❏ প্রশ্ন-৭ঃ ‘আল্লাহ্’ (اللهُ) শব্দটি প্রকৃত মাবুদের সত্তাগত নাম, না গুণবাচক নাম? যুক্তি ও বর্ণনা ভিত্তিক দলিল দ্বারা আলোচনা কর?
✍ উত্তরঃ هو المعين والمستعان আল্লাহ্ (اللهُ) অর্থ- খোদা, মাবুদ যা আল্লাহ্ তা‘আলার সত্তাগত নাম হিসেবে স্মরণ করা হয়। যদিও এতে গুণবাচক অর্থ বিদ্যমান আছে। সে নিরিখে এটাকে আল্লাহ'র গুণবাচক নাম হিসেবে গণ্য করা উচিত, কিন্তু সকল ওলামায়ে কিরাম এটা আল্লাহ'র সত্তাগত নাম হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উক্ত নাম সত্তাগতভাবে উল্লেখিত হয়েছে। বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরাম এর অর্থ এভাবে বর্ণনা করেছেন, هو ذات واجب الوجود المستجمع لجميع صفات الكمال ‘তিনি এমন সত্তা যার অস্তিত্ব অত্যাবশ্যকীয় এবং যার মধ্যে যাবতীয় সম্পূরক গুণাবলী সমষ্টিগত ও একীভূত ভাবে বিদ্যমান।’
الله‘‘ এই পবিত্র নামে এমন আশ্চর্যজনক ও বিস্ময়কর বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, যদি উক্ত নাম থেকে কোন একটি বর্ণ পৃথক করা হয়, তবুও আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র সত্তাগত নাম বিদ্যমান থাকে। যেমন- الله থেকে الف কে বাদ দিলে لله অবশিষ্ট থাকে এবং প্রথম لام কে বাদ দিলে لَـهُ অবশিষ্ট থাকে। আর দ্বিতীয় لام টি পৃথক করলে هُ ‘‘ শব্দটি বাকী থাকে- যেমন هو الحى القيوم । প্রত্যেক অবস্থায় আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র নামের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।
سبحانه ما اعظم شانه পবিত্র সে মহান সত্তার যাঁর শান ও মর্যাদা অতীব মহান। আল্লাহ্ শব্দের তাহ্কীক-এর জন্য আমার লিখিত التوضيح الجميل بشرح حديث جبرئيل এবং تنزيه الجليل عن الشبه والمثيل গ্রন্থদ্বয় পাঠের অনুরোধ রইল।
(اللهُ) আল্লাহ্ তা‘আলার অস্তিত্বের আক্বীদা পোষণ করা মানব জাতির আবশ্যকীয় বিষয়। কেননা যতদিন মানবজাতি চিন্তা-চেতনা, গবেষণা ও যুক্তিযুক্ত দলিল উপস্থাপনের মাধ্যমে উপকৃত হবে, ততোদিন উক্ত আক্বীদা পোষণ করতে তারা বাধ্য। কারণ মানুষ এর জন্য স্বীয় অস্তিত্ব ও মূল সত্তা এবং এ বিশাল জগত ও এর সৃষ্টি রহস্য উদঘাটন করার নিমিত্তে উক্ত আক্বীদা পোষণ করা আবশ্যক। কেননা চিন্তা-গবেষণা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এ অভাবনীয় বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রথম নীতিমালা হচ্ছে প্রত্যেক সৃজনশীল বস্তুর জন্যে অবশ্যই কোন না কোন প্রস্তুতকারক নির্মাতা রয়েছে। অনুরূপভাবে এই বিশ্বজগত দেখলে মানুষ সহজেই বুঝতে পারে যে, এর অবশ্যই একজন স্রষ্টা রয়েছেন। এ আক্বীদা মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই নিঃসন্দেহে চলে আসছে।
এতে কারো সন্দেহ নেই যে, হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর আগমনের ৬০০ বছর পূর্বে দর্শন শাস্ত্রের উদ্ভব হয়। তখন থেকে উক্ত আক্বীদা-বিশ্বাসে অনেক সন্দেহ-সংশয় ও মতবিরোধের সৃষ্টি হতে থাকে। যা আজো বিদ্যমান। হ্যাঁ! উক্ত আক্বীদায় কাল্পনিক সন্দেহ ব্যতীত অন্য কিছুর অবকাশ নেই। লোকেরা দর্শন শাস্ত্রের কাল্পনিক ও যুক্তি ভিত্তিক দলিল প্রমাণের মাধ্যমে আল্লাহর আকার-আকৃতি অনুমান করার চেষ্টা করেছে। পক্ষান্তরে আল্লাহ্ জওহর বা অণু, আরজ বা অস্থায়ী কিছুই নহেন। আর তিনি এমন বস্তুও নন যে, যা অন্তরে কল্পনা করা যায় এবং দৃষ্টিগোচর হয়। ফলে মানুষ তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহে নিপতিত। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, মানুষ তার সৃষ্টিকর্তাকে মানতিক শাস্ত্রের মুকাদ্দামা ও দর্শন বিদ্যার মূলভিত্তি لماذا، كيف، اين অর্থাৎ কোথায়, কিভাবে, কেন- এর মাধ্যমে জানার ও বুঝার চেষ্টা করছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তারা যুক্তি বিদ্যার নীতিমালার মাধ্যমে তাঁকে এজন্যে জানার চেষ্টা করছে যে, তারা যেন তাঁর ইবাদত করে।
নিঃসন্দেহে একথা বলা যায় যে, উক্ত দলিল প্রমাণাদির মাধ্যমে অবশ্যই দুটি বিষয়ের যে কোন একটি অর্জিত হবে। এক. হয়তো তারা যুক্তির নিরিখে কাল্পনিক আকৃতি নির্ধারণ করবে এবং তাকে খোদা মনে করে তাঁর উপাসনা করবে। এভাবে তারা আজীবন ধারণা ও কল্পনাপ্রসূত উপাসনা করতে থাকবে। দুই. অথবা সে নীতিমালার মাধ্যমে কিছুই মিলবে না, ফলে তারা আল্লাহকে অস্বীকার করে বসবে।
প্রথম শ্রেণির অনুসারী লোক অনেক। তারা তাদের কাল্পনিক খোদার উপাসনা করছে। তাদের মাঝে দ্বীন-ধর্মের প্রভাব মাত্রই প্রথাগত প্রচলন ও অভ্যাসগত নিদর্শন ছাড়া আর কিছুই নেই।
আর দ্বিতীয় শ্রেণির লোক- যখন তারা নিজেদের প্রাধান্য ও আধিক্য দেখতে পায়, তখন তারা অবাধ্য, সীমালংঘন ও নাফরমানী আরও বেশি করে এবং কুফরীতে লিপ্ত হয়ে যায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় যে, মানুষ যখন আল্লাহর ওপর আত্মবিশ্বাসের ইচ্ছে পোষণ করে, তখন গ্রীস দার্শনিক ও তাদের অনুসারীরা আরবীয় দার্শনিকদের নিকট জিজ্ঞেস করে এবং তর্কশাস্ত্রের জ্ঞান-বুদ্ধিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। বাহ! বাহ! এ কেমন জ্ঞানী-গুণীর কথা!
এ প্রচেষ্টা ও অনুসন্ধানের দ্বারা তাদের উপকার হবে যে, হয়তো তারা আল্লাহ'র কাল্পনিক আকৃতি নির্ধারণ করবে; না হয় মুলহিদ বা নাস্তিক হয়ে যাবে।
মানুষের একান্ত উচিত যে, নিজের অজ্ঞতা, অপারগতা, দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব স্বীকার করতঃ যে আক্বীদা বিশ্বাস হযরাতে আন্বিয়া-ই কিরাম বিশেষ করে হুযূর ইমামুল আন্বিয়া সৈয়্যদুল মুরসালীন মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে যে আক্বীদা-বিশ্বাস ও ঈমান রাখার আদেশ দিয়েছেন তা দৃঢ়ভাবে আকড়িয়ে ধরে এবং ভ্রান্ত আক্বীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ পরিহার করে একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি আন্তরিক ভাবে ফিরে আসা এবং এ বিশ্বাস স্থাপন করা যে,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ، لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ........ وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا .
অতএব মানুষ যখনই সত্যিকার অর্থে আন্তরিকভাবে কখন, কিভাবে, কোথায় মহান আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি ফিরে যাবে, তখন কোন ধরনের আকার-আকৃতি বিহীন তাঁর প্রকৃত পরিচিতি সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারবে, এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য অধম লিখকের লিখিত- تنزيه الجليل عن الشبه والمثيل গ্রন্থখানা অধ্যয়ন করার অনুরোধ রইল।
إِلَهٌ ‘ শব্দটি সাধারণত মাবুদ বা উপাস্যকে বুঝায়। তা সত্য হোক বা মিথ্যা হোক, হক্ব বা বাতিল- সকল উপাস্যকে বুঝায়। কেননা إِلَهٌ শব্দটি اسم جنس বা জাতি বাচক বিশেষ্য। যেমন- نجم বলতে যে কোন তারকাকে বুঝায়। কিন্তু পরবর্তীতে এর ব্যবহার ‘ছুরাইয়্যা’ তারকার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়।
الهى‘ঃ إِلَه শব্দটি আল্লাহ'র সত্তাগত নাম। ياء বর্ণটি متكلمএর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। إِلَهٌ অর্থ- আল্লাহ্। দর্শনশাস্ত্রের তিন প্রকারের এক প্রকারের নামও এটা। এটা একটি ঐতিহাসিক নামও। যা সম্রাট জালালুদ্দীন আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে শুরু হয়। যাকে ‘ইলাহি বছর’ বলা হয়।