বুযুর্গানে কিরামের উরস প্রসঙ্গে আলোচনা


দু’অধ্যায়ে বিন্যস্ত এ আলোচনার প্রথম অধ্যায়ে উরসের প্রমাণ এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে উত্থাপিত আপত্তিসমূহের জবাব দেওয়া হয়েছে।

প্রথম অধ্যায়

উরসের প্রমাণসমূহ


উরসের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘শাদী’। এ জন্যই বর-কনেকে আরবী ভাষায় উরস বলা হয়। বুযুর্গানে দ্বীনের মৃত্যু দিবসকে এ জন্যই উরস বলা হয় যে, মিশকাত শরীফে بَاب إِثْبَات عَذَاب الْقَبْر শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যখন মুনকার নকির মইয়তের পরীক্ষা নেয় এবং যখন সে সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়, তখন তাকে বলেন-


نَمْ كَنَوْمَةِ الْعَرُوسِ الَّذِي لَا يُوقِظُهُ إِلَّا أَحَبُّ أَهْلِهِ إِلَيْهِ.

আপনি সেই কনের মত শুয়ে পড়–ন, যাকে ওর প্রিয়জন ছাড়া আর কেউ উঠাতে পারে না।  ২৭১

{খতিব তিবরিযি, মিশকাত,  ১/৪৬ পৃঃ  , হা/১৩০, ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান, ২/৩৭৪পৃঃ  হা/১০৭১, পরিচ্ছেদ: بَابُ مَا جَاءَ فِي عَذَابِ القَبْرِ , ইমাম তিরমিযি বলেন, এ হাদিসটির সনদ ‘হাসান’। আলবানী এটিকে মিশকাতের তাহকীকে ‘হাসান’ বলে মত পোষণ করেছেন।}


তাই মুনকার নকির ফিরিশতাদ্বয় যেহেতু ওই দিনকে উরুস বলেছেন, সেহেতু উরস বলা হয়। অথবা জন্যই যে ওই দিন জামালে মুস্তাফা (ﷺ) দেখার দিন। মুনকার নকির হুযুরকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করবেন, ওনার সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? তিনিই তো সৃষ্টিজগতের দুলহা, সারা জগত তাঁরই ছোঁয়াছের প্রতিফলন। সেই মাহবুবে খোদার সাক্ষাতের দিন নিশ্চয় উরসের দিন। এজন্য এদিনকে উরস বলা হয়। বাস্তব অর্থ প্রতি বছর ওফাত দিবসে কবর যিয়ারত করা, কুরআনখানি ও সদকা ইত্যাদির ছওয়াব পৌছানোকে উরস বলা হয়। উরসের উৎস হাদীছে পাক ও ফকীহগণের বিভিন্ন উক্তি থেকে প্রমাণিত আছে।


❏ ফতওয়ায়ে শামীর প্রথম খণ্ড ----- শীর্ষক অধ্যয়ে বর্ণিত আছে-  ইমাম তবারী (رحمة الله عليه) সনদসহ বর্ণনা করেন হযরত মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন-


أَنَّ النَّبِيَّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - كَانَ يَأْتِي قُبُورَ الشُّهَدَاءِ بِأُحُدٍ عَلَى رَأْسِ كُلِّ حَوْلٍ فَيَقُولُ: السَّلَامُ عَلَيْكُمْ بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ.


-‘‘ইবনে আবি শাইবা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন যে হুযুর ﷺ প্রতি বছর উহুদ যুদ্ধের শহীদদের কবরে তাশরীফ নিয়ে যেতেন।’’  ২৭২

{ইবনে কাসির, তাফসীরে ইবনে কাসির, ৪/৩৮৯পৃঃ  দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন (মতনটি এ কিতাবের), আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফ, ৩/৫৭৩পৃঃ  আইনী, উমদাতুল ক্বারী, ৮/৭০পৃঃ , ইমাম তবারী, জামিউল বয়ান ফি তাফসিরীল কোরআন, ১৬/৪২৬পৃঃ  হাদিস নং- ২০৩৪৫, ইবনে আবিদীন শামী, ফাতোয়ায়ে শামী, ২/২৪২পৃঃ }


তাফসীরে কবীর ও তাফসীরে দুররুল মানসূরে উলে­খিত আছে-


 رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَأْتِي قُبُور الشُّهَدَاء على رَأس كل حول فَيَقُول {سَلام عَلَيْكُم بِمَا صَبَرْتُمْ فَنعم عُقبى الدَّار} وَأَبُو بكر وَعمر وَعُثْمَان.


-‘‘হুযুর ﷺ থেকে প্রমাণিত আছে যে তিনি প্রতি বছর শহীদদের কবরে তশরীফ নিয়ে যেতেন এবং ওদেরকে সালাম দিতেন। চার খলিফাগণও অনুরূপ করতেন।’’ ২৭৩

{ইমাম সুয়ূতি, তাফসীরে দুরুরুল মানসূর, ৪/৬৪১পৃঃ}


শাহ আবুদল আযীয ছাহেব ফতওয়ায়ে আযীযিয়ার ৪৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন-


دوم آنكه بيئت اجتماعيه مددماں كثير جمع شوند وختم كلام الله فاتحه بر شيرنى وطعام نموده تقسيم در مياں حاضراں كنند اي قسم معمول در زمانئه پيغمبر خدا وخلفائے راشدين نه بود اگر كسے اي طور كنند باك. نيست بلكه فائده احياء اموات را حاصل مى شود.


দ্বিতীয়তঃ অনেক লোক একত্রিত হয় এবং খতমে কুরআন পড়া হয় আর খাদ্য দ্রব্য শিরনীর ফাতিহা দিয়ে সমবেত ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এ ধরনের রীতি হুযুর ﷺ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে প্রচলিত ছিল না। কিন্তু কেউ যদি করে, তাতে কোন ক্ষতি নেই বরং জীবিতগণ মৃতদের দ্বারা লাভবান হয়।


❏ “যুবদাতুন নসায়েহ ফি মসায়েলিয যবায়েহ” গ্রন্থে আবদুল আযীয় ছাহেব (رحمة الله عليه) মৌলভী আবদুল হাকিম ছাবে শিয়ালকোটির একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন-


ايں طعن مبنى است برجهل به احوال مطعون عليه زيراكه غير از فرائض شرعيه مقرره راهيچ كس فرض نمى داندآرے تبرك بقبور صالحين وامداد ايشاں بايصال ثواب وتلاوت قرآن ودعائے خير وتقسيم طعم وشير ينى امر مستحن وخوب است باجماع علماء وتعيين روز عرس برائے آں است كه روز ذكر انتقال ايشاں مى باشد از دار العمل بدار الثوب والاهر روزكه ايں عمل واقع شود موجب فلاح ونجات است  .


অর্থাৎ মানুষের অবস্থা সম্পর্কে অবগত না হওয়ার কারণেই এ অপবাদ দেয়া হয়। কোন ব্যক্তিই শরীয়তের নির্ধারিত ফরযসমূহ ব্যতীত অন্য কিছুকে ফরয মনে করে না। তবে নেক বান্দাদের কবরসমূহ থেকে বরকত লওয়া এবং ঈসালে ছওয়াব, কুরআন তিলাওয়াত, শিরনী ও খাদ্যদ্রব্য বন্টন দ্বারা ওদের সাহায্য করা উলামায়ে কিরামের মতে ভাল। উরসের দিন এজন্য নির্ধারিত করা হয় যে ওই দিন মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্যথায় এ কাজ যে কোন দিনই করা হোক না কেন, উপকার রয়েছে।


❏ হযরত শেখ আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী ১৮২ নং পত্রে মাওলানা জালাল উদ্দিনকে লিখেছেন-


اعرس پيراں بر سنت پيرا بسماع وصفائى جارى دارند.


পীরগণের উরস ও তাঁদের তরিকা মতে কাওয়ালী পবিত্রতা সহকারে জারী রাখবেন। মৌলভী রশীদ আহমদ ও আশরাফ আলী ছাহেবানের পীর হাজী ইমদাদুল্লাহ ছাহেব স্বীয় রচিত ফয়সালা এ পাপ্ত মাসায়েল’ পুস্তিকায় উরস জায়েয হওয়া সম্পর্কে জোরালে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং স্বীয় আমলের কথা এভাবে বর্ণণা করেন-


فيقركا مشرب اس امر ميں يه هے كه هر سال اپنے پير ومرشدكى روح مبارك پر ايصال ثواب كرتاهوں اول قرآن خوانى هوتى هے اور گاه گاه اگر وقت ميں وسعت هو تو مولود پڑها جاتاهے -پهر ما حضر كهانا كهلايا جاتاهے اور اس كا ثواب بخش دياجاتاهے.


ফকীরের নিময় এ যে প্রতি বছর আমি আমার পীর মুর্শিদের পবিত্র আত্মার প্রতি ঈসালে ছওয়াব করে থাকি। প্রথমে কুরআনখানি হয। এরপর যদি সময় থাকে মিলাদ শরীফের আয়োজন করা হয় এবং উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে খাবার পরিবেশন করা ও এর ছওয়াবও বখশিশ করে দেয়া হয়।”  মৌলভী রশিদ আহমেদ ছাহেবও মূল উরসকে জায়েয মনে করেন। যেমন ফতওয়ায়ে রশিদীয়া প্রথম খন্ড কিতাবুল বিদআতের ৯৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন-  অনেক জিনিস প্রথমে মুবাহ ছিল কিন্তু পরে কোন এক সময় নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। উরস ও মিলাদ মাহফিলের বেলায়ও তাই হয়েছে। আরববাসী থেকে জানা যায় যে, মক্কা শরীফের লোকেরা হযরত সৈয়দ আহমদ বদ্দবী (رحمة الله عليه) এর উরস অনেক ধুমধাম সহকারে পালন করে থাকে। বিশেষ করে মদীনা মনোয়ারার আলিমগণ হযরত আমীর হামযা (رضي الله عنه) এর উরস করে থাকেন, যার পবিত্র মাযার উহুদ পাহাড়ে অবস্থিত। মোট কথা হলো, সারা দুনিয়ার মুসলমান, আলেম ও নেকবান্দাগণ বিশেষ করে মদীনাবাসী উরসের প্রতি আস্থাশীল এবং যেটাকে মুসলমানগণ ভাল মনে করে, ওটা আল্লাহর কাছেও ভাল বলে গণ্য। বিবেকও বলে যে বুযুর্গানে কিরামের উরস ভাল কাজ। কেননা, প্রথমতঃ উরস হচ্ছে যিয়ারতে কবর ও সদকা খয়রাতের সমষ্টি এবং উভয়টা সুন্নাত। তাই দুই সুন্নাতের সমষ্টি (উরস) কিভবে হারাম হতে পারে?


❏ মিশকাত শরীফে بَاب زِيَارَة الْقُبُور শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে, হুযুর ﷺ ইরশাদ ফরমান, আমি তোমাদেরকে যিয়ারতে কুবুর থেকে বারণ করেছিলাম -


نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا، فَإِنَّ فِي زِيَارَتِهَا تَذْكِرَةً.


-‘‘আমি তোমাদেরকে প্রাথমিককালে কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম এখন থেকে নিশ্চয়ভাবে যিয়ারত করবে।’’  ২৭৫

{ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, হা/৩৬৯৮, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৫৫২ পৃঃ  হা/১৭৬২, ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, হা/১৯৭৭, হাদিসটি হযরত ইবনে বুরায়দা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত।}


এর দ্বারা প্রত্যেক প্রকারের কবর যিয়ারতের বৈধতা বোঝা গেল, হয় প্রতিদিন বা বছরের পরে অথবা একাকী বা সমবেতভাবে যিংারত করা যায়। তাই নিজের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে শর্তারোপ করে সমবেতভাবে ও বছরের পর নির্ধারিত দিনে যিয়ারত করাকে নিষেধ বলাটা বাতুলতা মাত্র। নির্ধারিতভাবে হোক বা অনির্ধারিতভাবে হোক প্রত্যেক প্রকারের যিয়ারত জায়েয। দ্বিতীয়তঃ উরসের তারিখ নির্ধারিত থাকলে, লোকেরা সহজে জমায়েত হতে পারে এবং লোকেরা একত্রিত হয়ে কুরআনখানি, কলেমা তৈয়্যবা, দরূদ শরীফ ইত্যাদি পাঠ করতে পারে এবং এতে অনেক বরকতের সমন্বয় ঘটে। তৃতীয়তঃ পীরের উরসের দিন মুরিদানেরা আপন পীর ভাইদের সাথে অনায়াসে সাক্ষাত করতে পারে এবং পরস্পরের আপন পীর ভাইয়ের সাথে অনায়াসে সাক্ষাত করতে পারে এবং পরস্পরের অবস্থাদি সম্পর্কে অবগত হতে পারে। এর ফলে পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। চতুর্থতঃ এটা পীর অনুসন্ধান করার সুবর্ণ সুযোগ। কোন উরসে গিয়ে দেখবেন যে ওখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক বুযুর্গানেদ্বীন, উলামায়ে কিরাম ও সুফিয়ানে ইমাম সমবেত হয়েছেন। সবাইকে দেখে, যার প্রতি আকৃষ্ট হবেন তার কাছে বাইয়াত হবেন। হজ্ব ও মদীনা শরীফের যিয়ারতও নির্ধারিত তারিখে হয়ে থাকে। এতেও উপরোক্ত ফায়দাসমূহ নিহিত রয়েছে। আমি দেওবন্দী গুরুদের অনেক কবর দেখেছি, যেখনে নেই কোন সমাগম, নেই কোন ফাতিহাখানি বা ঈসালে ছওয়াব, না তাদের থেকে বা তারা কারো থেকে ফয়েয লাভ করে। এটা হচ্ছে ভাল কাজ বন্ধ করে দেওয়ার পরিণাম ফল।
Top