বিষয় নং- ৬: কোনো সনদের ক্ষেত্রে একজন রাবীর হেফ্যে (স্মৃতিশক্তিতে) সামান্য দুর্বলতা দ্বারা হাদিস ‘হাছান’ হয়, দ্বায়িফ নয়:
হাদিস শাস্ত্রে একজন রাবী হেফ্যে সামনে ক্রুটিযুক্ত হলে তার হাদিস ‘হাছান’ স্তরে উপনীত হবে, এটাই উসূলে হাদিসের নীতি। বর্তমান আহলে হাদিসগণ ফিতনা ছড়াচ্ছে যে, রাবীর এ ধরনের সমস্যার দ্বারা হাদিস দ্বায়িফ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমি কতিপয় বিজ্ঞ মুহাদ্দিছদের অভিমত পেশ করবো, ইনশা আল্লাহ।
১. হাফেজুল হাদিস ইমাম জালালুদ্দীন ছিয়তী ( رَحْمَةُ الله عليه) {ওফাত. ৯১১ হি.} বলেন- فَإِنْ خَفَّ الضَّبْطُ فَهُوَ الْحَسَنُ لِذَاتِهِ.
-“বর্ণনাকারীর সংরক্ষণ শক্তি সামান্য দুর্বল হলে সে হাদিসকে হাছান লি জা’তিহী বলা হয়।” ১০৭৭ . ইমাম ছিয়তী, তাদরীবুর রাবী, ১/১৭৩পৃ. দারু তৈয়্যব, বয়রুত, লেবানন।
২. ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী ( رَحْمَةُ الله عليه) লিখেন-
فَإِنْ خَفَّ الضَّبْطُ: فَالْحَسَنُ لِذَاتِهِ، وَبِكَثْرَةِ طُرُقِهِ يُصَحَّحُ
-“বর্ণনাকারীর সংরক্ষণ শক্তি যদি সামান্য ক্রটিযুক্ত হয়, অত:পর সে হাদিসের মান ‘হাছান লিজাতিহি’ এবং এ জাতীয় হাদিস যখন অনেক সূত্রে বর্ণিত হবে সেটিকে তখন ছহীহ্ (লিগাইরিহী) বলা হয়।” ১০৮৮. ইবনে হাজার আসকালানী, নুখবাতুল ফিকর, ১/৭৮ পৃ.
৩. ড. মাহমুদ আত-ত্বহান লিখেন-
فإن خف الضبط، فالحسن لذاته -“বর্ণনাকারীর সংরক্ষণ শক্তি সামান্য দুর্বল হলে সে হাদিসকে ‘হাছান লি জাতিহী’ বলা হয়।” ১০৯ ৯ . ড. মাহমুদ আত্-ত্বহান, তাইসিরুল মাসতালিউল হাদিস, ৫৮ পৃ.।
৪. মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী বলেন-
فان خف الضبط والصفات الاخرى فيه فهو الحسن- -‘রাবীর যবত (সংরক্ষণগুণ) সামান্য দুর্বল হয়ে ছহীহ্ হাদিসের সকল শর্ত বিদ্যমান থাকলে তাকে হাদিসে ‘হাছান’ বলে।” ১১০১০ . কাওয়াইদ ফি উলূমিল হাদিস, ৩৪ পৃ.
৫. আল্লামা আমির সান‘আনী লিখেন-
فَإِنْ خَفَّ الضَّبْطُ (مَعَ بَقِيَّةِ الشُّرُوطِ الْمُتَقَدِّمَةِ فِي الصَّحِيحِ) (فَالْحَسَنُ لِذَاتِهِ) وَبِكَثْرَةِ الطُّرُقِ يُصَحَّحُ (فَيُسَمَّى الصَّحِيحُ لِغَيْرِهِ)
-“বর্ণনাকারীর সংরক্ষণ শক্তি যদি সামান্য ক্রটিযুক্ত হয়, (এছাড়া ছহীহ্ হওয়ার বাকি শর্তসমূহে সে সনদে রাবীর থাকে) অত:পর সে হাদিসের মান ‘হাছান লিজাতিহি’ এবং এ জাতীয় হাদিস যখন অনেক সূত্রে বর্ণিত হয় সেটি ছহীহ্ হয়েছে যায় (যাকে ছহীহ্ লিগাইরিহী বলা হয়)।” ১১১১১ সান‘আনী, সবলুস সালাম, ২/৭২২ পৃ.;
বিষয় নং-৭: সনদে কোনো একজন বর্ণনাকারী মুনকার, অথবা মুদ্ত্বরাব অথবা মাতরুক থাকলে সে হাদিসকে জাল বলা হবে না।
বর্তমান আহলে হাদিসগণ খুবই ফিতনা ছড়াচ্ছে যে হাদিসের সনদে কোন রাবীর ব্যাপারে যদি মুনকার, মাতরুক ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয় তাহলে তা তাদের দৃষ্টিতে জাল হাদিস হিসেবে গণ্য। অথচ এটি হচ্ছে তাদের মনগড়া নীতিমালা। সকল মুহাদ্দিছগণই বলেছেন সনদের একজন রাবীর প্রতি উপরের বর্ণিত দুর্বলতার ইঙ্গিত দ্বারা সনদটি দ্বায়িফ হবে কিন্তু জাল নয়।
ক. (সনদ মুনকার হওয়া): এ বিষয়ে ইমাম জালালুদ্দীন ছিয়তী (رضي الله عنه) বলেন-
المنكر نوع اخر غير الموضوع وهو قسم الضعيف-التعقبات:৭৩-باب :الاطعمة
-“সর্বসম্মত অভিমত হলো মুনকার সনদ জাল হাদিসের প্রকার নয়, বরং দ্বায়িফ হাদিসের প্রকার।” ১১২১২ ছিয়তী, তা‘আকিবাত ‘আলাল মাওদ্বুআত, ৩৭ পৃ.;
ইমাম ছিয়তী (رضي الله عنه) তার এ কিতাবের অন্যস্থানে বলেন,
صرح ابن عدى بأن الحديث منكر فليس بموضوع-التعقبات:৬২
-“এটা সুস্পষ্ট কথা ইমাম ইবনু আদী (رَحْمَةُ الله عليه) বলেছেন মুনকার সনদের হাদিস জাল নয়।” ১১৩১৩ ছিয়তী, তা‘কিবাত, ৬২ পৃষ্ঠা
তিনি এ কিতাবের অন্যস্থানে বলেছেন যে,
المُنْكَرْ مِنْ قِسْم الضَّعِيْف وَهُوَ محتمل فى الفضائل-التعقبات:باب المناقب
-“হাদিসের সনদ মুনকার হওয়া দ্বায়িফ হওয়ার অর্ন্তভুক্ত, তবে ফাযায়েলে আমলের ক্ষেত্রে তা দলিল হওয়ার সম্ভবনা রাখে।” ১১৪১৪ ইমাম ছিয়তী, তা‘কিবাত, কিতাবুল মানাকিব;
আল্লামা ইবনুল র্আরাক কেনানী (৯৬৩ হি.) এ বিষয়ে লিখেন-
وَالْمُنكر من قسم الضَّعِيف وَهُوَ مُحْتَمل فِي الْفَضَائِل.
-“হাদিসের সনদ মুনকার হওয়া দ্বায়িফ হওয়ার অর্ন্তভুক্ত, তবে ফাযায়েলে আমলের ক্ষেত্রে তা দলিল হওয়ার সম্ভবনা রাখে।” ১১৫১৫ তানযিহুশ শরিয়াহ, ২/৫০ পৃ.;
খ. (সনদ মুজতারিব হওয়া): অপরদিকে মুজত্বরাব সনদ সম্পর্কে ইমাম জালালুদ্দিন ছিয়তী (رَحْمَةُ الله عليه) বলেন-
الُمضْطَرِبْ مِنْ قسم الضَعِيْف لَا المَوْضُوْع :২৭: باب الجنائز
-“মুজতারাব দ্বায়িফ সনদেরই প্রকার, এটি জাল নয়।” ১১৬১৬ ইমাম ছিয়তী, তা‘কিবাত, ২৭ পৃষ্ঠা;
আল্লামা তাহের পাটনী (رَحْمَةُ الله عليه) একটি হাদিস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেন- مُضْطَرب: قلت من قسم الضَّعِيف لَا الْمَوْضُوع
-“এ সনদটি মুজত্বারিব, আমি (তাহের পাটনী) বলি, মুজতারাব হলো দ্বায়িফ সনদের প্রকার, তাই বলে এটি জাল নয়।” ১১৭ ১৭ তাযকিরাতুল মাওদ্বুআত, ২১৯ পৃ.;
গ. (সনদ মু’দাল হওয়া): ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ বদরুদ্দীন হামাভী আশ-শাফেয়ী (ওফাত. ৭৩৩ হি.) -
والمعضل من قسم الضَّعِيف -“হাদিসের সনদ ‘মু’দাল’ হওয়া দ্বায়িফ সনদের অর্ন্তভুক্ত (জাল এর নয়)।” (المنهل الروي , ৪৭ পৃ.)
ঘ. (সনদ মুনকাতী‘ঈ হওয়া): আল্লামা জাযায়েরী দামেস্কী (رضي الله عنه) লিখেন-
والمنقطع من قسم الضَّعِيف -“সনদ মুনকাতী‘ঈ (সনদের মাঝে কোনো একজন বিচ্ছিন্ন) হওয়া দ্বায়িফ হাদিসের অর্ন্তভুক্ত (জাল নয়)।” ১১৮১৮ তাওজিহুন নযর ইলা উসূলিল আছার, ২/৭৩০ পৃ.;
বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা কাস্তাল্লানী (رَحْمَةُ الله عليه) লিখেন-
والْمُنْقَطِعَ مِنْ قِسْمِ الضَّعِيفِ -“সনদ মুনকাতী‘ঈ (সনদের মাঝে কোনো একজন বিচ্ছিন্ন) হওয়া দ্বায়িফ হাদিসের অর্ন্তভুক্ত (জাল নয়)।” ১১৯১৮ কাস্তাল্লানী, ইরশাদুস সারী, ১/২১ পৃ.;
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (رَحْمَةُ الله عليه) উল্লেখ করেন-
والْمُنْقَطِعَ مِنْ قِسْمِ الضَّعِيفِ -“সনদ মুনকাতী‘ঈ (সনদের মাঝে কোনো একজন বিচ্ছিন্ন) হওয়া দ্বায়িফ হাদিসের অর্ন্তভুক্ত (জাল নয়)।” ১২০২০ ইবনে হাজার, ফতহুল বারী, ১/৩৪৭ পৃ.;
আহলে হাদিসদের ইমাম শাওকানী লিখেন-
أَنَّ الْمُنْقَطِعَ مِنْ قِسْمِ الضَّعِيفِ -“নিশ্চয় সনদ মুনকাতী‘ঈ (সনদের মাঝে কোনো একজন বিচ্ছিন্ন) হওয়া দ্বায়িফ হাদিসের অর্ন্তভুক্ত (জাল নয়)।” ১২১২১ নায়লুল আউতার, ৬/৩৭৫ পৃ.;
ঙ. ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رَحْمَةُ الله عليه) লিখেন-
فقد صرح بأن رواية المجهول من قسم الضعيف -“এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে সনদ মাজহুল হওয়া দ্বায়িফ সনদের অর্ন্তভুক্ত (জালের নয়)।” ১২২২২ ইবনে হাজার, আন-নুক্কাত, ৩৮৭ পৃ.;
তাই কোনো মুহাদ্দিসের সনদ বিষয়ে কোনো দুর্বলতা বুঝায় এমন শব্দ দ্বারা কোনো হাদিসকে জাল বলা যাবে না।