রাসূল ( ﷺ)’র নাম শুনে অঙ্গুলী চুম্বন করা
বিশ্ব মানবতার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট নবী, সকল সৃষ্টির মূল, খোদা তা’লার প্রিয় রাসূল, বিশ্ব জগতের কান্ডারী, মানবতার মুক্তির দূত, যার উছিলায় আরশ-কুরছী, লওহ-কলম, সাত আসমান, সাত জমীন, বেহস্থ-দোজখ, তামান মাখলুকাত সৃষ্টি হয়েছে। সেই করুণার আধার রহমতের ভান্ডার ছায়্যেদুল মুরছালীন রহমাতুল্লিল আলামিন হুজুর পূর নূর ( ﷺ) এর পবিত্র নাম মোবারক শুনলে মু’মিনের বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখদ্বয়ে চুম্বন করে চোখে মাসেহ্ করা অতীব উত্তম কাজ ও মুস্তাহাব। নিচে এ সম্পর্কে দলিল-আদিল্লাহ উল্লেখ করা হল। হাফিজুল হাদিস ইমাম শামছুদ্দিন ছাখাবী ( رَحْمَةُ الله عليه) উল্লেখ করেছেন,
ذَكَرَهُ الدَّيْلَمِيُّ فِي الْفِرْدَوْسِ مِنْ حَدِيثِ أَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ أَنَّهُ لَمَّا سَمِعَ قول المؤذن أشهد أن محمد رَسُولُ اللَّه قَالَ هَذَا، وَقَبَّلَ بَاطِنَ الأُنْمُلَتَيْنِ السَّبَّابَتَيْنِ وَمَسَحَ عَيْنَيْهِ، فَقَالَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ فَعَلَ مِثْلَ مَا فَعَلَ خَلِيلِي فَقَدْ حَلَّتْ عَلَيْهِ شَفَاعَتِي،
-“ইমাম দায়লামী ( رَحْمَةُ الله عليه) তাঁর ‘ফেরদৌছ’ কিতাবে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) হতে হাদিস বর্ণনা করেন, যখন মুয়াজ্জিনের ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ বলা শুনবে ও ইহা বলেন এবং দুই আঙ্গুলদ্বয় চুম্বন করে চোখে মাসেহ্ করেন। রাসূল ( ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি এরূপ আমল করবেন যেরূপ আমার খলিল আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) করেছেন, তার জন্য আমার শাফায়াত বৈধ হয়ে যাবে।” ৭৬৭৬, ইমাম ছাখাবী: মাকাছিদুল হাছানাহ, ৩৮৪ পৃ: হাদিস নং ১০২১; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৭ম খন্ড, ২৬২ পৃ:;
এই হাদিস উল্লেখ করে হাফিজুল হাদিস ইমাম ছাখাবী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেছেন:
ولا يصح -“ইহা ছহীহ্ নয়।” ৭৭৭৭, ইমাম ছাখাভী: মাকাছিদুল হাছানাহ, ৩৮৪ পৃ: হাদিস নং ১০২১;
ইমাম ছাখাবী ( رَحْمَةُ الله عليه) যখন কোন হাদিস সম্পর্কে ولا يصح বলেন, তখন ইহার মান কিরূপ হয় সে সম্পর্কে ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী ( رَحْمَةُ الله عليه) এ নীতিমালাটিকে সুস্পষ্ট এভাবে করেছেন,
قَوْلَ السَّخَاوِيِّ لَا يَصِحُّ لَا يُنَافِي الضَّعْفَ وَالْحُسْنَ إِلَّا أَنْ يُرِيدَ بِهِ أَنَّهُ لَا يَثْبُتُ وَكَانَ الْمُنُوفِي فَهِمَ هَذَا الْمَعْنَى حَتَّى قَالَ فِي مُخْتَصَرِهِ إِنَّهُ بَاطِلٌ لَا أَصْلَ لَهُ
-“ইমাম ছাখাবী (رَحْمَةُ الله عليه)‘র বক্তব্য হাদিসটি ‘ছহীহ্ নয়’ (তিনি বলেন) তার ছহীহ্ হওয়ার নিষেধ দ্বারা হাদিসটি ‘হাছান’ ও দ্বায়িফ হওয়াকে নিষেধ করে না। তবে যদি ইহার মধ্যে এরুপ উদ্দেশ্য হয় যে, ইহার কোনভাবেই প্রমাণিত না তখন সংক্ষেপে এভাবে বলেছেন, إِنَّهُ بَاطِلٌ নিশ্চয় ইহা বাতিল, لَا أَصْلَ لَهُ ইহার কোন ভিত্তি নেই।” ৭৮৭৮, . আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারূল মারফ‚আ, ১/৩৪৯ পৃ. হা/৫০২, লাখনভী, রাফউ ওয়া তাকমীল, ১৯৫ পৃ.
বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিছ হাফিজুল হাদিস, ইমাম ইবনু হাজার আস্কালানী (রহ:) রচিত “আল ক্বওলুল মুসাদ্দাদ ফিয যুব্বি আন মুসনাদি আহমদ” নামক কিতাবে উল্লে¬খ করেছেন যে,
وَلا يَلْزَمُ مِنْ كَوْنِ الْحَدِيثِ لَمْ يَصِحَّ أَنْ يَكُونَ مَوْضُوعًا
-“হাদিসটি ‘ছহীহ্ নয়’ বললে সেটা মাওদ্বু বা বানোয়াট হাদিস হওয়া অপরিহার্য নয়।” ৭৯৭৯, আল ক্বওলুল মুসাদ্দাদ ফিয যুব্বি আন মুসনাদি আহমদ, ১/৩৭ পৃষ্ঠা, মাকতাবায়ে ইবনে তাইমিয়া, কায়রু, মিশর।
অতএব, হাফিজুল হাদিস ইমাম ছাখাবী ( رَحْمَةُ الله عليه) এর দৃষ্টিতে হাদিসটি ছহীহ্ নয় তবে হাছান অথবা দ্বায়িফ।
এই হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে বিশ্ব নন্দিত মুহাদ্দিস, হিজরী ১১শ শতাব্দির মুজাদ্দিদ, আল্লামা ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেন,
قُلْتُ وَإِذَا ثَبَتَ رَفْعُهُ عَلَى الصَّدِّيقِ فَيَكْفِي الْعَمَلُ بِهِ -“আমি (মোল্লা আলী ক্বারী) বলি: যখন সিদ্দিকে আকবর আবু বকর (رضي الله عنه) থেকে মারফুরূপে এই আমল প্রমাণিত আছে তখন ইহাই আমলের জন্য যথেষ্ঠ।” ৮০৮০, ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী: আসরারুল মারফুয়া, ৪৩৫ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়;
এছাড়া কোন ইমাম এই হাদিসকে মওজু বা জাল হাদিস বলেছেন এরুপ কোথাও দেখিনি। সুতরাং রাসূলে পাক ( ﷺ)’র নাম মুবারক শুনে বৃদ্ধঙ্গুলীতে চুম্বন করে চোখে মাসেহ করার আমলটি মুস্তাহাব জেনে করার জন্য এই হাদিসই যথেষ্ঠ।
হাদিসটি আল্লামা ইবনু আবেদীন শামী হানাফী ( رَحْمَةُ الله عليه) তদীয় কিতাবে এভাবে উল্লেখ করেছেন,
وَفِي كِتَابِ الْفِرْدَوْسِ مَنْ قَبَّلَ ظُفْرَيْ إبْهَامِهِ عِنْدَ سَمَاعِ أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ فِي الْأَذَانِ أَنَا قَائِدُهُ وَمُدْخِلُهُ فِي صُفُوفِ الْجَنَّةِ
-“কিতাবুল ফেরদৌছ গ্রন্থে আছে, রাসূলে পাক ( ﷺ) বলেন: যে ব্যক্তি আযানে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বলার সময় বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখদ্বয় চুম্বন করে, আমি নবী ( ﷺ) তার রাহবার হব এবং তাকে জান্নাতের সাড়িতে প্রবেশ করাব।” ৮১৮১, ফাতওয়ায়ে শামী, ২য় খন্ড, ৬৮ পৃ:; فَائِدَةٌ التَّسْلِيمُ بَعْدَ الْأَذَانِ
এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, আল্লাহর হাবীব ( ﷺ)’র নাম মুবারক শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখদ্বয় চুম্বন করে চোখে মাছেহ করার আমল কারীকে স্বয়ং আল্লাহর নবী ( ﷺ) নিজে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। সুতরাং এই আমল করা মূলত জান্নাতী বান্দাহ্গণের কাজ।
এ ব্যাপারে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ফকিহ্ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী ( رَحْمَةُ الله عليه) তদীয় ফাতওয়ার গ্রন্থে বলেন,
يُسْتَحَبُّ أَنْ يُقَالَ عِنْدَ سَمَاعِ الْأُولَى مِنْ الشَّهَادَةِ: صَلَّى اللَّهُ عَلَيْك يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَعِنْدَ الثَّانِيَةِ مِنْهَا: قَرَّتْ عَيْنِي بِك يَا رَسُولَ اللَّهِ، ثُمَّ يَقُولُ: اللَّهُمَّ مَتِّعْنِي بِالسَّمْعِ وَالْبَصَرِ بَعْدَ وَضْعِ ظُفْرَيْ الْإِبْهَامَيْنِ عَلَى الْعَيْنَيْنِ فَإِنَّهُ عَلَيْهِ السَّلَامُ يَكُونُ قَائِدًا لَهُ إلَى الْجَنَّةِ، كَذَا فِي كَنْزِ الْعِبَادِ.
-“মুস্তাহাব হল, আযানের প্রথম শাহাদাতের সময় ‘সাল্লাল্লাহু আলায়কা ইয়া রাসুলাল্লাহ’ বলা ও দ্বিতীয় শাহাদাতের সময় ‘র্কুরাতু আয়নী বিকা ইয়া রাসুলাল্লাহ’ বলা, দুই চোখে নখদ্বয় রাখার পরে বলবে ‘আল্লাহুম্মা মাত্তিনী বিছ ছামঈ ওয়াল বাছারী’ বলবে। কেননা আল্লাহর নবী ( ﷺ) তাকে রাহবার হয়ে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।” ৮২৮২ ফাতওয়ায়ে শামী, ২য় খন্ড, ৬৮ পৃ:; فَائِدَةٌ التَّسْلِيمُ بَعْدَ الْأَذَانِ
সুতরাং হানাফী মাজহাবের ফকিহ্গণের দৃষ্টিতে রাসূলে পাক ( ﷺ) নাম মুবারক শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলী চুম্বন কর চোখে মাসেহ্ করা মুস্তাহাব। এমনকি ময়দানে হাশরে রাসুলুল্লাহ ( ﷺ) এর শাফায়াত নছিব হবে। (সুবহানাল্লাহ)
তাঁরকার সূরতে রাসূল ( ﷺ)
নূরের তৈরী ফেরেস্থা হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) সৃষ্টি হওয়ার বহু পূর্বে আল্লাহর রাসূল ( ﷺ) সৃষ্টি হয়ে তারকার সূরতে ছিলেন। এ সম্পর্কেও পবিত্র হাদিস শরীফে বর্ণনা রয়েছে। যেমন পবিত্র হাদিসে আছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَأَلَ جِبْرِيلَ عليه الصلاة والسلام فَقَالَ: يَا جِبْرِيلُ كم عمرت من السنين؟ فقال يَا رَسُولَ اللَّهِ لَسْتُ أَعْلَمُ، غير أن في الحجاب الرابع نجما يطلع في كل سبعين ألف سنة مرة، رأيته اثنين وسبعين ألف مرة فقال: يَا جِبْرِيلُ وعزة ربي جل جلاله أنا ذلك الكوكب رواه البخاري، هذا كلامه،
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল ( ﷺ) জিব্রাইল (عليه السلام) কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে জিব্রাইল আপনার বয়স কত? তিনি বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ইহা অবগত নই, তবে চতুর্থ হেজাব-এ একটি তারকা ৭০ হাজার বছর পর পর একবার উদিত হত, আমি তাঁকে ৭২ হাজার বার দেখেছি। নবী করিম ( ﷺ) বললেন: হে জিব্রাইল! আমার রবের ইজ্জত ও জালালের কসম! আমিই ছিলাম সেই তারকা।” ৮৩৮৩, ‘আত তাশরিফাতে ফি খাছায়েছে ওয়াল মুজিজাত; আল্লামা নূরুদ্দিন হালাভী: সিরাতে হালভীয়া, ১ম খন্ড, ৪৭ পৃ: ইমাম বুখারীর সূত্রে; যাওয়াহিরুল বিহার, ৩য় খন্ড, ৩৩৯ পৃ:; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৭ম খন্ড, ৩য় খন্ড, ৬৫১ পৃ:; জিকরে হাসীন, ৩০ পৃ:
হাদিসটি উল্লেখ করার সময় ইমাম নূরুদ্দিন হালাভী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেছেন,
ورأيت في كتاب التشريفات في الخصائص والمعجزات لم أقف على اسم مؤلفه،
-“আমি (হালাভী) কিতাবুত তাশরিফাত ফিল খাছাইছে ওয়াল মুজিজাত গ্রন্থে দেখেছি তবে ইহার লেখক সম্পর্কে আমি অবগত নই।” আর হাদিসটির শেষে আল্লামা নূরুদ্দিন হালাভী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেছেন, رواه البخاري، هذا كلامه، -“ইহা ইমাম বুখারী ( رَحْمَةُ الله عليه) বর্ণনা করেছেন আর ইহা সেই গ্রন্থের লেখকের বাণী।” ৮৪৮৪, আল্লামা নূরুদ্দিন হালাভী: সিরাতে হালভীয়া, ১ম খন্ড, ৪৭ পৃ:
সিরাতে হালভিয়া কিতাবের মুকাদ্দমায় আছে, আল্লামা নূরুদ্দিন আলী হালাভী ( رَحْمَةُ الله عليه) মুকাদ্দমার মধ্যে বলেছেন,
ولا يخفى أن السير تجمع الصحيح والسقيم والضعيف والبلاغ والمرسل والمنقطع والمعضل دون الموضوع
-“আর ইহা গোপন নয় যে, সিরাত গ্রন্থে মওজু বা জাল হাদিস ব্যতীত ছহীহ্, ছাকিম, দ্বায়িফ , বালাগ, মুরছাল, মুনকাতে ও মুদাল হাদিস সবই থাকে।” ৮৫৮৫, আল্লামা নুরুদ্দিন হালভী: সিরাতে হালাভিয়া, ১ম খন্ড, ৫ পৃ: মুকাদ্দমা;
অতএব, মূলনীতি মোতাবেক আল্লামা নূরুদ্দিন হালভী ( رَحْمَةُ الله عليه) এর বিখ্যাত সিরাত গ্রন্থ ‘সিরাতে হালাভিয়া’ গ্রন্থে কোন জাল হাদিস থাকতে পারেনা। এই দৃষ্টিতে এই হাদিসখানা মওজু বা জাল নয়। অতএব, মাটির কোন অস্তিত্ব ছিলনা তখনো আল্লাহর রাসূল ( ﷺ) আল্লাহর দরবারে তারকার সূরতে ছিলেন।
--------------------------------