নামাজের মধ্যে দুরূদ পাঠ সম্পর্কিত হাদিস ও মাসায়েলঃ
❏ হাদিস ১:
ইমাম তাবরানী (رحمة الله) মারফু সূত্রে হযরত সাহল বিন সাদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন,
لاصَلاةَ لِمَن لا يُصَلّي علي النَّبي
(ص)
"যে নামাযে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রতি দূরুদ পড়ল না তার নামায নামাযই নয়।"
তথ্যসূত্রঃ
১.ইমাম দারাকুতনী, আস-সুনান, ২/১৭০ পূ, হা/১৩৪২,
২.ইমাম বায়হাকী, আল-মা'রিফাতুল সুনাল ওয়াল আছার, ৩/৬৯ পৃ. হা/৩৭২০,
৩.ইমাম হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, ১/৪০২ পৃ. হা/৯৯২,
৪.ইমাম বায়হাকীঃ আস-সুনানুল কোবরা, ২/৫২৯ পৃ, হা/৩৯৬৭,
৫.ইমাম ইবনে হিব্বান, আস-সহীহ, ৬/১২১ পৃ. হা/৫৬৯৮. ৩০৯।
৬.ইমাম শিহাবুদ্দীন আল-কাস্তালানীঃ আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহঃ ৪র্থ খন্ড, পৃ ১৫৭, সাকলাইন প্রকাশনী।
৭.সূনানে ইবনে মাযাহ খঃ ১, পৃঃ ১৪০, হাদীস ৪০০
❏ হাদিস ২:
ইমাম দারাকুতনী (رحمة الله) ও ইবনে মাযাহ (رحمة الله) হযরত আবু মাসউদ আনসারী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন,
-“যে নামায পড়লাে আর আমি নবী (ﷺ) এবং আহলে বায়াতের উপর সালাত পড়লাে না তার নামায কবুল হবে না।”
তথ্যসূত্রঃ
১.ইমাম দারাকুতনী, আস-সুনান, ২/১৭০ পূ, হা/১৩৪৩,
২.ইমাম যায়লাঈ, নাসবুর রায়্যাহ, ১৪২ পৃ., তিনি বলেন- “সনদে জাবের যঈফ রাবী, তার হাদিস নিয়ে অনেক আলােচনা-সমালােচনা রয়েছে।”
৩.ইমাম শিহাবুদ্দীন আল-কাস্তালানীঃ আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহঃ ৪র্থ খন্ড, পৃ ১৫৮, সাকলাইন প্রকাশনী।
❏ হাদিস ৩:
عن عبيد الله بن بريدة عن ابيه رضي الله تعالى عنه قال : قال رسول الله صلي الله عليه وسلم : یا بريده ، إذا جلست في صلاتك ، قلاتتركن التشهد والصلاة على فانها زكاة الصلاة ، وسلم على جميع أنبياء الله ورسوله ، وسلم على عباد الله الصالحين .
رواه الدار قطني والديلمي.
হযরত ওবাইদুল্লাহ ইবনু বুরায়দা নিজ পিতা হযরত বুরায়দা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে, হুযূর নবী আকরাম (ﷺ) বলেন, হে বুরায়দা! যখন তুমি নিজ নামায পড়তে বসবে, তখন তাশাহহুদ এবং আমার উপর দুরূদ প্রেরণকে কখনাে ছেড়ে দেবে না। উহা নামাযের যাকাত। এবং আল্লাহ তা'আলার সমস্ত নবী এবং রাসূলগণের উপর এবং তাঁর নেক বান্দাদের উপরও সালাম প্রেরণ কর।
এ হাদিসকে ইমাম দারুকুতনী এবং দায়লামী বর্ণনা করেছেন।
তথ্যসূত্রঃ
১. দারে কুতনী : আস্ সুনান, ১/৩৫৫, হাদিস: ৩
২. দায়লামী : আল্ মুসনাদুল ফেরদাউস, ৫/৩৯২, হাদিস: ৮৫২৭;
৩. হায়সামী : মাজমাউয্ যাওয়ায়েদ, ২/১৩২;
৪.ড. তাহেরুল ইসলাম কাদেরীঃ প্রিয় নবীর পরকালীন জীবন।
❏ হাদিস ৪:
ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) “কিতাবুল উম্ম” গ্রন্থে বলেন যে, আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াতে কারীমার দ্বারা নবী আকরাম (ﷺ) এর উপর দুরূদ শরীফ পাঠানাে ফরয করেন, নিশ্চয় আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ এ নবীর উপর দুরূদ প্রেরণ করেন, হে ইমানদারগণ, তোমরাও তাঁর প্রতি তাজিমের সাথে দুরূদ ও সালাম প্রেরণ কর।
[ইমাম কাসতালানীঃ আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ (৩য় খণ্ড), পৃ ৩৯২, সাকলাইন প্রকাশনী।]
❏ হাদিস ৫:
ইমাম উমারী (رحمة الله) “আমালিল ইয়ামি ওয়াল লাইল” গ্রন্থে হযরত ইবনে উমর (رحمة الله) শক্তিশালী সনদে বর্ণনা করেন, তিনি। বলেন, নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেন,
“কিরাত তাশাহুদ আর আমার উপর দুরূদ শরীফ পড়া ব্যতিত নামায হয় না।"
[ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, ফতহুল বারী, ১১/১৬৪ পৃ., ইমাম কাসতালানীঃ আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ (৩য় খণ্ড), পৃ ৩৯৫, সাকলাইন প্রকাশনী।]
ব্যাখ্যাঃ
ইমাম যুরকানী (رحمة الله) বলেন যে, উক্ত বর্ণনায় ওয়াজিবের কোন দলিল নেই, কারণ, যে, এর দ্বারা পূর্ণাঙ্গতার নিষেধ করা হয়। আর এ মমার্থ বেশী যুক্ত হয়, কারণ তাশাহুদের হাদিস সমূহে দুরূদ শরীফের উল্লেখ নেই। (মানে, নামাজ অপূর্নাঙ্গ রয়ে যায়)
(আল্লামা যুরকানী, শারহুল মাওয়াহেব, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩৩৪ পৃ.)
❏ হাদিস ৬:
হযরত আবু জাফরের হাদিসে হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেন, “যে নামাযে আমার উপর আমার আহলে বাইতের উপর দুরূদ শরীফ না পড়ে। তার নামায কবুল হবে না।”
[সুনানে দারাকুতনী, ২/১৭১ পৃ. হা/১৩৪৩, ইমাম কাসতালানীঃ আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ (৩য় খণ্ড), পৃ ৩৯৬, সাকলাইন প্রকাশনী।]
ব্যাখ্যাঃ
◾ইমাম দারাকুতনী (رحمة الله) বলেন, সহীহ হলাে এই যে, এ ইমাম আবু জাফর (رحمة الله) মুহাম্মাদ বিন আলী বিন হাসান (رحمة الله) এর অভিমত থেকে তিনি বলেন, যদি আমি নামায পড়ি আর তাতে নবী আকরাম (ﷺ) ও তাঁর পরিবার বর্গের উপর দুরূদ শরীফ না পড়ি, তখন আমি মনে করি যে আমার নামায পূর্ণাঙ্গ হয়নি।
[ইমাম কাসতালানীঃ আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ (৩য় খণ্ড), পৃ ৩৯৬,সাকলাইন প্রকাশনী।]
◾মিশরের ফিকহবিদগণের (বিভিন্ন শহরের ফিকহী) মধ্যে হযরত ইমাম আহমদ (رحمة الله) এক বর্ণনা অনুযায়ী- ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) এর আনুগত্য করেন, আর শেষে এর উপর আমল করেন, যেভাবে তার থেকে (তাঁর শিষ্য) ইমাম আর যারওয়া দামশকী (رحمة الله) (আবু যারওয়া বিন আবদুর রহমান বিন আমর বিন আবদুল্লাহ বিন সাফওয়ান আন-নাসায়ী, হাফেজুল হাদিস ওফাত-২৮০ হিজরি) বর্ণনা করেন, আর এ অভিমত কে আল্লামা হাফেজ ইবনে কাসীর (رحمة الله) করেন। ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াই (رحمة الله) বলেন যে,
"যদি কোন ব্যক্তি ভুল করে নয়, বরং জেনে শুনে দুরূদ শরীফ না পড়ে, তাহলে তার নামাজ ওয়াজিব হবে।"
আর ইমাম আহমদ (رحمة الله) থেকে প্রসিদ্ধ হল এই যে, নামাজে দুরূদ ছেড়ে দেয়ায় ঐ নামায বাতিল হয়ে যায়, জেনে শুনে ছেড়ে দেয় বা ভুলে ছেড়ে দেয়।
তাঁর অধিকাংশ শিশ্যগণ এ অভিমত এমনকি কোন কোন হাম্বলী ইমামগণ নামাজে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলা ওয়াজিব ঘোষণা করেন যে, তারা যখন আরজ করেন ইমাম আহমদ (رحمة الله) তাদের এভাবে শিক্ষা দিতেন। অথবা ইমাম ইবনে কাসীর (رحمة الله) অনুরূপ বর্ণনা করেন, ইমাম খারকী (رحمة الله) স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয়ার শর্তে ইমাম ইবনে ইসহাক (رحمة الله) এর আনুগত্য করেন।
[ইমাম কাসতালানীঃ আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ (৩য় খণ্ড), পৃ ৩৯৬-৩৯৭]সাকলাইন প্রকাশনী।
মালেকীদের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে , যেভাবে ইমাম ইবনে হাজেব (رحمة الله) নামাজের সুন্নাত সমূহের বর্ণনা করে বলেন , অর্থাৎ সহীহ অভিমত অনুযায়ী মতভেদ রয়েছে। তার ব্যাখ্যাকারী আল্লামা ( মুহাম্মদ) বিন আবদুস সালাম (رحمة الله) বলেন , এর মমার্থ হলাে এই যে , ওয়াজিব হবার সম্পর্কে দু ' টি অভিমত রয়েছে । আর ইমাম ইবনে মুওয়াজ (মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বিন যিয়াদাহ ইস্কান্দারী) এর বর্ণনায়ও এ কথা প্রকাশ হয়েছে।
ইমাম ইবনে কাচ্ছার (رحمة الله) ইমাম ইবনে মুওয়াজ (رحمة الله) থেকে এ বিষয় স্পষ্ট বর্ণনা করেন, অনুরূপ "আশ-শিফা" গ্রন্থে এ শব্দ সমূহের সাথে হয় যে, তিনি ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) এর মত যাতে ফরয নামাযে (ওয়াজিব) মনে করতেন।
তিনি বলেন আবু ইয়ালা (আহমদ বিন মুহাম্মাদ) আবদী (رحمة الله) এর ধারাবাহিকতায় তিন অভিমত প্রকাশ করেন,
( ১ ) ওয়াজিব , ( ২ ) সুন্নাত , ( ৩ ) মুস্তাহাব।
(আদ-দিরাজুল মাযহাব, ১ম খণ্ড, ১৭৫ পৃ , আস - সিলাত , ১ম , ৮৭ পৃ.)
◾আমি “ সিরাজুল মুরিদীন ” গ্রন্থে ইমাম কাযী আবু বকর বিন আরাবী (رحمة الله)' র প্রতি সম্পর্কিত অভিমত সমূহের মধ্যে দেখলাম যে , ইমাম ইবনে মাওয়ায (رحمة الله) আর ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) বলেন যে,
নবী আকরাম (ﷺ) এর উপর দুরূদ শরীফ পড়া নামাযের ফরযের মধ্যে হয়েছে , আর এটাই সহীহ হয়।
যে হানাফীগণ এ অভিমতের সমর্থক হয় যে,
"যখনই নবী আকরাম (ﷺ) এর অালোচনা করা হয়, দুরূদ শরীফ পড়া ওয়াজিব হয়।"
যথাঃ
▪ ইমাম তাহাবী (رحمة الله),
▪ আর ইমাম সুরুজী এটাকে “শরহে হেদায়া” গ্রন্থে “আল-মুহিত", "আল আকদ" আর "আত-তােহফা” এর গ্রন্থকার থেকে তার গ্রন্থে নকল করেন। তাই এ অভিমতের দ্বারা অবধারিত হয় যে , তিনি তাশাহুদেও দুরূদ শরীফকে ওয়াজিব ঘােষণা দেন।
❏ হাদিস ৭:
ইমাম ইবনে খােজাইমা (رحمة الله), ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) আর ইমাম হাকেম (رحمة الله) হযরত ফোজালাহ বিন ওবায়েদা আনসারী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, নি বলেন যে, নবী আকরাম (ﷺ) এক ব্যক্তি থেকে শুনেন যে,
"সে নামাযে এভাবে দোয়া প্রার্থনা করতেছে যে, সে না তাতে আল্লাহর প্রশংসা করছে, আর না নবী আকরাম (ﷺ) এর উপর দুরূদ শরীফ পড়তেছে। তখন তিনি (ﷺ) ইরশাদ করেন, এ ব্যক্তি জলদী করছে, তারপর তিনি তাকে তার নিজের নিকট ডাকেন, আর ইরশাদ করেন,
“যখন তােমাদের মধ্যে কোন লােক নামায পড়বে, তখন আল্লাহ তাআলার প্রশংসার সাথে শুরু করবে। তারপর নবী আকরাম (ﷺ) এর উপর দুরূদ শরীফ পড়বে, তারপর যা ইচ্ছা দোয়া প্রার্থনা করবে।”
তথ্যসূত্রঃ
▪ ইমাম তাবরানী, মুজামুল কবীর, ১৮/৩০৭ পৃ. হা/৭৯১,
▪ ইমাম ইবনে হিব্বান, আস-সহীহ, ৫/২৯০ পৃ. হা/১৯৬০,
▪ ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান, ৫/৩৯৪ পৃ. হা/৩৪৭৭,
▪ ইমাম আহমদ, আল আল-মুসনাদ, ৩৯/৩৬৩ পৃ, হা/২৩৯৩৭,
▪ ইমাম হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, ১/৪০১ পৃ. হা/৯৮৯,
▪ সুনানে আবি দাউদ, পৃ. হা/১৪৮১,
▪ মুসনাদে বাযযার, হা/৩৭৪৮,
▪ আল্লামা মুত্তাকি হিন্দি, কানযুল উম্মাল, হা/৩৩৩০,
▪ ইমাম কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ (৩য় খণ্ড), ৩৯৯ পৃ, সাকলাইন প্রকাশনী।
ইমাম যুরকানী (رحمة الله) বলেন, উক্ত হাদিস দ্বারা ওয়াজিব প্রমাণ হয় না, যদি তাই হতো ঐ ব্যক্তিকে পুনরায় নামায পড়ার হুকুম দিতেন। (আল্লামা যুরকানী, শারহুল মাওয়াহিব ৩৭ পৃ.)
আমি গ্রন্থকার (ইমাম কাস্তালানী) বলতেছি যে, আমার ইমাম, ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله)'র কারামতের মধ্যে এটাও এক বিষয় যে ইমাম কাযী আয়ায (رحمة الله) এ হাদিসকে নিজ সনদে ইমাম তিরমিযির সূত্রে নকল করেন, আর এ সনদ সম্পর্কে কোন ভৎর্সনা করা হয়নি। তিনি এটাকেঃ
فصل في المواطن التي تستحب فيها الصلاة على النبي - صلى الله عليه وسلم
"(এ পর্বে ঐ স্থান সমূহের উল্লেখ করা হবে, যাতে নবী আকরাম (ﷺ) এর উপর দুরূদ শরীফ পড়া মুস্তাহাব হয় আর এর প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়।)
এরপর নামাযের তাশাহুদের উল্লেখ করেন,
"আর এটা তাশাহুদের পর আর দোয়ার পর্বে হবে।"
"আর এ হাদিস যা তােমরা দেখতেছাে, আমার দলিল সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় দলিল, অথচ এর দ্বারা ওয়াজিব প্রমাণ হয় না। এর দ্বারা ঐ দলিল সমূহের দুর্বলতা, আর হানাফী অবস্থানের শক্তি সামর্থ প্রমাণ হয়।]
তথ্যসূত্রঃ
▪ ইমাম কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ (৩য় খণ্ড), ৩৯৯ পৃ। সাকলাইন প্রকাশনী।