দীর্ঘ ১২ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর পতন হয়েছে সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের। আজ রবিবার হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামক একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলার মুখে দামেস্ক থেকে পালিয়ে যান তিনি। এর মাধ্যমে অবসান ঘটে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে শাসন করা আসাদ পরিবারের।
সিরিয়ার দামেস্কসহ এর আশপাশের অঞ্চল নিয়ে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
বিশেষত কিয়ামতের আগের কিছু ঘটনা এ অঞ্চল ঘিরে সংঘটিত হবে। তাই বিভিন্ন হাদিসে এ অঞ্চলকে মুসলিমদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া মাহদি (আ.)-এর অনুসরণ, দাজ্জালের আগমন ও হত্যা, ঈসা (আ.)-আবির্ভাব, শাসনকালসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি লেখা পাঠকদের জন্য ফের অনলাইনে প্রকাশ করা হলো।
ভৌগোলিকভাবে আগের শাম অঞ্চল বর্তমানে কয়েকটি রাষ্ট্রে বিস্তৃত রয়েছে। বর্তমানের সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড প্রাচীন মুলকে শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই শামের সঙ্গে ভবিষ্যতের ও কিয়ামতপূর্ব অনেক ঘটনাও জড়িত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) শামের ব্যাপারে বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
১. আল্লাহর ওলিদের অবস্থান
হজরত শুরাইহ ইবনে উবাইদ (রহ.) বলেন, আলী (রা.) ইরাকে অবস্থানকালে তাঁকে শামবাসীর ব্যাপারে বলা হলো, আপনি তাদের ওপর অভিশাপ করুন! তখন তিনি বলেন, না, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, শাম ভূখণ্ডে আবদালরা (আল্লাহর ওলিদের বিশেষ দল) থাকেন।
তাঁরা ৪০ জন থাকেন। যখনই তাঁদের থেকে একজন মারা যান, আল্লাহ তাঁর স্থানে অন্য একজনকে রাখেন। তাঁদের বরকতে বৃষ্টি হয় ও শত্রুর ওপর জয়লাভ হয়। ভবিষ্যতে তাঁদের অছিলায় শামবাসীর ওপর থেকে আজাব তুলে নেওয়া হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮৯৬)
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, হিজরতের পর আরেকটি হিজরত শিগগিরই সংঘটিত হবে। তখন ভূপৃষ্ঠের সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ হবে তারা, যারা ইবরাহিম (আ.)-এর হিজরত ভূমিতে (শাম দেশে) অবস্থান করবে। আর পুরো পৃথিবীতে সর্বনিকৃষ্ট মানুষরাই বাকি থাকবে। তাদের ভূমিগুলো তাদের নিক্ষেপ করবে। আল্লাহ তাদের অপছন্দ করবেন। তাদের ফিতনার আগুন তাদের বানর ও শূকরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে। (তাদের দুশ্চরিত্রের কারণে তারা যেখানেই যাবে সেখানেই ফিতনা লেগে থাকবে)।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৮২)
ইবনে হাওয়ালা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ইসলামী বাহিনী শিগগিরই কয়েকটি দলে দলবদ্ধ হবে। একটি দল শামে, একটি ইয়েমেনে ও অন্য একটি ইরাকে। ইবনে হাওয়ালা (রা.) জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি সে যুগ পাই, তখন আমি কোন দলে যুক্ত হব, তা বলে দিন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি শামের বাহিনীতে থাকবে। কেননা তা আল্লাহর পছন্দনীয় ভূমির একটি। সেখানে তিনি তাঁর সর্বোত্কৃষ্ট বান্দাদের একত্রিত করবেন। আর যদি তুমি তাতে যুক্ত না হতে পারলে তুমি ইয়েমেনের বাহিনীকে গ্রহণ করো। আর তোমরা শামের কূপ থেকে পানি গ্রহণ করো। কেননা আল্লাহ আমার জন্য—অর্থাৎ আমার উম্মতের জন্য শাম ভূখণ্ড ও তার বাসিন্দাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৮৩)
৩. উম্মতে মুহাম্মদির কল্যাণ সম্পৃক্ত
মুয়াবিয়া ইবনে কুররা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন শামভূমি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের মাধ্যমে ধ্বংস হবে তখন তোমাদের মধ্যেও কোনো কল্যাণ থাকবে না। আর আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। তাদের যারা ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তারা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২১৯২)
৪. মুসলিম বাহিনীর সেনা ছাউনি
আবু দারদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মহাযুদ্ধের সময় মুসলিমদের ছাউনি হবে ‘গোতা’ শহরে, যা দামেস্ক শহরের পাশে অবস্থিত। এটি শামের উত্কৃষ্ট শহরগুলোর একটি।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪২৯৮)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘অচিরেই তোমরা শাম বিজয় করবে। যখন তোমরা সেখানে বসবাসের সুযোগ পাবে তোমরা দামেস্ক নগরীতে থাকবে। কেননা তা যুদ্ধবর্তীকালীন মুসলিমদের আশ্রয়স্থল হবে। আর তাদের ছাউনি হবে ওই দেশের একটি ভূমি, যাকে ‘গোতা’ বলা হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৭৪৭০)
আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘খোরাসান ভূমি থেকে কালো পতাকাবাহী দল বের হবে। তাদের কোনো কিছুই প্রতিরোধ করতে পারবে না। যতক্ষণ না তারা তা ‘ইলিয়া’ তথা জেরুজালেমে না পৌঁছে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২২৬৯)
উল্লেখ্য, আব্বাসীয় খিলাফতের যুগ থেকে অনেকেই নিজেদের ওই দল বোঝানোর জন্য কালো পতাকা নিয়ে অভিযানে নেমেছে। কেউ বা নিজেকে মাহদিও দাবি করে বসেছে। তবে তাদের এমন দাবি সম্পূর্ণ ভুল ছিল। বরং আল্লাহই ভালো জানেন, তারা কিয়ামতের আগে কোন যুগের ও কারা হবে।
৫. কিয়ামতের আগে মাহদির খেলাফত গ্রহণ
উম্মে সালামা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানদের একজন খলিফার ইন্তেকালের পর মতানৈক্য হবে। তখন মদিনাবাসীর একজন ব্যক্তি (মতানৈক্য এড়িয়ে যাওয়ার জন্য) মক্কায় চলে আসবেন। অতঃপর মক্কাবাসীর অনেক লোক তাঁর কাছে আসবে এবং তাঁকে তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘর থেকে বের করে এনে মাকামে ইবরাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তাঁর হাতে বাইয়াত হবে। (তিনিই হলেন ইমাম মাহদি) তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শাম থেকে একটি (বাতিল) দলকে পাঠানো হবে। তবে তারা মক্কা-মদিনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে পৌঁছলে ভূমিধসে আক্রান্ত হবে। মানুষ তা দেখার পর শামের আবদালরা ও ইরাকবাসী উৎকৃষ্ট মানুষের দল আসবে। অতঃপর তারা মাকামে ইবরাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তাঁর হাতে বাইয়াত হবে। অতঃপর কুরাইশ বংশের জনৈক ব্যক্তির উদ্ভব হবে। কালব গোত্র হবে তার মাতুল গোত্র। সে তাদের মোকাবেলায় একটি বাহিনী পাঠাবে। যুদ্ধে মাহদির অনুসারীরা কালব বাহিনীর ওপর বিজয়ী হবে। এ সময় যারা কালব থেকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিতে উপস্থিত হবে না তাদের জন্য আফসোস! মাহদি গনিমতের সম্পদ বণ্টন করবেন ও নবী করিম (সা.)-এর সুন্নাত অনুযায়ী মানুষের মধ্যে কার্য পরিচালনা করবেন। আর ইসলাম সারা পৃথিবীতে প্রসারিত হবে। অতঃপর তিনি সাত বছর অবস্থান করার পর মারা যাবেন। আর মুসলিমরা তাঁর জানাজার সালাত পড়বে। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) বলেন, কেউ কেউ হিশাম থেকে বর্ণনা করে বলেন, ৯ বছর অবস্থান।
৬. দামেস্কে ঈসা (আ.)-এর অবতরণ
নাউওয়াস ইবনে সামআন (রা.) সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিসে দাজ্জাল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। তাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দাজ্জাল ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে বের হবে এবং ডানে-বাঁয়ে গোটা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করতে থাকবে। তাই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ঈমানের ওপর অটল থাকবে।’
দীর্ঘ হাদিস বর্ণনার একপর্যায়ে নবী করিম (সা.) বলেন, দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে দাজ্জালের অনিষ্টতার পর আল্লাহ ঈসা ইবনে মারিয়াম (আ.)-কে পাঠাবেন। তিনি দামেস্কের পূর্ববর্তী এলাকার শুভ্র মিনারের কাছে আসমান থেকে দুজন ফেরেশতার কাঁধে চড়ে অবতরণ করবেন। তখন তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস যে কাফেরের গায়ে লাগবে সে মারা যাবে। আর তাঁর দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে। তিনি দাজ্জালকে তালাশ করবেন, অতঃপর শামের বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯৩৭)