হাফিজে কোরআনের শাফায়াতে ১০ জন জান্নাতে যাবে
বা’আমল হাফিজে কোরআনের শাফায়াতে হাশর ময়দানে তার পরিবারের ১০ জনসহ জান্নাতে যাবে। যেমন ইমাম তিরমিজি ( رَحْمَةُ الله عليه) হাদিস বর্ণনা করেছেন,
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ، حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ بَكَّارٍ، حَدَّثَنَا حَفْصُ بْنُ سُلَيْمَانَ يَعْنِي أَبَا عُمَرَ الْقَارِئَ، عَنْ كَثِيرِ بْنِ زَاذَانَ، عَنْ عَاصِمِ بْنِ ضَمْرَةَ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ وَاسْتَظْهَرَهُ، فَأَحَلَّ حَلاَلَهُ، وَحَرَّمَ حَرَامَهُ أَدْخَلَهُ اللَّهُ بِهِ الجَنَّةَ وَشَفَّعَهُ فِي عَشَرَةٍ مِنْ أَهْلِ بَيْتِهِ كُلُّهُمْ قَدْ وَجَبَتْ لَهُ النَّارُ.
-“হজরত আলী (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক ( ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করেন ও স্বরণ রাখেন, হালালকে হালাল জানে ও হারামকে হারাম জানে। আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবের এবং তার পরিবারের এমন ১০ জনকে সুপারিশ করবেন যাদের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে।”৮৬৮৬, তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ২৯০৫; মেসকাত শরীফ, ১৮৭ পৃ:; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২১৬; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১২৭৮; মেরকাত শরহে মেসকাত, ৫ম খন্ড, ৪১ পৃ:; লুমআতুত তানকীহ; শরহে ত্বাবী; তাবারানী তাঁর আওছাতে, হাদিস নং ৫১৩০;
এই হাদিসের সনদ প্রসঙ্গে ইমাম তিরমিজি ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেছেন,
هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ لَا نَعْرِفُهُ إِلَّا مِنْ هَذَا الوَجْهِ وَلَيْسَ لَهُ إِسْنَادٌ صَحِيحٌ، وَحَفْصُ بْنُ سُلَيْمَانَ أَبُو عُمَرَ بَزَّازٌ كُوفِيٌّ يُضَعَّفُ فِي الْحَدِيثِ
-“এই হাদিস গরীব, এই সূত্র ছাড়া ইহা জানিনা এবং ইহার ছহীহ্ কোন সূত্র নেই।‘হাফছ ইবনু সুলাইমান আবু আমর বাজ্জায কূফী’ হাদিস বর্ণনায় দুর্বল।” ৮৭৮৭, তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ২৯০৫;
অর্থাৎ ইমাম তিরমিজি ( رَحْمَةُ الله عليه) এর দৃষ্টিতে হাদিসটি দ্বায়িফ বা দুর্বল সনদের, তবে মওজু নয়। কিন্তু কওমী অঙ্গনের বড় আলেম জনাব জুনায়েদ বাবুনগরীর তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় লিখিত ‘প্রচলিত জাল হাদিস’ বইয়ের চতুর্থ প্রকাশের ৬৬ পৃষ্টায় লিখে দিয়েছেন,
“কোরআন হেফজের গুরুত্ব দিতে গিয়ে অনেকে বর্ণিত বাক্যটিকে নবীজির হাদিস হিসেবে পেশ করে থাকে, অথচ এটি হাদিস হিসেবে প্রমাণিত নয়।” (নাউজুবিল্লাহ)
স্বয়ং ইমাম তিরমিজি ( رَحْمَةُ الله عليه) এর কাছেহাদিসটি সনদের মাধ্যমে বর্ণিত থাকার পরেও তিনি ইহাকে হাদিস হিসেবে প্রমাণিত নয় বলে দিলেন। মুহাদ্দিছিনে কেরাম যখন কোন হাদিস সম্পর্কে ليس بثابت বলেন তখন ইহা মওজু বা জাল হাদিস বুঝায় না, বরং দ্বায়িফ সনদের বুঝায়।
যেমন হাফিজুল হাদিস ইমাম ছাখাবী ( رَحْمَةُ الله عليه) বর্ণনা করেছেন, বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিছ, হাফিজুল হাদিস, ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেছেন,
وَذكر السخاوي عَنهُ أَن لفظ لَا يثبت لَا يلْزم مِنْهُ أَن يكون مَوْضُوعا فَإِن الثَّابِت يَشْمَل الصَّحِيح فَقَط والضعيف دونه.
-“ইমাম ছাখাবী ( رَحْمَةُ الله عليه) হাফিজ ইবনু হাজার ( رَحْمَةُ الله عليه) থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় لا يثبت এই শব্দটি হাদিসকে মওজু বলা আবশ্যক করেনা, কেননা ছাবিত শব্দটি শুধুমাত্র ছহীহ্ এর ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় জয়ীফের ক্ষেত্রে নয়।” ৮৮৮৮, আল্লামা তাহের পাটনী: তাযকিরাতুল মওদ্বুআত, ৭৫ পৃষ্ঠা
অতএব, মুহাদ্দিছিনে কেরামের উসূল মোতাবেক এই হাদিস জয়ীফ। এ বিষয়ে আরেকজন সাহাবী থেকে আরেকটি রেওয়ায়েত বর্ণিত রয়েছে,
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ يُوسُفَ التُّرْكِيُّ قَالَ: نَا عِيسَى بْنُ سَالِمٍ الشَّاشِيُّ قَالَ: نَا سَلْمُ بْنُ سَالِمٍ، عَنْ جَعْفَرِ بْنِ الْحَارِثِ، عَنْ عَوْفِ بْنِ سُلَيْمَانَ، عَنْ أَبِي الزُّبَيْرِ، عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لِقَارِئِ الْقُرْآنِ إِذَا أَحَلَّ حَلَالَهُ وَحَرَّمَ حَرَامَهُ أَنْ يُشَفَّعَ فِي عَشَرَةٍ مِنْ أَهْلِ بَيْتِهِ كُلُّهُمْ قَدْ وَجَبَتْ لَهُ النَّارُ.
-“হযরত জাবের (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে খোদা ( ﷺ) বলেছেন: কোরআন পাঠকারী যে হালালকে হালাল জানবে ও হারামকে হারাম জানবে, সে তার আহলে বাইত থেকে এমন ১০জন লোক শাফায়াত করে জান্নাতে নিবে, যাদের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়েছে।” ৮৯৮৯, তাবারানী তাঁর আওছাত গ্রন্থে, হাদিস নং ৫২৫৮; ইমাম হায়ছামী: মজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ১১৬৫১;
অতএব, উভয় সনদ একত্রিত হয়ে হাদিসটি ক্বাবী বা শক্তিশালী হয়ে যাবে।
চারদিক থেকে মৃতের খাটিয়া বহন করা
এ বিষয়ে ইমাম তাবারানী ( رَحْمَةُ الله عليه) নিজ সনদে হাদিস বর্ণনা করেছেন,
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ مُحَمَّدٍ التَّمَّارُ قَالَ: نا مُحَمَّدُ بْنُ عُقْبَةَ السَّدُوسِيُّ قَالَ: نا عَلِيُّ بْنُ أَبِي سَارَةَ قَالَ: سَمِعْتُ ثَابِتًا الْبُنَانِيَّ قَالَ: سَمِعْتُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ حَمَلَ جَوَانِبَ السَّرِيرِ الْأَرْبَعَ كَفَّرَ اللَّهُ عَنْهُ أَرْبَعِينَ كَبِيرَةً
-“হজরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক ( ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি জানাযার খাটিয়ার চারটি খুটি বহন করবে, তার ৪০টি কবীরা গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” ৯০৯০, ইমাম তাবারানী: মুজামুল আওছাত, হাদিস নং ৫৯২০; ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, ৩য় খন্ড, ১২৬ পৃ: হাদিস নং ৪১০৯;
হাদিসটি উল্লেখ করে ইমাম নূরুদ্দিন হাইছামী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেছেন,
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ فِي الْأَوْسَطِ، وَفِيهِ عَلِيُّ بْنُ أَبِي سَارَةَ، وَهُوَ ضَعِيفٌ.
-“ইমাম তাবারানী তার আওছাত গ্রন্থে ইহা বর্ণনা করেছেন, ইহার সনদে আলী ইবনু ছারাহ রয়েছে সে দুর্বল রাবী।” ৯১৯১, ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ৪১০৯;
এই হাদিসের বর্ণনাকারী ‘আলী ইবনু ছারাহ’ সম্পর্কে হাফিজুল হাদিস ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেছেন,
عَلِيّ بْن أَبِي سارة ضَعِيف -“আলী ইবনু ছারাহ দুর্বল রাবী।” ৯২৯২, ইমাম ছিয়তী: আল লাআলীল মাসনুয়া, ২য় খন্ড, ৩৩৭ পৃ:;
আল্লামা তাহের পাতনী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেছেন,
لَكِن فِيهِ عَلِيُّ بْنُ يَسَارِهِ ضَعِيفٌ. -“কিন্তু এর সনদে ‘আলী ইবনু ছারাহ রয়েছে সে দুর্বল রাবী।” ৯৩৯৩, তাহের পাতনী: তাজকেরাতুল মাওজুয়াত, ১ম খন্ড, ২১৬ পৃ:;
সর্বোপরি হাদিসের সনদের মান দ্বায়িফ হবে। কোন অবস্থায় ইহা জাল হাদিস নয়। এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত লক্ষ্য করুন,
حَدَّثَنَا حَفْصُ بْنُ حَمْزَةَ، ثنا سَوَّارُ بْنُ مُصْعَبٍ، عَنْ عُمَارَةَ الْهَمْدَانِيِّ، عَنْ ثَوْبَانَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَنْ تَبِعَ جَنَازَةً فَأَخَذَ بِجَوَانِبِ السَّرِيرِ الْأَرْبَعِ غُفِرَ لَهُ أَرْبَعُونَ ذَنْبًا كُلُّهَا كَبِيرَةٌ
-“হজরত ছাওবান (رضي الله عنه) নবী করিম ( ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি জানাযা অনুসরণ করবে ও চারটি খাটিয়া বহন করবে, তার ৪০টি গোনাহ মাফ করা হবে এবং প্রত্যেকটি কবিরা গোনাহ।” ৯৪৯৪, মুসনাদে হারেছ, হাদিস নং ২৭০; ইত্তেহাফু খায়রাতুল মিহরাত, হাদিস নং ১৯৩১; ইমাম আসকালানী: মাতালিবুল আলিয়া, হাদিস নং ৮১২; ইবনে মুলাক্কিন: বাদরুল মুনীর, ৫ম খন্ড, ২২৪ পৃ:;
হযরত ছাওবান (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত এই রেওয়ায়েত সম্পর্কে হাফিজুল হাদিস ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী ( رَحْمَةُ الله عليه) ضَعِيفٌ বলেছেন। ৯৫৯৫, ইমাম আসকালানী: তালখিছুল হাবীর, ২য় খন্ড, ২৬০ পৃ:;
এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
أخبرنا أبو محمد بن الأكفاني نا عبد العزيز الكتاني أخبرني تمام بن محمد حدثني أبو القاسم الفضل بن جعفر التميمي من حفظه نا أبو قصي إسماعيل بن محمد بن إسحاق العذري حدثني أبي وعمي قالا نا معروف الخياط عَن وَاثِلَة بن الأسقع قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مَنْ حَمَلَ بِجَوَانِبِ السَّرِيرِ الأَرْبَعِ غُفِرَ لَهُ أَرْبَعُونَ كَبِيرَةً (ابْن عَسَاكِر).
-“হজরত ওয়াছিলা ইবনে আসকা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক ( ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি জানাযার খাটিয়া বহন করবে, তার ৪০টি কবিরা গোনাহ্ মাফ করা হবে।” ৯৬৯৬, ইমাম ইবনে আসাকির: তারিখে দামেস্ক, রাবী নং ৩১৮৬; ইমাম ছিয়তী: জামেউল আহাদিস, হাদিস নং ২২০৯৬; ইমাম ছিয়তী: জামেউছ ছাগীর, হাদিস নং ১২৩২১; ইমাম ছিয়তী: ফাতহুল কবীর, হাদিস নং ১১৭২৫; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৪২৩৩৮; আত তানভীর শরহে জামেউছ ছাগীর, হাদিস নং ৮৬২৯;
আল্লামা মানাভী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেছেন: واسناده ضَعِيف -“এর সনদ জয়ীফ।” ৯৭৯৭, আল্লামা মানাভী: আত তাইছির বি’শরহে জামেইছ ছাগীর, ২য় খন্ড, ৪১৫ পৃ:;
অতএব, শাওয়াহিদ থাকায় এই হাদিসটি ক্বাবী হয়ে সর্বনিম্ন ‘হাছান লি’গাইরিহী’ এর স্তরে পৌছবে। এছাড়াও ছহীহ্ সূত্রে মাওকুফরূপে এ ব্যাপারে হাদিস বর্ণিত রয়েছে। যেমন কাজী শাওকানী তার কিতাবে বলেছেন, وَرُوِيَ حَمْلُ الْجِنَازَةِ عَنْ جَمَاعَةٍ مِنْ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِينَ؛
-“জানাযা বহন করা একদল সাহাবী ও তাবেঈ থেকে বর্ণিত আছে।” ৯৮৯৮, কাজী শাওকানী: নাইলুল আওতার, ৪র্থ খন্ড, ৮৫ পৃ:;
প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন, ইমামগণের কাছে হাদিসটি এককভাবে দ্বায়িফ, কেউ ইহাকে মাওজু বলেননি। কিন্তু কওমীদের গুরু জনাব জুনায়েদ বাবু নগরী সাহেব তিনার তত্ত্বাবধানে নির্দেশনায় লিখিত “প্রচলিত জাল হাদীস” গ্রন্থেও ১৮৩ পৃষ্টায় বলেছেন- “মুহাদ্দিস ইবনে জাওযী ও আলবানী প্রমূখ মুহাদ্দিস এই অর্থের হাদীসকে মাওযূ বা মুনকার ও অন্যান্ত দুর্বল বলে গণ্য করেছেন।”
মুনকার হাদিস মাওজু নয় আবার মাওজু হাদিসও মুনকার নয় কিন্তু জুনায়েদ বাবুনগরীরা দুটিকে এক বুঝানোর জন্য লিখেছেন ‘মাওযূ বা মুনকার’! তারা সমস্থ মুহাদ্দিছগণের নীতি বাদ দিয়ে লা-মাজহাবী আলবানীর নীতি অবলম্বন করছে।
--------------------------------