বিষয় নং-৪: দুর্বল সনদ একাধিক সূত্রে বর্ণিত হলে ‘হাছান’ স্তরে উপনীত হয়:
ইলমে হাদিসের এ নীতিমালাটি এখানে এ জন্যই উল্লেখ করলাম যে বর্তমান আহলে হাদিসগণ তথা সালাফীরা দ্বায়িফ সনদের হাদিস একাধিক সনদে বর্ণিত হলেও সেটি নাকি দ্বায়িফই থাকে তাদের সে মিথ্যা শ্লোগানের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য। এটি তারা বলার পরেও বিভিন্ন সময়ে নিজেদের স্বার্থে নফসের তাড়নায় এ শ্লোগান ভুলে যান। নিজেদের স্বপক্ষে কোন অত্যন্ত দুর্বল (জাল হওয়ার নিকটবর্তী) হাদিস একাধিক সনদে বর্ণিত হলে তাকে ‘হাছান’ বলতে একটু দ্বিধাবোধ করেন না। এ উসূলে হাদিসের এ নীতিমালাটি বিভিন্ন হাদিস সম্পর্কে আলোকপাতকালে বিভিন্ন অবস্থায় অনেক প্রয়োজন পড়বে, তাই বারবার যাতে উল্লেখ করতে না হয় সেজন্য এখানে তা উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। এ প্রসঙ্গে আমি কিছু ঊসূলে হাদিসবিদ এবং পাশাপাশি ফকিহগণের অভিমতও পেশ করবো ইনশা আল্লাহ।
অভিমত নং-১: হিজরী ১১শ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, বিখ্যাত উসূলে হাদিসবিদ (যিনি উসূলে হাদিসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ নুখবাতুল ফিকরের শরাহ করেছেন), হানাফী বিখ্যাত ফকিহ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رَحْمَةُ الله عليه) লিখেন-
وَتَعَدُّدُ الطُّرُقِ يُبْلِغُ الْحَدِيثَ الضَّعِيفَ إِلَى حَدِّ الْحَسَنِ
-“দ্বায়িফ হাদিসও একাধিক সনদে বর্ণিত হলে “হাছান” হাদিস এর পর্যায়ে পৌঁছে যায়।” ৮৫৮৫ . আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাত: ৩/৭৭ পৃ. হা/১০০৮
অভিমত নং-২: তিনি আরেকটি দ্বায়িফ সনদ একাধিক সূত্রে বর্ণিত হওয়ার আলোচনা করতে গিয়ে লিখেন-
وَلَهُ طُرُقٌ أُخْرَى ذَكَرَهَا الطَّحَاوِيُّ وَغَيْرُهُ تَرْتَقِي إِلَى حَدِّ الْحَسَنِ
-“এ হাদিসটি আরেকটি ভিন্ন সনদেও বর্ণিত আছে যা ইমাম তাহাভী (رَحْمَةُ الله عليه)সহ আরও অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ উল্লেখ করেছেন। আর তাতে হাদিসটি ‘হাছান’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।” ৮৬৮৬. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাত: ২/৭৫৪, হাদিস: ৯৪৩;
অভিমত নং-৩: তিনি তার আরেক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে লিখেছেন-
وإن ضعف بعضها، فبتعدد الطرق، يرتقي إلى حد الحسن
-“আর যখন দ্বায়িফ সনদ একাধিক সনদে বর্ণিত হয় তখন তার মর্যাদা ‘হাছান’ পর্যায়ে পৌঁছে যায়।” ৮৭৮৭ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, শরহে মুসনাদে আবি হানিফা, ৫২১ পৃ.;
অভিমত নং-৪: তিনি তার সুপ্রসিদ্ধ দ্বায়িফ জাল নির্ণয়ের কিতাবে এক স্থানে লিখেন- وَتَعَدُّدُ الطُّرُقِ وَلَوْ ضَعُفَتْ يُرَقِّي الْحَدِيثَ إِلَى الْحسن
-“একাধিক সনদে যদিও দ্বায়িফ হাদিস বর্ণিত হয় তবে বর্ণিত ঐ হাদিস ‘হাছান’ বলে গণ্য হবে বা উপনীত হবে।” ৮৮৮৮ . আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী: আসারুল মারফ‚আহ, পৃ-৪৮১
অভিমত নং-৫: হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিছ, আল্লামা কামালুদ্দীন ইবনুল হুমাম (رَحْمَةُ الله عليه) বলেন-
وَلَوْ تَمَّ تَضْعِيفُ كُلِّهَا كَانَتْ حَسَنَةً لِتَعَدُّدِ الطُّرُقِ وَكَثْرَتِهَا
-“হাদিসের সমস্থ রাবী দুর্বল প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন তরিকায় বর্ণিত হওয়ার কারণে তা ‘হাছানে’ পরিণত হয়ে যায়।” ৮৯৮৯ . ইমাম ইবনুল হুমাম: ফতহুল কাদির: ১/৩০৬ পৃ.
অভিমত নং-৬: তিনি তাঁর লিখিত উক্ত কিতাবে আরও লিখেন-
جَازَ فِي الْحَسَنِ أَنْ يَرْتَفِعَ إلَى الصِّحَّةِ إذَا كَثُرَتْ طُرُقُهُ، وَالضَّعِيفُ يَصِيرُ حُجَّةً بِذَلِكَ لِأَنَّ تَعَدُّدَهُ قَرِينَةٌ عَلَى ثُبُوتِهِ فِي نَفْسِ الْأَمْر
-“যখন ‘হাছান’ হাদিস অনেক সনদ দ্বারা বর্ণিত হয়, তখন তা ছহীহ্ পর্যন্ত উন্নীত করা জায়েজ আছে এবং দুর্বল সনদের হাদিস এই পদ্ধতিতে (একাধিক তরিকায় বর্ণিত হওয়ার দ্বারা) দলীল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। যখন বিভিন্ন সনদে হাদিস বর্ণিত হয়, তা দৃঢ় দলীল হওয়ার ও আদেশ প্রয়োগের যোগ্যতা রাখে।” ৯০৯০. ইমাম ইবনুল হুমাম: ফতহুল কাদির, ১/৪৪৬ পৃ.
অভিমত নং-৭: সূফিকূল সম্রাট, বিখ্যাত ফকিহ, মুহাদ্দিছ ও মুফাচ্ছির, আরিফীন দরজার ওলী ইমাম আবদুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী (رَحْمَةُ الله عليه) তার একটি বিখ্যাত গ্রন্থে এ উসূলটি এভাবে বর্ণনা করেন-
قد احتج جمهور المحدثين بالحديث الضعيف اذا كثرت طرقه وألحقوه بالصحيح تارة وبالحسن أخرى- وهذا النوع من الضعيف يوجد كثيرا فى كتاب السنن الكبرى للبيهقى التى ألفها بقصد الاحتجاج لأقوال الأئمة وأقوال أصحابهم-
-“নি:সন্দেহে জমহুর মুহাদ্দিছীনগণ দুর্বল হাদিসকে অধিক সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে দলীল হওয়ার যোগ্যতা রূপে মেনে নিয়েছেন এবং সেটিকে কোন সময় ছহীহ্ আবার কোন সময় ‘হাছান’র সাথে মিলিয়েছেন। এই প্রকারের দুর্বল সনদের হাদিস সমূহ ইমাম বায়হাকী (رَحْمَةُ الله عليه) এর ‘সুনানুল কুবরা’ মধ্যে অধিক পাওয়া যায়, যাকে ইমাম মুজতাহিদীন এবং আসহাবে আইয়াম্মা দলীল হিসেবে গ্রহণের জন্য ইচ্ছাপোষণ করেন।” ৯১৯১.ইমাম আবদুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, মিযানুল কোবরা, ১/৬৮ পৃ.
অভিমত নং- ৮: হিজরী নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, বিখ্যাত হাফিজুল হাদিস (যিনি তাদরীবুর রাবী নামক উসূলে হাদিসের বিখ্যাত কিতাব লিখেছেন), শাফেয়ী মাযহাবের অন্যতম ফকিহ ও মুফাচ্ছির, ইমাম জালালুদ্দীন ছিয়তী (رَحْمَةُ الله عليه) লিখেন-
المتروك أو المنكر إذا تعددت طرقه ارتقى إلى درجة الضعيف الغريب بل ربما ارتقى الى الحسن-
-“মাতরুক ও মুনকার হাদিস বিভিন্ন তরিকায় বর্ণিত হওয়ার কারণে দ্বায়িফ হাদিসের মর্যাদায় উপনীত হয়। বরং কখনো হাদিসে “হাসানের” মর্যাদায় উপনীত হয়ে থাকে।” ৯২৯২.আল্লামা জালালুদ্দীন ছিয়তী: তাআকিবাত আলা মওজুআত: ৭৫ পৃ.: কিতাবুল মানাকিব
দেখুন এখানে তিনি সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে মুনকার, মাতরুক সনদের হাদিসও অনেক সনদে বর্ণিত হওয়ার দ্বারা ‘হাছান’ পর্যায়ে পৌঁছে; আফসোস তাদের জন্য যারা ইমাম ছিয়তীর চেয়েও বড় হাফেজুল হাদিস সেজে বসে আছেন।
অভিমত নং-৯: আল্লামা জাফর আহমদ উসমানী বলেন,
والحديث الضعيف اذا تعددت طرقه ولو طريقا واحدا اخر ارتقى بمجموع ذالك الى درجة الحسن وكان محتجا به-
-“দ্বায়িফ হাদিস একাধিক তরিকায় বর্ণিত হওয়ার কারণে, যদিও তা এক সনদে বর্ণিত ছিল, তা সমষ্টিগত ভাবে হাছানের দরজায় উন্নীত হয় এবং এটি দলীল হিসেবে প্রয়োগ করা যায়।” ৯৩৯৩ . আল্লামা জাফর আহমদ ওসমানী: কাওয়াইদুল উলূমুল হাদিস- ৭৮ পৃ.
অভিমত নং-১০: আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী (رَحْمَةُ الله عليه) বলেন,
والضعيف ان تعددت طرقه وانجبر ضعفه يسمى حسنا لغيره-
-“আর দ্বায়িফ হাদিস যদি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয় এবং তার দুর্বলতা দূরীভূত হয়, তাহলে তাকে ‘হাছান লিগাইরিহি’ নামে নামকরণ করা হয়।” ৯৪৯৪ . আল্লামা শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী: মুকাদ্দামাতুশ্ শায়খ: পৃ. ১০
অভিমত নং-১১: আল্লামা মুফতী আমিমুল ইহসান (رَحْمَةُ الله عليه) বলেন,
الضعيف ان تعددت طرقه أو تأيد بما يرجح قويه فهو حسن لغيره-
-“আর দ্বায়িফ হাদিস যদি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়, গ্রহণীয় হওয়ার প্রমাণ দ্বারা শক্তিশালী হয়, তবে তা ‘হাছান লিগাইরিহী’ হয়ে যাবে।” ৯৫৯৫ . মুফতি আমিমুল ইহসান: মিযানুল আখবার: ৭ পৃ.
অভিমত নং-১২: আল্লামা শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী (رَحْمَةُ الله عليه) বলেন :
الضعيف الذى بلغ بتعدد الطرق مرتبة الحسن لغيره ايضا مجمع وَمَا اشتهرَ (مقدمۃ للشیخ : فصل العاشر : ۲۵)
-“আর দ্বায়িফ হাদিস যদি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হওয়ার দরুন ‘হাছান লিগাইরিহী’ হওয়ার মর্যাদায় উপনীত হয়, তা দলীল হওয়া সম্পর্কে আলিমগণ একমত হয়েছেন।” ৯৬৯৬ . আল্লামা শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী: মুকাদ্দামতুশ্ শায়খ, পৃ-২৫
অভিমত নং-১৩: আল্লামা ইমাম বদরুদ্দিন আইনী (رَحْمَةُ الله عليه) বলেন,
وَاِذَا قَوی الضَّعِیفُ بِطَرِی اَخر أو اسانیدُ اخر حاد حَسَن لغیرہ
-“যখন দ্বায়িফ হাদিস অন্য কোন সনদ বা বর্ণনা দ্বারা শক্তিশালী হয় অর্থাৎ দুর্বলতা দূর হয়ে যায়, তখন তা হাছান লিগাইরিহী রূপে গৃহিত হবে। ” ৯৭৯৭ . আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী: উমদাদুল ক্বারী শরহে বুখারী: ১/৯ পৃ.
অভিমত নং-১৪: দুররুল মুখতার গ্রন্থের প্রথম খন্ড,مستحبات الوضوء শীর্ষক অধ্যায়ে ওযুর বিভিন্ন অংশের দু’আ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে,
وَقد رَوَاہ اِبنُ حِبَّانَ وَغَیرُہ عَنه عَلَیهِ السَّلامُ مِن طُرُفٍ -“এ হাদিসটি ইমাম ইবনে হিব্বানর প্রমুখের কয়েকটি সনদ দ্বারা মারফূ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।”
অভিমত নং- ১৫: উক্ত রেওয়ায়েতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (رَحْمَةُ الله عليه) বলেন :
أَيْ يُقَوِّي بَعْضُهَا بَعْضًا فَارْتَقَى إلَى مَرْتَبَةِ الْحَسَنِ
-“কতেক সনদ কতেক সনদকে শক্তি জোগায়। তাই এ হাদিস “হাছান” পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।” ৯৮৯৮ . আল্লামা ইমাম ইবনে আবেদীন শামী: ফতোয়ায়ে শামী: ১/৪২৮
অভিমত নং-১৬: আহলে হাদিসদের মুহাদ্দিছ, আব্দুর রহমান মোবারকপুরী লিখেন- وَتَعَدُّدُ الطُّرُقِ يُبَلِّغُ الْحَدِيثَ الضَّعِيفَ إِلَى حَدِّ الْحَسَنِ
-“দ্বায়িফ হাদিস যখন একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয় তা ‘হাছান’ স্তরে উন্নিত হয়।” ৯৯৯৯. তুহফাতুল আহওয়াজি, ২/৩৭২ পৃ.;
তিনি তার উক্ত গ্রন্থে আরেক স্থানে লিখেন-
وَهُوَ حَدِيثٌ ضَعِيفٌ لَكِنَّهُ مَرْوِيٌّ مِنْ طُرُقٍ يُقَوِّي بَعْضُهَا بَعْضًا
-“এ হাদিসটির সনদ দ্বায়িফ, তবে সনদটি যেহেতু একাধিক সূত্রে বর্ণিত হওয়ায় একটি সূত্র অপর সূত্রকে শক্তিশালী করেছে (হাছান স্তরে উপনীত হয়েছে)।” ১০০১০০. তুহফাতুল আহওয়াজি, ১/২৩৭ পৃ.;
ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (رَحْمَةُ الله عليه) লিখেন-
لأن كثرة الطرق تقوِّي. -“হাদিস যখন অধিক পদ্ধতিতে বর্ণিত হয় তা শক্তিশালী হয়।” ১০১১০১. নুখবাতুল ফিকর, ৮০ পৃ.;
তাই প্রমাণিত হলো যে, পূর্বসূরী মুহাদ্দিছীনের মূলনীতি মোতাবেক দ্বায়িফ হাদিসে একাধিক সূত্রে বর্ণিত হলে তা আর দ্বায়িফ থাকে না; বরং হাছান হাদিস হয়ে যায়।