বিষয় নং-০১. কথিত আহলে হাদিসদের দৃষ্টিতে দ্বায়িফ হাদিস বলতে কী বুঝায়?
বর্তমান আহলে হাদিস তথা সালাফীদের নিকট দ্বায়িফ হাদিস হলো এক প্রকার জাল হাদিস হিসেবে গণ্য, যেমনটি আলবানীর অনেক পুস্তকে দৃষ্টি দিলে তা অনুধাবন করা যায়। আহলে হাদিস শায়খ কামাল আহমদ তার লিখিত ‘দ্বায়িফ হাদীস কেন বর্জনীয়?’ (যা ওয়াহীদিয়া ইসলামিয়া লাইব্রেরী, রাণীবাজার, রাজশাহী, বাংলাদেশ হতে প্রকাশিত) গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটি নিয়েই আলোকপাত করেছেন। আরেক আহলে হাদিস মুযাফ্ফর বিন মুহসিন তার লিখিত ‘দ্বায়িফ ও জাল হাদীছ বর্জনের মূলনীতি’ গ্রন্থে সকল মুহাদ্দিছীনে কিরামের নীতিমালাকে উপেক্ষা করে ৩৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- “যার প্রতি (দ্বায়িফ হাদিসের উপর) আমল করা ঐকমত্যের ভিত্তিতে নাজায়েয।”
তিনি দ্বায়িফ আর জাল হাদিসের হুকুমকে এক সাথে মিলিয়ে ৩৫ পৃষ্ঠায় লিখেন- “অতএব শারঈ মানদন্ডে জাল হাদীছ তো নয়ই, দ্বায়িফ হাদীছও গ্রহণযোগ্য নয়।”
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! সকল মুহাদ্দেসীন কেরাম একমত যে, দ্বায়িফ সনদের হাদিসও হাদিসের এক প্রকারের অন্তর্ভূক্ত; সনদের রাবির আদালতের ক্ষেত্রে ছহীহ, হাছান, দ্বায়িফ হয়ে থাকে। কিন্তু আলবানী ও তার উত্তরসূরীরা সকল ইমাম ও মুহাদ্দীসিনে কেরামের নীতিমালাকে উপেক্ষা করে, তারাই এক উসূলে হাদিসের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। অথচ আজ এ আহলে হাদিসগণ পৃথিবীর সমস্ত মুহাদ্দিছদের ইজমার বিপরীতে কথা বলছেন। এ বিষয়ে বিখ্যাত হাফিজুল হাদিস ও ফকীহ, ইমাম নববী আশ-শাফেয়ী (رضي الله عنه) বলেন-
قد اتفق العلماء على جواز العمل بالحديث الضعيف فى فضائل الاعمال:مقدمة المؤلف
-“উলামায়ে কিরাম এই বিষয়ে সবাই ঐক্যমত পোষণ করেছেন দুর্বল হাদিস ফাযায়েলে আমলের জন্য গ্রহণযোগ্য।” ১১ . ইমাম নববী: আরবাঈন: ১/২০ পৃ. এবং ইমাম ইবনে দাকিকুল ঈদ, শরহে আরবাঈনুন নববিয়্যাহ, ১/২০ পৃ.
বিশ্ববিখ্যাত মুফাচ্ছির, মুহাদ্দিছ ও ফকিহ, আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী হানাফী (رضي الله عنه) ‘তাফসীরে রুহুল বায়ানে’ লিখেন-
لكن المحدثين اتفقوا على ان الحديث الضعيف يجوز العمل به فى الترغيب والترهيب
-“তবে মুহাদ্দিছীনে কিরাম এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, আকর্ষণ সৃষ্টি ও ভীতি সঞ্চারের বেলায় দ্বায়িফ হাদিস অনুযায়ী আমল করা যায়েয।” ২২. আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী: তাফসিরে রুহুল বায়ান, ২/৪১০ পৃ.
এ বিষয়ে বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ও ফকীহ, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رضي الله عنه) লিখেন, وَالضَّعِيفُ يُعْمَلُ بِهِ فِي فَضَائِلِ الْأَعْمَالِ اتِّفَاقًا -“দ্বায়িফ হাদিস ফাযায়েলে আমলের মধ্যে আমল করার ব্যাপারে ইমামগণের ঐক্যমত হয়েছে।” ৩ ৩. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী: মওজু আতুল কাবীর: ১/৩১৫ পৃ. হা/৪৩৩
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! উপরের তিনজন নির্ভরযোগ্য আলেমের অভিমত থেকে জানতে পারলাম দ্বায়িফ হাদিস ফাযায়েলে আমলের জন্য গ্রহণযোগ্য সে বিষয়ে সকল ইমামদের ইজমা হয়েছে, তাহলে এ নীতি অমান্য করে আহলে হাদিসরা কি তাদের অর্ন্তভুক্ত হবেন!
কিন্তু আহলে হাদিস আলবানী সকল মুহাদ্দিসের ইজমার বিরোদ্ধে অবস্থান নিয়ে লিখেছেন- “অনেকে এরূপ ধারণা পোষণ করেন যে, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীসের উপর আমল করা যাবে এ মর্মে কোনো মতভেদ নেই। বাস্তবিক পক্ষে তা সঠিক নয়।” ৪. আলবানী, য‘ঈফ ও জাল হাদীছ সিরিজ, ১ম খন্ড, ৫০ পৃ. তাওহীদ পাবলিকেশন্স, বংশাল, ঢাকা-১১০০;
পাঠকদের কাছেই বিচারের সিদ্ধান্ত অর্পন করা হলো, আপনারা কাকে মানবেন, আলবানীকে না ইমাম নববী (رَحْمَةُ الله عليه) সহ পৃথিবীর সকল বিখ্যাত ইমামদের?
অপরদিকে দ্বায়িফ হাদিস যখন একাধিক সনদে বর্ণিত হবে তা আর দ্বায়িফ থাকে না। মুহাদ্দিছীনে কিরামের এ নীতিমালাটি আহলে হাদিস সম্প্রাদায় নিজেদের মতের পক্ষে যখন একটি দ্বায়িফ সনদের হাদিসও আসবে তখন এটিকে ‘হাছান’ বলতে একটুও চিন্তা করে না, আর নিজেদের মত ও পথের বিরোদ্ধে যখন একাধিক সনদ নয় বরং ১৭ জন সাহাবী বর্ণনা করলেও তা তাদের নিকট দ্বায়িফ সনদই থেকে যায়! ৫৫. এ বিষয়ে আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন বেরলবী (রহ:) এর সংকলিত ‘ফতোওয়ায়ে আফ্রিকায়’ রাসূল (ﷺ) আবূ বকর, উমর একই মাটির সৃষ্টির হাদিসের আলোচনায় দেখতে পাবেন যে একটি জাল হাদিসকেও ড. আব্দুল্লাহ জাঙ্গীর তার ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ বইয়ের ৩৪৮ পৃষ্ঠায় আলবানীর দলিলের ভিত্তিতে ‘হাছান’ বলতে একটুও চিন্তা বা দ্বিধাবোধ করেননি। আবার আহলে হাদিস শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী আলেমের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র ও যে সূরা ইখলাস তিনবার পড়বে সে যেন সর্ম্পন্ন কুরআন পড়লো এবং ‘তোমরা মু‘মিনের অন্তর দৃষ্টিকে ভয় কর, কেননা তারা আল্লাহর নূর দ্বারা দেখে’ এ হাদিসটি দ্বারা ওলীদের কাশ্ফ প্রমাণিত হয় বিধায় মোট দশজনেরও বেশী সাহাবি হতে বর্ণিত হওয়ার হওয়ার পরেও হাদিসটিকে সে দ্বঈফ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। অনূরুপ বহু উদাহারণ আমার এ পুস্তুকে পাবেন এবং আলবানীর এ সমস্ত বাতিল মতবাদ এবং ভূয়া তাহকীকের জবাব জানতে জনাব শহিদুল্লাহ বাহাদুরের ‘আলবানীর স্বরূপ উন্মোচন’ পড়ুন।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, আলবানী ও তার উত্তরসূরীদের নিকট কোনো সনদের একজন রাবী মাজহুল (অপরিচিত) থাকলে তখন সেটিকে মাওদ্বু বা জাল হাদিস বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। আমার বিভিন্ন পুস্তুকের অনেক স্থানে আলবানী ও তার অনুসারীদের এ মনগড়া নীতির খন্ডন করেছি, এ কিতাবের বিভিন্ন স্থানেও আলবানীর এ ভুল নীতিমালার জবাব পাবেন, ইনশা আল্লাহ!