা (رحمة الله) বলেন: এটা রাসূল (ﷺ) বৈশিষ্ট্যাবলীর অন্তর্ভূক্ত যে, তাঁর দেহ মোবারকের ছায়া জমীনে পড়তনা কেননা তিনি ছিলেন নূর। নিশ্চয় তিনি নূর ছিলেন। কারণ তিনি যখন হাটতেন তখন চন্দ্র ও সূর্যের আলোতে তাঁর ছায়া পড়ত না।” ৩২৮
আল্লামা ইমাম আহমদ ইবনে মুহাম্মদ কাস্তালানী (رحمة الله) {ওফাত ৯২৩ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন,
ولم يقع له ظل على الأرض، ولا رؤى له ظل فى شمس ولا قمر -“আল্লাহর নবী (ﷺ) এর ছায়া চন্দ্র- সূর্যের আলোতে পড়তনা। ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) আরো বলেন: ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন যে, চাঁদ-সূর্যের আলোতে রাসূলে পাক (ﷺ) এর ছায়া দেখা যেতনা।” ৩২৯
৩২৬. তাফছিরে নাছাফী, ২য় খন্ড, ৪৯২ পৃ: সূরা নূর; শামে কারবালা; জিকরে জামীল;
৩২৭. ইমাম ছাখাবী: মাকাছিদুল হাছানাহ, ১ম খন্ড, ১২২ পৃ:;
৩২৮. ইমাম ছিয়তী: খাছাইছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ১৬৪ পৃ: হাদিস নং ৩২৮; শরহে মাওয়াহেব লিয যুরকানী; মাদারেজুন্নবুয়াত;
৩২৯. ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ২য় খন্ড, ৮৫ পৃ ও ২য় খন্ড, ৩৪৩ পৃ:; শরহে মাওয়াহেব;
এ সম্পর্কে আল্লামা ইমাম যুরকানী (رحمة الله) {ওফাত ১১২২ হিজরী} বলেন,
ولم يكن له صلى الله عليه وسلم ظل في شمس ولا قمر لأنه كان نورا
-“আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর দেহ মোবারকের কোন ছায়া ছিলনা, কারণ তিনি ছিলেন নূরের তৈরী।” ৩৩০
হাজারী মুজাদ্দেদ শায়েখ আহমদ ছেরহেন্দী মুজাদ্দেদ আল্ফেছানী (رضي الله عنه) বলেন: -“রাসূল (ﷺ) এর ছায়া ছিলনা, কারণ ইহ জগতে প্রত্যেক ব্যক্তির ছায়া তার চেয়েও সূক্ষতম হয়। যেহতেু রাসূলে পাক (ﷺ) এর চেয়ে সূক্ষতম কোন বস্তু সৃষ্টি জগতে নেই, সেহেতু হুজুর (ﷺ) এর ছায়া কিরূপে হতে পারে?” ৩৩১
❏ দেওবন্দীদের বিখ্যাত আলিম মাও: রশিদ আহমদ গাংগুহী সাহেব
দেওবন্দীদের বিখ্যাত আলিম মাও: রশিদ আহমদ গাংগুহী সাহেব বলেন,
-“আর সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) এর ছায়া ছিলনা এবং এটাও প্রকাশ্যমান যে, নূর ব্যতীত সমূদয় জড় দেহের ছায়া থাকে।” ৩৩২
প্রখ্যাত দেওবন্দী আলিম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ছাহেব বলেন,
-“এ কথা প্রসিদ্ধ যে, আমাদের নবী (ﷺ) এর ছায়া ছিলনা। কারণ রাসূল (ﷺ) এর আপাদমস্তক ছিল নূরের। রাসূল (ﷺ) এর মধ্যে নাম মাত্রও অন্ধকার ছিলনা, কেননা ছায়ার জন্য অন্ধকার অপরিহার্য।” ৩৩৩
৩৩০. ইমাম যুরকানী: শরহে মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ৫ম খন্ড, ৫২৫ পৃ:;
৩৩১. মাকতুবাত শরীফ, ৩য় খন্ড, ৯৩ পৃ:;
৩৩২. গাংগুহী: ইমদাদুছ ছুলুক, ৮৫ পৃ:;
৩২৩থানভী: শুকরুর নে’মাত, ৩৯ পৃ:;
উল্লেখিত দলিল সমূহ দ্বারা প্রতিয়মান হয়, আল্লাহ নবী (ﷺ) দেহ মোবারকের ছায়া চন্দ্র-সূর্যের আলোতে পড়ত না। কারণ হিসেবে ফোকাহায়ে এজামগণ বলেছেন: لِأَنَّهُ كَانَ نُورًا-“তিনি ছিলেন নূর।”
সর্বোপরি রাসূলে পাক (ﷺ) এর পুরো জেসেম বা শরীর মুবারকে নূর ছিল এটা ছহীহ্ রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত। যেমন হাদিস শরীফে আছে, হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) দোয়া করেছেন: وَاجْعَلْنِي نُورًا -“আমাকে নূরে পরিণত করো।” ৩৩৪. মুসনাদু আহমদ, হাদিস নং ২৫২৭; মুসনাদু আবী দাউদ ত্বায়ালিছী, হাদিস নং ২৮২৯; ছহীহ্ মুসলীম, হাদিস নং ১৮৩০;;
এই হাদিস অনুযায়ী প্রমাণিত হয়, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর পুরো শরীর মুবারক নূরে পরিণত ছিল। তাই তিনার ছায়া না থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়ার কোন সুযোগ থাকেনা। আল্লাহর নবী (ﷺ) নূর মোবারক এত সূক্ষ ছিল যে, চন্দ্র- সূর্যের আলো তার নাগাল পেত না। যেমন এক্স-রে রঞ্জন রশ্মি মানব দেহ ভেদ করে ফেলে কিন্তু চামড়া-গোস্ত তার প্রতিবন্ধক হতে পারেনা। নবী করিম (ﷺ) ছিলেন নূর ও ছিরাজুম মুনিরা। নূর নিজে আলোকিত ও অপরকে আলোকিত করেন। তাই কোন অবস্থাতেই তাঁর ছায়া মোবারক ছিলনা ও ছায়া মোবারক পড়ত না। রোদের সময় হোক বা রাতের বেলায় আলোর সামনেই হোক মানুষের ছায়া পড়ে। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই রাসূল (ﷺ) ছায়া মোবারক পড়ত না, কারণ তিনি নিজেই ছিলেন জ্যোতির্ময়।
❏ ছায়া থাকার বিষয়ে দুইটি হাদিসের ব্যাখ্যা
রাসূলে পাক (ﷺ) এর পবিত্র জেসেম মুবারকের ছায়া প্রমাণের জন্য যে সকল সকল রেওয়ায়েত গুলোর আশ্রয় নেওয়া হয় সেসব রেওয়ায়েত গুলোর ব্যাখ্যা এখানে দেওয়া হল। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলল:-
প্রথম হাদিস ও তার ব্যাখ্যাঃ ইমাম ইবনে খুজাইমা (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন,
نا بَحْرُ بْنُ نَصْرِ بْنِ سَابَقٍ الْخَوْلَانِيُّ، نا ابْنُ وَهْبٍ، حَدَّثَنِي مُعَاوِيَةُ بْنُ صَالِحٍ، عَنْ عِيسَى بْنِ عَاصِمٍ، عَنْ زِرِّ بْنِ حُبَيْشٍ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: صَلَّيْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَاةَ الصُّبْحِ قَالَ: فَبَيْنَمَا هُوَ فِي الصَّلَاةِ مَدَّ يَدَهُ، ثُمَّ أَخَّرَهَا، فَلَمَّا فَرَغَ مِنَ الصَّلَاةِ، قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، صَنَعْتَ فِي صَلَاتِكَ هَذِهِ مَا لَمْ تَصْنَعْ فِي صَلَاةٍ قَبْلَهَا قَالَ: إِنِّي رَأَيْتُ الْجَنَّةَ قَدْ عُرِضَتْ عَلَيَّ، وَرَأَيْتُ فِيهَا. . . . قُطُوفُهَا دَانِيَةٌ، حَبُّهَا كَالدُّبَّاءِ، فَأَرَدْتُ أَنْ أَتَنَاوَلَ مِنْهَا، فَأُوحِيَ إِلَيْهَا أَنِ اسْتَأْخِرِي، فَاسْتَأْخَرَتْ، ثُمَّ عُرِضَتْ عَلَيَّ النَّارُ، بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ حَتَّى رَأَيْتُ ظِلِّيَ وَظِلَّكُمْ،
-“হযরত আনাস ইবনে মালেক (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করলেন। ফলে তিনি নামাজেই সামনের দিকে হাঁত বাড়িয়ে দিলেন, অতঃপর ফিড়িয়ে আনলেন। যখন নামাজ থেকে বের হলেন তখন আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার হাঁত সামনের দিকে বাড়ালেন অথচ ইতিপূর্বে এরূপ করেননি। রাসূল (ﷺ) বললেন: আমি দেখলাম আল্লাহ পাক আমার সামনে জান্নাত পেশ করলেন এবং আমি ইহাতে দেখতে লাগলাম।.. জান্নাত থেকে আমি কিছু নিতে চাইলে আমার প্রতি ওহী নাজিল হল আপনি সরে দাঁড়ান। তারপর জাহান্নাম উপস্থিত করা হল যা আমার ও তোমাদের সামনেই ছিল। ফলে আমার ও তোমাদের ছায়া সেখানে দেখতে পাই।” ৩৩৫. ছহীহ্ ইবনে খুজাইমা, হাদিস নং ৮৯২;
প্রিয় পাঠক! এই ঘটনা ছিল ফজরের নামাজের সময়, বলুন ফজরের সময় কি সূর্য থাকে যে ছায়া পড়বে!? জিল্লুন শব্দের অর্থ সম্মান ও আশ্রয় হয়। সর্বোপরি এখানে ظِلِّيَ وَظِلَّكُمْ (জিল্লী ওয়া জিল্লুকুম) দ্বারা প্রিয় নবীজি (ﷺ) ও সাহাবীদের ছায়াকে উদ্দেশ্য নয়। কারণ ছায়া যদি উদ্দেশ্য হত তাহলে শুধু জাহান্নামে ছায়া পড়ল কিন্তু জান্নাতে ছায়া পড়লনা ইহার মানে হতে পারেনা।
প্রিয় নবীজি (ﷺ) বললেন: জান্নাত ও জাহান্নাম পেশ করা হয়েছিল بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ (বাইনি ওয়া বাইনাকুম) আমার ও তোমাদের মাঝে। লক্ষ্য করুন, প্রিয় নবীজি (ﷺ) হলেন ইমাম, আর সাহাবীরা হলে মুক্তাদী। জান্নাত-জাহান্নাম পেশ করা হয় উভয়ের মাঝে। অর্থাৎ নবীজির পিছনে এবং সাহাবীদের সামনে, কারণ তখন দয়াল নবীজি নামাজে ছিলেন। তাহলে একই সাথে সামনে থেকে পিছনে এবং পিছন থেকে সামনে ছায়া পড়ে কিভাবে!? কারণ ছায়া তো একই সাথে সামনে ও পিছনে পড়েনা। এখানে প্রিয় নবীজি (ﷺ) ظِلِّيَ وَظِلَّكُمْ (জিল্লী ওয়া জিল্লুকুম) ‘আমার ও তোমাদের ছায়া’ কথাটি রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। কেননা এরূপ অনেক ক্ষেত্রেই রূপক অর্থে ظِلّ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন লক্ষ্য করুন:-
حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، عَنْ مَالِكِ بْنِ أَنَسٍ، فِيمَا قُرِئَ عَلَيْهِ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ مَعْمَرٍ، عَنْ أَبِي الْحُبَابِ سَعِيدِ بْنِ يَسَارٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللهَ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: أَيْنَ الْمُتَحَابُّونَ بِجَلَالِي، الْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِي ظِلِّي يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلِّي
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ পাক কেয়ামতের দিন বলবেন, কে আমার ইজ্জতকে ভালবেসেছ, তাদের জন্য আমার ছায়া রয়েছে, যখন আমার ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না।” ৩৩৬
হাদিসটি হযরত এরবাজ ইবনে ছারিয়া (رضي الله عنه) থেকে ইমাম আহমদ (رحمة الله) তার মুসনাদে ছহীহ্ সনদে বর্ণনা করেছেন।
দেখুন এই হাদিসে আল্লাহর ছায়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আল্লাহর কোন ছায়া নেই কারণ আল্লাহ ছায়া থেকে পবিত্র। এখানে আল্লাহর আরশের ছায়া হল উদ্দেশ্যে। যেমন ইমাম যাহাবী (رحمة الله) উল্লেখ করেন,
جَزَاؤُهُ أَن أظلهُ فِي ظِلِّي يَوْم لَا ظل إِلَّا ظِلِّي مَعْنَاهُ ظل عَرْشِي يَوْم الْقِيَامَة
-“তার প্রতিদান হল সেদিন তার ছায়া হবে আমার ছায়ায় যেদিন আমার ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবেনা। ইহার অর্থ হল কেয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়া।” ৩৩৭
৩৩৬. ছহীহ্ মুসলীম, হাদিস নং ৬৭১৩; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৮৮৩২;
৩৩৭. ইমাম যাহাবী: আল কাবাইর, ১ম খন্ড, ৬৮ পৃ:;
এ বিষয়ে আরো দুইটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
ثنا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ شَبِيبٍ، ثنا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، ثنا ابْنُ أَبِي فُدَيْكٍ، أَنَّ مُوسَى بْنَ يَعْقُوبَ، أَخْبَرَهُ عَنْ عَبْدِ الْأَعْلَى بْنِ مُوسَى بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ قَيْسِ بْنِ مَخْرَمَةَ، أَنَّ إِسْمَاعِيلَ بْنَ رَافِعٍ يُحَدِّثُهُ، عَنِ ابْنِ أَسْلَمَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: قَالَ لِي أَبُو عُبَيْدَةَ: أَشْهَدُ لَسَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: لَا تَسُبُّوا السُّلْطَانَ؛ فَإِنَّهُ ظِلُّ اللَّهِ فِي الْأَرْضِ
-“জায়েদ ইবনে আসলাম তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, সাহাবী আবু উবাইদা (رضي الله عنه) আমাকে বলেছেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন: তোমরা সুলতানকে গালি দিওনা, নিশ্চয় সে জমীনে আল্লাহর ছায়া।” ৩৩৮
এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন,
حَدَّثَنَا الْمُقَدَّمِيُّ، ثنا سَلْمُ بْنُ سَعِيدٍ الْخَوْلَانِيُّ، ثنا حُمَيْدُ بْنُ مِهْرَانَ، عَنْ سَعْدِ بْنِ أَوْسٍ، عَنْ زِيَادِ بْنِ كُسَيْبٍ، عَنْ أَبِي بَكْرَةَ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: السُّلْطَانُ ظِلُّ اللَّهِ فِي الْأَرْضِ، فَمَنْ أَكْرَمَهُ أَكْرَمَ اللَّهَ، وَمَنْ أَهَانَهُ أَهَانَهُ اللَّهُ
-“হযরত আবী বাকরা (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূলে পাক (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: সুলতান জমীনবাসীর জন্য ছায়া। যে তাকে সম্মান করল সে আল্লাহকে সম্মান করল আর যে তাকে অসম্মান করল সে আল্লাহকে অসম্মান করল।” ৩৩৯
৩৩৮. ইমাম ইবনে আবী আছেম: আস সুন্নাহ, হাদিস নং ১০১৩; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ৬৯৮৭ উমর রা: থেকে;
৩৩৯. ইমাম ইবনে আবী আছেম: আস সুন্নাহ, হাদিস নং ১০২৪; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ৬৯৮৪ ইবনে উমর রা: থেকে;
এখানে সুলতানকে আল্লাহর ছায়া বলা হয়েছে, অথচ বাস্তবে তারা আল্লাহর ছায়া নয়। এখানে রূপক অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে। ঠিক তেমনি সেখানে প্রিয় নবীজি (ﷺ) রূপক অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে। মুহাদ্দিছীনে কেরাম ইহার সু-স্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা দেননি। যেহতেু শুধু জাহান্নামে ছায়ার কথা বলা হয়েছে, জান্নাতে নয়। সেহেতু এটা প্রিয় নবীজি (ﷺ) ও সাহাবীদের সত্ত্বা অর্থ নেওয়া যাচ্ছেনা, কারণ প্রিয় নবীজি (ﷺ) ও সাহাবীদের সত্ত্বা জাহান্নামে থাকবে এটা কল্পনাও করা যায়না। তবে নিশ্চয় জাহান্নামী পাপীদেরকে শাফায়াতের মাধ্যমে প্রিয় নবীজি (ﷺ) ও পরে সাহাবীরা বের করে আনবেন সেহেতু ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, জাহান্নামে পাপীদের শাফায়াত করার ছায়া। আল্লাহই সর্বোজ্ঞ।
দ্বিতীয় হাদিস ও তার ব্যাখ্যাঃ ইমাম আহমদ (رحمة الله) বর্ণনা করেন,
حَدَّثَنَا عَفَّانُ، حَدَّثَنَا حَمَّادٌ، قَالَ حَدَّثَنَا ثَابِتٌ: عَنْ سُمَيَّةَ، عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ فِي سَفَرٍ لَهُ،... قَالَ: فَتَرَكَهَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَا الْحِجَّةِ وَالْمُحَرَّمَ شَهْرَيْنِ، أَوْ ثَلَاثَةً، لَا يَأْتِيهَا، قَالَتْ: حَتَّى يَئِسْتُ مِنْهُ، وَحَوَّلْتُ سَرِيرِي، قَالَتْ: فَبَيْنَمَا أَنَا يَوْمًا بِنِصْفِ النَّهَارِ، إِذَا أَنَا بِظِلِّ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُقْبِلٌ
-“হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সফরে ছিলেন।... তিনি বলেন: রাসূলে পাক (ﷺ) তাকে (যায়নবকে) রাগ করে জিলহজ¦ ও মর্হারামের দুই অথবা তিন মাস তার কাছে আসেননি। এমনকি আমরা নিরাশ হয়ে গেলাম। আমার মনের অবস্থাও পরিবর্তন হয়ে গেল। ফলে একদা আমি মধ্য বেলায় তাঁর কাছে ছিলাম। যখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আগত সময়ে ছায়া দিলেন।” ৩৪০
এখানে ‘ছায়া দিলেন’ এর ভাবার্থ হল ‘তাকে আশ্রয় দিলেন’। কেননা পরিত্যাগ করার পর ছায়া দেওয়ার অর্থ হল আশ্রয় দেওয়া। আর ظِلّ (জিল্লুন) এর আরেকটি অর্থ হল আশ্রয় দেওয়া। মুসনাদে আহমদে আরেকটি রেওয়ায়েতে আছে,
فَلَمَّا كَانَ شَهْرُ رَبِيعٍ الْأَوَّلِ، دَخَلَ عَلَيْهَا، فَرَأَتْ ظِلَّهُ، فَقَالَتْ: إِنَّ هَذَا لَظِلُّ رَجُلٍ، وَمَا يَدْخُلُ عَلَيَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَمَنْ هَذَا؟ فَدَخَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،
-“যখন রবিউল আওয়াল মাস আসল তখন আমি রাসূল (ﷺ) এর ছায়া দেখতে পেলাম। তিনি (যায়নব) বলেন: নিশ্চয় ইহা একজন পুরুষ ব্যক্তির ছায়া, অথচ আল্লাহর নবী (ﷺ) আমার কাছে আসেনি, তাহলে এটা কে? অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ﷺ) প্রবেশ করলেন।” ৩৪১
৩৪০. মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২৫০০২;
৩৪১. মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২৬৮৬৬;
sউল্লেখ্য যে, হাদিসের শেষের অংশটুকু অর্থাৎ
فَقَالَتْ: إِنَّ هَذَا لَظِلُّ رَجُلٍ، وَمَا يَدْخُلُ عَلَيَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَمَنْ هَذَا؟ فَدَخَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،
-“তিনি (যায়নব) বলেন: নিশ্চয় ইহা একজন পুরুষ ব্যক্তির ছায়া, অথচ আল্লাহর নবী (ﷺ) আমার কাছে আসেনি, তাহলে এটা কে? অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ﷺ) প্রবেশ করলেন।”
এই অংশটুকু ইমাম আহমদ (رحمة الله) এর কাছে বর্ণিত হলেও ইমাম বুখারীর উস্তাদ ইমাম ইবনে সা’দ (رحمة الله) এর ‘তাবাকাত’-এ এবং ইমাম তাবারানী (رحمة الله) এর ‘আওছাতে’ এই অংশটুকু উল্লেখ করেননি। ফলে এই অংশটুকু ‘শায’ অথবা ‘মুনকার’ হলে গন্য হবে। কেননা এই অংশটুকু যদি ঐ হাদিসের অংশ হত তাহলে ইমাম ইবনে সা’দ ও ইমাম তাবারানী (র) এর কাছেও ইহা বর্ণিত হতো। এতে বুঝা যাচ্ছে এই অংশটুকু নিশ্চয় কোন রাবী বাড়িয়ে বর্ণনা করেছেন। ইমাম তাবারানী (رحمة الله) হাদিসটি উল্লেখ করে বলেন,
لَمْ يَرْوِ هَذَيْنِ الْحَدِيثَيْنِ عَنْ ثَابِتٍ إِلَّا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ -“এই দুইটি রেওয়ায়েত ছাবেত বুনানী থেকে হাম্মাদ ইবনে সালামা ব্যতীত কেউ বর্ণনা করেনি।” ৩৪২
৩৪২. ইমাম তাবারানী: মুজামুল আওছাত, হাদিস নং ২৬০৯;
৩৪৩. ইমাম যাহাবী: মিযানুল এতেদাল, রাবী নং ৩৫৫৮;
এদিকে বিবেচনা করে রেওয়ায়েতটি মুনফারিদ বা একক। আর ‘হাম্মাদ ইবনে সালামা বিশ্বস্ত রাবী হলেও তার শেষ বয়সে স্মৃতি দুর্বল হয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এখানে ছায়া শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহার হয়েছে। কারণ বর্ণনাকারী স্পষ্ট বলেছেন সে সময়টা ছিল نِصْف النَّهَارِ বা দিনের মধ্যবর্তী সময়। তখন সূর্য মাথার উপর থাকে। আর আমরা সবাই জানি দিনের মাঝামাঝি ছায়া সামনে বা পিছনে লম্বা হয়না। যার ফলে ছায়া দেখে দূর থেকে অনুভব করার কোন কথা সঠিক হতে পারেনা। উল্লেখ্য যে, এই হাদিসের বর্ণনাকারী سُمَيَّةُ ‘সুমাইয়্যা’ সম্পর্কে ইমাম শামছুদ্দিন যাহাবী (رحمة الله) বলেন: لا تعرف -“তাকে চিনিনা।” ৩৪৩
কোন কোন সূত্রে দেখা যায় سُمَيَّةُ ‘ছুমাইয়্যা’ এর স্থানে شُمَيْسَةُ ‘সুমাইছাহ’ এর নাম। মূলত হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে ‘ছুমাইয়্যা’ এর সূত্রে। কেননা ইমাম আব্দুর রাজ্জাক ছানআনী (رحمة الله) স্পষ্ট করেই বলেছেন:
قَالَ عَبْدُ الرَّزَّاقِ: هُوَ فِي كِتَابِي سُمَيَّةُ، عَنْ صَفِيَّةَ بِنْتِ حُيَيٍّ، -“আব্দুর রাজ্জাক বলেন: ইহা আমার কিতাবে আছে ছুমাইয়্যা বর্ণনা করেছেন ‘সাফিয়া বিনতে হুয়াই’ হতে।” ৩৪৪
এ জন্যেই ইমাম আহমদ হাদিসটি বর্ণনার সময় সন্ধিহান হয়ে দু’টি নামই উল্লেখ করেছেন এভাবে: حَدَّثَتْنِي شُمَيْسَةُ، أَوْ سُمَيَّةُ -“আমার কাছে হাদিস বর্ণনা করেছেন ‘সুমাইছাহ অথবা ছুমাইয়্যা’।” ৩৪৫
এখানে شُمَيْسَةُ ‘সুমাইছাহ’ এর নামটি যোগ করেছেন বর্ণনাকারী ‘জাফর ইবনে সুলাইমান’। কারণ ‘জাফর ইবনে সুলাইমান’ এর ব্যাপারে ইমাম ইবনে সা’দ (رحمة الله) বলেন: ثِقَةٌ، فِيْهِ ضَعْفٌ. -“সে বিশ্বস্ত এবং তার মাঝে দুর্বলতা রয়েছে।” ৩৪৬
ইমাম ইয়াহইয়া কাত্তান (رحمة الله) তার থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করতেন না এমনকি তার হাদিস লিখতেনও না। ইমাম বুখারী (رحمة الله) বলেছেন:
قَالَ البُخَارِيُّ: جَعْفَرُ بنُ سُلَيْمَانَ الحَرَشِيُّ يُخَالِفُ فِي بَعْضِ حَدِيْثِهِ. -“ইমাম বুখারী বলেন: জাফর ইবনে সুলাইমান হারাশী কোন কোন হাদিসে খেলাফ বা বিরোধপূর্ণ বর্ণনা করতেন।” ৩৪৭
وَقَالَ السَّعْدِيُّ: رَوَى مَنَاكِيْر -“ইমাম সা’দী বলেন: সে মুনকার রেওয়ায়েত বর্ণনা করত।” ৩৪৮
অতএব, এই হাদিস অত্যান্ত দুর্বল যা হুজ্জত হওয়ার যোগ্য নয়। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, ছাবেত বুনানী বর্ণনা করেছেন মাজহুল রাবী ‘ছুমাইয়্যা’ থেকে আর মাজহুল রাবী থেকে ছাবেত বুনানী (رحمة الله) এর রেওয়ায়েত প্রতিষ্ঠিত বা নির্ভরযোগ্য নয়। যেমন ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله) বলেন: وأحاديثه مستقيمة إذا روى عنه ثقة، -“যখন সে বিশ্বস্ত রাবী থেকে হাদিস বর্ণনা করেন তখন হাদিস গুলো প্রতিষ্ঠিত হবে।” ৩৪৯
৩৪৪. মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২৬৮৬৬;
৩৪৫. মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২৬৮৬৬;
৩৪৬. ইমাম যাহাবী: সিয়ারে আলামিন নুবালা, রাবী নং ৩৬;
৩৪৭. ইমাম যাহাবী: সিয়ারে আলামিন নুবালা, রাবী নং ৩৬;
৩৪৮. ইমাম যাহাবী: সিয়ারে আলামিন নুবালা, রাবী নং ৩৬;
৩৪৯. ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৮১১;
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, হাদিসটি হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত কিনা সেটা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কারণ প্রথম অবস্থায় ‘সুমাইছাহ’ মা আয়েশা (رضي الله عنه) এর রেফারেন্স ছাড়াই বর্ণনা করেছেন। যেমন লক্ষ্য করুন,
قَالَ عَفَّانُ: حَدَّثَنِيهِ حَمَّادٌ، عَنْ شُمَيْسَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ...
-আফ্ফান হাদিস বর্ণনা করেছেন হাম্মাদ থেকে- তিনি সুমাইছাহ থেকে- তিনি নবী করিম (ﷺ) থেকে।... ৩৫০
এই দৃষ্টিতে হাদিসটি মুরছাল হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে, যা অন্য ছহীহ্ ও প্রসিদ্ধ হাদিসের মোকাবেলায় গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং এই রেওয়ায়েত দ্বারা রাসূলে পাক (ﷺ) এর ছায়া থাকার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হবেনা। কারণ রেওয়ায়েতটি বহুল সমালোচিত ও অনির্ভরযোগ্য।
❏ একটি আয়াত ও তার ব্যাখ্যা
একটি আয়াত ও তার ব্যাখ্যা
أَوَلَمْ يَرَوْا إِلَى مَا خَلَقَ اللَّهُ مِنْ شَيْءٍ يَتَفَيَّأُ ظِلَالُهُ عَنِ الْيَمِينِ وَالشَّمَائِلِ سُجَّدًا لِلَّهِ
-“তারা কি আল্লাহর সৃজিত বস্তু দেখেনা, যার ছায়া আল্লাহর প্রতি বিনীতভাবে সেজদাবনত থেকে ডান ও বাম দিকে ঝুকে পড়ে।” (সূরা নাহল: ৪৮ নং আয়াত)
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে যেসব সৃষ্টির ছায়া ডানে-বামে সেজদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সেগুলো হল যাদের ছায়া আছে তাদের ব্যাপারে। এজন্যেই ইমাম আবু জাফর আত-তাবারী (رحمة الله) তদীয় তাফছিরে গ্রন্থে বলেন,
وَصَفَ اللَّهُ بِالسُّجُودِ فِي هَذِهِ الْآيَةِ ظِلَالَ الْأَشْيَاءِ، فَإِنَّمَا يَسْجُدُ ظِلَالُهَا دُونَ الَّتِي لَهَا الظِّلَالُ
-“আল্লাহ তা’লা এই আয়াকে প্রত্যেক কিছুর ছায়া সেজদার বিষয়টি সম্বন্ধযুক্ত করেছেন। নিশ্চয় এ গুলোর ছায়া সেজদা করে তবে যাদের ছায়া নেই তারা ব্যতীত।” ৩৫১
৩৫০. মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২৫০০২;
৩৫১. তাফছিরে তাবারী, ১৪তম খন্ড, ২৪১ পৃ:;
আমরা জানি অনেক সৃষ্টি রয়েছে যাদের ছায়া নেই, যেমন ফেরেস্তা ও জি¦ন। অথচ তারাও সেজদা করে। সকল প্রাণীর পাশাপাশি ফেরেস্তারাও যে সেজদা করে তার প্রমাণ সরূপ নিচের আয়াতটি লক্ষ্য করুন,
وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأرْضِ مِنْ دَابَّةٍ وَالْمَلائِكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ.
-“আসমান ও জমীন সমূহে সকল প্রকার প্রাণী ও ফেরেস্তারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেজদা করে, আর তারা অহংকারী নয়।” (সূরা নাহল: ৪৯ নং আয়াত)
অতএব, ফেরেস্তারা সেজদা করে কিন্তু তাদের কোন ছায়া নেই এবং জিন জাতিরাও আল্লাহর প্রতি সেজদা করে অথচ তাদের কোন ছায়া নেই। আর যাদের ছায়া নেই তাদের ছায়া সেজদা করবে কিভাবে? সুতরাং যাদের ছায়া আছে তাদের ছায়াও আল্লাহর প্রতি সেজদা করে ইহা ঐ আয়াতের মূল অর্থ। আর রাসূল (ﷺ) আল্লাহর নূরের সৃষ্ট এবং ছায়া বিহীন কায়া বিধায় প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর ছায়া থাকবেনা এটাই স্বভাবিক।
❏ জিব্রাইল যেখানে যেতে পারেনা রাসূল (ﷺ) সেখানেও গেছেন
আমরা সকলেই অবগত আছি হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) নূরের তৈরী ফেরেস্থা এবং ফেরেস্থা স¤্রাট। অথচ সেই হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) যেখানে যেতে পারেনি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সেই নূরের জগৎ পাড়ি দিয়ে আল্লাহর আরশে মোয়াল্লাহ পাড়ি দিয়ে গেছেন, এবং আল্লাহর সাথে দেখা করেছেন ও কথা বলেছেন। যেমন হাদিস শরীফে আছে,
حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ أَبُو سَلَمَةَ، ثنا حَمَّادٌ وَهُوَ ابْنُ سَلَمَةَ قَالَ: أنبأ أَبُو عِمْرَانَ الْجَوْنِيُّ، عَن زُرَارَة بن أوفى أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِجِبْرِيلَ: هَلْ رَأَيْتَ رَبَّكَ؟ فَانْتَفَضَ جِبْرِيلُ وَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ إِنَّ بَيْنِي وَبَيْنَهُ سَبْعِينَ حِجَابًا مِنْ نُورٍ لَوْ دَنَوْتُ مِنْ بَعْضِهَا لاحترقت
-“হযরত জুরারা ইবনে আওফা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) একদা জিব্রাইল (عليه السلام) কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনিকি আপনার রব তা’লাকে দেখেছেন? এ কথা শুনে জিব্রাইল (عليه السلام) কেপে উঠলেন এবং বললেন: ইয়া মুহাম্মদ! আমার ও তাঁর মাঝে ৭০টি নূরের পর্দা রয়েছে, যদি আমি ইহার কোন একটির নিকটবর্তী হই তবে আমি জ্বলে যাব।” ৩৫২
এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত রয়েছে,
وَعَن أبي أُمَامَة قَالَ: إِنَّ حَبْرًا مِنَ الْيَهُودِ سَأَلَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَيُّ الْبِقَاعِ خَيْرٌ؟ فَسَكَتَ عَنْهُ وَقَالَ: أَسْكُتُ حَتَّى يَجِيءَ جِبْرِيلُ فَسَكَتَ وَجَاءَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ فَسَأَلَ فَقَالَ: مَا المسؤول عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ وَلَكِنْ أَسْأَلُ رَبِّيَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى. ثُمَّ قَالَ جِبْرِيلُ: يَا مُحَمَّدُ إِنِّي دَنَوْتُ مِنَ اللَّهِ دُنُوًّا مَا دَنَوْتُ مِنْهُ قطّ. قَالَ: وَكَيف كَانَ ياجبريل؟ قَالَ: كَانَ بَيْنِي وَبَيْنَهُ سَبْعُونَ أَلْفَ حِجَابٍ مِنْ نُورٍ. فَقَالَ: شَرُّ الْبِقَاعِ أَسْوَاقُهَا وَخَيْرُ الْبِقَاع مساجدها
-“হযরত আবু উমামা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, জৈনিক ইহুদী রাসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, পৃথিবীতে উত্তম স্থান কোনটি? প্রিয় নবীজি (ﷺ) বললেন: জিব্রাইল (عليه السلام) আসার পূর্ব পর্যন্ত চুপ থাক। এই বলে তিনি নিজে ও ঐ ইহুদী চুপ থাকলেন। অতঃপর জিব্রাইল (عليه السلام) আসলেন। হুজুর (ﷺ) বিষয়টি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন। জিব্রাইল (عليه السلام) বললেন: প্রশ্নকারী অপেক্ষা প্রশ্নকৃত ব্যক্তি অধিক জ্ঞাত নয়। তবে আপনি বললে আমি আমার প্রতিপালককে জিজ্ঞাসা করব। অতঃপর জিব্রাইল (عليه السلام) বললেন: হে মুহাম্মদ! আমি আমার রবের নিকটবর্তী হয়ে ছিলাম, যতটা ইতিপূর্বে হয়নি। রাসূল (ﷺ) জিজ্ঞাসা করলেন: কিভাবে? তিনি বললেন: আমার ও আমার রবের মাঝে ৭০ হাজার নূরের পর্দা বাকী ছিল। তখন আল্লাহ পাক বললেন: পৃথিবীর নিকৃষ্টতম স্থান বাজার এবং উৎকৃষ্টতম স্থান মসজিদ।” ৩৫৩
হাদিসটি ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে মারফ‚ সনদে হাদিসটি ভিন্ন আরেকটি সূত্রে বর্ণনা করেছেন। সূত্রটি হল:
حَدَّثَنَا الْوَلِيدُ، حَدَّثَنَا أَبُو حَاتِمٍ، حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ، حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ أَبِي سَارَةَ، عَنْ ثَابِتٍ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ....
-“ওয়ালিদ- আবু হাতিম- মূসা ইবনে ইসমাঈল- আলী ইবনে আবী ছারা- ছাবিত- আনাস ইবনে মালেক (رضي الله عنه)... ৩৫৪
ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তার ছহীহ্ গ্রন্থে হযরত ইবন উমর (رضي الله عنه) থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। এই হাদিসটি হযরত আনাস (رضي الله عنه) ও হযরত জুরারা ইবনে আবী আওফা (رضي الله عنه) থেকেও বর্ণিত আছে। তবে এ বিষয়ে আরেক হাদিসে আছে,
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ الْحَضْرَمِيُّ، ثنا مُحَمَّدُ بْنُ عُمَرَ بْنِ أَبِي لَيْلَى، حَدَّثَنِي أَبِي، عَنِ ابْنِ أَبِي لَيْلَى، عَنِ الْحَكَمِ، عَنْ مِقْسَمٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ إِسْرَافِيلَ مُنْذُ يَوْمَ خَلْقَهُ صَافًّا قَدَمَيْهِ لَا يَرْفَعُ بَصَرَهُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ الرَّبِّ تَبَارَكَ وَتَعَالَى سَبْعُونَ نورا مَا مِنْهَا من نورٍ يدنو مِنْهُ إِلاّ احْتَرَقَ . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَصَححهُ
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: আল্লাহ তা’লা যেদিন হযরত ই¯্রাফিল (عليه السلام) কে সৃষ্টি করলেন, তিনি সেদিন হতেই দুই পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। চক্ষু তুলেও দেখেননি। আর তাঁর ও তাঁর রবের মাঝে ৭০ টি নূরের পর্দা রয়েছে। তিনি এগুলো যেকোন একটির নিকটবর্তী হলে তখন’ই ইহা তাঁকে জ্বালিয়ে ফেলবে।” ৩৫৫
ইমাম তিরমিজি হাদিসটিকে صَحِيحٌ ‘ছহীহ’ বলেছেন। এ সম্পর্কে আরেক হাদিসে আছে,
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَمْرٍو، ثَنَا يَحْيَى بْنُ سُلَيْمَانَ الْجُعْفِيُّ، ثَنَا عَمِّي عَمْرُو بْنُ عُثْمَانَ، ثَنَا أَبُو مُسْلِمٍ قَائِدُ الْأَعْمَشِ عَنِ الْأَعْمَشِ، عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: سَأَلْتُ جِبْرِيلَ: هَلْ تَرَى رَبَّكَ؟ قَالَ: إِنَّ بَيْنِي وَبَيْنَهُ سَبْعِينَ حِجَابًا مِنْ نُورٍ، لَوْ رَأَيْتُ أَدْنَاهَا لَاحْتَرَقْتُ
-“হযরত আনাস (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) কে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কি আপনার রবকে দেখেছেন? তিনি বললেন: আমার ও আমার প্রভূর মাঝে ৭০টি নূরের পর্দা রয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে কাছের পর্দাটির নিকটবর্তী হলেই আমি জ্বলে ছাই হয়ে যাব।” ৩৫৬
৩৫২. ইমাম দারেমী: রদ্দে আলা জাহমিয়া, হাদিস নং ১১৯; ইমাম আবুশ শায়েখ ইসবাহান: আল আজমাত, ২য় খন্ড, ৬৭৭ পৃ:; মেসকাত শরীফ, ৫১০ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১০ম খন্ড, ৪১০ পৃ:; ইমাম বাগভী: মাসাবিহুস সুন্নাহ, হাদিস নং ৪৪৫৭; ইমাম ছিয়তী: জামেউছ ছাগীর, হাদিস নং ৪৬১০; হিলিয়াতুল আউলিয়া, লুমআতুত তানকীহ;
৩৫৩. মেসকাত শরীফ, মাসাজিদ অধ্যায়, হাদিস নং ৭৪১; ইমাম ছিয়তী: জামেউল আহাদিস, হাদিস নং ৪১৩৮৯; ছহীহ্ ইবনে হিব্বান; সুনানে ইবনে মাজাহ্; মুসনাদে আহমদ, ৪র্থ খন্ড, ৮১ পৃ:; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, ৪র্থ খন্ড, ১৩৯ পৃ:; ইমাম আবু নুয়াইম: তারিখে ইছবাহান, ১ম খন্ড, ৩২৮ পৃ:; মেরকাত শরহে মেসকাত; শরহে ত্বাবী; আখবারুজ জামান, ১ম খন্ড, ২৭ পৃ:)। মেসকাতের তাহকিকে আলবানী হাদিসটিকেحسن ‘হাছান’ বলেছেন;
৩৫৪. ইমাম আবুশ শায়েখ ইসপাহানী: আল আজমাত, ২য় খন্ড, ৬৭১ পৃ:;
৩৫৫. ইমাম তাবারানী: মুজামুল কবীর, হাদিস নং ১২০৬১; ইমাম আবুশ শায়েখ: আল আজমাত, ২য় খন্ড, ৬৭৪ পৃ:; মেসকাত শরীফ, ৫১০ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১০ খন্ড, ৪১০ পৃ:; তিরমিজি শরীফ বাদাইল খাল্ক অধ্যায়ে; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ১৫৭; লুমআতুত তানকীহ;
এ বিষয়ে হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (رضي الله عنه), হযরত সা’দ (رضي الله عنه), হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه), মুজাহিদ (رحمة الله) প্রমূখ হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে শাহিন (رحمة الله), ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله), ইমাম আবু ইয়ালা (رحمة الله), ইমাম তাবারানী (رحمة الله), ইমাম আবুশ শায়েখ ইস্পাহানী (رحمة الله) আরেকটি সূত্র বর্ণনা করেছেন,
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ هَارُونَ الْحَضْرَمِيُّ حَدَّثَنَا بُنْدَارٌ مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ. ح. وَحَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ الْمَرْوَزِيُّ حَدَّثَنَا أَبُو سَعْدٍ الزُّهْرِيُّ وَعُمَرُ بْنُ مُدْرِكٍ وَإِبْرَاهِيمُ بْنُ مَالِكٍ قَالُوا: حَدَّثَنَا مَكِّيُّ بْنُ إِبْرَاهِيمَ حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ عُبَيْدَةَ عَنْ عُمَرَ بْنِ الْحَكَمِ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو وَعَنْ أَبِي حَازِمٍ عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالا: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: دُونَ اللَّهِ سَبْعُونَ أَلْفِ حِجَابٍ مِنْ نُورٍ وَظُلْمَةٍ
-“হযরত সাহল ইবনে সাদ (رضي الله عنه) থেকে আব্দুল্লাহ ইবনে ইবনে আমর ও আবু হাযেম উভয়েই বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: আল্লাহ তালা ছাড়াও ৭০ হাজার নূরের ও জুলমাতের পর্দা রয়েছে।” ৩৫৭
এ সম্পর্কে মোট ৮ জন সাহাবী ও একাধিক তাবেঈ থেকে হাদিস বর্ণিত আছে, যা ‘মশহুর’ পর্যায়ের এবং ‘তাওয়াতুর’ এর কাছাকাছি। সুতরাং প্রমাণিত হল, নূরের তৈরী ফেরেস্থা জিব্রাইল (عليه السلام), ই¯্রাফিল (عليه السلام) যেখানে যাইতে পারেনা, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সেখানেও গেছেন। আল্লাহর নূরের পর্দার কাছে যদি নূরের ফেরেস্থা জিব্রাইলও যেতে না পারেন সেখানে রাসূল (ﷺ) মাটির তৈরী হয়ে যাবেন কিভাবে? অথচ সেখানে মাটির অবস্থান চিন্তাও করা যায়না। সুতরাং প্রমাণিত হল, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এঁর নূরের ক্ষমতা জিব্রাইল, ই¯্রাফিল (عليه السلام) এর নূরের চেয়েও বেশী।
❏ ফকিহ্, মুজতাহিদ ও মুজাদ্দিদগণের দৃষ্টিতে রাসূল নূর
হাফিজুল হাদিস ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله) {ওফাত ৯১১ হিজরী} ও আল্লামা ইবনে ছা’বা (رحمة الله) এর আকিদা হচ্ছে,
قَالَ ابْن سبع من خَصَائِصه ان ظله كَانَ لَا يَقع على الأَرْض وَأَنه كَانَ نورا فَكَانَ إِذا مَشى فِي الشَّمْس أَو الْقَمَر لَا ينظر لَهُ ظلّ
-“হযরত ইবনে সাবা (رحمة الله) বলেন: এটা রাসূল (ﷺ) বৈশিষ্ট্যাবলীর অন্তর্ভূক্ত যে, তাঁর দেহ মোবারকের ছায়া জমীনে পড়তনা কেননা নিশ্চয় তিনি ছিলেন নূর। কারণ তিনি যখন হাটতেন তখন চন্দ্র ও সূর্যের আলোতে তাঁর ছায়া পড়ত না।” ৩৫৮
❏ হাজার বছরের মুজাদ্দেদ হযরত শায়েখ আহমদ ছেরহেন্দী মুজাদ্দেদ আল্ফেছানী (রাঃ
হাজার বছরের মুজাদ্দেদ হযরত শায়েখ আহমদ ছেরহেন্দী মুজাদ্দেদ আল্ফেছানী (رضي الله عنه) তদীয় মাকতুবাতে বলেন:
-“হাকিকতে মুহাম্মদী বিকাশের দিক দিয়ে সর্বপ্রথম এবং সকল হাকিকতের হাকিকত। সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম (عليه السلام) ও ফেরেস্থাগণ হুজুর (ﷺ) এর হাকিকতের নির্যাস। তাই রাসূলে খোদা (ﷺ) বলেছেন, সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’লা যা সৃষ্টি করেছেন তা হল আমার নূর। আরো বলেছেন যে, আমি আল্লাহর নূর হতে এবং সকল ইমানদারগণ আমার নূর হতে।” ৩৫৯
দেখুন! হাজার বছরের মুজাদ্দেদ শায়েখ আহমদ ছেরহেন্দী মুজাদ্দেদ আল্ফেছানী (رحمة الله) এর দৃষ্টিতেও রাসূলে করিম (ﷺ) এর নূরে মুহাম্মদীকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে। যেহেতু সবকিছুর পূর্বে রাসূল (ﷺ) এর সৃষ্টি, সেহেতু মাটি দ্বারা রাসূল (ﷺ) এর সৃষ্টি হতে পারেনা। কারণ যখন রাসূল (ﷺ) এর সৃষ্টি হয়েছে তখন মাটি বলতে কোন জিনিস ছিলনা।
❏ হিজরী ১২শ শতাব্দির মুজাদ্দেদ ও সর্বজন মান্যবর আলিম আল্লামা শাহ্ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله)
হিজরী ১২শ শতাব্দির মুজাদ্দেদ ও সর্বজন মান্যবর আলিম আল্লামা শাহ্ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله) বলেছেন:
-“রুহ্ জগতে সর্বপ্রথম যাকে সৃষ্টি করা হয় তিনি হচ্ছেন হযরত রাসূল (ﷺ)।” ৩৬০
হুজুর গাউছে পাক শায়েখ সায়্যেদ মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী (رضي الله عنه) বলেন,
قال الله عز وجل خلقت روح محمد صلى الله عليه وسلم من نور وجهى كما قال النبي اول ما خلق الله نوري
-“আল্লাহ তা’লা বলেন: আমি আমার নিজ জাতের কুদরতী জামালের নূর হতে মুহাম্মদ (ﷺ) এর রুহ্ সৃষ্টি করেছি। যেমন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন।” ৩৬১
৩৫৯. মাকতুবাতে ইমামে রব্বানী, ৩য় খন্ড, ২৩১ পৃ:;
৩৬০. তাফছিরে আজিজী, ৩০ পারা: ২১৯ পৃষ্টা;
৩৬১. গাউছ পাক: ছিররুল আছরার, ৫ পৃ:; বাহজাতুল আছরার, ১২ পৃ:;
হিজরী ১১শ শতাব্দির মুজাদ্দেদ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) {ওফাত ১০১৪ হিজরী} বলেন,
وَأَمَّا نُورُهُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ فَهُوَ فِي غَايَةٍ مِنَ الظُّهُورِ شَرْقًا وغَرْبًا وَأَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ نُورَهُ وَسَمَّاهُ فِي كِتَابِهِ نُورًا
-“সৃষ্টির সর্বত্র প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর নূরানী সত্বাই সর্বাধিক পরিচিত ও প্রকাশিত। আল্লাহ তা’লা তাঁর নূরানী সত্বাকে সর্বাগ্রে সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনে তাঁকে নূর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।” ৩৬২
ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) আরো বলেছেন,
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ سُئِلَ عَنْ قَوْلِهِ تَعَالَى: {وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ} عَلَى أَيِّ شَيْءٍ كَانَ الْمَاءُ؟ قَالَ: عَلَى مَتْنِ الرِّيحِ. رَوَاهُ الْبَيْهَقِيُّ ذَكَرَهُ الْأَبْهَرِيُّ، فَالْأَوَّلِيَّةُ إِضَافِيَّةٌ، وَالْأَوَّلُ الْحَقِيقِيُّ هُوَ النُّورُ الْمُحَمَّدِيُّ عَلَى مَا بَيَّنْتُهُ فِي الْمَوْرِدِ لِلْمَوْلِدِ.
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় তিনাকে আল্লাহ তালার বাণী وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। পানি কিসের উপর ছিল? তিনি বলেছেন, ঠান্ডা বাসাতের উপর। ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) ইহা বর্ণনা করেছেন, আবহার এরুপই উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি আওয়াল সম্বন্ধীয়, মূলত প্রথম সৃষ্টি হল নূরে মুহাম্মদী (ﷺ); যেমনটা ‘আল মাওরিদুর লিল মাওলিদ’ কিতাবে বয়ান করেছি।” ৩৬৩
ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এই কথার ব্যাখ্যা করে বলেন,
أنه الذي أفتتح به الوجودات وابتدىء به الكائنات كما قال أول ما خلق الله روحي أو نوري
-“নিশ্চয় তিনি সকল কিছু অস্তিত্বদান শুরু করলেন ইহার দ্বারাই শুরু করেছেন, যেমনটি বলেছেন: আল্লাহ সর্ব প্রথম আমার রুহ সৃষ্টি করেছেন অথবা আমার নূর থেকে।” ৩৬৪
৩৬২. ইমাম মোল্লা আলী: মাওজুয়াতুল কবীর, ৮৬ পৃ:;
৩৬৩. ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: মেরকাতুল মাফাতীহ, ৯৪ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
৩৬৪ইমাম মোল্লা আলী: শরহে শিফা, ২য় খন্ড, ১২৬ পৃ:;
এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত ইমাম ও হাফিজুল হাদিস, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) (ওফাত ৮৫২ হিজরী) বলেছেন ও হিজরী ১১শ শতাব্দির মুজাদ্দিদ, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) {ওফাত ১০১৪ হিজরী} সংকলন করেছেন,
قَالَ ابْنُ حَجَرٍ: اخْتَلَفَتِ الرِّوَايَاتُ فِي أَوَّلِ الْمَخْلُوقَاتِ، وَحَاصِلُهَا كَمَا بَيَّنْتُهَا فِي شَرْحِ شَمَائِلِ التِّرْمِذِيِّ أَنَّ أَوَّلَهَا النُّورُ الَّذِي خُلِقَ مِنْهُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ، ثُمَّ الْمَاءُ، ثُمَّ الْعَرْشُ
-“হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন: প্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে রেওয়ায়েতগুলোর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। এর সার কথা, যেমনটি আমি ‘শরহে শামায়েলে তিরমিজি’ কিতাবে বলেছি, নিশ্চয় এ গুলোর মধ্যে প্রথম সৃষ্টি হল ‘নূর’ যা দ্বারা রাসূলে পাক (ﷺ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর পানি সৃষ্টি করা হয় অতঃপর আরশ সৃষ্টি করা হয়।” ৩৬৫
আল্লামা ইবনুল হাজ্জ আল মালেকী (رحمة الله) {ওফাত ৭৩৭ হিজরী} তিনি বলেন,
أَنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى خَلَقَ نُورَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبْلَ خَلْقِ آدَمَ بِأَلْفَيْ عَامٍ وَجَعَلَهُ فِي عَمُودٍ أَمَامَ عَرْشِهِ يُسَبِّحُ اللَّهَ وَيُقَدِّسُهُ
-“নিশ্চয় আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’লা হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টির ১ হাজার বছর পূর্বে নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি করেছেন। পরবর্তীতে ইহাকে আরশের খুটিতে রাখলেন ও ইহা আল্লাহর তাসবীহ্ ও পবিত্র ঘোষনা করতে লাগলেন।” ৩৬৬
আল্লামা ইবনুল হাজ্জ আল মালেকী (رحمة الله) {ওফাত ৭৩৭ হিজরী} তিনি বলেন,
فِيهِ أَيْضًا أَنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ نُورُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَقْبَلَ ذَلِكَ النُّورُ يَتَرَدَّدُ وَيَسْجُدُ بَيْنَ يَدَيْ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ
-“তার মধ্যে আছে, আল্লামা খতিব আবী রবিঈ এর ‘সিফাউছ ছিকাম’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’লা যা সৃষ্টি করেছেন তা হল মুহাম্মদ (ﷺ) এঁর নূর। অতঃপর ঐ নূর ভূ-কম্পিত হচ্ছিল এবং আল্লাহ তা’লার নিকট সেজদা করছিল।” ৩৬৭
৩৬৫. ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১ম খন্ড, ২৪১ পৃ:, ৭৯ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
৩৬৬. ইবনুল হাজ্জ: মাদখাল, ২য় খন্ড, ৩০ পৃ:;
৩৬৭. ইবনুল হাজ্জ: আল মাদ্খাল, ২য় খন্ড, ৩২ পৃ:;
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকায়েদের ইমাম আল্লামা আবুল হাছান আশয়ারী (رحمة الله) বলেন:
انه تعالى نور ليس كالانوار وروح النبوية القدسية لمعة من نوره والملائكة اشرار تلك الانوار وقال صلى الله عليه وسلم اول ما خلق الله نورى ومن نورى خلق الله كل شئ
-“আল্লাহ তা’লা নূর, তবে অন্যান্য নূরের মত নয়। আর নবী করিম (ﷺ) এর রুহ্ মোবারক তার নূরের জলক। আল ফেরেস্থরা হচ্ছে তার নূরের শিখা। রাসূলে পাক (ﷺ) বলেন: আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন এবং সকল কিছু আমার নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ৩৬৮
বিশ্বখ্যাত মুফাচ্ছির আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী (رحمة الله) সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতের তাফছিরে উল্লেখ করেন,
ولذا كان نوره صلّى الله عليه وسلّم أول المخلوقات، ففي الخبر أول ما خلق الله تعالى نور نبيك يا جابر
-“আর এ কারণেই তাঁর নূরানী সত্বা সমস্থ মাখলুকাতের পূর্বে সৃষ্টি এবং এ কথাই হাদিস শরীফে আছে: হে জাবের! আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।” ৩৬৯
হাজার বছরের মুজাদ্দেদ শায়েখ আহমদ ছেরহেন্দী মুজাদ্দেদ আল্ফেছানী ফারুকী (رضي الله عنه) তদীয় মাকতুবাতে আরো বলেন:
-“জেনে রাখা অতীব প্রয়োজন যে, হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) সৃষ্টির অপরাপর মানুষের মত নন। এমনকি কুল কায়েনাত বা সমগ্র সৃষ্টি জগতের কেহই তাঁর সাথে সাদৃশ্য রাখেনা। কেননা রাসূল (ﷺ) ‘নিছায়ে উনসূরিতে’ বা মানবীয় দেহ বিশিষ্ট হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নূর কর্তৃক সৃষ্টি হয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) নিজেই বলেছেন: আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম আমার নূর সৃাষ্টি করেছেন”।” ৩৭০
৩৬৮. মাতালিউল মুসাররাত, ২১ পৃষ্টা;
৩৬৯. তাফছিরে রুহুল মাআনী, ৯ম খন্ড, ১০০ পৃ:;
৩৭০. মাকতুবাতে ইমামে রব্বানী;
❏ বিশ্ব বিখ্যাত মুফাচ্ছির আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী হানাফী (رحمة الله) {ওফাত ১১২৭ হিজরী}
বিশ্ব বিখ্যাত মুফাচ্ছির আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী হানাফী (رحمة الله) {ওফাত ১১২৭ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন,
وسمى الرسول نورا لان أول شىء أظهره الحق بنور قدرته من ظلمة العدم كان نور محمد صلى الله عليه وسلم كما قال أول ما خلق الله نورى
-“আল্লাহ তা’লা হযরত রাসূলে পাক (ﷺ) এর নাম মোবারক রেখেছেন ‘নূর’। কেননা আল্লাহ তা’লা তার কুদরতের নূর থেকে সর্বপ্রথম যা প্রকাশ করেছেন তা হল মুহাম্মদ (ﷺ) এর নূর। যেমন রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: সর্বপ্রথম আল্লাহ পাক আমার নূর সৃষ্টি করেছেন।” ৩৭১
আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী হানাফী (رحمة الله) {ওফাত ১১২৭ হিজরী} আরো বলেন,
ان السراج الواحد يوقد منه الف سراج ولا ينقص من نوره شىء وقد اتفق اهل الظاهر والشهود على ان الله تعالى خلق جميع الأشياء من نور محمد ولم ينقص من نوره شىء
-“নিশ্চয় একটি প্রদীপ থেকে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালালেও ঐ প্রদীপের আলো সামান্যতমও কমেনা। প্রত্যেক আহলে জাহের এ বিষয়ে একমত যে, আল্লাহ তা’লা সব কিছুই মুহাম্মদ (ﷺ) এর নূর মোবারক দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। অথচ তাঁর নূর মোবারক সামান্যতমও কমেনি।” ৩৭২
হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (رضي الله عنه) তদীয় নছিহত শরীফে বলেন:
“আল্লাহ তা’লা নবী করিম (ﷺ) এর নূর দ্বারা বিশ্বব্রম্মান্ড সৃষ্টি করেছেন। অন্যান্য নবীগণকেও তদীয় নূর বা নূরে মুহাম্মদী দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে”। ৩৭৩
তিনি আরো বলেন: “দয়াল নবী (ﷺ) প্রথম সৃষ্টি। তিনি আল্লাহর নূরে সৃষ্ট এবং তাবৎ বস্তু তাঁর নূরে সৃষ্ট”। ৩৭৪
৩৭১. তাফছিরে রুহুল বয়ান, ২য় খন্ড, ৩৭০ পৃ:;
৩৭২. তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৭ম খন্ড, ১৯৭ পৃ:;
৩৭৩. নছিহত বই নং ১৫, পৃষ্টা নং ৬৪;
৩৭৪. নছিহত বই নং ১৫, পৃষ্টা নং ২৫;
❏ হানাফী মাজহাবের ইমাম, মুজতাহিদ ফিদ্দ্বীন ইমামে আজম আবু হানিফা (رضي الله عنه) {ওফাত ১৫০ হিজরী}
হানাফী মাজহাবের ইমাম, মুজতাহিদ ফিদ্দ্বীন ইমামে আজম আবু হানিফা (رضي الله عنه) {ওফাত ১৫০ হিজরী} বলেন:-
انت الذى لو لاك ما خلق امرء * كلا ولا خلق الورى لو لاك
-“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি না হলে কোন ব্যক্তিই সৃষ্টি হতনা, আপনি না হলে কোন মাখলুখই সৃষ্টি হতনা।” ৩৭৫
ইমামে আজম আবু হানিফা (رضي الله عنه) এর দৃষ্টিতে নবী করিম (ﷺ) উছিলায় সব কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রথম সৃষ্টি হচ্ছে মহানবী (ﷺ)। তাই প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর উছিলায় মাটি সৃষ্টি হয়েছে, মাটি দ্বারা নবী করিম (ﷺ) কে নয়।
❏ আল্লামা সৈয়দ আহমদ ইবনে আব্দুল গণী ইবনে উমর দামেস্কী (رحمة الله)
আল্লামা সৈয়দ আহমদ ইবনে আব্দুল গণী ইবনে উমর দামেস্কী (رحمة الله) বলেন,
واعلم ايها الفهيم ان اول من خلق نور نبيك صلى الله عليه وسلم ثم جميع الخلائق من العرش الى الثرى من بعض نوره
-“হে জ্ঞানীগণ! তোমরা জেনে রাখ!! নিশ্চয় প্রথম সৃষ্টি হল নবী পাক (ﷺ) এর ‘নূরে মুহাম্মদী’। অতঃপর আরশ থেকে জমীনের নিম্ন পর্যন্ত সকল সৃষ্টি ঐ নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” ৩৭৬
❏ ভারতবর্ষের সকল উলামায়ে কেরামের মান্যবর আল্লামা শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله) এর সম্মানিত পিতা আল্লামা শাহ্ আব্দুর রহিম মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله)
ভারতবর্ষের সকল উলামায়ে কেরামের মান্যবর আল্লামা শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله) এর সম্মানিত পিতা আল্লামা শাহ্ আব্দুর রহিম মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে বলেন:
“আরশ থেকে ফরশ পর্যন্ত উর্দ্ধ জগতের সকল নূরী ফেরেস্থা, নিম্ন জগতের সকল সৃষ্টি হাকিকতে মুহাম্মদীয়া থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। নবী করিম (ﷺ) এর বাণী: সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’লা আমার নূর সৃষ্টি করেছেন এবং আমার নূর থেকেই সকল কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ তা’লা তাঁর প্রিয় মাহবুবকে লক্ষ্য করে বলেন: আমি আপনাকে না বানাইলে কোন কিছুই বানাইতাম না এবং আমার প্রভূত্বও প্রকাশ করতাম না”। ৩৭৭
৩৭৫. কাসিদায়ে নুমান, সনজরী পাবলি:;
৩৭৬. যাওয়াহিরুল বিহার, ৩য় খন্ড, ৩৬৩ পৃ:;
৩৭৭. আনফাছে রহিমিয়্যা, ১৩ পৃ:;
মারকাজুল আসানিদ, আল্লামা শায়েখ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله) এ সম্পর্কে তদীয় কিতাবে বলেন:-
بدانك اول مخلوقات وواسطہ صدور كا ئنات وواسطہ خلق عالم وادم عليه السلام نور محمد صلى الله عليہ وسلم ست چنانچہ حديث در در صحيح دار دشده كہ اول ما خلق الله نورى وسائر مكونات علوى وسفلى ازاں نور وازاں جوهر پاك پيدا شده-
-‘‘জেনে রেখ, সর্বপ্রথম সৃষ্টি এবং সকল মাখলুকাত তথা আদম সৃষ্টিরও একমাত্র মাধ্যম নূরে মুহাম্মদী (ﷺ)। কেননা ’’ছহীহ্’’ হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
اول ما خلق الله نورى
‘আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন’ এবং উর্ধ্ব ও নিম্ন জগতের সবই তাঁরই নূরে পাক ও মৌলিক সত্ত্বা থেকেই সৃষ্ট।” ৩৭৮
৩৭৮. শায়েখ আব্দুল হক্ব: মাদারেজুন নবুয়াত, ১ম খন্ড, ৬ পৃ:;
৩৭৯. শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী : মাদারেজুন নবুওয়াত : ১/৬ পৃ
সতিনি তাঁর কিতাবে সূরা আনআমের ১৬৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আরও বলেন-
اما اول وى صلى الله عليہ وسلم اوليت درايجاد كہ اول ما خلق الله نورى اوليت در نبوت كہ كنت اويست نبيا وادم منجدل فى طينة واول در عالم در روز ميثاق الست بربكم قالوا بلى واول من امن بالله وبذالك امرت وانا واول المسلمين-
-‘‘তিনি সৃষ্টির মধ্যে সর্বপ্রথম। ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘য়ালা সর্বপ্রথম যা সৃষ্টি করেছেন, তাহল আমারই নূর। তিনি নবুওয়াত প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও সর্বপ্রথম। অতঃপর ইরশাদ ফরমান, আমি তখনো নবী ছিলাম যখন আদম (عليه السلام) মাটির সাথে গড়াগড়ি খাচ্ছিল (এর সৃষ্টি সম্পন্ন হয়নি)। তিনি নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণের দিন আল্লাহর বাণী ‘আমি কি তোমাদের রব নই?’ এর বেলায় সর্বপ্রথম ‘হ্যা’ বলে সম্মানিত উত্তরদাতা। তিনিই সর্বপ্রথম আল্লাহ তা‘য়ালার প্রতি ঈমান স্থাপনকারী।’’ ৩৭৯
রাসূল (ﷺ) আপাদ মস্তক নূর ছিলেন তাই তাঁর ছায়া ছিল না। এ প্রসঙ্গে শায়খুল মুহাদ্দিসীন হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) বলেন,
ونبود مر آں حضرت صلی اللہ علیہ وسلم را سایہ در آفتاب نہ در قمر
-‘‘নূরে মুজাস্সাম (ﷺ) এর ছায়া সূর্যের আলোতে ও ছিল না, চাঁদের আলোতেও ছিল না।’’ ৩৮০
❏ ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা শাহ আব্দুল আযিয মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) {ওফাত. ১২৩৯ হিজরী)
২. ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা শাহ আব্দুল আযিয মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) {ওফাত. ১২৩৯ হিজরী) সমস্ত দেওবন্দী আলেমরা যাকে শ্রদ্ধা করে থাকে এবং অধিকাংশ বাংলাদেশের শাজরায় যার নাম রয়েছে, তিনি স্বীয় “তাফসীরে আযিযী”তে বলেন,
در عالم ارواح اول كسے كہ پيدا شد ايشاں بودند- -‘‘রূহ জগতে (আলমে আরওয়াহে) সর্বপ্রথম যাকে সৃষ্টি করা হয়, তিনি হচ্ছেন রাসূল (ﷺ)।’’ ৩৮১
রাসূল (ﷺ) আপাদ মস্তক নূর ছিলেন তাই তাঁর ছায়া ছিল না। এ প্রসঙ্গে শাহ সাহেব (رحمة الله) আরো লিখেন- سایہ ایشاں بر زمین نمی افتاد -‘‘হুযুর (ﷺ) এর ছায়া যমিনে পড়ত না।’’ ৩৮২
৩৮০. শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী : মাদারিজুন্নবুওয়াত, ১/৪৩ পৃ.
৩৮১. শাহ আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভী : তাফসীরে আযিযী (শেষ জিলদ) : ৩০ পারা : পৃ-২১৯
৩৮২. শায়খ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভী : তাফসীরে আযীযী, সূরা ওয়াদ্দোহাঃ ৩/৩১২ পৃ:;
সউল্লেখিত দালায়েল এর আলোকে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ পাক তাঁর নূর থেকে সর্বপ্রথম নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি করেছেন। আর এ বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর উলামা, ফোজালা, ফোকাহা, ও আইম্মায়ে কেরাম সকলেই একমত। রাসূলে পাক (ﷺ) এর পরে যারা দ্বীন ইসলামের ধারক ও বাহক ছিলেন এবং সিরাতুল মুস্তাকিম এর মডেল ছিলেন তাঁরা সকলেই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে আল্লাহর নূরের সৃষ্টি বলেছেন। তাই ছাল্ফে-ছালেহীনের আকিদার সাথে আমরাও একমত পোষণ করি, কারণ ইহাই সিরাতুম মুস্তাকিম তথা সরল-সঠিক এবং জান্নাতী দলের আকিদা ও বিশ্বাস।
❏ দেওবন্দী উলামাদের দৃষ্টিতে রাসূল (ﷺ) নূরের তৈরী
দেওবন্দী উলামাদের দৃষ্টিতে রাসূল (ﷺ) নূরের তৈরী
দেওবন্দের বিখ্যাত আলিম, মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহী ছাহেব তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন, একজন প্রশ্ন করেন-
سوال: اول ما خلق الله نورى اور لولاك لما خلقت الافلاك يہ دونوں حديثيں صحيح حديثيں ہیں يا وضعى ؟ كو وضعى بلاتا ہے-
প্রশ্নঃ সর্বপ্রথম আল্লাহ তা‘য়ালা যা সৃষ্টি করেছেন, তা হল আমার নূর এবং আপনাকে সৃষ্টি না করলে আসমানসমূহ এবং যমীন কোন কিছুই সৃষ্টি করতাম না। এ মর্মে বর্ণিত হাদিসগুলো বিশুদ্ধ, নাকি জাল? যায়েদ নামক ব্যক্তি এগুলো কে জাল বলছে। এ প্রশ্নের উত্তরে গাঙ্গুহী সাহেব বলেন,
جواب: يہ حديثيں كتب صحاح ميں موجود نہيں ہيں – مگر شيخ عبد الحق رحمة الله نے اول ما خلق الله نورى كو نقل كيا ہے اور بتايا ہے كہ اس كى كچہ اصل ہے فقط و الله تعالى اعلم -
-“এ হাদিসগুলো ছিহাহ কিতাবে (ছয়টি বিশুদ্ধ কিতাব) এর মধ্যে নেই। কিন্তু, শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) “সর্বপ্রথম রাসূল (ﷺ) এর নূর মোবারক সৃষ্টি করা হয়েছে” উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করে বলেছেন যে, এ হাদিসটির ভিত্তি আছে।’’ ৩৮৩। ফাত্ওয়ায়ে রশিদিয়া, ১ম খন্ড, ২৭৮ পৃ:;
প্রিয় পাঠক সমাজ! লক্ষ্য করুন, “সর্বপ্রথম আল্লাহ পাক নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি করেছেন” এই হাদিস সম্পর্কে মাওলানা গাংগুহী সাহেব কোন প্রকার তিরস্কার না করে সমর্থন দিয়েছেন। সুতরাং রাসূল (ﷺ) নূর সর্বপ্রথম সৃষ্টি ইহা মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহীর আকিদা ছিল।
মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহী সাহেব অন্যত্র আরো বলেন,
حق تعالی در شان حبیب خود صلی اللہ علیہ وسلم فرمود کہ آمدہ نزد شما از طرف حق تعالی نور وکتاب مبین ومراد از نور ذات پاک حبیب خدا صلی اللہ علیہ وسلم نیز فرمود کہ اے نبی ترا شاہد مبشر و نذیر وداعی الی اللہ وسراج منیر فرستادہ ایم ومنیر روشن کنندہ ونور دہندہ را گویند پس اگر کسے را روشن کردن از انساناں محال بودے آن ذات پاک صلی اللہ علیہ وسلم را ہم ایں امر میسر نیامد کہ آ ذات پاک صلی اللہ علیہ وسلم ہم از جملہ اولاد آدم علیہ السلام اند مگر آں حضرت صلى اللہ علیہ وسلم ذات خود را چناں مطہر فرمود کہ نور خالص گشتند وحق تعالی ان جناب سلامہ علیہ را نور فرمود وبہ تواتر ثابت شد کہ آں حضرت عالی سایہ نہ داشتند ظاہر است کہ بجز نور ہمہ اجسام ظل می دارند۔
-‘‘আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর হাবিব (ﷺ) এর শানে ফরমায়েছেন, তোমাদের কাছে আল্লাহর নিকট হতে এক নূর ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে। ৩৮৪
এ আয়াতের নূর দ্বারা হাবিবে খোদা (ﷺ) এর পবিত্র সত্তাকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তা‘য়ালা আরো বলেন, হে নবী (ﷺ)! আমি তো আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহŸানকারী এবং উজ্জ্বল প্রদীপ (সিরাজে মুনীর) রূপে পাঠিয়েছি। আর ‘মুনীর’ উজ্জ্বলকারী ও আলোক দাতাকে বলে। সুতরাং মানুষের মধ্যে কাউকে উজ্জ্বল করা যদি অসম্ভব হতো তাহলে হযরত (ﷺ) এর পবিত্র সত্তার অন্তর্গত, কিন্তু তিনি (ﷺ) তাঁর মোবারক সত্তাকে এমনভাবে পবিত্র করেছেন যে, তিনি নিখুঁত নূরে পরিণত হন এবং আল্লাহ তা‘য়ালা তাকে নূর ফরমায়েছেন। আর সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) এর ছায়া ছিলনা এবং এটাও প্রকাশ্যমান যে, নূর ব্যতীত সমুদয় জড় দেহের ছায়া থাকে।’’ ৩৮৫
৩৮৪. সুরা মায়েদা আয়াত নং.১৫
৩৮৫. এমদাদুস সুলুক, ৮৫ পৃষ্টা;
লক্ষ্য করুন, এখানে গাংগুহী সাহেব রাসূল (ﷺ) দেহ মোবারককে নূরের বলে স্পষ্ট দাবী করেছেন। কেননা মাটির দেহের ছায়া থাকে, আর নবী পাক (ﷺ) এর দেহ মোবারকের ছায়া ছিলনা।
❏ দেওবন্দের বিখ্যাত আরেক আলিম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব
দেওবন্দের বিখ্যাত আরেক আলিম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব তদীয় কিতাবে বলেন,
يہ بات مشہورہ كہ ہمارے حضور صلى الله عليه وسلم كا سايہ نہے تہا اسلئہ كہ ہمارے حضور صلى الله عليه وسلم سرچا نور ہے نور تہے-
-‘‘এ কথা প্রসিদ্ধ যে, আমাদের হুযুর (ﷺ) এর ছায়া ছিল না। (কারণ) আমাদের হুজুর (ﷺ) এর আপাদমস্তক নূরানী ছিলেন। হুযুর (ﷺ) এর মধ্যে নাম মাত্রও অন্ধকার ছিল না। কেননা ছায়ার জন্য অন্ধকার অপরিহার্য। ৩৮৬
ভারতবর্ষের প্রখ্যাত দেওবন্দী আলিম ও অসংখ্য দেওবন্দী আলিমদের উস্তাদ আল্লামা হুছাইন আহমদ মাদানী ছাহেব বলেন,
غرضيكہ حقيقت محمد صلى الله عليہ وسلم التحية واسطہ جملہ كمالات عالم عالميان ہے يہ هی معنى لولاك لما خلقت الافلاك اور اول ما خلق الله نورى اور انا نبى الانبياء كے ہیں -
-‘‘মোট কথা হলো সমস্ত কায়েনাত বা আলম হাকীকতে মুহাম্মদী তথা নূরে মুহাম্মদী থেকে সৃষ্ট। যেমন হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, যদি আপনি না হতেন তবে আমি সকল আসমান যমীন কিছুই সৃষ্টি করতাম না। রাসূল (ﷺ) এর বাণী : মহান আল্লাহ তা‘য়ালা সর্বপ্রথম আমার নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন এবং আরও বলেন, আমি নবীদেরও নবী।’’ (আস সিহাবুছ ছাকীব, ৫০ পৃ:)।
❏ ভারত বর্ষের বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল হাই লাখনভী (رحمة الله)
ভারত বর্ষের বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল হাই লাখনভী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে বলেন,
مَا يَذْكُرُونَهُ فِي ذِكْرِ الْمَوْلِدِ النَّبَوِيّ أَن نور مُحَمَّد خُلِقَ مِنْ نُورِ اللَّهِ بِمَعْنَى أَنَّ ذَاتَهُ الْمُقَدَّسَةَ صَارَتْ مَادَّةً لِذَاتِهِ الْمُنَوَّرَةِ وَأَنَّهُ تَعَالَى أَخَذَ قَبْضَة من نوره فخلق من نُورَهُ
-“যা নবী পাক (ﷺ) এর মিলাদের আলোচনা কালে উল্লেখ করেছি যে, নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি করেছেন আল্লাহর নূর থেকে। এর অর্থ হল নিশ্চয় নবী পাক (ﷺ) এর পবিত্র সত্তার মূল বস্তুকে আলোকিত করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা তাঁর সৃষ্ট নূরকে নিলেন ও নবী করিম (ﷺ) এর নূর সৃষ্টি করলেন।” ৩৮৭
৩৮৬. নশরুত্তিব, ২৫ পৃ:;
৩৮৭. আল্লামা আব্দুল হাই লাখনভী: আছারুল মারফূয়া, ১ম খন্ড, ৪২ পৃ:;
❏ মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেবের অন্যতম খলিফা, বি-বাড়িয়া জেলার বড় হুজুর নামে খ্যাত, মাওলানা সিরাজুল ইসলাম দেওবন্দী সাহেব
মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেবের অন্যতম খলিফা, বি-বাড়িয়া জেলার বড় হুজুর নামে খ্যাত, মাওলানা সিরাজুল ইসলাম দেওবন্দী সাহেব তদীয় কিতাবে বলেন,
“হুজুর (ﷺ) হলেন সারা বিশ্বের সৃষ্টির কারণ বা অছিলা। সর্বপ্রথম নবীজি (ﷺ) এর নূর মোবারক সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেন-
اول ما خلق الله نورى وكل الخلائق من نورى وانا من نور الله
-“আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আমার নূর থেকে সমগ্র জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং আমি আল্লাহর নূর।” ৩৮৮
৩৮৮. গাওহারে সিরাজী, ৭৯ পৃ:;
❏ চরমুনাইর প্রধান পীর মাওলানা ইসহাক্ব সাহেবের দৃষ্টিতেও প্রিয় নবীজি (ﷺ) নূরের তৈরী ছিলেন
চরমুনাইর প্রধান পীর মাওলানা ইসহাক্ব সাহেবের দৃষ্টিতেও প্রিয় নবীজি (ﷺ) নূরের তৈরী ছিলেন। যেমন তিনি বর্ণনা করেন,
“একদিন আমাদের সকল মোমেন লোকের মাতা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার হুজরা মোবারক হইতে হাবীবে আকরাম (ﷺ) যাইতেছেন, এমন সময় মা আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنه) মজাক করিয়া তাঁহাকে যাইতে বাধা দিবার মানসে একখানা রুমালের দুই দিকে দুই হাত ধরিয়া হুজুর (ﷺ) এর ছের মোবারকের উপর দিয়া ফেলিয়া কোমর মোবারকে পেছ দিলেন। হুজুর (ﷺ) স্বাভাবিক গতিতে চলিয়া গেলেন! বিবি আয়েশা (رضي الله عنه) অবাক হইয়া বলিলেন-
مَا هَذَا يَا رَسُول الله؟ -হে আল্লাহর রাসূল! ইহা কি হইল! তিনি জওয়াব দিলেন, ওগো আয়েশা! তোমরা আমার হাকিকত বুঝিবে না, আমার শরীর অন্য মানুষের মত নয়।
ছাহেবান! জানিয়া রাখুন। আমাদের পয়গাম্বর ছাহেবের শরীর মোবারকের ছায়া ছিলনা। কারণ রূহের ছায়া নাই এবং তাঁহার শরীর মোবারক আমাদের রূহের চেয়ে বেশী পাক ও শতগুণ বেশী মর্তবাওয়ালা ও বেশী সম্মানিত।” ৩৮৯. আশেক মা’শুক বা এস্কে এলাহী, ৭৫ পৃ:;
প্রিয় পাঠক ভাই ও বোনেরা! লক্ষ্য করুন, চরমুনাইর প্রধান পীর মাওলানা ইসহাক্ব সাহেব স্পষ্ট করেই বলেছেন: ‘রাসূল (ﷺ) এর শরীর অন্য মানুষের শরীরের মত না’। অর্থাৎ রাসূল (ﷺ) দেহ মোবারক অন্য মানুষের মত আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস দ্বারা তৈরী দেহের মত না, বরং আল্লাহর নূরের সৃষ্টি। এমনকি রাসূল (ﷺ) এর ছায়া মোবারক না থাকার বিষয়টিও তিনি স্বীকার করেছেন।
❏ তাফছিরে মারেফুল কোরআনের লেখক ও মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেবের অন্যতম খলিফা আল্লামা মুফতী শফি সাহেব (পাকিস্থান)
তাফছিরে মারেফুল কোরআনের লেখক ও মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেবের অন্যতম খলিফা আল্লামা মুফতী শফি সাহেব (পাকিস্থান) তদীয় তাফছিরের কিতাবে বলেন,
“মানব হওয়া নবুয়াতেরও পরিপন্থি নয় এবং রেছালতের উচ্চ মর্যাদারও প্রতিকূল নয়। রাসূল (ﷺ) নূর হলেও মানব হতে পারে। তিনি নূরও এবং মানবও।” ৩৯০। তাফছিরে মারেফুল কোরআন, সৌদি সং, ১৩৭৭ পৃ:; সূরা তাগাবুনের ৮ নং আয়াতের তাফছির;
বাংলাদেশে অধিকাংশ আলিমগণের কাছে ‘তাফছিরে মারেফুল কোরআন’ কিতাবটি রয়েছে, এবং হাজী সাহেবদেরকে হজের সময় সৌদি সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে এই কিতাবটি বিতরণ করা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক এই কিতাব ছাপানো হয়েছে। আর সেই কিতাবেই রাসূলে পাক (ﷺ) কে নূরের বাশার তথা নূরের তৈরী বলা হয়েছে।
❏ বিখ্যাত দেওবন্দী আলিম আল্লামা শাব্বির আহমদ উছমানী সাহেব
বিখ্যাত দেওবন্দী আলিম আল্লামা শাব্বির আহমদ উছমানী সাহেব বলেন,
عموما مفسرين وانا اول المسلمين كا مطلب يہ ليتے ہیں كہ اس امت محمد يہ كے اعتبار سے آپ اول المسلمين ليكن جب جامع ترمذى كى حديث "كنت نبيا وآدم بين الروح والجسد" كے موافق آپ اولا الانبياء ہیں تو اول المسلمين ہونے ميں كيا شبہ هو سكتا ہے –
-“সাধারণত মুফাসসিরগণ “আমি সর্বপ্রথম মুসলিম’’ এর ব্যাখ্যা এভাবেই করে থাকেন যে, তিনি উম্মতে মুহাম্মদিয়ার তুলনায় সর্বপ্রথম মুসলিম। কিন্তু জামে তিরমিযীর হাদিস “আমি তখন নবি ছিলাম, যখন আদম রূহ ও দেহের মাঝামাঝি অবস্থানে ছিলেন।” (অর্থাৎ- তাঁর সৃষ্টি হয়নি) এর আলোকে যেহেতু তিনি সর্বপ্রথম নবী, অতএব, তিনি মৌলিক অর্থে সর্বপ্রথম মুসলিম হওয়াতে কি সন্দেহ থাকতে পারে?” ৩৯১
❏ আল্লামা শামছুল হক্ব ফরিদপুরী উরফে ছদর সাহেব হুজুরের অন্যতম খলিফা বাংলাদেশের সু-পরিচিত ও প্রখ্যাত দেওবন্দী আলিম, শায়খুল হাদিস আজিজুল হক্ব সাহেব
আল্লামা শামছুল হক্ব ফরিদপুরী উরফে ছদর সাহেব হুজুরের অন্যতম খলিফা বাংলাদেশের সু-পরিচিত ও প্রখ্যাত দেওবন্দী আলিম, শায়খুল হাদিস আজিজুল হক্ব সাহেব ‘মাসিক আদর্শ নারী’ ম্যাগাজিনে রাসূল (ﷺ) এর কিছু অলোকিক ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন-
“রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর হিদায়েতের নূরে সারাবিশ্ব আলোকিত হবে, তাই তাঁর শুভাগমন লগ্নে এসব নূরের বিকাশ ছিল। নবীজি (ﷺ) ঐ নূরের আকর (উৎপত্তিস্থল)- নূরে মুজাচ্ছাম।” ৩৯২
৩৯১. তরজুমানুল কোরআন, পাদটিকা মাও: শাব্বির আহমদ উছমানী, ১৯৪ পৃ: টিকা নং ২;
৩৯২. মাসিক আদর্শ নারী, জানুয়ারী ২০১২ সংখ্যা, ১০ পৃ:;
প্রিয় পাঠক সমাজ! লক্ষ্য করুন, বাংলাদেশের অসংখ্য কওমী আলিমদের উস্তাদ শায়খুল হাদিস আজিজুল হক্ব সাহেব এখানে স্পষ্টভাবে রাসূল (ﷺ) কে নূরে মোজাচ্ছাম বা নূরের দেহদারী ও সকল নূরের উৎপত্তিস্থল বলেছেন। বলুন! নিম মোল্লাদের বকবক শুনবেন নাকি শায়খুল হাদিস আজিজুল হক্ব সাহেবের কথা মানবেন? এ সম্পর্কে নিচের বর্ণনাটুকু লক্ষ্য করুন:-
মাওলানা শামছুল হক্ব ফরিদপুরী সাহেবের ফয়েজে ও বরকতে লিখিত,
শায়খুল হাদিস আজিজুল হক্ব ছাহেবের অনুবাদকৃত বাংলা বোখারী শরীফে ‘সর্বপ্রথম সৃষ্টি হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)’ শিরোনামে বলেন:-
“এই হাকিকতে মুহাম্মদিয়াই নিখিল সৃষ্টি জগতের সর্বপ্রথম সৃষ্টি। লৌহ-ক্বলম, বেহস্থ-দোজখ, আসমান জমীন, চন্দ্র সূর্য, ফেরেস্তা এবং মানব-দানব সব কিছুই ঐ হাকিকতে মুহাম্মদিয়া বা নূরে মুহাম্মদীর পরে সৃষ্টি হয়েছে। এই তথ্য সু-স্পষ্টরূপে বিশিষ্ট ছাহাবী জাবের (رضي الله عنه) বর্ণিত এক হাদীছে উল্লেখ রহিয়াছে”।
❏ মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম সাহেবের বক্তব্য
লালবাগ শাহী মসজিদ এর ইমাম ও খতিব, সম্পাদক-মাসিক আল-বালাগ, সদস্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বোর্ড অফ গভর্ণরস, চেয়ারম্যান তফছিরে তাবারী প্রকল্প সম্পাদনা বোর্ড, তাফছিরে নূরুল কোরআন সহ বহু গ্রন্থ প্রণেতা, মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম সাহেবের বক্তব্য লক্ষ্য করুন:-“আবির্ভাবের পূর্বেই সারা পৃথিবীতে সকল যুগে যাঁর নাম প্রচারিত হয়েছে, শুধু তাই নয়; বরং পৃথিবী সৃষ্টিরও পূর্বে আল্লাহ পাকের মহান আরশে এবং জান্নাতে যাঁর পবিত্র নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে, তিনিই আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম। এমনকি, এই সমগ্র সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্বপ্রথম যাঁর সৃষ্টি তিনিই আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম।” অতঃপর জাবের (رضي الله عنه) এর নূরের হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। তারপর বলেন: অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদীই হলো আল্লাহ পাকের সর্বপ্রথম সৃষ্টি, কেননা যেসব জিনিসের ব্যাপারে প্রথম সৃষ্টি হওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়, সে সমস্থ সৃষ্টি যে নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টির পর, তা এই হাদিস দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয়।” নূরে নবী, ১ম খন্ড, ২য় অধ্যায়, ৫ পৃষ্টা; অসংখ্য কওমী আলিমদের উস্তাদ হলেন মাওলানা আমিনুল ইসলাম সাহেব। দীর্ঘদিন লালবাগ শাহী মসজিদের খতিব হিসেবে ছিলেন ও আল-বালাগ মাসিক ম্যাগাজিনে সম্পাদক ছিলেন। তিনি স্পষ্ট করে রাসূল (ﷺ) কে সর্বপ্রথম সৃষ্টি বলেছেন। বলুন! মাটি সৃষ্টি হওয়ার বহু পূর্বে যিঁনি সৃষ্টি হয়েছেন তিনি মাটির তৈরী হন কিভাবে? বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলামের আমির যিনি লক্ষ লক্ষ কওমী আলেমদের উস্তাদ তিনি হচ্ছেন মাওলানা শাহ্ আহমদ শফী। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম কওমী মাদরাসা দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম (হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) এর মহাপরিচালক। এ বিষয়ে তার লিখিত কিতাব “হক বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব’’ এর (যা চট্টগ্রামের হাটহাজারী হতে, আর যার প্রকাশক হচ্ছেন মাওলানা মুহাম্মদ আনাস) ৬১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেন- “অতএব, আমার আক্বীদা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই সাথে মানুষ ও নূর।’’ সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! এটাই আমাদের আক্বিদা যে প্রিয় নবীজি (ﷺ) সৃষ্টিতে নূর এবং কিন্তু এসেছেন বাশারিয়্যাত তথা মানব রূপে। দেওবন্দীদের আরেক প্রখ্যাত আলিম শায়খুল হাদিস আল্লামা মুফতী মনসূরুল হক সাহেব বলেন, “এই ভূমন্ডল, নভোমন্ডল এবং এতদুভয়ের যাবতীয় বস্তু রাসূলে করিম (ﷺ) এর সৃষ্টির বরকতমন্ডিত। তঁার নূরে রহমত পরশিত করেই এসব কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে। সর্বপ্রথম মহান আল্লাহ মহানবী (সঃ) এর নূরকে সৃষ্টি করেন। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক) তারপর সেই নূরকে কেন্দ্র করে অন্যান্য সকল কিছু, তথা আসমান-জমীন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, আলো-বাতাস, সমস্থ জীন-ইনছান, এক কথায় সমগ্র জগতের সৃষ্টি হয়।” মাসিক আদর্শ নারী, জানুয়ারী ২০১২ সংখ্যা, ৩ পৃষ্ঠা; হাফিজ ইবনে তাইমিয়া {ওফাত ৭২৮ হিজরী} তার কিতাবে বলেন, وَأَنَّ الْمَسِيحَ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ أَشْرَقَ نُورُهُ عَلَى الْأَرْضِ! كَمَا أَشْرَقَ قَبْلَهُ نُورُ مُوسَى عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ، وَأَشْرَقَ بَعْدَهُ نُورُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. -“নিশ্চয় ঈসা মাসিহ্ (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর নূর জমীনে চমকাচ্ছিল, যেমনটি হযরত মূসা (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর নূর চম্কাচ্ছিল, পরবর্তীতে নূরে মুহাম্মদী চমকিয়েছিল।” জাওয়াবুস ছহীহ্, ৩য় খন্ড, ৩৭১ পৃ:; লা-মাজহাবীদের শিরমনী, আল্লামা কাজী শাওকানী সাহেব বলেন, أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ أَجْمَعِينَ، لِأَنَّهُ وَإِنْ كَانَ مُتَأَخِّرًا فِي الرِّسَالَةِ فَهُوَ أَوَّلُهُمْ فِي الْخَلْقِ -“রাসূল (ﷺ) সকল মুসলমানের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলমান। কেননা তিনি রাসূল হিসেবে সবার পরে আবির্ভুত হলেও সৃষ্টির মধ্যে প্রথম।” কাজী শাওকানী কৃত: ‘তাফছিরে ফাতহুল কাদির, ২য় খন্ড, ২১১ পৃ:; প্রিয় মুসলীম ভাই ও বোনরা! সূরা ফাতেহার মধ্যে আমরা বলি: اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ-‘হে আল্লাহ আমাদেরকে সরল সঠিক পথ দেখান, যে পথে আপনার নেয়ামত প্রাপ্ত বান্দারা চলে গেছেন’। এখন সেই নেয়ামত প্রাপ্ত বান্দাগণের আকিদার সাথে আমাদের আকিদা মিলাতে হলে অবশ্যই রাসূলে পাক (ﷺ) কে আল্লাহর নূরের সৃষ্টি বলে স্বীকার করতেই হবে। কারণ পূর্ব যুগের সকল উলামা, ফোজালা, ফোকাহা, মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ, আইম্মায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে কেরাম প্রমূখ সকলেই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে সর্বপ্রথম সৃষ্টি ও নূরের সৃষ্টি বলে স্বীকার করেছেন। তাই জান্নাতী দলের আকিদা হচ্ছে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আল্লাহর নূরের তৈরী।
❏ কিছু আয়াতের সঠিক তাফছির
পবিত্র কোরআনে কিছু কিছু আয়াত রয়েছে যেগুলোর বাহ্যিক অর্থের দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় সকল মানুষই সরাসরি মাটির তৈরী। আর ওহাবীদের প্রধান সম্ভল হচ্ছে পবিত্র কোরআনের এসব আয়াত। অথচ ঐ সকল আয়াত সমূহ আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। আর এ কথা স্পষ্ট যে, হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)’ই একমাত্র সরাসরি মাটির তৈরী, এ ছাড়া অন্য কোন মানুষ সরাসরি মাটির তৈরী নয়। কেননা আল্লাহ তা’লা আমাদের সৃষ্টি সম্পর্কে এরশাদ করেন, خَلَقَ الْإِنْسانَ مِنْ عَلَقٍ -“মানুষকে আমি রক্তপিন্ড তথা শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আলাক্ব: ২ নং আয়াত)।
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের আরেক আয়াতে আছে,
خَلَقَ الْإِنْسانَ مِنْ نُطْفَةٍ -“আমি মানুষকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা নাহল: ৪ নং আয়াত)
অপর আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেন:وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً
-“তিনি বাশার তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
এই আয়াতে বলা হয়েছে ‘বাশার’ তথা মানুষকে ‘পানি’ হতে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ শুক্রানু ইহা পানির মতই তরল পদার্থ। তাই বলা হয়েছে পানি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছি। অপরদিকে عَلَق ‘আলাক্ব’ মানে রক্তপিন্ড অথবা শুক্রবিন্দু, যা স্বামী-স্ত্রী মিলনের মাধ্যমে স্ত্রীর জরায়োতে স্থানান্তরিত হয়। আর আল্লাহ পাক মানুষকে ঐ শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। অপরদিকে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সৃষ্টি করেছেন সরাসরি মাটি দ্বারা। যেমন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন: خَلَقَهُ مِنْ تُرابٍ -“আমি আদমকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আলে ইমরান: ৫৯ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনেও হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে طِين (তিন) বা মাটি দ্বারা সৃষ্টির বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ আছে, قالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِيناً -“শয়তান বলল: আমি কি এমন একজনকে সিজদা করব যাকে মাটি দিয়ে তৈরী করেছেন।” (সূরা ইসরা: ৬১ নং আয়াত)।
তাই সরাসরি মাটি দ্বারা একমাত্র হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কেই সৃষ্টি করা হয়েছে, আর বাকী সকল মানুষকে শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্তমানে বিজ্ঞান ইহা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন। কারণ শুধু মাটির মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টি হয়না, বরং স্বামী-স্ত্রীর মিলনের মাধ্যমে স্ত্রীর জরায়ুতে উভয়েরে শুক্রানু-ডিম্বানুর সংমিশ্রনেই পর্যায়ক্রমে মানুষ সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি মানব দেহের শতকরা ৭০ ভাগ হচ্ছে পানি। তাই সকল মানুষকে ঢালাও ভাবে মাটির তৈরী বলা পবিত্র কোরআন ও পবিত্র হাদিসের বিপরীত এমনকি বিজ্ঞানেরও বিপরীত। আর এরূপ কথা মূর্খ ব্যক্তিরাই বলতে পারে!!
❏ আয়াত নং ১
যারা হযরত রাসূলে পাক (ﷺ) ও সকল মানুষকে সরাসরি মাটির তৈরী বলার অপচেষ্টা করেন তাদের অন্যতম দলিল হচ্ছে এই আয়াত। যেমন পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে, خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ
-“আমি ইনছানকে শক্ত ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আর-রহ্মান: ১৪ নং আয়াত)।
এই আয়াত দ্বারা অনেকে’ই বলার চেষ্টা করেন যে, ‘ইনছান’ বা মানুষ ঠনঠনে মাটির তৈরী, আর আমাদের নবী (ﷺ)ও ইনছান। তাই তিনি মাটির তৈরী। (নাউজুবিল্লাহ)।
প্রথমত, আমাদের নবী (ﷺ) কে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের কোথাও সরাসরি ‘ইনছান’ বলেননি। কারণ الْإِنْسَانَ (ইনছান) শব্দটি ‘নিছওয়ান’ ধাতু থেকে আগত, যার অর্থ ভুল করনেওয়ালা। আমরা সকলেই অবগত আছি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সকল প্রকার ভুল-ত্রুটি, গোনাহ্ ও পাপাচার থেকে পবিত্র ও মাছুম।
দ্বিতীয়ত, وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً -“তিনি বাশার তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
শক্ত ঠনঠনে মাটি আর পানি উভয় এক জিনিস নয়, বরং একে অপরের বিপরীত। পবিত্র কোরআনের কোন আয়াত অন্য আয়াতের বিপরীত হতে পারেনা। তাই বিষয়টি স্পষ্ট যে, আল্লাহ তা’লা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে ঠনঠেনে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন ইহা সূরা আর-রহমানের ১৪নং আয়াত দ্বারা প্রমাণিত, এবং বাকী সকল মানুষকে শুক্রবিন্দু তথা পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন ইহা সূরা ফুরকানের ৫৪ নং আয়াত দ্বারা প্রমাণিত।
তৃতীয়ত: সূরা আর রহমানের ১৪ নং আয়াতে الْإِنْسَان (ইনছান) বলতে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কেই বুঝানো হয়েছে, সকল মানুষকে নয়। এ বিষয়ে মুফাচ্ছিরীনে কেরামগণ সকলেই একমত। যেমন নিচের দলিলগুলো লক্ষ্য করুন,
বিশ্ব বিখ্যাত ফকিহ্ আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী হানাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২৭০ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন,
وَالْمُرَادُ بِالْإِنْسَانِ آدم عِنْدَ الْجُمْهُورِ -“এই আয়াতের الْإِنْسَانَ (ইনছান) দ্বারা অর্থ হচ্ছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) আর ইহা অধিকাংশের অভিমত।” তাফছিরে রুহুল মাআনী, ২৭তম খন্ড, ১৩৭ পৃ:;
এই আয়াত সম্পর্কে আল্লামা ইমাম কুরতবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৭১ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন,
(خَلَقَ الْإِنْسانَ) بِاتِّفَاقٍ مِنْ أَهْلِ التَّأْوِيلِ يَعْنِي آدَمَ (مِنْ صَلْصالٍ كَالْفَخَّارِ)
-“তাফছির কারকগণের সর্বসম্মতিক্রমে ‘ইনছান’ তথা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে শক্ত ঠনঠনে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে কুরতবী, ১৭তম খন্ড, ১৬০ পৃ:;
এ সম্পর্কে আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৪১ হি} ও ইমাম আবু জাফর তাবারী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৩১০ হি.} তদীয় স্ব স্ব কিতাবে বলেন, خَلَقَ الإنْسَانَ الَّذِي هُوَ آدم عَلَيْهِ السَّلَامُ
-“ঠনঠনে মাটি দিয়ে ইনছান তৈরী করেছেন, আর তিনি হলেন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)।” তাফছিরে খাজেন, ৪র্থ খন্ড, ২২৬ পৃ:; তাফছিরে তাবারী, ২৮তম খন্ড, ১৩১ পৃ:;
এই আয়াত সম্পর্কে আল্লামা ইবনে যাওজী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫৯৭ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন, خَلَقَ الْإِنْسانَ يعني آدم مِنْ صَلْصالٍ -“ইনছান তথা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে শক্ত ঠনঠনে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে যাদুল মাইছির, ৪র্থ খন্ড, ২০৭ পৃ:;
এই আয়াত সম্পর্কে আল্লামা ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬০৬ হিজরী} তদীয় তাফছির গ্রন্থে বলেন, أَنَّ الْمُرَادَ مِنَ الْإِنْسَانِ أَبُونَا آدَمُ،
-“নিশ্চয় এই ইনছান দ্বারা মুরাদ বা অর্থ হল আমাদের পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)।” তাফছিরে কবীর, ২৯তম খন্ড, ৩৪৯ পৃ:;
অতএব, উল্লেখিত তাফছিরের আলোকে স্পষ্ট বলা যায়, এই আয়াতের الْإِنْسانَ (ইনছান) হল আদি পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)। আর এ বিষয়ে তাফছির কারকগণের কেউ দ্বিমত করেননি। তাই সূরা আর-রহমানের ১৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় সকল মানুষকে মাটির তৈরী বলা চরম পর্যায়ের মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। কারণ একমাত্র সরাসরি মাটির তৈরী মানুষ হলেন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ), এছাড়া অন্য কোন মানুষ সরাসরি মাটির তৈরী নয়। একমাত্র বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)’ই মাটির তৈরী ছিলেন। যেমন আল্লাহ তা’লা পবিত্র কোরআনের অন্যত্র এরশাদ করেন,
وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسانِ مِنْ طِينٍ -“মানুষের প্রথমকে (আদমকে) আমি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা সাজদা: ৭ নং আয়াত)
এই আয়াত সম্পর্কে বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত কাতাদা (رحمة الله عليه) বলেন,
حدثنا بشر، قال: ثنا يزيد، قال: ثنا سعيد، عَنْ قَتَادَةَ، وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسَانِ مِنْ طِينٍ وَهُوَ خَلْقُ آدَمَ، ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ: أَيْ ذُرِّيَّتَهُ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ
-“হযরত কাতাদা (رحمة الله عليه) বলেন: মানুষের শুরুকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তিনি হলেন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ), অতঃপর পানির নির্যাস থেকে আদম সন্তানদেরকে বিস্তার লাভ করিয়েছি।” তাফছিরে তাবারী, ৮তম খন্ড, ৬০০ পৃ:;
সুতরাং সকল মোফাচ্ছেরীনে কেরাম একমত যে, এই আয়াতে শক্ত ঠনঠনে মাটির তৈরী الْإِنْسَانَ (ইনছান) বলতে যাকে বুঝানো হয়েছে তিনি আদি পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)। অতএব, হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর সম্পর্কে নাজিলকৃত আয়াত এনে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) উপর বর্তানো চরম মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়। আর এটাই ওহাবীদের চিরাচরিত স্বভাব!!
❏ আয়াত নং ২
নবীয়ে আরাবী হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) কে মাটির তৈরী বলার ব্যাপারে ওহাবীদের আরেকটি সম্ভল হচ্ছে পবিত্র কোরআনের এই আয়াত। যেমন,
إِنِّي خالِقٌ بَشَراً مِنْ طِينٍ -“নিশ্চয় বাশার বা মানুষকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করব।” (সূরা সোয়াদ: ৭১ নং আয়াত)।
ওহাবীদের অন্যতম সম্ভল হচ্ছে এই আয়াত, কিন্তু আশ্চের্যের বিষয় হচ্ছে তারা সম্পূর্ণ আয়াতটি কিংবা এর পরের আয়াত গুলো উল্লেখ করেনা। এবার লক্ষ্য করুন সম্পূর্ণ আয়াত ও পরের আয়াত গুলো:-
إِذْ قالَ رَبُّكَ لِلْمَلائِكَةِ إِنِّي خالِقٌ بَشَراً مِنْ طِينٍ (৭১) فَإِذا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ ساجِدِينَ (৭২) فَسَجَدَ الْمَلائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ (৭৩) إِلاَّ إِبْلِيسَ اسْتَكْبَرَ وَكانَ مِنَ الْكافِرِينَ
-“যখন তোমার রব ফেরেস্থাদের বললেন, আমি মাটি দিয়ে বাশার তৈরী করব। আর যখন ইহার আকৃতি দেওয়া শেষ হবে অতঃপর ইহার মধ্যে রুহ প্রবেশ করানো হবে। তখন তোমরা তাঁর প্রতি সেজদায় পতিত হবে। অতঃপর ইবলিস ব্যতীত সকল ফেরেস্থাগণ তাঁর প্রতি সেজদায় পতিত হল..।” (সূরা সোয়াদ: ৭১-৭৪ নং আয়াত)।
এই আয়াত গুলোর দিকে লক্ষ্য করলে যে-কেউ বুঝতে পারবেন এই بَشَر ‘বাশার’ হচ্ছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)। কারণ ফেরেস্থাদেরকে সেজদা করার নির্দেশ দিয়েছেন একমাত্র হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) প্রতি। যেমন অপর আয়াতে আছে,
وَإِذْ قالَ رَبُّكَ لِلْمَلائِكَةِ إِنِّي جاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً قالُوا... وَإِذْ قُلْنا لِلْمَلائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلاَّ إِبْلِيسَ
-“যখন আপনার রব ফেরেস্থাদেরকে বলেছিল, আমি জমীনের জন্য আমার খলিফা প্রেরণ করব।...... সকল ফেরেস্থা সেজদা করল একমাত্র ইবলিশ ব্যতীত।” (সূরা বাকারা: ৩০ নং আয়াত)।
আফছুছ! ওহাবীরা এই আয়াতকেও প্রমাণ হিসেবে দেওয়া অপচেষ্টা করেন। অথচ ইহা স্পষ্ট হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর সম্পর্কীত আয়াত। এবার লক্ষ্য করুন এ আয়াত সম্পর্কে মোফাচ্ছেরীনে কেরাম কি বলেন:
আল্লামা ইমাম বাগভী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫১৬ হি.} ও ইমাম আবুল লাইছ নছর ইবনে মুহাম্মদ সমরকান্দী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৩৭৩ হি.} তদীয় স্ব স্ব কিতাবে বলেন,
إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ طِينٍ يَعْنِي: آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ. -“মাটি দ্বারা বাশারকে সৃষ্টি করব” এর অর্থ হচ্ছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করবেন।” তাফছিরে সমরকান্দী, ৩য় খন্ড, ১৪১ পৃ:; তাফছিরে বাগভী, ৪র্থ খন্ড, ৩৬৬ পৃ:;
ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৯১১ হি.} ও আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৪১ হি.} তদীয় স্ব স্ব কিতাবে বলেন,
إنِّي خَالِق بَشَرًا مِنْ طِين هُوَ آدَم عَلَيْهِ السَّلَامُ. -“মাটি দিয়ে বাশার তৈরী করব আর তিনি হচ্ছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)।” তাফছিরে জালালাইন শরীফ, ৩৮৪ পৃ:; তাফছিরে খাজেন, ৪র্থ খন্ড, ৪৭ পৃ:;
আল্লামা আবু জাফর তাবারী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৩১০ হিজরী.} বলেন,
إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ طِينٍ يَعْنِي بِذَلِكَ خَلْقَ آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ. -“মাটি দিয়ে বাশার সৃষ্টি করব’ ইহার অর্থ হচ্ছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করবেন।” তাফছিরে তাবারী শরীফ, ২৩তম খন্ড, ১৮৮ পৃ:;
যেমন অন্যত্র মহান আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন:
وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسانِ مِنْ طِينٍ -“মানুষের প্রথমকে (আদমকে) আমি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা সাজদা: ৭ নং আয়াত)
অতএব, মাটি দ্বারা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কেই সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ এই আয়াত হচ্ছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর শানে নাঝিলকৃত। তাই যারা এই আয়াত দ্বারা আমাদের নবী (ﷺ) কিংবা অন্য কোন মানুষকে সরাসরি মাটির তৈরী বলবে সে কোরআনের তাফছিরে চরম পর্যায়ের জাহেল বা মূর্খ ও নবীর দুশমন।
❏ আয়াত নং ৩
যারা আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে মাটির তৈরী বলেন তাদের উল্লেখ করা আরেকটি আয়াত হচ্ছে:-
وَمِنْ آياتِهِ أَنْ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرابٍ ثُمَّ إِذا أَنْتُمْ بَشَرٌ تَنْتَشِرُونَ -“আল্লাহর নিদর্শন হচ্ছে তোমাদেরকে (তোমাদের পিতা আদমকে) মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন অতঃপর তোমরা জমীনে বাশার রূপে ছড়িয়ে পরলে।” (সূরা রূম: ২০ নং আয়াত)।
এই আয়াতে خَلَقَكُمْ (খালাকাকুম) দ্বারা ওহাবীরা সমস্থ মানুষকে মাটির তৈরী বুঝানোর বৃথা চেষ্টা করেন। অথচ এই আয়াতে خَلَقَكُمْ (খালাকাকুম) বলতে হযরত বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কেই বুজানো হয়েছে। কারণ خَلَقَ (খালাকা) এবং كُمْ (কুম) এর মাঝে أَبَا (আবা) শব্দ মুজাফ হিসেবে ‘মাহজুব’ তথা গোপন রয়েছে। সুতরাং এর অর্থ হচ্ছে خَلَقَ أَبَاكُمْ (খালাকা আবাকুম) অর্থাৎ তোমার বাবাকে সৃষ্টি করেছি। কারণ সরাসরি মাটি দ্বারা কোন মানুষকে সৃষ্টি করা হয়নি একমাত্র আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) ছাড়া। কারণ অন্য সকল মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুক্রবিন্দু বা পানি দ্বারা।
যেমন অপর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন: وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً
-“তিনি (আল্লাহ) বাশার তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
আরেক জায়গায় আল্লাহ পাক বলেন: خَلَقَ الْإِنْسانَ مِنْ عَلَقٍ -“মানুষকে আমি রক্তপিন্ড বা শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আলাক্ব: ২ নং আয়াত)।
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের আরেক আয়াতে আছে,
خَلَقَ الْإِنْسانَ مِنْ نُطْفَةٍ -“আমি মানুষকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা নাহল: ৪ নং আয়াত)
পবিত্র কোরআনের এক আয়াত অপর আয়াতের বিপরীত হতে পারেনা। পবিত্র কোরআনের সকল আয়াতই সঠিক ও সত্য, ইহার উপর ঈমান রাখা ফরজ। সুতরাং সরাসরি মাটি দ্বারা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছেন এবং অন্য সকল মানুষ শুক্রবিন্দু তথা পানি দ্বারা সৃষ্টি, ইহাই পবিত্র কোরআনের মূল ভাবার্থ।
এবার সূরা রূম এর ২০ নং আয়াতের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত তথা হক্ব পন্থি মোফাচ্ছেরীনে কেরাম যা বলেছেন তা লক্ষ্য করুন:
আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম বাগদাদী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৪১ হিজরী} বলেন,
وَمِنْ آياتِهِ أَنْ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرابٍ أي خلق أصلكم وهو آدم من تراب
-“আল্লাহর নিদর্শন হচ্ছে, তোমাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করবেন অর্থাৎ তোমাদের সকলের মূলকে তথা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করবেন।” তাফছিরে খাজেন শরীফ, ৩য় খন্ড, ৩৯০ পৃ:;
এ সম্পর্কে আল্লামা ইমাম বাগভী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫১৬ হিজরী} বলেন,
(وَمِنْ آياتِهِ أَنْ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرابٍ) أَيْ: خَلَقَ أَصْلَكُمْ يَعْنِي آدَمَ مِنْ تُرَابٍ -“আল্লাহর নিদর্শন হচ্ছে, তোমাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করবেন অর্থাৎ তোমাদের সকলের মূলকে আর তিনি হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) যাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে বাগভী, ৪র্থ খন্ড, ২৩০ পৃ:;
আল্লামা কাজী নাছিরুদ্দিন বায়জাবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৮৫ হিজরী} বলেন,
وَمِنْ آياتِهِ أَنْ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرابٍ أي في أصل الإِنشاء لأنه خلق أصلهم منه.
-“আল্লাহর নিদর্শন হল, সকলের মূলকে কেননা তাদের সকলের মূলকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে।” তাফছিরে বায়জাবী, ২য় খন্ড, ২৬২ পৃ:;
এ সম্পর্কে আল্লামা হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৭৪ হিজরী} তদীয় তাফছির গ্রন্থে বলেন,
الدَّالَّةِ عَلَى عَظَمَتِهِ وَكَمَالِ قُدْرَتِهِ، أَنَّهُ خَلَقَ أَبَاكُمْ آدَمَ مِنْ تُرَابٍ
-“আল্লাহর মহত্ব ও কুদরতের পূর্ণতার দলিল হচ্ছে, নিশ্চয় তিনি মাটি থেকে তোমাদের বাবা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে ইবনে কাছির, ৩য় খন্ড, ৫২৫ পৃ:;
এ প্রসঙ্গে আল্লামা আবুল বারাকাত আন-নাছাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭১০ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন, أَنْ خَلَقَكُمْ أي أباكم مّن تُرَابٍ -“নিশ্চয় মাটি দ্বারা তোমাদের সকলের বাবাকে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে নাছাফী, ৩য় জি: ৩৪১ পৃ:; তাফছিরে আবু সাঊদ, ৫ম খন্ড, ৩৪৯ পৃ:;
এ সম্পর্কে আল্লামা ইমাম কুরতবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৭১ হিজরী} বলেন,
أَنْ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرَابٍ، أَيْ خَلَقَ أَبَاكُمْ مِنْهُ -“নিশ্চয় তেমাদেরকে সৃষ্টি করেছি অর্থাৎ তোমাদের বাবাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে কুরতবী, ১৪তম জি: ১৫ পৃ:;
আল্লামা আবু জাফর তাবারী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৩১০ হিজরী} অনুরূপ তাফছির পেশ করে দলিল পেশ করেন,
عَنْ قَتَادَةَ، وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَكُمْ، مِنْ تُرَابٍ خَلَقَ آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ مِنْ تُرَابٍ
-“বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত কাতাদা (رحمة الله عليه) বলেন, এই আয়াতের অর্থ: হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে।” তাফছিরে তাবারী, ২১তম খন্ড ৪২ পৃ:;
এরূপ অনেক রেফারেন্স দেওয়া যাবে, সংক্ষিপ্তের জন্য ক্ষান্ত হলাম। সুতরাং বিষয়টি স্পষ্ট যে, أَنْ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرابٍ (আন খালাকাকুম মিন তুরাব) এই কথা দ্বারা আমাদের সকলের আদি পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। আর এ বিষয়ে দুনিয়ার সকল মোফাচ্ছেরীনে কেরামগণ একমত। কারণ خَلَقَ (খালাকা) এবং كُمْ (কুম) মাঝে أَبَا (আবা) শব্দ মুজাফ হিসেবে ‘মাহজুব’ বা গোপন রয়েছে। কারণ كُمْ (কুম) হল ‘মুজাফ ইলায়হি’ তাই স্বভাবতই ‘মুজাফ’ থাকবে, আর ঐ ‘মুজাফ’ হচ্ছে أَبَا (আবা)। মুজাফ ও মুজাফ ইলায়হি একত্রিত হলে জুমলাটি হবে أَبَاكُمْ (আবাকুম)। তাই خَلَقَكُمْ (খালাকাকুম) অর্থ হচ্ছে خَلَقَ أَبَاكُمْ (খালাকা আবাকুম); যার মোট অর্থ হচ্ছে: তোমাদের বাবা আদমকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি। এখানে বাহ্যিক অর্থে যদিও সকল মানুষকে বুঝায় কিন্তু মূলত সকল মানুষের কথা আল্লাহ বলেননি। যেমন আল্লাহ পাক বলেছেন:
وَأَقِيمُوا الصَّلاةَ وَآتُوا الزَّكاةَ -“তোমরা নামাজ কায়েম কর ও যাকাত প্রদান কর।” এখানে কি ‘তোমরা’ বলতে কি দুনিয়ার সকল মানুষ? অবশ্যই না। কারণ বিধর্মী, নাবালেগ, পাগল প্রমূখের উপর নামাজ ফরজ নয়। অথচ বাহ্যিকভাবে ‘তোমরা’ বলতে সকল মানুষকেই বুঝায়। অপরদিকে আল্লাহ বলেছেন ‘তোমরা যাকাত প্রদান কর’ তাহলে কি দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য যাকাত ফরজ? অবশ্যই না। কারণ একমাত্র মুসলীম মালদারের উপর যাকাত ফরজ, অন্যদের উপর নয়। অথচ আল্লাহ সম্ভোধন করেছেন সকলকে। ঠিক তেমনিভাবে خَلَقَكُمْ বিষয়টিও অনুরূপ।
সর্বোপরি এই আয়াত দ্বারা দুনিয়ার সকল মানুষকে মাটির তৈরী বললে পবিত্র কোরআনের অপর একাধিক আয়াত যথা সূরা ফুরকান এর ৫৪ নং আয়াত এবং সূরা আলাক্ব এর ২ নং আয়াত প্রমূখ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে (নাউজুবিল্লাহ)। কারণ সেখানে বলা হয়েছে ‘বাশার’ বা মানুষকে আল্লাহ তা’লা শুক্রানু তথা পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তাই পবিত্র কোরআনের সকল আয়াতই স্ব স্ব স্থানে সত্য ও সঠিক। অতএব, হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) মাটির তৈরী ইহাও কোরআন দ্বারা প্রমাণিত এবং অন্য সকল মানুষ শুক্রবিন্দু বা পানিত তৈরী, ইহাও পবিত্র কোরআন দ্বারা প্রমাণিত।
❏ আয়াত নং ৪
فَإِنَّا خَلَقْناكُمْ مِنْ تُرابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ
-“নিশ্চয় তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর শুক্রবিন্দু থেকে, অতঃপর মাংশপিন্ড থেকে।” (সূরা হাজ্ব: ৫ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটিও বাহ্যিক অর্থে সকল মানুষকে মাটির তৈরী বুঝায়, কিন্তু এই আয়াতের মূল ভাবার্থ সকল মানুষ নয়, বরং প্রথম হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর আদম সন্তানদেরকে বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর نُطْفَةٍ ‘নুতফা’ তথা শুক্রানু থেকে সৃষ্টি করেছেন। যেমন এই আয়াতের তাফছির করেছেন আল্লামা আবু জাফর আত-তাবারী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৩১০ হি.} তদীয় কিতাবে বলেন,
فَإِنَّ فِي ابْتِدَائِنَا خَلْقَ أَبِيكُمْ آدَمَ صلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ إِنْشَائِنَاكُمْ مِنْ نُطْفَةِ آدَمَ
-“নিশ্চয় তোমাদের প্রথম মানুষকে তথা তোমাদের বাবা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আদমের শুক্রবিন্দু থেকে তোমাদের বিস্তার করেছেন।” তাফছিরে তাবারী, ১৬তম খন্ড, ৪৬১ পৃ:;
এই আয়াতের তাফছির প্রসঙ্গে মেসকাত শরীফের মূল ‘মাসাবিহুস সুন্নাহ’ ও ‘শরহে সুন্নাহ’ কিতাবে মুছান্নিফ আল্লামা ইমাম বাগভী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫১৬ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন,
فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ يَعْنِي: أَبَاكُمْ آدَمَ الَّذِي هُوَ أَصْلُ النَّسْلِ، مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ يَعْنِي: ذُرِّيَّتَهُ
-“নিশ্চয় তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ তোমাদের বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি সকল মানুষের মূল। অতঃপর তাঁর বংশধরকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে বাগভী, ৫ম খন্ড, ৩৬৬ পৃ:;
এই আয়াত সম্পর্কে হিজরী ৬ষ্ঠ শতাব্দির মুজাদ্দিদ, ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬০৬ হি.} বলেন,
فَإِنَّا خَلَقْناكُمْ مِنْ تُرابٍ وَفِيهِ وَجْهَانِ: أَحَدُهُمَا: إِنَّا خَلَقْنَا أَصْلَكُمْ وَهُوَ آدَمُ عَلَيْهِ السَّلَامُ مِنْ تُرَابٍ، لِقَوْلِهِ: كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرابٍ [آلِ عِمْرَانَ: ৫৯]
-“নিশ্চয় তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, এই আয়াতের দুইটি দিক, প্রথমটি হল: নিশ্চয় তোমাদের মূল হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। যেমন আল্লাহ তা’লা বলেছেন: আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর মত তাঁকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে কবীর: ২৩তম খন্ড, ২০৩ পৃ:;
এই আয়াত প্রসঙ্গে ইমাম কুরতবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৭১ হি.} বলেন,
(فَإِنَّا خَلَقْناكُمْ) أَيْ خَلَقْنَا أَبَاكُمُ الَّذِي هُوَ أَصْلُ الْبَشَرِ، يَعْنِي آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ (مِنْ تُرابٍ). (ثُمَّ) خَلَقْنَا ذُرِّيَّتَهُ. (مِنْ نُطْفَةٍ) وَهُوَ الْمَنِيُّ، سُمِّيَ نُطْفَةً لِقِلَّتِهِ، وَهُوَ الْقَلِيلُ مِنَ الْمَاءِ،
-“নিশ্চয় তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অর্থাৎ তোমাদের বাবাকে মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন, যিনি সকল মানুষের মূল। অতঃপর তাঁর বংশধরকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর ইহা হল ‘মনী’ সল্পতার কারণে একে ‘নুতফা’ বলা হয়। আর ইহা হচ্ছে সামান্যতম الْمَاءِ তথা পানি।” তাফছিরে কুরতবী: ১২তম খন্ড, ৬ পৃ:;
এই আয়াত সম্পর্কে আল্লামা কাজী নাছিরুদ্দিন বায়জাবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৮৫ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন,
فإنا خلقناكم. مِنْ تُرابٍ بخلق آدم منه، -“নিশ্চয় তোমাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন তথা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে বায়জাবী, ৪/৬৫;
এই আয়াত সম্পর্কে আল্লামা আবুল বারাকাত আন-নাসাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭১০ হিজরী} বলেন,
{فَإِنَّا خلقناكم} أي أباكم مّن تُرَابٍ ثُمَّ خلقتم مِن نُّطْفَ
-“নিশ্চয় তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অর্থাৎ তোমাদের বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদেরকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে নাছাফী, ২য় খন্ড, ৪২৮ পৃ:;
এ সম্পর্কে আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম আল-খাজেন (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৪১ হি.} বলেন,
فَإِنَّا خَلَقْناكُمْ مِنْ تُرابٍ يعني أباكم آدم الذي هو أصل النسل ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ يعني ذريته من المني وأصلها الماء القليل
-“নিশ্চয় তোমাদেরকে মাটি হতে সৃষ্টি করেছি, অর্থাৎ তোমাদের বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি হতে সৃষ্টি করেছি, যিনি সকল মানুষের মূল। অতঃপর শুক্রবিন্দু তথা ‘মনী’ থেকে তাঁর বংশধরকে সৃষ্টি করেছি। আর ইহার মূল হল সামান্যতম الْمَاءِ তথা পানি।” তাফছিরে খাজেন: ৩য় খন্ড, ২৪৮ পৃ:;
এই আয়াত প্রসঙ্গে আল্লামা হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৭৪ হি.} তদীয় কিতাবে বলেন,
فَإِنَّا خَلَقْناكُمْ مِنْ تُرابٍ أَيْ أَصْلُ بَرْئِهِ لَكُمْ مِنْ تُرَابٍ، وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنْهُ آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ
-“নিশ্চয় তোমাদেরকে মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন, অর্থাৎ তোমাদের প্রথমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি হলেন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) যাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে।” তাফছিরে ইবনে কাছির, ৫ম খন্ড, ৩৪৭ পৃ:;
এ প্রসঙ্গে প্রসিদ্ধ মোফচ্ছির আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপাথি নক্সবন্দী হানাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২২৫ হি.} বলেন,
فانا خلقناكم مِنْ تُرابٍ بخلق أبيكم آدم منه -“নিশ্চয় তোমাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, তথা তোমাদের বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে মাজহারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ২৫৪ পৃ:;
অতএব, উল্লেখিত তাফছির সমূহের দ্বারা স্পষ্ট প্রতিয়মান হয়, এই আয়াত দ্বারা সকল মানুষকে মাটির তৈরী বুঝানো হয়নি, বরং সকল মানুষের আদি পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে’ই বুঝানো হয়েছে। কারণ পবিত্র কোরআনেই বলা হয়েছে, হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) ব্যতীত বাকী সকল মানুষ সরাসরি মাটির তৈরী নয়।
যেমন আল্লাহ পাক বলেন, خَلَقَ الْإِنْسانَ مِنْ عَلَقٍ -“আমি ইনছান তথা মানুষকে রক্তপিন্ড (শুক্রবিন্দু) দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আলাক: ২ নং আয়াত)।
এ সম্পর্কে আরেক আয়াতে আছে: وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً -“তিনি ‘বাশার’ তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের আরেক আয়াতে আছে,
خَلَقَ الْإِنْسانَ مِنْ نُطْفَةٍ -“আমি মানুষকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা নাহল: ৪ নং আয়াত)।
সুতরাং ঢালাও ভাবে সকল মানুষ সারাসরি মাটির তৈরী হতে পারেনা বরং মানুষ শুক্রবিন্দুর হতে তৈরী। সকল মানুষকে মাটির তৈরী বললে কোরআনের একাধিক আয়াতের বিপরীত কথা হবে। যা প্রকাশ্য কুফূরী।
❏ আয়াত নং ৫
إِنَّا خَلَقْناهُمْ مِنْ طِينٍ لازِبٍ
-“তাদেরকে আমি কঠিন আঠাল মাটি হতে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা: সাফ্ফাত: ১১ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াত দ্বারাও বুঝা যায় মানুষ শক্ত আঠাল মাটি দ্বারা সৃষ্টি। কিন্তু এর ভাবার্থ ইহা নয়, বরং خَلَقْناهُمْ (খালাকনাহুম) এর অর্থ হচ্ছে, তাদের বাবা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে শক্ত ঠনঠনে মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন। যেমন তাফছিরের কিতাব সমূহের দালায়েল গুলো লক্ষ্য করুন:-
প্রসিদ্ধ মুফাচ্ছির আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী হানাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১১২৭ হিজরী} তদীয় গ্রন্থে বলেন: إِنَّا خَلَقْناهُمْ اى خلقنا أصلهم وهو آدم
-“নিশ্চয় তাদেরকে সৃষ্টি করেছি’ অর্থাৎ তাদের মূল হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৭ম খন্ড, ৪৫১ পৃ:;
আল্লামা নছর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে ইব্রাহিম সমরকান্দী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৩৭৩ হিজরী} স্বীয় তাফছিরে বলেন,
إِنَّا خَلَقْناهُمْ مِنْ طِينٍ لازِبٍ يعني: خلقنا آدم -“শক্ত আঠাল মাটি হতে তোমাদের সৃষ্টি করেছি এর অর্থ হল: আদমকে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে সমরকান্দী, ৩য় খন্ড, ১৩৭ পৃ:;
আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইবনে ইব্রাহিম ইবনে উমর খাজেন (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৪১ হিজরী} তদীয় তাফছিরের গ্রন্থে বলেন,
إِنَّا خَلَقْناهُمْ مِنْ طِينٍ لازِبٍ يعني آدم من طين جيد -“নিশ্চয় তাদেরকে শক্ত আঠাল মাটি হতে সৃষ্টি করেছি, অর্থাৎ আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে অতি-উত্তম মাটি হতে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে খাজেন, ৪র্থ খন্ড, ১৬ পৃ:;
কুখ্যাত লা-মাজহাবীদের অন্যতম কথিত ইমাম কাজী শাওকানী বলেন,
إِنَّا خَلَقْناهُمْ مِنْ طِينٍ لازِبٍ أَيْ: إِنَّا خَلَقْنَاهُمْ فِي ضِمْنِ خَلْقِ أَبِيهِمْ آدَمَ مِنْ طِينٍ لَازِبٍ
-“নিশ্চয় তাদেরকে শক্ত আঠাল মাটি হতে সৃষ্টি করেছি, অর্থাৎ শক্ত আঠাল মাটি হতে তাদের পিতা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে তাদের যিম্মাদারী রক্ষক হিসেবে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে ফাতহুল কাদির, ৪র্থ খন্ড, ৪৪৫পৃ:; ইহার তাফছিরে অন্যভাবেও রয়েছে। যেমন আল্লামা আবু জাফর তাবারী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৩১০ হিজরী} বলেন,
وَكَذَلِكَ خُلِقَ ابْنُ آدَمَ مِنْ تُرَابٍ وَمَاءٍ وَنَارٍ وَهَوَاءٍ؛ وَالتُّرَابُ إِذَا خُلِطَ بِمَاءٍ صَارَ طِينًا لَازِبًا،
-“এমনিভাবে আদম সন্তানকে ‘মাটি, পানি, আগুন ও বাতাস’ দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। যখন মাটিকে পানি দ্বারা মিশ্রিত করা হয় তখন ইহা শক্ত আঠালো মাটিতে পরিনত হয়।” তাফছিরে তাবারী, ১৯ তম খন্ড, ৫১০ পৃ:;
অতএব, উল্লেখিত দালায়েল দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণ হয়, আল্লাহ পাক সকল মানুষের আদি পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে শক্ত আঠাল মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। অতএব, কোন আদম সন্তানকে সরাসরি মাটির তৈরী বলা যাবেনা। পবিত্র কোরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বারা স্পষ্ট জানা যায়, আল্লাহ পাক আদম সন্তানদেরকে নুতফা তথা শুক্রানু-ডিম্বানু থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর এ কথা সকলেই জানেন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)’ই একমাত্র সরাসরি মাটির তৈরী, অন্য কেহ সরাসরি মাটির তৈরী নয়।
❏ আয়াত নং ৬
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ (১২) ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَكِينٍ
-“আর আমি ইনছানকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি। পরে তা শুক্রবিন্দু রূপে নিরাপদ স্থানে রাখি।” (সূরা: মু’মিনুন, ১২-১৩ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটি আদি পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) ও তাঁর সন্তানদের সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। প্রথমে আল্লাহ তা’লা মাটি হতে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আদম সন্তানদেরকে তাঁর নুতফা হতে সৃষ্টি করেছেন। এ জন্যেই ثُمَّ (ছুম্মা) দ্বারা পৃথক করে যুক্ত করা হয়েছে। কেননা অপর আয়াতে আদম সন্তানদেরকে পানির নির্যাস হতে সৃষ্টি করার কথা স্পষ্ট করেই বলেছেন। যেমন আল্লা তা’লা এরশাদ করেন:-
أَلَمْ نَخْلُقْكُمْ مِنْ ماءٍ مَهِينٍ (২০) فَجَعَلْناهُ فِي قَرارٍ مَكِينٍ -“আমি কি তোমাদেরকে পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করিনি? অতঃপর তাকে নিরাপদ স্থানে রাখিনি? (সূরা মুরছালাত: ২১-২১ নং আয়াত)।
অতএব, আল্লাহ তা’লা سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছেন আদি পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে, এবং مِنْ ماءٍ مَهِينٍ পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছেন আদম সন্তানদেরকে। এটাই পবিত্র কোরআন মোতাবেক সঠিক বর্ণনা ও সঠিক আকিদা। এর বিপরীত গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা। এ সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন,
الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسانِ مِنْ طِينٍ (৭) ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلالَةٍ مِنْ ماءٍ مَهِينٍ
-“যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর আকৃতি প্রদান করেছেন, এবং মাটি হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর পানির নির্যাস হতে তাঁর বংশ বিস্তার করেছেন।” (সূরা সাজদা: ৭-৮ নং আয়াত)।
এই আয়াতে স্পষ্ট করেই আল্লাহ তা’লা বলেছেন মানব সৃষ্টির সূচনা তথা আদি পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন, এবং আদম সন্তানদেরকে পানির নির্যাস বা শুক্রানু-ডিম্বানু হতে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং পবিত্র কোরআন অনুযায়ী সকল আদম সন্তান পানির নির্যাস বা শুক্রানু-ডিম্বানু হতে সৃষ্টি, সরাসরি মাটি হতে নয়। এ সম্পর্কে আরো পরিস্কার হওয়ার জন্য নিচের দলিল গুলো লক্ষ্য করুন:- এই আয়াতের তাফছিরে আল্লামা আবু জাফর তাবারী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৩১০ হিজরী} স্বীয় গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ، قَالَ: أَخْبَرَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ، عَنْ مَعْمَرٍ، عَنْ قَتَادَةَ، فِي قَوْلِهِ: مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ قَالَ: اسْتُلَّ آدَمُ مِنْ طِينٍ، وَخُلِقَتْ ذُرِّيَّتُهُ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ
-“হযরত কাতাদা (رحمة الله عليه) সূরা মু’মীনুন এর ১২ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি হতে গঠন করা হয়েছে, এবং তাঁর সন্তানদেরকে পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” তাফছিরে তাবারী, ১৭তম খন্ড, ১৮ পৃ:;
এ সম্পর্কে ইমাম বাগভী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫১৬ হিজরী}তদীয় তাফছিরে বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسانَ، يعني: ولد آدم، -“অবশ্যই ‘ইনছান’কে সৃষ্টি করেছি তথা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে বাগভী, ৩য় খন্ড, ৩৬১ পৃ:; এ সম্পর্কে ইমাম কুরতবী {ওফাত ৬৭১ হি.} (رحمة الله عليه) তদীয় কিতাবে বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسانَ مِنْ سُلالَةٍ مِنْ طِينٍ يَعْنِي آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ،"ثُمَّ جَعَلْناهُ" أَيْ جَعَلْنَا نَسْلَهُ وَذُرِّيَّتَهُ نُطْفَةً فِي قَرارٍ مَكِينٍ
-“ইনছানকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি’ এর অর্থ হচ্ছে: হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাঁর সন্তানদেরকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করে নিরাপদ স্থানে রাখলেন।” তাফছিরে কুরতবী, ২য় খন্ড, ২০২ পৃ:; এ বিষয়ে ইমাম কুরতবী (رحمة الله عليه) আরো বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسانَ مِنْ سُلالَةٍ مِنْ طِينٍ يَعْنِي آدَمَ، ثُمَّ قَالَ:" ثُمَّ جَعَلْناهُ نُطْفَةً" أَيِ ابْنَ آدَمَ، لِأَنَّ آدَمَ لَمْ يُجْعَلْ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَكِينٍ
-“অবশ্যই ইনছানকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি’ অর্থাৎ হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)কে। অতঃপর আদম সন্তানদেরকে শুক্রবিন্দু রূপে রাখলেন। কেননা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে নুতফা রূপে নিরাপদ স্থানে রাখা হয়নি।” তাফছিরে কুরতবী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৩৩৩ পৃ:;
এই আয়াত সম্পর্কে আল্লামা আবুল বারাকাত আন-নাছাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭১০ হিজরী} বলেন, {وَلَقَدْ خَلَقْنَا الإنسان} أي آدم -“অবশ্যই ইনছানকে সৃষ্টি করেছি অর্থাৎ আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে নাসাফী, ২য় খন্ড, ৪৬১ পৃ:;
এই আয়াত সম্পর্কে আল্লামা হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৭৪ হিজরী} স্বীয় গ্রন্থে বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسانَ مِنْ سُلالَةٍ مِنْ طِينٍ الآية، فإن المراد من آدَمُ الْمَخْلُوقُ مِنَ السُّلَالَةِ، وَذُرِّيَّتُهُ مَخْلُوقُونَ مِنْ نُطْفَةٍ، وَصَحَّ هَذَا
-“অবশ্যই ইনছানকে মাটির নির্যাস হতে সৃষ্টি করেছি’ এই আয়াতের মুরাদ বা অর্থ হচ্ছে: আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করা হয় মাটির নির্যাস হতে, তাঁর বংশধর সন্তানদেরকে শুক্রবিন্দু হতে সৃষ্টি করা হয়। আর ইহা বিশুদ্ধ।” তাফছিরে ইবনে কাছির, ৩য় খন্ড, ৩৫২ পৃ:;
এই আয়াত সম্পর্কে আল্লামা হাফিজ ইমাম জালাল উদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৯১১ হিজরী} বলেন,
عَن قَتَادَة فِي قَوْله {وَلَقَد خلقنَا الإِنسان من سلالة من طين} قَالَ بَدْء آدم خلق من طين {ثمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَة} قَالَ: ذُرِّيَّة آدم
-“হযরত কাতাদা (رحمة الله عليه) এই আয়াত সম্পর্কে বলেন, আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর সৃষ্টির শুরু হয় মাটি হতে। অতঃপর আদম সন্তানদেরকে শুক্রবিন্দু রূপে রাখা হয়।” তাফছিরে দুর্রে মানছুর, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৯০ পৃ:;
অতএব, এই আয়াতের বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা হল, আল্লাহ পাক মাটি কিংবা মাটির নির্যাস হতে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছেন, আর আদম সন্তানদেরকে নুতফা তথা শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন। পূর্ব যুগের ছাল্ফে-ছালেহীনগণ এরূপ’ই তাফছির করেছেন।
❏ আয়াত নং ৭
وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ جَعَلَكُمْ أَزْواجاً
-“আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি হতে অতঃপর নূতফা দ্বারা অতঃপর তোমাদের করেছেন যুগল।” (সূরা ফাতির: ১১ নং আয়াত)।
এই আয়াত শরীফ উল্লেখ করে ওহাবীরা বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, আল্লাহ তা’লা সকল মানুষকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং রাসূল (ﷺ)ও মানুষ তাই তিনিও মাটির মানুষ (নাউজুবিল্লাহ)। অথচ এই আয়াত নাজিল হয়েছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর মাটির সৃষ্টির সম্পর্কে, কারণ হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং অন্য মানুষ শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। আরবী গ্রামারের নূন্যতম জ্ঞান যার আছে সেও বিষয়টি বুঝার কথা। যেমন:
خَلَقَكُمْ مِنْ تُرابٍ এই কথা বলেই ثُمَّ হরফে আত্ফ ব্যবহার করে مِنْ نُطْفَةٍ এর কথা বলা হয়েছে। আরবী গ্রামার মোতাবেক ‘মাতুফ’ ও ‘মাতুফ আলাইহে’ উভয়ই কোন সময় এক জাতের হয়না ও একই সাথে সংগঠিত হয়না। সুতরাং تُرابٍ (তুরাব) এবং نُطْفَةٍ (নুতফা) দ্বারা সৃষ্টির বিষয়টি একই সময় সংগঠিত নয় এবং সৃষ্টিগত একই জাতের হবেনা। তাই ثُمَّ হরফে আতফ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মাটির সৃষ্টির ঘটনা এবং নুতফা দ্বারা সৃষ্টির ঘটনা একই সময়ে সংগঠিত নয় এবং উভয় একই জাতে বা সিস্টেমে সৃষ্টি নয়। সুতরাং خَلَقَكُمْ مِنْ تُرابٍ (মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি) এর অর্থ হচ্ছে, মাটি দ্বারা সৃষ্টি হল হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এবং مِنْ نُطْفَةٍ (নুতফা হতে) এর অর্থ হচ্ছে, ‘নুতফা’ বা শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি হল অন্যান্য মানুষ। যেমনটি অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেছেন: خَلَقَ الْإِنْسانَ مِنْ عَلَقٍ -“আমি ইনছান তথা মানুষকে শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আলাক: ২ নং আয়াত)।
এ সম্পর্কে আরেক আয়াতে আছে: وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً -“তিনি ‘বাশার’ তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
সুতরাং সরাসরি মাটির সৃষ্টি হচ্ছে বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এবং আমরা হলাম শুক্রবিন্দুর তথা পানি হতে সৃষ্টি। আর আমাদের নবী (ﷺ) আল্লাহর নূরের সৃষ্টি। এবার মোফাচ্ছেরীনে কেরামের অভিমত শুনুন:
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আবু বারাকাত নাছাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭১০ হিজরী} তদীয় তাফছির গ্রন্থে বলেন:
والله خَلَقَكُمْ أي أباكم مّن تُرَابٍ -“আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন’ এর মূল অর্থ তোমাদের বাবা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে নাছাফী, ২য় খন্ড, ৪২৫ পৃ:;
আল্লামা আবু জাফর আত্-তাবারী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৩১০ হিজরী} বলেন,
وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ أَيُّهَا النَّاسُ مِنْ تُرَابٍ يَعْنِي بِذَلِكَ أَنَّهُ خَلَقَ أَبَاهُمْ آدَمَ مِنْ تُرَابٍ،
-“হে মানব সম্প্রদায়! আল্লাহ মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এর অর্থ হচ্ছে: এরূপ তাদের বাবা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে তাবারী শরীফ, ২২তম জি: ১২৬ পৃ:;
আল্লামা আবু জাফর আত্-তাবারী (رحمة الله عليه) দলিল উল্লেখ করেন,
ذِكْرُ مَنْ قَالَ ذَلِكَ: حَدَّثَنِي بِشْرٌ، قَالَ: ثنا يَزِيدُ، قَالَ: ثنا سَعِيدٌ، عَنْ قَتَادَةَ {وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرَابٍ} يَعْنِي آدَمَ {ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ} يَعْنِي ذُرِّيَّتَهُ
-“হযরত কাতাদা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি এই আয়াত সম্পর্কে বলেন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং ‘নুতফা’ দ্বারা আদমের বংশধরকে সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে তাবারী, ২২তম জি: ১২৭ পৃ:; আল্লামা ইমাম কুরতবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৭১ হিজরী} বলেন,
قَالَ سَعِيدٌ عَنْ قَتَادَةَ قَالَ: يَعْنِي آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ، وَالتَّقْدِيرُ عَلَى هَذَا: خَلَقَ أصلكم من تراب.
-“সাঈদ হযরত কাতাদা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, এর অর্থ হচ্ছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি। তথা তোমাদের সকলের মূলকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে কুরতবী, ১৪তম জি: ২৬৭ পৃ:;
বিশ্ব বিখ্যাত ফকিহ্ আবুল ফিদা আল্লামা হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৭৪ হিজরী} স্বীয় গ্রন্থে বলেন,
وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ أي ابتدأ خلق أبيكم مِنْ تُرَابٍ،
-“এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন: অর্থাৎ সর্বপ্রথম তোমাদের বাবা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে ইবনে কাছির, ৩য় খন্ড, ৬৬৯ পৃ:;
আল্লামা কাজী নাছিরুদ্দিন বায়জাবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৮৫ হিজরী} বলেন,
وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرابٍ بخلق آدم عليه السلام منه. ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ بخلق ذريته منها.
-“এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি, ‘অতঃপর নুতফা দ্বারা’ এর অর্থ হচ্ছে: আদমের বংশধরকে শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে বায়জাবী, ২য় খন্ড, ৩২৩ পৃ:;
এই মর্মে আল্লামা ইমাম বাগভী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫১৬ হিজরী} বলেন,
{وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرَابٍ} أَيْ: آدَمَ، ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ يَعْنِي: نَسْلَهُ، -“মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি এর অর্থ হচ্ছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে, আর ‘নুতফা’ দ্বারা সৃষ্টি করেছি অর্থ হচ্ছে তার পরবর্তী প্রজন্মকে।” তাফছিরে বাগভী, ৪র্থ খন্ড, ৩০৬ পৃ:;
এ সম্পর্কে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬০৬ হিজরী} বলেন,
مِنْ تُرابٍ إِشَارَةٌ إِلَى خَلْقِ آدَمَ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ إِشَارَةٌ خَلْقِ أَوْلَادِهِ، -“মাটি হতে’ এর ঈশারা করা হয়েছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর সৃষ্টির প্রতি এবং ‘নুতফা হতে’ দ্বারা ঈশারা করা হয়ে আদমের আওলাদগণের প্রতি।” তাফছিরে কবীর, ২৬তম জি: ১০ পৃ:;
আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইব্রাহিম ইবনে মুহাম্মদ বাগদাদী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৪১ হিজরী} তদীয় গ্রন্থে বলেন,
وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرابٍ يعني آدم ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ يعني ذريته
-“আল্লাহ তোমাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এর অর্থ হচ্ছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এবং ‘নুতফা’ দ্বারা এর অর্থ হচ্ছে আদমের বংশধরকে সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে খাজেন, ৩য় খন্ড, ৪৫৪ পৃ:;
এরূপ আরো অনেক তাফছিরের কিতাবের রেফারেন্স দেওয়া যাবে, কিন্তু সংক্ষিপ্তের জন্য ক্ষান্ত হলাম। অতএব, বিষয়টি স্পষ্ট যে, আল্লাহ পাক সরাসরি মাটি দ্বারা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছেন এবং অন্যান্য মানুষকে শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, আর আমাদের নবী (ﷺ) নুরের তৈরী, আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সৃষ্টিরও বহু পূর্বে সৃষ্টি। ইহাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত তথা নেয়ামত প্রাপ্ত সকল বান্দাগণের আকিদা।
❏ আয়াত নং ৮
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ طِينٍ
-“তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আনআম: ২ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াত শরীফ উল্লেখ করে অনেকে বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, সকল মানুষই মাটির তৈরী। অথচ সকল মানুষ সরাসরি মাটির তৈরী নয় বরং হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)’ই একমাত্র সরাসরি মাটির তৈরী। যেমন পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন,
خَلَقَ الْإِنْسانَ مِنْ عَلَقٍ -“আমি ইনছান তথা মানুষকে শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আলাক: ২ নং আয়াত)।
অপর আয়াতে আছে: وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً -“তিনি ‘বাশার’ তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
অতএব, হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) ছিলেন সারাসরি মাটির তৈরী এবং অন্য সকল মানুষ (নবী পাক দ:, ঈসা আ: ও বিবি হাওয়া আ: ব্যতীত) শুক্রবিন্দু দ্বারা তৈরী, আর ইহা পবিত্র কোরআন ও বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত। সূরা আনআমের এই আয়াতে خَلَقَكُم (তোমাদেরকে) বলার দু’টি কারণ রয়েছে। এক. خَلَقَ (খালাকা) এবং كُم (কুম) এই দুই শব্দের মাঝে أَبَا (আবা) শব্দ ‘মাহজুব’ বা গোপন রয়েছে। সুতরাং মূল কথাটি হচ্ছে خَلَقَ أَبَاكُم (খালাকা আবাকুম) তথা তোমাদের বাবাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি। দুই. এখানে كُم (কুম) শব্দটি আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর সম্মানার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা আল্লাহর পাক একক ও তাঁর কোন শরীক নেই, অথচ পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় আল্লাহর শানে إِنَّا. نَحْنُ ইত্যাদি বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বোপরি যুগে যুগে মোফাচ্ছেরীনে কেরাম তাঁদের স্ব স্ব তাফছির গ্রন্থে এ বিষয়ে বিষয়টি পরিস্কার করে গেছেন। যাদের খেদমতের উছিলায় আমরা ইসলাম ধর্মকে পেয়েছি এবার এই আয়াত সম্পর্কে তাঁদের অভিমত শুনুন,
এই আয়াত সম্পর্কে ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৯১১ হিজরী} ও ইমাম বাগভী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫১৬ হিজরী} বলেন,
{هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ طِين} بِخَلْقِ أَبِيكُمْ آدَم مِنْهُ -“এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তোমাদের বাবা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে জালালাইন; তাফছিরে বাগভী, ২য় খন্ড, ১৯৯ পৃ:;
আল্লামা কাজী নাছিরুদ্দিন বায়জাবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৮৫ হিজরী} বলেন,
أي ابتدأ خلقكم منه، فإنه المادة الأولى وأن آدم الذي هو أصل البشر خلق منه، أو خلق أباكم فحذف المضاف.
-“তোমাদের মূলকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, কেননা তিনি সর্বোত্তম মূল আর তিনি হলেন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) যিনি সকল মানুষের মূল, তাঁকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। অথবা মুজাফকে (أَبَا শব্দকে) গোপন রাখা রয়েছে।” তাফছিরে বায়জাবী, ১ম খন্ড, ৩৭৫ পৃ:; তাফছিরে সিরাজুম মুনীর, ১ম খন্ড, ৪১০ পৃ:; হাশিয়াতুস শিহাব আলা তাফছিরে বায়জাবী, ৫ম খন্ড, ১০৯ পৃ:;
আল্লামা আবু বারাকাত আন-নাছাফী (رحمة الله عليه) বলেন,
{هُوَ الذي خَلَقَكُمْ مِّن طِينٍ} من لابتداء الغاية أى ابتدأ خلق أصلكم يعنى آدم
-“এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে: ‘মিন’ সকলের শুরুকে অর্থাৎ মাটি দিয়ে তোমাদের শুরু ও মূলকে তথা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে নাছাফী, ২য় জিল্দ, ৬ পৃষ্টা;
হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৭৪ হিজরী} বলেন,
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ طِينٍ يَعْنِي أَبَاهُمْ آدَمَ، الَّذِي هُوَ أَصْلُهُمْ، -“এই আয়াতের অর্থ: তাদের বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যিনি তাদের সকলের মূল।” তাফছিরে ইবনে কাছির, ২য় খন্ড, ১৫৬ পৃ:;
এ সম্পর্কে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬০৬ হিজরী} বলেন,
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ طِينٍ وَالْمَشْهُورُ أَنَّ الْمُرَادَ مِنْهُ أَنَّهُ تَعَالَى خَلَقَهُمْ مِنْ آدَمَ وَآدَمُ كَانَ مَخْلُوقًا مِنْ طِينٍ.
-“এই আয়াতের অর্থ: সু-প্রসিদ্ধ হচ্ছে, নিশ্চয় এর মুরাদ বা ভাবার্থ হল আল্লাহ তা’লা লোকদেরকে আদম থেকে সৃষ্টি করেছেন আর একমাত্র মাখলুক হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে কবীর, ১২তম জি: ১৩১ পৃ:; এ বিষয়ে হাদিস শরীফেও আছে,
ذَكَرَ ابْنُ سَعْدٍ فِي" الطَّبَقَاتِ" عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: (الناس وَلَدُ آدَمَ وَآدَمُ مِنَ التُّرَابِ)
-“ইবনে সা’দ তাঁর ‘তাব্কাত’-এ বর্ণনা করেন, হযরত আবু হহুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: মানুষ হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) থেকে সৃষ্টি, আর আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) মাটি থেকে সৃষ্টি।” তাফছিরে কুরতবী, ৬ষ্ঠ জি: ৩৩৭ পৃ:;
পবিত্র কোরআনেও হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে طِين (তিন) বা মাটি দ্বারা সৃষ্টির বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ আছে,قالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِيناً
-“ শয়তান বলল: আমি কি এমন একজনকে সিজদা করব যাকে মাটি দিয়ে তৈরী করেছেন।” (সূরা ইসরা: ৬১ নং আয়াত)।
এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ফকিহ্ আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপাথি (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২২৫ হিজরী} তদীয় গ্রন্থে বলেন,
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ طِينٍ يعنى ابتدأ خلقكم منه حيث خلق منه أصلكم آدم عليه السّلام او المعنى خلق أباكم آدم بحذف المضاف
-“তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করেছেন মাটি দিয়ে। এ হিসেবে যে, তোমাদের আদি পুরুষ হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অথবা অর্থ এই যে, তোমাদের পিতা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এখানে أَبَا (আবা) শব্দটি كُمْ (কুম) এর সাথে ‘মুজাফ’ হিসেবে উহ্য রয়েছে।” তাফছিরে মাজহারী, ৩য় খন্ড, ২৩৯ পৃ:;
আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম বাগদাদী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৪১ হিজরী} বলেন,
يعني أنه تعالى خلق آدم من طين وإنما خاطب ذريته بذلك لأنه أصلهم
-“নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সন্তাদেরকে সম্ভোধন করা হয়েছে এ কারণে যে, তিনি তাদের সকলের মূল।” তাফছিরে খাজেন, ২য় খন্ড, ৯৮ পৃ:;
উল্লেখিত দালায়েল এর আলোকে বলা যায়, هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ طِينٍ এই আয়াতের মূল অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তা’লা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এখানে خَلَقَكُمْ (খালাকাকুম) শব্দটি আনা হয়েছে দুটি কারণে এক. خَلَقَ (খালাকা) এবং كُمْ (কুম) এর মাঝে أَبَا (আবা) শব্দটি كُمْ (কুম) এর মুজাফ হিসেবে مَحْذُوف উহ্য রয়েছে। সুতরাং মোট অর্থ হচ্ছে তোমাদের বাবাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, এখানে كُمْ (কুম) শব্দটি হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সন্তানদের প্রতি লক্ষ্য রেখে সম্মানার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের এই আয়াতের ব্যাপারে দুনিয়ার সকল আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর মোফাচ্ছেরীনে কেরামগণ একমত যে, হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এর বিপরীত তাফছির করলে মূলত পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত হবে।
❏ আয়াত নং ৯
فَإِنَّا خَلَقْناكُمْ مِنْ تُرابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُضْغَةٍ
-“নিশ্চয় তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি অতঃপর শুক্রবিন্দু থেকে অতঃপর রক্তপি- থেকে অতঃপর মাংশপি- থেকে।” (সূরা হাজ্ব: ৫ নং আয়াত)।
অনুরূপ সূরা গাফির এর ৬৭ নং আয়াতেও বলা হয়েছে। উপরোক্ত আয়াতদ্বয় দ্বারা অনেকে বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, সকল মানুষর মূলত মাটির তৈরী। অথচ এখানেও আল্লাহ পাক মাটি দ্বারা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করার কথা বলেছেন এবং আদম সন্তানদের নুতফা তথা শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করার কথা বলেছেন। যেমর নিচের তাফছির গুলো লক্ষ্য করুন:-
এ সম্পর্কে আল্লামা আবু বারাকাত আন নাছাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭১০ হিজরী} বলেন,
{فَإِنَّا خلقناكم} أي أباكم {مّن تُرَابٍ ثُمَّ} خلقتم {مِن نُّطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ}
-“নিশ্চয় তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি অর্থাৎ তোমাদের বাবা (আদম আ:) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর তোমাদেরকে শুক্রবিন্দু থেকে অতঃপর রক্তপি- থেকে।” তাফছিরে নাছাফী, ২য় খন্ড, ৪২৮ পৃ:; আল্লামা কাজী নাছিরুদ্দিন বায়জাবী (رحمة الله عليه) বলেন,
فإنا خلقناكم. مِنْ تُرابٍ بخلق آدم منه، -“নিশ্চয় তোমাদেরকে মাটি থেকে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে বায়জাবী, ৪র্থ খন্ড, ৬৫ পৃ:;
এ সম্পর্কে আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আনছারী কুরতবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৭১ হিজরী} বলেন,
(فَإِنَّا خَلَقْناكُمْ) أَيْ خَلَقْنَا أَبَاكُمُ الَّذِي هُوَ أَصْلُ الْبَشَرِ، يَعْنِي آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ (مِنْ تُرابٍ). (ثُمَّ) خَلَقْنَا ذُرِّيَّتَهُ. (مِنْ نُطْفَةٍ) وَهُوَ الْمَنِيُّ، سُمِّيَ نُطْفَةً لِقِلَّتِهِ
-“নিশ্চয় তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ তোমাদের বাবা যিনি মানব জাতির প্রথম ব্যক্তি আর তিনি হলেন আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ), তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আদমের বংশধরকে শৃক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর ইহা হচ্ছে ‘মনী’ সল্পতার কারণে একে নুতফা বলা হয়।” তাফছিরে কুরতবী, ১২তম খন্ড, ৬ পৃ:;
আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম বাগদাদী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৪১ হিজরী} বলেন,
فَإِنَّا خَلَقْناكُمْ مِنْ تُرابٍ يعني أباكم آدم الذي هو أصل النسل ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ يعني ذريته من المني وأصلها الماء القليل
-“নিশ্চয় তোমাদেরকে মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ তোমাদের পিতা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) যিনি মানব জাতির প্রথম ব্যক্তি আর তিনি হলেন আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ), তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর আদমের বংশধরকে শৃক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন, যা মূলত সামান্য পানি।” তাফছিরে খাজেন, ৩য় খন্ড, ২৪৮ পৃ:;
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) বলেন,
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنْهُ آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ أَيْ ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلالَةٍ مِنْ ماءٍ مَهِينٍ
-“তিনি হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর শুক্রবিন্দু থেকে অর্থাৎ আদমের বংশধরকে পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে ইবনে কাছির, ৫ম খন্ড, ৩৪৭ পৃ:;
এ সম্পর্কে কুখ্যাত লা-মাজহাবী কাজী শাওকানী তদীয় কিতাবে বলেন,
خَلَقْناكُمْ مِنْ تُرابٍ فِي ضِمْنِ خَلْقِ أَبِيكُمْ آدَمَ ثُمَّ خَلَقْنَاكُمْ مِنْ نُطْفَةٍ أَيْ: مِنْ مَنِيٍّ، سُمِّيَ نُطْفَةً لِقِلَّتِهِ، وَالنُّطْفَةُ: الْقَلِيلُ مِنَ الْمَاءِ.
-“তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ তোমাদের বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদেরকে শুক্রবিন্দু থেকে অর্থাৎ ‘মনী’ থেকে সৃষ্টি করেছেন সল্পতার কারণে তাকে নুতফা বলা হয়।” তাফছিরে ফাতহুল কাদির, ৩য় খন্ড, ৫১৫ পৃ:;
অতএব, আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে আল্লাহ পাক সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং আদম সন্তানদেরকে পানি নির্যাস থেকে তথা নুতফা থেকে সৃষ্টি করেছেন। এটাই পবিত্র কোরআন অনুযায়ী ছালফে-ছালেহীনের চুড়ান্ত ফাতওয়া।
❏ আয়াত নং ১০
مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ
-“এই মাটি দিয়ে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এই মাটিতেই তোমাদেরকে দাফন করা হবে।” (সূরা ত্বহা: ৫৫ নং আয়াত)।
এই আয়াত শরীফ দ্বারা অনেকে সকল মানুষ তথা আমাদের নবীকেও মাটির তৈরী বলা চেষ্টা করেন। অথচ পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটিও আমাদের সকলের বাবা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। কারণ হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) ছাড়া অন্য কোন মানুষ সরাসরি মাটির তৈরী নয়। যেমন আল্লাহ তা’লা বলেন:
خَلَقَ الْإِنْسانَ مِنْ عَلَقٍ -“আমি ইনছান তথা মানুষকে রক্তপিন্ড তথা শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আলাক: ২ নং আয়াত)।
আরেক আয়াতে আছে: وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً -“তিনি বাশার তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
অপরদিকে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ তা’লা স্পষ্ট বলেন:
خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ-“আমি তাকে (আদমকে) মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আলে ইমরান: ৫৯ নং আয়াত)।
তাই পবিত্র কোরআনে যে সকল জায়গায় সরাসরি মাটি দ্বারা সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে সে সকল আয়াত হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর সম্পর্কে নাজিল হয়েছে, আর সাধারণ মানুষকে আল্লাহ তা’লা শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এবার مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ এই আয়াত সম্পর্কে মোফাচ্ছেরীনে কেরামগণ কি বলেছেন লক্ষ্য করুন:-
বিশ^ বিখ্যাত মুফাচ্ছির আবুল ফিদা আল্লামা হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৭৪ হিজরী} তদীয় তাফছির গ্রন্থে বলেন:
أَيْ مِنَ الْأَرْضِ مَبْدَؤُكُمْ، فَإِنَّ أَبَاكُمْ آدَمَ مَخْلُوقٌ مِنْ تُرَابٍ -“জমীন থেকে তোমাদের শুরু কেননা তোমাদের বাবা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) মাটির তৈরী সৃষ্টি।” তাফছিরে ইবনে কাছির, ৩য় খন্ড, ১৯৪ পৃ:;
এই আয়াত সম্পর্কে আল্লামা কাজী নাছিরুদ্দিন বায়জাবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৮৫ হিজরী} স্বীয় গ্রন্থে বলেন,
مِنْها خَلَقْناكُمْ فإن التراب أصل خلقة أول آبائكم -“নিশ্চয় মাটি হল তোমাদের বাবা প্রথম সৃষ্টির মূল।” তাফছিরে বায়জাবী, ২য় খন্ড, ৬৩ পৃ:;
আল্লামা আলাউদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম বাগদাদী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৪১ হিজরী} বলেন, مِنْها خَلَقْناكُمْ أي من الأرض خلقنا آدم، -“ইহা দ্বারা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি” অর্থাৎ, জমীন থেকে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে খাজেন, ৩য় খন্ড, ২০৬ পৃ:; তাফছিরে আবু সাঊদ, ৪র্থ খন্ড, ৬১৫ পৃ:;
এ সম্পর্কে আল্লামা ইমাম বাগভী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫১৬ হিজরী} ও আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২৭০ হিজরী} তদীয় তাফছির গ্রন্থে বলেন,
{مِنْهَا} أَيْ مِنَ الْأَرْضِ، {خَلَقْنَاكُمْ} يَعْنِي أَبَاكُمْ آدم. -“ইহা হতে” অর্থাৎ, জমীন থেকে “তোমাদের সৃষ্টি করেছি” অর্থাৎ তোমাদের বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে বাগভী, ৪র্থ খন্ড, ১১ পৃ:; তাফছিরে রুহুল মাআনী, ১৬তম জিল্দ, ৭২৩ পৃ:;
আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপাথি (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২২৫ হিজরী} বলেন,
مِنْها اى من الأرض خَلَقْناكُمْ يعنى خلقنا من تراب الأرض أباكم آدم
-“ইহা হতে” অর্থাৎ জমীন হতে, “তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি” অর্থাৎ তোমাদের বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে জমীনের মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে মাজহারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৭৩ পৃ:;
এ সম্পর্কে আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আনছারী কুরতবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৭১ হিজরী} বলেন,
(مِنْها خَلَقْناكُمْ) يَعْنِي آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ لِأَنَّهُ خُلِقَ مِنَ الْأَرْضِ،
-“ইহা হতে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি’ অর্থাৎ হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে কেননা আল্লাহ হযরত আদমকেই জমীনের মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।” তাফছিরে কুরতবী, ১১তম জিল্দ, ১৭৯ পৃ:;
এ সম্পর্কে আল্লামা আবুল বারাকাত আন-নাছাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭১০ হিজরী} বলেন:
{مِنْهَا} من الأرض خلقناكم أي أباكم آدم عليه السلام -“ইহা হতে’ তথা জমীন হতে তোমাদের সৃষ্টি করেছি; তথা তোমাদের বাবা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করেছি।” তাফছিরে মাদারিক্ব, ৩য় জিল্দ, ৭২ পৃ:;
মোট কথা হলো, আল্লাহ পাক এই আয়াতে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে লক্ষ্য করেই বলেছেন। এখানে خلقناكم (খালাকাকুম) শব্দটি আনা হয়েছে দুটি কারণে এক. خلقنا (খালাকা) এবং كم (কুম) এর মাঝে أَبَا (আবা) শব্দটি كم (কুম) এর মুজাফ হিসেবে محذوف উহ্য রয়েছে। সুতরাং মোট অর্থ হচ্ছে তোমাদের বাবাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি। কারণ পবিত্র কোরআনই বলছে আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সরাসরি মাটির সৃষ্ট এবং অন্যান্য মানুষ শুক্রবিন্দু দ্বারা সৃষ্ট। তাই কোরআনকে কোরআন দ্বারা ব্যাখ্যা করলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দুনিয়া সকল উলামায়ে কেরাম এ কথা স্বীকার করেছেন যে, আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) ছাড়া অন্য কোন মানুষ সরাসরি মাটির তৈরী নয়। কেউ কেউ বলেছেন: “প্রত্যেক মানুষ যেখানে দাফন হবে সেখানের মাটি তার নাভিতে দেওয়া হয়।” এই কথা কোন ছহীহ্ সনদ দ্বারা প্রমাণিত নয়। ইমাম কুরতবী (رحمة الله عليه) وَقِيلَ শব্দ প্রয়োগ করে এরূপ মতকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। এবং এ ধরণের কথা পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বিরুধী, কারণ পবিত্র কোরআনের বলা হয়েছে:
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً -“তিনি বাশার তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
তাই কোরআনের বিরুধী কোন কথা গ্রহণ করা যাবেনা। এমনকি আহাদ সূত্রে বর্ণিত কোন ছহীহ্ হাদিসও যদি কোরআনের বিপরীত হয় তথাপিও ঐ হাদিস বাদ দিয়ে পবিত্র কোরআনকে প্রাধান্য দিতে হবে। এমনকি এই বিষয়টি মেনে নিলেও মানুষকে এককভাবে মাটির তৈরী বলা যাবেনা, কারণ এতে ‘তাকজিবে কোরআন’ প্রমাণিত হবে। সর্বোপরি পৃথিবীর সর্বপ্রথম মাটির তৈরী মানুষ হলেন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)। আর ছহীহ্ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত আছে সকল মানুষের আদি পিতা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর সৃষ্টির বহু পূর্বেই হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) মানবরূপে নবী ছিলেন। এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে সা’দ (رحمة الله عليه) (ওফাত ২৩০ হিজরী) ও বিশ্ব বিখ্যাত ফকিহ্, আল্লামা আবুল ফজল হাফিজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৭৪ হি.} উল্লেখ করেন:
أَخْبَرَنَا عَبْدُ الْوَهَّابِ بْنُ عَطَاءٍ عَنْ سَعِيدُ بْنُ أَبِي عَرُوبَةَ عَنْ قَتَادَةَ قَالَ: وَأَخْبَرَنَا عُمَرُ بْنُ عَاصِمٍ الْكِلابِيُّ أَخْبَرَنَا أَبُو هِلالٍ عَنْ قَتَادَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ: كُنْتُ أَوَّلَ النَّاسِ فِي الْخَلْقِ وَآخِرَهُمْ فِي الْبَعْثِ. وَهَذَا أَثْبَتُ وَأَصَحُّ
-“হযরত কাতাদা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, আমাদেরকে জানানো হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এরূপ বলেছেন: সৃষ্টির মধ্যে আমিই প্রথম মানুষ এবং প্রেরিত হয়েছি সবার শেষে। ইহা প্রমাণিত ও অধিক ছহীহ্।” ইবনে সা’দ: তবকাতে কোবরা, ১ম খন্ড, ১১৯ পৃ:; ইবনে কাছির: আল বেদয়া ওয়ান নেহায়া, ১ম খন্ড, ৩২৫ পৃ:; শরফুল মোস্তফা,, ২য় খন্ড, ৭২ পৃ:; কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ১ম খন্ড, ১১৪ পৃ:; বাহজাতুল মাহফিল, ১ম খন্ড, ১৩ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৪২ পৃ:; শরহে মাওয়াহেব লিয যুরকানী, ১ম খন্ড, ৬৯ পৃ:; ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১০ম খন্ড, ২৭৪ পৃ:; ইবনে জারির তাবারী, শরহে শিফা, ১ম খন্ড, ১১৭ পৃ:;। যেমন ছহীহ্ হাদিসে আছে,
حَدَّثَنَا أَبُو النَّضْرِ الْفَقِيهُ، وَأَحْمَدُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ سَلَمَةَ الْعَنَزِيُّ، قَالَا: ثنا عُثْمَانُ بْنُ سَعِيدٍ الدَّارِمِيُّ، وَمُحَمَّدُ بْنُ سِنَانٍ الْعَوَقِيُّ، ثنا إِبْرَاهِيمُ بْنُ طَهْمَانَ، عَنْ بُدَيْلِ بْنِ مَيْسَرَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ شَقِيقٍ، عَنْ مَيْسَرَةَ الْفَجْرِ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَتَى كُنْتَ نَبِيًّا؟ قَالَ: وَآدَمُ بَيْنَ الرُّوحِ وَالْجَسَدِ
-“হযরত মাইছারা ফিখরী (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপিন কখন থেকে নবী ছিলেন? তিনি বললেন: আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) যখন রুহ্ ও দেহের মাঝামাঝি ছিলেন।” মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪র্থ খন্ড, ১৫৭৫ পৃ:; মাদারেজুন্নবুয়াত, ১ম খন্ড, ৭ পৃ:; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়াত, ২য় খন্ড, ৯০ পৃ:; মুসনাদে আহমদ; মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৫৮ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছায়েছুল কোবরা, ১ম খন্ড, ২১ পৃ:; ইমাম বূখারী তাঁর তারিখে কবীরে; ইমাম বাগভী: শরহে সুন্নাহ, ১ম খন্ড, ২০৭ পৃ:; হাফিজ ইবনে কাছির: আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ২য় খন্ড, ৬২৬ পৃ:; ইমাম আবু নুয়াইম তাঁর হুলিয়াতে; ইমাম আবু নুয়াইম: দালায়েলুন্নবুয়াত, ৫৮ পৃ:;
মাটির তৈরী সর্বপ্রথম মানুষ হলেন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ), আর সেই আদম সৃষ্টিরও বহু পূর্বে আমাদের নবী (ﷺ) সৃষ্টি হয়েছেন। তাই তাঁকে মাটির তৈরী বলা চরম মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। সুতরাং আল্লাহ তা’লা সর্ব প্রথম তার নূর থেকে হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) কে সৃষ্টি করেছেন, এটাই চূড়ান্ত কথা। তাছাড়া مِنْها خَلَقْناكُمْ ‘মিনহা খালাকনাকুম..’ এই আয়াত যে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সম্পর্কে নাজিল হয়েছে সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের অন্য আয়াত দ্বারা সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন:
قَالَ اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَى حِينٍ قَالَ فِيهَا تَحْيَوْنَ وَفِيهَا تَمُوتُونَ وَمِنْهَا تُخْرَجُونَ
-“তিনি (আল্লাহ) বললেন: তোমরা পরস্পর শত্রুরূপে নেমে যাও, তোমাদের জন্য পৃথিবীতে কিছু সময় বসবাস ও জিবীকা আছে। অতঃপর বললেন: সেখানেই জিবন-যাপন, সেখানেই মৃত্যুবরণ ও সেখান হতেই বের করে আনা হবে।” (সূরা আরাফ: ২৫-২৬ নং আয়াত)।
অতএব, সর্ব সম্মতিক্রমে আয়াতটি হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর সৃষ্টি কেন্দ্রীক। বনী আদম কেন্দ্রীক নয়।
❏ কিছু হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা
এবার ঐ সকল রেওয়ায়েত গুলো উল্লেখ করব যেগুলো রাসূল (ﷺ) কে মাটির তৈরী বলার ব্যাপারে ওহাবীদের সম্ভল। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন, إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطانِ كانَ ضَعِيفاً -“নিশ্চয় শয়তানের চক্রান্ত গুলো দুর্বল।” (সূরা নিসা: ৭৬ নং আয়াত)। তাই ওহাবীদের সম্ভল গুলো দুর্বল। এবার নিচের রেওয়ায়েত গুলো লক্ষ্য করুন:-
❏ প্রিয় নবীজি কি মদিনার রওজার মাটির তৈরী?
عَنْ كَعْبِ الْأَحْبَارِ قَالَ: لَمَّا أَرَادَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ أَنْ يَخْلُقَ مُحَمَّدًا أَمَرَ جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلَامُ، فَأَتَاهُ بِالْقَبْضَةِ الْبَيْضَاءِ الَّتِي هِيَ مَوْضِعُ قَبْرِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعُجِنَتْ بِمَاءِ التَّسْنِيمِ فَغُمِسَتْ فِي أَنْهَارِ الْجَنَّةِ وَطَيَّفَهَا فِي السَّمَاوَاتِ، فَعَرَفَتِ الْمَلَائِكَةُ مُحَمَّدًا صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبْلَ أَنْ يُعْرَفَ آدَمُ،..
-“হযরত কাব আহবার (তাবেঈ) বলেন: যখন আল্লাহ তা’লা তার নবীকে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন, তখন তিনি হযরত জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে তাঁর রওজা মোবারক থেকে এক মুষ্টিالْبَيْضَاء তথা আলোকময় বস্তু আনতে নির্দেশ দেন। যা রাসূল (ﷺ) এর রওজা মোবারকে রাখা ছিল। তারপর সেখান থেকে মুষ্টি পরিমান অংশ জান্নাতের তাসনীম নহর দিয়ে খামিরা বানানো হয়। আর তা আসমান ও জমীনে তাওয়াফ করানো হয়। আর ফেরেস্থারা তাঁর মর্যাদা বুজতে ও চিনতে পারল আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সৃষ্টি বহু পূর্বে। তারপর নূরে মুহাম্মদী আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর পৃষ্টদেশে রাখলে তারা তা দেখতে লাগল......।” (ইমাম ইবনে যাওজী: ‘আল ওয়াফা বি’আহওয়ালিল মুস্তাফা’, হাদিস নং ৮; ইমাম ত্বীবি: শরহে মেসকাত, ১১তম খন্ড, ১১৩৬ পৃ: ৫৭৩৯ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৫৭৩৯ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়; ইবনে আসাকির: তারিখে দামেস্ক, ১ম খন্ড, ৩৪৯ পৃ:; ইমাম ইবনে জাওযী: কিতাবুল মওজুয়াত, ১ম খন্ড, ২৮১ পৃ:; তারিখুল খামিছ, ১ম খন্ড, ২১ পৃ:; ইমাম খারকুশী: শারফুল মুস্তফা, ১ম খন্ড, ৩০০ পৃ:;)
এই হাদিস এনেই অনেকে বলেন যে, রাসূল (ﷺ) কে রওজা শরীফের মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই নবীজি (ﷺ) রওজা পাকের মাটির তৈরী। অথচ এই হাদিসে কোথাও মাটির কথা উল্লেখ নেই। বরং বলা হয়েছেبِالْقَبْضَةِ الْبَيْضَاءِ অর্থাৎ এক মুষ্টিالْبَيْضَاء তথা আলোময় বস্তু আনলেন। উল্লেখ্য যে, ইমাম কাস্তালানী ও ইমাম হালবী এই হাদিসের মতনকে কিছুটা পরিবর্তন করেছেন। হাদিসটি মূলত ৫ম হিজরীর মুহাদ্দেছ ইমাম ইবনে আসাকির (رحمة الله عليه) এর ‘তারিখে দামেস্ক’ ও ৬ষ্ঠ হিজরীর মুহাদ্দেছ আল্লামা ইবনে জাওযী (رحمة الله عليه) এর ‘আল ওয়াফা’ এর মধ্যে, ইমাম খারকুশী তার ‘শরফুল মুস্তফা’ এর মধ্যে, আল্লামা দিয়ারবকরী (رحمة الله عليه) তার ‘তারিখুল খামিছ’ কিতাবে এভাবেই বর্ণনা করেছেন। তাদের থেকে ইমাম ত্বীবি (رحمة الله عليه), ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله عليه) নকল করেছেন। যারা ইমাম কাস্তালানী ও হালভীর বহু পূর্বের মোহাদ্দিছ ও ইমাম। সুতরাং মূল মতনের কিতাব ও পূর্বের কিতাবের মতন’ই প্রাধান্য পাবে। প্রাচিন ও মূল কিতাবে বিষয়টি রয়েছে “بِالْقَبْضَةِ الْبَيْضَاءِ অর্থাৎ এক মুষ্টিالْبَيْضَاء তথা আলোময় বস্তু আনলেন।” আর পরবর্তীতে কেউ কেউ এটা পরিবর্তন করে লিখেছেন أن يأتيه بالطينة -“মাটির খামিরা আনলেন।” মূলত মাটির খামিরার কথাটি সঠিক নয় বরং আলোময় সাদা বস্তুর কথাটি সঠিক।
সর্বোপরি এই হাদিসের কোন নির্ভরযোগ্য সনদই নেই। এখন ইহাকে ছহীহ্ কিংবা হাছান বা জয়ীফ বলতে হলে সে হাদিসের তেমন সনদ প্রয়োজন। এরপরে হযরত কা’ব আহবার একজন তাবেঈ, তিনি এই কথা কোন সাহাবী কিংবা রাসূল (ﷺ) এর রেফারেন্স দিয়ে বলেননি বরং নিজের ইজতেহাদের কথা বলেছেন। রাসূলে পাক (ﷺ) এর ছহীহ্ রেওয়াতের মোকাবেলায় এরূপ মাথা-মুন্ডু বিহীন রেওয়ায়েত কতটুকু গ্রহণযোগ্য হতে পারে? যদি এর নির্ভরযোগ্য কোন সনদ থাকত তাহলে তাবেঈর কথা হিসেবে ইহা ‘মাকতু’ পর্যায়ের রেওয়ায়েত হত। সর্বোপরি সকলেই অবগত আছেন কোন আইনী বিষয়ে ‘মাকতু’ রেওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বোপরি ইহা ছহীহ্ ও মারফূ রেওয়াতের খেলাফ বা বিপরীত এবং মওজু বা বানোয়াট রেওয়ায়েত। এবার হযরত কা’ব আহবার (رحمة الله عليه) এর আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন:
أنه لما خلق الله تعالى آدم، ألهمه أن قال: يا رب، لم كنيتني أبا محمد، قال الله تعالى: يا آدم ارفع رأسك، فرفع رأسه فرأى نور محمد في سرادق العرش فقال: يا رب، ما هذا النور؟ قال: هذا نور نبى من ذريتك اسمه فى السماء أحمد، وفى الأرض محمد، لولاه ما خلقتك ولا خلقت سماء ولا أرضا.
-“নিশ্চয় যখন আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করা হল, তখন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) আল্লাহ পাকের দরবারে আবেদন করেছিলেন, হে আল্লাহ! আমার উপনাম ‘আবু মুহাম্মদ’ রাখা হল কেন? আল্লাহ পাক বললেন: হে আদম! তোমার মাথা উপরের দিকে উঠাও। আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) মাথা উঠিয়ে দেখলেন তাঁর চোখের সামনে আরশের পর্দায় নূরে মুহাম্মদী ভেসে উঠল। আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) আরজ করলেন: হে আল্লাহ! এই নূর মোবারক কার? আল্লাহ বললেন: এই ‘নূর’ হল ঐ নবীর যিনি তোমার বংশধরের একজন, যার আম আসমানে আহমদ এবং জমীনে তাঁর নাম মুহাম্মদ। যদি আমি তাঁকে না বানাইতাম তাহলে তোমাকেও বানাইতাম না, এমনকি আসমান জমীনও বানাইতাম না।” ( ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৭০ পৃ:; ইমাম যুরকানী: শরহে মাওয়াহেব, ১ম খন্ড, ৮৫ পৃ:; যাওয়াহিরুল বিহার, ৩য় খন্ড, ৩৫২ পৃ:;)
হযরত কাব আহবার (رحمة الله عليه) এর এই রেওয়ায়েত দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সৃষ্টির পূর্বেই নূর ছিলেন। আসমান-জমীন এমনকি হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ)ও আমাদের নবী (ﷺ) এর উছিলায় সৃষ্টি হয়েছে (সুবহানাল্লাহ)।
❏ আমি, আবু বকর, উমর একই মাটির তৈরী” এর ব্যাখ্যা
কিছু সংখ্যক লোকেরা বড় আনন্দের সাথে বলে থাকেন ছহীহ্ হাদিসে আছে! আল্লাহর রাসূল (ﷺ), আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) ও উমর ফারুক (رضي الله عنه) একই মাটি থেকে তৈরী এবং একই জায়গায় দাফন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা কিছু রেওয়ায়েত উল্লেখ করে থাকে। মূলত এই সকল রেওয়ায়েত গুলো জাল বা মওজু। আসমাউর রিজাল ও মুহাদ্দিছীনে কেরামের অভিমত সহ নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হল। প্রথমত খতিবে বাগদাদী (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন,
أَخْبَرَنَاهُ أَحْمَدُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ غَالِبٍ، قَالَ: أَخْبَرَنَا أَبُو بَكْرٍ الإِسْمَاعِيلِيُّ، قَالَ: أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ يُوسُفَ الْهَرَوِيُّ قَاطِنُ دِمَشْقَ، قَالَ: حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْبَغْدَادِيُّ بِمِصْرَ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ سَهْلٍ أَبُو هَارُونَ الرَّازِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ يُوسُفَ الأَزْرَقُ، قَالَ: حَدَّثَنَا سُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ الشَّيْبَانِيُّ، عَنْ أَبِي الأَحْوَصِ الْجُشَمِيِّ، عَن عبد الله بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ يُذَرُّ عَلَى سُرَّتِهِ مِنْ تُرْبَةٍ، فَإِذَا طَالَ عُمُرُهُ رَدَّهُ اللَّهُ إِلَى تُرْبَتِهِ الَّتِي خَلَقَهُ اللَّهُ مِنْهَا وَأَنَا وَأَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ خُلِقْنَا مِنْ تُرْبَةٍ وَاحِدَةٍ وَفِيهَا نُدْفَنُ
-“হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: প্রত্যেক শিশুর নাভিতে সেই মাটি রাখা হয় যেখানে তাকে দাফন করা হবে। তিনি আরো বলেন: আমি, আবু বকর, উমর একই মাটির তৈরী এবং একই জায়গায় দাফন হব।” (তারিখে বাগদাদ, ৩য় খন্ড, ৫৪২ পৃ: রাবী নং ১০৬২;)
এই হাদিস দিয়েও অনেকে রাসূল (ﷺ) কে মাটির তৈরী বলা অপচেষ্টা করেন। অথচ ইহা একটি গরীব ও বানোয়াট তথা জাল হাদিস। খতিবে বাগদাদী (رحمة الله عليه) হাদিসটিকে غريب ‘গরীব’ বলেছেন। যেমন উল্লেখ আছে:
غريب من حديث الثوري عن الشيباني، لا أعلم يروي إلا من هذا الوجه،
-“শায়বানী থেকে ছাওরীর বর্ণিত রেওয়ায়েতটি ‘গরীব’ এই সূত্রটি ছাড়া এ বিষয়ে অন্য কোন সূত্র আমার জানা নেই।” ( তারিখে বাগদাদ, ৩য় খন্ড, ৫৪২ পৃ: রাবী নং ১০৬২;)
এই হাদিসের সনদে একজন মিথ্যাবাদী ও বাতিল বর্ণনাকারী রয়েছে। তার নাম হল: موسى بن سهل بن هارون (মূসা ইবনে সাহল ইবনে হারুন) যেমন ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) বলেন:
مُوسَى بن سهل بن هَارُون الرَّازِيّ عَن اسحاق الْأَزْرَق بِخَبَر كذب -“মূসা ইবনে সাহল ইবনে হারুন রাজী বর্ণনাকারী ইসহাক্ব আযরাকী থেকে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করত।” ( ইমাম যাহাবী: আল মুগনী, রাবী নং ৬৪৯৪;) বিখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা ইবনে জাওযী (رحمة الله عليه) একে موضوع ‘জাল হাদিস’ বলেছেন। ( ইমাম ইবনে জাওযী: কিতাবুল মওজুয়াত, ১ম খন্ড, ৩২৮ পৃ:; তাফছিরে মারেফুল কোরআন, ৮৫৬ পৃ:, সৌ: সং: বা:; তাফছিরে মাজহারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৭৩ পৃ:;)
ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) ও হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله عليه) আরো বলেন:
موسى بن سهل بن هارون الرازي عن إسحاق الأزرق بخبر باطل
-“মূসা ইবনে সাহল ইবনে হারুন রাজী ইসহাক্ব আযরাকী থেকে বাতিল রেওয়ায়েত বর্ণনা করত।” ( ইমাম যাহাবী: মিযানুল এতদাল, রাবী নং ৮৮৭৩; ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ৪১৪;) অতএব, এই বর্ণনা বাতিল ও ভিত্তিহীন। আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই এরূপ রেওয়ায়েত হুজ্জত বা দলিল হবে না। অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়, যেটা বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله عليه) তদীয় কিতাবে:-
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ الْحُسَيْنِ بْنِ مُحَمد بْنُ عَمْرو بْنِ أَبِي سَلَمَةَ التِّنِّيسِيُّ، حَدَّثني عَبد اللَّهِ بْنُ مُحَمد بْنِ مُوسَى بْنِ هارون بتنيس، حَدَّثَنا إِبْرَاهِيمُ بْنُ عُبَيد التَّمَّارُ عَنْ يعقوب بن الجهم، حَدَّثَنا مُحَمد بْنُ وَاقِدٍ عَنِ الْمَسْعُودِيِّ عَنْ عُمَر مَوْلَى عَفْرَةَ، عَن أَنَس بن مالك قَالَ قَال رَسُول اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيهِ وَسلَّمَ... قَالَ لأَن اللَّهَ خَلَقَنِي وَخَلَقَ أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ مِنْ تُرْبَةٍ وَاحِدَةٍ وَفِيهَا نُدْفَنُ.
-“হযরত আনাস ইবনে মালেক (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন:... আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: নিশ্চয় আমাকে, আবু বকর ও উমরকে একই মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সেখানে দাফন করা হবে।” ( ইমাম ইবনে আদী: আল কামিল ফি দোয়াফাই রিজাল, ৮ম খন্ড, ৪৭৫-৭৬ পৃ:;)
এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) ও হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله عليه) বলেন: هذا حديث موضوع -“এই হাদিস বানোয়াট বা ভিত্তিহীন।” ( ইমাম যাহাবী: মিযানুল এ’তেদাল, রাবী নং ৯৮০৯; ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ১০৯৬;)
ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) উল্লেখ করেন: فقال ابن عدي: البلاء فيه من يعقوب. -“ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله عليه) বলেছেন: এর সনদে ইয়াকুব নামক রাবী হল দোষী।” ( ইমাম যাহাবী: মিযানুল এ’তেদাল, রাবী নং ৯৮০৯; ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ১০৯৬;)
আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই এরূপ রেওয়ায়েত হুজ্জত বা দলিল হবেনা। অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়। অনুরূপ আরেকটি অগ্রহণযোগ্য রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়,
وَقَالَ الْحَكِيم فِي نوادره حَدَّثَنَا الفضلُ بْن مُحَمَّد حَدَّثَنَا بَكْر بْن مُحَمَّد حَدَّثَنَا أَبُو عَبْد الرَّحْمَن المَقْبُري عَن إِبْرَاهِيم بن يزِيد الخوزي قَالَ سَمِعْتُ ابْنَ سِيرِينَ يَقُولُ: لَوْ حَلَفْتُ حَلَفْتُ صَادِقًا بَارًّا غَيْرَ شَاكٍّ وَلا مُسْتَثْنٍى إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى مَا خَلَقَ نبيه وَلا أَبَا بَكْرٍ وَلا عُمَرَ إِلا مِنْ طِينَةٍ وَاحِدَةٍ ثُمَّ رَدَّهُمْ إِلَى تِلْكَ الطِّينَةِ وَالله أعلم.
-“মুহাম্মদ ইবনে ছিরীন (رحمة الله عليه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: যদি আমি কসম করে বলি তাহলে সত্যি হবে যে, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা নবী (ﷺ), আবু বকর ও উমরকে একই মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ সর্বোজ্ঞ।” (ইমাম ছিয়তী: আল লাআলীল মাছনূয়া, ১ম খন্ড, ২৮৫ পৃ:; হাকেম তিরমিজি: নাওয়াদেরুল উছুল, ১ম খন্ড, ২৬৮ পৃ:; উমদাতুল ক্বারী, মাজহারী;)
ইহা মূলত হাদিসে রাসূল (ﷺ) নয়, এমনকি কোন সাহাবীর বাণীও নয় বরং ইহা তাবেঈর কওল যা মাকতু পর্যায়ের যা সাধারণত শরিয়তে দলিল হয়না। পাশাপাশি ইহার সনদে إِبْرَاهِيم بن يزِيد الخوزي (ইব্রাহিম ইবনু ইয়াজিদ আল খাওজী) নামক রাবী রয়েছে যার ব্যাপারে প্রচুর সমালোচনা রয়েছে। যেমন নিচের রেফারেন্স গুলো লক্ষ্য করুন,
قال أحمد، والنسائي: متروك. وقال ابن معين: ليس بثقة. وقال البخاري: سكتوا عنه.
-“ইমাম আহমদ, ইমাম নাসাঈ (رحمة الله عليه) তাকে পরিত্যাজ্য বলেছেন। ইমাম ইবনু মাঈন (رحمة الله عليه) বলেছেন, সে বিশ্বস্ত নয়। ইমাম বুখারী (رحمة الله عليه) বলেছেন, তার ব্যাপারে চুপ থেকেছেন।” ( ইমাম যাহাবী: মিযানুল এতেদাল, রাবী নং ২৫৪;)
وفي رواية محمد بن عبد الله بن الجنيد عن البخاري: إذا قال سكتوا عنه يعني: لا يحتجون بحديثه.
-“মুহাম্মদ ইবনু আব্দিল্লাহ ইমাম বুখারী (رحمة الله عليه) থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম বুখারী যখন কারো ব্যাপারে চুপ থাকে তখন বুঝতে হবে ইমামগণ তার হাদিসের উপর নির্ভর করেনা।” ( ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৩১৮;)
وقال البرقي: كان يتهم بالكذب.
-“ইমাম বারকী (رحمة الله عليه) বলেছেন: তার উপরে মিথ্যার অভিযোগ রয়েছে।” ( ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৩১৮;)
ইমাম ইবনু সাদ, ইমাম ইবনু জারুদ, ইমাম আবুল কাশেম বালখী, ইমাম ইবনে শাহিন, ইমাম সাজী, ইমাম উকাইলী, ইমাম ইয়াকুব ইবনু সুফিয়ান, ইমাম ইবনু ছামআনী (رحمة الله عليه) তাকে ضعيف দুর্বল বলেছেন। ( ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৩১৮;) ইমাম আলী ইবনে মাদিনী (رحمة الله عليه) বলেছেন:
ضعيف، لا أكتب عنه شيئا. -“সে দুর্বল আমি তার বর্ণিত হাদিস লিখিনা।” ( ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৩১৮;)
ইমাম দারা কুতনী (رحمة الله عليه) তাকে منكر الحديث. বলেছেন। ( ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৩১৮;)
ইমাম আলী ইবনু যুনাইদ (رحمة الله عليه) তাকে متروك বলেছেন। ( ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৩১৮;)
সুতরাং এই রেওয়ায়েত একদিকে মাকতু অপরদিকে খুবই দুর্বল, যা আকাইদ ও আহকাম শাস্ত্রের দলিল হওয়ার যোগ্য নয়। অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়, যা খতিবে বাগদাদী (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন:
أَخْبَرَنِي أَبُو الْقَاسِمِ عَلِيُّ بْنُ الْحَسَنِ بْنِ مُحَمَّدِ بْنِ أَبِي عُثْمَانَ الدَّقَّاقُ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ إِسْمَاعِيلَ الْوَرَّاقُ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو إِسْحَاقَ إِبْرَاهِيمُ بْنُ الْحُسَيْنِ بْنِ دَاوُدَ الْقَطَّانُ سَنَةَ إِحْدَى عَشْرَةَ وَثَلاثِ مِائَةٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ خَلَفٍ الْمَرْوَزِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِبْرَاهِيمَ الْمَرْوَزِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ جَعْفَرِ بْنِ مُحَمَّدٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خُلِقْتُ أَنَا وَهَارُونُ بْنُ عِمْرَانَ، وَيَحْيَى بْنُ زَكَرِيَّا، وَعَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ مِنْ طَيِنَةٍ وَاحِدَةٍ
-“মূসা ইবনে জাফর ইবনে মুহাম্মদ তদীয় পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: আমি, হারুন ইবনে ইমরান, ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া, আলী ইবনে আবী তালেব একই মাটি থেকে তৈরী।” ( কাজী শাওকানী: ফাওয়াইদুল মাজমুয়া, হাদিস নং ৩৯; তারিখে বাগদাদ, রাবী নং ৩০৪১;)
মাওলানা কাজী শাওকানী বলেন:
رواه الخطيب عن علي مرفوعًا، وهو موضوع. -“খতিব বাগদাদী ইহা আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন আর ইহা ভিত্তিহীন। (কাজী শাওকানী: ফাওয়াইদুল মাজমুয়া, হাদিস নং ৩৯;)
‘কাশফুল হাছিছ’ গ্রন্থে হাদিসটি উল্লেখ করে লিখেছেন: هَذَا مَوْضُوع
-“ইহা ভিত্তিহীন কথা।” (কাশফুল হাছিছ, রাবী নং ৬৫৬;) ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) লিখেছেন: هَذَا مَوْضُوع
-“ইহা ভিত্তিহীন কথা।” (ইমাম যাহাবী: মিযানুল এতেদাল, রাবী নং ৭৪৯০;) হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله عليه) বলেছেন: هَذَا مَوْضُوع -“ইহা ভিত্তিহীন কথা।” (ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ৫৩৬;)
আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই এরূপ রেওয়ায়েত হুজ্জত বা দলিল হবেনা। অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়, যা ইমাম ইবনু আসাকির (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন:
أخبرنا أبو بكر محمد بن القاسم بن المظفر بن الشهرزوري بدمشق أنا أبو عمرو عثمان بن محمد بن عبيد الله المحمي بنيسابور أنا الشيخ أبو عبد الله محمد بن عبد الله الصوفي نا أبو أحمد محمد بن إبراهيم بن أبرويه بأستراباذ نا أبو الحسن علي بن الحسن القومسي بجرجان نا محمد بن الفضل بن حاتم نا محمد بن الحسن الجوري نا أحمد بن الحسن بن أبان المصري نا الضحاك بن مخلد عن ابن عون عن ابن سيرين عن أبي هريرة قال قال رسول الله (صلى الله عليه وسلم)... وخلقت أنا وأبو بكر وعمر من طينة واحدة وندفن جميعا في بقعة واحدة
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে করিম (ﷺ) বলেছেন:... আমি আবু বকর ও উমর একই মাটির তৈরী ও সবাই একই স্থানে দাফন হব।” (ইমাম ইবনে আসাকির: তারিখে দামেস্ক, ৪৪তম খন্ড, ১২১ পৃ:;)
এর বর্ণনার মাঝে أحمد بن الحسن بن أبان المصري (আহমদ ইবনে হাছান ইবনে আবান মিছরী) রয়েছে। তার ব্যাপারে ইমামদের অভিমত লক্ষ্য করুন:-
قال ابن عدي: كان يسرق الحديث. وقال ابن حبان: كذاب دجال، يضع الحديث على الثقات. وقال الدارقطني: وهو كذاب.
-“ইমাম ইবনে আদী বলেন: সে হাদিস চুরি করত। ইমাম ইবনে হিব্বান বলেন: সে মিথ্যাবাদী দাজ্জাল ও বিশ^স্ত রাবী থেকে হাদিস জালকারী। ইমাম দারে কুতনী বলেন: সে মিথ্যাবাদী।” (ইমাম যাহাবী: মিযানুল এতেদাল, রাবী নং ৩৩০; ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ৪৮০;)
আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই এরূপ রেওয়ায়েত হুজ্জত বা দলিল হবেনা। অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়, যা ইমাম দায়লামী (رحمة الله عليه) তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন:
خلقت أنا وأبو بكر وعمر من طينة واحدة. الديلمي عن ابن عباس
-“আমি আবু বকর, উমর একই মাটির তৈরী। দায়লামী ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে।” (দায়লামী, ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৩২৬৮৩; ইমাম ছিয়তী: জামেউল আহাদিস, হাদিস নং ১১৯৫৩;) এই বর্ণনার কোন সনদই নেই। আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই এরূপ রেওয়ায়েত হুজ্জত বা দলিল প্রশ্নই আসেনা। অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়, যা ইমাম ইবনু আসাকির (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন:
وعن محمد بن علي قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم... وخلقت أنا وجعفر من طينة واحدة (ابن عساكر عن وهب بن وهب عن جعفر بن محمد عن أبيه مرسلاً، ووهب كان يضع الحديث
-“মুহাম্মদ ইবনে আলী বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন:... আমি ও জাফর একই মাটির তৈরী। (ইমাম ছিয়তী বলেন) ওহাব ইবনে ওহাব বর্ণনা করেছেন জাফর ইবনে মুহাম্মদ থেকে মুরছাল রূপে। আর বর্ণনাকারী ওহাব হাদিস জাল করত।” (ইমাম ছিয়তী: জামেউল আহাদিস, হাদিস নং ১১৯৫০; তারিখে ইবনে আসাকির, ৭২তম খন্ড, ১২৬ পৃ:;)
ইহা জাল রেওয়ায়েত এবং আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই এরূপ রেওয়ায়েত হুজ্জত বা দলিল হবেনা। অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়,
مُحَمَّد بن خلف الْمروزِي قَالَ الذَّهَبِيّ كذبه يحيى بن معِين قَالَه بن الْجَوْزِيّ فِي الموضوعات قَالَ ثَنَا مُوسَى بن إِبْرَاهِيم عَن مُوسَى بن جَعْفَر بن مُحَمَّد عَن ابائه مَرْفُوعا خلقت أَنا وَهَارُون وَعلي من طِينَة وَاحِدَة هَذَا مَوْضُوع
-“মুহাম্মদ ইবনে খালাফ মারওয়াজী সম্পর্কে ইমাম যাহাবী উল্লেখ করেন, ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله عليه) তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। ইবনে জাওযী (رحمة الله عليه) তার ‘মাওজুয়াত’ গ্রন্থে এরূপ উল্লেখ করেছেন। মূসা ইবনে ইব্রাহিম বর্ণনা করেছেন- মূসা ইবনে জাফর ইবনে মুহাম্মদ হতে- তিনি তাদের পিতার সূত্রে মারফূ রূপে: আমি হারুন ও আলী একই মাটি থেকে তৈরী। আর ইহা বানোয়াট কথা।” (কাশফুল হাছিছ, রাবী নং ৬৫৬, ১ম খন্ড, ২২৭ পৃ:; মুজামে শুয়ূখু তাবারী, রাবী নং ১১২;)
উল্লেখিত প্রমাণ ভিত্তিক আলোচনার দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রিয় নবীজি রাসূলে করিম (ﷺ) মাটির তৈরী বিষয়ক সকল রেওয়ায়েত ভূয়া, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এর মধ্যে কয়েকটির কোন সনদই নেই। সকলেই অবগত আছেন, উসূলে হাদিসের ভাষায় একাধিক জয়ীফ হাদিস একত্রিত হয়ে শক্তিশালী হয়ে হাছান লি’গাইরিহীর স্তরে পৌছে, কিন্তু একাধিক জাল ও বানোয়াট রেওয়ায়েত একত্রিত হয়ে শক্তিশালী হয়না। তাই কেউ যদি একাধিক রেওয়ায়েত দেখে ইহাকে ‘হাছান’ বলে ফেলে তাহলে বুঝতে হবে সে ‘আসমাউর রিজাল’ শাস্ত্রে দক্ষ ছিলনা।
আমরা সকলেই জানি, বায়হাকীকে ছহীহ্ সনদে আছে: শেষ জামানায় হযরত ঈসা (عَلَيْهَا السَّلَامُ) পৃথিবীতে আসবেন এবং রাজত্ব করবেন। পরে তিনি ইন্তেকাল করলে তাঁকে রাসূল (ﷺ) এর রওজা মোবারকের পাশে দাফন করা হবে। এখনো সেই দাফনের জায়গাটুকু খালি আছে। যদি এটা সঠিক হাদিস হত তাহলে আবু বকর, উমর (رضي الله عنه) এর সাথে হযরত ঈসা (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর নামও থাকত। সব চোরেই চোরি করে এবং সাথে প্রমাণও রেখে যায়!।
❏ যেখানে দাফন করা হয় সেখানের মাটি থেকে সৃষ্টি
এ ব্যাপারে একাধিক হাদিস বর্ণিত রয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষের নাভিমূলে ঐ স্থানের মাটি রাখা হয় যেখানের মাটি থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে মূলত নাভিমূলে মাটি রাখার বিষয়টিকে বুঝানো হয়েছে, সরাসরি মাটির তৈরী বুঝানো হয়নি। কারণ মানুষ সরাসরি মাটির তৈরী নয় বরং নুতফার তৈরী। যেমন মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً -“তিনি ‘বাশার’ তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে মানুষকে আল্লাহ পাক ‘পানি’ তথা শুক্রানু হতে সৃষ্টি করেছেন। এই আয়াতে الْماء ‘মাউন’ এর অর্থ নুতফা বা পিতা-মাতার শুক্রানু-ডিম্বানু। তথাপিও এই আয়াতে বর্ণিত الْماء ‘পানি’ সম্পর্কে মোফাচ্ছেরীনে কেরামের অভিমত গুলো উল্লেখ করা হল। এই আয়াতের তাফছিরে মহিউস সুন্নাহ ইমাম বাগভী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫১৬ হিজরী} বলেন,
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ مِنَ النُّطْفَةِ، بَشَرًا -“তিনি ‘বাশার’ তথা মানুষকে শুক্রানুর পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (তাফছিরে বাগভী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৯০ পৃ:;)
এই আয়াত সম্পর্কে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬০৬ হি.} বলেন,
أَنَّ الْمُرَادَ النُّطْفَةُ لِقَوْلِهِ: خُلِقَ مِنْ ماءٍ دافِقٍ [الطَّارِقِ: ৬] ، مِنْ ماءٍ مَهِينٍ )الْمُرْسَلَاتِ: ২০(
-“নিশ্চয় এর দ্বারা অর্থ হচ্ছে শুক্রানু, যেমন আল্লাহ তা’আলার বাণী হচ্ছে: ‘মানুষতে বেগবান পানি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। আরেক আয়াতে আছে: ‘পানির নির্যাস’ থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।” (তাফছিরে কবীর, ২৪তম খন্ড, ৪৭৫ পৃ:;)
এ সম্পর্কে নন্দিত মুফাচ্ছির ইমাম শামছুদ্দিন কুরতবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৭১ হিজরী} বলেন,
(وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً) أَيْ خَلَقَ مِنَ النُّطْفَةِ إِنْسَانًا. -“তিনি (আল্লাহ) ‘বাশার’ তথা মানুষকে ‘পানি’ হতে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ মানুষকে শুক্রানু থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (তাফছিরে কুরতবী, ১৩তম খন্ড, ৫৯ পৃ:;)
এ ব্যাপারে বিস্তারিত দালাইল আমার লিখিত ‘নূরে মুজাচ্ছাম’ নামক গ্রন্থে রয়েছে। অতএব, পবিত্র কোরআন অনুযায়ী মানুষ নুতফার তৈরী। এখানে উল্লেখিত রেওয়ায়েত গুলো দ্বারা মানুষের নাভিমূলে দাফনের স্থানের মাটি রাখার বিষয়টিই বুঝাবে অন্যথায় কোরআনের খেলাফ বিধায় এই রেওয়ায়েত গুলো গ্রহণ করা যাবেনা। কারণ এগুলো প্রায় সব গুলোও জাল, জয়ীফ পর্যায়ের।
ইমাম ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মদ ইবনে ফাদ্বল ইস্পাহানী (رحمة الله عليه) ওফাত ৫৩৫ হিজরী তদীয় কিতাবে বর্ণনা করেছেন,
أَخْبَرَنَا سُلَيْمَانُ، أَخْبَرَنَا أَبُو بَكْرٍ، حَدَّثَنَا مُحَمَّد بن الْفضل ابْن مُحَمَّدٍ الْقَيْسِيُّ الأَيْلِيُّ، حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ الْحَسَنِ بْنِ أَبَانٍ، حَدَّثَنَا أَبُو عَاصِمٍ، حَدَّثَنَا ابْنُ عَوْنٍ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ سِيرِينَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم مَا مِنْ مَوْلُودٍ يُولَدُ إِلا وَقَدْ ثُرِيَ عَلَيْهِ مِنْ تُرَابٍ حَفَرْتُهُ.
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম (ﷺ) বলেছেন: এমন কোন সন্তান জন্ম হয়না যার নাভিমূলে তার গর্তের মাটি রাখা হয়না।” ( ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মদ ইস্পাহানী: আল হুজ্জাতু ফি বায়ানিল মুহাজ্জাহ, হাদিস নং ৩৩৬;)
এই হাদিসের সনদে أحمد بن الحسن بن أبان (আহমদ ইবনুল হাছান ইবনে আবান) নামক একজন রাবী রয়েছে। তার ব্যাপারে ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন,
قال ابن عدي: كان يسرق الحديث. وقال ابن حبان: كذاب دجال، يضع الحديث على الثقات. وقال الدارقطني: حدثونا عنه وهو كذاب.
-“ইমাম ইবনু আদী (رحمة الله عليه) বলেছেন: সে হাদিস চুরি করত। ইমাম ইবনু হিব্বান (رحمة الله عليه) বলেছেন: সে মিথ্যাবাদী, দাজ্জাল ও বিশ্বস্ত রাবীদের কাছ থেকে হাদিস বানাইত। ইমাম দারা কুতনী (رحمة الله عليه) বলেছেন: আমরা তার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করি, আর সে মিথ্যাবাদী।” (ইমাম যাহাবী: মিযানুল এতেদাল, রাবী নং ৩৩০; ইমাম যাহাবী: দিওয়ানুদ দোয়াফা, রাবী নং ২০;) ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) অন্য কিতাবে বলেছেন,
قال ابن حِبّان، وابن البيع: كذّاب. وقال أبو يَعْلَى الخليليّ: كذاب يضع الحديث. أورد له ابن عديّ حديثين باطلين.
-“ইমাম ইবনু হিব্বান ও ইমাম ইবনু রবিঈ (رحمة الله عليه) বলেছেন: সে মিথ্যাবাদী। ইমাম আবু ইয়ালা খালিলী (رحمة الله عليه) বলেছেন: সে মিথ্যাবাদী ও হাদিস তৈরী করত। ইমাম ইবনু আদী (رحمة الله عليه) উল্লেখ করেছেন, তার বর্ণিত সকল হাদিসই বাতিল।” (ইমাম যাহাবী: মিযানুল এতেদাল, রাবী নং ৩৩০; ইমাম যাহাবী: দিওয়ানুদ দোয়াফা, রাবী নং ২০;)
সুতরাং এই সনদটি মওজু বা জাল ভিত্তিহীন। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন,
حدثنا عبدُالله بن أحمدَ بن حنبل، ثنا عُقْبة بن مُكْرَم، ثنا عبد الله بن عيسى الخَزَّاز، عن يحيى البَكَّاء، عن ابن عمر؛ أنَّ حَبَشيًّا دُفِنَ بالمدينة، فقال رسولُ الله صلى الله عليه وسلم: دُفِنَ بِالطِّينَةِ الَّتِي خُلِقَ مِنْهَا
-“হযরত ইবনু উমার (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় মদিনায় একজন হাবশীকে দাফন করা হল। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন, তাকে ঐ মাটিতে দাফন করা হচ্ছে যেখানে মাটি থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।”
এই হাদিসের সনদ প্রসঙ্গে ইমাম নূরুদ্দীন হায়ছামী (رحمة الله عليه) বলেছেন,
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ فِي الْكَبِيرِ، وَفِيهِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عِيسَى الْخَزَّازُ، وَهُوَ ضَعِيفٌ.
-“ইমাম তাবারানী তার কবীর গ্রন্থে ইহা বর্ণনা করেছেন, ইহার সনদে ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ঈসা খাজ্জায’ রয়েছে সে দুর্বল রাবী।” (ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ৪২২৮;)
বর্ণনাকারী عبد الله بن عيسى الخَزَّاز (আব্দুল্লাহ ইবনু ঈসা খাজ্জায) সম্পর্কে সকল ইমামগণ সমালোচনা করেছেন। অতএব, রেওয়ায়েতটি খুবই দুর্বল পর্যায়ের। সর্বোপরি এই হাদিসে রাসূলে পাক (ﷺ) মাটির তৈরী এরুপ কথা উল্লেখ নেই।
এ বিষয়ে ইমাম আবু বকর আহমদ দিনূরী (رحمة الله عليه) ওফাত ৩৩৩ হিজরী বর্ণনা করেন,
حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ نَصْرٍ النُّهَاوَنْدِيُّ، نَا سُفْيَانُ بْنُ وَكِيعٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ مَنْصُورٍ، عَنْ هِلَالِ بْنِ يَسَافٍ؛ قَالَ: مَا مِنْ مَوْلُودٍ يُولَدُ إِلَّا وَفِي سُرَّتِهِ مِنْ تُرْبَةِ الْأَرْضِ الَّتِي يَمُوتُ فِيهَا
-“তাবেঈ হিলাল ইবনু ইয়াছাফ (رحمة الله عليه) বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তির নাভিমূলে ঐ স্থানের মাটি রাখা হয় যেখানে তাকে দাফন করা হয়।” (ইমাম দিনূরী: আল মাজালিছাহ, হাদিস নং ১৯০;)
এই রেওয়ায়েতটি প্রথমত মাকতু বা তাবেঈ এর কথা যা সাধারণত শরিয়তে দলিল হয়না। দ্বিতীয়ত, ইহার মধ্যে রাসূলে আকরাম (ﷺ) মাটির তৈরীর কথা নেই, বরং অন্যান্য মানুষের দাফনের স্থানের মাটি নাভিমূলে রাখার কথা রয়েছে। তৃতীয়ত ইহার সনদেسُفْيَانُ بنُ وَكِيْعِ (সুফিয়ান ইবনু ওয়াকী) রয়েছে। তার ব্যাপারে ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) উল্লেখ করেছেন,
قَالَ البُخَارِيُّ: يَتَكَلَّمُوْنَ فِيْهِ لأَشْيَاءَ لَقَّنُوهُ إِيَّاهَا.
-“ইমাম বুখারী (رحمة الله عليه) বলেছেন: তার প্রতিটি বিষয়ে ইমামগণ সমালোচনা করেছেন, ইহা থেকে বিরত থাকার জন্য তাকে তালকীন দেওয়া হত।” (ইমাম যাহাবী: সিয়ারু আলামিন নুবালা, রাবী নং ৫৪;)
এই রাবীর উপরে মিথ্যার অভিযোগ রয়েছে। যেমন ইমাম ইবনু আবী হাতেম (رحمة الله عليه), ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) ও ইমাম ইবনু জাওযী (رحمة الله عليه) উল্লেখ করেছেন,
قَالَ أَبُو زرْعَة لَا يشْتَغل بِهِ قيل لَهُ أَكَانَ مُتَّهم بِالْكَذِبِ قَالَ نعم
-“ইমাম আবু যুরাআ (رحمة الله عليه) বলেছেন, তার ব্যাপারে মননিবেশ করবেনা, কেউ বলল: তার কি মিথ্যার অভিযোগ রয়েছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ রয়েছে।” ইমাম মুগলতাঈ (رحمة الله عليه) উল্লেখ করেছেন,
وقال الخليلي في الإرشاد: ضعفوه، وكان له وراق أدخل في حديثه ما ليس له
-“ইমাম খালিলী (رحمة الله عليه) তার ‘ইরশাদ’ গ্রন্থে তাকে দুর্বল রাবী বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার সমস্যা ছিল সে যেটা হাদিস নয় সেটাকে হাদিস বলে চালিয়ে দিত।” (ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ২০৮৭;)
অতএব, এই রেওয়ায়েত একদিকে মাকতু এবং অপরদিকে অত্যান্ত দুর্বল। সর্বোপরি এই রেওয়ায়েতে রাসূলে পাক (ﷺ) মাটির তৈরী এই ধরণের কোন কথা উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ الْحَافِظُ أَنَا أَبُو النَّضْرِ الْفَقِيهُ وَأَحْمَدُ بْنُ مُحَمَّدٍ الْعَنْبَرِيُّ قَالَا: نَا عُثْمَانُ بْنُ سَعِيدٍ الدَّارِمِيُّ نَا يَحْيَى بْنُ صَالِحٍ الْوُحَاظِيٍّ نَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ مُحَمَّدٍ حَدَّثَنِي أُنَيْسُ بْنُ أَبِي يَحْيَى مَوْلَى الْأَسْلَمِيِّينَ عَنْ أَبِيهِ عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: مَرَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِجَنَازَةٍ عِنْدَ قَبْرٍ فَقَالَ: قَبْرُ مَنْ هَذَا؟ فَقَالُوا: قَبْرُ فُلَانٍ الْحَبَشِيِّ يَا رَسُولَ اللهِ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ سِيقَ مِنْ أَرْضِهِ وَسَمَائِهِ إِلَى تُرْبَتِهِ الَّتِي خُلِقَ مِنْهَا
-“হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর কবরের জানাযার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। প্রিয় নবীজি (ﷺ) বললেন, এই কবর কার? লোকেরা বলল, এটা জনৈক হাবশীর কবর। তখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, জমীন অথবা আসমান থেকে ঐদিকেই তাকে দ্রুত হাকিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানের মাটি থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” (ইমাম ইবনু আসাকির: তাজিয়াতুল মুসলীম আন আখিহী, হাদিস নং ৯০; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ৯৪২৫;)
এই হাদিসের সনদে একজন রাবী রয়েছে যার নাম عَبْدُ العَزِيْزِ بنُ مُحَمَّدِ (আব্দুল আজিজ ইবনু মুহাম্মদ)। যার সম্পর্কে কেউ কেউ বলেছেন কোন অসুবিধা নেই আবার কেউ কেউ বলেছেন সে শক্তিশালী নয়। তবে ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (رحمة الله عليه) তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন,
وقال أحمد بن حنبل كان معروفا بالطلب وإذا حدث من كتابه فهو صحيح وإذا حدث من كتب الناس وهم. وقال أبو زرعة سيء الحفظ ربما حدث من حفظه الشيء فيخطيء وقال الساجي كان من أهل الصدق والأمانة إلا أنه كثير الوهم
-“ইমাম আহমদ (رحمة الله عليه) বলেছেন, সে একজন অন্বেষণকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ব্যক্তি, যখন সে স্বীয় কিতাব থেকে হাদিস বর্ণনা করেন তখন ইহা ছহীহ্ হয় আর যখন অন্য লোকদের কিতাব থেকে হাদিস বর্ণনা করেন তখন ইহা ত্রুটিযুক্ত হয়। ইমাম আবু যুরাআ (رحمة الله عليه) বলেছেন, তার স্মরণশক্তি ছিল খুবই দুর্বল, যখন সে নিজের স্মরণশক্তি থেকে হাদিস বর্ণনা করত তখন ইহা ভুল হত। ইমাম ছাজী (رحمة الله عليه) বলেছেন, সে সত্যবাদী ও আমানতদার তবে তার বর্ণিত হাদিসের মধ্যে প্রচুর ভুল রয়েছে।” (ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৬৮০;)
وقال أبو حاتم: لا يحتج بِهِ. ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله عليه) বলেছেন: তার উপর নির্ভর করা যায়না।” (ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ২২২;)
অতএব, এই রাবী হাদিসটি নিজের স্মরণশক্তি থেকেই বর্ণনা করেছেন যার কারণে হাদিসটি দুর্বল সনদের। এই হাদিসটি ইমাম বাজ্জার (رحمة الله عليه) বর্ণনা করেছেন। তবে ইহার সনদে একজন আপত্তিকর রাবী রয়েছে। যেমন ইমাম নূরুদ্দিন হায়ছামী (رحمة الله عليه) বলেছেন,
رَوَاهُ الْبَزَّارُ، وَفِيهِ عَبْدُ اللَّهِ وَالِدُ عَلِيِّ بْنِ الْمَدِينِيِّ، وَهُوَ ضَعِيفٌ.
-“ইমাম বাজ্জার ইহা বর্ণনা করেছেন, ইহার সনদে আলী ইবনু মাদিনীর পিতা ‘আব্দুল্লাহ’ রয়েছে আর সে দুর্বল রাবী।” (ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ৪২২৬;)
সুতরাং সনদের দৃষ্টিতে এই রেওয়ায়েত অত্যান্ত দুর্বল পর্যায়ের। সর্বোপরি এই হাদিসের মধ্যে রাসূলে পাক (ﷺ) মাটির তৈরী এরুপ কথা নেই। বরং অন্যান্য মানুষের দাফনের স্থানের মাটি নাভিমূলে থাকার বিষয়টিকে ঈশারা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ زِيَادٍ الرَّازِيُّ قَالَ: حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ مُوسَى الْفَرَّاءُ قَالَ: حَدَّثَنَا هِشَامُ بْنُ يُوسُفَ، عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ قَالَ: أَخْبَرَنِي عُمَرُ بْنُ عَطَاءِ بْنِ وَرَّان، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّهُ قَالَ: يُدْفَنُ كُلُّ إِنْسَانٍ فِي التُّرَابِ الَّتِي خُلِقَ مِنْهَا.
-“হযরত ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত নিশ্চয় তিনি বলেছেন, প্রত্যেক মানুষকে ঐ মাটিতে দাফন করা হয় যেখানের মাটি থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” (ইমাম ইবনু আদী: আল কামিল ফি দোয়াফাউর রিজাল, হাদিস নং ১৩৪৯; মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক, হাদিস নং ৬৫৩১;)
এই রেওয়ায়েতের মধ্যে عُمَر بن عطاء بن وَرَّان (উমর ইবনু আত্বা ইবনে র্অরান) নামক রাবী রয়েছে। যাকে ইমাম নাসাঈ (رحمة الله عليه) ضعيف বলেছেন। (ইমাম ইবনু আদী: আল কামিল ফি দোয়াফাউর রিজাল, হাদিস নং ১৩৪৯; মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক, হাদিস নং ৬৫৩১;) ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) উল্লেখ করেছেন,
ضعفه يحيى بن معين، والنسائي، وقال يحيى أيضا: ليس بشئ. وقال أحمد: ليس بقوي.
-“ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, ইমাম নাসাঈ (رحمة الله عليه) তাকে দুর্বল বলেছেন। অনুরুপ ইমাম ইয়াহইয়া (رحمة الله عليه) বলেছেন, সে কিছুই নয়। ইমাম আহমদ (رحمة الله عليه) বলেছেন: সে শক্তিশালী নয়।” (ইমাম ইবনু আদী: আল কামিল ফি দোয়াফাউর রিজাল, হাদিস নং ১৩৪৯; মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক, হাদিস নং ৬৫৩১;)
এছাড়াও ইমাম আবু যুরাআ, ইমাম ইয়াকুব ইবনু সুফিয়ান, ইমাম উকাইলী, ইমাম বালখী, ইমাম ইবনু জারুদ, ইমাম সাজী, ইমাম আবু আরব, ইমাম ইবনু শাহিন ও ইমাম খালিফুন (رحمة الله عليه) সবাই তাকে ضعيف দুর্বল বলেছেন।” অতএব, এই হাদিস জয়ীফ বা দুর্বল সনদের।
এই হাদিসের মধ্যেও রাসূলে পাক (ﷺ) মাটির তৈরী এরুপ কথা নেই। বরং অন্যান্য মানুষের দাফনের স্থানের মাটি নাভিমূলে থাকার বিষয়টিকে ঈশারা করা হয়েছে। কারণ কবরের মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি কথাটি কোরআনের খেলাফ। কেননা হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) ব্যতীত কোন মানুষই সরাসরি মাটির তৈরী নয়।
যেমন মহান আল্লাহ তা’লা অপর আয়াতে এরশাদ করেন:-
أَلَمْ نَخْلُقْكُمْ مِنْ ماءٍ مَهِينٍ (২০) فَجَعَلْناهُ فِي قَرارٍ مَكِينٍ -“আমি কি তোমাদেরকে পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করিনি? অতঃপর তাকে নিরাপদ স্থানে রাখিনি? (সূরা মুরছালাত: ২০-২১ নং আয়াত)।
সুতরাং এই হাদিস গুলোর অর্থ হবে প্রত্যেক মানুষের নাভিমূলে দাফনের স্থানের মাটি রাখা হয় যেখানে তাকে দাফন করা হয়। যেমন হযরত আত্বা (رحمة الله عليه) বলেছেন,
وَقَالَ عَبْد بْن حميد حَدَّثَنَا عَبْد الْوَهَّاب عَن عَطاء عَن دَاوُد بْن أبي هِنْد قَالَ حدَّثَنِي عَطَاءٍ الْخُرَاسَانِيِّ قَالَ إِنَّ الْمَلَكَ يَنْطَلِقُ فَيَأْخُذُ مِنْ تُرَابِ الْمَكَانِ الَّذِي يُدْفَنُ فِيهِ فَيَذُرُّه على النُّطْفَة فَيحل مِنَ التُّرَابِ وَمِنَ النُّطْفَةِ
-“হযরত আত্বা খুরাশানী (رحمة الله عليه) বলেছেন, নিশ্চয় ফেরেস্তা ঐ স্থানের মাটি নিয়ে নুতফার মধ্যে ফেলে যেখানে সে দাফন হবে।” অন্য রেওয়ায়েতে আছে,
مَا مِنْ مَوْلُودٍ يُولَدُ إِلَّا وَفِي سُرَّتِهِ مِنْ تُرْبَةِ الْأَرْضِ الَّتِي يَمُوتُ فِيهَا
-“তাবেঈ হিলাল ইবনু ইয়াছাফ (رحمة الله عليه) বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তির নাভিমূলে ঐ স্থানের মাটি রাখা হয় যেখানে তাকে দাফন করা হয়।”
অতএব, এই রেওয়ায়েত গুলো দিয়ে রাসূলে আকরাম (ﷺ) মাটির তৈরী এরুপ দলিল দেওয়া জিহালত ও হাস্যকর হবে। বরং অন্যান্য মানুষের নাভিমূলে দাফনের স্থানের মাটি রাখা হয় যেখানে তাকে দাফন করা হয় বা হবে।
❏ রাসূল (ﷺ) এর বাশারিয়্যাত বা মানবত্ব
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর সৃষ্টিগত জাত বা সত্ত্বা হল আল্লাহর নূর বা সৃষ্টিগত বেমেছাল নূর এবং পৃথিবী আগমন করেছেন জিন্ছে বাশার তথা মানব জাতির অন্তর্ভূক্ত হয়ে, এজন্যে তিনি ‘মানব রাসূল’। যেমন পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন:
قُلْ سُبْحانَ رَبِّي هَلْ كُنْتُ إِلاَّ بَشَراً رَسُولاً -“বলুন! আমার রবের জন্য সকল শান, আমি একজন মানব রাসূল ছাড়া কিছু নয়।” (সূরা ইসরা: ৯৩ নং আয়াত)।
তবে সৃষ্টির শুরুতে তিনি بَشَر ‘বাশার’ বা মানবীয় সূরতে ছিলেন না বরং তিনি সৃষ্টিগত ভাবে নূর ও আল্লাহ তা’লা যখন যেরূপে রেখেছেন তিঁনি ঐ রূপেই ছিলেন। কখনো ময়ূরের সূরত, কখনো তারকার সূরত ইত্যাদি ইত্যাদি, আল্লাহ’ই সর্বজ্ঞ। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা হল,
وقد ارسل الله تعالى رسلا من البشر الى البشر مبشرين لاهل الايمان والطاعة بالجنة والثواب
-“নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা মানুষের মধ্য হতে (পৃথিবীতে) মানব জাতির প্রতি রাসূল প্রেরণ করেছেন, ঈমানদার ও অনুগতদের জান্নাত ও সওয়াবের সু-সংবাদের জন্য।” (শরহে আকায়েদে নাছাফী, ৯৪ পৃ:;)
উল্লেখ্য যে, হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) মানব জাতির মধ্য থেকেই মানব জাতির প্রতি রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে বিনা মাধ্যমে আসেননি বরং পিতা-মাতার মাধ্যম হয়ে এসেছেন। যদিও অলৌকিকভাবে এসেছেন। আর এ বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর ইজমা বা ঐক্যমত সংগঠিত হয়েছে। যেমন আল্লামা হাফিজ ইবনে হাজার হায়তামী মক্কী (র:) {ওফাত ৯৭৪ হিজরী} তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন:
وقع الاجمع على ان افضل النوع الانسان نبينا سيدنا محمد صلى الله عليه وسلم لقوله صلى الله عليه وسلم- انا سيد ولد ادم ولا فخر
-“হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) মানব জাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, ইহার উপর ইজমা বা ঐক্যমত হয়েছে। আল্লাহর হাবীব (ﷺ) নিজেই এরশাদ করেন: আমি আদম সন্তানদের সরদার, এতে আমার কোন গৌরব নেই।” (ইমাম ইবনে হাজার মক্কী: আদ্ দুররুল মানদুদ, ২৮ পৃ:;)
উল্লেখ্য যে, مُطْلَقًا মত্লকান রাসূল (ﷺ) এর বাশারিয়্যাত বা মানবত্ব অস্বীকার করলে ‘তাকযিবে কোরআন’ এর কারণে কুফূরী হবে। কারণ পৃথিবীতে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) মানুষ হয়ে এসেছেন ইহা পবিত্র কোরআন দ্বারা প্রমাণিত। যেমন আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেছেন:
قُلْ سُبْحانَ رَبِّي هَلْ كُنْتُ إِلاَّ بَشَراً رَسُولاً -“বলুন! আমার প্রতিপালক অতি পবিত্র!! আর আমি মানুষ রাসূল ছাড়া কিছুই নই।” (সূরা ইসরা: ৯৩ নং আয়াত)।
অপর আয়াতে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন, قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ
-“বলুন! আমি তোমাদের মত (সূরতে) মানুষ।” (সূরা কাহাফ: ১১০ নং আয়াত)।
সুতরাং পবিত্র কোরআন দ্বারাই প্রমাণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) بَشَر বাশার বা মানুষ। তাই مُطْلَقًا মত্লকান নবী পাক (ﷺ) এর বাশারিয়্যাত তথা মানবত্ব অস্বীকার করা কোন রাস্তা নেই। এ জন্যে আ’লা হযরত আহমদ রেজা খাঁন ফাজেলে বেরলভী (رحمة الله عليه) তদীয় ফাত্ওয়ার কিতাবে বলেন:
“আওর যো মতলকান হুজুর ছে বাশারিয়াত কি নাফি কারতাহায় ওয়াহি কাফির হায়” -“যে ব্যক্তি রাসূল (ﷺ) কে মত্লকান বাশারিয়াত বা মানবত্ব অস্বীকার করবে সে ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে।” (ফাতওয়ায়ে রেজভিয়া, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৬৭ পৃ:;)
এ সম্পর্কে আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী হানাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২৭০ হিজরী} তদীয় তাফছিরের কিতাবে বলেন,
بأنه شرط في صحة الإيمان، ثم قال: فلو قال شخص: أو من برسالة محمد صلى الله تعالى عليه وسلم إلى جميع الخلق لكن لا أدري هل هو من البشر أو من الملائكة أو من الجن، أولا أدري هل هو من العرب أو العجم؟ فلا شك في كفره لتكذيبه القرآن
-“নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে মানুষ জানা ঈমান শুদ্ধ হওয়ার শর্ত। যদি কোন ব্যক্তি বলে আমি বিশ্বাস করি মুহাম্মদ (ﷺ) সমগ্র সৃষ্টির প্রতি রাসূল হয়ে প্রেরিত হয়েছেন; কিন্তু আমি জানিনা যে, তিনি মানুষ নাকি ফেরেস্থা নাকি জ্বিন জাতি, অথবা বলে যে, আমি জানিনা তিনি আরবীয় নাকি আজমী। তাহলে নিঃসন্দেহে পবিত্র কোরআনের প্রতি মিথ্যারোপ করার কারণে সে ব্যক্তি কাফের।” (তাফছিরে রুহুল মাআনী, ৪র্থ জি: ১১৩ পৃ:;)
এ বিষয়ে হানাফী মাজহাবের প্রসিদ্ধ ফাতওয়ার কিতাবে আছে,
وَمَنْ قَالَ: لَا أَدْرِي أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إنْسِيًّا، أَوْ جِنِّيًّا يَكْفُرُ كَذَا فِي الْفُصُولِ الْعِمَادِيَّةِ.
-“যে ব্যক্তি বলবে: আমি জানিনা আল্লাহর নবী (ﷺ) মানুষ নাকি জ্বিন, তাহলে কুফুরী হবে। যেমনটি ফুছুলে ইমাদী কিতাবে রয়েছে।” (ফাত্ওয়ায়ে আলমগিরী, ২য় খন্ড, ২৬৩ পৃ:;)
তাই রাসূলে পাক (ﷺ) পৃথিবীতে মানুষ হয়ে এসেছেন এই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আর ইহা ঈমান বিশুদ্ধ হওয়ার অন্যতম শর্ত। তাই مُطْلَقًا (মত্লকান) রাসূল (ﷺ) এর বাশারিয়্যাত বা মানবত্ব অস্বীকার করলে কাফির হয়ে যাবে। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের চূড়ান্ত আকিদা। পবিত্র কোরআনের আরেক জায়গায় আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন, لَقَدْ جاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ -“অবশ্যই তোমাদের মধ্য থেকেই রাসূল এসেছেন।” (সূরা তওবা: ১২৮ নং আয়াত)।
এই আয়াতের তাফছিরে আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২৭০ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন,
لَقَدْ جاءَكُمْ الخطاب للعرب رَسُولٌ أي رسول عظيم القدر مِنْ أَنْفُسِكُمْ أي من جنسكم ومن نسبكم عربي مثلكم
-“নিশ্চয় তোমাদের নিকট এসেছেন একজন অতি সম্মানিত রাসূল। তোমাদের মধ্যে থেকে তথা মানব জাতি থেকে এবং আরবীয় গোত্র থেকে এসেছেন।” (তাফছিরে রুহুল মাআনী, ৪র্থ জি: ৫২ পৃ:;)
আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী হানাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১১২৭ হিজরী} তদীয় তাফছিরে বলেন,
مِنْ أَنْفُسِكُمْ اى من جنسكم آدمي مثلكم لامن الملائكة ولا من غيرهم
-“নিশ্চয় তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে একজন সম্মানিত রাসূল আগমন করেছেন। “তোমাদের মধ্য থেকে” অর্থাৎ তোমাদের স্বজাত থেকে। বাহ্যত তিনি তোমাদের মত মানুষ, কোন ফেরেস্থা বা অন্য কোন জাতি নন।” (তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৩য় খন্ড, ৫৪২ পৃ:;)
এ মর্মে আল্লামা কাজী নাছিরুদ্দিন বায়জাবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৮৫ হি.} বলেন,
لَقَدْ جاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ من جنسكم عربي مثلكم. -“নিশ্চয় তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল এসেছেন” অর্থাৎ তোমাদের স্বজাতি থেকে তোমাদের মত আরবী।” (তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৩য় খন্ড, ৫৪২ পৃ:;)
সুতরাং রাসূলে পাক (ﷺ) আল্লাহর দরবার থেকে পৃথিবীতে সকল নবী আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) হতে পিতা আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) এর আছলাবের মাধ্যমে মানুষ রাসূল হয়ে মানব জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছেন, ইহা অস্বীকার করার কোন রাস্তা নেই। তবে তিনি সূরতে বাশার তথা সূরতে মানুষ হলেও মূলত স্বীয় সত্ত্বাগত ভাবে তিনি আল্লাহর নূর এবং তাঁর মৌলিক ৩টি সূরত মোবারক রয়েছে। যেমন ১. সূরতে বাশারী, ২. সূরতে মালাকী, ৩. সূরতে হাক্বী। (তাফছিরে রুহুল বয়ান, মেরকাত;)
বাহ্যত তিনি মানুষ, এ জন্যে মত্লকান তাঁকে মানুষ অস্বীকার করা যায়না। কিন্তু দুনিয়ার অন্য মানুষের সাথে রাসূল (ﷺ) তুলনা চলবেনা। কারণ তিনি মানুষের তুলনায় সর্ব বিষয়ে সকলের উর্দ্ধে। যেমন আ’লা হযরত আহমদ রেজা খাঁন ফাজেলে বেরলভী (رضي الله عنه) বলেন:
“আওর যো এহি কাহা কেহে রাসূল দ: কি ছুরত জাহিরী বাশারী হায়, হাকিকত বাতেনী বাশারিয়াত ছে আরকা ওয়া আ’লা হায় এহি কাহু হুজুর আওর উনকে মিছলে বাশার নেহি হায় ওহি ছাচ্ছা কাহ্তাহায়”
-“যে ব্যক্তি বলবে: হুজুর (ﷺ) বাহ্যিক সূরতে বাশার বা মানুষ, প্রকৃতপক্ষে বাতেনী দিক দিয়ে তাঁর হাকিকত মানুষের গুণাবলীর অতি উর্দ্ধে। তিনি মানুষ কিন্তু অন্য মানুষের মত নন, তাহলে সে ব্যক্তি সত্যই বলছে।” (তাফছিরে রুহুল বয়ান, মেরকাত;)
রাসূলে পাক (ﷺ) পৃথিবীতে আসার পূর্বে বাশার রূপে ছিলেন না। যেমন ফকিহ্ সাহাবী ও রইছুল মোফাচ্ছেরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর পিতা ও প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর আপন চাচা হযরত আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) এর বক্তব্য এবং ‘তাকরিরী হাদিস’ লক্ষ্য করুন,
حَدَّثَنَا أَبُو الْعَبَّاسِ مُحَمَّدُ بْنُ يَعْقُوبَ، ثَنَا أَبُو الْبَخْتَرِيُّ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ شَاكِرٍ، ثَنَا زَكَرِيَّا بْنُ يَحْيَى الْخَزَّازُ، ثَنَا عَمُّ أَبِي زَحْرِ بْنِ حُصَيْنٍ، عَنْ جَدِّهِ حُمَيْدِ بْنِ مُنْهِبٍ قَالَ: سَمِعْتُ جَدِّي خُرَيْمَ بْنَ أَوْسِ بْنِ حَارِثَةَ بْنِ لَامٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ يَقُولُ: هَاجَرْتُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُنْصَرَفَهُ مِنْ تَبُوكَ، فَأَسْلَمْتُ فَسَمِعْتُ الْعَبَّاسَ بْنَ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ يَقُولُ:
-“সাহাবী খুজাইম ইবনে আউছ ইবনে হারেছা ইবনে লাম (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলে পাক (ﷺ) এর কাছে তাবুকে হিযরত করলাম। অতঃপর ইসলাম গ্রহণ করলাম ও আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) কে বলতে শুনলাম:-
مِنْ قَبْلِهَا طِبْتَ فِي الظِّلَالِ وَفِي ... مُسْتَوْدَعٍ حَيْثُ يُخْصَفُ الْوَرَقُ
-“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আগমনে পূর্বে জান্নাতের ছায়ায় সানন্দে আমানতগার ছিলেন। যেখানে তিনি (আদম) বৃক্ষ-পত্র জোড়া দিয়ে শরীর আবৃত করেছিলেন।”
ثُمَّ هَبَطْتَ الْبِلَادَ لَا بَشَرٌ ... أَنْتَ وَلَا مُضْغَةٌ وَلَا عَلَقُ
-“অতঃপর আপনি জনপদে অবতরণ করলেন, তখন আপনি না মানব ছিলেন, না মাংশপিন্ড ছিলেন, না রক্তপিন্ড ছিলেন।” (মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস নং ৫৪১৭; ইমাম তাবারানী: মু’জামুল কবীর, হাদিস নং ৪১৬৭; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন নবুয়্যাত, ৫ম খন্ড, ২৬৮ পৃ:; কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ১ম খন্ড, ৩২৮ পৃ:; ইবনে কাছির: সিরাতে নববীয়া, ১ম খন্ড, ১৯৫ পৃ:; হাফিজ ইবনে কাছির: জামেউল মাসানিদ, হাদিস নং ২৮৩১; ইমাম ছিয়তী: খাছাইছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ৬৭ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৪২৬ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৭০ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: শরহে শিফা, ১ম খন্ড, ৩৬৯ পৃ:; শরহে যুরকানী আলাল মাওয়াহেব, ৪র্থ খন্ড, ১০৪ পৃ:; জিকরে হাছিন, ৩৮ পৃ:; ইমাম হায়ছামী: মজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ১৩৮৩০; ইবনে কাছির: জামেউল মাসানিদ ওয়াস সুনান, হাদিস নং ২৮৩১;)
এই হাদিসের বর্ণনাকারী ‘হুমাইদ ইবনে মিনহাব’ প্রসিদ্ধ তাবেঈ। তবে কেউ কেউ তাকে সাহাবী বলেছেন। তদীয় নাতী ‘আবু যুহার ইবনে হুছাইন’ এর মূল নাম হল ‘উমর ইবনে হুছাইন ইবনে হুমাইদ ইবনে মুনহিব’। তার ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন এমন কাউকে আমি দেখিনি। ‘যাকারিয়া ইবনে ইয়াহইয়া খাজ্জার’ ছহীহ্ বুখারীর রাবী। ‘আবুল বাখতারী আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ’ কে ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) বিশ^স্ত রাবী হিসেবে তার নুবালার মধ্যে উল্লেখ করেছেন। ‘আবুল আব্বাস মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব’ কে ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) আদিল ও হুজ্জত বলে তার ‘তারিখুল ইসলাম’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন। অতএব, হাদিসটি নির্ভরযোগ্য। সুতরাং পৃথিবীতে আগমনের পূর্বে আল্লাহর হাবীব (ﷺ) বাশারী রূপে ছিলেন না, বরং নূর রূপে ছিলেন। এ বিষয়ে বিখ্যাত ফকিহ্ আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী হানাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১১২৭ হিজরী} বলেন,
قُلْ إِنَّما أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ قل يا محمد ما انا الا آدمي مثلكم فى الصورة ومساويكم فى بعض الصفات البشرية
“হে হাবীব বলুন! আমি তোমাদের মত মানুষ” অর্থাৎ বলুন!! আমি মানুষ ছাড়া অন্য কিছু নই। সূরত বা আকৃতিগত দিক থেকে তোমাদের ন্যায় এবং মানবীয় কতিপয় গুণ-বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তোমাদের মতই।” (তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৫ম খন্ড, ৩০৯ পৃ:;)
এ সম্পর্কে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬০৬ হিজরী} বলেন,
قُلْ إِنَّما أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحى إِلَيَّ أَيْ لَا امْتِيَازَ بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ فِي شَيْءٍ مِنَ الصِّفَاتِ
-“আমি তোমাদের মত মানুষ’ অর্থাৎ গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে আমার ও তোমাদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই।” (তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৫ম খন্ড, ৩০৯ পৃ:;)
এখানে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله عليه) রাসূল (ﷺ) এর ছিফাত সমূহ বা গুণাবলীকে মানুষের সাথে তুলনা দিয়েছেন, জাত বা সত্ত্বাকে নয়। আবু মুহাম্মদ মক্কী ইবনে আবী ত্বালেব হাম্মুশী আন্দালুছী মালেকী রহঃ (ওফাত ৪৩৭ হিজরী) তদীয় কিতাবে বলেন,
قُلْ إِنَّمَآ أَنَاْ بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يوحى إِلَيَّ أَنَّمَآ إلهكم إله وَاحِدٌ أي: إنما أنا من ولد آدم مثلكم في الصورة
-“সূরা কাহাফ্ এর ১১০ নং আয়াতের তাফছিরে বলেন: নিশ্চয় আমি সূরতে তোমাদের মত আদম সন্তান।” (হেদায়া ইলা বুলুগিন নেহায়া;)
এ সম্পর্কে ইমাম আবু সাঊদ আমাদী মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুস্তফা রহঃ (ওফাত ৯৮২ হিজরী) সূরা ইব্রাহিম এর ১১ নং আয়াত:
قَالَتْ لَهُمْ رُسُلُهُمْ إِنْ نَحْنُ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ এর ব্যাখ্যায় বলেন:
بل نحن بشرٌ مثلُكم في الصورة -“বরং আমরা সূরতে তোমাদের মত বাশার বা মানুষ।” (তাফছিরে আবু সাউদ;)
আল্লামা মাহমুদ আলুছী বাগদাদী হানাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২৭০ হিজরী} সূরা ইব্রাহিমের ১১ নং আয়াতের তাফছিরে বলেন,
المعنى ما نحن من الملائكة بل نحن بشر مثلكم في الصورة -“এর অর্থ হল: আমরা (নবীরা) ফেরেস্থা নই বরং সূরতে তোমাদের মত মানুষ।” (তাফছিরে রুহুল মাআনী, ৭ম খন্ড, ১৮৮ পৃ:;)
এ বিষয়ে আল্লামা আহমদ শিহাবুদ্দিন খুফ্ফাজি মিশরী (رحمة الله عليه) বলেন,
الانبياء صلوات الله وسلامه عليهم اجمعين من جهة الاجسام والظواهر مع البشر (اى موافقين لهم فى صورتها) ومن جهة الارواح والبواطن مع الملائكة...
-“সম্মানিত নবীগণ (عَلَيْهَا السَّلَامُ) শারিরিক ও বাহ্যিক দিক দিয়ে মানবীয় গুণ সম্পন্য অর্থাৎ আকৃতি বা সূরতের দিক দিয়ে নবীগণ মানুষের অনুরূপ। রুহানী ও বাতেনী দিক দিয়ে তাঁরা ফেরেস্থাদের অনুরূপ অর্থাৎ ফেরেস্থাদের গুণে গুণান্বিত।” (নাছিমুর রিয়াজ ফি শরহে কাজী আয়্যাজ, ৩য় জি: ৫৪৪-৪৫ পৃ:;)
উক্ত কিতাবে তিনি আরো বলেন:
"وكما قال" رسول الله صلى الله عليه وسلم فيما يدل على ان باطنه ملكى وظاهره بشرى
-“রাসূল (ﷺ) বাতেনী দিক থেকে ফেরেস্থাদের মত, আর জাহেরী দিক থেকে মানুষের মত।” (নাছিমুর রিয়াজ ফি শরহে কাজী আয়্যাজ, ৩য় খন্ড, ৫৪৫ পৃ:;)
হাজার বছরের মুজাদ্দেদ শায়েখ আহমদ ছেরহেন্দী মুজাদ্দেদ আল্ফেছানী ফারুকী (رضي الله عنه) তদীয় মাকতুবাতে বলেন:
-“জেনে রাখা অতীব প্রয়োজন যে, হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) সৃষ্টির অপরাপর মানুষের মত নন। এমনকি কুল কায়েনাত বা সমগ্র সৃষ্টি জগতের কেহই তাঁর সাথে সাদৃশ্য রাখেনা। কেননা রাসূল (ﷺ) ‘নিছায়ে উনসূরিতে’ বা মানবীয় দেহ বিশিষ্ট হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নূর কর্তৃক সৃষ্টি হয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) নিজেই বলেছেন: আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম আমার নূর সৃাষ্টি করেছেন”।” (মাকতুবাতে ইমামে রব্বানী, ১০০ নং মাকতুবাত;)
এ সম্পর্কে শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله عليه) এর বড় ছাহেবজাদা ও হিজরী ১২শ শতাব্দির মুজাদ্দেদ আল্লামা শাহ্ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله عليه) বলেন, وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولَى এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: “আপনার জন্য ইহকাল থেকে পরকাল উত্তম। যেন আপনার বাশারিয়্যাত বা মানবত্বের অস্তিত্ব পরকালে থাকবেনা। সর্বদা নূরানিয়্যাতের প্রাধান্য আপনার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে।” (তাফছিরে আজিজী, ৪র্থ খন্ড, ৩৫৮ পৃ:;)
দেখুন! রাসূল (ﷺ) যদি সত্বাগত ভাবে মানুষ হতেন তাহলে সর্ব-অবস্থায় বা সর্ব কালেই তাঁর বাশারিয়্যাত বা মানবত্ব প্রাধান্য থাকত। সুতরাং রাসূল (ﷺ) সত্বাগতভাবে নূর এবং পৃথিবীতে মানুষ হয়ে আগমন করেছেন।
এ সম্পর্কে হিজরী ১০ম শতাব্দির অন্যতম মুজাদ্দিদ, মারকাজুল আসানিদ, আল্লামা শায়েখ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله عليه) বলেন,
“আমাদের নবী (ﷺ) এর আপদমস্তক ছিল নূর। তাঁর নূর বা সৌন্দের্যের প্রভায় দৃষ্টিশক্তি উল্টা যেন ফিরে আসত। তিনি যদি মানবীয় পোশাক পরিধান না করতেন, তবে কারো জন্য তাঁর সৌন্দর্য প্রভা উপলব্ধি করা সম্ভব হতনা।” (মাদারেজুন নবুয়াত, ১ম খন্ড, ১৩৭ পৃ:;)
খতিবে পাকিস্থান আল্লামা শফি উকারভী (رحمة الله عليه) বলেন:- “নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) সমগ্র কায়েনাতের পূর্বে সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেই নূরই সমস্থ আম্বিয়ায়ে কেরামের পর বাশারিয়াতে মুহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়। নিঃসন্দেহে তিনিও মানব কিন্তু তাঁর পবিত্র বাশারিয়্যাত অনুপম এবং বাশারিয়াতের যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র ও মুক্ত।” (জিকরে হাসিন, ৩২ পৃ:;)
অতএব, প্রমাণ হয়ে গেল, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বাহ্যিক সূরতে মানুষ, যাকে مُطْلَقًا মত্বলকান মানুষ বলা হয়, মূলত রাসূল (ﷺ) এ পবিত্র সত্ত্বা হচ্ছে আল্লাহর খাল্কী নূর। সুতরাং রাসূল (ﷺ) কে যেমন মত্বলকান বাশার অস্বীকার করার রাস্তা নেই, তেমনিভাবে রাসূল (ﷺ) হাকিকতে আল্লাহর নূর, ইহাকেও অস্বীকার করার কোন রাস্তা নেই। রাসূল পাক (ﷺ) জাতিগত ভাবে বা সত্ত্বাগত ভাবে নূর, কিন্তু মৌলিক সূরত মোবারক ৩টি। যথা: সূরতে বাশারী, সূরতে মালাকী ও সূরতে হাক্বী। পৃথিবীতে তিনি বাশারী সূরতে বা মানবীয় সূরতে আগমন করেছেন এ জন্যেই তিঁনি বাশার বা মানুষ। অর্থাৎ নূরানী বাশার। তবে রাসূলে পাক (ﷺ) কে পৃথিবীর অন্য কোন মানুষের সাথে তুলনা দেওয়া কুফূরী। কারণ ‘তাওয়াতুর’ পর্যায়ের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত আল্লাহর রাসূল (ﷺ) অন্য কোন মানুষের মত না। বিভিন্ন ছহীহ হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) নিজেই বলেছেন ‘তিনি পৃথিবীর কোন মানুষের মত না’। অর্থাৎ তিনি সূরতে মানুষ হলেও অন্য কোন মানুষের তুলনা তাঁর সাথে চলবেনা। আর এ বিষয়টি রাসূলে পাক (ﷺ) থেকে ‘তাওয়াতুর’ পর্যায়ের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন নিচের আলোচনা লক্ষ্য করুন।
❏ ছহীহ্ হাদিসের আলোকে ‘রাসূল (ﷺ) আমাদের মত নয়’
একাধিক ছহীহ্ হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: “আমি তোমাদের মত নই”। “আমি তোমাদের মত নই”। যার বাস্তবতা নিম্ন বর্ণিত হাদিস সমূহ। যেমন লক্ষ্য করুন:-
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ يُوسُفَ، أَخْبَرَنَا مَالِكٌ، عَنْ نَافِعٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاصَلَ فِي رَمَضَانَ فَوَاصَلَ النَّاسُ، فَنَهَاهُمْ، فَقِيلَ لَهُ: إِنَّكَ تُوَاصِلُ قَالَ: إِنِّي لَسْتُ مِثْلَكُمْ إِنِّي أُطْعَمُ وَأُسْقَى
-“হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) রমজানে ‘ছাওমে বিছাল’ পালন করতেন। লোকেরাও এরূপ রোজা রাখলেন। অতঃপর রাসূল (ﷺ) তাঁদেরকে এরূপ রোজা রাখতে নিষেধ করেন। সাহাবীরা বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিত এরূপ রোজা রাখেন। নবী পাক (ﷺ) বললেন: আমি তোমাদের কারো মত নই।” (ছহীহ্ বুখারী, হাদিস নং ১৯৬২; ছহীহ্ মুসলীম, হাদিস নং ৫৬; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৫৭৯৫ ও ৬২৯৯; ইমাম নাসাঈ: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ৩২৫০; মুস্তাখরাজে আবী আওয়ানা, হাদিস নং ২৭৯৮; ইমাম তাহাবী: শরহে মুশকীলুল আছার, হাদিস নং ৫৮৯৮; ইমাম বায়হাক্বী: মারেফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হাদিস নং ৮৯৪৭; ইমাম বায়হাক্বী শরীফ, হাদিস নং ৮৩৭৪; মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদিস নং ৯৫৮৭’) এ বিষয়ে আরেক রেওয়ায়েতে আছে,
حَدَّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ، حَدَّثَنَا الْأَعْمَشُ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: وَاصَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّاسَ فَوَاصَلُوا، فَبَلَغَ ذَلِكَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَنَهَاهُمْ، وَقَالَ: إِنِّي لَسْتُ مِثْلَكُمْ، إِنِّي أَظَلُّ عِنْدَ رَبِّي فَيُطْعِمُنِي وَيَسْقِينِي
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ‘ছাওমে বিছাল’ পালন করলেন, ফলে লোকেরাও এরূপ ‘ছাওমে বিছাল’ পালন করতে লাগলেন। এই কথা রাসূল (ﷺ) জানলেন ও তাঁদেরকে এরূপ রোজা রাখতে নিষেধ করেন। এরপর রাসূলে পাক (ﷺ) বললেন: আমি তোমাদের কারো মত নই, আমার আল্লাহ আমাকে বাতেনীভাবে খাওয়ায় ও পান করায়।” (ছহীহ্ বুখারী, হাদিস নং ১৯৬২; ছহীহ্ মুসলীম, হাদিস নং ৫৬; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৫৭৯৫ ও ৬২৯৯; ইমাম নাসাঈ: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ৩২৫০; মুস্তাখরাজে আবী আওয়ানা, হাদিস নং ২৭৯৮; ইমাম তাহাবী: শরহে মুশকীলুল আছার, হাদিস নং ৫৮৯৮; ইমাম বায়হাক্বী: মারেফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হাদিস নং ৮৯৪৭; ইমাম বায়হাক্বী শরীফ, হাদিস নং ৮৩৭৪; মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদিস নং ৯৫৮৭’) এরূপ আরেক রেওয়ায়েতে আছে,
حَدَّثنا محمد بن المثنى، حَدَّثنا خالد بن الحارث، حَدَّثنا حُمَيد، عَنْ ثابتٍ، عَن أَنَس، عَن النَّبِيّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيه وَسَلَّم: أَنَّهُ وَاصَلَ فَوَاصَلَ نَاسٌ مِنَ النَّاسِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيه وَسَلَّم:.... إِنِّي لَسْتُ مثلكم
-“হযরত আনাস (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় নবী (ﷺ) ‘ছাওমে বিছাল’ পালন করতেন। ফলে লোকেরাও এরূপ রোজা রাখা শুরু করলেন। অতঃপর রাসূল (ﷺ) বললেন:.... আমি তোমাদের কারো মত নই।” ( মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস নং ৬৮৩০; ছহীহ মুসলীম, হাদিস নং ৬০; ছহীহ্ বূখারী, হাদিস নং ৭২৪১; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১২২৪৮; শরহে মুশকীলুল আছার, হাদিস নং ৫৮৯৯; ইমাম বাগভী: শরহে সুন্নাহ, হাদিস নং ১৭৩৯; মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদিস নং ৯৫৮৫; তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ৭৭৮;)
এরূপ আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন,
أَخْبَرَنَا أَبُو الْقَاسِمِ عَبْدُ الرَّحْمَنِ الذَّكْوَانِيُّ قِرَاءَةً عَلَيْهِ، قَالَ: أَخْبَرَنَا أَبُو مُحَمَّدِ بْنِ حِبَّانَ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ يَحْيَى، قَالَ: حَدَّثَنَا مُعَاوِيَةُ بْنُ الْهُذَيْلِ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أَبَانٍ الْعَبْدِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنْ عُمَارَةَ بْنِ أَكْثَمَ اللَّيْثِيِّ، عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: نَهَاهُمُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ عَنِ الْوِصَالِ، قَالُوا: إِنَّكَ تُوَاصِلُ؟ قَالَ: إِنِّي لَسْتُ مِثْلَكُمْ؛ إِنِّي أُطْعَمُ وَأُسْقَى
-“হযরত আবু জার গিফারী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আল্লাহর নবী (ﷺ) লোকদেরকে ‘ছাওমে বিছাল’ থেকে নিষেধ করেন। সাহাবীরা বলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিত এরূপ রোজা রাখেন। প্রিয় নবীজি বললেন: আমি তোমাদের কারো মত নই, আল্লাহ আমাকে খাওয়ায় ও পান করায়।” ( তারতীবুল আমালী, হাদিস নং ১৯৪৩;) এরূপ আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন,
حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا عَبْدَةُ، عَنْ هِشَامِ بْنِ عُرْوَةَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الْوِصَالِ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ: إِنَّكَ تُوَاصِلُ؟، قَالَ: إِنَّمَا هِيَ رَحْمَةٌ رَحِمَكُمُ اللَّهُ، إِنِّي لَسْتُ مِثْلَكُمْ،
-“হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ‘ছাওমে বিছাল’ সম্পর্কে নিষেধ করেন। সাহাবীরা বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিত এরূপ রোজা রাখেন। নবীজি বললেন: নিশ্চয় ইহা রহমত ও তোমাদেরকে আল্লাহ রহম করুন, আমি তোমাদের কারো মত নই।” ( মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদিস নং ৪৩৭৮; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২৪৯৪৫; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৫৩১৩;) এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন,
وحَدَّثَنِي زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، حَدَّثَنَا جَرِيرٌ، عَنْ مَنْصُورٍ، عَنْ هِلَالِ بْنِ يَسَافٍ، عَنْ أَبِي يَحْيَى، عن عبد الله ابن عَمرو، قال: رأيتُ رسولَ الله صلى الله عليه وسلم وهو يصلِّي جالسًا، فقلتُ: يا رسولَ الله، حُدِّثتُ أنك قلتَ: صَلاَةُ القَاعِدِ عَلَى النِّصْفِ مِنْ صَلاَةِ القَائِمِ وأنت تصلِّي قاعدًا؟! قال: أَجَلْ، ولَكِنِّي لَسْتُ كَأَحَدِكُمْ
-“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে পাক (ﷺ) কে দেখলাম তিনি বসে বসে নফল নামাজ পড়ছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি বলেছেন: বসে নামাজ আদায়কারীর সওয়াব দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার চেয়ে অর্ধেক কম। অথচ আপনি বসে বসে নামাজ আদায় করছেন? দয়াল নবীজি (ﷺ) বললেন: ঠিকই কিন্তু আমি তোমাদের কারো মত না।” ( ছহীহ্ মুসলীম, হাদিস নং ১২০; ইমাম তাবারানী: মু’জামুল কবীর, হাদিস নং ১৪৪১৯; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৬৮৯৪; সুনানে দারেমী শরীফ, হাদিস নং ১৪২৪; সুনানে আবী দাউদ, হাদিস নং ৯৫০; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস নং ২৩৬১; ইমাম নাসাঈ: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ১৩৬৫; নাসাঈ শরীফ, হাদিস নং ১৬৫৯; ছহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস নং ১২৩৭;) এরূপ আরেকটি রেওয়ায়েত রয়েছে,
حَدَّثَنَا أَبُو اليَمَانِ، أَخْبَرَنَا شُعَيْبٌ، عَنِ الزُّهْرِيِّ، وَقَالَ اللَّيْثُ، حَدَّثَنِي عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ خَالِدٍ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ أَنَّ سَعِيدَ بْنَ المُسَيِّبِ أَخْبَرَهُ أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ قَالَ: نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الوِصَالِ، قَالُوا: فَإِنَّكَ تُوَاصِلُ، قَالَ: أَيُّكُمْ مِثْلِي، إِنِّي أَبِيتُ يُطْعِمُنِي رَبِّي وَيَسْقِينِ
-“ইবনে শিহাব হতে বর্ণিত, নিশ্চয় সাঈদ ইবনে মুছাইব (رضي الله عنه) হাদিস বর্ণনা করেছেন, হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ‘ছাওমে বিছাল’ সম্পর্কে নিষেধ করেন। সাহাবীরা বললেন: আপনিত এরূপ রোজা রাখেন। প্রিয় নবীজি (ﷺ) বলেন: তোমরা কে আছ আমার মত? নিশ্চয় আমার প্রভূ আমাকে খাওয়ায় ও পান করায়।” ( ছহীহ্ বুখারী, হাদিস নং ৭২৪২; ছহীহ্ মুসলীম, মুস্তাখরাজে আবী আওয়ানা, হাদিস নং ৭২৯২;)
মুসনাদে আহমদে হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত ১০৪৩৩ নং হাদিসে এবং ১১৪২৩ নং হাদিসে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) থেকে إِنِّي لَسْتُ مِثْلَكُمْ বর্ণিত আছে। ‘বাহরুল ফাওয়াইদ’ গ্রন্থে হাদিসটি হযরত হুজাইফা (رضي الله عنه) থেকে সনদ সহ বর্ণিত আছে। উম্মে আইয়ূব (رضي الله عنه) থেকেও ইবনে আবী শায়বাহ এরূপ হাদিস বর্ণনা করেছেন। মুসনাদে আহমদে বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আবী লায়লা (رحمة الله عليه) নবী করিম (ﷺ) এর কিছু সাহাবী থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়াও রাসূলে করিম (ﷺ) এর সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের আকিদা ছিল কেমন তা হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত এই হাদিসটির দিকে লক্ষ্য করুন:- قَالُوا إنَّا لسْنَا كَهْيَئتِكَ يَا رسولَ اللَّهِ -“সাহাবীরা বলতেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কেহ আপনার মত না।” ( ছহীহ্ বুখারী, হাদিস নং ২০; আল ঈমান লি’ইবনে মানদুহ, হাদিস নং ২৮৮; জামেউছ ছাহি লি সুনানিল মাসানিদ, ৩য় খন্ড, ৪৮৫ পৃ:; আল মুখতাছারুন নাছিহ, হাদিস নং ২৪; আলবানী: ছিলছিলায়ে ছাহিহা, হাদিস নং ৩৫০২; শরহে ছাহিহুল বূখারী লি’ইবনে বাত্তাল, ১ম খন্ড, ৭২ পৃ:; ইমাম ইবনে আব্দিল র্বা: আত-তামহিদ, ৫ম খন্ড, ১০২ পৃ:; ইবনে রজব: ফাতহুল বারী, হাদিস নং ২০; ইমাম আইনী: উমদাতুল ক্বারী, ১ম খন্ড, ১৬৫ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: এরশাদুছ ছারী, ১ম খন্ড, ১০৩ পৃ:; আল কাউকাবুদ দুরারী, ১ম খন্ড, ১১২ পৃ:; আনওয়ার শাহ্ কাশ্মিরী: ফায়জুল বারী, ১ম খন্ড, ১৬৯ পৃ:;) যে সকল সাহাবীদের কাছ থেকে এরূপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে তাঁদের তালিকা নিচে দেওয়া হল:
১. হযরত আনাস ইবনে মালেক (رضي الله عنه),
২. ” আবু হুরায়রা (رضي الله عنه),
৩. ” আবু জার গিফারী (رضي الله عنه),
৪. ” আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنه),
৫. ” আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه),
৬. ” আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (رضي الله عنه),
৭. ” উম্মে আইয়ূব (رضي الله عنه),
৮. ” হুজায়ফা ইবনে ইয়ামান (رضي الله عنه),
৯. ” আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه),
১০. ” ইবনে আবী লায়লা (رحمة الله عليه) এর সূত্রে একদল সাহাবী।
সুতরাং বিষয়টি মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদিস প্রমাণিত। তাই রাসূল (ﷺ) মানুষ, তবে পৃথিবীর কোন মানুষের মত নয়। বরং রাসূল (ﷺ) কে অন্য মানুষের সাথে তুলনা দেওয়া মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদিস এনকার বা তিরস্কার করার কারণে সে ব্যক্তি কাফের হিসেবে গন্য হবে। উল্লেখ্য যে, তাওয়াতুর পর্যায়ের হাদিস দিয়ে পবিত্র কোরআনের হুকুমকে মানছুখ বা রহিত করারও বিধান রয়েছে। তাই রাসূলে পাক (ﷺ) কে দুনিয়ার কোন মানুষের সাথে তুলনা দেওয়ার রাস্তা নেই। এ বিষয়টি স্পষ্ট করে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬০৬ হিজরী} তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন,
أَجْمَعْتِ الْأُمَّةُ عَلَى أَنَّ بَعْضَ الْأَنْبِيَاءِ أَفْضَلُ مِنْ بَعْضٍ، وَعَلَى أَنَّ مُحَمَّدًا صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفْضَلُ مِنَ الْكُلِّ،
-“উম্মতের ইজমা হয়েছে যে, কতক নবীগণ কতেক নবীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, আর নিশ্চয় মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁদের সকলের চেয়েও সর্বশ্রেষ্ঠ।” ( তাফছিরে কবীর, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৫২১ পৃ:;)
এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২৫২ হি.} বলেন,
أَجْمَعَتْ الْأُمَّةُ عَلَى أَنَّ الْأَنْبِيَاءَ أَفْضَلُ الْخَلِيقَةِ وَأَنَّ نَبِيَّنَا عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ أَفْضَلُهُمْ وَأَنَّ أَفْضَلَ الْخَلَائِقِ بَعْدَ الْأَنْبِيَاءِ الْمَلَائِكَةُ الْأَرْبَعَةُ وَحَمَلَةُ الْعَرْشِ وَالرُّوحَانِيُّونَ وَرَضْوَانُ وَمَالِكٌ؛ وَأَنَّ الصَّحَابَةَ وَالتَّابِعِينَ وَالشُّهَدَاءَ وَالصَّالِحِينَ أَفْضَلُ مِنْ سَائِرِ الْمَلَائِكَةِ.
-“উম্মতের ইজমা হয়েছে যে, সৃষ্টি জগতে শ্রেষ্ঠ হল নবীগণ, আর আমাদের নবী (ﷺ) হলে তাঁদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। নবীগণের পরে শ্রেষ্ঠ হল আরশ বহনকারী ৪ ফেরেস্থা ও রুহানিউন, রেদ্বওয়ান ও মালেক ফেরেস্থা। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈগণ, শোহাদায়ে কেরাম ও ছালেহীনগণ সাধারণ ফেরেস্থাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।” ( ফাতওয়ায়ে শামী, ১ম খন্ড, ৫২৭ পৃ:;)
তাই রাসূলে পাক (ﷺ) সমগ্র সৃষ্টি জগতে যা কিছু রয়েছে এই সব কিছুর চেয়েও সর্বশ্রেষ্ঠ, এমনকি কোন নবী-রাসূল ও আরশ বহনকারী ফেরেস্থারাও রাসূলে পাক (ﷺ) এর সমতুল্য নয়। সেখানে সাধারণ চটি মৌলভী বা নিম মোল্লার দলেরা বলে বেড়ায় ‘রাসূল (ﷺ) আমাদের মতই’। (নাউজুবিল্লাহ)।
❏ (আনা বাশারু মিছলুকুম) এই আয়াতের ব্যাখ্যা
"أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ (আনা বাশারু মিছলুকুম) এই আয়াতের ব্যাখ্যা
নূরে খোদা, নূরে মুজাচ্ছাম হযরত রাসূলে করিম (ﷺ) কে মাটির দেহদারী তথা আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস দ্বারা তৈরী বলার অন্যতম কারণ হল পবিত্র কোরআনের এই আয়াতাংশ। ওহাবীরা মনে করেন أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ (আনা বাশারু মিছলুকুম) ‘আমাদের মত বাশার’ মানে তিনি সর্ব দিকেই আমাদের মত মানুষ। (নাউজুবিল্লাহ) অথচ ‘আমি তোমাদের মত মানুষ’ এরূপ বলার প্রধান কারণ ছিল التَّوَاضُع ‘নম্্রতা বা বিনয় প্রকাশ’। প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর সাহাবায়ে কেরাম ও পূর্ব যুগের ছাল্ফে-ছালেহীন সকলেই এরূপ বলেছেন। যেমন নিচের দলিল গুলো লক্ষ্য করুন:- র’ইছুল মোফাচ্ছেরীন ও ফকিহ্ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এই আয়াতের তাফছিরে কি বলেছেন এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে যাওজী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫৯৭ হিজরী}, ইমাম বাগভী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫১৬ হিজরী} ও ছাহেবে খাজেন (رحمة الله عليه) {ওফাত ৭৪১ হিজরী} তদীয় স্ব স্ব কিতাবে উল্লেখ করেন,
قُلْ إِنَّما أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ عَلَّمَ اللَّهُ رَسُولَهُ التَّوَاضُعَ لِئَلَّا يَزْهُوَ عَلَى خَلْقِهِ، فَأَمَرَهُ أَنْ يُقِرَّ على نفسه بأنه آدَمِيٌّ كغيره، إِلَّا أنه أُكرم بِالْوَحْيِ.
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন: আল্লাহ তা’লা স্বীয় রাসূল (ﷺ) কে বিনয়-নম্রতা শিক্ষা দিয়েছেন, যাতে তিনি সৃষ্টির উপর বড়াই না করেন। অতঃপর তিনি তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন একথা স্বীকার করতে যে, তিনি অপরাপর মানুষের মতই।” (ইমাম ইবনে জাওযী: তাফছিরে যাদুল মাইছির, ৩য় খন্ড, ১১৪ পৃ:; তাফছিরে খাজেন শরীফ, ৩য় খন্ড, ১৮০ পৃ:; তাফছিরে বাগভী, ৫ম খন্ড, ২১৩ পৃ:;)
সুতরাং রাসূল (ﷺ) ‘আমি তোমাদের মত মানুষ’ বলার মূল কারণ হল ‘বিনয়-নম্রতা’ প্রকাশ। আর তিনি এরূপ কথা স্বয়ং আল্লাহ পাকের নির্দেশেই বলেছেন। তাই এই আয়াত দ্বারা রাসূল (ﷺ) কে আমাদের মত সাধারণ মানুষ ভেবে নেওয়া যাবেনা। যেমন এ সম্পর্কে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬০৬ হিজরী} তদীয় তাফছিরে বলেন,
وَاعْلَمْ أَنَّهُ تَعَالَى لَمَّا بَيَّنَ كَمَالَ كَلَامِ اللَّهِ أَمَرَ مُحَمَّدًا صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِأَنْ يَسْلُكَ طَرِيقَةَ التَّوَاضُعِ فَقَالَ: قُلْ إِنَّما أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحى إِلَيَّ أَيْ لَا امْتِيَازَ بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ فِي شَيْءٍ مِنَ الصِّفَاتِ
-“জেনে রাখুন! নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা পূর্ণরূপে কোন আদেশ রাসূল (ﷺ) কে দেন তখনই যখন বিনয়-নম্রতার জন্য তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা হয়। ফলে তিনি বলেন: ‘আমি তোমাদের মত মানুষ আমার প্রতি ওহী হয়’ অর্থাৎ গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যেগত দিক দিয়ে আমার ও তোমাদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই।” (ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী: তাফছিরে কবীর, সূরা কাহাফের ১১০ নং আয়াতের তাফছির;)
এখানে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله عليه) রাসূল (ﷺ) এর ছিফাত সমূহ বা গুণাবলীকে মানুষের সাথে তুলনা দিয়েছেন, জাত বা সত্ত্বাকে নয়। অর্থাৎ প্রিয় নবীজি (ﷺ) কে মানবীয় গুণাবলী দান করা হয়েছে। পাশাপাশি রাসূল (ﷺ) এরূপ কথা বলার প্রধান কারণ হল التَّوَاضُع ‘বিনয় প্রকাশ’। ইমাম আবু মুহাম্মদ মক্কী ইবনে আবী ত্বালেব হাম্মুশী আন্দালুছী মালেকী রহঃ (ওফাত ৪৩৭ হিজরী) তদীয় কিতাবে বলেন,
قُلْ إِنَّمَآ أَنَاْ بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يوحى إِلَيَّ أَنَّمَآ إلهكم إله وَاحِدٌ أي: إنما أنا من ولد آدم مثلكم في الصورة
-“বলুন আমি তোমাদের মতই মানুষ আমার প্রতি ওহী হয় তোমাদের একক’ অর্থাৎ নিশ্চয় আমি সূরতে তোমাদের মত আদম সন্তান।” (হেদায়া ইলা বুলুগিন নেহায়া;)
এ বিষয়ে বিখ্যাত ফকিহ্ আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী বরুছয়ী হানাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১১২৭ হিজরী} বলেন,
قُلْ إِنَّما أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ قل يا محمد ما انا الا آدمي مثلكم فى الصورة ومساويكم فى بعض الصفات البشرية
“হে হাবীব বলুন! আমি তোমাদের মত মানুষ” অর্থাৎ বলুন!! আমি মানুষ ছাড়া অন্য কিছু নই। সূরত বা আকৃতিগত দিক থেকে তোমাদের ন্যায় এবং মানবীয় কতিপয় গুণ-বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তোমাদের মতই।” ( আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী: তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৫ম খন্ড, ৩০৯ পৃ:;)
এ বিষয়ে বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত হাছান বছরী (رضي الله عنه) এর অভিমত সম্পর্কে বিখ্যাত ফকিহ্ আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী হানাফী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১১২৭ হিজরী} ও অন্যান্য ইমামগণ তদীয় কিতাবে আরো বলেন,
قَالَ الْحَسَنُ: رضى الله عنه عَلَّمَهُ اللَّهُ التَّوَاضُعَ بقوله (قُلْ إِنَّما أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ)
-“বিশিষ্ট সাহাবী হযরত হাসান (رضي الله عنه) বলেন: ‘আমি তোমাদের মত মানুষ’ এই কথা দ্বারা রাসূল (ﷺ) কে বিনয়-নম্রতা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।” ( তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৮ম খন্ড, ২২৮ পৃ:, সূরা হা-মিম সাজদার ৬ নং আয়াতের তাফছিরে; তাফছিরে খাজেন শরীফ, ৪র্থ খন্ড, ৮২ পৃ:; তাফছিরে বাগভী, ৭ম খন্ড, ১৬৪ পৃ:;)
বিশ্বনন্দিত মোফাচ্ছির আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপাথি (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২২৫ হিজরী} ফকিহু সাহাবী ও র’ইছুল মোফাচ্ছেরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর অভিমতটি এভাবে উল্লেখ করেছেন,
قُلْ إِنَّما أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحى إِلَيَّ أَنَّما إِلهُكُمْ إِلهٌ واحِدٌ قال ابن عبّاس علّم الله عزّ وجلّ رسوله، صلى الله عليه وسلم التواضع لئلا يزعى على خلقه
-“বলুন আমি তোমাদের মত মানুষ আমার কাছে ওহী আসে তোমাদের প্রভূ একক’ হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন: আল্লাহ তা’লা স্বীয় রাসূল (ﷺ) কে বিনয়-নম্রতা শিক্ষা দিয়েছেন, যাতে তিনি সৃষ্টির উপর বড়াই না করেন।” ( তাফছিরে মাজহারী, ৫ম খন্ড, ৪২৭ পৃ:, সূরা কাহাফের ১১০ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়;)
বিশ্বনন্দিত মোফাচ্ছির আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপাথি (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২২৫ হিজরী} আরো বলেন,
قُلْ يا محمد فى جوابهم إِنَّما أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحى إِلَيَّ قال الحسن علمه الله التواضع يعنى ما انا الا واحد منكم
-“ওহে মুহাম্মদ! তাদের জবাবে আপনি বলুন ‘আমি তোমাদের মত মানুষ আমার প্রতি ওহী হয়’। হযরত হাছান (رضي الله عنه) বলেন: আল্লাহ তা’লা তাঁর নবীকে ‘বিনয়-নম্রতা’ শিক্ষা দিচ্ছেন অর্থাৎ আমি তোমাদের মধ্য থেকেই একজন।” ( তাফছিরে মাজহারী, ৮ম খন্ড, ২৮১ পৃ:;)
এ সম্পর্কে ইমাম কুরতবী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৬৭১ হিজরী} বলেন,
قَوْلُهُ تَعَالَى:"قُلْ إِنَّما أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ" أَيْ لَسْتُ بِمَلَكٍ بَلْ أَنَا مِنْ بَنِي آدَمَ. قَالَ الْحَسَنُ: عَلَّمَهُ اللَّهُ تَعَالَى التَّوَاضُعَ.
-“আল্লাহ তা’লার বাণী: ‘বলুন আমি তোমাদের মত মানুষ’ অর্থাৎ আমি ফেরেস্থা নয় বরং আদম সন্তানদের অন্তর্ভূক্ত। হযরত হাসান (رضي الله عنه) বলেন: আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে ‘বিনয়-নম্রতা’ শিক্ষা দিচ্ছেন।” (তাফছিরে কুরতবী শরীফ, ১৫তম খন্ড, ৩৪০ পৃ:;)
অতএব, সাহাবী, তাবেঈ ও ছাল্ফে-ছালেহীনের উক্তি দ্বারা স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ ‘আমি তোমাদের মত মানুষ’ এরূপ কথা বলার মূল কারণ ছিল التَّوَاضُعِ (তাওয়াদু) বা বিনয়-নম্রতা। তাই এই কথাকে নম্রতা ছাড়া অন্য দিকে প্রবাহিত করার কোন রাস্তা নেই। পবিত্র কোরআনেই বলা হয়েছে নবীদেরকে আমাদের মত সাধারণ মানুষ মনে করা কাফেরদের আকিদা। যেমন মহান আল্লাহ তা’লা বলেন,
قالُوا مَا أَنْتُمْ إِلاَّ بَشَرٌ مِثْلُنا -“তারা (কাফেররা) বলে: আপনিত আমাদের মত মানুষ ছাড়া কিছুই না।” (সূরা ইয়াছিন: ১৫ নং আয়াত)।
যেমন আল্লামা রাগেব ইস্পাহানী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৫০২ হিজরী} বলেন,
ولمّا أراد الكفار الغضّ من الأنبياء اعتبروا ذلك فقالوا: إِنْ هذا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ [المدثر/ ২৫]
-“যখন কাফেররা নবীগণকে হেয়-প্রতিপন্য করা ইচ্ছা করতেন তখন তারা বলতেন: নিশ্চয় ইহা মানুষের কথা ছাড়া কিছুই নয়।” ( মুফরাদাত, ৫৩ পৃ:;)
এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, নবীদেরকে সাধারণ বাশার বা মানুষ মনে করা কাফেরদের চরিত্র ও আকিদা। আর নবীগণকে তাদের মত সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে দেখার কারণেই পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক তাদেরকে ধিক্কার দিয়েছেন। আর এরূপ আকিদা তথা নবীগণকে সাধারণ মানুষ মনে করে যত আমলই করেন সব কিছুই বিফলে যাবে এবং ঐ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অতএব, এরূপ কথা নবী পাক (ﷺ) এর মুখেই শোভা পায়, অন্য কারো মুখে নয়। যেমন একজন শায়েখ বা বুযুর্গ ব্যক্তি তার বক্তব্যে বলে থাকেন: ‘আমি আল্লাহর সবচেয়ে নগন্য বান্দাহ’। এরূপ বললে ইহা ঐ শায়েখের নম্রতা বা বিনয় প্রকাশ পাবে, তাই বলে তিনি দুনিয়ার সকল মানুষের চেয়ে নিকৃষ্ট নয়। এটাই উনার বিনয় ও নম্রতা। ঠিক অনুরূপ আল্লাহর হাবীব (ﷺ) বিনয়ের জন্য বলেছেন ‘আমি তোমাদের মত মানুষ’ এটা রাসূল (ﷺ) এর বিনয় ও নম্রতা, তাই বলে রাসূল (ﷺ) আমাদের মত সাধারণ মানুষ নয়। যেমন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) দোয়া করতে গিয়ে বলেছেন:
رَبَّنا ظَلَمْنا أَنْفُسَنا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنا وَتَرْحَمْنا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخاسِرِينَ -“হে আমাদের রব! আমরা নিজেদে উপর জুলুম করেছি.....।” (সূরা আরাফ: ২৩ নং আয়াত)।
এই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ বলছে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) স্বীয় নফছের উপর জুলুম করেছেন। বলুন! আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কি জালিম ছিলেন? (নাউজুবিল্লাহ), অবশ্যই না, বরং এটা ছিল আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর বিনয়। আর এরূপ কথা তাঁর মুখেই শোভ পায়, আমাদের মুখে এরূপ কথা বললে কুফূরী হবে।
হযরত ইউনুছ (عَلَيْهَا السَّلَامُ) দোয়া করেছেন, إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ -“নিশ্চয় আমি জালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়েগেছি।” (সূরা আম্বিয়া: ৮৭ নং আয়াত)।
এই আয়াতের বাহ্যিক দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় আল্লাহর নবী হযরত ইউনূছ (عَلَيْهَا السَّلَامُ) জুলুম করেছেন। বলুন! ইউনুছ নবী কি জালিম ছিলেন? (নাউজুবিল্লাহ)। অবশ্যই না, বরং এটা ছিল হযরত ইউনূছ (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর বিনয় প্রকাশ। আর এরূপ কথা তাঁর মুখেই শোভ পায়, আমাদের মুখে এরূপ কথা বললে কুফূরী হবে।
❏ নূরে তৈরী ফেরেস্থারা কি মাটির আদমকে সেজদা করেছিল?
আমরা জানি নূরের তৈরী ফেরেস্থারা মাটির তৈরী আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সেজদা করেছেন। এতে বুঝা যায়, মাটির মর্যাদা নূরের চেয়েও বেশী। তাই রাসূল (ﷺ) কে নূরের তৈরী বললে কি তাঁর মর্যাদা ক্ষুন্য হয়না?
উত্তরঃ অবশ্যই মর্যাদা ক্ষুন্য হবেনা। কারণ মাটির মর্যাদা নূরের চেয়ে বেশী নয়। যদি ধরে নেই মাটির মর্যাদা নূরের চেয়েও বেশী তাহলে আপনাদের দৃষ্টিকোন থেকে মাটির তৈরী রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, বুশ, টনী ব্লেয়ার, ফেরাউন, নমরুধ, কারুন ও কাফের-বেইমানদের মর্যাদা নূরের ফেরেস্থা জিব্রাইল, মিকাইল, ই¯্রাফিল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর চেয়েও কি বেশী? (নাউজুবিল্লাহ) অবশ্যই না।
পাশাপাশি কাফের-বেইমান ও মুসলমানের মর্যাদাও এক নয়। অথচ উভয় প্রকার মানুষ একই ভাবেই ও একই জিনিসের তৈরী। কাফেররা মানুষ হওয়ার পরও মুসলমানের মত মর্যাদা রাখেনা। কারণ মুসলমানের কাছে আছে, ঈমান, ইসলাম, কুরআন ও ইলিম। আর সকলেই অবগত আছেন:
الاسلام نور والايمان نور والعلم نور والقران نور
-“ইসলাম একটি নূর, ঈমানও নূর, কুরআনও নূর, ইলিমও নূর।” যদি মাটির মর্যাদা নূরের চেয়ে বেশী হয় তাহলে মাটির চেয়ে কোরআনের মর্যাদা কি কম?! মাটির চেয়ে ইসলামের মর্যাদা কি কম!? মাটির চেয়ে ঈমানের মর্যাদা কি কম!? তাহলে আপনারাই বিচার করুন মাটির মর্যাদা বেশী নাকি নূরের মর্যাদা বেশী। অবশ্যই নূরের মর্যাদা বেশী। নূরের কারণেই মাটির তৈরী আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এসব নূর যেসকল মানুষের কাছে আছে, ঐ সকল মানুষের মর্যাদা অন্যান্য মানুষের চেয়ে বেশী। তাই প্রমাণিত হল, নূরের সম্পর্ক থাকলেই মাটির মানুষের মর্যাদা বাড়ে। ঠিক তেমনিভাবে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর মাঝেও নূরের সম্পর্ক ছিল, এ কারণেই নূরের ফেরেস্থাদের চেয়েও তাঁর মর্যাদা বেড়েছিল। এখন জানতে হবে কি সেই নূর, যার কারণে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর মর্যাদা নূরের ফেরেস্থাদের চেয়েও বেশী হয়েছিল। এ সম্পর্কে আল্লামা ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (رحمة الله عليه) {ওফাদ ৬০৬ হিজরী} তদীয় তাফছিরে এবং হাফিজ ইবনে হাজার হায়তামী মক্কী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৯৭৪ হিজরী} বলেন,
أَنَّ الْمَلَائِكَةَ أُمِرُوا بِالسُّجُودِ لِآدَمَ لِأَجْلِ أَنَّ نُورَ مُحَمَّدٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ فِي جَبْهَةِ آدَمَ
-“নিশ্চয় ফেরেস্থাদেরকে আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) প্রতি সেজদা করা আদেশ দেওয়া হয়েছিল কারণ হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর কপালে নূরে মুহাম্মদী ছিল।” ( তাফছিরে কবীর, ৬ষ্ঠ জি: ১৮০ পৃ:; হাফিজ ইবনে হাজার মক্কী: আদ দুররুল মানদুদ, ২৪ পৃ:; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৩য় খন্ড, ৬৫১ পৃ:;)
হাফিজুল হাদিস ইমাম আবুল ফারাজ ইবনে জাওযী (رحمة الله عليه) (ওফাত ৫৯৭ হিজরী) তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন,
وكان نور محمد صلى الله عليه وسلم فى جبهة ادم كالشمس فى كمالها او كالقمر فى تمامه
-“নূরে মুহাম্মদী (رحمة الله عليه) আদমের চেহারায় ঐরূপ ছিল যেরূপ পরিপূর্ণরূপে থাকে অথবা চন্দ্র সকল কিছুর উপরে থাকে।” (তাফছিরে কবীর, ৬ষ্ঠ জি: ১৮০ পৃ:; হাফিজ ইবনে হাজার মক্কী: আদ দুররুল মানদুদ, ২৪ পৃ:; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৩য় খন্ড, ৬৫১ পৃ:;)
সুতরাং আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর কপালে নূরে মুহাম্মদী থাকার কারণেই আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর মর্যাদা বেড়েছে, ফলে সকল নূরের ফেরেস্থারা তাঁর দিকে সেজদা করেছেন। তাফছিরে মাজহারীতে আছে, আদমের সাথে আল্লাহ তা’লার সঙ্গ ছিল, এ কারণে ফেরেস্থারা তাঁর দিকে ফিরে সেজদা করেছেন। মূল কথা হল, কোন ফেরেস্থা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সেজদা করেননি, বরং তাঁর দিকে ফিরে নূরে মুহাম্মদীকে সিজদা করেছেন। সেখানে আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) ছিল শুধু কেবলার ভূমিকায়।
যেমন আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপাথি (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২২৫ হিজরী} উল্লেখ করেন,
جعل الله تعالى آدم قبلة للملائكة كما جعل الكعبة قبلة للناس
-“আল্লাহ পাক হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে ফেরেস্থাদের কেবলা বানিয়েছেন যেমনিভাবে কা’বা ঘরকে মানুষের কেবলা বানানো হয়েছে।” (তাফছিরে মাজহারী, ৫ম খন্ড, ১৬৩ পৃ:;)
অর্থাৎ আমরা যেমনিভাবে কা’বার দিকে ফিরে সেজদা করি কিন্তু কা’বা ঘরকে সেজদা করিনা বরং আল্লাহ তা’লাকেই সেজদা করি। তেমনিভাবে ফেরেস্থারা আদমের দিকে ফিরে সেজদা করেছেন কিন্তু আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সেজদা করেননি। তাই নূরে মুহাম্মদীর কারণেই বাবা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে, তিনি মাটির তৈরী ইহার কারণে নয়। এই ঘটনার দ্বারা নূরে মুহাম্মদীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, মাটির নয়। এছাড়াও কোন ফেরেস্থাকে নবী-রাসূলগণের সাথে তুলনা দেওয়া কুফূরী ও হারাম। এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (رحمة الله عليه) {ওফাত ১২৫২ হিজরী} তদীয় কিতাবে বলেন,
أَجْمَعَتْ الْأُمَّةُ عَلَى أَنَّ الْأَنْبِيَاءَ أَفْضَلُ الْخَلِيقَةِ وَأَنَّ نَبِيَّنَا عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ أَفْضَلُهُمْ وَأَنَّ أَفْضَلَ الْخَلَائِقِ بَعْدَ الْأَنْبِيَاءِ الْمَلَائِكَةُ الْأَرْبَعَةُ وَحَمَلَةُ الْعَرْشِ وَالرُّوحَانِيُّونَ وَرَضْوَانُ وَمَالِكٌ؛ وَأَنَّ الصَّحَابَةَ وَالتَّابِعِينَ وَالشُّهَدَاءَ وَالصَّالِحِينَ أَفْضَلُ مِنْ سَائِرِ الْمَلَائِكَةِ.
-“উম্মতের ইজমা হয়েছে যে, সৃষ্টি জগতে শ্রেষ্ঠ হল নবীগণ, আর আমাদের নবী (ﷺ) হলে তাঁদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। নবীগণের পরে শ্রেষ্ঠ হল আরশ বহনকারী ৪ ফেরেস্থা ও রুহানিউন, রেদ্বওয়ান ও মালেক ফেরেস্থা। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈগণ, শোহাদায়ে কেরাম ও ছালেহীনগণ সাধারণ ফেরেস্থাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।” ( ফাতওয়ায়ে শামী, ১ম খন্ড, ৫২৭ পৃ:;)
তাই নবীগণ (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সমগ্র সৃষ্টি জগতে যা কিছু রয়েছে এই সব কিছুর চেয়েও সর্বশ্রেষ্ঠ, এমনকি কোন আরশ বহনকারী ফেরেস্থারাও মর্যাদায় নবীদের সমতুল্য নয়। তাই ফেরেস্থাদেরকে আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর চেয়ে অধিক মর্যাদাবান ভাবা উম্মতের ইজমার বিপরীত যা প্রকাশ্য কুফূরী বটে। উল্লেখ্য যে, হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) মাটির তৈরী বলে অধিক মর্যাদাবান ছিলেন না, বরং আল্লাহর নবী হওয়ার কারণেই ও নূরে মুহাম্মদীর কারণে অধিক মর্যাদাবান ছিলেন।
❏ সর্বপ্রথম নবীজির রুহ কি নূর দিয়ে তৈরী?
এক হাদিসে আছে, أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ نُورِي -“আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন।” আরেক হাদিসে আছে, أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ رُوحِي-“আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম আমার রুহ্ সৃষ্টি করেছেন।” দু’টি হাদিস একত্র করলে বুঝা যায়, আল্লাহ তা’লা সর্ব প্রথম নূর দ্বারা রুহ্ মোবারক সৃষ্টি করেছেন, দেহ নয়।
উত্তরঃ প্রথমত: أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ رُوحِي -“আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম আমার রুহ্ সৃষ্টি করেছেন।” ইহার কোন সনদ নেই, অর্থাৎ সনদ বিহীন কোন কথা গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত: যদি ইহা গ্রহণ করা হয় তাহলে ইহার সম্পর্কে হাজার বছরের মুজাদ্দেদ শায়েখ আহমেদ ছেরহেন্দী মুজাদ্দেদ আল্ফেছানী (رضي الله عنه) বলেছেন:
-“রাসূলে পাক (ﷺ) ‘আমার রুহ্’ বলে যে রুহের প্রতি ঈঙ্গিত করেছেন ইহা তাঁর রুহ্ ঠিকই তবে ইহার মধ্যে রাসূল (ﷺ) এর নূর ও তদীয় পার্থিব সত্ত্বা এই দুই অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে।” ( মাকতুবাতে ইমামে রব্বানী; কামেল পীরের আবশ্যকতা, ১১৭ পৃ: কৃত: খাজাবাবা ফরিদপুরী র:;)
এ কারণেই ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله عليه) বলেছেন,
أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ نُورِي، وَفِي رِوَايَةٍ: رُوحِي، وَمَعْنَاهُمَا وَاحِدٌ، -“সর্বপ্রথম আল্লাহ পাক আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। অন্য রেওয়ায়েতে আছে, আমার রুহ। এই দুই কথার অর্থ একই।” ( ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৯৪ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;)
অর্থাৎ রুহ বলতে প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর নূরকেই বুঝানো হয়েছে। কারণ নূরে মুহাম্মদী ব্যতীত রুহে মুহাম্মদীকে কল্পনাও করা যায়না। অতএব, নূরে মুহাম্মদীই হচ্ছে পরবর্তীতে রুহে মুহাম্মদী (ﷺ) ( মূলত নূরে মুহাম্মদী ও রুহে মুহাম্মদী (ﷺ) একই। শুধু রূপ পরিবর্তন করা হয়েছে।)। আর সেই রুহে মুহাম্মদী হতেই সকল আরওয়াহ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী (رحمة الله عليه) সুন্দর বলেছেন,
ان الله تعالى كما خلق آدم ابتداء وجعل أولاده منه كذلك خلق روح محمد صلى الله عليه وسلم قبل الأرواح كما قال (أول ما خلق الله روحى) ثم خلق الأرواح من روحه فكان آدم أبا البشر وكان محمد صلى الله عليه وسلم أبا الأرواح
-“নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা প্রথমে আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে সৃষ্টি করলেন ও তিনার আওলাদগণতে তিনার থেকে (পর্যায়ক্রমে তিনার নূতফা থেকে) সৃষ্টি করেছেন। অনুরুপ রুহে মুহাম্মদী (ﷺ) সৃষ্টি হয়েছে সবার রুহের পূর্বে। যেমনটি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: সর্বপ্রথম আল্লাহ পাক আমার রুহ সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর সমস্থ রুহ সমূহকে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর রুহ মুবারক থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) হলেন আবুল বাশার এবং হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) হলে আবুল আরওয়াহ।” ( আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী: তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৩য় খন্ড, ৭২ পৃ: সূরা আনআম এর ৯৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়;)
সুতরাং أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ رُوحِي -“আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম আমার রুহ্ সৃষ্টি করেছেন।” ইহা দ্বারা আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর রুহ্ ও দেহ মোবারক উভয়কেই বুঝানো হয়েছে। যেমন হযরত জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কেও ‘রুহ’ বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন:
تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ -“কদরের রজনীতে অসংখ্য ফেরেস্থা ও রুহ নাজিল বা প্রেরিত হয়েছে।” (সূরা কাদর: ৪ নং আয়াত)।
এই আয়াতে ‘রুহ’ বলতে হযরত জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লামা আবু জাফর তাবারী (رحمة الله عليه) {ওফাত ৩১০ হিজরী} বলেন:
مَعْنَى ذَلِكَ: {تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ} وَجِبْرِيلُ مَعَهُمْ، وَهُوَ الرُّوحُ، -“ইহার অর্থ হচ্ছে: সকল ফেরেস্থার সাথে জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) নাজিল হয়েছে, কারণ তিনি’ই রুহ্।” ( তাফছিরে তাবারী শরীফ, ৩০তম জি: ২৮৫ পৃ:;)
আল্লামা আবুল ফিদা আল্লামা হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) বলেন:
وَأَمَّا الرُّوحُ فَقِيلَ الْمُرَادُ بِهِ هَاهُنَا جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ،-“আর রুহ্ বলতে যাকে মুরাদ নেওয়া হয়েছে তিনি হযরত জিব্রাইল আলায়হিস সালাম।”
আল্লামা ইমাম বাগভী (رحمة الله عليه) ও ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رحمة الله عليه) বলেন:
يَعْنِي: جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلَامُ مَعَهُمُ -“হযরত জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) তাঁদের সাথে নাজিল হয়েছে।” (তাফছিরে বাগভী, ৫ম খন্ড, ৩৯২ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: তাফছিরে দুর্রে মানছুর, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৬৭৩ পৃ:;)
সুতরাং প্রমাণিত হল ‘রুহ্’ বলতে হযরত জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর পুরো সত্ত্বাকেই বুঝানো হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে রাসূলে পাক (ﷺ) رُوحِي বলতে রাসূল (ﷺ) এর পুরো সত্ত্বাকেই বুঝিয়েছেন, যেমনটি হযরত মোজাদ্দেদ আল্ফেছানী (رضي الله عنه) বলেছেন। এ কারণেই আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله عليه) রুহ এবং নূর উভয়টিকে একই বুঝিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন,
أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ نُورِي، وَفِي رِوَايَةٍ: رُوحِي، وَمَعْنَاهُمَا وَاحِدٌ، فَإِنَّ الْأَرْوَاحَ نُورَانِيَّةٌ أَيْ: أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ مِنَ الْأَرْوَاحِ رُوحِي
-“সর্ব প্রথম আমার ‘নূর’ সৃষ্টি করেছেন। অপর বর্ণনায় আছে আমার ‘রুহ’ সৃষ্টি করেছেন। দু’টির মাআনা বা অর্থ একই। কেননা সকল রুহসমূহ নূরানী বা নূরের তৈরী। অর্থাৎ সকল রুহসমূহের মধ্যে আমার রুহ প্রথম সৃষ্টি করেছেন।” ( ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৯৪ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;)
এখানে রুহ বলতে প্রিয় নবীজি (ﷺ) পবিত্র সত্ত্বাকেই বুঝানো হয়েছে। কেননা সৃষ্টি জগতে তিনিই প্রথম মানুষ, আর মানুষ শুধু রুহ হয়না বরং ‘রুহ ও দেহ’ মিলিত হয়েই মানুষ হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, الرُّوحُ তথা ‘রুহ্’ মূলত আল্লাহ তা’লার আদেশ। যেমন আল্লাহ তা’লা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন: قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي-“বলুন, রুহ আপনার রবের আদেম মাত্র।” (সূরা ইসরা: ৮৫ নং আয়াত)।
অর্থাৎ আল্লাহ তা’লার আদেশ তথা কুন ফায়াকুনের মাধ্যমে নুরানী রুহ সৃষ্টি হয়েছে।
❏ নূরের তৈরী হলে কি মানুষের মত চুল, দাড়ি, পশম থাকা, খাওয়া-দাওয়া, রক্তপাত করা ও নারী সম্ভোক করা থাকে?
মাটির মানুষকে দেখা যায়, কথা বলা যায় ও তাদের চুল দাড়ি পশম ইত্যাদি আছে। নূরের তৈরী ফেরেস্থাকে দেখা যায়না, কথা বলা যায়না ও তাদের চুল দাড়ি পশম নেই। নবী করিম (ﷺ) যদি নূরের তৈরী হতেন তাহলে প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর তাঁকে দেখা গেল কেন ও তাঁর চুল-দাড়ি মোবারক ছিল কেন?
উত্তরঃ নূরের তৈরী ফেরেস্থা হযরত জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কেও দেখা গেছে, কথা বলা গেছে ও তাঁর চুল দাড়ি তথা পূর্ণাঙ্গ মানুষ রূপে তিনি আগমন করতেন। যেমন আল্লাহ তা’লা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন,
فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا -“আমি মরিয়ামের কাছে আমার রুহকে (জিব্রাইলকে) পরিপূর্ণ মানুষ রূপে প্রেরণ করেছি।” (সূরা মরিয়াম: ১৭ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে হযরত জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে স্পষ্ট ‘বাশার’ বা মানুষ বলেছেন। বলুন তাই বলে কি জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) মাটির তৈরী হয়ে গেছেন? যেমন ছহীহ্ হাদিসে আছে,
حَدَّثَنِي إِسْحَاقُ، عَنْ جَرِيرٍ، عَنْ أَبِي حَيَّانَ، عَنْ أَبِي زُرْعَةَ، عَن أبي هُرَيْرَة قَالَ كَانَ النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم بارزاً يَوْمًا للنَّاس إذ أتاه رجل يمشي فَقَالَ مَا الْإِيمَان قَالَ الْإِيمَان أَن تؤمن بِاللَّه...... قَالَ الْإِسْلَام قَالَ الْإِسْلَام أَن تعبد الله وَلَا تشرك بِهِ وتقيم الصَّلَاة..... قَالَ مَا الْإِحْسَان قَالَ أَن تعبد الله كَأَنَّك ترَاهُ.... ثمَّ أدبر فَقَالَ ردُّوهُ فَلم يرَوا شَيْئا فَقَالَ هَذَا جِبْرِيل جَاءَ يعلم النَّاس دينهم
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, একদা আল্লাহর রাসূল (ﷺ) জনসমক্ষে বসা ছিলেন। এমন সময় তাঁর কাছে এক পুরুষ ব্যক্তি এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ঈমান কি? তিনি বললেন: ঈমান হল আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখা...... অতঃপর জিজ্ঞাসা করলেন: ইসলাম কি? প্রিয় নবীজি (ﷺ) বললেন: ইসলাম হল, আল্লাহর ইবাদত করবেন ও তার সাথে কাউকে শরীক করবেন না।...... অতঃপর জিজ্ঞাসা করলেন, এহছান কি? উত্তরে নবীজি (ﷺ) বললেন: এহছান হল, এনভাবে আল্লাহর ইবাদত করা যেন আল্লাহকে দেখা যায়,.......। এরপর ঐ ব্যক্তি চলে গেল এবং তিনি বললেন তোমরা তাঁকে ফিরিয়ে আন। অতঃপর তাঁরা আর কিছুই দেখতে পেলনা। তখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন: ইনি হযরত জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) ছিলেন, তিনি লোকদেরকে তাদের দ্বীন শেখাতে এসেছিল।” ( ছহীহ্ বুখারী, ১ম খন্ড, ১২ পৃ:, হাদিস নং ৫০ ও ৪৭৭৭;)
এই হাদিসে স্পষ্ট জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কেرجل (রাজুল) বা একজন পুরুষ ব্যক্তি বলা হয়েছে। এক কথায় পূর্ণাঙ্গ পুরুষ মানুষ হতে যা যা প্রয়োজন তিনি হুবহ ঐরূপ আকৃতিতে এসেছেন। ফলে কোন সাহাবায়ে কেরাম তাকে জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) বলে চিনলেন না। সুতরাং যেমনিভাবে নূরের তৈরী ফেরেস্থা জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) নূরের সৃষ্টি হওয়ার পরেও মানুষের সূরতে এসেছেন, তেমনিভাবে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) নূরের সৃষ্টি হয়েও মানুষের সূরতে এসেছেন।
হযরত জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) অধিকাংশ সময় হযরত দাহিয়াতুল ক্বাল্বী (رضي الله عنه) নামক একজন সাহাবীর সূরতে আসতেন। ফলে সবাই মনে করতেন এটা দাহিয়াতুল ক্বাল্বী। মূলত দাহিয়াতুল ক্বাল্বী একজন মানুষ, আর ফেরেস্থা জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সেই মানুষের সূরতে এসেছেন। অতএব, নূরে তৈরী হলেও মানুষের সূরতে আসা অসম্ভব কিছু নয়। এমনকি ‘হারুত ও মারুত’ নামক দুইজন নূরের তৈরী ফেরেস্থা পৃথিবীতে এসেছিলেন ও মানুষের মতই বসবাস করেছেন, যাদের কথা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। তারা মানুষের মত পানাহার করেছেন, মহিলাদের সাথে মিলিত হয়েছে ও মানুষ হত্যাও করেছেন। যেমন হাদিসটি লক্ষ্য করুন,
حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ أَبِي بُكَيْرٍ، حَدَّثَنَا زُهَيْرُ بْنُ مُحَمَّدٍ، عَنْ مُوسَى بْنِ جُبَيْرٍ، عَنْ نَافِعٍ، مَوْلَى عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ، أَنَّهُ سَمِعَ نَبِيَّ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ آدَمَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا أَهْبَطَهُ اللهُ تَعَالَى إِلَى الْأَرْضِ، قَالَتِ الْمَلَائِكَةُ: أَيْ رَبِّ، {أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ}، قَالُوا: رَبَّنَا نَحْنُ أَطْوَعُ لَكَ مِنْ بَنِي آدَمَ. قَالَ اللهُ تَعَالَى لِلْمَلَائِكَةِ: هَلُمُّوا مَلَكَيْنِ مِنَ الْمَلَائِكَةِ، حَتَّى يُهْبَطَ بِهِمَا إِلَى الْأَرْضِ، فَنَنْظُرَ كَيْفَ يَعْمَلَانِ. قَالُوا: رَبَّنَا، هَارُوتُ وَمَارُوتُ. فَأُهْبِطَا إِلَى الْأَرْضِ، وَمُثِّلَتْ لَهُمَا الزُّهَرَةُ امْرَأَةً مِنْ أَحْسَنِ الْبَشَرِ، فَجَاءَتْهُمَا، فَسَأَلَاهَا نَفْسَهَا، فَقَالَتْ: لَا وَاللهِ، حَتَّى تَكَلَّمَا بِهَذِهِ الْكَلِمَةِ مِنَ الْإِشْرَاكِ. فَقَالَا: وَاللهِ لَا نُشْرِكُ بِاللهِ أَبَدًا. فَذَهَبَتْ عَنْهُمَا ثُمَّ رَجَعَتْ بِصَبِيٍّ تَحْمِلُهُ، فَسَأَلَاهَا نَفْسَهَا، فَقَالَتْ: لَا وَاللهِ، حَتَّى تَقْتُلَا هَذَا الصَّبِيَّ، فَقَالَا: وَاللهِ لَا نَقْتُلُهُ أَبَدًا. فَذَهَبَتْ ثُمَّ رَجَعَتْ بِقَدَحِ خَمْرٍ تَحْمِلُهُ ، فَسَأَلَاهَا نَفْسَهَا، فَقَالَتْ: لَا وَاللهِ، حَتَّى تَشْرَبَا هَذَا الْخَمْرَ. فَشَرِبَا، فَسَكِرَا فَوَقَعَا عَلَيْهَا، وَقَتَلَا الصَّبِيَّ
-“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় তিনি নবী করিম (ﷺ) কে বলতে শুনেছেন: যখন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে আল্লাহ পাক জমীনে নিক্ষেপ করলেন, তখন ফেরেস্তারা বলতে লাগল: “আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে প্রেরণ করবেন যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা আপনার তাসবীহ, গুণকীর্তন করছি ও পবিত্রতা ঘোষনা করছি..।” ফেরেস্তারা বলল, ওগো আমাদের রব! আমরাই আপনার জন্য আদম সন্তানদের চেয়ে অধিক উত্তম। আল্লাহ তা’লা ফেরেস্তাদেরকে বললেন, তোমাদের ফেরেস্তাদের মধ্য থেকে দুইজন জমীনে প্রেরণ কর, ফলে আমি দেখি তারা দু’জন কি করে। ফেরেস্তারা বলল, হে রব! হারুত ও মারুতকে পাঠান। এমনকি তাদেরকে জমীনে পাঠানো হল। তাদের কাছে জোহরা নামক একজন অতি সুন্দরী মহিলা লেলিয়ে দেওয়া হল। অতঃপর তারা দুইজন (ঐ মহিলাকে পাবার আশায়) ঐ মহিলার কাছে গেল ও তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। মহিলাটি অস্বীকৃতি দিল এবং বলল, আল্লাহর কসম! ততক্ষন পর্যন্ত আমাকে পাবেনা যতক্ষন না তোমরা কোন শিরিকের বাক্য পাঠ না করবে। ফেরেস্তারা বলল, আল্লাহর কসম! আমরা কখনই আল্লাহর সাথে শিরিক করবো না। ফলে সে তাদের কাছ থেকে চলে গেল। অতঃপর একটি বাচ্চা বহন করে ঐ সুন্দরী মহিলাটি আসল। ফেরেস্তা দুইজন পূর্বের মতই ঐ মহিলার ব্যাপারে জানতে চাইল। সে বলল, আল্লাহর কসম! ততক্ষন পর্যন্ত পাবেনা, যতক্ষন না তোমরা এই বাচ্চাটিকে হত্যা না করবে। তারা বলল, আল্লাহর কসম! আমরা কখনই তাকে হত্যা করতে পারব না। ফলে সে চলে গেল। অতঃপর সেই মহিলা মদ বহন করে পুনরায় আসল। ফেরেস্তা দুইজন পূর্বের মতই তাদের পাবার জন্য তার অবস্থা জানতে চাইল। মহিলাটি বলল, আল্লাহর কসম! ততক্ষন পর্যন্ত পাবেনা, যতক্ষন না তোমরা এই মদ পান করছ। ফলে তারা মদ পান করল ও মহিলাটির সাথে মিলিত হল এবং শিশুটিকে হত্যা করল।” ( মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৬১৭৮; ইমাম বায়হাক্বী: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ১৯৬৭৭; মুসনাদে আব্দ ইবনে হুমাইদ, হাদিস নং ৭৮৫; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ১৬০ ও ১৬১; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস নং ৫৯৯৬; ছহীহ্ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৬১৮৬; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৪২৭০; ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ৮১৭৫ ও ১০৮৩২;)
ইমাম নুরুদ্দিন হায়ছামী (رحمة الله عليه) এই সনদ প্রসঙ্গে বলেন,
رَوَاهُ أَحْمَدُ، وَالْبَزَّارُ وَرِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيحِ، خَلَا مُوسَى بْنِ جُبَيْرٍ، وَهُوَ ثِقَةٌ.
-“ইমাম আহমদ ও ইমাম বাজ্জার এই হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইহার সকল বর্ণনাকারী ছহীহ্ গ্রন্থের বর্ণনাকারী শুধু ‘মূসা ইবনে যুবায়ের’ ব্যতীত আর সে বিশ^স্ত রাবী।” ( ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ৮১৭৫ ও ১০৮৩২;)
ইমাম হায়ছামী (رحمة الله عليه) ‘মূসা ইবনে যুবাইর’ সম্পর্কে বিশ^স্ত হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট করেই বলেছেন। এমনকি ইমাম যাহাবী (رحمة الله عليه) তাকে ثقةবিশ^স্ত বলেছেন। ( ইমাম যাহাবী: আল কাশেফ, রাবী নং ৫৬৮৭;)
ذكره ابنُ حِبَّان فِي كتاب الثقات -“ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله عليه) তাকে বিশ^স্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।” ( ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৬২৪৬;) হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) তার ব্যাপারে বলেন: فَهُوَ مَسْتُورُ الْحَالِ -“তার অবস্থা নিষ্কলুষ বা নিরপরাধ।” ( তাফছিরে ইবনে কাছির, ১ম খন্ড, ৩৫৪ পৃ: সূরা বাকারা ১০৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়;) হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) ‘মুসা ইবনে যুবাইর’ এর হাদিসকে حسن ‘হাছান’ বলেছেন। ( হাফিজ ইবনে কাছির: জামেউল মাসানিদ ওয়াস সুনান, হাদিস নং ৫৫৯০;)
স্বয়ং নাছিরুদ্দিন আলবানী সুনানে আবী দাউদের ৪৩০৯ নং হাদিসের তাহকিকে ‘মূসা ইবনে যুবাইর’ এর বর্ণিত হাদিসকে حسن হাছান বলেছেন।
ফেরেস্তাদের পানাহার, দৌহিক মিলন ও মানুষ হত্যার বিষয়ে অনুরূপ আরেকটি মাওকুফ হাদিস রয়েছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকে ছহীহ্ সুত্রে বর্ণিত আছে। নিচে মাওকুফ হাদিসটির সনদটি উল্লেখ করা হল:-
حَدَّثَنَا أَبِي ثنا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ جَعْفَرٍ الرَّقِّيُّ ثنا عُبَيْدُ اللَّهِ يَعْنِي ابْنَ عُمَرَ عَنْ زَيْدِ بْنِ أَبِي أُنَيْسَةَ عَنِ الْمِنْهَالِ بْنِ عَمْرٍو وَيُونُسَ بْنِ خَبَّابٍ عَنْ مُجَاهِدٍ ، قَالَ: كُنْتُ نَازِلًا عَلَى عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ فِي سَفَرٍ، فَلَمَّا كَانَ ذَاتَ لَيْلَةٍ قَالَ لِغُلَامِهِ:...
-“ইবনে আবী হাতেম তার পিতা হতে- তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর রক্কায়ী থেকে- তিনি উবাইদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে- তিনি জায়েদ ইবনে আবী উনিছা থেকে- তিনি মিনহাল ইবনে আমর ও ইউনূছ ইবনে খাব্বাব থেকে- তিনি মুজাহিদ থেকে- তিনি বলেন আমরা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) এর সাথে সফরে গেলাম। যখন রাত আসল তিনি গোলামদেরকেত বললেন:...।” ( তাফছিরে ইবনে আবী হাতেম, হাদিস নং ১০০৭; তাফছিরে ইবনে কাছির, ১ম খন্ড, ৩৫৭ পৃ:;)
এই সনদ সম্পর্কে হাফিজ ইবনে কাছির (رحمة الله عليه) বলেন,
وَهَذَا إِسْنَادٌ جَيِّدٌ إِلَى عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ. -“আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) পর্যন্ত এই সনদ অতি-উত্তম।” (তাফছিরে ইবনে কাছির, ১ম খন্ড, ৩৫৮ পৃ:;)
স্বয়ং নাছিরুদ্দিন আলবানী এই হাদিসের সনদকে ছহীহ্ বলেছেন। যেমন লক্ষ্য করুর:-قلت: والموقوف صحيح -“আমি (আলবানী) বলি: মাওকুফটি ছহীহ্।” (আলবানী: ছিলছিলায়ে আহাদিসুদ দ্বায়িফা, ১৭০ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;)
উল্লেখিত হাদিস গুলো দ্বারা প্রমাণিত হয়, নূরের তৈরী হওয়ার পরেও পৃথিবীতে পানাহার করা, মহিলাদের সাথে মিলিত হওয়া ও মানুষ হত্যা করার মত কাজ অসম্ভব নয়। অতএব, প্রমাণিত হল নূরের তৈরী হলেই মানুষের সূরতে আসতে পারেনা, পানাহার করতে পারেনা, রক্তপাত হতে পারেনা এরূপ কথা ভিত্তিহীন। যেহেতু পবিত্র কোরআন ও ছহীহ্ হাদিস দ্বারা ইহা প্রমাণ হয়ে গেছে। সর্বোপরি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে بَشَرٌ (বাশার) বা মানুষ বলা হয়েছে। আর তিনিতো বেমেছেল সর্বোত্তম মানুষ। অর্থাৎ মানবীয় সকল গুনাবলী প্রিয় নবীজি (ﷺ) কে দান করা হয়েছে। আর ইহা আল্লাহ তা’লার ক্ষমতার ভিতরেই রয়েছে, তাই নয় কি?
❏ প্রিয় নবীজি (ﷺ) বাশার আর বাশার কি মাটির তৈরী?
পবিত্র কোরআনে আছে: أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ -“আমি তোমাদের মত মানুষ।” (সূরা কাহাফ: ১১০ নং আয়াত)। সুতরাং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) بَشَرٌ তথা মানুষ, আর মানুষ মাত্রই মাটি দ্বারা তৈরী হয়, নূর দ্বারা নয়।
উত্তরঃ মানুষ মাত্রই মাটি দ্বারা তৈরী নয়, বরং মানুষ মাত্রই ‘নুতফা’ বা শুক্রবিন্দু দ্বারা তৈরী। যেমন আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন:
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً -“তিনি বাশার তথা মানুষকে পানি (শুক্রবিন্দু) হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
অপরদিকে بَشَرٌ (বাশার) মানে মানুষ, তবে বাশার দ্বারা মাটির মানুষ প্রমাণিত হয়না। কারণ পবিত্র কোরআনে হযরত জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কেও بَشَرٌ (বাশার) বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন:
فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا -“জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) তাঁর কাছে পূর্ণ মানুষরূপে প্রকাশিত হল।” (সূরা মরিয়ম: ১৭ নং আয়াত)।
এই আয়াতে হযরত জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে স্পষ্ট بَشَرٌ (বাশার) বলা হয়েছে। তাহলে কি বলবেন জিব্রাইল মাটির তৈরী? সুতরাং بَشَرٌ (বাশার) মানেই মাটির তৈরী নয় বরং বাশার হচ্ছে বাহ্যিক সূরতে মানুষ। যেমন بَشَرٌ (বাশার) এর অর্থ বলতে গিয়ে আল্লামা রাগেব ইস্পাহানী (رحمة الله عليه) তাঁর ‘মুফরাদাতে ফি গরীবিল কোরআন’ কিতাবে বলেন: (الْبَشَرَةُ) ظَاهِرُ الْجِلْدِ -“বাশার হল বাহ্যিক সূরতকে বুঝায়।” (মুফরাদাতে ফি গরীবিল কোরআন, ৫৩ পৃ:;)
বিভিন্ন ছহীহ হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) নিজেই বলেছেন তিনি পৃথিবীর কোন মানুষের মত না। অর্থাৎ তিনি সূরতে মানুষ হলেও অন্য কোন মানুষের তুলনা তাঁর সাথে চলবেনা। আর এ বিষয়টি রাসূলে পাক (ﷺ) থেকে ‘তাওয়াতুর’ পর্যায়ের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত আছে। যেমন নিচের হাদিসটি লক্ষ্য করুন,
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ يُوسُفَ، أَخْبَرَنَا مَالِكٌ، عَنْ نَافِعٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاصَلَ فِي رَمَضَانَ فَوَاصَلَ النَّاسُ، فَنَهَاهُمْ، فَقِيلَ لَهُ: إِنَّكَ تُوَاصِلُ قَالَ: إِنِّي لَسْتُ مِثْلَكُمْ إِنِّي أُطْعَمُ وَأُسْقَى
-“হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) রমজানে ‘ছাওমে বিছাল’ পালন করতেন। লোকেরাও এরূপ রোজা রাখলেন। অতঃপর রাসূল (ﷺ) তাঁদেরকে এরূপ রোজা রাখতে নিষেধ করেন। সাহাবীরা বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিত এরূপ রোজা রাখেন। নবী পাক (ﷺ) বললেন: আমি তোমাদের কারো মত নই।” ( ছহীহ্ বুখারী, হাদিস নং ১৯৬২; ছহীহ্ মুসলীম, হাদিস নং ৫৬; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৫৭৯৫ ও ৬২৯৯; নাসাঈ: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ৩২৫০; মুস্তাখরাজে আবী আওয়ানা, হাদিস নং ২৭৯৮; ইমাম তাহাবী: শরহে মুশকীলুল আছার, হাদিস নং ৫৮৯৮; ইমাম বায়হাক্বী: মারেফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হাদিস নং ৮৯৪৭; ইমাম বায়হাক্বী: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ৮৩৭৪; মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদিস নং ৯৫৮৭;)
সুতরাং বিষয়টি ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদিস প্রমাণিত, পূর্বেও ১০জন সাহাবী থেকে বিষয়টি প্রমাণ করেছি। তাই রাসূল (ﷺ) মানুষ তবে পৃথিবীর কোন মানুষের মত না। বরং রাসূল (ﷺ) কে অন্য মানুষের সাথে তুলনা দেওয়া ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদিস এনকার বা তিরস্কার করার কারণে সে ব্যক্তি কাফের হিসেবে গন্য হবে। উল্লেখ্য যে, ‘তাওয়াতুর’ পর্যায়ের হাদিস দিয়ে পবিত্র কোরআনের হুকুমকে মানছুখ বা রহিত করার বিধান রয়েছে। তাই রাসূলে পাক (ﷺ) কে দুনিয়ার কোন মানুষের সাথে তুলনা দেওয়ার রাস্তা নেই।
হাদিস শরীফে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: لست مثلكم -“আমি তোমাদের কারো মত নই।” (বুখারী, মুসলীম)। অনেক সময় বলেছেন: لست كهيئتكم -“আমি তোমাদের মত নই।” (আবু দাউদ, তিরমিজি, ৬২-৬৩ পৃ:;) অনেক সময় চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন: أَيُّكُمْ مِثْلِي -“তোমরা কে আছ আমার মত? (ছহীহ্ বুখারী ও মুসলীম)। প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর সাহাবায়ে কেরাম বলতেন:
قَالُوا إنَّا لسْنَا كَهْيَئتِكَ يَا رسولَ اللَّهِ -“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কেহ আপনার মত নই।” (ছহীহ্ বুখারী, ৭ পৃ:)।
সুতরাং রাসূলে পাক (ﷺ) সূরতে আমাদের মত হলেও বাস্তবিক পক্ষে তথা হাকিকতে তিনি মূলত আমাদের কারো মত নন। সৃষ্টি জগতে তিনি বে-মেছাল ও বেনজীর বা তুলনাহীন। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) পৃথিবীতে মানুষের সূরতে এসেছেন এ জন্যেই তিনি بَشَرٌ (বাশার) বা মানুষ। মূলত রাসূল (ﷺ) এর মৌলিক ৩টি সূরত রয়েছে যথা: ১. সূরতে বাশারী, ২. সূরতে মালাকী, ৩. সূরতে হাক্বী। ( তাফছিরে রুহুল বয়ান, মেরকাত শরহে মেসকাত;)
এছাড়া ‘যুয উল মুফকুদ মিন মুছান্নাফে আব্দির রাজ্জাক’ এবং ‘আত তাশরীফাতে ফি খাছায়েছ ওয়াল মুজিজাত’ কিতাব এর ছহীহ্ হাদিস দ্বারা রাসূলে পাক (ﷺ) এর ময়ূরের সূরত ও তারকার সূরতের কথাও পাওয়া যায়। যেমন রাসূল (ﷺ) তারকার সূরতে থাকার হাদিসটি হচ্ছে,
عن أبي هريرة رضي الله تعالى عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم سأل جبريل عليه الصلاة والسلام فقال يا جبريل كم عمرت من السنين؟ فقال يا رسول الله لست أعلم، غير أن في الحجاب الرابع نجما يطلع في كل سبعين ألف سنة مرة، رأيته اثنين وسبعين ألف مرة فقال: يا جبريل وعزة ربي جل جلاله أنا ذلك الكوكب
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে জিব্রাইল আপনার বয়স কত? তিনি বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ইহা অবগত নই, তবে চতুর্থ হেজাব-এ একটি তারকার ৭০ হাজার বছর পর পর একবার উদিত হত, আমি তাঁকে ৭২ হাজার বার দেখেছি। নবী করিম (ﷺ) বললেন: হে জিব্রাইল! আমার রবের ইজ্জত ও জালালের কসম! আমিই ছিলাম সেই তারকা।” ( ‘আত তাশরিফাতে ফি খাছায়েছে ওয়াল মুজিজাত; সিরাতে হালভীয়া, ১ম খন্ড, ৪৭ পৃ: ইমাম বূখারীর সূত্রে; যাওয়াহিরুল বিহার, ৩য় খন্ড, ৩৩৯ পৃ:; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৭ম খন্ড, ৩য় খন্ড, ৬৫১ পৃ:; জিকরে হাসীন, ৩০ পৃ:;)
সুতরাং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আল্লাহর নূরে সৃষ্ট এবং জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সৃষ্টি হওয়ার বহু পূর্বে চতুর্থ হেজাবে তারকার সূরতে বিদ্যমান ছিলেন। আর তখন মাটির কোন অস্তিত্ব ছিলনা। তাই রাসূল (ﷺ) কে মাটির তৈরী বলা মূর্খতা ছাড়া কিছুই না। অপরদিকে আল্লাহর হাবীব (ﷺ) ময়ূরের সূরতে থাকার হাদিস খানা হচ্ছে,
عبد الرزاق عن معمر عن الزهري عن السائب بن يزيد قال: ان الله تعالى خلق شجرة ولها اربعة اغصان فسماها شجرة اليقين ثم خلق نور محمد صلى الله عليه وسلم فى حجاب من درة بيضاء مثله كمثل الطاووس ووضعه على تلك الشجرة....
-“হযরত সাইব ইবনে ইয়াজিদ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’লা একটি গাছ সৃষ্টি করলেন যার ৪টি শাখা বা ঢাল ছিল। অতঃপর নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) সৃষ্টি করে ঐ গাছের ঢালের মাঝে ময়ূরের সূরতে রাখলেন।......” (জুয উল মাফকুদ মিন মুছান্নাফে আব্দির রাজ্জাক, ৫১-৫২ পৃ:; দাকায়েকুল আখবার, কৃত: ইমাম গাজ্জালী র:;) সনদ ছহীহ্।
এই হাদিসটিও সনদের দিকে ছহীহ্। হযরত সাইব ইবনে ইয়াজিদ (رضي الله عنه) এর রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণ হয়ে যায়, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সৃষ্টি জগৎ সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে আল্লাহর দরবারে ময়ূরের সূরতে ছিলেন। তখন মাটি কিংবা মাটির এই পৃথিবীর কোন অস্তিত্বই ছিলনা। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে ‘আমাদের মত মানুষ বলা’ এই চরিত্রটা ছিল কাফেরদের, কোন সাহাবায়ে কেরামের নয়। কারণ পূর্বেও উল্লেখ করেছি, সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় নবীজি (ﷺ) সম্পর্কে বলতেন: قَالُوا إنَّا لسْنَا كَهْيَئتِكَ يَا رسولَ اللَّهِ -“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কেহ আপনার মত নই।” ( ছহীহ্ বূখারী, ৭ পৃ:, হাদিস নং ২০;)
অপরদিকে কাফের-মুশরীকরা আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে বলতেন:
قالُوا مَا أَنْتُمْ إِلاَّ بَشَرٌ مِثْلُنا-“তারা (কাফেররা) বলে: আপনিত আমাদের মত মানুষ ছাড়া কিছুই নন।” (সূরা ইয়াছিন: ১৫ নং আয়াত)।
আল্লামা রাগেব ইস্পাহানী (رحمة الله عليه) তদীয় ‘মুফরাদাতে’ বলেন:
ولما اراد الكفار الغص من الانبياء اعتبروا ذلك فقالوا: "ان هذا الا قول البشر"
-“যখন কাফেররা নবীদেরকে অপমানিত করার ইচ্ছা করতেন তখন তারা বলতেন: ‘ইহাত মানুষের কথা ছাড়া কিছুই নয়।” (সূরা মুদ্দাছির: ২৫) (মুফরাতে ফি গারিবিল কোরআন, ৫৩ পৃ:;)
তাই আল্লাহর নবী (ﷺ) কে আমাদের মত সাধারণ মানুষ ভাবা কাফেরদের চরিত্র। সাহাবায়ে কেরাম কেহই প্রিয় নবীজি (ﷺ) কে সাধারণ মানুষ ভাবতেন না। আল্লাহর নবী (ﷺ) ‘আমি তোমাদের মত মানুষ’ বলতেন নম্রতা প্রকাশের জন্য। এটা নবীজির মুখে শোভা পায়, আমাদের মুখে নয়। যেমন হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) বলেছিলেন: رَبَّنا ظَلَمْنا أَنْفُسَنا
-“আমাদের রব! আমরা জুলুম করেছি।” (সূরা আরাফ: ২৩ নং আয়াত)।
এটা আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর মুখে শোভা পায়, তাই বলে আমরা যদি বলি আল্লাহর নবী আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) জালিম ছিলেন তাহলে ঈমান থাকবেনা। হযরত ইউনূছ (্আঃ) বলেছিলেন: إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ -“নিশ্চয় আমি জালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছি।” (সূরা আম্বিয়া: ৮৭ নং আয়াত)।
এই কথা হযরত ইউনূছ (عَلَيْهَا السَّلَامُ) এর মুখে শোভা পায়, আর আমরা যদি ইউনূছ (عَلَيْهَا السَّلَامُ) কে জালিম বললে ঈমান থাকবেনা। যেমন অনেক সময় একজন বড় আলিম স্টেইজে বসে বলে থাকেন ‘আমি সবচেয়ে বড় গোনাহ্গার’ এই কথা ঐ আলিমের নম্রতা প্রকাশের জন্যই বলেছেন। তাই বলে অন্য সবাই এই বলা উচিৎ হবেনা। ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) নম্রতা প্রকাশের জন্যই এরূপ কথা বলেছেন। তাই বলে অন্যদের মুখে এরূপ কথা শোভা পাবেনা। আমরা যেন রাসূল (ﷺ) কে আমাদের মত না মনে করি সে জন্যেই তিনি বলেছেন: إِنِّي لَسْتُ مِثْلَكُمْ
-“আমি তোমাদের কারো মত নই।” (বুখারী, মুসলীম)।
❏ নবীজি নূর হলে ঐ নূরের আলোতে সব কিছু জ্বলে গেলনা কেন?
নূর মানে আলো আর নূরের কাছে গেলেত জ্বলে যেতে হবে। কারণ হযরত মূসা (عَلَيْهَا السَّلَامُ) সামান্য নূরের জ্বলক দেখেই বেহুশ হয়ে যান। তাহলে আল্লাহর নবী (ﷺ) নূরের তৈরী হলে সাহাবায়ে কেরাম জ্বলে গেলেন না কেন?
উত্তরঃ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন:
هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِياءً وَالْقَمَرَ نُوراً -“তিনি সূর্যকে ঔজ্জল্য রূপে এবং চন্দ্রকে নূর রূপে নির্ধারণ করেছেন।” (সূরা ইউনুছ: ৫ নং আয়াত)।
এখানে চন্দ্রকে নূর বলা হয়েছে অথচ চাঁদে মানুষ গেল তারা কেউ জ্বলে গেলনা কেন? তাহলে বুঝা গেল সকল নূরেই মানুষ জ্বলেনা। নূরের তৈরী ফেরেস্থা জিব্রাইল (عَلَيْهَا السَّلَامُ) বহুবার আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরামের কাছে দাহিয়াতুল ক্বাল্বী নামক সাহাবীর সূরতে কিংবা দরবেশের সূরতে এসেছেন, অথচ কেউ জ্বলে যাইনি। হারুত ও মারুত নামক দুইজন নূরের ফেরেস্থা পৃথিবীতে এসেছেন এবং বসবাস করেছেন। অথচ কেউ তাদের নূরে জ্বলে যাইনি। আল্লাহ পাক প্রিয় নবীজি (ﷺ) কে বাশারিয়্যাত এর গুণে গুনান্বিত করে তথা মানবীয় সূরতে প্রেরণ করেছেন। তাই মানুষ সরাসরি সেই নূরের ঝলক দেখতেন না। তবে অনেক সময় ইহার সামান্য নূর প্রকাশিত হত। যেমন:-
حدثنا عبد العزيز بن ثابت الزّهريّ. حدثني إسماعيل بن إبراهيم ابن أخي موسى بن عقبة عن موسى بن عقبة عن كريب عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُمَا قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفْلَجَ الثَّنِيَّتَيْنِ إِذَا تَكَلَّمَ رُؤِيَ كَالنُّورِ يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ ثَنَايَاهُ
-“হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, যখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কথা বলতেন তখন তাঁর সামনের দুই দাঁতের ফাক দিয়ে নূর বের হয়ে যেত।” (সুনানে দারেমী, ১ম খন্ড, ৫৮ পৃ:; ইমাম তিরমিজি: শামায়েলে মুহাম্মাদীয়া, হাদিস নং ১৪ পৃষ্টা নং ১৭; ইমাম বায়হাক্বী: দালায়েলুন্নবুয়াত, ১ম খন্ড, ২১৫ পৃ:; ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, ৮ম খন্ড, ৪৯৭ পৃ:; ইমাম তাবারানী: মুজামুল কবীর ও আওছাতে; ইমাম ছিয়তী: খাছাইছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ১০৬ পৃ:;)
দেখুন নবী করিম (ﷺ) এর দাঁত মোবারকের ফাক দিয়ে নূর বের হত। বলুন কোন মাটির ভিতর থেকে কি নূর বের হয়? এতেই প্রমাণিত হয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আল্লাহর নূরের সৃষ্টি তথা নূরানী বাশার বা নূরের মানুষ।
❏ নবীজির পিতা মাতা মাটির তৈরী হলে নবীজি নূরের তৈরী হবে কিভাবে?
নবী পাক (ﷺ) এর পিতা-মাতা উভয়ই মাটির তৈরী মানুষ। তাহলে মাটির তৈরী মানুষের ভিতর থেকে নূরের মানুষ আসে কিভাবে?
উত্তরঃ পূর্বেও বলেছি হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ) ছাড়া কোন মানুষ সরাসরি মাটির মানুষ নয়। যেমন আল্লাহ তা’লা বলেন:
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً -“তিনি বাশার তথা মানুষকে পানি (শুক্রবিন্দু) হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)
সরাসরি মাটির তৈরী হলে একমাত্র হযরত আদম (عَلَيْهَا السَّلَامُ), আর বাকী সকল মানুষ হল নুত্ফার তৈরী। আমাদের বক্তব্য হল, যে আল্লাহ সরাসরি মাটির তৈরী আদমের ভিতর থেকে নূতফার তৈরী মানুষ বানাতে পারেন, সে আল্লাহ নূতফার তৈরী মানুষের ভিতর থেকে নূরের মানুষও বের করতে পারেন। إِنَّ اللَّهَ عَلى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ -“নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্ব শক্তিমান।”
সর্বোপরি নবী পাক (ﷺ) জন্ম হওয়ার সময় মা আমেনা (رضي الله عنه) তাঁর গর্ভ থেকে নূর বের হতেই দেখেছেন, মাটি নয়। যেমন ছহীহ্ রেওয়ায়েতে আছে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: وَرَأَتِ أُمِّي أَنَّهُ خَرَجَ مِنْهَا نُورٌ
-“তিনি চর্মচক্ষু দ্বারা দেখলে তাঁর ভিতর থেকে নূর বের হচ্ছে।” ( মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪র্থ খন্ড, ১৫৬৫ পৃ:; মুসনাদে আহমদ, ১৬তম খন্ড, ২৫১ পৃ:; ইমাম বায়হাক্বী: দালাইলুন নবুয়াত, ১ম খন্ড, ৮৫ পৃ:; মেসকাত শরীফ, ৫১৩ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ১০ খন্ড, ৪১২ পৃ:; তাফছিরে ইবনে কাছির, ৪র্থ খন্ড, ৪২৮ পৃ:; কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ২য় জি: ২২০ পৃ:; খাছাইছুল কোবরা; মাদারেজুন নবুয়াত; ইমাম হায়ছামী: মজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, ৮ম খন্ড, ২২২ পৃ:;)
এমনকি রাসূলে পাক (ﷺ) গর্ভে থাকা কালীন অবস্থাও মা আমেনা (رضي الله عنه) স্বপ্নে দেখেছেন নূর, মাটি নয়। যেমন অপর হাদিসে আছে,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ان امي رَأَتْ فِي منامها أَن الَّذِي فِي بَطنهَا نور
-“আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: নিশ্চয় আমার মা আমেনা (رضي الله عنه) সপ্নে দেখেছেন তাঁর গর্ভে নূর রয়েছে।” ( আশ-শারিয়াতি লিল-আজরী, হাদিস নং ৯৬২; শরফুল মুস্তফা, ১ম খন্ড, ৪৪৭ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: খাছাইছুল কুবরা, ১ম খন্ড, ৯৬ পৃ:; ইমাম কাস্তালানী: মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, ৭৪ পৃ:; শরহে যুরকানী, ১ম খন্ড, ২০২ পৃ:; দুররুল মোনাজ্জাম;)
তাই প্রমাণিত হল, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) মা আমেনার গর্ভে থাকাকলীন অবস্থায়ও নূর ছিলেন এবং দুনিয়াতে আসার সময়ও নূরের নবী আসতে দেখা গেছে। তাই রাসূল (ﷺ) কে নূর অস্বীকার করার কোন রাস্তা নেই। নবী পাক (ﷺ) এর মা প্রিয় নবীজিকে নূর হিসেবে দেখেছেন ও নূর মেনেছেন, সেখানে আপনার মানতে এত কষ্ট হয় কেন? স্বয়ং আল্লাহর নবী (ﷺ) নিজেই বলছেন, তিনি মা আমেনার গর্ভ থেকে বের হওয়ার সময় নূর হয়ে বের হয়েছেন, সেখানে রাসূল (ﷺ) কে নূর বলতে আপনার এত কষ্ট কেন? রাসূল (ﷺ) যদি মাটি হতেন তাহলে জন্মের সময় নূর বের হতে দেখা গেল কেন? আল্লাহ পাক প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর শান-মান বুঝার তৌফিক দান করুক, আমিন।
------------------------------------------
❏ প্রমাণপঞ্জী
১. আল কুরআনুল হাকীম;
হাদিস
২. ইমাম বুখারী ঃ আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী (১৯৪হি-২৫৬হি.) : আস্-সহীহ্, দারু ত্বরিকি নাজাহ, প্রকাশ.১৪২২ হি.।
৩. ইমাম মুসলীম: আবুল হাছান মুসলীম ইবনে হাজ্জায নিছাপুরী, ওফাত ২৬১ হিজরী, আস সহীহ্, দারু এহইয়ায়ে তুরাশ আরাবী, বয়রুত লেবানন।
৪. ইমাম আবু দাউদ: আবু দাউদ সুলাইমান ইবনে আশয়াশ সিজিস্থানী, ওফাত ২৭৫ হিজরী, আস সুনান, মাকতাবাতু আছরিয়্যা, বয়রুত, লোবানন।
৫. ইমাম তিরমিজি: মুহাম্মদ ইবনে ঈসা তিরমিজি, ওফাত ২৭৯ হিজরী, জামেউল কবীর, দারুল গুরুবিল ইসলামী, বয়রুত, লোবানন, প্রকাশ কাল: ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ।
৬. ইমাম নাসাঈ: আবু আব্দির রহমান আহমদ ইবনে শুয়াইব আন নাসাঈ, মুজতাবী মিনাস সুনান/ সুনানু সুগরা, মাকতাবাতুল মাতবুয়াতিল ইসলামীয়্যা, খলব, প্রকাশ কাল ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ।
৭. ইমাম নাসাঈ: আবু আব্দির রহমান আহমদ ইবনে শুয়াইব আন নাসাঈ, ওফাত ৩০৩ হি. সুনানুল কুবরা, মুওয়াস্সাসাতু রিসালা, বয়রুত, লোবানন।
৮. ইমাম ইবনে মাজাহ: আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ কাযবিনী, সুনানু ইবনে মাজাহ, দারু এহইয়ায়ে কুতুবিল আরাবিয়্যা।
৯. মুসনাদ: আলী ইবনে জা’দ ইবনে উবাইদ বাগদাদী, ওফাত ২৩০ হি. মুওয়াস্সাসাতু নাদির, বয়রুত, লেবানন।
১০. আস সুন্নাহ: আবু বকর ইবনে আছেম শায়বানী, ওফাত ২৮৭ হি. মাকতাবুল ইসলামী, বয়রুত, লেবানন।
১১. ইমাম বায্যার: আবু বকর আহমদ ইবনে ওমর ইবনে আব্দিল খালেক বসরী (২১০-২৯২ হি. / ৮২৫-৯০৫ ইং) : আল মুসনাদ, মাকতাবাতুল উলুমিল ওয়াল হিকাম, মদিনা, সৌদি আরব।
১২. ইমাম বাগভী: আবু মুহাম্মদ হোসাইন ইবনে মাসউদ ইবনে মুহাম্মদ (৪৩৬-৫১৬ হি. / ১০৪৪-১১২২ ইং) : শরহে সুন্নাহ, বয়রুত, লেবানন, মাকতাবুল ইসললামী।
১৩. ইমাম বায়হাকী: আবু বকর আহমদ ইবনে হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মূসা (৩৮৪-৪৫৮ হি. / ৯৯৪-১০৬৬ ইং) : দালায়িলুন নবুয়ত, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ১৪০৫ হি. / ১৯৮৫ ইং।
১৪. ইমাম বায়হাকী: আবু বকর আহমাদ ইবনে হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মূসা (৩৮৪-৪৫৮ হি. / ৯৯৪-১০৬৬ ইং) : আস-সুনানুল কুবরা, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ১৪১৪ হি. / ১৯৯৪ ইং।
১৫. ইমাম বায়হাকী: আবু বকর আহমাদ ইবনে হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মূসা (৩৮৪-৪৫৮ হি. / ৯৯৪-১০৬৬ ইং) : আল-মা‘রিফাতুল সুনানি ওয়াল আছার, দারুল অফা, মানছুরা, কাহেরা, মিশর।
১৬. ইমাম বায়হাকী: আবু বকর আহমাদ ইবনে হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মূসা (৩৮৪-৪৫৮ হি. / ৯৯৪-১০৬৬ ইং): আল এতেক্বাদ, দারুল আফাকীল জাদিদাহ, বয়রুত, লেবানন।
১৭. ইমাম বায়হাকী: আবু বকর আহমাদ ইবনে হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মূসা (৩৮৪-৪৫৮ হি. / ৯৯৪-১০৬৬ ইং): আসমাউস সিফাত, মাকতাবাতু সাওয়াদি, জিদ্দা।
১৮. ইমাম হাকিম: আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ (৩২১-৪০৫ হি. ৯৩৩-১০১৪ ইং) : আল-মুস্তাদরাক আলাস সহিহাইন, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, ১৪১১ হি. ১৯৯০ ইং।
১৯. ইমাম ইবনে হিব্বান: আবু হাতেম মুহাম্মদ ইবনে হিব্বান ইবনে আহমাদ ইবনে হিব্বান (২৭০-৩৫৪ হি. ৮৮৪-৯৬৫ ইং), আস সহীহ্, মুয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, বয়রুত, লোবানন।
২০. ইমাম ইবনে খুযায়মা: আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (২২৩-৩১১ হি. / ৮৩৮-৯২৪ ইং) আস-সহিহ, বয়রুত, লেবানন, আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৩৯০ হি. / ১৯৭০ ইং।
২১. ইমাম ইবনে খুযায়মা: আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, ওফাত ৩১১ হি. আত তাওহীদ, মাকতাবাতুর রাশাদ, রিয়াদ।
২২. আস সুন্নাহ: আবু বকর আমহদ ইবনে মুহাম্মদ খাল্লাল বাগদাদী, ওফাত ৩১১ হি. দারুল রাইয়াহ, রিয়াদ।
২৩. আশ শারিয়াত: আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে হুছাইন বাগদাদী, ওফাত ৩৬০ হি. দারুল ওয়াতান, রিয়াদ।
২৪. আজমাত: আবু মুহাম্মদ আব্দিল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জাফর ইস্পাহানী, ওফাত ৩৬৯ হি. দারুল আছিমাহ, রিয়াদ।
২৫. খাওয়ারযামী: আবদুল মু’আয়্যিদ মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদ (৫৯৩-৬৬৫ হি.) : জা’মিউল মাসানিদ লি ইমাম আবী হানিফা, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া।
২৬. দারা কুতনী: আবুল হাসান আলী ইবনে ওমর ইবনে আহমদ ইবনে মাহাদী মাসউদ ইবনে নু’মান (৩০৬-৩৮৫ হি. / ৯১৮-৯৯৫ ইং) : আস সুনান, বয়রুত, লেবানন, মুওয়াস্সাসাতুর রিছালাহ, ১৩৮৬ হি. / ১৯৬৬ ইং।
২৭. দারেমী: আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান (১৮১-২৫৫ হি. / ৭৯৭-৮৬৯ ইং) : আস-সুনান, দারু মুগনী লিন নাশর ওয়াত তাওজি’, সৌদি আরব ১৪০৭ হি.।
২৮. দায়লামী: আবু সূজা শেরওয়াই ইবনে শহরদার ইবনে শেরওয়াই হামদানী (৪৪৫-৫০৯ হি. / ১০৫৩-১১১৫ ইং) : আল ফিরদাউস বি মা’সুরিল খিতাব, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ১৯৮৬ ইং।
২৯. ইবনে সা’দ: আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ (১৬৮-২৩০ / হি. ৭৮৪-৮৪৫ ইং) : আত্ব ত্বাবক্বাতুল কুবরা, মাকতাবাতু উলুমি ওয়াল হিকাম, মদিনা, সৌদি আরব।
৩০. ইবনে আবী শায়বা: আবু বকর আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম ইবনে উসমান কুফী (১৫৯-২৩৫ হি. / ৭৭৬-৮৪৯ ইং) : আল-মুসান্নাফ, রিয়াদ, সৌদি আরব, মাকতাবাতুর রাশাদ, প্রকাশ. ১৪০৯ হি.।
৩১. তাবরানী: আবুল কাসেম সুলাইমান ইবনে আহমদ ইবনে আইয়ুব (২৬০-৩৬০ হি. / ৮৭৩-৯৭১ ইং): আল-মু’জামুল আওসাত, দারুল হারামাইন, কাহেরা, মিশর।
৩২. তাবরানী: আবুল কাসেম সুলাইমান ইবনে আহমদ ইবনে আইয়ুব (২৬০-৩৬০ হি. / ৮৭৩-৯৭১ ইং): মাকতাবাতু ইবনে তাইমিয়্যা, কাহেরা, মিশর।
৩৩. তাবারী: আবু জা’ফর মুহাম্মদ ইবনে যারীর ইবনে ইয়াযীদ (২২৪-৩১০ হি./৮৩৯-৯২৩ ইং): জা’মিউল বয়ান ফী তাফসীরিল কুরআন, বয়রুত, লেবানন, দারু হিজরী লিত তাবায়াহ।
৩৪. তাহাবী : আবু জাফর আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সালামাহ ইবনে সালমা ইবনে আবদুল মালিক ইবনে সালমা (২২৯-৩২১ হি. / ৮৫৩-৯৩৩ ইং) শরহু মা’আনিল আসার, আলামুল কুতুব।
৩৫. তায়ালসী: আবু দাউদ সুলায়মান ইবনে দাউদ জারুদ (১৩৩-২০৪ হি / ৭৫১-৮১৯ ইং), আল মুসনাদ, দারু হিজর, কাহেরা, মিশর।
৩৬. ইবনে আবদুল বার: আবু ওমর ইউসূফ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ (৩৬৮-৪৬৩ হি. / ৯৭৯-১০৭১ ইং) : আল ইসতিয়াবু ফী মা’আরিফাতিল আসহাব, বয়রুত, লেবানন, দারুল জাবাল।
৩৭. ইবনে আবদুল বার: আবু ওমর ইউসূফ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ (৩৬৮-৪৬৩ হি. / ৯৭৯-১০৭১ ইং) : জামি’উল বয়ানিল ইলমি ওয়া ফাদ্বলি, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ১৩৯৮ হি. / ১৯৭৮ ইং।
৩৮. ‘আবদুর রায্যাক: আবু বকর ইবনে হুম্মাম ইবনে নাফে’ সানআনী (১২৬-২১১ হি. / ৭৪৪-৮২৬ ইং) : আল-মুসান্নাফ, বয়রুত, লেবানন, আল মাকতুবাতুল ইসলামী, ১৪০৩ হি.।
৩৯. ইমাম মালেক: ইবনে আনাস ইবনে মালেক ইবনে আবী ‘আমর ইবনে হারেছ আসবাহী (৯৩-১৭৯ হি. / ৭১২-৭৯৫ ইং) : আল মুআত্তা, বয়রুত, লেবানন, দারুল ইহইয়াউত আত তুরাসুল আরবিয়্যাহ, ১৪০৬ হি. / ১৯৮৫ খ্রি:।
৪০. ইমাম মুনযেরী: আবু মুহাম্মদ আবদুল আযীম ইবনে আবদুল কাভী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সালামাহ ইবনে সা’দ (৫৮১-৬৫২ হি. / ১১৮৫-১২৫৮ ইং) আত তারগীব ওয়াত তারহীব মিনাল হাদীসিশ শরীফ, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ১৪০৭ হি.।
৪১. ইমাম আবু নাঈম: আহমাদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে ইসহাক ইবনে মূসা ইবনে মেহরান ইসবাহানী (৩৩৬-৪৩০ হি. / ৯৪৮-১০৩৮ ইং): হিলয়াতুল আওলিয়া ওয়া তাবকাতুল আসফিয়া, বয়রুত, লেবানন, দারুল কিতাবিল আরাবী, ১৪০০ হি. / ১৯৮০ ইং;
৪২. ইমাম হিন্দি: হুসামুদ্দীন, আলা উদ্দিন আলী মুত্তাকী (৯৭৫ হি.) : কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আকওয়ালি ওয়াল আফ’আল, বয়রুত, লেবানন, মুআস্সাসাতুর রিসালা, ১৩৯৯ হি. / ১৯৭৯ ইং।
৪৩. ইমাম হাইসামী : আবুল হাসান নূরুদ্দিন আলী ইবনে আবু বকর ইবনে সুলাইমান (৭৩৫-৮০৭ হি. / ১৩৩৫-১৪০৫ ইং) : মাজমাউজ যাওয়ায়িদ ওয়া মানবা’উল ফাওয়ায়িদ, কায়রো, মিসর, দারুর রায়আন লিত তুরাছ + বয়রুত, লেবানন, দারুল কিতাবিল আরবী, ১৪০৭ হি. / ১৯৮৭ ইং।
৪৪. ইমাম আবু ই‘য়ালা : আহমাদ ইবনে আলী ইবনে মুসান্ন ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে ঈসা ইবনে হেলাল মুসিলী, তামিমী (২১০-৩০৭ হি. / ৮২৫-৯১৯ ইং) আল-মুসনাদ, দামিশক, সিরিয়া, দারুল মামুন লিত্ তুরাস, ১৪০৪ হি. / ১৯৮৪ ইং।
৪৫. ইমাম আবু ইউসূফ : ইয়াকুব ইবনে ইবরাহীম ইবনে আনসারী (১৮২ হি.): কিতাবুল আসার, সানগালা হাল, শেখপুরা, পাকিস্তান, আল মাকতাবুল আসারিয়া / বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ।
৪৬. ইমাম শাফেয়ী : আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রীস ইবনে আব্বাস ইবনে ওসমান ইবনে শাফেয়ী কারশী (১৫০-২০৪ হি. / ৭৬৭-৮১৯ ইং) : আল-মুসনাদ, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ।
৪৭. ইমাম মুহাম্মদ ঃ ইমাম মুহাম্মদ হাসান শায়বানী ঃ কিতাবুল আসার ঃ দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
৪৮. হাদিসু সিরাজ: আবুল আববাস মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ব খুরাশানী, ওফাত ৩১৩ হি. ফারুকুল হাদিসিয়্যা লিত তাবায়াতী ওয়ান নাশার।
৪৯. মুসনাদ: আবু আব্দিল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল, ওফাত ২৪১ হি. মুওয়াস্সাসাতু রিসালা, বয়রুত, লোবানন।
৫০. ফাদ্বাইলুস সাহাবা: আবু আব্দিল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল, ওফাত ২৪১ হি. মুওয়াস্সাসাতু রিসালা, বয়রুত, লোবানন।
৫১. মুসনাদু ইসহাক্ব ইবনে রাহবিয়া: আবু ইয়াকুব ইসহাক্ব ইবনে ইব্রাহিম, ওফাত ২৩৮ হি. মাকতাবাতুল ঈমান, মদিনা, সৌদি আরব।
-ঃ শারহুল হাদিস গ্রন্থ ঃ-
৫২. ইমাম বদরুদ্দীন আইনী: আবু মুহাম্মদ মাহমুদ ইবনে আহমদ ইবনে মূসা ইবন আহমদ ইবনে হুসাইন ইবনে ইউসূফ ইবনে মাহমুদ (৭৬২-৮৫৫ হি. / ১৩৬১-১৪৫১ ইং): ‘উমদাতুল ক্বারী শরহু সহীহিল বুখারী, বয়রুত, লেবানন, দারুল এহইয়ায়ে তুরাশ আরাবী।
৫৩. ইমাম যুরকানী: আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল বাকি ইবনে ইউসুফ ইবনে আহমাদ ইবনে আল-ওয়ান মিসরী, আযহারী মালেকী (১০৫৫-১১২২ হি. / ১৬৪৫-১৭১০ ইং) : শরহুল মু’আত্তা, বয়রুত, লেবানন, মাকতাবু ছাক্বাফাতি দিনিয়্যা।
৫৪. ইমাম সুয়ূতি: জালালুদ্দিন আবুল ফজল আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর ইবনে উসমান (৮৪৯-৯১১ হি. / ১৪৪৫-১৫০৫ ইং): শরহুস সুনান ইবনে মাযাহ, করাচী, পাকিস্তান, ক্বদীমি কুতুবখানা।
৫৫. ইমাম আসকালানী: আহমাদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আহমাদ ইবনে কিনানী (৭৭৩-৮৫২ হি. / ১৩৭২-১৪৪৯ ইং): ফাতহুল বারী বি শরহে সহীহুল বুখারী, বয়রুত, লেবানন, দারুল মারেফাহ।
৫৬. ইমাম কাস্তালানী: আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর ইবনে আবদুল মালিক ইবনে আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হোসাইন ইবনে আলী (৮৫১-৯২৩ হি. / ১৪৪৮-১৫১৭ ইং) : ইরশাদুস্ সারী শরহু সহীহিল বুখারী, মাতবুয়াতুল কুবরা আল উমিরিয়্যা, মিশর।
৫৭. মুবারকপুরী: আবুল ’উলা মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবদুর রহীম (১২৭৩-১৩৫৩ হি.) : তুহফাতুল আহ্ওয়াযী বি শরহে জামে’উত তিরমিযী, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া।
৫৮. ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: নুরুদ্দীন ইবনে সুলতান মুহাম্মদ হারভী হানাফী (১০১৪-১২০৬ ইং): মিরকাতুল মাফাতিহ শরহে মিশকাতুল মাফাতিহ, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
৫৯. ইমাম মানাভী: আবদুর রউফ ইবনে তাজুল আরেফিন ইবনে আলী ইবনে যায়নুল আবেদীন (৯৫২-১০৩১ হি. / ১৫৪৫-১৬২১ ইং) : ফয়জুল কাদির শরহিল জামেউস সগীর, মিসর, মাকতাবা তিজারিয়া কুবরা, ১৩৫৬ হি.।
৬০. ইমাম মানাভী: আবদুর রউফ ইবনে তাজুল আরেফিন ইবনে আলী ইবনে যায়নুল আবেদীন (৯৫২-১০৩১ হি. / ১৫৪৫-১৬২১ ইং): আত তাইছির বি’শারহি জামেইছ ছাগীর, মাকতাবু ইমামিশ শাফেয়ী, রিয়াদ্ব।
৬১. ইমাম নববী: আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে শরফ ইবনে মুরী ইবনে হাসান ইবনে হুসাইন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুম’আহ ইবনে হাযাম (৬৩১-৬৭৭ হি. / ১২৩৩-১২৭৮ ইং) : শরহুন নববী আলা সহীহিল মুসলিম, বয়রুত, লেবানন, দারু এহইয়ায়ে তুরাশ আরাবী।
৬২. আরফুশ শাজী শরহে তিরমিজি: মুহাম্মদ আনওয়ার শাহ্ ইবনে মুয়াজ্জম শাহ্ কাশ্মিরী, ওফাত ১৩৫৩ হি. দারু তুরাশিল আরাবী, বয়রুত, লেবানন।
৬৩. ফায়জুল বারী শরহে বুখারী: মুহাম্মদ আনওয়ার শাহ্ ইবনে মুয়াজ্জম শাহ্ কাশ্মিরী, ওফাত ১৩৫৩ হি. দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বয়রুত, লেবানন।
৬৪. হাশিয়াতুস সানাদী আলা সুনানি নাসাঈ: মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল হাদী সানাদী ওফাত ১১৩৮ হি. মাকতুব মাতবুয়াতিল ইসললামিয়্যা, হলব।
৬৫. হাশিয়াতুস সানাদী আলা সুনানি ইবনে মাজাহ: মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল হাদী সানাদী ওফাত ১১৩৮ হি. দারুল জ্বীল, বয়রুত।
৬৬. আওনুল মাবুদ শরহে আবী দাউদ: মুহাম্মদ আশরাফ ইবনে আমির ইবনে আলী আজিমআবাদী, মৃত্যু ১৩২৯ হি. দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বয়রুত, লেবানন।
৬৭. নাইলুল আওতার: মুহাম্মদ ইবনে আলী শাওকানী, মৃত্যু ১২৫০ হি. দারুল হাদিস, মিশর।
-ঃ আসমাউর রিজাল ঃ-
৬৮. আহমদ্ ইবনে হাম্বল: আবু আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ (১৬৪-২৪১ হি. / ৭৮০-৮৫৫ ইং): ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, বয়রুত, লেবানন, মুয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪০৩ হি. / ১৯৮৩ ইং।
৬৯. বুখারী: আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহিম ইবনে মুগীরাহ (১৯৪-২৫৬ হি./৮১০-৮৭০ ইং) আত্-তারীখুস সগীর : ক্বাহেরা, মিসর, মাকতাবাতু দারিত তুরাস, ১৩৯৭ হি.।
৭০. বুখারী: আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহিম ইবনে মুগীরাহ (১৯৪-২৫৬ হি. / ৮১০-৮৭০ ইং) : আত্-তারিখুল কাবির, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া।
৭১. ইমাম ইবনে হিব্বান: আবু হাতেম মুহাম্মদ ইবনে হিব্বান ইবনে আহমাদ ইবনে হিব্বান (২৭০-৩৫৪ হি. ৮৮৪-৯৬৫ ইং) : আস্-সিকাত, হায়দারাবাদ, হিন্দ, দায়েরাতুল মাআরিফ,আল উছমানিয়্যা, ১৩৯৫ হি. / ১৯৭৫ ইং।
৭২. খতীবে বাগদাদী: আবু বকর আহমাদ ইবনে আলী ইবনে সাবেত ইবনে আহমাদ ইবনে মাহদী ইবনে সাবেত (৩৯২-৪৬০ হি. / ১০০২-১০৭১ ইং): তারিখে বাগদাদ, বয়রুত, লেবানন, দারু গুরুবিল ইসলামী।
৭৩. যাহাবী: শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ (৬৭৩-৭৪৮ হি.) : তাযকিরাতুল হুফফায, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া।
৭৪. যাহাবী: শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ (৬৭৩-৭৪৮ হি.) : দিওয়ানুদ দোয়াফা, মক্কা, মাকতাবাতু নাহদ্বাহিল হাদিসাহ।
৭৫. যাহাবী: শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ (৬৭৩-৭৪৮ হি.) : তারিখুল ইসলাম, দারু গুরুবিল ইসলামী।
৭৬. যাহাবী: শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ (৬৭৩-৭৪৮ হি.) : সীয়ারু আ‘লামিন নুবালা, বয়রুত, লেবানন, মুয়াস্সাসাতুর রিসালা, ১৪১৩ হি.।
৭৭. যাহাবী: শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ (৬৭৩-৭৪৮ হি.) : মিযানুল এতেদাল, বয়রুত, লেবানন, দারুল মারিফাহ, ১৪১৩ হি.।
৭৮. যাহাবী: শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ (৬৭৩-৭৪৮ হি.) : আল কাশেফ, দারুল ক্বিবলা লিছাক্বাফাতিল ইসলাময়্যিা, জিদ্দা।
৭৯. ইমাম মুগলতাঈ: মুগলতাঈ ইবনে কালিজ ইবনে আব্দিল্লাহ মিছরী, ওফাত ৭৬২ হি. ফারুকুল হাদিসিয়্যা।
৮০. ইবনে আসাকির: আবুল কাশেম আলী ইবনে হাছান ইবনে হুব্বাতুল্লাহ, ওফাত ৫৭১ হিজরী, তারিখে দামেস্ক, দারুল ফিকর, বয়রুত, লেবানন।
৮১. সুবকী: তাজুদ্দীন ইবনে আলী ইবনে আবদুল কাফী (৭২৭-৭৭১ হি.): ত্ববকাতুশ শাফিআতিল কুবরা, হাজর লিত্ তাবাআতি ওয়ান নাশার, ১৪১৩ হি.।
৮২. সুয়ূতি: জালালুদ্দিন আবুল ফজল আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর ইবনে উসমান (৮৪৯-৯১১ হি. / ১৪৪৫-১৫০৫ ইং) : ত্ববকাতুল হুফ্ফায, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ১৪০৩ হি.।
৮৩. ইবনে ’আদী: আবদুল্লাহ ইবনে আদী ইবনে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুবারক, আবু আহমদ জুরযানী (২৭৭-৩৬৫ হি.) আল কামিল ফী মাআরিফাতি দ্বো’ফায়িল মুহাদ্দিসীন, কায়রো, মিসর, মাকতুবাতু ইবনে তাইমিয়া, ১৯৯৩ ইং।
৮৪. আসকালানী: আহমাদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আহমাদ ইবনে কিনানী (৭৭৩-৮৫২ হি. / ১৩৭২-১৪৪৯ ইং): তাকরীবুত তাহযীব, শাম, দারুর রশীদ, ১৪০৬ হি. / ১৯৮৬ ইং।
৮৫. আসকালানী: আহমাদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আহমাদ ইবনে কিনানী (৭৭৩-৮৫২ হি. / ১৩৭২-১৪৪৯ ইং): আল ইছাবা ফি তামিযিছ সাহাবা, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বয়রুত, লেবানন।
৮৬. আসকালানী: আহমাদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আহমাদ ইবনে কিনানী (৭৭৩-৮৫২ হি. / ১৩৭২-১৪৪৯ ইং): তাহযীবুত তাহযীব, মাতবুয়াতু দায়েরাতিল মায়ারিফ, হিন্দ।
৮৭. আসকালানী: আহমাদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আহমাদ ইবনে কিনানী (৭৭৩-৮৫২ হি. / ১৩৭২-১৪৪৯ ইং): লিসানুল মিযান, মাতবুয়াতু দায়েরাতিল মায়ারিফ, হিন্দ।।
৮৮. মিয্যী: আবুল হাজ্জাজ ইউসুফ ইবনে যকি আবদুর রহমান ইবনে ইউসুফ ইবনে আবদুল মালিক ইবনে ইউসুফ ইবনে আলী (৬৫৪-৭৪২ হি. / ১২৫৬-১৩৪১ ইং) : তাহযিবুল কামাল, বয়রুত, লেবানন, মুয়াস্সাসাতুর রিসালা, ১৪০০ হি. / ১৯৮০ ইং।
৮৯. ইমাম নববী: আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে শরফ ইবনে মুরী ইবনে হাসান ইবনে হুসাইন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুম’আহ ইবনে হাযাম (৬৩১-৬৭৭ হি. / ১২৩৩-১২৭৮ ইং) : তাহজিবু আসমাই ওয়াল লুগাত, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা।
৯০. ইমাম ছাখাবী: হাফিজ শামছুদ্দিন ছাখাবী, ওফাত ৯০২ হি.: আস সিক্বাত মিম্মান লা ইয়াকায়া ফি কুতুবি ছিত্তাহ, মারকাজুন নুমান, ইয়ামান।
৯১. ইবনে কাছির: হাফিজ আবুল ফিদ ইসমাঈল ইবনে উমর ইবনে কাছির দামেস্কী, ওফাত ৭৭৪ হি. আত তাকমিল ফি জারহি ওয়া তাদিল, মারকাজুন নুমাম, ইয়ামান।
৯২. ইবনে সা’দ: আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে সাদ (১৬৮-২৩০ / হি. ৭৮৪-৮৪৫ ইং) : আত্ব ত্বাবক্বাতুল কুবরা, মাকতাবাতু উলুমি ওয়াল হিকাম, মদিনা, সৌদি আরব।
৯৩. ইমাম ইজলী: আবুল হাছান আহমদ ইবনে আব্দিল্লাহ ইবনে ছালেহ্ আল ইজলী, ও২৬১ ওফাত ২৬১ হি. আস সিক্বাত, মাকতাবাতুদ দার, মদিনা, সৌদি।
-ঃ সিরাত গ্রন্থ ঃ-
৯৪. আহমদ্ ইবনে হাম্বাল: আবু আবদুল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল (১৬৪-২৪১ হি. / ৭৮০-৮৫৫ ইং): ফাদ্বায়িলুস সাহাবা, বয়রুত, লেবানন, মুয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪০৩ হি. / ১৯৮৩ ইং।
৯৫. বায়হাকী : আবু বকর আহমদ ইবনে হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মূসা (৩৮৪-৪৫৮ হি. / ৯৯৪-১০৬৬ ইং) : দালায়িলুন নবুয়ত, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ১৪০৫ হি. / ১৯৮৫ ইং।
৯৬. বায়হাকী : আবু বকর আহমদ ইবনে হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মূসা (৩৮৪-৪৫৮ হি. / ৯৯৪-১০৬৬ ইং) : আয্ যুহদুল কাবীর, বয়রুত, লেবানন, মুয়াস্সাসাতুল কুতুবুছ ছাক্বাফিয়া, ১৯৯৬ ইং।
৯৭. জুরজানী : আবুল কাসেম হামযা ইবনে ইউসূফ সাহামী (৪২৮ হি.): তারিখে জুরজান, বয়রুত, লেবানন, ’আ-লামুল কুতুব, ১৪০১ হি. / ১৯৮১ ইং।
৯৮. ইবনে জাওযী : আবুল ফরয আবদুর রহমান ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে উবাইদুল্লাহ (৫১০-৫৭৯ হি. / ১১৬-১২০১ ইং): আল ’ইলালুল মুতানাহিয়া ফীল আহাদীসিল ওয়াহীয়্যা, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ১৪০৩ হি.।
৯৯. ইবনে হাজর হাইতমী : আবুল আব্বাস আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বিন আলী বিন মুহাম্মদ বিন আলী বিন হাজর মক্কী (৯০৯-৯৭৩ হি. / ১৫০৩-১৫৬৬ ইং) : আল খায়রাতুল হাসান ফী মানাক্বিবিল ইমামিল আ’যম আবী হানিফা আন-নু’মান, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ১৪০৩ হি. / ১৯৮৩ ইং।
১০০. হাসকাফী : সদরুদ্দীন মূসা ইবনে যাকারিয়া (৬৫০ হি.) : মুসনাদুল ইমামিল আ’যম, করাচি, পাকিস্তান, মীর মুহাম্মদ কুতুবখানা।
১০১. ইবনে কাসীর : আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে ওমর (৭০১-৭৭৪ হি. / ১৩০১-১৩৭৩ ইং) : আল বেদায়াতু ওয়ান বেদায়া, বয়রুত, লেবানন, দারুল ফিকর, ১৪০১ হি.।
১০২. ইমাম ইবনে হাজার মক্বী: আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হাজার হায়তামী, ওফাত ৯৭৪ হি. আশরাফুল অসাইল আলা ফিতহি শামাঈল, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বয়রুত, লেবানন।
১০৩. দিয়ারবকরী: হুছাইন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হুছাইন দিয়ারবকরী, ওফাত ৯৬৬ হি. তারিখুল খামিছ ফি আহওয়ালি আনফাছি নাফিছ, দারুস সদর, বয়রুত, লেবানন।
১০৪. হালভী: আলী ইবনে ইব্রাহিম ইবনে আহমদ হালভী, ওফাত ১০৪৪ হি. সিরাতে হালাভিয়া, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বয়রুত, লেবানন।
১০৫. ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: নুরুদ্দীন ইবনে সুলতান মুহাম্মদ হারভী হানাফী (১০১৪-১২০৬ ইং): শরহে শিফা, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
১০৬. আবু সাদ খারকুশী: আব্দুল মালেক ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম নিছাপুরী খারকুশী, ওফাত ৪০৭ হিজরী, শারফুল মুস্তফা, দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়্যা, মক্কা।
১০৭. ক্বাজী আয়্যাজ: ইয়াদ্ব ইবনে মুছা ইবনে ইয়াদ্ব ইয়াহছাবী, ওফাত ৫৪৪ হি. আশ শিফা বি’তারিফিল হুকুকিল মুস্তফা, দারুল ফিহা, উমান।
১০৮. ইমাম তিরমিজি: মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে ছাওর তিরমিজি, ওফাত ২৭৯ হিজরী, শামাইলু মুহাম্মদীয়া, , দারু এহইয়ায়ে তুরাশ ্আরাবী, বয়রুত, লোবানন।
১০৯. ইমাম ইস্পাহানী: ইসমাঈল ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ফাদ্বল ইবনে আলী ইস্পাহানী, ওফাত ৫৩৫ হি. দালাইলুন নবুয়াত, দারুত তায়্যেবাহ, রিয়াদ্ব।
১১০. ইমাম যুরকানী: আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল বাকি ইবনে ইউসুফ ইবনে আহমাদ ইবনে আল-ওয়ান মিসরী, আযহারী মালেকী (১০৫৫-১১২২ হি. / ১৬৪৫-১৭১০ ইং) : শরহু যুরকানী আলাল মাওয়াহিবুল্লাদুন্নিয়া, বয়রুত, লেবানন, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা।
১১১. ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: নুরুদ্দীন ইবনে সুলতান মুহাম্মদ হারভী হানাফী (১০১৪-১২০৬ ইং): জামউল অছাইল ফি শারহি শামাইল, মাতবুয়াতু শারাফিয়্যা, মিশর।
১১২. ছালেহী: মুহাম্মদ ইবনে ইউছুফ ছালেহী শামী, ওফাত ৯৪২ হি. সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, দারুল কুতুব ইলমিয়্যা, বয়রুত, লেবানন।
১১৩. মুকরিজী: আহমদ ইবনে আলী ইবনে আব্দুল কাদের তক্বী উদ্দিন মুকরিজী, ওফাত ৮৪৫ হি. ইমতাউল আসমা, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বয়রুত, লেবানন।
১১৪. ইমাম কাস্তালানী: আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর ইবনে আবদুল মালিক ইবনে আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হোসাইন ইবনে আলী (৮৫১-৯২৩ হি. / ১৪৪৮-১৫১৭ ইং) : মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া, মাতবুয়াতু তাওফিকিয়্যা, কাহেরা, মিশর।
১১৫. ছিয়তী: আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর জালালুদ্দিন ছিয়তী, ওফাত ৯১১ হি. খাছাইছুল কুবরা, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বয়রুত, লেবানন।
১১৬. হারদ্বী: ইয়াহইয়া ইবনে আবী বাকর ইবনে মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আমেরী হারদ্বী, ওফাত ৮৯৩ হি. বাহজাতুল মাহাফিল ওয়া বাগিয়াতিল আমাছিল, দারু সদর, বয়রুত, লেবানন।