‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ বলে আহ্বান করা বা ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ শীর্ষক শ্লোগান প্রসঙ্গে আলোচনা


 হুজুর (ﷺ) কে দূর বা কাছ থেকে আহ্বান করা বৈধ- তাঁর পবিত্র ইহলৌকিক জীবনে ও তাঁর ওফাতের পরেও। তাই একজন ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ বলে আহ্বান করুক, কিংবা এক দলের সবাই মিলে সমবেত কণ্ঠে ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ বলে শ্লোগান দিক- এ উভয় ক্ষেত্রে এ আহবান বৈধ। আলোচ্য বিষয় বস্তুকে দু’টি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে।

প্রথম অধ্যায়


(‘‘ইয়া রাসুলাল্লাহ’’ বলে ডাকার প্রমাণাদি প্রসঙ্গে’)


হুজুর (ﷺ) কে আহবান করার স্বপক্ষে প্রমাণাদি কুরআন করীম, ফিরিশতা ও সাহাবীদের কর্মকান্ড ও উম্মতের বিবিধ কার্যাবলীতে সুস্পষ্টরূপে বিদ্যমান রয়েছে।


❏কুরআন করীমের অনেক জায়গায় আছে।


يَااَيُّهَا النَّبِىُّ، يَااَيُّهَا الرَّسُوْلُ، يَا اَيُّهَا الْمُزَّمِلُ، يَا اَيُّهَا الْمُدّثِّرُ


হে নবী, হে রাসূল, ওহে কম্বলাবৃত বন্ধু, ওহে চাদরাবৃত বন্ধু ইত্যাদি বলে। দেখা যায়, উলে­খিত আয়াতসমূহে তাঁকে আহবান করা হয়েছে।


❏অন্যান্য নবীদেরকে অবশ্য তাদের নাম ধরেই সম্বোধন করেছে কুরআন করীম। যেমন-


يَايَحْيى يَااِبْرَ اهِيْمَ يَاآدم يَامُوْسَى يَاعِيْسَى


(হে মুছা, হে ঈসা, হে ইয়াহয়া, হে ইব্রাহীম, হে আদম ইত্যাদি (আলাইহিমুস সালাম)। কিন্তু মাহবুব (ﷺ) কে আহবান করেছে প্রিয় উপাধিসমূহের ভূষিত করে।


❏কবির ভাষায়ঃ


يا آدم است باپدر انبياء خطاب

يا ايها النبي خطاب محمد است


অর্থাৎ- নবীগণের জনক হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) কে ডাকা হয়েছে ‘ইয়া আদামু’ বলে, আর মুহাম্মদ (ﷺ) কে ডাকা হয়েছে ‘ওহে নবী’ উপাধিতে।


কুরআন করীম বরঞ্চ সাধারণ মুসলমানদেরকেও এভাবে আহবান করেছেঃ يَااَيُّهَا الَّذِيْنَ اَمَنُوْآ (হে ঈমানদারগণ)। আর তাঁদেরকে নির্দেশ দিয়েছে- মাহবুব ﷺকে আহবান করো সম্মানসূচক উপাধিসমূহের মাধ্যমে।


❏কুরআনই ইরশাদ করছেঃ


لَا تَجْعَلُوا دُعَاءَ الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُمْ بَعْضًا


-‘‘তোমরা রাসূলকে এমনভাবে ডেকো না, যেভাবে তোমরা একে অপরকে ডাক।’’  

{সূরাঃ নূর, আয়াতঃ ৬৩, পারাঃ ১৮}


এখানে তাঁকে ডাকতে নিষেধ করা হয়নি। বরং অন্যান্যদেরকে ডাকার মত না ডাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


❏কুরআন অন্যত্র ইরশাদ করেছেঃ


اُدْعُوْ هُمْ لِاَبَاءِهِمْ


-‘‘তাদেরকে তাদের পিতার সাথে সম্পর্ক যুক্ত করে ডাকা।’’  

{সূরাঃ আহযাব, আয়াতঃ ৫, পারাঃ ২১}


এ আয়াতে একথাটির অনুমতি দেয়া হয়েছে যে, যায়েদ ইবনে হারিছা  (رضي الله عنه) কে ‘ইবনে হারিছা’ অর্থাৎ ‘হারিছার পুত্র’ বলে ডাক, কিন্তু তাঁকে ‘ইবনে রাসূলাল্লাহ’ বা ‘রাসূলাল্লাহর পুত্র’ বলে ডেকোনা। এরূপ কাফিরদেরকেও অনুমতি দেয়া হয়েছে তাদের সাহায্যার্থে তাদের সাহায্যকারীদেরকে ডাকারঃ


وَادْعُوا شُهَدَاءَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ


-‘‘তোমরা যদি নিজের দাবীর ব্যাপারে সত্যাবাদী হও, তা’হলে আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন তোমাদের অন্যান্য সাহায্যকারীদেরকে ডেকো।’’

{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ২৩, পারাঃ ১}

 

❏‘মিশকাত’ শরীফের প্রথম হাদীছে আছে, হযরত জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) আরয করছিলেনঃ


يَامُحَمَّدُ اَخْبِرْنِى عَنِ الْاِسْلاَمِ


‘হে মুহাম্মদ, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে অবহিত করুন।’  এখানে আহবান করার বিধান পাওয়া গেল।

{ক. খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতঃ ১/২১ হাদিসঃ ২

খ. মুসলিমঃ আস-সহীহঃ কিতাবুল ঈমানঃ ১/৩৬ হাদিসঃ ১

গ. বুখারীঃ আস-সহীহঃ

ঘ. আবু দাউদঃ আস-সুনানঃ ৫/৬৯ হাদিসঃ ৪৬৯৫

ঙ. ইবনে মাযাহঃ আস-সুনানঃ ১/২৪ পৃ. হাদিসঃ ৬৩}


❏মিশকাত শরীফের ‘ওফাতুন্নবী’ শীর্ষক অধ্যায়ে আছে,  হুজুর (ﷺ) এর ওফাতের সময় মালাকুল মাউত আরয করছিলেনঃ


يَا مُحَمَّدُ اِنَّ اللهَ اَرْسَلَنِىْ اِلَيْكَ


-‘‘হে মুহাম্মদ (ﷺ), আল্লাহ তা’আলা আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন।’’  

{ক. খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতঃ ৪/৪০৬, হাদিসঃ ৫৯৭২

  খ. বায়হাকীঃ দালায়েলুল নবুয়তঃ ৭/২৬৭ পৃ.}

 

দেখুন, এখানেও ‘ইয়া মুহাম্মদ’ বলে আহবান করা হয়েছে।


❏‘ইবনে মাজা’ শরীফের ‘সালাতুল হাজত’ শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত উছমান ইবন হানীফ  (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, এক অন্ধ ব্যক্তি  হুজুর (ﷺ) মহান দরবারে উপস্থিত হয়ে অন্ধত্ব দূরীকরণার্থে দোয়া প্রার্থী হয়েছিলেন,  হুজুর (ﷺ) তাঁকে শিখিয়ে দিলেন এ দু’আটিঃ


اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ، وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِمُحَمَّدٍ نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، يَا مُحَمَّدُ إِنِّي قَدْ تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّي فِي حَاجَتِي هَذِهِ لِتُقْضَى، اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ . قَالَ أَبُو إِسْحَاقَ: هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ


-‘‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি, রহমতের নবী মুহাম্মদ (ﷺ) মারফত তোমার দিকে মনোনিবেশ করছি। হে মুহাম্মদ (ﷺ) আমি আপনার মাধ্যমে আপন প্রতিপালকের দিকে আমার এ উদ্দেশ্য (অন্ধত্ব মোচন) পূরণ করার নিমিত্তে মনোনিবেশ করলাম, যাতে আপনি আমার এ উদ্দেশ্য পূরণ করে দিন। হে আল্লাহ আমার অনুকূলে  হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ কবুল করুন। এ হাদীছটির বিশুদ্ধতা প্রসঙ্গে ইমাম হযরত আবু ইসহাক (رحمة الله) বলেছেন, এ হাদীছটি বিশুদ্ধ (সহীহ)।’’

{ক. ইবনে মাজাহঃ আস-সুনানঃ ১/৪৪১ হাদিসঃ ১৩৮৫

খ. হাকেম নিশাপুরীঃ আল-মুস্তাদরাকঃ ১/৭০৭ হাদিসঃ ১৯৩০

গ. আহমদঃ আল-ুমসনাদঃ ৪/১৩৮ হাদিসঃ

ঘ. নাসাঈঃ আসালুল ইউমাল্-লাইলাঃ পৃ. ৪১৮ হাদিসঃ ৬৬০

ঙ. ইমাম বুখারীঃ তারীখুল কবীরঃ ৬/১০ পৃ. হাদিসঃ ২০৯

চ. ইমাম বায়হাকীঃ দালায়েলুল নবুয়তঃ ৬/১৬৬, আহলে হাদিস আলবানী সে সুনানে আবু দাউদ ও সুনানে তিরমিযীর তাহক্বীকে সনদটি সহিহ বলেছেন।}

 

লক্ষ্য করুন, দু’আটি কিয়ামত পর্যন্ত ধরাপৃষ্ঠে আগমনকারী মুসলশানদের জন্য শিক্ষার বিষয় বস্তুতে পরিণত হল। এখানে  হুজুর (ﷺ) কে আহবান করা হয়েছে এবং তাঁর সাহায্যও প্রার্থনা করা হয়েছে।


❏ফতোয়ায়ে আলমগীরী’ ১ম খন্ডের ‘কিতাবুল হজ্ব’ এর ‘আদাবু যিয়ারতে কবরিন্নবী (আলাইহিস সালাম) শীর্ষক বর্ণনায় উলে­খিত আছেঃ


كَذَا فِي الِاخْتِيَارِ شَرْحِ الْمُخْتَارِ ثُمَّ يَقُولُ: السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا نَبِيَّ اللَّهِ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ أَشْهَدُ أَنَّك رَسُولُ اللَّهِ


-‘‘ইখতিয়ার শরহে মুখতার গ্রন্থে লিখিত রয়েছে; অতঃপর নবীর রওযা যিয়ারতকারী ব্যক্তি বলবে- হে নবী, আপনার প্রতি আমার সালাম, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল।’’  

{মোল্লা নিযামুদ্দীন বলখী, ফাতওয়ায়ে হিন্দীয়া, ১/২৬৫পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, তৃতীয় প্রকাশ.১৩১০হি.}

 

❏এরপর লিখা হয়েছে হযরত আবু বকর  (رضي الله عنه) এর রওযার সামনে গিয়ে বলবেঃ


وَيَقُولُ: السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا خَلِيفَةَ رَسُولِ اللَّهِ السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا صَاحِبَ رَسُولِ اللَّهِ فِي الْغَارِ


-‘‘যিয়ারতকারী এরপর বলবে ‘ওহে রাসূলাল্লাহর সত্যিকার প্রতিনিধি, আপনার প্রতি সালাম; ওহে রাসূলের গুহার সাথী, (ছউর নামক পাহাড়ের গুহায় সহাবস্থানকারী) আপনার প্রতি আমার সালাম।’’


❏এরপর আরও লিখা হয়েছে যে হযরত উমরের রওযার সামনে গিয়ে বলবেঃ


فَيَقُولُ السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا مُظْهِرَ الْإِسْلَامِ السَّلَامُ عَلَيْك يَا مُكَسِّرَ الْأَصْنَامِ


-‘‘যিয়ারতকারী তারপর বলবে ‘ওহে মুসলমানদের আমীর, আপনার প্রতি সালাম ওহে ইসলামের প্রকাশ্য ঘোষণাকারী, আপনার প্রতি সালাম, ওহে মূর্তি নিধনকারী আপনার প্রতি সালাম, (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)।’’  

{মোল্লা নিযামুদ্দীন বলখী, ফতোয়ায়ে আলমগীরীঃ কিতাবুল মানাসিকঃ ১/২৬৬ পৃ.প্রাগুক্ত.}


এখানে দেখুন, হুযুর (ﷺ) কে ডাকা হয়েছে এবং তাঁরই পার্শ্বদেশে শায়িত হযরত সিদ্দীক ও ফারুক  (رضي الله عنه) কেও ডাকার বিধান রাখা হয়েছে।  

{মূল গ্রন্থাকার (رحمة الله) এর বক্তব্যের সমর্থনে আমারা সাহাবিদের আমল পাই সহিহ হাদিস দ্বারা যেমন:


عَنْ نَافِعٍ قَالَ: كَانَ ابْنُ عُمَرَ إِذَا قَدِمَ مِنْ سَفَرٍ أَتَى قَبْرَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ:السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ، السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا أَبَا بَكْرٍ، السَّلَامُ عَلَيْكَ يَا أَبَتَاهُ


-‘‘বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত নাফে (رحمة الله) বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর  (رضي الله عنه) সফর থেকে যখন রাসূল (ﷺ) এর রওজা মোবারক জিয়ারতের জন্য আসতেন তখন তিনি বলতেন, “আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তারপর বলতেন, আস্সালামু আলাইকা ইয়া আবা বকরীন; আস্সালামু আলাইকা ইয়া আবাতাহ।’’

(তথ্য সুত্রঃ ক. ইমাম আব্দুর রাজ্জাকঃ আল-মুসান্নাফঃ ৩/৫৭৬ পৃ. হাদিসঃ ৬৭২৪, ইমাম আবি শায়বাহঃ আল-মুসান্নাফঃ ৩/২৮ পৃ. হাদিসঃ ১১৭৯৩, ইমাম বায়হাকীঃ আস-সুনানিল কোবরাঃ ৫/২৪৫ পৃ. হাদিসঃ ১০০৫১, ইমাম নববীঃ আল-ইযাহঃ পৃ. ৪৫৩, ইমাম কুস্তালানীঃ মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়াঃ ৪/৫৮২ পৃ., ইমাম জুরকানীঃ শরহুল মাওয়াহেবঃ ১২/১৯৮ পৃ., ইমাম কাজী আয়াজঃ আশ-শিফাঃ ২/৬৭১, ইমাম বায়হাকীঃ আল-মাদখালঃ ১/২৬ পৃ.)}


এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন ব্যক্তিবর্গ, আওলিয়ায়ে মিল্লাত, মশায়েখ ও বুযুর্গানে দ্বীনও তাঁদের দু’আ ও নির্ধারিত পাঠ্য ওয়াযীফাসমূহেও ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ বলে আহবান করে থাকেন। যেমন-


❏‘কাসিদায়ে বোর্দা’ শরীফে আছেঃ


يَااَكْرَمَ الْخَلْقِ مَالِىْ مَنْ اَلُوْذُبِهِ

سِوَاكَ عِنْدَ حُلُوْلِ الْحَادِثِ الْعَمَمِ


অর্থাৎ- হে সৃষ্ট জীবের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত সত্ত্বা, আপনি ছাড়া আমার এমন কেউ নেই, যার কাছে ব্যাপক বিপদাপদের সময় আশ্রয় নিতে পারি।

{ইমাম খরপুতীঃ শরহে কাসীদায়ে বুরদাঃ ২১৭ পৃ.}


❏হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (رحمة الله) স্বীয় কাসিদায় নবী করীম (ﷺ) কে আহবান করেছেন এভাবেঃ


يَارَحْمَةً لِّلْعَا لَمِيْنَ اَدْرِكْ لِزَيْنِ الْعَابِدِيْنَ

مَحْبُوْس اَيْدِى الظَّالِمِيْنَ فِىْ مَوْكِبٍ الْمُذْدِهِمِ


হে বিশ্বব্রহ্মান্ডের রহমতের নবী (ﷺ), সেই যয়নূল আবেদীনের সাহায্যে এগিয়ে আসুন, যে জালিমদের ভিড়ের মধ্যে তাদের হাতে বন্দী হয়ে কাল যাপন করছে।



❏স্বনামধন্য আল্লামা জামী (رحمة الله) বলেছেনঃ


زمهجورے برامدجان عالم – ترحم يا نبى الله ترحم

نه اخر رحمة للعا لمين – زمحرو ماں چر افار غى نشينى


আপনার বিরহ বেদনায় সৃষ্টি জগতের প্রাণ ওষ্ঠাগত। হে আল্লাহর নবী, আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন, দয়ার ভান্ডার খুলে দিন। কেন, আপনি সারা বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ নন কি? আমাদের কত বঞ্চিত ও পাপীদের প্রতি এত বিমুখ হয়ে রয়েছেন কেন?  

{আল্লামা আব্দুর রহমান জামীঃ পৃ.১৫}

 

❏হযরত ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) স্বীয় ‘কাসিদায়ে নু’মানে’ নবী (ﷺ) কে আহবান করেছেন এভাবে-


يَاسَيِّدَ السَّادَاتِ جِئْتُكَ قَاصِدًا

اَرْ جُوْرِ ضَاكَ وَاَحْتَمِىْ بِحِمَاكَ


অর্থাৎ- ওহে সর্দারদের সর্দার, অন্তরে দৃঢ় আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি, আপনার সন্তুষ্টির প্রত্যাশী হয়েছি এবং নিজেকে আপনার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি।

{ইমাম আবু হানিফাঃ কাসীদায়ে নুমান (খায়রাতুল হিসান সহ)- ২০০ পৃ.}


এসব কবিতার স্তবকসমূহ  হুজুর (ﷺ) কে আহবান করা হয়েছে, তাঁর সাহায্য কামনা করা হয়েছে। এ আহবান করা হয়েছে দূর থেকে তাঁর ওফাতের পর।

সকল মুসলমান নামাযে বলেনঃ


اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ اَيُّهَا النَّبِىُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرْكَاتُهُ


ওহে নবী! আপনার প্রতি সালাম, আল্লাহর রহমত ও ‘বরকতসমূহ’ আপনার উপর বর্ষিত হোক! নামাযে তাঁকে এভাবে আহবান করা ‘ওয়াজিব’ বা আবশ্যিক কর্তব্য। এ ‘আততাহিয়াতু’ প্রসঙ্গে ‘হাযির-নাযির’ এর আলোচনায় সুবিখ্যাত ফতোয়ায়ে শামী’ ও ‘আশিআতুল লুমআত’ গ্রন্থদ্বয়ের উদ্ধৃতিসমূহ আগেই পেশ করেছি।


এতক্ষণ পর্যন্ত পর্যালোচনা করা হল এককভাবে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ বলা প্রসঙ্গে। যদি অনেক লোক একত্রে সমবেত হয়ে সমবেত কণ্ঠে ‘নারায়ে-রিসালাত’ ধ্বনি তোলে, তা’হলে তা’ও জায়েয। কারণ, যখন এককভাবে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ বলা জায়েয, তখন এক সাথে সবাই মিলে বলাও জায়েয হবে বৈকি। কয়েকটি ‘মুবাহ’ (যে সব কাজ করলে কোন ছওয়াব নেই, না করলেও কোন পাপ নেই, সে সব কাজ মুবাহ।) কাজকে একত্রিত করলে সমষ্টিও ‘মুবাহ’ বলে গণ্য হবে। যেমন- বিরানী ‘হালাল’। কেননা তা হচ্ছে কয়েকটি হালাল দ্রব্যাদির সমষ্টি মাত্র।


অধিকন্তু, সবাই মিলে সমবেত কণ্ঠে নবী (ﷺ) কে আহবান করার স্বপক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণও রয়েছে।


❏‘মুসলিম শরীফ দ্বিতীয় খন্ডের শেষে ‘হাদীছুল হিজরত’ শিরোনামের অধ্যায়ে হযরত বা’রা  (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে,  হুজুর (ﷺ) যখন মক্কা ত্যাগ করে মদীনা শরীফের প্রান্ত সীমায় প্রবেশ করলেন, তখন তাঁকে কিরূপে স্বাগত জানানো হয়েছিল তার বিবরণ হাদীছের ভাষায় শুনুনঃ


فَصَعِدَ الرِّجَالُ وَالنِّسَاءُ فَوْقَ الْبُيُوتِ، وَتَفَرَّقَ الْغِلْمَانُ وَالْخَدَمُ فِي الطُّرُقِ، يُنَادُونَ: يَا مُحَمَّدُ يَا رَسُولَ اللهِ يَا مُحَمَّدُ يَا رَسُولَ اللهِ


-‘‘তখন মদীনার নারী-পুরুষ ঘরের ছাদসমূহের উপর আরোহণ করেন, ছোট ছোট ছেলে ও ক্রীতদাসগণ মদীনার অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়েন, সবাই ‘ইয়া মুহাম্মদ’ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলেন।’’

{ক. মুসলিমঃ আস-সহিহঃ কিতাবুত-জিহাদঃ ৪/২৩১১পৃ. হাদিসঃ ২০০৯

খ. ইবনে হিব্বানঃ আস-সহিহঃ ১৫/২৮৯পৃ. হাদিসঃ ৬৮৯৭০

গ. আবু ই’য়ালাঃ আল-মুসনাদঃ ১/১০৭ পৃ. হাদিসঃ ১১৬}

 

❏মুসলিম শরীফের এ হাদীছে ‘নারায়ে রিসালাত’ ধ্বনি তোলার সুস্পষ্ট প্রমাণ বিধৃত। জানা গেল যে, সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম নারায়ে রিসালাতের ধ্বনি তুলতেন। এ হাদীছে হিজরতে একথাও আছে যে, সাহাবায়ে কেরাম ‘জুলুস’ ও বের করেছেন।  হুজুর (ﷺ) যখনই কোন সফর থেকে মদীনা শরীফে ফিরে আসতেন, তখন মদীনা বাসীগণ তাঁকে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জানাতেন এবং তাঁর সম্মানার্থে জুলুস’ বের করতেন। (মিশকাত ও বুখারী প্রভৃতি হাদীছগ্রন্থ দ্রষ্টব্য) উলে­খ্য যে, আরবী ‘জলসা’ শব্দের অর্থ হল বৈঠক বা উপবেশন। এ শব্দটির বহুবচন হচ্ছে ‘জলুস’, যেমন ‘জলদাহ’ শব্দের বহুবচন হচ্ছে ‘জলুদ’ অর্থ হচ্ছে বেত্রাঘাত তখন দুর্রা নামে অভিহিত হত।

নামাযও আল্লাহর যিকরের ‘জলসা’- একই জায়গায় বসে সম্পন্ন করা হয়। আর হজ্ব হচ্ছে যিকরের ‘জুলুস’ এক বৈঠকে সম্পন্ন করা যায় না, বরং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে সম্পন্ন করতে হয়। কুরআন থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ‘তাবুতে ছকীনা’ (বনী ইস্রাঈলের অতি বরকতমন্ডিত ‘সমশাদ’ বৃক্ষ নির্মিত একটি বাক্স, যেখানে হযরত মুসা ও হারুন (আলাইহিস সালাম) এর লাঠি পাগড়ী, পাদুকা ও কাপড় চোপড় রক্ষিত ছিল) ফিরিশতাগণ ‘জুলুস’ সহকারে নিয়ে এসেছিলেন।  হুজুর (ﷺ) এর শুভ জন্মক্ষণেও মিরাজের রাতে ফিরিশতাগণ তাঁর সম্মানার্থে ‘জুলুস’ বের করেছিলেন। সৎ ও পুতঃ মাখলুকের অনুকরণ করাও পুণ্য কাজ। সুতরাং বর্তমানে জুলুসের যে প্রচলন আছে, তা পূর্বসুরীদের অনুকরণ বিধায় একটি পূণ্য কাজ।


Top