যেখানে দাফন করা হয় সেখানের মাটি থেকে সৃষ্টি

এ ব্যাপারে একাধিক হাদিস বর্ণিত রয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষের নাভিমূলে ঐ স্থানের মাটি রাখা হয় যেখানের মাটি থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে মূলত নাভিমূলে মাটি রাখার বিষয়টিকে বুঝানো হয়েছে, সরাসরি মাটির তৈরী বুঝানো হয়নি। কারণ মানুষ সরাসরি মাটির তৈরী নয় বরং নুতফার তৈরী। যেমন মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً -“তিনি ‘বাশার’ তথা মানুষকে পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা ফুরকান: ৫৪ নং আয়াত)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে মানুষকে আল্লাহ পাক ‘পানি’ তথা শুক্রানু হতে সৃষ্টি করেছেন। এই আয়াতে الْماء ‘মাউন’ এর অর্থ নুতফা বা পিতা-মাতার শুক্রানু-ডিম্বানু। তথাপিও এই আয়াতে বর্ণিত الْماء ‘পানি’ সম্পর্কে মোফাচ্ছেরীনে কেরামের অভিমত গুলো উল্লেখ করা হল। এই আয়াতের তাফছিরে মহিউস সুন্নাহ ইমাম বাগভী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) {ওফাত ৫১৬ হিজরী} বলেন,
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ مِنَ النُّطْفَةِ، بَشَرًا -“তিনি ‘বাশার’ তথা মানুষকে শুক্রানুর পানি হতে সৃষ্টি করেছেন।” ৭৪৭৪,  তাফছিরে বাগভী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৯০ পৃ:;

এই আয়াত সম্পর্কে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) {ওফাত ৬০৬ হি.} বলেন,
أَنَّ الْمُرَادَ النُّطْفَةُ لِقَوْلِهِ: خُلِقَ مِنْ ماءٍ دافِقٍ [الطَّارِقِ: ৬] ، مِنْ ماءٍ مَهِينٍ )الْمُرْسَلَاتِ: ২০(
-“নিশ্চয় এর দ্বারা অর্থ হচ্ছে শুক্রানু, যেমন আল্লাহ তা’আলার বাণী হচ্ছে: ‘মানুষতে বেগবান পানি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। আরেক আয়াতে আছে: ‘পানির নির্যাস’ থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।” ৭৫৭৫,  তাফছিরে কবীর, ২৪তম খন্ড, ৪৭৫ পৃ:;


এ সম্পর্কে নন্দিত মুফাচ্ছির ইমাম শামছুদ্দিন কুরতবী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) {ওফাত ৬৭১ হিজরী} বলেন,
(وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْماءِ بَشَراً) أَيْ خَلَقَ مِنَ النُّطْفَةِ إِنْسَانًا. -“তিনি (আল্লাহ) ‘বাশার’ তথা মানুষকে ‘পানি’ হতে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ মানুষকে শুক্রানু থেকে সৃষ্টি করেছেন।” ৭৬৭৬,  তাফছিরে কুরতবী, ১৩তম খন্ড, ৫৯ পৃ:;


এ ব্যাপারে বিস্তারিত দালাইল আমার লিখিত ‘নূরে মুজাচ্ছাম’ নামক গ্রন্থে রয়েছে। অতএব, পবিত্র কোরআন অনুযায়ী মানুষ নুতফার তৈরী। এখানে উল্লেখিত রেওয়ায়েত গুলো দ্বারা মানুষের নাভিমূলে দাফনের স্থানের মাটি রাখার বিষয়টিই বুঝাবে অন্যথায় কোরআনের খেলাফ বিধায় এই রেওয়ায়েত গুলো গ্রহণ করা যাবেনা। কারণ এগুলো প্রায় সব গুলোও জাল, জয়ীফ পর্যায়ের। 
ইমাম ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মদ ইবনে ফাদ্বল ইস্পাহানী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) ওফাত ৫৩৫ হিজরী তদীয় কিতাবে বর্ণনা করেছেন,
أَخْبَرَنَا سُلَيْمَانُ، أَخْبَرَنَا أَبُو بَكْرٍ، حَدَّثَنَا مُحَمَّد بن الْفضل ابْن مُحَمَّدٍ الْقَيْسِيُّ الأَيْلِيُّ، حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ الْحَسَنِ بْنِ أَبَانٍ، حَدَّثَنَا أَبُو عَاصِمٍ، حَدَّثَنَا ابْنُ عَوْنٍ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ سِيرِينَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم مَا مِنْ مَوْلُودٍ يُولَدُ إِلا وَقَدْ ثُرِيَ عَلَيْهِ مِنْ تُرَابٍ حَفَرْتُهُ.
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম ( ﷺ‎‎) বলেছেন: এমন কোন সন্তান জন্ম হয়না যার নাভিমূলে তার গর্তের মাটি রাখা হয়না।” ৭৭৭৭, ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মদ ইস্পাহানী: আল হুজ্জাতু ফি বায়ানিল মুহাজ্জাহ, হাদিস নং ৩৩৬;

এই হাদিসের সনদে أحمد بن الحسن بن أبان (আহমদ ইবনুল হাছান ইবনে আবান) নামক একজন রাবী রয়েছে। তার ব্যাপারে ইমাম যাহাবী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন,
قال ابن عدي: كان يسرق الحديث. وقال ابن حبان: كذاب دجال، يضع الحديث على الثقات. وقال الدارقطني: حدثونا عنه وهو كذاب.
-“ইমাম ইবনু আদী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন: সে হাদিস চুরি করত। ইমাম ইবনু হিব্বান ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন: সে মিথ্যাবাদী, দাজ্জাল ও বিশ্বস্ত রাবীদের কাছ থেকে হাদিস বানাইত। ইমাম দারা কুতনী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন: আমরা তার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করি, আর সে মিথ্যাবাদী।”৭৮৭৮,  ইমাম যাহাবী: মিযানুল এতেদাল, রাবী নং ৩৩০; ইমাম যাহাবী: দিওয়ানুদ দোয়াফা, রাবী নং ২০;


  ইমাম যাহাবী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) অন্য কিতাবে বলেছেন,
قال ابن حِبّان، وابن البيع: كذّاب. وقال أبو يَعْلَى الخليليّ: كذاب يضع الحديث. أورد له ابن عديّ حديثين باطلين.
-“ইমাম ইবনু হিব্বান ও ইমাম ইবনু রবিঈ ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন: সে মিথ্যাবাদী। ইমাম আবু ইয়ালা খালিলী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন: সে মিথ্যাবাদী ও হাদিস তৈরী করত। ইমাম ইবনু আদী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) উল্লেখ করেছেন, তার বর্ণিত সকল হাদিসই বাতিল।” ৭৯৭৯,  ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ১১;


সুতরাং এই সনদটি মওজু বা জাল ভিত্তিহীন। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন,
حدثنا عبدُالله بن أحمدَ بن حنبل، ثنا عُقْبة بن مُكْرَم، ثنا عبد الله بن عيسى الخَزَّاز، عن يحيى البَكَّاء، عن ابن عمر؛ أنَّ حَبَشيًّا دُفِنَ بالمدينة، فقال رسولُ الله صلى الله عليه وسلم: دُفِنَ بِالطِّينَةِ الَّتِي خُلِقَ مِنْهَا
-“হযরত ইবনু উমার (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় মদিনায় একজন হাবশীকে দাফন করা হল। আল্লাহর রাসূল ( ﷺ‎‎) বললেন, তাকে ঐ মাটিতে দাফন করা হচ্ছে যেখানে মাটি থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” ৮০৮০,  ইমাম তাবারানী: মুজামুল কবীর, হাদিস নং ১৪০২২; ইমাম আবু নুয়াইম: তারিখে ইসবাহান, ২য় খন্ড, ২৭৫ পৃ:;


এই হাদিসের সনদ প্রসঙ্গে ইমাম নূরুদ্দীন হায়ছামী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন,
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ فِي الْكَبِيرِ، وَفِيهِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عِيسَى الْخَزَّازُ، وَهُوَ ضَعِيفٌ.
-“ইমাম তাবারানী তার কবীর গ্রন্থে ইহা বর্ণনা করেছেন, ইহার সনদে ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ঈসা খাজ্জায’ রয়েছে সে দুর্বল রাবী।” ৮১৮১,  ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ৪২২৮;


বর্ণনাকারী عبد الله بن عيسى الخَزَّاز (আব্দুল্লাহ ইবনু ঈসা খাজ্জায) সম্পর্কে সকল ইমামগণ সমালোচনা করেছেন। অতএব, রেওয়ায়েতটি খুবই দুর্বল পর্যায়ের। সর্বোপরি এই হাদিসে রাসূলে পাক ( ﷺ‎‎) মাটির তৈরী এরুপ কথা উল্লেখ নেই। অন্য হাদিসে রয়েছে মাটির জমীন তৈরী হয়েছে নবী করিম ( ﷺ‎‎) এঁর উছিলায়।
এ বিষয়ে ইমাম আবু বকর আহমদ দিনূরী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) ওফাত ৩৩৩ হিজরী বর্ণনা করেন,
حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ نَصْرٍ النُّهَاوَنْدِيُّ، نَا سُفْيَانُ بْنُ وَكِيعٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ مَنْصُورٍ، عَنْ هِلَالِ بْنِ يَسَافٍ؛ قَالَ: مَا مِنْ مَوْلُودٍ يُولَدُ إِلَّا وَفِي سُرَّتِهِ مِنْ تُرْبَةِ الْأَرْضِ الَّتِي يَمُوتُ فِيهَا
-“তাবেঈ হিলাল ইবনু ইয়াছাফ ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তির নাভিমূলে ঐ স্থানের মাটি রাখা হয় যেখানে তাকে দাফন করা হয়।” ৮২৮২,  ইমাম দিনূরী: আল মাজালিছাহ, হাদিস নং ১৯০;


এই রেওয়ায়েতটি প্রথমত মাকতু বা তাবেঈ এর কথা যা সাধারণত শরিয়তে দলিল হয়না। দ্বিতীয়ত, ইহার মধ্যে রাসূলে আকরাম ( ﷺ‎‎) মাটির তৈরীর কথা নেই, বরং অন্যান্য মানুষের দাফনের স্থানের মাটি নাভিমূলে রাখার কথা রয়েছে। তৃতীয়ত ইহার সনদেسُفْيَانُ بنُ وَكِيْعِ  (সুফিয়ান ইবনু ওয়াকী) রয়েছে। তার ব্যাপারে ইমাম যাহাবী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) উল্লেখ করেছেন,
قَالَ البُخَارِيُّ: يَتَكَلَّمُوْنَ فِيْهِ لأَشْيَاءَ لَقَّنُوهُ إِيَّاهَا.
-“ইমাম বুখারী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন: তার প্রতিটি বিষয়ে ইমামগণ সমালোচনা করেছেন, ইহা থেকে বিরত থাকার জন্য তাকে তালকীন দেওয়া হত।” ৮৩৮৩,  ইমাম যাহাবী: সিয়ারু আলামিন নুবালা, রাবী নং ৫৪;



এই রাবীর উপরে মিথ্যার অভিযোগ রয়েছে। যেমন ইমাম ইবনু আবী হাতেম ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎), হাফিজুল হাদিস ইমাম যাহাবী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) ও ইমাম ইবনু জাওযী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) উল্লেখ করেছেন,
قَالَ أَبُو زرْعَة لَا يشْتَغل بِهِ قيل لَهُ أَكَانَ مُتَّهم بِالْكَذِبِ قَالَ نعم
-“ইমাম আবু যুরাআ ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন, তার ব্যাপারে মননিবেশ করবেনা, কেউ বলল: তার কি মিথ্যার অভিযোগ রয়েছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ রয়েছে।”  ৮৪৮৪,  ইমাম যাহাবী: আল মুগনী ফিদ দোয়াফা, রাবী নং ২৪৮৯; ইবনু জাওযী: আদ দোয়াফা ওয়াল মাতরুকীন, রাবী নং ১৪৫২; ইমাম ইবনু আবী হাতেম, জারাহ ওয়া তাদিল, রাবী নং ৯৯১;


ইমাম মুগলতাঈ ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) উল্লেখ করেছেন,
وقال الخليلي في الإرشاد: ضعفوه، وكان له وراق أدخل في حديثه ما ليس له
-“ইমাম খালিলী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) তার ‘ইরশাদ’ গ্রন্থে তাকে দুর্বল রাবী বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার সমস্যা ছিল সে যেটা হাদিস নয় সেটাকে হাদিস বলে চালিয়ে দিত।” ৮৫৮৫,  ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ২০৮৭;


অতএব, এই রেওয়ায়েত একদিকে মাকতু এবং অপরদিকে অত্যান্ত দুর্বল। সর্বোপরি এই রেওয়ায়েতে রাসূলে পাক ( ﷺ‎‎) মাটির তৈরী এই ধরণের কোন কথা উল্লেখ নেই। অন্য হাদিসে আছে মাটির জমীন সৃষ্টি হয়েছে রাসূল ( ﷺ‎‎) এঁর উছিলায়। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ الْحَافِظُ أَنَا أَبُو النَّضْرِ الْفَقِيهُ وَأَحْمَدُ بْنُ مُحَمَّدٍ الْعَنْبَرِيُّ قَالَا: نَا عُثْمَانُ بْنُ سَعِيدٍ الدَّارِمِيُّ نَا يَحْيَى بْنُ صَالِحٍ الْوُحَاظِيٍّ نَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ مُحَمَّدٍ حَدَّثَنِي أُنَيْسُ بْنُ أَبِي يَحْيَى مَوْلَى الْأَسْلَمِيِّينَ عَنْ أَبِيهِ عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: مَرَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِجَنَازَةٍ عِنْدَ قَبْرٍ فَقَالَ: قَبْرُ مَنْ هَذَا؟ فَقَالُوا: قَبْرُ فُلَانٍ الْحَبَشِيِّ يَا رَسُولَ اللهِ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ سِيقَ مِنْ أَرْضِهِ وَسَمَائِهِ إِلَى تُرْبَتِهِ الَّتِي خُلِقَ مِنْهَا
-“হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল ( ﷺ‎‎) এর কবরের জানাযার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। প্রিয় নবীজি ( ﷺ‎‎) বললেন, এই কবর কার? লোকেরা বলল, এটা জনৈক হাবশীর কবর। তখন আল্লাহর রাসূল ( ﷺ‎‎) বললেন, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, জমীন অথবা আসমান থেকে ঐদিকেই তাকে দ্রæত হাকিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানের মাটি থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” ৮৬৮৬,  ইমাম ইবনু আসাকির: তাজিয়াতুল মুসলীম আন আখিহী, হাদিস নং ৯০; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং ৯৪২৫; 


এই হাদিসের সনদে একজন রাবী রয়েছে যার নাম عَبْدُ العَزِيْزِ بنُ مُحَمَّدِ (আব্দুল আজিজ ইবনু মুহাম্মদ)। যার সম্পর্কে কেউ কেউ বলেছেন কোন অসুবিধা নেই আবার কেউ কেউ বলেছেন সে শক্তিশালী নয়। তবে ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন,
وقال أحمد بن حنبل كان معروفا بالطلب وإذا حدث من كتابه فهو صحيح وإذا حدث من كتب الناس وهم. وقال أبو زرعة سيء الحفظ ربما حدث من حفظه الشيء فيخطيء وقال الساجي كان من أهل الصدق والأمانة إلا أنه كثير الوهم
-“ইমাম আহমদ ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন, সে একজন অন্বেষণকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ব্যক্তি, যখন সে স্বীয় কিতাব থেকে হাদিস বর্ণনা করেন তখন ইহা ছহীহ্ হয় আর যখন অন্য লোকদের কিতাব থেকে হাদিস বর্ণনা করেন তখন ইহা ত্রæটিযুক্ত হয়। ইমাম আবু যুরাআ ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন, তার স্মরণশক্তি ছিল খুবই দুর্বল, যখন সে নিজের স্মরণশক্তি থেকে হাদিস বর্ণনা করত তখন ইহা ভুল হত। ইমাম ছাজী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন, সে সত্যবাদী ও আমানতদার তবে তার বর্ণিত হাদিসের মধ্যে প্রচুর ভুল রয়েছে।”  ৮৭৮৭,  ইমাম আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ৬৮০;


وقال أبو حاتم: لا يحتج بِهِ. ইমাম আবু হাতিম ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন: তার উপর নির্ভর করা যায়না।” ৮৮৮৮,  ইমাম যাহাবী: তারিখুল ইসলাম, রাবী নং ২২২;


অতএব, এই রাবী হাদিসটি নিজের স্মরণশক্তি থেকেই বর্ণনা করেছেন যার কারণে হাদিসটি দুর্বল সনদের। এই হাদিসটি ইমাম বাজ্জার ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বর্ণনা করেছেন।৮৯৮৯,  কাশফুল আসতার আন জাওয়াইদিল বাজ্জার, হাদিস নং ৮৪২;

  তবে ইহার সনদে একজন আপত্তিকর রাবী রয়েছে। যেমন ইমাম নূরুদ্দিন হায়ছামী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন,
رَوَاهُ الْبَزَّارُ، وَفِيهِ عَبْدُ اللَّهِ وَالِدُ عَلِيِّ بْنِ الْمَدِينِيِّ، وَهُوَ ضَعِيفٌ.
-“ইমাম বাজ্জার ইহা বর্ণনা করেছেন, ইহার সনদে আলী ইবনু মাদিনীর পিতা ‘আব্দুল্লাহ’ রয়েছে আর সে দুর্বল রাবী।”  ৯০৯০,  ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ৪২২৬;


সুতরাং সনদের দৃষ্টিতে এই রেওয়ায়েত অত্যান্ত দুর্বল পর্যায়ের। সর্বোপরি এই হাদিসের মধ্যে রাসূলে পাক ( ﷺ‎‎) মাটির তৈরী এরুপ কথা নেই। বরং অন্যান্য মানুষের দাফনের স্থানের মাটি নাভিমূলে থাকার বিষয়টিকে ঈশারা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়, 
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ زِيَادٍ الرَّازِيُّ قَالَ: حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ مُوسَى الْفَرَّاءُ قَالَ: حَدَّثَنَا هِشَامُ بْنُ يُوسُفَ، عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ قَالَ: أَخْبَرَنِي عُمَرُ بْنُ عَطَاءِ بْنِ وَرَّان، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّهُ قَالَ: يُدْفَنُ كُلُّ إِنْسَانٍ فِي التُّرَابِ الَّتِي خُلِقَ مِنْهَا.
-“হযরত ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত নিশ্চয় তিনি বলেছেন, প্রত্যেক মানুষকে ঐ মাটিতে দাফন করা হয় যেখানের মাটি থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” ৯১৯১,  ইমাম ইবনু আদী: আল কামিল ফি দোয়াফাউর রিজাল, হাদিস নং ১৩৪৯; মুছান্নাফু আব্দির রাজ্জাক, হাদিস নং ৬৫৩১;


এই রেওয়ায়েতের মধ্যে عُمَر بن عطاء بن وَرَّان (উমর ইবনু আত্বা ইবনে র্অরান) নামক রাবী রয়েছে। যাকে ইমাম নাসাঈ ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) ضعيف বলেছেন। ৯২৯২,  ইমাম ইবনু আদী: আল কামিল ফি দোয়াফাউর রিজাল, রাবী নং ১১৯৫;


 ইমাম যাহাবী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) উল্লেখ করেছেন,
ضعفه يحيى بن معين، والنسائي، وقال يحيى أيضا: ليس بشئ. وقال أحمد: ليس بقوي.
-“ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, ইমাম নাসাঈ ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) তাকে দুর্বল বলেছেন। অনুরূপ ইমাম ইয়াহইয়া ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন, সে কিছুই নয়। ইমাম আহমদ ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন: সে শক্তিশালী নয়।”  ৯৩৯৩,  ইমাম যাহাবী: মিযানুল এতেদাল, রাবী ং ৬১৬৯;


এছাড়াও ইমাম আবু যুরাআ, ইমাম ইয়াকুব ইবনু সুফিয়ান, ইমাম উকাইলী, ইমাম বালখী, ইমাম ইবনু জারুদ, ইমাম সাজী, ইমাম আবু আরব, ইমাম ইবনু শাহিন ও ইমাম খালিফুন ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) সবাই তাকে ضعيف দুর্বল বলেছেন।”  ৯৪৯৪,  ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবিল কামাল, রাবী নং ৪০২৫;

অতএব, এই হাদিস জয়ীফ বা দুর্বল সনদের।
এই হাদিসের মধ্যেও রাসূলে পাক ( ﷺ‎‎) মাটির তৈরী এরুপ কথা নেই। বরং অন্যান্য মানুষের দাফনের স্থানের মাটি নাভিমূলে থাকার বিষয়টিকে ঈশারা করা হয়েছে। কারণ কবরের মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টির কথাটি পবিত্র কোরআনের খেলাফ। কেননা হযরত আদম (عليه السلام) ব্যতীত কোন মানুষই সরাসরি মাটির তৈরী নয়। যেমন মহান আল্লাহ তা’আলা অপর আয়াতে এরশাদ করেন:-
أَلَمْ نَخْلُقْكُمْ مِنْ ماءٍ مَهِينٍ (২০) فَجَعَلْناهُ فِي قَرارٍ مَكِينٍ -“আমি কি তোমাদেরকে পানির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করিনি? অত:পর তাকে নিরাপদ স্থানে রাখিনি? (সূরা মুরছালাত: ২০-২১ নং আয়াত)।
সুতরাং এই হাদিস গুলোর অর্থ হবে প্রত্যেক মানুষের নাভিমূলে দাফনের স্থানের মাটি রাখা হয় যেখানে তাকে দাফন করা হয়। যেমন হযরত আত্বা ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন,
وَقَالَ عَبْد بْن حميد حَدَّثَنَا عَبْد الْوَهَّاب عَن عَطاء عَن دَاوُد بْن أبي هِنْد قَالَ حدَّثَنِي عَطَاءٍ الْخُرَاسَانِيِّ قَالَ إِنَّ الْمَلَكَ يَنْطَلِقُ فَيَأْخُذُ مِنْ تُرَابِ الْمَكَانِ الَّذِي يُدْفَنُ فِيهِ فَيَذُرُّه على النُّطْفَة فَيحل مِنَ التُّرَابِ وَمِنَ النُّطْفَةِ
-“হযরত আত্বা খুরাশানী ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন, নিশ্চয় ফেরেস্তা ঐ স্থানের মাটি নিয়ে নুতফার মধ্যে ফেলে যেখানে সে দাফন হবে।” ৯৫৯৫,  ইমাম ছিয়তী: আল লাআলীল মাছনূয়া, ১ম খন্ড, ২৮৫ পৃ:; ইমাম ইবনু আব্দিল র্বার আত তামহীদ, ২৪তম খন্ড, ৪০০ পৃ:;


 অন্য রেওয়ায়েতে আছে,
مَا مِنْ مَوْلُودٍ يُولَدُ إِلَّا وَفِي سُرَّتِهِ مِنْ تُرْبَةِ الْأَرْضِ الَّتِي يَمُوتُ فِيهَا
-“তাবেঈ হিলাল ইবনু ইয়াছাফ ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তির নাভিমূলে ঐ স্থানের মাটি রাখা হয় যেখানে তাকে দাফন করা হয়।” ৯৬৯৬,  ইমাম দিনূরী: আল মাজালিছাহ, হাদিস নং ১৯০;


অতএব, এই রেওয়ায়েত গুলো দিয়ে রাসূলে আকরাম ( ﷺ‎‎) মাটির তৈরী এরুপ দলিল দেওয়া জিহালত ও হাস্যকর হবে। বরং অন্যান্য মানুষের নাভিমূলে দাফনের স্থানের মাটি রাখা হয় যেখানে তাকে দাফন করা হয় বা হবে। সর্বোপরি এই হাদিস থেকে অন্যান্য মানুষ মাটির তৈরী সাব্যস্থ হয়না বরং মানুষের নাভিতে দাফনের স্থানের মাটি রাখা হয় ইহা সাব্যস্থ হয়। আর মাটির জমীনই সৃষ্টি হয়েছে রাসূলে আকরাম ( ﷺ‎‎) এঁর উছিলায়। যেমন এ সম্পর্কে হাদিস শরীফে আছে,
وذكر صاحب كتاب شفاء الصدور في مختصره عَن عَليّ بن أبي طَالب، رَضِي الله تَعَالَى عَنهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ أَنَّهُ قَالَ: يَا مُحَمَّدُ وَعِزَّتِي وَجَلَالِي لَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ أَرْضِي، وَلَا سَمَائِي
-“হযরত আলী (رضي الله عنه) হযরত রাসূল ( ﷺ‎‎) থেকে বর্ণনা করেন, প্রিয় নবীজি ( ﷺ‎‎) মহান আল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা’লা বলেন: ওহে মুহাম্মদ! আমার ইজ্জত ও জালালের কসম! আপনাকে না বানাইলে আসমান জমীন কিছুই বানাইতাম না।”৯৭৯৭,  ইবনে সাবা র: এর ‘শিফাউছ ছুদুর’ গ্রন্থে; নজহাতুল মাজালিস, ২য় খন্ড, ১১৯ পৃ:; আল্লামা নুরুদ্দিন হালভী: ইনসানুল উয়ূন, ১ম খন্ড, ৩১৭ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৭৫ পৃ:; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৩২০২৫


  এ বিষয়ে অন্য হাদিসে আছে,
أخبرنا أبو يعقوب يوسف بن أيوب بن يوسف بن الحسين بن وهرة الهمذاني بمرو نا السيد أبو المعالي محمد بن محمد بن زيد الحسيني إملاء بأصبهان وأخبرنا أبو محمد بن طاووس أنا أبو القاسم بن أبي العلاء قالا أنا أبو القاسم عبد الرحمن بن عبيد الله بن عبد الله السمسار أنا حمزة بن محمد الدهقان نا محمد بن عيسى بن حبان المدائني نا محمد بن الصباح أنا علي بن الحسين الكوفي عن إبراهيم بن اليسع عن أبي العباس الضرير عن الخليل بن مرة عن يحيى عن زاذان عَنْ سَلْمَانَ قَالَ:.. قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عن الله تعالى لَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ الدُّنْيَا
-“হযরত ছালমান ফারছী (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক ( ﷺ‎‎) আল্লাহ তা’লা হতে বলেছেন: হে নবী! আপনাকে না বানাইলে দুনিয়া বানাইতাম না।” ৯৮৯৮,  তারিখে ইবনে আসাকির, ৩য় খন্ড, ৫১৭ পৃ:, হাদিস নং ৮০১; কাজী আয়্যায: শিফা শরীফ, ২য় খন্ড, ১০৫ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১ম খন্ড, ৭৫ পৃ:; যুরকানী: শরহে মাওয়াহেব, ১ম খন্ড, ১৮২ পৃ:; ইমাম মোল্লা আলী: মওজুয়াতুল কবির, ১০১ পৃ: মারফূ সনদে;


সুতরাং জমীনের মাটি দিয়ে রাসূল ( ﷺ‎‎) সৃষ্টি নয় বরং রাসূল ( ﷺ‎‎) এঁর উছিলায় জমীন সৃষ্টি হয়েছে।
--------------------------
Top