উপসংহারঃ বিরুদ্ধবাদীগণ এসব দলীল-প্রমাণাদির কোন উত্তর দিতে পারেন না। তারা কেবল প্রত্যুত্তরে এ কথাই বলেন যে যেই সব আয়াতে كُلاُّ شَيْئٍ উল্লেখিত আছে বা مَالَمْ تَعْلَمْবলা হয়েছে, সে সকল ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধি বিধানের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে, অন্য কোন কিছুর জ্ঞান বোঝানো হয়নি। এর সমর্থনে তারা নিম্নলিখিত দলীলাদি উপস্থাপন করেন,
(১) كُلاُّ شَيْئٍ বলতে সীমাহীনতা বোঝায় এবং বিষয়ের জ্ঞান খোদা ছাড়া অন্য কারো আয়ত্ত্বে থাকা তর্কশাস্ত্রে ‘শৃংখল পরস্পরের অসীমতা’ অনুসারে সম্পূর্ণরূপে বাতিল বলে গণ্য। (যুক্তিশাস্ত্রের ‘তাসালসুল ’ নামক দলীল দ্রষ্টব্য।)
(২) অনেক তাফসীরকারকগণ كُلاُّ شَيْئٍ এর ব্যাখ্যা করেছেনঃ مِنْ اُمُوْرُ الدِّيْنِ (অর্থাৎ ধর্মীয় বিষয়াদি) যেমন তাফসীরে জালালাইনে ও অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থে এরূপ ব্যাখ্যাই প্রদান করা হয়েছে।
(৩) কুরআন শরীফের অনেক জায়গায় كُلاُّ شَيْئٍ বলা হয়েছে। কিন্তু উহার দ্বারা ‘কিয়দংশ’ বা ‘কিয়ৎ পরিমাণ’ই বোঝানো হয়েছে। যেমন রাণী বিলকিস সম্পর্কে وَأُوتِيَتْ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ -‘‘বিলকিসকে সব কিছুই দেয়া হয়েছে।’’
{সূরাঃ আন-নামল, আয়াতঃ ২৩, পারাঃ ১৯}
বলা হয়েছে অথচ বিলকিসকে প্রদত্ত বস্তু বা বিষয়ের কিছু বা কিঞ্চিত পরিমাণই দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু এগুলো কোন দলীলই নয়। নিছক ভুল ধারণা ও ধোকা মাত্র। এগুলোর উত্তর নিম্নে দেয়া গেল।
আরবী ভাষায় كُلٌُ ও مَا শব্দদ্বয় ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। কুরআন শরীফের প্রত্যেকটি শব্দ অকাট্য। এতে মনগড়া কোন শর্ত জুড়ে দিয়ে শব্দকে সীমিত অর্থে প্রয়োগ করা জায়েয নয়। কুরআন শরীফের ব্যাপকতা নির্দেশক শব্দগুলোকে ‘হাদীছে আহাদ’ দ্বারাও সীমিত অর্থে গ্রহণ করা যায় না। এমতাবস্থায় নিজস্ব কোন যুক্তি বা রায়ের ভিত্তিতে সীমিত অর্থে প্রয়োগের প্রশ্নই উঠে না।
(১) كُلاُّ شَيْئٍ বলতে সীমাহীন বোঝা যায় না বরং এ দ্বারা সীমাবদ্ধতাই বোঝা যায়।
❏তাফসীরে কবীরে وَاَحْصَى كُلَّ شَئٍ عَدَدًا এর ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,
قَلْنَا لاَشَكَّ اِنْ اَحْصَاءَ الْعَدَدِ اِنَّمَا يَكُوْنُ فِى الْمُتَّنَاهِىْ فَاَمَّا لَفْظَةُ كُلٌُ شَيْئٍ فَاِنَّهَا لاَتَدُلُّ عَلَى كَوْنِه غَيْرَ مُتْنَا هِىْ لِاَنَّ الْشَئَ عِنْدَنَا هُوَالْمَوْ جُوْدَا وَالْمَوْ جُوْدَاتُ مُتَنَا هِيَةٌُ فِى الْعَدَدِ.
-‘‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে সংখ্যা দ্বারা গণনার বিষয়টি সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেই সম্ভবপর। কিন্তুكُلاُّ شَيْئٍ (প্রত্যেক জিনিস) শব্দ দ্বারা ঐ বস্তুর সীমাহীনতার অর্থ প্রকাশ পায় না। কেননা আমাদের মতে شَيْئٍ জিনিস) বলতে যা কিছুর অস্তিত্ব আছে, শুধু তা’ই বোঝায় এবং যাবতীয় অস্তিত্ববান বস্তু সীমাবদ্ধতার গন্ডীতে আবদ্ধ।’’
{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে ফকীরঃ সূরাঃ জ্বিন, আয়াতঃ ২৮ এর ব্যাখ্যা।}
❏তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ একই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ আছে,
وَهَذَهِ الْاَيَةُ مِمَّا يَسْتَدَلُّ بِهِ عَلَى اَنَّ الْمَعْدُوْمَ لَيْسَ بِشَيْئٍ لاَنَّهُ لَوْ كَانَ شَيْئًا لَكَانَتِ الْاَشَيُاء غَيْرَ مُتَنَاهِيَةٍ وَكَوْنُهُ اَحْصَى عَدَدًهَا يَقْتَضِىْ كَوْنَهَا مُتَنَاهِيَةً لِاَنُّ اِحْصَاءَ الْعَدَدِ اِنَّمَا يَكُوْنُ فِى آلْمُتَنَاهِىْ.
-‘‘এ আয়াত দ্বারা এ কথাটির বড় প্রমাণ মেলে যে, যা’ কিছু অস্তিত্বহীন উহা شَيْئٍ ‘বস্তু’ বলে গণ্য নয়। কেননা যদি এটা বস্তু (অস্তিত্ববান) বলে গণ্য হয়, তাহলে অস্তিত্ববান সবকিছুই সীমাহীন হয়ে যায়। অথচ বস্তুসমূহ গণনা বা শুমারীর আওতাভুক্ত এবং যা’ কিছু গণনার আওতায় আসে, উহা কেবল সীমাবদ্ধতার পর্যায়ভুক্ত হতে পারে।
{ইসমাঈল হাক্কী, তাফসীরে রুহুল বায়ান, ১০/২০৩পৃ.দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন}
(২) তাফসীরকারকদের মধ্যে অনেকেই كُلاُّ شَيْئٍ বলতে কেবল শরীয়তের আহাকামকে ধরে নিয়েছেন বটে, কিন্তু আবার অনেকেই আহকামকে বা সামগ্রীক ইলমে গায়বের প্রতি নির্দেশ করেছেন। চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী যখন কিছু প্রমাণ ইতিবাচক ও আর কিছু নেতিবাচক হয়, তখন ইতিবাচক প্রমাণগুলিই গৃহীত হয়।
❏সুবিখ্যাত ‘নুরুল আনোয়ার’ গ্রন্থে تَعَارُضْ (অসঙ্গতি বা বিরোধ) শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখিত আছে-
وَالْمُثْبِتُ اَوْلَى مِنَ النَّافِىْ
অর্থাৎ- স্বীকৃতি জ্ঞাপক প্রমাণ অস্বীকৃতি নির্দেশক প্রমাণ হতে অপেক্ষাকৃত উত্তম। যে সমস্ত তাফসীরের উদ্ধৃতি আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, সেগুলোতে যেহেতু বেশীরভাগ প্রমাণই স্বীকৃতি সূচক, কাজেই উহাই গ্রহণযোগ্য। অধিকন্তু স্বয়ং হাদীছ এ সুপ্রসিদ্ধ উলামায়ে উম্মতের উক্তিসমূহ দ্বারা এর তাফসীর করে আমি দেখাবো যে এমন কোন অণুপরমাণু নেই, যা’ হুযুর পুর-নুর (ﷺ) এর জ্ঞানানুভূতিতে আসেনি, এবং আমি এ গ্রন্থেরই ‘পেশ কালাম’ শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি যে, কুরআনের হাদীছে ভিত্তিক তাফসীর অন্যান্য তাফসীর সমূহ থেকে উন্নত। সুতরাং হাদীছের সমর্থনপুষ্ট তাফসীরই অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে।
এও উল্লেখ্য যে, যে সকল তাফসীরকারক كُلاُّ شَيْئٍ এর তাফসীরে ‘আহকামে দ্বীনকে’ বোঝাতে চেয়েছেন, তারাওতো অন্যান্য বিষয় বা বস্তুর সম্পকর্ীয় জ্ঞানের অস্বীকৃতির কথা বলেন নি। সুতরাং, আপনারা অস্বীকৃতির কথা কোথা থেকে আবিষ্কার করলেন? কোন বিষয়ের উল্লেখ না করলে যে সে বিষয়ের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়, একথা বলেন কিভাবে?
❏কুরআন শরীফে আছে,
تَقِيْكَمُ الْحَرَّ
তোমাদের কাপড় তোমাদেরকে উত্তাপ থেকে রক্ষা করে। এরূপ উক্তি থেকে কি একথা বোঝা যাবে যে, কাপড় আমাদেরকে শীত থেকে রক্ষা করে না? একথাতো কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি। অধিকন্তু, ‘দ্বীন’ বললেও সবকিছুকেই বোঝায়। জগতে এমন কি বিষয় আছে, যার উপর দ্বীনের আহকাম হালাল হারাম ইত্যাদি প্রযোজ্য হয় না? ঐ সকল মুফাস্সিরতো এ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন যে দ্বীনি ইলম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে, একথা বললে সব কিছুর জ্ঞানকে বোঝানো হয়।
(৩) বিলকীস ও অন্যান্যাদের কাহিনীতে যে كُلاُّ شَيْئٍ বলা হয়েছে, সেখানে এমন আলামত বা লক্ষণ মওজুত আছে, যা’র ফলে একথা পরিষ্কারূপে প্রতীয়মান হয় যে, كُلاُّ شَيْئٍ দ্বারা রাজত্বের কাজ কারবার সম্পকর্ীয় প্রত্যেক কিছুই বোঝানো হয়েছে। সেখানে উক্ত শব্দ দ্বারা এর ব্যবহারিক অর্থের দিকে নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু এখানে এমন কি লক্ষণ আছে, যে কারণে শব্দের আসল অর্থ বাদ দিয়ে তার ব্যবহারিক অর্থই গ্রহণ করা যাবে?
আরও লক্ষ্যণীয় যে, কুরআন করীম সেখানে ‘হুদহুদ’ পাখীর উক্তিকে নকল করেছে মাত্র। হুদহুদ বলেছিল, وَأُوتِيَتْ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ -‘বিলকিসকে প্রত্যেক কিছুই দেয়া হয়েছে।’
{সূরাঃ আন-নামল, আয়াতঃ ২৩, পারাঃ ১৯}
স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা এ খবর দেন নি। হুদহুদের ধারণা ছিল যে বিলকিস সারা দুনিয়ার সবকিছুই পেয়ে গেছেন। কিন্তু এখানে মুস্তাফা عليه السلامের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা নিজেই বলেছেন, تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْئٍ (প্রত্যেক কিছুর সুস্পষ্ট বিবরণ সম্বলিত)। হুদহুদ ভুল বলতে পারে কিন্তু আল্লাহর কালামতো ভুল হতে পারে না। হুদহুদতো আরও বলেছিল وَلَهَا عَرْشً عَظِيْمٌُ (তাঁর এক বিরাট আরশ আছে) তাহলে বিলকিসের সিংহাসন কি আরশ আযীমই ছিল? বস্তুতঃ কুরআনের অন্যান্য আয়াত থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, كُلاُّ شَيْئٍ দ্বারা এখানে জগতের সবকিছুকেই বোঝানো হয়েছে।
❏কুরআনেই ইরশাদ হয়েছে,
وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ.
-‘‘আর্দ্র শুষ্ক এমন কোন জিনিস নেই, যা’ লওহে মাহফুজে বা কুরআনে করীমে নেই।’’
{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৫৯, পারাঃ ৭}
এছাড়া সামনে উল্লেখিত বিভিন্ন হাদীছ, উলামা ও মুহাদ্দিছীনের উক্তি থেকেও এ কথার জোরালো সমর্থন পাওয়া যাবে যে জগতের প্রত্যেক কিছুর জ্ঞান হুযুর পুর-নুর (ﷺ) কে দান করা হয়েছিল।
আমি ইনশা আল্লাহ ‘হাযির-নাযির’ শিরোনামের আলোচনায় বর্ণনা করবো যে মৃত্যুর ফিরিশতা হযরত আযরাইল (عليه السلام) এর সামনে সারা জগৎটাই যেন একটা থালার মত। আর ইবলীস এক পলকে সারা পৃথিবী ঘুরে আসে। এ কথা দেওবন্দীগণও স্বীকার করেন যে আমাদের নবী (ﷺ) এর জ্ঞান সৃষ্টিকূলের সামগ্রিক জ্ঞান থেকে বেশী। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, হুজুর (ﷺ) এর সমগ্র সৃষ্টির জ্ঞান রয়েছে। আমি ‘পঞ্চ বিষয়ের জ্ঞান’ علوم خمسه শীর্ষক আলোচনায় হযরত আদম (عليه السلام) ও তাক্বলীদ লিখায় নিয়োজিত ফিরিশতার জ্ঞান সম্পর্কে আলোকপাত করবো, যা’ দ্বারা বোঝা যাবে যে গুরুত্বপূর্ণ ‘পঞ্চ বিষয়ের’ জ্ঞান তাদেরও রয়েছে। যেহেতু হুজুর (ﷺ) সমস্ত সৃষ্টিকূল থেকে বেশী জ্ঞানী, কাজেই, হুযুর আলাইহসি সালাম যে এসব বিষয়ের জ্ঞান বরং তার চেয়ে অধিক জ্ঞানের অধিকারী একথা মেনে নিতে হবে বৈ কি। আমাদের দাবী সর্বাবস্থায় প্রতিষ্ঠিত।
وَلِلَّهِ الْحَمْدُ
(আল্লাহ যাবতীয় প্রশংসার অধিকারী)
━━━━━━━━━━━━━━━━
🌍 তথ্যসূত্রঃ [শহিদুল্লাহ বাহাদুর গ্রন্থসমগ্র এপ্স]
ডাউনলোড লিংকঃ bit.ly/Sohidullah
অথবা, এপ্সটি পেতে প্লে স্টোরে সার্চ করুন।