শুক্রবারে পিতা-মাতার কবর যিয়ারতের ফজিলত
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ النُّعْمَانِ بْنِ شِبْلٍ قَالَ: حَدَّثَنِي أَبِي قَالَ: حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ النُّعْمَانِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، عَمِّ أَبِي، عَنْ يَحْيَى بْنِ الْعَلَاءِ الرَّازِيِّ، عَنْ عَبْدِ الْكَرِيمِ أَبِي أُمَيَّةَ، عَنْ مُجَاهِدٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ زَارَ قَبْرَ أَبَوَيْهِ أَوْ أَحَدِهِمَا فِي كُلِّ جُمُعَةٍ غُفِرَ لَهُ، وَكُتِبَ بَرًّا
-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে করিম ( ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি প্রতি শুক্রবারে তার পিতা-মাতার অথবা একজনের কবর যিয়ারত করবে আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং পিতা-মাতার প্রতি দ্বায়িত্ব পালনকারী হিসেবে তাকে লিপিবদ্ধ করবেন।”
(ইমাম তাবারানী: মুজামুল আওছাত, হাদিস নং ৬১১৪; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াইবুল ঈমান, হাদিস নং ৭৫২২; ইমাম তাবারানী: মুজামুল কবীর, হাদিস নং ৯৫৫; হাকেম তিরমিজি: নাওয়াদেরুল উসূল, ১ম খন্ড, ১২৬ পৃ:; আল ফিরদৌছ, হাদিস নং ৫৫৩৭; ইমাম ছিয়তী: জামেউল আহাদিস, হাদিস নং ২২৩০১; ইমাম ছিয়তী: জামেউছ ছাগীর, হাদিস নং ১২৩৮০; ইমাম ছিয়তী: ফাতহুল কবীর, হাদিস নং ১১৮১৯; হাফিজ ইরাকী: তাখরিজু আহাদিসুল এহইয়া, হাদিস নং ৮; ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ৪৩১২; আল্লামা ছানআনী: আত তানভীর শরহে জামেউছ ছাগীর, হাদিস নং ৮৬৯৯)
এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম নুরুদ্দিন হায়ছামী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেন:
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ فِي الْأَوْسَطِ وَالصَّغِيرِ، وَفِيهِ عَبْدُ الْكَرِيمِ أَبُو أُمَيَّةَ، وَهُوَ ضَعِيفٌ.
-“ইমাম তাবারানী তার আওছাত ও ছগীরে বর্ণনা করেছেন, এর মধ্যে ‘আব্দুল করীম আবু উমাইয়া’ নামক রাবী রয়েছে সে দ্বায়িফ ।”
(মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ৪৩১২)
এই হাদিস সম্পর্কে প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা মানাভী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেন:
(عَن أبي هُرَيْرَة) واسناده ضَعِيف -“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হাদিসটির সনদ দ্বায়িফ ।” (আল্লামা মানাভী: আত তাইছির বি’শরহে জামিইছি ছাগীর, ২য় খন্ড, ৪২০ পৃ:)
হাদিসটি আরেকজন সাহাবী থেকে ভিন্ন আরেকটি সূত্রে বর্ণিত আছে,
حَدَّثَنَا مُحَمد بْنُ الضَّحَّاكِ بْنُ عَمْرو بْنِ أَبِي عَاصِمٍ النبيل، حَدَّثَنا يزيد بن خالد الأصبهاني، حَدَّثَنا عَمْرو بن زياد، حَدَّثَنا يَحْيى بْنُ سُلَيْمٍ الطَّائِفِيُّ عَنْ هِشَامِ بْنِ عُرْوَةَ، عَنْ أَبِيهِ عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، عَن أَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يقُول: مَن زَارَ قَبْرَ وَالِدَيْهِ أَوْ أَحَدِهِمَا يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَرَأَ يس غُفِرَ لَهُ.
-“হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি রাসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি শুক্রবারে তার পিতা-মাতার কবর যিয়ারত করবে অথবা তাদের একজনের এবং সূরা ইয়াছিন তেলাওয়াত করবে, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে।”
(ইমাম ইবনে আদী: আল কামিল ফি দোয়াফাইর রিজাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, ২৬০ পৃ: ১৩১৬ নং রাবীর ব্যাখ্যায়; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৪৫৪৮৬; তাজকিরাতুল মাওজুআত লিল ফাতানী, ১ম খন্ড, ২১৯ পৃ:)
এর সনদ সম্পর্কে মাওলানা উবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী তদীয় কিতাবে বলেন,
وفي الباب عن أبي بكر عند ابن عدي بإسناد ضعيف، وعن أبي هريرة عند الحكيم الترمذي وإسناده أيضاً ضعيف، قاله العزيزي في شرح الجامع الصغير.
-“এই বিষয়ে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) থেকে ইবনে আদী ( رَحْمَةُ الله عليه) দ্বায়িফ সনদে হাদিস বর্ণনা করেছেন। অনুরূপ হাকেম তিরমিজি ( رَحْمَةُ الله عليه) দ্বায়িফ সনদে হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। আযিযী ( رَحْمَةُ الله عليه) তার ‘শরহে জামেউছ ছাগীর’ গ্রন্থে ইহা বলেছেন।”
(মেরআত শরহে মেসকাত, ১৭৮৩ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়)
এ বিষয়ে আরেকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,
حَدَّثَنِي هَاشِمُ بْنُ الْحَارِثِ، قَالَ: نا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ بَكْرٍ السَّهْمِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ النُّعْمَانِ، رَفَعَ الْحَدِيثَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَنْ زَارَ قَبْرَ وَالِدَيْهِ، أَوْ أَحَدِهِمَا، فِي كُلِّ جُمُعَةٍ مَرَّةً، غُفِرَ لَهُ وَكُتِبَ بَرًّا
-“মুহাম্মদ ইবনে নুমান মারফু রূপে নবী করিম ( ﷺ) হতে হাদিস বর্ণনা করেন, রাসূলে করিম ( ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি প্রতি শুক্রবারে তার পিতা-মাতার অথবা একজনের কবর যিয়ারত করবে আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং পিতা-মাতার প্রতি দ্বায়িত্ব পালনকারী হিসেবে তাকে লিপিবদ্ধ করবেন।”
(ইমাম ইবনে আবী দুানিয়া: মুকারিমুল আখলাক্ব, হাদিস নং ২৪৯; ইমাম বায়হাক্বী; শুয়াইবুল ঈমান, হাদিস নং ৭৫২২; মেসকাত শরীফ, হাদিস নং ১৭৬৮; ইমাম ছিয়তী: আল লাআলী মাসনূয়া, ২য় খন্ড, ৩৬৬ পৃ:)
এই হাদিস সম্পর্কে হাফিজ ইরাকী ( رَحْمَةُ الله عليه) এর অভিমত,
قال العراقي: مرسل صحيح الإسناد. -
“হাফিজ ইরাকী বলেন: মুরছাল হাদিসের সনদ ছহীহ্।”
(আল্লামা ছানআনী: তানভীর শরহে জামেউছ ছাগীর, হাদিস নং ৮৬৯৯)
অতএব, বিষয়টি ৩টি সনদে বর্ণিত হয়েছে বিধায় পরস্পর একত্রিত হয়ে হাদিসটি ক্বাবী বা শক্তিশালী হয়ে যাবে।
প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন, ইমাম নূরুদ্দিন হায়ছামী ও ইমাম মানাভী ( رَحْمَةُ الله عليه) হাদিস সম্পর্কে মওজু বলেননি বরং ضَعِيفٌ বলেছেন। হাফিজ ইরাজী ( رَحْمَةُ الله عليه) মুরছাল রেওয়ায়েতটিকে ছহীহ্ বলেছেন। কিন্তু কওমীদের বড় আলেম জনাব জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেবের তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় লিখিত ‘প্রচলিত জাল হাদিস’ নাম বইয়ের চতুর্থ প্রকাশের ১০৬ পৃষ্টায় লা-মাজহাবী নাছিরুদ্দিন আলবানীর রেফারেন্স দিয়ে হাদিসটিকে মওজু বা জাল হাদিস বানিয়ে দিয়েছে। আসলে এই বাবুনগরীরা পূর্বসূরী আইম্মায়ে কেরামের অনুসারী নয়, তারা ইবনু আব্দিল ওহাব নজদী ও আলবানীর দালাল।
সকল মুহাদ্দিছগণ একমত যে দ্বায়িফ সনদের হাদিস যখন একাধিক সনদে বর্ণিত হয় তখন তাকে তা ‘হাছান লিগাইরিহি’ নামে নামকরণ করা হয়। সে অনুপাতে এ হাদিসটি নি:সন্দেহে হাদিসে ‘হাছান’ পর্যায়ের। যেমন এ বিষয়ে আইম্মায়ে কেরামের অভিমত নিচে লক্ষ্য করুন,
হিজরী নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম আব্দুর রহমান জালালুদ্দীন ছিয়তী (رضي الله عنه) {ওফাত.৯১১হি.} বলেন-
المتروك او المنكر اذا تعددت طرقه ارتقى الى درجة الضعيف لغريب بل ربما ارتقى الى الحسن-
-“মাতরুক ও মুনকার হাদিস বিভিন্ন তরিকায় বর্ণিত হওয়ার কারণে দ্বায়িফ হাদিসের মর্যাদায় উপনীত হয়। আবার কখনো হাদিসে “হাসানের” মর্যাদায় উপনীত হয়ে থাকে।”
(আল্লামা জালালুদ্দীন ছিয়তী: তা‘আকিবাত আলা মওজুআত: ৭৫ পৃ. কিতাবুল মানাকিব)
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেন,
وَتَعَدُّدُ الطُّرُقِ يُبْلِغُ الْحَدِيثَ الضَّعِيفَ إِلَى حَدِّ الْحَسَنِ، -“দ্বায়িফ হাদিসও একাধিক সনদে বর্ণিত হলে “হাছান” হাদিস এর পর্যায়ে পৌঁছে যায়।”
(আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাত: ৩/৭৭, হাদিস: ১০০৮)
তিনি তার আরেক কিতাবে বলেন,
وَتَعَدُّدُ الطُّرُقِ وَلَوْ ضَعُفَتْ يُرَقِّي الْحَدِيثَ إِلَى الْحسن -“একাধিক সনদে যদিও দ্বায়িফ হাদিস বর্ণিত হয় তবে বর্ণিত ঐ হাদিস “হাছান” বলে গণ্য হবে বা উপনীত হবে।”
(মোল্লা আলী ক্বারী: আসারুল মারফ‚‘আ, পৃ-৪৮১)
আল্লামা কামালুদ্দীন ইবনে হুমাম ( رَحْمَةُ الله عليه) বলেন,
وَلَوْ تَمَّ تَضْعِيفُ كُلِّهَا كَانَتْ حَسَنَةً لِتَعَدُّدِ الطُّرُقِ وَكَثْرَتِهَا.
-“হাদীসের সমস্ত রাবী দুর্বল প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন তরিকায় বর্ণিত হওয়ার কারণে তা ‘হাসানে’ পরিণত হয়ে যায়।”
(ইমাম ইবনে হুমাম: ফতহুল কাদির: ১/৩০৬ পৃ)
সুতরাং একাধিক সূত্র থাকায় উসূল মোতাবেক হাদিসটি হাছান পর্যায়ের হাদিস। প্রিয় পাঠক! এই হাদিসটিকে ইমাম নূরুদ্দিন হায়ছামী ( رَحْمَةُ الله عليه), ইমাম মানাভী ( رَحْمَةُ الله عليه) দ্বায়িফ বলেছেন, স্বয়ং লা-মাজহাবী উবাইদুল্লাহ মুবারকপুরীও হাদিসটিকে দ্বায়িফ বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ ইহাকে জাল হাদিস বলেননি। অথচ জনাব আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেব তিনার ‘হাদিসের নামে জালিয়াতী’ নামক বইয়ের ৫৯৮ পৃষ্টায় এই হাদিসকে জাল বলে চালিয়ে দিলেন! আরো আশ্চর্যের বিষয় হল, ইমাম মানাভী ( رَحْمَةُ الله عليه) তার ‘আত তাইছির’ গ্রন্থে হাদিসটিকে দ্বায়িফ সনদের বলেছেন এবং ‘ফাযজুল কাদির’ গ্রন্থে হাদিসের মতন নিয়ে কিছু আলোচনা করেছেন কিন্তু হাদিসটিকে মওজু বা জাল বলেননি। অথচ জাহাঙ্গীর সাহেব লিখে দিলেন ইমাম মানাভী ( رَحْمَةُ الله عليه) নাকি বলেছেন, এই হাদিসের সনদে জালিয়াত রাবী রয়েছে! (নাউজুবিল্লাহ) আপনাই বলুন! ইহা কি ইমামদের নামে জালিয়াতী নয়?
------------------------------