বিষয় নং-৫: দ্বায়িফ সনদকে অবহেলা করার ভয়ংঙ্কর পরিণতি:

প্রিয় নবীর হাদিসকে দ্বায়িফ হাদিস বললে ঈমান থাকবে না, তবে হ্যাঁ, রাবীর গুণাবলীর কারণে সনদ ছহীহ্, হাছান, দ্বায়িফ হয়ে থাকে। তাই বলতে হবে সনদ দ্বায়িফ; হাদিস দ্বায়িফ এমনটি বলার কোন সুযোগ নেই। বর্তমান আহলে হাদিসগণ দ্বায়িফ সনদের হাদিসকে হাদিস হিসেবে মানতেই রাজি নন, অথচ মুহাদ্দিছগণের নিকট দ্বায়িফও রাসূল (ﷺ) এর হাদিস। যার উপর আমল করা মুস্তাহাব। তবে রাবী শক্তিশালী, দুর্বল হওয়া নিয়ে মতানৈক্য থাকতে পারে। তাই দ্বায়িফ সনদকে ‘হাদিস নয়’ বলা যাবে না। আর আমি নিম্নে দ্বায়িফ সনদকে অবহেলার শাস্তির কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করায় উল্লেখ করছি।

এক হাদিসে  বর্ণিত আছে-

عَن سَعِيد بْن الْمسيب عَن أَبِي هُرَيْرَةَ عَن النَّبِي قَالَ: مَنِ احْتَجَمَ يَوْمَ السَّبْتِ أَوِ الأَرْبِعَاءِ فَأَصَابَهُ وَضَحٌ فَلا يَلُومَنَّ إِلا نَفْسَهُ.

-“যে ব্যক্তি বুধবার কিংবা শনিবার নিজ শরীরে শিঙ্গা প্রয়োগ করে দূষিত রক্ত অপসারণ করবে, তার শরীরে কুষ্ট রোগ (সাদা রোগ) হবে। আর সে তখন নিজেকেই দোষারোপ করবে।”  ১০২১০২.  ইমাম ছিয়তী, আল-লাআলিল মাসনূআ,  ২/৩৪২ পৃ.,  দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ,  বয়রুত,  লেবানন;

একজন বিজ্ঞব্যক্তি, যার নাম মুহাম্মদ ইবনে জাফর নিশাপুরী তার শিঙ্গা প্রয়োগের প্রয়োজন হয়েছিল। সেদিন ছিল বুধবার। তিনি মনে করেছিলেন যেহেতু উল্লেখিত হাদিসটি ‘ছহীহ্ পর্যায়ের নয়’ সেহেতু শিঙ্গা প্রয়োগে কোন দোষ নেই। ওই দিন তিনি স্বীয় দূষিত রক্ত অপসারণের কাজ সম্পন্ন করলেন কিন্তু এর সাথে সাথে কুষ্ট রোগ তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ল যখন রাতে ঘুমালেন তখন স্বপ্নযোগে হুযূর করীম (ﷺ) দীদার লাভ করলেন। আর তিনি তাঁর নিকট রোগের ব্যাপারে আরয করলেন, তখন হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করলেন- إياك والاستهانة بحديثي -“সাবধান! আমার হাদিসকে হালকা (তুচ্ছ) মনে করবে না।” ইমাম জালালুদ্দীন ছিয়তী (رضي الله عنه) আরও উল্লেখ করেন-

فَقلت تبت يَا رَسُول اللَّهِ فانتبهت وَقد عافاني اللَّه وَذهب ذَلِكَ عني.

-“তাৎক্ষণিকভাবে তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহহ! (ﷺ) আমি তওবা করে নিচ্ছি এরপর জেগে ওঠে দেখেন তিনি সুস্থ হয়ে গেছেন।” ১০৩ ১০৩ . ইমাম ইবনে আসাকির: তারিখে দামেস্ক, ১/৭৫ পৃ., ইমাম ছিয়তী, আল-লাআলিল মাসনূআ, ২/৩৪২ পৃ., দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।


ইমাম জালালুদ্দীন ছিয়তী (رَحْمَةُ الله عليه‎‎) একটি ঘটনা উল্লেখ করেন এভাবে-

وَأخرج ابْن عَسَاكِر فِي تَارِيخه من طَرِيق أَبِي عَليّ مِهْرَان بْن هرون الْحَافِظ الهازي قَالَ سَمِعْتُ أَبَا معِين الْحُسَيْن بْن الْحَسَن الطَّبَرِيّ يَقُولُ: أردْت الْحجامَة يَوْم السبت فَقلت للغلام: ادْع لي الْحجام فَلَمَّا وُلّي الْغُلَام ذكرت خبر النَّبِي: مَنِ احْتَجَمَ يَوْمَ السَّبْتِ وَيَوْمَ الأَرْبِعَاءِ فَأَصَابَهُ وَضَحٌ فَلا يَلُومَنَّ إِلَّا نَفسه

قَالَ: فدعوت الْغُلَام ثُمّ تفكرت فَقلت هَذَا حَدِيث فِي إِسْنَادُه بعض الضعْف فَقلت للغلام ادْع الْحجام لي فَدَعَاهُ فاحتجمت فَأَصَابَنِي البرص فَرَأَيْت رَسُول الله فِي النّوم فشكوت إِلَيْهِ حَالي فَقَالَ إياك والاستهانة بحديثي ونذرت للَّه نذرا لَئِن أذهب اللَّه مَا بِي مِنَ البرص لَمْ أتهاون فِي خبر النَّبِي صَحِيحا كَانَ أَو سقيمًا فَأذْهب اللَّه عني ذَلِكَ البرص

-“ইমাম ইবনে আসাকির (رَحْمَةُ الله عليه‎‎) হাফিস রাযী আলী ইবনে মিহরান ইবনে হারুন থেকে স্বীয় ‘তারিখে দামেস্ক’ এ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি হযরত আবু মুঈন হুসাইন ইবনে হাছান তাবরীকে বলতে শুনেছি,  তিনি বলেন, আমি একবার শনিবার শিঙ্গা লাগাতে মনস্থ করেছি। সুতরাং আমি আমার ক্রীতদাসকে হাজ্জাম (ক্ষৌরকার) কে শিঙ্গা লাগানোর জন্য ডাকতে নির্দেশ দিলাম। ক্রীতদাস তাকে ডাকতে চলে যাওয়ায় এবং বুধবার আমার মনে পড়ল নবী করীম (ﷺ) ওই হাদিস যেখানে বর্ণিত আছে ‘যে ব্যক্তি বুধবার কিংবা শনিবার নিজ শরীরে শিঙ্গা প্রয়োগ করে দূষিত রক্ত অপসারণ করবে, তার শরীরে কুষ্ট রোগ (সাদা রোগ) হবে। আর সে তখন নিজেকেই দোষারোপ করবে।’ তারপর কিছু চিন্তা ভাবনা করে বললাম, এ হাদিসের সনদে মধ্যে তো কিছু দুর্বলতা আছে। শেষ পর্যন্ত আমি শিঙ্গা প্রয়োগ করলাম। ফলে আমার শ্বেত রোগ হয়ে গেল। অত:পর স্বপ্নযোগে নাবী কারিম (ﷺ) এর সাথে স্বপ্নে সাক্ষাত হল। তখন আমি স্বীয় অবস্থা সম্পর্কে হুযূর (ﷺ) এর মহান দরবারে ফরিয়াদ করলাম। তিনি ইরশাদ করেন, সাবধান! আমার হাদিসকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে না, অত:পর আমি আল্লাহর ওয়াস্তে মানত করলাম, আল্লাহ্ পাক যদি আমার শ্বেত রোগ থেকে মুক্তি দেন, তবে আমি আর কখনো নাবী কারিম (ﷺ) এর হাদিসকে তুচ্ছ জ্ঞান করব না, ওই হাদিস সনদ অনুযায়ী ছহীহ্ (বিশুদ্ধ) হোক কিংবা দ্বায়িফ (দুর্বল) হোক। সুতরাং আল্লাহ্ পাক আমার শ্বেত রোগ থেকে মুক্তি দান করলেন।” ১০৪১০৪ . ইমাম ইবনে আসাকির: তারিখে দামেস্ক, ১/৭৫ পৃ., ইমাম ছিয়তী, আল-লাআলিল মাসনূআ, ২/৩৪২ পৃ., দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।


এভাবে আল্লামা শিহাবুউদ্দীন খিফ্ফাযি হানাফী (رضي الله عنه) এর রচিত “নাসিমুর রিয়াদ্ব শরহে শিফা” গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, 

قص الاظفار وتقليمها سنة وورد النهى عنه فى يوم الاربعاء وانه يورث البرص وحكى عن بعض العلماء انه فعله فنهى عنه فقال لم يثبت هذا فلحقه البرص من ساعته فراى النبى صلى الله عليه وسلم فى منامه فشكى اليه فقال له الم تسمع نهى عنه فقال لم يصح عندى فقال صلى الله عليه وسلم يكفيك انه يسمع ثم مسح بدنه بيده الشريعة فذهب ما به فتاب عن مخالفة ما سمع كذا-نسيم الريض شرح الشفا:القسم الاول فى تعظيم العلى الا على لقدر النبى صلى الله عليه وسلم-

-“নখ কাটা বা ছেঁড়ে ফেলা সুন্নাত। তবে বুধবার এটা সম্পর্কে নিষেধ বলে বর্ণিত আছে এবং এটাও যে, এতে শ্বেত রোগ হয়। জনৈক আলিম সম্পর্কে কথিত আছে যে, তিনি বুধবার নখ কেটেছেন। উপস্থিত লোকেরা তাকে (হাদিসের ভিত্তিতে নিষেধ হওয়ার কারণে) নিষেধ করলেন। উত্তরে তিনি বললেন, হাদিসটি ছহীহ্ নয়। তখনই তাঁর শ্বেত রোগ ছড়িয়ে পড়ল। একদা তিনি হুযূর (ﷺ) কে স্বপ্নে দেখলেন এবং তার নিকট স্বীয় রোগ সম্পর্কে আবেদন করলেন। হুযূর কারীম (ﷺ) তাকে উত্তরে ইরশাদ করলেন, তুমি কি শোননি যে সেটা নিষিদ্ধ? আরয করলেন, হাদিসটি ছহীহ্ হিসেবে আমার কাছে পৌঁছেনি তখন ইরশাদ হল, তোমার জন্য তো এতটুকুই যথেষ্ট ছিল যে, হাদিসটি আমারই নামে উদ্ধৃত হয়ে তোমার কানে পৌঁছেছে। এটা ইরশাদ করার পর হুযূর (ﷺ) স্বীয় পবিত্র হাত তার শরীরে বুলিয়ে দিলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন এবং হাদিস শরীফ শুনে আর বিরোধ পোষণ করবেন না মর্মে তাওবা করে নিলেন।” ১০৫১০৫ . আল্লামা খিফ্ফাযী, নাসীমুর রিয়াদ্ব শরহে শিফা, পৃ- ১/১২০


ইমাম তিরমিজি ( رَحْمَةُ الله عليه‎‎) অনেক হাদিসে বলেছেন, 

هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ -“এই হাদিসটি হাছান, ছহীহ্ গরীবও বটে।  ১০৬১০৬  সুনানে তিরমিযী,  ১/১২৮পৃ. হাদিস:৭২,  ও ১/২৬২পৃ. হাদিস: ১৯০ এবং ১/৫৫৪পৃ. হাদিস: ৪২৮;

ইমাম তিরমিজির বক্তব্যের মর্ম হলো, এই হাদিসখানা কয়েক রকম সনদের দ্বারা বর্ণিত। এক সনদে দ্বারা হাছান আবার এক সনদ দ্বারা ছহীহ্ আবার এক সনদ দ্বারা গরীব। তাই শুধু গরীব চিন্তা নিয়ে বসে থাকা যাবে না। দ্বায়িফ সনদের হাদিসের অবহেলা কারীদের শাস্তির ব্যাপারে আ‘লা হযরত (رضي الله عنه) এর খলিফা আল্লামা জুফারুদ্দীন বিহারী (رضي الله عنه) রচিত ‘সহিহুল বিহারী’ প্রথম খন্ড বিষদ আকারে দেখতে পারেন।


Top